১০. সখী-সম্বোধনে

সখীদের কাছে রাধা কখনও বলিতেছেন, তোমরা আমার নিন্দার কথা শুনিয়া কষ্ট বোধ করিতেছ, কিন্তু কানুর কলঙ্ক–আমার অঙ্গের ভূষণ, এ নিন্দা আমার সৌভাগ্যঃ–

“কানু-পরিবাদ                    মনে ছিল সাধ,
সফল করিল বিধি।”

আমার এই কলঙ্কে যাঁহারা আমাকে ঘৃণা করিবেন, আমি তাঁহাদের কাছে বিদায় চাহিতেছি–

“দেখিলে কলঙ্কীর মুখ কলঙ্ক হইবে,
এজনার মুখ আর দেখিতে না হবে।
ফিরে ঘরে যাও নিজ ধরম লইয়া,
দেশে দেশে ফিরিব আমি যোগিনী হইয়া
কালো মাণিকের মালা তুলে দিব গলে,
কানুগুণ-যশ কাণে পরিব কুণ্ডলে।
কানু-অনুরাগ-রাঙ্গা বসন পরিব,
কানুর কলঙ্ক ছাই অঙ্গেতে মাখিব।”

এখানে গেরুয়া পরা, ভষ্ম মাথা, যোগিনী হওয়া–এ সমন্তই আধ্যাত্মিক সম্পদের আভাষ। চণ্ডীদাস যে রেখাপাত করিলেন, কিছু দিন পরেই তাহা এক সুবর্ণচ্ছবি গৌরকান্তি পুরুষ-রূপে দেখা দিল কৃষ্ণ নাম্ই তাঁহার কর্ণের কুণ্ডল, কৃষ্ণ-অনুরাগেই তাঁহার রাঙ্গা বাস এবং কৃষ্ণ-কলঙ্কই সেই তরুণ সন্ন্যাসীর অঙ্গের ভষ্ম হইয়াছিল।

এই কৃষ্ণের কলঙ্কের কথা তিনি সখীদের কাছে এবং আত্মনিবেদনের অনেক স্থলে উল্লেখ করিয়াছেন-

“কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে, তাহাতে নাহিক দুঃখ
বঁধু তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ।”

বস্তুতঃ যদিও কৃষ্ণের কালোবর্ণের কথা অনেক পুরাণে উল্লিখিত আছে কিন্তু বাঙ্গলায় এই বর্ণটি বিশেষ ভাবে ভগবানের স্মারক হইয়া পড়িয়াছিল। চৈতন্যের পূর্ব্বে মাধবেন্দ্র পুরী কালোমেঘ দেখিলে মূর্চ্ছিত হইতেন। কৃষ্ণপ্রন্তরনিষ্মিত শত শত বাসুদেব মূর্ত্তি অত্যাচারীর কুঠারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়াছিল, প্রাণপণ করিয়াও এই সকল বিগ্রহ পূজারীরা রক্ষা করিতে পারেন নাই। বাঙ্গলার এক পুকুরে দেখা গিয়াছিল–এক ভগ্ন কৃষ্ণ প্রন্তরের বাসুদেবকে কতকগুলি নরকঙ্কাল জড়াইয়া ছিল, অত্যাচারীরা বিগ্রহরক্ষাকল্পে যে সকল পুজারী প্রাণান্ত চেষ্টা করিয়াছিল, তাঁহাদের শবদেহ সহ মূর্ত্তি পুকুরে ফেলিয়া দিয়াছিল। মন্দির শ্রীবিগ্রহশূন্য হইলে কৃষ্ণ-মূর্ত্তি জগতের সর্ব্বস্থান হইতে ভক্তদের আঁকা কৃষ্ণমূর্ত্তি নব মেঘে বিরাজিত হইতেন, নীলাঞ্চলেও সেই রূপ প্রতিভাত হইত, কালো যমুনার জলে সে রূপ ঝলমল করিয়া উঠিত। ভক্ত-প্রাণে তাঁহাদের মন্দিরের আরাধ্য দেবমূর্ত্তি বড় দাগা দিয়া গিয়াছিল: এজন্য জগতের যেখানে কালো বর্ণ দেখিতেন, সেইখানে তাঁহারা প্রিয়তম দেবতাটিকে মনে করিতেন। চণ্ডীদাসের রাধা বলিতেছেনঃ–

“কালো জল ঢালতে সই কালো পড়ে মনে,
দিবানিশি দেখি কালা শয়নে স্বপনে।
কালো চুল এলাইয়া বেশ নাহি করি,
কালো অঞ্জন আমি নয়নে না পরি।”

বিগ্রহ বিচ্যুত হইয়া কৃষ্ণবর্ণ জগন্ময় পরিব্যপ্ত হইয়াছিল।

সখীর প্রতি উক্তির কোন কোনটিতে প্রেমের সর্ব্বোচ্চ কথা উচ্চারিত হইয়াছেঃ–

“কানু সে আমার                     জাতি, কুল, মান,
এ দুটি নয়নের তারা,
আমার হিয়ায় ‍মাঝারে,                      হিয়ার পুতলী,
নিমিষে নিমিষে হারা।
তোরা কুলবতী                      ভজ নিজ পতি,
যার যেবা মনে লয়,
আমি ভাবিয়া দেখিলাম,                      শ্যাম বধু বিনে
গতি আর কেহ নয়।
কি আর বুঝাও                      ধরম করম,
মন স্বতন্তর নয়,
কুলবতী হৈয়া,                      কুলে দাঁড়াইয়া,
মোর মত কেবা হয়।
গুরু পরিজন,                      বলে কুবচন,
সে বাসির চন্দন চুয়া,
কানু-অনুরাগে                      এদেহ সঁপেছি,
তিল-তুলসী দিয়া।
পরশী দুর্জ্জন                     বলে কুবচন,
আমি না যাব তাদের পাড়া,
কহে চণ্ডীদাস                      কানুর পীরিতি
জাতি-কুল-শীল ছাড়া।”

কানুই আমার জাতি, কুল ও শীল, আমি অন্য জাতি মানি না, আমার শীল(আচার) ও তিনি। আমার হৃদয়ে তিনি হৃদয়ের বিগ্রহ, পলকে পলকে আমি তাঁহাকে হারাই–নিরবধি একই চিন্তা। তোমরা কুলে আছ, নিজ নিজ স্বামীকে যথেচ্ছা ভজনা কর, কিন্তু গার্হস্থ্যাসুখ আমার কপালে নাই। আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি, কৃষ্ণই আমার একমাত্র অবলম্বন, তিনি

“মোর গতি,                     তিনি মোর পতি
মন নাহি আন ভায়।”

ধর্ম্মাধর্ম্মের কথা কি বলিতেছ, আমার ও সকল জানিবার ও শিখিবার আর কিছুই নাই, আমার মন স্বতন্তর (স্বাধীন) নহে, মন একান্ত পক্ষে তাঁহার অধীন হইয়া গিয়াছে। তোমাদের কোন উপদেশের অবকাশ নাই, আমি সম্পূর্ণ-রূপে তদধীন। কুলের বধুকে আমার মত এরূপ হইতে দেখিয়াছ কি? কুল থাকিতেও আমি অকূলে ভাসিয়াছি। গুরুজন আমায় কটূক্তি করেন, তা করিবেনই তো, তাঁদের দোষ কি? সে কটূক্তি আমার পক্ষে চুয়া-চন্দন, আমি কানু-অনুরাগে দেহ মন তাঁহাকে নিবেদন করিয়া দিয়াছি।

প্রতিবাসীরা নিন্দা করে, করুক আমি–তাহাদের পাড়ায় যাইব না। চণ্ডীদাস বলিতেছেন, সে কানুপ্রেমে পড়িয়াছে, তাহার জাতি-কুল-শীল সব গিয়াছে।

এই পদটি খুব উচ্চাঙ্গের, কৃষ্ণ প্রেমিকের ধর্ম্ম- কর্ম্ম কিছু থাকে না। চণ্ডীদাসের আর একটি পদে আছে–

“মরম না জানে ধরম বাখানে, এমন আছয়ে যারা।
কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহন তারা।
আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে,
ভিতর দুয়ার খোলা।”

যিনি ঈপ্সিতকে পাইয়াছেন,–তাহার বহিরিন্দ্রিয়ের খেলা খামিয়া গিয়াছে। মোহনা পর্য্যন্ত ডাক-হাক, কিন্তু নদী যখন সমুদ্রে পড়িয়াছে–তখন তাহার রব সমুদ্রের রবে মিশিয়া গিয়াছে। তাহার ক্ষুদ্র অস্তিত্ব দিগন্তপ্রসারী বিশাল জলধারার অস্তিত্বে মিশিয়াছে, তখন তাঁহার গতি থামিয়াছে–কর্ম্ম সমাপ্ত হইয়াছে, ভাল-মন্দের এ-পথ ও-পথের বিচার চলিয়া গিয়াছে। তখন—“কি আর শিখাও—ধরম-করম” এবং তখন “কহে চণ্ডীদাস পাপ-পুণ্য সম, তোমার চরণ মানি।” পাপ-পুণ্যে ভেদ নাই, তোমার চরণপদ্মই  আমার সব।

“কানু অনুরাগে এ দেহ সঁপেছি তিল-তুলসী দিয়া”,

তিল-তুলসী দিয়া যে দান হয়–তাহা ফিরিয়া লইবার আর অধিকার থাকে না। রাধা সেই ভাবে তাঁহার দেহ কৃষ্ণকে সমর্পণ করিয়াছেন, দেহ এই ভাবে নিবেদিত হইলে কর্ণ কেবল তাঁহারই প্রিয় কথা শুনিবে, চক্ষু তাঁহার রূপ দর্শন করিবে, চরণ তাঁহারই মন্দিরের পথে যাইবে, জিহবা তাঁহারই নামের আস্বাদ করিবে। সর্ব্বেন্দ্রিয় সহ দেহ তিনি “কৃষ্ণায় নমঃ” বলিয়া তাঁহাকে নিবেদন করিয়া দিয়াছেন, তাহার উপর আর তাঁহার কোন সত্ত্বা নাই। এরূপ নির্ব্যূঢ় সত্ত্বে যিনি নিজেকে দান করিতে পারিয়াছেন, তিনি অবশ্য প্রেমের তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন।

সুতরাং যখন কানুকে ভালবাসি বলিয়া লোকে নিন্দা করে, তখন তাহা রাধার শাপে বরঃ–

“সবে বলে মোরে কানু কলঙ্কিনী, গরবে ভরয়ে দে।
হামার গবর তুঁহু বাড়াইলি, অব টুটায়ব কে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *