এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ – ৫

পাঁচ

অনিলবরণ, সুহাস চলে গেল সাড়ে আটটার পর। এই সাড়ে আটটা পর্যন্ত সুহাস আর অনিলবরণের তর্কাতর্কি চলতে লাগল। অনিলবরণ বারংবার বোঝাতে লাগল শাসন বজায় রাখার জন্য পুলিশের কাজে মাথা গলানো ঠিক নয়। শাসন বজায় রাখার জন্য পুলিশকে অনেক কিছু করতে হয়। ধর্ষণও করতে হয়, পিটিয়েও মারতে হয়। একটা দুটো এমন কেস হয়ে গেলে লোকে সন্ত্রস্ত থাকে। ওইটা প্রয়োজন। বড়ো কাজে যখন নামে পুলিশ, আচমকা এমন হয়ে যেতে পারে। এ নিয়ে কাগজ হল্লা করতে পারে, কিন্তু তাতেই-বা কী! পুলিশ দেখলে মানুষের কাপড় যদি না ভিজে যায়, তবে কাজ হবে কী করে? আসলে দেখা দরকার কাজটা হয়ে উঠল কিনা। এসব ঘটনা তুচ্ছ। কে কাকে খিস্তি মেরে কী বলল, কটা মানুষের মাথা ফাটল লাঠির ঘায়ে, কোন মেয়েছেলের গায়ে হাত দিল, তা নিয়ে মাথা ঘামালে সুহাস প্রশাসনিক কাজই করতে পারবে না।

এই তর্কে কৃষ্ণেন্দু নিরপেক্ষ। মিটিমিটি শুধু হাসতে থাকে। দূর থেকে তার ভূমিকাও পছন্দ হয় না সুদামার। কৃষ্ণেন্দু কি অনিলবরণের মতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে, না হলে তাকে থামাচ্ছে না কেন? দুজন চলে গেলে সুদামা রোষে ফেটে পড়েছে, লোকটা যেন আর না আসে।

কে সুহাস? হাসছে কৃষ্ণেন্দু।

হ্যাঁ হ্যাঁ, সুহাস যেন তোমাদের আসরে আর না আসে। ও এর উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি, খারাপ হয়ে যাবে ছেলেটা।

তুমি কি অনিলবরণের কথা বলছ?

বলছিই তো, ও না উপন্যাস লেখে! লোকটা কি পাথর?

কৃষ্ণেন্দু বলে, পাথর নয়, মানুষই, ও এসব বলে ইচ্ছে করে, সুহাসকে রাগাবার জন্য আজ বলছিল।

রসিকতার মাত্রা থাকবে তো।

কৃষ্ণেন্দু তখন খেতে চায়। সে আর কথা বাড়াতে চাইছিল না। কিচেনের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণেন্দু। সুদামা গ্যাস ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে একটু নিচু হয়ে সিলিন্ডারের নব অন করতে গিয়ে চমকে ওঠে, এ কী! একটি ওভেনের নব তো খোলা। ছোটোটা, যেটি ব্যবহার হয় কম। সরে দাঁড়াতেই আবার খেয়াল হল গ্যাস সিলিন্ডারের নবে চাপ দিয়ে সে সরে এসেছে। হাত বাড়িয়ে ওভেনের নব না সিলিন্ডারের নব করতে করতে এক দু-সেকেন্ড যেতেই কৃষ্ণেন্দুর খেয়াল হয়, কী করছ তুমি, তোমারও কি নেশা হয়ে গেল।

সুদামাকে সরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণেন্দু ওভেনের নব বন্ধ করল, এটা খুলল কে?

সুদামা বিব্রত হয়ে পড়ে। তাই তো! রান্নার মেয়েটির তো এসব বিষয়ে খুব নজর। সে এই ভুলটা করল নাকি? সিলিন্ডারের চাবি ঘুরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ওভেনের শিখা নিভে যেতে সে মনে করেছিল সবই বন্ধ করা আছে। ছোটো ওভেন ব্যবহার করা হয় খুব তাড়া থাকলে। সময় তো বেশিই লাগে ওতে। আজ তাড়া ছিল কোথায়? কৃষ্ণেন্দু ভোরে বেরিয়েছে। আজ তো শুধু সে খেয়েছে দুপুরে। কাজের মেয়ে বিমলা নিশ্চিন্তে রান্না করেছে। সে নিজে শুধু একবার চা করেছিল চারটে নাগাদ। কিন্তু নিশ্চয়ই বড়ো ওভেনে চাপিয়েছিল জলের পাত্র। তাই-ই তো করে থাকে। নাকি ছোটো ওভেন ব্যবহার করেছিল? ছোটোটায় তো সময় বেশি লাগে। সময় লাগলে তারই-বা ক্ষতি কী! তার তো সারাদিনই কোনো তাড়া নেই। সে তো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পা ফেলে না। ঘড়ি তো দ্যাখেই না সে প্রায়। যদি বা দ্যাখে, তার ভেতরে কোনো কৌতূহল থাকে না, তাড়া থাকে না। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়াড্রোব, ওয়াসিং মেশিন, টেলিফোন, টিভি, ঘরের তেলরঙা দেওয়ালে টাঙানো কৃষ্ণেন্দুর মা-বাবার ছবি, নিসর্গ চিত্র, জীবনবিমার ক্যালেন্ডার দেখার মতো করেই দ্যাখে। তার কাছে দেওয়ালের কোয়ার্টাজ ঘড়িটি আসবাবের মতোই হয়ে গেছে প্রায়। হ্যাঁ তাই, এক একদিন বিকেলের দিকে, দুপুরের দিকে, রাতে ফোন এলে, তা কোনো বান্ধবীর হোক বা আত্মীয়-স্বজনের হোক, সে আচমকা তাদেরই জিজ্ঞেস করে, কটা বাজে এখন বলো দেখি? সময়টা শুনে নিয়ে আবার কথা বলতে থাকে।

কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, বিমলা খুলে রেখে গেছে?

কী জানি! অন্যমনস্কের মতো জবাব দিল সে।

তুমি খুলে বন্ধ করোনি?

আমি তো খুলিনি, এটা তো খুলি না। বলতে বলতে সুদামা ঘুরে ফ্রিজ থেকে মাছ তরকারি বের করতে থাকে। বাইরে থাকুক কিছু সময়, ততক্ষণে ভাত ফুটে যাক। ভাতের পর ওগুলো গরম করে নেবে।

তুমি খোলোনি, বিমলা খোলেনি, তাহলে কে?

সুদামা বিব্রত হয়ে পড়ে। মাথা কাজ করছে না। যদি সে বড়ো ওভেনে চা করে থাকে, যা তার অভ্যেস, তা হলে তখনও কি ছোটো ওভেনের নব খোলা ছিল। ছোটো ওভেন দিয়ে তখন গলগল করে বেরিয়ে আসছিল কুকিং গ্যাস — তরল পেট্রোলিয়াম — যা বাতাসের সংস্পর্শে এসে বায়বীয় হয়ে যায়। যতক্ষণ জল ফুটেছে, যত সময় পাশের ওভেনে আগুন জ্বলছে ততক্ষণ এই ওভেনের গ্যাস আপনা-আপনি বেরিয়ে গেছে। আগুন খুঁজেছে। খোল ছিলা জানালা। জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সুদামা মাথা নাড়তে থাকে। তা হয়নি। তা না হলে কেউ গ্যাস ওভেন খুলে দিয়ে চলে গেছে। আশ্চর্য! তা হতে পারে? সে কৃষ্ণেন্দুর মুখের দিকে তাকায়। নেশা কেটে গেছে কৃষ্ণেন্দুর। না কাটলেও খুব ব্যালান্সড মানুষ। ডাইনিং টেবিলের সামনে পাতা চেয়ারে বসে কিচেনের দিকে তাকিয়ে আছে কৃষ্ণেন্দু।

খেতে খেতে কৃষ্ণেন্দু বলল, আগে ওভেন বন্ধ করে, তারপর সিলিন্ডারের নব বন্ধ করা, এইভাবেই তো করো।

কী জানি!

কৃষ্ণেন্দু বলল, কেয়ারলেস হলে বিপদ ঘটে যেতে পারে।

হাসে সুদামা। তখন ফোন বাজল। সে উঠে গিয়ে ফোন ধরল। আশ্চর্য! ফোন কেটে গেল। গেল কিংবা কেটে দিল ওপাশের লোক। ফোন রাখার শব্দটিও কানে এল যেন। সুদামা ক্রেডলে রিসিভার রেখে ডাইনিং টেবিলে ফিরে এল।

কার ফোন? কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে।

কী জানি, রেখে দিল।

রেখে দিল মানে? কৃষ্ণেন্দু অবাক, রেখে দিল?

সাড়া দিতেই ফোন রাখার শব্দ শুনলাম।

নাকি কেটে গেল লাইনটা?

সুদামা জবাব দেয় না। কৃষ্ণেন্দু বিড়বিড় করে, মনে হয় লাইন কেটে গেছে, আবার আসবে, কিছু হল নাকি রাজারামপুরে?

কৃষ্ণেন্দু ধীরে ধীরে খায়। সুদামার চোখ টেলিফোনে। টেলিফোন আবার বাজবে হয়তো। লাইন কেটেও যেতে পারে, সে ভুল ভেবেছে বোধহয়। কৃষ্ণেন্দু খাওয়া শেষ করে ওঠে। সুদামার খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কোনোরকমে মুখে দুটো দিয়ে উঠে পড়ে। টেবিলে থালা বাসন পড়ে থাকল।

কৃষ্ণেন্দু মুখ ধুয়ে সোজা বিছানায়। এখন রাজ্যের ক্লান্তি তার উপরে ভর করেছে। ঘুম আসছে ঘুম। বিছানায় চিত হয়েই চোখ বন্ধ করল সে। ঘুমিয়েও পড়ল খুব তাড়াতাড়ি। সুদামা মশারি লাগিয়ে, মশারির ভিতরে কৃষ্ণেন্দুকে রেখে বাইরে। বাড়িতে টেলিফোন দুটি, একই লাইনে দুটো রিসিভার, একটি বেডরুমে, অন্যটি ডাইনিং কাম লিভিং-এ। সুদামা বেডরুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে যায়। গা-টা কেমন করছে। ভাজা মশলার কৌটো খুঁজতে গিয়ে তার নজরে আসে রুপোলি রঙের ওভেন। দুটি নবই বন্ধ আছে। সে ছোটো ওভেনের নবটি ঘোরায়। ঘুরিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। তখনই নাকে আসে কাঁচা গ্যাসের গন্ধ। ভক করে বেরিয়ে এল জমা গ্যাস। সে নব ঘুরিয়ে দিয়েই সিলিন্ডারের কাছে নিচু হয়। না বন্ধ আছে। পুরোপুরি কিনা দেখার জন্য হাত বাড়িয়ে নবটি সামান্য ঘোরাতে ঘুরল সেটি। তখনই আবার ফোন বাজল।

ফোন বাজছিল। সুদামার মনে হল কৃষ্ণেন্দুর ঘুম ভেঙে যাবে। সে বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে ধরবে টেলিফোন। কিন্তু ফোন বেজেই চলে। কৃষ্ণেন্দু জাগে না। সে কিচেন থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-এর টেলিফোন তোলে, সুদামা বলছি, মিসেস চ্যাটার্জি স্পিকিং…

ওপারে নীরবতা। কানের কাছে চেপে ধরল সুদামা রিসিভারটি। সে আবার বলে, সুদামা বলছি, কে?

ওপারের টেলিফোন থেমে যেতেই তার গা ঠাণ্ডা হয়ে গেল আচমকা। হ্যাঁ, ফোনটা রেখে দিল। খুব ক্ষীণ হলেও সে তো কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিল। এখন দশটা চল্লিশ। পার্লামেন্ট নিউজ টেলিভিশনে। সুদামা চট করে টিভির সুইচ অন করল। ঠিক তাই। পার্লামেন্টে নিউজ পড়ছেন সেই পরিচিত মুখ, কলকাতার মেয়ে, বিবাহের পর পশ্চিম ভারতীয়। চমৎকার পড়েন উনি। উচ্চারণ খুব স্পষ্ট। এক সময়ে কলকাতার নামি গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করতেন। সুন্দরী, সুদর্শনা। পার্লামেন্টে বিজেপি-কংগ্রেস-কমিউনিস্ট সদস্যরা কে কী বলেছেন তার বিবরণ দিচ্ছেন। এই বিবরণই তো ভেসে আসছিল টেলিফোনের ভিতর দিয়ে ক্ষীণভাবে।

বিজেপি, আবার কোথায় একটা মসজিদ নিয়ে প্ররোচনাময় বিবৃতি দিয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল … একটার পর একটা নাম কানে আসতে থাকে সুদামার। বিজেপির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট জনতা সদস্যেরা কী বলেছেন তার বিবরণ দিচ্ছে সুদর্শনা।

অনিলবরণ লোকটা কী রকম! ও কি সত্যিই সুহাসকে রাগাবার জন্য ওই কথা বলছিল? আশ্চর্য! ওর কথা মনে পড়ল কেন সুদামার? লোকটা নাকি খুন নিয়েই ভাবে সব সময়। কতরকমভাবে মানুষ খুন করা যেতে পারে। মার্ডারের সাইকোলজি, রহস্যের জটিলতায় ওর খুব উৎসাহ। এমন পুরুষ মানুষের সঙ্গে কে থাকতে পারে? ওর বউ চলে গেছে বাপের বাড়ি। কঙ্কনার সঙ্গে সুদামার ভালোই পরিচয়। এই ফ্ল্যাটে দুই মেয়ে নিয়ে কতবার এসেছে অনিলবরণের বউ। কিন্তু অনিলবরণের সঙ্গে সে যে কবে ভালো করে দুটো কথা বলেছে, তা মনে পড়ে না।

অনিলবরণকে মনে পড়ল কেন তার? সুদামা কেমন যেন শিহরিত হয়। কৃষ্ণেন্দু এখন ঘুমিয়ে। সুদামা মেঝের কার্পেটে বসে। মাথার উপরে ছাদ, ছাদে কী চমৎকার গোলাপি রং। ঘরটিই গেলাপি। টিভির খবর পাঠিকার কন্ঠস্বর শুনছে সে। মুখ দেখছে না আর। তার চোখের সামনে হত্যা-বিলাসী অনিলবরণের মুখ ভাসে। লোকটা পিকিউলিয়ার। কথাটা মাঝেমধ্যেই বলে কৃষ্ণেন্দু। আজকাল এই রকম মানুষের দেখা পাওয়াই ভার। শেষ পর্যত যেখানে খুনিও খুনকে সমর্থন করে না, সেখানে অনিলবরণ খোঁজে খুনের প্রয়োগ-পদ্ধতির ভেতরে শিল্প-সুষমা! হাস্যকর! আসলে সকলে যে কথা বলে, অনিলবরণ তার বিপক্ষে চলে। বলে রক্তপাত মৃত্যু ব্যতীত কোন বড়ো কাজটা ঘটেছে পৃথিবীতে! সে মহাভারতের কথা তোলে, মহাভারত রামায়ণ থেকে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, পৃথিবীর নানান যুদ্ধ বিপ্লবের কথা তুলে তার কথার পিছনে যুক্তি সাজায়। বলে ভালোবাসা আংশিক সত্য, হিংসা সম্পূর্ণ সত্য। পৃথিবী থেকে ভালোবাসা কখনও যাবে না এই কথা বলে বহু মান্যজন, তারা ভাবের ঘরে চুরি করে। ভালোবাসার আয়ু কতদিনের? ভালোবাসাই যদি সত্য হত হিটলারের জন্ম হত না এ পৃথিবীতে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে নাৎসিরা ক্লান্ত হয়েছিল, তাদের মন বিকল হয়েছিল বলে শোনা যায় না। আসল সত্য হল পৃথিবীর থেকে হিংসা কখনও যাবে না। সত্য বলতে দোষ কোথায়? আসলে পৃথিবীতে মূল দ্বন্দ্ব তো হিংসা আর ভালোবাসার ভিতরে। বারে বারে হিংসা জিতে গেছে। ভালোবাসা হল হীনবল পিঁপড়ের মতো, তাকে টিপে মারতে কতক্ষণ? অনিলবরণ হিংসার পিছনে দাঁড়ায় তার যুক্তি নিয়ে।

কিন্তু এত রাতে লোকটার কথা মনে পড়ছে কেন? সে কি ওই দীর্ঘদেহী পুরুষটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল। ভাবতেই কেমন গুটিয়ে যায় সুদামা। কী বিচিত্র মানুষ। কঙ্কনার মতো মেয়ের সঙ্গে ওর বনছে না। কৃষ্ণেন্দু বলেছে, আসল কারণ হল অনিলবরণ চায় তার বউ আবার সন্তান দিক, তার মুখাগ্নির জন্য একটি পুত্র। মধ্যযুগের মানসিকতা লোকটার।

সুদামা টিভি বন্ধ করে। টেলিফোন যেখান থেকে আসছিল সেখানে টিভি চলছিল। এক নম্বর চ্যানেলে পার্লামেন্ট নিউজ। তাই কি? ওপরের ফ্ল্যাটে তো টিভি চলে সব সময়। এখনও চলছে। পার্লামেন্ট নিউজের পর বিজ্ঞাপনের গান। তা ভেসে আসছে নীচে। তা হলে পার্লামেন্ট নিউজটা কি ওপর থেকে কানে আসছিল? লাইনটা কি কেটে যাচ্ছে, নাকি রেখে দিচ্ছিল কেউ তার কন্ঠস্বর শুনে। যে বারবার ফোন করছে সে কি তাকে চাইছে না? কৃষ্ণেন্দুর ফোন? ডেকে দিতেও তো বলত তা হলে, ফোন কি খারাপ হল? তাও তো নয়। লাইন কেটে যাওয়ার ব্যাপার আর কেটে দেওয়ার ব্যাপার তো আলাদা করেই ধরা যায়। হ্যাঁ, টেলিফোনের ভেতর থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছিল, ওপরের টিভির শব্দ যদি হত আগে শোনেনি কেন?

সুদামা বসেই থাকে। চোখ জুড়ে যায় প্রায়। আবার কি টেলিফোন বাজবে?

না বোধ হয়। সে ক্রেডল থেকে নামিয়ে রাখে টেলিফোন। এনগেজড হয়ে থাকুক। মশারি তুলে ভিতরে ঢোকে। ঢুকতে ঢুকতে আচমকা সুদামার মনে হয় কেউ হয়তো খোঁজ নিচ্ছে কিছু। আজ তার গ্যাস ওভেনের নব খোলা ছিল, যে ওভেন বেশি ব্যবহার করা হয় না, সেটিই। পাশেরটা অন্যমনস্কের মতো জ্বালিয়ে দিলে ছোটোটা থেকে গ্যাস বেরোতে আরম্ভ করত। কেউ কি সেই খোঁজ …। অবাক হয়ে যায় সুদামা।

ছয়

সকালে কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, আবার ফোন এসেছিল?

হ্যাঁ তুমি তখন ঘুমিয়ে।

শুনছিলাম যেন, কেটে গেল?

না লাইন রেখে দিল। সুদামা বলল।

কৃষ্ণেন্দু চুপ করে থাকে। ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। টেলিফোন তো এইরকম আচরণ করেই থাকে উলটোপালটা লাইন চলে আসে। আবার লাইন কেটেও যায় বারবার। রেখে দেবে কে? কেন রাখবে?

রান্নার মেয়ে বিমলা এসে দ্বিতীয়বার চা দিয়ে গেল। সুদামার মনে পড়ল, বিমলা তুমি কি ওভেনের নব বন্ধ করনি কাল?

করেছিলাম তো! সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে অল্পবয়সী মেয়েটি, স্বামী পরিত্যক্তা, থাকে উলটোডাঙার বস্তিতে।

মনে করে দ্যাখো তো।

হ্যাঁ বউদি, করেছিলাম। বিমলার চোখ মুখের ভাবে কেমন অনিশ্চিত উত্তর।

কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, দুটো ওভেন তো একসঙ্গে জ্বালাও তুমি।

হ্যাঁ দাদা।

কৃষ্ণেন্দু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। কৃষ্ণেন্দু এই ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দিল। গ্যাস ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতেই হয়। সে জেরা করতে থাকে বিমলাকে। বিমলা কেমন কুন্ঠার সঙ্গে জবাব দিতে লাগল। সুদামার মনে হল বিমলা খুব ভয় পাচ্ছে। এর আগে দু-জায়গায় চাকরি খুইয়েছে মেয়েটা। কারণ অবশ্য কাজে অবহেলা নয়। বয়স। প্রখর যুবতি সে। এক সন্তানের মা। কাজে ঢোকার পর গল্প করেছে সুদামার সঙ্গে। উলটোডাঙার এক ফ্ল্যাট বাড়িতে কীভাবে বিপদে পড়েছিল সে। ঘটনার মধ্যে নতুনত্ব বিশেষ কিছু নেই। যা হয়ে থাকে। সহায়হীন যুবতি, কাছে ঘুর ঘুর করে বাড়ির পুরুষরা, সুযোগ খোঁজে, তৈরি করে নেয়। কাজের মেয়েদের দেখে মধ্যবয়সী পুরুষ বিনা ঝুঁকিতে লাম্পট্য করতে চায়। লাম্পট্যের ইচ্ছা আছে, সাহস নেই সুতরাং কাজের মেয়েকে ব্যবহার করা। অনায়াসে সামান্য কিছু হাতে গুঁজে দিয়ে ভোগ করতে চাওয়া। এই ফ্ল্যাটে তেমন কিছু হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কাজটা তো থাকতে হবে। কৃষ্ণেন্দুর প্রশ্নে বিব্রত হয়ে এলোমেলো জবাব দিতে আরম্ভ করেছে বিমলা। প্রথমে বলল, দুটো ওভেনই জ্বালিয়ে ছিল। পরে বলল, না না একটা, বলল আগে সে গ্যাস সিলিন্ডারের নব বন্ধ করে, পরে ওভেন — না, না তা না দাদাবাবু, আগে সিলিন্ডার, পরে উনুন, না না ইস আমি তো জানি দাদাবাবু, পাঁচ বছর কাজ করছি নানা বাড়িতে, সেই কবে থেকে গ্যাসে রান্না করছি, গ্যাস আমার খুব চেনা, গ্যাসের গন্ধও জানি আমি, আমার ভুল হবে না, একবার এফ ডি ব্লকে কী হল…। আমার ঘরে অবশ্য কয়লার উনুন, স্টোভও আছে… আবোল-তাবোল বকছে। শেষে তার সম্বিত ফিরল, একটু থেমে থেমে বলল, আগে সে উনুন বন্ধ করে, পরে সিলিন্ডার।

তখন ফোন বাজল। কৃষ্ণেন্দু উঠে ধরল। কে? আরে এবিজিসি!

সুদামা শক্ত হয়ে গেল। এত সকালে লোকটার ফোন। কাল রাত্তিরে কি ফোনটা সে-ই করছিল, সে-ই রেখে দিচ্ছিল? আচমকা মনে হল যেন তাই। সে উঠল। বিমলাকে নিয়ে কিচেনে ঢুকল। এখন গ্যাস জ্বলছে না।

বিমলা জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল বউদি?

তোমার উনুন খোলা ছিল।

গ্যাস বন্ধ ছিল?

সুদামা তাকিয়ে আছে বিমলার মুখের দিকে, তার মানে, তুমি কি ওভেন বন্ধ করো না?

না না না, তা কেন? বিমলা ভীত হয়ে পড়ে, আগে বন্ধ করি, দুটোই বন্ধ করি। বলছি গ্যাস বন্ধ থাকলে উনুন খোলা থাকলেও তো ভয় নেই।

ভয় আছে। সুদামা বলে।

কীরকম? বিমলা বুঝতে পারে না।

আছে ভয়, শোনো …। সুদামা বোঝাতে থাকে বিমলাকে। একদম ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে ডেমনস্ট্রেশন দেয়। ছোটো ওভেনের নব খোলা, চায়ের জল চাপালে বড়ো ওভেনে। গ্যাস সিলিন্ডার চালু করে দিয়ে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে বড়ো ওভেনের মুখে ধরলে। বড়ো ওভেন জ্বলে উঠল। জল গরম হতে লাগল, তখনও খেয়াল করনি যে ছোটো ওভেনের নব অন করা। গ্যাস বেরোচ্ছে। কী ভীষণ ব্যাপার বলো দেখি বিমলা!

বিমলা ভয় পায়, তা কেন হবে বউদি, খোলা উনুন দিয়ে গ্যাস বেরোলে গন্ধ পাব না?

না পাবে না। কী করে পাবে। তেল-মশলার গন্ধে মিশে যাবে। আর যদি অন্যমনস্ক হও, তুমি করেছিলে?

না না, আমি না, সত্যি বলছি আমি না। বিমলার চোখে কর্মহীন হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক ফুটে ওঠে, বিশ্বাস করুন।

সুদামা চুপ করে থাকে। বিমলা কাঁপছে ভয়ে।

বিমলা বলল, আমি তো ভালো করে দেখেশুনে তারপর যাই বউদি, আর ছোটো উনুন তো জ্বালাইনে, ওতে সময় বেশি লাগে।

কেন, দুটো একসঙ্গে হয়, শেষ পর্যন্ত তো সময় বাঁচে। গ্যাসে তো এই সুবিধে।

হতে পারে বউদি, কিন্তু আমার যে কী হয়, গলা জড়িয়ে যায় বিমলার, ভুল করে ফেলি, ডাল আর মাছ একসঙ্গে চাপিয়ে যেটাতে নুন দেওয়ার কথা সেটাতে চিনি দিয়ে দিই, আবার মিষ্টির জায়গায় নুন, মাছের ঝোলের জিরেবাটা আমি ডালে দিয়ে ফেলেছিলাম একবার। একসঙ্গে দুটো রান্নায় মন বসে না। কোনোটাই ভালো মতো হয় না, অভ্যাস নেই।

সুদামা অবাক, অভ্যাস নেই মানে, এখানেই তো এক বছর কাজ করছ।

এখেনে তো দুজনের রান্না, দরকার কী দুটো একসঙ্গে চাপানোর, আর সব জায়গায়, মানে এর আগে যেখানে যেখানে কাজ করেছি, রান্না তো করতে হয়নি, যদি করতে হয়েছে তো এই রকম ফেমিলি, রান্নার অভ্যেস তো একদিনের নয়।

বাড়িতে তো অনেক লোক তোমার?

কুন্ঠায় জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে বিমলা, মাথা কাত করে বলছে, হ্যাঁ মা বাবা ভাই বুন, আছে অনেক। কিন্তু আমার ঘরে তো গ্যাস নেই। কয়লার তোলা উনুনে একটাই রান্না হয় একবারে। আমি তো অনেকদিন ধরে রান্না করি। ওই অভ্যেসটা রয়ে গেছে। আর ওই ছোটো উনুনের অল্প আগুন পছন্দ হয় না আমার, গ্যাসের উনুনে দুটোই বড়ো থাকে না কেন?

সুদামার মনে পড়ল। এই একই কথা তার বড়ো-জা যুথিকা বলত, যখন তারা বেলগাছিয়া থাকত। হ্যাঁ ডানদিকের ছোটো ওভেনটা তারও খুব পছন্দ হয় না। সেও তো বড়ো একটা জ্বালায় না ওটা।

বিমলা বলল, আপনি বউদি ভুল করে — না না আমারও ভুল হতে পারে, মাপ করে দিন, তবে কিনা এরকম ভুল তো হয়নি আগে, তবে গ্যাসটা যখন বন্ধ ছিল, তখন নিশ্চিন্ত, এবার থেকে সব দুবার করে দেখে বেরোব।

সুদামা মাথা নাড়ে, ডানদিকেরটা খোলা রেখে বাঁদিকেরটা জ্বালানো তো বিপজ্জনক, গ্যাসে বেরোতে বেরোতে ঘরে জমে যাবে একটু বাদেই, যাক গে সাবধানে করো।

কিচেন থেকে বেরোতে বেরোতে সুদামা ভাবে সেই কি তা হলে ভুল করে? কিন্তু তারও যে অভ্যাস বড়োটি জ্বালানো। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে সে প্রথমে ডানদিকেরটা খুলেছে, পরে অভ্যাস মতো বাঁদিকেরটায় জল চাপিয়েছে। একজনের চায়ে আর কত জল লাগে। বাঁদিকের অনেকটা আগুনে দ্রুত জল গরম হয়ে গেছে। ডানদিকেরটা খোলাই রয়েছে। সে কি ভুল করে আগে ওভেন খুলে, তার উপরে পাত্র চাপিয়ে পরে সিলিন্ডারের নব ঘুরিয়েছিল। ফলে বড়ো ছোটো দুটো ওভেনই খোলাই রইল। সামান্যক্ষণ লাগল চা করতে, তাই খেয়ালও হল না খোলা রয়েছে ছোটো ওভেন। গ্যাস তো তারপর বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক মিনিট ধরে কাঁচা গ্যাস বেরিয়েছিল নিশ্চিত। খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়েও গিয়েছিল। সে যদি অনেকক্ষণ ধরে রান্না করত তা হলে হয়তো তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস জমে যেত ঘরের ভেতরে ধীরে ধীরে। তারপর আচমকা আগুন …। পেট্রোলিয়াম গ্যাসে শ্বাস নিলে কী হয়? ফুসফুস ফেটে যায়?

কৃষ্ণেন্দু ডাকল, তোমাকে ডাকছে অনিলবরণ?

কেন?

কৃষ্ণেন্দু রিসিভার কানে রেখে হাসছে, ও বলছে কাল সন্ধেয় কীসব আবোল-তাবোল বকেছে, অ্যাপোলজি চেয়ে নেবে।

আমাকে তো কিছু বলেনি। সুদামার ভ্রূ কুঞ্চিত।

তোমাকে না বলুক, বলেছে তো। ফোনটা ধরো।

তার জন্য আমার সঙ্গে কী কথা, যা শুনেছে সব তো ওই সুহাস।

আহা সে তো দুজনেই বলেছে, কিন্তু ও বলছে ওর মনে হচ্ছে কথাগুলো তোমার সামনে না হলেই ঠিক হত …

সুদামা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে, গতকালের সন্দেহটা আবার জেগে ওঠে তার ভেতরে, সে বলল, কাল রাতে কি অনিলবরণ —?

না, না ও তো বলছে ও করেনি।

সুদামা ফোনটা নিল কৃষ্ণেন্দুর হাত থেকে। কানে চেপে দাঁড়িয়ে থাকল। ওপারে অনিলবরণের কন্ঠস্বর। সুদামার মনে হল কাল এই ফোনই দুবার এল, দুবার কেটে গেল। সে জিজ্ঞেস করে, ফোনটা কেটে দিচ্ছিলেন কেন?

কই না তো! ওপারের কন্ঠস্বর জড়িয়ে গেল, কখন কাটলাম, ধরে আছি তো!

এখন নয়, কাল রাতে। সুদামা বলল।

না, না, আপনি ভুল করছেন। ওপারের কন্ঠস্বর কাঁপছে।

আমার তো মনে হচ্ছিল —

ওপারের মানুষ হাসছে, কী করে মনে হল আপনার, ডিড য়্যু এক্সপেক্ট মাই কল, আপনি কি ভাবছিলেন আমি ফোন করতে পারি?

সকালে যখন সন্ধের বিষয়ে নিয়ে ফোন করছেন, রাতে বাড়ি ফিরেও তো করতে পারতেন?

বাহ নেশা কাটতে যে রাত গেল।

কিন্তু কয়েকবার তো চেষ্টা করেছেন, ফোন বেজেওছে এ বাড়িতে। সুদামা বলল।

ওপারে অনিলবরণ চুপচাপ। তারপর আচমকাই জিজ্ঞেস করে, গ্যাস নিয়ে কী যেন প্রব্লেম হয়েছিল? কৃষ্ণেন্দু বলছিল।

ও কিছু না, রাখছি।

কী হয়েছিল, রেগুলেটর খারাপ?

আপনাকে বলেনি কৃষ্ণেন্দু?

না, বলছিল একটা প্রব্লেম। যাক গে মিটে গেছে তো। আমি আসলে বলতে চাইছি, সন্ধেয় অত চিৎকার করেছি …।

ও তো আপনার অভ্যেস।

ওপারে হাসি, হ্যাঁ, একটু বেসামাল হয়ে যাই সুদামা চ্যাটার্জি। সহজ হয়ে উঠতে চায় অনিলবরণ।

সুদামা ফোন রেখে দেয়। কৃষ্ণেন্দু স্নানে গেছে। সুদামা আবার কিচেনের দরজায়। বিমলা কড়া চাপিয়েছে। সুদামা ফিরে এল বেডরুমে। সেখান থেকে ব্যালকনিতে। তারপর হঠাৎ মনে হয় নীলকে চিঠি লিখতে হবে। কালই লিখবে ভেবেছিল, ভুলে গেছে সে।

সাত

ভুলে যাচ্ছে সুদামা। প্রায় দিন-সাতেক এসেছে ছেলের চিঠি। জবাবটা দেওয়া হয়নি। গতকালই লেখার কথা ছিল। একদম মাথায় ছিল না। অথচ এর আগে নীলের চিঠি দুপুরে এলে, বিকেলে সে উত্তর লিখতে বসত। নিজে লিখে জায়গা রেখে দিত কৃষ্ণেন্দুর জন্য। রাতে তাকে দিয়ে লিখিয়ে পরদিন নিজে হাতে পোস্ট করতে বেরোত। এখন যে কী হয়েছে! টানই চলে যাচ্ছে যেন! আগে, এই ফ্ল্যাট, বেহালার সরকারি আবাসন, নীলবিহীন ভাবাই যেত না। একদিন নীল ডালিমতলা কিংবা বেলগাছিয়া থেকে গেলে ফ্ল্যাট হয়ে যেত শূন্য। মনে হতো একজন নেই। এখন নীল যখন আসে, মনে হয় অতিরিক্ত কেউ একজন এসেছে, যে এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নয়। তার ফলে ফ্ল্যাটের স্বাভাবিকতা ভেঙে পড়ছে। নিঃঝুমতা ভেঙে যাচ্ছে। নীল না থাকলে কেউ যে একজন নেই তা আর মনে হয় না। মনেই হয় না নীলের জন্য বড়ো ব্যালকনিটা অপেক্ষা করে থাকে সন্ধেয়। বড়ো ব্যালকনিতে যে টেলিস্কোপ বসাবে। টেলিস্কোপে চোখ দিয়ে রাতের আকাশ দেখবে।

নীলের চিঠি রাখল কোথায় সে? নীলের চিঠির কাগজ খাম সাদা পায়রার মতো ডানা মেলে দূর পাহাড় থেকে এই সমতলে উড়ে আসে। খাম প্যাড সুদামা নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল ছেলেকে। সেই খামের উপর সুন্দর কিন্তু একটু অগোছালো অক্ষরে নাম ঠিকানা লিখে ছেলে যেন উড়িয়ে দেয় তার হোস্টেলের কাচের সার্শি খুলে। এতটা পথ, নানান ডাকঘর, নানান ডাককর্মীর হাত ঘুরে ঘুরে এসেও খাম একটুও ময়লা হয় না। বোধহয় অত দুধ-সাদা রঙে, সাত রঙের খাঁটি মিশ্রণে উদ্ভূত সাদায় ময়লা হাত ফেলতে সঙ্কোচ বোধ করে ডাককর্মীরা। সাবধানে ছোঁয়।

সুদামা সেই সাদা পায়রাটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এখন। কোথায় যে রাখল! আগে এমন হতো না তো। নীলের চিঠি চোখের সামনে টেলিফোন স্ট্যান্ডের একধারে। শুধু নীলের চিঠি থাকে সেখানে। যতক্ষণ না স্বামী-স্ত্রীর পাঠ সম্পূর্ণ হয় ততক্ষণ, তারপর জবাব লেখা হয়ে কলকাতার চিঠি ক্যুরিয়র কিংবা স্পিড পোস্টে জমা করা হয়ে গেলে নীলের চিঠি সুদামার নিজস্ব হেফাজতে চলে যায়। চিঠিগুলো সে জমিয়ে রাখে। দশ বছর বাদে নীল বড়ো হয়ে গেলে তার হাতে তুলে দেবে বাবা-মায়ের কাছে লেখা তার মনের বিবরণ। সুদামা এইভাবেই ভেবে রেখেছে।

কোথায় গেল? টেলিফোনের পাশে নেই। এখানেই কি রেখেছিল, নাকি অন্য কোনো জায়গায়? সুদামা ঘরের বাইরে লিভিং স্পেসে যায়, খবরের কাগজের স্ট্যান্ডের উপরটা দ্যাখে। গুটিকয় ম্যাগাজিন এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সুদামা। এমন তো হওয়ার কথা নয়। নীলের চিঠি তো যত্নে রাখে।

সুদামা ডাকল বিমলাকে, চিঠিটা কোথায় গেল জান বিমলা?

বিমলা আঁচলে হাত মুছতে মুখ বাড়ায় কিচেন থেকে, কী চিঠি?

সুদামা জবাবা না দিয়ে আবার ঘরে ভেতরে এল। বিছানার চাদর তোশকের কোণ উলটে দেখল। না। বিছানার নীচে তো সে রাখে না কোনোদিন। সুদামা আবার বাইরে এসে ম্যাগাজিনগুলো উলটোতে লাগল। একটি পত্রিকা দিল্লির তন্দুর হত্যা নিয়ে বিস্তৃত রিপোর্ট ছেপেছে। দু-দিন আগে সে পড়ছিল দুপুরে, তার ভেতরে নীলের চিঠি লুকিয়ে গেল নাকি? পরপর করে পাতা উলটোতে থাকে সুদামা। নীলের চিঠির খোঁজ নেই। সুদামা হাতে ম্যাগাজিনটা নিয়ে আবার ঘরে আসে। বিছানার উপর ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে দেয়। অবাক লাগছে। নীলের চিঠি কি সে ফাইল বন্দী করে ফেলেছে? পুরোনো চিঠির ভেতরে চালান করে দিয়েছে ভালোভাবে না পড়ে, জবাব না দিয়ে? হ্যাঁ, ভালোভাবে পড়া হয়নি, কেন হয়নি তা বুঝতে পারে না সুদামা। তবে হ্যাঁ, ওই যে নীল লিখেছে, মাম, এবারে সামার ভ্যাকেশন কলকাতা নয়। ওইটুকু পড়ে সে রেখে দিয়েছিল। প্রথম পঙক্তিটিই তাকে আচমকা নিস্পৃহ করে দিয়েছিল। পরে তো অনেক কথা লিখেছে তার সন্তান। সেগুলিও তো পড়তে হবে। সামার ভ্যাকেশনের তো দেরি আছে। আর ক-দিনেরই বা ভ্যাকেশন। আসলে ফাইনাল একজাম হওয়ার পরে কয়েকটি দিন ছুটি। ওই হিল স্টেশনে তো সামারই সবচেয়ে ভালো ঋতু। সুন্দর ঋতু। কিন্তু মা-বাবার কাছে আসার সময়ের চেয়ে সুন্দর ঋতু আর কী হতে পারে?

স্নান শেষ করে কৃষ্ণেন্দু বলে, অনিলবরণের সঙ্গে কথা বললে না?

হ্যাঁ, কিন্তু নীলের চিঠিটা কোথায় রেখেছি বলো তো? জবাব দেব, চিঠিটা পাচ্ছি না।

কৃষ্ণেন্দু বলল, ও তো আমার ব্যাগে।

রাগ করল সুদামা, বলবে তো।

পড়ব বলে নিয়েছি।

দাও, জবাব লিখব।

কৃষ্ণেন্দু গায়ে শার্ট পরতে পরতে বলে, পড়া হয়নি আমার।

পড়া হয়নি? অবাক সুদামা।

না, সময় পেলাম কই, ও এই সামারে আসবে না বলছিলে না?

পড়ে দ্যাখো। সুদামা ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায়।

আজ পড়ে ফেলব, হ্যাঁ অনিল কী বলল। কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করে, ও কেমন যেন, তাই না?

সুদামা ঘুরে তাকায়, ফোন ও-ই করেছিল রাতে।

তাই! বলল সে কথা?

বলেনি, কিন্তু মনে হল যেন।

মনে হল মানে? কৃষ্ণেন্দু কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেল।

মনে হল মানে মনে হল, সব ঘটনার অকাট্য প্রমাণ তো হয় না, আন্দাজ করছি ও-ই টেলিফোন করছিল।

কৃষ্ণেন্দু হাসে, ও কেন খামোকা ফোন করে লাইন কেটে দেবে?

সুদামা বলল, খবর নিতে চাইছিল।

তার মানে?

ওই লোকটা সুবিধের নয়। ওকে আমি কোনোদিনই পছন্দ করি না। ওইরকম একটা হিংস্র প্রকৃতির লোকের সঙ্গে কী করে যে তোমার বন্ধুত্ব হয়। সুদামা বলে।

কৃষ্ণেন্দু হাসতে থাকে, আরে ওসব ও এমনি বলে। আজকে তো প্রথম বলছে না?

বলবে কেন, কোন কথা বলতে নেই তা জানে না, ও কাল রাত্তিরে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল না বলেই হয়তো ফোন রেখে দিচ্ছিল, অথবা—।

কৃষ্ণেন্দু ঠিক ধরতে পারে না সুদামা কী বলতে চাইছে। অনিলবরণ কেন ফোন করে লাইন কেটে দেবে? কী খোঁজ নেবে? সে যতটা জানে অনিলবরণের নারী-সংক্রান্ত কোনো দুর্বলতা নেই। সে পছন্দই করে না মেয়েদের। বন্ধুর স্ত্রীকে বিরক্ত করার মতো মানুষ অনিলবরণ নয়। হ্যাঁ সুদামার তো অপছন্দ হতেই পারে, অনেকেরই হতে পারে যখন অনিলবরণ নরহত্যার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করতে চায়, খুনির পক্ষে কথা বলে।

কৃষ্ণেন্দু বলে, আসলে অনিলবরণ কিন্তু ভিতু মানুষ, প্রচুর থ্রিলার পড়ে ওর মাথা বিগড়ে গেছে, আবার এর ভিতরে ওর চালাকিও আছে, ওইসব কথা বলে ও লোককে রাগিয়ে দিতে চায়, ত্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত মানুষ দেখতে ওর ভালো লাগে।

আরও অনেক কিছুই ভালো লাগে, আমার ধারণা বারবার ফোন করে ও খোঁজ নিতে চাইছিল কোনো কিছুর, না হলে সকালে ফোন করবে কেন? কী দরকার, একটু বাদেই তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে, সকালে ফোন করে হতাশই হয়েছে মনে হয়। অ্যাপোলজি-টজি ফালতু কথা। ও একটা ব্যাপার ঘটাতে চেয়েছিল মনে হয়। চতুর। থ্রিলার, ক্রাইম স্টোরি লিখতে লিখতে ও নিজেই ক্রাইম ঘটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল —।

কী আবোল-তাবোল বকছ তুমি! এবার কৃষ্ণেন্দু রেগে ওঠে।

সুদামা বলল, ঠিক-ই বলছি।

কৃষ্ণেন্দু বলে, তুমিও দেখছি অদ্ভুত সব কল্পনা করতে আরম্ভ করেছ। অনিলবরণের মতো।

সুদামা চুপচাপ। তার যা মনে হচ্ছে, যে সম্ভাবনার কথা ক্ষীণ হয়ে মাথায় উঁকি মারছে, তা তো অনিলবরণকে জড়িয়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটি কাল্পনিক দৃশ্য। তার আগের দৃশ্যটি তো তার জানা। সুহাস আর অনিল আচমকা উঠল। সুহাস আবার বসে পড়ল। কমবয়সী সুহাস এতই রেগে গিয়েছিল যে অনিলবরণের সঙ্গে যেতে চায়নি। এইটুকু জানা। অনিলবরণ উঠল। সুদামা তখন ব্যালকনিতে বসে। একা একা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল মানুষটা। ঘর থেকে সদর দরজায় যাওয়ার মধ্যে ঘটে গেল আর একটা ব্যাপার, সকলের অলক্ষে। সুদামা শক্ত হয়ে যায়। তার শীত করে যেন। মানুষটা কি খোলা কিচেনে ঢুকে পড়ল। নেশায় টলমল পা। একটু খেলা করে চলে গেল। নেশার জন্যই সবটা ঠিকঠাক করা হয়ে ওঠেনি ওর। তারপর বাড়ি গেল। অনেক রাতে ফোন। ফোনে খোঁজ নিতে লাগল, আন্দাজ করতে লাগল। শান্ত ঘরে শান্ত কন্ঠস্বর শুনতে তো চায়নি ও। সুদামা ভাবতে ভাবতে বসে পড়েছে কার্পেটে। বিমলা ঢুকল কৃষ্ণেন্দুকে ডাকতে। খেতে দিয়েছে। ডাকল সুদামাকেও।

ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে সুদামা বলল, চিঠিটা রেখে যাবে।

সঙ্গে থাক, পড়ে নিই। কৃষ্ণেন্দু বলে।

আট

কথাটা হাসতে হাসতে বলেছিল কৃষ্ণেন্দু, বয়স হচ্ছে, এখন ওসব ছাড়ো দেখি অনিল, তোমার ঠাট্টাগুলো কেউ আর ঠাট্টা বলে ভাবে না।

ভ্রূ ভাঁজ হয়ে গেছে অনিলবরণের, কোন ঠাট্টা?

নেশা করে সেদিন যা বলেছ।

অনিলবরণ বলল, সে তো খুব খারাপ ব্যাপার হয়েইছে, আমি তো সেইজন্যই ফোন করলাম সকালে, একজন মহিলার সামনে এসব আলোচনা কি ঠিক? ঠিক নয়।

ঠিক নয় তো বললে কেন ওসব? কৃষ্ণেন্দু বলে।

বলে ফেলেছি, সুহাসই তো কথা তুলল, কেন সুদামা কি কিছু বলেছে?

ও তো খুব রেগেই গেছে, বলছে তুমি একদিন ক্রাইম করে ফেলবে।

হা হা করে হাসছে, অনিলবরণ, করতে তো ইচ্ছেই হয়।

কৃষ্ণেন্দু অবাক হল, সত্যি বলছ?

কেন, তোমার ইচ্ছে হয় না?

পাগল। অনিলবরণের মাথার ভিতরে কলকব্জা বিগড়ে গেল নাকি। তা হলে কি সুদামার সন্দেহটা ঠিক! গ্যাস ওভেন অন করে চলে গিয়েছিল অনিলবরণ।

কৃষ্ণেন্দু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

কিছু বলবে আর? অনিলবরণ জিজ্ঞেস করে।

তা হলে তো সুদামা মিথ্যে বলেনি, আচ্ছা তুমি কি রাতে ফোন করছিলে?

না তো! অনিলবরণ যেন চমকে ওঠে, কী ব্যাপার বলো দেখি, সুদামাও জিজ্ঞেস করছিল, রাতে কে ফোন করছিল!

লাইন রেখে দিচ্ছিল বার বার।

অনিলবরণের চোখ-মুখে রহস্য আবিষ্কারের আবেশ, আমেজ। সে সিগারেট ধরিয়ে কৃষ্ণেন্দুকে বলে, তুমি চা খাবে?

না, না আমার সময় নেই, উঠব এখনই।

আরে রাখো তো তোমার কাজ, আচ্ছা কী হয়েছিল তোমার ফ্ল্যাটে, গ্যাস ভরতি হয়ে গিয়েছিল? বললে না তো টেলিফোনে।

কৃষ্ণেন্দু অনিলবরণকে জরিপ করে। লোকটা কি খুনি? সত্যি সত্যি চায় যে মানুষ খুন হয়ে যাক। তার এই সহকর্মী কি খেলার ছলে ওভেনের নব অন করে চলে এসেছিল? সুদামা তো বলছে সেই কথা। সুদামার কথাটা অবশ্য আন্দাজে। সে মনে করছে তাই। সে বলছে অনিলবরণই রাতে রিং করে আন্দাজ করতে চেয়েছিল ফ্ল্যাটে কী হচ্ছে। ফ্ল্যাটে আগুন ধরল কিনা। ঠিক এই ভাবেই ক-বছর আগে এক অভিনেত্রী পুড়ে মারা গিয়েছিল। তার কিচেন ভরতি হয়েছিল কুকিং গ্যাসে। ভেতরে গিয়ে দেশলাই ঠুকে দিতেই ফ্ল্যাট জ্বলে ওঠে।

অনিলবরণ জিজ্ঞেস করে, কী হল কথা বলছ না কেন? কী ভাবছ?

কৃষ্ণেন্দু বলে, তুমি যা বলো সত্যিই কি তা বিশ্বাস করো?

কী কথা?

ভায়োলেন্স, মার্ডার, ডেথ?

অনিলবরণ বলে, মার্ডার! আচ্ছা তোমার ভালো লাগে না ভায়োলেন্স?

সিনেমা, বইয়ের ভায়োলেন্স কি সত্যি বলে ভাবে কেউ?

অনিলবরণ বলে, আমার রক্ত গরম হয়। আসলে কী জানো মার্ডার নিয়ে আমি সত্যিই ভাবি, এমন ভাবে একটা খুন হবে, যাতে হত্যাকারীর পরিকল্পনার বৈচিত্র্য তোমাকে মুগ্ধ করবে, হত্যাকারী যে কতটা ইনোভেটিভ তা তুমি টের পাবে। আমি চাই সেইরকম একটা উপন্যাস লিখতে। হ্যাঁ ফ্ল্যাটে কী হয়েছিল?

কৃষ্ণেন্দু বলল, কেউ একজন ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক চেয়েছিল লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসে ফ্ল্যাট ভরতি হয়ে যাক।

চমকে ওঠে অনিলবরণ, তার মানে?

তাই-ই হয়েছিল, ওভেনের নব খোলা, সিলিন্ডারটি একটু বাঁকানো ছিল, নবটা ভেতরের দিকে, খুঁজে পায়নি বোধহয়। সিলিন্ডার বন্ধ ছিল।

অনিলবরণের দাঁতে ঠোঁট, সে যেন কী ভাবছে, তারপর বলল, আমিও ঠিক এই রকম ভাবছিলাম, শোনার পর থেকে এইরকম মনে হচ্ছিল আমার। আমি ভাবছিলাম এটাও মার্ডারের একটা দারুণ উপায় হতে পারে। শোনার পর প্রথমে ভাবলাম রেগুলেটর খারাপ হতে পারে, তা থেকে গ্যাস লিক করছে। পরে যা শুনেছি, এখন যা শুনছি মনে হচ্ছে আচমকা একটা সূত্র পেয়ে গেলাম আমি।

কৃষ্ণেন্দু বলল, সূত্র পাওয়ার কিছু নেই। ওভেনের আগে সিলিন্ডার বন্ধ করে আর ওভেন বন্ধ করেনি সুদামা বা আমার মেডসারভেন্ট। এটা একটা মিসটেক। আর এমন ভুল হয়েই থাকে, সুদামা শুধু শুধু ব্যাপারটাকে ঘোলা করছে। বলতে বলতে ওঠে কৃষ্ণেন্দু। তার মনে হচ্ছিল এ নিয়ে কথা বলা রুচি-গর্হিত ব্যাপার হবে।

আরে উঠছ কেন, বসো। অনিলবরণ উঠে হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণেন্দুকে চেয়ারে বসিয়ে দেয় আবার, সবে জমে উঠছে রহস্য, তুমি উঠে যাচ্ছ। চা খাও।

বেয়ারা ডেকে চায়ের কথা বলে অনিলবরণ ঘোষচৌধুরী সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে ধরে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। নাও, মগজে ধোঁয়া দাও। তুমি তো সত্যিই একটা মার্ডার স্টোরির কথা বলছ, হ্যাঁ একজন গ্যাস সিলিন্ডার এবং ওভেন অন করে কিচেনের দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। তারপর ভিকটিম হয়তো জ্বলন্ত সিগারেট, মহিলা হলে কিচেনে ঢুকে ওভেনে — আচ্ছা গন্ধ তো পাবে, ঢুকলেই তো টের পাবে? তোমার কি মত?

কৃষ্ণেন্দু বলল, আমার কোনো মত নেই, খুন নিয়ে আলোচনা করতে, পরিকল্পনা করতে আমার ভালো লাগে না, তুমি কি পাগল! এসব নিয়ে ভাবো কেন?

অনিলবরণ বলে, ভাবতে ভালো লাগে।

তোমার ওয়াইফ ফিরেছে?

অনিলবরণ অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ে, বিড়বিড় করে, কঙ্কনা ইদানীং আমাকে পছন্দ করছে না, আর আমার ইচ্ছে আর একটা বেবি, ও বলছে হবে না। দুই মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি।

কৃষ্ণেন্দু হাসে, এটা কোনো সমস্যা হল, তোমারই তো দোষ, আবার বাচ্চা, দুটোতে হচ্ছে না, তোমার বউ তো ঠিক বলছে।

অনিলবরণ বলল, একটা ছেলে হলে খারাপ হত?

এই বয়সে ছেলে। হাসতে থাকে কৃষ্ণেন্দু, পারো বটে, যাও শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিয়ে এসো ওদের।

অনিলবরণের ঘরে চা আসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে বলল, ওভাবে তো মার্ডার করা যায়, যায় না?

কৃষ্ণেন্দু বোঝে তার শেষের বাক্যগুলি শোনেনি অনিলবরণ, তার মাথার ভেতরে আবার মার্ডার-মিস্ট্রি ঢুকে গেছে। সুদামাই-বা কী করে ভাবল কাজটা অনিলবরণের? ওভেন খুলে দিয়ে বাড়ি গিয়ে অনেক পরে ফোন করছিল। কিন্তু নিরুত্তাপ কন্ঠস্বর শুনে টের পেয়েছে তার পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সুদামার মাথার ভেতরটাও যেন বিগড়েছে। চা খেয়ে কৃষ্ণেন্দু ওঠে। তাকে আর বসাতে পারে না অনিলবরণ।

একা রহস্য ঔপন্যাসিক জানালা দিয়ে রোদে পোড়া আকাশের দিকে তাকায়। মনে হয় যেন আকাশই সব জানে। আকাশই বলে দিতে পারে পরিকল্পনাটা কেমন হতে পারে। আচ্ছা কুকিং গ্যাসের গন্ধতেই তো টের পেয়ে যাবে ভিকটিম, যদি না সে খুব উদ্বিগ্ন থাকে, ডিস্টার্বড থাকে, যদি না তার মনে খেলা করে অন্য কোনো বিষয়। ভাবতে ভাবতে কিচেনে ঢুকে সিলিন্ডার অন করতে গিয়ে অন করা দেখেও তখন তার মনে কোনো সন্দেহ আসবে না। সে ওভেনের নবে হাত দিয়েও অন্য প্রসঙ্গে জড়িয়ে থাকবে মনে মনে, তারপর দেশলাই জ্বালতেই ঘর আগুনে ভরতি। খুন সম্পন্ন হল। একজন খুন হয়ে গেল।

সুদামা যেভাবে ভেবেছে, কৃষ্ণেন্দু যা ভেবেছে তা কি টের পায়নি অনিলবরণ? প্রকারান্তরে তাকেই যেন সন্দেহ করল। সন্দেহ তার উপরে পড়ায় অনিলবরণের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনার জন্ম হল। সে পর পর সিগারেট ধরায়। তার মনে হল ওভাবে হতে পারে। কিন্তু তার জন্য ভিকটিমকে থাকতে হবে চরম অসতর্ক। তার চেতনায় বাস্তবতা তখন, সেই মুহূর্তে, যেন ধীরে ধীরে অপসৃত হবে। এই রকম কোনো পরিবেশ হলে তবে হতে পারে তা। তা হলে খুনিকে আর একটা কাজ করতে হয়। তার শিকারকে অসতর্ক, উদ্বিগ্ন করে তোলা। সুদামা কি সেইদিন তেমন ছিল? তার আর সুহাসের তর্কে সুদামা নিজে হয়ে উঠেছিল উত্তেজিত, ফলে অসতর্ক। তা হলে তো ঘটেও যেতে পারত ভয়ংকর কিছু, যদি সিলিন্ডার খোলা থাকত, কিচেনে জমে থাকত গ্যাস।

অনিলবরণ সাদা কাগজে ডটপেন দিয়ে নানারকম আঁকিবুকি কাটে। নানারকম ভাবে। বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, ভিকটিম অসতর্ক, উদ্বিগ্ন, কোনো কারণে উত্তেজিত থাকবে না। স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু তার কিচেন ভরতি হয়ে আছে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসে। তখন আলো নিভল, হয়তো লোডশেডিং বা কেবল ফল্ট। না, তা হবে না। কোনো পরিকল্পনার সঙ্গে আকস্মিকতাকে জোড়া যায় না। খুনিকে কেউ সাহায্য করে না। খুনির কোনো ভাগ্য নেই। ভাগ্য বলে খুনি কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারে না। সবই তাকে নিজে করতে হয়। নিখুঁত পরিকল্পনায়। একেবারে একা একা। ফ্ল্যাটের ইনভার্টার খারাপ, এমারজেন্সি লাইটও খারাপ, কারণ তা এখন ব্যবহার হয় না। লোডশেডিং তো উঠেই গেছে। এখন বিদ্যুৎ অতিরিক্ত। এখানে যা হতে পারে, তা হল হত্যাকারী নীচে নেমে মেইন সুইচটা অফ করে দিল। আলো নিভতেই হতচকিত ফ্ল্যাটের দুই মানুষ, স্বামী-স্ত্রী। কোনো রকমে একটি মোমবাতি জোগাড় হল এখানে ওখানে খুঁজে। তা জ্বালিয়ে অনেক পুরোনো লন্ঠনের খোঁজ করতে পারে স্ত্রী। তা আছে কিচেনের সেলফে। মোমবাতি হাতে কিচেনের দরজা খুলতেই আগুন জ্বলে গেল বাতাসে ভাসা গ্যাসে।

ভাবতে ভাবতে শিহরিত, উত্তেজিত হয় অনিলবরণ। উত্তেজনায় সে ঘেমে যায়, তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে ওঠে। শরীরে ভাঙতে চায় যেন। অনিলবরণ চেয়ার থেকে উঠে তার অফিস চেম্বারের অপরিসর খালি জায়গাটিতে পায়চারি করতে থাকে। তারপর কী হল? হত্যাকারী বাড়ি ফিরে গিয়ে ফোন করল। ফোন বেজেই যায়। অথবা ফোন বাজেই না। বাজে না কেননা তখন আগুন ছড়িয়ে গেছে ফ্ল্যাটটির সব ঘরে। টেলিফোন পর্যন্ত পুড়ে গেছে। অথবা ফোন কেউ তোলে, স্বামী, খবরটা দিল। কন্ঠস্বরের উত্তেজনাতে ধরা গেল কিছু হয়েছে। ফোন রেখে দিল অপরাধী।

এইভাবে হত্যা যদি করা হয় তা কি নতুন ধরনের কিছু হবে? লোকে তো ধরবে এটি দুর্ঘটনা। সূত্র একটি, সূত্র আছে, প্রথমত হত্যাকারী সেই সন্ধ্যায় ওই ফ্ল্যাটে ছিল। আর ফোন এসেছিল একটা। সেই ফোনটি বেজেছিল, কিন্তু ফ্ল্যাট থেকে সেই ফোন তোলা হলে ওপারে লাইনটি কেটে দিয়েছে কেউ। সে অপরাধী, জানতে চাইছিল তার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে কিনা।

সব গোলমাল হয়ে যেতে থাকে অনিলবরণের। তার মনে হতে থাকে সুদামার সন্দেহটা একেবারে অমূলক নয়। সন্দেহ করতেই পারে। ওই সন্ধ্যায় যদি খুনের এই বিচিত্র পরিকল্পনাটা মাথায় আসত, তা হলে তো সে এই পরিকল্পনাটা যাচাই করে নিত সুদামার কাছে। আলোচনা করত তার সঙ্গে।

অনিলবরণ টেলিফোনের সামনে যায়। কিন্তু ডায়াল করতে তার হাত কাঁপে। সে ভাবছে জিজ্ঞেস করবে সুদামাকে এমন আশ্চর্য বিষয়টি তার মাথায় এল কী ভাবে? সেও কি নানারকম খুনের কথা ভাবে? অনিলবরণ অনেকদিন আগে তার একটি উপন্যাস পড়তে দিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু-সুদামাকে। কেউই পড়ে উঠতে পারেনি। তাতে তো শুধু রিভলবার পিস্তলের ব্যবহার ছিল। না, ওই বইটা পড়তে হবে না সুদামাকে। নতুন উপন্যাস সে আরম্ভ করবে খুব শিগগির। সেই উপন্যাসে মৃত্যু নিয়ে তার নিজস্ব মতামত থাকবে।

অনিলবরণ সিগারেট ধরিয়ে ঘরের বাইরে আসে। লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। করিডোরটাকে কেমন রহস্যময় মনে হয় তার। ফালি ফালি আলো, অন্ধকারে ঢাকা। এপার থেকে ওপারের মানুষকে ঠিক চেনা যায় না। এমন একটি করিডোরকে হত্যাকাণ্ডে চমৎকার ব্যবহার করা যায়। খুনি বেরিয়ে যাচ্ছে কাজ শেষ করে। তার জামার রং সবুজ। দূর থেকে জামার একটি কোণ দেখা যায়। যে লোকটিকে দেখে মনে হয় তার গাত্রবর্ণ অন্ধকারের মতো কালো —।

এ সব কী ভাবছে সে! এ তো অন্য গল্প, অন্য খুন। সুদামার বানানো গল্পটির সঙ্গে এর মিলটা কোথায়? অনিলবরণ করিডোর ধরে হাঁটে একটির পর আর একটি খুনের কথা ভাবতে ভাবতে। খুনের পিঠে খুন চাপাতে গিয়ে বিভ্রমে পড়ে যাচ্ছে সে। চিন্তা গুলিয়ে যাচ্ছে। গুনগুন করতে থাকে সে, চাঁদের পরে চাঁদ লেগেছে …। গুনগুন করতে করতে হাঁটে।

নয়

অনিলবরণের দেওয়া রহস্য উপন্যাসটি ছুঁয়েও দেখেনি সুদামা। পড়ার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। হাস্যকর, অগভীর, অহেতুক মারদাঙ্গা, যৌনতা। একেবারে মার্কিন থ্রিলার ভারতীয় ছদ্মবেশে।

আজ হঠাৎ কী খেয়াল হয়েছে অনিলবরণের বই হাতে নিয়ে সোফায় কাত হয়েছে সে। বইটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল বইটা। আজ পুরোনো খবরের কাগজ বিমলার হাতে চালান করার সময় হারানো রহস্য উপন্যাস অগভীর জলাশয়, কাদা-পাঁক ভরতি ডোবার মধ্যে থেকে হুস করে মাথা তুলল। ধুলো ঝেড়ে সেই মহাগ্রন্থে মনোনিবেশ করতে চায় সুদামা। আসলে এ ছাড়া কী বা করার আছে তার। খেয়াল পূরণই তো সময় কাটানোর উপায়। এই দীর্ঘ দুপুর নিয়ে তার কোনো পরিকল্পনা থাকে না। দীর্ঘ দুপুর, দুপুরের আগে অনেকটা সকাল, দুপুরের পর অনেকটা বিকেল, সন্ধেয় তার কাজের, অকাজের কোনো নিয়ম থাকে না। আর এই নিয়ম নেই বলেই বই পড়ার অভ্যেসও চলে যাচ্ছে। যেমন চলে যাচ্ছে অনেক রকম অভ্যাস। একটা কাজে থাকলে আর একটা কাজে উৎসাহ হয়। উৎসাহই নেই যেন। ফেব্রুয়ারির শেষে নার্সিংহোম থেকে ফিরে কদিন ডায়েরি লিখতে চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু কী লিখবে? তার ঘরের ধুলোবিহীন চকচকে হালকা গোলাপি দেওয়ালের কথা, সিলিং ফ্যানগুলির কথা, টেলিভিশন, ভি সি আর-এর কথা! টেলিফোনের কথা, ওয়াশিং মেশিন গ্যাস সিলিন্ডারের কথা। সেই ডায়েরির পাতা সাদা রয়ে গেছে। পড়তে পড়তে মনে হয় আরও কিছু কথা লিখে রাখে — যে সব কথা কৃষ্ণেন্দুকে বলতে পারেনি সেইগুলি। যে সব কথা কৃষ্ণেন্দুকে বলেছিল, সেইগুলি।

যেমন নারীর শরীর। প্রকৃতির দেওয়া শরীর নষ্ট করতে চায় না সে। এবারই তো কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, তা হলে সামান্য অপারেশনটি হয়ে যাক। তা হলে সুদামার আর ভয় থাকবে না কনসিভ করার। তা নিয়ে তর্ক হয়েছিল। প্রকৃতি যা দিয়েছে, প্রকৃতিই তা ফিরিয়ে নেবে, বয়স হলে তো সব আপনা আপনিই যাবে। সে রাজি হয়নি। আর রাজি হয়নি মানে কি তার মাথার ভিতরে গোপন ইচ্ছেগুলি এখনও ঘুমিয়ে আছে। সে আরও সন্তান চায়। এসব কিছুই লেখা হয়নি তার। একা একা কী-ই বা ভালো লাগে। এখন নয় তখন লিখব করতে করতে কিছুই হয়নি। সুদামা পাতা উলটোচ্ছে অনিলবরণের উপন্যাসের।

সে কখনও ভাবতেই পারেনি এই উপন্যাস নিয়ে দুপুর কাটাতে হতে পারে। বই পড়ার ইচ্ছেগুলি চলে গেলে মাঝে মধ্যে খেয়াল চাপলে এসবই নেড়ে-চেড়ে দেখে মানুষ। পড়তে পড়তে সুদামার হাসি পায়, অবাক হয় সে। কীভাবে লিখল এসব অনিলবরণ। কোত্থেকে জোটাল এইসব পাত্রপাত্রীদের?

বই রেখে দিয়ে চুপ করে বসে থাকল সুদামা। ডায়েরির পাতা ফরফর করছে সিলিং ফ্যানের হাওয়ায়। ধুস! লিখতেই ভালো লাগে না। অভ্যাসটাই চলে গেছে। না হলে এই ভয়াবহ উপন্যাস পাঠের প্রয়াস সম্পর্কেও তো সে লিখতে পারত। কৃষ্ণেন্দু তাকে শিখিয়েছিল ডায়েরি লেখা, কৃষ্ণেন্দুই যেন নিয়ে নিয়েছে সেই অভ্যাসটি —অথবা স্বাভাবিকভাবে, অনভ্যাসের কারণে ডায়েরি হারাচ্ছে মন থেকে। যেভাবে যৌবন যায় সেই ভাবেই যেন চলে যাচ্ছে মনের অক্ষরগুলি।

সুদামার দিনযাপন এখন এইরকম। নানা অনভ্যাসের অভ্যাস। তার দিনযাপনে কোনো রং নেই, সেই অনুভূতিময়তা নেই, যা আসে রক্তের ডাক থেকে। তার সন্তান নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। সন্তান পালনের কোনো অভ্যাসই নেই তার। তা হতো হয়তো, হয়নি। নিঃঝুম ফ্ল্যাট এখন আরও নিঃঝুম। সিলিং ফ্যানের সূক্ষ্ম শব্দের সঙ্গে হার্টবিট অহেতুক পাল্লা দিতে চায়। পারে না। বয়স বাড়লে হৃদয়ের শব্দও তো বিলম্বিত হয়, হয়ে যায়। একটি ধ্বনির সঙ্গে আর একটি ধ্বনির তফাত হয়ে যায় অনেক —তাই-ই যেন হচ্ছে ক্রমাগত।

টেলিফোনটা বেজেই থেমে গেল। সুদামা উঠতে গিয়েও উঠল না। যদি আবার বাজে। বাজল না। ভুল লাইন আচমকা চলে এসেছিল এদিকে। সে আবার চোখ দেয় অনিলবরণের রহস্যে। এই উপন্যাসের পুরুষ রহস্যভেদী, ঠিক তাও নয়, যেন রহস্য উদ্ধারে অভিযাত্রী মানুষটি, নিজেই একের পর এক খুন করে যাচ্ছে আসল খুনিকে ধরার জন্য। খুন যেন জলভাত। কল্পনা শক্তিও আছে বটে লোকটার, বিচিত্র সব খুনের বিবরণ। মানুষ খুন অতই সহজ। খুনে কোনো বিকার নেই খুনির সন্ধানে বেরোনো রহস্যভেদীর। সুদামার যে কী হল। বইটি হাতে করে কিচেনে এল। ভাবে দেশলাই ঠুকে দেয়। গ্যাস ওভেন জ্বালিয়ে তার উপর ধরে বইয়ের পাতাগুলো। কিন্তু বই তো প্রাণে লাগে। সে বুকে করে ফেরত এল আবার।

কাল রাতে কৃষ্ণেন্দু বলছিল, অফার আসছে।

কী অফার?

না যে সব বহুজাতিক সংস্থা এখানে ব্যবসা করতে চায়, তাদের কাছ থেকে। যেমন এল পি জি সংস্থা এসেছে।

তারপর?

প্রচুর মাইনে, এখন যা পায় কৃষ্ণেন্দু তার দ্বিগুণ, তিনগুণের কাছাকাছি। ভাবাই যায় না যে ওর কত সুযোগ দিতে পারে। ওরা তো প্রফিট ওরিয়েন্টেড কোম্পানি, লাভের জন্য ব্যবসা করে, লাভের জন্য প্রডাকশন করে, দিতে পারে অনেক।

সুদামা ভাবল কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করে। ফোন করে জানতে চায় সেই অফারের কী হল। কিন্তু তাও তো হাস্যকর। তাতে কী হতে পারে? এই ফ্ল্যাটটা আরও বড়ো, আরও উঁচুতে, কিন্তু তা কি আকাশের কোলে, হাত বাড়ালেই ছায়াপথ। ছায়াপথে হাঁটা যাবে তখন। আর কৃষ্ণেন্দু এইরকম কথা গত ছ-আট মাস ধরে বলছে, তেমন অফার পেলে চাকরি ছেড়ে দেবে। সরকারি চাকরির কত আর মাইনে। যে কাজ করে সেও মাইনে পায়, যে করে না, সেও। ওই সব বহুজাতিক সংস্থার, দেশীয় বিকাশশীল সংস্থার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, তারপর বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এ পৌঁছনো, তারপর চেয়ারম্যান — এক মহিলা ষাট লাখ টাকা পান পার অ্যানাম, একজন পায় এক কোটির কাছাকাছি — ও সবের সুখই আলাদা। টেলিফোনে হাত দিয়েও তুলে নেয় সুদামা। কৃষ্ণেন্দু কীই-বা বলবে? ও তো কথার কথা। আজই কি কোনো সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে? ওসব তো স্বপ্ন। তা কখনও সত্যি হয়।

টেলিফোনের কাছে বসে আছে সুদামা। তার মনে হচ্ছে আবার বাজবে। কে করবে? খবরের কাগজের সেই প্রুফ রিডার, যার কতকগুলি প্রতিবেদন পড়ে সে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছিল। লোকটা লেখাকে পেশা করবে বলেই কাগজে সামান্য চাকরি নেয় — তারপর যে কী হল তার।

আবার ফোনটা ভেঙে ভেঙে বাজল। সুদামা ছোঁয়ার আগেই থেমে গেল। কেউ খুব চেষ্টা করছে সুদামার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কে? কৃষ্ণেন্দু! কৃষ্ণেন্দু, তার প্রেমিক কি আবার পুরোনো প্রেম নিয়ে ফিরে এল। সে তো জানে এই সময়ে ঘুমোচ্ছে সুদামা। ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙাতে চাইছে কৃষ্ণেন্দু। না, চোদ্দ বছর আগে ফোনের কোনো প্রশ্নই ছিল না। তখন তো কৃষ্ণেন্দু সবে কাগজ ছেড়ে সরকারি পদে। সে যে কাগজে প্রুফ দেখত, তা আর চলল না। উঠেই গেল। সরকারি পদে ঢুকে বিয়ে করল কৃষ্ণেন্দু। তখনও লেখা থামায়নি। একবার লিখল কংসাবতী তীরে বর্ষা — সেই বরষার কথা এখনও ভোলেনি সুদামা। ভোলেনি মেঘের বিবরণ। দুপুরে আটকে রেখেছিল যুবক স্বামীকে তার স্ত্রী। বেলগাছিয়ার ফ্ল্যাটে। সেদিন দুপুরে তারা শ্বশুর-শাশুড়ির ভালো ঘরটি পেয়ে গিয়েছিল। এক সপ্তাহ ধরে পেয়েছিল। কী আশ্চর্য দিনই না গেছে! এক সপ্তাহ ধরে স্বামী-স্ত্রী নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলছিল। সে বার বর্ষায় শ্বশুর-শাশুড়ি দিন সাতের জন্য পুরী, সঙ্গে অর্ধেন্দুরাও গেল। পুরীর রথযাত্রা দেখতে তাকে কম লোভ দেখায়নি বড়ো জা যূথিকা। সে যায়নি। তার লোভ হয়েছিল অন্তত দিন-সাতের জন্য পুরো ফ্ল্যাটটা তো তাদের। সাতদিনই কৃষ্ণেন্দু তার সঙ্গে ছিল। তাকে ছুটি নেওয়াতে বাধ্য করেছিল সুদামা। মধুচন্দ্রিমা যাপন হবে।

টেলিফোনের সামনে বসে সেই ঘন বরিষণের দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল সুদামার। এখন বাইরে মেঘ আর রৌদ্র একসঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘ আসবে আসবে করেও আসছে না এই বালির মাঠের আকাশে। ভ্যাপসা গরম। এর থেকে পরিত্রাণের জন্যই কি সেই বাদল দিনের কথা মনে পড়ল। নাকি কৃষ্ণেন্দু জন্য? কৃষ্ণেন্দু তাকে ছুঁতে চাইছে, পারছে না। তার কন্ঠস্বর শুনতে চাইছে, পারছে না। কৃষ্ণেন্দুরও হয়তো মনে পড়ে গেছে সেই বাদল মেঘের কথা। টেলিফোনে সেই কথাই বলতে চাইছে কি? টেলিফোনে জানাতে চায় পুরাতন প্রেম? মনে পড়ে গেছে পুরাতন কথা, ঢাকা পড়েনি এখনও সব।

খেয়াল! এ সব খেয়াল। এলোমেলো সময়হীন জীবনযাপনের খেয়াল, বোধহয় এই ভাবনাও। না হলে দগ্ধ প্রকৃতির ভিতরে মেঘের অনুষঙ্গ ভাবনায় আসে কী করে?

কৃষ্ণেন্দু মনে পড়ে তোমার? অর্ধেক আকাশ দিয়েছিলে তুমি আর দিয়েছিলে … ফ্ল্যাট বাড়ির বাইরে টালা পার্ক খোলা। খোলা মাঠের ধারে কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া শিরিষ আকাশমণির ছায়া। তার ভিতরেই লুকিয়েছিল কোথাও একটি কদম গাছ। সেই যে চোদ্দ-পনেরো বছর আগের খবর। আমরা সেই সাতদিন তিনটি ঘরের মালিক। নিজের ঘর ছেড়ে সবচেয়ে ভালো ঘরটায় সকাল দুপুর সন্ধে কাটাচ্ছি। জানালা খুললেই মেঘ বর্ষা। তুমি এক ভোরে কী কাজে বেরিয়ে ফিরে এলে কোষবদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে। বাদল দিনের প্রথম কদমফুল একটি একটি করে নব পরিণীতার কোষবদ্ধ দু-হাতে তুলে দিয়েছিলে —

সুদামা একটা ফুল তোমার, আর একটা তোমার, আর একটা তোমার — পাঁচটা ফুলই তোমার, এতদিন ধরে জানতামই না এদিকে কদমফুল ফোটে। জানতে হল তোমার জন্য, ভালোবাসা চিনিয়ে দিল ফুলগুলিকে।

সুদামা টেলিফোন তুলে পটপট ডায়াল করতে থাকে। রিং হতে থাকে ওপাশে। রিং হয়েই যাচ্ছে। বেজে যাচ্ছে টেলিফোন, কেউ ধরছে না। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু ঘরে নেই! সুদামা কানে চেপে থাকে রিসিভার। যদি বেরিয়ে থাকে টয়লেটের দিকে, এখনই ফিরবে। দোরগোড়ায় তো পিয়ন থাকে, থাকে একজন ক্লার্ক একদম পাশের ছোট্ট খুপরিতে। সায়েবের পি আর ও-র কাজ করে। সে-ই বা গেল কোথায়? ফোনটা তো সেই ধরবে সায়েব না থাকলে। বাজতে বাজতে ফোন ক্লান্ত হয়ে থেমে গিয়ে অপ্রীতিকর এনগেজড সাউন্ড। সুদামা ফোন রেখে দিল। কৃষ্ণেন্দু অফিসে নেই, সে না থাকলে পিয়নও থাকে না, ক্লার্কও অন্য কোথাও গিয়ে তাস খেলে।

তা হলে ফোনটা কার? কৃষ্ণেন্দুরই। অন্য কোনো জায়গা থেকেও তো ফোন করতে পারে। হয়তো এতদিন বাদে তার মনে হয়েছে বাচ্চাটা রেখে দিলেই হত। আর একবার না হয় মা হত সুদামা। নাকি তার মনে হয়েছে কংসাবতী তীরে বর্ষার কথা। কী চমৎকার লিখেছিল।

পুরো ফ্ল্যাটে জা-শ্বশুর-শাশুড়ি-ভাসুর কেউ নেই, তারা দুজন। কদমফুল সাজানো রয়েছে মেঝের উপর পর পর। সেই ফুলের দিকে চেয়ে বসে আছে দুজন। আহ! বৈশাখে বিয়ের পর সেই প্রথমই যেন দুজনে নিবিড় হতে পারল। তাদের ঘর তো গ্যাস-চেম্বার, সেখানে বর্ষা বসন্ত একইরকম, শীত-গ্রীষ্মের তফাত নেই। ঘরে সারাদিন, হ্যাঁ ছুটির দিনেও হয় শ্বাশুড়ি, না হয় জা, না হয় জা-এর মেয়েটি আছেই। রাত এগারোটার আগে কেউ কারওর মুখই ভালো করে দেখতে পেত না যেন। দুপুরে খোলা জানালার কাছে শুয়ে দুজনে মেঘ দেখছিল তারা। ভরন্ত-মেঘ, যুবতি-মেঘ, কুমারী-মেঘ, গর্ভিনী-মেঘ। গর্ভের ভাবে শ্লথ-গমনা মেঘ-নারী। কৃষ্ণেন্দু শোনাচ্ছিল এই সব, কবে সে দেখেছিল কংসাবতী তীরে জেগে উঠছে মেঘ। তারা যেন বিন্ধ্য পর্বতের কোল থেকে উঠে এল, এল নির্বাসিত যক্ষের হৃদয়বেদনা ধারণ করে। মিলিত হয়েছিল পরস্পরে। কুমারী মেঘ গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে। সেদিন সন্ধ্যায় কৃষ্ণেন্দু খাতা-কলম নিয়ে বসে লিখেছিল সেই অলস-গমনা মেঘের কথা। যে বিবরণ শুনিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু, তার ভিতরে যেন নিজের মুখ দেখতে পেয়েছিল তরুণী বধূ।

সুদামা নিজেকে আছড়ে ফেলল বিছানায়। এখন যদি কৃষ্ণেন্দুর ফোনটা আবার আসত। তাকে সে এই সব কথা শোনাত। এসব কি এ গ্রহেই ঘটেছিল, এই জন্মেই?

আবার ফোন বাজল। এবার পরিষ্কার বাজছে। হাত বাড়িয়ে, অনেকটা নিজেকে এগিয়ে সুদামা ফোন ধরে। হ্যাঁ সুদামা বলছি, তুমি কোথায় ছিলে কৃষ্ণেন্দু, তোমার ঘরে ফোন বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরেনি, কেউ নেই। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই যে সবাই পুরী গেল, ঘন বর্ষার দিন, মেঘ এসে দাঁড়িয়েছে, আমাদের জানালায়, তুমি বলছ একটা তোমার, আর একটা তোমার … কদমফুল গো কদমফুল, মনে আছে? এবারে আমরা বর্ষায় কদিন বেলগাছিয়ায় গিয়ে থাকি বরং, দাদারা ক-দিনের জন্য এই ফ্ল্যাটে …। আচ্ছা নীলের চিঠি কী হল, পড়া হল …?

নীলের কথা আবার মনে পড়ে গেল সুদামার। আচমকাই। সেই আশ্চর্য রোমান্সের সঙ্গে নীলের কী সম্পর্ক, নীল তো তখন জন্মায়নি। কিন্তু মনে হল যেন ছিল। চারপাশের বাতাসে ভাসছিল সে …।

আমি সুহাস, সুহাস বোস ম্যাডাম।

কে! সুদামার হাত থেকে টেলিফোনের রিসিভার পড়ে গেল। সে ঘন নিশ্বাস ফেলে। তারপর আস্তে আস্তে রিসিভারটি তুলে কানে চেপে ধরে, তুমি মানে আপনি। বলবেন তো আপনি, আমি ভাবছি।

সুযোগ দিলেন কই ম্যাডাম, আপনি কি ফোন করেছিলেন?

কেন বলুন দেখি, কেউ তো ধরল না, আপনার স্যার কোথায়?

উনি বাইরে গেছেন নতুন একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে। ফিরবেন এখনই, বেশি দূরে নয়, বাইপাসের দিকে। আমি ফোনটা ধরতে এলাম, অনেকক্ষণ ধরে বাজছিল, কেটে গেল, মনে হল আপনি, কিছু বলবেন?

বলব! আপনাকে বলব! আপনাকে বললে কি বুঝবেন, শুনুন সুহাস, বলতে পারেন বর্ষা আসতে আর কত দেরি, অফিসিয়ালি বর্ষা কবে আসছে। খুব গরম! মেঘ কবে নাগাদ ঢুকবে এই শহরে, জানেন আপনি …?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *