১৩. কুগুরাভ সমীকরণের দ্বিতীয় সমাধানটা

কুগুরাভ সমীকরণের দ্বিতীয় সমাধানটা নীহার মাথায় আসি আসি করেও আসছিল না। কমপ্লেক্স প্লেনের কোথায় সমাধানটি হবে বোঝা যাচ্ছে, সমাধানটির ক্ষেত্রটিও পেয়ে গেছে শুধু সমাধানটি পাচ্ছে না। নীহা গভীরভাবে চিন্তা করে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল হঠাৎ করে সে বাস্তব জগতে ফিরে এল। কেউ একজন তাকে ডাকছে, নীহা। কোথায় যাচ্ছ তুমি? দাঁড়াও।

নীহা দাঁড়াল, কুগুরাভ সমীকরণের কথা চিন্তা করতে করতে সে কখন সবাইকে ছেড়ে একা একা খানিকটা দূরে চলে এসেছে লক্ষ করে নি। নীহা শুনল, টর বলছে, আমরা পৌঁছে গেছি।

কোথায় পৌঁছে গেছি?

যেখানে পৌঁছানোর কথা। মানুষের আবাসস্থল।

মানুষ কী আছে?

না। মানুষের থাকার কথা নয়। মঙ্গলগ্রহে এখন আমরা কয়জন ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই।

নীহা হেঁটে হেঁটে অন্যদের কাছে ফিরে এল। জিজ্ঞেস করল, মানুষের আবাসস্থলটা কোথায়?

টর হাত দিয়ে সামনের একটা পাথরের স্তৃপকে দেখিয়ে বলল, এইতো, এটা।

নীহা বলল, দেখে মোটেই মানুষের আবাসস্থল মনে হচ্ছে না।

টর হাতে ধরা মডিউলটা দেখে বলল, মনে না হলেও কিছু করার নেই। এটাই সেই জায়গা। মনে হয় মাটির নিচে তৈরি করেছে।

ইহিতা জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কী করব?

সুহা বলল, ভেতরে ঢুকব। অন্ততপক্ষে চারদিকে দেয়াল আর মাথার উপরে একটা ছাদ তো থাকবে।

কেমন করে ঢুকব? নীহা জানতে চাইল, দরজা কোথায়? চাবি কোথায়?

টুরান বলল, একটা ব্যবস্থা থাকবে। জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে আশ্রয় দেয়ার একটা কোড আছে, সেই কোডটি দিলেই দরজা খুলে যাবে। আগে দরজাটি খুঁজে বের করা যাক।

দরজাটা সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। কী প্যাডে যখন কোড সংখ্যাটি প্রবেশ করানো হচ্ছে তখন ক্লদ দরজাটাকে পা দিয়ে একটা লাথি দেয়, সাথে সাথে কঁাচ ক্যাচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। টুরান অবাক হয়ে বলল, দরজাটা খোলা।

ইহিতা দরজাটা পরীক্ষা করে বলল, কেউ একজন এটা ভেঙে আগে ভেতরে ঢুকেছে।

নীহা বলল, তার মানে এটা আশ্রয় হতে পারে, কিন্তু নিরাপদ আশ্রয় নয়। টুরান বলল, এখন কী করব?

টর বলল, অবশ্যই ভেতরে ঢুকব। ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে!

সে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল, বলল, আমি সবার আগে যাই। তোমরা পিছনে পিছনে এসো।

ভেতরে একটা ঝাঁপসা খোলা আলো। একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে, সাবধানে পা ফেলে টর এগিয়ে যায়। অন্যেরা তার পিছু পিছু নামতে থাকে। নিচে একটুখানি খোলা জায়গা সেখানে দাঁড়িয়ে তারা চারদিকে তাকায়। সামনে একটা ভারী দরজা, দরজার ওপরে একটা বাতি জ্বলছে নিভছে। টর এগিয়ে এসে দরজা লাথি দিতেই দরজাটা খুলে গেল, দরজায় অন্যপাশে একজন দীর্ঘদেহী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটির হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, অস্ত্রটি তাদের দিকে তাক করে মানুষটি ভারী গলায় বলল, তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ? তোমরা জান না এখানে ভয়ংকর বিপদ?

টর বলল, আমরা ঘটনাক্রমে এখানে এসেছি, আমাদের একটু আশ্রয় দরকার। এখানে বিপদটি কী?

মানুষটি তাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, টরের কথাটি শুনেছে কিংবা শুনে থাকলেও বুঝেছে বলে মনে হল না। মানুষটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ? তোমরা জান না এখানে ভয়ংকর বিপদ?

ইহিতা বলল, এটা সত্যিকারের মানুষ না। হলোগ্রাফিক ছবি।

টর মানুষটির হলোগ্রাফিক শরীরের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে যেতে যেতে বলল, কিছু একটা বিপদের কথা বলছে। মানুষকে সাবধান করার জন্যে এটাকে বসানো হয়েছে।

ইহিতা বলল, টর খুব সাবধান।

আমি সাবধান আছি।

ক্লদ বলল, আমার যন্ত্র আবার কটকট শব্দ করছে।

সবাই চমকে উঠল। শুনতে পেল সত্যিই তেজস্ক্রিয়তা মাপার ডিটেক্টরটি খুব মৃদুভাবে শব্দ করছে। টুরান ডিটেক্টরটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল। এখানে খুব অল্প তেজস্ক্রিয়তা আছে। আমাদের জন্যে বিপজ্জনক পরিমাণে নয়কিন্তু আছে।

টর হাতের অস্ত্রটা ধরে সাবধানে অগ্রসর হয়। চারপাশে কয়েকটা ঘর, ঘরের ভেতর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘরের মেঝেতে মানুষের ব্যবহারী কিছু জিনিসপত্র, জামাকাপড়, পানীয় এর বোতল–শুকনো রক্তের ছোপ, সবকিছু মিলিয়ে মনে হয় এখানে কোনো একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে।

শেষ ঘরটির ছাদ ভেঙে পড়েছে। দেওয়ালে বিস্ফোরণের চিহ্ন–একদিকে একটা বিশাল গর্ত। সেই গর্ত দিয়ে একটা সুড়ঙ্গে মতো বের হয়ে গেছে। তারা কিছুক্ষণ এই সুড়ঙ্গটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ইহিতা নিচু গলায় বলল, এই সুড়ঙ্গটা কী যাবার জন্যে নাকি আসার জন্যে?

টর বলল, আমরা ভিতরে ঢুকে দেখতে পারি।

ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, না। আমরা এমনিতেই অনেক বড় বিপদের মাঝে আছি। নতুন করে বিপদ ডেকে আনার কোনো প্রয়োজন নেই।

ঠিক তখন ক্লদের কথা শোনা গেল, সে চিৎকার করছে, সবাই এসো দেখে যাও।

সবাই গিয়ে দেখল, সে একটা ছোট দরজা খুলে ভিতরে তাকিয়ে আছে। টুরান নিচু হয়ে দেখল, একটি মৃতদেহ। মানুষটি কতদিন আগে মারা গেছে বোঝার উপায় নেই, সমস্ত শরীর শুকিয়ে চামড়া হাড়ের উপর লেগে আছে। মানুষটির হাতে একটি ভিডি রেকর্ডার শক্ত করে ধরে রেখেছে।

সবাই এক ধরনের আতংক নিয়ে মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে রইল। নীহা ভয়ার্ত গলায় বলল, মানুষটির চোখে মুখে কী আতংক লক্ষ করেছ?

ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ কী দেখে এতো ভয় পেয়েছ কে জানে?

হাতের ভিডি রেকর্ডারে হয়তো রেকর্ড করা আছে।

টর তখন নিচু হয়ে মৃত মানুষটির হাতে শক্ত করে ধরে রাখা ভিডি রেকর্ডারটি ছুটিয়ে আনে। উপরের লাল বোতামটি স্পর্শ করার সাথে সাথে ঘরের মাঝামাঝি একটি মানুষের ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে আসে। অস্পষ্ট ছবি, মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে ছবিটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তারপর আবার ফিরে আসছে। তারা শুনতে পেল, মানুষটি কাঁপা গলায় বলছে, বিপদ। এখনে খুব বড় বিপদ। তোমরা কারা আমার কথা শুনছ আমি জানি না, কিন্তু আমি তোমাদের বলছি তোমরা এক্ষুণি এই আবাসস্থল ছেড়ে চলে যাও। তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো এই আবাসস্থলের দেয়াল ভেঙে ফেলেছে তারা এখন এখানে ঢুকতে পারে… কিমি আর লুসাকে ধরে নিয়ে গেছে… আমাদেরকেও নেবে… কী ভয়ংকর একটি প্রাণী… এদের জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, ধ্বংস নেই… কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো…

ইহিতা এগিয়ে এসে ভিডি রেকর্ডারের বোতাম টিপে সেটাকে বন্ধ করে বলল, ক্লদের মতো ছোট একটা শিশুর সামনে এটা দেখা ঠিক হচ্ছে না।

টর বলল, কিন্তু আমাদের জানা দরকার মানুষটি কী বলছে।

সুহা বলল, ঠিক আছে আমি ক্লদকে সরিয়ে নিই। তোমরা দেখ।

ক্লদ বলল, না আমি যাব না। আমি শুনব মানুষটি কী বলছে।

না তুমি শুনবে না।

আমি শুনব।

না। তুমি শুনবে না–বলে সুহা ক্লদকে ধরে সরিয়ে নিল।

সবাই তখন মানুষটির কথা শুনল। কথাগুলো অনেকটা তার দিনলিপির মতো, সে ছাড়াছাড়া ভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে বলছে। অনেক কথা বলছে, বেশিরভাগই আতংকের কথা, অসহায়তার কথা। ক্রোধ এবং ক্ষোভের কথা। তারপরও তার কথা থেকে তারা অনেকগুলো জরুরি বিষয় জানতে পারল। এই মানুষগুলো বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টির একটা গোপন মিশনে এসেছিল। পৃথিবীর মতো এখানে যেহেতু কোনো জৈব জগৎ নেই তাই প্রাণীটার শক্তির জন্যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করেছে। যে প্রাণীটি তৈরি হয়েছে সেটি সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিমান প্রাণী হয় নি। যেহেতু নতুন করে তাদের জন্মানোর কোনো উপায় নেই তাই অন্যভাবে নিজেদের তৈরি করার পদ্ধতি বের করে নিয়েছে। মানুষদের ধরে তাদের শরীর টুকরো টুকরো করে ব্যবহার করছে। পুরো প্রক্রিয়াটা বীভৎস–যারা এই গোপন মিশনে এসেছিল তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে। যারা পালাতে পারে নি তারা প্রাণীগুলোর হাতে মারা পড়েছে।

যে বিষয়টা সবচেয়ে ভয়ংকর সেটি হচ্ছে তাদের ধ্বংস করা যায় না–গুলি করে বা বিস্ফোরণে শরীরটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলেও তারা ছিন্ন ভিন্ন অংশগুলো জুড়ে দিয়ে নতুন করে তাদের তৈরি করে নেয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে শক্তি পায় বলে তাদের কোনো রসদের অভাব নেই। মাটির নিচে দিয়ে এরা সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে, প্রয়োজন না হলে উপরে ওঠে না, সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত চলে যেতে পারে।

মানুষটির কাছ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য পেয়েছে। মানুষের এই আবাসস্থলটি তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো দখল করে নিলেও এখন থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে একটা খুব সুরক্ষিত আবাসস্থল রয়েছে যেখানে তেজস্ক্রিয় প্রাণী ঢুকতে পারে না। সেখানে কোনোভাবে আশ্রয় নিতে পারলে তারা বেঁচে যাবে।

ভিডি রেকর্ডে মানুষের কথাগুলো শেষ হবার পর সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, টর জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব?

টুরান বলল, করার তো খুব বেশি কিছু নেই। এই আবাসস্থলটা মোটেও নিরাপদ নয়, তাই আমাদের যেতে হবে সুরক্ষিত আবাসস্থলটিতে।

কেমন করে যাব? প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ।

হেঁটে যাওয়া ছাড়া কি অন্য কোনো পথ আছে?

টর মাথা নাড়ল, বলল, নেই।

তাহলে দেরি করে লাভ নেই। চল রওনা দিই।

ইহিতা বলল, আমাদের সাথে চার বছরের একটা শিশু আছে ভুলে যেও।

টুরান বলল, না। আমরা ভুলি নি।

নীহা খানিকটা অনিশ্চিত ভাবে বলল, আমি একটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে পারি?

অবশ্যই। ইহিতা বলল, জিজ্ঞেস তো করতেই পার, কিন্তু আমরা কেউ তার উত্তর জানি কী না সেটা অন্য ব্যাপার।

নীহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা লক্ষ করেছ আমরা কিন্তু ছোট একটা ঘটনা থেকে আরেকটা ঘটনার মাঝে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা পুরো ব্যাপারটা কখনো দেখছি না।

টর ভুরু কুঁচকে বলল, পুরো ব্যাপারটা কী?

আমরা এই গ্রহে আটকা পড়েছি, আমরা কোনোভাবে মহাকাশযানে ফিরে যেতে পারব না। আগে হোক পরে হোক তেজস্ক্রিয় প্রাণী আমাদের খেয়ে ফেলবে।

টর বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?।

নীহা বলল, আমি বলছি কেউ একজন আমাকে ভবিষ্যতের একটা পরিকল্পনা দেখাও। মিনিট মিনিট করে বেঁচে থাকতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।

ইহিতা নরম গলায় বলল, নীহা! আমরা যে বিষয়টা ভুলে থাকার ভান করছি, তুমি ঠিক সেই ব্যাপারটা টেনে এনেছ। সত্যি কথা বলতে কী আমরা মিনিট মিনিট করে বেঁচে আছি কারণ সেটা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। আমরা শুধু সময়টা কাটিয়ে যাচ্ছি, এ ছাড়া আর কিছু করার নেই, সেজন্যে।

নীহা বলল, আমি এই পৃথিবীতে কারো কাছে কিছু চাই নি। শুধু নিজের জন্যে একটু সময় চেয়েছিলাম। নিরিবিলি নিজের সাথে একটু সময়। আমি সেটাও পেলাম না। সেজন্যে দুঃখ দুঃখ লাগছে।

তারা যখন কথা বলছে তখন সুহা আর ক্লদও সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, ক্লদ কৌতূহলী চোখে নীহার দিকে তাকিয়ে রইল, সুহা বলল, মানুষকে কখনো আশা ছেড়ে দিতে হয় না।

নীহা বলল, আমি আশা ছেড়ে দিতে চাই না। আমাকে বল, আমি কী নিয়ে আশা করে থাকব? আমি এই অনিশ্চিত অবস্থাটা আর সহ্য করতে পারছি না, মনে হচ্ছে আমাদের ভেতরে যে দুইজন রবোমানব আছে তারা যদি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলত তাহলেই বুঝি বেশি ভালো হত! কে রবোমানব? আমাকে মেরে ফেলবে অনুগ্রহ করে?

সবাই নীহাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল, কী বলবে কেউ বুঝতে পারছে না। নীহা ভাঙা গলায় বলল, আমাকে এখানে রেখে তোমরা যাও। আমি বসে কুগুরাভ সমীকরণের সমাধানের কথা চিন্তা করতে থাকি। এক সময় তেজস্ক্রিয় প্রাণী এসে আমাকে খেয়ে সব ঝামেলা চুকিয়ে দেবে! অন্তত আমি যেটা করতে ভালোবাসি সেটা করতে করতে মারা যাব।

এই দীর্ঘ সময়ে নুট নিজে থেকে কখনো একটি কথাও বলে নি। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, আমি কী একটা কথা বলতে পারি?

সবাই চমকে ওঠে নুটের দিকে তাকাল।

ইহিতা বলল, নুট! তুমি যে আমাদের সাথে আছ সেই কথাটি আমাদের কারো মাথাতেই আসে না! অবশ্যই তুমি কথা বলতে পারবে। আমরা শুনতে চাই তুমি কী বলবে। কেমন করে বলবে!

নুট ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, কথা না বলতে বলতে আমি কেমন করে কথা বলতে হয় সেটাই ভুলে গেছি!

নীহা বলল, তোমার গলার স্বর সুন্দর। আমাদের মাঝে তোমার সবচেয়ে বেশি কথা বলা উচিত ছিল।

নুট দুর্বলভাবে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ধন্যবাদ নীহা। কিন্তু আমি অবশ্যি গলার স্বর নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। তুমি যে বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করেছ আমি সারাক্ষণ শুধু সেটাই ভেবেছি। ভেবে ভেবে একটা উত্তর পেয়েছি।

কী উত্তর পেয়েছ?

তুমি ভবিষ্যতের একটা পরিকল্পনা জানতে চেয়েছ, আমি তোমাকে সেই পরিকল্পনা দিতে পারি। একেবারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।

সত্যি?

হ্যাঁ।

পরিকল্পনাটা খুবই সহজ, তার জন্যে আমাদের এক-দুইজনকে হয়তো মারা যেতে হবে, কিন্তু যারা বেঁচে থাকবে তাদের একটা সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকবে।

ইহিতা বলল, সেটি কী বলে ফেল নুট।

আমাদের এখনই পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে মানুষের আবাসস্থলটাতে যেতে হবে। সেখানকার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে নয়। অন্য কারণে।

কী কারণে?

এই লম্বা পথ পায়ে হেঁটে যেতে আমাদের কয়েকদিন লাগবে। এই সময়টাতে তেজস্ক্রিয় প্রাণী নিশ্চিতভাবে আমাদের আক্রমণ করবে। তখন আমরা একটা ভয়ংকর বিপদে পড়ব। আমার ধারণা তখন আমাদের মাঝে কারা মানুষ কারা রবোমানব সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

কেউ কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে নুটের দিকে তাকিয়ে রইল। নুট বলল, আমরা যদি রবোমানবদের আলাদা করতে পারি তখন হয় তারা না হয় আমরা বেঁচে থাকব। আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি, দুই কারণে। প্রথম কারণ, আমরা সংখ্যায় বেশি।

ইহিতা জানতে চাইল, দ্বিতীয় কারণ?

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমি জানি আমাদের কোন দুইজন রবোমানব। কাজেই তারা হঠাৎ করে কিছু করতে পারবে না। অন্ততপক্ষে আমি সতর্ক থাকব!

সবাই ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, টর তীব্র স্বরে জিজ্ঞেস করল, কোন দুইজন?

নুট মাথা নাড়ল, বলল, আমি বলব না। আমি সেটা জানি কিন্তু আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া আমার কথার কোনো গুরুত্ব নেই, বরং সেটা একটা জটিলতা তৈরি করবে। আমি তাই প্রমাণের জন্যে অপেক্ষা করছি।

টর মাথা নেড়ে বলল, আসলে তুমি জান না।

জানি।

তুমি কথা বলতে না সেটাই ভালো ছিল।

নুট হাসার চেষ্টা করল, আমি বলতে চাই নি কিন্তু নীহা ভেঙে পড়ছে দেখে বলছি। নুট নীহার দিকে তাকিয়ে বলল, যখন আমরা একশভাগ খাঁটি প্রমাণসহ রবোমানবদের আলাদা করব–তখন ট্রিনিটি আমাদের যে কয়জন বেঁচে থাকবে সেই বাকি মানুষদের মহাকাশযানে নিয়ে নেবে। তুমি সেটাকে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হিসেবে নিতে পার।

নীহা কিছুক্ষণ নুটের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ধন্যবাদ নুট। তুমি আমার ভেতরে যথেষ্ট কৌতূহল তৈরি করেছ! আমি আরো এক দুই দিন বেঁচে থাকার জন্যে চেষ্টা করতে রাজি আছি!

চমৎকার।

ক্লদ নুটের পোশাক স্পর্শ করে বলল, নুট!

বল।

কোন দুইজন রবোমানব আমিও সেটা জানি।

নুট হাসল, বলল, চমৎকার! কিন্তু কাউকে সেটা বল না। আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।

ক্লদ মাথা নাড়ল, না বলব না।