• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মহরম পর্ব ১৮ প্রবাহ

লাইব্রেরি » মীর মশাররফ হোসেন » বিষাদ সিন্ধু (উপন্যাস) » ০১.মহরম পর্ব » মহরম পর্ব ১৮ প্রবাহ

এজিদ্ যে দিবস হাসানের মৃত্যুসংবাদ পাইলেন, মনের আনন্দে সেই দিনই অকাতরে ধনভাণ্ডার খুলিয়া দিয়াছেন। দিবা-রাত্রি আমোদ-আহ্লাদ। স্বদেশজাত “মাআল্-আনব”-নামক চিত্ত-উত্তেজক মদ্য সর্বদাই পান করিতেছেন। সুখের সীমা নাই। রাজপ্রাসাদে দিবারাত্রি সন্তোষসূচক ‘সাদিয়ানা’ বাদ্য বাজিতেছে। পূর্বেই সংবাদ আসিয়াছে মায়মুনার সঙ্গে জায়েদা দামেস্কে আসিতেছেন। আজই আসিবার সম্ভাবনা। এ চিন্তাও এজিদের মনে রহিয়াছে। স্বামীহন্তা জায়েদাকে দেখিতে এজিদের বড়ই সাধ হইয়াছে। জায়েদাকে অঙ্গীকৃত অর্থ দান করিবেন-এই প্রতিজ্ঞাটিও প্রতিপালন করিবেন। মায়মুনাকে কী প্রকারে পুরস্কৃত করিবেন, নবনরপতি এজিদ্ তাহাও চিন্তা করিতেছেন। পূর্বেই ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন যে, “আমার পরমশত্রুমধ্যে একজনকে মারওয়ানই কৌশল করিয়া বধ করিয়াছে, দামেস্কের ঘরে ঘরে সকলে আমোদ-আহ্লাদে প্রবৃত্ত হউক। অর্থের অনটন হইলে তজ্জন্য রাজভাণ্ডার অবারিতরূপে খোলা রহিল। সপ্তাহকাল রাজকার্য বন্ধ;-দিবারাত্রে কেবল আনন্দস্রোত বহিতে থাকিবে। যে ব্যক্তি হাসানের মৃত্যুসংবাদে দুঃখিত হইবে, কিংবা শোকাশ্রু বিনির্গত করিবে, কিংবা কোন প্রকার শোকচিহ্ন অঙ্গে ধারণ করিবে, তাহার গর্দান মারা যাইবে। যদি প্রকাশ পায় যে, এই সপ্তাহকালমধ্যে কেহ কোন কারণে দুঃখের সহিত এক বিন্দু চক্ষের জল ফেলিয়াছে, তাহার শরীর হইতে সহস্রাধিক শোণিতবিন্দু বহির্গত করা হইবে।” অনেকেই মহাহর্ষে রাজাজ্ঞা প্রতিপালন করিতেছে; কেহ কেহ প্রাণের ভয়ে আমোদে মাতিয়াছে।

সুসজ্জিত প্রহরীবেষ্টিত হইয়া মায়মুনার সহিত জায়েদা দামেস্ক নগরে উপস্থিত হইলেন। জায়েদার আগমন সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া মনে মনে কি অনুধ্যানপূর্বক এজিদ্ বলিলেন, “আজি আমার শরীর কিছু অসুস্থ। জায়েদা এবং মায়মুনাকে বিশেষ অভ্যর্থনার সহিত আমার উদ্যানস্থ প্রমোদভবনে স্থান দান কর। যথাযোগ্য আদরে তাহাদিগকে গ্রহণ কর। কোন বিষয়ে যেন অমর্যাদা কিংবা কোন ত্রুটি না হয়। আগামীকল্য প্রথম প্রকাশ্য দরবারে তাহাদের সহিত আমার দেখা হইবে। পরে অন্য কথা।”

এইরূপ উপদেশ দিয়া রাজা এজিদ্ তদর্থ উপযুক্ত লোক নিযুক্ত করিলেন। এজিদের আজ্ঞাক্রমে, তাঁহার উপদেশমতে সমুদয় কার্য সুসম্পন্ন হইল। জায়েদা ও মায়মুনা যথাযোগ্য সমাদরে প্রমোদভবনে স্থান পাইলেন। পরিচারক, পরিচারিকা, রক্ষক, প্রহরী সকলই নিয়োজিত হইল। দেখিতে দেখিতে সূর্যদেব অস্তাচলে গমন করিলেন। নিশা যে কী জিনিস, আর ইহার ক্ষমতা যে কী, তাহা বোধ হয় আজ পর্যন্ত অনেকেই বুঝিতে পারেন নাই। সমস্ত দিন চিরদুঃখে কাটাইয়া, কুহকিনী নিশার আগমনে নিদ্রায় অভিভূত হইলে সে দুঃখের কথা কাহার মনে থাকে? নিশ্চয়ই সূর্য উদয় হইলে প্রাণবিয়োগ হইবে, এ কথা জানিয়াও যদি রাত্রে নিদ্রাভিভূত হয়, তাহা হইলে প্রভাতের ভাবী ঘটনার কথা কি সেই দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অভাগার মনে পড়ে? দিবসে সন্তান-বিয়োগ হইয়াছে, ঐ কুহকিনী আসিয়া চতুর্দিক অন্ধকার করিল, ক্রমে জগৎ নিস্তব্ধ করিল, অজ্ঞাতসারে নিদ্রাকে আহ্বান করিল, সন্তানের বিয়োগজনিত দুঃখ কি তখন সন্তানবিয়োগীর মনে থাকে?-জায়েদা প্রমোদভবনে পরিচারিকাবেষ্টিতা হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে স্বর্ণপালঙ্কে কোমল শয্যায় শুইয়া আছেন। কত কী ভাবিতেছেন, তাহার তরঙ্গ অনেক। প্রথমতঃ দশ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা, তারপর রাজরাণী। এই প্রথম নিশাতেই সুখসোপানে আরোহণ করিয়াছেন? প্রভাত হইলেই রাজদরবারে নীত হইবেন, সুখের প্রাঙ্গণে পদার্পণ করিবেন, তৎপরেই গৃহপ্রবেশ! পরমায়ুর শেষ পর্যন্ত সুখ-নিকেতনে বাস করিবেন। মায়মুনা রাজরাণী হইবে না, শুধু কেবল স্বর্ণমুদ্রাপ্রাপ্ত হইবে মাত্র!

জায়েদার শয্যার পার্শ্বেই নিন্মতর আর একটি শয্যায় মায়মুনা শয়ন করিয়া আছে। তাহার মনে কী কোন চিন্তা নাই?-আশা নাই?-আছে। মারওয়ানের স্বীকৃত অর্থ মদিনায় বসিয়াই পাইতে পারিত, এতদূর পর্যন্ত আসিবার কারণ কিছু বেশির প্রত্যাশা। উভয়েই আপন আপন চিন্তায় চিন্তিত, উভয়েই নীরব। নিশার কার্য নিশা ভুলে নাই। ক্রমে ক্রমে উভয়েই নিদ্রার কোলে অচেতন। একবার এই সময়ে এজিদের শয়নগৃহটি দেখিয়া আসা আবশ্যক। আজ এজিদের মনের ভাব কিরূপ?-এত আশা এবং এত সুখকামনার মধ্যে আবার কিসের পীড়া? এজিদ্ আজ মনের মত মনতোষিণী সুরাপান করিয়া বসিয়া আছেন, এখনো শয়ন করেন নাই। সম্মুখে পানপাত্র, পেয়ালা এবং মদিরাপূর্ণ সুরাহী ধরা রহিয়াছে। রজতপ্রদীপে সুগন্ধি-তৈলে আলো জ্বলিতেছে। জনপ্রাণীমাত্র সে গৃহে নাই। গৃহের দ্বারে, কিঞ্চিৎ দূরে নিষ্কোষিত অসিহস্তে প্রহরী সতর্কিতভাবে প্রহরিতা করিতেছে। মদ্যপানে অজ্ঞানতা জন্মে, সাধ্যাতীত ব্যবহার করিলে মানবপ্রকৃতি বিকৃতিপ্রাপ্ত হয়। মানুষ তখন পশু হইতেও নীচ হইয়া পড়ে। কিন্তু সাধ্য-সমতার অতীত না হইলে বোধ হয় অতি জঘন্য হৃদয়ে অনেক উৎকৃষ্ট ভাবও আসিয়া উপস্থিত হয়। এজিদ্ আজ একা একা অনেক কথা বলিতেছেন। বোধ হয়, সুরাদেবীর প্রসাদে তাঁহার পূর্বকৃত কার্য একে একে স্মরণপথে উপস্থিত হইয়াছে। প্রথম জয়নাবকে দর্শন,-তাহার পর পিতার নিকট মনোগত ভাব প্রকাশ,-তাহার পর মাবিয়ার রোষ,-পরে আশ্বাস প্রাপ্তি,-আবদুল জাব্বারের নিমন্ত্রণ কল্পিতা ভগ্নীর বিবাহ-প্রস্তাব,-অর্থ লালসায় আবদুল জাব্বারের জয়নাব পরিত্যাগ, বিবাহ জন্য কাসেদ প্রেরণ,-বিফলমনোরথে কাসেদের প্রত্যাগমন,-পীড়িত পিতার উপদেশ, প্রথমে কাসেদের শরনিক্ষেপে প্রাণসংহার, মোস্‌লেমকে কৌশলে কারাবদ্ধ করা,-পিতার মৃত্যু, নিরপরাধে মোস্‌লেমের প্রাণদণ্ড, হাসানের সহিত যুদ্ধঘোষণা, যুদ্ধে পরাজয়ের পর নূতন মন্ত্রণা,-মায়মুনা এবং জায়েদার সহায়ে হাসানের প্রাণবিনাশ, মারওয়ানের প্রভুভক্তি,-জায়েদা এবং মায়মুনার দামেস্কে আগমন, প্রমোদভবনে স্থাননির্দেশ। এজিদ্ ক্রমে ক্রমে এই সকল বিষয় আলোচনা করিলেন। সুরাপ্রভাবে মনের কপটতা দূর হইয়াছে; হিংসা, দ্বেষ, শত্রুতা ঐ সময়ে অন্তর হইতে অনেক পরিমাণে বিদূরিত হইয়াছে। আজ এজিদের চক্ষের জল পড়িল; কেন পড়িল, কে বলিবে? পাষাণময় অন্তর আজ কেন কাঁদিল? কে জানিবে? কী আশ্চর্য! যদি সুরার প্রভাবে এখন এজিদের চিরকলুষিত পাপময় কুটিল অন্তরে সরলভাবে পবিত্রতা আসিয়া থাকে, তবে সুরা! তোমাকে শত শত বার নমস্কার! শত শত বার ধন্যবাদ! জগতে যদি কিছু মূল্যবান বস্তু থাকে, সেই মূল্যবান বস্তু তবে তুমি! হে সুরেশ্বরী! পুনর্বার আমি ভক্তিভাবে তোমাকে শত শত ধন্যবাদ প্রদান করি!! এজিদ্ আর এক পাত্র পান করিলেন। কোন কথা কহিলেন না। ক্ষণকাল নিস্তব্ধভাবে থাকিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন।

প্রমোদভবনে জায়েদা ও মায়মুনা নিদ্রিতা। রাজপ্রাসাদে এজিদ্ নিদ্রিত; মদিনায় হাসানের অন্তঃপুরে হাসনেবানু নিদ্রিতা; জয়নাবও বোধ হয় নিদ্রিতা। এই কয়টি লোকের মনোভাব পৃথক পৃথকরূপে পর্যালোচনা করিলে ঈশ্বরের অপার মহিমার একটি অপরিসীম দৃষ্টান্তপ্রাপ্ত হওয়া যায়। যদি ইহারা সকলেই নিদ্রিতাবস্থায় আপন আপন মনোমত ভাবের ফলানুযায়ী স্বপ্নে মাতিয়া থাকেন, তবে কে কি দেখিতেছেন? বোধ হয় জয়নাব আলুলায়িত কেশে, মলিন বসনে, উপাধানশূন্য মৃত্তিকাশয্যায় শয়ন করিয়া-হাসানের জীবিতকালের কার্যকলাপে অর্থাৎ বিবাহের পরবর্তী ঘটনাবলী,-যাহা তাঁহার অন্তরে চিরনিহিত রহিয়াছে, তাহারই কোন-না-কোন অংশ লইয়া স্বপ্নে ব্যতিব্যস্ত রহিয়াছেন। হাসনেবানুও স্বপ্নযোগে স্বামীর জ্যোতির্ময় পবিত্র দেহের পবিত্র কান্তি দেখিয়া কতই আনন্দ অনুভব করিতেছেন। স্বর্গের অপরিসীম সুখভোগে লালায়িতা হইয়া ইহজীবন ত্যাগে স্বামীপদপ্রান্তে থাকিতে যেন ঈশ্বরের নিকট কতই আরাধনা করিতেছেন। জায়েদা বোধ হয়, এক-একবার ভীষণ মূর্তি স্বপ্নে দেখিয়া নিদারুণ আতঙ্কে জড়সড় হইতেছেন, ফুঁকারিয়া কাঁদিতে পারিতেছেন না, পলাইবার উপযুক্ত স্থানও খুঁজিয়া পাইতেছেন না। স্বপ্নকুহকে ত্রস্তপদে যাইবারও শক্তি নাই, মনে মনে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কতই মিনতি করিতেছেন। আবার সে সকলই যেন কোথায় মিশিয়া গেল। জায়েদা যেন রাজরাণী, শত শত দাসী-সেবিতা, এজিদের পাটরাণী, সর্বময়ী গৃহিণী। আবার যেন তাহাও কোথায় মিশিয়া গেল! জায়েদা যেন স্বামীর বন্দিনী। প্রাণবিনাশিনী বলিয়া অপরাধিনী;-ধর্মাসনে এজিদ্ যেন বিচারপতি। মায়মুনা টাকার ভার আর বহিতে ও সহিতে পারিতেছে না। এত টাকা লইয়া কী করিবে? কোথায় রাখিবে? আবার যেন ঐ টাকা কে কাড়িয়া লইল! মায়মুনা কাঁদিতেছে। টাকা অপহারক বলিতেছে, “নে-পাপীয়সী। এই নে! তোর এ পাপপূর্ণ টাকা লইয়া আমি কি করিব?” এই বলিয়া টাকা নিক্ষেপ করিয়া মায়মুনার শিরে যেন আঘাত করিতে লাগিল! মায়মুনা কাঁদিয়া অস্থির। তাহার কান্নার রবে জায়েদার নিদ্রাভঙ্গ হইল। এজিদের বিচার হইতেও তিনি নিষ্কৃতি পাইলেন।

যে গৃহে জায়েদা ও মায়মুনা, সেই শয়নগৃহে আর আর সকলে নিদ্রিত, কেবল তাহারা দুই জনেই জাগিয়া আছেন। উভয়ে পরস্পর অনেক কথা কহিতে লাগিলেন।

এজিদ্ সুরাপ্রভাবে ঘোর নিদ্রাভিভূত। অনেক দিনের পর পিতাকে আজ বোধ হয় স্বপ্নে দেখিয়াই বলিলেন, “আমাকে রক্ষা করুন। আমি আর কখনোই হাসানের অনিষ্ট করিব না।” মাদকতার অনেক লাঘব হইয়াছে; কিন্তু পিপাসার ক্রমশঃই বৃদ্ধি। শয়নকে সুশীতল জলপূর্ণ স্বর্ণসুরাহী ছিল, জল পান করিয়া পিপাসা নিবৃত্তি করিলেন। শুকতারার উদয় দেখিয়া আর ঘুমাইলেন না;-প্রাতঃক্রিয়াদি সমাপন করিয়া রাজপরিচ্ছদ ধারণ করিলেন। এদিকে জগৎলোচন-রবিদেব সহস্র কর বিস্তার করিয়া আসিতেছেন;-কাহার সাধ্য, তাঁহার সম্মুখে দাঁড়ায়! শুকতারার অন্তর্ধান, ঊষার আগমন ও প্রস্থান; দেখিতে দেখিতে সূর্যদেবের অধিষ্ঠান। এজিদের প্রকাশ্য দরবার দেখিবার আশায়ই যেন লোহিতবর্ণ ধারণ করিয়া পূর্বাকাশপতি হাসিতে হাসিতে পূর্বাকাশে দেখা দিলেন-হাসিতে হাসিতে দামেস্ক নগরীকে জাগরিত করিলেন। স্বামীহন্তা জায়েদাকে এজিদ্ পুরস্কৃত করিবেন, সাহায্যকারিণী মায়মুনাকেও অর্থদান করিবেন, জায়েদাকেও মারওয়ানের স্বীকৃত স্বর্ণমুদ্রা দান করিয়া প্রতিজ্ঞা রা করিবেন, অধিকন্তু জায়েদাকে পাটরাণীরূপে গ্রহণ করিবারও ইচ্ছা আছে; সূর্যদেব প্রতি ঘরে ঘরে স্বকীয় কিরণ বিকিরণের সহিত ঐ কথাগুলি ঘোষণা করিয়া দিলেন। রাজমুকুট শিরে ধারণ করিয়া মহারাজ এজিদ্ খাস্ দরবারে বার দিলেন। প্রহরিগণ সশস্ত্রে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দণ্ডায়মান হইল। অমাত্যগণ এবং পূর্বাহূত নগরস্থ প্রধান প্রধান মাননীয় মহোদয়গণ স্ব-স্ব স্থান পূর্ণ করিয়া দরবারের শোভা সম্বর্ধন করিলেন। জায়েদা ও মায়মুনা পূর্ব-আদেশ অনুসারে পূর্বেই দরবারে নীত হইয়াছিলেন। শাহীতক্তের বামপার্শ্বে দুইটি স্ত্রীলোক। জায়েদা রজতাসনে আসীনা, মায়মুনা কাষ্ঠাসনে উপবিষ্টা। জায়েদার প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি পড়িতেছে। যাঁহারা জায়েদার কৃতকার্য বিষয়ে সবিশেষ পরিজ্ঞাত, অথচ ইমাম হাসানের প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁহারা জায়েদার সাহসকে ধন্যবাদ দিয়া তাহার ঘর্মাক্ত ললাট, বিস্ফারিত লোচন ও আয়ত ভ্রূযুগলের প্রতি ঘনঘন সস্পৃহ দৃষ্টিপাত করিতেছেন।

এজিদ্ বলিতে লাগিলেন, “আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, হাসান আমার চিরশত্রু ছিল, নানাপ্রকারে আমার মনে কষ্ট দিয়াছে। আমি কৌশল করিয়া এই সিংহাসন রক্ষা করিয়াছি; সেই চিরশত্রু হাসান কোন বিষয়েই আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল না, তথাচ তাহার বংশগৌরব এত প্রবল ছিল যে, নানাপ্রকার অযথা কটূক্তি দ্বারা সর্বদাই আমার মনে ব্যথা দিয়াছে। আমি সেদিকে লক্ষ্য করি নাই। রাজ্য বিস্তারই আমার কর্তব্য কার্য। বিশেষ মদিনারাজ্যের শাসনভার নিঃসহায়, নির্ধন ভিখারির হস্তে থাকা অনুচিত বিবেচনা করিয়া প্রথমতঃ কাসেদের দ্বারা তাঁহাদিগকে আমার বশ্যতা স্বীকার করিবার আদেশ করা হইয়াছিল। সে কথা তাঁহারা অবহেলা করিয়া কাসেদ্‌কে বিশেষ তিরস্কারের সহিত দামেস্ক সিংহাসনের অবমাননা করিয়া, আমার লিখিত পত্র শত খণ্ডিত করিয়া উত্তরস্বরূপ সেই কাসেদের হস্তে পুনঃপ্রেরণ করিয়াছিল। সেই কারণেই আমি যুদ্ধ ঘোষণা করি। প্রিয় মন্ত্রী মারওয়ানকে সেই যুদ্ধে “সিপাহসালার” (প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ) পদে বরণ করিয়া বহুসংখ্যক সৈন্যসহ হাসানকে বাঁধিয়া আনিতে মদিনায় প্রেরণ করি। আমার সৈন্যগণের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া হাসানের পক্ষে মিলিত হয় এবং দামেস্কের অবশিষ্ট সৈন্যদিগকে আক্রমণ করিয়া যুদ্ধে পরাস্ত করে। কি করি, চিরশত্রু দমন না করিলেও নহে, এদিকে সৈন্যদিগকের চক্রে বাধ্য হইয়া হাসানের প্রাণ কৌশলে গ্রহণ করাই যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা হয়। এই যে কাষ্ঠাসনোপরি উপবিষ্টা বিবি মায়মুনাকে দেখিতেছেন, ইহার কল্যাণে-আর এই রজতাসনে উপবিষ্টা বিবি জায়েদার সাহায্যে আমার চিরশত্রু বিনষ্ট হইয়াছে। বিবি জায়েদা আমার জন্য বিস্তর পরিশ্রম স্বীকার করিয়াছেন। কয়েকবার স্বহস্তে আপন স্বামী হাসানকে বিষপান করাইয়াছিলেন, শেষে হীরকচূর্ণ জলে মিশাইয়া পান করাইলেন। তাহাতেই চিরশত্রু, আমার চিরশত্রু ইহজগৎ পরিত্যাগ করিয়াছে। আমি এই মহোদয়ার কৃপাতেই শত্রুবিহীন হইয়াছি। এই গুণবতী রমণীর অনুগ্রহেই আমি প্রাণে বাঁচিয়াছি, এই সদাশয়া ললনার কৌশলেই আজ আমার মন কিঞ্চিৎ শান্তিলাভ করিয়াছে। বহু চেষ্টা ও বহু পরিশ্রমের ফল এই মহামতী যুবতীর দ্বারাই সুপক্ব হইয়া ফলিয়াছে। আর এই বিবি মায়মুনা, ইহার সহিত এই কথা ছিল যে, যে কৌশলে, যে কুহকেই হউক, হাসানকে প্রাণে মারিতে পারিলে ইনি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইবেন।”

ইঙ্গিতমাত্র কোষাধ্য সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পরিপূর্ণ থলিয়া আনিয়া বিবি মায়মুনার সম্মুখে রাখিয়া দিয়া, সসম্ভ্রমে পূর্বস্থানে পূর্ববৎ করজোড়ে দণ্ডায়মান রহিল।

এজিদ্ পুনর্বার বলিতে লাগিলেন, “রজতাসনপরিশোভিতা এই বিবি জায়েদার সহিত এই অঙ্গীকার করিয়াছিলাম যে, আপনার প্রিয়তম পতির প্রাণ যদি আপনি বিনাশ করিতে পারেন, তবে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা, মূল্যবান্ বস্ত্র ও মণিময় অলঙ্কার দান করিয়া রাজসিংহাসনে বসাইব।”

সঙ্কেতমাত্র কোষাধ্য সহস্র স্বর্ণমুদ্রাপূরিত কয়েকটি রেশমবস্ত্রের থলিয়া, রত্নময় অলঙ্কার এবং কারুকার্যখচিত বিচিত্র বসন জায়েদার সম্মুখে রাখিয়া দিল।

কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া এজিদ্ আবার বলিলেন, “যদি ইচ্ছা হয়, তবে বিবি জায়েদা এই সিংহাসনে আমার বাম পার্শ্বে আসিয়া বসুন।-বিবি জায়েদা! আপনি আপনার অঙ্গীকার পরিপূর্ণ করিয়াছেন, এখন আমিও আমার অঙ্গীকার পরিপূর্ণ করি।”

জায়েদা মনে মনে ভাবিলেন, বস্ত্র, অলঙ্কার ও মোহর, সকলই তো পাইয়াছি; এক রাজরাণী হওয়াই বাকি ছিল, রাজা যখন নিজেই তাঁহার বামপার্শ্বে বসিতে আদেশ করিতেছেন, তখন সে আশাও পূর্ণ হইল। বিবাহ না হয় পরেই হইবে। রাজরাণী করিয়া আর আমাকে পরিত্যাগ করিতে পারিবেন না। এই ভাবিয়া বুদ্ধিমতী জায়েদা সন্তুষ্ট হৃদয়ে রজতাসন পরিত্যাগপূর্বক রাজসিংহাসনে এজিদের বামপার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিলেন।

এজিদ্ বলিলেন, “আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হইল। এক্ষণে আমার কয়েকটা কথা আছে, আপনারা সকলেই মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করুন।”-এই কথা বলিয়াই এজিদ্ সিংহাসন ছাড়িয়া একেবারে নিচে নামিলেন। জায়েদা আর তখন কি বলিয়া সিংহাসনে বসিয়া থাকিবেন, সলজ্জভাবে অতি ত্রস্তে তিনিও সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া সভাস্থলে এজিদের পার্শ্বদেশে দাঁড়াইলেন।

এজিদের বাক্যস্রোত বন্ধ হইল। স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। জায়েদার সিংহাসন পরিত্যাগ দেখিয়া,-ক্ষণকাল নীরবে থাকিয়া, পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিলেন, “আমার শত্রুকে এই বিবি জায়েদা বিনাশ করিয়াছেন, আমি ইহার নিকট আজীবন কৃতজ্ঞতাঋণে আবদ্ধ থাকিলাম। কিন্তু সামান্য অর্থলোভে এমন প্রিয়তম নির্দোষ পতির প্রাণ যে রাক্ষসী বিনাশ করিয়াছে, তাহাকে কি বলিয়া কোন্ বিশ্বাসে আমার জীবনের চিরসঙ্গিনী সহধর্মিণী পদে বরণ করিয়া লইব? আমার প্রলোভনে ভুলিয়া যে পিশাচী এক স্বামীর প্রাণ বিনাশ করিল, অন্য কাহারো প্রলোভনে ভুলিয়া সেই পিশাচী আমার প্রাণও তো অনায়াসে বিনাশ করিতে পারে! যে স্ত্রী স্বামীঘাতিনী,-স্বহস্তে স্বামীর প্রাণ বধ করিতে যে এক বার নয়, দুই বার নয়, কয়েক বার বিষ দিয়া শেষ বারে কৃতকার্য হইল, আমি দণ্ডধর রাজা, তাহার সমুচিত শাস্তি বিধান করা কী আমার কর্তব্য নহে? ইহার ভার আমি আর কাহারো হস্তে দিব না; পাপীয়সীর শাস্তি, আমি গতরাত্রে আমার শয়নমন্দিরে বসিয়া যাহা সাব্যস্ত করিয়াছি, তাহাই পালন করিব।” এই কথা বলিয়াই কটিবন্ধসংযুক্ত দোলায়মান অসিকোষ হইতে সুতীক্ষ্ণ তরবারী রোষভরে নিষ্কোষিত করিয়া জায়েদার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “পাপীয়সী! স্ত্রী হইয়া স্বামীবধের প্রতিফল ভোগ কর! প্রিয় পতির প্রাণহরণের প্রতিফল!” এই বলিয়া কথার সঙ্গে সঙ্গেই এজিদ্ স্বহস্তে এক আঘাতে পাপিনী জায়েদাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন। শোণিতের ধারা ছুটিল। এজিদের অসি জায়েদার রক্তে রঞ্জিত হইল! কী আশ্চর্য!

অসি হস্তে গম্ভীরস্বরে এজিদ্ পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “ঐ কুহকিনী মায়মুনার শাস্তি আমি স্বহস্তে বিধান করিব না! আমার আজ্ঞায় উহার অর্ধশরীর মৃত্তিকায় প্রোথিত করিয়া, প্রস্তরনিক্ষেপে মস্তক চূর্ণ করিয়া ফেল।” আজ্ঞামাত্র প্রহরিগণ মায়মুনার হস্ত ধরিয়া দরবারের বাহিরে টানিয়া লইয়া গেল। মাটিতে অর্ধদেহ পুঁতিয়া প্রস্তরনিক্ষেপে মস্তক চূর্ণ করিল। স্বপ্ন আজ মায়মুনার ভাগ্যে সত্য সত্য ফলিয়া গেল। সভাস্থ সকলেই “যেমন কর্ম তেমনি ফল!” বলিতে বলিতে সভাভঙ্গের বাদ্যের সহিত সভাভূমি হইতে বহির্গত হইলেন। এজিদ্ হাসান-বধ শেষ করিয়া হোসেন-বধে প্রবৃত্ত হইলেন! আমরাও এই উপযুক্ত অবসরে দামেস্ক নগর পরিত্যাগ করিয়া মদিনার অভিমুখে যাত্রা করিলাম।

Category: ০১.মহরম পর্ব
পূর্ববর্তী:
« মহরম পর্ব ১৭ প্রবাহ
পরবর্তী:
মহরম পর্ব ১৯ প্রবাহ »

Reader Interactions

Comments

  1. Sofikul Islam

    October 30, 2016 at 9:17 am

    চন্দ্রবিন্দু গীতিকাব্যে আরো সংযোজন দরকার ৷ যেমন “প্যাক্ট”, “দে গরুর গা ধুইয়ে “

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑