১৮. বহু-বহুদিন পরে চন্দন এলো

বহু-বহুদিন পরে চন্দন এলো বাপের বাড়িতে। অথবা ভাইদের বাড়িতে।

আবির্ভাবটা অপ্রত্যাশিত।

স্বগত কর্তা প্রবোধকুমারের বড় মেয়ে চাপা বরং কদাচ কখনো এ বাড়িতে আসে, পাকা চুলের মাঝখানটায় সুগোল টাকের উপর বেশ খানিকটা সিঁদুর লেপে আর কপালের মাঝখানে বড় একটা সিঁদুর টিপ– পরে, ঢোলা সেমিজের ওপর চওড়াপাড় একটা শাড়ি জড়িয়ে প্রসাধিত হয়ে এসে পা ছড়িয়ে বসে। যতক্ষণ থাকে, নিজের হাঁটুর বাত, অম্বলশুল ও কর্তার হাঁপকাশ রক্ত আমাশা এবং খেকি মেজাজের গল্প করে, ভাই ভাই-বৌ এবং ভাইপো-বৌদের ওপর বিশ-পঁচিশ দফা নালিশ ঠুকে, বাঁধানোদাঁতের পাটি খুলে রেখে মাড়ি দিয়ে পাকলে পাকলে– সিঙ্গাড়া কচুরি সন্দেশ রসগোল্লা খেয়ে, বকুল সম্পর্কে কিছু তথ্য আর তার লেখা দু’চারটে বই সংগ্রহ করে চলে যায়। বকুলের সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয়, কোনোদিন দেখা হয় না। দেখা হলে প্রত্যেকবারই নতুন করে একবার জিজ্ঞেস করে, তা নিজের অমন খাসা নামটা থাকতে এই একটা অনামা-বিনামা নামে বই লিখতে যাস কেন?

তারপর ফোকলা মুখে একগাল হেসে বলে, আমার দ্যাওরঝি ভাসুরপো-বউরা আর নাতনী ছুঁড়িটা তোর নাম করতে মরে যায়! এইসব বইটই ওদের জন্যেই নিয়ে যাওয়া। আমি বাবা সাতজন্মেও নাটক-নভেল পড়ি না। তা ওদেরই একশো কৌতূহল। তুই কেমন করে লিখিস, কেমন করে হাঁটিস চলিস, উঠিস বসিস, এই সব। আমি বলি, আরে বাবা, আমাদেরই বোন তো, যেমন আমরা, তেমনি। চারখানা পাও নেই, মাথায় দুটো সিংও নেই। তবে বে থা করলো না, গায়ে হাওয়া দিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো, তাই ডাঁটো আছে।..তা ছুঁড়িদের খুব ইচ্ছে বুঝলি তোর সঙ্গে দেখা করবার, মানে তোকে একবার দেখবার, আমিই আনি না।

বকুল মৃদু হেসে বলে, তা আনো না কেন?

চাপা হয়তো ফট করে দালানের কোণে, কি সিঁড়ির কোণে খানিকটা পানের পিচ ফেলে মুখ হালকা করে নিয়ে বলে, আনা মানেই তো আমার জ্বালা। তাদের জন্যে গাড়ি ভাড়া কারো, হাপিত্যেশী হয়ে বসে থাকো কতোক্ষণে সাজগোজ হবে, আবার ফেরার জন্যে তাগাদা থাকবে, অতো ভালো লাগে না। এ বাবা স্বাধীনভাবে এলাম, দু-দণ্ড বসলাম, মুখ খুলে সংসারের দুটো গল্পগাছা করলাম, চুকে গেল। ওদের তাই বলি, সেই অনামী দেবীকে দেখে তোদের কী চারখানা হাত গজাবে রে?…তা তখন বলে, বেশ তবে ওঁর বই নিয়ে এসো? দে বাবা দু’চারখানা বই-ই দে।

চাঁপাকে সুবর্ণলতার মেয়ে বলে মনেই হয় না।

ফেরার সময় বইয়ের প্যাকেট বাঁধতে বাঁধতে আর একটি কথাও বলে যায় চাঁপা, এখন তো নতুন আইনে মেয়েরাও বাপের সম্পত্তি পাচ্ছে, তা আমাদের কপালে আইনকানুন সব মিথ্যে, যে ঘাসজল সেই ঘাসজল! তুই তবু চালাকি করে বাবার বাড়িটা খুব ভোগ করে যাচ্ছিস!

বকুল মৃদু হাসে।

হাসিটা কি নিজের চালাকির মহিমায়?

চাঁপার ওই আসাটা দৈবাতের ঘটনা হলেও, তবু ঘটে কদাচ কদাচ।

কিন্তু চন্দন?

তার চেহারাটাই তো প্রায় ভুলে গেছে এ বাড়ির লোকেরা। অথচ এমন কিছু দূরে সে থাকে না। থাকে রাণাঘাটে।

তবু চন্দনের পায়ের ধুলো এ বাড়িতে দুর্লভ।

চন্দনের শ্বশুর রাণাঘাটের এক নামকরা উকিল ছিলেন, সেখানে তিনি প্রচুর বিষয় সম্পত্তি করে রেখে গিয়েছিলেন–জমিজমা বাগানপুকুর ধানচাল। চন্দনের স্বামী জীবদ্দশাকাল সেই ভাঙিয়ে খেয়েছেন। এখন চন্দনই তার মালিক! ছটা মেয়ে চন্দনের, ছেলে নেই, মেয়েদের প্রায় সব কটাই বিয়ে হয়ে গেছে। একটাই বুঝি আছে এখনও আইবুড়ো। তবু চন্দনের মরবার সময় নেই।

সেই দুর্মূল্য সময় থেকে কিছুটা বাজে খরচ করে, এবং রেলগাড়ি ভাড়া খরচ করে চন্দন হঠাৎ ভাইয়ের বাড়ি এলো কেন, এটা দুর্বোধ্য। মেয়েদের বিয়েতে ডাকে একটা নেমন্তন্ন পর পাঠানো ছাড়া আর তো কোন যোগাযোগই রাখে না। এরাও অবশ্য নয়। পত্রোত্তরে কিছু মনিঅর্ডার, ব্যস!

এসে দাঁড়িয়েই বিস্ময় আনন্দ এবং কৌতূহলের প্রশ্ন শিকেয় তুলে রেখে দিন আগে ট্যাক্সি থেকে নামানো জিনিসপত্রগুলো নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাড়ির সবাই এখনো এক হাঁড়ির না ভিন্ন হাঁড়ির, এ প্রশ্ন তাকে উতলা করে তোলে। ভিন্ন হাঁড়ি হলে তো যা কিছু এনেছে যথা রাণাঘাটের বিখ্যাত কাঁচাগোলা এবং মানকচু, কচি ট্যাড়শ, সজনেডাঁটা, কাঁচা পেপে ইত্যাদি, সবই ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ করতে হবে।

কিন্তু জিজ্ঞেস করাও তো কঠিন।

তবে কথার কৌশলেই জগৎ চলে এই ভরসা। চন্দন হাঁক দিয়ে বলে, কই গো গিন্নীরা, সবাই রান্নাঘরে নাকি? দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখবে কোন্ দিক থেকে কে আসে।

খবরটা ইতিমধ্যেই রটে গিয়েছিল এবং সকলেই সচকিত হয়ে উঁকিবুকি দিচ্ছিল, উনি হঠাৎ কেন? অপ্রতিভ হবার কথা ওনারই, কিন্তু উনি অপ্রতিভ হবার মেয়ে নন, উনি ওঁর ঠাকুমা মুক্তকেশীর হাড়ে তৈরী। তাই উনি কোনোদিকে না তাকিয়ে সঙ্গের লোকটাকে নির্দেশ দিতে থাকেন, মাছটা উঠোনে রেখে ওই কলে হাত ধুয়ে তবে অন্য জিনিসে হাত দে। রোস রোস, টোপাকুলগুলো যেন চটকে ফেলিস নে। আচার তৈরি করেই আনবো ভেবেছিলাম, তা হুট করে আসা হয়ে গেল-সঙ্গী তো জোটে না সব সময়। ভাই-ভাজ তো আর ডাকবে না কখনো, তবু বাপের ভিটে মা-বাপের স্মৃতি একবার তো চোখেও দেখতে ইচ্ছে করে!… বড় পুকুরে জাল ফেলাতে পারলাম না এইটাই খেদ রয়ে গেল–হঠাৎ আসা তো। মেয়েটি কার? বিয়ে হয়নি দেখছি।..মাথায় ও কিসের খোঁপা রে? আমের টুকরি বসিয়ে তার ওপর চুড়ো বানিয়েছিস নাকি? এই এক বিটকেল ঢঙের খোঁপার ফ্যাশান হয়েছে বাবা। আমাদের রাণাঘাটেও কসুর নেই। যাদের পেটে ভাত জোটে না, তাদেরও মাথায় এতো বড়ো খোঁপা! …কানুর বৌকে দেখছি না যে? তারপর বকুল কোথায়? বই-লিখিয়ে বোন আমাদের? তার তো খুব নামডাক। রাণাঘাটেও কমতি নেই।…বকুল বাড়ি নেই? কোথায় গেছে?

অপূর্বর বৌ অলকা মুচকে হেসে বলে, কোথায় গেছেন তা আর কে জানতে যাচ্ছে?

ওমা সে কি! কোথায় যায় বলে যায় না? যতই মিটিং করুক আর লেকচার মারুক, মেয়েমানুষ বেরোবার সময় বাড়িতে বলে যাবে না?…স্বাধীন জেনানা হয়ে গেছেন বুঝি? আমার মেয়েরা তো নিত্যিই খবর-কাগজ এনে খুলে দেখায়, এই দেখো তোমার বোনের ছবি, মা এই দেখো তোমার বোনের নাম। তা আমি বলি, তোরা ওই অনামী দেবীকে দ্যাখ, তোরা গদগদ হ! আমার কাছে সেই চিরকেলে বোকা মুখচোরা বকুলই হচ্ছে বোন। মুখে একটা বাক্যি ছিল না, কেউ অন্যায় করে শাসন করলে বলতে জানতো না, শুধু শুধু বকছো কেন? আমি তো ও দোষটা করিনি! সেই বকুল লেকচার দিয়ে বেড়ায় শুনলে হাসি পায়। অবিশ্যি আমাদের তো বাবা অতি সকালে গলা টিপে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে খালাস হয়েছিলেন, পরে পারুল বকুলকে আধুনিক-টাধুনিক করে মানুষ করে থাকবেন। ছেলেদের তাই বলি, ওরে এক মায়েরই পেটের আমরা, তোদের মাকেও অতি সকালে গোয়ালে ঢুকিয়ে না দিলে, তোদের মাসির মতোই হতে পারতো!…তবে বাবা এও বলবো, বকুল একটা কীর্তি রাখা কাজ করেছে বিয়ে না করে। এ বংশের তিনকুলে কেউ আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবে না। প্রথম প্রথম তো শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে পারতাম না, বাপের বাড়ি আসা বন্ধই হয়ে গিয়েছিল ওই কারণে

অপূর্বর বৌ অলকা মৃদু হেসে বলে, সে সব তো ক্লাইভের আমলের কথা।

চন্দন মহোৎসাহে বলে, তোমাদের কাছে তাই আমাদের কাছে যেন এই সেদিন। সে যাক, মিষ্টিটা ঘরে তোলো গো কেউ, পিঁপড়ে ধরবে। কুলগুলো এইবেলা রোদে ফেললে হতো!

মানকচু, কাঁচা পেপে, টোপাকুল, কাতলা মাছ–সব কিছুর সঙ্গে বাড়ির প্রসঙ্গ মিশিয়ে মিশিয়ে একাই সব কথা কয়ে যায় চন্দন।

অলকা আর তার মা ঘরে ঢুকে হাসাহাসি করে বলে, আজব চীজ!

কানুর বৌ ঘরে বসেই কাকে বলে, ভাগ্যিস ওঁর বাপের বাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! না হলে হেসেই মারা যেতে হতো আমাদের। কিন্তু হঠাৎ এরকম আসার কারণটা কী বুঝতে পারছো?

কানু বলে, তাই ভাবছি।

এই মেজকর্তা মেজগিন্নী সাতে-পাঁচে থাকেন না, বাড়িতে যে ধরনের ঘটনাই ঘটুক তারা নির্লিপের ভূমিকা অভিনয় করে যান, তবু তারাও চন্দনের আগমন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। সকলেরই এক চিন্তা-ইনি কেন হঠাৎ?

বকুল ফিরলো সন্ধ্যার পর।

দরজায় ছোট চাকরটা বসে ছিল, তাড়াতাড়ি বলে উলো, পিসিমা, আপনার একজন বোন এসেছেন বিদেশ থেকে।

বকুলের বুকটা আহ্লাদে ধক করে উঠলো, পারুলের ঝকঝকে মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার। পারুল ছাড়া আর কে? দিদি মানে তো পারুল!

সত্যি বলতে, চাঁপা চন্দনকে কোনোদিনই তার নিজের দিদি বলে মনেই হয় না। একে তো তার জ্ঞানের আগেই ওদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাছাড়া ওলের সঙ্গে বকুল পারুলের মানসিক ব্যবধান আকাশ-পাতাল।

পারুলের আর্বিভাব আশায় বকুলের মনের ভারটা ভারী হাল্কা হয়ে গেল। হা, মনের ভার একটা ছিল বৈকি। শম্পা চলে যাওয়ার সব দোষটাই তো ছোড়দা ছোটবৌদি অব্যক্তভাবে তারই উপর চাপিয়ে বসে আছে।

অথবা একেবারে অব্যক্তও নয়। যখন জানা গেল বাপের নাকের সামনে দিয়ে সেই যে চটি পায়ে দিয়ে আচ্ছা তোমার আদেশ মনে রাখবো বলে বেরিয়ে গেল শম্পা, সেটাই তার শেষ যাওয়া–তখন তো বকুলকে নিয়েই পড়েছিল তার ছোড়দা ছোটবৌদি। এমন কি ভাইপো অপূর্ব এবং তস্য স্ত্রী-কন্যা পর্যন্ত।

নিজেই যখন খুব চিন্তিত বকুল, মেয়েটা কোথায় যেতে পারে ভেবে (কারণ বকুলের তো ওই যাত্রাকালীন ইতিহাসটা জানা ছিল না), তখন যে-ছোড়দা জীবনে কখনো তিনতলার এই ঘরটার ছায়াও মাড়ায় না সে একেবারে সস্ত্রীক উঠে এসে বলে উঠল, শ্রীমতী অনামিকা দেবীর মূল্যবান সময় একটু নষ্ট করতে এলাম!

অনামিকা দেবী!

বকুল একবার ছোড়দার মুখের দিকে তাকালো, তার মুখে এলো হঠাৎ পাগলামি শুরু করলে কেন? কিন্তু তা সে করলো না, সঙ্গে সঙ্গে অনামিকা দেবীই হয়ে গেল সে। স্রেফ বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার মতো শান্ত ভঙ্গীতে বললো, বোস, কী বলবে বল।

নতুন করে বলার কিছু নেই, বললো পিছনে দাঁড়ানো অপূর্ব। ইতিপূর্বে অপূর্বকে কোনোদিন তার ছোট কাকার এমন কাছাকাছি দেখেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না গাম্ভীর্যময়ী অনামিকা দেবী! সেই গাম্ভীর্যের অন্তরালে এক টুকরো ব্যঙ্গ হাসি খেলে গেল–ওঃ, পারিবারিক মানমর্যাদার প্রশ্ন যে! এ বাড়িতে যেটা বরাবর বাড়ির পুরুষদের মৈত্রীবন্ধনে বেঁধেছে। বাবার সঙ্গে বড়দার কোনোদিনই হৃদ্যতার বালাই ছিল না, কিন্তু বকুলের নির্মলদের বাড়িতে যাওয়া-আসার ব্যাপার নিয়ে পিতাপুত্রে রীতিমত একদল হয়েছিলেন।

অনামিকা অপুর্বর এই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন শুধু, কিছু বললেন না। অপূর্ব বললো বাকি কথাটা–শম্পার ব্যাপার নিয়েই কথা হচ্ছে। তার ঠিকানাটা তো জানা দরকার।

অনামিকা খুব স্থিরভাবে বললেন, সেই ঠিকানাটা আমার খাতায় লেখা আছে, এইটাই কি তোমাদের ধারণা?

এবার ছোড়দা উত্তর দিলেন, সে ধারণাটা খুব অস্বাভাবিক নয় নিশ্চয়ই?

আমার তো খুবই অস্বাভাবিক ঠেকছে।

এটা হচ্ছে তোমার এড়িয়ে যাওয়া কথা বকুল, তোমার কাছেই ছিল তার সব কথা, সব গল্প।

এ কথাটা বললেন ছোট বৗদি।

অনামিকা দেবীর ভঙ্গীতেই মৃদু হাসলো বকুল, তোমাদের তো দেখছি ত্রিশক্তি সম্মেলন, একা কী পেরে উঠবো? তবে এটা তোমাদের বোধ হয় ভুলে যাবার কথা নয়, শম্পা কোনো পূর্বপরিকল্পিত ব্যবস্থায় বাক্সবিছানা বেঁধে নিয়ে চলে যায়নি। কথা বলতে বলতে জেদের মাথায় চলে গেছে, আমি অন্ততঃ যা শুনেছি তোমাদের কাছে। অতএব আমার পক্ষে ওর ঠিকানা জানার প্রশ্নই ওঠা অদ্ভুত বৈকি। ব্যবস্থা করে যদি যেতো, হয়তো আমায় জানিয়ে। যেতো।

হয়তো কেন নিশ্চয়ই, সব পরামর্শই তো তোমার সঙ্গে– ছোটবৌদি পুঞ্জীভূত ঝাল উদ্গীরণ করে বলেছিলেন, মা মুখ্যু, সেকেলে গাঁইয়া, পিসী বিদুষী, আধুনিকা, সভ্য–কাজেই মার চেয়ে পিসীর মানসম্মান বেশী হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে এটাও বলবো–তুমি যদি সত্যিই ওর হিতৈষী হতে, তা হলে ওকে ওর ইষ্ট-অনিষ্ট বোঝাতে। তা তুমি করোনি, শুধু আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে নিজের দলে টেনেছে।

দলে! অনামিকার মুখটা হঠাৎ খুব বেশী লাল দেখায়, তবু কথা তিনি খুব নিরুত্তেজ গলাতেই বলেন, আমার যে বিশেষ কোনো দল আছে, তা তো আমার নিজেরই জানা ছিল না ছোটবৌদি! তবে দল থাকলে দলে টানার চেষ্টা থাকাটাও স্বাভাবিক।

এটা ঝগড়া করবার সময় নয়, ছোড়দা গম্ভীর গলায় বলে উঠেছিলেন, একটা পারিবারিক সুনাম-দুর্নামের প্রশ্ন নিয়ে কথা হচ্ছে। তোমার যদি জানা থাকে বকুল তবে সেটা বলে ফেলাই উচিত, সে বারণ করলেও।

কিন্তু আমার উত্তর তো আগেই শুনে নিয়েছ ছোড়দা। ঠিকানা ঠিকঠাক করে যদি কোথাও যেতো শম্পা, তাহলে হয়তো আমাকেই দিয়ে যেত ঠিকানাটা কিন্তু ঘটনাটা তো তা নয়!

কিন্তু মা-বাপকে বাদ দিয়ে তোমাকেই বা দিতো কেন?

অনামিকা হেসে ফেলেছিলেন, এ ‘কেন’র উত্তর আমার জানা নেই ছোড়দা। মেয়েটা কাছে থাকলে তাকেই করা চলতো প্রশ্নটা।

প্রশ্রয় দিলেই সে সুয়ো হয়, ছোটবৌদি তীব্র গলায় বলেন, কাঁদের সঙ্গে মিশতো সে, সে খবর তো জানা আছে তোমার, সেইগুলোই না হয় বলো।

যাদের সঙ্গে মিশত, তাদের আকৃতি-প্রকৃতির পরিচয় সে মাঝে মাঝে আমায় দিতে আসতো। কিন্তু ঠিকানা? কই মনে তো পড়ছে না!

তা হলে তুমি বলতে চাও জলজ্যান্ত মেয়েটা কর্পূরের মতোন উপে যাবে, আর সেটাই মেনে নিতে হবে?

হঠাৎ ছোটবৌদির চোখ থেকে একঝলক জল গড়িয়ে পড়েছিল।

অনামিকা সেই দিকে তাকিয়ে দেখে আস্তে বকুলের কাঠামোয় ফিরে এসেছিলে, নম্রকোমল গলায় বলেছিলেন, আমি এই অদ্ভুতটা চাই, তা কেন ভাবছো ছোটবৌদি? সত্যিই বলছি আমি তোমাদের মতোই অন্ধকারে আছি।

সে কথা বলে তুমি নিশ্চিন্দি হয়ে উপন্যাস লিখতে বসতে পারো বকুল, আমরা পারি না।

ছোটবৌদির গলায় কাঠিন্য, কিন্তু চোখে এখনো জল। বকুলকে অতএব নম্র আর কোমলই থাকতে হয়। বলতেই হয়, সে তো সত্যি কথাই বৌদি। মা-বাপের মনপ্রাণের সঙ্গে আর কার তুলনা!

ছোড়দাও এবার কোমল হয়েছিলেন, বলেছিলেন, না, সে কথা হচ্ছে না, তুইও ওকে মা বাপের থেকে কম ভালবাসিস না, বরং বেশীই। আর সেইজন্যেই তোকে ব্যস্ত করতে আসা। মনে হচ্ছে খবরটবর যদি কিছু দেয় সেই উদ্ধত অহঙ্কারী নিষ্ঠুর মেয়েটা, তোর কাছেই দেবে। যদি দেয় সঙ্গে সঙ্গে জানাস।

বকুল চোখ তুলে একটু হেসেছিল। যে হাসিটা কথা হলে এই দাঁড়াতো, সেটা আবার বলছো?

আর সেই সময়ই হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল বকুলের, যেন যুগযুগান্তর পরে ছোড়দা তাকে ‘তুই’ করে কথা বললো।

বকুলের একান্ত বাসনা হতে থাকে কালই যেন খবর আসে শম্পার, আর সেটা যেন ওর মা-বাপের কাছেই আসে। বকুলের গর্ব খর্ব হোক, সেটাই প্রার্থনা। সে প্রার্থনা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যেন মাথা তুলতে পারবে না বকুল।

কিন্তু তারপর কতগুলো দিন কেটে গেল, কারুর গর্বই বজায় রইল না, খবর এলো না শম্পার। না পিসির কাছে, না মা-বাপের কাছে।

তবু কি ওরা সবাই ভাবতে বসবে, রাগের মাথায় বেরিয়ে যেতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে শম্পা? কিন্তু তাই বা ভাবতে পারছে কই? তেমন খবর কি চাপা থাকে? তেমন খবর চাপা থাকে না নিশ্চয়ই।

কোনো খবরই চাপা থাকে না। বিশেষ করে দুঃসংবাদের।

দুঃসংবাদের একটা দুরন্ত গতিবেগ আছে, সে বাতাসের আগে ছোটে। নইলে শম্পার এই হারিয়ে যাবার খবরটা শম্পাদের সমস্ত আত্মীয়জনের কাছে পৌঁছয় কি করে?

পৌঁছয় বৈকি, নইলে হঠাৎই বা কেন এদের বাড়িতে এতো আত্মীয়-বন্ধুর পদধূলি পড়তে থাকে? আর কেনই বা তারা অনেক গল্পগাছা করে উঠে যাবার প্রাক্কালে হঠাৎ সচকিত হয়ে প্রশ্ন করেন, শম্পাকে দেখলাম না যে!

শম্পার আরো ভাই বিলেতে আছে, বাড়িতে আরো মেয়েটেয়ে আছে সেজ কর্তার দিকে, সকলের কথা তো মনে পড়ে না সকলের।

গোঁজামিল দেওয়া একটা উত্তরে তারা সন্তুষ্ট হন না, শুধু সন্তোষভাব দেখান। কিন্তু মুখের চেহারা অন্য কথা বলে।

তথাপি ওই প্রশ্নটা যে নিরুদ্দেশ রাজার উদ্দেশ করিয়ে ছাড়বে, রাণাঘাট থেকে এ বাড়ির কর্তার বহুদিন নিরুদ্দিষ্ট মেজো মেয়ে সেই প্রশ্নটা বহন করে আনবে, এতোটা কেউ আশা কারেনি। আশা করবার মতো নয় বলেই করেনি।

তাই বিদেশ থেকে বোন এসেছে শুনে আশায় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল বকুলের বুক।

বকুলের চোখের সামনে পারুলের ঝকঝকে চেহারাটা ভেসে উঠেছিল।

কিন্তু

কিন্তু তার বদলে?

তার বদলে চির-অব্যবহৃত ‘মেজদি’ শব্দটার পোশাক-আঁটা অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষটা বকুলের ঘরে এসে বকুলের মুখের কাছাকাছি মুখ এনে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে, হারে, মানুর মেয়েটা নাকি কোন একটা ছোটলোকের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে?

বকুল চমকে উঠলো।

তার ভিতরের রুচি নামক শব্দটাই যেন সিঁটিয়ে উঠলো এ প্রশ্নে। আর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ মনে হলো বকুলের, ইনি আমার সেজদিরও সহোদরা বোন। ইনি আমাদের মায়ের গর্ভজাত।

আশ্চর্য বৈকি!

ভাবলে কী অদ্ভুত আশ্চর্য লাগে! একই মানুষের মধ্যেই সৃষ্ট হয় কতো বর্ণ-বৈচিত্র্য, কতো জাতি-বৈচিত্র্য! মেজদি আর সেজদি কি এক জাতের?

বড়দি আর আমি? অথবা সবই পরিবেশের কারসাজি?

ওই ভাবনাটার মাঝখানেই মেজদি আবার প্রশ্ন করে উঠলো, কথাটা তাহলে সত্যি? বাবার বংশে তাহলে সব রকমই হলো?

বকুল মুখটা একটু সরিয়ে নিয়ে একটু কঠিন হেসে বললো, শুধু আমাদের বাবার বংশে কেন মেজদি, আজকের দিনে সকলের বংশেই সব রকম হচ্ছে!

হচ্ছে? সবাইয়েরই হচ্ছে?

হচ্ছে বৈকি। আর সেটা তো হতেই হবে। কালবদল হবে না? যুগবদল হবে না? সমাজের রীতিনীতি আচার-আচরণ সব অনড় হয়ে থাকবে? মানুষ চিরকাল এক ছাঁচেই থেকে যাবে?

এ ধরনের কথা বড় একটা বলে না বকুল। বললো শুধু মানুষটা তার একান্ত অন্তরঙ্গ হয়ে একান্তে তার ভাই-ভাইবৌ-ভাইঝির সমালোচনা করতে বসেছে দেখে।

বকুলের এই তিনতলার ঘরটাতেই বিছানা বিছানো হয়েছে চন্দনের জন্যে, আর অপ্রতিবাদেই সেটা মেনে নিতে হয়েছে বকুলকে। তাই প্রথম থেকেই বকুল আত্মরক্ষায় সচেতন হতে চাইছে।

যুগ যে বদল হয়, কাল যে বদল হয়, এটা স্পষ্ট করে বলে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাইছে। ওই সমালোচনার জাল থেকে।

মেজদি বলে ওঠে, তা তুই তো ও কথা বলবিই! তুই তো আবার নভেল লিখিস! ওই নাটক নভেল আর সিনেমা এই থেকেই তো দেশ ধ্বংস হতে চলেছে!

কে বললে তোমায় এ কথাটা?

বলবে আবার কে? চন্দন গভীর আত্মস্থ গলায় বলে, চোখ নেই দুটা? দেখতে পাচ্ছি না? কী ছিল সমাজ, আর কী হয়ে উঠেছে?

খারাপ হয়ে উঠেছে কিছু?

খারাপ নয়? চন্দন গালে হাত দেয়, আজকাল যা হচ্ছে তা খারাপ নয়, ভালো হচ্ছে? এই যে মেয়েগুলো হুট হুট করে পৃথিবী পয়লট্ট করছে, এটা ভালো? এই তো আমার সেজমেয়ের ননদটা, বিয়ে হলো আর বরের সঙ্গে আমেরিকা চলে গেল, এটাকে তুই খুব ভালো বলিস?

বকুল হেসে ফেলে, খারাপই বা কী? নিজের বরের সঙ্গেই তো?

বাবা বাবা, তোর সঙ্গে কথা কওয়া ঝকমারি! তুইও অতি আধুনিক হয়ে গিয়েছিস! বর হলেই অমনি তাকে ট্যাকে পুরতে হবে? দুদিন সবুর কর! যেখানে বিয়ে হলো তাদের সঙ্গে একটু চেনাজানা কর! তা নয়, জগতে শুধু বরটি আর বৌটি। যেন জীবজন্তু, পাখী-পক্ষী। ত্রিভুবনে আর কেউ নেই, শুধু উনিটি আর আমিটি। তাও তো সেই জুটিটিও ভাঙছে, যখন ইচ্ছে তখন আর একটার সঙ্গে জোড় বেঁধে ভাঙা সংসার জুড়ে নিয়ে দিব্যি আবার সংসার করছে। তবে আর এতকাল ধরে পৃথিবীতে এতো বেদ পুরাণ শাত্তর পালা গড়া হলো কেন? এই রকম চললে মানুষ এরপর হয়তো গাছের ফল পাতা খাবে আর উলঙ্গ হয়ে বেড়াবে যা দেখছি!

বকুল এঁর মতবাদে চমৎকৃত হয়, আবার শঙ্কিতও হয়, এঁকে নিয়ে সারা রাত্তিরটা কাটাতে হবে বকুলকে! হয়তো মাত্র একটা রাত্তিরই নয়, একাধিক রাত্তির!

অথচ পারুলও আসতে পারতো। আশ্চর্য, পারুলের একবারও মা-বাপের স্মৃতি-সম্বলিত বাড়িটার কথা মনে পড়ে না?

চন্দনের আবার মুহুর্মুহু দোক্তা খাওয়ার অভ্যাস, সেই বিজাতীয় গন্ধটা থেকে নিজেকে খানিক তফাতে সরিয়ে এনে বকুল বলে, তা এক সময়ে তো মানুষ তাই বেড়াত মেজদি, আর লোকে সেটাকেই “সত্যযুগ” বলে।

অনাছিষ্টি কথা বলিসনে বকুল, দেখছি তোর মতিগতি একেবারে বেহেড হয়ে গেছে। ছোটবৌ দুঃখ করে যা বললো, তা দেখছি সত্যি!

বকুল চমকালো না। চুপ করে থাকলো। ছোটবৌ দুঃখ করে কী বলেছে সেটা সে অনুমান করতে পারছে।

চন্দন কৌটো খুলে পান বার করে মুখে দিয়ে বললো, তা তোরও বাপু উচিত নয় সোমত্ত মেয়েটাকে এভাবে আস্কারা দেওয়া! লেখিকা হয়ে নাম করেছিস বলে কি মাথা কিনেছিস? কত বড় বংশ আমাদের, সেটা ভেবে দেখবি না?

বকুলের ইচ্ছে হয় না আর এর সঙ্গে তর্ক করে, তবু কথার উত্তর না দেওয়াটা অসৌজন্য এই ভেবে শান্ত গলায় বলে, বড় বংশ কাকে বলে বল তো মেজদি?

মেজদি একটু থতমত খেয়ে বলে, কাকে বলে, সেটা আমি তোকে বোঝাবো? এ বংশে আগে কখনো এদিক-ওদিক হয়েছে?

সেইটেই বড় বংশের সার্টিফিকেট মেজদি?

মেজদি তা বলে হারেন না, তাই বলে ওঠেন, তা আমরা সেটাকেই বড় বলি। সব বংশেই কি আর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ জন্মায়?

তা বটে। বলে একটু হাসে বকুল।

চন্দন উঠে গিয়ে ছাতের কোণে পানের পিক ফেলে এসে বলে, ছোট বৌটার প্রাণে জ্বালাও তো কম নয়। একেই তো ছেলেটা লেখাপড়া শেষ করেও বিলেতে বসে আছে, ভগবান জানেন কী মতলবে, তার ওপর মেয়ে এই কীর্তি করলো

প্রসূন তো বিলেতে চাকরি করছে

তুই থাম বকুল! বিলেতে চাকরি করছে। বিলেতে আর চাকরির উপযুক্ত লোক নেই, তাই একটা বাঙালীর ছেলেকে ধরে চাকরি দিয়েছে! ও সব ভুজুং শোনবার পাত্রী চন্দন নয়। মেম ফেম বিয়ে করেছেন কিনা বাছাধন কে জানে!

বকুল আর একবার নিঃশ্বাস ফেললো। এই ভদ্রমহিলা বকুলের সহোদরা!

চন্দন আবার বলে ওঠে, অবিশ্যি দোষ ছেলে-মেয়েকে দেব না, বাপ-মাকেই দেব। যেমন গড়েছ তেমনি হয়েছে। তুমি গড়তে পারলে শিব পাবে, না পারলে বাঁদর পাবে।

বকুল মৃদু হেসে বলে, তাই কি ঠিক মেজদি? আমাদের মা-বাপ তো তোমাকেও গড়েছেন, আবার আমাকেও–।

মেজদি ভুরু কুঁচকে বলেন, কী বলছিস?

অন্য কিছু না। তোমার বড়দির কত শিক্ষাদীক্ষা, শাস্ত্রজ্ঞান, সে তুলনায় সেজদি আর আমি তো যা-তা! অথচ একই মায়ের

চন্দন এই অভিমতটি পরিপাক করে বলে, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সবই বাবা শ্বশুরবাড়ির। এ সংসার থেকে তো কবেই দূর হয়ে গেছি। নেহাৎ নাড়ির টান, তাই মানুর মেয়েটার বেরিয়ে যাওয়ার খবর শুনে

বকুল শান্ত গলায় বলে, মেজদি, তোমার মেয়েদের খবর বলো

চট করে নিজের জগতে চলে যায় চন্দন। একে একে তার পাঁচ মেয়ের নিখুঁত জীবনী আওড়াতে বসে।

ক্লান্ত বকুলের মাথার মধ্যে কিছুই ঢোকে না। কিন্তু বকুলকে কে উদ্ধার করবে?

.

তা তেমন কাতর প্রার্থনা বুঝি ভগবান কানে শোনেন।

নইলে রাত সাড়ে নটায় একটি ভদ্রমহিলা দেখা করতে আসেন অনামিকা দেবীর সঙ্গে?

ছোট চাকরটার মুখস্থ হয়ে গেছে ভাষাটা, সে সিঁড়ির আধখানা পর্যন্ত উঠেই গলা তুলে ডাক দেয়, পিসিমা, একটি ভদ্রমহিলা দেখা করতে এসেছে আপনার সঙ্গে।

ভদ্রমহিলা! এই রাত্তির সাড়ে নটায়?

বকুল অবাক একটু হয়, তবে এমন ব্যাপার একেবারেই অপূর্ব অঘটন নয়। রাত দশটার পরেও এসে হানা দেয় এমন লোক আছে।

বকুল তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলে, জিজ্ঞেস করে আয় তো কোথা থেকে আসছেন?

জিজ্ঞেস করেছি। জানি তো নইলে আবার ছুটতে হতো। বলল, বল গে জলপাইগুড়ির নমিতা, তাহলেই বুঝতে পারবেন।

ছেলেটা চৌকস। সিনেমা-থিয়েটারের ভৃত্যের ভূমিকাভিনেতাদের মতো উজবুক অদ্ভুত নয়।

এ ছোঁকরা পায়জামা প্যান্ট ভিন্ন পরে না, রোজ সাবানকাঁচা ভিন্ন জামা গেঞ্জি ছুঁতে পারে না এবং পাউরুটি ব্যতীত হাতেগড়া রুটি জলখাবার খেতে পারে না। সপ্তাহে একবার করে সিনেমা যাওয়া ওর বাঁধা এবং বাঙালীর ছেলে হলেও বাংলা নাটকের থেকে হিন্দীকে প্রাধান্য দেয় বেশী। বাবুটাবুদের সামনেই সেই হিন্দী ছবির গানের কলি গুনগুনাতেও কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করে না এবং পুজোর সময় ওকে ধুতি দিলে ধুতি পরতে পারি না, পায়ে জড়িয়ে যায় বলে ফেরত দিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

এহেন চাকরকে দিয়ে বাইরের কাজ করানোর অসুবিধে নেই।

তাছাড়া পিসিমার কাজের ব্যাপারে ছেলেটা পরম উৎসাহী, অনামিকার কাছে অনেক লোকজনই তো আসে, ছেলেটা তাদের জন্যে চায়ের জল চাপাতে একপায়ে খাড়া।

বকুল হাত নেড়ে বলে, আচ্ছা তুই যা, আমি যাচ্ছি।

.

জলপাইগুড়ির নমিতা! নামটা খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে, তার কথাগুলোও। কিন্তু চেহারাটা? সেটা স্পষ্ট নয়, যেন ঝাঁপসা-ঝাঁপসা। ভাবতে ভাবতে নেমে এল।

মেজদি খুব বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, বাবা, এই রাতদুপুরে আবার কে এলো? মরণ! তাই বলেছিল ওরা, বাড়ি তো নয় হাটবাজার, রাতদিন লোক! দেখালি বটে বাবা খুব!

শেষটা কানে যায় না বকুলের, নেমে গেছে ততক্ষণে।

জলপাইগুড়ির নমিতা!

সেই মাঝরাত্তিরে এসে আস্তে আস্তে কথা বলা, বিষণ্ণ-বিষম মেয়েটা। একদিনের দেখাতেই জীবনের কাহিনী বলতে বসেছিল। অবশ্য অনামিকার ভাগ্যে তেমন অভিজ্ঞতা অনেক আছে, অদেখা মানুষ টেলিফোনে ডেকেও আপন জীবনের দুঃখের কাহিনী শোনাতে বসে, কিন্তু এই বৌটির দুঃখ যেন একটু অন্য ধরনের।

কী ধরনের? মনে পড়িয়ে নিয়ে নিচে যাওয়া দরকার, তা নইলে হয়তো লজ্জায় পড়তে হবে। আহত হয়ে বলবে, সে কি? আমার কথা আপনার মনে নেই?

তা মনে পড়ে গেল। স্বামী সাধু হয়ে চলে গেছে, হরিদ্বারে না হৃষিকেশে কে জানে কোথায়! কিন্তু ওর মুখটা মনে পড়ছে না কেন? কেমন দেখতে নমিতার মুখটা? ভাবতে ভাবতে নেমে এসে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই মনে মনে খুব একটা লজ্জাবোধ করলেন অনামিকা। এতো চেনা মুখটা মনে করতে পারছিলাম না! অথচ এখন একেবারে অতি-পরিচিত লাগছে!

হয়তো ওই লাগাটার কারণ মেয়েটার একান্ত বিশ্বস্ত চেহারাটার জন্যে। ও যেন ওর কোন পরম আত্মীয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখে সেই আশ্রয় প্রাপ্তির ছাপ।

ওই ছাপটাই মনে করালো মুখটা বড় বেশী পরিচিত। কী আশ্চর্য, এইটা মনে আসছিল না!

এরকম আজকাল প্রায়-প্রায় হচ্ছে অনামিকার। নাম মনে পড়ছে তো মুখ মনে পড়ছে। আবার হয়তো মুখ মনে পড়ছে, নামটা কিছুতেই মনে আসছে না! স্মৃতির দরজায় মাথা খুঁড়ে ফেলেও না।

বয়েস হওয়ার এইটাই বোধ করি প্রথম লক্ষণ। অবশ্য সবাইয়ের বয়েস একই নিয়মে বাড়ে না। সনৎকাকার কি কারো মুখ চিনতে দেরি হয়? অথবা তাদের নাম মনে আনতে? কি জানি!

অনামিকাকে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো নমিতা, এগিয়ে এসে অনামিকা ‘থাক থাক’ বলে পিছিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পায়ের ধুলো না নিয়ে ছাড়লো না। এবং অনামিকা কিছু বলবার আগেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, এতো রাত্তিরে এসে খুব বিরক্ত করলাম তো?

এক্ষেত্রে যা বলতে হয় তাই বললেন অনামিকা। বিরক্তির প্রশ্ন ওঠে না সেটাই জানালেন সুন্দরভাবে।

তারপর বললেন, কী খবর?

নমিতা স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলায় বললে, খবর কিছু না, আপনাকে দেখবার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব

শুধু আমাকে একবার দেখবার ইচ্ছেয়? অনামিকা হাসলেন, আশ্চর্য তো! তার জন্যে এত কষ্ট করে? কবে এলে কলকাতায়? এখানে এলে কার সঙ্গে?

ও একে একে বললো, আমার একটি ভাইপো পৌঁছে দিয়ে গেছে। এই পাড়ায় তার মাসির বাড়ি, ওখানে ঘুরে আবার এসে নিয়ে যাবে। কলকাতায় এসেছি দিন দশেক। আপনাকে দেখবার জন্যে কষ্ট করে আসার কথা বলছেন? কষ্ট কী? বলুন যে ভাগ্য! আপনাদের মতো মানুষদের চোখে দেখলেও প্রাণে সাহস আসে।

তার মানে নমিতা নামের মেয়েটা প্রাণে সাহস সংগ্রহের জন্যেই এই রাত্তিরে চেষ্টা করে সঙ্গী জুটিয়ে এসে হাজির হয়েছে! তার মানে নমিতার এখন কোনো কারণে সাহসের দরকার হয়েছে।

তবে প্রশ্ন করে বিপন্ন হবার সাহস অনামিকার হলো না। তিনি আলতোভাবে বললেন, জলপাইগুড়ির খবর কী?

খবর ভালই! মামা বেশ ভাল আছেন। বলেই খাপছাড়া ভাবে বলে ওঠে নমিতা, আমি ওখান থেকে চিরকালের মতো চলে এসেছি। আর ফিরবো না।

এমনি একটা কিছু অনুমান করেছিলেন অনামিকা। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যতই মৃদুছলে কথা বলুক, আপাততঃ ও একটি ছন্দপতনের শিকার। সেই যে ওর লক্ষ্মী-বৌয়ের ভূমিকা, সে ভূমিকায় আর বন্দী নেই নমিতা।

তবু প্রশ্নের মধ্যে গেলেন না অনামিকা, সাবধানে বললেন, তাই বুঝি?

হ্যাঁ, আমি মনস্থির করে ফেলেছি। কেন ফিরবো বলুন তো? সেখানে আমার প্রত্যাশার কী আছে?

অনামিকার মনে হলো, ও বদলে গেছে। আবার ভাবলেন, ও বদলে গেছে এ কথা ভাবছি কেন? ও হয়তো এই রকমই ছিল। এক-দুদিনে কি মানুষকে চেনা যায়? আমি ওর জীবনের সব ইতিহাস জানি? হয়তো ও এই ভাবেই একাধিক আশ্রয় থেকে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। হয়তো মূলকেন্দ্র থেকে চ্যুত হলে এমন একটা অবস্থাই ঘটে।

স্বামীর ঘরটা একটা আইনসঙ্গত অধিকারের মাটি, যেখানে দাঁড়িয়ে জীবনযুদ্ধে লড়ে যাওয়া সহজ। ওখানে প্রেম নামক দুর্লভ বস্তুটি নিয়ে মাথা না ঘামালেও কাজ ঠিকই চলে যায়। কিন্তু আর সেই সবই তো অনধিকারের জমি। সেখানে কেবলমাত্র মনোরঞ্জন ক্ষমতার জোরে টিকে থাকতে হয়। অতএব প্রতিপদেই হতাশ হতে হয়। নমিতা হয়তো তেমনি হতাশ হয়েছে।

দেখেছে চেষ্টা করে, কারো মনোরঞ্জন করা যায় না। কোথাও কোনো মন যদি আপনি রঞ্জিত হলে তো হলো, নচেৎ শ্রমই সার।

কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞেস করা যায় না, তাই অনামিকা বলেন, কলকাতায় তোমার বাপের বাড়ি, তাই না?

আন্দাজে ঢিল ফেলেন অবশ্য। হয়তো নমিতা ওর পরিচয়লিপি পেশ করেছিল সেই সেদিন রাত্রে, কিন্তু মনে থাকা সম্ভব নয়। অথচ সম্ভব যে নয়, সেকথা অপরকে বোঝানো কঠিন। সে ভাববে, আশ্চর্য, অতো কথা মনে রইল না! তবুও নমিতা এ প্রশ্নে আহত হয়।

সেই আহত সুরেই বলে, বাপের বাড়িতে আবার আমার কে আছে? আপনি তো সবই জানেন। বলেছি তো সবই।

বিপদ!

অনামিকা মনে মনে বলেন, বলেছে তো সবই, কিন্তু আমার কি ছাই মনে আছে? কিন্তু মুখে তো সেকথা বলা যায় না। তাই বলতে হয়, হ্যাঁ, সে তো জানিই। তবে মানে বলছিলাম কি, এখন তো কলকাতাতেই থাকতে হবে?

স্বরটা নিদারুণ নির্লিপ্ত, কিন্তু নমিতা সেই নির্লিপ্ত ভঙ্গীটি ধরতে পরে না; নমিতার বোধ করি মনে হয়, এটা নির্দেশ, তাই নমিতা ঈষৎ উত্তেজিত গলায় বলে, থাকতেই যে হবে তার কোনো মানে নেই। এখন আমি স্বাধীন, এখন আমি যা ইচ্ছে করতে পারি।

তাজ্জব! হঠাৎ এমন অগাধ স্বাধীনতাটি কোন সূত্রে লাভ করে বসলো নমিতা?

তা সূত্রটা নমিতা নিজেই ধরিয়ে দিল। ধরিয়ে দিল তার উত্তেজিত চিত্তের পরস্পর বিরোধী সংলাপ।

হঠাৎ একদিন চোখটা খুলে গেল, বুঝলেন? হঠাৎ নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এইভাবে দাসীর মত পড়ে আছিস কেন তুই? উত্তর পেলাম, “শুধু দুটো ভাতের জন্যে।” ঘেন্না ধরে গেল নিজের ওপর।

অনামিকা শান্ত গলায় বলেন, শুধু ভাতের জন্যে কেন বলছো নমিতা? তার থেকে অনেক বড়ো কথা ‘আশ্রয়’। আশ্রয়, নিরাপত্তা, সামাজিক পরিচয়–এইগুলোর কাছেই মানুষ নিরুপায়।

কিন্তু নমিতা এ যুক্তিতে বিচলিত হলো না। কারণ নমিতার হঠাৎ চোখ খুলে গেছে।

দৃষ্টিহীনের হঠাৎ দৃষ্টি খুলে যাওয়া বড় ভয়ানক, সেই সদ্য-খোলা দৃষ্টিতে সে যখন নিজের অতীতকে দেখতে বসে, এবং সেই দেখার মধ্যে আপন অন্ধত্বের শোচনীয় দুর্বলতাটি আবিষ্কার করে, তখন লজ্জায় ধিক্কারে মরীয়া হয়ে ওঠে। আর তখন সেই দুর্বলতার ত্রুটি পূরণের চেষ্টায় কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে ওঠে।

আমাকে সবাই ঠকিয়ে খেয়েছে, বুঝলেন, আমাকে সবাই ভাঙিয়ে খেয়েছে। আমি যে একটা রক্তমাংসের মানুষ, আমারও যে সুখ-দুঃখ বোধ আছে, শ্রান্তি-ক্লান্তি আছে, ভাল-লাগা ভাল-না-লাগা আছে সেকথা কোনোদিন কারুর খেয়ালে আসেনি।

খেয়ালে যে নমিতার নিজেরও আসেনি, এ কথা এখন ওকে বোঝায় কে?

লক্ষ্মী-বৌ নাম কেনার জন্যে, অসহায়ের পরম আশ্রয়টিকে শক্ত রাখবার জন্যে, নমিতা নিজেকে পাথরের মতো করে রেখেছিল, কাজেই নমিতার পরিবেশটাও ভুলে গিয়েছিল নমিতা রক্তমাংসের মানুষ।

কিন্তু ওর এই উত্তেজিত অবস্থায় বলা যায় না সেকথা বলা যায় না, নমিতা একবার পাথরের দেবী বনে বসলে আবার রক্তমাংসের মাটিতে নেমে আসা বড় কঠিন! তুমিই তোমার মুক্তির প্রতিবন্ধক হবে! অথবা হয়তো তুমি তোমার এই নবলব্ধ স্বাধীনতাটুকুকে অপব্যবহার করে নাম-পরিচয়হীন অন্ধকারে হারিয়ে যাবে!

কিন্তু এসব তো অনুমান মাত্র, এসব তো বলবার কথা নয়। অথচ বলবার কথা আছেই বা কী? একজনের জীবনের সমস্যার সমাধান কি অপর একজন করে দিতে পারে?

অথচ নমিতা চাইতে এসেছে সেই সমাধান। কেবলমাত্র দেখবার ইচ্ছেয় ছুটে চলে আসার যে মধুর ভাষ্যটি নমিতা উপহার দিয়েছে অনামিকাকে, সেটার মধ্যে যে অনেকখানিটাই ফাঁকি, তা নমিতা নিজেই টের পায়নি।

নমিতা তাই সেই কথা বলার পর সহজেই বলতে পারছে, আপনি বলে দিন এখন আমার কোন পথে যাওয়া উচিত? এই প্রশ্ন করবার জন্যেই এতো কষ্ট করে আসা।

অনামিকা আস্তে বলেন, একজনের কর্তব্য কি আর একজন নির্ণয় করে দিতে পারে নমিতা?

আপনারা নিশ্চয়ই পারেন! নমিতা আবেগের গলায় বলে, আপনারা কবিরা, সাহিত্যিকরাই তো আমাদের পথপ্রদর্শক।

সেটা অজ্ঞাতসারে এসে যেতে পারে, অনামিকা মৃদু হাসেন, প্রত্যক্ষ ভাবে গাইড সেজে কিছু বলা বড় মুশকিল। তোমার নিজের তো অবশ্যই কোনো একটা পথ সম্পর্কে পরিকল্পনা আছে।

নমিতা একটু চুপ করে থেকে একটা হতাশ-হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বিশেষ করে একটা কোনো কিছু ভাবতে পারছি না আমি। অনেক পথ অনেক দিকে চলে যাচ্ছে। শুনলে হয়তো আপনি হাসবেন, হঠাৎ-হঠাৎ কী মনে হচ্ছে জানেন, একটা গরীব লোক হঠাৎ লটারীতে অনেক টাকা পেয়ে গেলে তার যেমন অবস্থা হয়, কী করবে ভেবে পায় না, আমার যেন তাই হয়েছে। আমার এই জীবনটা যেন এই প্রথম আমার হাতে এসেছে, ভেবে পাচ্ছি না সেটাকে নিয়ে কী করবো?

অনামিকা আবার হাসলেন, তোমার উপমাটি কিন্তু এর নমিতা, আমার ইচ্ছে করছে কোথাও লাগিয়ে দিতে। কিন্তু বুড়ো মানুষের পরামর্শ যদি শোন তো বলি, লটারীতে পেয়ে যাওয়া টাকাটা কী ভাবে খরচ করবো ভেবে দিশেহারা হবার আগে সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখা। তারপর ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে–

নমিতা ক্লান্ত গলায় বলে, কিন্তু ধীরেসুস্থে কিছু করার আমার সময় কোথায়? একজন পিসতুতো দাদার বাড়িতে এসে উঠেছি, কদিন আর সেখানে থাকা চলে বলুন? এখান থেকে চলে যেতেই হবে। কিন্তু কোন্ দিকে যাবো?

অনামিকা কোমল করে বলেন, মনে কিছু কোরো না নমিতা, জিজ্ঞেস করছি জলপাইগুড়িতে থাকাটা কি সত্যিই আর সম্ভব হলো না?

নমিতা চোখ তুলে তাকায়।

নমিতা বোধ করি একটু হাসেও, তারপর বলে, অসম্ভবের কিছু ছিল না। যেমন ভাবে ছিলাম, ঠিক সেই ভাবেই থেকে গেলে মৃত্যুকাল অবধিই থাকতে পারতাম। আমায় তো কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। আর নতুন কোনো মতের মতান্তরের ঘটনাও ঘটেনি। এতোদিন জীবনের খাতাখানার দিনের পাতাগুলো উল্টেই চলেছি, দিন থেকে রাত্তির, রাত্তির থেকে দিন–খাতার পাতা হঠাৎ কোনও জায়গায় ফুরিয়ে যেত হয়তো। কিন্তু একসময় একটা হিসেবনিকেশ তো করতেই হবে। সেইটা করতে বসেই হঠাৎ চোখে পড়ে গেল শুধু বাজে খরচের পাহাড় উঠেছে জমে।

নাঃ, তোমার বাপু সাহিত্যিক হওয়াই উচিত ছিল। অনামিকা বলেন, যা সব সুন্দর উপমা দিতে পারে। কিন্তু আমি বলছিলাম কি, হয়তো ওই বাজে খরচের অঙ্কটা সবটাই ঠিক নয়। হয়তো ওর মধ্যেও কিছু কাজের খরচ হয়েছে।

কিছু না, কিছু না। আপনি জানেন না, এতোদিনের প্রাণপাত সেবার পুরস্কারে একটুকু ভালোবাসা পাইনি। শুধু স্বার্থ, তার জন্যেই একটু মিষ্টি বুলি। বলুন যেখানে একটুখানিও ভালবাসা নেই, সেখানে মানুষ চিরকাল থাকতে পারে?

অনামিকা মনে মনে হাসলেন।

অনামিকার মনে হলো, চোখটা তোমার হঠাৎই খুলেছে বটে। আর অন্ধত্বটা বড় বেশী ছিল বলেই ওই খোলা চোখে মধ্যদিনের রৌদ্রটা এতো অসহ্য লাগছে।

তবু ওই ভালবাসা-চাওয়া মেয়েটার জন্যে করুণা এলো, মেয়েটার জন্যে মমতা অনুভব করলেন।

এতোটুকু বাসার কাঙাল একটা ছোট্ট পাখিকে দেখলে যেমন লাগে। ওই বাসাটার আশায় পাখিটা ঝড়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

বললেন, পৃথিবীটা এই রকমই নমিতা।

এই রকমই? নমিতা উত্তেজিত হলো, আপনি বলছেন কি? পৃথিবীতে ভালোবাসা নেই? মমতা নেই? হৃদয় নেই? নেই যদি তো আপনি আমায় এতো ভালোবাসলেন কেন? আপনি তো আমার কেউ নন?

অনামিকা যেন হঠাৎ একটা হাতুড়ির ঘা খেলেন। অনামিকা মরমে মরে গেলেন। এই নিতান্ত নির্বোধ মেয়েটার এই সরল বিশ্বাসের সামনে নিজেকে যেন একান্ত ক্ষুদ্র মনে হলো।

ভালোবাসা! কোথায় সেই ঐশ্বর্য?

শম্পার জন্যে যে উদ্বেগ, শম্পার জন্যে যে প্রার্থনা, শম্পার জন্যে যে অগাধ ভালোবাসা তার শতাংশের একাংশও কি এই মেয়েটার জন্যে সঞ্চিত ছিল অনামিকার?

অনামিকা তো ওকে ভুলেই গিয়েছিলেন।

অথচ ও ভেবে বসে আছে অনামিকা ওকে ভালবাসেন!

ইস্, সত্যিই যদি তা হতো?

অনামিকার যেন নিজের কাছেই নিজের মাথা কাটা যাচ্ছে।

আমাদের চিত্ত কতো দীন! আমাদের প্রকৃতিতে কতো ছলনা!

আমাদের ব্যবহারের মধ্যে কতো অসত্য!

কই, অনামিকা কি স্পষ্ট করে ওর মুখের ওপর বলতে পারলেন, ভালবাসা? কই? সে জিনিসটা তো তোমার জন্যে আছে বলে মনে হচ্ছে না? দেখতে তো পাচ্ছি না? যা আছে তা তো কেবলমাত্র একটু করুণামিশ্রিত মমতা

না, বলতে পারলেন না।

সেই মিথ্যার মোহ দিয়ে গড়া কটি মিষ্টি কথাই বললেন, তুমি যে আমায় খুব ভালোবাসো। ভালোবাসাই ভালোবাসাকে ডেকে আনে।

ছাই আনে! দেখলাম তো পৃথিবীকে!

অনামিকার মনে হলো অভিমানটা যখন মানুষের ছোট সংসারের পরিধি ছাপিয়ে সমগ্র পৃথিবীর ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ে, তখন তার স্বাভাবিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনা শক্ত।

তবু কিছু তো বলতেই হবে, তাই বলেন, আচ্ছা নিজে নিজে কিছুও একটা তো ভাববে?

সেই তো! নমিতা মাথা তুলে বলে, আমি ওর মতো সন্নিসি হয়ে যাবো? ওর কাছে চলে যাবো? কিছুদিন থেকে এই ভাবনাটাই পেয়ে বসেছে। সে জীবনে কতো মান-সম্মান গৌরব! আর এই পরের আশ্রিত জীবনে কী আছে? মান নেই, সম্মান নেই, গৌরব নেই

অনামিকার সত্যিই খুব দুঃখ হয়।

অনামিকা হৃদয়ঙ্গম করেন ব্যথাটা কোথায়।

তবু আস্তে বলেন, ওঁর কাছে চলে যাবো বললেই তো যাওয়া যায় না। ওঁর মতামত জানা দরকার, সেখানে থাকা সম্ভব কিনা জানা দরকার।

আপনিও এ কথা বলছেন? নমিতা যেন হঠাৎ আহত হয়ে অভিমানে ফুঁসে ওঠে, সেই আমার জলপাইগুড়ির আত্মীয়দের মতো? থাকা কেন সম্ভব হবে না? আমি তো ওঁর সঙ্গে ঘরসংসার পাতিয়ে সংসার করতে চাইছি না। তাছাড়া মতের কথা ওঠে কেন? আমি কি ওঁর বিবাহিতা স্ত্রী নই? আমার কি একটা অধিকার নেই?

ওর এই সদ্যজাগ্রত অধিকারবোধের চেতনা ও স্বাধীনতার চেতনাই যে ওকে বিপর্যস্ত করছে, তাতে সন্দেহ নেই। ওর এই অস্থির-চাঞ্চল্যের মাটিতে উপদেশের বীজ ছড়ানো বৃথা, তবু অনামিকা বলেন, জীবনকে আরো কতো ভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে!

কিছু পারে না। আমার মতো মেয়েদের কিছু হয় না। আমি কি সাহিত্যিক হতে পারবো যে লোকের কাছে বড়ো মুখ করে দাঁড়াতে পারবো? আমি কি বড় গায়িকা হতে পারবো? আমার কি অনেক টাকা আছে যে দান-ধ্যান করে নাম কিনতে পারবো? আমার পক্ষে বড়ো হবার তো ওই একটাই পথ দেখতে পাচ্ছি, ভগবানকে ডেকে ডেকে অধ্যাত্মজগতের অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারি।

অনামিকা ওর আবেগ-আবেগ মুখটার দিকে তাকান। অনামিকা নিঃশব্দে একটু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন। বড় বার ক্ষমতা না থাকলেও যে সেটা হতে চায় তাকে বাঁচানো কঠিন।

অথচ এদিকে রাত বেড়ে যাচ্ছে, ছোট চাকরটা বার দুই ঘুরে গেছে দরজার কাছে, কারণ এই বসবার ঘরটিই তার রাত্রের শয়নমন্দির।

কত কম ক্ষমতা আমাদের! নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন অনামিকা, কার জন্যে কতোটুকু করতে পারি?

আমরা হয়তো লোকের রোগের সেবা করতে পারি, অভাবে সাহায্য করতে পারি, সংসারে চলার পথের পাথর-কঁকর সরিয়ে দিতে পারি, পায়ের কাটা তুলে দিতে পারি, কিন্তু কারো জীবনে যদি বিশৃঙ্খলা এসে যায়? যদি কারো মন তার নিজের শুভবুদ্ধির আয়ত্তের বাইরে চলে যায়?

কিছু করতে পারার নেই। হয়তো কিছুটা শুকনো উপদেশ বিতরণ করে মনকে চোখ ঠারতে পারি। ভাবতে পারি, অনেক তো বললাম! না,শুনলে কী করবো?

তাছাড়া প্রত্যক্ষভাবেই বা কতোটুকু করার ক্ষমতা আছে আমার? ভাবলেন অনামিকা, আমি কি ওকে সঙ্গে করে ওর সেই পলাতক স্বামীটার কাছে পৌঁছে দেওয়ার সাহায্যটুকুই করতে পারি? পারি না। মাত্র ওকে আর্থিক সাহায্য করতে পারি। খুব সন্তর্পণে বললেন, তা তুমি কি তার–মানে তোমার স্বামীর ঠিকানা জানো?

জানি।

চিঠিপত্র দাও?

নমিতার দুই চোখ দিয়ে হঠাৎ জল গড়িয়ে পড়ে, আগে আগে অনেক দিয়েছি, জবাব দেয় না। একবার মামাকে একটা পোস্টকার্ড লিখে পাঠালো, ওখান থেকে যে কোনো চিঠিপত্র আসে এ আমি পছন্দ করি না। ব্যাস, সেই অবধি

অনামিকা সেই অশ্রুলাঞ্ছিত মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখেন, অনামিকার নিজেকেই যেন অপরাধী মনে হয়। যেন এই মেয়েটার দুঃখের কারণের মধ্যে তারও কিছু অংশ আছে। সারাজীবন ধরে তিনি যা কিছু লিখেছেন, তার অধিকাংশই মেয়েদের চিন্তার মুক্তির কথা ভেবে। কিন্তু মুক্তির পথটা কোথায় তা দেখিয়ে দিতে পারেননি।

কিন্তু কেউ কি পারে সেটা?

কোনো কবি, কোনো সাহিত্যিক? কোনো সমাজসেবী?

সামগ্রিকভাবে কিছু করবার ক্ষমতা এদের নেই।

এবার ভেবেছি কোনো খবর না দিয়ে সোজা চলে যাবে। দেখি কেমন করে তাড়িয়ে দেয়।

অনামিকা চিন্তিত হন।

বলেন, সেটা কী ঠিক হবে? বলছো তো আশ্রম, সেখানে নিশ্চয়ই অন্য সাধুটাধু আছেন, তারা যদি

নমিতা প্রায় ছিটকে উঠে বলে, আপনার কাছে আমি নতুন কিছু শুনতে এসেছিলাম। অথচ আপনি আমার সব আত্মীয়দের মতোই কথা বলছেন।

লজ্জিত হন বৈকি অনামিকা।

কিন্তু কী নতুন কথা বলবেন তিনি এই হঠাৎ পাগলা-হয়ে-যাওয়া মেয়েটাকে? পৃথিবীটাকে তো তিনি ওর মতো অতো কম দিন দেখছেন না?

আস্তে অপরাধীর গলায় বলেন, আমিও তোমার আত্মীয় নমিতা। তাই তোমাকে নতুন কথা হলে বিভ্রান্ত করতে পারবো না। তবে সত্যিই যদি তুমি যাও, নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে কোনো ছেলে-টেলেকে নিতে হবে। অনেক তো খরচা হবে–কিছু যদি রাগ না করো তো বলি

নমিতা থামিয়ে দেয়।

নমিতা এবার নম্র গলায় বলে, আপনার ভালবাসা মনে থাকবে। কিন্তু খুব দরকার পড়লেও টাকার সাহায্য আমি আপনার কাছে নেব না। আমার গায়ে তো এখনো সামান্য সোনা-টোনা আছে।

কিন্তু নমিতা, অনামিকা থামলেন।

এখনই ওকে হতাশার কথা শোনানো উচিত হবে? অথচ নিশ্চিত বুঝতে পারছেন, ফিরে নমিতাকে আসতেই হবে।

সাবধানে বলেন, কিন্তু নমিতা, ধরো যদি তোমার সেখানে ভাল না লাগে, ধরো যদি ঠিকমতো সুবিধে না হয়–

বলুন না, ধরো যদি তাড়িয়ে দেয়–হঠাৎ বেখাপ্পা ভাবে হেসে ওঠে নমিতা। বলে, তাহলে তখন আবার আপনার কাছে আসবো। শুনবো জীবনকে আর কোন্ দিক থেকে গড়া যায় যা আমার সাধ্যের মধ্যে।

ছোট চাকরটা অভ্যাসমতো একসময় এক কাপ চা ও দুটো সন্দেশ রেখে গিয়েছিল, নমিতা তাতে হাতও দেয়নি। অনামিকা কয়েকবারই উসখুস করেছেন, এখন বললেন, চা-টা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল নমিতা!

নমিতা অদ্ভুত একটু হেসে বললো, তাই দেখছি। ঠিক আমার জীবনটার মতো, তাই না? ভরা ছিল, গরম ছিল, কেউ খেলো না। এখন কি আর-পেয়ালাটা হঠাৎ তুলে নিলো,

ঠাণ্ডা চা-টা ঢক্‌ করে এক চুমুকে খেয়ে নিয়ে বললো, তবু খেয়েই ফেললাম, নষ্ট হওয়ার থেকে ভাল হলো, তাই না?

অনামিকা অবাক হলেন। এ ধরনের কথা ওর মুখে যেন অপ্রত্যাশিত। অনামিকা চিন্তিত হলেন।

মানসিক ব্যাধির পূর্বলক্ষণ নয় তো?

পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে নমিতা এবার ঘড়ির দিকে তাকালো, একটু চঞ্চল হলো। বললো, দেখছেন তো আমার ভাইপোর কাণ্ড! এখনো এলো না! মাসির কাছে খেয়ে-দেয়ে আসছে বোধ হয়-পরনির্ভরতার এই জ্বালা!

ওর সহজ গলার কথা শুনে স্বস্তি পান অনামিকা, তিনিও সহজভাবে বলেন, তা আজকাল তো আর বাপু মেয়েরা এতো পরনির্ভর নেই, নিজেরাই তো একা একা চলা-ফেরা করে!

নমিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তা জানি। কিন্তু এযাবৎ তো পায়ে শেকল বাঁধা ছিল। অভ্যাস ভে নেই। রাস্তা-টাস্তা কিছুই চিনি না। এইবার থেকে উঠে পড়ে লেগে চিনতে হবে। একটু হেসে বললে, শিকলিটা তো কেটেছি মনের জোর করে। এগিয়ে এসে নিচু হয়ে আবার প্রণাম

অনামিকা দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, কী হলো?

ওই যে আসছে আমায় নিতে। খুব জ্বালাতন করে গেলাম আপনাকে। হয়তো আবারও আসবো।

বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে। অনামিকা তাকিয়ে থাকলেন ওই হঠাৎ-শিকলি-কাটা পাখিটার গতির দিকে। ও কি সত্যিই আকাশে উড়তে পারবে? নাকি অনভ্যস্ত ডানায় উড়তে গিয়ে ঝটপটিয়ে মাটিতে পড়ে ডানা ভাঙবে?

এই মেয়েটাকে আমি কোন পথ দেখাতে পারতাম? অনামিকা নিচে থেকে উঠে এসে সিঁড়ির জানলা-কাটা দরজা থেকে বেরনো দু-ফুট বাই চার-যুট ক্ষুদে ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবলেন, ও যদি আমার গল্পের নায়িকা হত, ওর জন্যে কোন্ পরিণতি নির্ধারণ করতাম আমি?

হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো, আর হঠাৎই মনে এলো, বেশ বহু বহুকাল এখানটায় এসে দাঁড়াননি। এটা যে ছিল তাই মনে পড়তে না কখনো। আজ মনে পড়লো- নিজের ঘরে ‘মেজদি’র উপস্থিতি স্মরণ করে। ঠিক এই মুহূর্তে সেই অতি-সংসারী মানুষটার কাছাকাছি গিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো না। যে মানুষটা নিকট আত্মীয়ত্বের দাবিতে নিতান্ত অন্তরঙ্গ সূরে কথা বলতে চায়, অথচ যার কাছে বলতে চায় সে অনুভব করে কতো যোজন ব্যবধান তাদের মধ্যে। সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতি তারা।

এই যোজন ব্যবধান নিয়েই তো আত্মীয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা। সব ক্ষেত্রে না থোক বহু ক্ষেত্রেই।

অনবরত বিদ্যুৎপাখার হাওয়া খাওয়ায় অভ্যস্ত শরীরকে এই বেশী রাত্রির উড়ো-উড়ো হাওয়াটা যেন আচ্ছন্ন করে তুলছে।

এই ক্ষুদে বারান্দাটুকুর পরিকল্পনা ছিল বকুলের মা সুবর্ণলতার! বাড়ি হয়ে পর্যন্তই এই জানলা ফুটিয়ে দরজা করে বারান্দার কথা বলে চলেছিলেন তিনি। বলতেন–টানা উঠতে নামতে মাঝে মাঝে এক নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা থাকা দরকার।

তখন বকুলের বাবা রেগে রেগে বলতেন, কী এমন বেণীমাধবের ধজার সিঁড়ি যে মাকে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলতে হবে। এতো এতো নিঃশ্বাস নেবারই যে দরকারটা কী বুঝি না। দেয়াল ফেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে হবে। আশ্চর্য!

অথচ সুবর্ণলতা মারা যাবার কিছুদিন পরে হঠাৎ বাবা মিস্ত্রী ডেকে, বেশ কিছু খরচা করে জানলা কাটিয়ে দরজা করে এই ক্ষুদ্র স্কুল-বারান্দা দুটো করিয়ে ফেললেন ওপর নীচে দুটো সিঁড়িতে।

কিন্তু কে কবে এসেছে নিঃশ্বাস নিতে? কে কবে আসে? নূতন নূতন বেলায় বকুলের তো আসতে পা ওঠেইনি। মনে হয়েছে মা বুঝি কোথায় বসে করুণ চোখে তাকিয়ে বলবেন, সেই হলো, শুধু আমারই ভোগে হলো না! তোরা বেশ–                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                   হ্যাঁ, এই ধরনের অনুভূতিই তখন দরজার চৌকাঠের কাছে এলেই বকুলকে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে দিতো। অথচ তখন বকুলের মাঝে মাঝে দেয়াল ফেঁড়ে নিঃশ্বাস নেবার দরকার ছিল।

দরকার ছিল আপন চিত্তের, দরকার ছিল একটা লাজুক মানুষের আবেদনের। সুযোগ পেলেই যে বলতে, অমন চমৎকার অলিন্দ হলো তোমাদের, একটু দাঁড়াতে পারো না?

তবু পারতো না বকুল।

দরজাটা খুললেই আকাশের তারার দিকে চোখ পড়ে যেতো। কেমন একটা অপরাধ-বোধ এসে যেতো।

তারপর?

তারপর তো বকুল অনামিকা হয়ে গেল। অনামিকার আর বাতাসের ওই একমুঠো দাক্ষিণ্য নেবার অবকাশ রইল কই?

কিন্তু অবকাশ কারই বা আছে এ বাড়িতে? দরকারই বা কই? ছুটতে ছুটতে নামা ওঠা, এই তো! জানে সিঁড়ির দরকার ওইটুকুই।

হয়তো এমনিই হয়। বাতাসের যার বড়ো প্রয়োজন সে পায় না, যে সেটা অনায়াসে পায় সে তার প্রয়োজন বোধ করে না। তবু আজ সাময়িক একটা কারণ প্রয়োজন বোধ করলেন অনামিকা আর যেন কৃতার্থ হয়ে গেলেন।

ভাবতে লাগলেন, নমিতা যদি আমার গল্পের নায়িকা হতো, কোন্ পরিণতি দিতাম আমি ওকে?

নিশ্চয়ই ওকে সন্ন্যাসী সাজিয়ে দেবতাত্মা হিমালয়ের শান্তিময় কোলে বসিয়ে নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলতাম না!…তাহলে আবার কি ওকে সংসার-আশ্রয়ের নিশ্চিন্ত ছায়ায় ফিরিয়ে দিতাম? সেই উত্তরবঙ্গের একটি সমৃদ্ধ পরিবারের মধ্যে?

না না, ছি!

তবে?

তবে কি নিতান্তই বাজারচলতি সমাধানে ওকে নার্স করে ছেড়ে দিতাম? আর একদিন ওর সেই মিথ্যা সন্ন্যাসী স্বামীটাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে ওর করতলে সমর্পণ করতাম?

দূর দূর! তবে কি ওকে ডানা ভেঙে স্রেফ ফেলেই দিতাম পথে-প্রান্তরে?

একটু চুপ করে ভাবলেন, তারপর প্রায় নিজের মনকেই বললেন, হয়তো গল্পের নমিতাকে শেষ পর্যন্ত তাই-ই করতাম। হয়তো বা তার মধ্যেই কিছু নতুনত্ব আনবার চেষ্টা করতাম।

কিন্তু ওই চোখে-দেখা-সত্যি-মেয়েটার জন্যে আমি সে পরিণতি ভাবতেই পারছি না। ওর সেই স্বামীটাকে জব্দ করার জন্যেও না–তাকে  মুখের মত জবাব দেবার জন্যেও না। আচ্ছা প্রগতিশীল মন কাকে বলে? সে মন কি নিতান্ত প্রিয়জনের জন্যে, নিকটজনের জন্যে তেমন দুঃসাহসিক প্রগতির পথ দেখাতে পারে? যে পথে অকল্যাণ, যে পথে গ্লানি?

তেমন প্রগতিশীল হওয়া আমার কর্ম নয়, ভাবলেন অনামিকা। তবে কী হবে ওর। মানে–কী করবে ও? ওর মধ্যে এখন একটা সর্বনাশা আগুন জ্বলছে, মনে হচ্ছে সে আগুন ওকে ছাড়া আর কাকে দগ্ধ করবে?

তারপর খুব হালকা এবং নেহাৎ সংসারী একটা কথা মনে এলো, এ সংসারটা যদি আমার হতো, হয়তো ওকে কিছুদিন আমার কাছে থাকতে বলতে পারতাম। তা আমিই তো বলতে গেলে আশ্রিত। নেহাৎ বাবার উইলে কী একটা আছে তাই–

তারপর মনে মনেই হেসে উঠলেন, তা তাতেই বা কি লাভ হতো নমিতার? সেই তো পরিচয় হতে পরাশ্রিত! আর ও নির্ঘাত ওর নিজস্ব স্বভাবে আমার মনোরঞ্জন করতে বসতো!.না, ওটা সমাধানের কোনো পথই নয়। ওর সত্যিকার দরকার ভালবাসার। করুণার নয়, দয়ার নয়, মমতার নয়, শুধু গৌরবময় ভালবাসার। এছাড়া আর বাঁচার উপায় নেই ওর। কিন্তু সে-বস্তু কে এনে ওর হাতে তুলে দেবে?

একমাত্র সুপথ হতে পারে, যদি ওর স্বামী মিথ্যা সন্ন্যাসের খোলস খুলে ফেলে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়–

ভাবতে গিয়ে মনটা কেন কে জানে কেমন বিরূপ হয়ে গেল। মনে হলো, ভারী জোলো আর বিবর্ণ একটা ভাবনা ভাবছি। নাঃ, সত্যি বিধাতা হবাঁর সাধ্য দ্বিতীয় বিধাতার নেই।

কিন্তু বিধাতারই বা প্লটের বাহাদুরি কোথায়?

নতুনত্বের নামও তো দেখি না। সবই তো অমনি জোলো-জোলো।…

পাশের বাড়িটার দিকে তাকালেন, বাড়িটা এখন এই দশটা সাড়ে-দশটা রাত্রেই গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।..ওরই কোণের একটা ঘরে দীনহীন একটু গৃহসজ্জার মধ্যে নির্মলের বৌ হয়তো ঘুমে নিমগ্ন হয়ে পড়ে আছে, হয়তো বা অনিদ্রার শিকার হয়ে পড়ে পড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। ওকে দেখলে এখন আর মনেও হয় না একদা ও পরমা সুন্দরী ছিল।…

বৌদিদের আলাপ-আলোচনার মাঝে মাঝে কানে আসে ওর ছেলের বৌটি নাকি মেয়ে সুবিধের নয়, কেমন করে যেন ওকে কোণঠাসা করে ফেলে নিজে সর্বগ্রাসী হয়ে বসেছে… বাড়িতে আর কেই বা আছে? নির্মলের জেঠি একটা ভাইপোকে পুষেছিলেন, ইদানীং সেই ই নাকি বাড়ির অর্ধাংশ দখল করে আছে। আর তাদের সঙ্গেই নাকি নির্মলের ওই ছেলের বৌয়ের খুব হৃদ্যতা। কী পুরনো প্লট!

আগে ওই বাড়ি রাত বারোটা অবধি গমগম করতো, গ্রামোফোনের গান শোনা যেতো অনেক রাত অবধি, আলো জ্বলতো ঘরে ঘরে।

এখন? ওই অন্ধকারই তার উত্তর দিচ্ছে। তবে? বিধাতার প্লটে নতুনত্বের নামও নেই। আলো জ্বালা আর আলো নিভানো এই ওঁর প্লট।…

আমি এ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখিনি কতদিন!

তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন হঠাৎ অবাক হয়ে গেলেন অনামিকা। কবে এতো জরাজীর্ণ হয়ে গেল বাড়িটা? হয়ে গেল এমন মলিন বিবর্ণ?

একদিনে হয়নি। আস্তে আস্তেই হয়েছে।

তার মানে দিনের পর দিন, কতো কতেদিন–আর আমি তাকিয়ে দেখিনি, তার মানে—নির্মল নামের একটা অনুভূতিও আস্তে আস্তে ওইরকম বিবর্ণ জরাজীর্ণই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবু

এই শিরশিরে বাতাসে রাত্রির আকাশের নিচে চিরপরিচিত অথচ অপরিচিত জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই বিবর্ণ জানলাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুভূতিটা আবার যেন আলোয় ভরে গেল…সেই আলোটা ওই জানলায় গিয়ে পড়লো যেন। দেখা গেল খোলা জানলায় ফ্রেমে আঁটা একটা আলোর ছবি।

ঘরের মধ্যে থেকে গ্রামোফোনে গান ভেসে আসছে!…দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে–

ধরা-ছোঁয়া নেই, তবু যেন কোথাও আছে বক্তব্যের আভাস। যারা লাজুক, যারা ভীরু–তারা পরের কথার মধ্যেই নিজের কথা মিশিয়ে দিয়ে নিবেদন করে। জানে যে ধরবার সে-ই ধরবে, যে ছোঁয়ার সে-ই ছোঁবে, আর কারো সাধ্য নেই ধরতে ছুঁতে।

দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই প্রিয়জনে–, তাই ‘আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই না তোমারে’।

আজকাল আর কেউ অমন বোকার মতো আর বেচারীর মতো ভালবাসে না!

এ যুগ ওই মৃদুতাকে-ওই চারুতাকে ভালবাসাই বলবে না। দেখলে ঠোঁট বাঁকাবে, রাবিশ বলবে, অথবা জোলো, ভাবালুতা বলে হেসে উড়িয়ে দেবে। এ যুগ জানে ভালোবাসা একটা ভোগ্যবস্তু, তাকে লুটে নিতে হয়, ছিঁড়ে আনতে হয়, দখল করতে হয়

হয়তো এরাই ঠিক জেনেছে। অথবা এরাই কিছু জানেনি, সত্যিকারের জানাটা আজও অপেক্ষা করছে কোনো এক ভবিষ্যৎ যুগের আশায়। যদিও শম্পারা ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছে, আমরাই ঠিক জেনেছি।

তবু সেটুকুও তো জুটছে ওদের ভাগ্যে! ওই আত্মপ্রসাদ! ওরা তো ভাবছে, আমরা নিলাম, আমরা পেলাম! সে যুগের ভাগ্যে সেটুকুও জোটেনি।

অথচ সে যুগেও ভাবত-ভালবাসলাম! ভাবতো এর নামই ভালবাসা!..শম্পারা– আশ্চর্য, শম্পা আমাকেও একটা চিঠি দিল না! যদিও আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, হে ঈশ্বর, আমার অহঙ্কার খর্ব হোক, ওর মা-বাপের কাছেই আগে চিঠি আসুক। তবু যেন কোথায় একটা শূন্যতাবোধ সব সময় সব কিছুতে নিরানন্দ করে রেখেছে।

মনে মনে নিশ্চিত ভেবেছিলাম, ও আমাকে অন্তত জানাবে।

শম্পা যেন নিজের জীবনটাকে বাজি ধরে বাপের সঙ্গে খেলতে বসেছে। শম্পা তেমনি লড়ুইয়ে মেয়ে। কে জানে এ খেলায় কে জিতবে? শম্পা না শম্পার বাবা? বাবার জেতাটা তো পরম দুঃখের। অথচ বাবার হারও দুঃখের।

.

এ বাড়িতে আরো একটি মেয়ে আছে, তাকে নিয়ে তার মা আপন সম্পত্তি ভেবে খেলতে বসেছে। সেটা আরো দুঃখের, বরং বা বলা যায় ভয়াবহও।

ওর মা এই পরিবেশ থেকে–তার নিজের ধারণা অনুযায়ী উঁচুতে উঠতে চায়। অনেক উঁচুতে। যে উঁচুর নাগাল পেতে হলে খুব বড় কিছু একটা বাজি ধরে জুয়ায় বসতে হয়।

‘জীবন’ জিনিসটাই সব চেয়ে বড়ো, আর সব চেয়ে হাতের মুঠোর জিনিস।

কিন্তু ওই হতভাগা মেয়েটার যে নিজের জীবনটা এখন আর চড়া দামে বিকোবে না, তাই দামী বস্তুটা নিয়েছে মুঠোয় চেপে। মেয়েটার বোঝবার ক্ষমতা নেই ওকে নিয়ে কী করা হচ্ছে, ওকে কতোখানি ভাঙানো হচ্ছে।

তা যাদের বোঝার ক্ষমতা আছে তারাই কি কিছু প্রতিকার করতে পারছে? পারে কী?

আশ্চর্য, আমাদের ক্ষমতা কতো সীমিত।

আরো একবার নিজের ক্ষমতার পরিসর মেপে দেখে যেন লজ্জায় মরে গেলেন অনামিকা।

কী অক্ষম আমি।

আমার চোখের সামনে একটা নির্বোধ মেয়ে আর একটা বোধহীন মেয়েকে হাত ধরে কাদায় পিছল গভীর জলের ঘাটে নামতে যাচ্ছে, আমি তাকিয়ে দেখছি। খুব দূরে বসেও দেখছি না, বরং খুব কাছেই গাছের ছায়ায় বসে আছি।

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো ওরা পিছলোবে, ওরা ডুবে যাবে।

ওইটাই ওদের নিশ্চিত পরিণতি জেনেও আমি হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠছি না, ছুটে গিয়ে ওদের হাত চেপে ধরে টেনে আনার চেষ্টা করছি না, আমি শুধু ভয়ানক একটা স্বস্তি বোধ করছি, ভয়ানক একটা নিরুপায়তার যন্ত্রণা অনুভব করছি।

কারণ আমি ধরেই নিয়েছি আমার ভূমিকা দর্শকের।

ধরে নিয়েছি ওরা আমার কথা শুনবে না, আমার নিষেধ-বাণী শুনবে না। তবে কেন মিথ্যে অপমানিত হতে যাওয়া ভেবে কথাটি কইছি না। চেষ্টা করে না দেখেই সেই কল্পিত অপমানটার ভয়ে উদাস দৃষ্টি মেলে বসে বসে ওদের ডুবতে যাওয়া দেখছি।

আমাদের অক্ষমতা হচ্ছে আমাদের অহমিকা। আমাদের নিরুপায় হচ্ছে আমাদের একটা অর্থহীন আত্মসম্মানবোধ। তাই আপন সন্তানকেও হয়তো ভুল পথ থেকে নিবৃত্ত করতে হাত বাড়াই না। অনিষ্টের পথ থেকে টেনে আনতে ছুটি না। এই ভেবে নিথর হয়ে বসে থাকি, যদি আমার কথা না শোনে!

সেই না শোনা মানেই তো খর্ব হবে আমার অহমিকা, ঘা পড়বে অহঙ্কারে।

আমার এই আমিটাকে কী ভালই বাসি আমরা।

কই, আমি কি একদিনও ছোড়দার ঘরে গিয়ে বসে পড়ে প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, ছোড়দা, কোনো চিঠি এলো?

অথচ মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, কি জানি হয়তো এসেছে, হয়তো গ্রাহ্য করে অথবা মান খুইয়ে বলতে আসছে না আমায়!..

এই, ‘মান’ জিনিসটা কী কঠিন পাথরের মতোই না ঘিরে রেখেছে আমাদের। ওর থেকে বেরিয়ে পড়বার দরজা আমাদের নেই। অথচ আশ্চর্য, কী তুচ্ছ কারণেই না জিনিসটা খোওয়া যায়।

ও যেন একটা ভারী দামী রত্ন, তাই খোওয়া যাবার ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকি। ও যেন আমার প্রভু, তাই ওর দাসত্ব করি।

আচ্ছা ওকে আমার অধীন করে রাখা যায় না? আমিই প্রভুত্ব করলাম ওর ওপর? অথবা যদি মনে করি কিছুতেই খোওয়া যেতে দেব না ওকে, দেখি কার সাধ্য নেয়? সযত্নে পাহারা দিয়ে নয়, অযত্নে রেখে দিয়ে যদি রক্ষা করি ওকে?

নাঃ, যতো সব এলোমেলো চিন্তা। আসলে আমি আমার সেই মেজদির ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করছি। বয়েস হয়েছে, রেলগাড়িতে এসেছেন, সারাদিন কথা বলেছেন, আর কতোক্ষণ পারবেন ঘুমের সঙ্গে লড়াই করতে? নিশ্চয় এতোক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছেন।

অলকা আর অপূর্বর সঙ্গে এই কঘণ্টাতেই মেজদির যেন বেশ হৃদ্যতা হয়ে গেছে। একত্রিত পরিবারে এই কৌতুক নাটকের অভিনয়টি সর্বদাই হতে দেখা যায়। বহিরাগত অতিথিরা অর্থাৎ কিনা এসে পড়া.আত্মীয়েরা হঠাৎ কেমন করেই যেন ওই একের মধ্যেই একাধিকের সন্ধান পেয়ে যান। আর কেমন করেই যেন কোনো একটি বিশেষ দলভুক্ত হয়ে যান। অবশ্য বাইরে ঠাটটা সর্বজীবে সমভাবে থাকে, কিন্তু আস্তে আস্তে দলভেদটা প্রকট হয়ে ওঠে, এবং নোনাধরা যে দেওয়ালটা তবুও ছাদটাকে ধরে রাখার কাজে সাহায্য করছিল, সেটা ধসে পড়ে ছাদটাকে নামিয়ে দেয়।

হতো অবশ্যই এগুলো, কালক্রমে হতো, আত্মীয় অতিথি সেটুকু ত্বরাণ্বিত করে দেন। হ্যাঁ, এ নাটক হামেশাই হচ্ছে ঘরে ঘরে!

কিন্তু দুই দলকেই বা ওঁরা চট করে চিনে ফেলেন কী করে?

সেটাই আশ্চর্য রহস্য! অবশ্য সেই খুঁটিটাই ধরা নিয়ম। নৌকো বাঁধতে হলে বড়ো গাছেই বাধতে হয়। আর কে না জানে শিষ্টের থেকে দুষ্টই শক্তিতে বড়ো।

মেজদি কেমন করেই যেন ওই বড়ো গাছটাকে চিনে ফেললেন, আর নৌকোটি বাঁধলেন। কিন্তু উনি তো থাকতে আসেননি।

আসেননি সত্যি, তবে এখন যে ওঁর একটা অবিবাহিতা মেয়ে আছে, সেটাকে কলকাতার আবহাওয়ায় রাখতে চান, সেটা বোঝা গেছে ওঁর তখনকার কথায়।

যখন খেতে বলা হয়েছিল, এবং অনামিকা আটপৌরে শাড়িটা আটপৌরে ধরনে জড়িয়ে নিয়ে বকুল হয়ে গিয়ে বসেছিলেন সে আসরে, তখন মেজদি আমিষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে বড় ভাজের পাশে খেতে বসে ইচ্ছেটা ব্যক্ত করেছিলেন, কলকাতার হালচাল তো দেখলে গা জ্বলে যায়, তবু এখনকার ছেলেদের তো ওই পছন্দ, মেয়েটাকে এখেনে চালান করে দেবো, বলবো, নে কতো হালচাল শিখতে পারিস শেখ।

বলা নিষ্প্রয়োজন, শ্ৰোত্রীবর্গ কেউই এ ইচ্ছেয় উৎসাহ প্রকাশ করেনি, এবং মেজদিও সঙ্গে সঙ্গেই সেটা বুঝে ফেলে বলেছিলেন, অবিশ্যি কন্যে আমার থাকতে চাইবে কিনা সন্দেহ। “মা” ভিন্ন আর কিছুতে দরকার নেই তার। কোলের তো!…তবে আমিই বলি, পরের ঘরে যেতে হবে না? তা হারামজাদি হেসেই মরে, বলে, “যাবোই না”।

বকুলকে মাথা নিচু করে যেতেই হয় সেখানে। এদিকে ছোড়দার বউও থাকেন, থাকে বড়দার বিয়ে-টিয়ে হয়ে যাওয়া সংসারী মেয়ে হেনা। অপূর্বর নিজের বোন সে, কিন্তু বাপের বাড়ি এলে এদিকেই খায়। বলে, বাবা, অলকার ওখানে কে খাবে? বাসন-মাজা ঝিতে রাধে, চাকর বাসি কাপড়ে জল-বাটনা করে!

বকুল হাসে মনে মনে। ভাবে, তোমার মহা বিশ্বে কিছু হারায় নাকো কভু– না, কোন কালেই হারিয়ে যায়।

হেনা যখনই আসে বেশ কিছুদিন থাকে, কারণ ওর স্বামী অফিসের কাজে ট্যুরে যায়, আর সেটাই ওর পিত্রালেয় আসার সময়। এসেই বলে, চলে এলাম! বরবিহন শ্বশুরবাড়ি-ছ্যাঁ, যেন নুনবিহীন পান্তা!

হেনার ছেলে-মেয়ে নেই, তাই হেনার স্বাধীনতাটা এত বেশী। চন্দ্র-সূর্যের গতির নিয়মেই হেনা তার নিজের ভাই-বৌয়ের থেকে খুড়ো-খুড়ীকেই ভজে বেশী। মা? তিনি তো এখন নখদন্তবিহীন, তাকে বড়জোর একটু করুণা করা চলে। তার কাছে তো আশ্রয় নেই।

বড়দার আরও মেয়ে-টেয়ে আছে। তারা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আর আসে না। যেমন আসা ছেড়ে দিয়েছিল চাপা আর চন্দন, সুবর্ণলতা মারা গেলে। বলেছিল, আর কোথায় যাবো?

কিন্তু পারুল?

ভাবনাগুলো যেন পারার মতো, কিছুতেই হাতে ধরে রাখা যায় না, গড়িয়ে পড়ে যায়, যেখানে-সেখানে ছিটকে পড়ে, শুধু যেখানেই পড়ুক ঝকঝকে চোখে তাকায়।

পারুলের কথা মনে হতেই পারুল যেন সামনে দাঁড়িয়ে হেসে উঠলো।

যেন বললো, কই রে বকুল, তোর সময় আর তাহলে হলো না? অথচ বলেছিলি-যাবো সেজদি তোর কাছে! বকুলকে আস্ত করে খুঁজে দেখবো তোর সঙ্গে একসঙ্গে। আমার কাছে কেবলই ভাঙাচোরা টুকরো।

বলেছিল বকুল। কিন্তু সেই আস্তটা খুঁজে দেখতে যাবার সময় সত্যিই হয়ে উঠলো না আজ পর্যন্ত।

কেন?

খাতাপত্তরের জঞ্জাল সরিয়ে তুলতে পারি না বলে? পাহাড়ের ওপর আবার পাহাড় জমে ওঠে বলে? আর সেইগুলোর গতি করবো বলে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বসামাত্র ফাংশানবাজেরা বাজপাখির মতো এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় বলে?… তার মধ্যিখান থেকেও ফাঁক বার করে নেবার চেষ্টার সময় দর্শনার্থী আর বিনামূল্যে লেখা প্রার্থীর ভিড় এসে জোটে বলে?

যখন ইচ্ছে হবে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলি–এ তো বড়ো মুশকিল, দেশসুদ্ধ সবাই তোমরা পত্রিকা প্রকাশ করবে? আর আমরা হবো সেই যূপকাষ্ঠের বলি?

তখন খুব মধুর করে হেসে বলতে হবে, কি করবো, বল বাপু? সময় তো মোটে নেই, কতো কাগজ বেরোচ্ছে প্রতিদিন!

সমুদ্রে বালির বাঁধ-এর মতো সেই কথার বাঁধ ভেসে যাবে ওদের কথার তোড়ে বলে?

এইগুলোই সব থেকে বড়ো দরকারী?

এই দরকারগুলোর স্তূপের ওপরে সেজদি বসে বসে মিটি মিটি হাসবে, আর তারপর মুখ ফিরিয়ে নেবে, আর তারও পরে আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাবে, বদলে যাবে! হয়তো সেই চেনা সেদিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনদিন, হয়তো মরেই যাবে কোনোদিন, আর বকুল বসে বসে টেবিলে জমানো স্তূপ সাফ করবে! কোনোদিনই সাফ হবে না, আবার জমে উঠবে জেনেও।

এর খাজ থেকে একবার পালিয়ে যাওয়া যায় না?

হঠাৎ গিয়ে বলে ওঠা যায় না, দেখ তত চেয়ে আমারে তুমি চিনিতে পারে কিনা?

অফিসের কাজেই পশ্চিম থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে হয়েছিল মোহনকে, তবু মোহন এমনভাবে এসে দাঁড়ালো, দেখে মনে হতে পারে শুধু মাকে ওই প্রশ্নটাই করতে এসেছিল মোহন, এই মাত্র যে প্রশ্নের উত্তরটা দিলো পারুল হেসে উঠে, ওমা, তা তাড়িয়ে দেব নাকি? এসেছে পিসির কাছে দুদশদিন থাকবে বলে-

মোহন রাগটা লুকোবার চেষ্টা না করেই বলে, একা থাকলে দু’দশদিন কেন, দু’দশ মাসই থাকতে পারতো, আপত্তির কিছুই ছিল না, কিন্তু আর একটা যা শুনলাম

কী শুনলি আর একটা? প্রশ্ন করলো পারুল।

মোহন মনে মনে ঠোঁট কামড়ালো।

মনে মনেই চেঁচিয়ে উঠলো, মা, তোমার এই ন্যাকামিটি আর গেল না কোনোদিন? সেই ছেলেবেলা থেকে এই বুড়ো-বেলা পর্যন্ত দেখছি–তুমি ঠিক শরৎবাবুর নভেলের নায়িকার প্যাটার্ন নিয়ে কথা বলবে! আমরা অতশত বুঝি না। গেরস্ত লোক গেরস্ত ধরনে কথা কইবো, উত্তর পাবো, মিটে গেল ল্যাঠা, তা নয়।…কেন বুঝতে পারছে না তুমি, কী শুনছি আর একটা? ঠিকই বুঝতে পারছো, তবু আমার মুখ দিয়েই বলিয়ে নিতে চাও। সাধে কি আর ছেলের বৌরা এত বিমুখ, আমি তোমার নিজের ছেলে, তবু যেন আমাকে অপদস্থ করার মধ্যেই তোমার আনন্দ।

বলছিল মনের মুখ দিয়ে চেঁচিয়ে, কিন্তু বাইরে সেও পারুলের ছেলে। আত্মস্থ অচঞ্চল।

যা শুনলাম, সেটা তুমি বুঝতে পারনি তা নয়। আমি বলতে চাইছি–একটা কুলিকামিন ধরনের বাজে লোককে নিয়ে নাকি সে এসে উঠেছে তোমার কাছে। এবং সেটা নাকি রোগগ্রস্ত?

রোগগ্রস্ত? না তো, পারুল বিস্ময়ের গলায় বলে, তোমাকে যে খবর দিয়েছে, সে তো দেখছি ভালো করে খবর-টবর না নিয়েই

আমায় কেউ কোনো খবর-বৈর দেয়নি! বলে বসে মোহন।

পারুলের কি মনে পড়ে না, মোহন রেলের রাস্তায় অনেকটা দূর থেকে এসেছে, ওর তেষ্টা পেয়ে থাকতে পারে, খিদে পেয়ে থাকতে পারে। আর তার পর মনে পড়ে না মোহন তার নিজের পেটের ছেলে! পারুল মোহনের মা!

মনে পড়েই না হয়তো।

যাদের মন অন্য এক ধাতু দিয়ে গড়া, তাদের হয়তো ওই সব ছোটখাটো কথাগুলো মনে পড়ে না। তারা শুধু খাঁটি বাস্তবটা দেখতে পায়।

সেই বাস্তব দৃষ্টিতে পারুল মোহনকে পারুলের ‘অপরাধের বিচারক’ ছাড়া আর কোন দৃষ্টিতেই দেখতে পাচ্ছে না, অতএব পারুল নিজ পক্ষে উত্তর মজুত রাখতেই তৎপর থাকছে। আর এও স্থিরনিশ্চিত যে, অনধিকারে যদি কেউ বিচারক সেজে জেরা করতে আসে, পারুল তাকে রেহাই-টেহাই দেবে না। ছেলে বলেও না।

তাই পারুল ছেলেটার ক্লান্ত মুখটার দিকে না তাকিয়েই খুব হালকা একটু হাসির সঙ্গে বলে, কেউ খবর-টবর দেয়নি? ওমা, তাই নাকি? তুই তাহলে বুঝি আজকাল হাতটাত গুনতে শিখেছিস? কার বই পড়ছিস? কিরোর?

কথাটা বলে ফেলে অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল মোহন একথা সত্যি, তাই বলে এইভাবে অপদস্থ করা? মোহন গম্ভীর হয়। মোহনের ক্লিষ্ট মুখ আরক্ত হয়ে ওঠে, তীব্রতা পরিহার করে গম্ভীর সুরেই বলে সে, আমি বেশীক্ষণ সময় হাতে নিয়ে আসিনি মা! সোজা আর সহজ ভাবে কথা বললে তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

ওঃ তাই বুঝি!

পারুল চট করে নিজেকেও প্রায় সোজা দাঁড় করিয়ে বলে, তবে তুই-ই চটপট করে বল তোর কী জানবার আছে? কী উদ্দেশ্যে হঠাৎ এসেছিস? এক নম্বর দুনম্বর করে বল–উত্তরটা চটপট হয়ে যাবে।

উঃ অসহ্য! বললো মোহনের মনের মুখ।

তবু বাইরের মুখটা সহ্যের ভানে রইলো, আমি জানতে চাই তোমার ওই ভাইঝির সঙ্গে আর একটা লোক আছে কিনা?

আছে। যান্ত্রিক উত্তর পারুলের। মোহনের মনের মুখ আবার চেঁচাতে শুরু করে, ওঃ, সাধে কি আর ভাবি বাবা সাতসকালে মরে বেঁচেছেন!…

লোকটা কে, তার সন্ধান নিয়েছিলে?

দরকার বোধ করিনি।

ওঃ দরকার বোধ করনি? তোমার সাতজন্মে না দেখা এক ভাইঝি এসে তোমার বাড়িতে উঠলো একটা বাজে লোক নিয়ে, তুমি তার পরিচয়টা জানবারও দরকার বোধ করলে না?

আমার ভাইঝি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, এটাই যথেষ্ট পরিচয় বলে মনে করেছি—

চমৎকার? তোমার ভাইঝি যদি একটা রাস্তার কুলি-মজুরকে নিয়ে আসে—

সেটাও মেনে নিতে হবে। সেই কুলিটাকেই যখন সে ভাবী স্বামী বলে ঠিক করে রেখেছে।

অতএব তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে জামাই আদরে রাখতে আপত্তি নেই, কেমন? তোমার ওই ভাইঝির বয়েস নিশ্চয়ই এমন বেশী হয়নি যে, মানুষ চিনতে পেরে উঠবে। লোকটা জেলপালানো আসামী কিনা–

মোহনের দ্রুত কথার ঠাসবুনুনির মাঝখানেও আস্তে একটা পাতলা ছুরি বসায় পারুল, বয়েসটা অনেক বেশী হলেই মানুষ চেনবার ক্ষমতা হয়, এটা আবার তোকে কে বললো মোহন? তা তোর তো অনেকটা বয়েস হয়েছে, আমাকে দেখছিসও জন্মাবধি, কই, চিনে উঠতে পারলি কই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *