১৩. আটটার মধ্যেই খাওয়াদাওয়া

আটটার মধ্যেই খাওয়াদাওয়া চুকে গেল। সরিৎশেখরই তাড়া দিচ্ছিলেন। আজ বিকেলে ইলেকট্রিক বিল এসেছে, দেখে মাথায় হাত। প্রথম ঝাঝ মিটিয়েছিলেন তিনি হেমলতার ওপরে। এত আলো জ্বাললে তিনি আর কী করে পেরে উঠবেন! হেমলতা তখন রান্নাঘরে বসে পায়েসের শেষ ব্যবস্থা করছিলেন, অনেক কষ্টে বাবার সঙ্গে তর্ক করার ঝোকটাকে সামলালেন। তর্ক মানেই ঝগড়া, অশান্তি। অন্যদিনে হলে ছেড়ে দিতেন না, কিন্তু কাল অনি কলকাতায় চলে যাবে, আজ তাঁর মন ভীষণ অশান্ত, কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না। সেই ছোট্টবেলা-ছোট্টবেলা জন্মাল তো ও তাঁরই হাতে। তারপর চোখের সামনে তিলতিল করে ওকে বড় হতে দেখলেন, এই দেখে যে কতটা কষ্টের এখন এই মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করছেন। নিজের সন্তান নেই, সন্তান-স্নেহ কথাটা লোকমুখে শোনা, কিন্তু হঠাৎ আজ সকাল থেকে তার মনে হচ্ছে তাঁর শরীরের একটা অংশ কাল বিযুক্ত হতে যাচ্ছে। বাবার চিৎকার শুনেও তিনি এখন কিছু বলতে পারলেন না, তার বদলে দুচোখ উপচে জল এসে গেল। অথচ অনি তাঁর ছেলে নয়, সেই কোকিল এসে যেন ডিম পেড়ে রেখে গেছে-তবু কেন যে ছাই এমন হয়। মৃতা ভ্রাতৃবধূকে মনেমনে ঠেসতে লাগলেন তিনি, বেঁচে থাকলে নাজ দেখতাম তুই কী কতিস! মরে গিয়ে সব দায় চাপিয়ে গেলি। বা হাতে চোখ মুছলেন তিনি। আজকাল যে কী হয় তার, মাঝে-মাঝে বড়মা, ছোটমা আর মাধুরীর মুখ এক হয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়। মৃতা এই তিন মহিলাকে বড় কাছাকাছি মনে হয়।

ভাড়াটে বসাবার পর থেকেই বাড়ির ট্যাক্স বেড়েছিল, কিছুদিন আগে আবার বেড়েছে। সরিৎশেখর, তার বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন, বেশ কয়েকবার তিনি মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে যোরাঘুরি করেছেন, কিন্তু সেই আবেদন শোনার সময় বাবুদের এখনও হয়নি। ফলে বাড়ির ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করেছেন তিনি। এদিকে জলের সাপ্লাই শহরে কমে গেছে, যেটুকু আসে তাতে চাপ নেই, ফলে অত সাধের ওয়াটার-ট্যাঙ্কটা শুকনো থাকে। পুচপুচ করে কয়েক দফায় যে-জ আসে তাতে মেহলতার কিছুই হয় আজকাল, চারধারে অভাবের তীরগুলো উচিয়ে বসে আছে, নড়াচড়া করলেই খেচা লাগছে। আজ শুতে যাবার সময় তার বুকে সামান্য ব্যথা বোধ হচ্ছে। প্রেশারট্রেশার কখনো চেক করাননি। শরীর মাঝে-মাঝেই অকেজো হয়ে যাচ্ছে, তখন হোমিওপ্যাথি গুরি তাকে সাহায্য করে।

একটু আগে হেমলতা মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেছেন, মাথার কাছে খাটের নিচে খবরের কাগজের ওপর বালির বাক্যে কফ ফেলার জায়গা ঠিক রাখতে ভোলেননি। একটা দিন এই মেয়ে না থাকলে তার শরীরটা বিকল হয়ে যাবে একথা তার চেয়ে আর-কেউ ভালো করে জানে না। তবু কোনো সমস্যায় পড়লেই মেয়ের ওপর হম্বিতম্বি করেন, কারণ এটাই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত জায়গা। এখন রাগ করতে পারেন এমন মানুষ তার ধারেকাছে নেই। বুকের ব্যথার কোনো ওষুধ তার কাছে নেই, এটা নতুন উপসর্গ। ডান হাত বুকে রাখলেন তিনি। শরীর ক্রমশ শুকিয়ে দড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে। সেইসর মাগুলো কোথায় চলে গেল, চামড়াগুলো গুটিয়ে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। নিজের শরীরের দিকে তাকালে বড় কষ্ট হয় এখন।

পঁচাত্তর বছর অল্প সময়-দেখতে-দেখতে চলে গেল। কিন্তু মৃত্যু অনেক দূরে-আরও পঁচিশটি বছর তার বেঁচে থাকার বড় সাধ। পৃথিবীতে রোজ কত কী খবর হয়-মরে গেলে সেসব থেকে সোজা ব্যাগ-হাতে দ্রুত হেঁটে বাড়ি ফেলেন। বেঁচে থাকার অধিকার তার আছে, এরকমটা ভেবে মনটা প্রফুল্ল হল সরিৎশেখরের। কিন্তু সে সামান্যক্ষণের জন্য। বুকের মধ্যে হাপ লাগছে। এই যে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে, এই বাড়িটাকে রোজ ভোরে উঠে দেখতে ইচ্ছে করে, সেটা কী জন্যে এত বছর বেঁচে থেকে তিনি কী দেখলেন? দুই স্ত্রী-তারা তো অনেকদিন আগেই ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেল। বড় ছেলের মুখদর্শন এ-জীবনে তিনি করবেন না, ছোট ছেলে-হ্যাঁ, তাকেও তিনি বাতিল করেছেন। এক মেয়ে চোখের সামনে মরে গেল, আর-একজন বিধবা হয়ে সারাজীবন থান পরে তার সংসারে পড়ে রইল। একমাত্র মহীতোষ যে কিনা কোনোদিন তার মুখের ওপর তর্ক করেনি, তাকে আঘাত দেয়নি, কিন্তু ওর কাছেও তিনি আপন হতে পারেননি কোনোদিন। মহীর বউ তো জোয়ান বসেই চলে গেল। অর্থাৎ এই এত বছর বয়স তাকে শুধু দুঃখই দিয়ে গেছে-বেঁচে থেকে হেয় সুখ পাওয়া যায় না। এই যদি নীট ফল হয়, তা হলে মনে হয়, এও তো একটু একটু করে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভাড়াটের অনাদর, ট্যাক্সের বোঝা তো আছেই, এতদিনে একবারও তিনি হোয়াইটওয়াশ করাতে পারলেন না। যত্ন না পেলে সবকিছুই নষ্ট হয়ে যায়, যাচ্ছেও।

এইসব সমস্যার মধ্যে বাস করেও তনি একটি জায়গায় অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন, সেখানে তার কোনোরকম গাফিলতি ছিলন না-তা হলে অনিমেষকে মানুষ করা। লোকে যে কেন মানুষ করার কথা বলে, মানুষ কেউ কাউকে করতে পারে না। তিনি তার পুত্রদের পারেননি। শরীর বড় হওয়া আর আর মানুষ হওয়া যখন এক ব্যাপার নয় তখন এই চলতি কথাটা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু অনিমেষের বেলায় তার আওতায় থেকে একটু একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছে, কখনো হোঁচট খায়নি। এই ছেলে প্রথম ডিভিশনে পাশ করবে এ অন্ধ বিশ্বাস তার ছিল এবং সেটা মিথ্যে হয়নি। আজ অবধি যখন যা খেতে বা পরতে দিয়েছেন ও কখনো সে নিয়ে অভিযোগ করেনি–এটাই মানুষ হবার প্রথম পদক্ষেপ। একমাত্র যে-জিনিসটা সরিৎশেখরকে ভাবাত, মাঝে-মাঝে ছোট ছেলের পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিত, তা হল অনিমেষের দেশের কাজে আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা। সেই ছেলেবেলা থেকে ওর কংগ্রেসের প্রতি যে-আকর্ষণ তা কি এখনও আছে। ইদানীং ওর সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা হয় না। অনিমেষের সঙ্গেওর সেই নতুন স্যারের সম্পর্ক কী তা তিনি জানেন না। তবে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ সত্ত্বেও যদি এ-ছেলে এমন ভালো ফল করে পাশ করতে পারে, তবে তিনি কখনোই আপত্তি করবেন না। আজ রাত্রে সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে এইসব চিন্তা করতে করতে আসল জায়গায় শেষ পর্যন্ত এলেন–অনিমেষ কাল কলকাতায় চলে যাচ্ছে।

বুকের ব্যথার জায়গায় এখন যেন কোনো স্পর্শ লাগল-কারণ উপলব্ধি করতে পারলেন সরিৎশেখর। এবং এই প্রথম তিনি ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। তার শরীর মনের হুকুমে চলে? এবং কোন মন, না, যে-মনকে তিনি নিজেই জানতেন না। এমনিতে তাঁর সম্পর্কে নির্দয় কঠোর পাষাণ এইসব বিশেষণ ব্যবহৃত হয়, সত্যি বলতে কী, অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কোনোদিন আপস করেননি বলেই তার সম্পর্কে সবাই একথা বলে। কিন্তু অনিমেষকে তিনি বড় করেছেন, পড়াশুনা শিখিয়েছেন আরও বড় হবার জন্য-কলকাতায় না গেলে তা সব নয়-এসব তো অনেক দিনের জানা কথা। তা হলে? তা ছাড়া তার বংশে আজ অবধি কেউ কলকাতায় পড়তে যায়নি-সেদিক দিয়ে তার গৌরবের ব্যাপার।

আজ খেতে বসে অনিমেষ মহীতোষের ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল। ওর বাবা ওকে ডাক্তার হতে বলেছে-সায়েন্স পড়াতে চায়। অথচ নাতির ইচ্ছে সে আর্টস পড়ে। তাঁকে সালিশি করেছে সে। অনিমেষ ইংরেজিতে এম এ পাশ করে অধ্যাপক হোক এই চিন্তা তাকে খুশি করে। মহীতোষ কদিন দেখেছে তার ছেলেকে সে কী করে জানবে ওর মনের গঠন কেমন? ফট করে কিছু চাপিয়ে দিলে ফল ভালো পাওয়া যাবে? তিনি নাতিকে বলেছেন, সায়েন্স পড়তে যদি ভালো না লাগে তো পড়ার দরকার নেই। সেকথা শুনে অনিমেষের মুখ কীরকম উজ্জ্বল হয়েছিল এখন চোখ বন্ধ করেও তিনি দেখতে পেলেন। আজকাল কোনো সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কেউ বড়-একটা তার শরণাপন্ন হয় না-সরিৎশেখরের তাই আজ নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে বোধ হচ্ছিল। মহীতোষের সঙ্গে পরে তিনি এব্যাপারে কথা বলবেন। অতএব কাল যে-ছেলেটা কলকাতায় যচ্ছে তাতে তার চেয়ে সুখী আর কে পারে। তবু যে কেন এমটা হয়? কেন মনে হচ্ছে সেখানে ওর কিছু হলে তিনি দেখতে পাবেন না! একটা অজানা শহরে ছেলেটা একা একা কীভাবে বাস করবে? সেইসঙ্গে এতক্ষণ যে-ব্যাপারটা তিনি মনের আড়ালে-আবডালে রাখছিলেন সেটা চট করে সামনে এসে দাঁড়াল-কাল থেকে তিনি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বেন। কাল থেকে বাড়িটা ফাঁক হয়ে পড়বে। তিনি কী করে বাঁচবেন? যৌবনে যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি তিনি যেভাবে হতে পারতেন, এই পঁচাত্তর বছরে এসে তা আর সম্ভব নয়-এই সত্যটা যেন বুকের ব্যথাকেআগলে রাখছিল। এখন তিনি বুঝতে পারেন যে হেলতা ক্রমশ অশক্ত হয়ে পড়ছে-শারীরিক ক্ষমতায় সে আর বেশিদিন এভাবে কাজ করে যেতে পারবে না। যদি তার আগে হেমলতা চলে যায়, তা হলে তিনি কী করবেন? এই বাড়িতে সম্পূর্ণ একা একা তিনি কীভাবে থাকবেন? এখন এই বয়সে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মহীতোষের কাছে গিয়ে দুদিন তিষ্ঠোতে পারবেন না তিনি।

কেউ জানে না, কাউকে জানাননি তিনি, বেশ কিছুদিন আগে গোপনে একটা উইল করেছেন এই বাড়ির ব্যাপারে। তাঁর অবর্তমানে এই বাড়ির সম্পূর্ণ মালিকানা হেমলতার, কিন্তু তিনি এই সম্পত্তি ভোগ করতে পারবেন, বিক্রি করতে পারবেন না। হেমলতার এ অনিমেষ এই বাড়ির মালিক হবে। আর কেউ নয়-আর কারও কথা তিনি চিন্তা করতে পারেন না। উইল করার সময় মনে হয়েছিল, মানুষ যখন বোঝে মৃত্যু খুব কাছে, চলে যাওয়ার সময় আর সুযোগ পাওয়া যাবে না, তখনই উইল করে। কিন্তু তিনি কখনোই খুব শিগগির যাচ্ছেন না, তা হলে উইল করা কেন? কি করে ফেলে আর পালটানো বা বাতিল করা হয়নি। এবং যেহেতু এটা একটা দুর্বলতা, তাই কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি, এমনকি হেমলতাকেও নয়। অনিমেষ কাল চলে যাবে। সে যদি কৃতিত্বের সঙ্গে এম এ পাশ করে অধ্যাপনা করে তা হলে কি জলপাইগুড়িতে ফিরবে না, কখনোই নয়। এই কথাটা এই মুহূর্তে অন্তত বিশ্বাস করতে আরম্ভ করলে। কলকাতায় গিয়ে শিখড় গাড়লে কেউ আর ফিরে আসে না। ওঁর মনে হতে লাগল, অনিমেষের এই চলে যাওয়াটা শেষ যাওয়া। এর পর ও আসবে ক্ষণিকের জন্য-সাময়িকভাবে। এই অনিমেষকে আর তিনি কখনো ফিরে পাবেন না। অতএব এই বাড়ির মালিকানা গেলে সে কোনোদিনই তার দখল চাইবে না। তখন এত যত্নের বাড়িটার কী অবস্থা হবে।

ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল তার। চট করে অনেক বছর আগে শোনা শনিবাবার কথা মনে পড়ল। এর কোনো কাজে বাধা দিও না-এই সংসারে সে আটকে থাকবে না। কথাটাকে এই মুহূর্তে তিনি ভীষণ সত্যি বলে মনে করতে লাগলেন। এবং এই প্রথম সরিৎশেখর ব্যথার কারণটা পুরোপুরি আবিষ্কার করলেন। তার বুকের ভেতর থেকে কী-একটা জিনিস.আস্তে-আস্তে খসে যাচ্ছে। তার ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছে সেটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রাখেন, অথচ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি বাধা দিতে পারলেন না। তাকে তার নিজের দৃষ্টির পূর্ণ রূপ দেখে যেতে হবে। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে এক বিছানায় এপাশওপাশ করতে করতে গভীর রাতে সহসা উঠে বসলেন সরিৎশেখর।

 

জিনিসপত্র মোটামুটি গোছগাছ হয়ে গেছে। একটা সুটকেস আর ছোট হোন্ডল নিয়ে সে যাবে। কাল সন্ধ্যেবেলায় ট্রেন। শিলিগুড়ি থেকে যে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ছাড়ে তাতে হলদিবাড়ি থেকে আসা একটা কম্পার্টমেন্ট জুড়ে দেওয়া হয়। অনিমেষ জলপাইগুড়ি স্টেশনে সেই লোকাল ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে উঠবে। সাধারণত জলপাইগুড়ির মানুষ আগেভাগেই লোক পাঠিয়ে হলদিবাড়ি থেকে জায়গা দখল করিয়ে আনে কিন্তু একজনের পক্ষে তেমন কোনো অসুবিধে হবে না। আজ সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতেই ও জয়াদির গলা পেয়েছিল, নিশ্চয়ই জয়াদি বিকেলে বাড়ি ফিরেছেন। যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে খুশি হয়েছিল অনিমেষ। সত্যি বলতে, জয়াদিই প্রথম তাঁকে কলকাতার সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিলেন। জয়াদি না থাকলে সে জানতেই পারত না জীবনানন্দ দাশ নামে সেই বিখ্যাত কবি ট্রামের তলায় চাপা পড়েছিলেন। জমাদির সঙ্গে দেখা করার জন্য সে ওদের বারান্দায় উঠে আসতেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। খুব চাপা গলায় জয়াদি কথা বলছিলেন, এতে যার সআের পক্ষে বিয়ে করা উচিত হয়নি।

জয়াদির স্বীমীর গলা কিন্তু চড়া ছিল, ওসব নাটুকে কথা ছেড়ে দাও, নবেল পড়ে মাথা বিগড়ে গিয়েছে তোমার। এত ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করি না আমি।

খুব নির্লিপ্তর মতো জয়াদি বললেন, বেশ, যাব না।

অ্যাঁ। কী বললে? এককথায় রাজি? তা সেইসব কচি কচি ভাইগুলোর মাথা চিবোতে পারবে না বলে মন-খারাপ লাগছে না? তোমার যে পুরুষ-ধরা রোগ ছিল তা যদি জানতাম কোন শালা বিয়ে করতে!

দ্রুত নেমে এসেছিল অনিমেষ। ওর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। কী ভীষণ নোংরা গলায় জয়াদির স্বামী কথা বলছেন! জয়াদির এই সমস্যায় জয়াদিকে এতখানি নোংরার মধ্যে থাকতে হয় কোনোদিন সে টের পায়নি! ওঁর সঙ্গে কথা বলেও আভাস পায়নি কখনো। ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল নেই এটা টের পেয়েছে, কিন্তু তাই বলে এতটা! কচি কচি ভাই বলতে উনি কী বোঝাচ্ছিলেন। সে-অর্থে ও নিজেও তো জয়াদির ভাই। ভীষণ অসহায় লাগল অনিমেষের। একবার মনে হয়েছিল পিসিমাকে ব্যাপারটা বরবে, কিন্তু চলে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে বাড়ির সবাই এত চিন্তিত যে একথাটা বলার অবকাশ পায়নি।

এখন রাত দশটা হবে। এই সময় জলপাইগুড়ি শহর ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। ওদের পাড়াটায় দোকানপাট নেই, বড় ছাড়া-ছাড়া বাড়ি, তাই গভীর রাতটা খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসে। একদম ঘুম পাচ্ছে না আজ অনিমেষের। কাল চলে যেতে হবে-এই বোধটা মাঝে-মাঝে সেই একাকিত্বের ভয়টাকে উসকে দিচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে ও সামনের দেওয়ালের দিকে তাকাল। সেখানে সেই ঘোট কুকুরটা এখনও চুপচাপ বসে আছে। আজ থেকে অনেক বছর আগে এটাকে আবিষ্কার করেছিল সে। দেওয়ালের চুনের আস্তরণ সরে গিয়ে যে-ফাটল হয়েছে সেটাই একটা কুকুরের আকৃতি নিয়ে নিয়েছে। খুব মজা লাগত ছেলেবেলায়। চট করে দেখলে মনে হয় খুব আদুরে ভঙ্গি নিয়ে কুকুরটা চেয়ে আছে। আজ এত রাত্রে ওর কুকুরটার জন্য ভীষণ কষ্ট হল, কাল থেকে সে আর এটাকে দেখতে পাবে না!

আগামীকাল ধর্মঘট। এবার যেভাবে কমিউনিস্টরা শহর পথে-পথে প্রচার করে বেড়াচ্ছে, এর আগে কখনো সেরকম দেখা যায়নি। কিন্তু একটা জিনিস অনিমেষে কিছুতেই বুঝতে পারে না, সাধারণত মানুষ একদম উত্তেজিত নয়। বরং তাদের মধ্যে নিস্পৃহা ভাব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত ফেরার সময় ও লক্ষ করেছে, কারও মধ্যে তেমন চাঞ্চল্য নেই। অথচ মানুষের খাবারের জন্য এই হরতাল। তা হলে কি, জলপাইগুড়ির সমস্ত মানুষ কংগ্রেসের সমর্থক হয়ে গেল? কী জানি! কিন্তু যদি এই হরতালের ফলে কাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়-তা হলে? এ-সপ্তাহে আর নাকি ভালো দিন নেই।

ভেজানো দরজা খুলে বাইরে এল অনিমেষ। ওদের বাগানটা এখন জঙ্গলে ভরে গেছে। সামান্য সৃষ্টি হলেই গাছগুলো রতর করে বড় হয়ে ওঠে। ফুলের গাছ আর নেই, বিভিন্ন ফলের গাছেই বিরাট জায়গাটা ভরাট। এখন সবে চাঁদ উঠেছে। লম্বা সুপারিগাছগুলোর মাথায় তার জ্যোৎস্না, নেতিয়ে পড়ে আছে। চারধার একটা আবছা আলো-অন্ধকারের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। চট করে তাকালে বোঝা যায় না, কিন্তু চোখ সয়ে এলে দেখতে কোনো অসুবিধে হয় না। অনিমেষ দেখল দ্রাদুর ঘরে আলো জ্বলছে না, কোনো শব্দ আসছে না সেখান থেকে। পিসিমার রান্নাঘর থেকে সামান্য আলো আসছে বাইরে।

উঠোনে নেমে এল সে খালিপায়ে। এখন গরমকাল। সময়ে-অসময়ে বৃষ্টি আসে। উঠোনের ঘাসগুলো এখন মাথাচাড়া দিয়েছে, গোড়ালি ড়ুবে যায়। এভাবে নামা ঠিক হয়নি, কারণ এই সময় সাপেরা মেজাজে চারধারে ঘুরে বেড়ায়। কখন কে বিরক্ত হয়ে ছোবল মারবে-অনিমেষ সাবধানে পা ফেলতে লাগল। দাদুর ঘর পেরিয়ে পিসিমার রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সে। দরজার কাচ দিয়ে ঈষৎ আলো বাইরে আসছে। এটা ইলেকট্রিক আলো নয়, নিশ্চয়ই কুপির আলো। পিসিমা ইলেকট্রিক আলো বাঁচাতে কুপি জ্বালান রাত্রে শোওয়ার সময়। এইটে ওঁর বহু পুরনো অভ্যেস। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে আসবার সময় পিসিমা ওটা নিয়ে এসেছেন। নিঃশব্দে বারান্দায় উঠে দরজার কাছে এসে কাঠ হয় দাঁড়িয়ে পড়ল অনিমেষ। ভেতর থেকে চাপা গলায় পিসিমা কান্নাটা ঘরের মধ্যে পাক খেতে লাগলু। পিসিমা কাঁদছেন কেন? কান্নাটাও যেন সতর্কভাবে-সরিৎশেখর বা আর-কেউ টের পান তিনি চান না। যেন নিজের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে কান্না। আগে চলে-যাওয়া, বোধহয় চেহারা গুলিয়ে বা ভুলে-যাওয়া পিসেমশাইকে অভিযোগ করে কেঁদে যাচ্ছেন। কেন তাকে একা ফেলে রেখেছেন এতকাল। কতদিন তিনি এইভাবে পৃথিবীতে থাকবেন। এখানে থাকলেই তো দুঃখ পেতে হয়-এই যেমন যে-ছেলেটাকে মা মারা যাবার পর বুকে করে মানুষ করেছেন সেও আজ চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ নিঃশব্দে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ও একবার ভাবল পিসিমাকে ডাকবে, কিন্তু ওর মন যেন সায় দিতে চাইল না। ভীষণ ভাববোধ হল তার, কাউকে জানতে না দিয়ে সে আবার উঠোনে নেমে এল।

এখান থেকে চলে গেলে আর-কিছু না হোক দুজন মানুষকে ছেড়ে যেতে হবে, যারা তাকে আগলে রেখেছিলেন। পৃথিবীর আর কোথাও গিয়ে, জীবনের কোনো সময়ে কি আর-কাউকে সে পাবে এমন করে যে তাকে ভালোবাসবে? খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে সে মুখ তুলে পরিষ্কার আকাশের দিকে দিকে তাকাল। দূরে এক কোনায় বাচ্চা মেয়ের কাপা-হাতে-পরা বাকা টিপের মতো অর্ধেক চাঁদ আকাশে আটকে আছে। মাথার ওপর অনেক তারার ভিড়। যেন হইচই পড়ে গেছে সেখানে। আজ অনেকদিন পর কেন বারবার ছেলেটাকে মনে পড়ে যাচ্ছে এইরকম তারার রাতে সে বিছানায় শুয়ে। শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেখানে অনেক তারার মধ্যে একটা তারা খুব জ্বলজ্বল চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকত আর কিছুক্ষণ চোখাচোখি হওয়ার পর সেই তারাটা যখন মায়ের মুখ হয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলত, সে-সময় ওই তারটাকে না দেখতে পেলে ওর কান্না পেত। যেন অনিমেষ আকাশের দিকে মুখ করে অনেক তারার মধ্যে সেই তারাটাকে খুঁজতে চাইল। আশ্চর্য, তারাও পালটে যায় নাকি! কারণ ওখানে অনেকগুলো জ্বলজ্বলে তারা একসনে জ্বলছে, কাউকে আলাদা করা যাচ্ছে না।

অনিমেষ উঠোন পেরিয়ে পাশের দরজা খুলে বাড়ির সামনে চলে এল। আশেপাশের সব বাড়ির আলো নিবে গেছে। এখন আর মাইকের শব্দ শোনা যাচ্ছে না যেটা সন্ধেবেলায় ছিল। অনিমেষ চেঁকিশাকে জঙ্গলটা ছাড়েয় ভাড়াটের ঘরের সামনে ওদের সদরদরজার দিকে এগোল। চাঁদটা বোধহয় সামান্য ওপরে উঠেছে, কারণ এখন চারদিক মশারির মধ্যে ঢুকে দেখলে যেমন দেখায় তেমন দেখাচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে কয়েক পা হেঁটে সামনে তাকাতে ওর চোখ যেন ঝাঁপসা দেখাল। জয়াদির ঘরের সামনে বারান্দায় কেউ-একজন দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশের থামের গায়ে হেলান দিয়ে যে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সে যে জয়াদি তা বুঝতে দেরি হল না অনিমেষের। জয়াদি ওখানে কী করছে? এভাবে কেন জয়াদি দাঁড়িয়ে থাকবে মানুষের যখন খুব দুঃখ হয় তখনই এরকম ভঙ্গিতে সে দাঁড়াতে পারে-অনিমেষ এটুকু বুঝতে পারছিল। জয়াদিতে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল সে। এত রাতে ও যদি জয়াদির সঙ্গে কথা বলে, তাহলে জয়াদির স্বামী রাগ করবেন না তো? সন্ধেবেলায় তিনি তো এ-ধরনের একটা কথা বলে জয়াদিতে আঘাত করেছিলেন। এখন কি আর আগের মতন জয়াদির সঙ্গে কতা বলা তার মানায় না?

অনিমেষ নিঃশব্দে আবার নিজের ঘরের দিকে ফিরে চলল। ওর মনে হল, আর যা-ই হোক এখন জয়াদিকে একা একা থাকতে দেওয়া উচিত, কারণ অনেক সময় ওর নিজেরই এক থাকতে ভালো লাগে। দরজা বন্ধ করে ও যখন উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছে তখনইরিংশেখরের ঘরের দরজা খুলে গেল। অনিমেষ দ্রুত নিঃশব্দে জায়গাটা পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে আলো নেবাল। এখন এত রাত্রে দাদু তাকে দেখলে অনেকরকম প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে। তার চেয়ে সে মুয়ে পড়েছে এটা বুঝতে দেওয়া ভালো। খাটে শুয়ে সে অন্ধকার ঘরে চুপচাপ কিছুক্ষণ পড়ে থাকল না, আজ রাত্রে ওর কিছুতেই ঘুম আসবে না। অন্ধকার ঘরের দেওয়ালের কাচের জানালায় চোখ বোলাতে গিয়ে সে শক্ত হয়ে গেল। একটা মুখ কাচের জানলার বাইরে থেকে মুখ চেপে ভেতরটা দেখবার চেষ্টা করছে। কে? চোর নয় তো? সঙ্গে সঙ্গে ওর মেরুদণ্ডে যেন একটা ভয় ঠাণ্ডা অনুভুতি নিয়ে যোরাফেরা করতে লাগল। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাটা সে এই মূহুর্তে হারিয়ে ফেলেছে, গলা থেকে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। বাইরের জ্যোৎস্নার পটভূমিতে, ভেতর থেকে একটা আবছা অন্ধকারমেশানো মুখের ছায়া কাচের ওপর ক্ষমতাটা সে এই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছে, গলা থেকে কোনো শব্দ, বেরুচ্ছে না। বাইরের জ্যোৎস্নার পটভূমিতে ভেতর থেকে একটা আবছা অন্ধকার-মেশানো মুখের মায়া কাচের ওপর লেপটে আছে এখনও। সে কী করবে অনিমেষ শার্শে এসে দাঁড়াল। বাইরে জ্যোত্রায় উঠোনটা পরিষ্কার হয়ে আছে। অনিমেষ প্রথম চমকটা কাটিয়ে উঠে খুব ধীরে হোঁচট খেতে-খেতে এগিয়ে-যাওয়া শরীরটাকে দেখতে পেল। এই শরীরটাকে সে জন্ম থেকে জানে। দাদুর এইরকম হেঁটে-যাওয়া অসহায় ভঙ্গি সে আগে কখনো দেখেনি, লাঠি না নিয়ে দাদু এসেছিলেন। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না, সরিৎশখর এত রাত্রে এই জানালায় মুখ দিয়ে কী দেখছিলেন।

 

খাওয়াদাওয়ার পর থেকেই সরিৎশেখর তাড়া দিচ্ছিলেন। সেই কোন সন্ধেবেলায় ট্রেন, অথচ দাদু এমন করে তাড়া দিচ্ছেন যেন আর সময় নেই। জিনিসপত্র গুছিয়ে বাইরে রাখা আছে।দাদু গিয়ে একজন পরিচিত রিকশাওয়ালাকে বলে এসেছেন, সে খানিক আগে এসে বসে আছে। অনিমেষ দেখল ট্রেন ছাড়তে এখনও আড়াই ঘন্টা বাকি। আজ জলপাইগুড়ি শহরে হরতাল বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে। দিনবাজার এলাকায় দোকান বন্ধ করা নিয়ে মারামারি হয়েছে। তবে অন্যদিনের চেয়ে আজকের দিনটা আলাদা সেটা বোঝা গিয়েছিল। রিকশা চলেছে তবে তা সংখ্যায় অর। সরকারি অফিস বা ফুলগুয়ে হয়নি। কিন্তু সিনেমা হল খোলা ছিল-সরিৎশেখর রিকশাওয়ালার কাছ থেকে এইসব সংবাদ আরও বিশদভাবে জেনে নিচ্ছিলেন।

নিজের ঘরে অনিমেষ যখন জামাকাপড় পরছে তখন হেমলতা দরজায় দাঁড়িয়ে। তার মুখটা থমথম করছে, শেষ পর্যন্ত অনিবাবা কলকাতায় চললি?

অনিমেষের বেশি কথা বলতে ভয় করছিল, ও চেষ্টা করে হাসল।

গিয়েই চিঠি দিয়ে খাখবর জানাবি আর প্রত্যেক সপ্তাহে যেন, চিঠি পাই। হেমলতা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।

আচ্ছ। অনিমেষ চুল আঁচড়াতে লাগল।

বেশি বাইরে ঘুরি না, বাজে আড্ডা দিবি না। যত তাড়াতাড়ি পড়াশুনা শেষ করে চলে আসতে পারিস সেই চেষ্টা করবি। তোর যা খাওয়াদাওয়ার ধরন-ওখানে পেট পুরে খেতে দেবে কি না জানি না।

বাঃ, খেতে দেবে না কেন? অনিমেষ বলল।

যারে তাদের কলেজে মেয়েরা পড়ে নাকি?

জানি না।

দেখিস বাবা। কলকাতার মেয়েরা খুব-মানে অন্যরকম-ওদের সঙ্গে একদম মিশবি না। হেমলতা শেষবার সতর্ক করলেন।

আমার সঙ্গে মিশবেই-বা কেন? অনিমেষ ঠাট্টা করবার চেষ্টা করল।

কী জানি বাবা, শনিবাবা তো সেইরকম কী বলেছিল। আর হ্যাঁ, ওসব পার্টি-ফার্টি একদম করবি না। তোর জেলে যাবার ফাড়া আছে, মাধু তো সেই চিন্তায় গেল। আমি কী করব! ছটফট করতে লাগলেন হেমলতা।

অনিমেষের হয়ে গেলে হেমলতা ওর হাত ধরে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে প্রণাম করতে বললেন। পিসিমার মন বুঝে অনিমেষ মাটিতে মাথা ঠেকাতে ওর চুলে হাত পড়ল। অনিমেষ মুনল, বিড়বিড় করে পিসিমা সেই কাল রাত্রের মন্ত্রটা বলে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত একটা ড়ুকবে-ওঠা কান্নার মাঝখানে পিসিমা বললেন, ঠাকুরের সামনে বসে তুই আমাকে কথা দে যে এমন-কিছু করবি না যাতে তোর জেল হয়। বল, আমাকে ছুঁয়ে বল!

গলা বুজে এসছিল অনিমেষে, কোনোরকমে বলল, আচ্ছ।

আচ্ছা না, আমাকে ছুঁয়ে বল, কথা দিরাম। পিসিমা ওর হাত ধরলেন।

আর সেই সময় সরিৎশেখরের চিৎকার শোনা গেল, কী হর তোমাদের কেন, বাবাকে করবি তো! বলতে বলতে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর সেই মুহূর্তে কান্নার কোনো সঙ্কোচ থাকল না।

সরিৎশেখর আর অপেক্ষা করতে রাজি নন। পিসিমাকে নিয়ে অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এল। জয়াদি ওঁদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আজ সকালে জয়াদির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। একবারও কালকের কথা তোলেননি তিনি, অনিমেষও ঘুণাক্ষরে জানায়নি কাল রাতে সে ওঁকে দেখেছে। যাকিছু গল্প কলকাতাকে নিয়ে। এখন চোখাচোখি হতে জয়াদি স্নান হাসলেন, চললো।

মাথা নাড়ল অনিমেষ। বুকের মধ্যে এমন অর্কশো সমুদ্র ফুঁসছে-যে-কোনো মুহূর্তের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। মুখ ফিরিয়ে অনিমেষ দেখল তার জিনিসপত্র রিকশায় তোলা হয়ে গিয়েছে। দাদু পিসিমার কেচে-দেওয়া লংথের পাঞ্জাবি আর মিলের ধুতি পরে লাঠি-হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে দেখে আর-একবার ঘড়ি দেখে নিলেন, তাড়াতাড়ি করো। এই সময়যোগটা খুব ভালো আছে।

জয়াদি বললেন, আপনি স্টেশনে যাচ্ছেন তো?

সরিৎশেখর রিকশার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, কালীবাড়িতে যেতেই হবে, কাছেই যখন ঘুরে আসি।

অনিমেষ পিসিমার দিকে ফিরে বলল, পিসিমা, আমি যাচ্ছি।

হেমলতা চট করে থানের আঁচল হাতে জড়িয়ে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে সে-অবস্থায় ঘাড় নাড়লেন। ঘোট ঘোট পা ফেলে অনিমেষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রিকশায় চাপল, ঘাড় ঘুরিয়ে সে আবার নিজেদের বারান্দার দিকে তাকাল। রিকশা এখন চলতে শুরু করেছে। আশ্চর্য, পিসিমা এখন এই মুহূর্তে আর বারান্দায় নেই। কেমন খাখা করছে জায়গাটা। নিঃশব্দে টপটপ করে জল পড়তে লাগল অনিমেষের দুগাল বেয়ে। রিকশাটা যখন টাউন ক্লাবের কাছ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তখন অনিমেষ পাশেবসা সরিৎশেখরের গলা শুনতে পেল, তোমাকে অনেক দূরে যেতে হবে অনিমেষ। পাশাপাশি রিকশায় বসে সে দাদুর শরীর থেকে আর্নিকা হেয়ার অয়েলের গন্ধ পেল। গন্ধটা ওকেএক লহমায় অনেকদিন আগে যেন টেনে নিয়ে গেল যেদিন সরিৎশেখর ওর সঙ্গে স্বৰ্গছেঁড়ার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কলকাতায় যাবার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এখন জরা এসে শরীর দখল করা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে সেই মানুষটি যেন একটুও পালটাননি। কাল রাত্রে-দেখা সেই সরিৎশেখরকে এখন জরা এসে শরীর দখল করা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে সেই মানুষটি যেন একটুও পালটাননি। কাল রাত্রে-দেখা সেই সরিৎশেখরকে এখন চেনা অসম্ভব।

টাউন ক্লাবের মাঠ, পিডব্লিউডির অফিস, করলা নদীর পুল পেরিয়ে রিকশাটা এফডিআই স্কুলের মোড়ে চলে এল। এখন বিকেল। দোকানপাট এ-চতুরে অন্যদিনের মতো খোলা। হরতাল শেষ হবার কথা ছটায়-কিন্তু দেখে মনে হয় এখানে হরতাল আদৌ হয়নি। রাস্তাঘাটে লোজন আড্ডা মারছে। এত দূর পথ এল, আশ্চর্য, একটাও চেনামুখ ওর চোখে পড়ল না!

স্টেশনের সামনেটা জমজমাট। রেডিও বাজছে দোকানে। রিকশা থেকে নেমে ওরা মালপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মে এল। সরিৎশেখর চশমার খাপ থেকে টাকা বের করে ফাঁকা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলেন। ট্রেন আসতে অনেক দেরি। প্ল্যাটফর্মে লোজন বেশি নেই। কুলিকে জিজ্ঞাসা করে প্রু কোচ কোথায় দাঁড়ায় জেনে সেখানে মালপত্র নামানো হল। পেছনেই একটা বেঞ্চি, সরিৎশেখর সাবধানে সেখানে বসে নাতিকে পাশে ডাকলেন।

তোমার পিসি যে-খাবার দিয়েছে রাস্তায় তা-ই খেয়ো, বুঝলে? দাদুর কথা শুনে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। দুপায়ের মধ্যিখানে লঠিটাকে রেখে হাতলের ওপর গলা চেপে সরিৎশেখর কথা বলছেন, টাকাপয়সা সব সাবধানে নিয়েছ তো?

হ্যাঁ।

গিয়েই চিঠি দেবে।

আচ্ছা।

যে-ভদ্রলোক তোমায় নিতে আসবেন তিনি তোমাকে চিনবেন কী করে তা-ই ভাবছি, কোনোদিন দেখেননি তো।

টেলিফোন বুথের সামনে মালপত্র নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমার বর্ণনা দিয়ে ওঁকে চিঠি লিখেছেন। তা ছাড়া ওর ঠিকানা আছে আমার কাছে।

জানি না কী হবে! কলকাতায় ঠিকানা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। উটকো লোকের কথায় কান দিও ন! তার চেয়ে তোমার কাকাকে লিখলে বোধহয় ভালো হত।

কিছু হবে না।

তোমার কীসব ফাঁড়া আছে শুনেছি-রাজনীতি থেকে দূরে থেকো। আমাদের মতো লোকের ওসব মানায় না।

অনিমেষ কোনো জবাব দিল না। অনেকদিন বাদে দার পাশে বসে এইভাবে কথা বলতে ওর গরি ভালো লাগছিল। এতদিন ধরে এক বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও তিল তিল করে যে-ব্যবধান তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেটা এখন হঠাই যেন মিলিয়ে গেছে। অনিমেষে চুপচাপ বসে থাকল।

কুলিদের চিৎকার, যাত্রীদের ব্যস্ততায় একসময় স্টেশনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। এত কুলি কোথায় ছিল কে জানে-অনিমেষ ট্রেন-টাইম ছাড়া কখনো এদের দেখতে পায়নি। সরিৎশেখর বেঞ্চি ছেড়ে সামান্য এগিয়ে কে বাঁদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, সিগনাল দিয়েছে দেখছি, রেডি হও।

কথাটা মুনেও অনিমেষ উঠতে চেষ্টা করল না। ওর মনে হচ্ছিল বুঝি জুর এসে গেছে শরীরে, হাত-পা কেমন ভারী বলে বোধ হচ্ছে। যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে-অনিমেষের এখন খুব ইচ্ছে করছিল ট্রেনটা দেরি করে আসুক। অথবা আজ তো ট্রেনটা নাও আসতে পারত। কত কী তো পৃথিবীতে রোজ হয়ে থাকে।

এই সময় বেশকিছু মালপত্র নিয়ে একটি পরিবার যেন সমস্ত প্ল্যাটফর্মে আলোড়ন তুলে এদিকে এগিয়ে এল। অনিমেষ দেখল কলিকে শাসন করতে করতে একজন মহিলা আগে-আগে আসছেন, তার মুখ দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটি মহিলার কন্যা। ওর সামনে এসে কুলি বলে উঠল, খাড়াইয়ে মেমসাব। পুরু গাড়ি ইহাই লাগে গা।

মহিলা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে ভদ্রলোককে ডাকলেন, আঃ, একটু তাড়াতাড়ি এসো-না, ওকে হেল্প করো! কিন্তু ততক্ষণে কুলি নিজেই মালপত্র নামিয়ে নিয়েছে। ভদ্রলোক কাছে এলে মহিলা বললেন, পইপই করে বললাম ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কাটো-চিরকাল কিষ্টেমি করে কাটালে। এখন এই পাহাড় নিয়ে গুতোগুতি করে ছোটলোকের মতো থার্ড ক্লাসে ওঠো, নিজে তো এখানে ফুর্তি সুটবেন!

ভদ্রলোক চাপা গলায় বলে উঠলেন, আঃ কী হচ্ছে কী, এটা স্টেশন! আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় তুমি জান। আর মেয়েরা একা থার্ড ক্লাসেই সেফ।

সেফ আর সেফ। সারাজীবন পুতুপুতু করে কাটালে। ট্রেন এলে তুমি লাফিয়ে উঠে জায়গা করবে-এই আমি বলে দিলাম। চট করে গলার স্বরে হুকুমের ঝাঝ আনলেন মহিলা।

এই সময় মেয়েটি কথা বলে, থমথমে গলার স্বর, এনলে শরীর কেমন করে, গোবিন্দদারা আসবে বলেছে।

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা ঝাঁকুনি দিয়ে শরীর ওর দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ওমা তা-ই নাকি। তোকে বলেছে আসবে? মেয়েটি ঘাড় নাড়ল।

তুমি আবার ওইসব লোফারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছ বিরক্তি-মেশানো গলায় জ্বলোক মেয়েকে ধমকালেন।

মাথা নিচু করল মেয়েটি কিন্তু তার মা জবাব দিল, মেলা বকবক করবে না তো! একটু আধটু কথা বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। তার বদলে ওরা প্রাণ দিয়ে যে-উপকার করবে, পয়সা ফেললে তা পাবে না। একটুও যদি বুদ্ধিশুদ্ধি থাকত।

অনেকক্ষণ থেকেই অনিমেষ সোজা হয়ে বসে ছিল। ওরা যখন প্রথম এদিকে এগিয়ে এসেছিল তখন ও বুঝতে পারিনি, কিন্তু মহিলাকে খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল। কোথায় ওকে দেখেছে এটাই মনে করতে পারছিল না সে। কিন্তু যেই উনি কথা বলতে শুরু করলেন তখনই তিস্তার চরের সেই সকালবেলার ট্যাক্সিটা ওর চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। সেই কাবুলিওয়ালাদের গান, তার শরীরে ভার রেখে বসা এই মহিলা, সেই গুডবয়-মার্কা ছেলেটি আর সর্বদা ঠুকে-কথা-বলা ভদ্রলোক-ও স্পষ্ট দেখতে পেল। অনিমেষ তখনই এই ভদ্রলোকের দিকে লক্ষ করল, কোনো মানুষের চেহারা এত পালটে যায়? কী নোগা এবং কালো হয়ে গেছেন ইনি। পরনে প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট। একে একা দেখলে সে কখনোই চিনতে পারত না। অথচ মহিলাটি একইরকম আছেন, তেমনি স্লিভলেস রাউজ, কড়া প্রসাধন আর মেজাজি কথাবার্তা। তুলনায় ভদ্রলোক অনেক নিষ্প্রভ, ওঁকে দেখলেই মনে হয় ইদানীং খুব অর্থকষ্টে রয়েছেন। ওঁরা ওকে চিনতে পারেননি, কয়েক বছর আগে সামান্য এক ঘন্টার সঙ্গীকে মনে রাখার কথাও নয়। অনিমেষের সেই কুষ্ঠরোগীটার কথা মনে পড়ল। ওকে হাত দিয়ে জল থেকে টেনে তুলেছিল বলে ভদ্রলোক কার্বলিক সাবান ব্যবহার করতে বলেছিলেন। হাসি পেল। অনিমেষের, সেসব না করেও তো ও অক্ষত আছে! সেদিন ভদ্রমহিলা ওর ছোঁয়াচ বাঁচাতে ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে নিয়েছিলেন।

সরিৎশেখর ফিরে এসে বেঞ্চিতে বসে বললেন, ভিড় হচ্ছে, হরতাল বলে লোকে আজকাল ভয় পায় না। এই সময় মহিলার বোধহয়-বেঞ্চিটা নজরে পড়ল। তিনি মেয়েকে নিয়ে বাকি বেঞ্চিটা দখল করলেন। কাছাকাছি হতেই অনিমেষ সেই মিষ্টি গন্ধটা টের পেল, ট্যাক্সিতে বসে যেটাতে ফুলের বাগান বলে মনে হয়েছিল। কী আশ্চর্য, এতগুলো বছরেও তিনি গন্ধটাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখে এসেছেন। সরিৎখেরের মুখের পাশটা দেখতে পাচ্ছিল অনিমেষ, তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন।

এই সময় ভদ্রলোক কিছু করতে হবে বলেই যেন যেচে কথা বললেন, আপনারা কলকাতায় যাচ্ছেন

সরিৎশেখর তার দিকে একটু লক্ষ করে ঘাড় নাড়লেন, না, আমার নাতি একাই যাচ্ছে।

ভদ্রলোক অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি বুঝি কলকাতায় পড়?

সরিৎশেখরই জবাবটা দিলেন, ও এবার ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে, কল সুতি হতে যাচ্ছে।

বাঃ, গুড। আমার মেয়েও বেরিয়েছে এবার, তবে ও শান্তিনিকেতনে পড়বে। ওর মা আর ও যাচ্ছে-বোলপুরে নামবে।

ভদ্রলোক কথা শেষ করা মাত্রই মহিলা বলে উঠলেন, বোলপুরে আমার ভাই তাকে, খুব বড় প্রফেসর। তা তুমি ভাই বোলপুর অবধি আমাদের একটু হেল্প কোরো, কী, করবে তো?

অনিমেষ মাথা নাড়ল। সে দেখল দাদু সামনের দিকে মুখ করে বসে আছেন আর মহিলার হাসিহাসি-মুখের পেছনে ওর মেয়ে ঐ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কী নাম তোমার, ভাই। মহিলা আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

অনিমেষ! নাম বলে অনিমেষ একটু আশা করল ওঁরা হয়তো চিনতে পারবেন।

এবার কিছুই হয় না। বরং মেয়েটি আকস্মিকভাবে উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ওই দ্যাখো মা, গোবিন্দদারা আসছে!

অনিমেষ দেখল তিনটি ওর চেয়ে বড় ছেলে হাসতে হাসতে এসে সামনে দাঁড়াল, কী বউদি, না বলে কখন বেরিয়ে এলেন, বাড়ি গিয়ে আমরা ফস খেয়ে গেলাম!

মহিলা খুব আদুরে ভঙ্গিতে বললেন, ওমা, কতক্ষণ অপেক্ষা করব ট্রেন এসে যাবে না? এখন এই ভিড় দেখে ভাবছি কী করে গাড়িতে জায়গা পাব।

রঙিন শার্ট পরা ছেলেটি হাত নাড়ল, এসে গেছি যখন তখন আর চিন্তা করবেন না। ট্রেন এলেই বডি ফেলে দেব-দুটো শোওয়ার জায়গা কবজা করতে না পারলে আমার নাম গোবিন্দ না!

ছেলেগুলো কথা বলছিল আর বারবার মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছিল। মেয়েটির চোখেমুখে নানারকম ঢং পরপর ঘোরাফেরা করছে। অনিনেষ দেখল ওরা এবার ওকেও লক্ষ করছে এবং দৃষ্টিটা ভালো নয়। সে মুখ ফিরিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন, যেন এই ছেলেগুলোর উপস্থিতি ওঁর কাছে কিছু নয়। ছেলেরা যে ওঁর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি সেটা অনিমেষ লক্ষ করেছিল। ও এদের সম্পর্কটা ঠিক বুঝতে পারছিল না-এদের কাউকেহ ও আগে দেখেনি।

একসময় প্ল্যাটফর্মটা চঞ্চল হয়ে উঠল। দূরে আশ্রমপাড়া ছাড়িয়ে কোথাও ইঞ্জিনটা হইসিল দিয়ে এগিয়ে আসছে। ওদিকের আকাশে কালো ধোঁয়া পাক খাচ্ছে। সরিৎশেখর এতক্ষণে কথা বললেন, তোমার ট্রেন এসে গেছে।

হইহই চ্যাঁচামেচির মধ্যে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে দাঁড়াল। গাড়িটা কিন্তু আজ একদম খালি, এমনকি–কোচেও ভিড় নেই। তবু গোবিন্দরা লাফিয়ে কম্পার্টমেন্টে উঠে অনাবশ্যক চিৎকার করে জায়গা দখল করল। অনিমেষ নিশ্চিন্তে জানালার পাশে একটা জায়গা পেয়ে জিনিসপত্র রেখে নিচে নামতে যাবে এই সময় ভদ্রমহিলা কন্যাসমত উপরে উঠে এলেন। অনিমেষকে দেখে বললেন, জায়গা পেয়েছ? ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল সে। বাথরুমটা কোথায়? জল-টল আছে কি না কে জানে! কথাটা যেন শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে অনিমেষ নিচে নেমে এল। ওর মনে হচ্ছিল যাওয়াটা খুব সুখকর হবে না, এই মহিলা ওকে আচ্ছা করে খাটাবেন।

প্ল্যাটফর্মে দাদু দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওকে দেখে বললেন, টিকিটটা তোমাকে দিয়েছি তো?

অনিমেষ বলল, হ্যাঁ।

তুমি গিয়েই চিঠি দেবে।

আচ্ছা।

আর বাইরের লোকের সঙ্গে বেশি আত্মীয়তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। সবার সঙ্গে মানসিকতায় নাও মিলতে পারে। কথাটা শেষ করে তিনি ট্রেনের জানালার দিকে তাকালেন, সেখানে গোবিন্দরা খুব হইচই করছে। অনিমেষ দাদুর দিকে তাকাল। ও চলে যাচ্ছে অথচ দাদুর মুখদেখে মনে হচ্ছে না তিনি একটুও দুঃখিত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সরিৎশেখর বললেন, এবার তুমি উঠে পড়ে, এখনই ট্রেন ছেড়ে দেবে। জিনিসপত্র নজরে রাখবে-পথে চুরিটুনি খুব হয়।

এবার অনিমেষ নিচু হয়ে সরিৎশেখরকে প্রণাম করল। ওর হাত তার শুকনো পায়ের চামড়া যেটুকু কাপড়ের জুতোর বাইরে ছিল সেখানে রাখতেই ও মাথায় স্পর্শ পেল। সরিৎশেখর দুহাত দিয়ে তার মাথা ধরে বিড়বিড় করে কিছু কথা উচ্চারণ করছেন। অনিমেষ শেষ বাক্যটি শুনতে পেল, বিদ্যা দাও, বুদ্ধি দাও, হৃদয় দাও। ও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই সমস্ত শরীর শিরশির করে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, অনিমেষ আর নিজেকে সামলাতে পারল না, ঝরঝর করে জল দুচোখ থেকে গালে নেমে এল। সরিৎশেখর সেদিকে তাকিয়ে খুব নিচু গলায় বললেন, চোখ মোছো অনিমেষ, পুরুষমানুষের। কান্না শোভা পায় না।

নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল ওর, ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছিল। এই মানুষটির সঙ্গে আজকাল তার কেটেছে, তার সবকিছু শিক্ষা এর কাছে, অথচ আজ অবধি সে এঁকে ঠিক চিনতে পারল না। সরিৎশেখর ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে অনিমেষের কাঁধে রাখলেন, অনিমেষ, আমি অশিক্ষিত এবং খুব গরিব। কিন্তু আমার পিতাঠাকুর আমাকে বলেছিলেন মানুষ হতে। আমি চেষ্টা করেছি, তোমাকেও সেই চেষ্টা করতে হবে। তুমি কলকাতায় গিয়ে শিক্ষিত হও, তোমার স্থিতি হোক সেটাই আমার আনন্দ। আমি যা পারিনি আমার ছেলেরা যা করেনি তুমি তা-ই করো। মানুষের জন্য পূর্ণতার জন্যে, তোমার মধ্যেই সেটা আমি পেতে পারি। আমার জন্যে ভেবো না, যতদিন তুমি মাথা উঁচু করে না। ফিরে আসছ ততদিন আমি বেঁচে তাকব। আই উইল ওয়েট ফর ইউ। যাও, তোমার গাড়ি হুইসল দিয়েছে।

হয় ভাই, সহ্য করে নিলেই আনন্দ। যে-কোনো সৃষ্টির সময় যন্ত্রণা যদি না আসে, তা হলে সেসৃষ্টি বৃথা হয়ে যায়। তোমার আজ নতুন জন্ম হতে যাচ্ছে-কষ্ট তো হবেই। সরিৎশেখর বললেন।

এই মুহূর্তে অনিমেষের অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, এই মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে ছেলেবেলায় সে যেমন ঘুমোত তেমনি কিছু করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সে কিছুক্ষণ পাথরের মতো মুখটার দিকে তাকিয়ে আস্তে-আস্তে ফিরে দাঁড়াল। ও দেখল সেই ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে আসছে! উনি কখন উঠেছিলেন তা সে লক্ষ করেনি। ভদ্রলোক নেমে বললেন, উঠে পড়ে তাই, গাড়ি এখনই ছাড়বে।

একটা একটা করে সিড়ি ভেঙে অনিমেষ দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সরিৎশেখর এগিয়ে এলেন, চিঠি দেবে। আর হ্যাঁ, মহিকেও রিখবে।

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। এই সময়ে ট্রেনটা হুইসল বাজিয়ে দুলে উটতেই গোবিন্দরা ওর পাশ দিয়ে লাফিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে জানালার কাছে চলে গেল। খুব আস্তে ট্রেনটা চলছে। সরিৎশেখর লাঠি হাতে ওর সামনে হাঁটছেন। অনিমেষ কান্না গিলতে গিলতে বলল, দাদু!

সরিৎশেখর বললেন, এসো ভাই। আমি অপেক্ষা করব।

একসময় আর তাল রাখতে পারলেন না সরিৎশেখর। ট্রেনটা গতি নিয়েছে। খানিক এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। সন্ধের অন্ধকার নেমে এসেছে পৃথিবীতে। অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে দাদুকে দেখতে লাগল। অনেক লোকের ভিড়ে নিঃসঙ্গ মানুষটা একা দাঁড়িয়ে আছেন। ও হাত নাড়তে গিয়ে থমকে গেল, সরিৎশেখর ডান হাতের পাঞ্জাবিতে নিজের চোখ মুছে পেচনদিকে হাঁটতে আরম্ভ করেছেন। অনিমেষ আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ সমস্ত চারচর যেন অস্পষ্ট, একটা সাদা পর্দার আড়ালে চলে গেল। স্টেশনের আলো, মানুষ সব মিলেমিশে একটা পিণ্ডাপাড়ার রেলক্রসিং বোধহয়। হুশ করে বেরিয়ে গেল। যে-কালো রাতটা চুপচাপ জলপাইগুড়ির ওপর নেমে এসেছে, এই ছুটন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। দৃষ্টি যখন অগম্য হত কল্পনা সৃষ্টা হয়ে যায়। কিন্তু চোখের জলের আড়াল চোখের এত কাছে যে অনিমেষ দাদুর মুখকেই ভালো করে তৈরি করে নিতে পারছিল না। সন্ধে পার হওয়ায় বাতাস এসে ওর ভেজা গালে শুধুই শীতলতা এন দিচ্ছিল। অনিমেষ চোখ মোছার চেষ্টা করল না।

 

নিয়মিত শব্দের আয়োজন রেখে ট্রেনটা যখন প্রায় ফাটাপুকুরের কাছবরাবর চলে এসেছে ঠিক তখন অনিমেষ পেছনে কারও আসার শব্দ পেল। আরে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ, আর আমি খুঁজে মরছি, কোথায় গেল ছেলেটা! ও পেছন ফিরে মহিলাকে দেখতে পেল, বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলছেন। বাঁ হাতের কনুই-এ ঝোলানো তোয়ালেটা হাতে নিয়ে মহিলা কয়েক পা এগিয়ে এলেন, ওমা তুমি কাঁদছিলে নাকি, একদম বাচ্চা ছেলে, মন-কেমন করছে বুঝি?

চোখের জলের কথা খেয়াল ছিল না। অনিমেষ অপ্রস্তুত হয়ে গালে হাত দিল। দরজাটা বন্ধ করে সে এবার মহিলার পেছন পেছন ভেতরে চলে এল। পুরো কামরায় দশ-বারোজনের বেশি লোক নেই, ফলে যে যার শোওয়ার জায়গা পেয়ে গেছে। মহিলারা একেবারে কোনায় জায়গা দখল করেছেন, অনিমেষ তার আগের পোপের সামনে দাঁড়াল। মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে কেন, আমার ওখানে প্রচুর জায়গা আছে, চলে এসো, আবার কোনো উটকো লোক এসে জুটবে হয়তো। ওকে ইতস্তত করতে দেখে কপট রাগ করলেন মহিলা, কী হবে কী, শুনতে পাচ্ছ না? চলে এসো!

এখন কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, চুপচাপ জানলায় বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভালো লাগবে। অথচ মহিলা যেভাবে কথা বলছেন তাতে মুখের ওপর না বলা যায় না। ও তবু বলল, আপনি বসুন, আমি আসছি।

নিজের খোপে এল অনিমেষ। ওর ছোট্ট ব্যাগ আর বেডিং কোনায় দিকে রাখা আছে। সেগুলোকে সরিয়ে জানলার পাশে বসল ও। উলটোদিকের বেঞ্চিতে একজন বুড়োমতন মানুষ দুটো বাচ্চা নিয়ে বসে বিড়ি খাচ্ছে। চোখাচোখি হতে বলল, শিশিগুড়ি আর কটা স্টেশন বাবু?

অনিমেষ বলল, তিন-চারটে হবে। লোকটা বিড়ি জানলা দিয়ে ফেলে চোখ বন্ধ করল। হুহু করে গাড়ি ছুটছে। বাইরের অন্ধকারে চোখ রাখল অনিমেষ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না অথচ কালকে আকাশে চাঁদ ছিল। হঠাৎ চটপটি জ্বালার মতো আকাশটাকে চিরে একটা আলো ঝলসে উঠতেই মাঠ গাছ পুকুর সামনে পলকের জন্য পরিষ্কার হয়ে মিলিয়ে গেল। আকাশ মেঘে চেয়ে গেছে, আজ চাঁদ উঠবে না।

জলপাইগুড়ি শহর এখন অনেক পেছনে, ট্রেনের চাকার প্রত্যেকটা আবর্তনে কলকাতা এগিয়ে আসছে। আজ সারা বাংলাদেশে হরতাল হয়ে গেল। কিন্তু এ কেমন হরতাল জলপাইগুড়িতে এর কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। তা হলে কি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে দেশের মানুষ তা সমর্থন করে না? কলকাতা শহরে আজ কী হয়েছে কে জানে? সেখানকার মানুষ আর জলপাইগুড়ির মানুষ কি আলাদা? অনিমেষ অন্ধকারের দিকে অলসভাবে তাকিয়ে বিদ্যুতের খেলা দেখছিল। জোলো হায়ো দিচ্ছে, বোধহয় বৃষ্টি নামবে। কলকাতায় বৃষ্টি হলে জল জমে যায়, খবরের কাগজে ছবি দেখেছে সে।

সামান্য পায়ের শব্দ সেইসঙ্গে মিষ্টি একটা গন্ধে অনিমেষ মুখ ফেরাল। ফেরাতেই ঝটপট সোজা হয়ে বসল সে। মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়েয়েছে। গাড়ির দুলুনি সামলাতে এক হাতে বাঙ্কটা ধরায় ওকে বেড় বড়সড় দেখাচ্ছে।

কী ব্যাপার, আপনার বুঝি আমাদের কাছে আসতেই ইচ্ছে করছে না? কথা বলার ভঙ্গি এমন আদুরে যে বয়সের সঙ্গে মানায় না। শরীর বেশিরকম ফীত, স্কার্টের কাপড়ে টান পড়েছে। ওর হাত এবং হাঁটুর ওপর মুক্ত পা থেকে চোখ সরিয়ে নিল অনিমেষ। মেয়েটি মুখ নেপালি-নেপালি ছাপ আছে, চোখ দিয়ে হাসছে সে। কী হল, কথা বলছেন না কেন?

যাচ্ছি। অনিমেষ ওঠার চেষ্টা করল।

যাচ্ছি না, আমার সঙ্গে চলুন, মা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। একটুও নড়ছে না মেয়েটি, ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করলেই গুড বয় হতে হয়।

আমি মোটেই গুড বয় নয়। অগত্যা অনিমেষ ওর জিনিসপত্র দুহাতে তুলে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি সামান্য সরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার নাম তো অনিমেষ, আমার নাম জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে না?

অনিমেষ কোনোরকমে দুলুনি সামলে বলল, নাম কী?

মুখে আঙুলচাপা দিয়ে খিলখিল করে হাসতে গিয়েই, গিলে ফেলে বুড়োর দিকে চেয়ে চোখ বড় বড় করল, সুরমা। একদম সেকেলে নাম, না?

অনিমেষ হেসে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে এল। মেয়েটির পাশ দিয়ে আসবার সময় ওর কুব অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া হল না সুরমার। অনিমেষ মেয়েটিকে যত দেখছিল তত অবাক হচ্ছিল। এ-মেয়ে সীতার মতো নয়, এমনকি রঙা বা উর্বশীর সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েরা বোধহয় এক-একজন এক-এক রকম হয়, কেউ বোধহয় কারও মতন হয় না।

ওদের খোপে এসে অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। মুখোমুখি দুটো বোখিতে লম্বা করে বিছানা পাতা হয়ে গেছে। জিনিসপত্র ওপরের বাঙ্কে ভোলা। মহিলা বালিশে হেলান দিয়ে একটা রঙিন পত্রিকা পড়ছেন। অবাক হবার পালা অনিমেষের চলছেই, কারণ মহিলার পরনে সেই বাড়িটা নেই। এখন পা-বুল একটা আলখাল্লা পরে রয়েছেন উনি। ওকেদেখে পত্রিকা থেকে মুখ তুলে একগাল হাসলেন, এসো, সু না গেলে বোধহয় আসতেই না! আচ্ছা, এই জিনিসপত্র ওপরের বাঙ্কে তুলে দাও।

বাধ্য ছেলের মতো অনিমেষ হুকুম তামিল করল। ততক্ষণে সুরমা অন্য বেঞ্চির জানলার ধারে বসে পড়েছে। মহিলা বললেন, বসে পড়ো, এখানেই বসো। হাত দিয়ে নিজের সামনে থেকে চাদর সারিয়ে নিলেন মহিলা। অনিমেষ বসে মহিলার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। ওর চট করে মুভিং ক্যাসেলের মুখটা মনে পড়ল। ঠিক সেই একই দৃশ্য, মহিলার আলখাল্লার ওপরে অনেকখানি ভোলা এবং সেখানে বাজহাঁসের ডিমের মতো দুটো মাংসপিণ্ড উঁচু হয়ে রয়েছে।

তুমি কি খাবার এনেছ? যা। আমার সঙ্গেও আছে। তোমারটা আর খেতে হবে না। আমি ভাবছি এই সুখ আর কতক্ষণ কপালে সইবে। শিরিগুড়িতে গিয়ে দেখব হুড়মুড় করে হাজার লোক উঠে বসেছে। আমি আবার শাড়ি পরে রাত্রে পারি না। মহিলা আবার পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেন।

অনিমেষ দেখল সুরমা ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। চোখাচোখি হতে বলল, শুনলাম আপনি কাঁদছিলেন, মায়ের জন্য-কেমন করছে বুঝি?

অনিমেষ ঘাড় নাড়াল, না।

সঙ্গে সঙ্গে মহিরা পত্রিকা সরিয়ে চোখ বড় বড় করলেন, ওমা, তবে কার জন্যে? কথা বলার ভঙ্গি এমন ছিল যে সুরমা খিলখিল করে হেসে উঠল। মহিলা কপট রাগের ভঙ্গি করে মেয়ের দিকে মুখ ফেরালেন, এই,তোকে বছি না এমন করে হাসবি না! মেয়েদের এরকম হাসি ভালা না।

অনিমেষের অস্বস্তি বেড়ে গেল। এরা যেভাবে কথা বলছে তাতে তার সঙ্গে তাল রাখা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমিকি জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলে?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ।

ওমা, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছ না কেন? অবুসিধে হচ্ছে?

ঘাড় নেড়ে তাকাল অনিমেষ, সেই একই দৃশ্য। অনিমেষ হজম করার চেষ্টা করতে লাগল।

সুরমা বলল, জেলা স্কুল! উর্বশীদের আপনি চেনেন?

থতমত হয়ে গেল অনিমেষ। তারপর ঘাড় নাড়ল, দেখেছি।

বাব্বা, জেলা স্কুলের সব ছেলে তো ওদের বাড়িতে সারাক্ষণ পড়ে থাকে। ঠোঁট বেঁকিয়ে সুরমা কথা বলর, ওরা তো এখন কলকাতায়। আপনার সঙ্গে আলাপ নেই।

অনিমেষ বলল, সামান্য।

মহিলা ঘাড় নেড়ে বললেন, ওদের মা আমার বন্ধু। ভদ্রলোক তো সারাজীবন কংস করে কাটালেন, মিসেস কর না থাকলে যে কী হত! তবু দ্যাখো, লোকে বদনাম দিতে ছাড়ে না। আমাদের এই দেশটাই এরকম। কেউ যদি একটু সাজগোজ করল, কি আধুনিক পোশাক পরল, ব্যস, চারধারে, খই ফুটতে আরম্ভ হল। এই আমিই কি কম শুনেছি!

 

শিলিগুড়িতে এসে ওদের গাড়িটা নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হরে আগে মহিলা জোর করে ওকে পরোটা আর শুকনো মাংস খাইয়েছেন। দারুণ রান্না! একটু ঝাল, বোধহয় এদের ওয়াটার-বটলটা নিয়ে জল আনতে প্ল্যাটফর্মে নামল। অল্প লোক মেনে। এত বড় প্ল্যাটফর্ম এর আগে দেখেনি অনিমেষ। চারিধার নিওন আলোয় ঝকঝক করছে। এখনও বৃষ্টি নামেনি। কুলিরা, কীসব কথা বলাবলি করছে। যদিও এর আগে কোনোদিন সে এই স্টেশনে আসেনি, তবু ওর যেন মনে হল এই আবহাওয়া স্বাভাবিক নয়। বেশির ভাগ গাড়িই খালি। জল ভরে নিয়ে হঠাৎ একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল। এর আগে কখনো একা একা সিগারেট খায়নি অনিমেষ। একটা স্টলের সামনে দাঁড়য়ে ও সিগারেট কিনে ধরাতে গিয়ে শুনল একজন লোক খুব উত্তেজিত গলায় বলছে, একটু আগে রেডিওতে বলল, দুজন খুন হয়েছে। কলকাতায় গুলি চালালে মাত্র দুজন মরবে? অসম্ভব! শালারা খবর চাপছে।

আর-একজন বলল, তা হলে তো কাল কলকাতায় আগুন জ্বলবে। পাবরিক ছেড়েদেবে নাকিএরকম হল?

আরে মশাই, আজ নাকি বাস পুড়িয়েছে তিনটে, রেডিওর খবর-বুঝে দেখুন!

হয়ে গেল, এই ট্রেন শেষ পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না দেখুন।

আরও খবরের আশায় খানিক দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। কিন্তু ওরা আর-কিছু বলছেনা দেখে মুখ তুলে তাকাল। লোক দুটো কথা বন্ধ করে ওর দিকে চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই মুখ সরিয়ে নিয়ে দুজনে হাঁটতে লাগল। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, ওদের একজন চাপা গলায় বলছে, এসব জায়গায় কতা বলা টিক নয়, দিনকাল কারাপ, কে যে কী ধান্দায় ঘুরছে বলা মুশকিল।

লোকগুলো কি ওকে সন্দেহ করল? কেন, সন্দেহ কেন? অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর চেহারার মধ্যে কি এমন কোনো চিহ্ন আছে যে অত বড় দুটো মানুষ ভয় পেয়ে যাবে। কিছুই বুঝতে না পেরে ও আস্তে-আস্তে ফিরে আসছিল নিজের কামরার দিকে। কলকাতায় আজ পুলিশ গুলি চালাল কেন? লোকেরা বাসই-বা পোড়াতে গেল কেন খামোকা? এই ট্রেন শেষ পর্যন্ত কলকাতায় যাবে না কেন?

কামরায় উঠে ও চমকৃত হল। কখন যে একটু একটু করে গাড়িটা বরে গিয়েছে বাইরে থেকে টের পায়নি এবং শুধু মানুষই নয়, চিৎকার করে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। একজন টাকমাথা মানুষ প্রথম খোপের বেঞ্চিতে বসে গলা তুলে বললেন, আরে মশাই, আমি নিজের কানে বাংলা খবর শুনেছি, লেফটিস্টরা স্ট্রাইক বানচাল হয়ে যাচ্ছে দেখে গুণ্ডামি করে ট্রামবাস পুড়িয়ে দিতে পুলিশ বাধ্য হয়ে দুএক রাউন্ড ফায়ারিং করেছে।

সঙ্গে সঙ্গে একজন চেঁচিয়ে উঠল, দাদু কি স্পটে ছিলেন?

আচ্ছা বুদ্ধি আপনার, দেখছেন এখানে বসে আছি, রেডিওতে বলল!–টাকমাথা খিঁচিয়ে উঠলেন।

আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক আজকের প্লেনে কলকাতা থেকে এসেছেন। তিনি বললেন, কমপ্লিট স্ট্রাইক হয়েছে কলকাতায়। গরমেন্ট জোর করে ট্রামবাস চালাতে চেষ্টা করে ফেল করেছে। কোন খবর বিস্বাস করব বলুন? আর-একটি কণ্ঠ বলে উঠল।

আরে মশাই, আমি ভাবছি কাল শেষ পর্যন্ত কলকাতায় পৌঁছাতে পারব কি না কে জানে! যদিপথে ট্রেন আটকে দেয়, অনেক টাকার টেন্ডার হাতছাড়া হয়ে যাবে।

প্লেনে গেলে পারতেন।

সে-চেষ্টা কি করিনি, টিকিট সব হাওয়া এই মওকায়।

ওয়াটার-বটল নিয়ে অনিমেষ কামরার শেষপ্রান্তে চলে এল। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাড়া সুরমাদের এখানে কেউ ভিড় করেনি। ওরা দুটো রেঞ্চি বেশ মেজাজেই দখর করে আছে। বৃদ্ধ অভদ্রলোক মহিলার বেঞ্চির একটা কোনায় বসে আছেন। ওকে দেখে সুরমা বলে উঠল, এই, আমারা। ভাবলাম যে আপনি নিশ্চয়ই পথ ভুলে গিয়েছেন।

মহিলা বললেন, খুব কাজের ছেলে দেখছি, এত ভাবাও কেন?

অনিমেষ উত্তেজিত গলায় বলল, আজ কলকাতায় খুব গোলমাল হয়েছে স্ট্রাইক নিয়ে, বাস পুড়েছে, গুলিতে লোক মারা গিয়েছে।

মহিলা আঁতকে উঠলেন, সে কী! হবে?

এই সময় ট্রেনটা দুলে উঠে চলতে শুরু করল। সুরমা জানলা দিয়ে সরে-যাওয়া স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলল, কালকাতায় হয়েছে তো আমাদের কী, আমরা তো শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি।

এতক্ষণ বৃদ্ধ ভদ্রলোক চুপচাপ ওদের লক্ষ করছিলেন, এবার উদাস গলায় বললেন, নগর পুড়লে কি দেবালয় এড়ায়? পাথে যখন নেমেছি তখন আর ভেবে কী লাভ, যা হবার তা হবে!

কথাটা অনিমেষের ভালো লাগল। ওকে সুরমা বসার জায়গা দিয়েছিল। বৃদ্ধের মুখোমুখি বসে ও জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?

কলকাতায়। তুমিও বোলপুরে?

না, আমি কলকাতায় যাব।

কলকাতায় কোথায়?

ঠিকানাটা সুটকেসে থাকলেও রাস্তার নাম ওর মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ বলল, সাত নম্বর হবেন মল্লিক লেন, কলকাতা বারো।

বৃদ্ধ হেসে ফেলেন, তুমি কলকাতায় এর আগে যাওনি, না? অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। বাবার এক বন্ধু স্টেশনে আসবেন।

তোমার ঠিকানা থেকে আমার বাড়ি পাঁচ মিনিটের রাস্তা, স্টেশনের কাছেই বউবাজারে। কলকাতায় পড়তে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

অন্য দিন হলে ট্রেনে জায়গা পাওয়া যেত না, আজ গড়ের মাঠ। প্যানিক একেই বলে। এবার একটু শোয়ার ব্যবস্থা করা যাক। আমি বরং ওপরের বাকে উঠে পড়ি, একদম কাল সকালে মনিহারিঘা না এলে উঠছি না।উপযাচক হয়েই অনিমেষ বৃদ্ধকে সাহায্য করল। সমস্ত মালপত্র একটা বাছে জমা করে বৃদ্ধের জায়গা অন্যটায় কয় দিল। ওর নির্দিষ্ট ঠিকানার কাছাকাছি একটা মানুষকে পেয়ে বুকে এখন কেম সাহস এসেছে। যদি সবার বন্ধুকে স্টেশনে চিনতে না পারে তা হলে আর জলে পড়তে হবে না।

রাত বাড়লে ছুটন্তু কামরায় একটা অদ্ভুত নির্জনতা সৃষ্টি হয়। ফণাকা মাঠ অথবা নদীর ওপর দিয়ে যেতে-যেতে রাতের রেলগাড়ি গজীর শব্দে চরাচর কাঁপিয়ে যায়, তখন চুপচাপ বসে থাকা বড় মুশকিল। এখন কামরাভরতি ঘুম, কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে-মাঝে অজানা অচেনা মেনে গাড়ি থামছে, কখনো ফেরিওয়ালার চিকার, কখনো তাও নেই। এই কামরায় যাত্রীরা সম্ভাব্য ভয়ের হাত থেমে নিশ্চিত হবার জন্য দরজা লক করে রাখায় কাটির টেশনে গ্যাটফর্ম থেকে কেউ-কেউ ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করেছিল। নিশ্চয়ই তখন অবধি দরজার নিকটবর্তীরা জেগে ছিলেন, কিন্তু দরজা খোলা হয়নি। এখন ট্রেনের দুলুনিতে চাকার শব্দ আর বাইরে আকাশভাড়া বৃষ্টির শীতলতায় সমস্ত কামরা গভীর ঘুমে অচেতন।

ওর শোয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওপরের একটা বাঙ্ক থেকে মালপত্র নামিয়ে শোয়া যেত কিন্তু অনিমেষের আর পরিশ্রম করতে ইচ্ছে করছিল না। ওর আজকের রাত্রে ঘুমাতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। শেষ পর্যন্ত মহিলা তাকে পায়ের কাছে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন, ইচ্ছে করলে আধশোয়া হয়ে গড়িয়ে নিতে পারে। ওপরের বাঙ্কে বৃদ্ধের নাক ট্রেনের চাকার শব্দের সঙ্গে তাল রেখে চমৎকার ডেকে যাচ্ছে। প্রথম দিকে অসুবিধে হচ্ছিল, এখন এই নির্জনতায় সেটা খাপ খেয়ে গেছে। মহিলা দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে চাদরমুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছন। এখন ওঁকে একদম অন্যরকম লাগছে। মানুষের ঘুমই বোধহয় তাকে সরলতা এনে দিতে পারে। অন্য বেঞ্চিতে সুরমা চিত হয়ে শুয়ে আছে। চাদর গলা অবধি টানা।

বৃষ্টি সমস্ত শরীরে মেখে ছুটন্ত রেলগাড়িতে এখন শীতল বাতাস ঢুকছে। যদিও জানলার কাচ নামানো তবু কোথাও বোধহয় ছিদ্র আছে। অনিমেষঅলস ভঙ্গিতে সামনের বেঞ্চিতে পা তুলে দিয়ে জানালায় চোখ রাখল। পুরু জলের ধারা কাচটাকে ঘোলাটে করে দিয়েছে। এখন দাদু নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন। পিসিমা অত বড় বাড়িতে দুজন বৃদ্ধ মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এই রাত্রে-শুধু এই রাত কেন, বাকি জীবন কীভাবে কাটাবেন। আই উইল ওয়েট ফর ইউ! অনিমেষের এই কথাটা মনে আসতেই কেমন কান্না পেয়ে গেল।

হঠাৎ ও টের পেল পায়ের ওপর কিসের স্পর্শ, মৃদু চাপ দিচ্ছে। ও এস্তে পা সরিয়ে নিয়ে চোখ খুলতেই কিছু বুঝতে পারল না। সামনে সুরমা ঘুমুচ্ছে। ঘুমের ঘোরে কি ওর পায়ের সঙ্গে পা লেগেছে। সেই সময় সরমা চোখ খুলল, তারপর খুব চাপা গলায় বলল, ঘুম আসছে না?

অনিমেষ হেসে মাথা নাড়ল।

কার জন্যে মন-কেমন করছে।

কারও জন্যে নয়।

ধ্যেৎ, মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে। আমার যে তা-ই হচ্ছে, একদম ঘুম আসছে না।

কেন?

লজ্জা-লজ্জা কুশ করল সুরমা, তারপর বলল, সব ছেড়ে যেতে কারও ভালো লাগে?

শান্তিনিকেতনে গেলে ভালো লাগবে।

মা ঘুমুচ্ছে?

হ্যাঁ। অনিমেষ মহিলার দিকে তাকাল।

গোবিন্দদাকে কেমন লাগল? ফিসফিস করে বলল সুরমা।

ভালো, কেন?

বাবা বলে, গুণ্ডা বদমাশ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মা বলে মেয়েরা নাকি কচুরিপানার মতো, যে-কোনো জায়গায় ঠিক জায়গা করে নেয়।

অনিমেষ কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ওর হঠাৎ সীতার কথা মনে পড়ল। সীতা এখন কী করছে? বুকের মধ্যে হুড়মুড় করে যেন সমস্ত ট্রেনটা ঢুকে পড়ল। ও প্রচণ্ড অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়াল। ভালো লাগছে না, কিছু ভালো লাগছে না। পাশ ফিরতেই ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। চাঁদরের তলায় সুমার সমস্ত শরীরটা কাঁপছে। ও চট করে সুমার মুখের দিকে তাকাল।অ একটা হাত ভাঁজ করে চোখের ওপর চাপা দেওয়া আর দুটো গাল ভিজিয়ে টিপে রাখা টের দিকে জল গড়িয়ে আসছে। অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল।

এই সময় কোনো বিরাট নদীর ওপর ট্রেন উঠে এল। চারধারে গমগম আওয়াজ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। কারও কান্না দেখলেই চোখে জল এসে যায় কেন? অনেকদিন বাদে হঠাৎ সেই লাইনগুলো মাথার মধ্যে ছুটে এল, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই-আমাদের আছে কেবল সুজলা সুফলা মলয়জসমীরা শীতলা-। জোরে গলা খুলে এই ইনগুলো উচ্চারণ করলেও পুলের ওপর ছুটে যাওয়া রেলগাড়ির শব্দে কেউ শুনতে পারবে না। কিন্তু মনেমনে লাইনটা মনে করতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল অনিমেষ। এখন আর এই লাইগুলো একদম সান্তনা এনে দেয় না, বুকে জোর পাওয়া যাচ্ছে না একটুকুও। কেন? কেন এরকম হল? হঠাৎ যেন অনিমেষ আবিষ্কার করল তার কিছু-একটা খোয়া যেতে বসেছে।

 

মনিহারিঘাট স্টেশনে যখন ট্রেন থামল তখন সূর্য উঠব-উঠব করছে, আকাশ পরিষ্কার। মহিলা খুব চটপটে, খানিক আগেই মেয়েকে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ছিমছাম হয়ে এসেছেন। বিছানাপত্র গুছিয়ে অনিমেষকে ভাই সোনা বলে সেগুলোকে বাঁদিয়ে জানলার পাশে বসে আকাশ দেখছিলেন। আজ সকালে-পরা চমৎকার কমলারঙের শাড়ির ওর কচি কলাপাতা রোদ এসে পড়ায় ওঁকে খুব সুন্দরী মনে হচ্ছে। সুরমা পোশাক পালটায়নি, কুক্ষু চুল কপালের ওপর থেকে সরিয়ে বলল, কী নাইস বালির চর, না?

অনিমেষের কাল নিঘুম রাত কেটেছে, এখন ভোরের হাওয়ায় ভালো লাগছিল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেও দেখল দুধারে গাছপালা ঘরবাড়ি কিছুই নেই, যেন মরুভূমির ওর দিয়ে ট্রেনটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এই সময় ওপর থেকে বৃদ্ধ ভদ্রলোক নেমে এলেন, ঘাট এসে গেছে। আঃ, ফার্স্ট ক্লাস ঘুম হল! তারপর নিচু হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই সোজা হয়ে বাথরুমের দিকে ছুটে গেলেন।

সুরমার কথাটা কানে গিয়েছিল, তাই ও বলল, এখন নদী পার হতে হবে?

মহিলা মুখ বিকৃত করলেন, বদারেশন। এখানকার কুলিরা খুব ডেঞ্জারাস!

মহিলা যখন এ-ধরনের কথা বলেন তখন তাকে মোটেই সুন্দর দেখায় না, বরং খুব কুটিল মনে হয়। কথাটা বলে এই যে উনি উদাস হয়ে সূর্যের দিকে তাকালেন তখন ওঁকে খুব সুন্দরী লাগছে, বিশেষ করে সকালবেলায় এই শাড়িটা পরায় সুরমার মা বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সুরমার দিকে তাকাল অনিমেষ, কাল রাত্রে ও চুপচাপ অনেকক্ষণ মেয়েটাকে কাঁদতে দেখেছে। অবাক কাণ্ড! খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে উঠে হঠাৎ ওইসব কথা বলে কাঁদতে লাগল, আবার কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ল। এখন এই সকালে ওকে দেখলে সেসব কেউ বিশ্বাসই করবে না।

গাড়ি মনিহারিঘাটে থামতেই চারধারে হইচই শুরু হয়ে গেল। গোলমালটা স্বাভাবিক নয়, অনিমেষ জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখল অসংখ্য স্বাস্থ্যবান কুলি সবাইকে ঠেলেঠুলে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করছে। যাত্রীরা যারা নামতে চাইছেন ওদের বিক্রমের কাছে নাজেহাল হয়ে পড়ছেন। চট করে মনে হয় বুঝি কিছু লোক খেপে গিয়ে ট্রেন আক্রমণ করেছে। এই সময় বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফিরে এসে বললেন, যে যার জায়গায় বসে থাকুন, ভিড় করে গেলে নামবেন, নইলে কুলিদের সামলাতে পারবেন না। ওর কথা শেষ না হতেই চার-পাঁচজন কুলি এসে পড়ল ওদের মধ্যে, প্রত্যেকেই হাত বাড়িয়ে। মালপত্রের দখর নেবার চেষ্টা করছে। মহিলা বোধহয় ভয় পেয়ে অথবা রেগে গিয়ে চিৎকার করতে। লাগলেন। সুরমা মুখে হাতচাপা দিয়ে বসে। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের সামলালেন না। ওর কথা শেষ না হতেই চার-পাঁচজন কলি এসে পড়ল ওদের মধ্যে, প্রত্যেকেই হাত বাড়িয়ে মালপত্রের দখল নেবার চেষ্টা করছে। মহিলা বোধহয় ভয় পেয়ে অথবা রেগে গিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন। সুরমা মুখে হাতচাপা দিয়ে বসে। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের সামলালেন। একটা কুলির মালপত্র দুজনে বয়ে নিয়ে যাবে আবদার করছে। অনিমেষের জিনিসপত্র সে নিজেই বইতে পারে, কিন্তু কুলি যখন দুজন করতেই হবে তখন মহিলা ওকে আলাদা নিতে দিলেন না। বৃদ্ধ বললেন, আগে দর টিক করে তবে মার তুলতে দেবেন।

কথাটা বলতেই ওরা বিনয়ে গেলে, যা দেবে অনিমেষরা তা-ই ওরা নেবে। বাকি কুলিরা অন্যত্র চলে গেলে শেষ পর্যন্ত ওরা বলল, কুলিপিছু দশ টাকা চাই। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দরকষাকষি করার পর সেটা অর্ধেকে নামিয়ে ওরা ট্রেন থেকে নামল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, শিলিগুড়িতে এই মালপত্র আট আনায় বওয়ানো যেতে। এখানে টেন টাইমস বেশি। ভারতবর্ষের ইকোনমি কোনোদিন সমান। হবে না। অনিমেষ কুলিদের দেখল, বেশ সহজভাবে ওরা হাঁটছে। এরকম চার-পাঁচবার মাল বইলেই ওরা মাসে ছয়-সাতশো টাকা রোজগার করতে পারে। এম এ পাশ করেও এত মাইনে সকলে পায় না। এখানে কোনোদিন হরতাল হয় না বোধহয়।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পাশাপাশি হাঁটছিল অনিমেষ! এখানে কোনো স্টেশন নেই। বোঝাই যায় অস্থায়ী মেললাইন বসানো হয়েছে। বৃদ্ধ বললেন, প্রায়ই ঘাট বদলায় তাই স্টেশন করার মানে হয় না। এমনকি এই যে দুপাশের চাটাই-এর দোকানগুলো, এরাও ঘাট বুঝে সরে-সরে যায়। ওদের দেখে দোকানদাররা চিৎকার করে ডাকাডাকি করছে চা-শিঙাড়ার লোভ দেখিয়ে। বর্ষাকালে ইলিশমাছ আর ভাত নাকি এসব দোকানের মতো আর কোথাও পাওয়া যায় না। .

পিঁপড়ের সারির মতো যাত্রীরা বালির চরে হেঁটে যাচ্ছিল। এদিকে বোধহয় বৃষ্টি হয়নি। শুকনো বালি বাতাসে উড়ছে। দুটো কলিকে অনেকটা এগিয়ে যেতে দেখে অনিমেষ ওদের ধরার জন্য দৌড়াল। মহিলা আর সুরমা পাশপাশি দ্রুত হাঁটছেন। ট্রেনটাকে কাল খালি বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন যাত্রীদের সংখ্যা খুব নগণ্য মনে হচ্ছে না। এখনও ঘাট চোখে পড়ছে না।

কুলিদের ধরে ফেলল অনিমেষ। একজন মহিলা বোধহয় বালিতে হাঁটতে পারছিলেন না, তাঁর স্বামী কোনোরকমে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন বিশালবপু মাড়োয়রি ইজিচেয়ারে শুয়ে চারজন কুলির ওপর ভর করে চলেছেন। তার দুই হাত বুকের ওপর জোড় করা, চোখ বন্ধ। অনিমেষ সামনে তাকিয়ে সূর্যদেবকে লক্ষ করল। বিরাট সোনার থালার মতো দিগন্তরেখার ওপর চুপচাপ দাঁড়েয়ে। চট করে দেললে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। দুপারে ধুধু বালির চরে এই যাত্রীরা ছাড়া কোনো মানুষ নেই। নির্জন এই প্রান্ততে চুপচাপ আমাশে উটে বসে সূর্য আলো ছুড়ে ছুড়ে মরছে। হঠাৎ সেই ছেলেবেলায় দাদুর সঙ্গে তিস্তার তীর ধরে হেঁটে গিয়ে সূর্যোদয়ের দর্শক হবার স্মৃতিটা মনে পড়ল অনিমেষের। মনটা এত চট করে খারাপ হয়ে যায়। কেন যে কোনো ভালো জিনিস দেখলেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়! সূর্য আস্তে-আস্তে রং পালটাচ্ছে, সেই ছেলেবেলার মতো ওর শরীরে যেন জুলনি শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এই সময়ের মধ্যে সে কত বড় হয়ে গিয়েছে, দাদু আরও বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু সে-সময়ের সকালবেলাগুলো, সূর্য ওঠার ভঙ্গিটা ঠিক একই রকম। রয়েছে। ওদের বোধহয় কখনো বয়স বাড়ে না, মানুষের হার এখানেই।

যে ওদের দেখেই তাড়াতাড়ি আসার জন্য স্টিমারটা হুইল বাজাচ্ছিল। বেশ গম্ভীর, জ্যাঠামশাই টাইপেলের গলা। এর আগে কখনো স্টিমার দেখেনি অনিমেষ। তিস্তায় একবার একটা বোট এসেছিল, তার ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দটা মনে আছে। এখন এই স্টিমারটাকে দেখতে ওর বেশ ভালো লাগল। অনেকটা লম্বা, লালে হলুদ সূর্যের আলো পড়ায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। পিলপিল করে মানুষেরা পাটাতনের ওপর দিয়ে ওর বুকে ঢুকে যাচ্ছে। এখানে কোনো ঘরবাড়ি নেই, দূরে কিছু খোড়ড়া জঙ্গল। যাত্রীদের কেউ-কেউ ঝটপট জলে নেমে দুএকটা ড়ুব দিয়ে নিল গঙ্গায়, কুলিদের পেছন পেছন

অনিমেষ ডেকে উঠে এল। চারধারে দড়ি লোহার বিম ছাড়ানো, এর মধ্যেই সবাই জায়গা করে। নিয়েছে। কুলি দুটো এক জায়গায় মালপত্র নামিয়ে পয়সার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল, অনিমেষ ওদের অপেক্ষা করতে বলল। সুরমারা মালপত্র নামিয়ে পয়সার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল, অনিমেষ ওদের অপেক্ষা করতে বলল। সুরমারা এখনও আসছে না কেন? ক্রমশ ভিড়টা বাড়ছে। ও দেখল কিছু সুরেশী মানুষ ভিড় বাঁচিয়ে দোতলায় চলে গেল। সেখানে সবাই উঠছে না। সুন্দর লোহার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ও অনুমান করে নিল, ওপরটা নিশ্চয়ই প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। নিচের তলায় হইচই হচ্ছে খুব। ওপাশে দুটো চায়ের স্টলের সামনে প্রচণ্ড ভিড়। অনিমেষ লক্ষ করল, যেন পুরো ভারতবর্ষটাই উঠে এসেছে এখানে-বাঙালি, বিহারি, মদ্রাজি থেকে ভুটিয়ারা পর্যন্ত সবাই গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে।

শেষ পর্যন্ত সুরমারা এল। তখন স্টিমার ঘনঘন হুইসল দিচ্ছে। ভিড় সরিয়ে মহিলা যখন চারদিকে ওকে খুঁজছিলেন তখন অনেকের চোখ ওর ওপর এট ছিল। অনিমেষকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে ছেলেমানুষের মতো হেরে বললেন, হিমালয় থেকে একজন সাধু এসেছেন, দেখেই মনে হয় খুব খাটি মানুষ।

সুরমা বলল, সাধুরা খাটি হলে মানুষ থাকে না, মহামানব হয়ে যায়।

মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে যেন মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে বললেন, আরে, এখানে মালপত্র নামিয়েছ কেন? ওপরে চলল। এই বাজারের মধ্যে দুঘন্টা থাকলে আমি মরে যাব।

কুলিদের তাগাদা দিয়ে মালপত্র তুলিয়ে তিনিই প্রথমে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চললেন। অনিমেষ সুরমার সঙ্গে ওর পেছনে যেতে-যেতে বলল, ওপরটা বোধহয় ফার্স্ট ক্লাস! আমাদের উঠতে দেবে?

সুরমা মুখ টিপে হেসে হলল, মা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।

দোতলায় সিঁড়ির মুখে স্টিমার কোম্পানির একজন হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মহিলা তার সামনে গিয়ে ঘাড়টাকে সামান্য বেঁকিয়ে বললেন, ও, নিচে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওপরে জায়গা নেই।

ভদ্রলোক ধমতম হয়ে কোনোরকমে বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আজকে ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জার কম। ওপাশটা একদম খালি আছে।

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা হাত বাড়িয়ে কুলিদের নির্দেশ দিলেন রেলিং-এর ধার-ঘেঁষে একটা খালি সোফার সামনে জিনিসপত্র রাখতে। কুলিরা বিনা বাক্যব্যয়ে কম তামিল করতেই অনিমেষ আর সুরমা ওদের সঙ্গে এসে সোফায় বসল। অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মহিলা ভদ্রলোকের সঙ্গে মিষ্টি করে কীসব কথা বলতেই ভদ্রলোক হেসে ঘাড় নাড়লেন। যেন এইমাত্র পলাশির যুদ্ধটা জিতে গেছেন এইরকম ভঙ্গিতে ওদের কাছে ফিরে এসে মহিলা বললেন, চিরকাল ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়া-আসা করেছি, এরা সবাই আমাকে চেনে। নিচে নরককুও।

এবার একজন কুলি অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, পিয়া দিজিয়ে মেমসাব।

যেন মনে পড়ে গিয়েছে এইরকম একটা ভঙ্গি করে ব্যাগ খুললেন মহিলা, তারপর একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে সামনে ধরলেন। কুলি দুটো বেজায় খেপে উঠল। তারা বলতে লাগল দশ টাকা দেবার কথা হয়েছে এবং ওরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করায় আর মাল বইতে পারেনি আর এখন পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেবার কারণটা কী? মহিলা পুতুলের মতো মাথা নেড়ে বললেন, যে, নোটিশবোর্ডে লেখা আছে কুলিদের রেট কী। এই মাল সেইমতো ওজন করে যা পড়বে তিনি তা-ই দেবেন। অনেকক্ষণ ঝগড়া চলতে লাগল। অনিমেষ দেখল দোতলায় মুষ্টিমেয় যাত্রীরা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের। যদিও কুলিরা বেশি নিচ্ছে তবু যখন একবার কথা হয়েই গিয়েছে তখন আর আর এখন করার কোনো অর্থ হয় না। ও ওদের ঝগড়ায় মধ্যে কোনো কথা বলছিল না। শেষ পর্যন্ত সুরমাকে বলতে শুনল, ম, টাকাটা দিয়েই দাও।

কিন্তু ভদ্রমহিলার অসম্ভব ধৈর্য, শেষ পর্যন্ত কুণিদের ছয় টাকায় রাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল। যাওয়ার সময় অনিমেষ শুনল, ওরা চাপা গলায় বোধহয় গালাগালি দিতে দিতে চলে গেল। এবার মহিলা ধপ করে ওর পাশে এসে বসলেন, কী পুরুষমানুষ বাবা, আমি এতক্ষণ একা ঝগড়া করে গেলাম, একটাও কথা বললে না।

অনিমেষ সোজা হয়ে বসে বলল, না মানে, আপনি তো কথা বলছিলেন তাই-। এই প্রথম কোনো মহিলা তাকে পুরুষমানুষ বলল। ও চট করে একবার সুরমাকে দেখে নিল। ডানদিকে রেলিং ধরে একদম খাটো প্যান্ট আর লাল গেঞ্জি-পরা একটা ছোকরা সাহেব প্যান্ট-পরা এক মেমসাহেবের সঙ্গে গল্প করছে-সুরমার চোখ সেদিক থেকে সরছে না। মহিলা সমস্ত শরীর সোফায় এলিয়ে দিয়ে সামনে তাকালেন। ওরা গঙ্গার দিকে মুখ করে বসে, ঘাট দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। চট করে বোঝা যায় এই নদীর অপর পাড় সকরিকুলি। অনিমেষের মনে হল সমদ্র বোধহয় এইরকম। ওর হাতে নাকি বিদেশযাত্রার রেখা আছে। বেশ হত যদি এইস্টিমার গঙ্গানদী দিয়ে সমুদ্রে, সেখান থেকে ভারত মহাসগর, অতলান্তিক বেয়ে ইংলভ আমেরিকা চলে যেত। ও দেখল একটা লম্বাটে ধরনের পাখি ছোঁ মেরে জল থেকে মাছ তুলে নিয়ে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে পাড়ের দিকে উড়ে গেল।

মহিলা বললেন, এবার চা না খেলে মাথা ধরবে। অনিমেষ, বেয়ারাকে বলে এসো, তো!

চায়ের কথায় অনিমেষের খেয়াল হল সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। এখানে জিনিসপত্রের দাম কীরকম? যদি খুব বেশি হয় তা হলে নিচ থেকে খেয়ে এলেই হত। ওকে উঠতেদেখে মহিরা বললেন, ঠিক আছে চলল, রেস্তোরাতেই খেয়ে আসি। জাহাজটা ঘুরে দেখা যাবে। হ্যারে, তুই চা। খাবি?

সুরমা সাহেবদের দিকে মুখ রেখেই বলল, নাঃ! আমার জন্য একটা কেক এনো। আমার উঠতে ভালো লাগছে না।

সকালবেলায় চা না খেয়ে কীভাবে থাকিস বাবা, কে জানে! যাক, মালপত্রগুলো দেখিস তা হলে, আমরা আসছি।

অনিমেষ উঠতেই কান ফাট: হুইল বেজে উঠল। স্টিমার এবার ছাড়ছে। চিৎকার চামেচির মধ্যে ওরা পায়ের তলায় দুলুনি অনুভব করল। ঘড়ঘড় শব্দে কোথাও ইঞ্জিন চলছে, রোদে সমস্ত গঙ্গা এখন উজ্জ্বল। অনিমেষ দেখল ওপরের ডেকে যারা বসে আছেন তাদের মধ্যে কোনে উত্তেজনা নেই। এরা কথা বলেন চাপা গলায়। একজন বিরাট-চেহারার মাড়োয়ারিকে ও শুধু নিঃশব্দে ঘুমুতে দেখল। এখানে কেউ কাউকে দেখছে না, যেন প্রত্যেকে অস্তিত্ব ভুলে বসে আছে। বেয়ারারা চায়ের ট্রে নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের। এই পরিবেশ ওর কাছে একেবারে নতুন।

রেস্তোরায় ভিড় নেই। মাত্র দুজন মানুষ বসে আছেন জানলায়। খুব চাপা গলায় ওঁরা কিছু আলোচনা করছিলেন, অনিমেষদের ভালো লাগল না। রেস্তোরার জাল বসলে বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যায়। মহিলা আর ও পাশাপাশি বসতেই বয় ছুটে এল! দুটো ওমলেট টোস্ট আর চা বললেন তিনি, জান অনিমেষ, সকালবেলা আমার একটা করে ডিম চাই। এমনিতেই আমি খুব লাইট খাবার নাই। ওজন বেড়ে যাচ্ছে খুব। আমি বাবা মিসেস কর হতে চাই না।

এই প্রথম এরকম সাহেবি রেস্তোরতে অনিমেষ এল। পরীক্ষার পর মণ্টুর সঙ্গে রূপশ্রীর পাশে একটা দোকানে ওরা কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়ার অভ্যেস করেছিল। খাবার এলে ও সেটাকে কাজে লাগাল। মহিলা বললেন, তোমাকে যেন আমি এর আগে কোথায় দেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

চট করে হাত কেঁপে উঠল অনিমেষের। ও মন দিয়ে খাওয়া মুরু করল। এখনও চোখ বন্ধ করলে সে কুষ্ঠরোগীটাকে দেখতে পায়। এই মহিলা যদি সেই ঘটনার কথা মনে করতে পারেন তা হলে নিশ্চয়ই আর এখানে বসে থাকবেন না। নাকি এতদিন পরেও অনিমেষ সুস্থ আছে দেখে নিজের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হবেন তবু অনিমেষ ঠিক করল সে চেনা দেবে না। মহিলা নিজের মনে বললেন, জলপাইগুড়ির ছেলেরা যা হয়েছে না, আমি অবাক হয়ে যাই। আমাদের সময় এরকম ছিল না। তাই তো আমি সুরমার ভাইকে কার্শিয়াং-এ পাঠিয়ে দিয়েছি পড়তে।

অনিমেষ সেই গোলালুর সন্ধান পেয়ে মাথা নাড়ল। তখনই তো সে ওর সমান ছিল, এখনও সে স্কুলে পড়ছে? অবশ্য মিশনারি স্কুলের নিয়মকানুন ও জানে না।

এই ছেলে, একদম মুখ নিচু করে খাচ্ছ যে, কথা বলবে না?

মুখ তুলল অনিমেষ, আবার সেই দৃশ্য। মহিলা যেভাবে বসে আছেন তাতে তার বুকের কাপড় জায়গায় থাকছে না। অতখানি সাধা উঁচু জায়গা এমন চট করে লজ্জা এনে দেয় কেন? তিস্তার পাড়ে অথবা স্বর্গহেঁড়ায় অনেক দেহাতি মেয়ে অথবা ভিখিরিদের নগ্ন বুক দেখেছে ও, তখন তো এরকম হত না! হঠাৎ মহিলা হাসলেন, আমার বয়স কত বলো তোর।

ওমলেট খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, চায়ের কাপ টেনে নিয়ে অনিমেষ বলল, বলতে পারব না।

এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন তিনি যেন অনিমেষকে নিয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না, থার্টিফাইভ। আমাকে অতটা দেখায়?

না। অনিমেষ হাসল।

সুরমা একদম বাপের মতো হচ্ছে, চেহারার দিকে যত্ন না নিলে বেঁচে থেকে লাভ কী? কলকাতায় গিয়ে কোথায় উঠছ।

আমার বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে। তারপর হোস্টেলে চলে যাব।

গুড। এর মধ্যে তুমি কলকাতাটা ভালো করে ঘুরে দেখে নাও। আমি ভাবছি সুরমাকে শান্তিনিকেতনে ভরতি করে মাসখানেক পরে কলকাতায় যাব। তখন তুমি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে। কী, দেখাবে না?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। বিল মিটিয়ে দিয়ে উনি রেস্তোরাঁ থেকে দুটো কেক কিনলেন, কলকাতার মতো কেক আর কোথাও পাওয়া যায় না।

ওর বাইরে বেরিয়ে এলে মহিলা সুরমা যেখানে বসেছিল সেকানে না গিয়ে ওকে নিয়ে উলটোদিকের ডেকটা ধরে হাঁটতে লাগল। খুব বাতাস দিচ্ছে এখন। নদীর দিকে চোখ রেখে মহিলা বললেন, ওঃ, কতদিন পরে আজ একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! জলপাইগুড়িতে মানুষ থাকতে পারে! সেই সংসার আর সংসার। নিজের বলে আর কিছু থাকে না। অনিমেষ কিছু বলল না। ও ক্রমশ টের পাচ্ছিল এই মহিলার এত সাজগোজ, এত কথার আড়ালে একটা দুখি মন আছে। কেন কিসের জন্য দুঃখ তা সে জানে না। দূরে জলের মধ্যে কিছু ভেসে-ভেসে উঠছিল। অনিমেষ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই লক্ষ করল একটা জলচর প্রাণীর কালো পিঠ দেখা যাচ্ছে। ও উত্তেজিত হয়ে মহিলাকে সেটা দেখাতেই তিনি সেদিকে তাকিয় ভীষণ নার্ভাস হয়ে অনিমেষকে শক্ত হাতে ধরলেন, ওটা কী! কুমির?

ততক্ষণে প্রাণীটা বোধহয় সাহস বেড়েছে। গোল হয়ে ডিগবাজি খেতে-খেতে জল থেকে লাফিয়ে উঠছিল। নিচের ডেকে সবাই বোধহয় দেখেছে। খুব হইচই করে সবাই স্টিমারের এদিকে আসতেএপাশটা একটু কাত হয়ে গেল। একজন কুলিমতন লোক ডেকের এদিকে আসছিল, অনিমেষদের দেখে একগাল হেসে বলল, শুশুক।

আর এই সময় ইঞ্জিন প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল। ঘনঘন হুইসল বাজছে। ওরা এখন নদীর প্রায় মাঝখানে। গঙ্গার বড় বড় ঢেউগুলো স্টিমার ছুঁয়ে যাচ্ছে। ওরা প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা, নিচের চিৎকারে বািক হয়ে মহিলা বললেন, কী হয়েছে নিচে।

স্টিমারের লোকজন তখন ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওরা সুরমার কাছে ফিরে আসতে শুনতে পেল জল কম থাকায় স্টিমার চরায় আটকে গেছে। অন্য যাত্রীদের মুখে এখন বিরক্তি, এভাবে স্টিমার চালানো হয় কেন? কেন জল মেপে আগে থাকতে গভীরতা বোঝা যায় না। ওদের ওপরে রেখে অনিমেষ ব্যাপারটা দেখবার জন্য নিচে নেমে এল। ওপরের বিরক্তি এখানে অন্যরকম চেহারা নিয়েছে। লোকে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সারেং মাল্লারা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্টিমারটাকে উদ্ধার করার জন্য। যেভাবে হেলে রয়েছে এটা একদিকে, বেশি নড়াচড়া করলে অন্যরকম বিপদ যেতে হতে পারে সেটাও সবাই বুঝে গিয়েছে।

অনিমেষ বুঝতে পারছিল না নদীতে যখন এত ঢেউ তখন চরায় ঠেকে যায় কী করে স্টিমার একজন বলল, জল অল্প বলেই ঢেউ বেশি, খালি পাত্রে বেশি শব্দ হয়। সেই শুকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। যদি স্টিমার ড়ুবে যায় তা হলে কী হবে? ওর নাকি জলে ডোবার ফাঁড়া আছে। সাঁতার না জানার জন্যে এখন আফসোস হচ্ছিল অনিমেষের।

একটু একটু করে পরবর্তী সমস্যাগুলো সবাই জানতে পারছিল। নদী পার হবার জন্য দুটো স্টিমার ছিল, অন্যটাকে জরুরি প্রয়োজনে রাজমহলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।এইটাই এখন পারাপার করছে। ট্রেনের যা সময় তাতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না যাত্রীদের। ফলে জল বাড়া অথবা অন্য স্টিমারটিকে রাজমহল থেকে ফিরিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার না করা পর্যন্ত ওদের এইখানেই আটক থাকতে হবে। এইভাবে বন্দি থাকার কথাটা যতই মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ছিল যাত্রীরা ততই নার্ভাস। হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টলের খাবারগুলো শেষ হয়ে গেল। অনেক দূরে জলের সীমার শেষে সকরিকলি ঘাট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা অনেক দূর। এখানে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে।

অনিমেষ ওপরে উঠে এল। মহিলা ওকে দেখেই ছুটে এল, কী হবে, অনিমেষ?

বিকেলনাগাদ জোয়ার আসবে বলছে সবাই। অনিমেষ ব্রিত হয়ে বলল।

বিকেল অবধি এখানে থাকলে আমরা কখন বোলপুরে পৌঁছাব? ওঁর মুখ কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অনিমেষের এই ব্যাপারটা একদম খেয়াল ছিল না। ওপারে গিয়ে ট্রেনে উঠলে সেটা দশটায় ছাড়ত, খুব আস্তে গেলেও বিকেলনাগাদ শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছাত। এখন যা অবস্থা তাতে কখন ওপারে পৌঁছাবে কখন ট্রেন ছাড়বে আর কখন সেটা কলকাতায় গিয়ে পৌঁছাবে কেউ বলতে পারবে না। তা হলে বাবার বন্ধুর দেখা সে পাবে কী করে? হঠাৎ যেন সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হতে বসেছে। অবশ্য এর ঠিকানা অনিমেষের কাছে আছে, অসুবিধে আর কতটুকু হবে।

কিন্তু এই স্টিমারের অনেকেই প্রচণ্ড সমস্যা দেখা দিল। কেউ যাবে রাতের প্লেন ধরতে, কাল ভোরেই অন্যত্র ট্রেন ধরার কথা, কারও ইন্টারভিউ, কেউ-বা আগামীকাল হাইকোর্টে কেস করতে যাচ্ছে। যদি ট্রেন আগামীকাল সকালের মধ্যেও না পৌঁছায়। বেলা বড়াতে লাগল। জল বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই, নিচের হইচই.এখন অনেকটা কম। সবাই বুঝে গিয়েছে কিছুই করার নেই। এবং এই স্টিমারে আর খাবার বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। অনিমেষের একবার মনে পড়ল ওর ব্যাগে পিসিমার দেওয়া খাবার এখনও পুরোটাই রয়েছে। কাল রাত্রে মহিলা ওকে নিজের খাবার খেতে দেননি। কিন্তু এখনও ওর একটুও খিদে পায়নি। মহিলা কয়েকবার খাবার খাবার করছিলেন। অনিমেষ ভাবল একবার বলে, ওরা ঘণ্টা দুয়েক আগে মাত্র জলখাবার খেয়েছে। এখনই খিদে লাগার কোনো কথা নয়। কিন্তু ও কিছু বলল না। খাবার নেই জানলেই বোধহয় মানুষের খিদেবোধটা চট করে বেড়ে যায়।

অনিমেষ আবার নিচে এল। দুএকটা মাছধরা নৌকো এখন ওদের স্টিমারের কাছাকাছি এসেছে। ওদের একটায় স্টিমারের একজন লোক পাড়ে চলে গেল। সে গিয়ে খবরাখবর দেবে। কই, নৌকোয় এত বড় নদী পার হবার সাহস কারও হল না। সবাই অসহায়ের মতো মুখ করে বসে। ভিড় বাঁচিয়ে কোনোরকমে হাঁটতে গিয়ে অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। একটা জায়গায় কিছু মানুষ গোল হয়ে বসে, মধ্যিখানে সর্বাঙ্গে ছাইমাখা জটাধারী একজন সাধু। মুখচোখ দেখলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। স্নিগ্ধ মুখে হাসি, মাথা নেড়ে শ্রোতাদের কথা শুনছেন। কেউ-একজন বলল, বাবা ইচ্ছে করলে স্টিমার চালু করতে পারেন। কে জানে হয়তো একটা বাবারই খেলা, নইলে রোজ স্টিমার চলছে, আজ হঠাৎ আটকে যাবে কেন? কথাটা যে অনেকের মনে লেগেছে সেটা একটু বাদেই বোঝা গেল। ভক্তদের। সংখ্যা বাড়ছে। কিছু বিহারি ভক্ত ধ্বনি দিয়ে উঠল, গঙ্গা মাঈকি জয়, সাধু বাবাকি জয়।

খানিক বাদেই, স্টিমারের সব মানুষ মাঝখানে জড়ো হয়ে গেল। অনিমেষ শুনল বাবা নাকি রাজি হচ্ছিলেন না কোনো পুজোআচ্চা করতে, কারণ তিনি ম্যাজিক দেখাতে ভালোবাসেন না, কিন্তু ভক্তদের চাপে তাকে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়েছে। অনিমেষ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে আর। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। ও কোনোরকমে দোতলায় উঠবার সিড়িতে এল, এখান থেকে মানুষের মাথা ডিঙিয়ে বাবাকে দেখা যাচ্ছে। কিছু ভক্ত সবাইকে সামলাচ্ছে, কসময় দর্শক পাটাতনের ওপর বসে গেল। মুহুর্মুহু বাবার নামে জয়ধ্বনি উঠছে। এর মধ্যে কোথা। কে কিছু ফুল বেলপাতা যাোড় হয়ে গিয়েছে। এগুলো নিয়ে যে মানুষ ট্রেনযাত্রা করতে পারে অনিষ বিশিত হয়ে আজ আবিষ্কার করল। বাবার নির্দেশে একটা পাত্রে টাটকা গঙ্গাজল তুলে আনা হল। নিজের ঝোলা থেকে কিছু কাঠ বের করে বাবা শেষ পর্যন্ত পুজোয় বসলেন।

অনিমেষ মহিলাকে ব্যাপারটা বলতে ওপরে উঠে এসে দেখল খরবটা আগেই এখানে পৌঁছে গেছে। ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীরা এখন আর ছড়িয়েছিটিয়ে নেই, সবাই প্রায় এক জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সমস্যায় সমাধানের উপায় ভাবছিলেন। সেই বৃহৎ মাড়োয়ারি তখন কথা বলছিলেন, আরে নেহি নেহি, সাধুবাবালোগে সবকুছ কৃর সেকতা।

একজন সুট-টাই-পরা প্রৌঢ় পাইপ খেতে-খেতে বলনে, আই ডোন্ট থিংক সো, তবে কোনোকোনো সময় মিরাকল ততো হয়েও যেতে পারে।

সেই ছোট প্যান্ট-পরা সাহেবটি বলল, ড়ু ইউ থিংক হি ইজ এ রিয়েল সাধু?

সুরমার মা সঙ্গে ঘাড় নাড়লেন, আমার মনে একটুও সন্দেহ নেই, প্রথম দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম একদম খাটি মানুষ।

প্রোঢ় বললেন, আমাকে আজ রাত্রের প্লেন ধরতেই হবে, পারহ্যাপস দিস ম্যান ক্যান হেল্প মি।

মাড়োয়ারি বললেন, আরে ভাই, আজ কলকাতা নেহি যানেসে মেরা দো লাখ রুপয়া লোকসান হো যায়েগা।

কথাবার্তাগুলো আর সেইরকম চাপা গলায় নয়, নিচের তলার মতো গলা খুলে এরা কথা বলছিলেন। অনিমেষকে দেখতে পেয়ে সুরমা বলে উঠল, ওই যে মা, এসে গেছে।

মহিলা ওকে দেখতে পেয়ে উৎসুক মুখ করে কয়েক পা এগিয়ে এলেন, নিচু শুনলাম সেই সাধুবাবা পুজো করছেন?

অনিমেষ হাসল, হ্যাঁ, খুব ভিড় হয়েছে।

মহিলা বললেন, চলো, আমি যাব।

সঙ্গে সঙ্গে সুরমা বলে উঠল, আমিও যাব না।

মহিলা একটু ইতস্তত করলেন, যাবি? কিন্তু মারপত্র সব পড়ে রইলযে! আচ্ছা ভাই অনিমেষ, তুমি এখানে একটু থাকবে? তোমার তো দেখা হয়ে গেছে।

অগত্যা অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, যদিও ওর এখানে একটুও থাকতে ইচ্ছে করছিল না। ওকে রাজি হতে দেখে অন্য সবাই যেন চাঁদ হাতে পেয়ে গেল। সবার মালপত্র পাহারা দেবার ভার নিতে হল ওকে। অনিমেষ দেখল মহিলার পেছন পেছন দোতলার মানুষগুলো একতলায় নেমে গেল। বিস্ময় বাড়ছিল ওর, কী তাড়াতাড়ি মানুষগুলো চেহারা বদলে গেল। কছুক্ষণ ও দোতলার রেলিং ধরে চেয়ে রইল জলের দিকে। ঘোলা জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। আকাশ বেশ মেঘলা, রোদের জৌলুস নেই একটুও, যদিও সূর্য আছে সামান্য ওপরে। ও মালপত্রগুলোর দিকে তাকাল। বেশির ভাগ ব্যাগের ওপর নামধাম লেখা। ওঁরা কী বিশ্বাসে সবকিছুর দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে গেলেন। যদি ও এগুলো নিয়ে কেটে পাড়ে, ভাবতেই হাসি পেল ওর, কারণ এইরকম মাঝগঙ্গায় আটক থেকে কেউ জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে পারবে না। তা ছাড়া নামবার সিডি তে মোট একটা।

নিচে কী হচ্ছে দেখার কৌতূহলটা আস্তে-আস্তে বেড়ে যাচ্ছিল। অনিমেষ সিড়ির কয়েক ধাপ নেমে এল, এখান থেকে দেশকে অসুবিধে হচ্ছে না। কালো মাখাগুলোর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সরিয়ে ও সাধুবাবার দিকে তাকাল। আর তাকাতেই চমকে উঠল অনিমেষ, পদ্মাসনে বসে চোখ বন্ধ করে মনে হয় মন্ত্র পড়ছেন সাধুবাবা আর তার সামনে সাষ্টাঙ্গে পড়ে আছেন সুরমার মা। তার দামি শাড়ি ডেকের ধুলোজলে লুটোপুটি খাচ্ছে, সুরমা পাশে হাঁটু গেড়ে দুহাত জোড় করে বসে! ওঁদের পেছনে ফাস্ট ক্লাসের অন্যান যাত্রী গদগদ হয়ে বসে আছে। মাড়োয়ারি ভাভদ্রলোক মা বাবার পায়ের কাছে মাথা নিয়ে গিয়েছেন। চারধার থেকে বাবার নামে জয়ধ্বনি উঠছে। এখন আর ওপর আর। নিচতলার যাত্রীদের মধ্যে কোনো ফরাক নেই, সবাই গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছেন। ঠাৎ অনিমেষের সামনে সুনীলদার মুখটা ভেসে উঠল। সুনীলদারা কি এইরকম ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেন?

আকাশে মেঘ বাড়ছে, একটু একটু করে বাতাসের দাপট বাড়ছে। সুনীলদার কথা মনে হতেই ওর মনে হল গতকাল কলকাতায় বাস পুড়েছে, পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা গিয়েছে। ব্যাপারটা তার মনেই ছিল না সকাল থেকে। দেশের কিছু মানুষ খাবা দাবি করে ধর্মঘট করছে, কিছু লোক সেটাকে সমর্থন করছে না। এই দুদল যতক্ষণ-না এক হবে-অনিমেষের মনে হল খুব বড়, এই স্টিমারে যেমন হয়েছে সেরকম সমস্যা না এলে দুদল কখনো এক হাতে পারে না। যারা দেশের কথা চিন্তা করেন তারা এটা কি জানেন না।

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে এখন। ঝোড়ো বাতাস জাহাজটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে মাঝে-মাঝে। হঠাৎ স্টিমারটা সামান্য দুলে উঠতেই সবাই চিৎকার করে উঠল। এতক্ষণ ইঞ্জিন বন্ধ ছিল, এবার সেটা শব্দ করে জেগে উঠল। ইঞ্জিন-চালক বোধহয় এই দুলুনিকে অবলম্বন করে স্টিমারটাকে নড়াবার চেষ্টা করছেন। এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো একসময় স্টিমার সত্যিই নড়ে উঠল। তারপর শব্দটাকে গানের মতো বাজিয়ে এগিয়ে চলল জল কেটে। ঝড়ের বেগ খুব বাড়ছে। বৃষ্টির জল এসে দোতলার ডেক ভিজিয়ে দিচ্ছে। অনিমেষ দৌড়ে এসে জিনিসপত্রগুলো সরিয়ে রাখত লাগল। এখন নদীর ওপর বৃষ্টি যেন অজস্র দেওয়াল তৈরি করে ফেলেছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর ওঁরা উপরে উঠে এলেন। মহিলা এখন ভক্তিতে আপুত, নিমেষকে সামনে পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, দেখলে বাবার কী লীলা, তখনই বলেছিলাম কী জাগ্রত সাধু।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক পাইপ ধরাতে ধরাতে বললেন, ইটস ও মির্যাকল! যাক, মাত্র তিন ঘণ্টা লেট হয়েছে। নিশ্চয়ই মেকআপ হয়ে যাবে।

কে-একজন বলল, বৃষ্টি শুরু হল–।

দূর মশায় ট্রেনে উঠলে বৃষ্টি কোনো প্রব্লেম নাকি!

অনিমেষ সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক কোথায়? নিচের ভিড়ে এতক্ষণ তাকে দেখেনি সে। সাধুবাবা সেই জায়গায় বসে আছেন। তার সম্পত্তিতে আর-একটা পুটুলি যোগ হয়েছে। ভক্তরা তাদের প্রণামি দিয়েছে। বেশকিছু মানুষ এখনও তাকে ঘিরে রয়েছে। কথা বলছেন না তিনি, মুখে প্রশান্তি। ঘট যত এগিয়ে আসতে লাগল তত উত্তেজনা বাড়তে লাগল। কে আগে ঘাটে নামতে পারবে তার জন্য ঠেলাঠেলি চলছে নামবার মুখটাতে। এখান থেকে বৃষ্টিতে-ভেজা ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে। স্টিমার আসছে দেখে ড্রাইভার বোধহয় খুশিতে দুবার হুইসল বাজিয়ে দিল।

স্টিমার ঘাটে লাগতেই একটা কাঠের পাটাতন নামিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে জলরাশির মতো মানুষ বেরিয়ে যেতে লাগল সেই ছোট্ট রাস্তা দিয়ে। নিচের তলায় সব মানুষ এখন মুখটাতে জড়ো হয়েছেন। স্টিমারের লোকজন বারণ করছে এভাবে দাঁড়াতে কিন্তু কে শোনে কার কথা! সাধুবাবাও এদের মধ্যে আছেন। অনিমেষ দেখল বাইরের মাটিতে পা রাখার উত্তেজনায় কেউ আর তাকে খেয়াল করছে না। এই সময় সে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখতে পেল। চোখাচোখি হতেই তিনি হাত নেড়ে চেঁচিয়ে ওকে আসতে বললেন। ওপারে গিয়ে ট্রেনে ভালো জায়গা পেতে আগে যাওয়া দরকার। বৃষ্টিতে ভিজতে হবেই, কোনো উপায় নেই। মানুষেরা ধাক্কাধাক্কি করতে করতে যাচ্ছে। একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে পিছনের মানুষের পায়ের তলায় যেতে-যেতে বেঁচে গেল।

অনিমেষ জায়গা রাখতে, আপনারা কুলির সঙ্গে আসুন।

মহিলারা বললেন, বৃষ্টিতে যাব কী করে?

অনিমেষ বলল, উপায় নেই। ও আর দাঁড়াল না। দৌড়ে নিচে এসে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। প্রচণ্ড ঠেলাঠেলি, কনুইয়ের গুতো সামলে সে পাটাতনটার ওপর এসে দেখল দুধারের দড়ির রেলিংএর ওপর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, বেতাল হলেই জলের তলায় চলে যাবে। নিজের ব্যাগ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল ও, চারধারে মানুষের আড়াল। সামনে বৃষ্টি হয়ে পথ পিছল থাকায় খুব সন্তর্পণে লোক এগুচ্ছে। একসময় হইহই গেল গেল শব্দ উঠল উপস্থিত যাত্রীদের মধ্যে, ততক্ষনে অনিমেষ বৃষ্টিতে নেমে পড়েছে, থেমে দাঁড়ালে পায়ের তলায় পড়তে হবে বলে ও দৌড়াতে শুরু করল। পেছনে কী হচ্ছে বোঝার আগেই ও সামনে ট্রেনটাকে দেখতে পেল। বৃষ্টির ফোঁটায় সমস্ত শরীর ভিজে একশা। ও অবাক হয়ে দেখল অত বড় ট্রেনটা একদম খালি। যে-যাত্রীরা আজকের ট্রেনের পক্ষে নিতান্তই সামান্য। অথচ কী ভয়েই সবাই এখনও ছুটে আসছে। এই সময় একজন কুলি চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল, সাধুবাবা গির গিয়া, জাহাজকা অন্দর ঘুস গিয়া।

হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ। সে-মানুষটাকে বিপদের সময় সবাই আশ্রয় করেছিল তাকেই জনতার চাপে জলে পড়তে হল! সেই প্রশান্ত মুখটাকে মনে করে অনিমেষ ছুটন্ত যাত্রীদের দিকে তাকাল। কারও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। প্রয়োজন ছাড়া মানুষের অন্য কোনো আকর্ষণ বোধহয় থাকে না। অনিমেষ সামনে-বসা বৃদ্ধ ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। তিনি হেসে বললেন, আড়াই ঘণ্টা লেট। তা আমরা নটার মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যাব, বুঝলে!

যতদূর চোখদেখা যায় মাঠ আর মাঠ, মাছে-মাছে দলবাঁধা তালগাছগুলো গলাগলি করে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ছে, এইরকম চিত্র ট্রেনের জানালার বাইরে অনেকক্ষণ স্থির ছিল। জলপাইগুড়ি শহরের বাইরের যে-বাংলাদেশ তার চেহারা এত আলাদা একথা কোনো ভূগোল বইতে অনিমেষ পড়েনি। সূর্য-ঢালা বিকেলে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস বোলপুরে এসে জিয়োল।

 

বৃষ্টি শেষ হয়েছিল সাহেবগঞ্জে। চারধারে রুক্ষ মাটি, মাটির ঘরের ওপর ধুলোর চাদর, ঠাণ্ড মেজাজ কোথাও নেই। কলকাতায় আসার পথে অন্য একটা প্রদেশের ওপর দিয়ে খানিকটা আসতে হয় বলে ভালো লাগছিল অনিমেষের। সেই প্রকৃতির চেহারাটা একটু একটু করে বদলাল বীরভূমে ঢুকে, বদলে অন্য চেহারা নিল। ট্রেন গতি বাড়িয়ে বিলম্ব সঙ্কোচনের চেষ্টা করে যাচ্ছে মুখে গরম বাতাসের ঝাঁপটানি। অনক যাত্রী ওঠানামা করল রামপুরহাটে। ওখানকার ডাইনিংরুমে ভালো ভাবারের আশায় ঢু মেরে এল অনেকে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যাকে অনিমেষ এখনও কোনো সম্বোধন করছে না, অনিমেষকে খাওয়ার কতা বলেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে ট্রেনে উঠে অথবা সেই সাধুবাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে কিংবা হিনপাহাড় স্টেশনে মহিলার অনুরোধে চা খেয়ে অনিমেষের ক্ষুধাবোধটাই একদম উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এখনও সঙ্গে পিসিমার তৈরি খাবার অটুট আছে, কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছেটাই নেই। এরকম এর আগে কখনো হয়নি, ট্রেনে উঠলে কি সব নিয়মকানুন বদলে যায়? সুরমারা সারাটা পথ আধশোয়া হলে এল। মহিলা এখন রীতিমতো ক্লান্ত, বৃষ্টিতে ভেজার পর ওঁর চেহারা এখন একাদশীর প্রতিমার মতো। কাল রাত অথবা সকালের জেল্লা চটে গিয়ে আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। ওঁদের নাকি খিদে নেই। দুপুরে শান্তিনিকেতনে ভাত তৈরি থাকবে, যখন হোক পৌঁছে সেটাই খাবেন ইচ্ছে হল। মানুষের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না মহিলা, যে-সাধুবাবার জন্য স্টিমার প্রাণ পেল তাকেই ওরা অসাবধানে জলে ফেলে দিল। মহিলা সত্যি সত্যি ব্যথা পেয়েছেন। বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তিনি সাধুবাবাকে তুলে আনার দৃশ্য দেখেছেন। ফলে এখন মাঝে-মাঝে নাক টানছেন, মেয়েদের সর্দি হলে মোটই ভালো দেখায় না। সুমা চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে সিনেমার পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা অত। যখন কথা বলে তখন বাচাল বলে মনে হয়, আবার চুপ করলে ওর গাম্ভীর্য দেখার মতন। কাল রাত্রের সেই মেয়েটাকে এখন মোটেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি চেহারা বদল করতে পারে। হঠাৎ সীতার মুখটা মনে পড়ে গেল ওর। সীতা ওর বদলে-যাওয়া জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ওর মুখ মনে এলেই বুকের ভেতর এমন অসাড় হয়ে যায় কেন?

বোলপুর স্টেশনে সুরমারা নেমে গেল। অনিমেষ কুলির সঙ্গে ধরাধরি করে জিনিসপত্র নামিয়ে দিল। গিলে-করা ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা এক ভদ্রলোক এসেছিলেন ওদের নিতে। মহিলা অনিমেষের হাত ধরে বললেন, আমাদের কথা মনে থাকবে তো?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। তোমার খবর কী করে পাব? মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।

অনিমেষ বিপদে পড়ল। কলকাতায় সে কোন হোস্টেলে থাকবে এখন কিছুই জানা নেই। কলেজও ঠিক হয়নি। মহিলাই উদ্ধার করলেন, ঠিক আছে, তোমার ঠিকানা ঠিক হলে আমায় চিঠি দিও। সুধাময়, ফরটিফাইভ ব্লক, শান্তিনিকেতন। ঠিকানাটা চটপট মুখস্থ করে নিয়ে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। ট্রেন-ছাড়ার মুহূর্তে সুরমা বলল, আসবেন তো? কোনো কথা না বলে অনিমেষ সম্মতির হাসি হেসে দরজায় দাঁড়িয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ওদের দূরে চলে যেতে দেখল। হঠাৎ ওর খেয়াল হল মহিলার নাম সে জানে না, কী নামে চিঠি দেবে? সুরমার নামটুকই সম্বল থাকল। মহিলার অনেকরকম উগ্রতা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে অনিমেষর খারাপ লাগছিল ওঁদের ছেড়ে যেতে। অথচ কতটুকুই-বা পরিচয়, কতক্ষণের?

ভেতরে এসে শুনল বেশ হইচই পড়ে গেছে। এক ভদ্রলোক বোলপুর থেকে খবরের কাগজ নিয়ে উঠেছেন, তাকে ঘিরে যাত্রীরা ভিড় করেছে। অনিমেষ একটা বেঞ্চির কোনায় পা রেখে উঁচু হয়ে হেডলাইনটা পড়ল, গুলি বোমা মৃত্যু-ধর্মঘটে কলকাতা উত্তাল। তার নিচেই একটা জ্বলন্ত বাসের ছবি। নিজের জায়গায় আসতেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, অবস্থা খুব মোরারো হয়েছে মনে হচ্ছে।

অনিমেষ বলল, কী হয়েছে?

শুনলাম আজ কলকাতায় কারফিউ চিক্লেয়ার করেছে। তার মানে রাস্তায় হাঁটাচলা যাবে না। তা হলে এতসব যাত্রী বাড়ি যাবে কী করে?

কারফিউ শব্দটার মানে অনুমান করে নিয়ে অনিমেষ বলল, হঠাৎ কারফিউ ডিক্লেয়ার করেছে কেন? হরতাল তো গতকাল শেষ হয়ে গিয়েছে।

তার জের চলছে। কলকাতায় তো কোনোদিন যাওনি, ওখানকার ব্যাপারই আলাদা। মানুষ যখন খেপে যায় তখন তাদের সামলানো মুশকিল, আবার খুব মারাত্তম ব্যাপার অত্যন্ত সহজে ভুলে যায় ওখানকার লোক। এরকম চরিত্র আর কোথাও পাবেন না।

বৃদ্ধের কথা শেষ হওয়ামাত্র আর-একজন মাঝবয়সি লোক ফোস করে উঠলেন, এইজন্যেই তো দশটার কিছু হল না!

আর-একজন বৃদ্ধ, তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত সরু, গলা কাঁপিয়ে বলে চললেন, আহা, এইজন্যেই আমরা স্বাধীনতা এনেছি। ভাগ্যিস সুভাষ বোস মহাত্মা গান্ধী নেই, তা হলে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতেন। ঝ্যাটা মার ঝাঁটা মার। যেন ভাগাড়ে শকুন পড়েছে, লুটেপুটে খেল সব!..

কংগ্রেস এইরকম ভুল করছে কী করে? এই দেশ স্বাধীন করার পেছনে কংগ্রসেরই তো সবচেয়ে বড় ভূমিকা। কমিউনিস্ট পার্টির তখন কোথায় ছিল? তা এত বছর আন্দোলন করে যখন স্বাধীনতা পাওয়া গেল, কংগ্রেস তার নীতি থেকে সরে যাচ্ছে কেন? কেন দেশের মানুষের বুকে গুলি চালাচ্ছে

উত্তেজিত কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে আর-একজন বলে উঠল, বাঃ বাঃ, আপনরা বাস পোড়াবেন, সম্পত্তি ক্ষতি করবেন আর সরকার আপনাদের দুধকলা খাওয়াবে? ফান্ডামেন্টাল রাইট মানে দেশের ক্ষতি করার অধিকার নিশ্চয়ই নয়!

গলা চড়াবেন না মশাই। যে-সরকার দেশের মানুষকে খেতে দিতে পারে না, তার চোখ রাঙাবার কোনো রাইট নেই। স্বাধীনতার মানে অনাহর নয়।

আপনার বাপ কম রোজগার করলে ডালভাত খাবেন, তাই বলে কি বাপের জামাকাপড় পুড়েয়ে আন্দোলন করবেন?

খবরদার বলছি, বাপ তুলে কথা বরবেন না। কংগ্রেস সরকার আমাদের বাপ? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! দালাল কোথাকার!

হঠাৎ প্রসঙ্গটা চিৎকার চামেচিতে পেীছে গিয়ে হাততালি লাগবার উপক্রম হল। অনিমেষ বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পাশে এসে বাইরের দিকে তাকাল। এই ভরবিকেলে মাঠের ওপর অদ্ভুত শান্ত ছায়া নেমেছে। এখন প্রকৃতির রং গাঢ় সবুজ। কোথাও-কোথাও ছোটবড় পুকুরে জল টলমল করছে। ছবিতে-দেখা বাংলার গ্রামের মতো বউঝিরা কলসি কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বীরভূমের পর বর্ধমান। কলকাতা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে। এখন বাইরে তাকিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে যতটুকু দেখা যায়, ক্ষণিক থেমে-তাকা স্টেশনে যতটুকু বোঝা যায়, কোথাও কোনো বিক্ষোভ নেই, ব্যস্ততা নেই। কলকাতা শহরে মানুষের খাবার নিয়ে যে-আন্দোলন চলছে, এই ফসলের মাঠ আর মাঠের মানুষের দিকে তাকালে তার কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়বে না।

বর্ধমান স্টেশনে সন্ধে পেরিয়ে গাড়ি ঢুকতেই সমস্ত পরিবেশটা চট করে পালটে গেল। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে খানিকক্ষণ গাড়ি কানফাটানো হুইল বাজাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তারপর বাধ্য ছেলের মতো হাঁটি হাঁটি করে এগিয়ে গিয়ে বুড়ি ছুঁল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা আওয়াজ শুনতে পেল। যারা এই স্টেশনে নামবেন তারা অবাক হয়ে দেখলেন প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। এমনকি কুলিরা রোজকার মতো ছুটে এল না। কিছু খাকি পুলিশ লাঠি-হাতে ইঞ্জিনের দিকে ছুটে গেল। আওয়াজটাকে ওরা ততক্ষণে বুঝতেপারল। অনেকগুলো কষ্ঠ এক হয়ে এক শব্দ উচ্চারণ করায় সেটা জড়িয়ে গিয়ে অমন হচ্ছে। কান পাতলে বোঝা যায়, আলাদা করা যায়-খাদ্য চাই বস্ত্র চাই, গুলি করে দমিয়ে রাখা যায় না যায় না।

ওরা শুনল, গতকাল এবং আজ কলকাতায় গুলি চলার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীরা ট্রেন-লাইনের ওপর বসে পড়ে অবরোধ সৃষ্টি করেছে। এই প্ল্যাটফর্মে হকার নেই। শুধু একজন বুড়ো মাথায় কর কাচের বাক্যে সীতাভোগ-মিহিদানা বিক্রি করতে করতে খবরগুলো দিয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনে গুঞ্জন উঠল। অনিমেষ দেখল যারা এতক্ষণ কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করছিলেন তারাই ব্যাপারটাকে মানতে পারছেন না। এইভাবে ট্রেন আটককে মানুষের ক্ষতি করে কী লাভ-মোটামুটি এইরকম আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল কামরায়। আন্দোলন যখন মানুষের জন্য তখন মানুষের সহানুভূতি আগে দরকার। এই ট্রেনের যাত্রীদের কথা কেন বিক্ষোভকারীরা ভাবছে না? বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, স্বার্থে আঘাত লাগলে মানুষের রাজনৈতিক তত্ত্ব আর আলাদা থাকেনা, বুঝলে?

অনিমেষ কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছিল না। এই মুহূর্তে যেটা ঠিক, পরের মুহূর্তে সেটা বেঠিক হয়ে যায় কী করে? কংগ্রেস সরকারকে অভিযুক্ত করে যারা কথা বলছিলেন, এই মুহূর্তে ট্রেন আটক হয়ে তারা খুশি হচ্ছেন না, অথচ এই আন্দোলনকে ওঁরা সমর্থন করেন। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অনিমেষ সামনে তাকাল। লম্বা কামরার সারি ছাড়িয়ে ইঞ্জিনের ওপাশে অনেক লোক এবং প্রচুর পুলিশ। ক্রমাগত ধ্বনি দেওয়া চলেছে। একবার প্ল্যাটফর্মে নেমে এগিয়ে গিয়ে দেখে এলে হয়। ও সেকথা বলতে বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিষেধ করলেন, কী দরকার ঝামেলার জড়িয়ে, কখন কী হয় বলা যায় না। অন্যাবশ্যক কৌতূহল মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনে।

কথা বলার ধরন এমন নিরাসক্ত যে অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে পড়ল। ওই যে ওখানে এরকম হইচই হচ্ছে, ট্রেনের অন্যান্য যাত্রীও বিলম্বের জন্যে আর-এক ধরনের উত্তেজনায় রয়েছে, অথচ বৃদ্ধ ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে বসে আছেন। অনিমেষ শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার দেখতে ইচ্ছে করছে না?

না।

দেরি করে পৌঁছলে অসুবিধে হবেনা?

হবে। তবে আমি এখানে বসে চেঁচিয়ে সেকথা বলে তাড়াতাড়ি যাবার ব্যবস্থা করতে পারব না। ট্রেন যখন ছাড়ার তখন চাড়বে-আমার তো কোনো হাত নেই।

সাহস করে অনিমেষ ঠাট্টা করার চেষ্টা করল, কিন্তু আর-সবাই তো চ্যাঁচামেচি করছে।

একটুও রাগলেন না বৃদ্ধ ভদ্রলোক, এই কামরায় বসে ওসব করা যায়। কিন্তু দ্যাখো তো, কেউ ইঞ্জিনের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করছে কি না। সে-বেলায় কেউ যাবে না। আমরা সব নিরাপদে থেকে আগুনে হাত সেঁকতে ভালোবাসি।

কথাগুলো এমন চাঁচাছোলা যে অনিমেষ অবাক-গলায় বলল, আপনি অনেক দেখেছেন, না?

আমার বয়স কত অনুমান করো তো!

ফাঁপরে পড়ল অনিমেষ, তবু অনুমান করার চেষ্টা করল, ষাট!

আটষট্টি। অর্থাৎ আমার আটান্ন বছর বয়সে ভারত স্বাধীন হয়েছে। অথচ আমি বাল্যকাল যৌবন এবং পৌঢ় অবস্থায় কখনো ইংরেজ-তাড়ানো আন্দোলনে যোগ দিইনি। আমার মতো লক্ষ লক্ষ লোক দেয়নি। কিন্তু তাতে কি দেশের স্বাধীন হওয়া আটকেছে মোটেই না। এখন বুঝতে পারি, খুব বড়লোক আর অত্যন্ত গরিব মানুষই প্রকৃত কাজ করতে পারে। আমি কিছুই দেখিনি, কিন্তু নিজেকে দিয়ে অন্য মানুষের স্বভাব বুঝতে পারি।

এই সময় আরও একঝাক পুলিশ প্ল্যাটফর্মে শব্দ তুলে সামনের দিকে ছুটে গেল। বৃদ্ধ বললেন, এবার জানালাটা বন্ধ করে দাও।

কেন?

নিরাপদে থাকা যাবে তা হলে। কথাটার মানে বুঝতে-না-বুঝতে গোলমাল বেড়ে গেল বাইরে। খুব ঘনঘন হুইল বাজাচ্ছে ড্রাইভার। কতগুলো ছেলেকে তাড়া করে ওদের সামনে দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে পুলিশরা চুটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দড়াম দড়াম করে জানলাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল ওদের কামরার। দরজা আগেই বন্ধ করা ছিল, একজন উঠে গিয়ে লক করে দিয়ে এলেন। কামরায় এখন কেউ কোনো কথা বলছে না, যে যার জায়গা চুপচাপ বসে। মাথার ওপর টিমটিমে আলো, একটুও বাতাস নেই পাখাগুলোয়। জানলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন গুমোট গরম লাগছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফিসফিস করে বললেন, দেখলে তো নিজেকে দিয়ে আমি কেমন বুঝতে পারি! সবকটা জানালা বন্ধ হয়ে গেল।

মিনিট পনেরো বাদে ওদের চমকে দিয়ে ট্রেনটা দুলে উঠল। এটা যেন প্রত্যাশাই করেনি কেউ, হাঁপ ছেড়ে কেউ-একজন বলে উঠল, যাক বচা গেল। এতক্ষণ মানুষগুলে নিজেরাই নিজেদের বন্দি করে বসে ছিলেন, কথাটা শুনেই বোধহয় সাড়া এল। প্ল্যাটফর্মে ছোটাছুটি, মা-মাঝে আহত মানুষদের চিৎকার তাঁদের একটুও বিচলিত করেনি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক চাপা গলায় ওকে বুঝিয়ে দিলেন, এটা হল একধরনের সাধনালবন্ধ নিরাসক্তি। মধ্যবিত্ত মানুষ অনেককালের চেষ্টায় তা আয়ও করেছে। অত্যন্ত খারাপ লাগছিল অনিমেষের। ও একবার উঠে দাঁড়াতে অন্য যাত্রীরা যেভাবে নীরবে চোখ তুলে ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তাতে আর এগোতে সাহস পায়নি সে। পুলিশগুলো কি আন্দোলনকারীদের মারছে। দৃশ্যটা কল্পনা করে সে চুপচাপ বসে রইল বন্ধ কামরায়। হঠাৎ ওর খেয়াল হল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে এই যে এত আন্দোলন হচ্ছে শুধু খাবারের দাবিতে, তার বিরুদ্ধে কংগ্রেস দল থেকে কোনো প্রতিবাদের মিছিল বা আন্দোলন হচ্ছে না তো! এখন পুলিশ না এসে যদি কংগ্রেসিরা মিছিল করে আসত তা হলে ব্যাপারটা কেমন হত? সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হত না কি? অথচ সেরকম ব্যাপার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না, তা হলে পুলিশ আসবে কেন? ট্রেন আচম্বিতে দুলে ওঠার সামান্য আগে ওদের দরজায় কেউ বা কারা বাইরে থেকে দুমদুম করে শব্দ করতে লাগল। কেউ-একজন চিৎকার করে ওদের দরজা খুলতে বলছ। শেষ পর্যন্ত অনুনয় করতে লাগল্প সে, অথচ যাত্রীরা নির্বিকার। কেউ যেন অত জোরে আওয়াজ এবং আর্তকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন না। অনিমেষ দেখল কেউ কারও দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছেন না পর্যন্ত, যেন পৃথিবীর কোনো শব্দ তাদের স্পর্শ করে না। অনিমেষ আর পরল না চুপ করে থাকতে, যে-ই শব্দ করুক দরজায় নিশ্চয়ই সে খুব বিপত্মত্ত এবং এই কামরায় এখন প্রচুর বসার জায়গা খালি পড়ে আছে। ও উঠে এগিয়ে যাচ্ছিল দরজাটা খুলতে, সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, আরে আরে করছ কী? খবরদার দরজা খুলবে না। কী মতলব কে জানে, হয়তো পুলিশের তাড়া খেয়ে এখানে ঢুকতে চাইছে, শেষে আমাদের সবাইকে হাজতে পুরুক! কেউ-একজন মন্তব্য করল, এঁচোড়েপক্ক।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকতে অনিমেষ ফিরে এল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, মন-খারাপ করো না, অভিজ্ঞতা মানুষকে সম্পদ এনে দেয়। ভবিষ্যতে কাজে লাগিও।

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর লোকটা চলে গেল। এত বড় গাড়িতে অনেক জায়গা আছে, তা হলে শুধু এখানেই লোকটা ঢুকতে চাইছিল কেন? হঠাৎ ওর খেয়াল হল, সমস্ত ট্রেনের মানুষ জানালাদরজা বন্ধ করে নেই তো এই কামরার মানুষের মতো? তা হলে লোকটা উঠবে কোথায়?

ট্রেনটা দুলে উঠতেই গাড়ির চেহারা আচমকা বদলে গেল। একজন ঘড়ি দেখে বলল, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যাব।

দেখুন আবার পথে গাড়ি আটকায় কি না।

আর-একজন কুব আশা করতে পারছিল না। প্রথমজন তাকে ভরসা দিল, ননস্টপ ট্রেন মশাই, সামনে দাঁড়ালে পিষে যাবে। একদম দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে দাঁড়াবে। ওখানে যদি আটকায় ক্ষতি নেই। নেমে গিয়ে বাস ধরব।

গাড়ি একটু একটু করে স্পীড নিচ্ছে। বর্ধমান স্টেশন ছাড়িয়ে গেলে তবেই জানলাগুলো ভোলা হল। এখন বাইরে কালো রাত। এখন তো আকাশে চাঁদ থাকার কথা, তবে কি মেঘ করেছে। বাতাস, নেই বড়-একটা। অনেক দূরে কোনো গ্রামের টিমটিমে আলো কাঁপছে। কিছুক্ষণ কথা বলে সামান্য স্বস্তিতে থেকে যাত্রীরা আবার চুপচাপ হয়ে গেল। ট্রেনটা আরও গতি বাড়াক, চট করে কলকাতা এসে। যাক, এইরকমটাই সবাই চাইছিল।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘড়ি দেখে বললেন, এইরকম যদি যায় তবে সাড়ে দশটার মধ্যেই পৌঁছে যাব মনে হচ্ছে।

একথা শুনে অনিমেষের সামনে-বসা একজন রোগামতন মানুষ বললেন, এত স্পীড বাড়ানো ঠিক নয়! কেন জানে যদি কোথাও ফিসপ্লেট খোলা থাকে-কিছুই বলা যায় না।

কথাটা মুহূর্তে কামরার সবার কানে বাজল। এরকম একটা ব্যাপার হবার সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দিতে পারছিল না। কিন্তু কথা শুনে রোগা অভদ্রলোকের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল সবাই। হ্যাঁ, সামনে দাঁড়িয়ে ট্রেন থামিয়ে দিতে না পেরে এইভাবে সরকারের উপর প্রতিশোধ নিতেপারে বিক্ষোভকারীরা। যারা বাস পোড়াতে পারে তরা ট্রে উড়িয়ে দেবে না কেন? যে-ভদ্রলোক বোলপুর স্টেশন থেকে কংগ্রেসের সমালোচনা করছিলেন তিনি বললেন, নেতারা তো সব এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে, তাই ক্যাডারদের সামলানো মুশকিল হয়ে পড়েছে।

আর-একজন খেঁকিয়ে উঠল, রাখুন মশাই, আর ক্যাডার ক্যাডার করবেন না। কমরেড, ক্যাডার-বুকনি আছে যোলোআনা। দেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুরকে মাথায় করে নাচতে নাচতে বলছে, দ্যাখো,-আমি কী হনু! ট্রামবাস পুড়িয়ে বিপ্লব করবি, ট্রেন ওড়াবি, এদিকে যাদের জন্য করা সেই সাধারণ মানুষ জানল না কিছু, তারা রাজি কি না না-জেনেই বিপ্লব হয়ে গেল!

যাই বলুন, এই দেশে কমিউনিস্টরা কখনন ক্ষমতায় আসবে না। কংগ্রেসিদের আফটার অল একটা ঐতিহ্য আছে। জওহরলাল বিধান রায়ের মতো পার্সোনালিটি কজনার আছে হ্যাঁ, নেতাজি ফিরে এলে আলাদা ব্যাপার হত।

নেতাজি মরে ভূত হয়ে গেছে, তাঁকে নিয়ে আর টানাটানি কেন?

আপনি জানেন নেতাজি মরে গেছেন। এনি প্রুফ ফটাফট আজেবাজে কথা বলা আমাদের জাতীয় অভ্যেস।

আবার সবাই সুপ করে গেল। এঁদের কথাবার্তা যেমন দুম করে শুরু হয়, তেমনি চট করেই থেমে যায়। আর কখনোই একটা বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে না। বেশ মজা লাগছিল এইসব কথা শুনতে। অনিমেষ দেখল বৃদ্ধ ভদ্রলোক গাড়ির দুলুনির তালে তালে ঢুলছেন। মুখচোখ কেমন কড়কড়ে লাগছে অনিমেষের, জিব শুকিয়ে উঠেছে। অনিমেষ অনুভব করল ওর পেটের ভেতরটা চিনচিন করছে। সারাদিন খাওয়া হয়নি, মুখের ভেতরটা বিস্বাদ হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা ওপরের বাঙ্কে আছে। অনিমেষ চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে দুহাতে ভর দিয়ে উঠে পড়ল বাঙ্কে। কেউ-কেউ ওর এই উঠে-আসা অলস-চোখে একবার তাকিয়ে দেখল শুধ। ভালো করে বাবু হয়ে বসে পকেট থেকে চাবি বের করে অনিমেষ ব্যাগটা খুলল। জামাকাপড় অনেকক্ষণ ব্যাগে থাকলে কেমন মিষ্টি গন্ধ বের হয়। বাদিকের কোণা থেকে সে। পলিথিনের ছোট্ট পুটলিটা টেনে বের করল। বাঁধন খুলে খাবারগুলো বের করল অনিমেষ। অনেকগুলো লুচি, কিছু আলুভাজা, সামান্য তরকারি আর ক্ষীর। জিবে জল এসে গেল অনিমেষের, খিদেটা যেন এতক্ষণ চুপিসাড়ে বসেছিল, খাবার দেখেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। অনিমেষ লুচি ছিঁড়ে তরকারি নিয়ে মুখে দিতেই টকটক গন্ধ পেল। নষ্ট হয়ে গিয়েছে খাবারটা। বিশ্রী স্বাদ লাগছে। তাড়াতাড়ি মুখ থেকে খাবারটা বের করে ও পুটলিটাকে মুখের কাছে নিয়ে অন্যগুলোর গন্ধ শুকলো। কোনোটাই ভালো নেই। গতকালের তৈরি খাবার কাল সারারাত আজ সারাদিন ব্যাগে বন্দি থাকায় এই গরমে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো বসে থাকল। পিসিমা এত যত্ন করে এসব তৈরি করলেন আর সে নষ্ট করে ফেলল! এগুলো ফেলে দিতে ওর খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু খাওয়া উচিত নয়। শুধু লুচিগুলো এখনও টকে যায়নি, খিদে মেটাতে অনিমেষ সেগুলোকেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। কয়েকটা খাওয়ার পর অনিমেষ শুনল নিচে কেউ বলছেন, বাস-ট্রাম পাব কি না জানি না।

বাস পাবেন কী মশাই, শুনছেন কারফিউ জারি হয়েছে। দিন-দিনে গেলে একরম হত, কিন্তু এত রাত্রে কী হবে কে জানে!

দূর কলকাতায় কখনো কারফিউ মানানো যায়! অত লোককে সামলাবে কে? দেখেন-না, একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি হল, কিন্তু লোকজন যেমনকে তেমন চলাফেরা করছে, না বলে দিলে বোঝা যায় না!

আরে কারফিউ হল কারফিউ, ভয়েই লোক বাড়ির বাইরে যাবে না। যুদ্ধের সময় দেখেছি তো! অনিমেষ নিচে নেমে এল। বৃদ্ধ ভদৃলোক একবার চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেললেন। প্যাসেঞ্জ দিয়ে অনিমেষ দরজার কাছে চলে এল। ভষিণ জলতেষ্টা পাচ্ছে। দরজার জানলা দিয়ে পুটলিটা বাইরে ফেলে দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। এতখানি খাবার ফেলে দেবে? আজকে যখন খাবার নিয়ে এত আন্দোলন হরতাল হচ্ছে তখন এটা অপচয় নয়? নাহয় সামান্য নষ্ট হয়েছে খাবারগুলো, কিন্তু কোনো ভিখিরিকে দিলে সে খুশি হয়ে খেয়ে নেবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত সে জানালা দিয়ে পুটলিটা বাইরে ফেলে দিল। একজন ভিখিরিকে এই খাবার খাইয়ে অসুস্থ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। বেসিনে হাত ধুয়ে অনেককানি ঘোলা গরম জল খেতে পেট ভরে গেল অনিমেষের। তবু কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে।

নিজের আসনে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল, বাইরে আর অন্ধকার নেই। তিরতিরে জ্যোত্মা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। দূরের বাড়িগুলো এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাকা একতলা দোতলা বাড়িতে আলো জ্বলছে। হুহু করে ট্রেন ছুটে যাচ্ছিল এতক্ষণ, এবার হঠাৎ গুমগুম শব্দ উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ ভদ্রলোক তড়াক করে উঠে বসলেন। তারপর বাদিকের জানালার দিকে ঝুঁকে দুটো হাত কপালে ঠেকিয়ে ঘনঘন প্রণাম করতে লাগলেন। অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল, কামরার অন্যান্য যাত্রীও সবাই হুড়মুড় করে বাদিকের জানরায় চলে গিয়ে নমস্কার করতে লাগলেন, মা, একটু দেখো মা।

অনিমেষ দেখল খুব বিরাট এক নদী ওপর দিয়ে ট্রেনটা যাচ্ছে। ঘোলা জলে জ্যোৎস্না পড়ে চকচকে ঢেউগুলোকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এপাশে কি কোনো মন্দির আছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক মাথা ঘুরিয়ে বললেন, আরে দেখছ কী, প্রণাম করো-মায়ের মন্দির দেখতে পাচ্ছ না?

মা? অনিমেষ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল।

দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ি। রামকৃষ্ণদেবের নাম শোননি? তিনি এখানে পাণপ্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আর ওপাশে, হাত বাড়িয়ে বিপরীত দিকের তীর দেখিয়ে তিনি বললেন, বেলুড়। বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সামনে এত মাথা আড়াল করে রেখেছে যে, অনিমেষ চেষ্টা করে শুধু মন্দিরের চুড়ো দেখতে পেল। দাদুর কাছে কথামত আছে, অনিমেষ পড়েছিল। রামকৃষ্ণদেব নাকি কালীঠাকুরের সঙ্গে কথা বলতেন। কিছু দেখার আগেই মন্দিরটা ছাড়িয়ে গেল। অনিমেষ যাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। এতক্ষণ যারা রাজনীতি নিয়ে কথা বলছিলেন, তারাই কী দারুণ ভক্ত-ভক্ত মুখ করে নিজের আসনে ফিরে আসছেন। গাড়ির গতি কমে আসছিল এবার। হঠাৎ যাত্রীদের খেয়াল পড়ল, তিন-চারটে গলা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, জানলা বন্ধ করে দিন মশাই, জানলা বন্ধ করে দিন!

একজন যাত্রী সুটকেস নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আমি কিন্তু এখানে নামব।

দাঁড়ান দাদা, চট করে নেমে পড়বেন না। শেষে আপারও বিপদ, আমাদেরও দফারফা হবে।

কিন্তু গাড়ি তো এখানে মোটে তিন মিনিট দাঁড়ায়। যাত্রীটি প্রতিবাদ করল।

পাঁচ মিনিট।

কক্ষনো নয়। আমি এখানে থাকি আর আমি জানি না! ভদ্রলোক লক খুলে দরজার হাতল ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারজন যাত্রী উঠে ওঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উনি নামলেই এঁরা দরজা বন্ধ করে দেবেন। আস্তে-আস্তে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দুমদাম করে কানফাটানো শব্দ হল। কেউ-একজন চাপা গলায় বলে উঠল, বোমা পড়ছে।

অনিমেষ দেখল, নামবার জন্য যিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেবার এগেই দরজা বন্ধ করতে যাওয়া যাত্রীরা চটপট আবার লক তুলে দিল, আপনাকে আর নামতে হবে না।

কিন্তু-। ভদ্রলোক বিড়বিড় করলেন।

জানলার ফুটো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একজন বলে উঠল, প্ল্যাটফর্মটা দেখেছেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্টেশনের বাইরে বোম পড়ছে-বাপের দেওয়া প্রাণটাকে হারাবেন মশাই।

হতাশ গলায় একজন বলে উঠল, অবস্থা খুব ঘোরালো দেখছি!

কিন্তু আমি শিয়ারদার গেলে ফিরব কী কর? না না, যা হয় হবে, আমাকে নামতে দিন। কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক লক খুলে দরজার হাতল ঘুরিয়ে যেন গায়ের জোরে নিচে নেমে গেলেন। অনিমেষ শুনল ভদ্রলোক চিৎকার করে কুলিকে ডাকেছেন। কিন্তু কোনো সাড়া এল না কোথাও থেকে। যাত্রীরা দরজা বন্ধ করে ফিরে আসেতই ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল। এখন প্রায়ই বোমের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভদ্রলোক কী করে বাড়ি যাবেন কে জানে!

দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে গেল, মানে কলকাতা এসে গেছে। এতক্ষণ অনিমেষ যেটা খুব আমল দেয়নি সেই চিন্তাটা মাথায় ঢুকে পড়ল। যে-সময়ে ট্রেনটা যাচ্ছে তা নির্ধারিত সময়ের সাড়ে তিন ঘণ্টা পার করে। বাবার বন্ধু, যাকে সে কোনোদিন দেখেনি, যদি এতক্ষণ তার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা না করেন? তা ছাড়া কারফিউ যখন জারি হয়েছে তখন তিনি রাস্তায় বের হবেন কী করে? যদি তিনি স্টেশনে না। আসেন তা হলে সে কী করবে? ক্রমশ অনিমেষ নার্ভাস হয়ে পড়ল। এখন এখানে এত বোমা পড়ছে। কেন জনসাধারণের সঙ্গে কি পুলিশের যুদ্ধ হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হল, এটা অসম্ভব। কারণ জনসাধারণ মানে তো এই কামরার মানুষেরাই, এরা কখনো পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন না। সারারাত কি তা হলে ওকে স্টেশনে কাটাতে হবে। অবশ্য বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঠিকানাটা শুনে বলেছেন যে স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয় এবং তিনি ওই অঞ্চলেই থাকেন। তা হলে ওঁর সঙ্গে থাকাই ভালো। তবু অনিমেষ হঠাৎ অনেকদিন পরে চটপট আঙুল দিয়ে কপালে র শব্দটা লিখে মা বলে দুই হাতে মুখটা ধরে মনেমনে প্রণাম করে নিল। এরকম করে ওর মনে হল ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সমাধান হয়ে যাবে। ও শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে নিশ্চয়ই বাবার বন্ধুকে দেখতে পাবে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার জিনিসপত্র ঠিকঠাক করে নিচে বেঞ্চির ওপর নামিয়ে রাখলেন। যাত্রীরা সবাই প্রস্তুত হচ্ছে। অনিমেষ চুপচাপ বসেছিল। এই মানুষগুলোর সঙ্গে অনেকক্ষণ কাটিয়ে ও নতুন রকমের অভিজ্ঞতা পেল, হয়তো জীবনে আর দেখা হবে না। অনেক কিছুর মধ্যে একটা ব্যাপার শুধু ওর মনে খচখচ করছে, সেই জ্বলোকের আর্তচিৎকার সত্ত্বেও সে দরজাটা এদের জন্য খুলে দিতে পারেনি। এখন নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল অনিমেষের। দেশকে যারা ভালোবাসে তারা কখনও কাপুরুষ হতে পারে না। তা হলে কি সে কাপুরুষ? দেশ মানে তো এইসব মানুষ, এঁরাই কী অদ্ভুত শামুকের মতো ভয়েভয়ে এতটা পথ কাটিয়ে এলেন, এখনও কামরার জানলা বন্ধ। কিন্তু এদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না, সেই ভদ্রলোককে উঠতে না দিয়ে এদের মনে কোনো আফসোস আছে। সকলেই যে যার বাড়িতে যাবার জন্য জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি, শুধু ট্রেন থামার অপেক্ষা।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, তোমার তো শুধু ওই ব্যাগ আর এই বেডিং। কুলির প্রয়োজন হবে না, কী বল?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। গতরাত্রে উনি অনিমেষকে আপনি করে কথা বলেছিলেন, আজ সকাল থেকে সেটা ঘুচে গেলে অনিমেষের স্বস্তি হয়েছে। সে বলল, আপনি একটু দাঁড়িয়ে যাবেন?

মানে?

আমার বাবার বন্ধুকে খুঁজে দেখব।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। উনি না এলে আমি তোমায় পৌঁছে দেব। আরে, ও তো আমারই পাড়া। তুমি নিন্তিত থাকো।

কলকাতা আসছে। অনিমেষের বুকের মধ্যে আজন্ম প্রতিপালিত ইচ্ছেটা পূর্ণ হতে যাওয়ার মুখে একটা উত্তেজনা ছটফট করছিল। সেই কোন ছেলেবেলায় সরিৎশেখর বলেছিলেন, কলকাতায় যখন সে আসবে মাথা উঁচু করে আসবে, কারও হাত ধরে নয়। আজ তো তা-ই হচ্ছে। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ বোসের কলকাতায় সে একটু বাদে পা দেবে। কলকাতা মানে বাংলাদেশের প্রাণ। সেই প্রাণকে সে স্পর্শ করতে যাচ্ছে।

একসময় ট্রেন গতি কমিয়ে আনল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক জানালা খুলে দিতে দূরে আলোঝলমল প্ল্যাটফর্ম চোখে পড়ল অনিমেষের। ট্রেনটা যত নিকটবর্তী হচ্ছে তত মানুষের মাথা চোখে আসেছ। কেন যেন বলল, যাক, শ্যালদা এসে গেল!

উত্তেজনায় অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার দুচোখ জ্বলতে লাগল। পরমুহূর্তেই হুহু করে সেই জলনি একরাশ জলে চোখ ভাসিয়ে দিল। কামরার সব মানুষের চোখে হাত কলকাতায়। পৌঁছেই অনিমেষ দুহাতে চোখ চেপে ধরল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলে উঠলেন, টিয়ার গ্যাস!

ট্রেনটা থামতেই হুড়মুড় করে নেমে গেল সবাই। অনিমেষ কিছুতেই নিজের চোখ দুটোকে সামলাতে পারছিল না। বাতাসে অদ্ভুত একটা গন্ধ, আর সেইসঙ্গে চোখ-জ্বলুনি। রুমালে চোখ চেপে ধরলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। চোখের জল ফেলতে সে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পেছন পেছন কলকাতার মাটিতে পা দিল। দিনের আলোর মতো নিয়নবাতিতে সমস্ত প্ল্যাটফর্ম পরিষ্কার। সেখানে তিল ফেলার জায়গা নেই যেন অজস্র মানুষ সুটকেস প্যাটরা নিয়ে বসে বসে কাঁদছে। এর মধ্যে কেউ জল যোগাড় করে বাচ্চাদের চোখে ঝাঁপটা দিচ্ছে। ওদের ট্রেনের যাত্রীরা নামতে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হাঁটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। এত বড় প্ল্যাটফর্ম কলকাতা শহরেই মানায়, অনিমেষ চোখ সামলে চারধার দেখছিল। ওপাশে পরপর অনেকগুলো এরকম প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সেখানেও মানুষেরা বসে আছে। এত মানুষ অথচ তেমন চিৎকার স্ট্যাচামেচি হচ্ছে না। অনিমেষ শুনল মাইকে যাত্রীদের শান্ত হয়ে থাকার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। একটা কুলিমতন লোক সামনে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল। মালপত্র তোলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার নেই। দুএকজন তাকে ডাকতে সে ঘাড় নেড়ে বলল, কারফু হো গ্যায়া, নেহি যায়েগা।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরও সেই দশা, চোখে রুমাল চেপে বললেন, বেশি রগড়িও না, তা হলে কষ্টটা কমে যাবে। কলকাতায় পা দিয়ে এরকম একটা অভিজ্ঞতা পেয়ে অনিমেষ খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। টিয়ার গ্যাসের নাম কাগজে সে পড়েছে, জিনিসটা কীরকম সে জানে না, তবে তার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই স্টেশনের মানুষগুলোকে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে কাদানো হচ্ছে কেন? এরা তো সবাই শান্ত হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ ওরা চুপাচাপ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকার পর বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, চলো, একটু এগিয়ে দেখা যাক।

এর মধ্যে অনেকেই বিছানাপত্র বিছিয়ে প্ল্যাটফর্মে শুয়ে পড়েছে। অনিমেষরা অনেক সাবধানে ওদের পাশ কাটিয়ে গেটের কাছে চলে এল। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়, সবাই উঁকিমেরে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছে। বৃদ্ধ বললেন, আজ দেখছি চেকার-টেকার কেউ গেটে দাঁড়িয়ে নেই।

একজন ফিরিওয়ালা সেকথা শুনে বলল, কলকাতা শহরের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এখন, আরা কে টিকিট চাইবে! দেখছেন না কেউ বাইরেই বেরুচ্ছে না!

অনিমেষ বলল, কেন, বাইরে বেরুলে কী হবে?

দুমদাম ফটাস! মুখ দিয়ে একটি অদ্ভুত আওয়াজ বের করল লোকটা, মিলিটারি নেমে গেছে, ভোরের আগে রাস্তায় কাউকে দেখলে সোজা মর্গে চালান করে দেবে।

বাবার বন্ধুর খোঁজ নেবার কথাটা এতক্ষণ অনিমেষ এইসব ঝামেলার খেয়াল করেনি, ভোর শব্দটা শুনে চট করে মনে পড়ে যেতে ও চঞ্চল হয়ে উঠল। বৃদ্ধকে সেকথা বলতে তিনি বললেন, তা হলে গেটের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু তিনি কি আসতে পেরেছেন? মনে হয় না। অনিমেষ যে-ভয়টা সারা পথ এড়িয়ে যাচ্ছিল এখন সেটা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল। সত্যি যদি তিনি না আসতে পারেন, তা হলে কী হবে? দুচোখ আড়াল করলে যেন জ্বালাটা সামান্য কমে যায়, অনিমেষ বৃদ্ধের সঙ্গে সেইভাবে ভিড়ের সামনের সারিতে এসে দাঁড়াল। কয়েক হাত খালি প্ল্যাটফর্মের পর। কোলাপসিবল গেট হাঁ করে খোলা, তার বাইরে বিশাল বারান্দা বা চাতাল শাখা করছে। যাত্রীরা সবাই একটা নিরাপদ দূরত্ব রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে, কেউ এগোতে সাহস করছে না। মাঝে-মাঝে দূরদূরান্ত থেকে বোমা পড়ার শব্দ ভেসে আসছে, কাছেপিঠে কিছু হচ্ছে না।

টেলিফোন বুথগুলোকে দেখলেই চেনা যায়, ওপরে ছবি টাঙানো আছে। তার সামনেই এনক্যায়ারি-লেখা কাউন্টার, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। কোনো মানুষকে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে। দেখা গেল না। যদি সারাদিন এইরকম কারফিউ থাকে শহরে তা হলে তিনি বের হবেন কী করে? এখন কিছুই করার নেই, শুধু এই প্ল্যাটফর্মে এত মানুষের সঙ্গে চুপচাপ ভোরের অপেক্ষা করা ছাড়া। অনিমেষের মনে পড়ল দাদু অনেক ভেবেচিন্তি ওর যাত্রার যে-দিন ঠিক করেছিলেন, সেটা এরকম গোলমালে হয়ে গেল? স্টেশনের ভেতরে একটা যে-দিন ঠিক করেছিলেন, সেটা এরকম গোলমেলে হয়ে গেল? স্টেশনের ভেতরে একটা বড় ঘড়িতে সময় দেখল যে, এগারোটা বেজে গিয়েছে।

আজ শিয়ালদা থেকে কোনো ট্রেন ছাড়ছে না। শুধু দূরপাল্লার মেলট্রেনগুলো এসে যাত্রী নামিয়ে চুপচাপ শেডে ফিরে গিয়েছে। টিয়ার গ্যাসের জ্বলুনি কমলে আটক যাত্রীদের গুঞ্জন মিলিয়ে গেল, কেউ বেশি কথা বলছে না। জিনিসপত্র নিচে নামিয়ে অনিমেষ বসে পড়েছিল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন। এখান থেকে তার বাড়ি হেঁটে গেলে মাত্র দশ মিনিটের পথ, অথচ সারারাত এই প্ল্যাটফর্মে আটকে থাকতে হবে এটা যেন তিনি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। অনিমেষের কাছে জিনিসপত্র রেখে তিনি খবরাখবর নেবার জন্য অন্য প্ল্যাটফর্মে চলে গেলেন।

শুরুতেই এ ধরনের ব্যাপার হয়ে গেল, অনিমেষের ভালো লাগছিল না। কলকাতা শহরকে দেখবার জন্য ওর মন ছটফট করছিল, এখন এই পরিবেশে নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছে। কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বামপন্থিদের যুদ্ধ হচ্ছে এখানে, কিসের যুদ্ধ খাবার যদি কারণ হয়, তা হলে সে-যুদ্ধে তো ও যে-বাংলাদেশ নয়। তা হলে বামপন্থিদের এই যুদ্ধ কতটা সাফল্যলাভ করবে। কংগ্রেস সরকারের হাতে মিলিটারি আছে, তাদের অস্ত্র আছে-এভাবে কি খাবার আদায় করা যায়? একে কি গৃহযুদ্ধ বলে?

আর কংগ্রেস সরকারই বা নিজের দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাচ্ছে কেন? তারা খাবার চেয়েছে অল্প দামে, সরকার সেটা দিয়ে দিলেই তো পারে! তা হলে দেশের মানুষ কংগ্রেসের ওপর খুশি হবে-আর বেশি বোট পাবে নির্বাচনে। সেটা নিশ্চয়ই কংগ্রেস সরকার জানে এবং জেনেশুনে। এরকম উপায়ে মোকাবিলা করছে! অনিমেষ অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত এইরকম একটা সিদ্ধান্তে এল যে, আজ যে-ঘটনাটা কলকাতা শহরে ঘটছে তা খুব সরল নয়। নিশ্চয়ই তার পেছনে অন্য কোনো কারণ আঁছে যা ও বুঝতে পারছে না। এখন আর টিয়ার গ্যাসের সেই জ্বলুনিটা নেই, পরিষ্কার মেখে চারধারে অনেক সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখতে পেল। এখন আলোগুলো কেমন হলুদ-হলুদ দেখাচ্ছে। রাত যত বাড়ে তত কি আলোগুলোর চেহারা পালটে যায়? অনিমেষ দেখল একটা কালোমতন রাত মাঝবয়সি মেয়েছেলে সামনে সতরঞ্জি পেতে শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে সে ফিক কর দোক্তা-খাওয়া-ইতাসি হাসল। চোখ ফিরিয়ে নিল অনিমেষ, কে না জানে কলকাতায় খারাপ মেয়ে এবং পুরুষ সবসময় শিকার ধরতে ঘুরে বেড়ায়। এদের থেকে সতর্ক না থাকলে এই শহরে একদিনও বাস করতে পারা যাবে না। ও অলসভাবে নিজের কোমরে হাত বুলিয়ে দেখে নিল, টাকগুলো ঠিকই আছে।

খুব জলতেষ্টা পাচ্ছে। এখানে কাছেপিঠে জলের কল কোথায় আছে। অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে। গিয়ে হাল ছেড়ে দিল। এত জিনিসপত্র এখানে রেখেসে জল খেতে যাবে কী করে? নিজেরটা হলে বয়ে নিয়ে যাওয়া যেত, কিন্তু বৃদ্ধা ভদ্রলোকের ব্যাগও রয়েছে। উনি যে কোথায় গেলেন! মাঝবয়সি মেয়েছেলেটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল আবার, এক হাত কনুই থেকে ভাজ করে মুখের ওপর আড়াল দিয়েছে। কালো দাঁত বের করে বলল, শুয়ে পড়ে খোকা, ঘুমিয়ে গেলে সকাল হয়ে যাবেখন।

অনিমেষ বলতে চাইল, আমি এইরকম পায়ে-চলা জায়গায় জীবনে শুইনি, অতএব আজ বসেই রাত কাটাব, কিন্তু বলতে গিয়েও থমকে গেল সে। তার এই ষোল-সতেরো বছরের জীবনে অনেক কিছু সে করেনি, এখন তো করছে। যেমন কোনোদিন সে কলকাতায় আসেনি, এর আগে কখনো দাদু-পিসিমাকে ছেড়ে একা একা থাকেনি, এইভাবে টিয়ার গ্যাসে কখনো তার চোখ জ্বলেনি-এগুলো সব এখন ঘটছে। তাই কোনোদিন করিনি বলে করব না বলা বোধহয় টিক নয়। সে ঘাড় নেড়ে বলল, না, ঘুম আসছে না।

কোত্থেকে আসা হল? কথা বলল মেয়েছেলেটা।

জলপাইগুড়ি।

সে কোথায়-আসামে?

না, তবে ওইদিকেই।

সেখানে পাহাড় আছে।

হেসে ফেলল অনিমেষ। জলপাইগুড়ি শহরে বা জেলায় পাহাড় বলতে তেমন-কিছু নেই। জঙ্গল, আছে, পাহাড়ি আবহাওয়া আছে। সে বলল, নেই।

যেন হতাশ হল মেয়েছেলেটা, আসামে পাহাড় আছে, সেখানে আমার দেওর কাজ করে। তবে লোক ভালো নয়, মাতাল।

অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। কী মতলব কে জানে, নাহলে যেচে যেচে নিজের পরিবারের খবর ওকে দিতে যাবে কেন? মেয়েছেলেটা অবশ্য একা নেই, ওর পাশে একটা ফ্ৰকপরা মেয়ে উলটোদিকে মুখ করে শুয়ে আছে। তাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না অনিমেষ। এই সময় মাইকে আবার ঘোষণা করা হল, যাত্রীসাধারণের কাছে আবেদন, সমগ্র কলকাতা শহরে শান্তিবিম্নের আশঙ্কায় কারফু জারি হওয়ায় আগামীকাল ভোর ছটার আগে কেউ স্টেশন-চত্বরের বাইরে যাবেন না। এতে আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত হবে। বেশ কয়েকবার এই কথাগুলো আওড়ে মাইকটা থেমে গেল। এই সময় বৃদ্ধ ভদ্রলোককে হন্তদন্ত হয়ে ফিরতে দেখল অনিমেষ। এক হাতে বাদামের ঠোঙা একটা, কাছে এসে বললেন, খিদে পায়নি? অনিমেষ ঘাড় নাড়তে তিনি বললেন, একটু আগে ট্রেনেই তো খেয়ে নিলে তুমি!

ওঁর বাদাম-চিবানো মুখটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী দেখলেন?

বুঝতে পারছি না। কোনোরকমে এই সার্কুলার রোডটা পেরিয়ে যেতে পারলেই বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়। কী যে করি! বৃদ্ধের চোয়াল নাচছিল। তারপর হঠাৎ যেন মনে পড়ে গিয়েছে এমন ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা চলো তো, এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাই।

কেন? অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

ওখান থেকে সার্কুলার রোড পাঁচ পা রাস্তা। কিন্তু বাইরে দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। গুড, চলে এসো এদিকে। নিজের জিনিস হাতে নিয়ে বৃদ্ধ আগে-আগে চললেন, পেছনে অনিমেষ। ওরা যাত্রীদের মধ্যে দিয়ে প্ল্যাটফর্মের পেছনদিকে ফিরে যাচ্ছিল। এদিক দিয়ে কীভাবে বের হওয়া যাবে অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে জায়গটা ঢালু হয়ে মাটিতে মিশে গিয়েছে। শেষ আলোটা ছাড়িয়ে ওরা নিচে নামল। তারপর কয়েক পা হেঁটে বাঁদিকে ঘুরে অনেকগুলো রেললাইন পেরিয় একদম শেষপ্রান্তে চলে এল। এখন কোনো ট্রেন আসা-যাওয়া করছে না। মাথার ওপর ঘুড়ির মতো কোনোটে চাঁদ ঝুলে রয়েছে। তার আলোয় রেললাইনগুলো চকচকে সাপের মতো জড়াজড়ি করছে।

বৃদ্ধ কোনো কথা বরছিলেন না, এতক্ষণ, এবার আবার ফিরতে শুরু করে বললেন, যা-ই বল বাবা, এভাবে প্ল্যাটফর্মে বসে সারারাত কাটাব আমি ভাবতেই পারি না। হাজার হোক আমরা কলকাতার ছেলে, বাড়ির দুপা দূরে বসে থাকব অথচ বাড়িতে যেতে পারব না-এ হতেই পারে না। আঃ, কোনোরকমে রাস্তাটুকু পার হতে পারলেই গলিতে ঢুকে পড়ব, ব্যস, সামান্য হাঁটলেই বাড়ি। বাড়ি মানে নিজের বিছানা-আঃ!

কথাগুলো শুনতে শুনতে অনিমেষের মনে হল জলপাইগুড়িতে ওর নিজের বিছানাটা এখন খালি পড়ে আছে। অথচ আজ রাত্রে ওর জন্য কোনো বিছানা তৈরি নেই। এত রাত্রে যদি বাবার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সে উপস্থিত হয় তিনি নিশ্চয়ই বিব্রত হবেন। আবার এও হতে পারে তিনি নিজে স্টেশনে আসতে পারলেন না, অনিমেষ একা কী করছে-এই ভেবে বোধহয় তিনি ঘুমুতেই পারছেন না। তাই যে যদি এখন বাড়িতে যায় তিনি নিশ্চিন্ত হবেন। কিন্তু রাস্তা যদি জনশূন্য হয়, তা হলে কে তাকে ঠিকানা চিনিয়ে দেবে? কলকাতার রাস্তার নাকি বাড়ির নম্বর পরপর থাকে না। তার চেয়ে কাল ভোরে আলো ফুটলে রাস্তায় লোক বের হলে জিজ্ঞাসা করেটরে গেলেই বোধহয় ভালো হবে। মোটামুটি এইরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে অনিমেষ বৃদ্ধের পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। দূর থেকে প্ল্যাটফর্মটাকে ছবিতে-দেখা জাহাজের মতো মনে হচ্ছে, আলো নিয়ে দুলতে দুলতে কাছে এগিয়ে আসছে।

এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে লোকজন তেমন নেই। কিছু ভিখিরি আর ছন্নছাড়া টাইপের মানুষ শুয়ে রয়েছে। ওরা ওদের পাশ দিয়ে মূল গেটে চলে গেল। এগিকে মেইন প্ল্যাটফর্মের মতো জোরালো আলো নেই। কোলাপসিবল গেটের সামনে এসে ওরা থমকে দাঁড়াল। সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা, ডানদিকে স্টেশনে ঢোকার গেট, গেট ছাড়িয়ে রাস্তা দেকা যাচ্ছে। ওপাশটা অন্ধকার। বৃদ্ধ ভদ্রলোক অনেকক্ষণ সেদিকে নজর রেখে ফিসফিস করে বললেন, কোনো মানুষজন তো দেখতে পাচ্ছি না। পুলিশও নেই।

ওটা কী রাস্তা? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

সার্কুলার রোড। ওটা পোয়রালেই হয়ে গেল, পায়েপায়ে বাড়ি পৌঁছে যাব। অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ প্রথম কলকাতাকে দেখল। বৃদ্ধের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, চলো আড়ালে পথটুকু পেরিয়ে যাই।

কিন্তু আমি এখন ঠিকানাটা কি খুঁজে বের করতে পারব।

অনিমেষ কী করবে বুঝতে পারছিল না। এই গ্যাটফর্মে রাতটা কাটানোই নিরপদ বলে মনে হচ্ছিল ওর। বৃদ্ধ বললেন, আঃ, কলকাতা শহরে ঠিকানা থাকলে বাড়ি খুঁজে পাওয়া খুব সোজা। বলছি তো, ওটা আমারই পাড়া।

আমিতো পথঘাট কিছু চিনি না। অনিমেষ বিড়বিড় করল।

সে তো ট্রেনে উঠেই শুনেছি। আমার ওপর ভরসা নেই। যদি আজ তোমার সেই ঠিকানা নাও পাওয়া যায় তুমি তো জলে পড়বে না। আমার বাড়িতে তোফা রাতটুকু কাটিয়ে যেতে পার। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, সেটা নিশ্চয়ই প্ল্যাটফমের চেয়ে নিরাপদ।

অনিমেষ অবাক হয়ে বলল, এখানে কী হতে পারে?

তুমি এখনও নাবালক। বৃদ্ধ ঠোঁট ওলটালেন, গুণ্ডাদের খুঁজতে পুলিশ এসে হামলা করলে তুমি কী করবে? তোমার বয়সের ছেলেদেরই তখন বিপদ হবে। আমার কী বলল, এতটা পথ একসঙ্গে এলাম, কেমন মায়া পড়ে গেছে বলে এত কথা বলা। একা একা যেতে ঠিক মানে-বুঝলে, সঙ্গী থাকলে সাহস পাওয়া যায়।

বৃদ্ধ চলে গেলে একা এই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে থাকার কথা ভেবে অনিমেষ ঘাবড়ে গেল। মেইন প্ল্যাটফর্মে অত লোকের সঙ্গে থাকলে এক কথা ছিল, পুলিশ খামোকা নাজেহাল করতে আসতই-বা কেন। কিন্তু এই ভিখিরিদের সঙ্গে সারাটা রাত থাকা অসম্ভব। এরা যদি হঠাৎ দল বেঁধে তার জিনিসপত্র টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয় ও কিছুই করতে পারবে না। তা ছাড়া পুলিশ এলে আর-কেউ তা দেখার থাকবে না। এক হয়, আবার যে-পথ দিয়ে ওরা মেইন স্টেশন থেকে এখানে এসেছিল সেই পথে ফিরে যাওয়া। অনিমেষ একা একা সাহস পাচ্ছিল না ফিরে যেতে। তার চেয়ে যা ইনি বলছেন তা-ই শোনাই ভালো। অন্তত ওর বাড়িতেও রাতটা নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে।

ওকে রাকি হতে দেখে বৃদ্ধ খুশি হলেন, কিছু চিন্তা করতে হবে না তোমাকে, শুধু আমার পেছন পেছন চলে এসো!

কোথাও কোনো শব্দ নেই, ওরা শেডের অন্ধকারে পা টিপে পিটে মেইন গেটের কাছে চলে এল। বৃদ্ধ সামনে, অনিমেষ পেছনে। সমুখেই বিরাট রাস্তা, মাঝখানে লোহার লাইন পোঁতা। নিশ্চয়ই এটা ট্রামলাইন। রাস্তার ওপাশের যেটুকু চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছিল তাতে বোঝা যায় যে এখন কোনো দোকানপাট খোলা নেই। বৃদ্ধ মুখ বের করে রাস্তাটা দাঁড়িয়ে দেখেনি ল, না, কেউ নেই, ধুধু করছে। এসো।

অনিমেষ আড়ালের আড়ালে ওঁর সঙ্গে নিঃশব্দ পায়ে বাইরে চলে এল। এতক্ষণ দুহাতে বয়েআনা ব্যাগ-বেডিং-এর ওজন সম্পর্কে ওর কোনো খেয়ালই ছিল না, এই বিরাট শহরের চওড়া রাস্তার ধারে নিজের দুটো হাতের টনটনানি হঠাৎই সে অনুভব করতে লাগল। সামনে আর-একটা বড় রাস্তা এসে এই রাস্তায় মিশেছে। বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, এখানে না, ধার দিয়ে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আমরা রাস্তা পার হব, বুঝলে?

ওটা কী রাস্তা?

হারিসন রোড। লোকজন কী প্যানিকি হয়ে গেছে আজকাল, মিছিমিছি ভয় পায়-দেখছ তো পথে একটাও পুলিশ নেই। ওরা যখন ফুটপাথের গা-ঘেঁষে অনেকটা সামনে এগিয়েছে তখন হঠাৎ দূরে কিছু শব্দ বেজে উঠল। অনিমেষ দেখল কী যেন কালোমতন এগিয়ে আসছে। বৃদ্ধ বললেন, আলো নেই-ট্রাম চলছে, ডিপোয় যাচ্ছে বোধহয়। এপাশটায় সবে এসো, কেউ দেখতে পাবে না তা হলে।

দেওয়ালের গায়ে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে অনিমেষ অনেক দূরে থাকা ট্রামটাকে দেখছিল। এর আগে কখনো ট্রাম দেখেনি, বিস্ময় নিয়ে এই বিচিত্র পরিবেশে সে অপেক্ষা করছিল। ওদের সামনে রাস্তার উলটোদিকে একটা বিরাট ব্যানারে সিনেমার বিজ্ঞাপন। এত বড় বিজ্ঞাপন সে এর আগে কখনো দেখেনি। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মুখটা কী দারুণ জীবন্ত দেখাচ্ছে চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে! পাশেই একটা বীভৎস মুখ, কী ছবি ওটা?

হঠাৎ বৃদ্ধ খপ করে হাত শক্ত করে ধরতেই অনিমেষ চমকে সামনের দিকে অকাল। চারপাঁচজন মানুষ খুব দ্রুত এগিয়ে এসে ট্রামের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন করছে। ওদের পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না অনিমেষরা। ট্রামটা আর চলছে না। বৃদ্ধ খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। অনিমেষ অনুভব করল, ওর হাত কাঁপছে। কোনোরকমে কথা বললেন তিনি, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। চলো রাস্তা পেরিয়ে যাই এইবেলা। কথা শেষ করেই তিনি উর্বশ্বাসে দৌড়ে রাস্তাটা টার হয়ে গেলেন। অনিমেষ তেমন দ্রুত দৌড়ে যেতে পারল না হাতে বোঝা থাকায়। সে যখন পার হয়ে গিয়ে বৃদ্ধের কাছে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখন দাউদাউ করে ট্রামটায় আগুন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়া-ছায়া শরীরগুলো দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। বৃদ্ধ ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ইস, ওরা ট্রামে আগুন ধনিয়ে দিয়েছে! এখনই পুলিশ আসবে-পালাও।

অনিমেষ ওঁর পেছন পেছন ছুটতে চেষ্টা করে বলল, আর কত দূরে? বৃদ্ধ কী বলতে মুখ ফেরাতে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়লেন। উঃ, বাবা গো! চিৎকারটা আচমকা অনিমেষকে পাথর করে দিল। ফুটপাথের একদিকে বেঞ্চিতো পাতা, বোধহয় হকাররা এখানে কেনাবেচা করে, তারই এক পায়ার সঙ্গে দড়ি বাঁধা ছিল, বৃদ্ধ তাতেই হোঁচট খেয়েছেন। অনিমেষ তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, খুব লেগেছে।

বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন, ওর খুব যন্ত্রণা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। সামনে দাউদাউ করে ট্রাম জ্বলছে। কলকাতায় পা দিয়ে অনিমেষ প্রথম যে-ট্রামটাকে পেল তার সর্বাঙ্গে আগুন। বৃদ্ধকে নিয়ে কী করা যায় বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। ও জিনিসপত্র মাটিতে রেখে ওঁকে তুলে ধরতে চেষ্টা করল, উঠতে পারবেন?

বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন, বড় কষ্ট হচ্ছে। তুমি বরং সামনে গলিতে ঢুকে বাঁ-হাতি পাঁচ নম্বর বাড়িতে খবর দাও। আমার ছেলের নাম সুজিত। সে-ই ভালো। বুদ্ধের বাড়ি তা হলে খুব কাছে। অনিমেষ উঠে মালপত্র নিয়ে কয়েক পা এগোতেই থমকে দাঁড়াল। খুব দ্রুত একটা কালো রঙের ভ্যান ছুটে আসছে এদিকে। পাশাপাশি একটা জিপগাড়ি। পেছনে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বায়ে বোধহয় একটা দমকালের গাড়ি আসছে। শব্দ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িগুলো। সঙ্গে ঙ্গে কতগুলো পুলিশ লাফিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে, নেমে ট্রামের দিকে ছুটে গেল। ওদের হাতের রাইফেল সামনের দিকে তাগ করা। জিপের লোকগুলো বোধহয় অফিসার, হাত নেড়ে ওদের কীসব উপদেশ দিচ্ছে। ওরা যদি এদিকে তাকায় তা হলে অনিমেষদের দেখতে পেয়ে যাবে। দেখতে পেলে ওরা মনে করবে। সে ট্রামগাড়িতে আগুন দিয়েছে। অন্তত তাকে ওরা প্রশ্ন নিশ্চয়ই করবে, আর তা হলেই জানতে পারবে সে এই প্রথম মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কলকাতায় এসেছে, এখনও টিকিট পকেটে আছে আর হাতের সুটকেসগুলো তো জলজ্যান্ত প্রমাণ। কিন্তু উচানো বন্দুকের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে কেমন টিপটি করতে লাগল অনিমেষের। যে-ট্রামটা জ্বলছে এখন সেটার আগুন নেবানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কতকগুলো লোক। আশেপাশে কোনোমানুষ নেই, কেউ কৌতূহলী হয়ে দেখছে না এখানে কী হচ্ছে। কলকাতা শহরে নাকি লোক সবসময় গিজগিজ করে, তারা এই মুহূর্তে কোথায় গেল!

অনিমেষ পেছন ফিরে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখল। তিনি বোধহয় পুলিশদের লক্ষ করেছেন, কারণ

 

তার শরীর এখন হকারদের বেঞ্চির তলায় অনেকখানি ঢোকানো। চট করে রাস্তা থেকে বোঝা যাবে না কেউ ওখানে আছে। অনিমেষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ও বুঝতে পারছিল, সামান্য নড়াচড়া করলেই পুলিশের নজরে পড়ে যাবে। ওই পাথরের মতো মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় ধরা পড়লে তা কখনোই সুখের হবে না। লোকগুলো আমোক এই ট্রামটা পোড়াতেই-বা গেল কেন? ট্রাম তো জনসাধারণের উপকারেই আসে। খাদ্য চাওয়ার সঙ্গে ট্রাম পোড়ানোর কী সম্পর্ক আছে। নাকি ওরা এইভাবেই সরকারকে জব্দ করতে চায়?

কিন্তু যা-ই হোক, একটা লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা শহরে। সেই লড়াই-এর এক পক্ষ কংগ্রেস সরকার আর তার পুলিশবাহিনী, কিন্তু অন্য পক্ষ কে? অনিমেষ নিজের শরীরের ভার এক পা, থেকে অন্য পায়ে আনার জন্য সামান্য নড়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা কড়া আলো ওর মুখের ওপর এসে পড়ল আচমকা। তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে সে শুনতে পেল, কে ওখানে? হু আর ইউ?।

টর্চের আলো ওর মুখ থেকে সরছে না, কিন্তু কেউ-একজন এদিকে এগিয়ে আসছে। অনিমেষের সঙ্গে একটা কাঁপুনি এসে গেল। কী করবে ও? চিৎকার করে নিজের নাম বলে ওদের দিকে এগিয়ে যাবে? ঠিক সেই সময় ও কয়েকটি ছুটন্ত শরীরকে সামনের গলি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল। কিছু বোঝার আগেই দুমদুম আওয়াজে সমস্ত কলকাতা যেন কাপতে লাগল। যারা ছুটে এসেছিল তারা। শব্দটার সঙ্গেই আবার গলির মধ্যে তুরিতগতিতে ফিরে গেছে। অনিমেষ তাকিয়ে দেখল যে-পুলিশ অফিসার টর্চ-হাতে ওর দিকে এগিয়ে আসছিল তার শরীর মাটিতে পড়ে আছে। সামনের ভ্যানটা ধোয়ায় ভরতি। ওরা বোমা ছুড়ে গেল। অনিমেষ আর-কোনো চিন্তা করতে পারল না। এইরকম একটা আকস্মিক ব্যাপার ওপর সমস্ত চেতনাকে নাড়া দিয়ে গেল। কোনোদিকে না তাকিয়ে শরীরে যত জোর আছে সব একত্রিত করে ও ছুটতে লাগল পাশের গলিটার দিকে। এক দুই তিন চার পাঁচ নম্বর বাড়িটার সামনে পৌঁছে গেলেই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। হঠাৎ একটা তীব্র ব্যথা এবং কানফাটানো গর্জন অনিমেষের সমস্ত শরীর অসাড় করে দিল। কিছু বোঝার আগেই ওর দুটন্ত শরীরটা হুমড়ি খেয়ে গলির মধ্যে পড়ে গেল, ব্যাগ আর বেডিং ছিটকে চলে গেল দুদিকে। পড়ে যাওয়ার পরও আওয়াজ বন্ধ হয়নি। একটা হাঁটু ভাজ করে অনিমেষ গলির রাস্তায় শুয়ে ছটফট করতে করতে আবিষ্কার করল, উষ্ণ স্রোত নেমে আসছে হাঁটুর ওপর থেকে। চটচটে হয়ে যাচ্ছে হাতের চেটো। সেখান থেকে উঠে ব্যথাটা এখন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল, সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে-সে কথা বলতে পারছে না। ক্রমশ চোখ ঘোলাটে হয়ে গিয়ে সমস্ত কলকাতা শহর অন্ধকার হয়ে গেল অনিমেষের সামনে।

কোনোদিন ঘোড়ায় অথবা পালকিতে চড়েনি অনিমেষ। হঠাৎ যেন ওর মনে হল সেরকম কিছুতে সে চেপে যাচ্ছে। বেশ দ্রুত। যন্ত্রণা হচ্ছে কেন এত পায়ে? চোখ খুলে কিছু দেখতে পাচ্ছে না কেন? স্বৰ্গছেঁড়ায় আঙরাভাসা নদীর হাঁটুজলে চেষ্টা করে ড়ুব দিয়ে চোখ খুলে যেরকম ঘোলাটে জগৎটাকে দেখা যেত এখন কেন সেরকম দেখাচ্ছে? কেউ কি ওকে পাজাকোলা করে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে কে? যে বাবা যারা নিয়ে যাচ্ছে তারা ওর হাত-পা-ধরে আছে, ওর বুক পেট নিচের সামনে অন্ধকারটাকে আসতে দেখল।

আর এই সময় একটা অদ্ভুত বাঁশির সুর বাজছে কোথাও, এরকম বোধ হল। মাথার ওপর কালীগাই-এর আদুরে চোখ দুটোর মতো আদর-করতে-চাওয়া আকাশ আর ওরা তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সঙ্গীদের সে কখনো দেখেনি, কিন্তু তাদের মুখচোখ অদ্ভুত উজ্জ্বল। একটা নীলচে ধোয়া ওদের পাকে পাকে কোমর অবধি ঘিরে রেখেছে। স্বৰ্গছেঁড়ার মাঠে যে কাঁঠালচাপা ফুটত সেইরকম একটা গন্ধে নাক ভরে যাচ্ছে। কেউ-একজন বলল, এখন তুমি এমন সুন্দর গান শুনতে পাবে যা কোনোদিন শোননি। কোনোদিন শুনবেও না। ওদের সামনে একটু ওপরে আরও কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে, শরীর নীল ধোয়ায় ছেয়ে আছে, কারওর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অপূর্ব জ্যোতি বের হচ্ছে সেখান থেকে। এই নীলাভ আলোয় অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল একটি মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। প্রচণ্ড নাড়া খেয়ে সে দুহাত বাড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পা নড়ছে না কেন? যেন তাকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ও দেখল, মাধুরীর হাসির মধ্যে যেন তিরস্কার, নাকি অনুযোগ, অথবা অভিমান! ও মনেমনে বলে উঠল, মাগো মা আমাকে আসতে দাও। কিন্তু সেই মূর্তি ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানালেন। আর সঙ্গে সঙ্গে এক অপূর্ব সুর উঠল বাতাসে। একে কি গান বলে? অনিমেষ এরকম গান এর আগে শোনেনি কখনো। তার সামনে থেকে সবকিছু সরে যাচ্ছে আর এই যাওয়ার জন্য এখন একটুও আফসোস হচ্ছে না তার।

হঠাৎ কেউ কথা বলল চাপা গলায়, খোকাকে শুট করেছে দাদা।

খোকাকে একটা ভারী গলা এগিয়ে আসতেই অনিমেষ অনুভব করল তাকে শক্তমতো কিছুর ওপর নামিয়ে রাখা হল। যেন কোনো গভীর কুয়োর তলা থেকে তীরবেগে সে ওপরে উঠে আসছে-এইরকম একটা বোধে দুলতে দূলতে অনিমেষ চোখ খুলল। কিন্তু এত অন্ধকার কেন? ঘরটাই কি অন্ধকার ও শুনতে পেল ভারী-গলা বলছে, সেন্স আছে, না ডেড?

আর-একজন খুব কাছ থেকে জবাব দিল, না, অজ্ঞান হয়ে আছে বোধহয়-খুব ব্লিডিং হচ্ছে। ওকে পড়ে যেতে দেখে বোম চার্জ করে পুলিশটাকে হটিয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে এসেছি।

ওদিকের অবস্থা কেমন?

গলির ভেতর পুলিশ ঢুকবে না মনে হয়।

কিন্তু খোকা ওখানে কী করতে গেল? ওর তো ওখানে থাকার কথা নয়? ভারী-গলাকে খুব চিন্তিত দেখাল।

একটু একটু করে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে, কিন্তু তক্ষুনি মনে হল কে যেন ওর ডান উরুতে পেরেক পুঁতে দিয়েছে-যন্ত্রণাটা তুবড়ির মতো সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। নিজের দুটো হাত সেখানে রাখতেই চটচটে হয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে শরীরটা দুমড়ে-মুচড়ে ও যন্ত্রণার সঙ্গে লড়তে লাগল। দাতের বাঁধন ছিটকে বেরিয়ে এল, মা-মাগো!

সঙ্গে সঙ্গে কেউ বলল, সেন্স এসেছে।

ভারী-গলা কাউকে বলল, গুলি যদি পেটে লেগে থাকে কিছু করার নেই, তুমি জলদি শিবু ডাক্তারের কাছে যাও, আমার নাম বলে নিয়ে আসবে।

দুহাতে মুখচাপা দিয়ে অনিমেষ স্থির হয়ে থাকতে চাইছিল। এইটুকু বোধ ওর কাজ করছিল যে, ও পুলিশের হাতে পড়েনি। এরা কারা? একটা ক্ষীণ আলো আস্তে-আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ও হাতদুটো মুখের ওপর তুলতেই সেই স্বল্প আলোয় টকটকে লাল রক্তমাখা আঙুলগুলো দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে একটা দৃশ্য ওর সামনে চলে এল। মাধুরী চিৎকার করে ওকে বলে উঠেছেন, ওরে মুছে ফ্যাল, তোর হাত থেকে রক্ত মুছে ফ্যাল! চোখের সামনে জ্বলা দাউদাউ চিতার আগুন ওকে যেন ঠেলে আবার সেই কুয়োটার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। অনিমেষ প্রাণপণে চেষ্টা করছিল জ্ঞানটাকে আঁকড়ে ধরার। আলোটা এখন ওর ওপরে। ভারী-গলা হাত দিয়ে ওর পা ছুঁয়ে বলল, থাইতে গুলি লেগেছে। যাক, বেঁচে যাবে। তারপর আলোটা ওর মুখের কাছে এল, আরে, এ কে? কাকে আনলে তোমরা? এ তো খোকা নয়!

খোকা নয়? খোকার মতো ফিগার-হ্যাঁ, তা-ই তো! এ তো অন্য লোক।

ক্রমশ অস্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে আলোটা। যন্ত্রণাটা এখন সারা শরীরে নিজের ইচ্ছেমতন খেলা করে যাচ্ছে। অনিমেষ কিছুতেই চোখ খোলা রাখতে পারছিল না। ভারী-গলা ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এই, তোমার নাম কী?

প্রাণপণে ঠোঁট নাড়তে চাইল অনিমেষ। ওর সমস্ত শরীর কথা বলতে চাইছে, অথচ কোনো শব্দ হচ্ছে না কেন?

ওর দুধ ধরে কেউ ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে সমানে। মুখের ওপর অস্পষ্ট একটা মুখ। ক্রমশ কুয়োর গভীরে যেতে-যেতে অনিমেষ দুটো শব্দ শুনতে পেল, তুমি কে?

ঠোঁট নাড়ল অনিমেষ। চিত হয়ে শুয়ে থাকা শরীরটার পরে মাথাটাকে সোজা রাখতে চেষ্টা করছিল সে প্রাণপণে।

ঠিক এই সময়ে কেউ-একজন বাইরে থেকে অনিমেষের নাম ধরে ডাকতে লাগল। সে বেরিয়ে দেখল ওদের পাড়ারই একটি ছেলে, কংগ্রেস করে, দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষকে দেখে সে বলল, তাড়াতাড়ি কংগ্রেস অফিসে চলো। মারাত্মক ফ্লাড হয়েছে ওপারের দিকে। নিশীথদা তোমাকে খবর দিতে বললেন-রিলিফ পর্টি যাবে।

ঠিক এই সময় কেউ-একজন বাইরে থেকে অনিমেষের নাম ধরে ডাকতে লাগল। সে বেরিয়ে দেখল ওদের পাড়ারই একটি ছেলে, কংগ্রেস করে, দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষকে দেখে সে বলল, তাড়াতাড়ি কংগ্রেস অফিসে চলো। মারাত্মক ফ্লাড হয়েছে ওপারের দিকে। নিশীথদা তোমাকে খবর দিতে বললেন-রিলিফ পার্টি যাবে।

অনিমেষ ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে একছুটে দাদুর কাছে ফিরে এল, দাদু, বন্যাতে অনেক লোক খুব বিপদে পড়েছে। কংগ্রেস থেকে রিলিফ পার্টি যাচ্ছে, আমাকে ডাকছে।

হেমলতা কাছেই ছিলেন। সরিৎশেখর কিছু বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন, তোর যাবার কী দরকার! অনেক বেকার ছেলে আছে, তারা যাক। দুমাস গেলেই তোর পরীক্ষা।

অনিমেষ এরকমটাই আশা করেছিল, গোঁ ধরে বলল, এখন তো পড়াশুনা শুরু হয়নি, মানুষের বিপদ শুনে ঘরে বসে থাকব?

সতিৎশেখর নাতির দিকে তাকালেন। হঠাৎ অনেকদিন পরে তার শনিবাবার কথাটা মনে পড়ে। গেল। কোনো কাজে একেবাধা দিও না। তিনি নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কখন ফিরছ।

অনিমেষ বুঝল আরা বাধা নেই, বুঝতে পারছি না, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। চিন্তার কিছু নেই।

সরিৎশেখর আর-কিছু বললেন না দেখে হেমলতা গজগজ করতে লাগলেন।

কংগ্রেস অফিসে মানুষ গিজগিজ করছে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে রিলিফ পার্টি যাচ্ছে। সরকার থেকে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে, তা ছাড়া দলীয় তার থেকে চিড়ে-মুড়ি-গুড়ের বড় বড় থলে বোঝাই করা হয়েছে। অনিমেষ স্বভাবতই নিশীথবাবুর দলে যাবে স্থির হল। এর মধ্যে খবর এল বামপন্থিরাও রিলিফের জন্য ব্যবস্থা করছে। তবে তারা এখনও বের হয়নি।

অনিমেষ দেখল প্রত্যেকটা দলকে আলাদা-আলাদা করে জায়গা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক যাবার মুখটায় বিরামবাবু কংগ্রেস অফিসে এলেন। তিনি সব দেখেশুনে নিশীথবাবুকে একটু আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে গোপনে কিছু পরামর্শ এবং একটা কাগজ দিলেন। শেষ পর্যন্ত ওরা রিলিফ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটা ট্রাকে দুদলের রিলিফ নিয়ে শহর ধরে রায়কতপাড়া দিয়ে সেনপাড়া ছাড়িয়ে বাধের শেষপ্রান্তে ওঁদের নামিয়ে দেওয়া হল। আগে থেকেই সেখানে লম্বা লম্বা ডিঙিনৌকো প্রস্তুত ছিল। দুটো দল নৌকোগুলো ভাগ করে নিল। অনিমেষদের ভাগে তিনটে ডিঙি জুটল। ওরা থলেঘুলো নৌকোতে চাপাতে বেশ ভারী হয়ে গেল সেগুলো। আজ অবধি কখনো ডিঙিনৌকাতে চড়েনি অনিমেষ। জলে ড়ুবে মরার একটা চান্য নাকি তার আছে যদিও প্রত্যেকটা নৌকোতে দুজন করে পাকা মাঝি আছে। এক-একটা ডিঙিতে ছয়জন মানুষ স্বচ্ছন্দে চড়াতে পারে। কোনোরকমে ব্যালেন্স রেখে ওরা নৌকোতে উঠল। নিশীথবাবু বললেন, তিনিও কোনোদিন ডিঙিয়ে চড়েননি।

তিস্তার চেহারাটা রাতারাতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বর্ষার সময় এইরকম মাঝে-মাঝে দেখা যায়। যদিও মাথার ওপর এখন কড়া রোদ, কিন্তু যে-বাতাসটা তিস্তার বুক থেকে ভেসে আসছে সেটা বুঝিতে দিয়ে শীতটা বাধ্য হয়ে দূরে অপেক্ষা করছে। অনিমেষ নিশীথবাবুর পাশে বসে ভয়েভয়ে জল দেখছিল। গেরুয়া রঙের ঢেউগুলো পাক খেতে-খেতে যাচ্ছে। সরু নৌকো বেশ তীরের মতো জল ঠেলে যাচ্ছে তীর ধরে।

নিশীথবাবু বললেন, বাড়িতে বলে এসেছে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

নিশীথবাবু বললেন, কখন ফিরব জানি না। আজ দুপুরে আমাদের এইসব খেতে হবে। বুঝলে অনিমেষ, এই হল প্রকৃত দেশসেবা। শুধু বিপ্লবের ফাঁকা বুলি নিয়ে দেশসেবা হয় না। .

বাঁধ ছাড়িয়ে কিছুটা ওপরে যেতেই অনিমেষ স্বম্ভিত হয়ে পড়ল। গাছপালা, মাটির ঘরবাড়ি যেন উপড়ে নিয়ে তিস্তা অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছে। নতুন-তৈরি বাঁধ ভেঙে শহরে ঢুকতে পারেনি বলে তার আক্রোশ এইসব খোলা এলাকায় নির্মমভাবে মিটিয়ে নিয়েছে। এখনও জল এদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, তিস্তা ঢুকে পড়েছে অনেকটা। মাঝে-মাঝে কালাগাছ কিংবা দুএকটা খড়ের চাল দেখা যাবে। একটি মানুষ কোথাও নজরে পড়ল না ওদের। অনিমেষ খেয়াল করেনি, নদী ছেড়ে ওরা এখন মাঠের ওপর দিয়ে চলেছে। জলের রঙ দেখে ঠাওর করা মুশকিল। কিছুটা দূরে গিয়ে নৌকোগুলো দুভাগ হয়ে গেল। অন্য দলটা বাঁদিক ঘুরে ভেতরে ঢুকে পড়ল, অনিমেষদের নৌকো চলল তিস্তার শরীরকে পাশে রেখে সোজা ওপরে।

নিশীথবাবু দুহাতে চোখ আড়াল করে নদীর অন্য পাড় দেখার চেষ্টা করছিলেন। সমুদ্র দেখেনি অনিমেষ, কিন্তু ওর মনে হল সমুদ্র নিশ্চয়ই এইরকম হবে। নিশীথবাবু মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু ওর মনে হল সমুদ্র নিশ্চয়ই এইরকম হবে। নিশীথবাবু মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওপারে যাওয়া যাবে মনে হয়?

মাঝি, যার সামান্য দাড়ি দাছে, বলল, আরও আধ ক্রোশ চলেন আগে। বুক হিম হয়ে গেল অনিমেষের। ওইরকম পাগলা কুঁসে-ওঠা ঢেউগুলো পার হতে গেলে নৌকো নির্ঘাত ড়ুবে যাবে আর এখানে একবার ড়ুবে গেলে বাঁচবার কোনো চান্স নেই। হয় ডেডবডি মঙ্গলঘাটে গিয়ে ঠেকবে, নয় সোজা পাকিস্তানে। সে তার সঙ্গীদের দিকে তাকাল। সবাই চুপচাপ নৌকো ধরে বসে আছে।

সামনে একটা গ্রাম পড়ল। জল এখনও চালের নিচে। এখানে বোধহয় সোতটা মারাত্মক ছিল, কারণ বাড়িগুলোর কিছু বেঁচে আছে। মাটির ঘর খড়ের চাল। দূর থেকে ওদের দেখে কিছু মানুষ চিৎকার করে উঠল। অনিমেষ দেখল একটা বিরাট ঝাকড়া বটগাছের ডালে-ডালে অনেকগুলো মানুষ ঝুলছে। তারাই প্রাণপণে চিৎকার করে চলেছে। নৌকো কাছাকাছি হতে অনিমেষের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বটগাছের কাছাকাছি একটা আমগাছে একজন নগ্ন মানুয গলায় কাপড়ের ফাঁস দিয়ে ঝুলছে। তার শরীরের চামড়া এখন কালচে, একটা বিকট গল্প বেরুচ্ছে শরীরটা থেকে। দুটো শকুন তার দুই কাঁধের ওপর বসে অনিমেষের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে আছে। মানুষটার চোখ দুই, শরীরের নানা। জায়গায় নিরক্ত ক্ষত।

প্রায় মানুষটির পায়ের তলা দিয়েই ওরা ডিঙি নিয়ে বটগাছটার দিকে এগিয়ে গেল। চিৎকারটা ওদের এগোতে দেখে সামান্য কমে এল, একটি গলা আর্তনাদের সুরে বলে উঠল, আসেন বাবু, আমাগো বাঁচান, তিনদিন খাই না।

সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলো বিভিন্ন কণ্ঠে আবৃত্তি করল। নিশীথবাবু সাবধানে নৌকোর ওপরে উঠে দাঁড়ালেন, এই গ্রামে কেউ মারা গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠ সংখ্যাটি বলতে লাগল। বটগাছের ডালে-বসা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল অনিমেষ। অনাহার এবং বৃষ্টিতে ভিজে মানুষের চেহারা যে কতটা বীভৎস হতে পারে এদের না দেখলে বোঝা যাবে না। ওরা যে গাছ থেকে নামবে তার উপায় নেই। নৌকোটা গাছের তলায় নিয়ে গেলে একদম নিচের ডালে যারা আছে তাদের হাতে খাবারের ব্যাগ পৌঁছে দেওয়া যায়। নিশীথবাবু মাঝিকে নৌকোটা থামাতে বললেন। তিনজন লোক মারা গেছে। দুজন মহিলা আর একজন বৃদ্ধি। বাকি মানুষ পেছনের দিকে একটা শিবমন্দিরের চুড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। খাবার জোটেনি কারও। নিশীথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ওই লোকটা আত্মহত্যা করল কেন?

ওর বাবু বড় ব্যথা। জল আইলে ঘর থিকা ইস্ত্রি আর মায়েরে লইয়া হুহ উঁচু ঢিবায় রাইখ্যা আইছিল। তারপর জলের মধ্যে ঘরে ফিইর‍্যা জিনিসপত্র যা পরে লইয়া গিয়া দেখল তারা নাই। জল, ওই রাক্ষুসী তিতামাগি অগো খাইছে। আমরা তখন যে যার প্রাণ বাঁচাই। একরাত ওই আমগাছে বইস্যা থাইক্যা শেষমেষ পরনের বস্ত্র দিয়া আমাগো সামনে গলায় ফাঁস দিল, বাবু।

ঘটনা শুনে অনিমেষ চোখের জল সামলাতে পারল না। এই তিনদিন তিনরাত ওরা শহরে বসে এসব ঘটনার কিছুই জানতে পারেনি। এতক্ষণ একটানা কথা বলে লোকটার গলা ধরে এসেছিল। এবার সবাই মিলে খাবার চাইতে লাগল। অনিমেষের সঙ্গীরা থলির মুখ খুলছিল, কিন্তু নিশীথবাবু তাদের হাত নেড়ে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। অনিমেষের সঙ্গীরা থলির মুখ খুলছিল, কিন্তু নিশীথবাবু তাদের হাত নেড়ে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। তারপর লোকগুলোর দিকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই গ্রামটার নাম কী?

নামটা শুনে নিশীথবাবু চট করে পকেট থেকে বিরামবাবুর দেওয়া কাগজ বের করে তাতে কী দেখে নিলেন। অনিমেষ দেখল, নিশীথবাবুর মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। খানিক ভেবে নিয়ে মাঝিকে নৌকো ঘোরাতে বললেন। মাঝি বোধহয় একদম আশা করেনি হুকুমটা, ফস করে জিজ্ঞাসা করে বসল, অগো খাবার দিবেন না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *