০৭. স্কাউটশিপটা

স্কাউটশিপটা এক ধরনের ভোতা যান্ত্রিক শব্দ করতে করতে মহাকাশযানের পাশে এসে থামল। স্বয়ংক্রিয় কিছু যন্ত্রপাতি স্কাউটশিপটাকে আঁকড়ে ধরে। মহাকাশযানের গোলাকার দরজার সাথে বায়ুনিরোধক সংযোগটা নিশ্চিত করার পর ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। বাতাসের চাপটি সমান হবার সময় একটা মৃদু কম্পন অনুভব করা গেল তারপর হঠাৎ করে সবকিছু পুরোপুরি নীরব হয়ে যায়।

সাতজন মহাকাশচারীকে মহাকাশযানে তুলে দেবার জন্যে যে চারজন ক্রু এসেছে তারা স্কাউটশিপের সিট থেকে নিজেদের মুক্ত করে ভাসতে ভাসতে কাজ শুরু করে দেয়। সবাইকে সিট থেকে মুক্ত করে ক্রুরা তাদেরকে খোলা দরজাটি দিয়ে মহাকাশযানের ভেতর নিয়ে আসে। যন্ত্রপাতিগুলো ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছিল সেগুলোকে মহাকাশযানের গায়ে আটকে দিতে দিতে একজন ক্রু বলল, তোমরা ভারশূন্য পরিবেশটাতে একটু অভ্যস্ত হয়ে নাও, ভবিষ্যতে কাজে দেবে। টুরান একটু সামনে এগুতে যাওয়ার চেষ্টা করে শূন্যে পুরোপুরিভাবে একটা ডিগবাজি খেয়ে বিব্রতভাবে বলল, ট্রেনিংয়ের সময় ভেবেছিলাম বিষয়টা খুব সোজা!

হাসিখুশি চেহারার ত্রুটি মহাকাশযানের এক অংশ থেকে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে অন্য অংশে ভেসে যেতে যেতে বলল, যে কোনো বিষয় অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর সোজা। তোমরাও দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে!

ইহিতা মহাকাশযানের দেয়াল ধরে সাবধানে একটু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু আমরা তো অভ্যস্ত হবার সুযোগ পাব না। মহাকাশযানটির ভেতরে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরি করার জন্যে তোমরা তো একটু পরেই এটাকে তার অক্ষের উপর ঘোরাতে শুরু করবে।

টুরান মহাকাশযানের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঝুলে ছিল, সেখান থেকে সরে যাবার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদেরকে একটু পরে শীতলঘরে আটকে দেবে, মাধ্যাকর্ষণ দিয়েছ কী দাও নি সেটা তো আমরা জানতেও পারব না!

মধ্যবয়স্ক একজন ক্রু একটা প্যানেলের সামনে নিজেকে আটকে ফেলে বলল, মহাকাশযানের কক্ষপথে ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে মহাকাশযানে একটা কৌণিক ভরবেগ দিতে হয়–মাধ্যাকর্ষণটি আসল উদ্দেশ্য না।

টর ভাসতে ভাসতে খানিকদূর এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি এখনো মনে করি আমাদের শীতলঘরে বন্ধ করে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। মহাকাশযানের যাত্রাটা আমাদের উপভোগ করতে দেয়া দরকার।

ইহিতা হেসে বলল, বারো জি ত্বরণে যাওয়ার সময় তুমি সেটা উপভোগ করবে বলে মনে হয় না! স্কাউটশিপেই আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল মনে আছে?

টর মহাকাশযানের একটা ভাসমান মডিউলকে ধরার চেষ্টা করে বলল, যেহেতু সত্যিকারের মহাকাশযানে এসেছি একটু বাড়তি উত্তেজনা তো পেতেই পারি।

মহাকাশচারীদের ছোট দলটি যখন ভারশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল তখন দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ক্লদকে সবার আগে বিষয়টিতে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে দেখা গেল। সে মহাকাশযানের এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে রবারের বলের মতো ছুটে যেতে লাগল, এবং তার মুখের আনন্দধ্বনি মহাকাশযানের পরিবেশটুকুকে বেশ অনেকখানি সহজ করে তুলে।

কিছুক্ষণের মাঝে মহাকাশযানের শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে এবং পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে ওঠে। মহাকাশযানের ভেতর বাতাসের প্রবাহ শুরু হয়ে যায়। বিশাল মহাকাশযানের নানা অংশে আলো জ্বলে ওঠে এবং অসংখ্য যন্ত্রপাতি গুঞ্জন করে ওঠে।

কয়েকজন ক্রু মহাকাশযানের কন্ট্রোল প্যানেলে কাজ করছিল। তারা এবারে সবাইকে ডাকল, বলল, মহাকাশযানের কোয়ান্টাম কম্পিউটার চালু হয়েছে। তোমরা এসে নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নাও।

সুহা বৃথাই তার ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদের সবাইকে আসতে হবে? ক্লদকেও?।

মধ্যবয়স্ক ক্রু বলল, ঠিক আছে, ক্লদকে একটু পরে আনলেও হবে। অন্যরা এসো।

দলের বাকি ছয়জন সদস্য ভাসতে ভাসতে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। টর জানতে চাইল, কোথায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার?

এই যে আমি এখানে। মহাকাশযানের ভেতর একটা কণ্ঠস্বর গম গম করে ওঠে।

টুরান বলল, এখানে মানে কোথায়?

এখানে মানে এই মুহূর্তে এখানে। যদি তুমি অন্য কোথাও থাকো আমি সেখানেও থাকব। আমি এই মহাকাশযানের সবজায়গায় আছি। সবসময়ে আছি।

নীহা জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

কণ্ঠস্বরটি তরল গলায় বলল, আমি তো আর তোমাদের মতো মানুষ নই যে আমার একটা নাম কিংবা পরিচয় থাকতে হবে। কিন্তু তোমরা যদি চাও আমাকে ট্রিনিটি নামে ডাকতে পার। ট্রিনিটি নামটি আমার খুব পছন্দের।

নীহা বলল, ট্রিনিটি, তোমার সাথে পরিচয় হয়ে খুব খুশি হলাম।

ধন্যবাদ নীহা।

তুমি আমার নাম জান?

শুধু নাম? আমি তোমার সবকিছু জানি। সত্যিকথা বলতে কী আমি তোমার সম্পর্কে এমন অনেক কিছু জানি যেটা তুমি নিজেই জান না!

সেটা কীভাবে সম্ভব?

খুবই সম্ভব। তুমি ইরিত্রা রাশিমালার যে সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা করছ, তুমি যে তার সমাধানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছ, তুমি কী সেটা জান? জান না। আমি জানি।

কী আশ্চর্য!

এটা মোটেও আশ্চর্য কিছু নয়। আমার জন্যে এটা খুবই সোজা। তোমাদের সবার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার ওপর, আমি তোমাদের সবসময় চোখে চোখে রাখি। তোমাদের শরীরের ভেতরে এমনকি মস্তিষ্কের ভেতরেও আমি উঁকি দিতে পারি!

কী আশ্চর্য! নীহা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার বলল, কী আশ্চর্য!

সুহা চোখের কোনা দিয়ে ক্লদকে দেখার চেষ্টা করছিল, সে তখন মহাকাশযানের এক অংশে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বিপজ্জনকভাবে অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে। সুহার চোখে মুখে আতংকের একটা ছায়া পড়ল, মনে হয় সেটা দেখেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ট্রিনিটি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, সুহা! তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমার ছেলে ক্লদকে চোখে চোখে রাখছি! তার কিছু হবে না।

সত্যি?।

সত্যি। সে চেষ্টা করলেও নিজেকে ব্যথা দিতে পারবে না। আমাদের এই মহাকাশযানের নিরাপত্তার ব্যবস্থার খুঁটিনাটি জানলে তুমি হতবাক হয়ে যাবে।

তোমার সাথে কথা বলেই আমি হতবাক হয়ে যাচ্ছি।

স্কাউটশিপে করে আসা ক্রুদের একজন বলল, ট্রিনিটি। আমরা কী আনুষ্ঠানিকভাবে তোমার কাছে এই মহাকাশচারীদের দায়িত্ব দিয়ে ফিরে যেতে পারি?

অবশ্যই পার। তোমার তথ্য ক্রিস্টালটি আমার ভিডি রিডারে প্রবেশ করিয়ে দাও। আমি তখন আনুষ্ঠানিকভাবে সাতজন মহাকাশচারীর দায়িত্ব নিয়ে নেব।

মধ্যবয়স্ক ক্রুটি তার পিঠে ঝোলানো ব্যাগ থেকে চতুষ্কোণ একটি ক্রিস্টাল বের করে কন্ট্রোল প্যানেলের নির্দিষ্ট জায়গায় ঢুকিয়ে দিল। কিছুক্ষণ একধরনের যান্ত্রিক শব্দ হল, প্যানেলে কিছু আলোর ঝলকানি হল তারপর ক্রিস্টালটি আবার বের হয়ে এলো। সবাই আবার তখন ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, চমৎকার! ছয়জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ এবং একজন শিশুর দায়িত্ব আমি নিয়ে নিচ্ছি। এই সাতজন মানুষ ছাড়াও শীতলঘরে আরো অসংখ্য মানুষ, প্রাণী, বৃক্ষলতা, তাদের দ্রুণ এবং তথ্য রয়েছে আমি সেগুলোর দায়িত্বও নিয়ে নিচ্ছি।

মধ্যবয়স্ক ক্রুটি কন্ট্রোল প্যানেল থেকে চতুষ্কোণ ক্রিস্টালটি বের করে সাবধানে নিজের ব্যাগে রেখে বলল, তাহলে আমরা বিদায় নিই?

ট্রিনিটি বলল, হ্যাঁ তোমাদের বিদায় নেয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি যখন আমার সবগুলো কুরু ইঞ্জিন চালু করব তখন তোমাদের স্কাউটশিপ নিয়ে এই মহাকাশযান থেকে দূরে থাকা ভালো, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর ঢুকে যাওয়া উচিত।

চারজন ক্রু তাদের যন্ত্রপাতি বাক্সে ঢুকিয়ে নিয়ে বিদায় নেবার জন্যে প্রস্তুত হল। মধ্যবয়স্ক ক্রু, একটু এগিয়ে এসে একজন একজন করে সাতজন মহাকাশচারীর সবার হাত স্পর্শ করল, তারপর বলল, তোমরা কারা, কেন তোমরা এই মহাকাশযানে এসেছ, তোমরা কোথায় যাবে, কতদিনের জন্য যাবে, কেন যাবে আমরা কেউ সেগুলো কিছু জানি না। আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তোমাদের এই মহাকাশযানে এনে ট্রিনিটির হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে। আমরা সেই দায়িত্ব শেষ করে তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি।

টুরান বলল, আমরা কারা কেন কোথায় যাচ্ছি তার সবকিছু আমরা জানি, কিন্তু আমাদের সেই কথাগুলো কাউকে বলার কথা নয়, তাই তোমাদেরকেও বলছি না–

মধ্যবয়স্ক ক্রু বলল, আমরা সেটি নিয়ে কোনোরকম কৌতূহল দেখাচ্ছি না! কিন্তু আমরা জানি তোমাদের এই মিশন মানবজাতির জন্যে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তোমাদের সাফল্য কামনা করি।

তোমাদের ধন্যবাদ।

অন্য তিনজন ক্রু এগিয়ে এসে সবার হাত স্পর্শ করে বিদায় নিয়ে মহাকাশযানের গোল দরজা দিয়ে ভেসে ভেসে বের হয়ে গেল। গোল দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার পর তারা একটা মৃদু গর্জন এবং কম্পন অনুভব করে। একটু পরেই স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তারা স্কাউটশিপটাকে নীল আলো ছড়িয়ে ছুটে যেতে দেখে।

টুরান তখন অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন থেকে আমরা একা। একেবারে একা।

ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমাদের জন্যে ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করে আছে আমরা জানি না। যদি কখনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে।

নীহা বলল, ট্রিনিটি আমাদের সাহায্য করবে।

টুরান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। অবশ্যই। ট্রিনিটি অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবে।

ইহিতা বলল, আমাদের কিছুক্ষণের মাঝে শীতলঘরে ঢুকে যেতে হবে, কতোদিন সেখানে আমরা থাকব জানি না। আবার কখন সবার সাথে দেখা হবে বলতে পারি না। আমার তাই মনে হয় শীতলঘরে যাবার আগে নিজেদের মাঝে একটু কথা বলে নিই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা।

টুরান কন্ট্রোল প্যানেলের একটা মনিটর ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদের ভরশূন্য পরিবেশে থাকার অভ্যাস নেই। এভাবে ভেসে ভেসে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা সোজা নয়।

ইহিতা ভুরু কুঁচকে বলল, গুরুত্বপূর্ণ কথা তাহলে কেমন করে বলতে হয়।

টুরান কাঁধ ঝাকুনি দিয়ে বলল, আমার গুরুত্বপূর্ণ কিংবা হালকা কোনো ধরনের কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না।

ইহিতা কিছুক্ষণ স্থির চোখে টুরানের দিকে তাকিয়ে রইল, কথা বলার প্রস্তাবটি আমি না দিয়ে যদি একজন পুরুষমানুষ দিত তাহলে কী তুমি আরেকটু আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে?

সম্ভবত।

ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টুরান। তোমার ব্যক্তিগত জীবনের একটা ঘটনাকে তুমি এই মহাকাশযানের এতো বড় একটা অভিযানে টেনে আনবে আমি সেটা বিশ্বাস করি নি।

টুরান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।

টর একটু এগিয়ে এসে বলল, ঠিক আছে, টুরানের যদি আগ্রহ না থাকে থাকুক। আমরা অন্যেরা তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো শুনি।

ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা তো যন্ত্র নই। আমরা মানুষ। মানুষের কাছে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ কথা মাত্র একটিই হতে পারে।

টুরানের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সেটি কী? একজনের জন্যে অন্যজনের সহমর্মিতা।

টুরান এবার হাসির মতো শব্দ করল, বলল, সহমর্মিতা অনেক কঠিন শব্দ। আমরা না হয় সেটি ব্যবহার না করলাম। তাছাড়া এই ধরনের শব্দ আমি বিশ্বাস করি না।

টর বলল, টুরান, তুমি কেন ইহিতাকে কথা বলতে দিচ্ছ না?

ইহিতা বলল, সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনে হয় আমার আর কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমরা এখন আমাদের শীতলঘরে যাই। যাবার আগে সবার জন্যে শুভেচ্ছা। আমরা আবার যখন জেগে উঠব, সেটি হবে আমাদের জন্যে নতুন জীবন।

নীহা বলল, আমি সেই নতুন জীবনের জন্যে অপেক্ষা করে আছি।

সুহা বলল, তোমরা আমার সন্তানটির জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করো যেন তাকে আমি একটি সুন্দর জীবন দিতে পারি।

নীহা বলল, নিশ্চয়ই পারবে সুহা। নিশ্চয়ই পারবে।

ইহিতা নুটের দিকে তাকিয়ে বলল, নুট, তুমি কখনো কোনো কথা বল না। আজকে কী বলবে?

নুট জোর করে হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ল, সে বলবে না। ৪২

ঠিক আছে, নুট। আশা করছি ভবিষ্যতে কখনো আমরা তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাব!

টুরান বলল, চল আমরা শীতলঘরে যাই। আমি এই অতীতকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিছনে ফেলে যেতে চাই।

টর বলল, আমি কী ঠিক করেছি জান? কী?

আমি শীতলঘরে ঢুকব না। আমি বাইরে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে বসে থাকব। আমি মহাকাশযানটির গতিবিধি দেখতে চাই।

হঠাৎ করে ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর গমগম করে ওঠে, না টর। সেটি সম্ভব নয় তোমাকে শীতলঘরে ঢুকতে হবে।

আমি ঢুকব না। আমি মানুষ, আমি একটা কম্পিউটারের নির্দেশ মানতে রাজি নই।

টর। আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাই না। একটা মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার হিসেবে আমার অনেক ক্ষমতা। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি তোমাকে শীতলঘরে যেতে বাধ্য করতে পারি।

কীভাবে?

আমি তোমাকে সেটি বলব না। তুমি যদি আমার কথা না শোনো আমি তোমাকে বাধ্য করতে পারব। আমার সেই ক্ষমতা আছে।

টর কঠোর মুখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ট্রিনিটি, আমি তোমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। আমাকে বাধ্য কর।

ট্রিনিটি বলল, সেটি না করলেই ভালো করতে। বিশ্বাস কর আমি অনেক কিছু করতে পারি।

টর মুখ শক্ত করে বলল, আমি বিশ্বাস করি না!

ঠিক আছে, আমি তাহলে অন্যদের বলছি। তোমরা শীতল ঘরে যাও, প্রস্তুতি নাও।

টুরান ইতস্তত করে বলল, আর টর?

ট্রিনিটি বলল, সেও আসবে। তোমরা সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।

টুরান বলল, আমার মনে হয় আমরা নিজেদের মাঝে একটা বোঝাঁপড়া করে নিতে পারতাম। আমাদের মাঝে কাউকেই নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হয় নি। আমরা সেটা করে নিতে পারতাম, তাহলে এই ঝামেলাটুকু হত না।

ইহিতা বলল, একটু আগে আমি সেই প্রস্তাবটি করেছিলাম তখন তুমি রাজি হও নি। এখন তুমি নিজে এই প্রস্তাবটি করছ।

টুরান মুখ শক্ত করে বলল, দুটি আসলে এক বিষয় নয়।

ইহিতা ভেসে ভেসে সামনে অগ্রসর হতে হতে বলল, দুটি আসলে একই বিষয়। তুমি সেটা খুব ভালো করে জান।

টুরান কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, সে স্বীকার করতে চাইছে না কিন্তু এই মেয়েটি আসলে সত্যি কথাই বলেছে।

ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, উপরে যে ঘরটিতে সবুজ বাতি জ্বলছে তোমরা সবাই সেখানে যাও। সবার জন্যে আলাদা করে একটা ক্যাপসুল রাখা আছে। তোমরা সেখানে ঢুকে যাও। টরকে নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না। আমি নিশ্চিতভাবে বলছি, সেও চলে আসবে। সম্ভবত তোমাদের আগেই সে ক্যাপসুলে ঢুকে যাবে।

প্রথমে ক্লদ, তার পিছু পিছু তার মা সুহা, তাদের পিছনে পিছনে ইহিতা নুট আর নীহা, সবশেষে টুরান উপরের ঘরটিতে এসে ঢুকল। দেয়ালের সাথে সাতটি ক্যাপসুল লাগানো, ক্যাপসুলের ওপর ছোট স্ক্রিনে তাদের ছবি। সবাই নিজের ক্যাপসুল খুঁজে বের করে নেয়। ক্লদ আনন্দের শব্দ করে বলল, আমার ক্যাপসুলটি কতো সুন্দর দেখেছ, মা?

সুহা বলল, হ্যাঁ বাবা খুব সুন্দর।

ভেতরে ভিডি রিডার আছে।

হ্যাঁ। তুমি খেলতে পারবে। আমাদের সাথে কথা বলতে পারবে।

আমি ভিতরে ঢুকি?

ঢুকে যাও। ঢুকে যাবার আগে শুধু আমাকে একটু আদর দিয়ে যাও।

ক্লদ তার মাকে একবার জড়িয়ে ধরল। সুহা গভীর মমতায় শিশুটিকে ক্যাপসুলের ভেতর শুইয়ে দেয়। আবার তার সাথে কবে দেখা হবে সে জানে। কত বছর পার হয়ে যাবে? একশ বছর? দুইশ বছর? নাকি লক্ষ বছর?

ক্লদের ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নেমে এসে ক্যাপসুলটি বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে অন্য সবাই একট আর্ত চিৎকার শুনতে পায়। ইহিতা চমকে ওঠে বলল, কী হয়েছে?

ট্রিনিটি বলল, টরকে শীতলঘরে আনছি। ছোট একটা ইলেকট্রিক শক দিয়েছি।

ইহিতা কঠিন গলায় বলল, তুমি আমাদের একজন অভিযাত্রীকে ইলেকট্রিক শক দিতে পার না।

পারি। শুধু ইলেকট্রিক শক নয়, আরো অনেক কিছু করতে পারি। এই মহাকাশযানটি আমার দায়িত্বে। এটি ঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্যে আমাকে অনেক কিছু করতে হয়।

আমি ভেবেছিলাম একটি কম্পিউটার কখনো একজন মানুষকে অত্যাচার করতে পারে না। তাদেরকে সেই অধিকার দেয়া হয় নি।

ঠিক তখন আবার একটা ভয়ংকর আর্ত চিৎকার শুনতে পেল, আগের থেকে জোরে এবং আগের থেকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী। প্রায় সাথে সাথেই সবাই দেখতে পেল টর বাতাসে ভেসে ভেসে দ্রুত এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ঘরের দরজায় সে আঘাত খেয়ে পিছনে ছিটকে গেল এবং দেয়াল আঁকড়ে ধরে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সে ঘরের ভেতরে ঢুকে পাগলের মতো নিজের ক্যাপসুলটি খুঁজতে থাকে। তার চোখ-মুখ রক্তশূন্য, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিকৃত এবং কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে সে তার ক্যাপসুলে হুঁড়মুড় করে ঢুকে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। ইহিতা ক্যাপসুলে মাথা ঢুকিয়ে টরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে টর?।

টর বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, কানের ভেতর ভয়ংকর শব্দ, মনে হয় মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কী ভয়ানক যন্ত্রণা তুমি চিন্তা করতে পারবে না!

এখন বন্ধ হয়েছে?

হ্যাঁ বন্ধ হয়েছে। টর হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, আমি এই ট্রিনিটিকে খুন করে ফেলব। সৃষ্টিকর্তার দোহাই, খুন করে ফেলব।

ট্রিনিটি একটা কম্পিউটার! কম্পিউটারকে খুন করবে কেমন করে?

সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও!

টর কথা শেষ করার আগেই ক্যাপসুলের দরজাটি নেমে আসে। ইহিতা মৃদু স্বরে বলল, কাজটা ঠিক হল না।

নীহা জানতে চাইল, কোন কাজটা?

আমরা এখনো আমাদের যাত্রা শুরু করিনি এর মাঝে ট্রিনিটির সাথে টরের বিরোধ!

ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, তোমরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমার সাথে কারো বিরোধ নেই।

ইহিতা বলল, না থাকলেই ভালো। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, চল আমরা আমাদের ক্যাপসুলে ঢুকে যাই।

নীহা বলল, চল।

সবাই যখন নিজের ক্যাপসুলে ঢুকছে তখন ইহিতা দেখল নুট তার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ইহিতা অবাক হয়ে বলল, নুট! কিছু বলবে?

নুট মাথা নাড়ল। ইতিহা জিজ্ঞেস করল, কী বলবে?

নুট মৃদু গলায় ফিসফিস করে বলল, আমার খুব ভয় করছে।

কিসের ভয়?

শীতলঘরে ঘুমানোর পর যদি আর কখনো জেগে না উঠি!

ইহিতা নুটের হাত ধরে বলল, জেগে উঠবে। নিশ্চয়ই জেগে উঠবে।

তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ?

ইহিতা একমুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। যাও ক্যাপসুলে শুয়ে পড়।

নুট তার ক্যাপসুলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে ইহিতার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, তোমার যদি কিছু করার জন্যে কখনো সাহায্যের দরকার হয় তুমি আমাকে বল। তুমি যেটা বলবে আমি সেটা করব।

ইহিতা হেসে বলল, অবশ্যই বলব নুট। অবশ্যই বলব।

 

ক্যাপসুলের ঢাকনাটা নেমে আসার সাথে সাথে ইহিতা একটা মিষ্টি গন্ধ অনুভব করতে পারল। তাদেরকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে সম্ভবত কোনো একটি গ্যাস ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইহিতা সামনে রাখা মনিটরটা স্পর্শ করে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি পৃথিবীটাকে শেষবার দেখতে চাই।

মনিটরে ধীরে ধীরে নীল পৃথিবীটার ছবি ভেসে উঠল। এই অপূর্ব সুন্দর নীল গ্রহটি ছেড়ে সে চলে যাবে? আর কখনো এই গ্রহটি সে দেখতে পাবে না? তাদের নতুন গ্রহ কেপলার টুটুবি দেখতে কেমন হবে? পৃথিবীর মতো সুন্দর?

গভীর একটা বেদনায় তার বুক টনটন করতে থাকে। ইহিতা অনুভব করে খুব ধীরে ধীরে অপূর্ব নীল গ্রহটি আবছা হয়ে আসছে। তার চোখে ঘুম নেমে আসছে। ঘুম। গভীর ঘুম।

কতো বছর পর তার এই ঘুম ভাঙবে?