৩৬. আমি তো একজন গল্পলেখক

থী খবর গর্ম্‌ কেহ্ গালিব-কে উড়েঁগে পূর্জে;
দেখনে হম-ভী গয়ে থে পেহ্ তমাশা নহ্ হুয়া।
(চারদিকে খবর রটে গেল-গালিবকে টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হবে;
দেখতে আমিও গিয়েছিলাম, কিন্তু তামাশাটা হলই না।)

মির্জাসাব আমি তো একজন গল্পলেখক, অথচ দুনিয়ার আদালত আমাকে সবসময় অশ্লীল লেখক হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। পাকিস্থান সরকার কখনও বলেছে, আমি কমিউনিস্ট, সন্দেহভাজন, কখনও আবার আমাকে মহান লেখকের শিরোপা দিয়েছে। বেঁচে থাকার সামান্য সুযোগটুকু অবধি কখনও কেড়ে নেওয়া হয়েছে, কখনও দয়া করে কিছু ভিক্ষা দেওয়া হয়েছে। একেক সময় ওরা বলেছে, আমি আসলে কেউ নই, একজন বহিরাগত; আবার নিজেদের মর্জি হলে আমাকে কাছে ডেকে নিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি বুঝেছি, মির্জাসাব ওদের চোখে আমি বহিরাগতই; শুধু পাকিস্তান সরকার কেন, যে কোনও সরকার, যে-কোনও ক্ষমতার কাছে। বাইরের লোক, মোহাজির। আপনার জীবনটাও তেমনভাবেই কেটে গেছে, নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছি, আমি তাহলে কে? আমার অবস্থান কোথায়? পাকিস্থানে আমার নিজের কোনও জায়গা হয় নি মির্জাসাব, তবু সেই জায়গাটা খোঁজবার চেষ্টা চালিয়ে গেছি পাগলের মতো। আর সেজন্যই কখনও হাসপাতালে, কখনও পাগলাগারদে দিন কেটে গেছে আমার। সবাই মুখে থুতু ছিটিয়েছে। মান্টো! আরে ও তো একটা অশ্লীল লেখক, পর্ণোগ্রাফার। সারাদিন শরাব খায়, শরাবের জন্য টাকা ধার করে, ভিক্ষে চায়, আর তারপর ওর দোজখে ঢুকে নোংরা-নোংরা গল্প লেখে।

এ-সব অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, ভাইজানেরা। তখনও দেশটা দু-টুকরো হয়ে যায় নি। কালি শালোয়ার গল্পটা বেরোনোর পরেই হইচই শুরু হয়েছিল। সেবারের মতো লাহোরের সেশন কোর্ট আমাকে মুক্তি দেয়। তারপর ধুয়া-র বিরুদ্ধে উঠল অশ্লীলতার অভিযোগ। আর তখন কালি শালোয়ার-কে আবার পুঁয়া-র সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল চার্জশিটে। ১৯৪৪-এর ডিসেম্বর মাস। লাহোর থেকে এক গোয়েন্দা পুলিশ এসে আমাকে গোরেগাঁও থানায় হাজিরা দিতে বলল। থানায় যেতেই আমাকে গ্রেফতার করা হল। গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখতে চাইলে একজন অফিসার বললেন, তা তো আপনাকে দেখানো যাবে না।

-কেন?

-হুকুম নেই।

-ওয়ারেন্ট না দেখিয়ে তো আপনি অ্যারেস্ট করতে পারেন না।

-মিস্টার মান্টো, আপনার কোনও কথারই আমি উত্তর দিতে পারব না। এখান থেকে আপনাকে সোজা লাহোর কোর্টে পাঠানোর নির্দেশ আছে।

আমি তখন থানা থেকে উকিল হীরালালকে ফোন করলাম। হীরালালজি অফিসারের সঙ্গে কথা বলার পর আমাকে ছেড়ে দেওয়া হল। জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখ রাতে আমাকে আবার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হল। জামিনে মুক্তি পেলাম ঠিকই, কিন্তু লাহোর স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আমাকে হাজির হতে বলা হল।

সেই সময় ইসমতকে লিহাফ গল্প লেখার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওকেও একই এজলাসে হাজির হতে হবে। শুনে বেশ মজাই পেয়েছিলাম, মির্জাসাব। যাক্, এবার তাহলে লাহোরে গিয়ে একটু মওজ-মস্তি করা যাবে। শফিয়াকে নিয়ে ইসমতের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম।

-তোমরা দুজনে যা শুরু করেছ! শহিদ আমার পিঠ চাপড়ে বলল, চলো সেলিব্রেট করা যাক। ইসমত তো গুম মেরে বসে আছে।

-কেন?

-আমিও তো তাই বলছি। ওর এখন মনে হচ্ছে, লিহাফ লিখে ও যেন বড় গুনাহ্ করে ফেলেছে।

-সে কথা এখনও বলিনি। ইসমত ফুঁসে ওঠে।

-তা হলে?

-একটা গল্প লেখার জন্য এত বিড়ম্বনা পোষায় না।

-মান্টোসাবকে আমিও তাই বলেছিলাম। শফিয়া বলে, গল্প লেখার জন্য জেলে যেতে হলে, ও সব না-লেখাই ভাল।

-শোনো, ইসমত বহিন, জীবনে এইরকম সময় খুব কম আসে।

-মানে? মনে হচ্ছে, তুমি ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছ।

-তা ছাড়া কী? গল্প লেখার জন্য রানি তোমাকে-আমাকে কোর্টে হাজিরা দেওয়ার ফরমান পাঠিয়েছেন, এর চেয়ে বড় সম্মান আর হয় না কি?

-ওই সম্মান তুমি ধুয়ে জল খাও, মান্টোভাই। সব কিছুতেই নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা দেখতে, তুমি ভালবাস।

-ঝগড়া করো না ইসমত। শহিদ, আইসক্রিম আনাও তো। ইসমত, কী একখানা গপ্পো লিখেছ, ভাবতে পারছ। হাজারবার নিজের পিঠ চাপড়াও। লাহোরের ট্রিপটা ভারি মজার হবে, ইসমত। শহিদ, তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে।

-ও কী করবে গিয়ে? ইসমত ধমক দেয়।

-আরে বাবা, শীতের লাহোরের সৌন্দর্য তোমরা জানো না। কথায় বলে না, যো লাহোর নেহি দেখা, উও জন্মাই নাই। মাছ ভাজা আর হুইস্কি -ওঃ শহিদ, সে এক জন্নত -আশিকের চুমুর মতো গরম রেড ওয়াইন, ভাবা যায়?

-আপনি থামবেন মান্টোসাব?

-কেন শফিয়া? থামব কেন? আমি চোর, না জালিয়াত? আসলে বিচারের নামে রানি চান আমরা একটু লাহোর ঘুরে আসি।

কোর্টে হাজিরা দেওয়ার জন্য আমাদের লাহোর যাওয়ার সব ব্যবস্থা পাক্কা হয়ে গেল। হীরালালজিই আমাদের দুজনের কেস লড়বেন।

আঃ লাহোর! মির্জাসাব, পুরো শহরটাই যেন একটা শিশমহল। না, লাহোর যেন সেই নারী, যার কটাক্ষে রামধনু খেলে, সে জুয়া খেলে তার ভাগ্য নিয়ে, আর দুহাত বাড়িয়ে তার বুকের খুশবুর ভেতরে টেনে নেয়। আমরা লাহোরে পৌঁছতেই কত যে নেমন্তন্ন আসতে লাগল। সবাই তো আমার চেনা। কিন্তু ওরা দেখতে চায় ইসমতকে। এ কেমন আজিব অওরৎ, যে একটা গল্প লিখে শোর মাচিয়ে দিয়েছে।

স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট রায়সাহেব সন্ত রামের এজলাসে আমাদের হাজিরা দিতে হল। আমরা আবেদন জানিয়েছিলাম, বম্বে থেকে লাহোর তো দীর্ঘপথ, তাই প্রতিবার যেন আমাদের হাজিরা মুকুব করা হয়। আমাদের আবেদন গ্রাহ্যই হল না। তাই উচ্চ আদালতে আবেদন জানাতে হল। এরপর বিচারপতি অচ্ছুরামের এজলাশে হাজির হতে হল আমাদের। সে এক অবাক কাণ্ড! বিচারপতি অনেকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি আপনাদের দুজনের গল্পই আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। আমার তো খুবই ভালো লেগেছে। এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। এ যাত্রা তাহলে বাঁচা গেল। কিন্তু অচ্ছুরাম ঠেলে দিলেন দীন মহম্মদের এজলাসে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন, সাহিত্যের নামে আপনারা নোংরামো করেছেন। তিনি আমাদের আবেদন নাকচ করে দিলেন। আমি তখন সত্যিই অসুস্থ ছিলাম, মির্জাসাব। তাই ডাক্তারের চিঠি নিয়ে গিয়েছিলাম। অগত্যা দীন মহম্মদসাব আমার হাজিরা মুকুব করে দিয়েছিলেন।

মির্জাসাব, অশ্লীলতার অভিযোগ সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট ভাষায় রায় সাহেব সন্ত রামের এজলাসে পেশ করেছিলাম। হুজুর, মহামান্য, আপনার অনুমতি চেয়ে নিজের দুএকটি কথা বলতে চাই। নারী ও পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে এমন কিছুই নেই, যাকে আমরা অশ্লীল বলতে পারি। এই সম্পর্ক নিয়ে কোনও কথাই নোংরা হতে পারে না। কিন্তু যখন দুজনের সম্পর্ককে শুধু চুরাশিরকম যৌনমুদ্রায় দেখানো হয়, তখনই তা একমাত্র নোংরা হয়ে যায়। গল্প, কবিতা, ভাস্কর্যকে দেখতে হবে সেই সৃষ্টির ভেতরের প্রণোদনাকে বুঝে। তার পিছনে কোনও অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে, তাকেই আমরা অশ্লীল বলতে পারি। যৌনতা মানেই অশ্লীল নয়। তা হলে কোনারক, খাজুরাহোর মন্দির ভেঙে ফেলা উচিত। কোনও মানুষ নোংরা মন নিয়ে জন্মায় না, হুজুর। ভাল বা মন্দ, যাই বলুন, সবই তার ভেতরে বাইরে থেকে এসে ঢোকে। ধুয়া গল্পে আমি একটা বিশেষ অবস্থাকে বর্ণনা করতে চেয়েছি। গল্পের বাবা ও মা, নিজেরা একটু আলাদা থাকার ভান করে যৌন উত্তেজনা উপভোগ করে। সেই উত্তেজনাই চারিয়ে যায় তাদের ছেলে মাসুদের মধ্যে, যেহেতু সে ঘটনাটা আচমকা দেখে ফেলেছিল। আমি জানি না, কেন এই গল্পকে অশ্লীল বলা হয়। কোন অসুস্থ মন এই গল্পের মধ্যে অশ্লীলতা খুঁজে পাবে। আমি গল্প লিখেছি সুস্থ মনের মানুষদের জন্যই। হুজুর, আমি সামান্য গল্প লেখক; আমাকে পর্নোগ্রাফার বানিয়ে দেবেন না।

রায়সাহেব সন্ত রাম সম্ভবত কিছুই শোনেননি, বা শুনলেও। তিনি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। আমার দুশো টাকা জরিমানা হল। আমি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে দুশো টাকা বার করে দিলাম। সন্ত রামজি মুচকি হেসে বললেন, আপনি তাহলে তৈরি হয়েই এসেছিলেন?

-তা ছাড়া উপায় কি বলুন?

তবে জরিমানাটা আবেদন করে মুকুব হয়ে গিয়েছিল।

এ-সব আদালত-জরিমানা-অপমানের কথা না-হয় একটু মুলতুবি থাক, ভাইজানেরা। লাহোরে ওই শানশওকতের দিনগুলো কখনও ভুলতে পারব না। এজলাসে হাজিরার সময়টুকু ছাড়া আমি, ইসমত আর শহিদ টাঙ্গায় চেপে ঘুরে বেড়াতাম আর কেনাকাটা করতাম। ইসমত কত যে কাশ্মীরি শাল আর জুতো কিনেছিল। আমারও জুতো কেনার লোভ ছিল খুব। জুতো কিনতে গিয়ে প্রতিবারই ইসমত আমার ছোট-ছোট পায়ের দিকে তাকিয়ে বলত, তোমার পা দেখলে বড় লোভ হয়, মান্টোভাই।

-ফালতু কথা বোলো না। এই পা দুটোকেই আমি সবচেয়ে ঘেন্না করি।

-কেন?

-এক্কেবারে মেয়েদের মতো। কোনও মানে হয়! খোদা যে তখন কী করছিলেন! ভুলে কোনও অওরতের পা লাগিয়ে দিয়েছেন।

-মেয়েদের পা তুমি এত ঘেন্না করো? এদিকে মেয়েদের প্রতি আগ্রহের তো কমতি নেই।

-তুমি সব কিছু উল্টো বোঝ ইসমত। মেয়েদের পা ঘেন্না করব কেন? পুরুষ হিসেবে আমি মেয়েদের পছন্দ করি। তার মানে তো এই নয় যে আমি মেয়ে হতে চাইব।

-বখোয়াশ বাদ দাও।

-বখোয়শ তুমিই করো, তারপর বলো বাদ দাও। শহিদ, তুমি একে সহ্য করা কী করে?

শহিদ হাসতে হাসতে বলে, ওর বিষটুকু তো তুমিই নিয়ে নাও, মান্টো। আমার জন্য অমৃতই থেকে যায়।

ইসমত গম্ভীর হয়ে বলে, নারী -পুরুষ ছেড়ে এবার মানুষের কথায় এসো তো মান্টোভাই।

-মানুষ? সেটা কী চিজ?

-মানে?

-আমি তো জানি, পুরুষ আর নারী। মানুষ বলে তো কিছু জানি না।

-আবার তুমি বদমায়েসি করছ। ইসমত চোখ বড় বড় করে তাকায়।

-আমি বিমূর্তকে পছন্দ করি না, ইসমত।

-মানে?

-মানুষ শব্দটা আমার কাছে বিমূর্ত। আমার কাছে আছে শহিদ, ইসমত, শফিয়া-তারা কেউ নারী কেউ পুরুষ। মানুষ শব্দটা একটা ফ্রড।

-সব তোমার কাছে ফ্রড, তাই না? ইসমত চিৎকার করে ওঠে।

-তুমি ফুড নও, ইসমত বহিন।

-আবার?

-কী?

-বহিন তোমাকে বলতেই হবে?

শহিদ হা-হা করে হেসে ওঠে। ইসমত, এ-জীবনে, মান্টোর খেলাটা মেনে নাও। পরের জীবনে না-হয় অপেক্ষা করো।

আমি গম্ভীর মুখে বলি, শহিদ, এত সিরিয়াস মেয়ের কিছুতেই গল্প লেখা উচিত নয়।

ইসমত কোনও কথা বলে না। অনেকক্ষণ পর সে আমার চোখে সোজাসুজি তাকায়। -তা হলে কী করব?

-মান্টো, আর রাগিও না ইসমতকে। শহিদ ইসমতের মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বলে। – তুমি চলে গেলে আমার গোস্ত কিমা করে ছাড়বে।

-পায়ের কথা কী এত বলছিলে, বলো তো ইসমত?

-না।

-এই নাও, পেস্তা খাও।

পেস্তার লোভ ইসমত কখনও ছাড়তে পারে? আমার হাত থেকে একমুঠো নিয়ে চিবোতে শুরু করল। অমনি অন্য এক ইসমত।-আমার কথাই তো তুমি শুনলে না। যাদের পা খুব সুন্দর, তার খুব বুদ্ধিমান আর অনুভূতিপ্রবণ হয়।

-তা-ই? আমার তা হলে বুদ্ধি আর অনুভূতি, দুটোই আছে?

-জানি না। ইসমত ঝাঝিয়ে ওঠে। -আমার দাদার ছিল। আজিম বেগের। কী সুন্দর পা! একেবারে মেয়েদের মতো। মরার সময় দুটো পা এমন ফুলে গেছিল, তাকানো যেত না, মান্টোভাই।

এরপর ইসমতকে আর রাগানো যায় না। আজিম বেগ চুঘতাই যে ঢুকে পড়েছে আমাদের মধ্যে। আমি দেখতে পেতাম ওই নামটা এলেই ইসমত স্থির হয়ে যেত; লোকটা এত বড় বজ্জাত, ইসমতকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে? আজিম বেগের ওপর ওর সব অভিমান লেখা আছে দোজখি গল্পে।

সে বড় সুখের সময় ছিল, মির্জাসাব, লাহোরের সেই দিনগুলো। আমরা প্রায় সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। আনারকলি বাজার, শালিমার বাগ। নূরজাহানের সমাধি। মুশায়েরা, গাপ-বাজি, মাছভাজা, কাবাব, মুরগ কি টিক্কা। কত পুরনো দিনের জলছবি ছড়িয়ে আছে। লাহোরের পথে-পথে। আমার প্রথম যৌবনের হাশ্মতের সব দিন।

আমার বু গল্পটা ছাপা হতেই আবার শোরগোল পড়ে গেল। এর চেয়ে অশ্লীল গল্প নাকি আর হয় না। তার ওপর খ্রীস্টানরা নাকি আমার ওপর খুব চটেছে। এ গল্পের রণধীর একটা খ্রীস্টান মেয়েকে ছেড়ে রাস্তার এক কালো মেয়ের শরীরের গন্ধে জীবনের উত্তাপ খুঁজে পেয়েছিল। আবার লাহোরের পথে ইসমত ও আমি। শহিদ তখন সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। প্রথম শুনানি শুরু হল বু নিয়ে।

আমার উকিল জিজ্ঞেস করলেন, মান্টোসাব এই গল্প নাকি অশ্লীল?

-আলবত। সরকার পক্ষের জবাব।

-কোন শব্দটা অশ্লীল?

-সিনা।

-মহামান্য আদালত, সিনা কি অশ্লীল শব্দ? আমার তো মনে হয় না।

সরকার পক্ষের উত্তর, সিনা অশ্লীল নয়। তবে এক্ষেত্রে মহিলার স্তনের কথা বলা হয়েছে।

আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না, মির্জাসাব। আদালতের উকিল-মুহুরি-সরকারের চাকরবাকরেরা বলে দেবে, কোন শব্দের মানে কী? আর শব্দ নিয়ে যে জাগরণে-স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে বেঁচে থাকে, তার কিছু বলবার থাকবে না? হ্যাঁ, আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, মহামান্য আদালত, আমার গল্পে সিনা শব্দে নারীর স্তনের কথাই বলা হয়েছে। নারীর স্তনকে নিশ্চয়ই কেউ চিনাবাদাম বলে না।

এজলাসে হাসির হল্লা উঠল। আমিও হাসি থামাতে পারছিলাম না, মির্জাসাব। যারা আমার বিচার করছে, তারা কেউ স্তন দেখেনি, স্তন স্পর্শ করেনি, টেপেনি, চোষেনি? তা হলে স্তন শব্দ নিয়ে এদের এত আপত্তি কেন? আমি স্তন ভালবাসি, মির্জাসাব। কী আশ্চর্য গড়ন, যেন সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে এল দুটি শঙ্খ, কত অজানা-অনামা প্রণিদের কামনার সৌরভ ছড়িয়ে আছে তাদের শরীরে, আমি তাদের উষ্ণতায় হাত বোলাই, দেখি তাদের সৌন্দর্য, যেন মন্দিরের দুই গোপুরম, কখনও তারা দুটি পাখি হয়ে যায়, আমি তাদের পালকে আদর সঞ্চার করি। আমি ভালবাসি নারীর গ্রীবা, বাহু, নাভিপুস্প, নিতম্ব, উরু। খোদা যাকে এমন সৌন্দর্য দিয়েছেন, আপনি তাকে অশ্লীল বলবেন কোন সাহসে?

বিচারপতিরা তো প্রায়শই বেরসিক। অতএব তিনি ঘোষণা করলেন, অভিযুক্ত দ্বিতীয়বার এমন করলে, আদালত অবমাননার দায়ে তাঁর শাস্তি হবে।

আমি বসে পড়লাম। ইসমত আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, সিনা যদি অশ্লীল হয়, তবে হাঁটু বা কনুই অশ্লীল নয় কেন?

-এ-সব বখোয়শ শুনো না।

-তুমি আর কিছু বলবে না?

-কী বলব?

-ওরা তোমাকে নিয়ে কাটাছেড়া করে যাবে, আর তুমি চুপচাপ বসে শুনবে মান্টোভাই?

ইসমত, এমনটাই তো লেখকদের নিয়তি। যে কেউ তোমাকে ছুরি দিয়ে ফালাফালা করবে। তোমাকে সব শুনে যেতে হবে। এই দুনিয়ায় সত্য কখনও জোর গলায় কিছু বলতে পারে নি।

-আমি বলব।

-কী বলবে?

-লিহাফ-এর পক্ষে। আমি ভুল করিনি।

-বোলো। তোমার কথা প্রতিধ্বনি হয়ে ঘুরবে এই এজলাসে। তবু তুমি কখনও ক্ষমা চেয়ো না ইসমত।

-কী ভাব আমাকে, মান্টোভাই?

-মার খেতে খেতে একসময় শিরদাঁড়া নুয়ে যায় তো। আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। ইসমত, আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে আমি চুপ করে থাকব। নীরবতা ছাড়া আমার আর কোনও অস্ত্র নেই।

সেদিন রাতে ইসমত হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, মান্টোভাই তোমার আগের মত দম নেই কেন বলো তো?

কী বলব ইসমতকে? ও কি জানে, আমি আসলে এক দুর্বল, নিরীহ মানুষ? শুধু বেঁচে থাকার জন্য আমি নিজেকে সবার সামনে এমনভাবে হাজির করেছি, যেন আমার মতো কালাপাহাড় আর কেউ নেই।

-ইসমত, জেলখানাকে আমি খুব ভয় পাই।

-তুমি জেলখানাকে ভয় পাও?

-আমার ভয়ের কথা কাউকে কখনও বলিনি, ইসমত। কাকে বলব, বলো? শফিয়াকে বলা যায় না। ও এত শান্ত আর ভাল মেয়ে। এমনিতেই আমাকে নিয়ে জেরবার হয়ে আছে। ইসমত, আমার দৈনন্দিন জীবনটাই তো একটা জেলের জীবন। তার মধ্যে যদি আরও একটা জেলখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, আমি এক মিনিটও বাঁচব না।

-কী হয়েছে তোমার মান্টোভাই?

-খুব ভয় করে ইসমত। এই জীবনটাকে চুষে-চিবিয়ে খাওয়ার খুব লোভ আমার। ধরো, রাস্তায় হাঁটছি, কেউ হঠাৎ এসে আমাকে বুকে গুলি করল, আমি মরে গেলাম, তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু জেলখানায় একটা ছারপোকার মতো আমি মরতে চাই না।

-এ-সব কেনো ভাবো?

-আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে ইসমত।

-মান্টোভাই। ইসমত চিৎকার করে ওঠে।-কী মনে করো নিজেকে? শুধু নিজের জন্য সহানুভূতি চাও, তাই না?

-গাড়িতে যে পাঁচ নম্বর চাকাটা লাগানো থাকে, দেখেছ ইসমত? আমি ওই পাঁচ নম্বর চাকাটা।

-আমাদের কথাগুলো হিন্দি সিনেমার ডায়লগের মতো হয়ে যাচ্ছে, মান্টোভাই। আমি আর কিছু বলিনি। তর্ক করার ইচ্ছে ছিল না। মনে-মনে বলেছিলাম, কেউ তো আমাদের নিয়ে একটা সিনেমাই তৈরি করছে ইসমত। হয়তো কেয়ামতের দিনে সিনেমাটা তিনি আমাদের দেখাবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *