এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ – ২০

কুড়ি

মনে পড়ে কৃষ্ণেন্দু, বৈশাখ থেকে ভালোবাসার কাঙাল হয়েছিলাম আমরা। তারপর যখন মেঘ ঢুকল শহরে, ফ্ল্যাটে আমরা দুজন, সবচেয়ে ভালো ঘরটা আমাদের। খোলা জানালার ওপারে পামট্রির সার, জৈন মন্দির, আকাশ আকাশ, কত দূরে কাছিমের পিঠের মতো ধূসর ব্রিজ, তুমি ভোরবেলায় বর্ষার ভিতরে বেরিয়েই নিয়ে আসতে কদম্ব, ”আরও চাই তোমার? আরও, আরও!”

হ্যাঁ চাই-ই তো। ফিসফিস করে বলতাম তোমার কানে কানে, চাই, আরও প্রেম চাই, চাই আরও ভালোবাসা। মেঘ বর্ষা ভেজা বাতাস, ছায়াঘন সকাল, কদম্ব পুষ্পে প্রেম যেন সীমাহীন হয়ে উঠেছিল ওই সাতদিন। মনে পড়ে তা?

এই বালির মাঠ, লবণ হ্রদেও তো গাছ-গাছালি বড়ো হয়ে উঠেছে এখন। ঘাস হয়েছে পিচ ঢাকা পথের ধারে, কাঠগোলাপ ফোটে প্রচুর। কদিন আগেও দেখেছি পরপর কৃষ্ণচূড়ার রং আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে। এখানে তো আকাশ অনেক অনেক বেশি উদার। এখানে মেঘ আসে বেশি। একটু পুবে গেলেই যেন মেঘের জন্মভূমি, বাইপাস ধরে গেলে তেমনই মনে হয়। কিন্তু কোথাও কি কদম্ব ফোটে না এদিকে? জানো তুমি কৃষ্ণেন্দু?

মনে মনে জিজ্ঞেস করতে করতেই বেলা গড়ায়, সকাল থেকে দুপুর। সুদামা বিছানায় উপুড় হয়ে শোয়। কদম্বের গন্ধ কী রকম? ভুলেই গেছে সে। আজ হঠাৎ যে কেন বার বার মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা। সুদামা উঠে বসে। নাকে যেন কী রকম একটা গন্ধ আসছে। সে চট করে বিছানা থেকে নামল। গ্যাসের। কাঁচা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের। বিমলা-বিমলা? কোথায় সে? কখন কাজ করে চলে গেছে। তারপর তো নিজের জন্য চা করল সুদামা। দৌড়ে কিচেনে ঢোকে সে। যা ভেবেছে ঠিক তাই। সিলিন্ডারের নব পুরো ঘুরিয়ে বন্ধ করা নেই, কিন্তু ওভেনের নব আধাআধি, বন্ধ বা খোলা। হ্যাঁ ছোটো ওভেনটা। সেখান থেকেই অল্প অল্প গ্যাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিচেনে গন্ধটা আরও গভীর। সুদামা পা বাড়িয়ে ঝপ করে দুটো নব বন্ধ করে একজস্ট ফ্যান চালিয়ে দিল। দাঁড়িয়ে থমথম করে। কখন মনের ভুলে সে গ্যাস খুলে রেখে মেঘ দেখতে চলে গেল ব্যালকনিতে? তা হলে কি সেই যে সেদিন, যেদিন রাজারামপুরে জমির দখল নিয়ে ফিরল তিনজন, এমন হয়েছিল। অনিলবরণকে সন্দেহ করেছিল কেননা সন্দেহ করার তো ওই একজনই ছিল। তবে হতেও তো পারে। তখন অনিলবরণের বউ কঙ্কনা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। লোকটা শুধুই খুনের কথা ভাবত। কে জানে কী হয়েছিল সেদিন। এখন আর পারবে না অনিলবরণ। মনে পড়ে যাবে একটি নারীর শৈশব, তার ভ্রূণাবস্থার কথা। সুদামা বেরিয়ে এল কিচেন থেকে। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। কী যে হয়েছে আজ, কৃষ্ণেন্দু বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই কদম্বের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কদম্ব-শিহরিত হয়ে উঠছে সে।

ব্যালকনিতে দাঁড়াতে পারল না সে বেশি সময়। জানালাগুলো সব খুলে দেবে নাকি। কাঁচা গ্যাসের গন্ধটা গিওে যেন রয়ে গেছে একটু একটু, ভাসছে হয়তো ঘরের আনাচে-কানাচে, লিভিং স্পেসে, অন্য ঘরটিতে, আর একটি ঘরে। সুদামা ঘুরে ঘুরে জানালা খুলে দিতে থাকে। ফ্ল্যাটের সব জানালা। বেশ লাগছে জানালা খুলতে। মনে হচ্ছে ভোর হয়েছে বোধহয়। ডালিমতলার বাপের বাড়ির কথা মনে পড়ল সুদামার। ওদিকে চোর-ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রব খুব। তাই ভরা গ্রীষ্মেও জানালা খুলে ঘুমোতে ভয় হত। ভোর হতে না হতেই সুদামা উঠে সব জানালা ধাক্কা মেরে মেরে খুলত। যেন গুমোট অন্ধকারকে ঠেলে বাইরে পাঠাত। আহ। কী চমৎকার ভিজে বাতাস! সুদামার মুখে বাতাসের গাঢ় ছোঁয়া। কী মেঘ না এসেছে আকাশে।

জানালা সব খুলে সুদামা লিভিং স্পেসে অ্যাকোরিয়ামের পাশে এসে বসে। মাছের জল বদলানো দরকার ছিল। হয়নি। অ্যাকোরিয়ামের আলো জ্বালিয়ে দেয় সে। প্রবাল দ্বীপ, লতাগুল্মের ভেতরে সমুদ্রের অতলে রঙিন মাছেরা নিঃশব্দে ঘোরে। নিশ্চুপ চেয়েই থাকে সুদামা। আচ্ছা সে যদি টের না পেত? গ্যাসে ভরতি হয়ে যেত এই ফ্ল্যাট। একটা সিলিন্ডারে কত গ্যাস ধরে যেন। সে গ্যাসের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকত। সুদামার বুক ধকধক করে। অ্যাকোরিয়ামের কাচের গায়ে কালো বিন্দুর মতো মাছের চোখ তার দিকে স্থির।

সুদামা উঠে এল অ্যাকোরিয়ামের কাছ থেকে। ধীর পায়ে টেলিফোনের কাছে যায়। ডাকবে নাকি কৃষ্ণেন্দুকে। যা হয়েছে তা ভুলে যাক। কৃষ্ণেন্দু, ভুলতে চাইলে কদিনই-বা লাগে ভুলে যেতে। এই তো আমি ভুলে যাচ্ছি সুহাস বোসকে। ভুলেই গেছি। অবাক লাগে তোমার কথা ভুলে ওর কথা ভাবতে আরম্ভ করলাম কীভাবে, কবে, কোন মুহূর্তে? কেন? এই তো আমি এখন আর কষ্ট পাই না নীল কাছে নেই বলে, এই ভ্যাকেশনে আসেনি বলে।

সুদামা দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে। ঠাণ্ডা বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে। তার মানে বৃষ্টি নেমেছে এই শহরে কোথাও না কোথাও। কৃষ্ণেন্দু বসে আটতলায়। তার ডানদিকে মস্ত জানালা, কাচ দিয়ে ঢাকা। চেয়ারে বসেই কৃষ্ণেন্দু শহর দেখতে পায়। গঙ্গা দেখা যায়, এমনকী খিদিরপুর ডকে দাঁড়ানো জাহাজের মাস্তুলও, দ্বিতীয় হুগলি সেতুর জাল। কৃষ্ণেন্দুর ঘরের জানালা বোধহয় মেঘের প্রলেপে অন্ধকার হয়ে গেছে। এত মেঘ, এখনও কি কদম্ব ফোটেনি?

কৃষ্ণেন্দুর কি মনে আছে সেই কদম্ব-শিহরিত দিনগুলির কথা? ভাগ্যিস সকলে পুরী গেল, আমরা গেলাম না। তিনটে ঘরে কেউ নেই, তবু আমরা দরজা বন্ধ না করে শুতে পারতাম না। মনে হত কেউ যেন আছে। রান্নাঘরে ঢুকে চুম্বন করতে চাইলে তুমি, আমি সরিয়ে দিলাম, কেউ আছে, দৌড়ে চলে এলাম ঘরে। মনে আছে তোমার কৃষ্ণেন্দু? এখন এই দেড় হাজার স্কোয়ার ফুটে কিন্তু কখনওই মনে হয় না কেউ আছে। কেউ না!

সুদামা ঘরে ঢুকে টেলিফোন তুলে ডাক দিল কৃষ্ণেন্দুকে। রিং হয়ে যেতে থাকে। অনেক বাদে ধরল একজন, হ্যাঁ কৃষ্ণেন্দুই, কোথায় ছিলে তুমি? ফোনটা ধরছেই না কেউ?

কে বলছেন?

আমি গো আমি। সুদামার গলার স্বর গাঢ়, গাঢ়তর হয়ে ওঠে।

আমি মানে কে? কৃষ্ণেন্দু যেন খেলা করছে।

আমিই-ই। টেলিফোনে মেঘের গুরু গুরু শুনতে পায় সুদামা। মেঘ এসে ডাক দিচ্ছে যেন কৃষ্ণেন্দুকে তার জানালার কাচের গায়ে মুখ লাগিয়ে।

কী হল, তোমার ঘরের জানালা কি খুলে রেখেছ? শুনছ তোমার ঘরের বাইরে মেঘ ডাকছে, বৃষ্টি শুরু হল ওখানে? আমি সুদামা।

কৃষ্ণেন্দু বলল, তোমার গলার স্বর এত ভারি লাগছে যে চেনাই যাচ্ছে না।

তুমি এখনই চলে এসো, এক্ষুণি।

কেন কী হয়েছে?

এসে শুনবে, খুব দরকার, না এলে হবেই না।

কী হয়েছে বলবে তো।

ফোনে বলা যাবে না, তুমি চলে এসো গো, ডাকল সুদামা। মেঘের মতো ডাকল তার স্বামীকে। মেঘ হয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইল প্রিয় পুরুষটিকে। ডাকতে ডাকতে আবার শুনল মেঘের গর্জন, গুরু গরু ধ্বনি। টেলিফোন কোনোক্রমে রেখে দিয়ে গেল জানালার ধারে।

এর পর ঘড়ির কাঁটা সরতে থাকে। বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে আসে। আকাশ ঘোর কালো, শূন্যতায় কোথাও কোথাও গভীর রুপোলি উজ্জ্বলতা, বৃষ্টির বিন্দু মুক্তোর মতো ঝরে পড়তে লাগল নীচে। তার ব্যালকনি গেল ভেসে। সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে। রাস্তার দিকে চোখ। গাড়ি এল কি? কতটুকু সময় লাগে বাইপাস ধরে আসতে।

ভিজতে ভিজতে ভিজেই গেল সে সম্পূর্ণ। ঘরে এসে শাড়ি-ব্লাউজ বদল করল। কচিপাতার রঙে সাজল। বৃষ্টিতে ধোয়া নতুন পাতার মতো রং ধরল তার গায়ে। ঘর আবছা আঁধারে ছাওয়া। কতকাল বাদে সে ঘড়ি দেখতে আরম্ভ করল। এমনভাবে ঘড়ি দেখত সেই কতদিন আগে, কৃষ্ণেন্দুর জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে হয়তো কোনো পথের মোড়ে, অথবা কৃষ্ণেন্দু দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। সে এক লজঝড়ে বাসে চেপে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বাস চলছে ঘড়ির কাঁটার অনেক পিছনে। অথবা কৃষ্ণেন্দু ফেরেনি অফিস থেকে। সে বেলগাছিয়ার পুরোনো ঘরে বসে উদ্বিগ্ন হয়েই যাচ্ছে। ঘড়িটা ফার্স্ট আছে কিনা খোঁজ নিচ্ছে বড়ো জা-র কাছে।

এতক্ষণ তো কৃষ্ণেন্দুর এসে যাওয়ার কথা। কৃষ্ণেন্দু যদি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে তো এত সময় লাগার কথা নয়। তা হলে কি ঘুরে আসছে। ঘুরে আসবে কেন? পথে কি গাড়ি বিগড়োল বৃষ্টির ভেতরে। খোলামেলা ই এম বাইপাসে তো হাওয়া আর মেঘের দাপট অনেক বেশি। কৃষ্ণেন্দু কি ভিজছে, গাড়ির কী হল তা দেখতে বেরিয়ে এসে।

বেলা যায়, সন্ধে হয়। কচিপাতার রং ঢেকে যায় অন্ধকারে। কৃষ্ণেন্দু এল সন্ধের পর, তখন সওয়া সাতটার মতো হবে। সুদামা ঘুম অন্ধকারে গুটিয়ে শুয়েছিল সোফার উপরে। ডোর বেল বাজলে তাকে উঠতে হয়। ঢুকতে ঢুকতে কৃষ্ণেন্দু বলল, বার পাঁচেক চেষ্টা করেছি তারপর, এনগেজড ফোনটা বোধহয় ঠিক করে রাখনি ক্রেডলে? এ কি আলো জ্বালোনি কেন?

আসতে পারলে না? সুদামার মুখ থমথমে।

বললেই আসা যায়, দায়িত্ব নেই? কৃষ্ণেন্দু যেন বিরক্ত।

দায়িত্ব আর কিসের, সে চাকরি তো আর একজন কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। যত কাজ তো ছিল ওইটার জন্যই।

কৃষ্ণেন্দু আলো জ্বালিয়ে সোফায় বসে, অন্ধকার ভূত করে রেখেছ বাড়িটা, কোম্পানি একটা নাকি, পর পর তো আসছে, এবার আসছে কম্পিউটার-সফটওয়্যার নিয়ে এক জাপানি কোম্পানি। ওই ব্যাপারে দিল্লি থেকে ফ্যাক্স এসেছিল। আরও কত অর্গানাইজেশন যে আসছে। বলতে বলতে হাসতে চেষ্টা করে কৃষ্ণেন্দু।

তাতে তোমার কী?

বাহ, প্রাথমিক দায়িত্ব তো আমার, প্রজেক্ট অফিসারকেই তো সব দেখতে হয়।

দায়িত্ব নিয়েই-বা কী হবে, তুমি কিছু গুছোতে পারবে এবার, কমিউনিটির কেউ নেই এখন?

কৃষ্ণেন্দু নিশ্চুপ। সুদামার কথায় আহত হয়েছে, কিন্তু মুখের ভাবে তা প্রকাশ করে না, সে হালকা করে দিতে চায় বিষয়টিকে, ডাকে সুদামাকে, কী জন্য ডেকেছিলে?

সুদামা কিচেনে গিয়ে ঢুকেছে। জবাব দেয় না।

কৃষ্ণেন্দু বলে, যখন তখন ডাকলে হয়, আমি কেরানি, পিয়নের চাকরি করি না, অবশ্য কেরানি পিয়নের চাকরিই সবচেয়ে আরামের, বউ ডাকলেই স্যারকে বলে চলে আসতাম, স্যার বউয়ের জ্বর, বাড়ি যেতে হবে। স্যার রান্না করতে গিয়ে বউয়ের হাত পুড়ে গেছে। স্যার কাল জামাই ষষ্ঠী, শালির ছেলের মুখে ভাত, বউয়ের হাঁচি হয়েছে ছুটি চাই, থিয়েটারের পাশ পেয়েছি স্যার, দুজনে যাব, বাঁকুড়া যাব ভায়রার বাড়িতে — কৃষ্ণেন্দু হা হা করে হাসতে থাকে, ডাকলেই আসা যায়?

সুদামা জবাব দেয় না। গ্যাসে চায়ের জল চাপায়। কৃষ্ণেন্দু জামা-কাপড় ছাড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে কিচেনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, বলল ফোনটা ঠিক করে রাখবে তো?

রাখলে কী হত?

আমি জানতে পারতাম ব্যাপারটা কী। তুমিও খবর পেতে আসছি না কেন, কথা বলার সময়ই তো দিলে না, লাইন কেটে দিলে।

সুদামা বলল, আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করছি না।

জিজ্ঞেস করবে কেন, আমিই বলছি। ফোনটা ঠিক করে রাখবে তো, কখন কী প্রয়োজন পড়ে, যতবার ডায়াল করি, এনগেজড।

যাক, আসনি, মিটে গেছে, চা নাও। গ্যাস বন্ধ করে সুদামা। একবার ওভেনের নব, আর একবার সিলিন্ডারের। বন্ধ করে খোলে, আবার বন্ধ করে। মুখে ভক করে গ্যাসের গন্ধ এসে লাগে। সে বেরিয়ে আসে কিচেন থেকে।

কৃষ্ণেন্দু তার পিছনে আসে, আরে বলবে তো কী হয়েছিল, সারাদিন অত ব্যস্ততা। তার ভেতরে ওই ফোন, রিং ব্যাক করছি, এনগেজড। কী টেনশন বলো দেখি, খামোকা ডাকলে কেন?

সুদামা একটা কথাও বলে না?

একবার ভাবলাম কাউকে পাঠাই, তো অর্ডারলি পিয়ন গোপালও দিন কয় আসছে না, পুরী গেছে নাকি রথ দেখতে, পারেও বটে।

সুদামা ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায়, পাঠাতে পারলে না?

না, তেমন কেউ ছিল না।

পাঠাতেই পারতে। সুদামার চোখের তারা জ্বলজ্বল করে ওঠে, ঠোঁটের কোণে চাপা হাসির রেখা, পাঠালে না কেন, সে এসে দেখে যেত তোমার বউ মরল কিনা, নাকি আর একটা সুহাস বোস জুটেছে। হিসহিস করতে থাকে সুদামা, তার জন্য ওয়েট করেছিলে?

একুশ

কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল, শেষে কেমন কুন্ঠিত গলায় বলল, আ য়াম স্যরি, সত্যিই দুঃখিত। তবে গোপাল থাকলে নিশ্চয়ই আসত, কিন্তু সে এত কামাই করছে ইদানীং, আমার অর্ডারলি পিয়নের কথা বলছি, নতুন বিয়ে করেছে তো। কিন্তু তোমার কী হয়েছিল?

সে তো অনেক আগের ব্যাপার, এখন শুনে কী করবে?

উদ্বিগ্ন হল কৃষ্ণেন্দু, কী ব্যাপার বলো দেখি, কেউ এসেছিল?

কে আসবে?

আজকাল দিন দুপুরে ফ্ল্যাটগুলোয় যে রকম কাণ্ড ঘটছে, এই তো গত সপ্তাহে নিউ আলিপুরে খুন হয়ে গেল একটা।

খুন তো হইনি, দেখতে পাচ্ছ তো।

অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে?

সুস্থই তো আছি, বেঁচে আছি। বিড়বিড় করে সুদামা।

আর একবার চা খাওয়াবে? কৃষ্ণেন্দু কন্ঠস্বরে ঘনিষ্ঠতা আনে।

সুদামা কিচেনে যায়। চায়ের সরঞ্জাম সব গুছিয়ে নেয় ছোটো ওভেনে। গ্যাসে দেশলাই ঠুকতে গিয়ে দ্যাখে নেই। আছে কিন্তু কোথায় রেখেছে? এই একটু আগেই তো চা করল, রাখল কোথায় দেশলাই মনে পড়ছে না। তার এক হাত সিলিন্ডারের নবে নেমে আসছিল। কেন যেন মনে হল অন্য হাতে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি। আচমকা সিলিন্ডারের নব ঘুরিয়ে অন করে দিল। এবার তার হাত ওভেনের নবে। বাঁ হাত ওভেনে, ডান হাতে দেশলাই কাঠি জ্বলছে। যে ওভেনে চায়ের সরঞ্জাম চাপিয়েছে সে, সেই ছোটো ওভেনে তো আগুন কম হয়। সে বড়ো ওভেনেই হাত রেখেছে। ওভেনের নব ঘুরিয়েই দিল সুদামা। দ্রুত গ্যাস বেরোতে থাকে। নাকে কাঁচা গ্যাসের গন্ধ পায় সুদামা। তখন খেয়াল হয় আগুন নেই কাছে। ওভেন বন্ধ করে। কাঁচা গ্যাস ইতিমধ্যেই বাতাসে বাতাসে কিছুটা ছড়িয়েছে। সে নাকে গ্যাসের গন্ধ নিতে থাকে। খারাপ লাগে না। আস্তে আস্তে গন্ধটা মিলিয়েও যায়। কী যে হল সুদামার, মনে হল আবার নাকে নেয় গ্যাসের গন্ধ। হাত বাড়াল ওভেনের দিকে। গ্যাস বেরিয়ে আসতে থাকে। সুদামার হাতে নবটি সম্পূর্ণ ঘুরে আরও যায় বাঁদিকে। অগ্নিশিখা কমিয়ে আনতে চায় যেন সে। দুজনের চায়ে আর কত আগুন লাগবে। ধীরে ধীরে গ্যাস বেরোতে থাকে। সুদামা তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের গন্ধে ডোবে।

গন্ধটা কৃষ্ণেন্দুও পেয়েছে, হয়তো পায়ওনি, পেল কিচেনের মুখে এসে, নাক টেনে বলল, গ্যাস লিক করছে যেন।

সুদামা কিছু বলল না। দেশলাইয়ের জন্য বেরিয়ে এল অপরিসর কিচেন থেকে। তখনই কৃষ্ণেন্দুর খেয়াল হল, ওভেন অন করা, সে খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। চট করে ওভেন অফ করতে ঢুকে পড়ল ভেতরে। চিৎকার করল, এ কী! গ্যাস বেরোচ্ছে, সিলিন্ডার ওভেন দুই-ই খোলা — বলতে বলতে কৃষ্ণেন্দু ওভেনের নবে হাত দিয়ে গ্যাস নির্গমন বন্ধ করতে থাকে। তাতে কয়েক পলের জন্য গ্যাস বেরিয়ে এল আরও অনেকটা বেশি। ওভেন অফ করে কৃষ্ণেন্দু ঝপ করে বেরিয়ে আসে বাইরে, কী করেছ তুমি, গ্যাসে যে ভরতি হয়ে যাচ্ছিল সব। বলতে বলতে কৃষ্ণেন্দু আবার ভেতর ঢুকে একজস্ট ফানের সুইচ অন করে, কিচেনের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সুদামার প্রবেশপথ বন্ধ করে চাপা গলায় ধমকে ওঠে, তুমি এত ভুলো মনের!

সুদামা বলল, কী হয়েছে?

গ্যাস বেরোচ্ছিল, টের পাওনি?

সুদামা হাসে, গন্ধটা বেশ লাগে।

বেশ লাগে মানে?

সুদামা বলে, ভালোই লাগে। সরো।

কৃষ্ণেন্দু সরে না, বলল, তোমাকে নিয়ে তো বিপদ। এর আগে আর একদিন এই রকম হয়েছিল, মনে আছে?

সুদামা বলল, প্রায়ই তো হয়।

হয় মানে?

হয় মানে হয়। সুদামা কিচেনে ঢোকে, কৃষ্ণেন্দুকে সরিয়ে সামনে যায়, বিড়বিড় করে, গন্ধটা বেশ ভালো, কদম ফুল কদম ফুল! বলতে বলতে সে দেশলাই কাঠি ঠুকে ওভেন অন করে আগুন জ্বালায়। গ্যাস জ্বলে ওঠে। নীল শিখা বৃত্তাকারে জ্বলতে থাকে। জ্বলতেই থাকে। ছোটো ওভেন থেকে সসপ্যান এনে সে বড়ো ওভেনে চাপায়। কৃষ্ণেন্দু সরে গেছে কিচেনের বাইরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সুদামা ঘুরল। কৃষ্ণেন্দুর মুখে উদ্বেগ দেখল সুদামা, বলল, তুমি গিয়ে বসো।

গ্যাস লিক করছে না তো?

সুদামা জবাব দেয় না। ঘুরে আবার জ্বলন্ত গ্যাস উনুনের দিকে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে থাকে। নীল শিখার তাপ নিতে থাকে। কৃষ্ণেন্দু সরেনি কিচেনের কাছ থেকে। সুদামা কঠিন হয়, মনে মনে বলে, তবুও মনে পড়েনি!

কৃষ্ণেন্দু বলল, এ ভাবে তুমি গ্যাস জ্বালবে না।

কীভাবে?

কোনোদিন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।

সুদামা বলল, আমার তো গন্ধটা খুউউব ভালো লাগে।

আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু ক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু সরে না তার জায়গা থেকে। বলল, কেন ডেকেছিলে বললে না তো।

এলে জানতে পারতে।

কী জানতাম?

গ্যাসের গন্ধ। বিড়বিড় করে সুদামা।

জল ফুটছে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। দূরে মেঘের ডাক। কৃষ্ণেন্দু সরে যায় আস্তে আস্তে। সুদামা অনেকটা সময় নিয়ে চা তৈরি করে। চা এনে টিপয়ে রেখে জানালার সামনে যায়। বন্ধ শার্সির ওপারে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা, বৃষ্টির একটানা শব্দ। সেই শব্দে কান পেতে সুদামা বলল, গ্যাসের গন্ধটা কিন্তু বেশ। আমার তো বাসের পোড়া পেট্রল, ডিজেলের গন্ধও দারুণ লাগে। তোমার লাগে না কৃষ্ণেন্দু? কোনো কোনো বাস যখন খুব ধোঁয়া ছাড়ে, ভরতি করে দেয় চারপাশ, চোখ জ্বলে যায়, কী আরাম, মনে হয় ধোঁয়ার ভিতরে ঢুকে যাই, তোমার মনে হয় না?

কৃষ্ণেন্দু চমকে উঠে দাঁড়ায়। তার হাতের চায়ের কাপ উলটে পড়ল কার্পেটের উপর, গরম চা ভিজিয়ে দিল পাঞ্জাবির কিছুটা, খোলা পায়ের পাতা। জ্বলছে পা। কৃষ্ণেন্দুর খুব রাগ হয়। ক্রোধটা গিয়ে পড়ে সুদামার উপর, যত্ত আবোল-তাবোল কথা, তুমি থামবে?

সুদামা তো থামেই না, ফিসফিস করে, গ্যাসের গন্ধ চমৎকার, ঘরে যখন আরশোলা-টিকটিকি মারার জন্য স্প্রে করা হয়, আমার কিন্তু খুউব ভালো লাগে। তুমি আনবে একটা স্প্রেয়ার? আচ্ছা, কাঁচা কয়লা পোড়ার গন্ধ, কালো ধোঁয়া কেমন লাগে? আমার কী ভালোই না লাগে, তোমার সিগারেটের গ্যাস লাইটারও জ্বালিয়ে দেখেছি, কী চমৎকার গন্ধ বেরোয় গ্যাসের, মনে হয় গ্যাসের ভেতর ঘুমিয়ে থাকি, মরে যাই সুখে, ভোপালে যা হয়েছিল।

কৃষ্ণেন্দুর পা জ্বলছে। সে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে টয়লেটে গিয়ে জলে পা ভেজায়। ভিজে পা নিয়ে ফেরে। কেমন যেন উদভ্রান্ত লাগছে। ধরতে পারছে না কী হয়েছে সুদামার, কেন ডেকেছিল।

তাকে দেখে সুদামা বলল, যাই বলো তুমি, গ্যাসের গন্ধ কী সুন্দর। বর্ষায় যেন তা আরও চমৎকার, ভিজে বাতাস, আকাশে মেঘ, কদম্ব-কদম্ব লাগে না?

কৃষ্ণেন্দু বিরক্ত হল, নাটক করছ কেন? কী হয়েছিল দুপুরে?

হাসে সুদামা, আমি মরে যাচ্ছিলাম ভেবে নাও।

বাজে কথা বোলো না তো, ডেকেছিলে কেন?

সুদামা জবাব দেয় না। সে নাক টানতে থাকে। তার মনে হতে থাকে সে হয়তো ডেকেছিল ওই জন্যই। দুপুরে কী এক ভুলে পুরো ফ্ল্যাট ধীরে ধীরে ভরে উঠল পেট্রোলিয়াম গ্যাসে। হ্যাঁ যেন তাই হয়েছিল। কী চমৎকার গন্ধ। সে ডাকল কৃষ্ণেন্দুকে ওই গন্ধটা টের পাওয়ার জন্য। তাই কী ওই আচ্ছা এই গ্যাস যদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয় মানুষ, মরে যায়! একি সেই ৎসুইক্লোন বেন নামের গ্যাস যা নাৎসিরা ব্যবহার করত গ্যাস চেম্বারে। ফসজিন, মাস্টার্ড গ্যাস, লেথালে গ্যাস, কার্বন মনোক্সাইড, মিক গ্যাস, লিউসাইট — সব গ্যাসের গন্ধ কি একরকম? হাত পারে তা? সব ফুলের গন্ধ কি এক রকম? কিন্তু ফুলের গন্ধ তো সুন্দর। কাঠ গোলাপ-কদম্ব-জুঁই-গন্ধরাজ —!

তোমার কী হয়েছে? কৃষ্ণেন্দু এগিয়ে এল সুদামার কাছে।

সুদামা তা কচিপাতা রঙের শাড়ির আঁচল ওড়াতে চাইল পাখার হাওয়ায়। উড়ল না। খুবই ঢিমেতালে কোনোক্রমে ঘুরছে পাখা। দেখে মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে, কিন্তু থামছে না।

সুদামা বলল, আমি মরে যাচ্ছিলাম, তুমি এলে না। মরছিলাম না হয়তো, কিন্তু সত্যি যদি এমন হত, গ্যাসে ভরতি হয়ে গেছে ঘর, আমি আগুন জ্বালিয়ে দিলাম তার ভেতরে।

কৃষ্ণেন্দু সুদামার কাঁধে হাত দেয়, ওরকম বলে না, আচ্ছা সত্যিই কী হয়েছিল বলবে? ওভাবে টেলিফোন এনগেজড করে?

আমার তো কিছু একটা হয়েছিল, না হলে ডাকলাম কেন?

কিন্তু কী হয়েছিল তা বলবে তো। কৃষ্ণেন্দুর ধৈর্য শেষ সীমানায়।

মনে মনে কথা বলে সুদামা, তুমি আমার কৃষ্ণ সখা। আমি সুদামা। তুমি আমায় পরিপূর্ণ করতে গিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছ।

সুদামা চুপ করে থাকে। সে বলবে না। কেননা একটু আগে তো বলেই দিয়েছে প্রায়। এখন গ্যাসের গন্ধ নিচ্ছে সে কদম্বের পরিবর্তে। গ্যাসের গন্ধে শিহরিত হচ্ছে কদম্বের পরিবর্তে। কদম্বের গন্ধ তো ভুলেই গেছে সুদামা। ভুলে গেছে বলেই আবার তা যেন টের পেতে চেয়েছিল। তা কি গ্যাসের গন্ধের ভেতরে লুকিয়ে আছে? কৃষ্ণেন্দুর কি একটা কথাও মনে নেই? গত ন-মাসে যা হয়েছে তা তো ভুলছে সুদামা। না ভুললে বাঁচা যাবে না, তাই ভুলতে চাইছে। কৃষ্ণেন্দুও ভুলুক তার কৃতকর্মের কথা। সেই বিস্মরণের জন্যই তো কদম্ব শিহরণ চেয়েছে সুদামা এই বর্ষায়… একটা তোমার, আর একটা তোমার …।

সুদামার মনে হচ্ছিল সে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়ে এই মেঘ বর্ষার রাতে। হাঁটতে হাঁটতে ভিজতে ভিজতে কোথাও, কোনো কদম্ব বনে। আজ দুপুরে সে খুন যয়ে যেতে পারত, যে কোনো দুপুরেই সে খুন হয়ে যেতে পারে। ধর্ষিতা হতে পারত, আজ দুপুরে প্রজ্বলন্ত গ্যাসের ভিতরে দগ্ধ হতে পারত, খুব জ্বরে বিছানায় পড়ে থাকতে পারত, অজ্ঞান হয়ে দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত — ছ-সাত ঘন্টার পড়ে থাকতে পারত। আজ দুপুরে আচমকা চলে আসতে পারত সুহাস বোস নামের সেই প্রেমিক প্রতারক। কানের কাছে আলোর বাজি, হাউই তুবড়ির কথা ধীরে ধীরে বলতে পারত আবার। বলে তাকে কয়েক ঘন্টার জন্য দখল করে ফেলত। সম্পূর্ণ হত প্রতারণা। এসব হয়নি, হতেই পারত। তখন তো সে ফোনেই সাহায্য চাইতে পারত, যদি তার পক্ষে সম্ভব হত। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু একটুও বিচলিত হয়নি সারা দুপুর ধরে। পিওন ছুটি না নিলে তাকে খোঁজ নিতে পাঠাত। কেন? কৃষ্ণেন্দু কি ভেবেছিল, যা হয় হোক। তার কি এতটুকুও বুক কাঁপেনি, হৃদপিণ্ড ধকধক করে ওঠেনি। তাহলে কি কৃষ্ণেন্দু এখন তার মৃত্যু চায়? না চাইলেও তার কিছু হলে চঞ্চল হয় না সে তো আর আগের মতো। সুদামা তো হয়। সেই সুহাস বোস যখন তার সঙ্গে গোপনে কথা বলত, তখনো তো হত। ভয় হত তার। নীল আর কৃষ্ণেন্দুর জন্য বিচলিত হত। ঘরের মানুষ বাইরে থাকলে যেমন উদ্বিগ্ন হয় সকলে, তেমনই তো হত।

এল না কেন কৃষ্ণেন্দু? সুদামার মনে পড়ল অনিলবরণের কথা। সে তার বউয়ের মৃত্যু কামনা করত কখনও কখনও, এখন আর করে না। সে বলেছিল আমাদের প্রত্যেকের পিছনে রয়েছে এক একজন খুনি। কৃষ্ণেন্দু কি সেই জন?

ভয় করে সুদামার। না এসে পারল কী করে কৃষ্ণেন্দু? সে কি আশা করেছিল সন্ধ্যেয় ফিরে দেখবে তার বউ আগুনে পুড়ে মরেছে, কিংবা বিষ খেয়েছে। সুদামার শরীর শক্ত হতে থাকে। সে তো এমনিই ডেকেছিল। ভেবেছিল যাচাই করে নেবে প্রেমের কতটুকু এখনও বেঁচে আছে। বাড়ি ফিরলে কৃষ্ণেন্দুকে দুপুরেই পাঠাবে কদম্ব সংগ্রহে। সুহাস বোস লুকিয়ে এসেছিল না কৃষ্ণেন্দুই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল গোপনে, তা জানাও হয়ে যাবে সেই সঙ্গে। সে তো শুধু খোঁজ পেতে চেয়েছিল প্রেম নিঃশেষ হয়েছে কিনা। যদি একটুও পড়ে থাকে তো সে বাঁচে। বাঁচে এই ভেবে যে সুহাস বোসের আসা সম্পূর্ণই দুর্ঘটনা, আর কিছু নয়। না হলে সব ওলটপালট, তাকে সামনে রেখে পাশা খেলতে বসেছিল যেন তার প্রেমিক স্বামী। পাশায় রাজা জিতে নেবে। সঞ্চিত সম্পত্তির মতো, চেক বই, ব্যাঙ্কের পাশ বইয়ের মতো থেকে যাবে রক্তমাংসের নারীটি। আবার যখন প্রয়োজন হবে ব্যবহার করবে।

কৃষ্ণেন্দু কথা বলছে না। রিমোট কন্ট্রোলে টেলিভিশন চালিয়েছে। জোর করে দিয়েছে শব্দ। উদ্দাম র‌্যাপ মিউজিক আর শরীরী নৃত্যে সব কেঁপে উঠছে। ছায়ার ছবিরা যেন নেমে এসেছে ফ্ল্যাটের ভিতরে।

সুদামা জানালা থেকে সরে এল, চাপা গলায় বলল, গ্যাসের গন্ধটা অনেকটা কদম ফুলের মতো, তাই না! বাদল দিনের কদম ফুল!

কৃষ্ণেন্দু শুনতে পায় না। না শোনার জন্যই যেন টেলিভিশনের উৎকট উল্লাস ঘরের ভিতরে ছড়িয়ে দিতে চাইছে সে।

সুদামা বলল, মনে নেই তোমার?

কৃষ্ণেন্দু শুনতে পায় না।

সুদামা গ্যাসের গন্ধ পেতে থাকে। একটু একটু করে বাড়ছে গন্ধটা। প্রতিক্ষণ, প্রতিদিন। কাঁচা গ্যাসের গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে। নির্জন নিঝুম ফ্ল্যাটের ভেতরে সে আর মারণ গ্যাস পাশাপাশি থেকে একে অন্যকে ছুঁয়ে যায় ক্রমাগত। সুদামা টেরও পায় না গ্যাসের গন্ধটি যেন কদম ফুলের সুবাসের মতো হয়ে গেছে। এই রকমই হয়তো হয়েছিল এক সময়। আরও বছর আগে ভোপাল শহরে — তখন গ্যাসটিকে চেনা গিয়েছিল। আরও অনেক বছর আগে ভিয়েতনাম নামে একটি দেশে — তখনও টের পেয়েছিল সব হতভাগ্য। আরও আরও অনেক বছর আগে জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড — এইরকম অনেক অনেক দেশে, বাথ হাউসের ভিতরে স্নান-সুখের স্বপ্নে মদির নগ্ন নারী-পুরুষ টের পেয়েছিল গ্যাসের গন্ধ। যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছিল নীল রক্তের মানুষ। বার বার প্রয়োগ-পদ্ধতি একটু একটু করে বদলেছে — বদলাতে হয়েছে অপরাধীকে, অথবা পৃথিবীর নিয়মানুযায়ী তা বদলায়। অপরাধীর আয়ু যেখানে হতভাগ্য নারী-পুরুষের চেয়ে বেশি, সেখানেই এমন হয়। আর অপরাধীর আয়ু তো বাড়ছেই ক্রমাগত। অনিলবরণের কথা মতো হত্যাকারী হত্যার আগে মরে না। সুদামা গ্যাসের গন্ধ নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়তে থাকে মেঝের কার্পেটের উপর। অর্ধেক আকাশ, কদম্বের সুবাস এখন ধূসর মরুভূমি, তরল পেট্রোলিয়াম গন্ধ — এ জীবন এমন হয়। হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *