৩৩. একটা সুফি কিস্সা মনে পড়ল

মওজুঁ করো কুছ অওরভী, শায়দ কেহ্ মীরজী
রহ জায়ে কোঈ বাত কিসূকী জবান পর।
(আরও কিছু কাব্য রচনা করো মীরসাহেব, হয়তো বা
তোমার কোনো কথা রয়ে যাবে কারুর মুখে।)

একটা সুফি কিস্সা মনে পড়ল, ভাইজানেরা। এক ভিখারি খিদের জ্বালায় শহরের বাড়ি থেকে বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভিখারিকে জানলা থেকে দেখে কেউই আর দরজা খোলে না। শেষে এক বাড়ির দরজা খুলল। বাড়ির কত্তা জিজ্ঞেস করল, কী-কী হয়েছে কী-তখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছ কেন?

-হুজুর কিছু খাবার। তিনদিন কিছু খাইনি।

-তা আমি কী করব? বাড়িতে এখন কেউ নেই।

-আমি কাউকেই চাই না হুজুর। শুধু একটু খাবার। আর কিছু চাই না।

এই ভিখারিটার মতোই আমি দোরে-দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর খোদা আমার জন্য কয়েকদিনের খাবারের বন্দোবস্ত করে দিলেন। মিঞা নাসিরুদ্দিন সাব আমাকে বুকে টেনে নিলেন। তাঁকে সবাই মিঞা কালে শাহ বলেই ডাকত। বাদশা বাহাদুর শাহ তাঁকে মুর্শিদ হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। তা জেল থেকে বেরিয়ে আমি লালকুঁয়ায় মিঞা কালে সাবের হাভেলির একটা অংশে এসে উঠলুম। ভাড়া দিয়ে থাকার মতো সামর্থ্য তখন আমার ছিল না; কালে সাবও সে-সব কথা তোলেননি। একদিন কালে সাবের সঙ্গে তাঁর বৈঠকখানায় বসে আছি, কে একজন এসে বলল, মুবারক মির্জাসাব।

-কেন?

-জেল থেকে ছাড়া পেলেন, তাই।

আমার মাথায় তো সবসময় বদবুদ্ধি খেলে, মান্টোভাই। কালে সাহেবের দিকে তাকিয়ে হেসে। বললুম, ছাড়া পেয়েছি? কী যে বলেন মিঞা! গোরাদের জেলখানা থেকে বেরিয়ে কালে সাবের জেলখানায় এসেছি বলতে পারেন।

কালে সাব রসিক মানুষ; হা-হা করে হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন, জাঁহাপনা কেন যে আপনাকে এতদিন দরবারে ডাকেননি, বুঝতে পারি না। আপনার রসের ছিটেফোঁটা বাদশাহর গায়ে লাগলে, তাঁর জীবনটা এমন অভিশপ্ত হত না।

-জাঁহাপনা কেন আমাকে ডাকবেন, মিঞাসাব। আমি তো খোদার কুকুর।

-মাশাল্লা! এই তো মির্জা গালিবের মতো কথা।

-কিছু ভুল বললুম?

-আপনি সেই কিস্সাটা শোনেননি? নকস্বন্দি তরিকার মুর্শিদ মওলা দরবেশ নিজেকে কুকুর বলতেন। -আপনি কিস্সাটা বলুন জনাব। শুধু তার আগে আমি একবার কাল্লুকে ডেকে পাঠাই।

-কেন?

-কিস্সা না শুনলে ওর ঘুম আসে না। আমার যেমন দারুর নেশা, ওর নেশা হয় কিস্সায়।

-বড় আজব নোকর আপনার, মির্জা।

কাল্লুকে ডেকে পাঠালুম। নতুন কিস্যা শোনার লোভে ওর চোখ দুটো চকচক করছিল; কালে সাবের সামনে বসে তাঁর পা টিপতে শুরু করে দিল। কাল্লুকে নিয়ে একটা নাম লেখা আমার। উচিৎ ছিল, মান্টোভাই; এমন কিস্সাখোর মানুষ আমি আর দেখিনি জীবনে।

কালে সাব তার কিস্স শুরু করলেন।-একদিন এক দরবেশ দরগায় বসে মুরিদদের মওলা রুমির বচন শোনাচ্ছিলেন। মওলা রুমি কী বলেছিলেন জানেন তো? মানুষকে তার জীবনে তিনটে পর্ব পেরিয়ে যেতে হয়। প্রথমে সে যে-কোনও কিছুকেই পুজো করে, পুরুষ, নারী, টাকা, শিশু, এই দুনিয়া, একটা পাথর, যাই হোক না কেন। পরের ধাপে সে আল্লার উদ্দেশ্যে। নামাজ পড়ে। আর শেষ ধাপে পৌঁছলে আল্লাই আমার সব যেমন বলে না, আবার আল্লা বলে কেউ নেই এ কথাও বলে না। এমন সময় এক মোল্লা রাগে গরগর করতে করতে দরগায় এসে ঢুকল। মওলার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করল, কুত্তা কাঁহিকা। এখানে বসে বসে তুমি। মুরিদদের নিয়ে খোশগল্প করছ, আর আমি যতই খোদার দিকে সবার মন ফেরাতে চাই, কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।

-তারপর? কালু উত্তেজিত হয়ে ওঠে।-মোল্লাটাকে বেধড়ক পেটানি দিলে—

-সবুর করো কাল্লু। কালে শাহ হাসলেন।-পেটালেই কি কাজ হাসিল হয়? তবে কিনা মুরিদরা সব উঠে দাঁড়িয়ে মোল্লাকে এই মারে তো সেই মারে।

-মারাই তো উচিত। কাল্লু আবার উত্তেজিত।-আমি থাকলে মোল্লার দাড়ি ছিঁড়ে—

-কাল্লু, মিঞাকে কিস্সাটা বলতে দে। তুই সেখানে থাকলে কিস্সাটাই আর আমরা শুনতে পেতুম না। আর তুই মোল্লার দাড়ি হাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াতিস। আমি হাসতে হাসতে বলি।

-মওলা তো তাঁর মুরিদদের থামালেন। হাসতে হাসতে তাদের বললেন, আরে করো কী, করো কী! কুত্তা শব্দটা এমন খারাপ কি শুনি? আমার তো বেশ ভালই মনে হয়। আমি কুকুর বই আর কী? প্রভুর সব কথা শুনে চলছি। প্রভুর বিপদ দেখলে ঘেউ ঘেউ করি, প্রভুর আনন্দ হলে লেজ নাড়াই। ঘেউ ঘেউ করা, লেজ নাড়ানো, প্রভুকে ভালবাসা-এই তো কুকুরের ধর্ম। এতে তো অপমানের কিছু আমি দেখছি না। তো মির্জা আপনি যদি খোদার কুকুর হন, তার চেয়ে বড় সম্মানের আর কী আছে?

এই হচ্ছেন মিঞা কালে শাহ। যেমন রসিক মানুষ, তেমনই পরম করুণাময়। জাঁহাপনাকে তিনি আমার সম্পর্কে অনেক কথাই বলতেন। তিনি সর্বান্তকরণে চাইতেন, দরবারে যেন আমি জায়গা পাই। আমাকে বলতেন, মনে রাখবেন মির্জা, খোদা এই দুনিয়াতেই সব হিসেবনিকেশ মিটিয়ে দেন। কেয়ামতের দিনে শুধু তো তাঁরই সঙ্গে থাকা। সেখানে চাওয়া-পাওয়া বলতে। কিছু নেই। খোদার জন্য যে-সৌন্দর্য আপনি সৃষ্টি করেছেন, তার মূল্য আপনি নিশ্চয়ই পাবেন।

-খোদাই তো সব সৌন্দর্যের স্রষ্টা, মিঞাসাব। তাঁর জন্য আমরা আর কী সৃষ্টি করতে পারি?

-তা হলে তিনি আমাদের এই দুনিয়াতে আনলেন কেন, মির্জা? তিনি আমাদের দেন সত্য, আর আমরা তাঁকে দিই মায়া।

কালেসাব ঠিকই বলেছিলেন। গজল তো আসলে মায়া-ই। গজল শব্দের ভেতরে লুকিয়ে আছে একটা কথা। আওরতো সে গুগু। দয়িতার সাথে প্রণয়ের কথা। বাহার যেমন আসে, আবার হারিয়ে যায়, প্রেমও তো বসন্তের মতোই আসে, তারপর হারিয়ে যায়। ভাবলে। খুব শীত করে না, মান্টোভাই? মিলনের আকাঙ্খর ভেতরেই ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে মৃত্যুর বীজ। শরীর ঝরে যাবে, মন ঝরে যাবে, আকাঙ্খা এগিয়ে যাবে তার মৃত্যুর পথে। মায়ার তসবিরমহলে আমরা কয়েকটা দিন ঘুরে-ফিরে বেড়াই। বাদ দিন এসব হেঁদো কথা। মায়া খেয়ে তো আর মানুষ বাঁচে না। আমার তখন দরকার একটু পরোটা –গোস্ত -সুরা।

বাহান্ন বয়েসে দরবারে জায়গা পেলুম। আগ্রা থেকে যখন শাহজাহানাবাদে এসেছিলুম, তখন দরবার ছিল আমার কাছে স্বপ্নের জগৎ। সে স্বপ্ন কবেই মরে হেজে গেছে, মান্টোভাই। শায়র হিসেবেও আর কিছু চাই না। আমি তো জানি, গুগু আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু খেয়ে পড়ে বাঁচবার জন্য দরবারে একটু জায়গা দরকার ছিল। দরবার তো আর কোন শিল্পীর জীবনে সৃজনের বসন্ত নিয়ে আসতে পারে না। যখন সত্যিই লিখতে পারতুম, তখন দরবারে ঠাঁই পেলে বেঁচে থাকার জন্য নানা নোংরামি করতে হত না, ভাষাকে আরও গভীরভাবে আদর করার সময় পেতুম। কালে সাব তো ছিলেনই, বাদশার হাকিম আক্সানউল্লা খানও আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিনি আমার ফারসি রচনা খুবই পছন্দ করতেন।বাদশাকে আমার ফারসি দিবান আর পঞ্চ অহঙ্গ-এর কথা বলে দরবারে চাকরি জুটিয়ে দিলেন। চাকরি ছাড়া আর কী?

আরে, কবিতা লেখো বা যতই ভাল ফারসি লেখো, মনে রাখতে হবে, তুমি দরবারের চাকর ছাড়া আর কিছু নও। বাদশার হারেমের খোজার চেয়ে নিজেকে বড় কিছু ভাবতে যেও না। বাদশার কাছে সবাই খোজা, মান্টোভাই। নইলে যে-লোকটা গজল লেখে, বাদশা তাঁকে কী। কাজ দিলেন? মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস লিখতে হবে ফারসিতে। বছরে এজন্য আমাকে ছশো টাকা দেওয়া হবে।

সব অপমানই আনুষ্ঠানিক। তাই দরবারি, পোশাকের সঙ্গে খেতাব দেওয়া হল আমাকে। নজম উদ-দৌল্লা, দবীর-উল-মুলক-নিজাম-জঙ্গ। এটা কোন কবির খেতাব? কিন্তু বাদসার মর্জি। তার মানে, আপনি আর কবি নন, সাম্রাজ্যের তারকা, দেশের রচনাকার ও যুদ্ধের নায়ক। আরে, কোন যুদ্ধটা আমি করতে পারি? টিকে থাকার যুদ্ধেই যে পরাজিত, সে হবে যুদ্ধের নায়ক? ঘরে ফিরে আমি খুব একচোট হেসেছিলুম; সে হাসি আর থামতেই চায় না। আমি হলুম ইতিহাসকার? সিকন্দর ও দারার গল্প আমি পরি নি, প্রেম আর মৃত্যুর কিস্সা নিয়েই তো আমার অর্ধেক জীবন কেটে গেছে। কিন্তু বাদশা চাইলে আমাকেও ইতিহাসকার হতে হবে। বছরে ছশো টাকা দেবে বলে কথা। বাদশা চাইলে আমাকে তাঁর হারেমের খোজা প্রহরীও করে দিতে পারেন।

সেদিন উমরাও বেগম আমার কাছে এল। হয়তো কাল্লুর মারফত শুনেছিল, গাধার ডাকের মতো আমার অনর্গল হাসির কথা। আমি সেদিন একটু বেশী নেশাও করেছিলুম। উমরাওকে দেখেই আমি হাসতে হাসতে বললুম, আরে, মসজিদ ছেড়ে আমার দোজখে কেন বেগম?

-আজ আপনার খুশির দিন, মির্জাসাব।

-বটেই তো। আমি নিজাম-জঙ্গ।

আবার হাসতে শুরু করলুম।

-কী হল মির্জাসাব?

-তুমি বুঝবে না বেগম।

-আমি কি আপনাকে একেবারেই বুঝি না?

-না, বেগম। তুমি একেবারেই আমাকে বোঝ না।

কতদিন পর, উমরাওকে আমার বুকের ভিতরে টেনে নিই।-বেগম, আমার আর কোনও স্বপ্ন নেই। কবিতা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু খাওয়া-পরার জন্য যে আমাকে চাকর হতে বলবে, আমি তার নোকর হতে পারি। আমি তো শুধু আসাদুল্লা খাঁ ছিলাম না, আমি গালিবও এই দুটো মানুষ আলাদা বেগম। আসাদুল্লা খাঁ দারু খেতে ভালবাসে, কাবাব -পরোটা খেতে ভালবাসে, গালিব খেতে ভালবাসে শধু শব্দ-রামধনু-লাগা শব্দ; বাদশা কিনতে পারে আসাদুল্লা খাঁ-কে, গালিবকে কেনার টাকা কোথায় তাঁর রাজকোষে? কেননা না, আমার আপস যত খুশি কেননা।

-মির্জাসাব

-বলো।

-আপনি তা হলে চাকরিটা ছেড়ে দিন।

-না, বেগম।

-কেন?

-এখন তো আর অসুবিধে নেই বেগম। গজল যাকে ছেড়ে চলে গেছে, সে এবার যা খুশি তা-ই করতে পারে। বাদশার পা টিপতে পারে, রাজনীতি করতে পারে। তুমি আমাকে না হয় কাল একটু কিমাপোলাও খাওয়াও। বেগম, এবার একটু সুখ চাই।

আমি বুঝতে পারতুম, জাঁহাপনা আমাকে একটুও পছন্দ করতেন না। শুধু কালে সাব আর অক্সানউল্লা খান সাবের জন্যই মেনে নিয়েছিলেন আমাকে। দরবারের আদব কায়দাও তো ভাল লাগত না আমার। ঈদের জন্য বাদশাকে খুশি করে কবিতা লেখো, আরও কত কত উৎসব যে লেগে থাকত, সব কিছুর জন্য কবিতা লিখে দাও। আমি ওসব লিখতে পারতুম না। মুখে মুখেই দুএকটা শের বলে দিতুম; সেসব কখনও লিখে রাখি নি। ওসব কবিতা নাকি? উৎসবের সময় তো জাঁহাপনাকে নজরানা দিতে হত; সেই টাকা বাঁচানোর জন্যই কিছু না – কিছু লিখতে হয়েছে। ওগুলো সবই গু-গোবর, মান্টোভাই, যা আমি বাদশার মুখে ছুঁড়ে মেরেছি; বাদশার সাধ্য কি শিল্পীর হারামিপনা বুঝবে? তার তো চাই শুধু প্রশস্তি। সভাকবি জওকসাবের কাছে প্রশস্তি শুনতে-শুনতে তার মজ্জায় মজ্জায় একটা কথাই ঢুকে গিয়েছিল, দুনিয়ার সব। কবিতা আসলে জাঁহাপনা বাহাদুর শাহর প্রশস্তি। সব সম্রাট এমনটাই ভাবেন। তাঁদের এই ভাবনার বিপরীতে গেলেই আপনাকে সারাজীবন লাথিঝাঁটা খেতে হবে। জাঁহাপনা আকবরকে নিয়ে ইতিহাসে কতই না প্রশস্তি ভাবুন। কিন্তু আনারকলিকে তিনি কীভাবে হত্যা করেছিলেন? তার আসল নাম ছিল নাদিরা বেগম। কেউ কেউ বলত, শরউন্নিশা বেগম। জাঁহাপনা আকবরের হারেমের অতি সুন্দরী ক্রিতদাস-কন্যা। একদিন আয়ানামহলে বসে জাঁহাপনা আকবর আয়নায় দেখতে পেলেন, আনারকলি যুবরাজ সেলিমের দিকে তাকিয়ে হাসছে। শুধু ওই হাসিটুকু হয়ে গেল আনারকলির মৃত্যুবীজ। প্রাসাদের দেওয়ালের গভীরে জীবন্ত আনারকলি হারিয়ে গেল। সব-সব সাম্রাজ্য এভাবেই মানুষকে গ্রাস করে।

সাম্রাজ্য আর ইতিহাস বড় সর্বগ্রাসী, মান্টোভাই। জাঁহাপনার আদেশে আমি ইতিহাস লিখতে শুরু করলুম। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে দুই খণ্ডে ছকে নিলুম। প্রথমভাগে থাকবে তৈমুর লং থেকে হুমায়ুন; আর দ্বিতীয় পর্বে সম্রাট আকবর থেকে বাদশা বাহাদুর শাহ পর্যন্ত। প্রথম খণ্ডের নাম দিলুম মিহর-ই-নিমরোজ। মধ্যদিনের সূর্য। আর দ্বিতীয় খণ্ড মাহ-ই-নিম্মাহ। মধ্য মাসের চাঁদ। পুরো বইয়ের নাম হবে পরতাবি স্তান, আলোর রাজ্য।

টাকা পেতে হবে বলে কথা, তাই তাড়াতাড়ি লিখতে শুরু করলুম। কথা ছিল, ছমাস অন্তর আমাকে পারিশ্রমিকের টাকা দেওয়া হবে। তা প্রথম ছমাসে আমি জাঁহাপনা বাবরের জীবনেতিহাস লিখে ফেললুম। কিন্তু এইরকম একটা বিরক্তিকর কাজের জন্য ছমাস অন্তর টাকা পেলে চলে? আমার পারিশ্রমিক যাতে প্রতি মাসে দেওয়া হয়, সেই অনুরোধ জানিয়ে বাদশাকে একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলুম। ঠিকই করেছিলুম মাসে-মাসে টাকা -না-দিলে ইতিহাস লেখা বন্ধ করে দেব।

আপ কা বন্দহ্ অওর ফিরু নঙ্গা?
আপ কা নৌকর,অওর খাঁউ উধার?
মেরী তনখাহ্ কীজিয়ে মাহ্ ব মাহ্
তা না হো মুঝকো জিন্দেগী দুশওয়ার।
(আপনার ভৃত্য, নিস্ব রিক্ত?
আপনার দাস, ঋণগ্রস্থ বারোমাস?
মাসে মাসে, হোক আমার বেতন
দুরূহ না হয় যেন জীবনযাপন।)

ওই ইতিহাস আমি আর শেষ করতে পারিনি ভাইজানেরা। শুধু প্রথম খণ্ড মিহর-ই-নিমরোজই প্রকাশিত হয়েছিল। মাহ-ই-নিম্মাহ-এর কাজ এগোয়নি। হয়েছিল কী, হাকিম অক্সানউল্লা খান সাবকে জানিয়েছিলুম, আমার মতো মানুষের পক্ষে ইতিহাসে জঙ্গল ছুঁড়ে ঠিক ঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, হৃদয়ের আলোয় আমি শুধু কবিতাই লিখতে পারি হাকিমসাব, তাই যে – তথ্যগুলো ইতিহাসে যাওয়া দরকার, সেগুলো বেছে পাঠিয়ে দিলে আমার সুবিধে হয়। তিনি কী করলেন জানেন? আদমের জন্মকাল থেকে চেঙ্গিজ খান পর্যন্ত নানা তথ্য লিখে পাঠালেন। আমি তো সাম্রাজ্যের ইতিহাস শুরু করেছিলুম তৈমুর লং থেকে। কী আর করা? যা লিখেছিলুম, তার আগে ওই অংশটা জুড়ে দিলুম। কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য আর তথ্য এল না। চৌষট্টি পাতার মতো লিখেছিলুম। কতবার খবর পাঠালুম পরবর্তী তথ্যগুলো পাঠানোর জন্য। একবার উত্তর এল, এখন রমজান চলছে। পরের বার জানাল, সবাই এখন ঈদের উৎসবে ব্যস্ত। ধুত্তোরি। আরে আমার কী দায় পড়েছে রাজা-বাদশার সাম্রাজ্যের ইতিহাস লেখার? ওই চৌষট্টি পাতাই পাঠিয়ে দিলাম। সে-লেখা কেল্লার কোন অন্ধকার ঘরে উইয়ে কেটেছে কে জানে! ইতিহাস তো উইয়ে কাটার জন্যই, তাই না, মান্টোভাই?

ইতিহাস লেখানো যেমন রাজাবাদশার খেয়াল, ইতিহাসকে মুছে দেওয়াও তাঁদেরই অহঙ্কার। আমরা তার সঙ্গে তাল রাখতে পারি? আর যে কবিতা লেখে? সে তো ইতিহাসের শরীরে প্রজাপতির রংচঙে দুটো ডানা লাগিয়ে দিতে চায়-উড়ক-উড়ে যাক-জন্নত, জাহান্নম, যেখানে খুশি। জাঁহাপনা বাহাদুর শাহ আমার গজল পছন্দ করতেন না, তা তো আপনাদের আগেই বলেছি। জওকসাবের শের শুনতে শুনতে তিনি হায় হায়, কেয়া বাৎ, কেয়া বাৎ বলতেন, আর আমার শের শুনে একটাই কথা, ঠিক হ্যায়। একবার বললেন, মির্জা, আপনি পড়েন খুব ভাল। মানে বুঝলেন? গজলের অর্থ যেন কিছুই নয়। তা তাঁরও তো খুব কবি হওয়ার শখ। হয়েছিল। একসময় তাঁর গজল সংশোধন করে দিতেন জওকসাব; আর জওকসাবের মৃত্যুর পর আমি। কী লিখেছেন আমাদের জাঁহাপনা? কী লেখা সম্ভব ছিল তার পক্ষে? ওইরকম। একটা কাপুরুষ-পূর্বপুরুষের টাকায় বসে বসে খাওয়া ছাড়া যার জীবনে আর কিছুই ছিল না, বেগম জিনত মহলের হাতের পুতুল, জীবনটা শুধু পরজীবী হয়ে কাটিয়ে দিলেন, তিনি লিখবেন গজল? আওরতো সে গুগু-র জন্য অনেক দম্ লাগে, মান্টোভাই।

বাদশার ছোট ছেলে মির্জা জওয়াঁ বখতের শাদির সময় এক কাণ্ড ঘটল। জওয়াঁ বখত বেগম জিনত মহলের ছেলে। ফলে বাদশার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী। খুব জাঁকজমক করে শাদি হবে। বেগমের নির্দেশে আমাকে শাদির জন্য একটা সেহ্রা-বিবাহগীতি লিখে দিতে হল। তো সেই। সেহ্রার শেষে আমি লিখেছিলুম :

হম্ সুখন্‌ মহিম হ্যায়, গালিব কে তরফদার নহীঁ
দেখে, ইস সহ্রে সে কহ্ দে দোই বেস্তর সেহরা।
(কবিতার মর্ম বোঝেন গালিবের তরফদার নন
লিখুন তো দেখি কেউ, সব সেরা সেহ্রা এমন।)

বাদশা ভেবে নিলেন আমি এখানে তাঁকে এবং তাঁর উস্তাদ ইব্রাহিম জওকত্সবকে অপমান। করেছি। তার মানে কী দাঁড়াল? জওকসাবকে যিনি মালিক-উশ-শুয়ারা খেতাব দিয়েছেন, তিনি যেমন কবিতা বোঝেন না, জওকসাবের পক্ষেও এমন কবিতা লেখা সম্ভব নয়। আমি চলে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলে বাদশা বললেন, একটু বসুন মির্জা। উস্তাদজিকে আসতে দিন।

-জি হুজুর।

জাঁহাপনা হঠাৎ শের বলতে শুরু করলেন :

হমসে ভী ইস বসত্ পে কম হোঙে বদ-কমর
জো চাল হম চালে, সো নিহায়ৎ বুরি চালে।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কার শের জানেন?

-না, জনাব।

-উস্তাদজির। আপনাকে দেখতে দেখেতে শেরটা মনে পড়ল।

এমন সময় জওকসাব দরবারে এসে ঢুকলেন। জাঁহাপনা উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন।

-আইয়ে আইয়ে উস্তাদজি। মির্জাসাব কেমন সেহ্রা লিখেছেন পড়ে দেখুন।

সেটা পড়ে জওকসাব আমার দিকে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টিতে আমার প্রতি আমর্ম ঘৃণা। যেন পোকার দিকে তাকিয়ে আছেন।

জাঁহাপনা বললেন, উস্তাদজি, আপ ভি এক সেহ্রা কহ দিজিয়ে।

-বহুৎ খুব। বলেই তিনি সেহ্রা লিখতে বসে গেলেন। শেষ দুই পংক্তিতে লিখেছিলেন :

জিস্ কো দেওয়া হয় সুখন্‌ কা, য়ে সুনা দে উস্ কো
দেখ ইস্ তরহ্ সে কহতে হ্যাঁয় সুখবর সেহ্রা।
(শুনিয়ে দাও তাদের, কবি বলে দাবি করে যারা,
দেখো এইভাবে কবিরা লেখেন সেহ্রা)

-কেয়া বাৎ। কেয়া বাৎ। জাঁহাপনা উল্লাসে ফেটে পড়লেন। তারপর কী হল জানেন? সন্ধেবেলায় দিল্লির অলিতেগলিতে জওকসাবের সেহ্রা মাতিয়ে তুলল সবাইকে।

জাঁহাপনা এভাবেই আমাকে অপমান করতেন। তিনি পতঙ্গবাজি করতে যাবেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কেন জানেন? অপমান, কত দূর অপমান করা যায়। মাসে মাসে যখন টাকা দিই, তুই মির্জা গালিব বা যেই হোস, আমার হারেমের একটা খোজা ছাড়া আর কী? মুশায়েরায় আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাকে বসিয়ে রাখতেন। সবশেষে বা মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আমাকে কবিতা পড়ার জন্য ডাকা হত।

সত্যি বলতে কী মান্টোভাই, সেহ্রার শেষ দুই পংক্তিতে আমি কাউকে আঘাত করতে চাইনি। তবু আমাকে ক্ষমা চেয়ে জাঁহাপনার কাছে কবিতা পাঠাতে হল। এছাড়া আর কীই বা করার ছিল বলুন? এই সমাজের চোখে কবি তো ভিখারিরও অধম। আমাকে বেশীর ভাগ মানুষ পছন্দ করত না কেন জানেন? মুশায়েরায় কেউ কবিতা পড়লেই-তা সে ভাল, খারাপ যাই হোক-সবাই হায় হায়, কেয়া বাৎ কেয়া বাৎ করত। আমি তা পারতুম না। কবিতার মর্মোদ্ধার না-করা। পর্যন্ত কারুর প্রশংসা আমি করতে পারিনি। সবাই আমার ওপর ক্ষেপে যেত। কিন্তু দেবী সরস্বতীর শুভ্রতা কবিতায় ফুটে না উঠলে, আমি কী করে প্রশংসা করব বলুন? অথচ কোনও গজল ভাল লাগলে আমার প্রশংসা বাধ মানতে চাইত না। একবার মুনশি গুলাম আলি খান দাবা খেলতে খেলতে একটা শের বললেন। ওঃ কী শের! একেবারে তিরের মতো বুকে এসে বিধল। আমি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলুম, এটা কার শের মুনশিজি?

-জওকসাবের।

-আবার বলুন।

মুনশিজির কাছে কতবার যে আমি শেরটা শুনতে চেয়েছি। জওকসাব লিখেছিলেন, ক্লান্ত হতে। হতে মৃত্যুর কাছেই তো আমরা আশ্রয় খুঁজি। কিন্তু মৃত্যুতেও যদি শান্তি না পাওয়া যায়? মুশায়েরায় যেতে আমার একেবারেই ভাল লাগত না। কবিতা তো একা একা জন্মায়-সমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতরে যেমন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মুক্তার জন্ম হয়।

মীর সাব একটা শের-এ যেমন লিখেছিলেন :

জুলফ্‌-সা পেচদার হ্যয় হর শের
হ্যায় সুখন্‌ মীরকা আজব ঢবকা।
(তার কেশের কুণ্ডলীর মতো আমার প্রত্যেকটা শের,
 মীরের কবিতার ধরনই অদ্ভুত।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *