মঙ্গল গ্রহের লাল পাথরে পাশাপাশি পড়ে থাকা সুহা আর ক্লদের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থেকে ইহিতা বলল, আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না এটি সম্ভব।
নীহা বলল, আমি নিজের চোখে দেখেও এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।
টর নুটের দিকে তাকালে, জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতের লিভারটি কী আসলেই বিস্ফোরকের সাথে জুড়ে দেয়া, নাকি পুরোটি একটি ধোঁকা?
নুট মাথা নাড়ল, বলল, না। এটা ধোকা না। এটা সত্যি। আমি জানতাম এরা দুজন রবোমানব।
ক্লদের শরীরে সত্যি বিস্ফোরক লাগানো আছে?
হ্যাঁ। ছোট বিস্ফোরক। এই দেখ–সে নিচু হয়ে ক্লদের ছিন্নভিন্ন স্পেসস্যুটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা বিস্ফোরকের গোলক বের করে আনে। সেটি দূরে ছুঁড়ে দিয়ে নুট তার লিভারটি ছেড়ে দিতেই দূরের বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হল।
টর নুটের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে স্বীকার করতেই হবে তুমি অসাধারণ। আমি কখনোই এই দুজনকে রবোমানব হিসেবে সন্দেহ করতে পারতাম না।
নুট কোনো কথা বলল না, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ইহিতা বলল, রেডিয়েশান মনিটরে রিডিং দিতে শুরু করেছে। প্রাণীগুলো আবার আসছে। আমাদের আবাসস্থলের ভেতর ঢুকে যাওয়া দরকার। চল যাই।
টুরান জিজ্ঞেস করল, মৃতদেহ দুটি?
এই মুহূর্তে কিছু করার নেই। পরে যদি সুযোগ পাই সমাহিত করে দেব।
লাল পাথরের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অস্ত্রগুলো তুলে পাঁচজন দ্রুত আবাসস্থলের দিকে যেতে থাকে প্রাণীগুলো আসার আগে তারা ভেতরে ঢুকে যেতে চায়।
আবাসস্থলের ভেতরটা খুব সাজানো গোছানো। মানুষজন থাকার জন্যে পরিপাটি ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাতাসের তাপ চাপ রক্ষা করা আছে বলে তারা স্পেসস্যুট খুলে বসেছে। শুধু তাই নয় তারা সত্যিকারের খাবারের প্যাকেট বের করে সেগুলো গরম করে ধূমায়িত কফির সাথে বসে বসে খেয়েছে। গত ছত্রিশ ঘণ্টার উত্তেজনা শেষে হঠাৎ করে একটা নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে বসে থাকতে পেরে তাদের মাঝে এক ধরনের আলস্য ভর করেছে।
কফির মগে চুমুক দিয়ে টুরান বলল, আমরা কী তাহলে এখন আমাদের মহাকাশযানে ফিরে যেতে পারি?
ইহিতা বলল, নিশ্চয়ই পারি। এখন আমাদের মাঝে কোনো রোমানব নেই। আমরা নিশ্চয়ই মহাকাশযানে ফিরে যাব।
টর বলল, তোমরা যা ইচ্ছে তাই বলতে পার–আমি কিন্তু তোমাদের পরিষ্কার করে একটা কথা বলতে চাই
কী কথা? মহাকাশযানে গিয়ে আমি ট্রিনিটিকে নিজ হাতে খুন করব!
ইহিতা শব্দ করে হাসল, বলল, তুমি কীভাবে সেটা কর, আমি সেটা দেখতে চাই।
নীহা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আমরা এখন মহাকাশযানে ফেরত যাব কেমন করে?
টুরান বলল, আমরা ট্রিনিটির সাথে যোগাযোগ করব, ট্রিনিটি কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। একটা স্কাউটশিপ পাঠাবে এখানে বা সেরকম কিছু একটা করবে।
তাহলে ট্রিনিটির সাথে যোগাযোগ করতে হবে?
হ্যাঁ।
কেমন করে করব?
এই আবাসস্থলাটাতে অনেক ভালো কমিউনিকেশন্স মডিউল থাকার কথাএসো খুঁজে বের করি।
নীহা আর টুরান মিলে আবাসস্থলে কমিউনিকেশন্স মডিউল খুঁজতে থাকে, আবাসস্থলের দোতলাতে সেটা পেয়ে গেল। টুরান কয়েকটা সুইচ স্পর্শ করে বলল, কী আশ্চর্য! দেখেছ, আমাদের জন্যে এখানে ম্যাসেজ রাখা আছে?
কী ম্যাসেজ?
এখনো জানি না। টুরান আরেকটা বোতাম চাপ দিতেই সামনে একটা আলোর ঝলকানি দেখা গেল, তারপর ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমি ট্রিনিটি বলছি। স্কাউটশিপে করে মঙ্গলগ্রহে যাওয়া মহাকাশচারীদের সাথে যোগাযোগ করতে চাই। জরুরি। আবার বলছি, স্কাউটশিপে করে…।
নীহা বলল, আমি সবাইকে ডেকে আনি। সবাই মিলে শুনি ট্রিনিটি কী বলে।
যাও ডেকে আনো।
কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই ওপরে কমিউনিকেশন মউিডলের কাছে চলে এলো। টুরান তখন যোগাযোগের চ্যানেলটি চালু করে। সাথে সাথে ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমি ট্রিনিটি, মহাকাশযান থেকে তোমাদের সবার জন্যে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
টর বলল, বাজে কথা বলল না। মানুষকে শুভেচ্ছা জানানোর মতো বুদ্ধিমত্তা তোমার নেই।
আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত—
টর মাঝপথে থামিয়ে বলল, আমি তোমাকে বলেছি, তুমি বাজে কথা বলবে। আমাদেরকে ভয়ংকর বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়ে বলছ তুমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত? তুমি জান অন্তর মানে কী? বেজন্ম কোথাকার!
ট্রিনিটি হাসির মতো শব্দ করে বলল, টর, আমি তোমার ক্ষোভটুকু পরিষ্কার বুঝতে পারছি। তবে তোমাকে দুটি ব্যাপার বুঝতে হবে। প্রথমত আমি যেটা করেছি সেটা না করে আমার উপায় ছিল না। খুব সোজা ভাষায় যদি বলতে হয় তাহলে বলা যায়, আমি একটা কম্পিউটার, আমাকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে আমাকে ঠিক সেভাবে কাজ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, তুমি যখন আমার ওপর রেগে যাও কিংবা রেগে গালাগাল কর আমি কিন্তু সেগুলো বুঝি না! তুমি যথার্থই বলেছ, আমার সেগুলো বোঝার ক্ষমতা নেই।
টুরান বলল, ঠিক আছে। ঠিক আছে! তুমি কী বলার জন্যে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছ সেটা বলে ফেল।
ট্রিনিটি বলল, পৃথিবী থেকে তোমাদের সাথে খুব জরুরিভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইহিতা অবাক হয়ে বলল, পৃথিবী থেকে? আমাদের সাথে?
হ্যাঁ।
কে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে?
আমার জানা নেই। গোপনীয় চ্যানেল। তোমরা যদি প্রস্তুত থাকো তাহলে আমি চ্যানেলটি তোমাদের জন্যে উন্মুক্ত করে দিই।
অবশ্যই। ইহিতা বলল, অবশ্যই উন্মুক্ত করে দাও।
সাথে সাথে ঘরের ভেতর কিছু আলোর বিচ্ছুরণ দেখা গেল কিছু যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এলো এবং বেশ কয়েক মিনিট পর হঠাৎ করে ঘরের ঠিক মাঝখানে তারা বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি মহামান্য থুলকে দেখতে পেল। মহামান্য থুল একটা সবুজ ঘাসের লনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। তারা শুনতে পেল মহামান্য থুল একটু ঘুরে তাদের দিকে বললেন, তোমাদের জন্যে শুভেচ্ছা। আমি খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তোমাদের সাথে যোগাযোগ করছি।
নীহা চিৎকার করে বলল, মহামান্য গুল? আপনি?
নীহার কথাটি মহামান্য থুল সেই মুহূর্তে শুনতে পেলেন না। মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে তার কথাটি পৌঁছাতে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট সময় নেবে, মহামান্য থুলের উত্তরটি ফিরে আসতে আরো পাঁচ মিনিট। নীহা এবং অন্যেরা শুনতে পেলো মহামান্য থুল ঠিক সেই কথাটিই বললেন, মুখোমুখি কথা বলার যে সুবিধেটুকু আছে সেটি এখন আমাদের মাঝে নেই, তোমাদের কথা আমার কাছে এবং আমার কথা তোমাদের কাছে পৌঁছানোর মাঝে বেশ অনেকখানি সময় নেবে। তোমরা কেমন আছ আমি জানি না। আমার জানা প্রয়োজন। আমি এখন চুপ করছি, তোমরা বল। কেমন আছ বল।
টুরান বলল, এর মাঝে অনেক কিছু ঘটে গেছে। কোনো মানুষের জীবনে এতো অল্প সময়ে এতো কিছু ঘটতে পারে সেটা বিশ্বাসই হতে চায় না। মহামান্য থুল আপনি শুনে খুশি হবেন যে আমরা ভয়ংকর ভয়ংকর বিপদের মাঝে থেকেও রক্ষা পেয়েছি। কীভাবে সেটা ঘটেছে সেটা আপনাকে বলবে ইহিতা। আমরা ইহিতাকে আমাদের দলপতি তৈরি করেছি। ইহিতা একজন অসাধারণ-দলপতি, সে কীভাবে আমাদের রক্ষা করে এনেছে সেটি শুনলে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন! টুরান ইহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ইহিতা! তুমি বল।
ইহিতা একটু বিব্রত হয়ে বলল, আমি এমন কিছুই করি নি! তারপর সে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে মহাকাশযানে কী ঘটেছে এবং কীভাবে তারা শেষ পর্যন্ত এই নিরাপদ আবাসস্থলে আশ্রয় নিয়েছে সেটি বলল। তাদের ভেতরে যে দুজন রবোমানব আছে এবং সেই দুজন শেষ পর্যন্ত কীভাবে নিজেরাই নিজেদের হত্যা করেছে সেটি বলার সময় ইহিতার মুখে গভীর একটা বেদনায় ছাপ পড়ে।
ইহিতার কথা শেষ হবার পর প্রায় দশ মিনিট সময় পরে তারা মহামান্য থুলের কথা শুনতে পেল, মহামান্য থুল বললেন, পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে একটা নির্জন গ্রহের ছোট একটা আবাসস্থলে তোমরা কোনো ভাবে নিজেদের রক্ষা করে বেঁচে আছ। কিন্তু আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে কী শুধু আমি নই, পৃথিবীর মানুষ তোমাদের কাছে ঋণী থাকবে। তোমরা সবাই জান রবোমানবেরা কিছুক্ষণের মাঝেই পৃথিবীর নেটওয়ার্কটি দখল করে নেবে। দখল করার পর নিশ্চিতভাবেই তারা আমাকে এবং বিজ্ঞান আকাদেমীর সবাইকে হত্যা করতে আসবে। আমি সেটা নিয়ে খুব বেশি দুর্ভাবনা করছি না। তোমরা জান আমি দীর্ঘ একটি আনন্দময় জীবন কাটিয়েছি, আমি এখন খুব আনন্দের সাথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি। কিন্তু আমাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করতে আমরা কি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি? রবোমানব যখন নেটওয়ার্ক দখল করে এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি কমিউনিটি, প্রতিটি অস্ত্রাগার প্রতিটি যোগাযোগ ব্যবস্থা এক কথায় পুরো পৃথিবীর সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে তখন পৃথিবীর মানুষ রবোমানবের হাতে ধ্বংস হয়ে যাবে?
মহামান্য থুল একটু থামলেন, অন্যমনস্কভাবে নিজের হাতের দিকে তাকালেন তারপর আবার মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালেন, তাকিয়ে বললেন, এর সঠিক উত্তর কেউ জানতো না। এখন আমি জানি। ভবিষ্যতে যে ভয়ংকর বিপদটি আসবে সেই বিপদের মাঝে মানুষ ভেঙে পড়বে না। তোমরা যেমন ভেঙে পড়নি। তারা নিজেদের মাঝে নেতৃত্ব তৈরি করে নেবে। সেই নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে তারা একে অন্যকে সাহায্য করবে। ঠিক যেরকম তোমরা করেছ। আর ঠিক তখন যদি আমরা রবোমানবকেও একই ধরনের বিপদের মাঝে ফেলতে পারি তখন তারা হবে ভয়ংকর রকম স্বার্থপর, তারা হবে হিংস্র, তারা হবে নিষ্ঠুর, তারা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে একে অন্যকে হত্যা করবে। ঠিক এখানে যেরকম করেছে।
মহামান্য থুল একটু হাসির মতো ভঙ্গি করলেন, তোমাদের প্রতি পৃথিবীর মানুষের কৃতজ্ঞতা! তোমাদের কাছ থেকে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পেয়েছি। আমাদের কী করতে হবে সেটা নিয়ে আমি একটু ভাবনার মাঝে ছিলাম, আমার ভাবনা দূর হয়েছে।
মহামান্য থুলের কথা শেষ হবার আগেই সবাই প্রায় এক সাথে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু আপনার কী হবে? আপনার কী হবে?
তারা সেই প্রশ্নের উত্তর পেল না, প্রশ্নটি মঙ্গলগ্রহ থেকে পৃথিবীতে গিয়ে সেখান থেকে আর ফিরে এলো না, তার কারণ ততক্ষণে সেখানে একটি মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেছে।
এ গানটা কাজী নজরুল ইসলাম এর লেখা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। কোন রাশিয়ানের সুর দেওয়া নয়।প্যারী কমিউনের গান।
Music by: Pierre Degeyter, 1889;
Written by: Eugène Pottier, Paris, June 1871;