১৭. নীহা ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠল

নীহা ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠল। টুরান ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করে বলল, নীহা! ওঠ।

নীহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে?

প্রাণীগুলো আসছে। রেডিয়েশান মিটারে আমরা সিগন্যাল পাচ্ছি।

সর্বনাশ! এখন কী হবে?

ইহিতা বলল, যা হবার সেটাই হবে। ভয় পাবার কিছু নেই। অস্ত্রটা তৈরি রাখ।

নীহা অস্ত্রটা তাক করে গুড়ি মেরে বসে বলল, আমরা তো নড়ছি না, প্রাণীগুলো আমাদের দেখছে কেমন করে?

জানি না। মনে হয় বাইরের তাপমাত্রা কমে যাবার কারণে আমাদের স্পেসস্যুট থেকে অনেক বেশি তাপ বিকিরণ করছে।

নীহা কথা না বলে তার চোখের গগলসটি অতি বেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নিল, সাথে সাথে চারপাশের জগৎটা অন্য রকম দেখাতে থাকে, তার মাঝে সে দূরে প্রাণীগুলোকে দেখতে পেল। সেগুলো গুড়ি মেরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, খুব ধীরে ধীরে চারদিকে থেকে তাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।

ইহিতা ফিসফিস করে বলল, আমি না বলা পর্যন্ত কেউ গুলি শুরু করবে না।

ঠিক আছে।

সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, দেখতে পেলো প্রাণীগুলো তাদের দিকে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে। রেডিয়েশন মিটারের কাটাটি নড়তে থাকে, প্রাণীগুলো থেকে চারপাশে তীব্র তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রাণীগুলো আরেকটু কাছে এগিয়ে এল, এখন তাদের চেহারাগুলো দেখা যেতে শুরু করেছে। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করল প্রাণীগুলো একরকম নয়, তাদের মাঝে গঠনগত একটা মিল আছে, সবগুলোরই সামনে বীভৎস ধারালো দাঁত, বড় মুখ। মুখটি কখনো শরীরের উপর, কখনো নিচে। অনেকগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কখনো তাদের অতিকায় মাকড়শার মতো মনে হয়, কখনো ক্লেদাক্ত কীটের মতো মনে হয়।

প্রাণীগুলো আরেকটু এগিয়ে এল, তাদের হিংস্র গর্জন খুব ক্ষীণভাবে তারা শুনতে পায়। মাটিতে মৃদু কম্পন অনুভব করতে পারে।

যদিও কথা ছিল ইহিতা অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত কেউ গুলি করবে না, কিন্তু হঠাৎ করে টর প্রচণ্ড আক্রোশে গুলি করতে শুরু করল। সাথে সাথে যেন নরক নেমে আসে, প্রাণীগুলো ছুটে তাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সেগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তারপরেও সেগুলো থেমে যায় না–আরো ভয়ংকর আক্রোশে সেগুলো ছুটে আসতে থাকে। প্রাণীগুলোর ছিন্নভিন্ন দেহগুলোও গড়িয়ে গড়িয়ে পাথরে ঘষতে ঘষতে কাঁপতে কাঁপতে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

ইহিতা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একটা প্রাণীকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার পরও তার প্রতিটি অংশ যদি আলাদাভাবে জীবিত থেকে যায় প্রতিটি অংশই যদি নিজের মতো করে তাদের আক্রমণ করতে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে তারা কেমন করে টিকে থাকবে?

ইহিতা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে কয়েকবার গুলি করে প্রাণীগুলোকে খানিকটা দূরে সরিয়ে দিল। তারপর দ্রুত তার পকেট থেকে রিমোট কন্ট্রোলটা বের করে। পথের মাঝখানে সে একটা সনিক চার্জার বসিয়ে এসেছে, সেটা ব্যবহার করা যায় কীনা পরীক্ষা করে দেখতে চায়।

রিমোট কন্ট্রোলের প্যানেলটি চোখের সামনে ধরে সে দ্রুত তার রেটিনা স্ক্যানিং করে নিয়ে বোতামগুলো স্পর্শ করে। প্রায় সাথে সাথেই সে একটা কম্পন এবং একটু পর বিস্ফোরণের চাপা শব্দ শুনতে পেল। ইহিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্ষ্যাপা প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল এবং হঠাৎ করে তার মনে হল প্রাণীগুলোর মাঝে এক ধরনের নতুন চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।

ইহিতা চিৎকার করে বলল, থামাও। গুলি থামাও! সবাই গুলি থামাও।

সবাই গুলি থামাল এবং দেখতে পেল হঠাৎ প্রাণীগুলো পিছনে ছুটে যেতে শুরু করেছে। ছুটে যাবার সময় প্রাণীগুলো তাদের শরীরের ছিন্নভিন্ন অংশগুলো মুখে করে নিয়ে যেতে থাকে। শরীরের নানা অংশে সেগুলো ছুঁড়ে দিতে থাকে এবং সেগুলো শরীরে লেগে কিলবিল করে নড়তে থাকে।

ইহিতা রদ্ধশ্বাসে এই বিচিত্র দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, এখন গুলি করো না–প্রাণীগুলোকে চলে যেতে দাও।

নীহা কাঁপা গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছে? আমি যেখানে সনিক চার্জার লাগিয়ে এসেছি সেখানে। কেন?

প্রথমবার যখন প্রাণীগুলো আমাদের দিকে ছুটে এসেছিল তখন হঠাৎ করে ছুটে চলে গিয়েছিল, মনে আছে?

মনে আছে।

আমি পরীক্ষা করে দেখেছিলাম–দূরে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল। বিস্ফোরণের পর খুব ছোট কম্পনের শব্দ তরঙ্গ ভেসে এসেছিল, ভূমিকম্পের বেলায় যেরকম হয়। তাই ভাবলাম-

কী ভাবলে?

প্রাণীগুলো ছোট কম্পনের শব্দ তরঙ্গ শুনতে পেলে সেদিকে নিশ্চয়ই ছুটে যায়। তাই পথে একটা সনিক চার্জার লাগিয়ে এসেছিলাম। এখান থেকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সেটা বিস্ফোরণ করিয়েছি। আসলেই প্রাণীগুলো সেদিকে ছুটে গেছে।

কেন? কেন ছুটে যায়?

এখনো জানি না, কিন্তু সেটা নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। আমাদের এক্ষুণি রওনা দিতে হবে। আমাদের কাছে আর সনিক চার্জার নেই, প্রাণীগুলো আবার আক্রমণ করলে আর ফেরাতে পারব না। এক্ষুণি রওনা দিতে হবে।

টুরান বলল, তাছাড়াও এই তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো থেকে অনেক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বের হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়।

নীহা বলল, হ্যাঁ চল রওনা দিই। ট্রান্সপোর্টারে করে আমি ক্লদকে নিতে পারি।

ক্লদ মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি ট্রান্সপোর্টারে যাব না। আমি হেঁটে যাব।

নীহা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

ইহিতা টরের দিকে তাকিয়ে বলল, আর টর, শোনো।

বল।

আমি কিন্তু বলেছিলাম আমি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ গুলি করবে না। তুমি আমার নির্দেশ শোনো নি। তুমি আগেই গুলি শুরু করেছ।

টর থতমত খেয়ে বলল, আমি দুঃখিত।

ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কেন জানি মনে হয় তুমি আসলে সেরকম দুঃখিত নও। কিন্তু শুনে রাখ–

কী?

মানুষের আবাসস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি তোমাদের দলপতি। তোমাদের আমার কথা শুনতে হবে। এটা একটা আদেশ। মনে থাকবে?

মনে থাকবে।

যদি মনে থাকে তাহলে আমাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। ঠিক আছে?

টর পাথরের মতো মুখ করে বলল, ঠিক আছে।

 

সাতজনের ছোট দলটা তখন মঙ্গলগ্রহের রুক্ষ পাথরের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। তাদের হাঁটার গতি দ্রুত। যেভাবে হোক তারা মানুষের আবাসস্থলে পৌঁছাতে চায়।

সাতজনের ছোট দলটি যখন মানুষের আবাসস্থলের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন সূর্যটি বেশ উপরে ওঠে গেছে। সূর্যের ম্লান আলোতে মঙ্গলগ্রহের বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে কেমন যেন নিঃসঙ্গ দেখায়। টর বলল, আমার মনে হয় আমরা শেষ পর্যন্ত আবাসস্থলে পৌঁছে গেছি।

নীহা বলল, হ্যাঁ। আরো কয়েকদিনের জন্যে বেঁচে থাকার সুযোগ হল।

টর বলল, ব্যাপারটা ভালো হল কি না বুঝতে পারছি না!

নীহা বলল, জীবন কখনো খারাপ হতে পারে না। জীবন সবসময়ই ভালো।

কে বলেছে? সুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সবকিছু অন্যরকমও হতে পারে।

হলেও আর কতোটুকু হবে?

অনেকখানি হতে পারে।

নীহা ভুরু কুঁচকে বলল, কীভাবে?

সুহা বলল, কাছে এসো দেখাচ্ছি।

নীহা দুই পা এগিয়ে সুহার কাছে যেতেই সে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা নীহার মাথায় ধরল। মুহর্তে সুহার চেহারাটি একটি হিংস্র মানবীতে পাল্টে গেল। সে হিসহিস করে বলল, সবাই তোমাদের হাতের অস্ত্র নিচে ফেলে দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও। এক সেকেন্ড দেরি করলে এই নির্বোধ মেয়েটার খুলি ফুটো হয়ে যাবে।

সবাই হতবাক হয়ে সুহার দিকে তাকিয়ে থাকে। সুহা প্রায় যান্ত্রিক গলায় বলল, এখনো যদি না বুঝে থাক তাহলে পরিষ্কার করে বলে দিই। আমি দুজন রবোমানবের একজন।

টুরান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আরেকজন কে?

ক্লদ বলল, আমি।

সবাই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, তুমি!

হ্যাঁ আমি। বলে ক্লদ এগিয়ে নীহার হাত থেকে হ্যাচকা টান মেরে তার অস্ত্রটা নিয়ে নেয়।

সুহা সবার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, আমি তোমাদের সাথে খোশগল্প করার জন্যে আসি নি। হাতের অস্ত্র নিচে ফেল।

টর ইহিতাকে জিজ্ঞেস করল, ইহিতা, কী করব? তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে এই ডাইনিবুড়িকে শেষ করে দিই।

তাহলে অন্যদের কথা জানি না কিন্তু নিশ্চিতভাবে নীহাকে হারাব।

সুহা চিষ্কার করে বলল, বাজে কথা বল না। অস্ত্র ফেল, তা না হলে এই মুহূর্তে এর খুলি উড়িয়ে দেব।

ইহিতা এক পা এগিয়ে এসে বলল, আমার মনে হয় না তুমি এই মুহূর্তে সেটা করবে। তুমি রবোমানব হতে পার কিন্তু রবোট নওনীহার মাথায় গুলি করা মাত্রই আমাদের চারজনের অস্ত্র তোমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে! কাজেই তুমি এতো সহজে গুলি করবে না।

তুমি রবোমানবকে চেনো না। রবোমানবের ভেতরে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা নেই

শব্দটা দুর্বলতা নয়। শব্দটা হচ্ছে মানবিক মায়া মমতা-

সুহা হিস হিস করে বলল, অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট কর না। তোমাদের মানবিক মায়ামমতা দুর্বলতা কি না সেটা এই মুহূর্তে প্রমাণিত হবে! তোমাদের নিজেদের রক্ষা করার একটি মাত্র উপায়-সেটি হচ্ছে আমাকে গুলি করা। করো গুলি। চিৎকার করে বলল, করো।

নীহা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

সুহা হিংস্র ভঙ্গিতে বলল, করতে পারবে না। কাজেই সময় নষ্ট করো না। হাতের অস্ত্র ফেলে দাও।

ইহিতা অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, সে ঠিকই বলেছে। আমাদের আর কিছু করার নেই–হাতের অস্ত্র ফেলে দিতে হবে।

টর বলল, কিন্তু এই ডাইনি বুড়ি তাহলে সাথে সাথে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।

সম্ভবত। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই, অন্তত নীহা জানবে আমরা আমাদের নিজেদের বাঁচানোর জন্যে তাকে মারা যেতে দিই নি।

টর কাঁপা গলায় বলল, তুমি আমাদের দলপতি, তুমি যেটাই বলবে আমি সেটাই শুনব। আমরা কি শেষ চেষ্টা করব না?

ইহিতা বলল, ক্লদের দিকে তাকাও। দেখো সে কীভাবে অস্ত্রটা তোমার দিকে তাক করে ধরেছে। সম্ভবত সে তোমাকে গুলি করবে, কিন্তু তুমি কি পারবে এই চার বছরের শিশুটাকে গুলি করে মারতে?

টর মাথা নাড়ল, বলল, না।

আমি জানি তুমি আমি কেউ পারব না। আমরা মানুষ সেই জন্যে এখানে এই মুহূর্তে হয়তো সবাই মারা যাব। কিন্তু জেনে রাখো যে কারণে আমরা সবাই এখানে মারা যাব ঠিক সেই কারণে পৃথিবীর অসংখ্য জায়গায় অসংখ্য মানুষ একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখবে।

সুহা চিৎকার করে বলল, অস্ত্র ফেল।

টর ইহিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইহিতা। তুমি আমাদের দলপতি। তুমি বল, অস্ত্র ফেলব?

আমি খুবই দুঃখিত টর, কিন্তু আমাদের অস্ত্র ফেলতে হবে।

টর হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলল। ইহিতা আর টুরান তাদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলল। নুট তার হাতের অস্ত্র তুলে বলল। আমি আমার হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে ফেলার আগে একটি কথা বলতে পারি?

কী কথা?

নুট একটু এগিয়ে এসে বলল, মনে আছে আমি বলেছিলাম আমি জানি আমাদের ভেতরে কোন দুজন রবোমানব? তোমরা কী বিশ্বাস কর আমি সেটা জানতাম?

সুহা মাথা নাড়ল, বলল, অসম্ভব। আমরা পুরো সময় নির্বোধ মানুষের মতো অভিনয় করে গেছি।

নুট এক হাতে তার অস্ত্রটি ধরে রেখেছিল, অন্য হাতটি উপরে তুলে দেখিয়ে বলল, এটা কী দেখেছ?

একটা লিভার।

হ্যাঁ। এই লিভারটি ছেড়ে দিলে কী হবে জান?

কী হবে?

এটা খুব ছোট একটা বিস্ফোরক ডেটোনেট করবে। বিস্ফোরকটা কোথায় আছে জানতে চাও?

সুহা হিংস্র মুখে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

তোমার ছেলে ক্লদের শরীরে!

মিথ্যা কথা!

তোমার মনে আছে, ক্লদকে স্পেসস্যুট পরাতে কে সাহায্য করেছিল? আমি। কেন আমি এতো ব্যস্ত হয়ে তাকে সাহায্য করেছিলাম? ছোট্ট এই বিস্ফোরকটি রাখার জন্যে!

তুমি মিথ্যা কথা বলছ!

ঠিক আছে! নুট হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, পরীক্ষা হয়ে যাক! আমাকে গুলি কর। আমার হাত থেকে লিভারটি মুক্ত করিয়ে দাও।

ক্লদ চিৎকার করে বলল, না! না! সুহা, গুলি করো না।

নুট হা হা করে হেসে বলল, আমি কম কথা বলি, তাই অনেক বেশি চিন্তা করি। চিন্তা করে করে সব কিছু বের করে ফেলা যায়। আরো একটা জিনিস জান?

কী?

আমাকে মানুষের এই দলটাতে কেন রেখেছে জান?

কেন?

আমার একটা অপরাধী মন আছে-যেটা এখানে আর কারো নেই। আমি অপরাধীর মতো চিন্তা করতে পারি-যেটা তোমাদের মতো রবোমানবদের বিপদে ফেলে দিতে পারে। নুট আবার হাসার চেষ্টা করে বলল, সুহা! নির্বোধ রবোমানব, তুমি কী লক্ষ করেছ, আমি সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। অন্যদের আড়াল করে ফেলেছি। তুমি আমাকে গুলি না করে অন্যদের গুলি করতে পারবে না।

সুহা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে নুটের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঘুরে ক্লদের দিকে তাকাল, বলল, ক্লদ তুমি নিচ থেকে সবগুলো অস্ত্র তুলে নিয়ে এস।

ক্লদ বলল, কেন?

আমার সাথে তর্ক করবে না, নিয়ে এস?

ক্লদ নিচে পড়ে থাকা অস্ত্রগুলো তুলে নিয়ে আসে। সুহা তখন ধাক্কা দিয়ে নীহাকে সরিয়ে দিল, তারপর ক্লদকে বলল, অস্ত্রগুলো দাও।

ক্লদ জিজ্ঞেস করল, কেন?

তুমি এতোগুলো রাখতে পারবে না সেজন্যে।

ক্লদ বলল, অস্ত্রগুলো ভারী না, তাছাড়া মঙ্গলগ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বল খুব কম। আমি এগুলো রাখতে পারব।

বাজে তর্ক করো না। অস্ত্রগুলো দাও আমার হাতে।

ক্লদ তার শিশুসুলভ কণ্ঠে কিন্তু একজন বড় মানুষের ভাষায় বলল, সব অস্ত্র তোমার হাতে থাকলে তোমার কাছ থেকে আমাকে নিরাপত্তা কে দেবে! তা ছাড়া-

তা ছাড়া কী?

কথা ছিল আমি এখন প্রথম মানুষ হত্যা করব। তুমি আমাকে এখনো হত্যা করতে দিচ্ছ না।

ক্লদ! নির্বোধের মতো আচরণ করো না! দেখতে পাচ্ছ না এই অপরাধীটা দাবি করছে তোমার জীবন তার হাতে? যতক্ষণ পরীক্ষা করে সেটা নিশ্চিত না হতে পারছি ততক্ষণ তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

ক্লদ চিৎকার করে বলল, তুমি বলেছিলে তুমি নিখুঁত পরিকল্পনা করেছ, এখানে দেখা যাচ্ছে তোমার পরিকল্পনায় শুধু ভুল আর ভুল! তুমি বলেছিলে মানুষ হচ্ছে নির্বোধ! এখন দেখা যাচ্ছে তুমি মানুষ থেকেও নির্বোধ?।

সুহা ধমক দিয়ে বলল, বাজে কথা বলো না। আমার পরিকল্পনা নিখুঁত।

তাহলে কেন এখনো আমি একটা মানুষকে হত্যা করতে পারছি না!

পারবে। সময় হলেই পারবে।

কখন সময় হবে?

সুহা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রেডিয়েশান মনিটরের দিকে তাকাল। সেখানে আবার তেজস্ক্রিয়তার চিহ্ন দেখা দিতে শুরু করেছে। সে ভুরু কুঁচকে বলল। প্রাণীগুলো আবার আসছে।

ক্লদ জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব?

তুমি ছুটে যাও আবাসস্থলের দিকে। অস্ত্রগুলো রেখে যাও।

না। আমি অস্ত্র নিয়ে যাব। বলে সে দুই হাতে কোনোভাবে অস্ত্রগুলো ধরে আবাসস্থলের দিকে ছুটতে থাকে।

নুট শব্দ করে হাসল, বলল, আমি তোমাকে যতই দেখছি—ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি! তুমি কী সত্যিই ক্লদকে জন্ম দিয়েছিলে?

হ্যাঁ দিয়েছিলাম। তাতে কী হয়েছে?

মা হয়ে তুমি যেভাবে তোমার নিজের সন্তানকে হত্যা করার ব্যবস্থা করলে। আমি সেটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি সুহা। এখন তুমি আমাদের হত্যা করবে তখন আমার হাতের লিভারটি ছুটে যাবে সাথে সাথে ক্লদের শরীরের ভেতর বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হবে–তুমি নিশ্চিত করলে তখন যেন সে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকে! তোমার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

এর ভেতরে কোন বিষয়টি অযৌক্তিক? একটা অবাধ্য শিশুর হাতে যখন অস্ত্র ওঠে যায় সে কতো বিপজ্জনক তুমি জান?

জানি। নুট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ক্লদ ছুটে অনেকদূর চলে গিয়েছে তাই তোমার মনে ধারণা হয়েছে সে তোমার কথা শুনতে পারছে না। তুমি ভুলে গেছো আমাদের হেলমেটের মাঝে কমিউনিকেশান মডিউল লাগানোএকশ কিলোমিটার দূর থেকেও কথা শোনা যায়। ক্লদ তোমার কথাগুলো শুনেছে। তার হাতে একটি নয় দুটি নয় চার-চারটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সে ফিরে আসছে–তোমার কী মনে হয় চার বছরের একটা শিশুর সাথে তুমি বোঝাপাড়া করতে পারবে?।

সুহা চমকে পিছনে তাকাল, তার গলা থেকে একটা হিংস্র শ্বাপদের মতো শব্দ বের হয়ে এলো। সে তার অস্ত্রটি শক্ত হাতে ধরে পায়ে পায়ে ক্লদের দিকে এগুতে থাকে। সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, চার বছরের একটা শিশুও হাতে একটা অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছে, দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝি একটা খেলনা ধরে রেখেছে। কিন্তু এটা মোটেও খেলনা নয়-এটা ভয়ংকর একটা অস্ত্র!

সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। একটা মা আর তার শিশু সন্তান একজন আরেকজনের দিকে উদ্যত অস্ত্র হাতে এগিয়ে যাচ্ছে-একজন আরেকজন হত্যা করতে চায়। কী ভয়ংকর একটি দৃশ্য–এর চাইতে ভয়াবহ, এর চাইতে নিষ্ঠুর কোনো কিছু কি হওয়া সম্ভব?

নুট নীহা টর টুরান আর ইহিতা নিঃশ্বাস বন্ধ করে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্যটির দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।