০৬-১০. পরতাপ এবং জিল্লু অঘ্রান মাসে

০৬.

পরতাপ এবং জিল্লু অঘ্রান মাসে মুর্শিদাবাদের পথ ধরেছিল। আশা ছিল পনেরো-বিশ দিনের মধ্যে তারা ফিরে আসবে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে যখন তারা ফিরে এল না, পীতেম তখন চিন্তায় পড়ে। এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট এখনো বাজিকরদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। তাছাড়া রাস্তা বিপদসংকুল। দল বেঁধে ছাড়া মানুষ একাকী কিংবা দু-একজনে রাস্তা চলাচল করে না। পীতমের চিন্তা অমূলক নয়। সে মুর্শিদাবাদ প্রত্যাগত ও চলাচলকারী ব্যবসায়ী মহাজনের কাছে খোঁজখবর করতে শুরু করে। কিন্তু কোনো সন্ধানই পাওয়া যায় না। কোনো পথিকের হদিশ না পাওয়া গেলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে দস্যু-তস্করের হাতে সে খুন হয়েছে।

তিন-চার মাস যাওয়ার পর পীতেম ধরে নেয় জিল্লু কিংবা পরতাপকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে বিষণ্ণ হয় এবং দুই যুবকের স্ত্রীদের কাছে অপরাধী হয়ে থাকে। পরতাপ যেহেতু তার কনিষ্ঠ সন্তান সে প্রচণ্ড আঘাতও পায় এবং সালমার কাছে সান্ত্বনা খোঁজে।

এইভাবে ছ-মাস পার হয়ে যাবার পরে সবাই যখন একরকম স্থির করেই নিয়েছে যে জিল্লু কিংবা পরতাপের ফেরত আসার কোনো আশাই নেই এবং যখন এই দুই যুবকের স্ত্রীরা দৈনন্দিনতার সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে নতুন করে জীবন খুঁজতে শুরু করেছে, তখন তারা ফেরে।

দলের সব মানুষ ভিড় করে তাদের এই অজ্ঞাতবাসের বিবরণ শোনে। বস্তুত, তাদের পোশাক-আশাকে এবং হাবভাবেও কিছু নতুনত্ব ছিল। তারা শহরে ঢুকেছিল আকস্মিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

ত্রিশ-চল্লিশজন সাঁওতাল যুবকের সঙ্গে তারা মিছিল করে শহরে ঢুকেছিল। মিছিলের আগে ছিল আটজন বাহকের কাঁধে বাঁশে ঝোলানো একটি মৃত বাঘ। তার পিছনে দড়ির খাটিয়ায় আহত এক যুবক। এই যুবক খাটিয়াতে উপবিষ্ট ছিল। এবং চারজন বাহক তাকে বহন করছিল। যুবকের মাথায় পাগড়িতে রক্তের ছোপ, তার ডান দিকের গাল ক্ষত-বিক্ষত এবং ভীষণভাবে ফোলা, তবুও তার দৃষ্টি বীরত্বব্যঞ্জক। তার মাথার চুলের ভিতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে একটি তির গোঁজা ছিল। তাতে তার অবয়বে একটা সমীহ আদায় করার ভঙ্গি ছিল। স্বভাবতই বোঝা যায় এই যুবকই বাঘটির শিকারী। খাটিয়ার দুই পাশে ছিল জিল্লু ও পরতাপ। পরতাপের হাতে ছিল রক্তমাখা একখানা পরশু এবং তার দৃষ্টিও যথেষ্ট দাম্ভিক ছিল। পরিষ্কার বোঝা যায় এই বৃহৎ শিকারে সেও অংশীদার।

বাজারের চত্বরে পৌঁছে দলের বেশ কিছু যুবক তুমদা ও ধামসা বাজিয়ে একটি শিকার-নৃত্য শুরু করে। বাজিকরদের চমকিত করে জিলুও সেই নৃত্যে সমান তালে পা মেলায়। অন্যরা ব্যবসাদার, মহাজন ও সাহেবদের কুন্‌ঠিতে কুন্‌ঠিতে বীরত্বের স্বীকৃতি বাবদ পুরস্কার আদায় করতে থাকে।

সমস্ত চত্বরে উৎসবের আলোড়ন ওঠে। রেশমের কারবারী উড সাহেবের কুন্‌ঠির সামনে আহতদের নিয়ে আসা হয়। উড কিছু চিকিৎসা জানত এবং এ অঞ্চলে সাহেবদের নিজস্ব কোনো চিকিৎসক না থাকাতে উডের এ কাজটা অতিরিক্ত ছিল।

শিকারী যুবকের নাম ডুমকা সোরেন। ডুমকার ক্ষত খুবই গুরুতর ছিল। উড চিকিৎসা শেষ না হলে তাকে স্থানত্যাগ করতে না করে। বাজিকরের ছাউনিতে সসম্মানে তার থাকার ব্যবস্থা হয়। তার সঙ্গে থাকে তার বাপ লক্ষণ।

পীতেম এই অপরিচিতদের সান্নিধ্যে আনন্দ বোধ করে। প্রথমত, হারানো দুই যুবকের এমন আকস্মিক ফিরে আসা তাকে এবং দলকে যেমন উদ্বেল করেছিল, তেমনি এই নতুন সম্পর্ক তার ভেতরে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে।

জিল্লু ও পরতাপ এই অপরিচিতদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রৌঢ় লক্ষ্মণ সোরেন বলিষ্ঠ ব্যক্তি এবং খুব সম্রমপূর্ণ তার আকৃতি ও ব্যবহার। পীতেম তার ভিতরে এমন এক আত্মমর্যাদা দেখে যা দীর্ঘকাল বিরাট সামাজিক কর্তৃত্বে থাকলেই আয়ত্ত করা সম্ভব।

বিষয়টি ভিখ-মাঙ্গা বাজিকরের কাছে বিস্ময়ের বটে। কেননা, এই মানুষেরা যে দৈন্য ও অভাব নিয়ে থাকে তাতে আর্থিক দিক দিয়ে বাজিকর গোষ্ঠীর থেকে তাদের স্বতন্ত্র করা যায় না। কিন্তু এই সম্রম ও মর্যাদা বাজিকরের চিন্তারই বাইরে। মানুষটিকে পীতেম যথাযোগ্য মর্যাদা দেয় এবং অতিথিদের বিরাট দলকে সে একসন্ধ্যায় আতিথেয়তার জন্য আমন্ত্রণ করে। এই উৎসবে বাজিকরেরা পাঁচ-ছুটি বাহাই শুয়োর মারে। সন্ধ্যার পরে তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে পীতেম লক্ষ্মণ সোরেনের সঙ্গে একত্রে বসে মদ্যপান করে এবং সবিস্ময়ে লক্ষ করে দলের অন্যান্যরা তার সঙ্গে ব্যবহারে অতিরিক্ত সম্রম দেখাচ্ছে। তার ভেতরে অংকুরিত হতে থাকে এক অনাস্বাদিত আকাঙ্ক্ষার বীজ।

ভোজন এবং পান যথেষ্ট হওয়াতে দুই প্রৌঢ় অত্যন্ত আন্তরিক ও উষ্ণ হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে দু-খানা খাটিয়া তাঁবুর বাইরে নিমগাছের নিচে দু-জনে প্রভূত আয়াসে টেনে নিয়ে আসে এবং এই কাজে তারা দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধুর মতো ব্যবহার করে। যেমন, খাটিয়া দু-হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে লক্ষ্মণ পীতেমকে হাত দিয়ে আটকায়। বলে, তুমি রাখ সর্দার। নেশাটা তোমার বড় জবরই হয়েছে। আমি নিয়ে যাই।

পীতেমের মর্যাদায় লাগে। সে নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্কে যতটা সম্ভব দৃঢ়তা এনে বলে, তুমি, একদম কথা বলবে না, পারগানা। এটা আমার কাজ, আর তুমি আমার অতিথি। ব্যাস্‌।

এবং দুটি খাটিয়া একসঙ্গে নেওয়ার প্রয়াসে পীতেম বেটাল হয়। লক্ষ্মণ এগিয়ে এসে তাকে সোজা রাখে এবং বলে, বলেছি না নেশাটা তোমার জবর হয়েছে। চুপচাপ এগুলো আমার কাছে ছেড়ে দাও।

যেন তোমারই কিছু কম নেশা হয়েছে।

দেখই না।

ঠিক আছে।

তারপর লক্ষ্মণ খাটিয়া দুটি ওঠাতে যায় এবং পীতেমের মতোই টাল খেয়ে পড়ে।

পীতেম বলে, বহোতখুব। যেন সাঁওতাল সর্দারকে চিনতে আমার কিছু বাকি wagi

নাঃ, নেশাতে নিশ্চয়ই কিছু তুক করেছ তোমরা।

হে পারগানা, এর নাম বয়েস, বুঝলে! তুমি পারতে ওই বাঘটাকে মারতে?

আমার বেটা মেরেছে!

তুমি তো খুব নির্লজ্জ, পারগানা! আমার বেটার নাম করছ না!

আলবাত! তোমার বটো না থাকলে আমার বেটার জান বাঁচত? খুব বাহাদুর বেটা তোমার।

তবে?

তবে কি?

তবে এই খাটিয়ার এদিকটা আমি ধরি, আর ওদিকটা তুমি ধর। তারপরে দেখি দুই বুড়োতে নিমগাছের নিচে নিয়ে যেতে পারি কিনা।

চমৎকার। তাই চল।

দু-জনে খাটিয়া দু-টি ধরাধরি করে গাছের নিচে নিয়ে যায়। এবং যেন খুব পরিশ্রান্ত এমন ভঙ্গিতে দুজনে মুখোমুখি বসে। তারপর দু-জনেই প্রায় একসঙ্গে শুয়ে পড়ে নিশ্ৰুপে আকাশ দেখে।

জ্যৈষ্ঠের পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারা, ছায়াপথ, প্রাচীন পরিত্যক্ত পথের স্মৃতি। দুই দলের যুবকেরা দূরে উল্লাস ও নাচগান করছে। যুবতীরাও আছে তাদের সঙ্গে। ধামসা, তুমদা, ঢোল, বাঁশি এবং একটি নামগোত্রহীন তার যন্ত্রে বিচিত্র সুর উঠেছে।

না, বাজিকরের সঙ্গে গেরস্থ মানুষের বন্ধুত্ব হয় না, এটা ঠিক। আমরা তো পথের মানুষ। মিলমিশ যতটুকু হয়, সে শুধু উপরে উপরে।

লক্ষ্মণ গভীর শ্বাস ফেলে বলে, দিনকাল খুব খারাপ। না হলে, তোমাকে বলতাম আমাদের গ্রামে গিয়ে থাকতে। এখন আর একথা বলতে সাহস য় না। অথচ, পাঁচ বছর আগেও কত মানুষকে বসত করিয়েছি। জঙ্গল কেটে, পাথর চটিয়ে, চাষের জমি পত্তন করে দিয়েছি। এখন আর সে দিন নেই। সব জমির মাসিক তৈরি হয়ে গেছে। জঙ্গল কেটে জমি যেই খালাস হল তখনই মালিক এসে হাজির হবে। দেও, তখন তাকে ভাগ দেও। আর সে ভাগ ক্রমশ সর্বস্ব হয়ে যায়।

পারগানা, সেজন্যই বাজিকর জমিতে বসত করতে চায় না। জমিতে বড় দুঃখ।

লক্ষ্মণ ঝট করে উঠে বসে। হাত দুটোকে কোলের মধ্যে সশব্দে আছড়ে ফেলে বলে, তোমার মাথা। জমিতেই স্থিতি, জমিতেই স্থায়িত্ব, জমিতেই সুখ। জমি না থাকলে জীবনের শেনো অর্থই হয় না। তুমি জান জমিতে যখন ফসল ধরে তখন মানুষের মনের ভাব কেমন লাগে?

পীতেম তেমনি আকাশের দিকে তাকিয়ে। সংক্ষেপে বলে, না, জানি না।

তোমার বউয়ের পেটে যখন বেটাবেটিরা এসেঁছে তখন তোমার মনের ভাব নিশ্চয়ই মনে আছে?

আছে।

তবেই বোঝ।

লক্ষ্মণ আবার শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়েই সে বলে, তুমি মানুষটাকে আমার বড় ভালো লেগেছে। তোমাদের কি জাত, সরদার?

আমরা বাজিকর জাত।

বাজিকর কোনো জাত নয়।

হিন্দু-মুসলমান সমাজ আমাদের ডোম-চণ্ডালের জাত হিসাবে ধরে।

তামরা ডোম জাত আর তোমাদের জমির আকাঙ্ক্ষা নেই?

না।

হতেই পারে না।

আকাঙ্ক্ষা থাকলেই বা দেয় কে জমি?

আমি আবার কে দেবে? জমি নিজেকে হাসিল করে নিতে হবে।

এই না বললে দিনকাল বড় খারাপ?

তা তো খারাপই। তা বলে মানুষ থাকবে তার জমি থাকবে না! পুরুষমানুষের যেমন একজন মেয়েমানুষ চাইই, তেমনি সব মানুষেরই জমিও চাই।

তারপর তোমাদের মতো মালিকের বাঁধা গোলাম হই আর কি! ওর মধ্যে বাজিকর যায় না।

তা যাবে কেন? খালি লোক ঠকিয়ে খাবে!

লক্ষ্মণের উম্মায় পীতেম হাসে। বলে, ঠিক করে বল তো পারগানা, জমি থেকে যে ফসল তোল কজন তা থেকে খাবলা মারে?

ওঃ, তার কি হিসাব আছে। যেমন ধর, জোতদার, গাঁতিদার, পত্তনিদার, ঘাটোয়াল, জমিদার, সাহেব, পুলিশ, দারোগা, ব্রাহ্মণ, আড়তদার, গোলাদার, মহাজন–

থাক্ থাক্‌, ওরে ব্বাপ—

আরো আছে, শুনবে?

না, আর দরকার নেই। তবুও তুমি বলবে জমিতেই স্থিতি, জমিতেই সুখ? ও তুমি বুঝবে না। তবুও তোমাকে বলে রাখি, যদি কখনো মন কর থিতু হবে, গেরস্থ হবে, পারগানা লক্ষ্মণ সোরেনের নাম মনে রেখো। এখান থেকে বিশ ক্রোশ দক্ষিণে, গ্রামের নাম বহেরা, থানার নাম দিঘি।

পীতেম জানবে না আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের এই নক্ষত্রখচিত রাতে খোলা আকাশের নিচে লক্ষ্মণ সোরেন যে বীজ তার অভ্যন্তরে প্রোথিত করল, তার অধস্তন তৃতীয় এবং চতুর্থ পুরুষে সে পল্লবিত হয়ে অনেক সমস্যা, আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখের জন্ম দেবে।

সে অভিভূত বোধ করে এবং বলে, মনে রাখব, ভাই।

ভাই? তুমি আমাকে ভাই বললে?

ভাই বললাম।

বাজিকর ছাউনির দু-টি বিশেষ তাঁবুতে আজকের রাতটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সে দু-টি বিশেষ তবু জিল্লু ও পরতাপের। বাঘের থাবার ঘায়ে পরতাপ কিছু আহত ছিল, কিন্তু সে কারণে তার বউ তাকে খাতির করে না। সারাদিনে নানা কথা হয়েছে কিন্তু কোনো একান্ত কথার অবকাশ হয়নি। আর এখন যখন অবকাশ হল তখন কথার কোনো প্রয়োজনই নেই যেন।

শেষরাতে ঘুম ভাঙলে পরতাপ বউয়ের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সন্তর্পণে মুক্ত করে বাইরে আসে এবং ডুমকা সেরেনের তাঁবুতে আসে। উড় সাহেবের ওষুধে ডুমকা আজ তিন রাত্তির পর ঘুমায়। তার পাহারাদার ছেলেটিও ঘুমে অচৈতন্য।

সেখান থেকে পরতাপ বেরিয়ে আসে এবং তখনই আবছা অন্ধকারের মধ্যে পেমাকে গঙ্গার দিক থেকে সে সন্তর্পণে ফিরে আসতে দেখে। তার কিছু সংশয় ও সন্দেহ হয়। কিন্তু এতদিন অনুপস্থিতির ফলে কিছুটা দূরত্ব ও সংকোচ সে বোধ করে। ফলে চট করে পেমাকে কিছু বলতেও পারে না, আবার তাকে দেখাও দেয় না।

ছাউনিতে ফিরে এসে পরতাপ তার বউকে জাগ্রত দেখে।

বউ বলে, এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

পরতাপ বলে, রাত কোথায়? গিয়েছিলাম ডুমকাকে দেখতে।

সে আবার বউয়ের পাশে শুয়ে পড়ে এবং সামান্য সময় পরে বলে, প্রেমাকে দেখলাম গঙ্গার দিক থেকে আসতে।

প্রেমার সঙ্গে আনন্দর সম্পর্ক গভীর হয়েছে। বিষয়টা আর গোপন নেই। যেহেত এটা বাজিকর ছাউনির ঘটনা তাই যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা সবাইকেই কেন্দ্র করে। দলকে ও পীতেমকে যে এ নিয়ে ভাবতে হবে, একথা সবাই জানে, জানে পেমাও। গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার সুবিধা এবং অসুবিধা এই। পেমা যখন সালমার কাছে ভাগ্য গণনা করতে গিয়েছিল, সালমা তখন বুঝতে চেষ্টা করে যে সে কতখানি বাজি ধরেছে। পেমা যে অচিরে তলিয়ে যাবে, এ সম্পর্কে তার সংশয় থাকে না। সে গম্ভীর হয়ে বলেছিল, তুই তো সর্বনাশ করে বসে আছিস।

সর্বনাশ কেন? আমার মনে লাগলে সে মানুষের কাছে যেতে পারব না কেন?

তা বলে দলের বাইরের মানুষ? সে তোকে কি দেবে?

কি দেবে? কিছু কি চাই আছি? আমি কি বেশ্যা?

তুই বেশ্যা না হলেও বাইরের মানুষ বাদিয়ার বেটিকে বেশ্যা হিসাবেই চায়।

চাক না। বেশ্যা কেন, আমাকে যদি সে একটা মাদি ঘোড়ার মতো চায়, তবে আমি তাই হব।

সালমা খুব আশ্চর্য হয়। এই মেয়েটা, সেদিনের মেয়েটা কবে এমন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হল? তারপরে ভাবে এক পুরনো আক্ষেপ। বাজিকর কখনো জাত যাযাবর নয়। জাত যাযাবর হল বানজারা। বাজিকরের ঘর-গেরস্থালির সঙ্গে সম্পর্ক করার একটা প্রবণতা সবসময়েই থাকে। এসবই রক্তের দোষ।

তারপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে সালমা জিজ্ঞেস করে, মানুষটা কে?

বলব না।

তবে আমার কাছে এসেছিস কেন?

আমার কি হবে?

সে তো তুইই বলে দিলি। তুই ঘোড়ি হবি।

পেমা রাগ করে উঠে যায়। লোকটা কে জানতে সালমা বা অন্য কারো দেরি হয়নি। দারোগা ভয়ানক ক্ষমতাশালী মানুষ। কাজেই পীতেমের কানে কথাটা ওঠার পরও সে অনেক চিন্তা করেও স্থির করতে পারে না কি করে এ সমস্যার সমাধান করবে। সমস্যাটা অন্য সবার মগজেও ঘুরপাক খায়। কিন্তু এই দু-তিন মাসের মধ্যে নানা ব্যস্ততায়, তাছাড়া দলের দুই ব্যক্তির নিরুদ্দেশ হওয়ার দলের কেউই বিশেষ করে এ নিয়ে ভাববার অবকাশ পায়নি।

এখন পরতাপ পেমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে তার বউ একটু সমস্যায় পড়ে। জৈষ্ঠের শেষরাত্রির অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক ঠাণ্ডা বাতাস শরীরকে আরাম দিচ্ছে। তাছাড়া এতদিন পরে যে মানুষটা ফিরে এল তার কথা কিছুই শোনা হয়নি। কাজেই এই মুহূর্তে সে এ প্রসঙ্গ তুলতে চাইল না।

সে বলল, হবে হয়ত আড়ালে গিয়েছিল। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, তোমার কথা তো কিছুই শোনা হয়নি কাল। কি করে ছিলে এতদিন আমাকে ভুলে?

পরতাপ তাদের অজ্ঞাতবাসের কথা বলে, যার প্রথম পর্ব গতানুগতিক। মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পথেই ডাকাত তাদের ধরে। তারা লুণ্ঠিত ও আহত হয়। টাকাকড়ি ও ঘোড়া দু-টি দস্যুরা নিয়ে যায়। মাথায় আঘাত পেয়ে জিল্লু অচৈতন্য হয়ে পড়ে। পরতাপ হাঁসুয়ার কোপ হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে জখম হয় এবং দৌড়ে জঙ্গলে পালিয়ে বাঁচে।

পরদিন সকালে শিকার থেকে ফেরত একদল সাঁওতাল তাদের ওই অবস্থায় দেখে তুলে নিয়ে যায় নিজেদের গ্রামে।

সেই গ্রাম ডুমকাদের। পাহাড়ের উপত্যকায় সবুজ সেই গ্রামে মানুষ খুব প্রাণবন্তু, জীবন খুব বেগবান।

তাহলে সেখানে ভালোই ছিলে? আমাদের কথা যখন মনেই পড়েনি!

খারাপ ছিলাম কি করে বলি? সমস্ত ব্যাপারটাই নতুন তো।

সবই নতুন। পরতাপ ওজিল্লু সেখানে অনেক কিছু শিখেছে যার সঙ্গে বাজিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে তারা ধান কেটেছে, ধান মেরেছে। বলদ দিয়ে সর্ষেকলাইয়ের খেত চষেছে। দেখেছে কেমন করে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মাঠ সবুজ হয়ে যায় এবং তাতে শরীরের ভিতরে কেমন খুশি শিহরণ জাগে। সন্ধ্যার পরে তারা অন্য সবাইয়ের সঙ্গে উদ্দাম হয়ে নাচ গান করেছে, নেশা করেছে পচানি ও তালের রসের। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দল বেঁধে শিকার খেলা। শিকারের উত্তেজনার কাছে কোনো কিছুই লাগে না। এমনকি বাজিকরের জানোয়ার চুরি করাও নয়। ধাবমান জানোয়ারকে তীরবিদ্ধ করা, আক্রমণােদ্যত জন্তুকে সাহসের সঙ্গে ঘায়েল করা এক বিরাট অভিজ্ঞতা। এইসব কাজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে, বুঝতে পারে মানুষের জন্মের কারণ এবং জীবনের অর্থ।

আর কিছু? আর কিছু?

কি আর?

কোনো সঙ্গিনী জোটেনি? এদ্দিন থাকলে?

কেন? তুমি জুটিয়েছ নাকি এর মধ্যে?

জোটাইনি। তবে ভাবছিলাম।

কি ভাবছিলে?

ভাবছিলাম, জীবন কিভাবে কাটবে? ভাবছিলাম, কি নিয়ে থাকব?

তাহলে, আমি ছাড়াও চলে?

কি দেখলে এত ঘুরে এসে? আমি ছাড়াও তো তোমার চলেছে। কাছে থাকলে মানুষ একরকম থাকে, দূরে গেলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়, ভুলে যায়। তুমি দুনিয়া ঘুরে এসে একথা বুঝলে, আর আমি তো একা এখানে বসে সেই কথা শিখলাম।

খুব ভেবেছ এ কয়মাস, না?

ভেবেছি, খুবই ভেবেছি প্রথম প্রথম।

তারপরে?

তারপরে সব আবার পুরনো হয়ে যায়। তখন আবার নতুন করে ভাবনা শুরু হয়।

তুমি অনেক বদলে গেছ।

তুমিও কি সেই মানুষ আছ? তা যাকগে, তারপর তোমার কথা বল। শুধু ভাবতে অবাক লাগছে যে, এত দীর্ঘ দিন না তোমাদের আটকে রাখল, সে কোন জিনিস?

পরতাপ যা বলতে পারে না তার নাম জীবন। সমস্ত যাযাবরী চাঞ্চল্যেও একসময় ক্লান্তি আসে। একঘেয়ে লাগে। যাযাবর তখন নতুন রাস্তায় পা বাড়ায়। কিন্তু সব রাস্তাই প্রাচীন এবং প্রথম চমক কেটে গেলে যাযাবর বোঝে সেই একই জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে।

জিল্লু ও পরতাপ সেই একঘেয়েমি থেকে কিছুদিনের জন্য নিষ্কৃতি পেয়েছিল। সেজন্যই এই বিস্মরণ। আর যেখানে ছিল সেখানে জীবন অঢেল। মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদ্যতা অটুট। এমন চমৎকার একাত্মবোধ তারা সারা দুনিয়ার আর কোথাও দেখেনি।

 

০৭.

প্রায় এক মাস পরে দুমকা সম্পূর্ণ সুস্থ হলে লক্ষ্মণ তাকে নিয়ে নিজের গ্রামে চলে গেল। যাওয়ার সময় পীতেমকে বলল, যদি নেমন্তন্ন পাঠাই, যেতে হবে কিন্তু।

পীতেম বলে, কথাটার মানে বুঝলাম না। যদি নেমন্তন্ন পাঠাই’ মানে কি? ‘যদি কেন?

এই একমাসে তাদের সম্পর্ক এমনই গভীর হয়েছে। প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ পীতেম লক্ষ্মণকে দিয়েছে একখানা অদ্ভুত আকৃতির হাঁসুয়া, যার হাতলটা ছোট কিন্তু ধাতব অংশটা চওড়া ও ভারি। ধারালো অস্ত্রটার এক কোপে একটা পশুর মাথা নামিয়ে দেওয়া যায়।

লক্ষ্মণ বলেছিল, ‘যদি’র মানে এই যে দিনকাল খারাপ। তারপরে একমাসের উপরে ঘরছাড়া। ওদিকের কি অবস্থা, কে জানে? তবুও কথা রইল, ডাক দিলে সাড়া দিও।

পীতেম বলেছিল, দেব।

তারপর রাজমহল শহরের উৎসবের মাস শেষ হলে লক্ষ্মণ সেরেনের নেমন্তন্ন এসেছিল। লক্ষ্মণ তাদের শহরায়ু উৎসবে যোগ দেবার জন্য পীতেমকে সদলে নেমন্তন্ন করেছিল।

বাজিকরেরা ইতিমধ্যে নিজেদের কিছু শ্রীবৃদ্ধি করেছিল। শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন এই তিন মাসে চাষি গৃহস্থের বড় দুঃসময় কাটে। এই সময় তাদের সঞ্চিত সম্পদ সব ব্যয় করতে হয়। কৃষকদের সঞ্চিত সম্পদ হল তার গৃহপালিত পশু। প্রথমে তারা এইসব পশু বেচে খায়, তারপর মহাজনের কাছে হাত পাতে।

কাজেই পশুর দাম এসময় একেবারে পড়ে যায়। বাজিকরেরা এবার অনেক পশু কিনেছে। পীতেমের দলে এখন ঘোড়াই আছে বারোটা, মোষ, শুয়োর, ভেড়া ইত্যাদিও অনেক। গরু ও বকরি তারা রাখে না, কারণ এই জানোয়ারগুলো তেমন কষ্টসহিষ্ণু নয় এবং রাস্তাঘাটের জীবনে অভ্যস্তও নয়।

পীতেমের জানোয়ারগুলো এখন রাজমহলের পাহাড়ের বর্ষার পরের অফুরন্ত সবুজ ঘাসে চরে ও স্বাস্থ্যবান হয়। স্বাস্থ্যবান জানোয়ারের মালিকানায় বাজিকরেরা বরাবরই খুব গর্বিত।

লক্ষ্মণের কাছ থেকে আমন্ত্রণ আসাতে পীতেম মনে মনে আনন্দ ও গর্ব বোধ করে। বাজিকরকে কেউ কোনোদিন নেমন্তন্ন করে না। তার সঙ্গে কুটুম্বিতা করার কথা কেউ ভাবে না। লক্ষ্মণ সেই মর্যাদা দিয়েছে তাদের, এ কি কম কথা?

কার্তিকের শেষে পীতেম, সালমা, পরতাপ, জিল্লু ইত্যাদি দশজন বাজিকর দশটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বহেরা আসে।

রাস্তায় সাঁওতাল গ্রামগুলিতে ঢোকার মুখে তারা দেখল গাছের গায়ে গরুর চামড়া ও আড়াআড়ি একজোড়া বাঁশি টাঙানো। তারা দেখল মোড়ে মোড়ে পুঁতে রাখা ঝাণ্ডা, ঘণ্টা, ভাঙাকুলো।

গ্রামে ঢোকার আগেই বাধা পায় বাজিকরেরা। প্রথমত বিদেশি চেহারা, তার উপরে ঘোড়সওয়ার। পথ আটকায় সাঁওতাল মানুষ।

কে যায়?

আমরা বাজিকর।

কোথায় যাওয়া হবে?

যাব দিঘি থানার বহেরা গ্রামে।

সেখানে কি দরকার?

সেখানে পারগানা লক্ষ্মণ সোরেন আমাদের বন্ধু লোক, শহরায় নেমন্তন্ন আছে।

রাস্তা ছেড়ে দেয় মানুষ। পীর্তেমের দল অগ্রসর হয়। মাঠে মাঠে পাকা ধান এ শাটার অপেক্ষায়। বাসে তার সুঘ্রাণ। পাখপাখালি সারা মাঠে উল্লাস জুড়েছে। পরিচ্ছন্ন সাঁওতাল গ্রামগুলোতে শহরায়-এর উৎসব শুরু হয়ে গেছে। পাওমের ভারি ভালো লাগে।

সন্ধ্যা হয়ে গেলে কোনো গ্রামে তারা রাত্তিরের মতো আশ্রয় নেয়। গ্রামের সর্দারেরা পীতমের কথা জানে। হয়ত লক্ষ্মণের ব্যবস্থাই এই রকম।

কে যায়?

আমি পীতেম বাজিকর।

কোন পীতেম? পারগানা লক্ষ্মণ সেরেনের বন্ধু বটে?

তাই বটে।

বসো হে কুটুম। আজ রাতে এখানেই কুটুম কর, বিশ্রাম কর, খাও দাও, নাচ গান দেখো।

এরকম একটি নাচ-গানের আসরে পীতেমরা একটি অদ্ভুত গান শোনে। গানটি বড় বিষাদের। গানটিতে স্ত্রী তার স্বামীর উদ্দেশে বলছে।

বাবারা আর ভাইয়েরা শুয়োর বলি দিচ্ছে, সাদা মোরগ বলি দিচ্ছে, সব জামাইরা হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে, পানভোজনের আনন্দ উপভোগ করছে। হায়রে, হায়রে, একজন মানুষ শুধু ভকত দয়ারামকে পিঠের উপরে বয়ে বেড়াচ্ছে।

চকিতে বাজিকরদের সেই দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে, যখন দয়ারাম ভকত মোষ কিনতে এসেছিল। সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে, যার ঘাড়ে পা রেখে দয়ারাম ঘোড়র উপরে আড় হয়ে বসে।

বহেরা গ্রামে বাজিকরেরা পৌঁছালে, লক্ষ্মণ সোরেন সপরিবারে পীতেমের দলকে প্রত্যুদগমন করে। এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা বাজিকরেরা কোনদিন পায়নি। সমস্ত ঘরবাড়ি নিপুণ করে নিকোনো, ঝকঝকে পরিষ্কার উঠোন। প্রবীণরা এসে সম্মান জানায় পীতেম, সালমা ইত্যাদি প্রবীণদের। পরতাপ এবং জিল্লু পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কলরব করে।

সন্ধ্যার পর লক্ষ্মণ সোরেন, তার স্ত্রী পীথা মুর্মু এবং অন্যান্য প্রবীণদের সঙ্গে পীতেম সালমা বসে শহরায় উৎসবের কথা শোনে। নিয়মমতো, কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে শহরায় পূজা হয়। কিন্তু এখন আর সব নিয়ম ঠিকমতো মানা যাচ্ছে না। সাঁওতালরা মহাজন, মালিকের শোষণে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ফলে ধান ওঠার আগে উৎসবের কথা কেউ ভাবতে পারে না। এখন তাই অঘ্রান মাসেই উৎসব হয়। উপায় কি? শহরায়ে যে ঠাকুর-ঠাকুরানের পূজা হয় তাঁরা শস্য ও পালিত পশুর শ্রীবৃদ্ধি করেন, নিরাপদে রাখেন। গোয়ালঘরে মারাংবুরু এবং ঠাকরানের পূজা হয়-আতপ চাল, মেথির গুঁড়া, তেল-সিঁদুর দিয়ে গোলাকার “খড়” সাজানো হয়। বলি দেওয়া হয় মোষ, শূকর, মোরগা। মোষ বলির চিন্তা এখন আর কেউ করে না, তবে শুয়োর ও কাটোল মুরগি বলি হয়। মানুষ প্রচুর নেশা করে। নাচ-গান চলে কয়েক দিন ধরে।

এবার যেসব নতুন গান বাঁধা হয়েছে, তার অধিকাংশই মানুষের দুঃখকে নিয়ে। একটি গানে বলেছে—

রাজমহল পাহাড়ে,
গাড়ি চলে লহরে,
চার হালের মোষ বেচে
হায়রে, হায়রে,
মরদ গেল শহরে।
হায়রে, হায়রে,–
গোমানীর জল গেল শুকিয়ে।

অথবা,

পারগানার কাছে নালিশ জানালাম,
পারগানা চুপ করে থাকে।
আমার বিচার করে দারোগা,
আমার বিচার করে মহাজন,
আমার বিচার করে
ঘোষা নালার ঘাটোয়াল।
পারগানা চুপ করে থাকে।

অথবা,

পারগানার কাছে আর্জি জানালাম,
হায়রে, হায়রে, মিছাপুর মেলায়,
কেনারাম দারোগা পেয়াদার জন্য
হায়রে, হায়রে! মিছাপুর মেলায়!
নির্দয় দারোগা, ধূর্ত পেয়াদা,
মনে প্রাণে সুখ নেই,
দারোগা ঘোড়ার উপর টাপটাপ যায়—
কোমরে পেতলের বেল্ট,
উজ্জ্বল পোশাক
আমার সুখ নেই।

পারগানা লক্ষ্মণ সোরেন এসব গান শুনে বিষণ্ণ হয়ে যায়। পীতেম তার পাত্রে মদ ঢেলে দেয়। লক্ষ্মণ ম্লান হেসে পানপাত্ৰ-মুখে তোলে। এক ঢোক খেয়ে, তারপর বলে, আমি কি করব বল? আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমার কি করবার আছে।

কথাবার্তা হয় আঞ্চলিক বাংলায়, বাজিকরেরা যে ভাষাটা ভালোই আয়ত্ত করেছে। গানগুলোর অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছে জিল্লু, যে আগেকার ছ-মাসে এদের ভাষাটা মোটামুটি ভালোই শিখেছে। বাজিকর অন্যদের ভাষা চট করে ধরে নিতে পারে। কিছু কিছু গান আবার বাংলাতে হয়, কিছু বাংলা ও সাঁওতালি মিশ্র ভাষায় হয়।

পরতাপ ও জিন্ধু সাঁওতাল যুবক-যুবতীর নাচের তালে তালে চমৎকার পা মেলাতে শিখেছে। এতে উভয় পক্ষই প্রচুর কৌতুক বোধ করে। ডুমকার মা পীথা একসময় সালমাকেও টেনে নামায়। বাজিকরদের কিছু নিজস্ব নাচও আছে। সালমা মাথায় রুমাল বেঁধে দলের আরো পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে হাততালি ও গান সহকারে নাচে। পীতেম জিল্লুর কাছ থেকে ঢোলক টেনে নিয়ে বোল তোলে।

প্রচুর উচ্ছ্বাস ও কোলাহল হয়। প্রবীণেরা পুনরুজ্জীবিত বোধ করে। দিন কেটে যায় অত্যন্ত দ্রুত। উৎসব তারপর স্তিমিত হয়ে আসে।

নতুন উৎসব শুরু হয় তারপরে। সে উৎসব ফসল কাটার। মানুষের পরিশ্রম যেন পরিশ্রমই নয়। সারাদিন মাঠের পর মাঠ ধান কাটা ও সেগুলো ঘরে বসে আনা। অফুরন্ত উৎসাহ। পীতেম অবাক হয়ে দেখে, জিল্লু ও পরতাপ এ কাজেও বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এই নিতান্ত গেরস্থালি কাজটাতে তারা সমান উৎসাহ বোধ করছে।

তারপর বাজিকরেরা একদিন দেখতে পেল কাটা ধানের খেতের ভেতরের আল কেটে কেটে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি ঢুকছে সার বেঁধে। গাড়িগুলো এ গ্রাম সে গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে। বহেরাতে দশখানা গাড়ি এ গ্রাম সে গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে। বহেরাতে দশখানা গাড়ি এল এক দিনেই।

পীতেম একসময় লক্ষ্মণকে জিজ্ঞেস করে, এসব ফসল তোমাদের নয়?

আমাদেরই, আবার আমাদেরও নয়ও।

কেমন?

মানুষ সব বাঁধা হয়ে আছে ধারে দেয়। এখন সেসব উশুল হবে। দেখছ, মহাজনরা সব এসে হাজির হয়েছে?

এরা সব মহাজন?

হ্যাঁ। ঐ যে কুঁজো মতো লোকটাকে দেখছ, ও হল পতিত সাউ। দশ বছর আগে বর্ধমান না কোথা থেকে যেন আসে এখানে। হাটে তামাক পাতার দোকান নিয়ে বসত। পাঁচ টাকার মালও রাখতে পারত না, এমন দুঃস্থ ছিল। এখন লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক।

কি করে হল?

সাঁওতালের রক্ত নিঙড়ে হল। বেশিদিনের কথা নয় সর্দার, এইসব জমি, যতদূর তোমার চোখ যায়, এইসব জমি’ আমরা জঙ্গল কেটে পাথর চটিয়ে খালাস করেছি। তখন কোনো ভাগীদার ছিল না। তারপরে পাকুড়ের রাজারা বেশি খাজনা পাবার আশায় সব জমি পত্তনি দিয়ে দেয়। পত্তনি গ্রাম গ্রাম ঘুরে আওয়াজ তোলে, যে চাষা টাকায় সিকি খাজনা এখন বেশি না দেবে তার সঙ্গে আর নতুন করে বন্দোবস্ত হবে না। তারপরে জরিপের জন্য যে রশি ফেলে তার মাপ পরিমাণ তারাই বোঝে, কি তারাও বোঝে না। এইভাবে পত্তনিদার আবার দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, ইজারাদার, ছে-ইজারাদার নিয়োগ করে। সর্দার, চোখ বন্ধ করলে মানুষ নায়েব, গোমস্তা, তশিলদার, পাইক, চৌকিদার, দারোগা এসব চোখের সামনে দেখে। সবাই খালি হাত পেতে আছে। না দিলেই হুজ্জত। না দিলেই তোমার সর্বনাশ। অথচ আগে এমন ছিল না। আমার খাটনির ভাত আমিই খেতাম, আর কেউ নয়। এখন আমার খাটনির ভাত, আমি ছাড়া আর সবাই খায়!

পারগানা, তুমি এত বোঝ! আর রাজমহলের মানুষ বলে সাঁওতাল হল জংলি জাত, বোধভাষ্য নেই।

হাঁ, তারা এমন ভাবে বটে। পাঁচ শলি ধান মহাজনের কাছ থেকে সাঁওতাল ধার নিলে দেড় বছরে কত ফেরত দিতে হয় জান?

কত?

হিসাব করতে জান তুমি?

জানি।

তবে দুনা হিসাবে হিসাব কর।

দশ শলি।

হল না।

তবে?

দেড় বছরে—ধর, প্রথম সনে ধান দেওয়া গেল—হয় ফসল হয়নি বা অন্য কোনো কারণ। সুতরাং তার পরের বছর।

বিশ শলি?

হল না।

হিসাবে তো তাই হচ্ছে।

সর্দার হিসাবটা কার, সেটা দেখতে হবে।

কার হিসাব?

হিসাব পতিত সাউয়ের, হিসাব দয়ারাম ভকতের, হিসাব গোরাচাঁদ সেনের।

হিসাব তো একই হয়, হিসাব আবার আলাদা হয় নাকি?

হয় না? পতিত সাউয়ের হিসাবে এই বিশ শলি ধান তুমি আলাদা নিয়ে ওজন কর,!! 1. চল্লিশ শলি হবে। আবার অন্য দু-জনার ওজন করা ধান নিয়ে আলাদা ওজন কর, যা বলবে তার দেড় তো হবেই।

মানুষ দেয়।

সাঁওতাল দেয়।

বুঝে দেয়, না, না, না বুঝে দেয়?

বুঝেও দেয়, না বুঝেও দেয়।

কেন দেয়?

হায়রে সর্দার! আশপাশের দশটা গ্রামের পারগানা আমি। নিয়ম করে দিয়েছি, ধান উঠলে পরে শহরায় উৎসব হবে, কার্তিক মাসের অমাবস্যায় হবে না। কারণ কি?

কি?

পাঁচ টাকা বেনিয়ার কাছ থেকে কর্জ নিয়ে সারা জীবন বেগার দিয়েছে আমার এলাকার মঙ্গল মুর্মু, সেই দেনা এখনো শোধ হয়নি। দয়ারাম ভকতের ঘরে তার বেটা সুফল এখনো বাঁধা চাকর হয়ে আছে। সাঁওতাল কর্জ নিলে তা আর বংশসুদ্ধ মরে হেজে না গেলে, শোধ হয় না।

এসব কথাবার্তা হচ্ছিল লক্ষ্মণের বাড়ির উঠোনে বসে। তিন পাশে ধানের মরাই উঠেছে উঁচু হয়ে লক্ষ্মণের ছেলেরা এবং অন্য কয়েকজন পাটার উপর ধান মাড়াই করছে। একপাশে পীথা ও অন্য কয়েকজন রমণী কুলো দিয়ে বাতাস কেটে মরা ধান পরিষ্কার করছে। লক্ষ্মণের বাড়ির মুরগি ও শুয়োরগুলো সুযোগ পেলেই ধানে মুখ দিচ্ছে। বহেরায় লক্ষ্মণই একমাত্র ব্যক্তি যার কোনো ঋণ নেই। পীতেম এইসব গেরস্থালি কাজকর্ম নজর করে দেখছে ও লক্ষ্মণের কথা শুনছে।

এমন সময় গ্রামের অন্যপ্রান্তে একটা হৈ-চৈ শোনা যায়। উত্তেজিত গলা মানুষের। সবার উপরে একটা তীক্ষ্ণ চেরা গলার তর্জনগর্জন। লক্ষ্মণ উত্তর্ণ হয়ে শুনল। গণ্ডগোল ক্রমাগত বেড়ে চলায় তাকে উঠতে হল। পীতেমও তার সঙ্গে

একটা অপ্রশস্ত উঠোনে ধান মাপা হচ্ছে। গণ্ডগোল সেখানে। চেতন মাঝির বাড়ি সেটি। এখন উত্তেজনা অপেক্ষাকৃত শান্ত। কিন্তু লক্ষ্মণের সঙ্গে পীতেম সেখানে উপস্থিত হয়েই বোঝে, একটা চাপা ত্রস্ত ভাব স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে। একপাশে একটা খাটিয়ায় জিল্লু শুয়ে আছে, তার মাথায় ও গালে রক্ত। কয়েকজন সাঁওতাল যুবক তাকে নানাভাবে শুশ্রুষা করবার চেষ্টা করছে।

জিল্লুকে ঐ অবস্থায় দেখে পীতেম ও লক্ষ্মণ দুজনেই তার কাছে দৌড়ে আসে।

কি করে হল এসব?

পীতেম সমস্ত উঠানটা খুঁটিয়ে দেখে একপাশে আড়াআড়ি জোড়া বাঁশে ঝোলানো দাঁড়িপাল্লা। ওজন করার সিঁদুরের দাগ দেওয়া পাথর। লক্ষ্মণের পরিচিতি মতো পতিত সাউ দু-হাতে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ানো। তার সামনে ছ-জন লাঠিধারা। একজন বৃদ্ধ, সম্ভবত চেতন মাঝি, উবু হয়ে বসে। তার দুই হাঁটুর ভিতরে মাথা, দুইকানের উপর হাত।

পীতেমকে দেখে পতিত সাউ হুংকার দিয়ে ওঠে, পারগানা, এ ছোকরা কে?

লক্ষ্মণ সে কথার উত্তর দেয় না? জিল্লুর পাশে বসা ডুমকাকে সে জিজ্ঞেস করে, কি করে হল, এসব?

জিল্লু ওজনের কারচুপি ধরেছিল।

পতিত তার কথার উত্তর না পাওয়াতে সম্ভবত অপমান বোধ করে। সে এগিয়ে এসে বলে, আমি জানতে চাই এ ছোকরা কে, আর কেন আমার কাজে বাধা দেয়?

লক্ষ্মণ শান্ত অথচ গম্ভীরস্বরে বলে, এরা আমার অতিথি। তোমার নোক এদের গায়ে হাত দিয়ে ঠিক করেনি।

আরে যা যা, শালা জংলি সাঁওতাল। তোর কাছে জিজ্ঞেস করে তবে আমি কাজ করব?

জবাব সামলে রাখ, বাবু। গতবার তোমাকে বলেছিলাম সরকারি বাটখারা নিয়ে এসে ধান ওজন করবে, অথচ এবারও তুমি এই পাথরগুলো নিয়ে এসেছ।

এই পাথরগুলো আমার লক্ষ্মী, এ পাথর দিয়েই আমি ওজন করব। যার পোষাবে সে আমার সঙ্গে কারবার করবে, যার পোষাবে না, করবে না। এই, তোল, তোল ধান তোল—

থামো, কথা আমার শেষ হয়নি। এ পাথর তোমার লক্ষ্মী, আমরা জানি, কিন্তু ও পাথর সাঁওতালের দুশমন। আমার ঘরে পাঁচসেরি সরকারি বাটখারা আছে। এবার তোমাকে সেই বাটখারা দিয়ে ধান মেপে নিতে হবে। কি, রাজি?

পতিত সাউয়ের কণ্ঠস্বর নিমেষে চাপা তর্জনে নেমে আসে। সে কেটে কেটে বলে, লক্ষ্মণ সোরেন, এবার তোর মরণের পাখা গজিয়েছে। নিজের ভালো চাস তো আমার কাজে বাধা দিতে আসিস না।

এই শেষ কথার পর ডুমকা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। লক্ষ্মণ হাত তুলে তাকে নিষেধ করে। লক্ষ্মণ পতিত সাউয়ের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। পতিত হঠাৎ যেন নিজের দুর্বলতা দেখে লজ্জা পায় এবং ওজনদারকে ধমক দিয়ে ওঠে, এই শালা, ধান তোল, ধান তোল।

খবরদার!

লক্ষ্মণ এবার প্রচণ্ড ধমকে সমস্ত চাঞ্চল্য স্তব্ধ করে দেয়। তার পিছনে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। পতিত সাউ যেন উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসও শুনতে পায়।

সে বলে, আচ্ছা, আমিও দেখব। এই চল সব।

দলবল নিয়ে সে ক্রুদ্ধ পশুর মতো ফিরে যায়। লক্ষ্মণ তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর একজন বয়স্ক মাঝিকে বলে, হাড়মা, সব মহাজনকে জানিয়ে দে এবার সরকারি বাটখারায় ধান মেপে নিতে হবে। আমার বাড়িতে লোহার বাটখারা আছে। তাতে রাজি না হলে, তারা এবার ধান নিতে পারবে না।

 

জিল্লুর আঘাত গুরুতর নয়। কানের পাশে একটা জায়গা লাঠির ঘায়ে থেঁতলে গেছে খানিকটা। ফেরার পথে পীতেমকে লক্ষ্মণ বলে, সর্দার, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার।

পীতেম বলে, ক্ষমা বরং আমিই চাইব, পারগানা। আমার লোকই তো এসব ঝামেলা বাধালো।

না, তা নয়, তা নয়। এ ঝামেলা বাধতই। কতদিন মানুষ সহ্য করে? তোমাদের ছেলে উপলক্ষ মাত্র। হয়ত, এ ভালোই হল। একটা মুখ দরকার ছিল বাঁধা ভাঙার। জিল্লু সেই মুখটা খুলে দিয়েছে। তবুও তোমার অপমান হল, এই আমার লজ্জা।

এ ঘটনার পর লক্ষ্মণ অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে গেল। পীতেম লক্ষ করল, কয়েকজন যুবককে কি কি নির্দেশ দিয়ে সে বিভিন্ন গ্রামে খবর দিতে পাঠালো। একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতা।

তৃতীয় দিনে পীতেম বলল, আমরা এবার ফিরে যাব, পারগানা, অনুমতি কর।

লক্ষ্মণ বলে, বুদ্ধিমান লোক তুমি, তাই আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছ, নয়?

কেমন?

ঢাকাঢাকির কোনো ব্যাপার নেই সর্দার। তোমার এখন যাওয়াই আমি চাচ্ছিলাম। বড় মুখ করে ডেকে এনে বিপদে ফেললাম তোমাকে। তোমার এখন যাওয়াই ভালো। পতিত সাউ, গোরাচাঁদ এরা আমাকে ছেড়ে দেবে না। পুলিশদারোগা এদের জাতভাই। তারা আসবে।

হুজ্জতি হবে?

হবে।

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পীতেম বিদায় নেয়। কিন্তু গ্রাম আড়াল হতেই জিল্লুকে সে শাসন করে। কি দরকার ছিল তোর পারের বেপারে নাক গলানোর!

জিল্লু অবাক হয়, বাঃ, বোকা গেয়ে লোকগুলোকে ঠকাচ্ছে, দশ সেরকে পাঁচ সের বানাচ্ছে, কিছু বলব না।

না, বলবি না। আমরা হলাম বাজিকর। গেরস্থের হাল-হকিকতের আমরা কি বুঝি! আমাদের তো রাস্তাতেই থাকতে হবে।

 

০৮.

রাজমহলে ফিরে এসে পীতেম সংবাদ পায় পেমা পালিয়ে গেছে। ধন্দু জানায় পেমাকে আনন্দরাম শহরের মধ্যে একটা কোঠা বাড়িতে রেখেছে। বাইরের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ধন্দু জানেও না পেমা সেখানে স্বেচ্ছায় আছে, না, জবরদস্তি আছে। তবে দরজায় পাহারা আছে চব্বিশ ঘণ্টাই।

বেপরোয়া পরতাপ এ খবরে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়। সে প্রকাশ্যেই বলতে থাকে যে দু-জনকেই খুন করবে। পীতেম ধমক দিয়ে তাকে থামাতে পরতাপ বউয়ের উপরে গিয়ে তন্বি করে। তুইই আমাকে মিথ্যা বলেছিলি। সেদিন আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।

সালমা পীতেমকে বলে, তাদের বাজিকরদের হালচালই এইরকম। সব সময় গেরস্থ মানুষের পানে নোলা বাড়ানো স্বভাব। পেমার দোষ দিয়ে লাভ কি? এ তো জাতের দোষ! দেখে আসলি না, কেমন সুখের কপাল গেরস্থ মানুষের!

তারপর অবশ্য সালমাই পেমার সঙ্গে দেখা করে আসে। পাহারাদারকে কথায় ভোলাতে তার সময় লাগে না বেশি।

পেমার সামনে এসে প্রথমে কথা বলে না সালমা। পেমা বলেছিল, আনন্দ যদি চায় আমি ঘোড়ি হই, তো আমি ঘোড়ি হব। সালমা দেখতে চায় পেমার সে তেজ এখনো আছে কিনা দেখে আশ্চর্য হয় যে সে তেমনি আছে।

পেমা হেসে বলে, খুব অবাক হচ্ছ পিসি?

সালমা তুচ্ছার্থক ধ্বনি করে। বলে, অবাক হব কেন? বাজিকরের জাতটাই তো এমন, যে-কোনো ছুতোয় বাঁধা পড়তে চায়। কি সুখে আছিস এখানে?

কেন? দুঃখ কিসের আমার? চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দু-জন মানুষ আমার সেবা করে। এই দেখ শাড়ি, এই দেখ কত গয়না।

আনন্দ পয়সা পায় কোথা এত?

জমিজমা আছে, মহাজনি কারবার আছে। দারোগা তো সেসব দেখাশুনা করে না, আনন্দই দেখে।

তবে ভালোই আছিস?

হ্যাঁ।

দারোগা কিছু বলে না?

বলবে কি? তার তো নিজের তিনজন মেয়েমানুষ আছে।

সালমা পেমার সর্বাঙ্গে তাকিয়ে তার অধঃপতন দেখে। শেষে একটু আতঙ্কিত হয়। বলে, তোর পেটে বাচ্চা এসেছে, মনে হয়?

পেমা সংকোচ বোধ করে না। বেহায়ার মতো হাসে। বলে, হ্যাঁ, এসেছে তোত।

এখন দাম্ভিক পেমা। অথবা, এখনো দাম্ভিক পেমা। যা সালমা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, তা এখন পেমা দেখতে পাচ্ছে না। দেখিয়ে দিলেও দেখবে না হঠাৎ সালমার মায়া হয়, যা তার কদাচিৎ হয়। সে বলে, আনন্দ জানে?

না। আরে সেটাই তো মজা! হেসে গড়িয়ে পড়ে পেমা। যেন ভারি মজার ব্যাপার সে লুকিয়ে একা উপভোগ করছে।

জানলে তোকে রাখবে?

রাখবে না? আমাকে ছাড়া একদিন বাঁচবে না আনন্দ।

তোকে বলেছে?

বলবে কেন? আমি বুঝতে পারি না?

আনন্দর ঘরে বউ আছে না?

থাকল, তাতে আমার কি?

সালমা বোঝে পেমার দম্ভ এখন যে স্তরে আছে, সেখানে আঘাত করলেও ফল হবে না। বস্তুত, বাজিকর মেয়েদের সতীত্বের তেমন বড়াই নেই। কেউ ভ্রষ্টা হলে, দল কিছু শাস্তি অবশ্যই বিধান করে, কিন্তু সে গেরস্থ সমাজের মতো নয়। কিন্তু যাযাবর রমণীরা বেশ্যা হতে কখনোই চায় না। সালমা সে কথাটাই বলে।

আনন্দ তোকে বেশ্যা বানিয়ে রেখেছে।

পিসি!

তবে কি সে তোকে ঘরের বউ করবে?

আনন্দ আমাকে ভালোবাসে।

ভালোবাসা? বাজিকরের বেটিকে গেরস্থ মানুষ ভালোবাসলে তাকে বাজিকর হতে হয়। আনন্দ তোকে রাখনি করেছে। নেশা কেটে গেলে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে।

কখনো নয়।

নির্বোধ এই অল্প বয়সের মেয়েটার জন্য সামলার করুণা হয়। শেষবারের মতো বলে, দল এখান থেকে চলে যাবে ঠিক করেছে, তুই কি করবি?

আমি যাব না, আমি যাব না!

বেশ।

সালমা চলে আসে এবং গীতেমের কাছে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। পীতেম দুঃখ পায়, কিন্তু এ অবস্থায় কি করণীয় তা স্থির করতে পারে না। সালমার কাছে বুদ্ধি চায় সে।

সালমা বলে, এখান থেকে উঠে চল।

পীতেম বলে, এত তাড়াতাড়ি? এখানে রোজগার ভালো হচ্ছিল।

তবে আর কি? থাক। এরপরে মানুষ মেয়েলোকের জন্য ছাউনিতে হামলে পড়বে। তখন কি করে সামলাবি?

এসব শুধু কথার কথা। বাজিকর ভাবে না। ছাউনিতে লোভী পুরুষ হামলে পড়লে ছুরি ঝলসে উঠতে পারে। আবার কোনো ব্যভিচারিণী নিজেই তার প্রেমাস্পদকে ছাউনিতে নিয়ে আসতে পারে। পুরুষেরা এসব দেখেও না দেখার ভান করতে পারে। দলের অন্য কেউ কিংবা বাপ মা-ও না দেখে থাকতে পারে কিন্তু ভাইরা প্রায়শ গণ্ডগোল করে। বিষয়টি বিচিত্র বটে।

কিন্তু পেমার উপাখ্যানে অভিনবত্ব আছে। দলছাড়া যাযাবর মেয়েপুরুষ নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় দেখে। দলত্যাগ করার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবে না। কিন্তু পেমা কি করে এর ব্যতিক্রম হল? পীতেম নিজের ভিতরেই এ প্রশ্নের উত্তর পেতে চায়। গভীর চিন্তা করেও সে কোনোরকম সুরাহা করতে পারে না এ সমস্যার। শেষে নিজেকে একসময় তার অত্যন্ত বৃদ্ধ ও অসমর্থ বোধ হয়। সে তখন সালমার কাছে আশ্রয় খোঁজে।

কিন্তু আশ্চর্য, এতেও সে পুরনো জায়গায় ফিরে আসে না। একসময় সালমা তার দেহের সান্নিধ্যে তাকে স্বস্তি ও উদ্যম দিতে পারত। এখন বয়স তার প্রয়োজনকে কমিয়ে দিয়েছে, কাজেই সে কিছুই ভুলে যেতে পারছে না। ফলে, সে চায় স্থিতি যার অন্য নাম অর্থোপার্জন।

 

০৯.

বাংলাদেশের বর্ষাকালের ভয়াবহতা সম্বন্ধে বাজিকরদের কোনো ধারণা ছিল না। যারা তাঁবুর নিচে থাকে, বর্ষা সব জায়গাতেই তাদের কাছে আতঙ্কের। গোরখপুরে মাটির ঘরে বর্ষার কয়েকটা মাস ছিল আপাত স্বস্তির। কিন্তু গোরখপুর থেকে চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে আর একটি অনুরূপ বন্দোবস্তের কথা বাজিকর ভাবছিল প্রথম থেকেই। তারা চেয়েছিল এমন একটি জায়গা যেখানে সারা বছর ঘুরে বেড়াবার পর বর্ষার সময়টা অন্তত এসে বিশ্রাম মিলতে পারে। রাজমহলে এসে পীতেমের আশা হয়েছিল এখানে সেরকম একটা বন্দোবস্ত হতে পারে। চারপাশের জমি এখনো খালাস হচ্ছে, নতুন নতুন মানুষ বসতি করছে। যারা বন্দোবস্ত নিচ্ছে তারা প্রায় সবাই চাষি। জমি বন্দোবস্ত নিয়ে তারা জঙ্গল কেটে, জমি সমতল করে চাষের খেত বানাচ্ছে। কিন্তু বাজিকর তো আবাদ করে না, তাকে কে জমি দেবে?

তবুও এমন লোকও পাওয়া যায়। ঈশ্বরপুরের জমিদারির কিছু খাস ছিল রাজমহল পাহাড়ের গায়ে। জঙ্গলাকীর্ণ জমি। জমিদারের নায়েব শ্যামলাল মিশ্র এইসব জমির পাট্টা বিলি করতে শুরু করল রাজমহলের কুন্‌ঠিতে বসে। একেবারে নগদ কারবার। টাকা ফেলে চাষিরা পাট্টা নিয়ে নিচ্ছে।

খোঁজ পেয়ে পীতেও গিয়েছিল। আগের দু-একবারের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এবারে কিছু তফাত ছিল। আগে দু-বার পীতেম এ ধরনের পাট্টা বিলিতে জমি নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। জমিদারের লোক জমি দিতে রাজি হয়নি। বাজিকর ঘুরে বেড়ানো জাত, তার কাছ থেকে খাজনা পাওয়ার কোনো স্থিরতা নেই।

কিন্তু শ্যামলাল মিশ্র এসব প্রশ্ন তুললই না। তার সম্পর্ক টাকার সঙ্গে কাছারিতে সারাদিন মানুষের আনাগোনা। পত্তনিদার, দালাল, মোসায়েব, গোমস্তা সবরকমের মানুষ জমিপ্রার্থী চাষির সঙ্গে চোটপাট করছে, পয়সা নিচ্ছে।

পয়সা খরচ করে পীতেম পাঁচ বিঘা জমির পত্তনি পেল। শীতেম এবার পেল, কেননা, ঈশ্বরপুরের জমি নিলামের ডাকের মতো ডাক উঠিয়ে তবে বন্দোবস্ত

তারপর পত্তনি জমির দখল দেওয়ার পালায় কাছারির গোমস্তারা তাদের কেরামতি দেখায়। এসব মাপজোখ ভালো ভালো চাষিরাই বোঝে না, বাজিকরের তা প্রশ্নই নেই। জমি মাপার রশির কোনো স্থিরতা নেই। আর থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি। কাজেই হামেশা ষোল-সতেরো কাঠায় বিঘার প্রমাণ হয়। দশ বিঘার পত্তনি রশির মাপে বারো বিঘা দাঁড়িয়ে যায়।

পরতাপের এসব কাজে উৎসাহ বেশি। বহেরা গ্রামের কয়েক মাসের জীবনে (সে কি পেয়েছে কে জানে! গোমস্তা সীমানা নির্ধারণ করে দিলে জমির চৌহদ্দিতে পাপ গর্ত করে পাথর বসায়। সেই পাথর ধারালো অস্ত্রে খোদাই করে চিহ্ন রাখে।

পীতেম কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। সালমা ঠাট্টা করলেও সে হাসে। বলে, বর্ষার সময় তাঁবুর নীচ দিয়ে যখন নদী বইবে, তখন বুঝবি।

বর্ষা আসার এখনো সাত-আট মাস দেরি। কাজেই পত্তনি জমিতে ধীরেসুস্থে তোলা যাবে। এরকম ভাবে পীতেম।

অন্যান্য বাজিকরদের মধ্যেও পরিবর্তনের ঢেউ আসে। পীতেম জানে না, গোপনে তার দলের অনেকেই ছোটখাটো মহাজনি কারবার শুরু করেছে। আশেপাশের গ্রামের গরিব মানুষ, বিশেষত সাঁওতাল চাষি গেরস্থ ছাউনিতে আসছিল, নানা ধরনের দাদন নিচ্ছিল। এক পীতেম যেদিন জানতে পারল সেদিন সে খুব হেসেছিল। বলেছিল, বা, বাহারে রহু! কি তোর কণ্ঠার হাড়ের কিসমৎ!—আসলে এভাবে সে জিনিসটা সমর্থনই করছিল। আর এইভাবে নিজের ভিতরে সে দ্বিতীয় আর একটি সত্তাকে ক্রমশ স্পষ্ট করে চিনছিল, যে মানুষটা সঞ্চয় চায়, স্থিতি চায়, মর্যাদা চায় এবং সালমার “চল বেরিয়ে পড়ি” কথাতে খুবই অবসন্ন বোধ করে।

বাজারের পাশের ময়দানে ধান ওঠার পরে কালীপুজো হয়। বিশাল কালীমূর্তি। আগে মূর্তি বানানো হয়, তারপর তার মণ্ডপ। সেই উপলক্ষ্যে মেলা।

তখন রাজমহল পাহাড়ের উপর শীত জাঁকিয়ে নামে। পীতেমও তখন তার সবের আয়োজন করে। মাঠের একটা দিক বেশ ভালো করে ঘিরে ফেলা হয়। সন্ধ্যার পর সেখানে অনেক আলো জ্বলে। বেশ খানিকটা দূরে দূরে বাঁশ পুঁতে মশাল জ্বালিয়ে একটা আলো-আঁধারির রহস্য তৈরি করা হয়। একপাশে মদের ভাঁটি বসে দু-দুটো। মিষ্টি ও ভাজার দোকান বসে। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় বাজিকর যুবক-যুবতীরা শারীরিক কসরৎ দেখায়। চারপাশের আলাদা আলাদা তাঁবুতে আলাদা আলাদা খেলা। কোনোটায় রহু চণ্ডালের হাড়ের কেরামতি—নিমেষে টাকা দ্বিগুণ হচ্ছে, পিতল সোনা হচ্ছে। কোনোটায় নিছক ভাতি—যদুদণ্ডের ছোঁয়ায় যুবতীর লম্বা বিনুনি মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠছে সোজা হয়ে, আবার কোথাও নিমেষে গাছ থেকে ফল, ফুল থেকে ফের গাছ তৈরি হচ্ছে। কোথাও বা বীভৎস নরকযন্ত্রণার মহড়া, যার বিষয়বস্তু বিশ্বাসহন্তার শাস্তি অথবা ব্যভিচারিণী স্ত্রীর কর্মফল। এইসব প্রযোজনায় একজন চতুর কথক থাকে, যে অতিদ্রুত দক্ষ বক্তৃতাবাজিকে তস্করবৃত্তি, বিশ্বাসভঙ্গ, স্বজনগমন ইত্যা অনাচার, লোভ, হিংসা যাবতীয় উত্তেজক ও নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে অনর্গল কথা বলে যায়, অভিনয় করে যা গ্রাম্য মানুষকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে।

সবচেয়ে উত্তেজক ও রোমহর্ষক খেলা বালি বাজিকরের তাঁবুতে (যে খেলার কথা দর্শকেরা বৃদ্ধবয়সে অধস্তন পুরুষের কাছেও গল্প করবে)। বালি একখানা চওড়া কাঠের পাটাতনের সামনে তার যুবতী বউকে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়। চারপাশে তার মশালের আলো জ্বলে। দশ হাত দূর থেকে বালি অত্যন্ত দ্রুতলায়ে একের পর এক ধারালো ছুরি নিক্ষেপ করে ঐ কাঠের উপর তার বউয়ের শরীরের চারপাশে। এক একখানা ছুরি ছুটে যায় আর দর্শক শিউরে চোখ বন্ধ করে, তারপর আবার চোখ খোলে, ততক্ষণে আরেকখানা ছুরি বিদ্ধ হয়েছে নির্দিষ্ট জায়গায়।

পীতেম তার এই বড় খেলায় মানুষ আকর্ষণ করে বিস্তর। শহর ও তার আশপাশের লোকেরা তো আসেই, আসে গঙ্গাঘাটের মহাজনি নৌকোর বাঙালি, মুঘল ও সাহেব ব্যবসাদারেরা, আসে কাছের ও দূরের গ্রামগঞ্জের মানুষ। সমস্ত মাঠে একটা মেলার মতো আয়োজন চলে দশদিন ধরে। পীতেমের পয়সা রোজগার হয় ভালোই। দলের অন্য সবাইও ভালো রোজগার করে। এমনকি সালমাও তার বাণিজ্য ভালোই চালায়।

এর মধ্যেই একদিন দয়ারাম আবার এসেছিল সালমার কাছে। সালমার ওষুধে যে একেবারেই ফল ফলেনি সেকথা জোর দিয়ে দয়ারাম বলতে পারে না। তবে কিনা আরো একটু দ্রুত ফল সে চায়।

সালমা মোহিনী হাসে। দয়ারাম প্রগল্‌ভ হয়। গলা কাঁপে তার। তারপর সে ফিসফিস করে করুণ আর্তি জানায়, ভান্‌মতি, একটা উপায় করে দেও। অনেক টাকা দেব তোমায়। সে হাত ধরে সালমার।

সালমা হাত ছাড়িয়ে নেয়। কপট দুশ্চিন্তায় বলে, ভকত, বড় কঠিন ব্যাপার। মানুষ ঠকিয়ে অনেক পয়সা করেছ, সময়মতো ভোগ-আহ্লাদে মন দেওনি, এখন মনে হচ্ছে ঠকে গেছ, নয়?

ভাতি, পয়সার তো অভাব নেই? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সব শেষ হয়ে যাবে, ভাবিনি।

কি করে এত পয়সা করলে, ভকত?

আঃহা, কি করে পয়সা করলাম না? এই জংলির দেশে পয়সা করতে হলে কিছু বুদ্ধি লাগে শুধু। আর কিছু নয়। করবে তুমি পয়সা? শিখিয়ে দেব?

হ্যাঁ, হা, দু-একটা কৌশল শেখাও তো!

দয়ারাম এই বিষয়ান্তরেও সমান উৎসাহ পায়। সারাজীবন ধরে পয়সা রোজগারই তার প্রধান নেশা। পয়সার আলোচনাও তার ভালো লাগে।

সে বলে, ভাতি, এই দেখ শ্যামলাল নায়েবকে কেমন জমিদার বানিয়ে দিলাম। কত পয়সা কামালো লোকটা অবশ্য আমাকেও সিকি ভাগ দিয়েছে, কারণ,

কি, বুদ্ধিটা তো আমার!

শ্যামলাল নায়েবকে কী বুদ্ধি দিলে?

কী বুদ্ধি দিলাম? দেখছ জমির কেমন টান এখন মানুষের? আর শ্যামলাল বহুদিন ধরে নায়েবি করছে, এখন এই শেষ বয়সে একটু আরাম করতে চায় নিজে জমিদার হয়ে। তা সেজন্যই আমার কাছে এসেছিল। পুরানো বন্ধু লোক আমার। রাজমহল পাহাড়ের তিন হাজার বিঘা জমির পাট্টা বিলি হল আর মন্দার পাহাড়ের নাবালেও, তা কম করে আরো পাঁচ-ছ হাজার বিঘা জমির পাট্টা বিলি হল। ভালো সরেস জমি সব। দাম যা পেয়েছে তাতে জঙ্গিপুরে দেখ গিয়ে কেমন জমিদারি কিনে বসেছে।

নায়েব জমি বিক্রির টাকা মেরে দিয়েছে? জমিদারকে দেয়নি?

আঃ হা হা হা! মজা তো ঐখানেই। তোমর বাদিয়া লোক, জমির ব্যাপারে কিছুই বোঝ না। আরে জমি বিক্রি নয়, শ্যামলাল শুধু পাট্টা বিক্রি করেছে। আর কার জমি কে পাট্টা বিলি করে দেখ।

দয়ারাম প্রচুর উপভোগেরহাসি হাসে। সালমার কান তীক্ষ্ণ হয়, চোখের দৃষ্টি খর হতে সে নিজেকে শাসন করে। এই পাট্টা বিলির সঙ্গে বাজিকরেরাও যে জড়িত, একথা, দয়ারাম নিশ্চয়ই জানে না। জানলে এত আবেগ নিয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তার কথা কখনোই বলত না, একথা সালমা বোঝে। সে মুখে কৌতুকের ভাণ করে। বলে, ব্যাপারটা একটু খোলস ছাড়িয়ে বল তো ভকত, যাতে বুঝতে পারি।

দয়ারাম আকর্ণ হাসে। বলে, দেখ ওই পাট্টা সব ভূয়া পাট্টা! ওতে জমিদারের দস্তখত নেই, নায়েবেরও নেই। শ্যামলাল চাকরি ছাড়ার পর ঈশ্বরপুরের জমিদার ব্যাপারটা জেনেছে। মন্দার পাহাড়ের জমি এর মধ্যেই লাঠিয়াল দিয়ে জমিদার আবার দখল নিয়েছে। রাজমহলেও দেখ না ক-দিনের মধ্যেই কেমন ধুন্দুমার লাগে।

পাট্টাতে দস্তখত নেই?

তবে আর বলছি কি?

সালমার মুখ নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। বলে, হাজার লোকের সঙ্গে এভাবে বেইমানি করলে?

পয়সা কি আর এমনিতে হয় সুন্দরী? পয়সা এমনি করেই হয়।

দয়ারাম আবেগে সালমার চিবুক নাড়িয়ে দেয়। সালমা ঝটকা দিয়ে হাতটা সরাতে গিয়ে নিজেকে সামলায়। চেষ্টা করে হাসে। তারপর বলে, সত্যি বাবা, তোমার বুদ্ধি বটে!

সবই আছে ভান্‌মতি, শুধু এক জায়গায়ই ঘাটতি। এখন শুধু তোমার করুণা।

সালমা উঠে গিয়ে ঝোলানো বাঁশের ভাড় নিয়ে আসে। ভাড় থেকে মদ ঢেলে দয়ারামের সামনে ধরে। বলে, খাও।

দয়ারাম বলে, খাব? বল কি? আমার যে কণ্ঠি।

আরে খাও, ভকত। কতদিন আর নিজেকে শুকিয়ে রাখবে?

সালমা নিজে গলায় পানীয় ঢালে। বিস্বাদ পানীয়, মুখ কুঁচকে ঢোক গেলে সে।

দয়ারাম বলে, তবে খাই?

সালমা ধমকের সুরে বলে, খাও।

দয়ারাম মদ পান করে। বলে, তোমার হাতেই সব ছেড়ে দিয়েছি, ভান্‌মতি। এখন তুমিই ভরসা।

খানিক সময় নিশ্ৰুপ যায়। দু-জনের রক্তেই আস্তে আস্তে নেশা লাগে। দয়ারামের মদের নেশা নেই। ফলে, অতিদ্রুত তার উত্তেজনা বাড়ে। প্রগম্ভ হাসিতে তার ঠোঁট বেঁকে যায়।

এ কি ওষুধ দিলে ভাতি, শরীর যে টানটান লাগে?

সালমা বলে, ও কিছু নয়, ভকত, ও শুধু আরকের নেশা। নেশা কেটে গেলে আবার পুরনো মানুষ হয়ে যাবে।

তাহলে নেশা কেটে দরকার নেই, ভাতি, দেও আমাকে আরো নেশা দেও।

সে আরো পান করে। দয়ারাম এরকম উত্তেজনা জীবনে ভোগ করেনি। সে এবার ফিসফিস করে বলে, ভান্‌মতি, একটু সুখ দেও আমাকে একটু সুখ।

সালমা বলে, ওখানে চুপ করে বস ভকত, আমার কথা শোন। তাকত যদি ফিরে পেতে চাও তাহলে একটাই উপায় আছে। কিন্তু সে কি তুমি পারবে?

পারব, পারব।

এসব বানজারা-বাজিকরের গুপ্তবিদ্যা, তোমাকেই শুধু শিখিয়ে দেব। মন দিয়ে শোন।

দয়ারাম উত্তেজিত মস্তিষ্কে যথাসম্ভব একাগ্র মনে সালমার নিদান শোনে না তেমন কিছু অসম্ভব মনে হয় না তার। এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার? খুব পারব খুব পারব, ভান্‌মতি।

সালমা কিছু শিকড়বাকড়ও দেয় তাকে। তারপর একজন লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

 

১০.

পাট্টা বন্দোবস্তের টাকা শ্যামলাল মিত্র ও দয়ারামই শুধু খায়নি, খেয়েছিল আরো অনেক। শ্যামলাল এবং পাট্টাপ্রাপ্ত প্রজাদের মধ্যে ইজারাদার, দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার ইত্যাদি মধ্যবর্তীরাও ছিল। এ ছাড়াও ছিল সেরেস্তার গোমস্তা, তশিলদার ইত্যাদি আমলারা। যেসব জমিতে কোনোরকম জলের আয় আছে সেখানে বুভুক্ষু চাষিরা যেমন করেই হোক কলাই কিংবা তৈলবীজের চাষ করেছে। সেসব ফসল এখন সবে লকলকিয়ে উঠেছে।

ঠিক এই সময়েই কোনোরকম সাবধান না জানিয়ে ঈশ্বরপুরের জমিদারের লাঠিয়ালেরা সেইসব চাষিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেননা, নিয়মটা এমনই। দখল কিংবা বেদখল করতে হলে আচমকা সন্ত্রাস ছড়াতে হয়। জমি নিয়ে যাদের কারবার তারা এসব জানে।

কাজেই প্রথম চোটেই যে দু-চারজনের লাশ পড়ে তারা জানতেই পারে না তাদের অপরাধটা কি। ভূয়া পাট্টাপ্রাপ্ত কৃষিজীবীরা খবর পেয়ে এরপর লাঠি বল্লম নিয়ে এসে কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সে অল্প কয়েকজন মাত্র এবং তারাও শুধুমাত্র তাদের সর্বস্ব যাওয়ার কথাই চিন্তা করেছিল, আর কিছু নয়। কাজেই তাদের প্রতিহত করা আক্রমণকারীদের বিশেষ অসুবিধার ছিল না, বরং এতে তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি হয়। ফলে এরপর আক্রমণ হয় আশেপাশের গ্রামে এবং লাঠিয়ালেরা মাইনের উপরে ফাউ হিসাবে কয়েকশো গরু-মোষ ধরে নিয়ে চলে যায়।

পীতেম ও অন্য বাজিকরেরা দুরের থেকে এসব ঘটনা শুধু লক্ষ করেছিল, কোনোকিছু করার চেষ্টা করেনি। তারা অবশ্যই আগে থেকে এসব জানত। সালমা-দয়ারাম সংলাপ কারো কাছেই অজ্ঞাত ছিল না। সালমা আর একবার শুধু পীতেমকে অন্তরটিপুনি দিয়েছিল গেরস্থ হওয়ার দুরাকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দিয়ে।

পীতেম ভয়ানক দমে যায় এই ঘটনায়। চাষিদের নালিশই কেউ শুনছে না, কাজেই বাজিকরকে আর কে পাত্তা দেয়। যাযাবরের নালিশ কেউ গ্রাহ্য করে না, একথা যাযাবরের থেকে আর বেশি কে জানে? সুতরাং পীতেম বিষয়টা একেবারে হজম করে ফেলে, এ নিয়ে আর দ্বিতীয় বার কথা তোলার অধিকার দেয় না কাউকে। এমনকি যখন মহী কর্মকার নামে একজন মানুষ গোপনে তার কাছ থেকে এ সম্পর্কে যখন বিস্তারিত জানতে চায় তখনো সহসা মুখ খোলে না পীতেম।

মহী তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল তারা কত টাকা দিয়ে কতটা জমির পত্তনি নিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, এই জমি পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে তারা রাজি আছে কিনা, কিংবা অন্যান্য কৃষকদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে কিনা।

পীতেম দেওয়ালের মতো মুখ করে বলেছিল, না। এ সম্পর্কে আর কোনো আলোচনাই করতে সে রাজি হয়নি। কর্মকার মানুষটা এক সাহেব ডাক্তারের চাকর ছিল এককালে। সেই খানিকটা লেখাপড়া, নতুন আইনকানুন সম্পর্কে সামান্য কাণ্ডজ্ঞান এবং সরকারি মহলে ক্ষীণ একটা যোগাযোগ ইত্যাদির ভিত্তিতে কিছু চেষ্টা চালাতে চাইছিল, যাতে এই পাহাড়প্রমাণ অবিচারের কিছু সুরাহা হয়। পীতেমের বাস্তব অবস্থা, সে নিজে হতাশ হলেও, বোঝে এবং বলে যায় যে, যদি সফল হয় বাজিকরদের ভুলবে না। একথা শুনেও পীতেমের মুখের কোনো ভাবান্তর হয়নি।

 

মহী কর্মকার শেষপর্যন্ত খুন হয়েছিল। কিন্তু তার আগে কালেক্টর হ্যাচ সাহেবকে এ ঘটনার প্রতিকারের ব্যাপারে সে খানিকটা সচেষ্ট করতে পেরেছিল।

প্রজাদের নালিশ শুনে কালেক্টর হ্যাচ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের করে জঙ্গিপুর থেকে শ্যামলাল মিশ্রকে গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদ আনে। তারপর মোকদ্দমা উঠল তার নামে। কিন্তু চতুর শ্যামলালকে বাগে আনা এত সহজ হল না। টাকা দিয়ে সে হ্যাচের সহকারীদের হাত করল। তার উপরে বড় কথা, ঈশ্বরপুরের জমিদারের রাজস্ব বাকি পড়েছিল পরপর দু’ সন। যদিও এর কারণ শ্যামলাল নিজে, কিন্তু সে প্রমাণ করতে পারল বকেয়া রাজস্ব জমিদারের খেয়ালখুশিতেই রাজসরকারে জমা হয়নি, সে নির্দোষ। হ্যাচের সহকারীরা গোপনে লাটসাহেবের কাছে। কালেক্টরের বিরুদ্ধে চিঠি দিল। হ্যাচের বিরুদ্ধে রাজস্ব আদায়ের গাফিলতির নালিশ ছিল। হ্যাচ কিন্তু খুব দমবার পাত্র ছিল না। মুর্শিদাবাদ থেকে শ্যামলালকে সে ভাগলপুর নিয়ে গিয়ে মামলা স্থানান্তর করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শ্যামলাল বেকসুর খালাস পেয়ে জঙ্গিপুরে জমিদারি করতে ফিরে গেল। এর পরে কয়েকদিনের মধ্যেই মহী কর্মকার খুন এবং তার বাড়িঘর লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়।

এসব নজির সালমা খুবই নির্মোহভাবে পীতেমকে দেখিয়েছিল। পতেম তবুও রাজমহল ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারছিল না। তার ভিতরে যেন জড়ত্ব এসে গিয়েছিল। আগে সে সালমাকে বলেছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই বর্ষা আসছে। তাঁবুর নিচে দিয়ে যখন নদী বইবে, তখন আমার কথা বুঝবি।

জলকে বড় ভয় যাযাবরের। তাই বর্ষা আসার আগে, পীতেম ভেবেছিল, পাহাড়ের ঢালে দুঃসময়ের স্থায়ী ঘর তুলতে পারবে। দল না হয় ঘুরলই সারা দুনিয়া, কিন্তু অসময়, বর্ষা এবং দলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য থাকলই না হয় একটুকরো আশ্রয়। এসব সালমা বোঝে না। অধিকন্তু পক্ষপাতদুষ্ট আরো সব ঘটনা ঘটতে থাকে যা পীতেমকে বেশি বেশি করে আহত করে। সালমার যুক্তির কাছে সে দাঁড়াতেই পারে না। আসলে, সালমা তো কোনো যুক্তি বিশেষ দেখায় না। শুধু ইঙ্গিত দেয় সে, শুধু ছোটোখাটো দু-একটা মন্তব্য করে। সে-ই বা কী করে, ঘটনা যে ঘটছেই।

যেমন লক্ষ্মণ সোরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বালির। শুনে পীতেম অধোবদন হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। বিস্তারিত বিবরণ জানতে চায় তার অনেক পরে। হায় রে হায়, ঐরকম মানী লোকের হাতে হাতকড়া, পায়ে শেকল! কেন, কেন রে বালি? কিবা তার দোষ?

বালি দেখেছিল শৃঙ্খলিত লক্ষ্মণকে আমগাছির হাটে। সে হাটে তো সাঁওতাল মানুষই বেশি? তবে? হ্যাঁ, হাট সেদিন থমথমা ছিল। কালো কালো মানুষগুলো বোবা হয়েছিল। মদের ঠেকে, তাড়ির গদিতে, মোরগ-লড়াইয়ের জুয়ায় জনপ্রাণী নেই। হাটের বিক্রিবাটাও যেন বন্ধই। একটা পিপুল গাছের নিচে দারোগা বিশ্রাম করছিল। দু-জন চৌকিদার দুটো ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছে। একপাশে ক্লান্ত অবসন্ন এবং শৃঙ্খলিত লক্ষ্মণ আধশোয়া। পাথরের মতো মানুষটার শরীর যেন ভেঙে পড়েছে। শিকলের ঘষায় পায়ে লাল দগদগে ঘা। মাছিও তাড়াতে পারছে

লক্ষণ। গাছটা থেকে বেশ খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে মানুষের ভিড়, যার মধ্যে অধিকাংশই সাঁওতাল। লক্ষ্মণ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল অথচ দৃষ্টি তার অনির্দিষ্ট। সিপাইরা মাঝেমাঝেই ভিড় দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল।

বালি ভিড়ের ভেতরে নিজেকে গুপ্ত রেখে এসব দেখছিল। হঠাৎ একজন যুবক ভিড় ঠেলে দৌড়ে লক্ষ্মণের কাছে যায় এবং তার হাঁটু দু’হাত দিয়ে ছোঁয়, হাঁটুতে মাথা রাখে। একজন সিপাই ঘাড় ধরে তাকে ছিটকে ফেলে এবং ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়, চড়চাপড় মারে। আর কেউ এগোয় না। হঠাৎ লক্ষ্মণ উঠে দাঁড়ায়, তার শিকলে আওয়াজ হয় ঠনঠন করে। তার বুক ঘন ঘন ওঠানামা করতে থাকে। সে আচমকা চিৎকার করে ওঠে, আমি দেখতে চাই এই দারোগার কত শিকল আছে! আমি দেখতে চাই এই দারোগা সমস্ত সাঁওতাল জাতকে শিকল দিয়ে বাঁধতে পারে কিনা!

দারোগা একটু সতর্ক হয়। সিপাইরা লাঠি তুলে ভিড়ের কাছাকাছি গিয়ে হম্বিতম্বি করে। মানুষ দূরে সরে যায়। তারপর দারোগা এবং সিপাই ঘোড়ায় ওঠে, অন্যরা লক্ষ্মণের কোমরের শিকল ধরে টেনে নিয়ে যায় শহরের পথে।

হাট তারপরে আর জমেনি। মানুষ ক্রমশ সরব হয়ে দলে দলে ফিরে যেতে থাকে। শুধুমাত্র লক্ষ্মণের হাঁটুস্পর্শকারী সেই যুবক গাছটার নিচে একাকী অনেকক্ষণ বসে থাকে।

ফাঁক বুঝে বালি একসময় তার কাছে যায় এবং পাশে বসে। যুবকটি প্রথমে চমকে ওঠে, তারপর বিরক্ত হয়।

কি চাই?

কিছু চাই না, ভাই। পারগানার বাড়িতে আমরা একবার কুটুম হয়েছিলাম। তাই ঘটনাটা একটু জানতে চাই।

ও, তোমরা সেই বাজিকর?

হ্যাঁ।

তাহলে আর কি জানতে চাচ্ছ? এসব ঘটনার গোড়ায় তো তোমরাই।

হ্যাঁ, বহেরায় থাকতে অঘ্রান মাসে একটা গণ্ডগোল হয়েছিল বটে, কিন্তু—

কিন্ত আবার কি? তোমরা ঝামেলা না করলে আজ–

না, ভাই, পারগানা কিন্তু এমন কথা বলেনি। মানুষ তোমাদের ঠকিয়ে খায়, তোমরা বাধা দেও না। আমরা বাধা দিয়েছিলাম, তাও তো মুখে।

তাই বা করতে গেলে কেন?

বালি ম্লান হাসে। বলে, আরে ভাই, অন্যায় আমাদের হয়েছে, মানছি। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে ওদের বাধতই। এক্ষেত্রে আমরা শুধু নিমিত্ত হয়েছি।

যুবকটি অন্যদিকে তাকিয়ে কি যেন চিন্তা করে খানিকক্ষণ। তারপর বলে, হয়ত ঠিকই বলেছ। পারগানাও এমন কথা বলত।

তারপর বালি তার কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ শোনে। পতিত সাউ মিথ্যাই শাসিয়ে আসেনি। বরং এই ঘটনায় তার লাভই হয়েছিল। কেননা লক্ষ্মণকে দাদন নিতে হতো না অন্যদের মতো। বহেরাতে পারগানা লক্ষ্মণই ছিল দাদনের ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম। থাকলেই সে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং লক্ষ্মণ পারগানা হিসাবে তা করতও। তাছাড়া বহেরার বাছাই জমি ক-খানাও ছিল লক্ষ্মণের পরিবারের বিভিন্ন জনের হাতে। এই জমির উপরেও পতিত সাউ এবং তার সহব্যবসায়ীদের লোভ ছিল। কাজেই এই সুযোগে সে হাতছাড়া করতে চাইল না। তারা ভালো করে জানে সাঁওতাল জাত বড় নিরীহ জাত। ফুর্তিতে থাকতেই তারা পছন্দ করে। মন ভারাক্রান্ত হয়, ঝামেলা হয়, কিংবা রক্তপাত হয় এমন কাজে তাই তারা মোটেই থাকে না। উত্তেজনা সঞ্চয় করে রাখে শিকার খেলার জন্য, নাচগান ও নেশার জন্য। এসব পতিত সাউরা ভালোমতোই জানত। কিন্তু এই পারগানা কিছুটা যেন অন্য ধাঁচের মানুষ। অনেক কিছুই বুঝত এবং যা বুঝত তাও তলিয়ে দেখতে চাইত। লক্ষ্মণ সোরেনই গ্রামের প্রথম ব্যক্তি যে ওজন ও পয়সার হিসাব বুঝতে শেখে। সুতরাং প্রতিপক্ষের কাছে সে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।

আর ঈশ্বরপ্রদত্ত সুযোগ বহন করে আনল এক বাজিকরের ছোকরা। পতিত সাউকে হিসাব বোঝাতে গেল! পতিত সাউ দারোগাকে কেন, দারোগা পতিত সাউকে কেনে। কি বা মোকদ্দমা, কে জানে রে ভাই? পারগানা জানতেই পারল না, অথচ তার ধান চাল গরু মোষ ক্রোক হয়ে গেল। হায়রে, হায়রে, কোন্ লোহারে বানাল এ শিকল? ঘোড়ার পিঠে সওয়ার দারোগা টাপ টাপ যায়।

এ কাহিনী শুনে পীতেম বিষাদগ্রস্ত হয়। আহারে এমন মানুষ, এমন মর্যাদাবান মানুষ। কোনো বাজিকর যা কোনোদিন পায়নি, লক্ষ্মণ পীতেমকে তাই দিয়েছিল। লক্ষ্মণ দিয়েছিল সম্রমপূর্ণ ব্যবহার। এমনকি সালমা পর্যন্ত চুপ করে থাকে। বহেরার সব মানুষ তাকেও জোহর করেছিল এক অপরিচিত অথচ সম্রান্ত ভঙ্গিতে।

আর সেই মানুষ! অনেকক্ষণ দু-জনে চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে দু-জনকেই ঢেকে দেয়। তখন সেই অন্ধকারের মধ্যে সালমা বলে, হাজার নাগ-নাগিনী আসছে মানুষকে গিলে খাবার জন্য! কি তাদের হিসহিস শব্দ! তাদের জিভ লক লক করে! তাদের চোখ থেকে আগুন বের হয়। পীতেম এ দেশ থেকে পালিয়ে চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *