পড়ন্ত রোদে

পড়ন্ত রোদে

এক এক জনের বন্ধু-প্রাপ্তির ব্যাপারে ভাগ্য খুব উল্টোপাল্টা হয়। যাদের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ বোধ করেছে, মেলামেশা করার তাগিদ অনুভব করেছে, সেসব মানুষদের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অরণ্যের ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলায়, মনে পড়লেও এখন হাসি পায়। যদিও তখন খুবই বেদনাদায়ক ছিল ব্যাপারটা, ওর হিরো ছিল রবীন্দ্রনাথ না, বিবেকানন্দ না, নেতাজি না, কোনও ফিল্‌ম স্টার তো নয়ই—মামার বাড়ির পাড়ার নিতাইদা। দারুণ ব্যক্তিত্ব ছিল ছেলেটির। শুধু তার হেঁটে-যাওয়া, বাসে-ওঠা আর বাস থেকে নামা দেখবার জন্যেই অরণ্যের অর্ধেক দিন স্কুলে দেরি হয়ে যেত। নিতাইদা যখন বি-এসসি পাস করল, ক্লাস এইটের ছাত্র অরণ্যের মনে হল যেহেতু নিতাইদা বি-এসসিটা পাস করে ফেলেছে ওটা একটা অসম্ভব বীরত্বপূর্ণ ব্যাপার ওর দ্বারা সুতরাং সেটা আর হবে না। অথচ অরণ্যর সঙ্গে নিতাইদার ‘কিরে কেমন আছিস?’-এর বেশি আলাপ কোনদিন এগোয়নি। অরণ্যর পেছন-পেছন ঘুরত ওর সব চেয়ে অপছন্দের ছেলে হাবুল। এলেই বড়মামা রাগ করতেন। বখা ছেলে। পয়সা চুরি করে সিনেমা যায়। কিন্তু হাবুল বেচারি ক্রীতদাসের মতো ঠোঙায় করে তেলেভাজা আনত ওর জন্যে। একতলায় যে ঘরে অরণ্য পড়াশোনা করত, তার জানলার খড়খড়ি ফাঁক করে তেলেভাজাগুলো গলিয়ে দিত। এমনি টান! নেহাত কৃপাবশতই হাবুলের সঙ্গে মিশত অরণ্য। সুমন্ত সেনগুপ্তকে কেন কে জানে ভালো লেগে গিয়েছিল তার। অথচ ভালোলাগার কথা নয়। চুপচাপ প্রকৃতির। অমিশুক। উন্নাসিক, দাম্ভিক ভাবাটাই স্বাভাবিক। ব্রততী এখন অন্যরকম বললে কি হবে একেবারে পছন্দ করত না ভদ্রলোককে। মুখে বলেনি কোনদিন। কিন্তু অরণ্য এটা ভালোই বুঝত।

একজন পুরুষ সাধারণত আরেক জন পুরুষকে, বিশেষত সফল পুরুষকে পছন্দ করতে পারে না। কিন্তু অরণ্য মনে মনে চুপি চুপি সুমন্ত সেনগুপ্তকে দারুণ পছন্দ করত। ও নিজে জানে মানুষ হিসেবে সত্যিই ও খুব বিচিত্র। ষষ্ঠ রিপুটা ওর মধ্যে একেবারে অনুপস্থিত। এসব কালোনিতে সাধারণত মাৎসর্য জিনিসটা খুব ছোটখাটো ব্যাপারেও নখ দাঁত খিঁচিয়ে বার হয়ে আসে। চৌধুরীর বাগানে দারুণ টোম্যাটো ফলেছে। আমার বাগানে কেন অমন টোম্যাটো ফলল না, ঘোষালের শ্বশুরবাড়িতে দারুণ খাতির, দুদিন অন্তর শালীরা এসে খোঁজ নিয়ে যায়, আমার কেন অমন হল না—এই জাতীয় ব্যাপার এসব জায়গায় থাকেই। যতই আবহাওয়া ভালো হোক। এই ঈর্ষা তো অরণ্যর আসেই না, এর চেয়ে অনেক বড় মাপের প্রতিযোগিতাতেও হেরে গেলে ও সফল প্রতিদ্বন্দ্বীকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রশংসার সঙ্গে অভিনন্দন জানাতে পারে। লম্বা, মেদহীন, বলিষ্ঠ অথচ আশ্চর্য সুকুমার, প্রায় ভঙ্গুর মুখশ্রীর সুমন্ত সেনগুপ্ত পাশ দিয়ে চলে গেল। আফটার-শেভ লোশনের মৃদু সুগন্ধ হাওয়ায় ভাসছে বিদেশি ফুলের সৌরভের মতো, গাড়ির চাবিটা ডানহাতের টসটসে তর্জনীতে ঘোরাচ্ছে।

—‘হ্যাললো মুখার্জী’, মৃদুস্বরে অভিবাদন।

—‘হ্যাললো সেনগুপ্ত’।

কেমন একটা সহজ সাবলীল আনন্দ ছিল এই সামান্য প্রাত্যহিক নিয়মরক্ষার সাক্ষাৎকারগুলোয়। বিশেষ কোনও কথাবার্তার আদানপ্রদান না হলেও একটা আন্তরিক যোগাযোগ যেন আপনা থেকেই হয়ে গিয়েছিল দুজনের মধ্যে।

—‘কি খবর? চললেন?’ সেনগুপ্ত যেন সামান্য স্বরক্ষেপের মধ্যে দিয়ে, দৃষ্টিবিভঙ্গের মধ্য দিয়ে বলতে চাইল—‘মুখার্জী, আপনি এরই মধ্যে চলে যাচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি। থাকুন আরেকটু থাকুন।’

সুইমিং পুল থেকে উঠছে সুমন্ত ক্লাবে, পিঠের ওপর মোটা একটা তোয়ালে,—অরণ্য নামতে যাচ্ছে।

—‘এত দেরি করে এলেন?’ আরেকটু আগে এলে দুজনে একসঙ্গে সাঁতার কাটা যেত, সুমন্ত যেন সেটাই বলতে চাইত।

—আমি আপনার ভালো চাই। সর্ব অর্থে। সুমন্তর চাহনিতে এই অর্থটা অরণ্য পড়তে পারত স্পষ্ট, যেমন করে স্পষ্ট পড়তে পেরেছিল ব্রততীর মনের ভাষাও।

—‘খুব কষ্ট আপনার না? কি যে একটা দুঃসহ বোঝা নিয়ে বেড়াচ্ছেন!’ গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের ওপর চাঁদের আলো পড়ে দুধ-সাগর হয়ে গেছে।

—‘আপনি জানলেন কি করে? জন্তু-জানোয়ারের ভাষা বুঝতে পারেন বুঝি?’

—‘একথা কেন বলছেন?’

—‘মানুষের কাছে ওরা তো বোবা···আমিও তো তাই।’

—‘মানুষ ছাড়া আর কারুর কাছে মন খোলেন? খুলতে পারেন তো খুলুন না! পারলে কেঁদে ফেলুন, এখানে কেউ দেখতে আসবে না। আমি সরে যাচ্ছি।’

—‘কি নিদারুণ শীত বুঝতে পারছেন না? কান্না সব জমে বরফ হয়ে যাবে। আপনার কোথাও সরে গিয়ে কাজ নেই।’

—‘তবে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি, হাতটা ধরুন, এই দেবভূমিতে কিছুক্ষণ দুজনে বিচরণ করি। কেউ দূর থেকে দেখলে কিন্নরমিথুন ভাবতে পারে।’

বেড়াতে বেড়াতে কিছুক্ষণ পর অরণ্য চেয়ে দেখছিল ব্রততীর দিকে। আকাশটা জ্যোৎস্নায় সাদা, তারাগুলো সব অদৃশ্য—ব্রততীকে দেখাচ্ছে কালচে রঙের পাথরে গড়া একটা মূর্তির মতো। সাদা শাড়ির আঁচল জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করছে। কালো ওভারকোটের মধ্যে থেকে আধ ঘোমটার মতো পড়ে আছে আঁচলের অংশ পিঠে। হাতে সাদা দস্তানা। মুখের শুধু আদল দেখা যায়, অবয়ব না। এমনিতেই রহস্যময়ী, সেদিন আরও। ওই পটভূমিতে। মানুষের সহ্যের অতীত কিছু যেন এই ভাস্কর্য গড়েছে। সুঠাম, সুন্দর কিন্তু অনমনীয়, কঠিন। শিলীভূত কোনও বেদনা। আস্তে আস্তে অরণ্য বলেছিল—‘আমরা কিন্তু সাত পায়ের চেয়েও অনেক বেশি হেঁটে ফেলেছি।’

পরিবেশের যাদুতে ছাড়া অরণ্যর পক্ষে এতটা একবারে বলা সম্ভব ছিল না। ও নিজে মুখচোরা। উদ্দিষ্টা রমণী প্রায় নির্বাক।

ব্রততী বলেছিল—‘অনেক রাত। ঠাণ্ডাও বেশ। চলুন ফিরে যাই।’

—‘যেখানেই ফিরি, একসঙ্গেই ফিরব কিন্তু’—অরণ্য নরম কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলেছিল।

হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রততী—‘আমি খুব গুরুভার অরণ্যদা, আপনি পারবেন না।’

—‘পারতেই হবে। তুমি পারতে দেবে কিনা সেটাই বলো।’

মৃতের সম্মানে সোমবার ফ্যাক্‌টরি ছুটি। শেষকৃত্যের হাঙ্গামাও রয়েছে। রায় বলে দিয়েছেন—‘মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন, কম্প্যানির উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে দাহকার্য হবে। বড় বড় সাদা ফুলের রীদ এসেছে। সাজানো খাট-টাট প্রস্তুত। খালি বডিই এখনও মর্গ থেকে এসে পৌঁছয়নি। সকালেই পার্ক সার্কাস থেকে ফোন এসেছিল। পারমিতা খুব অসুস্থ। তাকে দিয়ে কোনও কাজ করানো যাবে না। ছেলেকেও তার বোডিং স্কুল থেকে আনানো হয়নি। পারমিতার বাবা অবশ্য আসছেন। অরণ্য ব্রেকফাস্ট করে একবার ম্যানেজারের বাড়ি গিয়েছিল। রায় বললেন—‘আমাকে রীতিমতো দাবড়ানি খেতে হল হে!’

—‘কি রকম?’

—‘পারমিতার বাবাকে বলে ফেলেছিলুম ছেলে থাকতেও মুখাগ্নি করবে না···ব্যাপারটা ঠিক···। তা ভদ্রলোক বললেন কি জানো? মৃতের চেয়ে জীবিতের প্রতি কর্তব্যটা নাকি অনেক জরুরি, সাত আট বছরের ছেলের পক্ষে এক্সপিরিয়েন্সটা নাকি ট্রম্যাটিক। উনি সেটা হতে দেবেন না।’

জয়ন্তী ছিলেন, বললেন—‘তোমার যেমন সব তাতে সর্দারি। যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই।’

অরণ্য বাড়ি ফিরে ব্রততীকে বলল—‘আজকের ব্যাপারটা চুকে যাক। তারপর তুমি একদিন মিসেস সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা করো। আমিই নিয়ে যাবো এখন।

ব্রততী বলল, —‘না।’

—‘সে কি? কেন?’

—‘ভালো লাগে না।’

ভালো লাগা না লাগার ব্যাপার এটা নয় একথা ওকে কে বোঝাবে? ভাবল, পরে ওর মেজাজ অন্যরকম হতেও পারে। তখন আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে। এমনিতে ব্রততী বেশ আছে। কিন্তু একবার বেঁকে বসলেই মুশকিল।

শবদেহ এসে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর সুমন্তর দিদি এসে পৌঁছলেন। খুবই অস্বস্তিজনক পরিস্থিতি। শব আছে, দাহ করবার আইনসম্মত শাস্ত্রসম্মত লোক থেকেও নেই। ভদ্রমহিলা এসে ব্রততীদের ড্রয়িংরুমে গুম হয়ে বসে রইলেন। কোন রকম জিজ্ঞাসাবাদ, কথাবার্তার ধার দিয়েও গেলেন না। মহিলা মনে হয় সুমন্তর চেয়ে অনেক বড়। বেশ কঠিন ধাতের। ফর্সা রঙ মফঃস্বলে থাকলে রোদে জলে যেরকম একটা তামাটে ভাব আসে, সেই রকম। দোহারা শক্তপোক্ত চেহারা। সুমন্ত রীতিমত সুপুরুষ। মুখশ্রীতে একটা মেয়েলি কমনীয়তা আছে। দুধে-আলতা রঙ। মসৃণ গাল। এ ভদ্রমহিলার চেহারায় একটা গ্রাম্যতা-দোষ আছে। মুনিষ-টুনিষ চরান বোধহয়। একটা পুরুষালি রুক্ষতা। ব্রততী চা জলখাবার করে দিল, স্পর্শ করলেন না। কিছু বললেনও না। পারমিতার বাবা এসে পৌঁছতে বিনা ভূমিকায় উঠে গেলেন। উনি চলে গেলে ব্রততী বলল—‘তোমার কি না গেলেই নয়?’

—‘সে কি? এড়ানো সম্ভব নাকি? আর এড়াতে যাবই বা কেন শুধু শুধু?’

—‘যেরকম দেরি হচ্ছে। সন্ধ্যে হয়ে যাবে মনে হয়।’

—‘তোমার কি ভয়-টয় করবে?’

—‘না।’

—‘তবে?’

—‘কিছু না।’ ব্রততী নিশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

ব্যাপারটাতে ব্রততী একটা সাঙ্ঘাতিক ধাক্কা খেয়েছে। অরণ্য নিজেও কম ধাক্কা খায়নি। সুমন্ত সেনগুপ্তর মতো এমন একজন সফল পুরুষ নিজেকে এমন নির্মমভাবে শেষ করে দেয় কেন? মরবার ইচ্ছে হয়েছিল তো কয়েকটা স্লীপিং পিল খেয়ে নিলেও তো চুকে যেত। লোকটা কি পাগল ছিল? ছেলেবেলায় পাড়ায় পাড়ায় হাপুখেলা নামে এক ধরনের বিচিত্র ব্যাপার দেখা যেত খুব। আত্মনির্যাতন থেকে মনোরঞ্জন। একটা লোক নিজেই নিজের পিঠে বেত মারতে মারতে ছুটছে। সমস্ত পিঠটা কশাঘাতের দাগে কালশিটে পড়া। কি আনন্দ পেত এতে যারা ব্যাপারটা করত? যারা দেখত? সুমন্ত সেনগুপ্তও কি এই জাতের? মনোবিকারের রোগী?

স্থানীয় শ্মশান তিন সাড়ে তিন মাইল দূরে। চিতাটা জ্বলে ওঠবার পর সকলেই একটু এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল। অরণ্য একটা সিগারেট ধরিয়ে ভিড় থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে আলাদা করে নিল। এতো হই-চই, কথাবার্তা ঠিক ভালো লাগছে না। চৌধুরী যথারীতি ভাঁড়ামি করছে। পরমার্থদা নিজে না করলেও, আপত্তি করছেন না কোনও। মাঠের মধ্যে গাছপালা ঝোপঝাড়, অরণ্য হঠাৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। একটা খড়ো ঘর। সেখান থেকে এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলার ঈষৎ উত্তেজিত গলার স্বর ভেসে আসছে। পারমিতার বাবা আর সুমন্তর দিদি।

ভদ্রলোক বলছেন—‘জিনিসপত্রগুলো কোম্পানির ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি প্যাক-ট্যাক করে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে। খরচ যা লাগে দোব।’

দিদি বললেন—‘জিনিসপত্রের কথা চিন্তা করতে এখন আপনার লজ্জা হয় না? লজ্জা হওয়া উচিত!’

—‘কার? আপনার? না আমার?’ পারমিতার বাবা গলায় বিদ্রূপ মিশিয়ে বললেন, —‘জিনিসপত্র সবই নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি। খালি খাটটা নিতে পারব না। ওটা নিয়ে আপনারা যা খুশি করতে পারেন।’

—‘ইচ্ছে করলে আমরা মামলা করতে পারি, জানেন?’

পারমিতার বাবার গলায় হাসি—‘খুকুর জিনিস খুকু নিয়ে যাবে তাতে কার কি বলবার থাকতে পারে? তাছাড়া এগুলো তো কিছুই না। অস্থাবর আরও যা সেসব তো কোনমতেই আপনাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারব না।’

মহিলা বললেন—‘আপনার কাছে আমাদের দরুন অস্থাবর যা আছে তা-ও কি আদায় হবে কোনদিন?—সত্যিই আপনার লজ্জা হওয়া উচিত!’

এরপর ওঁরা বোধহয় সিগারেটের গন্ধ পেয়ে সতর্ক হয়ে গেলেন। অরণ্যও সামনে এগিয়ে গিয়ে মামুলি কথাবার্তা আরম্ভ করে দিল। হয়ত ভাববেন আড়াল থেকে ইচ্ছে করে ওঁদের কথা শুনছিল অরণ্য।

জয়ন্তী রায় বেল বাজালেন না। সামনের পর্চ দিয়ে না ঢুকে ঘুরে জানলার কাছে গেলেন—‘ব্রততী, ব্রততী!’

ব্রততী পেছনের বারান্দায় একলা দাঁড়িয়েছিল। প্রথমে শুনতে পায়নি। উদ্‌ভ্রান্ত দুপুরে বাতাসের ফিসফিসুনির মতো একটা ডাক—‘ব্রততী! ব্রততী!’ প্রথমটা শিউরে উঠেছিল ব্রততী। তারপর বুঝতে পেরে পেছনের দরজা খুলে বাগানে বেরিয়ে গেল, বলল—‘জয়ন্তীদি, আমি এদিকে।’

জয়ন্তী ঢুকতে ঢুকতে বললেন—‘নট’স হ্যাড, অল’স স্পেন্ট··· মনে আছে ব্রততী!’

ব্রততী বলল—‘লেডি ম্যাকবেথ! ওসব এবার ভুলে যাবার সময় এসেছে জয়ন্তীদি।’

—‘তবু তো ভুলতে পারি না! সময়ে-অসময়ে মনে পড়ে···থাক গে, ভীষণ একা-একা লাগছিল। তোরও নিশ্চয়ই লাগছিল। তবে তুই তো সাহসিকা, তোর কথা আলাদা! খাওয়া-দাওয়া করেছিস?’

—‘এবেলা আর হবে না বোধহয়।’

—‘আচ্ছা ব্রততী···কাল কথায় কথায় কি একটা ডুপ্লিকেট চাবির কথা বলছিলি না!’

—‘বলেছিলাম।’

—‘সেটা কোথায়?’

—‘যেখানে থাকে, চাবির হুকে।’

—‘এরকম একটা যাচ্ছে-তাই কাণ্ড ঘটে গেল, তার পরও তুই ও চাবি ওরকম প্রকাশ্য জায়গায় ঝুলিয়ে রেখেছিস?’

—‘কাল-পরশুর মধ্যে ও অফিসে জমা দিয়ে দেবার কথা বলছিল।’

—‘তার আগে চল, তোতে-আমাতে একবার ওপরে ঘুরে আসি।’

ব্রততী চমকে উঠল। তারপর শান্ত স্বরে বলল,—‘না জয়ন্তীদি, অত কৌতূহল ভালো নয়।’

—‘কৌতূহলের কি আছে? নিজে প্ল্যান করে ফ্ল্যাটটা বানালাম, সাজালাম, এইভাবে একটা বিশ্রী দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমি তো কাল ওখানে যাই-ই নি। আর পুলিসে সীল-টীলও তো করে দেয়নি!’

—‘শুধু-শুধু বিপদ ডেকে আনছো জয়ন্তীদি।’

—‘ঠিক আছে। তোকে যেতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি।’

—‘সেটা তো আরোই অ্যালাউ করব না।’

—‘তাহলে চল একবার প্লীজ।’

রান্নাঘরের হুক থেকে চাবিটা তুলে নিয়ে ব্রততী বলল—‘কাজটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।’

সন্তর্পণে দুজনে লিভিং রুমের কার্পেটে পা দিলেন। জয়ন্তী বললেন—‘ভালো জিনিসপত্র দিয়েছে পারমিতার বাবা। দামী কার্পেট রে। ফার্নিচার সব এ-ক্লাস। একমাত্র মেয়ে নাকি? জানিস কিছু?’

ব্রততী সংক্ষেপে বলল—‘না।’

জানলা দরজা সব বন্ধ। ব্রততী একটা জানলা খুলতে যাচ্ছিল। জয়ন্তী বললেন—‘করছিস কি? পাখাটা চালিয়ে দিচ্ছি, আলোটা জ্বালাচ্ছি, তাতেই হবে।’

শোবার ঘরের দরজাটা খুলে জয়ন্তী বললেন—‘কোনখানটায় ছিল রে?’ বলেই চুপ করে গেলেন। সুইচ বোর্ডের পাশে স্টীলের চেয়ারটা তখনো তেমনি বসানো ছিল। চেয়ারটার পাশে দাঁড়িয়ে জয়ন্তী কেঁদে ফেললেন। ব্রততী মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর ড্রেসিং-টেবলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন জয়ন্তী। ড্রয়ারগুলো খুললেন এক এক করে। ব্রততী বলল—‘জয়ন্তীদি, প্লীজ এবার চলে এসো। কেউ জানতে পারলে কি মনে করবে বলো তো?’

সজল চোখে জয়ন্তী রায় বললেন—‘সুইসাইড নোটটা তুই দেখেছিলি? এগজ্যাক্টলি কি লেখা ছিল রে তাতে?’

ব্রততী দ্রুত সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলল—‘আমি দেখিনি। জানি না। আর আমি এই বদ্ধ ঘরে দাঁড়াতে পারছি না। আসবে তো এসো। নয়ত আমি তোমার বাড়িতে ফোন করে রামশরণকে জানিয়ে দিচ্ছি—তার মেমসাহেবের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

জয়ন্তী চোখ মুছতে মুছতে ব্রততীর পাশে এসে দাঁড়ালেন, বললেন— ‘এইসব বইয়ের আলমারি, লেখার টেবিলের ড্রয়ার সবই তো দেখছি চাবি-টাবি দেওয়া।’

—‘তোমার ওসবে দরকার কি? কি খুঁজছো? সুইসাইড নোটের ডুপ্লিকেট?’

—‘ঠাট্টা করছিস? ব্রততী?’

—‘ঠাট্টা নয়, জয়ন্তীদি, তোমার আচরণ এক এক সময়ে আমার অসহ্য মনে হয়। তুমি মনে করো জীবন-নাট্যের তুমি ট্রাজি-কমিক নায়িকা, তাছাড়া আবার ডিরেক্টরও। এই বদ্ধমূল ভুল ধারণার ফলে অন্যকে এবং নিজেকেও যে কখনও কখনও কী বিপাকে ফেল, সেটা বোঝবার ক্ষমতা পর্যন্ত তোমার নেই। হোয়াই ডোন্ট য়ু লেট পীপ্‌ল অ্যালোন! তুমি লেডি ম্যাকবেথ তো নয়ই, পোর্শিয়াও নও। ঝোঁকের মাথায় যা খুশি করো না।’

বলতে বলতে উত্তেজনায় ব্রততীর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। চোখে বিদ্যুৎ। জয়ন্তী বোধহয় কারও কাছ থেকে কখনও এতো তিরস্কৃত হননি। চোখ দিয়ে রীতিমতো ধারা নামল। হাত বাড়িয়ে ব্রততীর হাত ধরলেন। আস্তে আস্তে বললেন—‘তুই তো আমার সবই জানিস—কি পেয়েছি জীবনে?’ ব্রততী একই রকম উত্তপ্ত স্বরে বলল—কি পাওনি, সেটাই বলো? কোনও কোনও মানুষের হাত জীবন কখনও খালি রাখে না জয়ন্তীদি। কোন না কোন প্রাপ্তিতে ভরে রাখে, তুমি সেই বিরল ব্যক্তিদের অন্যতম। ‘কিছু পাইনি’ এই রোমান্টিক বেদনাবিলাস তোমাকে মানায় না। তোমার এই ধারণাটা, অ্যাটিচুডটা তুমি বদলে ফেলো। না হলে তোমারও শান্তি নেই। তোমার বন্ধু-বান্ধবদেরও শান্তি নেই।’

ব্রততীর হাত ধরে ধরে নামলেন জয়ন্তী রায়। ল্যাণ্ডিং পার হয়ে ব্রততী বলল—‘চোখ মুছে নাও ভালো করে, লোকজন কেউ এসে পড়তে পারে।’

ব্রততীর শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন জয়ন্তী রায়। ব্রততী নরম গলায় বলল—‘তুমি ঘুমোও, কেউ এখন বিরক্ত করবে না। মিমি-মিন্টুর আসার সময় হলে আমি জাগিয়ে দোব।’

জয়ন্তী ঘুমিয়ে পড়লে, একটা ম্যাগাজিন হাতে করে বসবার ঘরের সোফায় গিয়ে বসল ব্রততী। সামনেই জানলা। ওখান দিয়ে দেখা যায় রক্তাভ গুলঞ্চের ঊর্ধ্বমুখ গুচ্ছ গুচ্ছ অঞ্জলি, বটল পামের সাদা দণ্ডের ওপর সবুজ পালক। হাতে পত্রিকা কিন্তু ওই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়েই তন্ময় হয়ে রইল ব্রততী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *