মহরম পর্ব
উদ্ধার পর্ব
1 of 2

উদ্ধার পর্ব ০৩ প্রবাহ

সময়ে সকলই সহ্য হয়। কোন বিষয়ে অনভ্যাস থাকিলে বিপদকালে তাহার অভ্যাস হইয়া পড়ে, মহা সুখের শরীরেও মহা কষ্ট সহ্য হইয়া থাকে-এ কথার মর্ম হঠাৎ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিমাত্রেই বুঝিতে পারিবেন। পরাধীন জীবনে সুখের আশা করাই বৃথা। বন্দি অবস্থায় ভাল-মন্দ সুখ-দুঃখ বিবেচনা করাও নিষ্ফল। চতুর্দিকে নিষ্কোষিত অসি, ত্বরিৎগতি বিদ্যুতের ন্যায় বর্শাফলক, সময়ে সময়ে চক্ষে ধাঁধা দিতেছে। বন্দিগণ মলিনমুখ হইয়া দামেস্কে যাইতেছে, কাহার ভাগ্যে কি আছে কে বলিতে পারে! সকলেরই একমাত্র চিন্তা জয়নাল আবেদীন। এজিদ্ সকলের মস্তক লইয়াও যদি জয়নালের প্রতি দয়া করে, তাহা হইলেও সহস্র লাভ। দামেস্ক নগরের নিকটবর্তী হইলেই, সকলেই এজিদ-ভবনে আনন্দধ্বনি শুনিতে পাইলেন। সীমার হোসেনের শির লইয়া পূর্বেই আসিয়াছে, কাজেই আনন্দের লহরী ছুটিয়াছে, নগরবাসী উৎসবে মাতিয়াছে। মহারাজ এজিদের জয়, দামেস্করাজের জয়-ঘোষণা মুহূর্তে মুহূর্তে ঘোষিত হইতেছে। নানা বর্ণে রঞ্জিত পতাকারাজি উচ্চ উচ্চ মঞ্চে উড্ডীয়মান হইয়া মহাসংগ্রামের বিজয় ঘোষণা করিতেছে। আজ এজিদ্ আনন্দসাগরে সন্তোষ-তরঙ্গে সভাসদ্গণ সহিত মনপ্রাণ ভাসাইয়া দিয়াছেন। বন্দিগণ রাজপ্রাসাদে আনীত হইল, দ্বিগুণরূপে আনন্দ-বাজনা বাজিয়া উঠিল। এজিদ্ যুদ্ধবিজয়ী সৈন্যদিগকে আশার অতিরিক্ত পুরস্কৃত করিলেন। শেষে মনের উল্লাসে ধনভাণ্ডার খুলিয়া দিলেন। অবারিত দ্বার,-যাহার যত ইচ্ছা লইয়া মনের উল্লাসে রাজাদেশে আমোদ-আহ্লাদে প্রবৃত্ত হইল। অনেকেই আমোদে মাতিল।

হাসনেবানু, সাহারবানু, জয়নাব, বিবি ফাতেমা (হোসেনের অল্পবয়স্কা কন্যা), এবং বিবি ওম্মে সালেমা (ওম্মে সালেমা হজরত মোহাম্মদের ষষ্ঠ স্ত্রী) প্রভৃতিকে দেখিয়া এজিদ্ মহাহর্ষে হাসি হাসি মুখে বলিতে লাগিলেন, “বিবি জয়নাব! এখন আর কার বল বলুন? বিধবা হইয়াও হোসেনের বলে এজিদ্কে ঘৃণার চক্ষে দেখিয়াছেন, এখন সে হোসেন কোথা? আর হাসানই-বা কোথা? আজি পর্যন্তও কি আপনার অন্তরের গরিমা চক্ষের ঘৃণা অপরিসীম ভাবেই রহিয়াছে? আজ কার হাতে পড়িলেন, ভাবিয়াছেন কি? দেখুন দেখি চেষ্টায় কি না হয়? ধন, রাজ্য, রূপ তুচ্ছ করিয়াছিলেন; একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি, রাজ্যে কি না হইল? বিবি জয়নাব! মনে আছে? সেই আপনার গৃহ নিকটস্থ রাজপথ? মনে করুন যেদিন আমি সৈন্য-সামন্ত লইয়া মৃগয়ায় যাইতেছিলাম, আপনি আমাকে দেখিয়াই গবাক্ষ-দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। কে না জানিল যে, দামেস্কের রাজকুমার মৃগয়ায় গমন করিতেছেন। শত সহস্র চক্ষু আমাকে দেখিতে ঔৎসুক্যের সহিত ব্যস্ত হইল, কেবল আপনার দু’টি চক্ষু তখনই ঘৃণা প্রকাশ করিয়া আড়ালে অন্তর্ধান হইল। সেদিনের সে অহঙ্কার কই? সে দোলায়মান কর্ণাভরণ কোথা? সে কেশ শোভা মুক্তার জালি কোথা? এ বিষম সমর কাহার জন্য? এ শোণিতের প্রবাহ কাহার জন্য? কী দোষে এজিদ্ আপনার ঘৃণার্হ? কী কারণে এজিদ্ আপনার চক্ষের বিষ? কী কারণে দামেস্কের পাটরাণী হইতে আপনার অনিচ্ছা?”

জয়নাব আর সহ্য করিতে পারিলেন না। আরক্তিম লোচনে বলিতে লাগিলেন, “কাফের! তোর মুখের শাস্তি ঈশ্বর করিবেন। সর্বস্ব হরণ করিয়া একেবারে নিঃসহায়া-নিরাশ্রয়া করিয়া বন্দিভাবে দামেস্কে আনিয়াছিস্, তাই বলিয়াই কী এত গৌরব? তোর মুখের শাস্তি, তোর চক্ষের বিধান, যিনি করিবার তিনিই করিবেন। তোর হাতে পড়িয়াছি, যাহা ইচ্ছা বলিতে পারিস্! কিন্তু কাফের! ইহার প্রতিশোধ অবশ্য আছে। তুই সাবধানে কথা কহিস, জয়নাব নামে মাত্র জীবিতা,-এই দেখ, (বস্ত্রমধ্যস্থ খঞ্জর দর্শাইয়া) এমন প্রিয়বস্তু সহায় থাকিতে বল তো কাফের! তোকে কিসের ভয়?”

এজিদ্ আর কথা কহিলেন না। জয়নাবের নিকট কত কথা কহিবেন, ক্রমে মনের কপাট খুলিয়া দেখাইবেন, শেষে সজলনয়নে দুঃখের কান্না কাঁদিবেন,-তাহা আর সাহস হইল না। কৌশলে হোসেন-পরিবারদিগের হস্ত হইতে অস্ত্রাদি অপহরণ করিবার মানসে সে সময়ে আর বেশি বাক্যব্যয় করিলেন না। কেবল জয়নাল আবেদীনকে বলিলেন, “কি সৈয়দজাদা! তুমি কী করিবে?”

জয়নাল আবেদীন সক্রোধে বলিলেন, “তোমার প্রাণবধ করিয়া দামেস্ক নগরের রাজা হইব।”

এজিদ্ হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তোমার আছে কী? তুমি মাত্র একা, অথচ বন্দি, তোমার জীবন আমার হস্তে। মনে করিলে মুহূর্তমধ্যে তোমাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া শৃগাল-কুকুরের উদরে দিতে পারি, এ অবস্থাতেও আমাকে মারিয়া দামেস্কের রাজা হইবার সাধ আছে?”

“আমার মনে যাহা উদয় হইল বলিলাম, এখন তোমার যাহা ইচ্ছা হয় কর। ইহা পার-উহা পার বলিয়া আমার নিকট গরিমা দেখাইয়া ফল কি?”

“ফল যাহা তো দেখিয়াই আসিতেছ। এখানেও কিছু দেখ। একটি ভাল জিনিস তোমাদিগকে দেখাইতেছি, দেখ।”

হোসেন-মস্তক পূর্বেই এক সুবর্ণ পাত্রে রাখিয়া এজিদ্ তদুপরি মূল্যবান্ বস্ত্রের আবরণ দিয়া রাখিয়াছিলেন; হোসেনের অল্পবয়স্কা কন্যা ফাতেমাকে এজিদ্ নিকটে বসাইলেন এবং বলিলেন, “বিবি! তোমার তো খর্জূর প্রিয়; এইক্ষণে যদি মদিনার খর্জূর পাও, তাহা হইলে কি কর?”

“কোথা খর্জূর? দিন, আমি খাইব!”

এজিদ্ বলিলেন, “ঐ পাত্রে খর্জূর রাখিয়াছি, আবরণ উন্মোচন করিলেই দেখিতে পাইবে! খুব ভাল খর্জূর উহাতে আছে! তুমি একা একা খাইয়ো না, সকলকেই কিছু কিছু দিয়ো।”

ফাতেমা বড় আশা করিয়া খর্জুর-লোভেপাত্রের উপরিস্থিত বস্ত্র উন্মোচন করিয়া বলিলেন, “এ কী? এ যে মানুষের কাটা মাথা! এ যে আমারই পিতার”-এই বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। পরিজনেরা হোসেনের ছিন্ন মস্তক দেখিয়া প্রথমে ঈশ্বরের নাম, পরে নূরনবী মোহাম্মদের গুণানুবাদ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বর! তোমার মহিমা অসীম, তুমি সকলই করিতে পার। দোহাই ঈশ্বর, বিলম্ব সহে না, দোহাই ভগবান্ আর সহ্য হয় না, একেবারে সপ্ততল আকাশ ভগ্ন করিয়া আমাদের উপর নিক্ষেপ কর। দয়াময়! আমাদের চক্ষের জ্যোতিঃ হরণ কর, বজ্রাস্ত্র আর কোন্ সময় ব্যবহার করিবে? দয়াময়। তোমাকে ধন্যবাদ দিয়াছি, এখনো দিতেছি। সকল সময়েই তোমার প্রতি নির্ভর করিয়াছি, এখনো করিতেছি; কিন্তু দয়াময়! এ দৃশ্য আর দেখিতে পারি না। আমাদের চক্ষু অন্ধ হউক, কর্ণ বধির হউক, এজিদের অমানুষিক কথা যেন আর শুনিতে না হয়। দয়াময়! আর কাঁদিব না। তোমাতেই আত্মসমর্পণ করিলাম।”

কী আশ্চর্য! সেই মহাশক্তিসম্পন্ন মহাকৌশলীর লীলা অবক্তব্য। পাত্রস্থ শির ক্রমে শূন্যে উঠিতে লাগিল। এজিদ্ স্বচক্ষে দেখিতেছেন, অথচ কিছুই বলিতে পারিতেছেন না। কে যেন তাঁহার বাক্শক্তি হরণ করিয়া লইয়াছে। পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন, হোসেনের মস্তক হইতে পবিত্র জ্যোতিঃ বহির্গত হইয়া যেন আকাশের সহিত সংলগ্ন হইয়াছে। খণ্ডিত শির ক্রমে সেই জ্যোতির আকর্ষণে ঊর্ধ্বে উঠিতে লাগিল এবং দেখিতে দেখিতে অন্তর্হিত হইল।

এজিদ্ সভয়ে গৃহের ঊর্ধ্বভাগে বারবার দৃষ্টি করিতে লাগিলেন; দেখিলেন কোথাও কিছু নাই। পাত্রের প্রতি দৃষ্টি করিলেন; শূন্য পাত্র পড়িয়া আছে! যে মস্তক লইয়া কত খেলা করিবেন, হোসেন-পরিবারের সম্মুখে কত প্রকারে বিদ্রূপ করিয়া হাসি-তামাশা করিবেন, তাহা আর হইল না। কে লইল, কেন ঊর্ধ্বে উঠিয়া একেবারে অন্তর্ধান হইল, এত জ্যোতিঃ, এত তেজ, তেজের এত আকর্ষণশক্তি কোথা হইতে আসিল-এজিদ্ ভাবিতে ভাবিতে হতবুদ্ধিপ্রায় হইলেন! কোনই কারণ খুঁজিয়া পাইলেন না। কেবল একটি অপূর্ব সৌরভে কতক্ষণ পর্যন্ত রাজভবন আমোদিত করিয়াছিলেন, তাহাই বুঝিতে পারিলেন।

এজিদ্ মনে মনে যে সকল সঙ্কল্প রচনা করিয়াছিলেন, দুরাশা-সূত্র আকাশকুসুমে যে মালা গাঁথিয়া রাখিয়াছিলেন, দেখিতে দেখিতে তাহার কিছুই থাকিল না। অতি অল্প সময়মধ্যে আশাতে আশা, কুসুমে কুসুম মিলিয়া-মিশিয়া এক হইয়া গেল। ঐশ্বরিক ঘটনায় ধার্মিকের আনন্দ, চিত্তের বিনোদন,-পাপীর ভয়, মনে অস্থিরতা। এজিদ্ ভয়ে কাঁপিতে লাগিল; কি করিবে, কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না। অস্ফুট স্বরে এইমাত্র বলিল, “বন্দিগণকে কারাগারে লইয়া যাও।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *