০৩. শম্পা সেজেগুজে আনন্দে ছলছল

শম্পা সেজেগুজে আনন্দে ছলছল করতে করতে এসে দাঁড়ালো, সিনেমা যাচ্ছি পিসি। মাৰ্ভেলাস একখানা বই এসেছে লাইটহাউসে। যাচ্ছি, বুঝলে? দেরি হয়ে গেল সাজতে। সেই হতভাগা ছেলেটা টিকিট নিয়ে হাঁ করে বসে আছে তীর্থের কাকের মত, আর বোধ হয় একশো শাপমন্যি দিচ্ছে! চললাম। মাকে বলে দিও, বুঝলে?

ওর ওই আহ্লাদে-ভাসা চেহারা কি কোনদিন দেখেননি অনামিকা দেবী? রোজই তো দেখছেন। তবু হঠাৎ কেন আজ বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এসে আড়াল করে ফেললো ওঁকে? সেই ছায়ায় হঠাৎ শম্পাকে বকুল মনে হল অনামিকা দেবীর?

ওর ওই হাওয়ায় ভাসা দেহটার সঙ্গে খাপ খাওয়া হাওয়া শাড়িটার জায়গায় একটা স্বদেশী মিল-এর মোটা শাড়ির একাংশ দেখতে পেলেন যেন।

বকুলের সেই শাড়িটা চাবিবাধা আঁচলের ধরনের ঘরোয়া করে পরা, বকুলের চুলের রাশি টান টান করে আঁচড়ে তালের মত একটা খোঁপা বাঁধা, বকুলের পা খালি। বকুলের হতে দুটি বই।

কিন্তু শম্পাকে হঠাৎ বকুল মনে হচ্ছে কেন? বকুলের তো শম্পার মত এমন আহ্লাদেভাসা চেহারা নয়?

বকুল ভীরু কুণ্ঠিত নম্র।

বকুলের মধ্যে দুঃসাহসের ভঙ্গী কোথায়?

নেই।

তবু শম্পাকে আড়াল করে বকুল এসে দাঁড়াচ্ছে। আর সেই ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বকুলকে কারা যেন ধমক দিচ্ছে, খবরদার আর ওদের বাড়িতে যাবে না তুমি। খবরদার নয় এত বড় ধিঙ্গী মেয়ে হয়েছ, রাতদিন নাটক-নভেলের শ্রাদ্ধ করছ, আর এ জ্ঞান নেই কিসে নিন্দে হয়?

বকুলের চেহারায় দুঃসাহসের ভঙ্গী নেই, তবু বকুল একটা দুঃসাহসিক কথা বলে বসলো। হয়তো এই জন্যই শম্পার সঙ্গে কেমন একটা মিল মনে হচ্ছে হঠাৎ।

বললো, হঠাৎ নিন্দে হবে কেন? চিরকালই তো যাই!

চিরকালের সঙ্গে এখনকার তুলনা কোরো না—, একটা ভাঙা-ভাঙা প্রৌঢ় গলা বলছে, এখন তোমার মাথার ওপর মা নেই। তাছাড়া ওদের ঘরে বড় ছেলে-

হ্যাঁ, এমন একটা অ-সভ্য কথা অনায়াসেই উচ্চারণ করেন তিনি।

বকুলের ক্ষীণ কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়, আচ্ছা বেশ, আর যাবো না, আজ শুধু এই বই দুটো ফিরিয়ে দিয়ে আসি।

কি বই?

এমনি।

এমনি মানে? নাটক-নভেল?

বকুল চুপ।

ওই তো, ওইটিই হয়েছে কুয়ের গোড়া! তিন পুরুষে একই রোগ! শুনতে পাই দিদিমার ছিলো, মার তো ষোলো আনা ছিলো, তারপর আবার মেয়েরও-দেখি কি বই!

বকুলের হাত থেকে বই দুটো প্রায় কেড়ে নেন তিনি। খুলে ধরেন। তারপর বিদ্রুপের গলায় বলেন, ওঃ, পদ্য! রবি ঠাকুর! সাধে আর বলছি তিন পুরুষের একই রোগ!- হুঁ, ঠিক আছে। আমি দিয়ে দেব। বই কার? ওই নির্মলটার নিশ্চয়?

বকুল পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বকুল উত্তর দিতে পারে না।

প্রৌঢ়র গলা থেকে একটি একাক্ষর শব্দ বেরোয়, হুঁ!

সেই শব্দের অন্তর্নিহিত ধিক্কারে পাথরের বকুল আষাঢ়ের ছায়ার আড়ালে মিলিয়ে যায়। শম্পার আহ্লাদে-ভাসা মূর্তিটা ঝলসে ওঠে সেই শূন্যতার উপর।

ঝলসে-ওঠা শম্পা বলে, যাচ্ছি তাহলে। মাকে একটু মুড বুঝে বোলো!

অনামিকা দেবী ঈষৎ কঠিন স্বরে বলেন, তুই নিজেই বলে যা না বাপু। আমি তোর মার মুডফুড বুঝতে পারি না।

তুমি পারো না? শম্পা হি হি করে হেসে ওঠে, তুমি বলে ওই করেই খাচ্ছ! দোহাই পিসি! এখন মাকে বলতে গেলে, সিনেমার বারোটা বেজে যাবে। হতভাগাটা হয়তো কাটা টিকিট ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে রেলে কাটা পড়তে যাবে!

হাসতে হাসতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় শম্পা পিসিকে টা-টা করার ভঙ্গী করে।

অনামিকা দেবী অপলকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভাবেন, আশ্চর্য! ও এ বাড়িরই মেয়ে? কত যুগ পরের মেয়ে?

শম্পা যখনই একটু দুঃসাহসিক অভিযানে বেরোয়, পিসিকে জানিয়ে যায়। পিসির সঙ্গে তার মাই-ডিয়ারি ভালোবাসা।

তাই তার প্ৰেমাস্পদের গল্পগুলো পিসির সঙ্গেই জমাতে আসে।

হয়তো অনামিকা দেবী সময়ের অভাবে ছটফটিয়ে মরছেন। হয়তো প্ৰতিশ্রুত লেখা প্রতিশ্রুতিমত সময়ে দিয়ে উঠতে না পারায় তাগাদার উপর তাগাদা আসছে, একটুমাত্র সময় সংগ্রহ করে বসেছেন খাতা কলম নিয়ে, তখন শম্পা তিনতলায় উঠে এসে জাঁকিয়ে বসলো, বুঝলে পিসি, হতভাগা বলেছি বলে বাবুর কী রাগ! বলে কিনা ভবিষ্যতেও তুমি তাহলে আমাকে এইরকম গালাগাল দেবে? বোঝো! এ অবতারাও সেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন! অর্থাৎ একটু প্ৰেম প্ৰেম ভাব দেখেছে কি বিয়ের চিন্তা করতে শুরু করেছে! ছেলেগুলো যে কেনই এত বোকা হয়? তা বুঝলে পিসি, আমিও ওকে বলে দিলাম, হতভাগা নয় তো কি? হতভাগা নইলে আমি ছাড়া আর ভালমত একটা সুইট-হার্ট জুটলো না তোমার? ঠিক বলিনি পিসী?

অনর্গল কথা বলে যায়।

অনামিকা তাকে শাসন করতে পারেন না। অনামিকা দেবী বলতে পারেন না, এত বাচালতা করে বেড়াস কেন?

না, বলতে পারেন না। বরং প্রশ্ৰয়ই দেন বলা যায়।

প্রশ্ৰয় দেন হয়তো নিজেরই স্বার্থে। এই মেয়েটার কাছাকাছি এলেই যেন অনামিকা দেবীর খাঁচার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একটি বন্দী পাখী, এসে আলোর দরজায় উঁকি মারে।

ও যে অনামিকা দেবীকে নস্যাৎ করে দিয়ে তার পিসির কাছে এসে দাঁড়ায়, এটাই যেন সর্বাঙ্গে ভালবাসার হাত বুলিয়ে দেয় অনামিকার।

জিনিসটা বড় দুর্লভ।

কিন্তু অনামিকার এমন হ্যাংলামি কেন?

কি নেই তার জন্যে?

যশ আছে, খ্যাতি আছে, শ্রদ্ধা-সম্মান আছে, ভালবাসাও আছে। অজস্রই আছে। কিন্তু এ সবেরই হেতুও আছে।

অহেতুক ভালবাসাই বড় দুর্লভ বস্তু। তাছাড়া যা আছে, সব তো আছে অনামিকা দেবী নামক খোলসটার জন্যে।

তাই শম্পার ওই বাচালতা, ওই বেপরোয়া ভঙ্গী, ওই লাজলজ্জার বালাইহীন কথাবার্তা সব কিছুই সহ্য হয়ে যায়। বরং ভালই লাগে। মনে হয়, যেন শম্পাকে এ ছাড়া আর কোন ভঙ্গীতে মানায় না।

বাড়ির লোক অন্য অনেক কিছু না বুঝুক, এটা বোঝে।

তাই প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে অনামিকা দেবীকেই দায়ী করে শম্পার বেচালের জন্যে।

বড় গাছে নৌকো বেঁধেছে যে —, ছোট বৌদি দেওয়ালকে উদ্দেশ করেই বলেন, ভয় কেন থাকবে? শুধু আমার নিজের হাতে মেয়ে থাকলে, কেমন না ঢিট করতাম দেখত সবাই। ছেলে জন্মাবার পর অনেকগুলো বছর বাদে শম্পার আবির্ভাব হয়েছিল। বড়ো বয়সের এই মেয়েটাকে এঁটে উঠতে কোনো দিনই পারেন না ছোট বৌদি, কিছু দোষারোপটা করেন অনামিকাকে।

অনামিকা দেবী তাই মাঝে মাঝে বলেন, তোর মাকে জিজ্ঞেস কর না বাবা! তোর মাকে বলে যা না বাবা!

শম্পা চোখ গোল করে বলে, মাকে? তাহলে আজকের মত বেরোনোর মহানিশা। কেন কি বৃত্তান্ত কোথায় কার সঙ্গে? ইত্যাদি, প্রভৃতি সে কী জেরা! উঃ, কী একখানা ব্রেন! মার বাবা যদি মাকে লেখাপড়া শিখিয়ে উকিল করে ছেড়ে দিতো, তাহলে দেশের দশের উপকার হতো, আর এই শম্পাটারও প্রাণ বাঁচত। কেন যে সে বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি ভদ্রলোকেরা!

অনামিকা ওর এই কথার ফুলঝুরিতে হাসেন, কিন্তু অনামিকার সেই হাসির অন্তরালে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস স্তব্ধ হয়ে থাকে।

তোরা আজকের মেয়েরা জানিস না, খেয়ালও করিস না, তখন কোনো ভদ্রলোকের মাথাতেই ও বুদ্ধিটা আসতো না। আর যদি বা দৈবাৎ কারো মাথায় আসতো, লোকে তাকে তখন আর ভদ্রলোক বলতো না।

তাই এমন কত মস্তিষ্কই অপচয় হয়েছে, কত জীবনই অপব্যয়িত হয়েছে। আজ পৃথিবী তোদের পায়ের তলায়, আকাশ তোদের মুঠোয়, তোরা নিজের জীবনকে নিজের হাতে পাচ্ছিস, আর তার আগে সেটা গড়ে দিচ্ছে তোদের গার্জেনরা।

তোরা কি বুঝবি গড়নের বালাইহীন একতাল কাদার জীবনটা কেমন? তাও সেই বাঁকাচোরা অসমান ডেলাটাও অন্যের হাতে!

সেই অন্যের হাতের চাপে বিকৃত অসমান কাদার জীবনকে দেখেছি আমরা, তাই ভাবি তোরা কত পেয়েছিস! কত পাচ্ছিস! কিন্তু সে বোধ কি আসে কোনোদিন তোদের? কিন্তু কেনই বা আসবে? প্রাপ্য পাওনা পাওয়ার জন্যে কি কৃতজ্ঞতা আসে?

বুকভরা নিঃশ্বাস নেবার মত বাতাস থাকলে কি কেউ ভাবতে বসে কে কবে কোথায় বাতাসের অভাবে দম আটকে মরেছে?

বকুলের ছবিটা একবার ভেসে এসেছিল বহু যুগের ওপার থেকে, কিন্তু তার খাতাটা? সেটা যে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না অনামিকা দেবী। খোঁজবার জায়গাটাই খুঁজে পাচ্ছেন না।

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, আর মনে হচ্ছে, এই সব নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর উপাদানের মধ্যে বকুলকে কোথায় পাবো?

বকুল বাপ-ভাইয়ের কঠোর শাসনে তার ভালবাসাকে লোহার সিন্দুকে পুরে ফেললো, এটুকু তো দেখতে পেলাম। কিন্তু সেটা কি একটা বলবার মত উপকরণ?

অথচ বকুলের কথা লেখবার জন্যে কোথায় যেন অঙ্গীকার ছিল। সে অঙ্গীকার কি ভুলে গেছেন অনামিকা দেবী?

ভুলে হয়তো যাননি, তবু কত হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হল জীবনে, কত হাজার হাজার বানানো মানুষের কথা, অথচ সেই কথাটা চাপা পড়ে রইল।

কিন্তু ও নিয়ে এখন আর ভাবনার সময় নেই। বনবাণীর সম্পাদক টেলিফোনযোগে হতাশ গলায় জানাচ্ছেন, আপনার কপিটার জন্যে কাগজ আটকে রয়েছে অনামিকা দেবী। সামনের সপ্তাহে বোরোবার কথা, অথচ-

বনবাণীর পরেই সীমান্তের কপি, তারপর অন্তহীন সাগরের প্রুফ। তার ভিতরেই তো উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন।

দিন আষ্টেক পরে সেজদির চিঠির উত্তর দিলেন, বকুলের খাতাটা কোথাও খুঁজে পেলাম না মনে হচ্ছে হারিয়েই ফেলেছি। আর তার সঙ্গে মনে হচ্ছে, হয়তো তোর কাছেই আছে। দেখা না খুঁজে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *