০৮. সংস্কারকদের ঈশ্বর

৮. সংস্কারকদের ঈশ্বর

ঈশ্বরের সকল জাতির ক্ষেত্রে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী ছিল চরম সিদ্ধান্ত মুলক। পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চানদের জন্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যায় ছিল এটা, যারা কেবল ওইকুমিনের অপরাপর সংস্কৃতির সঙ্গে তালই মেলায়নি বরং তাদের অতিক্রম করে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। এই দুই শতাব্দী ইতালিতে অতি দ্রুত উত্তর ইউরোপের বিস্তার লাভ করা রেনেসা, নতুন বিশ্বের আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা প্রত্যক্ষ করে যা বাকি বিশ্বের নিয়তির ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ পশ্চিম সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এক সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটাতে যাচ্ছিল। সুতরাং, এটা ছিল ক্রান্তিকাল, যার ফলে সাফল্য ও উদ্বেগ ছিল এ সময়ের বৈশিষ্ট্য। এ সময়ের পশ্চিমে ঈশ্বর সংক্রান্ত ধ্যানধারণায় ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে আছে। সেকুলার সাফল্য সত্ত্বেও ইউরোপের জনগণ অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে তাদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে ধর্মের মধ্যযুগীয় চরিত্র নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল, কেননা তা নতুন বিশ্বের সমস্যা বা প্রয়োজন মেটাতে পারছিল না। মহান সংস্কাররকগণ এই অসন্তোষকে ভাষা দান করেন এবং ঈশ্বর ও মুক্তিলাভকে বিবেচনা করার নতুন উপায় আবিষ্কার করেন। ফলে ইউরোপ দুটি বিবদমান শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে-ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট-যারা কখনও পারস্পরিক ঘৃণা ও সন্দেহ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সংস্কারকালীন সময়ে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারবাদীরা বিশ্বাসীদের প্রতি সাধু-সন্ন্যাসী ও দেবদূতদের ওপর প্রান্তিক ভক্তিবাদ ছেড়ে কেবল ঈশ্বরের দিকে মনোনিবেশ করার তাগিদ দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষেই ইউরোপে যেন ঈশ্বর উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কেউ কেউ ‘নাস্তিক্যবাদ’ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু করে দিয়েছিল। এর মানে কি তবে তারা ঈশ্বরকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল?

গ্রিক, ইহুদি ও মুসলিমদের জন্যেও এক সঙ্কট কাল ছিল এটা। ১৪৫৩ সালে অটোমান তুর্কীরা ক্রিশ্চান রাজধানী কন্সতান্তিনোপল অধিকার করে ও বাইযান্তিয় সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেয়। এরপর থেকে রুশ ক্রিশ্চানরা গ্রিক উদ্ভাবিত প্রথা ও আধ্যাত্বিকতা অনুসরণ অব্যাহত রাখে। ক্রিস্টোফার। কলোম্বাসের নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের বছর, ১৪৯২ সালে ফের্নিনান্দ ও ইসাবেলা ইউরোপের শেষ মুসলিম শক্ত ঘাঁটি স্পেনের গ্রানাদা অধিকার করে নেন: পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের বাসভূমি ইবেরিয় পেনিনসুলা থেকেও উচ্ছেদ করা হয়। স্পেনের মুসলিমদের বিনাশ ইহুদিদের জন্যে মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। গ্রানাদা দখল করার কয়েক সপ্তাহ পার হওয়ার পর ১৪৯২ সালের মার্চ মাসে ক্রিশ্চান শাসকগণ ইহুদিদের খৃস্টধর্ম গ্রহণ বা নির্বাসনের যেকোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেন। স্প্যানিশ ইহুদিদের অনেকেরই দেশের প্রতি এত প্রবল টান ছিল যে, তারা ক্রিশ্চান হয়ে গেলেও কেউ কেউ ইসলাম হতে ধর্মান্ত রিত মরিসকোসদের মতো গোপনে ধর্মচর্চা অব্যাহত রাখে: এই ইহুদি ধর্মান্ত রিতদের পরে ধর্মদ্রোহী সন্দেহ করে ইনকুইজিশন তাড়া করে বেড়িয়েছিল। অবশ্য প্রায় ১৫০,০০০ ইহুদি খৃস্টধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের জোরপূর্বক স্পেন ত্যাগে বাধ্য করা হয়: এরা তুরস্ক, বালকান অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকায় আশ্রয় নেয়। স্পেনের মুসলিমরা ডায়াসপোরার ইহুদিদের জন্যে সেরা বাসভুমি গড়ে দিয়েছিল, ফলে স্প্যানিশ ইহুদিদের বিনাশকে গোটা পৃথিবীর ইহুদিরা সিই ৭০-এ মন্দির ধ্বংসের পর তাদের জাতির ওপর নেমে আসা ভয়ঙ্করতম দুর্যোগ হিসাবে দেখেছে। অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে আরও গভীরভাবে ইহুদিদের ধর্মীয় চেতনায় নির্বাসনের বোধ স্থান করে নেয়: ফলে এক নতুন ধরনের কাব্বালাহ জন্ম লাভ করে, ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়।

বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মুসলিমদের জন্যেও জটিল সময় ছিল এটা। মঙ্গল আক্রমণ পরবর্তী শতাব্দীগুলোয়-সম্ভবত অনিবার্যভাবে-এক নতুন ধরনের রক্ষণশীলতা গড়ে উঠেছিল, জনগণ যেন এতে সম্পদ পুনরুদ্ধারের প্রয়াস পেয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইসলামি বিদ্যাপীঠ মাদ্রাসার সুন্নী উলেমাগণ ঘোষণা করেন যে, ইজতিহাদের (স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগ) পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন থেকে মুসলিমদের অতীতের মহান, বিশেষ করে শরীয়াহ বা পবিত্র আইনের জ্ঞানী ব্যক্তিদের অনুসরণ’ (তাকলিদ) করতে হবে। এ রকম রক্ষণশীল আবহে ঈশ্বর বা সত্যি বলতে অন্য কিছু সম্পর্কে নতুন ধ্যান-ধারণা গড়ে ওঠা অসম্ভব বা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হয়ে উঠবে। তা সত্ত্বেও পশ্চিম ইউরোপিয়রা যেমন মনে করে থাকে, এ সময়কালকে ইসলামের পতনের সূচনা লগ্ন বললে ভুল হবে। মার্শাল জি. এস. হজসন তাঁর দ্য ভেঞ্চার অভ ইসলাম: কনশিয়েন্স অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন আ ওয়ার্ল্ড সিভিলাইজেশন গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, এ রকম ঢালাও সরলীকরণ করার মতো এ সময় সম্পর্কিত যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই। উদাহরণ স্বরুপ, এই সময়ে মুসলিমদের বিজ্ঞান চর্চায় ভাটা পড়েছিল ভেবে নেওয়াটা ভুল হবে, কেননা আমাদের কাছে কোনও পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।

চতুর্দশ শতাব্দীতে দামাস্কাসের আহমেদ ইবন তাইমিয়াহ (মৃত্যু, ১৩২৮) এবং তাঁর শিষ্য ইবন আল-কাঈন আল-জওযিয়াদের মতো শরীয়াহ অনুসারীদের হাতে রক্ষণশীল প্রবণতা জন্ম লাভ করেছিল। মুসলিমরা যেন সম্ভাব্য সবরকম পরিস্থিতিতে শরীয়াহ প্রয়োগ করতে পারে সেভাবে একে বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন জনপ্রিয় ইবন তাঈমিয়াহ। একে নির্যাতনমূলক অনুশীলন হিসাবে গড়ে তোলার কোনও ইচ্ছা ছিল নাঃ তিনি পুরোনো অচল নিয়ম বা বিধিগুলোকে বাদ দিয়ে শরীয়াহকে এই সংকট-সময়ের মুসলিমদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করার উপযোগি প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চেয়েছিলেন। ধর্মীয় সমস্যাদির স্পষ্ট যৌক্তিক জবাব শরীয়াহ হতে পাওয়া উচিত। কিন্তু শরীয়াহর প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে তাঈমিয়াহ কালাম, ফালসাফাহ, এমনকি আশারিয়াদের ওপরও চড়াও হয়ে বসেন। যে কোনও সংস্কারকের মতো তিনি উৎসে-কোরান এবং হাদিসে (যার ওপর ভিত্তি করে শরীয়াহর সৃষ্টি)-প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছেন এবং চেয়েছিলেন পরবর্তীকালের সমস্ত সংযুক্তি ঝেড়ে ফেলতে: ‘আমি সকল ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখেছি। এসব রোগ উপশম বা তৃষ্ণা নিবারণে অক্ষম। আমার কাছে কোরানের পথই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর শিষ্য আল-জাওযিয়াহ উদ্ভাবনের তালিকায় সুফীবাদকে যোগ করেন এবং ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যার উপর জোর দেন; তাঁর ওপর সুফী সাধকদের কাল্টকে এমনভাবে নিন্দা জানান যার সঙ্গে পরবর্তীকালের ইউরোপের প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারবাদীদের খুব বেশি অমিল ছিল না। লুথার ও কালভিনের মতো ইবন তাঈমিয়াহ ও আল-জাওযিয়াহ তাঁদের সমসাময়িকদের চোখে সেকেলে বিবেচিত হননিঃ তাঁদের বরং প্রগতিশীল মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ সময়ের তথাকথিত রক্ষণশীলতাকে স্থবিরকাল হিসাবে নাকচ না করার জন্যে আমাদের সতর্ক করেছেন হজসন । তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, আমাদের আগে আর কোনও সমাজ আমরা এখন যে মাত্রায় প্রগতিকে উপভোগ করছি সেভাবে দেখতে বা বহন করার উপযোগি ছিল না। পশ্চিমের পণ্ডিতগণ প্রায়শঃই পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর মুসলিমদের ইতালিয় রেনেসাঁকে বিবেচনায় নেওয়ার ব্যর্থতার জন্যে ভর্ৎসনা করে থাকেন। ইতিহাসের এক ব্যাপক সাংস্কৃতিক বিকাশের পর্যায় ছিল এটা, সত্যি, কিন্তু এর সঙ্গে, উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, চীনের সুং রাজবংশের খুব একটা তারতম্য ছিল না, যা দ্বাদশ শতাব্দীর মুসলিমদের প্রেরণার উৎস ছিল । পশ্চিমের জন্যে রেনেসাঁ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল বটে, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি যুগের আবির্ভাব বুঝতে পারেনি কেউ, যদিও পেছনে তাকিয়ে আমরা এর আগমনের আভাস দেখতে পাই। মুসলিমরা এই পশ্চিমা রেনেসাঁর প্রতি যদি সাড়া নাও দিয়ে থাকে সেজন্যে একে দুরতিক্রম্য সাংস্কৃতিক অপুর্ণতা হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মুসলিমরা পঞ্চদশ শতাব্দীতে তাদের নিজস্ব উল্লেখযোগ্য সাফল্য নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল।

প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে ইসলাম ছিল বিশ্বের পরাশক্তি পশ্চিম ইউরোপ দোরগোড়ায় এর উপস্থিতি সম্পর্কে সম্পর্ক সচেতন ছিল। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে তিনটি নতুন ইসলামি সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে: এশিয়া মাইনর ও পূর্ব ইউরোপে অটোম্যান তুর্কী সাম্রাজ্য, ইরানে সাফাভিয়দের সাম্রাজ্য ও ভারতে মুঘোলদের সাম্রাজ্য। নয়া এই প্রয়াসগুলো দেখায় যে, ইসলামি চেতনা কোনও অর্থেই মরণোন্মুখ ছিল না বরং দুর্যোগ ও ধ্বংসের পর মুসলিমদের আবার সফল হওয়ার প্রেরণা জাগানোর ক্ষমতা এর রয়েছে। প্রত্যেকটি সাম্রাজ্যই যার যার নিজস্ব পরিমণ্ডলে সাংস্কৃতিক বিকাশ অর্জন করেছিল: ইরান ও মধ্য এশিয়ার সাফাভিয় রেনেসাঁ লক্ষণীয়ভাবে ইতালিয় রেনেসাঁর অনুরূপ ছিল: উভয় সংস্কৃতিই চিত্রকলায় নিজেদের তুলে ধরেছে ও সৃজনশীলতার সঙ্গে আবার তাদের সংস্কৃতির পৌত্তলিক উৎসে ফিরে যাবার অনুভুতি বোধ করেছে। অবশ্য এ তিনটি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও চমৎকারিত্ব সত্ত্বেও যাকে বলা হয়। রক্ষণশীল চেতনা অব্যাহত রয়ে গিয়েছিল। আল-ফারাবী ও ইবন-আল আবাবীর মতো পূর্ববর্তীকালের অতিন্দ্রীয়বাদী ও দার্শনিকরা যেখানে নতুন জগৎ আবিষ্কারের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, যেখানে এই পর্যায়ে প্রাচীন চিন্তা বা থিমেরই সূক্ষ্ম ও জটিল পুনরুত্থান ঘটতে দেখা গেছে। ফলে পশ্চিমাদের পক্ষে বিষয়টি বোঝা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ আমাদের পণ্ডিতগণ এসব আধুনিক ইসলামি প্রয়াসকে দীর্ঘদিন করে উপেক্ষা করে এসেছেন। এছাড়াও, দার্শনিক ও কবিগণ আশা করেন তাদের পাঠকদের মন অতীতের ইমেজ আর ধারণায় পরিপুর্ণ।

অবশ্য, পাশ্চাত্যের পরিবর্তনের সমান্তরাল অগ্রগতির নজীরও ছিল । সাফাভিয়দের অধীনে এক নতুন ধরনের দ্বাদশবাদী শিয়াবাদ ইরানের রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়েছিল; এর ফলে নজীরবিহীনভাবে শিয়াহ ও সুন্নীদের মাঝে সূচিত হয়েছিল বৈরিতার। এতদিন পর্যন্ত অধিকতর বুদ্ধিজীবী বা অতিন্দ্রীয়বাদী সুন্নীদের সঙ্গে শিয়াদের বহু ক্ষেত্রেই মিল ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে এরা দুটি বিবদমান শিবির গড়ে তোলে যার সঙ্গে একই সময়ে ইউরোপে সংঘটিত ধর্মীয় গোষ্ঠীগত সংঘাতের দুঃখজনক সাদৃশ্য রয়েছে। সাফাভিয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাহ ইসমাইল ১৫০৩ সালে আযেরবাইজানের ক্ষমতায় আরোহণ করেন এবং পশ্চিম ইরান ও ইরাকে ক্ষমতার বিস্তার ঘটান। সুন্নী মতবাদ উচ্ছেদ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি, অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে প্রজাদের ওপর শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন, যা আগে বিরল ছিল । নিজেকে প্রজন্মের ইমাম মনে করেছেন তিনি। এই আন্দোলনের সঙ্গে ইউরোপের প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের মিল ছিল: উভয়ের মূলে ছিল প্রতিবাদ, উভয়ই আভিজাত্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল এবং জড়িত ছিল রাজকীয় সরকার গঠনের সঙ্গে। শিয়ারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলসমূহ থেকে এমনভাবে সুফী ত্বরিকাসমূহের উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল যা প্রটেস্ট্যান্টদের মঠ বিলুপ্ত করার কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, এর ফলে অটোমান সাম্রাজ্যের সুন্নীদের মাঝেও এক নিরাপোস মনোভাব জেগে ওঠেছিল, যারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার শিয়াদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। ক্রুসেড়ে লিপ্ত পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে নিজেদের পবিত্র ধর্ম-যুদ্ধের একেবারে প্রথম কাতারে আবিস্কার করে অটোমানরা তাদের ক্রিশ্চান প্রজাদের বিরুদ্ধেও এক নতুন অসহিষ্ণু মনোভাব গড়ে তোলে। তবে গোটা ইরানি প্রশাসনকে ধর্মান্ধ বিবেচনা করা ভুল হবে। ইরানের শিয়াহ্ উলেমাগণ এই সংস্কৃত শিয়াদের তীর্যক দৃষ্টিতে দেখেছেন: সুন্নী প্রতিপক্ষের বিপরীতে তারা ইজতিহাদের পথ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ও শাহুদের নিকট থেকে স্বাধীনতাকে ইসলামকে ব্যাখ্যা করার অধিকারের ওপর জোর দিয়েছেন। তারা সাভাভিয় এবং পরে কাজার বংশকে ইমামদের উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার বদলে শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং ইস্পাহান এ পরে তেহরানে রাজকীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে উন্মাহর নেতায় পরিণত হয়েছেন। শাহৃদের অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বণিক সমাজ ও দরিদ্র জনসাধারণের অধিকার রক্ষার এক রেওয়াজ গড়ে তুলেছিলেন তারা যা তাঁদের ১৯৭৯ সালে শাহ মুহাম্মদ রেযা পাহলতীর বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করতে সক্ষম করে তুলেছিল।

ইরানের শিয়ারাও নিজস্ব ফালসাফাহ গড়ে তুলেছিল, যা সুহরাওয়ার্দির অতিন্দ্রীয়বাদী ধারা অব্যাহত রাখে। শিয়াহ্ ফালসাফাহর প্রতিষ্ঠাতা মির দামাদ (মৃত্যু, ১৬৩১) একাধারে বিজ্ঞানী ও ধর্মতাত্ত্বিক ছিলেন। ঐশী আলোকে তিনি মুহাম্মদ (স) এবং ইমামদের মতো প্রতীকী চরিত্রের আলোকনের সঙ্গে এক করে দেখেছেন। সুহরাওয়ার্দির মতো তিনিও ধর্মীয় অনুভূতির অবচেতন মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তবে এ ইরানি মতবাদের মূল রূপকার ছিলেন মির দামাদের শিষ্য সদর আলদিন রাযি, সাধারণভাবে যিনি মোল্লা সদরা (১৫৭১-১৬৪০) নামে পরিচিত। আজকের দিনে বহু মুসলিম তাকে সর্বমহান ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, তারা মনে করে, তিনি মুসলিম দর্শনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত মেটাফিজিক্স ও আধ্যাত্মিকতার সংশ্লেষ ঘটাতে পেরেছিলেন। অবশ্য পশ্চিমে সবে তিনি পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেছেন এবং এই গ্রন্থ রচনার সময় তাঁর মাত্র একটি নিবন্ধ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।

সুহরাওয়ার্দির মতো মোল্লা সদরাও বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞান কেবল তথ্য আহরণ নয় বরং পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া। সুহরাওয়ার্দির আলম আল মিথাল তার চিন্তাধারায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল: তিনি স্বয়ং স্বপ্ন ও দিব্য দর্শনকে সত্যের সর্বোচ্চ রূপ হিসাবে দেখেছেন। সুতরাং ইরানি শিয়াহবাদ তখনও সাধারণ বিজ্ঞান ও মেটাফিজিক্সের চেয়ে অতিন্দ্রীয়বাদকেই ঈশ্বরকে জানার সবচেয়ে জুৎসই উপায় হিসাবে দেখছিল। মোল্লা সদরা শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ বা ইমেটিশিও দেই (imitatio dei) দর্শনের লক্ষ্য এবং একে কোনও বিশেষ ক্ৰীড বা ধর্ম বিশ্বাসে সীমিত রাখা যাবে না। ইবন সিনা যেমন দেখিয়েছিলেন, কেবল পরম সত্তা ঈশ্বরেরই প্রকৃত অস্তিত্ব (উজুদ)। রয়েছে এবং এই একক সত্তাটি স্বর্গীয় জগৎ হতে শুরু করে বালু কণা পর্যন্ত সকল সত্তার গোটা ধারাবাহিকতাকে অনুপ্রাণিত করেন। মোল্লা সদরা সর্বেশ্বরবাদী ছিলেন না। তিনি স্রেফ ঈশ্বরকে অস্তিত্বমান সকল বস্তুর উৎস হিসেবে দেখেছেন: আমরা যেসব বস্তু বা সত্তা দেখি বা অনুভব করি সেগুলো সীমিত পরিসরে ঐশী আলোক বহনকারী মাত্র। তারপরেও ঈশ্বর পার্থিব বাস্তবতার ঊর্ধ্বে। সকল বস্তুর ঐক্য এটা বোঝায় না যে, কেবল ঈশ্বরেরই অস্তিত্ব রয়েছে বরং এর সঙ্গে সূর্য ও বিকিরিত রশ্মির ঐক্যর মিল রয়েছে। ইবন আল-আরাবীর মতো মোল্লা সদরা ঈশ্বরের সত্তা বা তাঁর ‘অন্ধত্বকে এর বিভিন্ন অভিব্যক্তি হতে আলাদাভাবে দেখেছেন। তাঁর দর্শনের সঙ্গে গ্রিক হেসিচ্যাস্ট কাব্বালিস্টদের ধ্যান-ধারণার খুব একটা অমিল নেই। গোটা সৃষ্টির জগতকে ‘অন্ধত্ব হতে বিকিরিত হয়ে বহু স্তর বিশিষ্ট একটা রত্ন’-এর গঠন হিসাবে দেখেছেন তিনি যাকে আবার ঈশ্বরের তার গুণাবলী বা ‘নিদর্শন সমূহের’ (আয়াত) মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের পর্যায়ক্রম হিসাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। এগুলো অস্তিত্বের উৎসে প্রত্যাবর্তনে মানুষের বিভিন্ন পর্যায়েরও প্রতিনিধিত্ব করে।

ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাপারটি পরকালের জন্যে সংরক্ষিত নয় । হেসিচ্যাস্টদের কারও কারও মতো মোল্লা সদরা বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানের মাধ্যমে ইহজগতেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব। বলাবাহুল্য, তিনি কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক যৌক্তিক জ্ঞানের কথা বোঝননিঃ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বরোহণের সময় অতিন্দ্রীয়বাদীকে দিব্যদর্শন ও কল্পনার জগৎ আলম আল-মিথাল-এর। ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ঈশ্বর বস্তুনিষ্ঠভাবে জানার মতো কোনও সত্তা নন, কিন্তু প্রত্যেক মুসলিমের কল্পনা-প্রবণ গুণের মাঝেই তাকে পাওয়া যাবে। কোরান বা হাদিস যখন স্বর্গ, নরক বা ঈশ্বরের আসনের কথা বলে, তখন এগুলো অন্যত্র অবস্থিত কোনও বাস্তবতার কথা বোঝায় না বরং বোধগম্য আড়ালে লুক্কায়িত এক অন্তর্জগতের কথা বোঝায়:

মানুষ যা কিছু কামনা করে, যা কিছু আশা করে, সঙ্গে সঙ্গে তা তার কাছে উপস্থিত হয় বা বলা উচিত তার ইচ্ছাকে রূপ দেওয়াই এর বস্তুর প্রকৃত উপস্থিতির অভিজ্ঞতা। কিন্তু মিষ্টতা ও আনন্দ হচ্ছে স্বর্গ ও নরক, শুভ ও অশুভ এর প্রকাশ, যা পরকালের জগতের শান্তিস্বরূপ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে, মানুষের অত্যাবশ্যকীয় ‘অমিত্ব’ ছাড়া যার আর কোনও উৎস নেই, যার গঠনের মূলে রয়েছে তার ইচ্ছা ও অভিক্ষেপ, অন্তর্গত বিশ্বাসসমূহ আর তার আচরণ।

ইবন আল-আরাবীকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন মোল্লা সদরা, তিনি তার মতো ঈশ্বরকে ভিন্ন এক জগতে অবস্থানরত বহিস্তঃ স্বর্গীয় সত্তা হিসাবে দেখেননি যার কাছে বিশ্বাসীরা মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তন করবে। নিজের মাঝেই ব্যক্তিগত আলম-আল মিথালে, স্বর্গ ও ঐশী জগতকে আবিষ্কার করতে হবে, যা প্রতিটি মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুজন ব্যক্তির স্বর্গ বা ঈশ্বর হুবহু এক রকম হবে না।

সুন্নী, সুফী ও গ্রিক দার্শনিকদের মতো শিয়াহ ইমামদেরও শ্রদ্ধাকারী মোল্লা সদরা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ইরানের শিয়া মতবাদ সবসময় বিশেষ ধরনের ও ধর্মান্ধ ছিল না। ভারতের বহু মুসলিম অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি অনুরূপ সহিষ্ণু মনোভাব গড়ে তুলেছিল। যদিও মুঘল ভারতে সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইসলামের প্রাধান্য ছিল, কিন্তু হিন্দুধর্মও গুরুত্বপুর্ণ ও সৃজনশীল রয়ে গিয়েছিল; মুসলিম ও হিন্দুদের কেউ কেউ শিল্পকলা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ বহুদিন আগে থেকেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা হতে মুক্ত ছিল। চতুর্দশ পঞ্চদশ শতাব্দীতে হিন্দু ধর্মমতের সর্বাধিক সৃজনশীল ধারা ধর্মীয় আশা আকাঙ্খার একতার ওপর জোর দিয়েছে: সকল পথই বৈধ, যদি একক ঈশ্বরের প্রতি প্রেমে গুরুত্ব দেয়। এর সঙ্গে সুফীবাদ ও ফালসাফাহ্র স্পষ্ট মিল রয়েছে যা ভারতে ইসলামের সবচেয়ে প্রাধান্য বিস্তারকারী ধরণ ছিল। মুসলিম ও হিন্দুদের কেউ কেউ আন্তঃধর্মীয় সমাজ গড়ে তুলেছিল। এগুলোর মাঝে পঞ্চদশ শতাব্দীতে গুরু নানক প্রতিষ্ঠিত শিখ ধর্মমত সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে। এ নতুন ধরনের একেশ্বরবাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ ও হিন্দুদের ঈশ্বর একই। মুসলিমদের দিক থেকে মির দামাদ এবং মোল্লা সদরার। সমসাময়িক ইরানি পণ্ডিত মির আবু আল-কাসিম ফিন্দিরিস্কি (মৃত্যু, ১৬৪১) ইস্পাহানে ইবন সিনার রচনাবলী শিক্ষা দান করলেও ভারতে হিন্দু ধর্মমত ও যোগ সাধনা নিয়ে গবেষণায় প্রচুর সময় ব্যয় করেছেন। এ সময় তোমাস আকুইনাসের ওপর কোনও বিশেষজ্ঞ রোমান ক্যাথলিকেরা আব্রাহামের ঐতিহ্য বহন করছে না এমন এক ধর্মের প্রতি একইরকম আগ্রহ দেখানোর কথা কল্পনা করাও কঠিন ছিল।

সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণকারী তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের ১৫৬০ থেকে ১৬০৫ পর্যন্ত রাজত্বকালে সহিষ্ণুতা ও সহযোগিতার এই চেতনা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে তার নীতিমালায় প্রকাশ পায়। হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতি থেকে তিনি নিরামিষভোজীতে পরিণত হন; শিকার ছেড়ে দেন-অথচ এই ক্রীড়াটি অত্যন্ত পছন্দের ছিল-তাঁর জন্মদিনে বা হিন্দুদের পবিত্র স্থানসমূহে পশু উৎসর্গ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৫৭৫ সালে একটি উপাসনা গৃহ স্থাপন করেছিলেন তিনি যেখানে সকল ধর্মমতের পণ্ডিতগণ ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনার জন্যে সমবেত হতে পারতেন। এখানে স্পষ্টতঃই ইউরোপ থেকে আগত জেসুইট মিশনারিরাই সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন। তিনি স্বর্গীয় একেশ্বরবাদের (তাওহীদ-ই-ইলাহি) প্রতি নিবেদিত নিজস্ব সুফী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা সঠিক পথে পরিচালিত যেকোনও ধর্মে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন এমন এক রেডিক্যাল বিশ্বাস ঘোষণা করেছিল। আবুল ফজল আল্লামি (১৫৫১-১৬০২)-এর আকবার নামাহয় (দ্য বুক অভ আকবর) আকবরের জীবনকে মহীয়ান করে তোলা হয়েছে, এই গ্রন্থটিতে সুফীবাদের নীতিমালাকে সভ্যতার ইতিহাস ব্যাখ্যায় প্রয়োগের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। আল্লামি আকবরকে ফালসাফাহর আদর্শ শাসক ও তাঁর সময়ের আদর্শ বা সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে দেখেছেন। আকবরের মতো কোনও শাসক যখন একটি উদার, মহৎ সমাজ গড়ে তোলেন, অসম্ভব করে তোলেন গোঁড়ামিকে, তখন সভ্যতা সর্বজনীন শান্তির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের ইসলামের যে মুল অর্থ সেটা যেকোনও ধর্মের মাধ্যমেই অর্জন করা যেতে পারে। তিনি তাঁর সময় ‘মুহাম্মদের (স) ধর্মের ঈশ্বরের ওপর একচেটিয়া অধিকার না থাকার দাবি করেছেন। অবশ্য সব মুসলিম আকবরের সঙ্গে একমত পোষণ করেনি; তাঁকে ধর্মের প্রতি হুমকি মনে করেছে। মুঘলরা যতদিন শক্তিশালী অবস্থানে ছিল ততদিনই কেবল তাঁর সহিষ্ণুতার নীতি স্থায়িত্ব পেয়েছে। ক্ষমতার অবনতি ঘটতে শুরু করলে মুঘল শাসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠী বিদ্রোহ ঘোষণা শুরু করে, ফলে মুসলিম, হিন্দু ও শিখদের মাঝে ধর্মীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে ওঠে। সম্রাট আওরেঙযেব (১৬১৮-১৭০৭) হয়তো ভেবেছিলেন মুসলিম শিবিরে অধিকতর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ঐক্য ফিরিয়ে আনা যাবে: তাই মদ্যপানের মতো বিভিন্ন শৈথিল্যের বিরুদ্ধে আইন জারি করেন তিনি, হিন্দুদের সাথে মেলামেশা অসম্ভব করে তোলেন, হিন্দুদের উৎসব অনুষ্ঠানের সংখ্যা হ্রাস করেন এবং হিন্দু-বণিকদের ওপর করের হার দ্বিগুণ করে দেন। তাঁর সম্প্রদায়িক নীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকাশ ছিল ব্যাপক হারে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস। আকবরের সহিষ্ণু নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত এই নীতিমালা আওরেঙযেবের মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত হয়, কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্য আর কখনওই তাঁর সৃষ্ট ধ্বংসাত্মক গোঁড়ামি ও ঈশ্বরের নামে পবিত্রকরণের হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

আকবরের জীবদ্দশায় তাঁর প্রবলতম প্রতিপক্ষ অসাধারণ পণ্ডিত শেখ আহমেদ শিরহিন্দি (১৫৬৪-১৬২৪) সুফী ছিলেন। শিষ্যরা তাঁকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে শ্রদ্ধা করত। শিরহিন্দি সরাসরি ইবন আল-আরাবীর অতিন্দ্রীয়বাদী ধারণার বিরোধিতা করেছেন। যার অনুসারীরা ঈশ্বরকেই একমাত্র সত্তা বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। আমরা যেমন দেখেছি, মোল্লা সদরা অস্তিত্বের একত্বের ওয়াহদাত আল উঁহুদ ধারণার কথা বলেছেন। এটা শাহাদার অতিন্দ্রীয়বাদী ঘোষণা: আল্লাহ ছাড়া আর কোনও সত্তা নেই। অন্যান্য ধর্মের অতিন্দ্রীয়বাদীদের মতো সুফীগণ এক একত্বের অনুভূতি লাভ করেছে এবং গোটা অস্তিত্বের সঙ্গে একত্ব বোধ করেছিল। কিন্তু শিরহিন্দি অগম্য এই ধারণাকে পুরোপুরি মনের কল্পনা বলে বাতিল করে দিয়েছেন। অতিন্দ্রীয়বাদী যখন কেবল ঈশ্বরের প্রতি মনোনিবেশ করে তখন অন্য সবকিছু তার চেতনা হতে সরে যেতে শুরু করে, কিন্তু এর সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ কোনও সত্তার মিল নেই। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর ও জগতের মাঝে কোনও রকম ঐক্য বা যোগাযোগের কথা বলতে যাওয়াটা সম্পূর্ণই মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণা। আসলে, ঈশ্বরের সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ করার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি পবিত্ৰজন, নাগালের বাইরে, আবার নাগালের বাইরে, আবার নাগালের বাইরে। প্রকৃতির ‘নিদর্শনসমূহ নিয়ে ধ্যানের পরোক্ষ উপায় ছাড়া জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের সরাসরি কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। শিরহিন্দি ইবন আল-আরাবীর মতো অতিন্দ্রীয়বাদীদের চেয়েও উচ্চতর এবং অধিকতর শান্ত চেতনা স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি দার্শনিকদের দূরবর্তী ঈশ্বরে বিশ্বাস পুনঃস্থাপিত করার জন্যে অতিন্দ্রীয়বাদ ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেছেন; যিনি বস্তুনিষ্ঠ কিন্তু অগম্য সত্তা। অনুসারীরা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা তা করেনি, তারা অতিন্দ্রীয়বাদীদের সর্বব্যাপী অন্তস্থঃ ঈশ্বরে বিশ্বাসী রয়ে গেছে ।

ফিন্দিরিস্কি ও আকবরের মতো মুসলিমরা যখন অপরাপর ধর্মের মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রয়াস পাচ্ছিলেন তখন, ১৪৯২ সালে, পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা দেখিয়ে দেয় যে, আব্রাহামের অপর দুটি ধর্মের নৈকট্য তাদের সহ্যের অতীত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে জুড়ে অ্যান্টি-সেমিটিজম বেড়ে ওঠে; ইহুদিদের একের পর এক শহর হতে বিতাড়িত করা হয়। ১৯২১ সালে লিন্য ও ভিয়েনা হতে, ১৪২৪ সালে (আবার ১৪৫০ সালেও) বাভারিয়া থেকে এবং ১৪৫৪ সালে মোরাভিয়া হতে, ১৪৮৫ সালে পেরুগিয়া, ১৪৮৬ ভিসেন, ১৪৮৮ সালে পরমা, ১৪৮৯ সালে লুক্কা ও মিলান এবং ১৪৯৪ সালে তোসকানি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। স্পেন হতে সেফার্দিক ইহুদিদের বিতাড়নের বিষয়টিকে অবশ্য বৃহত্তর ইউরোপিয় প্রবণতার প্রেক্ষিতে দেখতে হবে । অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী স্প্যানিশ ইহুদিরা বেঁচে থাকার জন্যে এক ধরনের অযৌক্তিক অথচ গভীর অপরাধবোধের পাশাপাশি স্থানচ্যুতির বোধে ভুগছিল। এটা সম্ভবত নাৎসি হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের অপরাধ বোধ হতে ভিন্ন কিছু নয়; সুতরাং বর্তমান যুগে কিছু সংখ্যক ইহুদি যে ষোড়শ শতাব্দীতে সেফার্দিক ইহুদিদের হাতে বিকাশিত আধ্যাত্মিকতায় আকৃষ্ট হচ্ছে সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। ইহুদিরা নির্বাসনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে এই আধ্যাত্মিকতার জন্ম দিয়েছিল।

কাব্বালিজমের এই নতুন ধরণ সম্ভবত অটোমান সাম্রাজ্যের বালকান অঞ্চলে সূচিত হয়েছিল, যেখানে বহু সেফার্দিম বসতি গড়ে তুলেছিল। ১৪৯২ সালের ট্র্যাজিডি যেন পয়গম্বরদের ভবিষ্যদ্বাণীর ইসরায়েলের নিস্কৃতির জন্যে ব্যাপক আকাক্ষার জন্ম দিয়েছিল। জোসেফ কারো ও সলোমন আলকাবা এর নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক ইহুদি প্রিস হতে ইসরায়েলের মাতৃভূমি প্যালেস্তাইনে অভিবাসী হয়। ইহুদি ও তাদের ঈশ্বরের ওপর চাপানো অপমান দূর করতে চেয়েছে তাদের আধ্যাত্মিকতা। তারা তাদের ভাষায় ‘ধুলি হতে আবার শেকিনাহর উত্থান চেয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধান কামনা করেনি কিংবা প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইহুদিদের ব্যাপক হারে প্রব্যার্তনও আশা করেনি। তারা গালিলির সাকেঁদে বসতি করে এমন উল্লেখযোগ্য এক অতিন্দ্রীয়বাদী পুনর্জাগরণের সৃষ্টি করে যা তাদের আবাসভূমিহীনতায় এক গভীর তাৎপর্য আবিষ্কার করেছিল। এতদিন পর্যন্ত কাব্বালাহার আবেদন ছিল কেবল অভিজাত শ্রেণীর কাছে, কিন্তু বিপর্যয়ের পর সারা দুনিয়ার ইহুদিরা আরও অধিকতর অতিন্দ্রীয় আধ্যাত্মিকতার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েছিল। এ সময় দর্শনের সান্ত্বনাকে যেন ফাঁকা মনে হয়েছে। অ্যারিস্টটলকে মনে হয়েছে বিরস ও তার ঈশ্বরকে দূরবর্তী, অগম্য। প্রকৃতপক্ষেই অনেকেই বিপর্যয়ের জন্যে ফালসাফাহকে দায়ী করে দাবি তোলে যে এর ফলে ইহুদিবাদ দুর্বল হয়ে পড়েছে ও ইসরায়েলের ভিন্ন মর্যাদাবোধ হাল্কা হয়েছে। এর বিশ্বজনীনতা ও জেন্টাইল দর্শনকে স্থান দেওয়ায় বহু ইহুদি ব্যাপ্টিজম গ্রহণ করেছিল। ফালসাফাহ আর কখনও ইহুদিবাদের পরিসীমায় গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিকতা হয়ে উঠতে পারেনি।

মানুষ আরও প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বরকে অনুভব করতে চেয়েছে। সাফেদে এই আকাক্ষা প্রায় অদম্য প্রাবল্য অর্জন করেছিল। কাব্বালিস্টরা প্যালেস্তাইনের পাহাড়-পর্বতে ঘুরে ঘুরে বিখ্যাত তালামুদিস্টদের কবরে শুয়ে নিজেদের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জীবনের তাদের দর্শন আত্মস্থ করার আকাঙ্ক্ষা করত। ব্যর্থ প্রেমিকের মতো নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে ঈশ্বরের নামে প্রেমের গান গাইত ও প্রিয় সব নামে তাঁকে ডাকত। তারা আবিষ্কার করে যে, মিথলজি ও কাব্বালাহর অনুশীলন তাদের বাধা ভেদ করে এমনভাবে আত্মার বেদনাস্থল ছুঁয়েছে যেটা মেটাফিজিক্স বা তালমুদ পাঠে সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু তাদের অবস্থা যেহেতু দ্য যোহারে রচয়িতা মোজেস অভ লিওনের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ছিল, সেজন্য স্প্যানিশ নির্বাসিতদের নিজেদের বিশেষ অবস্থার সঙ্গে সেই দর্শনকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। তারা এমন এক অসাধারণ রকম কল্পনানির্ভর সমাধানে পৌঁছেছিল যা পুরোপুরি উনুল অবস্থাকে পরম ঈশ্বরপূর্ণতার সঙ্গে এক করে দিয়েছে। ইহুদিদের নির্বাসন সকল অস্তিত্বের একবারে মূলে চরম স্থানচ্যুতিকে প্রতীকায়িত করে। কেবল গোটা সৃষ্টি জগৎ যে স্থানচ্যুত হয়েছে তাই নয়, স্বয়ং ঈশ্বরও নিজের কাছ থেকে নির্বাসিত হয়েছেন। সাফেদের নতুন কাব্বালাহ রাতারাতি জনপ্রিয়তা অর্জন করে এমন এক গণআন্দোলনের রূপ নেয় যা কেবল সেফামিদেরই অনুপ্রাণিত করেনি বরং ইউরোপের অ্যাশকানিজমের জগতে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল-যারা খৃস্টধর্ম জগতে তাদের কোনও স্থায়ী শহর না থাকার ব্যাপারটি আবিষ্কার করেছিল। এই অসাধারণ সাফল্য দেখায় যে, অচেনা ও বহিরাগতের চোখে বিসদৃশ সাফেদের মিথের ইহুদিদের অবস্থা তুলে ধরার ক্ষমতা ছিল। এটা ছিল সর্বজনগ্রাহ্য শেষ ইহুদি আন্দোলন যা বিশ্বের ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চেতনায় গভীর পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। কাব্বালাহর বিশেষ অনুশীলন কেবল একজন অভিজাত শিক্ষাব্রতীর জন্যে ছিল কিন্তু এর ধারণা ও ঈশ্বর সংক্রান্ত এর মতবাদ-ইহুদিদের ধর্মানুরাগের ক্ষেত্রে প্রমিত মানে পরিণত হয়েছিল।

ঈশ্বর সংক্রান্ত এই নতুন দর্শনের প্রতি সুবিচার করার জন্যে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে এইসব মিথকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার কথা বোঝানো হয়নি। সাফেদ কাব্বালিস্টরা তাদের ব্যবহৃত ইমেজারিগুলো অত্যন্ত বেপরোয়া হওয়ার বেলায় সজাগ ছিল, তাই এগুলোর সঙ্গে সবসময় যেমন বলা হয় বা যে কেউ ভাবতে পারে’ ধরনের অভিব্যক্তি জুড়ে দিয়েছে। কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে যেকোনও ধরনের আলোচনাই সমস্যাপূর্ণ, বিশ্ব সৃষ্টির বাইবেলিয় মতবাদও কম নয়। কাব্বালিস্টরাও ঠিক ফায়সালুফদের মতোই এক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল । উভয় দলই উৎসারণের প্লেটোনিক উপমা বেছে নিয়েছিল যেখানে মনে করা হয় যে, বিশ্বজগৎ চিরন্তনভাবে ঈশ্বরের নিকট হতে প্রবাহিত হচ্ছে। পয়গম্বরগণ ঈশ্বরের পবিত্রতা ও বিশ্বজগৎ হতে তার বিচ্ছিন্নতার ওপর জোর দিয়েছেন, কিন্তু দ্য যোহার মত প্রকাশ করেছে যে, ঈশ্বরের সেফিরদের জগৎ সমগ্র সত্তা দিয়ে সংগঠিত। তিনি সর্বেসর্বা হলে বিশ্বজগৎ হতে বিচ্ছিন্ন হবেন কী করে? সাফেদের মোজেস বেন জেকব কর্দাভেরো (১৫২২-১৫৭০) এই বৈপরীত্য স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে এর সমাধানের প্রয়াস পেয়েছেন। তার ধর্মতত্ত্ব অনুসারে ঈশ্বর এন সফ আর অগম্য গডহেড নন, বরং জগতের চিন্তা: আদর্শ প্লেটোনিক অবস্থানে তিনি সকল সৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে একীভূত; কিন্তু মর্ত্যের ত্রুটিপূর্ণ আকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন: যতক্ষণ অস্তিত্বমান সবকিছুই তার অস্তিত্বের মাঝে ততক্ষণ (ঈশ্বর) সকল অস্তিত্বকে আবৃত করেন, ব্যাখ্যা করেছেন তিনি, তাঁর সেফিরদে তাঁর সত্তা উপস্থিত আছেন; তিনি স্বয়ং সবকিছু এবং তার বাইরে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। ইবন আল-আরাবী ও মোল্লা সদরার মোনিজমের খুব কাছাকাছি ছিলেন তিনি।

কিন্তু সাফেদ কাব্বালিজমের নায়ক ও সন্ন্যাসী ইসাক লুরিয়া (১৫৩৪ ১৫৭২) ঐশী দুয়েতা ও সর্বব্যাপীতার বৈপরীত্বকে আরও পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তার ধারণা ঈশ্বর সম্পর্কিত সৃষ্ট মতবাদসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর। অধিকাংশ ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদী তাদের ঐশী অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নীরবতা পালন করেছে। এটা এই ধরনের আধ্যাত্মিকতার অন্যতম স্ববিরোধিতা যে অতিন্দ্রীয়বাদীরা তাদের অভিজ্ঞতা অনির্বচনীয় বলে কিন্তু তারপরেও সব লিপিবদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে। কাব্বালিস্টরা অবশ্য এ বিষয়ে সচেতন ছিল। লুরিয়া ছিলেন প্রথম যাদ্দাকিম বা পবিত্র পুরুষ যিনি ব্যক্তিগত ক্যারিশমার বদৌলতে অনুসারীদের দলে টানতে পেরেছিলেন। লেখক ছিলেন না তিনি; তার কাব্বালিস্ট পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে তাঁর অনুসারী হাঈম বাইতাল (১৫৪২-১৬২০) লিখিত কথোপকথন যা তাঁর নিবন্ধ এর হাইম (দ্য ট্রি অভ লাইফ) এবং যোজেফ ইবন তাকূল-এর পাণ্ডুলিপি, যা ১৯২১ সালের আগে প্রকাশিত হয়নি।

একেশ্বরবাদীদের শত শত বছর ধরে তাড়া করে আসা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন লুরিয়া: একজন পূর্ণাঙ্গ এবং অসীম ঈশ্বর কীভাবে অশুভে পরিপূর্ণ অপূর্ণাঙ্গ বিশ্ব সৃষ্টি করলেন? অশুভ এসেছে কোত্থেকে? সেফিরদের উৎসারণের পূর্ববর্তী ঘটনার মাঝে জবাব খুঁজে পেয়েছেন লুরিয়া, যখন এন সফ মহান অন্তর্মুখীনতায় নিজের দিকে মনোযোগি হয়েছিলেন। বিশ্বজগতের জন্যে স্থান তৈরি করতে, শিক্ষা দিয়েছেন লুরিয়া, এন সফ, বলা হয়, নিজের মাঝে খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেন। এই সংকোচন বা প্রত্যাহারে’র (তৃসিমতসুম) প্রক্রিয়ায় ঈশ্বর এমন একটা স্থান সৃষ্টি করেছিলেন যেখানে তিনি অনুপস্থিত, একটি শূন্যস্থান, যা তিনি আত্মপ্রকাশ ও সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় পূর্ণ করতে থাকেন। শূন্য হতে সৃষ্টির মতবাদ ব্যাখ্যার এক দুঃসাহসী প্রয়াস ছিল এটা। এন সফের সর্বপ্রথম কাজ ছিল আপন একটা অংশ হতে স্ব-আরোপিত নির্বাসন; তিনি, যেমন বলা হয়েছে, আপন সত্তায় আরও গভীরভাবে অবতরণ করে নিজের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছেন। এই ধারণাটি ক্রিশ্চানদের ট্রিনিটি মতবাদে কল্পনা করা আদিম কেনোসিসের চেয়ে ভিন্ন নয়, যেখানে ঈশ্বর নিজেকে আপন পুত্রের মাঝে শূন্য করে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর কাব্বালিস্টদের বেলায় প্রাথমিকভাবে তসিসুম নির্বাসনের প্রতীক ছিল, যা সকল সৃষ্ট অস্তিত্বের মূলে নিহিত এবং স্বয়ং এন সফ যার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।

ঈশ্বরের প্রত্যাহারের ফলে সৃষ্ট ‘শূন্য’ স্থানটিকে বৃত্ত হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে, যার চারদিকে রয়েছেন এন সফ। এটা জেনেসিসে বর্ণিত আকার বিহীন আবর্জনা তহু উ-বহু। তুসিসুম-এর সঙ্কোচনের আগে ঈশ্বরের বিভিন্ন ‘শক্তির’ সবগুলো (পরে যা সেফিরদে পরিণত হবে) সামঞ্জস্যতার সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। একটি অপরটি হতে আলাদা ছিল না। বিশেষ করে ঈশ্বরের হেসেদ (করুণা) ও দিন (কঠোর বিচার) নিখুঁত সামঞ্জস্যতার সঙ্গে ঈশ্বরের মাঝে অস্তিত্বমান ছিল। কিন্তু তুসিমতসুম প্রক্রিয়া চলার সময় এস সফ তার অন্যান্য গুণাবলী হতে দিনকে বিচ্ছিন্ন করে ছেড়ে আসা শূন্য স্থানে ঠেলে দেন। এভাবে সিমসুম কেবল আত্ম-শূন্যকারী প্রেমের ভঙ্গিমা নয়, বরং একে ঐশী পরিশুদ্ধতা হিসাবে দেখা যেতে পারে: ঈশ্বর তাঁর ক্রোধ বা বিচার (দ্য যোহার যাকে অশুভের মূল হিসাবে দেখেছে) আপন অন্তস্থঃ সত্তা হতে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন । সুতরাং তাঁর আদি কাজটি ছিল নিজের প্রতি দেখানো রূঢ়তা ও নিষ্ঠুরতা। হেসেদ ও ঈশ্বরের অন্যান্য গুণাবলী হতে দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এটা বিধ্বংসী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। কিন্তু এন সফ শূন্য স্থানটুকু পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করেননি। ঐশী আলোর একটা ‘ক্ষীণ রেখা’ এই বৃত্তকে ছেদ করে এমন একটা আকার গ্রহণ করেছিল যাকে দ্য যোহার আদম কাদমোন বা আদিম পুরুষ আখ্যায়িত করেছে।

এরপর সূচিত হয়েছে সেফিরদের উৎসারণ, যদিও তা দ্য যোহারে যেভাবে ঘটার কথা বলা হয়েছে সেভাবে ঘটেনি। লুরিয়া শিক্ষা দিয়েছেন যে, সেফিরদ গঠিত হয়েছিল আদম কাদমমানে: সর্বোচ্চ তিনটি সেফিরদ-কেদার (মুকুট), হোখমাহ (প্রজ্ঞা) ও বিনাহ (বুদ্ধিমত্তা)-যথাক্রমে তার নাক, কান এবং মুখ’ হতে বিকিরিত হয়েছে। কিন্তু এরপর ঘটে এক বিপর্যয়, লুরিয়া যাকে বলেছেন ‘পাত্রের ভাঙন’ (শেভিরাদ হা কেলিম)। সেফিরদসমূহকে আলাদা আবরণ বা পাত্রে রাখার প্রয়োজন ছিল, এগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্যে আবার যাতে আগের ঐক্যে ফিরে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। এইসব ‘পাত্র’ বা ‘পাইপ’ অবশ্যই ধাতব ছিল না, বরং এক ধরনের গাঢ় বা পুরু আলো যা সেফিরদ-এর খাঁটি আলোর ‘আবরণ’ (কেলিপত) হিসাবে কাজ করত। সর্বোচ্চ তিনটি সেফিরদ আদম কাদমোন হতে ঝিকরিত হওয়ার সময় সেগুলোর পাত্র ঠিকই কাজ করেছিল; কিন্তু পরবর্তী ছয়টি সেফিরদ তার চোখ থেকে বের হওয়ার সময় সেগুলোর ‘পাত্রগুলো ঐশী আলো ধরে রাখার মতো যথেষ্ট মজবুত ছিল না বলে দুমড়ে মুচড়ে যায়। পরিণামে আলো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। এর কিছু অংশ ঊর্ধ্বারোহণ করে গডহেডে ফিরে যায়, কিন্তু কিছু ঐশী বা স্বর্গীয় ‘ফুলিঙ্গ’ ফাঁকা আবর্জনায় পতিত হয়ে বিশৃঙ্খলায় আটকা পড়ে। এরপর আর কোনও কিছুই যথাস্থানে থাকেনি। বিপর্যয়ের ফলে এমনকি সর্বোচ্চ তিনটি সেফিরদও নিম্ন পর্যায়ের বলয়ে পতিত হয়েছিল। আদি সামঞ্জস্যতা বিঘ্নিত হয়েছিল এবং স্বর্গীয় ‘ফুলিঙ্গ’গুলো গডহেডের কাছ থেকে নির্বাসনে আকারবিহীন তহু উ-বহুর আবর্জনায় হারিয়ে গেছে।

এই অদ্ভুত মিথ এক আদিম স্থানচ্যুতির নসটিক মিথেরই স্মৃতিবাহী। এখানে গোটা সৃজনশীল প্রক্রিয়ার সংশ্লিষ্ট টানাপোড়েন বা টেনশন প্রকাশ পেয়েছে, যা জেনেসিসে বর্ণিত শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খল ঘটনার চেয়ে আজকের দিনে বিজ্ঞানীদের অনুমিত বিগ ব্যাং তত্ত্বের অনেক কাছাকাছি। গুপ্তস্থান হতে বেরিয়ে আসা এন সফের জন্যে সহজ ছিল নাঃ তিনি কেবল-যেমন বলা হয়-অনেকটা ট্রায়াল অ্যান্ড এরার প্রক্রিয়ায়ই এটা করতে পারতেন। তালমুদে র‍্যাবাইরা একই ধরনের ধারণা পোষণ করেন। তারা বলেছিলেন, ঈশ্বর এই বিশ্ব সৃষ্টি করার আগে অন্যান্য বিশ্ব সৃষ্টি ও ধ্বংস করেছেন। কিন্তু সব আশা তিরোহিত হয়ে যায়নি। কোনও কোনও কাব্বালিস্ট এই ‘ভাঙন’ (শেভিরাদ)কে জন্ম লাভ বা বীজের অঙ্কুরোদগমের সঙ্গে তুলনা করেছে। ধ্বংস ছিল নতুন সৃষ্টির পূর্বাভাস মাত্র। যদিও সমস্ত কিছু বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল, এন এফ তিন বা পুর্নগঠনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই আপাত বিশৃঙ্খলা হতে নতুন জীবন বের করে আনবেন।

বিপর্যয়ের পর এন সফ হতে আলোর এক নতুন ধারা বিচ্ছুরিত হয়ে আদম কাদমোনের কপাল কুঁড়ে বেরিয়ে আসে। এই সময় সেফিরদগুলো নতুন বিন্যাসে পুনগঠিত হয়। এগুলো আর ঈশ্বরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকেনি। প্রত্যেকটা আলাদা অবয়ব’-এ পরিণত হয় যেখানে ঈশ্বরের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়-যেমন বলা হয়-স্পষ্ট বৈশিষ্টসহ, অনেকটা ট্রিনিটির তিনটি পারসোনার মতোই। লুরিয়া দুয়ে ঈশ্বরের ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে জন্ম দেওয়ার প্রাচীন কাব্বালিস্ট ধারণাকে ব্যাখ্যা করার নতুন উপায় বের করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। তিন প্রক্রিয়ায় লুরিয়া মানুষের জন্ম ও বেড়ে ওঠাকে ঈশ্বরের একই রকম বিবর্তন বোঝাতে ধারণার প্রতীকী রূপ ব্যবহার করেছেন। ব্যাপারটা জটিল-চিত্রের মাধ্যমেই সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তিকুনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ঈশ্বর দশটি সেফিরদের নিচে বর্ণিত পর্যায়ক্রমে পাঁচটি ‘অবয়ব’-এ (পারযুফিম) পুনর্বিন্যাস করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন:

১. কেদার (মুকুট), সর্বোচ্চ সেফিরাহ, দ্য যোহার যাকে কিছু না বলেছে প্রথম Puruf–এ পরিণত হয়, নাম হয় ‘আরিক আনপিন: পূর্বপুরুষ। ২. হোখমাহ (প্রজ্ঞা) পরিণত হয় দ্বিতীয় পারযুফ-এ, নাম আব্বা: পিতা। ৩. বিনাহ (বুদ্ধিমত্তা) পরিণত হয় তৃতীয় পারযুফ-এ, নাম হয় ইমা: মা । ৪. দিন (বিচার); হেসেদ (করুণা); রাখামিম (সহানুভূতি); নেতসাখ (ধৈর্য); হোদ (আভিজাত্য); ইয়েসদ (ভিত্তি) সবগুলো পরিণত হয় চতুর্থ পারযুফ-এ; নাম হয় যায়ের আনপিন: অধৈর্য। তাঁর সঙ্গী হচ্ছে : ৫. শেষ সেফিরাহ যার নাম মালকুদ: রাজ্য কিংবা শেকিনাহ; এটা পরিণত হয় পঞ্চম পারযুফ-এ, নাম হয় নুকরাহ দে যায়ের: যায়েরের রমনী ।

যৌন প্রতাঁকের ব্যবহার সেফিরদের পুনঃএকত্রীকরণ তুলে ধরার এক দুঃসাহসী প্রয়াস, যা পাত্ৰসমূহ ভেঙে পড়ার সময়ের বেদনা উপশম করে আদি ছন্দ ফিরিয়ে আনবে। দুটি দম্পতি’ আব্বা ও ইমা, যায়ের ও নুকরাহ যিউওয়াগে বা সঙ্গমে লিপ্ত। নারী ও পুরুষের এই মিলন ঈশ্বরের মাঝেই পুনঃস্থাপিত শৃঙ্খলার প্রতীক বহন করে। কাব্বালিস্টরা বারবার একে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করার জন্যে পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছে। স্পষ্ট যৌক্তিক ভাষায় বর্ণনা। করা যাবে না এমন একটি একীভূত করার প্রক্রিয়ার আভাস দান ও ঈশ্বরের প্রবল পৌরুষ রূপকে নিরপেক্ষ করতে এই কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। অতিন্দ্রীয়বাদীরা মুক্তিকে যেভাবে দেখেছে সেখানে মেসায়াহর আগমনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর নির্ভরশীলতার কোনও ব্যাপার নেই, বরং ঈশ্বরকেই একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পাত্রসমূহের ভাঙনের ফলে যেসব স্বর্গীয় লিঙ্গ বিক্ষিপ্ত হয়ে বিশৃঙ্খলায় আটকা পড়ে গিয়েছিল সেগুলোর উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সাহায্যকারী হিসাবে পাবার জন্যে মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিলেন ঈশ্বর। কিন্তু স্বর্গোদ্যানে পাপ করছিলেন আদম। তা যদি তিনি না করতেন, আদি শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপিত হতো এবং প্রথম সাব্বাথে স্বর্গীয় নির্বাসন শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আদমের পতন পাত্রসমূহের ভাঙনে আদিম বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সৃষ্ট শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং তার আত্মার স্বর্গীয় আলো বাইরে ছড়িয়ে পড়ে ভাঙা বস্তুসমূহে আটকা পড়ে। পরিণামে, আরেকটা পরিকল্পনা সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। সার্বভৌমত্ব ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষার সংগ্রামে সাহায্য করার জন্যে ইসরায়েলকে বেছে নিয়েছেন তিনি। যদিও ইসরায়েল সেই স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গসমূহের মতো ডায়াসপোরার নিষ্ঠুর ও ঈশ্বরবিহীন অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে, কিন্তু ইহুদিদের এক বিশেষ মিশন রয়েছে। ঐশী স্ফুলিঙ্গ যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বস্তুতে মিশে থাকবে ততক্ষণ ঈশ্বর অসম্পূর্ণ রয়ে যাবেন। তোরাহর সযত্ন অনুসরণ ও প্রার্থনার অনুশীলনের ভেতর দিয়ে প্রত্যেক ইহুদি স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গকে ঐশী উৎসে পুনঃস্থাপনে সাহায্য করে জগতকে উদ্ধার করতে পারে। মুক্তির এই দর্শনে ঈশ্বর মানুষের দিকে তাকিয়ে নেই, বরং ইহুদিরা সবসময় যেটা বলে এসেছে, তিনি বরং মানবজাতির ওপর নির্ভরশীল। ঈশ্বরকে পুনঃআকৃতি দান ও তাকে নতুন করে সৃষ্টির অনন্য সুযোগ রয়েছে। ইহুদিদের ।

সুরিয়া শেকিনাহর নির্বাসনের আদি ইমেজের নতুন অর্থ দিয়েছেন। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, র‍্যাবাইগণ তালমুদে মন্দির ধ্বংসের পর শেকিনাহর স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যাবার কথা বলেছেন। দ্য যোহার শেকিনাহকে সর্বশেষ সেফিরাহ আখ্যায়িত করে একে ঐশী সত্তার নারী রূপ হিসাবে দেখেছে। লুরিয়ার মিথে পাত্র ধ্বংস হওয়ার পর অন্যান্য সেফিরাহ্র সঙ্গে শেকিনারও পতন ঘটেছে। তিকুনের প্রথম পর্যায়ে সে নুকরাহয় পরিণত হয় এবং যায়েরের সঙ্গে মিলনের মাধ্যমে (ষষ্ঠ ‘মধ্য সেফিরদ) স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে প্রায় পুনঃর্মিলিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আদম যখন পাপ করলেন, আবার পতন ঘটল শেকিনাহর এবং গড়হেডের বাকি অংশ হতে নির্বাসিত হলো। প্রায় অনুরূপ এক ক্রিশ্চান মিথলজির জন্ম দেওয়া নসটিক রচনাবলী লুরিয়া পড়েছেন, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নির্বাসন ও পতনের মিথ পুনকথন করেছেন তিনি, ষোড়শ শতাব্দীর করুণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চেয়েছেন। বাইবেলিয় সময়কালে ইহুদিরা একক ঈশ্বরের মতবাদের বিকাশ ঘটানোর সময় স্বর্গীয় মিলন ও নির্বাসিত দেবীদের কাহিনী প্রত্যাখ্যান করেছিল। পৌত্তলিকতা ও বহুঈশ্বরবাদীতার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ যুক্তিসঙ্গতভাবেই সেফার্দিদের বিক্ষুদ্ধ করে তোলার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে লুরিয়ার মিথ পারসিয়া থেকে ইংল্যান্ড, জার্মানি থেকে পোল্যান্ড, ইতালি থেকে উত্তর আফ্রিকা, হল্যান্ড থেকে ইয়েমেনের ইহুদিরা আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। ইহুদি পরিভাষায় বর্ণিত হওয়ায় এটা একটা সুপ্ত তারে টোকা দিতে সক্ষম হয়, প্রবল হতাশার মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে। এটা ইহুদিদের মাঝে এই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল যে, তাদের অনেকেই ভীতিকর অবস্থায় বাস করা সত্ত্বেও এর একটা পরম অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে।

ইহুদিরা শেকিনাহর নির্বাসনের অবসান ঘটাতে পারে। মিতাভোতের অনুসরণের মাধ্যমে আবার তারা তাদের ঈশ্বরকে গড়ে তুলতে পারবে। প্রায় একই সময়ে ইউরোপে লুথার ও কালভিনের গড়ে তোলা প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে এই মিথের মিল লক্ষণীয়। উভয় প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকই ঈশ্বরের পরম সার্বভৌমত্বের প্রচার করেছেন তাঁদের ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী নিজেদের মুক্তির ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের কিছুই করার নেই। অবশ্য লুরিয়া কর্মের এক মতবাদ প্রচার করেছেন: ঈশ্বরের মানবজাতির বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে এবং তাদের প্রার্থনা ও সঙ্কর্ম ছাড়া তিনি এক অর্থে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবেন। ইউরোপে ইহুদি জাতির ওপর নেমে আসা ট্র্যাজিডি সত্ত্বেও প্রটেস্ট্যান্টদের তুলনায় মানুষ সম্পর্কে অনেক বেশি আশাবাদী হতে পেরেছিল তারা। লুরিয়া তিকুনের মিশনকে ধ্যানের বিষয় হিসাবে দেখেছেন। ইউরোপের ক্রিশ্চানরা যেখানে-ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট উভয়ই-আরও বেশি মাত্রায় ডগমা প্রণয়ন করছিল, লুরিয়া সেখানে ইহুদিদের এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের ঊর্ধ্বে ওঠা, ও অধিকতর মনোগত সচেতনতা সৃষ্টিতে সাহায্য করতে আব্রাহাম আবুলাফিয়ার অতিন্দ্রীয়বাদী কৌশল পুনরুজ্জীবিত করেন। আবুলাফিয়ার আধ্যাত্মিকতা স্বর্গীয় নাম পুনর্বিন্যাস করে কাব্বালিস্টকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, ঈশ্বরের অর্থ মানবীয় ভাষায় যথাযথভাবে তুলে ধরা যাবে না। লুরিয়ার মিথলজিতে ঐশী সত্তর পুনর্গঠন ও পুনঃআকৃতিধারণকেও প্রতীকায়িত করা হয়েছে। হাঈম বাইতাল লুরিয়ার অনুশীলনের প্রগাঢ় আবেগজাত প্রভাব বর্ণনা করেছেন, নিজেকে দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনাচার হতে বিচ্ছিন্ন করে–অন্যরা যখন ঘুমে মগ্ন-তখন সজাগ থেকে, অন্যদের খাবার সময় উপাস থেকে, কিছু সময়ের জন্যে নিজেকে আলাদা করে-কাব্বালিস্ট স্বাভাবিক ভাষার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিচিত্র বা অদ্ভুত শব্দসমূহের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারত। নিজেকে অন্য জগতে আছে বলে মনে হয় তার, এমনভাবে সে কাঁপতে থাকে যেন বাইরের কোনও শক্তি তার ওপর ভর করেছে।

কিন্তু এখানে উদ্বেগের কোনও ব্যাপার ছিল না। লুরিয়া জোর দিয়ে বলেছেন, আধ্যাত্মিক অনুশীলন শুরু করার আগে কাব্বালিস্টকে অবশ্যই চিত্তের স্থিরতা অর্জন করতে হবে। সুখানুভূতি ও আনন্দ জরুরি; বুক চাপড়ানো বা বিষাদের কোনও ব্যাপার থাকতে পারবে না; কাজের ব্যাপারে কেউ উকণ্ঠা বা অনুতাপ বোধ করতে পারত না। বাইতাল জোর দিয়ে বলেছেন যে দুঃখ ও বেদনায় শেকিনাহ থাকতে পারে না-আমরা দেখেছি, এই ধারণা তালমুদে গভীরভাবে প্রোথিত। দুঃখবোধ আসে জগতের অশুভ শক্তি থেকে, অন্যদিকে সুখ কাব্বালিস্টকে ঈশ্বরকে ভালোবাসায় সক্ষম করে, তার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। কারও প্রতি-এমনকি গোয়িমদের প্রতিও না-কাব্বালিস্টের মনে কোনও রকম ক্রোধ বা আক্রমণাত্মক অনুভূতি থাকতে পারবে না। লুরিয়া ক্রোধ বা রাগকে বহুঈশ্বরবাদীতা হিসাবে দেখেছেন, কেননা ক্রুদ্ধ মানুষ অদ্ভুত দেবতা’য় আচ্ছন্ন থাকে। লুরিয়ার অতিন্দ্রীয়বাদের সমালোচনা করা সহজ। গারশ শোলেম যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন, ঈশ্বর এন সফের রহস্য দ্য যোহারে খুব জোরাল হলেও সিমন্সুম, পাত্রের ভাঙন ও তিন এর নাটকীয়তায় যেন শিথিল হয়ে আসে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব, এটা ইহুদিদের ইতিহাসে এক ধংসাত্মক ও বিব্রতকর পর্বের সূচনা করেছিল। তা সত্ত্বেও ঈশ্বর সম্পর্কে লুরিয়ার ধারণা এমন একটা সময়ে ইহুদিদের মাঝে আনন্দ ও দয়ার চেতনা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল ও সেইসাথে মানুষ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণে উৎসাহ জুগিয়েছে যখন অপরাধবোধ ও ক্রোধের ফলে বহু। ইহুদি হতাশায় ডুবে জীবনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় ছিল ।

ইউরোপের ক্রিশ্চানরা এ রকম ইতিবাচক আধ্যাত্মিকতার জন্ম দিতে পারেনি। তারাও ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল যা স্কলাস্টিক্সদের দার্শনিক ধর্মে প্রশমিত হওয়া সম্ভব ছিল না। ১৩৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথ, ১৪৫৩ সালে কন্সতান্তিনোপলের পতন, আভিগনন ক্যাপটিভিটির গির্জা সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি (১৩৩৪-৪২) ও চরম বিবাদ (১৩৭৮-১৪১৭) মানবীয় অবস্থার অক্ষমতাকে স্পষ্ট করে দিয়েছিল, বদনাম বয়ে এনেছিল চার্চের। ঈশ্বরের সহায়তা ছাড়া মানুষের পক্ষে যেন তখন ভীতিকর বিপদ হতে নিস্তার লাভ অসম্ভব ঠেকেছে। তো, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে অক্সফোর্ডের দানস স্কটাস (১২৬৫-১৩০৮)-দানস স্কটাস এরিজেনার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না–ও ফরাসি ধর্মাতাত্ত্বিক জা দে গরসন (১৩৬৩-১৪২৯)-এর মতো ধর্মতাত্ত্বিকদের উভয়ই ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের ওপর জোর দিয়েছেন, যিনি চরম শাসকের মতোই মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করেন। নারী ও পুরুষের পক্ষে মুক্তি লাভের ক্ষেত্রে কিছুই করণীয় নেই; ভালো কাজের নিজস্ব কোনও মূল্য নেই, ঈশ্বর প্রসন্ন হয়ে এগুলোকে ভালো বলেছেন বলেই ভালো। তবে এই দুই শতকে গুরুত্বের পরিবর্তন ঘটেছিল। গারসন স্বয়ং অতিন্দ্রীয়বাদী ছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বরের প্রকৃতি বোঝার জন্যে সত্য ধর্মের ওপর ভিত্তি করে যুক্তি দিয়ে খোঁজার চেয়ে উচ্চাভিলাষী অনুসন্ধান ছাড়াই ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা বজায় রাখাই শ্রেয়তর। আমরা যেমন দেখেছি, চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপে অতিন্দ্রীয়বাদের একটা জোয়ার দেখা দিয়েছিল, মানুষও বুঝতে শুরু করেছিল যে, যে রহস্যকে তারা ‘ঈশ্বর’ ডাকে তাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে যুক্তি যথেষ্ট নয়। টমাস আ কেম্পিস তাঁর দ্য ইমিটেশন অভ ক্রাইস্ট–এ যেমন বলেছেন:

যদি তোমার মাঝে বিনয় না থাকে, সে কারণে ট্রিনিটিকে রুষ্ট কর, তাহলে ট্রিনিটি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মূল্য কী…একে সংজ্ঞায়িত করতে পারার চেয়ে বরং অনেক বেশি মর্মপীড়া রোধ করব আমি। গোটা বাইবেল যদি তোমার মুখস্থ থাকে, সমস্ত দার্শনিকের সকল শিক্ষা জানা যাকে, ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও ভালোবাসা ছাড়া এসব তোমার কী কাজে আসবে?

দ্য ইমিটেশন অভ ক্রাইস্ট রুক্ষ অস্পষ্ট ধার্মিকতা নিয়েই পাশ্চাত্যে সকল আধ্যাত্মিক ক্লাসিকের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই শতাব্দীগুলোয় ধার্মিকতা বর্ধিত হারে মানুষ জেসাসের ওপর কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ক্রসের অবস্থান তৈরি জেসাসের শারীরিক কষ্ট ও বেদনার বিস্তারিত প্রকাশ নিয়ে কাজ করেছে। চতুর্দশ শতাব্দীর এক অজ্ঞাতনামা লেখকের মেডিটেশন আমাদের বলছে, লাস্ট সাপার ও অ্যাগনি ইন গার্ডেনের ওপর রাতের বেশির ভাগ সময় ধ্যান করে সকালে জেগে উঠেও তার চোখজোড়া কান্নার কারণে তখনও লাল হয়ে থাকা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধ্যানের মধ্য দিয়ে ক্যালভেরির দিকে জেসাসের এগিয়ে যাওয়া অনুসরণ করতে হবে ঘন্টায় ঘন্টায়। কর্তৃপক্ষের কাছে জেসাসের প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার কথা কল্পনা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে পাঠককে, কারাগারে তার পাশে বসে তার হাতকড়া ও শিকলে বাঁধা পায়ে চুমু খেতে বলা হয়েছে। আনন্দ বর্জিত এই অনুশীলনে পুনরুত্থানের ওপর সামান্যই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; বরং তার বদলে জেসাসের মানবরূপের অসহায়ত্বের উপরই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। প্রবল আবেগ ও আধুনিক পাঠকের কাছে বিকৃত কৌতূহল বলে মনে হওয়া একটা ব্যাপার অধিকাংশ রচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি বিখ্যাত অতিন্দ্রীয়বাদী সুইডেনের ব্রিজিত কিংবা নরউইচের জুলিয়ানও জেসাসের শারীরিক অবস্থার ভয়ঙ্কর বিবরণ দিয়েছেন:

তাঁর প্রিয় মুখ আমি দেখেছি, শুষ্ক, রক্তশূন্য, মড়ার মতো ফ্যাকাশে। আরও মলিন, মৃতবৎ, প্রাণহীন হয়ে উঠল। তারপর মূত, নীল বর্ণ ধারণ করল, আস্তে আস্তে বাদামী নীল হয়ে এল, ক্রমশ নীল হয়ে আসছিল মাংস। আমার জন্যে তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট চেহারার মাঝে আবেগের ছাপ দেখা যাচ্ছিল, বিশেষ করে তার ঠোঁটে। সেখানেও সেই চার রঙ দেখেছি আমি, যদিও আগে যখন দেখেছিলাম তখন তরতাজা, লাল ও চমৎকার ছিল। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করাটা ছিল খুবই দুঃখজনক। আমার চোখের সামনেই তার নাক কাঁপতে কাঁপতে শুকিয়ে গেল আর মৃত্যুর ছোঁয়ায় শুকিয়ে তার প্রিয় দেহ হয়ে গেল কালো ও বাদামী।

এই বিবরণ আমাদের জার্মান কুসিফিক্সের কথা মনে করিয়ে দেয়। চতুর্দশ শতাব্দীর সেই ভীতিকর পাঁকানো রক্তাক্ত দেহ ভেসে ওঠে চোখের সামনে, যা অবশ্যই ম্যাথিয়াস নওয়াল্ডের (১৪৮০-১৫২৮) রচনায় ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছিল। ঈশ্বরের রূপ সম্পর্কে জুলিয়ান অসাধারণ অন্তদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন: প্রকৃত অতিন্দ্রীয়বাদীর মতো ট্রিনিটিকে বরং আত্মার মাঝে জীবন্ত হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মানুষ ক্রাইস্টের প্রতি পশ্চিমের মনোযোগ এত জোরাল ছিল যে তা ঠেকানো যায়নি। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপের নারী-পুরুষ ক্রমবর্ধমান হারে ঈশ্বরের তুলনায় অন্যান্য মানুষকে তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রে স্থাপন করেছিল । মানুষ জেসাসের পাশাপাশি মেরি ও সাধুদের মধ্যযুগীয় কাল্ট মতবাদের প্রসার ঘটেছিল। প্রাচীন বস্তু ও পবিত্র স্থানসমূহের প্রতি প্রবল আগ্রহ পশ্চিমা ক্রিশ্চনদের একটা প্রয়োজনীয় জিনিস হতে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল: মানুষ যেন ঈশ্বর ছাড়া আর সবকিছুর দিকেই মনোনিবেশ করছিল।

এমনকি রেনেসাঁর সময়ও পাশ্চাত্য চেতনার অন্ধকার দিক প্রকাশ পেয়েছে। রেনেসাঁ যুগের দার্শনিক ও মানবতাবাদীরা মধ্যযুগীয় অধিকাংশ ধর্মানুরাগের ব্যাপারে তীব্র সমালোচনামুখর ছিল । স্কলাস্টিক্সদের গভীরভাবে অপছন্দ করত তারা, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের অনুমান বা ভাবনা ঈশ্বরকে অচেনা ও একঘেয়ে করে তুলেছে বলে মনে হয়েছে তাদের। এর বদলে ধর্ম বিশ্বাসের উৎস, বিশেষ করে সেইন্ট অগাস্তিনের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছেন। মধ্যযুগীয়রা অগাস্তিনকে ধর্মতাত্ত্বিক হিসাবে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু মানবতাবাদীরা কনফেশন পুনরাবিষ্কার করে এবং তাকে ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে রত একজন সতীর্থ মনে করেছে। খৃস্ট ধর্মমত, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, একগুচ্ছ মতবাদ নয়, বরং একটা অনুভূতি। লরেনযো ফাল্লা (১৪০৭-৫৭) যুক্তির কৌশল ও ‘মেটাফিজিক্সের দ্ব্যার্থবোধক কথাবার্তা পবিত্র ডগমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার অসারতার ওপর জোর দিয়েছেন। সেইন্ট পলও এইসব ‘অসারতার নিন্দা জানিয়েছিলেন। ফ্রান্সেসকো পোচ (১৩০৪-৭৪) মত প্রকাশ করেছিলেন যে, ‘ধর্মতত্ত্ব আসলে কাব্য, ঈশ্বর সংক্রান্ত কাব্য,’ এটা কোনও কিছু প্রমাণ করে বলে নয় বরং তা হৃদয়কে ভেদ করে বলে কার্যকর। মানবতাবাদীরা মানুষের মর্যাদা পুনরাবিষ্কার করেছে, কিন্তু সেটা ঈশ্বরকে ত্যাগ করার কারণ হয়নি। তার বদলে, সে যুগের প্রকৃত মানুষের মতো তারা মানুষে রূপান্তরিত ঈশ্বরের মানবতার ওপর জোর দিয়েছে, কিন্তু পুরোনো নিরাপত্তাহীনতা রয়ে গিয়েছে, রেনেসাঁ ব্যক্তিত্বগণ মানুষের জ্ঞানের নাজুকতার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, আবার অগাস্তিনের প্রকট পাপবোধের সঙ্গেও সমব্যাথী ছিলেন তাঁরা। পেত্রাচ যেমন বলেছেন:

কতবার নিজের দুঃখ দুর্দশা আর মরণ নিয়ে ভেবেছি আমি; অশ্রুর বানে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছি আমার সকল দাগ যাতে না কেঁদে এনিয়ে কথা বলতে পারি, কিন্তু তারপরেও এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছি। ঈশ্বর প্রকৃতই মহান: আর আমি নগণ্য।

সুতরাং মানুষ ও ঈশ্বরের মাঝে বিরাট দুরত্ব রয়ে গিয়েছিল: কলোচ্চিয়ো স্যালুতাতি (১৩৩১-১৪০৬) এবং লেনার্দো ব্রুতিন (১৩৬৯-১৪৪৪) দুজনই পুরোপুরি মানব মনের ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে দুয়ে ও অগম্য হিসাবে দেখেছেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও জার্মান দার্শনিক ও চাচম্যান নিকোলাস অভ কুসা (১৪০১-৬৪) ঈশ্বরকে বোঝার ব্যাপারে আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। নতুন বিজ্ঞান সম্পর্কে দারুণ রকম আগ্রহী ছিলেন তিনি, ভেবেছিলেন এর ফলে ট্রিনিটি রহস্য অনুধাবন সহজ হয়ে উঠবে। উদাহরণ স্বরূপ, গণিত একেবারেই বিমূর্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, সুতরাং অন্যান্য বিদ্যায় যেটা অসম্ভব তেমন বিষয়ে এর পক্ষে একটা নিশ্চয়তা দান করা সম্ভব। এভাবে গণিতের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন ধারণা দুটি আপাত বিপরীতমুখী মনে হলেও আসলে এগুলোকে যৌক্তিকতার প্রেক্ষিতে একই রকম বিবেচনা করা যেতে পারে। এই বিপরীতের সহাবস্থান’ ঈশ্বরের ধারণা ধারণ করে: ‘সর্বোচ্চ’র ধারণা সবকিছুকে অন্তর্ভূক্ত করে; এখানে একত্ব ও প্রয়োজনের ধারণা প্রকাশ পায় যা সরাসরি ঈশ্বরের দিকে ইঙ্গিত করে। আবার, সর্বোচ্চ রেখা কোনও ত্রিভূজ, বৃত্ত বা বলয় নয়, বরং তিনটির সমন্বয়; বিপরীতের ঐক্যও একটা ট্রিনিটি। তারপরেও নিকোলাসের বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনার ধর্মীয় অর্থ ছিল সামান্যই। এ যেন ঈশ্বরকে যুক্তির ধারায় নামিয়ে আনা । কিন্তু তাঁর বিশ্বাস, ঈশ্বর সবকিছুকে আলিঙ্গন করেন, এমনকি স্ববিরোধিতাকেও১৪ গ্রিক অর্থডক্স ধারণা-সকল সত্যি ধর্মতত্ত্ব প্যারাডিক্সিক্যাল হতে বাধ্য-এর খুব কাছাকাছি। দার্শনিক বা গণিতজ্ঞের বদলে শিক্ষক হিসাবে লেখার সময় নিকোলাস ঈশ্বরমুখী হওয়ার জন্যে ‘ক্রিশ্চানের সবকিছু পেছনে ফেলে যাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, এমনকি তাকে নিজের বুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে, যেতে হবে সকল বোধ আর যুক্তির বাইরে । ঈশ্বরের মুখায়ব ‘এক গোপন ও অতিন্দ্রীয় নৈঃশব্দ্যে আবৃত্ত রয়ে যাবে।

রেনেসাঁর নতুন দর্শন ঈশ্বরের মতো যুক্তির নাগালের বাইরে অবস্থানকারী গভীর ভয় বা শঙ্কার মোকাবিলা করতে পারেনি। নিকোলাসের মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যে তাঁর স্বদেশ জার্মানিতে এক বিশেষ ক্ষতিকর আতঙ্ক দেখা দেয় এবং সমগ্র উত্তর ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৪ সালে পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট দ্য বুল সুম্মা দে সিদারেন্তস প্রকাশ করেন যা এক প্রবল উন্মাদনা সূচিত করেছিল। এটি বিক্ষিপ্তভাবে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক উভয় সম্প্রদায়কে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পাশ্চাত্যের অন্ধকার চেতনা উন্মোচিত করেছে এটা। এই ভয়ঙ্কর নিপীড়নের কালে হাজার হাজার নারী-পুরুষের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে তাদের ভয়ঙ্কর সব অপরাধের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা স্বীকার করে নেয় যে, শয়তানের সঙ্গে যৌন মিলনে অংশ নিয়েছে তারা, আকাশ পথে হাজার মাইল দূরে উড়ে গিয়ে অশ্লীল সমাবেশে যোগ দিয়েছে যেখানে ঈশ্বরের বদলে ইবলিশের উপাসনা করা হয়। এখন আমরা জানি, ডাইনী বলে কিছু ছিল না, ঐ উন্মাদনা এক সম্মিলিত ফ্যান্টাসির প্রতিনিধিত্ব করেছে, যেখানে শিক্ষিত ইনকুইজিটরস ও তাঁদের বহু শিকার অংশ নিয়েছিল । এরা এসব স্বপ্ন দেখেছে ও সত্যিই এসব ঘটেছে বলে সহজেই বিশ্বাস করেছে। এই ফ্যান্টাসির সঙ্গে অ্যান্টি সেমিটিজম ও গভীর যৌন-আতঙ্কের যোগসূত্র ছিল। স্যাটান বা ইবলিশ এক অসম্ভব ভালো ও ক্ষমতাধর ঈশ্বরের ছায়া হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল । ঈশ্বরের অন্যান্য ধর্মে এমনটি ঘটেনি। উদাহরণ স্বরূপ, কোরানে স্পষ্ট বলা আছে, শেষ বিচারের দিনে স্যাটানকে (শয়তান) মার্জনা করা হবে। কোনও কোনও সুফী দাবি করেছে যে অন্যান্য দেবদূতের চেয়ে ঈশ্বরকে বেশি ভালোবাসার কারণেই সে করুণা হতে বঞ্চিত হয়েছে। সৃষ্টির পর আদমের সামনে আল্লাহ্ নতজানু হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে, কিন্তু অস্বীকৃতি জানিয়েছিল শয়তান, কারণ তার বিশ্বাস ছিল, কেবল আল্লাহ’র প্রতিই এরকম আনুগত্য দেখানো যেতে পারে। কিন্তু পশ্চিমে স্যাটান নিয়ন্ত্রণের অতীত এক অশুভ চরিত্রে পরিণত হয়েছে। বর্ধিত হারে তাকে সীমাহীন যৌনক্ষুধা ও অস্বাভাবিক বড় যৌনাঙ্গ বিশিষ্ট বিশাল জানোয়ার হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল। নরমান কন তাঁর ইউরোপ’স ইনার ডিমনস গ্রন্থে যেমন বলেছেন, স্যাটানের এই প্রতিকৃতি কেবল এক সুপ্ত আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার প্রকাশ ছিল না; এই ডাইনী-উন্মাদনা এক নিপীড়ক ধর্ম এবং আপাত অপ্রতিরোধ্য ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অবচেতন অথচ অনিবার্য বিদ্রোহের প্রতিনিধিত্ব করেছে। টর্চার চেম্বারে ইনকুইজিটর ও ‘ডাইনীরা মিলে এমন এক ফ্যান্টাসির জন্ম দিয়েছে যা খৃস্টধর্মের উল্টোচিত্র। ব্ল্যাক মাস এক ভীতিকর অথচ বিকৃতভাবে সন্তোষ জাগানো অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল যেখানে ঈশ্বরের বদলে শয়তানের উপাসনা চলত, ঈশ্বরকে কর্কশ ও বড় বেশি ভীতিকর মনে হতো।

মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) উইচক্র্যাফটে প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ক্রিশ্চানের জীবনকে স্যাটানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসাবে দেখেছেন। সংস্কারকে এই উৎকণ্ঠার মোকাবিলার প্রয়াস হিসাবে দেখা যেতে পারে; যদিও অধিকাংশ সংস্কারবাদী ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন কোনও ধারণা বা মতবাদ হাজির করেনি। মোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে ঘটে যাওয়া ধর্মীয় পরিবর্তনের বিরাট চক্রকে ‘সংষ্কার হিসাবে আখ্যায়িত করা অবশ্যই সরলীকরণ হয়ে পড়ে। শব্দটি যা ঘটেছে তার চেয়ে আরও সুচিন্তিত ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বোঝায়। বিভিন্ন সংস্কারক-ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যাট উভয়ই-এক নতুন ধর্মীয় সচেতনাকে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছিলেন যা প্রবলভাবে অনুভূত হলেও ধারণাগত রূপ বা সচেতনভাবে চিন্তা করা হয়নি। ঠিক কেন ‘সংস্কার ঘটেছিল আমরা জানি না। আজকের দিনে পণ্ডিতগণ আমাদের অতীতের পাঠ্য বইয়ের বিবরণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেন। প্রায়শঃ যেমন মনে করা হয়, আসলে কেবল চার্চের দুর্নীতির কারণেই পরিবর্তন ঘটেনি কিংবা ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনার হ্রাসের কারণেও নয়। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপে ধর্মের প্রতি এক ধরনের আগ্রহের জন্ম হয়েছিল বলেই মনে হয় যা মানুষকে বাড়াবাড়ির প্রতি সমালোচনামুখর করে তুলেছিল এক সময় যা অনিবার্য মনে করা হয়েছিল। সংস্কারবাদীদের সকল ধারণা এসেছে মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ব থেকে। ষোড়শ শতাব্দীতে সাধারণ মানুষের নতুন ধর্মানুরাগ ও ধর্মতাত্ত্বিক সচেতনতার মতো সুইটযারল্যান্ড ও জার্মানিতে জাতীয়তাবাদ ও নগরের উত্থানও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ইউরোপের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ বোধও চড়া হয়ে উঠেছিল, এটা বরাবরই প্রচলিত ধর্মীয় মনোভাবে তীব্র পরিবর্তন সূচিত করে থাকে। বাহ্যিক ও সমবেতভাবে বিশ্বাসের প্রকাশের বদলে ইউরোপিয়রা ধর্মের অভ্যন্তরীণ রূপ জানতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এইসব উপাদান বেদনাদায়ক ও প্রায়শঃ সহিংস পরিবর্তনে অবদান রেখেছিল ও পশ্চিমকে আধুনিকতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

দীক্ষিত হবার আগে লুথার যে ঈশ্বরকে ঘৃণা করে এসেছেন তাঁকে খুশি করার সম্ভাবনার ব্যাপারে প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন:

যদিও আমি সাধুর মতো পাপহীন জীবন যাপন করেছি, তারপরেও ঈশ্বরের সামনে অস্বস্তিতে ভরা বিবেক নিয়ে উপস্থিত হয়ে নিজেকে পাপী মনে হয়েছে। আমিও এও বিশ্বাস করতে পারিনি যে, আমার কাজ দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। পাপীকে শাস্তিদানকারী ঈশ্বরকে ভালোবাসা দূরে থাক, তাকে ঘৃণা করেছি। আমি ভালো সাধু ছিলাম, এত কঠোরভাবে নিয়ম পালন করেছি যে, যদি কোনও সাধু কখনও মনাস্টিক অনুশীলনের মাধ্যমে স্বর্গে যায় তবে মনেস্টারির আমার সতীর্থ সকল এতে সাক্ষী দেবে…তারপরেও আমার বিবেক আমাকে নিশ্চয়তা দেয়নি, বরং আমি সব সময় সন্দেহ করেছি এবং বলেছি, এটা ঠিক করোনি। তুমি যথেষ্ট অনুতপ্ত নও। স্বীকারোক্তিতে সেটা বাদ দিয়েছ তুমি।[১৭]

বর্তমানে বহু ক্রিশ্চান-প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক উভয়ই-এই লক্ষণ শনাক্ত করতে পারবে, সংস্কার যাকে সম্পূর্ণ দূর করতে পারেনি। লুথারের ঈশ্বর তাঁর ক্রোধে বৈশিষ্টমণ্ডিত । সাধু, পয়গম্বর বা সামিস্টদের কেউই এই ঐশী ক্রোধ সহ্য করতে পারেননি। স্রেফ, সাধ্যানুযায়ী করার প্রয়াসই যথেষ্ট নয়। ব্যক্তিক ঈশ্বর চিরন্তন ও সর্বব্যাপী, সুতরাং ‘আত্ম-তুপ্ত পাপীদের প্রতি তাঁর ক্রোধ বা আক্রোশও তাই অপরিমেয় এবং অসীম। তার ইচ্ছা জানার উপায় নেই। ঈশ্বরের আইন বা ধর্মীয় রীতিনীতি পোষণ আমাদের বাঁচাতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে, আইন শুধু অভিযোগ ও ত্রাস আনতে পারে, কারণ এটা আমাদের অপূর্ণাঙ্গতার মাত্রা দেখিয়ে দিয়েছে। আশার বাণী শোনানোর বদলে আইন ঈশ্বরের ক্রোধ, পাপ, ঈশ্বর সকাশে মৃত্যু এবং নরকবাসের কথা প্রকাশ করেছে।

ন্যায্যতার মতবাদ প্রণয়নের সময় লুথারের ব্যক্তিগত সাফল্য এসেছিল। মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। ঈশ্বর ন্যায্যতা’র, পাপী ও ঈশ্বরের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রয়োজনীয় সবকিছুর যোগান দেন। ঈশ্বর সক্রিয়, মানুষ স্রেফ নিষ্ক্রিয়। আমাদের সকর্ম’ ও আইনের অনুসরণ আমাদের ন্যায্যতার কারণ নয় বরং ফল মাত্র। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করেছেন বলেই আমরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে পারি। সেইন্ট পল ‘বিশ্বাসে ন্যায্যতা’ বলে একথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। লুথারের তত্ত্বের নতুন কিছুই ছিল নাঃ চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই ইউরোপে এর চল ছিল। কিন্তু লুথার একে আবিষ্কার করে আপন করে নেওয়ার ফলে তাঁর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তিরোহিত হয়ে যায়। এরপর আগত প্রত্যাদেশ ‘আমার মাঝে এমন বোধ জাগিয়ে তোলে যেন আমার নবজন্ম হয়েছে; আমি যেন উন্মুক্ত তোরণ দিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করেছি।[২০]

তারপরেও মানব প্রকৃতি সম্পর্কে পুরোপুরি নৈরাশ্যবাদী রয়ে যান তিনি। ১৫২০ সালের দিকে তার থিয়োলজি অভ দ্য ক্রস প্রণয়ন করেন তিনি। এই শব্দগুচ্ছ সেইন্ট পল থেকে নিয়েছিলেন তিনি। সেইন্ট পল করিন্থীয় নবদীক্ষিতদের বলেছিলেন, ক্রাইস্টের ক্রস দেখিয়ে দিয়েছিল যে, ঈশ্বরের নির্বুদ্ধিতা মানবীয় প্রজ্ঞার চেয়ে শ্রেয় ও ঈশ্বরের দুর্বলতা মানুষের শক্তির চেয়ে শক্তিমান।২১ ঈশ্বর ‘পাপীদের ন্যায্যতা দান করেন, একেবার মানবীয় বিচারে যারা কেবল শাস্তিরই যোগ্য। মানুষের কোছে যা দুর্বলতা সেখানেই ঈশ্বরের শক্তি প্রকাশিত হয়েছে। লুরিয়া যেখানে কাব্বালিস্টদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যে কেবল আনন্দ ও প্রশান্তিতেই ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব, লুথার সেখানে দাবি করেছেন, একমাত্র কষ্ট ও ক্রসেই ঈশ্বরকে পাওয়া যেতে পারে।২২ এই অবস্থান থেকে স্কলাস্টিসিজমের বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করেন তিনি-মানবীয় চাতুরি প্রকাশকারী ও ‘যেন স্পষ্ট বোধগম্য এমনভাবে ঈশ্বরের অদৃশ্য ব্যাপার প্রত্যক্ষকারী’ মিথ্যা কষ্ট ও ক্রসের মাধ্যমে’২৩ অনুধাবণকারী প্রকৃত ধর্মতাত্ত্বিকের পার্থক্য তুলে ধরেন। চার্চের ফাদারগণ যেভাবে ট্রিনিটি ও অবতারের মতবাদ প্রণয়ন করেছিলেন সেদিক থেকে এগুলোকে সন্দেহভাজন মনে হয়, এগুলোর জটিলতা জটিলতা ‘প্রতাপের ধর্মতত্ত্বের২৪ অসারতার কথাই বলে। তা সত্ত্বেও লুথার নাইসিয়া, এফিসাস এবং চ্যালসেডনদের অর্থডক্সির প্রতি অনুগত রয়ে গিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার ন্যায্যতা তত্ত্ব ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতা ও তাঁর ত্রিত্ববাদী মর্যাদার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ঈশ্বর সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণা খৃস্টজগতে এত গভীরভাবে প্রোথিত ছিল যে, লুথার বা কালভিন এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেননি, কিন্তু লুথার অসত্য ধর্মতাত্ত্বিকদের অস্পষ্ট মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমার কাছে কী মূল্য আছে এর? জটিল খৃস্টতত্ত্বীয় মতবাদের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনিঃ ক্রাইস্ট তাঁর ত্রাণকর্তা জানাটাই ছিল সব।২৫

লুথার এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণের ব্যাপারেও সন্দিহান ছিলেন। তোমাস আকুইনাস ব্যবহৃত যুক্তিভিত্তিক বিতর্কের মাধ্যমে একমাত্র পৌত্তলিক দার্শনিকদের ‘ঈশ্বর’কেই জানা যেতে পারে । লুথার বিশ্বাস দ্বারা আমাদের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের দাবি করে ঈশ্বর সম্পর্কে সত্য ধারণা গ্রহণ করার কথা বোঝননি। বিশ্বাসের জন্যে তথ্য, জ্ঞান ও নিশ্চয়তার প্রয়োজন নেই’ এক সারমনে প্রচার করেছেন তিনি, বরং প্রয়োজন তার অনুভূত, অপ্রয়াস লব্ধ এবং অজ্ঞাত মহত্বের কাছে আনন্দময় বাজি ধরে স্বাধীন আত্মসমর্পণ ।২৬ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সমস্যাদির সমাধানের বেলায় তিনি পাসকাল ও কিয়ের্কেগার্দের পূর্বগামী ছিলেন। বিশ্বাস’ কোনও বিশেষ ক্রীডের কতগুলো প্রস্তাবনার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন বোঝায়নি এবং অর্থডক্স মতানুযায়ী এটা আস্থা নয়। বরং বিশ্বাস হচ্ছে আস্থা স্থাপন করে একটা সত্তার উদ্দেশ্যে অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়া। এটা এক ধরনের জ্ঞান এবং অন্ধকার যা কিছুই দেখতে পায় না। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বর তাঁর প্রকৃতি বা রূপ নিয়ে অনুমান নির্ভর আলোচনা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। কেবল যুক্তি দিয়ে তাঁর দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে, জন্ম দিতে পারে হতাশার-যেহেতু আমরা কেবল ঈশ্বরের ক্ষমতা, প্রজ্ঞা ও. বিচার আবিষ্কারেই সক্ষম হব, যা কেবল কঠিন পাপীদের ভয় দেখাতে সক্ষম। ঈশ্বর সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনায় লিপ্ত হওয়ার বদলে ক্রিশ্চানের উচিত হবে ঐশীগ্রন্থে প্রকাশিত সত্য অনুধাবন করা ও সেগুলোকে আপন করে নেওয়া। লুথার তাঁর স্মল ক্যাটেশিজম-এ সংকলিত ক্রীডে সেটা কীভাবে করতে হবে দেখিয়েছেন:

আমি বিশ্বাস করি, অনন্ত অসীমের পিতার সন্তান ও কুমারী মেরীর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী মানুষ আমার প্রভু; যিনি আমাকে উদ্ধার করেছেন, একজন দিশাহারা ঘৃণিত প্রাণী এবং আমাকে সকল পাপ, মৃত্যু ও শয়তানের কবল হতে রক্ষা করেছেন; কিন্তু সেটা সোনা-রূপা দিয়ে নয় বরং তাঁর পবিত্র ও মূল্যবান রক্ত দিয়ে, তার পাপহীন কষ্ট ও মৃত্যু দিয়ে, যেন আমি তাঁর হয়ে যাই, তার ছায়াতলে বেঁচে থাকি ও আজীবন ন্যায়ের পথে তার সেবা করি, তাঁর আশীর্বাদ পাই, এমনকি যখন তিনি মৃত হতে পূনরুত্থিত হন এবং অনন্তকাল রাজত্ব করেন।[২৮]

স্কালাস্টিক ধর্মতত্ত্বে শিক্ষা পেয়েছিলেন লুথার, কিন্তু পরে বিশ্বাসের অধিকতর সরল ধরণ বেছে নিয়েছেন ও চতুর্দশ শতাব্দীর বিরস ধর্মতত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন যা তার আতঙ্ক প্রশমিত করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা ঠিক কীভাবে ন্যায্যতা পেয়েছি ব্যাখ্যা দেওয়ার বেলায় নিজেই অস্পষ্টতার দোষে অভিযুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। লুথারের গুরু অগাস্তিন শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, পাপীর ওপর অর্পিত ন্যায়নিষ্ঠা তার নয়, ঈশ্বরের । লুথার একে কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। অগাস্তিন বলেছিলেন, এই স্বর্গীয় ন্যায়নিষ্ঠা আমাদের অংশে পরিণত হয়েছে; লুথার জোর দিয়েছেন যে, এটা পাপীর বাইরেই রয়ে গেছে, কিন্তু ঈশ্বর একে এমনভাবে দেখেছেন যেন এটা আমাদের একান্ত নিজস্ব হয়ে গেছে। এটা পরিহাসের বিষয় যে, সংস্কার আরও বৃহত্তর মতবাদগত বিভ্রান্তি ও নতুনতর মতবাদের বিস্তার ঘটিয়েছিল, কারণ এগুলো যেসব গোষ্ঠীকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিল সেগুলোর মতোই কোনও কোনওটা নজীরবিহীন ও নাজুক ছিল।

ন্যায্যতার মতবাদ প্রণয়নের পর নিজের পুর্নজন্মের দাবি করেছিলেন লুথার, কিন্তু আসলে তাঁর সকল উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছে বলে মনে হয় না। তিনি ক্রুদ্ধ, অস্থির ও সহিংস মানুষই রয়ে গিয়েছিলেন। সকল প্রধান ধর্মীয় প্রথা দাবি করে যে, যেকোনও আধ্যাত্মিকতার অ্যাসিড টেস্ট হচ্ছে ঠিক কোন মাত্রায় সেটা দৈনন্দিন জীবনে আত্তীকৃত হয়েছে। বুদ্ধ যেমন বলেছিলেন আলোকপ্রাপ্তির পর যে কারও উচিত হবে বিপণি কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করা ও সকল প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শনের চর্চা করা। এক ধরনের শান্তিবোধ, অচঞ্চলতা ও প্রেমময়-দয়া হচ্ছে সকল সত্য ধর্মদর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু লুথার ছিলেন প্রবলভাবে অ্যান্টি-সেমাইট, নারী-বিদ্বেষী, যৌনতার ব্যাপারে ঘৃণা ও আতঙ্ক বোধ করতেন তিনি, এবং বিশ্বাস করতেন যে, বিদ্রোহী সকল কৃষককে হত্যা করা উচিত। প্রতিহিংসা পরায়ণ ঈশ্বরের দর্শন ব্যক্তিগত ক্রোধে ভরিয়ে তুলেছিল তাঁকে। মনে করা হয়, উদ্ধত চরিত্রের কারণে সংস্কার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংস্কারবাদী হিসাবে কাজ শুরুর আগে তাঁর বহু ধারণাই অর্থডক্স ক্যাথলিকরা গ্রহণ করেছিল, সেগুলোর চর্চা নতুন প্রাণশক্তি যোগাতে পারত; কিন্তু লুথারের আগ্রাসী কৌশল সেগুলো অপ্রয়োজনীয় সন্দেহের সঙ্গে দেখার কারণ হয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদে লুথার জন কালভিনের (১৫০৯-৬৪) চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন; লুথারের চেয়ে বেশি মাত্রায় রেনেসাঁর আদর্শের ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো, তাঁর সুইস সংস্কার উদীয়মান পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের ওপর গভীর প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ কালভিনিজম’ আন্তর্জাতিক ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এবং ভালো বা খারাপ যাই হোক, সমাজকে বদলে দিতে পেরেছিল; জনগণকে তা এই মর্মে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে যে, তারা যা চায় তাই অর্জন করতে পারে। কালভিনিস্টিক ধ্যান-ধারণা ১৬৪৫ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের অধীনে ইংল্যান্ডে পিউরিটান বিপ্লবে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল আর ১৬২০ এর দশকে নিউ ইংল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপনে সাহায্য করেছে। লুথারের মৃত্যুর পর তাঁর মতবাদ মূলত জার্মানিতেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু কালভিনের ধারণা যেন আরও প্রগতিশীল প্রতীয়মান হয়েছে। অনুসারীরা তাঁর শিক্ষার উন্নয়ন ঘটিয়ে সংস্কারের দ্বিতীয় ধারার সূচনা ঘটায়। ইতিহাসবিদ হিউ ট্রেভর রোপার যেমন মন্তব্য করেছেন, অনুসারীরা কালভিনিজমকে রোমান। ক্যাথলিসিজমের চেয়ে অনেক সহজে পরিত্যাগ করেছিল-সে কারণেই প্রবাদবাক্য ‘একবার যে ক্যাথলিক, সে আজীবন ক্যাথলিক’-এর জন্ম। তা সত্ত্বেও কালভিনিজম এর ছাপ রেখেছে: পরিত্যক্ত হলেও সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে একে প্রকাশ করা যেতে পারে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটা বেশি সত্যি। বহু আমেরিকান যারা এখন আর ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় তারা পিউরিটান কর্ম-নীতি মেনে চলে এবং নির্বাচনের কালভিনিস্টিক ধারণা বিশ্বাস করে, নিজেদের তারা মনোনীত জাতি’ মনে করে যাদের পতাকা ও আদর্শের আধা-ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা দেখেছি, সকল প্রধান ধর্মই এক অর্থে সভ্যতার এবং আরও নির্দিষ্টভাবে নগরের সৃষ্টি। ধনী বণিক শ্রেণী যখন প্রাচীন পৌত্তলিক রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থান দখল করে নিয়তিকে নিজের হাতে নিতে চেয়েছে তখনই এসব ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল। ইউরোপের উন্নয়নশীল শহরগুলোর বুর্জোয়াদের কাছে খৃস্ট ধর্মের কালভিনিস্টিক রূপ বিশেষভাবে আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, যার অধিবাসীরা নিপীড়নমূলক ধারাক্রমের শিকল হতে মুক্তি চেয়েছিল।

পূর্বেকার সুইস ধর্মতাত্ত্বিক হুলদ্রিচ যিউংগলি, (১৪৮৪-১৫৩১)-এর মতো কালভিন সেভাবে ডগমায় আগ্রহী ছিলেন নাঃ ধর্মের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ছিল তাঁর বিবেচনার বিষয়। তিনি সরল ধার্মিকতার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছেন, কিন্তু ট্রিনিটির অ-বাইবেলসুলভ উৎস সত্ত্বেও এই মতবাদ আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। দ্য ইন্সটিটিউট অভ দ্য ক্রিশ্চান রিলিজিয়ন-এ তিনি যেমন লিখেছেন, “ঈশ্বর নিজেকে একক হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তিনি তিনজন ব্যক্তি হিসাবে অস্তিত্ববান।৩১ ১৫৫৩ সালে ট্রিনিটি মানতে অস্বীকৃতি জানানোয় স্প্যানিশ ধর্মতাত্ত্বিক মাইকেল সারবেতাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করিয়েছিলেন কালভিন। ক্যাথলিক স্পেন ছেড়ে পালিয়ে যান সারবেতাস এবং কালভিনের জেনিভায় আশ্রয় নেন, তিনি অ্যাপল এবং চার্চের আদি পিতাদের ধর্মে ফিরে যাবার দাবি করেন, যারা কখনও এই অসাধারণ মতবাদের কথা শোনেননি। কিছুটা ন্যায়সঙ্গতভাবেই সাববেতাস যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে ইহুদি ঐশীগ্রন্থের কঠোর একেশ্বরবাদীতার বিরোধিতা করে এমন কিছুই নিউ টেস্টামেন্টে নেই। ট্রিনিটির মতবাদ মানব সৃষ্ট যা মানুষের মনকে প্রকৃত ক্রাইস্ট হতে সরিয়ে ত্রিরূপী ঈশ্বরকে আমাদের সামনে খাড়া করেছে।৩২ ইতালির দুজন। সংস্কারবাদী-জর্জিয়ো ব্ল্যানদ্ৰাতা (১৫১৫-১৫৮৮) ও ফস্তাস সোসিনাস (১৫৩৯-১৬০৪)-তার বিশ্বাসে সমর্থন যোগান। এঁরা দুজনই জেনিভায় পালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে বুঝতে পারেন যে, তাদের ধ্যান ধারণা সুইস সংস্কারের পক্ষে বেশ রেডিক্যাল। তারা এমনকি প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কিত পশ্চিমের প্রচল ধারণাও মানতেন না। নারী-পুরুষ ক্রাইস্টের মৃত্যুর ফলে ন্যায্যতা পেয়েছে, এটা তারা বিশ্বাস করতেন না; বরং সেটা কেবল ঈশ্বরে তাদের বিশ্বাস বা আস্থার ফল। ক্রাইস্ট দ্য সেভিয়র গ্রন্থে সোসিনাস নাইসিয়ার তথাকথিত অর্থডক্সি প্রত্যাখ্যান করেছেন: ঈশ্বরের পুত্র’ কথাটি জেসাসের স্বর্গীয় রূপ সম্পর্কিত কোনও মন্তব্য নয়, বরং এখানে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, ঈশ্বর তাকে বিশেষভাবে ভালোবেসেছিলেন। আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে প্রাণ দেননি তিনি, বরং শিক্ষক ছিলেন তিনি, আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন।’ ট্রিনিটির মতবাদ সম্পর্কে বলা যায়, এটা একেবারেই ‘আজগুবী ব্যাপার, যুক্তি বিবর্জিত একটা কাল্পনিক গল্প যা বিশ্বাসীকে তিনজন আলাদা ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনে উৎসাহিত করে। সারবেতাসের মৃত্যুদণ্ডের পর ব্ল্যান্দ্রাতা ও সোসিনাস উভয়ই পোল্যান্ড ও ট্রান্সসিলভিনিয়ায় পালিয়ে যান, সঙ্গে নিয়ে যান তাঁদের ‘ইউনিটারিয়ান’ ধর্ম ।

যিউইংগলি ও কালভিন ঈশ্বর সম্পর্কিত অধিকতর প্রচলিত ধারণায় নির্ভর করেছেন ও লুথারের মতো ঈশ্বরের পরম সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা স্রেফ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাস নয়, বরং গভীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফল ছিল। ১৫১৯ সালের আগস্ট মাসে জুরিখে মিনিস্ট্রির শুরুর অল্প পরেই যিউইংগলি প্লেগে আক্রান্ত হন, যা শেষ পর্যন্ত শহরের এক চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী ধ্বংস করে দিয়েছিল। নিজেকে বাঁচানোর কোনও উপায়ই নেই বুঝতে পেরে পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। সাহায্যের জন্যে সাধুদের কাছে প্রার্থনা করা বা চার্চকে তার হয়ে অনুকম্পা চাইতে বলার কথা মাথায়ই আসেনি। বরং তার বদলে নিজেকে ঈশ্বরের দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত প্রার্থনাটি রচনা করেছেন তিনি।

তোমার যা ইচ্ছা করো
কারণ আমার কোনও নেই।
আমি তোমার পাত্র
পূর্ণাঙ্গ বা বিচূর্ণ করার জন্যে।

তাঁর আত্মসমর্পণ ছিল ইসলামের আদর্শের অনুরূপ। ইহুদি ও মুসলিমদের মতো বিকাশের একটা তুলনাযোগ্য পর্যায়ে পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা আর মধ্যস্থতাকারীদের মেনে নিতে রাজি ছিল না, বরং তারা ঈশ্বরের প্রতি নিজেদের অবিচ্ছেদ্য দায়িত্বের বোধ গড়ে তুলছিল। কালভিনও তাঁর সংস্কারকৃত ধর্মকে ঈশ্বরের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছিলেন। নিজের পরিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আমাদের জন্যে রেখে যাননি তিনি। তাঁর কমেন্টারি অন দ্য সালমস গ্রন্থে কেবল এটুকু বলেছেন যে, এটা পুরো ঈশ্বরের কীর্তি। প্রথাগত চার্চ ও ‘পাপাসির কুসংস্কারে পুরোপুরি শৃঙ্খলিত ছিলেন তিনি। মুক্তি অর্জনে যুগপৎ অনিচ্ছুক ও অক্ষম ছিলেন, তাঁকে সরিয়ে আনার বেলায় ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল: অবশেষে ঈশ্বর তার ক্ষমতার গুপ্ত লাগাম দিয়ে আমার পথকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন…বহু বছরের অবাধ্য মনকে আচমকা বশ মানিয়ে নিয়েছেন।[৩৫]

ঈশ্বর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন, কালভিন ছিলেন একেবারে ক্ষমতাহীন, তা সত্ত্বেও আপন ব্যর্থতা ও অক্ষমতার তীব্র অনুভূতির দ্বারাই একটা বিশেষ মিশনের জন্যে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।

অগাস্তিনের সময় থেকেই আকস্মিক বিশ্বাস পরিবর্তন পশ্চিমা খৃস্টধর্মের বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ অতীতের সঙ্গে আকস্মিক ও প্রবল সম্পর্কচ্ছেদের প্রথা হিসাবে ক্রিয়াশীল রয়ে যাবে, আমেরিকান দার্শনিক উইলিয়াম জেমস যাকে বলেছেন ‘অসুস্থ আত্মা সমূহের জন্যে দ্বিতীয় জন্ম নেওয়া’ ধর্ম। ক্রিশ্চানরা ঈশ্বরের এক নতুন বিশ্বাসে ‘জন্ম গ্রহণ করছিল; তারা মধ্যযুগীয় চার্চের স্বর্গ এবং তাদের মাঝখানে বিরাজমান অসংখ্য মধ্যস্থতাকারীকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কালভিন বলেছেন, উদ্বেগবশতঃ মানুষ সাধুদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে এসেছিল; তারা একজন ক্রুদ্ধ ঈশ্বরকে তার কাছের মানুষদের তোয়াজ করে প্রসন্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাধুদের কাল্ট প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও প্রটেস্টান্টরা প্রায়শঃই প্রায় একই মাত্রার উদ্বেগের প্রকাশ ঘটিয়েছে। সাধুরা অকার্যকর, এ সংবাদ পাওয়ার পর এই নিরাপোস ঈশ্বর সম্পর্কিত আতঙ্ক ও বৈরিতার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যেন এক তীব্র প্রতিক্রিয়াসহ বিস্ফোরিত হয়েছিল। ইংরেজ মানবতাবাদী টমাস মূর সাধু-পুজার বহুঈশ্বরবাদীতার বিরুদ্ধে বহু ভৎর্সনামূলক রচনায় ব্যক্তিগত ঘৃণার ছাপ আবিষ্কার করেছিলেন। তাদের চরিত্র হননের ভেতর দিয়ে এর প্রকাশ ঘটেছিল। বহু প্রোটেস্ট্যান্ট ও পিউরিটান ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রতিমা বিরোধিতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, তারা সাধু এবং ভার্জিন মেরির মূর্তি ধ্বংস করে চার্চ ও ক্যাথেড্রালের ফ্রিসকোগুলোর ওপর চুন লেপ্টে দেয়। তাদের এই তীব্র উন্মাদনা দেখিয়ে দিয়েছে যে, তারা সাধুদের কাছে তাদের পক্ষে মধ্যস্থতা করার জন্যে প্রার্থনার সময় যেমন ভীত ছিল ঠিক সে রকমভাবেই বিরক্তি উদ্রেককারী ও ঈর্ষাতুর ঈশ্বরকে আক্রমণ করতে গিয়ে ভীতির শিকার হয়েছে। এটা আরও দেখিয়েছে, কেবল ঈশ্বরকে উপাসনা করার উৎসাহ স্থির বিশ্বাস হতে জন্ম নেয়নি বরং এক উদ্বেগাকূল প্রত্যাখ্যান ছিল এটা যা প্রাচীন ইসরায়েলিদের আশেরাহর খুঁটি ভাঙায় উৎসাহ যুগিয়েছিল ও প্রতিবেশীদের দেবতাদের খিস্তি-খেউড়ে ভাসিয়ে দিতে প্ররোচিত করেছিল।

মূলত পূর্বনির্ধারিত নিয়তি বিশ্বাসের জন্যে কালভিনকে স্মরণ করা হয়ে থাকে, কিন্তু আসলে এই বিষয়টি তাঁর চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু ছিল না; তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এটা কালভিনিজমের জন্যে অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি। ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানতা ও সর্বজ্ঞতার সঙ্গে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সমন্বয় সাধনের সমস্যাটি ঈশ্বরের ওপর নরত্ব আরোপের ফলে দেখা দিয়েছিল। আমরা দেখেছি, নবম শতাব্দীতে মুসলিমরা এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল; তারা কোনও যৌক্তিক সমাধান খুঁজে পায়নি; পরিবর্তে তারা ঈশ্বরের রহস্য ও দুর্বোধ্যতার ওপর জোর দিয়েছে। এটি গ্রিক অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের জন্য কখনও সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি, এরা প্যারাডক্সের অনুরাগী ছিল; একে আলো ও উদ্দীপনার উৎস হিসাবে দেখা গেছে; কিন্তু পশ্চিমে এটা বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিল, যেখানে ঈশ্বরের অধিকতর ব্যক্তিক ধারণা বজায় ছিল। মানুষ এমনভাবে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছার কথা বলার চেষ্টা করত যেন তিনি কোনও মানবসত্তা; আমাদের মতোই সীমাবদ্ধতার অধীন ও জাগতিক কোনও শাসকের মতো আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীকে শাসন করছেন। তা সত্ত্বেও ক্যাথলিক চার্চ ঈশ্বর হতভাগ্যদের চির নরক বাস স্থির করে রেখেছেন, এই ধারণার নিন্দা জানিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, অগাস্তিন পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি’ কথাটিকে মনোনীতদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত বোঝাতে প্রয়োগ করেছিলেন, কিন্তু হতভাগ্য কিছু আত্মার নরক বাস ঘটবে মানতে চাননি। যদিও তাঁর প্রতিপাদ্যের যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্ত ছিল তাই। ইনস্টিটিউটে পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি সম্পর্কে খুব বেশি আলোকপাত করেননি কালভিন । আমাদের দিকে যখন তাকাই, স্বীকার গেছেন তিনি, তখন সত্যি মনে হয় ঈশ্বর অন্যদের তুলনায় কিছু সংখ্যক লোককে বেশি সুবিধা দিয়েছেন। কেউ কেউ যখন স্পেলের প্রতি সাড়া দেয় তখন অন্যরা কেন নিস্পৃহ থাকে? ঈশ্বর কি তবে কোনও খামখেয়ালি বা অন্যায় আচরণ করছেন? কালভিন এটা অস্বীকার করেছেন: কাউকে পছন্দ বা প্রত্যাখ্যানের আপাতঃ চিত্রটি ঈশ্বরের রহস্যের নিদর্শন। এ সমস্যার কোনও যৌক্তিক সমাধান ছিল না, যেখানে বোঝায় যে ঈশ্বরের ভালোবাসা ও তার বিচার সমন্বয়ের অতীত। কিন্তু এটা ক্যালভিনকে খুব একটা বিচলিত করেনি; কেননা ডগমায় খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না তিনি।

কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর কালভিনিস্টদের’ যখন একদিকে লুথারান ও অন্যদিকে রোমান ক্যাথলিকদের কাছ থেকে আলাদা পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তখন জেনিভায় কালভিনের ডান হাত থিওদোরাস ব্যে (১৫১৯-১৬০৫) নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন এবং পূর্ব নির্ধারিত নিয়তিবাদকে কালভিনিজম-এর মূল বিষয়ে পরিণত করেন। নিষ্ঠুর যুক্তির সাহায্যে তিনি প্যারাডক্সকে অপসারিত করেন । ঈশ্বর যেহেতু সর্বশক্তিমান, এতে বোঝা যায়, আপন ত্রাণ লাভের ক্ষেত্রে মানুষের কিছুই করার নেই। ঈশ্বর অপরিবর্তনীয় এবং তার বিধানমালা যথাযথ ও চিরন্তন: এভাবে তিনি অন্তহীনকাল হতেই কাউকে কাউকে উদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং বাকী সবার জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন নরকবাস । এই অস্বস্তিকর মতবাদের ব্যাপারে কোনও কোনও কালভিনিস্ট প্রবল শঙ্কা বোধ করেছে। লো ক্যান্ট্রিজে জ্যাকব আরমিনাস যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এটা বাজে ধর্মতত্ত্বের একটা নজীর, কেননা এখানে এমনভাবে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে যেন তিনি সাধারণ কোনও মানুষ। কিন্তু কালভিনিস্টরা বিশ্বাস করত যে, আর দশটা বিষয়ের মতোই ঈশ্বর সম্পর্কেও বস্তুগত আলোচনা করা যায়। প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মতো তারাও এক নতুন অ্যারিস্টটলিজম গড়ে তুলছিল যেখানে যুক্তি ও মেটাফিজিক্সের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটা সেইন্ট তোমাস আকুইনাসের অ্যারিস্টটলিজমের চেয়ে আলাদা ছিল, কেননা নব্য ধর্মতাত্ত্বিকরা অ্যারিস্টটলের যৌক্তিক পদ্ধতির ব্যাপারে আগ্রহী হলেও তার চিন্তার বিষয়বস্তুর প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তারা খৃস্টধর্মকে একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ যৌক্তিক পদ্ধতি হিসাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, যা পরিচিত নীতিমালা হতে সিলোজিস্টিক যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বের করে আনা সম্ভব। অবশ্যই প্রবল স্ববিরোধী ছিল এটা, কারণ সংস্কারবাদীরা ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধরনের যৌক্তিক আলোচনা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছিল। পরবর্তী সময়ে পূর্ব নির্ধারিত নিয়তির কালভিনিস্ট মতবাদ দেখিয়েছে যে, ঈশ্বরের স্ববিরোধিতা ও রহস্যময়তাকে কাব্য হিসাবে। বিবেচনা না করে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিন্তু ভীতিকর যুক্তির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করতে গেলে কী অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। প্রতীকীভাবে ব্যাখ্যা না করে বাইবেল একেবারে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা হলে ঈশ্বর সম্পর্কে এর ধারণা অসম্ভবের। পর্যায়ে পর্যবসিত হয়ে থাকে। পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার জন্যে আক্ষরিক অর্থে দায়ী একজন উপাস্যকে কল্পনা করার সঙ্গে মারাত্মক স্ববিরোধিতা জড়িত। বাইবেলের ‘ঈশ্বর’ আর দুয়ে ও একক সত্তা থাকেন না, বরং নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হন। পূর্বনির্ধারিত নিয়তির মতবাদ এরকম ব্যক্তিক ঈশ্বরের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে।

কালভিনের ধারণার ওপর ভিত্তি করে পিউরিটানরা ধর্মীয় বোধ গড়ে তুলেছিল এবং ঈশ্বরকে স্পষ্ট এক সংগ্রাম হিসাবে আবিষ্কার করেছে। তিনি যেন সুখ বা সমবেদনায় তাদের সিক্ত করেননি। তাদের জার্নাল ও আত্মজীবনী দেখায়, পূর্ব নির্ধারিত নিয়তির ব্যাপারে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল তারা; উদ্ধার মিলবে না ভেবে শঙ্কিত ছিল। ধর্মান্তরকরণ এক কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ভয়াবহ নিপীড়নমূলক নাটক, যেখানে ‘পাপী’ ও তার আধ্যাত্মিক গুরু আত্মার জন্যে ‘সংগ্রামে লিপ্ত। প্রায়শ্চিত্তকারীকে প্রায়শঃ মারাত্মক অপমানের মুখোমুখি বা ঈশ্বরের কৃপার জন্যে প্রকৃত হতাশার বোধে জর্জরিত হতে হতো, যতক্ষণ না ঈশ্বরের ওপর সামগ্রিক নির্ভরতার বিষয়টি তার উপলব্ধিতে আসছে। ধর্মান্তকরণ প্রায়ই মনস্তাত্ত্বিক অ্যাব্রিঅ্যাকশন উপস্থাপিত করত-চরম হতাশা হতে মহাউল্লাসের পর্যায়ে চরম পরিবর্তন। নরক ও শাস্তির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত জোরের সঙ্গে আত্মসমীক্ষার বাড়াবাড়ি যোগ হওয়ায় অনেকের মাঝেই বিষণ্ণতার রোগ দেখা দিয়েছিল: আত্মহত্যা যেন সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল । পিউরিটানরা এর জন্যে শয়তানকে দায়ী করেছে যে কিনা তাদের জীবনে ঈশ্বরের মতোই ক্ষমতাবান মনে হয়েছে। পিউরিটানিজমের ইতিবাচক দিকও ছিল: কাজের ক্ষেত্রে মানুষকে এটা গৌরব এনে দিয়েছিল: এর আগে পর্যন্ত যাকে দাসত্ব হিসাবে দেখা হতো এবার সেটাই এক ‘আহবান’ বিবেচিত হয়েছিল। এর জরুরি প্রলয়বাদী আধ্যাত্মিকতা কাউকে কাউকে নয়া বিশ্বে উপনিবেশে স্থাপনে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু এর সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল, পিউরিটান ঈশ্বর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছেন ও যারা মনোনীত নয় তাদের প্রতি কঠোর অসহিষ্ণুতার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।

প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকরা পরস্পরকে এখন প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখে, কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা ও অনুভূতিতে আশ্চর্যরকম মিল রয়েছে। কাউন্সিল অভ ট্রেন্টের (১৫৪৫-৬১) পর ক্যাথলিক ধর্মতাত্ত্বিকরাও নিও-অ্যারিস্টটলিয়ান ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বরের গবেষণাকে যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান আবিষ্কারের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিল । সোসায়েটি অভ জেসাসের প্রতিষ্ঠাতা লয়োলার ইগনেশিয়াস (১৪৯১-১৫৫৬)-এর মতো সংস্কারকরা প্রত্যক্ষ ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভের প্রটেন্ট্যান্ট গুরুত্ব ও প্রত্যাদেশের উপলব্ধি ও একেবারে আপন করে নেওয়ার ব্যাপারটিকে সমর্থন করেছেন। প্রথম দিকে জেসুইটদের জন্যে বিকশিত আধ্যাত্মিক অনুশীলনের (স্পিরিচুয়াল এক্সারসাইসেজ)-এর মূল। লক্ষ্য ছিল ধর্মান্তকরণের প্রেরণা জাগানো, যা কিনা যুগপৎ যন্ত্রণাময় ও আনন্দপূর্ণ অভিজ্ঞতা হতে পারে। আত্মমূল্যায়ন ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর গুরুত্বদানকারী নির্দেশকের সঙ্গে একজন একজন করে ত্রিশদিন দীর্ঘ এই সাধনা পিউরিটান আধ্যাত্মিকতার চেয়ে ভিন্ন ছিল না। অনুশীলনগুলো অতিন্দ্রীয়বাদের পদ্ধতিগত ও খুব কার্যকর সাধনা তুলে ধরে। অতিন্দ্রীয়বাদীরা প্রায়শঃই এমন সব অনুশীলনের প্রয়োগ করেছে যার সঙ্গে বর্তমান কালের সাইকোঅ্যানালিস্টদের কৌশলের মিল রয়েছে। সুতরাং, এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে অনুশীলনগুলো আজও ক্যাথলিক ও অ্যাংলিক্যানরা এক ধরনের বিকল্প চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অনুসরণ করে থাকে।

ইগনেশিয়াস অবশ্য ভুয়া অতিন্দ্রীয়বাদের বিপদ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। লুরিয়ার মতো অবিচলতা ও আনন্দের প্রতি জোর দিয়েছিলেন তিনি, তাঁর রুলস অভ দ্য ডিসারনমেন্ট অভ স্পিরিটস-এ অনুসারীদের চরম আবেগের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন, যা কোনও কোনও পিউরিটানকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। অনুশীলনকারী সম্ভাব্য যেসব আবেগের মুখোমুখি হতে পারে সেগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছিলেন তিনিঃ ধ্যানের সময় কোনগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকে আসবে আর কোনগুলো আসবে শয়তানের তরফ থেকে। ঈশ্বর অনুভূত হবেন শান্তি, আনন্দ ও মনের চাঙা ভাব’ হিসাবে, অন্যদিকে বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্ন ভাব ও বিক্ষিপ্ততা আসে ‘অশুভ আত্মা’ হতে। ইগনেসিয়াশের নিজস্ব ঈশ্বর অনুভূতি ছিল তীব্র: এটা তাঁকে আনন্দে কাঁদাত। একবার তিনি বলেছিলেন, এর অনুপস্থিতিতে তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। কিন্তু আবেগের তীব্র ওঠানামাকে অবিশ্বাস করতেন তিনি; নতুন সত্তায় যাত্রায় শৃঙ্খলার প্রয়োজনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কালভিনের মতো খৃস্টধর্মকে তিনি ক্রাইস্টের মুখোমুখি দাঁড়ানো বলে বিবেচনা করেছিলেন, এক্সারসাইজ-এ যা উল্লেখ করেছেন: যার পরিণতি ছিল ‘ভালোবাসার জন্যে ধ্যান, যা সবকিছুকে ঈশ্বরের মহানুভবতার সৃষ্টি এবং এর প্রতিফলন হিসাবে দেখে। ইগনেসিয়াশের চোখে গোটা জগই ঈশ্বরে পরিপূর্ণ। অনুশীলন প্রক্রিয়া চলাকালে তাঁর অনুসারীরা স্মরণ করত:

আমরা প্রায়ই দেখেছি একেবারে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসও কীভাবে তাঁর আত্মাকে ঈশ্বর পানে ধাবিত করতে পারত, যিনি এমনকি তুচ্ছ বস্তুতেও সুমহান। ছোট একটা গাছ, পাতা, ফুল বা ফল, নগণ্য একটা কেঁচো বা ছোট্ট একটা জানোয়ার দেখেই ইগনেসিয়াশ মুক্ত হয়ে স্বর্গে উধ্বোরোহণ করতে পারতেন এবং পৌঁছে যেতেন বোধের অতীত জগতে।

পিউরিটানদের মতো জেসুইটরাও ঈশ্বরকে এক গতিময় শক্তি হিসাবে অনুভব করেছে যা সর্বোত্তম অবস্থায় তাদের আত্মবিশ্বাস ও শক্তিতে পুর্ণ করে দিতে পারত। পিউরিটানরা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউ ইংল্যান্ডে বসতি করার সময় জেসুইট মিশনাররা সারা বিশ্ব ঘুরে বেরিয়েছে: ফ্রান্সিস বাভিয়র (১৫০৬ ১৫৫২) ভারত ও জাপানে খৃস্টধর্ম প্রচার করেন, ম্যাত্তিও রিচি (১৫৫২ ১৬১০) গস্পেল পৌঁছে দিয়েছেন চীনে এবং রোবার্ত দে নবিলি (১৫৭৭ ১৬৫৬) নিয়ে গেছেন ভারতে। আবার পিউরিটানদের মতোই জেসুইটরা প্রায়শঃই উৎসাহী বিজ্ঞানচর্চাকারী ছিল এবং এমন মত প্রকাশ করা হয় যে, রয়াল সোসায়েটি অভ লন্ডন বা অ্যাকাডেমিয়া দেল সিমেন দো নয়, বরং সোসায়েটি অভ জেসাসই ছিল বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী।

তা সত্ত্বেও ক্যাথলিকরা যেন পিউরিটানদের মতোই অস্বস্তিতে ছিল। যেমন ইগনেসিয়াশ নিজেকে এমন মহাপাপী হিসাবে দেখতেন যে, তিনি প্রার্থনা করতেন মৃত্যুর পর যেন লাশ একটা গোবরের স্তূপে ফেলে রাখা হয় যাতে পাখী আর কুকুর তা খেয়ে শেষ করে ফেলতে পারে। চিকিৎসকরা তাকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, প্রার্থনা সভায় এমন প্রবলভাবে কান্না চালিয়ে গেলে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। নারীদের জন্যে নগ্নপদ সন্ন্যাসীনি কারমেলাইটদের মঠজীবনাচারকে সংস্কারকারী তেরেসা অভ আভিলা নিজের জন্যে নরকে রক্ষিত এক ভয়ঙ্কর জায়গা দর্শন করেছিলেন। এই পর্যায়ের সাধুরা যেন ঈশ্বর ও জগৎসংসারকে সমন্বয়ের অতীত বিপরীতমুখী শক্তি হিসাবে দেখেছেন: ত্রাণ লাভের জন্যে জগৎ ও সকল স্বাভাবিক মায়া ত্যাগ করতে হবে। দান-খয়রাত আর সৎকর্ম করে জীবনযাপনকারী ভিনসেন্ট দ্য পল প্রার্থনা করেছেন, ঈশ্বর যেন বাবা-মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা কেড়ে নেন; ভিজিটেশন বৃত্তির প্রতিষ্ঠাতার জেন ফ্রান্সিস দে শ্যানতাল আপন ছেলের নিথর দেহ টপকে কনভেন্টের পথে যাত্রা করেছিলেন; মাকে বাধা দেওয়ার জন্যে দরজার চৌকাঠে শুয়ে পড়েছিল সে। রেনেসাঁ যেখানে স্বর্গ-মর্তের মিলনের প্রয়াস পেয়েছে, ক্যাথলিক সংস্কার সেখানে এদের একেবারে আলাদা করার চেষ্টা চালিয়েছে। ঈশ্বর পাশ্চাত্যের সংস্কৃত ক্রিশ্চানদের দক্ষ ও ক্ষমতাশালী করেছিলেন হয়তো, কিন্তু তিনি তাদের সুখী করেননি। উভয়পক্ষের জন্যেই সংস্কারের সময়টি একটা মহাআতঙ্কের পর্যায় ছিল; অতীতের প্রতি প্রবল নিন্দা, তিক্ত ভৎর্সনা ও অভিশাপের প্রাবল্য, ধর্মদ্রোহ ও মতবাদগত বিভক্তির আতঙ্ক, পাপ সম্পর্কে অতিক্রিয়াশীল সচেতনতা এবং নরক সম্পর্কিত বিকার বিরাজ করছিল। ১৬৪০ সালে ডাচ ক্যাথলিক কর্নেলিয়াস জানসেনের বিতর্কিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, যাতে নব্য কালভিনিজমের মতো এক ভীতিকর ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে যিনি নির্বাচিতদের বাদ দিয়ে আর সবার জন্যে অনন্ত নরকবাস নির্ধারিত করে রেখেছেন। স্বাভাবিকভাবেই বইটি ‘ঈশ্বরের কৃপার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার মতবাদ শিক্ষা দিয়েছে যা সত্য এবং সংস্কার মতবাদের অনুসারী”*২ আবিষ্কার করে কালভিনিস্টরা এ বইয়ের প্রশংসা করেছে।

ইউরোপের এই ব্যাপক আতঙ্ক আর হতাশাকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? চরম উদ্বেগের একটা কাল ছিল এটা: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভরশীল এক নতুন ধরনের সমাজের পত্তন ঘটতে যাচ্ছিল যা কিনা অচিরেই গোটা বিশ্ব অধিকার করে নেবে। তা সত্ত্বেও ঈশ্বর যেন এসব আতঙ্ক দূর করে সেফার্দিক ইহুদিরা ইসাক লুরিয়ার মিথে যেমন সান্ত্বনার খোঁজ পেয়েছিল সে রকম সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চানরা যেন সবসময়ই ঈশ্বরকে বাড়তি চাপ হিসাবে দেখে এসেছে ও এই ধর্মীয় উদ্বেগ দূর করার প্রয়াস পাওয়া সংস্কারবাদীরা যেন শেষ পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের চিরন্তন নরকবাস নির্ধারিত করে রাখা পাশ্চাত্যের ঈশ্বর যেন তারতুলিয়ান বা অগাস্তিনের সবচেয়ে বিমর্ষতম কল্পনার করা উপাস্যের চেয়েও কর্কশ ও রূঢ় হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি হতে পারে যে, ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ কল্পনানির্ভর মিথলজি ও অতিন্দ্রীয়বাদ আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা সম্ভব এমন একজন ঈশ্বরের মিথগুলোর চেয়ে মানুষকে দুঃখ কষ্ট অতিক্রমে অধিকতর কার্যকরভাবে সাহস যোগাতে সক্ষম?

প্রকৃতপক্ষেই যোড়শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইউরোপের অনেকেই অনুভব করতে শুরু করেছিল যে, ধর্মের মারাত্মক অমর্যাদা করা হয়েছে। ক্যাথলিকদের হাতে প্রটেস্ট্যান্ট ও প্রটেস্ট্যান্টদের হাতে ক্যাথলিকদের হত্যায় বিতৃষ্ণ হয়ে। পড়েছিল তারা। সত্য বা মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয় এমন কিছু ধারণা রক্ষা করতে গিয়ে হাজার হাজার লোক শহীদ হয়েছিল। মুক্তি লাভের জন্যে অপরিহার্য বিবেচিত অসংখ্য মতবাদ প্রচারকারী গোষ্ঠীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ধর্মতাত্ত্বিক পছন্দের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল; অসংখ্য ধর্মীয় ব্যাখ্যার ছড়াছড়ি দেখে অনেকেই হতবিহ্বল ও অসহায় বোধ করছিল। কেউ কেউ হয়তো বিশ্বাস স্থাপনে আগের চেয়ে কঠিন বলেও ভেবেছে। সুতরাং, এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে পাশ্চাত্যের ঈশ্বরের ইতিহাসে মানুষ নাস্তিক’ আবিষ্কার করতে শুরু করে, যাদের সংখ্যা ঈশ্বরের পুরোনো শত্রু এবং শয়তানের মিত্র ‘ডাইনীদের’ সমানই বলা যায়। বলা হয়ে থাকে, এই নাস্তিকরা’ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে এবং নিজেদের বিশ্বাসে লোকদের আকর্ষণ করে সমাজের বাঁধন শিথিল করে দিচ্ছিল। তা সত্ত্বেও আজকের পৃথিবীতে আমরা যেমন নাস্তিক্যবাদ দেখি তেমন পূর্ণাঙ্গ নাস্তিকতা তখন ছিল অসম্ভব। লুসিয়েন ফেবভ্রে তার দ্য প্রবলেম অভ আনবিলিফ ইন দ্য সিক্সটিন্থ সেঞ্চুরীতে যেমন দেখিয়েছেন, এই সময় ঈশ্বরের অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করার ধারণাগত অসুবিধা ছিল পাহাড়সম। জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু এবং দীক্ষা, চার্চইয়ার্ডে শেষকৃত্য পর্যন্ত নারী পুরুষের জীবনের সকল পর্যায়ে ছিল ধর্মের প্রাধান্য। দৈনন্দিন প্রতিটি কাজ, যার শুরু হতো গির্জার ঘণ্টা-ধ্বনির মাধ্যমে বিশ্বাসীকে প্রার্থনায় যোগ দেওয়ার আহবান জানানোর মাধ্যমে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথায় ছিল পরিপূর্ণ ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রাধান্য ছিল এগুলোর-এমনকি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ফেবদ্রে যেমন তুলে ধরেছেন, ঈশ্বর এবং ধর্ম এমন। ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত ছিল যে, এই পর্যায়ে কেউ একথা বলার চিন্তা করেনিঃ ‘সুতরাং আমাদের জীবন, আমাদের গোটা জীবন, খৃস্ট ধর্ম শাসন। করছে। আমাদের জীবনের কত সামান্য অংশ ইতিমধ্যে সেকুলার হয়েছে সেই তুলনায় আর সবকিছু ধর্ম দিয়ে পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত ও সংগঠিত হচ্ছে! ধর্মের প্রকৃতি বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো প্রয়োজনীয় বস্তুনিষ্ঠতা অর্জনকারী ব্যতিক্রমী কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকলেও তার পক্ষে তখনবার বিজ্ঞান বা দর্শন হতে কোনও রকম সাহায্য বা সমর্থন পাওয়া সম্ভব ছিল না । এক গুচ্ছ বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কিছু সংক সামঞ্জস্যপূর্ণ যুক্তি অস্তিত্ব লাভ না করা পর্যন্ত কারও পক্ষে এমন একজন ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার সম্ভব ছিল না, যার ধর্ম ইউরোপের নৈতিক, আবেগজাত, সৌন্দর্য সংক্রান্ত এবং রাজনৈতিক জীবনকে আকৃতি দিয়েছে ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই সমর্থন ছাড়া এ জাতীয় অস্বীকৃতি কেবল ব্যক্তিগত ঝোঁক বা চকিত খেয়াল মাত্র যা গভীর বিবেচনার যোগ্যতা রাখে। ফেবদ্রে যেমন দেখিয়েছেন, ফরাসি ভাষার মতো স্বদেশী ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে বা বাক্য গঠনে সংশয়বাদের প্রতিশব্দ ছিল না। পরম, আপেক্ষিক,’ ধারণা’ ও ‘সংজ্ঞা’র মতো শব্দগুলোর তখনও চল হয়নি। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বের কোনও সমাজই তখনও জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হিসাবে ধরে নেওয়া ধর্মকে বাদ দেয়নি। অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যায়ে আসার পরেই কেবল মুষ্টিমেয় কয়েকজন ইউরোপিয়র পক্ষে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা সম্ভব হয়েছিল।

তাহলে পরস্পরের বিরুদ্ধে নাস্তিক্যবাদের অভিযোগ তুলে কী বোঝাতে চাইত লোকে? ফরাসি বৈজ্ঞানিক মারিন মার্সেনে (১৫৮৮-১৬৪৮) ফ্রান্সিস্কান রীতির গোঁড়া সদস্যও ছিলেন, তিনি ঘোষণা করেছিলেন, কেবল প্যারিসেই প্রায় ৫০,০০০ হাজার নাস্তিক রয়েছে। কিন্তু তাঁর উল্লিখিত অধিকাংশ নাস্তিক’ই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল। এভাবে মাইকেল মন্টাগের বন্ধু পীয়েরে কারিন তাঁর নিবন্ধ লেস এয়েস ভেরিতেস (১৫৮৯)-এ ক্যাথলিসিজমের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রধান রচনা দে লা গোসি-তে তিনি যুক্তির অসারতার ওপর জোর দিয়ে দাবি করেছিলেন যে, মানুষ কেবল বিশ্বাস দিয়েই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারে। মারসেনে এর বিরোধিতা করেন এবং একে নাস্তিক্যবাদের সমার্থক হিসাবে দেখেন। আরেকজন ‘অবিশ্বাসী’র নিন্দা করেছিলেন তিনি, তাঁর নাম ইতালিয় যুক্তিবাদি জিয়ার্দানো ব্রুনো (১৫৪৮ ১৬০০); যদিও ব্রুনো আত্মা এবং বিশ্ব জগতের আদি ও অন্ত স্টোয়িক ধরনের ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। মারসেনে এদের দুজনকেই নাস্তিক আখ্যা দিয়েছিলেন, কারণ ঈশ্বর সংক্রান্ত মতবাদে তাঁদের সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন, তারা পরম সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন বলে নয়। অনেকটা একইভাবে রোমান সাম্রাজ্যের পৌত্তলিকরা ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের নাস্তিক বলেছে, কারণ ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের নিজস্ব ধারণার সঙ্গে তাঁদের ধারণার মিল ছিল না। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘নাস্তিক’ শব্দটি কেবল যুক্তি হিসেবেই তোলা ছিল। প্রকৃতপক্ষে, আপনার যে কোনও শত্রুকেই তখন অনায়াসে ‘নাস্তি ক’ বলে গাল দেওয়া যেত, ঠিক যেমন উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লোকজনকে ‘অ্যানারক্রিস্ট’ বা ‘কমিউনিস্ট’ তকমা এঁটে দেয়া হয়েছে।

সংস্কারের পর মানুষ নতুনভাবে খৃস্ট ধর্ম সম্পর্কে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিল। ডাইনী কিংবা বলা যায় অ্যানারকিস্ট বা কমিউনিস্ট’-এর মতো। নাস্তিক’ কথাটি এক সুপ্ত উদ্বেগের অভিক্ষেপ। এটা বিশ্বাস সম্পর্কে এক গোপন উদ্বেগ ফুটিয়ে তুলেছে এবং স্রষ্টাভীরুদের মনে ভয় জাগিয়ে সঙ্কাজে উৎসাহ যোগানোর একটা প্রচেষ্টা ছিল । লজ অভ একলেসিয়াস্টিক্যাল-এ অ্যাংলিক্যান ধর্মবিদ রিচার্ড হকার (১৫৫৪-১৬০০) তখন দু’ধরনের নাস্তিকের অস্তিত্ব দাবি করেন: একটা ছোট দল ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না এবং অপর একটি বড় গোষ্ঠী এমনভাবে জীবনযাপন করত যেন ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই। মানুষ এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য টানতে ভুলে যায় এবং দ্বিতীয়টি অর্থাৎ বাস্তব ভিত্তিক নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এভাবে দ্য থিয়েটার অভ গড়’স জাজমেন্ট (১৫৯৭) টমাস বেয়ার্ডের কাল্পনিক নাস্তিক ঈশ্বরের ক্ষমতা, আত্মার অমরত্ব ও পরকালের জীবনকে অস্বীকার করে, কিন্তু দৃশ্যতঃ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি। জন উইংফিল্ড তার অ্যাথিজম ক্লোজড অ্যান্ড ওপেন অ্যানাটোমাইযড (১৬৩৪) শীর্ষক গবেষণামূলক নিবন্ধে দাবি করেছেন: ‘কপটাচারী একজন নাস্তিক; দুরাত্মা ধরনের মানুষ প্রকাশ্যে নাস্তিক; নিরাপদ, বেপরোয়া ও অহংকারী চরিত্র নাস্তিক: যাকে শিক্ষা দেওয়া বা সংস্কার করা যাবে না সে-ই নাস্তিক। নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের উপনিবেশের সহায়তা দানকারী ওয়ালশ কবি উইলিয়াম ফনের (১৫৭৭-১৬৪১) চোখে যারা খাজনা আদায় করে ও সাধারণ মানুষকে বন্দি করে তারা সন্দেহাতীতভাবে নাস্তিক। ইংরেজ নাট্যকার টমাস ন্যাশে’ (১৫৬৭-১৬০১) ঘোষণা করেছেন যে, উচ্চাভিলাষী, লোভী, অতিভোজী, আত্মশ্লাঘা পোষণকারী ও পতিত, এরা সবাই নাস্তিক।

‘নাস্তিক’ শব্দটি ছিল অপমানকর। নিজেকে নাস্তিক দাবি করার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করত না কেউ। তখনও গর্বের সঙ্গে বহন করার মতো ব্যাজে পরিণত হয়নি এটা। তা সত্ত্বেও সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের অধিবাসীদের মাঝে এমন একটা মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি জেগে উঠেছিল যা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকারের ব্যাপারটি কেবল সম্ভবই করে তোলেনি বরং কাক্ষিত করেছে। বিজ্ঞানে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন লাভ করেছে তারা। তা সত্ত্বেও সংস্কারবাদীদের ঈশ্বর যেন নতুন বিজ্ঞানের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন। ঈশ্বরের পরম সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ছিলেন বলে লুথার ও কালভিন দুজনই প্রকৃতির নিজস্ব সহজাত ক্ষমতা থাকার অ্যারিস্টটলিয় ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতি ক্রিশ্চানদের মতোই নিষ্ক্রিয়, যার কেবল ঈশ্বরের কাছ থেকে উপহার হিসাবে মুক্তিকে গ্রহণ করা ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কালভিন স্পষ্ট ভাষাতেই প্রকৃতি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রশংসা করেছেন, কেননা প্রকৃতিতে অদৃশ্য ঈশ্বর নিজেকে তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞান ও ঐশীগ্রন্থের মাঝে কোনও রকম বিরোধ থাকতে পারে নাঃ বাইবেলে ঈশ্বর আমাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন, ঠিক যেমন করে একজন সুবক্তা তার চিন্তা ও বক্তব্যকে দর্শকদের ক্ষমতা

অনুযায়ী সমন্বিত করে নেন। সৃষ্টির বিবরণ, কালভিন বিশ্বাস করতেন, বালবুটিভের (শিশুসুলভ কথাবার্তা) একটা নজীর, যেখানে জটিল ও রহস্যময় বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে সাধারণ মানুষের মানসিকতায় ঠাই দেওয়া হয়েছে যাতে ঈশ্বরের উপর সবার বিশ্বাস বজায় থাকে। একে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না ।

রোমান ক্যাথলিক চার্চ অবশ্য আবার সবসময় ভোলা মনের পরিচয় দেয়নি। ১৫৩০ সালে পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস তার দে রিভোলুশনিবাস রচনা শেষ করেন, যেখানে দাবি করা হয় যে সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। ১৫৪৩ সালে তাঁর মৃত্যুর অল্পদিন আগে এটি প্রকাশিত হয় এবং চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় সংযোজিত হয় । ১৬১৩ সালে পিসান গণিতবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি দাবি করেন যে, তার আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ কোপার্নিকাসের পদ্ধতিকে সঠিক প্রমাণ করেছে। তার ব্যাপারটা একটি cause celebre-এ পরিণত হয়েছে। ইনকুইজিশনের সামনে তলব করা হয় তাকে। বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয় গ্যালিলিওকে; কারাবন্দি করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্যে। সকল ক্যাথলিক এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেনি, কিন্তু রোমান ক্যাথলিক চার্চ রক্ষণশীল চেতনার কালে অন্য যে কোনও সংস্থার মতো পরিবর্তনের বেলায় সচেতনভাবে বিরোধী ছিল । চার্চকে যা আলাদা করেছিল সেটা হচ্ছে প্রতিপক্ষের ওপর জোর খাটানোর ক্ষমতা; চমৎকারভাবে চলমান এক যন্ত্র ছিল সেটা, বুদ্ধিবৃত্তিক একতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মারাত্মক দক্ষ হয়ে উঠেছিল। অনিবার্যভাবে গ্যালিলিওর নিন্দা ক্যাথলিক দেশসমূহে বিজ্ঞানচর্চা রুদ্ধ করে দেয়, যদিও পূর্ববর্তীকালের বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, যেমন মারিন মারসেনে, রেনে দেকার্তে ও ব্লেইজ পাসকেল ক্যাথলিক বিশ্বাসে অটল ছিলেন। গ্যালিলিওর ব্যাপারটি জটিল। অবশ্য আমি এর সকল রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। একটা সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে, আমাদের কাহিনীর জন্যে যা গুরুত্বপূর্ণ: রোমান ক্যার্থলিক চার্চ স্রষ্টা ঈশ্বরের বিশ্বাসকে বিপদাপন্ন করেছে বলে হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের নিন্দা করেনি, করেছে এর সঙ্গে ঐশী গ্রন্থের বাণী মেলেনি বলেই।

গ্যালিলিওর বিচারের সময় বহু প্রটেস্ট্যান্টকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল ব্যাপারটা। লুথার বা কালভিন কেউই কোপার্নিকাসের নিন্দা করেননি, কিন্তু লুথারের সহযোগী ফিলিপ মেলেঞ্চথন (১৪৯৭-১৫৬০) সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণের ধারণা বাতিল করে দেন, কেননা এটা বাইবেলের নির্দিষ্ট কয়েকটা অনুচ্ছেদ বিরোধী। এটা প্রোটেস্ট্যান্টদের ব্যাপার ছিল না। কাউন্সিল অভ ট্রেন্টের পর ক্যাথলিকদের মাঝে নিজস্ব ঐশীগ্রন্থ সেইন্ট জেরোম অনূদিত বাইবেলের লাতিন ভাষ্য দ্য ভালগেট নিয়ে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল। ১৫৭৬ সালে স্প্যানিশ ইনকিউজিটর লিয়ন অভ ক্যাস্ট্রোর ভাষায়: ‘দ্য ভালগেটের লাতিন সংস্করণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী কোনও কিছু সামান্য সময়, কিংবা সামান্য সিদ্ধান্ত, ক্ষুদ্র বিধি, কোনও অভিব্যক্তি প্রকাশক শব্দ, কোনও শব্দাংশ বা কোন কিছু পরিবর্তন করা যাবে না।৪৭ অতীতে, আমরা যেনম দেখেছি, কোনও কোনও যুক্তিবাদী ও অতিন্দ্রীয়বাদী প্রতীকী ব্যাখ্যার পক্ষে বাইবেল ও কোরানের আক্ষরিক পাঠ হতে স্বেচ্ছায় সরে এসেছিল। এবার প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকরা ঐশীগ্রন্থের পুরোপুরি আক্ষরিক অর্থের ওপর বিশ্বাস স্থাপন শুরু করেছিল। গ্যালিলিও ও কোপার্নিকাসের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়তো ইসরায়েলি, সুফী, কাব্বালিস্ট বা হেসিচ্যাস্টদের অস্বস্তিত্বে ফেলত না, কিন্তু নতুন আক্ষরিক অর্থকে আলিঙ্গনকারী ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের জন্যে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার তত্ত্বটি কীভাবে বাইবেলের পঙক্তির সঙ্গে খাপ খাবে: পৃথিবীও দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ, সুতরাং একে নড়ানো যাবে না,’ ‘সূর্য উদিত হয়, সূর্য অস্তমিত হয়, এর উদিত হওয়ার নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে।’ ‘চন্দ্রকে তিনি ঋতু চক্রের জন্যে নিযুক্ত করেছেন; সূর্য জানে যে সে অস্তগামী হচ্ছে? গ্যালিলিওর কিছু কিছু মন্তব্যের কারণে চার্চের অধিকর্তারা দারুণ বিব্রত ছিলেন। যদি, তিনি যেমন বলেছেন, চাঁদে যদি মানুষ থাকে, তাহলে তারা আদমের বংশধর হবে কী করে, কীভাবেই বা তারা নোয়াহর আর্ক থেকে অবতরণ করেছিল? পৃথিবীর ঘূর্ণনের তত্ত্বের সঙ্গে ক্রাইস্টের স্বর্গারোহনের ঘটনার খাপ খাবে কীভাবে? ঐশীগ্রন্থে বলা হয়েছে স্বর্গসমূহ ও পৃথিবী মানুষের উপকারের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটা কীভাবে সম্ভব, যদি গ্যালিলিও যেমন দাবি করেছেন, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণকারী অন্যান্য গ্রহগুলোর মতো একটা গ্রহ হয়ে থাকে? স্বর্গ ও নরককে বাস্তব স্থান হিসাবে দেখা হতো, কোপার্নিকান ব্যবস্থায় যা নির্দিষ্ট করা কঠিন ছিল। যেমন নরক একেবারে পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত বলে ব্যাপক বিশ্বাস ছিল, দান্তে যেখানে দেখিয়েছিলেন। জেসুইট পণ্ডিত কার্ডিনাল রবার্ট বারমাইনের সদ্য প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেনেশন ফর দ্য প্রপাগেশন অভ ফেইথ গ্যালিলিওর বিষয়ে পরামর্শ করেছিলেন, তিনিও প্রচলিত ধারণার পক্ষাবলম্বন করেছেন: নরক কবর হতে আলাদা ভূগর্ভস্থ একটা জায়গা। উপসংহারে তিনি বলেছিলেন যে, নিশ্চয়ই পৃথিবীর কেন্দ্রে এর অবস্থান। স্বাভাবিক যুক্তির ভিত্তিতে চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন তিনি।

শেষটি হচ্ছে স্বাভাবিক যুক্তি। এখানে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে দূরাত্মা ও পাপিষ্ঠদের অবস্থান দেবদূত ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হতে যতটা সম্ভব দূরে হবে। আশীর্বাদপ্রাপ্তদের আবাস হবে (আমাদের প্রতিপক্ষ যা স্বীকার করেন) স্বর্গ; সুতরাং, পৃথিবীর কেন্দ্র ছাড়া স্বর্গের চেয়ে দূরবর্তী স্থান আর কিছু হতে পারে না।

আজকের দিনে বালারমাইনের যুক্তি হাস্যকর ঠেকে। এমনকি পুরোপুরি আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাসী ক্রিশ্চানও নরকের অবস্থান পৃথিবীর কেন্দ্রে ভাবে না। কিন্তু অনেকেই এক সুসংঘবদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্বে ঈশ্বরেরর কোনও স্থান নেই আবিষ্কারকারী অন্যান্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মুখোমুখি হয়ে প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল।

মোল্লা সদরা যখন মুসলিম শিক্ষা দিচ্ছিলেন যে, স্বর্গ ও নরক প্রত্যেকের অন্তরের কাল্পনিক জগতে অবস্থিত; ঠিক তখন বালারমাইনের মতো বিশিষ্ট গীর্জা অধিকর্তারা প্রবল যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন যে, এগুলোর সত্যিকার ভৌগলিক অবস্থান আছে। কাব্বানিস্টরা যখন সৃষ্টির বাইবেলিয় বিবরণকে একেবারে প্রতীকী অর্থে ব্যাখ্য করছিল আর অনুসারীদের এই মিথলজি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করার জন্যে সতর্ক করছিল, ঠিক সেই সময় ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টরা দাবি করছিল যে, বাইবেলের প্রতিটি বর্ণনা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এটা নতুন বিজ্ঞানের সামনে প্রচলিত ধর্মীয় মিথলজি নাজুক করে দেয় ও শেষ পর্যন্ত বহু লোকের পক্ষেই ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখাটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মবিদরা আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানুষকে তৈরি করছিলেন না। আর সংস্কারের পরবর্তী প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকের মাঝে অ্যারিস্টটলবাদের প্রতি আগ্রহের কাল থেকে তারা ঈশ্বর সম্পর্কে এমনভাবে আলোচনা শুরু করেছিল যেন তিনি কোনও বস্তুগত বিষয়। শেষ পর্যন্ত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদ ও উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের সময়টা নতুন নাস্তিকদের পক্ষে ঈশ্বরকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে সক্ষম করে তোলে।

এভাবেই স্যুভিয়ানের অত্যন্ত প্রভাবশালী জেসুইট ধর্মতাত্ত্বিক লেনার্দ লেসিয়াস (১৫৫৪-১৬২৩) তাঁর দ্য ডিভাইন প্রভিডেন্ট নিবন্ধে দার্শনিকদের ঈশ্বরের প্রতি যেন আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। এই ঈশ্বরের অস্তিত্ব জীবনের অন্য যে কোনও বাস্তবতার মতো বৈজ্ঞানিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব। বিশ্ব জগতের পরিকল্পনা বা আকস্মিক দুর্ঘটনা হতে পারে না, একজন প্রাইম মুভার বা প্রতিপালকের অস্তিত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে। অবশ্য লেসিয়াসের ঈশ্বরের মাঝে ক্রিশ্চানসূচক কিছু ছিল নাঃ তিনি বৈজ্ঞানিক সত্য যাকে যে কোনও যুক্তিবাদী মানুষ আবিষ্কার করতে পারবে। লেসিয়াস কদাচ জেসাসের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এমন ধারণা দিয়েছেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সাধারণ পর্যবেক্ষণ, দর্শন, ধর্মের তুলনামূলক গবেষণা আর সাধারণ জ্ঞানেই বের করা সম্ভব। পশ্চিমের বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ আরও যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করতে যাচ্ছিলেন ঈশ্বর তেমনি একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছিলেন। ফায়সুফরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক প্রমাণাদির বৈধতা নিয়ে কখনও সন্দেহ পোষণ করেনি, কিন্তু তাদের সহধর্মবাদীরা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে দার্শনিকদের এই ঈশ্বরের খুব সামান্যই ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। তোমাস আকুইনাস হয়তো ধারণা দিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর সত্তার ধারাবাহিকতায় আর একটি বস্তু মাত্র-যদিও সর্বোত্তম-কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন যে, এইসব দার্শনিক যুক্তির সঙ্গে প্রার্থনায় তাঁর অনুভূত অতিন্দ্রীয় ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নেতৃস্থানীয় ধর্মতাত্ত্বিক ও গীর্জা-অধিপতিগণ পুরোপুরি যৌক্তিক ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ অব্যাহত রাখেন। আজকের দিনেও অনেকে তা করে আসছে। নতুন বিজ্ঞানের কাছে এসব যুক্তি অসার প্রমাণ হলো। স্বয়ং ঈশ্বরের অস্তিত্বই আক্রমণের মুখে পড়ল। কেবল কল্পনা নির্ভর অনুশীলন ও প্রার্থনায় আবিষ্কার যোগ্য ঈশ্বরকে অস্তিত্বের সাধারণ অর্থে অস্তিত্বহীন এক সত্তার প্রতীক হিসাবে দেখার বদলে ক্রমবর্ধমান হারে তাকে জীবনের অন্য যে কোনও বাস্তবতার মতো মনে করা হচ্ছিল। লেসিয়াসের মতো ধর্মতাত্ত্বিকদের মাঝে আমরা পাশ্চাত্যকে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যেতে দেখি, খোদ ধর্মবিদরাই ভবিষ্যতের নাস্তিকদের হাতে এমন এক ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যানের অস্ত্র তুলে দিচ্ছিলেন যার ধর্মীয় মূল্য ছিল খুব সামান্য এবং যিনি বহু মানুষের মনে আশা আর বিশ্বাসের পরিবর্তে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিলেন। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মতো সংস্কার-পরবর্তী ক্রিশ্চানরা অতিন্দ্রীয়বাদীদের কাল্পনিক ঈশ্বরকে কার্যকরভাবে বাদ দিয়ে যুক্তির ঈশ্বরের কাছে আলোকন প্রত্যাশা করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *