১১. আকাশ চক্রাকারে ঘুরছে

মুহব্বৎ সে হ্যায় ইন্তজাম-এ জহাঁ।
মুহব্বৎ গর্দীশমেঁ হ্যয় আসঁমা।।
(এই পৃথিবীর যত আয়োজন সবই তো প্রেমের জন্য
প্রেমের আকর্ষণেই আকাশ চক্রাকারে ঘুরছে।)

ইয়া আল্লা, কী জীবনটাই আপনার শুরু হয়েছিল, মান্টোভাই। খোদা আপনার নসিবে দোজখে যাওয়ার সব ব্যবস্থা একেবারে পাকা করেই রেখেছিলেন। যেমন আমার বেলাও খেয়াল ছিল। তাঁর; আরে এ বেটা জন্নতে গিয়ে করবে কী? সত্যিই তো, কী করতাম বলুন, না হয় একটা হুরি-পরি দেওয়া হত আমাকে, কিন্তু সেই একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কতদিন থাকা যায় বলুন? জন্নতের শান্তি মরেও সইত না আমার। সবই খোদার কলমে লেখা। আমার ব্যর্থতার কথা বলবার ভাষা সারা জীবনেও তো খুঁজে পাইনি আমি। এত যে ফারসি-উর্দু গজল লিখলাম, তার পরেও মনে হয়, না মান্টোভাই, সে-ক্ষতকে আমি ছুঁতে পারি নি, তার যন্ত্রণা ফুটে ওঠেনি আমার গজলের ভাষায়। তবে, মাঝে মাঝেই আমার মনে হত, যন্ত্রণা ছাড়া কি সত্যিই কোনও সৌন্দর্য তৈরী হয়েছে এই দুনিয়ায়? ধরুন না কেন, সাইপ্রেস গাছের ডাল-পালা হেঁটে-হেঁটেই না তাকে জামাল করে তোলা হয়। সেই খুবসুরতির জন্য কত যন্ত্রণাই না সইতে হয় সাইপ্রেসকে।তারপর ধরুন গিয়ে দারু। তা তো আঙুরদের কষ্ট না দিয়ে পাবেন না। কলম তৈরির জন্য কঞ্চিকে ঠিক ঠিক ভাবে কেটেকুটে নিতে হবে। তারপর ধরুন, আপনি খৎ লিখবেন। সে জন্য কাগজকে কাটতে হবে মাপ মতন,তার বুকে কালি দিয়ে আচড় বসাতে হবে। এক-একটা। আঁচড়ই তো এক একটা ক্ষত,আর তাঁর ফলে কী তৈরি হল? আশিকের কাছে আপনার মনের। রূপ রহস্যের কথা।তা, আমি দেখলুম, সবই তো হচ্ছে এইভাবে; যন্ত্রণা ছাড়া তো সুন্দরের জন্ম দিতেই পারিনা আমরা। খোদাও কী তা পারেন? তাঁর দুনিয়ায় এত যে ভাঙাগড়ার খেলা, এসবই তো নতুন নতুন খুবসুরতির জন্ম দেওয়ার জন্যই এই আমার কথাই ধরুন। এক মুঠো ধুলো দিয়ে তো তিনি তৈরি করেছিলেন আমাকে; তারপর আকাশে তুলে ধরলেন, সেখানে রইলুমও কিছুকাল; কিন্তু হঠাৎ একদিন দুনিয়ার বুকে ছুঁড়ে দিলেন, আমি এসে পড়লুম এখানে, আর এমন ভাবেই পড়লুম যে তাঁর দাগ রয়ে গেল এই পৃথিবীর বুকে; পৃথিবী ধারণ করল সেই ক্ষত,যার নাম মির্জা গালিব; কিন্তু সেই ক্ষতের সৌন্দর্যকেই বা কে অস্বীকার করবে,মান্টোভাই! এভাবেই চলেছে দুনিয়াদারি, তাই না?

দেখুন,দেখুন,আমাদের সব ভাইজানেরা আবার শুয়ে পড়তে শুরু করেছেন। কী হল – কী হল আপনাদের? দুটো বুরবাকের এই সব কথাবার্তা বড় জালেম মনে হচ্ছে তাই না? ঠিক হ্যায়, আজ তবে অন্য কিছু হোক, কী বলেন মান্টোভাই? জীবন-তা আমার হোক, হজরতের হোক, কী যুবরাজ সেলিমের হোক – জীবন এমনিতে খুব ম্যাড়ম্যাড়ে, তাঁকে বইবার জন্য ধোপার গাধা হয়ে যেতে হয়, টানছিই, বোঝা টেনেই চলেছি। তাকে সইয়ে নেবার জন্য মাঝে মাঝে হিকায় -এর কাছে ফিরতে হয় আমাদের; কিস্সা নয়, হিকায়; কিস্সা তো আমাদের জীবনের; আর হিকায়ৎ যেন আয়নায় ফুটে ওঠা অন্য এক দুনিয়ার ছবি। আমার কথা বলার সময় তো পড়েই রইল, আমরা তো কেউই আর কবর ছেড়ে পালাচ্ছি না,কিন্তু হিকায়ৎ-এর কথা যখন এল, তাই ই না হয় বলা যাক। হিকায় এই ভেসে, আবার হারিয়ে যায়।

এই হিকায়ৎ-এর নাম শির-উল-বয়ান। হ্যাঁ, একেবারে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো গপ্পো। দেখলেন মান্টোভাই, সবাই আবার উঠে বসতে শুরু করেছেন। মসনবিটা লিখেছিলেন মীর হাসান। সওদা যাঁকে নিয়ে মজা করতেন, সেই মীর জাহিকের ছেলে মীর হাসান। আমার জন্মেরও সত্তর বছর আগে পয়দা হয়েছিলেন। তবে দিল্লি ছেড়ে ফৈজাবাদে চলে গিয়েছিলেন; যাবার অবশ্য ইচ্ছে ছিলনা তাঁর, আশিক ছিল কিনা দিল্লিতে; কিন্তু কী আর করবেন, পেটের ধান্দা আর প্রেম, ও-দুটো তো আবার হাত ধরাধরি করে চলে না। শুনেছি, ফৈজাবাদেও খুব একটা ভাল জীবন কাটেনি হাসানসাবের, কষ্টেসৃষ্টে দিন চলত। তবে কিনা মসনবি লেখায়। একেবারে মাস্তান লোক ছিলেন। শির-উল-বয়ান এতোটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে ওটার নাম হয়ে গিয়েছিল মীর হাসানের মসনবি। এই মসনবি কিন্তু আসলে একটা হিকায়ৎ,আকাশে বাতাসে-লোকের মুখে মুখে ভেসে বেড়াত বলে শুনেছি। ভাবুন, সেই হিকায়ৎ-ই হয়ে গেল মীর হাসানের মসনবি।

মালিক শাহ নামে এক নবাব ছিলেন। কোথায়? তা বলতে পারব না। ধরে নিন না কেন, হয়তো আয়নার মধ্যে ছিল তাঁর এক অপরূপ নগরী। কেমন দেখতে ছিল সেই নগরী? ভাষা দিয়ে নাকি তা প্রকাশ করা যায় না। ভোরের আজানের কথা ভাবুন, সেইরকম সুন্দর।

ঝকঝকে সব রাস্তা, দুধের মতো সাদা সব বাড়ি, আর মাঝে মাঝে নানা রকম ফুলের বাগিচা, আর বাগিচা মানেই তো কতরকম পাখি আর তাদের গান। সেই নগরীতে নাকি এমন সব বাজার ছিল,যেখানে ঢুকলে আপনার আর বেরোতেই ইচ্ছে করবে না, যেন বাজার নয়,কোনও শিসমহলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনি।এমন যে-নগরী, সেখানে নবাবের দুর্গটি কেমন হবে কল্পনা। করে নিন। হ্যাঁ,ভাইসব, একটু কল্পনা করে নিতে হবে, হিকায়ৎ-এর এমনটাই দস্তুর।

নবাবের মনে বড় দুঃখ, তাঁর কোনও ছেলে নেই।এন্তেকাল এলে কাকে সিংহাসনে বসিয়ে। যাবেন?একদিন সব উজিরদের ডেকে বললেন, এইবার আমাকে দুনিয়া ছেড়ে যেতে হবে।

-কেন,জাঁহাপনা? সবাই হাঁ-হাঁ করে ওঠে।

-এত ধনসম্পদ নিয়ে আমি কী করব বলুন? কার জন্য রেখে যাব? এত দিন মন দিয়ে রাজত্ব করেছি, খোদার পথের দিকে তাকানোর ফুরসৎ ছিল না আমার। আর নয়। নবাবি ছেড়ে দিয়ে আমি এখন তাঁর পথেই যেতে চাই।

উজির-এ-আজম বললেন, এ আপনি ভুল ভাবছেন নবাব খোদা তো আপনাকে রাজত্ব চালানোরই দায়িত্ব দিয়েছেন। আপনার জন্য এটাই তো খোদার পথ। এই দায়িত্ব আপনি না সামলালে কেয়ামতের দিনে কী জবাব দেবেন, হুজুর?

-কিন্তু আমার পর কে এই রাজ্যপাঠ দেখবে?

-কে বলেছে আপনার ছেলে হবে না? ব্রাহ্মণ-জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠাচ্ছি। ওনারা এসে গণনা করে দেখুন।পরের কথা পরে ভাবা যাবে।

উজির-এ আজমের কথা মেনে নিলেন নবাব। এলেন ব্রাহ্মণেরা,জ্যোতিষীরা, শুরু হল নবাবের ভাগ্য গণনার কাজ। শেষে সবাই একবাক্যে রায় দিলেন, নবাবের বেগম ছেলে পয়দা করবেনই করবেন।বিধির এই লিখন কেউ খণ্ডাতে পারবেনা। সওদা সেখানে থাকলে হয়তো মজা করে বলতেন,বিধির লিখন কোথায় লুকোনো আছে, একবার দেখাতে পারেন? পাজামার তলায়? ব্রাহ্মণেরা জানালেন, চাঁদের মতোই সুন্দর ছেলে আসবে বেগমের কোলে। কিন্তু একটা কথা আছে। কী? না, বারো বছর পর্যন্ত ছেলেকে একবারে আগলে রাখতে হবে। বারো বছরের মধ্যে এমন কোনও ফাঁড়া আছে,যাতে নবাব ছেলেকে হারাতে পারেন।

-কী বলছেন আপনারা? নবাবের মুখ তো কালো হয়ে গেল।

-না, না, আমরা নবাবজাদার মৃত্যুর কথা বলছি না।তবে কিনা, কোনও ভাবে হারিয়েও যেতে পারেন।

তাই সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে হুজুর।

-আপনাদের কথা মতোই ব্যবস্থা হবে।কিন্তু কী করতে হবে?

-বারো বছর প্রাসাদের বাইরে যাওয়া চলবে না। এমনকী ছাদেও নেই।

-কেন?

-মনে হচ্ছে, কোনও পরি নবাবজাদার প্রেমে পড়বেন।

-আর?

-নবাবজাদা প্রেমে পড়বেন অন্য এক সুন্দরীর।

ভাবুন একবার মান্টোভাই, ছেলের জন্মই হল না, তার আগেই শুরু হয়ে গেল আশনাই নিয়ে কথাবার্তা। কী ভাইজানেরা, মজা জমেছে? এবার দেখুন না, মাথা ঘুড়িয়ে দেওয়ার মতো আরও কত কান্ড ঘটবে। আশনাই-এর কথা দিয়ে যার শুরু,সেই খেলা কি সহজে থামবার? তো বছর ঘোরবার আগেই নবাবের এক বেগম ছেলে পয়দা করলেন। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো সারা নগরী। হাফিজসাবের সেই শেরটা শুনুন:

শিগুফতা শুদ গুলে হম্রা
ব গশং বুলবুল মস্ত
সদা এ শর খুশি ঐ
আশিকানে বাদা পরস্ত।
(বাগানে ফুটেছে রক্ত গোলাপ,
মাতোয়ারা হল বুলবুল সব;
হে সুরাপ্রেমিক কোথায় তোমরা
তোলো চারিদিকে আনন্দরব।)

আর ছেলের নাম কী রাখা হল জানেন? বেনজির। প্রজাদের অকাতরে ধনসম্পদ বিলোলেন নবাব। ছদিন ধরে সারা নগরী জুড়ে চলল নাচা-গানা-খানা-পিনা-মৌজ-মস্তি।এমনকী, নবাব আনন্দে অনেক ক্রীতদাসকে মুক্ত করেও দিলেন। এই-ই হচ্ছে নবাবী। জাঁহাপনা জাফরের সময় আর নবাবি কোথায়? ও তো ভিখিরির একবেলার পোলাও খাওয়া।

নবাবজাদার জন্য বাগান-ঘেরা নতুন প্রাসাদ তৈরি হল। অতুলনীয় সে প্রাসাদ, বাগানে সাইপ্রেস ও অন্যান্য গাছ, পাখিদের গানে গানে মশগুল। কত যে দাসদাসী ঘিরে থাকত বেনজিরকে। কেন না নবাবজাদাকে চোখের আড়াল করা চলবে না। কয়েক বছরের মধ্যে লেখাপড়া, ঘোড়ায় চড়া, তীর-ধনুক চালানো, গান-বাজনা, ছবি আঁকা, বন্দুকবাজিও শিখে ফেলল বেনজির। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, তার মনটি ছিল বড় ভাল, দাসদাসীরা যেন তার ভাই বোন,আত্মীয়স্বজন নবাবজাদার নামটি সার্থক কি না বলুন, ভাইসব? সে যেন সত্যিই হাফিজসাবের বলা সেই রক্তগোলাপ, যে সৌরভ ছড়াতেই এই দুনিয়াতে এসেছে।

বেনজিরের বারো বছরের জন্মদিনে নবাব মালিক শাহ ঘোষণা করলেন, আজ নবাবজাদা শহর পরিক্রমায় বেরোবেন। সুন্দরী দাসীরা সুগন্ধী তেল মাখিয়ে বেনজিরকে স্নান করাল,তারপর এমন ভাবে তাঁকে সাজিয়ে তুলল, যেন উস্তাদ বিঞ্জাদের তুলি দিয়ে আঁকা ছবি। বেনজির প্রাসাদ থেকে বেরোতেই তার মাথায় মুক্তা বৃষ্টি শুরু হল আর তারপর সেই মুক্তো কে কতটা হাতিয়ে নিতে পারে তাই নিয়ে চলল মারামারি,কাজিয়া। নগরীর সব হাভেলি, দোকান সাজানো হয়েছিল মসলিনের নকশাদার কাপড় দিয়ে। আর লাগানো হয়েছিল বড় বড় আয়না, সূর্যের আলো যার ওপর পড়ে সাত রং ছড়িয়ে দেবে চারদিকে। তেমনই শোভাযাত্রার ছবিও ফুটে উঠবে আয়নায়। সত্যিই, নবাবজাদার প্রথম শহর-পরিক্রমা সবার মনে সোনার জলে আঁকা ছবির মতোই রয়ে গেল।

কিন্তু হিসেবে একটা ভুল হয়েছিল, যা নবাব এবং কারোরই খেয়াল ছিল না। বিপদের বারো বছর শেষ হতে তখনও এক রাত বাকি। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত, চাঁদের আলোর জোয়ার লেগেছে, আর এদিকে সারা দিনের হৈহল্লার পর বেনজিরেরও বেশ ঘুম পেয়ছে। এমন পূর্ণিমার রাতে প্রাসাদের ছাদে ঘুমোবার সাধ হল তার। ইনশাল্লাহ, এই হচ্ছে নিয়তির লিখন, মান্টোভাই। কখন যে আপনার কোন সাধ হবে, কিছুই জানেন না আপনি, আর তা যে আপনাকে কোন খুমারে নিয়ে যাবে কে জানে! তো ছাদেই নবাবজাদার বিছানা তৈরি হল, চাঁদের নরম আলো আর ফুলের খুশবুর আদরে ঘুমিয়ে পড়ল বেনজির। নজর রাখার জন্য নবাবজাদাকে ঘিরে বসেছিল অনেক দাসদাসী। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে মিঠে গন্ধ ছড়িয়ে ভেসে এল ঠাণ্ডা হাওয়া আর সেই হাওয়ার ছোঁয়ায় ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। শুধু চাঁদ আকাশ থেকে দেখছিল, বেনজির জীবনে কী ঘটতে চলেছে।

ওই ঠাণ্ডা হাওয়া কে নিয়ে এসেছিল জানেন, ভাইজানেরা? এক পরি। সে তখন রাতের আকাশে উড়ন্ত সিংহাসনে চড়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। এই পরির কথাটা একটু বলে নিতে দিন, মান্টোভাই। এখানে অনেকেই আছেন, যাঁরা আমার আসার বহুদিন পরে কবরে এসেছেন, তাঁরা পরি বলতে বোঝেন ফিনফিনে ডানা লাগানো সুন্দরী। ওসব হচ্ছে গোরাদের কল্পনা। ফারসিতে আমরা পরি কাকে বলি জানেন? এক অনৈসর্গিক আত্মা, সুন্দরী নারী সেজে সে পুরুষের জীবনে হাজির হয়। কেন জানেন? প্রেমের ছলনায় ভুলিয়ে সেই পরি পুরুষকে আসলে বন্দি করে রাখতে চায়। নিজের মর্জি মতো চালায়, তার হুকুম অমান্য করা মানেই মৃত্যু। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রেম তো এভাবেই আসে আমাদের জীবনে,এক-একটা প্রেম মানে এক একটা মৃত্যু; মান্টোভাই, মনে হয় না,আমরা যেন অনাদি,অনন্তকাল ধরে এক-একজন পরির হাতেই বন্দি হয়েই আছি? যাক, এইসব বখোয়াস বাদ দিন।

পরির নাম ছিল মাহরুখ। আকাশ থেকে বেনজিরের রূপ দেখে তার চোখ তো কপালে উঠল। এমন সুন্দর পুরুষ দুনিয়ায় আছে নাকি? কিন্তু আছে তো, দেখাই যাচ্ছে। তাহলে? আরে, একে তো আমার চাই, একে না বন্দি করতে পারলে আমি কেমন পরি? মাহরুখ ছাদে এসে নামল; তার মনে হল, পূর্ণিমার চাঁদের আলো নয়, বেনজিরের রূপের আলোতেই এমন মায়াবি হয়ে আছে আজকের রাত। ঘুমন্ত বেনজিরের ঠোঁটে সে ঠোঁট ঠেকাল। তারপর? তারপর উড়িয়ে নিয়ে চলল তার পরিস্থানে।

ঘুম ভেঙ্গে দাসদাসীরা দেখল, নবাবজাদা উধাও। কোথায় সে? সারা প্রাসাদ,বাগান খুঁজেও পাওয়া গেল না। নবাব ও বেগমরা তো এসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শুধু কি তাই? গাছপালা ফুল-পাখি-ঝরনা, সবাই কাঁদতে লাগল। আহা এমন সাধের নবাবজাদা কোথায় হারিয়ে গেলেন? কে নিয়ে গেল তাকে? সারা দেশ খুঁজেও বেনজিরের হদিশ পাওয়া গেল না, বুঝতেই পারছেন।

পরি মাহরুখের দেশে বন্দি হয়ে রইল বেনজির। বছরের পর বছর কেটে গেল,তবু সে তার শহরের কথা ভুলতে পারল না। মাহরুখ সব কিছু দিয়ে তাকে ভোলানোর চেষ্টা করেও কিছু হল না। তখন একদিন সে বেনজিরকে এসে বলল, তুমি আমার কাছে বন্দি, তা তো জানো?

-জানি।

-তা হলে আমার কথা মেনে চলো।

-আমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে চলো।

-তা হবে না। তবু তোমাকে সব সময় এমন মনমরা দেখলে আমারও খুব কষ্ট হয় গো বেনজির। আমি যে তোমাকে ভালবাসি।

– তা হলে আমার বাড়িতে নিয়ে চলো। বেনজির মাহরুখের চেপে ধরে।

মাহরুখ হেসে ওঠে। – বন্দির আর ফেরবার উপায় থাকেনা বেনজির। তবে কিনা একটা ব্যবস্থা হতে পারে। রোজ সন্ধেবেলা আমি যখন আব্বাজানের সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তুমিও একটু এদিক-ওদিক ঘুরে আসতে পারো। আমি তোমাকে একটা জাদুঘোড়া দিতে পারি। সেই ঘোড়ায় চেপে ঘন্টা তিনেক তুমি ঘুরে ফিরে এলে, তাতে মন ভাল থাকবে। যেখানে যেতে চাও, জাদুঘোড়া তোমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু তোমাকে লিখে দিতে হবে, যেখানেই যাও,তোমার দিল তুমি আর কাউকে দেবে না আর এমনটা যদি ঘটে তাঁর জন্য উপযুক্ত শাস্তি পাবে তুমি। মনে রেখো,আশ্নাই আমাদের যাই হোক,তুমি আমার বন্দি।

বেনজির মেনে নিল মাহরুখের কথা। না মেনে উপায়ই বা কী? পরির দেওয়া জানেন না তো ভাইজানেরা, সে দোজখের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এক রাতে জাদুঘোড়ায় চেপে ঘুরতে ঘুরতে নীচে একটা সুন্দর বাগান দেখতে পেল বেনজির। আর সেই বাগানের ভেতরে চাঁদের আলোয় ঝকমক করছিল অপূর্ব এক প্রাসাদ। বেনজির বাগানে নেমে গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে থাকল, কেউ কোথাও আছে কি না। কিছুক্ষণ পরে একটা ঝরনার পাশে কয়েকজন সুন্দরীকে দেখতে পেল সে। আর কী দেখল জানেন? যেন নক্ষত্রদের একেবারে মাঝখানে ভরা আলোর চাঁদ। সে আর এক নবাব মাসুদ শাহর নবাবজাদি বদর-ই-মুনির। মসলিনের পোশাকের ভেতর থেকে তার রূপ ফুটে উঠছিল যেন বাতিদানে জ্বলা মোমবাতির মতো। বেনজির আর চোখ ফেরাতে পারে না। তখন মনে পড়ল, পরি মাহরুখের কথা। তোমার দিল কাউকে দেবে বেনজির। কিন্তু বেনজির কী করে? দিল্ তো সে দিয়েই ফেলেছে প্রথম দেখাতেই। আমাদের জীবনে এমনটাই ঘটত ভাইজানেরা। চোখে চোখ পড়ল তো আশনাই-এর আগুন জ্বলে উঠল। কেন জানেন? আসলে তো বন্দির মতোই জীবন কাটত আমাদের। সেই জীবনে মহব্বত আর নিকাহ্-এর মধ্যে কোনও সম্পর্ক ছিল না। মহব্বত মানেই তো গুনাহ্। মেয়েদের জায়গা জেনানামহলে, ভাই-বেরাদর ছাড়া কারও দিকে তাকানো যাবে না। আর পুরুষ তো কোনও নারীকে দেখতে পেত না। তাই একবার কোনও জোড়া চোখ পরস্পরের দিকে তাকালেই হয়ে গেল। মহব্বত,গুনাহ্।ও সব যেন না হয়। তাই যত তাড়াতাড়ি পারো বিয়ে দিয়ে দাও।কিন্তু তাতে কী হয়েছে? পুরুষকে যেতে হয়েছে কোঠাবাড়িতে, আর বেগমরা গোপনে গোপনে আশনাই চালিয়ে গেছে। প্রবৃত্তি, মান্টোভাই, প্রবৃত্তি-কে ঠেকাতে পারে? মীরসাবকে কেউ ঠেকাতে পেরেছিল? পারেনি বলেই তাঁকে পাগল বানিয়ে ছাড়া হয়েছিল। সমাজ তো এটাই পারে মান্টোভাই, যখনই তোমাকে মেনে নিতে পারবেনা, তোমার গায়ে পাগলের ছাপ্পা মেরে দেবে। তখন তুমি সব তমদুনের বাইরে। বোবা, কালা, ভাষাহীন।

হ্যাঁ, তারপর কী হল, বলি। সেদিনই বদর-ই-মুনিরের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হল বেনজিরের। মীরসাবের সেই শেরটা মনে পড়ছে,

গরমিয়াঁ মুত্তসিল রহেঁ বাহম
নে তসাহিল হো, নে তগাফিল হো।।
(এসো আমরা পরস্পরে আসক্ত থাকি চিরদিন
না যেন আগ্রহ হারাই, না আসে উদাসীনতা।)

বদর-ই-মুনির তো বেনজিরের রূপ দেখে মূছা গেল। তখন উজিরের মেয়ে, তার বন্ধুনি, নাজোম-উন-নিসা সে-ও অসামাণ্য সুন্দরী, গোলাপ জল ছিটিয়ে নবাবজাদির জ্ঞান ফিরিয়ে আনল। কিন্তু জ্ঞান ফিরে পেয়ে নবাবজাদি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, কে আমার বাগানে এসে এই ভাবে ঢুকল? আসলে ওই কথার ভেতরে তো তখন অন্য এক আগুন জ্বলছে। প্রথম প্রেমে তো এরকমই হয়, না কি? চলল মান-অভিমানের পালা। পরস্পরের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকা। তারপর বেনজির তার সব কথা- পরি মাহরুখের কাছে বন্দি হওয়ার কথাও বলল নবাবজাদিকে। তখন বদর-ই-মুনির কী বলল জানেন? বলল, আমি তোমাকে কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারব না। তুমি পরির কাছেই থাকো গিয়ে,এখানে আর এসো না। বেনজির নবাবজাদির পা জড়িয়ে ধরে বলল, মাহরুখ আমাকে ভালবাসে কি না, তা আমি জানতেও চাই না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। কিন্তু এবার আমাকে ফিরে যেতেই হবে। যদি ছাড়া পাই তবে কাল আবার এই সময় আসব। আমার দিল আমি তোমার কাছেই রেখে যাচ্ছি, শুধু এই শরীরটা ফিরে যাবে মাহরুখের বন্দিশালায়।

পরদিন বেনজিরের আসার জন্য সব কিছু ঠিকমতো প্রস্তুত হল। বদর-ই-মুনির এমনভাবে সাজল, যেন সেদিনই তার নিকাহ্। ফুলে-ফুলে,আতরের গন্ধে ভরে উঠল ঘর। পানপাত্র, সুরা,খাবার-সব প্রস্তুত। বিছানায় মাথার কাছে রাখা হল ফারসি কবি জুহুরি আর নাজিরির কবিতার কিতাব। বেনজিরও যথাসময়ে এল। খানিক কথাবার্তার পর দুজনে বিছানায় গেল পান করতে করতে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। এ সব কথা তো বলে শেষ করা যায় না। ঘর থেকে ওরা যখন বেরিয়ে এল,বেনজির তখন আরও ঝকঝক করছে,আর বদর-ই-মুনির লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে। কিন্তু সময় এগিয়ে এল, বেনজিরকেও ফিরে যেতে হল। এভাবেই চলতে লাগল দিনের পর দিন।

কিন্তু সুখের দিন তো বেশিদিন সয় না মানুষের জীবনে। পরি মাহরুখ সব কথা গেল জেনে গেল, একদিন নিজের চোখে সব দেখেও এল। সেদিন বেনজির ফিরতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মাহরুখ। তার মুখ থেকে আগুন বের হতে লাগল, শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও বিশ্বাসঘাতক। এক জিনকে ডেকে মাহরুখ বলল, মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে একে শুকনো কুয়োর মধ্যে ফেলে দাও, কুয়োর মুখ ঢেকে দিও পাথর দিয়ে। দিনে একবার জিন তাকে সামান্য খাবার দিয়ে। আসত। অন্ধকার, শুকনো কুয়োয় বেনজিরের আর এক বন্দিজীবন শুরু হল। আর এদিকে বদর-ই-মুনির দিনের পর দিন বেনজিরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যেন পাপড়ি-ঝরা ফুল এক। সে ফুলের দিকে কি তাকানো যায়? দিনের পর দিন তার কেটে যায় না ঘুমিয়ে। তারপর একদিন ঘুম এল আর সেই ঘুমের ভেতরে স্বপ্নে সে দেখতে পেল মরুভূমির মধ্যের কুয়োটাকে। কুয়োর ভিতর থেকে ভেসে আসছে বেনজিরের ডাক। ঘুম ভেঙে গেল তার। বন্ধুনী নাজম-উন-নিসা স্বপ্নের কথা শুনে বলল, আর কেঁদো না তুমি। আমি মরুভূমিতে গিয়ে বেনজিরকে নিয়ে আসব। আমি বেঁচে থাকলে বেনজিরকে তুমি পাবেই। সাধুর বেশে হাতে বীণা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নাজম-উন-নিসা।

একদিন পূর্ণিমার রাতে মরুভূমিতে বসে বীণা বাজাচ্ছিল সে। তার বীণা শুনে পশু-পাখিরা ঘুম ভুলে গেল, গাছের মাথায় হাওয়া খেলতে লাগল, আর চাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ঠিক তখনই সেই পথ দিয়ে উড়ন্ত সিংহাসনে চড়ে যাচ্ছিল জিন রাজপুত্র ফিরোজ শাহ। সে নীচে নেমে এসে নাজমকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল, বুঝতে পারল সাধুর বেশে এ আসলে এক রূপসী। ফিরোজ শাহ তার পরিচয় জানতে চাইল। নাজম ফিরোজের মুগ্ধতা বুঝতে পেরে। বলল, আল্লার দিকে মন ফেরান, না হলে ফিরে যান। ফিরজ বলল, হ্যাঁ, ফিরে যাব, শুধু। একবার আপনার বাজনা শুনতে চাই। নাজমের বীণা শুনতে শুনতে ভোর হয়ে গেল আর ফিরোজ শাহ, অমন এক মরদ, হাউ হাউ করে কাঁদছে। মেয়েরা কী না পারে, মান্টোভাই! এরপরে কী হল জানেন? উড়ন্ত সিংহাসনে চড়িয়ে ফিরোজ শাহ নাজাম কে তার বাবার দরবারে নিয়ে গেল। জিনরাজার অনুরোধে বীণাও বাজাতে হল নাজমকে। তার বাজনা শুনে কেউ। চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। আর ফিরোজ শাহ? সে বুঝল, এ নারীকে ছাড়া আমার জীবন বাতিল হয়ে যাবে। নাজম জিনরাজার প্রাসাদেই থেকে গেল আর ফিরোজ কে নিয়ে বেশ খেলতে লাগল। এই ফিরোজের প্রতি সে গদগদ, পরক্ষণেই ঠান্ডা। একদিন ফিরোজ তার। পায়ে পড়ে গেল, কেন আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ? তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। নাজম দেখল, এই তো সুযোগ সে হেসে বলল, আমি যা বলছি, মন দিয়ে শোনো, কাজটা করতে পারলে তোমারও লাভ হতে পারে। নাজম তখন সব কথা খুলে বলল।

-আমি কী করব বলল।

-তুমি তো জিন। মাহরুখ কোথায় বেনজিরকে বন্দি করে রেখেছে, তা তুমি ইচ্ছে করলেই জানতে পারো। তুমি সাহায্য করলে বেনজিরও বাঁচবে, তুমিও যা চাও, তাই পাবে।

ফিরোজ শাহের নির্দেশে জিনেরা দিকে দিকে দিকে বেরিয়া পড়ল বেনজিরের খোঁজে। কিছুদিন পর এক জিন খোঁজ নিয়ে ফিরল। ফিরোজ শাহ কড়া ভাষায় মাহরুখকে খৎ লিখে পাঠাল, বেনজিরকে মুক্তি না দিলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে তাকে। আর শপথ করতে হবে, কখনও কোনও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে তৈরি করবে না সে। মাহরুখ তার দোষ স্বীকার করে অনুরোধ জানাল, তার বাবাকে যেন কিছু না জানানো হয়। এভাবেই শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেল বেনজির।

এরপর একদিন উড়ন্ত সিংহাসনে চড়ে ফিরোজ শাহ, বেনজির আর নাজম-উন-নিসা চলল বদর-ই-মুনিরের কাছে। বেনজির ফিরে এসেছে শুনে তো নবাবজাদি অজ্ঞানই হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরলে নাজম-উন-নিসা তাকে বলল, বেনজিরকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য অন্য একজনকে বন্দি করে নিয়ে এলাম আমি। দেখি, এবার কীভাবে তাকে ফেরত পাঠানো যায়। এরপর? সারা রাত ধরে চলল দুজোড়া কপত-কপতীর বকবকম। কথা যেন শেষই হতে চায় না। কথা যে কত বড় ফাঁদ, তা যদি মানুষ বুঝত, মান্টোভাই!

বদর-ই-মুনিরের ওয়ালিদ মাসুদ শাহকে এরপর চিঠি লিখে নিজের পরিচয় জানাল বেনজির, নিকাহর প্রস্তাবও পেশ করল। নবাব তা সানন্দে মেনে নিলেন। মাসুদ শাহর নগরী আনন্দে মেতে উঠল। একদিন ধুমধাম করে বেনজির ও বদর-ই-মুনিরের বিয়েও হয়ে গেল। কেমন হয়েছিল সে বিয়ে? ভাইজানেরা, কতদিন কবরে শুয়ে আছি, সে – ভাষা ভুলিয়া গেছি। এরপর বেনজিরের অনুরোধে নাজম-উন-নিসার বাবাও ফিরোজ শাহর সঙ্গে বিয়েতে মত দিলেন। উড়ন্ত সিংহাসনে চড়ে ফিরোজ শাহ তার বিবিকে নিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেল। বেনজিরও তার বিবিকে নিয়ে নিজের শহরে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করল।

কেমন লাগল ভাইজানেরা, আমাদের দুজনের বদনসিবি কিস্সার মাঝখানে মধুর মিলনে এই গল্পটা? কিন্তু মসনবিটা লিখে মীর হাসান কী পেলেন? কিছু না। শুধু এতদিন পর, এই কবরের অন্ধকারে, আমি আপনাদের এই হিকায়ৎটা শোনাতে পারলুম। কবির নসিবে এ ছাড়া আর কী জোটে, বলুন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *