এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ – অমর মিত্র
এক
সুদামার আবার সাধ হয়েছিল মা হওয়ার। হ্যাঁ, চোদ্দ বছর বাদেও। শুনে কৃষ্ণেন্দুর কী হাসি। হাসতে হাসতেই তুচ্ছ করে দিল সুদামার ইচ্ছেকে, মাথা খারাপ।
কেন, আমি তো তোমাকে বলেইছিলাম।
শুনে কৃষ্ণেন্দু আবার হাসে, বলেছিলে। কবে বলেছিলে? বলার কী আছে? এই বয়সে আবার ওই হ্যাপা কাঁধে নেয় কেউ?
তুমি সব জানতে, আমি বলিনি? সুদামার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে প্রায়।
বলেছিলে? সত্যি বলেছিলে? আমি কি তখন অফিসে, না ঘুমিয়ে? কৃষ্ণেন্দুর চোখের তারায় কী রকম তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা। সুদামার অচেনা মনে হয় তার প্রেমিক, স্বামীকে। কৃষ্ণেন্দু তো সব জানে। সে সম্মতি দিয়েছিল, এত বছর বাদে! তোমার যা ইচ্ছে —!
কৃষ্ণেন্দু বলল, সম্ভব নয়।
সম্ভব নয় তো হ্যাঁ বলেছিলে কেন? সুদামা কাঁপছে।
কৃষ্ণেন্দু বলল, কী আবোল-তাবোল বকছ! এত বছর বাদে আবার চেকআপ, আবার নার্সিংহোম, টেনসড হয়ে থাকা, ডাক্তার, বাচ্চা — ইস!
সুদামা অবাক হয়। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু নিজের কথা নিজে কেমন খেয়ে ফেলছে। অস্বীকার করছে সব। অথচ তার কথাতেই না সুদামা সাহস পেয়ে যাবতীয় নিরোধক ত্যাগ করে বসে আছে এই তিনমাস। সে কৃষ্ণেন্দুকে বুঝতে চেষ্টা করে ক্রমাগত।
কৃষ্ণেন্দু ঈষৎ বিরক্ত, বলল, তোমার কি সব কাণ্ডজ্ঞান উধাও হয়ে যাচ্ছে, য়্যু আর থার্টি সেভেন প্লাস, আটত্রিশে পা দিয়েছ। এই বয়সে কেউ মা হয়? তুমি কোলে বাচ্চা নিয়ে বেরোবে, পারবে!
সুদামা বলে, চিন্তা আমি করেই নিয়েছি আগে, তুমি সব জেনেও না জানার ভান করছ। রাখব বলেই কনসিভ করেছি আমি।
কৃষ্ণেন্দু উষ্মা প্রকাশ করল এবার, আমি জানি! তুমি সত্যি বলছ না সুদামা।
গলা উঠেছিল দুজনেরই। বাইরে মধ্য ফেব্রুয়ারির রাত। কৃষ্ণেন্দু আজ অনেক তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিল। নতুন প্রজেক্ট আসছে পরপর। আসছে নানা দেশি বিদেশি কোম্পানি, বণিকেরা। কেউ ফুড প্রডাক্ট, কেউ টিভি, মোটরগাড়ি, কেউ ঠাণ্ডা পানীয়, কেউ কম্পিউটার, কেউ হাসপাতাল নার্সিংহোম বানানোর প্রস্তাব নিয়ে আসছে। রূপায়িত করার অনেকটা দায়িত্ব কৃষ্ণেন্দুর। প্রাথমিক ব্যবস্থা করবে তো সে-ই। এই সব প্রজেক্টের সাফল্যের সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুর জীবনের সাফল্যও যে জড়িয়ে গেছে। রাজারামপুর বলে একটা গ্রামে তিনশো বিঘের উপর বেসরকারি এক পেট্রোলিয়াম গ্যাস কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ব্যাপারে কৃষ্ণেন্দু এখন খুব ব্যস্ত। ঘুমের ভিতরেও অফিস নিয়ে থাকছে যেন সে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, এত ঝামেলা নিয়ে আছি।
ঝামেলা তো আমার জন্য নয়।
কৃষ্ণেন্দুর বিরক্ত হয়। কিছু বলতে যাচ্ছিল চড়া গলায়, কিন্তু তখনই ফোন বাজল। সে এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তোলে।
কৃষ্ণেন্দু ফোন ধরেছে। সুদামা কঠিন হয়ে বসে আছে খাটের এক কোণে। চাপা গলায় বলল, আমার কি স্বাধীনতা নেই নাকি, ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছুই নেই…।
কৃষ্ণেন্দু রিসিভার হাতের পাতায় চেপে ধরে বিরক্ত মুখে তাকায় সুদামার দিকে। ইঙ্গিতে তাকে চুপ করতে বলে। সুদামার কথা ওপারের মানুষের কানে চলে যেতে পারে। সুদামা উঠল। ধীর পায়ে ব্যালকনির অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনের রাস্তাটা আবছা অন্ধকার। আলো আছে বটে, কিন্তু সেই আলো পথ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
কে কথা বলছে? না সুহাস বোস, কৃষ্ণেন্দুর জুনিয়র। সে আজ রাজারামপুর গিয়েছিল প্রজেক্ট সাইট দেখতে, রিপোর্ট দিচ্ছে। সুদামা কান পাতে। কিন্তু তার কৌতূহল সামান্যতেই উবে যায়। ল্যান্ড-কমপেনসেশন এইসব নিয়ে কথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সুহাস নতুন কিছু বলছে। নতুন কোনো প্রজেক্টের কথা। কৃষ্ণেন্দু খুব উৎসাহী।
সুদামা অন্ধকার আকাশে তাকায়। এখানে আকাশ অনেক পরিষ্কার। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তো আকাশ তারায় তারায় ছয়লাপ। ছায়াপথ দেখা যায়। খুব নজর করলে অচেনা কোনো গ্রহও হয়তো। হ্যাঁ, কথাটা কৃষ্ণেন্দুর। বছর সাত আগে যখন এই ফ্ল্যাট কিনে তারা বেহালার সরকারি আবাসন থেকে উঠে আসে, কৃষ্ণেন্দু বলেছিল তার সাত বছরের ছেলে নীলাঞ্জনকে। পাশে দাঁড়িয়েছিল সুদামা। রাত হয়েছিল অনেক। গৃহপ্রবেশের দিন ছোটো মতো উৎসব হয়েছিল এই ফ্ল্যাটে। এসেছিল অর্ধেন্দু, যূথিকা, যূথিকার মেয়ে টুম্পা। সব এখন কেমন অলীক মনে হয়।
অলীক-ই তো! সুদামা বলেছিল, নতুন গ্রহ মানে, নয় গ্রহের বাইরে?
তাই-ই তো! কৃষ্ণেন্দুর তার ছেলেকে দু-হাতে বেড় দিয়ে বলেছিল, নটি গ্রহ তো সূর্যের, অন্য নক্ষত্রের গ্রহের কথা বলছি, এই বারান্দায় টেলিস্কোপ বসিয়ে দেব নীল, তোর জন্যে, তুই গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের মতো টেলিস্কোপে চোখ দিয়ে বসে থাকবি। কী চমৎকার হয়েছে ফ্ল্যাটটা। আমাদের বাড়ি।
তখন অফিস থেকে এসে নীলকে নিয়ে বারান্দায় বসত কৃষ্ণেন্দু। নতুন ফ্ল্যাট কেনার ধাক্কা সামলাতে হচ্ছিল সেই সময় স্বামী-স্ত্রীকে। সুদামার সব গয়না তো বেচেই দিতে হয়েছিল, তা ছাড়া ছিল ঋণ। কিন্তু কোনো অসুবিধেই যেন হয়নি। কোনোদিন তারা কেউ মুখ অন্ধকার করেনি। বেহালার সরকারি আবাসন খারাপ ছিল না। সেখানে তারা গিয়েছিল বেলগাছিয়ার আলো-অন্ধকারে ছাওয়া ঘর ছেড়ে। না গিয়ে উপায় ছিল না। কৃষ্ণেন্দুর কাছে অফিসের কেউ এলে বসতে দেওয়ার জায়গা পর্যন্ত ছিল না। একটাই তো ঘর। আবার তিন ঘরের ফ্ল্যাটের ভিতরে ওই ঘরটিই ছিল সবচেয়ে কম আলোর কম বাতাসের, একটু স্যাঁতসেঁতে মতো। বাড়ির ভালো ঘর দুটি ছিল কৃষ্ণেন্দুর বাবা-মা আর বড়োভাই অর্ধেন্দুর দখলে। তখন তো উপায়ও ছিল না। অন্ধকার ঘরটি কাউকে না কাউকে নিতে হত, অর্ধেন্দু-যূথিকা কিংবা কৃষ্ণেন্দু-সুদামা। বাবা-মায়ের ঘরটি ছিল সবচেয়ে ভালো। দুই ভাইয়ের ব্যবস্থা ছিল না এটি। আপনা-আপনি হয়ে গিয়েছিল। ওই ফ্ল্যাটে তো অর্ধেন্দুর বাবা-মা চারটি সন্তান নিয়ে এসে উঠেছিলেন অনেক বছর আগে। মেয়েরা বিয়ের পর চলে যাওয়ায় ঘর ভাগ স্বাভাবিকভাবেই হয়ে গিয়েছিল।
এই তো কদিন আগে সুদামা গিয়েছিল বেলগাছিয়ায়। ওই ঘরটিতে ঢুকেছিল। বিশ্বাসই হয় না ওখানে সে আর কৃষ্ণেন্দু বিয়ের পর প্রথম দেড় বছর ছিল। দিনের বেলাতেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হত। জানালা যে খুলে রাখবে, লাভ কী? জানালা দুটি যেদিকে তার দশ ফুট ওপারে আর একটি বাড়ির পুরোনো দেওয়া, ময়লা কার্নিশ। ঠিক তাদের ঘরের জানলার মুখোমুখি ছিল পাশের তিনতলা বাড়ির দোতলার রান্নাঘর। একান্নবর্তী সেই বাড়ির রান্নাঘরে কড়া চাপত ভোরবেলা, সারাদিনই ছ্যাঁক-ছ্যাঁক, ধোঁয়াকালি, শেষ হতে হতে রাত এগারোটা। দুপুরে ঘন্টা দুয়েকের মতো থামত কখন তা টেরও পাওয়া যেত না। সুদামা জানালা খুললেই নাকে পেত তেল-মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ। ঘরে বসে শীতকালটাই টের পাওয়া যেত, অন্য কোনো ঋতু ধরাই যেত না। না বাদল, না শরৎ, না বসন্ত। হ্যাঁ গরমের দিনে যখন আলো-পাখা থাকত না, টের পাওয়া যেত দমবন্ধ ভাবটি। বৈশাখে বিয়ে হয়েছিল সুদামার। তখন ছিল অনবরত লোডশেডিং — সে যেন বন্দিশিবিরে এসে পড়েছিল। ডালিমতলার বাপের বাড়িও খুব আলো-হাওয়ার ছিল না, কিন্তু সে যে ঘরটিতে থাকত আর এক বোনের সঙ্গে, সেই ঘরের জানালা ছিল দখিনমুখী। হাওয়া আসত। শ্বশুরবাড়ির ঘরটি ছিল যেন জেলখানা, বড়ো প্রাচীরে ঘেরা অন্ধকার কুঠুরি। সুদামা ধূপ জ্বেলে রাখত ঘরে প্রায়ই সময়। বোটকা গন্ধটা যাতে যায়। এখন আর বিশ্বাসই হয় না ওই ঘরে তারা বিবাহের পর রাতের পর রাত জেগেছে, ঘুমিয়েছে। ওই ঘরে তাদের ভিতরে ভালোবাসা নিবিড় হয়েছিল। ওই ঘরে তারা পরস্পরকে চিনেছিল পরম নিশ্চিন্তে। এখন এই আটশো স্ক্যোয়ার ফুটের অঢেল আলো বাতাসে বসে ওই ঘরের কথা মনে হয় অসত্য, অন্য জন্মের কথা।
ডাকলে কৃষ্ণেন্দু, সুদামা তোমাকে ডাকছে সুহাস।
সুদামা ব্যালকনি থেকে সরে ঘরের দরজায়। ভ্রু-কুঞ্চিত মুখে তাকিয়ে আছে টেলিফোন হাতে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। কৃষ্ণেন্দু আবার ডাকল, এসো, ও কতক্ষণ ধরে থাকবে।
সুদামা এগিয়ে গিয়ে টেলিফোন ধরল, আমি তো আপনার বস নই বোসবাবু, আমাকেও কি ওইসব প্রজেক্ট বোঝাবেন?
ওপারে হো হো হাসি, না ম্যাডাম, আসলে কী জানেন ম্যাডামকে খুশি না করলে বস খুশি হয় না, তাই।
আমি খুশি হলাম না।
না হন, বসকে বলবেন না, তাহলেই হল। আপনি বলছিলেন না আমাদের প্রজেক্ট সাইটে যাবেন একবার, রাজারামপুর দেখবেন।
সুদামা বলল, এখন আর বলছি না।
সুহাস বলল, স্যার বলতে বললেন, তাই।
সুদামা কঠিন হল, এখন আর যেতে ইচ্ছে নেই। আপনারা ওসব নিয়ে থাকুন, সায়েব, কোম্পানি, জমি, ফ্যাক্টরি, অফিসের ফাইল।
কী করব বলুন, চাকরি তো, কবে যাবেন বলুন।
সুদামা বলল, ঠিক আছে ওকে বলে দেব, রাখছি।
টেলিফোন রেখে সুদামা ঘুরল কৃষ্ণেন্দুর দিকে। কৃষ্ণেন্দু সিগারেট ধরিয়ে হাতে একটা হেডলি চেজ — কভারে রিভলবার হাতে প্রায় নিরাবরণ যুবতি, বিদেশিনী। এখন কৃষ্ণেন্দুর অবসর কাটানো মানে হেডলি চেজ, নিক কার্টার, আরভিং ওয়ালেস — সফট পর্ণো কাম থ্রিলার। এইসব পুস্তক ওর যাবতীয় অবসাদ কাটিয়ে দেয়। সারাদিন অফিসে থেকে মাথা ভার হয়। ভারমুক্ত করে হেডলি চেজ কিংবা টেলিভিশনে। টেলিভিশনের অভ্যাস ক্রমশ বাড়ছে কৃষ্ণেন্দুর।
সুদামা বলল, কেন তুমি বলতে পারলে না?
চমকে ওঠে কৃষ্ণেন্দু, কী!
ওই যে রাজারামপুর যাওয়ার কথা, সুহাস বোসকে দিয়ে বলাতে হবে!
কৃষ্ণেন্দু হাসে, আমি বললেই বলতে পারতাম, কিন্তু সুহাস তো তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, রাজি তুমি হবেই।
সুদামা অবাক, সুহাস বললে রাজি হব কেন?
ওটা কথার কথা, তবে এই মুহূর্তে আমার কথায় যে রাজি হতে না তুমি, তা তো আমি জানতাম, তাই সুহাসকে বলতে বললাম।
সুদামা বলল, এখন তো আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
কেন? অবাক হয় কৃষ্ণেন্দু।
কেন তা বুঝতে পারছ না, এখন সাবধানে থাকতে হবে প্রথম কটা মাস।
হা হা করে হাসে কৃষ্ণেন্দু, প্রথম কটা মাস! পাগল! ও তো একদিনের ব্যাপার, সকালে যাবে, বিকেলে নার্সিংহোম থেকে ক্লিন হয়ে ফিরে আসবে।
সুদামার চোখ-মুখ থরথর করে, সে যেন অন্ধের মতো বাতাস হাতড়ায়। সত্যি বলছ তুমি?
সত্যি ছাড়া কি মিথ্যে? এ বয়সে আমি আবার বাবা হব, নীল কী ভাববে?
ওর আর ভাবার কী আছে, থাকে তো দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে! সুদামা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ও তো এরপর ভুলেই যাবে আমাদের, এবার সামারে আসবে না উটি যাবে, সাউথ ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে স্কুল থেকে, ওর মায়া চলে যাচ্ছে।
মায়া যাওয়ার কি আছে, বড়ো হচ্ছে। ছেলেরা তো ডিটাচড হয়ে যেতেই ভালোবাসে এই বয়সে। আবার ফিরেও আসে আরও বড়ো হলে। সামারে না আসুক দেওয়ালিতে, শীতে তো আসবে। না হলে আমরাই যাব মুসৌরি, তুমি ওসব মাথা থেকে তাড়াও দেখি। এখন আর নার্সিংহোমে দৌড়োদৌড়ি করা যায় না। সময়ও তো নেই।
সুদামা চুপ করে থাকে। মুখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দু খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ, যা বলে তাই করে। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছে। ঘন অন্ধকার। অন্ধকারে কী যেন খুঁজতে থাকে তার চোখ। সে যুক্তি খুঁজে বের করতে চাইছিল। পেয়েও গেল বোধহয়।
সুদামা বলে, নীল ছেলেবেলায় কী রকম বোন চাইত মনে আছে?
হাসে কৃষ্ণেন্দু, ছেলেবেলায় সবাই ওরকম চায়। এখন ও অবাক হবে। অ্যাডাল্ট হয়ে যাচ্ছে তো! আজকাল চোদ্দ বছরেই ছেলেরা অনেক কিছু বুঝে ফেলে, তারপর যে স্কুলে পড়ে। তুমি তো নীলের পরেও দুবার কনসিভ করেছ, তখন রাখার কথা তো বলোনি।
সুদামা আবার অন্ধকারে তাকায়। কথাটা অসত্য নয়। কিন্তু তখন যে নীল-নীলাঞ্জন ছিল কাছে। এখন সে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে উত্তরপ্রদেশের পাহাড়ে, শীতের ভিতরে। সেখানে গিয়ে প্রথম এক বছর মন খারাপ হত ছেলের। চিঠি লিখত খুব, আচমকা ফোন করত। এখন মন বসে গেছে। তার মানে সুদামার জন্য, মায়ের জন্য এখন আর তার ব্যস্ততা নেই, মন খারাপ নেই। নীল বাড়ি ছেড়েছে দু-বছর। কবে বাড়ি ফিরবে জানা নেই। ওই স্কুল থেকে বেরিয়ে আই আই টি — সেই রকমই প্ল্যান কৃষ্ণেন্দুর। তারপর বিদেশ। কলকাতায় পড়বেই না নীল। সুদামা তা হলে তার ছেলেকে কদিন কাছে রাখতে পারল? সন্তান প্রতিপালন করল কদিন? চোদ্দ বছরে অ্যাডাল্ট! এত তাড়াতাড়ি বাচ্চাটা বেড়ে উঠলে তার কী হবে? এত বড়ো ফ্ল্যাটে দিনভর সে একা। একটি শিশু এলে ফ্ল্যাটে চেহারাই বদলে যাবে।
কৃষ্ণেন্দুর ফোন এসেছে আবার। কথা বলছে অনিলবরণ ঘোষচৌধুরীর সঙ্গে। তারই সহকর্মী, অদ্ভুত এক রহস্য উপন্যাস লেখক। …কী বলছ, চেজের খুন। থার্ড মার্ডার — আমি অত দূর পর্যন্ত যাইনি… হ্যাঁ, প্রথম মার্ডারটা থ্রিলিং… লিফটে ভিতরে গলাকাটা ক্যাবারে গার্ল…। কৃষ্ণেন্দু মার্ডার নিয়ে গল্প করতে লাগল অনিলবরণের সঙ্গে, সেক্স মার্ডার ভায়োলেন্স —! চেজ থেকে নিক কার্টার তা থেকে অতিসাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, এইসব।
সুদামা ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে যায়। ঘাড় উঁচু করে আকাশে তাকায়। পাতলা শীত আছে এখনও। সে আঁচল টানল গায়ে। ভাবছিল আর কী বলা যায়। কৃষ্ণেন্দুর কাছে কীভাবে ব্যক্ত করে সে নিজেকে।
দুই
আবার আমার সাধ হয়েছিল মা হই। হ্যাঁ চোদ্দ বছর বাদেও। শুনে কৃষ্ণেন্দু মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, এখন আর ওসবের সময় নেই, মানুষের জীবনে এক একটি বয়স এক একটি অনুভূতির জন্য নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। সেই দিন আমাদের চলে গেছে। এক এক বয়সে এক এক রকম অনুভূতি, এক এক রকম জীবন। এখন এই বয়সে ও সব ঝামেলা নিয়ে কাজ কী? এখন তো কৃষ্ণেন্দু সেই চোদ্দ-পনেরো বছর আগের মতো সন্তানের মুখ দেখার প্রতীক্ষা করে থাকতে পারবে না। এখন প্রতি মাসে, প্রতি পক্ষে কৃষ্ণেন্দু আমাকে অতি সাবধানে কাঁচা মাটির পুতুলের মতো নিয়ে যেতে পারবে না সুখ্যাত ডাক্তারের কাছে, অপেক্ষা করতে পারবে না কখন ডাক্তারের সময় হয়। এখন অত সময় নেই। ওই রকম মনও নেই।
কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে রাতে অনেক সময় ধরে কথা কাটাকাটি। আমি ছিলাম আমার সিদ্ধান্তে স্থির নিশ্চিত, সন্তান ধারণ করবই। আমার ভেতরে জেদ চেপে গিয়েছিল, বলতে লাগলাম রাখবই একে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর সেই এক কথা, এই বয়সে এসব আর হয় না। আমার এই বয়স পুনর্বার মা হওয়ার উপযোগী নয়। সন্তান তো রয়েইছে, আবার কেন?
কৃষ্ণেন্দু কিন্তু ভুলে যাচ্ছে গত ছ-মাসের কথা। আমি যখন এই বাসনার কথা তার কাছে প্রকাশ করি, কৃষ্ণেন্দু ঘাড় কাত করেছিল, হবে তো হবে। আমি তখন সাবধান হইনি। কৃষ্ণেন্দুকেও সাবধান করিনি। আসলে কৃষ্ণেন্দু তার ছ-মাস আগের মত বদলাচ্ছে। ছ-মাসে কী হয়েছে ওর? নতুন এক দায়িত্ব পেয়েছে, যে দায়িত্বে ওর অনেক সম্ভাবনার চিহ্ন লুকিয়ে আছে। কিছু বলে না, কিন্তু আচমকা ব্যক্ত করে ফেলে। নানান স্বদেশি-বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে, বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে ওর যোগাযোগ হচ্ছে নিয়মিত। ওর দায়িত্ব হল এদেশে তাদের প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা। ও তা নিষ্ঠার সঙ্গে করছে। করতে গিয়ে প্রকৃত অর্থে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছুটির দিনও ছুটি নেই, সন্ধের পরও ছুটি নেই। মিটিঙের পর মিটিং, ফোনের পর ফোন। হ্যাঁ, সাগরপারের ফোনও আসে। কৃষ্ণেন্দু বলছে, তেমন কোনো অফার পেলে ও ছেড়ে দেবে সরকারি দায়িত্ব — এখন টাকার বাজার তৈরি হচ্ছে, টাকা সংগ্রহ করার প্রকৃষ্ট সময়ই তো এইটা।
অনেক বাক্য-বিনিময়েও কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত ওর জিত হল, হার হল আমার। কৃষ্ণেন্দুর একটিই যুক্তি, এখন যদি রাখতে চাইছি তো আগে দুবার নষ্ট করেছি কেন নীলের পরে?
কী বলি! তখন তো নীল ছিল ঘরে। আমার তো বাসনা শিখর-প্রমাণ নয়। নীলকে নিয়েই আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম, সন্তুষ্ট ছিলাম। নীল মিশন স্কুলে যাওয়ার পর আমি কী নিয়ে থাকি! কাকে নিয়ে থাকি!
কৃষ্ণেন্দু আমাকে সময় দিল। এখন মনে হচ্ছে এ-ই আমার ভবিতব্য। আমাকে সাবধানে, মাটির পুতুলের মতো নিয়ে গেল সেই পরিচিত নার্সিংহোমে, বুড়ো ডাক্তারকে গিয়ে বলল, পেশেন্ট নিয়ে এলাম ডাঃ দেব, আচ্ছা এই বয়সে মা হয় কেউ?
যে কথাটা ফ্ল্যাটে বলেছে আমাকে কৃষ্ণেন্দু, সেই কথা ডাক্তারকেও বলল। এই বয়সে যে কনসিভ করে সে নিতান্তই পেশেন্ট, আর কিছু নয়। আমার শরীরের অভ্যন্তরে যে প্রাণটি জন্ম নিচ্ছে, তা-ই হল আমার অসুখের কারণ। ভ্রূণমোচন করলেই আমার অসুখটি যাবে।
হাসতে হাসতে আমাকে ফ্ল্যাটে ফিরিয়ে আনল আমার স্বামী। নিশ্চিন্ত। বউয়ের শরীর ধুয়েমুছে সাফ করে এনেছে, অনেকদিন বাদে আমার মাথার চুলে হাত দিয়ে খোপা ভাঙতে ভাঙতে বলল, খুকি, এই রকম কেউ করে, দিস ইজ দা হাই টাইম টু আরন মানি, টু অ্যাচিভ মোর—এখন আমাদের সেই বয়স নেই, লোকে হাসবে।
আমি চুপ করে থাকলাম। কী করে বোঝাই যে সাধ হয়েছিল সত্যি। হ্যাঁ আমার মাথার ভিতরে খুঁজলে কোথাও না কোথাও রুপোলি রেখা চোখে পড়বেই। একটি দুটি। বয়স হয়েইছে। তা জেনেও তো চেয়েছিলাম আবার সেই স্বাদ নিই। সেই চোদ্দ বছর আগের শিহরণে শিহরিত হই। আবার আমার শূন্য শরীর ভরে উঠুক সন্তানের রক্তমাংসে, দশ মাস ধরে আমি বহন করি তার ভার। আমার দুই স্তনে দুধ আসুক। দুধের ভারে তা স্ফীত হোক, ব্লাউজ ভিজে যাক প্রাণের টানে। আমার গা দিয়ে দুধের গন্ধ বেরোতে থাকুক।
কী করে বোঝাই কৃষ্ণেন্দুকে এত বড়ো এই ফ্ল্যাট আর সহ্য হয় না। একা একা ভয় লাগে। হ্যাঁ সত্যিই। তাই আমি চেয়েছিলাম ফ্ল্যাটের বাতাসে ঘুরুক শিশুর গায়ের গন্ধ। ঘর-বিছানা ভরে যাক কাঁথা-কাপড়-দোলনা-ফিডিং-বোতল আর খালি দুধের কৌটোয়। খেলনা চাই না, সেই খালি দুধের কৌটো গড়িয়ে দিতে দিতে বড়ো হয়ে উঠুক সে। যেমন খেলত নীল। তখন আমরা বেহালার সরকারি আবাসনে। সবে স্টেট সার্ভিস — সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে কৃষ্ণেন্দু। বিয়ে যখন হল তখন তো সে কাগজের অফিসের প্রুফ-রিডার, আর দু-চার পাতা লেখে মাত্র …।
যদি ডায়েরি লিখত, এভাবেই যেন লিখত সুদামা। এখন আবার সেই অভ্যাস, যে অভ্যাস কৃষ্ণেন্দু তাকে দিয়েছিল আবার কৃষ্ণেন্দুই হরণ করেছিল, ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। ডায়েরি লিখতে বলত তাকে কৃষ্ণেন্দু, পরিচয়ের পর থেকে, কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলত, ডায়েরি লিখলে তোমার লেখার অভ্যাস হয়ে যাবে, আমরা দুজনেই লিখব।
সুদামা বলত, আমার যে ডায়েরি লিখতে ভয় করে।
কেন?
যদি কেউ সেই ডায়েরি খুঁজে পায়, দেখে ফেলে, বাড়িতে কত লোক!
হা হা করে হাসত কৃষ্ণেন্দু। তারা তখন হয়তো হাঁটছে রোদে ডোবা গ্রীষ্মের ময়দান দিয়ে। তারা তখন হয়তো আসছে ধর্মতলা থেকে কলেজ স্ট্রিটের দিকে। তারা তখন হয়তো বসে আছে কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে। তারা তখন হয়তো কলেজ স্ট্রিট থেকে বিবেকানন্দ রোডের দিকে হাঁটছে, ডালিমতলায় সুদামাকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরার বাস ধরবে কৃষ্ণেন্দু।
কৃষ্ণেন্দু বলেছে, দেখলে দেখবে।
তাতে যে তোমার কথা থাকবে।
থাকলে থাকবে, হ্যাঁ থাকবেই তো, আমার ডায়েরিতে তোমার কথা সব আছে।
কী আছে?
সে কী করে জানাব এখন, যদি কোনোদিন খুঁজে পাও, দেখে নেবে। শোনো খুকি, কবে তোমার হাত ছুঁয়েছি সেই কথাও, কবে কোনদিনে কোনক্ষণে তোমাকে চুম্বন করেছি, তাও।
ইস! তুমি আমার নাম লিখেছ?
লিখেছি তো খুকির কথা। কৃষ্ণেন্দু তার হাতের আঙুলে চাপ দিয়ে বলেছে।
অভ্যাস করছিল সুদামা। অভ্যাসটা ত্যাগও করেছে। আচমকা বিয়ে। বিয়ের কথাও লিখেছিল সুদামা। তারপর লিখতে গেলে হাত কাঁপে। লিখতে ইচ্ছে হয় অনেক কথা, কিন্তু লেখা হয়নি। লেখা হত না এই জন্য যে কৃষ্ণেন্দু টেনে টেনে পড়ত, আর হাসত। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু কী লিখেছিল তার ডায়েরিতে তা সে জানতেই পারেনি। কোথায় তার ডায়েরি! কৃষ্ণেন্দু বলত, তুমি খুঁজে বের করো।
সুদামার ফ্ল্যাটের বাইরে এখন প্রথম মার্চের দুপুর। আজ ভোরে কৃষ্ণেন্দু বেরিয়েছে রাজারামপুরের দিকে। তিনশো বিঘে জমি অধিগ্রহণের যে নোটিশ পড়েছে, তা দখল করা হবে আজ। কৃষ্ণেন্দু, সুহাস গেছে। গেছে পুলিশের বড়োকর্তা, বহু পুলিশ, রাইফেলধারী। কৃষ্ণেন্দু কদিন ধরে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। নির্বিঘ্নে জমি দখল করে সীমানা চিহ্নিত করে কাঁটাতারে বেড়ো দিয়ে দিতে পারলে তার প্রাথমিক দায়িত্ব শেষ। দায়িত্ব শেষ তো নয়। এই রকম প্রজেক্ট পরপর আসছে। এটি পেট্রোলিয়াম গ্যাস প্রজেক্ট, এরপর আছে হসপিটাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, ফুড পার্ক…। কদিন ধরে দেরিতে ফিরছে সে। জেলা শাসকের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক, পুলিশ কর্তার সঙ্গে বৈঠক, গ্যাস কোম্পানির উচ্চ পদাধিকারিদের সঙ্গে বৈঠক। তারা আরও পেট্রোলিয়াম প্রডাক্ট করতে নামছে, কৃষ্ণেন্দুকে সব দেখতে হবে। কৃষ্ণেন্দুর মুখে এখন ওই গল্প। এখন জুতো কোম্পানি শার্ট তৈরি করছে, ওষুধ কোম্পানি করছে টিভি-র বিজনেস। একটা ব্যবসায়ে কেউ পড়ে থাকছে না। বড়ো বিমার কোম্পানি হাসপাতাল করতে নেমেছে, এরপর তারা তৈরি করবে ফিলম ল্যাবরেটরি, ফুড পার্ক। গ্যাস কোম্পানিও নানারকম বিজনেস করে এ দেশে, বিদেশে। তারা দ্রুত কাজ চায়। ঘড়ির সঙ্গে হাঁটে, ঘড়ি ধরে কথা বলে, ঘড়ি ধরে ঘুমোয়। কৃষ্ণেন্দু হাসতে হাসতে বলেছে, তোমার ছেলে যদি প্রেম করে, করতেই পারে। তাহলেও ঘড়ি ধরে করবে, বুঝলে সুদামা।
টের পাচ্ছে সুদামা, ছ-মাসেই ঘড়ির কাঁটায় সতর্ক চোখ রেখে হাঁটার অভ্যেস করে ফেলেছে কৃষ্ণেন্দু। সেই অভ্যাস থেকেই যেন ভ্রূণমোচন করানো। অতদিন সন্তানের জন্য প্রতীক্ষা করার অভ্যেসই চলে গেছে তার। কৃষ্ণেন্দু বলে সে যদি এখন ছাব্বিশ বছরের যুবক, আর সুদামা উনিশ বছরের হত, তাহলে তারা কি আগের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা গঙ্গাতীরে জাহাজ দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারত? না পায়ে হেঁটে আউট্রাম ঘাট থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত আসতে পারত? প্রেমের প্রকাশও বদলে গেছে, যাচ্ছে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, এরপর দেখবে হয়তো সন্তানের জন্য দশ মাস ওয়েটই করতে হবে না, অত সময় কে দেবে…
কৃষ্ণেন্দু বলে, আমাদের দেশে সারপ্লাস লেবার, যদি সন্তান চাও, তুমি কষ্ট করবে কেন অতদিন, জানো ইউরোপ-আমেরিকায় উম্ব হায়ার করা যায়।
কৃষ্ণেন্দু বলে, ডায়েরি! তা লেখার সময় কখন পাবে এই সময়ের যুবক।
অবাক হয়ে সুদামা তার স্বামীকে দ্যাখে বিড়বিড় করে বলে, সল্টলেক থেকে সেদিন বেলগাছিয়া গেলাম, সেই তো আগের মতো, পথের ধারে চায়ের দোকানে, খালি বারান্দায় বসে আছে চব্বিশ-কুড়ি, নানা রকম বয়স!
ওরা খোঁজ রাখে না?
খোঁজ রাখে না মানে?
পালটে যাচ্ছে সব, দ্রুত পালটে যাচ্ছে, ওরা কি জানে উত্তর মেরুতে এবার বরফ গলবে বেশি, প্রতি বছর তাই হচ্ছে।
এ কথার সঙ্গে তোমার আগের কথার মিল কোথায়?
পালটে যাচ্ছে পৃথিবী।
সুদামা হেসে ফেলেছিল। যুক্তি প্রতিষ্ঠার কী অক্ষম প্রয়াস। উত্তর মেরুতে বরফ বেশি গলছে গ্রীষ্মে, তাই মানুষ হয়ে উঠছে ঘড়ির কাঁটার দাস! সে বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে তো দেখছি না আমি।
কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, প্রকৃতি পালটালে মানুষ পালটাবে না?
হ্যাঁ পালটাবে তো বটেই, তাপমাত্রা বাড়বে, কোনো কোনো বিষয়ের অভাব হবে। কোনো কোনো বিষয়ের প্রাচুর্য হবে, কিন্তু তার মানে কি মানুষ নিজের কথা ভাববে না?
ভাববে, বেশি করে ভাববে।
তোমার সেই ডায়েরি কোথায়?
অবাক হয়েছিল কৃষ্ণেন্দু, এতবছর বাদে আবার ডায়েরির কথা উঠতে। তখন সুদামা বলেছে, ডায়েরিতে এসব লিখে রাখো।
হা হা করে হেসেছিল কৃষ্ণেন্দু, ডায়েরি লেখার সময় কই মানুষের? দিস ইজ দ্য হাই টাইম টু অ্যাচিভ মোর, মোর অ্যান্ড মোর। আরও বেশি ভিটামিনের মতো, মানুষের এখন আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা দরকার। বহু বছর আমরা অনর্থক নষ্ট করেছি। সময় চলে গেছে হু-হু করে। এখন সবচেয়ে বড়ো সঙ্গী হল ঘড়ি।
সময় নষ্ট হয়েছে! কিসে? প্রেমে ভালোবাসায়, সুদামার জন্য নিদ্রাহীনতায়, কৃষ্ণেন্দুর জন্য রাত জাগায়। ঘড়ি কি প্রেমের সময়টুকুও কেড়ে নিচ্ছে? নিয়েছে?
ঘুম এসে যাচ্ছিল সুদামার। তখন ফোন বাজতে আরম্ভ করল। নতুন বছরের ডায়েরি পেন একধারে পড়ে আছে। আজই প্রথম পাখা চলল এই ঘরে।
সল্টলেক সিটির বালির মাঠ তপ্ত হতে আরম্ভ করেছে মধ্য বসন্তেই। সুদামা টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ায় একটু সময় নিয়ে। বেজে বেজে যদি থেমে যায় তো যাক। ফোনটা তো কৃষ্ণেন্দুর। ভোরে বেরোনোর সময় সে-ই কৃষ্ণেন্দুকে বলে দিয়েছিল, কী হল জানায় যেন। আজকের দিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি হল, আরও বেশি ভিটামিন, ‘টু অ্যাচিভ মোর, মোর অ্যান্ড মোর’-এর প্রথম নির্দিষ্ট পদক্ষেপ। তিনশো বিঘে দো-ফসলি চাষের জমি অধিগ্রহণ করা তো সহজ কথা নয়। জমির অবস্থানটি ভালো, ইনফ্রাস্ট্রাকচার — জল, বিদ্যুৎ, বড়ো পাকা রাস্তা সবই আছে। জমি দেখে গ্যাস কোম্পানি খুশি। দেওয়া নেওয়া নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল অনেকদিন। পঞ্চায়েত, গ্রামবাসীকে নানাভাবে বোঝাতে হয়েছে। ক্ষতিপূরণের নানারকম প্যাকেজ ঘোষণা করতে হয়েছে। নানারকম স্বপ্ন দেখাতে হয়েছে। রং চড়াতে হয়েছে। সব করেছে কৃষ্ণেন্দু, আর তার সহকারী সুহাস বোস।
ফোনটা কৃষ্ণেন্দুর। জানাবে, সব কাজ পিসফুলি, ওকে। ফিরতে দেরি হবে। সুদামা নিশ্চয় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। পুলিশ বন্দুক নিয়ে ফসল ভরা জমি দখল তো সামান্য বিষয় নয়। ফোনটা তুলল সে আধো ঘুম চোখে। টেনে নিয়ে অলস গলায় বলল, হ্যাঁ বলছি, সব হয়ে গেছে তো?
ম্যাডাম আপনি ঘুমোচ্ছিলেন, ডিস্টার্ব করলাম ম্যাডাম?
চোখ খুলে যায় সুদামার ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। না, কৃষ্ণেন্দু তো নেই ওপাশে। সুহাস বোস, তার সহকারী, খুবই বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করছে, তার ঘুম ভাঙাল কিনা। সুহাস রাজারামপুর পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন করছে। স্যার জানাতে বললেন….
তিন
ফোন রেখে দিয়েছিল সুদামা ওপারের মানুষ কিছু আন্দাজ করার আগেই। বোধহয় আরও একটু কথা বলার ইচ্ছে ছিল সুহাসের। সুদামার সঙ্গে সুযোগ পেলেই আলাপ দীর্ঘ করতে চায় সে। বসের স্ত্রীকে খুশি রাখার নিয়মেই হয়তো। এটা লক্ষ না করে পারেনি সুদামা। কারণ যাই হোক, সুহাস আলাপ থামাতে চায় না। হ্যাঁ খুবই বিনীত। কৃষ্ণেন্দুই সুহাসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সুহাস না থাকলে সে দম ফেলতে পারত না। তার অনেক কাজই তো সুহাস করে দেয়। যোগ্য সহকারী।
সেই যোগ্য সহকারী কৃষ্ণেন্দুর মুখ থেকে বাক্য স্ফুরণের অপেক্ষাটুকুই করে শুধু। বাকিটা বুঝে নেয়। মাঝে-মধ্যে সুদামাকে টেলিফোনে জানায়, কৃষ্ণেন্দু দেরিতে ফিরবে, কাজে ফেঁসে গেছে তারা। এখনই বড়ো একটা রিপোর্ট পাঠাতে হবে বাইরে। কম্পিউটার রুমে কেরানির সঙ্গে বসে আছে সাহেব। কখন যে শেষ হবে! সে ফ্যাক্স করল এখনই, রিপোর্ট যাচ্ছে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, সুহাস আন্দাজ করতে পারে চমৎকার। ফলে কাজ এগিয়ে থাকে। এখন এই সন্ধ্যায়, রাজারামপুর থেকে সুহাস এবং অনিলবরণ ঘোষচৌধুরীকে নিয়ে ফিরেছে কৃষ্ণেন্দু তার ফ্ল্যাটে। সারাদিন খুব পরিশ্রম গেছে, সন্ধেতে রিল্যাক্স করবে।
রাজারামপুরে তিনশো বিঘে জমি দখল করা হয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। হ্যাঁ, একেবারে নিঃশব্দে। গ্রামে কোনো মানুষ ছিল বলে ধরাও যায়নি। গ্রামের লোককে বারণ করা সত্বেও ওরা জমিতে ধান রুয়ে দিয়েছিল উচ্চ ফলনশীল।
এইরকমই হচ্ছে গত বছর দেড়েক ধরে। বার বার বারণ করা হচ্ছে গ্রামের মানুষকে জমিতে ফসল না ফলাতে। কিন্তু নির্দেশ অমান্য করে রোয়া বোনার সিজিনে মানুষ প্রতিবার নেমে পড়ছে জমিতে। জমিকে বিশ্রাম দিচ্ছে না। উচ্চ পর্যায়ে মিটিং করে জমি দখলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে অনেকদিন। গ্যাস কোম্পানি জমির দামও জমা দিয়ে রেখেছে সরকারি কোষাগারে। সেই টাকাতেই ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা। সব-ই ঠিকঠাক। কিন্তু জমি দখলের তারিখই বদলে গেছে বার বার। জমি কখনও ফাঁকা থাকছে না। ফসল ভরা জমির দখল নেওয়া একটু সমস্যার। তাতে প্রতিক্রিয়া খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। সেই সুযোগটিই নিয়েছে রাজারামপুরের মানুষ। ফসল ফলানোর প্রক্রিয়া কখনও থামিয়ে রাখেনি তারা। বীজতলা তৈরি, ধান বোনা, ধান রোয়া — এইসব ক্রিয়া কর্মগুলিকে ব্যবহার করছে জমি রক্ষার জন্য। অথচ ধান বোনা, রোয়ার অধিকারের জন্যই তো মানুষ জমি রক্ষার লড়াই-এ শামিল হয়। চিরকাল তাই হয়েছে। যাবতীয় কৃষক আন্দোলন, জমি দখলের আন্দোলন তো ফসল ফলানোর অধিকার অর্জনের জন্য। এখানে জমির অধিকার কায়েম রাখার জন্য রোয়া বোনা চলেছে। গত সিজিনে বারণ করা হল চাষিদের জমিতে নামতে, রোয়া বোনা করতে। নোটিশ করে দেওয়া হল জমির পজেশন নেওয়ার তারিখ জানিয়ে। কিন্তু চাষিরা জমিতে আগে-ভাগে নেমে পড়ে চাষ করে দিল। চাষের জল তো ওই এলাকায় সহজ লভ্য। রাজারামপুরের গা দিয়ে তিরিশ বছর আগে কাটা ইরিগেশন ক্যানেল। সেই ক্যানেল জল দেয় প্রচুর। সেই জলই জমির প্রকৃতি বদলে দিয়েছে। এক ফসলি থেকে দো-ফসলি, দুবার ফসল করেও তৃতীয়বারের চাষে গত দেড় বছর ধরে ব্যাপক মানুষ শামিল হয়ে পড়েছে। দু-বার ধান, একবার নানান সবজি, কলাই। ফসল দিয়েই তারা জমির দখল কায়েম রাখতে চেষ্টা করছে। এছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না, ভূমি রক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল কিছু মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক সমর্থনবিহীন আন্দোলন এগোতে পারেনি। আর আন্দোলনের নেতাদের খুব সহজেই গ্যাস কোম্পানি কিনে নিতে পেরেছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে। বটলিং প্ল্যান্ট মানে তো শুধুই তা-ই নয়। আরও ছোটো ছোটো শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে এ দিয়ে। রোজগারের নানারকম পথ খুলে যাবে। গ্যাস ডিলারশিপ, কন্ট্রাক্টরির সম্ভাবনা অনেক। আন্দোলন ভেঙে গেল বটে, কিন্তু গ্রামের মানুষের নিঃশব্দ প্রতিরোধ বন্ধ হল না। কতবার যে মিটিং হল, তারিখ ঠিক হল জমি দখলের। কিন্তু ফসলের প্রতিরোধে তারিখ বদলে যায় বারবার। শেষে পুলিশের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ক্যানেলের জল বন্ধ করে দেওয়ার। ছ-মাসের জন্য রাজারামপুর ইরিগেশন ক্যানেলের জলপ্রবাহ বন্ধ থাকুক। তা সম্ভব নয়। কেননা, ওই ক্যানেল তো শুধু তিনশো বিঘেতে জল দেয় না। বিস্তীর্ণ এলাকাকে সবুজ করেছে ওই ক্যানেলের জল যা হুগলি নদী থেকে আসে। গ্রামের মানুষ নিশ্চুপে তাদের কাজ করে যাচ্ছিল। জমির লড়াই চলছিল গোপনে। এবারও ধানকাটা হয়েছিল ডিসেম্বরে। তারপর আবার জানানো হয়েছিল নোটিশ করা জমিতে যেন ফসল না-রোপন করে চাষিরা। জানুয়ারি মাসে প্রশাসন অন্য বিষয়ে ব্যস্ত থাকে। পুলিশ পাওয়া সম্ভব হয় না, সরকারি কর্মীও অপ্রতুল হয়ে ওঠে সাগর মেলার কারণে। সেই সুযোগ নিয়েছে গ্রামের মানুষ। সুতরাং, শেষ অবধি নতুন রোয়া ধান সমেত জমি দখল করা হল। চাষিদের ফসলের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এল পি জি সংস্থা আর দেরি করতে রাজি হচ্ছিল না।
ফসল সমেত জমি দখল করতে যে হাঙ্গামার কথা আন্দাজ করে প্রায় শ-ছয়েক রাইফেলধারী নামানো হয়েছিল আজ, তাদের রাইফেলের একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি। সুদামাকে সব জানতে হচ্ছে এক একজনের মুখ থেকে। সে এখন এই মুহূর্তে ব্যালকনিতে, চেয়ার ঘুরিয়ে তিন পুরুষের দিকে তাকিয়ে। সুহাসের চোখ তার চোখে। সুহাস মদ্যপান করে না, করলেও বড়োজোর এক পেগ; অভ্যাসটা তাকে ধরাচ্ছে কৃষ্ণেন্দু। অন্য দু-জন তো রীতিমতো অভ্যাসের দাস।
সুহাস বলল, ম্যাডাম ফোনটা রেখে দিলেন তখন।
সুদামা কিছু বলল না সঙ্গে সঙ্গে, একটু সময় নিয়ে বলল, জেনে গেলাম তো, আবার কী? আপনাদের অফিসের কাজে আমার কোনো কৌতূহল নেই।
সুহাস চুপ করে যায়। সুদামা চেয়ার ঘুরিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে। এখন এই লবণ হ্রদ উপনগরীতে ফুল ফোটে অনেক। মার্চের সন্ধে চমৎকার। পথে বেরোলেই দু-পাশে কাঠগোলাপের গাছ, ফুটফুটে সাদা পাখির মতো ফুলে ভরে গেছে। একবার বাই-কার পুরুলিয়া যাওয়ার পথে আচমকা গাড়ি বিগড়ে ছিল বাঁকুড়ার কোনো এক গ্রামের কাছে। পথের ধারে মস্ত তেঁতুল গাছে বিকেলে হাজার বক। গাছ সাদা হয়েছিল। অবাক হয়ে সেই আশ্চর্য বকের গাছ দেখেছিল সে। সন্ধেয় উপনগরীর আধা নির্জন পথের দু-পাশে মাঝারি উচ্চতার অনেক হাত ছড়ানো হাত বাঁকানো কাঠগোলাপ গাছ দেখলে সেই স্মৃতি ঘুরে আসে। ফুল নয় যেন সাদা পাখি এসে বসে আছে ডালে ডালে। কত রকম গন্ধ এখন হাওয়ায়। নিম, কাঠগোলাপ, আচমকা আম-মুকুল। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সব টের পাওয়া যায়। সুহাসের কন্ঠস্বরে সুদামা উৎকর্ণ হল। কী বলছে!
সুহাস বলছে, ওই জমি না দেখানোই ঠিক ছিল, গ্রিন দেখেই ওদের পছন্দ হল, অথচ গ্রিন তো নষ্ট করবেই।
জমিটা কী দোষ করল? প্রশ্ন অনিলবরণের।
ওদের তো দরকার জমি, গ্রিন নয়। সুহাস বলে।
অনিলবরণ বিরক্ত হল, ভ্যাকান্ট ল্যান্ড, ফ্যালো ল্যান্ড তুমি পাবে কোথায়?
সার্চ করতে পারতাম, দেখলাম আর দিয়ে দিলাম, এটা ঠিক নয়। সুহাস বলে।
অনিলবরণ আচমকা হেসে ওঠে, তুমি যেমন! ও কৃষ্ণেন্দু, এ যে চাঁদের গায়ে চাঁদ, সোনার চাঁদ লেগেছে আমি করব কী?
সুহাস বলে, ঠাট্টার ব্যাপার নয় স্যার, আসলে এই কথা এতদিনে আমারও মনে হয়নি। আজ অনেকদিন বাদে রাজারামপুর গেলাম। আজ জমি পজেশন নেওয়া হল। চাষির জমি চলে গেলে যে কী হয় আমি তো কিছুটা বুঝি, শিকড় এখনও ছেঁড়েনি, যখন প্রথম গিয়েছিলাম তখন হাই-ইল্ডিং ক্রপ তোলা হয়ে গেছে। আমন ছিল না, চাষ হয়নি তখনও, ফাঁকা শুকনো মাঠ, আজ ক্রপ দেখে যে কী হল?
কী হল? অনিলবরণ মোটা গোঁফের ফাঁকে হাসে, কী হল বলো?
ফসল দেখলে আপনার ভালো লাগে না? পালটা প্রশ্ন করল সুহাস।
ফসল না ফসলভরা জমি? অনিলবরণ জিগ্যেস করে।
জমি। সুহাস উচ্চারণ করে।
অনিলবরণ বলে, না, বরং মরুভূমি চমৎকার লাগে। পতিত লালমাটির ডিহি, মাঠ।
সুহাস বলে, আপনার সঙ্গে আমার মেলে না। কারওরই মেলে না।
মেলে না কেননা সবাই একইরকম ভাবে ভাবতে ভালোবাসে, আরে বাবা ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা — সেই পাঁচবছর বয়স থেকে শুনছি। এর ভেতরে নতুন কী আছে। মরুভূমিতে গেছ কখনও?
সুহাস মাথা নাড়ে।
তাহলে আর কী বুঝবে। এক ভয়ংকর সৌন্দর্য। রোদে পুড়তে পুড়তে জল না পেয়ে মরেই গেলে হয়তো। তুমি ম্যাকেনাস গোল্ড দেখেছিলে?
দেখেছিলাম বোধহয়। নিস্পৃহে উত্তর দেয় সুহাস।
চোরাবালিতে ডুবে মৃত্যু দেখেছিল?
সুদামা অবাক হয়ে দুজনের কথোপকথান শুনছে। দেখছিল কীভাবে অনিলবরণ ফসল ভরা জমিকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় রাজারামপুরের সবুজ কৃষি ভূমি, কোথায় মরুভূমির বালি, চোরাবালি, মৃত্যু। চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া সেই স্বর্ণসন্ধানীর কথা শোনাচ্ছে অনিলবরণ। পারেও বটে মানুষটা ঘুরে ফিরে তার নিজের পছন্দের দিকে চলে যাবেই। চোরাবালির ভেতরে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে স্বর্ণসন্ধানীর দেহ। পা থেকে হাঁটু, হাঁটু থেকে কোমর, কোমর থেকে বুক…। মানুষটি আঁকড়ে ধরতে চাইছে মাটি। মাটি মানেই তো বালি, চোরাবালি, তার কোনো ভার নেই। সর সর করে সরে যাচ্ছে হাত। মানুষটার চোখমুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে আতঙ্ক। তার সহযাত্রী স্বর্ণসন্ধানী, তিনি বোধ হয় ছিলেন গ্রেগরি পেক, নিরাপদ দূরত্ব থেকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন দড়ি। দড়ি হাতের নাগালে এসেও আসছে না। আস্তে আস্তে মানুষটি তলিয়ে গেল বালির ভেতরে। বালি আবার শান্ত, নিশ্চুপ। একেবারে নিরাপদ চেহারা নিয়ে পড়ে থাকল মরুভূমির ভেতরে। অপেক্ষা করতে লাগল আর একটি শিকারের জন্য। আর একটি মানুষের মরণ হয়ে পড়ে থাকল হিলহিলে রোদ্দুর।
সুহাস বলল, এসব আমার মনে আছে।
তবে বোঝো, মৃত্যুর অমন চেহারা কি কখনও দেখেছ? যাচ্ছিল সোনার সন্ধানে, হারিয়ে গেল বালির ভেতরে —
সুহাসের মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে হাত তুলল, আমার ভালো লাগছে না এসব শুনতে।
ভালো না লাগলে হবে, দেখো ভায়া এসবই হল রিয়ালিটি।
আপনি থামুন।
হা হা করে হাসে অনিলবরণ, বলে, গেল সোনার সন্ধানে, পেয়ে গেল মৃত্যুর সন্ধান। অবশ্য শেষপর্যন্ত সবাই তো মরে না, কেউ কেউ মরে। যারা মরে তাদের মৃত্যু ওইরকম হয়, ভয়ংকর সুন্দর —
সুহাস বলে, আমি বলছিলাম গ্রিনের কথা, সবুজ ফসলের জমি, যা আমরা আজ দখল করেছি — আমরা কি ঠিক করেছি ওই ইরিগেটেড জমি প্রজেক্টের জন্য অ্যাকোয়ার করে?
অনিলবরণ বলে, বাজে কথা বলছ, তোমার নেশা হয়ে গেছে।
না, না আমি ঠিক আছি, আমি বলছি গ্রিইন….।
ঠিক নেই তুমি। অনিলবরণ ঢুলছে, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণসন্ধানী, সোনার খোঁজে বেরিয়েছ।
স্টপ ইট। সুহাস চিৎকার করে ওঠে, চুপ করুন মিঃ ঘোষচৌধুরী।
অনিলবরণ হাসে। সুহাসের কাঁধে হাত রাখে। বিড়বিড় করে, আমি কিন্তু ভুল বলছি না।
হ্যাঁ বলছেন।
তাহলে বলছি। উদাসীন হয়ে যায় অনিলবরণ।
সুহাস মুখ গম্ভীর করে টলতে থাকে। বিড়বিড় করতে থাকে, গ্রিইনের মূল্য কে বুঝবে, যারা চাষ বাস করেনি, ফসল ভরতি জমির মর্ম বুঝতে ফসল ফলানোর কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হয়….। সুহাস আপন মনে বকবক করতে থাকে।
চার
সুদামা ক্রমশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে সুহাসের প্রতি। একত্রিশ বত্রিশের বীরভুমের এই যুবককে তার মনে হয় অতি সাধারণ, অফিস কর্তার পিছনে ঘুর-ঘুর করা আর পাঁচটা চাকুরের একজন, যে বড়ো সায়েবের ফোন এলে ক্রমাগত স্যার, স্যার, ইয়েস স্যার উচ্চারণ করে কৃষ্ণেন্দুর মতো, যে বড়োকর্তার ফাইফরমাশ খেটেও নিজের উন্নতির পথ প্রশস্ত করতে চায়। কিন্তু কী বলছে সেই সুহাস? ও বীরভূমের গ্রামের ছেলে, বাবা প্রাইমারি স্কুলের টিচার, ওদের চাষের জমি আছে দশবিঘের মতো। প্রতি অঘ্রানে ধান ওঠে। না, দুটো ক্রপ ওদের জমিতে হয় না। ওখানে সেচের ব্যবস্থা নেই। সেচের সুফল পাওয়া দু-ফসলি জমি তারা আজ দখল করল, মন খারাপ হয়ে গেছে সুহাসের। এই সময়ে তাদের খয়রাশোল ব্লকের সব গ্রাম রোদে পোড়ে, শুধুই পোড়ে। জমির হাড়গোড় বেরিয়ে যায়। ধুলো ওড়ে শুধু …
অনিলবরণ হাসে, হুইস্কি কিক করছে তোমাকে সুহাস, জমি বাদ দিয়ে গান গাও দেখি, চাঁদের গায়ে ….।
মাথা নাড়ে সুহাস, নো স্যার, আমার মনে পড়ছে চাষি বউটার কথা, কিষাণী। ওই যে বলছিলাম চাষিরাই বোঝে সবুজের মর্ম ….।
হা হা করে হাসে অনিলবরণ। কিষাণী, চাষি বউ। দারুণ বলেছে তো সুহাস। এত পুলিশ, অফিসার গেল, মনে পড়ল শুধু চাষি বউকে, হ্যাঁ বয়স অবশ্য কমই ছিল! সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী, কৃষিকর্ম নিপুণা ….।
অনিলবরণ একটু ভোঁতা প্রকৃতির। নেশা করলে বেসামাল হয়। তার কথার আগল থাকে না কোনো। লোকটা কৃষ্ণেন্দুর সহকর্মী। এই ফ্ল্যাটে এসেছে অনেক, বউ নিয়েও এসেছে, কিন্তু সুদামার ওকে একদম পছন্দ হয় না। হৃদয়হীন মানুষ, অফিসেও নাকি খুব বদনাম ওর। কারওর সঙ্গেই ভালো করে কথা বলে না। সাব-অর্ডিনেট স্টাফরা তো ক্ষেপেই থাকে সর্বক্ষণ। ওর বউও নাকি ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ওইরকম লোকের সঙ্গে কেউ সংসার করতে পারে। সারাক্ষণই খুন জখম মৃত্যু রক্তপাত নিয়ে কথা বলে রহস্য ঔপন্যাসিক অনিলবরণ। হা হা করে হাসে।
অনিল বলল, চাষি বউটার জন্য কষ্ট হচ্ছে তোমার, আরে বাবা বললে না কেন, পুলিশ দিয়ে তো তোলাই যেত আজ। থানায় ভরে দিতাম। তারপর তোমাকে সুযোগ দিতাম, হ্যা হ্যা হ্যা, আলাপ করতে লকআপে ঢুকে। হা হা হা, তুমিই হলে আসল স্বর্ণসন্ধানী সোনাটা চিনেছ, চোরাবালিতে পড়া না-পড়া তোমার ইচ্ছে।
সুদামা অন্ধকারে সরে গেছে আরও। সে যদি আলোয় থাকে দরজার গোড়ায় তো ওরা ইচ্ছে মতো আলাপ করতে পারবে না। তার কৌতূহল বাড়ছিল। সে আন্দাজ করছিল, করতে চেষ্টা করছিল কী হয়েছে আজ। কে সেই চাষি বউ, যাকে নিয়ে অনিলবরণের রসিকতা।
কৃষ্ণেন্দুকে বলছে সুহাস। কৃষ্ণেন্দু ওই সামান্য ঘটনাটির কথা জানে না। সে তখন ওই স্পটে উপস্থিত ছিল না। উপস্থিত থাকার কথাও ছিল না তার। সে ছিল রাস্তার ধারে, একটি ক্লাব ঘরে এল পি জি সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত। দু-একটা প্রয়োজনীয় বিনিময়, সামান্য সময় খোস-গল্প, ইত্যাদিতে মগ্ন। আজ তো গ্রামের মানুষকে ঘরেই রেখে দিয়েছিল পুলিশ প্রশাসন। ভোরবেলায় রাজারামপুর গ্রামে রাইফেলধারীরা নেমে গিয়েছিল। ওই গ্রামে যত পুরুষ মানুষ ছিল, তার দশগুণ ছিল রাইফেলধারী, টিয়ার গ্যাস, লাঠি-ঢাল সমেত পুলিশ। সাবধানতার কোনো ত্রুটি ছিল না। অত উর্দি রাইফেল দেখে পুরুষ মানুষরা ঘর থেকে বেরোয়নি। পাড়ার মুখে মুখে, রাস্তার প্রতিটি বাঁকে, ঝোপেঝাড়েও পুলিশ বসিয়ে দিয়েছিল প্রশাসন। এইভাবেই হয়ে থাকে। মানুষের বেরোনোর সব পথ বন্ধ করে গ্রাম জনবিরল করে দেওয়া হয়েছিল। আগে কতকগুলি জোনে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল গোটা বসতিকে, সেইভাবে পাহারা বসানো হয়েছিল। একটা মানুষও বেরোয়নি, দু-একজন বৃদ্ধ প্রশ্ন করতে এলেই তাদের ঝটপট করে সরিয়ে দিয়েছিল রাইফেলধারীরা চোখ রাঙিয়ে।
কিন্তু এত সতর্কতার ভিতরে ও মাঠে চলে গিয়েছিল দু-চারজন। তাদেরও সরিয়ে দিতে অসুবিধে হয়নি। অসুবিধে হয়েছিল এক চাষি বউয়ের বেলায়। পুরুষ মানুষ ঘরে, সে বেরিয়েছিল। রাইফেলধারীদের নজর এড়িয়ে আড়াল-আবডাল দিয়ে রোয়া জমিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার হয়তো ক্ষীণ আশা ছিল জমিতে যখন ধান, জমি দখল করবে না গ্যাস কোম্পানি। জমির ধানই জমিকে তো রক্ষা করেছে এতদিন, এবারও তাই হবে। এইভাবেই যেন জমি চিরকাল রক্ষা করা যাবে। ধানকাটা পর্যন্ত সময় দেবে। ধানকাটার পর আবার ফসল ফলানোর আয়োজন করে পিছিয়ে দেওয়া যাবে অধিগ্রহণের দিন। কিন্তু তা যখন হচ্ছে না, শাল-খুঁটি পোঁতা হয়ে যাচ্ছে জমির সীমায়, তখন বউটি জমির আলে বসে পড়েছিল। একটু গলা তুলে বলেছিল, কাঁচা ধান যেন নষ্ট না করে পুলিশ, জমিতে যেন না নামে মজুররা, যারা শাল-খুঁটি কাঁধে নিয়ে সার্ভে পার্টির পিছনে পিছনে হাঁটছিল। কিন্তু কথা হল এই, মেয়েমানুষটা এল কী করে এতদূর? চাষ করতে কে বলেছিল তাকে? পুলিশের কথা হল এই রকম।
সুহাস বলছে, মানুষের কৃষিকর্মের অভ্যাস তো বহুকালের। মানুষ তো অভ্যাসে চাষ করে। আকাশে মেঘ উঠলে সবচেয়ে খুশি হয় কে? আকাশের পাখি, গাছ আর চাষি মানুষ। পুলিশ খুব খারাপ ব্যবহার করছে ওই বউটির সঙ্গে। অশ্লীল ভাষায় তাকে গালিগালাজ করেছিল।
কী রকম! না এক রাইফেলধারী কনেস্টবল প্রথমে বলল, উঠে যান জমি থেকে, ক্রপ কমপেনসেশন তো দেবে! আমাদের কাজে বাধা দেবেন না।
বউটি শোনেনি। তার বয়স কম। তার রাগও তাই বেশি। তেজও। তেজেই বলেছিল, তার জমি বাদ দিয়ে দিক বাবুরা। ধান নষ্ট করে যেন কোনো কাজ না হয়।
তখন পুলিশ ভয় পাওয়াল বউটিকে। ভয় দেখানো প্রয়োজন ছিল। না হলে সে জমি থেকে উঠতই না। এক রাইফেলধারী বলেছিল, যদি জমি থেকে না ওঠে সে, তবে তুলে নিয়ে গিয়ে লকআপে ভরে কেসে ঝুলিয়ে দেবে।
আর একজন আর একটু বাড়িয়ে বলল, তাতে ছ-মাস জেল, দশ হাজার টাকা জরিমানা।
চোখ রাঙানো তৃতীয় রাইফেলধারী, গর্জে উঠেছিল, যা ভাগ, লকআপে চোর-ছ্যাঁচোড়ের সঙ্গে গুণ্ডা বদমাশের সঙ্গে যদি সারা রাত্তির থাকিস তো কী হাত পারে জানিস! বেটাছেলেদের ঘরে থাকবি রাতভর।
অনিলবরণের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বলল, ঠিকই তো বলেছে, মেয়েছেলের জন্য যদি আলাদা লকআপ না থাকে তো কোথায় রাখবে, দারোগাবাবুর ঘরে?
সুহাস বলল, কথাগুলো বলাই তো ঠিক নয়, কোনো মহিলাকে সন্ধের পর থানা আটকে রাখতে পারে না। আর কথাগুলো খুব খারাপভাবে বলেছিল স্যার।
অনিলবরণ নিশ্চুপে মদ্যপান করে। বলল, তুমি একেবারে বাচ্চা। পুলিশকে ভয় না দেখালে চলে। আরে বাবা গায়ে তো হাত দেয়নি, আঁচল ধরে তো টানেনি। আর মেয়েটাই-বা কী রকম! অত পুলিশের ভেতরে চলে গেল? ভয় করল না?
বাহ! জমিটা তো তার।
হা হা করে হাসে অনিলবরণ, জমি আমাদের। মানে গভমেন্টের। আমরা ইচ্ছে হলেই নিয়ে নেব। স্টেট প্রয়োজন হলে সব কিছু করতে পারে, মানুষ মারতে পারে, মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পারে। ওর স্বামীই-বা কীরকম, বউকে পাঠিয়ে দিল পুলিশের ভেতর? জানে না পুলিশ কোনো সুবোধ বালক নয়।
সুহাস বিড়বিড় করে, আমরা ওই রকম এ ক্লাস ল্যান্ড না নিতেই পারতাম, কী চমৎকার ফসল হয়। দেখুন স্যার চাষিরাই এদেশে একমাত্র কাজ করে, সময়ের কাজ সময়ে করে, শ্রাবণে অঘ্রানে বৈশাখে জ্যৈষ্ঠে, তারা ধান রোয়া ধানকাটা বন্ধ রেখে ঘরে বসে তাস খেলে না, সিনেমার নায়িকার শরীর নিয়ে গল্প করে না, রহস্য উপন্যাসের খুনের বিচিত্র উপায় নিয়ে ভাবেও না। দে আর ডিসিপ্লিনড, পাঞ্চুয়াল, লেবোরিয়াস।
অনিলবরণ ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে নেশার টানে, মাথাটা তুলে বলল, রহস্য উপন্যাসে খুনের উপায়! হোয়াট ডু য়্যু ওয়ান্ট টু টেল, ওটা কোনো কাজ নয়। তুমি কি জানো মার্ডার ইজ অ্যান আর্ট, মূর্তি মার্ডার সম্পর্কে কী জানো, জানো মানুষের ভেতরে সবচেয়ে প্রখর দুটো ইনসটিঙ্কট, সেক্স অ্যান্ড মার্ডার, ছেলেবেলায় পিঁপড়ে টিপে মারতে না?
অনিলবরণ আবার তার প্রসঙ্গে চলে গেছে। মার্ডার নিয়ে বক্তৃতা করতে আরম্ভ করল। কেউ শুনছে কিনা সে বিষয়ে তার কোনো কৌতূহল নেই, নেশার ঘোরে তা থাকার কথাও নয়। সুহাস সরে গেল কৃষ্ণেন্দুর কাছে, সে বোঝাচ্ছে কৃষ্ণেন্দুকে, স্যার, আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমরা আমাদের ডিউটি ঠিকমতো করিনি। জমি চাইছে বিভিন্ন সংস্থা, ডেভেলপমেন্ট হবে। আমরা তো পরিশ্রম করে পতিত জমি, ফসলহীন জমি খোঁজ করে তাদের দেখাব। তা না করে চাষের জমি দিয়ে দিলাম, চাষই হওয়া উচিত আমাদের ডেভেলপমেন্টের হাতিয়ার, আমাদের চাষিরা কী চমৎকার ফসল ফলায়, যখন ধান ওঠে, কী ধান কী ধান! যখন, ধরুন শীতের সবজি, কপি ওঠে, কপির পাহাড়, এত ফসল কোথায় হয়? অথচ এসব আমরা ভাবছি না, এটাই হল ব্যুরোক্রেসির দোষ, ক্ষমতাকে ঠিকভাবে ব্যবহার করি না আমরা।
কৃষ্ণেন্দু গম্ভীর। তার নেশা হয় না। নেশা হলেও অচঞ্চল থাকে সে। সে সুহাসের কথা শোনে, কিন্তু মন্তব্য করে না। মাতালের কথার কোনো মানে নেই, তাই। সুহাস সাড়া না পেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ানো সুদামাকে খোঁজে। সে তার যুক্তির সমর্থক খুঁজে পেতে চাইছিল। আর তখন অনিলবরণ তা বক্তৃতায় কোনো সাড়া না পেয়ে আচমকা সুহাসের পিঠ চাপড়ে দেয়, তুমি বড্ড বেশি কথা বল, বেশি ভাব, বেশি বুদ্ধিমান মনে কর নিজেকে, বেশি চালাক, চাষি-দরদী! অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হচ্ছ এইভাবে? আরে শালা, পুলিশ তো অত্যন্ত ভদ্র-সভ্যের মতো কাজ করেছে আজ, সেই রকম ডিরেকশন ছিল। তা যদি না করত তাতেই-বা কী ক্ষতি হত, পুলিশকে লোকের ভয় করা উচিত, তা না হলে শাসনই থাকে না, তখন তোমার আমার মূল্য কী! পুলিশ দিয়েই তো রাজ্য শাসন হয়, মন্ত্রী, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনার, বিচারপতি সবার ক্ষমতার উৎসই তো পুলিশ। দরকারেই আমরা পুলিশ ডাকি। আরে বাবা পুলিশের প্রতি যদি ভয় না থাকবে, কাজ হবে কী করে? ভয় পাওয়ানোর জন্য একটা দুটো রেপ, লকআপে থার্ড ডিগ্রি দরকার। আই সাপোর্ট ইট। এসব ঘটে বলেই না মানুষ পুলিশকে যমের মতো ভয় করে — বলে হা হা করে হাসতে থাকে অনিলবরণ, শোনো সুহাস, মার্ডারের নানান কেস হিসট্রি আমি পুলিশের কাছ থেকে নিচ্ছি, যদি শুনতে তুমি।
সুদামা এইসব শুনতে থাকে। বাধ্য হয় শুনতে।
পাঁচ
অনিলবরণ, সুহাস চলে গেল সাড়ে আটটার পর। এই সাড়ে আটটা পর্যন্ত সুহাস আর অনিলবরণের তর্কাতর্কি চলতে লাগল। অনিলবরণ বারংবার বোঝাতে লাগল শাসন বজায় রাখার জন্য পুলিশের কাজে মাথা গলানো ঠিক নয়। শাসন বজায় রাখার জন্য পুলিশকে অনেক কিছু করতে হয়। ধর্ষণও করতে হয়, পিটিয়েও মারতে হয়। একটা দুটো এমন কেস হয়ে গেলে লোকে সন্ত্রস্ত থাকে। ওইটা প্রয়োজন। বড়ো কাজে যখন নামে পুলিশ, আচমকা এমন হয়ে যেতে পারে। এ নিয়ে কাগজ হল্লা করতে পারে, কিন্তু তাতেই-বা কী! পুলিশ দেখলে মানুষের কাপড় যদি না ভিজে যায়, তবে কাজ হবে কী করে? আসলে দেখা দরকার কাজটা হয়ে উঠল কিনা। এসব ঘটনা তুচ্ছ। কে কাকে খিস্তি মেরে কী বলল, কটা মানুষের মাথা ফাটল লাঠির ঘায়ে, কোন মেয়েছেলের গায়ে হাত দিল, তা নিয়ে মাথা ঘামালে সুহাস প্রশাসনিক কাজই করতে পারবে না।
এই তর্কে কৃষ্ণেন্দু নিরপেক্ষ। মিটিমিটি শুধু হাসতে থাকে। দূর থেকে তার ভূমিকাও পছন্দ হয় না সুদামার। কৃষ্ণেন্দু কি অনিলবরণের মতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে, না হলে তাকে থামাচ্ছে না কেন? দুজন চলে গেলে সুদামা রোষে ফেটে পড়েছে, লোকটা যেন আর না আসে।
কে সুহাস? হাসছে কৃষ্ণেন্দু।
হ্যাঁ হ্যাঁ, সুহাস যেন তোমাদের আসরে আর না আসে। ও এর উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি, খারাপ হয়ে যাবে ছেলেটা।
তুমি কি অনিলবরণের কথা বলছ?
বলছিই তো, ও না উপন্যাস লেখে! লোকটা কি পাথর?
কৃষ্ণেন্দু বলে, পাথর নয়, মানুষই, ও এসব বলে ইচ্ছে করে, সুহাসকে রাগাবার জন্য আজ বলছিল।
রসিকতার মাত্রা থাকবে তো।
কৃষ্ণেন্দু তখন খেতে চায়। সে আর কথা বাড়াতে চাইছিল না। কিচেনের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণেন্দু। সুদামা গ্যাস ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে একটু নিচু হয়ে সিলিন্ডারের নব অন করতে গিয়ে চমকে ওঠে, এ কী! একটি ওভেনের নব তো খোলা। ছোটোটা, যেটি ব্যবহার হয় কম। সরে দাঁড়াতেই আবার খেয়াল হল গ্যাস সিলিন্ডারের নবে চাপ দিয়ে সে সরে এসেছে। হাত বাড়িয়ে ওভেনের নব না সিলিন্ডারের নব করতে করতে এক দু-সেকেন্ড যেতেই কৃষ্ণেন্দুর খেয়াল হয়, কী করছ তুমি, তোমারও কি নেশা হয়ে গেল।
সুদামাকে সরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণেন্দু ওভেনের নব বন্ধ করল, এটা খুলল কে?
সুদামা বিব্রত হয়ে পড়ে। তাই তো! রান্নার মেয়েটির তো এসব বিষয়ে খুব নজর। সে এই ভুলটা করল নাকি? সিলিন্ডারের চাবি ঘুরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ওভেনের শিখা নিভে যেতে সে মনে করেছিল সবই বন্ধ করা আছে। ছোটো ওভেন ব্যবহার করা হয় খুব তাড়া থাকলে। সময় তো বেশিই লাগে ওতে। আজ তাড়া ছিল কোথায়? কৃষ্ণেন্দু ভোরে বেরিয়েছে। আজ তো শুধু সে খেয়েছে দুপুরে। কাজের মেয়ে বিমলা নিশ্চিন্তে রান্না করেছে। সে নিজে শুধু একবার চা করেছিল চারটে নাগাদ। কিন্তু নিশ্চয়ই বড়ো ওভেনে চাপিয়েছিল জলের পাত্র। তাই-ই তো করে থাকে। নাকি ছোটো ওভেন ব্যবহার করেছিল? ছোটোটায় তো সময় বেশি লাগে। সময় লাগলে তারই-বা ক্ষতি কী! তার তো সারাদিনই কোনো তাড়া নেই। সে তো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পা ফেলে না। ঘড়ি তো দ্যাখেই না সে প্রায়। যদি বা দ্যাখে, তার ভেতরে কোনো কৌতূহল থাকে না, তাড়া থাকে না। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়াড্রোব, ওয়াসিং মেশিন, টেলিফোন, টিভি, ঘরের তেলরঙা দেওয়ালে টাঙানো কৃষ্ণেন্দুর মা-বাবার ছবি, নিসর্গ চিত্র, জীবনবিমার ক্যালেন্ডার দেখার মতো করেই দ্যাখে। তার কাছে দেওয়ালের কোয়ার্টাজ ঘড়িটি আসবাবের মতোই হয়ে গেছে প্রায়। হ্যাঁ তাই, এক একদিন বিকেলের দিকে, দুপুরের দিকে, রাতে ফোন এলে, তা কোনো বান্ধবীর হোক বা আত্মীয়-স্বজনের হোক, সে আচমকা তাদেরই জিজ্ঞেস করে, কটা বাজে এখন বলো দেখি? সময়টা শুনে নিয়ে আবার কথা বলতে থাকে।
কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, বিমলা খুলে রেখে গেছে?
কী জানি! অন্যমনস্কের মতো জবাব দিল সে।
তুমি খুলে বন্ধ করোনি?
আমি তো খুলিনি, এটা তো খুলি না। বলতে বলতে সুদামা ঘুরে ফ্রিজ থেকে মাছ তরকারি বের করতে থাকে। বাইরে থাকুক কিছু সময়, ততক্ষণে ভাত ফুটে যাক। ভাতের পর ওগুলো গরম করে নেবে।
তুমি খোলোনি, বিমলা খোলেনি, তাহলে কে?
সুদামা বিব্রত হয়ে পড়ে। মাথা কাজ করছে না। যদি সে বড়ো ওভেনে চা করে থাকে, যা তার অভ্যেস, তা হলে তখনও কি ছোটো ওভেনের নব খোলা ছিল। ছোটো ওভেন দিয়ে তখন গলগল করে বেরিয়ে আসছিল কুকিং গ্যাস — তরল পেট্রোলিয়াম — যা বাতাসের সংস্পর্শে এসে বায়বীয় হয়ে যায়। যতক্ষণ জল ফুটেছে, যত সময় পাশের ওভেনে আগুন জ্বলছে ততক্ষণ এই ওভেনের গ্যাস আপনা-আপনি বেরিয়ে গেছে। আগুন খুঁজেছে। খোল ছিলা জানালা। জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সুদামা মাথা নাড়তে থাকে। তা হয়নি। তা না হলে কেউ গ্যাস ওভেন খুলে দিয়ে চলে গেছে। আশ্চর্য! তা হতে পারে? সে কৃষ্ণেন্দুর মুখের দিকে তাকায়। নেশা কেটে গেছে কৃষ্ণেন্দুর। না কাটলেও খুব ব্যালান্সড মানুষ। ডাইনিং টেবিলের সামনে পাতা চেয়ারে বসে কিচেনের দিকে তাকিয়ে আছে কৃষ্ণেন্দু।
খেতে খেতে কৃষ্ণেন্দু বলল, আগে ওভেন বন্ধ করে, তারপর সিলিন্ডারের নব বন্ধ করা, এইভাবেই তো করো।
কী জানি!
কৃষ্ণেন্দু বলল, কেয়ারলেস হলে বিপদ ঘটে যেতে পারে।
হাসে সুদামা। তখন ফোন বাজল। সে উঠে গিয়ে ফোন ধরল। আশ্চর্য! ফোন কেটে গেল। গেল কিংবা কেটে দিল ওপাশের লোক। ফোন রাখার শব্দটিও কানে এল যেন। সুদামা ক্রেডলে রিসিভার রেখে ডাইনিং টেবিলে ফিরে এল।
কার ফোন? কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে।
কী জানি, রেখে দিল।
রেখে দিল মানে? কৃষ্ণেন্দু অবাক, রেখে দিল?
সাড়া দিতেই ফোন রাখার শব্দ শুনলাম।
নাকি কেটে গেল লাইনটা?
সুদামা জবাব দেয় না। কৃষ্ণেন্দু বিড়বিড় করে, মনে হয় লাইন কেটে গেছে, আবার আসবে, কিছু হল নাকি রাজারামপুরে?
কৃষ্ণেন্দু ধীরে ধীরে খায়। সুদামার চোখ টেলিফোনে। টেলিফোন আবার বাজবে হয়তো। লাইন কেটেও যেতে পারে, সে ভুল ভেবেছে বোধহয়। কৃষ্ণেন্দু খাওয়া শেষ করে ওঠে। সুদামার খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কোনোরকমে মুখে দুটো দিয়ে উঠে পড়ে। টেবিলে থালা বাসন পড়ে থাকল।
কৃষ্ণেন্দু মুখ ধুয়ে সোজা বিছানায়। এখন রাজ্যের ক্লান্তি তার উপরে ভর করেছে। ঘুম আসছে ঘুম। বিছানায় চিত হয়েই চোখ বন্ধ করল সে। ঘুমিয়েও পড়ল খুব তাড়াতাড়ি। সুদামা মশারি লাগিয়ে, মশারির ভিতরে কৃষ্ণেন্দুকে রেখে বাইরে। বাড়িতে টেলিফোন দুটি, একই লাইনে দুটো রিসিভার, একটি বেডরুমে, অন্যটি ডাইনিং কাম লিভিং-এ। সুদামা বেডরুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে যায়। গা-টা কেমন করছে। ভাজা মশলার কৌটো খুঁজতে গিয়ে তার নজরে আসে রুপোলি রঙের ওভেন। দুটি নবই বন্ধ আছে। সে ছোটো ওভেনের নবটি ঘোরায়। ঘুরিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। তখনই নাকে আসে কাঁচা গ্যাসের গন্ধ। ভক করে বেরিয়ে এল জমা গ্যাস। সে নব ঘুরিয়ে দিয়েই সিলিন্ডারের কাছে নিচু হয়। না বন্ধ আছে। পুরোপুরি কিনা দেখার জন্য হাত বাড়িয়ে নবটি সামান্য ঘোরাতে ঘুরল সেটি। তখনই আবার ফোন বাজল।
ফোন বাজছিল। সুদামার মনে হল কৃষ্ণেন্দুর ঘুম ভেঙে যাবে। সে বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে ধরবে টেলিফোন। কিন্তু ফোন বেজেই চলে। কৃষ্ণেন্দু জাগে না। সে কিচেন থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-এর টেলিফোন তোলে, সুদামা বলছি, মিসেস চ্যাটার্জি স্পিকিং…
ওপারে নীরবতা। কানের কাছে চেপে ধরল সুদামা রিসিভারটি। সে আবার বলে, সুদামা বলছি, কে?
ওপারের টেলিফোন থেমে যেতেই তার গা ঠাণ্ডা হয়ে গেল আচমকা। হ্যাঁ, ফোনটা রেখে দিল। খুব ক্ষীণ হলেও সে তো কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিল। এখন দশটা চল্লিশ। পার্লামেন্ট নিউজ টেলিভিশনে। সুদামা চট করে টিভির সুইচ অন করল। ঠিক তাই। পার্লামেন্টে নিউজ পড়ছেন সেই পরিচিত মুখ, কলকাতার মেয়ে, বিবাহের পর পশ্চিম ভারতীয়। চমৎকার পড়েন উনি। উচ্চারণ খুব স্পষ্ট। এক সময়ে কলকাতার নামি গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করতেন। সুন্দরী, সুদর্শনা। পার্লামেন্টে বিজেপি-কংগ্রেস-কমিউনিস্ট সদস্যরা কে কী বলেছেন তার বিবরণ দিচ্ছেন। এই বিবরণই তো ভেসে আসছিল টেলিফোনের ভিতর দিয়ে ক্ষীণভাবে।
বিজেপি, আবার কোথায় একটা মসজিদ নিয়ে প্ররোচনাময় বিবৃতি দিয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল … একটার পর একটা নাম কানে আসতে থাকে সুদামার। বিজেপির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট জনতা সদস্যেরা কী বলেছেন তার বিবরণ দিচ্ছে সুদর্শনা।
অনিলবরণ লোকটা কী রকম! ও কি সত্যিই সুহাসকে রাগাবার জন্য ওই কথা বলছিল? আশ্চর্য! ওর কথা মনে পড়ল কেন সুদামার? লোকটা নাকি খুন নিয়েই ভাবে সব সময়। কতরকমভাবে মানুষ খুন করা যেতে পারে। মার্ডারের সাইকোলজি, রহস্যের জটিলতায় ওর খুব উৎসাহ। এমন পুরুষ মানুষের সঙ্গে কে থাকতে পারে? ওর বউ চলে গেছে বাপের বাড়ি। কঙ্কনার সঙ্গে সুদামার ভালোই পরিচয়। এই ফ্ল্যাটে দুই মেয়ে নিয়ে কতবার এসেছে অনিলবরণের বউ। কিন্তু অনিলবরণের সঙ্গে সে যে কবে ভালো করে দুটো কথা বলেছে, তা মনে পড়ে না।
অনিলবরণকে মনে পড়ল কেন তার? সুদামা কেমন যেন শিহরিত হয়। কৃষ্ণেন্দু এখন ঘুমিয়ে। সুদামা মেঝের কার্পেটে বসে। মাথার উপরে ছাদ, ছাদে কী চমৎকার গোলাপি রং। ঘরটিই গেলাপি। টিভির খবর পাঠিকার কন্ঠস্বর শুনছে সে। মুখ দেখছে না আর। তার চোখের সামনে হত্যা-বিলাসী অনিলবরণের মুখ ভাসে। লোকটা পিকিউলিয়ার। কথাটা মাঝেমধ্যেই বলে কৃষ্ণেন্দু। আজকাল এই রকম মানুষের দেখা পাওয়াই ভার। শেষ পর্যত যেখানে খুনিও খুনকে সমর্থন করে না, সেখানে অনিলবরণ খোঁজে খুনের প্রয়োগ-পদ্ধতির ভেতরে শিল্প-সুষমা! হাস্যকর! আসলে সকলে যে কথা বলে, অনিলবরণ তার বিপক্ষে চলে। বলে রক্তপাত মৃত্যু ব্যতীত কোন বড়ো কাজটা ঘটেছে পৃথিবীতে! সে মহাভারতের কথা তোলে, মহাভারত রামায়ণ থেকে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, পৃথিবীর নানান যুদ্ধ বিপ্লবের কথা তুলে তার কথার পিছনে যুক্তি সাজায়। বলে ভালোবাসা আংশিক সত্য, হিংসা সম্পূর্ণ সত্য। পৃথিবী থেকে ভালোবাসা কখনও যাবে না এই কথা বলে বহু মান্যজন, তারা ভাবের ঘরে চুরি করে। ভালোবাসার আয়ু কতদিনের? ভালোবাসাই যদি সত্য হত হিটলারের জন্ম হত না এ পৃথিবীতে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে নাৎসিরা ক্লান্ত হয়েছিল, তাদের মন বিকল হয়েছিল বলে শোনা যায় না। আসল সত্য হল পৃথিবীর থেকে হিংসা কখনও যাবে না। সত্য বলতে দোষ কোথায়? আসলে পৃথিবীতে মূল দ্বন্দ্ব তো হিংসা আর ভালোবাসার ভিতরে। বারে বারে হিংসা জিতে গেছে। ভালোবাসা হল হীনবল পিঁপড়ের মতো, তাকে টিপে মারতে কতক্ষণ? অনিলবরণ হিংসার পিছনে দাঁড়ায় তার যুক্তি নিয়ে।
কিন্তু এত রাতে লোকটার কথা মনে পড়ছে কেন? সে কি ওই দীর্ঘদেহী পুরুষটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল। ভাবতেই কেমন গুটিয়ে যায় সুদামা। কী বিচিত্র মানুষ। কঙ্কনার মতো মেয়ের সঙ্গে ওর বনছে না। কৃষ্ণেন্দু বলেছে, আসল কারণ হল অনিলবরণ চায় তার বউ আবার সন্তান দিক, তার মুখাগ্নির জন্য একটি পুত্র। মধ্যযুগের মানসিকতা লোকটার।
সুদামা টিভি বন্ধ করে। টেলিফোন যেখান থেকে আসছিল সেখানে টিভি চলছিল। এক নম্বর চ্যানেলে পার্লামেন্ট নিউজ। তাই কি? ওপরের ফ্ল্যাটে তো টিভি চলে সব সময়। এখনও চলছে। পার্লামেন্ট নিউজের পর বিজ্ঞাপনের গান। তা ভেসে আসছে নীচে। তা হলে পার্লামেন্ট নিউজটা কি ওপর থেকে কানে আসছিল? লাইনটা কি কেটে যাচ্ছে, নাকি রেখে দিচ্ছিল কেউ তার কন্ঠস্বর শুনে। যে বারবার ফোন করছে সে কি তাকে চাইছে না? কৃষ্ণেন্দুর ফোন? ডেকে দিতেও তো বলত তা হলে, ফোন কি খারাপ হল? তাও তো নয়। লাইন কেটে যাওয়ার ব্যাপার আর কেটে দেওয়ার ব্যাপার তো আলাদা করেই ধরা যায়। হ্যাঁ, টেলিফোনের ভেতর থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছিল, ওপরের টিভির শব্দ যদি হত আগে শোনেনি কেন?
সুদামা বসেই থাকে। চোখ জুড়ে যায় প্রায়। আবার কি টেলিফোন বাজবে?
না বোধ হয়। সে ক্রেডল থেকে নামিয়ে রাখে টেলিফোন। এনগেজড হয়ে থাকুক। মশারি তুলে ভিতরে ঢোকে। ঢুকতে ঢুকতে আচমকা সুদামার মনে হয় কেউ হয়তো খোঁজ নিচ্ছে কিছু। আজ তার গ্যাস ওভেনের নব খোলা ছিল, যে ওভেন বেশি ব্যবহার করা হয় না, সেটিই। পাশেরটা অন্যমনস্কের মতো জ্বালিয়ে দিলে ছোটোটা থেকে গ্যাস বেরোতে আরম্ভ করত। কেউ কি সেই খোঁজ …। অবাক হয়ে যায় সুদামা।
ছয়
সকালে কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, আবার ফোন এসেছিল?
হ্যাঁ তুমি তখন ঘুমিয়ে।
শুনছিলাম যেন, কেটে গেল?
না লাইন রেখে দিল। সুদামা বলল।
কৃষ্ণেন্দু চুপ করে থাকে। ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। টেলিফোন তো এইরকম আচরণ করেই থাকে উলটোপালটা লাইন চলে আসে। আবার লাইন কেটেও যায় বারবার। রেখে দেবে কে? কেন রাখবে?
রান্নার মেয়ে বিমলা এসে দ্বিতীয়বার চা দিয়ে গেল। সুদামার মনে পড়ল, বিমলা তুমি কি ওভেনের নব বন্ধ করনি কাল?
করেছিলাম তো! সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে অল্পবয়সী মেয়েটি, স্বামী পরিত্যক্তা, থাকে উলটোডাঙার বস্তিতে।
মনে করে দ্যাখো তো।
হ্যাঁ বউদি, করেছিলাম। বিমলার চোখ মুখের ভাবে কেমন অনিশ্চিত উত্তর।
কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, দুটো ওভেন তো একসঙ্গে জ্বালাও তুমি।
হ্যাঁ দাদা।
কৃষ্ণেন্দু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। কৃষ্ণেন্দু এই ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দিল। গ্যাস ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতেই হয়। সে জেরা করতে থাকে বিমলাকে। বিমলা কেমন কুন্ঠার সঙ্গে জবাব দিতে লাগল। সুদামার মনে হল বিমলা খুব ভয় পাচ্ছে। এর আগে দু-জায়গায় চাকরি খুইয়েছে মেয়েটা। কারণ অবশ্য কাজে অবহেলা নয়। বয়স। প্রখর যুবতি সে। এক সন্তানের মা। কাজে ঢোকার পর গল্প করেছে সুদামার সঙ্গে। উলটোডাঙার এক ফ্ল্যাট বাড়িতে কীভাবে বিপদে পড়েছিল সে। ঘটনার মধ্যে নতুনত্ব বিশেষ কিছু নেই। যা হয়ে থাকে। সহায়হীন যুবতি, কাছে ঘুর ঘুর করে বাড়ির পুরুষরা, সুযোগ খোঁজে, তৈরি করে নেয়। কাজের মেয়েদের দেখে মধ্যবয়সী পুরুষ বিনা ঝুঁকিতে লাম্পট্য করতে চায়। লাম্পট্যের ইচ্ছা আছে, সাহস নেই সুতরাং কাজের মেয়েকে ব্যবহার করা। অনায়াসে সামান্য কিছু হাতে গুঁজে দিয়ে ভোগ করতে চাওয়া। এই ফ্ল্যাটে তেমন কিছু হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কাজটা তো থাকতে হবে। কৃষ্ণেন্দুর প্রশ্নে বিব্রত হয়ে এলোমেলো জবাব দিতে আরম্ভ করেছে বিমলা। প্রথমে বলল, দুটো ওভেনই জ্বালিয়ে ছিল। পরে বলল, না না একটা, বলল আগে সে গ্যাস সিলিন্ডারের নব বন্ধ করে, পরে ওভেন — না, না তা না দাদাবাবু, আগে সিলিন্ডার, পরে উনুন, না না ইস আমি তো জানি দাদাবাবু, পাঁচ বছর কাজ করছি নানা বাড়িতে, সেই কবে থেকে গ্যাসে রান্না করছি, গ্যাস আমার খুব চেনা, গ্যাসের গন্ধও জানি আমি, আমার ভুল হবে না, একবার এফ ডি ব্লকে কী হল…। আমার ঘরে অবশ্য কয়লার উনুন, স্টোভও আছে… আবোল-তাবোল বকছে। শেষে তার সম্বিত ফিরল, একটু থেমে থেমে বলল, আগে সে উনুন বন্ধ করে, পরে সিলিন্ডার।
তখন ফোন বাজল। কৃষ্ণেন্দু উঠে ধরল। কে? আরে এবিজিসি!
সুদামা শক্ত হয়ে গেল। এত সকালে লোকটার ফোন। কাল রাত্তিরে কি ফোনটা সে-ই করছিল, সে-ই রেখে দিচ্ছিল? আচমকা মনে হল যেন তাই। সে উঠল। বিমলাকে নিয়ে কিচেনে ঢুকল। এখন গ্যাস জ্বলছে না।
বিমলা জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল বউদি?
তোমার উনুন খোলা ছিল।
গ্যাস বন্ধ ছিল?
সুদামা তাকিয়ে আছে বিমলার মুখের দিকে, তার মানে, তুমি কি ওভেন বন্ধ করো না?
না না না, তা কেন? বিমলা ভীত হয়ে পড়ে, আগে বন্ধ করি, দুটোই বন্ধ করি। বলছি গ্যাস বন্ধ থাকলে উনুন খোলা থাকলেও তো ভয় নেই।
ভয় আছে। সুদামা বলে।
কীরকম? বিমলা বুঝতে পারে না।
আছে ভয়, শোনো …। সুদামা বোঝাতে থাকে বিমলাকে। একদম ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে ডেমনস্ট্রেশন দেয়। ছোটো ওভেনের নব খোলা, চায়ের জল চাপালে বড়ো ওভেনে। গ্যাস সিলিন্ডার চালু করে দিয়ে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে বড়ো ওভেনের মুখে ধরলে। বড়ো ওভেন জ্বলে উঠল। জল গরম হতে লাগল, তখনও খেয়াল করনি যে ছোটো ওভেনের নব অন করা। গ্যাস বেরোচ্ছে। কী ভীষণ ব্যাপার বলো দেখি বিমলা!
বিমলা ভয় পায়, তা কেন হবে বউদি, খোলা উনুন দিয়ে গ্যাস বেরোলে গন্ধ পাব না?
না পাবে না। কী করে পাবে। তেল-মশলার গন্ধে মিশে যাবে। আর যদি অন্যমনস্ক হও, তুমি করেছিলে?
না না, আমি না, সত্যি বলছি আমি না। বিমলার চোখে কর্মহীন হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক ফুটে ওঠে, বিশ্বাস করুন।
সুদামা চুপ করে থাকে। বিমলা কাঁপছে ভয়ে।
বিমলা বলল, আমি তো ভালো করে দেখেশুনে তারপর যাই বউদি, আর ছোটো উনুন তো জ্বালাইনে, ওতে সময় বেশি লাগে।
কেন, দুটো একসঙ্গে হয়, শেষ পর্যন্ত তো সময় বাঁচে। গ্যাসে তো এই সুবিধে।
হতে পারে বউদি, কিন্তু আমার যে কী হয়, গলা জড়িয়ে যায় বিমলার, ভুল করে ফেলি, ডাল আর মাছ একসঙ্গে চাপিয়ে যেটাতে নুন দেওয়ার কথা সেটাতে চিনি দিয়ে দিই, আবার মিষ্টির জায়গায় নুন, মাছের ঝোলের জিরেবাটা আমি ডালে দিয়ে ফেলেছিলাম একবার। একসঙ্গে দুটো রান্নায় মন বসে না। কোনোটাই ভালো মতো হয় না, অভ্যাস নেই।
সুদামা অবাক, অভ্যাস নেই মানে, এখানেই তো এক বছর কাজ করছ।
এখেনে তো দুজনের রান্না, দরকার কী দুটো একসঙ্গে চাপানোর, আর সব জায়গায়, মানে এর আগে যেখানে যেখানে কাজ করেছি, রান্না তো করতে হয়নি, যদি করতে হয়েছে তো এই রকম ফেমিলি, রান্নার অভ্যেস তো একদিনের নয়।
বাড়িতে তো অনেক লোক তোমার?
কুন্ঠায় জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে বিমলা, মাথা কাত করে বলছে, হ্যাঁ মা বাবা ভাই বুন, আছে অনেক। কিন্তু আমার ঘরে তো গ্যাস নেই। কয়লার তোলা উনুনে একটাই রান্না হয় একবারে। আমি তো অনেকদিন ধরে রান্না করি। ওই অভ্যেসটা রয়ে গেছে। আর ওই ছোটো উনুনের অল্প আগুন পছন্দ হয় না আমার, গ্যাসের উনুনে দুটোই বড়ো থাকে না কেন?
সুদামার মনে পড়ল। এই একই কথা তার বড়ো-জা যুথিকা বলত, যখন তারা বেলগাছিয়া থাকত। হ্যাঁ ডানদিকের ছোটো ওভেনটা তারও খুব পছন্দ হয় না। সেও তো বড়ো একটা জ্বালায় না ওটা।
বিমলা বলল, আপনি বউদি ভুল করে — না না আমারও ভুল হতে পারে, মাপ করে দিন, তবে কিনা এরকম ভুল তো হয়নি আগে, তবে গ্যাসটা যখন বন্ধ ছিল, তখন নিশ্চিন্ত, এবার থেকে সব দুবার করে দেখে বেরোব।
সুদামা মাথা নাড়ে, ডানদিকেরটা খোলা রেখে বাঁদিকেরটা জ্বালানো তো বিপজ্জনক, গ্যাসে বেরোতে বেরোতে ঘরে জমে যাবে একটু বাদেই, যাক গে সাবধানে করো।
কিচেন থেকে বেরোতে বেরোতে সুদামা ভাবে সেই কি তা হলে ভুল করে? কিন্তু তারও যে অভ্যাস বড়োটি জ্বালানো। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে সে প্রথমে ডানদিকেরটা খুলেছে, পরে অভ্যাস মতো বাঁদিকেরটায় জল চাপিয়েছে। একজনের চায়ে আর কত জল লাগে। বাঁদিকের অনেকটা আগুনে দ্রুত জল গরম হয়ে গেছে। ডানদিকেরটা খোলাই রয়েছে। সে কি ভুল করে আগে ওভেন খুলে, তার উপরে পাত্র চাপিয়ে পরে সিলিন্ডারের নব ঘুরিয়েছিল। ফলে বড়ো ছোটো দুটো ওভেনই খোলাই রইল। সামান্যক্ষণ লাগল চা করতে, তাই খেয়ালও হল না খোলা রয়েছে ছোটো ওভেন। গ্যাস তো তারপর বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক মিনিট ধরে কাঁচা গ্যাস বেরিয়েছিল নিশ্চিত। খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়েও গিয়েছিল। সে যদি অনেকক্ষণ ধরে রান্না করত তা হলে হয়তো তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস জমে যেত ঘরের ভেতরে ধীরে ধীরে। তারপর আচমকা আগুন …। পেট্রোলিয়াম গ্যাসে শ্বাস নিলে কী হয়? ফুসফুস ফেটে যায়?
কৃষ্ণেন্দু ডাকল, তোমাকে ডাকছে অনিলবরণ?
কেন?
কৃষ্ণেন্দু রিসিভার কানে রেখে হাসছে, ও বলছে কাল সন্ধেয় কীসব আবোল-তাবোল বকেছে, অ্যাপোলজি চেয়ে নেবে।
আমাকে তো কিছু বলেনি। সুদামার ভ্রূ কুঞ্চিত।
তোমাকে না বলুক, বলেছে তো। ফোনটা ধরো।
তার জন্য আমার সঙ্গে কী কথা, যা শুনেছে সব তো ওই সুহাস।
আহা সে তো দুজনেই বলেছে, কিন্তু ও বলছে ওর মনে হচ্ছে কথাগুলো তোমার সামনে না হলেই ঠিক হত …
সুদামা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে, গতকালের সন্দেহটা আবার জেগে ওঠে তার ভেতরে, সে বলল, কাল রাতে কি অনিলবরণ —?
না, না ও তো বলছে ও করেনি।
সুদামা ফোনটা নিল কৃষ্ণেন্দুর হাত থেকে। কানে চেপে দাঁড়িয়ে থাকল। ওপারে অনিলবরণের কন্ঠস্বর। সুদামার মনে হল কাল এই ফোনই দুবার এল, দুবার কেটে গেল। সে জিজ্ঞেস করে, ফোনটা কেটে দিচ্ছিলেন কেন?
কই না তো! ওপারের কন্ঠস্বর জড়িয়ে গেল, কখন কাটলাম, ধরে আছি তো!
এখন নয়, কাল রাতে। সুদামা বলল।
না, না, আপনি ভুল করছেন। ওপারের কন্ঠস্বর কাঁপছে।
আমার তো মনে হচ্ছিল —
ওপারের মানুষ হাসছে, কী করে মনে হল আপনার, ডিড য়্যু এক্সপেক্ট মাই কল, আপনি কি ভাবছিলেন আমি ফোন করতে পারি?
সকালে যখন সন্ধের বিষয়ে নিয়ে ফোন করছেন, রাতে বাড়ি ফিরেও তো করতে পারতেন?
বাহ নেশা কাটতে যে রাত গেল।
কিন্তু কয়েকবার তো চেষ্টা করেছেন, ফোন বেজেওছে এ বাড়িতে। সুদামা বলল।
ওপারে অনিলবরণ চুপচাপ। তারপর আচমকাই জিজ্ঞেস করে, গ্যাস নিয়ে কী যেন প্রব্লেম হয়েছিল? কৃষ্ণেন্দু বলছিল।
ও কিছু না, রাখছি।
কী হয়েছিল, রেগুলেটর খারাপ?
আপনাকে বলেনি কৃষ্ণেন্দু?
না, বলছিল একটা প্রব্লেম। যাক গে মিটে গেছে তো। আমি আসলে বলতে চাইছি, সন্ধেয় অত চিৎকার করেছি …।
ও তো আপনার অভ্যেস।
ওপারে হাসি, হ্যাঁ, একটু বেসামাল হয়ে যাই সুদামা চ্যাটার্জি। সহজ হয়ে উঠতে চায় অনিলবরণ।
সুদামা ফোন রেখে দেয়। কৃষ্ণেন্দু স্নানে গেছে। সুদামা আবার কিচেনের দরজায়। বিমলা কড়া চাপিয়েছে। সুদামা ফিরে এল বেডরুমে। সেখান থেকে ব্যালকনিতে। তারপর হঠাৎ মনে হয় নীলকে চিঠি লিখতে হবে। কালই লিখবে ভেবেছিল, ভুলে গেছে সে।
সাত
ভুলে যাচ্ছে সুদামা। প্রায় দিন-সাতেক এসেছে ছেলের চিঠি। জবাবটা দেওয়া হয়নি। গতকালই লেখার কথা ছিল। একদম মাথায় ছিল না। অথচ এর আগে নীলের চিঠি দুপুরে এলে, বিকেলে সে উত্তর লিখতে বসত। নিজে লিখে জায়গা রেখে দিত কৃষ্ণেন্দুর জন্য। রাতে তাকে দিয়ে লিখিয়ে পরদিন নিজে হাতে পোস্ট করতে বেরোত। এখন যে কী হয়েছে! টানই চলে যাচ্ছে যেন! আগে, এই ফ্ল্যাট, বেহালার সরকারি আবাসন, নীলবিহীন ভাবাই যেত না। একদিন নীল ডালিমতলা কিংবা বেলগাছিয়া থেকে গেলে ফ্ল্যাট হয়ে যেত শূন্য। মনে হতো একজন নেই। এখন নীল যখন আসে, মনে হয় অতিরিক্ত কেউ একজন এসেছে, যে এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নয়। তার ফলে ফ্ল্যাটের স্বাভাবিকতা ভেঙে পড়ছে। নিঃঝুমতা ভেঙে যাচ্ছে। নীল না থাকলে কেউ যে একজন নেই তা আর মনে হয় না। মনেই হয় না নীলের জন্য বড়ো ব্যালকনিটা অপেক্ষা করে থাকে সন্ধেয়। বড়ো ব্যালকনিতে যে টেলিস্কোপ বসাবে। টেলিস্কোপে চোখ দিয়ে রাতের আকাশ দেখবে।
নীলের চিঠি রাখল কোথায় সে? নীলের চিঠির কাগজ খাম সাদা পায়রার মতো ডানা মেলে দূর পাহাড় থেকে এই সমতলে উড়ে আসে। খাম প্যাড সুদামা নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল ছেলেকে। সেই খামের উপর সুন্দর কিন্তু একটু অগোছালো অক্ষরে নাম ঠিকানা লিখে ছেলে যেন উড়িয়ে দেয় তার হোস্টেলের কাচের সার্শি খুলে। এতটা পথ, নানান ডাকঘর, নানান ডাককর্মীর হাত ঘুরে ঘুরে এসেও খাম একটুও ময়লা হয় না। বোধহয় অত দুধ-সাদা রঙে, সাত রঙের খাঁটি মিশ্রণে উদ্ভূত সাদায় ময়লা হাত ফেলতে সঙ্কোচ বোধ করে ডাককর্মীরা। সাবধানে ছোঁয়।
সুদামা সেই সাদা পায়রাটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এখন। কোথায় যে রাখল! আগে এমন হতো না তো। নীলের চিঠি চোখের সামনে টেলিফোন স্ট্যান্ডের একধারে। শুধু নীলের চিঠি থাকে সেখানে। যতক্ষণ না স্বামী-স্ত্রীর পাঠ সম্পূর্ণ হয় ততক্ষণ, তারপর জবাব লেখা হয়ে কলকাতার চিঠি ক্যুরিয়র কিংবা স্পিড পোস্টে জমা করা হয়ে গেলে নীলের চিঠি সুদামার নিজস্ব হেফাজতে চলে যায়। চিঠিগুলো সে জমিয়ে রাখে। দশ বছর বাদে নীল বড়ো হয়ে গেলে তার হাতে তুলে দেবে বাবা-মায়ের কাছে লেখা তার মনের বিবরণ। সুদামা এইভাবেই ভেবে রেখেছে।
কোথায় গেল? টেলিফোনের পাশে নেই। এখানেই কি রেখেছিল, নাকি অন্য কোনো জায়গায়? সুদামা ঘরের বাইরে লিভিং স্পেসে যায়, খবরের কাগজের স্ট্যান্ডের উপরটা দ্যাখে। গুটিকয় ম্যাগাজিন এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সুদামা। এমন তো হওয়ার কথা নয়। নীলের চিঠি তো যত্নে রাখে।
সুদামা ডাকল বিমলাকে, চিঠিটা কোথায় গেল জান বিমলা?
বিমলা আঁচলে হাত মুছতে মুখ বাড়ায় কিচেন থেকে, কী চিঠি?
সুদামা জবাবা না দিয়ে আবার ঘরে ভেতরে এল। বিছানার চাদর তোশকের কোণ উলটে দেখল। না। বিছানার নীচে তো সে রাখে না কোনোদিন। সুদামা আবার বাইরে এসে ম্যাগাজিনগুলো উলটোতে লাগল। একটি পত্রিকা দিল্লির তন্দুর হত্যা নিয়ে বিস্তৃত রিপোর্ট ছেপেছে। দু-দিন আগে সে পড়ছিল দুপুরে, তার ভেতরে নীলের চিঠি লুকিয়ে গেল নাকি? পরপর করে পাতা উলটোতে থাকে সুদামা। নীলের চিঠির খোঁজ নেই। সুদামা হাতে ম্যাগাজিনটা নিয়ে আবার ঘরে আসে। বিছানার উপর ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে দেয়। অবাক লাগছে। নীলের চিঠি কি সে ফাইল বন্দী করে ফেলেছে? পুরোনো চিঠির ভেতরে চালান করে দিয়েছে ভালোভাবে না পড়ে, জবাব না দিয়ে? হ্যাঁ, ভালোভাবে পড়া হয়নি, কেন হয়নি তা বুঝতে পারে না সুদামা। তবে হ্যাঁ, ওই যে নীল লিখেছে, মাম, এবারে সামার ভ্যাকেশন কলকাতা নয়। ওইটুকু পড়ে সে রেখে দিয়েছিল। প্রথম পঙক্তিটিই তাকে আচমকা নিস্পৃহ করে দিয়েছিল। পরে তো অনেক কথা লিখেছে তার সন্তান। সেগুলিও তো পড়তে হবে। সামার ভ্যাকেশনের তো দেরি আছে। আর ক-দিনেরই বা ভ্যাকেশন। আসলে ফাইনাল একজাম হওয়ার পরে কয়েকটি দিন ছুটি। ওই হিল স্টেশনে তো সামারই সবচেয়ে ভালো ঋতু। সুন্দর ঋতু। কিন্তু মা-বাবার কাছে আসার সময়ের চেয়ে সুন্দর ঋতু আর কী হতে পারে?
স্নান শেষ করে কৃষ্ণেন্দু বলে, অনিলবরণের সঙ্গে কথা বললে না?
হ্যাঁ, কিন্তু নীলের চিঠিটা কোথায় রেখেছি বলো তো? জবাব দেব, চিঠিটা পাচ্ছি না।
কৃষ্ণেন্দু বলল, ও তো আমার ব্যাগে।
রাগ করল সুদামা, বলবে তো।
পড়ব বলে নিয়েছি।
দাও, জবাব লিখব।
কৃষ্ণেন্দু গায়ে শার্ট পরতে পরতে বলে, পড়া হয়নি আমার।
পড়া হয়নি? অবাক সুদামা।
না, সময় পেলাম কই, ও এই সামারে আসবে না বলছিলে না?
পড়ে দ্যাখো। সুদামা ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায়।
আজ পড়ে ফেলব, হ্যাঁ অনিল কী বলল। কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, ও কেমন যেন, তাই না?
সুদামা ঘুরে তাকায়, ফোন ও-ই করেছিল রাতে।
তাই! বলল সে কথা?
বলেনি, কিন্তু মনে হল যেন।
মনে হল মানে? কৃষ্ণেন্দু কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেল।
মনে হল মানে মনে হল, সব ঘটনার অকাট্য প্রমাণ তো হয় না, আন্দাজ করছি ও-ই টেলিফোন করছিল।
কৃষ্ণেন্দু হাসে, ও কেন খামোকা ফোন করে লাইন কেটে দেবে?
সুদামা বলল, খবর নিতে চাইছিল।
তার মানে?
ওই লোকটা সুবিধের নয়। ওকে আমি কোনোদিনই পছন্দ করি না। ওইরকম একটা হিংস্র প্রকৃতির লোকের সঙ্গে কী করে যে তোমার বন্ধুত্ব হয়। সুদামা বলে।
কৃষ্ণেন্দু হাসতে থাকে, আরে ওসব ও এমনি বলে। আজকে তো প্রথম বলছে না?
বলবে কেন, কোন কথা বলতে নেই তা জানে না, ও কাল রাত্তিরে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল না বলেই হয়তো ফোন রেখে দিচ্ছিল, অথবা—।
কৃষ্ণেন্দু ঠিক ধরতে পারে না সুদামা কী বলতে চাইছে। অনিলবরণ কেন ফোন করে লাইন কেটে দেবে? কী খোঁজ নেবে? সে যতটা জানে অনিলবরণের নারী-সংক্রান্ত কোনো দুর্বলতা নেই। সে পছন্দই করে না মেয়েদের। বন্ধুর স্ত্রীকে বিরক্ত করার মতো মানুষ অনিলবরণ নয়। হ্যাঁ সুদামার তো অপছন্দ হতেই পারে, অনেকেরই হতে পারে যখন অনিলবরণ নরহত্যার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করতে চায়, খুনির পক্ষে কথা বলে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, আসলে অনিলবরণ কিন্তু ভিতু মানুষ, প্রচুর থ্রিলার পড়ে ওর মাথা বিগড়ে গেছে, আবার এর ভিতরে ওর চালাকিও আছে, ওইসব কথা বলে ও লোককে রাগিয়ে দিতে চায়, ত্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত মানুষ দেখতে ওর ভালো লাগে।
আরও অনেক কিছুই ভালো লাগে, আমার ধারণা বারবার ফোন করে ও খোঁজ নিতে চাইছিল কোনো কিছুর, না হলে সকালে ফোন করবে কেন? কী দরকার, একটু বাদেই তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে, সকালে ফোন করে হতাশই হয়েছে মনে হয়। অ্যাপোলজি-টজি ফালতু কথা। ও একটা ব্যাপার ঘটাতে চেয়েছিল মনে হয়। চতুর। থ্রিলার, ক্রাইম স্টোরি লিখতে লিখতে ও নিজেই ক্রাইম ঘটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল —।
কী আবোল-তাবোল বকছ তুমি! এবার কৃষ্ণেন্দু রেগে ওঠে।
সুদামা বলল, ঠিক-ই বলছি।
কৃষ্ণেন্দু বলে, তুমিও দেখছি অদ্ভুত সব কল্পনা করতে আরম্ভ করেছ। অনিলবরণের মতো।
সুদামা চুপচাপ। তার যা মনে হচ্ছে, যে সম্ভাবনার কথা ক্ষীণ হয়ে মাথায় উঁকি মারছে, তা তো অনিলবরণকে জড়িয়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটি কাল্পনিক দৃশ্য। তার আগের দৃশ্যটি তো তার জানা। সুহাস আর অনিল আচমকা উঠল। সুহাস আবার বসে পড়ল। কমবয়সী সুহাস এতই রেগে গিয়েছিল যে অনিলবরণের সঙ্গে যেতে চায়নি। এইটুকু জানা। অনিলবরণ উঠল। সুদামা তখন ব্যালকনিতে বসে। একা একা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল মানুষটা। ঘর থেকে সদর দরজায় যাওয়ার মধ্যে ঘটে গেল আর একটা ব্যাপার, সকলের অলক্ষে। সুদামা শক্ত হয়ে যায়। তার শীত করে যেন। মানুষটা কি খোলা কিচেনে ঢুকে পড়ল। নেশায় টলমল পা। একটু খেলা করে চলে গেল। নেশার জন্যই সবটা ঠিকঠাক করা হয়ে ওঠেনি ওর। তারপর বাড়ি গেল। অনেক রাতে ফোন। ফোনে খোঁজ নিতে লাগল, আন্দাজ করতে লাগল। শান্ত ঘরে শান্ত কন্ঠস্বর শুনতে তো চায়নি ও। সুদামা ভাবতে ভাবতে বসে পড়েছে কার্পেটে। বিমলা ঢুকল কৃষ্ণেন্দুকে ডাকতে। খেতে দিয়েছে। ডাকল সুদামাকেও।
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে সুদামা বলল, চিঠিটা রেখে যাবে।
সঙ্গে থাক, পড়ে নিই। কৃষ্ণেন্দু বলে।
আট
কথাটা হাসতে হাসতে বলেছিল কৃষ্ণেন্দু, বয়স হচ্ছে, এখন ওসব ছাড়ো দেখি অনিল, তোমার ঠাট্টাগুলো কেউ আর ঠাট্টা বলে ভাবে না।
ভ্রূ ভাঁজ হয়ে গেছে অনিলবরণের, কোন ঠাট্টা?
নেশা করে সেদিন যা বলেছ।
অনিলবরণ বলল, সে তো খুব খারাপ ব্যাপার হয়েইছে, আমি তো সেইজন্যই ফোন করলাম সকালে, একজন মহিলার সামনে এসব আলোচনা কি ঠিক? ঠিক নয়।
ঠিক নয় তো বললে কেন ওসব? কৃষ্ণেন্দু বলে।
বলে ফেলেছি, সুহাসই তো কথা তুলল, কেন সুদামা কি কিছু বলেছে?
ও তো খুব রেগেই গেছে, বলছে তুমি একদিন ক্রাইম করে ফেলবে।
হা হা করে হাসছে, অনিলবরণ, করতে তো ইচ্ছেই হয়।
কৃষ্ণেন্দু অবাক হল, সত্যি বলছ?
কেন, তোমার ইচ্ছে হয় না?
পাগল। অনিলবরণের মাথার ভিতরে কলকব্জা বিগড়ে গেল নাকি। তা হলে কি সুদামার সন্দেহটা ঠিক! গ্যাস ওভেন অন করে চলে গিয়েছিল অনিলবরণ।
কৃষ্ণেন্দু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
কিছু বলবে আর? অনিলবরণ জিজ্ঞেস করে।
তা হলে তো সুদামা মিথ্যে বলেনি, আচ্ছা তুমি কি রাতে ফোন করছিলে?
না তো! অনিলবরণ যেন চমকে ওঠে, কী ব্যাপার বলো দেখি, সুদামাও জিজ্ঞেস করছিল, রাতে কে ফোন করছিল!
লাইন রেখে দিচ্ছিল বার বার।
অনিলবরণের চোখ-মুখে রহস্য আবিষ্কারের আবেশ, আমেজ। সে সিগারেট ধরিয়ে কৃষ্ণেন্দুকে বলে, তুমি চা খাবে?
না, না আমার সময় নেই, উঠব এখনই।
আরে রাখো তো তোমার কাজ, আচ্ছা কী হয়েছিল তোমার ফ্ল্যাটে, গ্যাস ভরতি হয়ে গিয়েছিল? বললে না তো টেলিফোনে।
কৃষ্ণেন্দু অনিলবরণকে জরিপ করে। লোকটা কি খুনি? সত্যি সত্যি চায় যে মানুষ খুন হয়ে যাক। তার এই সহকর্মী কি খেলার ছলে ওভেনের নব অন করে চলে এসেছিল? সুদামা তো বলছে সেই কথা। সুদামার কথাটা অবশ্য আন্দাজে। সে মনে করছে তাই। সে বলছে অনিলবরণই রাতে রিং করে আন্দাজ করতে চেয়েছিল ফ্ল্যাটে কী হচ্ছে। ফ্ল্যাটে আগুন ধরল কিনা। ঠিক এই ভাবেই ক-বছর আগে এক অভিনেত্রী পুড়ে মারা গিয়েছিল। তার কিচেন ভরতি হয়েছিল কুকিং গ্যাসে। ভেতরে গিয়ে দেশলাই ঠুকে দিতেই ফ্ল্যাট জ্বলে ওঠে।
অনিলবরণ জিজ্ঞেস করে, কী হল কথা বলছ না কেন? কী ভাবছ?
কৃষ্ণেন্দু বলে, তুমি যা বলো সত্যিই কি তা বিশ্বাস করো?
কী কথা?
ভায়োলেন্স, মার্ডার, ডেথ?
অনিলবরণ বলে, মার্ডার! আচ্ছা তোমার ভালো লাগে না ভায়োলেন্স?
সিনেমা, বইয়ের ভায়োলেন্স কি সত্যি বলে ভাবে কেউ?
অনিলবরণ বলে, আমার রক্ত গরম হয়। আসলে কী জানো মার্ডার নিয়ে আমি সত্যিই ভাবি, এমন ভাবে একটা খুন হবে, যাতে হত্যাকারীর পরিকল্পনার বৈচিত্র্য তোমাকে মুগ্ধ করবে, হত্যাকারী যে কতটা ইনোভেটিভ তা তুমি টের পাবে। আমি চাই সেইরকম একটা উপন্যাস লিখতে। হ্যাঁ ফ্ল্যাটে কী হয়েছিল?
কৃষ্ণেন্দু বলল, কেউ একজন ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক চেয়েছিল লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসে ফ্ল্যাট ভরতি হয়ে যাক।
চমকে ওঠে অনিলবরণ, তার মানে?
তাই-ই হয়েছিল, ওভেনের নব খোলা, সিলিন্ডারটি একটু বাঁকানো ছিল, নবটা ভেতরের দিকে, খুঁজে পায়নি বোধহয়। সিলিন্ডার বন্ধ ছিল।
অনিলবরণের দাঁতে ঠোঁট, সে যেন কী ভাবছে, তারপর বলল, আমিও ঠিক এই রকম ভাবছিলাম, শোনার পর থেকে এইরকম মনে হচ্ছিল আমার। আমি ভাবছিলাম এটাও মার্ডারের একটা দারুণ উপায় হতে পারে। শোনার পর প্রথমে ভাবলাম রেগুলেটর খারাপ হতে পারে, তা থেকে গ্যাস লিক করছে। পরে যা শুনেছি, এখন যা শুনছি মনে হচ্ছে আচমকা একটা সূত্র পেয়ে গেলাম আমি।
কৃষ্ণেন্দু বলল, সূত্র পাওয়ার কিছু নেই। ওভেনের আগে সিলিন্ডার বন্ধ করে আর ওভেন বন্ধ করেনি সুদামা বা আমার মেডসারভেন্ট। এটা একটা মিসটেক। আর এমন ভুল হয়েই থাকে, সুদামা শুধু শুধু ব্যাপারটাকে ঘোলা করছে। বলতে বলতে ওঠে কৃষ্ণেন্দু। তার মনে হচ্ছিল এ নিয়ে কথা বলা রুচি-গর্হিত ব্যাপার হবে।
আরে উঠছ কেন, বসো। অনিলবরণ উঠে হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণেন্দুকে চেয়ারে বসিয়ে দেয় আবার, সবে জমে উঠছে রহস্য, তুমি উঠে যাচ্ছ। চা খাও।
বেয়ারা ডেকে চায়ের কথা বলে অনিলবরণ ঘোষচৌধুরী সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে ধরে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। নাও, মগজে ধোঁয়া দাও। তুমি তো সত্যিই একটা মার্ডার স্টোরির কথা বলছ, হ্যাঁ একজন গ্যাস সিলিন্ডার এবং ওভেন অন করে কিচেনের দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। তারপর ভিকটিম হয়তো জ্বলন্ত সিগারেট, মহিলা হলে কিচেনে ঢুকে ওভেনে — আচ্ছা গন্ধ তো পাবে, ঢুকলেই তো টের পাবে? তোমার কি মত?
কৃষ্ণেন্দু বলল, আমার কোনো মত নেই, খুন নিয়ে আলোচনা করতে, পরিকল্পনা করতে আমার ভালো লাগে না, তুমি কি পাগল! এসব নিয়ে ভাবো কেন?
অনিলবরণ বলে, ভাবতে ভালো লাগে।
তোমার ওয়াইফ ফিরেছে?
অনিলবরণ অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ে, বিড়বিড় করে, কঙ্কনা ইদানীং আমাকে পছন্দ করছে না, আর আমার ইচ্ছে আর একটা বেবি, ও বলছে হবে না। দুই মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি।
কৃষ্ণেন্দু হাসে, এটা কোনো সমস্যা হল, তোমারই তো দোষ, আবার বাচ্চা, দুটোতে হচ্ছে না, তোমার বউ তো ঠিক বলছে।
অনিলবরণ বলল, একটা ছেলে হলে খারাপ হত?
এই বয়সে ছেলে। হাসতে থাকে কৃষ্ণেন্দু, পারো বটে, যাও শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিয়ে এসো ওদের।
অনিলবরণের ঘরে চা আসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে বলল, ওভাবে তো মার্ডার করা যায়, যায় না?
কৃষ্ণেন্দু বোঝে তার শেষের বাক্যগুলি শোনেনি অনিলবরণ, তার মাথার ভেতরে আবার মার্ডার-মিস্ট্রি ঢুকে গেছে। সুদামাই-বা কী করে ভাবল কাজটা অনিলবরণের? ওভেন খুলে দিয়ে বাড়ি গিয়ে অনেক পরে ফোন করছিল। কিন্তু নিরুত্তাপ কন্ঠস্বর শুনে টের পেয়েছে তার পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সুদামার মাথার ভেতরটাও যেন বিগড়েছে। চা খেয়ে কৃষ্ণেন্দু ওঠে। তাকে আর বসাতে পারে না অনিলবরণ।
একা রহস্য ঔপন্যাসিক জানালা দিয়ে রোদে পোড়া আকাশের দিকে তাকায়। মনে হয় যেন আকাশই সব জানে। আকাশই বলে দিতে পারে পরিকল্পনাটা কেমন হতে পারে। আচ্ছা কুকিং গ্যাসের গন্ধতেই তো টের পেয়ে যাবে ভিকটিম, যদি না সে খুব উদ্বিগ্ন থাকে, ডিস্টার্বড থাকে, যদি না তার মনে খেলা করে অন্য কোনো বিষয়। ভাবতে ভাবতে কিচেনে ঢুকে সিলিন্ডার অন করতে গিয়ে অন করা দেখেও তখন তার মনে কোনো সন্দেহ আসবে না। সে ওভেনের নবে হাত দিয়েও অন্য প্রসঙ্গে জড়িয়ে থাকবে মনে মনে, তারপর দেশলাই জ্বালতেই ঘর আগুনে ভরতি। খুন সম্পন্ন হল। একজন খুন হয়ে গেল।
সুদামা যেভাবে ভেবেছে, কৃষ্ণেন্দু যা ভেবেছে তা কি টের পায়নি অনিলবরণ? প্রকারান্তরে তাকেই যেন সন্দেহ করল। সন্দেহ তার উপরে পড়ায় অনিলবরণের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনার জন্ম হল। সে পর পর সিগারেট ধরায়। তার মনে হল ওভাবে হতে পারে। কিন্তু তার জন্য ভিকটিমকে থাকতে হবে চরম অসতর্ক। তার চেতনায় বাস্তবতা তখন, সেই মুহূর্তে, যেন ধীরে ধীরে অপসৃত হবে। এই রকম কোনো পরিবেশ হলে তবে হতে পারে তা। তা হলে খুনিকে আর একটা কাজ করতে হয়। তার শিকারকে অসতর্ক, উদ্বিগ্ন করে তোলা। সুদামা কি সেইদিন তেমন ছিল? তার আর সুহাসের তর্কে সুদামা নিজে হয়ে উঠেছিল উত্তেজিত, ফলে অসতর্ক। তা হলে তো ঘটেও যেতে পারত ভয়ংকর কিছু, যদি সিলিন্ডার খোলা থাকত, কিচেনে জমে থাকত গ্যাস।
অনিলবরণ সাদা কাগজে ডটপেন দিয়ে নানারকম আঁকিবুকি কাটে। নানারকম ভাবে। বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, ভিকটিম অসতর্ক, উদ্বিগ্ন, কোনো কারণে উত্তেজিত থাকবে না। স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু তার কিচেন ভরতি হয়ে আছে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসে। তখন আলো নিভল, হয়তো লোডশেডিং বা কেবল ফল্ট। না, তা হবে না। কোনো পরিকল্পনার সঙ্গে আকস্মিকতাকে জোড়া যায় না। খুনিকে কেউ সাহায্য করে না। খুনির কোনো ভাগ্য নেই। ভাগ্য বলে খুনি কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারে না। সবই তাকে নিজে করতে হয়। নিখুঁত পরিকল্পনায়। একেবারে একা একা। ফ্ল্যাটের ইনভার্টার খারাপ, এমারজেন্সি লাইটও খারাপ, কারণ তা এখন ব্যবহার হয় না। লোডশেডিং তো উঠেই গেছে। এখন বিদ্যুৎ অতিরিক্ত। এখানে যা হতে পারে, তা হল হত্যাকারী নীচে নেমে মেইন সুইচটা অফ করে দিল। আলো নিভতেই হতচকিত ফ্ল্যাটের দুই মানুষ, স্বামী-স্ত্রী। কোনো রকমে একটি মোমবাতি জোগাড় হল এখানে ওখানে খুঁজে। তা জ্বালিয়ে অনেক পুরোনো লন্ঠনের খোঁজ করতে পারে স্ত্রী। তা আছে কিচেনের সেলফে। মোমবাতি হাতে কিচেনের দরজা খুলতেই আগুন জ্বলে গেল বাতাসে ভাসা গ্যাসে।
ভাবতে ভাবতে শিহরিত, উত্তেজিত হয় অনিলবরণ। উত্তেজনায় সে ঘেমে যায়, তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে ওঠে। শরীরে ভাঙতে চায় যেন। অনিলবরণ চেয়ার থেকে উঠে তার অফিস চেম্বারের অপরিসর খালি জায়গাটিতে পায়চারি করতে থাকে। তারপর কী হল? হত্যাকারী বাড়ি ফিরে গিয়ে ফোন করল। ফোন বেজেই যায়। অথবা ফোন বাজেই না। বাজে না কেননা তখন আগুন ছড়িয়ে গেছে ফ্ল্যাটটির সব ঘরে। টেলিফোন পর্যন্ত পুড়ে গেছে। অথবা ফোন কেউ তোলে, স্বামী, খবরটা দিল। কন্ঠস্বরের উত্তেজনাতে ধরা গেল কিছু হয়েছে। ফোন রেখে দিল অপরাধী।
এইভাবে হত্যা যদি করা হয় তা কি নতুন ধরনের কিছু হবে? লোকে তো ধরবে এটি দুর্ঘটনা। সূত্র একটি, সূত্র আছে, প্রথমত হত্যাকারী সেই সন্ধ্যায় ওই ফ্ল্যাটে ছিল। আর ফোন এসেছিল একটা। সেই ফোনটি বেজেছিল, কিন্তু ফ্ল্যাট থেকে সেই ফোন তোলা হলে ওপারে লাইনটি কেটে দিয়েছে কেউ। সে অপরাধী, জানতে চাইছিল তার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে কিনা।
সব গোলমাল হয়ে যেতে থাকে অনিলবরণের। তার মনে হতে থাকে সুদামার সন্দেহটা একেবারে অমূলক নয়। সন্দেহ করতেই পারে। ওই সন্ধ্যায় যদি খুনের এই বিচিত্র পরিকল্পনাটা মাথায় আসত, তা হলে তো সে এই পরিকল্পনাটা যাচাই করে নিত সুদামার কাছে। আলোচনা করত তার সঙ্গে।
অনিলবরণ টেলিফোনের সামনে যায়। কিন্তু ডায়াল করতে তার হাত কাঁপে। সে ভাবছে জিজ্ঞেস করবে সুদামাকে এমন আশ্চর্য বিষয়টি তার মাথায় এল কী ভাবে? সেও কি নানারকম খুনের কথা ভাবে? অনিলবরণ অনেকদিন আগে তার একটি উপন্যাস পড়তে দিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু-সুদামাকে। কেউই পড়ে উঠতে পারেনি। তাতে তো শুধু রিভলবার পিস্তলের ব্যবহার ছিল। না, ওই বইটা পড়তে হবে না সুদামাকে। নতুন উপন্যাস সে আরম্ভ করবে খুব শিগগির। সেই উপন্যাসে মৃত্যু নিয়ে তার নিজস্ব মতামত থাকবে।
অনিলবরণ সিগারেট ধরিয়ে ঘরের বাইরে আসে। লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। করিডোরটাকে কেমন রহস্যময় মনে হয় তার। ফালি ফালি আলো, অন্ধকারে ঢাকা। এপার থেকে ওপারের মানুষকে ঠিক চেনা যায় না। এমন একটি করিডোরকে হত্যাকাণ্ডে চমৎকার ব্যবহার করা যায়। খুনি বেরিয়ে যাচ্ছে কাজ শেষ করে। তার জামার রং সবুজ। দূর থেকে জামার একটি কোণ দেখা যায়। যে লোকটিকে দেখে মনে হয় তার গাত্রবর্ণ অন্ধকারের মতো কালো —।
এ সব কী ভাবছে সে! এ তো অন্য গল্প, অন্য খুন। সুদামার বানানো গল্পটির সঙ্গে এর মিলটা কোথায়? অনিলবরণ করিডোর ধরে হাঁটে একটির পর আর একটি খুনের কথা ভাবতে ভাবতে। খুনের পিঠে খুন চাপাতে গিয়ে বিভ্রমে পড়ে যাচ্ছে সে। চিন্তা গুলিয়ে যাচ্ছে। গুনগুন করতে থাকে সে, চাঁদের পরে চাঁদ লেগেছে …। গুনগুন করতে করতে হাঁটে।
নয়
অনিলবরণের দেওয়া রহস্য উপন্যাসটি ছুঁয়েও দেখেনি সুদামা। পড়ার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। হাস্যকর, অগভীর, অহেতুক মারদাঙ্গা, যৌনতা। একেবারে মার্কিন থ্রিলার ভারতীয় ছদ্মবেশে।
আজ হঠাৎ কী খেয়াল হয়েছে অনিলবরণের বই হাতে নিয়ে সোফায় কাত হয়েছে সে। বইটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল বইটা। আজ পুরোনো খবরের কাগজ বিমলার হাতে চালান করার সময় হারানো রহস্য উপন্যাস অগভীর জলাশয়, কাদা-পাঁক ভরতি ডোবার মধ্যে থেকে হুস করে মাথা তুলল। ধুলো ঝেড়ে সেই মহাগ্রন্থে মনোনিবেশ করতে চায় সুদামা। আসলে এ ছাড়া কী বা করার আছে তার। খেয়াল পূরণই তো সময় কাটানোর উপায়। এই দীর্ঘ দুপুর নিয়ে তার কোনো পরিকল্পনা থাকে না। দীর্ঘ দুপুর, দুপুরের আগে অনেকটা সকাল, দুপুরের পর অনেকটা বিকেল, সন্ধেয় তার কাজের, অকাজের কোনো নিয়ম থাকে না। আর এই নিয়ম নেই বলেই বই পড়ার অভ্যেসও চলে যাচ্ছে। যেমন চলে যাচ্ছে অনেক রকম অভ্যাস। একটা কাজে থাকলে আর একটা কাজে উৎসাহ হয়। উৎসাহই নেই যেন। ফেব্রুয়ারির শেষে নার্সিংহোম থেকে ফিরে কদিন ডায়েরি লিখতে চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু কী লিখবে? তার ঘরের ধুলোবিহীন চকচকে হালকা গোলাপি দেওয়ালের কথা, সিলিং ফ্যানগুলির কথা, টেলিভিশন, ভি সি আর-এর কথা! টেলিফোনের কথা, ওয়াশিং মেশিন গ্যাস সিলিন্ডারের কথা। সেই ডায়েরির পাতা সাদা রয়ে গেছে। পড়তে পড়তে মনে হয় আরও কিছু কথা লিখে রাখে — যে সব কথা কৃষ্ণেন্দুকে বলতে পারেনি সেইগুলি। যে সব কথা কৃষ্ণেন্দুকে বলেছিল, সেইগুলি।
যেমন নারীর শরীর। প্রকৃতির দেওয়া শরীর নষ্ট করতে চায় না সে। এবারই তো কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, তা হলে সামান্য অপারেশনটি হয়ে যাক। তা হলে সুদামার আর ভয় থাকবে না কনসিভ করার। তা নিয়ে তর্ক হয়েছিল। প্রকৃতি যা দিয়েছে, প্রকৃতিই তা ফিরিয়ে নেবে, বয়স হলে তো সব আপনা আপনিই যাবে। সে রাজি হয়নি। আর রাজি হয়নি মানে কি তার মাথার ভিতরে গোপন ইচ্ছেগুলি এখনও ঘুমিয়ে আছে। সে আরও সন্তান চায়। এসব কিছুই লেখা হয়নি তার। একা একা কী-ই বা ভালো লাগে। এখন নয় তখন লিখব করতে করতে কিছুই হয়নি। সুদামা পাতা উলটোচ্ছে অনিলবরণের উপন্যাসের।
সে কখনও ভাবতেই পারেনি এই উপন্যাস নিয়ে দুপুর কাটাতে হতে পারে। বই পড়ার ইচ্ছেগুলি চলে গেলে মাঝে মধ্যে খেয়াল চাপলে এসবই নেড়ে-চেড়ে দেখে মানুষ। পড়তে পড়তে সুদামার হাসি পায়, অবাক হয় সে। কীভাবে লিখল এসব অনিলবরণ। কোত্থেকে জোটাল এইসব পাত্রপাত্রীদের?
বই রেখে দিয়ে চুপ করে বসে থাকল সুদামা। ডায়েরির পাতা ফরফর করছে সিলিং ফ্যানের হাওয়ায়। ধুস! লিখতেই ভালো লাগে না। অভ্যাসটাই চলে গেছে। না হলে এই ভয়াবহ উপন্যাস পাঠের প্রয়াস সম্পর্কেও তো সে লিখতে পারত। কৃষ্ণেন্দু তাকে শিখিয়েছিল ডায়েরি লেখা, কৃষ্ণেন্দুই যেন নিয়ে নিয়েছে সেই অভ্যাসটি —অথবা স্বাভাবিকভাবে, অনভ্যাসের কারণে ডায়েরি হারাচ্ছে মন থেকে। যেভাবে যৌবন যায় সেই ভাবেই যেন চলে যাচ্ছে মনের অক্ষরগুলি।
সুদামার দিনযাপন এখন এইরকম। নানা অনভ্যাসের অভ্যাস। তার দিনযাপনে কোনো রং নেই, সেই অনুভূতিময়তা নেই, যা আসে রক্তের ডাক থেকে। তার সন্তান নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। সন্তান পালনের কোনো অভ্যাসই নেই তার। তা হতো হয়তো, হয়নি। নিঃঝুম ফ্ল্যাট এখন আরও নিঃঝুম। সিলিং ফ্যানের সূক্ষ্ম শব্দের সঙ্গে হার্টবিট অহেতুক পাল্লা দিতে চায়। পারে না। বয়স বাড়লে হৃদয়ের শব্দও তো বিলম্বিত হয়, হয়ে যায়। একটি ধ্বনির সঙ্গে আর একটি ধ্বনির তফাত হয়ে যায় অনেক —তাই-ই যেন হচ্ছে ক্রমাগত।
টেলিফোনটা বেজেই থেমে গেল। সুদামা উঠতে গিয়েও উঠল না। যদি আবার বাজে। বাজল না। ভুল লাইন আচমকা চলে এসেছিল এদিকে। সে আবার চোখ দেয় অনিলবরণের রহস্যে। এই উপন্যাসের পুরুষ রহস্যভেদী, ঠিক তাও নয়, যেন রহস্য উদ্ধারে অভিযাত্রী মানুষটি, নিজেই একের পর এক খুন করে যাচ্ছে আসল খুনিকে ধরার জন্য। খুন যেন জলভাত। কল্পনা শক্তিও আছে বটে লোকটার, বিচিত্র সব খুনের বিবরণ। মানুষ খুন অতই সহজ। খুনে কোনো বিকার নেই খুনির সন্ধানে বেরোনো রহস্যভেদীর। সুদামার যে কী হল। বইটি হাতে করে কিচেনে এল। ভাবে দেশলাই ঠুকে দেয়। গ্যাস ওভেন জ্বালিয়ে তার উপর ধরে বইয়ের পাতাগুলো। কিন্তু বই তো প্রাণে লাগে। সে বুকে করে ফেরত এল আবার।
কাল রাতে কৃষ্ণেন্দু বলছিল, অফার আসছে।
কী অফার?
না যে সব বহুজাতিক সংস্থা এখানে ব্যবসা করতে চায়, তাদের কাছ থেকে। যেমন এল পি জি সংস্থা এসেছে।
তারপর?
প্রচুর মাইনে, এখন যা পায় কৃষ্ণেন্দু তার দ্বিগুণ, তিনগুণের কাছাকাছি। ভাবাই যায় না যে ওর কত সুযোগ দিতে পারে। ওরা তো প্রফিট ওরিয়েন্টেড কোম্পানি, লাভের জন্য ব্যবসা করে, লাভের জন্য প্রডাকশন করে, দিতে পারে অনেক।
সুদামা ভাবল কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করে। ফোন করে জানতে চায় সেই অফারের কী হল। কিন্তু তাও তো হাস্যকর। তাতে কী হতে পারে? এই ফ্ল্যাটটা আরও বড়ো, আরও উঁচুতে, কিন্তু তা কি আকাশের কোলে, হাত বাড়ালেই ছায়াপথ। ছায়াপথে হাঁটা যাবে তখন। আর কৃষ্ণেন্দু এইরকম কথা গত ছ-আট মাস ধরে বলছে, তেমন অফার পেলে চাকরি ছেড়ে দেবে। সরকারি চাকরির কত আর মাইনে। যে কাজ করে সেও মাইনে পায়, যে করে না, সেও। ওই সব বহুজাতিক সংস্থার, দেশীয় বিকাশশীল সংস্থার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, তারপর বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এ পৌঁছনো, তারপর চেয়ারম্যান — এক মহিলা ষাট লাখ টাকা পান পার অ্যানাম, একজন পায় এক কোটির কাছাকাছি — ও সবের সুখই আলাদা। টেলিফোনে হাত দিয়েও তুলে নেয় সুদামা। কৃষ্ণেন্দু কীই-বা বলবে? ও তো কথার কথা। আজই কি কোনো সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে? ওসব তো স্বপ্ন। তা কখনও সত্যি হয়।
টেলিফোনের কাছে বসে আছে সুদামা। তার মনে হচ্ছে আবার বাজবে। কে করবে? খবরের কাগজের সেই প্রুফ রিডার, যার কতকগুলি প্রতিবেদন পড়ে সে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছিল। লোকটা লেখাকে পেশা করবে বলেই কাগজে সামান্য চাকরি নেয় — তারপর যে কী হল তার।
আবার ফোনটা ভেঙে ভেঙে বাজল। সুদামা ছোঁয়ার আগেই থেমে গেল। কেউ খুব চেষ্টা করছে সুদামার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কে? কৃষ্ণেন্দু! কৃষ্ণেন্দু, তার প্রেমিক কি আবার পুরোনো প্রেম নিয়ে ফিরে এল। সে তো জানে এই সময়ে ঘুমোচ্ছে সুদামা। ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙাতে চাইছে কৃষ্ণেন্দু। না, চোদ্দ বছর আগে ফোনের কোনো প্রশ্নই ছিল না। তখন তো কৃষ্ণেন্দু সবে কাগজ ছেড়ে সরকারি পদে। সে যে কাগজে প্রুফ দেখত, তা আর চলল না। উঠেই গেল। সরকারি পদে ঢুকে বিয়ে করল কৃষ্ণেন্দু। তখনও লেখা থামায়নি। একবার লিখল কংসাবতী তীরে বর্ষা — সেই বরষার কথা এখনও ভোলেনি সুদামা। ভোলেনি মেঘের বিবরণ। দুপুরে আটকে রেখেছিল যুবক স্বামীকে তার স্ত্রী। বেলগাছিয়ার ফ্ল্যাটে। সেদিন দুপুরে তারা শ্বশুর-শাশুড়ির ভালো ঘরটি পেয়ে গিয়েছিল। এক সপ্তাহ ধরে পেয়েছিল। কী আশ্চর্য দিনই না গেছে! এক সপ্তাহ ধরে স্বামী-স্ত্রী নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলছিল। সে বার বর্ষায় শ্বশুর-শাশুড়ি দিন সাতের জন্য পুরী, সঙ্গে অর্ধেন্দুরাও গেল। পুরীর রথযাত্রা দেখতে তাকে কম লোভ দেখায়নি বড়ো জা যূথিকা। সে যায়নি। তার লোভ হয়েছিল অন্তত দিন-সাতের জন্য পুরো ফ্ল্যাটটা তো তাদের। সাতদিনই কৃষ্ণেন্দু তার সঙ্গে ছিল। তাকে ছুটি নেওয়াতে বাধ্য করেছিল সুদামা। মধুচন্দ্রিমা যাপন হবে।
টেলিফোনের সামনে বসে সেই ঘন বরিষণের দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল সুদামার। এখন বাইরে মেঘ আর রৌদ্র একসঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘ আসবে আসবে করেও আসছে না এই বালির মাঠের আকাশে। ভ্যাপসা গরম। এর থেকে পরিত্রাণের জন্যই কি সেই বাদল দিনের কথা মনে পড়ল। নাকি কৃষ্ণেন্দু জন্য? কৃষ্ণেন্দু তাকে ছুঁতে চাইছে, পারছে না। তার কন্ঠস্বর শুনতে চাইছে, পারছে না। কৃষ্ণেন্দুরও হয়তো মনে পড়ে গেছে সেই বাদল মেঘের কথা। টেলিফোনে সেই কথাই বলতে চাইছে কি? টেলিফোনে জানাতে চায় পুরাতন প্রেম? মনে পড়ে গেছে পুরাতন কথা, ঢাকা পড়েনি এখনও সব।
খেয়াল! এ সব খেয়াল। এলোমেলো সময়হীন জীবনযাপনের খেয়াল, বোধহয় এই ভাবনাও। না হলে দগ্ধ প্রকৃতির ভিতরে মেঘের অনুষঙ্গ ভাবনায় আসে কী করে?
কৃষ্ণেন্দু মনে পড়ে তোমার? অর্ধেক আকাশ দিয়েছিলে তুমি আর দিয়েছিলে … ফ্ল্যাট বাড়ির বাইরে টালা পার্ক খোলা। খোলা মাঠের ধারে কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া শিরিষ আকাশমণির ছায়া। তার ভিতরেই লুকিয়েছিল কোথাও একটি কদম গাছ। সেই যে চোদ্দ-পনেরো বছর আগের খবর। আমরা সেই সাতদিন তিনটি ঘরের মালিক। নিজের ঘর ছেড়ে সবচেয়ে ভালো ঘরটায় সকাল দুপুর সন্ধে কাটাচ্ছি। জানালা খুললেই মেঘ বর্ষা। তুমি এক ভোরে কী কাজে বেরিয়ে ফিরে এলে কোষবদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে। বাদল দিনের প্রথম কদমফুল একটি একটি করে নব পরিণীতার কোষবদ্ধ দু-হাতে তুলে দিয়েছিলে —
সুদামা একটা ফুল তোমার, আর একটা তোমার, আর একটা তোমার — পাঁচটা ফুলই তোমার, এতদিন ধরে জানতামই না এদিকে কদমফুল ফোটে। জানতে হল তোমার জন্য, ভালোবাসা চিনিয়ে দিল ফুলগুলিকে।
সুদামা টেলিফোন তুলে পটপট ডায়াল করতে থাকে। রিং হতে থাকে ওপাশে। রিং হয়েই যাচ্ছে। বেজে যাচ্ছে টেলিফোন, কেউ ধরছে না। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু ঘরে নেই! সুদামা কানে চেপে থাকে রিসিভার। যদি বেরিয়ে থাকে টয়লেটের দিকে, এখনই ফিরবে। দোরগোড়ায় তো পিয়ন থাকে, থাকে একজন ক্লার্ক একদম পাশের ছোট্ট খুপরিতে। সায়েবের পি আর ও-র কাজ করে। সে-ই বা গেল কোথায়? ফোনটা তো সেই ধরবে সায়েব না থাকলে। বাজতে বাজতে ফোন ক্লান্ত হয়ে থেমে গিয়ে অপ্রীতিকর এনগেজড সাউন্ড। সুদামা ফোন রেখে দিল। কৃষ্ণেন্দু অফিসে নেই, সে না থাকলে পিয়নও থাকে না, ক্লার্কও অন্য কোথাও গিয়ে তাস খেলে।
তা হলে ফোনটা কার? কৃষ্ণেন্দুরই। অন্য কোনো জায়গা থেকেও তো ফোন করতে পারে। হয়তো এতদিন বাদে তার মনে হয়েছে বাচ্চাটা রেখে দিলেই হত। আর একবার না হয় মা হত সুদামা। নাকি তার মনে হয়েছে কংসাবতী তীরে বর্ষার কথা। কী চমৎকার লিখেছিল।
পুরো ফ্ল্যাটে জা-শ্বশুর-শাশুড়ি-ভাসুর কেউ নেই, তারা দুজন। কদমফুল সাজানো রয়েছে মেঝের উপর পর পর। সেই ফুলের দিকে চেয়ে বসে আছে দুজন। আহ! বৈশাখে বিয়ের পর সেই প্রথমই যেন দুজনে নিবিড় হতে পারল। তাদের ঘর তো গ্যাস-চেম্বার, সেখানে বর্ষা বসন্ত একইরকম, শীত-গ্রীষ্মের তফাত নেই। ঘরে সারাদিন, হ্যাঁ ছুটির দিনেও হয় শ্বাশুড়ি, না হয় জা, না হয় জা-এর মেয়েটি আছেই। রাত এগারোটার আগে কেউ কারওর মুখই ভালো করে দেখতে পেত না যেন। দুপুরে খোলা জানালার কাছে শুয়ে দুজনে মেঘ দেখছিল তারা। ভরন্ত-মেঘ, যুবতি-মেঘ, কুমারী-মেঘ, গর্ভিনী-মেঘ। গর্ভের ভাবে শ্লথ-গমনা মেঘ-নারী। কৃষ্ণেন্দু শোনাচ্ছিল এই সব, কবে সে দেখেছিল কংসাবতী তীরে জেগে উঠছে মেঘ। তারা যেন বিন্ধ্য পর্বতের কোল থেকে উঠে এল, এল নির্বাসিত যক্ষের হৃদয়বেদনা ধারণ করে। মিলিত হয়েছিল পরস্পরে। কুমারী মেঘ গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে। সেদিন সন্ধ্যায় কৃষ্ণেন্দু খাতা-কলম নিয়ে বসে লিখেছিল সেই অলস-গমনা মেঘের কথা। যে বিবরণ শুনিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু, তার ভিতরে যেন নিজের মুখ দেখতে পেয়েছিল তরুণী বধূ।
সুদামা নিজেকে আছড়ে ফেলল বিছানায়। এখন যদি কৃষ্ণেন্দুর ফোনটা আবার আসত। তাকে সে এই সব কথা শোনাত। এসব কি এ গ্রহেই ঘটেছিল, এই জন্মেই?
আবার ফোন বাজল। এবার পরিষ্কার বাজছে। হাত বাড়িয়ে, অনেকটা নিজেকে এগিয়ে সুদামা ফোন ধরে। হ্যাঁ সুদামা বলছি, তুমি কোথায় ছিলে কৃষ্ণেন্দু, তোমার ঘরে ফোন বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরেনি, কেউ নেই। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই যে সবাই পুরী গেল, ঘন বর্ষার দিন, মেঘ এসে দাঁড়িয়েছে, আমাদের জানালায়, তুমি বলছ একটা তোমার, আর একটা তোমার … কদমফুল গো কদমফুল, মনে আছে? এবারে আমরা বর্ষায় কদিন বেলগাছিয়ায় গিয়ে থাকি বরং, দাদারা ক-দিনের জন্য এই ফ্ল্যাটে …। আচ্ছা নীলের চিঠি কী হল, পড়া হল …?
নীলের কথা আবার মনে পড়ে গেল সুদামার। আচমকাই। সেই আশ্চর্য রোমান্সের সঙ্গে নীলের কী সম্পর্ক, নীল তো তখন জন্মায়নি। কিন্তু মনে হল যেন ছিল। চারপাশের বাতাসে ভাসছিল সে …।
আমি সুহাস, সুহাস বোস ম্যাডাম।
কে! সুদামার হাত থেকে টেলিফোনের রিসিভার পড়ে গেল। সে ঘন নিশ্বাস ফেলে। তারপর আস্তে আস্তে রিসিভারটি তুলে কানে চেপে ধরে, তুমি মানে আপনি। বলবেন তো আপনি, আমি ভাবছি।
সুযোগ দিলেন কই ম্যাডাম, আপনি কি ফোন করেছিলেন?
কেন বলুন দেখি, কেউ তো ধরল না, আপনার স্যার কোথায়?
উনি বাইরে গেছেন নতুন একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে। ফিরবেন এখনই, বেশি দূরে নয়, বাইপাসের দিকে। আমি ফোনটা ধরতে এলাম, অনেকক্ষণ ধরে বাজছিল, কেটে গেল, মনে হল আপনি, কিছু বলবেন?
বলব! আপনাকে বলব! আপনাকে বললে কি বুঝবেন, শুনুন সুহাস, বলতে পারেন বর্ষা আসতে আর কত দেরি, অফিসিয়ালি বর্ষা কবে আসছে। খুব গরম! মেঘ কবে নাগাদ ঢুকবে এই শহরে, জানেন আপনি …?
দশ
সুহাস বলল, খবর নিতে হবে, ম্যাডাম।
কী খবর নেবেন?
কবে নাগাদ বর্ষা নামবে?
আপনি কি হাওয়া অফিসে খবর নেবেন? সুদামা জিজ্ঞেস করে।
না, অন্য জায়গায়।
আর কোনো জায়গা আছে, যারা খবর দিতে পারে?
সুহাস বলল, খুঁজে বের করতে হবে।
সুদামা হাসতে লাগল, আপনার এখন কোনো কাজ নেই?
আছে তো।
কী কাজ?
এই যে কথা বলছি মিসেস চ্যাটার্জির সঙ্গে, আচ্ছা আপনি এখন কী করছিলেন, ঘুমিয়েছিলেন?
সুদামা হালকা হয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগছে না তো কথা বলতে। ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। চমৎকার কথা বলে। কী সুন্দর বলল, খোঁজ নেবে, খুঁজে বের করবে যারা বলতে পারে মেঘের খবর।
সুদামা বলল, হ্যাঁ ঘুমিয়েই তো ছিলাম।
তা হলে যে ফোন করলেন স্যারকে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে?
হাসে সুদামা, আপনার যে খুব সাহস, হ্যাঁ আপনার সেই ঘোষচৌধুরী সাহেবের খবর কী, রহস্য ঔপন্যাসিক।
উনি এখন রহস্য তৈরি করছেন।
ইস, কী খারাপই না লেখেন, উনি কি খুনের পরিকল্পনা করেন সবসময়?
না, না তা কেন হবে। সুহাস হাসে, লোকটা উনি খারাপ নন।
এ তো আপনার বসের কথা, যাক গে উনি খারাপই হন আর ভালোই হন, আমার তাতে কী, তবে আমার যেন মনে হয় …, যাকগে সে কথা, হ্যাঁ খোঁজটা কোথায় নেবেন?
সুহাস বলে, কত জায়গা আছে।
কত জায়গা মানে, আছে তো এক হাওয়া অফিসই।
সুহাস বলল, ধরুন, কোনো এক গাছের কাছে। কদমগাছ তো বলতে পারে।
সুদামা বলল, আপনি কি কবিতা লিখতেন?
সুহাস বলল, মনে হয় তা?
কী করে জানব, আপনার বস, মানে চ্যাটার্জি সাহেব লিখত। না কবিতা নয়, প্রোজ, আপনার সেই প্রজেক্ট কতদূর?
সুহাস বলল, যাবেন দেখতে?
আমি ওর কী বুঝি! সুদামা মাথার চুল কপাল থেকে সরিয়ে দেয়, আঁচলের খুঁট দিয়ে গলা মোছে, আর ধোঁয়া চিমনি, কারখানা কি দেখার মতো জিনিস, দানব দানব মনে হয় না?
সুহাস বলল, দানব এখনও জন্মায়নি, জায়গাটা খুব সুন্দর।
সুদামা বলে, সুন্দর জায়গাটা নষ্ট করার ব্যবস্থা করছেন।
তা কেন হবে?
গ্রিন তো থাকবে না।
কিন্তু একটা প্রজেক্ট, খুব বড়ো প্রজেক্ট, চারপাশ রাতারাতি বদলে যাবে।
তা যাক, কিন্তু সুন্দর কি থাকবে?
এক একজন সৌন্দর্যকে এক এক রকম ব্যাখ্যা করে।
যা-ই ব্যাখ্যা হোক, নদী পাহাড় সমুদ্র, সবুজ মাঠই তো লোকে দেখতে যায়, কারখানাকে দেখতে ছোটে?
আপনি দেখুন না।
সুদামা বলল, আপনার স্যারকে বলুন, উনি যদি নিয়ে যান।
একদিন গেলেই হল, হ্যাঁ ওদিকে খোঁজ পাওয়া যেতে পারে মেঘের, কাছেই গঙ্গা, মেঘ তো নদী থেকেই আকাশে ওঠে।
কারখানা হলে গঙ্গা থাকবে?
বাহ কেন থাকবে না?
আপনি সবুজ রক্ষা করতে পারলেন না?
ওপারে সুহাস হাসে, আমি খুব ইমোশনাল। সত্যি সেদিন খুব আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম। যাক আপনি আসুন মেঘের খবর নেব, নদীতে অনেক নৌকো, পাল তোলা, তারা হয়তো খবর দিতে পারে।
থাকুক গঙ্গা, থাকুক মেঘ, থাকুক নৌকো, সাদা পাল — ফোন রেখে দিল সুদামা। অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় কথা আর কত সময় ধরে চালানো যেতে পারে। সুহাস বোস কৃষ্ণেন্দুর জুনিয়র। বয়সে অনেক ছোটো, অন্তত বছর আট তো হবেই। ফোন রেখে শ্বাস নিল সুদামা। হ্যাঁ, হালকা লাগছে অনেক। ঘরের ভিতরে যে গুমোট বাতাস ছিল তা যেন এই মিনিট-কয়ে-র ভেতরে উধাও। বন্ধ জানালা কি খুলল সুদামা। না, সব তো তেমনই রয়েছে। কথা হয়েছে কিছু সময়। কিন্তু সুহাসের কথা তো তার কানে কানে — সুদামা অবাক হয়ে গেল। কী সব ভাবছে সে! ঘরে যেন আলো অনেক। তা কী তার কথার জন্য! সে বেশ জোরে জোরেই কথা বলছিল। দুপুরে ফোন এলে তেমনই করে থাকে সুদামা। ইচ্ছে করেই কন্ঠ উচ্চে তোলে কেননা প্রথমে কৃষ্ণেন্দু, পরে বিমলা চলে যাওয়ার পর এই ফ্ল্যাটে তো আর কেউ কথা বলে না। পাশের ফ্ল্যাটের অনিন্দিতা আসত ক-দিন। তার উদ্দেশ্য হল টিভি খুলে সিনেমা দেখতে দেখতে সুদামার সঙ্গে সিনেমার গল্প করবে। তাতে সিনেমাও হল, আড্ডাও হল। এখন তো সব সময় সিনেমা। সুদামার কোনো উৎসাহ নেই সিনেমায়, তা টের পেয়ে অনিন্দিতা এখন তার ঘরেই ডেকে নেয় তিনতলার মাধুরীকে। আবার মাধুরীও ডাকে অনিন্দিতাকে। সুদামাকেও ডাকে। গেল কবে সে?
সুদামার মনে হচ্ছিল এই ঘরে বহু সময় ধরে আলাপ হয়েছে। হাসতে হাসতে কথা হয়েছে। সেই আলাপের ভিতরে ছিল মেঘ-বিষয়ক কিছু কথাবার্তা, কদম ফুল, পুরোনো এক বরষা। আলাপ এখনই থামল। একজন চলে গেছে, একজন আছে।
সুদামা মনে করতে চেষ্টা করে কী কী কথা? হ্যাঁ, কংসাবতী তীরে বর্ষার কথা হয়েছে। বাইরে কী চকচকে রোদ, গরম বাতাস! এই সময়ে এই ঘরে নদী এসে ঢুকেছিল, মাথায় মেঘ, কী মেঘ! কুমারী মেঘ, মেঘ নারী, বর্ষণে বর্ষণে যে শীতল করে পোড়া পৃথিবী। কী যে হয়েছে তার। কখন এসব কথা হল। সুহাস বোস জানবে কী করে, ‘একটা তোমার, আর একটা তোমার, এইটা তোমার, এইটাও তোমার … সব ফুলই তোমার’।
সুহাস বোস তো নিতান্ত উচ্চাশী চাকুরে। বুদ্ধিমান। কিন্তু কত-বা আর বুদ্ধি ধরে? যে কৌশলটি প্রয়োগ করল সে তা তো বহু পুরাতন। বসকে খুশি করতে হলে তার অন্দরমহলকে খুশি কর। বড্ড ঘ্যানঘেনে ব্যাপার। বহু চর্চিত ওই কৌশলই তো রপ্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে সুহাস। প্রয়োগ করেছে সময় বুঝে। ঠিক দুপুর, একা ঘরে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এই সময়ে যে মানুষই ফোন করুক, তার কন্ঠস্বর প্রার্থিত মনে হয়। সুহাস সেই সুযোগই নিয়েছে। সকালে কিংবা রাতে ফোন করলে তো এত সময় কথা বলার সুযোগ পেত না। সুদামা নিজেই সে সুযোগ তাকে দিত না। টেলিফোন কৃষ্ণেন্দুর কাছে চলে যেত।
খামোকা ফোন করতে গেল ছেলেটা। উন্নতি করবে নিশ্চিত। কৃষ্ণেন্দুই তো বলে অতি বিনয়ী সুহাস তাকে ‘স্যার’ না বললেও ক্ষতি ছিল না। একই সার্ভিসের লোক। কিন্তু সুহাস চেয়ারের মর্যাদা দেয়। সে খুব সতর্ক। জানে কৃষ্ণেন্দু কিসে খুশি হবে।
তা হোক। চাকরি যখন করতে ঢুকেছে বীরভূমের কৃষক-পুত্র, সে তো উপরে উঠতেই চাইবে। যত উচুতে সম্ভব। তাতে সুদামারই বা কিসে মাথাব্যথা। সে ঘুরতে লাগল ফ্ল্যাটের ভিতর। মনে হচ্ছে, যেন আরও মিনিট নয়, আরও ঘন্টাই কথা হয়েছে। যতক্ষণ এই ফ্ল্যাট একাকী পড়ে আছে, ততক্ষণ। সেই বিমলা চলে যাওয়ার পর থেকেই সুহাস আলাপ জুড়ল ধীরে ধীরে। এখনই যেন মনে হচ্ছে সে একটু একা হয়ে গেল। ঘরে অতিথিকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে এল।
কী চমৎকার না কথা হল? বর্ষায় তো কদম্ব ফোটে, কদম্বে কুঁড়ি এসে যায় এই সময়েই, এখন জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। মে মাস শেষ হতে গেল। এই ঘরে বসে সুহাস যেন বলছিল, কদম্ব গাছের কাছেই জানা যেতে পারে কবে নাগদ মেঘ এসে শহর ভাসিয়ে দেবে। কদম্বও তো মেঘের অপেক্ষায় আছে।
কদম্বটা কোথায় আছে?
বেলগাছিয়ায়, মাঠের ধারে। সুহাস বোস তখনই উঠে যায় সোফা থেকে, ম্যাডাম যদি বলেন, দেখে আসি।
কী চমৎকার সব কথা হল। আলাপে আলাপে ঘর দুয়ার সব আলো হয়ে উঠল। মাধুরীদের ফ্ল্যাটের টিভিতে সিনেমার নাচ বন্ধ হয়ে গেল। হ্যাঁ, এখন যেন কানে আসছে উপরের টিভি-র শব্দ। যতক্ষণ সুহাস ছিল ততক্ষণ কানেই যে আসেনি। সুহাস বোস হোক বা যে কেউ হোক, সে অনেক কথা বলেছে অনেক সময় ধরে। হেসেছে হা-হা শব্দে। ডাইনিং কাম লিভিং-এ, শোওয়ার ঘরে, আর একটি ঘরে, আর একটি ঘরে।
কী আশ্চর্য মেঘ উঠেছিল তখন। মেঘে মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল আকাশ। ফাঁকা ফ্ল্যাট। শ্বশুর, শাশুড়ি, জা, ভাসুর গেছে পুরীতে — ফ্ল্যাটে শুধু দুজন কথা বলছে। কথা বলছেই না অনেক সময়, চুপ করে বাইরে চোখ ভাসিয়ে আছে। মেঘ দেখছে। কথা যখন বলছে না তারা, তখনই যে বেশি কথা।
সুহাস বোস তো কত সময় চুপ করেই থাকল। সুদামা জানালার কাছে যায়। পরদা সরিয়ে দিতেই বাইরে ছায়া ছায়া ভাব। আশ্চর্য! রোদ কি মরে গেল। বিকেল হয়ে গেল, না তো, এখন যে দুপুর, ভীষণ দুপুর। পোড়া দুপুর, সমুদ্রতীরে বৈশাখ মাসের দুপুর যেমন তেজি থাকে, তেমনি দুপুর। বালিতে আগুন ধরে যাচ্ছে। সেই রোদ তো নেই। ছায়া ঘনিয়ে এল। সুদামা পটাপট পরদা তুলে দিতে থাকে। ছায়া ছায়া ছায়া! ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। বন কোথায় এখানে? কৃষ্ণেন্দু কী সুন্দর গাইত!
ছায়া কি সত্যি এল? নাকি বেলা পড়ে এল? নাকি সুদামার চোখে ঘোর এল। মেঘের স্বপ্ন এল। ফিরে এল সেইব দিনরাত্রি। নিঝুম হয়ে বাইরে তাকিয়ে ধীরে ধীরে দু-চোখের পাতা নরম করে আনে সুদামা। আঁখি পল্লব ক্রমে বুজে এল, পাখি যেমন গোটায় রৌদ্র শেষ হলে, তেমনি। জানালার ওপারের প্রকৃতি ধীরে ধীরে মুছে যায়। আকাশ মুছে যায়। সত্যিই মেঘ এসেছে কিনা তাও জানে না সুদামা। ঢলে পড়ে সে পরদার ওপরে জানালার গ্রিল জালে।
কৃষ্ণেন্দু … ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। নীল … মেঘ বলেছে যাবো যাবো … মেঘ উঠেছে মা দেখো। কৃষ্ণেন্দু … নীল। হ্যাঁ, ওরা দুজন। দুজনই শুধু। নীলকে লিখতে হবে অবশ্যই যেন আসে। আয় নীল আয়। আমার ভয় করছে। চমকে ওঠে সুদামা। চোখ খুলে যায়। সত্যিই তো মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে সব। এ তার ঘোর নয়। এ তার ঘুম নয়, মুদিত চোখের অন্ধকার নয়।
এগারো
দু-হাতে পরদা সরিয়ে সুদামা বাইরে তাকায়।
বাইরে মেঘ এসে গেল! কখন? যখন তারা কথা বলছিল এ ঘরে ও ঘরে, কদম্বের কাছে খবর নেওয়ার কথা বলছিল সুহাস, তখন! না তো সুহাস তো কদম্বের কথা বলেনি, বলেছে তো শুধু খোঁজ নেবে। না, কি বলেছিল, তারই মনে নেই, কী যে ছাই বলেছে। ভুলেই গেছে সে। ভুলে যাওয়াই তো ঠিক। কৃষ্ণেন্দুর অফিসের একটা বাচ্চা ছেলে, (হ্যাঁ বাচ্চাই তো, বড়োজোর একত্রিশ, বত্রিশ হবে না বোধহয়। তার নিজের তো আটত্রিশ, না না ঊনচল্লিশ) টেলিফোনে কী না কী বলল তা নিয়ে ভাবছে সে। নীলের চেয়ে আর কত বড়ো হবে। সতেরো আঠেরো — হেসে ফেলেছে সুদামা, কম কি সতেরো আঠেরো?
সুহাস বোস আচমকা ফোনটা করল কেন? কী চমৎকার একটা ছুতো খুঁজে নিল। টেলিফোনে এই সুবিধেটা আছে। … আপনি কি ফোন করছিলেন, ম্যাডাম? করছিলাম তো কৃষ্ণেন্দুকে। কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে কথা আছে।
সে যদি ফোন না-ও করত, সুহাস এই সূত্রতেই ফোন করতে পারত, আপনি কি ফোন করছিলেন? কৃষ্ণেন্দুর ঘরে তো মুহূর্মুহূ ফোন যায়। সে থাকলে সে ধরে, নতুবা অন্য কেউ ছুটে আসে। জরুরি ফোন থাকে অনেক। যখন ঘরে বা আশপাশে কেউ থাকেন না, ফোন বেজে বেজে থেকে যায়। জরুরি ফোনও বেজে বেজে থেকে যেতে পারে। তেমন হলে আন্দাজ করে কাউকে রিং ব্যাক করা যেতে পারে, সেক্রেটারি, ডিরেক্টর, মিনিস্টারের ফোনও তো থাকতে পারে। কিন্তু সুহাস কিনা আন্দাজ করল ফোনটা করেছিল ম্যাডাম চ্যাটার্জি — হাসি পেয়ে যায় সুদামার। কোন আকাশ সুহাসকে ওই খবর দিল? আসলে সুহাস ফোন করতই। শুধু প্রথম কথাটা খেটে গেল আচমকা। যদি সুদামা বলত সে কোনো ফোন করেনি, তা হলে কী বলার ছিল সুহাসের? সে কি ফোন রেখে দিত? নাকি কথা খুঁজে আলাপই করে যেত, যেমন করল। সুহাস তার ম্যাডামের সঙ্গে সহজ হয়ে কৃষ্ণেন্দুর অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে চাইছে।
কিন্তু সত্যিই কি তাই! ছেলেটার কন্ঠস্বরে কেমন একটা ভাব আছে না। দূরাগত ধ্বনির মতো। বিপ বিপ বিপ …। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে ওর গলা জড়িয়ে যায়। আজ গিয়েছিল খুব। তার সঙ্গে বারবার কথা বলতে চায়। অর্থহীন তুচ্ছ কথাকেও মূল্যবান অর্থপূর্ণ মনে করে। সুদামা জানালা থেকে আচমকা সরে আসে। এসব কী ভাবছে সে! কেন ভাবছে? ভাববে কেন? কৃষ্ণেন্দুর অফিসের একটা ছেলে ফোন করেছিল। করতেই পারে। শুধুই তো ফোন। সে তার ঘরে আসেনি। হাত ধরেনি। দু-কান গরম হয়ে ওঠে সুদামার। আবার কী ভাবছে সে? হাত ধরবে কেন? ও তো সুহাস বোস। কৃষ্ণেন্দুর অধীনে চাকরি করে। বীরভূমের সুহাস। খুব আলাপি। খুব উচ্চাশী। বসের স্ত্রীকে খুশি করছে। আর কিছু না। এরপর যেদিন ফোন করবে, সুদামা আচমকা ফোন রেখে দিয়ে শুয়ে পড়বে। ফোন রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আশ্চর্য! কেন ঘুমিয়ে পড়বে সে? ঘুমোনোর কী আছে? ঘুমোবে বলেই ঘুমোতে পারবে? বরং বলে দেবে পরে কথা বলবে, সে খুব ব্যস্ত আছে। কিন্তু কিসে ব্যস্ত সে? তার কোনো ব্যস্ততাই যে নেই। তখন সে জিজ্ঞেস করবে, কখন ফোন করবে? তার চেয়ে যা বলার বলুক। ওর কথাগুলো তো সুন্দর। শুনতে ভালো লাগছিল তার। আশ্চর্য! ভালো লাগারই বা কী আছে? সে কি পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলেনি? কতজন ফোন করে। কৃষ্ণেন্দুর অফিসের কতজন। তার সঙ্গে কথা বলে। অনিলবরণও তো কথা বলে। আরও কে কে যেন! কারা কারা? কৃষ্ণেন্দুর পরিচিত কারা কারা? তার পরিচিত কে কে? সুদামা নাম মনে করতে চেষ্টা করে। কেউ না। কারওর নামই তো মনে পড়ছে না। তাহলে কি সুহাসই করে? সব ফোন সুহাসের? কলকাতা থেকে, কলকাতার বাইরে থেকে — সব সুহাসের কন্ঠস্বর। মাথা ঝাঁকায় সুদামা। খোপা ভেঙে দেয় হাত ঘুরিয়ে। চুল ছড়িয়ে দেয় পিঠময়। চুল তার মুখমণ্ডলে উড়ে আসে। চোখের উপরে উড়ে আসে। চুল সরাতে সরাতে সে জানালার কাছে আবার সরে যায়। যদি নীল বাড়ি থাকত, ফোনটা সেই ধরত। নীলই সব ফোন ধরত। তাকে তুচ্ছ কথায় সময় নষ্ট করতে হত না সুহাস বোসের সঙ্গে। নীলের কথা নিয়ে মনের ভিতরে খেলতে চায় সুদামা। এখন ছেলেটা নেই, তাকেই ফোন ধরতে হবে। সুহাস তার সঙ্গেই কথা বলবে। নীল থাকলে বোধহয় নীলের সঙ্গে ভাব জমাত। সত্যিই কি তাই! তাহলে ওর গলা কেঁপে যাবে কেন, জড়িয়ে যাবে কেন? কী যে তার ভাবনা। অর্থ নেই কোনো। সুহাসের ফোন নিয়ে এত ভাবনার কি আছে?
সুদামা সব জানালার পরদা তুলতে তুলতে বলল, যা হোক, ফোনটা করেছিল বলে সময় তো কাটল। একঘন্টা, দু-ঘন্টা কেটে গেছে যেন। তার যে নিজস্ব সময় ধারণা আছে, সময় সম্পর্কে কল্পনা আছে, তা ঘড়ির সঙ্গে চলে না। ঘড়িতে তো সময় বাঁধা। সুদামার মনে হয় ঘড়ি নামিয়ে রাখে। ঘড়ি নামালেই সময় তার ব্যাপ্তি ফিরে পাবে। ওই যে সামান্য কয়েক মুহূর্তের কথা, ফালতু, অপ্রয়োজনীয় কথা, যা সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়ার মতো, তা যেন বহু সময় ধরে বয়ে যাচ্ছে এখন। ওই কথার সময়ও ছিল অনেক, অনেক। না ঘড়ির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
কী আশ্চর্য! ঘড়ির সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না কেন? কতটুকু কথা বলেছে সে? দশ মিনিট বড়ো জোর। নাকি তার চেয়েও কম সময়। নানা, আরও বেশি সময়। আধ-ঘন্টা, এক ঘন্টা, দু-ঘন্টার, তিন ঘন্টা, চব্বিশ ঘন্টা ধরে, দিন রাত্রি ধরে। কথা তো এখনও চলছে। বয়ে যাচ্ছে কথার রেশ।
সুদামা দেখে লবণ হ্রদের আকাশ ছায়াময়। রোদ নিভে কেমন একটা থমথমে ভাব। আশ্চর্য। আজই মেঘের প্রার্থনা করছিল সে কদম্বের কথা মনে করে, প্রার্থনা মঞ্জুর হল। এই মেঘ জল দেয় না কিন্তু ছায়া করে। তাও বা কম প্রয়োজনীয় কিসে? সুদামা ভাবে, সুহাসের ওখানে কি মেঘ এল?
ঘন, পূঞ্জীভূত মেঘ। আষাঢ়ের মেঘ। ডাক দেওয়া মেঘ। প্রিয় পুরুষ ডেকে ডেকে ফেরা মেঘনারী। ঘোর গর্জনে আকাশ পৃথিবী মন্দ্রিত। মেঘ কি নারী? না পুরুষ! কৃষ্ণেন্দু বলত, মেঘ নারী। কংসাবতীর তীরে মেঘনারী মিলনের পিয়াসে ডেকেছিল পুরুষকে। সেই কবে যেন। কতকাল আগে? কত জন্ম আগে। কিন্তু নারী কি ডেকে ডেকে ফিরতে পারে? নারীর কন্ঠস্বর কি অমন ঘনগম্ভীর। মেঘ তো পুরুষ। ওই যে পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে জানালার ওপারে। সরে আসে সুদামা জানালা থেকে। তার কী হয়েছে। বুকে এমন কাঁপছে কেন? নীল … নীল থাকলে ফোনটা সে-ই ধরত। ফোনের ধারে কাছে যেত না সুদামা। নীলের চিঠি লেখা হয়নি এখনও। নীলের কথা ভাবা হচ্ছে না এখন। নিঝুম দুপুরে সন্তানের কথা মনে করে বিষণ্ণ হয়নি সে। তার চোখে মুখে বিষাদ ছায়া ফেলেনি। চিঠিটা এখনও কৃষ্ণেন্দুর কাছে। ফেরত দেয়নি সে। কৃষ্ণেন্দু ফেরত দেয়নি বটে, সেও কি চেয়েছে? কেন চেয়ে নেয়নি? চিঠি তো লিখতে হবে। এখন চিঠি লিখতে বসলে নিশ্চিন্ত। দুর্ভাবনায় মাথা খারাপ হবে না। এলোমেলো ভাবতে হবে না। কিন্তু চিঠি তো চাই। এখনই চাই। চিঠিটা পেলে সে বেঁচে যেত। কৃষ্ণেন্দুর ফিরতে তো রাত। তাহলে কি রাতে লিখবে? অনেক রাতে একা একা, জেগে জেগে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু যদি ফেরত না আসে। অফিসের ড্রয়ারে রেখে দেয়নি তো? অফিসের ড্রয়ারে নানান কাগজের ভিড়ে পড়ে আছে নীলের চিঠি। তাহলে বরং ফোন করা যাক কৃষ্ণেন্দুকে। ফোন করে সে বলবে, এখনই চিঠিটা নিয়ে চলে আসতে। সুদামা টেলিফোনের দিকে এগোয়। রিসিভারটা তোলে। এখনও ঘাম লেগে আছে যেন। ডায়াল করলেই তো ফোন পৌঁছে যাবে সুহাস বোসের কাছে। কৃষ্ণেন্দু অফিসে নেই। সুহাসকেই বরং বলে দেবে চিঠিটার কথা। কিন্তু ওপারে বসে সুহাস তো তারই ফোন ধরবে। কেমন যেন শিথিল হয়ে যায় সুদামা। আস্তে আস্তে রেখে দেয় রিসিভার। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
এখন সে কী করবে। সুহাসের ভয়ে ফোন করল না তার স্বামীকে। আচ্ছা, সুহাসে তার কিসের ভয়। সে এত গুটিয়ে যাচ্ছে কেন? সুহাসকে ডেকে সেও তো মেঘের খবর দিতে পারে। মেঘের খবর নিতে পারে। নিলে কী? ওই সুন্দর যুবক, তাকে মুগ্ধ করেছে। করতেই পারে। এক পুরুষের ভেতরে সব পুরুষের গুণ কি সমাবিষ্ট হয়? সে তো অনায়াসে জিজ্ঞেস করতে পারে, সুহাস তোমার ওখানে কি মেঘ এসেছে?
না, না সুহাস কেন? কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণেন্দু তুমি কি মেঘ দেখছো ওখানে? বাইপাস তো সল্টলেকের গা থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে চলে গেছে। উড়ে গেছে দক্ষিণে। কতদূরই বা যেতে পেরেছে? মেঘ নিশ্চয়ই এসেছে ওইদিকে। কিন্তু ফোনটা সে করে কী করে? কৃষ্ণেন্দু তো নেই। কৃষ্ণেন্দু, কৃষ্ণেন্দু … তোমাকে ডাকতে গিয়ে সুহাসকে ডাকতে যাচ্ছি কেন? কৃষ্ণেন্দু, কৃষ্ণেন্দু, তোমার বদলে সুহাস আমার ঘুম ভাঙাচ্ছে কেন? নীলের চিঠিও কি তুমি সুহাসের হাতে দিয়েছ? সুদামা মেঝেয় বসে পড়ে। ফোন বেজে উঠল।
ফোন বাজছে। কার ফোন হতে পারে? সুহাস বোস কী খবর দিচ্ছে মেঘের। তার কথা আকাশ শুনতে পেয়েছে। নাকি সুহাস বোস বলবে গঙ্গার গা দিয়ে ভাসা মেঘ সে পাঠিয়ে দিয়েছে লবণ হ্রদের দিকে, দেখা হয়েছে তা?
অথবা কৃষ্ণেন্দুর ফোন। এসে শুনেছে ফোন করেছিল সুদামা, তাই হয়তো। সুদামার মনে হল কৃষ্ণেন্দুই। সুহাস হয়তো হাসতে হাসতে বলেছে, স্যার, ম্যাডাম খুব মেঘ ভালোবাসেন, স্যার ম্যাডাম বলছিলেন মেঘ কবে আসবে, কবে বৃষ্টি নামছে … হা-হা-হা, ম্যাডাম কী চমৎকার কথা বলেন স্যার, উনি কি কবিতা লেখেন, পোয়েট? শুনে কৃষ্ণেন্দু হাসতে হাসতে ফাইলে চোখ নামায়।
সুদামা ফোন ধরল, কে কৃষ্ণেন্দু, নীলের চিঠি তুমি কার হাতে দিলে? কোথায় ছিলে, জানো আজ সেই যে বর্ষার মেঘ, কংসাবতী তীরে বরষা … কদম্ব পুষ্প …।
ওপারে নারীকন্ঠ হা-হা করে হাসছে, কদম্ব পুষ্প। পারিসও বটে, বয়স তো হল রে আমাদের। হ্যাঁরে সুদামা, তুই কি স্বপ্ন দেখছিলি?
চম্পা। তার বাপের বাড়ির পাড়ার বন্ধু। অফিস থেকেই করছে। মাঝেমধ্যে এমন করে। একেবারে অনিন্দিতার স্বভাব। অনিন্দিতা টিভি দেখতে দেখতে, তা ‘পথের পাঁচালী’ ছবি হোক আর ‘বাজিগর’ হোক কথা বলবেই — চম্পা অফিসের ফোনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ফোনে গল্প করে। ফাইল খোলা, চম্পা বলছে, তুই এখনও খুকি হয়েই আছিস সুদামা, কদম ফুল নিয়ে স্বপ্ন দেখিস, ভালোবাসাবাসি করিস, পনেরো বছরের পুরোনো বর আর কত প্রেম দেবে রে, হ্যাঁরে আছিস কেমন? উফ কী গরম। আমাদের এ সি আছে বলে রক্ষা, এ সি-র জন্যই তো অফিসে আসি, আমি আবার একদম গরম সহ্য করতে পারি না …।
দিন সাত গেছে। সুহাস ভাবছিল তার ঘর থেকে আবার একটা রিং করবে কিনা সুদামা চ্যাটার্জিকে। সেদিনের আলাপের বিবরণ দিয়েছে সুহাস তার সাহেব স্যারকে। স্যার, ম্যাডাম কী সুন্দর কথা বলেন।
কৃষ্ণেন্দু তাকিয়েছিল তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে। শুনেছে কথাগুলো। শুনে হাসতে হাসতে বলেছে, তোমার তা হলে একটা কাজ বাড়ল, তুমি বরং প্রজেক্টের কাজ থেকে ছুটি নিয়ে খোঁজ নাও কবে নাগাদ মেঘ আসতে পারে।
সুহাস সিগারেট এগিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। বলল, ও আমি বরং ফোনেই খোঁজ নিতে পারব স্যার, কৃষ্ণমূর্তি কি ফোন করেছিলেন?
কেন? কৃষ্ণেন্দুর দুই ভ্রূতে ভাঁজ।
ওঁদের ডিরেক্টর মিঃ মেটা আসবেন শুনেছিলাম, রাজারামপুর যাবেন প্রজেক্ট সাইট দেখতে।
কৃষ্ণেন্দু হাসে, তোমার বেশ মনে থাকে, না ফোন করেননি, তুমি তো জানতে পারবে। হ্যাঁ ওরা দশ লাখ টাকা জমা দিয়েছে, জানো।
জানি স্যার, ট্রেজারি অফিসার রবিন বলছিল, স্যার আর একটা কথা?
কী! কৃষ্ণেন্দুর কপালে উদ্বেগের ছায়া হয়তো।
কেউ কেউ বলছে আপনাকে ওরা অফার দিয়েছে, ইস্টার্ন ইন্ডিয়ায় অনেকগুলো প্রজেক্ট করছে।
তোমার মাথা খারাপ, গভর্মেন্ট সার্ভিস ছেড়ে, ও সব শোনা যায়।
কিন্তু ওদের ওখানে স্কোপ তো অনেক বেশি।
এই বয়সে হয় না। কৃষ্ণেন্দু বলেছে।
না, না, এই বয়সটাই তো কাজের সময়, আপনার এক্সপিরিয়েন্স অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাপাবিলিটি ওরা কাজে লাগাতে পারবে, বয়স কোনো ফ্যাক্টরই নয়, যে এজ-এ সকলে তো দক্ষতার শীর্ষে উঠে যায়, অথচ সুস্থ, কর্মঠ মানুষকে ঘরে বসিয়ে দেয় গভর্মেন্ট …।
কৃষ্ণেন্দু প্রসঙ্গ ঘোরায়, তুমি মাঝে-মধ্যে ফোন কোরো সুদামাকে। ও তো একা, ওর বন্ধুই না হয় হয়ে যাও। ওর একটা ভাই আছে, ব্যাঙ্গালোরে থাকে। তোমারই বয়সী হবে হয়তো। শি লাইকস য়্যু। এসব মেঘের গল্প আমি শুনেছি, খুব প্রশংসা করছিল তোমার।
কথা এইরকম। এর পরে সুহাস আবার এলপিজি প্রজেক্টের দিকে কথা ঘোরায়। কৃষ্ণেন্দু হুঁ-হাঁ উত্তর দেয়। সুহাস প্রজেক্ট বিষয়ে তার মতামত দেয়, কমপেনসেশন খুব তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ল্যান্ড নিয়ে কিছু জটিলতা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কৃষ্ণেন্দু বলে, ল্যান্ডের জটিলতা থাকবেই, যাকগে মিঃ মেটাকে ভালো করে সাইটটা দেখানো দরকার, ওঁরা বাইপাসের কাছে জমি চাইছেন। অসমে একটা এলপিজি প্ল্যান্ট করছেন, ওড়িশতে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, বিহারে থার্মাল পাওয়া — একটাই কোম্পানি, কত ব্যবসায় নামছে?
সুহাস বলল, প্রাইভেট সেক্টরের প্রসার যেভাবে হচ্ছে, এরপর গভমেন্ট সার্ভিসে কেউ থাকবে না স্যার, মহারাষ্ট্রে এক সিনিয়র আই এ এস, চাকরি ছেড়ে মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে, খবরটা দেখেছেন?
কৃষ্ণেন্দু চুপচাপ। সুহাস তখন উঠে এসেছিল কৃষ্ণেন্দুর সামনে থেকে। সুহাস ভেবেছিল খবরটা দেয়। কী খবর, না তার ‘স্যার’ হয়তো …। কিন্তু তা বোধহয় কৃষ্ণেন্দুর অভিপ্রেত নয়। কোথাও অফার পাওয়া, অফার নেওয়া বা না নেওয়া, এ সব কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আজ আবার ভাবছে সুদামাকে ফোন করে। না, অন্য খবর দেবে। ভাবছিল ডেকে বলে, খোঁজ পেয়েছি ম্যাডাম।
কিসের খোঁজ?
মেঘের খোঁজ।
আপনি কি সেই হাওয়া অফিসের খবর, আরে ওরা তো বিভ্রান্ত, এক-একদিন এক-একরকম খোঁজ দিচ্ছে, কোনোদিন বলছে দু-দিনের ভিতরে বৃষ্টি, পরের দিন বলছে মেঘের দেখা নেই, বৃষ্টির সম্ভাবনাই নেই, ওদের যন্ত্রপাতি সব বিগড়ে গেছে সুহাসবাবু।
ঠিকই বলেছেন ম্যাডাম, ওরা বলছে সের দরে সব বেচে দেবে, একটা বোর্ড লাগিয়ে দেবে, ‘ফর সেল’।
কী সেল করবে? যন্ত্রপাতি কে কিনবে?
যন্ত্রপাতি নয় ম্যাডাম, অন্য কিছু, হয়তো মাথার আকাশটা।
ওপারে হাসির শব্দ। সেই শব্দে কী যে মধুরতা। আটত্রিশ-ঊনচল্লিশের মহিলা কুড়ি-বাইশের তরুণী হয়ে গেছে। বলছে, আপনি সিভিল সারভেন্ট হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিন্দে করছেন।
স্যরি ম্যাডাম, আপনি আমার বসকে জানাবেন না, বস আবার ভীষণ সরকারি, ধরুন কেউ যদি তাঁকে অফারও দেয় … (না, শেষের কথাগুলো বলা যাবে না। কৃষ্ণেন্দু বিষয়ে কোনো কথাই বলবে না, ভালোই লাগবে না।)
বরং সুহাস বলবে, হাওয়া অফিসের ভার নেবেন মিঃ অজিত আগরওয়াল, ভোপালে তাঁর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে, ইউপি-তে আছে সুগার ফ্যাক্টরি, মহারাষ্ট্রে কাপড় কল, আর আসামে বাঁশবাগান।
বাঁশবাগান! খিলখিল করে হাসছে সুদামা, কী সুন্দর কথা বল তুমি সুহাস, বাঁশবাগান কেন?
এমনি! বাঁশ কেটে চালান দেন, কত বাঁশ প্রয়োজন ভারতবর্ষে, এ নিয়ে আর একটা ডিসকাসন হতে পারে, হ্যাঁ আমাদের দেশের রোদ্দুরও কিছুটা কিনছেন অজিত আগরওয়ালজি, নরওয়ের এক কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ, শীতের দেশে রোদ্দুর সাপ্লাই করবেন, ওফ, কী রোদ না হয়েছে ম্যাডাম, বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, মালদহে খরা, জল নেই, এত রোদ আর কোনো দেশে হয়, গ্রিনল্যান্ডে সাপ্লাই যদি করা যেত —
কী চমৎকার বলছ, চেরাপুঞ্জির মেঘ গোবি সাহারার বুকে, সুহাস তুমি কি কবিতা লেখো?
নো ম্যাডাম, আপনি এখন কী করছিলেন?
কী আর কিছুই না, তুমি?
কিছুই না ম্যাডাম, কিছুই না, আমাদের এখানে ক-দিন খুব দৌড়-ঝাঁপ চলে, আবার ঠান্ডা, ভাঁটা পড়ে কদিনের জন্য, অমাবস্যা-পূর্ণিমা, দিন-রাত, জোয়ার-ভাঁটার মতো, আপনি এখন কি ঘুমিয়েছিলেন?
না, না তোমার ফোনের জন্য বসেছিলাম।
ভাবতে ভাবতে রিসিভার তুলবে সুহাস, তো ঘরে ঢুকল অনিলবরণ, শোনো সুহাস, মার্ডার ইজ অ্যান আর্ট, তুমি কি বিশ্বাস কর?
টেলিফোন নামিয়ে সুহাস বলল, কেউ কি বিশ্বাস করে এ কথা?
আমি করি, অনিলবরণের কন্ঠস্বরে প্রত্যয়, মাথায় দশটা খুন বিজবিজ করছে।
সুহাস চুপ করে থাকে। তার খুব ইচ্ছা করছিল সুদামার সঙ্গে কথা বলে। হ্যাঁ, ওই কথাগুলোই হবে। কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জির স্ত্রী খুব খুশি হবে তার ফোন পেয়ে, রাগ করবে, কী ব্যাপার, আর তো ফোন করলেন না?
ব্যস্ত ছিলাম ম্যাডাম।
কিসে ব্যস্ত?
আপনি একটা কাজ দিয়েছেন।
কী কাজ?
মেঘের খবর।
ও তাই নাকি। ওপারে নারীকন্ঠে উচ্ছ্বাস শোনা যায়, জানলেন কিছু?
সুহাস বলে, জানি না আপনি ছাড়া আর কেউ এসব বিশ্বাস করে কিনা।
অনিলবরণ চেয়ার জুড়ে বসে, বিদেশে এসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হয়।
আমি তো শুনিনি স্যার।
ইন্টারেস্ট থাকলে তো শুনবে, এখন তো সিরিয়াস ব্যাপারে কারওর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সুহাস তুমি কি জানো, হোয়াট ইজ পয়জন?
সুহাস হাসবে, না খুব গম্ভীর হয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো অনিলবরণের সামনে বসে থাকবে তা ঠিক করতে পারছিল না। অনিলবরণ মাঝে-মধ্যে এইরকম বিচিত্র বিষয় নিয়ে কথা আরম্ভ করে। আর সব কথাই ধ্বংসাত্মক। একদিন সেই কথা নিয়ে অনিলবরণ দু-ঘণ্টাই কাটিয়ে দিল পাঁচটার পর, পুলিশ রেপ এবং মার্ডার, লকআপে পিটিয়ে মারা। মেজাজই খারাপ করে দেয় মানুষটা। সময় পেলেই যত সব হিংস্রতা নিয়ে কথা বলে। হাওড়ায় যে একটা মানুষকে কিছু লোক পিটিয়ে পুড়িয়ে দিল, অনিলবরণ বলে, একটা-দুটো এসব ব্যাপার হলে অ্যান্টি-সোশ্যালরা সতর্ক হবে, হিংস্রতা চরমে উঠে গেলেই মানুষ আবার তার নিজস্ব ভূমিতে ফিরবে, শান্ত হবে, নরম হবে। অনিলবরণ সাপোর্ট করে এসব। দেশকে একটা ভালো জায়গায় আনতে হলে ড্রাসটিক স্টেপস নেওয়া প্রয়োজন। কিছু বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষের হাতে ক্ষমতা যাওয়া দরকার। শুনতে শুনতে রাগ হয় সুহাসের। সে তর্ক জোড়ে।
সুহাস ইদানীং ভয় করে অনিলবরণকে। এখন সে যেভাবে বসেছে তাতে ঘন্টা-দেড়েকের আগে উঠবে না। সন্ধের পর চ্যাটার্জি সায়েবই তো ফিরে যাবেন ঘরে, তার তো ইচ্ছে করছিল ফোন করে। সুদামা, তুমি কী করছিলে? সুহাস দাঁতে ঠোঁট কাটে, আপনি কি অমিতাভ ঘোষ পড়েছেন ম্যাডাম, বিক্রম শেঠ? কী ছবি দেখলেন ইদানীং, রশোমন দেখেছেন কুরোসোয়ার, কী নাটক, নাটক দেখতে ভালোবাসেন?
অনিলবরণ বলে, তুমি আগাথা ক্রিস্টি পড়েছ, কোনান ডয়েল?
হ্যাঁ স্যার।
মার্ডার মিস্ট্রিগুলো অদ্ভুত না! খুনিরা খুব ইনভেনটিভ হয়, আনার মনে হয় পয়জনিং একটা আর্ট, তুমি কী বল?
জানি না স্যার, গাঁয়ে দেখেছি স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে চাষি বউরা খেতের পোকা-মাকড় মারার বিষ তেল, এনড্রিন খেয়ে মরো-মরো, কী কষ্ট, একটা কেস আমি সিউড়ি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম, আপনি হঠাৎ যে এ নিয়ে ভাবছেন?
অনিলবরণ বলে, একটা রহস্য উপন্যাস আরম্ভ করব। খুনটা কী দিয়ে হবে, বিষ! নিঃশব্দে মৃত্যু অথবা গুলি বন্দুক, গলায় ফাঁস দিয়ে, কতরকমভাবে মার্ডার করা যায় জানো তুমি? অনিলবরণের মাথায় চাঁদের পরে চাঁদ লেগেছে …।
নো স্যার।
একশো পঁচানব্বই রকমের উপায় আছে, যাকে খুন করা হবে তার উপরেই নির্ভর করবে কীভাবে তাকে খুন করা হবে, ধরো কোনো বাচ্চা সবে জন্মাল, জাস্ট বেরিয়েছে, তাকে যদি সরাতে চাও, সেরেফ লবণ, কমন সল্ট, সোডিয়াম ক্লোরাইড, আমি তুমি লবণ ছাড়া কিছুই খেতে পারব না, অথচ ওই লবণই হল আর একজনের কাছে বিষতুল্য।
সুহাস অবাক হয়ে অনিলবরণের মুখে তাকিয়ে আছে। কীরকম নির্বিকার হয়ে সদ্য জন্মানো শিশু-খুনের কথা বলে গেল। ভেবেছে নিশ্চয়ই। অনিলবরণ বলছে, আন ওয়ান্টেড বেবিকে এভাবেই তো শেষ করে দেওয়া হত, বিষ আমাদের চারপাশে আছে, শুধু কেস বুঝে প্রয়োগ করতে হবে। হিটলারের জার্মানিতে অসুস্থ মানুষ, দুর্বল মানুষ, অসুস্থ বাচ্চাদের মেরে ফেলা হত, তা জানো? মার্সি কিলিং শব্দটা শুনেছ? বিষ ইনজেকশন দিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হত চিরকালের মতো, আরে বাচ্চাদের ফ্যামিলির লোকই রাষ্ট্রের কাছে মার্সি কিলিং-এর আবেদন জানাত, নাৎসি জার্মানির মানুষকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল অসুস্থ দুর্বল মানুষ সমাজের বোঝা।
সুহাস বলল, ভয় লাগে শুনতে, এসব আমার ভাবতে ভালো লাগে না।
অনিলবরণ হাসে, ভাবতে ভাবতে আমার তো ঘুমই আসে না, খুন করা খুব সহজ ব্যাপার, তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিলেই হল, তোমাকে যদি আচমকা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই টেনথ ফ্লোর থেকে, মরে যাবে। তোমাকে ধর মেট্রো রেল স্টেশনে ছোট্ট একটা ধাক্কা, নীচে পড়ে গেলে, হাই ভোল্টেজ লাইন, সঙ্গে সঙ্গে শেষ, ওডেসা ফাইল-এ এইরকম একটা দৃশ্য ছিল না?
মনে নেই স্যার।
অনিলবরণ হাসে, তোমার ইন্টারস্টেই নেই তাই মনে নেই, ছুরি বন্দুক তো এখন হয়েছে, আগে তো এসব ছিল না, মার্ডার হতই, তখন ছিল পয়জন, আসলে কী জানো, ছুরি বন্দুক আমার খুব খারাপ লাগে। মৃত্যু ঘটানো উচিত রক্তপাতহীনভাবে, ঘুমের ঘোরে নিঃশব্দে মারা যাক মানুষ, হাসতে হাসতে মারা যাক। হার্টের রোগীকে আচমকা ভয় দেখিয়ে মারা যায়, হাই প্রেসারের পেশেন্ট-এর টেনশন বাড়িয়ে বাড়িয়ে মেরে ফেলা যায়, এ হল মার্ডারের সবচেয়ে সূক্ষ্ম টেকনিক, ধরতেও পারবে না, মার্ডার না অ্যাকসিডেন্ট। নাৎসিরা এসব নিয়ে গবেষণা করত, তাদের মতো ক্রিয়েটিভ খুনি পৃথিবীতে আর জন্মায়নি।
না জন্মানোই তো ভালো। সুহাস বলে।
অনিলবরণ শোনে না সুহাসের কথা, বিড়বিড় করে, কতরকম যে খুনের পদ্ধতি ছিল, তাদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে কত মানুষ একসঙ্গে মেরেছে। মেয়েদের পাঠাল স্নানঘরে, বাথ হাউসে, চুল কেটে, জামাকাপড় খুলে, হাতে সাবান তোয়ালে নিয়ে তারা ঢুকে যাচ্ছে মৃত্যু গহ্বরে — ওফ ভাবতে পারো, মানুষ খুনের কী বিচিত্র উপায় উদ্ভাবন করেছিল হিটলারের পুলিশ, সেনাবাহিনী, নিশ্চিন্তে মৃত্যুর দিকে হাঁটছে নগ্ন নারীরা।
সুহাস বলল, আমার সত্যিই এসব শুনতে ভালো লাগে না স্যার।
অনিলবরণ হাসে, তুমি একটা ফোন করতে যাচ্ছিলে, আমি ঢুকে পড়ায় ফোনটা রেখে দিলে, জরুরি ছিল? ফোনটা করে নাও, আসলে আমি কীভাবে খুনটা করব তা ঠিক করতে পারছি না, এ তো স্রেফ ডিসকাসন, জাস্ট ডিসকাসন, তার বেশি কিছু নয়। আমি ঘুরে আসছি, তুমি ফোনটা সেরে নাও। বেয়ারা ডেকে চা বলে দাও দেখি।
তেরো
কেউ একজন খুব হবে, কাউকে খুন করা হবে, কিন্তু কীভাবে? মানুষ খুন করার সবচেয়ে পুরোনো পদ্ধতি হল বিষ প্রয়োগ। বিষ কী? বিষ তো প্রতিদিন একটু একটু করে আমরা আমাদের শরীরে গ্রহণ করে থাকি। যে জীবনদায়ী ওষুধ ব্যবহার করছি জীবন বাঁচানোর জন্য, তাই-ই পরিবেশ এবং পরিপ্রেক্ষিত বদলে গেলে হননের উপকরণ হয়ে উঠতে পারে। আবার এর বিপরীতও হয়ে থাকে। যে উপকরণকে বিষ বলে জানি আমরা, তাই-ই কোনো কোনো সময়ে জীবনদায়ী উপাদান হয়ে ওঠে। আর্সেনিক-পারদ-সিসা, কিছু অ্যালকালয়েড যেমন, মরফিন, স্ট্রিকনিন ইত্যাদি তো তীব্র বিষ, অথচ এই বিষই আবার অনেক ক্ষেত্রে দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিষ এক আশ্চর্য জিনিস। যাকে খুন করা হবে, তার শরীর-ই বলে দেয় তার উপরে কোন বিষ প্রয়োগ করা যেতে পারে। অনিলবরণ লিখছে।
অনিলবরণ লিখছে, বিষ বহুক্ষেত্রে ইতিহাসের গতি বদলে দিয়েছে। অবলুপ্তির পথে পাঠিয়েছে বহু রাজবংশকে। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নতুন শাসককে। মধ্যযুগ, প্রাচীন যুগ, আদিম যুগে বিষচর্চা ছিল রীতিমতো শিক্ষার বিষয়। বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগ কৌশল-নিপুণ মানুষ সম্মানিত হত ইতিহাসখ্যাত নগরে। আশ্চর্য। সেই যে যুগে নারীরাই প্রধান ভূমিকা নিতেন বিষচর্চায়। তাঁদের সেইভাবে তৈরি করত রাষ্ট্রশাসকরা, নারীর কোমল রূপটিকে বিষ প্রয়োগ কর্ত্রী হিসেবে ব্যবহার করতে সুবিধে হত অনেক। অন্ন, জলদাত্রী, স্নেহ-মায়াদাত্রী নারীর হাতে যে বিষপাত্র থাকতে পারে, এ ছিল কল্পনার অতীত। ইতিহাসে কত বিষকন্যার কথাই না আছে। খ্রিস্টজন্মের চারশো বছর আগে পারস্য দেশের রানি ছিলেন বিষ প্রয়োগে সিদ্ধ। তিনি তাঁর পুত্রবধূকে এক আশ্চর্য উপায়ে হত্যা করেন। খ্রিস্টজন্মের দুশো বছর আগে রোমের অভিজাত পরিবারের নারীরা বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগে ছিল নিপুণা। সম্রাট নিরোর মা আগরিপিনা বিষ প্রস্তুতের জন্য নিয়োগ করেছিলেন রোমেরই আর এক বিষকন্যাকে। তারপর সে-ই বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন স্বামী ক্লদিয়াসকে। রোমের সেই বিষকন্যাকে সম্রাট নিরো সিংহাসনে বসার পর পুরস্কৃত করেন রাষ্ট্রীয় সম্মানে। রাষ্ট্রীয় বিষকন্যা রীতিমতো শিক্ষণপ্রণালী চালু করে দেয় বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগ বিষয়ে। নানারকম বিষরে খবর রাখত সে। সম্রাট তার কাছে দাসদের পাঠাতেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। সেইসব দুর্ভাগা দাসদের উপর সে বিষ প্রয়োগ করে তার বিষের গুণাগুণ নির্ধারণ করত। কী আশ্চর্য দিনই না ছিল! কীভাবে খুন করা যেতে পারে তা নিয়ে চর্চা হত রীতিমতো। এখন এইরূপ দেখা যায় না।
অনিলবরণ লেখে, মানুষের জ্ঞানচর্চার একটি মূল্যবান দিকই অবহেলিত। মৃত্যু তো স্বাভাবিক সত্য। বিষচর্চা তো মৃত্যুচর্চা। বুদ্ধিমান মানুষ গোপনে জ্ঞানের এই মূল্যবান শাখাটিকে আবার চর্চা করতে পারে। আমাদের পরিবারে এইরূপ চর্চা ছিল। শোনা যায়, আমার পিতামহ নগেন্দ্রর অনুজ সুরেন্দ্রকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন তাঁরই আর এক অগ্রজ নরেন্দ্র। দুজনে একই ব্যাবসা করতেন। আবার নরেন্দ্রর পুত্র জীবেন্দ্রকে সেঁকো বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন সুরেন্দ্রর বিধবা পত্নী। এই রকম আরও অনেক ঘটনার কথা জানা যায়। প্রতি পরিবারেই বিষের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। হননের ইচ্ছা মানুষের জন্মগত। শিশুরা তো কীটপতঙ্গ। ছোটোখাটো প্রাণী হত্যায় উল্লাস অনুভব করে। কৈশোরে উপনীত হলে সেই ইচ্ছাটি চাপা পড়ে যায় অন্য অনেক অনুভূতির ভেতরে। যৌবনে মানুষ প্রেম ভালোবাসায় জড়ায়। মধ্যবয়সের পর আবার তার ভিতরে হননের ইচ্ছা জেগে উঠতে থাকে। হ্যাঁ, এটাই সত্য।
অনিলবরণ লেখে, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক আনুকূল্য না পাওয়ায় নারীর সেই নিজস্ব প্রকৃতি আজ যেন অন্তর্হিত। বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগের বিদ্যাটি আজ অবলুপ্তির পথে। নরহত্যার নানা উপায় আবিষ্কৃত হওয়ায় বিষের ভূমিকা ক্রমশ গৌণ। আমার মাতুলালয়ে, বড়ো মাতুল স্বর্গীয় বিমানবিহারী গুহ মহাশয়কে পারদ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি গলিত দেহে যন্ত্রণাকাতর হয়েছিলেন অনেককাল। না মাতুলানী তো তখন বেঁচেই ছিলেন না। মা বলতেন, মাতুলকে হত্যা করেছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ির কেউ একজন। তারা সন্দেহ করত তাদের বাড়ির মেয়ে, আমার মাতুলানী স্বর্গীয়া রানিবালা দেবীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিলেন তাদেরই জামাই, আমার মাতুল।
অনিলবরণ লেখে, বিষ প্রয়োগ করা হত কেবলমাত্র শক্তিমানকে হত্যার জন্য। বিষ অতি মহার্ঘ বস্তু, তা যত্রতত্র প্রয়োগ করা হত না। নারী হত্যায় বিষপ্রয়োগের কথা তেমন শোনা যায় না। দুর্বল অরক্ষিতা নারীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার প্রয়োজন হত কিনা সন্দেহ আছে, নারী হত্যার জন্য আগের দিনে অর্থাৎ একশো দুশো বছর, কি পঞ্চাশ বছর আগেও বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন হত না। এখনও হয় না। বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে হলে হত্যাকারীকে নানান পরিকল্পনা করতে হয়, বিষ প্রয়োগের জন্য সময় নির্বাচন করতে হয়। হত্যাকারীকে তার মনোবাসনা গোপন রাখতে হয়। হতভাগ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে হয়। এবং এই ঘনিষ্ঠতা নারীর দ্বারা স্থাপন করা সবচেয়ে সহজভাবে সম্ভব ছিল। এমন ঘটনাও শোনা গেছে হতভাগ্য পুরুষের সঙ্গে মিলনের পর নারীকে তার হাতে তুলে দিতে হয়েছে বিষ পানীয়।
নারী হত্যার জন্য আগুনই যথেষ্ট। গৃহবধূকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যার পদ্ধতি অনেক পুরোনো। নারীকে জন্তু জানোয়ার কীটপতঙ্গের ন্যায় হত্যা করাই হল সামাজিক পদ্ধতি। কখনও পেট্রল ও দেশলাই কাঠি, কখনও রিভলবারের একটি গুলিই সেখানে যথেষ্ট। অতি সম্প্রতি জনৈক রাজনীতির কারবারি নেতা নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে হত্যা করে হোটেলের তন্দুর চুল্লিতে দাহ করে দেহটি নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। শেষ রক্ষা হয়নি বটে, কিন্তু সে যদি দাহ কাজটি সম্পন্ন করে ফেলতে পারত, ওই হত্যাকাণ্ডের কিনারা হত না। আর একটি ঘটনার কথা শোনা গেছে, স্ত্রী হত্যা করে সেই দেহ খণ্ড খণ্ড করে কুমীর দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে কোনো এক ক্ষমতাধারী রাজনৈতিক নেতা। বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগের কারণে নারীকে যেহেতু ব্যবহার করা হত নিপুণভাবে, নারীও আত্মহত্যার জন্য বিষ ব্যবহার করত। এখনও আত্মহত্যার জন্য বিষ কিংবা অ্যাসিড ব্যবহার করে থাকে স্ত্রীজাতি।
একটি কথা মনে হয়, বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগে খুনির উদ্ভাবনী শক্তির যে পরিচয় পাওয়া যেত, তা ক্রমশই অন্তর্হিত। এই সব হত্যাকাণ্ডে অপরাধী এবং রহস্যভেদী যেন গোপনে পরস্পরে বুদ্ধির খেলায় রত হতেন। সেইরূপ এখন আর দেখা যায় না। পরবর্তীকালে খুনি, অপরাধী আত্মপ্রকাশ করেই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকে। সেক্ষেত্রে কোনো রহস্যই আর থামে না রহস্যভেদীর জন্য। তবে হ্যাঁ, অপরাধীর খুনের বিচিত্র সব উপায় উদ্ভাবন কিন্তু কখনওই থেকে থাকে না। এই বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল হিটলারের জার্মানিতে গ্যাস চেম্বারে লক্ষ লক্ষ নরনারী হত্যার ভেতর দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনেক অপরাধী ও অপরাধকে আলোয় এনেছে। অপরাধী অন্ধকারে গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজন আর বোধ করেনি তখন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তীকাল হল হননের নানারূপ পদ্ধতি উদ্ভাবনের সময়। গ্যাস চেম্বার, বিষ ইনজেকশন, অনাকাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমা দিয়ে জনপদের পর জনপদকে ধ্বংস করেও অপরাধীর মনোবিকলনের কোনো চিহ্নের খবর আমরা পাইনি। গণহত্যাকে রাষ্ট্র নায়কদের সাফল্যের চিহ্নস্বরূপ মানা হতে লাগল মহাযুদ্ধের পর থেকেই। গণহত্যার পক্ষে রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রশাসকরা যুক্তি সাজিয়ে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। সাতের দশকের প্রথম ভাগে এই পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতাভোগী রাজনীতিক এবং পুলিশ বাহিনী গণহত্যার যে অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তার রেশ এখনও কাটেনি। সেই সব হত্যাকারীর রক্তই এখনও পুলিশ বাহিনীর ভেতরে যত্রতত্র জেগে ওঠে। এই পৃথিবীতে হত্যাকারীর মৃত্যু অতি সহজে হয় না। হত্যাকারী আগে হত্যাকাণ্ডের পক্ষে যুক্তি সাজাতে ভয় পেত, এখন তারা অসংখ্য যুক্তি সাজিয়ে হত্যাকাণ্ডকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের চেহারা দিতে পারছে। নাৎসি জার্মান জাতি পরাস্ত জাতি, জনগোষ্ঠী, ইহুদিদের নির্মূল করার পক্ষে অনেক যুক্তি সাজিয়েছিল। হত্যার পক্ষে হত্যাকারীর যুক্তি সাজানোর আরম্ভ যেন সেই প্রথম। তারপর সেই ধারাই চলছে। পুলিশ বাহিনী কী চমৎকার না যুক্তি উত্থাপন করে। লকআপে পিটিয়ে মেরে, ধৃতের চক্ষুতে অ্যাসিড ঢেলে অন্ধ করে দিয়ে পুলিশ বাহিনী কিন্তু অন্ধকারে গা ঢাকা দেয় না।
বিষ প্রয়োগে হত্যার ভেতরে হিংস্রতার প্রকাশ হত কম। ধীরে ধীরে হতভাগ্যর প্রাণচাঞ্চল্য স্তিমিত হয়ে আসত। ঘুমিয়ে পড়ত সে। আমার মনে হয় মানুষ এখন হিংস্রতা চায়, এবং সেই কারণেই বিষের ব্যবহার কমে গেছে। বিষ প্রয়োগে যে হিংস্রতা ছিল না তা নয়, যে কোনো হত্যার ভেতরে লুকোনো হিংসা থাকেই। কিন্তু তা লুকোনোই মাত্র। ওই হত্যাকাণ্ড আর পাঁচজনকে অপরাধে প্রবৃত্ত হতে প্ররোচিত করতে পারত না। গ্যাস চেম্বার, হিরোসিমা, নাগাসাকি, ভিয়েতনামের গ্রাম — হিংস্রতাকে আলোয় এনেছে। হত্যাকারীর জান্তব উল্লাসে রহস্যভেদী অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে। বিষপ্রয়োগে হত্যাকারীর জান্তব উল্লাস প্রকাশ যথাযথ হওয়া সম্ভব নয়। বরং অস্ত্রের সাহায্যে রক্তপাত ঘটালে সেই রক্তদর্শনে আর একটি হত্যার ইচ্ছা তার ভেতরে জেগে উঠতে পারে। পুলিশকে ক্ষমতা প্রকাশ করতে একটি হত্যা করলে তো চলে না। হননের অভ্যাস বজায় রাখার কারণে পিটিয়ে মারাই তাদের কাছে প্রিয়তম পদ্ধতি।
অথচ বিষের কী শক্তিই না ছিল। বিষচর্চা অব্যাহত থাকলে আজ যাবতীয় হত্যাকারীর বিরুদ্ধে এত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারত না। আহা কী দিনই-না পার হয়ে গেছে! ধুতুরা, কলকে ফুল, লাল চিত্রা, আকন্দ, রক্তকরবী দিয়ে কী ভাবেই না নর হত্যা করা হত। প্রকৃতিদত্ত এই বিষভাণ্ড ত্যাগ করে হত্যাকারী তার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রটিই হারিয়েছে যেন। ফুল যেমন মন স্নিগ্ধ করে, ফুল তো জীবনহানিও করতে পারে। প্রকৃতিতে এগুলি আছে ব্যবহারের জন্যই। মানুষের মাথার ভেতরে কাঠগোলাপ, রক্তগোলাপ, জুঁই, চামেলি, বেলি, রজনীগন্ধা, কাঁটালি চাপা যেমন ফোটে, আকন্দ, ধুতুরাও তো ফোটে। কিন্তু সে কথা কে মনে রেখেছে? পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য ধনী রাষ্ট্রগুলি বারুদের গন্ধই পছন্দ করে বেশি। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা অস্ত্র উৎপাদন করে যাচ্ছে, আর তা ব্যবহারের জন্য যুদ্ধ বাধাচ্ছে। যুদ্ধ চলছে, গণহত্যার জন্য বিষ উপযুক্ত নয়, তাই অস্ত্রের এত রমরমা। এতে খুনির উদ্ভাবন শক্তির দৈন্যই প্রকাশ পাচ্ছে বেশি, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। মানুষ এখন অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল বেশি, ফলে বিষচর্চা, মৃত্যু চর্চার জটিলতা ক্রমশ অন্তর্হিত। সমাজে তার ছায়া। সিনেমা বায়োস্কোপে তার প্রয়োগ। হিংস্রতা কত প্রখর হতে পারে তা উদ্ভাবনেই ব্যস্ত যেন হত্যাকারী। আমার ভয় হয়, হিংস্রতা শিখর ছুঁয়ে গেলে হত্যাকারী তা নিজের উপরেই না প্রয়োগ করে বসে। কেননা হতভাগ্যের আর্তনাদ, হতভাগ্যের বেদনা কত তীব্র হতে পারে তা শ্রবণ, দর্শনের জন্যই তো হত্যাকারীর হিংস্রতা চর্চা। মৃত্যুচর্চা এখন হিংস্রতা চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হতভাগ্যের আর্তনাদ, কান্না যেন সংগীতের মতো হত্যাকারীর কানে বাজে। রহস্যভেদীর সামনে থেকে যাবতীয় রহস্য উধাও হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এই হিংস্রতা চর্চা নরহত্যা থেকে অন্যদিকেও সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। নরনারীর ভালোবাসার প্রকাশে এর ছায়া পড়ছে দেখে আমি স্তম্ভিত হচ্ছি। পুরুষ নারীর দিকে ধাবিত হচ্ছে হিংস্র ভালোবাসা নিয়ে। সমাজে এই ছায়া গোপনে বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। নারীও যেন পুরুষের কাছে হত হওয়ার জন্যই নিজেকে নিবেদনে আগ্রহী। নারীর শরীর খণ্ড খণ্ড করে ভক্ষণ করায় যেন পুরুষের আগ্রহ। মৃত্যুচর্চার গোপনীয়তা অন্তর্হিত হয়ে যাওয়ার কারণেই কি ভালোবাসার গোপনীয়তা, নারী, সৌন্দর্যের গোপনীয়তাও বিলীয়মান? আশ্চর্য! পণ্যের গুণাগুণ প্রচারেও হিংস্রতাই মূল মাধ্যম। কখনও তা প্রত্যক্ষে, কখনও তা পরোক্ষে। সাবান থেকে ওয়াশিং মেশিন, জীবনদায়ী টনিক থেকে শীতল পানীয় — সর্বত্রই এই প্রবণতা।
অনিলবরণ লিখতে লিখতে ওঠে, জল খায়। লিখতে লিখতে সে বিভ্রান্ত বোধ করে। সে যা লিখছে তা তার বিপক্ষে যাচ্ছে, কেননা মৃত্যু চর্চাই যদি পৃথিবীতে না থাকে, তাহলে সে লিখবে কী? তার রহস্যভেদী কোন রহস্য উদঘাটন করবে? তার উপন্যাসের হত্যাকারীই-বা কে? হত মানুষটিই-বা কে? সে ধরতে পারছে তার উপন্যাসের আসল জটটি কোথায়? হতভাগ্য নারী হলে, সে তো নিজেই হত হওয়ার জন্য হত্যাকারীকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন। আর হত্যাকারী তো হত্যার কথা হিংস্র কণ্ঠে দশদিককে জানিয়ে দিচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে, যেমন সাজায় পুলিশ, যুদ্ধবাজ দেশ, যেমন সাজিয়েছিল হিটলারের নাৎসি পার্টি, যেমন সাজিয়েছিল অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমার প্রয়োগকর্তা, ধনী রাষ্ট্রের প্রধান। এখন তাহলে রহস্যভেদীর কাজ রহস্য উদঘাটন নয়, হত্যাকারীর সঙ্গে যুক্তির লড়াই-এ বসা। অনিলবরণ কলম থামিয়ে নিঝুম হয়ে বসে থাকল।
রহস্যভেদী হত্যার বিপক্ষে হত্যাকারীর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। তর্কে। রহস্যভেদী কি অতিমানব হিটলারের মুখোমুখি বসবে, গ্যোয়েরিং, গোয়েবলস হিটলারের বিপক্ষে বসবে। সে কি রাষ্ট্রনায়কদের মুখোমুখি, সেনাবাহিনী, পুলিশের মুখোমুখি বসে হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে বলবে? কী বলবে? অনিলবরণের মনে হয় রহস্যভেদীর চেয়ে হত্যাকারীর হাতে যুক্তি অনেক বেশি — তা তো সে এতকাল শুনছে। কলম থামিয়ে মাথা নামিয়ে বসে আছে অনিলবরণ। রহস্যহীন হত্যাকাণ্ডের জালে পড়েছে সে। হিংস্রকণ্ঠে হত্যাকারী তাকে যুক্তির জালে ফেলেছে। অথচ সে নিজেই তো হত্যাকাণ্ডের পক্ষে থাকতে চায়, অন্তত তার উপন্যাসের অপরাধী তো থাকতেই চায়। অপরাধীকে সেইভাবেই তো সে নির্মাণ করতে চায়। অনিলবরণ আবার বিশেষ কথা ভাবতে চেষ্টা করল। আরম্ভ করতে চাইল প্রথম থেকে।
চোদ্দ
কলম নিয়ে চুপচাপ অনিলবরণের কলমটি ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় নিজের লেখাটি আগাগোড়া পাঠ করে। সে তো তার নিজের কথার বাইরে চলে গেছে। একটি খুনের কথাই তো ভাবতে হবে তাকে। গণহত্যা, রাষ্ট্রীয় হত্যা, হিংস্রতার সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না তার রহস্যভেদী। তার অপরাধীও অতদূর পৌঁছতে পারবে না।
অনিলবরণ প্রথম থেকে আরম্ভ করে — একটি খুন হবে। তার রহস্যও ভেদ করা হবে। খুন হবে কেননা মানুষের মনে হননের ইচ্ছা মাঝে মধ্যেই জেগে ওঠে। কত সামান্য কারণেই না মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তার প্রতিবেশী, সহবাসীকে হত্যা করার কথা ভাবে। হত্যা না করুক, কত জনের মৃত্যুকামনা করছে গোপনে। একাকী মানুষ দুই কামনার ভেতরেই দিন অতিবাহিত করে। যৌনতা এবং মৃত্যু। বিবাহের পূর্বে আমার প্রেমিকা কঙ্কনা আমার কল্পনায় যে কতরকম ভাবে এসেছে। ভালোবাসা, যৌনতা, অথচ এখন! আচমকা আমার মনে হয়, আমার স্ত্রী কঙ্কনা যদি মরে যায় তো আমি বেঁচে যাই। যেদিন কঙ্কনা দুই মেয়ে নিয়ে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে ট্যাক্সিতে চেপে বাপের বাড়ি বালিগঞ্জ প্লেসের উদ্দেশ্যে রওনা হল, আমি ভাবছিলাম ফোন বাজবে। ফোনে খবর হবে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বাইপাসে, এক মহিলা মারা গেছেন, বাচ্চা দুটি আঁচড়বিহীন। বাচ্চা দুটি অক্ষত।
এইরকম একটি ঘটনার কথা কয়েকদিন আগেই পড়েছিল অনিলবরণ। হ্যাঁ, ফোন বাজল। ফোন বাজতে সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। নিশ্চয়ই সেই খবর এসেছে। ফোনের রিসিভার কানে ধরতে ওপার থেকে কঙ্কনার কন্ঠস্বর ভেসে এল। বাড়ি পৌঁছেছে সে। বাড়ি পৌঁছনোর শব্দে কী নিশ্চিন্তই না হয়েছিল সে। অথচ কয়েক মুহূর্ত আগে মৃত্যু ভাবনায় বিভোর হয়ে গিয়েছিল।
মাসখানেকের উপর হয়ে গেছে কঙ্কনা এই ফ্ল্যাটে নেই। অনিলবরণ একটু আগে ফোন করেছিল, ধরেছিল শ্বাশুড়ি। তুমি নিজে এসে নিয়ে যাও, হ্যাঁ, তুমি কি পাগল, দু-বারের পর তৃতীয়বার মা হয় কেউ? সিজার বেবি দুটোই, থার্ড টাইম সিজার করতে গেলে আমার মেয়ে বাঁচবে না, তুমি কি তাকে খুন করতে চাও?
চায়ই তো অনিলবরণ! তার তো মনেই হয় তা। সবসময় নয়, কোনো কোনো সময়। কঙ্কনারও যে তা মনে হয় না, একথা মনে করার কারণ নেই। মানুষ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কতজনকে মনে মনে হত্যা করছে। সে তো সামান্য রহস্য ঔপন্যাসের লেখক। এ পৃথিবীর ইতিহাসই তো চরম হত্যাকাণ্ড নির্ভর। প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হেরে গেলে তার মৃত্যু ঘটায় মানুষ মনে মনে।
অনিলবরণ এই অবধি লিখে থামল। ধীরে ধীরে ফোনের দিকে ঝুঁকল। রিসিভার তুলে পটাপট ডায়াল করতে থাকে, আমি অনিলবরণ বলছি, ঘোষচৌধুরী, চ্যাটার্জি আছে?
ওপারে হাসি, রহস্য ঔপন্যাসিক? সুদামার মনের মেঘ কেটে গেছে, ওই লোকের যে অত বুদ্ধি হবে না তার ওর লেখা পড়লে ধরা যায়।
অনিলবরণ বিস্মিত হয়, সুদামা চ্যাটার্জি তার সঙ্গে যে এইভাবে কথা বলতে পারে, তা তার ভাবনার অতীত। মহিলা তো দাম্ভিক। তবে তার তো ভালোই লাগে। ওকে। ইদানীং লাগছে। কী চমৎকার একটি সূত্র দিয়েছে তাকে। ওই সূত্রটিকে নিয়ে খেলা করা দরকার মনে মনে। ওই সূত্র থেকে এটি পরিষ্কার হয় যে সুদামা চ্যাটার্জিও গোপনে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সাজায়। সাজাতে পারে।
সুদামা বলল, ও নেই, দেরি হবে ফিরতে, বেলগাছিয়া গেছে।
ফোন ধরে কয়েক দণ্ড নিশ্চুপ অনিলবরণ। তাহলে সে কার সঙ্গে কথা বলবে? সুদামা কি তার কথায় কথা যোগ করতে পারবে? এপার থেকে সুদামা জিজ্ঞেস করে, কী দরকার?
অনিলবরণ বলল, দরকার আছে, আচ্ছা ডেথ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
সুদামা হাসতে আরম্ভ করে, কোনো ধারণাই নেই। দেখেছি লোকে মরে যায়।
অনিলবরণের মাথার ভেতরে নতুন একটা সূত্র যেন জেগে উঠতে থাকে। সে বিড়বিড় করে, ডেথ সম্পর্কে জানা গেলে, মানুষের সব সমস্যা মিটে যায়।
সুদামা আবার হাসে, কোনে সমস্যাই মেটে না, আপনি কী জানেন ডেথ নিয়ে?
অনিলবরণ বলে, মৃত্যুটা খুব জরুরি মনে হয় আপনার?
সুদামা বলে, জানি না, এ সব কথার কোনো অর্থ হয় না। আপনার কি কোনো কাজ নেই, মৃত্যু হত্যা এসব নিয়ে ভাবেন সর্বক্ষণ।
অনিলবরণ বলে, মৃত্যু না থাকলে এসব নিয়ে ভাবতেই হত না। আপনি কি বাড়ি আছেন এখন, বেরোচ্ছেন না তো?
সুদামা কপট ভয়ে বলে ওঠে, ও বাবা আপনি এসে আমাকে মৃত্যু বোঝাবেন নাকি, মৃত্যুর কথা ভাবতেই পারি না আমি।
অনিলবরণ বলে, আমি একটু বাদে আপনাকে আবার ফোন করছি, একটা পয়েন্ট মনে পড়ছে, দেখুন মার্ডার এবং মার্ডারারের চরিত্রই বদলে গেছে এখন, যেভাবে বদলে যাচ্ছে প্রেম এবং প্রেমিকের। আমার মনে হয় প্রেম এবং মৃত্যু, একে অপরের উপর নির্ভরশীল, প্রেম নিঃশেষ হলে মৃত্যু অশেষ হয়ে এগোতে পারে, আবার মৃত্যু দুর্বল হলে ভালোবাসা গভীর হয়। — রাখছি, একটু বাদে আমি আপনাকে আবার ধরছি সুদামা, আমাকে এখন হত্যাকারীর সঙ্গে বসতে হবে, মুখোমুখি বসতে হবে, এখন হত্যাকারীই নিজেকে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী বলে ঘোষণা করে হত্যার সপক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে —
আশ্চর্য লাগে সুদামার, তার কৌতূহল বাড়ে, সে জিজ্ঞেস করে, কীরকম?
এই ধরুন না, নানান দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা খুন হয়ে যাচ্ছে, তার দায় নিয়ে হত্যাকারীরা ঘোষণা করছে দেশের জন্য, ঈশ্বরের জন্য এই হত্যাকাণ্ড, এই দেখুন না ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ঘুমন্ত শহরের মানুষকে শেষ করে দিচ্ছে শক্তিমান রাষ্ট্র। টেলিভিশনে সেই ধ্বংস লীলার লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, লোকে দেখছে, শুনছে আক্রমণের পক্ষে কী চমৎকার যুক্তি সাজাচ্ছে হত্যাকারী — তার সঙ্গে আমাকে বসতে হবে, এখন রহস্য উপন্যাস বলুন, হত্যাকাণ্ডের কিনারায় উদ্যোগী রহস্যভেদীর কাহিনি বলুন, তার প্রকৃতিই বদলে যাচ্ছে তা লক্ষ করেছেন? রাখছি।
টেলিফোন রেখে দেয় অনিলবরণ। আবার কলম নিয়ে বসে কাগজের সামনে। মাথা নীচু করে নিঝুম হয়ে বসে থাকে। মৃত্যু! ধ্বংস! হত্যা! প্রেম! ধীরে ধীরে মাথা তোলে অনিলবরণ।
অনিলবরণ লেখে, মৃত্যুর রূপটি কেমন? আমাদের পুরাণে লিখছে মৃত্যু হলেন নারী — পিঙ্গল বর্ণা, রক্তনয়না, রক্তাননা স্বর্ণকুণ্ডল ধারিণী। ব্রহ্মা তাঁকে প্রাণী সংহারের কারণে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বার থেকে জন্ম দিয়েছিলেন। মৃত্যু হলেন ব্রহ্মার ক্রোধাগ্নিজাত। কী আশ্চর্য! মৃত্যুর সৃষ্টি হয় ভয়ার্ত পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য। এখন পৃথিবীকে ভয়ার্ত করে তোলার জন্যই মৃত্যুকে ব্যবহার করা হয়। পুরাণকথিত এই নারী ব্রহ্মার কথামতো সংহার কর্ম করতে ভীত হয়েছিলেন। তিনি নারী, নারীর হৃদয় কোমল, তিনি কী করে এই ভয়ংকর কাজ করবেন। সুস্থ প্রাণীকে বধ করবেন কী করে? শেষ অবধি তো মৃত্যু রাজি হন ব্যাধির সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে। যম ও ব্যধি সংহার কর্মের সূত্র হিসেবে থেকে গেলেন। লোভ, ক্রোধ, অসূয়া, দ্রোহ, মোহ, অলজ্জা ইত্যাদি দোষে দেহ বিদ্ধ হলে মৃত্যু সংহার কর্মে প্রবৃত্ত হবেন বলে ব্রহ্মাকে বললেন।
পুরাণ কথিত সেই মৃত্যুদেবীরই মৃত্যু ঘটেছে বোধহয় আধুনিক পৃথিবীতে। অথবা মৃত্যুকে সংহার কর্মে কোনো ক্রমে রাজি করিয়ে স্রষ্টা ব্রহ্মা এ জগতে এক চরম আঁধারের সূচনা করে দিয়েছিলেন। জন্মের পর সৃষ্টি কর্তার কাছে সংহারকর্মের কথা শুনে, কোমলপ্রাণ সেই নারী বেদনায় যে অশ্রুপাত করেছিল, সেই অশ্রুবিন্দুই হল ব্যাধি। আজ পৃথিবীময় ব্যাধির প্রতাপ। মানুষ কখনও স্ব-ইচ্ছায় গোপনে, কখনও অজান্তে ব্যাধির জন্ম দিয়ে চলেছে নিরন্তর। ভীষণ সব অসুখ মানব সভ্যতার শত্রু হয়ে জন্মাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। সভ্যতা উজাড় হয়ে যেতে পারে আগামী এক শতাব্দী ভেতরে। এইভাবে তো হয়েছেও। চতুর্দশ শতকের প্রথম ভাগে চীন দেশে যে মৃত্যুর সূচনা হয় প্লেগ — ব্ল্যাক ডেথ দিয়ে, উটের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে মরুভূমি গিরিপথ ধরে সেই অসুখ তুরস্কে যায়। তুরস্ক থেকে একপথে যায় অস্ট্রিয়ায়, একপথে বাগদাদ থেকে মিশর, সার্দিনিয়া হয়ে সাইপ্রাস, ইতালির ভেনিস শহরে। তেরো বছরের মধ্যে চীন থেকে এই মহামারী চলে এল সিসিলি, স্পেন, ফ্রান্সে, ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে, ইংল্যান্ড থেকে জার্মানি, জার্মানি থেকে রাশিয়ায়। চতুর্দশ শতাব্দীর ঠিক মধ্যভাগে, ১৩৪৭ থেকে ১৩৫০, এই তিন বছরে ভয়াবহ ব্ল্যাক ডেথ শেষ করে দিয়েছিল ইউরোপকে। প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষকে খেয়ে ফেলে এই দৈত্য। ইংল্যান্ডে মৃতের কবর দেওয়ার মতো জায়গাই অকুলান হয়ে পড়েছিল, মৃতদেহ তখন টেমস নদীতে ফেলে দেওয়া হতে থাকে। কী ভয়ংকর ছিল সেই মৃত্যুর উল্লাস। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণে ইওরোপের সামাজিক গঠনই বদলে যায় সেই সময়। অসংখ্যা প্রভুর মৃত্যুতে দাসরা হয়ে যায় মুক্ত, জমি হয়ে যায় মালিকানাবিহীন। শ্রমিকের অভাবে কারখানা অচল, ফলে শ্রমের মজুরি বেড়ে যায় দ্বিগুণ। অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে যায়। চার্চের প্রভু, যাজকদের মৃত্যুর জন্য খ্রিস্টধর্মের ভিতই প্রায় আলগা হয়ে যায়। সর্বশক্তিমান চার্চের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়ে।
অনিলবরণ লেখে, এত মৃত্যুর পক্ষে প্রকৃতির কি কোনো যুক্তি থাকে? থাকে না, ছিল না। কিন্তু ছিল হিরোসিমা নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা প্রয়োগের পক্ষে। মানুষ এখন নিজেই মৃত্যুদেবীর ভূমিকা নিয়েছে। বিজ্ঞান ব্যাধিকে যত নির্মূল করার পথে এগিয়েছে, মানুষ তত ব্যাধির জন্ম দিয়ে অন্য পথে সংহারকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আমার আশ্চর্য লাগে, বিজ্ঞান যত মানুষকে ব্যাধি থেকে রক্ষা করেছে, মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষকে বোধহয় যাতনা দিয়ে মেরেছে। এসবের পক্ষে হত্যাকারীর কী যুক্তি থাকতে পারে? প্রকৃতি যখন ব্যাধি দিয়ে সংহার কর্মে প্রবৃত্ত হয়, প্রভু, দাস বিচার করে না, আধুনিক পৃথিবীতে হত্যাকারী কিন্তু বিচার পদ্ধতি প্রয়োগ করে। এই পৃথিবীতে মৃত্যু দেবতা অনেক হিসেবি। মৃত্যুকে অন্য চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করছে মানুষ অবিরত। ফলে মৃত্যু তার মহিমা হারিয়ে ফেলেছে, হত্যাকাণ্ডের নিবিড় কল্পনা উধাও হয়ে গেছে, এর জন্য বিষকে ফিরিয়ে এনে পুরাকালের মৃত্যুচর্চায় মগ্ন হতে হবে হত্যাকারীকে।
অনিলবরণ উঠে পড়ে, ডায়াল করে, হ্যাঁ আমি অনিলবরণ বলছি।
আবার! কী হল আপনার মার্ডারের? ওপাশে সুদামা আসছে অনিলবরণের ডাক পেয়ে।
আচ্ছা আমার একটা ব্যাপার মনে পড়ছে, মৃত্যু, হত্যার অন্য চেহারা দিচ্ছে এখন হত্যাকারী। আমার মার্ডারার, যেন বলতে চায় যে এ মৃত্যু আসলে মৃত্যুই নয়, এটা একটা দায়িত্ব পালন করা হল মাত্র …
বুঝতে পারছি না। সুদামা বলে।
আচ্ছা আপনার কখনও কাউকে খুন করতে ইচ্ছে হয়, হয়েছে?
সুদামা হাসতে আরম্ভ করে, হয়নি আবার, কত হয়েছে।
অনিলবরণ বলে, কী রকম হয় বলতে পারেন?
সুদামা আবার হাসছে, মনে হয় বিষ দিয়ে — ইঁদুর মেরেছেন বিষ দিয়ে?
অনিলবরণ চমকায়। আশ্চর্য! তার কথার প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পাচ্ছে সে। ওপার থেকে সুদামা জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ এইসব জিজ্ঞাসার মানে?
অনিলবরণ বলে, আমি একটা বিষয়ে লেখার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, আমার মনে হয় মৃত্যু ছিল প্রাকৃতিক একটি ঘটনা, তা এখন হয়ে গেছে মানুষের হাতে বন্দী কোনো অভুক্ত পশু, এক সময় একটি দুটি মৃত্যু ঘটিয়ে মানুষ অদ্ভুত সব কল্পনার পরিচয় দিয়েছিল। বিষ ছিল সেই কল্পনা প্রয়োগের উপাদান। মার্ডার হয়ে উঠেছিল বিস্ময়কর ঘটনা। এখন তা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর। হত্যাকারী ঘুরছে, রহস্যভেদী লুকিয়ে পড়ছে, বিজ্ঞান যত মানুষকে সুখ দিয়েছে …
সুদামা বলল, আপনি এইসব ভাবেন? সবসময় খুনের পরিকল্পনা করেন, ভাবেন?
হ্যাঁ ভাবি, আমার মনে হয় এক হত্যাকাণ্ড একসময় শিল্প হয়ে ওঠে, বিশ্বাস করেন?
কী জানি, আমার তো ভাবতেই ভয় করে।
ভয় তো আমারও করে, কিন্তু ভয়ই তো আনন্দের বিপরীত অভিব্যক্তি, আমরা জানিও না যে গোপনে কেউ কেউ আমাদের হত্যা করার জন্য ভাবে।
ওপারে সুদামা চুপ। অনিলবরণ ডাকে, হ্যালো, এটাকে সিরিয়াসলি নিতেও পারেন, না নিতেও পারেন। কত লোক আশি-নব্বই বছর পর্যন্ত বাঁচে, তাদের খুনিরা তাদের আগেই মরে যায়, এই রকমই হয় বেশিরভাগ। ধরুন আমাকেও অনেকে খুন করার কথা ভেবেছে, মৃত্যু-কামনা করেছে আমার, পেরে ওঠেনি। তাই বলে আমার পিছনে যে একজন দুজন খুনি নেই, একথা আমি বিশ্বাস করি কী করে?
সুদামা বলল, থামুন দেখি, আপনার বউ কোথায়? কঙ্কনা?
বালিগঞ্জ প্লেসে, ছেড়ে চলে গেছে, এখনও ফেরেনি।
বাচ্চারা?
মায়ের সঙ্গে গেছে।
কেন গেছে তা জানেন?
অনিলবরণ বলল, জানি। জানি এটাও, আমার বউ মনে মনে আমার মৃত্যু-কামনা করে, আমাকে খুন করতে চায়।
আপনি কি পাগল! সুদামা চিৎকার করে ওঠে।
তা কেন, পাগল হব কেন। বলছি আমাদের মনের ভেতরে কতরকম খেলা, আমিও আচমকা ভেবে বসি কঙ্কনা মরে যাক, আমি তাকে খুন করি, হয়ে ওঠে না, পারি না।
কিন্তু কেন, ও কী করল?
কিছুই না, আমার মনে হয় শুধু।
এইরকম মনে হতে হতে যদি কোনোদিন সত্যি ঘটে যায় তা। সুদামা চিৎকার করে, আপনি প্রেমের উপন্যাস লিখুন।
আমি তো মৃত্যুর চর্চা করি, আপনি ব্ল্যাক ডেথের কথা শুনেছেন, ফোরটিনথ সেঞ্চুরিতে —
সুদামা বলে, শুনতে চাই না, আচ্ছা আপনি এত খারাপ কথা ভাবেন কেন সবসময়?
সবাই ভাবে।
না, ভাবে না।
হ্যাঁ ভাবে, হাসে অনিলবরণ, আপনিও ভাবেন, শুনুন আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, অদ্ভুত একটা পরিকল্পনা নিয়েছেন বলে, ওই রকমভাবে খুনের কথা, বুঝতে পারছেন তো গ্যাসের কথা বলছি। আপনি কী করে ভাবলেন, তাই মনে হচ্ছে আপনিও বোধহয় খুনের কথা ভাবতে পারেন। মানে ভাবেন, পরিকল্পনা করেন।
সুদামা কী বলবে বুঝতে পারে না, লোকটা কি চতুর, হিংস্র, না পাগল! সে চুপ করে থাকে। অনিলবরণ ডাকে, শুনেছেন, আপনি যা বলেছেন, তা হল একেবারে আধুনিক পরিকল্পনা। কিন্তু আমার হয়েছে মুশকিল, একটা করিডোর দেখি অফিসে, লম্বা, এপার থেকে ওপার প্রায় দেখা যায় না, মনে হয় ওখানেও একটা খুন হতে পারে, আবার ভাবছি বিষের কথা। মধ্যযুগে কী চমৎকার বিষ তৈরি হত। নানারকম বিষয় মিশে যাচ্ছে, আলাদা করে উঠতে পারছি না। একটা কোনো বিষয়ে স্টিক করে থাকতে পারি না। বিষ থেকে ব্ল্যাক ডেথ, অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমা, লকআপে হত্যাকাণ্ড, নানান দিকে মন ঘুরে যায়, গোলমাল হয়ে যায় সব।
সুদামা বলল, যে কোনো মানুষ দেখলে খুন করতে ইচ্ছে হয় আপনার?
অনিলবরণ বলে, ওইটাতে হয়েছে মুশকিল। ভিকটিম খুঁজে বের করাও একটা প্রব্লেম। ধরুন, খুনের তো একটা কারণ থাকবে। সেই কারণটা আবিষ্কার করাও সহজ নয়। আমার মাথায় ভিকটিমের আদল আছে ছায়া ছায়া, কিন্তু তার মুখখানিকে ট্রেস করতে পারছি না। তবে করে ফেলব ঠিক, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, মুখের সঙ্গে মুখ মিশে যায়। আচ্ছা আপনার এমন মনে হয়?
সুদামা বলল, আপনি তো ভেবেই বসে আছেন আমি বসে বসে মানুষ খুন করার কথা ভাবি — রাবিশ! আপনি ভালো গান শুনুন, সমুদ্রের ধারে গিয়ে বেড়িয়ে আসুন। হাওয়া খান ভালো করে।
তখন অনিলবরণ বলে, সি-বিচটাকে আমার মনে হয় খুনের পক্ষে উত্তম জায়গা ঠিক দুপুর বেলা, বালি পুড়ছে, নোনা বাতাস, লোকজন বিশেষ নেই, একটা লাশ ভেসে এল জলে, হাঙরে মাছে খাওয়া … কী দারুণ দৃশ্য রচনা হবে বলুন!
সুদামা ঝপ করে টেলিফোন রেখে দেয়। অনিলবরণ তখনও বিড়বিড় করছে, পোড়া আকাশ, পোড়া বালি, ভাটায় জল সরে গেছে অনেক দূর, ভেসে এল একটি তরুণী যুবতির লাশ, আবিষ্কার করল এক জেলে, মস্ত কালো শরীর। চারদিকে শুধু লবণ লবণ ভাব …। অনিলবরণ টের পায় ওপাশে কোনো শব্দ নেই।
ফোন রেখে আবার তোলে অনিলবরণ। পটাপট ডায়াল করতে থাকে। সুদামা পুরোটা শুনুক। এভাবে ফোন রেখে দিল কেন? ওপারে রিং হচ্ছে। হ্যাঁ তুলল কেউ …। আমি অনিলবরণ।
হঠাৎ মনে পড়ল, দ্যাখো বাবলির কদিন ধরে জ্বর, বাবা বাবা করছে। রহস্য ঔপন্যাসিক তুমি কি তোমার মেয়েকে দেখে যাবে?
অবাক হয় অনিলবরণ, সে না ডায়াল করল সুদামাকে। ফোন গিয়ে বাজল বালিগঞ্জ প্লেসে। এ তো কঙ্কনার গলা। আশ্চর্য! এ কী করে হয়? অনিলবরণের মাথায় একটি সূত্র খেলা করতে থাকে। চাঁদের গায়ে …। বাবলির জ্বর। কিন্তু তুমি কী করে ফোনটা ধরলে কঙ্কনা, আমি তো অন্য নম্বর ডায়াল করেছিলাম।
ওপারে হাসি, অনেক পাগলামি হয়েছে, যা বললাম তা শুনলে তো।
পনেরো
দুপুরে ঘুম না এলেও ঘুমোতে হয়। এই দীর্ঘ প্রসারিত গ্রীষ্ম দুপুর সে কাটায় কী করে? দুপুরে ঘড়ির কাঁটাও যেন সরে না। সরলেই-বা কী, সুদামার হাতে অফুরন্ত সময়, সেই সময় যে ফুরোয়ই না। তাই ঘুমে ডুবতে হয়। ঘুমের ভিতরে পার করে দিতে হয় দুপুরের কিছুটা অংশ। মাধুরী, অনিন্দিতা, দুই ফ্ল্যাটের দুই বউ এসে ফিরে গেছে অনেকবার, এখন তারা আর আসে না। নিজেরাই টিভি চালিয়ে গল্প করে, তারপর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়, বাস থেকে বাচ্চা নামলে, সেই বাচ্চাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সুদামার এইসব নেই। নেই বলে বেঁচে গেছে সে। বলে অনিন্দিতা-মাধুরী। কী সুখেই আছে সুদামা। ছেলেকে পড়াতে হয় না, তার খাতা দেখতে হয় না, রেজাল্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয় না। আগে ছেলেকে বড়ো চিঠি লিখত। চিঠিতে আলো বাতাসের বর্ণনা থাকত। ঋতুচক্রের ছায়া থাকত। রোদ হলে রোদ, ছায়া হলে ছায়া, মেঘ, বৃষ্টি, আলো, শীত-বসন্ত — এখন, এই সময়ে তো তাও লিখতে হয় না। কী সামান্য কথাই না লিখেছে সে। কৃষ্ণেন্দু চিঠিটা হারিয়ে ফেলেছে। সুদামা আন্দাজে আন্দাজে পনেরো লাইন — কত কাজই না কমে গেছে। ছেলেকে বড়ো চিঠিও লিখতে হচ্ছে না। তার জ্বর হলেও জানতে পারে না। কী আরাম! সে দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠলেও ঘুম ভেঙে মাকে উঠতে হয় না।
কী আরামেই না আছে সুদামা, বলে তার কলেজের বান্ধবী বিনতা। কোনো ঝামেলাই নেই, স্বামী অত বড়ো চাকরি করে। শীতের সময় কয়েকদিন তার বাড়ি একা একা চলে গিয়েছিল সুদামা দুপুরবেলা। বিনতার অনেক ঝামেলা, বেকার দেওর, বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি। ছেলে ক্লাস সিক্স। তাকে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা। ছেলেটা প্রায়ই ভোগে। ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয় মাঝেমধ্যে। সেই ছেলে আবার দুরন্তও খুব। এত সবের ভেতরেই রান্নাবান্না, ঘরের কাজ। সময়ই পায় না। দুপুর সকাল বলে তার আর কিছু নেই। বিয়ের পর চাকরির চেষ্টা করেছিল। পায়নি। স্বামীর সামান্য মাইনের চাকরি, ফলে বিনতাকে সবদিক সামাল দিতে হয়। টিউশানিও করে এর মধ্যে। না কাজের লোক নেই। কী করে পারে বিনতা? বিনতা বলে হয়ে যায়। কোথা থেকে কী হয়ে যায় তা সে খেয়ালও করতে পারে না। সুদামার সুখ কি সে পাবে? দুপুরে ঘুমোনোর উপায়ও নেই তার। হ্যাঁ, তবে ফাঁক বের করে ঘণ্টাখানেক গড়িয়ে নেয়।
সুদামা, তোর স্বামী, মানে তোর বর, মানে তোর প্রেমিক, তোকে কী ভালোই না বাসে। কী দেয়নি বল দেখি? বলে সুদামার বন্ধু অর্চনা। সে একটা প্রাইভেট ফার্মের কেরানি। নড়তেই পারে না। তার কাছে গিয়ে যে গল্প করবে সুদামা, সে উপায়ও কি আছে।
উপায় একমাত্র ঘুমের কাছে সমর্পিত হওয়া। ঘুমের ভেতরেই সে শুনতে পাচ্ছিল টেলিফোন বাজছে। এখন এই রোদে বিনতা হয়তো বেরিয়েছে বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে। মাধুরী-অনিন্দিতা আড়ামোড়া ভাঙছে গলির মুখে দাঁড়িয়ে। স্কুলবাস এসে নামিয়ে দেবে তাদের বাচ্চাদের। অর্চনা সেই মাড়োয়ারি ফার্মে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। অর্চনা বলেছিল, মাইনে খুব একটা ভালো দেয় না, খাটিয়ে নেয়। কাজে ভুল হলে এমনভাব করে যেন সে তার বাড়ির বাসন মাজার ঝি।
সুদামা অলস হাতে টেলিফোনটা তুলল, কার ফোন? বলছি।
দিন দশেক না, না প্রায় পক্ষকাল পেরিয়ে ফোন এল দূর রাজারামপুর থেকে। আজ ভোরে ওদিকে প্রোজেক্ট সাইট ভিজিটে গেছে এল পি জি সংস্থার কর্তাব্যক্তির সঙ্গে সরকারি কর্তারা, কৃষ্ণেন্দু গেছে, সুহাস গেছে। সে তো ভোরের ব্যাপার, এখন তো তিনটে।
ওপার থেকে কথা উড়ে এল, সুহাস বলছি, আপনি কি ঘুমিয়ে আছেন?
মনে হচ্ছে তো তাই।
ম্যাডাম, আমি রাজারামপুর থেকে বলছি।
মেঘের খবর পেলেন? ঘুমের ভেতরে যেন কথা বলে সুদামা।
পেয়েছি।
কে দিল?
পাখিরা, সমুদ্র থেকে আসছিল একদল পাখি…
সুদামা নিঝুম হতে থাকে। কী আশ্চর্য! সে কার সঙ্গে কী কথা বলছে? এইসব কথার অর্থ কী? এইসব কথা কেন বলা? কী এমন জরুরি! আটত্রিশ পার হওয়া কোনো মহিলার সঙ্গে তিরিশ-একত্রিশের এভাবে কথা হয়? রেখে দেবে নাকি টেলিফোন?
ওপার থেকে সুহাস বলল, কী হল?
সুদামা বলল, সমুদ্রের পাখির সঙ্গে দেখা হল কোথায়?
সুহাস বলল, টেলিফোনে। একজন আকাশে, অন্যজন …। থেকে গেল সুহাস।
সুদামার মনে হল পা যেন একটু টলল। আর একজন কোথায় ছিল? সুদামার গলায় বাতাস জড়িয়ে যায়। সে যে জিজ্ঞেস করবে আর একজন ছিল কোথায়, তা ভুলেই গেল। কথা বলতে পারে না। তার সমস্ত শরীর ভারি হয়ে উঠছে। চোখ বুজে গেল তার। ওপারও নিঝুম। ওপারের নিশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। যেন সৌর ঝড়। মহাব্রহ্মাণ্ড তোলপাড়। অচেনা কোনো গ্যালাক্সির ভেতরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে নক্ষত্র দল।
বলুক সে কথা, সুদামা শুনে যাবে।
কী হল, হ্যালো ম্যাডাম?
ম্যাডামের কন্ঠস্বর এবার বাজল, আমার নাম নেই নাকি!
আছে, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঘুমিয়ে পড়ছি।
হা হা করে হাসছে ওপারে কোনো এক ভিন গ্রহের মানুষ হয়তো-বা। আবার ভিন গ্রহের মানুষ! কোথায় কৃষ্ণেন্দু? কৃষ্ণেন্দু মনে আছে, সেই কতকাল আগে এক ভিন গ্রহের মানুষ ধরা দিয়েছিল সামনে। কথা ফুরিয়ে গিয়েছিল আমার। কথা ফুরোনো মানে অনেক অনেক কথা বলা। নৈঃশব্দ্য কথা বলে বেশি। বিড়লা তারামণ্ডলের সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দুজন। সারা শহর থেমেছিল তখন। এখন যেন মহাবিশ্ব থেমে আছে, মহাবিশ্ব পার হয়ে আরও অসীমে কোথায় ঝড় উঠছে। আমি কে? আমি কী করে টের পাচ্ছি সেই ঝড়ের শব্দ? বিপ বিপ বিপ — কে যেন কিছু বলতে চাইছে আকাশের ওপার থেকে।
ঘেমে যাচ্ছে সুদামা। হাত ঘেমে যাচ্ছে তার। কে যেন শক্ত মুঠিতে চেপে ধরেছে তার করপুট। কী তপ্ত হাত! টেলিফোনের রিসিভার আরও জোরে চেপে ধরে সুদামা। ওপার থেকে আবার ডাক এল, সুদামা কী হল আপনার?
সুদামা বলল, কোথা থেকে ফোন করছেন?
আমরা রাজারামপুর ছাড়িয়ে বেরিয়েছি সবে, স্যার সামনের গাড়িতে প্রজেক্টের মহাজনদের নিয়ে, আমি গাড়ি থামিয়েছি একটা জায়গায়, হঠাৎ মনে হল ফোন করি, পাবলিক বুথ।
জায়গাটা কেমন?
চমৎকার, কাছেই একটা-দুটো গ্রাম আছে, মাইলটাক ভেতরে, যেখানে সবাই বাজি তৈরি করে।
বাজির গ্রাম?
হ্যাঁ, কতরকম বাজি, ফুলঝুরি, তুবড়ি, রংমশাল, চরকি, হাউই, ছেলে-বুড়ো সবাই বাজি তৈরি করে, সব আলোর বাজি।
কেন বোমা তৈরি করে না, দোদোমা, পটকা, চকলেট বোম?
না, এখানে যে হাউই তৈরি হয়, তা মাদ্রাজের আকাশেও উড়ে যায়, মহারাষ্ট্রের আকাশও আলো করে দেয়, উত্তরপ্রদেশের গ্রামে পরপর উড়ে যায়।
তারপর?
তারপর অন্ধকারে আচমকা বিস্ফোরিত হয়ে একটা ছায়াপথ তৈরি করে দেয়, তাতে কত তারা, সব ভেসে থাকে অনেকটা সময় ধরে।
কী চমৎকার বলছ তুমি, তারপর কী হয়?
তারপর আবার একটা হাউই উঠে আছে উপরে, একটা ফুরোতে না ফুরোতে আর একটা, গ্রামের সবচেয়ে বড়ো মহাজনের ছেলের বিয়ে, বাজিতে আকাশ আলো।
বাহ, বাহ! তারপর?
কথা চলতে থাকে। চলতেই থাকে। হাউই-এর বিবরণ থেকে ভুঁই চরকির কথা। ভুঁই চরকি থেকে ফুলঝুরি। ফুলঝুরিরই-বা কী সুন্দর বর্ণনা। ফুলঝুরি থেকে তুবড়ির আলোয় নাচতে থাকে ছেলেবুড়ো সবাই। সুদামা, বললে কি বিশ্বাস হবে, সেই আলোয় মানুষগুলোও যেন আলোর ফুলকি।
বাহ! কী সুন্দর বলছ তুমি!
আমি কী বলব, বাজির গ্রামে যেমন বাজি তৈরি হয় তেমন কথাই তো বলছি, বাজিই এত সুন্দর যে কথা বলতে হয় না, আপনা-আপনি হয়ে যায়, ওরা চিরকাল আলোর বাজিই তৈরি করত, এখন ‘সাউন্ড’ করতে আরম্ভ করেছে।
সাউন্ড।
সে ভীষণ শব্দ! শব্দে কানে তালা লেগে যায়, পাখিরা উড়ে যায় ভয় পেয়ে, বাতাস পালায়, মেঘও, বুড়ো মানুষ কেঁদে ফেলে। কী শব্দ! গুম গুম গুম — যেন মেঘে মেঘে লড়াই হচ্ছে, সাউন্ড কি আপনি পছন্দ করেন সুদামা?
সুদামা বলল, খুব দূরের শব্দ!
কত দূরের?
বহু দূরের।
বহুদূর, কতদূর?
সুদামা চাপা গলায় বলল, অনেক অনেক আকাশ পার হয়ে দূর কোনো গ্যালাক্সির বিপ বিপ — তুমি টের পাও তো?
ওপারে কন্ঠস্বর থেমে আছে। সুদামা চোখ বুঝে ঘন শ্বাস নেয়। গাঢ় নিশ্বাসে ভেসে যায় টেলিফোনের কথা বলার মুখটি। টেলিফোন থেকে কানে যেন ভাপ এসে লাগে। গরম বাতাস। থরথর করে কাঁপে সুদামা। তার যে এ কী হল। কার সঙ্গে কথা বলছে সে? এ কি কোনো মানুষের কন্ঠস্বর!
মনে পড়ে যাচ্ছে বিয়ের পর পর, সেই আলোহীন বাতাসহীন ঘরে কৃষ্ণেন্দু ঘুমোলেও সে জেগে থাকত কত রাত। কান পাতত কৃষ্ণেন্দুর বুকের উপর। কী আশ্চর্য এক শব্দ! কতদূর থেকে উঠে আসছে তা। কখনও মনে হত শব্দটি যেন আসছে পাতালের অতল থেকে। সে যেন মাটিতে কান পেতে আছে। আবার মনে হত সেই শব্দ যেন আসছে অনন্ত জাগরণে জেগে থাকা কোনো এক নক্ষত্রের ভেতর থেকে। তখন এক নারী তার পুরুষকে নিয়ে বহু রাত পর্যন্ত রচনা করত অখণ্ড এক নক্ষত্রের সমগ্রতা। এখন তো কৃষ্ণেন্দু নিজের জগৎ আলাদা করে নিয়েছে। এখন সেই নক্ষত্র থেকে তারা ছিটকে বেরিয়ে দুটো গ্রহপিণ্ডের মতো দুদিকে, মহাবিশ্বে ঘুরছে আর ঘুরছে।
ওপার থেকে আবার কথা এল, আপনি কি অনেক রাত পর্যন্ত জাগেন?
না, ঘুমিয়ে পড়ি।
আপনার ঘুম ভেঙে যায় আচমকা?
যায়।
এমনি এমনি!
না, মনে হয় যেন কেউ ডাকল?
কেউ কি ডাকে?
চুপচাপ হয়ে যায় সুদামা। ডাকে হয়তো কৃষ্ণেন্দু। দু-হাত দূরের কৃষ্ণেন্দু ডাক দেয় পনেরো-ষোলো বছর পিছন থেকে। নাকি অন্য কেউ! দু-হাত দূরে ঘুমিয়ে থাকা পুরুষ তো পনেরো-ষোলো বছর আগে ছিল না। এ তো অন্যজন। এ জীবনে বারবার, নানা সময়ে নানাজনের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হয় যেন। নানারকম মুখ, নানারকম চোখ, নানারকম মন …
সুদামা জিজ্ঞেস করে, তোমার ঘুম ভাঙে?
ভাঙে।
এমনি এমনি?
জানি না।
কেউ কি ডাকে?
জানলার বাইরে অন্ধকার, অনেক দূরে আকাশ, পামট্রির সারের ফাঁকে চাঁদ, তারা। অন্ধকার দেখলেই মনে হয় ডাকে যেন — থাক, এখন, শুনুন, আজ আমাদের ভিজিট ছিল সাইটে, ঠিক আমাদের নয়, যে কোম্পানি মানে ওই যে এলপিজি বটলিং কোম্পানিকে জমি দিচ্ছি আমরা, তাদের টপ বস এসেছিল বোম্বে থেকে। ওদের নানান প্রজেক্ট নামছে নানা জায়গায়। এখন ফাইনাল চেকিং সেরে নিচ্ছে, ফরেন কনসার্ন তো, অনেক ভেবেচিন্তে চয়েস করে। তো আজই একটা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল।
কী সমস্যা জিজ্ঞেস করছেন সুদামা, বলছি, খুব বড়ো সমস্যা তৈরি হওয়ার আগেই সবটা ট্যাকল করা গেছে। আজ নারীবাহিনী, রাজারামপুরের জমিহারা মানুষেরা একজোট হয়ে আমাদের পাঁচটা গাড়ি ঘিরে ধরেছিল। খুব তপ্ত জনতা। জানেন তো জনতা মানেই জনরোষ! রোদে মানুষের মাথার সব কলকব্জা বিগড়ে যাচ্ছে, পিটিয়ে মারছে, শুনতে পাচ্ছেন তো, কাগজে দেখছেন তো সুদামা, ঠিক সেই রকম সব, আগে মেয়েরা ঝাঁটা-খুনতি হাতে, কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে …।
বলতে লাগল সুহাস। যা বলবে তাই-ই ভালো লাগবে এখন। সে যেন শিশুর কন্ঠস্বর শুনছে। দেড় দু-বছরের বাচ্চা। সে যেন …। সুদামার বুক কাঁপে। একত্রিশ বছরের পুরুষের কন্ঠে শিশুর ভাব থাকে না। জোর করে ভাবলেও ভাবা যায় না শেষ পর্যন্ত। ও তো পুরুষই। প্রখর যুবক। টেলিফোন বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নিল সুদামা। ভিজে গেছে হাত। শাড়িতে মুছতে লাগল সুদামা। হ্যাঁ, কী হল বল তারপর?
অর্থহীন আর কয়েকটা কথার মতো এটিও। এইভাবেই অর্থহীন আলাপকে অর্থময় করে তোলার সুখটি কতকাল বাদে ফিরে আসছে যে!
ষোলো
কৃষ্ণেন্দুর ফিরতে একটু দেরি হল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দারুণ বুদ্ধিমান, আজ সুহাস না থাকলে যে কী হত! ফোন করেছিল সুহাস?
সুদামার মনে হল সে সতর্ক হয়। তার মন যেন তাই-ই চাইছে। বুক দুরুদুরু হতে আরম্ভ করেছে সেই প্রথম বয়সের মতো। সে কৃষ্ণেন্দুর কথায় জবাব দেয় না। কৃষ্ণেন্দু তার জবাবের অপেক্ষা না করে বলছে, সে সারাদিনে এই প্রথম বসতে পারল, বিশ্রাম পেল, দিনটা যে কী গেছে!
কৃষ্ণেন্দু বলতে থাকে, সুদামা শোনে। শোনে সামান্য, বাকিটা তার কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। সে বিরক্ত হচ্ছিল। সে শুনল, কৃষ্ণেন্দু বলেছিল সুহাস যেন ফোন করে, তার একটু দেরি হবে।
দেরি তো হয়ই, রাজারামপুর গেছ, তাতে ফোনের কী আছে? সুদামা যেন মেজাজ হারাচ্ছে।
ফোন করেনি? কৃষ্ণেন্দু আশ্চর্য হয়।
করেছিল, আমি রেখে দিয়েছি। সুদামা সত্য বলল না, রাজারামপুরে কী হয়েছে তা শুনে আমি কী করব?
কৃষ্ণেন্দু খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। বোঝে, কোনো কারণে সুদামা অসন্তুষ্ট। সে আর কথা বাড়ায় না। জামা-কাপড় ছেড়ে স্নানে যায়। স্নান করে কাচা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে নিজে হাতে চা করে আনে। সুদামা রাগলে কৃষ্ণেন্দু নিজের কথা থামিয়ে এভাবেই রাগ ভাঙায়। বুদ্ধিমান পুরুষ। সুদামা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ও ফোন করে কী বলত, ফোন করতে বলেছিলে কেন?
বাচ্চা ছেলে, ম্যাডাম ম্যাডাম করে তাই! কৃষ্ণেন্দু বোধহয় একটু তোতলায়, গ্রামের ছেলে তো, ওরা মাসি-পিসি-বউদিদের সঙ্গে মিশতে পারে ভালো। বউদি পাতাতে পারে ভালো। নিজেই তো বলল ফোন করবে, করেনি?
বললাম তো। সুদামা বিড়বিড় করে, আমার ভালো লাগছিল না, খুব ঘুম পাচ্ছিল দুপুরে, কী শুনব ভ্যাজোর ভ্যাজোর। তুমি নীলের চিঠিটা খুঁজে পেলে।
তুমি তো উত্তর দিয়েছ। বলল কৃষ্ণেন্দু।
কিন্তু চিঠিটা?
কৃষ্ণেন্দু শোনে না। বলে, সুহাস আজ মান রাখল, যে ভাবে সব ট্যাকল করেছে, আমাদের ছটা গাড়ি গিয়েছিল, এলপিজি-র লোকজন সমেত সকলকে ঘেরাও করে ফেলেছিল গাঁয়ের মানুষ। আগে নারীবাহিনী, কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে সব স্লোগান দিচ্ছে।
সুদামা চুপ করে থাকে। এসব কথা একটাও বলেনি সুহাস। কী দারুণ কাজই না করেছে সে। তার বিবরণ দিচ্ছে কৃষ্ণেন্দু, দিতে দিতে থামল। আশ্চর্য ও কিছু বলেনি! নিজের কথা বলতে বোধহয় লজ্জা পেয়েছিল। শুনতে শুনতে সুদামার বুক থরথর করে। কাঁপে বোধহয় সে ভেতরে ভেতরে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, গাঁয়ের মানুষ খবরও রাখে বটে। তারা তো আচমকা ঘেরাও প্রোগ্রাম ঠিক করেছিল এল পি জি-র কর্তাদের আসার খবর পেয়ে। গত পরশু ঠিক হল, আজ যাওয়া হল ভিজিটে। পঞ্চায়েত কর্তারা কেউ ছিল না ধারে কাছে। তারা থাকলে তো সামাল দিতে পারত ক্ষুব্ধ জনতাকে। জনতা ঘিরে ধরে ক্ষতিপূরণ দাবি করল। খেতমজুরদের জন্য প্রজেক্টে কাজ দাবি করল। জমি হারানো পরিবার পিছু একটি করে চাকরি চাইল, পুনর্বাসনের নীতি জানতে চাইল যদিও এখানে পুনর্বাসনের কোনো সমস্যা নেই। কোনো ভিটে বাস্তু অধিগ্রহণ হয়নি। জমি তো শুধু জমির মালিককে অন্ন দেয় না। জমি মানে বহু মানুষের সম্পৃক্ততা। তিনশো বিঘে কত লোককে না কাজ দিত। সবাইকে খুশি করতে হবে। তখন সুহাসই সাহস করে এগোল। কৃষ্ণেন্দু বুঝে উঠতে পারেনি কীভাবে ট্যাকল করবে এত সকলকে। তার কাছে কাগজপত্রও রেডি ছিল না। ভিনদেশি মহাজনরা অবাক হয়ে তখন জিজ্ঞেস করতে আরম্ভ করেছে, অ্যাফেকটেড পিপল-এর জন্য কী কী প্যাকেজ ভেবে রেখেছে গভর্নমেন্ট। কী ব্যবস্থা ভেবেছে কৃষ্ণেন্দু। তাদের তো জানতে চাওয়ার অধিকার আছে, কেননা কাজ আরম্ভ হলে, লোকাল পিপল ঝামেলা আরম্ভ করলে, সামাল দিতে হবে তো তাদের। তখন তো সরকার দেখবে না। তারা জমির টাকা দিচ্ছে গভর্নমেন্টের দাবি মতো, কিন্তু পরিবর্তে গভর্নমেন্ট কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি-পরিবারের জন্য তাও তো জানতে হবে দেখতে হবে। কৃষ্ণেন্দু বোঝাতে আরম্ভ করেছিল। তখন সুহাস গাড়ি থেকে নেমে জনতার মুখোমুখি হয়।
কিন্তু ছেলের চিঠিটা তুমি হারালে কী করে? সুদামা প্রসঙ্গ বদলে দিতে চায়। তার বুকের ভেতরে মেঘ ডাকছে। ভয় করছে। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। ঠিকমতো কৃষ্ণেন্দু তার কথা শুনতেই পায় না।
কৃষ্ণেন্দু বলে, সুহাস তো চাষির ছেলে, ওর মতো জমির চরিত্র কে জানবে? বাস্তব সমস্যা কে চিনবে? তাই সুহাসই জনতার মুখোমুখি হয়ে তাদের বোঝাতে লাগল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে বর্গাদার, খেতমজুর, মার্জিনাল পেজান্ট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছে সুহাস জমিহারা মানুষদের সঙ্গে। ফলে তারা বুঝেছে সব। শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে ফিরে গেছে।
কৃষ্ণেন্দু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, ও বোধহয় ছাত্রজীবনে রাজনীতিও করত, ফলে বক্তব্য রাখতে পারে ভালো। রেখেছেও চমৎকার। এল পি জি প্রজেক্ট রূপায়িত হলে কী কী সুবিধে হবে স্থানীয় মানুষের তা জানিয়েছে নিজের কল্পনাকে ব্যবহার করে সত্য মিথ্যা বলে। নানারকম স্বপ্নের কথা বলেছে, উন্নয়নের কথা বলেছে, গ্রামের মানুষের জন্য কতটা ভাবা হয়েছে তা বাড়িয়ে বলেছে। গ্রামের মানুষ খুশি। এল. পি. জি. কর্তারাও খুশি। শেষ পর্যন্ত তারা বলেছে, হ্যাঁ বড়ো প্রজেক্টে এইরকম হয়ে থাকে, ব্যাপারটাকে ভালোভাবে সামাল দেওয়া দরকার। সুহাস বোস সম্পর্কে খোঁজও নিল। সুহাস তাদেরও বুঝিয়েছে, এই রকম ঘটনা দু-একটা হবে। কেননা যে চাষির জমি চলে যায় সে কি জমির মায়া সহজে ত্যাগ করতে পারে? জমি তো চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে। জমি চলে যাওয়া মানে তাদের নানান অভ্যাসও চলে যাওয়া। কালচারাল চেঞ্জ তো হবেই …।
সুদামার মুখ আলো হয়ে ওঠে কৃষ্ণেন্দুর কাছে সুহাসের প্রশংসা শুনতে শুনতে। সে উঠে গিয়ে টেলিফোনটা এক হাতে তুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছে। তারপর সাবধানে রেখে দিয়ে সোফায় ফিরে এসে একটু গাঢ় স্বরে কৃষ্ণেন্দুকে বলে, হয়েছে, এবার কদিন রেস্ট নাও দেখি। চলো, নীলের কাছে যাই।
মাথা নাড়ে কৃষ্ণেন্দু, সুদামার হাতটি নিয়ে খেলা করে। বলে, গেলে ওর পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। আর আমার রেস্ট কী করে হবে? সেই পুজোর আগে তো নয়ই।
বাহরে, তোমার শরীর দেখেছ! সুদামা তার হাত ছাড়িয়ে নেয় কৃষ্ণেন্দুর মুঠি থেকে, ঠাণ্ডা হাত, স্নান করে এসেছে তাই হয়তো। শক্ত হাত। বয়স হলে পুরুষ মানুষের হাত এই রকম ভাবেই শিহরণহীন হয়ে ওঠে নাকি। সুদামা চমকে ওঠে। কী ভাবছে সে! আবার হাত বাড়িয়ে দেয় কৃষ্ণেন্দুর দিকে। কৃষ্ণেন্দুর হাত ছুঁয়ে বুকে হাত দেয় সে। বাঁদিকে। কোথায় হৃদয়ের শব্দ। বিপ বিপ বিপ! সুদামার যে কী হল, সে কৃষ্ণেন্দুর কাছে সরে আসে, কান রাখে ওর বুকে। কৃষ্ণেন্দুর হাত তার মাথার খোপা ভাঙে, ভাঙতে থাকে। চুলের ভেতরে হাত ডোবায় কৃষ্ণেন্দু। সুদামা টের পায় ধক-ধক করছে কৃষ্ণেন্দুর হৃদপিণ্ড। কিন্তু সেই যে অতি পুরাতন শব্দ, যা তার সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হয়ে যেত গভীর রাতে, তা কই! আছে কি? সুদামা জোরে চেপে ধরে তার কান। তারপর আচমকা সরে যায়।
কী হল? কৃষ্ণেন্দুর মুখে কেমন বিপন্নতা, উদ্বেগ।
তুমি কি টেনশনে আছ? জিজ্ঞেস করে সুদামা।
না না, টেনশন কিসের, টেনশন যা হয়েছিল কেটে গেছে।
সুদামা উঠল। শ্লথ পায়ে অন্ধকার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় একা একা। কৃষ্ণেন্দু রিমোট কন্ট্রোলে টিভি অন করে। টেলিভিশনের নারী নাচতে নাচতে পণ্য বিজ্ঞাপিত করতে থাকে। টেলিভিশনের নারী নিজেকে দেখায় পণ্যের গুণাগুণ দেখাতে গিয়ে। কৃষ্ণেন্দুর চোখ টেলিভিশনে।
সুদামা অন্ধকার আকাশে তাকায়। হালকা মেঘ এসেছে কলকাতার আকাশে। সেই মেঘ ময়লা করে দিয়েছে ঝকঝকে আকাশকে। গ্রহ তারা ঢেকে গেছে ধূসরতায়। সুদামা ঘাড় উঁচু করে আকাশ দ্যাখে। কিছুই দেখা যায় না, শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। অন্ধকার ভূমিতল থেকে উঠে গেছে অসীমে। একটি তারাও নেই আকাশে। কোথায় সেই গ্যালাক্সি, যার কোনো এক জীবিত নক্ষত্র তার সঙ্গে রতে কথা বলত। ধ্বনিময় হয়ে উঠত রাতের নৈঃশব্দ। শুধু কি কৃষ্ণেন্দুর বুকের শব্দ! যখন নীল এল পেটে, মনে পড়ে যায় সুদামার। গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে যেত ভরন্ত শরীরের। বিপ বিপ বিপ —অদ্ভূত এক শব্দতরঙ্গ। তা কি নীলের বুকের শব্দ, নাকি সেই ভ্রূণ গ্রহণ করছিল গ্রহান্তরের ধ্বনিময়তা। মানুষের হৃদয়ের শব্দ কি গ্রহান্তর থেকে আহরণ করা! প্রেমের ধ্বনিময়তাও কি তাই! এই তখন যে শব্দ শুনে এল সুদামা, তার ভিতরে আছে উদ্বেগ, চিন্তা প্রেমহীনতা, হ্যাঁ যেন তাইই। সে ঘুমন্ত কৃষ্ণেন্দুর বুকে কান রাখলেও, তার প্রিয় পুরুষ সেই ঘুমের ভিতরেও টের পেত তা। ভালোবাসা আবেগে বুকের শব্দ বদলে যেত ধীরে ধীরে। বুকের শব্দের সঙ্গে অসীম গ্রহান্তরের ধ্বনিময়তা একাকার। অচেনা এক সংকেতে শিহরিত হত সুদামা। সন্তানের প্রাণের শব্দ আর প্রেমের শব্দ কি এক? কোথায় গেল সেই নক্ষত্র, সেই ছায়াপথ? সব তারা কি নিভে গেল এই কবছরেই। অথচ গ্রহ তারার আয়ু তো কোটি কোটি বছর। পরিমাপহীন সময়। ভালোবাসার আয়ুও তো তাই! মনে হত তো তাই। ভালোবাসার এক একটি মুহূর্ত তো এক এক কোটি বছরের সমান সময়।
সুদামার চোখে জল এল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। অশ্রুপতনের শব্দ শুনতে পায় সে। ভেতরের ঘরে টেলিভিশনে প্রায় নির্মোক নৃত্য। সুদামা ঝুঁকে থাকে নীচের দিকে। তখন টেলিফোন বাজল। টেলিফোন বাজতে থাকল কর্কশ স্বরে। খুব খারাপ লাগে সুদামার। মনে হয় থেমে যাক টেলিফোন। তাকে কি কান্নার সময়টুকুও দেবে না?
কৃষ্ণেন্দু ডাকে, ফোনটা ধরো।
সুদামা অচল। সুদামা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কৃষ্ণেন্দু ডাকে, সুহাস হয়তো ফোন করেছে। সুদামা দাঁতে দাঁত চেপে আরও কঠিন। সে যেন শিলীভূত হয়ে যেতে চায়।
হাজার বছর ধরে যেভাবে মাটি জমে জমে পাথর হয়, তেমনই পাথর হয়ে যাক সে। সময় তার নতুন পরিমাপ খুঁজে নিক। এক একটি মুহূর্ত হয়ে যাক হাজার বছর।
বিরক্ত কৃষ্ণেন্দু নিজে উঠে টেলিফোন ধরল টিভি বন্ধ করে। সুদামা কান পেতে থাকে। বাঁচল সে। না সুহাস বোস নয়, ফোনটা আর একজনের। অনিলবরণ ঘোষের। অনিলবরণ বোধহয় জানতে চাইছে, কী হয়েছিল সাইটে।
সুদামা আঁচলে চোখ মুছে ঘরে ঢোকে নিশ্চিন্ত হয়ে। কৃষ্ণেন্দু হাসছে অনিলবরণের কথায়। অনিলবরণ নিশ্চয়ই কোনো খারাপ কথা বলেছে। কী বলতে পারে? সুদামা আন্দাজ করার চেষ্টায় থাকে। গুলি চালালে ঠিক হয়ে যেত। দু-চারটে লাশ না পড়লে পাবলিক ঠাণ্ডা হয় না।
ফোন রেখে কৃষ্ণেন্দু বলে, পাগল!
কেন কী হল?
বলছে জমি পজেশন নেওয়ার সময় দু-চারটে তুলে পেটালে আজ এসব করতে সাহস পেত না। আচ্ছা ও কি এসব সত্যি বলে?
আমি কী করে জানব?
আমাকে বলছে মানুষ খুন করার একশো পঁচানব্বই রকম উপায় বের করেছে ও, কী একটা লিখছে।
সুদামা টিভি চালায়। চালানোর অর্থ হল কৃষ্ণেন্দুর কথা না শোনা। পর পর চ্যানেল চেঞ্জ করতে থাকে রিমোট কন্ট্রোলে। গান, নাটকের ডায়লগ, খবরের অংশ, বিজ্ঞাপনের শীৎকার, ফুটবলের চিৎকার, রেসিং কার-এর উত্তেজনা সব পর পর পার হয়ে যেতে থাকে। তার ভিতরেই কৃষ্ণেন্দু বলে যাচ্ছে অনিলবরণের কথা। টেলিভিশনের শব্দ আর কৃষ্ণেন্দুর কন্ঠস্বর একে অপরকে অতিক্রম করতে চেষ্টা করে যায় অবিরাম। তাতে ধ্বনির তীব্রতা বাড়ে। বাড়তে থাকে। ঘর গমগম করতে থাকে। আচমকা কৃষ্ণেন্দু তার কথা থামিয়ে দেয়, কী হয়েছে তোমার, শুনছো সুদামা? টিভিটা বন্ধ করো। চিৎকার করে ওঠে কৃষ্ণেন্দু।
সুদামা টিভি বন্ধ করে। ঘর আবার নৈঃশব্দ্যে ঢাকে, কিন্তু কানে যেন একটু আগের উত্তেজক শব্দগুলি তাদের রেশ নিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে। সুদামা দু-হাতে কান চাপে। কৃষ্ণেন্দু বলে, কী হয়েছে বলো দেখি, অত জোরে টিভি চালায়?
সুদামা জবাব দেয় না। কৃষ্ণেন্দু ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে থাকে। চলে যায় ব্যালকনিতে। সুদামা কী করবে ভেবে পায় না। উঠে স্টিরিওতে ক্যাসেট চাপায়। দ্যাখেও না কী ক্যাসেট। ভল্যুম লো করে দেয়। কী আশ্চর্য! নিখিল ব্যানার্জি বেজে ওঠেন। সুদামা দু-চোখ বন্ধ করে বসে থাকে মেঝের কার্পেটে। সেতারে মেঘমল্লার বিলম্বিত লয়ে বেজে উঠেছে ঘরে ও বাইরে। কৃষ্ণেন্দু চুপচাপ।
কৃষ্ণেন্দু সুদামার গা স্পর্শ করে ডাকতে গিয়েও সরে যায়। একটু দূর থেকে অনুচ্চ স্বরে ডাকল, তুমি ঘুমোলে, ঘুমোলে নাকি?
বলতে বলতে কৃষ্ণেন্দু আরও এগিয়ে আসে। সুদামা বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ল। খোপাভাঙা মাথার চুল পাখার হাওয়ায় সামান্য উড়ছে। চুল ছড়িয়ে অছে কাঁধের দু-পাশে। গায়ের আঁচল ঈষৎ লিত। মুখখানিতে ক্লান্তি। সারাদিন ঘরে বসে সুদামার চোখ-মুখে এত ক্লান্তি! চোখের কোলে কালিও পড়েছে যেন। কৃষ্ণেন্দু একটু নিচু হয়ে হাত বাড়ায়। ব্লাউজের সীমারেখা যেখানে শেষ হয়েছে কাঁধ ও গ্রীবার সেই সংযোগস্থলে একটি শিরা দপদপ করছে যেন। কৃষ্ণেন্দু হাত আরও এগিয়ে দেয়। ছুঁয়ে, একটু নাড়িয়ে আচমকা ভয় পাইয়ে সুদামার আধো ঘুম ভাঙিয়ে দেবে? নাকি অন্যভাবে। খুব আলতো করে কপালের উপর একটি চুম্বন, কিংবা ঠোঁটে চুম্বন! চুম্বনের টানে জাগিয়ে দেবে সুদামাকে। শুকনো ঠোঁট দুটি দ্যাখে কৃষ্ণেন্দু। এইভাবে কতদিন আগে শেষ চুম্বন দিয়েছিল। সুদামাকে। মনে পড়ে না। ইদানীং কখনও এমন হয়েছে কি? মনে পড়ে না। কৃষ্ণেন্দু আরও এগিয়ে সুদামার খুব কাছে পৌঁছে গিয়ে অপেক্ষা করে। ঠোঁট দুটিতে আঙুল ছোঁয়াতে গিয়েও থমকে যায়। কী আশ্চর্য! সে যেতে চাইছে, তার পা সরছে না, শরীর ভাঙছে না। শরীর টানছে না। তাকে তো নীচু হতে হবে চুম্বনের জন্য। তাকে তো হাঁটু মুড়ে বসতে হবে ঠোঁট, গাল, চোখের পাতা, স্তন স্পর্শ করার জন্য। নীচু হতে পারে না কৃষ্ণেন্দু। সরে যায়। পিছিয়ে গিয়ে ডাকে সুদামাকে আবার।
সুদামা আচমকা চোখ খোলে। সে তো জেগেই ছিল প্রায়। সে টের পাচ্ছিল, এগিয়ে আসছে কৃষ্ণেন্দু। চুরি করে ভালোবাসা দিতে অগ্রসর হয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। ঘরে এখনও নিখিল ব্যানার্জির হাতের কারুকার্য ভেসে আছে, বাতাস মথিত করছে। সুদামা স্পষ্ট টের পেয়েছে, পিছিয়ে গেছে মানুষটা। সাড়া পায়নি তাই। সে উঠল। স্টিরিও বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। আবার চোখে জল এল। মেঘের আস্তরণ কিছুটা পরিষ্কার হওয়ায় আকাশে এখন দু-একটি তারার চোখ। সুদামা নিঝুম হয়ে চোখের জল ঝরে যেতে দেয়। জানা হয়ে গেল নাকি সব! কে জানে? কৃষ্ণেন্দু তো এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। সুদামা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। কেউই কোনো কথা বলে না।
সতেরো
আকাশে মেঘ এল অবশেষে। গতকাল ঘুমের ভেতরে মেঘ এসেছিল, আজ সকাল থেকে আকাশ ঘোর হয়ে আছে। বৃষ্টি কখনও টিপ টিপ, কখনও একটু জোরে। আবার অনেক সময় ধরে আকাশ গুম হয়ে থাকছে। দেখে মনে হয় ফেটে চৌচির হয়ে যাবে আচমকা। দুপুরে সুহাস ফোন করেছিল। গতকাল করেছিল সুদামা নিজে। এখন টেলিফোন প্রায়ই আসছে।
কৃষ্ণেন্দু ইদানীং উদ্বিগ্ন বেশ, চিন্তাক্লিষ্ট। সুদামা কিছুই জিজ্ঞেস করেনি তাকে। সেই যে দিন-কুড়ি আগে রাজারামপুর ভিজিট করে এল, তারপর দিন সাত-আট তো নিশ্চিন্তে ছিল কৃষ্ণেন্দু। এখন কী হল? কী হল তা ও-ই জানে। সুদামার কোনো কৌতূহল নেই। কথা হয় সামান্য। রাতে কৃষ্ণেন্দুর টিভির সামনে বসে থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে। উপগ্রহ যে ছবি ধরে। তার সময়কাল তো প্রসারিত হয়ে হয়ে মধ্য রাতে পৌঁছে গেছে। কৃষ্ণেন্দু জাগে প্রায় শেষ অনুষ্ঠানের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত। পর পর সিগারেট ধ্বংস করে।
একদিন সুদামা ডেকেছে তাকে, কী দেখছ আজে-বাজে ছবি। শুয়ে পড়ো।
কৃষ্ণেন্দু জবাব দেয়নি। সুদামা তখন ঘুরে শুয়েছে। কৃষ্ণেন্দু টিভির শব্দ বন্ধ করে শুধু ছবি দেখতে আরম্ভ করেছে গত কয়েকদিন। সুদামা ঘুমিয়ে থাকে তখন।
বৃষ্টি আবার নেমেছে টিপটিপ। কৃষ্ণেন্দু ফিরেছে একটু আগে। চা খেয়ে অফিসের ফাইল নিয়ে বসেছে টেবিলে। সুদামা ঘুরতে ঘুরতে তার সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, তুমি বাজির গ্রাম চেন?
ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত মুখে তাকায় কৃষ্ণেন্দু, মাথা নাড়ে।
বাহ! এটাও জানো না, তোমাদের রাজারামপুরের কাছে।
সুহাস বলেছে? কৃষ্ণেন্দু ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করে।
সুদামা জবাব দেয় না। বলে, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে থাকলে এসব জানতে হয় না?
মাথা নাড়ে কৃষ্ণেন্দু, বলে, মেশিনারি আছে, দরকার পড়লে সার্ভে রিপোর্ট পর্যন্ত পেয়ে যাবে, যদি চাও কালই রিপোর্ট পেতে পার।
সুদামা ঘুরতে ঘুরতে আবার এল, চিনেম্যানতলা চেন? চিনেমন্দির আছে যেখানে।
ট্যাংরায় হবে বোধহয়? কৃষ্ণেন্দু দায়সারা জবাব দেয়।
জান না তুমি, মন্দিরটা তো বজবজের গঙ্গার কাছে।
কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, সুহাস বলেছে?
সুদামা ঘুরছে ঘরের ভেতরে, দূর থেকে বলল, হ্যাঁ ও-ই বলছে।
এই সব কথা বলে?
বলে, ফাল্গুনে মেলা হয় সেখানে। সুদামা বলল।
কৃষ্ণেন্দু শোনে না। সুদামা টেলিফোনের কাছে দাঁড়ায়। আঁচল দিয়ে যন্ত্রটিকে ধূলিমুক্ত করতে করতে বলে, সবে তো আষাঢ় এল, অনেকদিন ওয়েট করতে হবে ওই মেলার জন্য, হ্যাঁ তোমাদের ওই প্রজেক্ট সাইটে আর কোনো গোলমাল হয়নি তো?
কৃষ্ণেন্দু ফাইল রেখে ঘুরে বসে। সিগারেট ধরায়। কী যেন ভাবতে থাকে। কী যেন বলতে গিয়েও বলে না। ধোঁয়ায় ঘর ভরতি হয়ে যায়। ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকায় ঘরের ভেতরে। কৃষ্ণেন্দু অনেক সময় নিয়ে, সিগারেটে ছোটো ছোটো টান দিয়ে ধোঁয়া উগরে দিতে দিতে আচমকা বলে ফেলে, সুহাস খুব চতুর, ওকে দেখলে ধরা যায় না ও আসলে কী রকম!
ভয় পায় সুদামা। তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। এতদিনে কি টের পেল কৃষ্ণেন্দু? তার পৌরুষ আহত হল এই প্রথম! অসম বয়স বলে সন্দেহ করেনি, এখন কি সে সন্দেহের বিষে জ্বলছে? সুদামা কঠিন হতে থাকে। সে প্রতিরোধ করবে। হ্যাঁ, তাই, তাই। সম্পর্কটা স্বীকার করে নেবে। এই চোদ্দ বছরে যা যা হারিয়েছে সে, সব তো কুড়িয়ে এনে দিচ্ছে একত্রিশ বছরের ওই যুবক। সে না নিয়ে পারে কী করে?
তুমি বোঝো না, ও খুব ধূর্ত? জিজ্ঞেস করে কৃষ্ণেন্দু।
সুদামা শক্ত হয়। পায়ের উপর ভরসা না করতে পেরে বসে পড়েছে সোফায়। কী বলতে চাইছে কৃষ্ণেন্দু তা আন্দাজ করতে পারছে না সে। সে কি দুজনের সম্পর্কের কথা বলবে? কৃষ্ণেন্দুর মুখ দ্যাখে সে।
কৃষ্ণেন্দু আবার বলে, ও যে ধূর্ত তা তুমি বোঝো না?
কেন? রুখে দাঁড়ায় যেন সুদামা, ও তো তোমার ডান হাত, এই তো সেদিন ও তোমার মান বাঁচাল, নিন্দে করছ হঠাৎ?
কৃষ্ণেন্দু চেয়ার ছেড়ে ওঠে। পায়চারি করতে থাকে। জানালার কাছে যায়। গ্রিলজাল দু-হাতে চেপে ধরে। ঝাঁকুনি দেয় নিজেকে। তারপর বলে, অনিলবরণই ধরিয়ে দিল।
কী ধরিয়ে দিল? সুদামার বুক ধকধক করে।
সেদিনের ব্যাপারটা, আমি একদম ধরতেই পারিনি, মাথায় আসেনি, একটু খচ খচ করছিল সত্যি, ঠিক মেলাতে পারছিলাম না সব, অনিলবরণ আজ দুপুরে বলল আমাকে, এই বুদ্ধি নিয়ে চাকরি করো চ্যাটার্জি।
সুদামা ঠিক বুঝতে পারে না কোন দিনের ব্যাপার। তার মাথায় কিছু ঢোকে না। তবে সে বোঝে কোনো কারণে কৃষ্ণেন্দু চটেছে সুহাসের উপর। কেন? এমন হতে পারে, কৃষ্ণেন্দু ধরতে পেরেছে সুহাস বোস নামের তার অধঃস্তন অফিসার তার আটত্রিশ পার হওয়া স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করছে। প্রেমে পড়েছে সুদামা। তাই ঈর্ষায় ভুগছে কৃষ্ণেন্দু। ঈর্ষা সরাসরি প্রকাশ করতে সাহস হচ্ছে না তার স্বামীর। মনে মনে অসম্মানিতও হচ্ছে নিশ্চয় কৃষ্ণেন্দু। সেই অসম্মানের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে সুহাসের সম্পর্কে খারাপ কথা বলছে অন্য প্রসঙ্গে। অনিলবরণ কী বলেছে, তাদের সম্পর্কের কথা। সম্পর্ক তো টেলিফোনে। হ্যাঁ, এবার একদিন আবার আসবে বলেছে সুহাস। কবে তা কেউ জানে না। চমকে দেবে সুহাস। আবার বলছে বস না বললে বসের স্ত্রীর কাছে যায় কী করে? হা হা করে হাসতে থাকে তখন সুহাস বোস। অনিলবরণ জানল কী করে? সুহাস কি নবীন প্রেমিকের মতো অনিলবরণের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, করে হালকা হয়েছে। সুদামা কপালে হাত দিল। কপালের ভার হাতে রাখল।
কৃষ্ণেন্দু বলে, আসলে আমার বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করছিল না ঠিক ঠিক, আমার সন্দেহ সেদিনের ঝামেলাটা প্রি-প্ল্যানড, আমরা যে ভিজিটে যাব তা তো কয়েকজনই জানত, শুধুমাত্র টপমোস্ট লেভেলে, আমরা কয়েকজন মাত্র, গাঁয়ের মানুষ কী করে দলবদ্ধ হয়ে হামলা করল, খবর পায় কী করে, পঞ্চায়েত পর্যন্ত জানত না।
কী করে আবার? কথা খুঁজে পায় না সুদামা।
আশ্চর্য! সুহাস যেন তৈরিই হয়েছিল ঝামেলা সামলাবে বলে। কৃষ্ণেন্দু বলতে থাকে, ঝামেলা সামলে বাইরের লোকের কাছে, অর্থাৎ এল.পি.জি-র কর্তা-ব্যক্তিদের কাছে কী চমৎকার নিজেকে প্রজেক্ট করল সুহাস বোস।
কৃষ্ণেন্দু বোঝাতে থাকে সুদামাকে, বলে, সুহাসই আগাম খবর পাঠিয়ে ওই প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করেছিল, সবাইকে চালিত করেছিল। কৃষ্ণেন্দুর ধারণা সুহাস সেদিনকার ব্যাপারে গ্রামের লোকদের কাছ থেকে ভালোই সাহায্য পেয়েছে, গ্রামের মানুষ তো ওর কাছে আসে ক্ষতিপূরণ নিয়ে কথা বলতে, ডাইরেক্ট কনট্যাক্ট তো ওর সঙ্গেই হয়, যে ভাবে হোক, এটা করিয়েছে ও। না হলে গ্রামের মানুষ জানল কী করে ওইদিন ওই সময়ে তারা যাচ্ছে সাইট ভিজিটে, সবাই তো তৈরি হয়েই ছিল, এর ব্যাখ্যা কী? পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে দেখা হয়েছে কৃষ্ণেন্দুর, সে এসেছিল জানতে কী ঘটনা হয়েছে সেদিন। রহস্য ঔপন্যাসিক ঠিক ধরে ফেলেছে দুয়ে দুয়ে চার।
সুদামা বলল, তোমার অনিলবরণের কথা বাদ দাও দেখি, সেদিন যে অন্য কথা বলেছিলে।
তখন তো বুঝতে পারিনি, এখন সব মিলে যাচ্ছে।
সুদামা বোঝে ঈর্ষায় ভুগছে কৃষ্ণেন্দু। নিজের ক্ষমতা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেনি বলে তার জুনিয়রের সম্পর্কে সন্দেহ করছে। কোনটা সাজানো তা জানার কোনো ইচ্ছেই নেই সুদামার। তার কোনো মায়াই নেই যেন। কৃষ্ণেন্দুকে ভুলতে শুরু করেছে সে হয়তো-বা। আসল সন্দেহটা প্রকাশ করতে পারছে না কৃষ্ণেন্দু। ভীত পুরুষ। নির্বোধ পুরুষ। সুদামা কি বুঝতে পারছে না কেন কৃষ্ণেন্দুর এই বিদ্বেষ। অনিলবরণ হয়তো সুহাস আর তার সম্পর্ক নিয়েই কথা বলেছে। সেই কথাটিকে অন্য চেহারায় হাজির করছে কৃষ্ণেন্দু। বলতে পারছে না তাই আবোল-তাবোল বোঝাচ্ছে তাকে। কী লাভ সুহাসের? সেই দুপুরে তো রাজারামপুর নিয়ে একটি কথাও বলেনি যুবকটি। বলেছে হাউই-এর কথা। তুবড়ির আলোর কথা। আলো আর আলোর বাজির কথা।
কৃষ্ণেন্দু বসেছে আবার, বলছে, অনিলবরণ গেলে স্পটেই ঝামেলা পাকাত, সুহাসকে জেরা করত ও।
তোমার অনিলবরণের কথা রাখ তো, ও কি কোনো মানুষ। সব সময় খুন যখম, নরহত্যা নিয়ে ভাবে, আমাকে একদিন ফোন করে বিষ নিয়ে কথা বলতে লাগল, সন্দেহবাতিক লোক, মৃত্যুচর্চা করে।
কৃষ্ণেন্দু কিছু আর বলে না। টিভি চালিয়ে নিঝুম হয়ে বসে থাকে। রাত যায় দিন আসে। পর দিন দুপুরে ফোন এল সুহাস বোসের! সুদামা শক্ত করে রিসিভার চেপে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বসের সঙ্গে?
কই, কিছু না তো?
তোমার বস তোমার সম্পর্কে কিছু সন্দেহ করছে।
তা হলে তো তোমার সম্পর্কেও। বলল সুহাস।
না না, বিষয়টা এখানে নয়, শোনো সেদিন কী হয়েছিল রাজারামপুরে?
সুহাস বলতে চায় না। বলে দু-একটি কথা। তখন সুদামা তাকে জানায় কৃষ্ণেন্দুর সন্দেহের কথা। সুহাস ওপারে যেন একটু থমকায়, তারপর হা হা করে হাসে, স্যারের বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে, ঘোষচৌধুরী সায়েবের কথা কেউ শোনে, ঘোষচৌধুরী সায়েব তাঁর রহস্য উপন্যাসের খুনি কী দিয়ে খুন করবে, কীভাবে খুন করবে তাই-ই ঠিক করতে পারছেন না, শুনেছ কি কোনো রহস্য উপন্যাসে অপরাধী অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমা, গ্যাস চেম্বার থার্ড ডিগ্রি — এইসব অ্যাপ্লাই করছে খুনের জন্য — পাগল। আচ্ছা ঘোষচৌধুরী সায়েবকে দেখলেই মনে হয় না কেমন রহস্যময় মানুষ। চোখ দুটো দেখেছ, মনে হয় না মরা মানুষের চোখ!
হাসতে থাকে সুদামা। কী চমৎকার কথা বলো তুমি, আমার তো মনে হয় ওই ঘোষচৌধুরী ভেরি মাচ লিভিং, জ্যান্ত মানুষ।
ঘোষচৌধুরীকে পছন্দ হয় তোমার?
হাসছে সুদামা, পছন্দ হলে কী করব, অত জ্যান্ত মানুষের সঙ্গ সহ্য করতে পারব কী করে। দেখছ না ওর সুন্দরী বউ বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে, বিয়ে তো করনি। করলে টের পেতে, আর মেয়ে হলে আরও বুঝতে।
আহা আমি সে কথা বলছি না, ওপারে সুহাস বোসের গলা জড়িয়ে যায়। নিশ্বাস ঘন হয়, সে বলে, ঘোষচৌধুরীর সবসময় সন্দেহ।
বাহ সন্দেহ করাই তো ওর কাজ। খিলখিল করে হাসে সুদামা, তারপর বলে, তুমি সব ট্যাকল করেছ তাতেই বস রেগে গেছে, আমি বললাম, তুমি জানো তাই ট্যাকল করতে পেরেছ, তুমি ল্যান্ড অ্যান্ড পিপল বোঝ।
আমার তো চিন্তা হয়ে গেল, চাকরি থাকলে হয়।
না থাকবে, না থাকবে।
কী করব তখন?
লিখবে, লেখাও চমৎকার প্রফেশন, ধরো তুমি লিখবে কংসাবতী তীরে বর্ষা! বলতে বলতে সুদামা শিহরিত হয়। আরও কিছু বলতে ইচ্ছে হয়। ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। সে শুয়ে আছে প্রিয় পুরুষের কোলে মাথাটি ছুঁইয়ে। খোলা জানালার গায়ে মেঘ। সেই মেঘ এসেছে আবার। ঢুকছে শহরে। সুদামার নিশ্বাস গাঢ় হতে থাকে। সে ফিস ফিস করে, দেখেছ কংসাবতী তীরে বর্ষা?
হ্যাঁ দেখেছি। ওপারেও নিশ্বাস আগুন।
লিখতে পারবে?
যদি তুমি বলো। ফিসফিস করে ওপার থেকে কেউ, যেন ওদিকে শুরু হয়ে গেছে এককণা এককণা রোঁয়ার মতো বৃষ্টি, পাখির গা থেকে পালক ঝরে যাচ্ছে ক্রমাগত। পুরোনো পালক বৃষ্টির কণার মতো নামছে শুধু নামছে। দুজনে নিঝুম হয়ে গেছে। পরস্পরকে অনুভব করতে থাকে দুজনে যেন দুটি গ্রহে বসে। বাইরে বৃষ্টি জোরে এল। বৃষ্টির শব্দে টেলিফোন ভেসে যায়।
ওপার থেকে সুহাস বলল, আমি একটু টেনশনে আছি, দু-একদিন বাদে ফোন করছি। আজ রাতে খয়রাশোল যাচ্ছি, বাড়িতে।
আঠারো
আশ্চর্য! ক-দিনের জন্য যে মেঘ এসেছিল শহরে, তা আচমকা উধাও। আকাশ আবার খটখটে, রোদের ভিতরে ঘোলাটে ভাব। ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হচ্ছে ঘরে থাকা মানুষ। সুদামা ভাবে সুহাস কি মেঘ নিয়ে চলে গেছে খরা-পীড়িত বীরভূমে! সুহাস কি এখনও ফেরেনি? কৃষ্ণেন্দু খুব গম্ভীর। ওর নাম উচ্চারণই করে না। মাঝে-মধ্যে টেলিফোন আসে সন্ধের পরে, রাত্রে। ঘোষচৌধুরী বা অন্য কেউ কথা বলতে চায় কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে। কৃষ্ণেন্দু কী কথা বলে তা শুনতে চায় সুদামা। সুহাসের নাম যে উচ্চারিত হয় না, তা নয়। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুও যেন ধরে ফেলছে সুদামার কৌতূহল, খুব আস্তে কথা বলে।
সুদামার ঘরে থাকাই দায় এখন। ভাবে বেরিয়ে যায় বিনতার কাছে। তার কাছে উন্মোচন করে নিজের সব। কিন্তু বিনতার কি সময় হবে? শুনে বিনতা তাকে তিরস্কার করবে না! ছিঃ সুদামা, তোর না অত বড়ো একটা ছেলে, অত সুন্দর স্বামী। তুই না প্রেম করেছিলি বিয়ের আগে অনেকদিন। প্রেম কি ফুরিয়ে যায় কখনও! আমার তো বিয়ের পরে ভালোবাসা। বিয়ের আগে চিনতামও না লোকটাকে। কম দিন তো বিয়ে হয়নি, এখনও লোকটা দেরি করে ফিরলে ঘর-বার করি। ও যদি না ঘুমোতে পারে, আমিও ঘুমোই না। আমি যদি না ঘুমোই, ও-ও তো ঘুমোতে পারে না। ছিঃ সুদামা, সম্পর্ক কি দু-দিনেই বাসি ভাত। তোর কাছে সব তাই নেই নেই করিস। খোঁজ নিয়ে দ্যাখ তোকে কী ভালোই না বাসে তোর বর।
তুই আমার কথাটা —
কী আর বুঝব রে, বোঝা আমার হয়ে গেছে, সারাদিন ঘরে বসে বসে, এত সুখে থেকে, রাজরানির মতো থেকে তোর মাথা ঘুরে গেছে। ছিঃ, যদি শোনে কৃষ্ণেন্দু, তুই কী জবাব দিবি? সারাদিনে এত কাজ আমার, অন্য পুরুষ মানুষের মুখ কেন গলার আওয়াজ শুনতেও কৌতূহল হয় না। তুই বাড়ি যা, ভাব বসে। ভেবে দ্যাখ কী বলতে এসেছিলি আমার কাছে। যা তুই সুদামা, যা। বরং তুই ছেলেকে ডাক, না হয় ছেলের কাছে চলে যা। তোর মন খারাপ লাগে না বাচ্চার জন্য, তার কথাও তো ভাববি।
তা হলে কি সে যাবে অর্চনার কাছে। অর্চনা তো অফিসে একটা কথাও বলতে পারবে না। তা হলে কি অফিসের পরে, স্ট্র্যান্ড রোডে, গঙ্গার সামনে। কিন্তু অর্চনাও কি শুনবে? বলবে, কী আবোল-তাবোল বলছিস রে সুদামা, তোর কি মাথা খারাপ? যাই, ছেলেকে পড়াতে হবে ফিরে গিয়েই, ফার্স্ট টার্মিনাল সামনে। ও সুদামা, তুই বরং এটা কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে আলোচনা করে দেখ। হি-হি করে হাসতে হাসতে বাসের জন্য ছুটল অর্চনা।
এইকরমই হবে। এ ছাড়া দুপুরে তো সুহাসের ফোন আসতে পারে। ফোন বেজেই যাবে, কেউ ধরবে না। তাই-বা কী করে হয়? সুদামা দুপুরের ভ্যাপসা গরমে ফোনের দিকে চেয়ে জেগে থাকে। ঘুরঘুর করে। ভাবে ডেকে আনে অনিন্দিতা আর মাধুরীকে। টিভি চালিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতে বসে। গল্প করতে করতে জানিয়ে দেয় সুহাস বোস নামের যুবকটির কথা। আর তাই শুনে মাধুরী অবাক, সে কি গো, তলে তলে, একা একা এত! আমাদের জন্যও ওইরকম একটা জোগাড় করে দাও, দুপুরের প্রেম সারি। হি-হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে মাধুরী! খুব খোলামেলা! খুব ক্যাজুয়াল, কেমন দেখতে গো, শাহরুখ খানের মতো ইয়াং, টগবগে ঘোড়া, সানি দেওলের মতো মাসকুলার বডি, নাকি ওই যে কে এস-এর বিজ্ঞাপনে থাকে ছেলেটা, রাহুল না কী যেন নাম, তার মতো, উডল্যান্ড শ্যু-এর ছেলেটার মতো নাইস! দেখলেই শরীর জ্বলে ওঠে, কী গো সুদামা, বলছ না কেন, বাঙালির ওইরকম চেহারা, ওইরকম ম্যাসকুলিনিটি থাকে! নাকি ওই গেঞ্জির বিজ্ঞাপনের নায়কের মতো ভ্যাদভেদে — বিজ্ঞাপন দেখতেই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে …।
শুনে অনিন্দিতা বলে, তুমি কি সত্যি বলছ, সাচ। ঝুটা তো নেহি!
মাধুরী বলে, কিন্তু তোমার কবীর বেদির মতো স্বামীটাই-বা কী খারাপ, নাকি তিনিও জুটিয়েছেন আর কাউকে! হি হি হি, আমাদের বরের মাথায় পাকা চুল, কিছুতেই ডাই করবে না, তোমার উনি তো ডাই করেন, একদিন নতুন ঘোড়াটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও না গো, দেখেই সুখ, তোমার কী মজা! কখন আসে, দেখতে পাই না তো, এই জন্য তুমি আমাদের ত্যাগ করেছ সুন্দরী।
আবার অনিন্দিতা বলে, আহ। একত্রিশ বছরের ইয়াং, কেমন পুরুষ মানুষ সে বলো দেখি, তুমি তার শার্টের বোতাম … ক্লিন শেভড ইয়াংম্যান — ডেনিম আফটার শেভের অ্যাডটা দেখেছ, ওইভাবে জামার বোতাম খুলতে পারো — হি হি হি, কী প্রভোকেটিভ — সেনসুয়াস …
সুদামা তা হলে কী করে যায় ওদের কাছে? তা হলে এই দেওয়াল, টেলিফোনই ভরসা। টেলিফোন তো সব জানে, দেওয়াও। সুদামা অপেক্ষা করে টেলিফোন বেজে ওঠার। যত সময় টেলিফোন না বাজে সে টিভি চালিয়ে দেয়। বিজ্ঞাপন চিত্র দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, উডল্যান্ড শ্যু, ডেনিম আফটার শেভ, কে-এস-রেমন্ড শ্যুটিং দেখতে দেখতে টেলিফোনের দিকে কান রাখে। টেলিফোন ঘুমিয়ে থাকে। তারপর আচমকা সে দুঃস্বপ্ন না সুখস্বপ্নের ঘোরে জেগে ওঠে। বাজে। ছুটে ফোন ধরতে যায় সুদামা। সুদামা ছিল ও ঘরে। ডাইনিং কাম লিভিং-এর লাইনটা, না বেডরুমের লাইন, কোনটা ধরবে সে? বেডরুম অনেক নির্জন। অনেক গোপনীয়তাযুক্ত। ফোন ডেকে যাচ্ছে যেন অনেক সময় ধরে। দূর থেকে ডাকছে, যে ভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষ ডাকে, সেইভাবে হয়তো-বা। ছুটে ফোন ধরতে গিয়ে চুল এলো হয়ে যায়, গায়ের আঁচল পড়ে যায়।
সুদামা ডাক দেয়, হ্যাঁ বলছি, আমি সুদামা।
কোথায় ছিলেন এত সময়? ওপারে ঠিক সুহাসের কন্ঠস্বর।
তুমি কবে ফিরলে?
ফিরেছি তিনদিন। খুব জরুরি একটা ব্যাপার ছিল। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়েছিলাম। তুমি কেমন আছ?
টেলিফোনে সুদামার কান। দুচোখ শব্দহীন টেলিভিশনের চিত্রময়তায়। সে যেন বিজ্ঞাপনের পুরুষকে দেখছে না, দেখছে সুহাসকে। স্বাস্থ্যবান পুরুষ তাকে আহ্বান জানাচ্ছে। ভালোবাসায় হাত ধরেছে। সুহাস বলল, পরামর্শটা নেওয়া খুব জরুরি ছিল, তোমার কাছেও তো নিতে হবে।
পরামর্শ! কী পরামর্শ? সুদামার বুক ধকধক করে, ও কি তার কথা বলতে গিয়েছিল বীরভূমে। হা ঈশ্বর! কোথা থেকে রে কী হয়ে যায়, যাচ্ছে। এবার নীল ফেরেনি গরমের ছুটিতে। ইস্কুল থেকে ওদের নিয়ে গেছে উটকামন্ড। নীল একদিন ফোন করেছিল অতদূর থেকে।
সুহাস বলল, খুব জরুরি ব্যাপার। ডিসিশন নিতে হবে।
কী ডিসিশন? সুদামা থরথর করে কাঁপে।
তোমাকেও বলছি, শোনো আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
তাই! লিখবে বলে, আহ! আনন্দে রিসিভার কানে চেপে ধরে সুদামা, সত্যিই ছাড়ছ, এই ডিসিশন নিতে বীরভূম গিয়েছিলে? হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো সিদ্ধান্ত। সুদামা নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলে। যে ভয় পেয়েছিল সে! এ যে আগুনের সঙ্গে খেলা! এত তাড়াতাড়ি তো তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। তার যে ভয় করে! নীল রয়েছে উটিতে। তাকেও তো বলতে হয়। বাঁচল যেন সুদামা, বলল, ভালো করছ, এখন থেকে তোমার পেশা হবে লেখা, কংসাবতী তীরে বর্ষা, বাজির গ্রাম, চিনেম্যানতলা …। নীল নীল … আচমকা নীলের জন্য চোখে জল আসতে শুরু করে, আবেগে চোখ ভিজে যায়। সময় যন্ত্রে সে ফিরে যাচ্ছে চোদ্দ বছর আগের প্রেমে।
শোনো ম্যাডাম, তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওসব আমার হবে না। আমি মিঃ মেটা, এল পি জি সংস্থায় এদেশি ডিরেক্টরের কাছ থেকে অফার পেয়েছিলাম, অ্যাকসেপ্ট করছি। এখনই জয়েন করতে বলছে ওরা, ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি তো আছেই আমার — দারুণ অফার, স্যালারি প্রায় ডাবল। এ ব্যতীত অন্য সুযোগ, যাকে পার্কস বলো তোমরা তা অনেক। বাইরে পাঠাবে ট্রেনিং-এ, বোম্বেতে যেতে বলছে এখনই। কী, খুশি তো ম্যাডাম?
হাতের টেলিফোন ঠান্ডা হতে থাকে। কী ঠান্ডা, কঠিন, যেন বরফ চাপা হাত ধরেছে সে। তখনো সুহাস বর্ণনা করে যাচ্ছে অফারের বিবরণ, কীভাবে এটা হল, ওরা ইয়াং ম্যান খুঁজছে, সেদিন ভিজিটে গিয়ে আমার কাজ দেখে …।
সুদামার কানে বরফ শীতল বাতাস, চোখে টিভির রঙিন ছবি। পুরুষটি যত দুর্দম, তার সঙ্গিনী ততই ক্ষীণায়ু। রূপটুকু নিয়ে সে পুরুষের দিকে তাকিয়ে আছে। কী শূন্য দৃষ্টি! রূপ ব্যতীত তার আর কোনো কিছুই নেই। পুরুষের স্পর্শের জন্য সে ঝুঁকে পড়ছে ক্রমশ। কী চমৎকার শ্যুটিং … ইয়ে হা জে সি …। টেলিফোন ছেড়ে দেয় সুদামা। কাটা হাতের মতো রিসিভারটি ক্রেডল ছাড়া হয়ে পড়ে থাকল। ঝুলতে লাগল তারে।
সেদিন বিকেলেই কৃষ্ণেন্দু ফেরে। ঈষৎ নুব্জ। ঝুঁকে আছে সে। একদিনেই বয়স যেন বেড়ে গেছে অনেক। ব্রিফ কেস রেখে নিজেকে সে নিক্ষেপ করল সোফার উপর। কালো মুখ থমথমে।
বিপন্ন সুদামা জিজ্ঞেস করে, তোমার হল না তো?
চমকায় না কৃষ্ণেন্দু। বলল, সুহাস তো ফোন করবে বলছিল, করেছিল?
হ্যাঁ।
ও রিজাইন করেছে।
জানি। সুদামার কন্ঠস্বর কঠিন। বিপন্নতা অগ্রাহ্য করে সে।
তুমি পারলে না? সুদামার দিকে সরাসরি তাকায় কৃষ্ণেন্দু।
কী পারলাম না? সুদামা ফুঁসে ওঠে আচমকা, কী বলছ?
ওই হাউই, তুবড়ি, ঝুলঝুরির গ্রাম! সব বাজির মতো নিভে গেল! বিড়বিড় করে কৃষ্ণেন্দু, হাউই আকাশে উঠে ফেটে গিয়ে কতকগুলো তারা জ্বালিয়ে দিল, তাদের আয়ু কয়েক সেকেন্ড! তারপর অন্ধকার!
কী বলতে চাইছ তুমি? সুদামা গলায় জোর আনতে গিয়েও পারে না। কেমন নির্জীব হয়ে যাচ্ছে সে। বসে পড়েছে মেঝের কার্পেটে। চোখ দুটো ভার হয়ে যাচ্ছে, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, এ কথা কে বলল?
কেন সুহাস বোস।
অবাক হয় না সুদামা। তার জীবনের শেষ বিস্ময় কেটে গেছে আজ দ্বিপ্রহরে, ঘোলাটে রোদের দিনে। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি জানতে কী হতে যাচ্ছিল?
সব জানতাম, আন্দাজে ভুল ছিল না।
মুখ কালো হয়ে যায় অপমানে। সে মাথা নীচু করে, বলল, কী করে আন্দাজ করতে, আমি তো ওর সঙ্গে কোনোদিন পথেও বেরোইনি, দুপুরে এই ফ্ল্যাটে ওকে কোনোদিন আসতে বলিনি, ও আসেওনি। তবে কী জানতে?
তুমি ঠিকই বুঝেছ, কৃষ্ণেন্দু বলে, থাক এসব।
না, থাকবে কেন? বলো কী ভেবেছিলে?
তুমি তো নিজে ভালো জানো, ও তো বোম্বে চলে যাচ্ছে, তুমি নিশ্চয়ই তা জানো।
জানি, কিন্তু তুমি কী আন্দাজ করেছিলে, পরিষ্কার করে বলো।
কৃষ্ণেন্দুর মুখে ক্লিষ্ট হাসি, সে বলল, ভেবেছিলাম হাউই ফুলঝুরি, তুবড়ির আলোয় তুমি ওকে আটকে রাখবে, চিনেম্যানতলায় ওকে নিয়ে যাবে, পারলে না, ও খুব ধূর্ত!
তুমি সব জানো।
জানিই তো, এখন বুঝতে পারছি সুহাস যখন তোমার সঙ্গে হাউই-বাজির কী কথা হল তা বলতে লাগল আমাকে হাসতে হাসতে, তোমার কথা বলতে বলতে গলা আটকে যেতে লাগল, আমারই বোঝা উচিত ছিল সব ওর ধূর্তামি, আমাকে জানাচ্ছিল যে, স্যার ম্যাডামের প্রেমে পড়েছি আমি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সুদামার জন্য আমি আমার প্রতিষ্ঠা ছেড়ে দিচ্ছি। বড়ো চাকরিটায় আমার কোনো লোভ নেই, প্রেমে পড়লে ওসব দিকে মন থাকে না মানুষের। ও তো প্রায়ই বলতে তোমার কথা। বলত আর আমার চোখের দিকে তাকাত, আমি তখন ভাবিইনি, ও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। পেশায় যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী না হয় তাই তো আমি মেনে নিয়েছিলাম ওকে।
তোমার ভয় করেনি, আমি নীলের মা।
মাথা নাড়ে কৃষ্ণেন্দু, না ভয় করবে কেন, টেলিফোন ব্যতীত তুমি আর কতটা এগোবে, আমি তো তোমাকে চিনি। চেনায় ভুল নেই। ওকে তো ফ্ল্যাটে ডাকোনি। হয়তো ডাকার দিকে এগোচ্ছিলে। তার আগে আমি তোমার কাছে চলে আসতাম, নিজের কথা বলতাম, তোমাকে আমি যতটা চিনি, ততটা কি ও চেনে? তুমি কেন মা হতে গিয়েছিলে তাও তো জানি। তোমার মন তো আমি চিনি, তোমার রোমান্স কীসে তা কি আমি জানি না? আসলে প্রথম থেকেই ওর কথাবার্তায় আমি টের পেয়েছিলাম ও আমার গোপন প্রতিদ্বন্দ্বী। না এই ঘরে নয়, তোমাকে নিয়ে নয়, আমার চাকরিতে, পেশাতে, কোম্পানি আমাকে একটা আভাস দিয়েছিল মাত্র। সেটা আমি ওকে আচমকা একদিন বলে ফেলেছিলাম, না, না, বলিওনি, আন্দাজ দিয়েছিলাম। ও খুব চতুর, ধরে ফেলেছিল সব, তখন আমার আর উপায় ছিল না, ওরা তো টাকার বাজার খুলে বসেছে, সেই টাকা ছাড়ি কী করে। যখন টের পেলাম আটত্রিশ বছরের নারীও ওকে মুগ্ধ করতে পারে তখন আমি নিশ্চিন্ত —
সুদামার আর কিছু জানার নেই। সে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ভাঙা দেহ নিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়, দু-হাতে মুখ ঢাকে, তুমি আমাকে তোমাদের টাকার বাজারে তাই ঠেলে দিলে, আমাকে এইভাবে অপমান —। তুমি কি পুরুষ মানুষ!
কৃষ্ণেন্দু মাথা নামায়, বলল, আমি চেয়েছিলাম ঘরে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক। তাতে বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমবে, বাইরে আমি নিশ্চিন্ত থাকব, ও আমাকে আমার মতো করে নিশ্চিন্তও করেছিল যাতে আমি সতর্ক না হই।
সুদামা টলতে টলতে আছড়ে পড়ে কৃষ্ণেন্দুর ঠাণ্ডা শরীরে, গলার কাছ থেকে জামার কলার টেনে ওর মাথা নামিয়ে দিল আবার, বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সুদামা, কৃষ্ণের সখা, পুরুষের নামে নাম, আমি যেন পুরুষ মানুষের মতো অধিকার করতে পারি সব, তুমি আমার প্রেমিক, সখা, বন্ধু। একটা প্রতারকের হাতে তুলে দিয়ে কেমন নিশ্চিন্ত ছিলে হে প্রেমিক, আমার স্বামী, অগ্নিসাক্ষী রাখা পুরুষ মানুষ, নির্বোধ, তুমি কেন আমাকে আগে বলনি কথা যা হত আমার সঙ্গে তা সে সব আবার গল্পচ্ছলে জানায় তোমাকে, তুমি বসে বসে শুনতে আর ভাবতে তোমার বিশ্বাসী বউয়ের প্রেমে পড়ে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী তোমার সামনে থেকে সরে দাঁড়াবে। আসলে সরে দাঁড়িয়েছিলে তো তুমি, সরে দাঁড়িয়েছ, আমাকে দুজনে মিলে অপমান করেছ, দুজনে মিলে একটা মেয়ে মানুষকে তোমরা উলঙ্গ করে দিয়েছ। বড়ো কাজে একটা দুটো রেপ, থার্ড ডিগ্রি … যা বলে ওই অনিলবরণ, তাই-ই করেছ তোমরা, আমি তো প্রতারকের প্রেমেই পড়েছিলাম, হয়তো ঘরও ছাড়তাম — ছিঃ, তুমি এই রকম।
কৃষ্ণেন্দু ধীরে ধীরে সুদামার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে সরে যায়, খুব ঠাণ্ডা গলায় বলে তুমি ভুল করছ। এটা তেমন কোনো ব্যাপারই নয়। যদি আজ আমি জিতে ফিরতাম, আমাকে তুমিও জিজ্ঞেস করতে না কীভাবে কী করলাম আমি, বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না সে যা করেছিল তা ন্যায়সঙ্গত কিনা। আমি জিতে গেলে ওকে পিঁপড়ের মতো টিপে মারতাম। ওর ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়ে চাকরি ছাড়তাম, খুব সামান্য ব্যাপার এটা। ও তো তোমার ঘরে আসেনি, ও তো প্রেমের ভান করেছে।
সুদামা শুনছিল না। সে আছড়ে পড়ে মেঝের কার্পেটে, বিড়বিড় করে, ওই জন্যই বাচ্চাটাকে রাখতে দাওনি, গর্ভবতী বউয়ের সঙ্গে তো প্রেম করতে পারবে না তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী, টাকার বাজারে সওদা করতে আসা বেনিয়া, বাজারের মেয়ে-মানুষ পেটে ধরলে তো তার দাম কমে যায় —।
কৃষ্ণেন্দু চুপ।
উনিশ
বহুদিন বাদে কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করে সুদামার। ডায়েরির পাতায় জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার কী হয়েছিল, সে কেমন আছে, কেমন ছিল। কেউ না পড়ুক, নীল তো পড়বে। নীল — নীলাঞ্জন লিখেছিল কলকাতায় খুব গরম, তারা যাচ্ছে উটকামণ্ডে। কলকাতা তার আর ভালো লাগে না। অথচ এটা তো সবাই জানে, চোদ্দ বছরের নীলও জানে কলকাতার চেয়ে দক্ষিণ ভারত কম তপ্ত নয়।
নীল লিখেছিল, কলকাতায় গেলে প্রাণ হাসফাস করে, জ্যাম, ধুলো-ময়লা। আশ্চর্য মায়ের জন্যও মন কেমন করে না তার। কলকাতায় এসে না হয় বড়ো ব্যালকনিটাতে দূরবিন নিয়ে বসে থাকতিস, তোকে না হয় নিয়েই যেতাম দার্জিলিং! সুদামা ছেলের চিঠির সম্পূর্ণ জবাব দেয়নি। দায়সারা হয়ে কী লিখেছিল মনেও নেই আজ। বাবা-মায়ের কাছে এলেও দমবন্ধ হয়ে যাবে তার। ওখানেই যত বাতাস!
তার কথা শুনে কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, থাক না, বড়ো হচ্ছে তো। নিজের মতো বড়ো হোক।
নিজের মতো বড়ো হওয়া! নিজের মতো বড়ো হচ্ছে, না কৃষ্ণেন্দু তাকে তার নিজের মতো করে তুলছে। নীলের হোস্টেল বাস নিয়ে কম আপত্তি করেনি সুদামা। কলকাতায় কি স্কুল নেই। না, অমন কোনো স্কুল নেই এখানে, বলেছিল কৃষ্ণেন্দু।
ডায়েরিতে কী লিখবে ঠিক করতে পারছে না সুদামা। কার জন্য লিখবে? নীলের জন্য! ওখানেই তো একটু বাতাসের চিহ্ন এখনও। শো-কেসের উপর সাজানো নীলের ছবির হাসিটিতে সেই বাতাস।
কদিন বাদে কৃষ্ণেন্দু তাকে ডেকেছিল, ঠিক আছে, এতই যদি ইচ্ছে, তুমি আবার মা হও। আমার কোনো আপত্তি নেই, আবার আরম্ভ হোক।
ঘৃণায় সরে গিয়েছিল সুদামা। ঘৃণা এবং ভয়ে তার সর্বাঙ্গ শক্ত হচ্ছে ক্রমশ, হে বন্ধু, সখা, হে আমার প্রেমিক এইভাবে আর কত কাল! আবার যদি কোনো সুযোগ আসে তোমার কাছে?
বাজার তো বাড়ছে ক্রমশ। বাজার বাড়ছে টিভির বিজ্ঞাপনে, রাস্তার হোর্ডিং-এ, মানুষের মুখের ভাষায়। বাজারের উপযোগী হয়ে উঠতে চাইছে সকলে। হ্যাঁ, তার সন্তানও। বাজারের বড়ো বেনিয়া করে তুলতেই না তাকে অতদূর পাঠানো।
দীর্ঘ দুপুর কাটাতে কাটাতে, একদিন কী খেয়াল হল সুদামার, অনিলবরণকে ডেকে বসল। অফিসে বসে ফোন পেয়ে অনিলবরণ, কী ব্যাপার মিসেস চ্যাটার্জি?
আমি সুদামা।
হ্যাঁ সুদামা, হঠাৎ যে?
আপনি একটু আসবেন।
টেলিফোনে হবে না?
না, টেলিফোন বেশি সময় আমার ভালো লাগে না, এখনই আসুন না।
খুব দরকার?
হ্যাঁ, ওকে কিছু বলতে হবে না। সুদামা ফোন রেখে দিল।
এল অনিলবরণ। ডাকামাত্রই প্রায় ছুটে এল। অফিসের গাড়ি ছিল না, ট্যাক্সি নিয়েই চলে এসেছে হাচোড়-পাচোড় করতে করতে। জামা-কাপড় আধ-ময়লা, সাদা জামার বুক পকেটে কালির দাগ। দাঁড়ি কামানোও নেই।
হাঁপাতে বসল অনিলবরণ, হঠাৎ তলব, তাও ওকে না জানিয়ে।
সুদামা বলল, বিশ্রাম নিন, তারপর বলছি, স্কোয়াশ দিই। মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন তো, ভালো জলভরা সন্দেশ আছে।
অনিলবরণ বলল, না কিছুই লাগবে না, আমার সব রকম খাওয়াও এখন বন্ধ। সুগার হয়ে গেছে যে তলে তলে, তা টের পাইনি, ব্লাড কোলেস্টেরল তো আছেই, দেখুন এটাও একটা উপায়, যদি কারো হাই সুগার থাকে, মিষ্টি খাইয়ে খাইয়ে তাকে শেষ করে দেওয়া যায় —।
সুদামা বলল, থাক, আমি আপনাকে মারতে চাই না। আপনার মুখের ভাষা এত খারাপ।
অনিলবরণ বলে, খারাপটা কিন্তু সবাই শোনে, রেপ-মার্ডার এসব খুব খারাপ। কিন্তু কাগজে এই সব খবর বেশি পড়তে চায় মানুষ। রেপের বিবরণ পড়তে চায়। কেন বলুন দেখি, আসলে মানুষ নিজেই নিজের খোঁজ রাখতে পারে না, কী ভালোবাসে, কাকে ভালোবাসে তাই-ই জানে না।
সুদামা বসেছে দূরত্ব রেখে। ডাকল কেন অনিলবরণকে। ঠিক দুপুরবেলায় তার ফাঁকা ফ্ল্যাটে একটি অন্য পুরুষ যার মুখে খুন রেপ, এসব নিয়ে সর্বক্ষণই যে ভাবিত, খুঁজে খুঁজে বার করেছে ১৯৫ বা ১৯৮ রকমের খুনের পদ্ধতি, সুদামা তাকে ডেকে এনেছে কেন? খুন হতে? নাকি সুহাস বোসের খোঁজ নিতে?
সুহাস বোসের খোঁজ নিতেই ডাকা অনিলবরণকে। সে কি জানে সুহাসের কোনো খবর? দিন পনেরো কাটার পর এখন সুদামার মনে হচ্ছে কৃষ্ণেন্দু সব সত্যি বলেনি। সুহাস তার প্রেমের বিবরণ প্রেমিকার স্বামীর কাছে বলত, এই কথাটি হয়তো সত্যি নয়। হাউই বাজি, ফুলঝুরি, তুবড়ির কথা বলতে পারে, বাজির গ্রামের কথা কৃষ্ণেন্দুকে বলতেই পারে সুহাস, তাতে কল্পনা যোগ করেছে কৃষ্ণেন্দু। পরাজয়ের গ্লানি কাটানোর জন্য আর একজনকেও অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার ছিল তার। সুহাসকে তার অপরাধের সহযোগী করে তুলে নিজেকে কিছুটা আড়াল করতে চেয়েছে হয়তো কৃষ্ণেন্দু। সুদামা জানে, তার এই ভাবনাও সঠিক না হতে পারে। সুহাসকে নিরপরাধ সাজিয়ে সে মনে মনে কৃষ্ণেন্দুকে আরও অপরাধী করে তুলতে চায় যেন-বা। তাতে সে বাঁচে।
সুদামা বলল উপন্যাস লেখা হল?
না, এখন খুনি কীভাবে খুন করবে তা-ই ঠিক করে উঠতে পারেনি।
হাসতে থাকে সুদামা, তার মানে, খুন না হলে উপন্যাস এগোয় কোন পথে?
কোনো পথেই নয় ম্যাডাম। হাসে অনিলবরণ, আসলে খুনের তো বহু উপায় আছে, কোনটা অ্যাপ্লাই করলে সুবিধে হবে লেখকের তাই-ই লেখক ঠিক করে উঠতে পারছে না। তাই বিষের মাত্রা কমে যাচ্ছে। ধরুন যদি চার মিলিগ্রাম স্ট্রিকনিন বিষের প্রয়োজন হয় মানুষ খুন করতে, খুনির হাতে আছে পয়েন্ট ফোর মিলিগ্রাম, কিছু বুঝলেন? স্ট্রিকনিন না ধুতুরা, কোনোটা ভালো, এ নিয়ে তার ধন্ধ আছে।
মাথা নাড়ে সুদামা, আপনি এত জটিল করেন। কেন ব্যাপারটা?
জটিল করতে তো চাই। পারছি না ম্যাডাম চ্যাটার্জি, ডাকলেন কেন?
কঙ্কনা ফিরল?
ফোন করুন না, না না এখন নয়, ও বোধহয় বাচ্চাদের ইস্কুল থেকে আনার জন্য বেরিয়েছে, ফিরেছে চুক্তি করে।
কী চুক্তি?
আমাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে আমার বউ, আসলে ও খুব তেজস্বিনী। ধীরে ধীরে বলে অনিলবরণ।
কী হয়েছে, ও কি নার্সিংহোমে গিয়ে …?
না, না, তাতে তো ওর হার হত। এই রে আমার কী হচ্ছে, ঘরের কথা সব বলে দিচ্ছি। যাক গে, আমি আবার চেপে রাখতে পারি না। শুনুন দিদিমণি, ও বলেছে হ্যাঁ আবার বাচ্চার মা হতে পারে, পরিবর্তে আমাকে খুন করতে হবে তাদের।
কী বলছেন আপনি, দুজনেই কি পাগল হলেন?
হাসে অনিলবরণ, পাগল হইনি। মাথা বেশ ঠাণ্ডাই। ও বলছে খুনটা করতে হবে উপন্যাসে। বলতে বলতে অনিলবরণের মুখ কালো, তা কি সম্ভব? পারা যায়?
সুদামার বিস্ময় বাড়ে, সত্যি বলেছেন?
হ্যাঁ সত্যি, তাই ১৯৫-৯৮ রকম খুনের উপায় জেনেও আমি একটা খুনও করতে পারছি না আমার খুনিকে দিয়ে কঙ্কনা ওই কথা বলার পর, আমার মাথার ভেতরের খুনিটা ভয় পেয়ে গেছে, দেখুন সুদামা, আমার আবার বাচ্চা খুব পছন্দ, ছেলের ছুতোয় আরও কয়েকটা বাচ্চা, তাতে যদি ঘর ভরতি হয়ে যায় যাক না, আমি ব্যাকডেটেড, কৃষ্ণেন্দু বলে, সুহাসও বলত। আমি যেন নাইনটিনথ সেঞ্চুরির মানুষ, কী জানি এক আনি দু-আনি চার আনি আধুলি, দশ-বিশ-পঞ্চাশ পয়সায় পকেট ঝনঝন করুক এ আমার খুব পছন্দ, ও বলে আমি ওকে খুন করতে চাই।
তাই তো, এত বাচ্চার ধকল কী করে নেবে একটা মা?
নিতে পারে, হলেই নেবে, মেয়ে হলে আমিও নিতাম। হাসে অনিলবরণ, কেউ চায় কেউ চায় না, আমাকে আমার বউ বলে আমি একটা খুনি, কী করে বলে ভাবুন দেখি, পাঁচটা বাচ্চা চাইলে খুনি!
সুদামা চুপ করে থাকে। তার আর ভালো লাগে না। এখন মনে হচ্ছে অনিলবরণ উঠে যাক। সে নিজে ওঠে। পায়চারি করে। অনিলবরণ কথা বলতে আরম্ভ করলে থামে না, বলছে, আমি নাকি ফিউডাল। মেয়েদের শুধু আঁতুড়ঘরে আর রান্নাঘরে দেখতে চাই। ওসব এখন আর চলে না। লোকে জানলে নাকি আমিই খুন হয়ে যাব, কী বুঝলেন কিছু?
সুদামা বলে, তা হলে আপনার খুনি খুন করতে পারবে না?
না, তাকে চিনে গেছে যে তার বউ, খুনিকে যদি আগেই চিনে ফেলে সবাই, সে খুনের মানে কী? খুনই-বা হবে কী করে? খুনি নিজেই তো ভয় পেয়ে গুটিয়ে গেছে। বুঝতে পারছে ১৯৫-৯৮, তিনশো রকমের বিষ দিয়েও আর সম্ভব নয়, ভিকটিমটা কে?
তা হলে কীভাবে সম্ভব?
তা তো আমি জানি না, আমার জ্ঞানবুদ্ধি, ধ্যান-ধারণা সব ধরা পড়ে গেছে আমার বউয়ের কাছে। আসলে কী জানেন, কঙ্কনা আমাকে ভালো তো বাসে, আর তাতেই হয়েছে তার বিপদ। আমারও বিপদ। কঙ্কনা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ওইসব বস্তাপচা রহস্য উপন্যাস আর চলবে না, খুনই হবে না। শেষ পর্যন্ত মাথা ভার করে ঘুরে বেড়াবে খুনি, হয়েছেও ঠিক তাই। এক পাতাও লিখে উঠতে পারছি না। আমার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়েছে ভিকটিম খুঁজে বের করা।
আশ্চর্য! সুদামা অবাক হয়ে দেখছে মানুষটাকে। চোখ দিয়ে আলো গলে পড়ছে যেন। মুখখানিতে জেগে উঠছে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগের একটি শিশু। এ যেন হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর অন্ধকার থেকে বের করে আনা কোনো শিলাখণ্ড, তার গায়ে গায়ে উৎকীর্ণ করা আছে জীবনের ইতিহাস।
অনিলবরণ বলে, বাচ্চাকে খুন তো করাতে পারব না, ইমপসিবল। হ্যাঁ এজেড ম্যান কাউকে যে গ্যাসে ডুবিয়ে, বিষ দিয়ে, গলা টিপে, গুলি করে, লোক লেলিয়ে দিয়ে মারব, তাও হয়ে উঠছে না। রেপ মার্ডার যে করবে আমার খুনি, সে তো খুনের আগেই দেখতে পাচ্ছে ভিকটিমের চাইল্ডহুড, হতভাগ্যের তো বাল্যকাল ছিল। আমার খুনি বিষ তৈরি করতে করতে, বন্দুকের নল পরিষ্কার করতে করতে, ছুরিতে শান দিতে দিতে, পরমাণু বোমা, গ্যাস চেম্বার থার্ড ডিগ্রির কথা ভাবতে ভাবতে বিমনা হয়ে যাচ্ছে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে যাকে খুন করবে তার শৈশবের কথা, হতভাগ্য তখন বালক বা বালিকা হয়ে যাচ্ছে, আকাশে গ্যাস বেলুন ওড়াচ্ছে, মাঠ দিয়ে দৌড়চ্ছে, হাততালি দিচ্ছে মাদারি খেল দেখে। তারপর সে আরও ছোটো হয়ে যাচ্ছে, আরও ছোটো হয়ে সে হাত-পা নাড়ছে, ফোকলা গালে হাসছে, চোখ ফুটেছে সবে, আলো দেখছে আকাশ দেখছে, পাখির উড়াল দেখছে, খসে পড়া পালক দেখছে — আরও পিছিয়ে তো অন্ধকারে গুটি-সুটি মেরে, মায়ের শরীরের অভ্যন্তরে লুকিয়ে — তারপর ভ্রূণ হয়ে যাচ্ছে। তাকে কী করে খুন করানো যাবে বলুন দেখি। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, একটা বয়সের পিঠে আর একটা বয়স, চাঁদের গায়ে চাঁদ …।
শুনতে শুনতে সুদামার মুখ-চোখ বদলে যায়। সে কাঁপতে থাকে। বাক্যগুলি আশ্চর্য এক ধ্বনির মতো তার কানের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। বাইরে মেঘ ঘন হয়েছে। সেই মেঘের ওপর থেকে, কোনো এক সীমাহীনতা থেকে ধ্বনিপুঞ্জযেন বিলম্বিত লয়ে প্রবেশ করছে এই পৃথিবীতে, এই শহরে, এই স্থলভূমিতে, ফ্ল্যাটের ভেতরে — বিপ বিপ বিপ! সে দুহাতে মুখ ঢাকে। হতভাগ্য মাতৃগর্ভে, ভ্রূণ হয়ে আছে, শুধু তার প্রাণ জেগেছে মাত্র। তাকে কী করে হত্যা করতে পারে অনিলবরণ। তার কলমের নিব ভেঙে যাচ্ছে।
সুদামা ধরা গলায় বলে, আপনি বলে যান।
বললে আপনি কষ্ট পাবেন, কেন ডেকেছিলেন আমাকে, একটি খুনের কাহিনি শুনতে, নাকি সুহাস বোসের কথা শুনতে?
সুদামা ভেঙে যায়, বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করে, জানেন?
জানব না কেন, ওই ছোঁড়াটা তো বলত, এমনভাবে বলত যেন আমরা যথেষ্ট ভাবতে পারি, কল্পনা করতে পারি, এক ঘন্টা ধরে ফোন করেছে বসের স্ত্রীকে, অত সময় ধরে গল্প করেছে, করছে — এইসব শুনলে, দেখলে সন্দেহ হবে না? ও তো চাইত যেন কৃষ্ণেন্দু ভালো করে টের পেয়ে নিশ্চিন্ত থাকে — এইভাবে মানুষের প্রেম ভালোবাসা, অনুভূতিকে কেউ হত্যা করে? আমার খুনির চেহারাটা কিন্তু, না থাক, কিছু বলব না। আমি উঠি এবার, আচমকা বাড়ি ফিরলে আমার বউ চমকে যাবে, দেখুন দিদিমণি, খুন করা খুব সোজা, করে দিলেই হল, ভালোবাসা খুব কঠিন, আপনি তা মানেন?
বলতে বলতে চলল অনিলবরণ। ঘরে এখন মেঘের গায়ে মেঘ লেগেছে, ছায়ার ভেতরে ছায়া। একা সুদামা সেই ছায়ার ভিতরে লুকিয়ে আছে। মনে হয় যাচাই করা শেষ। কিন্তু সত্যিই শেষ কি? ভালোবাসা বড়ো কঠিন। তিলে তিলে গড়ে তুলতে হয় ভালোবাসা। সন্তানের মতো লালন করতে হয় রক্তের ভেতরে। তাকে হারাতে চায় না সে।
কুড়ি
মনে পড়ে কৃষ্ণেন্দু, বৈশাখ থেকে ভালোবাসার কাঙাল হয়েছিলাম আমরা। তারপর যখন মেঘ ঢুকল শহরে, ফ্ল্যাটে আমরা দুজন, সবচেয়ে ভালো ঘরটা আমাদের। খোলা জানালার ওপারে পামট্রির সার, জৈন মন্দির, আকাশ আকাশ, কত দূরে কাছিমের পিঠের মতো ধূসর ব্রিজ, তুমি ভোরবেলায় বর্ষার ভিতরে বেরিয়েই নিয়ে আসতে কদম্ব, ”আরও চাই তোমার? আরও, আরও!”
হ্যাঁ চাই-ই তো। ফিসফিস করে বলতাম তোমার কানে কানে, চাই, আরও প্রেম চাই, চাই আরও ভালোবাসা। মেঘ বর্ষা ভেজা বাতাস, ছায়াঘন সকাল, কদম্ব পুষ্পে প্রেম যেন সীমাহীন হয়ে উঠেছিল ওই সাতদিন। মনে পড়ে তা?
এই বালির মাঠ, লবণ হ্রদেও তো গাছ-গাছালি বড়ো হয়ে উঠেছে এখন। ঘাস হয়েছে পিচ ঢাকা পথের ধারে, কাঠগোলাপ ফোটে প্রচুর। কদিন আগেও দেখেছি পরপর কৃষ্ণচূড়ার রং আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে। এখানে তো আকাশ অনেক অনেক বেশি উদার। এখানে মেঘ আসে বেশি। একটু পুবে গেলেই যেন মেঘের জন্মভূমি, বাইপাস ধরে গেলে তেমনই মনে হয়। কিন্তু কোথাও কি কদম্ব ফোটে না এদিকে? জানো তুমি কৃষ্ণেন্দু?
মনে মনে জিজ্ঞেস করতে করতেই বেলা গড়ায়, সকাল থেকে দুপুর। সুদামা বিছানায় উপুড় হয়ে শোয়। কদম্বের গন্ধ কী রকম? ভুলেই গেছে সে। আজ হঠাৎ যে কেন বার বার মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা। সুদামা উঠে বসে। নাকে যেন কী রকম একটা গন্ধ আসছে। সে চট করে বিছানা থেকে নামল। গ্যাসের। কাঁচা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের। বিমলা-বিমলা? কোথায় সে? কখন কাজ করে চলে গেছে। তারপর তো নিজের জন্য চা করল সুদামা। দৌড়ে কিচেনে ঢোকে সে। যা ভেবেছে ঠিক তাই। সিলিন্ডারের নব পুরো ঘুরিয়ে বন্ধ করা নেই, কিন্তু ওভেনের নব আধাআধি, বন্ধ বা খোলা। হ্যাঁ ছোটো ওভেনটা। সেখান থেকেই অল্প অল্প গ্যাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিচেনে গন্ধটা আরও গভীর। সুদামা পা বাড়িয়ে ঝপ করে দুটো নব বন্ধ করে একজস্ট ফ্যান চালিয়ে দিল। দাঁড়িয়ে থমথম করে। কখন মনের ভুলে সে গ্যাস খুলে রেখে মেঘ দেখতে চলে গেল ব্যালকনিতে? তা হলে কি সেই যে সেদিন, যেদিন রাজারামপুরে জমির দখল নিয়ে ফিরল তিনজন, এমন হয়েছিল। অনিলবরণকে সন্দেহ করেছিল কেননা সন্দেহ করার তো ওই একজনই ছিল। তবে হতেও তো পারে। তখন অনিলবরণের বউ কঙ্কনা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। লোকটা শুধুই খুনের কথা ভাবত। কে জানে কী হয়েছিল সেদিন। এখন আর পারবে না অনিলবরণ। মনে পড়ে যাবে একটি নারীর শৈশব, তার ভ্রূণাবস্থার কথা। সুদামা বেরিয়ে এল কিচেন থেকে। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। কী যে হয়েছে আজ, কৃষ্ণেন্দু বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই কদম্বের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কদম্ব-শিহরিত হয়ে উঠছে সে।
ব্যালকনিতে দাঁড়াতে পারল না সে বেশি সময়। জানালাগুলো সব খুলে দেবে নাকি। কাঁচা গ্যাসের গন্ধটা গিওে যেন রয়ে গেছে একটু একটু, ভাসছে হয়তো ঘরের আনাচে-কানাচে, লিভিং স্পেসে, অন্য ঘরটিতে, আর একটি ঘরে। সুদামা ঘুরে ঘুরে জানালা খুলে দিতে থাকে। ফ্ল্যাটের সব জানালা। বেশ লাগছে জানালা খুলতে। মনে হচ্ছে ভোর হয়েছে বোধহয়। ডালিমতলার বাপের বাড়ির কথা মনে পড়ল সুদামার। ওদিকে চোর-ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রব খুব। তাই ভরা গ্রীষ্মেও জানালা খুলে ঘুমোতে ভয় হত। ভোর হতে না হতেই সুদামা উঠে সব জানালা ধাক্কা মেরে মেরে খুলত। যেন গুমোট অন্ধকারকে ঠেলে বাইরে পাঠাত। আহ। কী চমৎকার ভিজে বাতাস! সুদামার মুখে বাতাসের গাঢ় ছোঁয়া। কী মেঘ না এসেছে আকাশে।
জানালা সব খুলে সুদামা লিভিং স্পেসে অ্যাকোরিয়ামের পাশে এসে বসে। মাছের জল বদলানো দরকার ছিল। হয়নি। অ্যাকোরিয়ামের আলো জ্বালিয়ে দেয় সে। প্রবাল দ্বীপ, লতাগুল্মের ভেতরে সমুদ্রের অতলে রঙিন মাছেরা নিঃশব্দে ঘোরে। নিশ্চুপ চেয়েই থাকে সুদামা। আচ্ছা সে যদি টের না পেত? গ্যাসে ভরতি হয়ে যেত এই ফ্ল্যাট। একটা সিলিন্ডারে কত গ্যাস ধরে যেন। সে গ্যাসের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকত। সুদামার বুক ধকধক করে। অ্যাকোরিয়ামের কাচের গায়ে কালো বিন্দুর মতো মাছের চোখ তার দিকে স্থির।
সুদামা উঠে এল অ্যাকোরিয়ামের কাছ থেকে। ধীর পায়ে টেলিফোনের কাছে যায়। ডাকবে নাকি কৃষ্ণেন্দুকে। যা হয়েছে তা ভুলে যাক। কৃষ্ণেন্দু, ভুলতে চাইলে কদিনই-বা লাগে ভুলে যেতে। এই তো আমি ভুলে যাচ্ছি সুহাস বোসকে। ভুলেই গেছি। অবাক লাগে তোমার কথা ভুলে ওর কথা ভাবতে আরম্ভ করলাম কীভাবে, কবে, কোন মুহূর্তে? কেন? এই তো আমি এখন আর কষ্ট পাই না নীল কাছে নেই বলে, এই ভ্যাকেশনে আসেনি বলে।
সুদামা দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে। ঠাণ্ডা বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে। তার মানে বৃষ্টি নেমেছে এই শহরে কোথাও না কোথাও। কৃষ্ণেন্দু বসে আটতলায়। তার ডানদিকে মস্ত জানালা, কাচ দিয়ে ঢাকা। চেয়ারে বসেই কৃষ্ণেন্দু শহর দেখতে পায়। গঙ্গা দেখা যায়, এমনকী খিদিরপুর ডকে দাঁড়ানো জাহাজের মাস্তুলও, দ্বিতীয় হুগলি সেতুর জাল। কৃষ্ণেন্দুর ঘরের জানালা বোধহয় মেঘের প্রলেপে অন্ধকার হয়ে গেছে। এত মেঘ, এখনও কি কদম্ব ফোটেনি?
কৃষ্ণেন্দুর কি মনে আছে সেই কদম্ব-শিহরিত দিনগুলির কথা? ভাগ্যিস সকলে পুরী গেল, আমরা গেলাম না। তিনটে ঘরে কেউ নেই, তবু আমরা দরজা বন্ধ না করে শুতে পারতাম না। মনে হত কেউ যেন আছে। রান্নাঘরে ঢুকে চুম্বন করতে চাইলে তুমি, আমি সরিয়ে দিলাম, কেউ আছে, দৌড়ে চলে এলাম ঘরে। মনে আছে তোমার কৃষ্ণেন্দু? এখন এই দেড় হাজার স্কোয়ার ফুটে কিন্তু কখনওই মনে হয় না কেউ আছে। কেউ না!
সুদামা ঘরে ঢুকে টেলিফোন তুলে ডাক দিল কৃষ্ণেন্দুকে। রিং হয়ে যেতে থাকে। অনেক বাদে ধরল একজন, হ্যাঁ কৃষ্ণেন্দুই, কোথায় ছিলে তুমি? ফোনটা ধরছেই না কেউ?
কে বলছেন?
আমি গো আমি। সুদামার গলার স্বর গাঢ়, গাঢ়তর হয়ে ওঠে।
আমি মানে কে? কৃষ্ণেন্দু যেন খেলা করছে।
আমিই-ই। টেলিফোনে মেঘের গুরু গুরু শুনতে পায় সুদামা। মেঘ এসে ডাক দিচ্ছে যেন কৃষ্ণেন্দুকে তার জানালার কাচের গায়ে মুখ লাগিয়ে।
কী হল, তোমার ঘরের জানালা কি খুলে রেখেছ? শুনছ তোমার ঘরের বাইরে মেঘ ডাকছে, বৃষ্টি শুরু হল ওখানে? আমি সুদামা।
কৃষ্ণেন্দু বলল, তোমার গলার স্বর এত ভারি লাগছে যে চেনাই যাচ্ছে না।
তুমি এখনই চলে এসো, এক্ষুণি।
কেন কী হয়েছে?
এসে শুনবে, খুব দরকার, না এলে হবেই না।
কী হয়েছে বলবে তো।
ফোনে বলা যাবে না, তুমি চলে এসো গো, ডাকল সুদামা। মেঘের মতো ডাকল তার স্বামীকে। মেঘ হয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইল প্রিয় পুরুষটিকে। ডাকতে ডাকতে আবার শুনল মেঘের গর্জন, গুরু গরু ধ্বনি। টেলিফোন কোনোক্রমে রেখে দিয়ে গেল জানালার ধারে।
এর পর ঘড়ির কাঁটা সরতে থাকে। বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে আসে। আকাশ ঘোর কালো, শূন্যতায় কোথাও কোথাও গভীর রুপোলি উজ্জ্বলতা, বৃষ্টির বিন্দু মুক্তোর মতো ঝরে পড়তে লাগল নীচে। তার ব্যালকনি গেল ভেসে। সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে। রাস্তার দিকে চোখ। গাড়ি এল কি? কতটুকু সময় লাগে বাইপাস ধরে আসতে।
ভিজতে ভিজতে ভিজেই গেল সে সম্পূর্ণ। ঘরে এসে শাড়ি-ব্লাউজ বদল করল। কচিপাতার রঙে সাজল। বৃষ্টিতে ধোয়া নতুন পাতার মতো রং ধরল তার গায়ে। ঘর আবছা আঁধারে ছাওয়া। কতকাল বাদে সে ঘড়ি দেখতে আরম্ভ করল। এমনভাবে ঘড়ি দেখত সেই কতদিন আগে, কৃষ্ণেন্দুর জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে হয়তো কোনো পথের মোড়ে, অথবা কৃষ্ণেন্দু দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। সে এক লজঝড়ে বাসে চেপে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বাস চলছে ঘড়ির কাঁটার অনেক পিছনে। অথবা কৃষ্ণেন্দু ফেরেনি অফিস থেকে। সে বেলগাছিয়ার পুরোনো ঘরে বসে উদ্বিগ্ন হয়েই যাচ্ছে। ঘড়িটা ফার্স্ট আছে কিনা খোঁজ নিচ্ছে বড়ো জা-র কাছে।
এতক্ষণ তো কৃষ্ণেন্দুর এসে যাওয়ার কথা। কৃষ্ণেন্দু যদি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে তো এত সময় লাগার কথা নয়। তা হলে কি ঘুরে আসছে। ঘুরে আসবে কেন? পথে কি গাড়ি বিগড়োল বৃষ্টির ভেতরে। খোলামেলা ই এম বাইপাসে তো হাওয়া আর মেঘের দাপট অনেক বেশি। কৃষ্ণেন্দু কি ভিজছে, গাড়ির কী হল তা দেখতে বেরিয়ে এসে।
বেলা যায়, সন্ধে হয়। কচিপাতার রং ঢেকে যায় অন্ধকারে। কৃষ্ণেন্দু এল সন্ধের পর, তখন সওয়া সাতটার মতো হবে। সুদামা ঘুম অন্ধকারে গুটিয়ে শুয়েছিল সোফার উপরে। ডোর বেল বাজলে তাকে উঠতে হয়। ঢুকতে ঢুকতে কৃষ্ণেন্দু বলল, বার পাঁচেক চেষ্টা করেছি তারপর, এনগেজড ফোনটা বোধহয় ঠিক করে রাখনি ক্রেডলে? এ কি আলো জ্বালোনি কেন?
আসতে পারলে না? সুদামার মুখ থমথমে।
বললেই আসা যায়, দায়িত্ব নেই? কৃষ্ণেন্দু যেন বিরক্ত।
দায়িত্ব আর কিসের, সে চাকরি তো আর একজন কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। যত কাজ তো ছিল ওইটার জন্যই।
কৃষ্ণেন্দু আলো জ্বালিয়ে সোফায় বসে, অন্ধকার ভূত করে রেখেছ বাড়িটা, কোম্পানি একটা নাকি, পর পর তো আসছে, এবার আসছে কম্পিউটার-সফটওয়্যার নিয়ে এক জাপানি কোম্পানি। ওই ব্যাপারে দিল্লি থেকে ফ্যাক্স এসেছিল। আরও কত অর্গানাইজেশন যে আসছে। বলতে বলতে হাসতে চেষ্টা করে কৃষ্ণেন্দু।
তাতে তোমার কী?
বাহ, প্রাথমিক দায়িত্ব তো আমার, প্রজেক্ট অফিসারকেই তো সব দেখতে হয়।
দায়িত্ব নিয়েই-বা কী হবে, তুমি কিছু গুছোতে পারবে এবার, কমিউনিটির কেউ নেই এখন?
কৃষ্ণেন্দু নিশ্চুপ। সুদামার কথায় আহত হয়েছে, কিন্তু মুখের ভাবে তা প্রকাশ করে না, সে হালকা করে দিতে চায় বিষয়টিকে, ডাকে সুদামাকে, কী জন্য ডেকেছিলে?
সুদামা কিচেনে গিয়ে ঢুকেছে। জবাব দেয় না।
কৃষ্ণেন্দু বলে, যখন তখন ডাকলে হয়, আমি কেরানি, পিয়নের চাকরি করি না, অবশ্য কেরানি পিয়নের চাকরিই সবচেয়ে আরামের, বউ ডাকলেই স্যারকে বলে চলে আসতাম, স্যার বউয়ের জ্বর, বাড়ি যেতে হবে। স্যার রান্না করতে গিয়ে বউয়ের হাত পুড়ে গেছে। স্যার কাল জামাই ষষ্ঠী, শালির ছেলের মুখে ভাত, বউয়ের হাঁচি হয়েছে ছুটি চাই, থিয়েটারের পাশ পেয়েছি স্যার, দুজনে যাব, বাঁকুড়া যাব ভায়রার বাড়িতে — কৃষ্ণেন্দু হা হা করে হাসতে থাকে, ডাকলেই আসা যায়?
সুদামা জবাব দেয় না। গ্যাসে চায়ের জল চাপায়। কৃষ্ণেন্দু জামা-কাপড় ছাড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে কিচেনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, বলল ফোনটা ঠিক করে রাখবে তো?
রাখলে কী হত?
আমি জানতে পারতাম ব্যাপারটা কী। তুমিও খবর পেতে আসছি না কেন, কথা বলার সময়ই তো দিলে না, লাইন কেটে দিলে।
সুদামা বলল, আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করছি না।
জিজ্ঞেস করবে কেন, আমিই বলছি। ফোনটা ঠিক করে রাখবে তো, কখন কী প্রয়োজন পড়ে, যতবার ডায়াল করি, এনগেজড।
যাক, আসনি, মিটে গেছে, চা নাও। গ্যাস বন্ধ করে সুদামা। একবার ওভেনের নব, আর একবার সিলিন্ডারের। বন্ধ করে খোলে, আবার বন্ধ করে। মুখে ভক করে গ্যাসের গন্ধ এসে লাগে। সে বেরিয়ে আসে কিচেন থেকে।
কৃষ্ণেন্দু তার পিছনে আসে, আরে বলবে তো কী হয়েছিল, সারাদিন অত ব্যস্ততা। তার ভেতরে ওই ফোন, রিং ব্যাক করছি, এনগেজড। কী টেনশন বলো দেখি, খামোকা ডাকলে কেন?
সুদামা একটা কথাও বলে না?
একবার ভাবলাম কাউকে পাঠাই, তো অর্ডারলি পিয়ন গোপালও দিন কয় আসছে না, পুরী গেছে নাকি রথ দেখতে, পারেও বটে।
সুদামা ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায়, পাঠাতে পারলে না?
না, তেমন কেউ ছিল না।
পাঠাতেই পারতে। সুদামার চোখের তারা জ্বলজ্বল করে ওঠে, ঠোঁটের কোণে চাপা হাসির রেখা, পাঠালে না কেন, সে এসে দেখে যেত তোমার বউ মরল কিনা, নাকি আর একটা সুহাস বোস জুটেছে। হিসহিস করতে থাকে সুদামা, তার জন্য ওয়েট করেছিলে?
একুশ
কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল, শেষে কেমন কুন্ঠিত গলায় বলল, আ য়াম স্যরি, সত্যিই দুঃখিত। তবে গোপাল থাকলে নিশ্চয়ই আসত, কিন্তু সে এত কামাই করছে ইদানীং, আমার অর্ডারলি পিয়নের কথা বলছি, নতুন বিয়ে করেছে তো। কিন্তু তোমার কী হয়েছিল?
সে তো অনেক আগের ব্যাপার, এখন শুনে কী করবে?
উদ্বিগ্ন হল কৃষ্ণেন্দু, কী ব্যাপার বলো দেখি, কেউ এসেছিল?
কে আসবে?
আজকাল দিন দুপুরে ফ্ল্যাটগুলোয় যে রকম কাণ্ড ঘটছে, এই তো গত সপ্তাহে নিউ আলিপুরে খুন হয়ে গেল একটা।
খুন তো হইনি, দেখতে পাচ্ছ তো।
অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে?
সুস্থই তো আছি, বেঁচে আছি। বিড়বিড় করে সুদামা।
আর একবার চা খাওয়াবে? কৃষ্ণেন্দু কন্ঠস্বরে ঘনিষ্ঠতা আনে।
সুদামা কিচেনে যায়। চায়ের সরঞ্জাম সব গুছিয়ে নেয় ছোটো ওভেনে। গ্যাসে দেশলাই ঠুকতে গিয়ে দ্যাখে নেই। আছে কিন্তু কোথায় রেখেছে? এই একটু আগেই তো চা করল, রাখল কোথায় দেশলাই মনে পড়ছে না। তার এক হাত সিলিন্ডারের নবে নেমে আসছিল। কেন যেন মনে হল অন্য হাতে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি। আচমকা সিলিন্ডারের নব ঘুরিয়ে অন করে দিল। এবার তার হাত ওভেনের নবে। বাঁ হাত ওভেনে, ডান হাতে দেশলাই কাঠি জ্বলছে। যে ওভেনে চায়ের সরঞ্জাম চাপিয়েছে সে, সেই ছোটো ওভেনে তো আগুন কম হয়। সে বড়ো ওভেনেই হাত রেখেছে। ওভেনের নব ঘুরিয়েই দিল সুদামা। দ্রুত গ্যাস বেরোতে থাকে। নাকে কাঁচা গ্যাসের গন্ধ পায় সুদামা। তখন খেয়াল হয় আগুন নেই কাছে। ওভেন বন্ধ করে। কাঁচা গ্যাস ইতিমধ্যেই বাতাসে বাতাসে কিছুটা ছড়িয়েছে। সে নাকে গ্যাসের গন্ধ নিতে থাকে। খারাপ লাগে না। আস্তে আস্তে গন্ধটা মিলিয়েও যায়। কী যে হল সুদামার, মনে হল আবার নাকে নেয় গ্যাসের গন্ধ। হাত বাড়াল ওভেনের দিকে। গ্যাস বেরিয়ে আসতে থাকে। সুদামার হাতে নবটি সম্পূর্ণ ঘুরে আরও যায় বাঁদিকে। অগ্নিশিখা কমিয়ে আনতে চায় যেন সে। দুজনের চায়ে আর কত আগুন লাগবে। ধীরে ধীরে গ্যাস বেরোতে থাকে। সুদামা তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের গন্ধে ডোবে।
গন্ধটা কৃষ্ণেন্দুও পেয়েছে, হয়তো পায়ওনি, পেল কিচেনের মুখে এসে, নাক টেনে বলল, গ্যাস লিক করছে যেন।
সুদামা কিছু বলল না। দেশলাইয়ের জন্য বেরিয়ে এল অপরিসর কিচেন থেকে। তখনই কৃষ্ণেন্দুর খেয়াল হল, ওভেন অন করা, সে খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। চট করে ওভেন অফ করতে ঢুকে পড়ল ভেতরে। চিৎকার করল, এ কী! গ্যাস বেরোচ্ছে, সিলিন্ডার ওভেন দুই-ই খোলা — বলতে বলতে কৃষ্ণেন্দু ওভেনের নবে হাত দিয়ে গ্যাস নির্গমন বন্ধ করতে থাকে। তাতে কয়েক পলের জন্য গ্যাস বেরিয়ে এল আরও অনেকটা বেশি। ওভেন অফ করে কৃষ্ণেন্দু ঝপ করে বেরিয়ে আসে বাইরে, কী করেছ তুমি, গ্যাসে যে ভরতি হয়ে যাচ্ছিল সব। বলতে বলতে কৃষ্ণেন্দু আবার ভেতর ঢুকে একজস্ট ফানের সুইচ অন করে, কিচেনের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সুদামার প্রবেশপথ বন্ধ করে চাপা গলায় ধমকে ওঠে, তুমি এত ভুলো মনের!
সুদামা বলল, কী হয়েছে?
গ্যাস বেরোচ্ছিল, টের পাওনি?
সুদামা হাসে, গন্ধটা বেশ লাগে।
বেশ লাগে মানে?
সুদামা বলে, ভালোই লাগে। সরো।
কৃষ্ণেন্দু সরে না, বলল, তোমাকে নিয়ে তো বিপদ। এর আগে আর একদিন এই রকম হয়েছিল, মনে আছে?
সুদামা বলল, প্রায়ই তো হয়।
হয় মানে?
হয় মানে হয়। সুদামা কিচেনে ঢোকে, কৃষ্ণেন্দুকে সরিয়ে সামনে যায়, বিড়বিড় করে, গন্ধটা বেশ ভালো, কদম ফুল কদম ফুল! বলতে বলতে সে দেশলাই কাঠি ঠুকে ওভেন অন করে আগুন জ্বালায়। গ্যাস জ্বলে ওঠে। নীল শিখা বৃত্তাকারে জ্বলতে থাকে। জ্বলতেই থাকে। ছোটো ওভেন থেকে সসপ্যান এনে সে বড়ো ওভেনে চাপায়। কৃষ্ণেন্দু সরে গেছে কিচেনের বাইরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সুদামা ঘুরল। কৃষ্ণেন্দুর মুখে উদ্বেগ দেখল সুদামা, বলল, তুমি গিয়ে বসো।
গ্যাস লিক করছে না তো?
সুদামা জবাব দেয় না। ঘুরে আবার জ্বলন্ত গ্যাস উনুনের দিকে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে থাকে। নীল শিখার তাপ নিতে থাকে। কৃষ্ণেন্দু সরেনি কিচেনের কাছ থেকে। সুদামা কঠিন হয়, মনে মনে বলে, তবুও মনে পড়েনি!
কৃষ্ণেন্দু বলল, এ ভাবে তুমি গ্যাস জ্বালবে না।
কীভাবে?
কোনোদিন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।
সুদামা বলল, আমার তো গন্ধটা খুউউব ভালো লাগে।
আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু ক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু সরে না তার জায়গা থেকে। বলল, কেন ডেকেছিলে বললে না তো।
এলে জানতে পারতে।
কী জানতাম?
গ্যাসের গন্ধ। বিড়বিড় করে সুদামা।
জল ফুটছে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। দূরে মেঘের ডাক। কৃষ্ণেন্দু সরে যায় আস্তে আস্তে। সুদামা অনেকটা সময় নিয়ে চা তৈরি করে। চা এনে টিপয়ে রেখে জানালার সামনে যায়। বন্ধ শার্সির ওপারে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা, বৃষ্টির একটানা শব্দ। সেই শব্দে কান পেতে সুদামা বলল, গ্যাসের গন্ধটা কিন্তু বেশ। আমার তো বাসের পোড়া পেট্রল, ডিজেলের গন্ধও দারুণ লাগে। তোমার লাগে না কৃষ্ণেন্দু? কোনো কোনো বাস যখন খুব ধোঁয়া ছাড়ে, ভরতি করে দেয় চারপাশ, চোখ জ্বলে যায়, কী আরাম, মনে হয় ধোঁয়ার ভিতরে ঢুকে যাই, তোমার মনে হয় না?
কৃষ্ণেন্দু চমকে উঠে দাঁড়ায়। তার হাতের চায়ের কাপ উলটে পড়ল কার্পেটের উপর, গরম চা ভিজিয়ে দিল পাঞ্জাবির কিছুটা, খোলা পায়ের পাতা। জ্বলছে পা। কৃষ্ণেন্দুর খুব রাগ হয়। ক্রোধটা গিয়ে পড়ে সুদামার উপর, যত্ত আবোল-তাবোল কথা, তুমি থামবে?
সুদামা তো থামেই না, ফিসফিস করে, গ্যাসের গন্ধ চমৎকার, ঘরে যখন আরশোলা-টিকটিকি মারার জন্য স্প্রে করা হয়, আমার কিন্তু খুউব ভালো লাগে। তুমি আনবে একটা স্প্রেয়ার? আচ্ছা, কাঁচা কয়লা পোড়ার গন্ধ, কালো ধোঁয়া কেমন লাগে? আমার কী ভালোই না লাগে, তোমার সিগারেটের গ্যাস লাইটারও জ্বালিয়ে দেখেছি, কী চমৎকার গন্ধ বেরোয় গ্যাসের, মনে হয় গ্যাসের ভেতর ঘুমিয়ে থাকি, মরে যাই সুখে, ভোপালে যা হয়েছিল।
কৃষ্ণেন্দুর পা জ্বলছে। সে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে টয়লেটে গিয়ে জলে পা ভেজায়। ভিজে পা নিয়ে ফেরে। কেমন যেন উদভ্রান্ত লাগছে। ধরতে পারছে না কী হয়েছে সুদামার, কেন ডেকেছিল।
তাকে দেখে সুদামা বলল, যাই বলো তুমি, গ্যাসের গন্ধ কী সুন্দর। বর্ষায় যেন তা আরও চমৎকার, ভিজে বাতাস, আকাশে মেঘ, কদম্ব-কদম্ব লাগে না?
কৃষ্ণেন্দু বিরক্ত হল, নাটক করছ কেন? কী হয়েছিল দুপুরে?
হাসে সুদামা, আমি মরে যাচ্ছিলাম ভেবে নাও।
বাজে কথা বোলো না তো, ডেকেছিলে কেন?
সুদামা জবাব দেয় না। সে নাক টানতে থাকে। তার মনে হতে থাকে সে হয়তো ডেকেছিল ওই জন্যই। দুপুরে কী এক ভুলে পুরো ফ্ল্যাট ধীরে ধীরে ভরে উঠল পেট্রোলিয়াম গ্যাসে। হ্যাঁ যেন তাই হয়েছিল। কী চমৎকার গন্ধ। সে ডাকল কৃষ্ণেন্দুকে ওই গন্ধটা টের পাওয়ার জন্য। তাই কী ওই আচ্ছা এই গ্যাস যদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয় মানুষ, মরে যায়! একি সেই ৎসুইক্লোন বেন নামের গ্যাস যা নাৎসিরা ব্যবহার করত গ্যাস চেম্বারে। ফসজিন, মাস্টার্ড গ্যাস, লেথালে গ্যাস, কার্বন মনোক্সাইড, মিক গ্যাস, লিউসাইট — সব গ্যাসের গন্ধ কি একরকম? হাত পারে তা? সব ফুলের গন্ধ কি এক রকম? কিন্তু ফুলের গন্ধ তো সুন্দর। কাঠ গোলাপ-কদম্ব-জুঁই-গন্ধরাজ —!
তোমার কী হয়েছে? কৃষ্ণেন্দু এগিয়ে এল সুদামার কাছে।
সুদামা তা কচিপাতা রঙের শাড়ির আঁচল ওড়াতে চাইল পাখার হাওয়ায়। উড়ল না। খুবই ঢিমেতালে কোনোক্রমে ঘুরছে পাখা। দেখে মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে, কিন্তু থামছে না।
সুদামা বলল, আমি মরে যাচ্ছিলাম, তুমি এলে না। মরছিলাম না হয়তো, কিন্তু সত্যি যদি এমন হত, গ্যাসে ভরতি হয়ে গেছে ঘর, আমি আগুন জ্বালিয়ে দিলাম তার ভেতরে।
কৃষ্ণেন্দু সুদামার কাঁধে হাত দেয়, ওরকম বলে না, আচ্ছা সত্যিই কী হয়েছিল বলবে? ওভাবে টেলিফোন এনগেজড করে?
আমার তো কিছু একটা হয়েছিল, না হলে ডাকলাম কেন?
কিন্তু কী হয়েছিল তা বলবে তো। কৃষ্ণেন্দুর ধৈর্য শেষ সীমানায়।
মনে মনে কথা বলে সুদামা, তুমি আমার কৃষ্ণ সখা। আমি সুদামা। তুমি আমায় পরিপূর্ণ করতে গিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছ।
সুদামা চুপ করে থাকে। সে বলবে না। কেননা একটু আগে তো বলেই দিয়েছে প্রায়। এখন গ্যাসের গন্ধ নিচ্ছে সে কদম্বের পরিবর্তে। গ্যাসের গন্ধে শিহরিত হচ্ছে কদম্বের পরিবর্তে। কদম্বের গন্ধ তো ভুলেই গেছে সুদামা। ভুলে গেছে বলেই আবার তা যেন টের পেতে চেয়েছিল। তা কি গ্যাসের গন্ধের ভেতরে লুকিয়ে আছে? কৃষ্ণেন্দুর কি একটা কথাও মনে নেই? গত ন-মাসে যা হয়েছে তা তো ভুলছে সুদামা। না ভুললে বাঁচা যাবে না, তাই ভুলতে চাইছে। কৃষ্ণেন্দুও ভুলুক তার কৃতকর্মের কথা। সেই বিস্মরণের জন্যই তো কদম্ব শিহরণ চেয়েছে সুদামা এই বর্ষায়… একটা তোমার, আর একটা তোমার …।
সুদামার মনে হচ্ছিল সে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়ে এই মেঘ বর্ষার রাতে। হাঁটতে হাঁটতে ভিজতে ভিজতে কোথাও, কোনো কদম্ব বনে। আজ দুপুরে সে খুন যয়ে যেতে পারত, যে কোনো দুপুরেই সে খুন হয়ে যেতে পারে। ধর্ষিতা হতে পারত, আজ দুপুরে প্রজ্বলন্ত গ্যাসের ভিতরে দগ্ধ হতে পারত, খুব জ্বরে বিছানায় পড়ে থাকতে পারত, অজ্ঞান হয়ে দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত — ছ-সাত ঘন্টার পড়ে থাকতে পারত। আজ দুপুরে আচমকা চলে আসতে পারত সুহাস বোস নামের সেই প্রেমিক প্রতারক। কানের কাছে আলোর বাজি, হাউই তুবড়ির কথা ধীরে ধীরে বলতে পারত আবার। বলে তাকে কয়েক ঘন্টার জন্য দখল করে ফেলত। সম্পূর্ণ হত প্রতারণা। এসব হয়নি, হতেই পারত। তখন তো সে ফোনেই সাহায্য চাইতে পারত, যদি তার পক্ষে সম্ভব হত। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু একটুও বিচলিত হয়নি সারা দুপুর ধরে। পিওন ছুটি না নিলে তাকে খোঁজ নিতে পাঠাত। কেন? কৃষ্ণেন্দু কি ভেবেছিল, যা হয় হোক। তার কি এতটুকুও বুক কাঁপেনি, হৃদপিণ্ড ধকধক করে ওঠেনি। তাহলে কি কৃষ্ণেন্দু এখন তার মৃত্যু চায়? না চাইলেও তার কিছু হলে চঞ্চল হয় না সে তো আর আগের মতো। সুদামা তো হয়। সেই সুহাস বোস যখন তার সঙ্গে গোপনে কথা বলত, তখনো তো হত। ভয় হত তার। নীল আর কৃষ্ণেন্দুর জন্য বিচলিত হত। ঘরের মানুষ বাইরে থাকলে যেমন উদ্বিগ্ন হয় সকলে, তেমনই তো হত।
এল না কেন কৃষ্ণেন্দু? সুদামার মনে পড়ল অনিলবরণের কথা। সে তার বউয়ের মৃত্যু কামনা করত কখনও কখনও, এখন আর করে না। সে বলেছিল আমাদের প্রত্যেকের পিছনে রয়েছে এক একজন খুনি। কৃষ্ণেন্দু কি সেই জন?
ভয় করে সুদামার। না এসে পারল কী করে কৃষ্ণেন্দু? সে কি আশা করেছিল সন্ধ্যেয় ফিরে দেখবে তার বউ আগুনে পুড়ে মরেছে, কিংবা বিষ খেয়েছে। সুদামার শরীর শক্ত হতে থাকে। সে তো এমনিই ডেকেছিল। ভেবেছিল যাচাই করে নেবে প্রেমের কতটুকু এখনও বেঁচে আছে। বাড়ি ফিরলে কৃষ্ণেন্দুকে দুপুরেই পাঠাবে কদম্ব সংগ্রহে। সুহাস বোস লুকিয়ে এসেছিল না কৃষ্ণেন্দুই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল গোপনে, তা জানাও হয়ে যাবে সেই সঙ্গে। সে তো শুধু খোঁজ পেতে চেয়েছিল প্রেম নিঃশেষ হয়েছে কিনা। যদি একটুও পড়ে থাকে তো সে বাঁচে। বাঁচে এই ভেবে যে সুহাস বোসের আসা সম্পূর্ণই দুর্ঘটনা, আর কিছু নয়। না হলে সব ওলটপালট, তাকে সামনে রেখে পাশা খেলতে বসেছিল যেন তার প্রেমিক স্বামী। পাশায় রাজা জিতে নেবে। সঞ্চিত সম্পত্তির মতো, চেক বই, ব্যাঙ্কের পাশ বইয়ের মতো থেকে যাবে রক্তমাংসের নারীটি। আবার যখন প্রয়োজন হবে ব্যবহার করবে।
কৃষ্ণেন্দু কথা বলছে না। রিমোট কন্ট্রোলে টেলিভিশন চালিয়েছে। জোর করে দিয়েছে শব্দ। উদ্দাম র্যাপ মিউজিক আর শরীরী নৃত্যে সব কেঁপে উঠছে। ছায়ার ছবিরা যেন নেমে এসেছে ফ্ল্যাটের ভিতরে।
সুদামা জানালা থেকে সরে এল, চাপা গলায় বলল, গ্যাসের গন্ধটা অনেকটা কদম ফুলের মতো, তাই না! বাদল দিনের কদম ফুল!
কৃষ্ণেন্দু শুনতে পায় না। না শোনার জন্যই যেন টেলিভিশনের উৎকট উল্লাস ঘরের ভিতরে ছড়িয়ে দিতে চাইছে সে।
সুদামা বলল, মনে নেই তোমার?
কৃষ্ণেন্দু শুনতে পায় না।
সুদামা গ্যাসের গন্ধ পেতে থাকে। একটু একটু করে বাড়ছে গন্ধটা। প্রতিক্ষণ, প্রতিদিন। কাঁচা গ্যাসের গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে। নির্জন নিঝুম ফ্ল্যাটের ভেতরে সে আর মারণ গ্যাস পাশাপাশি থেকে একে অন্যকে ছুঁয়ে যায় ক্রমাগত। সুদামা টেরও পায় না গ্যাসের গন্ধটি যেন কদম ফুলের সুবাসের মতো হয়ে গেছে। এই রকমই হয়তো হয়েছিল এক সময়। আরও বছর আগে ভোপাল শহরে — তখন গ্যাসটিকে চেনা গিয়েছিল। আরও অনেক বছর আগে ভিয়েতনাম নামে একটি দেশে — তখনও টের পেয়েছিল সব হতভাগ্য। আরও আরও অনেক বছর আগে জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড — এইরকম অনেক অনেক দেশে, বাথ হাউসের ভিতরে স্নান-সুখের স্বপ্নে মদির নগ্ন নারী-পুরুষ টের পেয়েছিল গ্যাসের গন্ধ। যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছিল নীল রক্তের মানুষ। বার বার প্রয়োগ-পদ্ধতি একটু একটু করে বদলেছে — বদলাতে হয়েছে অপরাধীকে, অথবা পৃথিবীর নিয়মানুযায়ী তা বদলায়। অপরাধীর আয়ু যেখানে হতভাগ্য নারী-পুরুষের চেয়ে বেশি, সেখানেই এমন হয়। আর অপরাধীর আয়ু তো বাড়ছেই ক্রমাগত। অনিলবরণের কথা মতো হত্যাকারী হত্যার আগে মরে না। সুদামা গ্যাসের গন্ধ নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়তে থাকে মেঝের কার্পেটের উপর। অর্ধেক আকাশ, কদম্বের সুবাস এখন ধূসর মরুভূমি, তরল পেট্রোলিয়াম গন্ধ — এ জীবন এমন হয়। হয়েছে।
Leave a Reply