• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

১১-১৫. যেমনটি সালমা এবং অন্য বাজিকরেরা

লাইব্রেরি » অভিজিৎ সেন » রহু চণ্ডালের হাড় » ১১-১৫. যেমনটি সালমা এবং অন্য বাজিকরেরা

১১.

যেমনটি সালমা এবং অন্য বাজিকরেরা আশা করেছিল ঠিক তেমনটি হয়। পেমার তলপেট যত স্কুল হতে থাকে আনন্দর আসা-যাওয়াও তত কমে। তারপর পেটের চামড়া যখন একেবারে টানটান হয়ে নাভিকে পর্যন্ত সমতল করে দিল, তখন আনন্দর আসা একেবারেই বন্ধ হল।

আর মালিকের পছন্দ-অপছন্দ সব থেকে আগে বোঝে চাকরবাকরেরা। পেমার দেখাশোনার জন্য যে দু-জন চাকরানি ছিল, প্রথমে তারা তাকে অবহেলা দেখাতে শুরু করে, তারপরে অবাধ্য হতে থাকে এবং সবশেষে অপমান করতে শুরু করে।

সালমা যখন আকারে ইঙ্গিতে এসব কথা বলেছিল তখন যে পেমা বোঝেনি এমন নয়। সে বয়সে নিতান্ত বালিকা হলেও সালমা বলার আগেই সে এসব চিন্তা করেছিল। কিন্তু এসব চিন্তাকে আমল দেওয়ার কোনো কারণ সে তার যাযাবরী রক্তে খুঁজে পায়নি। সালমা যা চিন্তা করেছিল তা হল, বয়সের অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতায় মানুষ পেমার মতো অপরিণামদর্শী যুবতীকে মূখ মনে করে। বয়সের অভিজ্ঞতা ও তজ্জনিত উপলব্ধি অন্য একটা বয়সের আবেগ এবং উপলব্ধিকে তির্যকভাবে দেখে। সালমা যখন পেমাকে সাবধান করে তখন সে নিজের যৌবনের কথা, তার মায়ের যৌবনের কখা, সবই ভুলে থাকে।

তাছাড়া পেমা প্রেমে উন্মাদ হয়েছিল। আনন্দর রাজকীয় চেহারা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যতদিন সে দলে ছিল সেই ক-দিনের গোপন অভিসার তার সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। আর এখন যে সমস্যা, তার সমাধান এখনই করতে হবে। এসব আগে থাকতে কিছুতেই স্থির করা যাবে না। আনন্দর অদর্শনে সে কষ্ট পায়, কাঁদে এবং পরিচারিকাদের অনুরোধ করে, ঘুষ দিয়ে আনন্দকে ডাকতে পাঠায়।

আনন্দ বিরক্ত হয়ে আসে, সামান্য সময় বসে কিন্তু কথাবার্তার বিশেষ উত্তর দেয় না। পেমা আহত এবং অপমানিত বোধ করে, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়।

তারপর বহুদিন আনন্দ আসে না। পেমা বারবার খবর দেওয়া সত্ত্বেও আসে। খরচ-পত্তরও নিয়মিত পাঠায় না। সে। দু-জন পরিচারিকার একজন এবং দারোয়ান চলে যায় কোন অজ্ঞাত নির্দেশে। বস্তুত, আনন্দ আর এই আয়োজনের অর্থও খুঁজে পায় না। এ কথা ঠিক, এই বিদেশি মেয়েটা তাকে অস্বাভাবিক নেশাগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে। এসব নিয়মে নেই। তবুও একেবারে তাড়িয়ে দিতে পারছে না আনন্দ। সামান্য একটা দুর্বলতা এখনো রয়েছে তার।

শেষপর্যন্ত পেমা তার পরিচারিকাকে শেষবারের মতো আনন্দর কাছে পাঠায়। বলে দেয়, যদি সে না আসে, তাহলে আমিই তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হব, এ কথা মনে রাখে যেন।

সুতরাং আনন্দ আসে। এবার শুধু বিরক্ত নয়, ক্রুদ্ধও সে। বলে, কি ব্যাপার, তুই যে বিয়ে করা মাগের মতো দাবি করছিস?

এখানে আস না কেন?

এখানে এসে কি হবে? আমার আর কাজকর্ম নেই?

তা বলে একেবারেই আসতে পার না?

তোর যদি এখানে ভালো না লাগে, তাহলে দলে ফিরে যা।

তার মানে?

তার মানে, তোকে যে সারাজীবন পুষতে হবে এমন কি কথা আছে?

সে কথাই তো ছিল।

না, সে কথা ছিল না, আর তোকে আমি ডেকে নিয়ে আসিনি। তুই নিজেই এসেছিলি। আমার এখন অন্য কাজ আছে, এসব ঝামেলা আর পোয়াতে পারব না, বুঝলি?

পেমা দপ করে জ্বলে ওঠে। চিঙ্কার করে বলে, বেইমান, এখন আমাকে চলে যেতে বলছিস, তো, এটার কি হবে, এটার? সে তার পেটের উপর চড় মারতে থাকে উন্মাদের মতো। জঠরের শিশু মোচড় মেরে ওঠে। পেমা অস্বস্তি ও যন্ত্রণায় মাটির উপরেই বসে পড়ে।

আনন্দ বলে, ওটার আমি কি জানি? বাজিকরের ছাউনিতে অমন বেজম্মা অনেক আছে। আজই এ ঘর খালি করে দিবি।

পরিচারিকাকে ডেনে আনন্দ বলে, এ যদি সন্ধ্যার মধ্যে ঘর ছেড়ে না যায় তবে ঘাড় ধরে বের করে দিবি। না হলে, তোদেরই তাড়িয়ে দেব, মনে রাখিস।

পেমা লাফিয়ে উঠে ক্ষিপ্তের মতো আক্রমণ করে আনন্দকে। দাঁতে নখে ঘায়েল করতে চায় সে। সঙ্গে অশ্লীল গালিগালাজ।

আনন্দ বলশালী পুরুষ। এক হাতে পেমার আক্রমণ সামলে অন্য হাতে মুখের উপর আঘাত করে বারবার। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

পেমা দরজার উপর থুথু ছিটায়, মা-বাপ তুলে খিস্তি করে, কাঁদে, তারপর বিছানার তলা থেকে একখানা ছুরি ঝট করে টেনে বের করে। বাজিকরের কামারশালার তৈরি ছুরি, মাথা ভারি, বাঁট ছোট। সে ছুটে যায় দরজার দিকে। পরিচারিকা তাকে আটকাতে সাহস পায় না।

আনন্দ তখন উঠোনে তার ঘোড়র কাছে। পিছনের চিৎকারে সে কান পাতে। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে পেমা ছুরি ছুঁড়ে মারে। ছুরিটা বিদ্যুৎ গতিতে আনন্দকে পাশ কাটিয়ে ঘোড়ার পিছনের নরম মাংসে বিদ্ধ হয়। ত্রাসে আনন্দ পিছন ফিরে তাকায় আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিপ্ত ঘোড়ার পিছনের পায়ের চাট খায় পরপর দু-বার। একটি আঘাতে তার মাথার খুলির খানিকটা ছিটকে বেরিয়ে যায়, সে সেখানেই পড়ে থাকে।

কয়েক মুহূর্ত পেমা হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর পরিচারিকার চিঙ্কারে তার চমক ভাঙে। আনন্দর দেহটা ছটফট করে এখন স্থির হয়ে আছে। ঘোড়াটি দড়ি ছিঁড়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। ভয়ংকর চোখে পেমা অপর স্ত্রীলোকটির দিকে এগোয়া। তার যাযাবরী রক্ত এবং ইন্দ্রিয় এবার পুরোপুরি ক্রিয়াশীল। স্ত্রীলোকটি ভয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ছুটে যায় চিৎকার করতে করতে।

 

পেমা তারপর দ্রুত তার অলংকার ও টাকা-পয়সা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তার গন্তব্য এখন পীতেমের ছাউনি। যাযাবর কি দলছাড়া বাঁচতে পারে?

পেমা যখন ছাউনিতে পৌঁছায় তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। দলের কেউ কেউ তাকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে দেখে, কিন্তু কথা বলে না। পেমা সালমার ছাউনিতে গিয়ে ঢোকে।

সালমা তাকে লক্ষ করতে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। পেমা বসেও তার অস্থিরতা দূর করতে পারে না। অবশেষে সালমা বলে, কি হল?

আনন্দ খুন হয়েছে।

কি করে?

পেমা সবকিছুই বলে। সালমা ধৈর্য ধরে শোনে, কোনোরকম অধীরতা দেখায়। তারপর পেমাকে ছাউনিতে রেখে সে পীতেমের কাছে যায়।

 

১২.

শীত শেষ না হতেই সে বছর হাওয়া উঠেছিল দুরন্ত। সূর্য যত চড়া হতে থাকে হাওয়াও বাড়তে থাকে। ফাল্গুন মাসে এত তাপ কেউ কখনো দেখেনি।

হাটে-বাজারে ফসল আসছিল অজস্র, কিন্তু নিমেষে সেসব উধাও হয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সারাদিন হাজার হাজার মণ মাল, যার প্রায় সবটুকুই খাদ্যশস্য ও তৈলবীজ। সেসব নৌকোয় বোঝাই হয়। এছাড়া চালান যায় রেশম ও তাঁতবস্ত্র। এত অজস্র উপকরণ, তবু মানুষ ধুকছে। রেশম, তাঁত, ধান, নীল প্রভৃতি সমস্ত উৎপাদন প্রচুর পরিমাণ দাদনের আওতায়। রাজকর্মচারীরাও ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রচুর দাদন খাটাচ্ছে। গঙ্গার ওপারে মালদার কালেক্টরের সঙ্গে লবণ ও বস্তুব্যবসায়ী সাহেবদের বিরোধ বাধে। কতকগুলো লবণের নৌকো বিভিন্ন জায়গায় জমিদারেরা আটকে দিয়েছিল। তাদের দাবি জমিদারকে খাজনা না দিয়ে জমিদারিতে লবণের ব্যবসা করা চলবে না। আবার অন্য এক জায়গায় দাদন নেওয়া তাঁতিদের উপর জমিদার খাজনা বৃদ্ধি করলে ব্যবসায়ী সাহেবরা কালেক্টরের উপর এসবের জন্য কৈফিয়ৎ ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কোন সাহেব কত ক্ষমতাশালী, কালেক্টর বড় না ব্যবসাদারেরা বড় এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন জায়গায়। সেইসব বিরোধ কলকাতা পর্যন্ত গড়ায় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানির কর্তারা কালেক্টরকেই অপদার্থ প্রতিপন্ন করে। কালেক্টরের সবচেয়ে বড় ত্রুটি রাজস্ব আদায়ে ধরা পড়ে। এ এমনই একটি কাজ যাতে কোনো কর্তৃপক্ষকে কখনো খুশি করা যায় না।

এ ছাড়া স্থানে স্থানে ছোটখাটো প্ৰজাবিদ্রোহ লেগেই আছে। আছে ছোট বড় জমিদার ও তাদের নায়েবদের হাতে আইনের ব্যাপারে কালেক্টরের নাস্তানাবুদ নানারকম ঘটনা। সবার উপরে সমস্ত দামিন-ই-কো, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম প্রভৃতি জায়গার সাঁওতালদের সংঘবদ্ধতার খবর।

প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন গুজব ছড়ায়। যে কথা সালমা একদিন ঘোরের মধ্যে উচ্চারণ করেছিল, কি করে যেন সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। হয়ত সালমা আরো কারো কাছে কথাটা বলেছিল, এখন সে কথা সাঁওতাল গ্রামে মুখে মুখে ফেরে। হাজার হাজার নাগ-নাগিনী উড়ে আসছে। তাদের নিশ্বাসে বিষ। সেই বিষ-নিশ্বাসে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এসব কথা মানুষ বিশ্বাস করত।

বাজিকরের ছাউনিতে এখন ঘোর দুর্দিন। চতুর্দিকে এত বিশৃঙ্খলা যে দল আর এখানে-সেখানে ঘুরে, খেলা দেখিয়ে বিশেষ কিছু রোজগার করতে পারছে না। যে যার সঞ্চয় খেয়ে শেষ করছে। অথচ নতুন রাস্তায় পা বাড়াতেও সাহস করছে না।

সালমা যখন পীতেমের কাছে এসে পেমা-আনন্দ বৃত্তান্ত বলে, তখন সে আশা করেছিল, পীতেম বোধহয় এবার তার প্রস্তাবে রাজি হবে। সে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেই রাত্রেই পালিয়ে যাবার। সে ভেবেছিল, বাপ হিসাবে পীতেম হয়ত পেমাকে বাঁচাবার কথা ভেবে তার মতে সায় দেবে। কিন্তু পীতেম রাজি হয়নি। সে গৃহী মানুষের মতো আতঙ্কিত হয়েছিল। কোথায় যাব পালিয়ে? কোম্পানির রাজত্বে পালাবার জায়গা নেই। গর্ত করে ঢুকে থাকলে বেতআঁকড়া দিয়ে সেখান থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসবে।

কাজেই সে জানকীরামের অপেক্ষুম্ভ ছিল। জানকীরাম আসেনি। কিন্তু অন্য পুলিশ এসে বাজিকর ছাউনি তছনছ করেছিল। পীতেম, ধন্দু, পরতাপও গ্রেপ্তার হয়েছিল পেমার সঙ্গে। অত্যাচার চলেছিল সারারাত ধরে। পীতেম কিংবা কেউই জানত না এ সমস্যার সমাধান কোন পথে।

সমাধান পেমাই করে দেয়। চরম শাস্তি হিসাবে পেমাকে রাখা হয়েছিল দাগি কয়েদিদের সঙ্গে। দারোগার ছেলে খুন, যে-সে অপরাধ নয়। সারারাত ধরে পেমার চিৎকার শোনা গিয়েছিল। ছ’দিন পরে পেমা মৃত সন্তান প্রসব করে এবং প্রচুর রক্তপাতে নিজেও মরে যায়। পীতেম, ধন্দু ও পরতাপ ছাড়া পায় সেদিনই।

এর থেকে আর স্বস্তির সমাধান কিছু ছিল না পীতেমের কাছে। পেমাকে যদি ছেড়ে যেতে হতো, তাহলে সারাজীবন একটা কাঁটা বুকের কাছে খচখচ করত।

এবার সে নিজেই সালমাকে বলে, গোছ জিনিসপত্র, গোটা তাঁবু, চল বেরিয়ে পড়ি।

 

১৩.

কিন্তু ‘চল’ বললেই যাওয়া যায় না। চারদিকে তখন যেসব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, তার উপরে করোরই কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না না! বাজিকর ছাউনিতে তখন অভাবটা সংকটের আকার ধারণ করেছে। গৃহস্থদের দেখাদেখি যা ছিল তার কতক বেচে খাওয়া হয়েছে, কতক বেচে পুলিশের হুজ্জতি বন্ধ করা হয়েছে।

এরই মধ্যে একদিন শোনা গেল কোথায় নাকি সাঁওতালরা সভা করেছে, তার পরে এক দারোগাকে সদলবলে খুন করে বন্দীদের ছিনিয়ে নিয়েছে। রাজমহলে তখন সরকারি মহলে ভীষণ চাঞ্চল্য শুরু হয়। থানা পুলিশ বন্দুক লাঠি সব জোরদার করা হতে লাগল। কেননা মানুষের স্মৃতিতে বাবা তিলকা মাঝির বিদ্রোহের কথা তখনো জাগ্রত ছিল।

হাওয়ায় গুজব এত ছড়াচ্ছিল যে পীতেম যেদিন শুনল দয়ারাম ভকত গাধার পায়ের চাট খেয়ে মরেছে, সে বিশ্বাস করেনি। সে ভেবেছিল বজ্জাত লোকটা বেঘোরে মরেছে কোনোরকমে, আর মানুষ রটাচ্ছে এই রকম। কেননা দারোগার ছেলের ঘোড়ার চাট খাওয়া ব্যাপারটা দুরদূরান্তের সবাই জেনে গিয়েছিল। কাজেই চাট খাওয়াটা মানুষ একটা সাধারণ ব্যাপার করে ফেলেছে। তাছাড়া, গাধা কখনো চাট মারে, এ কখনো কেউ শুনেছে? তবুও খোঁজ নিতে গিয়ে সে খুবই তাজ্জব বনে যায়। ঘটনাটা সত্যি। দয়ারামের খামারবাড়িতে দয়ারাম মরে পড়েছিল তার নতুন কেনা গাধার পায়ের কাছে। এত কাছে একটা মৃতদেহ মরে থাকাতে গাধাটা নাকি ভয়ে সারারাত চিৎকার করেছে। পরদিন মানুষ বিরক্ত হয়ে সেই খামার বাড়িতে গিয়ে দয়ারামের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে। কেউ বলছে দয়ারাম গাধার পায়ের চাট খেয়ে মরেছে, কেউ বলছে তার চাকর সুফল তাকে খুন করে পালিয়েছে। সবিস্তারে সব শুনে পীতেম সালমার কাছে এসেছিল।

দয়ারামের মরার খবর শুনেছিস?

শুনেছি।

সালমার মুখে কোনোরকম ঔৎসুক্য ছিল না। কিন্তু পীতেম এত সহজে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। এই আশ্চর্য ঘটনার পেছনে সালমার হাত সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। অথচ সালমা যেন কিছুই জানে না।

পীতেম, সালমা, বা অন্য কেউই জানত না সেদিন দয়ারামের নতুন কেনা মাদি গাধাটা আরেকজন মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। সে মানুষটা দয়ারামের সেই বাঁধা দাস সফুল মুর্মু। খামারবাড়িতে গাধা নিয়ে মালিক ব্যস্ত ছিল, তখন সে বন্ধ দরজায় মালিকের নির্দেশমতো পাহারা ছিল। কিছু একটা সন্দেহ হওয়াতে ফোকর দিয়ে উঁকি দিয়ে সে যা দেখেছিল, তা তার জাতের কেউ কখনো দেখেনি। তারপর চা খেয়ে জলচৌকির উপর থেকে মালিককে ছিটকে পড়তে দেখেছিল সে। তারপর আবার আবার চাট। তখনো সে ভেতরে ঢোকেনি, কেননা, না ডাকলে ভেতরে ঢোকা নিষেধ ছিল মালিকের। শেষে একসময় নিঃসন্দেহ হয় যে, মালিক আর ডাকবে না।

তখনো সে ঢোকেনি। সে ভেবছিল, গাধাও গা-জোয়ারী কিংবা বদমাইসি সহ্য করে না, অথচ সে সুফল মুর্মু আজ দশ বছর ধরে এই জানোয়ারের অধম মানুষটাকে সহ্য করে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল, পরপর সাতদিন স্বর্গের ঠাকুর আকাশ থেকে সিদুকানুর ঘরে এসে নেমেছিল, নির্দেশ দিয়েছিল। সে ভেবেছিল, তার ঘরের উঠোনে নিশ্চয়ই আগাছা আর ঘাসের জঙ্গল হয়ে আছে। যদি সেই অমঙ্গল চিহ্নিত মোষ আর কোথাও চরার জায়গা না পায়, তবে তার উঠোনে নিশ্চয়ই জেঁকে বসবে এবং ঘাস খাবে। কেননা তখন সব সাঁওতাল জানত এরকম মোষ আসছে। কোথা থেকে আসছে কেউ জানত না। তবু গ্রামে গ্রামে খবর রটে গিয়েছিল এবং প্রত্যেকটি বাড়িতে উঠোন চেঁছে গোবরজল দিয়ে সবাই পরিষ্কার করে রেখেছিল। কেননা ঘাস দেখলেই সেই অমঙ্গল বহনকারী মোষ তাতে চরবে, ঘাস খাবে। আর তাতে সবংশে সে বাড়ির মানুষ ধ্বংস হবে। সুফল মমুর বাড়ি আছে, বংশের মানুষও আছে, কিন্তু এখন আর কেউই সেই বাড়িতে থাকে না।

সে ভেবেছিল, তার বাড়ি তিন মাথার মোড়ে। সেখানে গাছের গায়ে গরুর চামড়া, জোড়া বাঁশি এবং শালপল্লব সাজিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল তার, যাতে প্রমাণ হয় এ বাড়িটা সাঁওতালের, এ গ্রাম সাঁওতালের, তা না হলে বাঁচি না কোথায় যে নেতা জন্মে বড় হয়েছে যে যদি এসে এসব দেখতে না পায়, তাহলে ক্রুদ্ধ হয়ে সবাইকে হত্যা করতে পারে। সে মনে করেছিল, যেসব যুবক সাঁওতাল এখন পায়ে ঘুঙর বেঁধে টামাং নিয়ে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে প্রচার করছে এবং অন্যকে প্রচারে উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের দলে তার থাকা অবশ্যই উচিত ছিল। তার মনে হল, সে তো এক মায়ের এক বেটা, আর এখন সব এক বেটার মায়েরা পরস্পর সই পাতাচ্ছে। হয়ত, তার মাকে সবাই অবহেলা করছে এবং সই না পাতিয়ে নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। কেননা সে তত অন্যসব এক মায়ের এক বেটাদের মতো নির্ভীক হয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি।

এসব চিন্তা করার পর মাদি গাধাটাকে তার খুব ময়ীয়সী মনে হয়। সে তারপর মালিকের ঘোড়াটার বাঁধন খুলে তাতে সওয়ার হয়ে বসে। ঘোড়াটা দীর্ঘকাল সওয়ারকে এককাতে বসিয়ে আস্তে চলতে অভ্যস্ত। এখন দু-পা ঝোলানো সওয়ারী পেয়ে একটু বেকায়দা বোধ করে। সুফল দু-গা চাবুক চালিয়ে বলে, চল বেটা, আজ মনের আনন্দে ছোট। ঘোড়া গ্রামের পথে ছুটতে শুরু করে।

 

১৪.

দলের হালচাল সম্বন্ধে অনেকদিন ধরেই পীতেম আর মনোযোগ দেয় না। নানা ধরনের আপদ-বিপদে একেই তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল, অবশেষে পেমার মৃত্যু তাকে মারাত্মক আঘাত দিয়ে যায়। তাছাড়া অনেক চিন্তা করেও দলের মতিগতি এবং অবস্থা ফেরাবার মতো কোনো বুদ্ধি তার মাথায় আসেনি।

সেই মেলার সময় যে বড় খেলা হয়েছিল তখন ইউসুফ নামে এক মুসলমান যুবক একদিন খেলার শেষে হাত ধরে বালিকে একধারে টেনে এনেছিল। হাত দু-খানা একত্র করে ঝুঁকে পড়ে সে চুম্বন করেছিল। মুখে অকুণ্ঠ বাহবা ছিল তার।

ইউসুফ বলেছিল, কি হাতই বানিয়েছ ওস্তাদ, ইচ্ছে হয় সোনা দিয়ে মুড়ে রাখি।

এসব বীরাচারের স্তুতিতে সব বীরেরাই বিগলিত হয়। বালিও হয়েছিল। তারপর ইউসুফের সঙ্গে দোস্তি হতে তার দেরি হয়নি।

কিন্তু ইউসুফের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। দু-একদিনের মধ্যেই সে কথাটা পাড়ে বালির কাছে। বালির মতো এক-আধজন লোক তার দরকার। এসব ডুগডুগি বাজানো হেঁচড়া কাজে বালির মতো ওস্তাদের সময় নষ্ট করা অন্যায়। বড় কাজ কিছু করতে চায় তো বালি আসুকর সঙ্গে। যে কাজে সাহস লাগে, উত্তেজনা ও পয়সাও ভালো আছে।

বালি বলেছিল, আদরে-পাদারে ঢিল না ছুঁড়ে আসল কথাটি বল। আমার ছুরি কেমন সোজা এবং জায়গামতো যায়, দেখেছ তো? আমি মানুষটাও সেরকম।

তারপর ইউসুফ মনের কথা খুলে বলেছিল। গঙ্গায় আছে অনেক মহাজনি নৌকো। দেশবিদেশের ব্যবসাদারেরা। এখানে হরেকরকমের মাল বোঝাই করে। প্রশস্ত গঙ্গার অন্ধকার রাতগুলো ইউসুফের। মানুষ আজকাল ভীষণ ত্রাসে থাকে। পাহারাদারগুলো টের পেলেও রা কাড়ে না। সেখান থেকে পাঁচ-দশ পেটি মাল সরালে দিব্যি মাসখানেক নিশ্চিন্তে বসে খাওয়া যায়। আর এসব কাজের সুসন্ধান ইউসুফের ভালোই জানা আছে। যা করার সেই করবে। বালি শুধু সঙ্গে থাকবে তার।

প্রস্তাব শুনে বালি ভয় পেয়েছিল। সে বলেছিল, না ভাই, দলে থেকে এসব হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে চাই না। আমার একার দোষে দল নষ্ট হবে, এ ঠিক নয়।

ইউসুফ অবশ্য বেশি পেড়াপিড়ি করেনি। যাওয়ার সময়ে বলে গিয়েছিল, গেলে ভালো করতে, না যাও, ইউসুফ মিয়ার আটকাবে না। এ দুনিয়ার বোকা লোকেরা খেটে মরে আর বুদ্ধিমানেরা বসে খায়। আর আমার মতো তোমার মতো, যারা খাটতেও চায় না আবার পয়সা রোজগার করার মতো অনেক বুদ্ধিও নেই তারা সাহস দিয়ে রোজগার করে। কথাটা তোমার কাছে ভোলা রইল, ভালো মনে কর, খবর দিও একসময়।

বালি কথাটা তখন ভালো মনে করেনি। এখন এই দুর্দিনে কথাটা ভালো মনে করলেও একেবারে ফেলনা মনে হয় না। কাজেই সেই ইউসুফের খোঁজ লাগায়।

অস্থিরতার সময় সব ধান্দাবাজরা শহরেই থাকে। ইউসুফও তার ব্যতিক্রম নয়। কাজেই তাকে খুঁজতে বালির বেগ পেতে হয় না।

ইউসুফ বলে, আমি জানতাম তুমি আসবে। খুব ভালো সময়ে এসেছে। ঘাটে নৌকো রাখার জায়গা নেই। গুদামগুলো ভর্তি। সাঁওতাল হাঙ্গামার ভয়ে কোনো মহাজনই এখন নৌকো ভাসাতে রাজি নয়। তার উপরে দেখ কেন, ঘাটের দিকে থানা পুলিশ পাহারাদারের নজর নেই। নজর এখন সবার গ্রামের দিকে। সবারই ভয় কোন দিক দিয়ে কখন এসে জংলিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।

প্রথমে বালি একা, তারপরে ধন্দু, পরুপ, জিল্লু ইত্যাদিরাও এসে যোগ দেয়। অন্ধকারের মধ্যে বোঝাই নৌকো থেকে মালের পেটি তুলে নিজের নৌকোয় তোল। তারপর ভাঁটির দিকে তরতর করে বেয়ে যাও। মাইল দুয়েক তফাতে বড় বজরা অপেক্ষা করে থাকে। সেখানে মাল ফেলে দিলেই ছুটি আর নগদ টাকা।

এভাবে চলছিল সেই গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। পীতেম আফিঙের নেশা করত এবং ঝিমোত। নতুন করে কিছু চিন্তা করার কথা আর তার মাথায় আসত না। হাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আস্তে আস্তে সে একেবারেই গম্ভীর হয়ে যায়। জাগ্রত ও ঘুমন্ত দুই অবস্থাতেই তার কানে সারারাতব্যাপী পেমার আর্তনাদ এসে আঘাত করত। সে ছটফট করত, তাঁবুর বাইরে সারারাত পায়চারি করত এবং একা বিড়বিড় করত। সে কারো সঙ্গে কোনরকম পরামর্শ করত না এবং কথাও সারাদিনে মাত্র দু-একটা বলত। তাঁবুর সামনে একটা গাছের গোড়ায় সে প্রায় সারাক্ষণই বসে থাকত।

তারপর সালমা তাকে আফিং খাওয়ানো শুরু করল। আফিঙের নেশায় সে খানিটা স্বস্তি পেয়েছিল। দিনরাত একটা আচ্ছন্ন একাকিত্বের সে বিভোর হয়ে থাকত। তার চুল দাড়ি ক্রমশ বড় এবং ঝকড়া হয়ে তাকে ক্রমশ এক বিজ্ঞ প্রবীণ মানুষ বানিয়ে দেয়। আফিং খাওয়ার অনুষঙ্গ হিসাবে সে স্নানও করত না, ফলে তার গায়ের রঙ একটা সবুজ শ্যাওলার ভাব এসে পড়ে।

এরকম সময় একদিন দারোগা জানকীরাম ছাউনিতে এসে হাজির হয়। পীতেম অর্ধনিমীলিত চোখে তাকে দেখে। তার দৃষ্টিতে পরিচিতির কোনো লক্ষণ নেই। সুতরাং এগিয়ে সে কথা বলতে হয় সালমাকেই।

বেশ কয়েকজন ইংরেজ সাহেব তখন শহরে ছিল। তাদের মধ্যে একজন মেজর বারোজ। সাঁওতালদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য লোকজন সংগ্রহ চলছে। সে কাজ বারোজ সাহেব নিজে তত্ত্বাবধান করছে। জানকীরামের আসার উদ্দেশ্য ঘোড়ার খিদমৎ করার জন শিক্ষিত লোক অন্বেষণ। বাজিকরদের থেকে সে কাজ আর ভালো কে জানে। সুতরাং তোক দিতে হবে।

সালমা বলতে চেষ্টা করেছিল কয়েকটা কথা কিন্তু শোনে কে? দারোগা বলে, কথা বলার এবং শোনার সময় আমার নেই। এমনি যদি না যেতে চাও, বেঁধে নিয়ে যাব, তাও না যেতে চাও, আগুড় দিয়ে সমস্ত ছাউনি পুড়িয়ে দেব।

ধন্দু, বালি, পরতাপ, পিয়ারবক্স এবং জিল্লু এই পাঁচজন মনোনীত হয়। বারোজ তাদের নিজে পছন্দ করে। বাজিকরদের পাঁচ সেরা যুবক যুদ্ধে যায়।

তবু ছেড়ে যাওয়ার আগে তারা সবাই গাছতলায় পীতেমের কাছে এসে দাঁড়ায়। পীতেমের সেই একই অনির্দিষ্ট অর্থহীন দৃষ্টি। যেন সে কানেও শোনে

এমনভাবে সালমা তার কানের কাছে চিৎকার করে, সাহেবরা ছেলেদের যুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে। পীতেম, শুনতে পাচ্ছিস। সাঁওতালদের সঙ্গে সাহেবদের যুদ্ধ হচ্ছে।

পীতেম মাথা নাড়ে, তার শরীর থেকে প্রাচীন রহস্যময় গন্ধ ছড়ায়, সে আবার ঝিমোয়, যেন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।

যুবকেরা একে একে তার পা স্পর্শ করে, পীতেম টেরই পায় না যেন। তার পর তারা বিদায় নেয়।

 

১৫.

উত্তরে গঙ্গা এবং দক্ষিণে বনভূমি অঞ্চল। মাঝে মাঝে অনতিউচ্চ গিরিমালা। এমন জায়গায় গ্রীষ্মের আবহাওয়া বড় অকরুণ হয়। ইংরেজ বাহিনী সাঁওতালদের মুখখামুখি হওয়ার জন্য শিবির করেছে এমনই একটি জায়গায়। স্থানটির নাম পিয়ালাপুর। পিয়ালাপুরের পুবে রাজমহল এবং পশ্চিমে ভাগলপুর প্রায় সমান দূরত্বে। ভাগলপুরের কমিশনার চায় এখানে সাঁওতালদের একটা মারণ আঘাত হানতে। কারণ এখানে যদি বিদ্রোহীদের আটকানো না যায়, তাহলে ভাগলপুর রক্ষা করা যাবে না। বাহিনীর নেতৃত্ব করছে ছজন ইংরেজ অফিসার, তারা হল মেজর বারোজ, মেজর স্টুয়ার্ট, কর্নেল জোন্স, চার্লস ইজারটন, জেমস পস্টেট এবং এডেন।

পিয়ালাপুরে অস্থায়ী ঘাঁটি হল। পথপ্রদর্শক হিসাবে এক বৃদ্ধ সাঁওতালকে বন্দী করে আনা হয়েছিল। সংবাদ ছিল যে পীরপৈতি গিরিসংকটে সাঁওতালদের ঘাঁটি। ঘাঁটিতে রসদ ও খাবারদাবারসহ কিছু সৈন্যকে অপেক্ষায় রেখে ঠিক দুপুরবেলায় মেজর বারোজ গিরিসংকটে প্রবেশ করে সৈন্যসমাবেশ করল। রাস্তা অত্যন্ত দুর্গম, পাথর ও আগাছার জঙ্গলে ঢাকা। পাহাড়ের নিচে আছে একটা নালা। আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হলে তার যাবতীয় জল প্রবল বেগে বেরিয়ে যায় সেই নালা দিয়ে। পাহাড়ের উপর দিকে কোনোরকম চাঞ্চল্য নেই। যতটা সম্ভব অগ্রসর হয়ে মেজর বারোজ কামান পাতল স্থানে স্থানে।

পিয়ালাপুরের অস্থায়ী ঘাঁটিতে জিল্লু এবং পরতাপ তখন বৃদ্ধ বন্দীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। জিল্লু বলেছিল, বুড়ো তুমি বেইমানি করলে? রাস্তা দেখিয়ে দিলে সাহেবদের? বৃদ্ধ এতক্ষণ দূরের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই হাসছিল। তার হাত-পায়ের শৃঙ্খলকে সে যেন আমলেই আনছিল না।

জিল্লুর কথা শুনে সে বলে, হা, রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছি, একেবারে যমের দক্ষিণ দুয়ার।

বৃদ্ধের দড়ির মতো শীর্ণকায় চেহারা, খোঁচা খোঁচা কয়েকটা মাত্র দাড়ি, অযত্নবর্ধিত চুল সারা মুখে ছড়ানো।

সে হঠাৎ জিল্লুর দিকে তীব্রভাবে তাকায়। তারপর বলে, ওখানে কে আছে, জানিস?

কে?

ওখানে যে আছে, তাকে দেখলে বাঘ রাস্তা ছেড়ে দেয়। তার নাম চাঁদ রাই। আর পশ্চিমের ঘাঁটিতে আছে শ্যাম পারগানা, যার নাম তোর সাহেবরা গোরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত মনে রাখবে। শ্যামের বাঁয়ে আছে ডুমকা সোরেন, যার ছোঁড়া তিরের ঢপলা যেখানেই বিধুক তা বাইরের আলো দেখবেই। বুঝলি? যা এখন, কানের পিছনের ঘা তো শুকিয়েছে, এবার সাহেবদের কাছে বলে আয়।

বৃদ্ধের নাটকীয় কথাবার্তায় জিল্লু ও পরতাপ পা পর্যন্ত চমকায়। কে এ মানুষটা? তারা দুজনে কাছে এসে ভালো করে দেখে। হায়রে, এই সেই মানুষ! এমন নাটক বুঝি যুদ্ধক্ষেত্রেই হয়!

সেই মানুষ, যার ধান ওজনের কারচুপিতে জিল্লু প্রতিবাদ করে মাথায় চোট খেয়েছিল। হাঁ, এ সেই চেতন মাঝিই বটে!

জিল্লু, পরতাপ দু-জনে আশপাশ দেখে নিয়ে কাছে এসে হাঁটু ছোঁয় তার।

চেতন মাঝি শৃঙ্খলিত হাত দিয়ে ঝটকা দেয়, থাক্ থাক্‌, সাঁওতাল মারতে এসেছিস!

নিজের ইচ্ছায় আসিনি মাঝি, জোর করে নিয়ে এসেছে।

জোর করে আবার কি আনে রে? মরদ নোস তোরা?

মাঝি ভীষণ উত্তেজিত হয়। বালি বলে, এই ধরো যেমন তোমাকে এনেছে। জোর করেই তো এনেছে? নিজের ইচ্ছায় তো আর আসনি?

চেতন মাঝি বালির দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকায়, তারপর হঠাৎ হেসে ফেলে। বলে একে দেকো, তার উপর বাজিকর। তোদের সাথে কথায় পারে কে? তবে লড়াইতে পারবি না। সাঁওতালরা তোদের কচুকাটা করবে!

পরতাপ বলে, লড়াই থোড়াই করব আমরা। তুমি সত্যি বলছ, কাকা, ওখানে ডুমকা আছে?

আছে না?

ডুমকা আর আমি বাঘের সঙ্গে লড়াই করেছিলাম। মনে আছে?

চেতন মাঝি অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার দৃষ্টি পীরপৈতি পাহাড়ের দিকে। সে আর কথা বলে না।

ঠিক এই সময় প্রথমবার কামানের গম্ভীর গর্জন শোনা যায়। চেতন মাঝি চঞ্চল হয়ে ওঠে। শিকল ঝনঝন করে শব্দ করে। উত্তেজনায় সে উঠে দাঁড়ায়। পাঁচ বাজিকরের চোখে যুদ্ধের চেহারা পাল্টে যায়।

মেজর বারোজ চিন্তাই করতে পারেনি তার সমরসজ্জার এত কাছে সাঁওতালরা। প্রত্যেকটা পাথর, প্রত্যেকটা ঝোপ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ঝাকে ঝাকে ছুটে আসে তির। মেজর স্টুয়ার্ট তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে একেবারে ফাঁকা জায়গায়। দু-দিকে কাঁটাগাছের জঙ্গল। গাছের ও পাথরের আড়াল থেকে তির আসছে বৃষ্টিধারার মতো।

দু-পক্ষের প্রবল রণহুংকার এবং আর্তনাদ বহুদূর থেকে শোনা যাচ্ছে। পাহাড়ের নিচে অপেক্ষমাণ ঘোড়াগুলো পা দাপাচ্ছে। নালার কাছে সৈন্যরা তীরবিদ্ধ হয়ে পালাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। ইংরেজদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে সাঁওতালরা উন্মাদের মতো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তির-ধনুক আর টাঙ্গি-বল্লম নিয়ে।

চেতন মাঝি এবং পাঁচজন যুবক দূর থেকে দেখল পাহাড়ের মাথার উপর মেঘ জমেছে ঘন কালো রঙের। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম হাওয়া প্রবল বেগে সেদিকে ধেয়ে চলল। চেতন তার ভারি শিকল নিয়ে নাচতে শুরু করল—নাম, নাম, আকাশ ভেঙে নাম!

কামানের গর্জনকে ছাপিয়ে মেঘের গর্জন উঠল। বাজ পড়তে লাগল মুহুর্মুহু। বারুদের ও গন্ধকের গন্ধে বাতাসকে ভারি করে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। পীরপৈতির নালা দিয়ে প্রবলবেগে ঘোলা জল গর্জন করে হতাহত ইংরেজ সৈন্যকে ভাসিয়ে ছুটে চলল। মেজর বারোজ এ অবস্থায় আর যুদ্ধ চালানো নিরাপদ মনে না করে পিছু হটতে শুরু করে। এদিকে সাঁওতাল বাহিনী পিঁপড়ের সারির মতো পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে। ইংরেজ সৈন্য দ্রুত পিছিয়ে এসে পিয়ালাপুরের রাস্তায় উঠল। তারপর পলায়ন।

সাঁওতালরা কিছুদূর পশ্চাদ্ধাবন করে ফিরে গেল। কেননা পাহাড়ের উপরে আহত ও নিহতদের ব্যবস্থা করতে হবে। যার মধ্যে আছে বীর শ্যাম পারগানা।

পরাজিত ইংরেজ বাহিনী পিয়ালাপুরে এসে আর বিশ্রাম করতেও সাহস পেল all

ভাগলপুর ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হল। আকাশে যেমন ঘনঘটা তেমনি অন্ধকার। ঝড় ও বৃষ্টিতে দিকনির্ণয় করা যায় না। তখন খোঁজ পড়ে চেতন মাঝি নামে সেই বন্দীর।

মশালের আলোয় অস্থায়ী আস্তাবলে দেখা যায় আরেক দৃশ্য। ছুরিবিদ্ধ চারজন সিপাই মৃত। একটু দূরে বন্দুকের গুলিতে নিহত ধন্দু বাজিকর। পাঁচটি ঘোড়া এবং বন্দীকে নিয়ে চার বাজিকর যুবক দুর্যোগ ও অন্ধকারের মধ্যে কোথা মিলিয়ে গেছে।

« পূর্ববর্তী:
« ০৬-১০. পরতাপ এবং জিল্লু অঘ্রান মাসে
পরবর্তী: »
১৬-২০. যে গাছের নিচে পীতেম প্রতিদিন বসে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top