১০. ভোরবেলা নিকি আর ত্রিপি

ভোরবেলা নিকি আর ত্রিপি খুব ব্যস্তভাবে বের হয়ে যাচ্ছিল, অনেকগুলো টারমিনালের সামনে ক্রিনিটিকে বসে থাকতে দেখে তারা থেমে গেল। নিকি জিজ্ঞেস করল, ক্রিনিটি তুমি কী করছ?

নেটওয়ার্কে যে সব তথ্য ব্রডকাস্ট করা হচ্ছে সেগুলো দেখছি।

ত্রিপি বলল, এই কাজটার মাঝে কোনো আনন্দ নেই, তাই না?

ক্রিনিটি মনিটরের উপর থেকে চোখ না তুলে বলল, আমার মাঝে আনন্দ অনুভব করার কোনো ক্ষমতা নেই, তাই আমি জানি না।

আমাদের সাথে চল, আজকে আমরা অনেক মজা করব।

ক্রিনিটি এবারে চোখ তুলে তাকাল, তারপর বলল,  তোমরা কী মজা করবে?

আমরা একটা ভেলা তৈরি করব, তারপর হ্রদের মাঝে সেই ভেলা ভাসাব।

আমার যদি দুশ্চিন্তা করার ক্ষমতা থাকতো তাহলে এখন নিশ্চয়ই তোমাদের ভেলা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম।

ত্রিপি হি হি করে হাসল, বলল, এটা খুব ভালো যে তুমি দুশ্চিন্তা করতে পার না।

নিকি বলল, তুমি চল আমাদের সাথে। আমরা কী করি দেখবে।

তোমরা কী করে সেটা দেখার জন্যে আমায় তোমাদের সাথে যেতে হয়। না। তোমাদের গলায় যে মাদুলি ঝুলিয়ে রেখেছি সেগুলো পঞ্চম প্রজন্মের ট্রাকিওশান। সেগুলো দিয়ে আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে বসে তোমাদের ওপর নজর রাখতে পারি।

ত্রিপি বলল, কিন্তু আমরা তো তোমার ওপর নজর রাখতে পারি না। তুমি আমাদের সাথে চল, তাহলে আমরাও তোমার ওপর নজর রাখতে পারব।

ক্রিনিটি বলল, আমি এখন যেতে চাই না। নেটওয়ার্কে আমি একটা তথ্যকে ব্রডকাস্ট হতে দেখছি। তথ্যটা সত্যি হলে গুরুত্বপূর্ণ। আমি তথ্যটাকে বিশ্লেষণ করতে চাই।

এটি কী তথ্য?

আমি তথ্যটা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না তাই এই মুহূর্তে তোমাদের কিছু বলছি না। যখন নিশ্চিত হব তখন তোমাদের বলব।

ঠিক আছে। বলে নিকি আর ত্রিপি বের হয়ে গেল। তারা আজ খুব ব্যস্ত।

 

রাত্রিবেলা খেতে বসে নিকি বলল, ক্রিনিটি আজকে আমার যে খিদে পেয়েছে যে, মনে হচ্ছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলব।

ক্রিনিটি বলল, তুমি কখনো ঘোড়া দেখ নি। তাই একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলার অর্থ কী তোমার জানার কথা নয়।

নিকি বলল, আমি প্রাচীন সাহিত্যে দেখেছি, সেখানকার চরিত্রগুলো বেশি খিদে লাগলে বলে আমি আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেল।

ক্রিনিটি বলল, এটি একটি অযৌক্তিক কথা। একজন মানুষ কখনোই একটা আস্ত ঘোড়া খেতে পারবে না।

না পারলে নাই। কিন্তু আমি বলব। বলতে খুব মজা হয়।

ত্রিপি খেতে খেতে ছোট একটা বিষম খেল, এক ঢোক পানি খেয়ে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রলল, তুমি সকালে বলেছিলে যে তুমি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখেছ। সেটা কী আমাদের বলবে?

হ্যাঁ বলব।

বল।

আমার মনে হয় তোমরা খাওয়া শেষ করে আমার কাছে আস। আমি মনিটরে সরাসরি দেখাই, তোমরা তাহলে বিষয়টা ভালো বুঝতে পারবে।

দুজনেই তাড়াতাড়ি খেয়ে ক্রিনিটির সাথে মনিটরের সামনে গিয়ে বসে। ক্রিনিটি কয়েকটা সুইচ স্পর্শ করতেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একটা ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। সাথে নীচু স্বরে একটি কোমল সুর। ক্রিনিটি বলল, এই নির্দিষ্ট চ্যানেলে কিছুক্ষণ পরপর একটা বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে?

কে প্রচার করছে?

একজন মানুষ।

মানুষ? নির্কি ও ত্রিপি দুজনে একসাথে চমকে চিৎকার করে ওঠে।

হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে একজন মানুষ।

কী বলছে মানুষটি?

তোমরা এক্ষুণি নিজেরাই সেটা শুনতে পাবে।

নিকি দুই হাত উপরে তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি এতো বড় একটা খবর আমাকে এতো পরে দিচ্ছ?

পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে আমি খবরটি তোমাদের দিতে চাচ্ছিলাম না। যদি এটি কোনো একটি রোবটের ষড়যন্ত্র হয়?

রোবটের ষড়যন্ত্র? নিকি অবাক হয়ে বলল, রোবটের ষড়যন্ত্র?

হ্যাঁ। সে জন্যে আমাকে নিশ্চিত হতে হয়েছে যে এটি কোনো রোবট নয়।

তুমি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছ? কী বলেছে মানুষটা?

ক্রিনিটি উত্তর দেবার আগেই ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, মানুষটা কতো বড়? কী বলেছে মানুষটা?

ছেলে না মেয়ে? কোথায় থাকে?

নিকি এবং ত্রিপির আরো প্রশ্ন ছিল কিন্তু ঠিক তখন হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা এক মুহূর্তের জন্যে অন্ধকার হয়ে আবার আলোকিত হয়ে ওঠে এবং কিছু বোঝার আগেই তারা দেখতে পেল ঠিক তাদের সামনে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি কিন্তু সেটি এতো জীবন্ত যে নিকি এবং ত্রিপির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

মানুষটির সোনালি চুল এবং নীল চোখ। নিকি আর ত্রিপি আগে সত্যিকারের মানুষ দেখে নি, তারপরও তারা বুঝতে পারল মানুষটি খুব সুদর্শন। মানুষটি চারদিক একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তারপর ভরাট গলায় বলল, আমার নাম। ফ্লিকাস। আমি একজন মানুষ আমার বয়স চৌত্রিশ। ভয়ঙ্কর ভাইরাস আক্রমণে। পৃথিবীর সব মানুষ মারা গিয়েছে কিন্তু প্রকৃতির কোনো এক বিচিত্র খেয়ালে আমি মারা যাই নি। আমি বেঁচে গিয়েছি, যেহেতু আমি বেঁচে গিয়েছি আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত আমার মতো আরও কিছু মানুষ বেঁচে গিয়েছে। তাদের সংখ্যা হয়তো খুবই কম, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই আছে।

মানুষটি একটি নিঃশ্বাস নেয় এবং হঠাৎ করে তার মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে। সে নীচু গলায় বলে, আমি ভেবেছিলাম যারা বেঁচে আছে তারা নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বের করবে, আমি সেজন্যে অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু কেউ আমাদের খুঁজে বের করতে এলো না। তখন আমার মনে হলো তাহলে সত্যিই কী সারা পৃথিবীতে শুধু আমি একা বেঁচে আছি? আর কেউ বেঁচে নেই? কেউ বেঁচে নেই?

তখন আমি ঠিক করেছি যে আমি নিজেই সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে খুঁজব। খুঁজে দেখব আর কোথাও বেঁচে থাকা মানুষকে খুঁজে পাই কি-না। আমি প্রযুক্তির মানুষ নই। নিবিড় একটি গ্রামের একটি কফি হাউজে আমি গান গাইতাম, প্রযুক্তির কিছু আমি জানি না। তারপরেও আমি একটু একটু করে শিখেছি, পৃথিবীর পরিত্যক্ত নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেছি এবং সারা পৃথিবীতে এই তথ্যটি ব্রডকাস্ট করছি।

যদি কোনো মানুষ এই মুহূর্তে আমার কথাগুলো শুনছে আমি তাকে শুভেচ্ছা জানাই, ভালোবাসা জানাই। ফ্লিকাস হাসি মুখে বলল, আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই যে পৃথিবীতে আমরা পুরোপুরি একা নই, নিঃসঙ্গ নই। তোমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক আমার সাথে যোগাযোগ করো। আমরা সবাই মিলে আবার নতুন পৃথিবীর জন্ম দেব। মানুষের কলকাকলীতে এই পৃথিবী আবার মুখরিত হয়ে উঠবে।

হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে মানুষের ছবিটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। নিকি আর ত্রিপি লাফিয়ে উঠে আনন্দে চিৎকার করে ক্রিনিটিকে জড়িয়ে ধরে লাফাতে থাকে। ক্রিনিটি তাদের প্রাথমিক উচ্ছসিটি একটু কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, আশা করছি ফ্লিকাস সত্যিকারের মানুষ, এটি কোনো কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি নয়।

নিকি বলল, কী বলছ ক্রিনিটিঃ ফ্লিকাস কেন কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি হবে? তুমি দেখছ না সে আমাদের মতো মানুষ? কী সুন্দর করে হাসতে পারে তুমি দেখ নি?

ক্রিনিটি বলল, আমি সত্যিকার বা কৃত্রিম কোনো হাসিই বুঝতে পারি না, তাই আমি ফ্লিকাসের বক্তব্যটি টুরিন টেস্ট করেছি।

সেটি কী?

কোনো বক্তব্য সত্যিকারের মানুষের না কৃত্রিম রোবটের সেটি বোঝার একটি পরীক্ষা।

তুমি পরীক্ষা করে কী দেখেছ?

আমি দেখেছি যে ফ্লিকাস সত্যিকারের মানুষ। কিংবা—

কিংবা কী?

মানুষ থেকেও বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী।

ত্রিপি হেসে বলল, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান হতে পারে শুধু একটি মাত্র প্রাণী।

সেটি কী?

সেটি হচ্ছে আরেকজন মানুষ! বলে ত্রিপি হি হি করে হাসতে থাকে।

নিকি বুক থেকে আটকে থাকা একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, ক্রিনিটি, আমরা কখন ফ্লিকাসের কাছে যাব?

তার সাথে আগে যোগাযোগ করে নিই। তারপর রওনা দেব।

সে কতদূর থাকে ক্রিনিটি?

বেশ অনেক দূর। আমাদের ভালো একটা বাইভার্বাল দরকার তা না হলে যেতে অনেকদিন লাগবে।

তুমি তাহলে আরেকটা বাইভার্বাল ঠিক কর ক্রিনিটি।

করব।

ঠিক করলেই আমরা যাব।

ঠিক আছে।

নিকি ত্রিপির দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা যখন যাব তখন আমাদের মতো পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে হয়তো আরো অনেক বাচ্চা চলে আসবে।

হ্যাঁ। নিশ্চয়ই আসবে। রোবটেরা যদি আটকে না রাখে তাহলে নিশ্চয়ই চলে আসবে।

নিকি ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার কী মনে হয় ত্রিপি, রোবটেরা কী সত্যিই আরো বাচ্চাদের আটকে রেখেছে?

রাখতেও তো পারে। আমাকে যেরকম রেখেছিল।

তাহলে তো অনেক ঝামেলা হবে। তাই না ত্রিপি?

হলে হবে। ফ্লিকাস সব ঝামেলা দূর করে দেবে।

নিকি মাথা দুলিয়ে হাসল, বলল, ঠিকই বলেছ। ফ্লিকাস সব ঝামেলা দূর করে দেবে।

ত্রিপি বলল, ফ্লিকাস দেখতে কী সুন্দর, তাই না?

হ্যাঁ।

আরো যে সব বাচ্চারাও আসবে, তারাও নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে, তাই না নিকি?

নিকি মাথা নাড়ল, তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, অন্য বাচ্চারা আরো সুন্দর হোক আর যাই হোক তুমি কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। আমি আর তুমিই কিন্তু বিয়ে করব। ঠিক আছে?

ত্রিপি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।

 

ক্রিনিটি বাইভার্বালটি ঠিক করল, ফ্লিকাসের সাথে যোগাযোগ করল তারপর তার সাথে দেখা করার জন্যে রওনা দিল। নিকি আর ত্রিপি বাইভার্বালের রেলিং ধরে আনন্দে চিৎকার করে গান গাইতে লাগল। দুজন আগে কখনো গান গায় নি, গান গাওয়া বলে যে একটা ব্যাপার থাকতে পারে সেটাও তারা জানত না, কিন্তু তারপরও তাদের গান গাইতে কোনো সমস্যা। হল না।

সারাদিন সারারাত তারা বাইভার্বাল চালিয়ে গেল। ফ্লিকাস ক্রিনিটিকে যে। ঠিকানা দিয়েছে সেখানে তারা যখন পৌঁছাল তখন দুপুর হয়ে গেছে। গাছগাছালি ঢাকা ছোট একটা বাসা। বাসার বাইরে দুইজন রোবট পাহারা দিচ্ছে, তারা হাত তুলে বাইভার্বালটিকে থামাল। একজন রোবট জিজ্ঞেস করল, কী চাই?

ক্রিনিটি বলল, আমরা মহামান্য ফ্লিকাসের সাথে দেখা করতে এসেছি।

তোমরা কারা?

আমি একজন তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমাকে ক্রিনিটি নামে পরিচয় দেওয়া হয়। আমার সাথে দুজন মানবশিশু আছে।

একটি রোবট অন্য রোবটের দিকে তাকিয়ে বলল, পৃথিবীতে মানবশিশু বলে কিছু নেই। সব মরে গেছে।

নিকি কঠিন মুখে বলল, সবাই মরে নি। আমরা বেঁচে আছি।

তোমরা সূত্যিকারের মানবশিশু?

হ্যাঁ। ফ্লিকাস আমাদের সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছে আমরা তার সাথে দেখা করতে এসেছি।

রোবটটি একধরনের ঘোলা চোখে তাদের দুজনকে দেখল তারপর বলল, ঠিক আছে, তোমরা গেটে অপেক্ষা কর। আমরা খোঁজ নিই।

নিকি ভাবছিল একটা রোবট ভেতর গিয়ে খোঁজ নেবে কিন্তু তার দরকার হলো না। গেটে দাঁড়িয়ে থেকেই কোনো একভাবে খোঁজ নিয়ে নিল তারপর ওদের বলল, তোমরা ভেতরে যাও, মহামান্য ফ্লিকাস তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

ক্রিনিটি মাটির কাছাকাছি রেখে বাইভার্বালটি বাসার সামনে হাজির করল এবং প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে ফ্লিকাস বের হয়ে এলো। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে তাকে যেটুকু সুদর্শন দেখা গিয়েছিল সে তার থেকে অনেক বেশি সুদর্শন। দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে নিকি আর ত্রিপির দিকে ছুটে যায়, দুজনকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে বলল, মানুষের পৃথিবীতে তোমাদের আমন্ত্রণ। নিকি আর ত্রিপি তোমাদের জন্যে আমার ভালোবাসা আর ভালোবাসা।

এভাবে কেউ আমন্ত্রণ জানালে কী বলতে হয় নিকি আর ত্রিপি কেউই জানে না। জানে না। তাই দুজনেই হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্লিকাস বলল, তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ। এখন দ্রুতগামী ট্রেন নেই, জেষ্ট নেই মহাকাশযানও নেই, তোমরা এসেছ সেই আদিম বাইভার্বালে করে। তোমাদের নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে?

এবারে নিকি বলল, না আমাদের কোনো কষ্ট হয় নি।

ত্রিপি বলল, আমরা গান গাইতে গাইতে এসেছি।

কী মজা! পৃথিবীর সব মানুষকে যখন আমরা একত্র করব তখন প্রথম কাজটি হবে একটা গানের কনসার্ট। কী বল?

ত্রিপি হাত তালি দিয়ে বলল, কী মজা হবে তখন!

ফ্লিকাস বলল, তোমরা হাত মুখ ধুয়ে কিছু একটা খেয়ে নাও। তোমাদের জন্য আমি কিছু জৈবিক খাবার তৈরি করে রেখেছি।

নিকি জিজ্ঞেস করল, অন্য মানবশিশুরা কী এসে পৌঁছেছে?

না, তারা এখনো পৌঁছায় নি। কেউ কেউ রওনা দিয়েছে, কেউ কেউ রওনা দেবে।

ত্রিপি জানতে চাইল, সব মিলিয়ে কতোজন মানবশিশু আছে পৃথিবীতে?

কমপক্ষে দুইশ। আরো বেশিও হতে পারে।

আমরা সবাই মিলে এক জায়গায় থাকব?

ফ্লিকাস হাসল, বলল, অবশ্যই। সারা পৃথিবী খুঁজে আমরা সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা খুঁজে বের করব। একপাশে পাহাড় অন্যপাশে হ্রদ, মাঝখানে থাকবে সবুজ বন। আমরা বাচ্চাদের জন্যে চমৎকার একটা স্কুল বানাব–সেখানে বাচ্চারা হইচই করে পড়বে। ছোটাছুটি করবে, খেলবে, হ্রদে সাঁতার কাটবে। যখন অন্ধকার হয়ে আসবে আমরা তখন কোথাও একটা আগুন জ্বালাব, সেটাকে ঘিরে আমরা বসব। একজন গিটার বাজাতে বাজাতে গান গাইবে— কথা বলতে বলতে ফ্লিকাসের চোখে যেন স্বপ্নের ছোঁয়া লাগে। দেখে মনে হয় সে যেন তার চোখের সামনে পুরো দৃশ্যটি দেখতে পাচ্ছে।

নিকি দাঁত বের করে হাসল। বলল, কী মজা হবে? তাই না?

হ্যাঁ অনেক মজা হবে। হঠাৎ ফ্লিকাসের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যে শুধু মজা করব তা কিন্তু নয়। আমাদের ওপর তখন থাকবে অনেক বড় দায়িত্ব। অনেক অনেক বড় দায়িত্ব।

ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, কী দায়িত্ব?

মানুষের দায়িত্ব। পৃথিবীর দায়িত্ব। আমাদের সারা পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা যে কয়জন মানুষ আছি তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাদের। দিয়েই আস্তে আস্তে সারা পৃথিবীতে একসময় মানুষে ভরে উঠবে। ভবিষ্যতের যে পৃথিবী হবে আমরাই হব তার স্থপতি। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে যে মানুষ থাকবে আমরা হব তার পূর্বপুরুষ!

ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, আর রোবট? রোবটদের কী হবে?

রোবটেরাও থাকবে। মানুষকে সাহায্য করার জন্যে রোবটেরা আগেও ছিল, এখনো থাকবে।

লিপি ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু অনেক জায়গায় রোবটেরা সবাই মিলে মানবশিশুকে আটকে রেখেছে।

একটা-দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ফ্লিকাস কঠিন গলায় বলল, রোবটরা কখনো মানবশিশুকে আটকে রাখতে পারবে না। আমরা সবাই যখন একত্র হব তখন রোবটরা কখনো মানুষের সাথে প্রতিযোগিতা করতে সাহস পাবে না। মানুষের বুদ্ধিমত্তা রোবটদের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি, রোবটেরা কখনোই মানুষের সাথে পারবে না।

নিকি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু যদি তারা পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি করে?

পঞ্চম মাত্রার রোবট? ফ্লিকাসকে একটু চিন্তিত দেখায়, সে ভুরু কুঁচকে বলল, পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি করলে আমাদের একটু সতর্ক হতে হবে, তার কারণ পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষ থেকে বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা— ফ্লিকাস কথা শেষ না করে থেমে গেল।

নিকি জিজ্ঞেস করল, তার চেয়ে বড় কথা কী?

তার চেয়ে বড় কথা পঞ্চম মাত্রার রোবটদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার একটা জগৎ আছে। তারা তাদের মতো করে ভাবে। তাদের যদি মনে হয় পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন নেই, তারাই পৃথিবীকে এগিয়ে নেবে তাহলে তারা পৃথিবী থেকে সব মানুষকে সরিয়ে দিতে পারে।

নির্কির মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল, বলল, সর্বনাশ! তাহলে কী হবে?

ফ্লিকাস সহৃদয়ভাবে হাসল, বলল, তুমি কেন ধরে নিচ্ছ পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সেটা কী সহজ কাজ নাকি?

ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, পঞ্চম মাত্রার রোবট দেখতে কেমন হবে?

ফ্লিকাস মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না। এখন পর্যন্ত সব রোবট তৈরি হয়েছে মানুষের অনুকরণে, তাদের হাত আছে, পা আছে, মাথা আছে, চোখ আছে। যেহেতু মানুষ অনেক উন্নত তাই শরীরের ডিজাইনটা হয়েছে। মানুষের মতো। কিন্তু–

কিন্তু কী?

যখন পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি হবে তখন তারা হবে মানুষ থেকেও উন্নত। তাই তখন তাদের শরীর মানুষের মতো হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের কাছে যে ডিজাইনটা বেশি কাজের মনে হবে সেভাবে তৈরি করবে। হয়তো–হয়তো–

হয়তো কী?

মানুষের মতো সামনে দুটি চোখ না থেকে সামনে-পেছনে, ডানে-বামে চোখ থাকবে। দুইপা না থেকে তিনটি কিংবা চারটি পা থাকবে–

নিকি বলল, হয়তো মাকড়শার মতো আটটি পা থাকবে–

ফ্লিকাস আবার মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, হয়তো আটটি পা থাকবে। শুড়ের মতো আঙুল, মস্তিষ্কটি হয়তো শুধু মাথায় না থেকে সারা শরীরে থাকবে। পৃথিবীর নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হবার জন্যে এন্টেনা থাকবে। হয়তো অন্ধকারে দেখতে পারবে হয়তো আঙুলের ডগা দিয়ে তীব্র রেডিয়েশন বের হবে। হয়তো—

ত্রিপি বলল, থাক থাক! পঞ্চম মাত্রার রোবটের চেহারার কথা শুনেই আমার গা কেমন কেমন করছে।

ফ্লিকাস বলল, ঠিকই বলেছ। শুধু শুধু পঞ্চম মাত্রার রোবটের চেহারা কল্পনা করে লাভ নেই। পঞ্চম মাত্রার রোবট খুব সোজা ব্যাপার নয়। সত্যিই যদি তৈরি হয় তখন দুশ্চিন্তা করা যাবে।

নিকি বলল, আমরা এতো দুশ্চিন্তা করতে পারব না। যদি দুশ্চিন্তা করতে হয় সেটা করবে তুমি।

ফ্লিকাস হাসার ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে। তোমাকে আর কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সব দুশ্চিন্তা করব আমি।