এগারোর অঙ্ক – কর্নেল সমগ্র ৫ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
বৃষ্টিসন্ধ্যার বিভীষিকা
হিমাদ্রির পিঠে নোখের আঁচড় কাটতে কাটতে ঊর্মি শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে বলল, চুপ। কারণ হিমাদ্রি ফিসফিস করে অনর্গল প্রেমের কথা বলছিল। বলার সময়। ঘনিষ্ঠতার এই চরম পর্যায়ে কতসব কথা বলতে ইচ্ছে করে। সময় ও পরিবেশ এত নিরাপদ। আজ জুলাই মাসের ১১ তারিখের সন্ধ্যাবেলায় এখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে। কয়েকমিনিট আগে লোডশেডিং হয়ে গেছে এবং একটু তফাতে টেবিলের ওপর সরু একটা মোম জ্বলছে। আর সেই রাগী ও নির্বোধ ব্যবসাদার লোকটা, যে এই ফ্ল্যাটের মালিক–এখন দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে আরবসাগরের উপকূলে বসে আবুধাবির দিকে তাকিয়ে আছে। দশতলা বাড়িটার সাততলার এই ফ্ল্যাটে খুবই প্রাকৃতিক একটা স্বাধীনতা চনমন করছে আবেগে। হিমাদ্রি চিন্তাভাবনাহীন, নির্বিকার।
মোমের আলোটা কাঁপছে। এপাশের দেয়ালে নিজের লম্বাটে ছায়াটা দেখতে পাচ্ছিল হিমাদ্রি। নিজের ছায়া দেখে নিজের শরীরটাকে অবিকল দেখার ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসল। তখন সে বাঁদিকে কিছুটা তফাতে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল। আয়নায় প্রতিবিম্বিত শরীরের দিকে আচ্ছন্ন চোখে সে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তার চেয়ে ঊর্মি বহুগুণ ফর্সা। এতক্ষণে সে নিছক শরীরের সৌন্দর্য জিনিসটাও আবিষ্কার করল। এ একটা আবিষ্কার এবং সব পুরুষের কাছেই ঠিক তাই। ঊর্মির মুখটাকে সেদিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে সে বলল, দেখ, দেখ ঊর্মি! আহা, দেখ না!
ঊর্মি বলল, আঃ! চুপ করো!
আর ঠিক তখনই পর-পর তিনবার কেউ নক করল জোরে পাশের ডাইনিং–কাম-ড্রয়িংরুমের ওদিকে সদর দরজায়। একটু পরে আবার তিনবার। এবারকার নকে অধৈর্য যেমন, তেমনি কোনো সাংকেতিক কথাও বুঝি বা স্পষ্ট।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাঠ হয়ে গিয়েছিল দুটিতে। তারপর ঊর্মি ঠেলে হিমাদ্রিকে সরিয়ে উঠে বসল। মেঝেয় লুটিয়ে আছে অন্তর্বাস, নাইটি। হিমাদ্রির পোশাকের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। ঝটপট নিজের পোশাক খুঁজে নিয়ে ঊর্মি হিমাদ্রিকে ইশারায় পোশাক পরে নিতে বলল।
হিমাদ্রির মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। ঊর্মি। পোশাক পরেই ড্রেসিং টেবিলে গেল। ব্রাস টেনে চুল ঠিকঠাক করে বিছানা গোছাতে এল তখন হিমাদ্রি তার পোশাক পরতে শুরু করেছে। তার চোখ ঊর্মির দিকে। ঊর্মির মুখে এখন শান্ত একটা দৃঢ়তা। সে হিমাদ্রির জুতোদুটো। দেখিয়ে পরে নিতে ইশারা করল। তখন আবার তিনবার শব্দ হল বাইরের দরজায়। কিন্তু আগের জোরটা নেই, কেমন যেন ক্লান্ত।
হিমাদ্রি বিভ্রান্ত হয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিল। ঊর্মি বারণ করার আগেই সে এটা করে বসল। ঊর্মি ফিসফিস করে তাকে কিচেনের পাশে স্টোররুমে যেতে বলছিল।
মোটামুটি আধমিনিট সময় লাগল এই ঘর সামলানোতে। তারপর মুখে বেপরোয়া একটা ভাব ফুটিয়ে ঊর্মি স্লিপার ফটফটিয়ে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দিল। মৃগাঙ্কের কলিংবেল বা লোডশেডিং থাকলে দরজায় নক করার রীতি তার জানা। পরপর তিনবার। মৃগাঙ্ক সংসারী ও সতর্ক মানুষ। তার সবকিছুতে এরকম হিসেবের ছাপ আছে।
বাথরুমের ভেতর হিমাদ্রি দরজা খোলার শব্দটা শুনতে পেল না, শুনল বন্ধ হওয়ার শব্দ। বেশ জোরে বন্ধ হল দরজা। তার মানে হারামজাদা মৃগাঙ্ক দরজা। খুলতে দেরি হওয়ায় রেগে গেছে।
কিন্তু আজ সকাল সাড়ে দশটার প্লেনে যে বোম্বে গেছে, সে আজই সন্ধ্যা সাতটায় কেন এবং কীভাবে ফিরে এল, বুঝতে পারছিল না হিমাদ্রি। নাকি বউকে ফাঁদে ফেলার জন্য এ এক চক্রান্ত?
তবে ঊর্মি বুদ্ধিমতী। তার বুদ্ধির ওপর বিশ্বাস আছে হিমাদ্রির। মৃগাঙ্ককে অন্য বাথরুমের দিকেই–যদি ওর এখন বাথরুমে যাবার দরকার হয়, গাইড করবে ঊর্মি। তারপর একটা কিছু করবে, যাতে হিমাদ্রি ওর অলক্ষ্যে বেরিয়ে যেতে পারে। হিমাদ্রি অন্ধকারে ঘামতে লাগল দরদর করে।
কিন্তু মৃগাঙ্কের কথা শুনতে পেল না সে। ঊর্মিরও না। তেমনি স্তব্ধতা গুমোট হয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টির একটানা শব্দ শোনা যাচ্ছে। এত উঁচুতে নিচের রাস্তার কোনো শব্দ এমনিতে শোনা যায় না, তাতে এখন বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। বাথরুমের আয়নায় নিজের ভূতের মতো মূর্তি আবছা ভেসে উঠতে দেখছিল হিমাদ্রি। এতক্ষণে নিজের ওপর রাগে দুঃখে খেপে উঠছিল সে। কেন ঊর্মির কথায় এই ফ্ল্যাটে চলে এল সে? বরং তার পক্ষে একটা নিরিবিলি ফ্ল্যাট পাওয়া কঠিন ছিল না। সুব্রতর একটা ফ্ল্যাট নেওয়া আছে থিয়েটার রোডে। সেটা স্ফুর্তির জন্যই রেখেছে সুব্রত! তাকে বললে ঘণ্টাখানেকের জন্য ওই ফ্ল্যাটটা পেতে পারত। সুব্রতর কাছে তার গোপন করার কিছু নেই।
মৃগাঙ্ককে বোকা ভেবেছিল। এখন হিমাদ্রি টের পাচ্ছে, নিজেই সে রাম বোকা। মৃগাঙ্কের পেতে রাখা ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছে। সময় যেন থেমে গেছে। দরজায় কান রেখে ভেতরে কী ঘটছে বোঝার চেষ্টা করল হিমাদ্রি। অবাক হয়ে গেল। মৃগাঙ্ক ও ঊর্মি কোনো কথা বলছে না। কোনো চলাফেরার শব্দও শোনা যাচ্ছে না। এই অস্বাভাবিক চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কারণ কী?
কষ্টকর একমিনিট….দুমিনিট….পাঁচ মিনিট কাটল। তবু কোনো শব্দ নেই। সাত মিনিট….আট…দশ….বারো….পনের মিনিট। কোনো শব্দ নেই। শুধু একবার মনে হল, কেউ যেন জোরে শ্বাস ছাড়ল।
হঠাৎ হিমাদ্রি মরিয়া হয়ে গেল।
একটানে দরজা খুলে বেডরুমে পা বাড়িয়ে থমকে দাঁড়াল সে। তেমনি মোম জ্বলছে। তলায় ঠেকেছে শিখাটুকু। ঘরের ভেতরটা তেমনি হয়ে আছে। খাটে বেড কভার চাপানো রয়েছে। ঊর্মি নেই। মৃগাঙ্কও নেই।
সে অবাক হয়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-কাম-ড্রইংরুমে পা দিল। বেডরুমের মোমের দপদপে ক্ষীণ আলোর ছটা পর্দার ফাঁক দিয়ে একটুখানি ছড়িয়ে গেছে। সেই সামান্য আলোয় সদর দরজার কাছে কী একটা সাদা হয়ে পড়ে আছে।
চোখের দৃষ্টি একটু পরিষ্কার হতেই হিমাদ্রি ঊর্মির সাদা নাইটির অংশ দেখতে পেল। সঙ্গে সে প্যান্টের পকেটে সহজাত বোধ-বশে হাত ভরে লাইটার খুঁজল।
লাইটারটা তখন তাড়াহুড়োয় প্যান্ট খোলর সময় বেডরুমেই হয়তো পড়ে গেছে। সে দুঃস্বপ্নের ঘোরে বেডরুমে ঢুকে মোমটুকু নিয়ে এল। তারপর তার সারা শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। দুহাতে মুখ ঢাকল সে।
ঊর্মি চিত হয়ে পড়ে আছে। তার শ্বাসনালী কাটা। ভয়াবহ চাপচাপ রক্ত।
হিমাদ্রির হাত থেকে মোমটা পড়ে গেছে। সে ঊর্মিকে ডিঙিয়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। নির্জন করিডোর। পাশের ফ্ল্যাটে একটা কুকুর গর্জন করছিল। হিমাদ্রির সিঁড়ি বেয়ে টলতে টলতে নামতে থাকল।…
.
একটা অদ্ভুত চিঠি
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সকালে খুরপি হাতে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ড’-এ। ছাদজুড়ে দেশবিদেশের যত অদ্ভুত ক্যাকটাস, অর্কিড আর বিদঘুঁটে গড়নের কিছু উদ্ভিদ। তার হাতে ইতিমধ্যে যথেষ্ট মাটি মেখে গেছে এবং অন্যমনস্কতার দরুন সান্তাক্লজ অথবা পাদ্রীসুলভ সাদা দাড়িও কলঙ্কিত। তার। টুপিতে একটা সবুজ পোকা শীর্ষে ওঠার চেষ্টা করছে এবং কিনারায় গড়িয়ে পড়ছে। তবু তার চেষ্টার বিরাম নেই। গত বছর অ্যারিজোনার রুক্ষ মরু অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ব্যারেল ক্যাকটাসটা বাংলার কোমল জলবায়ুতে–বিশেষ করে বৃষ্টির স্বাদ পেয়ে ফুলে উঠেছে এবং মাথায় গোলাপী টুপি পরেছে। রাজসভার ভড়দের মতো দেখতে। অথচ তদ্রূপ নিরীহ নয়। ধারাল কাটা উঁচিয়ে সজারুর মতো মারমুখী। গার্গাতুয়া পাতাগুয়েলের কথা মনে পড়ে।
কিন্তু কর্নেল অন্যমনস্ক। কাল রাত থেকে একটা চাপা ক্ষোভ আর ব্যর্থতা ভেতর ভেতর তাঁকে অস্থির রেখেছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ভাবছিলেন, নেমে গিয়ে ডাক দফরতরকে একটা চিঠি কড়া লিখবেন। মাত্র শ পাঁচেক কিলোমিটার দুরত্ব অতিক্রম করতে একটা চিঠির প্রায় তিন মাস লেগে যায়। অথচ এমন একটা জরুরি চিঠি।
কাল সম্ভবত বিকেলে লেটারবক্সে চিঠিটা দিয়ে গেছে পোস্টম্যান। ডায়মন্ডহারবারের ওদিকে খোঁজ পেয়ে কাল একটা আমবাগান থেকে আবার এক দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড আনতে গিয়েছিলেন। রাতে খাবার টেবিলে ষষ্ঠী চিঠিটা রেখেছিল। খাওয়ার পর অভ্যাসমতো ড্রয়িংরুমে ইজিচেয়ারে বসে কফি ও চুরুটের সঙ্গে চিঠিটা পড়েই তিনি অবাক। পুরনো নোটবই ছিঁড়ে ঝটপর্ট লেখা চিঠি। আঁকাবাকা জড়ানো হরফ। চিঠিটা এই :
বসন্তনিবাস
সেতাপগঞ্জ, পূর্ণিয়া, বিহার
৭-৪-৮০
মান্যবরেষু,
অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা যোগাড় করিয়াছি। বরদাভূষণ ত্রিবেদীর বাড়িতে আপনি একবার আসিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় নাই। আমি পক্ষাঘাতে চলচ্ছক্তিরহিত। নতুবা নিজেই আপনার কাছে যাইতাম। কাহাকেও বিশ্বাস করার ভরসা হয় না। তাই এই চিঠি। আপনি দয়া করিয়া শীঘ্র আসুন। আমি বিপন্ন। প্রতিমুহূর্তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় আছি। কতকগুলি অদ্ভুত ঘটনা ঘটিতেছে। সাক্ষাতে সব কথা বলিব। স্টেশনে টাঙ্গা, রিকশা, ট্যাক্সি সবই পাইবেন। বসন্তনিবাস বলিলেই চলিবে। সামান্য ইঙ্গিত দিলাম মাত্র। প্রচুর রহস্য।
ইতি–
রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরি
আজ আঠারো জুলাই। রুদ্রেন্দুপ্রসাদ সম্ভবত বৃদ্ধ (কর্নেলও সদ্য পঁয়ষট্টিতম জন্মদিন পেরিয়ে এসেছেন) এবং অসুস্থতার দরুন হয়তো বাতিকগ্রস্তও। এক ধরনের বুড়ো মানুষ আছেন, তাঁরা বিপত্নীক হলে তো কথাই নেই, অকারণ ঝামেলা বাড়ান। বিপন্ন হন বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায়’ থাকেন। তাছাড়া ওই প্রচুর রহস্য’। একটা ছেলেমানুষিও আঁচ করা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা অন্যদিকে থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে কর্নেলের। চিঠির তারিখ ৭ এপ্রিল। এতদিন লেগে গেল কেন পৌঁছুতে? ঠিকানাও সঠিক লেখা আছে। অথচ কর্নেল হঠাৎ একটু চঞ্চল হলেন। চিঠিটা তার গার্ডেনিং জোব্বার পকেটে নিয়ে ছাদে উঠেছেন নিজের এই অবচেতন তাগিদটা টের পেয়েই এ চাঞ্চল্য। তাহলে কি কিছু মিস করেছেন চিঠিতে, যেজন্য আবার ওটা খুঁটিয়ে পড়ার ইচ্ছে? টেবিলে পড়ে ছিল খামটা। পকেটে ভরার সময় অতকিছু ভাবেননি। এখন ধরা পড়ল, শুধু ডাকবিভাগের দেরির জন্য নয়, যেন অন্য কোনো গূঢ় ব্যাপার আছে এর মধ্যে, যা নিয়ে তাঁর অবচেতনায় চিন্তার তরঙ্গ বয়ে চলেছে। খামটা বের করে সকালের আলোয় খোলা আকাশের নিচে আবার পড়তে গেলেন। তারপর জোব্বার অন্য পকেট থেকে বের করলেন একটা আতস কাঁচ। প্রথমে পেছনদিকটা পরীক্ষা করলেন। হুঁ, খামটা কেউ খুলেছিল। আবার ধ্যাবড়া করে এঁটে দিয়েছে। খামের ওপর ডাকঘরের ছাপ অস্পষ্ট। সেতাপগঞ্জ। অনুমান করা যাচ্ছে। তারিখের আবছা কালির আঁচড়ের সঙ্গে খামের ওপর দাগ পড়েছে। আতসকাঁচের ভেতর সব মিলিয়ে ১৩ সংখ্যাটার ছাপ ফুটে উঠল। পাশে জে হরফ।
আনলাকি থার্টিন। তের জুলাই চিঠিটা সেতাপগঞ্জ ডাকঘরে পোস্ট করা হয়েছে। তাহলে ব্যাপারটা সত্যি রহস্যময় হয়ে উঠল এতক্ষণে। ডাক দফতরের কোনো দোষ নেই। চিঠিটা এতদিন বাদে ডাকে দেওয়া হয়েছে। মধ্যে একটা রবিবার গেছে। স্থানীয় ডাকঘরের ছাপ পড়েছে ১৭ জুলাই। কর্নেল একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করলেন। পত্রলেখক রুদ্ৰেন্দুপ্রসাদ কি এখনও বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকুন আর মারাই যান, ব্যাপারটা গোলমেলে থেকে যাচ্ছে। মারা গেলে সেই মৃত্যুর মধ্যেই গণ্ডগোল আছে, তা সুনিশ্চিত–চিঠিটা ডাকে দেওয়ায় সেটা আঁচ করা যায়।
আর যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, কোনো কারণে সব গণ্ডগোল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আবার শুরু হয়েছে।
অবশ্য তারিখটা—
হয়তো তারিখটা সংশোধন করতে মনে ছিল না বা সুযোগ পাননি।…
ষষ্ঠী এসে দাঁত বের করল। নালবাজারের নাহিড়িসায়েব, বাবামশাই।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন, ফোন নামিয়ে রেখে ডাকতে এসেছিস তো? নাকি সেদিনকার মতো–
ষষ্ঠী জোরে মাথা দুলিয়ে খিক খিক করে হাসল। বারেবারে ফোং ভুল হবে নাকি? দেখুন গে না, টেবিলে কাত করে রেখে এয়েছি।
কর্নেল খাম আর আতসকাচ পকেটে ঢুকিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।…
.
আকস্মিক যোগসূত্র
কর্নেল, আমি বিপন্ন।
ডার্লিং আজকাল সবাই বিপন্ন। তাহলেও তোমার বিপন্ন হওয়ার কারণ তো দেখছি না। আবার কি নকশাল অভ্যুত্থান ঘটেছে? কাগজটাগজ তত পড়ি না। ভাল লাগে না। বয়সও একটা কারণ আর
কর্নেল! প্লিজ, শুনুন।
শুনছি। বলো।
আমি আধঘণ্টার মধ্যে যাচ্ছি। সি পি’র ঘরে একটা জরুরি কনফারেন্স চলছে। একবার ঢু মেরেই আপনার কাছে হাজির হবো পাছে আপনি কোথায় কোন দুর্লভ প্রজাতির পোকামাকড় বা গাছপালার খোঁজে বেরিয়ে যান, তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখলাম। বেরুবেন না যেন।
অরিজিৎ! মানুষের মধ্যে আজকাল তত বেশি রহস্য নেই–প্রায় সবই জানা হয়ে গেছে। তাই আমি প্রকৃতি রহস্যে তলিয়ে পড়তে চাইছি। দুর্লভ প্রজাতি বললে। কথাটার সত্যিকার তাৎপর্য যদি তোমার জানা থাকত ডার্লিং!
কর্নেল, ঘাট মানছি। বেঁফাস বলে ফেলেছি।
আচ্ছা, এস।
ফোন রেখে কর্নেল একটু হাসলেন। একালে পুলিশের গোয়েন্দা দফতরে ছেলেছোকরাদের রাজত্ব। এই ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী–এখনও গাল টিপলে দুধ বেরুনোর আশঙ্কা আছে। পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে বেরুনো ছেলে হঠাৎ কী খেয়ালে আই পি এস করে লালবাজারে ঢুকে পড়েছে। হা– বুদ্ধিমান, চতুর, প্রত্যুপন্নমতি। সামান্যতেই উৎসাহে চনমন করে ওঠে। কিন্তু বয়স জিনিসটার চেয়ে অভিজ্ঞতার পরিধিই এ লাইনে খুব কাজের জিনিস। যেমন ডাক্তারদের। আগের দিনে ডি সি ডি ডি মনেই তুম্বো মুখো পাকা কুমড়ো এক প্রৌঢ়। ঠোঁটের কোনায় সব সময় বাঁকা হাসি। খুনে ডাকাতের মতো চাউনি। আর অরিজিতের চোখ দুটো যুবতীদের মতো কোমল। জঘন্যতম অপরাধের মধ্যেও সে আর্টের রূপরেখা আবিষ্কার করতে চায়। অবশ্য কোনো কোনো মার্ডারেও আর্ট থাকে ব্ল্যাক আর্ট বলাই ভাল। কিন্তু সব আর্টের মতো ব্ল্যাক আর্টও বাজারের পণ্য হয়ে গেছে। গার্ডেনিংয়ের পোশাক খুলে কর্নেল হাত ধুয়ে এলেন বাথরুমের বেসিনে। তারপর চিঠি আর আতসকাচ বের করে ড্রয়িংরুমে বসলেন। এবার চিঠিটার ওপর আতসকাচ রেখে দেখতে থাকলেন হরফগুলো।
মানুষের হাতের লেখায় তার চারিত্রিক ছাপ ফুটে ওঠে। ভদ্রলোক যখন চিঠিটা লিখছিলেন, তখন মানসিক চাঞ্চল্য ছিল। উৎকণ্ঠা ছিল। গোপনেই লিখছিলেন বোঝা যায়। কিন্তু হরফের গড়ন বলে দিচ্ছে, উনি লেখালিখিতে অভ্যস্ত নন। প্রচুর রহস্য কথাটায় ওঁর রোমান্টিক মনের ছাপ আছে। তাড়াহুড়ো করে লিখলেও গুছিয়ে লিখতে পেরেছেন। তার মানে ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্র, খানিকটা হিসেবী। একটু জেদীও যেন। যেতে বলার মধ্যে সেটা আঁচ করা যায়।
বরদাবাবুর কথা লিখেছেন। বরদাবাবু ছিলেন দ্বারভাঙ্গা স্টেটের দেওয়ানের পুত্র। ম্যানেজার ছিলেন একসময়। পরে ইস্তাফা দিয়ে সেতাপগঞ্জে বাড়ি করেছিলেন। ভদ্রলোকের শিকারের বাতিক ছিল। ১৯৭৮ সালের মার্চে কর্নেল সেতাপগঞ্জ গিয়েছিলেন ভারত সরকারের লোকাস্ট রিসার্চ সেন্টারের একটা সেমিনারে। গঙ্গা নদীর অববাহিকায় সিস্টেসার্কা গ্রেগারিয়া প্রজাতির যে ঘাসফড়িংয়ের প্রজননক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেবারই তা ধ্বংস করা হয় পেস্টিসাইডস ছড়িয়ে। দেখতে নিরীহ ঘাসফড়িং হলেও ওগুলো পরবর্তী বিবর্তনে ডেজার্ট লোকাস্ট বা মরু পঙ্গপালে পরিণত হয় রাজস্থানে গিয়ে। এক শ্রেণীর পাখির মতো ওরাও পরিযায়ী। এ যেন যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। গাঙ্গেয় ঘাসফড়িং কালক্রমে পঙ্গপালে বিবর্তিত হয়ে রাজস্থান থেকে পশ্চিম এশিয়া আর আরব হয়ে আফ্রিকার সাহারায় যায়। তারপর সর্বনাশের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে আফ্রিকা জুড়ে। দুর্ভিক্ষের হাহাকার ওঠে কালো মানুষদের দেশে।
তো বরদাবাবুর সঙ্গে আলাপ ওই সূত্রে। গত বছর ওঁর মেয়ে বিবি সুনেত্রার চিঠিতে জানতে পেরেছিলেন, বরদাবাবু গঙ্গার চরে হাঁস মারতে গিয়ে নৌকাডুবি হয়ে মারা পড়েছেন। খুব সহৃদয় অমায়িক আর বন্ধুবৎসল ছিলেন বরদাভূষণ ত্রিবেদী। কর্নেল খুব বিচলিত হয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুসংবাদে।
উনি বেঁচে থাকলে আগে যোগাযোগ করে রুদ্ৰেন্দুবাবুর ব্যাপারটা জেনে নেওয়া যেত। সুনেত্রাকৈ লিখবেন? কিন্তু ইতিমধ্যে সুনেত্রার যদি বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে, রেলওয়ে রেস্টরুমে ওঠা যায়। দেখা যাক।
অরিজিৎ সটান ঢুকে বললেন, আসা করি লেট নই।
না। অবিশ্বাস্য, পনের মিনিটের মধ্যে এসে গেছ, ডার্লিং! বসো।
অরিজিৎ একটু অবাক হয়ে বললেন, সর্বনাশ! আপনার অসাধারণ চোখদুটো কি হঠাৎ বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠল, কর্নেল? আতস কাঁচ দিয়ে আপনাকে চিঠি পড়তে হচ্ছে যে!
চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে হাসলেন কর্নেল। নাঃ! এও এক বাতিক তোমার বিবেচনায় দুর্লভ প্রজাতির কিছু খোঁজার মতো।
অরিজিৎ হাসতে লাগলেন। আপনার অভিমান এখনও যায়নি। ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, বৃদ্ধরা হয়তো একটু অভিমানী হয়।
বিশেষ করে আপনার মতো ক্রনিক ব্যাচেলাররা!
কর্নেল ওঁর হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে বললেন, ক্রনিক শব্দটা অসুখবিসুখের সম্পর্কিত, ডার্লিং!
একস্যাক্টলি! বলেই চোখে একটা ভঙ্গি করলেন অরিজিৎ। না–আপনাকে রোগী বলছি না। যদিও বিয়ে না করে বুড়ো হয়ে যাওয়াটা একটা রোগ অবশ্য মানসিক। যেমন ধরুন আমাদের কমিশনার সাহেব। কিংবা ধরুন হোম সেক্রেটারি ভদ্রলোক। একা রামে রক্ষা নেই, তাতে লক্ষ্মণ দোসর! বাপস! প্রাণান্তকর অবস্থা একেবারে। বুঝুন, দুজনেই ব্যাচেলার এবং রিটায়ারিং এজের কিনারায় ঠেকেছেন। তাই যেন তর সইছে না। তাতে গোদের ওপর বিষফেঁড়ার মতো এক মন্ত্রীমশাইয়ের যন্ত্রণা।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন। কোনো মন্ত্রীর জামাইয়ের কলম চুরি গেছে বুঝি?
উঁহু-ভাগ্নের। তবে কলম চুরি নয়, বউঘটিত ব্যাপার। না, না–পালাননি ভদ্রমহিলা। মার্ডার হয়েছেন।
কর্নেল তাকালেন। অরিজিৎ কফিতে ঘনঘন চুমুক দিচ্ছিলেন। কর্নেল চুরুট বের করে হাল্কা গলায় বললেন, মার্ডার নিয়ে লালবাজার বিপন্ন! এ যে বানরে সঙ্গীত গায়, শিলা জলে ভেসে যায়, ডার্লিং! আর মার্ডারের কথা বলছ–এ তো আজকাল ডালভাতের সামিল। অরিজিৎ, তোমার ভেতর একজন আর্টিস্ট আছে জানতাম। ইদানীং মার্ডারের আর্ট কোথায়? সিধে খুনে বুদ্ধির চাতুর্য দরকার হয় না। কোনো ধুরন্ধর মেধার প্রয়োজন নেই। চিন্তাভাবনা অবান্তর। তুমি যে-কোনো একটা অস্ত্র তুলে নাও হাতে। অসংখ্য লোকের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে
ওয়েট প্লিজ। হাত তুললেন অরিজিৎ। এটা একজন মিনিস্টারের কেস। কিন্তু শুধু সে জন্যও নয়, ব্যাপারটা আগাগোড়া জটিল। আপনার ভাষায় আর্টিস্টিক এবং নিপুণ হাতের কাজ। কর্নেল চুরুট জ্বেলে পা ছড়িয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। চোখ বুজে বললেন, হুঁ বলো।
লেক প্লেসে একটা নতুন বাড়ি হয়েছে দশতলা–লেকভিলা নাম। তার সাততলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকেন মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি নামে এক ভদ্রলোক– মিনিস্টারের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে তিনি। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কারবার আছে। এগারো জুলাই মর্নিং ফ্লাইটে মৃগাঙ্কবাবু বোম্বে যান। ফ্ল্যাটে তার স্ত্রী ঊর্মিমালা একা ছিলেন। ওইদিন বিকেল থেকে সারারাত বৃষ্টি ছিল! রাত নটা নাগাদ লোকাল থানায় কেউ ফোন করে জানায়, লেকভিলার সাততলায় তিন নম্বর ফ্ল্যাটে একটা গলাকাটা ডেডবডি পড়ে আছে। তার কয়েকমিনিট পরে ওই বাড়িরই একই ফ্লোরের দু নম্বর ফ্ল্যাট থেকে রঞ্জন অধিকারী নামে এক ভদ্রলোক ফোন করেন থানায়। তার কুকুর খুব ছটফট করছিল বাইরে যাবার জন্য। দরজা খুলে। দিলে কুকুরটা তিন নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই সময় লোডশেডিং ছিল। রঞ্জনবাবু দরজা নক করে কোনো সাড়া পান না। কুকুরের কাণ্ড দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলেন ভদ্রলোক। অন্য ফ্ল্যাটের লোকেদের ডেকে আনেন। তারপর হাতল টানাটানি করতেই দরজা খুলে যায়। তার মানে দরজা খোলা ছিল। দরজার কাছে ঊর্মিদেবীকে পড়ে থাকতে দেখেন। মাংসপোড়া গন্ধ পান।
মাংসপোড়া?
হ্যাঁ–পরনে সিন্থেটিক ফাইবারের নাইটি ছিল। পুড়ে মাংসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। রঞ্জনবাবুরা সুইসাইড ভেবেই ফোন করে থানায়। কিন্তু শ্বাসনালী কাটা।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলেছে?
খুন করা হয়েছে শ্বাসনালী কেটে। পরে আগুন ধরে গেছে নাইটিতে। ভদ্রমহিলার হাতে মোমবাতি ছিল। সম্ভবত খুনীকে দরজা খুলে দেওয়ার সময় সে তাকে ধরে ফেলে এবং গলায় ড্যাগার চালিয়ে দেয়। মোমটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে আগুন ধরে থাকবে। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে একটা অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে। ঊর্মিদেবীর শরীরে–আই মিন ফিমেল অর্গানে সদ্য যৌনমিলনের প্রমাণ ছিল। এটা রেপ বলা মুশকিল। কারণ অন্য কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যাতে মনে হবে কেউ ওঁকে রেপ করেছিল। তবে বলা কঠিন। শি ওয়াজ ম্যাচিওর্ড।
প্রাণভয়ে যৌনমিলনে রাজি হলে অবশ্য অমনটা স্বাভাবিক।
আমাদের থিওরিও তাই। ঠিক দরজা খোলার মুখে খুনী ঊর্মিদেবীকে খুন করেছে, তাতে ভুল নেই। কিন্তু পোস্টমর্টমের আগে মনে হয়েছিল, খুনী ফ্ল্যাটে ঢুকেই খুনটা করেছে। চেঁচানোর সময় দেয়নি। পরে দেখা যাচ্ছে, ঊর্মিদেবীকে ভোগ করার পর
কর্নেল চোখ খুলে সোজা হলেন। তাহলে দরজার কাছে কেন? ঊর্মি নিশ্চয় দরজা খুলে তাকে বিদায় দিতে যাচ্ছিলেন কি?
অরিজিৎ তাকালেন। দ্যাটস এ পয়েন্ট। অনিচ্ছায় বা প্রাণভয়ে যৌনমিলনে রাজি হবে যে, সে লোকটাকে দরজা খুলে দিতে যাবে কেন?
যাবে–যদি সে ঊর্মির প্রেমিক হয়। ধরো, ঊর্মির সঙ্গে মিলনের পর দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ সে কর্নেল থেকে মাথাটা দোলালেন। নাঃ! খুনের ইচ্ছা নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলে সে কামনা মিটিয়ে নিয়ে বিছানাতেই ঊর্মিকে খুন করতে পারত। –ঠিক তাই করত। দরজার কাছে খুন করাটাই গণ্ডগোল বাধাচ্ছে। যাই হোক, কোনো সূত্র খুঁজে পেয়েছ কি ঘরে?
বলছি। কিন্তু আরও অবাক লাগে, বিছানায় কিন্তু তেমন কোনো চিহ্ন পাইনি–যাতে মনে হবে যে বিছানায় কিছু ঘটেছিল। ইন্সপেক্টর মোহনবাবুর মতে, মেঝেয় ব্যাপারটা ঘটে থাকবে।
বিছানার অবস্থা কেমন ছিল?
বেডকভার চাপানো। বেডশিটও নির্ভজ। অরিজিৎ এতক্ষণে সিগারেট ধরালেন। বেডরুমের মেঝেয় একটা বিদেশী লাইটার পড়ে ছিল। মৃগাঙ্কবাবু পরদিন বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে আসেন। লাইটারটা তাকে দেখানো হয়েছে। ওঁর নয়। ডগস্কোয়াড থেকে রেক্সিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লাইটার শুঁকে সিঁড়ি দিয়ে নিচের ফুটপাত পর্যন্ত গিয়ে রেক্সি থেমে যায়। সম্ভবত খুনী গাড়ি চেপে এসেছিল। তবে লাইটারে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।
মৃগাঙ্কবাবুর আঙুলের ছাপ নিয়েছ?
হ্যাঁ। তাঁর আঙুলের ছাপ নয়।
মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন ছিল খোঁজ নিয়েছ?
হ্যাঁ। তেমন কোনো খারাপ সম্পর্ক ছিল না এটুকু বলা যায়। তাছাড়া ওঁরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। গতবছর জুনে ওঁদের বিয়ে হয়েছিল। এবং হয়তো জাস্ট কোইনসিডেন্স–বিয়ের তারিখও ১১।
ঊর্মিদেবীর আগের জীবন সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছ কি? ওঁর প্রেমিক ছিল কি—
ব্যাপারটা হল, ভদ্রমহিলার বাবার বাড়ি বিহারে। পাটনা কলেজের গ্রাজুয়েট ঊর্মি। কলকাতায় মামার বাড়ি ভবানীপুরে। সেখানে থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে এম এ পড়তে এসেছিলেন। তারপর মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে ঘটনাচক্রে এক বিয়েবাড়িতে আলাপ, তারপর প্রেম, তারপর পড়াশোনা খতম করে বিয়ে। মৃগাঙ্কবাবু লোকটিকে আমার সরল মনে হয় না অবশ্য।
কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন অরিজিতের দিকে! আস্তে বললেন, বাবার বাড়ি বিহারে? কোথায়?
ভাগলপুরের কাছে কী গঞ্জ যেন। ওয়েট, বলছি। অরিজিৎ ব্রিফকেস খুলতে ব্যস্ত হলেন।
সেতাপগঞ্জ নয় তো? কর্নেল আস্তে বললেন।
অরিজিৎ একটু চঞ্চল হলেন হঠাৎ। কেন? চেনা মনে হচ্ছে নাকি? বলে নোটবই বের করে গম্ভীর হলেন আগের মতো। বলেছি কেসটা জটিল। কারণ। মাস তিনেক আগে ওঁর বাবাকেও ঠিক একইভাবে কেউ শ্বাসনালী কেটে খুন করেছিল। বিহার পুলিশের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। হ্যাঁ–ইউ আর রাইট। সেতাপগঞ্জ। রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরি।
হোয়াট? কর্নেল উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন।
অরিজিৎ বললেন, হ্যাঁ–সেতাপগঞ্জের রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরি।…..
.
রোবোটের দাম্পত্য জীবন
একঘণ্টা পরে লেকভিলার সামনে অরিজিৎ লাহিড়ীর শাদা ফিয়াট গাড়িটা থামল। কর্নেল ফুটপাতে নেমে প্রথমে বাড়ির উচ্চতা এবং তারপর চারপাশটা দেখে নিয়ে বললেন, যে বাড়ির নাম দেওয়া উচিত ছিল খাপছাড়া, তার নাম লেকভিলা। অরিজিৎ, নাম জিনিসটার চেয়ে বিভ্রান্তিকর আর কিছু নেই।
অরিজিৎ গাড়ির চাবি এঁটে গেটের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, আপনি পাশেই লেক দেখার আশা করেছিলেন কি? দেখা যায়–চারতলা অব্দি উঠলে। তবে এর স্থাপত্যের প্রশংসা করা উচিত।
প্রশংসার কিছু দেখছি না। কর্নেল একটু হাসলেন। কিপলিং এই মেট্রপলিসের একটা পর্যায়ে পভার্টি অ্যান্ড প্রাইড সাইড বাই সাইড দেখেছিলেন। আমরা এখন দেখছি দ্বিতীয় পর্যায়। কিপলিংয়ের মাথা ঘুরে যেত নির্লজ্জতা দেখে।
নিচের তলাটা গ্যারেজ। মৃগাঙ্কের সঙ্গে কর্নেলের ফ্ল্যাট থেকে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার সময় অরিজিৎ নিশ্চিত হয়েছেন, বিদ্যুৎ বারোটা অব্দি থাকবে। অটোমেটিক লিফট তরতর করে উঠছিল। অরিজিৎ কর্নেলের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। বললেন, আপনি বাড়িটা দেখে রিক্ত হয়েছেন মনে হচ্ছে!
হয়েছি বলতে পারো ডার্লিং!
কারণ?
প্রথম কথা লেকভিলা নামটা, তারপর–স্কুল প্রয়োজন যখন সৌন্দর্যের ভান করে, তখন আসলে তা আরও কুৎসিত হয়ে ওঠে। এসথেটিকস সম্পর্কে আমার ধারণা স্বতন্ত্র।
সাততলায় লিফট থেকে নেমে চোখে পড়ল সামনেই ফ্ল্যাট তিন। কলিং বেল টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। মৃগাঙ্ক প্রতীক্ষা করছিল।
ডাইনিং-কাম-ড্রয়িংরুমে সোফায় ওঁদের বসিয়ে সে বলল, আপনারা আসছেন বলে আমি থানায় এখনও জানাইনি। কিছুক্ষণ আগে মিঃ লাহিড়ীর ফোন পাবার পর আবিষ্কার করেছি ঊর্মির ছোট্ট স্যুটকেসটা নেই। ওই র্যাকের তলায় ছিল ওটা। কাল রাত্তিরেও দেখেছি।
অরিজিৎ বললেন, কী ছিল স্যুটকেসে?
জানি না। বিয়ের কিছুদিন পরে ঊর্মিকে নিয়ে সেতাপগঞ্জ গিয়েছিলুম। আসার সময় ও সুটকেশটা নিয়ে এসেছিল। আমি জানতে চাইনি কিছু।
আজ ঘুম থেকে ওঠার পর আপনি কি বেরিয়েছিলেন?
সাড়ে আটটায় একটা জরুরি চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিলাম। ডাকবাক্স বাড়ির সামনেই ফুটপাতে আছে। কারেন্ট ছিল। বড়জোর মিনিট পাঁচেকের বেশি বাইরে ছিলুম না। ঊর্মির ডুপ্লিকেট চাবিটাও আলমারির লকারে আছে।
ফ্ল্যাটে কে ছিল তখন?
কেউ না। কাজের মেয়েটি ঊর্মি মার্ডার হবার পর এসে বলে গেছে আর আসবে না। তার দরকারও হত না। আমি বাইরে খেতেই অভ্যস্ত বরাবর। শুধু চা-ফা আর ব্রেকফাস্টটা।
কর্নেল আস্তে বললেন, ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি এঁটে বেরিয়েছিলেন তো?
অবশ্যই। মৃগাঙ্কের মুখে দৃঢ়তা ফুটে উঠল। সে উঠে দাঁড়াল। বসুন, আসছি। বলে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল।
কর্নেল তাকে দেখছিলেন। লম্বা, একটু রোগা, ফর্সা চেহারা মৃগাঙ্কের। নাকটা বেশ বড়ো, চাচা গাল, চিবুক সংকীর্ণ। চোখে কড়া পাওয়ারের স্টিল ফ্রেমের চশমা। কিন্তু রোগা হলেও মোটা শক্ত হাড়ের কাঠামো। আঙুলগুলো লম্বাটে আর মোটা। ঠোঁটের কোনায় সূক্ষ্ম একটা ভাজে আত্মবিশ্বাসের ছাপ আছে। কর্নেল অনুমান করছিলেন, একসময় খুব লড়াই করে জিতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গি আছে যেন ওর ব্যক্তিত্বে।
কর্নেল অরিজিৎকে মৃদু স্বরে বললেন, তোমরা ঊর্মির জিনিসপত্র সার্চ করোনি?
অরিজিৎ মাথা দোলালেন। ওঁর কিছু চিঠিপত্র চেয়েছিলাম মৃগাঙ্কবাবুকে। সবই আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের চিঠি। বন্ধুদের মধ্যে কোনো পুরুষমানুষের চিঠি দেখিনি। তারপর একটু হেসে বললেন, কোনো কু পাইনি এটুকু বলতে পারি।
এ বাড়িতে ফ্ল্যাটের সংখ্যা কত?
নিচের ফ্লোরে গ্যারেজ। দারোয়ান আর কোঅপারেটিভ আপিসের গোটা তিনেক ঘর আছে। বাকি নটা ফ্লোরে সাতাশটা ফ্ল্যাট। দুটো এখনও খালি। বাকি পঁচিশটা ভর্তি। মৃগাঙ্কবাবুকে বাদ দিলে চব্বিশজনের নামধাম পেশা এসব তথ্য আমরা জেনেছি।
কোঅপারেটিভের কর্মচারী কজন?
দুজন। একজন ক্লার্ক, একজন পিওন। সেক্রেটারির নাম দুলাল গুপ্ত! থার্ড ফ্লোরে দুনম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন। তিনিই এই হাউসিং কোঅপারেটিভের প্রধান উদ্যোক্তা।
মৃগাঙ্ক ঝটপট চা করে আনল। তারপর বসে বলল, বলল, এঁকে চিনতে পারলাম না–
অরিজিৎ বললেন, সরি। ইনি আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড বলতে পারেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
মৃগাঙ্ক জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে নমস্কার করল। কর্নেল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ! অপূর্ব!
মৃগাঙ্ক একটু হাসল। কিছু কিছু ব্যাপারে আমি এখনও স্বাবলম্বী। পুরনো অভ্যাস আর কী! যেমন চা করা। নিজের হাতের চা না হয়ে আমার তৃপ্তি হয় না। তবে বুঝতেই পারছেন, যে কারবারে আছি, ক্রমশ সব শৌখিনতা ছাড়তে হয়েছে। ছুটোছুটি দৌড়ঝাঁপ সারাক্ষণ। আপনারা না এলে আমি এতক্ষণ বেরিয়ে যেতাম।
গাঙ্কের চেহারায় শোকের ছাপ এরই মধ্যে মুছে গেছে। হয়তো ভেতরে রেখে দিয়েছে শোকটাকে। কর্নেল তাকে দেখছিলেন। যত দেখছিলেন, তত একটা চরিত্রের আদল স্পষ্ট হচ্ছিল। ছত্রিশ-সাঁইত্রিশের মধ্যে বয়স। এখনই এমন পরিণত শক্তির আভাস সচরাচর আশা করা কঠিন। লড়াই করেছে, ঘা খেয়েছে। হয়তো বিস্তর। কিন্তু প্রেম করে পাওয়া বউয়ের এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যুর ধাক্কা সামলানো সহজ কি? অথচ ওর মুখে নির্বিকার উদাসীন ওই ভাব। ঊর্মির স্যুটকেসটা এমন অদ্ভুতভাবে চুরি যাওয়াতেও তত বিচলিত নয়। হুঁ, সব কিছুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে দেরি করে না এমন এক চরিত্র মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি।
অরিজিৎ চুপ করে আছেন। কারণ কথা বলার কথা কর্নেলেরই। মৃগাঙ্ক চায়ের কাপে চোখ রেখে কিছু ভাবছে। কর্নেল তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পরিবেশটা আবার দেখে নিলেন। কোথাও বিলাসিতার চিহ্ন নেই। একালীন রুচি হয়তো আছে। ছবি, ভাস্কর্য এসব বলতে যৎকিঞ্চিৎ। সোফার অংশে সাধারণ একটা কার্পেট। এই ঘরের ঘরণী সম্পর্কেও প্রশ্ন জাগে! সাজিয়ে নিতে জানার মতো শিক্ষা বা রুচি কি তারও ছিল না? নাকি মনের ভেতর অনিচ্ছা, বিদ্রোহ বা ঘৃণা ছিল? অথচ নাকি প্রেম করে বিয়ে!
কর্নেল বললেন, আপনার শ্বশুর রুদ্রেন্দুবাবুও একইভাবে খুন হয়েছিলেন, তাই না মৃগাঙ্কবাবু?
মৃগাঙ্ক সোজা হয়ে বসল। হ্যাঁ। সেজন্যই আমি মিঃ লাহিড়ীদের বলেছি এর পেছনে কোনো পারিবারিক প্রতিহিংসার ব্যাপার আছে। অশ্রদ্ধা মনে হবে, কিন্তু আমি ফ্যাক্টস বলছি–শ্বশুরমশাই মোটেও ভালমানুষ ছিলেন না। না– আমার সঙ্গে ওঁর মেয়ের বিয়েতে রাজি ছিলেন না বলেও বলছি না। খুব উদ্ধত রাগী প্রকৃতির লোক ছিলেন। জমিদারবংশের ব্যাপার আর কী! কোন যুগে কী সব ছিল-টিল, তারই দেমাক। তাছাড়া এলাকায় ওঁর সুনামও ছিল না। মামলাবাজ ছিলেন ভীষণ। অবশ্য আমি বিয়ের পর ঊর্মির তাগিদেই মাত্র একবার গেছি। তখন উনি পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেননি।
মৃগাঙ্ক একটা শ্বাস ছেড়ে চুপ করল। কর্নেল বললেন, ঊর্মিদেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ কীভাবে?
শ্যামবাজারে আমার এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়েছিলাম। সেখানেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়।
কেউ আলাপ করিয়ে দিয়েছিল নাকি…
মৃগাঙ্ক মুখ নামিয়ে কথা বলছিল। আস্তে বলল, হ্যাঁ। আমার আরেক বন্ধু হিমাদ্রি রায়ের সঙ্গে আলাপ ছিল ঊর্মির। হিমাদ্রিই আলাপ করিয়ে দেয়। হিমাদ্রিও সেতাপগঞ্জের ছেলে, সেদিনই জানতে পেরেছিলাম।
হিমাদ্রিবাবু কোথায় থাকেন?
সাউদার্ন এভেনিউতে। ওর বাসায় কখনও যাইনি। নাম্বারও জানি না।
কী করেন?
কোল ইন্ডিয়া অফিসে পার্সোনেল ডিপার্টের অফিসার।
ঊর্মিদেবী খুন হওয়ার পর আপনার বন্ধুরা নিশ্চয় এসেছিলেন আপনার কাছে?
মৃগাঙ্ক একটু হাসবার ভঙ্গি করে মাথাটা দোলাল। সত্যি বলতে কী, আমার সে অর্থে কোনো বন্ধুই নেই। জাস্ট কাজকর্মের সূত্রে পরিচয়। তারপর একটুখানি মেলামেশা বড়জোর। আসলে কোনোরকম সামাজিকতা বা মেলামেশার মতো অঢেল সময় আমি পাই না। সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়।
হিমাদ্রিবাবুর দেশের মেয়ে ছিলেন ঊর্মি?
হ্যাঁ প্রতিবেশী ছিল। তবে হিমাদ্রিরা নাকি চলে এসেছিল ওখান থেকে বাড়ি-টাড়ি বেচে দিয়ে।
হিমাদ্রিবাবু আসেননি বলছেন?
না। সেটাই একটু অবাক লাগছিল। পরশু ওর অফিসে তাই ফোন। করেছিলাম। শুনলাম ছুটিতে আছে। বাইরে কোথায় গেছে নাকি।
হিমাদ্রিবাবু এ ফ্ল্যাটে এসেছেন কখনও?
বিয়ের পর বউভাতের দিন এসেছিল। তার মানে, একবছর আগে। মৃগাঙ্ক সিগারেট অফার করল প্রথমে অরিজিৎকে। অরিজিৎ নিলেন। কর্নেল থ্যাংকস, বলে পকেট থেকে চুরুটের কৌটো বের করলেন।
চুরুট ধরিয়ে বললেন, আপনার শ্বশুর খুন হবার খবর পেয়েও আপনি যাননি সেতাপগঞ্জ?
সময় পাইনি। ঊর্মি গিয়েছিল ওর মামার সঙ্গে।
তিনি তো ভবানীপুরে থাকেন?
অরিজিৎ বললেন, এখান থেকে আমরা ওঁর কাছে যাব। ওঁর নাম বনবিহারী চক্রবর্তী।
মৃগাঙ্ক বলল, ঊর্মির মামা অসাধারণ মানুষ। ঊর্মি হয়তো শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি হত না–অন্তত আমার সেটাই মনে হয়েছিল ওর মতিগতি দেখে। উনি ওকে রাজি করান। আসলে ঊর্মির দ্বিধার কারণ হল ওরা তিন বোন, ভাই-টাই নেই। ও মেজ। বড় শ্রাবন্তীতার বিয়ে হয়নি এখনও। অদ্ভুত একটা অসুখে ভুগছে ছোটবেলা থেকে। ওখানকার লোকের ধারণা কোন দেবীর ভর হয়েছে–আমি জানি, ওটা হিস্টিরিয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। চোখ খুললেন। আপনি দেখেছেন তো?
দেখেছি। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে। তারপর মাথা দোলাতে থাকে। বিড়বিড় করে কী-সব বলে। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। বিশ-তিরিশ মিনিট পরে শুয়ে পড়ে। তারপর উঠে বসে। শ্রাবন্তী একটা প্রবলেম।
আপনার শাশুড়ি বেঁচে আছেন কি?
না। মৃগাঙ্ক সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে বলল, বছর সাতেক আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ওদের ফ্যামিলিটা দেখে মনে হবে যেন অভিশপ্ত। বাড়ির পরিবেশও কেমন অস্বস্তিকর। আমি জাস্ট তিনটে দিন ছিলাম। আমার দম আটকে যাচ্ছিল। অতবড় একটা পুরনো বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে যেন পোড়োবাড়ি।
ঊর্মির ছোট বোনের নাম কী?
অপালা। ওদের মধ্যে বয়সের ফারাক বেশি নয়। ঊর্মির বাইশ ছিল। শ্রাবন্তীর চব্বিশ। আর অপালার উনিশ। মৃগাঙ্ক একটু পরে ফের বলল, ঊর্মির মামার কাছে ওদের বাড়ির কথা সামান্যই শুনেছি। ঊর্মি কোনো কথা বলতে চাইত না। এড়িয়ে যেত। নিজের ফ্যামিলি সম্পর্কে ওর কেমন একটা যেন আড়ষ্টতা ছিল।
শ্রাবন্তী, অপালা–এসেছিলেন তো বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে?
অপালা এসেছিল। ওর মামার কাছে উঠেছিল। মামার সঙ্গে এসেছিল। আধঘণ্টা থেকেই চলে গেল।
কান্নাকাটি করছিল খুব?
মৃগাঙ্ক শক্ত মুখে বলল, ওরা সত্যি অদ্ভুত প্রাণী–আপনি ক্ষমা করবেন কর্নেল সরকার! আমার।
কর্নেল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলুন!
আমার ভুল হয়েছিল ডিসিশন নিতে!
বিয়ের?
আবার কিসের? মৃগাঙ্কের মুখের রেখা বিকৃত দেখাল। ওরা তিন বোনই কমবেশি অ্যাবনর্মাল-বাবার মতোই।
কথাটা সম্ভবত ঝোঁকের বশে বলেছে। তখনই সংযত হয়ে হাসবার চেষ্টা করল সে। অবশ্য ঊর্মি একটু অন্যরকম ছিল। বাইরে থেকে লেখাপড়া শেখার দরুনও হতে পারে সেটা, খানিকটা ইমোশনাল আর হঠকারী বুদ্ধির মেয়ে হলেও ওর মধ্যে সিভিলাইজড ম্যানার ছিল। শ্রাবন্তী তো স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি-নাকি ওই অসুখের জন্য। আর অপালা কলেজে ভর্তি হয়েই পড়াশুনো ছেড়ে দেয়। ভীষণ প্রিমিটিভ টাইপ। দেখলে হিন্দুস্থানী মেয়ে মনে হবে।
অরিজিৎ হাসলেন। সম্ভবত বিহারের জলবায়ুর গুণ।
আই এগ্রি।
কর্নেল বললেন, বিয়ের পর এই একবছরে আপনার শ্যালিকারা কেউ আসেনি বোনের কাছে–মানে ঊর্মির মৃত্যুর পরে ছাড়া?
নাঃ।
মামার কাছে?
এসে থাকবে। জানি না।
আপনার শ্বশুরের আর্থিক অবস্থা কেমন?
মন্দ না। জমিজমা আছে কিছু। দেখাশুনো করার লোক আছে।…
কর্নেল একটু পরে বললেন, আপনি এ ফ্ল্যাট কিনেছেন কতদিন?
বছর দুই হল প্রায়। গোড়া থেকেই আমি অন্যতম প্রমোটার।
এর আগে কোথায় থাকতেন?
বেহালায়।
আপনার বাবা-মা বেঁচে আছেন?
না।
ভাইবোন?
আমি বাবা-মায়ের এক সন্তান। বাবা স্কুলটিচার ছিলেন।
ফোন বাজল। মৃগাঙ্ক উঠে গিয়ে ফোন ধরল। মৃদুস্বরে কথা বলে ফোন রেখে ফিরে এল সোফায়। ঘড়ি দেখে একটু হাসল সে। ডাক এসেছে। বেরুতে হবে। অবশ্য আর কিছু জানবার থাকলে জিগ্যেস করতে পারেন।
কর্নেল বললেন, আপনার তো এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কারবার? কোথায় অফিস?
চৌরঙ্গীতে। সে উঠে গিয়ে একটা কার্ড এনে দিল কর্নেলকে।
আপনাকে তাহলে বেশির ভাগ সময় বাইরে কাটাতে হয়।
হয়। কখনও একসপ্তাহ বোম্বেতে কাটাতে হয়।
ঊর্মি একা থাকতেন ফ্ল্যাটে?
উপায় ছিল না। মৃগাঙ্ক গম্ভীর হল। অবশ্য ঊর্মি সাহসী মেয়ে ছিল– বেপরোয়াও বলা যায়।
একা থাকার জন্য অভিযোগ করতেন না ঊর্মি?
করত। কিন্তু উপায় ছিল না।
আপনার ফ্ল্যাট একবার দেখতে চাই। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অরিজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডেডবডি কোথায় পড়ে ছিল, এবং সিগারেট লাইটারটা? তুমি দেখিয়ে দেবে অরিজিৎ! তবে আগে ফ্ল্যাটটা দেখে নিই।
মৃগাঙ্ক উঠল। আসুন! বলে সে বেডরুমে নিয়ে গেল প্রথমে।
কর্নেল একটু অবাক হলেন। দম্পতির শোবার ঘর বলে মনে হয় না। বিয়ের ছবি তো দূরের কথা, কোনো ফোটোই নেই। আসবাবপত্রও কিঞ্চিৎ। ড্রেসিং টেবিলে তত কিছু প্রসাধনসামগ্রী নেই। আশা করেছিলেন, আমদানি, রফতানির কারবারীর বউয়ের ড্রেসিং টেবিলে দেখবেন বিদেশী হরেক প্রসাধনদ্রব্য থরেবিথরে। ড্রয়ার টেনেও নিরাশ হলেন। মৃগাঙ্ক এগিয়ে নিজেই বাকি ড্রয়ারগুলো টেনে দেখাল। বলল, ঊর্মি সাজতে ভালবাসত না। কিছু এনে দিলে পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েদের বিলিয়ে দিত। শেষে আর কিছু আনতাম না।
অরিজিৎ খাটের মাথার দিকে মেঝে দেখিয়ে বললেন, লাইটারটা এখানে পড়েছিল।
কর্নেল মৃগাঙ্কের মুখের দিকে তাকালেন। মৃগাঙ্ক মুখ নামিয়ে আস্তে বলল আগেই বলেছি, আমার ডিসিশনে ভুল হয়েছিল। ঊর্মিকে আমি চিনতে পারিনি।
কর্নেল একটু হাসলেন। একটা লাইটার তত কিছু প্রমাণ করে না, যদি না আরও কোনো ফ্যাক্ট–
মৃগাঙ্ক কথা কেড়ে বলল, লাইটারটা আমি দেখেছি। জাপানি। অন্তত কুড়ি ডলার দাম।
এবাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটের লোকেদের সঙ্গে আপনার স্ত্রীর আলাপ ছিল নিশ্চয়?
ছিল। অবশ্য এক ফ্ল্যাটের সঙ্গে অন্য ফ্ল্যাটের লোকেদের মধ্যে রেষারেষিও প্রচণ্ড। আলাপ আছে–ভাব নেই তত। ভদ্রতাটুকু। আর ঊর্মি তেমন আলাপী মেয়ে ছিল না। ওর আলাপের গণ্ডি ছিল লিমিটেড। পাশের দুনম্বর ফ্ল্যাটের রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বা তার মেয়েরা, নাইনথ ফ্লোরের তিন নম্বর ফ্ল্যাটের পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের বউ, আর থার্ড ফ্লোরের স্কুলমিস্ট্রেস মহিলা–এক নম্বর ফ্ল্যাটের। এর বাইরে কারুর সঙ্গে আলাপ থাকার কথা আমি জানি না। ঊর্মির কাছে শুনিনি অন্তত আর কারুর কথা।
কর্নেল অ্যাটাচড বাথরুমে উঁকি মেরে পাশের একটা ঘরে গেলেন। একেবারে খালি! এবার ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুমের অন্য পাশের ঘরে উঁকি দিলেন। একটা স্টোর রুম, তার লাগোয়া কিচেন। পাশে একটা ছোট্ট সার্ভেন্টস রুম সম্ভবত সেটাও একেবারে খালি। দরজার পাশেই দ্বিতীয় বাথরুম। এটা অব্যবহৃত মনে। হল। আসলে টুরুম ফ্ল্যাট বলা যায়। ছোট ফ্যামিলির পক্ষে যথেষ্টই।
অরিজিৎ দরজার সামনে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে ডেডবডি পড়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার, মেঝেয় যা একটু রক্ত পড়েছিল। খুব এক্সপার্ট হাতের কাজ।
কর্নেল বললেন, আপাতত এই। মৃগাঙ্কবাবু, আপনি এবার বেরুতে পারেন। অরিজিৎ, আমি একবার রঞ্জনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেই চাই।
অরিজিৎ কিছু বলার আগে মৃগাঙ্ক বলল, ওঁকে এখন পাওয়া যাবে কি? এখন অফিসে থাকার কথা।
ওঁর স্ত্রী সঙ্গে কথা বলব বরং!
মৃগাঙ্ক বেরিয়ে দু নম্বর ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাল। কর্নেল ও অরিজিৎ তার পেছন পেছন বেরিয়ে এলেন। দরজা একটু খুলে এক মহিলা কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করে কর্নেল ও অরিজিৎকে দেখে থমকে গেলেন। মৃগাঙ্ক বলল, রঞ্জনদা বেরিয়েছেন নাকি?
অনেকক্ষণ।
বউদি, এঁরা লালবাজার থেকে এসেছেন। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বললেন, ভেতরে আসুন! এস মৃগাঙ্ক!
মৃগাঙ্ক বলল, আমি আর যাচ্ছি না বউদি। এখনই বেরুতে হবে। তারপর কর্নেল ও অরিজিতকে নমস্কার করে বিদায় জানিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল। কর্নেল বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মৃগাঙ্ক যেন যন্ত্রমানুষ।…
.
দুবার দরজায় নক
ফ্ল্যাটগুলো এই গড়নের, একই আয়তনের। কিন্তু রঞ্জনবাবুর ফ্ল্যাটে সংসারী মানুষের ভোগী মনোভাবের ছাপ স্পষ্ট। অরিজিৎ বললেন, প্লিজ, চা-ফা আর নয়। মৃগাঙ্কবাবুর ওখানে হয়ে গেছে। আমরা বেশি সময় নেব না আপনার।
পাশের ঘরে কুকুরের গজরানি শোনা যাচ্ছিল। কর্নেল একটু হেসে বললেন, রঞ্জনবাবুর, নাকি আপনার পেট?
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী হাসলেন। দুজনেরই।
চেহারায় সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে মহিলার। সপ্রতিভ ভঙ্গি। একটু যেন স্মিতভাষিণীই। কথা বলেন যেন হিসেব করে। কর্নেল বললেন, আপনার ছেলেমেয়েরা স্কুলে?
স্কুলে, কলেজে।
ঊর্মিদেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ ছিল শুনলাম।
ছিল–তত বেশি কিছু না।
যাতায়াত ছিল পরস্পর?
বিশেষ না। একটু খামখেয়ালী মনে হত ভদ্রমহিলাকে।
আপনার ছেলেমেয়েরা যেত ওঁর কাছে?
গেছে কখনও-সখনও।
একটু অপ্রীতিকর প্রশ্ন হয়তো কিন্তু আপনার সাহায্য মূল্যবান হতে পারে। কর্নেল একটু ইতস্তত করছিলেন। একটু হাসলেন এবার। অবজার্ভার হিসেবে পুরুষের চাইতে মেয়েরা শ্রেষ্ঠ। মেয়েদের ইনটুইশানে আমি বিশ্বাসী।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বললেন, নিঃসঙ্কোচে বলুন কী জানতে চান।
মৃগাঙ্কবাবুকে কেমন লোক মনে হয় আপনার?
আমিশুকে প্রকৃতির। কৃপণটাইপ বলতে পারেন। ভীষণ হিসেব করে চলে।
আপনার কি মনে হয় ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নর্মাল ছিল?
তেমন কিছু দেখিনি যে মতামত দেব। তবে
তবে?
কয়েকবার ঝগড়া হতে শুনেছি। সেটা কোথায় না হয়?
ফ্ল্যাটে–ধরুন, যখন মৃগাঙ্কবাবু নেই, তখন কেউ এসেছে কি না দেখেছেন?
কেউ এলে আবছা কলিং বেলের বা লোডশেডিং থাকলে নক করার শব্দ শোনা যায় আমাদের ফ্ল্যাট থেকে। তাছাড়া সনি, মানে আমাদের কুকুরটা একটু চাচামেচি করে। রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। আমার নাক গলানোর অভ্যাস নেই অন্যের ব্যাপারে।
তাহলে কেউ এসেছে মাঝে মাঝে–মানে মৃগাঙ্কবাবু না থাকার সময়?
হ্যাঁ। এসেছে বৈকি। ফ্ল্যাটগুলোর দরজা ডিফেক্টিভ। প্রাইভেসি রাখা একটা প্রব্লেম।
দৈবাৎ কি আপনার চোখে পড়েনি মৃগাঙ্কবাবুর ফ্ল্যাটে কারা আসেন?
ভদ্রমহিলা কয়েক সেকেন্ড আঙুল খুঁটে মুখ তুললেন। মৃগাঙ্কবাবুর বউ মার্ডার হওয়ার দিন–মানে সন্ধ্যা ৭টা হবে তখন, সনি হঠাৎ দরজায় আঁচড় কাটতে কাটতে চাঁচামেচি করছিল। শুনলাম কেউ নক করছে ওদের দরজায়। তাই দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়েছিলাম।
কাকে দেখলেন?
লোডশেডিং ছিল। তাছাড়া তখনই দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। দেখতে পাইনি।
বাই দা বাই, মৃগাঙ্কবাবু বাড়ি ফিরলে সনি কি চাচামেচি করে?
সনি কিন্তু খুব মেজাজী। কখন কাকে তার পছন্দ বলা কঠিন। তবে তিনবার নক করলে বুঝতে পারি মৃগাঙ্ক এল। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সনি কমবেশি চাচামেচি তো করেই।
কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন সেদিন সন্ধ্যাবেলা? কর্নেল রিপিট করলেন।
না। রঞ্জনবাবুর স্ত্রী আবার নখ খুঁটতে থাকলেন। একটু পরে মুখ তুলে বললেন, বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার সনি দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে চাঁচামেচি করতে লাগল। তখন আমার ভয় করছিল। ওঁকে বললাম, সনি এমন করছে। কেন। উনি একটু ভীতু মানুষ। বললেন, বেঁধে রাখো। দরজা খুলো না আর। …..হ্যাঁ, আবার শুনতে পেয়েছিলাম কেউ ওদের দরজায় নক করছে। ভেবেছিলাম। মৃগাঙ্ক। কিন্তু সে নাকি বোম্বে গেছে।
তাহলে কিছুক্ষণ অন্তর দুবার নক করার শব্দ?
হ্যাঁ। সনির ব্যাপারটাতে বুঝতে পেরেছিলাম দুবারই ওর অপছন্দ লোক এল ও ফ্ল্যাটে।
অরিজিৎ বললেন, আপনি পুলিশকে একথা বলেছেন। নিশ্চয়?
না জিগ্যেস করলে কেন আগ বাড়িয়ে বলব? ইনি জিগ্যেস করছেন, তাই বলছি।
অরিজিৎ হাসলেন। আপনার স্বামীর নিষেধ ছিল।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী জোরে মাথা দুলিয়ে বললেন, মোটেও না। উনি মৃগাঙ্ককে খুব ভালবাসেন। খুনী, ধরা পড়ার জন্য সবরকম সাহায্য করেছেন পুলিশকে। অথচ পুলিশের লোকেরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত।
কর্নেল বললেন, এক নম্বর ফ্লাটে কে থাকেন।
মিঃ নায়ার। সাউথ ইন্ডিয়ান। অবশ্য একনাগাড়ে থাকেন না–মাঝে মাঝে এসে থাকেন। পার্ক স্ট্রিটেও ওঁদের ফ্ল্যাট আছে।
এখন আছেন কি?
না। মার্ডারের সময়ও ছিলেন না ওঁরা। দুদিন পরে এসে আবার চলে গেছেন। এ বাড়ির অনেকেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আচ্ছা–অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী ওঁরা লিফটে ওঠা অব্দি দরজা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
সেতার শিল্পী বনবিহারী
ভবানীপুরের দিকে এগোচ্ছিল শাদা ফিয়াট। অরিজিৎ বললেন, ওই ভদ্রমহিলা– মানে রঞ্জনবাবুর স্ত্রী সম্ভবত আরও কিছু জানেন। চেপে গেলেন। তাই না কর্নেল?
কর্নেল একটু হাসলেন। কেন একথা মনে হল তোমার?
মাই গুডনেস! সেটা আমাকেই বলতে হবে?
হবে। কারণ ধারণাটা তোমার।
আপনার কী ধারণা?
আমি অন্তর্যামী নই, ডার্লিং! বিশেষ করে স্ত্রীলোক সম্পর্কে আমি অতিমাত্রায় অজ্ঞ। ক্রনিক ব্যাচেলার–তোমার ভাষায়।
অরিজিৎ হাসতে লাগলেন। আপনি যাই বলুন, ভদ্রমহিলা গভীর জলের। মাছ। অনেককিছু জানেন। একটু চাপ দিলেই আরও কথা বেরিয়ে পড়তে পারে। পুলিশী পদ্ধতি সব সময় ইমিডিয়েট রেজাল্ট দেয়।
কর্নেল আধপোড়া চুরুটটা হাওয়া বাঁচিয়ে ধরালেন। আমার পদ্ধতি সম্পূর্ণ অন্যরকম। সাইকো-অ্যানালেসিস প্রক্রিয়ার মতো। কাউকে মনের কথা বলাতে হলে তার স্বাধীনতাবোধকে এগিয়ে দিতে হয়। আরও একটা ব্যাপার আছে, অরিজিৎ! যার কাছে তথ্য পেতে চাইছ, সে কিন্তু জানে না কোন তথ্যটা তোমার কেসে মূল্যবান বা প্রয়োজনীয়। কাজেই আমার স্লোগান হল, প্রাণ খুলে বলতে দাও। তারপর তুমি সেইসব কথা থেকে তোমার দরকারি জিনিসটা বেছে কুড়িয়ে নাও।
বাপস! পুলিশ এ পদ্ধতিতে চললে একেকটা কেসে দশ বছর লেগে যাবে চার্জশিট দিতে।
কর্নেল চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়েছেন। ঠোঁটে চুরুটটা কামড়ানো। সেই অবস্থায় বললেন, ঊর্মির সুটকেসের ব্যাপারটা আরও জট পাকিয়ে তুলল। দেখছি।
খুনী ওই বাড়িতেই আছে–দেখবেন। কারণ মাত্র পাঁচ মিনিটের সুযোগে বাইরের কেউ একাজ সারতে পারে না। তাছাড়া দরজার একটা নকল চাবি করা তার পক্ষেই সম্ভব।
কো-অপারেটিভ অফিসে মাস্টার কি আছে কি না জানো?
থাকতেও পারে। অনেক বাড়িতে আজকাল থাকে। খোঁজ নেব।
স্যুটকেসে কি এমন কিছু ছিল, যা খুনীকে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করত? কর্নেল স্বগতোক্তি করলেন। তাছাড়া ওটা চুরির কারণ কী থাকতে পারে?.. হুঁ স্যুটকেসটা একটা প্রব্লেম এনে ফেলল।
অরিজিৎ বললেন, সমস্যা হল, অতগুলো ফ্ল্যাট সার্চ করা একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। তাছাড়া অনেক প্রভাবশালী লোকও আছে। দেখুন না, লাইটারের হাতের ছাপের সঙ্গে মৃগাঙ্কবাবুর হাতের ছাপ মেলেনি। কিন্তু যদি ও বাড়ির অন্যান্য লোকের হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখার সুযোগ পেতাম–আমার ধারণা, ঠিক লোকটি বেরিয়ে আসত। কিন্তু সেও বড় অসুবিধার ব্যাপার। প্রায় অসম্ভব। মৃগাঙ্কবাবুর মামা মিনিস্টার। অনেকের মামা হয়তো তার চেয়েও ভি আই পি।
অরিজিৎ হাসতে লাগলেন। একটু পরে চোখে ঝিলিক তুলে বললেন ফের, লেকভিলার একটা খালি ফ্ল্যাটে আপনার বসবাসের ব্যবস্থা করতে পারি। থাকবেন নাকি?
কর্নেল মাথা দোলালেন। না ডার্লিং! বরং তুমি তোমার কোনো লোককে সপরিবারে ওখানে ঢোকানোর ব্যবস্থা করো। তাতে বেশি কাজ হবে।
সিরিয়াসলি বলছেন কি?
কর্নেল চোখ বুজে আছেন। ঠোঁটে কামড়ানো চুরুট। জবাব দিলেন না।
রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে মিছিল চলেছে। প্রবল স্লোগানের চাপে কথা বলা মুশকিল।
ভবানীপুরে পৌঁছে একটা গলির মুখে গাড়ি রেখে এগিয়ে গেলেন দুজনে। পুরনো একটা দোতলা বাড়ির বারান্দায় উঠে নক করলেন অরিজিৎ। একটু পরে এক প্রৌঢ়া দরজা খুলে বললেন, কাকে চান?
বনবিহারীবাবু আছেন কি?
আছেন। আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
ওঁকে বলুন অরিজিৎ লাহিড়ী এসেছেন। বললেন বুঝবেন।
একটু পরে ঊর্মির মামা বনবিহারীবাবু এসে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বসবার ঘরে জীর্ণতা দাঁত বের করে আছে। মাথার ওপরকার ফ্যানটা পুরনো। নিচের সোফা জীর্ণ। বনবিহারীবাবু মোটাসোটা লম্বাটে চেহারার মানুষ। মুখে অমায়িকতা ঝলমল করছে। বয়স ষাটের কাছাকাছি। কিন্তু সমর্থ শরীর। মাথার চুল বাবরি করে রাখা। খাড়া নাক। পোড়খাওয়া মুখের চামড়া। পুরুষ্টু গোঁফ। চোখদুটো কয়রা। সব মিলিয়ে হিন্দুস্থানী চেহারার ছাপ চোখে পড়ে। কর্নেল বললেন, আপনার ভগ্নীপতি রুদ্রেন্দুবাবু সম্পর্কে কিছু কথা জানতে এসেছি।
বেশ তো। বলুন কী জানতে চান?
বাই দা বাই, আপনি নিশ্চয় সঙ্গীত চর্চা করেন?
বনবিহারীবাবু হাসলেন। আমার চুল দেখে বলছেন তো? আমি–
না। আপনার আঙুল দেখে। আপনি সেতারশিল্পী।
নিজের ডান তর্জনী দেখে নিয়ে বনবিহারীবাবু বললেন, ওই একটু আধটু– মানে একসময় ভীষণ রেওয়াজ করেছি-টরেছি। এখন বিশেষ না। তাছাড়া সাংসারিক প্রব্লেম। বনবিহারীবাবুর হাসিটা কমে একটু বিষণ্ণতা ঘনিয়ে এল মুখে। ভাগলপুরে থাকার সময় একটু নামটামও হয়েছিল। কিন্তু সবাইকে সবকিছু সয় না। হঠাৎ আঙুলটাতে ক্র্যাম্প হয়ে গেল। মেজরাব পরলেই ব্যথা করে।
আপনি ভাগলপুরে ছিলেন?
আমার পৈতৃক বসবাস ওখানেই। কলকাতায় চলে এসেছি বছর বিশেক হবে। স্বাধীনতার পর ওখানকার লোকজন ও পরিবেশ খুব বদলে যাচ্ছিল। চলে। এসেছিলাম অগত্যা। এই বাড়িটা ছিল এক মুসলমান ভদ্রলোকের। ভাগ্যিস বুদ্ধি, করে কিনে নিয়েছিলাম। নৈলে এ বয়সে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হত।
রুদ্ৰেন্দুবাবুদের শুনেছি জমিদারি ছিল সেতাপগঞ্জে?
ছিল। খুব দাপটে রাজত্ব করেছে একসময়। তারপর অবস্থা পড়ে গিয়েছিল রুদ্রদার আমলে। ভাগলপুরে থাকার সময়ই ওঁদের সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির আত্মীয়তা হয়।
রুদ্ৰেন্দুবাবুও শুনেছি খুব তেজী লোক ছিলেন?
একটু হাসলেন বনবিহারীবাবু। সেই তেজেই শেষে প্যারালেসিস। তাছাড়া আর কী বলব?
কিন্তু উনিও ওঁর মেজমেয়ের মতো খুন হয়েছেন?
বনবিহারীবাবু গম্ভীর হলেন সঙ্গে সঙ্গে। একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ব্যাপারটা খুব মিসট্রিয়াস, জানেন? বিহারের আবহাওয়াই অন্যরকম। পুলিশের ব্যাপার-স্যাপারও অন্যরকম। নৈলে একটা ফয়সালা হয়ে যেত–খুনী ধরা পড়ত। হতভাগিনী মেয়েটাকেও ও ভাবে–
ঢোক গিলে শোকের আবেগ সামলে নিলেন। কর্নেল বললেন, আপনার ধারণা একই লোক বাবা ও মেয়েকে খুন করেছে?
বনবিহারীবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, রুদ্রদার অনেক শত্রু ছিল একসময়। তবে তারা বেশির ভাগই দেহাতী জোতদার। জমিজমা নিয়ে বিবাদ আর কী! কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব অদ্ভুত লাগে। রুদ্রদাকে কোনো শত্রু খুন করতেই পারে। কিন্তু তাঁর তিন মেয়ের ভেতর বেছে শুধু মেজকেই সে খুন করল কেন! ঊর্মির তো বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কম। ছোটবেলা থেকে বাইরে-বাইরে মানুষ। পাটনায় পিসিমার কাছে থেকে পড়াশুনো করেছে। যদুর মনে পড়ে, ক্লাস সেভেনেই ওকে সেতাপগঞ্জ স্কুল থেকে পাটনা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বি এ অব্দি সেখানেই পড়েছে। তারপর মাস চারেক মাত্র বাড়িতে ছিল। আমাকে লিখল কলকাতায় এসে এম এ পড়বে। গিয়ে নিয়ে এলাম ওকে।
শুনলাম, বড় বোনের নাকি দেবীর ভর ওঠে।
ওই এক ঝামেলা ওদের। একবার তো গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে ডুবে মরতে বসেছিল প্রায়। জেলেরা ভাগ্যিস দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। ডাক্তাররা কেউ বলেন মৃগী, কেউ বলেন হিস্টিরিয়া। সব রকম চিকিৎসা তো হয়েছেই, এমন কী ওঝা-তান্ত্রিক-ফকির সে সবও যথেষ্ট হয়েছে। ঊর্মির খবর পেয়ে অপু–মানে ছোটবোন অপালা এসেছিল লাস্ট উইকে। তার কাছে শুনলাম, ওর বড়দির মাথায় নাকি একটুখানি জটা দেখা যাচ্ছে। ইদানীং শ্মশানের কাছে মন্দির তলায় গিয়ে নাকি বসেও থাকছে। বাড়ি আসতে চায় না।
জোরালো শ্বাস ছাড়লেন বনবিহারীবাবু। কর্নেল বললেন, বাড়িতে দুইবোন ছাড়া আর কে থাকেন?
ইন্দুবাবু-ইন্দুমাধব ভট্টাচার্য নামে একজন আছে। পুরনো আমলের কর্মচারী। সেই আগলে রেখেছে সংসারটাকে। আর ধরুন, শ্যামা নামে একজন চাকর। সেও আগের আমলের লোক। আর মনিয়া নামে আদিবাসী মেয়েটা–ঝি বলতে পারেন। আর একজন রাঁধুনী দয়াল নামে। ওড়িশার লোক। কানে কালা।
আপনি রুদ্ৰেন্দুবাবুর হাতের লেখা দেখলে চিনতে পারবেন? বনবিহারী। চমকে উঠে তাকালেন মুখের দিকে। তারপর মাথা একটু দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ–পারি। কেন স্যার?
কর্নেল পকেট থেকে রুদ্রেন্দুবাবুর লেখা চিঠিটা এগিয়ে দিলেন ওর হাতে। অরিজিৎ অবাক। উঁকি মেরে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে উত্তেজনা থমথম করছে। বনবিহারীবাবু দ্রুত চিঠিটা পড়ে নিয়ে বললেন, রুদ্রদার হাতের লেখা। হ্যাঁ, রুদ্রদা খুন হওয়ার মাস দু তিন আগে থেকে বাড়িতে নাকি ভৌতিক উপদ্রব হচ্ছিল। আমাকেও লিখেছিল রুদ্রদা। কিন্তু আশ্চর্য তো! আমাকে আপনার কথা কিছু জানায়নি রুদ্রদা। শুধু লিখেছিল, ভৌতিক উপদ্রব হচ্ছে।
ভৌতিক উপদ্রব মানে?
বনবিহারীবাবু হাসবার চেষ্টা করলেন। দেখুন স্যার, আমি নাস্তিক মানুষ। ভূত-ভগবানে বিশ্বাস নেই। ওসব কোনো শত্রুর কারসাজি। বললাম না? জমিদারি রক্তের দাপটে রুদ্রদা অসংখ্য লোককে শক্ত করে ফেলেছিল।
কী উপদ্রব হত?
রাতবিরেতে ঢিল পড়ত। ওদের বাড়ির পেছনে বাগান আছে। এখন অযত্নে জঙ্গল হয়ে গেছে। সেখানে একটা ফোয়ারাও ছিল একসময়। মদ্যিখানে লাইমকংক্রিটের বেদির ওপর একটা বিদেশী স্কাল্পচার আছে। রুদ্রদার ঠাকুর্দরা আমলের। এখন ওটা বোঝাই যায় না কিসের মূর্তি ছিল। তো সেটা নাকি রাতে চলাফেরা করে বেড়াত বাগানে। রুদ্রদা একরাতে দেখতে পেয়ে বন্দুক নিয়ে। দৌড়ে যান। তারপর কিন্তু ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যান। ব্যস! সেই আছাড় খেয়ে একেবারে পক্ষাঘাত।
এ ব্যাপারে আপনার কী ধারণা বনবিহারীবাবু?
বনবিহারী গুম হয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর বললেন, কেউ রুদ্রদাকে ভয় দেখাত। তবে আমি একবার গিয়ে রাত্রি জেগে ওত পেতে থেকেছি। কিছু ঘটেনি, তেমন কিছু দেখিও নি।
রুদ্রবাবু খুন হন কীভাবে।
গত এগারো এপ্রিল ভোরে অপু বাবার ঘরে রোজকার মতো ফুল দিতে গিয়ে দেখে, রুদ্রদার ঘরের দরজা ফাঁক হয়ে আছে আর একটা হাত বেরিয়ে আছে। সে ভেবেছিল, বাবা বেরুতে গিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। কিন্তু কপাট ঠেলে দেখতে পায়, গলা ফাঁক হয়ে আছে। চাপচাপ জমাটবাঁধা রক্ত।
কর্নেল আনমনে বললেন, এগারো এপ্রিল! খুনীর কাছে এগারো তারিখটা পছন্দসই।
সেই প্রৌঢ়া মহিলা–বনবিহারীবাবুর স্ত্রী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা শুনছিলেন। এবার চাপা গলায় উত্তেজিতভাবে বললেন, আগের সন্ধ্যার ঘটনাটা বলো ওঁদের! নৈলে বুঝবেন কী করে?
বনবিহারীবাবু বললেন, ও হ্যাঁ। আগের সন্ধ্যায় খুকু, মানে রুদ্রদার বড় মেয়ে শ্রাবন্তী বাগানে গিয়েছিল কী জন্য। হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। বাড়ির লোকেরা দৌড়ে যায়। গিয়ে দেখে খুকুর ভর উঠেছে। নাকিস্বরে সুর ধরে বলছে, আজ তোর শেষদিন রুদ্র…
তাই বুঝি? আশ্চর্য তো! অরিজিৎ বললেন।
হ্যাঁ। গিয়ে ইন্দুর কাছে সব শুনেছিলাম। তখন খুকুর কাছে সে ছিল। মানিয়া ছিল। শ্যামা ছিল। অপুও দাঁড়িয়ে শুনেছিল দোতলার বারান্দা থেকে। ওই এক কথা–আজ তোর শেষদিন রুদ্র। বারবার ওই কথাটা বলছিল খুকু। পরে যখন। জ্ঞান ফিরল, তখন জিগ্যেস করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কিছু জানে না।
কর্নেল বললেন, সেরাতে কোনো প্রিকশান নেওয়া হয়নি?
খুকুর কথায় গুরুত্ব দেওয়ার কারণ ছিল না। ভর ওঠার সময় সে বাবাকে নাম ধরে অশ্লীল গালাগালি করত। শাসাত। কাজেই ওর ওসব কথা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। বরং সবাই হাসাহাসি করত। রুদ্রদাও।
এতক্ষণে চা এবং প্লেটে সন্দেশ বিস্কুট নিয়ে এল ফ্ৰকপরা একটি মেয়ে। বাড়িতে কাজকর্ম করে এমন মেয়ে। সে প্যাটপ্যাট করে দাড়িওলা কর্নেলকে দেখতে থাকল। প্রৌঢ়া ধমক দিলে সে ফিক করে হেসে চলে গেল।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, কোনো দুর্বোধ্য কারণে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের আমি দ্রষ্টব্য।
অরিজিৎ মন্তব্য করলেন, সান্তা ক্লজ মনে করে আর কী! জ্যান্ত সান্তা ক্লজ!
বনবিহারীবাবু বললেন, ওনাকে দেখলে সায়েব মনে করে, তাই। সায়েবরা এখনও এদেশের ছোটদের কাছে আজগুবি মানুষ।
আমি খাঁটি বাঙালি। বলে কর্নেল চায়ে বিস্কুট ডোবালেন। তারপর ছোটদের মতো চুষতে থাকলেন। শাদা দাড়িতে গলিত বিস্কুট মেখে গেল। টের পেলেন না।
চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। অসংখ্য ধন্যবাদ বনবিহারীবাবু। চলি, পরে আপনাকে আবার দরকার হতেও পারে। তবে আপাতত অনেক খবর পাওয়া গেল আপনার কাছে।
বনবিহারীবাবু করযোড়ে বললেন, একটা অনুরোধ স্যার। আপনারা বিহার পুলিশকে একটু তাগিদ দেবার ব্যবস্থা করুন। আমার বিশ্বাস খুনী ধরা পড়ে যাবে।
অরিজিৎ বললেন, তা আর বলতে! এই ব্যাকগ্রাউন্ডটা আমাদের দেয়নি ওরা। দেখি, এবার কতটা এগোনো যায় নতুন অ্যাঙ্গেলে।
কর্নেল দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, বনবিহারীবাবু, আর একটু কথা।
বলুন স্যার!
প্লিজ স্যার-ট্যার বলবেন না। আমি সাধারণ মানুষ আপনার মতোই। শুধু কর্নেল বললেই আমি খুশি হই। কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে নিলেন। কথাটা হল ঊর্মি সম্পর্কে। ঊর্মিকে কেন বাইরে রেখে পড়াশুনো করানো হয়েছিল? নিশ্চয় জানেন আপনি।
বনবিহারীবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, তিন বোনই কমবেশি তেজী আর ডানপিটে মেয়ে। ঊর্মি একটা বয়স পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ডানপিটে প্রকৃতির ছিল। এখন যেমন অপু হয়েছে।
শুধু কি এটাই কারণ?
প্রৌঢ়া এটু রাগ দেখিয়ে বললেন, বলতে তোতলামি করছ কেন? গুণের ভাগ্নী সব! দেখো, আরও কী বরাতে আছে ওদের!
বনবিহারীবাবু অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। সামলে নিয়ে বললেন, আসলে ঊর্মির একার দোষ ছিল না। ওদের প্রতিবেশী ছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন ডাক্তার। তার ছেলেটা ছিল হাড়ে বজ্জাত প্রকৃতির। তারই অত্যাচারে রুদ্রদা টুকু–মানে ঊর্মিকে পাটনায় রেখে আসেন। নৈলে কবে ইলোপ করে ফেলত।
আপনি চিনতেন ডাক্তারের ছেলেকে?
খুব চিনতাম। এখন অবশ্য ভীষণ বদলে গেছে। একদিন দেখা হয়েছিল ওমাসে। প্রণাম করল পায়ে হাত দিয়ে। বলল, কোল ইন্ডিয়ায় অফিসার হয়ে কলকাতা অফিসে আছে।
কোল ইন্ডিয়ায় অফিসার? কর্নেল অরিজিতের দিকে তাকালেন।
অরিজিৎ বললেন, কী নাম বলুন তো?
ডাকনামটা মনে আছে–হিম। আসল নামটা কী যেন…পেটে আসছে, মুখে আসছে না।
কর্নেল বললেন, হিমাদ্রি রায়?
বনবিহারীবাবু নড়ে উঠলেন। হিমাদ্রিই বটে। ওর বাবার নাম ছিল ডাঃ নিরঞ্জন রায়। একমিনিট! একটা কার্ডও দিয়েছিল। দাঁড়ান, আছে নাকি খুঁজে দেখি।
বনবিহারীবাবু ভেতরে গেলেন। একটু পরে একটু কার্ড নিয়ে বেরিয়ে এলেন। হ্যাঁ–এই যে। বাসার ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই আছে। কিন্তু…
কর্নেল কার্ডটা দেখে অরিজিৎকে দিলেন। তারপর বললেন, কিন্তু কী বনবিহারীবাবু?
সে কেন এতকাল পরে খুনোখুনি করতে যাবে? সে-সব ঘটনা দশ-বারো বছর আগের ব্যাপার। তখন ঊর্মি যেমন, তেমনি হিমুরও বয়স কম ছিল। নেহাত দুষ্টুমি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে কী জানেন? আজকাল যা হয়েছে, কাউকে চেনা কঠিন।
অরিজিৎ বললেন, রুদ্ৰেন্দুবাবুর তো খুব দাপট ছিল। উনি হিমাদ্রিবাবুকে শায়েস্তা করতে পারেননি?
করেছিল বৈকি। অবস্থা এমন ঘোরালো করে তুলেছিল, ওদের বাড়ি বেচে চলে আসতে হয়েছিল সেতাপগঞ্জ থেকে।
তাহলে?
তাহলেও হিমাদ্রি খুন করবে? কিছু বলাও যায় না অবশ্য।
বনবিহারীবাবুর স্ত্রী ঝাঁঝালো স্বরে মন্তব্য করলেন, সবাই তো তোমার মতো করুণার অবতার নয়! কার পেটে কী থাকে তুমি জানো? ওঁদের কাজ ওনারা করুন। নাক গলাতে যেও না।….
গাড়িতে উঠে অরিজিৎ বললেন, পুরো ব্যাপারটা বিহারে চলে গিয়েছিল দেখে খুব মুষড়ে পড়েছিলাম। যাই হোক, কলকাতায় ফিরে এল শেষপর্যন্ত।
কর্নেল আস্তে বললেন, তোমরা কি হিমাদ্রিবাবুকে অ্যারেস্ট করবে?
কেন? আপত্তি আছে আপনা?
কর্নেল মাথাটা একটু দুলিয়ে বললেন, না। আপত্তি কিসের?..
.
নস্টালজিয়া
সুনেত্রা চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিল ডাকঘরে। ফেরার সময় গঙ্গার ধারে উঁচু বাঁধের ওপর পিচের রাস্তা ধরে আসছিল। এ সড়ক মুঙ্গের হয়ে চলে গেছে পাটনার দিকে। নিচে বর্ষার গঙ্গা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস এবার বর্ষাটা কম। বেশির ভাগ সময় আকাশ পরিষ্কার, উজ্জ্বল রোদ্দুর–হঠাৎ কখনও একটুখানি মেঘ, তারপর ঝিরঝির করে বৃষ্টি কিছুক্ষণ।
আজ সকাল থেকে অবশ্য মেঘ করে আছে। হাল্কা সাদা মেঘ, কোথাও রঙটা সামান্য ধূসর। ভরা গঙ্গায় পাল উড়িয়ে নৌকো চলেছে। স্টেশনঘাটের নিচে অসংখ্য নৌকোর ঝক। দূরে চরের ওপর হঠাৎ রোদ্দুর আবার হঠাৎ মেঘের ছায়া খেলা করছে।
কর্নেল চিঠিটা পেয়ে অবাক হয়ে যাবেন হয়তো। কিন্তু গুরুত্ব দেবেন কি? বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো ইতিমধ্যে আবার কতবার আসতেন কর্নেল! বাবা। যেমন ছিলেন, তেমনি উনিও এক পাগলা মানুষ। পাখি-প্রজাপতির পেছনে সারাদিন টোটো করে মাইলের পর মাইল ঘুরে কী পান, কে জানে! সুনেত্রা লিখেছে, ডানায় হলুদ-লাল ফুটকিওয়ালা সেই কালো প্রজাপতিগুলো ইটখোলার জঙ্গলে বেরিয়ে পড়েছে। সেবার তো একটা ধরতেই হন্যে হয়েছিলেন। এবার একশোটা ধরতে পারবেন শুধু হাত বাড়িয়ে। জালের দরকার হবে না। আর উড্ডাকের কথা বলেছিলেন। শুশানের ওখানে আশ্বত্থ গাছে একজোড়া উড্ডাক এসে জুটেছে। চিঠি পেয়েই চলে না এলে পালিয়ে যাবে। লোকের যা অত্যাচার!
ঊর্মির অদ্ভুত চিঠিটার কথা সে লেখেনি। কর্নেল এলে তাঁকে দেখাবে। ঊর্মি বেচারীও ওর বাবার মতো মারা পড়ল। ঊর্মির জন্য বড় কষ্ট হয় সুনেত্রার। ছোটবেলায় দুজনে কী কাণ্ড না করে বেড়িয়েছে। আর হিমুদা! সে এসে জুটলে চলে যেত সেই ধোয়াড়ির দহে। সাঁতার শিখতে যেত লুকিয়ে। ফেরার পথে আস্তরের জঙ্গল হয়ে আসার সময় পাকা বৈঁচি পেড়ে খেত। মালা গেঁথে নিয়ে। আসত। কথাটা আস্তর নয়, আতর। ওই জঙ্গলে মাঝেমাঝে আতরের সুগন্ধ ওঠে। একবার ভরদুপুরে সেই গন্ধ পেয়ে ঊর্মি ভয়ে কাঠ। কিছুতেই তাকে আটকানো গেল না। বাড়ি ফিরে সুনেত্রা শুনল, ঊর্মিকে পেয়ারা গাছে বেঁধে খুব পিট্টি দিয়েছে ওর বাবা।
বরদাবাবু ছিলেন অন্যরকম মানুষ। সুনেত্রার এসব দুষ্টুমির প্রশ্রয় দিতেন বরং। রুদ্রবাবুকে বলতেন দেখবে, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো না হয়। বেশি শাসন করলে একদিন মেয়ে দেখবে চম্বলের ডাকুরানী হয়ে উঠেছে।
সুনেত্রা জানে ঊর্মি যত বেপরোয়া ভাব দেখাক, সে ভেতর-ভেতর ছিল খুব ভীতু প্রকৃতির। পাটনা কলেজে পড়ার সময় মাঝেমাঝে বাড়ি আসত। তখন। অনেকটা বদলে গিয়েছিল। খুব ভদ্র আর স্মার্ট থাকার চেষ্টা করত! ইংরেজি বলত অনর্গল। সুনেত্রাও এখানকার মিশনারি স্কুলকলেজে পড়েছে। কিন্তু ইংরেজি বলতে খারাপ লাগে। বরং হিন্দিটাই বেশি বলে। বাংলা সামান্য পাড়ানো হত স্কুলে। বাবার তাগিদে বাড়িতে বাঙালি শিক্ষক রেখে শিখেছে। সেতাপগঞ্জে বাংলা স্কুলও ছিল। এখন সেটা হিন্দির চাপে প্রায় বদলে গেছে। অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট হয়ে গেছে বাংলা। এখানে আর বাঙালিদের সে-প্রভাবও নেই। অনেকে চলে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। শুধু যাদের জমিজমা আছে, কিংবা অন্য অসুবিধা, তারাই রয়ে গেছে।
সুনেত্রা রাস্তা থেকে ডাইনে ঘুরে রেলফটক পেরুনোর সময় হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেল। ফটকের ঘুপটি ঘরটার পেছনে গিয়ে মাথা বাঁচাবে ভাবল। কিন্তু এই সাতসকালে ফটকওলার ঘর আর বারান্দাজুড়ে একদঙ্গল দেহাতী মুস্কো চেহারার লোক। একটা প্রকাণ্ড কালো কলসী থেকে সাদা তাড়ি ঢেলে গিলছে আর হাসাহাসি করছে। তারা সুনেত্রার দিকে অশালীন দৃষ্টে তাকাচ্ছিল।
সুনেত্রা হনহন করে সর্বমঙ্গলার মন্দিরতলায় গিয়ে ঢুকল। ওপরে প্রকাণ্ড বটগাছ। চারদিকে নিচু পাঁচিল। খুব পুরনো ভাঙাচোরা মন্দির চত্বরের আটচালাটা এবার বর্ষার মুখে ব্যবসায়ীরা মেরামত করে দিয়েছেন। তার তলায় গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠল সুনেত্রা।
একটা থামে হেলান দিয়ে পিছন ফিরে কেউ সিগারেট টানছিল। মুখটা ঘুরিয়েছে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। গায়ে নীলচে টিশার্ট, ছাইরঙা প্যান্ট পরনে। দারুণ ঝকমকে চেহারা।
সুনেত্রা আধমিনিট পরে শুনল, তুমি বিবি না?
সুনেত্রা হেসে ফেলল। হিমুদা!
হিমাদ্রি হাসতে হাসতে বলল, মেয়েদের ঝটপট সবকিছু বদলে যায়। ইশ! তুমি তো একেবারে মহিলা হয়ে উঠেছ বিবি!
সুনেত্রা অবাক চোখে ওকে দেখছিল। বলল, কবে এসেছ তুমি। আমাদের বাড়ি যাওনি কেন? কতবছর পরে তোমাকে দেখছি বলো তো!
হিমাদ্রি বলল, পাটনা গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। কলকাতা ফেরার সময় হঠাৎ নেমে পড়েছি গতকাল। জন্মভূমি দর্শনের ইচ্ছে হল।
আশ্চর্য! উঠেছ কোথায়?
স্টেশনে রেস্টরুমে। ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে যাব ভাবছি।
যাওয়াচ্ছি! চলো, ব্যাগেজ নিয়ে আমাদের বাড়ি যাবে।
আরে! বৃষ্টির মধ্যে–একটু দাঁড়াও। বৃষ্টি ছাড়ুক, তারপর দেখা যাবে।
সুনেত্রা উঁকি মেরে আকাশ দেখল। তারপর হিমাদ্রির দিকে ঘুরে মুখ টিপে হাসল। আশ্চর্য! তুমি কাউকে দেখা না করে চলে যেতে? আজিব আদমি!
হিমাদ্রি হাসতে লাগল। এখনও খোট্টাই চাল বজায় রেখেছ, বিবি!
মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যস্মিন দেশে যদাচার। সুনেত্রা একটু গম্ভীর হল হঠাৎ। হিমুদা, তুমি জানো, টুকুর বাবা মার্ডার হয়েছে–লাস্ট এপ্রিলে?
জানি। টুকুও তো একইভাবে
ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত। তাই না? তারিখ সেই এগারো!
হিমাদ্রি আস্তে বলল, হ্যাঁ। কিছু বোঝা যায় না।
সুনেত্রা চাপা গলায় বলল, গত শীতের সময় থেকে বসন্তনিবাসে অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছিল। আমার খালি মনে হত, ওদের কিছু বিপদ ঘটবে। ঘটল।
হিমাদ্রি তাকাল। কেন মনে হত?
সুনেত্রা একটু চুপ করে থাকার পর বল, এ সবই রঘুনাথের কাণ্ড।
রঘুনাথ মানে?
রঘুয়া! সাহুজীর ছেলে। তোমার সঙ্গেও তো খাতির ছিল ওর।
ও, রঘুয়া! সে এখন কী করে? সে তো নকশাল ছিল একসময়।
কিছুদিন খুব পলিটিকস করে বেড়াচ্ছিল। টুকুর বাবার সঙ্গে জমিটমি নিয়ে খুব লড়াই করেছিল। তারপর একটা ডাকাতি কেসে ফেঁসে গিয়েছিল–আমার ধারণা, রুদ্রজ্যাঠাই এর পেছনে ছিলেন। গত পুজোর সময় শুনলাম, জেল থেকে পালিয়ে গেছে ও।
হিমাদ্রি হাসবার চেষ্টা করল। কিন্তু সে ঊর্মিকে খুন করবে কেন?
সুনেত্রা ফিসফিস করে বলল, কিছুদিন আগে টুকুর একটা চিঠি পেয়েছিলাম। লিখেছিল, ওর বরের সঙ্গে কোন হোটেলে একটা পার্টিতে গিয়ে সেখানে। রঘুনাথকে দৈখেছে। ভয় পেয়ে শরীর খারাপ করছে বলে চলে আসে টুকু।
হিমাদ্রি একটু উত্তেজিতভাবে বলল, রঘুয়াকে ঊর্মির অত ভয় পাবার কারণ কী?
সুনেত্রা তাকাল বড়ো বড়ো চোখে। তুমি জান না?
কী?
সুনেত্রা আবার ফিসফিস করে বলল, রঘুনাথের সঙ্গে টুকুর রিলেশান ছিল পাটনায় থাকার সময়। রঘুনাথও তো পাটনা কলেজে পড়ত। ওদের ঝি মনিয়াবুড়ির কাছে শুনতাম এসব। রঘুনাথ নাকি রুদ্রজেঠুকে সামনাসামনি বলেছিল টুকুর সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। রুদ্রজেঠু ওকে গুলি করতে বন্দুক বের করেছিলেন পর্যন্ত।
হিমাদ্রি বাঁকা মুখে বলল, ছেড়ে দাও! ঊর্মি ভাল মেয়ে ছিল না–সে তুমিও যেমন জান, আমিও তেমনি জানি।
বৃষ্টিটা থেমে গেছে। সুনেত্রা বলল, চলো স্টেশনে যাই হিমুদা! জিনিসপত্র নিয়ে রিকশো করে–
কিন্তু আমার যে ছুটি নেই!
সুনেত্রা নিঃসঙ্কোচে তার হাত ধরে টানল। ছোড়ো জী! বলেই সে ঘুরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। মা তোমাকে দেখলে ভীষণ খুশি হবে। প্রায়ই তোমাদের কথা বলে।
হিমাদ্রি মুখে আনন্দ আর স্বস্তিটা প্রকাশ করতে পারছিল না। রেস্টরুমে ব্যাগেজ রেখে সে আসলে মনস্থির করতে এসেছিল নির্জনে। বুঝতে পারেনি, কোথায় কার বাড়ি উঠবে, তারা কীভাবে নেবে তাকে। তার এখানে কিছুদিন থাকা দরকার। ঊর্মি বা তার বাবার খুনী কে, সেটা খুঁজে বের করার তাগিদ সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যার পর থেকে তার মাথায় ঢুকে গেছে। হয়তো আত্মরক্ষার স্বার্থেই। তার বিশ্বাস, পুলিশ তার সেদিন ওই ফ্ল্যাটে উপস্থিতির সূত্র যদি পায়ও কোনোভাবে, তার কাছে আসার আগেই সে খুনীকে ধরে ফেলতে পারবে।
সুনেত্রা অনর্গল কথা বলতে বলতে হাঁটছিল রেললাইন ধরে। হিমাদ্রি শুনছিল না। দেখছিল–মনের ভেতর আঁধারে একটা আবছা মূর্তি। তার হাতে ঠাণ্ডা নীল একটুকরো ইস্পাতের ফলা।……
.
সুটকেস এবং অ্যালসেসিয়ান
বিকেলে ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ড-এ স্প্রে হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্নেল। চ্যাটালো লম্বাটে পাতা, কিনারা ঢেউখেলানো, এই অর্কিডটার আশ্চর্য স্বভাব–যত বেলা বাড়ে, তত গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের কেন্দ্রের দিকে। সূর্যাস্তের পর ক্রমশ আবার ছড়িয়ে পড়ে। কালচে সবুজ রঙের ওপর লাল নীল হলুদ সাদা ফুটকি। ফুল ফুটবে সেই শীতে। বেগুনি রঙের থোকাথোকা ফুল। এপ্রিলে ফুল শুকিয়ে গুটি বাঁধে। হঠাৎ কখন ফেটে যায় গুটিগুলো। অর্কিডের বইতে আছে, এই হিষ্পনোলিয়া সিডারিকা অর্কিডের একটা কেন্দ্র থেকে ৪৪৭৭২০টা করে সূক্ষ্ম বীজ বাতাসে ছড়িয়ে যায়। উড়ে যায়ও বহুদূর। পথে দেবদারু গাছ পেলে তবে বীজ থেকে আবার আঁকুর গজায়। না পেলে ধ্বংস হয়ে যায় প্রাকৃতিক নিয়মে।
কর্নেল হিস্পানোলিয়া সিডারিকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কলকাতার আকাশ আজ প্রায় নির্মেঘ। তিনতলা বাড়ির এই ছাদ থেকে বহুদূর দেখা যায়। কারণ এলাকায় উঁচু বাড়ির সংখ্যা কম। গঙ্গার শিয়রে চাপচাপ সিঁদূরে মেঘ জমে আছে। সূর্য নেমে গেছে তার ভেতরে। ক্রমশ ফুটে উঠছে সেই আশ্চর্য। কনেদেখা আলো। অন্যমনস্কভাবে পকেট থেকে বাঁ হাতে ঊর্মির ফোটোটা বের করলেন কর্নেল। আবার দেখতে থাকলেন।
ফোটোটা সকালে অরিজিৎ পাঠিয়ে দিয়েছেন। মৃগাঙ্ক যেন তার ঘর থেকে ঊর্মির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছে। আগের দিন তার ফ্ল্যাটে গিয়ে কর্নেল তা লক্ষ্য করেছেন। অথচ মৃগাঙ্ক চাইছে খুনীকে ধরতেই হবে। মিনিস্টার মামাকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে। এ কি তার নিতান্তই চরিত্রগত জেদ? অর্থাৎ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কি সে এমনি একগুঁয়ে?
ওকে ঠিক বোঝা যায় না। যন্ত্রমানুষের মতো মনে হচ্ছিল। যেন ভাবাবেগহীন, অকপট, নির্বিকার। সে তত রূপবান স্বাস্থ্যবান মানুষও নয়। অথচ ঊর্মির মতো মেয়ে তার প্রেমে পড়েছিল! অসাধারণ রূপবতী ছিল ঊর্মি। অবশ্য ফোটো অনেকক্ষেত্রে প্রবঞ্চনা করে। ঊর্মির বোনদের মুখোমুখি না হলে কিছু বোঝা যাবে না।
খুনের মোটিভ মৃগাঙ্কেরও থাকা স্বাভাবিক। রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর কথায় বোঝা গেছে মৃগাঙ্কের অনুপস্থিতিতে ঊর্মির কাছে কেউ এসেছে। কিন্তু ঊর্মি নাকি তত আলাপী মেয়ে ছিল না। তাহলে কে আসতে পারে? সমস্যা হয়েছে, বাড়িটা বহুতল, ফ্ল্যাটও অসংখ্য। তাছাড়া এ ধরনের ফ্ল্যাটবাড়ি প্রত্যেকটাই নির্জন একেকটা দ্বীপের মতো–যোগাযোগবিহীন। ঊর্মির কাছে কোনো পরিচিত মহিলা আসতে পারে। আবার কেউ মৃগাঙ্কেরও খোঁজেও আসতে পারে। নিঃসংশয় হওয়া কঠিন। তবে ওর মামা বনবিহারীবাবুর কথাতেও মনে হয়েছে, ঊর্মি নিষ্কলুষ চরিত্রের মেয়ে ছিল না।
মৃগাঙ্কের কী ধারণা স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে? প্রশ্নটা সরাসরি করতে বেধেছিল কর্নেলের। কিন্তু আভাস পেয়েছেন, ধারণা ভাল ছিল না। মৃগাঙ্ক দুবার বলেছিল, ডিসিশনে ভুল হয়েছিল।
হুঁ, মৃগাঙ্কেরও একটা শক্ত মোটিভ পাওয়া যায়। কিন্তু তার শ্বশুরের হত্যাকাণ্ডটা এক্ষেত্রে জট পাকিয়ে তোলে। একই পদ্ধতিতে হত্যা। শ্বাসনালী কেটে। ডেডবডি দরজার খুব কাছেই পড়ে থাকাটাও একই হত্যাকারীর দিকে নির্দেশ করে। তারিখ সেই এগারো। কিন্তু মৃগাঙ্কের শ্বশুরঘাতী হওয়ার কোনো কারণ আছে কি?
কাজেই এভাবে পাঁচমিনিটের মধ্যে ঊর্মির স্যুটকেস চুরি যাওয়াটা বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। আর অরিজিতের কাছে জানা গেছে, মৃগাঙ্কের অ্যালিবাই খুব মজবুত। বোম্বের হোটেলের রসিদ, প্লেনের টিকিট–সবই ঠিক আছে। বোম্বে পুলিশের কাছে এও জানা গেছে, ঘটনার সময় মৃগাঙ্ক সেই হোটেলেই ছিল। সেদিন বোম্বেতেও প্রচণ্ড বৃষ্টি দিনভর রাতভর।
ষষ্ঠী একটা মোড়া দিয়ে গেছে কফি আনার সময়। স্প্রে রেখে ছবিটা হাতে নিয়ে কর্নেল মোড়ায় বসলেন। কনেদেখা আলোটা মরে যাচ্ছে দ্রুত। পুবের আকাশে খানিকটা অতর্কিত ধুসর মেঘ। রাতে বৃষ্টি নামতে পারে।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী সেই সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ অন্তর দুবার দরজায় নক করার শব্দ শুনেছিলেন। দুবারই ওঁদের অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা চ্যাঁচামেচি করেছিল। রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর কথায় সনির অপছন্দের লোক এসেছিল তিন নম্বর ফ্ল্যাটে।
খাটের তলায় পড়ে ছিল একটা দামী লাইটার।
এবং থানায় কেউ ফোন করে বলেছিল, লেকভিলার সাততলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটে একটা ডেডবডি পড়ে আছে।
হঠাৎ কর্নেলের মনে হল ঊর্মির ছবির ভেতর কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে-না, লাইটার নয়, একটা ড্যাগার। ক্রমশ একটা আদল ফুটে উঠছে। ঋজু, শক্ত একটা কাঠামো। কিন্তু মুখটা অস্পষ্ট।
চেষ্টা করেও তার মুখটা দেখতে পেলেন না কর্নেল। উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেন।
সেইসময় ষষ্ঠী সিঁড়ির মাথায় মুখ বাড়িয়ে ঘোষণা করল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েবের ফোং বাবামশাই!
ফোন নামিয়ে রেখেছিস তো?
ষষ্ঠীর দাঁত দেখা গেল। আর নজ্জা দেবেন না বাবামশাই! একবার করিছি বলে কি বারম্বার ভুল হবে?
কর্নেল হাসলেন। ওরে হতভাগা! ভুলের নিয়মই যে এই। একবার করে ফেললে-ওই যে বললি বারম্বার–হ্যাঁ, বারম্বার হয়।..
অরিজিতের গলা শোনা গেল, কর্নেল, খবর আছে।
বলো ডার্লিং!
হিমাদ্রি রায়ের আঙুলের ছাপের সঙ্গে সেই লাইটারের ছাপ মিলে গেছে।
হু–ওঁর আঙুলের ছাপ পেলে কীভাবে? অ্যারেস্ট করেছ?
না। নিখোঁজ বলতে পারেন। বাড়িতে বলে গেছেন দিল্লি যাচ্ছি অফিসের কাজে। ফিরতে দেরি হবে। অফিসে ছুটি নিয়েছেন এক মাসের। বলেছেন, স্বাস্থ্যোদ্ধারে পাহাড়ে যাচ্ছেন। যাই হোক, ওঁর গাড়িটা গ্যারেজে ছিল তালাবন্ধ। ওঁর বাড়িতে কেউ ড্রাইভ করার মতো নেই। শুধু এক বৃদ্ধা আত্মীয়া আছেন।
গাড়ি থেকে আঙুলের ছাপ পেলে?
আবার কোথায় পাব? স্টিয়ারি থেকে কয়েকটা ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হল, স্টিয়ারিঙের একখানে একটু রক্তের ছাপ ছিল। টেস্ট করা হয়েছে। আর
কর্নেল উত্তেজনা চেপে বললেন, আর কী?
মার্ডার উইপন। ইঞ্জিনের পাশে লুকোনো ছিল রক্তমাখা ছোট্ট ইঞ্চিচারেক লম্বা একটা বিদেশী ছুরি। বাঁটে অবশ্য আঙুলের ছাপ মুছে ফেলা হয়েছে।
গাড়ির ভেতর পেয়েছ ছুরিটা?
গাড়ির ভেতর। ব্লেডের মতো ধারালো ছুরি। রক্তমাখা।
কী করবে ভাবছ–মানে হিমাদ্রিবাবুর ব্যাপারে?
সর্বত্র পুলিশকে অ্যালার্ট করা হয়েছে। দেখা যাক।..অরিজিতের হাসি শোনা গেল। আপনার কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ। বনবিহারীবাবুকে ওভাবে প্রশ্ন করার ধৈর্য আমাদের ছিল না–থাকে না কোনোক্ষেত্রেই। অসংখ্য ধন্যবাদ, কর্নেল!
তাহলে তো কেস ইজ সেটলড।
অবশ্যই। সব মার্ডারের ভাইটাল পয়েন্ট যেটা–অর্থাৎ মোটিভ, সেটা হিমাদ্রি রায়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত এস্টাব্লিশড। রুদ্রেন্দুবাবুকে খুন করে সে সুযোগ খুঁজছিল__
একমিনিট, অরিজিৎ! রুদ্রেন্দুবাবুকে খুনের মোটিভ নিশ্চয় স্পষ্ট। কিন্তু ঊর্মিকে?
আবার অরিজিতের হাসি শোনা গেল।সেও আরও স্পষ্ট। আমরা কাল দুপুর থেকে একটানা কাজ করছি। সংক্ষেপে বলছি, শুনুন। মৃগাঙ্কবাবুর যে বন্ধুর বাড়ি বিয়েতে গিয়ে ঊর্মির সঙ্গে পরিচয় হয়, সে-ভদ্রলোকের নাম সুব্রত সিংহরায়। সুব্রতবাবু ওঁদের-মানে মৃগাঙ্কবাবু, ঊর্মি আর হিমাদ্রির কমন ফ্রেন্ড। ওঁর একটা ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং কারবার আছে। ওঁর এক বোনের শ্বশুরবাড়ি পাটনায়। সেই সুত্রেই ঊর্মির সঙ্গে ওঁদের চেনাজানা। হিমাদ্রিবাবুর চেনাজানা মৃগাঙ্কবাবুরই সূত্রে। তো সুব্রতবাবুর কাছে জানা গেছে, মৃগাঙ্কের সঙ্গে ঊর্মির মাখামাখিতে হিমাদ্রি ভীষণ চটে গিয়েছিল। সুব্রতবাবুকে বলেছিল, ঊর্মির চরিত্র ভাল নয়।
শুধু এই?
ওয়েট, ওয়েট! আরও আছে। সুব্রতবাবু স্বীকার করেছেন, হিমাদ্রি ও ঊর্মির মধ্যে পুরনো প্রেম ছিল। কাজেই ঊর্মি মৃগাঙ্কবাবুকে বিয়ে করায় সে প্রতিহিংসাবশে তাকে খুন করেছে। অবশ্য আমার ধারণা সুব্রত আরও কিছু ব্যাপার জানেন হিমাদ্রি সম্পর্কে। কোনো কারণে চেপে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের হাবভাব দেখেও মনে হয়েছে, কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেছেন। এর একটাই অর্থ হয়। উনি হিমাদ্রিকে ভীষণ ভয় করেন।
কিন্তু
কিন্তু কিসের? দেখুন না, শিগগির আমরা দেশের সব ন্যাশনাল ডেলিতে হিমাদ্রির ছবি ছাপিয়ে ওয়ান্টেড বলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি।
ডার্লিং! হিমাদ্রিকে তাহলে আর খুঁজে পাবে না।
পুরস্কার ঘোষণা থাকবে। পাবলিক হেল্প করবে টাকার লোভে।
যদি হিমাদ্রি নির্দোষ হয়, ভেবে দেখেছ কি ওর কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে?
আশ্চর্য, কর্নেল! কেস তো সেটলড।
হুঁ, ইট অ্যাপিয়ার্স অ্যাজ সেটলড। গাড়ির ভেতর মার্ডার উইপন, স্টিয়ারিঙে রক্তের ছাপ, সিগারেট লাইটারে আঙুলের ছাপ। কিন্তু রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বলেছেন, দুজন লোক এসেছিল, মৃগাঙ্কের ফ্ল্যাটে। কিছুক্ষণ অন্তর দুবার নক করার শব্দ শুনেছিলেন। তাছাড়া ঊর্মির সুটকেস চুরি গেল। অরিজিৎ, কেস কি সত্যি সেটলড?
ধরুন, হিমাদ্রি খুন করে চলে যাবার পর মৃগাঙ্কবাবুর কোনো বন্ধু বা কোনো চেনা লোক মৃগাঙ্কবাবুর খোঁজেই এসেছিলেন। সাড়া না পেয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।
কিন্তু স্যুটকেস কেন চুরি গেল? কে চুরি করল? আর লোকাল থানায় ফোন করে খুনের কথা জানিয়েছিল কে?
হিমাদ্রি নিজে অথবা কোনো ক্রিমিন্যালকে দিয়ে চুরি করিয়েছে। স্যুটকেসে নিশ্চয় পুরনো প্রেমপত্র ছিল। ঊর্মির সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রমাণ হয়ে যাবে ভেবেই একাজ সে করেছে। আর ফোনের ব্যাপারটা তদন্ত করা হচ্ছে।
তাহলেও হুট করে বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত হবে না, অরিজিৎ।
ভীষণ চাপ আসছে রাইটার্স থেকে। সামলাতে পারছি না কর্নেল! বিজ্ঞাপনটা ছাপা হলে বোঝাতে পারব, আমরা চুপচাপ বসে নেই।
বিহার পুলিশ থেকে আশা করি রিপোর্ট পেয়ে গেছ?
কিছুক্ষণ আগে পেয়েছি। তবে হিমাদ্রির নামগন্ধ নেই। সেতাপগঞ্জের জনৈক রঘুনাথ সাহুর সঙ্গে ঊর্মির বাবার বিবাদের কথা আছে। রঘুনাথ ছিল নকশাল। জমি দখল করে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল। ডাকাতি খুনোখুনি আর জেলপালানোর দায়ে তার নামে একডজন কেস ঝুলছে। লোকাল পুলিশ রুদ্ৰেন্দু রায়চৌধুরীর মার্ডারের জন্য রঘুনাথের নামে এফ আই আর করেছে।
রঘুনাথ জেল থেকে পালিয়েছিল?
পাটনা জেল থেকে মাসচার আগে পালিয়ে গেছে।
একটা শ্বাস ছেড়ে কর্নেল বললেন, আচ্ছা, ছাড়ি ডার্লিং।
আপনি যাচ্ছেন নাকি সেতাপগঞ্জে?
দেখা যাক। বলে কর্নেল ফোন রেখে দিলেন।
একটু পরে ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে ঊর্মির ছবিটা আবার বের করলেন। ছবির ভেতর হিমাদ্রির আদল–নাকি অন্য কেউ, মুখটা আগের মতো আবছা। কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। অথচ হিমাদ্রি ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল, তা নিশ্চিত। কিন্তু আরেকজনও নক করেছিল দরজায়।
কে আগে ঢুকেছিল, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। লাইটারটা যখন নিশ্চিত হিমাদ্রির, তখন সে ও ঘরে সিগারেট খেয়েছিল। কথা হচ্ছে, তখন ঊর্মি জীবিত, না মৃত? ঊর্মির লাস পাওয়া যায় দরজার কাছে এবং লাইটারটা বেডরুমের মেঝেয় খাটের নিচে। ঊর্মিকে দরজার কাছে খুন করে তার বেডরুমে গিয়ে সিগারেট খাওয়ানাঃ। যত নার্ভই থাক, এটা পাগলামি স্রেফ। কাজেই জীবিত ঊর্মির সামনেই সিগারেট খেয়েছিল হিমাদ্রি। সেক্সের ব্যাপারটাও এসে যায় এ পরিবেশে। মৃগাঙ্ক সুদূর বোম্বেতে।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুটটা কামড়ানো। অভ্যাসমতো শাদা দাড়িতে আঙুলের চিরুনি টানতে থাকলেন।
অনুমান নয়, নিশ্চিত তথ্য থেকে ডিডাকশান করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো যায়। এবং তা থেকে এও বেরিয়ে আসে যে হিমাদ্রিই যদি তারপর ঊর্মিকে খুন করে থাকে (ধরা যাক, বেরিয়ে আসার সময় দরজার কাছে গিয়েই তাকে ধরে তার গলায় ড্যাগার চালায়), তাহলে লাইটারের খোঁজে সে ফিরে যেতে পারে ওই ফ্ল্যাটে। কিন্তু তাহলে আবার সে দরজায় নক করবে কেন?সে তো জানে দরজা খোলা আছে!
কাজেই লাইটারের খোঁজে সে দ্বিতীয়বার যায়নি। আরেকজন এসে দরজায় নক করেছিল। দরজা ভেতর থেকে লক করা নেই দেখে সে দরজা খুলেছিল। তারপর ঊর্মির ডেডবডি দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই কি ফোন করেছিল থানায়? কে সে? অরিজিৎ বলল, মৃগাঙ্কের কোনো বন্ধু বা চেনা লোক দ্বিতীয়বার দরজায় নক করে থাকবে। হ্যাঁ, সেও স্বাভাবিক। পুলিশ এভাবেই কেসটা দাঁড় করাচ্ছে। হিমাদ্রির বাঁচার উপায় নেই। ঊর্মির সঙ্গে তার পুরাতন প্রেম যখন, তখন তার সাহায্যে ওদের ফ্ল্যাটের চাবির একটা ডুপ্লিকেট বানিয়ে নেওয়া তার পক্ষে কঠিন ছিল না। স্যুটকেসে প্রেমপত্র ছিল অনেকদিনের। হিমাদ্রি তাই ওটা নিজে না হলেও কারুর সাহায্যে চুরি করিয়েছে। উদ্দেশ্য, কোনো সম্পর্ক থাকার প্রমাণ লোপ। নাঃ, হিমাদ্রি বাঁধা পড়ে গেছে। তাকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে একেবারে।
আর মোটিভও স্পষ্ট, মজবুত। অথচ…
কর্নেল চোখ খুললেন। হিমাদ্রির পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার। আরও অনেক তথ্য চাই। তার চরিত্র, তার অতীতকাল, তার সাম্প্রতিক গতিবিধি। কারণ কোথায় যেন হিসেবে মিলছে না। কী একটা গণ্ডগোল থেকে যাচ্ছে।
কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোন তুললেন। সাতটা বাজে। যদি পাওয়া যায় মৃগাঙ্ককে। ফ্ল্যাটে না থাকলে অফিসে। অফিসে নাকি কোনো-কোনোদিন সন্ধ্যার পরও থাকে।
প্রথমে ওর ফ্ল্যাটে রিং করলেন। পাওয়া গেল মৃগাঙ্ককে। কর্নেল বললেন, একটু বিরক্ত করছি, মৃগাঙ্কবাবু!
না, না। আমিই আপনাকে রিং করব ভাবছিলাম!
তাই বুঝি? তাহলে আপনিই আগে বলুন।
সেই স্যুটকেসটা পাওয়া গেছে। মিঃ লাহিড়ীকে জানিয়ে দেবেন প্লিজ।
পাওয়া গেছে? কোথায়?
নিচের গ্যারেজে দারোয়ান কুড়িয়ে পেয়ে কাল সকালেই আমাদের কোঅপারেটিভ অফিসে জমা দিয়েছিল। ওরা তো জানত না ব্যাপারটা। হঠাৎ কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানিয়েছিল। ওরা অবশ্য সব ফ্ল্যাটেই ফোন করেছিল। আমি নিয়ে এসেছি।
কী অবস্থায় পেলেন?
তালা ভাঙা। ভেতরে ঊর্মির ছোটবেলার খেলনা, পুতুলের পোশাক, এইসব হাবিজাবি জিনিসপত্র আছে। কিছু ইমপর্ট্যান্ট জিনিস নিশ্চয় ছিল। নৈলে চুরি যাবে কেন?
তেমন কিছু নেই স্যুটকেসে?
না।
মৃগাঙ্কের ঘরে কেউ আছে যেন। আবছা শোনা গেল, কাকে ধমক দিয়ে কী বলল। কর্নেল বললেন, হ্যালো! হ্যালো!
আছি বলুন কর্নেল!
একটা কথা জানা দরকার। হিমাদ্রিবাবুর সঙ্গে আপনার কীভাবে আলাপ?
আমার একটা ছোটখাট কারখানাও আছে। কোল-ডাস্ট দরকার হয়। কোল ইন্ডিয়া থেকে কিনি। সেই সূত্রে হিমাদ্রির সঙ্গে আলাপ।
আপনি শুনেছেন কি যে সিগারেট লাইটারটা হিমাদ্রিবাবুর?
কয়েক সেকেন্ড পরে মৃগাঙ্ক আস্তে বলল, আমি জানতাম।
জানতেন?
মানে জাস্ট অনুমান। তাছাড়া সুব্রত সিংহরায় নামে আমার এক বন্ধু আছে, তার বোন পাটনায় থাকে। সে আমাকে হিমাদ্রি আর ঊর্মির কিছু ঘটনা বলেছিল। আমি পাত্তা দিইনি। আসলে তখন আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
শুনুন। হিমাদ্রিই খুনী বলে পুলিশ সিওর হয়েছে। অরিজিৎ আপনাকে জানাবে সব। ইতিমধ্যে একটা কথা বলতে চাই আপনাকে।
বলুন!
হিমাদ্রি ফেরার হয়েছে। তাকে ধরার জন্য পুলিশ কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। শিগগির। পুলিশের ধারণা, এ সব ক্ষেত্রে পুরস্কার ঘোষণা না করা হলে পাবলিক হেল্প পাওয়া যাবে না। আপনি কি–
আমাকে কী করতে হবে বলুন, করব।
প্রাইজমানি গভর্নমেন্ট যদি না দেয়, আপনি দেবেন কি?
নিশ্চয় দেব। কেন দেব না?
এক সেকেন্ড! ছাড়বেন না প্লিজ! আর একটা কথা আছে।
বলুন।
কথাটা আপনার প্রতিবেশী রঞ্জনবাবুর কুকুর সম্পর্কে।
কুকুর সম্পর্কে? কী ব্যাপার বলুন তো?
কুকুরটা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
কুকুর-টুকুর নিয়ে আমি ভাবি না। আপনার প্রশ্নটা ভারি অদ্ভুত!
ভুলে যাবেন না মৃগাঙ্কবাবু! কুকুরটা সেদিন যথেষ্ট
ড্যাম ইট! হোয়াট হেল আর ইউ টকিং অ্যাবাউট?
আপনি কি কখনও কুকুর পুষেছেন মৃগাঙ্কবাবু?
নেভার। আই হেট দ্যাট ব্লাডি অ্যানিম্যাল! কিন্তু হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন?
রঞ্জনবাবুর অ্যালসেসিয়ানটার ভয়েই নাকি আপনাদের ফ্লোরের এক নম্বর ফ্ল্যাটের সাউথ ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক ফ্ল্যাট বেচতে চাইছেন!
আমি জানি না। খবর রাখি না।
আশাকরি কুকুরটা আপনার কোনো প্রব্লেম বাধায়নি কখনও?
কিন্তু কেন এসব কথা–
শুনুন, আমি একনম্বর ফ্ল্যাটটা কিনতে চাই। আমারও কুকুরভীতি প্রচণ্ড। তাই জিগ্যেস করছি।
তাই বলুন! মৃগাঙ্কের হাসি শোনা গেল। রঞ্জনবাবুর কুকুরটা অনেককেই পছন্দ করে না দেখেছি। আমাকেও করে না। আপনাকে করবে কি না বলা কঠিন। প্রথম-প্রথম তো ছাড়া থাকত। অনেকে কমপ্লেন করার পর আজকাল বেঁধে রাখে। একবার আমার বুকে দুই পা তুলে গলা কামড়াতে এসেছিল। ভেরি ন্যাস্টি ডগ!
ছাড়ছি মৃগাঙ্কবাবু!
কিছু মনে করবেন না যেন। ইদানীং আমার মেজাজটা ভাল যাচ্ছে না।
জানি। থ্যাঙ্কস মৃগাঙ্কবাবু!
ফোন রেখে কর্নেল হাসতে লাগলেন। ষষ্ঠী কাপ নিতে এসে বলল, হাসছেন কেন বাবামশাই?
তোকে দেখে।
ষষ্ঠী নিজেকে দেখার চেষ্টা করে ক্ষুব্ধ মুখে বলল, আমি কি সার্কেসবাজির কেলাউন সেজেছি নাকি? এই গেঞ্জিটা তো আপনিই কিনে এনেছেন! হাসলে পরে খুলে রেখে দেব।
কর্নেল তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে বললেন, তুই যদি ওটা খুলে রাখিস, আমি নিচের ফ্ল্যাটের মিসেস ডিসুজার কুকুরটা এনে তোর পেছনে লেলিয়ে দেব হতভাগা!
ষষ্ঠী আঁতকে উঠে চলে গেল। মেমসায়েবের কুকুরটা তার গাল চাটতে আসে। ছ্যা ছ্যা।
কর্নেল আবার চোখ বুজলেন। স্যুটকেসটা তাহলে পাওয়া গেছে। কী ছিল ওর মধ্যে? ছোটবেলার খেলনা বা তুচ্ছ অনেক জিনিস কেউ কেউ যত্ন করে রেখে দেয়। মেয়েদের এ স্বভাব আছে। কর্নেলের মা তার বাচ্চা বয়সের পোশাকগুলো রেখে দিয়েছিলেন। পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা যেন বেশি স্মৃতি অনুগামী। ঊর্মির স্যুটকেসের জিনিসগুলো একবার দেখলে হত। মৃগাঙ্কের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, কর্নেলের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ হতেও পারে। কিছু বলা যায় না।
হুঁ–সেতাপগঞ্জ যাবেন। তার আগে কিছু জরুরি কাজ সেরে নেওয়া দরকার।
বাইরের ঘরের ওদিকে কলিং বেল বাজল। একটু পরে ষষ্ঠী এসে বলল, এক ভদ্রলোক এয়েছেন।
নিয়ে আয়।
যিনি ঢুকলেন, তার পরনে ঢোলা প্যান্ট-শার্ট, মাথায় কর্নেলের চেয়েও চওড়া টাক। বয়স বোঝা কঠিন। রোগা চ্যাঙা চেহারা। নাকে নস্যির ছোপ। নমস্কার করে বসে পড়লেন সোফায়…
.
গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার
কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক খ্যাখ্যা করে হেসে বললেন, চিনতে পারলেন না? নাইনটিন সেভেনটি থ্রির অক্টোবরে মাকড়দহে আলাপ–সেই যে হাবলবাবুর ফার্মে যাঁড়ের কেস! কে কে হালদার। চিনেছেন তো এবার?
কর্নেল হাসলেন। চিনেছি। কেমন আছেন হালদারবাবু? কোথায় আছেন এখন?
কৃতান্তকুমার হালদার চোখে ঝিলিক তুলে বললেন, আপনার মনে পড়তে পারে কর্নেল স্যার, আপনাকে বলেছিলাম, রিটায়ার করলেই প্রাইভেট এজেন্সি করব। করেছি। গণেশ এভেনিউতে আমার শ্যালক টি কে রায়ের লিগ্যাল কনসাল্টিং এজেন্সি। সেখানেই একটা রুম পেয়েছি। ওদিকে গেলে সাইনবোর্ড চোখে পড়বে, হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি।
হালদারবাবু জাঁদরেল পুলিশ সি আই ছিলেন বটে! কর্নেল মুখে প্রশংসা ফুটিয়ে বললেন, বাঃ! খুব ভালো! খাসা! তো কেস-টেস কেমন পাচ্ছেন বলুন?
পাচ্ছি। বেশিরভাগই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনসার্নের। হালদারবাবু পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করলেন। শ্যালক বিরাট লইয়ার। সেদিক থেকেও সুবিধে হয়েছে। বলে একটিপ নস্যি নাকে খুঁজে হাঁ করে রইলেন। হাঁচির আশা করছিলেন। এল না। তখন ফাঁচ করে হেসে বললেন, আপনাকে কাল সকাল দশটা নাগাদ লেকভিলার ফুটপাতে হঠাৎ দেখতে পেলাম। ডি সি ডি ডির সঙ্গে শাদা ফিয়াটে উঠলেন। নেমে যেতে যেতে আপনারা ততক্ষণে মোড় পেরিয়ে গেছেন।
আপনি লেকপ্লেসে থাকেন বুঝি?
থাকি মানে? লেকভিলারই পাঁচতলায় একনম্বর ফ্ল্যাটটা কিনেছি। বছরখানেক হয়ে গেল প্রায়।
কর্নেল একটু নড়ে বসলেন। আর সব খবর বলুন!
হালদারবাবু গলা চেপে বললেন, বলব বলেই আসা। আপনাকে কাল দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেছি, ও কেসের অবস্থা জটিল! তবে একটা কথা আগে বলে নিই কর্নেল স্যার, আমি বরাবর গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি মেনে চলি।
বেশ তো!
মৃগাঙ্কবাবুকে আমি বলেছিলাম কেসটা আমাকে দিন। আমি তো এর ব্যাকগ্রাউন্ড সবই জানি। ভদ্রলোক গাঁইগুই করতে লাগলেন। পুলিশের ওপরমহল কেস নিয়েছে। প্রাইভেট থেকে নাকগলানো ওরা পছন্দ করবে না। শুনে বুঝলেন, আমার রাগ হল। আসলে পয়সা খরচ করতে চায় না। হাড়কেপ্পন। বদমেজাজী লোক একেবারে। মিনিস্টার মামার দৌলতে পয়সার মুখ দেখেছে! গুমোরে মাটিতে পা পড়ে না। অথচ দেখুন, আগের মাসে নামমাত্র ফিতে আমি ওর কাজ করেছি। আমি হোল বাকগ্রাউন্ড জানি।
কর্নেল মুখে নিরাসক্তি ফুটিয়ে বললেন, হু, ভদ্রলোক কেমন যেন।
কেমন মানে কী? ধুরন্ধর হাড়ে হারামজাদা। কাউকে বিশ্বাস করে না। কাজ করিয়ে পয়সা না দিতে পারলে বেঁচে যায়। দেখুন না, মাত্র পঞ্চাশটা টাকায় ওর ওয়াইফ সম্পর্কে একগাদা ইনফরমেশন সাপ্লাই করেছিলাম। ওনলি ফিফটি রুপিজ। এদিকে আমার ট্যাক্সিভাড়াই গেছে সত্তর-পঁচাত্তর টাকা। বলবেন, কেন তাহলে কেস নিলেন? নিলাম। নেশা। এই আপনার যেমন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
কৃতান্ত হালদার আবার খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগলেন। কর্নেল বললেন, হা-মৃগাঙ্কবাবুকে সন্দেহপ্রবণ লোক মনে হয়েছে। অথচ নাকি প্রেম করে–
হাতি! হাতি! বুড়ো আঙুল দেখালেন কৃতান্ত হালদার। বিহারের মেয়ে মশাই–সাতঘাটে জল খাওয়া চরিত্র। বেশিদিন আমার লাগেনি। কয়েকদিনেই নাড়িনক্ষত্র জেনে গিয়েছিলাম। কলকাতায় পড়ার ছলে চলে আসার কারণ কী জানেন? জেলপালানো এক ডাকুর সঙ্গে প্রেম ছিল। সে মেয়েটার পেছনে। কলকাতায় ধাওয়া করেছিল। তার ভয়েই মিনিস্টারের ভাগ্নের ঘরে এসে ঢুকেছিল। মিঃ লাহিড়ীকে জিগ্যেস করবেন, সব জানতে পারবেন। বলে চোখ নাচালেন হালদারবাবু। পারবেন কী বলছি, আপনার কি তার অজানা আছে? কেস যখন নিয়েছেন।
উত্তেজনা চেপে কর্নেল মৃদু হাসলেন। স্ত্রীর গতিবিধি জানতে তাহলে আপনার সাহায্য নিয়েছিলেন মৃগাঙ্কবাবু?
হ্যাঁঃ। কৃতান্ত হালদার বাঁকা মুখে বললেন। আমার আরও একটা সুবিধা একই বাড়িতে থাকি। মৃগাঙ্কবাবু যখন থাকেন না, তখন কে আসছে-যাচ্ছে ওঁর বউয়ের কাছে, সেটা নজর রাখা কঠিন ছিল না। শুধু একটা ঝামেলা ছিল ওই ফ্লোরে পাশের ফ্ল্যাটে একটা বজ্জাত অ্যালসেসিয়ান আছে। প্রায়ই ছাড়া থাকত কুকুরটা শেষে মৃগাঙ্কবাবুকে বললাম, কুকুরটার এগেনস্টে কমপ্লেন করুন। নৈলে অসুবিধে হচ্ছে। তখন কুকুরটাকে আর ছাড়া হত না।
কারা আসত ঊর্মির কাছে?
হালদারবাবু ফাঁচ করে হেসে বললেন, গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি কর্নেল স্যার!
বেশ তো। আমি যা জানি বলব আপনাকে।
সে তো বলবেনই। আমার ক্লেইমটা একটু অন্যরকম।
বলুন।
আমাকে আপনার অ্যাসিস্টেন্ট করতে হবে ননঅফিসিয়ালি। বলবেন, এতে আমার কী লাভ? আছে। কাগজে আপনার সঙ্গে আমারও নাম বেরুবে। তাতে আমার এজেন্সির সুনাম হবে। তাছাড়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আমার প্রাক্তন কলিগরা বলুন, কিংবা অন্যান্য অফিসাররা যারা আছেন, তারা ভবিষ্যৎ কেসে দরকার হলে আমাকে হেল্প করবেন।
এখন করেন না বুঝি?
বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন কৃতান্ত হালদার। সব চাকরিতে এ-রকম। রিটায়ার করলে আর কেউ তাকে মনেও রাখে না, পাত্তাও দেয় না। বরং বেঁগড়বাজি করে। তার ওপর আমাদের দেশের পুলিশকে তো জানেন। প্রাইভেটকে নাক গলাতে দেখলেই তেড়ে আসে ডাণ্ডা উঁচিয়ে। আপনার কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। আপনি স্যার ভি আই পি লোক। ইন্টারন্যাশান্যালি ফেমাস।
কর্নেল হাসি চেপে বললেন, বেশ তো। আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। ওদের জানিয়ে দেব, যাতে আপনার কোনো অসুবিধে না ঘটায় কেউ।
কৃতান্ত হালদার আর এক টিপ নস্যি নিতে যাচ্ছিলেন, ষষ্ঠী চা নিয়ে এল। এতক্ষণে বাইরে বৃষ্টির শব্দ। চায়ে চুমুক দিয়ে হালদারবাবু বললেন, এ জন্যই আসা। জানতাম, আপনি ফেলে দেবেন না। উরে বাস! মাকড়দহ ফার্মে ষাঁড়ের কেস–মানে, গোঁজ মেরে মার্ডার করে কেমন যাঁড় বেচারার ওপর দোষ। চাপিয়েছিল বলুন, আমি কী রকম কোঅপারেশন করেছিলাম আর আপনিও আমার অ্যাডভাইস নিয়ে শেষপর্যন্ত–উরে বাস! মনে পড়ে আর এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। এমনি বর্ষার রাত। খড়ের গাদার পাশে ওত পেতে আছি। আসামী রক্তমাখা গোঁজটা খড়ের ভেতর থেকে সরাতে এসেছে। অন্ধকারে খড় খড় শব্দ…
ঊর্মির কাছে কারা যাতায়াত করত হালদারবাবু?
গলা চেপে কৃতান্ত হালদার বললেন, একজন রেগুলার যেত। তাকে ফলো করে নাম-ধাম পেয়েছিলাম। মৃগাঙ্কবাবুরই বন্ধু ভদ্রলোক। সুব্রত সিংহরায় নাম। ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং কনসার্নের মালিক।
মৃগাঙ্কবাবুকে বলেছিলেন সে কথা?
বলতে বাধ্য। প্রফেশনাল এথিকস বলে কথা। নুন খেয়েছি যে জন্য।
আর কেউ?
দুদিন এসেছিল এক নন-বেঙ্গলি ভদ্রলোক। তখন জানতাম না, ওই ব্যাটা পাটনা জেল ভেঙে ফেরার হয়েছে। অনেকদিন পরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে একজন প্রাক্তন কলিগের সূত্রে সব জেনেছিলাম। কিন্তু তখন সে বেপাত্তা।
কী নাম বলুন তো?
রঘুনাথ সাহু। কৃতান্তবাবু ফের গলা চাপলেন। এসব ক্ষেত্রে রিস্ক নিতেই হয়েছে। সাততলার একনম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন মিঃ নায়ার। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে। দাবাখেলার ঝোঁক আছে ভদ্রলোকের। মাঝে মাঝে এ ফ্ল্যাটে এসে থাকেন। বিপত্নীক বড়লোক মানুষ। যাই হোক, ওঁর ফ্ল্যাটটা থেকে নজর রাখার সুবিধে হত। নায়ার তার ফ্ল্যাটের চাবি আমার কাছে রেখে যেতেন। আমি ডাকুব্যাটার ছবি তুলে নিয়েছিলাম। বুঝলেন না? ক্লায়েন্টকে উইথ এভিডেন্স প্রডিউস করতে হবে সব ইনফরমেশান!
কৃতান্ত হালদার পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। খামের ভেতর একগাদা ফোটো।…এই দেখুন রঘুডাকাত! দেখলেই মনে হয় না মার্ডারার? আর এই দেখুন দরজায় ওয়েলকাম করছেন মৃগাঙ্কবাবুর ওয়াইফ। ইনি হলেন সুব্রত সিংহরায়। এবার এগুলো দেখুন, পার্কস্ট্রিটের একটা বারে তোলা। মুখোমুখি বসে বিয়ার খাচ্ছে-চেনেন কি একে? হিমাদ্রি রায়-কোল ইন্ডিয়ার অফিসার। খুব রিস্ক নিয়ে ছবিগুলো তুলতে হয়েছে। আলো কম বলে একটু আবছা হয়েছে। কিন্তু চেনা যায়।
কর্নেল প্রশংসা করে বললেন, ওয়েলডান মিঃ হালদার!
কৃতান্ত হালদার বিগলিত হয়ে বললেন, একটা করে কপি আপনি রাখুন। দরকার হতে পারে।
মৃগাঙ্কবাবুকে এককপি করে দিয়েছেন নিশ্চয়?
দিতে হয়েছে। বিলের টাকা এখনও পাওনা। ভাবতে পারেন লোকটা কী কঞ্জুস! বলে বাকি ছবি খামে ভরে কৃতান্ত হালদার সোজা হয়ে বসলেন। এবার আমাকে কিছু ইনফর্মেশান দিন স্যার! যাতে আমি ঠিক রাস্তায় এগুতে পারি।
আপনি জানেন কি মৃগাঙ্কবাবুর ফ্ল্যাট থেকে কাল সকালে ওঁর স্ত্রীর একটা স্যুটকেস চুরি গিয়েছিল?
খ্যা খ্যা করে হেসে উঠলেন কৃতান্ত হালদার। জানি মানে? প্রচণ্ড জানি। স্যুটকেসটা পাওয়া গেছে।
আরও হেসে হালদারবাবু বললেন, যাবে না কেন? কোনো ক্লু না পেলে খামোকা ওটা গাপ করে লাভটা কী? খালি মেয়েলি কারবার। খেলনা, হাবিজাবি, পুঁতির মালা, একগাদা কুঁচফল।
কর্নেল হাসলেন। বুঝলাম, আপনারই কীর্তি! চাবি পেলেন কোথায়?
এ লাইনে রিস্ক না নিয়ে উপায় থাকে না। আপনি তো সবই জানেন। দরজার লকের ছাঁচ নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি করিয়েছি সম্প্রতি। দু নম্বরের কুকুর হারামজাদাটার জ্বালায় সে এক প্রাণান্তকর অবস্থা। তাও তো ভেতরে বাঁধা ছিল। আর ওই নাকগলানে ভদ্রমহিলা! কুকুর চাঁচালেই দরজা খোলেন। অমনি ভালমানুষ সেজে নায়ারের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ি।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী?
আজ্ঞে দিনদুই আগে দরজা খুলেছি, দেখি দু নম্বরের দরজার ফাঁকে মুখ। চোখ পড়তেই বললাম, পুলিশ অফিসার।
মৃগাঙ্কবাবুর ফ্ল্যাটে কোনো ক্লু পেয়েছেন কি মিঃ হালদার?
হালদারবাবু থেকে মিঃ হালদার হয়ে কৃতান্তকুমারের মুখে আত্মবিশ্বাস ও গর্বের ভাব ফুটে উঠল। বললেন, ঠিক কু কি না জানি না, ড্রেসিং টেবিলের তলায় দলাপাকানো ছেঁড়াখোঁড়া একটা টেলিগ্রাম পড়ে ছিল। আজ নাইনটিনথ– ওটা পেয়েছি ফিফটিনহ্ জুলাই। মৃগাঙ্কবাবুর স্ত্রী মার্ডার হয়েছে ইলেভেনথ জুলাই। তো টেলিগ্রামটা জোড়াতাড়া দিয়ে খানিকটা উদ্ধার করেছি। এই দেখুন।
শাদা কাগজে আঁটা কয়েকটুকরো হলদে কাগজ। টেলিগ্রামই বটে। REACHED….. CARGO NOT…. ADVISE…. HEMANTA HOTEL DELIGHT BOMBAY.
কৃতান্ত হালদার বললেন, লোকাল পোস্টঅফিসের নাম ঘেঁড়া। রিসিভিং ডেটটা দেখুন। শুধু ওয়াই এইটুকু আছে। আমার ধারণা জুলাই–মানে এমাসেরই। আমি মৃগাঙ্কবাবুর অফিস-এরিয়ার পোস্টাপিসে আর আমাদের লেক প্লেস এরিয়ার পোস্টাপিসে খোঁজ নিতে গিয়ে হন্যে হয়েছি। একাজ আপনি পুলিশ দিয়ে পারবেন। বুঝলেন না? পুলিশের ইউনিফর্ম দেখলে সবাই জব্দ। এতদিনে হাড়ে হাড়ে সেটা টের পাচ্ছি। ওই যে বলে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা
হেমন্ত? কর্নেল আস্তে বললেন।
মৃগাঙ্কবাবুর এক কর্মচারী। হেমন্ত বোস।
কিন্তু টেলিগ্রামটাকে ক্লু ভাবছেন কেন?
অমন ছেঁড়া অবস্থায় ড্রেসিং টেবিলের তলায় পড়ে থাকার জন্য।
কারবারী লোক। এসব টেলিগ্রাম আসতেই পারে। অন্যমনস্কভাবে ছিঁড়ে ফেলতেও পারেন।
তাই। ফ্যানের হাওয়ায় কিছু টুকরো উড়ে গিয়ে ওখানে আটকেছিল। কৃতান্ত হালদার নস্যি নিলেন। তারপর বিকট হেঁচে বললেন ফের, তাহলেও ওই যে বলে, যেখানে দেখিবে ছাই, পাইলে পাইতে পারো-হেঁ হেঁ, আপনাকে আর কী জ্ঞান দেব স্যার? আপনি হলেন এ লাইনে রাজা–সম্রাটও বলা যায়।
বৃষ্টিটা বেড়েছে। রাস্তায় জল জমবে। কর্নেল উঠে গিয়ে জানালায় বৃষ্টি দেখে এলেন। কৃতান্ত হালদার আবার হাঁচার জন্য হাঁ করে আছেন তো আছেন। ইজিচেয়ারে বসে কর্নেল ডাকলেন, মিঃ হালদার!
ব-চ্ছোঁ! হেঁচে নোংরা রুমালে নাম মুছে কৃতান্তবাবু রিপিট করলেন, বলুন স্যার!
ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
কৃতান্ত হালদার বেজার মুখে বললেন, ঠিক ওইদিনটাতে আমি অ্যাবসেন্ট। কুগ্রহ ছাড়া কী বলব? দমদমে দিদির নাতনির বিয়ে। না থাকলেই নয়। টুয়েলফথ দুপুর নাগাদ ফিরে শুনি ওই সাংঘাতিক কাণ্ড। আমি থাকলে কালপ্রিট হাতেনাতে ধরা পড়ত।
কাকে সন্দেহ হয় আপনার?
গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার এককথায় বললেন, মৃগাঙ্কবাবুই মার্ডারার।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কেন?
তাহলে ওই যে বলে, সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসি হয়, কর্নেলস্যার! ব্যাকগ্রাউন্ডটা তো সবই শুনলেন। বউয়ের ওপর সন্দেহ। ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্যে বউয়ের গোপন গতিবিধি ইত্যাদি খবর যোগাড়। মোটিভ ভেরি ক্লিয়ার। পুলিশ ছিলাম, পুলিশের কারবার তো জানি। তাতে মিনিস্টারের ভাগ্নে। বাকিটা বুঝে নিন। ওই যে বলে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে–তাই করবে। আমার গ্রিভ্যান্সটা তো এখানেই।
কিন্তু আপনি জানেন কি মৃগাঙ্কবাবুর শ্বশুরও মাসতিনেক আগে বিহারের সেতাপগঞ্জের বাড়িতে একইভাবে খুন হয়েছেন? দরজার কাছেই ডেডবডি ছিল শ্বাসনালী কাটা।
কৃতান্ত হালদার নড়ে বসলেন। উরে ব্বাস! তাহলে তো মোটিভ আরও স্ট্রং হল স্যার!
কেন?
শ্বশুরের ওপর ভীষণ রাগ মৃগাঙ্কবাবুর। খুলে বলি, আমার এজেন্সিকে কেউ কাজ দিলে আগে কিছু ইনফরমেশন চাইবই চাইব। ব্যাকগ্রাউন্ড না জেনে তো এগুনো যায় না। মৃগাঙ্কবাবু সব বলেছিলেন। শ্বশুর ওঁকে নাকি ইনসাল্ট করেছেন। কথা বলেননি। তবে–আশ্চর্য তো! শ্বশুর খুন হওয়ার কথাটা কেন চেপে গেলেন ভদ্রলোক? কৃতান্তবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। চেপে যাওয়াতেই মোটিভ স্ট্রার হলো। আমার কথায় তো ডি ডির কোনো অফিসার কান দেবে না–বরং ঠাট্টাবিদ্রূপ করবে। সবসময় করে। রামগোয়েন্দা নাম দিয়েছে আমার জানেন? ইনসাল্টিং!
কর্নেল সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন, যাতে আপনি কোঅপারেশান পান, চেষ্টা করব। একপেয়ালা কফি খাবেন মিঃ হালদার?
মন্দ হয় না। বৃষ্টিবাদলার রাতে কফি খেতে ভালই লাগবে আশা করি। তবে একটু বেশি দুধ দিতে বলুন। অনিদ্রার রোগী। সারারাত ঘুম হয় না। তিরিশ বছর পুলিশলাইনের অভিশাপ, বুঝলেন না?
কর্নেল ষষ্ঠীকে ডেকে কফির আদেশ দিলেন। মনে মনে হাসছিলেন। কৃতান্ত হালদারের সারারাত সম্ভবত মাথার ভেতর ধুরন্ধর ক্রিমিন্যাল ঘুরে বেড়ায়। ঘুম হওয়ার কথা নয়। মাকড়দহ ফার্মে সারারাত যা কাণ্ড করেছিলেন।
কৃতান্ত হালদার এতক্ষণে ড্রয়িংরুমের ভেতর চোখ বুলোচ্ছেন। বললেন, ঘরখানা যে যাদুঘর বানিয়ে রেখেছেন স্যার! ইশ! কতসব অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস! কত বই! উরে ব্বাস! ঘরের ভেতর গাছ! ফুলও ফোটে!
চোখে বিস্ময় নিয়ে উঠে গেলেন। সারা ঘর ঘুরে এটাওটা দেখে নাড়াচাড়া করে ফিরে এলেন। অনেকরকম মুখোস দেখলাম। একবার বর্ধমান খনি এরিয়ায় এক ভদ্রলোক মুখোস পরে নিজের বউ আর ছেলেমেয়েকে মার্ডার করেছিলেন। ওই মুখোসের ক্লু থেকেই ধরে ফেলেছিলাম, জানেন? রথের মেলায় আগেরদিন মুখোস কিনে এনেছিলেন—
ষষ্ঠী কফি আনতেই থেমে গেলেন কৃতান্তবাবু। কর্নেল অতিরিক্ত দুধ মিশিয়ে কফির পেয়ালা ওঁর হাতে তুলে দিলে চুমুক দিলে বললেন, মৃগাঙ্ক রায় ইজ দা মার্ডারার। ওকে এখনই অ্যারেস্ট করতে বলুন। আর ওর শ্বশুরের কথা বললেন। বিহারে কোথায় যেন বাড়ি?
সেতাপগঞ্জ। মোতিহারির কাছে।
আমি এভিডেন্স এনে দেব। আই অ্যাসিওর ইউ। কৃতান্ত হালদার সেই জোড়াদেওয়া টেলিগ্রামের কাগজটা কর্নেলের হাতে গুঁজে দিলেন। পোস্টঅফিস থেকে এটার একটা কিনারা করে ফেলুন। দেখবেন, ওই যে বলে, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আর এই রইল আমার কার্ড। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস কর্নেলস্যার! মাকড়দহে তো দেখেছেন আমাকে। এবারও দেখুন। শুধু একটা রিকোয়েস্ট।
বলুন!
আমার এজেন্সির পাবলিসিটিটা যেন হয়, স্যার। কাগজের লোকও আপনার হাতে আছে শুনেছি।
ভাববেন না। সব হবে।
গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার আশ্বস্ত হয়ে কফিতে ঘন-ঘন চুমুক দিয়ে বললেন, ব্রিলিয়ান্ট!….
.
শ্রাবন্তী সংবাদ
সুনেত্রা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, তুমি স্রি বুদ্ধ বুড়বক থেকে গেলে হিমুদা! তুমি সঙ্গেসঙ্গে থানায় গেলে না কেন?
হিমাদ্রি হাসবার চেষ্টা করল। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরেও ডিসিশন নিতে ঘণ্টা দেড়েক লাগল। তারপর লেক প্লেস এরিয়ার থানায় রিং করলাম।
বললে, তোমার সামনে খুন হয়েছে?
সামনে তো হয়নি।
কী বললে তাহলে?
নিজের নাম বলি নি। শুধু বললাম লেকভিলার সাততলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটে এক ডেডবডি পড়ে আছে। আর কিছু বললাম না।…হিমাদ্রি একটু চুপ করে থাকার পর ফের বলল, শুধু একটা ব্যাপার তখন বুঝতে পারিনি। ঊর্মি দরজা খুলতে গিয়ে কিন্তু জিগ্যেস করেনি পর্যন্ত, কে নক করছে। তাহলে শুনতে পেতাম। এমন কী লোকটা যে ওর গলায় ছুরি চালাল, চিৎকার পর্যন্ত করেনি!
সুনেত্রা ক্ষুব্ধভাবে বলল, তুমি ভীষণ ব্লান্ডার করেছ! দেখবে, সব দোষ তোমার ঘাড়ে পড়বে।
হিমাদ্রি মাথা দোলাল। আমি ওদের ফ্ল্যাটে ওই প্রথম আর শেষবার গেছি। লোডশেডিং ছিল। কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি। সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত।
এই হিমুদা! সুনেত্রা চাপা গলায় বলল। কিছু ফেলে আস নি তো টুকুর ফ্ল্যাটে?
সিগারেট লাইটার ফেলে এসেছি শুধু। মৃগাঙ্কও সিগারেট খায়। কাজেই ওটা নিয়ে পুলিশ মাথা ঘামাবে না মনে হয়।
সুনেত্রা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। দুপুরে জোর বৃষ্টি হয়ে বিকেলে রোদ্দুর ফুটেছে। ঝলমল করছে চারদিক। ওরা দেতালার একটা ঘরে বসে কথা বলছিল। উত্তরের জানালা দিয়ে পোড়ো মাঠের ওধারে বাঁধের সড়ক এবং তার পেছনে ভরা গঙ্গা দেখা যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ হলুদ জলের ওপর রোদ্দুর। মহাজনী নৌকোর পালে হাওয়া লেগেছে। হিমাদ্রি বলল, বিবি, চলো না বসন্তনিবাসে যাই একবার! ওদের ব্যাপারটা দেখে আসি।
ইন্দুকাকাকে সকালে তোমার কথা বললাম। শুধু বললেন, তাই নাকি? বললেন না, নিয়ে এস ওকে।
হিমাদ্রি দুঃখিতভাবে হাসল। ও বাড়িতে অভিশাপ আছে। ওখানে যারাই থাকে, তারাই অ্যাবনর্মাল! ইন্দুকাকাকেও ওদের বাড়ির ভূতটা কীভাবে পেয়ে বসছিল, দেখেছি তো চোখের সামনে।
সুনেত্রা গম্ভীর মুখে বলল, আমার তা মনে হয় না! ওদের মধ্যে একমাত্র উনিই হোশিয়ার আদমি।
কেন একথা বলছ?
বাঃ! ইন্দুকাকা না থাকলে খুকু-অপুর কী অবস্থা হত ভাবো একবার? জমিনগুলোও সব দখল করে ফেলত বাচ্চু সিংরা। রঘুয়ার কীর্তি তো তুমি জান না। সেও ভি নকশাল মুভমেন্টের ঘাঁটি করেছিল এরিয়ায়। ইন্দুকাকা রাছুজীর সঙ্গে ফয়শালা করে ওদের ভাগিয়ে দিয়েছিল, জান?
হিমাদ্রি জানালার পাশেই বসে ছিল। হঠাৎ বলল, বিবি! দেখ, দেখ। ওই মেয়েটা অপু না?
সুনেত্রা উঁকি মেরে দেখে একটু হাসল। হ্যাঁ। তুমি কেমন করে চিনলে? দেখেছ তো স্রিফ খোখি বয়সে!
হিমাদ্রিও হাসল। ঊর্মির মুখের সঙ্গে খুব মিল আছে মনে হল।
পোড়ো জমির ওপর দিয়ে অপালা হনহন করে আসছিল। বাড়ির নিচে। আসতেই সুনেত্রা ডাকল, অপু! এই অপু!
অপালা মুখ তুলল। নির্বিকার ঠাণ্ডা চাউনি।
আ যা! সুনেত্রা হাসতে হাসতে হাতে নেড়ে ডাকল। দেখকে যা কৌন আয়া!
অপালা একটু ইতস্তত করে বাড়ি ঢুকল। হিমাদ্রি বলল, অপু কি বাংলা বলে না নাকি?
কেন বলবে না? আমি ইচ্ছে করেই ওর সঙ্গে হিন্দুস্থানী বলি।
নিচে সুনেত্রার মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে অপালা ওপরে এল। দরজার পর্দা তুলে হিমাদ্রিকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সুনেত্রা বলল, ক্যা রী? নেহি পছনতি?
অপালা বলল, ভ্যাট! খালি এইসব। যাচ্ছি।
সুনেত্রা ওকে টেনে এনে হিমাদ্রির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল, কী দারুণ মেয়ে হয়েছে দেখতে পাচ্ছ? একেবারে দেহাতী খোট্টামার্কা। তাই না? বলে সে অপালার পাঁজরে খুঁচিয়ে দিল। হাঁ করে কী দেখছিস তুই? বল্ তো এ কে?
অপালা হিমাদ্রিকে ফের ঠাণ্ডা নিষ্পলক চোখে দেখে নিয়ে মাথা দোলাল। চিনতে পারছি না।
হিমুদা রে! খিলখিল করে হেসে উঠল সুনেত্রা। গঙ্গায় ডোবা থেকে তোকে কে বাঁচিয়েছিল মনে নেই? তখন তো তুই খোখি ছিলি না, অপু!
অপালা চুপ করে থাকল। হিমাদ্রি বলল, দশটা বছর খুব কম নয়। তাছাড়া আমরা ছিলাম ওদের শত্রু। রুদ্রজ্যাঠা আমাকে গুলি করতে এসেছিলেন। এখন–
সুনেত্রা ধমকাল। শাট আপ! ওসব কথা ওকে ভী বলছ?
সরি। হিমাদ্রি একটু হাসল। অপু, কিছু মনে কোরো না। তোমার বড়দি কেমন আছে বলো।
অপালা আস্তে বলল, ভাল।
সেই অসুখটা সারেনি এখনও শুনলাম?
অপালা কিছু বলল না। সুনেত্রা বলল, খুকুদির সঙ্গে পরশু দেখা হয়েছিল। একা মন্দিরের ওখানে বসে ছিল। বললাম, এখানে কী করছ-বাড়ি এস। জবাব দিল না। হাত ধরলাম তো ছাড়িয়ে নিয়ে এমন চোখ কটমট করে তাকাল যে ভয় পেয়ে ভেগে এলাম। হ্যাঁ রে অপু, ও কী করছে? বাড়িতে আছে, না মন্দিরতলায় গিয়ে বসে আছে?
অপালা বলল, শুয়ে ছিল দেখেছি।
বস্ অপু! চা খেয়ে যাবি। বলে আসি। ততক্ষণ তুই হিমুদার সঙ্গে গপসপ কর।
সুনেত্রা চলে গেলে হিমাদ্রি ডাকল, অপু!
উঁ?
তুমি বুঝি বেশি কথা বলো না মেজদির মতো?
অপালা এতক্ষণে ঠোঁটের কোনায় একটু হাসল। না বলার কী আছে?
আমার কথা তোমার মনে পড়া উচিত, অপু।
মনে পড়বে না কেন?
আচ্ছা! হিমাদ্রি সিগারেট ধরাল। একটু পরে আস্তে বলল, মেজদির খবর পেয়ে তোমরা কেউ যাওনি কলকাতা?
মামাবাবু এসে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে।
ও। তাহলে বডি দেখতে পাওনি?
অপালা আস্তে মাথাটা দোলাল।
শুনেছি তোমার বাবাও তো একইভাবে
অপালা মুখ নামিয়ে বলল, ওসব কথা থাক। তারপর একটু পরে মুখ তুলে ফের বলল, আপনি কলকাতায় থাকেন? মামাবাবু বলছিলেন।
থাকি। এবার কলকাতা গেলে দেখা কোরো যেন তোমার মামা ঠিকানা জানেন। যাবে তো?
গেলে যাব।
হিমাদ্রি ওর হাবভাব দেখে একটু অস্বস্তিতে পড়েছে। কী কথা বলবে ওর সঙ্গে, খুঁজে পাচ্ছে না। ধোঁয়ার রিং পাকিয়ে বলল, বিবির কাছে শুনলাম, কলেজে ঢুকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছ। ঠিক করোনি। আজকাল মেয়েদের একটা ডিগ্রি থাকা ভাল। নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। তাছাড়া ধরো, এই বাজে পরিবেশ। এখানে পচে মরার কোনো মানে হয় না। তুমি মামার কাছে থেকে ফের পড়াশোনা শুরু করো, অপু! কী?
অপালা কপাল থেকে রুক্ষ চুলের গোছা সরিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলল, কী হবে?
হাসল হিমাদ্রি। এই লাইফ তোমার পছন্দ?
আমার খারাপ লাগে না।
আসলে সবই অভ্যাস। তুমি এই লাইফে অভ্যস্ত হয়ে গেছ। হিমাদ্রি কথা বলার জন্য কথা বলছিল। আমার কথাই ধরো। আমার বেলা শাপে বর হয়েছিল। আমিও ভাবতাম, সেতাপগঞ্জ ছেড়ে কোথাও গিয়ে একবেলা থাকতে পারব না। শেষে যখন বাধ্য হয়ে চলে যেতে হল, তখন দেখলাম কী ওয়ার্সট প্রিমিটিভ পরিবেশে পচে মরছিলাম!
সবাই আপনার মতো নয়।
তা নয় ঠিকই। তবু তুমি তো এখন সাবালিকা–বয়স কত তোমার? আই থিঙ্ক টোয়েন্টি–বা কাছাকাছি। সামনে অগাধ লাইফ পড়ে আছে।
হিমাদ্রি হঠাৎ চুপ করে গেল। ওকে কি সে সিডিউস করছে, যেমন করত দিনের পর দিন ওর মেজদিকে? কিন্তু ঊর্মির সঙ্গে চেহারা আর এই স্মিতভাষিতায় যেটুকু সামান্য মিল, বাকি সবটাই বিপরীত মনে হচ্ছে। রুক্ষ দেহাতী আদিম একটা যৌবনের সামনে বসে আছে সে। কমিউনিকেট করা হয়তো অসম্ভব। আর ঊর্মি ছিল স্মার্ট, ছিমছাম, এবং তার ব্যক্তিত্বে সারাক্ষণ মেঘের ভেতর। থেকে বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিত সেক্স। বড় নিষ্ঠুর সেক্সি মেয়ে ছিল ঊর্মি!
অপালা নোখ খুঁটছিল। কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করল, কিন্তু বলল না। সুনেত্রা ট্রে সাজিয়ে চা আর স্ন্যাকস নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, কথা বলাতে পারলে। কাঠপুতলিকে?
হিমাদ্রি হাসল। যৎকিঞ্চিৎ! ওর মেজদির মতোই। অবশ্য ঊর্মির কথা বলার স্বভাব ছিল চোখে।
সুনেত্রা পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, বন্যেরা বনে সুন্দর। ওকে দেহাতে ওদের ফার্মে গিয়ে ছেড়ে দাও, দেখবে অন্য মূর্তি। সেবার বাবার সঙ্গে চৌথিয়া ঝিলে হাঁস মেরে ফিরে আসছি–আমি না, বাবা দুটো হাঁস মেরেছিলেন, তো আসার পথে ওদের ফার্ম হয়ে এলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা। দেখি কী, একদঙ্গ ল মেয়ে গেঁহু বাছাই করছে আর মধ্যিখানে বসে অপু তাদের সঙ্গে মৈথিলী। চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেখেই সরম বাজল। কী রে? মিথ্যা বলছি?
অপালা স্ন্যাকসের প্লেট তুলে নিয়ে নির্বিকার মুখে চিবুচ্ছে। হিমাদ্রি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ওর খাওয়ার মধ্যেও কেমন যেন আদিমতা। একটু পরে সুনেত্রার চোখে পড়ল যেন। একটু হেসে বলল, আমার প্লেটটাও খাবি কিন্তু অপু। বিকেলে কিছু খেলেই আমার কেমন গা-বমি করে। কী? দেব?
অপালা একটু হাসল। ক্ষিদে পেয়েছিল।
দুপুরে খাসনি বুঝি?
না। মাঠে গিয়েছিলাম। এখন ফিরছি।
একা গিয়েছিলি?
না। ইন্দুকাকার সঙ্গে।
উনি ফেরেননি?
মাঠ থেকে আসছি বলে কেঁওডিহি গেল। আমি চলে এলাম।
তাই তোকে অমন শুখা-রুখা দেখাচ্ছে। মরবি ছোঁকড়ি! ভদ্রলোকের মেয়ে কে বলবে রে তোকে? অমনি করে দিনভর ক্ষেতি করে বেড়াচ্ছিস! ইন্দুকাকা তোর মাথাটা খাবে।
অপালা চুপচাপ খাচ্ছিল। তেমনি নির্বিকার মুখ। শ্বাস ছেড়ে সুনেত্রা ফের বলল, কী অবস্থা বুঝতে পারছ হিমুদা?
হিমাদ্রি একটু হাসল শুধু। এতক্ষণে তার চোখে পড়ছিল অপালার রুক্ষ চুলে একচিলতে শুকনো কাদা, ব্লাউসের কাঁধের কাছে একটু ফাটা অংশ, যেমন তেমন একটা ধূসর রঙের প্রিন্টেড শাড়ি, এবং খালি পা! চোখের তলায় ক্ষীণ কালো ছোপ আর নাকের ডগা, গলায় নুনের কণা। জুলাই মাসের কড়া রোদে মাঠ-ঘাটে ঘুরে আসা এক যুবতীর শরীরে প্রকৃতির নোখের আঁচড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হিমাদ্রি বলল, বৃষ্টির সময় কোথায় ছিলে?
অপালা বলল, ফার্মে।
সুনেত্রা বলল, ফার্ম না কিছু! দুখানা কুঁড়ে ঘর ক্যানেলের ধারে। গভমেন্ট থেকে ফেসিলিটি পাওয়া যায় ক্ষেতিতে। তাই ইন্দুকাকা ফার্ম-টার্ম করে। শোন অপু কাল থেকে ও সব ছেড়ে দে। এত বড় মেয়ে হয়েছিস, কত বড় বংশের মেয়ে তুই, সরম বাজে না?
হিমাদ্রি মন্তব্য করল, বেঙ্গলে থাকলে এ সব পারত না। মেন্টালিটিই বদলে যেত। আসলে বিহারের অ্যাটমসফিয়ারই অন্যরকম–বিশেষ করে এ সব ছোটখাট গঞ্জে। ঊর্মির ব্যাপারটা দেখ না! ও এটা কাটাতে পেরেছিল বলেই
অপালা ফোঁস করে উঠল হঠাৎ। সে জন্যেই খুন হয়ে গেল মেজদি!
সুনেত্রা খিলখিল করে হেসে উঠল। কাকে কী বলা হচ্ছে? ডাকুরানী অপু, তুই রঘুয়ার দলে ভিড়ে যা। ফুলনদেবী হয়ে যা।
অপালা এতক্ষণে চায়ের কাপ তুলল। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঢকঢক করে গিলে আঁচলে ঠোঁট মুছে একটু হাসল। বাড়ি ফিরে আর খাচ্ছিনে এবেলা–চলি বিবিদি!
বস্। গল্প করি। অনেকদিন আসিস নি।
অপালা উঠে দাঁড়াল। উঁহু। ইন্দুকা এতক্ষণে এসে গেলে বকবে। আমি যাই।
সে দরজার কাছে গিয়ে ঘুরল। হিমুদাকে নিয়ে যেও। বড়দিকে বলছি গিয়ে। বলে বেরিয়ে গেল হাল্কা পায়ে।
সুনেত্রা তাকাল হিমাদ্রির দিকে। কী বুঝলে?
তুমি যা বলছিলে–মানে, ফুলনদেবীর আগের স্টেজ।
ভ্যাট! সুনেত্রা জানালায় গিয়ে নিচে অপালাকে দেখতে দেখতে বলল, ওর একটা আশ্চর্য স্বভাব–কিছুতেই রাগ করে না। একেবারে পান্থরকা মাফিক। ওর জন্য কষ্ট হয়, জানেনা হিমুদা?
হিমাদ্রি অন্য কথা ভাবছিল। ডাকল, বিবি?
কী?
শ্রাবন্তীদি–মানে খুকুদির কথা বলছি। সে অপুকে শাসন-টাসন করে না?
তাকেই কে শাসন করে ঠিক নেই। তাছাড়া শাসন করার কী আছে? অপু আর যাই হোক, ওর স্বভাবচরিত্র ভাল। টুকুর সঙ্গে আকাশপাতাল ফারাক। মুখ টিপে হাসল সুনেত্রা। টুকুকে তো তুমি ভাল চিনতে। তোমার ছোটবেলার প্রেমিকা।
হিমাদ্রি ঠাট্টায় কান করল না। গলার ভেতর বলল, আমার ভয় হয়–
কিসের ভয়?
অপুর জন্য।
অপুর জন্য তোমার ভয়-ডর মাথাব্যথা–কিছু করতে হবে না। নিজের কথা ভাবো।
হিমাদ্রি যেন দেয়ালকে শুনিয়ে বলল, ঊর্মির একটা কথা মাথা থেকে যাচ্ছে না। বরং
সুনেত্রা ভুরু কুঁচকে তাকাল। কী কথা?
ওর বড়দি সম্পর্কে।
সুনেত্রা বিরক্ত হয়ে বলল, আমার দিকে তাকিয়ে বলবে না কি? পরিষ্কার করে বলো!
হিমাদ্রি গলা চেপে বলল, কথাটা এমন অবিশ্বাস্য লেগেছিল। অথচ এখন মনে হচ্ছে, ঊর্মি হয়তো ঠিকই আঁচ করেছিল। কাউকে বোলো না যেন মাকেও না।
সুনেত্রা অধৈর্য হয়ে রেগে গেল। ছোড় দো জী! মাৎ বোলো।
বিবি, গত মাসে ঊর্মির সঙ্গে একখানে কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলাম। কথায় কথায় হঠাৎ ঊর্মি বলল, ওর বরের সঙ্গে এখানে এসেছিল বাবাকে প্রণাম করতে। তখন ওর বাবা ওকে চুপিচুপি সাবধান করে দিয়েছিলেন ওর বড়দি সম্পর্কে।
সে কী?
হ্যাঁ। শ্রাবন্তীদি নাকি একদিন দুপুর রাতে ওর বাবার দরজায় নক করেছিল। তখনও রুদ্রজ্যাঠার প্যারালেসিস হয়নি। দরজা খুলেই দেখেন, শ্রাবন্তীদি একটা ড্যাগার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে চাচামেচি করেছিলেন। তারপর অপালা পাশের ঘর থেকে এসে শ্রাবন্তীদিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। অজ্ঞান হয়ে যায় শ্রাবন্তীদি। তারপর–ঊর্মি বলছিল, ওর ভর ওঠে। ভরের সময় বলে, কাউকে রাখবে না। সক্কলের গলা কাটবে।
টুকু বলেছিল এ সব কথা?
হিমাদ্রি চুপ করে থাকল। সুনেত্রা ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমি বিশ্বাস করি না। অ্যাবসার্ড! তুমি কি ভাবছ, তুমি যখন টুকুর সঙ্গে আসনাই করছিলে, তখন খুকুদি গিয়ে দরজায় নক করেছিল? ইমপসিবল! ইয়ে কভি নেহি হো সকতা। দুবলা শরীরে সেই কলকাতা গিয়ে বোনকে খুন করেছে সে? টোটালি ইমপসিবল!
হিমাদ্রি উঠে দাঁড়াল। মাথা ঝিমঝিম করছে। একটু বেরোই।
অপুদের বাড়ি যাবে তো চলো।
তাই চলো।..
.
সুব্রতর আবির্ভাব
আজ সব কাগজে ওয়ান্টেড শিরোনামে হিমাদ্রির ছবিসহ বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার সন্ধান দিয়ে ধরতে সাহায্য করলে। কর্নেল ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্লডে ধুলোমাখা হাতে কয়েকটা খবরের কাগজ উল্টেপাল্টে বিজ্ঞাপনটা দেখছিলেন। এমন সময় ষষ্ঠী এসে খবর দিল, ফোং।
অরিজিতের ফোন হলে সে করাসরি ঘোষণা করত নালবাজারের নাহিড়িসায়েব। কর্নেল ফোন তুলতেই গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনলেন। দেখেছেন স্যার পুলিশের কাণ্ডটা? মিনিস্টারের ভাগ্নের ট্র্যাপে কেমন করে পা দিয়ে বসল! এখন আর কী করব বলুন?
কর্নেল শান্তভাবে বললেন, তাহলে আর সেতাপগঞ্জ যাচ্ছেন না?
টিকিট–মানে বার্থ রিজার্ভেশান করে রেখেছিলাম আজ সন্ধ্যার ট্রেনে। এখন ক্যান্সেল করা ছাড়া উপায় কী বলুন স্যার? কৃতান্তবাবুর কণ্ঠস্বরে এবার হতাশা ফুটে উঠল।
পুলিশ নিশ্চয় কোনো ডেফিনিট ক্লু পেয়েছে।
হাতি! হাতি!
সম্ভবত হাতি নয় মিঃ হালদার, একটা সিগারেট লাইটার।
খি খি খি!
মিঃ হালদার, আপনি সেতাপগঞ্জ চলে যান।
অ্যাঁ?
টিকিট ক্যান্সেল করবেন না। চলে যান।
গিয়ে আর লাভ কী!
আছে। আপনি কি ভূতপ্রেত পিশাচ তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করেন মিঃ হালদার?
অ্যাঁ?
বসন্তনিবাসে–মৃগাঙ্কবাবুর শ্বশুরবাড়ির বাগানে একটা পাথরের মূর্তি আছে। রাতে সেটা জ্যান্ত হয়ে চলাফেরা করে। হাতে ড্যাগার থাকে।
খি খি খি! যাঃ!
সিরিয়াসলি বলছি, মিঃ হালদার। মৃগাঙ্কবাবুর বড় শালীর শরীরে দেবীর ভর হয়। ভরের সময় অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে। তার ভেতর অনেক ক্লু পেতে পারেন।
আর ক্লুর কী দরকার? পুলিশ তো কেসের বারোটা বাজিয়ে দিল স্যার!
আপনি কলকাতা পুলিশের বারোটা বাজান।
প্রব্লেমটা বুঝতে পারছেন না স্যার? মিনিস্টারের
বিহার পুলিশের হাতে ক্লু তুলে দিয়ে কলকাতা পুলিশের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ুন আপনি!
খি খি খি! স্টেট ভার্সেস স্টেট!
একজ্যাক্টলি।
একমিনিট স্যার! নোট করে নিই। কী যেন বলছিলেন বসন্ত নিবাসে পাথরের মূর্তি-টুর্তি?
কর্নেল রিপিট করলেন।
একটু পরে ফোন রেখে কর্নেল হাসতে হাসতে ছাদের সিঁড়ির দিকে পা। বাড়ালেন। সেই সময় ষষ্ঠী পিছু ডেকে বলল, বাবামশাই, এক ভদ্রলোককে বসিয়ে রেখেছি সিটিং রুমে।
কর্নেল ঘুরলেন। কে ভদ্রলোক?
রোগা করে ফর্সা করে। এটুখানি দাড়ি আছে। গায়ে নাল গেঞ্জি পরনে—
লেজ নেই?
ষষ্ঠী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, তা তো দেখিনি! বলেই জিভ কাটল। ও! ন্যাজ বললেন। হি হি হি!
হতভাগা, তোকে হাজারবার বলেছি–আগে নামটা জেনে নিবি।
আজ্ঞে, ভুল হয়েছে। জেনে আসছি।
তার কাধ ধরে আটকে কর্নেল বললেন, কফি নিয়ে আয়। তারপর ড্রইং রুমের বাইরের দিকের দরজার পর্দা তুলে উঁকি মারলেন, আসুন সুব্রতবাবু!
সুব্রত সিংহরায় উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। কিন্তু কোনো কথা না বলে নমস্কার করে সে ড্রইংরুমে ঢুকল।
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, বসুন সুব্রতবাবু!
আপনি আমাকে চেনেন?
আপনার ছবি দেখেছি। যাই হোক, বলুন।
সুব্রত একটু ইতস্তত করে বলল, মৃগাঙ্ক আমার বন্ধু। মৃগাঙ্কের কাছে কৌশলে আপনার ঠিকানা পেয়েছি। তার পরামর্শেই আপনার কাছে চলে এলাম। বলবেন, সরাসরি পুলিশের কাছে যাইনি কেন–যাইনি, তার কারণ পুলিশের ওপর আমার আস্থা নেই।
হু–বলুন।
হিমাদ্রির ছবি বেরিয়েছে আজকের কাগজে। কাজেই মৃগাঙ্কের বউকে হিমাদ্রিই খুন করেছে বসে সাব্যস্ত করেছে পুলিশ। কিন্তু আমার ধারণা, খামোকা ও বেচারাকে জড়ানো হয়েছে।
কেন এ ধারণা, সুব্রতবাবু?
এগারো জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ আমি মৃগাঙ্কের ফ্ল্যাটে যাচ্ছিলাম। লেকভিলার সামনে পৌঁছে দেখি, লোডশেডিং। সিঁড়ি ভেঙে ওঠা আমার পক্ষে ডিফিকাল্ট। তাই গাড়িতে বসে ভাবছি কী করব। হঠাৎ
এক মিনিট। আপনি জানতেন মৃগাঙ্কবাবু কলকাতায় নেই ওই দিন?
সুব্রত অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, জানতাম।
বেশ। বলুন।
তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। গাড়িতে বসে আছি। হঠাৎ আমার গাড়ির পেছনে একটা গাড়ি এসে থামল। নিছক খেয়ালে ঘুরে দেখি, সেই গাড়ি থেকে হিমাদ্রি বেরুচ্ছে। ফ্র্যাংকলি বলছি কর্নেল, আমি খুব খাপ্পা হয়েছিলাম বিশেষ করে ঊর্মির ওপর। ঊর্মিই ফোনে ডেকেছিল আমাকে। ভাবলাম, যেভাবে হোক কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় উঠে ঊর্মির সঙ্গে একটা ভালরকম বোঝাপড়া করব। হিমাদ্রিও জানবে, ঊর্মি আসলে একটা প্রস। এ পার্ভাটেড অ্যানিম্যাল। সুব্রত সংযত হল। ক্ষমা করবেন।
তারপর কী হল বলুন?
কিন্তু আমার হার্টের অবস্থা ভাল নয়। শেষ পর্যন্ত রিস্ক আর নিলাম না। হিমাদ্রির ফেরার অপেক্ষায় থাকলাম। ভাবলাম ও ফিরে এলে ওকে ঊর্মির লীলাখেলার কথা ফাঁস করে দেব।
আপনি অপেক্ষা করলেন?
হ্যাঁ। তারপর জাস্ট আধঘণ্টা পরে–একটু বেশিও হতে পারে, আমি ঘড়ি দেখিনি–মনের অবস্থা সাংঘাতিক ছিল তখন হঠাৎ দেখলাম একটা লোক জোরে বেরিয়ে আসছে গেটের দিকে। অন্ধকারে ওকে প্রথমে হিমাদ্রি বলেই মনে করলাম। কারণ সে হিমাদ্রির গাড়ির সামনে এল। একটানে বনেট খুলেই আবার নামিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ বাড়িয়ে ডাকলাম, হিমাদ্রি! আশ্চর্য, লোকটা থমকে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে চলে গেল রাস্তা পেরিয়ে। তখন বৃষ্টিটা বেশ জোরে পড়ছে। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, কেনই বা হিমাদ্রি গাড়ির
হুঁ–তারপর?
পনের-কুড়ি মিনিট পরে আগের লোকটার মতোই আরেকটা লোক গেট পেরিয়ে এল। সে হিমাদ্রি। গাড়িতে ঢুকলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেটুকু আলো জ্বলল, তাতে অস্পষ্টভাবে ওকে চিনতে পারলাম। বৃষ্টির জন্য আমার গাড়ির কাঁচ ওঠানো ছিল। তবু হিমাদ্রিরই গাড়ি ওটা–তাছাড়া তার ফিজিক্যাল আউটলাইন আমার চেনা। আমি কাঁচ নামিয়ে ওকে ডাকলাম, কিন্তু শুনতে পেল না। ওর গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেল আমার গাড়ির পাশ দিয়ে। মাথায় জেদ চাপল তখন। ওর গাড়ি ফলো করলাম। কিন্তু বড় রাস্তায় পৌঁছে জ্যামে আটকে। ওকে মিস করলাম। বাড়ি পৌঁছে ওকে ফোন করেছিলাম। লাইন পেলাম না।
বেশ। আপনার বক্তব্য কী তাহলে?
মৃগাঙ্কের অফিসে গিয়েছিলাম কাল। ওর কাছে শুনলাম, পুলিশ হিমাদ্রির গাড়িতে ইঞ্জিনের কাছে রক্তমাখা ড্যাগার পেয়েছে। কথায়-কথায় মৃগাঙ্ক বলল, হিমাদ্রির বাঁচার উপায় নেই। একজন খুব নামকরা ডিটেকটিভ নেমেছেন পুলিশের সঙ্গে। জিগ্যেস করে আপনার কথা জানলাম। আমার কারখানায় লেবার-ট্রাবল চলেছে। সেই ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন দরকার। মৃগাঙ্ক তাই শুনে প্রথমে কে এক কে কে হালদারের কথা বলল–গণেশ এভেনিউতে অফিস। আমি ওর কাছে আপনার ঠিকানা চাইলাম। বললাম, হালদার-টালদার দিয়ে হবে না। আরও ঝানু লোক চাই। তখন আপনার ঠিকানা দিল।
কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। বললেন, নিন সুব্রতবাবু।
সুব্রত কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, সেই লোকটাই মার্ডারার। তাকেই আমি হিমাদ্রির গাড়ির ভেতর মার্ডার উইপন রাখতে দেখেছিলাম।
তাকে চিনতে পারেননি তো?
না। ওর পরনে রেনকোট ছিল। ফিজিক্যাল আউটলাইনও অন্ধকারে আঁচ করতে পারিনি। তাতে বৃষ্টি। লোডশেডিংয়ে সারা এলাকা অন্ধকার। আশেপাশে দোকানপাট থাকলে আলো থাকত। দেখেছেন তো রাস্তাটা কেমন নির্জন–আর। বস্তি-টক্তিও আছে।
মৃগাঙ্কবাবু নন তো?
সুব্রত একটু চমকে উঠল। তারপর একটু হাসল। ও খুব কোল্ডব্লাডেড লোক। বউকে খুন করা ওর পক্ষে অসম্ভব হয়তো নয়। কিন্তু ও সে দিন বোম্বেতে ছিল। আমি জানি, আবুধাবিতে মাল পাঠানোর জন্য কার্গো বুক করে রেখেছিল। কন্ট্রাক্টের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল। বন্দর ধর্মঘটের জন্য কার্গো পাচ্ছিল না। প্রায় তিন লক্ষ টাকার ডিল। কাজেই ওর মতো অর্থলোভী লোকের পক্ষে ওই প্রব্লেম ছেড়ে বউয়ের জন্য কলকাতায় পড়ে থাকা সম্ভব ছিল না।
আপনি ওঁর অফিসের লোকেদের চেনেন?
কাউকে কাউকে চিনি।
হেমন্ত নামে কাউকে?
চিনি। মৃগাঙ্কের খুব বিশ্বাসী লোক। ওর কনসার্নের রিপ্রেজেন্টেটিভ। কেন বলুন তো?
হেমন্তবাবুকে তো মৃগাঙ্কবাবু নানা জায়গায় পাঠান?
হ্যাঁ। ওর ওটাই কাজ।
সুব্রতের মুখে প্রশ্নচিহ্ন রয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। আপনি আপাতত পুলিশকে কিছু বলবেন না। অন্য কাউকে তো নয়ই। দরকার হলে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
সুব্রত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, পুলিশের ওপর আমার আস্থা নেই। অথচ হিমাদ্রি বেচারাকে বাঁচানো কর্তব্য। তাই আপনার কাছেই এসেছিলাম। বেশ বুঝতে পেরেছি, বোকা পেয়ে ওকে ট্র্যাপ করা হয়েছে।
কর্নেল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে বললেন, হিমাদ্রিবাবু কোথায় এখন?
হাসল সুব্রত। বিশ্বাস করুন, জানি না। ভয় পেয়ে একেবারে গা ঢাকা দিয়েছে।…
সুব্রত সিংহরায় চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরে এলেন ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী। তখন কর্নেল সবে ব্রেকফাস্ট সেরে চুরুট ধরিয়ে এদিনকার কাগজে চোখ বুলোচ্ছেন। হিমাদ্রির ছবিতে চোখ আটকে গেছে।
অরিজিৎ বসেই হাসতে হাসতে বললেন, ভাবতে পারিনি আপনিও শেষে রাম গোয়েন্দার পাল্লায় পড়বেন!
রাম নামে কোনো গোয়েন্দার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই ডার্লিং!
কে কে হালদারকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা রাম গোয়েন্দা বলে।
কর্নেল হাসলেন। আহা, ওর পেছনে তোমরা লেগো না! লোকটি বড় ভালো। অনেস্ট, সিনসিয়ার। বুদ্ধিসুদ্ধিও আছে। তুমি জানো? মাকড়দহের ফার্মে একটা রহস্যময় মার্ডার কেসে
ওঃ! সে গল্প হালদার মশাই ইতিমধ্যে তিনশোবার শুনিয়েছেন। অবশ্য আপনার ভার্সান তার বিপরীত হবেই। অরিজিৎ অ্যাটাচি খুললেন। কিন্তু হাতে সময় কম। এই নিন আপনার সেই টেলিগ্রাম। পোস্ট অফিসের লোকেরাও দেখলাম রাম গোয়েন্দার কথা বলে হাসাহাসি করছে। ওদের খুব ভুগিয়েছেন কে কে হালদার। আপনিও যে কেন ওঁর পাল্লায় পড়তে গেলেন! দেখবেন আপনার কী অবস্থা করে ছাড়ে।
টেলিগ্রামের কপিটা নিয়ে চোখ রাখলেন কর্নেল। REACHED TIMELY (.) CARGO NOT AVAILABLE (.) ADVISE (.) HEMANTA HOTEL DELIGHT BOMBAY (.) স্থানীয় পোস্ট অফিসে পৌঁছুনোর তারিখ দেখে কর্নেল অবাক হলেন। এগারো জুলাই রাত নটা। ডেলিভারি হয়েছে পরদিন সকালে। সম্ভবত অফিস খোলার পর। বোম্বের পোস্ট অফিসে টেলিগ্রামটা দেওয়া হয়েছে এগারো জুলাই তারিখেই। জরুরি টেলিগ্রাম। আর সে দিনই সন্ধ্যায় খুন হয়েছে ঊর্মি।
কর্নেল মুখ তুললেন। চোখে চোখ পড়লে অরিজিৎ একটু হেসে বললেন, গোলমেলে মনে হচ্ছে তো? আমারও হয়েছিল। হেমন্ত বোসকে মৃগাঙ্কবাবু বোম্বে পাঠিয়ে কার্গোর জন্য তদ্বির করতে বলেছিলেন। হেমন্তবাবু যান ন তারিখে। দুদিন অপেক্ষা করার পর পোর্টস্ট্রাইকের ঝামেলায় কার্গোর ব্যবস্থা না করতে পেরে এই টেলিগ্রাটা করেন। এদিকে মৃগাঙ্কবাবু অধৈর্য হয়ে টেলিগ্রাম পাবার আগেই এগারো তারিখ রওনা হন। তাই এই গণ্ডগোল।
মৃগাঙ্কবাবুর ভার্সান?
দুজনেরই–মানে, হেমন্তবাবুরও।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ট্রাঙ্ককল করেননি হেমন্তবাবু! টেলিগ্রাম কেন?
লাইন পাননি। ন থেকে বারো–এই চারদিন বোম্বে ক্যালকাটা লাইন ডিসটার্বড় ছিল। আমরা হটলাইনে মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম।
ডিলাইটে হোটেলে?
হোটেল ডিলাইটে।
অরিজিৎ মুখ টিপে হাসছিলেন। ষষ্ঠী কফি রেখে গেল যথারীতি। কর্নেল কফির পেয়ালা ওঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, হেমন্তবাবু বোম্বে থেকে কবে ফিরেছিলেন?
বারো জুলাই, মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে।
মৃগাঙ্কবাবুর প্লেনের টিকিট তো দেখেছ বলছিলে। যাওয়া এবং ফিরে আসার।
হ্যাঁ। আমার কাছে এখনও রয়ে গেছে। দেখবেন নাকি?
নেব।
অরিজিৎ তেমনি মুখ টিপে হেসে অ্যাটাচি থেকে টিকিট দুটো বের করে দিলেন। তারপর বললেন, অবশ্য হেমন্তবাবুর টিকিট পাইনি। পাওয়ার কথাও না। ও সব কে রেখে দেয়?
কিন্তু মৃগাঙ্কবাবু রেখে দিয়েছিলেন!
খুব স্বাভাবিক। ওঁর অ্যালিবাই দরকার ছিল। বুদ্ধিমান লোক। অরিজিৎ ঘন ঘন চুমুক দিয়ে কফি শেষ করে ফের বললেন, কর্নেল আপনাকে পরামর্শ দেওয়া ধৃষ্টতা। কিন্তু প্লিজ আপনি হালদার মশাইকে ছাড়ুন। আমার ধারণা, উনি এস্টাব্লিন্ড অ্যান্ড সেট একটা কেসকে ঘুলিয়ে দেওয়ার তালে আছেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিকে সে জন্যই লাইসেন্স দিতে আজকাল ভীষণ কড়াকড়ি করা হয়। কে বলতে পারে, হালদার মশাই আসামীর কাছে টাকা খেয়ে কাজে নেমেছেন কি না? আমি তো স্পষ্ট দেখছি, ভদ্রলোক আপনাকে মিসগাইড করার চেষ্টা করছেন।..
অরিজিৎ চলে গেলে টেলিগ্রামের কপিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন কর্নেল। একটু পরে হলদে কাগজে ফুটে উঠল একটা দশতলা বাড়ি। গেটে লেখা আছে লেকভিলা। অন্ধকার সন্ধ্যাবেলায় ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সুব্রত সিংহরায় নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। তারপর এল হিমাদ্রির গাড়ি।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন কর্নেল। সাততলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটের বেডরুমে হিমাদ্রি সিগারেট টানতে টানতে প্রেমালাপ করছে ঊর্মির সঙ্গে। ঘরে একটা মোম জ্বলছে। নিশ্চিন্ত নিরাপদ সময়। মৃগাঙ্ক বোম্বেতে।
ওদের প্রেমের খেলা শেষ। বর্ষাতিপরা আততায়ী দরজায় নক করল। পাশের ফ্ল্যাটে কুকুরটা গরগর করছে। আঁচড় কাটছে দরজায়। জন্তুরা সহজাত বোধেই কি সব টের পায়?
কিন্তু ঊর্মি কেন দরজা খুলতে গেল? তার হাতে মোমবাতিটা দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় চেনা লোক দরজায় নক করছে। দরজা খুলতেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় আততায়ী তার মুখ চেপে ধরে মুহূর্তেই শ্বাসনালী কেটে দিল। তারপর বেরিয়ে গেল। নিচের ফুটপাতে তাকে দেখতে পেয়েছে সুব্রত সিংহরায়। আততায়ী হিমাদ্রির গাড়ির বনেট খুলে ছুরিটা রেখে দিল। রক্তাক্ত হাতটা ঘসে দিয়ে চলে গেল রাস্তা পেরিয়ে।
হিমাদ্রির চোখের সামনে ঘটেছে ওই অতর্কিত ঘটনা। আতঙ্কে সে লাইটারটার কথা ভুলে গেছে। পালিয়ে আসছে দিশেহারা হয়ে। সুব্রত সিংহরায়ের ডাক শোনার মতো কান তার নেই তখন। বৃষ্টিও ঝমঝম করে পড়ছে। হুঁ..হিমাদ্রিকে অনুসরণ করে এসেছিল আততায়ী। কিন্তু কে সে?
কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোনের ডায়াল করতে থাকলেন। … মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে চাইছি।
মহিলা অপারেটার বলল, উনি বাইরে গেছেন।
তাহলে মিঃ হেমন্ত বোসকে দিন।
উনিও বাইরে।…।
.
হিমাদ্রির সর্বনাশ
শ্রাবন্তীর চেহারা দেখে শিউরে উঠেছিল হিমাদ্রি। দশ বছর আগে দেখা মোটামুটি স্বাস্থ্যবতী একটি মেয়ের শুটকো মড়া যেন–কোটরগত একজোড়া উজ্জ্বল চোখে অস্বাভাবিক চাউনি। হিমাদ্রিকে চিনতে পেরেছিল অবশ্য। কিন্তু সামান্য দু-একটা কথা বলে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। ও নিচের একটা ঘরে থাকে। মণিয়া থাকে ওর ঘরের বারান্দায়। ওর সঙ্গে রাতে ঘরের ভেতর থাকতে মণিয়ার মতো সাহসী মেয়েও ভয় পায়।
অপালা থাকে একা ওপরে ওর বাবার ঘরে। পাশের দুটো ঘর খালি পড়ে ছিল। ইদানীং একটা ঘরে ইন্দুবাবু থাকছেন। ইন্দুবাবুকে দেখলে কিছুতেই বাঙালি বলে মনে হয় না। হিমাদ্রি ওঁকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেনি। একেবারে ছাতুখোর হিন্দুস্থানীর আদল এসে চেপে বসেছে ভেতো বাঙালির গায়ে। স্বাস্থ্যটিও এখন পুষ্ট ও পেল্লায় হয়েছে। বলছিলেন, ক্লাইমেটের গুণ হে! দেখ না, বিশ বছর আগে এখানে প্রথম যখন এলাম, তখন আমার একটুতে ঠাণ্ডা জ্বর-জ্বালা সর্দিকাশি, তার ওপর ওই অম্বলের রোগ। রুদ্রদা আমার পেছনে লাগল। রোজ টানতে টানতে গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিত। ভাবতাম কালই পালিয়ে যাব। তো পালাব কেমন করে? সব সময় রুদ্রদার কড়া নজর।
হিমাদ্রি আজও জানে না, ইন্দুবাবুর সঙ্গে রায়চৌধুরীদের সম্পর্কটা কী। জানে না সুনেত্রা বা অপালাও। ঊর্মিও সম্ভবত জানত না। তবে হিমাদ্রি দেখেছে, ইন্দুবাবু বরাবর ওঁদের চাষবাস আর বাড়ির সব কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। রুদ্রবাবুর সঙ্গে ছায়া হয়ে ঘুরতেন।
হিমাদ্রি জানতে চেয়েছিল, রুদ্রবাবু কীভাবে খুন হন। ইন্দুবাবু শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, একটু ভুলের জন্য ওই অপঘাত ঘটে গেল। খুকুর ভরের সময় ওর মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে এসেছিল, বুঝলে? …রুদ্র, আজ তোর শেষ দিন! কিন্তু আমরা ওর ব্যাপারটা প্রলাপ বলেই জানতাম। আমল দিইনি।
হিমাদ্রি বলেছিল, তাহলে কি বলতে চাইছেন, সত্যি শ্রাবন্তীদির কোনো দেবীর ভর হয়?
কে জানে! ইন্দুবাবু গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন। আগে বিশ্বাস করতাম না। এখন করি।
এমনও তো হতে পারে, শ্রাবন্তীদি ওর বাবা খুন হওয়ার আভাস পেয়েছিল? কিছু দেখেছিল অথবা শুনেছিল কোথাও।
ইন্দুবাবু হেসেছিলেন একটু। মাথা দুলিয়ে বলেছিলেন, নাঃ! তাহলে সরাসরি বলত। সবসময় তো আর দেবী ওর মধ্যে থাকেন না। মাঝেমাঝে হঠাৎ এসে পড়েন, হঠাৎ চলে যান। কাজেই সুস্থ অবস্থায় থাকার সময় কথাটা বলতে বাধা ছিল না। তাছাড়া জন্মদাতা বাবা বলে কথা।
হিমাদ্রি বলেছিল, আচ্ছা ইন্দুজ্যাঠা, এমন তো হতে পারে, শ্রাবন্তীদি ভরওঠা অবস্থায় ওর বাবাকে খুন করেছে! এরকম কেসের কথা আমি সাইকলজির বইতে পড়েছি। তখন সাইকিক পেসেন্ট নিজেই জানে না কী করছে!
ইন্দুবাবু, হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। দেখ হে হিমু, তোমাদের ওই সাইকলজি-টাইকলজি কী আমি বুঝি না। কিন্তু এটুকু বুঝি, খুকু একটা আরশোলা দেখলে চেঁচিয়ে এক কাণ্ড করে। তাছাড়া ওকে তো দেখলে! গত তিন-চার মাসেও এমনি দুবলা হয়ে ছিল। কাঠির মতো নড়বড়ে শরীর। কোনরকমে হাঁটাচলা করে বেড়ায়। ঠেলে দিলে আছাড় খায়।
কিন্তু আমি শুনেছি, এক রাত্রে শ্রাবন্তীদি ছুরি হাতে নিয়ে ওর বাবার ঘরের দরজায়–
ইন্দুবাবু নড়ে উঠেছিলেন। ভারি গলায় বলেছিলেন, কে বলেছে তোমাকে?
ঊর্মির কাছে শুনেছিলাম।
ঊর্মি মিথ্যা বলেছে। ও কী করে জানবে? তখন কি ও ছিল এখানে? অপুকে জিজ্ঞেস করো, কী হয়েছিল। অপু, বল্ তো হিমুকে ব্যাপারটা।
অপাল একটু তফাতে বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, খালি ওই কথা!
ইন্দুবাবু আবার জোরে হেসে বলেছিলেন, অপু রুদ্রদার বকাবকি শুনে বেরিয়ে দেখে, খুকু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে। হাতে ছুরি-উরি কিছু নেই। তারপর তো আমি নিচে থেকে তুরন্ত এসে ওকে ধরলাম। ব্যস, ভর হয়ে গেল। আসলে টুকুটা বরাবর ওইরকম। তিলকে তাল করে বসে।
তাহলে কে খুন করল রুদ্রজ্যাঠাকে?
সে তো পুলিশ এনকোয়ারি করে এত্তেলা দিয়েছে আদালতে। রঘুয়া হারামীর নামে হুলিয়া ঝুলছে।
রঘুয়া–মনে সাহুজীর ছেলে রঘুনাথ?
আবার কে? রঘুয়ার কীর্তি এখানকার লোকের কাছে শুনতে পাবে।… একটু চুপ করে থাকার পর ইন্দুবাবু আস্তে বলেছিলেন ফের, আমাদের বিহারের পুলিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অবস্থা এখন ভাল নয়। সাহুজী টাকা খাইয়ে রেখেছে। কী আর করা যাবে?
হিমাদ্রি বলেছিল, আচ্ছা, তাহলে উঠি ইন্দুজ্যাঠা। বিশ্রাম করুন।
তুমি থাকছ কয়েকদিন?
দেখি।
কাল দুপুরে খেও আমাদের বাড়ি। নাকি এখনও রাগ করে আছ আমাদের ওপর?
কী যে বলেন! ওসব কিছু মনে নেই।
মনে থাকলেও যার জন্য রাগ, সে তো নেই। এসো বাবা হিমু?
আচ্ছা বলে হিমাদ্রি চলে এসেছিল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুনেত্রাকে বলেছিল, কিছু বোঝা গেল না। ঊর্মি কেন আমাকে মিথ্যা বলবে?
সুনেত্রা ঝাঁঝালো কণ্ঠ স্বরে বলেছিল, টুকু ভারি সতীলক্ষ্মী মেয়ে! ওর মুখে এক কথা, পেটে আর এক কথা।
হঠাৎ ওর ওপর খাপ্পা হলে যে?
টুকু সবসময় উল্টোপাল্টা কথা বলে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সুনেত্রা মুখ খুলেছিল ফের। এদিকে আমি এক কাণ্ড করে বসেছি টুকুর কথায়। এখন ভাবছি, ভুল হয়ে গেছে। কেঁকের বশে কর্নেলকে আসতে লিখেছি। খামোকা বুড়ো মানুষটাকে হয়রান করা হবে।
কর্নেল মানে? কী ব্যাপার?
ও। তুমি তো চেন না। তোমার কলকাতার লোক। থাকেন এলিয়ট রোডে। বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভদ্রলোক। ভেরি চার্মিং পার্সোনালিটি। এসে পড়লে দেখবে, কী ওয়ান্ডারফুল আদমি!
ওপরের ঘরে গিয়ে বাকিটা বলেছিল সে। টুকু ওমাসে আমাকে হঠাৎ একটা চিঠি লিখেছিল। চিঠিটা পেয়ে আমি তো তাজ্জব। ওর বাবাকে খুন করার পর এখানে এসে ওর ধারণা হয়েছে, এই খুনের পেছনে ইন্দুকাকার হাত আছে। ইদুকাকা ওদের সব সম্পত্তি হাতানোর চক্রান্ত করেছেন!
অসম্ভব নয়।
ভ্যাট! তাহলে ইন্দুকাকাকে আরও দু-দুটো খুন করতে হবে জানো? খুকুদি আর অপু বেঁচে আছে না? ওদের যদি কিছু হয়, সেতাপগঞ্জের লোক এমন বুদ্ধু নয় যে ইন্দুকাকার ঘাড়ে সব দোষ পড়বে না! তাছাড়া সম্পত্তি হাতানোর জন্য ওঁর খুন করার কী দরকার? এমনিতেই তো উনি সবকিছুর প্র্যাকটিক্যালি মালিক হয়ে বসে আছেন।
কর্নেল ভদ্রলোককে আসতে লিখেছ কেন? উনি কী করবেন?
সুনেত্রা ওর দিকে একটু তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। হিমুদা! যা হয়, ভালর জন্যই হয়। দেখছ, কথাটা কিছুতে আমার মাথায় আসেনি? কর্নেল এলে তুমি ওঁকে সব বলবে, যা যা আমাকে বলেছ। তুমি না বললে আমিই বলব।
বিবি!
চুপ রহো জী! সুনেত্রা হেসেছিল। লেট হিম কাম। আনে দো!
কে তিনি?
ক্রিমিনোলজিস্ট, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার, ন্যাচারালিস্ট, অ্যাডভেঞ্চারার কী নন বলো? মিলিটারিতে ছিলেন একসময়। বাবার কাছে ওঁর কতসব সাংঘাতিক গস্প শুনেছি আর তাজ্জব হয়ে গেছি, জানো? ওয়েট। কাল মর্নিংয়ে ওঁকে পোস্টঅফিস থেকে ট্রাঙ্ক কল করছি। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।…
সারারাত হিমাদ্রি অদ্ভুত-অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে কাটিয়েছে। শ্রাবন্তী প্রেতিনী হয়ে ওকে তাড়া করেছে। রুদ্রে রায়চৌধুরীকে হিমাদ্রি খুন করে লাস নিয়ে বিপদে পড়েছে। ঊর্মি নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে হিমাদ্রির সামনে। কিন্তু তার পেছনে মৃগাঙ্ক। তারপর মৃগাঙ্ক আর অপালা ভরা গঙ্গায় সাঁতার কাটতে চলে গেল। ভোরে হিমাদ্রি দেখল, পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। হাতকড়া পরিয়ে দিতেই ঘুম ভেঙে গেল হিমাদ্রির। তখনও দু হাতের কবজিতে হাতকড়ার ঠাণ্ডা স্পর্শ লেগে আছে যেন।
সকালে সুনেত্রা বলল, যাবে নাকি আমার সঙ্গে?
কোথায়?
পোস্টঅফিসে।
থাক। তুমি যাও। আর শোনো, কলকাতার কাগজ যদি পাও, একটা এনো।
কলকাতার কাগজ এখানে পৌঁছুতে বিকেল হয়ে যায়। তবে আগের দিনেরটা পেতে পারি মধুবাবুর কাছে। উনি এজেন্ট।
হিমাদ্রি হাসল। এখনও একই অবস্থা সেতাপগঞ্জের। সেই মধুবাবু!
সুনেত্রা চলে গেলে সে কিছুক্ষণ জানালার ধারে বসে সিগারেট টানতে টানতে গঙ্গা দেখল। তারপর নিচে এল। সুনেত্রার মা সুনয়নী লনের পাশে ফুলবাগানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছু ফলের গাছও আছে। সুনয়নী পেয়ারাগাছে বাদুড়ের অত্যাচারের অভিযোগ করলেন। তারপর একথা-ওকথার শেষে চাপা গলায় বললেন, বসন্তনিবাসে তোমার এবেলা নেমন্তন্ন শুনলাম। আমি বলি কী, তুনি বলে পাঠাও ওদের শরীর খারাপ। কেন নিষেধ করছি জানো হিমু? ও : বাড়ির অন্ন তুমি ছুঁলে তোমার বাবার আত্মা কষ্ট পাবেন। তখন তোমার বয়স কম ছিল। সব জানো না। আমরা জানি। ডাক্তারবাবুর ওপর কী অত্যাচার না করেছিল রুদ্রবাবু! তারই পরিণাম। ভগবান হাতে-নাতে দেখিয়ে দিচ্ছেন! তুমি রিফিউজ করো, হিমু।
হিমাদ্রি একটু হাসল। বলছেন যখন—
বলছি। ধনিয়াকে দিয়ে ইন্দুবাবুকে বলে পাঠাচ্ছি, হিমুর শরীর খারাপ।
হিমাদ্রি অন্যমনস্কভাবে গেট পেরিয়ে খোয়াঢাকা নির্জন রাস্তা ধরে বাজারের মোড়ে গেল। সিগারেট কিনল। সেই সময় সাইকেলরিকশোয় সুনেত্রা ফিরল। হিমাদ্রিকে দেখে সে রিকশো ছেড়ে দিল। তারপর চাপা গলায় বলে উঠল, হিমুদা! বহৎ খতরনাক। কালকের কাগজে তোমার ছবি বেরিয়েছে। শিগগির বাড়ি চলো। টুকুকে মার্ডারের জন্য পুলিশ কাগজে হুলিয়া ছেপে দিয়েছে। ধরে দিলে পাঁচ হাজার টাকা প্রাইজ।
হিমাদ্রির মনে হল, সে শূন্যে নিঃসাড় ভেসে চলেছে।…
.
মন্দিরে এক সন্ন্যাসী
সেতাপগঞ্জের সর্বমঙ্গলা মন্দিরের আটচালায় মাঝেমাঝে সাধু-সন্ন্যাসী এসে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকেন। নিছক গাঁজার লোভেও ভক্ত জুটতে দেরি হয় না। তারপর খবর পেয়ে পরমতত্ত্বের খোঁজে দু-চারজন, কেউ বা আধিব্যাধি মামলা মোকর্দমার ঝামেলা থেকে উদ্ধারের আশাতেও জুটে যায়।
গাঁজালোভীরা ঘুরঘুর করেছে কাল সন্ধ্যা থেকে। দেখেছে এই সাধুবাবার লাইন অন্যরকম। গাঁজার বদলে নস্যি আর হাঁচি। কখনও যোগাসনে ধ্যানীমূর্তি, কখনও ধুনির আলোয় শাস্ত্রপাঠে নিবিষ্ট। লম্বা খেকুটে চেহারা। মাথায় জটা, মুখে লম্বা দাড়ি, পরনে গেরুয়া কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষ–সবই ঠিক আছে। কিন্তু ইনি চা খান। কাছেই রেলের ফটক। ফটকওয়ালা শিবুয়া গাঁজার লোভেই জুটেছিল। কিন্তু সাধুবাবা তাকে পাঁচটাকার নোট দিয়ে বলেছেন, বেটা! হাম চায় পিয়েগা হরঘড়ি। ঔর রাতমে স্রিফ দো রোটি, থোড়াসা ডাল-উল। ব্যস! ঔর শুনো বেটা, টিশনবাজারসে ডিব্বাভরকে থোড়া সা নস্যি।
শিবুয়া লোকটা ভাল। সে আদিবাসী। তার ছোঁয়া চা-রোটি-ডাল খাবেন সাধুবাবা, এর চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে? হাবভাব দেখে তার মনে হয়েছে, এতদিনে একজন সাচ্চা সাধুর সঙ্গলাভ তার হয়েছে। তার বউটা বাঁজা মেয়ে। এদিক থেকেও একটা আশীর্বাদসহ দাওয়া আশা করছে সে।
সকালে কাঁধে প্রকাণ্ড বোঁচকার মতো ঝোলা ঝুলিয়ে কমণ্ডুল হতে সাধুবাবা গঙ্গাস্নান করে ফেরার সময় ফটকে শিবুয়াকে চা আনতে বলে এসেছিলেন।
আটচালায় আসন করে বসে আছেন, হঠাৎ দেখলেন মন্দিরের ধারে কল্কেফুলের জঙ্গলের ভেতর একটা কেমন চেহারার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চমকে উঠেলেন দিনদুপুরে ভূত দেখছেন ভেবে। ময়লা যেমনতেমন শাড়ি পরনে, খালি পা, মাথায় রুক্ষ একরাশ চুল। রোগা হাড়জিরেজিরে মেয়ে। তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকার পর একটা পাথরে বসে পড়ল সে।
শিবুয়া চা আনলে সাধুবাবা জিগ্যেস করলেন, বেটা! দেখো তো উও লড়কি কৌন?
শিবুয়া হাসল। উও তো খুখুদিদি! মঙ্গলামাইকী ভর হোতি উসকি উপ্পর, সাধুবাবা!
কিধার রহতি উও?
উধার! বহৎ বড়া ঘরকী বেটি, বাবা! উও দেখিয়ে, উও মকান। বাঙালি জমিদারবাবুকা। লেকিন, জমিদারবাবু তো মার্ডার হো গেয়া!
মার্ডার হো গেয়া?
হাঁ সাধুবাবা!
শিবুয়া উঠে গেল বউয়ের চিলাচানিতে। বউটা বড় হাড়জ্বালানী মেয়ে। একটু কোথাও গিয়ে বসার যো নেই শিবুয়ার।
সাধুবাবা মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখছিলেন মেয়েটিকে। চা শেষ করে হাত নেড়ে ডাকলেন, এ বেটি! ইধার আ! মেরা পাশ আ যা!
কিন্তু মেয়েটি গ্রাহ্য করল না দেখে উঠে গেলেন কাছে। অমনি সেও উঠে দাঁড়াল। তারপর জঙ্গলে ঢুকে গেল। সাধুবাবাও জঙ্গলে ঢুকলেন। ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো! একবারে অদৃশ্য হয়ে গেল যে! সাধুবাবা ডাকলেন, বেটি! তু কঁহা হ্যায়? মেরা বাত তো শুন্ বেটিয়া!
তারপর জঙ্গল ঠেলে ওপাশে গিয়ে দেখেন, নিচু পাঁচিল ডিঙিয়ে মেয়েটি পোছড়া পাথুরে মাঠটায় গিয়ে পৌঁছুল। সাধুবাবা পাঁচিল ডিঙিয়ে এগিয়ে গেলেন। ডর কাহে বেটি! বাত তো শুন!
এবার মেয়েটি একটি পাথর কুড়িয়ে নিল। সাধুবাবা ভড়কে গেলেন। মেয়েটির চোখদুটি থেকে যেন হিংসা ঠিকরে বেরুচ্ছে।
সাধুবাবা কী করবেন ভাবছিলেন। মেয়েটি হঠাৎ হন হন করে চলতে শুরু করল। তখন উনিও পা বাড়ালেন। কয়েক পা গেছেন, অমনি মেয়েটি ঘুরে হাতের পাথরটা ছুড়ল তার দিকে। অল্পের জন্য মাথা বাঁচল। আর এগোনোর সাহস হল না! বাপস! এ যে একেবারে গোখরো সাপের মতো ফণা তুলেই। আছে।
মেয়েটি যেতে-যেতে মাঝেমাঝে পিছু ফিরে দেখে নিচ্ছে। একটু পরে রাস্তা ডিঙিয়ে গাছপালার ভেতর একটা বাড়ির দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওই বাড়িটাই তাহলে বসন্তনিবাস। সাধুবাবা আটচালায় ফিরে গুম হয়ে বসলেন পদ্মাসনে। একটু পরে একজন দেহাতী লোক মন্দিরে প্রণাম করতে এল। প্রণাম করে সে সাধুবাবাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। তারপর আটচালার নিচে সাষ্টাঙ্গে আবার একটা প্রণাম ঠুকে করযোড়ে বসে রইল। কিন্তু সাধুবাবা চোখ খুলছেন না দেখে নিরাশ হয়ে সে চলে গেল। সাধুবাবা পিটপিট করে তাকিয়ে গলার ভেতর বলেন, জ্বালাতন! বসন্তনিবাস থেকে কেউ আসছে না। যে এসেছিল, সে তো কাছ ঘেঁসতেই দিল না। দেখা যাক, সারাটা দিন পড়ে। আছে সামনে। অগত্যা রাত্রিবেলা দেখা যাবে।…
.
সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ ভাদুড়ী
কিছুক্ষণ আগে সেতাপগঞ্জ থেকে সুনেত্রা ট্রাঙ্ককল করেছে। হিমাদ্রি ওখানে আছে শুনে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন কর্নেল। বলেছেন, ওকে বাড়ি থেকে বেরুতে বারণ কোরো। আমি আগামীকাল যে-কোনো সময় পৌঁছচ্ছি। হাতে কিছু জরুরি কাজ আছে। সুনেত্রার চিঠিটা পেঁছুল এর ঘণ্টাখানেক পরে। সমস্ত ব্যাপারটা বড়বেশি জট পাকিয়ে গেল। ঊর্মি নাকি সুনেত্রাকে লিখেছিল, ওর বাবার হত্যাকাণ্ডের পেছনে ইন্দুমাধব ভট্টাচার্যির হাত আছে। থাকা বিচিত্র নয়। কিন্তু হত্যার পদ্ধতি হুবহু এক। এটাই গণ্ডগোল করে ফেলছে সব। ঊর্মির হত্যাকারীর সঙ্গে তার বাবার হত্যাকারীর কোথায় একটা গরমিল।
রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরির চিঠিটা বের করে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। ..কাউকে বিশ্বাস হয় না, তাই এই চিঠি।… ইন্দু ভটচাযকেও না? তাই তো মানে দাঁড়ায়।
তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, চিঠিটা এতদিন পরে কে ডাকে দিয়েছিল? ওঁর মেজমেয়ে ঊর্মিও কলকাতার ফ্ল্যাটে একইভাবে খুন হওয়ার ঠিক পরেই কেউ চিঠিটা ডাকে দিয়েছিল। এও একটা পয়েন্ট।
হুঁ, হিতাকাঙ্ক্ষী কেউ। যার কাছে মনে হয়ে থাকবে এর একটা আস্কারা করার দরকার আছে। সে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সম্পর্কে খবর না রাখুক, অন্তত এটুকু জানে রুদ্রেন্দুবাবু যাকে এভাবে চিঠি লিখতে চেয়েছিলেন, তার ওপর ভরসা রাখা যায়। তাই সে চিঠিটা ডাকে দিয়েছে। সে কি ভেবেছে হত্যাকারী একজনই?
ঊর্মির হত্যাকাণ্ড না ঘটলে রুদ্রেন্দুবাবুর চিঠিটা পেয়েই ছুটে যেতেন সেতাপগঞ্জে। ভেবেছিলেন, ঊর্মির হত্যাকাণ্ড থেকে এমন কোনো সূত্র পাবেন, যা রুদ্রেন্দুবাবুর হত্যাকাণ্ড রহস্যের মীমাংসা করে দেবে। কিন্তু কৃতান্ত হালদারের অবাঞ্ছিত টেলিগ্রামটা একটা বাড়তি গেরো পাকিয়ে দিয়েছে।
বারো জুলাই সকালে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতর ট্রাঙ্ককল করে বোম্বের ডিলাইট হোটেলে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে তার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিল। ফোনটা করেছিলেন ইন্সপেক্টর মোহনবাবু। মোহনবাবু কর্নেলকে বলেছেন, মৃগাঙ্কবাবুই ফোনে কথা বলেছেন, তাতে তার সন্দেহ নেই। কেন সন্দেহ নেই, তার স্পষ্ট জবাব মোহনবাবু দিতে পারেননি। শুধু বলেছেন, আই অ্যাম, কনভিড়।
কর্নেল সুনেত্রার চিঠিটা খুললেন আবার। ডানায় হলুদ-লাল ফুটকিওয়ালা প্রজাপতি আর উড-ডাকের লোভ দেখিয়েছে। মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিন্তু হাতে একটা জরুরি কাজ বাকি। সেটা চুকে গেলেই নিঃসংশয় হবেন ঊর্মির হত্যাকারী সম্পর্কে। বিকেলের মধ্যেই আশা করছেন সেই মূল্যবান তথ্যটা পেয়ে যাবেন।
সুনেত্রার চিঠির একটা অংশে আবার চোখ রাখলেন। ..ঊর্মির দিদির ভর ওঠার ব্যাপারটাও আপনার চিন্তার খোরাক যোগাবে। ভরের সময় ওর চেহারা কী ভীষণ বদলে যায়। একেবারে রাক্ষুসীর মুর্তি। আপনি যে অত সাহসী, আপনিও ভয় পেয়ে যাবেন। আমার মনে হয়, তখন যদি ওর হাতে ছুরি থাকে, খুন করে ফেলবে। তাই ভর উঠলে ও বাড়ির লোকেরা খুব সাবধান হয়ে যায়। কাউকে কাছে যেতে দেয় না। তখন ওকে একজনই সামলাতে পারে। সে দয়াল ঠাকুর। ওবাড়ির রাঁধুনী। দয়ালকে দেখলে শ্রাবন্তীর ভর থেমে যায় নাকি।…
চিঠি দুটো টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে কর্নেল বেরুলেন।
পার্ক স্ট্রিটে একটা প্রকাণ্ড পুরনো বাড়ির দোতলায় ডাঃ অশোক ভাদুড়ীর চেম্বার সুস্থ মন। নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার। ট্যাংরায় ওঁর মেন্টাল ক্লিনিক। এখানে একটা চেম্বার রেখেছেন। সকাল-সন্ধ্যা ঘণ্টাচারেক করে বসেন।
কর্নেলকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন। হ্যালো ওল্ড বস! ঘিলু বিগড়ে গেল নাকি?
গেছে।
ডাঃ ভাদুড়ি হাসিখুশি মানুষ। হো হো করে হাসলেন। আবার কোন পাগল খুনখারাপি করেছে বুঝি? সাবধান কর্নেল! পাগলের পেছনে এ বয়সে আর ছোটাছুটি করবেন না।
কর্নেল বসে বললেন, একটা কথা জানতে এলাম ডাঃ ভাদুড়ি।
কর্নেলের গম্ভীর মুখ দেখে ডাঃ ভাদুড়ী সিরিয়াস হলেন। …বলুন, বলুন।
এই যে দেবদেবীর ভর-ওঠা ব্যাপারটা কী আসলে?
আপনি বিজ্ঞ মানুষ, কর্নেল! আপনি আমার মতামত জানতে চাইছেন? ডাঃ ভাদুড়ী হাত বাড়িয়ে বললেন, কৈ, আগে একটি বিখ্যাত চুরুট দিন। এতক্ষণ দুডজন মেন্টাল পেসেন্ট ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘিলু জ্যাম হয়ে গেছে। অনেকসময় ধোঁয়া ঘিলুকে চাঙ্গা করে। গ্রামের ওঝারা হিস্টিরিয়ার পেসেন্টের নাকে ঝঝাল ধোঁয়া ঢুকিয়ে দেয়। ব্যস! পেসেন্ট তখন দিব্যি নর্মাল।
চুরুট দিয়ে লাইটারে আগুন ধরিয়ে দিলেন কর্নেল। পকেট থেকে একটা আধপোড়া চুরুট বের করে নিজেও ধরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ভর ওঠার ব্যাপারটাও কি হিস্টিরিয়া ডাঃ ভাদুড়ী?
আলবাৎ হিস্টিরিয়া। তবে এসব কেস কমন হিস্টিরিয়া নয়। হিস্টেরো এপিলেন্সির ঠিক বিপরীত একটা অবস্থা। এপিলেন্সির ফিটে রোগীর সব লক্ষণই প্রায় শারীরিক প্রক্ষোভ। হিস্টিরিয়ায় শারীরিক প্রক্ষোভের সঙ্গে মানসিক প্রক্ষোভও থাকে। কিন্তু মানসিক প্রক্ষোভের মধ্যে অস্পষ্টভাবে সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণও বজায় থাকে। হিস্টেরো-এপিলেন্সিতে
ভর ওঠার কথা বলুন প্লিজ!
সেই বলতে যাচ্ছি। হিস্টিরিয়া হয় কাদের? যাদের নার্ভ-সিস্টেম দুর্বল, আত্মসচেতন, অনুভূতিপ্রবণ, নিজের প্রাপ্য সম্পর্কে সতর্ক, কল্পনাপ্রবণ, বড় বেশি আশা করে থাকে, অথচ ভেতর-ভেতর ভিতু। এ জন্য মেয়েদের মধ্যেই এর প্রকোপ বেশি। এমন পুরুষ নিশ্চয় অসংখ্য আছে। কিন্তু সমাজ পুরুষশাসিত বলে তাদের ওইসব মানসিক বৃত্তি চরিতার্থ হবার সুযোগ পায়। মেয়েরা পায় না। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলব, কামনা-বাসনার অবদমন ঘটাতে বাধ্য হয় মেয়েরা। দিনের পর দিন অবদমিত কামনা-বাসনা জমতে জমতে একসময় যেন বিস্ফোরণ ঘটে।
প্লিজ, ভর ওঠার ব্যাপারটা…
তাই তো বলছি। কোনো আকস্মিক সাংঘাতিক ঘটনার অভিজ্ঞতা অনেকক্ষেত্রে হিস্টিরিয়ার কারণ হতে পারে। আচমকা প্রচণ্ড ভয় পেয়েও এ অসুখ হতে পারে। আবার প্রচণ্ড শোক বা দুঃখ কোনো কারণে চেপে রাখলেও হতে পারে। তো ভর ওঠার ব্যাপারটা আরও জটিল একটা প্রক্রিয়া। প্রকৃতি মানুষের মনেই একটা ব্যবস্থা রেখেছে। স্বপ্ন দেখার মতোই। হিস্টিরিয়ার একটা পর্যায়ে অবদমনকে অসচেতন মনের একটা স্বতশ্চল প্রক্রিয়া বেরিয়ে যেতে দেয়। অনেকটা মুক্তি ঘটে। স্বপ্নেও একই ব্যাপার ঘটে থাকে। প্রক্ষোভের গ্যাস বেরিয়ে যাওয়া বলতে পারেন। কিন্তু হিস্টিরিয়ায় সেই স্বতশ্চল প্রক্রিয়া সাহায্য নেয় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের। যেমন ধরুন, কেউ ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী–কেউ দেবদেবীতে বিশ্বাসী। এদের ক্ষেত্রে ভূতপ্রেত বা দেবদেবীই যেন কথা বলে। তার মানে, দমিত প্রক্ষোভের গ্যাস ভূতপ্রেত বা দেবদেবীর কথা হয়ে বেরিয়ে যায়। বুঝলেন তো?
কর্নেল হাসলেন। ঘিলু আরও জ্যাম হয়ে গেল। ধরুন, কোনো মেয়ের মধ্যে দেবীর ভর উঠেছে। ভরের সময় সে কোনো বিপদ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করল। তারপর তা ঠিক ঘটেও গেল। এমন কেন হয়?
ডাঃ ভাদুড়ী ভুরু কুঁচকে বললেন, শোনা কথা বলছেন তো? অমন হতে পারে না।
হয়েছে।
ডাঃ ভাদুড়ী একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হলে জানবেন, মেয়েটি আগে কিছু টের পেয়েছিল। কিন্তু কোনো কারণে তা বলতে পারছিল না। চেপে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থাৎ সেই অবদমন।
হিস্টিরিয়াগ্রস্ত পেসেন্ট যা করে, সে সম্পর্কে কি সে সচেতন?
মোটেও না। কী শুনলেন এতক্ষণ? ডাঃ ভাদুড়ী হাসতে লাগলেন। সে যা করে–মারধর, এমন কী খুনোখুনি পর্যন্ত–সবই অবচেতন মানসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল। এমন কেস আছে, পেসেন্ট রাতে নিজের জিনিস নিজেই চুরি করে। অবসেসন আর কী! ওই যে কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলা করে বা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সেও ওই অবসেসনের একটা সাধারণ প্রক্রিয়া।
অবসেসন প্রক্রিয়ার মধ্যে খুন করাও কি সম্ভব?
মোটেও অসম্ভব নয়। তবে সত্যি যদি তাই করে, জানবেন যাকে খুন করেছে, তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা আর রাগ লুকিয়ে ছিল অবচেতন মনে।
ওই অবস্থায় তাকে কেউ গাইড করতে পারে না?
শতকরা দুটি বা একটি কেসে দেখা গেছে, কেউ গাইড করেছে। যে গাইড করছে, তার প্রতি পেসেন্টের প্রচণ্ড আতঙ্ক থাকতে পারে, শ্রদ্ধাভক্তি বিশ্বাসও থাকতে পারে। তবে এটা খুব বিপজ্জনক ব্যাপার। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনী তো জানেন!
যে গাইড করছে, তারও ক্ষতি করতে পারে বলছেন?
একজ্যাক্টলি। তবে সেটা নির্ভর করছে একটা বিশেষ অবস্থার ওপর। ধরুন, কোনো পেসেন্ট কারও গাইডেন্সে পড়ে অবসেসন প্রক্রিয়ায় কাউকে খুন করল। জ্ঞান হবার পর যদি সে দৈবাৎ জানতে পারে যে সে খুন করেছে, তার মধ্যে। একটা স্বাভাবিক প্রক্ষোভ সৃষ্টি হবে। তখন আবার অবদমন ঘটলে যে তাকে গাইড করেছে, তার বিপদের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কথাটা হল, জানতে পারা– শুধু জানতে পারা নয়, বিশ্বাস হওয়া যে সে সত্যি সত্যি ওই খুনটা করেছে এবং ওই খুনটা করেছে এবং ওই লোকটার কথাতেই করেছে।
ধরুন, এ বির গাইডেন্সে সিকে খুন করল অবসেসন প্রক্রিয়ায়। এ যদি সির অত্যন্ত আপনজন–মনে করা যাক, বাবা হয়, তাহলে?
বির বিপদের সম্ভাবনা প্রচণ্ড।
বি খুব শক্তিমান আর ধূর্ত লোক হলে?
পেসেন্ট বদ্ধ পাগল হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে। ব্যর্থতার অবদমনের ফলে তার নার্ভ সিস্টেম বাকি জীবনের জন্য ভেঙে পড়বে। ডাঃ ভাদুড়ী চোখে ঝিলিক তুললেন এবং চাপা গলায় বললেন, কেসটা কী?
হাসলেন কর্নেল। পরে জানতে পারবেন। বলে উঠে দাঁড়ালেন।
ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, ও কী! বসুন। কফি আনতে বললুম না?
আপনার পেসেন্টরা হয়তো ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন!
মোটেও না। নটা অব্দি চেম্বারে থাকি। এখন দশটা বাজে প্রায়। টেবিলের স্লিপগুলোর দিকে তাকালেন ডাঃ ভাদুড়ী। দেখতে দেখতে চড়া গলায় হাঁক দিলেন, ব্যানার্জিবাবু! দেখুন তো, কফি আনতে দেরি হচ্ছে কেন?
পার্টিশানের ওদিক থেকে কেউ বলল, এসে গেছে স্যার।
ব্যানার্জিবাবু, একটু আসুন তো আপনি।
কম্পাউন্ডার ব্যানার্জিবাবু চেম্বারে ঢুকলেন। বেঁটে কালো মানুষ। কিন্তু চেহারায় সৌখিনতা রমরম করছে।
মেমসায়েব পেসেন্টের টাকা জমা দিয়ে গেছে?,
না স্যার। আসেই নি আজ।
দেখছেন কাণ্ড? আপনি ফেরার পথে একবার ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হয়ে যান না! অ্যাড্রেস দেওয়া আছে তো?
আছে স্যার।
ঠিক আছে। ওঁকে বলে যান, পরশুর মধ্যে টাকা জমা দিলে পেসেন্ট রাখা যাবে না। দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান তো নয়। তার ওপর অমন জটিল কেস।
কফির পট আর দুটো কাপ-প্লেট রেখে কর্নেলকে অবাক চোখে দেখতে দেখতে চলে গেল একটা কমবয়সী ছেলে। কর্নেল একটু হাসলেন আপনমনে। তাকে দেখে কমবয়সীরা কেন অবাক হয় কে জানে? অরিজিতের মতে, জীবন্ত সান্তাক্লজ মনে করে। কে জানে কী ব্যাপার।
কফি ঢেলে ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, কর্নেল ভাবছেন কী কঞ্জুস ডাক্তার রে বাবা! তাই না?
না, না। ক্লিনিক চালাতে আপনার খরচের ব্যাপার আছে।
কেস খুব পিকিউলিয়ার বলেই হাফ খরচে ভর্তি করিয়েছি। তাছাড়া আমারও একটা নতুন কেস স্টাডি করা হবে। কিন্তু কী যেন নাম মেমসায়েবের?
ব্যানার্জিবাবু বললেন, মিসেস পেরিয়ার।
ঠিক আছে। আপনি আসুন ব্যানার্জিবাবু। দেখুন কী বলে মিসেস পেরিয়ার! ডাঃ ভাদুড়ী কফিতে চুমুক দিয়ে ঘুরলেন কর্নেলর দিকে। ব্যানার্জিবাবু চলে গেলে চাপা গলায় বললেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং কেস। আমাদের প্রফেশনে কী সব অদ্ভুত-অদ্ভুত মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা হয় দেখুন!
কী কেস?
প্যারানইয়াক পেসেন্ট। হাইপোকন্ড্রিয়া থেকে এই স্টেজে এসেছে। অদ্ভুত সিম্পটম। পেসেন্ট দুহাতে নিজের গলা চেপে ধরে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ও নো নো! তারপর অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান অবস্থাতেও শূন্যদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না।
গলা চেপে ধরে বললেন?
ডাঃ ভাদুড়ী দুহাতে নিজের গলার সামনের দিকে চেপে ধরে ভঙ্গিটা দেখিয়ে দিলেন। তারপর আগের মতো আস্তে বললেন, মিসস পেরিয়ার রেডলাইট এরিয়ায় থাকে। বুঝতেই পারছেন কী ব্যাপার। পেসেন্টের বয়স তিরিশ-বত্রিশ হবে। চেহারা মোটেও ভাল নয়। নেহাত সেক্সের দায়ে না ঠেকলে কেউ ওর কাছে যেত বলে মনে হয় না। তো ওইরকম অদ্ভুত সিম্পটম! দুটো সিটিং এই চেম্বারেই দিলাম প্রথমে। সাইকো-অ্যানালেসিস পদ্ধতি প্রয়োগ করে ব্যাপারটার খানিকটা আভাস পেয়ে গেলাম। মাসখানেক আগে একটা লোক ওর কাছে এসে অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দেয়। সে সেক্সটেক্স চায় না। শুধু এই একটা কাজ সে করবে। রোজ আসবে আর করবে।
কী?
হাসলেন ডাঃ ভাদুড়ী। এও ধরে নিতে পারেন সেক্সপার্ভার্সান এক ধরনের। এতেও যৌনতৃপ্তি পায় কেউ কেউ। অর্থাৎ ফিজিক্যাল টর্চার! যাকে বলা হয় স্যাডিজম।
লোকটা তার গলা টিপে ধরত বুঝি?
না। শুনুন না! মেয়েটা টাকার লোভে পড়ে রাজি হয়েছিল। কাজটা হল : লোকটা এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলত, দরজা বন্ধ করো। আমি তিনবার নক করলেই খুলে দেবে। তো প্রথম দিন মেয়েটা তাই করল। আর লোকটা দরজা খোলামাত্র মেয়েটার মুখে একটা হাত চেপে নিজের বুকে টেনে নিয়ে কী একটা ঘষে দিল ওর গলায়। তারপর হাসতে হাসতে ছেড়ে দিল। মেয়েটা প্রথম। দিন ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে আর তত ভয় পেত না। জানত তার খদ্দের কী করবে এবং তাকেও কী করতে হবে। এভাবে সপ্তাহখানেক চলার পর একদিন মেয়েটা আবিষ্কার করল, লোকটা এতদিন একটা কাঠের ছুরি ঘসেছে ওর গলায় একদিন একটা সত্যিকার ছুরি দিয়ে ঘসেছে তবে ছুরিটার উল্টো পিঠ দিয়ে। ব্যস, মেয়েটির মনে আতঙ্ক জন্মে গেল। কিন্তু টাকার লোভ বড় লোভ। প্রতিদিন ওই একটা সময় তার মনে একটা ঝড় বয়ে যায়। দরজা খুলে দেয় নক করলে। লোকটা তার মুখ চেপে ধরে। ঠিক একইভাবে ছুরির উল্টো দিকটা গলায় ঘসে দেয়। তারপর ছেড়ে দিয়ে প্রতিশ্রুতিমতো কুড়িটা টাকা দিয়ে চলে যায়। মেয়েটা টাকা মুঠোয় চেপে ক্লান্তভাবে বসে থাকে। শুধু ভাবে, ছুরিটা যদি আগামীদিন তার গলায় উল্টোদিকে না ঘসে ভুল করে সিধে দিকে ঘসে দেয়! বুঝতে পারছেন তো? হাইপোকন্ড্রিয়ার সূচনা এভাবেই হয়।
কর্নেল আস্তে বললেন, কতদিন আগের এ ঘটনা?
একমাস-দেড়মাস আগে। এভাবে তিন সপ্তাহ বা তার বেশি চলার পর মেয়েটার নার্ভ গেল। মুখের ওপর জবাব দিল। তারপর হল কী, লোকটা আর আসে না। কিন্তু যখনই কেউ দরজায় নক করে, ও দুহাতে নিজের গলা চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ঔ নো নো! তারপর অজ্ঞান হয়ে যায়। মিসেস পেরিয়ার এ সব কিছু জানে না। তার বিশ্বাস, স্বয়ং স্যাটার্ন ওকে ভর করেছে। হাসতে লাগলেন ডাঃ ভাদুড়ী।
নাম কি পেসেন্টের?
এক মিনিট বলছি। ড্রয়ার থেকে মোটা একটা নোটবই বের করলেন ডাঃ ভাদুড়ী। এতে অদ্ভুত কেস হিস্টরি নোট করে রাখি। .., মিস প্যাটি– প্যাট্রিসিয়া।
আপনার ট্যাংরা মেন্টাল ক্লিনিকে আছে?
হ্যাঁ। যাবেন একদিন। একটা অভিজ্ঞতা হবে।
লোকটার কেমন চেহারা বলেনি?
চোখে ঝিলিক দিয়ে হাসলেন ডাঃ ভাদুড়ী। কেন? কোনো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন নাকি?
হয়তো।
চেহারার কথা বলেনি। আদায় করতে পারিনি। আপনাকে যা বললাম, ওর অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে আমিই ব্যাপারটা দাঁড় করিয়েছি। তবে ফেথ ফুল ডেসক্রিপশন অফ দা ইনসিডেন্টস।
আপনি কখন যাবেন ক্লিনিকে?
যাবার সময় হয়ে গেছে কখন।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আমি আজ একটু ব্যস্ত। নৈলে আপনার সঙ্গে যেতাম। তবে একটা অনুরোধ করব। প্লিজ, এলিয়ট রোড হয়ে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে চলুন। এক মিনিট থামবেন। আমি আপনাকে একটা ছবি এনে দেব। আপনি ছবিটা মিস প্যাটিকে দেখাবেন। ওর রিঅ্যাকশনটা আমি জানতে চাই।
ডাঃ ভাদুড়ী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। দমআটকানো গলায় বললেন, রহস্য ঘনীভূত হলো।….
.
ইন্দু ভটচাযের বিবর্তন
সুনেত্রা অস্বস্তিতে আড়ষ্ট। হিমাদ্রি সকালেই বাসে চেপে মুঙ্গেরের দিকে কোথায় চলে গেছে। এখন ভয়, যে কোনো সময় পুলিশ না হানা দেয় সুনেত্রাদের বাড়িতে। হয়তো কতলোক জেনে গেছে হিমাদ্রি ফেরারী আসামী এবং সুনেত্রাদের। বাড়িতেই উঠেছিল। আর সবচেয়ে ভয় ইন্দু ভটচাযকে। উনি যদি জানতেন, ঊর্মিকে খুনের দায়ে হিমাদ্রি পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তাহলে কেলেঙ্কারি ঘটে যেত।
তবু সুনেত্রা হিমাদ্রিকে আর দুটো দিন এখানেই লুকিয়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিল। কলকাতা থেকে কর্নেল এসে গেলে হয়তো হিমাদ্রির আর তত ভয়ের কারণ ছিল না। ওই বুড়ো মানুষটি সম্পর্কে সুনেত্রার বিশ্বাস খুব গভীর। কিন্তু হিমাদ্রি আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গেল।
সুনয়নী খুব বকাবকি করেছেন মেয়েকে। হিমুটা ছোটবেলা থেকেই ঝামেলা বাধাতে ওস্তাদ। হুট করে ওকে বাড়িতে ডেকে এনে ভাল করেনি সুনেত্রা। তার ওপর চরিত্রহীন বলে বদনাম আছে হিমুর। তার সঙ্গে সুনেত্রার এমন মাখামাখি দেখে নিশ্চয় বাঙালিপাড়া জুড়ে এতক্ষণ ভেতর-ভেতর ঢি ঢি পড়ে গেছে।
সুনয়নীর স্বভাব এই। মায়ের এই বৈপরীত্য দেখতে অভ্যস্ত সুনেত্রা। পাত্তা দেয়নি মাকে। কিন্তু তার অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। প্রথম কথা, পুলিশ হয়রানি করতে পারে। দ্বিতীয় কথা, বসন্তনিবাসে ঢোকার মুখ রইল না আর। ও বাড়ির মেয়ের খুনীকে সে ধরিয়ে না দিয়ে পালিয়ে যেতে দিয়েছে কেন?
বিকেলে অস্থির সুনেত্রা বাড়ির পেছনের আগাছাভরা জমিটা পেরিয়ে রেললাইন ডিঙিয়ে নাক বরাবর হেঁটে উঁচু সড়কে উঠল। তারপর গঙ্গার ধারে আকাশিয়া গাছটার তলায় যেতেই চমকে উঠল। অপালা চুপচাপ বসে আছে।
তাকে দেখে অপালা একবার মুখ ঘোরালো। সুনেত্রা পাশে নগ্ন মাটিতে বসে বলল, এখানে কী করছিস রে অপু? আজ বুঝি তোদের ফার্মে যাসনি?
অপালা মাথা দোলাল। একটু পরে সুনেত্রা আরও অবাক হয়ে টের পেল, অপালা যেন নিরিবিলি বসে কান্নাকাটি করছিল। সুনেত্রা ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে রে?
কিছু না।
সুনেত্রা বুঝতে পারছিল না, হিমাদ্রির ব্যাপারটা অপালা জানে কি না। বলল, উঁহু-নিশ্চয় কিছু হয়েছে। বল না অপু আমাকে? আমি কাউকে বলব না।
অপালা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল হঠাৎ। আমার কেন মরণ হয় না বিবিদি? আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।
সুনেত্রা ধমক দিল, কাঁদতে লজ্জা করে না পোড়ারমুখী, ধাড়ী লড়কি হয়েছিস! ওই দ্যাখ, লোকেরা তাকাচ্ছে। চোখ মোছ। মুছে ফ্যাল বলছি!
অপালা আস্তে ভাঙা গলায় বলল, আমি সন্ধ্যার ট্রেনে কলকাতায় মামার কাছে চলে যাচ্ছি।
হয়েছে কী, বলবি তো খুলে? ইন্দুকাকা বকেছে?
অপালা চারদিক দেখে নিয়ে চোখ মুছল। তারপর সুনেত্রার একটা হাত ধরে ফিসফিস করে বলে উঠল, তুমিই আমার আসলি দিদি, বিবিদি! তুমি যেন কাউকে বলে দিও না। আমি বাড়ি থেকে ভেগে এসেছি। ছটার ট্রেনে কলকাতা। যাব। মঙ্গলা মাইজির দিব্যি বিবিদি, বোলো না যেন।
বলব না। কেন তুই ভেগে যাচ্ছিস?
অপালা মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, ইন্দুকাকা রোজ আমাকে ফার্মে নিয়ে যায় আর আজেবাজে কথা বলে। সে দিন আসবার পথে রতুয়ার টাড়ে সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল। কাল অনেক রাতে আমার ঘরের দরজায় গিয়ে ডাকছিল। আমি দরজা খুলিনি। তখন আমাকে শাসালো।
সুনেত্রা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, তুই কী বলছিস। অপু! ইন্দুকাকা–
অপালা ফুঁসে উঠল। বাবা মার্ডার হবার কিছুদিন পর থেকে ইন্দুকাকা আমার পেছনে লেগেছে। লজ্জায় আমি কাউকে বলতে পারি না, বিবিদি। সময়ে-সময়ে ইচ্ছে করেছে, দিই ওর গলায় ছুরি চালিয়ে। এখন তো বুঝতে পারছি, বাবাকে কে মার্ডার করেছে?
সুনেত্রা উত্তেজিতভাবে বলল, জানিস? টুকুও সেটা বুঝতে পেরেছিল। আমাকে লিখেছিল সে।
মেজদিকে আমি বলেছিলাম, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখো। মেজদি বলেছিল, বড়দি একা পড়ে থাকবে। ওকে সামলাবে কে?
লোকটা–আশ্চর্য, ওকে দেখে মনেও হয় না ভেতর-ভেতর এই। সুনেত্রা সতর্কভাবে চারদিক দেখে নিয়ে বলল। তা তুই তোর মামাকে ইশারায় জানালেও পারতিস?
মামা বিশ্বাস করবে না।
হ্যাঁ–বিশ্বাস করাও শক্ত।
তুমি জানো? আজ সকালেও আমাকে ফার্মে নিয়ে যেতে চাইছিল। শরীর খারাপ বললাম। তখন গায়ে হাত দিয়ে দেখতে এল। আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। সোজা বলে দিলাম, মামাকে সব লিখে পাঠাচ্ছি।
তখন কী বলল?
দাঁত বের করে বলল, তোমার মামাই আমাকে সাধছেন তোমাকে বিয়ে করতে!
অসম্ভব। তোর বাবার বয়সী একটা লোক! সুনেত্রা খাপ্পা হয়ে বলল। ওল্ড হ্যাগার্ড! আজ যদি আমার বাবাও বেঁচে থাকতেন রে অপু, দেখতিস ওকে গুলি করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতেন।
অপালা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, আমিও কম নই। আমিই এবার শায়েস্তা করে ফেলতাম ওকে। মারতে মারতে বাড়ি থেকে ভাগিয়ে দিতাম। কিন্তু বড়দির মাথাও তো বিগড়ে দিয়েছে। বড়দি পর্যন্ত ওর দলে।
সুনেত্রা অবাক হয়ে বলল, সে কী রে? খুকুদি ওকে—
কথা কেড়ে অপালা হিসহিস করে বলল, বড়দি ওর কথায় ওঠে বসে। বড়দি কিছুদিন থেকে আমাকে বলছে, আমি তো আর বাঁচব না, অপু। ইন্দুকাকা যা বলবে মেনে চলিস। কক্ষনো ওর অবাধ্য হোসনে। ইন্দুকাকা না থাকলে আজ আমরা ভিখিরি হয়ে যেতাম।
খুকুদি তাই বলছে?
হ্যাঁ–যখন ভাল থাকে, তখন ওইসব কথা বলে।
তুই ওকে বলিসনে কেন, লোকটা তোকে
অপালা মুখ নামিয়ে বলল, ছিঃ!
শরম বাজে তোর! নাদান ছোঁকড়ি! সুনেত্রা ঘড়ি দেখল অন্যমনস্কভাবে। তাই চলে যা মামার কাছে। গিয়ে ওঁকে সব খুলে বল। আর আমিও দেখছি, বদমাসটাকে কেমন করে শায়েস্তা করা যায়। পুলিশ খামোকা রঘুয়াকে দায়ী করেছে, এদিকে আসলি খুনী দেবতা সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপু, টুকুকেও এই ইন্দু ভটচায খুন করে এসেছে জেনে রাখ। স্ট্র্যাটেজি ক্লিয়ার হয়ে গেছে আমার কাছে। তোর বড়দির যা অবস্থা, বেঁচেও না বাঁচার শামিল। টুকু রইল না। বাড়ি আর সম্পত্তির মালিক ছিলি তোরা তিন বোন। এখন যদি তোকে বিয়ে করে ফেলতে পারে, ব্যস! বাচ্চু সিংয়ের মতো লর্ড বনে যাবে ইন্দু ভটচায। হ্যাঁ অপু, ওর মতলব ক্লিয়ার। সে জন্যই তোর বিয়ের চেষ্টা করেনি এতদিন। অন্য কোথাও তোর বিয়ে হলে কী হতে পারত ভেবে দ্যাখ। তোর বর এসে বসন্তনিবাসের মালিক হত। তোদের ফার্মের মালিক হত।…অপু, তুই চলে যা। মামার কাছে। সব কথা খুলে বল ওঁকে। শরম করিসনে।
অপালা বলল, কটা বাজল দেখ তো বিবিদি?
সময় হয়ে গেছে রে! চল, তোকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি।…
.
মারাত্মক অ্যাডভেঞ্চার
সন্ধ্যায় খানিকটা মেঘ জমেছিল আকাশে। জোরালো বাতাসে এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে গেল। নৈলে বৃষ্টি হত এবং মুশকিলে ফেলত সাধুবাবাকে। মন্দিরতলার পশ্চিমে পোড়া মাঠটাতে বড় বড় পাথর ছড়ানো রয়েছে। পাথরে বসে সাধুবাবা চাঁদ দর্শন করছিলেন মুখ ঘুরিয়ে। নবমীর চাঁদ। মাঝেমাঝে মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, আবার বেরিয়ে পড়ছে। সবে সাড়ে সাতটা বাজে। আর একটু অপেক্ষা করবেন ভাবছিলেন। এখানকার লোকেরা সকাল-সকাল শুয়ে পড়ে যেন। এরই মধ্যে নিঝুম নিশুতি হয়ে গেছে। গাছপালার ফাঁকে জুগজুগ করে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে কোথাও কোথাও। বসন্তনিবাসে দোতলার ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে। আলোটা দেখে উসখুস করছিলেন সাধুবাবা। অলোটা এক রহস্যময়-হাতছানি যেন।
দেবীর ভর ওঠা মেয়েটা আবার বিকেলে মন্দিরতলায় এসেছিল। কিন্তু সাধুবাবাকে দেখামাত্র আবার পাথর হাতে নিয়েছিল। ভয় পেয়ে ওকে ঘটাননি সাধুবাবা। ঘণ্টাখানেক ঠায় বসে থেকে হঠাৎ উঠে চলে গেল হনহন করে। অবেলায় একদঙ্গল লোক জুটেছিল আটচালায়। কেউ ভবঘুরে, কেউ আড্ডাবাজ, কেউ কেউ ধার্মিক। আবার কেউ এসেছিল গাঁজার লোভে। নস্যি দেখে ভড়কে গেল। গঙ্গার দুই তীরে সাধুদের অবাধ এক জগৎ। সেতাপগঞ্জে সাধুরা চোখসওয়া। কিন্তু এই সাধুবাবা ধ্যানে বসেছেন তো বসেই আছেন–হয়তো মৌনীবাবা। তাই শেষপর্যন্ত একে একে নিরাশ হয়ে সবাই কেটে পড়েছিল। তারপর সাতটার মধ্যে শিবুয়া এসে রোটি-ডাল ঔর থোড়াসা সজি দিয়ে গেছে শালপাতায়। মন্দিরতলায় ইঁদারা, টিউবেল সবই আছে। সাধুবাবা জানেন, এখন শিবু ফটকওয়ালা ফটকে আড্ডা জমিয়েছে। ঢোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাড়ি বা হাঁড়িয়া গিলছে আর জড়ানো গলায় গান গাইছে একদল লোক।
দিনে বসন্তনিবাসের আনাচে-কানাচে ঘুরে গেছেন সাধুবাবা। পুব আর উত্তর জুড়ে বাগান। চৌহদ্দি ঘিরে ভাঙাচোরা পাঁচিল। মধ্যিখানে প্রকাণ্ড জীর্ণ একটা বাড়ি। সামনের দিকে কয়েকটা মরাই আছে। শিবুয়ার কাছে শুনেছেন, ওখানে একসময় ফুলবাগিচা ছিল। একটা মোটরগাড়িভি ছিল। এখন আর বাড়িটার সে ইজ্জত নেই। এ মুলুকের ক্ষেতিওয়ালা লোকের বাড়ি হয়ে গেছে। ও বাড়ির ছোটি ছোঁকড়িটা তো স্রিফ গাঁওবালি হয়ে উঠেছে।
তর সইছিল না সাধুবাবার। খোয়া ঢাকা নির্জন পথটা ডিঙিয়ে আরেকটা পোড়া এবং আগাছাভরা মাঠ পেরিয়ে বসন্তনিবাসের কাছে পৌঁছে গেলেন। কাঁধে বোঁচকাটা একটু অসুবিধে ঘটিয়েছে। কিন্তু রেখে আসবেনই বা কোথায়? কমণ্ডলুটা ঢুকিয়ে মুশকিল হয়েছে, ওজন যেমন বেড়েছে, তেমনি নড়লেই কেন একটা বিদঘুঁটে শব্দ ঢঙাস্ করে।
আবার মেঘ সরলে চাঁদের আলোয় ভাঙা অংশটা দেখতে পেলেন। উঁকি মেরে দেখলেন, বাগানে কেউ নেই। দোতলার একটা ঘর থেকে খানিকটা আলো তেরচা হয়ে এসে ঘাসের ওপর পড়েছে। কুকুর থাকলে এতক্ষণ সাড়া দিত। অতএব নিশ্চিন্তে ঢোকা যায়।
ওপারে সাবধানে নামলেন। তারপর সেই ফোয়ারার খোঁজে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চললেন সাধুবাবা। জ্যোৎস্না বেশ পরিষ্কার। একটু পরে বাগানের মাঝখানে ফোয়ারা এবং সেই পাথরের মূর্তিটা দেখতে পেলেন। একটু অস্বস্তি হল। এই মূর্তিটা নাকি রাতবিরেতে জ্যান্ত হয়ে বাগানে ঘুরে বেড়ায়।
পাশে একটা মানুষ-সমান উঁচু ঝোপ। ঝোঁপের পাশে বসে পড়লেন সাধুবাবা। তারপর টর্চ বের করে বোঁচকার ভেতর সাবধানে জ্বেলে দেখে নিলেন জ্বলছে। কি না।
মশার উৎপাতে অস্থির। বিহারের মশাগুলো বাঙালি মশাদের চেয়ে তেজী। পরনে মাত্র একটুকরো গেরুয়া কাপড়। খালি গা। ক্রমশ হতাশা ও জ্বালায় নিজের ওপর চটে উঠছিলেন। পাথরের মূর্তিটা জ্যান্ত হতে হতে ফুলে ঢোল হয়ে যাবেন যে!
কতক্ষণ পরে চাঁদটা আবার মেঘে ঢেকে গেল। তারপর হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি। গাছের তলায় যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন, সেই সময় ফোয়ারার মূর্তিটার দিক থেকে আবছা কী একটা শব্দ শুনতে পেলেন। কিন্তু কিছু দেখতে পেলেন না। বৃষ্টিটা মিনিটখানেক পরে থেমে গেল। আবার চাঁদ বেরিয়ে পড়ল মেঘের ফাঁকে। তখন বসে পড়লেন আবার।
আবার শব্দটা শোনা গেল। ফোয়ারার মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার ওপাশ থেকেই শব্দটা ভেসে এসেছে। কেউ কিছুঘসছে ঘসঘস করে। থামছে, আবার ঘসছে। ঘস্ ঘস্ ঘস…ঘস্ ঘস…।
ঝোপ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে একটু এগিয়ে ফোয়ারার অন্যপাশে আরেকটা ঝোপে গিয়ে ঢুকলেন সাধুবাবা। এবার দেখলেন, পাথরের কালো মূর্তির পায়ের কাছে কেউ ঘসছে। পরনে শাড়ি, একরাশ খোলা চুল। আবার জ্যোৎস্না ফুটতেই শিউরে উঠলেন সাধুবাবা। সেই মেয়েটাই বটে! একটা লম্বা ছুরিতে শান দিচ্ছে!
এ কী অদ্ভুত রোমহর্ষক ব্যাপার! মাথামুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছিলেন না সাধুবাবা। দেখা যাক, ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়।
একটু পরে বাড়ির দোতলার সেই আলো-জ্বলা ঘরের জানালা থেকে কেউ গম্ভীর গলায় ডাকল, খুকু! খুকু! সাড়া না পেয়ে লোকটা সরে গেল জানালা থেকে।
মেয়েটা এবার মূর্তিটার পায়ের কাছে উঠে বসল। তার হাতের ছুরিটা দেখা গেল না আর। কিন্তু ওর হাতে সদ্য শান দেওয়া ছুরিটা নিশ্চয় আছে। শিউরে উঠলেন সাধুবাবা।
তারপর দোতলার ঘরের সেই লোকটাই হবে, খুকু, খুকু বলে ডাকতে ডাকতে বাগানে এগিয়ে এল। তার হাতে জ্বলন্ত টর্চ। সাধুবাবা ঝোপে ঢুকে পড়লেন। উঁকি মেরে দেখতে থাকলেন, লোকটার পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি টর্চের আলো ফেলে মেয়েটাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। আবার ওখানে গিয়ে বসে আছ? ধমক দিল লোকটা। উঠে এস, বলছি। উঠে এস!…কী? কথা কানে যায় না? চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব সেদিনকার মতো।
লোকটা এগিয়ে আসতেই মেয়েটা হি হি হি করে হেসে মূর্তির পায়ের কাছ থেকে নেমে দাঁড়াল। তার হাতের ছুরিটা চকচক করে উঠল। লোকটা চাপা গলায় ধমক দিল ফের, আবার ছুরি নিয়ে বেরিয়েছ? ফেলো, ফেলে দাও বলছি।…ফেললে না? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা! বলে সে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, শ্যামা! শ্যামা! এদিকে আয় তো শিগগির! চাবুকটা নিয়ে আয়। মেরে ভূত ভাগাচ্ছি হারামজাদী মেয়ের!
অমনি মেয়েটি ছুরি উঁচিয়ে বিকট চিৎকার করে ছুটে গেল লোকটার দিকে। লোকটা দ্রুত সরে না গেলে সাংঘাতিক কাণ্ড হত।
মেয়েটা আবার তাড়া করল ওকে। লোকটা শ্যামা, শ্যামা বলে চাঁচাতে চাঁচাতে বাড়ির দিকে দৌডুল। মেয়েটা আর তাকে অনুসরণ করল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
একটু পরে বাড়ি থেকে আবার বেরিয়ে এল সেই লোকটা। তার সঙ্গে আরও দুজন লোক আর একটা মেয়ে। সেই লোকটার হাতে চাবুক দেখা যাচ্ছিল। লোকটা চাবুক তুলে সপাৎ করে মারল খুকুকে। খুকু ডুকরে কেঁদে পড়ে গেল। তখন সেই মেয়েটা এসে ওকে ধরে ফেলল। লোকটা চাবুক হাঁকড়ে গর্জাতে থাকল, ছোড় দে মনিয়া! শ্যামা, মাগীকে ধর তো। তারপর দেখছি! দুটোকেই আজ শায়েস্তা করে ভূত ভাগাচ্ছি!
শ্যামা মনিয়াকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। মনিয়া চেঁচিয়ে উঠল, নেমকহারাম! হারামীকাবাচ্চা!
লোকটা সপাং করে চাবুক মারল খুকুকে। খুকু নিঃসাড়। শ্যামা মনিয়াকে ঠেলতে ঠেলতে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। অন্য লোকটা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার বলল, বাবু! খুব হয়েছে! আর না–আর না। মরে যাবে।
লুঙ্গি-পাঞ্জাবিপরা বাবুটি চাবুক তুলেছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। খুকু উঠে বসেছে। মাথা দোলাতে শুরু করেছে। খোলা চুলগুলো এপাশে-ওপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। খুকু কান্নার সুরে কী বলছে, বোঝা যাচ্ছে না।
বাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, দয়াল! ওকে নিয়ে এসো তুমি। তারপর বাড়ির দিকে চলে গেল।
দয়াল নামে লোকটা দাঁড়িয়ে রইল খুকুর পিঠের কাছে। সাধুবাবা কাঠ হয়ে বসে আছেন ঝোঁপের ভেতর। একটু পরে শুনলেন, খুকু মাথা দোলাতে দোলাতে বলছে, আমি রুদ্রকে খুন করেছি। ইন্দুকে খুন করব।…সব্বাইকে খুন করব। আমি রক্ত খেয়ে নাচব।…আমি টুকুকে খুন করেছি। অপুকে খুন করব।…আমি সব্বাইর রক্ত খেয়ে নাচব।…আমি শ্যামাকে খুন করব। দয়ালকে খুন করব। সব্বাইকে খুন করব। সব্বাইর রক্ত খেয়ে নাচব।… হি..হি..হি..হি..!
ভুতুড়ে হাসি হাতে হাসতে হঠাৎ সে আবার হিপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর তার শরীরটা বেঁকে আছড়ে পড়ল এবং স্থির হয়ে গেল।
একটু পরে দয়াল ডাকল, খুকু! মা! এবার ওঠ!
খুকুকে সে টেনে ওঠাল। তারপর তার কাধ ধরে বাড়ি নিয়ে গেল। সাধুবাবার এতক্ষণে মনে হল, এতক্ষণ ধরে যে আশ্চর্য নাটকীয় ঘটনা দেখছিলেন, আগাগোড়া সেটা যেন একটা অদ্ভুত স্বপ্ন। দুঃস্বপ্নই বলা যায়।
বসন্তনিবাসে রোজই হয়তো এমন টুকরো টুকরো নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। একটা পুরো নাটকের একটা দৃশ্য খণ্ডিতভাবে দেখা গেল। বাকিটুকু হয়তো বাড়ির ভেতর ঘটছে এতক্ষণ।
কিন্তু এ মুহূর্তে জরুরি হয়ে উঠেছে সেই ছুরিটা খুঁজে বের করা। ওই ছুরি দিয়েই খুকু নামে দেবীর ভর-ওঠা মেয়েটা নিজের বাবা আর বোনকে খুন করেছে। এরপর তার খুনের তালিকায় আরও কয়েকটা নাম আছে। সর্বনাশ! সর্বনাশ! সাধুবাবা মুহুর্মুহু শিউরে উঠছিলেন।
সাবধানে উঠে বাড়ির দিকটা দেখে নিলেন। বাড়িটা অস্বাভাবিক চুপচাপ। দোতলার জানলা থেকে সেই আলোর ফালিটা তেরচা হয়ে বাগানে এসে পড়েছে। সেখানে কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সাধুবাবা টর্চ জ্বাললেন। সতর্কভাবে টর্চের আলো পায়ের সামনে ফেলে ছুরিটা খুঁজতে থাকলেন। ওটাই তাহলে আসল মার্ডার উইপন। খুঁজলে এখনও হয়তো দুএকফোঁটা শুকনো রক্তের দাগ মিলতে পারে।
টর্চের আলোয় ঘাসের ভেতর ছুরিটা দেখতে পেয়ে সাধুবাবা সেটা কুড়িয়ে নিতে ঝুঁকেছেন, সেই সময় একঝলক উজ্জ্বল আলো তার ওপর এসে পড়ল। অমনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।
যে টর্চ জ্বেলেছিল, সেও থমকে গেছে। রাতবিরেতে বাড়ির বাগানের ভেতর জটাজুটধারী সাধু দেখার আশা সে করেনি। কয়েকসেকেন্ড পরে তার খেয়াল হয়েছে, সাধু যেন ছুরিটাই কুড়োতে হাত বাড়িয়েছিল। ব্যাপারটা গোলমেলে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ছোটবাবু! ছোটবাবু! শিগগির আসুন তো!
দোতলায় আলো-জ্বলা জানালা থেকে সাড়া এল, কী রে শ্যামা!
এক সাধুবাবা ঢুকেছে!
কী ঢুকছে?
সাধু–সাধুবাবা!
ধর তো ব্যাটাকে। ধরে রাখ। আমি যাচ্ছি!
শ্যামা এবার সাহস করে তেড়ে এল এবং তার মারমুখী এগিয়ে আসার সামনে আর তিষ্ঠোনেনার মতো নার্ভ রইল না গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদারের। সটান ঘুরে পাঁচিলের সেই ভাঙা জায়গাটার দিকে দৌড়লেন। কিন্তু বয়স হয়েছে। একসময় পুলিশের চাকরিতে এধরনের মারাত্মক অভিজ্ঞতা প্রচুর পরিমাণে অর্জন করলেও এক্ষেত্রে তার ভূমিকাটাই যে বিপরীত! আগে ক্রিমিন্যাল পালাত এবং তার পেছনে পাঁচিল ডিঙিয়েও দৌড়ুতে পারতেন। এখন তাকেই পালাতে হচ্ছে। এবাড়ির ছোটবাবু লোকটার মেজাজ আর রকমসকম যা দেখেছেন একটু আগে, কিছু বলা যায় না। প্রতিমুহূর্তে পিঠে সপাং করে চাবুক পড়ার আশঙ্কা নিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে পাঁচিলের সেই ভাঙা অংশটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কাঁধের বেঁচকা বিপদ বাধাচ্ছে। সেই সময় চাঁদ ঢেকে আবার কালো মেঘ এবং হাতের টর্চটাও কোনো দুর্বোধ্য কারণে বিগড়ে গেল। গাছপালা ঝোপঝাড়ের ওপর আলো ফেলে শ্যামা চাচাতে দৌড়চ্ছে। ইতিমধ্যে ছোটবাবুও এসে, হাঁকাহাঁকি করছে, চোর! চোর! বাড়িটা শেষপ্রান্তে নিরিবিলি জায়গায় না হলে। এতক্ষণ পাড়ার লোক চারদিক থেকে ঘিরে ফেলত।
ভাঙা পাঁচিলে ওঠার মুহূর্তে শ্যামা পেছন থেকে তার জটা ধরে ফেলল। উপড়ে গেল জটাজুট। তবে কৃতান্তবাবু বেঁচে গেলেন। ওধারে ধপাস করে পড়ে আগাছার ঝোঁপের ভেতর দিয়ে রেললাইনের দিকে দৌডুলেন।
ঠিক দৌড়ুনো নয়–প্রাণের দায়ে পা ফেলা। মাটিটা ভিজে আছে বৃষ্টিতে। আছাড়ও খেলেন। বাষট্টি বছর বয়সেও এই যে এতখানি অ্যাডভেঞ্চার করে ফেললেন, সেটা তিনি পুলিশ ছিলেন বলেই। কেরানিগিরি করলে কি পারতেন? রেলইয়ার্ডে পৌঁছে একটা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ওয়াগনের আড়ালে বসে গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার ছদ্মবেশের বাকি অংশ খুলে বোঁচকা থেকে প্রথমে বের করলেন জুতো, তারপর প্যান্টশার্ট।
একটু পরে সিগারেট ধরিয়ে খিখি করে আপন মনে হাসতে থাকলেন কৃতান্তবাবু। নিজের কীর্তির কথা ভেবেই।
.
টেলিগ্রামের গেরো
আজ সারা দুপুর সারা-বিকেল প্রচণ্ড অস্থিরতায় কাটিয়েছেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। সন্ধ্যা অব্দি ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্লডে গাছপালার পরিচর্যা করেছেন আর কানে প্লেনের শব্দ এলেই বাইনোকুলার চোখে রেখে আকাশে দৃষ্টিপাত করেছেন। আকাশে হাল্কা মেঘের ভেতর লুকোচুরি খেলতে-খেলতে আজ কেন যেন সব প্লেনই বিপরীতমুখী! প্রত্যাশিত প্লেনটি আসবে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে। দমদমে মাটি ছোঁবার কথা তিনটে পঞ্চাশে। দুর্ঘটনা ঘটল না তো?
ষষ্ঠী কফি দিতে এসে অবাক হয়ে বলেছিল, কী পাখি বাবামশাই?
তখন কর্নেল হেসে ফেলেছিলেন। মাঝে মাঝে অস্থিরতা তাঁকে বালক করে ফেলে। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর ২৩১-এ বোয়িং বিমানের পাইলট বদলে যেতেও পারে। অনিন্দ্যর বদলে কোন মালহোত্র কিংবা সিং। আর অনিন্দ্যরও বড্ড ভুলো মন। এইসব ভেবেই মনে অস্থিরতা এত।
রাত আটটায় ফোন করলেন আবার দমদম এয়ারপোর্ট। ইতিপূর্বে দুবারই ফোন করে জেনেছেন, ফ্লাইট লেট। বোম্বে এলাকায় আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ। ফ্লাইট ২৩১ স্থগিত হবার সম্ভাবনা আছে। এতক্ষণে শুনলেন, প্লেনটি টেকঅফ করেছে আধঘণ্টা আগে।
প্রত্যাশিত ফোন এল রাত সওয়া দশটায়। কর্নেল, অনিন্দ্য বলছি। ফ্লাইট সাড়ে ছ ঘণ্টা লেট। যদি না একদঙ্গল ভি আই পি প্যাসেঞ্জার থাকতেন, ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে যেত।
কর্নেল উত্তেজনা দমন করে বললেন, বুঝতে পেরেছি। খবর বলো, ডার্লিং!
অনিন্দের হাসি ভেসে এল। আমি তো ভাবছিলাম আপনাকে পাব না। কোথায় যেন যাবেন বলেছিলেন আজ?
যাওয়া পিছিয়ে দিয়েছি। যাই হোক, খবর বলো।
হ্যাঁ, শুনুন। আইটেম বাই আইটেম বলে যাচ্ছি।
কর্নেল ঝটপট কাগজকলম টেনে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ।
৯ জুলাই মর্নিং ফ্লাইটের ফ্লাইট নম্বর ২২৭ প্যাসেঞ্জার লিস্টে হেমন্ত বোস নামে এক ভদ্রলোকের নাম আছে। কিন্তু উনি সেদিন দমদম এয়ারপোর্টে চেক ইন করেননি। কোনো খবর দিয়ে বুকিং ক্যান্সেলও করেননি। কাজেই সিট খালি ছিল একটা।
হু–১১ জুলাই?
১১ জুলাই মর্নিং ফ্লাইটে হেমন্ত বোস নামে কোনো যাত্রীর নাম নেই।
মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নাম আছে তো?
আছে। উনি চেক ইন করেছিলেন। সিট নম্বর এ-৩৭।
১২ জুলাই?
আমাদের বোম্বে অফিসে ১২ জুলাইয়ের মর্নিং ফ্লাইটে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নামে বুকিং করা হয়েছিল ২৬ জুন।
কর্নেল চমকে উঠলেন। ঠিক দেখেছ?
দেখেছি মানে? রেকর্ড চেক করে বলছি। যাই হোক, ১২ জুলাই মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি চেক ইন করেছিলেন। ওর সিট নাম্বার ছিল বি-১৭।
ওই দিনের ওই ফ্লাইটে হেমন্ত বোস নামে কারুর নাম নেই লিস্টে?
না। লিস্টে নেই।
ওক্কে। হোটেল ডিলাইটে খোঁজ নিয়েছ?
অনিন্দের হাসি শোনা গেল। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস, কর্নেল। হোটেল ডিলাইটে স্যুট নাম্বার ৭২-এ মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির রিজার্ভেশন ছিল। পৌঁছান ১১ জুলাই বেলা দুটোয়। পরদিন সকাল সাড়ে নটায় চেক আউট করে সোজা এয়ারপোর্টে যান।
চেহারার বর্ণনা কিছু পেয়েছ?
চেষ্টা করেছিলাম। ওদের মনে রাখা সম্ভব নয়। শুধু টেলিফোন অপারেটর বলল, তার মনে আছে, স্যুট নাম্বার ৭২-এ কলকাতা থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছিল। বুঝলেন তো? ওদের একটু নাকগলানো স্বভাব–মানে মেয়েদের যা হয়। বলল, বউ মরার খবর এসেছিল। খবর পেয়েই ভদ্রলোক চেক-আউট করেন।
কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ, ডার্লিং! ওয়েলডান।
আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস, মাই ডিয়ার অল ওল্ড ম্যান! গুডনাইট।
গুডনাইট! কর্নেল শান্তভাবে ফোন রাখলেন। তারপর কাগজে লেখা নোটগুলোর দিকে তাকালেন। হু, সব ঠিক করা ছিল। ১২ জুলাই মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি ফিরে আসবে বলে ২৬ জুন প্লেনের টিকিট কেটে রাখা হয়েছিল বোম্বে থেকে। ওইদিন সকালে যদি গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর মোহনবাবু ট্রাঙ্ককল না করতেন, তাও মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি ফিরে আসতেন কলকাতা।
১১ জুলাই রাতে টেলিগ্রাম করেছিল হোটেল ডিলাইট থেকে হেমন্ত বোস। তার মানে, হেমন্ত বোস তখনও জানত না তার মনিবের উদ্দেশ্য কী। মনিবের নামের টিকিটে সে বোম্বে গিয়েছিল। হয়তো কার্গো সম্পর্কে খবর নিয়ে স্বাভাবিক কর্তব্যবোধে জরুরি টেলিগ্রাম করেছিল। হোটেলে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নামেই স্যুট বুক করা ছিল। কাজেই তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি সাজা ছাড়া উপায় ছিল না। ১২ জুলাই সকালে ইন্সপেক্টর মোহনবাবুর ফোন পেয়ে সে চমকে গিয়ে থাকবে। কিন্তু তাহলে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ১২ জুলাই মৃগাঙ্কের নামে প্লেনের টিকিট বুক করা ছিল। হেমন্ত যদি জানত একথা, তাহলে আগের রাতে টেলিগ্রাম করল কেন?
কৃতান্ত হালদার সত্যিই একটা অসাধারণ সূত্র হাতে এনে দিয়েছেন। হেমন্ত বোসের টেলিগ্রামটা একটা মূল্যবান ডকুমেন্ট। শিপিং কোম্পানিতে খোঁজ নিলেও নিশ্চয় জানা যাবে হেমন্ত বোসই সেখানে কার্গো সম্পর্কে খবর নিতে গিয়েছিল।
কর্নেল চোখ বুজে দাড়ি টানতে শুরু করলেন।
স্বাভাবিক কর্তব্যবোধেই কি টেলিগ্রামটা করেছিল হেমন্ত বোস? কিন্তু সে তো জানত, ১২ জুলাই তাকে কলকাতা ফিরতে হবে আবার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি হয়ে। তাহলে কেন সে টেলিগ্রাম করল মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নামে?
হুঁ, টেলিগ্রামটা ছিঁড়ে–শুধু ছিঁড়ে নয়, পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন মৃগাঙ্কবাবু। বিব্রত বোধ করেছিলেন কি? ধূর্ত হেমন্ত বোস কি তাকে
কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। ডিসি ডিডি অরিজিৎ লাহিড়ী এখন রাত এগারোটায় নিজের ফ্ল্যাটে থাকার সম্ভাবনা।
সাড়া পেলেন সঙ্গে সঙ্গে। কর্নেল বললেন, আশা করি, ঘুম ভাঙাইনি ডার্লিং?
না। গোদারের একটা চিত্রনাট্য পড়ছি। অসাধারণ!
বুঝতে পারছি, তুমি ভবিষ্যতে চাকরি ছেড়ে আর্ট ফিল্ম করবে। পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটে অর্জিত জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা তোমার আছে।
প্রশংসা, না নিন্দা করছেন কে জানে!
প্রশংসা। তো শোনো
মাই গুডনেস! আপনি সেতাপগঞ্জ যাননি?
যাব। শোনো–কাল এগারোটা নাগাদ একবার সময় করে নাও। তোমাকে নিয়ে একবার বেরুতে চাই। বেশি দূরে নয়। টাংরা অঞ্চলে একটা মেন্টাল ক্লিনিকে।
কী সর্বনাশ! আমার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে আপনি কি সন্দিহান?
ডাঃ অশোক ভাদুড়ী সাইকিয়াট্রিস্টের নাম আশা করি শুনেছ।
শুনেছি। কিন্তুমাই গড়! আপনি কী বলছেন!
প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, তোমার অভিজ্ঞতাটা হবে অত্যন্ত চমকপ্রদ।
ব্যাপারটা কী খুলে বলুন না প্লিজ! একে তো গোদার গোলমেলেনার্ভের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন ভদ্রলোক, তার ওপর আপনি আরও এককাঠি সরেস। কাল সকালেই ডাঃ ভাদুড়ীর পেসেন্ট করতে চাইছেন আমাকে! ও! হরি!
ডার্লিং, লজিক শাস্ত্রে অবভাসতত্ত্ব বলে একটা টার্ম আছে জান তো? হোয়াট অ্যাপিয়ারস, ইজ নট রিয়্যাল। যাই হোক, আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।
অরিজিৎ কিছু বলার আগে ফোন রেখে দিলেন কর্নেল। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের পাইলট ক্যাপ্টেন অনিন্দ্য মিত্রের দেওয়া তথ্যগুলোর ওপর আবার চোখ রাখলেন। হুঁ, টেলিগ্রামটা মূল্যবানই বটে।
.
মিস প্যাটির খদ্দের
অরিজিৎ লাহিড়ীর গাড়ি কাটায় কাটায় এগারোটায় এসেছিল। তার মুখে উত্তেজনা ও কৌতূহল থমথম করছিল। কর্নেল তার প্রশ্নের জবাবে শুধু বললেন, তোমাকে একজন মেন্টাল পেসেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। বাকিটা তুমি ডাঃ ভাদুড়ীর মুখে শুনবে। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়েছেন অরিজিৎ, সেই সময় কেউ চেঁচিয়ে উঠল, কর্নেল স্যার! কর্নেল স্যার!
কর্নেল ঘুরে দেখেন, সবে একটা ট্যাক্সি থেকে নেমে গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার ভাড়া মেটাতে মেটাতে চেরা গলায় ক্রমাগত চ্যাঁচাচ্ছেন, কর্নেল স্যার! কর্নেল স্যার!
কাছে এসে ডিসি ডিডিকে দেখে প্রাক্তন অভ্যাসে খট করে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকে কৃতান্ত হালদার একগাল হাসলেন। আশাতীত গৌভাগ্য স্যার! দুজনকেই একত্র পেয়ে গেলাম। আর একটু হলেই মিস করতাম।
কর্নেল বললেন, আপনি সেতাপগঞ্জ যাননি?
সেখান থেকেই তো ফিরছি। কাল রাত নটা দশে ট্রেন ছেড়েছে, হাওড়া পৌঁছুলো দশটায়। উঃ! ছ্যাকরা গাড়িরও অধম।
কর্নেল ছিলেন সামনের দিকে। পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আসুন!
কৃতান্তবাবু গাড়িতে ঢুকে আরাম করে বসে বললেন, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন স্যার?
জবাবটা অরিজিৎ দিলেন। পাগলাগারদে হালদারবাবু! ভেবে দেখুন, কী। করবেন।
খিকখিক করে হাসলেন কৃতান্তবাবু। তা যা বলেছেন স্যার! পাগল করে ছাড়লে ব্যাটারা। বিস্তর ক্রিমিন্যাল ঘেঁটেছি, এমন সাংঘাতিক ক্রিমিন্যাল কখনও দেখিনি!
কার কথা বলছেন হালদারবাবু?
আজ্ঞে, সেতাপগঞ্জের ইন্দু ভট্টাচার্য। আপনি চেনেন কী না জানি না, কর্নেল স্যার চেনেন। উঃ, রোগা মেয়েটাকে আমার চোখের সামনে চাবুক মেরে ফ্ল্যাট করে দিল–চোখে জল এসে যাচ্ছিল স্যার! কিন্তু উপায় ছিল না। তখন আমি বেকায়দায় আছি। সাধুর ছদ্মবেশে। মাথায় জটা, পরনে গেরুয়া একটুকরো বস্ত্র। এদিকে মশার কামড়, বৃষ্টি। বাস্!
কর্নেল ঘুরে তাকালেন কৃতান্তবাবুর দিকে। তখন কৃতান্তবাবু বললেন, হ্যাঁ, গোড়া থেকেই বলছি। সে এক সাংঘাতিক এক্সপিরিয়েন্স বলতে গেলে। গেলাম রহস্যের জট ছাড়াতে–তো আরও জট বেধে গেল। হাল ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম।
কৃতান্ত হালদার সবিস্তারে বলতে শুরু করলেন। ট্যাংরায় ডাঃ ভাদুড়ীর মেন্টাল ক্লিনিকের গেটে তার বিবরণ মোটামুটি শেষ হল। তবে বিশ্লেষণ বাকি থেকে গেল। কথা দিলেন, ফেরার পথে তার বিশ্লেষণ-ভিত্তিক থিওরি তুলে ধরবেন। অরিজিৎ রসিকতা করে বললেন, আপনাকে আমরা এখানে রেখে যাব ভাবছি হালদারবাবু!
কৃতান্ত হালদার মনে বেজায় রুষ্ট। কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, তাহলে তো বেঁচে যাই স্যার! পাগল হওয়ার চেয়ে সুখ নেই।
তাহলে আপনার ডিটেকটিভ এজেন্সির কী হবে?
কৃতান্তবাবু কী জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, ডাঃ ভাদুড়ী অভ্যর্থনা করতে আসায় বাধা পড়ল। মনে মনে যথেষ্ট অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়েই রইলেন কৃতান্ত হালদার। তবে আসার সময় সেতাপগঞ্জ স্টেশনের পাবলিক বুথ থেকে থানায় ফোন করে এসেছেন, রুদ্রে রায়চৌধুরিকে যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছিল, সেটা বসন্তনিবাসের বাগানে এখনও পড়ে আছে। শিগগির গেলে সেটা পাওয়া যাবে। আর রুদ্ৰেন্দুবাবুর বড় মেয়েকে জেরা করলেই বেরিয়ে পড়বে আসল কথাটা। নিজের নামধাম বলেননি কৃতান্ত হালদার। শুধু বলেছেন, আমি পুলিশের বন্ধু। দেখা যাক, বিহার ভার্সেস পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মধ্যে বেধে যায় নাকি। বাধা উচিত। কারণ, মেয়েটা সম্ভবত জানে, একই লোক তার বাবাকে আর বোনকে খুন করেছে। ভর ওঠার সময় আমি খুন করেছি বলছিল বারবার। ওর ওই আমিটা কে, জেরার মুখে বেরিয়ে পড়বেই। আমি নিয়েই যত রহস্য। তবে সে আর যেই হোক, কখনো হিমাদ্রি রায় নয়।…
ডাঃ ভাদুড়ী অফিসে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তারপর বললেন, আজ সকাল থেকে পেসেন্টের অবস্থা কিছুটা ভাল। রাতে বিশেষ ডিসটার্ব করেনি। একটু আগে দেখলাম, শুয়ে বই পড়ছে।
অরিজিৎ গম্ভীর। কর্নেল বললেন, ডাঃ ভাদুড়ী, ডি সি সাহেবকে তাহলে ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুনিয়ে দিন।
অরিজিৎ তাকালেন। ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, কফি আসুক। আপনার রকমসকম তো জানি। কফি না হলে আপনার ব্রেন খোলে না। আর কৈ, একটা বিখ্যাত চুরুট দিন। আমিও ঘিলুকে চাঙ্গা করে নিই।
কফি এসে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। বলা ছিল আগে থেকে। চুরুট টানতে টানতে ডাঃ ভাদুড়ী শুরু করলেন তার এক পেসেন্ট মিস প্যাটির কাহিনী। সবিস্তারে–বেশ খানিকটা রঙ চড়িয়েই।
অরিজিৎ নিষ্পলক তাকিয়ে শুনছিলেন। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। চুমুক দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। এবার ঠাণ্ডা কফি গিলে নিয়ে বললেন, কিন্তু লোকটা কে, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না।
ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, একমিনিট। এখনও শেষ করিনি।
বলুন।
কর্নেল আমাকে গতকাল একটা ছবি দিয়ে বলেছিলেন, ছবিটা মিস প্যাটিকে দেখিয়ে ওর রিঅ্যাকশন, যেন লক্ষ্য করি। শুনলে অবাক হবেন, ছবি দেখা মাত্র প্যাটি ভায়লেন্ট হয়ে উঠল। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান হলে ফিস ফিস করে বলল, লোকটা আছে, না চলে গেছে?
দেখি ছবিটা।
ড্রয়ার থেকে, ডাঃ ভাদুড়ী ছবিটা বের করে একটু হাসলেন। আপনাকে একটু স্টান্ট দেব স্যার, অপরাধ নেবেন না। প্লিজ, আসুন আমার সঙ্গে। প্যাটিকে আলাদা একটা কেবিনে রেখেছি কাল থেকে। কারণ ভয় ছিল, ছবিটা দেখার পর ওর আরও কিছু রিঅ্যাকশন দফায় দফায় ঘটতে পারে। অন্য পেসেন্টের ক্ষতি করতে পারে।
লম্বা করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন ডাঃ ভাদুড়ী। দরজা বাইরে থেকে লক করা আছে। চাপা গলায় বললেন, বারণ করা ছিল কেউ যেন ভুলেও দরজায় নক না করে। দরকার হলে সাবধানে যেন নিঃশব্দে দরজা খুলে ঢোকে। কিন্তু এবার আমি নক করতে চাই। দেখা যাক, কী ঘটে।
বলে ডাঃ ভাদুড়ী কপাটে তিনবার নক করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে চিৎকার শোনা গেল, নো নো! গো ব্যাক ইউ সোয়াইন! গো ব্যাক! ইউ সন অফ এ বিচ… ডার্টি ডগ… গো ব্যাক অর আই কিল ইউ। তারপর কান্নাজড়ানো গলা–অ্যান্টি! অ্যান্টি! হেল্প মি প্লিজ! হে হে হে! তারপর সব চুপ।
দরজা প্রায় নিঃশব্দে খুলে প্রথমে ঘরে ঢুকলেন ডাঃ ভাদুড়ী। তারপর অরিজিৎ ও কর্নেল। দরজার কাছে ভয়েভয়ে উঁকি মেরে রইলেন কৃতান্তবাবু।
বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে একটা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে-রোগা লম্বাটে গড়ন। পা দুটো কাঁপছে। দুহাতের নিজের গলাটা আঁকড়ে ধরে আছে। ডাঃ ভাদুড়ী ডাকলেন, মিস প্যাটি! জাস্ট লুক! মিস প্যাটি! ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড, প্লিজ! লুক!
পিঠে হাত রেখে ওকে ঘুরিয়ে চিত করে দিলেন। মিস প্যাটি চোখ পিটপিট করে তাকাল। তারপর উঠে বসল। প্রত্যেকটা মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে সে যেন আশ্বস্ত হল। তারপর কর্নেলের দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল, ফাদার! সেভ মি ফাদার! আই অ্যাম এ সিনার! ও ফাদার, আই কনফেস!
পেছন থেকে কৃতান্তবাবু ফিসফিসিয়ে উঠলেন, কর্নেলকে পাদ্রীবাবা ভেবেছে। খি খি খি!
অরিজিৎ ঘুরে চোখ কটমটিয়ে তাকালে কৃতান্তবাবু গম্ভীর হলেন। কর্নেল প্যাটির বিছানায় বসে যথার্থ পাদ্রীর ঢঙে ইংরেজিতে বললেন, আমি তোমাকে চার্চে নিয়ে যাব, বাছা! কিছু ভেবো না। আর শোনো, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি। হলেন কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের বড়কর্তা। যে লোকটা রোজ এসে তোমার দরজা নক করত আর তুমি দরজা খুললেই তোমার মুখ চেপে ধরে গলায় ছুরির উল্টোপিঠটা ঘসত, তাকে উনি পাকড়াও করে ফেলবেন।
প্যাটি অরিজিৎকে দেখছিল। অরিজিৎ বললেন, হ্যাঁ, তাকে আমরা শিগগির পাকড়াও করছি, মিস প্যাটি!
কর্নেল বললেন, তুমি কি লোকটাকে চিনিয়ে দিতে পারবে, মেয়ে?
প্যাটি আস্তে মাথা দোলাল।
কর্নেল ডাঃ ভাদুড়ীর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে বললেন, তাহলে তুমি এবার বলো, এই ছবির লোকটাই সেই লোক কি না।
প্যাটিকে ছবিটা দেখাতেই সে দুহাতে মুখ ঢেকে চেঁচিয়ে উঠল, ও নো নো! ওকে তোমরা এক্ষুণি জেলে পাঠাও। নৈলে ও আমার শ্বাসনালী কেটে ফেলবে।
কর্নেল একটু হেসে ছবিটা অরিজিতের হাতে হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, তাহলে এবার আশা করি তুমি শ্রীমতী ঊর্মির খুনীকে গ্রেফতারের হুকুম দেবে, অরিজিৎ!
অরিজিৎ ছবিটা দেখেই চমকে উঠলেন। অন্য কাউকে দেখার আশাই করছিলেন এতক্ষণ। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ও মাই গড! এ যে দেখছি মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি! আর সঙ্গে সঙ্গে কৃতান্ত হালদার মাটিছাড়া হয়ে প্রায় চাঁচালেন, আমি জিতে গেছি। আমি জিতে গেছি!
.
ব্ল্যাকমেলারের শাস্তি
অফিসঘরে ফিরে এসেছেন সবাই। অরিজিতের মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। ছবিটা এখনও তার হাতে। ডাঃ ভাদুড়ী আর কৃতান্ত হালদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কর্নেল বুঝতে পারছিলেন ডিসি ডিডি খুব ফাঁপরে পড়েছেন। মিনিস্টারের ভাগ্নেকে গ্রেফতারের হুকুম দেওয়া শুধু নয়, এ কেসের মুখ একেবারে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়তো একটু কঠিন। পুলিশ প্রশাসন ঝাঁকুনি খাবে। হিমাদ্রির ছবি ছাপিয়ে পুরস্কার ঘোষণা করে যে হঠকারিতা ঘটানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কাগজগুলোও তেড়েমেড়ে আসরে নামবে। অরিজিতের কপালে ঘামের ফোঁটা জমছে।
অরিজিৎ একটা আড়ষ্ট হাত টেবিলের ফোনে রাখলে কর্নেল একটু হেসে বললেন, স্ত্রীর সতীত্বে মৃগাঙ্কের সংশয় ছিল। তাই প্রাইভেট গোয়েন্দা আমাদের এই মিঃ হালদারকে সে স্ত্রীর গতিবিধির খবর নিতে বলেছিল। তারপর নিঃসংশয় হয়ে সে সিদ্ধান্ত করে, একটা ফয়সালা করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পরে, ডিভোর্সের পথে না গিয়ে সে এই সাংঘাতিক পথে গেল কেন? আসলে এই প্রবণতা নিহিত ছিল তার চরিত্রের ভেতর। সে আজীবন লড়াই করে বড় হয়েছে। তার প্রকৃতি রুক্ষ। ন্যায়-অন্যায় বোধ কম। মামা মন্ত্রী হবার পর স্বভাবত সে বড়লোক হবার সবরকম সুযোগ-সুবিধা লুটে নিতে ছাড়েনি। দুর্নীতির পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা পর্যায়ে মানুষের মধ্যে ক্রমশ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ক্রুরতা জেগে ওঠে। বেপরোয়া হতে থাকে সে। সেই ক্রুরতা আর উদ্ধত সাহসই তাকে অসতী স্ত্রীর প্রতি হিংস্র করে তুলেছিল। সে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চেয়েছিল ঊর্মিকে। সেই সময়–গত ১১ এপ্রিল হঠাৎ তার শ্বশুর খুন হয়ে গেলেন। সে ওঁদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে ফেলেছে। অমনি সে ঊর্মিকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিল। বলা যায়, রুদ্ৰেন্দুবাবুর হত্যাকাণ্ড তাকে প্রেরণা যোগাল। হত্যার পদ্ধতি–মোডুস অপারেন্ডি যদি এক হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ঊর্মিদের পারিবারিক ঘটনার সঙ্গে ঊর্মির হত্যাকাণ্ডটাও জড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ বাবার হত্যাকারীই মেয়ের হত্যাকারী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে গিয়েই সে হিমাদ্রিকে পেয়ে গেল। অথচ সুব্রতের ওপরও তার রাগ ছিল। কারণ কৃতান্তবাবুর কাছে সে জানতে পেরেছিল, সুব্রত তার বউয়ের প্রেমিক। কিন্তু সুব্রতকে জড়াতে গেলে রুদ্রেন্দুবাবুকে খুন করার মোটিভ পাওয়া। যাবে না। মোটিভ শক্ত হওয়া চাই। এদিকে হিমাদ্রির সঙ্গে ঊর্মির প্রণয়ের কথাও সে কৃতান্তবাবুর মারফত জেনে গেছে। সেতাপগঞ্জে যা যা ঘটেছিল তাও তার অজানা নেই। রুদ্রেন্দুবাবু একই কারণে ভিটেছাড়া করেছিলেন হিমাদ্রিদের ফ্যামিলিকে। কাজেই একমাত্র হিমাদ্রির পক্ষেই বাবা ও মেয়েকে হত্যার মোটিভ অত্যন্ত জোরালো। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। নিজের হাতে অসতী স্ত্রীকে শাস্তি দিতে হলে যে নিষ্ঠুর ক্রুরতা থাকা চাই, তা তার আছে। হত্যাপদ্ধতিও একই হবে। তাই সে হাত প্র্যাকটিস করতে চাইল।
কৃতান্ত হালদার বললেন, বুঝে ফেলেছি। ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটার ওপর দিয়ে হাত প্র্যাকটিস
অরিজিৎ অনুচ্চস্বরে ধমক দিলেন, আঃ! আপনি চুপ করুন তো!
কৃতান্তবাবু ক্ষুব্ধ হয়ে তোক গিয়ে বললেন, বলুন কর্নেল স্যার! প্রথম দিনই আমি বলেছিলাম কি না, মৃগাঙ্কবাবুই খুনী?
কর্নেল বললেন, লোডশেডিং থাকলে দরজা তিনবার নক করা এবং অন্য সময় তিনবার কলিংবেল বাজানো মৃগাঙ্কের অভ্যাস। সেটা রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর কাছে জেনেছি, কিন্তু যেই ঊর্মি দরজা খুলবে, তাকে অমনি নিঃশব্দে এবং কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে খতম করতে হবে শ্বাসনালী কেটে। টু শব্দ করতে দেওয়া হবে না। কারণ পাশের ফ্ল্যাটের একটা কুকুর এবং এক ভদ্রমহিলার বড় নাকগলানো স্বভাব। তাছাড়া উভয়ের কান বড্ড বেশি সজাগ। অতএব হাত প্র্যাকটিশ জরুরি ছিল। সে তখন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক বোকাসোকা বারবনিতা মিস প্যাটিকে খুঁজে বের করল।
অরিজিৎ আস্তে বললেন, কিন্তু মৃগাঙ্ক ১১ জুলাই বোম্বেতে ছিল! তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।
না। তার নামে প্লেনের টিকিট কাটা হয়েছিল। গিয়েছিল তার প্রতিনিধি হেমন্ত বোস। ১২ জুলাই হোটেল ডিলাইটে যাকে তোমাদের ইন্সপেক্টর মোহনবাবু ট্রাঙ্ককল করে ঊর্মির মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন, সে হেমন্ত বোস। কিন্তু হেমন্ত বোস ধুরন্ধর লোক। সে বোম্বে পৌঁছেই একটা টেলিগ্রাম করেছিল মৃগাঙ্ককে। ওটাই তার সেদিন বোম্বেতে থাকার একটা শক্ত এভিডেন্স। সম্ভবত সে ব্যাপারটা টের পেয়েই মৃগাঙ্ককে ব্লাকমেলের ফন্দি এঁটেছিল। টেলিগ্রামটা সে পাঠিয়েছিল তারই সংকেত হিসেবে। চতুর মৃগাঙ্ক বুঝতে পেরেছিল হেমন্তের উদ্দেশ্য।
অরিজিৎ দ্রুত ডায়াল করলেন মৃগাঙ্কের অফিসে। হেমন্তবাবুকে চাইছি! কী? কখন? কী আশ্চর্য! হ্যাঁলা! হ্যালো! হ্যালো!
কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন। অরিজিৎ ফোন নামিয়ে রেখে বললেন, হেমন্ত বোস কিছুক্ষণ আগে অফিসের পাঁচতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
কৃতান্ত হালদার চেঁচিয়ে উঠলেন, মার্ডার! মার্ডার না হয়ে যায় না!
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ–মার্ডার। অরিজিৎ! অরিজিৎ! আর এক মুহূর্তও দেরি নয়। তোমার এবার অনেক জরুরি কাজ এসে গেছে।
অরিজিৎ আবার ফোন তুলে ডায়াল করলেন। এবার লালবাজার সদর দফতরে।
.
মামা-ভাগ্নীর স্বপ্নভঙ্গ
কর্নেল বিকেলে ছাদে গিয়ে একটা ক্যাকটাসের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। অ্যারিজোনার মরু অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ব্যারেল ক্যাকটাস। দেখতে ব্যারেল বা পিপের মতো। বাংলার কোমল জলবায়ুতে কিছুদিন কষ্ট পাওয়ার পর এখন সামলে উঠেছে। মাথায় গোলাপী মুকুট পরে নিয়েছে। কাটাগুলোর রঙেও সবুজের ঘোর লেগেছে। তবু চেহারা দেখে হাসি পায়। যেন ইউরোপের মধ্যযুগের সেই রাজসভার ভড়। পেটমোটা কুমড়োপটাস। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, না ডার্লিং! তোমাকে বরং বলা যাক্ গাগাঁতুয়া পাতাগ্রুয়েল। কী? খুশি তো?
ষষ্ঠী এসে দেখল, বাবামশাই বিড় বিড় করে কী বলছেন আর হাসছেন। আজকাল কী যেন হয়েছে ওঁর। মাথার গণ্ডগোল হয়নি তো? সে খুক করে কাসল।
কর্নেল ঘুরে তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ষষ্ঠী, মজা দেখে যা।
বাবামশাই, এক ভদ্রলোক এয়েছেন। সঙ্গে মেয়েছেলেও রয়েছেন।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালে ষষ্ঠী ঝটপট বলল, মাথায় নম্বা-লম্বা চুল, মোটা করে। আর মেয়েছেলেটা কেমন যেন জংলি-জংলি ভাব। গেরামের মেয়েছেলের মতো। কেমন যেন
কর্নেল নেমে গিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকলেন। আরে! বনবিহারীবাবু যে! বলে ওঁর পাশে বসে থাকা ঊনিশ-কুড়ি বছর বয়সের এবং সত্যিই জংলি-জংলি ভাবের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। সম্ভবত আপনার ছোট ভাগ্নী অপালা?
বনবিহারীবাবুও হাসলেন। আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন স্যার!
মৃগাঙ্কবাবুকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে শুনেছেন, কি?
শুনেছি। ডি সি সায়েবের কাছ থেকেই আসছি। উনি আপনার কাছে আসতে বললেন।
কর্নেল অপালাকে সস্নেহে বললেন, তুমি কখন এসেছ?
অপালা লজ্জিতভাবে মুখ নামিয়ে বলল, আজ ভোরবেলা।
বোঝা যাচ্ছিল, সে যথেষ্ট আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। বনবিহারীবাবু বললেন, প্রথমে ডি সি সায়েবের কাছে ওকে সঙ্গে করে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ওঁরা যদি বিহার পুলিসকে একটু বলে দেন তাতে কাজ হবে। কিন্তু ডি সি সায়েব বললেন, কিছু দরকার নেই। কর্নেলসায়েব হয়তো সেতাপগঞ্জ যাবেন। ওঁকে বলুন।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, নতুন কিছু ঘটেছে ওখানে?
ঘটেছে মানে–অপালা এসে যা বলল, তাতে তো আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারিনি, মানুষ এমন জানোয়ার হতে পারে। আপনাকে ইন্দু ভটচায়ের কথা বলেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, রুদ্রদাকে সেই খুন করেছে। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষে গেছে রুদ্রদা! বনবিহারীবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, তার এমন সাহস যে সে অপুর গায়ে হাত ওঠায়?
মারধর করেছে বুঝি?
চোখ জ্বলে উঠলে বনবিহারীবাবুর। ইন্দু হারামজাদা অপুকে বিয়ে করতে চায়! স্পর্ধাটা দেখুন একবার। অপুর বাপের বয়সী ব্যাটা! নেমকহারাম! আবার বলেছে, আমার নাকি এতে সায় আছে। বুঝুন!
কর্নেল অপালার দিকে তাকালেন। অপালা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেকদিন থেকে আমার পেছনে লেগেছে ইন্দুকাকা। বাবা খুন হওয়ার পর থেকে। আমার। শরম বাজত। তাই কাউকে কিছু বলিনি। কাল দয়ালদা চুপি চুপি বলল, মামার কাছে চলে যাও। নইলে বিপদ হতে পারে।
কে দয়াল?
বনবিহারীবাবু বললেন, রাঁধুনি। একমাত্র ওই লোকটাই খাঁটি মানুষ ওদের বাড়িতে।
অপালা চোখ মুছে বলল, আর মনিয়াও ভাল। সে না থাকলে বড়দি মরে যেত।
কর্নেল চোখ বুজেছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, তুমিই তোমার বাবার একটা চিঠি পোস্ট করেছিলে কি অপালা–আমার নাম-ঠিকানা লেখা চিঠি?
অপালা আস্তে বলল, হ্যাঁ। চিঠিটা বাবার বিছানার তলায় পেয়েছিলাম। খামের মুখ আঁটা ছিল। ভাবলাম, চিঠিটা বাবা পোস্ট করতে ভুলে গিয়েছিল।
তুমি জানতে না চিঠিতে কী, লেখা আছে?
কর্নেলের চোখের দিকে তাকিয়ে অপালা মুখ নামালো। তেমনি মৃদুস্বরে বলল, খামটার মুখ জলে ভিজিয়ে খুলেছিলাম। তখন অতকিছু বুঝতে পারিনি। ভাবছিলাম, বাবা তো খুন হয়ে গেছেন। আর কী হবে চিঠিটা পাঠিয়ে? তারপর মেজদি খুন হবার খবর পেলাম। তখন খামটা এঁটে পোস্ট করে দিলাম।
তোমার কাকে সন্দেহ হয়, অপালা? তোমার বাবাকে কে খুন করেছে মনে হয়?
বনবিহারীবাবু কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। কর্নেল ইশারায় তাকে থামিয়ে বললেন, বলো, অপালা!
অপালা বলল, ইন্দুকাকা।
ষষ্ঠী যথারীতি কফি ও স্ন্যাক্স রেখে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা এগিয়ে দিলেন অপালার দিকে। অপালা অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে চুমুক দিল। বনবিহারীবাবু বললেন, ওকে ইন্দু একেবারে জংলি করে ফেলেছে ছোটবেলা থেকে। রুদ্রদা তো কিছু দেখতেন না। শুধু জমিজমা, মামলা-মোকদর্মা আর হাঙ্গামা।
কর্নেল বললেন, যে রাতে তোমার বাবা খুন হন, তখন তুমি কোথায় ছিলে?
অপালা বলল, পাশের ঘরে। ভোরবেলা রোজ বাগান থেকে ফুল এনে বাবাকে দিই। বাবা ফুল ভালবাসতেন। যাবার সময় কিছু লক্ষ্য করিনি। ফুল। এনে দেখি, বাবার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একটা হাত দেখা যাচ্ছে। ভাবলাম, বাবা দরজা খুলতে এসে পড়ে গেছেন। তারপর কপাট ঠেলে দেখি, বাবা চিত হয়ে পড়ে আছেন। গলায় চাপচাপ রক্ত।
সেরাতে কোনো সন্দেহজনক কিছু ঘটেছিল? কোনো শব্দ শুনেছিলে?
না। আমার ঘুমটা খুব বেশি।
তোমার বাবা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী ছিলেন?
হ্যাঁ। একটুও চলাফেরা করতে পারতেন না। বিছানা ছেড়ে নামতেও পারতেন না। আমি থাকলে আমিই বাবার মুখ ধুইয়ে গা মুছিয়ে দিতাম। খাইয়ে দিতাম। আমি না থাকলে দয়ালদা বা মনিয়াই ওসব করত।
তুমি কোথায় থাকতে?
প্রায় সারাটাদিন আমাদের ফার্মে। ইন্দুকাকা যেতে বলত। আমার ভালও লাগত যেতে। ফিরতাম সন্ধ্যাবেলায়।
হুঁ–তোমার বাবা বিছানা ছেড়ে নামতে পারতেন না বলছ। তাহলে কেমন। করে তিনি দরজা খুলেছিলেন?
অপালা একটু চুপ করে থেকে বলল, পরে আমার অবাক লেগেছিল। কারণ, বাবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে আমি রোজ বন্ধ করে দিতাম। ও ঘরের ভেতর দিয়ে আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তাম। বাবার ঘর আর আমার ঘরের মাঝের দরজাটা খোলা থাকত। ভোরে যখন বেরুতাম, তখন আমার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় যেতাম। বারান্দার মুখেই সিঁড়ি। বাবার ঘুম হয় না সারা রাত। ভোরে একটু ঘুমোন। বাগান থেকে ফুল এনে আমার ঘর হয়ে বাবার ঘরে ঢুকতাম। বাবা জেগে উঠলে তখন ওঘরের দরজা আমিই খুলে দিতাম।
তুমিই বাবার ডেডবডি প্রথম দেখেছিলে?
হ্যাঁ। বাড়িতে তখনও সবাই শুয়ে।
কে কোথায় শুয়ে?
আমি আর বাবা ওপরতলায়। ইন্দুকাকা, বড়দি, শ্যামা, দয়ালদা, মানিয়া– সবাই নিচের তলায় যে যার ঘরে। এখন ইন্দুকাকা বাবার ঘরটা দখল করেছে।
বাবার গলায় রক্ত দেখেছিলে। টাটকা রক্ত, না জমাটবাঁধা রক্ত?
টাটকা রক্ত। তখনও চুঁইয়ে পড়ছিল।
তোমার মনে হয়নি তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ ওঁকে খুন করেছে।
তখন কিছু মাথায় আসেনি। এখন আপনি বললেন বলে তাই মনে হচ্ছে।
তাহলে তো তোমার ঘর দিয়ে ঢুকে ওঁকে খুন করতে পারে?
বনবিহারী কান করে শুনছিলেন। হু। তাই করেছিল। আমি গিয়ে সব শোনার পর পুলিশকে সেটাই সাজেস্ট করেছিলাম। ওখানকার পুলিশ বড় অদ্ভুত। পাত্তাই দিল না আমাকে। ওদের মাথায় রঘুয়া ঢুকে বসে আছে।
তুমি বাগান থেকে ফুল আনার সময় যখন বাড়ি ঢুকেছিলে কাউকে দেখতে পাওনি?
না। সবাই শুয়েছিল তখনও। অত ভোরে আমাদের বাড়ির কেউ ওঠে না।
তোমার বড়দি–
অপালা দ্রুত বলল, তার কিছুদিন আগে একরাত্রে বড়দি বাবার দরজায় জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল আর খারাপ-খারাপ কথা বলে বাবাকে গাল দিচ্ছিল। আমি বাবার ডাকাডাকিতে জেগে গেলাম। বাবার ঘরের দরজা খুলে দেখি, বড়দি একটা লম্বা ছুরি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছুরি মারতে এল আমাকে। আমি ওর হাত ধরে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলাম। বড়দিকে ধাক্কা দিলাম। বড়দি পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। কিন্তু কথাটা কাউকে বলতে বারণ করেছিল ইন্দুকাকা। শুধু কলকাতা এসে মেজদিকে বলেছিলাম।
ইন্দুবাবু বারণ করেছিলেন?
হুঁ। বড়দির হাতে অনেকসময় ওই ছুরিটা দেখতে পেতাম। কেড়ে নিতে গেলে অজ্ঞান হয়ে যেত। তাই ইন্দুকাকা আমাকে বকত। বলত, কেন ওকে ঘাঁটাতে যাচ্ছিস? যা খুশি করুক না।
তোমার বাবা খুন হওয়ার পর তোমার বড়দির রি-অ্যাকশন কী হয়েছিল?
বড়দি সবার সঙ্গে ওপরে এসে বাবাকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
যখন সুস্থ থাকত, তখন কিছু বলত না তোমাকে বাবার সম্পর্কে?
কৈ, তেমন কিছু বলে অপালা ঢোক গিলল। হ্যাঁ–একদিন মন্দিরতলায় গিয়ে বসেছিল। ডাকতে গেলাম। তখন হঠাৎ বলল, অপু, তুই পালিয়ে যা শিগগির! নইলে তোর গলা কেটে ফেলবে। কে গলা কাটবে, কিছুতেই বলল না। তারপর থেকে আমি রাত্রে ভাল করে দরজা এঁটে শুতাম। কেউ কোনো কারণে ডাকলেও দরজা খুলতাম না।
বনবিহারীবাবু বললেন, লজ্জা করিসনে। ইন্দু ব্যাটার ব্যাপারটা বল্ ওঁকে!
অপালা মুখ নামিয়ে বলল, ইন্দুকাকা রোজ রাতে আমার ঘরের দরজা নক করতেন। পরশু রাতেও খুব জ্বালাচ্ছিলেন। আমি দরজা খুলিনি।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তোমাদের বাড়িতে রাত্রে ঢিল পড়ত শুনেছি?
হ্যাঁ। বড়দি বদমাইসি করত।
বনবিহারীবাবু অবাক হয়ে বললেন, খুকু ঢিল ছুড়ত? কৈ, বলিসনি তো?
বলে কী লাভ? বড়দি তো ওইরকমই চিরদিন। ওর যত রাগ ছিল বাবার ওপর। রাত্তিরবেলা নিচে থেকে বাবার ঘরের দিকে ঢিল ছুঁড়ত। বাবা চেঁচামেচি করতেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, তোমাদের বাগানে পাথরের মূর্তিটা নাকি চলাফেরা করে বেড়ায় রাত্রিবেলা?
অপালা বলল, সেও বড়দির কাণ্ড। মূর্তিটার পায়ের কাছে রাতদুপুরে গিয়ে বসে থাকত। কেউ খুঁজতে গেলেই লুকিয়ে যেত। সবাই ভাবত বুঝি মূর্তিটা জ্যান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এক রাত্রে বাবাও সেই ভুল করে বন্দুক নিয়ে। দৌড়ে গিয়েছিলেন। আছাড় খেয়ে প্যারালেসিস হয়েছিল।
আচ্ছা বনবিহারীবাবু, রুদ্রেন্দুবাবু কি কোনো উইল করে গেছেন?
বনবিহারীবাবু বললেন, উইল করবেন বলে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি যাবার আগেই তো খুন হয়ে গেলেন।
তাহলে ওঁর সব সম্পত্তি প্রচলিত আইনে তিন মেয়েই পাবে?
হ্যাঁ। তার মানে, মেয়েদের বিয়ে হলে কার্যত তাদের স্বামীরাই মালিক হবে।
তাহলে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি এক-তৃতীয়াংশের মালিক হয়ে গেছে?
হয়েছে বৈকি। বনবিহারীবাবু গলার ভেতর বললেন। তবে মৃগাঙ্ক তো এখন খুনের আসামী। তাছাড়া বিহারমুল্লুকে গিয়ে সম্পত্তি দখলের হাঙ্গামা সামান্য নয়। ইন্দু ব্যাটাচ্ছেলে বাগড়া দেবার জন্য তৈরি আছে। ওই লোকটা থাকতে কারুর সাধ্য নেই ওখানে গিয়ে নাক গলায়। ক্রমশ খুঁটি গেড়ে বসে গেছে যে।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, ঠিক আছে। অপালা আপাতত আপনার কাছেই থাক। আমি আগামীকাল সেতাপগঞ্জ রওনা হব, ভাবছি। আশা করি, একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
বনবিহারীবাবু করজোড়ে বললেন, মা-বাবা হারা অনাথা দুই বোন, কর্নেল! একজন তো মরার দিন গুনছে। চোখে জল এসে গেল বনবিহারীবাবুর। ওই মগের মুল্লুকে আর অপুকে পাঠাচ্ছি না। আমার ছেলেমেয়ে নেই–নিঃসন্তান মানুষ আমি। অপু থাক আমার কাছে। এখন ওই হতভাগিনী খুকুকে আপনি উদ্ধারের ব্যবস্থা করুন। চুলোয় যাক সম্পত্তি! বলবেন, আমি গিয়ে ওকে নিয়ে এলেই পারি। চেষ্টা করেছি বহুবার। মেয়েটা কিছুতেই আসবে না। এই অপুও কি আসত? তাছাড়া এখন যদি আমি যাই, ইন্দু আমাকে মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে। অপু চলে আসাতে সে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। আপনি অভাগা মেয়েটাকে আমার কাছে এনে দিন কর্নেল!
কর্নেল আস্তে বললেন, দেখা যাক।..
.
ছুরি ও চাবুক
সুনেত্রা স্টেশনে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছে কয়েকটা দিন। সকাল-দুপুর-বিকেল সন্ধ্যা কত আপ ট্রেন এসে থামছে। কত যাত্রী নামছে। কিন্তু কোথায় সেই সৌমদর্শন বৃদ্ধ, মুখে সাদা একরাশ দাড়ি, মাথায় চুপি, কাঁধে প্রকাণ্ড কিটব্যাগ, বুকে ঝুলন্ত বাইনোকুলার আর ক্যামেরা, হাতে ছড়ি, উজ্জ্বল ফর্সা মুখে অমায়িক হাসি-লম্বা-চওড়া এক মানুষ!
বিকেলে বেজারমুখে ফিরে আসছিল সুনেত্রা। অভ্যাসমতো রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফটক পেরিয়ে মন্দিরতলায় আসতেই দেখল, শ্রাবন্তী চুপচাপ বসে আছে।
গত পরশু সন্ধ্যার ট্রেনে অপালা কলকাতা চলে গেছে। বসন্ত নিবাসের আনাচেকানাচে ঘুরে এসেছে সুনেত্রা। ভেতরে ঢোকেনি। কাল একবার দেখেছিল ইন্দু ভটচায দোতালার বারান্দা থেকে কাকে বকাবকি করছে। ওকে এত ঘেন্না। করছিল বলেই সুনেত্রা ঢোকেনি ও বাড়িতে।
আজ শ্রাবন্তীকে দেখে সে এগিয়ে গেল। তারপর আঁতকে উঠল। শ্রাবন্তী একটা লম্বাটে ছুরি নিয়ে বসে আছে। সুনেত্রা থমকে দাঁড়াল। শ্রাবন্তী তার দিকে অদ্ভুত চাউনিতে তাকিয়ে হি হি করে হেসে বলল, আয় আয়। তোর গলা কাটি!
সুনেত্রা ভয়ে ভয়ে বলল, ও কী বলছ খুকুদি? আমার গলা কাটবে কেন? কী করেছি তোমার?
শ্রাবন্তী একই সুরে বলল, তোর গলা কাটব। অপুর গলা কাটব। সব্বাইর গলা কাটব। তারপর উঠে দাঁড়াল।
সুনেত্রা পিছিয়ে এল। বলল, খুকুদি! ভাল হবে না বলছি! ছুরি ফেলে দাও।
শ্রাবন্তী তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। অস্বাভাবিক দৃষ্টি চোখে, ঠোঁটের কোনায় বিকৃত হাসি। সুনেত্রা ভীষণ ভয় পেয়ে খোয়াঢাকা এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হন্তদন্ত হাঁটতে থাকল বাড়ির দিকে। মাঝে মাঝে সে পিছু ফিরে দেখছিল, শ্রাবন্তী সমানে এগিয়ে আসছে। বসন্তনিবাসের কাছাকাছি আসতেই শ্যামার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সুনেত্রা ব্যস্তভাবে বলল, শ্যামা! খুকুদিকে জলদি পাকড়ো। ওই দেখ, ছুরি নিয়ে আমার গলা কাটতে আসছে।
শ্যামা হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, আরে না না দিদিজী! গলা কাটবে কেন? ভয় দেখাচ্ছে।
না ওই দেখ আসছে ছুরি নিয়ে।
শ্যামা শ্রাবন্তীকে দেখে নিয়ে হাঁক দিল, ছোটবাবু! ছোটবাবু!
দোতলা থেকে ইন্দু ভটচাযের সাড়া এল, কী হয়েছে রে শ্যামা?
বড়দিদি আবার পাগলামি করে বেড়াচ্ছে!
ইন্দু ভটচায হন্তদন্ত বেরিয়ে এলেন। সুনেত্রা শিউরে উঠে দেখল, ওঁর হাতে একটা চাবুক। ইন্দুবাবু চাবুকটা সপাং সপাং করে এপাশে ওপাশে আস্ফালন করতে করতে এগিয়ে গেলেন। তাকে দেখে শ্রাবন্তী দাঁড়িয়ে গেল। ইন্দুবাবু বললেন, ফেলে দাও ছুরি! নইলে চাবকে ছাল ছাড়িয়ে নেব। ফেলো বলছি!
শ্রাবন্তী হঠাৎ রাস্তার ওপাশে আগাছাভরা জমির ভেতর দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। ইন্দুবাবুর হাঁক-ডাক শাসানি গ্রাহ্য করল না। একটু পরে তাকে আর দেখা গেল না। তখন ইন্দু ভটচায বললেন, এস তুমি বাড়ি, তারপর দেখাচ্ছি মজা। বড়বাবু নেই। আমি তো আছি।
শ্যামা বলল, ছোটবাবু, বড়দিদির একটা ব্যবস্থা করুন। পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিন। নইলে কখন কী সাংঘাতিক কাণ্ড করে ফেরে যে?
ইন্দু ভটচায বললেন, তাছাড়া আর উপায় কী? তারপর ঘুরে বাড়ির গেটের দিকে যেতেই সুনেত্রাকে দেখতে পেলেন। বিবি, তোমার সঙ্গে একটা কৃথা আছে। বলে এগিয়ে গেলেন ইন্দুবাবু।
সুনেত্রা গম্ভীর মুখে বলল, বলুন!
কাছে এসে ইন্দুবাবু চাপা গলায় বললেন, অপুকে দেখেছ? পরশু বিকেল থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেলেঙ্কারির ভয়ে এখনও চেপে রেখেছি। দেখনি অপুকে?
সুনেত্রা বলল, না।
তাহলে দেখছি, পুলিশে খবর দিতেই হবে।
সুনেত্রা বলল, কেন? কলকাতায় ওর মামার বাড়িও তো যেতে পারে। আগে খোঁজ নিন সেখানে।
ইন্দুবাবু হাসলেন। হ্যাঁ–তাও যেতে পারে। তুমি ঠিকই বলেছ। বলে চলে গেলেন।
সুনেত্রা বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ইন্দুবাবুর সঙ্গে কথা বলেছে বলে যেন তার মুখটা বিষিয়ে গেছে। ঘৃণায় সে থুথু ফেলল। এই শয়তানটাকে বাধা দেবার কেউ নেই ভেবে রাগে তার মাথার ভেতরটা গরম হয়ে উঠছিল। সে এবার বুঝতে পেরেছে, ইন্দু ভটচা শ্রাবন্তাকে চাবুক পর্যন্ত মারে। এত স্পর্ধা তার হল কিসের জোরে? অপালা কলকাতা গিয়ে মামাকে সব কথা কি বলেনি এখনও?
বললে তো ওর মামার ছুটে আসা উচিত ছিল। হয়তো বলেনি, অপালা যা মুখচোরা বোকা মেয়ে! মাঠঘাট ঘুরে আর দেহাতীদের সঙ্গে মিশে ও ভীষণ গেঁয়ো হয়ে গেছে। এতদিন ধরে ইন্দু ভটচায ওকে জ্বালিয়েছে, অথচ সব মুখ বুজে সহ্য করেছে অপালা।
তাহলেও ওর মামার সব বোঝা উচিত ছিল। অন্তত শ্রাবন্তীকেও তো উনি নিয়ে গিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে পারতেন। অথচ ভদ্রলোক একেবারে চুপচাপ বসে আছেন। সুনেত্রা ভীষণ আশা করেছিল, উনি এসে ভাগ্নীদের মাথার ওপর দাঁড়াবেন। কিন্তু সেই একবার এসেছিলেন রুদ্রবাবু খুন হবার পর। তারপর আর এলেনই না।
সুনেত্রা বাড়ি ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
তার মা লনের ওধারে পেয়ারাতলায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন আর শ্রাবন্তী একটু তফাতে ঘাসের ওপর পা দুমড়ে বসে সুস্থ মানুষের মতো কথা বলছে। সুনেত্রা ওর হাতে এখন ছুরিটা দেখতে পেল না। কিন্তু তার বুক কেঁপে উঠল। যদি হঠাৎ মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তাকে দেখে সুনয়নী বললেন, শুনেছিস বিবি? ইন্দু খুকুকে চাবুক মারতে তাড়া করেছিল! লোকটার স্পর্ধা কী রে বিবি! দেশে কি আইন বলতে কিছু নেই?
সুনেত্রা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে হাসবার চেষ্টা করে বলল, খুকুদি ছুরি নিয়ে আমার গলা কাটতে আসছিল, সেটা বলছে না বুঝি!
শ্রাবন্তী ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বলল, না জেঠিমা! বিবি মিথ্যা বলছে। আমি ওর গলা কাটব কেন?
সুনয়নী হাসলেন। কখন কী করে, ও কি জেনেশুনে করে? ওকে করান, তাই করে। দেবদেবীদের লীলা। বলে ঘুরলেন শ্রাবন্তীর দিকে। হু, শোন খুকু! অপু কলকাতা চলে গেছে। তুইও চলে যা। আর বাড়ি ঢুকিসনে। হাবুলবাবুকে ডেকে পাঠাচ্ছি। তোকে সঙ্গে করে তোর মামার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এখানে থাকলে তুই যে মরে যাবি, মা! একেবারে কংকাল হয়ে গেছিস যে!
শ্রবন্তী মাথাটা আস্তে নাড়ল।
যাবি না?
না।
ইন্দুর হাতে মার খাবি, তাও ভাল?
শ্রাবন্তী চুপ করে বসে রইল। সুনেত্রা বলল, খুকুদি, ছুরিটা কী করলে?
জানি না।
কাপড়ের ভেতর লুকিয়ে রাখোনি তো?
সুনয়নী ধমক দিলেন, কী আজেবাজে বলছিস ওকে, বিবি? ওকে ওপরে নিয়ে যা। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ওর খাওয়া জোটেনি আজ। গরিকে বলেছি, খানকতক গরমগরম পুরি ভেজে দিতে। তুই ওপরে যা মা খুকু! গিয়ে গল্প কর বিবির সঙ্গে। আমি যাচ্ছি।
সুনেত্রা ইতস্তত করছে দেখে ফের তাড়া দিলেন, আঃ! হাঁ করে দেখছিস কী? নিয়ে যা। খুকু, যাও ওর সঙ্গে।
শ্রাবন্তী হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। আমাকে তোমরা লুকিয়ে রাখো জেঠিমা। আমার বড় ভয় করছে। আমি আর বাড়ি যাব না।
সুনয়নী উঠলেন। শ্রাবন্তীকে টেনে তুললেন। তারপর ওকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, চলো, আগে খেয়ে নেবে। তারপর দেখছি, কী করা যায়। এর একটা বিহিত করতেই হবে।…
.
অবশেষে সান্তাক্লজ
অস্থির সুনেত্রা আবার স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সকালের আপট্রেনে যদি কর্নেল এসে পৌঁছান! সে কর্নেলের ওপর খাপ্পা হচ্ছিল। অদ্ভুত লোক তো! আসব বলে আর আসবার নাম নেই। নাকি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না উনি? বসন্তনিবাসে এমন একটা সাংঘাতিক ব্যাপার চলেছে। কত কথা মনে গিজগিজ করছে। তবে যে। তার বাবা বলতেন, যেখানে রহস্য, সেখানেই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার!
আপট্রেনের দেরি আছে আধ ঘণ্টা–যদি সময়মতো আসে! ডাউন দিল্লি হাওড়া প্যাসেঞ্জার এসে গেল উল্টোদিক থেকে। তত বেশি যাত্রী নামল না। সুনেত্রা অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে ছিল ডাউন সিগন্যালের দিকে। হঠাৎ তার পিঠে কেউ মৃদু স্পর্শ করতেই ঘুরে দাঁড়াল এবং অবাক হয়ে গেল।
এসে গেছি ডার্লিং!
সুনেত্রা হেসে ফেলল। কী অদ্ভুত মানুষ আপনি! প্রতিদিন আপনার জন্য স্টেশনে এসে হয়রান! বলে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু আপনি তো আসবেন এদিক থেকে! উল্টোদিক থেকে এলেন যে?
কর্নেল মুখ টিপে হেসে বললেন, তোমাকে চমক দেব বলে!
উঁহু আপনার গতিবিধি সন্দেহজনক। বলে সুনেত্রা উৎসাহে পা বাড়ালো।
তাই বুঝি? হুঁ–আমি হঠাৎ একটা জরুরি ট্রাঙ্ককল পেয়ে মুঙ্গেরে গিয়েছিলাম।
মুঙ্গেরে কী ব্যাপার? সুনেত্রা গেট পেরিয়ে রিকশো ডাকতে লাগল। কর্নেল বললেন, হাঁটার চেয়ে স্বাস্থ্যকর আর কোন প্রক্রিয়া নেই, বিবি! এস, হাঁটি।
দুজনে হাঁটতে লাগল। সুনেত্রা আবার বলল, মুঙ্গেরে কী ব্যাপার?
অবাক হয়ো না। হিমাদ্রি ওখানেই নিরাপদে আছে এক বন্ধুর বাড়িতে।
হিমুদা ওখানে আছে? সর্বনাশ!
সর্বনাশের কারণ নেই, ডার্লিং। কর্নেল সংক্ষেপে ঊর্মির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ও মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে গ্রেফতারের বিবরণ দিয়ে বললেন, যাই হোক, পুলিশের হঠকারিতায় ওর কেরিয়ারের খুব ক্ষতি হয়েছে। আমি পুলিশকে অনুরোধ করেছি, ও বেচারার দোষস্থালন করে যেন সব কাগজে বিবৃতি দেওয়া হয়। সম্ভবত দু একদিনের মধ্যে পুলিশ কমিশনার সাংবাদিক সম্মেলন ডাকবেন এব্যাপারে।
তাহলে হিমুদাকে নিয়ে এলেন না কেন?
ওবেলা এসে যাবে। ভাগলপুরে ও কী একটা কাজে গেল।
সুনেত্রা হাসল। কর্নেল! আপনার দাড়ি কি ওয়াশ করেছেন? এত সাদা দেখাচ্ছে কেন? একেবারে ক্রিসমাসের সান্তাক্লজ!
ওই দেখ ডার্লিং, বাচ্চাগুলো আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে!
রাস্তার দুধারে দোকানপাট। এটা বাজার এলাকা। ডাইনে প্রায় নির্জন সংকীর্ণ রাস্তায় ঘুরে সুনেত্রা চাপা গলায় বলল, খুকুদি–মানে শ্রাবন্তী কাল বিকেল থেকে আমাদের বাড়িতে এসে লুকিয়ে আছে। আমি তো ভীষণ ভয়ে-ভয়ে কাটাচ্ছি। মা কিন্তু নির্বিকার। মায়ের ব্যাপার জানেন তো? বলে কী, তোর বাবা মরার সময় সব সাহস আমাকে দিয়ে গেছেন!
সুনেত্রা কাল যা ঘটেছিল, শোনাতে থাকল। গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদারের বৃত্তান্ত মনে পড়ছিল কর্নেলের। সবটা শোনার পর বললেন, ছুরিটা তাহলে এখন নেই শ্রাবন্তীর কাছে?
সুনেত্রা বলল, না। জিগ্যেস করলে বলছে, কিচ্ছু জানিনে। কিন্তু কাল বিকেল থেকে একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করছি, খুকুদি বেশ নর্মাল হয়ে গেছে যেন। ভর-টর ওঠেনি। অজ্ঞানও হয়নি। আবোল-তাবোল কোনো কথাও বলছে না আগের মতো। অথচ ওদের বাড়িতে থাকার সময় কী যে করত। ভুতুড়ে সব কাণ্ড, ভাবতে পারবেন না!
কর্নেল কান করে শুনছিলেন। বললেন, সম্ভবত বসন্তনিবাসেই ওর অস্বাভাবিক আচরণের কারণ লুকিয়ে আছে।
ঠিক এই কথাটাই আমি ভেবেছি, জানেন?
বাড়ির সামনে পৌঁছে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, তুমি আর ভুল করেও খোট্টাই বুলি বলছ না যে?
সুনেত্রা হেসে ফেলল। ক্যাবলু জী? এত্তা খতরনাক হরবখত–মেরি হাড্ডি ভি পিলি হো গেয়ি!
সুনয়নী পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেলকে দেখে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আসুতে পারলেন তাহলে! আপনার জন্য বিবি আহার-নিদ্রা ছেড়ে দিয়েছিল! ওকে যে সেবার কী যাদু করে গেলেন কে জানে!
ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সুনয়নী। ওপরের সবচেয়ে সাজানো ঘরটায় নিয়ে গিয়ে তুললেন কর্নেলকে। এটা বরদাবাবুর ড্রয়িং রুম। দেয়াল জুড়ে এবং আনাচেকানাচে জীবজন্তুর স্টাফ-করা মাথা বা পুরো শরীর। একটা আস্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পর্যন্ত।
সুনয়নী বললেন, একটু আগে ওদের চাকর শ্যামা খুকুকে খুঁজতে এসেছিল। বললাম, জানি না।
সুনেত্রা বলল, খুকুদি কোথায় মা?
আমার ঘরে শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে। সারারাত ঘুমোয়নি বেচারী। আমাকেও ঘুমোতে দেয়নি। হঠাৎ আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলে কী, ইন্দুকাকা খুঁজতে আসেনি তো? সুনয়নী আস্তে বললেন, ওদের বাড়িটাই অভিশপ্ত। রুদ্রবাবুর পাপ আর কী! আমি তো কম দেখিনি আর কম শুনিনি। জমিদারি আমলে দিনকে রাত করেছেন রুদ্রবাবু। কত খুনখারাপি করেছেন। কত মেয়ের সর্বনাশ করেছেন। সে-সব হিসট্রি সময়মতো বলব আপনাকে। আমাদের এ অঞ্চলটা চিরদিন এমনি মগের মুলুক। আমাদের বাংলাদেশের মতো শিক্ষিত লোক তো নেই বিশেষ। তাই প্রতিকার হয়নি। ইদানীং যদি বা কিছু শিক্ষাদীক্ষা দেখা যাচ্ছে, তো ওই রাজনীতি! রাজনীতির দাপটে অস্থির।
সুনেত্রা বলল, আঃ! মা! তুমি দেখছি সত্যি হিসট্রি নিয়ে বসলে। কর্নেলজেঠু ট্রেন জার্নি করে এসেছেন! বিশ্রাম করতে দাও।
সুনয়নী হাসলেন। পরে বলবখন। …কর্নেল তো কফির ভক্ত। কড়া কফি। হুঁউ–আমার সব মনে আছে। সারাদিন দুই বন্ধুতে গঙ্গার চরে টো টো করে ঘুরে এসে এই ঘরে–ঠিক ওই ইজিচেয়ারে বসে বলতেন, বউঠান! এবার কফি চাই। কড়া কফি!
মেয়ে মায়ের দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালে মা হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে কর্নেলের মনে হল, শ্রাবন্তী-ঊর্মি-অপালার মা যদি বেঁচে থাকতেন, হয়তো বসন্তনিবাসে এই সাংঘাতিক সর্বনাশগুলো ঘটত না। মায়ের চেয়ে। রক্ষাকর্তী আর কে আছে পৃথিবীতে?
চাপা শ্বাস ছেড়ে কর্নেল বললেন, বিবি, শ্রাবন্তীদের ফার্মটা কতদূর?
যাবেন নাকি? সুনেত্রা বলল। যে রাস্তায় এলাম, কিছুটা দক্ষিণে গেলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের শালজঙ্গল। ওটা একসময় ছিল রতুয়ার টাঁড়-মাইল দেড়েক লম্বা বাঁজা ডাঙ্গা। এখন, শালগাছ লাগিয়েছে। তারপর ক্যানেল। ক্যানেলের ওধারে ওদের ফার্ম। দুখানা ছোট-ছোট ঘর আছে। ব্যস, ওই হল ফার্ম। কিন্তু ফার্মে কেন? পাখি দেখতে, না প্রজাপতি ধরতে? … হ্যাঁ, উড্ডাক দুটো কালও দেখে এসেছি। আর সেই প্রজাপতিগুলোও আছে কিন্তু। ও কর্নেল, আমি আপনার সঙ্গে যাব।
সুনেত্রা কচি মেয়ের মতো আব্দার জানাল। কর্নেল একটু হেসে বলল, এ বেলা আমি একা বেরুচ্ছি। কারণ তোমাকে থাকতে হবে বাড়িতে। হিমাদ্রি আসবে। তার অবশ্য পুলিশের ভয় আর নেই। আসার আগে কলকাতা পুলিশের মারফত এখানকার পুলিশকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে বলেছি। নিশ্চয় জানিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, তুমি বাড়িতে থেকে হিমাদ্রিকে রিসিভ করবে। নাইস চ্যাপ! তোমাদের বাল্যসঙ্গী আফটর অল। …
কিছুক্ষণ পরে যৎকিঞ্চিৎ খাওয়া-দাওয়া করে কর্নেল বেরোলেন। শ্রাবন্তী তখনও সুনয়নীর ঘরে ঘুমোচ্ছে।
কর্নেলের বুকে ঝুলছে বাইনোকুলার, কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা। হাতের ছড়িটা আসলে প্রজাপতি ধরা জালের হ্যান্ডেল। প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করা আছে সুক্ষু জালখানা।
রতুয়ার টাঁড়ে কচি শালগাছের জঙ্গল। মাঝখানে একফালি নির্জন পথ। বাইনোকুলারে পাখি দেখতে দেখতে কর্নেল হাঁটছিলেন। ক্যানেলের ধারে পৌঁছে দেখতে পেলেন হলুদ রঙের ছোট্ট ফার্মহাউস-চৌহদ্দিতে কাটাতারের বেড়া। সবুজ ধান-পাট আর আখের ক্ষেত উজ্জ্বল রোদে ঝকঝক করছে। ফার্মহাউসের পাশে কচি তাড়হর আর ভুট্টার ক্ষেতের ধারে একটা লোক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বাইনোকুলারের লেন্স অ্যাডজাস্ট করতেই তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
কর্নেল ক্যানেলের ব্রিজ পেরিয়ে গেলেন। লোকটা ফার্মে গিয়ে ঢুকেছে এখন। ফার্মের সামনে একটুকরো ফুলবাগিচা। মন্দ না। নদীয়ার মাকড়দহে অবশ্য আরও বড় ফার্মহাউস ছিল। তার সঙ্গে পোলট্রি, ডেয়ারি এবং একটা সাংঘাতিক হরিয়ানা ষাঁড়। ইন্সপেক্টর কৃতান্ত হালদার একটু বোকামানুষ হলেও দুর্দান্ত সাহসী। যাঁড়টা যখন কর্নেলকে তাড়া করে পাঁচিলে চড়িয়ে ছেড়েছে, কৃতান্ত হালদার তখন খড়ের পাঁজাটা বুড়ি করে ঘুরছেন। যাঁড়টাও ঘুরছে। আর। শিঙের গুঁতোয় খড়ের পাঁজাটা ছত্রখান করে ফেলছে।
গেটের কাছে যেতেই রুক্ষ চেহারা লম্বাটে গড়নের প্যান্ট-শার্ট আর পায়ে গামবুট পরা একটা লোক বেরিয়ে এল। কাঁহাসে আয়া আপলোগ?
ভাগলপুরসে।
কিসকো ঢুঁড়তা আপ?
ইন্দুবাবুকো।
তো বলিয়ে?
কর্নেল নমস্কার করে একটু হেসে বললেন, আপনি মিঃ ইন্দুমাধব ভট্টাচার্য?
ইন্দুবাবু নির্বিকার মুখে বললেন, হ্যাঁ। বলুন স্যার, কী দরকার?
এভাবে দাঁড়িয়ে তো বলা যাবে না মিঃ ভট্টাচার্য। ভেতরে গিয়ে—
আমার সময় নেই, স্যার। যা বলার এখানে বলুন!
লোকটা তো ভারি অভদ্র। কর্নেল বললেন, আহা! আমি কৃষিদফতর থেকে—
কথা কেড়ে ইন্দুবাবু বললেন, ছাড়ুন স্যার! আপনি পুলিশের লোক–আমি জানি। বড়বাবুর মার্ডার কেসে তো এফ আর আই হয়ে গেছে রঘুনাথ সাহুর নামে। যা হবার, কোর্টে হবে।
কর্নেল গলা নামিয়ে বললেন, মিঃ ভট্টাচার্য, আপনি বিপন্ন। তারপর দ্রুত ঘুরে হনহন করে চলে এলেন। ক্যানেলের কাছাকাছি এসে পিছু ফিরে দেখলেন, ইন্দু ভটচায তখনও দাঁড়িয়ে আছেন গেটে।
কর্নেল ক্যানেলের পাড় ধরে পুবে হাঁটতে থাকলেন। দুধারে সবুজ ক্ষেত। ক্যানেল ক্রমশ উত্তরে ঘুরেছে। তারপর রেললাইন ও পিচের সড়কের তলা দিয়ে গঙ্গায় মিশেছে।
ঘণ্টা দুই পাখি দেখে এবং বিস্তর চেষ্টা করে একটি প্রজাপতি ধরার পর সেটা সচ্ছিদ্র ছোট্ট কাঁচের কৌটোয় বন্দী করে কর্নেল সর্বমঙ্গলার মন্দিরতলায় পৌঁছুলেন। কল্কেফুলের জঙ্গলে প্রচুর প্রজাপতি। কিন্তু চেষ্টা করে একটাও ধরা গেল না। হু হু করে বাতাস বইছে। আর প্রজাপতিগুলোও বড় বেশি চঞ্চল।
বসন্তনিবাস কি ওই বাড়িটা—আগাছা ভরা ছোট্ট মাঠের পর ভাঙাচোরা পাঁচিলে ঘেরা হানাবাড়ির মতো দেখতে? আগাছার জঙ্গলেও কত প্রজাপতি রঙ-বেরঙের! সেতাপগঞ্জের প্রকৃতির কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু এমন ধড়িবাজ সচরাচর দেখা যায় না।
কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। প্রকাণ্ড একটা কালো পাথরের ওপর মস্ত বড় শাদা একটা প্রজাপতি বসে আছে। তার সংগ্রহশালায় এক দুর্লভ সংযোজন ঘটবে যদি–
জাল রেডি করে পা বাড়াতে গিয়ে চোখ নিস্পলক হয়ে উঠল। পাথরটার নিচে পড়ে আছে একটা লম্বা ছুরি। প্রজাপতিটা পালিয়ে গেল। ছুরিটা তুলে নিলেন। ইঞ্চি আষ্টেক লম্বা এবং ইঞ্চিটাক চওড়া ছুরিটার বাঁট জীর্ণ হয়ে গেছে। ভীষণ ধারাল। কিন্তু উল্টো দিকটায় মরচে ধরে গেছে। হু, শ্রাবন্তী এই পাথরটাতে বসেছিল সম্ভবত। ছুরিটা তার হাত থেকে পড়ে গেছে বা ফেলে দিয়েছে। সুনেত্রার বিবরণ অনুসারে ব্যাপারটা গতকাল বিকেলেই ঘটা সম্ভব। এই পাথরে বসলে বসন্তনিবাস থেকে কেউ দেখতে পাবে না। ওদিকে সামনে ঘন গাছপালার আড়াল রয়েছে।
আতসকাচ বের করে ছুরিটা পরীক্ষা করতে গিয়ে একবার হাত কেঁপে উঠল। এই ক্ষুরধার ছুরি দিয়েই কি এপ্রিলের এক নিঝুম ভোরবেলায় নিষ্ঠুর আততায়ী রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরির শ্বাসনালী কেটে দিয়েছিল? শ্রাবন্তী কি বলতে পারবে, এ ছুরি সে কোথায় পেল?
বৃষ্টি এবং হাতের ঘষা খেয়ে রক্ত মুছে যাওয়া সম্ভব। তবু পিঠের দিকে ভঁজে কালচে জমাট আর সূক্ষ্ম এই ছোপগুলো হয়তো মরচে নয়। ফরেন্সিক টেস্ট করানো দরকার। ছুরিটা রুমালে জড়িয়ে সাবধানে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন কর্নেল।
ঊর্মিকে যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছিল, সেটা বিদেশী ছুরি। পশ্চিম জার্মানির তৈরি। মৃগাঙ্কের আমদানি-রফতানির কারবার থাকায় ব্লেডের মতো ধারালো অমন একটা ছোট্ট চার ইঞ্চি ছুরি যোগাড় করা খুব সহজ ছিল। এই ছুরিটা দেশী। দ্বিগুণ লম্বা।
ঊর্মির কাছে তার বাবার হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতি জেনে নিয়েছিল মৃগাঙ্ক। একটা হত্যা থেকে আরেক হত্যার প্রেরণা লাভ করেছিল সে। প্রেরণা ছাড়া আর কী। বলা যাবে–যদিও প্রেরণার সঙ্গে শুভের সম্পর্ক রয়েছে। আসলে হয়তো। কালের নিয়ম। অধুনা সবকিছুর সঙ্গে অশুভ জড়িয়ে যাচ্ছে। স্নেহ পাওয়ার কথা যেখানে, সেখানে এসে পড়ছে কদর্য ব্যাভিচার।…
সুনেত্রা ওপরের জানালা থেকে চেঁচিয়ে উঠল, কর্নেল জেঠু!
কর্নেল বুঝতে পারেননি অন্যমনস্কতায় আগাছার জঙ্গল ঠেলে বসন্তনিবাসের পেছন ঘুরে কোথায় এসে পড়েছেন। হ্যাঁ, এই তো সুনেত্রাদের বাড়ি। হাত তুলে হাসলেন।
হিমুদা এই মাত্র এসে গেছে। সুনেত্রা ঘোষণা করল।
ওপরের ঘরে হিমাদ্রি, শ্রাবন্তী ও সুনেত্রা আড্ডা দিচ্ছিল। কর্নেলকে দেখে হিমাদ্রি বলল, কর্নেল, এভরিথিং পজিটিভ। কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক আমার চেনা। উনি—
এক মিনিট। এই ভদ্রমহিলাকে সামলাই। বলে কর্নেল সচ্ছিদ্র কাঁচের কৌটোটা বের করলেন। হিমাদ্রি ও সুনেত্রা প্রজাপতিটা দেখতে থাকল। কর্নেল বাইনোকুলার, ক্যামেরা টেবিলে রাখলেন।
শ্রাবন্তী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল কর্নেলকে। কর্নেল তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন না ইচ্ছে করেই। কিন্তু এ কী দেখছেন! এ যেন জীবন্ত এক কংকাল মূর্তি। কোটরগত চোখ। চোখে কী অস্বাভাবিক–যেন অপার্থিব দৃষ্টি জ্বল জ্বল করছে।
সুনেত্রা বলল, কর্নেল জেঠু, শ্রাবন্তী।
কর্নেল পকেট থেকে রুমালে জড়ানো ছুরিটা বের করছিলেন। ছুরিটা শ্রাবন্তীর দিকে বাড়িয়ে যেই বলেছেন, এটা চিনতে পারছ কি শ্রাবন্তী?–অমনি শ্রাবন্তী দু হাতে মুখ ঢেকে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল।
সে পড়ে যাচ্ছিল, সুনেত্রা ধরে ফেলল। অজ্ঞান হয়ে গেছে। হিমাদ্রি ও সুনেত্রা তাকে ডিভানে শুইয়ে দিল। ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিল।
কর্নেল একটু হাসলেন। এই রি-অ্যাকশনটাই দেখতে চেয়েছিলাম। হু, তোমরা অবাক হয়ো না। এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। বলে শ্রাবন্তীর মাথার কাছে গিয়ে বসলেন।
শ্রাবন্তী হঠাৎ উঠে বসল ডিভানে। এক ধাক্কায় কর্নেলকে সরিয়ে দিল। তারপর সে মাথা দোলাতে শুরু করল। চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে পড়ল। সে। প্রথমে বিড় বিড় করে দুর্বোধ্য কী সব বলতে থাকল। তারপর ক্রমশ তার কথা স্পষ্ট হচ্ছিল। ভুতুড়ে কণ্ঠস্বরে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল এবার ইন্দুর পালা। ইন্দুর, গলা কাটব। তারপর শ্যামার গলা কাটব। দয়ালের গলা কাটব মনিয়ার গলা কাটব। ইন্দুর গলা কেটে রক্ত খাব। রক্ত খেয়ে আমি নাচব। আমাকে কেউ ছুঁয়ো না। আমি বলি খেতে এসেছি। আমি কে জানো? আমি সর্বমঙ্গলা। আমি সব্বাইর গলা কেটে রক্ত খাব। রক্ত খেয়ে নাচব। ইন্দুর গলা কাটব।
কর্নেল তার কিটব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট শিশি নিয়ে এলেন। সুনেত্রা বলল, স্মেলিং সল্টে কিছু হয় না শুনেছি।
স্মেলিং সল্ট নয়। আরও তেজী জিনিস। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। কলকাতার এক বড় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। দেখা যাক রেজাল্ট কী হয়।
নাকের কাছে ধরতেই শ্রাবন্তী ছিটকে ধনুকের মতো বেঁকে চিত হয়ে গেল। তার বুক ও পেট খুব ঝাঁকুনি দিতে থাকল। ক্রমশ ঝাঁকুনি থেমে এল। দু-তিন মিনিট পরে সে স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বলল, জল খাব।
সুনেত্রা জলের গ্লাস নিয়ে এল তক্ষুনি। কর্নেল শ্রাবন্তীকে জল খাইয়ে দিয়ে বললেন, চুপচাপ শুয়ে থাকো। কেমন?
শ্রাবন্তী শুয়ে রইল। সুনেত্রা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
কর্নেল হিমাদ্রিকে বললেন, খবর পজিটিভ?
হ্যাঁ। কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক বললেন, উনি আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। আঙুলের ডগা প্রায় দুভাগ হয়ে হাড়ে ঠেকেছিল। তবে লোকটার নার্ভের প্রশংসাও করলেন। রুমালে জড়িয়ে অতক্ষণ ধরে যন্ত্রণা সহ্য করেছে–আর হ্যাঁ, হাতের তালু চিরে গিয়েছিল একটুখানি।
সুনেত্রা বলল, কার হিমুদা?
হিমাদ্রি কর্নেলের দিকে তাকিয়ে হাসল। একটা লোকের।
সুনেত্রা অভিমান করে বলল, যাও, বোলো না।
কর্নেল বললেন, শ্রাবন্তীর বাবার হত্যাকারীর ডান তর্জনী কেটে গিয়েছিল, বিবি। রুদ্রেন্দুবাবু তার মতলব টের পেয়ে একটু ধস্তাধস্তি করেছিলেন। এমন কী পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থাতেও প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে দরজার দিকে ঝুঁপিয়ে পড়েছিলেন। হয়তো সেটাই ভুল হয়েছিল। আততায়ী তাকে বাগে পেয়েছিল।
সুনেত্রা দম আটকানো গলায়, বলল, কে সে?
সম্ভবত আজ রাতের মধ্যেই তাকে ধরে ফেলতে পারব, যদি আমার অনুমান সঠিক হয়।
সে তো ইন্দুবাবু!
কর্নেল তার কথার জবাব না দিয়ে শ্রাবন্তীর দিকে ঘুরলেন। শ্রাবন্তী, কেমন বোধ করছ?
শ্রাবন্তী আস্তে বলল, ভাল।
ছুরিটা কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছিলে শ্রাবন্তী?
বাড়ির পেছনে খিড়কির কাছে ঘাসের ভেতর পড়েছিল। টাটকা রক্ত লেগে ছিল। খিড়কিও খোলা ছিল।
তুমি কাউকে দেখাওনি ছুরিটা?
তারপর কী হয়েছিল আমার মনে পড়ছে না।
ঠিক আছে। স্মরণ করতে হবে না আর। ও সব কথা ভুলে যাও।
সুনেত্রা উঠল। সর্বনাশ! কর্নেল জেঠু বাইরে থেকে ফিরেই কফি খান। ভুলে গেছি। বলে সে হন্তদন্ত বেরিয়ে গেল।
হিমাদ্রি হাসতে হাসতে বলল, মাত্র দুদিন আগে আমিই পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে থেকেছি। আজ দিব্যি পুলিশের ডিটেকটিভ সেজে সারা ভাগলপুরের সব ডিসপেন্সারি আর হাসপাতাল চষে বেড়িয়েছি। তবে ভয় হচ্ছিল, যদি কেউ বলে বসত, কৈ, দেখি আইডেন্টিটি কার্ড? স্মার্টলি চালিয়ে গেছি শেষ পর্যন্ত।
কর্নেল বললেন, আমার ধারণা ছিল সেতাপগঞ্জের কোনো ডিসপেন্সারিতে ঢুকবে না লোকটা। কারণ ছোট্ট জায়গা। তার ওপর অনেকেই চেনাজানা। ধরা পড়ার ভয় ছিল। কাজেই কাছাকাছি–তার মানে, পরবর্তী কোনো চেনা জায়গায় সে ছুটে যাবে, যেখানে কেউ আঙুলকাটা নিয়ে সন্দেহ করবে না। কাল বিকেলে সেতাপগঞ্জে নেমে দেখি, বিবি গেটে দাঁড়িয়ে। ওর চোখ এড়িয়ে আড়ালে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে স্টেশন মাস্টারের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। ভাগ্যক্রমে আগেরবার এসে যে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি বদলি হননি। কাজেই তদন্তে অসুবিধা হল না। সন্ধ্যা সওয়া ছটায় মুঙ্গেরে তোমার কাছে চলে গেলাম। আজ সকালে ফিরে দেখি, বিবি যথারীতি এসে দাঁড়িয়ে আছে গেটে।
আপনার জন্য ও ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিল।
বুঝতে পারছি। কিন্তু ঊর্মির হত্যাকাণ্ডের ফয়সালা না করে তো আসা যাচ্ছিল না।
আপনি তাহলে বুঝতে পেরেছিলেন দুটো আলাদা কেস?
হ্যাঁ। শুরুতেই। দ্বিতীয়টা ঘটেছে প্রথমটা থেকে শিক্ষা নিয়ে।
হিমাদ্রি দুঃখিত ভাবে হাসল। পৃথিবীটা কী হয়ে যাচ্ছে, কর্নেল! দয়ামায়া স্নেহভালবাসা–এ সব মানবিক বোধের আর কোনো ঠাঁই নেই। টাকাকড়ি সম্পত্তি এ সব জিনিসই বড় হয়ে উঠছে।
কে জানে! কর্নেল অন্যমনস্কভাবে উঠে গেলেন। বাইনোকুলার নিয়ে একটা জানালার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, হয়তো আবহমান কাল ধরে পৃথিবীটা এরকমই, ডার্লিং! বিশ্ব প্রকৃতিতে পাপ-পুণ্য মিলেমিশে আছে। হয়তো থাকবে–যতদিন না পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে
সুনেত্রাদের বাগানে উড ডাকের চিৎকার শুনতে পেয়েছেন কর্নেল। চোখে বাইনোকুলার রেখে খুঁজতে থাকলেন।…
.
মধ্যরাতের আততায়ী
সন্ধ্যায় আকাশ কালো করে মেঘ উঠেছিল। তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। সেই বৃষ্টি আর থামতেই চায় না। রাত দশটাতেও টিপ টিপ করে পড়তে থাকল। তারপর ক্রমশ কমে গেল। তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে। আরও কিছুক্ষণ পরে মেঘ সরে ঝলমলে চাঁদ বেরিয়ে এল আকাশে। বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিকে রহস্যময় করে ফেলল তার জ্যোৎস্না।
বসন্তনিবাসের ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে কেউ সাবধানে নামল বাগানের ভেতর। একটু দাঁড়াল ফোয়ারাটার কাছে। তারপর সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেল বাড়ির সামনের দিকে।
শ্যামা গাঁজা টেনে মড়ার মতো পড়ে আছে বারান্দার খাঁটিয়ায়। দয়াল ঠাকুর বাড়িতে খুন হবার পর বাইরে শুতে পারে না। কপাট বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। শুধু মনিয়ার চোখে ঘুম নেই। রোগা মেয়েটা কোথায় গেল, সেই ভাবনায় কষ্ট পাচ্ছে। রান্নাঘরের পাশের ঘরে শুচ্ছে সে গত রাত থেকে। এখন তার শ্বাস। ফেলতেও ভয় হচ্ছে। ঘাপটি পেতে পড়ে আছে।
মরাইগুলোর আড়ালে ছায়া জমেছে। সেই ছায়ার ভেতর লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পা টিপেটিপে বারান্দায় উঠল। রাত একটায় গয়াপ্যাসেঞ্জার। হঠাৎ মনে পড়ল কথাটা। একটু চঞ্চল হল সে। তারপর সাবধানে বারান্দায় উঠল। চওড়া সিঁড়ির প্রথম ধাপে উঠে সে পিছু ফিরে দেখে নিল চারদিক। গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ার শব্দ ব্যাঙ আর পোকামাকড়ের ডাক আর দুরের শব্দ।
স্টেশনের শান্টিং ইয়ার্ডে একটা কোনো ইঞ্জিনের হুইসি। আরও দূরে গঙ্গার ধারে শ্মশানে শেয়ালের চিৎকার। সর্বমঙ্গলার মন্দিরের বটগাছে পাচা ডেকে উঠল ক্রাও…ক্রাও…ক্রাও!
সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওপরের বারান্দায় পৌঁছুল লোকটা। তারপর মাঝের ঘরের দরজায় নক করল। বারকতক নক করার পর চাপা গলায় ডাকল, ইনু, ইনু! ইনু ঘুমুচ্ছ নাকি? ও ইনু!
একটু পরে ভেতর থেকে সাড়া এল, কে?
আমি। বড়দা!
বড়দা! মাঠে ঘুম হল না বুঝি? খ্যা খ্যা খ্যা!
না রে। বড্ড মশা! সত্যি বলছি।
খ্যা খ্যা খ্যা!
হাসছিস যে? মশার কামড় খেলে বুঝতিস। নে, দরজা খোল।
খুলি।
দরজা খুলে গেল। খোলার সঙ্গে সঙ্গে বড়দা ঝাঁপিয়ে পড়ল। খড় খড় খস। খস অদ্ভুত শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে দুটো টর্চ জ্বলে উঠল এবং প্রায় একই সঙ্গে ঘরের আলোর সুইচও কেউ টিপে দিল। মাত্র একটা সেকেন্ড।
জামাকাপড় পরানো খড়ের তৈরি ডামি মূর্তিটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে বড়দা এবং হাতে চকচকে একটা ছোরা। পেঁচিয়ে গলা কাটতে গিয়ে মুহূর্তে এই নাটকীয় উপদ্রব। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেই একলাফে যেই বেরুতে গেছে, দরজায় হিন্দুস্থানী সেপাই ডাণ্ডা উঁচিয়ে বলল, আবে ভেসড়িবালে, চুপ সে খাড়া যা! তখন বড়দা কাচুমাচু মুখে ঘুরল এদিকে।
তিনজন পুলিশ অফিসার ঘরের ভেতরে ওত পেতে ছিলেন। রিভলবার দেখে হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল বড়দার। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সামনে এসে বললেন, জানতাম আজ রাতেই যে কোনো সময়ে আপনার আবির্ভাব ঘটবে। তাই সন্ধ্যা থেকে আমরা তৈরি ছিলাম। যাই হোক, ফঁদটা কেমন দেখছেন?
একজন পুলিশ অফিসার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলে বড়দা মুখ নামিয়ে ঘোঁত-ঘোত করে বলল, ইনুর সঙ্গে ইয়ার্কি করছিলাম। আমি কি মানুষ খুন করতে পারি?
ইন্দু ভটচায ভেংচি কেটে বললেন, পারো না? তুমি সব পারো! ওঃ, এতক্ষণ আমি গলাকাটা হয়ে বড়বাবুর মতো দরজার কাছে পড়ে থাকতাম। আর নাম হত রঘুয়ার! এবার তো সব জানা গেল। তুমি অপুর পেছনে আমাকে। লেলিয়ে দিয়েছিলে! লোভ দেখিয়েছিলে অপুর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে। আর আমিও এক রামপাঁঠা-তাই বিশ্বাস করে–ছ্যা ছ্যা ছ্যা! ছ্যাঃ! ওয়াক থুঃ!
বড়দার পরনে প্যান্ট-শার্ট, পায়ে রবার সোলের হান্টিং বুট, দুহাতে রবারের দস্তানা, মাথার চুল ঢেকে রুমাল বাঁধা। বড়দা ফুঁসে উঠল। থাম রে লম্পট মাতাল! তোরও রেহাই নেই। তুই-ও ধোয়া তুলসীপাতা নোস। তুই যা যা করেছিস, সব ফাঁস করে দেব কোর্টে।
ইন্দু ভটচায তেড়ে এলেন। কী? কী ফাঁস করবি কোর্টে? কী করেছি আমি? তোর মতো মানুষ খুন করেছি? আপনারা শুনে নিন স্যার! লখনউতে বাইজীদের দালালী করে খেত। পদ্মাবতাঁকে খুন করে ধরা পড়েছিল হাতেনাতে। বড়বাবু এই নেমকহারামকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। জিগ্যেস করুন, কেন ভাগলপুর ছেড়েছিল চিরকালের মতো? নিজের বউটাকে মেরে কড়িকাঠে ঝুলিয়ে কালীবাবুর বিধবা বোনকে ইলোপ করেছিল। বড়বাবুর জোরে সে দিন ওর ধড় থেকে মুণ্ডুটা খসে যায়নি। উঃ এতটুকু যদি জানতাম, এ ব্যাটাই বড়বাবুকে খুন করে গেছে, আমি তখনই সাবধান হয়ে যেতাম! ভাবতেও পারিনি, বুঝলেন স্যার–যে লোকটা ওর সব সময় মাথা বাঁচিয়েছে, সাহায্য করেছে, নেমকহারাম তারই গলায় ছুরি চালাবে! আমি ভেবেছিলাম রঘুনাথ সাহুর কাজ! ছ্যা ছ্যা ছ্যা! ওয়াক থুঃ!
বড়দা লাল কুতকুতে চোখে তাকিয়ে ছিল। ইন্দু ভটচায আবার গায়ে থুতু ফেলতে এলে সে হাতকড়াআঁটা দুহাত বাড়িয়ে ওঁর গলা টিপে ধরল।
কর্নেল ও পুলিশ অফিসাররা মুখ টিপে হেসে দুজনের বাকযুদ্ধ উপভোগ করছিলেন। এবার কর্নেল বড়দার পেছন থেকে জামার কলার ধরে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললেন, মিঃ শর্মা! মিঃ বড়দাকে যথাস্থানে নিয়ে চলুন। আর ইন্দুবাবু, আপনিও আসুন।
ইন্দু ভটচায ফেঁসে যাওয়া বেলুনের মতো নেতিয়ে গিয়ে বললেন, আমি… আমি কেন স্যার? আমি তো নিজে থেকেই কো-অপারেশান করলাম আপনাদের সঙ্গে। ফার্মে গিয়ে যখনই বলে এলেন আমি বিপন্ন, তখনই চলে আসিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে? সব কথা খুলে বলিনি, বলুন? তারপর আপনার কথামতো শ্যামাকে দিয়ে খড়ের ডামি তৈরি করিয়ে–কী করলাম না স্যার?
হ্যাঁ। যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন খুনীকে ফাঁদ পেতে ধরতে।. ধন্যবাদ ইন্দুবাবু। তবু আপনাকে দরকার। পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিতে হবে আপনাকে।
বড়দাকে নিয়ে যাচ্ছিল দুজন কনস্টেবল। বড়দা দরজার কাছে ঘুরে বলল, তুইও বাঁচবি না। আমার চেয়ে তোর পাপ আরও সাংঘাতিক। সব ফাঁস করে দিচ্ছি। আয় না তুই!
ইন্দু ভটচায ভেংচি কাটলেন। আরে যা যা উল্লুকের বাচ্চা ভল্লুক!
চোপ ব্যাটা রামপঠা। লম্পট! মা-মাসি জ্ঞান নেই–লজ্জা করে না?
ইন্দুবাবু গর্জালেন, খুনী! নেমকহারাম! কসাই!
গিদ্ধড়! উজবুক! গাড়োল!…
এইরকম চলতে থাকল বাড়ির গেট অব্দি। শ্যামাকে ওঠানো যায়নি। মনিয়া দয়ালকে জাগিয়েছে। বারান্দায় দুজনে কাঠপুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দুবাবু পিছু ফিরে বললেন, আমি ফেরা না অব্দি জেগে থাকবি মনিয়া! দেখবি চোর ডাকাত না ঢোকে। সদর দরজা এঁটে দিয়ে যা এক্ষুনি।
রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, ইন্দুবাবু উনি আপনার কোন সম্পর্কে বড়দা?
ইন্দু ভটচায বললেন, রামোঃ! ভাগলপুরে থাকতে পাড়া সম্পর্কে কেউ কেউ বড়দা বলত। আমিও বলতাম। তা যদি বলেন, বরং বড়বাবু–মানে অপুর বাবার সঙ্গে একটুখানি সম্পর্ক ছিল। জ্যাঠামশাই বলতে পারেন কিংবা নাও পারেন–এইরকম আর কী!
আপনি এখনও বিয়ে করেননি?
আজ্ঞে না।
বয়স কত হল?
তা উনপঞ্চাশ হয়ে এল।
আপনি শ্রাবন্তীকে চাবুক মারতেন শুনেছি!
ইন্দু ভটচায ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, বড় জ্বালাত যে মেয়েটা। ছুরিটুরি নিয়ে হাঙ্গামা করত। একরাত্রে তো আমাকে স্ট্যাব করার জন্য ঝুঁপিয়ে পড়েছিল। তবে ভেবে দেখুন, আমি ওর গায়ে হাত তুলি সাধ্য কী? ওই নেমকহারামটা আমাকে বলেছিল, বাড়াবাড়ি করলে চাবুক মেরো। ভূত ছেড়ে যাবে।
সুনেত্রাদের বাড়ির সামনে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুনেত্রা ও হিমাদ্রি। এঁদের দেখে রাস্তায় নেমে এল। এ রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট নেই। চাঁদটা আবার মেঘে ঢেকেছে। কিন্তু গেটের মাথায় একটা বাল্ব জ্বলছে। সেই আলোয়। হাতকড়া পরা বড়দাকে দেখেই থমকে দাঁড়াল দুজনে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ওরা।
কর্নেল সামনে এসে বললেন, ফাঁদ পাতা ব্যর্থ হয়নি, ডার্লিং!
সুনেত্রা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, এ কী কর্নেল জেঠু! ওই লোকটা যে খুকুদির কর্নেল জবাব দেবার আগেই পিছন থেকে হিমাদ্রি বলে দিল, খুকুদির মামা বনবিহারী চক্রবর্তী। ১১ এপ্রিল খুকুদির বাবাকে খুন করে কাটা আঙুল রুমালে জড়িয়ে ভাগলপুর গিয়েছিল ব্যান্ডেজ বাঁধতে।..
.
কার কী ভূমিকা
থানা থেকে কর্নেল ফিরলেন, তখনও সুনেত্রা, হিমাদ্রি আর সুনয়নী জেগে আছেন। শ্রাবন্তী ঘুমিয়ে গেছে নিচের ঘরে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।
ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গরম কফি পেয়ে গেলেন কর্নেল। সুনয়নী বললেন, ওই গুণধর মামার কীর্তির কথা বলছিলাম এতক্ষণ এদের। কিন্তু ভাবতেও পারিনি সে নিজের ভগ্নীপতিকে খুন করবে!
সুনেত্রা বলল, তুমি চুপ করো তো, মা! তারপর সে কর্নেলের দিকে তাকাল। কেমন করে বুঝলেন ওই লোকটাই খুনী?
কর্নেল একটু হাসলেন। ১৮ জুলাই সকালে ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে ভবানীপুরে বনবিহারীবাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ওঁর ডান তর্জনীর ডগায় কাটা দাগ দেখতে পেলাম। মাথায় বাবরি চুলও আছে। মনে হল সেতার বাজান ভদ্রলোক। তাই মেজরাবের দাগ। জিগ্যেস করলে সায় দিলেন। কিন্তু আমার চোখ রয়ে গেল ওখানে। একটু পরে বুঝলাম, ওটা মেজরাবের দাগ হতেই পারে না। দাগটা মোটা এবং আঙুলের পেছন অব্দি রয়েছে। তাহলে ওটা কাটার দাগ। অথচ ভদ্রলোককে সেতারশিল্পী বলায় মেনে নিলেন দিব্যি। খটকা লাগল। আমার চোখ গেল ওঁর স্ত্রীর দিকে। দেখলাম, মুখের রেখা হঠাৎ বদলে গেছে। খটকা বেড়ে গেল। ব্যস, এই থেকে শুরু।
হিমাদ্রি বলল, কম্পাউন্ডার রুনুবাবু সাক্ষী দেবেন।
সুনেত্রা বলল, শুধু ওই একজনের এভিডেন্স আদালত মেনে নেবে?
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, হুঁ–তুমি ল পড়লে উকিল হতে পারতে, বিবি। ঠিকই বলেছ। তবে আমার হাতে এভিডেন্স একাধিক। দশ এপ্রিল বিকেল পাঁচটার আপ দিল্লি পাসেঞ্জারে বনবিহারীবাবু সেতাপগঞ্জ স্টেশনে নেমেছিলেন। স্টেশন মাস্টার হরিদপদবাবু সাক্ষী। রাতে রেস্ট রুমে ছিলেন। তার রেকর্ড আছে। তারপর গতকাল বিকেল পাঁচটায় একই গাড়িতে পৌঁছে বনবিহারীবাবু ফের রেস্টরুম বুক করেন। রাতে রেস্টরুমে ছিলেন। আজ ভোরে সোজা মাঠের ফার্মে চলে যান। আমি দূর থেকে বাইনোকুলারে ওঁকে দেখতে পেয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম, ওঁর মতলব খারাপ। কারণ ইন্দু ভটচাযকে এবার না সরালে জোতদার বাচ্চু সিংকে জমিজমা বেচতে বাগড়া পড়বে।
আপনি বাচ্চু সিংয়ের কথা জানতেন বুঝি?
হিমাদ্রি বলল, আমি বলেছিলাম কর্নেলকে। তারপর ওঁর কথামতো ভাগলপুরে গিয়ে এই কাজটাও সেরে ফেললাম। বাচ্চু সিংয়ের ওখানে ট্রান্সপোর্টেরও কারবার আছে। সোজা বলে দিল, রুদ্রবাবুর সব প্রপার্টি শিগগির কিনে নিচ্ছে। রুদ্রবাবুর শ্যালক নাকি আইনত গার্জেন।
কর্নেল বললেন, বনবিহারীবাবু আমাকে বলেছিলেন, রুদ্রেন্দুবাবু কোনো উইল করে যাননি। অথচ এখানকার পুলিশের সঙ্গে কলকাতা পুলিশের মারফত যোগাযোগ করে জানতে পেরেছিলাম, উইল করে গেছেন। তাতে তিন মেয়ের গার্জেন করা হয়েছে মামা বনবিহারী চক্রবর্তীকে। রুদ্রেন্দুবাবু জানতেন শ্যালক কী জিনিস। তবু উপায় ছিল না হয়তো। ইন্দুবাবুকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ ইন্দুবাবু লম্পট প্রকৃতির লোক। আফটার অল, মামা হয়ে ভাগ্নীদের সর্বনাশ করবেন, কে ভাবতে পারে?
সুনেত্রা বলল, ইন্দু ভটচাযের হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়নি যে? কর্নেল হাসলেন। ইন্দুবাবু রাজসাক্ষী হবেন।
কিন্তু ও অসভ্যতা করেছে অপুর সঙ্গে। খুকুদিকে চাবুক মেরেছে!
ইন্দুবাবু যাতে আর বসন্তনিবাসে না ঢুকতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হবে। কর্নেল সুনয়নী দেবীর দিকে ঘুরলেন। মিসেস ত্রিবেদী! শিগগির অপালার জন্য বুদ্ধিমান এবং শক্তিমান পাত্র দেখে দিন। স্থানীয় ছেলে হওয়াই ভাল। তেমন। নেই কেউ?
সুনয়নী বললেন, আছে বৈকি। পাত্র আবার নেই। দেখবেন, খুকুর অসুখ সেরে গেলে তার জন্যও বর ঠিক করে দেব।
সুনেত্রা হাসল। মা এ সব ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট!
সুনয়নী ফোঁস করে উঠলেন, শুধু তোমার ব্যাপারেই এক্সপার্ট হতে পারলাম না, এই দুঃখ। তবে থামো একটুখানি। বর্ষার মাসটা যাক।
সুনেত্রা তক্ষুনি খাপ্পা হয়ে বলল, ছোড় দো জী ফালতু বাত। আননেসেসারি টকিং! এখন একটা সিরিয়াস কথাবার্তা হচ্ছে। আর ওঁর মাথায় খালি–
হিমাদ্রি মুখ ফিরিয়ে আস্তে বলল, কপালে শেষ পর্যন্ত খোট্টা বর আছে, বিবি। সাবধান! তারপর সে একটু কেসে কর্নেলের দিকে ঘুরল। নাও সিরিয়াস টকিং! কর্নেল, বলুন!
সুনেত্রা চোখ কটমট করে হিমাদ্রির দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল, হ্যাঁ কর্নেলজেঠু, বলুন–কেন সন্দেহ হয়েছিল খুকুদির মামাকে?
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে বসে দুলছিলেন। ঠোঁটে কামড়ানো চুরুট। চোখ খুলে বললেন, ওই তো বললাম। তবে তাছাড়া আর কিছু ব্যাপারে খটকা বেধেছিল। যেমন ধরো, এখানে ভাগ্নীদের এই অবস্থা–অনাথ, নিঃসহায় দুটি অবিবাহিতা মেয়ে। এক বোন রুগ্ণ। মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে। অন্য বোন বলতে গেলে একা। মাথার ওপর একজন–অনাত্মীয়ই বলা যায়, নেহাত কর্মচারী। অতসব জমিজমা দেখাশোনা, সংসার, টাকাকড়ি–সব তার হাতে। এই অবস্থায় তাদের মামা চুপচাপ সুদূর কলকাতায় বসে আছেন। এসে মাথার। ওপর দাঁড়াচ্ছেন না। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? আমি ভেবেছি–ভেবে কোনো সূত্র পাইনি। কেন বনবিহারীবাবু সেতাপগঞ্জে গিয়ে থাকছেন না?
হিমাদ্রি বলল, অথচ ওঁর এখানে এসে থাকাটাই তো উচিত। কারণ বাচ্চু সিংকে ভগ্নিপতির জমিজমা বেচে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই খুন করেছেন ভগ্নিপতিকে।
তুমি ঠিকই বলেছ। এখানে এসে আইনমোতাবেক অর্থাৎ উইল অনুসারে গার্জেন হয়ে থেকে অপালা আর শ্রাবন্তীকে মিথ্যা বুঝিয়ে শাদা স্ট্যাম্পড পেপারে সই করিয়ে নেওয়াও এমন কিছু কঠিন ছিল না। অথচ বনবিহারীবাবু আসছিলেন না।
সুনেত্রা বলল, কিন্তু কেন? অসুবিধেটা কী ছিল?
কর্নেল নিভন্ত চুরুট ফের জেবেলে নিয়ে বললেন, ছিল। অসুবিধেটা হল ইন্দুমাধব ভটচায। লোকটার অনেক দোষ। লম্পট, কিছুটা নির্বোধও বটে, গোঁয়ারগোবিদ প্রকৃতির এবং হঠকারী। কিন্তু সে সিনসিয়ার। নিজেকে সে ও বাড়ির প্রকৃত গার্জেন ভেবে বসেছিল। কারণ তাকে হাতে রাখার জন্য তার মনে লোভ জাগিয়ে দিয়েছিলেন বনবিহারীবাবু–অপালার সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন বলে। ইন্দুবাবু তাই বিশ্বাস করে বসেছিলেন। তাছাড়া অপুর প্রতি তার বহুদিনের। লোভও ছিল। তাকে সঙ্গে নিয়ে মাঠঘাটে থেকেছেন। জংলি স্বভাব গড়ে উঠেছে অপুর। ইন্দুবাবুর মেঠো মানসিকতায় এই টাইপের মেয়েকে পছন্দ করা স্বাভাবিক।
সুনেত্রা বলল, বাপের বয়সী, সেটা ভাবেনি ছোটলোক?
কর্নেল হাসলেন। পুরুষচরিত্র এরকমই, ডার্লিং! বলে চোখ বুজলেন আবার। দুলতে দুলতে বললেন, ইন্দুবাবু ভেবেছিলেন, শিগগির তো বাড়ির জামাই হয়ে যাচ্ছেন! তাই মন দিয়ে চাষবাসে মেতে উঠেছিলেন। অপুদের জমি যে বেদখল হয়ে যায়নি, সেটা এই লোকটার জন্যই। কাজেই বুঝতে পারছ, বনবিহারীবাবু যতদিন না ইন্দুবাবুকে সরাতে পারছেন, ততদিন তাঁর এখানে এসেও লাভ হত না। ইন্দুবাবুর হাতেও লোকজন আছে। একজন আউটসাইডারকে সহজে ঘেঁসতে দিতেন না। তাই বনবিহারীবাবু সুযোগের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। অথবা মনঃস্থির করতে পারছিলেন না। তারপর অপালা পালিয়ে গিয়ে ওঁর আশ্রয় নিতেই টের পেলেন, ইন্দুমাধবের তর সইছে না জামাই হতে। অপালা হাত ফসকে যেতে লোকটা এবার খচে গেছে। বনবিহারীবাবুকে আর ঘেঁসতেই দেবে। না ওখানে। তখন আর অপেক্ষা করা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন না বনবিহারীবাবু। সটান এসে হাজির হলেন।
হিমাদ্রি বলল, ফার্মেই তো ইন্দুবাবুকে খুন করতে পারত সে!
পারতেন না। ফার্মে লোক থাকে। ফসল পাহারা দেয় সবসময়। ক্ষেতের কাজকর্ম করে। দিনদুপুরে ওখানে ইন্দুবাবুকে খুন করা অসম্ভব। তাই রাতে এসে হানা দিয়েছিলেন।
সুনেত্রা বলল, দুপুরে হন্তদন্ত এসে ইন্দুবাবু আমাকে জিগ্যেস করল আপনার কথা। তখন আপনি বেরিয়ে গেছেন–
থানায় গিয়েছিলাম। থানা থেকে বেরুতেই দেখা হল। বললেন, কথা আছে।
সুনয়নী হাই তুলে বললেন, দেড়টা বাজতে চলল। কর্নেলসায়েবের কি ক্ষিদে পায়নি?
সুনেত্রা বলল, তুমিও তো অদ্ভুত। মা! চুপচাপ বসে আছ! লক্ষ্মীদি দেখ গে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সুনয়নী উঠলেন। না। ওকে খুকুর পাহারায় রেখেছি। লক্ষ্মী ঘুমোবার মেয়ে নয়।
সুনয়নী বেরিয়ে গেলে হিমাদ্রি বলল, ইন্দু ভটচায আপনাকে খুকুদির মামার কথা বলল নাকি?
কর্নেল বললেন, প্রথমে বলতে চাননি। পরে কবুল করলেন। বললেন, অপুর মামা এসে আমাকে কলকাতা নিয়ে যেতে চাইছেন। ওখানে গিয়েই বিয়েটা হয়ে যাবে। জোর করে মেজভাগ্নীর বিয়ে দিয়েছিলেন। ছোটরও দেবেন।
তাই বলেছিল বুঝি?
কিন্তু ইন্দুবাবু মাঠঘাট ছেড়ে নড়ার পাত্র নন। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি। শেষে গোঁ ধরে বললেন, ভাগ্নীকে এখানে এনে বিয়ে না দিলে আর বিয়েই করবেন না। বুঝতে পারছ তো? বনবিহারীবাবুর মতলব ছিল, কলকাতা নিয়ে গিয়ে কিংবা পথেই খতম করে ফেলবেন ইন্দুবাবুকে।
সুনেত্রা তাড়া দিল। এনাফ অফ ইট! খেতে চলুন তো এবার। কান ঝালাপালা হয়ে গেল। আর ভাল লাগে না ওসব কথা।
বলল ভাল লাগে না, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নিচের ডাইনিং রুমে সুনেত্রাই আবার ওই কথা তুলল। হঠাৎ বলল, কর্নেলজেঠু! একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন?
কর্নেল তাকালেন। হাতে মুর্গির ঠ্যাং।
সুনেত্রা বলল, খুকুদিদের ফ্যামিলিতে ১১ তারিখটা অপয়া।
হিমাদ্রি বলল, কেন?
১১ এপ্রিল খুকুর বাবা খুন হলেন। ১১ জুলাই টুকু খুন হল!
কর্নেল তো বলেই দিয়েছেন ১১ এপ্রিল প্রেরণা দিয়েছিল ১১ জুলাইকে।
আর আজ ইন্দুবাবু খুন হতে যাচ্ছিল–আজও ১১ তারিখ।
যাঃ! আজ পঁচিশ জুলাই।
না বুঝে কথা বলো না তো! সুনেত্রা রেগে গেল। আজ বাংলা শ্রাবণ মাসের ১১ তারিখ, তা জানো?
কর্নেল মুর্গির ঠ্যাংয়ে কামড় দিয়ে মন্তব্য করলেন, বিপজ্জনক ১১।
.
উপসংহার
মাসদুই পরের কথা। কর্নেল এলিয়ট রোডে তার অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে বিকেলবেলায় সেতাপগঞ্জ থেকে সংগৃহীত একটা অর্কিডের পরিচর্যা করছিলেন। যষ্ঠী এসে বলল, বাবামশাই, ফোং!
সর্বনাশ! তোর নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবের নয় তো রে?
ষষ্ঠী দাঁত বের করল। আজ্ঞে না বাবামশাই, পাগলাগারদের।
কী বলছিস হতভাগা?
হ্যাঁ গো! পাগল ভাল করেন, সেই ডাক্তারবাবুর। দেখুন না গিয়ে!
ডাঃ ভাদুড়ীর ফোন! হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন কর্নেল। থা, তোকে ওঁর পাগলাগারদে পাঠাবার ব্যবস্থা করে আসি।
ষষ্ঠী বলল, আগে আপনি গিয়ে ঢুকবেন। পেছন পেছন বরঞ্চ আমি গিয়ে ঢুকব।
আমাকে তুই পাগল বলছিস?
সবাই বলে।
বড় সাহস বেড়েছে দেখছি। বলে হাসতে হাসতে কর্নেল ড্রইং রুমে ঢুকলেন।
ফোন তুলতেই সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ ভাদুড়ীর সাড়া পেলেন। কর্নেল! আপনার পেমেন্টের সাইকো-অ্যানালেটিক রেজাল্ট শুনুন। একডজন সিটিংয়ের পর সাকসেসফুল হয়েছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং!
বলুন ডাঃ ভাদুড়ী!
বারো বছর বয়সে একদিন সন্ধ্যাবেলা প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির সময় বাড়ির একতলার একটা ঘরে পেসেন্ট ওয়াজ ব্লুট্যালি রেপড বাই এ ম্যান বুঝলেন তো? যাকে সে কাকা বলত। ভয়ে লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি। সেদিন তার বাবা-মা বাড়িতে ছিলেন না। পুওর গার্ল! ভীষণ শক পেয়েছিল। তারপর ক্রমশ হিস্টেরিক সিম্পটম ডেভলাপ করতে থাকে। অবদমনের প্রতিক্রিয়া।
বুঝতে পারছি। আর কিছু?
একটা সাংঘাতিক কথা ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আপনার কাজে লাগতে পারে।
কী?
ওর বাবাকে যে ছুরি দিয়ে মার্ডার করা হয়েছিল, সেটা কুড়িয়ে পেয়ে লুকিয়ে রেখেছিল।
জানি। আর কিছু?
খিড়কির দরজা দিয়ে ঠিক ওইসময় একপলকের জন্য ওর মামাকে দেখতে পেয়েছিল–জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। সেই থেকে মামার প্রতি আতঙ্ক এবং ঘৃণা।
এনিথিং এলস?
দিস ইজ মোর ইমপর্ট্যান্ট। আজ দুপুরে হিপোটিজম প্রয়োগ করেছিলাম। বাবা মার্ডার হবার আগের দিন সন্ধ্যায় দোতলার জানালা থেকে মামাকে পেছনের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। পরে ভেবেছিল, চোখের ভুল। কারণ ভদ্রলোক তখনই ঝোঁপের আড়ালে সরে যান। কিন্তু সন্দেহটা থেকে গিয়েছিল, তার মামা কেন ওভাবে লুকিয়ে থাকবে? আমি বারবার প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, ওর মামা লোকটি মোটেও সৎ লোক ছিল না। জিগ্যেস করলাম, বাবাকে ব্যাপারটা জানিয়েছিল কি না। বলল, জানায়নি। কাউকে জানায়নি। কারণ ফিটের ঘোরে আবোল তাবোল কথা বলত বলে কেউ ওর কথা গ্রাহ্য করত না। তাই এসব কথা চেপে রেখেছিল। আসলে এসব– পেসেন্টের অসুখের উৎপত্তি সাপ্রেশান থেকে এবং যত দিন যায়, সাপ্রেশান তত বাড়তে থাকে। সজ্ঞান অবস্থায় আর মুখ খুলতেই চায় না। যা কিছু দেখে, সবই সাপ্রেসড হয়ে যায়–চলে যায় অবচেতনায়। ফলে একটা আগে দেখা কোনো ঘটনা সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায়। সাইকলজি শাস্ত্র বড়–
ধন্যবাদ ডাঃ ভাদুড়ী! ছাড়ি।
ভাববেন না। মাস তিনেকের মধ্যে নর্মাল করে তুলব। মিস প্যাটির ব্যাপারটা দেখেছেন তো?
কর্নেল ফোন রেখে ছাদে উঠে গেলেন। পড়ন্ত বেলার শেষ আলোয় হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, শরৎকাল আসন্ন। এবার শরতে সেতাপগঞ্জেই যাচ্ছেন। কালো ডানার ওপর লাল-হলুদ ফুটকিওলা প্রজাপতিগুলো–তাছাড়া হিমাদ্রি ও সুনেত্রার বিয়ের নেমন্তন্নও আছে। সত্যি, প্রজাপতি বড় রহস্যময় জীব।
Leave a Reply