০২. এক ঈশ্বর

২. এক ঈশ্বর

বিসিই ৭৪২ সালে জুদাইন রাজ পরিবারের একজন সদস্য দিব্যদৃষ্টিতে জেরুজালেমে বাদশাহ সলোমন কর্তৃক নির্মিত মন্দিরে অবস্থানরত ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে দেখতে পান। ইসরায়েলের জনগণের এক উদ্বেগময় সময় ছিল সেটা। সে বছর জুদাহ্র রাজা উযিয়াহ্ মারা যান এবং তার ছেলে আহায় সিংহাসনে আরোহন করেন। প্রজাদের ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পাশাপাশি পৌত্তলিক দেবতাদেরও উপাসনা করার জন্যে উৎসাহিত করেন তিনি। উত্তরাঞ্চলীয় ইসরায়েল রাজ্যে তখন প্রবল অরাজক-প্রায় অবস্থা চলছে: রাজা দ্বিতীয় জেরোবম-এর মৃত্যুর পর ৭৪৬ থেকে ৭৩২ সময় কালে পাঁচ পাঁচজন রাজা সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন, এদিকে আসিরিয়ার রাজা তৃতীয় তিগলেদ পিলসার বুভুক্ষের মতো তাদের ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়েছিলেন, ওই অঞ্চলটিকে নিজের ক্রমপ্রসারমান সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করতে উদগ্রীব ছিলেন তিনি। ৭২২ সালে তার উত্তরাধিকারী রাজা দ্বিতীয় সারগন উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য দখল করে অধিবাসীদের বিতাড়িত করেন: ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় দশটি গোত্র একীভূত হতে বাধ্য হয় এবং ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়। ওদিকে ক্ষুদ্র জুদাহ রাজ্যটি আপন অস্তিত্ব নিয়ে ছিল শঙ্কিত। রাজা উযিয়াহর মৃত্যুর অল্প দিন পরে মন্দিরে প্রার্থনা করার সময় ইসায়াহ্ সম্ভবত প্রবল বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন; এবং একই সময় সম্ভবত অস্বস্তির সঙ্গে বিলাসবহুল মন্দিরে আনুষ্ঠানিকতার অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। ইসায়াহ্ হয়তো শাসক শ্রেণীর সদস্য ছিলেন, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জনমুখী ও গণতান্ত্রিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্দশা নিয়ে দারুণভাবে চিন্তিত ছিলেন তিনি। পবিত্র মন্দিরের সামনের স্যাঙ্কচুয়্যারি যখন সুগন্ধি ধুপের ধোঁয়ায় ভরে উঠত ও উৎসর্গের প্রাণীর রক্তের উৎকট গন্ধে ভরে যেত তিনি হয়তো তখন ইসরায়েলের ধর্ম অখণ্ডতা ও অন্তর্নিহিত অর্থ হারিয়ে ফেলেছে ভেবে শঙ্কিত বোধ করছিলেন।

সহসা তিনি যেন দেখতে পেলেন, স্বর্গীয় প্রাসাদের প্রতিরূপ মন্দিরের ঠিক ছাদ বরাবর স্বর্গীয় সিংহাসনে বসে আছেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র আলখেল্লাহ স্যাঙ্কচুয়ারি পরিপূর্ণ করে ফেলেছে, দুজন সেরাফ তার সেবা করছিল, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ মুখের দিকে যেন না তাকাতে হয় তাই ডানা দিয়ে মুখ আড়াল করে রেখেছে তারা। সমবেত কণ্ঠে পরস্পরের উদ্দেশে চেঁচাচ্ছে তারা: ‘পবিত্র! পবিত্র! ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ স্যাবোথ পবিত্র। তার প্রতাপ গোটা পৃথিবীকে পূর্ণ করেছে।’[১] ওদের কণ্ঠস্বরে গোটা মন্দির যেন ভিত্তিমূলসহ কাঁপছে বলে মনে হতে লাগল, ধোঁয়ায় ভরে গেল পুরো জায়গা, নিশ্চিদ্র মেঘের মতো ঢেকে ফেলল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে, সিনাই পর্বতে যেমন মেঘ আর ধোঁয়া মোজেসের কাছ থেকে আড়াল করেছিল তাঁকে। বর্তমানে আমরা ‘পবিত্র’ শব্দটি ব্যবহার করার সময় সাধারণভাবে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু হিব্রু কাদ্দোশ এর সঙ্গে নৈতিকতার কোনও সম্পর্ক নেই, এটা ‘ভিন্নতা’ (otherness), চরম ভিন্নতা বোঝায়। সিনাই পর্বতে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র আবির্ভাব মানুষ ও স্বর্গীয় জগতের মাঝে আকস্মিক সৃষ্ট বিশাল দূরত্ব তুলে ধরেছিল। এযাত্রা সেরাফরা চিৎকার করে বলেছিল: ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আলাদা আলাদা! আলাদা!’ সময়ে সময়ে নারী-পুরুষকে বিস্ময় ও আতঙ্কে ভরিয়ে তোলা ঐশ্বরিক অনুভূতির (numinous) অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন ইসায়াহ্। রুডল্‌ফ অটো তার ক্লাসিক গ্রন্থ দ্য আইডিয়া অভ হোলিতে দুয়ে সত্তার আতঙ্কময় উপলব্ধিকে মিস্টেরিয়াম টেরিবল এত ফ্যাসিনান্স বলে বর্ণনা করেছেন: এটা ভয়ঙ্কর, কেননা এমন গভীর ধাক্কার মতো আমাদের কাছে আসে যার ফলে আমরা স্বাভাবিক অবস্থার সান্ত্বনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি; এবং ফ্যাসিন্যান্স, কারণ বিপরীতে এটা এক ধরনের অদম্য আকর্ষণের সৃষ্টি করে। এই সর্বগ্রাসী অভিজ্ঞতার কোনও যুক্তি নেই, যার সঙ্গে অটো সঙ্গীত বা যৌনতার তুলনা করেছেন: এর সৃষ্ট আবেগ ভাষা বা ধারণা দিয়ে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে ‘সম্পূর্ণ’ ভিন্ন-এর অনুভূতির ‘অস্তিত্ব’ আছে, এটাও বলা যাবে না, কারণ আমাদের স্বাভাবিক বাস্তবতার জগতে এর কোনও স্থান নেই।[২] অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তখনও যোদ্ধাদের দেবতা স্যাবোথ ছিলেন, কিন্তু স্রেফ একজন যুদ্ধ দেবতা ছিলেন না; আবার কোনও গোত্রীয় উপাস্যও ছিলেন না তিনি, যিনি চরমভাবে ইসরায়েলের পক্ষে তার প্রতাপ ও প্রতিশ্রুত ভূমির সীমানায় আবদ্ধ ছিলেন না, বরং গোটা পৃথিবীকে পূর্ণ করে তুলেছিলেন।

ইসায়াহ্ স্থৈর্য ও আনন্দবাহী আলোকনের অভিজ্ঞতা অর্জনকারী বুদ্ধ ছিলেন না। তিনি মানুষের নিখুঁত শিক্ষকে পরিণত হতে পারেননি। উল্টে মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছেন, সশব্দে বলে উঠেছেন:

তখন আমি কহিলাম, হায় আমি নষ্ট হইলাম,
কেননা আমি অশুচি-ওষ্ঠাধর মানুষ,
এবং অশুচি-ওষ্ঠাধর জাতির মধ্যে বাস করিতেছি;
আর আমার চক্ষু রাজাকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ স্যাবোথকে দেখিতে পাইয়াছে।[৩]

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ছাপিয়ে যাওয়া পবিত্রতায় আক্রান্ত ইসায়াহ কেবল নিজের অসম্পূর্ণতা ও আচরিক অপবিত্রতা সম্পর্কেই সচেতন ছিলেন। বুদ্ধ বা কোনও যোগীর বিপরীতে কিছু সংখ্যক আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ভেতর দিয়ে নিজেকে এরকম অভিজ্ঞতার জন্যে প্রস্তুত করেননি তিনি। আচমকা তার কাছে হাজির হয়েছে এটা, এর প্রলয়ঙ্করী প্রভাবে সম্পূর্ণ দিশাহারা হয়ে গেছেন তিনি। জ্বলন্ত কয়লায় টুকরো হাতে এক সেরাফ তাঁর কাছে উড়ে এসে মুখ পবিত্র করে দিল যাতে তিনি তার মুখে ঈশ্বরের বাণী উচ্চারণ করতে পারেন। পয়গম্বরদের অনেকেই ঈশ্বরের পক্ষে কথা বলতে অনিচ্ছুক ছিলেন বা সক্ষম ছিলেন না। ঈশ্বর সকল পয়গম্বরদের আদি সংস্করণ মোজেসকে জ্বলন্ত ঝোঁপ থেকে ডেকে ইসরায়েলের সন্তানের কাছে তার বার্তাবাহক হওয়ার নির্দেশ দিলে মোজেস এই বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যে, তিনি ‘জড় মুখ ও জড় বিত্তের। এই অপরাগতার জন্যে ছাড় দিয়েছেন ঈশ্বর, তাঁর ভাই আরনকে মোজেসের পক্ষে কথা বলার অনুমতি দিয়েছেন। পয়গম্বরদের জীবন-কাহিনীর এই সাধারণ মোটিফটি ঈশ্বরের ভাষায় কথা বলার সমস্যাকেই প্রতীকায়িত করে। পয়গম্বরগণ স্বর্গীয় বার্তা ঘোষণায় আগ্রহী ছিলেন না; প্রবল চাপ ও কষ্টের মিশন গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন তারা। ইসরায়েলের ঈশ্বরের এক দুৰ্জ্জেয় শক্তিতে রূপান্তর শান্ত, অচঞ্চল প্রক্রিয়া ছিল না, বরং কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করতে হয়েছে।

হিন্দুরা কখনও তাদের ব্রহ্মাকে মহান রাজা বলে আখ্যায়িত করেনি, কারণ তাদের ঈশ্বরকে এরকম মানবীয় পরিভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ইসায়াহ্‌র দিব্যদর্শনের কাহিনীটিকে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা না করার জন্য আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে: এটা বর্ণনাতীতকে বর্ণনার একটা প্রয়াস মাত্র। ইসায়াহ্ নিজের অজান্তেই মানুষের কাছে আপন অভিজ্ঞতার খানিকটা ধারণা দিতে তাঁর দেশের জনগণের পৌরাণিক ঐতিহ্য ফিরে নিয়েছেন। শ্লোকসমূহে (Psalms) প্রায়শঃই ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে সিংহাসনে আসীন রাজা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ঠিক তাদের প্রতিবেশীদের দেবতা বাআল, মারদুক ও দাগনের মতো, প্রায় একই ধরনের মন্দিরে রাজা হিসাবে যাদের অধিষ্ঠান ছিল। অবশ্য পৌরাণিক ইমেজারির আড়ালে ইসরায়েলে পরম সত্তা সম্পর্কিত এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ধারণা উঠে আসছিল। এই ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ। ভীতিকর ভিন্নতা সত্ত্বেও ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ইসায়াহ্‌র সঙ্গে কথা বলতে পারেন, ইসায়াহ্ও জবাব দেন। কিন্তু উপনিষদের সাধুদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য ঠেকত, কেননা ব্রাহ্মণ আত্মার সঙ্গে কথোপকথন বা সাক্ষাতের ধারণা অসঙ্গতভাবে মানবীয়।

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ জিজ্ঞেস করলেন: ‘আমি কাকে পাঠাব? কে আমাদের বার্তাবাহক হবে?’ অতীতের মোজেসের মতো ইসায়াহ্ ঝটপট জবাব দিলেন: ‘আমি উপস্থিত (হিনেনি), আমাকে পাঠান!’ এই দর্শনের মূল কথা পয়গম্বরকে আলোকিত করা নয় বরং তাকে একটা নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দেওয়া। প্রাথমিকভাবে পয়গম্বর তিনি যিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্যে যান, কিন্তু দুয়ের এই অভিজ্ঞতা-বোধ বৌদ্ধমতবাদের মতো জ্ঞান দান করে না বরং দায়িত্ব সৃষ্টি করে । পয়গম্বর অতিন্দ্রীয় আলোকনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হবেন না বরং আনুগত্যের স্বাক্ষর রাখবেন। এটা প্রত্যাশা করাই স্বাভাবিক যে, বার্তা কখনও সহজ নয়। প্রচলিত সেমিটিক প্যারাডক্সের মাধ্যমে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে ইসায়াহকে বলেছেন যে মানুষ একে গ্রহণ করবে নাঃ তারা ঈশ্বরের বাণীকে প্রত্যাখ্যান করলে তিনি যেন হতাশ না হন: তুমি যাও, ওই জাতিকে বল, তোমরা শুনিতে থাকিও, কিন্তু বুঝিও না; এবং দেখিতে থাকিও, কিন্তু জানিও না।[৬] সাত শত বছর পর মানুষকে একই রকম কঠিন বার্তা প্রত্যাখ্যান করতে দেখে জেসাসও এই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন। খাঁটি সত্যকে মানব জাতি ধারণ করতে পারে না। ইসায়াহর আমলের ইসরায়েলিরা সংঘাত ও বিলুপ্তির উপান্তে অবস্থান করছিল। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তাদের কোনও সুসংবাদ দেননিঃ তাদের শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, গ্রামগুলো বিধ্বস্ত হবে, জনশূন্য হয়ে পড়বে ঘরবাড়ি। ৭২২ সালে উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের ধ্বংস ও দশটি গোত্রের বিতাড়ন প্রত্যক্ষ করার জন্য বেঁচে ছিলেন ইসায়াহ্। ৭০১ সালে সেন্নাচেরি এক বিশাল আসিরিয় সেনাবাহিনী নিয়ে জুদাহয় হামলা চালান, এখানকার ছিচল্লিশটি নগরী ও দুর্গ অবরোধ করেন; শূলে চড়িয়ে হত্যা করেন প্রতিরোধকারী কর্মকর্তাদের, দেশছাড়া করেন : ২০০০ মানুষকে এবং জেরুজালেমে ইহুদি রাজাকে ‘খাঁচায় বন্দি পাখির মতো’[৮] আটক করেন। এসব আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করার পুরস্কারহীন দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইসায়াহ্:

যদ্যপি তাহার দশমাংশও থাকে,
তথাপি তাহাকে পুনর্বার গ্রাস করা যাইবে;
কিন্তু যেমন এলা ও অলোনে বৃক্ষ ছিন্ন হইলেও তাহার গুঁড়ি থাকে,
তেমনি এই জাতির গুঁড়িস্বরূপ এক পবিত্র বংশ থাকিবে।[৯]

একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের পক্ষে এসব দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া অসম্ভব ছিল না। ইসায়াহর বাণীর অসাধারণ মৌলিকত্ব হচ্ছে তার পরিস্থিতির বিশ্লেষণ। মোজেসের প্রাচীন পক্ষপাতদুষ্ট ঈশ্বর আসিরিয়াকে শত্রুর ভূমিকায় নিয়ে আসতেন; ইসায়াহর ঈশ্বর আসিরিয়াহকে নিজ উপায় হিসাবে দেখেছেন: দ্বিতীয় সারগন ও সেন্নাচেরিব ইসরায়েলিদের দেশান্তরী করে দেশকে ধ্বংস করেননি। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই জনগণকে বিতাড়ন করেছেন।[১০]

অ্যাক্সিয়াল যুগের পয়গম্বরদের বাণীর এটাই ছিল এক সুর। কেবল মিথ ও লিটার্জিতে নয়, ইসরায়েলের ঈশ্বর নিরেট বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে নিজেকে প্রকাশের মাধ্যমে মূলত পৌত্তলিক উপাস্য হতে নিজের অনন্যতা প্রকাশ করেছিলেন। এবার নতুন পয়গম্বরগণ জোর দিয়ে বলতে শুরু করলেন যে, রাজনৈতিক দুর্যোগ ও বিজয় উভয়ই ঈশ্বরকে প্রকাশ করে যিনি ইতিহাসের প্রভু ও নিয়ন্তা হয়ে উঠছেন। সকল জাতি তার ভাণ্ডারে ছিল। আসিরিয়াহ দুর্যোগ কবলিত হবে, কারণ এর শাসকগণ উপলব্ধি করতে পারেনি যে তারা আসলে আরও বিশাল এক সত্তার হাতের পুতুল মাত্র।[১১] যেহেতু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আসিরিয়ার ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছেন, সেহেতু ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্ষীণ একটা আশা ছিল। কিন্তু কোনও ইসরায়েলি এ কথা শুনতে চাইত না যে তার স্বজাতিই অদূরদর্শী রাজনীতি ও শোষণমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে মাথার উপর রাজনৈতিক ধ্বংস ডেকে এনেছে। এ কথা শুনে কেউ খুশি হতো না যে, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই ৭২২ এবং ৭০১ সালে আসিরিয়া যুদ্ধের রূপকার ছিলেন, ঠিক যেভাবে তিনি জোশুয়া, গিদিয়ান ও রাজা ডেভিডের সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যে জাতির তার মনোনীত জাতি হওয়ার কথা সে জাতিকে নিয়ে কী ছেলেখেলা খেলছিলেন তিনি? ইসায়াহু কর্তৃক ইয়াহ্‌ওহেয়ের বর্ণনায় স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা পূরণের কিছু ছিল না। মানুষকে কষ্ট হতে মুক্তি দানের বদলে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ যেন অনাকাক্ষিত বাস্তবতার মোকাবিলা করতে বলছিলেন। মানুষকে পৌরাণিক কালে নিক্ষেপকারী প্রাচীন কাল্টিক রীতিনীতির আশ্রয় নেওয়ার বদলে ইসায়াহ্‌র মতো পয়গম্বরগণ দেশবাসীকে ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনাপ্রবাহের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন এবং সেগুলোকে ঈশ্বরের সঙ্গে ভীতিকর সংলাপ হিসাবে মেনে নিতে বলেছিলেন।

মোজেসের ঈশ্বর যেখানে বিজয়ের আনন্দে উল্লাসিত ছিলেন, ইসায়াহর ঈশ্বর সেখানে বিষাদময়। ভবিষ্যদ্বাণী, আমরা যেভাবে পাই, শুরু হয়েছে এক শোকবার্তা দিয়ে যেটা চুক্তির মানুষের জন্য দারুণভাবে হতাশাব্যাঞ্জক: ষাঁড় ও গাধা যার যার মনিবকে চেনে, কিন্তু ইসরায়েল জানে না, আমার প্রজাগণ বিবেচনা করে না।[১২] মন্দিরে পশুর উৎসর্গ নিয়ে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ দারুণ বিক্ষুব্ধ, বাছুরের চর্বি দেখে তিনি অসুস্থ বোধ করেন, ছাগলের রক্ত ও পোড়া পশুর ঝরে পড়া রক্ত বিবমিষা জাগায়। ওদের উৎসব, নববর্ষের অনুষ্ঠান ও তীর্থযাত্রা বরদাশত করতে পারেননি তিনি।[১৩] ইসায়াহর শ্রোতারা এতে হতচকিত হয়ে থাকতে পারে: মধ্যপ্রাচ্যে এইসব কাল্টিক আনুষ্ঠানিকতা ছিল ধর্মের মূল রূপ । পৌত্তলিক দেবতাগণ তাঁদের হ্রাসমান শক্তির নবায়নের জন্যে আনুষ্ঠানিকতার। ওপর নির্ভরশীল ছিলেন; মন্দিরের জাকজমকের ওপর তাদের মর্যাদার অংশ নির্ভর করত। এখন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বলছেন তার কাছে এসব কর্মকাণ্ড একেবারে অর্থহীন। ওইকুমিনের অন্যান্য সাধু ও দার্শনিকের মতো ইসায়াহ্ উপলব্ধি করেছিলেন যে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা যথেষ্ট নয়। ইসরায়েলিদের অবশ্যই তাদের ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে হবে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ উৎসর্গ নয় বরং সমবেদনা চেয়েছেন:

যদ্যপি অনেক প্রার্থনা কর,
তথাপি শুনিব না;
তোমাদের হস্ত রক্তে পরিপূর্ণ।
তোমরা আপনাদিগকে ধৌত কর, বিশুদ্ধ কর,
আমার নয়নগোচর হইতে তোমাদের ক্রিয়ার দুষ্টতা দূর কর;
কদাচরণ ত্যাগ কর,
সদাচরণ শিক্ষা কর,
ন্যায় বিচারের অনুশীলন কর,
উপদ্রবী লোককে শাসন কর,
পিতৃহীন লোকের বিচার নিষ্পত্তি কর,
বিধবার পক্ষ সমর্থন কর। [১৪]

স্বয়ং পয়গম্বরগণই সমবেদনার প্রবল দায়িত্ববোধ আবিষ্কার করেছিলেন যা পরবর্তীকালে অ্যাক্সিয়াল যুগে বিকশিত সকল প্রধান ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্যে পরিণত হবে। এ সময়কালে ওইকুমিনে বিকাশমান নতুন মতবাদসমূহ এই মর্মে জোর দিয়েছে যে, সত্যের পরীক্ষা হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে সাফল্যের সঙ্গে সমন্বিত করা। মন্দিরের আনুষ্ঠানিকতা ও মিথের অপার্থিব জগতে আবদ্ধ হয়ে থাকা যথেষ্ট ছিল না। আলোকপ্রাপ্তির পর পুরুষ বা নারীকে অবশ্যই বাজার এলাকায় ফিরে গিয়ে সকল জীবিত প্রাণীর প্রতি দরদ প্রদর্শনের অনুশীলন করতে হবে।

সিনাইয়ের আমল থেকেই পয়গম্বরদের সামাজিক মতবাদ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্টে অন্তর্লীন ছিল: এক্সোডাসের কাহিনীতে ঈশ্বর যে নির্যাতিতের পক্ষেই ছিলেন তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পার্থক্য হচ্ছে এবার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধেই নির্যাতনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ইসায়াহ্‌র পয়গম্বরত্ব প্রাপ্তির সময় আরও দুজন পয়গম্বর অরাজক উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যে একই ধরনের বাণীর শিক্ষা দিচ্ছিলেন। প্রথমজনের নাম আমোস যিনি ইসায়াহ্‌র মতো অভিজাত শ্রেণীর লোক ছিলেন না, বরং রাখাল হিসাবে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যে বাস করতেন। আনুমানিক ৭৫২ সালে আমোসও আকস্মিকভাবে আদিষ্ট হয়ে উত্তরের ইসরায়েল রাজ্যে ধেয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঝড়ের বেগে বেথ এলের প্রাচীন মন্দিরে প্রবেশ করে প্রলয়ের ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা পণ্ড করে দিয়েছিলেন তিনি। বেথ-এলের যাজক আমাযিয়াহ তাড়ানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন তাঁকে। অর্বাচীন রাখালকে ভর্ৎসনা করার সময় আমরা তার কণ্ঠে প্রশাসনের কর্তৃত্বের সুর শুনতে পাই। তিনি যেন তাঁকে ভবিষ্যদ্বক্তাদের কোনও সদস্য ধরে নিয়েছিলেন, যারা দলে দলে ঘুরে ভবিষ্যদ্বাণী করে পেট চালায়। ‘হে দর্শক, যিহুদা দেশে পলায়ন কর।’ বিকৃত কণ্ঠে বলেন তিনি। সেই স্থানে রুটি ভোজন কর আর সেই স্থানে ভাববাণী বল। বেথল-এলে আমরা কিন্তু বৈথেলে আর ভাববাণী বলিও না, কেননা এ রাজার পূণ্যধাম ও রাজপুরী। একটুও দমলেন না আমোস, ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তীব্র ভর্ৎসনার সুরে জবাব দিলেন, তিনি দলীয় পয়গম্বর নন, বরং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাছ থেকে সরাসরি ক্ষমতাপ্রাপ্ত: ‘আমি কোনও পয়গম্বর নই, আমি পয়গম্বরদের ভ্রাতুসঙ্ঘের সদস্যও নই। আমি গোপালক ও ডুমুরফল সংগ্রাহক ছিলাম, কিন্তু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আমাকে ভেড়ার পাল দেখাশোনা থেকে সরিয়ে এনেছেন, এবং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বলেছেন: ‘যাও, আমার ইসরায়েল জাতিকে ভবিষ্যৎ জানিয়ে দাও।’[১৫] তবে কি বেথ-এলের জনগণ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র বাণী শুনতে রাজি নয়? খুব ভালো, আবার এক দফা বক্তব্য রাখলেন তিনি: ওদের স্ত্রীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে, সন্তানদের হত্যা করা হবে এবং ইসরায়েল থেকে বহু দূরে নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যু ঘটবে ওদের।

নিঃসঙ্গতা ছিল পয়গম্বরের মূল বৈশিষ্ট্য। আমোসের মতো ব্যক্তিরা ছিলেন একাকী; অতীতের ছন্দ ও কর্তব্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল তাঁর। এটা তার বেছে নেওয়া কিছু ছিল না, তার ওপর আরোপিত হয়েছে। মনে হয় যেন চেতনার স্বাভাবিক প্যাটার্ন থেকে সহসা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল তাঁকে, ফলে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ আর বজায় রাখতে পারছিলেন না। চান বা না চান জোর করে তাকে পয়গম্বর হতে বাধ্য করা হয়েছে। আমোস যেমন বলেছেন:

সিংহ গর্জন করিল, কে না ভয় করিবে?
প্রভু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ কথা কহিলেন, কে না ভাববাণী বলিবে?[১৬]

বুদ্ধের মতো নির্বাণের সত্তাহীন বিলুপ্তিতে হারিয়ে যাননি আমোস; পরিবর্তে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তার অহমের স্থান দখল করে তাকে ভিন্ন জগতে টেনে নিয়েছেন। পয়গম্বরদের মাঝে আমোসই প্রথম সামাজিক ন্যায়বিচার ও সহানুভূতির গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। বুদ্ধের মতো তিনিও মানুষের দুঃখকষ্ট সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন ছিলেন। আমোসের ভবিষ্যদ্বাণীর মাঝে নির্যাতিতের পক্ষে কথা বলছিলেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌, দরিদ্রদের, ভাষাহীনদের অক্ষমতাকে ভাষা দিয়েছেন। আমরা যেভাবে পাই, তার ভবিষ্যদ্বাণীর একেবারে প্রথম লাইনেই ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ জেরুজালেমে তার মন্দির থেকে জুদাহ্ ও ইসরায়েলসহ নিকট প্রাচ্যের সবগুলো দেশের দুঃখকষ্টের কথা ভেবে তীব্র রোষে গর্জন করছেন। ইসরায়েলের জনগণ গোয়িম (goyim) অর্থাৎ জেন্টাইল (বা অ-ইহুদিদের মতোই খারাপ: তারা হয়তো দরিদ্রের ওপর নিষ্ঠুরতা ও তাদের নির্যাতনকে অগ্রাহ্য করতে পারে, কিন্তু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তা পারেন না। প্রতিটি প্রতারণা, শোষণ ও বঞ্চনার দারুণ নজীর লক্ষ করছেন তিনিঃ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ যাকবের মহিমাস্থলের নাম লইয়া শপথ করিয়াছেন: ‘নিশ্চয়ই ইহাদের কোনও ক্রিয়া আমি কখনও ভুলিয়া যাইব না।’[১৭] প্রভুর শেষ বিচারের আকাক্ষা করার মতো কী হঠকারী তারা, যেদিন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ইসরায়েলকে আনন্দিত করবেন আর অপমানিত করবেন গোয়িমদের? ওদের জন্যে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে: ‘ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র দিন তোমাদের কি করিবে? তাহা অন্ধকার, আলোক নহে।’[১৮] ওরা কী নিজেদের ঈশ্বরের মনোনীত জাতি ভেবেছে? আসলে চুক্তির (Covenant) প্রকৃতি উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে তারা, যার অর্থ দায়িত্ব, সুবিধা নয়: ‘হে ইসরায়েল-সন্তানগণ, তোমরা এই বাক্য শুন, যাহা তোমাদের বিরুদ্ধে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বলিয়াছেন। চিৎকার করে বলেছেন আমোস, ‘আমি মিশর দেশ হইতে যাহাকে বাহির করিয়া আনিয়াছি সেই সমস্ত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে [বলিয়াছি] :

‘আমি পৃথিবীস্থ সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে তোমাদেরই পরিচয় লইয়াছি এইজন্য তোমাদের সমস্ত অপরাধ ধরিয়া তোমাদিগকে প্রতিফল দিব।’[১৯]

চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েলের সকল মানুষ ঈশ্বরের নির্বাচিত এবং সে কারণে ভালো আচরণ পাবার দাবিদার। ঈশ্বর কেবল ইসরায়েলকে মহত্ব দান করার জন্যেই ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করেন না, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই তার উদ্দেশ্য। ইতিহাসে এটাই তাঁর স্বার্থ, প্রয়োজনে তিনি আপনভূমিতে ন্যায়বিচার স্থাপন করার জন্যে আসিরিয় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করবেন।

এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, অধিকাংশ ইসরায়েলি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হতে পয়গম্বরের আহ্বানে সাড়া দিতে রাজি হয়নি। জেরুজালেম মন্দির বা কানানের প্রাচীন উর্বরতার দেবীদের স্বল্প চাহিদাসম্পন্ন ধর্ম পছন্দ ছিল তাদের। এভাবেই চলে আসছে: সংখ্যালঘুরা সহমর্মিতার ধর্ম অনুসরণ করে; অধিকাংশ ধার্মিক ব্যক্তিই সিনাগগ, চার্চ, মন্দির আর মসজিদে জাঁকজমকপূর্ণ উপাসনা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। প্রাচীন কানানিয় ধর্মগুলো তখনও ইসরায়েলে বিকশিত হচ্ছিল। দশম শতকে রাজা প্রথম জেরোম ডান ও বেথ এলের স্যাঙ্কচুয়ারিতে দুটো কাল্টিক সঁড় স্থাপন করেছিলেন। দুই শত বছর পরও ইসরায়েলিরা সেখানে উর্বরতা বৃদ্ধির আচার ও পবিত্র যৌনতায় অংশ নিয়েছে, আমোসের সমসাময়িক পয়গম্বর হোসেয়ার ভবিষ্যদ্বাণীতে যেমনটি আমরা দেখতে পাই। ইসরায়েলিদের কেউ কেউ অন্যান্য দেবতার মতো ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌রও স্ত্রী আছে ভেবেছিল মনে হয়: প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সম্প্রতি ‘ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ও তার আশেরাহর উদ্দেশে নিবেদিত’ খোদাইলিপি আবিষ্কার করেছেন। বাআলের মতো দেবতাদের উপাসনা করে ইসরায়েল চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করছে দেখে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন হোসেয়া। সকল নতুন পয়গম্বরের মতো তিনিও ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে ভাবিত ছিলেন। যেমন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন: আমি দয়াই (hesed) চাই, বলিদান নয়; এবং হত্যাযজ্ঞ অপেক্ষা ঈশ্বর বিষয়ক জ্ঞান [daath Elohim].[২১]। ধর্মতত্তীয় জ্ঞানের কথা বোঝাননি তিনিঃ daath শব্দটি এসেছে হিব্রু ক্রিয়াপদ yada: জানা থেকে, যার যৌন দ্যোতনা রয়েছে। এভাবে ‘J’ বলেছেন আদম তার স্ত্রী ইভকে জানতেন।[২২] প্রাচীন কানানিয় ধর্মে বাআল মাটিকে বিয়ে করেছিলেন, মানুষ আচরিক যৌনমিলনের মাধ্যমে এর উদযাপন করত; কিন্তু হোসেয়া জোর দিয়ে বললেন যে, চুক্তির পর থেকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বাআলের স্থান। গ্রহণ করেছেন এবং ইসরায়েলের জনগণের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ওদের বুঝতে হবে যে বাআল নন, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই মাটিতে প্রাণের সঞ্চার করবেন।[২৩] তখনও একজন প্রেমিকের মতো ইসরায়েলকে তোয়াজ করছিলেন তিনি, তাকে কুসংস্কার বাআলের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রলুব্ধ। করতে বদ্ধপরিকর:

আর সেই দিন আমি লোকদের নিমিত্তে মাঠের পশু, আকাশের পক্ষী ও ভূমির সরীসৃপ সকলের সহিত নিয়ম করিব; এবং ধনুক খড়গ ও রণসজ্জা ভাঙিয়া দেশের মধ্য হইতে উচ্ছিন্ন করিব ও তাহাদিগকে নিশ্চিন্তে শয়ন করাই। আর আমি চিরকালের জন্যে তোমাকে বাগদান করিব; হাঁ, ধার্মিকতায়, ন্যায় বিচারে, দয়াতে ও বহুবিধ অনুকম্পায় তোমাকে বাগদান করিব।[২৪]

আমোস যেখানে সামাজিক দুরাচারকে আঘাত করেছেন, হোসেয়া সেখানে ইসরায়েলি ধর্মের অন্তর্মুখীতার অভাবের প্রতি ওপর জোর দিয়েছেন: ঈশ্বরের জ্ঞান-কে (hesed)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে, যা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সঙ্গে অন্তরের সংযোগ ও উপলব্ধি বোঝায়, যাকে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার উর্ধ্বে উঠতেই হবে।

পয়গম্বরগণ কীভাবে ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলছিলেন হোসেয়া তার এক চমকপ্রদ আভাস দিয়েছেন। তার পয়গম্বরত্বের একেবারে সূচনায় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ যেন কঠিন নির্দেশ জারি করেছিলেন। হোসেয়াকে তিনি একজন পতিতাকে (esheth zeauntm) বিয়ে করতে বলেছিলেন, কেননা ‘গোটা দেশ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র অনুগমন হইতে নিবৃত্ত হওয়ায় ভয়ানক ব্যাভিচার করিতেছে।’[২৫] অবশ্য এটা মনে হয় যে, ঈশ্বর হোসেয়াকে পতিতার আক্ষরিক অর্থ:a wife of prostitution]-এর খোঁজে রাস্তায় ঘুরতে বলেননি। eseth telumim এমন কোনও নারী যে বাছবিচারহীন চলাফেরা করে বা উর্বরতার ধর্ম বিশ্বাসের পবিত্র পতিতা। উর্বরতার আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে হোসেয়ার পূর্ব পরিচয় ছিল বলে এটা মনে হয় যে তার স্ত্রী গোমার বাআলের ধর্মের পবিত্র কর্মচারীতে পরিণত হয়েছিলেন। সুতরাং, তাঁর বিয়েটা ছিল বিশ্বাসহীন ইসরায়েলের সঙ্গে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সম্পর্কের একটা প্রতীক। হোসেয়া ও গোমারের তিন সন্তান ছিল যাদের ভয়ঙ্কর প্রতীকী নাম দেওয়া হয়েছিল। বড় ছেলের নাম ছিল বিখ্যাত রণক্ষেত্রের নামানুসারে জেরিল, মেয়ের নাম ছিল লো-রুবামাহ যার অর্থ যাকে ভালোবাসা হয়নি এবং ছোট ছেলের নাম ছিল লো-আম্মি আমার জাতি নয়]। এর জন্মের পর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি রদ করে দেন: ‘কেননা তোমরা আমার প্রজা নহ, আমিও তোমাদের ঈশ্বর নহি।’[২৬] আমরা দেখব, পয়গম্বরগণ প্রায়শঃই স্বজাতির বিপজ্জনক অবস্থা বোঝাতে দীর্ঘ প্রহসনের আশ্রয় নিতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, কিন্তু এটা মনে হয় যে, হোসেয়ার বিয়ের বিষয়টি আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল না। টেক্সট থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, গোমার তাদের সন্তান জন্ম নেওয়ার আগ পর্যন্ত eseth Reuumim-এ পরিণত হননি। কেবল পরবর্তী সময়ে হোসেয়ার মনে হয়েছে যে, তাঁর বিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে। স্ত্রী বিয়োগ এক মারাত্মক অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর, হোসেয়াকে যা ইসরায়েলিরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে ত্যাগ করে বাআলের মতো উপাস্যদের সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ায় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র অনুভূতির স্পষ্ট ধারণা দিয়েছিল। প্রথমে গোমারকে ত্যাগ করতে চেয়েছেন হোসেয়া, তাঁকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাননি আর: প্রকৃতপক্ষে ‘আইন’ অনুযায়ী অবিশ্বস্ত স্ত্রীকে তালাক দেওয়া পুরুষের দায়িত্ব। কিন্তু গোমারকে ভালোবাসতেন হোসেয়া, ফলে শেষ পর্যন্ত তার খোঁজে বের হন এবং নতুন মালিকের কাছ থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। গোমারকে ফিরে পাবার আপন ইচ্ছার মাঝে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ইসরায়েলকে আরেকটা সুযোগ দিতে রাজি থাকার আভাস পেয়েছেন তিনি।

পয়গম্বরগণ যখন তাদের মানবিক অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার জন্যে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে দায়ি করছেন তখন আসলে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থে নিজেদের ভাবমূর্তি অনুযায়ী একজন ঈশ্বরকে গড়ে তুলছিলেন। রাজপরিবারের সদস্য ইসায়াহ্ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে রাজা হিসেবে দেখেছেন; আমোস দরিদ্রের প্রতি তাঁর নিজের সহানুভূতি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ওপর আরোপ করেছেন, হোসেয়া ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে দেখেছেন স্ত্রী পরিত্যাগকারী স্বামী হিসাবে, যিনি স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত রয়ে গেছেন। সকল ধর্মকে কোনও না কোনও মনুষ্যরূপ নিয়ে শুরু হতে হবে। মানবজাতি থেকে বহু দূরের কোনও উপাস্য, যেমন অ্যারিস্টটলের অটল চালক (Unmoved Mover) আধ্যাত্মিক আকাক্ষা জাগিয়ে তুলতে অক্ষম। এই অভিক্ষেপ যতক্ষণ নিজের মাঝে শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ এটা কার্যকর ও উপকারী হতে পারে। এটা বলা প্রয়োজন যে, মানবীয় ভাষায় ঈশ্বরের এই কাল্পনিক উপস্থাপন এক সামাজিক দায়িত্বের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে, হিন্দু ধর্মে যা অনুপস্থিত। ঈশ্বর ধর্মের প্রত্যেকটাই আমোস ও ইসায়াহর সাম্যতা ও সমাজতান্ত্রিক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। ইহুদিরাই প্রথমবারের মতো প্রাচীন বিশ্বে এক কল্যাণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল যা তাদের পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে।

অন্যসব পয়গম্বরের মতো হোসেয়া বহুঈশ্বরবাদীতার আতঙ্কে ভুগেছেন। তিনি উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রগুলো নিজেদের বানানো দেবতার উপাসনা করে নিজেদের স্বর্গীয় প্রতিশোধ বয়ে আনবে ভেবে শঙ্কিত ছিলেন।

আর এখন তাহারা উত্তরোত্তর আরও পাপ করিতেছে,
তাহারা আপনাদের নিমিত্তে আপনাদের রৌপ্য দ্বারা ছাঁচে ঢালা প্রতিমা
ও আপনাদের নিজ বুদ্ধিমতো পুত্তলি নিৰ্মাণ করিয়াছে;
সেই সমস্তই শিল্পকারদের কর্ম মাত্র; তাহাদের বিষয়ে উহারা বলে,
যেসকল লোক যজ্ঞ করে তাহারা গোব্যসদিগকে চুম্বন করুক।[২৭]

এটা অবশ্যই কানানিয় ধর্মের অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত ও অবমূল্যায়িত বর্ণনা। কানান ও বাবিলনের মানুষ কখনও ভাবেনি যে, তাদের দেবতাদের প্রতিমাসমূহও স্বর্গীয়, ওরা কখনও কোনও মূর্তির উপাসনা করতে মাথা নোয়ায়নি। প্রতিমাগুলো ছিল স্বর্গ বা আলৌকিকের প্রতীক। উপাসকদের মনোযোগকে আরও ঊর্ধ্বে আকৃষ্ট করার জন্যে তাদের কল্পনাতীত আদি ঘটনাবলীর মিথের মতো এসব নির্মাণ করা হয়েছিল। এসালিগার মন্দিরে মারদুকের মূর্তি বা কানে আশেরাহর শিলাস্তম্ভকে কখনও দেবতাদের সঙ্গে একীভূত করা হয়নি, বরং এগুলো মানুষকে মানবজীবনে অতিপ্রাকৃত উপাদানের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তারপরেও পয়গম্বরগণ অত্যন্ত অনাকর্ষণীয় অসন্তোষের সঙ্গে পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের উপাস্য বা দেবতাদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছেন। ওদের দৃষ্টিতে ঘরে তৈরি এইসব দেবতা সোনা ও রূপা ছাড়া আর কিছুই নয়; মাত্র কয়েক ঘণ্টায় একজন কারিগর এগুলো তৈরি করেছে; ওদের চোখ আছে কিন্তু ওরা দেখতে পায় না, কান দিয়ে শোনে না, ওরা হাঁটতে পারে না; উপাসকদেরই এদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে হয়; ওরা বুদ্ধিহীন, জড় পদার্থ, মানবেতর বস্তু; তরমুজ খেতের কাগভাড়ুয়ার চেয়ে উন্নত কিছু নয়। ইসরায়েলের ইলোহিম ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র তুলনা ওরা এলিহিম (elihim), কিছু না। যেসব গোয়িম ওদের উপাসনা করে তারা নির্বোধ; ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ওদের ঘৃণা করেন।[২৮]

বর্তমান কালে একেশ্বরবাদের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া দুর্ভাগ্যজনক অসহিষ্ণুতার সঙ্গে আমরা এত পরিচিত হয়ে উঠেছি যে আমরা হয়তো অন্য দেবতাদের প্রতি এই বৈরিতা যে নতুন ধর্মীয় প্রবণতা ছিল সেটা অনুধাবণ করতে পারব না। পৌত্তলিকতাবাদ আবশ্যকীয়ভাবে সহিষ্ণু ধর্মবিশ্বাস ছিল: নতুন দেবতার আবির্ভাবে পুরোনো কাল্টগুলো হুমকির সম্মুখীন না হলে প্রচলিত দেবনিচয়ের পাশে অনায়াসে আরেকজন দেবতার স্থান হতো। এমনকি অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন মতবাদসমূহ যেখানে দেবতাদের প্রতি প্রাচীন শ্রদ্ধার স্থান দখল করছিল তখনও প্রাচীন দেবতাদের প্রতি এমন তীব্র বিতৃষ্ণা দেখা যায়নি। হিন্দু ও বৌদ্ধমতবাদে আমরা দেখেছি, মানুষকে দেবতার ওপর সক্ষোভে চড়াও হওয়ার পরিবর্তে তাদের অতিক্রম করে যাওয়ার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অথচ ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখা দেবতাদের প্রতি এরকম শান্ত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেননি। ইহুদি ধর্মগ্রন্থে ‘বহুঈশ্বরবাদীতা’র নতুন পাপ, মিথ্যা দেবতার উপাসনা বিবমিষার অনুভূতির সৃষ্টি করে। এটা এমন এক প্রতিক্রিয়া যা সম্ভবত চার্চের কোনও পোপ ও ফাদার যৌনতা সম্পর্কে যেমনটি বোধ করেন সেরকম। সুতরাং এটা যৌক্তিক বিবেচনাসূত্র কোনও প্রতিক্রিয়া নয় বরং গভীর উদ্বেগ ও অবদমনের পরিচায়ক। পয়গম্বরগণ কী তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় আচরণের কোনও সুপ্ত উদ্বেগ লালন করছিলেন? এমন কি হতে পারে, যে তারা অস্বস্তির সঙ্গে সচেতন ছিলেন যে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সম্পর্কিত তাঁদের ধারণাও পৌত্তলিকদের বহুঈশ্বরবাদীতার সমরূপ, কারণ তাঁরাও নিজস্ব ভাবমূর্তি অনুযায়ী একজন দেবতার সৃষ্টি করছিলেন?

যৌনতার প্রতি ক্রিশ্চানদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তুলনা অন্য দিক দিয়েও আলোক নিক্ষেপকারী। এই পর্যায়ে অধিকাংশ ইসরায়েলি অবচেতনভাবে পৌত্তলিক উপাস্যদের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল। এটা সত্যি যে, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ক্রমশঃ নির্দিষ্ট কিছু বলয়ে কানানিয়দের ইলোহিমের ভূমিকা গ্রহণ করছিলেন: যেমন হোসেয়া যুক্তি দেখাতে চাইছিলেন যে, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বাআলের চেয়ে ভালো উর্বরতার দেবতা। কিন্তু অপরিবর্তনীয় পুরুষ দেবতা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পক্ষে আশেরাহ, ইশতার বা আনাতের ভূমিকা দখল নিশ্চয়ই কঠিন ছিল, ইসরায়েলিদের মাঝে যাঁদের বহু অনুসারী তখনও ছিল-বিশেষ করে নারীদের মাঝে। যদিও একেশ্বরবাদীরা জোর দিয়ে বলবে, তাদের ঈশ্বর লিঙ্গের ঊর্ধ্বে; তবু তিনি আবশ্যকীয়ভাবে পুরুষ রয়ে যাবেন; যদিও আমরা লক্ষ করব, কেউ কেউ এই অসাম্য দূর করার প্রয়াস পাচ্ছে। এটা অংশতঃ তাঁর গোত্রীয় যুদ্ধ দেবতা হিসাবে আবির্ভাবের কারণে। কিন্তু দেবীদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম বা যুদ্ধ অ্যাক্সিয়াল যুগের অধিকতর কম ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখায়, এই সময় ক্রমশঃ মেয়েরা সামাজিক মর্যাদা হারাতে শুরু করেছিল। এটা মনে হয় যে, অধিকতর আদিম সমাজে নারীদের পুরুষদের চেয়ে অধিক মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। প্রথাগত ধর্মে মহান দেবীদের সম্মান নারীদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিফলন। অবশ্য নারীর উত্থান বোঝায় যে সামরিক ও শারীরিক শক্তির পুরুষালি বৈশিষ্ট্য নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে ওইকুমিনে নারীদের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়, সভ্যতায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয় তারা। যেমন, গ্রিসে তাদের অবস্থান ছিল বিশেষভাবে খারাপ-পশ্চিমের লোকেরা প্রাচ্যের পুরুষতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা করার সময় এ সত্যটা তাদের মনে রাখা উচিত। এথেন্সের নারীদের জন্যে গণতান্ত্রিক আদর্শ সম্প্রসারিত হয়নি, তাদের পৃথক স্থানে রাখা হতো, নিম্নস্তরের প্রাণী হিসাবে ঘৃণা করা হতো। ইসরায়েলি সমাজও আরও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠছিল। অতীতকালে নারীরা ছিল শক্তিমতী, নিজেদের তারা তাদের স্বামীদের সমকক্ষ ভাবত। ডেবোরাহর মতো কেউ কেউ যুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বও দিয়েছে। এরকম বীরাঙ্গনাদের ইসরায়েলিরা জুথি ও এশতার হিসাবে শ্রদ্ধা করে যাবে, কিন্তু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সাফল্যের সঙ্গে কানান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেবদেবীদের হারিয়ে দিয়ে একমাত্র ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার পর তাঁর ধর্ম প্রায় পুরোপুরিভাবে পুরুষরা পরিচর্যা করবে। দেবীদের কাল্টগুলো বাদ পড়ে যাবে আর এটাই হবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একটা লক্ষণ, যা ছিল নতুন সভ্য জগতের বৈশিষ্ট্য।

আমরা দেখব, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র বিজয় ছিল কষ্টার্জিত। এখানে চাপ, সহিংসতা ও সংঘাতের প্রয়োজন হয়েছে; এ থেকে বোঝা যায় একজন ঈশ্বরের ধর্ম ইসরায়েলিদের কাছে উপমহাদেশের জনগণের কাছে যেভাবে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম এসেছিল তেমন সহজে আসতে পারছিল না। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ যেন শান্তি পূর্ণ স্বাভাবিক উপায়ে প্রাচীন উপাস্যদের অতিক্রম করতে পারছিলেন না। তাঁকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল । এভাবে ৮২ নম্বর শ্লোকে আমরা দেখি স্বর্গীয় সভার (Devine Assembly) নেতৃত্ব অর্জনের জন্যে তিনি একটা নাটক করছেন, যেটা বাবিলনিয় এবং কানানিয় উভয় মিথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে:

দেবতার মাঝে রায় ঘোষণা করার জন্যে
এলের সভায় আপন অবস্থান গ্রহণ করলেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌।[২৯]

‘বিচার নিয়ে আর প্রহসন নয়
দুষ্টদের পালন আর নয়!
দুর্বল ও এতিমদের ন্যায়বিচার পেতে দাও,
দুস্থ ও পীড়িতদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ কর,
দুর্বল ও দরিদ্রকে বাঁচাও,
দুষ্টের কবল হতে ওদের রক্ষা কর!’

মুখ ও নির্বোধ, ওরা অন্ধের মতো চলে,
মানব সমাজের মূল ভিত্তি হানি করে।
আমি একবার বলেছিলাম, “তোমরাও দেবতা,
তোমরা সবাই এল এলিয়নের সন্তান’;
কিন্তু তারপরেও, মানুষের মতোই মারা যাবে তোমরা;
মানুষের মতো, দেবতাগণ, তোমাদের পতন ঘটবে।

স্মরণাতীত কাল থেকে এলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা সভায় মোকাবিলা করার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে অন্যান্য দেবতার বিরুদ্ধে কালের সামাজিক চ্যালেঞ্জ মেটাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌। পয়গম্বরদের আধুনিক সমর্মিতার নীতি তুলে ধরেছেন তিনি, কিন্তু তার স্বর্গীয় সহকর্মীগণ বছরের পর বছর ন্যায়বিচার ও সাম্যের পক্ষে কথা বলার জন্যে কিছুই করেননি। প্রাচীনকালে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ওঁদের ইলেহিম হিসাবে মেনে নিতে তৈরি ছিলেন, এল এলিয়নের (‘সর্ব শ্রেষ্ঠ ঈশ্বর’, God Most high)[৩০] সন্ত নিগণ, কিন্তু দেবতারা প্রমাণ করেছেন তাঁরা অচল। মরণশীল মানুষের মতো ফুরিয়ে যাবেন তাঁরা। শ্লোক রচয়িতা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে সহযোগী দেবতাদের মৃত্যুর অভিশাপ দিতেই দেখাননি, বরং একই সঙ্গে তিনি এল’র প্রচলিত অবস্থানও কেড়ে নিয়েছেন, ইসরায়েলে তখনও যার সমর্থক ছিল বলে মনে হয়।

বাইবেলে ক্ষতিকর প্রচারণা সত্ত্বেও বহু-ঈশ্বরবাদীতার মাঝে খারাপ কিছু নেই আসলে এটা তখনই আপত্তিকর বা আনাড়ি হয়ে দাঁড়ায় যখন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে নির্মিত ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিকে অতিপ্রাকৃত সত্তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। আমরা দেখব, ঈশ্বরের ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়ে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের কেউ কেউ পরম সত্তার এই আদি ইমেজের ওপর কাজ করেছে ও এমন এক ধারণার উপনীত হয়েছে যা কিনা হিন্দু বা বৌদ্ধ দর্শনের কাছাকাছি। অন্যরা অবশ্য কখনওই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে উঠতে পারেনি, তবে ধরে নিয়েছে যে, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা পরম রহস্যের অনুরূপ। বহুঈশ্বরবাদী ধার্মিকতার বিপদ বিসিই ৬২২ সালে জুদাহ্র বাদশাহ জোসিয়াহর শাসন আমলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পূর্বসুরি রাজা মানাসেহ (৬৮৭-৪২) এবং রাজা আমন (৬৪২-৪০)-এর সমন্বয়ের নীতিমালা বদল করার জন্যে ব্যার্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। উল্লিখিত দুই রাজা জনগণকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পাশাপাশি কানানের অন্য দেবতাদের উপাসনা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। মানাসেহ প্রকৃতপক্ষে মন্দিরে আশেরাহ্‌র এক প্রতিমাও স্থাপন করেন, এখানে উর্বরতার কান্ট দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। অধিকাংশ ইসরায়েলি যেহেতু আশেরাহ্‌র ভক্ত ছিল এবং কেউ কেউ তাকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র স্ত্রী হিসাবে কল্পনা করত, তাই কেবল গোঁড়া ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌বাদীরাই একে ব্লাসফেমাস মনে করতে পারত। কিন্তু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্টকে উৎসাহিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জোসিয়াহ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেন। শ্রমিকরা যখন প্রত্যেকটা জিনিস ওলট পালট করছিল, প্রধান যাজক হিলকিয়েহ একটা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করে বসেন, যেটা কিনা ইসরায়েলের সন্তানদের উদ্দেশে দেওয়া মোজেসের শেষ সারমনের বিবরণ। জোসিয়াহর সচিব শাপানকে ওটা দেন তিনি; রাজার উপস্থিতিতে উচ্চ স্বরে তা পাঠ করেন। এটা শোনার পর তরুণ রাজা আতঙ্কে তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন: ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রতি এমন ক্ষুব্ধ হওয়ায় বিস্ময়ের কিছু নেই। তারা মোজেসকে দেওয়া তাঁর কঠিন নির্দেশ পালন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলেন।[৩১]

এটা প্রায় নিশ্চিত যে, হিলকিয়াহ্র আবিষ্কৃত ‘বুক অভ দ্য ল’ই বর্তমানে আমাদের কাছে ডিউটেরোনমি নামে পরিচিত গ্রন্থের মূল অংশ ছিল। সংস্কারক দল কর্তৃক এটার সময়োচিত আবিষ্কার নিয়ে নানান মতবাদ রয়েছে। কেউ কেউ এমনও মত প্রকাশ করেছেন যে, পয়গম্বর হুলদার সহায়তায় হিলকিয়াহ ও শাপানই গোপনে এটা লিখেছিলেন। জোসিয়াহ্ অবিলম্বে হুলদাহর সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আমরা কখনওই নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না, তবে গ্রন্থটি নিশ্চিতভাবে ইসরায়েলে এক নতুন পরিবর্তনের আভাস প্রদান করে যা সপ্তম শতকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। মোজেসকে তাঁর শেষ সারমনে চুক্তির প্রতি নতুন কেন্দ্রিকতা আরোপ করতে ও ইসরায়েলের বিশেষ মনোনয়নের ধারণা দিতে দেখানো হয়েছে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সকল জাতির মধ্য থেকে নিজ জাতিকে আলাদা করে নিয়েছেন, সেটা তাদের কোনও গুণের কারণে নয় বরং তাদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার কারণে। বিনিময়ে তিনি পুর্ণ আনুগত্য ও অন্য সব দেবতার তীব্র প্রত্যাখ্যান দাবি করেছেন। ডিউটেরোনমির মূলে অন্তর্ভুক্ত ঘোষণাটি পরে ইহুদিদের বিশ্বাস প্রকাশের মন্ত্রে পরিণত হবে:

হে ইস্রায়েল শোন (shema)! ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আমাদের ইলোহিম। একমাত্র ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ (ebad) আর তুমি তোমার সমস্ত হৃদয় ও তোমার সমস্ত প্রাণ দিয়া আপন ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে প্রেম করিবে আর এই যে সকল কথা ও তোমার সমস্ত শক্তি আমি অদ্য তোমাকে আজ্ঞা করি; তাহা তোমার হৃদয়ে থাকুক।[৩২]

ঈশ্বরের নির্বাচন ইসরায়েলকে গোয়িমদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। লেখক মোজেসকে দিয়ে বলাচ্ছেন, ওরা প্রতিশ্রুত ভূমিতে পৌঁছানোর পর, স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক থাকবে না। তারা তাহাদের সহিত কোনও নিয়ম করিবে না, বা তাহাদের প্রতি দয়া করিবে না। মিশ্র বিবাহ বা সামাজিক মেলামেশা চলবে না। সর্বোপরি, তাদেরকে কানানিয় ধর্ম উচ্ছেদ করতে হবে। তাহাদের যজ্ঞবেদী সকল উৎপাটন করিবে, তাহাদের স্তম্ভ সকল ভঙ্গিয়া ফেলিবে, তাহাদের আশেরাহ্ মূর্তি সকল ছেদন করিবে এবং তাহাদের খোদিত প্রতিমাসকল অগ্নিতে পোড়াইয়া দিবে। ইসরায়েলিদের নির্দেশ দিয়েছেন মোজেস, ‘কেননা তুমি আপন ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র পবিত্র প্রজা; ভূতলে যত জাতি আছে সেসকলের মধ্যে আপনার নিজস্ব প্রজা করিবার জন্যে তোমার উপর ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তোমাকেই মনোনীত করিয়াছেন।’[৩৯]

আজকের দিনে ইহুদিরা শেমা (Shema) আবৃত্তি করার মাধ্যমে একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা দেয়। আমাদের ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এক এবং অদ্বিতীয়। ডিউটেরোনমিস্টরা তখনও এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারেননি। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এবাদ (ebad) মানে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ একক বোঝায়নি, বরং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই একমাত্র উপাস্য যাকে উপাসনা করার অনুমোদন আছে। অন্য দেবতারা তখনও হুমকি স্বরূপ ছিলেন: ওদের কাল্ট আকর্ষণীয় ছিল ও ঈর্ষাপরায়ণ ঈশ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাছে থেকে প্রলুব্ধ করে ইসরায়েলিদের টেনে নিতে পারতেন। তারা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র আইনকানুন মেনে চললে তিনি তাদের আশীর্বাদ করবেন, সমৃদ্ধি দান করবেন, কিন্তু তাকে পরিত্যাগ করলে পরিণাম হবে ধ্বংসাত্মক:

‘এবং তুমি যে দেশ অধিকার করিতে যাইতেছ তথা হইতে তোমরা উনুলিত হইবে। আর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তোমাকে পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত জাতির মধ্যে ছিন্নভিন্ন করিবেন; সেই স্থানে তুমি আপনার ও আপন পিতৃপুরুষদের অজ্ঞাত অন্য দেবগণের ধর্ম ও প্রস্তরের সেবা করিবে…আর তোমার জীবন তোমার দৃষ্টিতে সংশয়ে দোলায়মান হইবে…তুমি হৃদয়ে যে শঙ্কা করিবে ও চক্ষুতে যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিবে, ত্যুক্ত প্রাতঃকালে বলিবে, “হায় হায় কখন সন্ধ্যা হইবে?” এবং সন্ধ্যাকালে বলিবে “হায় হায় কখন প্রাতঃকাল হইবে”।[৩৫]

সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে রাজা জোসিয়াহ এবং তাঁর প্রজারা এই কথাগুলো শোনার সময়ে এক নতুন রাজনৈতিক হুমকির মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলেন। আসিরিয়দের ঠেকাতে সক্ষম হওয়ায় উত্তরাঞ্চলীয় দশটি গোত্রের পরিণতি এড়াতে পেরেছিল ওরা। ওই দশ গোত্র মোজেসের বর্ণিত শাস্তি ভোগ করেছিল। কিন্তু বিসিই ৬০৬ সালে বাবিলনের রাজা নেবুপোলাসার আসিরিয়দের ধ্বংস করে নিজস্ব সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজ শুরু করেছিলেন।

এমনি চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশে ডিউটেরোনমিস্টদের নীতিমালা ব্যাপক প্রভাব রাখে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র নির্দেশ মানা দূরে থাক, ইসরায়েলের শেষ দুজন রাজা সেধে বিপদ ডেকে এনেছেন। অবিলম্বে সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন জোসিয়াহ, অদম্য উৎসাহে কাজ শুরু করেন তিনি। সমস্ত ইমেজ, মূর্তি ও উর্বরতার প্রতীক মন্দিরের বাইরে এনে পোড়ানো হয়। জোসিয়াহ্ আশেরাহর বিরাট মূর্তি নামিয়ে সেখানে আশেরাহ্‌র পোশাক তৈরি করা মন্দির পতিতাদের থাকার ঘরগুলো ধ্বংস করে দেন। পৌত্তলিকতাবাদের আশ্রয় দেশের বিভিন্ন প্রাচীন উপাসনাগৃহও ধ্বংস করা হয়। এরপর থেকে পুরোহিতরা কেবল পবিত্ৰকৃত জেরুজালেম মন্দিরে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র উদ্দেশে প্রাণী উৎসর্গ করতে পারতেন। প্রায় ৩০০ বছর পরে জোসিয়াহ্র সংস্কার কর্ম লিপিবদ্ধকারী ভাষ্যকারগণ এই অস্বীকৃতি ও দমনের ধার্মিকতার এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।

[জোসিয়াহর] সাক্ষাতে লোকেরা বাআল দেবগণের যজ্ঞবেদী ভাঙিয়া ফেলিল এবং তিনি তদুপরি স্থাপিত সূৰ্য্য প্রতিমা ছেদন করিলেন আর আশেরা-মূর্তি ক্ষোদিত প্রতিমা ও ছাঁচে ঢালা প্রতিমা সকল ভাঙিয়া ধূলিস্যাৎ করিয়া যাহারা তাহাদের উদ্দেশে যজ্ঞ করিয়াছিল তাহাদের। কবরের উপর সেই ধূলা ছড়াইয়া দিলেন। আর তাহাদের যজ্ঞবেদীর উপরে যাজকদের অস্থি পোড়াইলেন এবং যিহুদা ও যিরূসালেমকে শুচি করিলেন। আর মনঃশির ইফ্রায়িম ও শিমিয়নের নগরে নগরে এবং নপ্তালি পৰ্য্যন্ত সর্বত্র কাঁথড়ার মধ্যে এইরূপ করিলেন।[৩৬]

অন্যান্য উপাস্যদের উর্ধ্বে ওঠার বুদ্ধের বিশ্বাসের পরেও সেগুলোকে নিঃশব্দে মেনে নেওয়ার ধারেকাছেও নেই আমরা। এই পাইকারী ধ্বংস সুপ্ত উদ্বেগ ও অভিযোগ থেকে উদ্ভূত ঘৃণা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।

সংস্কারকরা ইসরায়েলের ইতিহাস নতুন করে লিখেছিলেন। নতুন মতবাদ অনুযায়ী জোশুয়া, জাজেস, স্যামুয়েল এবং রাজাবলীর ঐতিহাসিক গ্রন্থ পরিমার্জনা করা হয়েছে এবং পরবর্তীকালে পেন্টটিউকের সম্পাদকগণ নতুন নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করেছেন যা এক্সোডাস মিথের ডিউটেরোনমিস্ট ব্যাখ্যাকে অধিকতর পুরোনো ‘J’ ও ‘E’-এর বর্ণনার রূপ দিয়েছে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এখন কানানের ধ্বংসের পবিত্র যুদ্ধের রূপকার। ইসরায়েলিদের বলা হয়েছে স্থানীয় কানানবাসীরা অবশ্যই তাদের দেশে থাকতে পারবে না,[৩৭] জোশুয়া যেন অশুভ সম্পূর্ণতার সঙ্গে এই নীতির বাস্তবায়নে বাধ্য হয়েছিলেন।

আর সেই সময় জোশুয়া আসিয়া পর্বতময় প্রদেশ হইতে–হিব্রোন, দবির ও আনাব হইতে, যিহুদার সমস্ত পর্বতময় প্রদেশ হইতে আর ইসরায়েলের সমস্ত পৰ্বতময় প্রদেশ হইতে আনাকীয়দিগকে উচ্ছেদ করিলেন; জোশুয়া তাহাদের নগরগুলোর সহিত তাহাদিগকে নিঃশেষে বিনষ্ট করিলেন। ইসরায়েল সন্তানগণের দেশে অনাকীয়দের কেহ অবশিষ্ট থাকিল না; কেবল দেলাতে গাতে ও আসদোদে কতকগুলি অবশিষ্ট থাকিল। [৩৮]

প্রকৃতপক্ষে সন্দেহাতীতভাবেই জোশুয়া ও জাজেস কর্তৃক কানান বিজয় সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, যদিও নিশ্চিতভাবেই প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল । কিন্তু এবার রক্তপাতের ঘটনাকে একটা ধর্মীয় যুক্তির ভিত্তি দেওয়া হলো। নির্বাচনের এই ধরনের ধর্মতত্ত্বের বিপদ এই যে, ধর্মতত্ত্ব একজন ইসায়াহর অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিভঙ্গির সমপর্যায়ের নয়। একেশ্বরবাদের গোটা ইতিহাসকে ক্ষতবিক্ষতকারী পবিত্র যুদ্ধগুলোতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরকে আমাদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটা প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করে নিজের ঘাটতিসমূহ উপলব্ধি করার বদলে এঁকে আমাদের অহমসৃষ্ট ঘৃণা বাড়িয়ে তোলা বা বৈধ করা ও একে চরম পর্যায়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে ঈশ্বরের আচরণ একেবারে আমাদের অনুরূপ হয়ে পড়ে, যেন তিনি আরেকজন মানুষ মাত্র। এমন একজন ঈশ্বর আমোস বা ইসায়াহ্‌র ঈশ্বরের চেয়ে আরও বেশি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয়ই হওয়ার কথা, যিনি নির্দয় আত্মসমালোচনা দাবি করেন।

নিজেদের মনোনীত জাতি দাবি করার জন্যে ইহুদিদের প্রায়ই সমালোচনা করা হয়, কিন্তু তাদের সমালোচকগণ প্রায়শঃই বাইবেলিয়কালে বহুঈশ্বরবাদীতার বিরুদ্ধে পরিচালিত যুক্তিতর্ককে উস্কে দেওয়া অস্বীকৃতির সমরূপ অপরাধে দায়ী। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রত্যেকটি যার যার ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মনোনয়নের অনুরূপ ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলেছে, কখনও কখনও যা এমনকি বুক অভ জোশুয়ায় কল্পিত ধ্বংসলীলার চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে। পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চানরা অদ্ভুতভাবে নিজেদের ঈশ্বরের নির্বাচিত ভেবে আত্মপ্রসাদে ভোগে। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রিশ্চানরা নিজেদের নব্য নির্বাচিত জাতি দাবি করে ইহুদি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ক্রুসেডসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল–ইহুদিদের হারানো মর্যাদার অধিকারী হয়েছে তারা। নির্বাচনের কালভিনিস্ট ধর্মতত্ত্ব আমেরিকানদের ঈশ্বরের আপন জাতি বলে ভাবতে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। জোশুয়ার জুদাহ্ রাজ্যের মতো এমন একটা বিশ্বাসের তখনই ব্যাপক সাড়া পাওয়ার কথা যখন রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ফলে জাতি আপন অবলুপ্তির আতঙ্কে তাড়িত। সম্ভবত এ কারণেই বর্তমানে ইহুদি, ক্রিশ্বান ও মুসলিমদের মাঝে প্রকট বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদে এ ব্যাপারটা নতুন করে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র মতো একজন ব্যক্তি-ঈশ্বরকে এভাবে ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন সত্তাকে বাঁচানোর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে; ব্রাহ্মণের মতো নৈব্যক্তিক উপাস্যের বেলায় যা সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখা দরকার, বিসিই ৫৮৭ সালে নেবুচাদনেযারের জেরুজালেম ধ্বংসের ঘটনা ও বাবিলনের ইহুদিদের বিতাড়নের পেছনে ক্রিয়াশীল ডিউটেরোনিজমে সকল ইসরায়েলি জড়িত ছিল না। নেবুচাদনেযারের অভিষেকের বছর ৬০৪ সালে পয়গম্বর জেরেমিয়াহ্ ইসায়াহ্‌র প্রতিমা-বিরোধী মতবাদের পুনর্জন্ম দেন যা মনোনীত জাতির বিজয়বাদী মতবাদ উল্টে দিয়েছিল: ঈশ্বর ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে বাবিলনকে ব্যবহার করছেন এবার ‘ইসরায়েলের পালা নিষিদ্ধ হবার’। সত্তর বছরের জন্যে নির্বাসনে যেতে হবে তাদের। এই ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর যাজকের হাত থেকে লিপি কেড়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে আগুনে নিক্ষেপ করেন রাজা জোহায়াকিম। প্রাণভয়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন জেরেমিয়াহ্‌।

জেরেমিয়ার জীবন দেখায়, ঈশ্বরের এই অধিকতর চ্যালেঞ্জিং ইমেজ গড়ে তোলার পেছনে কী বিশাল কষ্ট ও প্রয়াসের প্রয়োজন হয়েছিল। পয়গম্বর হতে চাননি তিনি, ভালোবাসার জাতিকে নিন্দা করতে গিয়ে গভীরভাবে বেদনার্ত হয়ে পড়েছিলেন।[৪০] জন্মগতভাবে ঝামেলাবাজ ব্যক্তি ছিলেন না তিনি, তার হৃদয় ছিল অত্যন্ত কোমল। যখন তার কাছে আহ্বান আসে, প্রতিবাদে কেঁদে উঠেছিলন তিনি: ‘হায়, হায়, হে প্রভু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌, দেখ, আমি কথা কহিতে জানি না, কেননা আমি বালক!’ আর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তখন ‘হস্ত প্রসারিত করিয়া’ তার ঠোঁট স্পশ করলেন এবং আপন বাণী তাঁর মুখে স্থাপন করলেন। যে বাণী তাঁকে উচচারণ করতে হয়েছিল সেটা ছিল দ্ব্যর্থবোধক ও স্ববিরোধী: ‘দেখ, উৎপাটন, ভঙ্গ, বিনাশ ও নিপাত করিবার নিমিত্ত, পত্তন ও রোপন করিবার নিমিত্ত…তোমাকে নিযুক্ত করিলাম।’[৪১] সমম্বয়ের অতীত চরম অবস্থার মাঝে যন্ত্রণাদায়ক টানাপোড়েন দাবি করেছে এটা। জেরেমিয়াহ্র ঈশ্বরের অনুভূতি ছিল যন্ত্রণাময়, যার ফলে হাত-পায়ে খিচুনি সৃষ্টি হয়েছে, ভেঙে গেছে হৃদয়, মাতালের মতো টলতে হয়েছে তাঁকে।[৪২] mysterium terrible et fascinans-এর অভিজ্ঞতা যুগপৎ ধর্ষণ ও চরিত্র খোয়ানোর মতো:

হে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌, তুমি আমাকে প্ররোচনা করিলে। আমি প্ররোচিত হইলাম;
তুমি আমা হইতে বলবান, তুমি প্রবল হইয়াছ।
আমি সমস্ত দিন উপহাসের পাত্র হইয়াছি-সকলেই আমাকে ঠাট্টা করে ।
যদি বলি তাহার বিষয় আর উল্লেখ করিব না, তাহার নামে আর কিছু কহিব না,
তবে আমার হৃদয়ে যেন দাহকারী অগ্নি অস্থিমধ্যে রুদ্ধ হয়;
তাহা সহ্য করিতে করিতে আমি ক্লান্ত হইয়া পড়ি,
আর তিষ্ঠিতে পারি না। [৪৩]

দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নদিকে জেরেমিয়াহকে টানছিলেন ঈশ্বর: একদিকে তিনি গভীর আকর্ষণ বোধ করেছেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতি যেখানে প্রলোভনের মিষ্টি আত্মসমর্পণের সকল ছোঁয়া রয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেসে যাওয়া এক শক্তির টানে বিধ্বস্ত বোধ করেছেন।

আমোসের আমল হতেই পয়গম্বর একজন নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ। এই সময়ে ওইকুমিনের অন্যান্য অঞ্চলের বিরপীতে মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় আদর্শ গ্রহণ করেনি।[৪৪] পয়গম্বরদের ঈশ্বর ইসরায়েলিদের পৌরাণিক সচেতনতার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে মুলস্রোতের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে এগোনোর ওপর জোর দিচ্ছিলেন। জেরেমিয়ার যন্ত্রণার মাঝে আমরা দেখতে পাই কি বিরাট টানাপোড়েন ও স্থানচ্যুতি জড়িত ছিল এতে। ইসরায়েল ছিল। পৌত্তলিক এলাকা ঘেরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ম্বাদের একটা ছোট অনক্লেভ; ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ নিজেও বহু ইসরায়েলি দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। এমনকি ডিউটেরোনমিস্টরা, যাঁদের ঈশ্বর অনেক কম ভীতিকর, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সঙ্গে সাক্ষাৎকে উৎপীড়ক সংঘাত হিসাবে দেখেছেন। তিনি মোজেসকে ইসরায়েলিদের কাছে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য করেছেন, যারা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের সম্ভাবনায় শঙ্কিত ছিল, ঈশ্বর প্রত্যেক প্রজন্মে একজন করে পয়গম্বর পাঠাবেন ঐশী প্রচারের ভার বহন করার জন্যে।

কিন্তু তখনও সর্বব্যাপী স্বর্গীয় শক্তি আত্মার সঙ্গে তুলনীয় কোনও কিছুর আবির্ভাব ঘটেনি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্টে । বহিস্থঃ দুয়ে সত্তা হিসেবে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে দেখা হয়েছে। যাকে দূরবর্তী মনে না হওয়ার জন্যে কোনওভাবে মানব-সম করার প্রয়োজন ছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল: বাবিলনিয়রা জুদাহয় আগ্রাসন চালিয়ে রাজা ও ইসরায়েলিদের প্রথম দলটিকে দেশান্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিল; শেষ পর্যন্ত জেরুজালেমও আক্রান্ত হয়। পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে জেরেমিয়াহ মানবীয় আবেগসমূহ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতি আরোপ করা অব্যাহত রাখেন: গৃহহীন বলে দুঃখকষ্ট আর নিঃসঙ্গতার জন্যে ঈশ্বরকে বিলাপ করিয়েছেন তিনি, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তাঁর জাতির মতোই হতবুদ্ধি, অপমানিত ও পরিত্যক্ত বোধ করেছেন; তাদের মতোই যেন চিন্তিত, বিচ্ছিন্ন এবং বিবশ। জেরেমিয়াহ্ তার বুকে ফুঁসে ওঠা যে ক্রোধ অনুভব করেছেন সেটা তাঁর ক্রোধ নয় বরং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ক্রোধ।[৪৫] পয়গম্বরগণ যখনই মানুষের কথা ভেবেছেন তখনই আপনাআপনি ঈশ্বরের কথাও ভেবেছেন-জগতে যার উপস্থিতি যেন তাঁর জাতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতপক্ষেই, পৃথিবীতে কার্যকর হতে চাইলে ঈশ্বরকে মানুষের ওপর নির্ভর করতে হয়-এ ধারণাটি ঈশ্বর সম্পর্কে ইহুদি ধারণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এমনও ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ তার আপন আবেগ ও অভিজ্ঞতার মাঝে ঈশ্বরের ভূমিকা উপলব্ধি করতে সক্ষম, অর্থাৎ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ মানবীয় অবস্থারই একটা অংশ।

শত্রু যতক্ষণ সদর দরজায় অবস্থান করেছে, জেরেমিয়াহ্ ততক্ষণ ঈশ্বরের নামে তাঁর জাতিকে বকাবাদ্যি করেছেন (যদিও ঈশ্বর সকাশে তিনি তাদের পক্ষেই কথা বলেছেন)। ৫৮৭ সালে বাবিলনিয়দের হাতে জেরুজালেমের পতন হওয়ার পর, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাছ থেকে আগত ভবিষ্যদ্বাণী আরও স্বস্তি দায়ক হয়ে উঠল: তিনি তাঁর জাতিকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এখন যেহেতু তাদের শিক্ষা হয়ে গেছে, ওদের দেশে ফিরিয়ে আনবেন। বাবিলনের কর্তৃপক্ষ জেরেমিয়াকে জুদাহ্য় থেকে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা প্রকাশের পক্ষে তিনি কিছু ভূসম্পত্তি কিনেছিলেন: ‘কেননা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ স্যারেথ এই কথা কহেন: বাটীর, ক্ষেত্রের ও দ্রাক্ষাক্ষেত্রের ক্রয় বিক্রয় এই দেশে আবার চলিবে।’[৪৬] এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, কেউ কেউ বিপর্যয়ের জন্যে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে দোষারোপ করেছে। মিশর ভ্রমণকালে জেরেমিয়াহ্ ডেল্টা অঞ্চলে পলায়নকারী ইহুদিদের একটা দলের দেখা পান যারা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বিশ্বাসী ছিল না। ওই দলের মহিলারা দাবি করল যে, যতদিন তারা স্বর্গের রানি ইশতারের সম্মানে প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান পালন করেছে। ততদিন সব কিছু চমৎকার চলছিল; কিন্তু জেরেমিয়াদের মতো লোকদের প্ররোচনায় সেসব বাদ দেওয়ার পরই বিপর্যয়, পরাজয় ও শাস্তি নেমে এসেছে। কিন্তু ট্র্যাজিডি যেন জেরেমিয়ার নিজস্ব অন্তদৃষ্টিকে আরও গভীর করে তুলেছিল।[৪৭] জেরুজালেমের পতন ও মন্দির ধ্বংসের পর তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন যে, ধর্মের এসব বাহ্যিক আবরণ স্রেফ এক অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থার প্রতীক। ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিটি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন: ‘আমি তাহাদের অন্তরে আমার ব্যবস্থা দিব, ও তাহাদের হৃদয়ে তাহা লিখিব।’[৪৮]

যাদের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল তাদের ৭২২ সালের উত্তরাঞ্চলীয় দশটি গোত্রের মতো একীভূত হতে বাধ্য করা হয়নি। দুটো গোষ্ঠী হিসাবে বাস। করেছে তারা একটা পোত্র বাবিলনে ও অপরটি নিষ্ঠুর এবং উরের অদূরবর্তী ইউফ্রেতিসের শাখা নদী শেরারের অন্য পারে এক এলাকায় যার নাম তারা। রেখেছিল তেল আবিব (বসন্তকালীন পাহাড়)। ৫৯৭ সালে নির্বাসিত ইহুদিদের প্রথম দলে একজন পুরোহিত ছিলেন, তাঁর নাম ইযেকিয়েল। টানা প্রায় পাঁচ বছর নিজ গৃহে অবস্থান করেন তিনি, এ সময় কারও সঙ্গে কথা বলেননি। এরপর অস্তিত্ব বিদীর্ণকারী ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ দর্শনের অভিজ্ঞতা হয় তার যার ফলে আক্ষরিক অর্থেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর প্রথম দিব্যদর্শনের ঘটনাটির একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা জরুরি, কারণ বহু শতাব্দী পরে-সপ্তম অধ্যায়ের আমরা যেমন দেখব-ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীদের কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। হয়ে উঠবে। ইযেকিয়েল আলোর ভেতর দিয়ে বস্ত্র নিক্ষিপ্ত আলোর একটি মেঘ দেখেছিলেন। উত্তর দিক থেকে তীব্র হওয়া বইছিল। এই ঝড়ো অস্পষ্টতার মাঝে তিনি যেন দেখতে পেলেন-ইমেজারির সাময়িক প্রকৃতির ওপর জোর দেওয়ার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন তিনি-চারটি শক্তিশালী পশু টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা বিশাল রথ। এগুলো বাবিলনের রাজপ্রাসাদের তোরণে খোদাই করা কারিবু (Karibu)-র মতো প্রায়, কিন্তু ইযেকিয়েল কল্পনার চোখে এগুলোকে দেখা অসম্ভব করে তুলেছেন: প্রত্যেকটার মানুষ, সিংহ, বঁড় ও ঈগলের চেহারা বিশিষ্ট চারটি করে মাথা, প্রত্যেকটি চাকা একটি অন্যটির উল্টোদিকে ঘুরছে। ইমেজারি কেবল দর্শনের যে অচেনা প্রভাব তিনি বর্ণনা করার চেষ্টা করছিলেন, তার গুরুত্বই তুলে ধরেছে। পশুগুলোর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। পানির স্রোতের মতো শোনাচ্ছিল ওটার শব্দ, শাদ্দাইয়ের কণ্ঠস্বরের মতো, ঝড়ের মতো কণ্ঠস্বর, শিবিরের শব্দের মতো। রথের ওপর সিংহাসনের মতো একটা কিছু ছিল যেখানে পুরুষ মতো কেউ একজন ছিল, পিতলের মতো চকচক করছিল ওটা, বাহু থেকে অগ্নি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। ওটাকে আবার ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতাপের (কভোদ) মতো মনে হয়েছে।[৪৯] নিমেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন ইযেকিয়েল এবং একটা কণ্ঠস্বরকে তার উদ্দেশে কথা বলতে শুনেছেন।

কণ্ঠস্বরটি ইযেকিয়েলকে ‘মানব সন্তান’ বলে সম্বোধন করেন, ঠিক যেন। মানুষ ও স্বর্গীয় জগতের মধ্যে বর্তমান দূরত্বের ওপর জোর দেওয়ার জন্যই। কিন্তু ইযেকিয়েলের ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ দর্শন আবার নির্দিষ্ট কাজের বাস্তব পরিকল্পনার জন্ম দেবে। ইসরায়েলের বিদ্রোহী সন্তানদের কাছে ঈশ্বরের বাণী পৌঁছে দিতে হবে ইযেকিয়েলকে। ঐশ্বরিক বার্তার অমানবীয় রূপটি এক ভয়ঙ্কর ইমেজ দিয়ে বোঝানো হয়েছে: বিলাপ ও গোঙানিতে আবৃত একটা পুঁথি ধরা হাত পয়গম্বরের দিকে এগিয়ে আসে। ঈশ্বরের বাণী হজম করে আপন সত্তার অংশে পরিণত করার জন্যে। যথারীতি Mysterium terrible এর মতোই fascinans : পুঁথির স্বাদ মধুর মতো মনে হলো। শেষ পর্যন্ত ইযেকিয়েল বললেন, ‘আর আত্মা আমাকে তুলিয়া লইয়া গেলে আমি মনস্তাপে দুঃখিত হইয়া গমন করিলাম আর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র হস্ত আমার উপর বলবৎ ছিল।’[৫০] তিনি তেল আবিবে পৌঁছে গোটা সপ্তাহ স্তব্ধ থাকিয়া বসিয়া থাকলেন।

ইযেকিয়েলের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দেখায় যে, স্বর্গীয় জগৎ মানব জাতির কাছে কতখানি অচেনা ও দূরবর্তী হয়ে উঠেছিল। তিনি স্বয়ং এই দূরত্বের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বারবার বিভিন্ন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁকে, যেগুলো স্বাভাবিক সত্তা থেকে ইযেকিয়েলকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ওসব আচরণ এই সংকটকালে ইসরায়েলের দুর্ভোগ তুলে ধরার জন্যেও প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং এক গভীরতরে স্তরে দেখিয়েছে যে, খোদ ইসরায়েল পৌত্তলিক জগতে অনাহুত হয়ে উঠছে। এই কারণে স্ত্রীর মৃত্যুর পর ইযেকিয়েলের ওপর শোক প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরেপিত হয়েছে: একপাশে কাত হয়ে ৩৯০ দিন এবং অন্য পাশ ফিরে ৪০ দিন শুয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। একবার অবশ্য কোনও বাসযোগ্য নগর ছাড়া তল্পিতল্পাসই শরণার্থীর মতো তেল আবিবের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেও হয়েছিল তাকে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এমন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ভরে দিয়েছিলেন তাকে যে কম্পন আর অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়ানো থেকে বিরত থাকতে পারেননি তিনি। অন্য এক ঘটনায় পশুর বিষ্ঠা খেতেও বাধ্য করা হয়েছে তাকে, জেরুজালেম অবরোধকালে স্বদেশবাসীর অদৃষ্ট দুর্ভিক্ষের আগাম নিদর্শন ছিল সেটা। ইযেকিয়েল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্টের প্রকট ধারাবাহিকতাহীনের (radical discontinuti)-এর প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন: কোনও কিছুই নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়ার উপায় ছিল না, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।

অন্যদিকে পৌত্তলিক দর্শন দেবতা ও সাধারণ জগতের মাঝে অনুভূত ধারাবাহিকতা উপভোগ করে যাচ্ছিল। প্রাচীন ধর্মে সান্ত্বনাদায়ক কিছুই পাননি ইযেকিয়েল, যেটাকে স্বভাবক্রমে তিনি আবর্জনা’ আখ্যায়িত করতেন। এক দিব্যদর্শনের সময় জেরুজালেমের মন্দির দেখানো হয় তাকে। আতঙ্কের সঙ্গে তিনি দেখাতে পান, বিনাশের দোরগোড়ায় পৌঁছেও জুদাহ্র জনগণ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র মন্দিরে স্থাপিত পৌত্তলিক দেবতাদের উপাসনা করছে। খোদ মন্দির এক দুঃস্বপ্নময় জায়গায় পরিণত হয়েছে: এর কক্ষগুলোর দেয়াল কিলবিলে সাপ আর বিশ্রী সব জানোয়ারের ছবিতে ঢাকা; অশ্লীল আলোয় পুরোহিতরা ‘অশ্লীল আচরণে লিপ্ত, ঠিক যেন ব্ল্যাকরুমে যৌন ক্রিয়ায় জড়িয়ে আছে। হে মনুষ্যসন্তান, ইস্রায়েল জলের প্রাচীন-বর্গ অন্ধকারে, প্রত্যেকে আপন আপন ঠাকুর ঘরে কি কি কাৰ্য্য করে তাহা কি তুমি দেখিলে?[৫১] আরেকটা ঘরে দেবতা তামমুযের (Tammuz) দুর্ভোগের জন্যে বসে বসে কাঁদছিল মহিলারা; অন্যরা স্যাঙ্কচুয়্যারির দিকে পেছন ফিরে সূর্যের উপাসনা করছিল। সবশেষে পয়গম্বর তার প্রথম দিব্যদর্শনে দেখা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতাপ চলে যাওয়া রথ দেখতে পান। কিন্তু তখনও পুরোপুরি দূরবর্তী উপাস্যে পরিণত হননি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌। জেরুজালেম ধ্বংসের পূর্ববর্তী শেষ দিনগুলোতে ইযেকিয়েল ইসরায়েল জাতির মনোযোগ আকর্ষণ ও তাঁকে মেনে নিতে বাধ্য করার ব্যর্থ প্রয়াসে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ও চিৎকার করার কথা বলে গেছেন। আসন্ন বিপর্যয়ের জন্যে খোদ ইসরায়েলই দায়ী। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে বারবার দূরবর্তী মনে হলেও তিনি ইযেকিয়েলের মতো ইসরায়েলিদের বুঝতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। যে, ঐতিহাসিক অমোঘ আঘাত দৈবচয়িত ও খেয়ালি নয় বরং এর নিগূঢ় যুক্তি ও সুষ্ঠুতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিষ্ঠুর জগতে প্রকট একটা অর্থ খুঁজে পাবার প্রয়াস পাচ্ছিলেন তিনি।

বাবিলনের নদনদীর তীরে বসে নির্বাসিতদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই অনুভব করেছিল যে, প্রতিশ্রুত ভূমির বাইরে তারা ধর্ম পালন করতে পারবে না। পৌত্তলিক দেবতারা সবসময় আঞ্চলিক প্রকৃতির ছিলেন, ফলে কারও কারও কাছে ভিন্ন দেশে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র গান গাওয়া অসম্ভব মনে হয়েছে: বাবিলনের শিশুদের পাথরের ওপর আছড়ে ফেলে মগজ বের করে ফেলার চিন্তা অনেকেই উপভোগ করেছে।[৫২] নতুন একজন পয়গম্বর অবশ্য শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা, এটা হয়তো তাৎপর্যবহ, কেননা তার ভবিষ্যদ্বাণী ও শ্লোকে পূর্বসূরিদের মতো ব্যক্তিগত সংগ্রামের কোনও চিহ্ন দেখা যায় না। পরবর্তীকালে তাঁর রচনা ইসায়াহর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ায় সাধারণভাবে তাঁকে দ্বিতীয় ইসায়াহ্ আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। নির্বাসিত অবস্থায় ইহুদিদের কেউ কেউ বাবিলনের দেবতাদের উপাসনায় ফিরে গিয়েছিল, কিন্তু অন্যরা এক নতুন ধর্মীয় সচেতনতার দিকে ধাবিত হয়েছে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র মন্দির ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল, বেথ-এল ও হেবরনের প্রাচীন কাল্টিক উপাসনালয়গুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাবিলনে তাদের পক্ষে স্বদেশী আচার-অনুষ্ঠান বা শাস্ত্রাচার পালন সম্ভব ছিল না। ওদের একমাত্র সম্বল ছিল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌। দ্বিতীয় ইসায়াহ্ একে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কেই একমাত্র ঈশ্বর ঘোষণা দেন। তাঁর পুনর্লিখিত ইসরায়েলিদের ইতিহাসে এক্সোডাসের মিথ এমন ইমেজারির আবরণ পায় যা আমাদের আদিম সাগরে তিয়ামাতের বিরুদ্ধে মারদুকের বিজয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়:

আর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ মিশ্ৰীয় সমুদ্রের খাড়ি নিঃশেষে বিনষ্ট করিবেন।
ফরাৎ নদীর উপরে নিজ উত্তপ্ত বায়ু সহকারে হস্ত দোলাইবেন,
তাহাকে প্রচার করিয়া সপ্ত প্রণালী করিবেন,
ও লোকদিগকে পাদুকাঁচরণে পার করিবেন।
আর মিসর দেশ হইতে ইস্রায়েলের বাহির হইয়া আসিবার সময়ে যেমন
তাহার নিমিত্ত পথ হইয়াছিল তেমনি তাহার প্রজাদের
অবশিষ্টাংশের অনূর হইতে অবশিষ্ট লোকদের নিমিত্ত এক রাজপথ
হইবে ।[৫৩]

প্রথম ইসায়াহ্ ইতিহাসকে স্বর্গীয় সতর্কবাণীতে পরিণত করেছিলেন। তাঁর সান্ত্বনা পুস্তকে (Book of Cousolation) বিপর্যয়ের পর দ্বিতীয় ইসায়াহ ইতিহাসকে ভবিষ্যতের নতুন আশা সঞ্চারে ব্যবহার করেছেন। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ অতীতে ইসরায়েলকে একবার উদ্ধার করে থাকলে আবারও তা করতে পারবেন। তিনি স্বয়ং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উদগাতা, তার চোখে সকল গোয়িম কোনও পাত্রের এক ফোঁটা পানির চেয়ে বেশি কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই একমাত্র ঈশ্বর যার গুরুত্ব আছে। বাবিলনের প্রাচীন উপাস্যদের একটা ঠেলাগাড়িতে তুলে সূর্যাস্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে কল্পনা করেছেন দ্বিতীয় ইসায়াহ্।[৫৪] তাদের দিন ফুরিয়ে গেছে: ‘আমি কি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ নই? বারবার জিজ্ঞাসা রেখেছেন তিনি, আমার পাশে আর কোনও দেবতা নেই।[৫৫]

আমি ব্যতীত অন্য ঈশ্বর নাই;
আমি ধৰ্ম্মশীল ও ত্রাণকারী ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌।
আমি ব্যতীত অন্য নাই।[৫৬]

গোয়িমদের দেবনিচয়কে অস্বীকার যেতে দেরি করেননি দ্বিতীয় ইসায়াহ্, বিপর্যয়ের পর যাদের অবশ্য বিজয়ী রূপে দেখা হয়ে থাকতে পারে। নির্বিকার চিত্তে তিনি ধরে নিয়েছেন, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ই-মারদুক বা বাআল নন–সমস্ত মহান ঘটনাবলী ঘটিয়েছেন যা বিশ্বকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সম্ভবত বাবিলনের সৃষ্টি সংক্রান্ত মিথগুলোর সঙ্গে নতুন যোগাযোগ ঘটার কারণেই ইসরায়েলিরা প্রথমবারের মতো সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ভূমিকার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। তারা অবশ্যই বিশ্বজগতের ভৌত বা বাস্তব উৎপত্তি বা। সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জনের প্রয়াস পায়নি বরং বর্তমান কঠিন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা পেতে চেয়েছে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ আদিকালের দানবসদৃশ্য বিশৃঙ্খলাকে দমন করে থাকলে তার পক্ষে নির্বাসিত ইসরায়েলিদের উদ্ধার করা কোনও ব্যাপারই নয়। এক্সোডাস মিথ ও সময়ের সূচনালগ্নে জলীয় বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে বিজয়ের পৌত্তলিক গল্প গাথার মাঝে মিল লক্ষ করে স্বর্গীয় ক্ষমতা বা শক্তির এক নতুন আবির্ভাবের আশায় আস্থার সঙ্গে বুক বাঁধার আহ্বান জানিয়েছেন দ্বিতীয় ইসয়াহ। উদাহরণ স্বরূপ, এখানে তিনি কানানের সৃষ্টি সংক্রান্ত মিথ, দানব লোতনের বিরুদ্ধে বাআলের বিজয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই সাগর-দানবকে রাহাব: কুমীর (tannin) ও অতলগহ্বর (tebom) বলেও ডাকা হতো:

ওঠো, জাগিয়া ওঠো! শক্তিতে আবৃত করো,
ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র হাত,
জাগিয়া ওঠো, অতীত কালের ন্যায়,
সেই বহু প্রজন্ম অতীতের সময়ের ন্যায়।
তুমি কি রাহাবকে খণ্ড-বিখণ্ড করো নাই;
আর ড্রাগনকে (tannin) বিদ্ধ করো নাই?
তুমি কি সাগরকে শুস্ক করো নাই,
বিশাল গহ্বরের (tehom) পানিকে
সাগতলকে পথে রূপান্তরিত করার জন্যে
যাতে উদ্ধারপ্রাপ্তরা অতিক্রম করিতে পারে? [৫৭]

ইসরায়েলের ধর্মীয় কল্পনায় অবশেষে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিদের গ্রাস করে ফেললেন: নির্বাসিত অবস্থায় পৌত্তলিকতাবাদের প্রলোভন আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল ও জুদাইজমের ধর্ম জন্ম নিয়েছিল। সে সময় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্ট সঙ্গত কারণেই বিলুপ্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল ঠিক তখন চরম হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতিতে তিনি মানুষের আশাবাদী হয়ে ওঠার উপায়ে পরিণত হয়েছিলেন।

সুতরাং, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ পরিণত হয়েছিলেন এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরে। দার্শনিক দিক দিয়ে তাঁর দাবির যৌক্তিকতা বিচারের কোনও প্রয়াস ছিল না। বরাবরের মতো নতুন মতাদর্শ যৌক্তিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব বলে নয় বরং তা হতাশা রোধ ও আশা সঞ্চারে কার্যকর বলেই সফল হয়েছিল। ইহুদিরা স্থানচ্যুত ও বিতাড়িত অবস্থায় থাকায় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র বিচ্ছিন্নতাবাদী কাল্টকে আর দূরবর্তী, অস্বস্তিকর ভাবতে পারেনি। এটা বরং প্রবলভাবে ওদের অবস্থা তুলে ধরেছে।

কিন্তু দ্বিতীয় ইসায়াহ্‌র ঈশ্বরের ইমেজে আরামপ্রদ কিছুই ছিল না। তিনি মানব মনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন

কারণ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ কহেন, আমার সংকল্প সকল ও
তোমাদের সংকল্প সকল এক নয়,
এবং তোমাদের পথ সকল ও আমার পথ সকল এক নয়।
কারণ ভূতল হইতে আকাশ মণ্ডল যত উচ্চ,
তোমাদের পথ হইতে আমার পথও
তোমাদের সংকল্প হইতে আমার সংকল্প তত উচ্চ।[৫৮]

ঈশ্বরের রূপ ভাষা ও ধারণার আওতার অতীত। মানুষ যা আশা করে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সবসময় সেটা করেনও না। অত্যন্ত দুঃসাহসী এক অনুচ্ছেদে, আজকের দিনে যেটাকে বেশ কটু মনে হয়, পয়গম্বর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এমন এক সময় আসবে যখন মিশর ও আসিরিয়াও ইসরায়েলের পাশে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র জাতিতে রূপান্তরিত হবে। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বলবেন: ‘আমার প্রজা মিসর আমার হস্তকৃত অশূর ও অধিকার ইস্রায়েল আশীর্ব্বাদ যুক্ত হউক।”[৫৯] দুয়ে সত্তার প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন তিনি যার ফলে নির্বাচনের সংকীর্ণ ব্যাখ্যা তুচ্ছ ও অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে।

বিসিই ৫৩৯ সালে পারসিয়ার রাজা সাইরাস বাবিলনিয় সাম্রাজ্য অধিকার করার পর পয়গম্বরদের বিরুদ্ধে বুঝি বদলা নেওয়া হয়েছে মনে হয়েছে। সাইরাস তার নতুন প্রজারে ওপর পারসিয় দেবতাদের চাপিয়ে দেননি, তবে বিজয়ীর বেশে বাবিলনে প্রবেশ করার পর মারদুকের মন্দিরে উপাসনা করেছেন। বাবিলনিয়দের কাছে পরাস্ত জাতির দেবতাদের প্রতিমাও তাদের আদি গৃহে পুনঃস্থাপন করেন তিনি। বিশ্ব বিশালাকৃতির আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যের অধীনে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ায় দেশান্তরীকরণের পুরোনো পদ্ধতি প্রয়োগ প্রয়োজন মনে করেননি। প্রজারা তাদের নিজস্ব এলাকায় নিজস্ব দেবতাদের উপাসনা করলে শাসন করার বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়। গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে প্রাচীন মন্দিরসমূহের পুনঃস্থাপন উৎসাহিত করেছেন তিনি, বারবার দাবি করেছেন, তাদের দেবতাই তাঁর ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তিনি ছিলেন পৌত্তলিক ধর্মের কোনও কোনও রূপের অন্তর্দৃষ্টির সহনশীলতা ও উদারতার উদাহরণ। ৫৩৮ সালে ইহুদিদের জুদাহয় ফিরে তাদের মন্দির পুনর্নির্মাণের অনুমতি দিয়ে এক আদেশ জারি করেন সাইরাস। কিন্তু ওদের অধিকাংশই ফিরে না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে কেবল সংখ্যালঘু একটা দল প্রতিশ্রুত ভূমিতে বাস করবে। বাইবেল আমাদের বলছে, ৪২,৩৬০ জন ইহুদি বাবিলন ও তেল আবিব ত্যাগ করে স্বদেশের পথ ধরেছিল, যেখানে তারা তাদের হতবুদ্ধি স্বজাতিদের ওপর নতুন জুদাইজম চাপিয়ে দিয়েছিল।

আমরা নির্বাসনের পর রচিত এবং পেন্টাটিউকের অংশে পরিণত প্রিস্টলি ট্র্যাডিশনের রচনায় এর সঙ্গে কী জড়িত ছিল তা দেখতে পাই। এটা আমাদের ‘J’ এবং ‘E’ বর্ণিত ঘটনাবলীর নিজস্ব ব্যাখ্যা যোগায় এবং নাম্বারস ও লেভিটিকাস শীর্ষক দুটো নতুন পুস্তক যোগ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা মতোই ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সম্পর্কে অত্যন্ত উন্নত ও অতিরঞ্জিত ধারণা ছিল ‘P’-র। যেমন, তিনি বিশ্বাস করতেন না যে ‘J’ যেভাবে বলেছেন সেভাবে কারও পক্ষেই সত্যি সত্যি ঈশ্বরকে দেখা সম্ভব। ইযেকিয়েলের বহু ধারণার মতো তাঁর বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের ধারণা এবং প্রকৃত সত্তার মাঝে একটা পার্থক্য রয়েছে। ‘P’-এর সিনাই পর্বতে মোজেসের কাহিনীতে মোজেস ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌হ্‌ দর্শন লাভের জন্যে আবেদন জানাচ্ছেন, ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ জবাবে বলছেন: ‘তুমি আমার মুখ দেখিতে পাইবে না, কেননা মনুষ্য আমাকে দেখিলে বাঁচিতে পারে না।’[৬০] তার বদলে স্বর্গীয় প্রতাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্যে পাহাড় প্রাচীরের একটা ফোকরে আশ্রয় নিতে হবে মোজেসকে যেখান থেকে তিনি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বিদায় নেওয়ার সময় এক ঝলকের জন্যে অনেকটা পেছন থেকে দেখতে পাবেন। ‘P’-এমন একটা ধারণা যোগান দিয়েছেন যেটা ঈশ্বরের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। নারী-পুরুষ কেবল স্বর্গীয় সত্তার একটা আভা দেখতে পাবে, যাকে তিনি বলছেন ‘ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতাপ (kavod), ‘তাঁর সত্তার একটা প্রকাশ, যাকে স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।[৬১] মোজেস যখন পাহাড় থেকে নেমে এলেন, তার চেহারায়ও এই প্রতাপ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, এমন ঔজ্জ্বল্য নিয়ে ঝলমল করছিল যে, ইসরায়েলিরা তার দিকে তাকাতে পারছিল না।[৬২]

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ‘প্রতাপ’ পৃথিবীতে তাঁর উপস্থিতির একটি প্রতীক, সুতরাং এটা নারী-পুরুষের সৃষ্ট ঈশ্বর সংক্রান্ত ইমেজ ও স্বয়ং ঈশ্বরের পবিত্রতার পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। এভাবে এটা ইসরায়েলি ধর্মের পৌত্তলিক বৈশিষ্ট্যের এক পাল্টা ভারসাম্য ছিল। এক্সোডাসের প্রাচীন কাহিনীগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে ‘P’ এটা ভাবেননি যে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলোয় স্বয়ং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ইসরায়েলিদের সঙ্গে ছিলেন সেটা হতো একটা অসম্ভব পার্থিব ব্যাপার। বরং তার বদলে তিনি ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ যেখানে মোজেসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন সেই তাঁবু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র ‘প্রতাপে’ ভরে ওঠা দেখিয়েছেন। একইভাবে মন্দিরে অবস্থানকারীও কেবল ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতাপই হতে পারে।[৬৩]

পেন্টাটিউকে ‘P’-র সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান অবশ্যই জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে সৃষ্টি সংক্রান্ত বিবরণ, যা এনুমা এলিশের অনুসরণ। আদিম গহ্ববের (tehom, tiamat-এর অপভ্রংশ) পানি দিয়ে শুরু করেছেন ‘P’, যেখান থেকে স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌। তবে দেবতাদের যুদ্ধের কোনও উল্লেখ নেই, উল্লেখ নেই ইয়াম, লোতান বা রাহাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ একাই সবকিছুর অস্তিত্ব দান করার দাবিদার। বস্তু ক্রম-উৎসারিত হয়নি, বরং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ স্রেফ অনায়াস ইচ্ছা দিয়েই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্বভাবতই পৃথিবীকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ উপাদান বিশিষ্ট স্বর্গীয় ভাবতে যাননি ‘P’। প্রকৃতপক্ষে ‘P’-র ধর্মতত্ত্বে ‘পৃথকীকরণ’ (Separation) খুবই গুরুত্বপূর্ণ: রাত্রি হতে দিন, পানি হতে জমিন এবং অন্ধকার হতে আলোকে পৃথক করার ভেতর দিয়ে ঈশ্বর মহাবিশ্বকে এক সুশৃঙ্খল রূপ দিয়েছেন। প্রত্যেক পর্যায়ে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ সৃষ্টিকে আশীর্বাদ ও পবিত্র করেছেন এবং ভালো’ আখ্যা দিয়েছেন। বাবিলনিয়দের কাহিনীর বিপরীতে মানব সৃষ্টি হচ্ছে সৃষ্টির ক্লাইমেক্স, হাস্যকর পশ্চাদচিন্তা নয়। নারী এবং পুরুষ স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার না হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের অনুরূপ আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের তাদের অবশ্যই তার সৃজনশীল কর্মধারাকে এগিয়ে নিতে হবে। এনুমা এলিশে যেমন রয়েছে, ছয়দিনব্যাপী সৃষ্টি কর্মের পর সপ্তম দিনে সাবাথের মতো বিশ্রামের কথা রয়েছে: বাবিলনিয় বর্ণনায় এই দিনে মহাসভা ‘নিয়তি নির্ধারণ ও মারদুককে স্বর্গীয় উপাধি দান করার জন্যে মিলিত হয়েছিল। ‘P’-র বর্ণনায় প্রথম দিনে বিরাজিত আদিম বিশৃঙ্খলার প্রতীকী বিপরীত অবস্থান পেয়েছে সাবাথ। শিক্ষামূলক সুর ও পুনরাবৃত্তি বোঝায়, ‘P’-র সৃষ্টি-কাহিনী এনুমা এলিশের মতো আচরিক আবৃত্তির উদ্দেশে রচিত হয়েছিল; ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাজের প্রশংসা এবং ইসরায়েলের স্রষ্টা ও শাসক হিসাবে তাকে অভিষিক্ত করার জন্য।

স্বভাবতই ‘P’-র ইহুদিবাদে নতুন মন্দির ছিল কেন্দ্রীয় বিষয়। নিকট প্রাচ্যে মন্দিরকে প্রায়শঃই মহাবিশ্বের অনুকৃতি হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। মন্দির নির্মাণ ছিল এমন এক কর্মকাণ্ড যা মানুষকে খোদ দেবতাদের সৃজনশীলতায় যোগ দিতে সক্ষম করে তোলে। নির্বাসনকালে বহু ইসরায়েলি চুক্তির আর্ক-এর পুরোনো কাহিনীসমূহে সান্ত্বনা খুঁজে পেত; আর্ক একটা বহনযোগ্য মন্দির যেখানে ঈশ্বর তার জাতির সঙ্গে তাঁবু খাঁটিয়েছেন’ (Shaken), তাদের গৃহহীন অবস্থার অংশীদার হয়েছেন। স্যাঙ্কচুয়্যারি নির্মাণ, বিরান এলাকায় ভল্ট অভ মিটিং বর্ণনা করার সময় প্রাচীন পুরাণের আশ্রয় নিয়েছেন ‘P’। এর স্থাপত্য নকশা নতুন নয় বরং স্বর্গীয় মডেলেরই অনুকরণ: সিনাই পর্বতে মোজেসকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ অত্যন্ত দীর্ঘ ও বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলেন: ‘তাহারা আমার নিমিত্তে এক ধৰ্মধাম নির্মাণ করুক, তাহাতে আমি তাহাদের মধ্যে বাস করিব। আবাসের ও তাহার সকল দ্রব্যের বা আদর্শ আমি তোমাকে দেখাই, তদনুসারে তোমরা সকলই করিবে।[৬৫] স্যাঙ্কচুয়্যারি নির্মাণের দীর্ঘ বিবরণী আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার কথা বলা হয়নি; এটা কেউ কল্পনা করেনি যে প্রাচীন ইসরায়েলিরা সত্যি সত্যি স্বর্ণ, রৌপ্য, পিত্তল; এবং নীল, বেগুনি ও লাল, এবং শাদা মসিনা সূত্র ও ছাগলোম ও রজীকৃত মেষচৰ্ম্ম ও শিটী কাষ্ঠ ইত্যাদি দিয়ে এমন একটা বিশাল উপাসনাগৃহ নির্মাণ করেছিল।[৬৬] এই দীর্ঘ প্রক্ষেপন আসলে ‘P-র সৃষ্টি-কাহিনীর স্মারক। নির্মাণের প্রত্যেক পর্যায়ে মোজেস সকল কাজ দেখেছেন এবং সৃষ্টির দিনের ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র মতো মানুষকে আশীর্বাদ করেছেন। বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে স্যাঙ্কচুয়্যারি নির্মিত হয়েছিল; উপাসনালয়ের স্থপতি বেয়ালেল ঈশ্বরের চেতনা (ruachelohim) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন যা বিশ্বসৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তাধারা ছিল, এবং উভয় বিবরণীই সাবাথ বিশ্রামের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে।[৬৭] মন্দির নির্মাণ আদি সাম্যেরও একটা প্রতীক যা মানবজাতি পৃথিবী ধ্বংস করার আগে বিরাজমান ছিল।

ডিউটেরোনমিতে দাসসহ প্রত্যেককে একদিন বিশ্রাম দান ও ইসরায়েলিদের এক্সোডাসের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সাবাথের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।[৬৮] সাবাথকে এক নতুন তাৎপর্য দান করেছেন ‘P’। ঈশ্বরকে অনুসরণ করার ও বিশ্ব সৃষ্টির স্মরণের উপলক্ষ্যে পরিণত হয়েছে এটা। সাবাথ বিশ্রাম গ্রহণের সময় ইহুদিরা এমন এক কর্মকাণ্ডে অংশ নিত যা আদিতে ঈশ্বর একাই পালন করেছিলেন: স্বর্গীয় জীবন যাপনের একটা প্রতীকী প্রয়াস এটা ছিল। প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদে মানবীয় প্রতিটি আচরণ দেবতাদের কর্মকাণ্ডের অনুকরণ ছিল, কিন্তু ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র কাল্ট স্বর্গীয় ও মানব জগতের মাঝখানে এক বিশাল দূরত্ব তুলে ধরেছিল। এবার মমাজেসের ভোরাহ্ অনুকরণের মাধ্যমে ইহুদিরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র আরও কাছাকাছি যাবার প্রেরণা পেল। ডিউটেরোনমিতে বেশ কিছু অবশ্য পালনীয় আইনের উল্লেখ করা হয়েছে, টেন কমান্ডমেন্টস যার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নির্বাসন ও এর অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে পেন্টাটিউকে একে বিস্তৃত করে ৬১৩টি নির্দেশ (mitzvot) সম্বলিত জটিল বিধিবিধানে পরিণত করা হয়। সূক্ষ্ম এই নির্দেশনাগুলো বহিরাগত কারও চোখে অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে; নিউ টেস্টামেন্টের যুক্তিতর্কে তা খুব নেতিবাচক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ক্রিশ্চানরা যেমনটি ভাবতে চায়, ইহুদিরা সেরকম অসহনীয় ভার মনে করেনি এগুলোকে, বরং তারা একে ঈশ্বরের সকাশে বেঁচে থাকার প্রতীকী উপায় হিসাবে দেখেছে। ডিউটেরোনমিতে আহার সংক্রান্ত বিধিবিধান ইসরায়েলের বিশেষ মর্যাদার নিদর্শন ছিল।[৬৯] এগুলোকে ঈশ্বরের পবিত্র ভিন্নতার আচরিক প্রয়াস হিসাবেও দেখেছে তারা, মানুষ ও স্বর্গের মধ্যকার বেদনাদায়ক বিচ্ছিন্নতাকে যা দূর করে দিয়েছে। ইসরায়েলিরা যখন মধুঁকে মাংস হতে, অপরিচ্ছন্ন থেকে পরিচ্ছন্নকে ও গোটা সপ্তাহ থেকে সাবাথকে আলাদা করে তখন তারা ঈশ্বরের সৃজনশীল কর্মকাণ্ড অনুকরণের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হতে পারে।

‘J’ এবং ‘E’ ও ডিউটেরোনমিস্ট বর্ণনার পাশাপাশি পেন্টাটুয়েকে প্রিস্টলি বিবরণের রচনাবলী স্থান পেয়েছে। যে কোনও প্রধান ধর্ম যে কতগুলো স্বাধীন দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে গঠিত, এটা আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়। কোনও কোনও ইহুদি বরাবরই ডিউটেরোনমিয় ঈশ্বরের দিকে ঝুঁকে থাকে, যিনি ইসরায়েলকে প্রচণ্ডভাবে গোয়িমদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন; কেউ কেউ একে মেসিয়ানিক মিথ পর্যন্ত প্রসারিত করেছে যখন সময়ের শেষ পর্যায়ে ‘ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র দিবসের প্রত্যাশা করা হয়েছে, যেদিন তিনি ইসরায়েলকে মহিমান্বিত করবেন ও অন্যান্য জাতিকে অপদস্থ করবেন। এসব পৌরাণিক বিবরণী ঈশ্বরকে খুব দূরবর্তী সত্তা হিসাবে দেখতে চেয়েছে। একটা বিষয়ে নীরব সম্মতি রয়েছে যে, নির্বাসনের পর পয়গম্বরদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। ঈশ্বরের সঙ্গে আর সরাসরি যোগাযোগ হবে না; ইনোখ ও দনিয়েলের মতো সুদূর অতীতের মহান ব্যক্তিত্বের ওপর আরোপিত প্রতীকী দর্শনের মাধ্যমেই কেবল তা অর্জিত হয়।

দূর অতীতের এই বীরদের একজন, দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করার ক্ষেত্রে বাবিলনে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হিসাবে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন জব। নির্বাসনের পরে রক্ষাপ্রাপ্তদের একজন এই প্রাচীন কিংবদন্তী উল্লেখ করে ঈশ্বরের প্রকৃতি ও মানুষের দুঃখদুর্দশা লাঘবে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। প্রাচীন কাহিনীতে ঈশ্বর কর্তৃক পরীক্ষিত হয়েছেন জব, তিনি ধৈর্যের সঙ্গে অপরিসীম দুঃখকষ্ট সহ্য করেছেন বলে ঈশ্বর অতীতের ঐশ্বর্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করেছিলেন। জবের কাহিনীর নতুন ভাষ্যে রচয়িতা প্রাচীন কিংবদন্তীকে দুভাগ করে ঈশ্বরের আচরণের বিরুদ্ধে জবকে ক্ষুব্ধ দেখিয়েছেন। তিনজন সান্ত্বনাদাতাকে নিয়ে স্বর্গীয় বিধি-বিধানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনের সাহস দেখিয়েছেন জব, লিপ্ত হয়েছেন প্রবল বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে। ইহুদিদের ধর্মীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ধর্মীয় কল্পনা আরও গভীর বিমূর্ত প্রকৃতির অনুধাবনের দিকে বাঁক নিয়েছিল। পয়গম্বরগণ দাবি। করেছিলেন যে, পাপের ফল হিসাবেই ইসরায়েলকে দুর্দশাগ্রস্ত করেছেন ঈশ্বর; জবের রচয়িতা দেখাচ্ছেন, ইসরায়েলিদের কেউ কেউ প্রচলিত জবাবে আর সন্তুষ্ট ছিল না। জব এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আক্রমণ করেছেন এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক অপূর্ণতা প্রকাশ করে দিচ্ছেন, কিন্তু ঈশ্বর সহসা তার হিংস্র ভাবনায় বাদ সাধছেন। এক দিব্যদর্শনে জবকে দেখা দিয়ে আপন সৃষ্ট জগতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনিঃ জবের মতো এক সামান্য সৃষ্টি দুয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে তর্কে যাবার সাহস করেন কীভাবে? জব হার মানেন, কিন্তু একজন আধুনিক পাঠক, যিনি দুঃখ বেদনার আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ ও দার্শনিক সমাধানের সন্ধানে আছেন, এ সমাধানে সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। অবশ্য জবের রচয়িতা প্রশ্ন ভোলার অধিকার অস্বীকার করছেন না, কিন্তু বোঝাতে চাইছেন স্রেফ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এসব চিন্তাতীত বিষয়ের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক আঁচ-অনুমানকে অবশ্যই প্রত্যক্ষ প্রত্যাদেশের পথ খুলে দিতে হবে, পয়গম্বররা। যেমন পেয়েছিলেন।

ইহুদিরা তখনও পর্যন্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার শুরু করেনি, তবে চতুর্থ শতাব্দীতে তারা গ্রিক ন্যাশনালিজমের প্রভাবের আওতায় এসেছিল। বিসিই ৩৩২ সালে মেসিদোনিয়ার আলেকজান্দার পারসিয়ার তৃতীয় দারিয়াসকে পরাজিত করেন এবং এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তুলতে শুরু করে গ্রিকরা। তারা তায়ার, সিদন, গাযা, ফিলাদেলফিয়া (আম্মান ও ত্রিপোলি) এবং এমনকি শেচেম-এ নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। প্যালেস্তাইন ও ডায়াসপোরার ইহুদিরা হেলেনিক সংস্কৃতি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল, অনেকের কাছে তা ছিল অস্বস্তিকর, অন্যরা গ্রিক থিয়েটার, দর্শন, ক্রীড়া ও কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তারা গ্রিক ভাষা শিখেছে, জিমন্যাসিয়ামে শরীর চর্চা করেছে এবং গ্রিক নাম গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ মার্সেনারি হিসাবে গ্রিক সেনাবাহিনীতেও কাজ করেছে। নিজেদের ঐশীগ্রন্থ গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করেছে তারা, ফলে সেপচুয়াজিন্ট নামে পরিচিত ভাষ্যটির সৃষ্টি; এভাবে গ্রিকদের কেউ কেউ ইসরায়েলের ঈশ্বর সম্পর্কে জানতে পারে এবং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ (বা ইয়াও, যেভাবে সম্বোধন করত তারা)-কে যিউস ও দায়োনিসাসের পাশাপাশি উপাসনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কেউ কেউ সিনাগগ বা বিকল্প স্থানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ডায়াসপোরার ইহুদিরা মন্দিরে উপাসনার বদলে বিকল্প এই স্থান গড়ে তোলে। এখানে তারা তাদের ঐশীগ্রন্থ পাঠ করত, প্রার্থনায় মগ্ন হতো ও সারমন শুনত। প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বের অন্য আর কিছুর সঙ্গে সিনাগগের মিল ছিল না। এখানে কোনও রকম আচার-অনুষ্ঠান পালন বা উৎসর্গের উপস্থিতি ছিল না বলে নিশ্চয়ই এগুলোকে দর্শনের স্কুলের মতো মনে হতো; সুপরিচিত কোনও ইহুদি পুরোহিতের আগমনের সংবাদ পেলে অধিক সংখ্যায় সিনাগগে হাজির হতো তারা, যেমন আপন দার্শনিকদের বক্তব্য শোনার জন্যে লাইন দিয়ে দাঁড়াত। কোনও কোনও গ্রিক এমনকি তোরাহ্র নির্দিষ্ট অংশ অনুসরণ করত ও ইহুদিদের সঙ্গে সমন্বয়বাদী সেক্টে যোগ দিয়েছিল। বিসিই চতুর্থ শতাব্দীতে ইহুদি ও গ্রিকদের ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে জনৈক গ্রিক দেবতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে।

অবশ্য অধিকাংশ ইহুদি দূরত্ব বজায় রাখে। মধ্যপ্রাচ্যের হেলেনিস্টিক নগরসমূহে ইহুদি ও গ্রিকদের মাঝে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। প্রাচীন বিশ্বে ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না। নগরীসমূহে দেবতারা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। মনে করা হতো যে তাঁদের কাল্টের প্রতি অবহেলা করা হলে তাঁরা পৃষ্ঠপোষকতা তুলে নেবেন। যেসব ইহুদি এইসব দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকার করত তাদের নাস্তিক ও সমাজের শত্রু আখ্যা দেওয়া হয়। বিসিই দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ এই বৈরিতা আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে: প্যালেস্তাইনে যখন সেলুসিদ গভর্নর অ্যান্তিওকাস এপিফেন্স জেরুজালেমকে হেলেনাইজ করে মন্দিরে যিউসের কাল্ট চালু করার প্রয়াস পেয়েছিলেন তখন এমনকি একটা বিদ্রোহেরও সৃষ্টি হয়েছিল। ইহুদিরা নিজস্ব সাহিত্য গড়ে তুলতে শুরু করেছিল যেখানে যুক্তি দেখানো হয় যে, প্রজ্ঞা গ্রিক চাতুর্য নয় বরং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ভীতি। মধ্যপ্রাচ্যে প্রজ্ঞা-সাহিত্য ছিল এক সুপ্রতিষ্ঠিত ধারা, দার্শনিক বিচার বিবেচনা নিয়ে নয় বরং বেঁচে থাকার সর্বোত্তম উপায় অনুসন্ধানের মাধ্যমে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবার প্রয়াস পেয়েছে এটা: প্রায়শঃ অনেক বাস্তবভিত্তিক হতে দেখা গেছে এটাকে। বিসিই তৃতীয় শতাব্দীতে বুক অভ প্রোভার্বস-এর রচয়িতা আরেকটু অগ্রসর হয়ে মত প্রকাশ করেছেন যে, প্রজ্ঞা হচ্ছে বিশ্ব সৃষ্টির সময় ঈশ্বরের মহাপরিকল্পনা অর্থাৎ এটাই ছিল তার প্রথম সৃষ্টি। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, এই বিশ্বাসটি আদি ক্রিস্টানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রজ্ঞাকে ব্যক্তিক রূপ দিয়েছেন রচয়িতা যেন একে আলাদা সত্তা মনে হয়:

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ নিজ পথের আরম্ভে আমাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন,
তাহার কর্ম সকলের পূর্বে, পূৰ্বাবধি।
আমি স্থাপিত হইয়াছি অনাদি কালাবধি,
আদি অবধি, পৃথিবীর উদ্ভবের পূৰ্বাবধি।
তৎকালে আমি তাহার কাছে কাৰ্য্যকরী ছিলাম;
আমি দিন দিন আনন্দময় * ছিলাম,
তাহার সম্মুখে নিত্য আহ্লাদ করিতাম;
আমি তাহার তুমণ্ডলে আহ্লাদ করিতাম,
মনুষ্য সন্তানগণে আমার আনন্দ হইত।[৭০]

[* (বা) ইয়াহ্‌য়ে আপন পথের আদিস্বরূপ আমাকে গঠন করিয়াছিলেন।
* (বা) তাঁহারা আনন্দজনক।]

অবশ্য প্রজ্ঞা স্বর্গীয় সত্তা ও ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা প্রিস্টলি রচয়িতাদের বর্ণিত ঈশ্বরের প্রতাপে’র মতো, যা মানব জাতি সৃষ্টি ও মানুষের জীবনে অনুভব করতে পারে ঈশ্বরের সেই পরিকল্পনার কথা বোঝায়: রচয়িতা প্রজ্ঞাকে (হোখমাহ) পথে পথে ঘুরে মানুষকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে ভয় করার আহ্বান জানাচ্ছেন বলে দেখিয়েছেন। বিসিই দ্বিতীয় শতাব্দীতে জেরুজালেমের একজন ধর্মভীরু ইহুদি জেসাস বেন সিরা প্রজ্ঞার একই রকম চিত্র এঁকেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, স্বর্গীয় সভায় দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞা নিজ গুণ গাইছেন: তার আগমন ঘটেছে স্বর্গীয় বাণী হিসাবে পরম প্রভুর (Most High) মুখ হতে যা দিয়ে ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন; সৃষ্টির সর্বত্র তার উপস্থিতি রয়েছে কিন্তু ইসরায়েলের জনগণের মাঝে আপন আবাস বেছে নিয়েছেন তিনি।[৭১]

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র প্রতাপে’র মতো প্রজ্ঞার চরিত্রটি পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের একটা প্রতীক। ইহুদিরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র এমন এক উঁচু ধারণার বিকাশ ঘটাচ্ছিল যে মানব জীবনে তার সরাসরি হস্তক্ষেপের কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ‘P’-এর মতো তারা ঈশ্বরকে আমাদের জ্ঞান ও স্বর্গীয় সত্তার অভিজ্ঞতার মাঝে পার্থক্য টানার পক্ষপাতি ছিল। আমরা যখন মানুষের খোঁজে ঈশ্বরকে ছেড়ে প্রজ্ঞার গোটা বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর কথা পড়ি তখন খুব সহজেই ইশতার, আনা ও আইসিসের মতো পৌত্তলিক দেবীদের কথা মনে পড়ে যায় যাঁরা নিষ্কৃতির দায়িত্ব নিয়ে স্বর্গীয় জগৎ হতে অবতরণ করেছিলেন। বিসিই ৫০ সালের দিকে প্রজ্ঞা-সাহিত্য আলেকজান্দ্রিয়ায় ধর্মীয় যুক্তির রূপ লাভ করেছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার এক ইহুদি দ্য উইজডম অভ সলোমন-এ ইহুদিদের চারপাশের আগ্রাসী হেলেনিক সংস্কৃতিকে প্রতিহত করে আপন ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখানে ইহুদিদের গুরুত্বপূর্ণ বসতি ছিল-গ্রিক দর্শন নয় বরং ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ ভীতিই প্রকৃত প্রজ্ঞা গড়ে তুলেছে। গ্রিক ভাষায় লিখেছেন তিনি; প্রজ্ঞাকে (সোফিয়া) ব্যক্তিরূপ দিয়েছেন ও যুক্তি উত্থাপন করেছেন যে একে ইহুদি ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়:

[সোফিয়া] ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রশ্বাস,
সর্বশক্তিমানের প্রতাপের নিখাদ উৎসারণ;
সুতরাং অপবিত্র কোনও কিছুই তাহার মাঝে প্রবেশাধিকার পাইবে না।
তিনি অনন্ত আলোকের প্রতিফলন,
ঈশ্বরের সক্রিয় ক্ষমতার ঝলমলে শশী,
তাহার মহত্বের ভাবমূর্তি। [৭২]

এই অনুচ্ছেদটি জেসাসের মর্যাদা সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে ক্রিশ্চানদের কাছেও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইহুদি রচয়িতা অবশ্য সোফিয়াকে কেবল দুয়ে ঈশ্বরের এক বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখেছেন, যিনি নিজেকে মানবীয় উপলব্ধির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর-যেভাবে-আপনাকে মানুষের-কাছে-প্রকাশ করেছেন, ঈশ্বর সম্পর্কিত মানবীয় উপলব্ধি, ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তার চেয়ে রহস্যজনকভাবে আলাদা; যিনি সব সময় আমাদের উপলব্ধিকে এড়িয়ে যাবেন।

দ্য উইজডম অভ সলোমন-এর রচয়িতা গ্রিক চিন্তা-ভাবনা ও ইহুদি ধর্মের মধ্যকার টানাপোড়েন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। আমরা দেখেছি, অ্যারিস্টটলের সৃষ্ট জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্বিকার ঈশ্বর ও বাইবেলের মানবীয় ব্যাপারে তীব্রভাবে জড়িত ঈশ্বরের মাঝে এক জটিল এবং সম্ভবত সমন্বয়ের অতীত পার্থক্য রয়েছে। গ্রিক ঈশ্বরকে মানুষের যুক্তির মাধ্যমে আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল, কিন্তু বাইবেলের ঈশ্বর কেবল প্রত্যাদেশের মাধ্যমেই নিজেকে প্রকাশ করেন। এক অতল গহ্বর ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, কিন্তু গ্রিকরা বিশ্বাস করত যে, যুক্তির ক্ষমতা মানুষকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে; সুতরাং আপন প্রচেষ্টা দিয়েই তারা তার কাছে পৌঁছুতে পারবে। তা সত্ত্বেও যখনই একেশ্বরবাদীরা গ্রিক দর্শনের প্রেমে পড়েছে অনিবার্যভবে তারা তাদের ঈশ্বরকে নিজেদের ঈশ্বরের সঙ্গে মেলানোর প্রয়াস পেয়েছে। এটা আমাদের কাহিনীর একটা প্রধান থিম হয়ে দাঁড়াবে। প্রথম যাঁরা এই প্রয়াস পেয়েছিলেন তাঁদের প্রথম জন হচ্ছেন প্রখ্যাত ইহুদি দার্শনিক ফিলো অভ আলেকজান্দ্রিয়া (৩০ বিসিই-৪৫ সিই)। ফিলো ছিলেন প্লেটোনিস্ট; আপন মেধা ও জ্ঞানে যুক্তিবাদী দার্শনিক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চমৎকার গ্রিক ভাষায় লিখতেন তিনি। সম্ভবত হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন না, তবু ধর্মপ্রাণ ইহুদি ও মিতভোতের অনুসারী ছিলেন। নিজ ঈশ্বর ও গ্রিক ঈশ্বরের মাঝে বেমানান কিছু দেখেননি তিনি। তবে অবশ্যই একথা বলা প্রয়োজন যে, ফিলোর ঈশ্বরকে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হয়। যেমন, ফিলো যেন বাইবেলের ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে বিব্রত ছিলেন, এগুলোকে তিনি বিস্তারিত রূপক বর্ণনায় পরিণত করার প্রয়াস। পেয়েছিলেন। স্মরণযোগ্য, অ্যারিস্টটল ইতিহাসকে অদার্শনিকসুলভ বিবেচনা করেছিলেন। তাঁর ঈশ্বরের কোনও মানবীয় গুণ নেই: যেমন, তিনি ক্রুদ্ধ’ হয়েছেন বলাটা খুবই ভুল হবে। আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে যেটুকু জানতে পারি সেটা হলো তার অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা মাত্র। তবু ধার্মিক ইহুদি হিসাবে ফিলো বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর পয়গম্বরদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল?

সম্পূর্ণ উপলব্ধির অতীত ঈশ্বরের মূল সত্তা (আউসিয়া) এবং পৃথিবীতে তার কর্মকাণ্ডকে ফিলো তার ক্ষমতা (dynameis) বা শক্তি’ (energeia) বলেছেন, এ দুটোর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য টেনে এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন তিনি। মূলত এটা ‘P’ এবং প্রজ্ঞা-রচয়িতাদের সমাধানের অনুরূপ। ছিল। ঈশ্বর স্বয়ং কেমন কোনওদিনই আমরা তা জানতে পারব না। ফিলো তাঁকে দিয়ে মোজেসকে বুলিয়েছেন: আমাকে বুঝতে পারাটা মানুষের প্রকৃতি, এমনকি গোটা আকাশ এবং মহাবিশ্বের সাধের অতীত। আমাদের সীমিত উপলব্ধিতে নিজেকে অভিযোজিত করার জন্যে ঈশ্বর তার ক্ষমতার মাধ্যমে যোগাযোগ করেন যার সঙ্গে প্লেটোর স্বর্গীয় আকারের মিল আছে বলে মনে হয় (যদিও ফিলো সব সময় এ ব্যাপারে স্থির নন)। এগুলো মানুষের বোধগম্য উচস্তরের বাস্তবতা। এগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকে উৎসারিত বলে মনে করেছেন ফিলো, যেমন প্লেটো ও অ্যারিস্টটল আদি কারণ হতে মহাবিশ্বকে উৎসারিত হতে দেখেছিলেন। এসব ক্ষমতার দুটি বিশেষভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিলো এদের নাম দিয়েছেন রাজকীয় ক্ষমতা (Kingly Power), যা মহাবিশ্বের শৃঙ্খলার মাঝে ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটায়; এবং সৃজনী ক্ষমতা, যার মাধ্যমে ঈশ্বর মানুষের ওপর বর্ষিত আশীর্বাদের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করেন। এসব ক্ষমতার কোনওটাকে স্বর্গীয় সত্তার আউসিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না-যেটা দুর্ভেদ্য রহস্যের আড়ালে ঢাকা থাকে। এগুলো কেবল আমাদের বোধের অতীত এক সত্তার কিঞ্চিৎ আভাস পেতে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে ফিলো ঈশ্বরের অপরিহার্য সত্তাকে (আউসিয়া) রাজকীয় ও সৃজনী ক্ষমতায় পরিবেষ্টিত থাকার কথা বলেছেন, অনেকটা ট্রিনিটর মতো। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি মামরিতে দুজন দেবদূতসহ ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র অ্যাব্রাহামের কাছে হাজির হওয়ার কাহিনীর ব্যাখ্যা করার সময় যুক্তি দেখান: ঈশ্বরের আউসিয়ার রূপক উপস্থাপন দুই উচ্চতম ক্ষমতাসহ তিনি স্বয়ং।[৭৪]

‘J’ হয়তো এ ধারণায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়তেন। প্রকৃতপক্ষেই, ইহুদিরা ঈশ্বর সম্পর্কে ফিলোর ধারণাকে অনেকটা অসত্য হিসাবে দেখেছে। ক্রিশ্চানরা। অবশ্য তাকে দারুণ রকম উপকারী হিসাবে দেখবে এবং আমরা দেখব, গ্রিকরা ঈশ্বরের দুয়ে ‘সত্তা’ (essence) এবং যে শক্তি’ (energies) তাঁকে আমাদের কাছে প্রকাশ করে, এ দুটোর পার্থক্য লুফে নিয়েছিল। তারা তাঁর স্বর্গীয় লোগোসের তত্ত্বেও প্রভাবিত হবে। প্রজ্ঞা-রচয়িতদের মতো ফিলো কল্পনা করেছেন যে ঈশ্বর সৃষ্টির একটা মহাপরিকল্পনা (লোগোস) প্রণয়ন করেছিলেন; যার সঙ্গে প্লেটোর আকৃতির জগতের মিল রয়েছে। এইসব আকৃতি এরপর ভৌত বিশ্বে স্থাপন করা হয়। ফিলো কিন্তু সবসময় অটল ছিলেন না। কখনও তিনি বলেছেন, লোপোস অন্যতম একটা শক্তি, অন্য সময় মনে হয়েছে তিনি একে শক্তির চেয়েও বড় কিছু মানুষের পক্ষে অর্জনযোগ্য ঈশ্বর সম্পর্কিত সর্বোচ্চ ধারণা মনে করছেন। অবশ্য, আমরা যখন লোগোসের কথা ভাবি তখন ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও ইতিবাচক জ্ঞান পাই নাঃ আমাদেরকে বাস্তব যুক্তির নাগালের বাইরে এক অনুভবভিত্তিক উপলব্ধির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যা ‘চিন্তার উপায়ের চেয়ে উন্নত কিছু চিন্তা করা যেতে পারে এমন যেকোনো কিছুর চেয়ে মূল্যবান।’[৭৫] এটা প্লেটোর ধ্যান (থিয়োরিয়া-র মতো কিছু, একই ধরনের একটা ব্যাপার। ফিলো জোর দিয়ে বলেছেন, আমরা কখনওই ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তার কাছাকাছি যেতে পারব নাঃ ঈশ্বর মানব মনকে যে পরমানন্দ স্বীকৃতিতে ছাপিয়ে যান তার মাঝেই সর্বোচ্চ সত্য অনুধাবন করতে পারি আমরা।

যেমন শোনাচ্ছে, ততটা নিরস নয় ব্যাপারটা: অজানার উদ্দেশে এক আবেগময় আনন্দ যাত্রার বিবরণ দিয়েছেন ফিলো, যা তাঁকে মুক্তি ও সৃজনশীল ক্ষমতা এনে দিয়েছে। প্লেটোর মতো আত্মাকে তিনি ভৌত জগতে নির্বাসিত অবস্থায় থাকার মতো দেখেছেন। একে অবশ্যই আবেগ, অনুভূতি এমনকি ভাষা ত্যাগ করে, এর প্রকৃত আবাস ঈশ্বরের দিকে এগোতে হবে, কারণ এসব আমাদের অপূর্ণ পৃথিবীর সঙ্গে বেঁধে রাখে। শেষ পর্যন্ত এটা এমন এক আনন্দের পর্যায়ে উন্নীত হবে যা একে অহমের আতঙ্কময় সীমাবদ্ধতা থেকে এক বৃহত্তর পূর্ণ সত্তায় তুলে নেবে। আমরা দেখেছি, ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা প্রায়শঃই কল্পনা-নির্ভর অনুশীলন ছিল। পয়গম্বরগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতা নিয়ে ভেবেছেন, মনে করেছেন একে ঈশ্বর নামে আখ্যায়িত সত্তার প্রতি আরোপ করা যেতে পারে। ফিলো দেখাচ্ছেন: ধর্মীয় ভাবনা অনেকাংশে সৃজনশীলতার অন্যান্য রূপের মতোই। কখনও কখনও, বলেছেন তিনি, নিজের গ্রন্থসমূহ নিয়ে বিষণ্ণ মনে সংগ্রাম করে কোনও পথ খুঁজে পাননি, আবার কখনও মনে হয়েছে তার ওপর স্বর্গীয় প্রভাব ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে:

আমি…সহসা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলাম, ধারণাগুলো তুষারপাতের মতো নেমে আসছে, যার ফলে স্বর্গীয় প্রভাবে আমি করিব্যান্টিক (Corybrantic) উন্মাদনায় ভরে উঠলাম এবং স্থান-কাল-পাত্র, বর্তমান, নিজেকে কী বলা হয়েছে, কী লেখা হয়েছে, সবকিছু সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়ে গেলাম। কেননা আমি অভিব্যক্তি, ধারণা, জীবনের এক আনন্দ, বস্তুর স্পষ্ট স্বচ্ছতা অতিক্রম করে যাওয়া তীক্ষ্ণ দর্শন, যা সবচেয়ে স্পষ্ট উপস্থাপনের ফলে চোখের সামনে উপস্থিত হতে পারে, তা অর্জন করলাম।[৭৬]

অচিরেই গ্রিক জগতের সঙ্গে এমন একটা সমন্বয় অর্জন দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। ফিলোর মৃত্যুর বছর আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হত্যালীলা পরিচালিত হয় এবং ইহুদিদের বিদ্রোহের ব্যাপক আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। বিসিই প্রথম শতকে রোমানরা যখন উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল তখন তারা নিজেরাই গ্রিক সংস্কৃতির কাছে পরাস্ত হয়ে পুর্বসূরিদের উপাস্যদের গ্রিক দেবনিচয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে এবং অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে গ্রিক দর্শনকে আপন করে নেয়। তারা অবশ্য ইহুদিদের প্রতি গ্রিকদের বৈরিতার উত্তরাধিকার লাভ করেনি। প্রকৃতপক্ষে, গ্রিকদের চেয়ে ইহুদিদেরই বেশি পছন্দ করত তারা, গ্রিক নগরসমূহে ওদের প্রয়োজনীয় মিত্র হিসাবে বিবেচনা করত যেখানে রোমের প্রতি বৈরিতার ক্ষীণ অস্তিত্ব ছিল । ইহুদিদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল: ওদের ধর্ষ সুপ্রাচীন ঐতিহ্য হিসাবে পরিচিত ছিল, একে সম্মান জানানো হয়েছে। ইহুদি ও রোমানদের ভেতর সম্পর্ক এমনকি প্যালেস্তাইনেও চমৎকার ছিল, যেখানে বিদেশী শাসন সহজে মেনে নেওয়া হতো না। বিসিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ রোমান সাম্রাজ্যে ইহুদিবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। গোটা সাম্রাজ্যের এক দশমাংশ ছিল ইহুদি: ফিলোর আলেকজান্দ্রিয়ায় জনসংখ্যার চল্লিশ শতাংশ ছিল ইহুদি। রোমান সাম্রাজ্যের জনগণ এক নতুন ধর্মীয় সমাধানের অনুসন্ধানে ছিল: একেশ্বরবাদী ধ্যান-ধারণাসমূহ প্রচারণা পাচ্ছিল, স্থানীয় দেবতাদের আরও বৃহৎ, সর্বব্যাপী এক ঐশ্বরিক সত্তার প্রকাশ হিসাবে দেখা হচ্ছিল। রোমানরা ইহুদিবাদের উন্নত নৈতিক চরিত্রে আকৃষ্ট হয়েছে। বোধগম্য কারণে যারা হত্যা করা ও গোটা তোরাহ্ অনুসরণ করার বেলায় অনিচ্ছুক ছিল তারা প্রায়শঃই ‘গডফিয়ারার’ (Godfearer) নামে পরিচিত সিনাগগের সম্মান সূচক সদস্যপদ গ্রহণ করত, ওদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান ছিল। এমনকি এমনও মত প্রকাশ করা হয়েছে যে ফ্ল্যাভিয় সম্রাটদের একজন সম্ভবত ইহুদিবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন, যেমন কতস্তাইন পরে ক্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবেন। অবশ্য, প্যালেস্তাইনে রাজনৈতিক উগ্রপন্থীদের একটা দল তীব্রভাবে রোমান শাসনের বিরোধিতা করে। সিই ৬৬ সালে তারা রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং অবিশ্বাস্যভাবে রোমান সেনাবাহিনীকে চার বছর ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। বিদ্রোহ ডায়াসপোরার ইহুদিদের মাঝে ছড়িয়ে যাবার আশঙ্কা করে কর্তৃপক্ষ, ফলে নিষ্ঠুরভাবে তা দমন করে। সিই ৭০ সালে নতুন সম্রাট ভেসপাসিয়ান-এর সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত জেরুজালেম অধিকার করে, মন্দির পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে নগরীটিকে রোমান নগরে রূপান্তরিত করে এর নাম রাখে আইলিয়া কাপিলানা। আরও একবার দেশান্তরী হতে বাধ্য হয় ইহুদিরা।

নয়া ইহুদিবাদের মূল প্রেরণা মন্দির ধ্বংস বিরাট দুঃখের কারণ ছিল; কিন্তু পরবর্তী ঘটনার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে মনে হয় ডায়াসপোরার হেলেনাইজড ইহুদিদের তুলনায় প্রায়শঃ অনেক বেশি রক্ষণশীল প্যালেস্তাইনের ইহুদিরা, সম্ভবত আগে থেকেই এই বিপর্যয়ের জন্যে তৈরি ছিল। পবিত্র ভূমিতে অসংখ্য গোত্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল যারা বিভিন্নভাবে জেরুজালেম মন্দির থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল । এসিন ও কুমরান গোষ্ঠীর বিশ্বাস ছিল যে মন্দির অর্থলিলু ও দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছে; আলাদা কমিউনিটিতে বাস শুরু করেছিল তারা, মৃত সাগর তীরবর্তী মঠ ধরনের কমিউনিটির মতো একটা নতুন মন্দির গড়ে তুলছে বলে বিশ্বাস ছিল তাদের, যা হাতে নির্মিত নয়। ওদের মন্দির হবে আত্মার; প্রাচীন রীতি অনুযায়ী পশু উৎসর্গ করার বদলে নিজেদের পরিশুদ্ধ করত তারা এবং দীক্ষাগ্রহণমূলক অনুষ্ঠান ও দলীয় ভোজের মাধ্যমে পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করত। পাথরের মন্দিরে নয়, ঈশ্বরের আবাস হবে প্রেমময় ভ্রাতৃসংঘে।

প্যালেস্তাইনের সকল ইহুদির মাঝে ফারিজিরা ছিল সবচেয়ে প্রগতিশীল। এরা এসিনদের সমাধানকে বাড়াবাড়িরকম অভিজাত শ্রেণীর মনে করেছিল। নিউ টেস্টামেন্টে ফারিজিদের কপটাচারী ও চরম ভণ্ড হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর জন্যে দায়ী প্রথম শতকের ধর্মীয় যুক্তিতর্কের বিকৃতি। ফারিজিরা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ইহুদি ছিল। তারা বিশ্বাস করত গোটা ইসরায়েল পুরোহিতদের এক পবিত্র জাতি হিসাবে অ্যাখ্যায়িত। মন্দিরের মতো তুচ্ছ ঘরেও ঈশ্বর অবস্থান করতে পারেন। এরই প্রেক্ষিতে তারা রাজকীয় বা স্বীকৃত পুরোহিত গোত্রের মতো জীবন যাপন করত এবং নিজস্ব বাড়িতে পবিত্রতা অর্জনের সেইসব বিধিবিধান পালন করত সেগুলো কেবল মন্দিরের জন্যে প্রযোজ্য ছিল। আচরিক অবস্থায় খাদ্যগ্রহণের ওপর জোর দিত তারা, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে প্রত্যেক ইহুদির খাবার টেবিল আসলে মন্দিরে ঈশ্বরের বেদীর মতো। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে ঈশ্বরের উপস্থিতির একটা অনুভূতি গড়ে তুলেছিল ওরা। পুরোহিত শ্রেণী ও জাঁকাল আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ইহুদিরা। এখন ঈশ্বরের কাছে সরাসরি প্রার্থনা জানাতে পারে। প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় আচরণ দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত করতে পারে; তোরাহ অনুযায়ী দান হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিতভাহ (mitzvah): দুজন বা তিনজন ইহুদি সম্মিলিতভাবে যখন তোরাহ্ পাঠ করে, ঈশ্বর তখন তাদের মাঝে উপস্থিত থাকেন। শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোয় দুটো আলাদা মতবাদ জন্ম নিয়েছিল। একটির নেতৃত্বে ছিলেন শাম্মাই দ্য এল্ডার, এটা ছিল বেশি উগ্র। অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন মহান ব্যাবাই হিল্লেল দ্য এল্ডার। ফারিজিদের ইতিহাসে এই মতবাদই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। একটা গল্প চালু আছে যে, একদিন জনৈক পৌত্তলিক এসে হিল্লেলকে জানায় তিনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় প্রভু গোটা তোরাহ্ আবৃত্তি করতে পারলে সে ইহুদিবাদে দীক্ষা নেবে। হিল্লেল জবাব দিয়েছেন: “নিজে যেটা করতে পারবে না সেটা অন্যকে করতে বলো না। এটা গোটা তোরাহ; যাও এবং শিখে নাও।”[৭৭]

দুর্যোগের বছর ৭০ সাল নাগাদ প্যালেস্তাইনি ইহুদিবাদে ফারিজিরা সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গুরুত্বপূর্ণ গোত্রে পরিণত হয়; ইতিমধ্যেই ওরা দেখিয়ে দিয়েছিল যে, ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্যে মন্দিরের প্রয়োজন নেই ওদের, এই বিখ্যাত গল্পটি যেমন দেখায়:

একবার ব্যাবাই ইয়োহান্নান বেন যাক্কাই জেরুজালেম থেকে আসছিলেন, র‍্যাবাই জোশুয়া তাকে অনুসরণ করেন এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান।

“আমাদের দুর্দশা!’ বললেন ব্যাবাই জোশুয়া, এই যে, যেখানে ইসরায়েলিদের অসাম্যতার প্রায়শ্চিত হতো, সেটি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

‘বস আমার,’ বললেন ব্যাবাই ইয়োহান্নান, ‘দুঃখ করো না। এটার মতোই কার্যকর প্রায়শ্চিত্তের স্থান আমাদের কাছে। এবং সেটা কী? এটা হচ্ছে প্রেমময় দয়ার প্রকাশ, যেমন কথায় আছে: “কারণ আমি ক্ষমা চাই, উৎসর্গ নয়”।[৭৮]

কথিত আছে, জেরুজালেম অধিকারের পর র‍্যাবাই ইয়োহান্নানকে একটা কফিনে করে জ্বলন্ত নগরী থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ইহুদি বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি, রাষ্ট্র ছাড়াই ইহুদিরা ভালো থাকবে বলে ধারণা ছিল তাঁর। রোমানরা ইয়োহান্নানকে জেরুজালেমের পশ্চিমে জবনেহতে স্ব-শাসিত একটা ফারিজিয় সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছিল। প্যালেস্তাইন ও বাবিলোনিয়ায়ও একই ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয় যারা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখত। এই সমাজগুলো তান্নাইম নামে পরিচিত পণ্ডিতদের জন্ম দিয়েছিল, যাদের মধ্যে খোদ র‍্যাবাই ইয়োহান্নান স্বয়ং, র‍্যাবাই আকিভা দ্য মিস্টিক এবং র‍্যাবাই ইশমায়েল অন্তর্ভুক্ত ছিলেন: এঁরা মিশনাহ সংকলিত করেন: কথ্য আইনের লিখিত রূপ, মোজেসের আইনকে যা হালনাগাদ করেছে। এরপর অ্যামোরাইম নামে পরিচিত নতুন আরেক শ্রেণীর পণ্ডিত মিশনার ব্যাখ্যা দান শুরু করেন এবং সম্মিলিতভাবে তালমুদ নাম পরিচিত প্রবন্ধগুচ্ছ রচনা করেন। আসলে দুটো তালমুদ সংকলিত হয়েছিল; চতুর্থ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমাপ্ত জেরুজালেম তালমুদ এবং অধিকতর প্রভাবশালী হিসাবে বিবেচিত বাবিলোনিয় তালমুদ-এর সংকলন পঞ্চম শতকের শেষের দিকে শেষ হয়। প্রত্যেক প্রজন্মের পণ্ডিতগণ তালমুদ এবং এর ওপর প্রদত্ত পূর্বসুরিদের ব্যাখ্যার ওপর নিজস্ব মতামত দান শুরু করায় এই প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রয়ে যায়। বহিরাগতরা যেমনটি ভাবতে চান, এই প্রথাসিদ্ধ ধ্যান উপলব্ধি নিরস বিষয় ছিল না। এটা ছিল ঈশ্বরের বাণী নিয়েই অনন্ত ধ্যান, নতুন পবিত্র মন্দির; পূর্ববর্তী ব্যাখ্যার প্রত্যেকটা এক নতুন মন্দিরের দেয়াল ও দরবারের প্রতীক, আপন জাতির মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্থাপন করছে।

ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ বরাবরই এক দুৰ্জ্জেয় উপাস্য ছিলেন, যিনি মহাশূন্য থেকে অদৃশ্য থেকে মানবজাতিকে পরিচালনা করছেন। র‍্যাবাইগণ তাঁকে মানুষের মাঝে ও জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে গভীরভাবে উপস্থিত করে তোলেন। মন্দির হাতছাড়া ও ফের নির্বাসিত হওয়ার যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার পর নিজেদের মাঝে একজন ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল ইহুদিদের। র‍্যাবাইগণ ঈশ্বর সংক্রান্ত কোনও আনুষ্ঠানিক মতবাদ গড়ে তোলেননি। পরিবর্তে প্রায় দৃশ্যমান। সত্তার মতো তাঁকে অনুভব করেছেন। ওঁদের আধ্যাত্মিকতাকে ‘স্বাভাবিক অতিন্দ্রীয়বাদ’[৭৯] হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তালমুদের একেবারে শুরুর দিকের অনুচ্ছেদগুলোয় ঈশ্বরকে রহস্যময় বাস্তব সত্তা হিসাবে অনুভব করা হয়েছে। র‍্যাবাইগণ পবিত্র আত্মা (Holy Spirit)-র কথা বলেছেন যিনি সৃষ্টি এবং স্যাঙ্কচুয়্যারির নির্মাণ নিয়ে ভাবিত ছিলেন; প্রবল হাওয়া বা প্রচণ্ড অগ্নিশিখায় নিজ উপস্থিতি অনুভব করিয়েছিলেন। অন্যরা ঘণ্টাধ্বনি বা তীক্ষ্ণ করাঘাতের শব্দের মতো শুনতে পেয়েছেন একে। উদাহরণস্বরূপ, র‍্যাবাই ইয়োহান্নান একদিন ইযেকিয়েলের রথ দর্শনের প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলেন, এমন সময় আকাশ থেকে আগুন নেমে এল এবং কাছেই দেবদূতদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল: এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর জানিয়ে দিল যে, ঈশ্বরের কাছ থেকে এক বিশেষ মিশন পেয়েছেন তিনি। [৮০]

তাঁদের সত্তার অনুভূতি এত প্রবল ছিল যে প্রচলিত যে কোনও বাস্তব মতবাদ বেমানান মনে হতো। র‍্যাবাইগণ বারবার মত প্রকাশ করেছেন যে সিনাই পর্বতের পাদদেশে অপেক্ষমান প্রত্যেক ইসরায়েলি ভিন্ন ভিন্নভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেছিল। ব্যাপারটি ছিল এরকম, ঈশ্বর ‘প্রত্যেকের উপলব্ধির মাত্রা অনুযায়ী’[৮১] ওদের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। একজন র‍্যাবাই যেমন বলেছেন: ‘ঈশ্বর গুরুভার হয়ে মানুষের কাছে আসেন বরং তাকে গ্রহণ করার মানুষটির ক্ষমতার সঙ্গে মানানসইভাবেই উপস্থিত হন।[৮২] র‍্যাবাইদের এই গুরত্বপূর্ণ দর্শনের মানে হচ্ছে ঈশ্বরকে কোনও সূত্র দিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব নয় বা সবার কাছে তিনি একরকম নন। তিনি অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মানসিক উপলব্ধি। প্রত্যেক ব্যক্তি যার যার নিজস্ব বিশেষ মেজাজ-মর্জির চাহিদার সমাধান হিসাবে ভিন্ন ভিন্নভাবে ঈশ্বরের সত্তার অভিজ্ঞতা লাভ করবে। র‍্যাবাই জোর দিয়ে বলছেন, প্রত্যেক ব্যক্তি পয়গম্বর ভিন্ন ভিন্নভাবে ঈশ্বরকে অনুভব করেছেন, কারণ তাঁর ব্যক্তিত্ব ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে প্রভাবিত করেছে। আমরা দেখব, অন্য একেশ্বরবাদীরাও পুরোপুরি অনুরূপ ধারণা গড়ে তুলবে। এখন পর্যন্ত ইহুদিদের ঈশ্বর সম্পর্কিত ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাসমূহ ব্যক্তিগত ব্যাপার, প্রশাসন এগুলো চাপিয়ে দেয় না।

যে কোনও প্রথাবদ্ধ মতবাদ ঈশ্বরের আবশ্যকীয় রহস্যময়তাকে সীমিত করে দেবে। র‍্যাবাই যুক্তি দেখিয়েছেন, ঈশ্বর সম্পূর্ণ বোধের অতীত। এমনকি মোজেসও ঈশ্বরের রহস্য ভেদ করতে পারেননিঃ দীর্ঘ গবেষণার পর রাজা ডেভিড স্বীকার গেছেন যে, তাঁকে বোঝার চেষ্টা বৃথা, কারণ তিনি মানুষের বুদ্ধির নাগালের বাইরে।[৮৩] ইহুদিরা এমনকি ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করার অনুমতি পায়নি, এটা তাঁকে প্রকাশ করার যে কোনও প্রয়াস যে অপর্যাপ্ত হতে বাধ্য তারই স্মারক: YHWH এভাবে ঈশ্বরের নাম লেখা হয়েছিল, কিন্তু ধর্মগ্রন্থ পাঠের সময় নামটি উচ্চারণ করা হয় না। প্রকৃতিতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পারি আমরা; কিন্তু র‍্যাবাই হুনা যেমন বলেছেন, এটা কেবল গোটা সত্তা সম্পর্কে আমাদের খুবই সামান্য ধারণা দেয়: ‘বজ্র, ঘূর্ণিঝড়, তুফান, বিশ্বজগতের নিয়ম শৃঙ্খলার অর্থ এবং নিজ প্রকৃতি মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়; তাহলে কী করে সে সকল রাজার রাজার কার্যকলাপ বোঝার দাবি করে? ঈশ্বরের ধারণার মোদ্দা কথা হচ্ছে রহস্যময়তা এবং জীবনের বিস্ময় সম্পর্কে অনুভূতি উৎসাহিত করা নিখুঁত সমাধানের সন্ধান নয়। র‍্যাবাইগণ এমনকি প্রার্থনার সময় ঘনঘন ঈশ্বরের প্রশংসা করার ব্যাপারে ইহুদিদের সতর্ক করে দিয়েছেন, কারণ তাদের ভাষা ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য। [৮৫]

এই দুৰ্জেয় এবং দুর্বোধ্য সত্তা কীভাবে বিশ্ব জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিলেন? র‍্যাবাইগণ একটি প্যারাডক্সের মাধ্যমে এই সংক্রান্ত মত প্রকাশ করেছেন: ‘ঈশ্বর হচ্ছেন পৃথিবীর স্থান, কিন্তু পৃথিবী ঈশ্বরের স্থান নয়।’[৮৬] ঈশ্বর পৃথিবীকে ঘিরে আছেন, আবৃত্ত করে রেখেছেন, কিন্তু সাধারণ সৃষ্টির মতো তিনি এখানে বাস করেন নাই। আরেকটি প্রিয় ইমেজে তারা বলছেন। যে, আত্মা যেমন দেহকে ভরিয়ে রাখে ঈশ্বর তেমনি পৃথিবীকে ভরে রেখেছেন: আত্মা দেহে থেকেও দেহাতীত। আবার, তারা এও বলেছেন যে, ঈশ্বর ঘোড়ার পিঠে একজন সওয়ারির মতো: যখন তিনি ঘোড়ার দিকে থাকেন, আরোহীকে ঘোড়ার ওপর নির্ভর করতে হয়, কিন্তু তিনি পশুটির চেয়ে উন্নত এবং লাগাম থাকে তাঁর হাতে। এগুলো ইমেজ মাত্র এবং অনিবার্যভাবে অপূর্ণাঙ্গ; এগুলো ছিল এক বিশাল, সংজ্ঞাতীত কিছুর কল্পনাভিত্তিক বর্ণনা, যার মাঝে আমরা বেঁচে থাকি, চলাফেরা করি এবং আমাদের সত্তাকে পাই। তারা পৃথিবীতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলবার সময় বাইবেল-লেখকদের মতো বৃহত্তর প্রবেশাতীত স্বর্গীয় রহস্যের সঙ্গে তিনি তাঁর যেসব চিহ্ন দেখার অনুমতি দিয়ে থাকেন তার মাঝে সযত্নে পার্থক্য টানার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁরা YHWH এবং পবিত্র আত্মার ‘প্রতাপ’ (কাভোদ) ইমেজ পছন্দ করেছেন, এগুলো আমাদের অনুভূতির ঈশ্বরের সঙ্গে যে স্বর্গীয় সত্তার প্রকৃত রূপ মেলে না তারই স্মারক।

তাদের অন্যতম প্রিয় ঈশ্বর সমার্থক শব্দ ছিল হিব্রু শাকান হতে গৃহীত শেকিনাহ, যার অর্থ কারও তাঁবুতে বাস করা বা আবৃত্ত করা; যেহেতু এখন আর মন্দিরের অস্তিত্ব নেই, যেই ঈশ্বর ইসরায়েলিদের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর সময় সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর ইমেজ ঈশ্বরের নৈকট্যের কথা তুলে ধরেছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, পৃথিবীতে তাঁর জাতির সঙ্গে বাসকারী শেকিনাহ এখনও টেম্পল মাউন্টে বাস করছেন, যদিও মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্য র‍্যাবাইদের যুক্তি ছিল, মন্দির ধ্বংস হওয়ায় শেকিনাহ জেরুজালেম থেকে মুক্ত হয়ে বাকি বিশ্বে বাস করার সুযোগ পেয়েছেন। স্বর্গীয় প্রতাপ’ বা পবিত্র আত্মার মতো শেকিনাহকে আলাদা স্বর্গীয় সত্তা হিসাবে চিন্তা করা হয়নি বরং পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপস্থিতি মনে করা হয়েছে। র‍্যাবাইগণ স্বজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন এবং লক্ষ করেছেন যে এটা সবসময় ওদের সঙ্গে ছিল:

এসো এবং দেখ ইসরায়েলিরা ঈশ্বরের কত প্রিয়, কারণ ওরা যেখানেই গেছে শেকিনাহ্ ওদের অনুসরণ করেছে, যেমন বলা হয়েছে, ‘ওরা যখন মিশরে ছিল আমি কি তখন ওদের পূর্বপুরুষদের ঘরে নিজেকে সহজে প্রকাশ করেছিলাম? খাবিলনে শেকিনাহ্ ওদের সঙ্গে ছিল, যেমন বলা হয়েছে, তোমাদের স্বার্থে আমাকে বাবিলনে পাঠানো হয়েছিল।’ এবং ভবিষ্যতে যখন ইসরায়েল নিষ্কৃতি লাভ করবে, শেকিনাহ ওদের সঙ্গে থাকবে, যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমাদের প্রভু তোমাদের ঈশ্বর তোমাদের বন্দিত্ব ঘোচাবেন।’ অর্থাৎ ঈশ্বর বন্দিত্বের সাথে ফিরে আসবেন। [৮৮]

ইসরায়েল এবং ঈশ্বরের সম্পর্ক এতো নিবিড় ছিল যে অতীতে যখন তিনি ইসরায়েলকে উদ্ধার করেছেন, ইসরায়েলিরা ঈশ্বরকে বলেছে: ‘আপনি আপনাকেই মুক্তি দিয়েছেন।’[৮৯] নিজস্ব ইহুদি ঢঙে র‍্যাবাইগণ এই ধারণা গড়ে তুলছিলেন যে, ঈশ্বরের অনুভূতি সত্তার (Self) সঙ্গে জড়িত, হিন্দুরা যাকে আত্মা বলেছে। নির্বাসিতরা যেখানেই যাক না সেখানেই ঈশ্বরের অস্তিত্বের অনুভূতি বা ধারণা গড়ে তুলতে শোকিনাহর ইমেজ সাহায্য করেছিল। র‍্যাবাইগণ ডায়াসপোরার এক সিনাগগ থেকে অন্যটিতে শেকিনাহর ঘুরে বেড়ানোর কথা বলেছেন, অন্যরা বলেছেন এটা সিনাগগের দরজায় দাঁড়িয়ে ইহুদিদের হাউস অভ স্টাডিজের দিকে প্রতি পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়াকে আশীর্বাদ জানায়; ইহুদিরা সিনাগগে সম্মিলিতভাবে শেমা আবৃত্তি করার সময়ও শেকিনাহ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।[৯০] পূর্বকালের ক্রিশ্চানদের মতো ইসরায়েলিরা তাদের র‍্যাবাইদের দ্বারা নিজেদেরকে ‘এক দেহ এবং এক আত্মা’[৯১] বিশিষ্ট একটি সমাজ হিসেবে দেখতে উৎসাহিত হয়েছে। এই সমাজই নতুন মন্দির, অন্তস্থ ঈশ্বরের আবাস: এজন্যেই যখন তারা সিনাগগে ‘ভক্তি সহকারে নিখুঁত সমস্বরে শেমা আবৃত্তি করে এক সুরে এক মনে আর এক কণ্ঠে’ তখন ঈশ্বর তাদের মাঝে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু সমাজের যে কোনওরকম অসামঞ্জস্য তিনি ঘৃণা করেন এবং স্বর্গে ফিরে যান, দেবদূতরা যেখানে ‘এক স্বরে এবং এক সূরে’ স্বর্গীয় প্রশংসার গান[৯২] গাইতে থাকে। ঈশ্বর এবং ইসরায়েলের উচ্চ সম্মিলন তখনই সম্ভব হবে যখন ইসরায়েলিদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের নিম্ন সম্মিলন সম্পন্ন হবে: র‍্যাবাইগণ ক্রমাগত তাদের বলে গেছেন, ইহুদিদের কোনও দল যখন একসঙ্গে তোরাহ্ পাঠ করে, শেকিনাহ্ তাদের মাঝে বসে থাকে। [৯৩]

নির্বাসিত অবস্থায় ইহুদিরা চারপাশের বিশ্বের কঠোরতা অনুভব করেছে; এই ধরনের উপস্থিতির বোধ তাদের সদাশয় ঈশ্বর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার অনুভূতি লাভে সাহায্য করেছে। তারা যখন তাদের ফিলেক্টরিগুলো (Plyaetoris: tfillin) হাত ও মাথায় জড়াত, আচরিক ঝালড় পরত এবং শেমার বাণী লেখা nezuzah দরজায় ঝোলাত ডিউটেরোনমি অনুযায়ী ঐসব অস্পষ্ট ও অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যার প্রয়াস না পেতে বলা হয়েছে তাদের, তা এর মূল্য সীমীত করে দেবে; বরং তাদের উচিত হবে এসব mitzvot-এর অনুসরণ যেন ঈশ্বরের পরিব্যাপী ভালোবাসা সম্পর্কে সজাগ করে তুলতে পারে সে অবকাশ দেওয়া; ‘ইসরায়েল প্রিয়ভাজন! mitzvot দিয়ে বাইবেল তাঁকে ঘিরে রেখেছে: মাথা আর বাহুতে tfillin, দরজায় একটা mizuzah, পোশাকে titzit,[৯৪] এগুলো যেন কোনও রাজার তার রানিকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্যে উপহার দেওয়া রত্নের মতো। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। তালমুদ দেখায় যে, কেউ কেউ চিন্তা করেছিল এমন অন্ধকার পৃথিবীতে ঈশ্বর খুব একটা আসেন-যান কিনা।[৯৫] যারা জেরুজালেম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল কেবল তাদের মাঝেই নয়, বরং বরাবর ডায়াসপোরায় বাসকারী ইহুদিদের মাঝেও র‍্যাবাইদের আধ্যাত্মিকতা ইহুদিদের একটা মান স্থাপন করেছিল। সেটা একটা নিখুঁত তত্ত্বীয় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে নয়: আইন-এর বহু অনুশীলনের যৌক্তিক কোনও অর্থ নেই, র‍্যাবাইদের ধর্ম গৃহীত হয়েছিল এর কার্যকারিতার জন্যে। র‍্যাবাইদের দর্শন তাদের স্বজাতির হতাশায় কবলিত হওয়া ঠেকিয়েছিল।

অবশ্য এ ধরনের আধ্যাত্মিকতা ছিল কেবল পুরুষের জন্যে-কেননা প্রয়োজন না থাকায়, নারীদের র‍্যাবাই হওয়া, তোরাহ্ পাঠ বা সিনাগগে যাবার অনুমতি ছিল না। সেসময়ের অধিকাংশ মতাদর্শের মতো ঈশ্বরের ধর্ম পুরুষতান্ত্রিক রূপ নিচ্ছিল। নারীদের দায়িত্ব ছিল বাড়িতে আচরিক পবিত্রতা বজায় রাখা। ইহুদিরা বহু আগেই বিভিন্ন উপকরণ আলাদা করার মাধ্যমে সৃষ্টিকে পবিত্র করেছিল। এই চেতনার আলোকে নারীদের পুরুষ সমাজ থেকে একটা ভিন্ন স্তরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক যেমন রান্নাঘরে দুধ আর মাংস আলাদা তাকে রাখতে হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে এর অর্থ ছিল ওদের নিম্নস্তরে ঠেলে দেওয়া। যদিও র‍্যাবাইরা শিক্ষা দিয়েছিলেন যে নারীরা ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট, কিন্তু পুরুষদের সকালের প্রার্থনায় তাদের অ-ইহুদি (জেন্টাইল) দাস বা নারী হিসাবে সৃষ্টি না করার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তবু বিয়েকে পবিত্র দায়িত্ব এবং পারিবারিক জীবনকে পবিত্র বিবেচনা করা হতো। র‍্যাবাইগণ বিধিবিধানে এর পবিত্রতার প্রতি জোর দিয়েছেন যাকে প্রায়শঃই ভুল বোঝা হয়েছে। ঋতুস্রাবের সময় যৌন মিলনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ এই নয় নারীকে নোংরা বা অস্পৃশ্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। পুরুষরা যেন স্ত্রী-সঙ্গকে নিশ্চিত ভেবে না বসে সেজন্যেই এই অবকাশের সৃষ্টি করা হয়েছিল: ‘কারণ একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে অনেক বেশি জেনে ফেলতে পারে এবং তাতে বিতৃষ্ণা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে, তোরাহ্ বলছে (ঋতুস্রাবের পর। সাতদিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীকে নিদ্দাহ (যৌন সঙ্গমের অতীত] হতে হবে যাতে করে পরে সে পুরুষের কাছে বিয়ের দিনের মতো প্রিয় হয়ে। উঠতে পারে।’[৯৬] উৎসবের দিনে সিনাগগে যাবার আগে একজন পুরুষের জন্যে আচরিক স্নান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সে সাধারণ অর্থে অপরিচ্ছন্ন বা নোংরা বলে নয়, বরং সে যেন পবিত্র প্রার্থনার জন্যে নিজেকে আরও বেশি পবিত্র করে তুলতে পারে সে জন্যে। এবং একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ঋতুস্রাবের পর আসন্ন পবিত্রতা অর্থাৎ স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়ার লক্ষ্যে নারীকে আচরিক-স্নানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এভাবে যৌনতা যে পবিত্র হতে পারে, এ ধারণা ক্রিশ্চানদের কাছে বিসদৃশ্য শোনাবে, খৃস্টধর্মে যৌনতা ও ঈশ্বরকে অনেক সময় পরস্পর বিরোধী হিসাবে দেখা হবে। এ কথা সত্যি যে, পরবর্তীকালের ইহুদিরা র‍্যাবাইদের এসব বিধিনিষেধের নেতিবাচক ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু র‍্যাবাইগণ নিরানন্দ, সন্ন্যাসমূলক জীবনবিরোধী আধ্যাত্মিকতার প্রচার করেননি।

বরং, উল্টো তারা জোর দিয়েছেন যে ভালো ও আনন্দে থাকা ইহুদিদের কর্তব্য। বারবার তারা বাইবেলিয় চরিত্র জ্যাকব, ডেভিড বা এশতারের অসুস্থ বা অসুখী অবস্থায় পবিত্র আত্মার তাদের ত্যাগ করা বা পরিত্যাগ করার কথা উল্লেখ করেছেন। অনেক সময় আত্মা তাঁদের ছেড়ে যাচ্ছে মনে হলে তাঁরা শ্লোক আবৃতি করে দেখিয়েছেন: ‘হে আমার ঈশ্বর, হে আমার ঈশ্বর, আমাকে কেন তুমি ত্যাগ করলে?’ ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় জেসাস যখন এই প্রশ্নটি উচ্চারণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন ওঠে এখানে। র‍্যাবাইগণ শিক্ষা দিয়েছেন যে, নারী-পুরুষ কষ্ট পাক এটা চাননি ঈশ্বর। দেহ যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে গঠিত, সুতরাং একে সম্মান দিতে হবে, যত্ন নিতে হবে: এমনকি মদ পান বা যৌনতার মতো আনন্দ ত্যাগ করাটাও পাপ হতে পারে, কারণ মানুষের উপভোগের জন্যেই ঈশ্বর এগুলো দান করেছেন। দুঃখ কষ্টে আর সন্ন্যাসে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না। তারা মানুষকে পবিত্র আত্মা ‘অধিকার করার প্রকৃত পথে চলার তাগিদ দেওয়ার সময় আসলে এক অর্থে নিজেদের জন্যে ঈশ্বরের নিজস্ব ইমেজ গড়ে নেওয়ার কথাই বুঝিয়েছেন। তারা শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈশ্বরের কাজের শুরু ও মানুষের কাজের শেষ কোথায় বলা মোটেই সহজ নয়। পয়গম্বরগণ সব সময় তাঁদের। নিজস্ব অন্তদৃষ্টি ঈশ্বরের ওপর আরোপ করে পৃথিবীতে তাঁকে দৃশ্যমান করে ভুলেছেন। এখন র‍্যাবাইরা এমন একটা কাজে নিজেদের নিয়োজিত করলেন যেটা একাধারে মানবীয় ও স্বর্গীয়। যখন তারা কোনও নতুন বিধান জারি করেছেন, সেটাকে একই সঙ্গে ঈশ্বর প্রদত্ত ও তাদের নিজস্ব আরোপিত বলেও দেখা হয়েছে। তোরাহ্র সংখ্যা বাড়িয়ে তাঁরা পৃথিবীতে তাঁর উপস্থিতির বিস্তার ঘটাচ্ছিলেন এবং একে আরও কার্যকর করে তুলছিলেন। নিজেরাই তোরাহর অবতার হিসাবে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়েছেন তারা; ‘ল’-এর ক্ষেত্রে দক্ষতার কারণে অন্য যে কারও চেয়ে তারা অনেক বেশি মাত্রায় ‘ঈশ্বরের মতো’[৯৮] ছিলেন ।

সর্বব্যাপী ও অন্তস্থ ঈশ্বরের এই বোধ ইহুদিদের মানুষকে পবিত্র হিসাবে দেখতে সাহায্য করেছে। র‍্যাবাই আকিভার শিক্ষা (reduce), ‘প্রতিবেশীকে নিজের মতো করেই ভালোবাসতে হবে’ই ছিল ‘তোরাহর মহান নীতি।’[৯৯] ঈশ্বর, যিনি তাঁর অনুরূপে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, মানুষের বিরুদ্ধে আক্রমণ সেই ঈশ্বরেরই প্রত্যাখ্যান স্বরূপ। এটা নাস্তিক্যের সমান, ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করার ব্লাসফেমাস প্রয়াস। এ কারণেই হত্যা সর্বোচ্চ পাপ, ঐশীগ্রন্থ আমাদের শেখায়, যে মানুষের রক্ত ঝরায় সে যেন স্বর্গীয় প্রতিরূপকেই বিনষ্ট করে।’[১০০] আরেকজন মানুষের সেবা করার কাজটি হচ্ছে imitatio de: এতে ঈশ্বরের বদান্যতা আর দয়ার পুনসৃষ্টি ঘটে। যেহেতু সকলকেই ঈশ্বরের প্রতিরূপে গড়ে তোলা হয়েছে, সেহেতু সবাই সমান: এমনকি সর্বোচ্চ পুরোহিত যদি কাউকে আহত করেন তো তাকেও প্রহার করা যাবে, কেননা আঘাত করে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার অনুরূপ অপরাধ করেছেন।[১০১] ঈশ্বর আদম (adam) নামে একজন মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন আমাদের এই শিক্ষা দেওয়ার জন্যে যে, যদি কেউ একজন মানুষকেও ধ্বংস করে তাকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে যেন সে গোটা বিশ্ব ধ্বংস করেছে।[১০২] এটা স্রেফ চড়া আবেগ ছিল না, বরং আইনের মূল নীতি: এর অর্থ ছিল, উদাহরণ স্বরূপ, যুদ্ধ বিদ্রোহের সময় কোনও একদলের স্বার্থে একজন ব্যক্তিকেও হত্যা করা যাবে না। কাউকে অপমানিত করা, হোক না সে গোয় (Goy) বা দাস, অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ, কেননা এটা হত্যার সমান, ঈশ্বরের ভাবমূর্তিকে অস্বীকার করার অপবিত্র অপরাধ ।[১০৩] মুক্তি বা স্বাধীনতার অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: র‍্যাবাইদের গোটা সাহিত্য তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে বন্দি করার কোনও রকম উল্লেখ খুঁজে পাওয়া কঠিন, কারণ একমাত্র ঈশ্বরই কারও স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকারী। কারও সম্পর্কে বাজে গুজব রটানো ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার সামিল।[১০৪] ঈশ্বরকে বড় ভাইয়ের মতো কিছু যেন না ভাবে ইহুদিরা, মহাশূন্য হতে যিনি তাদের প্রতিটি নড়াচড়ার উপর নজর রাখছেন; বরং তাদের প্রত্যেক মানুষের মাঝে ঈশ্বর উপস্থিতির একটা বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে যাতে অন্যদের সঙ্গে আমাদের আচার আচরণ পবিত্র সাক্ষাতে পরিণত হয়।

প্রকৃতির দাবি অনুযায়ী বাস করতে পশু জগতের কোনও সমস্যা হয় না, কিন্তু নারী-পুরুষের জন্যে যেন পুরোপুরি মানুষ হয়ে ওঠা কঠিন। ইসরায়েলের ঈশ্বর মাঝে মাঝে যেন একেবারে অপবিত্র ও অমানুষিক নিষ্ঠুরতাকে উৎসাহিত করেছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু শত শত বছরের পরিক্রমায় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এমন এক ধারণার রূপ নিয়েছিলেন যা মানুষকে স্বজাতির প্রতি দরদ ও শ্রদ্ধা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, যা ছিল অ্যাক্সিয়াল যুগের সকল ধর্মের বৈশিষ্ট্য বা নির্দেশক। র‍্যাবাইদের মতবাদ ঈশ্বরের ধর্মসমূহের দ্বিতীয়টির অনেক কাছাকাছি, ঠিক একই ঐতিহ্য বা ধারায় প্রোথিত ছিল যার শেকড় ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *