০৭. মেয়েটি রুহানের থুতনি ধরে

মেয়েটি রুহানের থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলল, ইশ! তোমার চেহারাটা কি মিষ্টি! দেখে মনেই হয় না যে তুমি এত বড় খুনি।

রুহান কিছু বলল না। সে কী আসলেই খুব বড় খুনি? মেয়েটা তার মুখটা ডান থেকে বামে নাড়িয়ে বলল, এরকম মিষ্টি চেহারার মানুষ হয়ে তুমি মানুষ খুন করার খেলোয়াড় হলে কেমন করে?

রুহান এবারেও কিছু বলল না। মেয়েটা হাতে খানিকটা কালো রং নিয়ে রুহানের চিবুকের নিচে লাগিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। রুহান বলল, তুমি কী করছ? আমার মুখে রং লাগাচ্ছ কেন?

তোমার মুখে একটু নিষ্ঠুর ভাব আনার চেষ্টা করছি। চোয়ালের হাড় উঁচু থাকলে মানুষকে নিষ্ঠুর দেখায়। চোখটাও গভীরে ঢোকাতে হবে। চুলগুলো আরো ছোট করে ছাটতে হবে।

কেন? আমাকে এরকম নিষ্ঠুর দেখাতে হবে কেন? আমাকে যে কাজে ব্যবহার করছ সেটা কী যথেষ্ট নিষ্ঠুর না?

সেজন্যেই তো এটা জরুরি। একটা নিষ্ঠুর কাজে যাচ্ছে একজন মানুষ, তার চেহারাটা যদি ছোট শিশুর মতো কোমল হয় তাহলে কেমন করে হবে?

মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের নিচে খানিকটা রং লাগিয়ে মাথা বাঁকা করে তাকে দেখল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, নাহ্। তোমার চেহারায় নিষ্ঠুরতা ঠিক আসছে না।

রুহান বলল, ছেড়ে দাও। আমি হয়তো আর ঘণ্টাখানেক বেঁচে আছি। এখন কী এগুলো ভালো লাগে?

মেয়েটা হাত দিয়ে পাশের টেবিলে ঠোকা দিয়ে বলল, কাঠে ঠোকা। কাঠে ঠোকা। অপয়া কথা বল না। ঘণ্টাখানেক বলছ কেন? তুমি অনেকদিন বেঁচে থাকবে। সব খেলোয়াড়কে খুন করে তুমি হবে খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়। হাজার ইউনিট দিয়ে মানুষ তখন তোমার খেলা দেখতে আসবে।

রুহান কোনো কথা বলল না। তার ভেতরে সে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। পাথরের দেয়ালে ঘেরা একটা মাঠের মধ্যে কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে, সেখানে থাকবে ঠিক তার মতো একজন মানুষ হত্যা করতে যার এতটুকু দ্বিধা নেই, শিকারিরা যেভাবে পাখিকে গুলি করে ঠিক সেভাবে গুলি করবে সে। চারপাশে থাকবে হাজার হাজার মানুষ। তারা চিৎকার করবে আনন্দে। মানুষকে খুন করার দৃশ্য কী আসলেই আনন্দের হতে পারে?

মেয়েটা বলল, তুমি কী ভাবছ?

কিছু না।

মানুষ কিছু না ভাবতে পারে না। ভাবনাতে কিছু না কিছু থাকতে হয়। তোমার বলা উচিত ছিল আমি কী ভাবছি, সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না।

রুহান বলল, আমি কী ভাবছি বলতে ইচ্ছে করছে না।

ঠিক আছে, বলতে হবে না। মেয়েটা রুহানের মুখে কয়েক জায়গায় একটু রং মাখিয়ে আবার তাকে ভালো করে লক্ষ্য করে, তারপর হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। কোনোভাবেই রুহানকে নিষ্ঠুর রক্তলোভী একটা মানুষে পাল্টে দেয়া যাচ্ছে না।

রুহান জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী মেয়ে?

আমার নাম জেনে তুমি কী করবে?

কিছু করব না। এমনি জানতে চাইছি।

আমার নাম ত্রিনা।

ত্রিনা? কী আশ্চর্য!

কেন? আশ্চর্য কেন?

আমার একটি ছোট বোন আছে, তার নাম ত্রিনা। রুহান এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমার কী মনে হয় ত্রিনা, আমি কী কখনো আবার আমার ছোট বোনকে দেখব?

সত্যি কথা বলব?

বলো।

ত্রিনা নামের মেয়েটা বলল, একজন খেলোয়াড়ের ভাই বোন মা এসব থাকতে হয় না। যার আপনজন থাকে সে কখনো খেলোয়াড় হতে পারে না।

রুহান বলল, ও।

ত্রিনা বলল, হ্যাঁ। এখন তুমি কথা বল না, তুমি কথা বললে আমি তোমার মুখে ঠিক করে রং লাগাতে পারি না।

রুহান বলল, ঠিক আছে ত্রিনা। আমি এখন কথা বলব না, ত্রিনা।

রুহান অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, প্রতিবার ত্রিনা কথাটা উচ্চারণ করতেই তার ভেতরে কিছু একটা যেন কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে সত্যিই বুঝি সে তার বোনের সাথে কথা বলছে।

ত্রিনা চলে যাবার পর নীল কাপড় পরা চারজন মানুষ তার অস্ত্রগুলো নিয়ে। এলো। তারা সময় নিয়ে অস্ত্রগুলো তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বেল্ট দিয়ে বেঁধে দিতে থাকে। গুলির ম্যাগাজিন ঝুলিয়ে দিতে থাকে। রুহান বলল, আমাকে যত গুলি দিচ্ছ মনে হচ্ছে একজন নয়, একশজনের সাথে যুদ্ধ করব।

মানুষ চারজনের কেউ তার কথার উত্তর দিল না। একটু পরেই যে ঘটনাটি ঘটবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা–সেটা নিয়ে কেউ হালকা কিছু বলতে চায় না। বলার সাহস পায় না। রুহানকে অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে দেবার পর তারা তাকে সামনে হাঁটিয়ে নিতে থাকে। তখন রুহান প্রথমবার অসংখ্য মানুষের কলরব শুনতে পায়। তার সাথে সাথে লাউড স্পীকারে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একজন মানুষ চিৎকার করে কিছু একটা বলছে–গলার স্বরে উত্তেজনা। কী বলছে স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে না শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরে প্রায় উন্মত্ততার কাছাকাছি উত্তেজনাটুকু ধরা পড়ছে।

রুহান পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, কী বলছে ওখানে?

তোমার কথা।

আমার কথা?

হ্যাঁ।

আমার কী কথা?

তুমি কী ভয়ঙ্করভাবে আজকে তোমার প্রতিপক্ষকে হত্যা করবে, এইসব।

রুহান একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। সত্যিই কী তাই বলছে? সত্যিই কী এই ধরনের কথা বলা যায়? বলা সম্ভব?

হঠাৎ হাজার হাজার মানুষের চিৎকার শোনা যায়। রুহান মাথা ঘুরিয়ে পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, সবাই চিৎকার করছে কেন?

তোমার প্রতিপক্ষ এইমাত্র মাঠে এসেছে। সবাই তাকে অভিনন্দন। জানাচ্ছে। তুমি যখন যাবে, তখন তোমাকেও এভাবে অভিনন্দন জানাবে।

আমি কখন যাব?

এই তো এক্ষুণি যাবে। যখন তোমাকে ডাকবে।

হঠাৎ করে রুহান নিজের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। কিছুক্ষণের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে সে তার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হয়ে যাক–সে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারবে না। রুহানের নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাস জমে ওঠে। সমস্ত শরীর টান টান হয়ে থাকে উত্তেজনায়।

ঠিক এরকম সময়ে পাশে দাঁড়ানো মানুষটি বলল, চল। তোমাকে ডাকছে।

রুহান কোনো কথা না বলে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। সামনে একটা বড় স্টেনলেস স্টীলের গেট। কাছাকাছি আসতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে গেল, সাথে সাথে সে বাইরে অসংখ্য মানুষের গুঞ্জন শুনতে পেল। লাউড স্পীকারে মানুষটির কথা হঠাৎ করে স্পষ্ট হয়ে যায়। গমগমে উত্তেজিত গলায় একজন বলছে, তোমরা যারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিষ্ঠুর একটা হত্যাকারীকে দেখার জন্যে ধৈর্য ধরে বসে আছ, সে আসছে। সে তোমাদের সামনে আসছে। এই ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু হিংস্র মানুষটি হচ্ছে রুহান রুহান!

রুহান খোলা গেট দিয়ে হেঁটে বাইরে মাঠে এসে দাঁড়ায়, চারপাশে পাথরের দেয়াল, তার উপরে বসার জায়গা সেখানে হাজার হাজার মানুষ বসে আছে। তাকে দেখে তারা আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। রুহানের এখনো বিশ্বাস হয় না, এই হাজার হাজার মানুষ একটা হত্যাকাণ্ড দেখতে এসেছে? কে কাকে হত্যা করতে পারে সেই ভয়ঙ্কর খেলার দর্শক এরা? এরা কী মানুষ? মানুষ কী এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড দেখে আনন্দ পেতে পারে? পাওয়া সম্ভব?

রুহান হাজার হাজার মানুষের চিৎকার আর আনন্দধ্বনি শুনতে শুনতে চারদিকে তাকাল। তখন সে মাঠের অন্য পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পেল। মাঠটি অনেক বড়, মানুষটি অনেক দূরে পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারাটি ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। না দেখেও সে বুঝতে পারে মানুষটির মুখমণ্ডল নিশ্চয়ই পাথরের মতো শক্ত, চোখের দৃষ্টি কুর। রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটি তাকে হত্যা করবে নাকি সে এই মানুষটিকে হত্যা করবে?

হঠাৎ করে আবার সে লাউড স্পীকারে একজন মানুষের গমগমে গলার স্বরে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মানুষটি উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলে, তোমরা সবাই যে খেলাটি দেখার জন্যে শত শত কিলোমিটার দূর থেকে এসেছ, এক্ষুণি সেই খেলাটি দেখবে। এই খেলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। এই খেলা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ মানুষকে হত্যা করার খেলা!

বিশাল মাঠের চারপাশে বসে থাকা অসংখ্য মানুষ এক ধরনের আনন্দধ্বনি করে ওঠে।

মানুষটির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর আবার গমগম করে ওঠে, এই বিশাল আনন্দ মেলায় সবাইকে স্বাগতম। আজকের এই খেলা যিনি আয়োজন করেছেন, এই অঞ্চলের সেই অলিখিত সম্রাট, যুদ্ধবাজ নেতা সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক বীর সাহসী যোদ্ধা ক্ৰিভনকে সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন।

রুহান দেখতে পেল একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকা জমকালো পোশাকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ উঠে দাঁড়াল, উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে তাকে অভিনন্দন জানাল। ক্ৰিভন হাত নেড়ে সবার অভিবাদনের প্রত্যুত্তর দেয় তারপর আবার নিজের জায়গায় বসে যায়।

লাউড স্পীকারে গমগমে গলায় মানুষটি বলে, তোমরা সবাই দেখেছ, মাঠের উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুহান রুহান। ভয়ঙ্কর হিংস্র রুহান রুহান। মাঠের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিদি-নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু রিদি।

আমার প্রিয় দর্শকেরা। তোমরা কী এখন এই দুই হিংস্র মানুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তেজনাময় খেলার খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে চাও?

হাজার হাজার মানুষ উন্মত্ত গলায় চিৎকার করে ওঠে দেখতে চাই! দেখতে চাই!!

লাউড স্পীকারে আবার মানুষটির গলা শোনা গেল, তাহলে দেখ! রুহান রুহান এবং রিদি হাজার হাজার মানুষ তোমাদের খেলা দেখতে এসেছে। দেখাও তোমাদের খেলা দেখাও। হত্যা করো একজন আরেজনকে। হত্যা করো। হত্যা—হত্যা–

লাউড স্পীকারে ভয়ঙ্কর একটা বাজনা বেজে হঠাৎ করে সেটি থেমে যায়। রুহানের মনে হয় কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারপাশে পাথরের দেয়াল, দেয়ালের উপর সারি সারি বসে থাকা মানুষ সবকিছু কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যায়। মনে হয় কোথাও কেউ নেই। শুধু বহুঁ দূরে দুই পা অল্প একটু ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ। যে কোনো মুহূর্তে মানুষটি একটা অস্ত্র তুলে নিয়ে তাকে গুলি করবে।

মানুষটি অনেক দূরে, তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রুহানের কী হলো কে জানে, হঠাৎ করে এই মানুষটার সত্যিকার চেহারা দেখার একটা অদম্য ইচ্ছে তার বুকের ভেতর জেগে উঠল। যে মানুষটাকে সে হত্যা করবে কিংবা যে মানুষটা তাকে হত্যা করবে, তাকে সে ভালো করে একবার দেখবে না, চোখে চোখে তাকাবে না, সেটা তো হতে পারে না। রুহান তাই এক পা অগ্রসর হলো।

বহুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিও ঠিক এক পা অগ্রসর হলো। কী আশ্চর্য! সে যেরকম মানুষটিকে কাছে থেকে দেখতে যাচ্ছে ঠিক সেরকম এই মানুষটিও তাকে কাছে থেকে দেখতে চাচ্ছে? তার যেরকম কৌতূহল রিদি নামের মানুষটারও কী ঠিক সেই একই রকম কৌতূহল? রুহান তখন আরো এক পা অগ্রসর হয়–রিদি নামের মানুষটাও এক পা অগ্রসর হয়। রুহান হাত দিয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে নেয়। ডান হাতে টুপিটা ধরে রাখায় আপাতত সেই হাতটি অচল হয়ে গেল। রিদিকে সে এটা জানিয়ে দিতে চায়। সে এই মুহূর্তে ডান হাতে অস্ত্র তুলে নেবে না, ইচ্ছে করলেও পারবে না। রিদিও তার মাথা থেকে টুপিটা খুলে হাতে নেয়। এই মানুষটাও রুহানকে জানাল, সে এই মুহূর্তে তাকে গুলি করবে না। আগে কাছে এসো তোমাকে একবার ভালো করে দেখি।

দুজন দুজনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। পাথরের দেয়ালের উপরে বসে থাকা সারি সারি মানুষের ভেতরে একটা বিস্ময়ধ্বনি শোনা যায়, কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, দুজন খেলোয়াড় একজন আরেকজনের কাছে এত সহজে এগিয়ে যেতে পারে। নতুন এক ধরনের উত্তেজনার জন্যে সবাই সোজা হয়ে বসে, তাদের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়।

রুহান আর রিদি হেঁটে হেঁটে একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি এসে থামল। এত কাছে যে ইচ্ছে করলে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করতে পারে। কিন্তু তারা একজন আরেকজনকে স্পর্শ করল না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রিদির মুখে ছোপ ছোপ কালো রং, চেহারায় ভয়ঙ্কর একটি ছাপ দেয়ার চেষ্টা করেছে। রুহান অবাক হয়ে দেখল ছোপ ছোপ কালো রঙের আড়ালে রিদির চেহারায় এক আশ্চর্য সারল্য। চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, বিষণ্ণ এবং বেদনাতুর। তরুণটি তার দিকে বিস্ময়ে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মনে হয় সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

রুহান রিদির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, আমি পারব।

কী পারবে না?

আমি তোমাকে হত্যা করতে পারব না।

রিদির মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসিটাকে ধরে রেখে বলল, চারদিকে তাকিয়ে দেখ, কত মানুষ। তারা সব দেখতে এসেছে তুমি আমাকে কেমন করে হত্যা করবে আর আমি তোমাকে কেমন করে হত্যা করব।

আসুক।

তারা অপেক্ষা করছে।

করুক। তুমি চাইলে আমাকে হত্যা করতে পার। রুহান মাথা নেড়ে বলল,  কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করব না।

তুমি তাহলে কী করবে?

রুহান বলল, আমি জানি না।

তুমি কিছু না করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তোমাকে কিছু একটা করতে হবে।

করতেই হবে?

হ্যাঁ। করতেই হবে।

রুহান মাথার টুপিটা পরে বলল, ঠিক আছে, তাহলে কিছু একটা করি।

এর পর সে যে কাজটা করল তার জন্যে রিদি প্রায় হাজার দশেক শ্বাসরুদ্ধ দর্শক এমন কী সে নিজেও প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে সে ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর পাথরের দেয়ালের দিকে ছুটে যায়। এবড়ো থেবড়ো দেয়াল ধরে সে ক্ষীপ্র সরীসৃপের মতো উপরে উঠে কিছু বোঝার আগে জমকালো পোশাক পরা ক্ৰিভনের মাথার উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ধরে।

শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বসে থাকা হাজার দশেক দর্শক বিস্ময়ের এক ধরনের আর্ত শব্দ করে হঠাৎ করে একেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে যায়, মনে হয় একটা সূচ ফেললেও বুঝি তার শব্দ শোনা যাবে।

রুহান ফিসফিস করে বলল, ক্ৰিভন! তোমার সেনাবাহিনীকে বলে দাও তারা যদি একটুও বোকামী করে তাহলে তোমার মস্তিষ্কে কমপক্ষে এক ডজন। বুলেট ঢুকে যাবে।

ক্রিভন কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী চাও?

আমি ভালো করে জানি না। রুহান অস্ত্রটা ক্ৰিভনের মাথায় আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল, আগে তোমার সেনাবাহিনীর কাছে নির্দেশ পাঠাও, তারা যেন হাতের অস্ত্র নিচে নামিয়ে রাখে। এই মুহূর্তে

ক্ৰিভনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে তার পাশে বসে থাকা সামরিক পোশাক পরা একজনকে বলল, জেনারেল, তুমি এক্ষুনি নির্দেশ দাও। এই মুহূর্তে। কেউ যেন কোনো পাগলামী না করে।

চমৎকার! রুহান এবার ক্ৰিভনের বুকের কাপড় টেনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় তারপর তাকে ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে যায়। মাথার পিছনে অস্ত্রটা ধরে রেখে বলল, এবারে আমার সাথে চলো।

ক্ৰিভন ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায়?

রুহান বলল, আমি ভালো করে জানি না। তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে পাথরের দেয়াল থেকে নিচে ফেলে দেয়। দেয়ালটি খুব বেশি উঁচু নয় কিন্তু ক্ৰিভন প্রস্তুত ছিল না বলে নিচে লুটোপুটি খেয়ে পড়ল, রুহান লাফিয়ে নাম ঠিক তার পাশে। রুহানের পোশাক ধরে তাকে টেনে তুলে বলল, ব্যথা পেয়েছ?

ক্ৰিভন মুখে যন্ত্রণার চিহ্নটা সরাতে সরাতে বলল, না। পাইনি।

চমৎকার! রুহান তাকে নিজের খুব কাছাকাছি টেনে এনে বলল, ক্ৰিভন, তুমি আমার কাছাকাছি থাক। তোমার গার্ডগুলোর যদি মাথা মোটা হয় আর তোমাকে বাঁচানোর জন্যে দূর থেকে গুলি করার চেষ্টা করে তাহলে সেট। যেন শুধু আমাদের গায়ে না লাগে, তোমার ঘিলুও যেন খানিকটা বের হয়ে আসে। বুঝেছ?

ক্ৰিভন ফ্যাকাসে মুখে বলল, কেউ গুলি করবে না।

না করলেই ভালো।

রুহান ক্ৰিভনকে টেনে মাঠের মাঝামাঝি নিয়ে যায় যেখানে রিদি দুই হাতে দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রিদির মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। বলল, রুহান! তুমি এটা কী করেছ?

এই পুরো এলাকার অলিখিত যুদ্ধবাজ সম্রাটকে ধরে এনেছি। কেন?

তুমি বলেছ হাজার হাজার দর্শক অনেকগুলো ইউনিট খরচ করে আমাদের খেলা দেখতে এসেছে। কিছু একটা যদি না করি তাহলে তাদের খুব আশাভঙ্গ হবে।

রিদি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভালো মানুষের মতো হেসে ফেলল, তারপর কাছে এসে রুহানের পিঠে থাবা দিয়ে বলল, আমি আমার জীবনে তোমার চাইতে বিচিত্র মানুষ দেখি নি!

রুহান বলল, সেটা নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে। কিন্তু ক্ৰিভনকে নিয়ে কী করি?

রিদি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গাল ঘষে বলল, দর্শকদের একটা সহজ উপায় হচ্ছে এই মাঠের মাঝখানে একে গুলি করে মেরে ফেলা। দর্শকদের তাহলে একেবারেই আশা ভঙ্গ হবে না। তারপর আমরা ঘোষণা করে দিই আমরা এখন এই সাম্রাজ্যের হর্তাকর্তা বিধাতা!

ক্রিভনের মুখ হঠাৎ একেবারে রক্তশূন্য হয়ে যায়। সে ভাঙ্গা গলায় বলল, ঈশ্বরের দোহাই লাগে তোমাদের, তোমরা যা চাও তাই দেব আমি–আমাকে মেরো না।

যা চাই তাই দেবে?

হ্যাঁ। ঈশ্বরের কসম খেয়ে বলছি–

বেশ। রিদি অস্ত্রটা তার গলায় স্পর্শ করে বলল, এই মুহূর্তে আমাদের হওনকে এখান থেকে বের হয়ে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়িতে করে নিয়ে যাও।

নিয়ে যাব। অবশ্যই নিয়ে যাব। একশবার নিয়ে যাব।

কোথায় নিয়ে যাবে?

ক্রিভন ভাঙ্গা গলায় বলল, তোমরা যেখানে বলবে। তোমরা যেখানে যেতে চাও–

যাবার কোনো জায়গা আছে নাকি আবার। পুরো দুনিয়াটাই তো তোমরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে রেখেছ!

জঙ্গলে?

মাথা খারাপ, জঙ্গলে গিয়ে আমি শেয়াল কুকুরের মতো লুকিয়ে থাকব?

তাহলে কোথায় যাবে?

লাল পাহাড়ে গেলে কেমন হয়?

লাল পাহাড়ে? ক্ৰিভনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। লা-লাল পাহাড়ে?

হ্যাঁ। রিদি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়ে গলায় খোঁচা দিয়ে বলল, কোনো সমস্যা আছে?

না, নেই।

চমৎকার! রিদি ক্ৰিভনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, চল যাই।

ক্রিভন অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দুই পা হেঁটে সামনে যায়। রিদি পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে একবার দর্শকদের মুখের দিকে তাকাল। তারপর রুহানের দিকে চোখ মটকে বলল, দর্শকদের আরেকটু আনন্দ দেয়া যাক কী বলো?

রুহান মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। সেও তার অস্ত্রটা বের করে নেয়। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে দর্শকের মাথার উপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে সবাই মাথা নিচু করে যে যেখানে আছে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করে, হুঁটোপুটি করে ছুটে পালাতে শুরু করে। রিদি হা হা করে হেসে বলল, হায়রে আমাদের মুরগি ছানার দল! ইউনিট খরচ করে মানুষ মারা দেখতে এসেছে অথচ সাহসের নমুনা দেখ!

রুহান বলল, অনেক হয়েছে, এখন চল।

রিদি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দেখা যাক আসলেই আমরা পালাতে পারি কি না!

ক্রিনের পোশাকের পিছনে ধরে তারা তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে। সমস্ত এলাকাটা তখন মানুষের হৈ চৈ চিৎকারে একটা নারকীয় পরিবেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে কোনো জায়গা থেকে কেউ গুলি করে তাদের শেষ করে দিতে পারে কিন্তু সেটা নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় নেই।

রুহান আর রিদি পাশাপাশি ছুটতে থাকে। কিছুক্ষণ আগেও তাদে একজনের আরেকজনকে হত্যা করার কথা ছিল।