০১. বাতিঘর

১. বাতিঘর

পশ্চিমের সার-বাঁধা পাহাড়গুলোর আড়ালে অদৃশ্য হ’য়ে গেছে আকাশ। তখন সূর্য ডুবতে চলেছে। পাহাড়গুলোর আড়ালে আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে শেষ বিকেলের আলো। চমৎকার শান্ত আবহাওয়া, সচরাচর এমন আবহাওয়া এখানে দেখা যায় না। পুব আর উত্তর-পুব দিকে তাকালে আকাশ আর সমুদ্রকে আলাদা ক’রে বোঝবার জো নেই—দুয়েই যেন মিলে-মিশে একাকার হ’য়ে গিয়েছে : অন্তত খালি চোখে তাকালে তা-ই মনে হয়। আকাশের ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘগুলোর গায়ে বিকেলের যে-শেষ রশ্মিগুলো ঝিলিক মারছিলো, গভীর-নীল নির্জন সমুদ্রের চঞ্চল জলে ঝিকমিক ক’রে উঠে সেগুলো যেন অপূর্ব এক মায়াজাল রচনা ক’রে বসেছে।

ইগোর উপসাগরে তখন দাঁড়িয়ে ছিলো সান্তা-ফে, তার সব নোঙর ফেলে। উত্তর-মেহিকোর এক শহরের নামে নাম এই জাহাজের : সান্তা-ফে। হঠাৎ সেই জাহাজের ডেক থেকে গর্জন করে উঠলো একটি কামান। সঙ্গে- সঙ্গে মাস্তুলের ওপর তরতর ক’রে উঠে গেলো আরহেতিন প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা, আর সমুদ্রের প্রশান্ত হাওয়ায় পৎপৎ ক’রে উড়তে লাগলো।

ঠিক তখনই, যেন সাড়া দিয়েই, বাতিঘর থেকে একটি বন্দুক গর্জন ক’রে উঠলো, আর তৎক্ষণাৎ ইগোর উপসাগরের জলে এক ঝলক তীব্র আলোর ছটা চোখ ধাঁধিয়ে পিছলে পড়লো। সমুদ্র-সৈকতে এসে দাঁড়ালে দুজন আলোকরক্ষী। জাহাজের সামনের দিকে যে-নাবিকটি দাঁড়িয়েছিলো সে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে তাদের অভিনন্দন জানালে।

আরো-দুটি বন্দুকের আওয়াজ স্টটেন আইল্যাণ্ডের স্তব্ধতা ভেঙে গ’র্জে উঠলো, আর অন্যপাশের পাহাড়গুলোর গায়ে ঘা খেয়ে তাদের প্রতিধ্বনি যেন বার-বার গর্জন ক’রে উঠলো তারপর

অতলান্তিক মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের জলোচ্ছ্বাস যেখানে পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছে, সেখানে সবুজ বনানী-ঢাকা মাথা তুলে সূর্যকে অভিবাদন জানায় স্টটেন আইল্যাণ্ড।

কামান-বন্দুকের এই আওয়াজগুলো সমুদ্রের বিস্তারে মিলিয়ে যেতেই আবার একটি নীরবতা নেমে এলো স্টটেন আইল্যাণ্ডের ওপর

দ্বীপে শুধু তিনজন আলোকরক্ষীকেই কাজে বাহাল করা হয়েছে। একজন এখন বাতিঘরের মিনারে তার কাজে ব্যস্ত, বাকি দুজনকে আমরা দেখেছি সমুদ্র-সৈকতে, সেখানে পায়চারি করতে-করতে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। দুজনের মধ্যে তুলনায় যার বয়স কম, সে বললে, ‘তাহ’লে, বাস্‌কেথ, সান্তা-ফে কালকেই আমাদের ছেড়ে চ’লে যাচ্ছে।’

‘জানি, ফিলিপ।’ বাস্‌কেথ জবাব দিলে, ‘এবং আমি আশা করি সান্তা- ফে নির্বিঘ্নেই দেশে ফিরতে পারবে।’

কথাটা আশা করার। আসলে সান্তা ফে সত্যি-সত্যি বুয়েনোস আইরেসে ফিরতে পারবে কি না, সে-কথা বাস্‌কেথ বা ফিলিপ কেউই নিশ্চয় ক’রে বলতে পারবে না।

পারা সম্ভবও ছিলো না। তিয়েরা দেল ফুয়েগো কিংবা পাতাগোনিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় কোনো জায়গায় নেই, যাতে অশান্ত সমুদ্রে তুফান উঠলে সান্তা-ফে ডাঙায় ভিড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে পারে। মাগেলান প্রণালীর এ-পাশে সমুদ্রের ঝড়তুফান নাবিকদের মধ্যে তার ভয়াবহ তাণ্ডবের জন্যে কুখ্যাত। এখানকার সমুদ্র ভয়ংকর বেয়াড়া, নাবিকদের সম্ভবত আদপেই পছন্দ করে না, প্রায়ই শৃঙ্গ অন্তরীপের শিলাময় প্রাচীরে আছড়ে প’ড়ে কত-যে জাহাজ সোজা পাতালে চ’লে যায়, তার আর কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে সে-অবস্থা এখন, এতদিন পর, পালটাতে চলেছে। কারণ স্টটেন আইল্যাণ্ডে এখন বাতিঘর বসানো হয়েছে, আর তার ফলে আশা করা যায় হাজার তুফান, হাজার হারিকেন উঠলেও তার আলো আর নিভবে না। দুর্যোগের সময় এই বাতিঘরের আলোয় জাহাজগুলো তাদের পথ দেখতে পাবে, আর ঘুটঘুটে আঁধার রাতেও সান হুয়ান অন্তরীপ কিংবা সান দিয়েগো অন্তরীপ অথবা ফালোস অন্তরীপের রাস্তায় সংঘর্ষ অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবে।

ফিলিপ এই জনমানবশূন্য দ্বীপে পুরো তিন-তিনটি মাস কাটাতে হবে ব’লে বেশ-একটু মনমরাই হ’য়ে পড়েছিলো। তিনমাস পরে যতক্ষণ-না নতুন তিনজন আলোকরক্ষী এসে ওদের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে, ততদিন সভ্যজগতের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন কোনো নির্জন দ্বীপে দিন কাটানো খুব-একটা সহজ কাজ নয়। জাহাজে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়া যায়, অন্য মাল্লারা আছে, জাহাজ ভেসেই চলেছে, মাঝে-মাঝেই নতুন-নতুন বন্দরে গিয়ে ভিড়তে পারে। কিন্তু এ-দ্বীপটা এক অর্থে বন্দীশালাই–তিনমাসের মেয়াদ না-ফুরোলে আর মুক্তি নেই। চাকরির জন্যে আরজি পাঠাবার সময় ব্যাপারটা সে এদিক থেকে ভেবে দ্যাখেনি। এখন দ্বীপে এসে হাজির হবার পর এদিকটা তার খেয়াল হয়েছে।

বাস্‌কেথ বললে, ‘দ্যাখো বাছা ফিলিপ, আজ চল্লিশ বছর ধ’রে সমুদ্রকেই আমি আমার ঘর করেছি। জাহাজের ক্যাবিনবয়, খানশামা, নাবিক, অফিসার হিশেবে কত জাহাজে ক’রেই না ঘুরেছি, বলতে গেলে সারা দুনিয়াটাই চ’ষে বেড়িয়েছি। এবার আমার অবসর নেবার সময় এসেছে। বাতিঘরের রক্ষী হওয়া ছাড়া আর কী-ই বা এখন আমার সাজে? আর এই বাতিঘর কি যে-সে বাতিঘর না কি? একেবারে দুনিয়ার শেষ সীমানার বাতিঘর।’ এইসব নানান কথা ব’লে ফিলিপকে উৎসাহ দেবার চেষ্টা করতে-করতে বাস্‌কেথ বাতিঘরে গিয়ে প্রবেশ করলে।

প্রশান্ত মহাসাগরের জোয়ারের তেমন বিশেষ শক্তি নেই ব’লে একটা কিংবদন্তি আছে। সেটা ঠিক হোক বা না-হোক, অতলান্তিক মহাসাগরের সংযোগস্থলে প্রশান্ত মহাসাগর কিন্তু প্রচণ্ড খেপেই থাকে সবসময়, আর জোয়ার এলে তো কথাই নেই। সেখানে কী তার উন্মাদ গর্জন আর ঢেউয়ের কী প্রচণ্ড দাপট! এমনকী এর তীব্র প্রভাব অনেক দূর থেকে মাগেলানের জলেও টের পাওয়া যায়।

সান্তা-ফে আরহেতিন নৌ-বাহিনীর জলপোত। একশো ষাট অশ্বশক্তিতে শক্তিমান জাহাজটি দুশো টন ভার বইতে পারে। কাপ্তেন লাফায়েৎ আর লেফটেনান্ট রীগাল ছাড়া পঞ্চাশ জন মাঝিমাল্লা রয়েছে এর খবরদারিতে। এর কাজ হ’লো রিও দে লা প্লাতার দক্ষিণ থেকে লেময়র প্রণালী অব্দি অতলান্তিক মহাসাগর এলাকায় নজর রেখে বেড়ানো। আমাদের এই কাহিনী যখনকার, তখন দ্রুতগতিসম্পন্ন জাহাজ, ক্রুজার বা টর্পেডো-বোট তৈরি হয়নি। তাই, সান্তা-ফের ঘণ্টায় ন-মাইল গতিবেগই তখনকার দিনে যথেষ্ট বলে মনে হ’তো।

এই বছরের গোড়ার দিকে আরহেন্তিনার সরকার এই জাহাজের হাতে লেময়র প্রণালীর প্রবেশমুখে নির্মীয়মান বাতিঘরটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছিলো। মানুষ-জন, যন্ত্রপাতি, মাল-মশলা প্রভৃতি যা-যা বাতিঘর বানাবার জন্যে দরকার, তাই নিয়েই সে স্টটেন আইল্যাণ্ডে যাতায়াত করছিলো। বুয়েনোস আইরেসের জনৈক সুদক্ষ বাস্তুকারের নকশা অনুযায়ী বাতিঘরের কাজ এই ডিসেম্বর মাসে অবশেষে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সান্তা ফে সপ্তাহ তিনেক আগে এসে ইগোর উপসাগরে নোঙর ফেলেছিলো। চারমাসের উপযোগী রসদ ও অন্যান্য জিনিশপত্র বাতিঘরের ভাঁড়ারে জমা ক’রে, বাতিঘরের রক্ষী তিনজন যাতে তিনমাসের মধ্যে কোনোকিছুর অভাবে না-পড়ে সে-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হ’য়ে, কাপ্তেন লাফায়েৎ স্টটেন আইল্যাণ্ড থেকে বিদায় নেবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন।

বহু আবেদনকারীর মধ্যে থেকে কর্তৃপক্ষ বাস্‌কেথ, ফিলিপ এবং মরিসকেই বিশ্বের শেষ প্রান্তের এই বাতিঘরের আলোকরক্ষী হিশেবে মনোনীত করেছেন। ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাস তারা বাতিঘরের ভার নিয়ে থাকবে, তারপর মার্চ মাসে আবার নতুন আলোকরক্ষীরা এসে এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেবে।

আলোকরক্ষীদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে মিনারের নিচেই। ঝড়ের তীব্রতা যাতে ঠেকাতে পারে, সেই জন্যে এই কোয়ার্টারটি পুরু দেয়াল দিয়ে আগাগোড়া মোড়া। কোয়ার্টারটি মিনারের সিঁড়ি থেকে একটা বারান্দা দিয়ে আলাদা করা। বারান্দাটির একেবারে শেষ মাথায় আলোকস্তম্ভের সিঁড়িতে ওঠবার দরজা। সিঁড়িটা সরু, এবং ঘোরানো। দেয়ালের থাকে-থাকে পাথর গেঁথে তৈরি। সিঁড়িপথ মোটেই অন্ধকার নয়। অনেকগুলো লুপহোল বা ছোটো গবাক্ষ দিয়ে আলো আসার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। বাতিঘরের লুক-আউট কামরায় লণ্ঠনের আতসকাচ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি একেবারে আনকোরা ব’লেই ঝকঝক করছে। দেয়ালের গা ঘেঁষে গ্যালারি। গ্যালারিতে বসে চারদিকের সমুদ্রের ওপর নজর রাখতে কোনোই অসুবিধে হবার কথা নয়।

পরদিন সকালবেলা থেকেই সান্তা-ফে-র ওপর একটা সাজো-সাজো রব উঠলো। বিকেলবেলা জাহাজ ছাড়বে, তারই প্রস্তুতির জন্যে এই শশব্যস্ত কর্মচাঞ্চল্য। কাপ্তেন লাফায়েৎ আর লেফটেনান্ট রীগাল তীরে নেমে শেষবারের মতো সবকিছু পরিদর্শন ক’রে এলেন। গতকাল সান্তা-ফের ডেক থেকে কামান দাগবার সঙ্গে-সঙ্গেই বাতিঘরের লণ্ঠনের প্রথম আলো জ্বলেছিলো। কাপ্তেন লাফায়েৎ ভালো ক’রে বাকেথের কাছ থেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে খবর নিলেন : না, লণ্ঠন ভালোভাবেই কাজ দিয়েছে, চিন্তার কোনোই কারণ নেই।

আলোকরক্ষীদের কাজটা খুবই কঠিন। একটি নির্জন পরিত্যক্ত দ্বীপে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়াটা মোটেই সুখের ব্যাপার নয়। তবে বাস্‌কেথ, ফিলিপ এবং মরিস—তারা তিনজনই সহ্যশীল ও দক্ষ ব্যক্তি, সমুদ্র সম্পর্কে তাদের বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। জাহাজে জাহাজে কাজ করতে-করতে খানিকটা ক্লান্ত হ’য়ে গিয়ে হয়তো বিশ্রামের জন্যেই এই কাজ নিয়েছে। বাতিঘরের কাজকর্ম রুটিন-বাঁধা, তবে জাহাজের শশব্যস্ত তাড়ার তুলনায় এই কাজ তাদের কাছে হয়তো পরিপূর্ণ বিশ্রাম ব’লেই মনে হবে। তাছাড়া মাত্র তো তিন মাসের ব্যাপার। চোখ-কান বুজে তিনমাস কাটিয়ে দিলেই হ’লো, তারপর এদের ছুটি দিতে বদলি এসে যাবে।

কাপ্তেন লাফায়েৎ রক্ষী তিনজনকে বিস্তর উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা করে জাহাজে ফিরে গেলেন।

বিকেলবেলা আলোকরক্ষীরা তিনজনেই সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ালে। একটু পরেই সান্তা-ফে এখান থেকে রওনা হবে। স্টটেন আইল্যাণ্ডে তারপর বাস্‌কেথ, মরিস আর ফিলিপ ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাবে না। তারা একদৃষ্টে জাহাজের ডেকে কর্মচঞ্চল নাবিকদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

বিকেল পাঁচটায় সান্তা-ফে-র বয়লার গর্জে উঠলো। তার চোঙ দিয়ে ভলকে ভলকে বেরিয়ে এলো কালো-কালো ধোঁয়া, তীক্ষ্ণ বেজে উঠলো বাঁশি, পাহাড়ের গায়ে ঘা খেয়ে তার রেশ জাগিয়ে রাখলে প্রতিধ্বনি। জোয়ারের বেগ এখনও বেশ শিথিল; একটু পরে যখন জোয়ারের তোড়ে তীরের কাছের জল ফুলে-ফেঁপে উঠলো, তখন ঘড়ঘড় শব্দে সান্তা-ফে-র নোঙর তোলা হ’লো।

পৌনে ছটার সময় কাপ্তেন লাফায়েৎ এনজিনম্যানকে তৈরি হ’য়ে নেবার জন্যে হুকুম করলেন। শোঁ-শোঁ ক’রে শব্দ উঠলো এনজিনে। লেফটেনান্ট রীগাল এগিয়ে এসে অপারেটর প্রস্তুত কি না দেখে গেলেন।

সান্তা-ফে নড়তে শুরু করলো।

আলোকরক্ষী তিনজন তীর থেকে বিদায়-অভিনন্দন জানালে। বাকেথের মনোভাব এখন কী—সেটা তার মুখ দেখে সঠিক বলা শক্ত। তবে তার অন্য দুজন সহকর্মীকে বেশ একটু বিচলিতই দেখাচ্ছে। সান্তা ফের লোকজনেরাও আমেরিকার অনেক দূরে বিশ্বের একেবারে শেষ প্রান্তে জনশূন্য দ্বীপে এদের ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে ব’লে বেশ-একটু মনখারাপই করলে।

ইগোর উপসাগরের উত্তর-পশ্চিম উপকূল ধ’রে মোটামুটি সাধারণ গতিতেই তরতর ক’রে জল কেটে এগিয়ে চললো সাত্তা-ফে। আটটার সময় সে গিয়ে পড়লো বারদরিয়ায়; সান হুয়ান অন্তরীপ ঘুরে, পশ্চিমে প্রণালীটি ফেলে রেখে তারপর সে পুরোদমে চলতে শুরু করলো। ঘন হ’য়ে যখন রাত্রি নামলো, তখন সাত্তা-ফের ডেক থেকে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের এই বাতিঘরের ঝলমলে আলোই শুধু দেখা গেলো : দিগন্তে একটা ছোট্ট তারার মতো জ্বলজ্বল করছে বাতিঘর।

তখনও আলোকরক্ষীরা কল্পনাও করতে পারেনি তাদের ভাগ্যের আকাশে কী-ভয়ানক বিপদের কালোমেঘ এসে জমছে।

স্টটেন আইল্যাণ্ডকে স্টটেন ল্যাণ্ড বলেও অভিহিত করতো কেউ-কেউ। আমেরিকার একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম বিন্দুতে এর অবস্থিতি। উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের নীল জল দিয়ে ঘেরা দ্বীপটি দু-দুটো মহাসাগরের জলে অবগাহন করতো। শৃঙ্গ অন্তরীপের মধ্যে দিয়ে যে-সব জাহাজ যেতো, তাদের ডেক থেকে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো দেখাতো স্টটেন ল্যাণ্ডকে।

এই এলাকায় লেময়র প্রণালী নামে একটি প্রণালী আছে। এই প্রণালী দিয়েই তিয়েরা দেল ফুয়েগো থেকে স্টটেন আইল্যাণ্ড বিচ্ছিন্ন; পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান কুড়ি মাইলের মতো। দ্বীপটার পুবদিকে সান আন্তোরিয়ো আর কেম্প অন্তরীপ।

স্টটেন আইল্যাণ্ড পুব থেকে পশ্চিমে ঊনচল্লিশ মাইল, আর উত্তর-দক্ষিণে এগারো মাইল। এর উপকূলভাগ অত্যন্ত আঁকাবাঁকা। কোথাও আকাশে মাথা তুলেছে খাড়া পাহাড়, কোথাও-বা কোনো খাড়ির মধ্যে দিয়ে চর্কি দিয়ে ঘূর্ণি দিয়ে ছুটেছে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। ডুবোপাহাড়ও এই এলাকায় প্রচুর। তাই প্রায়ই এই এলাকায় জাহাজডুবি হয়, গত একশো বছরে অগুনতি জাহাজ এখানে ডুবোপাহাড়ে ঘা খেয়ে ভেঙেছে। উপকূলের সমুদ্রের তলাতেও বিস্তর পাহাড়-পর্বত আছে ব’লে সবচেয়ে শান্ত অবস্থাতেও এখানকার সমুদ্র যেন প্রচণ্ড খেপে থাকে, ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস তোলে।

দ্বীপটি জনমানবহীন। অবশ্য এর সবচেয়ে ভালো ঋতুতেই—মানে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি অব্দি—এখানে কোনোরকমে বাস করা চলে—ঐ সময়টুকুই দক্ষিণ গোলার্ধের এই দ্বীপের গ্রীষ্মকাল কি না—অথচ তখনও সেখানে সে-কী হাড়কাঁপানো কনকনে শীত।

দ্বীপের অরণ্যে কিছু-কিছু গুঅনাকো দেখা যায়। গুঅনাকো দক্ষিণ আমেরিকার একধরনের আদিম জাতের হরিণ। এর মাংস বেজায় স্বাদু। শীতকালে যখন ঘন পুরু বরফের চাদর মুড়ি দেয় দ্বীপ, তখনও এই হরিণগুলো খাবারের অভাবে মরে না, কারণ বরফের তলা থেকে তারা গাছগাছড়ার পাতা-শেকড় ইত্যাদি খুঁজে নিয়ে খেতে পারে।

সত্যি-বলতে দ্বীপটিকে একটা প্রকাণ্ড পাথুরে টিলা ছাড়া আর-কিছুই বলা চলে না। প্রাণহীন, নির্জন। ঐ এলাকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু-কিছু পাখপাখালি আর উপকূলের নানান জাতের মাছ ছাড়া আর-কোনো প্রাণীকেই দেখতে পাওয়া যায় না। দ্বীপটির মালিক চিলে ও আরহেনতিনার প্রজাতন্ত্র। আরহেন্তিনার সরকার পৃথিবীর শেষ কিনারে এখানে একটি বাতিঘর তৈরি ক’রে দিয়ে সব দেশের নাবিকদেরই কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এখানে সমুদ্র জাহাজে জাহাজে ব্যস্ত—অথচ ঝড়ে-তুফানে ভয়াবহ। এখানকার ভয়ংকর সমুদ্রে স্টটেন আইল্যাণ্ডের বাতিঘর নিশ্চয়ই দেবতার আশীর্বাদের মতোই কাজ দেবে। তাই, আরহেন্তিনার সরকারের উদ্যোগে ১৮৫৯ সালের নয়ই ডিসেম্বর একবছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে বাতিঘরটি তৈরি হয়েছে—তৈরি হয়েছে সবেমাত্র।

দ্বীপটির মাঝখান থেকে চারদিকে রুক্ষ ঊষর মরুভূমি ছড়িয়ে পড়েছে। বাকি দ্বীপটা পাথুরে জমির। এবড়ো-খেবড়ো, উঁচু-নিচু, মাঝে-মাঝে হাঁ ক’রে আছে মস্ত সব গহ্বর, পাতালের অন্ধকারই যেন উগরে দিতে চাচ্ছে। আর নয়তো উঁচু-নিচু কিছু টিলা আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আকাশকে বিদ্রুপ করবার চেষ্টা করছে। দ্বীপটার সৃষ্টি হয়েছে অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। দ্বীপের পুবদিকটা অন্তরীপের মতো ছড়ানো, পশ্চিমদিকটাও সেইরকম : উঁচু, পর্বতবহুল। অরণ্য যেখানে নিবিড়, সেখানে অ্যান্টার্কটিকের সব গাছ। দ্বীপের সমতল অংশটুকু অনেকটাই তুন্দ্রা অঞ্চলের মতন দেখতে—শীতকালে তা তুষারে ঢাকা প’ড়ে যায়।

দ্বীপে সারাক্ষণই ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত লেগে আছে।

তীর ঘেঁষে খাড়াই পাহাড়। দ্বীপে কোনো নদী বা ঝরনা নেই। গ্রীষ্মকালের সূর্যের তাপে বরফ গললে এদিকে-ওদিকে বরফগলা জলে ছোটোখাটো ঝিল জাগে, আর ঘোর প্রচণ্ড শীতের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত রোদ্দুরে সেই জল ঝিকমিক ক’রে ওঠে। আমাদের কাহিনীর যবনিকা যখন উঠলো তখন ঐসব ঝিলের জলধারা টিলাপাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে এসে ইগোর উপসাগরের সুনীল-ফেনিল জলরাশিকে আলিঙ্গন করছিলো। কিন্তু কে জানতো পৃথিবীর একেবারে শেষ কিনারে, বাসের অযোগ্য এই নির্জন দ্বীপটাতেও একদল বোম্বেটে এসে আস্তানা গেড়েছে!