1 of 4

২.০২ সিন্দাবাদের দ্বিতীয় সমুদ্র-যাত্রা

সিন্দাবাদের দ্বিতীয় সমুদ্র-যাত্রা

অসাধারণ আনন্দ উল্লাসে দিন কাটছিলো। একঘেয়ে আনন্দও আমার বেশিদিন ভালো লাগে না। ইচ্ছে হলো, আবার অজানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। বাজারে গেলাম। অনেক অর্থব্যয় করে বহু মূল্যবান জিনিসপত্র সওদা করে গোটরি বাঁধলাম। আমি জানতাম কোন কোন জিনিস বিদেশের বাজারে চাহিদা বেশি। সেই সব জিনিসপত্রেই বোঝাই করলাম আমার বাক্স প্যাটরা প্রভৃতি।

সন্ধান পেলাম, সুন্দর একখানা আনকোরা জাহাজ বিক্ৰী আছে। শুধু দেখতেই বাহারী নয়, তার সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, কলকব্জা ইত্যাদি আমার খুব পছন্দ হলো। জাহাজের নওজোয়ান কাপ্তেনটিও দারুণ চৌকস। এই বয়সে সে তামোম দুনিয়ার সব দেশে জাহাজ ভিডিয়েছে। দাম কিছু বেশিই নিলো, তা নিক, জাহাজখানা আমার বেশ মনের মতো হলো।

আমার চেনাজানা পেয়ারের সওদাগর বন্ধুদের খবর দিলাম। তারা যদি বাণিজ্যে যেতে ইচ্ছা করে আমার জাহাজে যেতে পারে। পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের প্রায় সকলেই তল্পিতল্পা নিয়ে জাহাজে উঠে বসলো।

দিনক্ষণ দেখে একদিন জাহাজ ছেড়ে দিলাম। ভেসে চললাম অজানার সন্ধানে। এদেশ থেকে ওদেশ, দ্বীপ থেকে দীপান্তরে সওদার সন্ধানে ঘুরে বেড়াই। কত নতুন নতুন শহর বন্দর দেখতে থাকি। সেই সব দেশের হাটে বাজারে গঞ্জে বিক্রি করি বাগদাদের বাহারী জিনিসপত্র। বিদেশীরা হুমভী খেয়ে পড়ে। এমন জিনিস তারা কখনও চোখে দেখেনি। বেশ চড়া দামে বিক্র হতে থাকে মাল।

এইভাবে একদিন সমুদ্র মধ্যে এক সুন্দর দ্বীপে এসে নোঙর করলাম। যেদিকে তাকাই সবুজের সমারোহ। বিশাল বিশাল গাছপালা। আমরা সবাই নামলাম। খানাপিনা পাকবার ব্যবস্থা করা হলো।

আমি চারদিক ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির শোভা দেখতে থাকি। এক জায়গায় এসে গাছের পাকা ফল পড়লাম। পাশেই কুলকুল রবে ঝর্ণ বয়ে চলেছে। গাছের সুমিষ্ট ফল ঝরণার জল খেয়ে প্রাণ ভরে গেলো। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছিলো। আবেশে দু চোখ জুড়িয়ে আসে।

কতক্ষণ ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম জানি না, কিন্তু দ্রুতপায়ে জাহাজের দিকে এসে দেখি জাহাজখানা নাই। মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। ওরা আমাকে ফেলে রেখেই জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। এই নিরালা নির্জন প্রান্তরে আমি একা-কপর্দক শূন্য। আমার যা কিছু সবই ছিলো ঐ জাহাজে।

কিছুই বুঝতে পারলাম না, কেন ওরা আমাকে এই নির্জন দ্বীপে ফেলে রেখে চলে গেলো? কী তাদের মৎলব?

যতই ভাবি, কোনও কুলকিনারা পাই না। বুক ফেটে কান্না এলো, হায় খোদা, একি কঠিন পরীক্ষায় ফেললে? এই কি আমার নিয়তি? প্রথম যাত্রায় তোমার দয়ায় কোনওরকমে প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু এবার? এবার কি করে এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবো? বার বার কি বিপদে বাঁচা যায়?

আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে  তাকি। কখনও বা নিজের কপালটা মাটিতে ঠুকি, এ কি করলে আল্লাহ। এমন শাস্তি কেন আমায় দিলে? কী পাপ আমি করেছি? হায়, আমার আবার কেন এই সমুদ্রযাত্রার দুর্মতি হলো। বেশ তো মহা সুখে ছিলাম বাগদাদে। কেন আমাকে সুখে থাকতে ভুতে কিলালো? খাওয়াপরা, ধনদৌলত কোনও কিছুরই তো অভাব ছিলো না আমার। তবে কেন সোধে এই বাঁশ ঘাড়ে নিতে গেলাম! প্রথমবারের সমুদ্রযাত্রায় যা পেয়েছিলাম—সাতপুরুষ দিবি আরামে বসে খেতে পারতাম। কেন আবার আমার লোভ হলো—কেন-কেন?

মাথা ঠুকতে ঠুকতে আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে পড়লাম।

অবশেষে আমি বুঝলাম, এইভাবে নিজেকে ধ্বংস করে কোন ফয়দা নাই। হাহুতাশ করে মাথা ঠুকলে এ বিপদের সুরাহা হবে না। সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় উপায় খুঁজতে হবে। তারপর উপরে আল্লাহ আছেন, তিনি যদি দয়া করেন, উদ্ধার পেয়ে যাবো। আর না হলে মরতে হবে। উপায় কী?

উঠে দাঁড়িয়ে এদিক দিক চেয়ে দেখলাম খানিকক্ষণ। তারপর একটা বিরাট গাছের ডালে উঠে। বসলাম। কি জানি, কোথায় ওৎ পেতে আছে কোন জন্তুজানোয়ার। গাছের অত্যুচ্চ শিখরে উঠে এদিক ওদিক যে দিকে তাকাই কোনও জনবসতি দেখি না। চারদিকে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত গহন গভীর বন-জঙ্গল, ধুধু করা মাঠ, প্রান্তর, সমুদ্র, পাহাড় আর পাখী। দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিকে বহু দূরে কি যেন উজ্জ্বল সাদা ধরনের একটা বস্তু নজরে পড়লো। কিন্তু কিছুই আন্দাজ করতে পারলাম না।

গাছ থেকে নেমে পড়লাম। কিন্তু একা একা এগিয়ে যেতে গা ছমছম করতে লাগলো। যাই হোক, এদিক-ওদিক খুব ভালোভাবে দেখে শুনে অতি সন্তৰ্পণে সেই অদ্ভুত সাদা বস্তুটার উদ্দেশে এগোতে থাকলাম। পায়ে পায়ে এক সময় পৌঁছেও গেলাম। তার কাছে। বিশাল বিরাট পোল্লাই একটা গম্বুজ। সাদা পাথরের তৈরি। চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম! কিন্তু না, কোথাও একটা দরজা নাই। অথবা ভেতরে ঢোকার কোনও সিঁড়ি বা পথ-কিছুই দেখতে পেলাম না। অনেক রকম কায়দা কসরৎ করে গম্বুজটার মাথার ওপরে ওঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথাই আমার কোসিস। এমন তেলতোলে মসৃণ তার গা— যে কোনও রকমেই আঁকড়ে ধরে ওপরে ওঠা সম্ভব না। পা-এর সামনে পা রেখে সার গম্বুজটা প্রদক্ষিণ করে মেপে দেখলাম-একশো পঞ্চাশ পদক্ষেপ।

গম্বুজের ভিতরে ঢোকার বা ওপরে ওঠার ফিকির খুঁজতে খুঁজতে কখন যে সূর্য পাটে বসেছে বুঝতে পারিনি। ধীরে ধীরে যখন চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো তখন আমার চৈতন্য হলো। তাই তো-এখন কি করি।

প্রথমে মনে হয়েছিলো, একখণ্ড বিশাল কালো মেঘ। সারা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাই বা হবে কি করে? এই দারুণ গ্রীষ্মে এমন বর্ষার মেঘ আসবে কোথা থেকে? পরে বুঝতে পারলাম, মেঘ নয়, একটি বিশাল পাখী ডানা মেলে নিচের দিকে নেমে আসছে।

অনেক গল্প কাহিনীতে পড়েছিলাম, একরকমের পাখী আছে তারা দেখতে ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মতো। এদের নাম রকপাখী। এবার আমি আন্দাজ করতে পারলাম, যাকে আমি এতক্ষণ একটা গম্বুজ বলে মনে করেছিলাম আসলে তা ঐ রক পাখীরই ডিম।

একটু দূরে সরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পাখীটা নেমে এসে তার বিশাল বিস্তৃত ডানা দু’খানা মেলে সেই গম্বুজটার ওপরে বসলো।

মাথায় একটা মৎলব এলো। মাটিতে হামাগুডি দিয়ে অতি সন্তপণে ডিমটার পাশে চলে এলাম। পাখীটা তখন পাখা দু’খানা দিয়ে ডিমটাকে আচ্ছাদিত করে তা দিচ্ছে। ডিমের দুপাশে তার দু’খানা পা ঝুলে পড়েছে। মাথার পাগড়ীটা খুলে আলগোছে পাখীর একটা পায়ে ফাঁস পরিয়ে দিলাম। ভাবলাম, যখন সে আবার আকাশে উড়বে, ফাসটা পায়ে আটকে যাবে, আর পাগড়ীর অপরপ্রান্ত আঁকড়ে ধরে ঝুলতে ঝুলতে আমিও তার সঙ্গে উড়ে চলবো। শুনেছি, এই রক পাখিরা নাকি আস্ত একটা হাতীকেও ঠোঁটে ধরে তুলে নিয়ে যায়।

এই সময়ে রাত ফুরিয়ে আসতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

দুশো ছিয়ানব্বইতম রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে শুরু করে :

সারাটা রাত ডিমটার পাশে আমি উপুড় হয়ে শুয়ে রইলাম। আমার হাতের কাজীতে বাঁধা পাগড়ীর অন্য এক প্রান্ত। চোখে তন্দ্ৰা নাই। কখন রক আকাশে উড়বে তারই … অধীর প্রতীক্ষায় রাতের প্রহর গুণতে থাকি। মনে মনে আশার জাল বুনি, হয়তো; রক আমাকে এই নির্জন কারাদ্বীপ থেকে উদ্ধার করে কোনও এক জনবসতি। এলাকায় নিয়ে যাবে। তারপর ঘরে ফেরার পথ আমি নিশ্চয়ই খুঁজে ঠু পাবো।

এই সব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে এক সময় ভোর হয়ে আসে। ডানা ঝাপটে রক আকাশে উড়লো। আমি প্ৰাণপণে পাগড়ীর প্রান্ত আঁকড়ে ধরে থাকি। পাখীটা শোঁ শোঁ করে খাড়াই উপরে উঠে। যায়—একেবারে মহাশূন্যে, প্রায় বেহেস্তের কাছাকাছি। মনে হতে থাকে, এর ওপরে বুঝি আর যাওয়ার কোনও পথ নাই। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, পাখীটা তীরবেগে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। সারা দেহের রক্ত শিরশির করে মাথার দিকে ধাবিত হতে লাগলো। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তার পরই অনুভব করলাম। আমার শরীরের ওজন একেবারে হাল্কা হয়ে গেছে। চোখ মেলে। তাকিয়ে দেখি, এক পর্বতমালার ওপরে এসে সে বসেছে।

ক্ষিপ্র হাতে কাজীর বাঁধন খুলে পাগড়ীটা ফেলে দিই। কি জানি, আবার যদি এখুনি সে আকাশে উঠে যায়।

আমার অনুমানই ঠিক। আর এক পলক দেরি করলেই আবার সে আমাকে নিয়ে আকাশে উড়ে যেত। ভাগ্যিস পাগড়ীর ফাসটা আমি পাখীটার পা থেকে খুলে ফেলতে পেরেছিলাম।

কিন্তু না পারলেই বোধহয় ভালো হতো। পাখীটা উড়তে উড়তে সমুদ্রের ওপারে কোন অজানা দেশে অদৃশ্য হয়ে গেলো। দেখে শিউরে উঠলাম, পর্বতচূড়া থেকে ডানা ঝাপটে ওঠার সময় সে বিশাল কে পাহাড়ী ময়াল সাপ ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে গেলো। মনে হয়। পাহাড়ের মাথায় ঐ সাপটিাকে দেখেই সে নেমে এসেছিলো।

আমার প্রাণ ভয়ে উড়ে গেলো। ঐ ভয়ালভয়ঙ্কর সাপটা এই পর্বত কন্দরেই কোথাও নিশ্চয়ই ছিলো। আর একটা যখন দেখলাম, তখন বিশ্বাস কি, আরও হাজারটা থাকতে পারে।

এদিক ওদিক ভালো করে তোকালাম। না, কোথাও কোনও গাছপালা, ঝর্ণা, নদী কিছুই নাই। সেই দ্বীপটা তবু অনেক ভালো ছিলো-জনমানব না তাক, ফলমূল জল প্রচুর ছিলো। না খেয়ে অন্তত মারা যেতাম না। কিন্তু এ যে একেবারে নির্জলা নিষ্ফলা বন্ধুর মরুপর্বত। এখানে শুধু বিষধর সাপের আড়ডা। একবার তাদের নিশ্বাসের আওতায় পড়লে আর রক্ষা নাই। প্রচণ্ড আকর্ষণে টেনে নিয়ে মুখের গহ্বরে পুরে ফেলবে। যত বড় বীরপুরুষই হোক, পালাতে পারবে না। মৃত্যু অনিবার্য ভেবেই সেই পর্বত শীর্ষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে ভাবছি। খিদে পেলে কি খাবো। তৃষ্ণার জল দেবে কে? উফ ভাবতেও মাথা ঘুরে যায়। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। এ একেবারে কড়াই থেকে চুল্লিতে এসে পড়েছি।

ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকি। একটু নামলেই একটা উপত্যকা। পর্বতসন্ধুল হলেও মোটামুটি সমতল। নামতে নামতে, কি আশ্চর্য, যেদিকে তাকাই শুধু দেখি হীরের স্তুপ। চোখ ঝলসে যায়। দূর থেকে এতক্ষণ যেগুলোকে পাথরের টুকরো বলে ভ্বম হচ্ছিল আসলে তা সবই ছোট বড় হীরে। কোথাও কোথাও এই হীরের স্তুপ প্রায় মানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠেছে।

আমি অবাক হয়ে সেই হীরের স্তুপ দেখছি। এমন সময় নজরে পড়লো কিছুটা দূরে অসংখ্য সাপ কিলবিল করছে। ভয়ে শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে। দেখলাম সাপগুলো ধীরে ধীরে তাদের গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এই সাপগুলো রকপাখীর ভয়ে দিনেরবেলায় আদৌ বাইরে বেরোয় না। রাতের বেলা, যখন রক-এর উপদ্বব থাকে না, ওরা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে আহারের সন্ধান করে। এক-একটা সাপ। এত বড় যে একটা হাতী পর্যন্ত অনায়াসে গিলে ফেলতে পারে।

প্রতি পদক্ষেপের আগে খুব ভালোভাবে জায়গাটা দেখে নিই। কি জানি, হয়তো সাপের গর্তেই পা রাখবো। মনে মন নিজের নসীবের কথা ভাবি। সুখে থাকতে ভূতে কিলালো। তা না। হলে আমন বেহেস্তের বাগদাদ ছেড়ে এই দোজকের দক্ষিণ দুয়ারে আসবো কেন?

সারাটা দিন আমি একটু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করে কাটালাম। কিন্তু একটিমাত্র গুহা ছাড়া কোনও কিছুই চোখে পড়লো না। প্ৰাণে আমার সাপের ভয়। ক্ষিদেতেষ্টা মাথায় উঠেছে। সারাটা দিনের মধ্যে সেসব কথা মনেও এলো না।

ক্বমে সন্ধ্যার কালো ছায়া নেমে আসতে থাকে। আমি আর বাইরে থাকা নিরাপদ মনে না। করে সেই ছোট গুহাটার ভিতরে কোনওরকমে শরীরটাকে গলিয়ে দিলাম। একটা পাথরের চাই দিয়ে চাপা দিয়ে দিলাম গুহাটার মুখ। ভাবলাম, কোনওরকমে রাতটুকু তো কাবার করা যাক। তারপর কাল সকালে যা ভাগ্যে থাকে হবে।

গুহার ভিতরে একটা কোণ বেছে নিয়ে শুতে যাবো হঠাৎ সামনের পাথরের চাইটা কেমন নড়েচড়ে উঠলো। সর্বনাশ! দিনের বেলায় যাকে একখণ্ড কালো পাথরের চাই ভেবেছিলাম আসলে সেটা একটা সাপ-কুণ্ডলি পাকিয়ে ডিমে তা দিচ্ছে! আমার অবস্থা তখন যে কি; বুঝতেই পারছেন। সারা শরীর অবশ হয়ে গেলো। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। তারপর আর কিছু মনে নাই।

সকালবেলায় জ্ঞান ফিরে পেলাম। অতি সন্তৰ্পণে গুহার মুখ থেকে পাথরখানা সরিয়ে দেহটাকে টেনে বাইরে বের করে আসতে পারলাম। গতকাল সারা দিনরাত্ৰি উপবাসে কেটেছে। তার উপর স্নায়ুর ওপর ঐ ভয়ঙ্কর চাপ—আমার শরীরের সব শক্তি যেন কে কেড়ে নিয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নাই। তবু কোনওরকমে দেহটাকে তুলে ধরলাম। ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না। মাতালের মতো টলতে থাকি। হঠাৎ থাপ করে কি একটা শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি আমার সামনে এসে পড়েছে প্রকাণ্ড মাংসের একটা খণ্ড। অবাক হলাম। কাছে গিয়ে দেখি একটা ভেড়ার চার ভাগের এক ভাগ ছালচামড়া ছাড়ানো মাংসপিণ্ড।

মনে হলো, গল্প শুনেছিলাম, জহুরীরা এই হীরক পাহাড় থেকে হীরে সংগ্বহ করার জন্য ভেড়ার মাংসপিণ্ড ছুঁড়ে দেয়। কাঁচা মাংসের গায়ে হীরের কিছু টুকরো গেঁথে যায়। তারপর রক অথবা বাজপাখীরা এসে মাংসের খণ্ডটাকে ছোঁ। মেরে তুলে নিয়ে নিজের বাসায় গিয়ে বসে। সেই সময় পাখীগুলোকে তাডিয়ে দিয়ে তারা হীরের টুকরোগুলো বেছে নিয়ে যায়।

মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। বড় বড় অনেকগুলো হীরে কুড়িয়ে আনলাম কুর্তা কামিজ ইজার পাতলুন সব খুলে হীরের টুকরোগুলো বোঝাই করে কোমরে ঝুলিয়ে নিলাম। তারপর পাগড়ীটা খুলে মাংসার পিণ্ডটাকে ফাঁস দিয়ে এমনভাবে বাঁধলাম, যাতে মাংসার বেশির ভাগ অংশই অনাবৃত থাকে। তারপর পাগড়ীর অপর প্রান্ত আমার হাতে বেঁধে একটা পাথরের চাই-এর আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। একটুক্ষণ পরে শো শোঁ করে নেমে এলো একটা রকপাখী। ছোঁ। মেরে তুলে নিয়ে গেলো মাংস পিণ্ডটা। আর সেই সঙ্গে আমাকেও। ঝুলতে ঝুলতে আমিও রকপাখীর সঙ্গে সঙ্গে উড়ে চললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাখীটা তার আস্তানায় নামলো। আমি কৰ্ত্তীর বাঁধন খুলে একটু দূরে সরে পড়লাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বৃদ্ধ জহুরী এগিয়ে এলো সেখানে। আমাকে দেখে সে অবাক হয়েছে। মানুষের মুখ দেখে আমার তো আর আনন্দ ধরে না। আমি খুশিতে লাফাতে লাফাতে তার দিকে এগিয়ে যাই। সে কিন্তু খুশি হতে পারলো না। রুক্ষ স্বরে কৈফিয়ৎ চাইল, কে তুমি? এখানে কী করতে এসেছ, চোর কোথাকার। আমার হীরে চুরি করার মৎলব করেছ? কিন্তু জেনে রাখ, সেটি হবে না। এ আমাদের বংশজাত অধিকার। আমাদের রুটিতে হাত দিতে এলে কিছুতেই ব্যবদাস্ত করবে না।

আমি হাসতে হাসতেই বলি, আপনি অত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন কেন, শেখসাহেব। আমি আপনার বাড়া ভাতে ছাই দিতে আসিনি। আপনার ধারণা বিলকুল ভুল। আমি চোরও না, ডাকাতও না-নেহাতই একজন সাদাসিধে সৎ সওদাগর। ভাগ্যের ফেরে আজ আমার এই দশা।

কমিজের জেব থেকে কয়েকখানা হীরে বের করে তার হাতে দিয়ে বললাম, এই নিন। হবে তো?

বৃদ্ধের চোখ ছানাবড়ার মতো গোল গোল হয়ে ওঠে, ইয়া আল্লাহ, এত বড় বড় হীরে তো জীন্দগীভর কখনও দেখিনি। আমাদের মাংসের পিণ্ডে তো ছোট ছোট হীরের কুচি আটকে আসে। এ হীরে তুমি কোথায় পেলে, বেটা?

—কোথায় পেলাম, পরে বলছি। আগে বলুন, আপনি খুশি হয়েছেন। কিনা। না, আরও কয়েকটা দেব।

জহুরী বলে না, না, বাবা, আর কী করবো। এর একখানার দামেই সাতপুরুষ বসে বসে খাওয়া যায়। আমার তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। তা ছাড়া বংশে বাতি দেবার কেউ নাই। এই পয়সাই কে খাবে। ওসব তোমার নিজের কাছে রাখি।

আমি বললাম, আমাকে একটা থলেটলে দিতে পারেন?

তখনও আমি উলঙ্গ। আমার পাতলুনের দোনলায় ভরা হীরের টুকরো। বৃদ্ধ বললো, আলাবৎ, এই নাও থলে। কটা নেবে?

সমস্ত হীরেগুলো একটা বড় থলেতে বোঝাই করে আবার আমি কামিজ পাতলুন পরে সভ্য হলাম।

জহুরী জিজ্ঞেস করলো, ঐ দুৰ্গম হীরক পাহাড়ে কী করে তুমি গিয়েছিলে বেটা। ওখানে আজ অবধি কোনও মানুষ গিয়ে ফিরে আসতে পারেনি।

আমি আমার সমুদ্রযাত্রা থেকে শুরু করে আগাগোড়া সব কাহিনী তাকে খুলে বললাম।

বৃদ্ধ আমাকে বাহবা দিয়ে বললো, তোমার সাহস বটে। যাই হোক, আল্লাহর দোয়ায় প্ৰাণে বেঁচে গেছ।

আমি তখন দারুণ ক্ষুধার্ত। বললাম, কাল সারাদিন রাতে পেটে দানাপানি পড়েনি। কিছু খেতে দিতে পারেন।

বৃদ্ধ বললো, ও, তাই তো, আমি একেবারে খেয়াল করিনি, বাবা। চলো, আমাদের তাঁবুতে চলো। কাছেই।

ওদের তাঁবুতে এসে পেট ভরে খানাপিনা খেলাম। এতক্ষণে দেহে বল ফিরে এলো। সারাটা দিন ওদের তাঁবুতে ঘুমালাম। সন্ধ্যায় খেয়েদেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।

সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠলাম দেহ, মন বেশ ঝরঝরে হয়ে গেছে। ওরা আমাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে এলো। সেখান থেকে জাহাজে উঠে চলে এলাম কপূর দ্বীপে। এই দ্বীপে একটা প্রকাণ্ড বড় বৃক্ষ আছে। তার ডালপালার মধ্যে শখানেক মানুষ নির্বিবাদে লুকিয়ে থাকতে পারে। এই বৃক্ষের দুধের মতো সাদা রস থেকে তৈরি হয় কর্পূর।

এই দ্বীপটিায় আমি অবশ্য কতকগুলো মারাত্মক রকমের হিংস্ব জানোয়ার দেখে এসেছি। এই জানোয়ারটার নাম কার্যকাডন-অনেকটা আমাদের দেশের গণ্ডারের মতো দেখতে। এর নাকের ডগায় আছে প্ৰায় ছয় হাত লম্বা একটা শিং। এদের গায়ে ভীষণ জোর। বড় বড় হাতীর সঙ্গে যুঝতে পারে এরা। শিং দিয়ে গুতিয়ে গুতিয়ে হাতীকে মেরে না ফেলা পর্যন্ত এরা ক্ষান্ত হয় না। কিন্তু হাতীটো মরে পড়ে গেলে এরা আর তার ধারে কাছে যায় না। রক পাখিরা তাকে তাকে থাকে। হাতীর বিশাল বপুটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই উড়ে এসে ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে মহাশূন্যে উড়ে যায়।

এই দ্বীপে এসে আমি আমার একখানা হীরে বিক্রি করে সোনা কিনলাম। এখান থেকে দেশে ফেরার জন্য জাহাজ ভাড়া করতে হবে। জাহাজ-এর ভাড়া মেটাবার জন্য সোনা দরকার।

এ বন্দর থেকে সে বন্দর, আবার সেখান থেকে অন্য এক বন্দর-এইভাবে একদিন আমি বসরায় এসে পৌঁছলাম। আমার মন খুশিতে নেচে উঠলো। দেশ আর বেশি দূর নয়। দু-এক জীউ দিনের মধ্যেই আমি আমার জন্মভূমি চিরসুন্দর সুখের নীড় বাগদাদে ফিরে এলাম।

আমাকে পেয়ে আপনজনরা খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো। আমিও বহুদিন বাদে তাদের সঙ্গ ফিরে পেয়ে আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলাম। সোনাদানা হীরে—যা, এনেছিলাম সবারই হাতে কিছু কিছু দিলাম। অনেকদিন পর আবার হাসি গানে ভরে উঠলো আমার ঘর।

এর পর থেকে নানা ভোগবিলাসের মধ্যেই দিন কাটতে লাগলো। দামী দামী মদ আর মাংস সপরিবারে নিত্য খাই। বাহারী সাজপোশাক পারি। গান বাজনা হৈহল্লার মধ্যে আমার মহা আনন্দে দিন কাটতে থাকে। প্রতিদিন আমার ইয়ার বন্ধুরা আমার কাছে গল্প শুনতে আসে। বহু বিচিত্র আমার জীবনের শত। অভিজ্ঞতা। দিনের পর দিন বলেও শেষ করা যায় না।

এই হলো আমার দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রার কাহিনী। কিন্তু আগামীকাল, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তোমাদের আমি তৃতীয় সমুদ্রযাত্রার বিচিত্র কাহিনী শোনাবো। যে দুটো কাহিনী তোমরা শুনলে সে কাহিনী তার চেয়ে আরও অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।

রাত্রি অবসান হতে চলেছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *