০৪. আগাগোড়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ

আগাগোড়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ, ছোট-ছোট পাহাড় ঘুরে-ঘুরে এগিয়ে চলল গাড়িটা। পাশে-পাশে দেখা যায় জাটিংগা নদী। বর্ষার জলে একেবারে ভর্তি, স্রোতও খুব। মনে হয় যেন নদীটা মাঝে-মাঝে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে।

নদীর ধারে-ধারে রেল লাইন। উলটো দিকের একটা ট্রেন যাচ্ছে। ছোট ট্রেন, দূর থেকে খেলনার মতন মনে হয়। পাহাড়ের মাঝে-মাঝে টানেল, ট্রেনটা এক-একবার ঢুকে যায় অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে। গাড়ি অবশ্য বাইরে দিয়েই। যায়।

জজসাহেব বসেছেন সামনের সিটে। মাঝে-মাঝে পেছনে তাকিয়ে দেখছেন সন্তুকে। গাড়িতে উঠেই তিনি বলেছেন যে, শিলচরে তাঁর চেনা একজন ডাক্তার আছেন। খুব ভাল ডাক্তার। তাঁর কাছে নিয়ে গেলে তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন, দরকার হলে অপারেশানও করতে পারবেন।

একবার গাড়িতে খুব জোর ঝাঁকুনি লাগতেই সন্তু চোখ মেলে চাইল।

কাকাবাবু অমনি মুখ ঝুঁকিয়ে বললেন, সন্তু, খুব ব্যথা করছে?

সন্তু কোনও কথা না বলে কয়েক মিনিট চেয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, হ্যাঁ, ব্যথা আছে। খুব বেশি না। কাকাবাবু, তোমার কিছু হয়নি?

কাকাবাবু বললেন, না, আমার কিছু হয়নি!

সন্তু খুব একটা নিশ্চিন্ত ভাব করে বলল, ও! তোমার কিছু হয়নি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি আর-একটু ঘুমোই?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ঘুমো ঘুমো!

গাড়ির ড্রাইভারটি বেশ দক্ষ। রাস্তা অনেক জায়গায় বেশ খারাপ হলেও চার ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে দিল শিলচর শহরে।

ব্রিজের ওপর এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যাম হয়েছে, সেখানেই দেরি হতে লাগল খানিকক্ষণ। কাকাবাবু অধৈর্য হয়ে উঠলেন।

পাশ থেকে একজন মোটর সাইকেল আরোহী হঠাৎ বলে উঠল, আরে, কাকাবাবু! আপনি এদিকে কবে এলেন?

যুবকটিকে দেখে কাকাবাবুর মুখখানাতে স্বস্তি ফুটে উঠল। এর নাম প্রবীর চৌধুরী। কাকাবাবুর এক বন্ধুর ছেলে, ডাক্তার।

কাকাবাবু বললেন, প্রবীর? তুমি এখানে কী করছ?

প্ৰবীর বলল, আমি তো এখানকার এক চা বাগানে ডাক্তারি করছি দু বছর ধরে। আপনি জানতেন না? আমি মাঝে-মাঝে শিলচর শহরে আসি কিছু কেনাকাটা করবার জন্য।

কাকাবাবু বললেন, খুব ভাল হল, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে। শোনো প্রবীর, সন্তুর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, একটা পা ভেঙে গেছে বোধ হয়। এক্ষুনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্ৰবীর বলল, তাই নাকি? আমার বন্ধুর নার্সিং হোম আছে। চলুন, সেখানে গিয়ে আমি দেখছি। আমার বন্ধুটিও দেখবে।

জজসাহেব বললেন, না, না, তার দরকার নেই। আমার চেনা ডক্টর ভার্গব এখানকার খুব নামকরা ডাক্তার। আমি তাঁর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আর কোনও অসুবিধে হবে না।

এর মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম ছেড়ে গেল, গাড়িটা আবার স্টার্ট দিল। প্রবীরের মোটর বাইক আড়ালে পড়ে গেল একটা ট্রাকের।

মিনিট-দশেক পর গাড়িটা থামল একটা বড় বাড়ির সামনে। সেটা একটা নার্সিং হোেম বলে মনে হয়।

জজসাহেব প্রথমে নিজে নেমে গিয়ে তোক ডেকে আনলেন। সন্তুকে নিয়ে শোওয়ানো হল একটা ঘরে। তারপর জজসাহেব বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। ডক্টর ভার্গব ওপরে আছেন। আমি তাঁকে ডেকে আনছি। উনি ব্যস্ত থাকলেও আমি অনুরোধ এলে এক্ষুনি আসবেন।

সন্তুর এখন ঘুম ভেঙে গেছে। সে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, কোনও কথা বলছে না। মাঝে-মাঝে শুধু যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে তার মুখ। কাকাবাবু হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তার কপালে।

মিনিট-পাঁচেক বাদেই বিচারকের সঙ্গে নেমে এলেন ডাক্তার ভার্গব। বেশ বলশালী চেহারা, দাড়ি-গোঁফ কামানো, মাথায় টাক, গায়ের রং খুব ফর্সা।

তিনি সন্তুর মাথা, বুক, পেট আর পা পরীক্ষা করলেন খুব মনোযোগ দিয়ে। সন্তুকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কোথায় কতটা লাগছে। সন্তুর নাম, কোন কলেজে পড়ে, কী পড়তে ভাল লাগে, এরকম নানা কথাও জানতে চাইলেন।

তারপর কাকাবাবুকে বললেন, ভগবানকে ধন্যবাদ দিন, এ ছেলেটি বেঁচে গেছে। খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। মাথায় তেমন চোট লাগেনি, কথাবার্তা পরিষ্কার বলছে। কয়েকটা এক্স-রে করতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, আর পা-টার অবস্থা?

ডাক্তার ভার্গব একটু সরে এসে বললেন, পায়ের অবস্থাটাই বেশ খারাপ। মনে হচ্ছে অপারেশান করে বাদ দিতে হবে। প্রাণটাই বেঁচে গেছে, সেই তুলনায় একটা পা যাওয়া আর এমন কী ক্ষতি? তবে এক্ষুনি নয়, দিন-দশেক দেখা দরকার। যদি অপারেশান না করে পা-টা রাখা যায়।

কাকাবাবু বললেন, দিন-দশেক? তা হলে আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাই।

ডাক্তার ভার্গব বললেন, এই অবস্থায় ওকে নাড়াচাড়া করা আরও বিপজ্জনক। এই যে এতখানি রাস্তা এনেছেন, গাড়ির ঝাঁকুনিতে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অন্তত চার-পাঁচদিন একদম চুপচাপ শুইয়ে রেখে দেখা যাক।

এই সময় পাশ থেকে একজন বলল, কাকাবাবু একটা কথা বলব?

কাকাবাবু চমকে গিয়ে দেখলেন ডাক্তার প্রবীর চৌধুরী কখন এসে কাছে। দাঁড়িয়েছে।

প্রবীর ডাক্তার ভার্গবকে বলল, নমস্কার সার। আমি একজন জুনিয়ার ডাক্তার। তবে আমার বন্ধু ডাক্তার ভূপেন বড়ঠাকুর এখানে অনেকদিন প্র্যাকটিস করছেন, তাঁকে চেনেন নিশ্চয়ই। ওঁর নিজের বাড়িতেই নার্সিং হোম, সেখানে যদি সন্তুকে নিয়ে রাখা যায়, তা হলে কাকাবাবুও কাছে থাকতে পারবেন।

ডাক্তার ভার্গব বললেন, এখানেও কাছেই হোটেল আছে, সেখানে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

জজসাহেব বললেন, না, না, এখান থেকে আর সরানো ঠিক হবে না। ছেলেটির আরও ক্ষতি হয়ে যাবে।

প্ৰবীর বলল, ভূপেন বড়ঠাকুরের চেম্বার কাছেই। নিয়ে যাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান আছে। ওখানে নিয়ে গেলে আমরা সবাই মিলে চব্বিশ ঘন্টা ওর কাছে থাকতে পারি।

এবার সন্তু বলে উঠল, আমি প্রবীরদার সঙ্গে যাব?

ভার্গব ডাক্তার দু কাঁধ কাঁপিয়ে বললেন, পেশেন্ট নিজে যদি থাকতে না চায়, তা হলে আমি জোর করে তো ধরে রাখতে চাই না! নিয়ে যান তা হলে!

প্রবীর সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে ছুটে বেরিয়ে গেল।

কাকাবাবু জজসাহেবকে প্রচুর ধন্যবাদ দিলেন। ভার্গব ডাক্তারকেও বললেন, আপনি ভালভাবে ওকে পরীক্ষা করে দেখেছেন, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

ভার্গব ডাক্তারকে টাকা দিতে চাইলেন কাকাবাবু, কিন্তু তিনি নিলেন না।

সন্তুকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে আসা হল ভূপেন বড়ঠাকুরের চেম্বারে। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুকে এক্স-রে করার ঘরে নিয়ে গেলেন।

প্ৰবীর বলল, জানেন কাকাবাবু, যখনই শুনলাম, সন্তুকে ভার্গব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনই আমার ঠিক পছন্দ হয়নি। ডাক্তার হিসেবে ভার্গব খারাপ নন, কিন্তু উনি রুগিদের বেশিদিন ধরে রাখেন। যে রুগিকে চার-পাঁচদিনে ছেড়ে দেওয়া যায়, তাকেও উনি দশ বারোদিন আটকে রাখেন। তা ছাড়া সন্তুর পা ভেঙে গেছে, উনি তো হাড়ের ডাক্তার নন। ভূপেন ডাক্তারের একজন সহকর্মী আছেন, ডাক্তার ইউসুফ, তাঁকে বলা যেতে পারে হাড়ের অসুখের জাদুকর।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, তোর কী হয়েছিল মনে আছে? তোকে ওরা ঠেলে ফেলে দেওয়ার আগে তুই কিছু বুঝতে পেরেছিলি?

সন্তু বলল, আমায় কেউ ঠেলে ফেলে দেয়নি তো!

প্রবীর অবাক হয়ে বলল, তা মানে? আপনাদের কে ঠেলে ফেলে দেবে?

কাকাবাবু বললেন, দুজন লোক। আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল, তারপর একটা খাদের পাশে…তোমাকে সব ঘটনাটা পরে বলব। সন্তু, তুই কী বললি? তোকে কেউ ফেলে দেয়নি?

সন্তু বলল, না। হঠাৎ ওখানে দেখলাম, পাহাড়ের ওপর থেকে হুড়মুড় করে দু-তিনজন লোক নেমে এল। ওরা ওখানে লুকিয়ে ছিল। আমি পেছন ফিরে তাদের দেখতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছি। তার মধ্যে ওরা তোমার হাত বেঁধে ফেলেছে। আমি দেখলুম, কুমার সিং তোমাকে লাথি মেরে খাদে ফেলে দিল। তারপর ওরা আমাকেও ধরতে গেল। সামনে আর পেছনদিকে, দুদিকেই ওরা। একজন আমার একটা হাত ধরেও ফেলেছিল, আমি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেই খাদের মধ্যে লাফ দিলাম!

কাকাবাবু একটা ভয়ের শব্দ করে বললেন, অ্যাঁ! বলিস কী? তুই ইচ্ছে, করে ওই গভীর খাদে লাফিয়ে পড়লি?

সন্তু ফ্যাকাসেভাবে হেসে বলল, হ্যাঁ।

কাকাবাবু বললেন, কেন এরকম কাণ্ড করলি সন্তু? ওরা হয়তো তোকে মারত না?

সন্তু বলল, তা বলে ওদের হাতে ধরা দেব? ওরা তোমাকে খাদে ফেলে দিয়েছে, আমি নিজের চোখে দেখলাম, তখন আমার একটাই কথা মনে হয়েছিল। তোমার ভাগ্যে যা ঘটবে, আমারও তাই হবে।

প্ৰবীর বলল, তুই কী সাঙ্ঘাতিক ছেলে রে সন্তু! ইচ্ছে করে খাদে লাফিয়েছিস? লোকগুলো কে? তাদের পুলিশ ধরেনি?

কাকাবাবু বললেন, এসব কথা অন্য কাউকে এখন বলার দরকার নেই।

অ্যাম্বুলেন্সটা শিলচর শহর ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় একটা বাড়ির সামনে থামল। বেশ পরিষ্কার, সাজানো-গোছানো বাগানও রয়েছে সামনে, দেখলে নার্সিং হোম বলে মনেই হয় না।

ডাক্তার বড়ঠাকুরকে ডেকে প্রবীর তাড়াতাড়ি সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।

তিনি তাঁর এক সহকারীকে ডেকে সন্তুকে পাঠিয়ে দিলেন এক্স-রে করার জায়গায়। তারপর কাকাবাবুর দিকে কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনার ছবি আমি কাগজে দেখেছি। কিন্তু এখন তো আপনাকেই খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।

প্রবীর কাকাবাবুর কপালে হাত দিয়ে বলল, বেশ জ্বর!

কাকাবাবু বললেন, ও এমন কিছু না। বেশি বৃষ্টিতে ভিজেছি। সন্তুর পা-টা আপনি ভাল করে দেখুন। যদি ওর একটা পা সত্যিই বাদ দিতে হয়…

হঠাৎ কাকাবাবুর সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল। হু-হু করে জল এসে গেল দু চোখে। বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে তিনি উঠছিলেন, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। ঘুরে পড়ে গেলেন মাটিতে!

দুই ডাক্তার ধরাধরি করে কাকাবাবুকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল একটা বিছানায়।

প্রবীর ফিসফিস করে বলল, কারা যেন কাকাবাবুকে হাফলঙ পাহাড়ে হঠাৎ ঠেলে একটা খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। উনি যে বেঁচে গেছেন, সেটাই একটা চরম আশ্চর্য ব্যাপার। ওঁর নিশ্চয়ই কোথাও খুব চোট লেগেছে, তারপর সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছেন। কিন্তু সন্তুর জন্য এমনই চিন্তিত যে নিজের চিকিৎসার কথা একবারও ভাবেননি।

ডাক্তার বড়ঠাকুর বললেন, ওঁর এখন বিশ্রাম দরকার। আজ রাতটা ভাল করে ঘুমোলেই অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবেন।

প্ৰবীর বলল, সে উনি ঘুমোবেন না। একটু বাদে জ্ঞান ফিরলেই আবার সন্তুর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবেন।

কাকাবাবুকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ওরা দুজনে চলে গেল সন্তুর দেখাশোনা করতে।

পরদিন সকালে চোখ মেলেই কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন।

সে-ঘরের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে প্রবীর।

কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, সন্তু কোথায়?

সন্তু কেমন আছে? প্রবীর বলল, সন্তু ভাল আছে। আপনার শরীর কেমন?

কাকাবাবু বললেন, আমি ঠিক আছি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? কাল বিকেল থেকে? আমি এক্ষুনি সন্তুকে দেখতে চাই!

প্ৰবীর বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি আপনার জন্য একজোড়া ক্রাচ আনছি। ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে আপনার অসুবিধে হবে।

প্রবীর ক্রাচ আনতে গেল, তার মধ্যে কাকাবাবু খাট থেকে নেমে এসে দরজার কাছে এলেন। তাঁর জ্বরটা এখনও পুরো ছাড়েনি। ঠাণ্ডা লেগে মাথাটা ভারী হয়ে আছে, তবু শরীর সুস্থ মনে হচ্ছে অনেকটা।

প্রবীর ক্রাচ নিয়ে ফিরে এসে বলল, ভাল খবর আছে। এক্স-রে করে দেখা গেছে সন্তুর হাঁটুর মালাইচাকি মোটেই গুঁড়িয়ে যায়নি। ডক্টর ভার্গব ওটা কী করে বললেন, কে জানে! অত তাড়াতাড়ি তো এক্স-রে হয় না।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুর পা তা হলে ঠিক হয়ে যাবে?

প্রবীর বলল, মালাইচাকি গুঁড়িয়ে যায়নি। তবে সরে গেছে। অপারেশান করতে হতে পারে। কিন্তু পা কেটে বাদ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।

কাকাবাবু প্রবীরের কাঁধ ধরে বললেন, প্রবীর, আজ সকালে তুমি আমায় সত্যিকারের ভাল খবর শোনালে!

প্রবীর হেসে বলল, এর পর হয়তো আরও একটা ভাল খবর শুনবেন।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী? কী? প্ৰবীর বলল, আর-একটু অপেক্ষা করুন।

সন্তুর ক্যাবিনে এসে দেখলেন, বিছানায় আধ-শোওয়া হয়ে সন্তু টোস্ট আর ওমলেট খাচ্ছে। দুজন ডাক্তার বসে আছেন তার কাছে।

ডাক্তার বড়ঠাকুর ছাড়া অন্য ডাক্তারটির দিকে ইঙ্গিত করে প্রবীর বলল, কাকাবাবু, আপনাকে যে একজন হাড়ের ডাক্তারের কথা বলেছিলাম, ইনিই সেই ডাক্তার ইউসুফ। ইনি এক-এক সময় আশ্চর্য কাণ্ড করে ফেলেন।

ইউসুফ ডাক্তার মাঝবয়েসী, সাদা রঙের কোট পরা, মুখখানা ভালমানুষ ধরনের। তিনি কাকাবাবুর দিকে হেসে নমস্কার জানিয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড কিছু না। হাড় যদি না ভাঙে, শুধু এদিক-ওদিক সরে যায়, তা হলে অনেক সময় অপারেশান ছাড়া ঠিক করে দেওয়া যায়। আমি সেই চেষ্টাই একবার করব। আগে ওর খাওয়া হয়ে যাক।

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হয়ে গেছে। আর খাব না!

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, একটু ব্যথা লাগবে। সহ্য করতে পারবে তো? সন্তু দুবার মাথা নাড়ল।

সন্তুর যে-পায়ে চোট লেগেছে, সেই পায়ের প্যান্ট উরু পর্যন্ত কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। হাঁটুর কাছে অনেকটা ফোলা।

সন্তুর পা-টা লম্বা করে দিয়ে ইউসুফ ডাক্তার হাত বুলোতে লাগলেন।

সন্তু মাঝে-মাঝে ব্যথায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। দুরুদুরু করছে কাকাবাবুর বুকের ভেতর। তিনি ভাবছেন, উলটোপালটা কিছু করতে গিয়ে আরও বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে কি না।

ডাক্তার বড়ঠাকুর ঠোঁটে একটা আঙুল দিয়ে সবাইকে একেবারে চুপ করে থাকতে বললেন। ইউসুফ ডাক্তার হাত বুলোচ্ছেন, মাথাটা ঝুঁকে গেছে, বিড়বিড় করে নিজের মনে কী যেন বলছেন তিনি।

সবাই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কাকাবাবু চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছেন।!

হঠাৎ ইউসুফ ডাক্তার পা-টা ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিলেন। সন্তু বিকট চিৎকার করে উঠল। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে সে বলি দেওয়া ছাগলের মতন ছটফট করতে করতে বলতে লাগল, আঃ, আঃ, মরে গেলুম! মরে গেলুম।

কাকাবাবু আর্তভাবে বললেন, কী হল? ছেলেটাকে মেরে ফেললে? অ্যা, মেরে ফেললে?

ডাক্তার বড়ঠাকুর কাকাবাবুকে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। রাগের চোটে কাকাবাবু রিভলভারটা খোঁজার জন্য পকেটে হাত দিলেন।

ইউসুফ ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, ঠিক হয়ে গেছে। আর অপারেশান করার দরকার হবে না।

সন্তুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কী হল? তুমি যে বললে ব্যথা পেলেও সহ্য করতে পারবে? খুব বেশি লেগেছে?

তারপর তিনি জোর করে সন্তুকে বিছানা থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন মেঝেতে।

সন্তুর চিৎকার থেমে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। সে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, দাঁড়াতে পারছি? অ্যাঁ? আমি আবার দাঁড়াতে পারছি?

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, শুধু দাঁড়ানো নয়, তুমি হাঁটবে। চলো, আমার সঙ্গে বাগানে। আর কোনও অসুবিধে হবে না। হাঁটুর ফোলাটা আস্তে-আস্তে কমে যাবে।

প্রবীর বলল, মিরাকল! মিরাকল!

কাকাবাবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সত্যিই তো দেখছি মিরাকল। ডাক্তার ভার্গব বলেছিলেন, ওর পা কেটে বাদ দিতে হবে।

ডাক্তার বড়ঠাকুর বললেন, কাকাবাবু, আপনি মাথার ঠিক রাখতে পারেননি! আর-একটু হলে আপনি ইউসুফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিলেন। তাই আপনাকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম।

কাকাবাবু লজ্জিতভাবে বললেন, হ্যাঁ, আমার মাথার ঠিক ছিল না। জীবনে আমি অনেক বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, কিন্তু এবারের মতন ভয় পাইনি কোনওবার। আমি খোঁড়া মানুষ, সন্তু আমার অন্ধের যষ্টি। আমি খোঁড়া, সন্তুও যদি সারাজীবনের মতন খোঁড়া হয়ে যেত…তা হলে…তা হলে…আমার দাদা বউদির কাছে মুখ দেখাতাম কী করে? তা হলে আমি আত্মহত্যা করতাম।

তারপর তিনি ইউসুফ ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনি যে আমার কতখানি উপকার করলেন, তা আমি বোঝাতে পারব না। কী করে যে আপনার ঋণ শোধ করব, তা জানি না।

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, না, না, আমি আর বেশি কী করেছি? খানিকটা ভাগ্যের ব্যাপার আছে। মালাইচাকিটা ভাঙেনি! ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে আমি কিছু করতে পারতাম না।

প্ৰবীর বলল, কাকাবাবু, আমাকে ধন্যবাদ দেবেন না? ভাগ্যিস ব্রিজের ওপর আমার মোটর বাইকটা আপনাদের গাড়ির পাশাপাশি এল, তাই আপনাদের আমি দেখতে পেলাম। না হলে, ডাক্তার ভার্গবের ওখানে আপনাদের কতদিন পড়ে থাকতে হত তার ঠিক নেই।

কাকাবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে ওরকমভাবে দেখা হয়ে যাওয়াটাও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। একেই বলে বোধ হয় নিয়তি। তোমাদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমরা শুধু সন্তুকে বাঁচাওনি,আমাকেওবাঁচিয়েছ!

প্ৰবীর বলল, তা হলে আজ খুব ভাল করে খাওয়াদাওয়া হোক। এবার আপনাদের খুব জোর একটা ফাঁড়া কেটে গেল।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়া হোক। খরচ কিন্তু আমি দেব।

তারপর তিনি একটু লাজুকভাবে হেসে বললেন, আমাকে এখন কিছু খেতে দিতে পারো? হঠাৎ টের পাচ্ছি, খুব খিদে পেয়েছে। পরশু রাত্তির থেকে তো কিছু খাইনি।

ডাক্তার বড়ঠাকুর বললেন, অ্যাঁ? পরশু থেকে কিছু খাননি? কাল আপনাকে কিছু খেতে দেওয়ার কথা আমাদের মনেই পড়েনি।

কাকাবাবু বললেন, পরশু তো ওরা নেমন্তন্ন খাওয়াবে বলে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু খাওয়াবার বদলে দিল ধাক্কা?

ডাক্তার বড়ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কারা? আপনাদের খুন করে ওদের লাভ কী হত?

কাকাবাবু মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তা এখনও জানি না। তবে জানতে পারব ঠিকই। যাদের জন্য সন্তু খোঁড়া হয়ে যাচ্ছিল আর-একটু হলে, তাদের সবকটাকে আমি খোঁড়া করে ছাড়ব।