০৮. মক্কেলের নাম বাস্‌কেথ

৮. মক্কেলের নাম বাস্‌কেথ

স্কুনারটি স্টটেন আইল্যাণ্ডে ভেড়বার পর থেকেই বাস্‌কেথ সান হুয়ান অন্তরীপের তীরে বাস করেছে। এখান থেকে সে ইচ্ছে করলেই দ্বীপের গহনে যেতে পারতো, কিন্তু যায়নি। মনে উঁকিঝুঁকি ছিলো ক্ষীণ আশার : কাছ দিয়ে যদি কোনো জাহাজ যায়, তবে সে সংকেত ক’রে সেটাকে থামতে বলবে তারপর জাহাজে উঠে কাপ্তেনকে খুলে বলবে কী ভয়ানক ব্যাপার দ্বীপে ঘ’টে গিয়েছে, তারপর বদমায়েশগুলোকে এক হাত দেখে নেয়া যাবে।

তবে আদৌ কোনো জাহাজ সেখান দিয়ে যাবে কি না, তার তো কোনোই ঠিক ঠিকানা নেই। নেহাৎ ঝড়ের পাল্লায় না-পড়লে কোনো জাহাজ যে এদিকটায় আসবে, বা কেথের কখনোই সে-ভরসা ছিলো না। তবু…

এই ‘তবু’র জন্যেই সে এখানে থেকে গিয়েছিলো। নিজের নিরাপত্তার জন্যে সে মোটেই মাথা ঘামায়নি। তার মনে শুধু তীব্র-একটা প্রতিশোধস্পৃহাই ছিলো তখন—কী ক’রে এই বোম্বেটেগুলোকে শায়েস্তা করা যায়। বোম্বেটেদের গুহা থেকে ইচ্ছে মতো রসদ নিয়ে এসে নিজের সম্পর্কে একরকম নিশ্চিন্তই ছিলো সে। এটা সে জানতো যে স্কুনারটি সারিয়ে সাগরপাড়ির উপযুক্ত ক’রে তুলতে কয়েক সপ্তাহ কেটে যাবে। তবে সান্তা- ফের ফিরে আসা অব্দি স্কুনারটি দ্বীপে থাকবে কিনা সেটা অবশ্য সে বুঝে-উঠতে পারেনি।

সান্তা ফের এখানে আসতে আরো দুটো গোটা মাস বাকি। ততদিনে বোম্বেটেরা নিশ্চয়ই প্যাসিফিক আইল্যাণ্ডসের উদ্দেশে রওনা হ’য়ে যাবে। কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কীই-বা সে করতে পারে, একা? এখন সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন, আরেকটা আশ্রয় খুঁজে বার করা। এই গুহাটা জলদস্যুদের গুহার খুবই কাছে। সুতরাং দূরে-কোথাও একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বার করা খুবই জরুরি।

পাঁচশো গজ দূরে, প্রণালীর কাছেই, আরেকটি গুহা দেখতে পেয়েছিলো বাস্‌কেথ। দুটি বড়ো-বড়ো পাথরের আড়ালে ঢাকা ছিলো তার মুখ। বাস্‌কেথ খুব ভালো ক’রে খেয়াল ক’রে দেখতে পেলে, বাইরে থেকে চট ক’রে এর মুখ খুঁজে বার-করা খুব-একটা সহজ হবে না। কেউ যদি না-জানে যে গুহাটা এখানে আছে, তবে হাজার বার এর পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করলেও নেহাৎই দৈবের অনুগ্রহ ছাড়া গুহার মুখটা আবিষ্কার করা কারু পক্ষেই সম্ভব নয়। দিন কতক তন্নতন্ন ক’রে খোঁজবার পর দৈবাৎ যখন সে গুহাটি আবিষ্কার করলে, তক্ষুনি সে তার জিনিশপত্র নিয়ে সেখানে চ’লে গেলো।

কন্‌গ্রে বা তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ক্বচিৎই এদিকটায় এসেছে। দ্বিতীয়বার গুহায় এসে কন্‌গ্রে আর সের্‌সান্তে মাত্র একবার এদিকটায় এসেছিলো, কিন্তু সে-ই প্রথম আর সে-ই শেষ। এর পর আর-কখনোই তারা এদিকটায় আসেনি।

সন্ধের দিকে খুব সতর্ক হ’য়ে বোম্বেটেদের হালচাল জানবার জন্যে বেরুতো বাস্‌কেথ। এই নিঃসঙ্গ জীবনের দীর্ঘ মুহূর্তগুলো ঠিক যেন এককটা দিন। তার মগজটা সারাক্ষণ কুরে কুরে খায় এক তীব্র অস্বস্তি। বার-বার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই নৃশংস হত্যার দৃশ্য। উঃফ্, তার যেন আর মুক্তি নেই এই দৃশ্যটার কাছ থেকে। সারাক্ষণ তার চোখে হানা দেয় দৃশ্যটা, আর সারাক্ষণই প্রতিশোধের এক তীব্র বাসনা তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। হঠাৎ-হঠাৎ মনে হয় একবার মুখোমুখি গিয়ে সে জলদস্যুদের সর্দারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া ক’রে নেয়। সে ভাবে, অপরাধের সাজা তাদের একদিন পেতেই হবে, পাপের মাশুল গুনে-গুনে দিতে হবে তাদের সবাইকে।

কিন্তু ভাবগতিক দেখে মাঝে-মাঝে মনে হয় সত্যি কি তারা কোনো শাস্তি পাবে? সান্তা-ফের এখানে আসতে এখনও অন্তত তিন সপ্তাহ দেরি। বাতিঘরের লগবই দেখেই নিশ্চয়ই সে-কথা বোম্বেটেরা জেনে গিয়েছে। এবং তার আগেই যে কাজ হাসিল ক’রে তারা জাহাজ ভাসিয়ে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ষোলোই ফেব্রুয়ারি। বাস্‌কেথ সেদিন অধীর, উদ্বিগ্ন, আর কিংকতর্ব্যবিমূঢ় বোধ করছিলো। কী করবে সে? কী করা সম্ভব তার পক্ষে, একা অতজনের বিরুদ্ধে? হতভম্ব লাগছে, কিন্তু অস্থিরতাটাও বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। শেষটায় আর থাকতে না-পেরে, সূর্যাস্তের সঙ্গে-সঙ্গে সে উপসাগরের প্রবেশমুখে গিয়ে হাজির হ’লো। সেখানে যাবার পর নিজেই জানে না কখন সে উত্তর তীর ধরে বাতিঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। যদিও ঝপ ক’রে আঁধার নেমে এসেছে আর ক্রমেই ঘন হ’য়ে উঠছে আঁধার, তবু ব্যাপারটা হঠকারী—যে-কোনো মুহূর্তে কারু মুখোমুখি প’ড়ে যেতে পারে সে। হুঁশিয়ার হ’য়েই কানখাড়া ক’রে চলেছে সে, উপসাগরের মাঝামাঝি পৌঁছুতে হ’লে তাকে আরো মাইল তিনেক হাঁটতে হবে। এখনও যে তাকে কেউ দ্যাখেনি, সেটা নিশ্চয়ই তার ভাগ্য।

রাত তখন নটা। বাতিঘর থেকে কয়েকশো গজ দূরে এসে তার হুঁশ হ’লো সে কী করতে চলেছে, অমনি সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো; বাতিঘরের জানলা আর ঘুলঘুলিগুলো দিয়ে বাইরের ঘন অন্ধকারে চাপড়া-চাপড়া আলো এসে পড়েছে। দেখেই অসহ্য ক্রোধে জ্বলে উঠলো সে।

স্কুনারটা অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে প’ড়ে আছে, তাই বাস্‌কেথ সেখান থেকে সেটাকে দেখতে পেলে না। সতর্ক পায়ে, সন্তর্পণে, সে আরো শ’খানেক গজ এগুলো। বোম্বেটেগুলো নিশ্চয়ই যে যার ঘরের ভেতরে, দরজা বন্ধ হয়তো এখন কেউ খামকা বাইরে আসবে না। বাস্‌কেথ কী ভেবেছে জানে না, সে পায়ে-পায়ে আরো এগুচ্ছে। বেশ-কিছু দূর এগিয়ে এসে দেখতে পেলে স্কুনারটি তীর ঘেঁষে জলে ভাসছে। ওহ্! একবার যদি আগুন ধরিয়ে দেয়া যেতো এটায়!

মেরামতের কাজ যদি চলতো, তাহ’লে এখানে লোকজনের সাড়া পাওয়া যেতো। তা যখন নেই, তখন ধ’রে নিতে হবে যে মেরামত হ’য়ে গিয়েছে। কাছে এসে ভালো ক’রে খেয়াল ক’রে বাস্‌কেথ বুঝতে পারলে এখনও জাহাজে মালপত্র বোঝাই করা হয়নি। তাহ’লে জাহাজটা আরো-কয়েকদিন এখানে থাকবে! কিন্তু সে আর কতদিন? দিন তিনেকের মধ্যেই হয়তো মউল দিগন্তে হারিয়ে যাবে।

পরদিন। তখনও ভালো ক’রে দিনের আলো ফোটেনি। রসদে টান পড়েছে দেখে বাস্‌কেথ কিছু খাবারদাবার জোগাড় করবার জন্যে বোম্বেটে গুহায় গিয়েছে। জলদস্যুরা মালপত্র নিতে গুহায় আসবে, তাই তাড়াহুড়ো করা দরকার। তখনও গুহাটি মালে বোঝাই। কিন্তু খাবারদাবার খুঁজতে-খুঁজতে সে একেবারে হয়রান হ’য়ে গেলো। আহার্য বলতে কোনোকিছুই নেই, তারা নিশ্চয়ই সমস্ত-কিছু সরিয়ে ফেলেছে। তাহ’লে দিন তিন-চার পরে তার আর কোনো খাবারই থাকবে না।

কিন্তু তখন ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবারও সময় নেই। বাইরে একটা আওয়াজ হ’লো কীসের। সে তাড়াতাড়ি গুহা থেকে মুখ বার করে দেখতে পেলে, তিনটে লোক নৌকো ভিড়িয়ে তীরে নামছে। এখন তাহ’লে উপায়?

বিপদ দেখে গুহার মধ্যেই ঢুকে পড়লো বাস্‌কেথ। চট ক’রে গিয়ে সবচেয়ে অন্ধকার কোনাটায় একরাশ জিনিশপত্রের আড়ালে সে লুকিয়ে পড়লো। মনে-মনে ঠিক ক’রে নিলে, যদি ধরাই প’ড়ে যাই, তাহ’লে অন্তত বিনামূল্যে আমি আমার জীবন হারাবো না। কোমরের বেল্‌টে হাত বুলিয়ে বাস্‌কেথ নিশ্চিন্ত হলো যে তার রিভলভারটা আছে। কিন্তু সে একা—আর তারা তিন জন!

শুধু সের্‌সান্তে আর ভার্গাসই গুহায় ঢুকেছিলো। সের্‌সান্তের হাতে একটা লণ্ঠন ঝুলছে, সে-ই ছিলো আগে, আর তার পেছনে ভার্গাস। নানান দরকারি জিনিশ জড়ো করতে-করতে তারা কথা বলছিলো। ভার্গাস বললে : ‘আজ তো সতেরোই ফেব্রুয়ারি। এবার আমাদের সটকে পড়া উচিত।’

-’ভেবো না, আমরা শিগগিরই রওনা হবো।’

– কবে?’

—’কাল। অবশ্য মালগুলো যদি তার আগেই জাহাজে তোলা সম্ভব হয়।’ ভার্গাস মন্তব্য করলে : ‘আবহাওয়া ভালো থাকলে হবে বৈ কি।’

-’তা ঠিক। কিন্তু আজ সকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছো? ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ জমছিলো। তবে তা শিগগিরই স’রে যাবে ব’লে মনে হচ্ছে।’

-‘যদি আরো আট-দশ দিন আটকা প’ড়ে যেতে হয়?’

—’তাহ’লে অবিশ্যি বিপদের একটা সম্ভাবনা আছে। ততদিনে সাত্তা-ফে এসে পড়তে পারে। তবে কালই রওনা হওয়া যাবে ব’লে মনে করছি।’

বাসকেথ দমবন্ধ ক’রে উৎকর্ণ হ’য়ে তাদের কথাবার্তা শুনছে। সের্‌সান্তে আর ভার্গাস লণ্ঠন হাতে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব-একটা দরকারি জিনিশ তাদের চোখে পড়ছিলো না। বেশির ভাগ জরুরি জিনিশই আগেভাগে নিয়ে-যাওয়া হয়েছিলো ব’লে অত্যাবশ্যক কিছু প’ড়ে নেই। ইতস্তত মালপত্র খুঁজতে-খুঁজতে বা কেথের গা ঘেঁষেও ক-বার তারা চ’লে গিয়েছে। বাকেথের হাত নিশপিশ করছিলো, ইচ্ছে করছিলো রিভলভারের গুলিতে তাদের মুণ্ডু উড়িয়ে দেয়, কিন্তু সবদিক ভেবে-চিন্তে সে শান্ত হ’য়েই রইলো।

আধঘণ্টাটাক পরে সের্‌সান্তে নৌকোয় পাহারায়-ব’সে-থাকা লোকটার উদ্দেশে হাঁক পাড়লে। লোকটা চটপট এসে মালপত্র ব’য়ে নিয়ে যেতে তাদের সাহায্য করলে। সের্সান্তে যাবার আগে বাকি মালপত্রের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলে।

ভার্গাস বললে, ‘এত-সব জিনিশ ফেলে যেতে কষ্ট হচ্ছে।’

—’কিন্তু কী আর করা যাবে? ফেলে তো যেতেই হবে। স্কুনারটা যদি আরো কয়েকশো টন মাল বইতে পারতো তবে না-হয় একবার চেষ্টা ক’রে দেখা যেতো। কিন্তু আমাদের তো এখন শুধু বাছাই-করা জিনিশই নিয়ে যেতে হবে।’ বলতে-বলতে তারা গুহা থেকে বেরিয়ে গেলো।

….বোম্বেটের গুহা থেকে বেরিয়ে বাসকেথ তখন নিজের গুহায় ফিরে এসেছে। তার মনে তখন একটাই ভাবনা—আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে কোনো খাবারদাবার থাকবে না তার, বাতিঘরের খাবারদাবার নিশ্চয়ই জলদস্যুরা অ্যাদ্দিনে সাবাড় ক’রে ফেলেছে। আর না-ও যদি ক’রে থাকে, ফেলে রেখে যাবে না নিশ্চিত : কিন্তু এর পর? সান্তা-ফে আসতে এখনও অন্তত দিন পনেরো বাকি। ততদিন কী ক’রে চলবে? অবস্থা বিষম ঘোরালো হ’য়ে উঠেছে, এই মস্ত সংকটে তার সাহস বা খাটুনি কিছুই কোনো কাজে আসবে না। মাছ ধ’রে হয়তো ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যায়, কিন্তু যতক্ষণ-না মউল দ্বীপ ছেড়ে চ’লে যাচ্ছে, সে-আশাতেও ছাই। তবে কি শেষ অব্দি তাকে না-খেয়েই মরতে হবে? অন্যদিকে, দস্যুদের যদি সাজা দিতে হয় তবে এমন ব্যবস্থা করাও জরুরি, মউল যাতে দ্বীপ ছেড়ে চ’লে যেতে না-পারে। যে ক’রেই হোক, তাকে দ্বীপে আটকে রাখতেই হবে। আর মউল দ্বীপে থাকলে তার পক্ষে খোলাখুলি জলের ধারে গিয়ে মাছধরা অসম্ভব।

সে যখন এই উভয়সংকটে নিজেকে ছিঁড়ছে, দিনটাও তখন কেমন যেন করুণ কান্নার মতো একঘেয়ে মলিন হ’য়ে আছে। একটু পরেই আকাশে মেঘ জমতে লাগলো। বাতাসও জোরালো হ’য়ে উঠছে। সমুদ্রের ঢেউ এখন যেন ফুঁসে উঠে গরজাতে শুরু করেছে। আবহাওয়ায় ঝড়ের পূর্বাভাস। এ-রকম আবহাওয়া থাকলে একটা সংকট মোচন হয়—জলদস্যুর দল পরদিন আর তাদের জাহাজ ছাড়তে পারবে না।

সন্ধে নাগাদ আবহাওয়া আরো খারাপ হয়ে উঠলো। সত্যি, ভয়ংকর একটা ঝড় আসছে। মেঘগুলো যেন আকাশে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বাতাস ছুটছে খ্যাপার মতো। বাকেথের অভিজ্ঞ চোখ জানে যে এ-ঝড়টা নেহাৎ সাধারণ হবে না। যে-দুর্যোগ আসছে সেটা ক্রমেই ভয়াল চেহারা নেবে।

অথচ তবু শান্ত হ’য়ে গুহায় ব’সে থাকতে পারলে না সে। বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আঁধার-ঢাকা দিগন্তের দিকে আচ্ছন্নের মতো সে তাকিয়ে রইলো। মেঘ ছিঁড়ে সূর্যের শেষ যে-রশ্মিগুলো দেখা যাচ্ছিলো, তারাও এখন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।

হঠাৎ তার মনে হ’লো সমুদ্রে কালো মতন কী-একটা যেন নড়ছে।

—’জাহাজ!’ সে ঝোড়ো হাওয়ায় নিজের স্বর উড়িয়ে দিলে। ‘জাহাজ! এই দ্বীপের দিকেই আসছে!’

সত্যিই পুবদিক থেকে তখন একটা জাহাজ দ্বীপের দিকে আসছিলো। কিন্তু তার মধ্যেই শুরু হ’য়ে গেছে তাণ্ডব, ঝড়ের প্রলয়নৃত্য। হেজিপেঁজি কোনো ঝড় না, রীতিমতো হারিকেন!

হারিকেন! কী সর্বনাশ!

শয়তানগুলো তবু বাতিঘর অন্ধকার ক’রে রেখেছে! জাহাজটা নিশ্চয়ই বাতিঘরের আলো খুঁজছে। এই অন্ধকার তুফানের মধ্যে জাহাজের লোকজন জানতেই পারবে না যে কয়েক মাইলের মধ্যেই এই দ্বীপ আছে! হাওয়ার পাল্লায় প’ড়ে এদিকেই আসছে, আরেকটু পরেই হয়তো আছড়ে পড়বে তীরের পাথরে!

তা-ই হ’তে চলেছে, এবং তা-ই হবে। আলোকস্তম্ভের লণ্ঠনঘর থেকে নিশ্চয়ই বোম্বেটেরা জাহাজটাকে দেখতে পেয়েছে, অথচ তবু আলো জ্বালছে না। কী নিষ্ঠুর এরা—কারু জন্যে একফোঁটা দয়ামায়া নেই প্রাণে। আধঘণ্টার মধ্যেই জাহাজটা তীরে আছড়ে প’ড়ে ভেঙে-চুরে গুঁড়িয়ে যাবে।

ঝড় তখন উদ্দাম হ’য়ে উঠেছে, ঢেউগুলো উত্তাল। পরদিনও যে এ-ঝড় থামবে না, লক্ষণ দেখে তাও বোঝা যায়।

বাসকেথের কিন্তু নিজের ডেরায় ফিরে যাবার কথা মনেই হ’লো না। সে অপলক চোখে উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিরেট অন্ধকারে জাহাজটাকে তখন ভালো ক’রে দেখা যাচ্ছে না, তবু সে তাকিয়ে আছে। শুধু মাঝে-মাঝে যখন জাহাজটা ঢেউয়ের মাথায় ওঠে, তার ক্ষীণ আলো চোখে পড়ে। সমুদ্র তখন যেন কোনো হিংস্র আনন্দে জাহাজটাকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে। জাহাজটার আজ আর কোনোমতেই রেহাই নেই।

অক্ষম বাস্‌কেথ উত্তেজনায় বেলাভূমিতে ছুটোছুটি করছে। একবার যদি বাতিঘরের আলো জ্বলে ওঠে! মুঠো-করা হাত ঝাঁকিয়ে সে দস্যুগুলোকে অভিশাপ দিলে। বাজে গালাগাল দিলে একটা।

জাহাজ কিন্তু অনিবার্যভাবে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আচমকা বাস্‌কেথের মাথায় একটা ফন্দি খেলে গেলো। জাহাজ যদি জানতে পারে যে এখানে ডাঙা আছে, তবে নিশ্চয়ই তার গতিপথ বদল করার চেষ্টা করবে। চারপাশে তাকিয়ে কিছু কাঠকুটো দেখতে পেলে সে। এই কাঠকুটোগুলো জ্বালিয়ে জাহাজটার নজর টানা যায় না কি? এই জোরালো হাওয়ার মধ্যে, যদি কোনোমতে, একবার, আগুন জ্বালানো যায়, জাহাজ কি তা দেখতে পাবে না? অন্তত আধমাইল দূর থেকেও যদি আগুনটা দেখতে পায়, তাহ’লে হুঁশিয়ার হ’য়ে এই ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করতে পারে হয়তো।

তক্ষুনি সে কাজে লেগে গেলো। কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে নিয়ে সে অন্তরীপের মুখটায় চ’লে এলো। সেখানেও কিছু শুকনো কাঠকুটো পাওয়া গেলো। যদিও বেদম তুফান এতক্ষণ ধরে প্রলয় কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে, তবু একফোঁটাও বৃষ্টি পড়েনি এখনও। তাই সে কাঠকুটো জড়ো ক’রে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতে লাগলো।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হ’য়ে গেছে, প্রচুর দেরি হ’য়ে গেছে! আর-কিছু ক’রে কোনো লাভ নেই। অন্ধকারে দৈত্যের মতো অতিকায় একটা জিনিশ তার চোখে পড়লো। উন্মাদ ঢেউয়ের মধ্যে সেটা তীব্র বেগে পাক খাচ্ছে। তারপরেই বিকট একটা আওয়াজ ক’রে মস্ত একটা জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে তীরের কঠিন পাথরে আছড়ে পড়লো সেই অচেনা জাহাজ!

আওয়াজটা বিকট, পিলে চমকানো, কানে তালা লাগানো! হাওয়ার মধ্যে কাদের যেন আর্ত চীৎকার ভেসে এলো। তারপর সব চুপচাপ। শুধু ক্রুদ্ধ হাওয়ার ফোঁস-ফোঁস আর উদ্দাম ঢেউয়ের উত্তাল আছড়ানি ছাড়া আর-কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আগের মতোই এখন ফের ঝড়ের হিংস্র গর্জন নিরেট অন্ধকারের মধ্যে টালমাটাল তোলপাড় তুলে যাচ্ছে।