১৮. শিব ঠাকুরের আপন দেশে

শিব ঠাকুরের আপন দেশে

পুরনো দিল্লি স্টেশন থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে আমাদের তিন পুরুষের পারিবারিক বন্ধু ডক্টর সুকুমার দত্তর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। উনি তখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কিছুদিন গণতান্ত্রিক চিনের দূতাবাসে কাজ করে সম্পূর্ণ অবসর নিয়েছেন। ওঁর স্ত্রী সাবিত্রী দত্ত বিদেশি সব দূতাবাসে ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। জ্যাঠামশায় শৈশব অবধি বই পড়েই কাটিয়েছেন। ওঁর জ্ঞানচর্চায় যাতে কোনও বাধা না ঘটে, দেখলাম জেঠিমার প্রধান চিন্তা তাই নিয়ে। সংসারের হাল তিনি শক্ত হাতে ধরে আছেন। কোথাও কোনও অসচ্ছলতা বা অস্বাচ্ছন্দ্যর চিহ্ন নেই। যখন কলকাতায় পড়াচ্ছিলাম তখন বার দুই রোডস স্কলারশিপের ইন্টারভিউ দিতে দিল্লি গিয়ে ওঁদের বাড়িতে উঠেছি। শিক্ষা সংস্কৃতি কৃষ্টি জীবনচর্যা—সব দিক থেকেই ওঁরা অন্য পাঁচটা বাঙালি পরিবার থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র ছিলেন। ফলে মাঝে মাঝেই নানা জায়গায় ওঁদের সম্পর্কে কিছু কাটা কাটা মন্তব্য শুনতাম। যে-পারস্পরিক ঈর্ষা বাঙালি জীবনের অন্ধকার দিকটির কেন্দ্রস্থলে, মার্জিত রুচিবান এই পরিবারটি তার শিকার হওয়ায় বিস্ময়ের কিছু ছিল না। জীবনে কয়েকটি অসাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। জেঠিমা অর্থাৎ সাবিত্রী দত্ত সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের অন্যতম। ওঁর মধ্যে যে বিপুল সম্ভাবনা ছিল বাস্তব জীবনে তা ফলবতী হয়নি। কিন্তু সংসার চালানোর সঙ্গে সঙ্গে নানা জনসেবার কাজের ভিতর দিয়ে উনি তৃপ্তির সন্ধান পেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি কঠিন কাজ ছিল দেশবিভাগের সময় দুই দেশের বহু অপহৃতা নারীকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা। এই কাজে উনি কয়েকবার পাকিস্তান যান। এই প্রসঙ্গে ওঁর কাছে যেসব মর্মন্তুদ কাহিনি শুনেছি, দেশবিভাগ বিষয়ে রচিত কোনও গল্প উপন্যাস বা সিনেমায় তার তুলনীয় কিছু আমার নজরে আসেনি।

দত্তভবনে কয়েকদিন থেকে আমার জন্য নির্ধারিত সরকারি বাসস্থান কনস্টিটিউশন হাউসের ৯৩ নম্বর ঘরে গিয়ে উঠলাম। এই বিচিত্র শাল্মলী তরুর কথা লোকে এখন ভুলে গিয়েছে। যুদ্ধের সময় সৈন্যদের অস্থায়ী বাসস্থান হিসাবে অনেকটা জায়গা জুড়ে এই ব্যারাক গোছের একতলা বাড়িটি তৈরি হয়েছিল। যুদ্ধের পর যখন স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র তৈরি করার জন্য কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হল, তখন এই ফৌজি ব্যারাক ভেঙে না ফেলে সাংসদদের বাসস্থানের কাজে লাগানো হল। পরে লোকসভার কিছু সভ্য এবং সরকারি কর্মচারীদের সাময়িকভাবে ওইখানে থাকার ব্যবস্থা হয়। তারও পরে ব্যারাকটি ভেঙে পাকা বাড়ি উঠেছে। কনস্টিটিউশন হাউসের আধুনিক ভারতের ইতিহাসে একটা বিশেষ জায়গা আছে। ইতিহাস-সচেতন কোনও দেশে যদি এরকম একটি বাসভবন থাকত তা হলে বাড়িটি ভেঙে ফেলার প্রয়োজন হলেও জায়গাটির ঐতিহাসিক মূল্য মনে রেখে একটি স্মৃতিফলক ওখানে রাখা হত। আমাদের এক দিকে ঘুষ-গুন্ডামি অন্য দিকে মোক্ষমুখিন সংস্কৃতিতে এইসব তুচ্ছ জাগতিক ব্যাপারের দিকে নজর কিছু কম। মাত্র দশ বছর আগে স্বাধীন হওয়া দেশের মেজ সিঁড়ির নেতৃবৃন্দ এবং কর্মচারীদের বাসস্থান এই ব্যারাক ভবনে বাস করে প্রচুর শিক্ষা এবং আনন্দ পেয়েছিলাম। সে কথায় পরে আসছি।

কনস্টিটিউশন হাউসে উঠে আসার আগেই কর্মস্থল ন্যাশনাল আর্কাইভসের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় সেরে নিয়েছি। জনপথের উপর ব্রিটিশ আমলের এই বিরাট দফতর-ভবন সত্যিই সুদৃশ্য। আমার জন্য নির্দিষ্ট অফিস ঘরটি দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। আকাইভসের ডিরেক্টরের পদ তখন খালি। সুতরাং এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আনাড়ি আমি ডিরেক্টরের পদে অ্যাকটিনি করতে নিযুক্ত। সেই সুবাদে ডিরেক্টরের জন্য নির্দিষ্ট অফিসটিই আমার অস্থায়ী অফিস—যতদিন না আসল ডিরেক্টরের আবির্ভাব ঘটে। ইংরেজদের তৈরি সেই মেজকর্তার অফিসে টেনিস না হোক ব্যাডমিন্টন খেলতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা না। এর আগে ইংরেজ আমলে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন আর্কাইভসের ডিরেক্টরের পদ কিছুদিন অলঙ্কৃত করায় পদটি বাঙালিদের এবং সাধারণভাবে ঐতিহাসিকদের চোখে বিশেষ সম্মানিত। লোকের ভুল ধারণা হয়েছিল যে, আমি সুরেনবাবুর পদটিই পেয়েছি। ফলে সব অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করে। কলকাতার উচ্চকোটির স্নবমণ্ডলীও আমাকে যোগ্য পাত্র বিবেচনা করতে শুরু করেন। সেই ‘পুতুল নিয়ে খেলা’র দু-একটি কাহিনি সামাজিক দলিল হিসাবে যথাস্থানে নিবেদন করব। আপাতত দফতর কাহিনিতে ফিরে যাই।

আর্কাইভসে কাজ করতে গিয়ে একটা কথা বারে বারেই মনে হয়েছে। আমাদের শাসনযন্ত্রের যেসব অভাবনীয় কার্যকলাপ দেখেছি, তাতে দেশে সব সরকারি কাজকর্ম কী করে মোটামুটি ঠিকভাবেই চলছে সে কথা আমার কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ঠেকেছে। মানে অন্তত তখন পর্যন্ত ট্রেন, পোস্ট অফিস এসব তো ঠিকভাবেই চলছিল। এখনও নেংচিয়ে নেংচিয়ে হলেও মোটামুটি ঠিকভাবেই চলে। আমি দেড় বছর সরকারি চাকরি করতে গিয়ে যেসব ব্যাপার প্রত্যক্ষ করেছি তাতে ভগবদকৃপা ছাড়া এই ‘মোটামুটি চলা’র ঘটনাটা ব্যাখ্যা করা চলে না। যেহেতু ওই কৃপায় আমার বিশ্বাস নেই, তাই ওই রহস্য আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে।

একটা উদাহরণ দিই। যখন কাজে যোগ দিই তখন আমাদের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দ্বিতীয় বছর প্রায় শেষ হতে চলেছে। পরিকল্পনা শুরু হওয়ার আগেই প্রতিটি সরকারি দফতর বা ডিপার্টমেন্টকেই তাদের উন্নয়নমূলক প্রস্তাব পেশ করতে বলা হয়। জাতীয় অভিলেখাগারও যথারীতি এবং যথাসময়ে তাদের উন্নয়ন প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। এই সাধু উদ্যোগ এবং সময়ানুবর্তিতার পেছনে একটি স্বার্থঘটিত কারণ ছিল। নানাবিধ আমলাতন্ত্রের অন্তর্নিহিত রহস্য নিয়ে বঙ্গব্যঙ্গ করে ‘পিটার প্রিন্সিপল’ বলে একটি বই আছে। তার অন্যতম বক্তব্য—সর্ব শ্রেণির আমলারই অন্যতর চেষ্টা মইয়ের যে-সিঁড়িতে সে-পঁড়িয়ে, সেই সিঁড়িতে কাজের চাপ খুব বেশি, এই অজুহাতে পদের সংখ্যা বাড়ানো। উদ্দেশ্য পরোপকার না, আত্নোন্নতি। একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের জায়গায় যদি চারজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর নিযুক্ত হয়, তবে তাদের পরিদর্শন করার জন্য একজন ডেপুটি ডিরেক্টরের জায়গায় অন্তত দুই জন ডেপুটি ডিরেক্টরের পদ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা এবং তা ঘটলে যে ব্যক্তি প্রথমে পদসংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁর পদোন্নতির সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়। ‘পিটার প্রিন্সিপল’-এর সত্যতা আকাইভসের উন্নয়ন প্রস্তাবে স্পষ্টই প্রতিভাত ছিল। কর্ম অনুযায়ী ওই দফতরে চারটি বিভাগ ছিল। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য ওই দফতর থেকে যেসব প্রস্তাব যায় তার মূল বক্তব্য ছিল এই যে কাজের চাপে কর্মীদের আহার-নিদ্রা ত্যাগ করতে হয়েছে। সুতরাং অবিলম্বে প্রতি বিভাগেই পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানটিকে সহস্রপদী কীটে পরিণত করা অত্যাবশ্যক। না হলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

যেদিন কাজে যোগ দিই, সেই দিন আমার টেবিলে ‘অত্যন্ত জরুরি’ মার্কা দেওয়া দুটি ফাঁইল ছিল। তার প্রথমটি শিক্ষামন্ত্রক থেকে ফেরত আসা আমাদের দফতরের উন্নয়ন। প্রস্তাব। এই প্রস্তাবটি প্রায় দেড় বছর আগে পাঠানো হয়েছিল। এখন মহামান্য শিক্ষামন্ত্রক জানাচ্ছেন যে জাতীয় স্বার্থে (অল্পদিন সরকারি চাকরি করে বুঝেছি যে জাতীয় স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনও কারণে সরকারি চাকুরেরা কখনও কিছু করেন না। স্বজনপোষণ, উৎকোচগ্রহণ সবই ওই একই মহৎ উদ্দেশ্যে)। প্রস্তাবটা শতকরা বিশ ভাগ ছাটাই করতে হবে এবং ঘাটাইকৃত প্রস্তাব যেন এক সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রকে ফেরত পাঠানো হয়। এ বিষয়ে কী কর্তব্য শৌরীনবাবুকে জিগ্যেস করলাম। তিনি পরামর্শ দিলেন–আমলাতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী মূল প্রস্তাব যাঁরা খসড়া করেছিলেন, সেই অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরদের কাছে কুড়ি শতাংশ ছাটাইয়ের কথা জানিয়ে নতুন প্রস্তাব তিন দিনের মধ্যে ফেরত চাওয়া। তিন না, দু’ দিনের মধ্যে এই নোটের উত্তর পেলাম। মন্ত্রক-প্রস্তাবিত ছাঁটাই কার্যকরী হলে দেশের কী সর্বনাশ হবে সবাই সে কথা ওজস্বনী ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। আমি আরও এক মাত্রা চড়িয়ে নোট দিলাম যেন দেশের এই সমুহ সর্বনাশ থেকে বাঁচবার কথা ভেবে মন্ত্রক কোনও রকম ছাঁটাই না করেন। প্রায় দেড় বছর পরে আর্কাইভস যেদিন ছেড়ে যাই সেই দিন এই নোটের উত্তর আসে। শিক্ষামন্ত্রক আমাদের সুযুক্তি মেনে নিয়ে ছাঁটাই প্রস্তাব বাতিল করেছেন। ব্যাপারটায় সামান্য একটু অসুবিধে ছিল। দ্বিতীয় পরিকল্পনার তখন আর দু বছর বাকি। প্রস্তাবগুলির অধিকাংশই ছিল নতুন পদ সৃষ্টি করার। নতুন পদ সৃষ্টি এবং তোক নিয়োগ করতে অন্তত ছ’ মাস লাগে। এবং অনেক সময়েই এক বছরের কমে কাজটা সম্পূর্ণ হয় না। সুতরাং চরম উদ্যোগ নিয়ে কাজ করলেও পরিকল্পনার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের প্রস্তাবের কুড়ি শতাংশের বেশি পরিপূরণ করা সম্ভব না। অথচ সরকার উদারহস্তে আমাদের মূল প্রস্তাবের শতকরা একশো ভাগই মঞ্জুর করেছেন।

দ্বিতীয় যে-ফাইলটি সম্পর্কে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার হুকুম ছিল তার বিষয়বস্তু শৌরীনবাবুর ব্যক্তিগত জীবন-যা নাকি নিতান্তই কলুষিত। এ বিষয় অবিলম্বে অনুসন্ধান করে এবং কিংকর্তব্য সে সম্বন্ধে আমার মতামত জানিয়ে আমি যেন অনতিবিলম্বে শিক্ষামন্ত্রককে অবহিত করি। সাত দিন ফাঁইলটি ধরে রাখার পর মন্ত্রক থেকে শালা সাহেবের সই সংবলিত চিঠি পাই। বক্তব্য–ব্যাপারটা সরকারের চোখে অত্যন্ত জরুরি (মানে দামাদ সাহেবের পদোন্নতির জন্য শৌরীনবাবুকে অবিলম্বে বরখাস্ত করা প্রয়োজন)। সুতরাং আমি যেন পত্রপাঠ আমার মতামত জানাই। উত্তরে আমি লিখি কারও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা আমার নেই। এ বিষয়ে কী করতে হবে তা জানালে আমি অবশ্যই আদেশ পালন করব। এর কোনও উত্তর আমি পাইনি। নতুন ডিরেক্টর নিযুক্ত হওয়ার পর, তিনি নাকি সৌরীনবাবুকে বরখাস্ত করার পরামর্শ দেন। শুনেছি ব্যাপারটা নেহরুর টেবিল পর্যন্ত গড়িয়েছিল। উদারনীতিতে বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী জনস্বার্থের কোনও হানি না হলে দুশ্চরিত্রতার অভিযোগে কারও চাকরি খাওয়ার বিপক্ষে মত দেন। ফলে দামাদ সাহেবের কর্মোন্নতিটা আটকে যায়। শৌরীনবাবুও যথা সময়ে সসম্মানে অবসর গ্রহণ করেন।

আমলাতন্ত্রের অবিশ্বাস্য কর্মপটুতার আর একটি উদাহরণ দিই। নতুন কাজের প্রথম সপ্তাহেই আরও এক বিচিত্র ব্যাপারের মোকাবিলা করতে হয়। অভিলেখাগারের লাইব্রেরিয়ানের বিরুদ্ধে একটি বেনামি চিঠি আসে। পরের ক’বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি বেনামি চিঠি স্থানীয় সংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। এ কথা বলে রাজনৈতিক অশুদ্ধতার অপরাধে অপরাধী হলাম, সন্দেহ নেই। সে কথা যাক। উক্ত চিঠিটির মূল বক্তব্য লাইব্রেরিয়ানের এলটিটি ডিপ্লোমাটি গ্রন্থাগার-ঘটিত কোনও ব্যাপার নয়, প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর যোগ্যতার সার্টিফিকেট। সরকারি চাকরির নিয়ম—এরকম চিঠি এলে তা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে না দিয়ে সযত্নে তার সত্যতা বিষয়ে অনুসন্ধান করা। এটা নাকি ‘জাতীয় স্বার্থে’ নিতান্তই আবশ্যিক। প্রতি সপ্তাহেই জাতীয় স্বার্থে এই রকম তিন-চারটি চিঠির মোকাবিলা করতে হত। ফলে জাতীয় স্বার্থে আমার পালনীয় অন্যান্য যেসব কর্তব্য সেগুলি কিছুটা ব্যাহত হত সন্দেহ নেই। যা হোক, লাইব্রেরিয়ান সাহেবের সার্টিফিকেটটি আনিয়ে দেখলাম, অভিযোগ সত্যি। এক্ষেত্রে কী কর্তব্য জানতে চেয়ে ‘জেসি’কে ‘ডিও’ লিখলাম। [বি. দ্র. : এই বিচিত্র ভাষার ব্যাখ্যা একটু পরেই পাবেন।] কদিন পরে উত্তর এল-ভদ্রলোক দশ বছরের উপর ওই চাকরিতে বহাল আছেন। এখন কিছু করতে গেলে উনিই উল্টে মামলা করতে পারেন। এক্ষেত্রে তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বনই বিধেয়। অন্ধ্রপ্রদেশজ এই গ্রন্থাগারিক কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন। পেশায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হলেও উনি গ্রন্থাগারের ভার পেয়ে লাইব্রেরিয়ানশিপ সংক্রান্ত অনেক পুস্তক পড়ে ফেলেছিলেন। ফলে মাঝে মাঝেই আমাকে মরাল অ্যান্ড মেটিরিয়াল ডিফেন্স অফ বুকস বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেনী বারে বারেই সাবধান করতেন—যেন এই দুই স্বতন্ত্র কর্তব্য আমি কখনও না গুলিয়ে ফেলি। ওঁর উন্নয়ন প্রস্তাবে দুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ানের পদ সৃষ্টি করার অনুরোধ ছিল। একটি মরাল, অন্যটি মেটিরিয়াল ডিফেন্স অফ বুকসের জন্য। এই দুই পরস্পরবিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রে পুস্তক রক্ষার লড়াইয়ে উনি জীবনদান করেছিলেন। মরাল ডিফেন্স অর্থ বইয়ের যথাযথ শ্রেণিবিভাগ ইত্যাদি আর মেটিরিয়াল ডিফেন্স মানে বইয়ের শরীরটি যথাসম্ভব বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু রণক্লান্ত যোদ্ধা কখনও কোনও বই চেয়ে পাঠালে তা উপস্থিত করতে পেরেছেন এমন কোনও ঘটনা আমার স্মৃতিতে নেই।

.

আগেই লিখেছি—জীবনে যে ক’জন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে শৌরীনবাবু তাদের অন্যতম। তিরিশের দশকে বহু প্রতিভাবান বাঙালি হিন্দু প্রথমে দীর্ঘদিন বেকারত্ব এবং পরে সামান্য মাইনেয় কেরানিগিরি জাতীয় চাকরি (খুব ভাগ্যবান হলে সাব ডেপুটিগিরি) করার অভিজ্ঞতা নিয়ে জীবনযাপন করেছেন। শৌরীনবাবু এই ভাগ্যহতদের একজন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ এবং এম.এ পাস করার পর উনি অক্সফোর্ডের এক্সেটার কলেজে পড়ার জন্য প্রস্তুত। হচ্ছিলেন। আকস্মিক পারিবারিক বিপর্যয়ের ফলে ওঁকে সেইসব উচ্চাশা ছেড়ে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়াতে হয়। অনেক চেষ্টায় এবং সুরেন্দ্রনাথ সেনের অনুগ্রহে অভিলেখাগারে (তখন তার জমকালো নাম ইম্পিরিয়াল রেকর্ডস) একটি কেরানিগিরি জোটে। সৌভাগ্যক্রমে চাকরিটি সাধারণ বিভাগ থেকে টেকনিকাল বিভাগে স্থানান্তরিত হয় এবং বিশ-পঁচিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে উনি পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ অভিলেখ-বিশারদ বলে স্বীকৃতি পান। চাকরিক্ষেত্রে ক্রমে উন্নতি হয়ে উনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হন। নতুন সৃষ্ট ডেপুটি ডিরেক্টরের পদ এবং কালে ডিরেক্টরের পদের জন্য ওঁর চেয়ে যোগ্য লোক কেউ ছিল না। কিন্তু পূর্বোক্ত শালা-দামাদ কাহিনি সেই সম্ভাবনা ভেস্তে দেয়। সবাই আমাকে ভয় দেখিয়েছিল, ওখানে যাচ্ছ, সাবধান থেকো। শৌরীন রায় অতি সাংঘাতিক লোক। তোমার সর্বনাশ করে ছাড়বে। কার্যত এই সাংঘাতিক লোকটি আমাকে আন্তরিক সৌহার্দ্যের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন এবং হাতে ধরে আর্কাইভসের কাজ আমাকে শিখিয়েছিলেন। জীবনের নানা ক্ষেত্রে কয়েকটি যোগ্য শিক্ষকের সন্ধান পেয়েছি—এ আমার পরম সৌভাগ্য। শৌরীনবাবু তাঁদের অন্যতম। নানা চতুর্থ শ্রেণির মানুষের অধীনে কাজ করেও উনি আশ্চর্যজনকভাবে নিজের আত্মসম্মান এবং চরিত্রমাহাত্ম একটুও ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। যন্ত্রণাদায়ক দারিদ্র্য আর অসম্মানের মধ্যে বাস করেও ওঁর জ্ঞানচর্চা কখনও বন্ধ হয়নি। ইতিহাস আর ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত এবং ফরাসি সাহিত্যে ওঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। মাতৃভাষার মতো সংস্কৃত বলতে পারতেন। সরকারি আমলারা ওঁকে যে চোখেই দেখুক, দিল্লির পণ্ডিতমহলে ওঁর বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। ওঁর বসবার ঘরে দেশি-বিদেশি বহু পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে।

চাকরিতে যথেষ্ট উন্নতি না হওয়ার একটি কারণ ওঁর স্পষ্টবাদিতা এবং মুজনোচিত আদেশ অগ্রাহ্য করার প্রবণতা। সরকারি বা যে-কোনও চাকরি করতে গেলেই দ্বিতীয় প্রবণতাটিকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। বড় জোর দু-একবার বিনীতভাবে নিজের আপত্তি জানিয়ে শেষ অবধি কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করতে হয়। শৌরীনবাবু এই নিয়ম মানতে রাজি ছিলেন না। দিল্লির সেক্রেটারিয়েট, বিশেষত শিক্ষামন্ত্রক, বহু এবং বিচিত্র সব মূর্থের আবাসস্থল ছিল। কিন্তু তাদের আদেশ অমান্য করলে শাসনযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। (আদেশ মানা সত্ত্বেও শাসনযন্ত্র কীভাবে চলছিল তাও অবশ্য এক চিরন্তন বিস্ময়ের ব্যাপার) সুতরাং অবাধ্যতার শাস্তি দিয়ে সরকার ভদ্রলোকের প্রতি অবিচার করেছিল এমন কথা বলতে পারব না। ওঁর আর একটি দোষ ছিল ক্ষমতাশালী লোকদের কারণে-অকারণে খোঁচানো। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে অবধি গ্রীষ্মকালে সাহেবদের লেজ ধরে কিছু বড়-মেজ দেশি কর্তারা সিমলা পাহাড়ে উঠে যেতেন। এই ওঠা এবং গ্রীষ্মশেষে আবার সমতলভূমিতে নেমে আসা সরকারি মহলে বিশেষ শ্লাঘার ব্যাপার ছিল। বড়-মেজ আমলাদের বাড়িতে গ্রীষ্মের প্রারম্ভে ‘কবে উঠছেন’ এবং গ্রীষ্মশেষে ‘কবে নামছেন’ চলতি বাক্যালাপের অনিবার্য অঙ্গ ছিল। এই জাতীয় বাক্যালাপের সময় শৌরীনবাবু উপস্থিত থাকলে নিষ্পাপ শিশুর মতো অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলে, ‘কোন গাছে’ বা ‘কোন গাছ থেকে’। ওঁর এই জ্ঞানপিপাসা ওঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছিল—এমন কথা বলা চলে না।

শৌরীনবাবুর কাছ থেকে আমলাজীবনের সত্যি বা কল্পিত নানা কাহিনি শুনতাম। পাঠিকা-পাঠকদের মনোরঞ্জনের জন্য তার দু-একটি নিবেদন করছি। বিদেশি শাসনের যুগে ক্ষমতার দিক থেকে প্রায় সব দেশি আমলাই নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ। তাই তাঁদের বিশ্রম্ভালাপের অন্যতর প্রধান উপজীব্য ছিল কোথায় কবে তাঁরা অসামান্য সাহস দেখিয়ে সাহেবকে নোট পাঠিয়েছিলেন এবং তার ফলে হতভাগ্য সাহেব কীভাবে কুকড়ে গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেছিলেন। এই আলোচনার ভাষা সরকারি নথিপত্রের বিশেষ এবং অতি বিচিত্র সংক্ষিপ্তকরণের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। এবং পতিগর্বে গর্বিতা আমলাদের সহধর্মিণীদের বাক্যালাপও সরকারি জারগন-এ রত্নখচিত ছিল। ডি.ও (ডেমি-অফিসিয়াল), এফ.ও (ফাইনান্স অফিসার), ডি. এস (ডেপুটি সেক্রেটারি), জে, এস (জয়েন্ট সেক্রেটারি) ইত্যাদি নানা বিচিত্র আপাত-অর্থহীন আওয়াজে আমলাদের বৈঠকখানা মুখরিত হত। শৌরীনবাবুর কাছে শোনা একটি কাহিনি বড় উপভোগ্য ঠেকেছিল। এক মনোরম সন্ধ্যায় মোতিবাগবাসী কোনও ডেপুটি সেক্রেটারির ভবনে সরকারের অপদার্থতা বিষয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছিল। ডি.এস-এর পতিগর্বে গর্বিতা ধর্মপত্নী হঠাৎ আদুরে গলায় বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁগা, তুমি যে জে.এস-কে এফ.ওর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে ডি.ও লিখেছিলে সেই ফাঁইলের গল্পটা বলো না’।

একটি নিঃসন্দেহে কাল্পনিক কাহিনি পঞ্চাশের দশকে দিল্লির বাজারে চালু ছিল। আমলা এবং তাঁদের চারপাশের লোকের বোলচালের অন্যতর অন্তর্নিহিত বক্তব্য ছিল—তাঁরা প্রভুদের কত ঘনিষ্ঠ এবং পেয়ারের লোক। তার চরম উদাহরণ নিম্নোক্ত কাহিনিটি। জনৈক সরকারি চাকুরের পদগর্বিতা পত্নী নাকি সব সময়েই বলতেন, ‘ওঁকে না হলে লিথু ঠাকুরপোর এক মুহূর্তও চলে না।’ পাঠিকা-পাঠক, চিনলেন লিথু ঠাকুরপো আর ‘ওঁকে’? লিথু হচ্ছেন লর্ড লিনলিথগো আর ‘উনি’ তাঁর চাপরাশি।

জনৈক ফরাসি পণ্ডিত হেঁদুদের জাতিভেদপ্রথা সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করে বিশেষ যশস্বী হয়েছিলেন। তাঁর মূল বক্তব্য—হেঁদুরা সমাজে আপসহীনভাবে স্তরবিন্যাসে বিশ্বাসী–হোমো হিয়েরার্কিকুস। অন্তর্নিহিত অন্যতর বক্তব্য, এই দোষ থেকে ‘হোমো স্যাপিয়া’ নামক জীবশ্রেণির অন্য পাঁচটা প্রজাতি—যেমন সাহেবরা প্রায় মুক্ত। সাহেবদের হিয়েরার্কিকুসতা বিষয়ে অন্যত্র কিছু বলব। কিন্তু বিদেশি শাসনমুক্ত দিল্লিতে কিছুকাল বাস করে আমার দুর্ম সাহেবের কথায় ফেত্ হয়েছিল সন্দেহ নেই। তবে হেঁদুদের কুসংসর্গের ফলে দিল্লিবাসী অন্যান্য সব জাতির মানুষও হিয়েরার্কিকুসতায় ভুগছে বলে আমার ধারণা। এই ব্যাধির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে যাব।

আমাদের সমাজে ব্রাহ্মণ শূদ্রাদি জাতিভেদ উদারনীতিকরা বিশেষ নিন্দা করেন। দিল্লি শহরে ইংরেজ আমলে এই প্রথা নতুন রূপ নিয়ে দেখা দেয়। নতুন প্রথাটির নাম চাকরিভেদ প্রথা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গুণকর্ম অনুযায়ী বিভাগ করে জাতিভেদ সৃষ্টি তাঁর অন্যতম কীর্তি বলে ভগবদ্গীতায় ঘোষণা করেছেন। ওঁর আইডিয়াটা নিয়েই ইংরেজরা চাকুরিভেদ প্রথা সৃষ্টি করেন। তবে জয়েন্ট সেক্রেটারি ডেপুটি সেক্রেটারির ছোঁওয়া চা খাবে না, সেকুলারপন্থী আধুনিকতার স্রষ্টা সাহেবরা এমন নিয়ম করেননি। কিন্তু ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে বিভিন্ন স্তরের চাকুরিজীবীদের মধ্যে বেশি মেলামেশা ঘটে সমাজ চাকুরিসঙ্করতায় আক্রান্ত না হয়। হঠাৎ ডেপুটি সেক্রেটারির ছেলে আপার ডিভিসন ক্লার্কের মেয়ে বিয়ে করলে সমাজের ভারসাম্য বিপন্ন হবে এ সত্য ওঁরা অবগত ছিলেন। কালে ডেপুটি সেক্রেটারি-সাহেব শ্বশুর সেকশন-অফিসারের পদধূলি নিচ্ছেন–এ চলে না। তাই চাকরিসঙ্করতা নিবারণার্থে নবগৌরাঙ্গপ্রভু ইন্দ্রপ্রস্থে বিভিন্ন স্তরের চাকুরেদের বাসস্থান বিভিন্ন পাড়ায় নির্দিষ্ট করেন। কিন্তু কে না জানে ভারতীয়রা আতিশয্যপ্রবণ? বিশেষ করে আধুনিক পণ্ডিতদের মতে যে-লোকটি আমাদের যাবতীয় দুর্ভাগ্যের মূল কারণ, সেই জওহরলাল নেহরুর এ ব্যাপারে বিশেষ দুর্বলতা ছিল। উন্নয়ন উন্নয়ন বলে খেপে গিয়ে উনি সব পঞ্চবর্ষী পরিকল্পনা বানালেন এবং সেইসব কাজ চালু রাখতে হাজার হাজার চাকরি সৃষ্টি করলেন। ফলে ইংরেজরা যা আশঙ্কা করেছিল তাই ঘটল। অবশ্যি জাতিভেদে অভ্যস্ত। ভারতীয়রা ব্যাপারটা বেশি দূর এগুতে দেননি। কেরানিপুত্রের সঙ্গে ডেপুটি সেক্রেটারির কন্যার বিবাহ স্বয়ং মদনদেবও বিশেষ ঘটাতে পারেননি। কিন্তু এক ক্ষেত্রে সমূহ সর্বনাশ ঘটল। এর আগে দিল্লির আমলাতন্ত্রে কারও বাসস্থান কোথায় জানলেই সে কী স্তরের চাকরি করে তা বোঝা যেত, এবং তার সঙ্গে বাক্যালাপ করা চলবে কি না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। নেহরুর নতুন চাকরি সৃষ্টির বাতিকের ফলে এই সুব্যবস্থা কিছুটা বানচাল হল। যত চাকরি তত বাসস্থান নেই। যে জয়েন্ট সেক্রেটারির বি টাইপ বাংলোয় থাকার কথা তাকে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মাসের পর মাস সি এমনকী ডি টাইপ বাসস্থানে থাকতে হত। চাকুরি-সচেতন বড় চাকুরিয়ারা এমন দুর্ভাগ্যের শিকার হলে মরমে মরে থাকতেন।

এমনই এক দুর্ভাগার সঙ্গে আমার নিতান্তই আকস্মিকভাবে সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমাদের এক পরিচিত ব্যক্তি ক’জনকে চা খেতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি শহরের উপান্তে ডি টাইপ ফ্ল্যাট পেয়েছেন। গিয়ে দেখি সেই শাল্মলী তরুতে শত শত লোকের বাস। ওঁর ফ্ল্যাটের নম্বর অনেক খুঁজেও না পেয়ে ভাবলাম কাউকে জিগ্যেস করি। একটি ফ্ল্যাটের বাইরে বাঙালি নাম লেখা নেমপ্লেট দেখে ঘণ্টা বাজালাম। দরজা খুলে উগ্রমূর্তি এক ভদ্রলোক বের হয়ে এলেন। বিগত জমানার রাজভাষায় প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’ বললাম মিস্টার ভট্টাচার্যের ফ্ল্যাটটা খুঁজছি। বেগুন তেলে ফেললে যে আওয়াজ হয় (মানে চিড়বিড় চিড়বিড়) ওঁর কণ্ঠস্বরে তার প্রতিধ্বনি শুনলাম। আমি কী করে জানব এইসব ডি টাইপ ফ্ল্যাটে কারা থাকে? আমার বি টাইপ বাংলোয় থাকার কথা আর ব্যাটারা নানা ছুতো করে এইসব বাজে লোকের মধ্যে আমাকে মাসের পর মাস ফেলে রেখেছে। বলে ধড়াম করে দরজাটা আমাদের মুখের উপর বন্ধ করে দিলেন। হতমান এই উঁচু চাকুরের জন্য সত্যি বড় মায়া হল। পদমর্যাদা বলে কথা!

বাজে কথা ছেড়ে সরকারি চাকুরিজীবনের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। একটি স্মরণীয় দিনের কথা বলি। শৌরীনবাবু একদিন বললেন-সরকারি আদব অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসারদের চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি আছে। শিক্ষামন্ত্রী তখন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। এমন লোককে শ্রদ্ধা নিবেদন করা চাটুকারিতার পর্যায়ে পড়ে না, বরং অসামান্য সৌভাগ্য বলেই বর্ণনা করা চলে। আমি কংগ্রেসি পরিবারের ছেলে। বাল্যকাল থেকে জাতীয় নেতাদেরই দেশের সত্যিকার এবং ন্যায্য শাসক বলে জেনেছি। প্রতিবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের পর কাগজে তাঁর এবং তাঁর নিয়োজিত ওয়ার্কিং কমিটির সভ্যদের ছবি বের হত। সভাপতিকে বলা হত রাষ্ট্রপতি। আমাদের চোখে তিনিই সত্যিকার রাষ্ট্রপ্রধান, তাঁর নিযুক্ত ওয়ার্কিং কমিটি আমাদের প্রকৃত মন্ত্রিসভা। রাষ্ট্রপতি এবং বহুবার ওয়ার্কিং কমিটির সভ্য হিসেবে মৌলানার ছবি কাগজে দেখেছি। আর ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন যখন এল, তখন তো আলোচনায় জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে উনিই প্রধান প্রবক্তা। সুতরাং শৌরীনবাবুর উপদেশ অনুযায়ী নির্দ্বিধায় মৌলানার সেক্রেটারিকে টেলিফোন করে সাক্ষাতের দিন চেয়ে নিলাম।

নর্থ ব্লকে শিক্ষামন্ত্রকের দফতরে গিয়ে মন্ত্রীমশায়ের সেক্রেটারির ঘরে অপেক্ষা করছিলাম। সেক্রেটারি ভদ্রলোকের নাম ভুলে গেছি। শুধু মনে আছে উনি ভারতবর্ষের অলিম্পিক হকি টিমের নামজাদা খেলোয়াড় ছিলেন। আর মনে আছে—ভদ্রলোক অসাধারণ সুপুরুষ। ওঁর ঘরে বসে অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু উনি তখন মন্ত্রীর ঘরে। এক সময় শাহজাদা-মার্কা অভিজাত চেহারা এবং উত্তর ভারতের সম্রান্ত মুসলমানের সহজাত এবং সহবতলব্ধ অমায়িকতা সহ ভদ্রলোক এসে আমাকে আদাব জানালেন এবং সংক্ষেপে বললেন, ‘তশরিফ লাইয়ে’। মন্ত্রীমশায়ের ঘরটি বিরাট। তার এক প্রান্তে মোগল সম্রাটের মতো রাজকীয় চেহারা নিয়ে মৌলানা আজাদ বসে আছেন। ওঁর সামনের টেবিলটিতে কাগজপত্র কিছু নেই। শুনতাম—ওঁকে ফাঁইলের বক্তব্য মুখে মুখে সংক্ষেপে বলা হত। উনি সব শুনে নিয়ে উর্দুতে ওঁর আদেশ বা মন্তব্য লিখে দিতেন। কখনওবা ওঁর মৌখিক আদেশ অন্য কেউ লিখে নিত, উনি শুধু উর্দুতে সই করে দিতেন।

ওঁর সামনে এসে মনে হল যেন সত্যিই রাজসমীপে উপস্থিত হয়েছি। নর্থ ব্লকের বিশাল অফিসঘরটি হঠাৎ যেন লালকেল্লার দেওয়ান-ই-খাস-এ পরিণত হয়েছে। চারদিকে তাকালেই দেখতে পাব আশাসোটা-ঢাল-তলোয়ার-বল্লম হাতে সব আহাদি আর দেহরক্ষকরা দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবেলা থেকে যার নাম শুনে এসেছি এমন এক বিরাট ব্যক্তিত্বর মুখোমুখি হয়ে সত্যিতে কেমন যেন বিহ্বল লাগছিল। মন্ত্রী বোধ হয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন। দেখলাম ওঁর মুখে মৃদু হাসি বরং বোধ হয় বললে ঠিক হবে, মনে হল উনি হাসি চাপবার চেষ্টা করছেন। নিজেকে সামলে নিয়ে সেক্রেটারি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জনাবকে বলুন আমি উর্দু বুঝি, কিন্তু বলতে পারি না, সেজন্য লজ্জিত।’ এ কথা বলার কারণ মৌলানা সাহেব ইংরিজি ভাল জানলেও উর্দু ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বলতেন না। হাত তুলে উনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন।

আমার জীবনের এই স্মরণীয় দিনটিতে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। নিয়মমাফিক শিষ্টাচার বিনিময়ের পর মন্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। সেক্রেটারি ওঁর নির্দেশমতো আমাকে দরজা অবধি পৌঁছে দিলেন। ব্যস, এর বেশি কিছু ঘটেনি। কিন্তু ওই দিনটির স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে স্মৃতি রাজদর্শনের, যে রাজা মহামানবও বটে।

শিক্ষামন্ত্রকের সামান্য চাকুরে হিসেবে মৌলানা সাহেবের সঙ্গে আর একবার পরোক্ষ যোগাযোগ হয়েছিল। সে ঘটনাটি বেশ অস্বস্তিজনক। জাতীয় অভিলেখাগারের মুখপত্র একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা ছিল। তার নাম ‘ইন্ডিয়ান আর্কাইভস’। প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকটিনি ডিরেক্টর হিসেবে আমি তার সম্পাদক। ১৮৫৭র শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে সুরেন্দ্রনাথ সেন মহাশয় ওই ঐতিহাসিক বিদ্রোহের একটি প্রামাণ্য বিবরণী লেখেন। একই সময়ে ডক্টর তারাচাঁদ ভারত সরকারের কাছ থেকে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিস্তৃত ইতিহাস লিখবার দায়িত্ব পান। এই দায়িত্ব প্রথমে ডক্টর রমেশ মজুমদারকে দেওয়া হয়। এবং এইসব নিয়ে অনেক দলাদলি রেষারেষির ঘটনা ঘটে। লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি—এই দলাদলিতে আমিও জড়িয়ে পড়ি এবং ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’তে ডক্টর তারাচাঁদের বইয়ের বেনামিতে এক সমালোচনা লিখি। কাজটা পরে নিজের চোখেই জঘন্য বলে মনে হয়েছিল। যদি স্বনামে লিখতাম তা হলেও ব্যাপারটা গৌরবের হত না, কারণ সমালোচনার ভাষায় প্রবীণ পণ্ডিতের প্রতি যেটুকু শ্রদ্ধা রেখে লেখা প্রয়োজন তার চিহ্নও ছিল না। যাদের পাল্লায় পড়ে কাজটা করি, তাদের আমি দোষ দিচ্ছি না, কারণ আমি তখন নাবালক নই। কিন্তু এই কুকার্যটি করে একটি সুশিক্ষা হয়। দিল্লি এবং ভারতবর্ষব্যাপী শিক্ষাজগতে যখন দলাদলির বান ডাকল—এবং যে দলাদলিতে যোগ দিলে বিশেষ লাভবান হতাম, অন্তত কিছু প্রভাবশালী লোক এবং তথাকথিত বন্ধুর নিরঙ্কুশ শত্রুতার ফল ভুগতে হত না, তখন ওই একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে নিজেকে দূরে রাখতে পারি। এত গ্লানিবোধ জীবনে আর কখনও হয়নি। পরে দেখেছি বাস্তবিকই আমার পরিচিত দলবাজদের ভালমন্দ বোধ সোপ পেয়েছিল। বিচিত্র কুকর্মকে মানুষগুলি প্রকৃত আদর্শভিত্তিক সৎকাজ বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ঈশ্বরবিশ্বাসী হলে বলতাম ওই চরম দুর্গতি থেকে স্রষ্টাপুরুষ আমাকে রক্ষা করেন।

যাক, যে-ঘটনা প্রসঙ্গে এইসব কথা বললাম, সেই কথায় ফিরে যাই। আমি কাজে যোগ দেওয়ার আগেই সুরেনবাবুর লেখা বইটি আমাদের পত্রিকায় সমালোচনার জন্য পেন্ডেরেল মুনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। পেন্ডেরেল মুন আধুনিক ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় পুরুষ। বেয়াল্লিশের আন্দোলনের সময় কংগ্রেসি বন্দিদের প্রতি যে ব্যবহার করা হচ্ছিল তার সমালোচনা করে এই ইংরেজ আইসিএস অফিসার তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু গাঁধীশিষ্যা অমৃত কউরের ভাইকে একটি চিঠি লেখেন। যত দূর মনে পড়ে সেই চিঠিতে অথবা ওঁর লেখা আর কোনও ব্যক্তিগত চিঠিতে ‘৪২-এর আন্দোলন নীতির দিক থেকে নিন্দনীয় নয়, এই রকম কিছু উক্তি ছিল। তখন সরকারের সেন্সর বিভাগ থেকে ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও নিয়মিত খোলা হত। মুন সাহেবের ওই চিঠি পড়ে ওঁর কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করা হয়। এবং এই নিয়ে স্টেটসম্যান পত্রিকা সাম্রাজ্যবিরোধিতার অভিযোগ তুলে ওঁর পদত্যাগ দাবি করে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে ভদ্রলোক চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে যান। বাকি জীবন উনি অক্সফোর্ডে গবেষণা করে কাটান। ‘৭৩ সালে অক্সফোর্ডে পড়াতে এসে এই বিচিত্র মানুষটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের সুফলে বিশ্বাসী এই বনেদি ঘরের ইংরেজ সন্তান কিন্তু ভারতবর্ষে ইংরাজ শাসনের নানা অনাচার, বিশেষত জাতিবৈর সম্বন্ধে বিশেষ সচেতন ছিলেন এবং সে সম্বন্ধে বিনা দ্বিধায় লিখেছেনও বটে। ইংরেজ সংস্কৃতিতে একটা ন্যায়বিচারের ঐতিহ্য আছে। মুন সেই ঐতিহ্যে আপসহীনভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে উনি হোয়াইট হলের বড়কর্তাদের কাছে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ উন্নতি সম্পর্কে ওঁর যেসব ধারণা তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। কর্তারা দু-চার কথা শুনে যা মন্তব্য করেন তার মর্ম এই : দেখো বাপ, ভারতবাসীদের গণতন্ত্র শেখাবার জন্য আমরা ওখানে বসে নেই। ওদেশে ইংরেজদের বহু কোটি পাউন্ড আমানত আছে। আমরা রয়েছি তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে।যখন ইস্কুলে আইসিএস পরীক্ষায় বসবার জন্য ছাত্রদের উৎসাহ দিতে ওই হোয়াইট হল থেকেই লোক এসেছিল, তখন কিন্তু আবেদনটা ছিল সাদা মানুষের বোঝার নামে যাক গে, নেহরুজি প্রধানমন্ত্রী হয়ে মুনকে আমন্ত্রণ জানান—ওঁর পরিকল্পিত যোজনার কাজে এসে সাহায্য করতে। এই আমন্ত্রণের অন্যতর কারণ—মুন যোজনায় বিশ্বাসী ছিলেন। এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রের পঞ্চবর্ষী পরিকল্পনাগুলি ভারতের পক্ষে বিশেষ শিক্ষাপ্রদ এ কথা উনি বারবারই লিখেছেন। ফলকথা মুন নেহরুজির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং যোজনার কাজে পরামর্শদাতা হিসেবে ভারত সরকারের চাকরিতে যোগ দেন।

আমি কাজে যোগ দেওয়ার দু-চারদিন আগে মুনের লেখা সুরেনবাবুর ‘১৮৫৭’-এর সমালোচনা দফতরে পৌঁছে গেছে। সাহেব দেখলাম বইটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মুশকিল হয়েছে অন্যত্র। বইটির ভূমিকা লেখেন মৌলানা আজাদ। জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা সেই ভূমিকা ঐতিহাসিকের কাছে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য নয়। মুন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সোজা কথা বলার আদর্শে অবিচল থেকে মৌলানার ভূমিকা অনৈতিহাসিক বলে বর্ণনা করেছেন। শিক্ষা দপ্তরের প্রকাশিত পত্রিকায় স্বয়ং মন্ত্রীর লেখার সমালোচনা হবে? সবাই হাহাকার করে উঠল। সবুজ শৃঙ্গবিশিষ্ট আমি এতে চিন্তার কোনও কারণ দেখিনি। কিন্তু দপ্তরব্যাপী হাহাকার উপেক্ষা করা চলে না। তাই আমি মন্ত্রীর মতামত প্রার্থনা করে সমালোচনাটি ওঁকে পাঠিয়ে দিলাম। আর সেই সঙ্গে মুন সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা। করলাম। দেখা হলে বললাম, ‘একটু মুশকিলে পড়েছি। মানে সরকারি দপ্তরের মুখপত্র ওই পত্রিকা। আর মন্ত্রীর রচনার সমালোচনা। যদি সুরটা একটু নরম করা সম্ভব মনে করেন। হেঁ হেঁ!’ মুনের স্পষ্ট উত্তর, ‘না ছাপালেই হয়। নরম-টরম আমি করতে পারব না’। আমি বললাম, ‘সে হয় না। বদলাতে না চান তো যেমন আছে তেমনিই ছাপাব’। এবার সাহেব একটু নরম হলেন। বললেন, ‘আচ্ছা, রেখে যাও। দেখি কী করা যায়’। কদিন পর মৌলানার নোট পেলাম, ‘নির্দ্বিধায় মুনের সমালোচনা ছাপাও। আমার কোনও আপত্তি নেই।‘ একই সময় দিয়ে সাহেবের কাছ থেকে নব কলেবরে সমালোচনাটি ফেরত এল। সেটিই ছাপা হল। আসলে মন্ত্রী বলে না, মানুষটিকে বিশেষ শ্রদ্ধা করি বলে কঠিন ভাষায় ওঁর লেখার সমালোচনা ছাপাতে আমার মন সরছিল না।

আর্কাইভসে কাজ করবার সময় অন্যতর স্মরণীয় অভিজ্ঞতা কনস্টিটিউশন হাউসে বাস। স্বল্পস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে কয়েকজন ছোট-মেজ সরকারি কর্মচারী ওখানে বাস করতেন বটে। কিন্তু অধিকাংশ বাসিন্দা হয় রাজ্যসভা বা লোকসভার সদস্য—যাঁরা দিল্লিতে সংসার

পাতবার ঝামেলা পোয়াতে চাননি, অথবা আমাদের মতো অকৃতদার তরুণ-তরুণী। ওখানকার বন্মুক্ত জীবনে ওই দ্বিতীয় শ্রেণির বাসিন্দারা মাঝে মাঝে একটু উচ্ছল হতেন ঠিকই, তবে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি কখনও কিছু ঘটেনি। বয়স্ক দু-একজন বাসিন্দা অবশ্য আমাদের কার্যকলাপ বিশেষ সন্দেহের চোখে দেখতেন। এতগুলি অল্পবয়সি মেয়ে-পুরুষ এক সঙ্গে ঘুরছে, অনেক রাত অবধি হো-হো হা-হা করে আড্ডা দিচ্ছে, হোলির দিনে মেয়ে-পুরুষ এক সঙ্গে রং খেলছে। এ কি বৃন্দাবন ধাম পেয়েছে? কেষ্ট ঠাকুরের যা মানায় সরকারি চাকুরেরা সেই চালে চলবে? এগুলি মরাল টার্পিচুডের ফর্দে পড়ে না? এঁদের মধ্যে মধ্যবয়স্ক অকৃতদার এক ব্যক্তি নিজেকে সেন্সরের পদে নিযুক্ত করেন। উনি রাত ন’টা-দশটা নাগাদ রুদ্ধদ্বার ঘরগুলির ভিতর উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে একবার সমস্ত হস্টেলটা টহল দিতেন। টহলরত অবস্থায় একদিন আমার মুখোমুখি পড়ে যান। কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করায় ভদ্রলোক সামলাতে না পেরে বলেই ফেললেন, এই তিরানব্বই আর চুরানব্বই নম্বর ঘর দুটো একটু দেখে যাব।আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎ শয়তানের চেলা ছিল অমর সান্যাল। এমআইটি থেকে পাস করে অধ্যাপক মহলানবিশের উৎসাহে অমর যোজনা ভবনে চাকরি নিয়েছিল। লঘু-গুরু ভেদ করতে সে নিতান্তই নারাজ। একদিন ও ওই সেন্সর ভদ্রলোককে সরল মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনার কী করে চলে?’ ‘মানে?’ ‘মানে বিয়ে-থা করেননি তো, তাই ভাবলাম জিজ্ঞেস করি’। বলে ব্যাপারটা আরও সরল এবং প্রাকৃত ভাষায় বুঝিয়ে দিল।

কনস্টিটিউশন হাউসে প্রেম-ভালবাসা অল্পবিস্তর হত না এমন না, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি গর্হিত কাজও ঘটত। কিছু কিছু উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জায়গাটাকে হারেম হিসেবে ব্যবহারের তালে থাকতেন। একজন বিখ্যাত ব্যক্তির বান্ধবী আমাদের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। দেখতাম রাত একটু গম্ভীর হলে তাঁকে নিতে গাড়ি আসত। একদিন এক ডাকসাইটে মন্ত্রীর বাড়িতে চাকরির ইন্টারভিউর জন্য মহিলাটির তলব হয়। ইন্টারভিউর সময়টা একটু অসাধারণ। রাত এগারোটা। উনি যাবার সময় অমরকে বলে গেলেন, ‘অত রাতে একা ফিরতে চাই না। তোকে ফোন করব। তুই গিয়ে আমাকে নিয়ে আসিস। সেই ফোন এল রাত দুটোয়। মহিলা উচ্ছ্বসিত। চাকরি হয়েছে। পরের দিন আমরা ভোজ খেলাম। ইন্টারভিউটা একটু বেশিক্ষণ চলেছিল। হবেই তো। বেশ মোটা মাইনের চাকরি।

কনস্টিটিউশন হাউসে থাকবার ঘর এবং সংলগ্ন বাথরুমের বিলিব্যবস্থায় একটু বৈচিত্র্য ছিল। পাশাপাশি দুটি ঘরের জন্য একটি করে বাথরুম। দুই ঘর থেকেই বাথরুমে ঢোকা যায়। যিনি ব্যবহার করছেন তিনি প্রতিবেশীর দিকের দরজাটি ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করে দিতেন। আর বাথরুম ছেড়ে বের হবার আগে ওটি খুলে দিয়ে যেতে হত। কারণ না খুললে প্রতিবেশীর বাথরুমে ঢুকবার পথ বন্ধ। এই যৌথ বাথরুম ব্যবস্থায় আরও অসুবিধে ছিল। ব্যবহার করার সময় প্রতিবেশীর দিকের দরজাটি বন্ধ করতে ভুলে গেলে বিশেষ অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হতে পারত। বিশেষত যদি পাশের ঘরের বাসিন্দা অন্য লিঙ্গের মানুষ হতেন। সরকারের সুব্যবস্থায় ঘর বিলি করার সময় লিঙ্গভেদের দিকে কোনও দৃষ্টিপাত করা হত না। উঠতি গণতন্ত্রে এরকম হওয়ারই কথা। যেখানে সবাই সমান সেখানে আবার ভেদাভেদ কেন? ফরাসিরা নাকি স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে যে-সামান্য পার্থক্যটুকু আছে সেটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ যত্নবান। ভোগবিরোধী ভারত সরকারের সেসব বালাই ছিল না। ফলে আমি যাঁর সঙ্গে বাথরুম ভাগে ভোগদখল করতাম তিনি ছিলেন এককালের বিখ্যাত নর্তকী উদয়শঙ্করের দলের মাদাম সিমকি। তখন তিনি সরকারি চাকরি করে জীবিকানির্বাহ করছেন। আমি কিছুটা ভুলো স্বভাবের মানুষ। বাথরুম ব্যবহার করার সময় মাদাম সিমকির দিকের দরজাটা বন্ধ করতে কখনও ভুলিনি ঠিকই, কিন্তু স্নানাগার ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে দরজাটি ছিটকিনিমুক্ত করতে প্রায়ই ভুলে যেতাম। ফলে ধুন্ধুমার কাণ্ড। অফিস পৌঁছেই শ্ৰীমতী সিমকির ক্রুদ্ধ টেলিফোন পেতাম। চাপরাশি আমার ঘরের চাবি নিয়ে দৌড়াত। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে শ্রীমতীর দরজায় শুধু নাকে খত দেওয়া বাকি থাকত। বলতাম ‘আপনি আমার ঘরের একটা চাবি রেখে দিন’। কিন্তু এই সহজ সমাধানে উনি কিছুতেই রাজি না। অন্য লোকের ঘরে উনি কিছুতেই ঢুকবেন না। কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলাম ঘর বদলে দিতে। তাঁরা স্বাধীন ভারতের আমলাতন্ত্রের মূলমন্ত্র আবৃত্তি করলেন, ‘দেখেঙ্গে’। আসলে ওই দেখার ব্যাপারে ওঁদের কোনও উৎসাহ ছিল না। ওঁরা যা দেখছিলেন তা হচ্ছে মজা। এই নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে ওঁরা নিতান্তই নারাজ।

একবার অমর্ত্য কদিনের জন্য অতিথি হয়ে আমার ঘরে বাস করেছিলেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে তাঁর বিস্মিত প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হল। কী ব্যাপার বলুন তো। স্নান করে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসছি। আচম্বিতে ওদিককার দরজা খুলে একটি মহিলা এসে বললেন—ইউ মাস্ট নট শাট মি আউট লাইক ইওর ফ্রেন্ড। ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলাম। ওটা কোনও আমন্ত্রণ না। চেতাবনি।

তখন দেশ সবে দশ বছর আগে স্বাধীন হয়েছে। পুরনো আদর্শবাদ এবং তদনুসারী জীবনযাত্রা, বিশেষ করে তীব্র জাত্যভিমান তখনও সকলের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়নি। কনস্টিটিউশন হাউসে যেসব ছোট-মেজ নেতা বা সাংসদরা এসে সাময়িকভাবে বাসা বাঁধতেন, তাঁদের অনেকের আচরণে সেই জাত্যভিমান বা জীবনাদর্শর বিচিত্র প্রকাশ নজরে পড়ত। এঁদের কারও কারও চোখে স্বাধীন ভারতের সরকারি আমলা আর সাংসদদের জন্য বিলাতি কেতায় টেবিল-চেয়ারে এবং কাঁটা-চামচে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নিতান্তই বিজাতীয় ঠেকত। এঁদের মধ্যে এক চরমপন্থী সাংসদ বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তাঁর দাবি তাঁকে মাটিতে আসন পেতে খেতে দিতে হবে এবং ভূম্যাসনে বসে তিনি কবজি ডুবিয়ে খাদ্যবস্তু মুখে তুলবেন। খাওয়ার ঘরে টেবিলে বিলাতি কেতায় ছুরিকাঁটা সাজানো থাকলেও বেশ কয়েকজন আবাসিক ঈশ্বরদত্ত অঙ্গুলির সাহায্যেই ভোজনকার্য সমাধা, করতেন। বাদামি বর্ণ সাহেবকুলকে এই কলা দেখানোর দৃশ্য আমার ভালই লাগত, যদিও নিজে কখনও সাহস করে নতুন ভব্যতার আদর্শ লঙ্ঘন করিনি। কিন্তু চারিদিকে টেবিল চেয়ারের মাঝখানে আসন পেতে বসে খাওয়ার দাবি কেটারার ভ্রাতৃদ্বয় মানতে পারলেন না। ফলে দাবিদার টেবিলের উপরে আসনপিড়ি হয়ে বসে হস্তদ্বারা ভোজন শুরু করলেন। কনস্টিটিউশন হাউস জাতীয়তাবাদের এই অসামান্য প্রকাশে স্তম্ভিত। অনেক কোশিশ করে ভদ্রলোককে নিজের ঘরে ভূম্যাসনে বসে খেতে রাজি করানো হল।

ওড়িশা রাজ্য থেকে আগত লোকসভার দুই সভ্য তাঁদের গাঁধীবাদী জীবনাদর্শ অন্যভাবে প্রকাশ করতেন। গ্রামবাসী এই দুই দেশপ্রেমিকের কাছে জুতো জিনিসটা বোধ হয় বিশেষ মূল্যবান ছিল। শহরের রাস্তায় রাস্তায় বস্তুটি ব্যবহার করে অকালে তার তলা খসানো কোনও কাজের কথা না। তাই এঁরা যখন পথে বার হতেন এঁদের সঙ্গে একটি করে গামছা থাকত। বারান্দা থেকে রাস্তায় নামবার আগে ওঁরা জুতোজোড়া সযত্নে খুলে গামছায় জড়িয়ে বগলস্থ করতেন এবং ফিরে এসে ওই গামছায়ই পা মুছে জুতো পরতেন। কনস্টিটিউশন হাউসের ভিতরে এঁদের পাদুকাহীন অবস্থায় কখনও দেখা যেত না।

ছোটা সিং আর বড়া সিং বলে বর্ণিত দুই ভাই আমাদের কেটারার ছিলেন। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবেই তাঁদের চোট্টা সিং আর ডাকু সিং উপাধি দেওয়া হয়েছিল। মাত্র দুশো আড়াইশো টাকায় ওঁরা চারবেলা যা-খেতে দিতেন তা একঘেয়ে হলেও কোনও অর্থেই খারাপ ছিল না। শুধু নেহরু পরিবারের দু-একজন আর ক্ষমতাশালী লোকদের কৃপাভাজন কিছু বেচারা লোক ওখানে থাকতেন। তাঁরা অন্যদের তুলনায় একটু খাতিরযত্ন বেশি পেতেন। এটা অনেকেরই চক্ষুশূল ছিল। কতকটা সেই কারণেও কেটারারদের চৌর্যখ্যাতি বেড়ে গিয়েছিল। এক দিক দিয়ে ছোটা সিং বিশেষ প্রতিভাবান ছিলেন। লোকটি অসম্ভব আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য মিথ্যা কথা বলতে পারত। ওখানে কেটারারদের সঙ্গে কথা বলে নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য বিশেষ খানার ব্যবস্থা করা যেত। এক মহিলা আবাসিক একবার নীহারবাবুকে (নীহাররঞ্জন রায়) রাত্রে খেতে বলেন। সেদিন খাওয়ার ঘরে ঢুকে দেখি মহিলা বাক্যে এবং দৃষ্টিতে অগ্নিবর্ষণ করছেন। ছোটা সিং অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা নিম্নরূপ। মহিলা অতিথির জন্য হাঁস রান্নার ফরমাস দিয়েছিলেন। খেতে বসে দেখেন যা পরিবেশন করা হয়েছে তা দ্বিপদ না চতুষ্পদ—পাঁঠা। ছোটা সিং বলছেন, ‘জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না। তবু সত্যিটা কী ঘটেছে শুনুন। আপনাদের জন্য হাঁসই কেনা হয়েছিল। বাবুর্চি তাকে বধ করতে যাবে। তখন সে সকলের মায়া কাটিয়ে উড়ে গেল’। ছোটা সিংয়ের কল্পনায় প্রয়োজন হলে হাঁস কেন হাতিও উড়ে যেতে পারত।

ইতিমধ্যে চাকরিজীবনে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছিল। শালা সাহেবের উদ্যম শৌরীনবাবুকে ঘায়েল করেই শেষ হয়নি। আমিও তো দুলাভাইয়ের পথের কাঁটা। সুতরাং তাঁর পদোন্নতির পথ মুক্ত করার জন্য আমাকেও সরানো প্রয়োজন। আমার সঙ্গে মানুষটির কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। অতি অমায়িক ব্যবহার। সজনী দাস ব্যবহৃত অমায়িক খচ্চর কথাটার অর্থ কী, এই দ্বিপদকে দেখে সে বিষয়ে কিছু ধারণা হল। ঐতিহাসিক পি এম জোশী আমাকে বলেন, ‘লোকটা বড় মার্জিত। ধরো তোমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা। আরে কেমন আছেন বলে পেটে ছুরিটা বসিয়ে দেবে। তারপর অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বলবে, আরে আরে, লাগল নাকি! যাক গে, ভাববেন না। বেশিক্ষণ কষ্ট হবে না। বলে ছুরিটায় একটু মোচড় দেবে। ফলে তোমার তৎক্ষণাৎ বিষ্ণুলোকপ্রাপ্তি। ভারি অমায়িক লোক’। শুনলাম শালা সাহেব আমাকে সরাবার জন্য সক্রিয় হয়েছেন।

এবার মারণাস্ত্র আমার ব্যক্তিগত চরিত্র না, রাজনৈতিক মতামত। একদিন শিক্ষাবিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর শ্রীমালি আমাকে ডেকে পাঠালেন। দেখা হলে বললেন, ‘শোনো হে, একটু গোলমাল হয়েছে। তোমার নামে পুলিশের কিছু রিপোর্ট আছে। আমরা ওসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু তুমি কিছুদিনের জন্য সেক্রেটারিয়েটে চলে এসো। এ ব্যাপারটার একটা সুরাহা করে আবার তোমাকে আর্কাইভসে ফেরত পাঠাব’। সেক্রেটারিয়েটে কলম ঠেলার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। ফলে কিছু সময় চাইলাম। মন্ত্রীমশায় সত্যিই আমার প্রতি সহানুভূতিশীল। বিনা আপত্তিতে আমাকে তিন মাস সময় দিলেন। আমি চাকরি খোঁজা শুরু করলাম।

পুলিশের আমার বিরুদ্ধে কী নালিশ জানতে কৌতূহল হল। ভারতবর্ষে খুব কম জিনিসই বেশিদিন গোপন থাকে। ফলে গোলমালের সূত্র শিগগিরই জানা গেল। অনেক বছর পর এই ব্যাপার সংক্রান্ত ফাঁইলটিও দেখার সুযোগ হয়েছিল। যা জানলাম তাতে আমার চক্ষুস্থির। ভারত সরকার বিলাতে তাঁদের হাই কমিশন থেকে খবর পেয়েছেন যে, আমি নাকি অক্সফোর্ডে পড়ার সময় ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত ছিলাম। শুধু তাই নয়। উক্ত দলের উচ্চতম সংস্থা পোলিটব্যুরোয় আমার বেসরকারিভাবে আসন ছিল। আমার এই কৃতিত্বের কথা জেনে আমি চমৎকৃত। কোন সূত্রে আমাদের হাই কমিশন এই মূল্যবান তথ্য পেয়েছিলেন তা সঠিক জানার উপায় নেই। আমার ধারণা বিলাতের যে গোয়েন্দা সংস্থা ইরাকে বহুজনঘাতী অস্ত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন এই অপূর্ব আবিষ্কার তাঁদেরই কীর্তি। এদেশে যখন থেকে নয়া সন্ত্রাসবাদের সূচনা হয়েছে তদবধি আমি অত্যন্ত আতঙ্কে বাস করছি। কারণ যে-সংস্থা আমার মতো লোককে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করে, তারা আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারবে, এমন আশা করার কোনও কারণ নেই। বুঝলাম ক্রিস্টোফার হিলের ঘরে হবস্তুম আদি কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা নিকৃষ্ট বিয়ার খাওয়ার পরিণাম এই। এমন আশঙ্কা কখনও করিনি। নিতান্ত চারপেয়ে না হলে কেউ আমার মতো লোককে রক্তাক্ত বিপ্লবের ধারক ও বাহক বলে সন্দেহ করতে পারে, একথা কখনও মনে হয়নি। ভাবলাম ওই অপেয় বিয়ার না গিললেই হত। কিন্তু ভবিষ্যতে চাকরি খোয়াবার ভয়ে কি হিল বা হবস্তুমের সঙ্গ বর্জন করতে পারতাম? বোধ হয় না।

বেশ বুঝতে পারলাম টিকটিকিরা আমার উপর নজর রাখছে। টেলিফোন তুললেই নানা বিচিত্র আওয়াজ পেতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে ফিসফাস কথাও শুনি। কুলু-মানালি বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে পণ্ডিত নেহরু ঠিক তখনই মানালিতে। ফলে কোনও রকম ঢাকাঁচাপা না করেই এক টিকটিকি আমাদের সঙ্গ নিল। বেচারাকে বুঝলাম রাহাখরচা বিশেষ দেয়নি। বেশ কষ্টে আছে। ওকে ডেকে দু-একদিন খাওয়ালাম। আশা করি এর জন্য ওর চাকরি যায়নি। কারণ ওর পিছনেও কোনও টিকটিকি ছিল বলে মনে হয়নি।

ইতিমধ্যে আমার পিসতুতো ভাই কল্যাণশংকর, যে আমাকে এক বছর বয়স থেকে জ্বালাচ্ছে, সিরাকুস থেকে কমিউনিস্ট হয়ে ফিরে এসে কনস্টিটিউশন হাউসে আমার স্কন্ধারূঢ় হল। সে প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসেই উঠেছিল। লোকসভায় সরকার বিবৃতি দিলেন যে, কমিউনিস্টরা তাদের অফিসে রাশিয়ার এক গুপ্তচরকে আশ্রয় দিয়েছে। ফলে কল্যাণ পার্টি দফতর ছেড়ে আমার আতিথ্য গ্রহণ করল। এবং সকাল সন্ধ্যা আমার ঘর থেকে পার্টি অফিস এবং দিল্লিবাসী যাবতীয় কমিউনিস্ট নেতাদের অনর্গল ফোন করতে লাগল। আমার চাকরির তখন পৌনে বারোটা। কল্যাণের সৎ প্রচেষ্টায় অচিরেই বারোটা বেজে গেল। ইতিমধ্যে হো চি মিন দিল্লি সফরে এসেছেন। কনস্টিটিউশন ক্লাবে নেতাকে অভিনন্দিত করার জন্য যে-চায়ের পার্টি হল, শৌরীনবাবুর উৎসাহে এবং শ্ৰীযুত হীরেন মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তাতে আমি নিমন্ত্রণ পেলাম। চাকরি তো ছাড়তেই হবে। তাই এই নিমন্ত্রণ আমি প্রত্যাখ্যান করলাম না। হীরেনবাবু এসে আমাকে হো চি মিনের সঙ্গে একই টেবিলে বসালেন। মানুষটি দেখলাম নিতান্তই সাদাসিধে। পরনে ভিয়েতনামের চাষাদের মতো একটি ফতুয়া আর নিভাঁজ পাতলুন। পায়ের চটিজোড়া সাইকেলের টায়ার কেটে তৈরি। ওঁর ইংরেজি জ্ঞান দেখলাম কিছু কম। কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে টেবিলে বসে তারপর উনি উঠে সকলের সঙ্গে আলাপ করতে লাগলেন। এই মহাশক্তিশালী মানুষটি সম্বন্ধে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি মনে আছে, তা ওঁর মুখের সরল হাসি। এই ব্যক্তিই যে কঠোর আপসহীন বিপ্লবী যোদ্ধা, ওঁকে দেখে সে কথা একবারও মনে হয়নি। যা হোক, নানাভাবেই সরকারি টিকটিকিবৃন্দ অকাট্য প্রমাণ পেয়ে গেল যে আমি অত্যন্ত বিপজ্জনক কমিউনিস্ট। শালা সাহেব উৎফুল্ল হয়ে চিঠি দিতে লাগল আমি সেক্রেটারিয়েটের চাকরি নেব কি না তা সত্বর জানাতে।

ইতিমধ্যে নবনিযুক্ত ডিরেক্টর কাজে যোগ দিলেন। তাঁর চরিত্রবর্ণন প্রসঙ্গে ভারতবর্ষীয় সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত রাজনৈতিক অশুদ্ধ কয়েকটি কথা বলতে চাই। জাতীয় চরিত্র বলতে অনাদিকাল থেকে কোনও জাতির অব্যয় অনন্ত কোনও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে, এমন কথা এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু ইতিহাসের কোনও নির্দিষ্ট মুহূর্তে সংস্কৃতিগোষ্ঠীবিশেষের যে কিছু বিশিষ্ট প্রবণতা থাকে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। মার্কিন সংস্কৃতির উদাহরণ ধরা যাক। সম্প্রতি পড়লাম ওদেশে শতকরা পঞ্চাশ জনেরও বেশি মানুষ বাইবেল বর্ণিত সৃষ্টিকাহিনিতে আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ তাদের ধারণা যে, সত্যিই ঈশ্বর ছ’ দিনে বিশ্বসৃষ্টির কাজটা সেরে সপ্তম দিনে একটু গড়িয়ে নেন। একবিংশ শতাব্দীতে এত সংখ্যায় এরকম আকাট মুখ পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও পাওয়া কঠিন বলেই আমার ধারণা। আর একটা উদাহরণ দিই। বাঙালিদের সংস্কৃতিপ্রিয়তা কাল্পনিক ব্যাপার নয়। তেমনই তারা যে পঞ্জাবি বা গুজরাতিদের তুলনায় উদ্যমহীন একথাও বোধ হয় অনস্বীকার্য। বাংলায় একটি অত্যন্ত অর্থবহ শব্দজোট আছে—বোকা বজ্জাত। এই বর্ণনার সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খায় এরকম মানুষ হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে যত দেখেছি তত আর কোথাও না। আকাট মুখ সব মানুষ কী পরিমাণ ত্যাদড়ামি করতে সক্ষম দেখে বারবারই বিস্মিত হতে হয়েছে। একটা কথা স্পষ্ট করে বলে রাজনৈতিক অশুদ্ধতা-দোষ কিঞ্চিৎ লাঘব করতে চাই। হিন্দি-ভাষাভাষীদের ৫% বা ১০% বোকা বজ্জাত এ আমার বক্তব্য নয়। আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় ওই বর্ণনার সঙ্গে মেলে এরকম প্রাণী উক্ত সংস্কৃতি তথা ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখেছি-এটুকুই শুধু বলতে চাই। কথাটা প্রগতিবাদীদের অপছন্দ হলে দু-গ্রাস ভাত বা দু-খানা চাপাটি বেশি খাবেন। এঁদের মধ্যে অবশ্যি বোকা বেশি দেখিনি। কিন্তু বজ্জাত! সীমাসংখ্যা নেই।

নতুন ডিরেক্টর মিস্টার ভার্গব এলেন। তাঁর মুখ সরল হাসিতে উজ্জ্বল। হঠাৎ দেখলে মনে হবে স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছেন। দু-চারটে কথা বললেই বোঝা যায়, লোকটির বহুদিন ধরে মা সরস্বতীর সঙ্গে ফৌজদারি মামলা চলছে এবং দেবীর জিতবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সঙ্গে সব সময়ই একটি পানের ডিব্বা। সদাশয় মানুষটি সর্বদাই উদার হস্তে সেই পান বিলোচ্ছন। আমিও প্রথম দিকে দু-চারদিন পান খেলাম। সকাল দশটা-সাড়ে দশটায় দফতরে এসে সকলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গালগপ্পো করে বারোটা নাগাদ টিফিনের ডিব্বাটি খুলতেন। এ সময়ও মাঝে মাঝে আমার ডাক পড়ত। ডিব্বাস্থিত আহার্য কখনও খুব মুখরোচক হত না। পুরি কচৌরিবিলাসী ভার্গব তাতে কিছুটা বিরক্তই ছিলেন। একদিন বলেই ফেললেন—ওঁর স্ত্রী একেবারেই রাঁধতে পারেন না। তিরিশ বছর উনি সব সহ্য করে আছেন। এবার ভাবছেন আর একটা বিয়ে করবেন। ব্যাপারটা উনি বুঝিয়েই বললেন। না, খারাপ রান্নার জন্য উনি স্ত্রীকে তালাক দেবেন, এমন হৃদয়হীন মানুষ ভার্গব না। তবে কথা কী জানো, আজীবন শুদ্ধ ঘি খেয়েছেন, কুস্তি লড়েছেন, তাই পঞ্চান্ন বছরেও ওঁর পূর্ণ যৌবন। আর ওঁর স্ত্রী, বলতে নেই, বহু সন্তান প্রসব করে বিগতযৌবনা। এমতাবস্থায় দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ শাস্ত্রানুমোদিত। উনি নীতিবিরুদ্ধ কিছু করবেন না। সামলে-সুমলে বললাম, নীতিবিরুদ্ধ না হলেও আইনবিরুদ্ধ হবে যে। এক গাল সরল হাসি হেসে ভার্গব বললেন, ওঁকে কে কী করবে! পাঁচটা মিনিস্টার, সাতটা সেক্রেটারি ওঁর হাতধরা। আইনের তোয়াক্কা উনি থোড়াই রাখেন! রাখেন যে না তার প্রমাণ পরে পেয়েছিলাম। যা হোক, মধ্যাহ্নভোজন শেষ হলে ডিরেক্টর ভার্গব সেক্রেটারিয়েটে চলে যেতেন। সেখানে বাকি দিনটা ওঁর হাতধরা সেক্রেটারি আর মন্ত্রীদের সঙ্গে গল্পগুজবে কেটে যেত। ওঁর এক ব্যাপারে বিশেষ খ্যাতি ছিল। উনি নাকি ডাকসাইটে হস্তরেখাবিদ। সেক্রেটারিয়েটে বহু লোকের হাত দেখে উনি ওঁর প্রতিষ্ঠার ভিত আরও দৃঢ় করেন। একদিন আমারও হাত দেখলেন। সামনে অনেক ভাল ভাল কথা বললেন। ওঁর ঘর থেকে বের হয়ে আসবার পরেই শুনলামকাকে যেন বলছেন, ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর কেউ আমাকে চাকরি যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে না।

এই সংবাদ জানার ওঁর বিশেষ লিয়াকত ছিল। কারণ ভার্গব ছিলেন যোগসিদ্ধ। দরকার হলে উনি তাঁহা-তাঁহা দেবতাদের সঙ্গেও পাঞ্জা লড়তে পারতেন। ওঁর মুখেই শোনা একটি ঘটনার বিবরণ দিই। সিদ্ধপুরুষের স্ত্রী তখন অসুস্থ। মুদ্রিত নেত্রে ভার্গব আরাধনা করছিলেন। হঠাৎ যোগবলে বুঝতে পারলেন ‘দি জেন্টেলম্যান হ্যাড অ্যারাইভড।’ বলাই বাহুল্য, জেন্টেলম্যানটি হচ্ছেন যমদেব। ভার্গব চোখ উন্মীলন করে দেবতাকে প্রণাম জানালেন। ‘ওহ তো বয়েল পে বৈঠা থা।’ একটু শোধরাবার চেষ্টা করলামঅয়েল না, ভয়েস হওয়ার কথা। ভার্গব আমল দিলেন না। ওহ একই হ্যায়।ওঁর চোখে তো তা হবেই। ব্রহ্মজ্ঞান হলে সব ভেদাভেদ লুপ্ত হয়, বিষ্ঠা-চন্দনে ভেদবুদ্ধি থাকে না, বয়েল আর ভঁয়েস তো পিঠোপিঠি ভাই। যম ইঙ্গিত করলেন—চলে এসো, বউকেও তৈরি হয়ে নিতে বলো। কিন্তু যোগসিদ্ধ ভার্গবকে সামান্য যম কী করবে? বিনীতভাবে সিদ্ধপুরুষ বললেন—আজ্ঞে এ যাত্রায় নয়। আপনি ফিরে যান। যম এবার পাশ নিক্ষেপ করলেন। ভার্গব শ্রীহস্ত তুলে পাশ হটিয়ে দিলেন। হতমান যমদেব ম্লানমুখে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। তবে দেবতার আয়ুধ বলে কথা। পাশটা যেখানে লেগেছিল সে জায়গাটা কেটে গেল। ভার্গব দেখালেন ডান হাতের তালুতে তখনও গভীর দাগ রয়ে গেছে। আমার সঙ্গে যখন সিদ্ধপুরুষটির পরিচয় হয় তখন তাঁর সিদ্ধাই আরও উচ্চকোটিতে পৌঁছে গেছে। অধ্যাপক ব্যাশাম দিল্লি এসেছিলেন। একদিন বললেন, ‘দিস চ্যাপ ভার্গব হ্যাজ বিকাম রাদার ইমপসিবল। হি টোন্ড মি দা আদার ডে দ্যাট ইফ হি পিকস আপ এনি স্টোন, ইট কুইভারস অ্যান্ড টার্নস ইনটু এ লিঙ্গম। সউন্ডেড সর্ট অফ রুড টু মি।‘ ভার্গব যা-ই ধরছেন তাই ওঁর হাতে নড়েচড়ে লিঙ্গে পরিণত হচ্ছে, এই ব্যাপারটা ব্যাশামের খুব শ্লীল মনে হয়নি।

চাকরির শেষ প্রান্তে পৌঁছে ভার্গব তাঁর শেষ খেল দেখালেন। এর পরে যা লিখছি তার সব কথারই আগে ইংরেজি ‘অ্যালেজড’ শব্দটা বসিয়ে নেবেন। কারণ যদিও সম্ভবত এ সম্পর্কে যাবতীয় কাগজপত্র শিক্ষামন্ত্রকের মহাফেজখানায় এখনও আছে, কিন্তু ওই মন্ত্রক কখনও ব্যাপারটা আদালতে তোলেননি, সুতরাং যা-লিখছি তা সবই প্রমাণসাপেক্ষ।

ঘটনাটা এই। আর্কাইভসে নথিপত্র রাখার জন্য প্রতি বছরই লাখ দুয়েক টাকার পিচবোর্ডের কার্টন প্রয়োজন হয়। রীতিমতো টেন্ডার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে জিনিসটি সরবরাহের ভার কোনও কোম্পানিকে দেওয়া হত। কাজটা জটিল এবং মূনাফা সামান্য। অনেক বছর ধরে একটি ছোট কোম্পানিই জিনিসটা সরবরাহ করে আসছিল। ভার্গব শুধু যোগী নন, কর্মকুশলও বটে। ফলে ওঁর রাজত্বে যখন কার্টনের প্রয়োজন হল, তখন উনি অফিসেরই একটি দফতরিকে ডেকে একটি পুরনো কার্টন নতুন করে মুড়িয়ে সাহজাহানপুরের এক অস্তিত্ববিহীন কোম্পানির নামে টেন্ডারের জবাব দিলেন। যথাকালে টেকনিকাল অফিসারদের উপদেশ বাতিল করে ওই অস্তিত্ববিহীন কোম্পানিকেই ভার্গব কার্টনের ফরমায়েস দিলেন। আকাইভসেরই চারটি দফতরি ভার্গবের বাড়ির উঠানে বসে কার্টন তৈরি শুরু করল। যথাকালে ভিজিলেন্স বিভাগ তদন্ত করে ভার্গবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিল।

কিন্তু যার হাতে পাঁচ মন্ত্রী, সাত সেক্রেটারি তার বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবে! কিছুই করা হল না। ইতিমধ্যে মহাপুরুষের অবসর নেওয়ার সময় এল। উনি আসলে হোম মিনিস্ট্রির লোক। তাঁরা ওঁর চাকরির মেয়াদ দু’বছর বাড়িয়ে দিল। নতুন শিক্ষামন্ত্রী ত্রিগুণা সেন চটে মটে ওঁকে ডিরেক্টরের পদে বহাল রাখতে নারাজ হলেন। ওদিকে হোম মিনিস্ট্রিতে তখন কোনও উপযুক্ত পদ নেই। সরকারের নামে মামলা ঠুকে দিয়ে ভার্গব বাড়ি বসে আরাম করতে লাগলেন। দু’বছর পর যখন তিনি সত্যিতে অবসর নিলেন তখনও মামলার সুরাহা হয়নি। আর বৃথা অপব্যয় না করে ভার্গব মামলা তুলে নিলেন। শুনেছিলাম ভারত সরকারের চাকরিতে লিয়েন রেখে জেলে যাওয়া যায়। এই অপূর্ব ঘটনাপঞ্জী দেখে সে কথা বিশ্বাস করলাম।

এদিকে আমার চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল। শৌরীনবাবুর উপদেশ মতো তখন শিক্ষাবিভাগের উপমন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে ভরসা দিলেন। শুনলাম উনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লিখেছিলেন। ওঁর এই আস্পর্ধায় বিশেষ বিরক্ত হয়ে তিনি এঁকে নাকি রীতিমতো ধমকে দেন। আমার চাকুরি-সংকটের কথা তখন সকলেই শুনেছে। একদিন ডক্টর অশোক মিত্র এসে আমাকে দিল্লি স্কুলের ডিরেক্টর কে এন রাজের কাছে নিয়ে যান। সব শুনে রাজ খুবই সহানুভূতি দেখালেন, কিন্তু বললেন, কোনও উপযুক্ত পদ তো নেই। তাই তিনি কিছু করতে অপারগ। হঠাৎ একদিন পি এম জোশী আমার আপিসে এসে হাজির। বললেন, ‘চলো তোমাকে ভি কে আর ভি রাওর কাছে নিয়ে যাই।’ রাও তখন দিল্লির ভাইস চ্যান্সেলর, জোশীর ছেলেবেলার বন্ধু। উনি আমাকে অর্থনৈতিক ইতিহাসে রিডার হয়ে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। একটা ইন্টারভিউ হল। সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসে অর্থনৈতিক ইতিহাসে রিডার হয়ে নতুন কাজে যোগ দিলাম। উক্ত স্কুলের ইতিহাসে তখন স্বর্ণযুগের উজ্জ্বল ঊষাকাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *