০৯. ছোটকাকা চলে যাবার পর

ছোটকাকা চলে যাবার পর বিরাম করের বাড়িতে অনিমেষের খাতির যেন বেড়ে গেল। মুভিং ক্যাসেল পরদিন স্কুল ছুটি হতেই ধরলেন। গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রমহিলা, জেলা স্কুলের ছেলেরা ছুটির পর পিলপিল করে বেরিয়ে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। স্কুলের গেট পার হবার আগেই তপন ওঁকে দেখতে পেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে একটা খোঁচা খেল অনিমেষ, ওই দ্যাখ, হোলি মাদার দাঁড়িয়ে আছেন। উইদাউট ডগ।

অনিমেষ বলল, কী হচ্ছে কী?

তপন থামল না, মাইরি, জলপাইগুড়িতে কোনো মেয়ের এরকম ব্লাউজ পরার হিম্মত নেই। শালা নিশীথবাবুটা বহুৎ চালু মাল!

অনিমেষ এবার রেগে গেল, তপন, তুই যদি ভদ্রভাবে কথা না বলতে পারিস তা হলে আমার সঙ্গে আসিস না।

মণ্টু এতক্ষণ শুনছিল চুপচাপ, এবার অনিমেষের পক্ষ নিল, সত্যি কথা। সব ব্যাপারে ইয়ার্কি করা ঠিক নয়। তারপর ফিসফিস করে বলল, মাসিমার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দে না ভাই।

ততক্ষণে ওরা রাস্তায় এসে পড়েছে। চোখাচোখি হতে মুভিং ক্যাসেল ঠোঁট টিপে মাথা সামান্য কাত করে হাসলেন অনিমেষ বলল, তোরা দাঁড়া, আমি আসছি। কাছাকাছি হতেই মুভিং ক্যাসেল অদ্ভুত মিষ্টি গলায় বললেন, বাবাঃ, ছুটি আর যেন হয় না, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বাড়িতে একটু আসবে না

অনিমেষ দেখল স্কুলের অন্যান্য ছেলে যেতে-যেতে ওদের দেখছে। মণ্টু আর তপন চুপচাপ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। অনিমেষ বলল, আমার সঙ্গে যে বন্ধুরা আছে?

ও। চোখ বড় বড় করলেন মুভিং ক্যাসেল, ওঁরাও কংগ্রেসকে সার্পোট করে?

অনিমেষ চটপট ঘাড় নাড়ল, না।

মুভিং ক্যাসেল তাতে একটুও দুঃখিত হলেন না, আচ্ছা! তোমার বন্ধু যখন তখন ওরা নিশ্চয়ই ভালো ছেলে, কী বল? তা ওদের ডাকো না, ওরাও আসুক, বেশ আড্ডা দেওয়া যাবে খন। তোমার দাদা আবার আজকে প্লেনে কলকাতায় গেলেন। ঘোটকুটার শরীর খারাপ বলে আমি থেকে গেলাম।

অনিমেষ হাতে নেড়ে বন্ধুদের ডাকল। মণ্টু বোধহয় এতটা আশা করতে পারেনি, ও তপনকে ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু বলল, তারপর দুজনে আড়ষ্ট-পায়ে এদিকে আসতে লাগল। মুভিং ক্যাসেল গেটটা খুলে ওদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন, এসো এসো, তোমরা তো অনিমেষের বন্ধু, এক ক্লাসেই পড় বুঝি?

মণ্টু ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। তারপর ঝুঁকে পড়ে ওঁকে প্রণাম করতে গেল। প্রথম বুঝতে পারেনি মুভিং ক্যাসেল, তারপর সাপ দেখার মতো যতদূর সম্ভব শরীরটাকে সরিয়ে নিলেন, ওমা, এর যে দেখছি দারুণ ভক্তি! দিদি বউদিকে কি কেউ প্রণাম করে, বোকা ছেলে! এসো।

মুভিং ক্যাসেলের পেছন পেছন যেতে-যেতে অনিমেষ মণ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। আজকাল কথায়-কথায় মুভিং ক্যাসেলের প্রসঙ্গ উঠলে মণ্টু মাসিমা বলে, বেচারার প্রথম চালটাই নষ্ট হয়ে গেল।

বারান্দার বেতের চেয়ারে ওরা বসল। মুভিং ক্যাসেলের বসবার সময় চেয়ারটায় মচমচ শব্দ হতেই তিনি বললেন, খুব মোটা হয়ে গেছি, না?

অনিমেষ কোনো কথা বলল না। উত্তরটা দিলে কারও স্বস্তি হবে না। মুভিং ক্যাসেলও বোধহয় চাননি জবাব, কী গরম পড়েছে, বাবা! পুজো এসে গেল কিন্তু ঠাণ্ডার নাম নেই। কথা বলতে বলতে বুকের আঁচল দিয়ে একটু হাওয়া নিলেন উনি, এবার তোমাদের দুজনের নাম জানা যাক।

অনিমেষ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখল দুজনেই মুখ নিচু করে নাম বলল। কারণটা বুঝতে পেরে চট করে অনিমেষের কান লাল হয়ে গেল। আঁচলে হাওয়া খাওয়ার পর ওটা এমনভাবে কাঁধের ওপর রয়েছে যে মুভিং ক্যাসেলের বুকের গভীর ভাজটা একদম ওর মুখের মতো উন্মুক্ত। মুভিং ক্যাসেলের কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই, নাম শুনে বললেন, বাঃ! সামনের বছর তো তোমরা সব কলেজ স্টুডেন্ট। এখন বলো তো, তোমরা কংগ্রেসকে কেন সাপোর্ট কর না?

মণ্টু সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের দিকে তাকাল। তপন বলল, আমি এসব ভাবি না।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, তুমি?

মণ্টু আস্তে-আস্তে বলল, আমি কংগ্রেসকে পছন্দ করি না।

গুড। হাততালি দিয়ে উঠলেন মুভিং ক্যাসেল, আজ বেশ জমবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তার আগে একটু চা হলে ভালো হয়, না? চা খাও তো সবাই?

অনিমেষ বাড়িতে চা খায় না। কখনো-কখনো সর্দিকাশি হলে পিসিমা আদা দিয়ে চা তৈরি করে। দেন। কিন্তু আজ বন্ধুরা কেউ আপত্তি না করাতে ও চুপ করে থামল। মুভিং ক্যাসেল চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করে আবার বসে পড়লেন, আর পারি না। অনিমেষ ভাই, তুমি একটু যাও-না, ভেতরের রান্নাঘরে দেখবে আমাদের মেইড-সার্ভেন্ট আছে, ওকে বলবে চার কাপ চা আর খাবার দিতে। তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে। আদুরে মুখভঙ্গি করলেন উনি।

বই-এর ব্যাগটা রেখে অনিমেষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মণ্টু আর মুভিং ক্যাসেলের আলোচনাটা শোনে। মণ্টু ইদানীং খুব কংগ্রেসকে গালাগালি দেয়। অনিমেষকে ঠাট্টা করে বলে, কবে ঘি খেয়েছিস এখন হাত চেটে গন্ধ নে। ও চটপট ফিরে আসবার জন্য ভেতরে পা বাড়াল। ড্রইংরুমটায় কেউ নেই। বিরাম কর যেখানটায় বসেন সে-জায়গাটা চোখে ফাঁকা ঠেকল। সেদিন যে-ঘরটায় ওরা বসেছিল তার দরজায় এল, কেউ নেই এখানে। উর্বশীদের স্কুল এত দেরিতে ছুটি হয় কেন? মেনকাদিও বাড়িতে নেই। ও গরমূখে একদম শেষপ্রান্তে এসে একটা বড় উঠোন দেখতে পেল। উঠোনের এক কোনায় কুয়োর ধারে বসে একজন মাঝবয়সি বউ কী সব ধুচ্ছে। অনুমান করে অনিমেষ তাকেই মুভিং ক্যাসেলে হুকুমটা শোনাল। ও দেখল মুখ ঘুরিয়ে বউটা তাকে দেকে নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল। ভেতরটা বেশ ছিমছাম, সুন্দর। অনিমেষ দেখল উঠোনের এপাশে আর একটা ঘর, তাতে পর্দা ঝুলছে। ওটা কার ঘর? এই সময় ওর মনে পড়ল বাড়িতে ঢোকার সময় মুভিং ক্যাসেল বলেছিলেন, ওঁর বিরাম করের সঙ্গে কলকাতায় যাওয়া হল না ছোটকুটার অসুখের জন্য। ছোটকু কে? বাড়ির সবচেয়ে ছোট তো রম্ভা, নাকি আর কেউ আছে? ওর মন বলল, যে-ই হোক সে। অসুস্থ হয়ে ওই ঘরে শুয়ে আছে। মুভিং ক্যাসেল বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর কেউ একজন অসুস্থ। হয়ে ঘরে শুয়ে আছে ভাবতে খারাপ লাগল অনিমেষের। ওর ইচ্ছে হল একবার ঘরটা দেখে যাবার। কুয়োর ধারে বসে কাজ করে-যাওয়া বউটার দিকে তাকিয়ে ওর একটু সঙ্কোচ হচ্ছিল, ফট করে একটা পর্দা-ফেলা-ঘরে উঁকি দিয়ে কিছু ভাববে না তো? তারপর সেটা ঝেড়ে ফেলে পায়েপায়ে উঠোনটা পেরিয়ে পর্দাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। আশ্চর্য, বউটা একবারও ঘুরে ওকে দেখল না, কিন্তু দাঁড়ানোমা ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কেউ বলে উঠল, কে? অনিমেষের আর সন্দেহ রইল না ছোটকু মানে রম্ভাই। ও-ই অসুস্থ। কী হয়েছে রম্ভার? এখন এই মুহূর্তে আর এখান থেকে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। ও মণ্টুর কথা ভাবল। মণ্টু এখন বাইরে মুভিং ক্যাসেলের সঙ্গে পলিটিকস্ নিয়ে আলোচসা করার সময় ঘৃণাক্ষরে ভাবতে পারছে না রম্ভা এখানে অসুস্থ হয়ে রয়েছে! এক হাতে পর্দাটা সরাল অনিমেষ।

ভেতরটা আবছায়া, খাটের ওপর রম্ভাকে দেখতে পেল ও। পর্দা তোলামাত্র রম্ভা চট করে কী যেন সরিয়ে ফেলতে গিয়ে ওকে দেখে সেটা নিয়েই অবাক হয়ে উঠে বসল, আরে! কী আশ্চর্য ব্যাপার!

অনিমেষ সেখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে তোমার?

হঠাৎ মুখটা গম্ভীর করে রম্ভা শুয়ে পড়ল, বলব না।

এরকম ব্যাপার কখনো দেখেনি অনিমেষ, কেন?

মায়ের কাছে জেনে নাও। দরজায় দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে থা বলা দ্রতা নয়। রম্ভা বলল।

আনিমেষ ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, এবার বলল, কী হ যছে?

সর্দি জ্বর। কাছে এসেছ তোমারও হয়ে যাবে। রম্ভা চাদরটা গলা অবধি টেনে নিল। অনিমেষ হাসল। মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রম্ভা বলল, দিদির কাছে এসেছে।

চমকে উঠল অনিমেষ, না না। আমাদের মাসিমা ডেকে এনেছেন। দিদি বলতে উর্বশীর মুখ মনে পড়ে গেল ওর। এবং এখন ওর ইচ্ছে হচ্ছিল উর্বশী তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক।

আমাদের মানে? রম্ভ কথা ধরল।

এবার অনিমেষ একটু মজা করল, আমি আর আমার দুই বন্ধু। যার একজনের কথা তুমি সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলে, তোমার কথাও ও আমাকে জিজ্ঞাসা করে।

মুখ বেঁকাল রম্ভা, ও, সেই গুন্ডাটা! ও আবার এল কেন?

গুণ্ডা? হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ।

একটা ছেলে সাইকেলে চেপে এসেছিল, তাকে ও মারেনি? বদমাশ ইতর। রম্ভার গলায় তীব্র ঝাঁঝ, কীসব বন্ধু তোমার! আবার তাদের নিয়ে এসেছ!

অনিমেষ চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, আমি যাই।

সঙ্গে সঙ্গে খিঁচিয়ে উঠল রম্ভা, যাই মানে? ইয়ার্কি, না? আমার ঘুম ভাঙিয়ে এখন চলে যাওয়া হচ্ছে। বসো এখানে পাঁচ মিনিট।

তুমি ঘুমিচ্ছিলে কোথায়? বই পড়ছিলে তো! অনিমেষ বালিশের পাশে উপুড় করে রাখা বইটা দেখাল।

রম্ভা বলল, আচ্ছা আচ্ছা। একটু বসে যাও প্লিজ।

মাসিমা খোঁজ করবেন, আমি চা বলতে এসেছিলাম। অনিমেষ ইতস্তত করছিল।

মা এখন তোমার বন্ধুদের সঙ্গে বকবক করবে, খেয়াল করবে না। তা ছাড়া তোমার বাকা হল। মায়ের ফ্রেন্ড। কথাটা বলার ভঙ্গি অনিমেষের ভালো লাগল না। ঘরের এক কোণে টেবিলের গায়ে একটা চেয়ার সাঁটা আছে। ওখানে বসলে এদিকে মুখ ফেরানো যাবে না। এরকম চেয়ার-টেবিল স্কুলে থাকে। নিশ্চয়ই পড়ার টেবিল। ও কোথায় বসবে বুঝতে পারছে না দেখে রুয়া হাত বাড়িয়ে বিছানার একটা পাশ দেখিয়ে বলল, এখানে বসো, কথা বলতে সুবিধে হবে। অবশ্য তোমার যদি ছোঁয়া লেগে। যাবার ভয় থাকে তো অন্য কথা। এরপর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, অনিমেষ সন্তর্পণে বিছানার একপাশে। বসল। বসেই ও বইটার মলাট স্পষ্ট দেখতে পেল।

রম্ভা সেদিকে তাকিয়ে বইটা সরাতে গিয়ে থেমে গেল, এই বইটা তুমি পড়েছ?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। মাথার ওপর চাঁদ, বকুলগাছের তলায় আলুথালু হয়ে দুটো ছেলেমেয়ে জড়াজড়ি করছে, নিচে লেখা হনিমুন। এ-ধরনের বই এর আগে কখনো দেখেনি ও। একদিন ওদের ক্লাসের ফটিক কেমন বিশ্রী ছাপা মলাটা-ছাড়া একটা বই নিয়ে এসেছিল। ফটিকদের একটা দল আছে যাদের সঙ্গে ওরা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। প্রত্যেক বছর একবার করে ফেল করে ফটিক ওদের ক্লাসে উঠেছে। বইটার নাম বাকি লাল গামছা। এরকম নামের কোনো বই হয় বিশ্বাষ হয়নি প্রথমে। তপন বলেছিল, ওটা নাকি খুব জঘন্য বই। এখন এই হনিমুনটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের মনে হল এটাও সেরকম নাকি?

তুমি এখন কচি, নাক টিপলে দুধ বের হবে। রম্ভা বইটাকে বালিশের তলায় চালান করে দিয়ে বলল, আমি যে বইটা পড়ছি দিদিকে বলবে না।

হঠাৎ রাগ হয়ে গেল অনিমেষের, তখন থেকে দিদি-দিদি করছ কেন?

ঠোঁট টিপে হাসল রম্ভা, কেন বলব না, তুমি তো উর্বশীহরণ করেছ।

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অনিমেষ বলল, কী যা-তা বলছ!

চোখ বড় বড় করল রম্ভা, ওমা তাই নাকি! বেশ, তা হলে আমার মাথাটা একটু টিপে দাও তো, খুব যন্ত্রণা করছে। বলেই চোখ বুজে ফেলল ও।

খুব রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। এই মেয়েটা ওর থেকে অনেক ছোট, অথচ এমন ভঙ্গিতে কথা বলে যে নিজেকে কেমন বোকা-বোকা লাগে। ও বলল, ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি মাথা টিপতে জানি না। আমি উঠি, মাসিমা বসে আছেন।

রম্ভা হাসল, তুমি ভীষণ দুটু। মা ঠিকই বুঝবেন যে তুমি আমার সঙ্গে গল্প করছ, রুগির সঙ্গে থাকলে কেউ অখুশি হয় না। তারপর একটু চেয়ে থেকে বলল, তুমি কী জান?

মানে?

রম্ভা এবার কাত হয়ে শুয়ে বাঁ হাতটা ধপ করে অনিমেষের পায়ের ওপর রাখল, মানে তুমি মাথা টিপতে জান না, গল্প করতে পার না, একদম ভোঁদাই।

অনিমেষ টের পেল ও পা নাড়তে পারছে না, কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি রম্ভা ওকে শেষ যে-কথাটা বলল, সেটা শুনেও রাগ করতে পারছে না। আঙ্গুল দিয়ে ওর থাই-এর ওপর টোকা মারতে মারতে রম্ভা বলল, তুমি তো বললে দিদির সঙ্গে কিছু হয়নি। তা তোমার আর লাভার আছে?

লাভার। অনিমেষ চোখ খুলেই উর্বশীর মুখ দেখতে পেল। উর্বশী কি ওর লাভার? কী জানি? আর কোনো মেয়ে-যেন গভীর কোনো কুয়ো থেকে দ্রুত টেনে-তোলা-বালতির মতো ওর সীতাকে মনে পড়ল। সীতা কি ওর লাভার সীতাকে কতদিন দেখেনি ও! কতদিন স্বৰ্গছেঁড়ায় যাওয়া হয়নি। সীতার তো এখানে তপুপিসির স্কুলে পড়তে আসার কথা ছিল, ইস, একবার গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলে হত।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রম্ভা বলল, আছে, না?

আস্তে-আস্তে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না।

যাঃ, বিশ্বাস করি না! আজকালকার ছেলেদের আবার লাভার নেই! দিদিভাই-এর তিনজন আছে, একজন কলেজে, একজন কলকাতায় আর একজন তোমার মাস্টার নিশীথদা। দিদিভাই অবশ্য কলকাতার ছেলেটাকে বিয়ে করবে। রম্ভা খবরটা দিল।

সে কী! নিশীথবাবুর সঙ্গে বিয়ে করতে! রম্ভা বলল।

হঠাৎ অনিমেষ সোজা হয়ে প্রশ্ন করল, তোমার দিদির লাভার আছে?

চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল রম্ভা, নাঃ। একজন ছিল কিন্তু বাবার জন্যে কেটে গেছে। আসলে দিদি খুব কাওয়ার্ড।

এবার মোক্ষম প্রশ্নটা করল অনিমেষ, তোমার?

খিলখিল করে হেসে উঠল রম্ভা, কী চালু, এই কথাটা জিজ্ঞাসা করার জন্য কত ভান! হুঁ, আমার পাঁচজন লাভার আছে। কিন্তু কারও সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলিনি। ওদের সবাই আমাকে লাভলেটার দিত, একজন যা ফার্স্ট ক্লাস লিখত না!

তারা কোথায় গেল? অনিমেষের মজা লাগছিল।

দিদিভাই টের পেয়ে গিয়ে মাকে বলে দিল। মা বলল, কলেজে ওঠার আগে এসব করলে বাড়ি থেকে বার হওয়া বন্দ। আমি যে কী করি! রম্ভা হতাশ গলায় বলল।

অনিমেষ এবার উঠে দাঁড়াল, তারপর রম্ভার হাতটা সন্তর্পণে বিছানায় রেখে দিল, এবার তুমি ঘুমোও, আমি চলি।

রম্ভা বলল, আমার বোধহয় আবার জ্বর আসছে।

অনিমেষ দেখল, ওর মুখটা সত্যি লালচে দেখাচ্ছে। ও একটু ঝুঁকে রম্ভার কপালে হাত রাখতেই আঙুলে উত্তাপ লাগল। ও বলল, ইস, তোমার দেখছি বেশ জ্বর!

রম্ভা ততক্ষণে ওর হাত দুহাতে ধরে গলায় ঘষতে আরম্ভ করেছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না কী করবে। একবার চেষ্টা করেও রম্ভার শক্ত মুঠো থেকে হাতটাকে সে ছাড়াতে পারল না। শেষ পর্যন্ত টাল সামলাতে পারল না অনিমেষ, ধপ করে রম্ভার বালিশের পাশে বসে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে রম্ভা ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অনিমেষ দেখল ওর কোলে একরাশ লক্ষ ফুল ফুলেফেঁপে আট হয়ে ওঠানামা করছে। কিছুতেই যেন কান্না থামছিল না রম্ভার, অনিমেষ টের পেল ওর গা যেন রম্ভার শরীরের জুর-উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। কেমন মায়া হল ওর, আলতো করে রম্ভার চুলের ওপর আঙুল রেখে প্রশ্ন করল, এই, কাঁদছ কেন?

সেইরকম কোলে মুখ ড়ুবিয়ে শুয়ে থেকে কান্নাজড়ানো গলায় রম্ভা বলল, আমাকে কেউ ভালোবাসে না, কেউ না। আমি ছেলে হইনি বলে জন্ম থেকে মার আফসোস। আমার যে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, আমি কী করব?

অনিমেষ কী বলবে প্রথম বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর ও বলল, ঠিক আছে।

ওকে শক্ত করে ধরে রেখে কেমন করুন গলায় রা জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমাকে ভালোবাসবে?

রম্ভার শরীর থেকে উঠে-আসা উত্তাপ হঠাৎই অনিমেষের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। এর জন্য সে একটুও প্রস্তুত ছিল না, যেন অন্ধকার ঘরে ঢুকে কেউ টপ করে সুইচ অন করে দিয়েছে। সেই তিস্তার চর থেকে পালিয়ে-আসা অনিমেষের মুখোমুখি হয়ে গেল সে। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম হাত-পা অবশ। রম্ভা আবার বলল, এই বলো-না, আমাকে ভালোবাসবে তো?

সিল্কি চুলের ওপর আলতো করে রাখা আঙুলগুলো হঠাৎ গোড়ায় গোড়ায় অক্টোপাসের মতো ঢুকে পড়ল। আর সেই মুহূর্তেই ঘরের আলোটা একটু নড়ে উঠতেই অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে দেখল এক হাতে পর্দা সরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে উর্বশী ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে আলোটা নিভে গেল, উর্বশীর চোখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ আবিষ্কার করল ওর শরীরটা আস্তে-আস্তে শীতল হয়ে যাচ্ছে। উর্বশীর এই উপস্থিতি ওর কোলে মুখ ড়ুবিয়ে শুয়ে থাকা রম্ভা টের পায়নি। কান্নার রেশটা গলায় নিয়ে নিজের মনে এই সময় ও বলল, আমি খারাপ, খুব খারাপ, না?

এভাবে বসে থাকা যায় না, অনিমেষ সমস্ত শক্তি দিয়ে রম্বার দুটো হাত কোমর থেকে ছাড়িয়ে নিল। ওর চোখ উর্বশীর দিকে-দরজা থেকে একটুও নড়ছে না সে। পরনে স্কুল-ইউনিফর্ম, কপালে ঘাম রুক্ষ চুল আর চোখে পাথর-হয়ে-যাওয়া বিস্ময়। অনিমেষ জোর করে রম্ভার মাথাটা বিছানায় নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রম্ভার মুখ তখনও উলটোদিকে পাশ-ফেরানো। একটা ঘোরের মধ্যে সে বলে যেতে লাগল, তুমিও আমাকে সরিয়ে দিলে!

অনিমেষ উর্বশীকে কিছু বলতে যেতেই ও দেখল পর্দাটা পড়ে গেল, উর্বশী যেমন এসেছিল তেমন নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর এই আসা এবং চলে যাওয়াটা রম্ভা টের পেল না। অনিমেষের ইচ্ছে হল ও এখনও ছুটে গিয়ে উর্বশীকে সব কথা বলে। ও রর সঙ্গে ইচ্ছে করে এরকম করেনি, রম্ভার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু উর্বশী কি একথা বিশ্বাস করবে? অনিমেষ নিজের মনে সমর্থন পেল না। হঠাৎ ওর বুকের ভেতর অনেকদিন বাদে সেই কান্নাটা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে গলার কাছে জড়ো হয়ে থাকল।

আস্তে-আস্তে বিছানায় উঠে বসে রম্ভার ওর দিকে তাকাল, কী হয়েছে?

নির্জীব গলায় অনিমেষ বলল, তোমার দিদি এসেছিল।

কখন? অনিমেষ অবাক হয়ে শুনল রম্ভার গলা একটু কাঁপল না।

একটু আগে। তারপর বলল, যদি এখন মাসিমাকে বল দেয়!

না, বলবে না। আমি তা হরে অনেক কথা বলে দেব। একদিন বাবার এক বুড়ো বন্ধু ওকে বিচ্ছিরিভাবে আদর করেছিল, আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। ও তো সেকথা মাকে বলেনি? রম্ভা মাথা নাড়ল।

অনিমেষ বলল, কী জানি!

হঠাৎ যেন কারণটা ধরতে পেরে রম্ভা বলে উঠল, ও, দিদি এসেছিল বলে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তরে কথা বলছিলে না, তা-ই বলো! তুমি একদম ভোঁদাই!

অনিমেষ এগোল, আমি যাচ্ছি।

খুব ক্লান্ত হয়ে গেল রম্ভার গলা, আবার কবে আসবে?

অনিমেষ বলল, দেখি।

রম্ভা বলর, দাঁড়াও, তোমাকে একটা কথা বলবে, আর বিরক্ত করব না।

বলার ধরনটা এমন ছিল অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াল, কী কথা?

তোমার খুব অহঙ্কার, না?

না তো!

ভালো ছেলে বলে ভীষণ গর্ব তোমার!

হেসে ফেলল অনিমেষ, তুমি বাজে কথা বলছ!

ওর চোখে চোখ রেখে রম্ভা বলল, তোমাকে একটা কথা বলব, শুনবে?

বলো?

উঁহু, এতদূর থেকে চেঁচিয়ে বললে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ শুনে ফেলবে। প্লিজ, একটু কাছে এসো-না! একদম মুভিং ক্যাসেলের মতো ঘাড় কাত করে রম্ভা বলল।

খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে অনিমেষ বলল, বলো।

ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রম্ভা আস্তে-আস্তে খাট থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়াল। অনিমেষ ওর ভাবভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কথাট বলার জন্য ডেকে যেন ভুলে গেছে রম্ভা। ওর সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরাল, তারপর কী অবলীলায় দীর্ঘ ফীত চুলের। গোছাকে দুহাতে পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে ধরে আঁট খোঁপার মতো জড়িয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে রম্ভার চেহারাটাই পালটে গেল। সেদিকে চেয়ে থাকতে রম্ভা দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ওর সমস্ত শরীর দিয়ে ওকে চুমু খেল।

অদ্ভুত একটা স্বাদ-ঠোঁট, ঠোঁট থেকে জিভে এবং সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে অনিমেষ দুহাতে ঠেলে রম্ভাকে সরিয়ে দিল। শরীরটা হঠাৎ গুলিয়ে উঠল যেন ওর, বিচ্ছিরি লাগছে রম্ভার ঠোঁটের গন্ধ। বোধহয় এরকমটা হবে রম্ভার অনুমানে ছিল তাই খানিকটা দূরে ছিটকে সরে দাঁড়িয়ে ও মুখটা বিকৃত করল, ভীতু, বুন্ধু, ভোঁদাই! ছি!

কথাগুলো বলে ও আর দাঁড়াল না, দ্রুত গিয়ে বিছানায় উঠে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল। বিহ্বল অনিমেষ দেখল শোয়ার আগে রম্ভা হনিমুনটাকে বিছানার তোশকের তলায় চালান করে দিতে ভুলাল না।

অদ্ভুত একটা অবসাদ, গা-রি-বি-বা অস্বস্তি এবং অপরাধবোধ নিয়ে অনিমেষ চুপচাপ পর্দা সরিয়ে বাইরে এল। উঠোন এবং কুয়োর পাড়ে কেউ নেই। এখন ওর সমস্ত শরীরে কোনো উত্তেজনা নেই, কোনো মেয়ে তাকে এই প্রথম চুম্বন করল অথচ ওর মনে হচ্ছে মুখটা ভালো করে ধুয়ে ফেলতে। পারলে বোধহয় স্বস্তি হত। ও দেখল সেই বউটা একটা ট্রেতে চায়ের কাপ আর খাবার নিয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে যাচ্ছে। উঠোনে নামল অনিমেষ। কুয়োর ধারে গিয়ে ও অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে। সংবরণ করে পায়েপায়ে বারান্দায় উঠে এল। একটা দুটো ঘর পেরোতেই ও প্রথম দিনের বসার ঘরটার সামনে এল। বাড়ির জামা পরে উর্বশী চুল বাঁধছে। ও যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে উর্বশী যেন। দেখেও দেখছেন না। আয়নার ওপর একটু বেশি ঝুঁকে পড়েছে যেন সে! অনিমেষ বুঝতে পারল উর্বশী ওর সঙ্গে কথা বলতে চায় না। সঙ্গে সঙ্গে ও ঠিক করল উর্বশীকে সব কথা খুলে বলে যাবে। রম্ভাকে ও ভালোবাসে না, কোনো অন্যায় কিছু করতেও চায়নি, যা হয়েছে সবই রম্ভার ইচ্ছা হয়েছে এবং এই মুহূর্তে ও শরীরে কোন স্বস্তি পাচ্ছে না-এইসব খুলে বলবে। উর্বশীকে ডাকতে গিয়ে ও আবিষ্কার করল গলা দিয়ে প্রথমে কোনো স্বর বের হল না; জোরে কেশে গলা পরিষ্কার করে ও ডাকল।

মুখ ফেরাল না উর্বশী, সেই ভঙ্গিতে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, তোমাদের চা দেওয়া হয়েছে, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

অনিমেষের মনে হল সেদিন যে-মেয়েটা বন্ধুর মতো কথা বলেছিল এ সে নয়। ওর বুকের ভেতরটা কেমন করছিল, অকারণে কেউ ভুল বুঝবে অনিমেষ ভাবতে পারছিল না। নিজেকে শক্ত করে অনিমেষ বলেই ফেলল, তুমি যা দেখেছ সেটাই সত্যি না।

একটুও অবাক হল না উর্বশী, আয়নার ওপর ঝুঁকে পড়ে কপালে টিপ আকঁতে আঁক-৬ লল, এ-বাড়িতে এই ব্যাপার নতুন নয়, জ্ঞান হওয়া থেকেই তো দেখছি। যাও, মা হয়তো ভাবছেন। একবারও তাকাল না সে, অনিমেষ মুখ দেখার কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রচণ্ড অভিমানে অনিমেষের চোখে জল এসে গেল। ও চুপচাপ আচ্ছন্নের মতো পা ফেলে বিরাম করের ঘরে এল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না কেন? রম্ভার ওপর যে-বিতৃষ্ণা ওর মনে। জমেছিল সেটা এখন প্রচণ্ড ক্রোধ হয়ে উর্বশীকে লক্ষ করল। রম্ভা ওকে অহঙ্কারী বলেছিল, ওর মনে। হল উর্বশী ওর চেয়ে হাজার-গুণ অহঙ্কারী। মেয়েরা সুন্দর হলে এরকম হয় বোধহয়। রম্ভাকে ওর। একদম ভালে লাগে না, এখন ও আবিষ্কার করল উর্বশীকে ও বন্ধু বলে ভাবতে পারছে না আর।

বাইরে বোরতে গিয়ে অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। ও বুঝতে পারছিল শরীর এবং মনের ওপর যেঝড় এতক্ষণ বয়ে গেছে, ওর মুখ দেখলে যে-কেউ টপ করে বুঝে ফেলবে। অন্তত মুভিং ক্যাসেলের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। ও জলদি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা রগড়ে নিল। তারপর অনেকটা নিশ্বাস নিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বারান্দায় এল। ওকে দেখতে পেয়েই তিনজনে একসঙ্গে ওর দিকে তাকাল। মুভিং ক্যাসেল বললেন, তোমার চা বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আমরা কিন্তু শেষ করে ফেলেছি।

জড়সড় হয়ে অনিমেষ চেয়ারে বসে দেখল প্লেটে একটা কেক ওর জন্যে পড়ে আছে। কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না, ও চায়ের কাপটা তুলে নিল। সত্যি ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে। মুভিং ক্যাসেল বলরেন, ওমা, কেকটা খেলে না?

কাচুমাচু করে অনিমেষ বলল, খিদে নেই।

সে কী! এইটুকুনি ছেলের খিদে নেই কী গো! তোমাদের বয়সে আমি কত খেতাম! বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন। চা খেতে-খেতে অনিমেষ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে নিল। মটুর মুখটা বেশ গম্ভীর। ওদের খাওয়া হয়ে গিয়েছে, বইপত্তর নিয়ে উঠবার জন্যে তৈরি।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, ছোটকুটার শরীর নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। কথা বলল তোমার সঙ্গে?

চমকে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল অনিমেষ। ও দেখল, মণ্টু সোজা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুভিং ক্যাসেল কি কিছু বুঝতে পারছেন?

ও ঘাড় নাড়ল, ই। খুব জ্বর আছে এখন। যেন জ্বর হরে কেউ কোনো বাজে কিছু করতে পারে।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, একটু আগে আমি দেখলাম নাইন্টি নাইন। তুমি ভুল করেছ। আর ওমেয়ে সবসময় বাড়িয়ে বলে।

অনিমেষ বই-এর ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল, আমরা যাই।

ওকে উঠতে দেখে মণ্টুরা উঠে দাঁড়াল। মুভিং ক্যাসেল চোখ বড় বড় করে বললেন, ওমা, তোমাদের অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি, না? কথা বলার লোক পেলে একদম খেয়াল থাকে না আমার। কথা বলতে এত ভালোবাসি আমি! কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে উনি অনিমেষের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে লাগলেন গেটের দিকে। মণ্টুরা আগে-আগে যাচ্ছিল। না, অনিমেষ ফিরে আসার পর থেকে মণ্টু একটাও কথা বলেনি। মুভিং ক্যাসেলের ধীরে চলার জন্য মণ্টুদের সঙ্গে দূরত্বটা বেড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ উনি ফিসফিস করে বললেন, তোমার ওই বন্ধুটা কিন্তু মোটেই ভালো নয়। ওর দাদা পি এস পি করে?

অনিমেষ বলল, জানি না। মুভিং ক্যাসেলের নরম হাতের চাপ ক্রমশ ওর কাঁধের কাছে অসহ্য হয়ে আসছিল। সেই মিষ্টি গন্ধটা ওকে এখন ঘিরে ধরেছে।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, তোমার মতো ওর মন পরিষ্কার নয়। একটু সতর্ক হয়ে মিশো ওর। সঙ্গে। আর হ্যাঁ, আমাদের সে স্টুডেন্টস সংগঠন আছেন তাতে তোমার জয়েন করার দরকার নেই। তুমি,-তোমাকে দিয়ে অন্য কাজ করাবার প্ল্যান আছে।

অনিমেষ কিছু বলল না। ওরা গেটের কাছে এসে পড়তেই উনি দাঁড়িয়ে পড়ে অনিমেষের কাঁধ থেকে হাতটা নামাতে নামাতে ওর চিবুক ধরে নেড়ে দিলেন, ছেলের চিবুকটা এত সুন্দর যে কী বলব? তারপর গেটটা বন্ধ করে বললেন, কালকে এসো।

ওরা দেখল মুভিং ক্যাসেলের ফিরে যাওয়ার সময় সমস্ত শরীর নাচছে, শুধু কুকুরটা সঙ্গে নেই বলে যা মানাচ্ছে না। আচ্ছা, কুকুরটাকে সে সারা বাড়িতে দেখল না তো! মণ্টু মুভিং ক্যাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল, বহুত খচ্চর মেয়েছেলে।

তপন সঙ্গে তাল দিল, হোলি মাদার গোয়িং ব্যাক।

অনিমেষ এখন আর কিছু বলতে পারল না। ওদের। মণ্টু যদি জানতে পারে রম্ভা ওকে চুমু খেয়েছে তা হলে কী করবে? এই পৃথিবীর কাউকে কখনো একথা বলা যাবে না।

তপন বলল, এতবড় মেয়েছেলে, এখনও কচি খুকি হয়ে আছে। মাসিমা বোলো না-বউদি বলো। পেয়াজি!

অনিমেষ ওদের এমন রাগের কারণ ঠিক বুঝতে পারছিল না।

মণ্টু বলল, আমাকে বলে কিনা তুমি ভুল পথে চলছ তোমার দাদার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কংগ্রেসে এলে তুমি কত সুযোগ-সুবিধে পাবে-অনির মাথা চিবিয়েছে, এবার আমারটার দিকে লোভ।

হঠাৎ তপন বলল, গরু, এতক্ষণ কী খেলে এলে ভেতরে বুকে হাত দিয়ে জ্বল দেখলে?

অনিমেষ রাগতে গিয়েও পারল না, কোনোরকমে বলল, কী হচ্ছে কী!

তপন বলল, হোলি মাদারের একজিবিশন দেখলাম অমরা, এতক্ষণ হোলি ডটার কি তোমাকে গ্রামার পড়াল?

অনিমেষ কোনো উত্তর না দিয়ে হাঁটতে শুরু করতেই দেখল বাগান পেরিয়ে উর্বশীর ঘরের এদিকের জানালাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। তপন আর মণ্টু সেদিকে চেয়ে চাপা গলায় কী-একটা কথা বলে এগোতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। অনিমেষ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখল, মটু পকেট থেকে কালোমাতন কী একটা বের করে চটপট গেটের গায়ে বিরাম করের নামটার আগে বিরাট অ: লিখে গম্ভীরমুখে হাঁটতে লাগল।

আচমকা ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় অনিমেষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। ও এগিয়ে-আসা মণ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটু আগের সেই বিরক্তিটা আর একদম সেখানে নেই। অনিমেষ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

ভাড়াটে আসার পর তেরাত্তিরও কাটেনি সরিৎশেখর অস্থির হয়ে উঠলেন। তিস্তা বাঁধ প্রকল্প অফিস বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে, সইসাবুদ চুক্তি হয়েছে, উনি ভেবেছিলেন আর-পাঁচটা সরকারি অফিস যেমন হয় তেমনি দশটা-পাঁচটার ব্যাপার, সকাল সয়ে রাত নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। অফিস হলেই গাড়ি আসবে ফলে সরিৎশেখর নিজে যা অনেক চেষ্টা করেও পরেননি সরকার নিজের প্রয়োজনেই বাড়ির দরজা অবধি রাস্তা বের করে নেবে। কিন্তু সেসব কিছুই হল না। প্রকল্পের দুজন ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের ফ্যামিলি নিয়ে এসে উঠলেন এ-বাড়িতে। রেগেমেগে সরিৎশেখর চুক্তিপত্রটা খুলে দেখলেন তার হাত-পা বাঁধা। তিনি শুধু সরকারকে বাড়িভাড়াই দিয়েছেন, কিন্তু কোথাও বলেননি যে পরিবার নিয়ে কেউ বসবাস করতে ফ্যামিলি নিয়ে থাকবার জন্য ভাড়ার প্রস্তাব তিনি নাকচ করেছেন। দিনে-দিনেই বাড়ির মদ্যে কাঠের একটা পার্টিশন হয়ে গেল, দেওয়ালে পেরেকের শব্দ হতেই সরিৎশেখরের মনে হল ওঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে, চিৎকারে চ্যাঁচামেচিতে কোনো কাজ হল না, মিস্ত্রিগুলো বধিরের মতো কাজ শেষ করে গেল। সেই বিকেলেই সাধুচরণের কাছে ছুটলেন সরিৎশেখর। সাধুচরণ এখন আর তেমন শক্ত নন। মেয়ে মারা যাবার পর স্ত্রী একদম উদ্যেম পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, সম্প্রতি তিনিও গত হয়েছেন। দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গিয়েছে, পাগলের সংসারে তারা থাকতে চাননি। ফলে সাধুচরণের কী অবস্থা তা জানতে বাকি ছিল না সরিৎশেখরের। তবু ওঁরই কাছে ছুটলেন তিনি, বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে লোকটার বুদ্ধি খেলে খুব। সাধুচরণ সব শুনে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?

উত্তেজিত হব না? কী বলছ তুমি! আমার বুকে বসে ওরা পেরেক ঠুকবে, সহ্য করব? ও–বাড়ি আমার ছেলের চেয়েও আপন, বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে, আমি দেখব?

আহা, আপনি বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, কে থাকল বা না-থাকল তাতে আপনার কী দরকার! শুধু যদি ওরা কিছু ড্যামেজ করে তা হলেই লিগ্যাল অ্যাকশন নেওয়া যেতে পারে।

তুমি বলছ আইন আমাকে সাহাযৗ করবে না?

ঠিক এই মুহূর্তে নয়। যারা আসছে তাদের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে যদি থাকা যায় তা হলে খারাপ কী। আপনারা একা একা থাকেন, বিপদে-আপদে কাজ দেবে। তা ছাড়া, আপনার মেয়ে তো একদম নিঃসঙ্গ, ভাড়াটে মেয়েদের সঙ্গে ভাব হয়ে গেলে দেখবেন ও খুশি হবে।

সরিৎশেখর তুব মেনে নিতে পারছিলেন না, দিনরাত চা-ভ্যা এই বয়সে সহ্য হবে না। দেওয়ালে থুতু ফেলবে, পেন্সিল দিয়ে লিখবে, আমার বিলিতি বেসিনগুলো ভাঙবে, ওঃ, কী দুর্মতি হয়েছিল। তখন রাজি হয়ে গেলাম!

বললেন সাধুচরণ, উঁহু, রাজি না হলে বাড়ি ওরা জোর করে নিয়ে নিত। সরকার তা পাবে। তৎ আঙুল কামড়াতে হত।

কথাটা খেয়াল ছিল না সরিৎশেখরের। সাধুচরণের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন তিনি। হঠাৎ ওর মনে হল, ছেলেদের মতো এই বাড়িটাও বোধহয় তাকে শেষ বয়সে জ্বালাবে। সাধুচরণ হঠাৎ ওঁর দিকে মুখ তুলে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।

ভ্রূ কুঁচকালেন সরিৎশেখর, হাসছ কেন?

তেমনিভাবে সাধুচরণ বললেন, কথায় আছে রাজার মাও ভিখ মাঙে।

বুঝতে পারলেন না সরিৎশেখর, মানে?

বাঃ, আপনার ছোট ছেলে থাকতে কোনো চিন্তার মানে হয় না।

ছোট ছেলে! প্রিয়তোষ?

হ্যাঁ শুনেছি তার কথায় নাকি কংগ্রেসিরা উঠে বসে। মন্ত্রীর সঙ্গে খুব ভাব। ও আপনার বাড়িতে এসে থাকেনি?

সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন, কমিউনিস্ট ছোঁড়ারা ওর খোঁজে এসেছিল।

তা-ই নাকি! আমি তো শুনে অবাক। কমিউনিস্ট ছিল বলে ঘর ছেড়ে পালাল যে-ছেলে তার এখন এত খাতির! জলন্ধরের পাঁজির বিজ্ঞাপনের মতো ব্যাপার, যাক, তাকে আপনি বলুন এইসব কথা, সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়ে যাবে।

ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর, সে চলে গিয়েছে।

তাকে আসতে লিখুন।

এতক্ষণ পর সরিৎশেখরের খেয়াল হল প্রিয়তোষকে ওর ঠিকানার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এমনকি সে কোথায় গেল তাও বলে যায়নি। হয়তো তাড়াহুড়োয় সময় পায়নি, হয়তো পরে চিঠি দেবে, কিন্তু সেকথা সাধুচরণকে বললে কাল সমস্ত শহর জেনে যাবে। হেমলতা হয়তো প্রায়ই বলে যে, বাবা, কিন্তু সেকথা সাধুচরণকে বললে কাল সমস্ত শহর জেনে যাবে। হেমলতা প্রায়ই বলে যে, বাবা, আপনার পেট আলগা তাঁকে ফিরিয়ে দেয় সরিৎশেখর এখন তাই ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়লেন, যেন সাধুচরণের এই প্রস্তাবটা তার খুব মনঃপূত হয়েছে। কিন্তু রায়কতপাড়ার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কিছুতেই তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।

অনিমেষ দাদুর ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিল না। সরকার বাড়ির ভাড়া দেবে, কে থাকল বা–থাকল তাতে কী এসে যায়! ওর নিজের খুব মজা লাগছিল। ওদের বাড়িতে নতুন কিছু মানুষ এসে কছে, রেডিওতে হিন্দি গান বাজছে, এটা কল্পনায় ছিল না। সরিৎশেখর বাইরের বারান্দায় দাঁড়ানো একজন মহিলাকে দ্রভাবে বলতে গেলেন যে জোর হিন্দি গান বাজলে হেমলতার পুজোআচ্চার অসুবিধে হবে, বরং শ্যামাসঙ্গীত কীর্তন আর খবর শুনলে মন ভালো থাকে। কথাটা শুনে মহিলা হেসেই বাঁচেন না, বললেন, দাদু, আপনি কী কী পছন্দ করেন না তার একটা লিস্ট দিয়ে দেবেন। হিন্দি গান ভালো না, বুঝলাম। রবীন্দ্রসংগীত?

সরিৎশেখর সুরটা ধরতে পারেননি, রবি ঠাকুরের গান? না মা, ও বড় প্যানপেনে। ওই এখন যা হয়েছে আধুনিক না ফাধুনিক-ওসব একই ব্যাপার!

মহিলা এত জোরে হেসে উঠলেন যে, সরিৎশেখর আর দাঁড়ালেন না। কথাটা শুনে হেমলতা রাগ করতে লাগলেন, কী দরকার ছিল আপনার গায়ে পড়ে ওসব কথা বলার! নিজের সম্মান রাখতে পারেন না।

সরিৎশেখর বললেন, তোমার পূজোর অসুবিধে হবে বলেই-

ঝাঁঝিয়ে উঠলে হেমলতা, আমার জন্যে চিন্তা করে যেন আপনার ঘুম হচ্ছে না! আমি কি কিছু বুঝতে পারি না? হিন্দি গানস, রবীন্দ্রসংগীত, এসব তো আপনার চিরকালের কর্ণশূল। নি পর্যন্ত রেডিওতে হাত দেয় না তাই।

সরিৎশেখর শেষবার হুঙ্কার ছাড়ার চেষ্টা করলেন, আমার বাড়িতে মাইক বাজাবে আমি সেটা সহ্য করব!

আকাশ থেকে পড়লেন হেমলতা মাইক? বুড়ো বয়সে আপনার কথাবার্তার যা ছিরি হয়েছে না! মেয়েটা কী ভালো! বেচারাকে মামার বুড়ো ভরের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে, সাধ-আহ্লাদ করার সুযোগ পেল না।

কথাটা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন সরিৎশেখর, তুমি জানলে কী করে?

বাঃ, আপনি যখন বাড়ি ছিলেন না তখন ও তো আলাপ করতে এসেছিল, আমার আমের আচার খেয়ে কী প্রশংসাটাই-না করল!

সরিৎশেখর মনেমনে বেশ দমে গেলেন। ওঁর আড়ালে বেশ একটা ষড়যন্ত্র চলছে এই বাড়িতে। অনেকদিন থেকেই তিনি হেমলতাকে সন্দেহ করেন। পরিতোষ বউকে নিয়ে এল এমন সময় যখন তিনি বাড়ি নেই। পরেও এসেছে কি না না কে জানে। তিনি তো আর সবসময় বাড়িতে থাকেন না। মহীতোষ যখনই আসে তার সঙ্গে দুএকটা কথা বলার পর রান্নাঘরে গিয়ে দিদির কাছে চুপচাপ বসে। থাকে। কী কথা বলে কে জানে! ইদানীং নাতিটাও তার কাছাকাছি ঘেঁষে না, নেহাত প্রয়োজনে। দুএকটা কথা হয় অথচ দিনরাত পিসির সঙ্গে ফুসফুস গুজগুজ চলছে। প্রিয়তোষ অ্যাদ্দিন পর বাড়ি ফিরল, তার সঙ্গে আর কটা কথাই-বা হল! হেমলতা অনেক রাত অবধি ছোট ভাই-এর সঙ্গে গল্প করছে এটা টের পেয়েছেন তিনি। সাধুচরণের কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় বেশ শক্ত গলায় এখন সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, প্রিয়তোষ ওর ঠিকানা তোমাকে দিয়ে গেছে, না?

চট করে প্রসঙ্গ পালটে বাবা একথা জিজ্ঞাসা করায় প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলেন হেমলতা, তারপর বললেন, আমাকে দিয়েছে কে বলল?

সরিৎশেখর জেরা করার ভঙ্গিতে বললেন, দেয়নি?

আর সামলাতে পারলেন না হেমলতা বাবার কূটচালটা ধরে ফেলে চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনি আপনার ছেলেদের চেনেন না? এ-বংশের ব্যাটাছেলেরা কোনোদিন মেয়েদের সঙ্গে খোলামনে কথা বলেছে। আমরা তো ঝিগিরি করতে এসেছি আপনাদের বাড়িতে। কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না হেমলতা, হনহন করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। সরিৎশেখর আর কিছু বললেন না। এই মেয়েকে তিনি চটাতে সাহস পান না। আজ সাধুচরণের যে-দশা সেটা তার হলে তেরাত্তিরও কাটবে না। তার জন্য স্পেশাল ভাত তরকারি থেকে ওরু করে কফ ফেলার বাক্স পর্যন্ত ঠিক করে দেওয়া হেমলতা ছাড়া আর কেউ পারবে না। নিজের জন্যেই চুপচাপ সব হজম করে যেতে হবে। নিঃশব্দে লাঠি আর টর্চ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন সরিৎশেখর। সন্ধেবেলায় কালীবাড়ির বাধানো চাতালে বসে আরতি দেখলে মনটা খানিকক্ষণ চিন্তামুক্ত থাকে, ইদানীং এই সত্যটা আবিষ্কার করেছেন তিনি। রাত হলেই বাড়িটা নিঝুম হয়ে যেত। এদিকটায় তিস্তার চর বেশি দূরে নয় বলেই সন্ধের পর। শেয়ালগুলো তারস্বরে ডাকাডাকি করে। নদী যখন টইটম্বুর হয়ে যায়, এপার-ওপার হাত মেলায়, তখন শেয়ালগুলো এসে এপারের কিছু ঝোপজঙ্গলে দিব্যি গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে থাকে। অনিমেষ দিনদুপুরে কয়েকটাকে বাগান থেকে তাড়িয়েছে, নেহাতই নেড়িকুত্তা-মার্ক নিরীহ চেহারা। পিসিমা তো সেই ভুলটাই করে ফেললেন। একদিন রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর বাসন ধুতে গিয়ে দেখলেন, একটা কুকুর ধুকতে ধুকতে ওঁর দিকে তাকিয়ে উঠোনে বসে আছে। কী মনে হল, এঁটোকাটা ছুড়ে দিতে সেটা ভয়েভয়ে গুড়ি মেরে এগিয়ে এসে খেয়ে গেল। পরদিনও একই ব্যাপার। আস্তে-আস্তে জীবটার ভয় কমে গেল। উঠোনে আলো কম, ভোল্টেজ এত অল্প যে একশো পাওয়া টিমটিম করে, তার ওপর। হেমলতা চোখে খুবই কম দেখছেন, ঠাওর করতে পারেনি। একদিন সরিৎশেখরকে বললেন কুকুরটার কথা, বাড়িতে রাত্রে আসে, যখন-তখন চোরটোর আসতে পারবে না। অনিমেষও শুনেছিল, সেদিন দেখল। খাওয়াদাওয়ার পর পিসিমা এটোর সঙ্গে একটা আস্ত রুটি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, সিধু, ও সিধু, আয় বাবা, সিধু। পিসিমা কুকুরটার নাম রেখেছেন সিধু। নিজের ঘরের কাচের জানালায় মুখ রেখে কৌতূহলী হয়ে অনিমেষ দেখল কয়েকবার ডাকার পর বাগানের জঙ্গলটায় ঝটপট শব্দ হল। তারপর একটা শেয়াল প্রায় দৌড়ে পিসিমার সামনে এসে দাঁড়াল। পিসিমা খাবারগুলো মাটিতে রেখে দিতেই সে চেটেপুটে খেতে লাগল। বিস্ময়ে থ হয়ে গেল অনিমেষ। সত্যিই শেয়ালটার চেহারার সঙ্গে কুকুরের যথেষ্ট মিল আছে, তাই বলে অত কাছে দাঁড়িয়ে পিসিমা ভুল করবেন? অনিমেষ ভাবতে পারেনি শেয়ালের এত সাহস হবে। তবে কুকুরটার রাত্তিরবেলায় শুধু চুপচাপ আসাটা কেমন ঠেকছিল। পরদিন যখন ও পিসিমাকে বলল পিসিমা তো বুঝতে পারছি না। তুই আবার বাবাকে বলিস না। হাজার হোক কৃষ্ণের জীব তো, আর ডাকলেই কেমন আদুরে-আদুরে মুখ করে চলে আসে। পিসিমা নিজেই যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না ওটা শেয়াল শোনার পর থেকে।

এইরকম একটা পরিবেশে নতুন মানুষজন এসে যাওয়ায় সন্ধের পর আর নির্জন থাকল না। তবে যা-কিছু আওয়াজ শোরগোল হচ্ছে তা বাড়ির ওদিকটায়। নতুন বাড়ির দুখানা ঘর সরিৎশেখর নিজেদের জন্য রেখে দিয়েছেন। তার আসা-যাওয়ার পথ আলাদা। ভাড়াটেরা দুটো ফ্লাট করে নিয়েছেন। একটাতে মহিলা আর তার স্বামী, অন্যটায় যিনি থাকেন তাঁর বোধহয় বেশিদিন চাকরি নেই, দেখতে বৃদ্ধ মনে হয়। তার ছেলে আর চাকর আছে। ছেলেটি অনিমেষদের চেয়ে কয়েক বছরের। বড়, সবসময় পাজামা তার গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে। আনন্দচন্দ্র কলেজে পড়ে ও, মহিলা এসে পিসিমাকে বলে গিয়েছেন। পিসিমার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে গেছে ওঁর। আজ বিকেলে অনিমেষের সঙ্গে আলাপ হতে উনি জোর করে ওকে ওদের ঘরে নিয়ে গেলেন।

মহিলার নাম জয়া, ঘরে ঢুকেই তিনি বললেন, আমাকে তুমি জয়াদি বলে ডাকবে ভাই। আমার কর্তার দিকে তাকালে অবশ্য আমাকে মসিমা বলতে হয়, তোমার কী ইচ্ছে করছে।

অনিমেষ হেসে বলল, আমার কোনো দিদি নেই, আমি দিদি বলব।

বসবার ঘরে পা দিয়ে সত্যি মজা লাগছিল ওর। এই ঘরগুলো কদিনে জব্বর ভোল পালটেছে। সুন্দর বেতের চেয়ার, দেওয়ালে একটা বিরাট ঝরনার ক্যালেন্ডার আর মস্ত বড় একটা বুককেস-তাতে ঠাসা বই।

জয়াদি বললেন, তুমি কোন ক্লাসে পড়? অনিমেষ গর্বের সঙ্গে উত্তরটা দিল। ও বাবা, তা হলে তো তোমাকে খুব পড়তে হচ্ছে, আমি ডেকে আনলাম বলে পড়ার ক্ষতি হল না?

না না। আমি বিকেলবেলায় পড়তে পারি না তো!

তুমি কারও কাছে প্রাইভেট পড়?

আগে পড়তাম। টেস্টের পর কোচিং ক্লাসে ভর্তি হব।

তোমার বই পড়তে ভালো লাগে?

বই-পড়ার বই?

হুঁ পড়ার বই, গল্পের বই, কবিতার বই।

পড়ার বই-এর মধ্যে অঙ্কটা আমার একদম ভালো লাগে না। আমি চার রকমের অঙ্ক খুব। ভালোভাবে শিখেছি, যে-কোনো প্রশ্নই আসুক শুধু তা দিয়েই চল্লিশ নম্বর পেয়ে যাই।

তা-ই নাকি! যা! সত্যি! সরল, চলিত নিয়ম, ল, সা. গু., গ. সা. গু. আর সুদের অঙ্ক।

জয়াদি শুনে শব্দ করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি তোমার সব খবর জেনে নিচ্ছি বলে কিছু মনে করছ না তো?

না।

আচ্ছা, এবার বলো গল্পের বই কী কী পড়েছ।

অনিমেষ একপলক চিন্ত করে নিল, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, বিবক্ষ, কপালকুণ্ডলা, সীতারাম। নীহারঞ্জন গুপ্তের কালো ভ্রমর-

সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি জয়াদির। হাসতে হাসতে বললেন, তুমি কালো ভ্রমর পড়েছ। ওঃ, দারুণ না? দস্যু মোহন ও বাবা, তাও পড়েছ! কিন্তু শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি, প্রায় একশো বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র যেসব বই লিখেছেন সেগুলোকে আমরা বলি অমর সাহিত্য। অমর মানে যা কোনোদিন পুরনো হয় না। আর কালো ভ্রমর হচ্ছে আইসক্রীম খাওয়ার মতো, ফুরিয়ে গেলেই শেষ। তাই কখনো আনন্দমঠের সঙ্গে কালো ভ্রমরের নাম একসঙ্গে কোরো না। তা হলে বঙ্কিমচন্দ্রকে অশ্রদ্ধা করা হয়।

এভাবে কেউ তাকে লেখকদের চিনিয়ে দেয়নি, অনিমেষ জয়াদিকে আরও পছন্দ করে ফেলল, আমাকে এখান থেকে বই পড়তে দেবেন? আঙুল দিয়ে ও বুককেসটাকে দেখাল।

নিশ্চয়ই, কিন্তু আর-কাউকে দেবে না। বই অন্যের হাতে গেলে তার পা গজিয়ে যায়। ঠিক আছে, আমি তোমাকে বই বেছে দেব। প্রথমে বঙ্কিচন্দ্রের সব বই তুমি পড়বে, তারপর শরৎচন্দ্র–।

আমি শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি পড়েছি। অনিমেষ মনে করে বলল।

আচ্ছা। তারপর রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ পড়া হয়ে গেলে তোমার সব পড়া হয়ে যাবে।

রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আমার মুখস্থ। ভীষণ ভালো, না?

যত বড় হবে তত ভালো লাগবে। কিন্তু তুমি পড়বে কখন, তোমার তো স্কুরে পড়ার চাপ এখন?

একটুও দেরি করল না অনিমেষ, বিকেলবেলায় পড়ব। এখন থেকে আর বিকেলে খেলতে যাব না, খেললে রাত্রে পড়ার সময় ঘুম আসে। .

বেশ তা হলে বিকেলে এখানে বসে আরাম করে পড়বে, রোজ বাড়িতে নিয়ে গেলে পড়ার বই-এর তলায় গল্পের বই লুকিয়ে রাখবে, পড়া হবে না।

অনিমেষ হেসে ফেলল, আমি কাল একটা বই কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না বলে ওরকম করে পড়েছি। দাদু অল্পের জন্য ধরতে পারেননি।

কী বই সেটা?

পথের পাঁচালী। এখন যে-সিনেমাটা হচ্ছে রূপশ্রীতে, সেই বইটা। ক্লাসের একটা ছেলের কাছ থেকে এনেছি। তুমি পড়েছ?

হঠাৎ যে ও তুমি বলে ফেলেছে অনিমেষ নিজেই খেয়াল করেনি। জয়াদি আস্তে-আস্তে বলল, দুর্গাকে তোমার কেমন লাগে?

মুহূর্তে বুক ভার হয়ে গেল অনিমেষের, দুর্গার জন্য আমি কেঁদে ফেলছিলাম, ওঃ, কী ভালো। আর জান, পড়তে-পড়তে নিজেকে অপু বলে মনে হয়।

জয়াদির সঙ্গে রিকশায় যেতে-যেতে অনিমেষ বইটা যে পথের পাঁচালী তা জানতে পারল। আজ শেষ শো, কাল রবিবার থেকে অন্য বই। শুক্রবার থেকে এখানে নতুন ছবি দেখানো হয়, কিন্তু এবার। কিছু গোলমাল হয়ে যাওয়ায় পুরনো ছবিটা থেকে গেছে। হলের সামনে এসে দাঁড়াতেই তপপিসি আর ছোটকাকার কথা মনে পড়ে গেল ওর। তপূপিসির সঙ্গে জয়াদির অনেক মিল আছে। জয়াদিও যেটুকু নইলে নয় তার বেশি সাজে না। অনিমেষ দেখছে যাকে ভালো লেগে যায় তার সঙ্গে সবসময় ভালোলাগা মানুষগুলোর অদ্ভুত একটা মিল পাওয়া যায়।

জয়াদি এবং অনিমেষ পাশাপাশি বসে ছবিটা দেখল। হরে আজকে একদম দর্শক নেই। অনেকদিন বাদে সিনেমা দেখতে এল অনিমেষ। মূল ছবির আগে গর্ভমেন্টের ঝবি দেখাল, তাতে জওহরলাল নেহরু, বিধানচন্দ্র রায়কে দেখতে পেল ও। একবার গান্ধীজিকে এক হয়ে গেল তার অজান্তে। তারপর দুর্গা মারা যেতে সেই বৃষ্টির রাত্রে ছাদের ঘরে শুয়ে-থাকা মাধুরীর মুখটাকে দেখতে পেল ও। সঙ্গে সঙ্গে ড়ুকরে কেঁদে উঠল অনিমেষ। ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। জয়াদির একটা হাত ওর পিঠে এসে নামল, এই, কেঁদো না, এটা তো সিনেমা, সত্যি নয়।

অনিমেষ বুঝতে পারল কথা বলার সময় জয়াদির গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে, জয়াদি কোনোরকমে কান্নাটাকে চেপে যাচ্ছেন।

ছবি শেষ হবার পর গম্ভীর হয়ে গেল অনিমেষ। ওর মনে হল ও যেন নিজের কখন অপু হয়ে গিয়েছে। জয়াদিও আর কোনো কথা বলছেন না। সন্ধে হবার অনেক আগেই ওরা রিকশায় চেপে বাড়িতে পৌঁছে গেল। পথের পাচালী সদ্য-সদ্য পড়া ছিল অনিমেষের, তার ওপর এই ছবি দেখা, দুই-এ মিলে অদুত একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল ওর মদ্যে। যা বঙ্কিমচন্দ্র শরৎ এমনকি রবীন্দ্রনাথ পারেননি, বিভূতিভূষণ সেটা সহজে যেন পেরে গেলেন। অনিমেষের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ও যদি কখনো কলকাতায় যেতে পারে তা হরে বিভূতিভূষণের কাছে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে।ত

দ্বিতীয় ভাড়াটের ছেলেটিকে অনিমেষ কয়েকবার দেখেছে, খুব ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অথবা ঢুকছে, কিন্তু আলাপ হয়নি। জয়াদির সঙ্গে ওদের আলাপ নেই এটা বুঝতে পেরেছে অনিমেষ, ওদের বাড়িতে মহিলা নেই বলেই বোধহয়। জয়াদির স্বামী খুব গভীর। ওকে দেখলে কেমন আছ, বসো, এর বেশি কোনো কথা বলেন না। না বলে দিলে উনি যে জয়াদির স্বামী বোঝা মুশকিল। মাথার চুল সব পাকা, চোখে খুব পাওয়ারওয়ালা কালো ফ্রেমের চশমা। বরং অন্য ভাড়াটে, যিনি ওই ছেলেটির বাবা, তাকে খুব ভালোমানুষ মনে হয়। দাদু যখন এন্তার অভিযোগ করে যান তখন চুপচাপ মাথা নেড়ে শোনেন। রিটায়ার করার সময় হয়ে গেছে ওঁর, মাথায় একটাও চুল নেই।

তা ছেলেটার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে আলাপ হয়ে গেল ওর। একদিন বিকেলে ও স্কুল থেকে ফিরেছে এমন সময় দেখল গেটে পিয়ন দাঁড়িয়ে, হাতে একটা পার্সেল। ওকে দেখতে পেয়ে পিয়ন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সুনীল রায় বলে কেউ থাকে এখানে?

সুনীল আশ্চর্য অনিমেষ এরকম নামের কাউকে চিনতে পারল না, না তো!

কী আশ্চর্য। দুদিন ধরে ঘুরছি, হামিপাড়া নিয়ার টাউন ক্লাব। একটু আগে একটা ছেলে বলল, এই বাড়িতে হবে। অচেনা লোকের নামের আগের কেয়ার অফ দেয় না কেন? যেন সবাই বিধান রায়। হয়ে গেছে! বিরক্ত হয়ে পিয়ন চলে যাচ্ছিল।

খুব হতাশ হল সুনীল, কী আশ্চর্য! আচ্ছা, তুমি এখানে বসো। হাত দিয়ে বিছানার একটা দিক দেখিয়ে দিল ও। অনিমেষ বসতে এই তিনটে ওর সামনে রেখে বলল, সুকান্ত হল কবি, নবজাগরণের কবি। ওর কবিতা পড়লে রক্ত টগবগ করে ওঠে। আমাদের এই ভাঙাচোরা সমাজ, বুর্জোয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কবিতা লিখেছে। সুনীল বলল, শুনবে শেষ চারটে লাইন?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ওর খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সুনীল কেমন অন্যরকম গলায় কবিতা পড়ল,

এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে
সোনালি নয়কো, রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সকালে সেখানে জ্বলছে
দাউ দাউ করে বাংলা দেশের প্রাণ।

তারপর চোখ বন্ধ করে বলল,

কবিতা তোমায় দিলাম ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

এরকম কবিতা এর আগে শুনেছ? কবিতা বলতে তো বোঝ প্যানপেনে চাঁদফুল আর প্রেমের ন্যাকামি। প্রেম সম্পর্কে সুকান্ত কী লিখেছে শুনবে?

হে রাজকন্যে
তোমার জন্যে
এ জনারণ্যে
নেইকো ঠাঁই–
জানাই তাই।

অনিমেষ ক্রমশ চমকৃত হচ্ছিল। এ-ধরনের কবিতা ও আগে শোনেনি। খুব সাহস করে সে বলল, উনি কি কমিউনিস্ট

হঠাৎ মুখের চেহারা পালটে গেল সুনীলের। খুব শক্ত গলায় সে বলল, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে যদি কমিউনিস্ট হতে হয় তিনি কমিউনিস্ট। একদল মানুষ ফুলেফেঁপে ঢোল হবে আর কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে শুকিয়ে মরবে-এরকম সমাজ্যবঘা চিরদিন চলতে পারে না। সুকান্ত তাই বলেছে, জন্মেই দেখি, ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। কথাটা এই স্বাধীনতার পওে সত্যি।

অনিমেষের একথাগুলো শুনে চট করে সদ্যপড়া রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল, রাজার হস্ত করে সমস্ত সোৎসাহে যে-বইটা ওকে দিল তার নাম ছাড়পত্র।

সুনীলের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল অনিমেষের। বয়সে বড় বলে সে ওকে সুনীলদা বলে ডাকে। জয়াদি ব্যাপারটা ভালো করে শুনে বলল, বাঃ, বেশ ছেলে তো! আমাদের সঙ্গে কথা বলে না তো, তাই জানতাম না। কিন্তু এর চেয়ে বেশি কৌতূহল প্রকাশ করল না।

জয়াদির কথা সুনীলদাকে বলতেই সুনীলদা বলল, হ্যাঁ, ওঁকে দেখেছি। মহিলাকে সঙ্গে মপ্রয়োজনে কথা বলি না।

অনিমেষ সুকান্তের পর গোর্কির মা পড়ে ফেলল। সুনীলদা ওকে বুঝিয়েছে, পৃথিবীতে মানুষের মাত্র দুটো শ্রেণী আছে। একদল শোষক অন্যদল শোষিত। শোষকের হাতে আছে সরকার, মিলিটারি, পুলিশ। শোষিতের সম্বল ক্ষুধা, বঞ্চনা, তাই আজকের স্লোগান দুনিয়ার শ্রমিক এক হও। ভিয়েতনাম, কিউবা, আফ্রিকার দেশগুলো আজ মানুষের অধিকার আদায় করতে লড়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষকে ওদের সংগ্রামের শামিল হতে হবে। ইংরেজ চলে যাবার পর তাদের স্নেহে পুষ্ট কিছু কংগ্রেসি সরকা হাতে পেয়েছে। সাধারণ মানুষ এখনও এদেশে কুতুপুজো করে, তারা জওহরলালের ভণ্ডামিতে ভুলবেই। কংগ্রেসের একটা নকল ইতিহাস আছে যার ফলে জেলায় সাধারণ মানুষ এমন মুগ্ধ যে এতদিন কংগ্রেস যা ইচ্ছে তা-ই করতে পেরেছে। কিন্তু কংগ্রেস তো দালালমাত্র। আসলে এই দেশ শাসন করে কয়েকটা ফ্যামিলি। তারাই দেশের টোটাল ইকনমিতে কবজা করে বসে কংগ্রেসকে শিখণ্ডী করে যা ইচ্ছে করছে।

অনিমেষ লক্ষ করেছে সুনীলদা যে-কথা বলে ছোটকাকা ঠিক সে-ধরনের কথা বলত না। ছোটকাকা সেই সময় যেরকম ছন্নছাড়া ছিল সুনীলদা তা নয়। ছোটকাকার কথাবার্তার মধ্যে একটা বিক্ষোভ ছিল ঠিকই, কিন্তু সুনীলদার মতো এত পরিষ্কার ধারনা ছিল না। সুনীলদাকে ওর অনেক সমঝদার মনে হয়। অবশ্য সে-সময়কার ছোটকাকাকে ও স্পষ্ট মনে করতে পারে না, শুধু ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় ছাড়া। মুখে যেসব কথা বলেছেন নিশীথবাব, কাজের সময় তার কোনোটার কথা মনে রাখেননি। সুনীলদা ওকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে, সেটা জন্মভূমি নিয়ে। নিশীথবাবু বলেছেন, জন্মভূমিই হল মায়ের বিকল্প। জন্মভূমিকে ভালো না বাসলে মাকে ভালোবাসা যায় না।

সুনীলদা বলল, স্বাধীনতার পর যে লক্ষ লক্ষ মানুষ পাকিস্তান থেকে এদেশে চলে এল তাদের জন্মভূমি ওপারেই পড়ে রইল। এদেশে এসে তারা দেশপ্রেম দেখাতে পারে না নিশ্চয়ই। পশ্চিমবাংলা তাদের জন্মভূমি নয়, যে-মানুষগুলো নিজের জন্মভূমিতে লড়াই করে না থেকে পালিয়ে এল বাচার তাদিগে তুমি কি তাদের শ্রদ্ধা করবে?

অনিমেষ বলর, কিন্তু ওরা তো সবাই বাংলাদেশের লোক। তা হলে এটাও ওদের জন্মভূমি।

সুনীলদা বলল, ঠিক তাই। আমরা আরও বড় করে ভাবি। আমাদের জন্মভূমি গোটা পৃথিবীটা। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যে-কথা বলছ তা স্বাধীনতার অনেক আগে বলা হত। বঙ্কিমচন্দ্রের সে-যুগে প্রয়োজন ছিল হয়তো, এখন তিনি ব্যাকডেটেড হয়ে গেছেন। এখন এত সংকীর্ণ। হলে হলে না। তখন ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই, এখন নিজেদের সঙ্গে নিজেদের সগ্রাম।

জলপাইগুড়ি শহরে বামপন্থি আন্দোলনের পুরোধ হিসেবে জাতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং পি এস পির মধ্যে বেশ একটা রেষারেষি আছে। সুনীলদা এই দুটো দলের সঙ্গেই পরিচিত, তবে অনিমেষের মনে হয়, ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বেশি যুক্ত। খোলাখুলি কথা বলে না কখনো। মাঝে-মাঝে বেশ কদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। এবার ফিরে এসে বলল, তোমাদের চা-বাগানের নাম স্বৰ্গছেঁড়া?

অনিমেষ বলল, হ্যাঁ।

সুনীলদা হেসে বলল, ওখানেই ছিলাম এই কয়দিন।

বেশ অবাক হল অনিমেষ। স্বৰ্গছেঁড়ায় ওর কেউ থাকে সেটা বলেনি তো কখনো!

কার বাড়িতে ছিলে?

একজন শ্রমিকনেতার।

আরও অবাক হয়ে গেল অনিমেষ, স্বৰ্গছেঁড়ায় কখনো কোনো শ্রমিকনেতা ছিল না! ও জিজ্ঞাসা করল, ওঁর নাম কী?

জুলিয়েন। বেশ শিক্ষিত ছেলে। চা-বাগানের কর্তৃপক্ষ ওকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাবুদের চাকরি দেয়নি। সেই মুলকরাজ আনন্দের যুগ এখনও চলে আসছে দেখলাম।

মুলকরাজ আনন্দের নাম এর আগে শোনেনি অনিমেষ। কিন্তু বুকু সর্দারের ছেলে মাংরা যে এখন শ্রমিকনেতা কল্পনা করতে ওর কষ্ট হচ্ছে।

সুনীলদা বলল, যাহোক, শ্রমিকরা খুব উত্তপ্ত। আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে। কিছু কিছু দারিদাওয়া নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এদের ঠিকমতো গাইড করলে চা-বাগানের চেহারা পালটে যাবে।

অনিমেষ চেহারা পালটে যাবে।

সুনীলদা বলল, কী আশ্চর্য, তুমি বাগানে ছিল আর দেখনি? বাগানের কুলিদের মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয়? গরু-ছাগলের মতো বাড়িতে কাজ করানো হয় না? কী বেতন পয়া ওরা? থাকার জায়গা ধোয়াড়ের চেয়ে অধম!,

কথাগুলো শুনতে শুনতে অনিমেষ আজ এতদিন পরে চোখে দেখে সয়ে-যাওয়া সত্যটার অর্থ আবিষ্কার করল। সুনীলদা যা বলেছে তা মিথ্যে নয়, অথচ এতদিন ওখানে থেকে ওর কাছে এটা একটুও অন্যায় বলে মনে হয়নি।

অনিমেষ বলল, আন্দোলন হবে?

নিশ্চয়ই। সুনীলদা বলল। তারপর একটু বিষ গলায় জুড়ে দিল, কিন্তু আমাদের এই বামপন্থি পাটিগুলো যেরকম শম্বুকগতিতে চলছে তাতে কোনো কাজ হবে না। এদেশে এভাবে কোনোদিন বিপ্লব আসবে না। ভিক্ষে করে অধিকার পাওয়া যায় না।

অনিমেষের এতদিন বাদে খুব ইচ্ছে করছিল স্বৰ্গহেঁড়ায় গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে। খুব দ্রুত একটা পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়ে গেছে ওখানে। একটা মজার ব্যাপার মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে সুনীলদা বলল, জান, আসবার সময় দেখলাম কিছু কংগ্রেসি ধ্বনি দিচ্ছে, বন্দে মাতরম্ মাতরম্। ঠিক ইনকিলাব জিন্দাবাদের নকল করে। ওদের আর নিজস্ব বলে কিছু থাকল না।

জলপাইগুড়ি শহরের শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। ওধারে চাঁদমারি থেকে এধারে রায়কতপাড়া ছাড়িয়ে তিস্তার গা-ঘেঁষে দিনরাত কাজ চলছে। প্রত্যেক বছর নিয়মিত বন্যার হাত থেকে শহর বাঁচবে, দল বেঁধে মানুষেরা আসত বাঁধ গড়া দেখতে। প্রচুর বোন্ডার পড়ছে, বড় বড় কাঠের বিমকে বালির ভেতরে ঠুকে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে সারাদিন। মানুষেরা একটু নিশ্চিন্ত, যদিও গত দশ বছরের মধ্যে একবারই শুধু বড়সড় বন্যা হয়েছিল তবু তিস্তাকে কেউ বিশ্বাস করে না।

বাঁধের কাজ শুরু হবার পর জলপাইগুড়ির ছেলেমেয়েদের একটা বেড়াবার জায়গা জুটে গেল। এমনিতে কোনো পার্ক নেইবা শহরের মধ্যে যে-খেলার মাঠগুলো সেখানে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা সাহস করে বসতে পারে না। কারণ এই শহরের মানুষ পরস্পরকে এত চেনে যে, শোভনতার বেড়া ডিঙানো অসম্ভব। তবু রায়কতপাড়ার ছেলে সাহস করে বাবুপাড়ার মেয়ের সঙ্গে মাষকলাইবাড়ির। রাস্তায় পাঁচ মিনিট হেঁটে আসে কখনো-সখনো। কিন্তু তাই নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। দেখা। যায় মোটামুটি একটি সুন্দরী বালিকার প্রতি শহরের একাধিক কিশোর আকৃষ্ট। এবং তারা। প্রয়োজনমতো দুটো শিবিরে বিভক্ত। এই দুটো শিবির পরিচালনা করে থাকে শহরের দুই মাস্তান, রায়কতপাড়ার অনিল দত্ত আর পাণ্ডাপাড়ার সাধন। এরা অবশ্য কদাচিত্র মুখোমুখি হয়, কিন্তু যখন হয় তখন শহরের পুলিশবাহিনীর হৃৎকল্প শুরু হয়ে যায়। বিরাট দুটো বাহিনী হাতে হান্টার, গুপ্তি এবং লাঠি নিয়ে বীরদর্পে রাস্তা দিয়ে প্রায় মিছিল করে এগিয়ে যায়। আগ্নেয়াস্ত্র বা বোমার ব্যবহার হয় না। তবে এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুই মাস্তান এবং তাদের প্রথম সারির শিষ্যরা রাজনৈতিক সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে। তাদের এখন অবধি কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে মারামারি করতে দেখা যায়নি। বাধ তৈরি হওয়ার পর থেকে এরা প্রায়ই তিস্তার পাড়-ঘেঁষে টহল দিচ্ছে সনোগাদ। কারণ যেহেতু এই অঞ্চলটা শহরের বাইরে অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় এবং অজস্র কাঠ ও বোন্ডারে বোঝায় হয়ে থাকে, পরস্পরের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য প্রেমিক-প্রেমিকরা নদীর শীতল বাতাস পাথরের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রেখে উপভোগ করতে পছন্দ করছে।

কংগ্রেস অফিসে এই নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। নাগরিকরা স্বচ্ছন্দে পছন্দমতো জায়গায় যোরাফেরা করতে পারছে না-এটা চলতে দেওয়া যায় না। অবশ্য সাধন এবং অনিল কখনো ঘটনাস্থলে যায়নি। এরা কয়েকবার জেলে কাটিয়ে এসেছে এবং এখন বেশি ঝামেলা পছন্দও করছে না। থানার বড়বাবু তিস্তার পাড়ে সেপাই মোতায়েন করেছেন, কিন্তু সন্ধ্যার পর সেই বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের খোঁজ পাওয়া মুশকিল। ফলে নিত্যনতুন হাঙ্গামা লেগেই আছে। শহর প্রতিদিন নতুন কেচ্ছার খবর পেয়ে জমজমাট হয়ে থাকে।

বাঁধ তৈরি আরম্ভ হওয়ায় সবচেয়ে অসুবিধে হচ্ছে সরিৎশেখরের। সেই কাকভোরে লাঠি দুলিয়ে তিস্তার নির্মল বাতাসে তিনি হনহন করে হেঁটে যেতে পারছেন না। প্রাতঃভ্রমণ বন্ধ হলে আয়ু সংক্ষিপ্ত হবে, এরকম একটা ধারণা থাকায় তিনি এলোপাতাড়ি শহরের পথে ঘুরে আসেন। ইদানীং অর্থচিন্তা বেড়েছে তাঁর। বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন দুই মাস হয়ে গেল অথচ পয়সা পাচ্ছে না। সরকারের হাজাররকম নিয়মকানুনের জট ছাড়িয়ে তার কাছে পয়সা হয়ে গেল অথচ পয়সা পাচ্ছেন না। সরকারের হাজাররকম নিয়মকানুনের জট ছাড়িয়ে তার কাছে পয়সা আসতে দেরি হচ্ছে। হেমলতার নামে জমানো টাকা প্রায় শেষ। এদিকে মিউনিসিপ্যালিটি জলের প্রেশার কমিয়ে দেওয়ায় ওপরের ট্যাঙ্কে জল উঠছে না। ফলে হেমলতা তো বটেই, ভাড়াটেরাও অনুযোগ করছে। জয়ার স্বামী তো সেদিন বলে দিলেন, একটা-কিছু ব্যবস্থা করুন।

হেমলতা অনিকে স্কুলের ভাত দিচ্ছিলেন, হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় এসে বললেন, কে টাকা পাঠিয়েছে, প্রিয়? আপনি নিলেন?

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লেন সরিৎশেখর, মাথা-খারাপ! আমি কি ভিখিরি!

হেমলতা বললেন, ঠিক করেছেন। বাবা, আপনার ছেলেরা কোনোদিন আপনাকে শান্তি.দেবে। সরিৎশেখর আর দাঁড়াতে পারছিলেন না, বারান্দায় বেতের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। হঠাৎ তার সবকিছু ফাঁকা বলে মনে হতে লাগল। শুধ আলোচাল খেয়ে হেমলতা অম্বল থেকে পেটের যাবতীয় রোগ পেয়েছে বলে তিনি জানতেন, কিন্তু এরকম মনের জোর পায় কী করে! হেমলতা এই মুখভঙ্গি দেখে তিনি ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।

বিকেলের দিকে আজকাল আর খেলার মাঠে যায় না অনিমেষরা। উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকেই খেলাধুলা কমে এসেছিল। ইদানীং বিরাম করের বাড়িতেও যাওয়া কমে গেছে। রম্ভার সঙ্গে সেই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর থেকে ওর ওখানে যেতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। অবশ্য মুভিং ক্যাসেল.কয়েকবার ধরে নিয়ে গিয়েছেন ওকে, আদর করে বসিয়েছেন, কিন্তু উর্বশীর দেখা পায়নি। মেনকাদি কলকাতায় চলে গিয়েছে। এখানকার কলেজে পড়ানা ভালো হচ্ছে না, হোস্টেলের থেকে কলকাতার কলেজে ভরতি হয়েছে মেনকাদি। মণ্টু বলে, নিশীথবাবু নাকি জব্বর ল্যাং খেয়েছেন। তবে ভেঙে পড়েননি, কারণ এখনও উর্বশী রম্ভা রয়েছে। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আশ্চর্যভাবে বদলে গেছে:মণ্টু। আর : একবারও.ও মুভিং ক্যাসেলের বাড়িতে যায়নি এবং তপন রম্ভাকে নিয়ে দু একবার ঠাট্টা করার চেষ্টা করলেও ও চুপচাপ থেকেছে। রম্ভার প্রতি মণ্টুর যেন আকর্ষণ নেই। বিকেলে সেনপাড়া ছাড়িয়ে বাঁধের বেল্ডারের ওপর বসে থাকে ওরা। ক্লাসে যে নতুন ছেলেটি টাকি থেকে এসেছে সে খুব মেধাবী এবং দাবখেলায় হারে না সহজে। এসে অরূপকে ডিঙিয়ে ফার্স্ট হয়েছে এবার। ছেলেটির নামটাও অদ্ভু, অর্ক। অর্ককে দেখে অবাক হয়ে যায় অনিমেষ। ওদের সঙ্গে বিকেলবেলায় তিস্তার পাড়ে বসে যখন সে কথা বলে তখন অনর্গল মুখ খারাপ করে যায়। নিজেই বলে, খিস্তিতে কোনো শালা আমার সঙ্গে পারবে না। এমনকি মণ্টুকেও নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে আর্ক আসার পর থেকে। যে-ছেলে প্রত্যেকটা সাবজেক্টে লেটার মার্ক পায়ে সে কী করে খিস্তি করে বলে, এটা একটা রেয়ার কলেকশন। আরকারও কাছে শুনবি না। এই সময় অনিমেষ না-শোনার ভান করে নির্লিপ্ত মুখে তিস্তার দিকে চেয়ে থাকে। অর্কর ইংরেজি খাতা দেখে হেডমাস্টারমশাই নাকি এত মুগ্ধ হয়েছেন যে নিজে গিয়ে ওর বাবার সঙ্গে আলাপ করে এসেছেন। ও যে এবার স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করবে তা সবাই জানে। সেই অর্ক আজ বিকেলে এসে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, বল তো, আমরা জন্মেছি কেন?

উত্তরটা দেবে কি না অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। মণ্টু বলল, শহীদ হতে।

তপন বলল, হাফসোল খেতে।

খুব বিরক্ত হয়েছে এমন ভঙ্গিতে অর্ক বলল, তোদের সঙ্গে সিরিয়স আলোচনা করে সুখ পাওয়া যায় না। উত্তরবঙ্গের মানুষগুলোর মাথা মোটা হয়। তো একবার মনেও হয় না কেন জন্মেছি জানতে?

প্রশ্নটা ওর দিকে তাকিয়ে, তাই অনিমেষ বলল, আমি উত্তরটা জানি এবং তা খুব সোজা। আগের জন্মের কর্মফল অনুযায়ী আমরা জন্মগ্রহণ করি।

অর্ক বলল, বুকিশ! জন্মগ্রহণ করি, যেন তুই চাইলেই জন্মাতে পারবি! জন্মগ্রহণ পানিগ্রহণ করার মতো ব্যাপার, না? কোনো প্র্যাকটিক্যাল নলেজ নেই!

মণ্টু বলল, কীরকম?

পকেট থেকে একটা গোটা সিগারেট বের করে অর্ক ধরাল। আগে ও দেশলাই রাখত না, আজ এনেছে। অর্ক আসার পর মণ্টুদের এই নতুন অভ্যাসটা হয়েছে। একটা সিগারেট ঘুরে ঘুরে দুএকটান দিয়ে শেষ করে। শহরের বাইরে এরকম নির্জন জায়গায় ধরা পড়ার কোনো ভয় নেই। চাপে পড়ে অনিমেষ একদিন একটা টান দিয়েছিল, দম বন্ধ হবার যোগাড়! বিশ্রী টেস্ট, কেন যে লোকে সিগারেট খায় কে জানে!

, গলগল করে দুই নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করে অর্ক,বলল, জন্মাবার পেছনে আমাদের কোনো কৃতিত্ব নেই।

অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল! মণ্টু বলল, উঠলি যে!

অনিমেষ বলল, এইসব কথা শুনতে আমার ঘেন্না করে।

বেশ রাগের মাথায় ও দপদপিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। অর্ক চেঁচিয়ে বলল, সত্য খুব ন্যাংটো রে! তা সিগারেটে টান দিবি না, শেষ হয়ে গেল যে!

অনিমেষ কোনো কথা বলল না। সত্যি, ওদের আড্ডাটা ইদানীং খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। চারপাঁচজন এক হলেই মেয়েদের শরীর নিয়ে বিশ্রী আলোচনাটা আসবেই। তার চেয়ে কংগ্রেস অফিসে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও এত খারাপ লাগে না। জয়াদি মামার বাড়ি গিয়েছেন প্রায় দিন-দশেক বিকেলে বইপড়া বন্ধ। সুনীলদাও কোনোদিন মুখ-খারাপ করেনি। ওর সঙ্গে থাকতে খুব ভালো লাগে অনিমেষের। চা-বাগান অঞ্চলে কীসব সংগঠনের কাজে সুনীলদা ড়ুব দিয়েছে। সুনীলদার সঙ্গে ওর যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা একদিন কংগ্রেস অফিসে বসে নিশীথবাবুকে বলেছিল ও। নিশীথবাবু। নির্দেশ দিয়েছেন, সুনীলের সঙ্গে একদম মেলামেশা নয়। কথাটা একদম সমর্থন করতে পারছে না অনিমেষ। একধম তিস্তার বাধে মেয়েসংক্রান্ত ঘটনা ঘটলে মণ্টু কেস বলে তাকে চিহ্নিত করে।

বিরাট একটা পাথরের স্কুপের আড়াল থেকে চিৎকারটা আসছিল। একটা গলা খুব ধমকাচ্ছে আর মেয়েটি না না, পায়ে পাড়ি আপানার বলে মিনতি কছে। অনিমেষ নিঃশব্দে পাথরগুলোর আড়াল রেখে কাছে যেতেই কী করবে বুঝতে পারল না চট করে। চারটে ওদের বয়সি ছেলে এই সন্ধে হয়ে আসা অন্ধকারে গুণ্ডার মতো মুখ করে হাসছিল। ওদের সামনে যে ছেলেটি শুধুমাত্র জাঙ্গিয়া পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে অনেক কষ্টে চিনতে পারল ও। তার জামাপ্যান্ট মাটিতে পড়ে রয়েছে। চারজানের যে নেতা সে বলছিল, ওটুকু আবার কার জন্য রাখলে চাঁদ, খুলে ফ্যালো। তোমাকে মারব না, কিছু বলব না। তিস্তার পাড়ে লুকিয়ে প্রেম করতে এসেছ যখন তখন তুমি তো হিরো, একদম ন্যাংটো হয়ে বাড়ি চলে যাও। খোলো! শেষ কথাটা ধমকের মতো শোনাল।

ছেলেটি, যাকে একদিন মণ্টু মেরেছিল, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, প্লিজ, আমি এটা পরেই যাই, আর কোনোদিন করব না, আপনারা যা চান তা-ই দেব।

অনিমেষ রম্ভার মতো মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। ওদের দিকে পেছন ফিরে রম্ভা দুহাতে চোখ ঢেকে অনিমেষ যেদিকে দাঁড়িয়ে সেদিকে ফিরে রয়েছে। ওর শরীরটা ফোঁপানির তালে কাঁপছে। এই সময় চারজনের একজন রম্ভার দিকে এগিয়ে গেল, তোমার নাম কী?

রম্ভা কোনো জবাব দিল না, তেমনি ফোপাতে লাগল।

বাড়ি কোথায়? তাও জবাব নেই। ছেলেটি বোধহয় একটু রেগে গেল, আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ হচ্ছে! শালা লুকিয়ে এখানে এসে হামু খাবার বেলায় মনে ছিল না। আমরা যে সামনে এসেছি তা খেয়াল হচ্ছিল না! যাক, জামাটামা খুলে ন্যাংটো হয়ে বাড়ি যাও খুকি।

রম্ভা সজোরে ঘাড় নাড়ল। ওদের মধ্যে একজন ছেলেটির চিবুক নেড়ে দিয়ে বলল, জম্পেস মাল পটিয়েছ বাবা! একা খাওয়া কি ভালো!

প্রথম ছেলেটি এবার চট করে রম্ভার পিঠে জামার ওপরটা খপ করে ধরে বলল, অ্যাই খোল, নইলে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মাথা গরম হয়ে গেল। একছুটে সে দলটার মধ্যে গিয়ে পড়ল এবং কেউ কিছু বোঝার আগেই ছেলেটার হাত মুচড়ে ধরল, কী আরম্ভ করেছ তোমরা, এটা কি গুণ্ডামির জায়গা?

ব্যাপারটা এত দ্রুত হয়ে গিয়েছিল যে ছেলেটি ভীষণ ঘাবড়ে গেল। র ঘুরে অনিমেষকে দেখতে পেয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, অনিমেষ, দ্যাখো ওরা আমার ওপর অত্যাচার করছে। আমি এমনি কথা বলতে এসেছিলাম-আর আমাকে অপমান করছে।

বোধহয় রম্ভার গলার স্বরেই বাকি তিনজনের সংবিৎ ফিরে এসেছিল। ওরা এক লাফে সামনে তো আন্তি এগিয়ে এলন হতাশার এরকরেছে, জঙ্গি এসে প্রথম ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিল। রম্ভার হাতের বাঁধন শরীরে থাকায় অনিমেষ নড়তে পারছে না। প্রথম ছেলেটি এবার খেপে গিয়ে বলল, এ-শালা আবার কে? দুজনের সঙ্গে এসেছিল নাকি?

হঠাৎ অনিমেষ দেখল একটা ঘুসি ওর মুখ লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু বোঝার আগেই ও মাথা নিচু করে রম্ভাকে নিয়ে বসে পড়ল। তাল সামলাতে না পেরে না পড়ে যেতে ওর হাত অনিমেষের শরীর থেকে খুলে গেল। অনিমেষ নিজেকে বাঁচাতে প্রাণপণে ছেলেটার উদ্দেশে একটা লাথি ঝাড়ল ওই অবস্থায়। ককিয়ে-ওঠা একটা শব্দ কানে যেতেই অনিমেষ দেখল ওর চারপাশে পাগুলো ঘিরে ফেলেছে। কোনোরকমে মাটি থেকে লাথি-খাওয়া ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এবার বুঝবে আমার গায়ে হাত তুললে কেমন লাগে। শালাকে শেষ করে ফেলব। অনিমেষ মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসেছিল। রম্ভা খানিক পেছনে উঠে দাঁড়িয়েছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল, ও যদি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে তা হলে সব দিক দিয়ে আক্রমণ শুরু হবে। ও হির.করল যদি মরতে হয় একজনকে মেরে মরবে।

ঠিক এই সময় মণ্টুর গলা শুনতে পেল অনিমেষ, কী হচ্ছে কী?

সঙ্গে সঙ্গে চারটে ছেলেই ঘুরে দাঁড়াল। অনিমেষ ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখল মটু অর্ক আর তপন পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ বুকের মধ্যে যে-ঢিপঢিপানিটা শব্দ তুলছিল সেটা চট করে থেমে গেল। এখন ওরা সমান-সমান, ও আর একা নয়। এই সময় এক নম্বর ছেলেটি বলে উঠল, আরে মণ্টু, তুই ওখানে।

মণ্টু বলল, তোরা কী করছিস? ওর গলার স্বর গম্ভীর।

ছেলেটি বলল, আরে শালা এখানে লায়লামজনুর জোর পেয়ার চলছিল। কী হাম খাওয়ার শব্দ? আমরা কেসটা হাতে নিতেই এই মাল ছুটে এল। আবার আমার গায়ে লাথি মারে, বোঝ। জানে না তো আমি কার শিষ্য!

মণ্টু এগিয়ে এল, সেমসাইড হয়ে যাচ্ছে। ও আমার বন্ধু, চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে।

ছেলেটা যেন ভীষণ হতাশ হল, বলল, যাঃ শালা! তারপর অনিমেষের হাত ধরে তুলে বলল, খুব বেঁচে গেলে ভাই। কিন্তু ফিউচারে এরকম করলে ছাড়ব না।

এতক্ষণে মণ্টু রম্ভাকে ভালো করে লক্ষ করেছে, জাঙ্গিয়া-পরা ছেলেটাকে ও আগেই দেখেছিল। ও অনিমেষের কাছে এসে দাঁড়াল, খুব সাহস তো!

রম্ভা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে উঠল এই সময়, আমি কিছু জানি না।

এক নম্বর চাপা গলায় বলল, বৃহৎ হারামি মেয়েছেলে মাইরি! একদম বিশ্বাস করবি না। ওর কীর্তি আমি নিজের চোখে দেখেছি।

মণ্টু অনিমেষকে বলল, কী করা যায় রে?

অনিমেষ কিছু বলার আগেই অর্ক বলল, ছেড়ে দে, বালিকা জানে না ও মরে গেছে।

হঠাৎ মণ্টু ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে খুব জোরে চট মারল। বেচারা এমনিই দাঁড়িয়ে কাঁপছিল, চড় খেয়ে পাথরের ওপর উলটে পড়ল। মণ্টু এগিয়ে গিয়ে ওকে আবার তুলে ধরল, এই, এই, তোকে বলেছিলাম না যে-এ পাড়ায় আসবি না! আবার সাইকেলে কেষ্টর বাঁশি বাজিয়েছে!

কোনোরকমে ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসতে চাইনি, ও জোর করে এনেছে।

চাপা গলায় মণ্টু বলল, কী করে দেখা হল।

ছেলেটা গড়গড় করে বলে গেল, আমার বোন ওর সঙ্গে পড়ে। বোনের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দেখা করতে বলেছিল।

একটু চিন্তা করল মণ্টু, ঠিক আছে। তুই ওকে বিয়ে করবি?

একটুও দ্বিধা করল না ছেলেটা, না!

কেন? প্রেম করছ আর বিয়ের বেলা না কেন? ধমক দিল মণ্টু।

ও মিথ্যেবাদী। নিজেই সব কাজ করে এখন ভান করছে।

অর্ক বলল, মেয়েছেলে মানেই তা-ই। এই সত্যটা চিরকার মনে রেখো চাঁদ। এখন কেটে পড়ো। রেডি, ওয়ান টু থ্রি-। অর্কের কথা শেষ হতেই ছেলেটা তীরের মতো দৌড়াতে লাগল সেনপাড়ার দিকে।

এক নম্বর ছেলেটি সেদিকে তাকিয়ে বলল, যা চলে, পাখি উড়ে গেল! কিছু আমদানি হত। তারপর ঝুঁকে মাটি থেকে ছেলেটার শার্টপ্যান্ট তুলে তার পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করল। অনিমেষ দেখল তার মধ্যে বেশকিছু টাকা আছে। অন্ধকারে ছেলেটার ছুটন্ত জাঙ্গিয়া-পরা শরীরটা আর দেখা যাচ্ছে না। এই সময় তিস্তার পাড়ায় চমৎকার একটা চাঁদ উঠে পা ঝুলিয়ে বসে ওদের দিকে চেয়ে রইল। এক নম্বর ছেলেটি টাকাগুলোর পর একটা কাগজ বের করে সামনে ধরে বলল, আরে এ যে লাভ-লেটার। আমার প্রাণ-পাপিয়া, আজ বিকেলে বাঁধের পেছনে জেলা স্কুলের শেষে আমায় দেখতে পাবে। তোমাকে বুকভরে আদর না করতে পারলে আমার শান্তি নেই।

চাঁদের আলোয় চিঠিটা পড়ে ফেলল সে।

পড়া শেষ হতেই মণ্টু হাত বাড়িয়ে খপ করে চিঠিটা কেড়ে নিল, এটা আমাকে দে।

এক নম্বর তাতে একটুও অখুশি হল না। টাকাগুলো পকেটে পুরে ছেলেটার ফেলে-যাওয়া জামা প্যান্ট ও মানিব্যাগ টান মেরে তিস্তার জলে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কেসটা তোদের দিয়ে দিলাম। চলি। ওর সঙ্গীদের নিয়ে সেনপাড়ার দিকে চলে গেল সে।

এবার মণ্টু অনিমেষকে বলল, চল, আমরা বিরাম করের সঙ্গে দেখা করি।

সঙ্গে সঙ্গে রম্ভা চেঁচিয়ে উঠল, না।

মণ্টু বলল, কেন? বিখ্যাত কংগ্রেসি নেতার কন্যা তিস্তার ধারে প্রেম করছে-এটা তাকে জানাতে হবে না?

রম্ভা বলল, আমি অন্যায় করলে আমিই শাস্তি পাব। বাবা তার জন্য দায়ী নয়।

অর্ক বলল, বয়স কত খুকি তেরো না চোদ্দ?

রম্ভা বলল, আপনার তাতে কী?

অর্ক হাসল, আমরা জন্মেছি বাপ-মায়ের প্লেজার থেকে। অতএব বাপ-মাকে না জানিয়ে কিছু করা ভালো?

হঠাৎ রম্ভা মরিয়া হয়ে গেল, আমার চিঠি ফেরত দিন।

মণ্টু বলল, ফেরত পাবার জন্য লিখেছ?

রম্ভা বলল, যাকে লিখেছি তাকে লিখেছি। আপনাকে লিখতে যাইনি।

মণ্টু বলল, তা লিখবে কেন? আমি তো তোমার বাবাকে তেল দিয়ে কংগ্রেসি হইনি। আর আমার বাপের জমিদারিও নেই।

রম্ভা বলল, নিশ্চয়ই। আপনি তো একটা গুণ্ডা। রোজ দুবেলা ড্যাবড্যাবে করে রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, আমি দেখিনি? এই চিঠি যদি আপনাকে লিখতাম তা হলে আপনার জীবন ধন্য হয়ে যেত।

মণ্টু চেঁচিয়ে বলল, মুখ সামলে কথা বল, এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব, বদমাশ মেয়েছেলে। বাপ কংগ্রেসের নাম করে ঘুষ খাচ্ছে, মা দিনরাত ছেলে ধরছে আর মেয়ে তিস্তার পাড়ে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে চোখ রাঙাচ্ছে। আমি ছিলাম বলে বেঁচে গেলি, বুঝলি! নইলে ওরা তোকে সঁড়ে ছিঁড়ে খেত। আমি গুণ্ডা, না? থুঃ থুঃ করে একরাশ থুতু মাটিতে ফেলে ও অনিমেষকে বলল, অনিমেষ, এটাকে বাড়ি পৌঁছে দে, নইলে তোর মুভিং ক্যাসেল কান্নাকাটি করবে। কথাটা শেষ করে ও দাঁড়াল না। অনিমেষ দেখল অর্ক আর তপন ওর সঙ্গে ফিরে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে। বলল, সচিত্র প্রেমপত্র আমিও পড়েছি। বলে মুঠো-পাকানো রম্ভার চিঠিটা ওদের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটতে লাগল। অনিমেষ দেখল কাগজটা শুন্যে ভাসতে ভাসতে তিস্তার জরে গিয়ে পড়ল। জ্যোত্সা সমস্ত শরীরে মেখে জলেরা দ্রুত ওটাকে টেনে নিয়ে গেল মণ্ডলঘাটের দিকে।

হঠাৎই যেন সমস্ত চরাচর শব্দহীন হয়ে গেল। মণ্টুদের শরীরগুলো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, তিস্তার চর থেকে উত্থাত-হওয়া শেয়ালগুলো আজ আর ডাকাডাকি করছে না। শরতে পা-দেওয়া আকাশটা নবীন জ্যোৎস্নায় সুখী কিশোরীর মতো আদুরে হয়ে আছে। এমনকি তিস্তার ঢেউগুলো অবধি নতুন বউ-এর লজ্জা রপ্ত করেছে। অনিমেষ রম্ভার দিকে তাকাল। তিস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে দাঁড়িয়ে, তার দীর্ঘ কেশ নিতম্ব ছাড়িয়ে নেমে এক মায়াময় ছবি হয়ে রয়েছেল রম্ভা এখনও মহিলা হয়নি, কিন্তু ঈশ্বর ওকে অনেক কিছুই অগ্রিম দান করে বসে আছেন। এই রম্ভা ওকে চুম্বন করেছিল। তিক্ত সেই স্বাদটা অনিমেষ এখনও বেশ অনুভব করতে পারে। আজকের এই ছেলেটিকে রম্ভা কি সেই স্বাদ দিয়েছে। একাধিক ছেলের সঙ্গে এইরকম সম্পর্ক যে করে সে কখনোই সৎ নয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়ল রম্ভা তার কাছে এগিয়ে এলেও সে সায় দেয়নি। বোচার ভালোবাসা পেতে নিশ্চয় এই ছেলেটির শরণাপন্ন হয়েছে। এতে ঠিক ওকে দোষী করা যাচ্ছে না। কিন্তু ছেলেটি তো ওদের বাড়িতে যেতে পারত। বিশেষ করে যে-তিস্তা বাধের এত দুর্নাম সেখানে আসার ঝুঁকি ওরা কেন নিল? রম্ভার বয়সের মেয়েরা কখনোই এত সাহসী হয় না। অন্তত সীতা বা উর্বশীকে ও এই শ্রেণীতে ফেলতে পারবে না কিছুতেই। হয়তো কোনো কোনো মেয়ে এমন অকালে যৌবন পেয়ে যায় যে কাউকে ভালোবাসতে না পারলে সবকিছু বৃথা হয়ে যায় তাদের কাছে। কিন্তু মণ্টুর বেলায়। ওর মনে হল মণ্টু আজ বেশ একহাত নিয়ে গেল রম্ভাকে। রম্ভার জন্য মণ্টু ছটফট করত, একবার দেখবার জন্য চারবার সামনের রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করত। কিন্তু সেই যে ওর সঙ্গে মুভিং ক্যাসেলের বাড়িতে গিয়ে চা খেল, ব্যস, তার পর থেকেই ও যেন রম্ভাকে আর চেনে না। আজ এই অবস্থায় পেয়ে রম্ভাকে নিয়ে ও যা ইচ্ছে করতে পারত। বিশেষ করে মস্তানগুলো ওর পরিচিত এবং রম্ভার চিঠিটা হাতে পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব কিছুই না করে ও থুতু ফেলে চলে গেল। অনিমেষ এরকম আচরণের কারণটা ঠিক ধরতে পারছিল না। আবার মটুর ওপর সব নি করছে জেনেও রম্ভা কিন্তু ওর কাছে মাথা নোয়ায়নি। সামনে তর্ক করে গিয়েছে। এমনকি এরকম জেনেও দাঁড়িয়ে মটুর মুখের ওপর ওকে গুপ্তা বলে গালাগালি দিয়েছে। কেন? রম্ভা যদি পুরুষ ঘেষা হত তা হলে নিশ্চয়ই এরকম করত না এবং বিশেষ করে ওর লেখা চিঠিটা যখন মটুর মুঠায় তখনও ধরা ছিল। ভাবতে কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল অনিমেষের। কী করে যে সব কীরকম হয়ে যায়। ও মুখ তুলে দেখল রম্ভা পায়ে পায়ে তিস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানটায় পাথর রয়েছে ছড়ানো। কাঠোর বিমগুলো নদীর গায়ে এখনও পোতা হয়নি। ফলে জলে নামা অসুবিধের নয়। পাথরের গা বাঁচিয়ে স্বচ্ছন্দে যাওয়া যায়। অনিমেষ দ্রুত গিয়ে রম্ভার পাশে দাঁড়াল, কোথায় যাচ্ছ?

রম্ভা মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল। পাথরের মতো মুখ, কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু দুচোখ উপচে মোটা জলের রেখা গালের ওপর দিয়ে নিচে নেমে গেছে। অনিমেষ চোখ সরিয়ে নিল। কেউ কাঁদলে ও সহ্য করতে পারে না। কারও জল-টলমল চোখের দিকে তাকালেই মায়ের মুখটা চট করে মনে এসে যায়। অনিমেষ আবার বলল, বাড়ি চলো, রাত হচ্ছে!

রম্ভা কীরকম উদাস গলায় বলল, আমি খারাপ, না?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, জানি না। তবে তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি।

রম্ভা বলল, কী করব! ওদের বাড়ি খুব কড়া। আর আমাদের বাড়িতে দিদির জন্য আজকাল কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলা যায় না। কিন্তু এখানে এসে কী লাভ হল।

অনিমেষ বলল, লাভ তো দূরের কথা, তোমার বাবার সম্মান নষ্ট হয়ে যেত একটু হলে।

রম্ভা মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মনে হল ওর গালের ওপর কয়েকটা মুক্তো যেন টলমল করছে। রম্ভা বলল, সে যাহোক হত, কিন্তু ও সবার সামনে আমাকে অপমান করে গেল, আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। তার মানে সমস্ত সম্পর্ক এখানেই শেষ! অথচ প্রথমে এখানে এসে বসতেই ও-ই হাঘরের মতো করছিল। কত আবদার! হঠাৎ দাঁড়াল রম্ভা, ওর চোখমুখ পলকেই হিংস্র হয়ে উঠল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই ওর জামা দুহাতের মুঠোয় ধরে ঝাঁকুনি দিতে-দিতে চিৎকার করে উঠল, তোমরা ছেলেরা সবাই সমান। স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক। চুরি করে উঠল, তোমরা, তোমরা ছেলেরা সবাই সমান। স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক। চুরি করে মধু খেতে চাও, স্বীকার করার সাহস নেই। বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে ফেলল.ও। কান্নার দমকে ওর মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। অনিমেষ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল। ওর বলতে ইচ্ছে করছিল, আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি; তোমার কাছে চুরি করে কিছু নিতে চাইনি। কিন্তু ও কিছু না বলে রম্ভাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল।

অনিমেষ বলল, অনেক রাত হয়েছে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। চলো।

আর এই সময় সেই উৎখাত-হওয়া শেয়ালগুলো তারস্বরে ডেকে উঠল! বাঁধের আশপাশ থেকেই ডাকগুলো আসছিল। সেই কর্কশ শব্দে ভীষণরকম চমকে গিয়ে রম্ভা অনিমেষের হাত ধরল।

ধীরপায়ে ওরা-হাকিমপাড়ার দিকে হেঁটে আসছিল। এখন এ-অঞ্চলটায় লোকজন নেই। শুধু কোনো বিরহী রাজবংশী বাঁধের জন ফেলে রাখা পাথরের ওপর বসে বাঁশিতে একলা কেঁদে যাচ্ছে। জ্যোত্সায় চারধার বড় কোমল, মোলায়েম লাগছে। খুব নিচুগলায় রম্ভা বলল, তুমি আমাদের বাড়িতে, বলে দেবে না তো?

অনিমেষ হাসল, মাথা-খারাপ, এসব কথা কাউকে বলে?

রম্ভা বলল, তোমার বন্ধুরা তো সবাই বলবে।

অনিমেষ এটা অস্বীকার করতে পারল না। কাল বিকেলের মধ্যে সমস্ত শহর নিশ্চয়ই ঘটনাটা জেনে যাবে। ওর রম্ভার জন্য কষ্ট হচ্ছিল।

হঠাৎ রম্ভা বলল, একটা উপকার করবে?

কী? অনিমেষ জানতে চাইল।

তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে বলো যে আমরা এখানে বেড়াতে এসেছিলাম, এমন সময়। কয়েকজন ছেলে আমাদের অপমান করেছে। রম্ভা সাগ্রহে ওর হাত ধরল।

সে কী! কেন? অনিমেষের সমস্ত শরীর চট করে অবশ হয়ে গেল।

তা হলে পরে যার কাছ থেকেই বাবা-মা শুনুক বিশ্বাস করবে না। তোমাকে মা খুব ভালোবাসেন। প্লিজ, এই উপকারটা করো।

কিন্তু তা তো সত্যি নয়। আর খামোকা তোমার সঙ্গে আমি বেড়াতে যাব কেন?

অনিমেষ ওর হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু রম্ভা যেন একটা অবলম্বন পেয়ে গেছে, দিদি সেদিন তোমার আমার ব্যাপারটা দেখে ভেবেছে যে আমরা লাভার। একথা ও দিদিভাইকে বলেছে। তাই আমরা বেড়াতে গিয়েছি শুনলে ওরা সহজেই বিশ্বাস করবে।

অনিমেষ বলল, রম্ভা, আমি মিথ্যে কথা বলতে পারব না।

রম্ভা বলল, কেন? আমার জন্য বলো। তুমি যা চাও সব পাবে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না, সত্যি হলে আমি যেতাম তোমাদের বাড়ি।

রম্ভা বলল, বেশ, সত্যি করে নাও।

অনিমেষ বলল, তা হয় না।

সঙ্গে সঙ্গে রম্ভা খেপে উঠল, ও, তুমি খুব সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, না?

অনিমেষ কোনো জবাব দিল না। কথা বলতে বলতে ওরা জেলা স্কুলের পাশে এসে পড়েছিল। নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রম্ভা আচমকা দৌড়াতে আরম্ভ করল। অনিমেষ প্রথমটা বুঝতে পারেনি, ওর ভয় হল রম্ভা বুঝি কিছু-একটা করে ফেলবে। নিজের অজান্তেই সে রম্ভার পেছন পেছন ছুঁটতে লাগল। খানিকটা যেতে-যেতে হঠাৎ ওর মাথায় একটা ছবি হুড়মুড় করে জুড়ে এসে বসল। এলো চুল বাতাসে উড়িয়ে দুর্গা ছুটছে, পেছনে অপু।

চট করে থেমে গেল অনিমেষ। রম্ভার ছুটন্ত শরীরটা ওদের বাড়ির গেটের কাছে চলে গেল। গেট খুলে রম্ভা ভেতরে চলে গেল।

রাত হয়ে গেছে। সন্ধের মধ্যে বাড়িতে না ঢুকলে দাদু রাগ করেন। আজকে যে কীসব ব্যাপারে। হয়ে গেল! দ্রুত পা চালাল অনিমেষ। কিছুদূর যেতেই ওর মনে হল কেউ যেন ওর পেছনে আসছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে ও হা হয়ে গেল। প্রথমে ওর মনে হল বোধহয় ভূত দেখছে সে। তারপর ছেলেটা কথা বলল, আমাকে একটা কাপড় বা যাহোক কিছু দাও, আমি এভাবে শহরের মধ্যে ঢুকতে পারছি না। কেঁদে ফেলল সে। এই জ্যোৎস্নায় জাঙ্গিয়া-পরা শরীরটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের ক্রমশ কষ্ট হতে লাগল। বেচারা বোধহয় এতক্ষণ ওদে কাছাকাছি ছিল, সাহস করেনি কাছে আসতে। এভাবে শহরের মধ্যে দিয়ে হাঁটা যায় না।

অনিমেষ কোনো কথা না বলে ইঙ্গিতে ছেলেটাকে ওর সঙ্গে আসতে বলল। ও হেঁটে যাচ্ছে আর ওর হাতে-ছয়েক দূরে একটি জাঙ্গিয়া-পরা শরীর লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে হাঁটছে। দৃশ্যটা আর-একবার দেখেই অনিমেষ আর পারল না। ওকে সেখানেই দাঁড়াতে বলে একটা-কিছু এনে দিতে ও জীবনের সবচেয়ে দ্রুত দৌড়টা দৌড়াল। বাড়ির কাছাকাছি হতে অনেক মানুষের কথাবার্তা ও কান্নার শব্দ শুনতে পেল সে।

বাগানের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে প্রথমে একটু থমকে দাঁড়াল অনিমেষ। কিছু গুঞ্জন,এবং একটি পুরুষকণ্ঠে কান্না ভেসে আসছে। ও খুব ত্রস্ত হয়ে চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। কাঁদছে কে না তো, কল্পনাতেও অনিমেষ সরিৎশেখর এইরকম গলায় কাঁদছেন ভাবতে পারে না। রান্নাঘরের ভেতর থেকে আলো আসছে। অনিমেষ শব্দ না করে বারান্দায় উঠে এল। ওকে দেখে পিসিমার শেয়ালটা যেন বিরক্ত হয়েই নেমে দাঁড়াল সিড়ি থেকে। ফুটফুটে জ্যোত্যায় বাগানের গাছপালাগুলো স্নান করে উঠে এইবার ফুরফুরে হাওয়ায় গা মুছে নিচ্ছে। অনিমেষ দেখল রান্নাঘরে কেউ নেই। এমনকি দরজাটা অবধি বাইরে থেকে টেনে দেওয়া, চোর এলে সব ফাঁক হয়ে যাবে। পিসিমা তো এত অসতর্ক হয়ে বাইরে যান না! দাদুর ঘরের দিকে যাবার সময় ওর মাথায় উঠোনের তারে ঝুলেথাকা একটা ময়লা গামছা ঠেকল। দাদুর ঘামমোছা এই গামছাটা এখনও শুকোচ্ছ-এই বাড়িতে এরকম আগে হয়নি। নিশ্চয়ই গোলমালটা খুব গুরুতর ধরনের। দেরি করে বাড়িতে আসার জন্য যেসংঙ্কোচ এবং কিছুটা ভয় ওর মধ্যে ছিল, ক্রমশ সেটা কমে যাচ্ছিল।

গুঞ্জনটা হচ্ছে বাইরে ভাড়াটের দিকে। কান্নাটা এখন একটু কমেছে, মাঝে-মাঝে গোঙানির শব্দ হচ্ছে। অনিমেষ দ্রুত সেদিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর ফিরে এসে তারে-ঝোলানো ভিজে গামছাটা একটানে নামিয়ে নিয়ে বাগান পেরিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। সুপুরিগাছের ছায়া থেকে চট করে ছেলেটা সামনে বেরিয়ে এল, কী হয়েছে।

অনিমেষ মাথা নেড়ে বলল, জানি না। এটা ছাড়া কিছু পেলাম না।

ছেলেটা বলল, কেউ মারা গেল এইরকম কাঁদে।

অনিমেষ কথাটা শুনে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ঠিক আছে, এটা নিয়ে এবার কাটো।

ছেলেটা হাত বাড়িয়ে ভিজে গামছাটা নিয়ে করুণ গলায় বলে উঠল, এ মা, এই ভেজা গামছা পরে আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটব?

অনিমেষের মাথায় তড়াক করে রক্ত উঠে গেল। ও জাঙ্গিয়া-পরা শরীরটার দিকে একবার তাকাল, তা হলে যা পরে আছে তাতেই যাও।প্রেম করতে যাওয়ার সময় খেয়াল ছিল না! বসতে দিলেই শুতে চায়! আর দাঁড়াল না সে। হনহন করে ফিরে এল একবারও পেছনে না তাকিয়ে।

নতুন বাড়ির বারান্দা দিয়ে এগোতে শব্দটা বাড়তে লাগল। বাইরের বারান্দায় যাবার মুখটায় পিসিমা দাঁড়িয়ে আছেন। আঁচলটা এক হাতে মুখে চাপা দেওয়া। ঠিক তার পাশে একটা মোড়ায় দাদু হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে চুপচাপ বসে। আর সামনের হোট লনটা লোকে ভরতি হয়ে গিয়েছে। খুব আস্তে সবাই কথা বলছে। কিন্তু সেটাই গুঞ্জন বলে ওর এতক্ষণ মনে হচ্ছিল। সবার মুখ ডানদিকের বারান্দার দিকে ফেরানো, অনিমেষ এখান থেকে সেদিকটা দেখতে পাচ্ছিল না। পিসিমার পাশে যেতেই খপ করে তিনি ওর হাত ধরলেন, তারপর অস্বাভাবিক চাপা গলায় বললেন, এতক্ষণ কোথায়। ছিলি? কী উত্তর দেবে ঠিক করার আগেই তিনি বললেন, চিন্তায় চিন্তায় আমার বুক ধড়ফড় করছিল। বাবা জিজ্ঞাসা করছিল তোর কথা, আমি বলেছি অনেকক্ষণ এসেছিস।

অনিমেষ খুব নিচুগলায় জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে, এত লোক কেন?

মুখ থেকে আঁচল না সরিয়ে তেমনি গলায় পিসিমা বললেন, সুনীল মরে গেছে।

সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল অনিমেষের। ও কিছুক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে পিসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কেন?

পিসিমা বলল, কী জানি, শুনছি মেরে ফেলেছে। প্রিয়র জন্যে ভীষণ ভয় হচ্ছে।

আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না অনিমেষ, দৌড়ে ও লনে নেমে পড়তেই সুনীলদাকে দেখতে পেল। ওদের বারান্দায় প্রচুর মানুষ মাথা নিচু করে বসে আছে, আর তার ঠিক মাঝখানে একটা খারিয়ায় সুনীলদা চুপচাপ শুয়ে আছে। বুক অবধি সাদা কাপড় টানা, হাত দুটো তার তলায় মাথায় লাল ছোপলাগা ব্যান্ডেজ। নাক চোখ ঠোঁট জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে রয়েছে। সুনীলদার বাবা যাঁকে কোনোদিন কথা বলতে দেখেনি অনিমেষ, তিনি ছেলের মাথার কাছে বসে মাঝে-মাঝে ড়ুকরে উঠছেন। জয়াদিদের দরজা বন্ধ, ওঁদের ফিরতে দেরি আছে।

অনিমেষ পায়েপায়ে সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ উঠে এল। সুনীলদার কাছে যাবার জন্য একটা সরু প্যাসেজ করে রেখেছে উপবিষ্ট মানুষেরা। একদৃষ্টে সুনীলদার বন্ধ চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ ভীষণ কাঁপুনি অনুভব করল। যেন প্রচণ্ড শীত করছে, হাতে পায়ে সাড় নেই, একটা শীতল স্রোত ক্রমশশিরায়-শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। সুনীলদা মরে গেছে। যে-সুনীলদা ওকে কত কথা বলত, ওর চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড়, সুন্দর চেহারার সুনীলদা ঠোঁটের কোণে আলতো হাসির ভঁজ রেখে মরে গেছে। কিন্তু কেন? কেন সুনীলদাকে মরতে হল? স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ওকে কেউ হত্যা করেছে। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল, অনেকেই ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে এখানে কোনো কথা বললে সেটা বিচ্ছিরি লাগবে, এটা অনুভব করতে পারল অনিমেষ। ও আস্তেআস্তে বাকি ধাপগুলো পেরিয়ে সুনীলদার খাটিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সুনিলদার বাবা ওকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক দুহাত বাড়িয়ে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরলেন, দ্যাখো, দ্যাখো, আমার সুনীলকে তোমরা দ্যাখো। চিৎকারটা শেষদিকে কান্নায় জড়িয়ে যেতে অনিমেষ এই প্রৌঢ়ের হাতে বাঁধনে দাঁড়িয়ে থেকে হুহু করে কেঁদে ফেলল।

কেউ-একজন পাশ থেকে এই প্রথম কথা বলল, মেলোমশাই, একটু শক্ত হন।

শক্ত হব? কান্নাটা তখনও শব্দগুলোকে নিয়ে খেলা করছিল, আমি তো শক্ত আছি। আমার ছেলে কমিউনিস্ট পার্টি করে-আমি কিছু বলি না, কলকাতা থেকে বই আনায়-আমি টাকা দিই, দশবারো দিন কোথায় গিয়ে সংগঠন করে-আমি চুপ করে থাকি। আমার চেয়ে শক্ত আর কোন বাবা থাকবে?

অনিমেষ ওঁর আলিঙ্গনে বন্দি হয়ে পাশে বসে পড়েছিল। সুনীলদার মুখ এখন ওর এক হাতের মধ্যে। সুনীলদা কোথায় গিয়েছিল? স্বৰ্গছেঁড়ায়? স্বৰ্গছেঁড়াতে কেউ সুনীলদাকে খুন করতে পারে? কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না ওর। সুনীলদার কেউ শক্ত হতে পারে। পারে, সুনীলদা বলেছিলেন, শক্র চারধারে। যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় তারাই আমাদের শত্রু। তা হলে স্বৰ্গছেঁড়ায় ক্ষমতা আগলে থাকবে এবং শত্রু হবে-এরকমটা শুধু বাগানের ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো পুলিশ আছে। ওই ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ স্পষ্ট শুনতে পেল, এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, মৃত পৃথিবী ভগ্ন ধ্বংসস্তুপ পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব, তবু দেহে যতক্ষণ আছে, প্রাণ, প্রাণপণে এ পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল। এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি। এই বারান্দায় এক সন্ধেবেলায় পায়চারি করতে করতে আবৃত্তি করেছিল সুনীলদা। এখন এই জ্যোৎস্নায়-ঘোয়া। সুনীলদার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল সুনীলদা হয়তো সামান্য বড় ছিল বয়সে, কিন্তু তার কোনো কথা ও স্পষ্ট বুঝতে পারেনি।

ঠিক এই সময় একটা রিকশা এসে গেটের কাছে থামল। দু-তিনজন লোক সেদিকে এগিয়ে যেতে অনিমেষ দেখল রিকশা থেকে একটা বিরাট ফলের মালার নামিয়ে যিনি আসছেন তাঁকে সে চেনে। এক হাত কাটা অথচ কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। মালাটা নিয়ে দৃঢ় পায়ে নেমে এসে সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে গেলেন তিনি। সুনীলদার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে কয়েক মুহূর্ত ওর মুখে দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মালাটা সুনীলদার বুকের ওপর এমন আলতো করে নামিয়ে রাখলেন যাতে একটুও না লাগে। তারপর খুব মৃদুস্বরে বললেন, সুনীল, আমরা আছি, তুই ভাবিস না।

অনিমেষ ওঁর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল, না, চিনতে পারেনি। সেই সন্ধ্যায় ছোটাকার সঙ্গে ওঁর বাড়িতে সে যে গিয়েছিল নিশ্চয়ই খেয়াল করতে পারেননি। এই মানুষটির হাঁটাচলা এবং কথা বলা তাকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ছোটকাকা কী করে পকেট থেকে রিভলবার বের করে ওর মুখের ওপর ধরেছিল, তা হরে ছোটকাকাও কি ওঁর শত্রু! যা, ছোটাকাক তো ক্ষমতাবান মানুষদের একজন-ক্রমশ ঘোলা জলটা থিতিয়ে আসছিল।

প্রায় নিঃশব্দেই সুনীলদাকে ওরা ঠিকঠাক করে নিল। সুনীলদার বাবা হঠাৎ যেন একদম বোবা হয়ে গেছেন, কোনো কথা বলছেন না। সেই কান্নাটাও যেন আর ওঁর গলায় নেই। এতক্ষণের নাগাল পেল। না, স্বৰ্গছেঁড়ায় নয়, ড়ুয়ার্সের অন্য এক চা-বাগানে দুদল শ্রমিকের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ থামাতে সুনীলদা ছুটে গিয়েছিল। আসন্ন হরতাল বানচাল হয়ে যেত তাতে। শেষ পর্যন্ত সফল হয়ে সংগঠনকে আরও মজবুত করে আজ সকালে জলপাইগুড়িতে ফিরে আসছিল সে। তোরবেলায় বাসস্ট্যান্ডে আসবার সময় কেউ ওকে ভোজালি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে চা-বাগানের ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে গাড়িতে ময়নাগুড়ি হাসপাতালে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। সুনীলদা ডাক্তারদের কাছে কিছু বলতে পারেনি বলে শোনা যাচ্ছে, যেটা এই জনতা বিশ্বাস করছে না। পুলিশ বিকেলবেলায় অনেক তদ্বির করার পর মৃতদেহ ছেড়েছে। কোনো ধরপাকড়ের কথা শোনা যায়নি এখনও। জনতার ধারণা হরতাল হোক এটা যারা চায়নি তারাই সুনীলদাকে মেরেছে। সুনীল রায়ের মৃত্যুতে আগামীকাল সেই চা-বাগানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।

শেষ মুহূর্তে সুনীলদার বাবা ঘাড় নাড়লেন। না, তিনি শোনে যাবেন না। অনেকের অনুরোধে তার এক কথা, আমার স্ত্রীকে অমি দাহ করেছি, সুনীলকে আমার সঙ্গে সে রেখে গেছে বলে। সুনীলকে আমি দাহ করে কার জন্যে অপেক্ষা করব?

শেষ পর্যন্ত সরিৎশেখর এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ দূরে বসে তিনি চুপচাপ সব দেখছিলেন। ভদ্রলোক শোনে যাবেন না শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলেন হেমলতা নিষেধ সত্ত্বেও, মিঃ রায়, আপনি গেলে যে ওর অমঙ্গল হবে।

সুনীলদার বাবা বোধহয় এখনও মানুষ চিনছিলেন না, না, ও এখন মঙ্গল-অমঙ্গলের বাইরে।

সরিৎশেখর বললেন, কিন্তু পিতা হিসেবে আপনার কর্তব্য তো শেষ হয়নি। আপনি ওকে জন্ম দিয়েছেন, পালন করেছেন, উপযুক্ত করেছেন, তাই তার শেষ যাওয়ার সময় আপনার উপস্থিতি ওকে মুক্তি দেবে।

সঙ্গে সঙ্গে সজোরে ঘাড় নাড়তে লাগলেন তিনি, হল না, হল না, ও বলত, মরে গেলেও আমি আবার কমিউনিস্ট হব। আচ্ছা, আপনার আঙ্গুল আগুনে পুড়ছে আপনি সহ্য করতে পারবেন? পারুন, আমি বড় দুর্বল, পারব না।

প্রায় নিঃশব্দে সুনীলদাকে বাড়ির গেট খুলে বের করা হল। ওরা যখন যাত্রা শুরু করছিল, অনিমেষ তখন দৌড়ে পিসিমার কাছে গেল। দাদু নেই বারান্দায়। সুনীলদার বাবা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর লনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। অনিমেষ পিসিমাকে বলল, আমি শ্মশানে যাব। …।

ও ভেবেছিল পিসিমা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন, তাই প্রশ্ন করেনি, নিজের ইচ্ছাটা জানিয়েছিল। কিন্তু ও অবাক হয়ে দেখল পিসিমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপর বললেন, জামাপ্যান্ট পালটে একটা গামছা নিয়ে যা। কেউ চলে গেলে প্রতিবেশীর শুশানবন্ধু হওয়া উচিত। এই প্রথম পিসিমা এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দাদুর অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলেন না।

গামছা নিয়ে একটা পুরনো শার্ট গায়ে চাড়িয়ে অনি বারান্দায় এসে দাঁড়ানো দাদুর শরীরের পাশ দিয়ে দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে এল। সুনীলদাকে নিয়ে ওরা এতক্ষণ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে দাদু যেন কিছু বললেন পেছন থেকে, কিন্তু তা শোনার জন্য অনিমেষ অপেক্ষা করল না। টাউন ক্লাবের পাশের রাস্তায় শুশানযাত্রীদের ধরে ফেলল। ওরা তেরাস্তার মোড়ে আসতেই অনিমেষ খাটিয়ার পাশে চলে এল। ওপাশের হাসপাতাল-পাড়ার রাস্তা দিয়ে কয়েকজন ফুল নিয়ে এদিকে আসছিল, তাদের দেখে শুশানযাত্রীরা থামল। যে চার-পাঁচজন এসেছিল তারা ফুলগুলো সুনীলদার বুকে ছড়িয়ে দিতেই একজন বলে উঠল, সুনীল রায়-তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলব না।

চাপা গলায় অদ্ভুত অভিমান নিয়ে বলে-ওঠা এই বাক্যটির জন্য যেন এতক্ষণ সবাই অপেক্ষা করছিল। প্রত্যেকটি মানুষের বুকের এই কথাটা একজনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে সবার মুখ খুলে গেল। চলতে চলতে একজন চাপা গলায় বলল, সুনল রায়-তোমায় আমরা বাকি কণ্ঠগুলো দৃঢ় ভঙ্গিতে পূরণ করল, ভুলছি না, ভুলব না।

এই স্বপ্নের মতো জ্যোত্যায়-চুবানো শহরের পথ দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে অনিমেষের বুকের মধ্যে অদ্ভুত শিহরন জাগল। আজ রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলছে না। চন্দ্রদেব তাঁর সবটুকু সঞ্চয় উজাড় করে দিয়েছেন, কারণ সুনীলদা শেষযাত্রায় চলেছে। শহরের পথে-পথে যারা জানত না এসবের কিছু তারাও উৎসুক হয়ে এবং কিছুটা শ্রদ্ধার সঙ্গে ওদের দেখছিল। শোকযাত্রা: ক্রমশ মিছিলের আকার নিয়ে নিল। অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলে যাচ্ছিল, ভুলব না, ভুলব না। কেন, সে ভুলবে না এই মুহূর্তে ভাববার অবকাশ তার নেই।

দিনবাজারের পুল পেরিয়ে বাজারের সামনে দিয়ে ওরা বেগুনটুলির রাস্তায় এসে পড়ল। এতক্ষণ অনিমেষ চুপচাপ হেঁটে আসছিল, এখন চলতে চলতে একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একে ও সুনীলদার কাছে দুএকদিন যেতে দেখেছে। এতক্ষণ সুনীলদাকে কাঁধে নিয়েছিল বলে ওকে লক্ষ করেনি অনিমেষ। সুনীলদার সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছিল এর সেদিন। সুনীলদা বলেছিল, পার্লামেন্টরি গণতন্ত্র, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বড়লোরে গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পালটে বড়লোকদের বাঁচাবার জন্য তাদের প্রয়োজনেই এর সৃষ্টি।

ছেলেটি বলেছিল, তা হলে আমরা সেটা সমর্থন করেছি কেন? কেন আপনি প্রকাশ্যে তা বলেন?

বলার সময় এলে নিশ্চয় বলব। ফোঁড়া না পাকলে অপারেশন করা হয় না। সুনীলদার এই কথা নিয়ে ওদের তর্ক উত্তপ্ত হয়েছিল। অনিমেষ তার সবটা মাথায় রাখতে পারেনি। এখন হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটি নিজের মনে বলল, আশ্চর্য, রমলাদি আসেননি!

রমলাদি। অনিমেষ মহিলাকে মনে করতে পারল। ওই যে হাতকাটা প্রৌঢ় নরম চেহারার মানুষটি পেছন পেছন হেঁটে আসছেন। তার চেয়ে রমলাদি অনেক বেশি শক্ত হয়ে ছোটকাকার সঙ্গে কথা বলেছিলেন সেই রাত্রে। দলের ছেলে কেউ নিহত হলে কর্মীরা সবাই আসবেই, অতএব স্বাভাবিক কারণেই রমলাদি না আসায় এই ছেলেটিকে ক্ষুন্ন হতে দেখল অনিমেষ।

না, একবারও হরিধ্বনি দেয়নি কেউ। এতক্ষণ দমবন্ধ-করা পরিবেশে ওকে না-ভোলার অঙ্গীকার করা হচ্ছিল, হঠাৎ গলাগুলো পালটে গেল। কে যেন চাচাল, লং লিভ সুনীল রায়–লং লিভ লং লিভ।

সুনীল রায়ের হত্যাকারীর কালোহাত খুঁড়িয়ে দাও, ভেঙ্গে দাও।

হত্যা করে আন্দোলন বন্ধ করা-যায় না, যাবে না।

সুনীল রায়কে মারল কারা-কংগ্রেসিরা জবাব দিও।

শেষ স্লোগান কানে যেতে থমকে দাঁড়াল অনিমেষ।.ওরা হঠাৎ কী বলতে আরম্ভ করেছে। এর মধ্যে কংগ্রেসিরা আসছে কী করে! সুনীলদাকে কি কংগ্রেসিরা মেরেছে? কংগ্রেসি মানে ভবানী মাস্টার, হরবিলাসবাবু, কংগ্রেসি মানে বন্দেমাতরম্। আবার চট করে ছোটকাকার মুখ মনে পড়ে গেল ওর, ছোটকাকা কি কংগ্রেসি এখব? ছোটকাকার কাছে লিভারভার থাকে যে!

মিছিলটা ওকে ফেলে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকদিন পরে হরবিলাসবাবুর নামটা মনে পড়তেই ওর মনটা কেমন করে উঠল। হরবিলাসবাবুকে সে শহরে আসার পর দেখেছে। এখন আর রাজনীতি করেন না তিনি। প্রথমে নিশীথবাবু পর্যন্ত ওঁর খবর বলতে পারেনি। কংগ্রেস অফিসে আসেন না। এককালে স্বাধীনতা আন্দোলনে এই জেলায় সবচেয়ে যে-মানুষ আলোড়ন তুলেছিলেন, তার কথা। আজ আর কারও মনে নেই। অনিমেষ এক বিকেলে তাকে ডি সি অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিল। ভীষণ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, শরীর ভেঙে পড়েছে আর দারিদ্র্যের ছাপ পোশাক থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ লোভ হয়েছিল সেদিন ছুটে গিয়ে প্রণাম করতে। কিন্তু যদি চিনতে না পারেন, যদি ভুলে গিয়ে থাকেন সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের সকালে স্বৰ্গছেঁড়ায় তিনি কোন বালককে কী দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তা হলে? হরবিলাসবাবু ওর সামনে দিয়ে ক্লান্তপায়ে চলে গেলেন, দমবন্ধ করে অনিমেষ দেখল তিনি ওকে চিনতে পারলেন না।

চাপা আক্ষেপের মতো দূরে-মিলিয়ে-যাওয়া মিছিলটা থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। স্কুলের মাঠে একদিন সিনেমা দেখিয়েছিল ওদের। চেন বেঁধে বিরাট এক দুর্ধর্ষ জন্তুকে নিয়ে যাওয়ার একটা দৃশ্য ছিল তাতে। প্রচণ্ড আক্রোশে সে গজরাচ্ছিল, অথচ বন্দি থাকায় সেই মুহূর্তে তার কিছুই করার ছিল না। অনিমেষের মনে হল এই মিছিলটা যেন সেইরকম।

এখন রাত কটা কে জানে! কিন্তু একটুও ক্লান্তি লাগছে না ওর। এদিকটায় দোকানপাট কম এবং সেগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চাঁদটা এখন হেলতে মাথার ওপর এসে টুপির মতো বসে আছে। এই নির্জন রাস্তায় একা একা দাঁড়িয়ে ওর কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল। দুপাশে লোকজন নেই, মাঝে-মাঝে এক-আধটা সাইকেল-রিকশা দ্রুত চলে যাচ্ছে। সুনীলদাকে কংগ্রেসিরা মেরেছে মাথা নাড়ল ও। কিন্তু অপঘাতে মারা গেলে আত্মার শান্তি পায় না। ঝাড়িকাকুর মুখে শোনা হরিশের গল্পটা মনে পড়তেই ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখন যদি সুনীলদা কাছে এসে বলে, হ্যাঁ অনমেষ, তোমার কংগ্রেসিরা আমাকে মেরে ফেলেছে, তা হলে সে কী করবে? সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। মিছিলের ধ্বনিটা আর আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। নিজেকে এই মুহূর্তে ভীষণ একা বলে মনে হতে লাগল ওর। সুনীলদা বলেছিল, যারা কংগ্রেস করে তারা সবাই খুনি-একথা আমি বিশ্বাস করি না। তবে তাদের নেতাদের মধ্যে কেউ দরিদ্র নয়। এই গরিব দেশে কিছু বড়লোক নেতা চিরকাল। লাঠি ঘোরাতে পারে না। অনিমেষের খেয়াল হল, কথাটা প্রায় সত্যি। কংগ্রেস অফিসে গিয়ে সে। দেখেছে সাবই হাজাররকম গল্প বলে, কন্ট্রাক্টরদের আশ্বাস দেয়, মন্ত্রীর সুপারিশ চায়। কিন্তু এরা তো সেরকম কথা বলে না। যেন একই দেশে দুরকমের মানুষ বাস করে। কী ধরনের ক্ষোভ থাকলে মানুষ এত রাত্রে একই রকম জেহাদ সারা শহরের মানুষকে শুনিয়ে যেতে পারে! আচ্ছা, এরা তো সবাই। স্বচ্ছন্দে কংগ্রেসি হয়ে যেতে পারত। কেন হয়নি? হলে তো এরা সুখেই থাকত।

অনিমেষ পায়েপায়ে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। একা থাকতে ওর ভীষণ ভয় করছিল। বেগুনটুলির পাশ দিয়ে গিয়ে ও থমকে দাঁড়াল। বাদিকে একটু এগিয়ে গেলে ছোটমায়ের বাপের বাড়ি। আজ অবধি কখনো যায়নি সে ওখানে। কেউ তাকে যাওয়ার কথা বলেনি, আর আগ্রহও হয়নি। তার। একমাত্র বাবার বিয়ের দিন-হাসি পেল অনিমেষের! কী মজাই-না সেদিন হয়েছিল। অল্পের জন্য ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিল ও। একছুটে পালিয়ে-অনিমেষের মনে পড়ে গেল গলিটার কথা। ওর পা কেটে গিয়েছিল, আনন্দমঠটা হারিয়ে গিয়েছিল। আর সেই মেয়েটি-কী যেন নাম তার, আঃ, অনেক করেও নামটা মনে করতে পারল না। পেটে আসছে তো মুখে আসছে না। এটুকু মনে আছে সে ছিল অন্য সবার থেকে একদম আলাদা ধরনের। তাকে বলেছিল এই গলিতে আর কখনো না। আসতে। কেন বলেছিল সেটা অনেক পরে বুয়েসে। স্কুলের বন্ধুরা ইদানীং বেগুনটুলির এই গলিটার অল্প রসিয়ে করে। এদিক দিয়ে শর্টকাটে সানাউল্লা স্কুলের ফুটবল মাঠে যাওয়া যায়। ওরা দল বেঁধে শর্টকাট করার নাম করে এদের দেখতে-দেখতে যায়। এখন ব্যাপারটা ওর কাছে ঘৃণ্য এবং ভীতিকর হওয়া সত্ত্বেও যখনই মনে পড়ে সেই মেয়েটি কী মমতায় ওর পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল তখনই সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়। আচ্ছা, সেই মেয়েটি, কী যেন তার নাম এখন সেই ঘরটায় আছে তো?

ওকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন রিকশাওয়ালা ঠাঠা করে হেসে উঠল। লাইটপোস্টের পাশে রিকশা রেখে সে তাতে চেপে বসে আছে। চোখাচোখি হতে খুব রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। এমন সময় ও দেখল একটা মোটামতন লোক টলতে টলতে গলি থেকে বেরিয়ে আসছে আর তার। পেছন পেছন বিভিন্ন বয়েসের কুড়ি-পঁচিশজন ভিখিরি চাঁচামেচি করতে করতে আসছে। গলিটার মুখে এসে ওরা লোকটাকে হেঁকে ধরতের রিকশাওয়ালা চেঁচিয়ে উঠল। তারপর যে ছুটে গিয়ে লোকটাকে উদ্ধার করে রিকশায় বসিয়ে উধাও হয়ে গেল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে ভিখিরিগুলো কিছু করার অবকাশ পেলন না। হতাশ হয়ে ও ওকে গালাগালি দিতে গিয়ে প্রায় মারামারি বেধে গেল ওদের মধ্যে। এমন সময় কয়েকজনের নজর পড়ল অনিমেষের উপর। ওর দিকে তাকিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে আরম্ভ করতেই অনিমেষ প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। অবশ্য ওর কাছে কিছুই নেই যা ওরা কেড়ে নিতে পারবে। তুব এই এত রাত্রে মাতাল-ফসকে–ফেলা ক্রুদ্ধ ভিখিরিদের এই চাহনিকে ও সহ্য করতে পারছিল না। প্রায় প্রাণের ভয়ে অনিমেষ দৌড়াতে লাগল।

শিল্প সমিতি পাড়ার কাছাকাছি ও মিছিলটাকে ধরে ফেলল। এখন যেন অতটা দীর্ঘ নয়, মিছিলের আকার বেশ ছোট হয়ে গেছে। কোনো হরিধ্বনি নেই, শুধু একটিই লাইন ঘুরে ঘুরে প্রতিটি মানুষের মুখে ফিরছে-সুনীল, রায়, আমরা তোমায় ভুলছি না ভুলব না। অমর শহীদ সুনীল রায়, মরছে না মরবে না।

অনিমেষ মিছিলের পাশাপাশি চলতে চলতে শুনল, কে যেন গলা খুলে হাঁটতে হাঁটতে কবিতা আবৃত্তি করছে। কবিতাটি ওর চেনা, সুনীলদা ওকে পূর্বাভাস বলে একটা বই পড়তে দিয়েছিল, তাতে ওটা আছে। ও দেখল সেই ছেলেটি যার সঙ্গে সুনীলদার তর্ক হয়েছিল, সুনীলদার শরীরের পাশে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মায়াময় গলায় কবিতাটি বলে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিটা আস্তে হয়ে এলে, যেন কবিতার কথাগুলো গান হয়ে গেল আর ধ্বনিটা তার সঙ্গে স্ত্র হয়ে সঙ্গত করে যেতে লাগল-সময় যে স্ত্ৰ বিন্ধ্যাচল, ছেঁড়া আকাশের উঁচু ত্রিপল, দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল-শত শত। মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল, মোছ উদগত অশ্রুজল, যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল? ভোল ক্ষত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ উঠল, ভুলছি না, ভুলব না। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তাধারা একটা শোকের মুতোয় বাঁধা পড়ে ক্রমশ এক হয়ে যাচ্ছে–অনিমেষ অনুভব করছিল। ওর হঠাৎইছে করেছিল সুনীলদার খাটিয়াতে কাঁধ দিতে। আজ অবধি কোনোদিন সে কাউকে কাঁধে করে শোন নিয়ে যায়নি। সত্যি বলতে কি, শোনে সে গিয়েছিল একবারই। খুব অস্পষ্ট সেই যাওয়াটা মনে পড়ে। কিন্তু একটা লকলকে চিতার আগুন আর মা তার মেঘের মতো চুল ছড়িয়ে সেই আগুনে শুয়ে আছেন, বুকের মধ্যে জন্মটিকার মতো এ-দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে আছে। আজ এতদিন বাদে শ্মশানে যাচ্ছে। যে-অনিমেষ সুনীলদার পাশে চলে এল। যে-চারজন ওকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে তাকাল সে। প্রক্যেকের মুখ এত গম্ভীর এবং যেন মহান কোনো কর্ম সম্পন্ন করার নিষ্ঠায় মগ্ন যে। অনিমেষ চেষ্টা করেও তাদের নিজের ইচ্ছেটা জানাতে পারল না।

মাষকলাইবাড়ি ছাড়িয়ে ওরা শ্মশানে এসে গেল। ছোট্ট পুলটা পেরিয়ে শুশানচত্বরে ঢুকতেই অনিমেষের চট করে সমস্ত কিছু মনে পড়ে গেল। মাকে নিয়ে ওরা এখানে এসে ওই গাছটার তলায়। বসেছিল। চিতা সাজানো হয়েছিল এই নদীর ধারটায়। বুকের মধ্যে সেই ব্যথাটা তিরতির করে ফিরে আসছিল যেন, অনিমেষ অনেকদিন পর মায়ের জন্য কেঁদে ফেলল। কোনো-কোনো সময় চোখের জল ফেলতে এত আরাম লাগে-কখনো জানতে না সে। হঠাৎ একজন ওকে জিজ্ঞাসা করল, সুনীল আপনার কেউ হয়? কথাটা বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকাতেই সে প্রশ্নটা শুধরে নিল, আত্মীয়?

এবার চট করে চোখের জলটা মুছে ফেলল অনিমেষ, আমরা এক বাড়িতে থাকি।

ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। দাহ করার তোড়জোড় চলছে। অনিমেষ ভালো করে নজর করে দেখল সুনীলদার জন্য কেউ কাঁদছে না। সবাই যেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সুনীলদার শেষকৃত্য করে যাচ্ছে। এখন কেউ কোনো ধ্বনি দিচ্ছে না।

খুব অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের। যেহেতু সুনীলদা হিন্দু, তাই অন্তর এই সময়ে হরিধ্বনি দেওয়া উচিত। একথাটা কারও মাতায় ঢুকছে না কেন এই সময় হরিধ্বনি নেই, কান্না নেই-যদিও সে কখনো দাহ করতে শ্মশানে আসেনি, তবু পিসিমার কাছ থেকে শুনে-শুনে এটা একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে হচ্ছিল তার। শেষ সময়ে হরিনাম করলে আত্মার শান্তি হয়। কথাটা ও সেই ছেলেটিকে বলল। এতক্ষণ কবিতা আবৃত্তি করার পর শ্মশানে এসে সে চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। কথাটা শুনে সে ম্লান হাসি হাসল, সব মানুষের আত্মা কি এক নিয়মে চলে? কোটিপতি চোরাকারবারি আর সত্যিকারের একজন শহীদ মরার পর হরিনাম শুনলেই যদি আত্মা শান্তি পায় তা হলে বলার কিছু নেই। সত্যিকারের কমিউনিস্ট তার যতক্ষণ দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততক্ষণ শান্তি পাবে না।

অনিমেষ হঠাৎ অনুভব করল, ও যেন কথাটা অস্বীকার করতে পারছে না। ক্ষুদিরাম বলেছিলেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি ফিরে জন্ম নেবেন। সত্যি একটা চোর আর শহীদের আত্মা সমান সম্মান এবং সুবিধে পেতে পারে না।

অনিমেষ অলসভাবে পায়চারি করতে লাগল। দূরে একটা চিতা প্রায় নিবে এসেছে। কাঠগুলো জ্বলে জ্বলে আগুন নিবুনিবু। প্রচণ্ড কান্নায় কেউ ভেঙে পড়েছে সেখানে, তাকে সামলাচ্ছে অন্যরা। হরিবোল ধ্বনি দিতে দিতে আর-একটি মৃতদেহ নিয়ে শানের দিকে কিছু লোক আসছে। অনিমেষের এখন রি ভয় করছিল না। দুধেলা জ্যোৎস্নায় এই শ্মশানের মাটি গাছ নদী ধবধব করচে। আকাশে এত নীল রঙ চেয়ে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গোল আধুলির মতো রুপোলি চাঁদ চুপচাপ সরে সরে যাচ্ছে। আশ্চর্য, ঠিক এরকম সময় কিছু মানুষকে পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর শ্মশানে আনা হয়েছে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার জন্য। ওর খুব মন-খারাপ হয়ে গেল, কেন যে ছাই শোনে ও চাঁদের আলো পড়ে।

স্নান করিয়ে দাহ করার যে-নিয়মটা এখানে চালু আছে তা সকলে মানেন না, সামান্য জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেয় অনেকে-অনিমেষ শুনতে পেল। যে-ডোমটি তদারক করছিল তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। এর মুখ দেখে মনে হয় না এইসব শোক দুঃখ একে স্পর্শ করে। কখনো কি ও মাথা তুলে আকাশ-ভাসানো চাঁদটাকে ভালো করে দেখেছে? মনে হয় না। সুনীলদার উলঙ্গ শরীরটাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে সে যেভাবে পা দুটো সোজা করে দিল তাতে পিসিমার উনুন ধরানোর ভঙ্গিটা মনে পড়ে গেল ওর। চিতার কাছাকাছি গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবাই সুনীলদার কোমরের পেছনদিকটায় বিরাট জরুলটায় আলো পড়ে চোখ টেনে নিচ্ছে। মানুষ মরে গেলে তার কত গোপন জিনিস সবাই সহজে জেনে যায়-সুনীলদার এখন কিছু করার নেই। হঠাৎ ও মাকে দেখতে পেল। মা শুয়েছিল সমস্ত চিতা আলো করে-ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই চুলগুলো। সুনীলদাকে এই মুহূর্তে খুব দুর্বল, অসহায় বলে মনে হচ্ছিল অনিমেষের।

কে যেন বলল, মুখাগ্নি করবে কে?

সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সুনীলদার বাবা আসেননি, কোনো আত্মীয় এই শহরে থাকে। সমস্যাটা চট করে সমাধান করতে পারছিল না শুশানযাত্রীরা। এমন সময় অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি, যে আবৃত্তি করেছিল, যার সঙ্গে সুনীলদার খুব তর্ক হত, সে অলসভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে গেল, কই, কী করতে হবে বলুন।

একজন একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, তুমি করবে?

নিশ্চয়ই! ছেলেটি জাবাব দিল, সংগ্রাম শুরু কর মুক্তির, দিন নেই তর্ক ও যুক্তির। আমার চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে! দিন। হাত নেড়ে নেড়ে কথাটা বলে সে পাটকাঠির আগুনটা তুলে নিয়ে সুনীলদার বুকে ছুঁইয়ে মুখের ওপর বুলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত আগুন ছুঁইয়ে চিতাটাকে জাগিয়ে দিল। কেউ কোনো কথা বলছে না, শুধু ফটফট করে কাঠ ফাটার শব্দ আর আগুনের শিখাগুলো যেন হামাগুড়ি দিয়ে সুনীলদার দিকে এগিয়ে আসছে।

হঠাৎ ডোমটা চেঁচিয়ে উঠল, বোল হরি হরিবোল। তার সেই একক কণ্ঠ শ্মশানের আকাশে একবার পাক খেয়ে ফিরে এল আচমকা। অবাক হয়ে সে শুশানযাত্রীদের দিকে তাকাল, তার অভিজ্ঞতায় এইরকম নৈঃশব্দ্য সে বোধহয় দেখেনি।

নীরবতা এতখানি বুকচাপা হয় এর আগে অনিমেষ এমন করে কখনো বোঝানি। সেই বাড়ি থেকে বের হবার পর যে-ধ্বনি দেওয়া চলছিল, যে-মানুষগুলো সুনীলদাকে কেন্দ্র করে জেহাদ জানাচ্ছিল, এখন এই সময় তারা ছবির মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কতখানি ভালোবাসা পেলে এরকমটা হয়-অনিমেষ আঁচ করতে পারছিল না। তবে সুনীলদা কিছু মানুষকে ভীষণরকম। আলোড়িত করেছিলেন, এখন অনিমেষ নিজেকে তার বাইরে ফেলতে পারল না। আগুন কাউকে ক্ষমা। করে না, সুনীলদার শরীরটা ক্রমশ গলে গলে পড়ছে। মারও এরকমটা হয়েছিল। হঠাৎ দুচোখে। দুহাতে চাপা দিল অনিমেষ। এ-দৃশ্য সে দেখতে পারছে না। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও সে যে নিস্তার। পাচ্ছে না। অজস্র ছোট ছোট চিতা চোখের পাতায়-পাতায় জ্বলে যাচ্ছে। এটাকে নেভাতে গেলে অন্যটা জ্বলে উঠে।

চোখ খুলতে সাহস হচ্ছে না, অথচ। অনিমেষ এই অবস্থায় শুনতে পেল সেই ছেলেটা নিজের মনে কিছু আবৃত্তি করে যাচ্ছে। মনে হয় ঘোরের মধ্যে ছে সে। কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ সবাই কথা বলে উঠল। দুর্গাঠাকুর বিসর্জনের সময় সাতপাক ঘোরানো হয়ে গেলে জলে ফেলবার মুহূর্তটাতেই এইরকম ব্যস্ততা ভক্তদের মধ্যে হয়ে থাকে। অনিমেষ বন্ধু-চোখ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল, কুব চাপা এবং রুদ্ধ গলায় ছেলেটি বলছে, কমরেড, তোমায় আমি ভুলছি না, ভুলব না। চোখ খুলল অনিমেষ, খুলে একটু একটু করে সাহস এনে চিতার দিকে তাকাল। না, সুনীলদা ওখানে নেই। একটা দল-পাকানো কালো কিছু পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীর কোথাও আর সুনীলদাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

একটু একটু করে মানুষজন ফিরে ফিরে যাচ্ছিল। সামান্য বাতাস দিচ্ছে। কোথা থেকে হালকা মেঘেরা এসে মাঝে-মাঝে চাঁদের মুখ আড়াল করে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে সমস্ত চরাচরে একটা ছায়া। দুলে দুলে যাচ্ছে। অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি আচ্ছন্নের মতো হেঁটে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। যেতে-যেতে মুখ তুলে চাঁদকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক ঠিক। কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়-পূর্ণিমা চাঁদ যেন জলসানো রুটি।

অনিমেষ আর দাঁড়াল না। ও দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির সঙ্গ নিল। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, পথ অনেকটা, কিন্তু আমাকে একা হাঁটতে হচ্ছে না, তুমি আর আমি হাঁটলে পথ আর বেশি হবে না। কী বল

অনিমেষ কোনো কথা বলল না। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের ওপর এসে ওর খেয়াল হল, যাঃ, মান করা হয়নি। পিসিমা বলেন, শ্মশানে এলে স্নান করে যেতে হয়। তাই গামছা নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্নান করার কথা ভাবতে পারছে না ও। শরীর ননাংরা হলে লোকে স্নান করে। সুনীলদাকে দাহ করার পর স্নান করার কোনো মানে হয়। এই সময় ছেলেটি হঠাৎ আকাশের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, চাঁদটা আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে, না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *