এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ – ১৫

পনেরো

দুপুরে ঘুম না এলেও ঘুমোতে হয়। এই দীর্ঘ প্রসারিত গ্রীষ্ম দুপুর সে কাটায় কী করে? দুপুরে ঘড়ির কাঁটাও যেন সরে না। সরলেই-বা কী, সুদামার হাতে অফুরন্ত সময়, সেই সময় যে ফুরোয়ই না। তাই ঘুমে ডুবতে হয়। ঘুমের ভিতরে পার করে দিতে হয় দুপুরের কিছুটা অংশ। মাধুরী, অনিন্দিতা, দুই ফ্ল্যাটের দুই বউ এসে ফিরে গেছে অনেকবার, এখন তারা আর আসে না। নিজেরাই টিভি চালিয়ে গল্প করে, তারপর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়, বাস থেকে বাচ্চা নামলে, সেই বাচ্চাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সুদামার এইসব নেই। নেই বলে বেঁচে গেছে সে। বলে অনিন্দিতা-মাধুরী। কী সুখেই আছে সুদামা। ছেলেকে পড়াতে হয় না, তার খাতা দেখতে হয় না, রেজাল্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয় না। আগে ছেলেকে বড়ো চিঠি লিখত। চিঠিতে আলো বাতাসের বর্ণনা থাকত। ঋতুচক্রের ছায়া থাকত। রোদ হলে রোদ, ছায়া হলে ছায়া, মেঘ, বৃষ্টি, আলো, শীত-বসন্ত — এখন, এই সময়ে তো তাও লিখতে হয় না। কী সামান্য কথাই না লিখেছে সে। কৃষ্ণেন্দু চিঠিটা হারিয়ে ফেলেছে। সুদামা আন্দাজে আন্দাজে পনেরো লাইন — কত কাজই না কমে গেছে। ছেলেকে বড়ো চিঠিও লিখতে হচ্ছে না। তার জ্বর হলেও জানতে পারে না। কী আরাম! সে দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠলেও ঘুম ভেঙে মাকে উঠতে হয় না।

কী আরামেই না আছে সুদামা, বলে তার কলেজের বান্ধবী বিনতা। কোনো ঝামেলাই নেই, স্বামী অত বড়ো চাকরি করে। শীতের সময় কয়েকদিন তার বাড়ি একা একা চলে গিয়েছিল সুদামা দুপুরবেলা। বিনতার অনেক ঝামেলা, বেকার দেওর, বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি। ছেলে ক্লাস সিক্স। তাকে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা। ছেলেটা প্রায়ই ভোগে। ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয় মাঝেমধ্যে। সেই ছেলে আবার দুরন্তও খুব। এত সবের ভেতরেই রান্নাবান্না, ঘরের কাজ। সময়ই পায় না। দুপুর সকাল বলে তার আর কিছু নেই। বিয়ের পর চাকরির চেষ্টা করেছিল। পায়নি। স্বামীর সামান্য মাইনের চাকরি, ফলে বিনতাকে সবদিক সামাল দিতে হয়। টিউশানিও করে এর মধ্যে। না কাজের লোক নেই। কী করে পারে বিনতা? বিনতা বলে হয়ে যায়। কোথা থেকে কী হয়ে যায় তা সে খেয়ালও করতে পারে না। সুদামার সুখ কি সে পাবে? দুপুরে ঘুমোনোর উপায়ও নেই তার। হ্যাঁ, তবে ফাঁক বের করে ঘণ্টাখানেক গড়িয়ে নেয়।

সুদামা, তোর স্বামী, মানে তোর বর, মানে তোর প্রেমিক, তোকে কী ভালোই না বাসে। কী দেয়নি বল দেখি? বলে সুদামার বন্ধু অর্চনা। সে একটা প্রাইভেট ফার্মের কেরানি। নড়তেই পারে না। তার কাছে গিয়ে যে গল্প করবে সুদামা, সে উপায়ও কি আছে।

উপায় একমাত্র ঘুমের কাছে সমর্পিত হওয়া। ঘুমের ভেতরেই সে শুনতে পাচ্ছিল টেলিফোন বাজছে। এখন এই রোদে বিনতা হয়তো বেরিয়েছে বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে। মাধুরী-অনিন্দিতা আড়ামোড়া ভাঙছে গলির মুখে দাঁড়িয়ে। স্কুলবাস এসে নামিয়ে দেবে তাদের বাচ্চাদের। অর্চনা সেই মাড়োয়ারি ফার্মে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। অর্চনা বলেছিল, মাইনে খুব একটা ভালো দেয় না, খাটিয়ে নেয়। কাজে ভুল হলে এমনভাব করে যেন সে তার বাড়ির বাসন মাজার ঝি।

সুদামা অলস হাতে টেলিফোনটা তুলল, কার ফোন? বলছি।

দিন দশেক না, না প্রায় পক্ষকাল পেরিয়ে ফোন এল দূর রাজারামপুর থেকে। আজ ভোরে ওদিকে প্রোজেক্ট সাইট ভিজিটে গেছে এল পি জি সংস্থার কর্তাব্যক্তির সঙ্গে সরকারি কর্তারা, কৃষ্ণেন্দু গেছে, সুহাস গেছে। সে তো ভোরের ব্যাপার, এখন তো তিনটে।

ওপার থেকে কথা উড়ে এল, সুহাস বলছি, আপনি কি ঘুমিয়ে আছেন?

মনে হচ্ছে তো তাই।

ম্যাডাম, আমি রাজারামপুর থেকে বলছি।

মেঘের খবর পেলেন? ঘুমের ভেতরে যেন কথা বলে সুদামা।

পেয়েছি।

কে দিল?

পাখিরা, সমুদ্র থেকে আসছিল একদল পাখি…

সুদামা নিঝুম হতে থাকে। কী আশ্চর্য! সে কার সঙ্গে কী কথা বলছে? এইসব কথার অর্থ কী? এইসব কথা কেন বলা? কী এমন জরুরি! আটত্রিশ পার হওয়া কোনো মহিলার সঙ্গে তিরিশ-একত্রিশের এভাবে কথা হয়? রেখে দেবে নাকি টেলিফোন?

ওপার থেকে সুহাস বলল, কী হল?

সুদামা বলল, সমুদ্রের পাখির সঙ্গে দেখা হল কোথায়?

সুহাস বলল, টেলিফোনে। একজন আকাশে, অন্যজন …। থেকে গেল সুহাস।

সুদামার মনে হল পা যেন একটু টলল। আর একজন কোথায় ছিল? সুদামার গলায় বাতাস জড়িয়ে যায়। সে যে জিজ্ঞেস করবে আর একজন ছিল কোথায়, তা ভুলেই গেল। কথা বলতে পারে না। তার সমস্ত শরীর ভারি হয়ে উঠছে। চোখ বুজে গেল তার। ওপারও নিঝুম। ওপারের নিশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। যেন সৌর ঝড়। মহাব্রহ্মাণ্ড তোলপাড়। অচেনা কোনো গ্যালাক্সির ভেতরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে নক্ষত্র দল।

বলুক সে কথা, সুদামা শুনে যাবে।

কী হল, হ্যালো ম্যাডাম?

ম্যাডামের কন্ঠস্বর এবার বাজল, আমার নাম নেই নাকি!

আছে, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঘুমিয়ে পড়ছি।

হা হা করে হাসছে ওপারে কোনো এক ভিন গ্রহের মানুষ হয়তো-বা। আবার ভিন গ্রহের মানুষ! কোথায় কৃষ্ণেন্দু? কৃষ্ণেন্দু মনে আছে, সেই কতকাল আগে এক ভিন গ্রহের মানুষ ধরা দিয়েছিল সামনে। কথা ফুরিয়ে গিয়েছিল আমার। কথা ফুরোনো মানে অনেক অনেক কথা বলা। নৈঃশব্দ্য কথা বলে বেশি। বিড়লা তারামণ্ডলের সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দুজন। সারা শহর থেমেছিল তখন। এখন যেন মহাবিশ্ব থেমে আছে, মহাবিশ্ব পার হয়ে আরও অসীমে কোথায় ঝড় উঠছে। আমি কে? আমি কী করে টের পাচ্ছি সেই ঝড়ের শব্দ? বিপ বিপ বিপ — কে যেন কিছু বলতে চাইছে আকাশের ওপার থেকে।

ঘেমে যাচ্ছে সুদামা। হাত ঘেমে যাচ্ছে তার। কে যেন শক্ত মুঠিতে চেপে ধরেছে তার করপুট। কী তপ্ত হাত! টেলিফোনের রিসিভার আরও জোরে চেপে ধরে সুদামা। ওপার থেকে আবার ডাক এল, সুদামা কী হল আপনার?

সুদামা বলল, কোথা থেকে ফোন করছেন?

আমরা রাজারামপুর ছাড়িয়ে বেরিয়েছি সবে, স্যার সামনের গাড়িতে প্রজেক্টের মহাজনদের নিয়ে, আমি গাড়ি থামিয়েছি একটা জায়গায়, হঠাৎ মনে হল ফোন করি, পাবলিক বুথ।

জায়গাটা কেমন?

চমৎকার, কাছেই একটা-দুটো গ্রাম আছে, মাইলটাক ভেতরে, যেখানে সবাই বাজি তৈরি করে।

বাজির গ্রাম?

হ্যাঁ, কতরকম বাজি, ফুলঝুরি, তুবড়ি, রংমশাল, চরকি, হাউই, ছেলে-বুড়ো সবাই বাজি তৈরি করে, সব আলোর বাজি।

কেন বোমা তৈরি করে না, দোদোমা, পটকা, চকলেট বোম?

না, এখানে যে হাউই তৈরি হয়, তা মাদ্রাজের আকাশেও উড়ে যায়, মহারাষ্ট্রের আকাশও আলো করে দেয়, উত্তরপ্রদেশের গ্রামে পরপর উড়ে যায়।

তারপর?

তারপর অন্ধকারে আচমকা বিস্ফোরিত হয়ে একটা ছায়াপথ তৈরি করে দেয়, তাতে কত তারা, সব ভেসে থাকে অনেকটা সময় ধরে।

কী চমৎকার বলছ তুমি, তারপর কী হয়?

তারপর আবার একটা হাউই উঠে আছে উপরে, একটা ফুরোতে না ফুরোতে আর একটা, গ্রামের সবচেয়ে বড়ো মহাজনের ছেলের বিয়ে, বাজিতে আকাশ আলো।

বাহ, বাহ! তারপর?

কথা চলতে থাকে। চলতেই থাকে। হাউই-এর বিবরণ থেকে ভুঁই চরকির কথা। ভুঁই চরকি থেকে ফুলঝুরি। ফুলঝুরিরই-বা কী সুন্দর বর্ণনা। ফুলঝুরি থেকে তুবড়ির আলোয় নাচতে থাকে ছেলেবুড়ো সবাই। সুদামা, বললে কি বিশ্বাস হবে, সেই আলোয় মানুষগুলোও যেন আলোর ফুলকি।

বাহ! কী সুন্দর বলছ তুমি!

আমি কী বলব, বাজির গ্রামে যেমন বাজি তৈরি হয় তেমন কথাই তো বলছি, বাজিই এত সুন্দর যে কথা বলতে হয় না, আপনা-আপনি হয়ে যায়, ওরা চিরকাল আলোর বাজিই তৈরি করত, এখন ‘সাউন্ড’ করতে আরম্ভ করেছে।

সাউন্ড।

সে ভীষণ শব্দ! শব্দে কানে তালা লেগে যায়, পাখিরা উড়ে যায় ভয় পেয়ে, বাতাস পালায়, মেঘও, বুড়ো মানুষ কেঁদে ফেলে। কী শব্দ! গুম গুম গুম — যেন মেঘে মেঘে লড়াই হচ্ছে, সাউন্ড কি আপনি পছন্দ করেন সুদামা?

সুদামা বলল, খুব দূরের শব্দ!

কত দূরের?

বহু দূরের।

বহুদূর, কতদূর?

সুদামা চাপা গলায় বলল, অনেক অনেক আকাশ পার হয়ে দূর কোনো গ্যালাক্সির বিপ বিপ — তুমি টের পাও তো?

ওপারে কন্ঠস্বর থেমে আছে। সুদামা চোখ বুঝে ঘন শ্বাস নেয়। গাঢ় নিশ্বাসে ভেসে যায় টেলিফোনের কথা বলার মুখটি। টেলিফোন থেকে কানে যেন ভাপ এসে লাগে। গরম বাতাস। থরথর করে কাঁপে সুদামা। তার যে এ কী হল। কার সঙ্গে কথা বলছে সে? এ কি কোনো মানুষের কন্ঠস্বর!

মনে পড়ে যাচ্ছে বিয়ের পর পর, সেই আলোহীন বাতাসহীন ঘরে কৃষ্ণেন্দু ঘুমোলেও সে জেগে থাকত কত রাত। কান পাতত কৃষ্ণেন্দুর বুকের উপর। কী আশ্চর্য এক শব্দ! কতদূর থেকে উঠে আসছে তা। কখনও মনে হত শব্দটি যেন আসছে পাতালের অতল থেকে। সে যেন মাটিতে কান পেতে আছে। আবার মনে হত সেই শব্দ যেন আসছে অনন্ত জাগরণে জেগে থাকা কোনো এক নক্ষত্রের ভেতর থেকে। তখন এক নারী তার পুরুষকে নিয়ে বহু রাত পর্যন্ত রচনা করত অখণ্ড এক নক্ষত্রের সমগ্রতা। এখন তো কৃষ্ণেন্দু নিজের জগৎ আলাদা করে নিয়েছে। এখন সেই নক্ষত্র থেকে তারা ছিটকে বেরিয়ে দুটো গ্রহপিণ্ডের মতো দুদিকে, মহাবিশ্বে ঘুরছে আর ঘুরছে।

ওপার থেকে আবার কথা এল, আপনি কি অনেক রাত পর্যন্ত জাগেন?

না, ঘুমিয়ে পড়ি।

আপনার ঘুম ভেঙে যায় আচমকা?

যায়।

এমনি এমনি!

না, মনে হয় যেন কেউ ডাকল?

কেউ কি ডাকে?

চুপচাপ হয়ে যায় সুদামা। ডাকে হয়তো কৃষ্ণেন্দু। দু-হাত দূরের কৃষ্ণেন্দু ডাক দেয় পনেরো-ষোলো বছর পিছন থেকে। নাকি অন্য কেউ! দু-হাত দূরে ঘুমিয়ে থাকা পুরুষ তো পনেরো-ষোলো বছর আগে ছিল না। এ তো অন্যজন। এ জীবনে বারবার, নানা সময়ে নানাজনের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হয় যেন। নানারকম মুখ, নানারকম চোখ, নানারকম মন …

সুদামা জিজ্ঞেস করে, তোমার ঘুম ভাঙে?

ভাঙে।

এমনি এমনি?

জানি না।

কেউ কি ডাকে?

জানলার বাইরে অন্ধকার, অনেক দূরে আকাশ, পামট্রির সারের ফাঁকে চাঁদ, তারা। অন্ধকার দেখলেই মনে হয় ডাকে যেন — থাক, এখন, শুনুন, আজ আমাদের ভিজিট ছিল সাইটে, ঠিক আমাদের নয়, যে কোম্পানি মানে ওই যে এলপিজি বটলিং কোম্পানিকে জমি দিচ্ছি আমরা, তাদের টপ বস এসেছিল বোম্বে থেকে। ওদের নানান প্রজেক্ট নামছে নানা জায়গায়। এখন ফাইনাল চেকিং সেরে নিচ্ছে, ফরেন কনসার্ন তো, অনেক ভেবেচিন্তে চয়েস করে। তো আজই একটা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল।

কী সমস্যা জিজ্ঞেস করছেন সুদামা, বলছি, খুব বড়ো সমস্যা তৈরি হওয়ার আগেই সবটা ট্যাকল করা গেছে। আজ নারীবাহিনী, রাজারামপুরের জমিহারা মানুষেরা একজোট হয়ে আমাদের পাঁচটা গাড়ি ঘিরে ধরেছিল। খুব তপ্ত জনতা। জানেন তো জনতা মানেই জনরোষ! রোদে মানুষের মাথার সব কলকব্জা বিগড়ে যাচ্ছে, পিটিয়ে মারছে, শুনতে পাচ্ছেন তো, কাগজে দেখছেন তো সুদামা, ঠিক সেই রকম সব, আগে মেয়েরা ঝাঁটা-খুনতি হাতে, কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে …।

বলতে লাগল সুহাস। যা বলবে তাই-ই ভালো লাগবে এখন। সে যেন শিশুর কন্ঠস্বর শুনছে। দেড় দু-বছরের বাচ্চা। সে যেন …। সুদামার বুক কাঁপে। একত্রিশ বছরের পুরুষের কন্ঠে শিশুর ভাব থাকে না। জোর করে ভাবলেও ভাবা যায় না শেষ পর্যন্ত। ও তো পুরুষই। প্রখর যুবক। টেলিফোন বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নিল সুদামা। ভিজে গেছে হাত। শাড়িতে মুছতে লাগল সুদামা। হ্যাঁ, কী হল বল তারপর?

অর্থহীন আর কয়েকটা কথার মতো এটিও। এইভাবেই অর্থহীন আলাপকে অর্থময় করে তোলার সুখটি কতকাল বাদে ফিরে আসছে যে!

ষোলো

কৃষ্ণেন্দুর ফিরতে একটু দেরি হল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দারুণ বুদ্ধিমান, আজ সুহাস না থাকলে যে কী হত! ফোন করেছিল সুহাস?

সুদামার মনে হল সে সতর্ক হয়। তার মন যেন তাই-ই চাইছে। বুক দুরুদুরু হতে আরম্ভ করেছে সেই প্রথম বয়সের মতো। সে কৃষ্ণেন্দুর কথায় জবাব দেয় না। কৃষ্ণেন্দু তার জবাবের অপেক্ষা না করে বলছে, সে সারাদিনে এই প্রথম বসতে পারল, বিশ্রাম পেল, দিনটা যে কী গেছে!

কৃষ্ণেন্দু বলতে থাকে, সুদামা শোনে। শোনে সামান্য, বাকিটা তার কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। সে বিরক্ত হচ্ছিল। সে শুনল, কৃষ্ণেন্দু বলেছিল সুহাস যেন ফোন করে, তার একটু দেরি হবে।

দেরি তো হয়ই, রাজারামপুর গেছ, তাতে ফোনের কী আছে? সুদামা যেন মেজাজ হারাচ্ছে।

ফোন করেনি? কৃষ্ণেন্দু আশ্চর্য হয়।

করেছিল, আমি রেখে দিয়েছি। সুদামা সত্য বলল না, রাজারামপুরে কী হয়েছে তা শুনে আমি কী করব?

কৃষ্ণেন্দু খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। বোঝে, কোনো কারণে সুদামা অসন্তুষ্ট। সে আর কথা বাড়ায় না। জামা-কাপড় ছেড়ে স্নানে যায়। স্নান করে কাচা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে নিজে হাতে চা করে আনে। সুদামা রাগলে কৃষ্ণেন্দু নিজের কথা থামিয়ে এভাবেই রাগ ভাঙায়। বুদ্ধিমান পুরুষ। সুদামা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ও ফোন করে কী বলত, ফোন করতে বলেছিলে কেন?

বাচ্চা ছেলে, ম্যাডাম ম্যাডাম করে তাই! কৃষ্ণেন্দু বোধহয় একটু তোতলায়, গ্রামের ছেলে তো, ওরা মাসি-পিসি-বউদিদের সঙ্গে মিশতে পারে ভালো। বউদি পাতাতে পারে ভালো। নিজেই তো বলল ফোন করবে, করেনি?

বললাম তো। সুদামা বিড়বিড় করে, আমার ভালো লাগছিল না, খুব ঘুম পাচ্ছিল দুপুরে, কী শুনব ভ্যাজোর ভ্যাজোর। তুমি নীলের চিঠিটা খুঁজে পেলে।

তুমি তো উত্তর দিয়েছ। বলল কৃষ্ণেন্দু।

কিন্তু চিঠিটা?

কৃষ্ণেন্দু শোনে না। বলে, সুহাস আজ মান রাখল, যে ভাবে সব ট্যাকল করেছে, আমাদের ছটা গাড়ি গিয়েছিল, এলপিজি-র লোকজন সমেত সকলকে ঘেরাও করে ফেলেছিল গাঁয়ের মানুষ। আগে নারীবাহিনী, কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে সব স্লোগান দিচ্ছে।

সুদামা চুপ করে থাকে। এসব কথা একটাও বলেনি সুহাস। কী দারুণ কাজই না করেছে সে। তার বিবরণ দিচ্ছে কৃষ্ণেন্দু, দিতে দিতে থামল। আশ্চর্য ও কিছু বলেনি! নিজের কথা বলতে বোধহয় লজ্জা পেয়েছিল। শুনতে শুনতে সুদামার বুক থরথর করে। কাঁপে বোধহয় সে ভেতরে ভেতরে।

কৃষ্ণেন্দু বলে, গাঁয়ের মানুষ খবরও রাখে বটে। তারা তো আচমকা ঘেরাও প্রোগ্রাম ঠিক করেছিল এল পি জি-র কর্তাদের আসার খবর পেয়ে। গত পরশু ঠিক হল, আজ যাওয়া হল ভিজিটে। পঞ্চায়েত কর্তারা কেউ ছিল না ধারে কাছে। তারা থাকলে তো সামাল দিতে পারত ক্ষুব্ধ জনতাকে। জনতা ঘিরে ধরে ক্ষতিপূরণ দাবি করল। খেতমজুরদের জন্য প্রজেক্টে কাজ দাবি করল। জমি হারানো পরিবার পিছু একটি করে চাকরি চাইল, পুনর্বাসনের নীতি জানতে চাইল যদিও এখানে পুনর্বাসনের কোনো সমস্যা নেই। কোনো ভিটে বাস্তু অধিগ্রহণ হয়নি। জমি তো শুধু জমির মালিককে অন্ন দেয় না। জমি মানে বহু মানুষের সম্পৃক্ততা। তিনশো বিঘে কত লোককে না কাজ দিত। সবাইকে খুশি করতে হবে। তখন সুহাসই সাহস করে এগোল। কৃষ্ণেন্দু বুঝে উঠতে পারেনি কীভাবে ট্যাকল করবে এত সকলকে। তার কাছে কাগজপত্রও রেডি ছিল না। ভিনদেশি মহাজনরা অবাক হয়ে তখন জিজ্ঞেস করতে আরম্ভ করেছে, অ্যাফেকটেড পিপল-এর জন্য কী কী প্যাকেজ ভেবে রেখেছে গভর্নমেন্ট। কী ব্যবস্থা ভেবেছে কৃষ্ণেন্দু। তাদের তো জানতে চাওয়ার অধিকার আছে, কেননা কাজ আরম্ভ হলে, লোকাল পিপল ঝামেলা আরম্ভ করলে, সামাল দিতে হবে তো তাদের। তখন তো সরকার দেখবে না। তারা জমির টাকা দিচ্ছে গভর্নমেন্টের দাবি মতো, কিন্তু পরিবর্তে গভর্নমেন্ট কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি-পরিবারের জন্য তাও তো জানতে হবে দেখতে হবে। কৃষ্ণেন্দু বোঝাতে আরম্ভ করেছিল। তখন সুহাস গাড়ি থেকে নেমে জনতার মুখোমুখি হয়।

কিন্তু ছেলের চিঠিটা তুমি হারালে কী করে? সুদামা প্রসঙ্গ বদলে দিতে চায়। তার বুকের ভেতরে মেঘ ডাকছে। ভয় করছে। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। ঠিকমতো কৃষ্ণেন্দু তার কথা শুনতেই পায় না।

কৃষ্ণেন্দু বলে, সুহাস তো চাষির ছেলে, ওর মতো জমির চরিত্র কে জানবে? বাস্তব সমস্যা কে চিনবে? তাই সুহাসই জনতার মুখোমুখি হয়ে তাদের বোঝাতে লাগল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে বর্গাদার, খেতমজুর, মার্জিনাল পেজান্ট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছে সুহাস জমিহারা মানুষদের সঙ্গে। ফলে তারা বুঝেছে সব। শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে ফিরে গেছে।

কৃষ্ণেন্দু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, ও বোধহয় ছাত্রজীবনে রাজনীতিও করত, ফলে বক্তব্য রাখতে পারে ভালো। রেখেছেও চমৎকার। এল পি জি প্রজেক্ট রূপায়িত হলে কী কী সুবিধে হবে স্থানীয় মানুষের তা জানিয়েছে নিজের কল্পনাকে ব্যবহার করে সত্য মিথ্যা বলে। নানারকম স্বপ্নের কথা বলেছে, উন্নয়নের কথা বলেছে, গ্রামের মানুষের জন্য কতটা ভাবা হয়েছে তা বাড়িয়ে বলেছে। গ্রামের মানুষ খুশি। এল. পি. জি. কর্তারাও খুশি। শেষ পর্যন্ত তারা বলেছে, হ্যাঁ বড়ো প্রজেক্টে এইরকম হয়ে থাকে, ব্যাপারটাকে ভালোভাবে সামাল দেওয়া দরকার। সুহাস বোস সম্পর্কে খোঁজও নিল। সুহাস তাদেরও বুঝিয়েছে, এই রকম ঘটনা দু-একটা হবে। কেননা যে চাষির জমি চলে যায় সে কি জমির মায়া সহজে ত্যাগ করতে পারে? জমি তো চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে। জমি চলে যাওয়া মানে তাদের নানান অভ্যাসও চলে যাওয়া। কালচারাল চেঞ্জ তো হবেই …।

সুদামার মুখ আলো হয়ে ওঠে কৃষ্ণেন্দুর কাছে সুহাসের প্রশংসা শুনতে শুনতে। সে উঠে গিয়ে টেলিফোনটা এক হাতে তুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছে। তারপর সাবধানে রেখে দিয়ে সোফায় ফিরে এসে একটু গাঢ় স্বরে কৃষ্ণেন্দুকে বলে, হয়েছে, এবার কদিন রেস্ট নাও দেখি। চলো, নীলের কাছে যাই।

মাথা নাড়ে কৃষ্ণেন্দু, সুদামার হাতটি নিয়ে খেলা করে। বলে, গেলে ওর পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। আর আমার রেস্ট কী করে হবে? সেই পুজোর আগে তো নয়ই।

বাহরে, তোমার শরীর দেখেছ! সুদামা তার হাত ছাড়িয়ে নেয় কৃষ্ণেন্দুর মুঠি থেকে, ঠাণ্ডা হাত, স্নান করে এসেছে তাই হয়তো। শক্ত হাত। বয়স হলে পুরুষ মানুষের হাত এই রকম ভাবেই শিহরণহীন হয়ে ওঠে নাকি। সুদামা চমকে ওঠে। কী ভাবছে সে! আবার হাত বাড়িয়ে দেয় কৃষ্ণেন্দুর দিকে। কৃষ্ণেন্দুর হাত ছুঁয়ে বুকে হাত দেয় সে। বাঁদিকে। কোথায় হৃদয়ের শব্দ। বিপ বিপ বিপ! সুদামার যে কী হল, সে কৃষ্ণেন্দুর কাছে সরে আসে, কান রাখে ওর বুকে। কৃষ্ণেন্দুর হাত তার মাথার খোপা ভাঙে, ভাঙতে থাকে। চুলের ভেতরে হাত ডোবায় কৃষ্ণেন্দু। সুদামা টের পায় ধক-ধক করছে কৃষ্ণেন্দুর হৃদপিণ্ড। কিন্তু সেই যে অতি পুরাতন শব্দ, যা তার সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হয়ে যেত গভীর রাতে, তা কই! আছে কি? সুদামা জোরে চেপে ধরে তার কান। তারপর আচমকা সরে যায়।

কী হল? কৃষ্ণেন্দুর মুখে কেমন বিপন্নতা, উদ্বেগ।

তুমি কি টেনশনে আছ? জিজ্ঞেস করে সুদামা।

না না, টেনশন কিসের, টেনশন যা হয়েছিল কেটে গেছে।

সুদামা উঠল। শ্লথ পায়ে অন্ধকার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় একা একা। কৃষ্ণেন্দু রিমোট কন্ট্রোলে টিভি অন করে। টেলিভিশনের নারী নাচতে নাচতে পণ্য বিজ্ঞাপিত করতে থাকে। টেলিভিশনের নারী নিজেকে দেখায় পণ্যের গুণাগুণ দেখাতে গিয়ে। কৃষ্ণেন্দুর চোখ টেলিভিশনে।

সুদামা অন্ধকার আকাশে তাকায়। হালকা মেঘ এসেছে কলকাতার আকাশে। সেই মেঘ ময়লা করে দিয়েছে ঝকঝকে আকাশকে। গ্রহ তারা ঢেকে গেছে ধূসরতায়। সুদামা ঘাড় উঁচু করে আকাশ দ্যাখে। কিছুই দেখা যায় না, শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। অন্ধকার ভূমিতল থেকে উঠে গেছে অসীমে। একটি তারাও নেই আকাশে। কোথায় সেই গ্যালাক্সি, যার কোনো এক জীবিত নক্ষত্র তার সঙ্গে রতে কথা বলত। ধ্বনিময় হয়ে উঠত রাতের নৈঃশব্দ। শুধু কি কৃষ্ণেন্দুর বুকের শব্দ! যখন নীল এল পেটে, মনে পড়ে যায় সুদামার। গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে যেত ভরন্ত শরীরের। বিপ বিপ বিপ —অদ্ভূত এক শব্দতরঙ্গ। তা কি নীলের বুকের শব্দ, নাকি সেই ভ্রূণ গ্রহণ করছিল গ্রহান্তরের ধ্বনিময়তা। মানুষের হৃদয়ের শব্দ কি গ্রহান্তর থেকে আহরণ করা! প্রেমের ধ্বনিময়তাও কি তাই! এই তখন যে শব্দ শুনে এল সুদামা, তার ভিতরে আছে উদ্বেগ, চিন্তা প্রেমহীনতা, হ্যাঁ যেন তাইই। সে ঘুমন্ত কৃষ্ণেন্দুর বুকে কান রাখলেও, তার প্রিয় পুরুষ সেই ঘুমের ভিতরেও টের পেত তা। ভালোবাসা আবেগে বুকের শব্দ বদলে যেত ধীরে ধীরে। বুকের শব্দের সঙ্গে অসীম গ্রহান্তরের ধ্বনিময়তা একাকার। অচেনা এক সংকেতে শিহরিত হত সুদামা। সন্তানের প্রাণের শব্দ আর প্রেমের শব্দ কি এক? কোথায় গেল সেই নক্ষত্র, সেই ছায়াপথ? সব তারা কি নিভে গেল এই কবছরেই। অথচ গ্রহ তারার আয়ু তো কোটি কোটি বছর। পরিমাপহীন সময়। ভালোবাসার আয়ুও তো তাই! মনে হত তো তাই। ভালোবাসার এক একটি মুহূর্ত তো এক এক কোটি বছরের সমান সময়।

সুদামার চোখে জল এল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। অশ্রুপতনের শব্দ শুনতে পায় সে। ভেতরের ঘরে টেলিভিশনে প্রায় নির্মোক নৃত্য। সুদামা ঝুঁকে থাকে নীচের দিকে। তখন টেলিফোন বাজল। টেলিফোন বাজতে থাকল কর্কশ স্বরে। খুব খারাপ লাগে সুদামার। মনে হয় থেমে যাক টেলিফোন। তাকে কি কান্নার সময়টুকুও দেবে না?

কৃষ্ণেন্দু ডাকে, ফোনটা ধরো।

সুদামা অচল। সুদামা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কৃষ্ণেন্দু ডাকে, সুহাস হয়তো ফোন করেছে। সুদামা দাঁতে দাঁত চেপে আরও কঠিন। সে যেন শিলীভূত হয়ে যেতে চায়।

হাজার বছর ধরে যেভাবে মাটি জমে জমে পাথর হয়, তেমনই পাথর হয়ে যাক সে। সময় তার নতুন পরিমাপ খুঁজে নিক। এক একটি মুহূর্ত হয়ে যাক হাজার বছর।

বিরক্ত কৃষ্ণেন্দু নিজে উঠে টেলিফোন ধরল টিভি বন্ধ করে। সুদামা কান পেতে থাকে। বাঁচল সে। না সুহাস বোস নয়, ফোনটা আর একজনের। অনিলবরণ ঘোষের। অনিলবরণ বোধহয় জানতে চাইছে, কী হয়েছিল সাইটে।

সুদামা আঁচলে চোখ মুছে ঘরে ঢোকে নিশ্চিন্ত হয়ে। কৃষ্ণেন্দু হাসছে অনিলবরণের কথায়। অনিলবরণ নিশ্চয়ই কোনো খারাপ কথা বলেছে। কী বলতে পারে? সুদামা আন্দাজ করার চেষ্টায় থাকে। গুলি চালালে ঠিক হয়ে যেত। দু-চারটে লাশ না পড়লে পাবলিক ঠাণ্ডা হয় না।

ফোন রেখে কৃষ্ণেন্দু বলে, পাগল!

কেন কী হল?

বলছে জমি পজেশন নেওয়ার সময় দু-চারটে তুলে পেটালে আজ এসব করতে সাহস পেত না। আচ্ছা ও কি এসব সত্যি বলে?

আমি কী করে জানব?

আমাকে বলছে মানুষ খুন করার একশো পঁচানব্বই রকম উপায় বের করেছে ও, কী একটা লিখছে।

সুদামা টিভি চালায়। চালানোর অর্থ হল কৃষ্ণেন্দুর কথা না শোনা। পর পর চ্যানেল চেঞ্জ করতে থাকে রিমোট কন্ট্রোলে। গান, নাটকের ডায়লগ, খবরের অংশ, বিজ্ঞাপনের শীৎকার, ফুটবলের চিৎকার, রেসিং কার-এর উত্তেজনা সব পর পর পার হয়ে যেতে থাকে। তার ভিতরেই কৃষ্ণেন্দু বলে যাচ্ছে অনিলবরণের কথা। টেলিভিশনের শব্দ আর কৃষ্ণেন্দুর কন্ঠস্বর একে অপরকে অতিক্রম করতে চেষ্টা করে যায় অবিরাম। তাতে ধ্বনির তীব্রতা বাড়ে। বাড়তে থাকে। ঘর গমগম করতে থাকে। আচমকা কৃষ্ণেন্দু তার কথা থামিয়ে দেয়, কী হয়েছে তোমার, শুনছো সুদামা? টিভিটা বন্ধ করো। চিৎকার করে ওঠে কৃষ্ণেন্দু।

সুদামা টিভি বন্ধ করে। ঘর আবার নৈঃশব্দ্যে ঢাকে, কিন্তু কানে যেন একটু আগের উত্তেজক শব্দগুলি তাদের রেশ নিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে। সুদামা দু-হাতে কান চাপে। কৃষ্ণেন্দু বলে, কী হয়েছে বলো দেখি, অত জোরে টিভি চালায়?

সুদামা জবাব দেয় না। কৃষ্ণেন্দু ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে থাকে। চলে যায় ব্যালকনিতে। সুদামা কী করবে ভেবে পায় না। উঠে স্টিরিওতে ক্যাসেট চাপায়। দ্যাখেও না কী ক্যাসেট। ভল্যুম লো করে দেয়। কী আশ্চর্য! নিখিল ব্যানার্জি বেজে ওঠেন। সুদামা দু-চোখ বন্ধ করে বসে থাকে মেঝের কার্পেটে। সেতারে মেঘমল্লার বিলম্বিত লয়ে বেজে উঠেছে ঘরে ও বাইরে। কৃষ্ণেন্দু চুপচাপ।

কৃষ্ণেন্দু সুদামার গা স্পর্শ করে ডাকতে গিয়েও সরে যায়। একটু দূর থেকে অনুচ্চ স্বরে ডাকল, তুমি ঘুমোলে, ঘুমোলে নাকি?

বলতে বলতে কৃষ্ণেন্দু আরও এগিয়ে আসে। সুদামা বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ল। খোপাভাঙা মাথার চুল পাখার হাওয়ায় সামান্য উড়ছে। চুল ছড়িয়ে অছে কাঁধের দু-পাশে। গায়ের আঁচল ঈষৎ লিত। মুখখানিতে ক্লান্তি। সারাদিন ঘরে বসে সুদামার চোখ-মুখে এত ক্লান্তি! চোখের কোলে কালিও পড়েছে যেন। কৃষ্ণেন্দু একটু নিচু হয়ে হাত বাড়ায়। ব্লাউজের সীমারেখা যেখানে শেষ হয়েছে কাঁধ ও গ্রীবার সেই সংযোগস্থলে একটি শিরা দপদপ করছে যেন। কৃষ্ণেন্দু হাত আরও এগিয়ে দেয়। ছুঁয়ে, একটু নাড়িয়ে আচমকা ভয় পাইয়ে সুদামার আধো ঘুম ভাঙিয়ে দেবে? নাকি অন্যভাবে। খুব আলতো করে কপালের উপর একটি চুম্বন, কিংবা ঠোঁটে চুম্বন! চুম্বনের টানে জাগিয়ে দেবে সুদামাকে। শুকনো ঠোঁট দুটি দ্যাখে কৃষ্ণেন্দু। এইভাবে কতদিন আগে শেষ চুম্বন দিয়েছিল। সুদামাকে। মনে পড়ে না। ইদানীং কখনও এমন হয়েছে কি? মনে পড়ে না। কৃষ্ণেন্দু আরও এগিয়ে সুদামার খুব কাছে পৌঁছে গিয়ে অপেক্ষা করে। ঠোঁট দুটিতে আঙুল ছোঁয়াতে গিয়েও থমকে যায়। কী আশ্চর্য! সে যেতে চাইছে, তার পা সরছে না, শরীর ভাঙছে না। শরীর টানছে না। তাকে তো নীচু হতে হবে চুম্বনের জন্য। তাকে তো হাঁটু মুড়ে বসতে হবে ঠোঁট, গাল, চোখের পাতা, স্তন স্পর্শ করার জন্য। নীচু হতে পারে না কৃষ্ণেন্দু। সরে যায়। পিছিয়ে গিয়ে ডাকে সুদামাকে আবার।

সুদামা আচমকা চোখ খোলে। সে তো জেগেই ছিল প্রায়। সে টের পাচ্ছিল, এগিয়ে আসছে কৃষ্ণেন্দু। চুরি করে ভালোবাসা দিতে অগ্রসর হয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। ঘরে এখনও নিখিল ব্যানার্জির হাতের কারুকার্য ভেসে আছে, বাতাস মথিত করছে। সুদামা স্পষ্ট টের পেয়েছে, পিছিয়ে গেছে মানুষটা। সাড়া পায়নি তাই। সে উঠল। স্টিরিও বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। আবার চোখে জল এল। মেঘের আস্তরণ কিছুটা পরিষ্কার হওয়ায় আকাশে এখন দু-একটি তারার চোখ। সুদামা নিঝুম হয়ে চোখের জল ঝরে যেতে দেয়। জানা হয়ে গেল নাকি সব! কে জানে? কৃষ্ণেন্দু তো এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। সুদামা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। কেউই কোনো কথা বলে না।

সতেরো

আকাশে মেঘ এল অবশেষে। গতকাল ঘুমের ভেতরে মেঘ এসেছিল, আজ সকাল থেকে আকাশ ঘোর হয়ে আছে। বৃষ্টি কখনও টিপ টিপ, কখনও একটু জোরে। আবার অনেক সময় ধরে আকাশ গুম হয়ে থাকছে। দেখে মনে হয় ফেটে চৌচির হয়ে যাবে আচমকা। দুপুরে সুহাস ফোন করেছিল। গতকাল করেছিল সুদামা নিজে। এখন টেলিফোন প্রায়ই আসছে।

কৃষ্ণেন্দু ইদানীং উদ্বিগ্ন বেশ, চিন্তাক্লিষ্ট। সুদামা কিছুই জিজ্ঞেস করেনি তাকে। সেই যে দিন-কুড়ি আগে রাজারামপুর ভিজিট করে এল, তারপর দিন সাত-আট তো নিশ্চিন্তে ছিল কৃষ্ণেন্দু। এখন কী হল? কী হল তা ও-ই জানে। সুদামার কোনো কৌতূহল নেই। কথা হয় সামান্য। রাতে কৃষ্ণেন্দুর টিভির সামনে বসে থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে। উপগ্রহ যে ছবি ধরে। তার সময়কাল তো প্রসারিত হয়ে হয়ে মধ্য রাতে পৌঁছে গেছে। কৃষ্ণেন্দু জাগে প্রায় শেষ অনুষ্ঠানের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত। পর পর সিগারেট ধ্বংস করে।

একদিন সুদামা ডেকেছে তাকে, কী দেখছ আজে-বাজে ছবি। শুয়ে পড়ো।

কৃষ্ণেন্দু জবাব দেয়নি। সুদামা তখন ঘুরে শুয়েছে। কৃষ্ণেন্দু টিভির শব্দ বন্ধ করে শুধু ছবি দেখতে আরম্ভ করেছে গত কয়েকদিন। সুদামা ঘুমিয়ে থাকে তখন।

বৃষ্টি আবার নেমেছে টিপটিপ। কৃষ্ণেন্দু ফিরেছে একটু আগে। চা খেয়ে অফিসের ফাইল নিয়ে বসেছে টেবিলে। সুদামা ঘুরতে ঘুরতে তার সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, তুমি বাজির গ্রাম চেন?

ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত মুখে তাকায় কৃষ্ণেন্দু, মাথা নাড়ে।

বাহ! এটাও জানো না, তোমাদের রাজারামপুরের কাছে।

সুহাস বলেছে? কৃষ্ণেন্দু ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করে।

সুদামা জবাব দেয় না। বলে, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে থাকলে এসব জানতে হয় না?

মাথা নাড়ে কৃষ্ণেন্দু, বলে, মেশিনারি আছে, দরকার পড়লে সার্ভে রিপোর্ট পর্যন্ত পেয়ে যাবে, যদি চাও কালই রিপোর্ট পেতে পার।

সুদামা ঘুরতে ঘুরতে আবার এল, চিনেম্যানতলা চেন? চিনেমন্দির আছে যেখানে।

ট্যাংরায় হবে বোধহয়? কৃষ্ণেন্দু দায়সারা জবাব দেয়।

জান না তুমি, মন্দিরটা তো বজবজের গঙ্গার কাছে।

কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, সুহাস বলেছে?

সুদামা ঘুরছে ঘরের ভেতরে, দূর থেকে বলল, হ্যাঁ ও-ই বলছে।

এই সব কথা বলে?

বলে, ফাল্গুনে মেলা হয় সেখানে। সুদামা বলল।

কৃষ্ণেন্দু শোনে না। সুদামা টেলিফোনের কাছে দাঁড়ায়। আঁচল দিয়ে যন্ত্রটিকে ধূলিমুক্ত করতে করতে বলে, সবে তো আষাঢ় এল, অনেকদিন ওয়েট করতে হবে ওই মেলার জন্য, হ্যাঁ তোমাদের ওই প্রজেক্ট সাইটে আর কোনো গোলমাল হয়নি তো?

কৃষ্ণেন্দু ফাইল রেখে ঘুরে বসে। সিগারেট ধরায়। কী যেন ভাবতে থাকে। কী যেন বলতে গিয়েও বলে না। ধোঁয়ায় ঘর ভরতি হয়ে যায়। ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকায় ঘরের ভেতরে। কৃষ্ণেন্দু অনেক সময় নিয়ে, সিগারেটে ছোটো ছোটো টান দিয়ে ধোঁয়া উগরে দিতে দিতে আচমকা বলে ফেলে, সুহাস খুব চতুর, ওকে দেখলে ধরা যায় না ও আসলে কী রকম!

ভয় পায় সুদামা। তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। এতদিনে কি টের পেল কৃষ্ণেন্দু? তার পৌরুষ আহত হল এই প্রথম! অসম বয়স বলে সন্দেহ করেনি, এখন কি সে সন্দেহের বিষে জ্বলছে? সুদামা কঠিন হতে থাকে। সে প্রতিরোধ করবে। হ্যাঁ, তাই, তাই। সম্পর্কটা স্বীকার করে নেবে। এই চোদ্দ বছরে যা যা হারিয়েছে সে, সব তো কুড়িয়ে এনে দিচ্ছে একত্রিশ বছরের ওই যুবক। সে না নিয়ে পারে কী করে?

তুমি বোঝো না, ও খুব ধূর্ত? জিজ্ঞেস করে কৃষ্ণেন্দু।

সুদামা শক্ত হয়। পায়ের উপর ভরসা না করতে পেরে বসে পড়েছে সোফায়। কী বলতে চাইছে কৃষ্ণেন্দু তা আন্দাজ করতে পারছে না সে। সে কি দুজনের সম্পর্কের কথা বলবে? কৃষ্ণেন্দুর মুখ দ্যাখে সে।

কৃষ্ণেন্দু আবার বলে, ও যে ধূর্ত তা তুমি বোঝো না?

কেন? রুখে দাঁড়ায় যেন সুদামা, ও তো তোমার ডান হাত, এই তো সেদিন ও তোমার মান বাঁচাল, নিন্দে করছ হঠাৎ?

কৃষ্ণেন্দু চেয়ার ছেড়ে ওঠে। পায়চারি করতে থাকে। জানালার কাছে যায়। গ্রিলজাল দু-হাতে চেপে ধরে। ঝাঁকুনি দেয় নিজেকে। তারপর বলে, অনিলবরণই ধরিয়ে দিল।

কী ধরিয়ে দিল? সুদামার বুক ধকধক করে।

সেদিনের ব্যাপারটা, আমি একদম ধরতেই পারিনি, মাথায় আসেনি, একটু খচ খচ করছিল সত্যি, ঠিক মেলাতে পারছিলাম না সব, অনিলবরণ আজ দুপুরে বলল আমাকে, এই বুদ্ধি নিয়ে চাকরি করো চ্যাটার্জি।

সুদামা ঠিক বুঝতে পারে না কোন দিনের ব্যাপার। তার মাথায় কিছু ঢোকে না। তবে সে বোঝে কোনো কারণে কৃষ্ণেন্দু চটেছে সুহাসের উপর। কেন? এমন হতে পারে, কৃষ্ণেন্দু ধরতে পেরেছে সুহাস বোস নামের তার অধঃস্তন অফিসার তার আটত্রিশ পার হওয়া স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করছে। প্রেমে পড়েছে সুদামা। তাই ঈর্ষায় ভুগছে কৃষ্ণেন্দু। ঈর্ষা সরাসরি প্রকাশ করতে সাহস হচ্ছে না তার স্বামীর। মনে মনে অসম্মানিতও হচ্ছে নিশ্চয় কৃষ্ণেন্দু। সেই অসম্মানের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে সুহাসের সম্পর্কে খারাপ কথা বলছে অন্য প্রসঙ্গে। অনিলবরণ কী বলেছে, তাদের সম্পর্কের কথা। সম্পর্ক তো টেলিফোনে। হ্যাঁ, এবার একদিন আবার আসবে বলেছে সুহাস। কবে তা কেউ জানে না। চমকে দেবে সুহাস। আবার বলছে বস না বললে বসের স্ত্রীর কাছে যায় কী করে? হা হা করে হাসতে থাকে তখন সুহাস বোস। অনিলবরণ জানল কী করে? সুহাস কি নবীন প্রেমিকের মতো অনিলবরণের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, করে হালকা হয়েছে। সুদামা কপালে হাত দিল। কপালের ভার হাতে রাখল।

কৃষ্ণেন্দু বলে, আসলে আমার বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করছিল না ঠিক ঠিক, আমার সন্দেহ সেদিনের ঝামেলাটা প্রি-প্ল্যানড, আমরা যে ভিজিটে যাব তা তো কয়েকজনই জানত, শুধুমাত্র টপমোস্ট লেভেলে, আমরা কয়েকজন মাত্র, গাঁয়ের মানুষ কী করে দলবদ্ধ হয়ে হামলা করল, খবর পায় কী করে, পঞ্চায়েত পর্যন্ত জানত না।

কী করে আবার? কথা খুঁজে পায় না সুদামা।

আশ্চর্য! সুহাস যেন তৈরিই হয়েছিল ঝামেলা সামলাবে বলে। কৃষ্ণেন্দু বলতে থাকে, ঝামেলা সামলে বাইরের লোকের কাছে, অর্থাৎ এল.পি.জি-র কর্তা-ব্যক্তিদের কাছে কী চমৎকার নিজেকে প্রজেক্ট করল সুহাস বোস।

কৃষ্ণেন্দু বোঝাতে থাকে সুদামাকে, বলে, সুহাসই আগাম খবর পাঠিয়ে ওই প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করেছিল, সবাইকে চালিত করেছিল। কৃষ্ণেন্দুর ধারণা সুহাস সেদিনকার ব্যাপারে গ্রামের লোকদের কাছ থেকে ভালোই সাহায্য পেয়েছে, গ্রামের মানুষ তো ওর কাছে আসে ক্ষতিপূরণ নিয়ে কথা বলতে, ডাইরেক্ট কনট্যাক্ট তো ওর সঙ্গেই হয়, যে ভাবে হোক, এটা করিয়েছে ও। না হলে গ্রামের মানুষ জানল কী করে ওইদিন ওই সময়ে তারা যাচ্ছে সাইট ভিজিটে, সবাই তো তৈরি হয়েই ছিল, এর ব্যাখ্যা কী? পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে দেখা হয়েছে কৃষ্ণেন্দুর, সে এসেছিল জানতে কী ঘটনা হয়েছে সেদিন। রহস্য ঔপন্যাসিক ঠিক ধরে ফেলেছে দুয়ে দুয়ে চার।

সুদামা বলল, তোমার অনিলবরণের কথা বাদ দাও দেখি, সেদিন যে অন্য কথা বলেছিলে।

তখন তো বুঝতে পারিনি, এখন সব মিলে যাচ্ছে।

সুদামা বোঝে ঈর্ষায় ভুগছে কৃষ্ণেন্দু। নিজের ক্ষমতা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেনি বলে তার জুনিয়রের সম্পর্কে সন্দেহ করছে। কোনটা সাজানো তা জানার কোনো ইচ্ছেই নেই সুদামার। তার কোনো মায়াই নেই যেন। কৃষ্ণেন্দুকে ভুলতে শুরু করেছে সে হয়তো-বা। আসল সন্দেহটা প্রকাশ করতে পারছে না কৃষ্ণেন্দু। ভীত পুরুষ। নির্বোধ পুরুষ। সুদামা কি বুঝতে পারছে না কেন কৃষ্ণেন্দুর এই বিদ্বেষ। অনিলবরণ হয়তো সুহাস আর তার সম্পর্ক নিয়েই কথা বলেছে। সেই কথাটিকে অন্য চেহারায় হাজির করছে কৃষ্ণেন্দু। বলতে পারছে না তাই আবোল-তাবোল বোঝাচ্ছে তাকে। কী লাভ সুহাসের? সেই দুপুরে তো রাজারামপুর নিয়ে একটি কথাও বলেনি যুবকটি। বলেছে হাউই-এর কথা। তুবড়ির আলোর কথা। আলো আর আলোর বাজির কথা।

কৃষ্ণেন্দু বসেছে আবার, বলছে, অনিলবরণ গেলে স্পটেই ঝামেলা পাকাত, সুহাসকে জেরা করত ও।

তোমার অনিলবরণের কথা রাখ তো, ও কি কোনো মানুষ। সব সময় খুন যখম, নরহত্যা নিয়ে ভাবে, আমাকে একদিন ফোন করে বিষ নিয়ে কথা বলতে লাগল, সন্দেহবাতিক লোক, মৃত্যুচর্চা করে।

কৃষ্ণেন্দু কিছু আর বলে না। টিভি চালিয়ে নিঝুম হয়ে বসে থাকে। রাত যায় দিন আসে। পর দিন দুপুরে ফোন এল সুহাস বোসের! সুদামা শক্ত করে রিসিভার চেপে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বসের সঙ্গে?

কই, কিছু না তো?

তোমার বস তোমার সম্পর্কে কিছু সন্দেহ করছে।

তা হলে তো তোমার সম্পর্কেও। বলল সুহাস।

না না, বিষয়টা এখানে নয়, শোনো সেদিন কী হয়েছিল রাজারামপুরে?

সুহাস বলতে চায় না। বলে দু-একটি কথা। তখন সুদামা তাকে জানায় কৃষ্ণেন্দুর সন্দেহের কথা। সুহাস ওপারে যেন একটু থমকায়, তারপর হা হা করে হাসে, স্যারের বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে, ঘোষচৌধুরী সায়েবের কথা কেউ শোনে, ঘোষচৌধুরী সায়েব তাঁর রহস্য উপন্যাসের খুনি কী দিয়ে খুন করবে, কীভাবে খুন করবে তাই-ই ঠিক করতে পারছেন না, শুনেছ কি কোনো রহস্য উপন্যাসে অপরাধী অ্যাটম বোমা, নাপাম বোমা, গ্যাস চেম্বার থার্ড ডিগ্রি — এইসব অ্যাপ্লাই করছে খুনের জন্য — পাগল। আচ্ছা ঘোষচৌধুরী সায়েবকে দেখলেই মনে হয় না কেমন রহস্যময় মানুষ। চোখ দুটো দেখেছ, মনে হয় না মরা মানুষের চোখ!

হাসতে থাকে সুদামা। কী চমৎকার কথা বলো তুমি, আমার তো মনে হয় ওই ঘোষচৌধুরী ভেরি মাচ লিভিং, জ্যান্ত মানুষ।

ঘোষচৌধুরীকে পছন্দ হয় তোমার?

হাসছে সুদামা, পছন্দ হলে কী করব, অত জ্যান্ত মানুষের সঙ্গ সহ্য করতে পারব কী করে। দেখছ না ওর সুন্দরী বউ বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে, বিয়ে তো করনি। করলে টের পেতে, আর মেয়ে হলে আরও বুঝতে।

আহা আমি সে কথা বলছি না, ওপারে সুহাস বোসের গলা জড়িয়ে যায়। নিশ্বাস ঘন হয়, সে বলে, ঘোষচৌধুরীর সবসময় সন্দেহ।

বাহ সন্দেহ করাই তো ওর কাজ। খিলখিল করে হাসে সুদামা, তারপর বলে, তুমি সব ট্যাকল করেছ তাতেই বস রেগে গেছে, আমি বললাম, তুমি জানো তাই ট্যাকল করতে পেরেছ, তুমি ল্যান্ড অ্যান্ড পিপল বোঝ।

আমার তো চিন্তা হয়ে গেল, চাকরি থাকলে হয়।

না থাকবে, না থাকবে।

কী করব তখন?

লিখবে, লেখাও চমৎকার প্রফেশন, ধরো তুমি লিখবে কংসাবতী তীরে বর্ষা! বলতে বলতে সুদামা শিহরিত হয়। আরও কিছু বলতে ইচ্ছে হয়। ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। সে শুয়ে আছে প্রিয় পুরুষের কোলে মাথাটি ছুঁইয়ে। খোলা জানালার গায়ে মেঘ। সেই মেঘ এসেছে আবার। ঢুকছে শহরে। সুদামার নিশ্বাস গাঢ় হতে থাকে। সে ফিস ফিস করে, দেখেছ কংসাবতী তীরে বর্ষা?

হ্যাঁ দেখেছি। ওপারেও নিশ্বাস আগুন।

লিখতে পারবে?

যদি তুমি বলো। ফিসফিস করে ওপার থেকে কেউ, যেন ওদিকে শুরু হয়ে গেছে এককণা এককণা রোঁয়ার মতো বৃষ্টি, পাখির গা থেকে পালক ঝরে যাচ্ছে ক্রমাগত। পুরোনো পালক বৃষ্টির কণার মতো নামছে শুধু নামছে। দুজনে নিঝুম হয়ে গেছে। পরস্পরকে অনুভব করতে থাকে দুজনে যেন দুটি গ্রহে বসে। বাইরে বৃষ্টি জোরে এল। বৃষ্টির শব্দে টেলিফোন ভেসে যায়।

ওপার থেকে সুহাস বলল, আমি একটু টেনশনে আছি, দু-একদিন বাদে ফোন করছি। আজ রাতে খয়রাশোল যাচ্ছি, বাড়িতে।

আঠারো

আশ্চর্য! ক-দিনের জন্য যে মেঘ এসেছিল শহরে, তা আচমকা উধাও। আকাশ আবার খটখটে, রোদের ভিতরে ঘোলাটে ভাব। ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হচ্ছে ঘরে থাকা মানুষ। সুদামা ভাবে সুহাস কি মেঘ নিয়ে চলে গেছে খরা-পীড়িত বীরভূমে! সুহাস কি এখনও ফেরেনি? কৃষ্ণেন্দু খুব গম্ভীর। ওর নাম উচ্চারণই করে না। মাঝে-মধ্যে টেলিফোন আসে সন্ধের পরে, রাত্রে। ঘোষচৌধুরী বা অন্য কেউ কথা বলতে চায় কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে। কৃষ্ণেন্দু কী কথা বলে তা শুনতে চায় সুদামা। সুহাসের নাম যে উচ্চারিত হয় না, তা নয়। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুও যেন ধরে ফেলছে সুদামার কৌতূহল, খুব আস্তে কথা বলে।

সুদামার ঘরে থাকাই দায় এখন। ভাবে বেরিয়ে যায় বিনতার কাছে। তার কাছে উন্মোচন করে নিজের সব। কিন্তু বিনতার কি সময় হবে? শুনে বিনতা তাকে তিরস্কার করবে না! ছিঃ সুদামা, তোর না অত বড়ো একটা ছেলে, অত সুন্দর স্বামী। তুই না প্রেম করেছিলি বিয়ের আগে অনেকদিন। প্রেম কি ফুরিয়ে যায় কখনও! আমার তো বিয়ের পরে ভালোবাসা। বিয়ের আগে চিনতামও না লোকটাকে। কম দিন তো বিয়ে হয়নি, এখনও লোকটা দেরি করে ফিরলে ঘর-বার করি। ও যদি না ঘুমোতে পারে, আমিও ঘুমোই না। আমি যদি না ঘুমোই, ও-ও তো ঘুমোতে পারে না। ছিঃ সুদামা, সম্পর্ক কি দু-দিনেই বাসি ভাত। তোর কাছে সব তাই নেই নেই করিস। খোঁজ নিয়ে দ্যাখ তোকে কী ভালোই না বাসে তোর বর।

তুই আমার কথাটা —

কী আর বুঝব রে, বোঝা আমার হয়ে গেছে, সারাদিন ঘরে বসে বসে, এত সুখে থেকে, রাজরানির মতো থেকে তোর মাথা ঘুরে গেছে। ছিঃ, যদি শোনে কৃষ্ণেন্দু, তুই কী জবাব দিবি? সারাদিনে এত কাজ আমার, অন্য পুরুষ মানুষের মুখ কেন গলার আওয়াজ শুনতেও কৌতূহল হয় না। তুই বাড়ি যা, ভাব বসে। ভেবে দ্যাখ কী বলতে এসেছিলি আমার কাছে। যা তুই সুদামা, যা। বরং তুই ছেলেকে ডাক, না হয় ছেলের কাছে চলে যা। তোর মন খারাপ লাগে না বাচ্চার জন্য, তার কথাও তো ভাববি।

তা হলে কি সে যাবে অর্চনার কাছে। অর্চনা তো অফিসে একটা কথাও বলতে পারবে না। তা হলে কি অফিসের পরে, স্ট্র্যান্ড রোডে, গঙ্গার সামনে। কিন্তু অর্চনাও কি শুনবে? বলবে, কী আবোল-তাবোল বলছিস রে সুদামা, তোর কি মাথা খারাপ? যাই, ছেলেকে পড়াতে হবে ফিরে গিয়েই, ফার্স্ট টার্মিনাল সামনে। ও সুদামা, তুই বরং এটা কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে আলোচনা করে দেখ। হি-হি করে হাসতে হাসতে বাসের জন্য ছুটল অর্চনা।

এইকরমই হবে। এ ছাড়া দুপুরে তো সুহাসের ফোন আসতে পারে। ফোন বেজেই যাবে, কেউ ধরবে না। তাই-বা কী করে হয়? সুদামা দুপুরের ভ্যাপসা গরমে ফোনের দিকে চেয়ে জেগে থাকে। ঘুরঘুর করে। ভাবে ডেকে আনে অনিন্দিতা আর মাধুরীকে। টিভি চালিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতে বসে। গল্প করতে করতে জানিয়ে দেয় সুহাস বোস নামের যুবকটির কথা। আর তাই শুনে মাধুরী অবাক, সে কি গো, তলে তলে, একা একা এত! আমাদের জন্যও ওইরকম একটা জোগাড় করে দাও, দুপুরের প্রেম সারি। হি-হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে মাধুরী! খুব খোলামেলা! খুব ক্যাজুয়াল, কেমন দেখতে গো, শাহরুখ খানের মতো ইয়াং, টগবগে ঘোড়া, সানি দেওলের মতো মাসকুলার বডি, নাকি ওই যে কে এস-এর বিজ্ঞাপনে থাকে ছেলেটা, রাহুল না কী যেন নাম, তার মতো, উডল্যান্ড শ্যু-এর ছেলেটার মতো নাইস! দেখলেই শরীর জ্বলে ওঠে, কী গো সুদামা, বলছ না কেন, বাঙালির ওইরকম চেহারা, ওইরকম ম্যাসকুলিনিটি থাকে! নাকি ওই গেঞ্জির বিজ্ঞাপনের নায়কের মতো ভ্যাদভেদে — বিজ্ঞাপন দেখতেই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে …।

শুনে অনিন্দিতা বলে, তুমি কি সত্যি বলছ, সাচ। ঝুটা তো নেহি!

মাধুরী বলে, কিন্তু তোমার কবীর বেদির মতো স্বামীটাই-বা কী খারাপ, নাকি তিনিও জুটিয়েছেন আর কাউকে! হি হি হি, আমাদের বরের মাথায় পাকা চুল, কিছুতেই ডাই করবে না, তোমার উনি তো ডাই করেন, একদিন নতুন ঘোড়াটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও না গো, দেখেই সুখ, তোমার কী মজা! কখন আসে, দেখতে পাই না তো, এই জন্য তুমি আমাদের ত্যাগ করেছ সুন্দরী।

আবার অনিন্দিতা বলে, আহ। একত্রিশ বছরের ইয়াং, কেমন পুরুষ মানুষ সে বলো দেখি, তুমি তার শার্টের বোতাম … ক্লিন শেভড ইয়াংম্যান — ডেনিম আফটার শেভের অ্যাডটা দেখেছ, ওইভাবে জামার বোতাম খুলতে পারো — হি হি হি, কী প্রভোকেটিভ — সেনসুয়াস …

সুদামা তা হলে কী করে যায় ওদের কাছে? তা হলে এই দেওয়াল, টেলিফোনই ভরসা। টেলিফোন তো সব জানে, দেওয়াও। সুদামা অপেক্ষা করে টেলিফোন বেজে ওঠার। যত সময় টেলিফোন না বাজে সে টিভি চালিয়ে দেয়। বিজ্ঞাপন চিত্র দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, উডল্যান্ড শ্যু, ডেনিম আফটার শেভ, কে-এস-রেমন্ড শ্যুটিং দেখতে দেখতে টেলিফোনের দিকে কান রাখে। টেলিফোন ঘুমিয়ে থাকে। তারপর আচমকা সে দুঃস্বপ্ন না সুখস্বপ্নের ঘোরে জেগে ওঠে। বাজে। ছুটে ফোন ধরতে যায় সুদামা। সুদামা ছিল ও ঘরে। ডাইনিং কাম লিভিং-এর লাইনটা, না বেডরুমের লাইন, কোনটা ধরবে সে? বেডরুম অনেক নির্জন। অনেক গোপনীয়তাযুক্ত। ফোন ডেকে যাচ্ছে যেন অনেক সময় ধরে। দূর থেকে ডাকছে, যে ভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষ ডাকে, সেইভাবে হয়তো-বা। ছুটে ফোন ধরতে গিয়ে চুল এলো হয়ে যায়, গায়ের আঁচল পড়ে যায়।

সুদামা ডাক দেয়, হ্যাঁ বলছি, আমি সুদামা।

কোথায় ছিলেন এত সময়? ওপারে ঠিক সুহাসের কন্ঠস্বর।

তুমি কবে ফিরলে?

ফিরেছি তিনদিন। খুব জরুরি একটা ব্যাপার ছিল। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়েছিলাম। তুমি কেমন আছ?

টেলিফোনে সুদামার কান। দুচোখ শব্দহীন টেলিভিশনের চিত্রময়তায়। সে যেন বিজ্ঞাপনের পুরুষকে দেখছে না, দেখছে সুহাসকে। স্বাস্থ্যবান পুরুষ তাকে আহ্বান জানাচ্ছে। ভালোবাসায় হাত ধরেছে। সুহাস বলল, পরামর্শটা নেওয়া খুব জরুরি ছিল, তোমার কাছেও তো নিতে হবে।

পরামর্শ! কী পরামর্শ? সুদামার বুক ধকধক করে, ও কি তার কথা বলতে গিয়েছিল বীরভূমে। হা ঈশ্বর! কোথা থেকে রে কী হয়ে যায়, যাচ্ছে। এবার নীল ফেরেনি গরমের ছুটিতে। ইস্কুল থেকে ওদের নিয়ে গেছে উটকামন্ড। নীল একদিন ফোন করেছিল অতদূর থেকে।

সুহাস বলল, খুব জরুরি ব্যাপার। ডিসিশন নিতে হবে।

কী ডিসিশন? সুদামা থরথর করে কাঁপে।

তোমাকেও বলছি, শোনো আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।

তাই! লিখবে বলে, আহ! আনন্দে রিসিভার কানে চেপে ধরে সুদামা, সত্যিই ছাড়ছ, এই ডিসিশন নিতে বীরভূম গিয়েছিলে? হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো সিদ্ধান্ত। সুদামা নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলে। যে ভয় পেয়েছিল সে! এ যে আগুনের সঙ্গে খেলা! এত তাড়াতাড়ি তো তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। তার যে ভয় করে! নীল রয়েছে উটিতে। তাকেও তো বলতে হয়। বাঁচল যেন সুদামা, বলল, ভালো করছ, এখন থেকে তোমার পেশা হবে লেখা, কংসাবতী তীরে বর্ষা, বাজির গ্রাম, চিনেম্যানতলা …। নীল নীল … আচমকা নীলের জন্য চোখে জল আসতে শুরু করে, আবেগে চোখ ভিজে যায়। সময় যন্ত্রে সে ফিরে যাচ্ছে চোদ্দ বছর আগের প্রেমে।

শোনো ম্যাডাম, তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওসব আমার হবে না। আমি মিঃ মেটা, এল পি জি সংস্থায় এদেশি ডিরেক্টরের কাছ থেকে অফার পেয়েছিলাম, অ্যাকসেপ্ট করছি। এখনই জয়েন করতে বলছে ওরা, ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি তো আছেই আমার — দারুণ অফার, স্যালারি প্রায় ডাবল। এ ব্যতীত অন্য সুযোগ, যাকে পার্কস বলো তোমরা তা অনেক। বাইরে পাঠাবে ট্রেনিং-এ, বোম্বেতে যেতে বলছে এখনই। কী, খুশি তো ম্যাডাম?

হাতের টেলিফোন ঠান্ডা হতে থাকে। কী ঠান্ডা, কঠিন, যেন বরফ চাপা হাত ধরেছে সে। তখনো সুহাস বর্ণনা করে যাচ্ছে অফারের বিবরণ, কীভাবে এটা হল, ওরা ইয়াং ম্যান খুঁজছে, সেদিন ভিজিটে গিয়ে আমার কাজ দেখে …।

সুদামার কানে বরফ শীতল বাতাস, চোখে টিভির রঙিন ছবি। পুরুষটি যত দুর্দম, তার সঙ্গিনী ততই ক্ষীণায়ু। রূপটুকু নিয়ে সে পুরুষের দিকে তাকিয়ে আছে। কী শূন্য দৃষ্টি! রূপ ব্যতীত তার আর কোনো কিছুই নেই। পুরুষের স্পর্শের জন্য সে ঝুঁকে পড়ছে ক্রমশ। কী চমৎকার শ্যুটিং … ইয়ে হা জে সি …। টেলিফোন ছেড়ে দেয় সুদামা। কাটা হাতের মতো রিসিভারটি ক্রেডল ছাড়া হয়ে পড়ে থাকল। ঝুলতে লাগল তারে।

সেদিন বিকেলেই কৃষ্ণেন্দু ফেরে। ঈষৎ নুব্জ। ঝুঁকে আছে সে। একদিনেই বয়স যেন বেড়ে গেছে অনেক। ব্রিফ কেস রেখে নিজেকে সে নিক্ষেপ করল সোফার উপর। কালো মুখ থমথমে।

বিপন্ন সুদামা জিজ্ঞেস করে, তোমার হল না তো?

চমকায় না কৃষ্ণেন্দু। বলল, সুহাস তো ফোন করবে বলছিল, করেছিল?

হ্যাঁ।

ও রিজাইন করেছে।

জানি। সুদামার কন্ঠস্বর কঠিন। বিপন্নতা অগ্রাহ্য করে সে।

তুমি পারলে না? সুদামার দিকে সরাসরি তাকায় কৃষ্ণেন্দু।

কী পারলাম না? সুদামা ফুঁসে ওঠে আচমকা, কী বলছ?

ওই হাউই, তুবড়ি, ঝুলঝুরির গ্রাম! সব বাজির মতো নিভে গেল! বিড়বিড় করে কৃষ্ণেন্দু, হাউই আকাশে উঠে ফেটে গিয়ে কতকগুলো তারা জ্বালিয়ে দিল, তাদের আয়ু কয়েক সেকেন্ড! তারপর অন্ধকার!

কী বলতে চাইছ তুমি? সুদামা গলায় জোর আনতে গিয়েও পারে না। কেমন নির্জীব হয়ে যাচ্ছে সে। বসে পড়েছে মেঝের কার্পেটে। চোখ দুটো ভার হয়ে যাচ্ছে, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, এ কথা কে বলল?

কেন সুহাস বোস।

অবাক হয় না সুদামা। তার জীবনের শেষ বিস্ময় কেটে গেছে আজ দ্বিপ্রহরে, ঘোলাটে রোদের দিনে। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি জানতে কী হতে যাচ্ছিল?

সব জানতাম, আন্দাজে ভুল ছিল না।

মুখ কালো হয়ে যায় অপমানে। সে মাথা নীচু করে, বলল, কী করে আন্দাজ করতে, আমি তো ওর সঙ্গে কোনোদিন পথেও বেরোইনি, দুপুরে এই ফ্ল্যাটে ওকে কোনোদিন আসতে বলিনি, ও আসেওনি। তবে কী জানতে?

তুমি ঠিকই বুঝেছ, কৃষ্ণেন্দু বলে, থাক এসব।

না, থাকবে কেন? বলো কী ভেবেছিলে?

তুমি তো নিজে ভালো জানো, ও তো বোম্বে চলে যাচ্ছে, তুমি নিশ্চয়ই তা জানো।

জানি, কিন্তু তুমি কী আন্দাজ করেছিলে, পরিষ্কার করে বলো।

কৃষ্ণেন্দুর মুখে ক্লিষ্ট হাসি, সে বলল, ভেবেছিলাম হাউই ফুলঝুরি, তুবড়ির আলোয় তুমি ওকে আটকে রাখবে, চিনেম্যানতলায় ওকে নিয়ে যাবে, পারলে না, ও খুব ধূর্ত!

তুমি সব জানো।

জানিই তো, এখন বুঝতে পারছি সুহাস যখন তোমার সঙ্গে হাউই-বাজির কী কথা হল তা বলতে লাগল আমাকে হাসতে হাসতে, তোমার কথা বলতে বলতে গলা আটকে যেতে লাগল, আমারই বোঝা উচিত ছিল সব ওর ধূর্তামি, আমাকে জানাচ্ছিল যে, স্যার ম্যাডামের প্রেমে পড়েছি আমি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সুদামার জন্য আমি আমার প্রতিষ্ঠা ছেড়ে দিচ্ছি। বড়ো চাকরিটায় আমার কোনো লোভ নেই, প্রেমে পড়লে ওসব দিকে মন থাকে না মানুষের। ও তো প্রায়ই বলতে তোমার কথা। বলত আর আমার চোখের দিকে তাকাত, আমি তখন ভাবিইনি, ও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। পেশায় যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী না হয় তাই তো আমি মেনে নিয়েছিলাম ওকে।

তোমার ভয় করেনি, আমি নীলের মা।

মাথা নাড়ে কৃষ্ণেন্দু, না ভয় করবে কেন, টেলিফোন ব্যতীত তুমি আর কতটা এগোবে, আমি তো তোমাকে চিনি। চেনায় ভুল নেই। ওকে তো ফ্ল্যাটে ডাকোনি। হয়তো ডাকার দিকে এগোচ্ছিলে। তার আগে আমি তোমার কাছে চলে আসতাম, নিজের কথা বলতাম, তোমাকে আমি যতটা চিনি, ততটা কি ও চেনে? তুমি কেন মা হতে গিয়েছিলে তাও তো জানি। তোমার মন তো আমি চিনি, তোমার রোমান্স কীসে তা কি আমি জানি না? আসলে প্রথম থেকেই ওর কথাবার্তায় আমি টের পেয়েছিলাম ও আমার গোপন প্রতিদ্বন্দ্বী। না এই ঘরে নয়, তোমাকে নিয়ে নয়, আমার চাকরিতে, পেশাতে, কোম্পানি আমাকে একটা আভাস দিয়েছিল মাত্র। সেটা আমি ওকে আচমকা একদিন বলে ফেলেছিলাম, না, না, বলিওনি, আন্দাজ দিয়েছিলাম। ও খুব চতুর, ধরে ফেলেছিল সব, তখন আমার আর উপায় ছিল না, ওরা তো টাকার বাজার খুলে বসেছে, সেই টাকা ছাড়ি কী করে। যখন টের পেলাম আটত্রিশ বছরের নারীও ওকে মুগ্ধ করতে পারে তখন আমি নিশ্চিন্ত —

সুদামার আর কিছু জানার নেই। সে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ভাঙা দেহ নিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়, দু-হাতে মুখ ঢাকে, তুমি আমাকে তোমাদের টাকার বাজারে তাই ঠেলে দিলে, আমাকে এইভাবে অপমান —। তুমি কি পুরুষ মানুষ!

কৃষ্ণেন্দু মাথা নামায়, বলল, আমি চেয়েছিলাম ঘরে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক। তাতে বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমবে, বাইরে আমি নিশ্চিন্ত থাকব, ও আমাকে আমার মতো করে নিশ্চিন্তও করেছিল যাতে আমি সতর্ক না হই।

সুদামা টলতে টলতে আছড়ে পড়ে কৃষ্ণেন্দুর ঠাণ্ডা শরীরে, গলার কাছ থেকে জামার কলার টেনে ওর মাথা নামিয়ে দিল আবার, বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সুদামা, কৃষ্ণের সখা, পুরুষের নামে নাম, আমি যেন পুরুষ মানুষের মতো অধিকার করতে পারি সব, তুমি আমার প্রেমিক, সখা, বন্ধু। একটা প্রতারকের হাতে তুলে দিয়ে কেমন নিশ্চিন্ত ছিলে হে প্রেমিক, আমার স্বামী, অগ্নিসাক্ষী রাখা পুরুষ মানুষ, নির্বোধ, তুমি কেন আমাকে আগে বলনি কথা যা হত আমার সঙ্গে তা সে সব আবার গল্পচ্ছলে জানায় তোমাকে, তুমি বসে বসে শুনতে আর ভাবতে তোমার বিশ্বাসী বউয়ের প্রেমে পড়ে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী তোমার সামনে থেকে সরে দাঁড়াবে। আসলে সরে দাঁড়িয়েছিলে তো তুমি, সরে দাঁড়িয়েছ, আমাকে দুজনে মিলে অপমান করেছ, দুজনে মিলে একটা মেয়ে মানুষকে তোমরা উলঙ্গ করে দিয়েছ। বড়ো কাজে একটা দুটো রেপ, থার্ড ডিগ্রি … যা বলে ওই অনিলবরণ, তাই-ই করেছ তোমরা, আমি তো প্রতারকের প্রেমেই পড়েছিলাম, হয়তো ঘরও ছাড়তাম — ছিঃ, তুমি এই রকম।

কৃষ্ণেন্দু ধীরে ধীরে সুদামার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে সরে যায়, খুব ঠাণ্ডা গলায় বলে তুমি ভুল করছ। এটা তেমন কোনো ব্যাপারই নয়। যদি আজ আমি জিতে ফিরতাম, আমাকে তুমিও জিজ্ঞেস করতে না কীভাবে কী করলাম আমি, বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না সে যা করেছিল তা ন্যায়সঙ্গত কিনা। আমি জিতে গেলে ওকে পিঁপড়ের মতো টিপে মারতাম। ওর ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়ে চাকরি ছাড়তাম, খুব সামান্য ব্যাপার এটা। ও তো তোমার ঘরে আসেনি, ও তো প্রেমের ভান করেছে।

সুদামা শুনছিল না। সে আছড়ে পড়ে মেঝের কার্পেটে, বিড়বিড় করে, ওই জন্যই বাচ্চাটাকে রাখতে দাওনি, গর্ভবতী বউয়ের সঙ্গে তো প্রেম করতে পারবে না তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী, টাকার বাজারে সওদা করতে আসা বেনিয়া, বাজারের মেয়ে-মানুষ পেটে ধরলে তো তার দাম কমে যায় —।

কৃষ্ণেন্দু চুপ।

উনিশ

বহুদিন বাদে কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করে সুদামার। ডায়েরির পাতায় জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার কী হয়েছিল, সে কেমন আছে, কেমন ছিল। কেউ না পড়ুক, নীল তো পড়বে। নীল — নীলাঞ্জন লিখেছিল কলকাতায় খুব গরম, তারা যাচ্ছে উটকামণ্ডে। কলকাতা তার আর ভালো লাগে না। অথচ এটা তো সবাই জানে, চোদ্দ বছরের নীলও জানে কলকাতার চেয়ে দক্ষিণ ভারত কম তপ্ত নয়।

নীল লিখেছিল, কলকাতায় গেলে প্রাণ হাসফাস করে, জ্যাম, ধুলো-ময়লা। আশ্চর্য মায়ের জন্যও মন কেমন করে না তার। কলকাতায় এসে না হয় বড়ো ব্যালকনিটাতে দূরবিন নিয়ে বসে থাকতিস, তোকে না হয় নিয়েই যেতাম দার্জিলিং! সুদামা ছেলের চিঠির সম্পূর্ণ জবাব দেয়নি। দায়সারা হয়ে কী লিখেছিল মনেও নেই আজ। বাবা-মায়ের কাছে এলেও দমবন্ধ হয়ে যাবে তার। ওখানেই যত বাতাস!

তার কথা শুনে কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, থাক না, বড়ো হচ্ছে তো। নিজের মতো বড়ো হোক।

নিজের মতো বড়ো হওয়া! নিজের মতো বড়ো হচ্ছে, না কৃষ্ণেন্দু তাকে তার নিজের মতো করে তুলছে। নীলের হোস্টেল বাস নিয়ে কম আপত্তি করেনি সুদামা। কলকাতায় কি স্কুল নেই। না, অমন কোনো স্কুল নেই এখানে, বলেছিল কৃষ্ণেন্দু।

ডায়েরিতে কী লিখবে ঠিক করতে পারছে না সুদামা। কার জন্য লিখবে? নীলের জন্য! ওখানেই তো একটু বাতাসের চিহ্ন এখনও। শো-কেসের উপর সাজানো নীলের ছবির হাসিটিতে সেই বাতাস।

কদিন বাদে কৃষ্ণেন্দু তাকে ডেকেছিল, ঠিক আছে, এতই যদি ইচ্ছে, তুমি আবার মা হও। আমার কোনো আপত্তি নেই, আবার আরম্ভ হোক।

ঘৃণায় সরে গিয়েছিল সুদামা। ঘৃণা এবং ভয়ে তার সর্বাঙ্গ শক্ত হচ্ছে ক্রমশ, হে বন্ধু, সখা, হে আমার প্রেমিক এইভাবে আর কত কাল! আবার যদি কোনো সুযোগ আসে তোমার কাছে?

বাজার তো বাড়ছে ক্রমশ। বাজার বাড়ছে টিভির বিজ্ঞাপনে, রাস্তার হোর্ডিং-এ, মানুষের মুখের ভাষায়। বাজারের উপযোগী হয়ে উঠতে চাইছে সকলে। হ্যাঁ, তার সন্তানও। বাজারের বড়ো বেনিয়া করে তুলতেই না তাকে অতদূর পাঠানো।

দীর্ঘ দুপুর কাটাতে কাটাতে, একদিন কী খেয়াল হল সুদামার, অনিলবরণকে ডেকে বসল। অফিসে বসে ফোন পেয়ে অনিলবরণ, কী ব্যাপার মিসেস চ্যাটার্জি?

আমি সুদামা।

হ্যাঁ সুদামা, হঠাৎ যে?

আপনি একটু আসবেন।

টেলিফোনে হবে না?

না, টেলিফোন বেশি সময় আমার ভালো লাগে না, এখনই আসুন না।

খুব দরকার?

হ্যাঁ, ওকে কিছু বলতে হবে না। সুদামা ফোন রেখে দিল।

এল অনিলবরণ। ডাকামাত্রই প্রায় ছুটে এল। অফিসের গাড়ি ছিল না, ট্যাক্সি নিয়েই চলে এসেছে হাচোড়-পাচোড় করতে করতে। জামা-কাপড় আধ-ময়লা, সাদা জামার বুক পকেটে কালির দাগ। দাঁড়ি কামানোও নেই।

হাঁপাতে বসল অনিলবরণ, হঠাৎ তলব, তাও ওকে না জানিয়ে।

সুদামা বলল, বিশ্রাম নিন, তারপর বলছি, স্কোয়াশ দিই। মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন তো, ভালো জলভরা সন্দেশ আছে।

অনিলবরণ বলল, না কিছুই লাগবে না, আমার সব রকম খাওয়াও এখন বন্ধ। সুগার হয়ে গেছে যে তলে তলে, তা টের পাইনি, ব্লাড কোলেস্টেরল তো আছেই, দেখুন এটাও একটা উপায়, যদি কারো হাই সুগার থাকে, মিষ্টি খাইয়ে খাইয়ে তাকে শেষ করে দেওয়া যায় —।

সুদামা বলল, থাক, আমি আপনাকে মারতে চাই না। আপনার মুখের ভাষা এত খারাপ।

অনিলবরণ বলে, খারাপটা কিন্তু সবাই শোনে, রেপ-মার্ডার এসব খুব খারাপ। কিন্তু কাগজে এই সব খবর বেশি পড়তে চায় মানুষ। রেপের বিবরণ পড়তে চায়। কেন বলুন দেখি, আসলে মানুষ নিজেই নিজের খোঁজ রাখতে পারে না, কী ভালোবাসে, কাকে ভালোবাসে তাই-ই জানে না।

সুদামা বসেছে দূরত্ব রেখে। ডাকল কেন অনিলবরণকে। ঠিক দুপুরবেলায় তার ফাঁকা ফ্ল্যাটে একটি অন্য পুরুষ যার মুখে খুন রেপ, এসব নিয়ে সর্বক্ষণই যে ভাবিত, খুঁজে খুঁজে বার করেছে ১৯৫ বা ১৯৮ রকমের খুনের পদ্ধতি, সুদামা তাকে ডেকে এনেছে কেন? খুন হতে? নাকি সুহাস বোসের খোঁজ নিতে?

সুহাস বোসের খোঁজ নিতেই ডাকা অনিলবরণকে। সে কি জানে সুহাসের কোনো খবর? দিন পনেরো কাটার পর এখন সুদামার মনে হচ্ছে কৃষ্ণেন্দু সব সত্যি বলেনি। সুহাস তার প্রেমের বিবরণ প্রেমিকার স্বামীর কাছে বলত, এই কথাটি হয়তো সত্যি নয়। হাউই বাজি, ফুলঝুরি, তুবড়ির কথা বলতে পারে, বাজির গ্রামের কথা কৃষ্ণেন্দুকে বলতেই পারে সুহাস, তাতে কল্পনা যোগ করেছে কৃষ্ণেন্দু। পরাজয়ের গ্লানি কাটানোর জন্য আর একজনকেও অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার ছিল তার। সুহাসকে তার অপরাধের সহযোগী করে তুলে নিজেকে কিছুটা আড়াল করতে চেয়েছে হয়তো কৃষ্ণেন্দু। সুদামা জানে, তার এই ভাবনাও সঠিক না হতে পারে। সুহাসকে নিরপরাধ সাজিয়ে সে মনে মনে কৃষ্ণেন্দুকে আরও অপরাধী করে তুলতে চায় যেন-বা। তাতে সে বাঁচে।

সুদামা বলল উপন্যাস লেখা হল?

না, এখন খুনি কীভাবে খুন করবে তা-ই ঠিক করে উঠতে পারেনি।

হাসতে থাকে সুদামা, তার মানে, খুন না হলে উপন্যাস এগোয় কোন পথে?

কোনো পথেই নয় ম্যাডাম। হাসে অনিলবরণ, আসলে খুনের তো বহু উপায় আছে, কোনটা অ্যাপ্লাই করলে সুবিধে হবে লেখকের তাই-ই লেখক ঠিক করে উঠতে পারছে না। তাই বিষের মাত্রা কমে যাচ্ছে। ধরুন যদি চার মিলিগ্রাম স্ট্রিকনিন বিষের প্রয়োজন হয় মানুষ খুন করতে, খুনির হাতে আছে পয়েন্ট ফোর মিলিগ্রাম, কিছু বুঝলেন? স্ট্রিকনিন না ধুতুরা, কোনোটা ভালো, এ নিয়ে তার ধন্ধ আছে।

মাথা নাড়ে সুদামা, আপনি এত জটিল করেন। কেন ব্যাপারটা?

জটিল করতে তো চাই। পারছি না ম্যাডাম চ্যাটার্জি, ডাকলেন কেন?

কঙ্কনা ফিরল?

ফোন করুন না, না না এখন নয়, ও বোধহয় বাচ্চাদের ইস্কুল থেকে আনার জন্য বেরিয়েছে, ফিরেছে চুক্তি করে।

কী চুক্তি?

আমাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে আমার বউ, আসলে ও খুব তেজস্বিনী। ধীরে ধীরে বলে অনিলবরণ।

কী হয়েছে, ও কি নার্সিংহোমে গিয়ে …?

না, না, তাতে তো ওর হার হত। এই রে আমার কী হচ্ছে, ঘরের কথা সব বলে দিচ্ছি। যাক গে, আমি আবার চেপে রাখতে পারি না। শুনুন দিদিমণি, ও বলেছে হ্যাঁ আবার বাচ্চার মা হতে পারে, পরিবর্তে আমাকে খুন করতে হবে তাদের।

কী বলছেন আপনি, দুজনেই কি পাগল হলেন?

হাসে অনিলবরণ, পাগল হইনি। মাথা বেশ ঠাণ্ডাই। ও বলছে খুনটা করতে হবে উপন্যাসে। বলতে বলতে অনিলবরণের মুখ কালো, তা কি সম্ভব? পারা যায়?

সুদামার বিস্ময় বাড়ে, সত্যি বলেছেন?

হ্যাঁ সত্যি, তাই ১৯৫-৯৮ রকম খুনের উপায় জেনেও আমি একটা খুনও করতে পারছি না আমার খুনিকে দিয়ে কঙ্কনা ওই কথা বলার পর, আমার মাথার ভেতরের খুনিটা ভয় পেয়ে গেছে, দেখুন সুদামা, আমার আবার বাচ্চা খুব পছন্দ, ছেলের ছুতোয় আরও কয়েকটা বাচ্চা, তাতে যদি ঘর ভরতি হয়ে যায় যাক না, আমি ব্যাকডেটেড, কৃষ্ণেন্দু বলে, সুহাসও বলত। আমি যেন নাইনটিনথ সেঞ্চুরির মানুষ, কী জানি এক আনি দু-আনি চার আনি আধুলি, দশ-বিশ-পঞ্চাশ পয়সায় পকেট ঝনঝন করুক এ আমার খুব পছন্দ, ও বলে আমি ওকে খুন করতে চাই।

তাই তো, এত বাচ্চার ধকল কী করে নেবে একটা মা?

নিতে পারে, হলেই নেবে, মেয়ে হলে আমিও নিতাম। হাসে অনিলবরণ, কেউ চায় কেউ চায় না, আমাকে আমার বউ বলে আমি একটা খুনি, কী করে বলে ভাবুন দেখি, পাঁচটা বাচ্চা চাইলে খুনি!

সুদামা চুপ করে থাকে। তার আর ভালো লাগে না। এখন মনে হচ্ছে অনিলবরণ উঠে যাক। সে নিজে ওঠে। পায়চারি করে। অনিলবরণ কথা বলতে আরম্ভ করলে থামে না, বলছে, আমি নাকি ফিউডাল। মেয়েদের শুধু আঁতুড়ঘরে আর রান্নাঘরে দেখতে চাই। ওসব এখন আর চলে না। লোকে জানলে নাকি আমিই খুন হয়ে যাব, কী বুঝলেন কিছু?

সুদামা বলে, তা হলে আপনার খুনি খুন করতে পারবে না?

না, তাকে চিনে গেছে যে তার বউ, খুনিকে যদি আগেই চিনে ফেলে সবাই, সে খুনের মানে কী? খুনই-বা হবে কী করে? খুনি নিজেই তো ভয় পেয়ে গুটিয়ে গেছে। বুঝতে পারছে ১৯৫-৯৮, তিনশো রকমের বিষ দিয়েও আর সম্ভব নয়, ভিকটিমটা কে?

তা হলে কীভাবে সম্ভব?

তা তো আমি জানি না, আমার জ্ঞানবুদ্ধি, ধ্যান-ধারণা সব ধরা পড়ে গেছে আমার বউয়ের কাছে। আসলে কী জানেন, কঙ্কনা আমাকে ভালো তো বাসে, আর তাতেই হয়েছে তার বিপদ। আমারও বিপদ। কঙ্কনা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ওইসব বস্তাপচা রহস্য উপন্যাস আর চলবে না, খুনই হবে না। শেষ পর্যন্ত মাথা ভার করে ঘুরে বেড়াবে খুনি, হয়েছেও ঠিক তাই। এক পাতাও লিখে উঠতে পারছি না। আমার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়েছে ভিকটিম খুঁজে বের করা।

আশ্চর্য! সুদামা অবাক হয়ে দেখছে মানুষটাকে। চোখ দিয়ে আলো গলে পড়ছে যেন। মুখখানিতে জেগে উঠছে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগের একটি শিশু। এ যেন হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর অন্ধকার থেকে বের করে আনা কোনো শিলাখণ্ড, তার গায়ে গায়ে উৎকীর্ণ করা আছে জীবনের ইতিহাস।

অনিলবরণ বলে, বাচ্চাকে খুন তো করাতে পারব না, ইমপসিবল। হ্যাঁ এজেড ম্যান কাউকে যে গ্যাসে ডুবিয়ে, বিষ দিয়ে, গলা টিপে, গুলি করে, লোক লেলিয়ে দিয়ে মারব, তাও হয়ে উঠছে না। রেপ মার্ডার যে করবে আমার খুনি, সে তো খুনের আগেই দেখতে পাচ্ছে ভিকটিমের চাইল্ডহুড, হতভাগ্যের তো বাল্যকাল ছিল। আমার খুনি বিষ তৈরি করতে করতে, বন্দুকের নল পরিষ্কার করতে করতে, ছুরিতে শান দিতে দিতে, পরমাণু বোমা, গ্যাস চেম্বার থার্ড ডিগ্রির কথা ভাবতে ভাবতে বিমনা হয়ে যাচ্ছে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে যাকে খুন করবে তার শৈশবের কথা, হতভাগ্য তখন বালক বা বালিকা হয়ে যাচ্ছে, আকাশে গ্যাস বেলুন ওড়াচ্ছে, মাঠ দিয়ে দৌড়চ্ছে, হাততালি দিচ্ছে মাদারি খেল দেখে। তারপর সে আরও ছোটো হয়ে যাচ্ছে, আরও ছোটো হয়ে সে হাত-পা নাড়ছে, ফোকলা গালে হাসছে, চোখ ফুটেছে সবে, আলো দেখছে আকাশ দেখছে, পাখির উড়াল দেখছে, খসে পড়া পালক দেখছে — আরও পিছিয়ে তো অন্ধকারে গুটি-সুটি মেরে, মায়ের শরীরের অভ্যন্তরে লুকিয়ে — তারপর ভ্রূণ হয়ে যাচ্ছে। তাকে কী করে খুন করানো যাবে বলুন দেখি। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, একটা বয়সের পিঠে আর একটা বয়স, চাঁদের গায়ে চাঁদ …।

শুনতে শুনতে সুদামার মুখ-চোখ বদলে যায়। সে কাঁপতে থাকে। বাক্যগুলি আশ্চর্য এক ধ্বনির মতো তার কানের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। বাইরে মেঘ ঘন হয়েছে। সেই মেঘের ওপর থেকে, কোনো এক সীমাহীনতা থেকে ধ্বনিপুঞ্জযেন বিলম্বিত লয়ে প্রবেশ করছে এই পৃথিবীতে, এই শহরে, এই স্থলভূমিতে, ফ্ল্যাটের ভেতরে — বিপ বিপ বিপ! সে দুহাতে মুখ ঢাকে। হতভাগ্য মাতৃগর্ভে, ভ্রূণ হয়ে আছে, শুধু তার প্রাণ জেগেছে মাত্র। তাকে কী করে হত্যা করতে পারে অনিলবরণ। তার কলমের নিব ভেঙে যাচ্ছে।

সুদামা ধরা গলায় বলে, আপনি বলে যান।

বললে আপনি কষ্ট পাবেন, কেন ডেকেছিলেন আমাকে, একটি খুনের কাহিনি শুনতে, নাকি সুহাস বোসের কথা শুনতে?

সুদামা ভেঙে যায়, বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করে, জানেন?

জানব না কেন, ওই ছোঁড়াটা তো বলত, এমনভাবে বলত যেন আমরা যথেষ্ট ভাবতে পারি, কল্পনা করতে পারি, এক ঘন্টা ধরে ফোন করেছে বসের স্ত্রীকে, অত সময় ধরে গল্প করেছে, করছে — এইসব শুনলে, দেখলে সন্দেহ হবে না? ও তো চাইত যেন কৃষ্ণেন্দু ভালো করে টের পেয়ে নিশ্চিন্ত থাকে — এইভাবে মানুষের প্রেম ভালোবাসা, অনুভূতিকে কেউ হত্যা করে? আমার খুনির চেহারাটা কিন্তু, না থাক, কিছু বলব না। আমি উঠি এবার, আচমকা বাড়ি ফিরলে আমার বউ চমকে যাবে, দেখুন দিদিমণি, খুন করা খুব সোজা, করে দিলেই হল, ভালোবাসা খুব কঠিন, আপনি তা মানেন?

বলতে বলতে চলল অনিলবরণ। ঘরে এখন মেঘের গায়ে মেঘ লেগেছে, ছায়ার ভেতরে ছায়া। একা সুদামা সেই ছায়ার ভিতরে লুকিয়ে আছে। মনে হয় যাচাই করা শেষ। কিন্তু সত্যিই শেষ কি? ভালোবাসা বড়ো কঠিন। তিলে তিলে গড়ে তুলতে হয় ভালোবাসা। সন্তানের মতো লালন করতে হয় রক্তের ভেতরে। তাকে হারাতে চায় না সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *