২১. নরকে এক ঋতু

নরকে এক ঋতু

এক দীর্ঘস্থায়ী তিক্ত অভিজ্ঞতা এই পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের নিন্দা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রায় চার দশক আগের কথা লিখছি। নাটকের কুশীলবরা কেউ কেউ এখন প্রয়াত। যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের পরিচয়ও যাতে পাঠকসাধারণের কাছে স্পষ্ট না হয় সেইভাবেই লেখার চেষ্টা করছি। এইসব ঘটনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল জনৈক সুধী ব্যক্তিকে (যাঁর বিচারবুদ্ধির উপর আমার বিশ্বাস আছে) আমি জিগ্যেস করি, এই বিচিত্র দলবাজি এবং সর্বত অশালীন ব্যবহারের ইতিহাস লেখা ঠিক হবে কি না। তিনি আমাকে লিখতেই উৎসাহ দেন। এ ব্যাপারে তাঁর এবং আমার মত একই। বর্তমান লেখাটি ব্যক্তিগত কাহিনির চেয়ে সামাজিক ইতিহাসের অন্যতর দলিল হিসেবেই পাঠকদের কাছে আমি উপস্থিত করছি। সে ইতিহাসের কৃষ্ণবর্ণ দিক সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং ক্ষমতাশালী মানুষদের নিরঙ্কুশ দলবাজি। এই বিষ শিক্ষাজগতেও প্রবেশ করেছিল। তার স্বরূপ বর্তমান পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনাগুলি থেকে কিছুটা বোঝা যাবে।

যুগধর্ম বলে একটা সত্য বস্তু আছে। তাকে এড়ানো সহজ নয়। খুব কম মানুষই তা এড়ানোর চেষ্টা করেন, করলেও সাধারণত সফল হন না। স্বাধীনতা লাভের পর প্রচুর ক্ষমতা এবং সম্পদ আমাদের এলিট শ্রেণির অধিকারগ্রস্ত হয়। এই নবলব্ধ ক্ষমতা সর্বদা সুব্যবহার করার মতো সংযম বা সুবুদ্ধি অল্প লোকেরই ছিল। আমি যাঁদের কথা লিখব—তাঁরা। উচ্চশিক্ষিত এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। নানা দিক থেকেই এরা গুণবান মানুষও বটে। এঁদের মধ্যে এক-আধজন ছাড়া কেউ সাধারণ অর্থে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন না। অর্থাৎ এঁদের কেউ যাকে সোজা বাংলায় বাঁকা পথে পয়সা করার চেষ্টা বলে, তা করেননি। শুধু দু-একজন গোষ্ঠীসংযোগ বা কানেকশনের অসদ্ব্যবহার করে অযোগ্য নিকট আত্মীয়দের জন্য অন্যায়ভাবে সুযোগ-সুবিধা (যথা পরীক্ষার ফল বদলানো, তদ্বির করে বিদেশে স্কলারশিপ জোটানো) চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়েছেন। আজকের হিসেবে ওগুলি দুর্নীতির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু শিক্ষাজগতে উচ্চস্তরে দুর্নীতি প্রধানত ক্ষমতাচক্র গড়ার রূপ নেয়। নতুন মাতব্বরগোষ্ঠীর দলভুক্ত বা প্রীতিভাজন না হলে কয়েকটি বিষয়ে ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কোথাও কোথাও কোনও কলেজেই চাকরি পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। গবেষণার জন্য অনুদানের বেলায়ও একই নিয়ম চালু হয়। রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে এঁরা যখন ক্ষমতাচ্যুত হলেন, তখন ক্ষমতাপ্রাপ্ত নতুন গোষ্ঠী একই খেলা খেলতে শুরু করেন। তাঁদের দলে বিদ্বান বুদ্ধিমান মানুষের সংখ্যাল্পতাবশত কিছু তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির মানুষ গদিয়ান হলেন। তাঁদের রাজত্ব শেষ হয়েছে। আগের যুগের কর্তাব্যক্তিরা অনেকে রাজ্যপাট ফিরে পেয়েছেন। তার নানা সুফল এখনই বেশ দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু দু বছর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়ানোর অভিজ্ঞতা ভেবেচিন্তেই নারকীয় বলে বর্ণনা করেছি—প্রধানত এই দলবাজির পরিপ্রেক্ষিতে না। কারণ দলের নেতারা বাহ্যত আমার বন্ধুই ছিলেন। যতদিন দেশে ছিলাম ততদিন আমার প্রতি তাঁদের বিরূপ মনোভাব স্পষ্টভাবে প্রকট হয়নি। ইতিহাস বিভাগে পড়াবার সময় স্থানীয় শিক্ষিত সমাজের ব্যবহারে যে অশ্লীলতার পরিচয় পাই সেটাই আমার অসহ্য লেগেছিল। তার পরিচয় যথাস্থানে দেব। উল্লেখ্য, যত দূর জানি বিশ্ববিদ্যালয়টির সব বিভাগে সকলেরই আমার মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি।

দিল্লি স্কুল ছেড়ে ইতিহাস বিভাগে যাওয়ার প্রধান কারণ অর্থনীতি বিভাগে পড়ানোর অভিজ্ঞতায় আমার ব্যক্তিগত অতৃপ্তি—একথা আগেই বলেছি। কারণ ওখানকার সভ্য শালীন আবহাওয়ার তুলনা দেশে বা বিদেশে কোথাও বেশি দেখিনি। কিন্তু পুণ্যশ্লোক রায় ঠিকই বলেছিলেন—ভারতীয় শিক্ষাজগতে দিল্লি স্কুল একটি দ্বীপ। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে এক ঘনকৃষ্ণ দিক আছে ওখানে পড়িয়ে তার সাক্ষাৎ পরিচয় আমি পাইনি। এখানে বলা উচিতকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার সময়েও আমার সেই নেতিবাচক দিকটির শিকার হতে হয়নি। তার কারণ আমি আমার প্রিয় শিক্ষকদের পক্ষপুটে আশ্রিত ছিলাম। আমাদের সহকর্মীদের অনেকে যে সঙ্গত কারণেই তীব্র অসন্তোষ নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন সেকথা আমার অজানা ছিল না। একটি পরিবারের প্রভাব যে সুনীতির সীমা সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করেছিল সে কথাও সবাই জানতেন। কিন্তু দিল্লির ইতিহাস বিভাগে পড়াবার সময় যে ধরনের আচরণ সহ্য করতে হয়েছে, আশা করি তার তুলনা অন্যত্র কোথাও নেই।

ব্যক্তিগত অতৃপ্তি ছাড়াও ইতিহাস বিভাগে যাওয়ার আমার একটি ইতিবাচক উদ্দেশ্য ছিল। দিল্লি স্কুলে কে. এন. রাজ এবং ডক্টর রাও একটি অর্থনীতি বিভাগ গড়ে তুলেছিলেন যেটি পৃথিবীর যে-কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে। আমার আশা ছিল যে ওইরকম একটি উচ্চকোটির ইতিহাস বিভাগও গড়ে তোলা সম্ভব। দেশের নানা জায়গার নানা মতের ঐতিহাসিকদের একত্র করে এ কাজ করা সাধ্যায়ত্ত বলেই মনে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ব্যাপারে তখন বিভাগীয় প্রধানের ক্ষমতা অসাধারণ এবং কয়েক বছরের জন্য বিভাগীয় প্রধান হিসাবেই আমি ইতিহাস বিভাগে যোগ দিই। কিন্তু আমার একটি কথা জানা ছিল না। বাবারও বাবা থাকে। ইতিহাস বিভাগে আমার বন্ধুগোষ্ঠী রাবণনন্দন ইন্দ্রজিতের মতো মেঘের আড়ালে থেকে শরবর্ষণ করে আমার প্রচেষ্টা বানচাল করছিলেন। না, সব ব্যাপারে না। যাঁদের প্রতি ওঁদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল না, তাঁদের নিয়োগের ব্যাপারে ওঁরা আপত্তি করেননি।

সব জায়গায়ই আমার সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত ছিল, এমন দাবি আমার নেই। তবে স্বজন বা তাঁবেদার-পোষণের জন্য কিছু করিনি, এটুকু বলতে পারি। আমি চলে যাওয়ার পর নয়া কামণ্ডলীর চোখে গ্রহণযোগ্য নতুন বিভাগীয় প্রধান সত্যিতেই একটি শক্তিশালী বিভাগ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। আমার মতে তার সঙ্গে যোগ্যতায় তুলনীয় কোনও ইতিহাস বিভাগ ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও হয়নি। আমার পরবর্তী বিভাগপ্রধানের কূটনৈতিক পারদর্শিতা এই সাফল্যের অন্যতর কারণ। যে ব্যক্তিকে ছ’ মাস আগে কিছুতেই উচ্চতর পদে নিয়োগ করার ব্যাপারে দলবাজচক্রের নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞর সম্মতি পাওয়া যায়নি, ছ’ মাস পরে সেই একই বিশেষজ্ঞ একই ব্যক্তির পদোন্নতিতে সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন। নতুন বিভাগ-প্রধান পাকা কূটনৈতিক না হলে এটা সম্ভব হত না।

অবশ্যি আগে যে সম্মতি পাওয়া যায়নি, তার পিছনে আমাকে হেনস্থা করার উদ্দেশ্যটাও কাজ করছিল। বিশেষজ্ঞটির প্রকৃতিতে একটিই বড় দোষ ছিল—প্রতিহিংসাপরায়ণতা। এটি বাদ দিলে তিনি নানা গুণের রীতিমতো বড় মাপের মানুষ ছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তাঁর একটি দুষ্ট মন্ত্রী ছিলেন। এর চেয়ে কপটতর ব্যক্তি আমি আমার দীর্ঘ জীবনে কখনও দেখিনি। হাড়ে হাড়ে অসৎ সেই মানুষটি কেন জানি না নানা মিথ্যে কথা বলে তাঁর বন্ধুর কান ভাঙিয়েছিলেন। ফলে তিনি আমার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়েন এবং তিন দশক ধরে নানাভাবে আমার বিরোধিতা এবং অনিষ্ট করার চেষ্টা করেন। সে চেষ্টা আমি বিদেশ যাওয়ার পরও বন্ধ হয়নি।

সর্বভারতীয় নতুন কর্তাগোষ্ঠী একটি নয়া নীতি শিক্ষাক্ষেত্রে চালু করেছিলেন। দিল্লি থেকে তা ক্রমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ওই গোষ্ঠীর ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। নয়া নীতির সংক্ষিপ্ত নাম ‘লাইকমাইন্ডেডনেস’। অর্থাৎ চাকরি পেতে হলে উমেদারদের ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে মতের দিক থেকে এক গোয়ালের গোরু হতে হবে। অবশ্যই সেই মত পবিত্র বামপন্থা। পরে এই নীতির উন্নততর নাম হল ‘আইডিওলজিকাল কনসিসটেন্সি’ অর্থাৎ আদর্শগত সমঝোতা। ওই সমঝোতা হলে যখন চাকরি হয় তখন উমেদারদের মধ্যে বামপন্থা দাবাগ্নির মতো ছড়াতে লাগল—এ আর বিচিত্র কী? শব্দ যেটা ব্যবহার হত সেটা অবশ্যি বামপন্থা নয় প্রগতিবাদ। কিন্তু প্রগতিবাদের রূপ এক নয়, বহু। তাই মাঝে মাঝে মুশকিল হত, বিশেষ করে যখন ক্ষমতায় আসীন প্রগতিবাদীদের মধ্যে স্বার্থ বা ক্ষমতাঘটিত কারণে ঝগড়া বাধত। কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের মেজাজ বুঝে চললে চাকরির ক্ষেত্রে চুনোখুঁটিদের অসুবিধে হত না। এবং ‘লয়্যালটি টেস্ট’ পাস করলে যথা বা অযথা সময়ে পদোন্নতিও হত।

আমি যোগ দেওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্থানীয় ক্ষমতাপন্নদের মধ্যে এক বিচিত্র দলাদলির ইতিহাস ছিল। তার কাহিনি দলের নেতাদের কাছেই শুনেছি। তাঁরা সময় এবং অবস্থা বুঝে সন্ধিবিগ্রহ করতেন। আজ যাঁরা ‘আদর্শগত শত্রু’ কাল তাঁরা বিশেষ প্রয়োজনে ক্ষণকালের জন্য স্যাঙাত হতেন (কতকটা স্তালিন এবং হিটলারের চুক্তির মত) এবং এসব ব্যাপারে খুব ঢাকা-চাপা কিছু ছিল না। বর্তমানে বিখ্যাত এক ব্যক্তি তাঁর প্রথম শ্রেণিতে ডিগ্রি পাওয়া এক ছাত্রীকে লেকচারারের পদে একটি চাকরির জন্য ইন্টারভিউতে আসতে নিষেধ করেন। কারণ কুটনৈতিক কারণে পদটি অন্য এক অধ্যাপকের কন্যার জন্য সংরক্ষিত ছিল। বশংবদ ছাত্রীটিকে অবশ্যি তার বাধ্যতার জন্য ভালভাবেই পুরস্কৃত করা হয়েছিল। আমাকে বলা হয়—ইতিহাস বিভাগে গেলে আদর্শ এবং জনস্বার্থের খাতিরে (পাঠক/পাঠিকা স্মরণ রাখবেন জনস্বার্থ ছাড়া আমাদের এলিট শ্রেণির অন্য কোনও চিন্তা নেই; যাবতীয় কুকর্ম তাঁরা জনস্বার্থেই করেন।) আমারও অনুরূপ সন্ধিবিগ্রহ করতে হবে। আমার সীমিত সৌভাগ্য—এ জাতীয় সন্ধিবিগ্রহ আমার করার প্রয়োজন হয়নি। আমার কোনও কোনও সহকর্মীর যে দানবীয় ছবি আঁকা হয়েছিল, বাস্তবে তারও সাক্ষাৎ আমি পাইনি।

এক সময়ে এই আইডিয়োলজিকাল কনসিসটেন্সি নামক ব্যাধি ভারতব্যাপী হয়ে শিক্ষাজগতে এক সর্বগ্রাসী শনিগ্রহ হয়ে দেখা দেয়। আমি যে ধরনের ইতিহাস বিভাগ গড়ে তোলার কথা চিন্তা করেছিলাম তা সব দিক থেকেই আদর্শগত ঐক্যের বিরোধী। আমার বা আমাদের সঙ্গে মতে মেলে না এমন লোকই আমি সহকর্মী হিসাবে পেতে চাইছিলাম। নানা মতের সহাবস্থান এবং সঘর্ষে ঐতিহাসিক চিন্তা বহু স্রোতে বইবে, আমাদের বুদ্ধিগত জীবনকে সমৃদ্ধ করবে, এইটাই আমার আশা ছিল। কিন্তু যা ঘটছিল তা ঠিক এর উলটো। এবং যা ঘটছিল তার মধ্যে আমি এক সমূহ বিপদের সঙ্কেত পাচ্ছিলাম।

এতক্ষণ যে বিবরণী বেনামিতে চালাচ্ছিলাম, এবার তার মধ্যে দু-একটি সুপরিচিত নাম আমদানি করতে চাই। ইতিহাস শিক্ষা এবং শিক্ষাগত প্রশাসনের ক্ষেত্রে তথাকথিত বামায়ন যখন প্রবল বেগে চলছে, তখন একবার আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সুশোভন সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। আমি বলি—উত্তর ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রভাব যেমন দুর্নীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং শিক্ষাব্যবস্থার মান এবং বিশ্বাসযোগ্যতা দুই-ই নিম্নগামী, এখন যা ঘটছে তার ফলে বামপন্থী ভাবধারারও অনুরূপ দুর্গতির সম্ভাবনা। উনি সর্বজনের শ্রদ্ধেয়। উনি যদি ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তিদের এই বিষয়ে সাবধান করেন, তবে হয়তো এই অযোগতি বন্ধ হতে পারে। আমার এই ধারণা অবশ্য নিতান্তই ভুল ছিল। কারণ খেলা যেটা চলছিল সেটা আগাগোড়াই স্বার্থ এবং ক্ষমতাঘটিত। কারও সুপরামর্শ শুনে তার রদবদল হবার সম্ভাবনা ছিল না।

সুশোভনবাবু আমার কথা শুনে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। ওঁর বক্তব্য–যাঁদের নানা উচ্চপদে বসানো হচ্ছে তাঁরা কেউ অযোগ্য লোক না। আর দীর্ঘদিন ধরে যে চাকরিবাকরি ক্ষমতা বিতরণের ব্যাপারে বামপন্থী আদর্শের ছোঁয়াচ থাকলে কোনও রকম সুযোগ পাওয়া অসম্ভব ছিল, তাতে আমরা কেউ আপত্তি করিনি। এখন স্রোত সামান্য উলটোমুখি হওয়ায় আমরা ‘গেল গেল’ রব তুলছি। বলা বাহুল্য–উনি ঠিক এই ভাষা ব্যবহার করেননি। কিন্তু আমার বয়ান এবং ওঁর মূল বক্তব্যে খুব তফাত ছিল না। উত্তরে আমি বলি, স্যার, আমরাও নিজেদের প্রগতিবাদী বলেই মনে করি। কিন্তু যা ঘটছে তাতে প্রগতিবাদীদের বিশ্বাসযোগ্যতা শুন্যের ঘরে নামবে বলে আশঙ্কা করি। আরও কথা আছে। রাজনৈতিক চাকা। যদি কখনও উলটো দিকে ঘোরে, তখন নতুন রাজারা আজকের ব্যাপারগুলো ভুলবে না। অবাঞ্ছিত মানুষের হাতে পড়ে শিক্ষার অবস্থা সঙ্গীন হবে বলে আশঙ্কা করি।অবশ্যি এ কথা যখন বলি তখন গৈরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসীন হবে—এমন কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। আমার একটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণ হয়েছিল যাতে আমার আনন্দের কোনও হেতু নেই। বিবিধ কুকার্য করার সময় গৈরিক পরিবার সর্বদাই পূর্ববর্তীদের ‘সদাচার’-এর নজির। দেখাতেন। সর্বত্র নিজের দলের লোক বসাচ্ছেন এমন অভিযোগ করলে বলতেন, তবে কি আমরা আমাদের শত্রুদের দায়িত্বপূর্ণ পদে বসাব? পাঠিক/পাঠক আইডিওলজিকাল কনসিসটেনসির কথা স্মরণ করুন। গৈরিক বাহিনীর এক পণ্ডিত প্রগতিবাদীদের কীর্তিকলাপ নিয়ে একটি কুরুচিপূর্ণ বই প্রকাশ করেন। এই অশ্লীল গ্রন্থটি সর্বৈব মিথ্যা বলতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা বলার পথ প্রগতিপন্থীরা রাখেননি। উপযুক্ত আলোচনায় সুশোভনবাবুর সুযোগ্য পুত্র বর্তমানে বিখ্যাত ঐতিহাসিক সুমিত সরকারও যোগ দিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর পিতার মতই সমর্থন করেন। (বলা বাহুল্য, এদের সঙ্গে। বর্তমান পরিচ্ছেদে বর্ণিত বিচিত্র কুকর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।) এর অল্পদিন পরে উনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। তখন আমি বিদেশে চলে গিয়েছি। বছর দুই বাদে সুমিত আমাকে একটি চিঠি লেখেন। তার মূল বক্তব্য ছিল–নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উনি আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারছেন। আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে ওঁর অভিজ্ঞতার খুব তফাত ছিল না। শুধু বিভাগীয় প্রধান হিসাবে আমার একটি দুঃস্বপ্ন থেকে উনি রেহাই পেয়েছিলেন। সে কথায় পরে আসছি।

ইতিহাস বিভাগে যোগ দেওয়ার ব্যাপারটাও সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশভাবে ঘটেনি—সে কথা অনেক পরে জানতে পারি। আমাকে ইতিহাস বিভাগে নেওয়ার ব্যাপারে যে সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার প্রধান স্থানীয় ছিলেন একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক। তাঁর। বিদ্যাবত্তা সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন ওঠেনা। কিন্তু নিজেকে প্রচার করার ব্যাপারে তাঁর পটুত্ব কিছু কম। তাই তাঁর নাম শিক্ষিত সাধারণের কাছে পরিচিত নয়। যে-বিখ্যাত ব্যক্তিটির নানা সুকীর্তি এর আগে বর্ণনা করেছি, তিনি এই পণ্ডিত ব্যক্তির দ্বারস্থ হয়ে অনুরোধ করেন যেন আমাকে ইতিহাস বিভাগে নেওয়া না হয়। এই অনুরোধের কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর হয়—লোকটা বিভাগীয় প্রধান হয়ে এলে সব কমিটিতে ঢুকবে। অর্থাৎ তাঁরা যে নিরঙ্কুশ রাজত্ব স্থাপনের চেষ্টায় আছেন, তার ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা। সত্যিতে তার আশঙ্কার কোনও কারণ ছিল না। কারণ কমিটি আমার কাছে বিভীষিকার বস্তু, একেবারেই কামনীয় নয়। ইনি এবং ওঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী চাকরিতে নিয়োগ-বিনিয়োগের ব্যাপারে সম্পূর্ণ দু কান কাটা ছিলেন। সবাই জানতে পারবে জেনেও চাকরির ব্যাপারে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক তদ্বির তথা ঘোঁট করতে এঁরা কোনও দ্বিধা করতেন না। আমাদের দেশে এ জাতীয় অসৎ লোকের অভাব নেই। সুতরাং ওই দুই ব্যক্তি ব্যতিক্রম না, নিয়মের মধ্যেই পড়েন। আমার শুধু দুঃখ যে এই জুটির একটি আজ উদার নিরপেক্ষতার আদর্শ বলে পরিচিত। প্রয়াত পণ্ডিত পার্থসারথি গুপ্ত যাতে অধ্যাপকের পদ না পান, সে জন্য এই দুষ্ট জুটিটি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের প্রচেষ্টা বিফল হয় আমি বিদেশ চলে যাওয়ার পরে। এঁদের বজ্জাতির সঙ্গে আমি পরে উঠিনি। পার্থসারথির মতো নিপাট ভালমানুষ এবং বিদ্যাচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ পণ্ডিত ব্যক্তি যে-কোনও দেশেই দুর্লভ। তিনি কীভাবে এই দুষ্টচক্রের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তা এখনও আমার বুদ্ধির অগোচর রয়ে গেছে। বোধহয় তিনি এঁদের নিরঙ্কুশ দলবাজিতে শামিল হতে নারাজ ছিলেন বলেই তাঁকে তাঁর প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সব সমাজেই কিছু অসৎ দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ থাকে। তা। নিয়ে আক্ষেপ করে লাভ নেই। কিন্তু দুজন মানুষের ধর্মধ্বজ বলে খ্যাতি হলে কিছুটা গাত্রদাহ হয় ঠিকই।

ইতিহাস বিভাগে বিভাগীয় প্রধানের পদ গ্রহণ করে কয়েকটা ব্যাপারে অস্বস্তিজনক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। প্রথমেই নজরে আসে স্নাতকোত্তর বিভাগের অল্প সংখ্যক এবং কলেজগুলির বহু সংখ্যক শিক্ষকদের মধ্যে একটা রেষারেষির সম্পর্ক। এর কারণ কলেজের এবং স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষকদের মাইনে এক হলেও শেষোক্তদের মানমর্যদা কিছু বেশি, যদিও তাঁরা যে বিদ্যাবুদ্ধিতে তুলনায় শ্রেষ্ঠ এমন কথা হলফ করে বলা চলত না। এই রেষারেষির প্রকাশ হত কখনও বিরোধিতায়, কখনও বিরোধ-ভক্তিতে। স্নাতকোত্তর বিভাগের দল-অনুদলকে ঘিরে বৃহত্তর গোষ্ঠী গড়ে উঠত। কোনও কোনও প্রফেসর-সাব বা ডক্টর-সাবের বৈঠকে সন্ধ্যায় বা সপ্তাহান্তে রীতিমতো আসর জমত। সেসব আসরের প্রধান আলোচ্য থাকত প্রতিপক্ষের নিন্দা বা ডক্টর/প্রফেসর সাহেবের মাহাত্ম্য। আর সঙ্গে সঙ্গে ছোটখাটো দাবিদাওয়াও পেশ করা হত।

এইসব দাবিদাওয়ার কেন্দ্রে ছিল স্নাতকোত্তর বিভাগে পড়ানোর জন্য তদ্বির। আমার পূর্ববর্তী শিক্ষকদের একজন এই সমস্যার এক অভিনব গণতান্ত্রিক সমাধান আবিষ্কার করেন। তিনি সব কলেজ শিক্ষকদের এক ইস্তাহার পাঠান–যেন তাঁরা তাঁদের যে বিষয়ে পারদর্শিতা আছে সেই বিষয়ের একটি পাঠক্রম তৈরি করে পাঠান। উদ্দেশ্য তাঁদের এই পাঠক্রম অনুযায়ী সাধ্যমতো সব বিশেষ বিষয় বা স্পেশাল পেপার তৈরি করা হবে এবং পাঠক্রম-স্রষ্টারা তাঁদের বিশিষ্ট জ্ঞান ওই বিষয় মারফত পরিবেশন করবেন। এই গণতান্ত্রিক হরির লুঠের ফলে পঁচিশ বা তিরিশটি নতুন বিষয় পড়ানোর ব্যবস্থা হল। উচ্চাকাঙ্ক্ষী কলেজ শিক্ষকরা হরিবোল দিতে লাগলেন। এই নীতির প্রবক্তার নামে ধন্য ধন্য পড়ল। তাঁর প্রভাব ও ক্ষমতা আরও বাড়ল এবং সেই অনুপাতে দলও ভারী হল।

এ ব্যাপারে সামান্য একটু অসুবিধে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিংয়ে স্থানাভাববশত প্রতি বিভাগে ক্লাস হত মাত্র সপ্তাহে তিন দিন এবং অনেক ক্ষেত্রেই দু’বেলার মাত্র একবেলা। সপ্তাহের বাকি সময়টা শিক্ষক ও ছাত্ররা গভীর অধ্যয়ন-তপস্যায় নিমগ্ন থাকতেন। ওই তিন দিনে এতগুলি বিষয়ের স্থান সংকুলান করা সংখ্যাতত্ত্বের কোনও আইনস্টাইনেরও ক্ষমতায় কুলাত না। ফলে ইতিহাস বিভাগের নতুন বিস্তৃত পাঠক্রম মৃত পত্র বা ডেড লেটার হিসাবে শোভা পেতে লাগল। এই সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না নীতি ভালই চলছিল। কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে কিছু দুবৃত্ত ছিলেন, তাঁরা এই বিস্তৃত পাঠক্রমের মধ্যে গোলমাল বাধাবার সুবর্ণ সুযোগ খুঁজে পেলেন। মাঝে মাঝেই তাঁরা ধুয়া ধরতে লাগলেন, কেন অমুক বিষয় পড়ানো হচ্ছে না জবাব দাও, জবাব দাও। আমার ক্লাসে একটি ছাত্র ছিলেন, যাকে রুচি অনুযায়ী গুন্ডা বা ছাত্রনেতা যে-কোনও অভিধায় অভিহিত করা চলত। মানুষটি মাঝে মাঝেই আমার ইউনিভার্সিটির দেওয়া বাড়ির লনে এসে চা সামোসা খেয়ে যেত। লোকটিকে আমার বেশ লাগত। তার কোনও রকম নীতিবোধ বা স্কুসের বালাই ছিল না। বুঝতাম সে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নেতা হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু যে দলে সে যোগ দিয়েছিল তাদের কখনও ক্ষমতায় আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। এর হেতু জিগ্যেস করায় এই অত্যন্ত স্পষ্টভাষী মানুষটি মোম যুক্তি দেখিয়েছিল। বড় দলে উপরে উঠতে সময় লাগে। ছোট দলে নেতৃস্থানীয় হতে পারলে দল বদলাতে আর কতটুকু সময় প্রয়োজন?

হঠাৎ টার্মের মাঝামাঝি সে আমার দফতরে এসে দাবি জানাল, গাঁধী বিষয়ে যে স্পেশাল পেপার আছে তা পড়াবার ব্যবস্থা করতে হবে। এক একটা পেপার পড়াতে এক টার্ম সময় নেওয়া হত। সুতরাং টার্মের মাঝামাঝি কী করে হঠাৎ নতুন পেপার পড়ানোর ব্যবস্থা করা যাবে? আমি আরও বললাম, দ্যাখো বাপ, পড়ানোর ব্যবস্থা হলে তোমার ব্যক্তিগত কী সুবিধা হবে? তোমাকে তো কখনও ক্লাসে আসতে দেখা যায় না। পাকা কুটনৈতিকের মতো মহাশয় উত্তর দিলেন, সে কথা অবান্তর। ছাত্ৰসাধারণের গণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে সে এসেছে। জাতির পিতার জীবন ও কর্ম বিষয়ে পড়াবার কথা পাঠক্রমে আছে, অথচ ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিবিশিষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে কিছু গা করছেন না। এর কোনও সুরাহা না হলে তাঁরা সক্রিয় ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবেন। জাতির পিতা মাথায় থাকুন, এ ব্যক্তি যে নিজের পিতা বিষয়েও কৌতূহলী এ কথা মনে করার কোনও কারণ ছিল না। আমি বললাম–এত অল্প সময়ে নতুন বিষয় পড়াবার ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। নেতা তৎক্ষণাৎ উপাচার্যের ঘরে গিয়ে হামলা করলেন। মহম্মদের পর্বতের কাছে যেতে হল না। উপাচার্যরূপী পর্বত স্বয়ং আমার দফতরে এসে উপস্থিত হলেন। বললেন–এই জাতীয় জটিল বিষয়ে বিনা আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। বুঝলাম উনি ওই বজ্জাতচূড়ামণিকে ভয় পান। যে ব্যক্তি গাঁধী বিষয়ক পাঠক্রম তৈরি করেছিলেন তাঁকে ডাকা হল। তিনি সানন্দে চার সপ্তাহে গাঁধীবিষয়ক যাবতীয় তত্ত্ব ও তথ্য সম্যকভাবে পড়িয়ে দিতে রাজি হলেন। এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে মহান ছাত্রনেতা আমার বাড়ির লনে নির্ধিধায় আবির্ভূত হলেন। বললেন, কিছু মনে করবেন না। এইসব আমাদের মাঝে মাঝে করতে হয়। এখন আর কোনও ইস্যু হাতের কাছে ছিল না। তা না হলে আপনাকে বিব্রত করার আমার ইচ্ছা ছিল না। চা-সিঙাড়া এল। আহারান্তে আমার পদধূলি নিয়ে নেতা বিদায় নিলেন। পরের দিন কাগজে বের হল–ইতিহাস বিভাগের কমিউনিস্ট প্রধান রায়চৌধুরী গাঁধী বিষয়ক পেপারটি পড়াতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। ছাত্রনেতা অমুকের চাপে পড়ে অবশেষে বাধ্য হয়েছেন। আলেলুইয়া! বোল হরিবোল।

এই জাতীয় সন্দেহাতীত এবং নির্লজ্জভাবে বজ্জাত লোকদের আমার সত্যিই ভাল লাগে। এরা অনেক আনন্দ ও শিক্ষার খোরাক জোগায়। আমার সমস্যা হয় আপাতভদ্র মানুষগুলিকে নিয়ে, যারা সামনে বন্ধুত্বের মুখোশ পরে পিছন থেকে ছুরি মারে; উদারনীতি, বামপন্থা আর জনস্বার্থের নামাবলী গায়ে নিরঙ্কুশ দলবাজির রাজত্ব কায়েম করার তালে থাকে। সজনী দাস বর্ণিত অমায়িক খচ্চরদের দূর থেকে দেখতে মজাই লাগে, তাদের অমায়িকতার আবরণ বেশি পুরু না হওয়ায় অন্তরস্থিত খচরামি মাঝে মাঝেই প্রকট হয়ে কৌতুকের খোরাক জোগায়। কিন্তু এদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে কৌতুকবোধটা বেশি দিন সজাগ রাখা কঠিন হয়ে ওঠে।

সত্তরের দশকে দিল্লির ছাত্র রাজনীতিতে দুই দলের শক্তির লড়াই চলছিল। একটি কংগ্রেসপন্থী, অন্যটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তথা ভারতীয় জনসর ছাত্র সংগঠন বিদ্যার্থী পরিষদ। শোনা যেত এই দুই দলের পিছনে দুই বৃহত্তর শক্তির মদত ছিল। তারা হচ্ছে যথাক্রমে কোকাকোলা এবং পেপসি কোম্পানি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাফেটেরিয়াটি ছাত্র ইউনিয়নের কর্তৃত্বাধীন ছিল। সুতরাং সেখানে মুখ্য পানীয় হিসেবে কোকাকোলা বিক্রি হবে, পেপসি, তা ক্ষমতাসীন দলের মর্জির উপর নির্ভর করত। দিল্লির স্থানীয় রাজনীতিতে তখন জনসঙ্ঘ ক্ষমতালাভের চেষ্টায় সাফল্যের মুখে। বিদ্যার্থী পরিষদ তাদের হাতে অত্যন্ত মূল্যবান হাতিয়ার। শিক্ষকদের এক বড় অংশ প্রকাশ্যে বা গোপনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সমর্থক। এক কলেজ পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখি অধ্যক্ষের চেয়ারের পিছনে অতি সুদৃশ্য এক ভারতবর্ষের ম্যাপ ঝুলছে। ম্যাপের আড়ালে কী ছিল সে বিষয়ে আমি অবহিত ছিলাম। তাই ম্যাপটি সরাতে বললাম। পিছনে আর একটি ভারতবর্ষের ম্যাপ উদঘাটিত হল। সেটির বিষয়বস্তু সারা ভারতবর্ষে আর. এস. এস-এর শাখাগুলির স্থাননির্দেশ। অধ্যক্ষ মহাশয়কে বিনীত অনুরোধ জানালাম ও বস্তুটি ওখান থেকে স্থানান্তরিত করে সঙ্গেঘর শাখা দফতরে নিয়ে টাঙাতে। মহাশয় স্থানীয় শাখার সরসঘচালক, সে কথা যে আমাদের জানা আছে এ তথ্যও নিবেদন করলাম।

যে ব্যাপারে আমার চরম দুর্ভোগ ভুগতে হয়েছিল তার সঙ্গে উপরে উল্লিখিত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনীতির সম্পর্ক কম। তবে আমার ক্ষমতাপন্ন বন্ধুগোষ্ঠী অন্তত আংশিকভাবে তার পিছনে ছিলেন কি না জানি না। এদের কর্মপদ্ধতি ক্ৰম-প্রকাশ্য উপন্যাসের মতো ধাপে ধাপে আমার চেতনাগোচর হয়েছে। এখন আমার বিশ্বাস কোনও কুকর্মই এদের সাধ্যাতীত নয়। তবে ওই বিশেষ ঘটনাগুলির পিছনে এদের হাত ছিল কি না সে বিষয়ে কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আমি পাইনি।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলিতে নিয়োগের ব্যাপারে যে ব্যবস্থা চালু ছিল, তাকে আমি কুপ্রথা ছাড়া অন্য কোনও কিছু বলে বর্ণনা করতে পারি না। আপাতদৃষ্টিতে সে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই। বিভাগীয় প্রধান বা তার প্রতিনিধি সিলেকশন কমিটির অন্যতর সভ্য। তা ছাড়া গভর্নিং বডিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি, কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি এ রকম কয়েকজন থাকত। সাধারণত বিভাগীয় প্রধান এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের সমঝোতার উপর নির্বাচন নির্ভর করত। যেখানে দু’পক্ষের মতান্তর ঘটত, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করে সাধারণত বিভাগীয় প্রধানের পক্ষে মত দিতেন। ইতিহাস বিভাগের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসের ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে অধ্যাপকরা রোটা সিসটেমে সিলেকশন কমিটিতে যাবেন। তবে প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধানের মত অনুযায়ীই নিয়োগ হত।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজের সংখ্যা ছিল যত দূর মনে পড়ে কমবেশি চল্লিশের মতো। প্রতি বিষয়েই প্রত্যেক বছরই কিছু লেকচারারের পদ খালি হত। এবং নিয়োগকর্তা শেষাশেষি বিভাগীয় প্রধান। ফলে কর্মপ্রার্থীদের অনেকেই সারা বছরই তাকে অল্পবিস্তর তৈলপ্রদান করতেন। বহু চেষ্টায় আমি এই জাতীয় সহকর্মীদের বোঝাতে সক্ষম হই যে এই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে কলাটা-মূলোটা নিয়ে আমার বাড়ি আসা বন্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে উৎকোচ প্রদানের চেষ্টা বিফল হলে বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে সম্পর্কটা অন্য পথে গেল।

চাকরির জন্য যারা দরখাস্ত করতেন বা ইন্টারভিউর জন্য যাদের ডাকা হত, তারা অধিকাংশই মোটামুটি এক দরের মানুষ। এঁদের মধ্যে থেকে যাকে বা যাঁদের বাছা হত, তিনি বা তারা সব হিসেবে আর সবাইয়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠ এ কথা অবশ্যই বলা যেত না। ফলে যারা বিফলমনোরথ হতেন তাদের মনে ক্ষোভ হওয়া বিচিত্র নয়। যারা বারবার দরখাস্ত করেও চাকরি পেতেন না তাদের কারও কারও ধারণা জন্মাত যে কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি কোনও অসঙ্গত কারণে বিরূপ৷ এরকম ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক কিছুনা। সত্যিতে একবার হাত বাছাইয়ের পর যাঁদের ইন্টারভিউতে ডাকা হত তাদের মধ্যে লটারি করে একজন কাউকে বাছা হলে নির্বাচনটা খুব ভ্রমাত্মক হত বলে মনে হয় না।

যা হোক, ব্যর্থমনোরথ হয়ে ক্ষুব্ধ হওয়াটা এক ব্যাপার আর সেই ক্ষোভ প্রকাশের ভঙ্গিটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। কিছু কিছু আশাহত উমেদার যা শুরু করলেন, আশা করি তার তুলনা ভারতবর্ষের অন্যত্র কোথাও নেই। তারা আমার বাড়ির ঠিকানায় অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে চিঠি লিখতে শুরু করলেন। প্রায়ই আমার স্ত্রী এই চিঠিগুলি খুলে এবং পড়ে অত্যন্ত বিচলিত হতেন। শিক্ষিত ভদ্রলোক ওই রকম ভাষা ব্যবহার করতে পারে এ তার কল্পনার অতীত ছিল। চিঠি না খুলে ফেলে দেওয়ার উপায় ছিল না। কারণ তা করলে প্রয়োজনীয় তথ্যও না পড়ে ফেলে দেওয়ার আশঙ্কা। আমি খুব বিচলিত হতাম না। কারণ মানুষগুলি (?) শিক্ষিত কি না জানি না, ভদ্রলোক যে না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তাদের চিঠির ভাষায়ই পাওয়া যায়। চতুষ্পদ এবং দ্বিপদের চালচলন এক রকম হবে এটা আশা করা যুক্তিবিরুদ্ধ। কিন্তু রোজ সকালবেলা এক বছর ধরে এই রকম চিঠি আসা কারও পক্ষেই খুব আনন্দদায়ক না, এ কথা বলাই বাহুল্য।

এর পর যা শুরু হল, তা আরও বিচিত্র। আমি চিঠিগুলির ব্যাপারে কোনও ‘গা’ বা ‘রা’ করায় পত্রলেখকরা এক কেন্দ্রীয় দফতর বসালেন। সেখান থেকে সাইক্লোস্টাইল করে স্নাতকোত্তর বিভাগ এবং কলেজ মিলিয়ে ইতিহাস বিষয়ে ন্যূনধিক দু’শো শিক্ষককে নিয়মিত চিঠির কপি পাঠানো শুরু হল। চিঠির বক্তব্য থেকে বোঝা গেল যে পত্ৰলেখকদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় তাদের নজর স্নাতকোত্তর বিভাগের পদগুলির উপর। তাঁদের প্রধান অভিযোগ তাঁদের মতো যোগ্য লোক থাকতে আমি বাইরে থেকে তোক নিয়ে এসেছি। এরা ব্যাপারগুলি এতই প্রকাশ্যে করতেন যে কারা করছেন তা আমি সহজেই জানতে পারি।

একটি দক্ষিণ ভারতীয় মানুষ (চিঠিতে যেখানেই ত-এর জায়গায় থ থাকত, অবশ্যই ইংরেজি বর্ণান্তরে, বুঝতাম ওটি তার অবদান), এই গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ছিলেন। মানুষটি সব দিক থেকেই সজনী দাস বর্ণিত অমায়িক খচ্চর। বাহ্যিক ব্যবহারে এঁর চেয়ে মার্জিত রুচির মানুষ আমি বেশি দেখিনি। প্রকৃতপক্ষে ওঁর তুলনীয় বজ্জাত শুধু শিক্ষাজগৎ কেন যে কোনও জগতেই বিরল। ইনি সর্বভারতীয় কর্তাগোষ্ঠীর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাদের নেকনজরের ফলে যথা না, অযথা কালেই মেওয়া ফলেছিল। লোকটি প্রথমে অধ্যাপক পরে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পদে অধিষ্ঠিত হন। এবং এখনও মাঝে মাঝে কারণে-অকারণে আমার উদ্দেশে আকার-ইঙ্গিতে গালিগালাজ ছোঁড়েন। তৎকালীন দলবাজ গোষ্ঠীর বিশেষ প্রিয়পাত্র এই মানুষটি বিদেশের ডিগ্রিধারী ছিলেন। কিন্তু তা ছাড়া তাঁর বিদ্যা বা সুবুদ্ধির কোনও পরিচয় আমি পাইনি, যদিও দলবাজ নেতৃবৃন্দ এঁকে হেরোডোটাস-থ্যকিডিডিসের সঙ্গে তুলনীয় বলে ঘোষণা করেন।

দলবাজ কোম্পানির দলবৃদ্ধি এবং দলপালনের অন্যতর প্রধান টেকনিক ছিল হঠাৎ তাঁদের কোনও চেলাকে মহাপুরুষ ঘোষণা করা। আমার ধারণা এই জাতীয় তথ্য ওঁরা স্বপ্নদেশ মারফত পেতেন। আর যদি মাফিয়ার কোনও সভ্য স্বপ্ন মারফত জ্ঞাত হতেন যে অমুক ব্যক্তি জিনিয়াস, তা হলে দলস্থ সবাই হরিবোল হরিবোল ধ্বনি তুলে ভাগ্যবান লোকটিকে মাথায় তুলে নাচানাচি শুরু করতেন। এবং অচিরেই যোগ্য লোকদের ডিঙিয়ে তাঁকে উচ্চপদে বহাল করা হত। সে যদি থার্ড ক্লাস ডিগ্রিধারী হত, তো বলতেন আরে রবীন্দ্রনাথের তো কোনও ডিগ্রিই ছিল না। এই পদ্ধতিতে ভারতবর্ষে ইতিহাসচর্চার জগৎ জিনিয়াসে জিনিয়াসে জনাকীর্ণ হয়ে গেল। আর বহু বিমর্ষ বানর বীরদর্প হনুমানে পরিণত হল।

এরকম একটি জিনিয়াস একবার আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেখলাম জিনিয়াসটি এক লাইন শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে অপারগ। সেই মহাপণ্ডিত হিন্দি বা উর্দু ভাষায় তার অসামান্য প্রতিভা প্রকাশ করলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, উনি ঘৃণিত বিদেশি ভাষায়ই বক্তব্য রাখতেন। শুনেছি দলবাজ কোম্পানির অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উক্ত মহাপুরুষের ইংরেজি শুদ্ধ করে দিতেন। কিন্তু নেতাটি বিশ্বভ্রমণে ব্যস্ত থাকায় সব ভুল শোধরাবার সময় পেতেন না। ফলে জিনিয়াসের সব উক্তি বোঝা যেত না। অবশ্যি তা আমাদের পূর্বজন্মকৃত পাপেরই ফল। ওঁর কোনও দোষ নেই।

একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে দলবাজমণ্ডলী সব চেলাদেরই জিনিয়াস বলে ঘোষণা করতেন না। অনেক ক্ষেত্রেই আদর্শগত সমঝোতাই যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে যথেষ্ট বলে ধরে নেওয়া হত। আর যাদের হাতে চাকরির কলকাঠি তাদের সঙ্গে আদর্শগত সমঝোতাসম্পন্ন মানুষ কখনওই দুর্লভ হওয়ার কথা নয়। আমার দুর্ভাগ্যবশত এই রকম এক আদর্শগত সমঝদার ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে নিমিত্তের ভাগী হতে হয়েছিল। ঘটনাটি এতই চমকপ্রদ যে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে হল।

হঠাৎ একদিন প্রগতিবাদীদের নেতৃস্থানীয় এক সহকর্মী, উপযুক্ত দুষ্ট জুটিটির একজন, আমার বাংলোয় পদধূলি দিলেন। তার বক্তব্য স্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থতাবিহীন। তিনি জানালেন-সম্প্রতি যে একটি কলেজে লেকচারারের পদ খালি হয়েছে সেটি অমুক ব্যক্তিকে দিতে হবে। আমি বললাম-আগেভাগে এরকম ব্যবস্থা করা কীভাবে সম্ভব? আর যত দূর জানি—বি.এ এবং এম.এ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে যে-ছেলেটি প্রথম হয়েছে, সেও ওই চাকরিটির উমেদার। তাকে ডিঙিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির মাঝামাঝি ডিগ্রি পাওয়া একটি মেয়েকে কী করে চাকরি দেওয়া যাবে? সহকর্মী তখন সমস্যাটা আমাকে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। মেয়েটির যোগ্যতা প্রধানত তার প্রগতিবাদ এবং প্রগতিবাদী নেতাদের প্রতি আনুগত্যে। এসব ব্যাপারে সে একেবারে খাঁটি সোনা। সুতরাং তার সুবিধে-অসুবিধে তো দেখতে হবে। সে তার বাগদত্ত ভাবী স্বামীর সঙ্গে এক সঙ্গে বাস করে মেয়েটির ভাবী স্বামী এবং সে দিল্লির দুটি কলেজে কাজ করে। ছেলেটি যে কলেজে কাজ করে সেই কলেজেই নতুন চাকরিটি খালি হয়েছে। এখন চাকরিটা মেয়েটি পেলে দু’জনে এক সঙ্গে আসা-যাওয়া করতে পারবে—ওদের নতুন কেনা মোটর সাইকেলে চেপে। ওদের এতে বিশেষ সুবিধে হবে। সামান্য ব্যাপার। আর প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ওই ছোঁকরা? ওকে ডেকে বললো ওকে অন্য চাকরি দেওয়া যাবে। এই অভূতপূর্ব প্রস্তাবে আমি হতবাক। আমার আমরণ লজ্জায় বিষয়—এই অনাচার আমি বন্ধ করতে পারিনি। যে অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে ওই নির্বাচক কমিটিতে গিয়েছিলেন, তিনি নির্দ্বিধায় প্রগতিবাদী নেতার প্রস্তাব অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির ডিগ্রি পাওয়া মেয়েটিকে চাকরিটি দিলেন। আমি সাক্ষীগোপাল হয়ে সমস্ত ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে দেখলাম।

এই চরম দুর্নীতিপূর্ণ ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থনে আমার কিছুই বলার নেই। চেষ্টা করলেও এই অপকর্ম হয়তো থামাতে পারতাম না। কিন্তু চেষ্টা না করার সপক্ষে কোনও যুক্তিই ছিল না। আমার কর্তব্য ছিল সমস্ত ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষকে লিখে জানানো। কেন পারিনি? কারণ এই দুবৃত্তদের তখনও আমি বন্ধু বলে জ্ঞান করতাম এবং ওদের মুখোশ খুলে দেওয়ার মতো জোর ভিতর থেকে পেলাম না। ফলে এই বিশেষ ব্যাপারটাতে আমিও দলবাজদের হাতিয়ার হলাম। এ লজ্জা থেকে আমার আমরণ রেহাই নেই। আমার সৌভাগ্যবার প্রতি অবিচার করা হয়েছিল তার শেষ অবধি খুব অনিষ্ট হয়নি। বর্তমানে সে জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিক। কিন্তু মাফিয়াগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হওয়ার মাশুল তাকে এখনও দিতে হচ্ছে। যেখানেই ‘রুটি-মাছ’ বিলির ব্যাপারে ওই দুষ্টচক্রের হাত আছে, সেখানেই সব সুযোগ-সুবিধে থেকে সে আজও বঞ্চিত। আমার যে কটি ছাত্র সম্পর্কে আমি বিশেষ গর্বিত, এই মানুষটি তাদের একজন।

আগেই বলেছি ইতিহাস বিভাগে পড়াবার সময় যে পূতিগন্ধময় পরিবেশের মধ্যে আমাকে বাস করতে হয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে বিভাগীয় প্রধানদের সম্ভবত সেই ধরনের আবহাওয়া সহ্য করতে হয়নি। সুমিত সরকার যখন ওই কুর্সিতে বসলেন তখন তাঁকে নানা দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রোজ সকালবেলা এক গোছা অশ্লীল চিঠি পড়তে হয়নি। আমার এই দুর্ভোগ কেন ভুগতে হয়েছিল তা আমি বোঝার চেষ্টা করেছি।

আমি ওই বিভাগে যোগ দেওয়ার আগে আদর্শগত ঐক্যের নামে ইতিহাসের স্নাতকোত্তর বিভাগ এবং কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে এক দলবাজির ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। তথাকথিত প্রগতিবাদীরা বোধ হয় আশা করেছিলেন যে আমি স্বাভাবিক নিয়মে তাদের দলেই যোগ দেব। সেটা যখন ঘটল না, তখন যাঁদের কিছুমাত্র ক্ষোভের কারণ ছিল তারা সবাই একত্র হলেন এবং ক্ষোভ প্রকাশের নিত্যনতুন উপায় বের করতে লাগলেন। তারা যে শ্লীলতার সীমা লঙ্ঘন করতে কোনও দ্বিধা করনে না, তার ব্যাখ্যা আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত লোকেদের সামাজিক সংস্কৃতির স্বরূপ। আর ক্ষমতাপন্ন মাফিয়া যা ঘটছিল তা সবই জানতেন। যদি এইসব অপকর্মে তারা উৎসাহ নাও দিয়ে থাকেন, এই অনাচার বন্ধ করার জন্য যে অঙ্গুলিহেলনও করেননি, সে বিষয়ে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই। একটা তুলনা মনে পড়ল। বিদেশি শাসনের যুগে ইংরেজরা সম্ভবত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানি দেয়নি। কিন্তু দাঙ্গা বাধলে এক শ্রেণির ইংরেজ কর্মচারী যে বিশেষ প্রীত হতেন, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।

যত দূর মনে পড়ে ১৯৭১ সনে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের হাঙ্গামা চরমে ওঠে। যা ঘটছিল তাকে আন্দোলন বলে সম্মানিত করার কোনও কারণ নেই। তার একমাত্র পরিচয় সুপরিশীলিত গুণ্ডামি। কে. এন. রাজ তখন উপাচার্য। তিনি শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারিয়ে পদত্যাগ করে চলে গেলেন। আমরা অনেক শিক্ষকের সই সংগ্রহ করে ওঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করি। সে অনুরোধ রাখা উনি সম্ভব মনে করলেন না। সহ-উপাচার্য স্বরূপ সিং ওঁর পদে অভিষিক্ত হলেন।

এই জাঠ ভদ্রলোকটি আমার পাশের বাড়িতে থাকতেন এবং সব ব্যাপারেই উনি আমাকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করেছে। কিন্তু তাতে আমার খুব সুবিধে হয়নি। নিয়োগের ব্যাপারে মাফিয়াগোষ্ঠী যে চক্রব্যুহ রচনা করেছিল তা ভেদ করার ক্ষমতা ওঁরও ছিল না।

স্বরূপ সিং উপাচার্য হওয়ার পরদিন আমাদের জাঠ জমাদারনি চামেলি লম্বা এক ঘোমটা টেনে কাজে এল। কী ব্যাপার প্রশ্ন করায় সে জিভ কেটে উপাচার্যর বাংলোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে জানাল, জেঠ লাগতা। অর্থাৎ উপাচার্যও জাঠ এবং সেই সুবাদে তার সম্পর্কে ভাশুর। উল্লেখযোগ্য এই যে ভদ্রলোক বরাবরই আমাদের পাশের বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু তিনি উপাচার্য হওয়ার আগে পর্যন্ত চামেলি ভ্রাতৃবধুসুলভ শালীনতা প্রকাশের কোনও প্রয়োজন অনুভব করেনি।

‘সাব-অলটার্ন’ গোষ্ঠীভুক্ত গবেষকরা বলেন, বিদেশি শাসকদের ধামাধরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রভুদের কাছে শেখা তথাকথিত যুক্তিবাদের মোহে নিষ্কলুষ প্রাক-ঔপনিবেশিক চেতনা হারিয়ে ফেলে। চামেলি মারফত সেই প্রাক-ঔপনিবেশিক চেতনার রূপরেখা এবং ঘৃণ্য যুক্তিবাদের তুলনায় তার অবিসংবাদিত শ্ৰেষ্ঠতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত হই। সে চেতনা ঔপনিবেশিক যুগের দাসভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির তথাকথিত যুক্তিবাদের তুলনায় কত উন্নত তা বুঝে শ্রদ্ধায় নতমস্তক হই। আমাদের এক সহকর্মীর পত্নী পরিবার পরিকল্পনার কাজে সাহায্য করতেন। চামেলি যখন তার দশম সন্তানকে গর্ভে ধারণ করল, তিনি শঙ্কিত হয়ে ওকে ডেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কিছু উপদেশ দিলেন। চামেলি পদদলিতা সর্পিণীর মতো ফুসতে ফুসতে আমাদের বাড়ি এসে তীব্র ভাষায় তার বিষোদর করল।

সংক্ষেপে ওর বক্তব্য এইরকম৷ ওই চুড়াইল অর্থাৎ ডাইনি সত্যিকার পুরুষ মানুষের সাক্ষাৎ কখনও পায়নি। তার অপদার্থ স্বামী দুটির বেশি সন্তান প্রজননে অক্ষম। তাই ঈর্ষাতুরা ডাইনি স্বামীসৌভাগ্যবতী এবং বহু সন্তানগর্বে গর্বিতা চামেলিকে নজর লাগিয়ে অনিষ্ট করার তালে আছে। ও বাড়ি ফিরেই এর প্রতিকার করবে। জবরদস্ত ওঝা ডেকে চুড়াইলের বিষ ঝাড়বে। তিন দিনের মধ্যে চুড়াইল রক্তবমি করে মারা যাবে। ভদ্রমহিলা ওঝার অপরিসীম ক্ষমতা সত্বেও বেঁচেই ছিলেন। এবং চামেলির সন্তান সংখ্যাও ক্রমবর্ধমানই থাকে।

ইতিহাস বিভাগের প্রধান হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভ্য হই। সেখানকার কিছু কিছু ক্রিয়াকলাপ সত্যিই বিস্ময়কর। কয়েকজন কলেজ শিক্ষক প্রতিষ্ঠানটিকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কুস্তি লড়ার আখড়া মনে করতেন বলে মনে হয়। তারা নানা বিষয়ে তাদের মতামত তারস্বরে ঘোষণা করতেন এবং সভাপতি বারবার অনুরোধ করলেও আসনে বসে পড়তে রাজি হতেন না। তখন সভাপতিও তারস্বরে ‘সিট ডাউন’ ‘সিট ডাউন’ বলে চিৎকার করতে থাকতেন। এই প্রতিযোগিতায় রেফারি না থাকায় কারও সুস্পষ্ট জয়ের সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিরোধিতার বিষদন্ত উৎপাটনের এক অভিনব উপায় আবিষ্কার করলেন। যারা সবচেয়ে বেশি গোলমাল করত, তারা সম্পূর্ণ উন্মাদ না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও আনকোরা প্রশাসনিক পদে তাদের বসিয়ে দেওয়া শুরু হল। নীতিটা সুচিন্তিত বলে আমার মনে হয়নি। কারণ নতুন নীতির আওতায় বিরোধ-ভক্তির বান ডাকল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত আয়ের বেশ একটা দশাসই অংশ এই অভিনব উপায়ে অপদেবতা শান্তির জন্য ব্যয় হতে লাগল।

ইতিহাস বিভাগের যে আবহাওয়া এখন অবধি বর্ণনা করেছি তাকে কোনও অর্থেই স্বাস্থ্যকর বলা চলে না। কিন্তু তাতে সম্পূর্ণ অবিচলিত থেকে কয়েকটি মানুষ সযত্নে এবং সানন্দে কাজ করে যান। অনেক বছরের ব্যবধানে তাদের প্রতি এই লেখার মাধ্যমে আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এই বিদ্যাচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের কেন্দ্রে ছিলেন পার্থসারথি গুপ্ত এবং তার স্ত্রী নারায়ণী। পার্থ আত্মপ্রচারের বিদ্যা রপ্ত করেননি। আমাদের প্রচারপ্রিয় এলিট সংস্কৃতিতে তার যে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল তা তিনি পাননি। কিন্তু কোনও ব্যর্থতাই তাকে দেবী সরস্বতীর অঞ্চলাশয় থেকে উদ্বাস্তু করতে পারেনি। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও তিনি তার বিদ্যাচর্চায় কখনও ত্রুটি করেননি। শেষ জীবনে ওঁর অতি সযত্নে সম্পাদিত স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বিষয়ক দু’খণ্ড আকরগ্রন্থ গৈরিক বাহিনী চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। মনে হয় তার প্রধান কারণ ওই দলিল সংগ্রহে বিদেশি সরকারের সঙ্গে আর.এস.এস-এর দহরম-মহরম বিষয়ে প্রচুর তথ্য ছিল। রাজা বদল হওয়ায় এই অপচেষ্টা সফল হয়নি। পার্থ এবং নারায়ণী বহু বাধা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইতিহাস বিষয়ক যাবতীয় নতুন বই এবং পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করতেন এবং তা একাধিক ভাষায়। পার্থ জার্মান আর ফরাসি ভাষা ভালভাবে শিখেছিলেন। মার্কসবাদী হিসাবে জীবন শুরু করেও পরিণত বয়সে তিনি মার্কসবাদে বিশ্বাস হারান। পড়া এবং পড়ানোয় এত আনন্দ পেতে আমাদের প্রজন্মের কোনও মানুষকে আমি দেখিনি। কোনও ব্যর্থতাই তাকে নিরুৎসাহ করতে পারত না। আর ওই দম্পতিটির দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা স্থায়ী অবদান ছিল। ওঁরা কিছু ছাত্রছাত্রী বেছে নিয়ে তাদের বিশেষ করে পড়াতেন যাতে তারা বিষয়ের গভীরে ঢুকতে পারে। এঁরা পরবর্তীকালে দিল্লির নানা কলেজে শিক্ষকতা করে ইতিহাস শিক্ষার মান সত্যিতেই উঁচুতে তুলেছিলেন।

আমি যে বছর অক্সফোর্ড চলে যাই, সেই বছর দেশে ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে সরকার কিছু নতুন নীতি অবলম্বন করেন। ডক্টর ভি. কে. আর. ভি. রাও যখন শিক্ষামন্ত্রী তখন তিনি একটি মূল্যবান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ডক্টর আর. সি. মজুমদার-সম্পাদিত বারো খণ্ডে প্রকাশিত ভারতীয় ইতিহাস দেশের চোদ্দোটি ভাষায় অনুবাদের জন্য উনি তিন কোটি টাকা মঞ্জুর করেন। এই বহু খণ্ডে প্রকাশিত ইতিহাস কোনও দিক থেকেই দোষমুক্ত ছিল না। আদর্শের দিক থেকে রমেশবাবু মুসলমানবিদ্বেষী, দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। ওঁর সম্পাদিত বইটিতে আর একটি প্রবণতা ছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা এবং বাঙালির প্রতি সর্বভারতীয় নেতৃত্বের নানা অন্যায় নিয়ে আলোচনা। সম্ভবত এইসব কথা ভেবেই নতুন প্রগতিপন্থী শিক্ষামন্ত্রী ওই গ্রন্থাবলী অনুবাদের সিদ্ধান্ত এক রকম বাতিল করে সেই টাকা নিয়ে কী করা হবে সে-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি কমিটি বসান। ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত প্ৰগতিপন্থী নেতারা সবাই এই কমিটিতে ছিলেন। সম্ভবত তখনও এঁরা সবাই আমাকে শত্রুজ্ঞান করতে শুরু না করায়, এবং নতুন মন্ত্রীমশায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম বলে আমিও এই কমিটির সভ্য মনোনীত হই।

এই কমিটির সভ্য হয়ে আমার ভুয়োজ্ঞান বেড়ে তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত হল এবং মা কী হইতেছেন সে বিষয়ে দিব্যজ্ঞানে সমৃদ্ধ হলাম। প্রথম দিনের মিটিংয়ে আলোচ্য বিষয়–রমেশবাবুর সম্পাদিত বইগুলি অনুবাদ করা হবে কি না। যদিও বুঝলাম যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েই গিয়েছে, তবু আমি একটা সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করি। আমার বক্তব্য যে ওই বইগুলি নানা দোষ সত্ত্বেও এক বিরাট কীর্তি। ভারতবর্ষের ইতিহাসের মূল তথ্যগুলি এত সহজে আর কোথাও পাওয়া সম্ভব না। সুতরাং অনুবাদ প্রচেষ্টাটি সম্পূর্ণ খারিজ না করে প্রতিটি খণ্ড এবং পরিচ্ছেদের প্রথমে নবলব্ধ জ্ঞান আর নতুন বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির সংক্ষিপ্তসার জুড়ে দিয়ে প্রস্তাবিত অনুবাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া। এই রকম উলটো কথা বলায় কমিটির অন্য সভ্যরা একটু অপ্রস্তুত হলেন। বিষয়টা আলোচনার জন্য আর একটি মিটিংয়ের দিন ধার্য করা হল। মিটিংয়ের দিন খবর পেলাম—সময় এবং মিটিংয়ের জায়গা বদল হয়েছে আমাকে না জানিয়ে। আমি যথা সময়ে সেই নয়া সভাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমার আবির্ভাবে জনৈক সভ্য খিকখিক করে হাসতে শুরু করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার প্রস্তাবিত সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হল, এবং সিদ্ধান্ত হল যে ওই তিন কোটি টাকা দিয়ে ইন্ডিয়ান হিস্টরিকাল রিসার্চ কাউন্সিল স্থাপিত হবে। কাউন্সিলের প্রথম কাজ হবে বাছা বাছা কিছু বই ওই চতুর্দশ ভাষায়ই অনুবাদ করা।

তারপর যা শুরু হল তাতে আমি সত্যিই হতবাক। কোনও প্রস্তুতি বা পূর্ববর্তী আলোচনা ছাড়াই কোন কোন বই ছাপা হবে তার তালিকা প্রস্তুত করা শুরু হল। কোনও বিদ্বৎসমিতি যে এত বড় গুরুদায়িত্ব এত লঘুভাবে পালন করার চেষ্টা করতে পারেন তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। বলা বাহুল্য, টেবিলের চারপাশে যাঁরা বসে ছিলেন প্রথমে তাদের যাবতীয় লেখা অনুবাদের লিস্টে উঠল। আমিও এই লঙ্কাভাগ থেকে বাদ পড়লাম না। আমার একটি বই অনুবাদের প্রস্তাব হলে আমি আপত্তি করলাম, কারণ ওই বইটি সম্পর্কে আমার কোনও শ্রদ্ধা নেই। তারপর নেতৃবৃন্দের চেলা-চামুণ্ডাদের নিতান্তই খাজা রচনাবলি লিস্টে উঠল। মা কী হইবেন তার স্পষ্ট আঁচ পেলাম যখন আমি ধর্মা কুমারের ‘ল্যান্ড অ্যান্ড কাস্ট ইন সাদার্ন ইন্ডিয়া’ নামে বইটি তালিকাভুক্তির প্রস্তাব দিলাম। কেমব্রিজে প্রাইজ পাওয়া এই বইটি ইংরেজ শাসনের কুফল বিষয়ে আমাদের প্রচলিত কিছু ধারণার বিরোধী। বইটির সাধারণ সিদ্ধান্তগুলি আমিও নানা কারণে মানতে পারিনি। কিন্তু তা বলে বইটির একটি অসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি কোনও মতেই খারিজ করা চলে না। আমি প্রস্তাবটি করা মাত্র কিছু লোক হাঁ হাঁ করে উঠলেন, যদিও তাদের আপত্তির কারণ কেউ ব্যাখ্যা করেননি। ভারতবর্ষে ইতিহাসচর্চা কোন পথে যাবে তার স্বরূপ। উপলব্ধি করে আমি অক্সফোর্ড রওনা হই। উল্লেখযোগ্য এই যে, যত দূর জানি ওই তালিকার কোনও বই-ই চোদ্দো কেন, চার ভাষায়ও অনুদিত হয়নি। ইতিহাস কংগ্রেসে প্রস্তাবিত বহু খণ্ডে প্রকাশ্য ভারতবর্ষের ইতিহাসেরও একই হাল হয়। লাভের মধ্যে রমেশবাবুর সম্পাদিত গ্রন্থমালার অনুবাদ মারফত ইংরেজি না জানা পাঠক ভারতীয় ইতিহাস বিষয়ে জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হলেন। ওই গ্রন্থমালার দোষগুলি শুধরে পাঠকসাধারণের কাছে উপস্থিত করা কোনও মতেই অসম্ভব ছিল না।

আমার শিক্ষক কলিন ডেভিস অক্সফোর্ড থেকে অবসর নেওয়ার পর অধ্যাপক ব্যাশাম আমাকে একটি চিঠি লেখেন। ওঁর বক্তব্য যে, পদটির জন্য দরখাস্ত করলে আমার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি দরখাস্ত করেছিলাম, কিন্তু কাজটি আমি পাইনি। যার পাওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক ছিল, সেই কেনেথ বলহ্যাচেটই পদটি পান। উনি লন্ডন চলে গেলে ডক্টর গোপাল অক্সফোর্ডে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের রিডার নিযুক্ত হন। যখন কমনওয়েলথের ইতিহাসের অধ্যাপকের পদ খালি হয়, তখন গোপাল সাহেব ওই পদের জন্য দরখাস্ত করেন। পদটি পান রবিনসন। গোপাল পদত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন।

এবার যখন পদটি আবার বিজ্ঞাপিত হল, তখন অনেক ভারতীয় শিক্ষাবিদ দরখাস্ত করেন। এ যাত্রা আমি করিনি, কারণ আমার ধারণা হয়েছিল যে এই জাতীয় পদে নির্বাচকরা প্রথমেই মনস্থির করে নেন কাকে বা কী জাতীয় লোককে তাঁরা চান। কারণ ওইসব পদের জন্য যাদের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সুতরাং আগের থেকেই সফল কর্মপ্রার্থী বেছে নেওয়ার মধ্যে কোনও দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠে না। আমার যে ধরনের কাজ তা তাদের পছন্দ হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুতরাং শুধু শুধু দরখাস্ত করে লাভ নেই। বিশেষত তখন আমি দিল্লিতে সিনিয়র অধ্যাপক। এই সময় কেমব্রিজের অধ্যাপক প্রয়াত এরিক স্টোকস দিল্লি এসেছিলেন। সবাই জানত যে উনি এই পদটির জন্য যে নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করা হয়েছে তার অন্যতম সভ্য। চাকরিটির জন্য উমেদার কারও বাড়িতে ওঁর নেমন্তন্ন হলেই তা নিয়ে খুব একটা হাসাহাসি হত। এরিকের সঙ্গে এর আগে আমার পরিচয় হয়নি। ওঁকে একটা সেমিনার দিতে ডাকি। তখনই আমার সঙ্গে পরিচয় হয়।

এরিক স্টোকস ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে আমাকে এক চিঠি লেখেন। তাঁর বক্তব্য ওই রিডারশিপের ব্যাপারে আমার আগ্রহ থাকলে উনি আমার নাম প্রস্তাব করতে চান। আমি পত্রপাঠ উত্তর দিই—হ্যাঁ, ওই কাজ পেলে আমি নিশ্চয়ই নেব। তবে কয়েকটি শর্ত আছে। তার মধ্যে প্রধান কথা নিশ্চিত না হয়ে উনি যেন আমার নাম প্রস্তাব না করেন। কারণ আমি আমার বয়সে এবং দেশে যে পদে আছি তার গুরুত্ব চিন্তা করে অসফল উমেদারের পরিচয় গ্রহণ করতে গররাজি। মাস চারেক পরে হঠাৎ চিঠি পেলাম—আমি মনোনীত হয়েছি এবং বেতন ইত্যাদির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় আমার প্রস্তাবিত শর্তগুলি মেনে নিয়েছেন। আর আমি রিডারশিপ ছাড়া সেন্ট এন্টনিস কলেজের প্রফেসরিয়াল ফেলো নির্বাচিত হয়েছি। আমি চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য কিছু সময় চাইলাম। ১৯৭৩ সনের ২০ জানুয়ারি আমি দিল্লির পাট গুটিয়ে অক্সফোর্ড রওনা হলাম। কয়েকটি মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ভারি সুন্দর বাড়িটা, সেখানে আমাদের তৈরি সুন্দর বাগান (যেখানে আমরা ষাট রকমের গোলাপের গাছ পুঁতেছিলাম) আর অল্প কয়েকটি বন্ধুকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওই শহরের অস্বাভাবিক সামাজিক আবহাওয়ায় আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। প্লেনে উঠে আমি এক গভীর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলোম।

এই পরিচ্ছেদের একটি সংক্ষিপ্ত এপিলগ লেখা প্রয়োজন। আমার নিয়োগপত্র যখন আমার হাতে পৌঁছয় সেই সময় আমার এক তথাকথিত বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। খবরটি ওঁকে পড়ে শোনালাম। মানুষটির মুখ দৃশ্যতই কালো হয়ে গেল। তারপর তিনি উক্তি করলেন, আপনি চলেই যান। আপনার তো কোনও রুটস নেই। কেন আমি শিকড়বিহীন হলাম এবং এই ব্যক্তি কীভাবে দেশের মাটিতে শিকড় গজালেন, সে কথা আজও আমার কাছে রহস্য রয়ে গেছে। নতুন ক্ষমতাচক্রের এই জ্যোতিষ্কটি অক্সফোর্ডের চাকরিটির জন্য উমেদার ছিলেন–একথা পরে জানতে পারি। পেলে কি তিনি শিকড়ের টানে দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতেন?

যারা আমার বিরুদ্ধে পত্রাঘাতযুদ্ধ চালাচ্ছিলেন তাঁরা শিকার হাতছাড়া হচ্ছে দেখে নতুন ধুয়া তুললেন। দেশের একজন সিনিয়র অধ্যাপক বিদেশে রিডার হয়ে চলে যাচ্ছে এতে দেশের ঘোর অপমান হচ্ছে। ওঁদের দলস্থ নেতা যখন অনুরূপ পাপকর্ম করেন তখন এরাই কিন্তু উদ্বাহু হয়ে নেচেছিলেন। যাঁরা কথাটা জানেন না তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই সারা পৃথিবী থেকে বহু শিক্ষাবিদ উচ্চতর পদ ছেড়ে অক্সফোর্ডে কাজ করতে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির খ্যাতি তার একমাত্র কারণ নয়। ওখানকার জীবনধারার কতগুলি বৈশিষ্ট্য আছে যা যে কোনও শিক্ষাব্রতীর কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। এবং পৃথিবীর অন্য কোথাও তার তুলনীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়া দুষ্কর। জীবনে যদি কখনও কোনও সুবুদ্ধির কাজ করে থাকি তো তার প্রথম সারিতে দিল্লি ছেড়ে অক্সফোর্ড যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু ওই যে গোষ্ঠীবিশেষ ধরে নিলেন যে পঁচিশ বছর দেশে পড়াবার পর অক্সফোর্ড চলে গিয়ে আমি মহাপাপ করেছি সেই ধুয়া তারা ছাড়লেন না। এ দেশে যে-কোনও প্রসঙ্গে আমার নাম প্রস্তাবিত হলেই এঁরা বলেন, উনি তো চলে গেছেন। এই নারা যারা জিকির দেন তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় হচ্ছেন সেই ব্যক্তিটি যিনি আমার শিকড়হীনতার কারণে আমাকে বিদেশ চলে যেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। এই মানুষগুলি তাদের স্বভাবসিদ্ধ ব্যবহার করবেন তাতে কিঞ্চিৎ বিরক্তি লাগলেও সত্যিতে ক্ষোভের কোনও কারণ নেই। সাপ ছোবল দেবে, খাটাস দুর্গন্ধ ছড়াবে, দুর্জন দুর্জনোচিত ব্যবহার করবে—এসব নিয়ে মনস্তাপ করা নেহাতই মুখামি। আমার শুধু দুঃখ একটি কারণে। ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে-মানুষটিকে সবচেয়ে শ্রদ্ধা করি এখন শুনি তিনিও এই দুষ্টচক্রে যোগ দিয়েছেন। বিদ্যায় চরিত্রগুণে তার সঙ্গে তুলনীয় মানুষ আমি বেশি দেখিনি। তবে আশৈশব শুনছি–দশচক্রে ভগবান ভূত হয়। তিনি যদি সত্যিই এই মানুষগুলির সঙ্গে পড়ে এদের নানা নোংরা কাজে শামিল হয়ে থাকেন তো দুর্ভাগ্য শুধু আমার না, সমস্ত দেশের। ওঁর বিষয়ে অভিযোগগুলি সত্যি হলে জানব আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমিতে সৎ লোক বেশি দিন সৎ থাকতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *