০২. অংশুমান চৌধুরী খুব রোগা আর লম্বা

অংশুমান চৌধুরী খুব রোগা আর লম্বা একজন মানুষ। গায়ের রং বেশ ফসা, মাথায় একটাও চুল নেই, দাড়ি-গোঁফ নেই, ভুরুর চুল সব পাকা, কিন্তু সেরকম বুড়ো থুরথুরে নন্। চোখ দুটি ঝকঝকে। তাঁর ঘরে অনেক কালের পুরনো একটা খাট, যার আর-এক নাম পালঙ্ক। খাটটি বেশ উঁচু, একটা টুলের ওপর পা দিয়ে সেটার ওপরে উঠতে হয়। সেটির সারা গায়ে কারুকার্য করা। ঘরের দেওয়ালে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো দুটি ছবি। একটি চাঁদের, আর একটি সূর্যের। দরজার পাশের দেওয়ালে, যেখানে আলোপাখার সুইচ থাকে, সেখানে অন্তত কুড়ি-পঁচিশটা সুফ।

অংশুমান চৌধুরী ঘুম থেকে উঠে তামাক খেতে লাগলেন। খাটের মাথার কাছে একটা বেশ বড় গড়গড়া। তার নলটা এত লম্বা যে, অংশুমান চৌধুরী সারা ঘরে পায়চারি করতে করতেও তামাক খেতে পারেন। তিনি পরে আছেন একটা ডোরাকাটা আলখাল্লা আর তাঁর পায়ের চটিজোড়া মনে হয় রুপো দিয়ে তৈরি। তিনি ঘুরে ঘুরে তামাক টানতে টানতে একটা গান ধরলেন, এমন দিন কী হবে মা তারা..। প্রত্যেকদিন বিকেলে এই সময় তাঁর গান গাওয়া অভ্যেস। তবে ওই একটি গান ছাড়া তিনি আর কোনও গান জানেন না।

দরজার কাছ থেকে মুখ বাড়িয়ে জোজো জিজ্ঞেস করল, পিসেমশাই, আসব?

দারুণ চমকে গিয়ে অংশুমান চৌধুরী হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, কে? জোজো বলল, পিসেমশাই, আমি জোজো। হঠাৎ চলে এলাম!

অংশুমান চৌধুরী যেন বেশ রেগে গিয়ে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর হেসে ফেলে বললেন, তুই জোজো, তাই না? আমি প্রথমে ভাবলুম বুঝি দাজু! সে যখন-তখন এসে বড্ড বিরক্ত করে। তারপর তোর কী খবর বল! তোর বাবা আর কজন রাজা-উজিরকে খতম করল?

জোজো বলল, পিসেমশাই, আমার কলেজের দুজন বন্ধুকে নিয়ে এসেছি।

অংশুমান চৌধুরী চোখ থেকে চশমাটা খুলে সন্তু আর অরিন্দমকে দেখলেন ভাল করে। তারপর বললেন, এসো, ভেতরে এসো!

ঘরের মধ্যে মস্ত বড় খাটখানা ছাড়া আর রয়েছে একখানা ইজিচেয়ার। তার। ওপরে একখানা সুন্দর কাশ্মিরী শাল জড়ানো। সন্তু আর অরিন্দম ভেতরে এসে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

জোজো তার পিসেশমাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই তিনি তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গিয়ে বললেন, এই, এই, ইঁস না আমাকে। ছুঁস না। তোর গায়ে কিসের গন্ধ, মনে হল জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ। নিশ্চয়ই ওই সিংহ-টিংহগুলো দেখতে গিয়েছিলি!

জোজো অপরাধীর মতন মাথা চুলকোতে লাগল।

সন্তু অবাকভাবে তাকাল অরিন্দমের দিকে। জোজোর পিসেশমাইয়ের এত তীব্র ঘ্রাণশক্তি? ওরা সিংহটার কাছে একটুখার্নি দাঁড়িয়ে ছিল, তাতেই তাদের গায়ে এত গন্ধ হয়ে গেছে! এরকম কথা সন্তু কখনও শোনেনি।

অংশুমান চৌধুরী নাক কুঁচকে বললেন, জানিস না, আমি জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারি না! দ্যাখ, আমার ঘরে কোনও চামড়ার জিনিস

নেই। আমি বেল্ট পরি না। চামড়ার জুতো পরি না!

সন্তু আর অরিন্দম নিজেদের কোমরে হাত দিল। ওরা যদিও বাইরে জুতো খুলে রেখে এসেছে, কিন্তু ওদের কৈামরে চামড়ার বেল্ট। এ-ঘরে সত্যিই কোনও চামড়ার জিনিস নেই।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, ইচ্ছে করলে আমি ওই ম্যাজিশিয়ান ছছাকরার পোষা সিংহ আর হাতিটাতিগুলোকে এখানে বসে বসেই মেরে ফেলতে পারি। ছোকরাকে আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দেব। ও যদি ওগুলোকে কলকাতায় নিয়ে না যায়, তা হলে মেরে ফেলতেই হবে।

অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, আমরা কি আমাদের বেল্ট বাইরে খুলে রেখে আসব?

অংশুমান চৌধুরী সে প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে জোজোকে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ বন্ধুদের নিয়ে বারুইপুরে এলি যে, এখানে কী দেখার আছে?

জোজো বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য নিয়ে এসেছি।

অংশুমান চৌধুরী হেসে বললেন, আমার সঙ্গে আলাপ; এই বুড়োমানুষটার সঙ্গে কথা বলে ওদের কী ভাল লাগবে?

জোজো বলল, আপনি একজন বিশ্ববিখ্যাত মানুষ!

অংশুমান চৌধুরী হো হো করে হেসে বললেন, বিশ্ববিখ্যাত বলছিস কেন? বল্ মহাবিশ্ববিখ্যাত! তা বিশুর মা তোদের কিছু খেতে টেতে দিয়েছে? মুখচোখ তো শুকিয়ে গেছে দেখছি!

জোজো বলল, হ্যাঁ, আমরা খেয়েছি। পিসেমশাই, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার এই যে বন্ধুটাকে দেখছেন, ওর ডাক নাম সন্তু। ওর কাকার নাম রাজা রায়চৌধুরী। আপনি নাম শুনেছেন? তিনি দুএকটা রহস্যের সমাধান করেছেন বলে কাগজে নাম বেরোয় মাঝে-মাঝে। আর সন্তুর পাশের জনের নাম অরিন্দম। ও আমার সঙ্গে বাজি ফেলে হেরে গেছে। ও বলেছিল…।

অংশুমান চৌধুরী এতক্ষণ সন্তু বা অরিন্দমের দিকে ভাল করে তাকাননি। এবারে তিনি সন্তুর মুখের দিকে দারুণ অবাকভাবে চেয়ে রইলেন। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী তোমার কাকা? রাজা রায়চৌধুরী মানে সেই যার একটা পা ডিফেকটিভ?

সন্তু মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল।

অংশুমান চৌধুরী নিজের কপালে বাঁ হাত দিয়ে একটা চাপড় মেরে বললেন, নিয়তি, নিয়তি! জানতাম একদিন দেখা হবেই।

তারপর তিনি ঘরের কোনায় গিয়ে কাচের একটা আলমারির পাল্লা খুলে একটা জরিবানো টুপি বার করে মাথায় পরলেন। আয়নায় নিজেকে ভাল করে দেখে টুপিটা ঠিকমতন বসাবার চেষ্টা করলেন একটুক্ষণ।

এবারে তিনি সন্তুর একেবারে কাছে চলে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাকাবাবু কি পুরোপুরি রিটায়ার করেছেন? আজকাল আর কোনও সাড়াশব্দ পাই না?

সন্তু কিন্তু উত্তর দেওয়ার আগেই জোজো বলল, না, উনি রিটায়ার করেননি তো? এই তো কয়েকমাস আগে উনি ইজিপ্ট গিয়েছিলেন, পিরামিডের মধ্যে কী যেন আবিষ্কার করার জন্য। সন্তু সঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুই পাননি সেখানে। কী রে, ঠিক না? এবারে ইজিপ্টে গিয়ে তো তোরা পিরামিডের মধ্যে কিছুই খুঁজে বার করতে পারসিনি। তাই না? সোনাদানা কিছু পেয়েছিলি?

সন্তু বলল, কাকাবাবু গিয়েছিলেন, পিরামিডের মধ্যে দেওয়ালের গায়ে যেসব ছবি আঁকা আছে, তার ভাষা পড়তে। সোনাটোনা তো খুঁজতে যাননি। সোনা পেলেও আমরা নিতাম না।

অংশুমান চৌধুরী ভুরু কুঁচকে বললেন, পিরামিডের দেওয়ালের ভাষা? ইয়রোগ্লিফিক্স? রাজা রায়চৌধুরী আবার সে ভাষা পড়তে শিখল কখন? ওটা

তো আমার সাবজেক্ট!

জোজো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা পিসেমশাই, বাড়ির দেওয়ালে টিকটিকি বা আরশোলা বসলেও আপনি এই ঘরে বসেই মেরে ফেলেন কী করে? সেটা আমাদের একটু দেখান না!

অংশুমান চৌধুরী বললেন, ওটা আর এমন কী ব্যাপার। এই যে সুইচগুলো দেখছিস, এর সঙ্গে প্রত্যেকটা ঘরের দেওয়ালের সঙ্গে যোগ আছে। যখনই আমি মন দিয়ে কাজ করি, তখন কোনও পোকামাকড়ের খারাপ গন্ধ আমার নাকে এলেই আমি সেই জায়গায় সুইচ টিপে দিই, অমনি সেখানকার মেঝেতে, দেওয়ালে, ছাদে এমনই ভাইব্রেশান হয় যে, কোথাও পোকামাকড় আর সেখানে টিকতে পারে না। ছেলেবেলায় একটা কাঁকড়াবিছে আমায় কামড়ে ছিল! মানে, ওরা তো কামড়াতে পারে না, হুল ফুটিয়ে দেয়। সেই থেকে আমি কোনও পোকামাকড় সহ্য করতে পারি না।

জোজো বলল, আপনি তো কুকুর-বেড়ালও… একবার একটা কুকুরও কামড়ে দিয়েছিল আমাকে। তখন আমি ঠিক করেছিলুম, পৃথিবী থেকে সব কুকুর ধ্বংস করে দেব! ইচ্ছে করলেও পারি।

কথাটা শুনে সন্তু একটু শিউরে উঠল। তার নিজের একটা পোষা কুকুর আছে। সে কুকুর ভালবাসে। একবার একটা কুকুর কামড়েছে বলে ইনি সব কুকুর ধ্বংস করে দিতে চান!

অংশুমান চৌধুরী আবার সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আমার এই টুপি-পরা চেহারাটা ভাল করে দেখে রাখো। তারপর বাড়ি ফিরে তোমার কাকাবাবুকে আমার কথা বলো! তোমার কাকা রাজা রায় চৌধুরীকে আমি আমার জীবনের প্রধান শত্রু বলে মনে করি। দশ বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল আফগানিস্তানে। তখন উনি একটা ব্যাপারে আমাকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। সে অপমান আমি আজও ভুলিনি। আশা করি, এবারে আবার দেখা হবে। এবারে আমি শোধ নেব?

তারপর তিনি হেসে সন্তুর কাঁধ চাপড়ে বললেন, তোমার কোনও ভয় নেই। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না!