০৯. আমার বাবা

আমার বাবা

আমার নাম ডগলাস। বয়স চৌদ্দ। একটি ছোট পাহাড়ি শহরে আমরা থাকি। নিরিবিলি, সবুজ একটি শহর। আমার বাবা একজন মহাকাশযানের চালক। একজন দক্ষ চালক হিশেবে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। প্রায় সময় তাকে মহাকাশে থাকতে হয়। আমাদের ঘরে বসে তার জন্যে শুধু অপেক্ষা করি। কখন সুদূরের প্রান্ত থেকে নেমে আসবেন তিনি।

কোনো কোনো মাঝ রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারি পাশের ঘরে মা জেগে আছে। আমি নীল বোতামে হাত ছোঁয়াই। তখন আমার যান্ত্রিক খাটটা দুলতে থাকে। মিষ্টি সুর ভেসে আসে স্পিকার থেকে। ঘুম পাড়ানি সুর। হঠাৎ দেখি আমাদের ঘরের দেয়ালগুলো এক মুহূর্তের জন্যে জ্বলে ওঠে রঙিন হয়। বুঝতে পারি আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে এখন মহাকাশযানটি উড়ে গেল। যা চালাচ্ছেন আমার বাবা। পাশের ঘর থেকে মার কণ্ঠ ইন্টারকমে ভেসে আসে।

-ডগলাস, বুঝতে পেরেছিস।

-হ্যাঁ মা। বাবা আসছেন।

এরপরের সব ঘটনাগুলো আমাদের জানা। হিশেব মতো ঘটবে। মহাকাশযানটি নামবে স্রীপ্রংফিল্ডে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে আমার বাবা নদী, পাহাড় পেরিয়ে আমাদের ছোট শহরের হেলিপ্যাডে নামবেন। তারপর হেঁটে আসবেন তিনি। বাড়িতে আসার সময় কখনো বাবা গাড়ি ব্যবহার করেন না। বাবা আসবেন বড় পার্কটার ভেতর দিয়ে। এরপর শোনা যাবে বাবা আমাদের বাগানের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন। আমি আর মা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বাবা তার ঘরে ঢুকে প্রথমে কালো বাক্সটা রাখবেন। ওটার ভেতরে রয়েছে তার মহাকাশযানের ইউনিফর্মটা। তারপর পাশের ঘরে খেতে যাবেন।

আমি ঠিক ঐ সময়টার জন্যেই অধীরভাবে অপেক্ষা করি। যেইমাত্র বাবা পাশের ঘরে চলে যান আমি তখন বাবার ঘরে ঢুকি। সেই কালো বাক্সটাকে তুলে নিয়ে আসি নিজের ঘরে। প্রচণ্ড এক কৌতূহলে খুলি বাক্সের ডালা। ভেতর থেকে বের করে আনি বাবার ইউনিফর্ম। ঐ পোশাকটা দেখলেই আমি যেন অন্য রকমের হয়ে যাই। আমার চোখে ঘনিয়ে আসে সুদূর নীহারিকাপুঞ্জের স্বপ্ন। আমি কালো পোশাকটার গন্ধ শুকতে থাকি। মনে হয় ঐ পোশাক থেকে পাচ্ছি মঙ্গল গ্রহের লোহার গন্ধ। শুক্র গ্রহের সবুজ শ্যাওলার গন্ধ। বুধ গ্রহের পোড়া গন্ধকের মতো গন্ধ। চাঁদের দুধের মতো মিষ্টি গন্ধ। এসব গ্রহ নক্ষত্রের চিহ্ন লেগে রয়েছে পোষাকে।

এরপর আমি ঐ পোশাকটাকে আমার তৈরি করা সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেই। এতে মেশিনের বকযন্ত্রের ভেতরে কিছু মিহি গুঁড়ো জমে। এই গুঁড়োগুলো লেগেছিল পোশাকে। তারপর পোশাকটাকে আবার কালো বাক্সের ভেতরে রেখে আসি। কেউ জানতেও পারে না কিভাবে আমি আমার স্বপ্নের জিনিশগুলোকে সংগ্রহ করেছি।

রাত বাড়ে। এক সময় সবাই ঘুমিয়ে যায়। বাবা মা ঘুমায়। আমাদের বাড়ির কাজ করে দেবার রোবটগুলো বৈদ্যুতিক নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আমি তখন আমার অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখি ঐ মিহি গুঁড়োগুলো। তখন আমার সামনে উদ্ভাসিত হয় বিশাল ছায়াপথ। আমি যেন দেখতে পাই উল্কাকণা, মহাজাগতিক ধূলি। ধূমকেতুর উজ্জ্বল পুচ্ছ। বৃহস্পতি গ্রহের লালচে মাটি। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দূরের মহাকাশ তার অসীম রহস্য নিয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমি তখন সে অনন্তু অসীম রাজ্যে স্বপ্নের সোনালি পাখায় ভর করে সাঁতরাতে থাকি।

বাবা এবার এসেছেন তিন মাস পর। বিকেলে বাবাকে দেখি বাগানে মাটি খুঁড়ছেন। বিভিন্ন ধরনের গাছের ডালপালা ছাটছেন। চারাগাছ পুঁতছেন। এক মনে মাথা নিচু করে কাজ করে যান। তখন একবারও আকাশের দিকে তাকান না।

সন্ধেবেলায় আমরা বাগানে বিশ্রাম নেই। বাগানে একটি যন্ত্র দোলনা রয়েছে। দোলনা থেকে গান শোনার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা বসে থাকি ঐ দোলনায়। চাঁদের রুপোলি আলো চারপাশে ঝকঝক করছে। আমরা লেবুর ঠাণ্ডা রস খাচ্ছি। বাবা স্টিরিও খবরের কাগজ পড়ছেন। এই কাগজগুলো বসানো থাকে এক ধরনের টুপির মধ্যে। তিন বার পরপর চোখের পাতা ফেললেই কাগজের মাইক্রো পাতাগুলো আতশ কাচের পেছনে চলে আসে।

বাবা একবার তাকালেন আকাশের দিকে। বাবা আকাশে তাকালেই মা কেমন চমকে যান। একটা অজানা আশঙ্কা তার মুখে ছায়া ফেলে। বাবা বুঝি এখনি পাখা মেলে উড়ে যাবেন আকাশে।

বাড়িতে আসার তৃতীয় রাতে বাবা বেশি করে তাকাবেন আকাশের দিকে। আমার মা রাতের ঐ তারা ঝিকমিক আকাশকে খুব ভয় পায়।

পরদিন সকালে দেখা যাবে বাবা তৈরি। কালো বাক্সটা বের করেছেন।

-চলি আবার তিন মাসের জন্যে।

ঠিক এভাবেই চলে আসছে। এবার কিন্তু অন্য রকম হচ্ছে। বাবা এবার একটু বেশি গম্ভীর।

আমি ভাবি, আমার বাবা এতো গ্রহে যায় কিন্তু কখনো আমার জন্যে মহাকাশ থেকে কিছু আনে না। শনি, নেপচুন, প্লুটোতে এতোবার গিয়েছে। কখনো কিছু আনেনি। আমার বন্ধুদের বাবারা কত জিনিশ আনে। কালো উল্কার টুকরো, নীল বালি, লালচে ঝামা পাথর।

আশ্চর্য, কেন যে বাবা এসব আনে না। তবে মার জন্যে মাঝে মাঝে আনে। একবার মঙ্গল থেকে এনেছিল কয়েকটি সূর্যমুখীর চারা। লাগিয়েছিল বাগানে। চারাগুলো লকলকে করে বেড়েছিল। একদিন কি কারণে মা সেগুলো উপড়ে ফেলে দিলেন।

বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করি আচ্ছা বাবা, ওপরটা তোমার কাছে কি রকম লাগে? আমার প্রশ্ন শুনে মা কেমন ভিত হন। বাবার চোখে তখন আনন্দ।

-বুঝলে ডগলাস, জীবনে যা কিছু সবচাইতে সুন্দর সে সবের চাইতেও কিন্তু অনেক অনেক সুন্দর ঐ ওপরটা।

কোন গ্রহে বা নক্ষত্রে যেতে হবে এটা তখন ঠিক করত মহাকাশযান চালকেরা।

আমার খুব ইচ্ছে বাবাকে একদিন ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখি। এই ইচ্ছের কথা বললে মা রেগে যায়। তখন মাকে দেখলে মনে হয় তিনি বুঝি এক সর্বনাশের কথা শুনছেন। আমারও জেদ চাপে। বাবাকে ঐ পোশাকে দেখবই।

একদিন রাজি হলেন বাবা। এই রাজি হওয়াতে মা ক্রুদ্ধ চোখে তাকালেন আমার দিকে।

কালো চকচকে পোশাক পরে বাবা এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। রুপোলি বোতাম লাগানো। কালো বুট জোড়া। গোড়ালির কাছে রুপোর বালা।

কি চমৎকার লাগছে আমার বাবাকে তখন। মনে হচ্ছে নীহারিকাপুঞ্জ থেকে জিনিশ এনে এই বিশেষ পোষাক বানানো হয়েছে। কালো পোশাকটিতে ঝিকমিক করছে তারা। ঐ পোশাক থেকে ভেসে আসছে দূর গ্রহের ধাতু আর মহাকাশের গন্ধ।

মা খুব চুপচাপ থাকেন। তার সব সময় মন খারাপ। বাবা যেকোনো সময় উড়ে চলে যাবেন। এই আশঙ্কা তাকে ঘিরে রাখে। বাবা কিন্তু কখনো মহাকাশ থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে না।

আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাবা উত্তরে বলল,

-মহাকাশ থেকে তোমাদের সাথে কথা বললেই আমার তখন তোমাদের কাছে পেতে ইচ্ছে করবে। আর তাহলেই মন খারাপ হয়ে যাবে।

সেদিন সকালে বাবা রঙিন টিকিট নিয়ে হৈচৈ করে বাড়িতে এলেন। আমরা বেড়াতে যাব। ক্যালিফোর্নিয়া আর মেক্সিকো যাওয়ার রকেট টিকিট।

-চলো, আমরা এবার মন ভরে বেড়াব। আনন্দ করব। প্রচুর মজা করব।

আমরা বেরিয়ে পরলাম। প্রশান্তু মহাসাগরের উপকূল দিয়ে ছুটে গেলাম। ডেরা বাঁধলাম মালিবুর বালিয়াড়িতে। রাতে আগুন জ্বালিয়ে ঝলসানো মাংস খাওয়া। তিতির পাখি আর কচি ভেড়ার মাংস। বাবা গান গাইলেন। তিনি যেন চারপাশের সব কিছুকে ভালোবাসছেন। সব কিছুর প্রতি তার প্রবল মায়া জন্ম নিচ্ছে। বাবা শুয়ে পড়লেন। রকেটে এই জিনিশটারই অভাব।

বাবা কিন্তু আগে কখনো আমাদের কাছে এ ধরনের কথা বলেন নি। তিনি জানাননি রকেটে কিসের অভাব। রকেটে যে এমন নোনা বাতাসের ঝাপটা পাওয়া যায় না, এমন ঝকঝকে নীল আকাশ আর প্রসন্ন আবহাওয়া নেই সে কথা বলেন নি। কখনো বলেন নি রকেটে মার হাতের মতো সুস্বাদু রান্না পাওয়া যায় না। চৌদ্দ বছরের কিশোর ছেলের সাথে কথা বলা যায় না।

আমি তখন কলকল করে বাবাকে আমাদের স্কুলের গল্প বলি। আমি কত দ্রুত সাঁতার কাটতে পারি। বনে পাহাড়ে গিয়ে অর্কিড চিনতে পারি। বাবা আমার চুল আদর করে টেনে দেন। তার মুখে খুশির ছাপ।

আমরা তখন রকেটের কথা বলি না। মহাকাশের কথা বলি না। বিশাল ছায়াপথের কথাও বলি না। আমরা তখন গল্প করি মেক্সিকোর পাহাড়ি অরণ্যের কথা। তার সোনালি রোদের কথা। কিভাবে গভীর বনের ভেতরে বৃষ্টির মধ্যে প্রজাপতি ধরেছিলাম সেই গল্প। অজস্র প্রজাপতি তখন দেখেছিলাম আমরা। ঝাঁক বেঁধে উড়ছিল।

বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে আমার সব কথা শুনছেন। বাবা যেন কান ভরে সব শব্দ শুনতে চান। পাখির ডাক, সমুদ্রের ঢেউ আর অরণ্যের পাতা ঝরার শব্দ। এক সময় বাবাকে দেখি মাঠের সবুজ ঘাসের ঘ্রাণ বুক ভরে নিচ্ছেন। পৃথিবী নামের এই নীল গ্রহটার জন্য বাবার এতো মায়া।

সেদিন বিকেলে বাবা আমাকে কাছে ডাকলেন। শোন, আজ তুমি আমাকে একটা কথা দেবে।

-কি কথা বাবা? কখনো মহাকাশযানের চালক হবে না। আমি চুপ করে রইলাম। বাবা আমার কাধ ধরলেন।

-কখনো না। কারণ যখন তুমি ওপরে থাকবে তখন তোমার মন চাইবে এখানে থাকতে আর যখন এখানে থাকবে তখন মন চাইবে উড়তে। এটা হলো একটা ফাঁদের মতো।

-কিন্তু …।

ডগলাস, তুমি আমার এই কষ্টটা বুঝতে পারবে না। যতবার উপরে যাই তখন ভাবি এবার পৃথিবীতে ফিরে এলে আর উড়ব না। কিন্তু তবু ঠিকই বেরিয়ে যেতে হয়। মনে হয় সারা জীবন এভাবেই যাবে।

-আমি জানি, আজ রাতে বাবা বারান্দায় বসে আকাশের কালপুরুষ দেখবেন।

বাবা মমতা মাখা কণ্ঠে আমাকে বলছেন খোকা, কথা দাও, তুমি আমার মতো হবে না।

-কথা দিলাম।

সে রাতে খুব চমৎকার খাওয়া হলো। হাঙ্গরের ডানার স্যুপ। বুনো কুমড়োর আচার। কড়াইশুটির তরকারী। দইমাখা লেটুস পাতা। তিতির পাখির রোস্ট।

বাবা প্রত্যেকটি খাবারের গন্ধ নিলেন। মা টেবিল সাজিয়েছেন খুব চমৎকার করে। বাবা যেন আমাদের ঘরকে ভালোবেসে আর মহাকাশে না যান।

ঠিক সে সময় ঘর কাঁপিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল। জানালার কাচের শার্সিগুলো ঝনঝন করে উঠল।

বাবা তাকালেন জানালার দিকে। আকাশে তখন সন্ধ্যাকাশের নীল তারা পুবে লাল মঙ্গল গ্রহ। বাবা তাকিয়ে রইলেন মঙ্গলের দিকে।

সে রাতে আমার ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। বাতাস বইছে। চাঁদের মায়াবী আলোতে ফকফক করছে সব কিছু।

বাবা বাগানের যন্ত্র দোলনায় বসে রয়েছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাবার কাছে গেলাম। বাবা তাকালেন আমার দিকে। একটা রাতচরা পাখি পেছনের ঝাকড়া গাছ থেকে ডেকে উঠল।

-আচ্ছা বাবা, একটা কথা বলবে?

-কি খোকা?

-মহাকাশে কি কি ভাবে মৃত্যু হতে পারে?

-অনেক ভাবে।

-যেমন?

-এই মনে কর উল্কাপিণ্ডে ধাক্কা খেল তোমার রকেট। তখন রকেটের বাতাস গেল ফুরিয়ে। কিংবা ধূমকেতুর লেজের ঝাঁপটা খেল। সংঘর্ষ বিস্ফোরণ হলো। কত রকমের বিকিরণ হচ্ছে। যেকোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

-ওখানে কেউ মারা গেলে কি কবর দেয়া হয়?

-খুঁজেই পায় না কেউ।

-মৃতদেহ তাহলে কোথায় যায়?

হারিয়ে যায়। কোটি কোটি মাইল দূরে। মৃতদেহগুলো উল্কা বা গ্রহের মতো একটা কিছু হয়ে চিরকাল ধরে মহাকাশে চলতে থাকে।

পরদিন সকাল।

বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছেন বারান্দায়। খাঁচার বন্দী হলুদ ক্যানারি পাখিটা গান শোনাচ্ছে। বাবা খাঁচায় টোকা দিচ্ছে। ক্যানারিটা পুঁতির মতো চোখ দিয়ে বাবাকে দেখছে। আমি পেছনে এসে দাঁড়াই।

বাবা দেখেন আমাকে।

বুঝলে ডগলাস, আমি মন স্থির করে ফেলেছি। এর পরের বার যখন আসব তখন আর বেরুব না। একেবারে থেকে যাব।

বাবা যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন। মা তখনো ঘুমুচ্ছেন।

ঘুম থেকে উঠলে তোমার মাকে বলো। আবার দেখা হবে তিন মাস পর।

বাবা নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে। হাতে ধরা সেই কালো বাক্স। সামনের জামগাছের নুয়ে থাকা ডাল থেকে কয়েকটা টসটসে জাম পাড়লেন। তারপর ভোরের নরম আলোর ভেতরে মিলিয়ে গেলেন।

ঘুম থেকে উঠলে আমি মাকে বাবার চলে যাওয়ার কথা বললাম। মা আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল।

আচ্ছা মা, বাবা বলছিল তুমি নাকি এমন ভাব কর যে বাবাকে তোমার সামনে দেখতে পাচ্ছ না। তিনি অদৃশ্য। তার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছ না।

ঠিক।

তোমার এরকম অদ্ভুত আচরণের মানে?

তোমার বাবা দশ বছর আগে প্রথম মহাকাশে গেলেন। তখন থেকেই আমি তাকে মৃত হিসেবে ধরে নিয়েছি। বছরে মাত্র তিন চার বার ফিরে আসে। বেশির ভাগ সময় থাকে মহাকাশে। তার কোনো প্রভাবই আমাদের জীবনে নেই। আমার কাছে তিনি মৃত ছাড়া আর কি?

কিন্তু বাবা যে আজ আমাকে বলে গেলেন এরপর ফিরে এসে তিনি আর যাবেন না থাকবেন।

উনি আর ফিরবেন না। উনি মৃত।

তুমি দেখ মা, বাবা আবার বেঁচে উঠবেন। মাকে তখন কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে।

আমি ভাবতাম যদি শুক্র গ্রহে ওর মৃত্যু হয় তাহলে কি হবে? তাহলে তো আমি আর শুকতারাটির দিকে তাকাতে পারব না। যদি মঙ্গলে মৃত্যু হয়? তাহলে তো ঐ লাল গ্রহের দিকে তাকানো যাবে না। কিংবা যদি শনি বা নেপচুনে? তখন কি করব? যেসব রাতে ঐ গ্রহগুলো আকাশে জ্বলজ্বল করবে সেসব রাতে তারাভরা আকাশ আর দেখতে পারব না।

আমি দেখলাম মার চোখ চিকচিক করছে। খবরটা পেলাম পরদিন।

মহাকাশকেন্দ্র থেকে এসেছে সংবাদদাতা। আমার হাতে তুলে দিল বার্তাটি। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মা পেছনে দাঁড়িয়ে। বার্তাটি খোলা ।

আমার বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বাবার মহাকাশযান পড়ে গিয়েছিল সূর্যের মধ্যে।

বাবার মৃত্যুর পর মা অনেক দিন দিনের বেলা ঘুমুতেন। বাইরে যেতেন না। আমরা রাতে বেশির ভাগ কাজ করতাম। দিনে ঘুমাতাম।

আর দিনের বেলায় যদি বেরুতে হতো তাহলে বেছে নিতাম বৃষ্টি ঝরার দিন। যখন আকাশে সূর্য দেখা যায় না।

বে. ব্র্যাডবেরির কাহিনি অবলম্বনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *