১০. ঈশ্বরের প্রয়াণ?

১০. ঈশ্বরের প্রয়াণ?

ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় নাস্তিক্যবাদ নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ আলোচনার বিষয় ছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা এক নতুন স্বাধীন চেতনার জন্ম দিচ্ছিল যা অনেককে ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীলতা ত্যাগে অনুপ্রাণিত করেছে। এই শতাব্দীতেই লুদভিগ ফয়েরবাখ, কার্ল মার্ক্স, চার্লস ডারউইন, ফ্রেডেরিখ নিৎশে ও সিগমুন্ড ফ্রয়েড বাস্তবতার দর্শন ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রণয়ন করেন যেখানে ঈশ্বরের কোনও স্থান ছিল না। প্রকৃতপক্ষেই শতাব্দীর শেষদিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল যে, ঈশ্বরের এখনও মৃত্যু না ঘটে থাকলে যৌক্তিক মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে হত্যা করা। ক্রিশ্চান পাশ্চাত্যে। শত শত বছর ধরে লালিত ঈশ্বরের ধারণা এ সময় মারাত্মকভাবে অপর্যাপ্ত বোধ হচ্ছিল; যুক্তির কাল যেন শত শত বছরের কুসংস্কার আর গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। আসলেই কি তাই? পশ্চিম এবার সূচনা করার সুযোগ করায়ত্ত করেছিল। এর কর্মকণ্ডের অনিবার্য পরিণাম মুসলিমদেরও প্রভাবিত করবে, যারা নিজেদের অবস্থান যাচাই করতে বাধ্য হবে। ঈশ্বরের ধারণা প্রত্যাখ্যানকারী বহু আদর্শই অর্থপূর্ণ প্রতীয়মান হয়েছে। পাশ্চাত্য খৃস্টজগতের মানবরূপী ব্যক্তি ঈশ্বর ছিলেন নাজুক। তার নামে ভয়াবহ সব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তার প্রয়াণ আনন্দমুখর মুক্তি হিসাবে উদযাপিত হয়নি এবং সন্দেহ, আতঙ্ক আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে যন্ত্রণাদায়ক বিরোধ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ গবেষণামূলক চিন্তাধারার প্রতিবন্ধক ব্যবস্থা হতে মুক্ত করে নতুন ধর্মতত্ত্ব সৃষ্টি করে ঈশ্বরকে বাঁচানোর প্রয়াস নিয়েছিল, কিন্তু নাস্তিক্যবাদ বিদায় নেওয়ার জন্যে আসেনি।

যুক্তির কাল্টের বিরুদ্ধেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। রোমান্টিক আন্দোলনের কবি, ঔপন্যাসিক ও দার্শনিকরা উল্লেখ করেছিলেন যে, আপাদমস্তক যুক্তিবাদ ক্ষতিকর, কারণ তাতে মানবীয় চেতনার কল্পনা ও সহজাত প্রবৃত্তি নির্ভর কর্মকাণ্ড বাদ পড়ে যায়। কেউ কেউ সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে খৃস্টধর্মের ডগমা ও রহস্যসমূহকে নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন। এই পুনর্নির্মিত ধর্মতত্ত্ব নরক ও স্বর্গ, পুনর্জন্ম ও উদ্ধার লাভের প্রাচীন থিমসমূহকে বাগধারায় রূপান্তরিত করে আলোকন পর্ব পরবর্তী মানুষের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে সেগুলোকে ‘মহাশূন্যে বিরাজিত অতিপ্রাকৃত সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক হতে বঞ্চিত করে। এইসব ‘স্বাভাবিক অতিপ্রাকৃতবাদের অন্যতম মূলসুর ছিল আমেরিকায় সাহিত্য সমালোচক এম. আর. আব্রামস যেমন আখ্যায়িত করেছেন, সৃজনশীল কল্পনা। একে এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখা হয়েছে যা এমনভাবে বাহ্যিক সত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে যার ফলে একটি নতুন সত্যের সৃষ্টি হয়। ইংরেজ কবি জন কীটস (১৭৯৫-১৮২১) অল্প কথায় বলেছেন: ‘কল্পনা হচ্ছে আদমের স্বপ্নের মতো-জেগে উঠে তিনি একে সত্য বলে আবিষ্কার করেছেন।’ মিল্টনের প্যারাডাইস লস্টের ঈভের সৃষ্টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। সৃষ্টিই হয়নি এমন এক সত্তার স্বপ্ন দেখার পর ঘুম থেকে জেগে উঠে সামনে অবস্থানরত নারীর মাঝে তার দেখা পেয়ে যান আদম। একই চিঠিতে কল্পনাকে পবিত্র গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন কীটস: ‘আমি হৃদয়ের টানের পবিত্রতা ও কল্পনার সত্যতা ছাড়া আর কোনও কিছুর ব্যাপারেই নিশ্চিতই নই-কল্পনা যাকে সুন্দর বলে গ্রহণ করে তা সত্য হতে বাধ্য-তা আগে হতেই থাকুক বা না থাকুক। সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় যুক্তির ভূমিকা খুবই সীমিত। কীটস মনের একটা অবস্থারও বিবরণ দিয়েছেন যাকে তিনি বলেছেন নেতিবাচক ক্ষমতা’, ‘যখন মানুষ সত্য ও যুক্তির দিকে বিরক্তিকরভাবে অগ্রসর না হয়ে অশ্চিয়তা, রহস্য, সন্দেহের পর্যায়ে অবস্থান করতে পারে। অতিন্দ্রীয়বাদীর মতো কবিকেও যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠে নীরব প্রতীক্ষার মনোভাব নিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে হয়।

মধ্যযুগীয় অতিন্দ্রীয়বাদীরা অনেকটা এভাবেই ঈশ্বরের অনুভুতির বর্ণনা দিয়েছিল। ইবন আল আরাবী এমনকি আপন সত্তার গভীরে কল্পনা শক্তির ঈশ্বরের সৃষ্টিহীন সত্তার নিজস্ব অনুভূতি সৃষ্টির কথাও বলেছেন। যদিও কীটস স্যামুয়েল কোলরিজের (১৭৭২-১৮৩৪) সঙ্গে মিলিতভাবে রোমান্টিক আন্দোলনের সূচনাকারী উইলিয়াম ওঅডওসঅর্থের (১৭৭০-১৮৫০) সমালোচনামুখর ছিলেন, তাঁরা কল্পনা সম্পর্কে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। ওঅর্ডসওর্থের সেরা কবিতাগুলো মানুষের মন ও প্রকৃতি জগতের মৈত্রীর জয়গান গেয়েছে, যারা দৃশ্য ও অর্থ সৃষ্টির লক্ষ্যে পরস্পর পরস্পরের ওপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। ওঅর্ডসওঅর্থ স্বয়ং অতিন্দ্রীয়বাদী ছিলেন, প্রকৃতি সম্পর্কিত যার বোধ ঈশ্বর অনুভূতির অনুরূপ ছিল। লাইন্স কম্পোজড আ ফিউ মাইলস অ্যাবাভ টিনটার্ন অ্যাবি-তে তিনি মনের গ্রাহী অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন যা বাস্তবতার এক মোহাবেশের রূপ নিয়েছে:

সেই সুখী মন
যখন রহেস্যর ভার
যখন জগদ্দল বোঝ
এই দুর্বোধ্য জগতের
হালকা হয়ে আসে, সেই
নিরিবিলি সুখী মন
যখন মমতা ক্রমশঃ আমাদের এগিয়ে নেয়–
যতক্ষণ না মননের এই কাঠামোর শ্বাস
এমনকি আমাদের মানবীয় শোণিতের প্রবাহ
প্রায় থমকে যায়, আমরা ঘুমিয়ে পড়ি,
দৈহিকভাবে হয়ে উঠি জীবন্ত আত্মা
যখন ছন্দের শক্তিতে নীরব হয়ে ওঠা
চোখ দিয়ে আর আনন্দের গভীর
শক্তিতে আমরা সমস্ত কিছুর জীবন দেখতে পাই।

এই দৃশ্য হৃদয় আর আবেগ থেকে এসেছে, ওঅর্ডসওঅর্থের ভাষ্যে অনধিকার হস্তক্ষেপকারী বুদ্ধিমত্তা হতে নয়, বুদ্ধি সম্পূর্ণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা এই ধরনের অনুভবকে নষ্ট করে দিতে পারে। মানুষের জ্ঞানগর্ভ বই ও তত্ত্ব প্রয়োজন নেই। আসলে যা দরকার তা হচ্ছে এক প্রাজ্ঞ নিষ্ক্রিয়তা’ ও ‘দর্শক ও গ্রাহক হৃদয়’। অন্তরের অনুভূতি থেকে অন্তদৃষ্টি সূচিত হয়। যদিও একে ‘প্রাজ্ঞ’ হতে হবে, অনুপ্রেরণাবিহীন ও আত্মমগ্ন নয়। কীটস যেমন বলতেন, যতক্ষণ আবেগে তাড়িত হয়ে প্রাণবন্ত অবস্থায় হৃদস্পন্দনে অনুভূত হয়ে হৃদয়ে না যাচ্ছে ততক্ষণ সত্য পুরোপুরি সত্যে পরিণত হয় না।

ওঅর্ডসঅর্থ একটি চেতনা উপলব্ধি করেছেন যা যুগপৎ প্রাকৃতিক ঘটনাবলীতে পরিব্যাপ্ত আবার তা থেকে বিচ্ছিন্ন

উন্নত চিন্তার আনন্দ আমাকে
অস্বস্তিতে দেখে দেওয়া সত্তা;
ঢের গভীরভাবে জড়িত কোনও কিছুর
একটা বোধ, সূর্যের রশ্মিতে যার
আবাস, আর পাক খাওয়া সাগর ও নীলাকাশ আর
মানুষের মন: এক সজীবতা ও আত্মা,
যা সমস্ত চিন্তাশীল জিনিসকে
চিন্তার সমস্ত বিষয়ক প্রলুব্ধ করে আর
বয়ে যায় সমস্ত জিনিসে।

হেগেলের মতো দার্শনিকগণ ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহে এ ধরনের চেতনা খুঁজে পাবেন। ওঅর্ডসওঅর্থ তার এই অনুভূতিকে প্রচলিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন, যদিও অন্যান্য উপলক্ষ্যে আনন্দের সঙ্গে ‘ঈশ্বর সম্পর্কে কথাবার্তা বলেছেন তিনি। ইংরেজ প্রোটেস্ট্যান্টরা অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বরের সঙ্গে পরিচিত ছিল না, সংস্কারকগণ এই ঈশ্বরকে আগেই বাদ দিয়ে কর্তব্যের আহবানে বিবেকের মাধ্যমে ঈশ্বর কথা বলেছেন; তিনি হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষাকে সংশোধন করে দেন, কিন্তু ওঅর্ডসঅর্থ প্রকৃতিতে যে অনুভূতি বোধ করেছেন তার সঙ্গে যেন তেমন মিল নেই। অনুভূতি প্রকাশের সঠিকতা নিয়ে আগাগোড়া সতর্ক ওঅর্ডসঅর্থ একে কেবল একটা কিছু আখ্যায়িত করেছেন যা সাধারণত পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞার বিকল্প হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। ওঅর্ডসওঅর্থ চেতনাকে বর্ণনা করতে এর ব্যবহার করেছেন, কারণ প্রকৃত অতিন্দ্রীয়বাদী অজ্ঞাবাদের কারণে তিনি এর কোনও নাম দিতে চাননি, কেননা এটা তার জানা কোনও শ্রেণীতে খাপ খায়নি।

একই সময়ে আরেক অতিন্দ্রীয়বাদী কবির কণ্ঠে আরও প্রলয়ঙ্করী সুর ধ্বনিত হয়েছে, তিনি ঈশ্বর মৃত ঘোষণা দিয়েছেন। উইলিয়াম ক্লেক (১৭৫৭-১৮২৭) তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন: ‘নিষ্পাপ’ ও ‘অভিজ্ঞতা’র মতো শব্দগুলো সম্পূর্ণ বিপরীত মনে হওয়া এক অধিকতর জটিল বাস্তবতার অর্ধ-সত্য বলে আবিস্কৃত হয়েছে। ব্লেক ইংল্যান্ডে যুক্তির কালে কবিতার ছন্দোবদ্ধ রীতির বৈশিষ্ট্যকে অর্থাৎ ভারসাম্যপূর্ণ আন্টিথিসিসকে ব্যক্তিগত ও অন্তর্গত দৃশ্যকল্প সৃষ্টির পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করেন। সংস অভ ইনোসেন্স অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স-এর মানবাত্মার দুটো পরস্পর বিরোধী অবস্থা সংজ্ঞায়িত না হওয়া পর্যন্ত অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে: পাপহীনতাকে অবশ্যই অভিজ্ঞ হতে হবে এবং প্রকৃত নিষ্পাপকে উদ্ধার করার আগে সর্বনিম্ন গভীরতায় পতিত হতে হবে। কবি একজন পয়গম্বরে পরিণত হয়েছেন, “যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দেখেন এবং যিনি আদিম কালে মানুষের উদ্দেশে কথা বলা পবিত্র বাণী শোনেন:

ভ্রষ্ট আত্মাকে আহবান
জানিয়ে,
সন্ধ্যার শিশিরে কেঁদে
যা হয়তো তারা খচিত
মেরুকে নিয়ন্ত্রণ করতে
পারবে,
আর আলো
পড়ছে আর পড়ছে।

নাস্টিক ও কাব্বালিস্টদের মতো এক পরম পতনোন্মুখতার কল্পনা করেছেন ব্লেক। মানুষ যতক্ষণ না তার পতিত অবস্থাকে স্বীকার করছে ততক্ষণ প্রকৃত দিব্যদর্শন আসতে পারে না। প্রাথমিক যুগের অতিন্দ্রীয়বাদীদের মতো ব্লেক আমাদের চারপাশের জাগতিক বাস্তবতায় অবিরামভাবে উপস্থিত একটি প্রক্রিয়াকে প্রতীকায়িত করার জন্যে আদি পতনের ধারণাকে ব্যবহার করেছেন।

সত্যকে পদ্ধতির অধীন করার প্রয়াস পাওয়া আলোকন পর্বের দর্শনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন ব্লেক। তিনি খৃস্টধর্মমতের ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলেন, যাঁকে নারী-পুরুষকে মনুষ্যত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যবহার করা হয়েছে। যৌনতা, স্বাধীনতা ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দকে দমন করার। উদ্দেশ্যে অস্বাভাবিক আইন বা বিধি জারি করার জন্যে এই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। দ্য টাইগার’-এ এই অমানবীয় ঈশ্বরের ভয়ঙ্কর সামঞ্জস্যতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ব্লেক, ঈশ্বরকে তিনি ভাষাতীতভাবে পৃথিবী থেকে ‘দূরবর্তী গভীরে এবং আকাশে বহুদূরের হিসাবে দেখেছেন। তা সত্ত্বেও, বিশ্ব জগতের স্রষ্টা সম্পূর্ণ ভিন্ন ঈশ্বর তাঁর কবিতায় পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। স্বয়ং ঈশ্বরকে পৃথিবীতে পতিত হয়ে ব্যক্তি জেসাসের রূপে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তিনি এমনকি মানবজাতির শত্ৰু স্যাটানে পরিণত হন। নাস্টিক, কাব্বালিস্ট ও আদি ট্রিনিটি মতবাদে বিশ্বাসীদের মতো ব্লেক এক কেনোসিস অর্থাৎ, গডহেডের আত্ম শূন্যকরণের চিন্তা করেছেন যিনি স্বর্গ হতে নিঃসঙ্গ পতিত হয়ে মতে অবতারে পরিণত হন। একজন স্বাধীন উপাস্যের আর অস্তিত্ব রইল না, যিনি নারী-পুরুষকে বাহ্যিক সামঞ্জস্যহীন আইনের কাছে মাথা নত করার দাবি জানান। মানুষের এমন কোনও কর্মকাণ্ড নেই যা ঈশ্বরের অজানা; এমনকি গির্জা কর্তৃক অবদমিত যৌনতাও খোদ জেসাসের আবেগে প্রকাশ। পেয়েছে। স্বেচ্ছায় জেসাসের মাঝে মৃত্যুবরণ করেছেন ঈশ্বর এবং দুর্জ্ঞেয় দূরবর্তী ঈশ্বরের আর অস্তিত্ব নেই। ঈশ্বরের মৃত্যু সম্পূর্ণ হওয়ার পর মামবসুখ ঐশীসত্তা হিউম্যান ফেস ডিভাইন’ আবির্ভূত হবেন:

জেসাস বললেন; তোমরা কি কখনও তাকে ভালোবাসবে যে কখনও তোমাদের জন্যে প্রাণ দেয়নি, কিংবা যে তোমাদের জন্যে প্রাণ দেয়নি তার জন্যে কি প্রাণ দেবে? আর ঈশ্বর যদি মানুষের জন্যে প্রাণ না দিতেন এবং নিজেকে চিরকালের জন্যে মানুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ না করতেন, মানুষের অস্তিত্ব থাকত না; কেননা মানুষই প্রেম যেমন ঈশ্বরই প্রেম: পরস্পরের প্রতি প্রতিটি দয়া স্বর্গীয় রূপে-ক্ষুদ্র মৃত্যু বিশেষ। স্বর্গীয় রূপে ভ্রাতৃত্ববোধ ছাড়া কোনও মানুষ টিকে থাকতে পারবে না।

প্রাতিষ্ঠানিক চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন ব্লেক, কিন্তু কিছু কিছু ধর্মবিদ আনুষ্ঠানিক খৃস্টধর্মমতে রোমান্টিক দর্শন অন্তর্ভূক্ত করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। তাঁরাও একজন দূরবর্তী দুয়ে ঈশ্বরের ধারণাকে পরিত্যাজ্য ও অপ্রাসঙ্গিক হিসাবে আবিষ্কার করেছেন; তার বদলে অন্তর্গত ধর্মীয় অনুভূতির ওপর জোর দিয়েছেন। ১৭৯৯ সালে ওঅর্ডসঅর্থ ও কোলরিজ ইংল্যান্ডে লিরিক্যাল ব্যালাডস প্রকাশ করার পর এবং জার্মানিতে ফ্রেইডরিখ শ্ৰেইয়ারম্যাশার (১৭৬৮-১৮৩৪) তাঁর নিজস্ব রোমান্টিক ইশতেহার অন রিলিজিয়ন, স্পিচেস টু ইটস কালচার্ড ডেসপাইজার্স বের করেন। ডগমাসমূহ স্বর্গীয় সত্য নয় বরং স্রেফ ‘ভাষায় প্রকাশ করা ক্রিস্টান ধর্মীয় দুর্বলতার বিবরণ। ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিভিন্ন ক্রীডের প্রস্তাবনার মাঝে সীমিত রাখা যায় নাঃ এর জন্যে প্রয়োজন আবেগ নির্ভর উপলব্ধি ও অভ্যন্তরীণ আত্মসমর্পণ চিন্তা। যুক্তির নিজস্ব স্থান রয়েছে, কিন্তু এগুলো আমাদের খুব বেশি দূরে নিতে পারে না। আমরা যখন যুক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছাই, তখন অনুভব পরমের দিকে আমাদের যাত্রা সম্পূর্ণ করবে। শ্লেইয়ারম্যাশার ‘অনুভব’-এর কথা বলে শিথিল আবেগের কথা বোঝননি বরং এক সজ্ঞার কথা বলেছেন যা নারী ও পুরুষকে অসীমের দিকে চালিত করে। অনুভব মানবীয় যুক্তির বিরোধী নয় বরং এক কল্পনানির্ভর উল্লম্ফন যা আমাদের নির্দিষ্টতাকে অতিক্রম করে সমগ্রের উপলব্ধিতে নিয়ে যায়। এইভাবে অর্জিত ঈশ্বরের অনুভূতি প্রতিটি মানুষের গভীর থেকে উঠে আসে, বস্তুগত কোনও সত্যের সঙ্গে সংঘাত হতে নয়।

তোমাস আকুইনাসের সময় হতেই পাশ্চাত্যের ধর্মতত্ত্ব যুক্তিবাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জোর দিয়ে আসছিল, সংস্কারের পর এই প্রবণতা আরও বেড়ে ওঠে। শ্লেইয়ারম্যাশারের রোমান্টিক ধর্মতত্ত্ব ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রয়াস ছিল । তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, অনুভূতিই শেষ কথা নয়, তা ধর্মের সম্পূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। যুক্তি ও অনুভব উভয়ই তাদের অতীত এক বর্ণনাতীত সত্তার দিকে ইঙ্গিত করে। শ্লেইয়ারম্যাশার ধর্মের মূল সুরকে ‘পরম নির্ভরতার অনুভূতি’[১৩[ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এটা, আমরা দেখব, এমন এক মনোভাব যা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রগতিশীল চিন্তাবিদদের জন্যে অভিশাপে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু শ্লেইয়ারম্যাশার ঈশ্বরের সামনে শোচনীয় বশ্যতার কথা বোঝননি। বিষয়ের প্রেক্ষিতে বাক্যবন্ধটি আমরা জীবনের রহস্যের কথা চিন্তা করার সময় যে শ্রদ্ধার বোধ জেগে ওঠে তার দিকে ইঙ্গিত করে। ভয়ের এই অনুভূতি নুমিনাসের অনুভূতি থেকে জেগে ওঠা মানুষের চিরন্তন বোধ। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ পবিত্র আত্মার দর্শন গভীর আঘাত হিসাবে এই অনুভূতি লাভ করেছিলেন। ওঅর্ডসওঅর্থের মতো রোমান্টিকগণ প্রকৃতিতে দেখা পাওয়া আত্মার প্রতি একই রকম শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা বোধ করেছেন। শ্ৰেইয়ারম্যাশারের বিশিষ্ট শিষ্য রুডলফ অটো তার দ্য আইডিয়া অভ দ্য হোলি শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে এই অনুভূতির বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ দুয়ের মুখোমুখি হলে তাদের মাঝে আর এই বোধ থাকে না যে, তারা অস্তিত্বের আলফা ও ওমেগা ।

জীবনের শেষ দিকে শ্লেইয়ারম্যাশারের ধারণা হয় তিনি সম্ভবত অনুভব ও অন্তর্মুখীতার গুরুত্বের ওপর বেশি জোর দিয়ে ফেলেছেন। খৃস্টধর্মকে অচল বিশ্বাস মনে হওয়ার ব্যাপারে সজাগ ছিলেন তিনিঃ কিছু কিছু ক্রিশ্চান মতবাদ ছিল বিভ্রান্তিকর, এগুলো নয়া সংশয়বাদের কাছে ধর্ম বিশ্বাস দুর্বল করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ট্রিনিটির মতবাদ যেন বোঝাতে চায় ঈশ্বরের সংখ্যা তিন। শ্লেইয়ারম্যাশারের অনুসারী অ্যালবার্ট রিটশল (১৮২২-৮৯) এই মতবাদকে হেলেনাইযেশনের প্রকট নজীর হিসাবে দেখেছেন। এটা গ্রিকদের প্রাকৃতিক দর্শন থেকে উদ্ভূত মেটাফিজিক্যাল ধারণার একটা আস্তরণ’ যোগ করে খৃস্টীয় বাণীকে দুষিত করেছে, যার সঙ্গে সূক্ষ্ম ক্রিশ্চান অনুভূতির কোনও সম্পর্ক নেই। তা সত্ত্বেও শ্লেইয়ারম্যাশার ও রিটশ প্রতিটি প্রজন্ম যে ঈশ্বর সংক্রান্ত নিজস্ব কল্পনানির্ভর ধারণা গ্রহণ করেছে তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিলেন, ঠিক যেমন প্রত্যেক রোমান্টিক কবি আপন হৃদস্পন্দনে সত্যকে অনুভব করেছেন। গ্রিক ফাদারগণ আপন সংস্কৃতির পরিভাষায় প্রকাশের মাধ্যমে ঈশ্বরের সেমিটিক ধারণাকে নিজেদের জন্যে কার্যকর করার প্রয়াস পেয়েছিলেন মাত্র। পাশ্চাত্য আধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করার সময় ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণাগুলো অপর্যাপ্ত প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু তারপরেও শেষ পর্যন্ত শ্লেইয়ারম্যাশার জোরের সঙ্গে বলেছেন যে, ধর্মীয় আবেগ যুক্তির বিপক্ষে নয়। মৃত্যু শয্যায় তিনি বলেছেন: আমাকে অবশ্যই গভীরতম, অনুমান নির্ভর চিন্তা করতে হবে ও আমার কাছে এগুলো সর্বোচ্চ অন্তরঙ্গ ধর্মীয় অনুভূতির পুরোপুরি সমার্থক।[১৫] অনুভব এবং ব্যক্তিগত ধর্মীয় অভিজ্ঞতা কাল্পনিকভাবে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণাসমূহ অর্থহীন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে একের পর এক প্রধান দার্শনিক ঈশ্বরের প্রচলিত ধারণা, অন্তত পশ্চিমে বিরাজমান ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ করতে উদ্যত হয়েছেন। তারা বিশেষ করে মহশূন্যে বস্তুগত অস্তিত্ব সম্পন্ন এক অতিপ্রাকৃত উপাস্যের অস্তিত্বের ধারণায় সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছেন। আমরা দেখেছি, পরম সত্তা হিসাবে ঈশ্বরের ধারণা পশ্চিমে প্রবল হয়ে উঠলেও অন্য একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো নিজেদের এ ধরনের ধর্মতত্ত্ব হতে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ভিন্ন দিকে যাত্রা করছিল। ইহুদি, মুসলিম ও অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের প্রত্যেকেই তাদের মতো করে বিভিন্নভাবে জোর দিয়ে বলেছে যে, ঈশ্বর সম্পর্কিত মানবীয় ধারণা এটা যে অনিবৰ্চনীয় সত্তার তুচ্ছ প্রতীক এর সঙ্গে মেলেনি। সবাই বোঝাতে চেয়েছে, কোনও না কোনও সময় ঈশ্বরকে পরম সত্তা না বলে কিছু না হিসাবে বর্ণনা করাই অধিকতর সঠিক, যেহেতু আমাদের বোধগম্য উপায়ে “তিনি অস্তিতৃমান নন। শত শত বছরের পরিক্রমায় পাশ্চাত্য ঈশ্বর সংক্রান্ত অধিকতর কল্পনা-নির্ভর এই ধারণাটি হারিয়ে ফেলেছে। ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টরা তাকে আমাদের চেনা জগতের ওপর আরোপিত আরেকটি বাস্তবতা হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল, যিনি স্বর্গীয় বড় ভাইয়ের মতো, আমাদের কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধান করছেন। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, বিপ্লবোত্তর বিশ্বের অনেকের কাছেই ঈশ্বরের এই ধারণা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ছিল, কারণ এতে মানুষকে অত্যন্ত হীনভাবে বশ্যতা মানানো হয়েছে বলে মনে হয়, মানুষকে অর্থহীন, নির্ভরশীল করেছে যা মানুষের মর্যাদার সঙ্গে বেমানান। উনবিংশ শতাব্দীর নাস্তিক্যবাদী দার্শনিকরা যথার্থ কারণেই এই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তাদের সমালোচনার ফলে সমসাময়িক অনেকেই একই পথ অনুসরণে অনুপ্রাণিত হয়েছে; তারা যেন একেবারে নতুন কিছু বলছিলেন, কিন্তু যখন ঈশ্বর প্রসঙ্গে নিজেদের জবাব দিয়েছেন, তখন প্রায়শঃই অবচেতনভাবে অতীতের অন্যান্য একেশ্বরবাদীর দর্শনের পুনরাবৃত্তি করেছেন।

এভাবেই জর্জ উইলহেম হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) এমন এক দর্শনের জন্ম দেন যা লক্ষণীয়ভাবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কাব্বালাহর অনুরূপ ছিল। ব্যাপারটি পরিহাসমূলক, কেননা ইহুদিবাদকে হীন ধর্ম বিবেচনা করতেন তিনি, যা মহাভ্রান্তি ঘটানো ঈশ্বরের আদিম ধারণার জন্যে দায়ী। হেগেলের দৃষ্টিতে ইহুদিদের ঈশ্বর ছিলেন স্বৈরাচারী, যিনি অসহনীয় এক আইন বা নিয়মের কাছে প্রশ্নাতীত বশ্যতা দাবি করেছেন। জেসাস নারী ও পুরুষকে এই নীচতা থেকে উদ্ধার করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু ক্রিশ্চানরাও ইহুদিদের মতো একই ফাঁদে আটকা পড়ে স্বর্গীয় শাসকের ধারণাকে সংহত করেছে। এখন সময় হয়েছে এই বর্বর উপাস্যকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে মানবীয় অবস্থার অধিকতর আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। নিউ টেস্টামেন্টের যুক্তির উপর গড়ে ওঠা ইহুদিবাদ সম্পর্কে হেগেলের ভুল ধারণা ছিল: এক নতুন ধরনের মেটাফিজিক্যাল অ্যান্টি-সেমিটিজম। কান্টের মতো হেগেল ইহুদিবাদকে ধর্মের সব রকম ভুল বা ক্রটির উদাহরণ হিসাবে দেখেছেন। দ্য ফেনোমনোলজি অভ মাইন্ড (১৮০৭)-এ তিনি প্রচলিত উপাস্যের জন্যে পৃথিবীর প্রাণশক্তি আত্মা-র ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করেন। তা সত্ত্বেও কাব্বালাহর মতো আত্মা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা ও আত্ম-সচেতনা অর্জনের জন্যে সীমাবদ্ধতা ও নির্বাসন ভোগ করতে ইচ্ছুক ছিল। আবার কাব্বালার মতোই আত্মা-এর পূর্ণতার জন্যে পৃথিবী ও মানুষের ওপর নির্ভরশীল। এভাবে হেগেল প্রাচীন একেশ্বরবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন-যা খৃস্টধর্ম ও ইসলামেরও বৈশিষ্ট্য-যে ঈশ্বর জাগতিক বাস্তবতা হতে বিচ্ছিন্ন নন, তাঁর আপন জগতে ঐচ্ছিক বাড়তি কিছু নন, বরং মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্লেকের মতো দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমে এই দর্শন প্রকাশ করেছেন তিনি, মানুষ ও আত্মা, সসীম ও অসীমকে একই সত্যের দুটি অংশ বিবেচনা করেছেন, যারা পরস্পরের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশ্মল ও আত্ম-উপলব্ধির একই প্রক্রিয়ার জড়িত। অপরিচিত অনাকাক্ষিত বিধি-বিধান পালনের ভেতর দিয়ে দূরবর্তী এক উপাস্যকে প্রসন্ন। করার বদলে কার্যতঃ হেগেল ঘোষণা করেছেন, ঈশ্বর আমাদের মনুষ্যত্বেরই একটা মাত্রা। প্রকৃতপক্ষেই, হেগেলের আত্মার কেননাসিসের ধারণা-যা পৃথিবীতে সর্বব্যাপী ও রূপ ধারণের জন্যে নিজেকে নিঃশেষে করে-এর সঙ্গে তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মে গড়ে ওঠা অবতারবাদমূলক ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে প্রচুর মিল রয়েছে।

হেগেল অবশ্য একাধারে আলোকন পর্ব ও রোমান্টিক যুগের মানুষ ছিলেন; সে কারণে কল্পনার চেয়ে যুক্তিকে বেশি মূল্য দিয়েছেন। আবার অনিচ্ছাকৃতভাবেই অতীতের দর্শনের প্রতিধ্বনি করেছেন। ফায়লাসুফদের মতো যুক্তি ও দর্শনকে ধর্মের চেয়ে উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন হিসাবে দেখেছেন তিনি, যা চিন্তার প্রতিনিধিত্বমূলক ধারায় প্রোথিত। আবার ফায়লাসুফদের মতো পরম সত্তা সম্পর্কে ব্যক্তির মনোজগতের ক্রিয়া হতে উপসংহার টেনেছেন হেগেল, যাকে তিনি সমগ্রকে তুলে ধরা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বন্দি হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

তাঁর দর্শনকে আর্থার শোপেনহঅর (১৭৮৮-১৮৬০) কাছে হাস্যকরভাবে আশাবাদী ঠেকেছিল । ১৮১৯ সালে বার্লিনে হেগেল নির্ধারিত সময়েই ভাষণ দেওয়ার সময়সূচি নির্ধারণ করেছিলেন তিনি, এ বছরই তাঁর দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড আইডিয়া গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। শোপেনহঅর বিশ্বাস করতেন, পরম সত্তা, ঈশ্বর বা আত্মা বলে কোনও কিছু এই জগতে ক্রিয়াশীল নেই: আছে কেবল বেঁচে থাকার অদম্য আদিম ইচ্ছা। এই বিষণ্ণ দর্শন রোমান্টিক আন্দোলনের নেতিবাচক চেতনায় আবেদন সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য ধর্মের সকল দর্শন বাতিল করে দেয়নি এটা। শোপেনহর বিশ্বাস করতেন হিন্দুধর্মমত ও বুদ্ধ মতবাদ (এবং ঐসব ক্রিশ্চান যারা সমস্ত কিছুকে অসার বলে মেনে নিয়েছিল) পৃথিবীর সবকিছু মায়া মাত্র দাবি করে বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ও ন্যায্য ধারণায় পৌঁছেছিল। যেহেতু আমাদের রক্ষা করার জন্যে কোনও ঈশ্বর’ নেই, কেবল শিল্পকলা, সঙ্গীত এবং আত্মত্যাগ ও সমবেদনার এক অনুশীলনই আমাদের মাঝে অটল অচঞ্চল বোধ জাগাতে পারে। ইহুদিবাদ ও ইসলাম নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ শোপেনহঅর ছিল না, তাঁর দৃষ্টিতে এদুটো ইতিহাসের অসম্ভব সহজ এবং উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে তিনি দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখেছেন: আমরা দেখব যে আমাদের দেশে ইহুদি এবং মুসলিমরা আবিষ্কার করেছে যে, থিওফ্যানি হিসাবে ইতিহাসকে দেখার পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি এখন আর আগের মতো ধরে রাখা যাচ্ছে না। অনেকেই এখন আর ইতিহাসের নিয়ন্তা ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। কিন্তু মুক্তি সম্পর্কিত শোপেনহঅর দৃষ্টিভঙ্গি ইহুদি ও মুসলিম ধারণার কাছাকাছিঃ প্রত্যেককে যার যার জন্যে পরম অর্থের একটা বোধ সৃষ্টি করতে হবে। এর সঙ্গে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত প্রোটেস্ট্যান্ট ধারণার কোনওই মিল ছিল না, যেখানে বোঝানো হয়েছে যে, মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের কিছুই করার নেই, বরং তারা সম্পূর্ণভাবে বাহ্যিক এক উপাস্যের ওপর নির্ভরশীল।

ঈশ্বর সম্পর্কিত এইসব পুরোনো ধারণা ত্রুটিপূর্ণ ও অপূর্ণ বলে ক্রমবর্ধমান হারে নিন্দিত হচ্ছিল। ডেনিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্দ (১৮১৩-৫৫) জোর দিয়ে বলেছেন যে, বিভিন্ন প্রাচীন বিশ্বাস ও মতবাদ প্রতিমায় পরিণত হয়ে ঈশ্বরের অনির্বচনীয় সত্তার বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত খৃস্টধর্ম বিশ্বাস এসব ফসিলায়িত মানবীয় ও প্রাচীন ধ্যান-ধারণা হতে দূরবর্তী অজানায় এক উল্লম্ফন। অন্যরা অবশ্য এই পৃথিবীতেই মানুষের শেকড় স্থাপন করতে চেয়ে মহান বিকল্পের ধারণা (Great Aiternative) বাদ দিতে চেষ্টা করেছেন। জার্মান দার্শনিক লুদভিগ আন্দ্রিয়াস ফয়েরবাখ (১৮০৪-৭২) তার প্রভাব বিস্তারকারী গ্রন্থ দ্য এসেন্স অভ ক্রিশ্চানিটি (১৮৪১)-তে যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, ঈশ্বর স্রেফ মানবীয় এক অভিক্ষেপ মাত্র। ঈশ্বরের ধারণা আমাদের মানবীয় অক্ষমতা-দুর্বলতার বিপরীতে এক অসম্ভব সম্পূর্ণতাকে স্থাপন করার ভেতর দিয়ে আমাদের নিজস্ব স্বভাব বা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। এভাবে ঈশ্বর অমীম, মানুষ সসীম; ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, মানুষ দুর্বল; ঈশ্বর পবিত্র, মানুষ পাপী। ফয়েরবাখ পাশ্চাত্য ট্র্যাডিশনের বিশেষ দুর্বল জায়গায় হাত দিয়েছিলেন, সবসময়ই যাকে একেশ্বরবাদে বিপদজ্জনক বিবেচনা করা হয়েছে। যে অভিক্ষেপে ঈশ্বর মানবীয় অবস্থার বাইরে চলে যান সেখানে পরিণাম স্বরূপ প্রতিমা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যান্য ট্রাডিশন এই বিপদ মোকাবিলা করার বিভিন্ন উপায় আবিষ্কার করেছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একথা সত্য যে, পশ্চিমে ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা ক্রমবর্ধমানহারে বহিরঙ্গের বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং মানব প্রকৃতির অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণা বিস্তারে অবদান রেখেছে। অগাস্তিনের সময় থেকেই পশ্চিমে ঈশ্বরের ধর্মে অপরাধ ও পাপ, সংগ্রাম ও চাপের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল, যা উদাহরণ স্বরূপ, গ্রিক অর্থডক্স ধর্মতত্ত্বের কাছে অজানা ছিল। এটা বিস্ময়কর নয় যে, ফয়েরবাখ বা অগাস্ত কোতে (১৭৯৮-১৮৫৭)-এর মতো দার্শনিকগণ, যাদের মানুষ সম্পর্কে অধিকতর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, অতীতে ব্যাপক আস্থাহীনতার কারণ এই ঈশ্বরকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন।

নাস্তিক্যবাদ সবসময়ই ঈশ্বর সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার প্রত্যাখ্যান ছিল। ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা নাস্তিক আখ্যা পেয়েছিল, কারণ তারা ঈশ্বর সংক্রান্ত প্যাগান ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে, যদিও ঈশ্বরে তাদের বিশ্বাস ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর নব্য-নাস্তিকরা ঈশ্বরের সামগ্রিক ধারণা নয় বরং পশ্চিমে প্রচল ঈশ্বর সম্পর্কিত বিশেষ ধারণার বিরুদ্ধে বাক্যবান হানছিল; এভাবে কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) ধর্মকে নিপীড়িত জনের দীর্ঘশ্বাস…জনগণের জন্যে এই দুর্দশাকে সহনীয় করে তোলা আফিম’১৬ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও তিনি জুদো-ক্রিশ্চান ট্র্যাডিশনের ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল ইতিহাসে মেসিয়ানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ঈশ্বরকে অপ্রাসঙ্গিক হিসাবে নাকচ করে দিয়েছেন। যেহেতু ঐতিহসিক প্রক্রিয়ার বাইরে অন্য কোনও তাৎপর্য মুল্য বা উদ্দেশ্য নেই, সুতরাং ঈশ্বরের ধারণা মানুষের উপকারে আসতে পারে না। ঈশ্বরের অস্বীকৃতি নাস্তিক্যবাদ সময়ের অপচয়। তবু মার্ক্সীয় সমালোচকের কাছে ঈশ্বর আক্রমণের বিষয় ছিলেন, কেননা শাসক কর্তৃক তিনি প্রায়শঃই ব্যবহৃত হয়েছেন এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা অনুমোদন করার জন্যে যেখানে ধনী প্রাসাদে অবস্থান করে আর দরিদ্রজন তার দরজায় বসে থাকে। অবশ্য সমগ্র একেশ্বরবাদী ধর্মের ক্ষেত্রে এ অভিযোগ সত্যি ছিল না। সামাজিক অনাচারকে প্রশ্রয় দানকারী ঈশ্বর আমোস, ইসায়াহ কিংবা মুহাম্মদকে (স) শঙ্কিত করে তুলতেন, যারা ঈশ্বরের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন, যার সঙ্গে মার্ক্সীয় আদর্শের প্রচুর সাজুয্য ছিল।

একইভাবে ঈশ্বর ও ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক উপলব্ধি বহু ক্রিস্টানের ধর্ম বিশ্বাসকে এ সময়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাছে নাজুক করে তুলেছিল। চার্লস লিয়েলের ভূতাত্ত্বিক সময়কালের বিশাল দৃষ্টিকোণ উন্মোচনকারী প্রিন্সিপালস অভ জিওলজি (১৮৩০-৩৩) এবং চার্লস ডারউইনের বিবর্তনের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসা দ্য অরিজিন অভ স্পিসিস (১৮৪৯) সৃষ্টির বাইবেলিয় বিবরণের বিরোধী বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। নিউটনের সময় থেকেই সৃষ্টির প্রসঙ্গটি ঈশ্বর সম্পর্কে পাশ্চাত্যে উপলব্ধির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছিল; মানুষ একথা বিস্মৃত হয়েছিল যে, বাইবেলের কাহিনীকে কখনও বিশ্বজগতের ভৌত ইতিহাসের বিবরণ হিসেবে বিবেচনা করার উদ্দেশ্য ছিল না। প্রকৃতপক্ষেই শূন্য হতে সৃষ্টির মতবাদ বহুকাল আগে থেকেই সমস্যা সঙ্কুল ছিল এবং অপেক্ষাকৃত অনেক পরে ইহুদিবাদ ও খৃস্ট ধর্মে অনুপ্রবেশ করেছিল; ইসলাম ধর্মে আল্লাহ কর্তৃক জগৎ সৃষ্টির ধারণা মেনে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা কীভাবে ঘটেছে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। ঈশ্বর সম্পর্কে কোরানের অন্য সব বক্তব্যের মতো সৃষ্টি সম্পর্কিত মতবাদও ‘রূপক’-এক নিদর্শন বা প্রতীক মাত্র। তিন একেশ্বরবাদী ধর্মের সবকটাই সৃষ্টিকে মিথ হিসাবে দেখেছে, শব্দটির সবচেয়ে ইতিবাচক অর্থে এটা এক প্রতীকী বিবরণ যা নারী-পুরুষকে একটি বিশেষ ধর্মীয় মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ইহুদি ও মুসলিমদের কেউ কেউ ইচ্ছা করেই সৃষ্টির কাহিনীর কল্পনা-নির্ভর ব্যাখ্যা করেছে যা কোনও আক্ষরিক অর্থ থেকে মারাত্মকভাবে দূরে সরে গেছে। কিন্তু পশ্চিমে বাইবেলের প্রতিটি বিবরণকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি বলে বিশ্বাস করার একটা প্রবণতা ছিল। বহু মানুষই পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার জন্যে ঈশ্বরকে আক্ষরিক ও শারীরিকভাবে দায়ী বলে বিশ্বাস করতে শিখেছে, যেমন আমরা কোনও কিছু তৈরি করি বা কোনও ঘটনা ঘটিয়ে থাকি।

অবশ্য এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রিশ্চান অচিরেই বুঝতে পেরেছিল, ডারউইনের আবিষ্কারসমূহ কোনওভাবেই ঈশ্বরের ধারণার প্রতি মারাত্মক হুমকি ছিল না। মূল স্রোতধারার খৃস্টধর্ম বিবর্তন তত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিল, ইহুদি ও মুসলিমরা জীবনের বিকাশ সম্পর্কে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারে কখনই তেমন বিচলিত বোধ করেনি। সাধারণভাবে বলতে গেলে আমরা দেখব, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উৎস থেকে। এটা অবশ্য সত্যি যে, পশ্চিমা সেকুলারিজম বিস্তার লাভ করায় তা অনিবার্যভাবে অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসের সদস্যদের প্রভাবিত করেছে। ঈশ্বর সম্পর্কে আক্ষরিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বহাল আছে; পশ্চিমের অনেকেই সকল পর্যায়ে ধরেই নিয়েছে যে, আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্ব ঈশ্বরের ধারণায় মারণ-আঘাত হেনেছে।

গোটা ইতিহাস জুড়ে ঈশ্বরের ধারণা যখনই আর কাজে আসেনি তখনই মানুষ তা ছুঁড়ে ফেলেছে। কখনও এটা প্রতিমা পূজার বিরোধিতার রূপ নিয়েছে, যেমন প্রাচীন ইসরায়েলিরা কাননবাসীদের ভজনালয়গুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল কিংবা পয়গম্বররা যখন তাদের পৌত্তলিক দেবতাদের বিরুদ্ধে। অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৮২ সালে ফ্রেডেরিখ নিৎশে ঈশ্বরের প্রয়াণ ঘটার ঘোষণা দিয়ে অনুরূপ সহিংস কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এক পাগলের কাহিনীর মাধ্যমে বিপ্লবাত্মক ঘটনার প্রকাশ করেছেন তিনি। এই উন্মাদ একদিন সকালে বাজার এলাকার হাজির হয়ে চেঁচাতে লাগল, আমি ঈশ্বরকে চাই! আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি।’ উন্মাসিক দর্শকরা যখন জানতে চাইল যে, ঈশ্বর কোথায় গেছেন বলে তার ধারণা-তিনি কি পালিয়েছেন নাকি ভিন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন?-উন্মাদ চোখ রাঙিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ঈশ্বর কোথায় গেছে? সেটাই তোমাদের বলতে চাই। আমরা তাকে হত্যা করেছি-তোমরা এবং আমি! আমরা সবাই তার হত্যাকারী। এক অকল্পনীয় অথচ অপরিবর্তনীয় ঘটনা মানব জাতিকে মহাবিশ্বে ছুঁড়ে দিল। এতদিন পর্যন্ত যা মানুষকে একটা দিক নির্দেশনায় অনুভূতি যোগাচ্ছিল তা হারিয়ে গেল । ঈশ্বরের প্রয়াণ নজীরবিহীন হতাশা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করবে। এখনও কি স্বর্গ আর নরক আছে? পাগল লোকটি যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে ওঠে, আমরা কি এক অসীম শূন্যতার মাঝে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাইনি?১৭

নিৎশে উপলব্ধি করেছিলেন, পশ্চিমের মানুষের চেতনায় এক চরম পরিবর্তন ঘটে গেছে যা অধিকাংশ লোকে যে ব্যাপারটিকে ‘ঈশ্বর হিসাবে বিবৃত করে তাতে বিশ্বাস রাখা ক্রমবর্ধমান হারে কঠিন করে তুলবে। আমাদের বিজ্ঞান সৃষ্টির আক্ষরিক অনুধাবনের ধারণাকে কেবল অসম্ভবই করে তোলেনি, বরং আমাদের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা স্বর্গীয় তত্ত্বাবধায়কের ধারণাকেও অগ্রহণযোগ্য করে দিয়েছে। মানুষের মনে হয়েছে, তারা এক নতুন দিন। প্রত্যক্ষ করছে। নিৎশের উন্মাদ জোর দিয়ে বলেছে, ঈশ্বরের প্রয়াণ মানুষের ইতিহাসের এক উচ্চতর পর্যায়ের সূচনা করবে। উপাস্য হত্যা ন্যায্য প্রতিপন্ন। করার জন্যে মানুষকেই দেবতায় পরিণত হতে হবে। দাস স্পেক যরোথুস্ট্র (১৮৮৩)-তে এক অতিমানবের জন্মলাভের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি, যিনি ঈশ্বরের স্থান গ্রহণ করবেন; আলোকিত নতুন মানুষ প্রাচীন ক্রিশ্চান মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন, মানুষের মূল রীতিনীতিকে ধ্বংস করে নতুন শক্তিশালী মানবজাতির আগমন ঘটাবেন, ক্রিশ্চানদের দুর্বল ভালোবাসা ও করুণার গুণাবলীর কোনওটিই যার থাকবে না। তিনি বুদ্ধ মতবাদের মৃত ধর্মে দেখা পাওয়া চিরন্তন পুনর্ঘটন ও পুনর্জন্মের প্রাচীন মিথেরও শরণাপন্ন হয়েছেন। এখন ঈশ্বর যেহেতু পরলোকগমন করেছেন, এই পৃথিবীই পরম মূল হিসাবে তার স্থান অধিকার করতে পারে। যা কিছু বিদায় নেয়, আবার ফিরে আসে; যা কিছু মারা যায়, আবার তা জন্ম নেয়; যা কিছু ভাঙে আবার তা জোড়া লাগে। আমাদের পৃথিবী চিরন্তন ও স্বর্গীয় হিসাবে পূজিত হতে পারে, যে গুণাবলী এক সময় কেবল দূরবর্তী দুৰ্জ্জেয় ঈশ্বরের প্রতি প্রযুক্ত হতো।

নিৎশে শিক্ষা দিয়েছেন, ক্রিশ্চান ঈশ্বর ছিলেন করুণার যোগ্য, অবাস্তব এবং জীবনের বিরুদ্ধে এক অপরাধ। মানুষকে তিনি আপন দেহ, আবেগ ও যৌনতাকে ভয় করার উৎসাহ দিয়েছেন ও সমবেদনার এক করুণ নৈতিকতার পক্ষে কথা বলেছেন যা আমাদের দুর্বল করে দিয়েছে। পরম অর্থ বা মূল্য বলে কিছু ছিল না এবং ঈশ্বরের কোনও রকম পরিশ্রম সাপেক্ষ বিকল্প দান করার কোনও প্রয়োজন ছিল না; আবার একথা বলা দরকার যে, পশ্চিমের ঈশ্বর এই সমালোচনার কাছে নাজুক ছিলেন। জীবন অস্বীকারকারী সংযমের মাধ্যমে মানুষকে মনুষ্যত্ব ও যৌন কামনা থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্যে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। পৃথিবীর এই জীবনের বিকল্প ও সহজ রোগ নিরাময়কারীতেও পরিণত করা হয়েছিল।

সিগমান্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের বিশ্বাসকে ভ্রান্তি হিসাবে বিবেচনা করেছেন, পরিণত নারী-পুরুষের যা একপাশে সরিয়ে রাখা উচিত। ঈশ্বরের ধারণা মিথ্যা, বরং অবচেতন মনের কৌশল, যাকে মনস্তত্ত্ব দিয়ে উৎপাটন করা প্রয়োজন ছিল । একজন ব্যক্তিক ঈশ্বর এক মহিমান্বিত পিতৃপুরুষ ছাড়া আর কিছুই নন; এমন একজন উপাস্যের আকাঙ্ক্ষা ছোটবেলার শক্তিমান ও যত্নবান পিতার জন্যে কামনা এবং বিচার, নিরপেক্ষতা ও বাধাহীন জীবনযাপনের ইচ্ছা থেকে জেগে ওঠে। ঈশ্বর এসব আকাক্ষার অভিক্ষেপ মাত্র, অসহায়ত্বের অনুভূতির কারণে মানুষ এর উপাসনা করে। ধর্ম মানব জাতির শৈশবের ব্যাপার ছিল; ছেলেবেলা থেকে পরিণত বয়সে পৌঁছাতে এর প্রয়োজন ছিল। সমাজের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়েছিল তা। এখন যেহেতু মানব জাতি পরিণত হয়ে উঠেছে, একে এবার ত্যাগ করা উচিত। এটা নয়া লোগোস-বিজ্ঞান-ঈশ্বরের স্থান অধিকার করতে পারবে, আমাদের নৈতিকতার নতুন ভিত্তি যোগাবে আমাদের আতঙ্কের মোকাবিলায় সাহায্য করবে। বিজ্ঞানে আপন বিশ্বাসের বেলায় অন্ধ ছিলেন। ফ্রয়েড, যাকে প্রায় ধার্মিকতার মতো প্রবল মনে হয় না, আমাদের বিজ্ঞান বিভ্রান্তি নয়। এটা মনে করা ভ্রান্তি হবে যে, বিজ্ঞান যা দিতে পারবে না তা আমরা অন্যত্র পাব।’

সকল সাইকোঅ্যানালিস্ট ঈশ্বর সম্পর্কে ফ্রয়েডিয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত পোষণ করেননি। আলফ্রেড অ্যাডলার (১৮৭০-১৯৩৭) ঈশ্বরকে অভিক্ষেপ হিসাবে মেনে নিলেও বিশ্বাস করতেন যে, এটা মানুষের জন্যে উপকারী ছিল; এটা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠর এক অসাধারণ ও কার্যকর প্রতীক। সি. জি, জাংয়ের (১৮৭৫-১৯৬১) ঈশ্বর অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বরের মতোই এক মনস্তাত্ত্বিক সত্য ছিলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরে যিনি অনুভূত হন। বিখ্যাত ফেস টু ফেস সাক্ষাৎকারে জন ফ্রিম্যান যখন জানতে চেয়েছিলেন তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। কিনা, জাং জোরাল জবাব দিয়েছিলেন: “আমার বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই, আমি জানি। জাংয়ের বিশ্বাস দেখায় যে, সত্তার গভীরে রহস্যময়ভাবে অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা একজন অভ্যন্তরীণ ঈশ্বর সাইকোঅ্যানালিস্টিক বিজ্ঞানের মুখেও টিকে যেতে পারেন; অন্যদিকে প্রকৃতই চিরন্তন অপরিপক্কতাকে উৎসাহিতকরী অধিকতর ব্যক্তিক মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন (anthropomorphic) উপাস্য নাও টিকতে পারেন।

মনে হয় অন্যান্য বহু পাশ্চাত্যবাসীর মতো ফ্রয়েড এই অন্তরের ঈশ্বর সম্পর্কে সজাগ বা সচেতন ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি ধর্ম ধ্বংস করার প্রয়াস বিপদজ্জনক হবে বলে এক বৈধ এবং বুদ্ধিগ্রাহ্য যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। মানুষকে যথাসময়ে ঈশ্বরকে অতিক্রম করতে হবে; প্রস্তুত হওয়ার আগেই জোর করে তাদের নাস্তিক্যবাদ বা সেকুলারিজমের দিকে ঠেলে দিলে অস্বাস্থ্যকর অস্বীকৃতি ও নিপীড়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আমরা দেখেছি, সুপ্ত উদ্বেগ ও অন্যের প্রতি আমাদের নিজস্ব শঙ্কা থেকে প্রতিমা বিরোধিতা জন্ম নিতে পারে। ঈশ্বরকে ধ্বংস করতে ইচ্ছুক নাস্তিকদের কেউ কেউ নিঃসন্দেহে এক ধরনের চাপের লক্ষণ প্রকাশ করেছে। এভাবে প্রেমপূর্ণ নীতিবোধের পক্ষে কথা বললেও শোপেনহঅর মানুষের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিভৃতচারীতে পরিণত হয়েছিলেন যিনি কেবল পোষা কুকুর আত্মানের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখেছেন। নিৎশে কোমল হৃদয়, নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন, ভঙ্গ স্বাস্থ্য ছিল তাঁর, অতি মানব থেকে একেবারেই ভিন্ন। শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মহানন্দে ঈশ্বরকে ত্যাগ করেননি তিনি, যদিও তাঁর তাঁর পদ্যের পরমানন্দের ভাবে আমাদের সেরকম মনে হতে পারে। অনেক কম্পন, শিহরণ ও আত্ম-নিপীড়নের মরু পেরিয়ে আসা এক কবিতায় তিনি যুরোথুস্টকে দিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তনের আবেদন জানিয়েছেন।

না! তোমার সকল নিপীড়নসহ
ফিরে এসো!
হায়, ফিরে এসো,
সকল নৈঃসঙ্গের শেষে!
আমার চোখের সব অশ্রু
তোমার জন্যেই বয়ে যায়!
আমার হৃদয়ের শেষ শিখাটি
তোমার জন্যে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে!
হায়, ফিরে এসো।
আমার অচেনা ঈশ্বর! আমার বেদনা! আমার অন্তিম-সুখ।

হেগেলের মতো নিৎশের মতবাদসমূহও পরবর্তী জার্মান প্রজন্ম ন্যাশনাল সোশ্যালিজমের নীতিমালার ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করতে কাজে লাগিয়েছে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নাস্তিক্যবাদী আদর্শও ঈশ্বরের ধারণার মতোই নিষ্ঠুর, নির্দয় ক্রুসেডিয় নীতির দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে ।

পশ্চিমে ঈশ্বর সব সময়ই এক সংগ্রামের নাম ছিলেন। তাঁর প্রয়াণও মানসিক চাপ, নৈঃসঙ্গ ও আতঙ্ক দিয়েই মোকাবিলা করা হয়েছে। এভাবে ইন মেমোরিয়াম কবিতায় মহান ভিক্টোরিয়ান সংশয়বাদী কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসন এক উদ্দেশ্যবিহীন, নির্বিকার, তীক্ষ্ম নখ-দাঁতঅলা প্রকৃতির সম্ভাবনায় আতঙ্কে কুকড়ে গিয়েছেন। দ্য অরিজিন অভ স্পিসিস প্রকাশের নয় বছর আগে ১৮৫০ সালে প্রকাশিত এই কবিতায় দেখা যায়, টেনিসন ইতিমধ্যে অনুভব করেছেন তাঁর বিশ্বাস ভেঙে-চুরে যাচ্ছে আর তিনি স্বয়ং পরিণত হয়েছেন:

রাতে ক্রন্দরত শিশুতে;
আলোর জন্যে ক্রন্দনরত শিশু
কান্না বাদে আর কোনও ভাষা নেই যার।

ডোভার বীচ-এ ম্যাথু আরনল্ড মানব জাতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিস্তারে দিশেহারা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া বিশ্বাসের সাগরের অপ্রতিরোধ্য প্রত্যাহারে বিলাপ করেছেন। সন্দেহ আর মহাশঙ্কা অর্থোডক্স বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, যদিও ঈশ্বরের প্রত্যাখ্যান পাশ্চাত্যের সন্দেহের স্পষ্ট চেহারা ধারণ করেনি, বরং আরও বেশি করে চরম অর্থেরই প্রত্যাখ্যান ছিল। ফিয়দর দস্তয়েভস্কি-যার দ্য ব্রাদার্স কারামাযোভ (১৮৮০) কে ঈশ্বরের প্রয়াণের বর্ণনা হিসাবে দেখা যেতে পারে১৮৫৪ সালের মার্চ মাসে এক চিঠিতে বন্ধুর কাছে বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে আপন টানপড়েনের কথা লিখেছেন:

নিজেকে আমি কালের শিশু মনে করি, অবিশ্বাস আর সন্দেহ ভরা শিশু; এমন হতে পারে, উঁহু, আমি নিশ্চিত, মৃত্যুর দিনেও আমি এমনই রয়ে যাব। বিশ্বাস করার আকাঙ্ক্ষায় আমি নির্যাতিত হয়েছি-এমনকি, সত্যি বলতে এখনও হচ্ছি; আর বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা যত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আকাক্ষাও ততই প্রবল রূপ নিচ্ছে।

তাঁর উপন্যাসটিও একইভাবে দোদূল্যমান। ইভান, অন্য চরিত্রগুলো যাকে নাস্তিক হিসাবে বর্ণনা করেছে, (যে বর্তমানে বিখ্যাত: ‘ঈশ্বর না থাকলে সব কিছুই বৈধ প্রবাদটির জনব) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলছে, সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেও এই ঈশ্বরকে গ্রহণযোগ্য মানতে পারছে না। কেননা তিনি জীবনের ট্র্যাজিডির পরম অর্থের যোগান দিতে ব্যর্থ। বিবর্তন তত্ত্বে উদ্বিগ্ন নয় ইভান, বরং ইতিহাসে মানুষের দুঃখ কষ্ট ও বেদনাই তাকে বিচলিত করে: সবকিছু ঠিক হয়ে যাবার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে একমাত্র সন্তানের মৃত্যু মূল্য হিসাবে অনেক চড়া। এই অধ্যায়ের শেষে আমরা দেখব, ইহুদিরাও একই উপসংহারে পৌঁছাবে। অন্যদিকে সাধু-প্রতীম আলিয়োশা স্বীকার করেছে, সে ঈশ্বর বিশ্বাসী নয়-এই স্বীকারোক্তি যেন অসচেতন অবস্থায় বেরিয়ে এসেছে, যেন তার মনের গভীর অচেনা প্রদেশ থেকে পালিয়ে এসেছে। দোদূল্যমানতা ও বিশ্বাস পরিত্যাগের অস্পষ্ট বোধ বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যকে তাড়া করে বেরিয়েছে এর পরিত্যক্ত ভূমির ইমেজারি আর এক গদোর জন্যে মানুষের প্রতীক্ষা নিয়ে, যিনি কখনও আবির্ভূত হন না।

মুসলিম বিশ্বেও একই রকম অস্থিরতা ও অশান্তি ছিল, যদিও তার উৎস ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইউরোপের মিশন সিতিলাপ্রাইস অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। ১৮৩০ সালে ফরাসিরা আলজিয়ার্সে উপনিবেশ স্থাপন করে; ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশরা অডেন উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত করে। নিজেদের মধ্যে তিউনিসিয়া (১৮৮১), মিশর (১৮৮২), সুদান। (১৮৯৮) এবং লিবিয়া ও মরক্কো (১৯১২) ভাগ করে নিয়েছিল এরা। ১৯২০ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যকে প্রটেক্টরেট ও ম্যান্ডেট হিসাবে ভাগ করে নেয়। এই উপনিবেশবাদী প্রকল্প পাশ্চাত্যকরণের এক নীরব প্রক্রিয়াকে আনুষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছিল, কেননা ইউরোপিয়রা আধুনিকতার নামে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছিল। কারিগরি শক্তিতে বলীয়ান ইউরোপ নেতৃত্বের অবস্থানে এসে গোটা বিশ্ব দখল করে নিচ্ছিল। তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যে ট্রেডিং পোস্ট ও কনসুলার মিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়; প্রকৃত পাশ্চাত্য শাসন শুরু হওয়ার আগেই এসব সমাজের ঐতিহ্যগত কাঠামোর ক্ষতি সাধন করেছিল তা। এটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের উপনিবেশিকরণ। মুঘলরা ভারত অধিকার করে নেওয়ার পর হিন্দু জনগোষ্ঠী তাদের সংস্কৃতিতে বহু মুসলিম উপাদান আত্মস্থ করে নিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বদেশী সংস্কৃতির পুনরুত্থান ঘটেনি । নতুন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে শাসনাধীন জাতির জীবনাচারকে চিরদিনের মতো পাল্টে দিয়েছিল ।

উপনিবেশের অধীনস্থ এলাকার পক্ষে তাল মিলিয়ে ওঠা অসম্ভব ছিল। প্রাচীন প্রথাসমূহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; মুসলিম সমাজই ‘পাশ্চাত্যকৃত’ ও ‘অন্য এই দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিমদের কেউ কেউ হিন্দু ও চীনাদের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে তাদের সম্পর্কে পশ্চিমাদের মূল্যায়ন ‘প্রাচ্যবাসী’ তকমা মেনে নিয়েছিল নির্বিচারে। কেউ কেউ প্রথাবদ্ধ আপন জাতভাইদের ছোট করে দেখেছে। ইরানে শহা নাসিরুদ্দিন (১৮৪৮ ৯৬) জোরের সঙ্গে প্রজাদের ঘৃণা করার কথা বলেছেন। একসময় নিজস্ব পরিচয় ও ঐক্য নিয়ে জীবন্ত সভ্যতা ক্রমেই অচেনা এক জগতের অসম্পূর্ণ অনুকরণের ছোট ছোট পরাধীন খণ্ড রাষ্ট্রে পরিণত হয়। উদ্ভাবন ছিল ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার মূল সুর: অনুকরণ দিয়ে এটা অর্জন করা যায় না। আজকের দিনে যেসব নৃতাত্ত্বিক আরব বিশ্বের আধুনিকায়িত দেশ বা নগরী যেমন, কায়রো, নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁরা বলেন, নগরীর স্থাপত্য কলা ও পরিকল্পনা প্রগতির চেয়ে প্রভুত্বকেই বেশি করে প্রকাশ করে।[২৩]

অন্যদিকে ইউরোপিয়দের ভেতর কেবল আজকের দিনেই উন্নত নয়, বরং আগাগোড়াই তাদের সংস্কৃতি প্রগতির বাহন থাকার বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। প্রায়শঃই ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞতার প্রকাশ ঘটায় তারা। নিজেদের মঙ্গলের জন্যেই ভারতীয়, মিশরিয় ও সিরিয়দের পশ্চিমাকরণের প্রয়োজন হয়েছিল। এই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি ১৮৮৩ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত মিশরে নিয়োজিত কনসাল জেনারেল ইভলিন ব্যারিং, লর্ড ক্রোমারের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে:

স্যার আলফ্রেড লায়াল আমাকে একবার বলেছিলেন: “প্রাচ্য মননে সঠিকতা খাপ খায় না। প্রতিটি অ্যাঙলো-ইন্ডিয়ানের সব সময় একথা মনে রাখা উচিত’: সঠিকতার ঘাটতি, যা সহজেই অবিশ্বাস্যতায় পরিণত হয়, আসলে প্রাচ্য মননের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ইউরোপিয় কঠোর যুক্তিবাদী: কোনও কিছু সম্পর্কে তার বক্তব্যে কোনওরকম দ্ব্যর্থবোধকতা থাকে না; সে স্বভাব যুক্তিবাদী, যুক্তি বিজ্ঞান পড়াশোনা নাও করে থাকে, জন্মগতভাবেই সে সংশয়বাদী, যে কোনও প্রস্তাবনা সত্য হিসাবে মেনে নেওয়ার আগে প্রমাণ খোঁজে। তাঁর প্রশিক্ষিত বুদ্ধিমত্তা যন্ত্রের মতো কাজ করে। অন্যদিকে প্রাচ্যবাসীর মন তার চিত্রবৎ রাস্তার মতোই সর্বক্ষণ সামঞ্জস্যতার অভাবে ভুগছে। তাঁর যুক্তি প্রয়োগ অগোছালো। যদিও প্রাচীন আরবরা দ্বাম্বিকতার জ্ঞানে কিছুটা উচ্চ যোগ্যতা অর্জন করেছিল, কিন্তু তাদের উত্তরসুরিদের ভেতর যৌক্তিক জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। প্রায়শঃই তারা কোনও সহজ প্রস্তাবনার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না যা থেকে তারা সত্য স্বীকার করতে পারে।[২৪]

যেসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে ইসলাম। ক্রুসেডের সময় খৃস্ট জগতে পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) ও তাঁর ধর্ম সম্পর্কে এক নেতিবাচক ইমেজ গড়ে উঠেছিল যা ইউরোপের অ্যান্টি-সেমিটিজমের সঙ্গে অব্যাহত রয়ে গিয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে ইসলামকে প্রগতির প্রত্যক্ষ অন্তরায় অদৃষ্টবাসী ধর্ম হিসাবে দেখা হয়েছে। যেমন, লর্ড ক্রোমার মিশরিয় সংস্কারক মুহাম্মদ আবদুহর সংস্কার প্রয়াসকে তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ইসলাম নিজেকে সংস্কারের অযোগ্য।

প্রচলিত উপায়ে ঈশ্বরের উপলব্ধির বিকাশ ঘটানোর সময় বা শক্তি কোনওটাই মুসলিমদের ছিল না। পশ্চিমের সঙ্গে তাল মেলানোর সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল তারা। কেউ কেউ পশ্চিমের সেকুলারিজমকে সমাধান হিসাবে দেখেছে, কিন্তু ইউরোপে যা ইতিবাচক ও উদ্দীপক হিসাবে কাজ করেছে ইসলামি বিশ্বের কাছে স্রেফ অচেনা ও বিদেশী ঠেকেছে, কেননা এর উৎপত্তি তাদের নিজস্ব ট্র্যাডিশন ও কালে ঘটেনি। পশ্চিমে ঈশ্বরকে দূরত্ব সৃষ্টিকারী স্বর হিসাবে দেখা হয়েছিল; মুসলিম বিশ্বের পক্ষে এটা ছিল ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া। সংস্কৃতির শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ দিশাহারা ও নিখোঁজ বোধ করেছে। কোনও কোনও মুসলিম সংস্কারক ইসলামের ভুমিকাকে জোরপূর্বক খাটো করে প্রগতির গতিকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এর ফল মোটেই তাঁদের আশানুরূপ হয়নি। নতুন জাতি-রাষ্ট্র তুরস্কে ১৯১৭ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর পর পরবর্তীকালে কামাল আতার্তুক নামে পরিচিত হয়ে ওঠা মুস্তাফা কামাল (১৮৮১-১৯৩৮) নিজ দেশকে পশ্চিমা জাতিতে পরিবর্তিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন; ধর্মকে তিনি নেহাতই ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত করে ইসলামকে হটিয়ে দেন। সুফী বৃত্তি ধ্বংস করা হয়, আত্মগোপনে চলে যায় তা: মাদ্রাসাগুলো বন্ধ ঘোষিত হয়; রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে উলেমাদের প্রশিক্ষণের অবসান ঘটে। সেকুলারকরণের এই প্রক্রিয়া ধর্মীয় শ্রেণীগুলোর দর্শনযোগ্যতা কমিয়ে দেওয়া ফেয নিষিদ্ধ করার মাঝে প্রতীকায়িত হয়েছে, মানুষকে পাশ্চাত্যের অনুরূপ পোশাক পরতে বাধ্য করার একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রয়াসও ছিল এটা: ফেযের বদলে মাথায় হ্যাট চাপানোর মানে ছিল ইউরোপায়িত হওয়া। ১৯২৫-১৯৪১ মেয়াদে ইরানের শাহ্ রেযা খান আতাতুর্ককে সম্মান করতেন; তিনিও একইরকম নীতি গ্রহণ করার চেষ্টার চালান; বোরখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, মোল্লাদের দাড়ি কামাতে বাধ্য করে ঐতিহ্যবাহী পাগড়ীর বদলে কেপি পরতে বাধ্য করা হয়; শিয়াহ্ ইমাম ও শহীদ হুসেইনের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচলিত অনুষ্ঠানও বাতিল করে দেওয়া হয়।

ফ্রয়েড প্রাজ্ঞভাবেই অনুভব করেছিলেন, ধর্মের যে কোনও জবরদস্তিমূলক অবদমন ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে। যৌনতার মতো ধর্মও জীবনকে সর্বস্তরে প্রভাবিতকারী একটি মানবিক চাহিদা। অবদমান করা হলে যে কোনও মারাত্মক যৌন অবদমনের মতো বিস্ফোরক ও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে । মুসলিমরা নব্য তুরস্ক ও ইরানকে সন্দেহ ও বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে। ইরানে আগে থেকেই মোল্লাহদের জনগণের নামে শাহদের বিরোধিতা করার একটা ঐতিহ্য ছিল। অনেক সময় অসাধারণ সাফল্যও অর্জন করেছেন তারা। ১৮৭২ সালে শাহ তামাকের উৎপাদন, বিক্রি ও রপ্তানির একচেটিয়া অধিকার ব্রিটিশদের কাছে বিক্রি করে ইরানি উৎপাদক প্রতিষ্ঠাগুলোকে ব্যবসাচ্যুত করলে মোল্লাহরা ইরানি জনগণের জন্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করে ফতোয়া জারি করেছিলেন। প্রদত্ত সুবিধা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন শাহ। পবিত্র নগরী কুম তেহরানের স্বৈরাচারী ও ক্রমশঃ নির্মম হয়ে ওঠা শাসকের বিরুদ্ধে এক বিকল্প হয়ে ওঠে। ধর্মের অবদমন মৌলবাদের জন্ম দিতে পারে, যেমন ঈশ্বর বিশ্বাসের অপূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে পারে ঈশ্বরের প্রত্যাখ্যানের রূপ। তুরস্কে মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় অনিবার্যভাবে উলেমাদের কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে পড়েছিল। এর মানে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অধিকতর শিক্ষিত, পরিমার্জিত ও দায়িত্বশীল উপাদান কমে গিয়েছে, অন্যদিকে আগ্রাউন্ডের সুফীবাদের অধিকতর জাঁকাল রূপ ধর্মের একমাত্র ধরণ রয়ে গিয়েছিল।

অন্য সংস্কারগণও বুঝতে পেরেছিলেন যে, জবরদস্তিমূল অবদমন সমাধান নয়। অন্যান্য সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগে ইসলাম সবসময়ই উদ্দীপ্ত হয়েছে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, সমাজের ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী সংস্কারের জন্যে ধর্মের আবশ্যকতা রয়েছে। অনেক কিছু পরিবর্তন করার প্রয়োজন ছিল; অনেক কিছুই পশ্চাদপদ চেহারা ধারণ করেছিল; কুসংস্কার ও অজ্ঞতার প্রকোপ ছিল। কিন্তু ইসলাম মানুষের মনে গভীর উপলব্ধি গড়ে তুলতেও সাহায্য করেছিল: একে অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠতে দেওয়া হলে সারা পৃথিবীর মুসলিমদের আধ্যাত্মিক সুস্থতা ভোগান্তির মুখে পড়বে। মুসলিম সংস্কারকরা পশ্চিমের প্রতি বৈরী ছিলেন না। অনেকেই পাশ্চাত্যের সাম্যতা, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শকে উপযোগী হিসাবে দেখেছেন, যেহেতু ইসলাম জুদো ক্রিশ্চানিটির মুল্যবোধের অংশীদার, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যার প্রবল প্রভাব ছিল। পাশ্চাত্য সমাজের আধুনিকায়ন কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক নতুন ধরনের সাম্যের জন্ম দিয়েছিল; সংস্কারকগণ তাদের জনগণকে বলেছেন, এই ক্রিশ্চান যেন তাদের চেয়ে ভালোভাবে ইসলামি জীবনযাপন করছে বলে মনে হয়। ইউরোপের সঙ্গে এই নতুন যোগাযোগে ব্যাপক উৎসাহ আর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। বিত্তশালী মুসলিমরা ইউরোপে শিক্ষা নিয়ে এখানকার দর্শন, সাহিত্য ও আদর্শ আত্মস্থ করে নিজেদের শিক্ষা ভাগ করে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে যার যার দেশে ফিরে গিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে বলতে গেলে প্রায় সব মুসলিম বুদ্ধিজীবীই পশ্চিমের গভীর ভক্তও হয়ে উঠেছিলেন।

সংস্কারকদের সবারই বুদ্ধিবৃত্তিক পক্ষপাত ছিল, আবার তাঁরা প্রত্যেকেই ইসলামি অতিন্দ্রীয়বাদের কোনও না কোনও ধরনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। সুফীবাদ ও ইশরাকি অতিন্দ্রীয়বাদের অধিকতর কল্পনা-নির্ভর ও বুদ্ধিদীপ্ত রূপ মুসলিমদের অতীত সঙ্কট মোকাবিলায় সাহায্য করেছিল। তারা আবার এগুলোর শরণাপন্ন হয়েছেন। ঈশ্বরের অনুভূতিকে প্রতিবন্ধক মনে করা হয়নি, বরং আধুনিকতায় পদার্পণকে তরান্বিতকারী গভীর স্তরে পরিবর্তনের শক্তি হিসাবে দেখা হয়েছে একে। এভাবেই ইরানি সংস্কারক জামাল আদ-দিন আল-আফগানি (১৮৩৮-৮৭) সুহরাওয়ার্দির ইশরাকি অতিন্দ্রীয়বাদের ব্রতী হয়েও একই সঙ্গে আধুনিকীকরণেরও প্রবল সমর্থক ছিলেন। ইরান, আফগানিস্তান, মিশর ও ভারত ভ্রমণ করার সময় আল-আফগানি সবার কাছে নিজেকে সবকিছু হিসাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছিলেন। নিজেকে সুন্নীর কাছে সুন্নী, শিয়াহর কাছে শিয়াহ্, শহীদ, বিপ্লবী, ধার্মিক, দার্শনিক ও একজন সাংসদ হিসাবে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। ইশরাকি অতিন্দ্রীয়বাদের অনুশীলন মুসলিমদের চারপাশের জগতের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে ও সত্তায় বাধা হয়ে থাকা সীমা রেখা অদৃশ্য হওয়ার এবং মুক্তির অনুভূতির স্বাদ পেতে সাহায্য করে। মনে করা হয় যে, আল-আফগানির বেপরোয়া ভাব ও বিভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ সত্তা সম্পর্কে এর বর্ধিত ধারণাসহ অতিন্দ্রীয়বাদী অনুশীলন প্রভাবিত হয়েছিল।২৫ ধর্ম আবশ্যক ছিল, যদিও সংস্কার প্রয়োজন ছিল। আল দ্বারা আফগানি বিশ্বাসী, এমনকি প্রবলভাবে আস্তিক ছিলেন, কিন্তু তার একমাত্র গ্রন্থ দ্য রিফিউটেশন অভ দ্য মেটেরিয়ালিস্টস-এ ঈশ্বর সম্পর্কে তেমন আলোচনা স্থান পায়নি। পশ্চিম যুক্তিকে মূল্য দেয় এবং ইসলাম ও প্রাচ্যবাসীদের অযৌক্তিক হিসাবে দেখে জানতেন বলে আল-আফগানি ইসলামকে এর যুক্তির নির্দয় কাল্ট দিয়ে আলাদা ধর্ম বিশ্বাস হিসাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন। আসলে মুতাযিলিদের মতো যুক্তিবাদীরাও তাদের। ধর্মেরই এই ব্যাখ্যাকে অদ্ভূত বলে আবিষ্কার করত। আল-আফগানি যত না দার্শনিক তার চেয়ে বেশি ছিলেন কর্মী। সুতরাং, মাত্র একটি সাহিত্য প্রয়াস দিয়ে তাঁর জীবন ও বিশ্বাসকে বিচার না করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও, পাশ্চাত্য আদর্শ হিসাবে পরিগণিত ব্যবস্থায় মানানসই করার উদ্দেশ্যে ইসলামের এ রকম বর্ণনা মুসলিম বিশ্বের এক নতুন আস্থাহীনতা তুলে ধরেছে অচিরেই যা চরম ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে।

আল-আফগানির মিশরিয় অনুসারী মুহাম্মদ আবদুহর (১৮৪৯-১৯০৫) ভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কেবল মিশরে কার্যক্রম সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানকার মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেন তিনি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামি পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি, যা তাঁকে সুফী শেখ দারবীশ এর প্রভাবে নিয়ে আসে, যিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, বিজ্ঞান ও দর্শন ঈশ্বরের জ্ঞান লাভের সবচেয়ে নিশ্চিত দুটি পথ। পরিণামে আবদুহু কায়রোর মর্যাদাপূর্ণ আল-আযহার মসজিদে পড়াশোনা শুরু করার সময় এখানকার প্রাচীন পাঠক্রম দেখে মোহমুক্ত হয়ে পড়েন। এর বদলে তিনি আল-আফগানির প্রতি আকৃষ্ট হন, যিনি তাঁকে যুক্তিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থ বিজ্ঞান ও অতিন্দ্রীয়বাদের শিক্ষা দেন। পশ্চিমের কোনও কোনও ক্রিশ্চান মনে করত বিজ্ঞান ধর্ম বিশ্বাসের শত্রু, কিন্তু মুসলিম অতিন্দ্রীয়বাদীরা প্রায়শঃই ধ্যানের সহায়ক হিসাবে গণিত ও বিজ্ঞান ব্যবহার করেছে। বর্তমানকালে শিয়াদের কিছু চরমপন্থী অতিন্দ্রীয়বাদী গোষ্ঠী-যেমন দ্রুজ বা আলা-বিশেষভাবে আধুনিক বিজ্ঞানে আগ্রহী। ইসলামি বিশ্বে পশ্চিমা রাজনীতির ব্যাপারে অনেক সঙ্কোচ রয়েছে। কিন্তু একে পশ্চিমা বিজ্ঞানের সঙ্গে ঈশ্বরে বিশ্বাসের সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে খুব নগণ্য সংখ্যকই সমস্যা হিসাবে আবিষ্কার করেছে।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে উত্তেজনা বোধ করেছেন আবদুহ; বিশেষভাবে কোতে, তলস্তয় ও ব্যক্তিগত বন্ধু হার্বাট স্পেন্সর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। পুরোপুরি পশ্চিমি জীবনধারা গ্রহণ করলেও বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে নিজেকে সজীব রাখতে নিয়মিত ইউরোপ সফর করতেন আবদুহ। এর মানে এই নয় যে, তিনি ইসলাম পরিত্যাগ করেছেন বরং বিপরীতে যেকোনও সংস্কারকের মতো আবদুহ ধর্মবিশ্বাসের মূলে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। সুতরাং, তিনি পয়গম্বর ও সঠিক পথে পরিচালিত চার খলিফার (রাশিদুন) চেতনায় ফিরে যাবার তাগিদ দিয়েছেন। এতে অবশ্য আধুনিকতা ত্যাগ করার মৌলবাদী প্রত্যাখ্যানের প্রয়োজন হয়নি। আবদুহ্ জোর দিয়ে বলেছেন, আধুনিক বিশ্বে স্থান করে নেওয়ার জন্যে মুসলিমদের অবশ্যই বিজ্ঞান, কারিগরি জ্ঞান ও সেকুলার দর্শন পাঠ করতে হবে। মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি অর্জনে সক্ষম করে তোলার জন্যে শরীয়াহ আইনকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। আল-আফগানির মতো তিনিও ইসলামকে যুক্তিভিত্তিক ধর্ম হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোরানে যুক্তি ও ধর্ম হাতে হাত রেখে অগ্রসর হয়েছে। পয়গম্বরের আগে প্রত্যাদেশের সঙ্গে অলৌকিক ঘটনা, কিংবদন্তী ও অযৌক্তিক বাগাড়তা যুক্ত ছিল, কিন্তু কোরান এইসব সুপ্রাচীন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়নি। এটা তুলে ধরেছে প্রমাণ ও প্রকাশ, অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করে এবং যুক্তির আলোকে সেগুলোকে আক্রমণ করেছে। ফায়সুফদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আল-গাযযালির আক্রমণ শোভন ছিল না। এর ফলে ধর্মপরায়ণতা ও যুক্তিবাদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, যা উলেমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানকে ক্ষন্ন করেছে। আল-আযহারের পুরোনো পাঠ্যক্রমে এটা স্পষ্ট ছিল। সুতরাং, মুসলিমদের কোরানের অধিকতর গ্রাহী ও যৌক্তিক চেতনায় ফিরে যাওয়া উচিত। তা সত্ত্বেও আবদুহ পুরোপুরি বিড়াকশনিস্ট যুক্তিবাদ হতে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। তিনি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন: রহস্যে ঢাকা ঈশ্বরের অত্যাবশ্যকীয় সত্তা যুক্তির নাগালের বাইরে। আমরা কেবল এটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারি যে, ঈশ্বর আর কোনও বস্তুর মতো নন । ধর্মতাত্ত্বিকরা অন্য যেসব প্রশ্ন নিয়ে কাজ করেন সেগুলো একেবারে তুচ্ছ; কোরান এগুলোকে যান্না বলে। নাকচ করে দিয়েছে।

ভারতে স্যার মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) নেতৃস্থানীয় সংস্কারক ছিলেন; ভারতীয় হিন্দুদের গান্ধীর মতো মুসলিমদের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও দর্শন শাস্ত্রে ডক্টরিটও ছিল তাঁর। বার্গসন, নিৎশে এবং এ. এন. হোয়াইটহেডদের প্রতি প্রবলভাবে আগ্রহী ছিলেন তিনি; নিজেকে প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের সেতুবন্ধ কল্পনা করে তাদের দর্শনের আলোকে ফালসাফাহকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তাঁর চোখে ভারতে ইসলামের অবনতি দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ভারতের মুসলিমদের মাঝে এক ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি কাজ করে আসছিল। ইসলামের উৎসভূমি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ভাইদের মতো আস্থার অভাব ছিল তাদের, এরই পরিণামে ব্রিটিশদের কাছে আরও বেশি হারে আত্মরক্ষামূলক ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল তারা। কবিতা ও দর্শনের মাধ্যমে ইসলামি নীতিমালার সৃজনশীল পুনর্নির্মাণের ভেতর দিয়ে ইকবাল তার জাতির বিব্রতকর অবস্থা দূর করার প্রয়াস পেয়েছিলেন।

নিৎশের মতো পশ্চিমা দার্শনিকদের কাছ থেকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের গুরুত্ব আত্মস্থ করেন ইকবাল। গোটা বিশ্বজগৎ এক পরম সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ, মানুষ যাকে ঈশ্বর’ আখ্যায়িত করেছে। নিজস্ব অনন্য স্বভাব অর্জন করার লক্ষ্যে সকল মানুষকে আরও বেশি করে ঈশ্বরের অনুরূপ হয়ে উঠতে হবে। তার মানে প্রত্যেককে অবশ্যই আরও স্বতন্ত্র, আরও সৃজনশীল হয়ে উঠতে হবে; আবার এই সৃজনশীলতার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে হবে। ভারতীয় মুসলিমদের নিষ্ক্রিয়তা ও কাপুরুষোচিত আত্ম-বিলীনতা (ইকবাল যাকে পারস্যের প্রভাব হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন) ত্যাগ করতেই হবে। মুসলিমদের ইজতিহাদ (স্বাধীন বিবেচনা) তাদের নতুন নতুন ধ্যান ধারণা গ্রহণে উপযোগী করে তোলার কথা: খোদ কোরানে অব্যাহত পরিমার্জনা ও আত্মনীরিক্ষার দাবি জানিয়েছে। আল-আফগানি ও আবদুর মতো ইকবাল দেখতে চেয়েছিলেন যে প্রগতির চাবিকাঠি গবেষণামূলক মনোভাব ইসলামেই জন্ম নিয়েছিল এবং মধ্যযুগে মুসলিম বিজ্ঞান গণিতের মাধ্যমে পশ্চিমে গেছে। অ্যাক্সিয়াল যুগের মহান স্বীকারোক্তিমূলক ধর্মগুলোর আবির্ভাবের আগে মানবজাতির উন্নতি ছিল অগোছাল, সামঞ্জস্যহীন, বিশেষভাবে মেধাবী ও অনুপ্রাণিত ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল। মুহাম্মদের (স) পয়গম্বরত্ব ছিল যা পরবর্তী প্রত্যাদেশ অপ্রয়োজনীয় করে দেওয়া এইসব স্বজ্ঞাজাত প্রয়াসাদির সম্মিলন। এরপর থেকে মানুষ বিজ্ঞান ও যুক্তির ওপর নির্ভর করতে পারে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ নিজেই লক্ষ্যে পরিণত হওয়ায় পশ্চিমে তা বহুঈশ্বরবাদীতার এক নতুন ধরনের রূপ নিয়েছিল। মানুষ ভুলে গিয়েছিল যে, সব রকম স্বাতন্ত্র্য এসেছে ঈশ্বরের কাছ থেকে। লাগামহীনভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেলে ব্যক্তির মেধা বিপজ্জনক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। নিজেদের ঈশ্বর বিবেচনাকারী নিৎশের কল্পিত অতিমানবের প্রজন্ম এক ভীতিকর সম্ভাবনাঃ মানুষের মুহূর্ত বিশেষের খেয়াল ও মর্জির অতীত এক রীতি যে নিয়মের চ্যালেঞ্জ থাকার প্রয়োজন রয়েছে। পশ্চিমের দূষণের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদের প্রকৃত রূপকে রক্ষা করা ইসলামের দায়িত্ব। তাদের সম্পূর্ণ মানুষ সম্পর্কিত সুফী আদর্শ, সৃষ্টির পরিণতি ও এর অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ছিল। নিজেকে পরম বিবেচনাকারী অতিমানব সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করে; তার বিপরীতে পূর্ণাঙ্গ মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি পরম সত্তার প্রতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকবেন এবং সাধারণ মানুষকে চালিত করবেন। বিশ্বের বর্তমান অবস্থা বোঝায় যে প্রগতি বা উন্নতি এক অভিজাত গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল, যারা বর্তমান ছাড়িয়ে দেখতে পান ও মানুষকে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সবাই ঈশ্বরের মাঝে প্রকৃত ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে অর্জন করতে পারবে । ইকবালের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামের ভূমিকা আংশিক ছিল, কিন্তু খৃস্টধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ইসলামকে অসম্মানকে করার চলমান পশ্চাত্য প্রয়াসের চেয়ে ঢের বেশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল এটা। অতিমানবের আদর্শের ব্যাপারে তাঁর আশঙ্কা বা সংশয় জীবনের শেষ বছরগুলোয় জার্মানির ঘটনা প্রবাহে চমৎকারভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এ সময় মধ্যপ্রাচ্যের আরব মুসলিমরা পাশ্চাত্যের হুমকি মোকাবিলার ব্যাপারে আর আগের মতো আস্থাশীল ছিল না। ১৯২০ সাল, যে বছর ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্য অধিকার করে নেয়, আম-আল-নাখবাহ বা বিপর্যয়ের বছর হিসবে পরিচিত হয়ে ওঠে: শব্দটি মহাজাগতিক বিপর্যয়ের সমার্থক। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আরবরা স্বাধীনতার আশা করেছিল, কিন্তু এই নতুন দখলদারির ফলে মনে হয়েছে, তারা বুঝি আর কখনওই আপন নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না; এমনকি এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ব্রিটিশরা যায়নিস্টদেও হাতে প্যালেস্তাইনকে তুলে দিতে যাচ্ছে: যেন এর আরব অধিবাসীদের অস্তিত্বই নেই। লজ্জা আর অপমানের অনুভূতি প্রবল হয়ে উঠেছিল। কানাডিয় পণ্ডিত উইলফ্রেড ক্যান্টয়েল স্মিথ বলেছেন, অতীতের স্বর্ণালি সাফল্যের স্মৃতি তাদের এই বোধ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল; আধুনিক আরব) এবং, ধরা যাক, আধুনিক আমেরিকানের পার্থক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় যা অতীতের সাফল্যের স্মৃতিবাহী এক সমাজের সঙ্গে বর্তমান সাফল্যের অনুভূতির গভীর পার্থক্য। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল। খৃস্টধর্ম প্রধানত দুঃখকষ্ট ও বৈরিতার ধর্ম এবং অন্তত পশ্চিমে, তর্কসাপেক্ষে দুর্যোগকালেই সর্বাধিক সত্য প্রমাণিত হয়ে এসেছে: ক্রুশবিদ্ধ ক্রাইস্টের ইমেজের সঙ্গে জাগতিক সাফল্য বা মহিমাকে মেলানো সহজ হয়। কিন্তু ইসলাম এক সাফল্যের ধর্ম। কোরান শিক্ষা দিয়েছে, যে সমাজ ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী (ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে, সামঞ্জস্য আনে, সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ। করে) পরিচালিত সেটি ব্যর্থ হতে পারে না। মুসলিম ইতিহাস যেন এরই। সত্যতা নিশ্চিত করে। ক্রাইস্টের বিপরীতে মুহাম্মদ (স) আপাত ব্যর্থ ছিলেন না বরং বিস্ময়করভাবে সফল। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মুসলিম সাম্রাজ্যের অবিশ্বাস্য অগ্রযাত্রায় তাঁর সাফল্য স্বাভাবিকভাইে ঈশ্বরের মুসলিম বিশ্বাস প্রমাণিত বলে মনে হয়েছে: ইতিহাসের পরিমণ্ডলে নিজের ওয়াদা রক্ষা করে আল্লাহ চুড়ান্তভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছেন। মুসলিমদের সাফল্য অব্যাহত ছিল। এমনকি মঙ্গোল আগ্রাসনের মতো বিপর্যয়ও কাটিয়ে ওঠা গেছে। শত শত বছরের পরিক্রমায় উম্মাহ প্রায় পবিত্র গুরুত্ব অর্জন করেছিল এবং ঈশ্বরের উপস্থিতি তুলে ধরেছে। কিন্তু এখন মুসলিম ইতিহাসে কি যেন ভয়ানক ওলটপালট হয়ে গেছে আর তা অনিবার্যভাবে ঈশ্বরের ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এখন থেকে বহু মুসলিম ইসলামি ইতিহাসকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার ও জগতে কোরানের দর্শনকে কার্যকর করে তোলার দিকে মন দেবে ।

ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে পয়গম্বর এবং তাঁর ধর্মের প্রতি পশ্চিমা অসন্তোষ কতটা গভীর প্রকাশ পেলে লজ্জার অনুভূতি আরও প্রবল। হয়ে উঠেছিল। মুসলিম পণ্ডিতগণ ক্রমবর্ধমান হারে অ্যাপোলোজিটিক্স বা অতীতের বিজয় গাথার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিলেন। এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি। ঈশ্বর আর মধ্যমঞ্চে ছিলেন না। মিশরিয় পত্রিকা আল-আযহার-এ ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সংখ্যার নিবিড় নিরীক্ষায় এই প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছেন ক্যান্টওয়েল স্মিথ। এই সময়কালে পত্রিকার দুজন সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত এটা পরিচালিত হয় সর্বান্ত করণে ট্রাডিশনিস্ট আল-খিজর হুসেইন এর হাতে, ধর্মকে তিনি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সত্তা নয় বরং ধারণা হিসাবে দেখেছেন। ইসলাম ছিল এক নির্দেশনা, ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের আহ্বান; সম্পূর্ণ অর্জিত বাস্তবতা নয়। মানবীয় জীবনে স্বর্গীয় আদর্শের বাস্তবায়ন সবসময়ই কঠিন, এমনকি অসম্ভবও-হুঁসেইন তাই উন্মাহর অতীত বা বর্তমান ব্যর্থতায় হতাশ ছিলেন না। তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুসলিমদের আচরণের সমালোচনা করেছেন, তাঁর কার্যকালে সাময়িকীটি সবগুলোর সংখ্যা করতে হবে’ ও ‘করা উচিত’ শব্দে আকীর্ণ ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করতে আগ্রহী হলেও বিশ্বাস করতে পারছে না, এমন একজন ব্যক্তির সমস্যা কল্পনা করতে পারেননি হুসেইন: আল্লাহর অস্তিত্ব সন্দেহাতীত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। পুরোনো এক সংখ্যায় ইউসুফ আল দিনি রচিত প্রবন্ধে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তিসমূহের রূপরেখা বর্ণিত হয়েছিল। স্মিথ উল্লেখ করেছেন, লেখার ধরণ আবশ্যিকভাবে ভক্তিমূলক এবং এখনও প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মহিমার গভীর, উচ্ছল প্রশংসা প্রকাশ পেয়েছে যা স্বর্গীয় সত্তার প্রকাশ করে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে আল-দিনির কোনও সন্দেহ ছিল না। তাঁর প্রবন্ধ যতটা না ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ তার চেয়ে বেশি ধ্যান। একথা তার জানা ছিল না যে, পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা বহু। আগেই এই ‘প্রমাণ’ উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই মনোভাব ছিল পুরোনো । সাময়িকীটির প্রচার সংখ্যায় ধস নেমেছিল।

১৯৩৩ সালে ফরিদ ওয়াজদি দায়িত্ব নেওয়ার পর পর পাঠকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ওয়াজদির প্রাথমিক বিবেচনা ছিল পাঠকদের আশ্বস্ত করা যে, ইসলাম ঠিক আছে। হুসেইনের একথা মনে আসার কথা নয় যে ঈশ্বরের মনের দুজ্ঞেয় ধারণা ইসলামের সময়ে সময়ে সাহায্যের হাত প্রয়োজন হতে পারে; কিন্তু ওয়াজদি ইসলামকে হুমকির সম্মুখীন একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখেছেন। প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে যাচাই, শ্রদ্ধা ও প্রশংসা করা । উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ যেমন উল্লেখ করেছেন, এক গভীর ধর্মহীনতা ওয়াজদির রচনাবলীকে ঘিরে রেখেছে। পূর্বসুরিদের মতো তিনিও অব্যাহতভাবে যুক্তি দেখিয়েছেন শত শত বছর আগের ইসলামের আবিষ্কারসমূহই এখন পশ্চিম আবার শিক্ষা দিচ্ছে; কিন্তু তাদের মতো খুব কমই ঈশ্বরের প্রসঙ্গ এনেছেন তিনি। ইসলামের মানবিক দিকটাই ছিল তাঁর। মনোযোগের প্রধান বিষয়; এই পার্থিব মূল্যবোধ এক অর্থে দুয়ে ঈশ্বরকে প্রতিস্থাপিত করেছিল । স্মিথ উপসংহার টানছেন:

ইসলামে বিশেষ করে ঐতিহাসিক ইসলামে বিশ্বাসী কেউ প্রকৃত মুসলিম নন; বরং যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন ও পয়গম্বরের মাধ্যমে তাঁর প্রত্যাদেশের প্রতি যিনি অঙ্গীকারবদ্ধ তিনিই মুসলিম। শেষাক্তটি আছে। এবং যথার্থভাবে শ্রদ্ধা পাচ্ছে, কিন্তু অঙ্গীকার অদৃশ্য হয়েছে। এই পৃষ্ঠাগুলোয় ঈশ্বর লক্ষণীয়ভাবে কদাচিৎ আবির্ভূত হয়েছেন।[২৮]

বরং তার জায়গায় অস্থিতিশীলতা ও আত্মমর্যাদাবোধের অভাব রয়েছে: পশ্চিমের মতামত বড় বেশি গুরুত্বহ হয়ে উঠেছে। হুসেইনের মতো ব্যক্তিরা ধর্ম ও ঈশ্বরের কেন্দ্রীকতা উপলব্ধি করলেও আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না। আধুনিকতার সংস্পর্শে আসা মানুষ ঈশ্বর বোধ হারিয়ে ফেলেছিল। এই অস্থিতিশীলতা থেকেই জন্ম নেবে আধুনিক মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, যা আবার ঈশ্বর হতে পিছু হটা।

ইউরোপের ইহুদিরাও তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বৈরী সমালোচনায় ক্ষতিগস্ত হয়েছিল। জার্মানিতে ইহুদি দার্শনিকগণ তাদের ভাষায় ইহুদিবাদের বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছিলেন, যেখানে দাসত্বমূলক দূরত্ব সৃষ্টিকারী বিশ্বাস নয় প্রমাণ করার জন্যে হেগেলিয় পরিভাষায় ইহুদিদের ইতিহাস পুনঃলিখিত হয়েছিল । ইসরায়েলের ইতিহাসের পুনর্ব্যাখ্যার এই প্রয়াসের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন সলোমন ফর্মস্তেচার (১৮০৮-৮৯)। দ্য রিলিজিয়ন অভ দ্য স্পিরিট (১৮৪১)-এ ঈশ্বরকে তিনি সকল বস্তুতে বিরাজমান বিশ্বাত্ম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই আত্মা পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না, যেমন হেগেল যুক্তি দেখিয়েছেন। ফর্মস্তেচার জোর দিয়ে বলেছেন, এটা যুক্তির নাগালের বাইরে অবস্থান করে। ঈশ্বরের সত্তা ও তার কর্মকাণ্ডের প্রাচীন পার্থক্যে ফিরে গেছেন তিনি। হেগেল সেখানে প্রতিনিধিত্বমূলক ভাষা ব্যবহারের বিরোধিতা করেছেন, ফর্মস্তেচার সেখানে যুক্তি দিয়েছেন যে, প্রতীকীবাদ ঈশ্বর আলোচনার যথার্থ বাহন, কেননা তিনি দার্শনিক ধ্যান ধারণার নাগালের বাইরে অবস্থান করেন। এসব সত্ত্বেও ইহুদিবাদই প্রথম ধর্ম যা ঈশ্বরের এক অগ্রসর ধারণায় পৌঁছেছিল এবং অচিরেই গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবে একটি প্রকৃত আধ্যাত্মিক ধর্ম কেমন হতে পারে।

আদিম পৌত্তলিক ধর্ম ঈশ্বরকে প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত করেছিল, যুক্তি দেখিয়েছেন ফর্মস্তেচার। এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা রহিত কালটি মানব জাতির শিশুকাল তুলে ধরে। মানব জাতি আরও উঁচু মাত্রায় আত্ম সচেতন হয়ে উঠলে তারা ঈশ্বরের আরও মার্জিত ধারণার দিকে অগ্রসর হতে তৈরি হয়। তারা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে ‘ঈশ্বর’ বা ‘আত্মা’ প্রকৃতিতে মিশে নেই, বরং এর ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। এই নতুন ধারণা অর্জন করার পয়গম্বরগণ এক নীতি ধর্ম প্রচার করেছেন। প্রথম দিকে তারা বিশ্বাস করেছেন যে প্রত্যাদেশসমূহ দেহাতীত কোনও শক্তি থেকে আসছে, কিন্তু আস্তে আস্তে তারা বুঝতে পারেন, কোনও বহিস্থঃ ঈশ্বরের ওপর পুরোপুরি তারা নির্ভরশীল নন, বরং তাঁদের নিজস্ব আত্মায় পরিপুর্ণ স্বভাবে অনুপ্রাণিত। ইহুদিরাই সবার আগে ঈশ্বরের এই নৈতিক ধারণা অর্জন করতে পেরেছিল। দীর্ঘ নির্বাসন ও মন্দির ধ্বংস বাহ্যিক বিষয়াদি ও কর্তৃত্বের ওপর নির্ভরশীলতা হতে তাদের মুক্ত করেছিল। ফলে এক উন্নতর ধর্মীয় সচেতনতার দিকে অগ্রসর হয়েছিল তারা যা স্বাধীনভাবে ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হবার সুযোগ করে দিয়েছে। হেগেল এবং কান্ট যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন, তারা মধ্যস্থতাকারী পুরোহিতের উপর নির্ভরশীল বা কোন বিদেশী আইনের ভয়ে ভীতও ছিল না। তার বদলে মন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র দিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে শিখেছে। খৃস্টধর্ম ও ইসলাম অনুকরণের প্রয়াস পেয়েছে, কিন্তু তেমন সফল হয়নি। যেমন, খৃস্টধর্মের ঈশ্বর বর্ণনায় বহু পৌত্তলিক উপাদান রয়ে গিয়েছিল। ইহুদিরা যেহেতু শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছে, অচিরেই তারা সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করবে; উন্নতির এই চূড়ান্ত পর্বের জন্যে তৈরি হতে তাদের অতীত ইতিহাসের অনুন্নত এক পর্যায়ের এক অবশেষ আনুষ্ঠানিক আইন পরিত্যাগ করতে হবে।

মুসলিম সংস্কারবাদের মতো ইহুদিবাদের বিজ্ঞানের উদ্যোক্তরা তাঁদের ধর্মকে পুরোপুরি যৌক্তিক বিশ্বাস হিসাবে উপস্থাপনে উদগ্রীব ছিলেন। তাঁরা বিশেষভাবে কাব্বালাহ ত্যাগ করতে চেয়েছেন, শ্যাব্বেতাই যেভি বিপর্যয় ও। হাসিবাদ-এর আবির্ভাবের সময় থেকে যা বিব্রতকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরই পরিণতিতে ১৮৪২ সালে দ্য রিলিজিয়াস ফিলোসফি অভ দ্য জুজ-এর। প্রকাশক স্যামুয়েল হার্শ ইসরায়েলের একটি ইতিহাস রচনা করেছিলেন যেখানে অতিন্দ্রীয়বাদী দিক উপেক্ষা করে স্বাধীনতার ধারণার ওপর বিশেষ জোর দিয়ে ঈশ্বরের একটি নৈতিক ও যৌক্তিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। একজন মানুষ তার ‘আমি’ বলার ক্ষমতায় আলাদাভাবে পরিচিত হয়। এই আত্ম-সচেতনতা অবিচ্ছেদ্য ব্যক্তি স্বাধীনতা তুলে ধরে। পৌত্তলিক ধর্ম এই স্বাধীন মনোভাবের বিকাশ ঘটাতে পারেনি, কেননা মানুষের উন্নতি বা বিকাশের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে আত্ম-সচেতনতার বোধটি স্বর্গ হতে প্রাপ্ত বলে মনে করা হতো। প্যাগানরা প্রকৃতিতে তাদের ব্যক্তিগত মুক্তির উৎস স্থাপন করেছিল, তারা বিশ্বাস। করত যে, তাদের কিছু কিছু দোষ বা অপরাধ অনিবার্য। আব্রাহাম অবশ্য এই পৌত্তলিক অদৃষ্টবাদ ও নির্ভরতা অস্বীকার করেছিলেন। ঈশ্বরের সামনে নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একা দাঁড়িয়েছেন তিনি। এমন একজন মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈশ্বরের দেখা পাবে। বিশ্ব জগতের প্রভু ঈশ্বর এই অন্তস্থঃ স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের সাহায্য করার জন্যেই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন; স্বয়ং ঈশ্বরই প্রতিটি মানুষকে এই লক্ষ্যে শিক্ষা দান করেছেন। জেন্টাইলরা যেমন মনে করে, ইহুদিবাদ দাসত্বমূলক ধর্ম নয়। এটা সব সময়ই, উদাহরণ হিসাব বলা যায়, খৃস্টধর্মের তুলনায় অগ্রসর ধর্ম ছিল; ইহুদি উৎস ভুলে গিয়ে খৃস্টধর্ম পৌত্তলিকতার যুক্তিহীনতা ও কুসংস্কারে ফিরে গিয়েছিল।

নাখমান ক্ৰচমাল (১৭৮৫-১৮৪০), যার মৃত্যুর পর ১৮৪১ সালে গাইড ফর দ্য পিরপ্লেক্সড অভ আওয়ার টাইম প্রকাশিত হয়েছিল, সতীর্থদের মতো অতিন্দ্রীয়বাদ থেকে সরে যাননি। তিনি ঈশ্বর’ বা ‘আত্মা’কে কাব্বালিস্টদের মতো কিছু না বলতে ভালোবাসতেন; ঈশ্বরের আপন সত্তার ক্রমপ্রকাশ বর্ণনা করার জন্যে উৎসারণের কাব্বালিস্ট রূপকল্প ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ইহুদিদের সাফল্য ঈশ্বরের ওপর শোচনীয়। নির্ভরতার নয় বরং সম্মিলিত সচেতনতার কর্মকাণ্ডের ফল। শত শত বছর ধরে ইহুদিরা ক্রমশঃ ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা পরিশুদ্ধ করেছে। এভাবে । নির্বাসনের সময় ঈশ্বরকে অলৌকিক ঘটনা সংগঠনের মাধ্যমে নিজের উপস্থিতিতে প্রকাশ করতে হয়েছিল । কিন্তু বাবিলন থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় নাগাদ ইহুদিরা ঈশ্বর সম্পর্কে আরও অগ্রসর ধারণা অর্জন করে, ফলে নিদর্শন ও বিস্ময়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। গোয়িম যেমনটি কল্পনা করে, ঈশ্বর উপাসনার ইহুদি ধারণা মোটেই সে রকম দাসত্বমূলক নির্ভরতা নয়, বরং তা প্রায় হুবহু দার্শনিক আদর্শের অনুরূপ। ধর্ম ও দর্শনের একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে শেষোক্তটি নিজেকে ধারণা দিয়ে প্রকাশ করে, আর ধর্ম ব্যবহার করে প্রতীকী ভাষা। তা সত্ত্বেও প্রতীকী ভাষা যথার্থ, কেননা ঈশ্বর তাঁর সম্পর্কে আমাদের। সকল ধারণা অতিক্রম করে যান। প্রকৃতপক্ষে আমরা এমনকি এও বলতে পারি না যে তার অস্তিত্ব আছে, কারণ অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারেই আংশিক এবং সীমাবদ্ধ ।

১৮৮১ সালে তৃতীয় জার আলেকজান্দারের অধীন রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে ভয়ানক অ্যান্টি-সেমিটিজমের জোয়ারে মুক্তির মাধ্যমে আগত নতুন আত্মবিশ্বাস কঠিন আঘাত লাভ করে। পশ্চিম ইউরোপেও এটা ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯৪ সালে ইহুদিদের মুক্তি দানকারী প্রথম দেশ ফ্রান্সে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে ভুলবশতঃ ইহুদি কর্মকর্তা আলফ্রেড ভ্ৰেয়ফুস অভিযুক্ত হলে অ্যান্টিসেমিটিজমের এক উন্মাদনাময় স্রোত বয়ে গিয়েছিল। একই বছর উল্লেখযোগ্য অ্যান্টি-সেমাইট কার্ল লুগার ভিয়েনার মেয়র নির্বাচিত হলেও জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত ইহুদিদের ধারণা ছিল যে তারা নিরাপদ। এভাবে হারমান কোহেন (১৮৪২-১৯১৮) যেন কান্ট এবং হেগেলের মেটাফিজিক্যাল অ্যান্টি-সেমিটিজমে আবিষ্ট ছিলেন। সবার উপরে ইহুদিবাদ একটি দাসত্বমূলক ধর্মবিশ্বাস, এই অভিযোগ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন কোহেন ঈশ্বরকে বাহ্যিক সত্তা হিসাবে মানতে অস্বীকার করেন। মহাশূন্যে । অবস্থান করে আনুগত্য আরোপকারী ঈশ্বর মানুষের মনে সৃষ্টি হওয়া একটা ধারণা মাত্র, নৈতিক আদর্শের একটা প্রতীক। মোজেসের সামনে স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক নিজেকে ‘আমি যা আমি তাই বলে পরিচয় দেওয়ার সময় জ্বলন্ত ঝোঁপের বাইবেলিয় কাহিনীর আলোচনা প্রসঙ্গে কোহেন যুক্তি দেখিয়েছেন, এটা আমরা যাকে ‘ঈশ্বর’ বলি তা যে কেবল সত্তা স্বয়ং সেই সত্য প্রকাশেরই আদিম অভিব্যক্তি। এটা আমাদের বোধের সাধারণ সত্তাসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা কেবল এই আবশ্যক অস্তিত্বে অংশগ্রহণ করতে পারে। দ্য রিলিজিন অভ রিজন ড্রন ফ্রম দ্য সোর্সের্স অভ জুদাইজম এও (১৯১৯ সালে মৃত্যুর পর প্রকাশিত) কোহেন জোরের সঙ্গে বলেছেন, ঈশ্বর স্রেফ মানুষের একটা ধারণা। তারপরও তিনি মানুষের জীবনে ধর্মের আবেগগত ভূমিকা স্বীকার করেছেন। তুচ্ছ নৈতিক ধারণা আমাদের সান্ত্বনা দিতে পারে না। ধর্ম আমাদের প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়, সুতরাং এটা বলা যেতে পারে যে ধর্মের ঈশ্বরই-নীতি ও দর্শনের ঈশ্বরের বিপরীতে-সেই আবেগময় ভালোবাসা।

এসব ধারণা ফ্ৰান্য রোজেনভিগের (১৮৮৬-১৯২৯) হাতে সকল শনাক্তের অতীত বিকাশ লাভ করে; ইহুদিবাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধারণার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন তিনি, যা তাকে তার সমসাময়িকদের তুলনায় আলাদা স্থান দিয়েছে। তিনি কেবল প্রথম যুগের অস্তিত্ববাদীদের অন্যতম ছিলেন না, এমন সব ধারণাও প্রণয়ন করেছিলেন যা প্রাচ্য ধর্মসমূহের অনেক কাছাকাছি। তার স্বাধীনতাকে সম্ভবত এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, তরুণ বয়সে তিনি ইহুদিবাদ ত্যাগ করে পরিণত হয়েছিলেন অজ্ঞাবাদীতে, তারপর খৃস্টধর্ম গ্রহণের কথা ভেবে শেষে আবার অর্থডক্স ইহুদিবাদে ফিরে এসেছিলেন। স্বেচ্ছাচারী ঈশ্বরের ওপর দাসত্বমূলক কারণ নির্ভরতাকে উৎসাহিতকারী তোরাহ অনুসরণের অস্বীকৃতি জানিয়েছেন রোজেসভিগ। ধর্ম কেবলা নৈতিকতার একটা ব্যাপার নয় বরং অত্যাবশ্যকীয়ভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন। সাধারণ মানুষের পক্ষে দুয়ে ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়া কীভাবে সম্ভব? এই মিলন কেমন ছিল, আমাদের কখনও বলেননি রোজেনসভিগ। এটা তাঁর। দর্শনের একটি ত্রুটি। তিনি মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে আত্মাকে মিলিয়ে ফেলার হেগেলিয় প্রয়াসকে অবিশ্বাস করেছেন। আমাদের মানবীয় চেতনাকে ‘বিশ্বাত্মার একটা বৈশিষ্ট্য ভাবতে গেলে আমরা আর প্রকৃত স্বতন্ত্র ব্যক্তি থাকি না। একজন খাঁটি অস্তিত্ববাদী রোজেনভিগ প্রতিটি মানুষের চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতার ওপর জোর দিয়েছেন। আমরা প্রত্যেকেই মানুষের বিশাল সমুদ্রে দিশাহারা, আতঙ্কিত। কেবল ঈশ্বর আমাদের দিকে প্রসন্ন হয়ে দৃষ্টি ফেরালেই এই অজ্ঞাতনামা অবস্থা ও আতঙ্ক হতে উদ্ধার লাভ করি। সুতরাং, ঈশ্বর আমাদের স্বাতন্ত্রকে খর্ব করেন না, বরং আমাদের পরিপূর্ণ আত্মসচেতনতা অর্জনে সক্ষম করে তোলেন।

মানবীয় কোনও রূপে আমাদের পক্ষে ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা অসম্ভব। ঈশ্বর অস্তিত্বের মূল, সুতরাং আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছেন তিনি, যে আমাদের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়, যেন তিনি আমাদের মতোই কোনও ব্যক্তি বিশেষ। ঈশ্বরকে বর্ণনা করার মতো কোনও ধারণা বা ভাষা নেই। বরং মানুষ ও তার মাঝের বিশাল ব্যবধান তোরাহর নির্দেশনাবলীতে দূর হয়। গোয়িম যেমন ভাবে, এগুলো স্রেফ বেআইনী বিধি বিধান নয়। এগুলো পবিত্র মূল্য বিশিষ্ট প্রতীকী কর্মকাণ্ড যা নিজেদের অতীতে কোথাও ইঙ্গিত করে ও ইহুদিদের আমাদের সত্তার গভীরস্থ স্বর্গীয় মাত্রার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। র‍্যাবাইদের মতো রোজেনভিগ যুক্তি দেখিয়েছেন, নির্দেশনাবলী এত বেশি রকম প্রতীকী যে যেহেতু প্রায়শঃই এগুলোর কোনও নিজস্ব অর্থ থাকে না-এগুলো আমাদের খোদ অনির্বচনীয় সত্তা সম্পর্কে আমাদের সীমিত ভাষা ও ধারণাসমূহের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। এগুলো আমাদের শ্রবণ ও অপেক্ষার মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে, ফলে আমরা আমাদের অস্তিত্বের মূল-এর দিকে মনোযোগী ও অবিচল থাকতে পারি। সুতরাং, মিতভা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না। ব্যক্তি বিশেষকে এগুলোকে এমনভাবে উপলব্ধিতে নিতে হবে যাতে প্রতিটি মিতভা বাহ্যিক নির্দেশ হিসাবে পরিচয় হারিয়ে কেবল আমার অন্তরের মনোভাব প্রকাশ করে আমার অন্তরের অবশ্যকরণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাসত্ত্বেও তোরাহ্ যদিও বিশেষভাবে ইহুদিদের ধর্মীয় অনুশীলন, কিন্তু প্রত্যাদেশ কেবল ইসরায়েলের জনগণের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি, রোজেনসভিগ, ঐতিহ্যগতভাবে ইহুদি প্রতীকী ভঙ্গিতে ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, কিন্তু একজন ক্রিশ্চান অন্যরকম প্রতীক ব্যবহার করবে। ঈশ্বর সম্পর্কিত মতবাদসমূহ প্রাথমিকভাবে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি ছিল না, বরং সেগুলো ছিল অন্তরের মনোভাবের প্রতীক। যেমন সৃষ্টি ও প্রত্যাদেশের মতবাদসমূহ ঈশ্বরের জীবন ও পৃথিবীর প্রকৃত ঘটনাবলীর আক্ষরিক বিবরণ ছিল না। প্রত্যাদেশের কিংবদন্তীগুলো আমাদের ব্যক্তিগত ঈশ্বর অনুভূতি প্রকাশ করে। সৃষ্টি সংক্রান্ত মিথগুলো আমাদের মানবীয় অস্তিত্বের চরম অনিশ্চয়তাকে প্রতীকায়িত করে, অস্তিত্বের ভিত্তির ওপর আমাদের অসীম নির্ভরতার আলোড়ন সৃষ্টিকারী জ্ঞান যা আমাদের অস্তিত্বকে সম্ভব করে তুলেছে। স্রষ্টা হিসাবে ঈশ্বর যতক্ষণ না প্রতিটি সৃষ্টির কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছেন ততক্ষণ তিনি তাঁর সৃষ্টিসমূহ নিয়ে মাথা ঘামান না, কিন্তু তিনি যদি স্রষ্টা অর্থাৎ সকল অস্তিত্বের মূল না হতেন, তাহলে গোটা মানব জাতির জন্যে ধর্মীয় অনুভূতির কোনও মানে থাকত না। এটা কতগুলো আজগুবি ঘটনার ক্রমধারা রয়ে যেত। নব্য অ্যান্টি-সেমিটিজমের বিপক্ষে বিকাশমান নতুন রাজনৈতিক ইহুদিবাদের ব্যাপারে ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বজনীনতার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন রোজেনসভিগ সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন। ইসরায়েল, যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, প্রতিশ্রুত ভূমিতে নয়, বরং মিশরেই জাতিতে পরিণত হয়েছিল; এবং চিরন্তন জাতি হিসাবে তখনই এর গন্তব্যে পৌঁছবে যদি সে জাগতিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে এবং রাজনীতিতে জড়িত না হয়।

কিন্তু ক্রমবর্ধমান অ্যান্টি-সেমিটিজমের শিকারে পরিণত হওয়া ইহুদিরা এই রাজনীতি-বিচ্ছিন্নতা পোষাতে পারবে মনে করেনি। ঈশ্বর বা মেসায়াহ এসে উদ্ধার করবেন ভেবে বসে থাকতে পারেনি তারা। তাদের নিজেদেরই উদ্ধার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ১৮৮২ সালে রাশিয়ায় প্রথম হত্যালীলার এক বছর পর ইহুদিদের একটা দল পূর্ব ইউরোপ ছেড়ে প্যালেস্তাইনে বসতি করতে যায়। তাদের বিশ্বাস ছিল নিজেদের একটা আবাসভূমি না হওয়া পর্যন্ত ইহুদিরা অসম্পূর্ণ, বিচ্ছিন্ন মানুষ রয়ে যাবে। যায়নে (জেরুজালেমের অন্যতম প্রধান পাহাড়) ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষার সূচনা ঘটেছিল এক বিদ্রোহী সেকুলার আন্দোলন হিসাবে, কেননা ইতিহাসের উত্থান-পতন যায়োনিস্টদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল যে, ধর্ম ও তাদের ঈশ্বর কাজ করেননি। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যায়নবাদ ছিল বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের একটা শাখা, যার কর্মীরা মার্ক্স এর তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করেছিল। ইহুদি বিপ্লবীরা সচেতন হয়ে উঠেছিল যে তাদের কমরেডরা জারের মতোই অ্যান্টি-সেমিটিক কমিউনিস্ট শাসনাধীন; তাদের অবস্থার কোনও উন্নতি হবে না ভেবে শঙ্কিত ছিল ওরা: পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে তাদের আশঙ্কা ঠিক ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডেভিড বেন গুরিয়নের (১৮৮৬-১৯৭৩) মতো উৎসাহী তরুণ সমাজতন্ত্রীরা স্রেফ মালসামান নিয়ে প্যালেস্তাইনে পাড়ি জমিয়েছিলেন এমন একটা আদর্শ সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে যা কিনা জেন্টাইলদের জন্যে আলোকবর্তিকা হবে ও সমাজতান্ত্রিক সহস্রাব্দের সূচনা ঘটাবে। অন্যদের এইসব মার্ক্সীয় স্বপ্নে বিভোর হবার অবকাশ ছিল না। ক্যারিশম্যাটিক অস্ট্রিয়ান থিওদর হার্যল (১৮৬০ ১৯০৪) নতুন ইহুদি প্রয়াসকে ঔপনিবেশিক উদ্যোগ হিসাবে দেখেছেন: ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কোনও একটির আশ্রয়ে ইহুদি রাষ্ট্রটি ইসলামি বর্বরতার মাঝে প্রগতির ভ্যানগার্ডে পরিণত হবে।

ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সত্ত্বেও যায়নবাদ নিজেকে উৎপত্তিগতভাবেই প্রচলিত ধর্মীয় পরিভাষায় প্রকাশ করেছে; অত্যাবশ্যকীয়ভাবে এক নিরীশ্বরবাদী ধর্ম ছিল এটা। ভবিষ্যতের জন্যে ভাবাবেশ ও অতিন্দ্রীয়বাদী আশায় ভরপুর ছিল। উদ্ধার লাভ, তীর্থযাত্রা ও পুনর্জন্মের প্রাচীন থিমের ওপর নির্ভরশীল। যায়নবাদীরা এমনকি উদ্ধারপ্রাপ্ত সত্তার চিহ্ন হিসাবে নতুন নাম গ্রহণ করার চর্চাও শুরু করেছিল। এভাবেই প্রথমদিকের প্রচারক অ্যাশার গিনবার্গ নিজেকে আহাদ হা’আম (জনগণের একজন) আখ্যায়িত করেছিলেন। এখন তিনি আপন পরিচয় পেয়েছেন, কারণ নিজেকে তিনি নতুন জাতীয় চেতনার সঙ্গে একীভূত করতে পেরেছেন, যদিও তিনি প্যালেস্তাইনে ইহুদি রাষ্ট্রে সম্ভব বলে ভাবেননি। তিনি কেবল ইসরায়েল জাতির একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে সেখানে একটি ‘আধ্যাত্মিক কেন্দ্র’ চেয়েছিলেন যা ঈশ্বরের স্থান গ্রহণ করবে। এটা জীবনের সকল বিষয়ের একটি নির্দেশনায় পরিণত হবে, হৃদয়ের একেবারে গভীরে প্রবেশ করবে এবং প্রত্যেককে প্রত্যেকের অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত করবে। যায়বাদীরা প্রাচীন ধর্মীয় পরিচয় পাল্টে ফেলেছিল। এক দুয়ে ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত হওয়ার বদলে ইহুদিরা পৃথিবীতেই পূর্ণতার খোঁজ করেছে। হিব্রু শব্দ হাগশামাহ, আক্ষরিক অর্থে ‘নিরেট করণ’, মধ্যযুগীয় ইহুদি দর্শনে নেতিবাচক শব্দ ছিল, যা ঈশ্বরে মানবীয় ভৌত গুণ আরোপ করার স্বভাবের কথা বোঝাত। যায়নবাদে হাগশামাহ সম্পূর্ণতা বোঝাল, পার্থিব জগতে ইসরায়েলের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রকাশ। পবিত্রতা আর স্বর্গে অবস্থান করছে নাঃ প্যালেস্ত ইিন একটি পবিত্র ভূমি-শব্দটির পূর্ণাঙ্গ অর্থে।

কতটা পবিত্র সেটা বোঝা যাবে প্রথম দিকের পাইওনিয়ার আরন ডেভিড গর্ডনের (মৃ. ১৯২২) লেখায়, যিনি সাতচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত প্রথমে অর্থডক্স ইহুদি ও কাব্বালিস্ট ছিলেন, এরপর যায়নবাদে দীক্ষা নেন। শাদা চুল ও শশ্রুমণ্ডিত দুর্বল ও অসুস্থ মানুষ গর্ডন অপেক্ষাকৃত তরুণ বসতি স্থাপনকারীদের পাশাপাশি মাঠে কাজ করতেন, রাতে মোহবিষ্ট অবস্থায় তাদের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াতেন এবং চেঁচিয়ে বলতেন, ‘আনন্দ… আনন্দ। আগেকার দিনে, লিখেছিলেন তিনি, ইসরায়েল ভূমির সঙ্গে পুনর্মিলনের অভিজ্ঞতাকে শেকিনার প্রকাশ হিসাবে আখ্যায়িত করা হতো। পবিত্র ভূমি এক পবিত্র মূল্যে পরিণত হয়েছিল: কেবল ইহুদিদের কাছেই বোধগম্য, এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল, যা এক অসাধারণ ইহুদি চেতনা জন্ম দিয়েছিল। এই পবিত্রতার বর্ণনা দিতে গিয়ে গর্ডন এক সময় ঈশ্বরের রহস্যময় জগৎ বোঝাতে প্রযুক্ত কাব্বালিস্টিক ভাষা ব্যবহার করেছেন:

ইহুদির আত্মা হচ্ছে ইসরায়েলের ভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশের উত্তরসুরি । স্পষ্টতা এক অসীম পরিষ্কার আকাশের গভীরতা, এক স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, নির্মলতার কুয়াশা। এমনকি স্বর্গীয় অজানাও যেন এই স্পষ্টতায় অদৃশ্য হয়ে যায়, সীমিত প্রকাশিত আলো হতে অসীম গুপ্ত আলোয় হারিয়ে যায়। এই পৃথিবীর মানুষ ইহুদির আত্মার এই স্পষ্ট দৃষ্টিকোণ বা আলোকিত অজানার কোনওটিই উপলব্ধি করতে পারে না।[২৯]

প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্যের এই ল্যান্ডস্কেপ তাঁর পিতৃভূমি রাশিয়া থেকে এত আলাদা ছিল যে গর্ডনের কাছে আতঙ্ক জাগানো এবং অচেনা ঠেকেছে। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছেন, পরিশ্রমের (আভোদাহ শব্দটি দিয়ে ধর্মীয় আচারও বুঝিয়ে থাকে) ভেতর দিয়ে একে আপন করতে পারবেন। জমিনের উন্নতি করে, আরবরা যার উপেক্ষা করেছে, যায়নিস্টদের দাবি অধিকার করে নিতে পারবে এবং একই সময়ে নিজেদের নির্বাসনের বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তোরণ ঘটাতে পারবে।

সমাজতন্ত্রী যায়নবাদীরা তাদের অগ্রগামী আন্দোলনকে শ্রমের জয় হিসাবে আখ্যায়িত করে তাদের কিঝুতষিম সেকুলার মঠে পরিণত হয়েছিল, সেখানে তারা শাদামাটাভাবে বাস করত ও নিজেদের মুক্তি খুঁজে পেত। জমির আবাদ পুনর্জন্ম ও বিশ্বজনীন ভালোবাসার এক অতিন্দ্রীয়বাদী অনুভূতির দিকে ধাবিত করেছিল তাদের। গর্ডন যেমন ব্যাখ্যা করেছেন:

আমার দুই হাত পরিশ্রমের সাথে যেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, আমার চোখ আর কান যা দেখতে ও শুনতে শিখেছে এবং আমার হৃদয় বুঝতে পেরেছে এর মাঝে কী আছে: আমার আত্মাও পাহাড়ে পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়াতে শিখেছে, উড়তে শিখেছে, ভাসতে শিখেছে-অচেনা বিস্তারে ছড়িয়ে পড়ার জন্যে চারপাশে সকল জমিনকে আলিঙ্গন করার জন্যে, গোটা জগৎ এবং এতে যা কিছু আছে আর সমগ্র বিশ্বজগতের আলিঙ্গনে নিজেকে আবদ্ধ দেখার জন্যে।

তাদের কাজ ছিল সেকুলার প্রার্থনা। ১৯২৭ সালের দিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ অগ্রদূত ও পণ্ডিত আম্রাহাম শ্লোনস্কি (১৯০০-৭৩), সড়ক নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি, ইসরায়েল ভূমির উদ্দেশে নিচের কবিতাটি লিখেছেন:

আমাকে পরিয়ে দাও, লক্ষ্মী মা আমার, বহু রঙা জমকালো পোশাক,
ভোরে নিয়ে যাও ক্ষেতে।
প্রার্থনার চাদরের মতো আলোয় মোড়া আমার জমিন।
কপালের ফিতের মতো দাঁড়িয়ে ঘরগুলো;
হাতে বিছানো পাথরসারি, ঝর্নাধারা যেন ধর্মগ্রন্থের বাক্স বাঁধার ফিতে।
এখানে অনিন্দ্য সুন্দর নগরী স্রষ্টার উদ্দেশে প্রার্থনা করে।
স্রষ্টাদের মাঝে আছে তোমার পুত্র আব্রাহাম,
ইসরায়েলের সড়ক নির্মাতা কবি।[৩১]

যায়নবাদীর আর ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই, সে নিজেই স্রষ্টা।

অন্য যায়নবাদীরা অধিকতর প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসে নিষ্ঠ রয়ে গিয়েছিল। প্যালেস্তাইনী ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রবীন র‍্যাবাইর দায়িত্ব পালনকারী কাব্বালিস্ট আব্রাহাম ইসাক কুকের (১৮৬৫-১৯৩৫) ইসরায়েলে পা রাখার আগে জেন্টাইল বিশ্বের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ঈশ্বরের সেবা করার ধারণা যতদিন ধর্মের আদর্শ ও কর্তব্য হতে ভিন্ন একটি নির্দিষ্ট সত্তার সেবা হিসাবে সঙ্গায়িত হবে ততদিন তা বিশেষ বস্তুসমূহে মনোযোগী অপরিণতি দৃষ্টিভঙ্গি হতে মুক্ত হবে না। ঈশ্বর ভিন্ন এক সত্তা নন। ব্যক্তিত্ব জাতীয় সকল মানবীয় ধারণার উধ্বে এন সফ। ঈশ্বরকে সত্তা বিশেষ হিসাবে কল্পনা করতে যাওয়া বহু ঈশ্বরবাদীতা ও আদিম মানসিকতায় লক্ষণ। ইহুদি ট্র্যাডিশনে সিক্ত ছিলেন কুক, কিন্তু তিনি যায়নিস্ট আদর্শে আতঙ্ক বোধ করেননি। একথা সত্য যে, ধর্মকে ঝেড়ে ফেলার কথা বিশ্বাস করত শ্রমবাদীরা, কিন্তু নাস্তিক্যবাদী যায়নবাদ ছিল একটা পর্যায় মাত্র। অগ্রগামীদের মাঝে তৎপর ছিলেন ঈশ্বর: স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গসমূহ’ এসব ‘খোসার’ অন্ধকারে বন্দি হয়ে উদ্ধারের প্রতীক্ষায় ছিল। তারা ভাবুক বা না ভাবুক, ইহুদিরা মূলত ঈশ্বরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল এবং নিজেদের অজান্তেই ঈশ্বরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল। নির্বাসনের সময় পবিত্র আত্মা তার জাতিকে ত্যাগ করে গিয়েছিলেন। শেকিনাহকে সিনাগগ ও পাঠকক্ষে লুকিয়ে রেখেছিল তারা। কিন্তু ইসরায়েল অচিরেই পৃথিবীর আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে পরিণত হবে, জেন্টাইলদের সামনে ঈশ্বরের প্রকৃত ধারণা প্রকাশ করবে।

এ ধরনের আধ্যাত্মিকতা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। পবিত্র ভূমির প্রতি অতিভক্তি আমাদের কালেই ইহুদি মৌলবাদীদের বহুঈশ্বরবাদীতার জন্ম দেবে। ঐতিহাসিক ইসলামের প্রতি ভক্তি মুসলিম বিশ্বে অনুরূপ মৌলবাদ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। ইহুদি ও মুসলিম উভয়ই এক অন্ধকার জগতে অর্থ খুঁজে পাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। ইতিহাসের ঈশ্বর যেন তাদের হতাশ করেছেন। যায়নবাদীরা তাদের জনগণের চূড়ান্ত বিনাশের ভয় করে ভুল করেনি। বহু ইহুদির কাছেই ঈশ্বরের প্রচলিত ধারণা এক অসম্ভাব্যতার রূপ নেবে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এলি ওয়েইসেল হাঙেরিতে ছেলেবেলায় কেবল ঈশ্বরের জন্যে বেঁচেছিলেন; তালমুদের বিধিবিধান অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল তার জীবন; একদিন কাব্বালাহর রহস্যে দীক্ষা নেওয়ার আশা ছিল তার। বালক বয়সে তাকে প্রথমে অশওঁই ও পরে বুচেনভন্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যু শিবিরে প্রথম রাতেই ক্রিমাটোরিয়াম থেকে কুত্তলী পাকানো ধোঁয়া উঠতে দেখে-যেখানে তাঁর মা বোনের মৃতদেহ নিক্ষেপ করার কথা ছিল-তিনি বুঝে যান যে অগ্নিশিখা তাঁর বিশ্বাসকে গ্রাস করে নিয়েছে। এমন এক জগতে ছিলেন তিনি যা কল্পিত ঈশ্বরবিহীন জগতেরই বাস্তব রূপ। রাত্রির সেই নৈঃশব্দ্য কোনওদিনই ভোলা উচিত হবে না আমার, যা চিরদিনের জন্যে আমার বাঁচার আকাক্ষা দূর করে দিয়েছিল, বহু বছর পর লিখেছেন তিনি, আমার ঈশ্বর, আমার আত্মা ও আমার স্বপ্নকে চুরমার দেওয়া এই মুহূর্তগুলোর কথাও কখনও ভুলব না আমি।

গেস্টাপো একদিন একটা শিশুকে গলায় দড়ি দিয়ে হত্যা করে। হাজার হাজার দর্শকের সামনে একটা বাচ্চা ছেলেকে ফাঁসিতে ঝোলানোয় এমনকি এসএস পর্যন্ত বিব্রত বোধ করেছে। শিশুটির, স্মৃতিচারণ করেছেন ওয়েইসেল ‘চেহারা ছিল ‘বিষণ্ণ-চোখ দেবদূতের মতো; ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় চুপচাপ, একেবারে ফ্যাকাশে আর প্রায় শান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। ওয়েইসেলের পেছন থেকে বন্দিদের কেউ একজন জানতে চেয়েছে: ‘ঈশ্বর কোথায়? কোথায় তিনি? আধঘণ্টা লেগেছিল শিশুটি মারা যেতে। এই সময় বন্দিরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। একই লোক আবার জিজ্ঞেস করেছে; ঈশ্বর এখন কোথায়?’ তখন ভিড়ের ভেতর একটা কণ্ঠস্বরকে জবাব দিতে শুনেছেন ওয়েইসেল: ‘কোথায় তিনি? তিনি এখানে-এখানে ফাঁসিতে ঝুলে আছেন।

দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন, একটি শিশুর মৃত্যুও ঈশ্বরকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে, কিন্তু এমনকি তিনিও, যার সঙ্গে নিষ্ঠুরতার পরিচয় ছিল, এ রকম অবস্থায় কোনও শিশুর মৃত্যু কথা কল্পনা করেননি। অশউঁইযের বিভীষিকা ঈশ্বরের প্রচলিত ধারণায় বিশ্বাসী আরও অনেকের কাছেই প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছিল। দুৰ্জেয় অ্যাপাথিয়ায় হারিয়ে যাওয়া দার্শনিকদের দূরবর্তী ঈশ্বর অসহনীয় হয়ে উঠেছেন। ইহুদিদের অনেকেই আর ইতিহাসে নিজেকে প্রকাশকারী ঈশ্বরের বাইবেলিয় ধারণায় বিশ্বাস রাখতে পারেনি। যিনি, ওয়েইসেলের সঙ্গে তারাও বলে, অশউইযে প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের বৃহত্নপ ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে মোকাবিলা করা হয়েছে। এই ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হলে হলোকাস্ট ঠেকাতে পারতেন। ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে থাকলে তিনি অক্ষম, অপ্রয়োজনীয়; আর থামানোর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও না থামানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তিনি দানব। হলোকাস্ট যে প্রথাগত ধর্মতত্ত্বের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে, এ বিশ্বাস কেবল ইহুদিদের একার নয়।

কিন্তু তারপরেও একথা সত্যি, এমনকি অশওঁইযেও কিছুসংখ্যক ইহুদি তালমুদ পড়া চালিয়ে গেছে, প্রচলিত উৎসব পালন করেছে, ঈশ্বর তাদের উদ্ধার করবেন এই আশায় নয়, বরং এর একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া গেছে বলে । একটা গল্প চালু আছে যে, অশউইযে একদিন একদল ইহুদি ঈশ্বরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা ও বিশ্বাসঘাকতার অভিযোগ আনে তারা। জবের মতো তারাও অশুভের সমস্যা ও বর্তমান অশ্লীলতার মাঝে দুর্ভোগের প্রচলিত জবাবে সান্ত্বনা খুঁজে পায়নি। ঈশ্বরের পক্ষে তারা কোনও অজুহাত পায়নি, অপরাধের গুরুত্ব হ্রাস করতে পারে এমন কোনও পরিস্থিতিও দেখেনি, তো, তারা তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য বলে ঘোষণা দেয়। র‍্যাব্বাই রায় ঘোষণা করেন। তারপর মুখ তুলে তাকিয়ে বলেন, বিচারের কাজ শেষ; এখন সান্ধ্য প্রার্থনার সময় হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *