০১. তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে উঠে

উৎসর্গ

সামিন রিয়াসাত, নাজিয়া চৌধুরী, তারিক আদনান মুন, হক মোহাম্মদ ইশফাঁক, প্রাণন রহমান খান, কাজী হাসান জুবায়ের এবং মোঃ আবিরুল ইসলাম
গণিত অলিম্পিয়াড এবং ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের প্রতিযোগীরা

(আমি তাদের কথা দিয়েছিলাম তারা যদি বাংলাদেশের জন্যে পদক নিয়ে আসতে পারে আমি তাহলে আমার পরবর্তী সায়েন্স ফিকশনটি তাদের নামে উৎসর্গ করব। তারা পদক এনেছে আমিও আমার কথা রাখলাম!)

 

১. পূর্বকথা

তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে দোলনায় শুয়ে থাকা শিশুটির দিকে তাকাল। মাকে দেখে শিশুটির দাতহীন মুখে একটি মধুর হাসি ফুটে ওঠে। সে চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং একসাথে দুই হাত আর দুই পা নাড়তে থাকে, ইঙ্গিতটি খুব স্পষ্ট, সে মায়ের কোলে উঠতে চায়। মায়ের শিশুটিকে কোলে নেওয়ার ক্ষমতা নেই, দুর্বল হাতে শিশুটির মুখ স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, বেঁচে থাকিস বাবা। একা হলেও বেঁচে থাকিস।

শিশুটি মায়ের কথার অর্থ বুঝতে পারল না কিন্তু কথার পেছনের ভালোবাসা আর মমতাটুকু অনুভব করতে পারল। সে হঠাৎ করে আরো চঞ্চল। হয়ে ওঠে, দুই হাত আর দুই পা ছোড়ার সাথে সাথে মুখ দিয়ে সে একধরনের অব্যক্ত অর্থহীন শব্দ করল। মা আবার কিছু একটি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে সে কাশতে শুরু করে এবং কাশির সাথে সাথে ঝলকে ঝলকে রক্ত বের হয়ে আসে। তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল। তার ঠিক পেছনেই ক্রিনিটি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিনিটি তৃতীয় মাত্রার। একটি রোবট, অনেকদিন থেকে সে এই পরিরারকে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করে আসছে।

তরুণী মা একটু শক্তি সঞ্চয় করে বলল, ক্রিনিটি, আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আমি তোমাকে যা বলি তুমি একটু মন দিয়ে শোনো।

ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না, সে জানে মানুষ বেশিরভাগ সময়ই অর্থহীন কথা বলে। মানুষের যে কোনো কথাই তার গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়, সেটি আলাদাভাবে তাকে বলার প্রয়োজন নেই। তরুণী মাটি একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমার মনে হয় নিকি বেঁচে যাবে। যে ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে মেরে ফেলছে সেটি আমার এই বাচ্চাটিকে মারতে পারেনি। আমার এই বাচ্চার শরীরে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আছে।

ক্রিনিটি বলল, তোমার ধারণা সত্যি। এই ভাইরাসের আক্রমণে সবার আগে শিশুরা মারা গেছে। নিকির কিছু হয়নি।

আমি আর কিছুক্ষণের মাঝেই মারা যাব ক্রিনিটি। তখন এই নিকিকে দেখার কেউ থাকবে না। কেউ থাকবে না। তরুণী মা কষ্ট করে একটি কাশির দমক সামলে নিয়ে বলল, ক্রিনিটি, তখন তোমাকে এই বাচ্চাটাকে দেখতে হবে। যতদিন সে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে না পারবে ততোদিন তাকে তোমার দেখেশুনে রাখতে হবে।

ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না, মানুষ যখন তাকে কোনো আদেশ দেয়। তাকে সবসময় সেই আদেশ মানতে হয়। তরুণী মাটি কিন্তু একটু অস্থির হয়ে উঠল, বলল, তুমি কথা বলছ না কেন ক্রিনিটি? তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?

ক্রিনিটি বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি।

তাহলে তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আমার সোনামণি নিকিকে দেখে রাখবে।

আমি নিকিকে দেখে রাখব। তুমি আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।

ক্রিনিটি আর কপোট্রনে একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করল, মানুষ সময়ই অর্থহীন কাজ করে। একটি কথা উচ্চারণ করার জন্যে কখনোই কারো গা ছুঁতে হয় না। অন্যসময় হলে সে ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করত কিন্তু এখন সে তার চেষ্টা করল না। কমবয়সী এই তরুণীটি কিছুক্ষণের মাঝেই মারা যাবে, সে কী কথা-ব্রলতে চায় সেটি জেনে রাখা প্রয়োজন। ক্রিনিটি তার শীতল হাত দিয়ে তরুণী মাটির হাত স্পর্শ করে বলল, আমি তোমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি।

তরুণী মাটির মুখে তখন অত্যন্ত ক্ষীণ একটি হাসি ফুটে ওঠে। সে একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্রিনিটি। অনেক ধন্যবাদ।

ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। এই তরুণী মাটির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারছে খুব দ্রুত তার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছে। ছোট শিশুটি দোলনা থেকে আবার তার দুই হাত-পা ছুড়ে একটি অব্যক্ত শব্দ করে তার মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। মা শিশুটির দিকে একনজর তাকিয়ে আবার ঘুরে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি। তুমি আমাকে কথা দাও যে তুমি আমার বাচ্চাটিকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করবে।

ক্রিনিটি নীচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত। আমার ভেতরে কোনো মানবিক অনুভূতি নেই। কেমন করে ভালোবাসতে হয় আমি জানি না।

তরুণী মেয়েটি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, তোমাকে জানতে হবে। সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু আমার এই বাচ্চাটা বেঁচে আছে। তাকে মানুষের মতো বড় করতে হবে। তাকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করতেই হবে।

পুরোপুরি অর্থহীন একটি কথা, কিন্তু ক্রিনিটি প্রতিবাদ করল না। এই মেয়েটির সাথে এখন যুক্তি দিয়ে কথা বলার সময় পার হয়ে গেছে; এখন কোনো প্রতিবাদ না করে মেয়েটির কথাগুলো শুনতে হবে। অর্থহীন, অযৌক্তিক এবং অবাস্তব হলেও শুনতে হবে।

তরুণী মাটি দোলনাটি ধরে কয়েকটা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ক্রিনিটি তুমি ভালো করে গুনে রাখো। আমার এই বাচ্চাটি যেরকম বেঁচে গেছে সেরকম পৃথিবীতে হয়তো আর এক-দুটি বাচ্চা বেঁচে গেছে। তুমি আমার বাচ্চাটিকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। বুঝেছ?

ক্রিনিটি শান্ত গলায় বলল, বুঝেছি। কিন্তু-

আমি কোনো কিন্তু শুনতে চাই না ক্রিনিটি। তুমি যেভাবে পার তাদের খুঁজে বের করবে। আমার বাচ্চাটিকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। এই কথাটি তোমার মনে থাকবে?

ক্রিনিটি বলল, মনে থাকবে।

তুমি আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি সেটি করবে।

অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি ব্যাপার কিন্তু তবুও ক্রিনিটি তার শীতল ধাতব হাত দিয়ে দ্বিতীয়বার তরুণী মাটির হাত স্পর্শ করে বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে তোমার বাচ্চাটিকে আমি অন্য বাচ্চার কাছে নিয়ে যাব।

তরুণী মাটি ক্ৰিনিটির হাত ধরে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্রিনিটি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ক্রিনিটি তার নিস্পলক চোখে তরুণীটির দিকে তাকিয়েছিল, সে বলল, তোমাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। আমার মনে হয় উত্তেজিত না হয়ে তোমার বিশ্রাম নেয়া দরকার।

তুমি ঠিকই বলেছ ক্রিনিটি, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমি এখন এখানেই শোবো। আমি জানি আমি আর কোনোদিন উঠতে পারবো না। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?

কী সাহায্য?

তুমি কি আমার বাচ্চাটিকে আমার বুকের ওপর শুইয়ে দিতে পারবে? আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে আমার বাচ্চার মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই।

ক্রিনিটি জানে এই দুর্বল মেয়েটির বুকের ওপর এই দুরন্ত ছটফটে শিশুটিকে শুইয়ে দিলে মেয়েটির অনেক কষ্ট হবে, কোনোভাবেই এই কাজটি করা উচিৎ হবে না। ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি প্রবল বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করল কিন্তু সে চাপটিকে উপেক্ষা করে এই অযৌক্তিক কাজটি করল। শিশুটি দুই হাতে তুলে মেঝেতে শুয়ে থাকা তরুণীটির বুকে শুইয়ে দিলো।

শিশুটির দাঁতহীন মুখে মধুর একধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে তার ছোট হাত দুটি দিয়ে তার মায়ের রক্তমাখা ঠোঁট দুটি ধরে আনন্দে হাসতে থাকে। তরুণী মাটি তার দুই হাতে বাচ্চাটিকে তার বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, সোনা আমার। যাদু আমার। বেঁচে থাকিস বাবা। যেভাবে পারিস বেঁচে থাকিস।

সন্ধ্যে হওয়ার আগেই তরুণী মাটি মারা গেল। ছোট শিশুটি সেটি বুঝতে পারল না, সে তার মায়ের চুলগুলো ধরে খেলতেই থাকল।

ক্রিনিটি নিস্পলক দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তার কপোট্রনে প্রবল একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করে।