এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ – ১০

দশ

সুহাস বলল, খবর নিতে হবে, ম্যাডাম।

কী খবর নেবেন?

কবে নাগাদ বর্ষা নামবে?

আপনি কি হাওয়া অফিসে খবর নেবেন? সুদামা জিজ্ঞেস করে।

না, অন্য জায়গায়।

আর কোনো জায়গা আছে, যারা খবর দিতে পারে?

সুহাস বলল, খুঁজে বের করতে হবে।

সুদামা হাসতে লাগল, আপনার এখন কোনো কাজ নেই?

আছে তো।

কী কাজ?

এই যে কথা বলছি মিসেস চ্যাটার্জির সঙ্গে, আচ্ছা আপনি এখন কী করছিলেন, ঘুমিয়েছিলেন?

সুদামা হালকা হয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগছে না তো কথা বলতে। ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। চমৎকার কথা বলে। কী সুন্দর বলল, খোঁজ নেবে, খুঁজে বের করবে যারা বলতে পারে মেঘের খবর।

সুদামা বলল, হ্যাঁ ঘুমিয়েই তো ছিলাম।

তা হলে যে ফোন করলেন স্যারকে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে?

হাসে সুদামা, আপনার যে খুব সাহস, হ্যাঁ আপনার সেই ঘোষচৌধুরী সাহেবের খবর কী, রহস্য ঔপন্যাসিক।

উনি এখন রহস্য তৈরি করছেন।

ইস, কী খারাপই না লেখেন, উনি কি খুনের পরিকল্পনা করেন সবসময়?

না, না তা কেন হবে। সুহাস হাসে, লোকটা উনি খারাপ নন।

এ তো আপনার বসের কথা, যাক গে উনি খারাপই হন আর ভালোই হন, আমার তাতে কী, তবে আমার যেন মনে হয় …, যাকগে সে কথা, হ্যাঁ খোঁজটা কোথায় নেবেন?

সুহাস বলে, কত জায়গা আছে।

কত জায়গা মানে, আছে তো এক হাওয়া অফিসই।

সুহাস বলল, ধরুন, কোনো এক গাছের কাছে। কদমগাছ তো বলতে পারে।

সুদামা বলল, আপনি কি কবিতা লিখতেন?

সুহাস বলল, মনে হয় তা?

কী করে জানব, আপনার বস, মানে চ্যাটার্জি সাহেব লিখত। না কবিতা নয়, প্রোজ, আপনার সেই প্রজেক্ট কতদূর?

সুহাস বলল, যাবেন দেখতে?

আমি ওর কী বুঝি! সুদামা মাথার চুল কপাল থেকে সরিয়ে দেয়, আঁচলের খুঁট দিয়ে গলা মোছে, আর ধোঁয়া চিমনি, কারখানা কি দেখার মতো জিনিস, দানব দানব মনে হয় না?

সুহাস বলল, দানব এখনও জন্মায়নি, জায়গাটা খুব সুন্দর।

সুদামা বলে, সুন্দর জায়গাটা নষ্ট করার ব্যবস্থা করছেন।

তা কেন হবে?

গ্রিন তো থাকবে না।

কিন্তু একটা প্রজেক্ট, খুব বড়ো প্রজেক্ট, চারপাশ রাতারাতি বদলে যাবে।

তা যাক, কিন্তু সুন্দর কি থাকবে?

এক একজন সৌন্দর্যকে এক এক রকম ব্যাখ্যা করে।

যা-ই ব্যাখ্যা হোক, নদী পাহাড় সমুদ্র, সবুজ মাঠই তো লোকে দেখতে যায়, কারখানাকে দেখতে ছোটে?

আপনি দেখুন না।

সুদামা বলল, আপনার স্যারকে বলুন, উনি যদি নিয়ে যান।

একদিন গেলেই হল, হ্যাঁ ওদিকে খোঁজ পাওয়া যেতে পারে মেঘের, কাছেই গঙ্গা, মেঘ তো নদী থেকেই আকাশে ওঠে।

কারখানা হলে গঙ্গা থাকবে?

বাহ কেন থাকবে না?

আপনি সবুজ রক্ষা করতে পারলেন না?

ওপারে সুহাস হাসে, আমি খুব ইমোশনাল। সত্যি সেদিন খুব আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম। যাক আপনি আসুন মেঘের খবর নেব, নদীতে অনেক নৌকো, পাল তোলা, তারা হয়তো খবর দিতে পারে।

থাকুক গঙ্গা, থাকুক মেঘ, থাকুক নৌকো, সাদা পাল — ফোন রেখে দিল সুদামা। অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় কথা আর কত সময় ধরে চালানো যেতে পারে। সুহাস বোস কৃষ্ণেন্দুর জুনিয়র। বয়সে অনেক ছোটো, অন্তত বছর আট তো হবেই। ফোন রেখে শ্বাস নিল সুদামা। হ্যাঁ, হালকা লাগছে অনেক। ঘরের ভিতরে যে গুমোট বাতাস ছিল তা যেন এই মিনিট-কয়ে-র ভেতরে উধাও। বন্ধ জানালা কি খুলল সুদামা। না, সব তো তেমনই রয়েছে। কথা হয়েছে কিছু সময়। কিন্তু সুহাসের কথা তো তার কানে কানে — সুদামা অবাক হয়ে গেল। কী সব ভাবছে সে! ঘরে যেন আলো অনেক। তা কী তার কথার জন্য! সে বেশ জোরে জোরেই কথা বলছিল। দুপুরে ফোন এলে তেমনই করে থাকে সুদামা। ইচ্ছে করেই কন্ঠ উচ্চে তোলে কেননা প্রথমে কৃষ্ণেন্দু, পরে বিমলা চলে যাওয়ার পর এই ফ্ল্যাটে তো আর কেউ কথা বলে না। পাশের ফ্ল্যাটের অনিন্দিতা আসত ক-দিন। তার উদ্দেশ্য হল টিভি খুলে সিনেমা দেখতে দেখতে সুদামার সঙ্গে সিনেমার গল্প করবে। তাতে সিনেমাও হল, আড্ডাও হল। এখন তো সব সময় সিনেমা। সুদামার কোনো উৎসাহ নেই সিনেমায়, তা টের পেয়ে অনিন্দিতা এখন তার ঘরেই ডেকে নেয় তিনতলার মাধুরীকে। আবার মাধুরীও ডাকে অনিন্দিতাকে। সুদামাকেও ডাকে। গেল কবে সে?

সুদামার মনে হচ্ছিল এই ঘরে বহু সময় ধরে আলাপ হয়েছে। হাসতে হাসতে কথা হয়েছে। সেই আলাপের ভিতরে ছিল মেঘ-বিষয়ক কিছু কথাবার্তা, কদম ফুল, পুরোনো এক বরষা। আলাপ এখনই থামল। একজন চলে গেছে, একজন আছে।

সুদামা মনে করতে চেষ্টা করে কী কী কথা? হ্যাঁ, কংসাবতী তীরে বর্ষার কথা হয়েছে। বাইরে কী চকচকে রোদ, গরম বাতাস! এই সময়ে এই ঘরে নদী এসে ঢুকেছিল, মাথায় মেঘ, কী মেঘ! কুমারী মেঘ, মেঘ নারী, বর্ষণে বর্ষণে যে শীতল করে পোড়া পৃথিবী। কী যে হয়েছে তার। কখন এসব কথা হল। সুহাস বোস জানবে কী করে, ‘একটা তোমার, আর একটা তোমার, এইটা তোমার, এইটাও তোমার … সব ফুলই তোমার’।

সুহাস বোস তো নিতান্ত উচ্চাশী চাকুরে। বুদ্ধিমান। কিন্তু কত-বা আর বুদ্ধি ধরে? যে কৌশলটি প্রয়োগ করল সে তা তো বহু পুরাতন। বসকে খুশি করতে হলে তার অন্দরমহলকে খুশি কর। বড্ড ঘ্যানঘেনে ব্যাপার। বহু চর্চিত ওই কৌশলই তো রপ্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে সুহাস। প্রয়োগ করেছে সময় বুঝে। ঠিক দুপুর, একা ঘরে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এই সময়ে যে মানুষই ফোন করুক, তার কন্ঠস্বর প্রার্থিত মনে হয়। সুহাস সেই সুযোগই নিয়েছে। সকালে কিংবা রাতে ফোন করলে তো এত সময় কথা বলার সুযোগ পেত না। সুদামা নিজেই সে সুযোগ তাকে দিত না। টেলিফোন কৃষ্ণেন্দুর কাছে চলে যেত।

খামোকা ফোন করতে গেল ছেলেটা। উন্নতি করবে নিশ্চিত। কৃষ্ণেন্দুই তো বলে অতি বিনয়ী সুহাস তাকে ‘স্যার’ না বললেও ক্ষতি ছিল না। একই সার্ভিসের লোক। কিন্তু সুহাস চেয়ারের মর্যাদা দেয়। সে খুব সতর্ক। জানে কৃষ্ণেন্দু কিসে খুশি হবে।

তা হোক। চাকরি যখন করতে ঢুকেছে বীরভূমের কৃষক-পুত্র, সে তো উপরে উঠতেই চাইবে। যত উচুতে সম্ভব। তাতে সুদামারই বা কিসে মাথাব্যথা। সে ঘুরতে লাগল ফ্ল্যাটের ভিতর। মনে হচ্ছে, যেন আরও মিনিট নয়, আরও ঘন্টাই কথা হয়েছে। যতক্ষণ এই ফ্ল্যাট একাকী পড়ে আছে, ততক্ষণ। সেই বিমলা চলে যাওয়ার পর থেকেই সুহাস আলাপ জুড়ল ধীরে ধীরে। এখনই যেন মনে হচ্ছে সে একটু একা হয়ে গেল। ঘরে অতিথিকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে এল।

কী চমৎকার না কথা হল? বর্ষায় তো কদম্ব ফোটে, কদম্বে কুঁড়ি এসে যায় এই সময়েই, এখন জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। মে মাস শেষ হতে গেল। এই ঘরে বসে সুহাস যেন বলছিল, কদম্ব গাছের কাছেই জানা যেতে পারে কবে নাগদ মেঘ এসে শহর ভাসিয়ে দেবে। কদম্বও তো মেঘের অপেক্ষায় আছে।

কদম্বটা কোথায় আছে?

বেলগাছিয়ায়, মাঠের ধারে। সুহাস বোস তখনই উঠে যায় সোফা থেকে, ম্যাডাম যদি বলেন, দেখে আসি।

কী চমৎকার সব কথা হল। আলাপে আলাপে ঘর দুয়ার সব আলো হয়ে উঠল। মাধুরীদের ফ্ল্যাটের টিভিতে সিনেমার নাচ বন্ধ হয়ে গেল। হ্যাঁ, এখন যেন কানে আসছে উপরের টিভি-র শব্দ। যতক্ষণ সুহাস ছিল ততক্ষণ কানেই যে আসেনি। সুহাস বোস হোক বা যে কেউ হোক, সে অনেক কথা বলেছে অনেক সময় ধরে। হেসেছে হা-হা শব্দে। ডাইনিং কাম লিভিং-এ, শোওয়ার ঘরে, আর একটি ঘরে, আর একটি ঘরে।

কী আশ্চর্য মেঘ উঠেছিল তখন। মেঘে মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল আকাশ। ফাঁকা ফ্ল্যাট। শ্বশুর, শাশুড়ি, জা, ভাসুর গেছে পুরীতে — ফ্ল্যাটে শুধু দুজন কথা বলছে। কথা বলছেই না অনেক সময়, চুপ করে বাইরে চোখ ভাসিয়ে আছে। মেঘ দেখছে। কথা যখন বলছে না তারা, তখনই যে বেশি কথা।

সুহাস বোস তো কত সময় চুপ করেই থাকল। সুদামা জানালার কাছে যায়। পরদা সরিয়ে দিতেই বাইরে ছায়া ছায়া ভাব। আশ্চর্য! রোদ কি মরে গেল। বিকেল হয়ে গেল, না তো, এখন যে দুপুর, ভীষণ দুপুর। পোড়া দুপুর, সমুদ্রতীরে বৈশাখ মাসের দুপুর যেমন তেজি থাকে, তেমনি দুপুর। বালিতে আগুন ধরে যাচ্ছে। সেই রোদ তো নেই। ছায়া ঘনিয়ে এল। সুদামা পটাপট পরদা তুলে দিতে থাকে। ছায়া ছায়া ছায়া! ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। বন কোথায় এখানে? কৃষ্ণেন্দু কী সুন্দর গাইত!

ছায়া কি সত্যি এল? নাকি বেলা পড়ে এল? নাকি সুদামার চোখে ঘোর এল। মেঘের স্বপ্ন এল। ফিরে এল সেইব দিনরাত্রি। নিঝুম হয়ে বাইরে তাকিয়ে ধীরে ধীরে দু-চোখের পাতা নরম করে আনে সুদামা। আঁখি পল্লব ক্রমে বুজে এল, পাখি যেমন গোটায় রৌদ্র শেষ হলে, তেমনি। জানালার ওপারের প্রকৃতি ধীরে ধীরে মুছে যায়। আকাশ মুছে যায়। সত্যিই মেঘ এসেছে কিনা তাও জানে না সুদামা। ঢলে পড়ে সে পরদার ওপরে জানালার গ্রিল জালে।

কৃষ্ণেন্দু … ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। নীল … মেঘ বলেছে যাবো যাবো … মেঘ উঠেছে মা দেখো। কৃষ্ণেন্দু … নীল। হ্যাঁ, ওরা দুজন। দুজনই শুধু। নীলকে লিখতে হবে অবশ্যই যেন আসে। আয় নীল আয়। আমার ভয় করছে। চমকে ওঠে সুদামা। চোখ খুলে যায়। সত্যিই তো মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে সব। এ তার ঘোর নয়। এ তার ঘুম নয়, মুদিত চোখের অন্ধকার নয়।

এগারো

দু-হাতে পরদা সরিয়ে সুদামা বাইরে তাকায়।

বাইরে মেঘ এসে গেল! কখন? যখন তারা কথা বলছিল এ ঘরে ও ঘরে, কদম্বের কাছে খবর নেওয়ার কথা বলছিল সুহাস, তখন! না তো সুহাস তো কদম্বের কথা বলেনি, বলেছে তো শুধু খোঁজ নেবে। না, কি বলেছিল, তারই মনে নেই, কী যে ছাই বলেছে। ভুলেই গেছে সে। ভুলে যাওয়াই তো ঠিক। কৃষ্ণেন্দুর অফিসের একটা বাচ্চা ছেলে, (হ্যাঁ বাচ্চাই তো, বড়োজোর একত্রিশ, বত্রিশ হবে না বোধহয়। তার নিজের তো আটত্রিশ, না না ঊনচল্লিশ) টেলিফোনে কী না কী বলল তা নিয়ে ভাবছে সে। নীলের চেয়ে আর কত বড়ো হবে। সতেরো আঠেরো — হেসে ফেলেছে সুদামা, কম কি সতেরো আঠেরো?

সুহাস বোস আচমকা ফোনটা করল কেন? কী চমৎকার একটা ছুতো খুঁজে নিল। টেলিফোনে এই সুবিধেটা আছে। … আপনি কি ফোন করছিলেন, ম্যাডাম? করছিলাম তো কৃষ্ণেন্দুকে। কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে কথা আছে।

সে যদি ফোন না-ও করত, সুহাস এই সূত্রতেই ফোন করতে পারত, আপনি কি ফোন করছিলেন? কৃষ্ণেন্দুর ঘরে তো মুহূর্মুহূ ফোন যায়। সে থাকলে সে ধরে, নতুবা অন্য কেউ ছুটে আসে। জরুরি ফোন থাকে অনেক। যখন ঘরে বা আশপাশে কেউ থাকেন না, ফোন বেজে বেজে থেকে যায়। জরুরি ফোনও বেজে বেজে থেকে যেতে পারে। তেমন হলে আন্দাজ করে কাউকে রিং ব্যাক করা যেতে পারে, সেক্রেটারি, ডিরেক্টর, মিনিস্টারের ফোনও তো থাকতে পারে। কিন্তু সুহাস কিনা আন্দাজ করল ফোনটা করেছিল ম্যাডাম চ্যাটার্জি — হাসি পেয়ে যায় সুদামার। কোন আকাশ সুহাসকে ওই খবর দিল? আসলে সুহাস ফোন করতই। শুধু প্রথম কথাটা খেটে গেল আচমকা। যদি সুদামা বলত সে কোনো ফোন করেনি, তা হলে কী বলার ছিল সুহাসের? সে কি ফোন রেখে দিত? নাকি কথা খুঁজে আলাপই করে যেত, যেমন করল। সুহাস তার ম্যাডামের সঙ্গে সহজ হয়ে কৃষ্ণেন্দুর অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে চাইছে।

কিন্তু সত্যিই কি তাই! ছেলেটার কন্ঠস্বরে কেমন একটা ভাব আছে না। দূরাগত ধ্বনির মতো। বিপ বিপ বিপ …। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে ওর গলা জড়িয়ে যায়। আজ গিয়েছিল খুব। তার সঙ্গে বারবার কথা বলতে চায়। অর্থহীন তুচ্ছ কথাকেও মূল্যবান অর্থপূর্ণ মনে করে। সুদামা জানালা থেকে আচমকা সরে আসে। এসব কী ভাবছে সে! কেন ভাবছে? ভাববে কেন? কৃষ্ণেন্দুর অফিসের একটা ছেলে ফোন করেছিল। করতেই পারে। শুধুই তো ফোন। সে তার ঘরে আসেনি। হাত ধরেনি। দু-কান গরম হয়ে ওঠে সুদামার। আবার কী ভাবছে সে? হাত ধরবে কেন? ও তো সুহাস বোস। কৃষ্ণেন্দুর অধীনে চাকরি করে। বীরভূমের সুহাস। খুব আলাপি। খুব উচ্চাশী। বসের স্ত্রীকে খুশি করছে। আর কিছু না। এরপর যেদিন ফোন করবে, সুদামা আচমকা ফোন রেখে দিয়ে শুয়ে পড়বে। ফোন রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আশ্চর্য! কেন ঘুমিয়ে পড়বে সে? ঘুমোনোর কী আছে? ঘুমোবে বলেই ঘুমোতে পারবে? বরং বলে দেবে পরে কথা বলবে, সে খুব ব্যস্ত আছে। কিন্তু কিসে ব্যস্ত সে? তার কোনো ব্যস্ততাই যে নেই। তখন সে জিজ্ঞেস করবে, কখন ফোন করবে? তার চেয়ে যা বলার বলুক। ওর কথাগুলো তো সুন্দর। শুনতে ভালো লাগছিল তার। আশ্চর্য! ভালো লাগারই বা কী আছে? সে কি পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলেনি? কতজন ফোন করে। কৃষ্ণেন্দুর অফিসের কতজন। তার সঙ্গে কথা বলে। অনিলবরণও তো কথা বলে। আরও কে কে যেন! কারা কারা? কৃষ্ণেন্দুর পরিচিত কারা কারা? তার পরিচিত কে কে? সুদামা নাম মনে করতে চেষ্টা করে। কেউ না। কারওর নামই তো মনে পড়ছে না। তাহলে কি সুহাসই করে? সব ফোন সুহাসের? কলকাতা থেকে, কলকাতার বাইরে থেকে — সব সুহাসের কন্ঠস্বর। মাথা ঝাঁকায় সুদামা। খোপা ভেঙে দেয় হাত ঘুরিয়ে। চুল ছড়িয়ে দেয় পিঠময়। চুল তার মুখমণ্ডলে উড়ে আসে। চোখের উপরে উড়ে আসে। চুল সরাতে সরাতে সে জানালার কাছে আবার সরে যায়। যদি নীল বাড়ি থাকত, ফোনটা সেই ধরত। নীলই সব ফোন ধরত। তাকে তুচ্ছ কথায় সময় নষ্ট করতে হত না সুহাস বোসের সঙ্গে। নীলের কথা নিয়ে মনের ভিতরে খেলতে চায় সুদামা। এখন ছেলেটা নেই, তাকেই ফোন ধরতে হবে। সুহাস তার সঙ্গেই কথা বলবে। নীল থাকলে বোধহয় নীলের সঙ্গে ভাব জমাত। সত্যিই কি তাই! তাহলে ওর গলা কেঁপে যাবে কেন, জড়িয়ে যাবে কেন? কী যে তার ভাবনা। অর্থ নেই কোনো। সুহাসের ফোন নিয়ে এত ভাবনার কি আছে?

সুদামা সব জানালার পরদা তুলতে তুলতে বলল, যা হোক, ফোনটা করেছিল বলে সময় তো কাটল। একঘন্টা, দু-ঘন্টা কেটে গেছে যেন। তার যে নিজস্ব সময় ধারণা আছে, সময় সম্পর্কে কল্পনা আছে, তা ঘড়ির সঙ্গে চলে না। ঘড়িতে তো সময় বাঁধা। সুদামার মনে হয় ঘড়ি নামিয়ে রাখে। ঘড়ি নামালেই সময় তার ব্যাপ্তি ফিরে পাবে। ওই যে সামান্য কয়েক মুহূর্তের কথা, ফালতু, অপ্রয়োজনীয় কথা, যা সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়ার মতো, তা যেন বহু সময় ধরে বয়ে যাচ্ছে এখন। ওই কথার সময়ও ছিল অনেক, অনেক। না ঘড়ির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

কী আশ্চর্য! ঘড়ির সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না কেন? কতটুকু কথা বলেছে সে? দশ মিনিট বড়ো জোর। নাকি তার চেয়েও কম সময়। নানা, আরও বেশি সময়। আধ-ঘন্টা, এক ঘন্টা, দু-ঘন্টার, তিন ঘন্টা, চব্বিশ ঘন্টা ধরে, দিন রাত্রি ধরে। কথা তো এখনও চলছে। বয়ে যাচ্ছে কথার রেশ।

সুদামা দেখে লবণ হ্রদের আকাশ ছায়াময়। রোদ নিভে কেমন একটা থমথমে ভাব। আশ্চর্য। আজই মেঘের প্রার্থনা করছিল সে কদম্বের কথা মনে করে, প্রার্থনা মঞ্জুর হল। এই মেঘ জল দেয় না কিন্তু ছায়া করে। তাও বা কম প্রয়োজনীয় কিসে? সুদামা ভাবে, সুহাসের ওখানে কি মেঘ এল?

ঘন, পূঞ্জীভূত মেঘ। আষাঢ়ের মেঘ। ডাক দেওয়া মেঘ। প্রিয় পুরুষ ডেকে ডেকে ফেরা মেঘনারী। ঘোর গর্জনে আকাশ পৃথিবী মন্দ্রিত। মেঘ কি নারী? না পুরুষ! কৃষ্ণেন্দু বলত, মেঘ নারী। কংসাবতীর তীরে মেঘনারী মিলনের পিয়াসে ডেকেছিল পুরুষকে। সেই কবে যেন। কতকাল আগে? কত জন্ম আগে। কিন্তু নারী কি ডেকে ডেকে ফিরতে পারে? নারীর কন্ঠস্বর কি অমন ঘনগম্ভীর। মেঘ তো পুরুষ। ওই যে পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে জানালার ওপারে। সরে আসে সুদামা জানালা থেকে। তার কী হয়েছে। বুকে এমন কাঁপছে কেন? নীল … নীল থাকলে ফোনটা সে-ই ধরত। ফোনের ধারে কাছে যেত না সুদামা। নীলের চিঠি লেখা হয়নি এখনও। নীলের কথা ভাবা হচ্ছে না এখন। নিঝুম দুপুরে সন্তানের কথা মনে করে বিষণ্ণ হয়নি সে। তার চোখে মুখে বিষাদ ছায়া ফেলেনি। চিঠিটা এখনও কৃষ্ণেন্দুর কাছে। ফেরত দেয়নি সে। কৃষ্ণেন্দু ফেরত দেয়নি বটে, সেও কি চেয়েছে? কেন চেয়ে নেয়নি? চিঠি তো লিখতে হবে। এখন চিঠি লিখতে বসলে নিশ্চিন্ত। দুর্ভাবনায় মাথা খারাপ হবে না। এলোমেলো ভাবতে হবে না। কিন্তু চিঠি তো চাই। এখনই চাই। চিঠিটা পেলে সে বেঁচে যেত। কৃষ্ণেন্দুর ফিরতে তো রাত। তাহলে কি রাতে লিখবে? অনেক রাতে একা একা, জেগে জেগে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু যদি ফেরত না আসে। অফিসের ড্রয়ারে রেখে দেয়নি তো? অফিসের ড্রয়ারে নানান কাগজের ভিড়ে পড়ে আছে নীলের চিঠি। তাহলে বরং ফোন করা যাক কৃষ্ণেন্দুকে। ফোন করে সে বলবে, এখনই চিঠিটা নিয়ে চলে আসতে। সুদামা টেলিফোনের দিকে এগোয়। রিসিভারটা তোলে। এখনও ঘাম লেগে আছে যেন। ডায়াল করলেই তো ফোন পৌঁছে যাবে সুহাস বোসের কাছে। কৃষ্ণেন্দু অফিসে নেই। সুহাসকেই বরং বলে দেবে চিঠিটার কথা। কিন্তু ওপারে বসে সুহাস তো তারই ফোন ধরবে। কেমন যেন শিথিল হয়ে যায় সুদামা। আস্তে আস্তে রেখে দেয় রিসিভার। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

এখন সে কী করবে। সুহাসের ভয়ে ফোন করল না তার স্বামীকে। আচ্ছা, সুহাসে তার কিসের ভয়। সে এত গুটিয়ে যাচ্ছে কেন? সুহাসকে ডেকে সেও তো মেঘের খবর দিতে পারে। মেঘের খবর নিতে পারে। নিলে কী? ওই সুন্দর যুবক, তাকে মুগ্ধ করেছে। করতেই পারে। এক পুরুষের ভেতরে সব পুরুষের গুণ কি সমাবিষ্ট হয়? সে তো অনায়াসে জিজ্ঞেস করতে পারে, সুহাস তোমার ওখানে কি মেঘ এসেছে?

না, না সুহাস কেন? কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণেন্দু তুমি কি মেঘ দেখছো ওখানে? বাইপাস তো সল্টলেকের গা থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে চলে গেছে। উড়ে গেছে দক্ষিণে। কতদূরই বা যেতে পেরেছে? মেঘ নিশ্চয়ই এসেছে ওইদিকে। কিন্তু ফোনটা সে করে কী করে? কৃষ্ণেন্দু তো নেই। কৃষ্ণেন্দু, কৃষ্ণেন্দু … তোমাকে ডাকতে গিয়ে সুহাসকে ডাকতে যাচ্ছি কেন? কৃষ্ণেন্দু, কৃষ্ণেন্দু, তোমার বদলে সুহাস আমার ঘুম ভাঙাচ্ছে কেন? নীলের চিঠিও কি তুমি সুহাসের হাতে দিয়েছ? সুদামা মেঝেয় বসে পড়ে। ফোন বেজে উঠল।

ফোন বাজছে। কার ফোন হতে পারে? সুহাস বোস কী খবর দিচ্ছে মেঘের। তার কথা আকাশ শুনতে পেয়েছে। নাকি সুহাস বোস বলবে গঙ্গার গা দিয়ে ভাসা মেঘ সে পাঠিয়ে দিয়েছে লবণ হ্রদের দিকে, দেখা হয়েছে তা?

অথবা কৃষ্ণেন্দুর ফোন। এসে শুনেছে ফোন করেছিল সুদামা, তাই হয়তো। সুদামার মনে হল কৃষ্ণেন্দুই। সুহাস হয়তো হাসতে হাসতে বলেছে, স্যার, ম্যাডাম খুব মেঘ ভালোবাসেন, স্যার ম্যাডাম বলছিলেন মেঘ কবে আসবে, কবে বৃষ্টি নামছে … হা-হা-হা, ম্যাডাম কী চমৎকার কথা বলেন স্যার, উনি কি কবিতা লেখেন, পোয়েট? শুনে কৃষ্ণেন্দু হাসতে হাসতে ফাইলে চোখ নামায়।

সুদামা ফোন ধরল, কে কৃষ্ণেন্দু, নীলের চিঠি তুমি কার হাতে দিলে? কোথায় ছিলে, জানো আজ সেই যে বর্ষার মেঘ, কংসাবতী তীরে বরষা … কদম্ব পুষ্প …।

ওপারে নারীকন্ঠ হা-হা করে হাসছে, কদম্ব পুষ্প। পারিসও বটে, বয়স তো হল রে আমাদের। হ্যাঁরে সুদামা, তুই কি স্বপ্ন দেখছিলি?

চম্পা। তার বাপের বাড়ির পাড়ার বন্ধু। অফিস থেকেই করছে। মাঝেমধ্যে এমন করে। একেবারে অনিন্দিতার স্বভাব। অনিন্দিতা টিভি দেখতে দেখতে, তা ‘পথের পাঁচালী’ ছবি হোক আর ‘বাজিগর’ হোক কথা বলবেই — চম্পা অফিসের ফোনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ফোনে গল্প করে। ফাইল খোলা, চম্পা বলছে, তুই এখনও খুকি হয়েই আছিস সুদামা, কদম ফুল নিয়ে স্বপ্ন দেখিস, ভালোবাসাবাসি করিস, পনেরো বছরের পুরোনো বর আর কত প্রেম দেবে রে, হ্যাঁরে আছিস কেমন? উফ কী গরম। আমাদের এ সি আছে বলে রক্ষা, এ সি-র জন্যই তো অফিসে আসি, আমি আবার একদম গরম সহ্য করতে পারি না …।

বারো

দিন সাত গেছে। সুহাস ভাবছিল তার ঘর থেকে আবার একটা রিং করবে কিনা সুদামা চ্যাটার্জিকে। সেদিনের আলাপের বিবরণ দিয়েছে সুহাস তার সাহেব স্যারকে। স্যার, ম্যাডাম কী সুন্দর কথা বলেন।

কৃষ্ণেন্দু তাকিয়েছিল তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে। শুনেছে কথাগুলো। শুনে হাসতে হাসতে বলেছে, তোমার তা হলে একটা কাজ বাড়ল, তুমি বরং প্রজেক্টের কাজ থেকে ছুটি নিয়ে খোঁজ নাও কবে নাগাদ মেঘ আসতে পারে।

সুহাস সিগারেট এগিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। বলল, ও আমি বরং ফোনেই খোঁজ নিতে পারব স্যার, কৃষ্ণমূর্তি কি ফোন করেছিলেন?

কেন? কৃষ্ণেন্দুর দুই ভ্রূতে ভাঁজ।

ওঁদের ডিরেক্টর মিঃ মেটা আসবেন শুনেছিলাম, রাজারামপুর যাবেন প্রজেক্ট সাইট দেখতে।

কৃষ্ণেন্দু হাসে, তোমার বেশ মনে থাকে, না ফোন করেননি, তুমি তো জানতে পারবে। হ্যাঁ ওরা দশ লাখ টাকা জমা দিয়েছে, জানো।

জানি স্যার, ট্রেজারি অফিসার রবিন বলছিল, স্যার আর একটা কথা?

কী! কৃষ্ণেন্দুর কপালে উদ্বেগের ছায়া হয়তো।

কেউ কেউ বলছে আপনাকে ওরা অফার দিয়েছে, ইস্টার্ন ইন্ডিয়ায় অনেকগুলো প্রজেক্ট করছে।

তোমার মাথা খারাপ, গভর্মেন্ট সার্ভিস ছেড়ে, ও সব শোনা যায়।

কিন্তু ওদের ওখানে স্কোপ তো অনেক বেশি।

এই বয়সে হয় না। কৃষ্ণেন্দু বলেছে।

না, না, এই বয়সটাই তো কাজের সময়, আপনার এক্সপিরিয়েন্স অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাপাবিলিটি ওরা কাজে লাগাতে পারবে, বয়স কোনো ফ্যাক্টরই নয়, যে এজ-এ সকলে তো দক্ষতার শীর্ষে উঠে যায়, অথচ সুস্থ, কর্মঠ মানুষকে ঘরে বসিয়ে দেয় গভর্মেন্ট …।

কৃষ্ণেন্দু প্রসঙ্গ ঘোরায়, তুমি মাঝে-মধ্যে ফোন কোরো সুদামাকে। ও তো একা, ওর বন্ধুই না হয় হয়ে যাও। ওর একটা ভাই আছে, ব্যাঙ্গালোরে থাকে। তোমারই বয়সী হবে হয়তো। শি লাইকস য়্যু। এসব মেঘের গল্প আমি শুনেছি, খুব প্রশংসা করছিল তোমার।

কথা এইরকম। এর পরে সুহাস আবার এলপিজি প্রজেক্টের দিকে কথা ঘোরায়। কৃষ্ণেন্দু হুঁ-হাঁ উত্তর দেয়। সুহাস প্রজেক্ট বিষয়ে তার মতামত দেয়, কমপেনসেশন খুব তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ল্যান্ড নিয়ে কিছু জটিলতা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কৃষ্ণেন্দু বলে, ল্যান্ডের জটিলতা থাকবেই, যাকগে মিঃ মেটাকে ভালো করে সাইটটা দেখানো দরকার, ওঁরা বাইপাসের কাছে জমি চাইছেন। অসমে একটা এলপিজি প্ল্যান্ট করছেন, ওড়িশতে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, বিহারে থার্মাল পাওয়া — একটাই কোম্পানি, কত ব্যবসায় নামছে?

সুহাস বলল, প্রাইভেট সেক্টরের প্রসার যেভাবে হচ্ছে, এরপর গভমেন্ট সার্ভিসে কেউ থাকবে না স্যার, মহারাষ্ট্রে এক সিনিয়র আই এ এস, চাকরি ছেড়ে মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে, খবরটা দেখেছেন?

কৃষ্ণেন্দু চুপচাপ। সুহাস তখন উঠে এসেছিল কৃষ্ণেন্দুর সামনে থেকে। সুহাস ভেবেছিল খবরটা দেয়। কী খবর, না তার ‘স্যার’ হয়তো …। কিন্তু তা বোধহয় কৃষ্ণেন্দুর অভিপ্রেত নয়। কোথাও অফার পাওয়া, অফার নেওয়া বা না নেওয়া, এ সব কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আজ আবার ভাবছে সুদামাকে ফোন করে। না, অন্য খবর দেবে। ভাবছিল ডেকে বলে, খোঁজ পেয়েছি ম্যাডাম।

কিসের খোঁজ?

মেঘের খোঁজ।

আপনি কি সেই হাওয়া অফিসের খবর, আরে ওরা তো বিভ্রান্ত, এক-একদিন এক-একরকম খোঁজ দিচ্ছে, কোনোদিন বলছে দু-দিনের ভিতরে বৃষ্টি, পরের দিন বলছে মেঘের দেখা নেই, বৃষ্টির সম্ভাবনাই নেই, ওদের যন্ত্রপাতি সব বিগড়ে গেছে সুহাসবাবু।

ঠিকই বলেছেন ম্যাডাম, ওরা বলছে সের দরে সব বেচে দেবে, একটা বোর্ড লাগিয়ে দেবে, ‘ফর সেল’।

কী সেল করবে? যন্ত্রপাতি কে কিনবে?

যন্ত্রপাতি নয় ম্যাডাম, অন্য কিছু, হয়তো মাথার আকাশটা।

ওপারে হাসির শব্দ। সেই শব্দে কী যে মধুরতা। আটত্রিশ-ঊনচল্লিশের মহিলা কুড়ি-বাইশের তরুণী হয়ে গেছে। বলছে, আপনি সিভিল সারভেন্ট হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিন্দে করছেন।

স্যরি ম্যাডাম, আপনি আমার বসকে জানাবেন না, বস আবার ভীষণ সরকারি, ধরুন কেউ যদি তাঁকে অফারও দেয় … (না, শেষের কথাগুলো বলা যাবে না। কৃষ্ণেন্দু বিষয়ে কোনো কথাই বলবে না, ভালোই লাগবে না।)

বরং সুহাস বলবে, হাওয়া অফিসের ভার নেবেন মিঃ অজিত আগরওয়াল, ভোপালে তাঁর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে, ইউপি-তে আছে সুগার ফ্যাক্টরি, মহারাষ্ট্রে কাপড় কল, আর আসামে বাঁশবাগান।

বাঁশবাগান! খিলখিল করে হাসছে সুদামা, কী সুন্দর কথা বল তুমি সুহাস, বাঁশবাগান কেন?

এমনি! বাঁশ কেটে চালান দেন, কত বাঁশ প্রয়োজন ভারতবর্ষে, এ নিয়ে আর একটা ডিসকাসন হতে পারে, হ্যাঁ আমাদের দেশের রোদ্দুরও কিছুটা কিনছেন অজিত আগরওয়ালজি, নরওয়ের এক কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ, শীতের দেশে রোদ্দুর সাপ্লাই করবেন, ওফ, কী রোদ না হয়েছে ম্যাডাম, বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, মালদহে খরা, জল নেই, এত রোদ আর কোনো দেশে হয়, গ্রিনল্যান্ডে সাপ্লাই যদি করা যেত —

কী চমৎকার বলছ, চেরাপুঞ্জির মেঘ গোবি সাহারার বুকে, সুহাস তুমি কি কবিতা লেখো?

নো ম্যাডাম, আপনি এখন কী করছিলেন?

কী আর কিছুই না, তুমি?

কিছুই না ম্যাডাম, কিছুই না, আমাদের এখানে ক-দিন খুব দৌড়-ঝাঁপ চলে, আবার ঠান্ডা, ভাঁটা পড়ে কদিনের জন্য, অমাবস্যা-পূর্ণিমা, দিন-রাত, জোয়ার-ভাঁটার মতো, আপনি এখন কি ঘুমিয়েছিলেন?

না, না তোমার ফোনের জন্য বসেছিলাম।

ভাবতে ভাবতে রিসিভার তুলবে সুহাস, তো ঘরে ঢুকল অনিলবরণ, শোনো সুহাস, মার্ডার ইজ অ্যান আর্ট, তুমি কি বিশ্বাস কর?

টেলিফোন নামিয়ে সুহাস বলল, কেউ কি বিশ্বাস করে এ কথা?

আমি করি, অনিলবরণের কন্ঠস্বরে প্রত্যয়, মাথায় দশটা খুন বিজবিজ করছে।

সুহাস চুপ করে থাকে। তার খুব ইচ্ছা করছিল সুদামার সঙ্গে কথা বলে। হ্যাঁ, ওই কথাগুলোই হবে। কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জির স্ত্রী খুব খুশি হবে তার ফোন পেয়ে, রাগ করবে, কী ব্যাপার, আর তো ফোন করলেন না?

ব্যস্ত ছিলাম ম্যাডাম।

কিসে ব্যস্ত?

আপনি একটা কাজ দিয়েছেন।

কী কাজ?

মেঘের খবর।

ও তাই নাকি। ওপারে নারীকন্ঠে উচ্ছ্বাস শোনা যায়, জানলেন কিছু?

সুহাস বলে, জানি না আপনি ছাড়া আর কেউ এসব বিশ্বাস করে কিনা।

অনিলবরণ চেয়ার জুড়ে বসে, বিদেশে এসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হয়।

আমি তো শুনিনি স্যার।

ইন্টারেস্ট থাকলে তো শুনবে, এখন তো সিরিয়াস ব্যাপারে কারওর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সুহাস তুমি কি জানো, হোয়াট ইজ পয়জন?

সুহাস হাসবে, না খুব গম্ভীর হয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো অনিলবরণের সামনে বসে থাকবে তা ঠিক করতে পারছিল না। অনিলবরণ মাঝে-মধ্যে এইরকম বিচিত্র বিষয় নিয়ে কথা আরম্ভ করে। আর সব কথাই ধ্বংসাত্মক। একদিন সেই কথা নিয়ে অনিলবরণ দু-ঘণ্টাই কাটিয়ে দিল পাঁচটার পর, পুলিশ রেপ এবং মার্ডার, লকআপে পিটিয়ে মারা। মেজাজই খারাপ করে দেয় মানুষটা। সময় পেলেই যত সব হিংস্রতা নিয়ে কথা বলে। হাওড়ায় যে একটা মানুষকে কিছু লোক পিটিয়ে পুড়িয়ে দিল, অনিলবরণ বলে, একটা-দুটো এসব ব্যাপার হলে অ্যান্টি-সোশ্যালরা সতর্ক হবে, হিংস্রতা চরমে উঠে গেলেই মানুষ আবার তার নিজস্ব ভূমিতে ফিরবে, শান্ত হবে, নরম হবে। অনিলবরণ সাপোর্ট করে এসব। দেশকে একটা ভালো জায়গায় আনতে হলে ড্রাসটিক স্টেপস নেওয়া প্রয়োজন। কিছু বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষের হাতে ক্ষমতা যাওয়া দরকার। শুনতে শুনতে রাগ হয় সুহাসের। সে তর্ক জোড়ে।

সুহাস ইদানীং ভয় করে অনিলবরণকে। এখন সে যেভাবে বসেছে তাতে ঘন্টা-দেড়েকের আগে উঠবে না। সন্ধের পর চ্যাটার্জি সায়েবই তো ফিরে যাবেন ঘরে, তার তো ইচ্ছে করছিল ফোন করে। সুদামা, তুমি কী করছিলে? সুহাস দাঁতে ঠোঁট কাটে, আপনি কি অমিতাভ ঘোষ পড়েছেন ম্যাডাম, বিক্রম শেঠ? কী ছবি দেখলেন ইদানীং, রশোমন দেখেছেন কুরোসোয়ার, কী নাটক, নাটক দেখতে ভালোবাসেন?

অনিলবরণ বলে, তুমি আগাথা ক্রিস্টি পড়েছ, কোনান ডয়েল?

হ্যাঁ স্যার।

মার্ডার মিস্ট্রিগুলো অদ্ভুত না! খুনিরা খুব ইনভেনটিভ হয়, আনার মনে হয় পয়জনিং একটা আর্ট, তুমি কী বল?

জানি না স্যার, গাঁয়ে দেখেছি স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে চাষি বউরা খেতের পোকা-মাকড় মারার বিষ তেল, এনড্রিন খেয়ে মরো-মরো, কী কষ্ট, একটা কেস আমি সিউড়ি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম, আপনি হঠাৎ যে এ নিয়ে ভাবছেন?

অনিলবরণ বলে, একটা রহস্য উপন্যাস আরম্ভ করব। খুনটা কী দিয়ে হবে, বিষ! নিঃশব্দে মৃত্যু অথবা গুলি বন্দুক, গলায় ফাঁস দিয়ে, কতরকমভাবে মার্ডার করা যায় জানো তুমি? অনিলবরণের মাথায় চাঁদের পরে চাঁদ লেগেছে …।

নো স্যার।

একশো পঁচানব্বই রকমের উপায় আছে, যাকে খুন করা হবে তার উপরেই নির্ভর করবে কীভাবে তাকে খুন করা হবে, ধরো কোনো বাচ্চা সবে জন্মাল, জাস্ট বেরিয়েছে, তাকে যদি সরাতে চাও, সেরেফ লবণ, কমন সল্ট, সোডিয়াম ক্লোরাইড, আমি তুমি লবণ ছাড়া কিছুই খেতে পারব না, অথচ ওই লবণই হল আর একজনের কাছে বিষতুল্য।

সুহাস অবাক হয়ে অনিলবরণের মুখে তাকিয়ে আছে। কীরকম নির্বিকার হয়ে সদ্য জন্মানো শিশু-খুনের কথা বলে গেল। ভেবেছে নিশ্চয়ই। অনিলবরণ বলছে, আন ওয়ান্টেড বেবিকে এভাবেই তো শেষ করে দেওয়া হত, বিষ আমাদের চারপাশে আছে, শুধু কেস বুঝে প্রয়োগ করতে হবে। হিটলারের জার্মানিতে অসুস্থ মানুষ, দুর্বল মানুষ, অসুস্থ বাচ্চাদের মেরে ফেলা হত, তা জানো? মার্সি কিলিং শব্দটা শুনেছ? বিষ ইনজেকশন দিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হত চিরকালের মতো, আরে বাচ্চাদের ফ্যামিলির লোকই রাষ্ট্রের কাছে মার্সি কিলিং-এর আবেদন জানাত, নাৎসি জার্মানির মানুষকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল অসুস্থ দুর্বল মানুষ সমাজের বোঝা।

সুহাস বলল, ভয় লাগে শুনতে, এসব আমার ভাবতে ভালো লাগে না।

অনিলবরণ হাসে, ভাবতে ভাবতে আমার তো ঘুমই আসে না, খুন করা খুব সহজ ব্যাপার, তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিলেই হল, তোমাকে যদি আচমকা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই টেনথ ফ্লোর থেকে, মরে যাবে। তোমাকে ধর মেট্রো রেল স্টেশনে ছোট্ট একটা ধাক্কা, নীচে পড়ে গেলে, হাই ভোল্টেজ লাইন, সঙ্গে সঙ্গে শেষ, ওডেসা ফাইল-এ এইরকম একটা দৃশ্য ছিল না?

মনে নেই স্যার।

অনিলবরণ হাসে, তোমার ইন্টারস্টেই নেই তাই মনে নেই, ছুরি বন্দুক তো এখন হয়েছে, আগে তো এসব ছিল না, মার্ডার হতই, তখন ছিল পয়জন, আসলে কী জানো, ছুরি বন্দুক আমার খুব খারাপ লাগে। মৃত্যু ঘটানো উচিত রক্তপাতহীনভাবে, ঘুমের ঘোরে নিঃশব্দে মারা যাক মানুষ, হাসতে হাসতে মারা যাক। হার্টের রোগীকে আচমকা ভয় দেখিয়ে মারা যায়, হাই প্রেসারের পেশেন্ট-এর টেনশন বাড়িয়ে বাড়িয়ে মেরে ফেলা যায়, এ হল মার্ডারের সবচেয়ে সূক্ষ্ম টেকনিক, ধরতেও পারবে না, মার্ডার না অ্যাকসিডেন্ট। নাৎসিরা এসব নিয়ে গবেষণা করত, তাদের মতো ক্রিয়েটিভ খুনি পৃথিবীতে আর জন্মায়নি।

না জন্মানোই তো ভালো। সুহাস বলে।

অনিলবরণ শোনে না সুহাসের কথা, বিড়বিড় করে, কতরকম যে খুনের পদ্ধতি ছিল, তাদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে কত মানুষ একসঙ্গে মেরেছে। মেয়েদের পাঠাল স্নানঘরে, বাথ হাউসে, চুল কেটে, জামাকাপড় খুলে, হাতে সাবান তোয়ালে নিয়ে তারা ঢুকে যাচ্ছে মৃত্যু গহ্বরে — ওফ ভাবতে পারো, মানুষ খুনের কী বিচিত্র উপায় উদ্ভাবন করেছিল হিটলারের পুলিশ, সেনাবাহিনী, নিশ্চিন্তে মৃত্যুর দিকে হাঁটছে নগ্ন নারীরা।

সুহাস বলল, আমার সত্যিই এসব শুনতে ভালো লাগে না স্যার।

অনিলবরণ হাসে, তুমি একটা ফোন করতে যাচ্ছিলে, আমি ঢুকে পড়ায় ফোনটা রেখে দিলে, জরুরি ছিল? ফোনটা করে নাও, আসলে আমি কীভাবে খুনটা করব তা ঠিক করতে পারছি না, এ তো স্রেফ ডিসকাসন, জাস্ট ডিসকাসন, তার বেশি কিছু নয়। আমি ঘুরে আসছি, তুমি ফোনটা সেরে নাও। বেয়ারা ডেকে চা বলে দাও দেখি।

তেরো

কেউ একজন খুব হবে, কাউকে খুন করা হবে, কিন্তু কীভাবে? মানুষ খুন করার সবচেয়ে পুরোনো পদ্ধতি হল বিষ প্রয়োগ। বিষ কী? বিষ তো প্রতিদিন একটু একটু করে আমরা আমাদের শরীরে গ্রহণ করে থাকি। যে জীবনদায়ী ওষুধ ব্যবহার করছি জীবন বাঁচানোর জন্য, তাই-ই পরিবেশ এবং পরিপ্রেক্ষিত বদলে গেলে হননের উপকরণ হয়ে উঠতে পারে। আবার এর বিপরীতও হয়ে থাকে। যে উপকরণকে বিষ বলে জানি আমরা, তাই-ই কোনো কোনো সময়ে জীবনদায়ী উপাদান হয়ে ওঠে। আর্সেনিক-পারদ-সিসা, কিছু অ্যালকালয়েড যেমন, মরফিন, স্ট্রিকনিন ইত্যাদি তো তীব্র বিষ, অথচ এই বিষই আবার অনেক ক্ষেত্রে দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিষ এক আশ্চর্য জিনিস। যাকে খুন করা হবে, তার শরীর-ই বলে দেয় তার উপরে কোন বিষ প্রয়োগ করা যেতে পারে। অনিলবরণ লিখছে।

অনিলবরণ লিখছে, বিষ বহুক্ষেত্রে ইতিহাসের গতি বদলে দিয়েছে। অবলুপ্তির পথে পাঠিয়েছে বহু রাজবংশকে। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নতুন শাসককে। মধ্যযুগ, প্রাচীন যুগ, আদিম যুগে বিষচর্চা ছিল রীতিমতো শিক্ষার বিষয়। বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগ কৌশল-নিপুণ মানুষ সম্মানিত হত ইতিহাসখ্যাত নগরে। আশ্চর্য। সেই যে যুগে নারীরাই প্রধান ভূমিকা নিতেন বিষচর্চায়। তাঁদের সেইভাবে তৈরি করত রাষ্ট্রশাসকরা, নারীর কোমল রূপটিকে বিষ প্রয়োগ কর্ত্রী হিসেবে ব্যবহার করতে সুবিধে হত অনেক। অন্ন, জলদাত্রী, স্নেহ-মায়াদাত্রী নারীর হাতে যে বিষপাত্র থাকতে পারে, এ ছিল কল্পনার অতীত। ইতিহাসে কত বিষকন্যার কথাই না আছে। খ্রিস্টজন্মের চারশো বছর আগে পারস্য দেশের রানি ছিলেন বিষ প্রয়োগে সিদ্ধ। তিনি তাঁর পুত্রবধূকে এক আশ্চর্য উপায়ে হত্যা করেন। খ্রিস্টজন্মের দুশো বছর আগে রোমের অভিজাত পরিবারের নারীরা বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগে ছিল নিপুণা। সম্রাট নিরোর মা আগরিপিনা বিষ প্রস্তুতের জন্য নিয়োগ করেছিলেন রোমেরই আর এক বিষকন্যাকে। তারপর সে-ই বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন স্বামী ক্লদিয়াসকে। রোমের সেই বিষকন্যাকে সম্রাট নিরো সিংহাসনে বসার পর পুরস্কৃত করেন রাষ্ট্রীয় সম্মানে। রাষ্ট্রীয় বিষকন্যা রীতিমতো শিক্ষণপ্রণালী চালু করে দেয় বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগ বিষয়ে। নানারকম বিষরে খবর রাখত সে। সম্রাট তার কাছে দাসদের পাঠাতেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। সেইসব দুর্ভাগা দাসদের উপর সে বিষ প্রয়োগ করে তার বিষের গুণাগুণ নির্ধারণ করত। কী আশ্চর্য দিনই না ছিল! কীভাবে খুন করা যেতে পারে তা নিয়ে চর্চা হত রীতিমতো। এখন এইরূপ দেখা যায় না।

অনিলবরণ লেখে, মানুষের জ্ঞানচর্চার একটি মূল্যবান দিকই অবহেলিত। মৃত্যু তো স্বাভাবিক সত্য। বিষচর্চা তো মৃত্যুচর্চা। বুদ্ধিমান মানুষ গোপনে জ্ঞানের এই মূল্যবান শাখাটিকে আবার চর্চা করতে পারে। আমাদের পরিবারে এইরূপ চর্চা ছিল। শোনা যায়, আমার পিতামহ নগেন্দ্রর অনুজ সুরেন্দ্রকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন তাঁরই আর এক অগ্রজ নরেন্দ্র। দুজনে একই ব্যাবসা করতেন। আবার নরেন্দ্রর পুত্র জীবেন্দ্রকে সেঁকো বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন সুরেন্দ্রর বিধবা পত্নী। এই রকম আরও অনেক ঘটনার কথা জানা যায়। প্রতি পরিবারেই বিষের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। হননের ইচ্ছা মানুষের জন্মগত। শিশুরা তো কীটপতঙ্গ। ছোটোখাটো প্রাণী হত্যায় উল্লাস অনুভব করে। কৈশোরে উপনীত হলে সেই ইচ্ছাটি চাপা পড়ে যায় অন্য অনেক অনুভূতির ভেতরে। যৌবনে মানুষ প্রেম ভালোবাসায় জড়ায়। মধ্যবয়সের পর আবার তার ভিতরে হননের ইচ্ছা জেগে উঠতে থাকে। হ্যাঁ, এটাই সত্য।

অনিলবরণ লেখে, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক আনুকূল্য না পাওয়ায় নারীর সেই নিজস্ব প্রকৃতি আজ যেন অন্তর্হিত। বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগের বিদ্যাটি আজ অবলুপ্তির পথে। নরহত্যার নানা উপায় আবিষ্কৃত হওয়ায় বিষের ভূমিকা ক্রমশ গৌণ। আমার মাতুলালয়ে, বড়ো মাতুল স্বর্গীয় বিমানবিহারী গুহ মহাশয়কে পারদ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি গলিত দেহে যন্ত্রণাকাতর হয়েছিলেন অনেককাল। না মাতুলানী তো তখন বেঁচেই ছিলেন না। মা বলতেন, মাতুলকে হত্যা করেছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ির কেউ একজন। তারা সন্দেহ করত তাদের বাড়ির মেয়ে, আমার মাতুলানী স্বর্গীয়া রানিবালা দেবীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিলেন তাদেরই জামাই, আমার মাতুল।

অনিলবরণ লেখে, বিষ প্রয়োগ করা হত কেবলমাত্র শক্তিমানকে হত্যার জন্য। বিষ অতি মহার্ঘ বস্তু, তা যত্রতত্র প্রয়োগ করা হত না। নারী হত্যায় বিষপ্রয়োগের কথা তেমন শোনা যায় না। দুর্বল অরক্ষিতা নারীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার প্রয়োজন হত কিনা সন্দেহ আছে, নারী হত্যার জন্য আগের দিনে অর্থাৎ একশো দুশো বছর, কি পঞ্চাশ বছর আগেও বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন হত না। এখনও হয় না। বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে হলে হত্যাকারীকে নানান পরিকল্পনা করতে হয়, বিষ প্রয়োগের জন্য সময় নির্বাচন করতে হয়। হত্যাকারীকে তার মনোবাসনা গোপন রাখতে হয়। হতভাগ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে হয়। এবং এই ঘনিষ্ঠতা নারীর দ্বারা স্থাপন করা সবচেয়ে সহজভাবে সম্ভব ছিল। এমন ঘটনাও শোনা গেছে হতভাগ্য পুরুষের সঙ্গে মিলনের পর নারীকে তার হাতে তুলে দিতে হয়েছে বিষ পানীয়।

নারী হত্যার জন্য আগুনই যথেষ্ট। গৃহবধূকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যার পদ্ধতি অনেক পুরোনো। নারীকে জন্তু জানোয়ার কীটপতঙ্গের ন্যায় হত্যা করাই হল সামাজিক পদ্ধতি। কখনও পেট্রল ও দেশলাই কাঠি, কখনও রিভলবারের একটি গুলিই সেখানে যথেষ্ট। অতি সম্প্রতি জনৈক রাজনীতির কারবারি নেতা নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে হত্যা করে হোটেলের তন্দুর চুল্লিতে দাহ করে দেহটি নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। শেষ রক্ষা হয়নি বটে, কিন্তু সে যদি দাহ কাজটি সম্পন্ন করে ফেলতে পারত, ওই হত্যাকাণ্ডের কিনারা হত না। আর একটি ঘটনার কথা শোনা গেছে, স্ত্রী হত্যা করে সেই দেহ খণ্ড খণ্ড করে কুমীর দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে কোনো এক ক্ষমতাধারী রাজনৈতিক নেতা। বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগের কারণে নারীকে যেহেতু ব্যবহার করা হত নিপুণভাবে, নারীও আত্মহত্যার জন্য বিষ ব্যবহার করত। এখনও আত্মহত্যার জন্য বিষ কিংবা অ্যাসিড ব্যবহার করে থাকে স্ত্রীজাতি।

একটি কথা মনে হয়, বিষ প্রস্তুত এবং প্রয়োগে খুনির উদ্ভাবনী শক্তির যে পরিচয় পাওয়া যেত, তা ক্রমশই অন্তর্হিত। এই সব হত্যাকাণ্ডে অপরাধী এবং রহস্যভেদী যেন গোপনে পরস্পরে বুদ্ধির খেলায় রত হতেন। সেইরূপ এখন আর দেখা যায় না। পরবর্তীকালে খুনি, অপরাধী আত্মপ্রকাশ করেই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকে। সেক্ষেত্রে কোনো রহস্যই আর থামে না রহস্যভেদীর জন্য। তবে হ্যাঁ, অপরাধীর খুনের বিচিত্র সব উপায় উদ্ভাবন কিন্তু কখনওই থেকে থাকে না। এই বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল হিটলারের জার্মানিতে গ্যাস চেম্বারে লক্ষ লক্ষ নরনারী হত্যার ভেতর দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনেক অপরাধী ও অপরাধকে আলোয় এনেছে। অপরাধী অন্ধকারে গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজন আর বোধ করেনি তখন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তীকাল হল হননের নানারূপ পদ্ধতি উদ্ভাবনের সময়। গ্যাস চেম্বার, বিষ ইনজেকশন, অনাকাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমা দিয়ে জনপদের পর জনপদকে ধ্বংস করেও অপরাধীর মনোবিকলনের কোনো চিহ্নের খবর আমরা পাইনি। গণহত্যাকে রাষ্ট্র নায়কদের সাফল্যের চিহ্নস্বরূপ মানা হতে লাগল মহাযুদ্ধের পর থেকেই। গণহত্যার পক্ষে রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রশাসকরা যুক্তি সাজিয়ে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। সাতের দশকের প্রথম ভাগে এই পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতাভোগী রাজনীতিক এবং পুলিশ বাহিনী গণহত্যার যে অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তার রেশ এখনও কাটেনি। সেই সব হত্যাকারীর রক্তই এখনও পুলিশ বাহিনীর ভেতরে যত্রতত্র জেগে ওঠে। এই পৃথিবীতে হত্যাকারীর মৃত্যু অতি সহজে হয় না। হত্যাকারী আগে হত্যাকাণ্ডের পক্ষে যুক্তি সাজাতে ভয় পেত, এখন তারা অসংখ্য যুক্তি সাজিয়ে হত্যাকাণ্ডকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের চেহারা দিতে পারছে। নাৎসি জার্মান জাতি পরাস্ত জাতি, জনগোষ্ঠী, ইহুদিদের নির্মূল করার পক্ষে অনেক যুক্তি সাজিয়েছিল। হত্যার পক্ষে হত্যাকারীর যুক্তি সাজানোর আরম্ভ যেন সেই প্রথম। তারপর সেই ধারাই চলছে। পুলিশ বাহিনী কী চমৎকার না যুক্তি উত্থাপন করে। লকআপে পিটিয়ে মেরে, ধৃতের চক্ষুতে অ্যাসিড ঢেলে অন্ধ করে দিয়ে পুলিশ বাহিনী কিন্তু অন্ধকারে গা ঢাকা দেয় না।

বিষ প্রয়োগে হত্যার ভেতরে হিংস্রতার প্রকাশ হত কম। ধীরে ধীরে হতভাগ্যর প্রাণচাঞ্চল্য স্তিমিত হয়ে আসত। ঘুমিয়ে পড়ত সে। আমার মনে হয় মানুষ এখন হিংস্রতা চায়, এবং সেই কারণেই বিষের ব্যবহার কমে গেছে। বিষ প্রয়োগে যে হিংস্রতা ছিল না তা নয়, যে কোনো হত্যার ভেতরে লুকোনো হিংসা থাকেই। কিন্তু তা লুকোনোই মাত্র। ওই হত্যাকাণ্ড আর পাঁচজনকে অপরাধে প্রবৃত্ত হতে প্ররোচিত করতে পারত না। গ্যাস চেম্বার, হিরোসিমা, নাগাসাকি, ভিয়েতনামের গ্রাম — হিংস্রতাকে আলোয় এনেছে। হত্যাকারীর জান্তব উল্লাসে রহস্যভেদী অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে। বিষপ্রয়োগে হত্যাকারীর জান্তব উল্লাস প্রকাশ যথাযথ হওয়া সম্ভব নয়। বরং অস্ত্রের সাহায্যে রক্তপাত ঘটালে সেই রক্তদর্শনে আর একটি হত্যার ইচ্ছা তার ভেতরে জেগে উঠতে পারে। পুলিশকে ক্ষমতা প্রকাশ করতে একটি হত্যা করলে তো চলে না। হননের অভ্যাস বজায় রাখার কারণে পিটিয়ে মারাই তাদের কাছে প্রিয়তম পদ্ধতি।

অথচ বিষের কী শক্তিই না ছিল। বিষচর্চা অব্যাহত থাকলে আজ যাবতীয় হত্যাকারীর বিরুদ্ধে এত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারত না। আহা কী দিনই-না পার হয়ে গেছে! ধুতুরা, কলকে ফুল, লাল চিত্রা, আকন্দ, রক্তকরবী দিয়ে কী ভাবেই না নর হত্যা করা হত। প্রকৃতিদত্ত এই বিষভাণ্ড ত্যাগ করে হত্যাকারী তার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রটিই হারিয়েছে যেন। ফুল যেমন মন স্নিগ্ধ করে, ফুল তো জীবনহানিও করতে পারে। প্রকৃতিতে এগুলি আছে ব্যবহারের জন্যই। মানুষের মাথার ভেতরে কাঠগোলাপ, রক্তগোলাপ, জুঁই, চামেলি, বেলি, রজনীগন্ধা, কাঁটালি চাপা যেমন ফোটে, আকন্দ, ধুতুরাও তো ফোটে। কিন্তু সে কথা কে মনে রেখেছে? পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য ধনী রাষ্ট্রগুলি বারুদের গন্ধই পছন্দ করে বেশি। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা অস্ত্র উৎপাদন করে যাচ্ছে, আর তা ব্যবহারের জন্য যুদ্ধ বাধাচ্ছে। যুদ্ধ চলছে, গণহত্যার জন্য বিষ উপযুক্ত নয়, তাই অস্ত্রের এত রমরমা। এতে খুনির উদ্ভাবন শক্তির দৈন্যই প্রকাশ পাচ্ছে বেশি, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। মানুষ এখন অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল বেশি, ফলে বিষচর্চা, মৃত্যু চর্চার জটিলতা ক্রমশ অন্তর্হিত। সমাজে তার ছায়া। সিনেমা বায়োস্কোপে তার প্রয়োগ। হিংস্রতা কত প্রখর হতে পারে তা উদ্ভাবনেই ব্যস্ত যেন হত্যাকারী। আমার ভয় হয়, হিংস্রতা শিখর ছুঁয়ে গেলে হত্যাকারী তা নিজের উপরেই না প্রয়োগ করে বসে। কেননা হতভাগ্যের আর্তনাদ, হতভাগ্যের বেদনা কত তীব্র হতে পারে তা শ্রবণ, দর্শনের জন্যই তো হত্যাকারীর হিংস্রতা চর্চা। মৃত্যুচর্চা এখন হিংস্রতা চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হতভাগ্যের আর্তনাদ, কান্না যেন সংগীতের মতো হত্যাকারীর কানে বাজে। রহস্যভেদীর সামনে থেকে যাবতীয় রহস্য উধাও হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এই হিংস্রতা চর্চা নরহত্যা থেকে অন্যদিকেও সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। নরনারীর ভালোবাসার প্রকাশে এর ছায়া পড়ছে দেখে আমি স্তম্ভিত হচ্ছি। পুরুষ নারীর দিকে ধাবিত হচ্ছে হিংস্র ভালোবাসা নিয়ে। সমাজে এই ছায়া গোপনে বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। নারীও যেন পুরুষের কাছে হত হওয়ার জন্যই নিজেকে নিবেদনে আগ্রহী। নারীর শরীর খণ্ড খণ্ড করে ভক্ষণ করায় যেন পুরুষের আগ্রহ। মৃত্যুচর্চার গোপনীয়তা অন্তর্হিত হয়ে যাওয়ার কারণেই কি ভালোবাসার গোপনীয়তা, নারী, সৌন্দর্যের গোপনীয়তাও বিলীয়মান? আশ্চর্য! পণ্যের গুণাগুণ প্রচারেও হিংস্রতাই মূল মাধ্যম। কখনও তা প্রত্যক্ষে, কখনও তা পরোক্ষে। সাবান থেকে ওয়াশিং মেশিন, জীবনদায়ী টনিক থেকে শীতল পানীয় — সর্বত্রই এই প্রবণতা।

অনিলবরণ লিখতে লিখতে ওঠে, জল খায়। লিখতে লিখতে সে বিভ্রান্ত বোধ করে। সে যা লিখছে তা তার বিপক্ষে যাচ্ছে, কেননা মৃত্যু চর্চাই যদি পৃথিবীতে না থাকে, তাহলে সে লিখবে কী? তার রহস্যভেদী কোন রহস্য উদঘাটন করবে? তার উপন্যাসের হত্যাকারীই-বা কে? হত মানুষটিই-বা কে? সে ধরতে পারছে তার উপন্যাসের আসল জটটি কোথায়? হতভাগ্য নারী হলে, সে তো নিজেই হত হওয়ার জন্য হত্যাকারীকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন। আর হত্যাকারী তো হত্যার কথা হিংস্র কণ্ঠে দশদিককে জানিয়ে দিচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে, যেমন সাজায় পুলিশ, যুদ্ধবাজ দেশ, যেমন সাজিয়েছিল হিটলারের নাৎসি পার্টি, যেমন সাজিয়েছিল অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমার প্রয়োগকর্তা, ধনী রাষ্ট্রের প্রধান। এখন তাহলে রহস্যভেদীর কাজ রহস্য উদঘাটন নয়, হত্যাকারীর সঙ্গে যুক্তির লড়াই-এ বসা। অনিলবরণ কলম থামিয়ে নিঝুম হয়ে বসে থাকল।

রহস্যভেদী হত্যার বিপক্ষে হত্যাকারীর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। তর্কে। রহস্যভেদী কি অতিমানব হিটলারের মুখোমুখি বসবে, গ্যোয়েরিং, গোয়েবলস হিটলারের বিপক্ষে বসবে। সে কি রাষ্ট্রনায়কদের মুখোমুখি, সেনাবাহিনী, পুলিশের মুখোমুখি বসে হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে বলবে? কী বলবে? অনিলবরণের মনে হয় রহস্যভেদীর চেয়ে হত্যাকারীর হাতে যুক্তি অনেক বেশি — তা তো সে এতকাল শুনছে। কলম থামিয়ে মাথা নামিয়ে বসে আছে অনিলবরণ। রহস্যহীন হত্যাকাণ্ডের জালে পড়েছে সে। হিংস্রকণ্ঠে হত্যাকারী তাকে যুক্তির জালে ফেলেছে। অথচ সে নিজেই তো হত্যাকাণ্ডের পক্ষে থাকতে চায়, অন্তত তার উপন্যাসের অপরাধী তো থাকতেই চায়। অপরাধীকে সেইভাবেই তো সে নির্মাণ করতে চায়। অনিলবরণ আবার বিশেষ কথা ভাবতে চেষ্টা করল। আরম্ভ করতে চাইল প্রথম থেকে।

চোদ্দ

কলম নিয়ে চুপচাপ অনিলবরণের কলমটি ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় নিজের লেখাটি আগাগোড়া পাঠ করে। সে তো তার নিজের কথার বাইরে চলে গেছে। একটি খুনের কথাই তো ভাবতে হবে তাকে। গণহত্যা, রাষ্ট্রীয় হত্যা, হিংস্রতার সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না তার রহস্যভেদী। তার অপরাধীও অতদূর পৌঁছতে পারবে না।

অনিলবরণ প্রথম থেকে আরম্ভ করে — একটি খুন হবে। তার রহস্যও ভেদ করা হবে। খুন হবে কেননা মানুষের মনে হননের ইচ্ছা মাঝে মধ্যেই জেগে ওঠে। কত সামান্য কারণেই না মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তার প্রতিবেশী, সহবাসীকে হত্যা করার কথা ভাবে। হত্যা না করুক, কত জনের মৃত্যুকামনা করছে গোপনে। একাকী মানুষ দুই কামনার ভেতরেই দিন অতিবাহিত করে। যৌনতা এবং মৃত্যু। বিবাহের পূর্বে আমার প্রেমিকা কঙ্কনা আমার কল্পনায় যে কতরকম ভাবে এসেছে। ভালোবাসা, যৌনতা, অথচ এখন! আচমকা আমার মনে হয়, আমার স্ত্রী কঙ্কনা যদি মরে যায় তো আমি বেঁচে যাই। যেদিন কঙ্কনা দুই মেয়ে নিয়ে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে ট্যাক্সিতে চেপে বাপের বাড়ি বালিগঞ্জ প্লেসের উদ্দেশ্যে রওনা হল, আমি ভাবছিলাম ফোন বাজবে। ফোনে খবর হবে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বাইপাসে, এক মহিলা মারা গেছেন, বাচ্চা দুটি আঁচড়বিহীন। বাচ্চা দুটি অক্ষত।

এইরকম একটি ঘটনার কথা কয়েকদিন আগেই পড়েছিল অনিলবরণ। হ্যাঁ, ফোন বাজল। ফোন বাজতে সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। নিশ্চয়ই সেই খবর এসেছে। ফোনের রিসিভার কানে ধরতে ওপার থেকে কঙ্কনার কন্ঠস্বর ভেসে এল। বাড়ি পৌঁছেছে সে। বাড়ি পৌঁছনোর শব্দে কী নিশ্চিন্তই না হয়েছিল সে। অথচ কয়েক মুহূর্ত আগে মৃত্যু ভাবনায় বিভোর হয়ে গিয়েছিল।

মাসখানেকের উপর হয়ে গেছে কঙ্কনা এই ফ্ল্যাটে নেই। অনিলবরণ একটু আগে ফোন করেছিল, ধরেছিল শ্বাশুড়ি। তুমি নিজে এসে নিয়ে যাও, হ্যাঁ, তুমি কি পাগল, দু-বারের পর তৃতীয়বার মা হয় কেউ? সিজার বেবি দুটোই, থার্ড টাইম সিজার করতে গেলে আমার মেয়ে বাঁচবে না, তুমি কি তাকে খুন করতে চাও?

চায়ই তো অনিলবরণ! তার তো মনেই হয় তা। সবসময় নয়, কোনো কোনো সময়। কঙ্কনারও যে তা মনে হয় না, একথা মনে করার কারণ নেই। মানুষ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কতজনকে মনে মনে হত্যা করছে। সে তো সামান্য রহস্য ঔপন্যাসের লেখক। এ পৃথিবীর ইতিহাসই তো চরম হত্যাকাণ্ড নির্ভর। প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হেরে গেলে তার মৃত্যু ঘটায় মানুষ মনে মনে।

অনিলবরণ এই অবধি লিখে থামল। ধীরে ধীরে ফোনের দিকে ঝুঁকল। রিসিভার তুলে পটাপট ডায়াল করতে থাকে, আমি অনিলবরণ বলছি, ঘোষচৌধুরী, চ্যাটার্জি আছে?

ওপারে হাসি, রহস্য ঔপন্যাসিক? সুদামার মনের মেঘ কেটে গেছে, ওই লোকের যে অত বুদ্ধি হবে না তার ওর লেখা পড়লে ধরা যায়।

অনিলবরণ বিস্মিত হয়, সুদামা চ্যাটার্জি তার সঙ্গে যে এইভাবে কথা বলতে পারে, তা তার ভাবনার অতীত। মহিলা তো দাম্ভিক। তবে তার তো ভালোই লাগে। ওকে। ইদানীং লাগছে। কী চমৎকার একটি সূত্র দিয়েছে তাকে। ওই সূত্রটিকে নিয়ে খেলা করা দরকার মনে মনে। ওই সূত্র থেকে এটি পরিষ্কার হয় যে সুদামা চ্যাটার্জিও গোপনে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সাজায়। সাজাতে পারে।

সুদামা বলল, ও নেই, দেরি হবে ফিরতে, বেলগাছিয়া গেছে।

ফোন ধরে কয়েক দণ্ড নিশ্চুপ অনিলবরণ। তাহলে সে কার সঙ্গে কথা বলবে? সুদামা কি তার কথায় কথা যোগ করতে পারবে? এপার থেকে সুদামা জিজ্ঞেস করে, কী দরকার?

অনিলবরণ বলল, দরকার আছে, আচ্ছা ডেথ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

সুদামা হাসতে আরম্ভ করে, কোনো ধারণাই নেই। দেখেছি লোকে মরে যায়।

অনিলবরণের মাথার ভেতরে নতুন একটা সূত্র যেন জেগে উঠতে থাকে। সে বিড়বিড় করে, ডেথ সম্পর্কে জানা গেলে, মানুষের সব সমস্যা মিটে যায়।

সুদামা আবার হাসে, কোনে সমস্যাই মেটে না, আপনি কী জানেন ডেথ নিয়ে?

অনিলবরণ বলে, মৃত্যুটা খুব জরুরি মনে হয় আপনার?

সুদামা বলে, জানি না, এ সব কথার কোনো অর্থ হয় না। আপনার কি কোনো কাজ নেই, মৃত্যু হত্যা এসব নিয়ে ভাবেন সর্বক্ষণ।

অনিলবরণ বলে, মৃত্যু না থাকলে এসব নিয়ে ভাবতেই হত না। আপনি কি বাড়ি আছেন এখন, বেরোচ্ছেন না তো?

সুদামা কপট ভয়ে বলে ওঠে, ও বাবা আপনি এসে আমাকে মৃত্যু বোঝাবেন নাকি, মৃত্যুর কথা ভাবতেই পারি না আমি।

অনিলবরণ বলে, আমি একটু বাদে আপনাকে আবার ফোন করছি, একটা পয়েন্ট মনে পড়ছে, দেখুন মার্ডার এবং মার্ডারারের চরিত্রই বদলে গেছে এখন, যেভাবে বদলে যাচ্ছে প্রেম এবং প্রেমিকের। আমার মনে হয় প্রেম এবং মৃত্যু, একে অপরের উপর নির্ভরশীল, প্রেম নিঃশেষ হলে মৃত্যু অশেষ হয়ে এগোতে পারে, আবার মৃত্যু দুর্বল হলে ভালোবাসা গভীর হয়। — রাখছি, একটু বাদে আমি আপনাকে আবার ধরছি সুদামা, আমাকে এখন হত্যাকারীর সঙ্গে বসতে হবে, মুখোমুখি বসতে হবে, এখন হত্যাকারীই নিজেকে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী বলে ঘোষণা করে হত্যার সপক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে —

আশ্চর্য লাগে সুদামার, তার কৌতূহল বাড়ে, সে জিজ্ঞেস করে, কীরকম?

এই ধরুন না, নানান দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা খুন হয়ে যাচ্ছে, তার দায় নিয়ে হত্যাকারীরা ঘোষণা করছে দেশের জন্য, ঈশ্বরের জন্য এই হত্যাকাণ্ড, এই দেখুন না ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ঘুমন্ত শহরের মানুষকে শেষ করে দিচ্ছে শক্তিমান রাষ্ট্র। টেলিভিশনে সেই ধ্বংস লীলার লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, লোকে দেখছে, শুনছে আক্রমণের পক্ষে কী চমৎকার যুক্তি সাজাচ্ছে হত্যাকারী — তার সঙ্গে আমাকে বসতে হবে, এখন রহস্য উপন্যাস বলুন, হত্যাকাণ্ডের কিনারায় উদ্যোগী রহস্যভেদীর কাহিনি বলুন, তার প্রকৃতিই বদলে যাচ্ছে তা লক্ষ করেছেন? রাখছি।

টেলিফোন রেখে দেয় অনিলবরণ। আবার কলম নিয়ে বসে কাগজের সামনে। মাথা নীচু করে নিঝুম হয়ে বসে থাকে। মৃত্যু! ধ্বংস! হত্যা! প্রেম! ধীরে ধীরে মাথা তোলে অনিলবরণ।

অনিলবরণ লেখে, মৃত্যুর রূপটি কেমন? আমাদের পুরাণে লিখছে মৃত্যু হলেন নারী — পিঙ্গল বর্ণা, রক্তনয়না, রক্তাননা স্বর্ণকুণ্ডল ধারিণী। ব্রহ্মা তাঁকে প্রাণী সংহারের কারণে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বার থেকে জন্ম দিয়েছিলেন। মৃত্যু হলেন ব্রহ্মার ক্রোধাগ্নিজাত। কী আশ্চর্য! মৃত্যুর সৃষ্টি হয় ভয়ার্ত পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য। এখন পৃথিবীকে ভয়ার্ত করে তোলার জন্যই মৃত্যুকে ব্যবহার করা হয়। পুরাণকথিত এই নারী ব্রহ্মার কথামতো সংহার কর্ম করতে ভীত হয়েছিলেন। তিনি নারী, নারীর হৃদয় কোমল, তিনি কী করে এই ভয়ংকর কাজ করবেন। সুস্থ প্রাণীকে বধ করবেন কী করে? শেষ অবধি তো মৃত্যু রাজি হন ব্যাধির সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে। যম ও ব্যধি সংহার কর্মের সূত্র হিসেবে থেকে গেলেন। লোভ, ক্রোধ, অসূয়া, দ্রোহ, মোহ, অলজ্জা ইত্যাদি দোষে দেহ বিদ্ধ হলে মৃত্যু সংহার কর্মে প্রবৃত্ত হবেন বলে ব্রহ্মাকে বললেন।

পুরাণ কথিত সেই মৃত্যুদেবীরই মৃত্যু ঘটেছে বোধহয় আধুনিক পৃথিবীতে। অথবা মৃত্যুকে সংহার কর্মে কোনো ক্রমে রাজি করিয়ে স্রষ্টা ব্রহ্মা এ জগতে এক চরম আঁধারের সূচনা করে দিয়েছিলেন। জন্মের পর সৃষ্টি কর্তার কাছে সংহারকর্মের কথা শুনে, কোমলপ্রাণ সেই নারী বেদনায় যে অশ্রুপাত করেছিল, সেই অশ্রুবিন্দুই হল ব্যাধি। আজ পৃথিবীময় ব্যাধির প্রতাপ। মানুষ কখনও স্ব-ইচ্ছায় গোপনে, কখনও অজান্তে ব্যাধির জন্ম দিয়ে চলেছে নিরন্তর। ভীষণ সব অসুখ মানব সভ্যতার শত্রু হয়ে জন্মাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। সভ্যতা উজাড় হয়ে যেতে পারে আগামী এক শতাব্দী ভেতরে। এইভাবে তো হয়েছেও। চতুর্দশ শতকের প্রথম ভাগে চীন দেশে যে মৃত্যুর সূচনা হয় প্লেগ — ব্ল্যাক ডেথ দিয়ে, উটের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে মরুভূমি গিরিপথ ধরে সেই অসুখ তুরস্কে যায়। তুরস্ক থেকে একপথে যায় অস্ট্রিয়ায়, একপথে বাগদাদ থেকে মিশর, সার্দিনিয়া হয়ে সাইপ্রাস, ইতালির ভেনিস শহরে। তেরো বছরের মধ্যে চীন থেকে এই মহামারী চলে এল সিসিলি, স্পেন, ফ্রান্সে, ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে, ইংল্যান্ড থেকে জার্মানি, জার্মানি থেকে রাশিয়ায়। চতুর্দশ শতাব্দীর ঠিক মধ্যভাগে, ১৩৪৭ থেকে ১৩৫০, এই তিন বছরে ভয়াবহ ব্ল্যাক ডেথ শেষ করে দিয়েছিল ইউরোপকে। প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষকে খেয়ে ফেলে এই দৈত্য। ইংল্যান্ডে মৃতের কবর দেওয়ার মতো জায়গাই অকুলান হয়ে পড়েছিল, মৃতদেহ তখন টেমস নদীতে ফেলে দেওয়া হতে থাকে। কী ভয়ংকর ছিল সেই মৃত্যুর উল্লাস। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণে ইওরোপের সামাজিক গঠনই বদলে যায় সেই সময়। অসংখ্যা প্রভুর মৃত্যুতে দাসরা হয়ে যায় মুক্ত, জমি হয়ে যায় মালিকানাবিহীন। শ্রমিকের অভাবে কারখানা অচল, ফলে শ্রমের মজুরি বেড়ে যায় দ্বিগুণ। অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে যায়। চার্চের প্রভু, যাজকদের মৃত্যুর জন্য খ্রিস্টধর্মের ভিতই প্রায় আলগা হয়ে যায়। সর্বশক্তিমান চার্চের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়ে।

অনিলবরণ লেখে, এত মৃত্যুর পক্ষে প্রকৃতির কি কোনো যুক্তি থাকে? থাকে না, ছিল না। কিন্তু ছিল হিরোসিমা নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা প্রয়োগের পক্ষে। মানুষ এখন নিজেই মৃত্যুদেবীর ভূমিকা নিয়েছে। বিজ্ঞান ব্যাধিকে যত নির্মূল করার পথে এগিয়েছে, মানুষ তত ব্যাধির জন্ম দিয়ে অন্য পথে সংহারকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আমার আশ্চর্য লাগে, বিজ্ঞান যত মানুষকে ব্যাধি থেকে রক্ষা করেছে, মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষকে বোধহয় যাতনা দিয়ে মেরেছে। এসবের পক্ষে হত্যাকারীর কী যুক্তি থাকতে পারে? প্রকৃতি যখন ব্যাধি দিয়ে সংহার কর্মে প্রবৃত্ত হয়, প্রভু, দাস বিচার করে না, আধুনিক পৃথিবীতে হত্যাকারী কিন্তু বিচার পদ্ধতি প্রয়োগ করে। এই পৃথিবীতে মৃত্যু দেবতা অনেক হিসেবি। মৃত্যুকে অন্য চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করছে মানুষ অবিরত। ফলে মৃত্যু তার মহিমা হারিয়ে ফেলেছে, হত্যাকাণ্ডের নিবিড় কল্পনা উধাও হয়ে গেছে, এর জন্য বিষকে ফিরিয়ে এনে পুরাকালের মৃত্যুচর্চায় মগ্ন হতে হবে হত্যাকারীকে।

অনিলবরণ উঠে পড়ে, ডায়াল করে, হ্যাঁ আমি অনিলবরণ বলছি।

আবার! কী হল আপনার মার্ডারের? ওপাশে সুদামা আসছে অনিলবরণের ডাক পেয়ে।

আচ্ছা আমার একটা ব্যাপার মনে পড়ছে, মৃত্যু, হত্যার অন্য চেহারা দিচ্ছে এখন হত্যাকারী। আমার মার্ডারার, যেন বলতে চায় যে এ মৃত্যু আসলে মৃত্যুই নয়, এটা একটা দায়িত্ব পালন করা হল মাত্র …

বুঝতে পারছি না। সুদামা বলে।

আচ্ছা আপনার কখনও কাউকে খুন করতে ইচ্ছে হয়, হয়েছে?

সুদামা হাসতে আরম্ভ করে, হয়নি আবার, কত হয়েছে।

অনিলবরণ বলে, কী রকম হয় বলতে পারেন?

সুদামা আবার হাসছে, মনে হয় বিষ দিয়ে — ইঁদুর মেরেছেন বিষ দিয়ে?

অনিলবরণ চমকায়। আশ্চর্য! তার কথার প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পাচ্ছে সে। ওপার থেকে সুদামা জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ এইসব জিজ্ঞাসার মানে?

অনিলবরণ বলে, আমি একটা বিষয়ে লেখার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, আমার মনে হয় মৃত্যু ছিল প্রাকৃতিক একটি ঘটনা, তা এখন হয়ে গেছে মানুষের হাতে বন্দী কোনো অভুক্ত পশু, এক সময় একটি দুটি মৃত্যু ঘটিয়ে মানুষ অদ্ভুত সব কল্পনার পরিচয় দিয়েছিল। বিষ ছিল সেই কল্পনা প্রয়োগের উপাদান। মার্ডার হয়ে উঠেছিল বিস্ময়কর ঘটনা। এখন তা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর। হত্যাকারী ঘুরছে, রহস্যভেদী লুকিয়ে পড়ছে, বিজ্ঞান যত মানুষকে সুখ দিয়েছে …

সুদামা বলল, আপনি এইসব ভাবেন? সবসময় খুনের পরিকল্পনা করেন, ভাবেন?

হ্যাঁ ভাবি, আমার মনে হয় এক হত্যাকাণ্ড একসময় শিল্প হয়ে ওঠে, বিশ্বাস করেন?

কী জানি, আমার তো ভাবতেই ভয় করে।

ভয় তো আমারও করে, কিন্তু ভয়ই তো আনন্দের বিপরীত অভিব্যক্তি, আমরা জানিও না যে গোপনে কেউ কেউ আমাদের হত্যা করার জন্য ভাবে।

ওপারে সুদামা চুপ। অনিলবরণ ডাকে, হ্যালো, এটাকে সিরিয়াসলি নিতেও পারেন, না নিতেও পারেন। কত লোক আশি-নব্বই বছর পর্যন্ত বাঁচে, তাদের খুনিরা তাদের আগেই মরে যায়, এই রকমই হয় বেশিরভাগ। ধরুন আমাকেও অনেকে খুন করার কথা ভেবেছে, মৃত্যু-কামনা করেছে আমার, পেরে ওঠেনি। তাই বলে আমার পিছনে যে একজন দুজন খুনি নেই, একথা আমি বিশ্বাস করি কী করে?

সুদামা বলল, থামুন দেখি, আপনার বউ কোথায়? কঙ্কনা?

বালিগঞ্জ প্লেসে, ছেড়ে চলে গেছে, এখনও ফেরেনি।

বাচ্চারা?

মায়ের সঙ্গে গেছে।

কেন গেছে তা জানেন?

অনিলবরণ বলল, জানি। জানি এটাও, আমার বউ মনে মনে আমার মৃত্যু-কামনা করে, আমাকে খুন করতে চায়।

আপনি কি পাগল! সুদামা চিৎকার করে ওঠে।

তা কেন, পাগল হব কেন। বলছি আমাদের মনের ভেতরে কতরকম খেলা, আমিও আচমকা ভেবে বসি কঙ্কনা মরে যাক, আমি তাকে খুন করি, হয়ে ওঠে না, পারি না।

কিন্তু কেন, ও কী করল?

কিছুই না, আমার মনে হয় শুধু।

এইরকম মনে হতে হতে যদি কোনোদিন সত্যি ঘটে যায় তা। সুদামা চিৎকার করে, আপনি প্রেমের উপন্যাস লিখুন।

আমি তো মৃত্যুর চর্চা করি, আপনি ব্ল্যাক ডেথের কথা শুনেছেন, ফোরটিনথ সেঞ্চুরিতে —

সুদামা বলে, শুনতে চাই না, আচ্ছা আপনি এত খারাপ কথা ভাবেন কেন সবসময়?

সবাই ভাবে।

না, ভাবে না।

হ্যাঁ ভাবে, হাসে অনিলবরণ, আপনিও ভাবেন, শুনুন আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, অদ্ভুত একটা পরিকল্পনা নিয়েছেন বলে, ওই রকমভাবে খুনের কথা, বুঝতে পারছেন তো গ্যাসের কথা বলছি। আপনি কী করে ভাবলেন, তাই মনে হচ্ছে আপনিও বোধহয় খুনের কথা ভাবতে পারেন। মানে ভাবেন, পরিকল্পনা করেন।

সুদামা কী বলবে বুঝতে পারে না, লোকটা কি চতুর, হিংস্র, না পাগল! সে চুপ করে থাকে। অনিলবরণ ডাকে, শুনেছেন, আপনি যা বলেছেন, তা হল একেবারে আধুনিক পরিকল্পনা। কিন্তু আমার হয়েছে মুশকিল, একটা করিডোর দেখি অফিসে, লম্বা, এপার থেকে ওপার প্রায় দেখা যায় না, মনে হয় ওখানেও একটা খুন হতে পারে, আবার ভাবছি বিষের কথা। মধ্যযুগে কী চমৎকার বিষ তৈরি হত। নানারকম বিষয় মিশে যাচ্ছে, আলাদা করে উঠতে পারছি না। একটা কোনো বিষয়ে স্টিক করে থাকতে পারি না। বিষ থেকে ব্ল্যাক ডেথ, অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমা, লকআপে হত্যাকাণ্ড, নানান দিকে মন ঘুরে যায়, গোলমাল হয়ে যায় সব।

সুদামা বলল, যে কোনো মানুষ দেখলে খুন করতে ইচ্ছে হয় আপনার?

অনিলবরণ বলে, ওইটাতে হয়েছে মুশকিল। ভিকটিম খুঁজে বের করাও একটা প্রব্লেম। ধরুন, খুনের তো একটা কারণ থাকবে। সেই কারণটা আবিষ্কার করাও সহজ নয়। আমার মাথায় ভিকটিমের আদল আছে ছায়া ছায়া, কিন্তু তার মুখখানিকে ট্রেস করতে পারছি না। তবে করে ফেলব ঠিক, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, মুখের সঙ্গে মুখ মিশে যায়। আচ্ছা আপনার এমন মনে হয়?

সুদামা বলল, আপনি তো ভেবেই বসে আছেন আমি বসে বসে মানুষ খুন করার কথা ভাবি — রাবিশ! আপনি ভালো গান শুনুন, সমুদ্রের ধারে গিয়ে বেড়িয়ে আসুন। হাওয়া খান ভালো করে।

তখন অনিলবরণ বলে, সি-বিচটাকে আমার মনে হয় খুনের পক্ষে উত্তম জায়গা ঠিক দুপুর বেলা, বালি পুড়ছে, নোনা বাতাস, লোকজন বিশেষ নেই, একটা লাশ ভেসে এল জলে, হাঙরে মাছে খাওয়া … কী দারুণ দৃশ্য রচনা হবে বলুন!

সুদামা ঝপ করে টেলিফোন রেখে দেয়। অনিলবরণ তখনও বিড়বিড় করছে, পোড়া আকাশ, পোড়া বালি, ভাটায় জল সরে গেছে অনেক দূর, ভেসে এল একটি তরুণী যুবতির লাশ, আবিষ্কার করল এক জেলে, মস্ত কালো শরীর। চারদিকে শুধু লবণ লবণ ভাব …। অনিলবরণ টের পায় ওপাশে কোনো শব্দ নেই।

ফোন রেখে আবার তোলে অনিলবরণ। পটাপট ডায়াল করতে থাকে। সুদামা পুরোটা শুনুক। এভাবে ফোন রেখে দিল কেন? ওপারে রিং হচ্ছে। হ্যাঁ তুলল কেউ …। আমি অনিলবরণ।

হঠাৎ মনে পড়ল, দ্যাখো বাবলির কদিন ধরে জ্বর, বাবা বাবা করছে। রহস্য ঔপন্যাসিক তুমি কি তোমার মেয়েকে দেখে যাবে?

অবাক হয় অনিলবরণ, সে না ডায়াল করল সুদামাকে। ফোন গিয়ে বাজল বালিগঞ্জ প্লেসে। এ তো কঙ্কনার গলা। আশ্চর্য! এ কী করে হয়? অনিলবরণের মাথায় একটি সূত্র খেলা করতে থাকে। চাঁদের গায়ে …। বাবলির জ্বর। কিন্তু তুমি কী করে ফোনটা ধরলে কঙ্কনা, আমি তো অন্য নম্বর ডায়াল করেছিলাম।

ওপারে হাসি, অনেক পাগলামি হয়েছে, যা বললাম তা শুনলে তো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *