২১. বকুল যখন বাড়ির সামনে

বকুল যখন বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলো, তখন আকস্মিক ভাবেই ছোড়দার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল ঢলঢলে একটা গেঞ্জি আর আধময়লা একটা ধুতি পরে। গেঞ্জির গলার ফাঁক দিয়ে পৈতের একটুখানি দেখা যাচ্ছে।

ছোড়দাকে দেখে বাড়ির বামুনঠাকুর-টাকুর মনে হচ্ছে, বকুলের আবার ছোড়দাকে দেখে মন-কেমন করলো। ছেলেবেলায় সব ভাইদের মধ্যে ছোড়দাই সবচেয়ে শৌখিন ছিলো।

বলতে যাচ্ছিল, কী ছোড়দা, এখানে দাঁড়িয়ে যে? তার আগেই ছোড়দা বলে উঠলো, কী, তুই আজই ফিরে এলি যে?

বকুল দেখতে পেলো ছোড়দা গাড়ির মধ্যে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

হয়তো বকুলের চোখের ভ্ৰম, হয়তো বকুলের মনের কল্পনা, তবু বকুলের মনে হলো, সেই সন্ধানী দৃষ্টির অন্তরালে একটি প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল, সেটা নিভে গেল।

বকুল মিটার দেখে ভাড়া চুকিয়ে ফিরে তাকিয়ে বললো, চলেই এলাম।

তারপর আর প্রশ্ন করবে না ছোড়দা, জানা কথা। হয়তো অন্যদিন হলে বকুলও আর কথা বলতো না, আজ কি জানি কেন নিজে থেকে বললো, মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলো না।

অসতর্কেই বোধ হয় ছোড়দার মুখ থেকে প্রায় আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো, দেখা হলো না?

নাঃ! কালই সকালে চলে গেছে।

ছোঁড়দা একটু চুপ করে থেকে বললো,গেলেন কোথায়?

চসেজদি তো বললো, কলকাতাতেই ফিরে এসেছে। একটু গোলমেলে ব্যাপার আছে। বললো, কারণ ভাবলো বলাই উচিত।

ছোড়দা ধিক্কারের গলায় বলে উঠলো, ভালো। এ যুগের ছেলেমেয়েরা তো গোলমাল বাধানোই বাহুদুরি বলে মনে করেন। নির্মলের ছেলের অতোটুকু ছেলেটা যা করেছে–আচ্ছা শুনো পরে, এখন বাড়ির মধ্যে যাও।

নির্মলের ছেলের অতোটুকু ছেলেটা যা করেছে

এটা আবার কোন্ ভাষা?

বকুল ওই শব্দ ক’টার অর্থ আবিষ্কার করতে পারে না। অবাক হয়ে ছোড়দার মুখের দিকে নয়, নির্মলদের বাড়িটার দিকে তাকায়। যেন বাড়িটার ওই জীর্ণ দেয়ালটার গায়ে অর্থটা লেখা আছে।

ওই বাড়িটা থেকে নির্মল নামের অস্তিত্বটা কত-কতোদিন আগে যেন মুছে গিয়েছিল, ওর দিকে তাকিয়ে দেখার কথা আর মনে পড়েনি এতো দিন।

বদলির চাকরি করতে নির্মল, ছুটিতে ছুটিতে বাড়ি আসত, সে ঘটনা কবেকার? বকুল তার সব খবর জানত বৌদিদের কলকাকলীর মধ্যে থেকে। কানে এসেছে মা-বাপ মারা যাওয়ার পর নির্মল আর কলকাতায় আসে না, ছুটি হলে বরং অন্য দেশে যায়। নির্মলদের ঘরগুলো চাবি বন্ধই পড়ে থাকে।

আর বাকি সারা বাড়িটা?

যেটা নাকি নির্মলের প্রবল প্রতাপ জেঠিমার দখলে ছিল? সেটার দখলদার তখন জেঠিমার দুই ভাইপো। জেঠিমা যখন নিঃসন্তান, তখন তার ভাইপোরা তার উত্তরাধিকারী হবে এটাই স্বাভাবিক। শেষ বয়সে তাকে দেখবার জনোও তো লোক চাই?

সেই নিঃসন্তানা ভদ্রমহিলা, শ্বশুরকুলের যাদের জন্যে জীবনপাত করলেন, জা, দ্যাওর, দ্যাওরপো, দ্যাওরঝি ইত্যাদি, তারা কি তাঁকে দেখলো? জা দ্যাওর দিব্যি তার আগে মরে কর্তব্য এড়িয়ে গেল, আর দ্যাওরপো ল্যাওরপো-বৌ বাসায় গিয়ে মজায় কাটাতে লাগলো, তিনি তবে পিতৃকুলের শরণ নেবেন না কী করবেন?

দ্যাওরপোরই না হয় চাকরি; কী করবে পরের দাসত্ব, কিন্তু বৌ থাকতে পারতো না ছেলেদের নিয়ে কলকাতায়? কলকাতায় ছেলেদের পড়াবার মত ইস্কুল নেই? তাই নানাস্থানী বাপ শেষ অবধি ছেলেদের বোর্ডিঙে, হোস্টেলে রেখে মানুষ করছে। তা তো নয়, ‘কর্তা-গিন্নী’ কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না!

তা জগৎসংসারে সবাই যখন আপন স্বার্থটি দেখছে, জেঠিমাই বা কেন না দেখবেন? দেখেছেন তিনি। ভাইপোদের আনিয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এসব খবর ছিটকে ছিটকে কানে এসেছে বকুলের, তার সঙ্গে এও কানে এসেছে, একেই বলে রাজা বিনে রাজ্য নষ্ট! কী বাড়ি কী হলো! কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে ওই জেঠির ভাইপো দুটো বাড়িটাকে যেন নরককুণ্ডু করলো গো! করবে না কেন, নিজেদের পিতৃপুরুষের ভিটে তো নয় যে মনে একটা ইয়ে আসবে? তাই সারা বাড়িটার খোপে খোপে ভাড়াটে বসিয়েছে। এখানে টিনের ঘের, ওখানে ক্যাম্বিসের পর্দার আড়াল, সেখানে নিরাবরণ ইটের দেওয়াল তোলা আবরণ, এমন কি গেটের ধারের চাকরের ঘরটাতে পর্যন্ত পানের দোকানদার বসিয়েছে।

অতএব নরককুণ্ডু বলাটা আতিশয্য নয়। তবে? কে তাকাতে যায় নরককুণ্ডুর দিকে? বকুলদের তিনতলার সিঁড়ির থেকে নামতে মাঝামাঝি চাতালটা থেকে যে ছোট্ট বারান্দাটুকু যেন আকস্মিকভাবে বেরিয়ে পড়েছে, সেখান থেকেও শুধু ওদের বাড়ির সেই কোণের দিকটা। দেখা যায়, যেদিকটা চাবিবন্ধ পড়ে থাকে।

তারপর তো হঠাৎ একদিন খবর এলো, ওই অংশের মালিক ছুটি পেয়ে অন্যত্র চলে গেছে, আর কোনোদিন এসে ওই তালার চাবি খুলবে এমন আশা নেই।

নির্মলের বৌ হয়তো কদাচ কখনো এসেছে, তারপর ছেলের কাছে কোথায় যেন থেকেছে সেই ছেলে যে এতো বড়ো হয়ে গেছে, যার ছেলে একটা গোলমাল বাধাতে পারে, এটা বুঝতে সময় লাগলো বকুলের।

তারপর আস্তে আস্তে মনে পড়ল, অসম্ভব হতে যাবে কেন? দিন মাস বছর গড়িয়ে চলেছে নির্ভুল নিয়মে।

আমরা যদি কাউকে ভুলে যাই, ভুলে থাকি, সে কি বাড়তে ভুলে যাবে? কিন্তু সেই অতোটুকু টা কতটুকু? কোথায় বসে বাধালো সে গোলমাল? ওই জরাজীর্ণ দেয়ালটার ওধারের চাবিবন্ধ ঘরগুলোর চাবি খোলা হয়েছে নাকি? রাস্তা থেকে শুধু সামনের ওই পানের দোকানটা, আর দোতলার বারান্দার রেলিং-এর জানলার কার্নিশে ভাড়াটেদের ঝুলন্ত জামা কাপড় গাছা লুঙ্গি বিছানা শতরঞ্জি ব্যতীত আর কিছু দেখতে পাওয়া যায় না।

তবু বোকাটে চোখে ওই বাড়িটার দিকেই তাকালো বকুল। যেন ছোড়দার বলা ওই শব্দগুলোর পাঠোদ্ধার হবে ওখানের দেয়ালে দেয়ালে।

ছোড়দা যে বকুলকে বাড়ির ভেতরে যেতে বললো সেকথা ভুলে গিয়ে বকুল আস্তে বললো, কতো বড়ো ছেলে?

আরে কতো বড়ো আর হবে! বছর বারো-তেরো! নিজেরও তেমন সাতসকালে বিয়ে হয়েছিল, ছেলেরও তো তাই দিয়েছিল। দিয়েছিল ভালই করেছিল, জীবনের কাজ-কর্তব্য চুকিয়ে গেছে। আমারই কিছু হোলো না। যাক শুনো পরে

ছোড়দার কথায় যেন একটা ক্ষুব্ধ আক্ষেপের সুর! যেন নির্মল নামের সেই চালাকচতুর লোকটা বকুলের ছোড়দার থেকে জিতে গেছে!

বকুলের চিন্তার মধ্যে এখন আর ওই বয়েসের অঙ্কটা ঢুকলো না, ওর শুধু মনে হলো জীবনের কাজ-কর্তব্য বলতে কি ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে ফেলা? ছোড়দা সেটা পেরে ওঠেনি বলে ছোড়দা ক্ষুব্ধ?

ছোড়দা আবারও নির্দেশ দিলল, শুনো পরে।

কী সেই গোলমেলে ব্যাপারটা, যা অতোটুকু ছেলের দ্বারা সংঘটিত হতে পারে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর প্রশ্ন চলে না। তবু বকুল আর একটা কথা বললো, বললো, তুমি এসময় এভাবে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে?

ছোড়দা যেন আত্মধিক্কারের গলায় বলেন, আমাদের আবার এভাবে সেভাবে! দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির মধ্যে ছটফটানি ধরলো বলে!

তোমার–, থেমে গেল বকুল।

বকুলের হঠাৎ মনে পড়লো, শীগগিরের মধ্যে রিটায়ার করার কথা ছিল ছোড়দার, বোধ হয় সেই ঘটনাটাই ঘটেছে। তাই তোমার অফিসের বেলা হয়ে যাচ্ছে না? বলতে গিয়ে থেমে গেল।

ভিতরে ঢুকতেই আর এক পরম লজ্জার মুখোমুখি দাঁড়াতে হলো বকুলকে। বকুল সত্যিই এটা ভাবেনি। ওকে ঢুকতে দেখেই ছোটবৌদি বলে উঠলো, পেয়ারের ভাইঝিকে নিজের তিনতলায় নিয়ে তোলোগে বাবা, তোমার দাদা দেখলে পরে আগুন হয়ে উঠবে। একেই তো নানা কাণ্ডয় ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।

তার মানে এরা ধরেই রেখেছিল বকুল খবর পেয়ে শম্পাকে আনতে ছুটলো! এবং এ-ও ধরে রেখেছিল, আমরা যতই বারণ করি ও যা করতে যাচ্ছে ঠিকই তা করবে!

ছোঁড়দার ওপর মায়া হয়েছিল, কিন্তু এখন যেন আর সে-বস্তুটা তেমন এলো না বকুল নিজস্ব স্থিরতার খোলসে ঢুকে পড়ে বললো, গাড়ি থেকে নামতেই ছোড়দাও এইরকম কী এক বললো, মানে বুঝতে পারিনি, তোমার কথারও পারছি না। আমি শম্পাকে নিয়ে এসেছি এরকম একটা ধারণা কেন হলো তোমাদের।

ছোটবৌদি এই পরিষ্কার ধারালো কথাটার উত্তরের দিক দিয়ে গেল না, কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখে বললো, আসেনি?

বকুল তেমনি স্থির গলায় বলে, আসার কথাটাই যে উঠছে কেন তা বুঝছি না, তাছাড়া তোমরা তো বিশেষ করে বারণ করে দিয়েছিলে!

হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটলো।

অপ্রত্যাশিত এবং অভূতপূর্বও বটে।

ছোটবৌদিকে কে কবে কেঁদে ফেলতে দেখেছে?

অন্তত বকুল কখনো দেখেনি এটা নিশ্চিত। সেই হঠাৎ কেঁদে ফেলা বিকৃত গলায় বলে উঠলো ছোটবৌদি, সেই বারণ করাটাই এতো বড়ো হলো তোমার কাছে?

বকুল স্তব্ধ হয়ে গেল।

বকুলের নিজেকে হঠাৎ ভারী ছোট মনে হলো। বকুল বরাবর যাকে (অস্বীকার করার উপায় নেই) মনে মনে প্রায় অবজ্ঞাই করে এসেছে, সে যেন সহসা বকুলের থেকে অনেকটা উঁচু আসনে উঠে গেল।

বকুলের ইচ্ছে হলো ছোটবৌদির খুব কাছে সরে যায়, ওর গায়ে একটু হাত ঠেকায়, মমতার গলায় বলে, ওটা আমি মনের দুঃখে বলেছিলাম ছোটবৌদি, ওর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো নিয়ে না এসে ছাড়তাম না, কিন্তু দেখাই হয়নি!

কিন্তু অনভ্যাসের বশে পারলো না বকুল।

ওই অন্তরঙ্গতার সুর অনেকদিন হারিয়ে ফেলেছে বকুল। অথবা ছিলই না কোনোদিন। হয়তো তাই–ছিলই না কোনোদিন।

ছেলেবেলা থেকেই অদ্ভুত একটা নিঃসঙ্গতার দুর্গে বাস বকুলের।

সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই তার, ক্ষমতা নেই কারো অন্তরঙ্গ হবার। সে দুর্গের একটি মাত্রই দরজা আছে, সে দরজার চাবি তো অন্যের কাছে।

অথচ লোকে কত সহজেই অন্তরঙ্গ হতে পারে। ওই ছোটবৌদির ব্যাপারেই দেখেছে একদা যখন বড়বৌদির সঙ্গে মুখ-দেখাদেখি নেই, সেইরকম সময় হঠাৎ ছোটবৌদির বাবা মারা যাওয়ার খবর এলো। বকুল কাঠ হয়ে ছোটবৌদির ধারে-কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো, দেখলে বড়বৌদি কী অবলীলায় ছোট জাকে তুলে ধরে প্রায় বুকে টেনে নিয়েই পৃথিবীর নিয়তি বোঝাতে বসলেন। বোঝাতে বসলেন, মা-বাপ চিরদিনের বস্তু নয়।

যেন আর সবাই চিরদিনের।

পরের দৃশ্যে দেখা গেল বড়বৌদি ছোট জাকে জোর করে তুলে শরবৎ খাওয়াচ্ছেন, হবিষ্যিকালে নেশার জিনিস খেতে নেই এটা মানলেও চা খেতে বিধান দিচ্ছেন এবং ছোট জা’র চতুর্থীর যোগাড় করে দিতে কোমরে আঁচল জড়িয়ে খাটছেন।

দেখে দেখে বকুল হাঁ হয়ে গেছে। বকুলের সাধ্য নেই অমনটি করবার।

কিন্তু ওই না-পারাটা যে একটা বড় রকমের অক্ষমতা, এটা কোনোদিন মনে আসেনি বকুলের। আজ হঠাৎ বকুল টের পেল মস্ত একটা অক্ষমতা আছে তার। তবু বকুল যেটা পারে সেটা করলো। গলাটা নরম করে আস্তে বললে, বারণ করাটা বাজে কথা বৌদি, ওর সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি।

দেখাই হয়নি? ছোড়দার প্রশ্নটাই করলো ছৌটবৌদি। তবু স্বরের পার্থক্য।

ছোড়দা কেমন যেন অবাক তার হতাশ গলায় উচ্চারণ করেছিল প্রশ্নটা। ছোটবোদির গলায় অবিশ্বাসের আঁজ।

সহসা কেঁদে-ওঠা গলায় এই ঝাঁজটা খুব বেমানান লাগলো, আর আরো বেচারী লাগলো মানুষটাকে।

বকুল আস্তে বললো, সত্যিই দেখা হয়নি ছোটবৌদি। আমি যাওয়া মাত্রই সেজদি বলে উঠলো, তুই আজ এলি বকুল? কালকে এলেও মেয়েটার সঙ্গে দেখা হতো।

এতোদিন তো ছিল-

প্রশ্ন না উক্তি?

ঝাঁপসা গলায় যেটা উচ্চারণ করলো শম্পার মা?

এতোদিন যে ছিল সেখানে, সে খবর তো শম্পার মার জানা। শুধু কিছুতেই নত হবো না এই নীতিতেই চুপ করে ছিল। হয়তো বা নিরাপদ একটা আশ্রয়ে আছে জেনে নিশ্চিন্তও ছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে মনটা ভেঙে আসছিল বৈকি।

শান্ত বাধ্য বিনীত সন্তানের বিচ্ছেদব্যথা মাতৃহৃদয়কে যত কাতর করে, তার চেয়ে অনেক বেশী কাতর করে উদ্ধত অবাধ্য দুরন্ত সন্তানের বিচ্ছেদব্যথা। সেই অবাধ্য সন্তানের স্মৃতিমন্থনে যে দুঃসহ বোঝা জমে ওঠে, সে বোঝা তো আপন অপরাধের বোঝ।

অবাধ্য সন্তানকে যে নিষ্ঠুর শাসন না করে উপায় থাকে না, কটু কথা না বলে উপায় থাকে, দুর্ব্যবহার না করে পারা যায় না, সেইগুলোর স্মৃতি তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের মতো প্রতি মুহূর্তেই তো ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে সেই হৃদয়।

সমস্ত নিষ্ঠুর শাসন শতগুণ হয়ে ফিরে আসে নিজেরই কাছে। শম্পার মার এই ভিতরে ভিতরে গুঁড়ো-হয়ে-যাওয়া মনটা বাইরে শক্ত হয়ে থাকবার সাধনায় আরো গুঁড়ো হচ্ছিল, তাই বুঝি মনে মনে একান্তভাবে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিল, বকুল তাদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে মেয়েটাকে নিয়ে আসবে!

বকুলের কথা সেই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা অগ্রাহ্য করতে পারবে না।

বকুলের কথায় সেই প্রত্যাশার পাত্রটি চূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো, শম্পার অহঙ্কারী মা তার চিরদিনের অহঙ্কারটাকেও তাই আর ধরে রাখতে পারলো না।

বকুল সেই গুঁড়ো হয়ে যাওয়া অহঙ্কার আর গুড়ো হয়ে যাওয়া প্রত্যাশার পাত্রখানা দুটোই দেখতে পেলো। বকুল নিঃশ্বাস ফেলে বললো, আমার ভাগ্য। ছিল তো এতদিন, পরশু পর্যন্ত ছিল। কাল আমি গেলাম, আর কালই শুনলাম। মুশকিল এই–কোথায় যে যেতে পারে বোঝা যাচ্ছে না–।

তারপর বকুল আস্তে আস্তে সাবধানে পারুলের কাছে শোনা ঘটনাকে ব্যক্ত করে।

ছোটবৌদির কান্নার চোখ শুকিয়ে উঠেছিল, পাথরের মত বসে থেকে সবটা শুনে বলে ওঠে সে, এ আমাদের পাপের ফল বকুল, বুঝতে পারছি। সব জেনেও আমরা–ওকে আর ফিরে পাব না বকুল! ওকে নিশ্চয় কোনো বদমাইস ভুল বুঝিয়ে নিয়ে গেছে। ঠিকই হয়েছে, উচিত শাস্তি হয়েছে আমার। চিরদিন তোমার উপর একটা হিংসের আক্রোশে ওকে আমি মায়ের প্রাণটা বুঝতে দিইনি, আর ওকেও বুঝতে চেষ্টা করিনি।

বকুল চমকে তাকায়।

এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তির সামনে বকুল আর একবার মাথা নত করে। এ সত্য বকুলের অবোধ্য ছিল না, কিন্তু ওই মানুষটারও যে সে বোধ ছিল, তা তো কোনোদিন বিশ্বাস করেনি। ভেবেছে নিতান্তই অবচেতনে এটা করে চলেছে ও।

অথবা হয়তো সত্যিই তাই।

শুধু আজকেই মেয়েটাকে সত্যিই হারিয়ে ফেলে ওর বোধের দরজা খুলে গেল। আঘাতই তো রুদ্ধ চৈতন্যকে ঘা মেরে জাগায়!

বকুল ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে না, নিজেও যে সে ওই হাহাকারের শরিক! বকুল শুধু নরম গলায় বলে, ছোড়দার সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি কী করা যায়। কিন্তু নির্মলদের বাড়ির কী কথা বলছিলো ছোড়দা?

ছোটবৌদি কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, সে-ও এক কাণ্ড!..বারো-তেরো বছরের ছেলেটা, কিনা বোমা বানাতে গিয়ে হাত-পা উড়িয়ে হাসপাতালে গেছে!

বোমা বানাতে গিয়ে?

অবাক হয়ে তাকায় বকুল।

নির্মলের বংশধর না ছেলেটা? সে গিয়েছিল বোমা বানাতে?

ছোটবৌদি বলে, তাই তো খবর! কুসঙ্গে পড়ে যা হয়! কোথায় কোন বস্তির মধ্যে কার কোন্ আড্ডায় এই সব চলছিল, আশেপাশেরও কেউ জানতো না, হঠাৎ বোমা ফেটে–

কোথায় ছিল ওরা? যন্ত্রের মত উচ্চারণ করে বকুল।

ওমা, এইখানেই তো আজ কতোদিন আছে নির্মলবাবুর বৌ। তা বছর দেড়েক তো হবেই। ছেলে তো বদলির জ্বালায় সাতঘাটের জল খেয়ে বেড়ায়, বাপের চাকরিটাই পেয়েছে, কোম্পানী দিয়েছে দয়াধর্ম করে! নাতিটার পড়া হচ্ছে না বলে ঠাকুমা তাকে নিয়ে এসে ওই পচা বাড়ির মধ্যেই এসে বাস করছিল। ইস্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছিল, কিন্তু মেয়েমানুষে ঘরে বসে কেমন করে জানবে গুণধর নাতি ইস্কুলে যায় না, মাইনেগুলো নিয়ে পার্টির চাঁদা দেয়, তার নিজের ধ্বংসের পথ পরিষ্কার করতে–

কিন্তু ছোটবৌদির এসব কথা কি আর মাথায় ঢুকছিল বকুলের?

বকুলের মাথার মধ্যে যেন একটা ইঞ্জিন চলতে শুরু করেছিল ওর সেই প্রথম কথাটার পর থেকেই।

নির্মলবাবুর বৌ তো অনেক দিনই এখানে রয়েছে।

অথচ বকুল তার খোঁজ রাখে না! বকুল তাকে দেখতে যায়নি।

মাধুরী-বৌ কি জানছে বকুলকে কেউ বলেনি একথা? কেউ খবরটা দেয়নি? না, একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নির্মলের বৌ জানছে, জেনে নিশ্চিন্ত আছে, বকুল নামের সেই মেয়েটা ‘অনামিকা দেবী’ হয়ে গিয়েছে। যশের, খ্যাতির আর অর্থের অহঙ্কারে ‘বকুল’কে সে জীর্ণ বস্ত্রের মত ত্যাগ করেছে।

হয়ত একটু দার্শনিক হাসি হেসেছে নির্মলের বৌ।

কিন্তু এখন কোন্ কাজটা করবে বকুল?

অপরাধীর মুখ নিয়ে সেই দার্শনিক হাসির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে যাবে–বিশ্বাস করো আমি জানতাম না, আমায় কেউ বলেনি!

নাকি শম্পা নামের বিদ্যুতের শিখাটুকু কোথায় হারিয়ে গেল তার খোঁজ করতে ছুটবে? আস্তে আস্তে উঠে গেল তিনতলায় নিজের এলাকায়।

টেবিলে তাকিয়ে দেখলো, অনেকগুলো চিঠি এসে জমে রয়েছে। যত্ন করে পেপার-ওয়েট চাপা দিয়ে রেখে গেছে কেউ।

হঠাৎ যেন অবাক হয়ে গেল বকুল।

ভাবলো আমি এই সংসার থেকে এই সেবা-যত্ন-সহৃদয়তা পাই, কিন্তু কোনোদিন তো ভেবে দেখিনি এগুলো পাচ্ছি! জন্মসূত্রের অধিকারে এগুলো প্রাপ্য বলেই ভেবেছি, অথবা কিছু ভাবিনি। হয়তো ভেবে দেখা উচিত ছিল, হয়তো সেটা দেখলে আমার প্রকৃতিতে কিছু বদল হতো। নিজের চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পেতাম।

উঠে দাঁড়ালো। এদিকের জানলাটা খুলে দেখলো। কিন্তু জানলাটা থেকে তো শুধু পেছনের দেয়ালটাই দেখা যায় ও-বাড়ির।

শ্যাওলা-পড়া নোনাধরা বিবর্ণ।

আমাদের মনগুলোও ক্রমশ এইরকমই হয়ে যায়, এইরকম শ্যাওলা-পড়া নোনাধরা বিবর্ণ।

ভাবি সেই বিবর্ণ চেহারাটা অন্যের চোখে পড়ে না। কিন্তু সত্যি কি পড়ে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *