০৪. ঘরটি ছোট, ঘরের ছাদ বেশ নিচু

ঘরটি ছোট, ঘরের ছাদ বেশ নিচু, ইচ্ছে করলে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। ঘরটির মাঝে একটি ধাতব টেবিল, টেবিল ঘিরে তেরোজন নারী-পুরুষ বসে আছে। ঘরটির ভেতর নিরানন্দ পরিবেশ কিন্তু ঠিক কেন সেটি নিরানন্দ হঠাৎ করে বোঝা যায় না। ধাতব টেবিলের একপাশে যে বসে আছে তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য লুকিয়ে আছে। সে টেবিলে থাবা দিতেই টেবিলের চারপাশে বসে থাকা নারী ও পুরুষগুলো ঘুরে তার দিকে তাকাল। মানুষটি সুনির্দিষ্ট কারো দিকে না তাকিয়ে বলল, বিজ্ঞান আকাদেমী কী নিয়ে তাদের গোপন সভা করেছে সেটা কি জানা গেছে?

কমবয়সী একটা মেয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, আমাদের নিয়ে!

অবশ্যি আমাদের নিয়ে? কিন্তু আমাদের কোন বিষয়টা নিয়ে সেটা জানা গেছে?

মাঝবয়সী একজন মানুষ বলল, মোটামুটি অনুমান করতে পারি।

ঠিক আছে অনুমান কর।

মানুষটি বলল, আমরা রবোমানবেরা নেটওয়ার্ক দখলের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছি। সমাজের সব জায়গায় আমাদের রবোমানবেরা আছে—তারা গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। আগে যেরকম প্রতিদিন মানুষেরা কিছু রবোমানব ধরে ফেলতো-আজকাল সেটা পারছে না। তার প্রধান কারণ–

কঠিন চেহারার মানুষটি বিরক্তির সুরে বলল, আমরা সবাই এগুলো জানি। আমি তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করছি সেটা বল। বিজ্ঞান আকাদেমী কী নিয়ে সভা করেছে?

তারা একটা মহাকাশযান পাঠাবে।

মহাকাশযান?

হ্যাঁ।

তুমি কেমন করে সেটা জান? বিজ্ঞান আকাদেমীর সভা ছিল গোপন। বিজ্ঞান আকাদেমীর কোনো সদস্যের মাঝে আমরা কোনো রবোমানব ঢুকাতে

পারি নি।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, বিজ্ঞান আকাদেমীর সভা শেষ হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর অনেক জায়গায় অনেক রকম কাজ শুরু হয়ে গেছে। সব কাজগুলো হচ্ছে একটা মহাকাশযানকে নিয়ে। আমরা তাই অনুমান করছি একটি মহাকাশযান পাঠানো হবে।

মহাকাশযানে কী পাঠানো হবে?

কমবয়সী মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, মানুষ। মানুষের ফিটাস। মানুষের জিনোম।

কঠিন চেহারার মানুষটি কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, সত্যি?

হ্যাঁ। নেটওয়ার্কের তথ্য আমরা আজকাল যখন খুশি পরীক্ষা করতে পারি। আমি নিশ্চিতভাবে জানি অসংখ্য মানুষ, মানুষের ফিটাস আর জিনোম প্রস্তুত করা হচ্ছে!

কঠিন চেহারার মানুষটির মুখে বিচিত্র একধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, মানুষ তাহলে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে! নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে মহাকাশযানে করে কিছু মানুষ বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে না থাকলেও অন্য কোথাও যেন মানুষেরা বেঁচে থাকে?

হ্যাঁ। মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, সবকিছু দেখে আমাদের তাই মনে হচ্ছে।

কঠিন চেহারার মানুষটি তরল গলায় বলল, আমার ঘনিষ্ঠ রবোমানবেরা, তোমাদের অভিনন্দন। সেই দিনটি আর খুব বেশি দূরে নয় যখন আমরা পৃথিবীর দায়িত্ব নেব।

সবাই মাথা নাড়ল, শুধু মধ্যবয়স্ক মানুষটি গম্ভীর গলায় বলল, এখন আমাদের অনেক কাজ। পৃথিবীর দায়িত্ব নেবার আগে আমাদের নিজেদের কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।

কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, আমরা কি প্রস্তুতি নেইনি?

নিয়েছি। বেশ কিছু প্রস্তুতি নিয়েছি। নেটওয়ার্কটি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সাথে সাথে আমাদের কাজে লেগে যেতে হবে।

তুমি ঠিকই বলেছ। কঠিন চেহারার মানুষটি হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়, নিজের হাতের আঙুলগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার ঘনিষ্ঠ রবোমানবেরা, তোমাদের মাঝে যারা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছ আমি তাদের পুরস্কার দিতে চাই!

ধাতব টেবিল ঘিরে বসে থাকা সবাই একটু নড়েচড়ে বসে তার দিকে তাকাল। কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, তোমরা সবাই জান মানুষ রোমানব খুঁজে বের করার একটা পদ্ধতি বের করেছিল। যে ছেলেটি সেটা বের করেছিল তার অসাধারণ গাণিতিক প্রতিভা থাকলেও মানুষ হিসেবে সে ছিল অতি নির্বোধ। আমাদের একজন এজেন্ট তার করোটি কেটে মস্তিষ্কটা বের করে নিয়ে এসেছে! সেই মস্তিষ্ক থেকে আমরা সব তথ্য বের করে এনেছি, বলতে পার এই ঘটনাটি রবোমানবের জীবনের বিশাল বড় একটি সাফল্য। যে এজেন্ট সেই কাজটি করেছে সেও আমাদের মাঝে আছে–আমি এখন তাকে পুরস্কৃত করতে চাই।

কঠিন চেহারার মানুষটি টেবিলের অন্য মাথায় বসে থাকা লাল চুলের কমবয়সী হাসিখুশি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, বল, তুমি কী পুরস্কার চাও?

লাল চুলের মেয়েটি হাসি হাসি মুখে বলল, আমি এখন কোনো পুরস্কার চাই না। আমরা রবোমানবেরা যখন নেটওয়ার্ক দখল করে পৃথিবীর দায়িত্ব নিয়ে নেব তখন আমাকে পুরস্কার দিও! আমি তখন তোমার কাছে একটা পুরস্কার চাইব।

তখনো তুমি পুরস্কার পাবে। এখন তুমি কী পুরস্কার চাও বল।

লাল চুলের মেয়েটা রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, সত্যি বলব?

বল।

আমি যে মস্তিষ্কটা কেটে এনেছি সেটাকে একটা ইন্টারফেস দিয়ে কমিউনিকেশন মডিউলের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যার অর্থ সেই মানুষটার সাথে আমি এখন কথা বলতে পারি। আমি কমিউনিকেশন মডিউল ব্যবহার করে আমার পরিচিত এই ছেলেটার সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতে চাই। তাই তুমি পুরস্কার হিসেবে আমাকে এই মস্তিষ্কটা দিতে পার।

কঠিন চেহারার মানুষটি দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, আমি ভেবেছিলাম রবোমানবের ভেতর থেকে মায়া-মমতা ভালোবাসা সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

লাল চুলের মেয়েটি হাসল, বলল, এটি মায়া মমতা ভালোবাসা না–এটা হচ্ছে একটা বিনোদন। যে মানুষের কোনো দেহ নেই, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই তার সাথে কথা বলার বিষয়টা প্রায় রূপকল্পের মতো। মানুষটি একটা শব্দহীন আলোহীন অস্তিত্বহীন জগতে অনন্ত জীবনের জন্য আটকা পড়ে আছে তার ভেতরে যে অমানুষিক আতংক আর হতাশা সেটি বিনোদনের জন্যে অসাধারণ।

কঠিন চেহারার মানুষটি লাল চুলের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, তথাস্তু। তোমার প্রিয় মানুষটির মস্তিষ্ক নিয়ে খেলা করার জন্যে সেটা তোমাকে দিয়ে দেয়া হল।

লাল চুলের মেয়েটি বলল, ধন্যবাদ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, আমার মনে হচ্ছে আমরা আমাদের কাজে ঠিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না। যেটি করা দরকার সেটি না করে অন্যান্য ছেলেমানুষী কাজে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি।

কঠিন চেহারার মানুষটির মুখের মাংসপেশি একটু শিথিল হয়ে সেখানে একটা হাসির আভাস পাওয়া গেল। সে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা সত্যিকারের কাজ না করে আনুষঙ্গিক কাজ বেশি করছি। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না। কেন জান?

কেন?

তার কারণ তুমি গোপনে সত্যিকারের কাজ করে যাচ্ছ?

মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কঠিন চেহারার মানুষটি হাসি হাসি মুখে বলল, আমাদের ভেতর থেকে মায়া মমতা ভালোবাসা এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলো সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভয়ের অনুভূতিটি সরানো হয় নি। নিরাপত্তার জন্যে ভয়ের অনুভূতি দরকার। আমরা এখনো ভয় পাই। তুমি যেরকম ভয় পাচ্ছ। কঠিন চেহারার মানুষের মুখের হাসিটি আস্তে আস্তে সরে গিয়ে সেখানে আবার কাঠিন্যটি ফিরে আসে, সে শীতল গলায় বলল, তুমি কেন ভয় পাচ্ছ বলবে?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি আমতা আমতা করে বলল, না–আমি ভয় পাচ্ছি না। আমি-

না পেলে ক্ষতি নেই। যখন প্রয়োজন হবে তখন ভয় পেলেই হবে। কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, আমি বলেছি যে তোমাদের সবার কাজের জন্যে একটা পুরস্কার দেব। একজনকে দিয়েছি। তোমাকেও দেব।

আমাকে? আ-আমাকে?

হ্যাঁ। ছোট একা সীসার টুকরো। তোমার কপালে, শব্দের চেয়ে তিনগুণ গতিতে সেটা ঢুকে যাবে। সীসা নরম ধাতু, সেটা টুকরো টুকরো হয়ে তোমার মস্তিষ্ককে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। তুমি কিছু বোঝার আগেই তোমার সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।

কঠিন চেহারার মানুষটি তার ড্রয়ার থেকে একটা পুরানো ধাঁচের রিভলবার বের করে আনে। সেটির দিকে তাকিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়, অবর্ণনীয় আতংকে সেটি কদর্য হয়ে ওঠে। মানুষটি কাঁপা গলায় বলল, তু–তুমি কী বলছ?

আমি কী বলেছি তুমি শুনেছ। রবোমানবদের এই বিস্ময়কর সাফল্যের কারণ হচ্ছে শৃঙ্খলা। কারণ হচ্ছে নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বকে তুমি গোপনে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছ? তোমার এতো বড় দুঃসাহস?

কঠিন চেহারার মানুষটি তার চেপে রাখা রিভলবারটি মধ্যবয়স্ক মানুষের কপালের দিকে তাক করে। মধ্যবয়স্ক মানুষটি ভাঙা গলায় বলল, আমি দুঃখিত। আমি খুবই দুঃখিত–

মিথ্যা কথা বলো না। রবোমানবেরা কখনো দুঃখিত হয় না।

লাল চুলের মেয়েটি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলল, দাঁড়াও! দাঁড়াও।

কঠিন চেহারার মানুষটা মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

আমি কী একটু অন্যপাশে সরে বসতে পারি? কেন?

দৃশ্যটা যেন একটু ভালো করে দেখতে পারি। গুলি খাবার পর যখন একজন ছটফট করতে থাকে সেই দৃশ্যটি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।

কঠিন চেহারার মানুষটি লালচুলের মেয়েটিকে অন্যপাশে বসার সময় দিয়ে ট্রিগার টেনে ধরে।