০২০. বাড়ি খুঁজতে যাই

২০

জামাল বললেন, আমিও বাড়ি খুঁজতে যাই।

ওদুদ বললেন, জামালের সঙ্গে আমিও যাই।

খোকা বললেন, চলো, তিনজন বের হই। আমি এক রাস্তায় হাঁটি। তোমরা দুজন আরেক রাস্তায় হাঁটো।

একটা রাত ভুতুড়ে বাড়িতে কেটেছে। সবাই মেঝেতে শুয়ে কোনোরকমে রাতটা কাটিয়েছে। বিছানা-বালিশের তো ঠিকঠিকানা নাইই, মশারির তো প্রশ্নই আসে না। বাচ্চাদেরও খাওয়া হয়নি। রাসেলের জন্য হলেও খাবার কিনতে সকাল সকাল বেরিয়েছিলেন খোকা আর ওদুদ। কারফিউ প্রত্যাহার করার সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে গেছেন খাবারের সন্ধানে।

এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানোতে রেনুর জুড়ি নেই। তিনি এরই মধ্যে চাল-ডাল বসিয়ে খিচুড়ি বেঁধে ডিম ভেজে তুলে দিলেন সবার হাতে হাতে। কেউবা খেল সসপ্যানে, কেউবা হাঁড়ি থেকে তুলে নিয়েই সরাসরি চালান করতে লাগল মুখে। রেহানা বললেন, মা, খিচুড়িটা খুব টেস্টি হয়েছে।

খুঁজতে বেরিয়ে বাড়ি পেলেন মুমিনুল হক খোকাই। ঘর্মাক্ত কলেবরে পলির শ্বশুরবাড়িতে এসে বললেন, ভাবি। বাড়ি পাওয়া গেছে?

রেনু এগিয়ে এলেন। রেহানাও কাছে দাঁড়ালেন। রেহানা বললেন, কোথায় পেলেন, কাকু?

এই তো চৌধুরীপাড়াতেই। গোলচত্বরের কাছে। ফ্ল্যাটবাড়ি। বাড়িওয়ালি তো আমার আগের পরিচিত। কমলাপুর জাহাজবাড়ির মালিক। ওদের বাড়িতে আগে তো আমি ভাড়া থাকতাম।

বাসা ভালো? রেনু বললেন।

হ্যাঁ। ভালো। চলেন দেখে আসি।

তুই দেখেছিস। তোর পছন্দ হয়েছে। আর দেখতে হবে না নে। ভাড়া কত?

পাঁচ শ টাকা।

এত টাকা কই পাব?

ভাবি। আমি তো আছি, ভাবি। মিয়া ভাই আমাকে বলে গেছেন, আপনাদের দায়িত্ব আমার।

অগ্রিম দিতে হবে?

না। এক মাসের ভাড়া দিয়ে এসেছি।

চল, তাহলে উঠে যাই।

পলির শাশুড়ি দিলেন চাদর। কিছু হাঁড়িকুঁড়িও দিয়ে দিলেন। খোকার গাড়ি করে রেনু, জামাল, রেহানা, রাসেল উঠলেন নতুন বাসায়। বাসাটা বড়সড়। বেশ পছন্দই হলো রেনুর। খোকার বাড়িতে ফরিদ নামের একজন গৃহপরিচারক ছিলেন, দেখতে একেবারে চীনাদের মতো, সবাই তাকে ডাকত টুংফুং বলে, তাকে বলাই হয়েছিল, বাসা পেলে চলে এসো। সে চলে এল। সঙ্গে এল কাজের ছেলে আবদুলও। চুপচাপ তারা নতুন বাড়িতে উঠলেন। যেন কেউ টের না পায় কোন ভাড়াটে এসে উঠেছে এখানে।

আবদুল গেল কলাবাগান। রেহানাদের ফুফুর বাড়িতে। রেনুই পাঠিয়েছেন তাকে। যা তো খবর নিয়ে আয় ডলি, রোজী, ওরা কেমন আছে। লিলি কেমন আছে।

কলাবাগানে বঙ্গবন্ধুর বোন লিলির বাড়ি এসে আবদুলের চোখ ছানাবড়া। আবদুর রহমান রমা, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের লোক, যাকে কিনা ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময়ে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়, সে এই বাড়িতে! লিলি যখন শুনলেন, রেনু ভাবি বাড়ি পেয়ে গেছেন, তখন তার দুই মেয়ে ডলি আর রোজীকে পাঠিয়ে দিলেন সেই বাড়িতে। কারণ, ৩২ নম্বরের খুব কাছের এই বাড়িটি যে শেখ সাহেবের বোনের, সেটা সবারই জানা। এই বাড়িতে দুই তরুণীকে রাখা মোটেও নিরাপদ নয়।

৩২ নম্বরের আরেক পরিচারক, ২৫ মার্চ রাতে মিলিটারির হাতে ধরা পড়া রমা এল চৌধুরীপাড়ার বাড়িতে। সবাই তাকে ঘিরে ধরলেন।

রমা, কী খবর? আব্বা কোথায়? রেহানা জিজ্ঞেস করলেন।

সাহেবকে তো আমাদের সাথে একটা স্কুলে রাখছিল।

তোমরা আব্বাকে দেখলা কীভাবে?

সাহেব বাথরুমে যাচ্ছিল। তখন বুড়ি চিৎকার করে ওঠে তাকে দেখে। আমরাও দেখি। স্যার তখন ইংরেজিতে অনেক গালি দিল। আমাকে এনেছ, এনেছ, এদেরকে কেন এনেছ। তখন আমাদেরকে ছেড়ে দেয়।

কত তারিখে ছাড়ে?

তিন রাইত আছিলাম তো ওইখানে।

কেমনে ছাড়ল?

আমাদেরকে ট্রাকে তুলে আইয়ুব গেটের কাছে নামায় দিয়ে গাড়ি চইলা যায়!

আব্বা এখন কোথায় জানো?

না তো জানি না।

আব্বা বেঁচে আছে, মা, আব্বা বেঁচে আছে। কাঁদতে কাঁদতে রেহানা জড়িয়ে ধরলেন মাকে। রেনু চোখ মুছতে লাগলেন আঁচল দিয়ে। বললেন, আজিজ কই?

আজিজ মিয়া যে কই গেল, জানি না। রমা বলল।

আম্বিয়ার মা কোথায়?

অর মাইয়াদের লগে কলাবাগানে গিয়া উঠছে।

টুংফুং (ফরিদ, বয়স ১৭) একটা আস্ত হাঁস নিয়ে এসেছে। তাকে পাঠানো হয়েছিল চাল-ডাল কিনতে। এরই মধ্যে রব উঠল মিলিটারি আসছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেনু দেখতে পেলেন, লোকজন ছুটে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। খিলগাঁও, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া এলাকাটা আধা শহর, আধা গ্রাম। তারপরও মানুষ আরও গ্রামের দিকে ছুটছে।

রেনু ভয় পেয়ে গেলেন। ফরিদ বাইরে। না জানি কী হয়।

খানিক পরে ফরিদ এল। খোকার শাশুড়ি মাওইমা তো বলেই দিয়েছিলেন, ও চটপটে। ওকে নিয়ে যাও। আসলেই ছেলে চটপটে। চাল ডাল তো কিনে এনেছে। আবার লোকেরা যখন পালাচ্ছিল, একজনের হাতে ছিল হাঁস। সে দুই টাকা দিয়ে সেই হাঁস কিনে এনেছে।

রাসেল বলল, মা, হাঁস পুষব।

রেনু বললেন, বাবা! হাঁস পুষতে তো পানি লাগবে। আমাদের ৩২ নম্বরের বাসায় কত হাঁস ছিল! আবদুল তো হাঁস-মুরগিগুলোর খাঁচা খুলে দিছিল। গরুগুলোর দড়ি খুলে দিছিল। জানি না, সেগুলো বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।

রাসেল বলল, বাথরুমে বালতিতে পানি ভরব। তার মধ্যে হাঁসটাকে রাখব!

রেনু বললেন, এত বড় হাঁস, বালতির পানিতে থাকবে কী করে?

এই বাড়িতে এখন মমিনুল হক খোকার বউ মমতাজও এসে গেছেন। তাঁর সঙ্গে ছোট্ট বাচ্চা, পুতুল। আর আছে ছোট্ট দুই খোকা টিটো আর সাব্বির। লিলির মেয়ে ডলি আর রোজী আছে। হাসিনা আর ওয়াজেদের ওখান থেকে চলে এসেছে জেলিও।

রেনু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। হাসুর এখন শরীরের দিকে যত্ন নেওয়া দরকার। বিশ্রাম দরকার। মন ভালো রাখা দরকার। অথচ একা একা মেয়েটা মানুষের বাসায় আশ্রিতের মতো না জানি কত কষ্ট করেই আছে। যাক, তবু তো বেঁচে আছে। কিন্তু কামালের যে কোনো খবর নেই। কামাল ভালো আছে তো!

হাসুর আব্বাই-বা কোথায় আছেন? রমার কাছ থেকে জানা গেল, বেঁচে ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টে রেখেছে।

এই বাসায় কবে যে মিলিটারি হামলা করে ঠিক নেই। সারা রাত রেনু আর মমতাজ জেগে থাকেন। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখেন। মিলিটারি এল কি না। জামাল আর খোকা বাড়ির পেছনের বারান্দা পরখ করে রেখেছে। একটা গাছ আছে। পানির পাইপ আছে। দিব্যি পাইপ বেয়ে নামা যাবে। মিলিটারি এলে ওরা দুজন পাইপ বেয়ে নেমে পালিয়ে যাবে।

চারদিক থেকে শুধু খারাপ খবর আসে। মানুষ মেরে ওরা রাস্তার ধারে ফেলে রেখেছে। বাসভর্তি মানুষকে বাস থেকে নামিয়ে লাইন ধরে গুলি করে মেরেছে। তবে আকাশবাণী থেকে, বিবিসি থেকে ভালো সংবাদও আসে। চট্টগ্রাম এখনো মুক্ত। কুষ্টিয়া মুক্ত। বগুড়া মুক্ত। ওখানকার মুক্তিবাহিনী। ভালো লড়াই করছে।

বিকেলবেলা রেহানা দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। মা তখনো রান্নাঘরে। এতগুলো মানুষের খাওয়া কেবল শেষ হলো। সবকিছু গোছগাছ করতে তিনি সাহায্য করছেন আবদুলদের। বাসার সামনে একটা আমগাছ। গাছটা দোতলা পর্যন্ত উঠে এসেছে। আমের ছোট ছোট গুটি এসেছে গাছে। যা সুন্দর লাগছে। দেখতে। দুই দিন আগের বৃষ্টিতে পাতাগুলো ধোয়া হয়ে গেছে। পাতাগুলো সবুজ আর বেশ পুষ্ট দেখাচ্ছে।

বাড়ির সামনে একটা মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াল। দুজন আরোহী তাতে। তরুণ বয়সী বলেই মনে হয়। একজন তাঁদের বাড়ির সামনেই থাকলেন। আরেকজন মোটরবাইকটা নিয়ে রাস্তার উল্টো পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

রেহানার গভীর সন্দেহ হচ্ছে। এই দুজন কারা? কেন তারা এই বাড়ির সামনেই এসে দাঁড়াল?

একটু পরে রঙিন জামা পরা, মাথার মধ্যখানে সিঁথি, দাড়িগোঁফবিহীন। ছেলেটা এসে ঢুকে পড়ল বাসায়। তারপর সোজা চলে গেল রেনুর কাছে। মা বলে জড়িয়ে ধরল তাঁকে।

মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, কামাল, কই ছিলি বাবা এত দিন?

কামাল আস্তে আস্তে মুখ খুললেন। একটা সুইডিশ ফ্যামিলির সাথে ছিলাম। গোঁফ তো আগেই কেটেছি। হেয়ারস্টাইলও বদলে ফেলেছি। দেখছ না কেমন লাল ফুলওয়ালা জামা পরেছি। যাতে কেউ চিনতে না পারে।

রেহানা বললেন, আমিই তো চিনতে পারি নাই। কামাল ভাই, মোটরসাইকেল চালাচ্ছে কে?

তারেক।

রেনু বললেন, তারেককে ওপরে ডেকে নিয়ে আয়।

তারেক এলেন। দেখা করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। মা ছেলের জন্য ভাত বাড়লেন। কামাল আস্তে আস্তে ভাত খাচ্ছেন। রেহানাও পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

কামাল খোকা কাকুর গাড়ি নিয়ে বের হলেন। সবাই খুব উদ্বিগ্ন। রেনু বারবার করে বলতে লাগলেন, ভাইডি, কাজটা কি তুই ঠিক করলি? অরে গাড়ির চাবি দিলি ক্যান?

ও চাইলে আমি না করি কী করে?

এখন সেই যে গেল। আসতেছি বলে গেল। আসে না তো। রাস্তায় মিলিটারি চেকপোস্ট। চেক করলেই তো ওকে ধরে ফেলবে।

সবার চোখেমুখে উদ্বেগের ছায়া এসে ভর করল। রেহানা বারান্দায় কামাল ভাইয়ের পথ চেয়ে তাকিয়ে রইলেন। কোনো গাড়ি যদি এদিকটায় আসে, তাহলে তো চোখে পড়বেই। জামালও উদ্বিগ্ন। কামাল ভাই যে কী করে না? গাড়ি নিয়ে যাওয়ার দরকার কী! জামাল বললেন।

সন্ধ্যার দিকে কামাল ফিরলেন। বললেন, আমি চলে যাব মা।

কই যাবি?

আপাতত টুঙ্গিপাড়া যাব। ঢাকায় থাকা একদম নিরাপদ নয়।

মা বললেন, আচ্ছা যা।

কামাল বললেন, রেহানা, ওই ব্যাগটা আন। খোল। দ্যাখ ভিতরে একটা টু ইন ওয়ান আছে। আমার হোস্ট ফ্যামিলি আমাকে গিফট করেছে। এটা তুই রাখ। দেশ-বিদেশের খবর শুনতে পারবি। গানও শুনতে পারবি। আর শোন, পাকিস্তানি মিলিটারি যদি আসে, খবরদার ধরা দিবি না। হয় পালিয়ে যাবি, না হলে মারা যাবি।

রেনু বললেন, এগুলো কী ধরনের কথা?

কামাল বললেন, যা রিয়েল, তাই বললাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা তো মানুষ না, পশু।

কামাল বেরিয়ে পড়লেন। লঞ্চ ধরতে হবে। সদরঘাট যেতে হবে। নিচে তারেক দাঁড়িয়ে আছেন মোটরসাইকেলসমেত।

রেহানার ইচ্ছা হলো, নিচে গিয়ে ভাইকে বিদায় দিয়ে আসেন। কিন্তু সম্ভব নয়। তারা এখানে আছেন নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে। পাড়া প্রতিবেশীকে তাঁরা জানাতে চান না নিজেদের পরিচয়।

সবাই বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। হেডলাইট জ্বালিয়ে ভটভট শব্দ তুলে কামালকে পেছনে তুলে নিয়ে তারেকের মোটরবাইক অদৃশ্য হয়ে গেল।

রেনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

পরের দিন বাড়িতে এলেন কয়েকজন মহিলা। তাঁরা বললেন, আমরা এসেছি আশপাশের বাসা থেকে।

তাঁরা রেনুকে বললেন, আপনারা নাকি শেখ সাহেবের আত্মীয়।

সবাই চুপ করে আছেন। কী বলবেন এই প্রশ্নের উত্তরে।

কালকে নাকি শেখ সাহেবের ছেলে কামাল এই বাড়িতে এসেছিল? আপনারা আপা প্লিজ এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। জানেনই তো ৩২ নম্বরের বাড়িতে মিলিটারিরা হামলা চালিয়েছে। শেখ সাহেব চলে যাওয়ার পরও মিলিটারি গিয়ে পুরা বাড়িতে গুলি করেছে। জিনিসপত্র তছনছ করেছে। আপনারা এই বাড়িতে আছেন জানলে এই বাড়িতেও কামান দাগাবে। আপনারা চলে যান প্লিজ।

রেনু বললেন, আচ্ছা, একটা দিন সময় অন্তত দেন।

এরই মধ্যে রেহানার ছোট ফুফু খবর পাঠালেন, তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন। রেনু বললেন, তাহলে জেলি, রোজী, ডলি এদেরকেও নিয়ে যা। ঘরে মেয়েদের রাখা বড়ই বিপদের কথা।

খোকাকে বললেন, ভাইডি, ওদের একটু সদরঘাট পৌঁছায়ে দাও না।

ভাবির কথা খোকার জন্যে অলঙ্ঘনীয় হুকুম। কী সর্বনাশের কথা! সদরঘাটের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে গেলে রক্ষা আছে? তবু আল্লাহর নাম নিয়ে খোকা বের হলেন জেলি, রোজী, ডলি, তাদের মাকে নিয়ে সদরঘাটের দিকে।

আরেকটা বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে। একটা সমাধান আপনাপনিই পাওয়া গেল। বদরুন্নেসা আর নূরুদ্দিন ভারত চলে গেছেন। তাঁদের মগবাজারের বাড়ির চাবি রেখে গেছেন। খবর দিয়েছেন, মুজিব ভাই নেই, এই দুঃসময়ে বাসা ভাড়া করে থাকার দরকার কী। আমাদের মগবাজারের বাড়িতে থাকুন।

এত দিন ওই বাড়ির কথা রেনু ভাবতে চাননি, বাড়িটা একেবারে বড় রাস্তার ওপরে। ১ নম্বর সার্কুলার রোড। এখন আর উপায় কী?

তারা গিয়ে মগবাজারের বাড়িতেই উঠলেন।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, এই ছিল তাগো বরাতে।

ব্যাঙ্গমি বলে, ২৫ মার্চ রাত থাইকা তারা কয়টা বাড়িতে গেলেন? ১. ডা. সামাদের বাড়ি. ২. মোরশেদের বাড়ি. ৩. ক্যাপ্টেন রহমানের বাড়ি ৪. মগবাজারের ইঞ্জিনিয়ার আলী সাহেবের বাড়ি। ৫. বলধা গার্ডেনে খোকার শ্বশুরবাড়ি ৬. খিলগাঁও পলির শ্বশুরবাড়ি ৭. চৌধুরীপাড়ার ভাড়া বাড়ি ৮. মগবাজারের ১ নম্বর সার্কুলার রোডের বাড়ি।

ব্যাঙ্গমা বলে, এইটাই শেষ নয়।

ব্যাঙ্গমি বলে, হ। এইটাই শেষ নয়। সেই গল্পে আমরা পরে আসতাছি…

২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছ ছেড়ে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি কোথাও যাবে না। এই ছিল তাদের প্রতিজ্ঞা। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা তারা ধরে রাখতে পারে না।

তারা দেখতে পায়, পাকিস্তানি মিলিটারি ট্রাকে করে ধরে এনেছে কাঠুরে, ইলেকট্রিক করাত, আর তারা কেটে ফেলছে বটগাছটাকে।

ব্যাঙ্গমা বলে, দ্যাখো, মানুষের জিঘাংসার আগুন কত ভয়াবহ হতে পারে! পাকিস্তানি মিলিটারিরা শুধু মানুষ মারছে, তা-ই না, তারা পুড়ায়া দিতেছে বস্তি, তারা গুঁড়ায়া দিতেছে মন্দির আর শহীদ মিনার। জগন্নাথ হলের মাঠে লাইন কইরা মানুষ মাইরা তাগো জিঘাংসা চরিতার্থ হয় নাই, চট্টগ্রামে, রংপুরে, কুমিল্লায়, যশোরে ক্যান্টনমেন্টে ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্য আর তাগো স্ত্রী পুত্র-কন্যা-পরিজনদের গুলি কইরা বেয়নেট চার্জ কইরা মাইরা তাগো রক্তের তৃষ্ণা মেটে নাই, তারা এবার হত্যা করতে এসেছে একটা বটগাছকে।

৪ এপ্রিল ১৯৭১।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি আকাশে ওড়ে আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, পাকিস্তানি মিলিটারিদের আনা শ্রমিকেরা করাত চালাচ্ছে তাদের আশ্রয় বটগাছটার ওপরে। বটগাছ থেকে কাঠের গুঁড়ো নয়, যেন হলুদ রক্ত বেরোচ্ছে। গলগল করে। বটগাছের পাতারা আর্তনাদ করে উঠছে, গাছে আশ্রয় নেওয়া পরগাছারা অশ্রুপাত করছে, গাছের ডালে বাসা বানিয়েছিল যে পাখি আর পতঙ্গ তারা চিৎকার করছে, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার তো কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না এই পৃথিবীতে। পুরো গাছটাকে ধরাশায়ী করে টুকরো টুকরো কেটে তারপর রাগ কিছুটা কমে হয়তো দায়িত্ব পাওয়া মেজরের আর সৈন্যদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছ বলতে আর কিছু রইল না, এখন কোথায় তোরা আন্দোলন করবি, বেইমান বেজন্মা বাঙালির বাচ্চারা!

ব্যাঙ্গমা বলে, এখন আমরা কই যামু?

ব্যাঙ্গমি বলে, চলো তাইলে আমরা রমনা পার্কের পাকুড়গাছটায় গিয়া বসি।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি উড়ে গিয়ে বসল রমনার অশ্বথশাখায়।

২২

এই মাটি ছাইড়া আমি কোথাও যামু না। কারে বলে দ্যাশ? এই মাটিই আমার দ্যাশ। কুমিল্লার বাড়িতে লাগানো সুপুরিগাছের গোড়ার মাটিতে খুরপি চালাতে চালাতে তিনি আপনমনে বিড়বিড় করছিলেন। নিজ হাতে কতগুলো নারকেল আর সুপুরির চারা লাগিয়েছেন কিছুদিন আগে। এগুলো এখনো মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে শক্তপোক্ত হয়নি। এই গাছগুলোকে বাঁচাতে পরিচর্যা দরকার। কিন্তু সেই যে চারপাশে এত আম, জাম, কাঁঠাল, কদম, হিজলগাছ আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে, মাটির গভীরে শিকড় ছড়িয়েছে, এদেরকে যদি জিজ্ঞেস করি, তোমাদের দেশ কী, ও গাছ ভাইয়েরা, ওরা কী বলবে? যাবে তোমরা নিজের দেশে? একটাই দেশ ছিল, এখন ভাগ হয়ে গেছে। এইটা আর তোমাদের দেশ না? ও বকুলগাছ দিদি, ও অশ্বত্থ দাদা, যাইবা আমগো সাথে, ওই পারে?

১৯৪৭ সালে একষট্টি বছরের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হাসেন। তাঁর সাদা চুল। যেন বকুলগাছ নয়, তার হাসি বকুল ঝরায়। এই মাটি ছাইড়া আমি কোথাও যামু না। এই মাটিই আমার দ্যাশ। এই আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি, এই আমার কুমিল্লার মাটি। এই আমার পূর্ব বাংলার মাটি। রমেশ পানির ঝাঁঝরি এনে তাঁর পাশে দাঁড়ালে তিনি গাছের গোড়ায় পানি ঢালেন, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাছের পাতাতেও পানি ঢালেন। গাছের পাতারা জলের সোহাগ পেয়ে ঝকমকিয়ে ওঠে, ধীরেন্দ্রনাথ সেই হাসিটুকু যেন দেখতে পান।

রমেশ লোকটা তার পুরোনো ভূত্য, ঘাড়ে গামছা, পরনে ধুতি, কুচকুচে কালো গায়ের রং, চামড়া ফাটা, তার বয়স পঁয়তাল্লিশও হতে পারে, পঁয়ত্রিশও হতে পারে, সে তার বাবুর এই স্বভাব জানে, গাছের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে কথা কন তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ বলেন, রমেশ, এই যে ছোট সুপারিগাছের চারা, নারকেলগাছের চারা, এইগুলান তুইলা লইয়া গিয়া কলকাতায় মাটিতে লাগাইলে বাঁচব না?

বাঁচতেও পারে বাবু।

কিন্তু বড়গুলানরে লইয়া যাওন যাইব? ওই বটগাছটারে যদি তুইলা লইয়া যাই?

রমেশ হাসে। তাঁর দাঁত কালো, পান-তামাক নানা কিছু খেয়ে দাঁতের বারোটা বাজিয়েছে সে।

বড়গাছ কি আর তোলন যাইব বাবু! কাইটা-চিইরা তক্তা লইয়া যান।

তাইলে আমরা বড় মানুষগুলান, কই যামু? এইহানে থাকুম নাহি কলকাতা যামু?

রমেশ আবার দাঁত বের করে। বড় কালো ওর দাঁতগুলো।

শোনো, করাচি গেছিলাম না? মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণটা শুইনা, কইলজাটা ঠান্ডা হইছে। আসলে তো হেও কংগ্রেসই করত। শিক্ষিত লোক। সেকুলার আছে।

জিন্নাহ কী কইছে? রমেশ নারকেলগাছের চারার ওপরে পানি ঢালতে ঢালতে শুধায়।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মনে পড়ে জিন্নাহর প্রথম বক্তৃতাটা। করাচিতে গণপরিষদ সম্মেলনে তিনি প্রথম দিয়েছিলেন এই ভাষণটা। যা-ই হোক না কেন, পাকিস্তান কখনোই এমন ধর্মরাষ্ট্রের পরিণত হবে না, যা কিনা ধর্মযাজকেরা পারলৌকিক মিশন নিয়ে শাসন করে থাকে। আমাদের আছে অনেক অমুসলিম-হিন্দু, খ্রিষ্টান, পারসি, কিন্তু তারা সবাই পাকিস্তানি। তারা অন্যদের মতো সমান অধিকার ভোগ করবে এবং পাকিস্তান বিষয়ে তারা পূর্ণ অধিকার নিয়ে ভূমিকা পালন করবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমরা শুরু করছি এমন একটা কালে, যখন কোনো বৈষম্য নেই, কোনো সম্প্রদায়ের তুলনায় আরেকটা সম্প্রদায়কে আলাদা করা হয় না, বর্ণের কারণে, গোত্রের কারণে কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয় না। আমরা শুরু করতে যাচ্ছি এই মৌলনীতি অবলম্বন করে যে আমরা সবাই একটা রাষ্ট্রের নাগরিক এবং সম অধিকারসম্পন্ন নাগরিক।

এই কথা শুনে আসার পরে ধীরেন্দ্রনাথ কি এই কুমিল্লা ছেড়ে, এই পূর্ব বাংলা ছেড়ে কলকাতা যেতে পারেন?

আমি এই মাটির পোলা, আমি এই আমগাছের মতো, এই বটগাছের মতো, আমারে তোমরা আর কোথাও লইতে পারবা না। আমি এই মাটির সাথে হামাগুড়ি দিয়া মাটি ধইরা আঁকড়াইয়া থাকুম।

রমেশ আবার তার কালো দাঁত বের করে।

মাটির কথাই ধীরেন্দ্রনাথকে বলতে হয়। কংগ্রেসি ছিলেন তিনি। গান্ধীবাদী ছিলেন। জেল খেটেছেন স্বদেশি করতে গিয়ে। স্বদেশ হিসেবে পেয়েছেন পাকিস্তানকে। মাটির গন্ধ তার গা থেকে যায় না। পাস করা উকিল। ওকালতিই তার ব্যবসা। কিন্তু কথা বলতেন মাটির টানমাখা বুলিতে।

মাটি অথবা মা-টি। দুটোই তো মা। ভাষা, সে-ও তো মা-ই। মায়ের ভাষা–আমরা বলি না?

তো, ১৯৪৮ সালের বসন্তকালে, ফাল্গুন মাসে, কুমিল্লায় কি ঢাকায় যখন। পলাশ ফুটেছে, কোকিল ডাকছে, দক্ষিণা সমীরণ বইছে, তখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য, তাঁর মাটির কথা, কিংবা মা-টির কথা পেড়ে বসলেন পার্লামেন্টে। জিন্নাহ তখন সভাপতিত্ব করছিলেন গণপরিষদে। পার্লামেন্টে একটা বিধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধিটা কী?

গণপরিষদে সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও বিবেচিত হবে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নোটিশ দিলেন। একটা ছোট্ট, খুবই ছোট্ট সংশোধনী আছে তার। ফ্লোর পেলেন দুদিন পর।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পায়ের নিচে তাঁর করাচির গণপরিষদ ভবনের পাথুরে মেঝে, কিন্তু কেথেকে যেন তিনি পাচ্ছেন তাঁর কুমিল্লার মাটির গন্ধ, তার মনে হলো, তিনি বৃক্ষ হয়ে উঠছেন, এবার তার শিকড় তার পায়ের নিচে চাড়া দিচ্ছে, জানান দিচ্ছে তার পায়ের নিচে মাটি আছে, তার রক্তের মধ্যে মা আছে, ভাষা আছে–তিনি বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, স্যার, আমার সংশোধনী : ২৯ নম্বর বিধির ১ নম্বর উপবিধির ২ নম্বর লাইনে ইংরেজি শব্দের পর অথবা বাংলা শব্দ দুটি যুক্ত করা হোক।

বাংলার বসন্তকালের সমস্ত শিমুল আর পলাশ আর আম আর জামগাছের মুকুলগন্ধমাখা ডালপালা-পাতার ফাঁক থেকে এক কোটি কোকিল কুহু কুহু বলে ডেকে উঠল।

ধীরেন্দ্রনাথ বললেন, আমি এই সংশোধনীটা ক্ষুদ্র প্রাদেশিকতার মানসিকতা থেকে উত্থাপন করিনি। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছ কোটি নব্বই লাখ। এর মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লাখ কথা বলে বাংলায়। তাহলে স্যার দেশের রাষ্ট্রভাষা কোনটি হওয়া বাঞ্ছনীয়।…স্যার, এই জন্য আমি সারা দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোভাবের পক্ষে সোচ্চার হয়েছি। বাংলাকে একটা প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এই বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

পূর্ববঙ্গের সাধারণ সদস্য প্রেমহরি বর্মণ তাকে সমর্থন করলেন।

প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর বক্তব্য হলো, এটা আসলে কোনো নিরীহ সংশোধনী নয়, এটা হলো পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বিনষ্ট করা। পাকিস্তান একটা মুসলিম রাষ্ট্র। এ জন্য মুসলিম জাতির ভাষা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

উঠে দাঁড়ালেন ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত। তিনিও পূর্ববঙ্গের সদস্য। বললেন, প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু মন্তব্য বেছে বেছে করেছেন, যা তিনি না করলেও পারতেন।

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বললেন, আমি নিশ্চিত, পাকিস্তানের বিপুল জনগোষ্ঠী উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে।

পূর্ববঙ্গের শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বললেন, পাকিস্তান একটা মুসলিম রাষ্ট্র, এই কথাটা পরিষদের নেতার মুখে শুনে দুঃখ পেয়েছি খুব। এত দিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রে মুসলিম আর অমুসলিমদের সমান অধিকার।

ভোটে উঠল সংশোধনীটা। পরিষদের সভাপতি মোহামদ আলী জিন্নাহ। তিনি কণ্ঠভোটে দিলেন প্রস্তাবটা। মোট সদস্য ৭৯ জন। ৪৪ জন পূর্ব বাংলার।

কিন্তু কণ্ঠভোটে ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল।

এক কোটি কোকিল তীব্রস্বরে ডেকে উঠল পূর্ব বাংলায়। এক লাখ শিমুল মাথা ঝাঁকাল। এক লাখ পলাশ পাপড়িতে আগুন জ্বালাল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল আর পুরান ঢাকার নানা স্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়তে লাগল স্লোগান দিতে দিতে–পাখির ঠোঁটে ঠোঁটে বার্তা রটে গেল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেই ১৯৪৮-এর ফাল্গুনেই। ১১ মার্চ হরতাল। পিকেটিং করতে হবে। ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের জলদগম্ভীর কণ্ঠ বেজে উঠলে অলি আহাদ সমর্থন দিলেন। তোয়াহা, শওকত, শামসুল হক, অধ্যাপক আবুল কাশেম, নাইমুদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, কামরুদ্দীন, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল-হরতালের দিনে কে কোন জায়গায় পিকেটিং করবেন, দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়ে গেল।

মাটির টানটা ধীরেন্দ্রনাথের কথাবার্তায় ছিল সর্বক্ষণই। ৪৮ সালেই ময়মনসিংহ শহরে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে আগের বক্তা মালেক সাহেবের দেশে আরেকটা তুলাধুনার ব্যবস্থা হওয়া উচিত এই বক্তব্যের পরে তিনি বললেন, এই তো মাত্র দেশে বহুত তুলাধুনা হইয়া গেল, কিন্তু তার রেশ তো এখনো শেষ হইল না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করতে হইবে, যাতে হিন্দু মুসলমান, আমরা বরাবর যে রকম মিইলা-মিইশা কাজ কইরা যাইতাছি, ইংরেজের বিরুদ্ধে মিইলা-মিইশা সংগ্রাম কইরা তারারে তাড়াইছি, এইভাবে মিইলা-মিইশাই আমরা আগাইয়া যাইব, এই সম্প্রীতি কিছুতেই নষ্ট হইতে দেওন যাইব না।

কথায় মাটি গন্ধ। মগজে মাটির নেশা। কতজন উকিল কুমিল্লা ছেড়ে চলে গেল কলকাতায়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গেলেন না। মন্ত্রী হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তো মন্ত্রী তো তিনি কলকাতাতেও হতে পারতেন। হয়তো মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন, ডেপুটি লিডার ছিলেন কংগ্রেসের। মুখ্যমন্ত্রী না হলেও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তো হতে পারতেনই।

কিন্তু কুমিল্লার মাটি, মেঘনা কি তিতাসের জল তাকে আবিষ্ট করে রাখল। এই মাটিই যে তার দেশ।

১৯৭০-এ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা বলল, কলকাতায় চলে যাও। মেয়ে পুতুল বলল, বাবা, দেশে যদি একটা কিছু ঘটে যায়, তোমাকেই তো বাবা সবার আগে মারবে।

তিনি বললেন, তোরা শুনবি তোগো বাবারে গুলি কইরা রাস্তায় ফেইলা রাখা হইছে। শকুনি আমার দেহটা খাইতাছে। তবু তো ভালো প্রাণীর খাদ্য হমু। জীবন এইভাবে শেষ হইলে তবু একটা মূল্য থাকে।

সেই কথা শুনে রমেশ কেঁদে উঠেছিল। পুতুল বলেছিল, কাকু, কেঁদো না তো। বাবাকে তো চেনোই। সেই স্বদেশি আমল থেকে জেলখাটা মানুষ।

রমেশ বলল, কোথাও সইরা থাকলেই তো হয়।

এই মাটি ছাইড়া আমি কই যামু রমেশ? ৮৫ বছরের বৃদ্ধ অকম্পিত স্বরে বললেন।

২৯ মার্চ ১৯৭১। কুমিল্লা শহরে কারফিউ। চারদিকে নিস্তব্ধতা। শিমুল ফুল ফেটে গিয়ে তুলো বীজ উড়ছে, তার শব্দও যেন পাওয়া যাবে, এমনই নিস্তব্ধতা। থেকে থেকে ফৌজি গাড়ি ছুটছে আর তার পেছনে ধেয়ে যাচ্ছে নেড়িকুকুরের দল।

ধীরেন্দ্রনাথকে আজ বড় শান্ত দেখায়। তিনি সন্ধ্যার সময় মাথা ধুলেন। নাতনিকে ডেকে এনে বললেন, ওই কালো চামড়ায় মোড়া বইটা দাও তো দিদি। বইটা এনে দিল নাতনি। তিনি পাতা ওলটালেন। লাল পেনসিল দিয়ে দাগ দিলেন কয়েকটা বাক্যে। বললেন, শোনো, কী লেখা এখানে, দেশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলে সে মরে না, সে শহীদ হয়। সে অবিনশ্বর, তার আত্মা অমর।

পুত্র আর পুত্রবধূদের ডাকলেন তিনি। বললেন, আজ রাতেই ওরা আমাকে নিয়ে যাবে। রমেশের চোখ দিয়ে দরদরিয়ে জল গড়াতে লাগল। সুপুরিগাছগুলো বড় হয়েছে। নারকেলগাছে নারকেল ধরেছে।

রাত বাড়ছে। কুকুরের আর্তনাদ আসছে কানে। রাত দেড়টায় বাড়ির সামনে এসে থামল পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্রাক। ধরে নিয়ে গেল ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে।

ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের। ওটা ততক্ষণে কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের মারা হয়েছে। নৃশংসভাবে।

নির্যাতন শুরু হলো ৮৫ বছরের ওই বৃদ্ধের ওপরে। এই বৃদ্ধই সব নষ্টের গোড়া। আজ থেকে ২৪ বছর আগে করাচির পার্লামেন্টে এই মালাউনই প্রথম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলে। এ বছর, ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারিতেও শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বেইমান শেখ মুজিব এই ধীরেন্দ্রনাথের নাম নিয়েছে। ওকে পেটাও।

বেশি প্রহার দরকার ছিল না। হাঁটুর হাড় মড়মড় করে ভেঙে গেল। তবু থামে না নির্যাতন। চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো কলম। যেন এই চোখে সে আর কোনো দিনও বাংলা বর্ণমালা দেখতে না পায়। দুহাতের নখ উপড়ে ফেলা হলো। চোখের পাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলা হলো।

ক্যান্টনমেন্টের একজন নাপিত দেখতে পেল, বুড়ো মানুষটি হামাগুড়ি দিচ্ছেন, একটু আড়ালে সরে যাচ্ছেন মলত্যাগ করবেন বলে। একাত্তরের বসন্তে, চৈত্রের শেষ দিনে নাকি পয়লা বৈশাখে তিনি হামাগুড়ি দিয়ে পাকা শান ছেড়ে চলে এলেন মাটিতে। মাটি আঁচড়ালেন। মাটি মাখলেন চোখে মুখে-মাথায়।

নাপিতটা ভাবল, মলত্যাগ করতেই এসেছেন। কিন্তু এবার তিনি মলত্যাগ করতে আসেননি। তিনি বিড়বিড় করলেন। বললেন, এই মাটিই আমার মা। এই মাটিই আমার দেশ। এই মাটি আমার মা-টি। তাঁর ভাষাই আমার মায়ের ভাষা। মাটি, আমি তোমারে নিলাম। মা-টি, তুমি আমারে লও।

তিনি মাটিতে দেহ রাখলেন।

পাকিস্তানি সৈন্যরা আরও আরও বাঙালি সৈন্য আর বেসামরিক মানুষের সঙ্গে তাকে পুঁতে ফেলল মাটিতেই।

রমেশ আর্তনাদ করে। কোনোরকমে কুমিল্লা ছেড়ে আগরতলা পাড়ি দিয়ে রমেশ নিজের প্রাণটা বাঁচায়। তারও বয়স হয়েছে। চোখে ঠিকমতো দেখতে পায় না। দাঁত পড়ে গেছে। কিন্তু সে তো বেঁচে আছে। তার মনিব ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়েছিল, সেই কথাটা আকাশে-বাতাসে ১৯৭১-এ। খুব শোনা গেল। রমেশও শুনল। কতজনের মুখ থেকে! তারা বলল, উনি হামাগুড়ি দিতেন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য, আড়াল খোঁজার জন্য।

রমেশ বিড়বিড় করে বলল, আমি জানি ক্যান বাবু হামাগুড়ি দিচ্ছিল। মাটি ধরার জন্য। ভগবান তাঁর ইচ্ছা পূরণ কইরাছে, তিনি মাটিতেই মিইশা গেছেন।

২৩

স্যার, আপনাকে আসতে হবে।

দুজন অফিসার এসে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসের তার কক্ষটির সামনে। তিন রাত স্কুলের একটা ঘরে ছিলেন তিনি। এরপর তাঁকে আনা হয় এই হাউসে। এখানকার পরিচ্ছন্ন ঘরের পরিচ্ছন্ন বিছানায় তিনি থাকছিলেন, আর কখন তার বিচার শুরু হবে, সে জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিচারের জন্য তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে আনা তো আজকেই প্রথম নয়।

শেখ মুজিব তার পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে নিলেন। এপ্রিলের গরমের মধ্যেও ওপরে পরলেন মুজিব কোটটি। হাতে পাইপ, পকেটে তামাকের কৌটা, লাইটার নিয়ে তিনি বললেন, আমি রেডি।

জনাব। আমরা আপনার ব্যাগটি সঙ্গে নিচ্ছি। আপনাকে আরেক জায়গায়। রাখতে নিয়ে যাওয়া হবে।

সৈনিকেরাই তার ছোট্ট জেলখানার থলেটি সঙ্গে নিল। সামনে-পেছনে সৈন্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় তিনি ফ্ল্যাগ হাউসের লম্বা বারান্দা হেঁটে পার হলেন। প্রথম তিন রাত প্রায় নিঘুম কাটানোর পর ফ্ল্যাগ হাউসের তিন দিন তিন রাত তুলনামূলকভাবে ছিল অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। এখন এরা আবার তাঁকে কোথায় নিচ্ছে কে জানে? রাত আটটার মতো বাজে। বারান্দার বাতিগুলো জ্বলছে, আর তাতে পোকা ঘিরে আছে। শেখ মুজিব এগোচ্ছেন, একটার পর একটা লাইটের আলোয় তার চারদিকে অনেকগুলো ছায়া একবার ছোট হচ্ছে, একবার বড় হচ্ছে।

তিনি বারান্দার সিঁড়ির কাছে এসে দেখলেন তিনটি গাড়ি। সামনের দুটো লরি। তাতে সৈন্যরা এলএমজি বসিয়ে সদা প্রস্তুত। মাঝখানেরটা একটা সেডান গাড়ি। তাঁকে মাঝখানের কারেই ওঠানো হলো। গাড়ির কাঁচ পুরোটাই পর্দা দিয়ে ঢাকা। তার দুপাশে দুজন সৈনিক বসল। সামনে ড্রাইভার আর একজন সৈনিক। বেশিক্ষণ চলল না গাড়ি। দরজা খুলে গেল। তাঁকে বলা হলো, নামুন। তিনি নামলেন।

বুঝতে পারলেন তাকে এয়ারপোর্টে নেওয়া হয়েছে। সামনে একটা উড়োজাহাজ। পিআইএর মনোগ্রাম আঁকা আছে প্লেনের গায়ে। তিনি বিমানের সিঁড়িতে পা রাখলেন। তারপর তাকালেন আকাশের দিকে। কালো আকাশে অনেক তারা। একপশলা বাতাস এসে মুজিবের পাঞ্জাবির হাতা ওড়াতে লাগল। মুজিব প্লেনের ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন। পুরো প্লেন ফাঁকা। তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। তবে প্রহরী আছে কয়েকজন। তিনি একটা সিটে গিয়ে বসলেন। জানালা দিয়ে বিমানবন্দরের আলো দেখতে পেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান নড়তে শুরু করল। তিনি বিমানের জানালা দিয়ে অপস্রিয়মাণ গাছগাছড়া, আলোকস্তম্ভ, দূরের টার্মিনাল ভবনের আলো দেখতে লাগলেন। বিমান দ্রুততর হলো। আকাশে উড়ে গেল। তিনি নিচে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন ঢাকার কী অবস্থা।

বিস্ময়করভাবে তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কিংবা বৃদ্ধ আব্বা-আম্মার কথা তাঁর মনে পড়ল না। তিনি একটা অদ্ভুত দৃশ্য কল্পনায় দেখতে পেলেন : রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ জনপদে ঢুকে পড়েছে। একের পর মানুষের ওপরে থাবা বসাচ্ছে। তখন গ্রামবাসী জেগে উঠছে। যার যা কিছু আছে–লাঠিসোটা, বন্দুক, বল্লম, জাল, ঢাকঢোল, মশাল–নিয়ে হাজার হাজার মানুষ তাড়া করছে বাঘটাকেই।

প্লেন প্রথমে গেল কলম্বো। সেখানে ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে আবারও উড়াল। একঘেয়ে বিরক্তিকর ফ্লাইট। একসময় মুজিব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘণ্টা দেড়েক ঘুমানোর পর জাগলেন। এই সময় একজন ক্রু তাঁর কাছে এল এবং বলল, তিনি সকালের ব্রেকফাস্ট করবেন কি না। তিনি মাথা নাড়লেন। বিমানের নাশতার একটা রেডিমেড প্যাকেট গরম করে তাঁকে দিয়ে দেওয়া হলো। ভেতরে তিনি একটা রুটি, ডাল এবং ডিম দেখতে পেলেন। সেটা সামনে নিয়ে তিনি বসে রইলেন। চা বা কফি কিছু খাবেন? তিনি কফির কথা বললেন। এই সময় হঠাৎ করে তার মনে হলো তাঁর বাড়ির পোষা কবুতরগুলোর কথা। তিনি প্রায়ই কবুতরগুলোকে গম, খুদ ইত্যাদি খেতে দিতেন। ২৫ মার্চ রাতে যে হারে গুলির শব্দ আর আগুন তিনি দেখেছেন, তাতে বাড়ির মানুষ সব বেঁচে আছে কি না, আল্লাহ জানেন, আর কবুতরগুলোর কী পরিণতি হয়েছে, সে খবর কে রাখবে।

প্লেনটা অবতরণ করছে। ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নিচের দিকে নামছে। বেশ খানিকটা ঝাঁকুনি খেয়ে আবার শান্তভাবেই বিমান নিচের দিকে নামতে লাগল। এরা তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে আনছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের কোন এয়ারপোর্ট এটা? সমুদ্র দেখে তিনি অনুমান করতে পারলেন যে এটা করাচি। বিমান অবতরণ করে দৌড় ধরল। শেষে গাড়ির মতো চলে যথাস্থানে থামল। বেশ খানিকক্ষণ তিনি বসে রইলেন আসনে।

পরে দরজা খুলে গেল। সিঁড়ি বেয়ে নেমে তিনি সৈন্যভরা গাড়িতে উঠে টার্মিনালের ভিআইপি লাউঞ্জে গেলেন। বাইরে আকাশে তীব্র রোদ।

তাঁকে বসানো হলো সোফায়। তারপর এল ক্যামেরাম্যান। তাঁর ছবি তোলা হলো। তাঁকে কফি পান করতে দেওয়া হলো। এরপর আবারও একটা সামরিক বিমানে তোলা হলো তাকে। নেওয়া হলো রাওয়ালপিন্ডিতে। সেই প্লেন থেকে নামিয়ে একটা হেলিকপ্টারে তোলা হলো তাকে। এক ঘণ্টার মতো উড়ে হেলিকপ্টার সোজা গিয়ে নামল একটা কারাগারের ভেতরে।

শেখ মুজিবকে নেওয়া হলো একটা ছোট্ট ঘরে। সেই ঘরে একটামাত্র ছোট্ট গবাক্ষ। একটা নোংরা বিছানা। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। নিঃসঙ্গ কারাবাসের অভিজ্ঞতা তার আছে? তাই বলে এই রকম একটা বদ্ধ কেটলির মতো ঘরে! তিনি তাকিয়ে দেখলেন, ঘরে কোনো ফ্যানও নেই। আর ততক্ষণে প্রচণ্ড গরমে তাঁর সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাঁকে এই প্রকোষ্ঠের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো।

তিনি স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর নোংরা বিছানাতেই বসলেন। গায়ের কোটটা খুললেন। একটু পর লোহার দরজা খোলা হলো।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, বঙ্গবন্ধুরে লওয়া হয় পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে।

ব্যাঙ্গমি বলল, নারীদের কারাগারের পাশে তার লাইগা একটা বিশেষ সেল তৈরি করা হয়।

ব্যাঙ্গমি বলল, একটা ছোট্ট ঘরে রাতের বেলা তালা বন্ধ কইরা রাখা হইত তারে।

ব্যাঙ্গমা বলল, দিনের বেলা একটা সময় তারে হাঁটার সুযোগ দেওয়া হইত। সেই জায়গাটাও আছিল উঁচা দেওয়াল দিয়া ঘেরা। চল্লিশ ফুট বাই দশ ফুট একটা জায়গায় তিনি হাঁটতেন।

ব্যাঙ্গমি বলল, বাথরুম আছিল নোংরা।

পুরা জায়গার বাতাস থিকাথিকা হইয়া আছিল শুকনা মলমূত্রের গন্ধ। দিয়া।

তার সেলের চারপাশে থাকত সৈন্যদের সশস্ত্র পাহারা।

কেউ তার সাথে কথা কইত না। তিনিও কারও লগে কথা কইতেন না। খাওয়াদাওয়া আছিল খুবই খারাপ।

২৪

ব্যাঙ্গমা বলল, ইতিহাসের মধ্যে কতকগুলান সুইট কো-ইনসিডেনস ঘটে।

ব্যাঙ্গমি বলল, এই যেমন এখন ঘটল।

ব্যাঙ্গমা বলল, হ। এই যেমন এখন ঘটল। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান এবং আনিসুর রহমান আর্মির তাড়া খাইয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া হইয়া আগরতলা গেলেন। সেইখান থাইকা প্লেনে তুইলা আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী তাগো লইয়া আইলেন দিল্লি। আর ব্যারিস্টার আমীর আর তাজউদ্দীন চুয়াডাঙ্গা দিয়া বর্ডার পার হইয়া কলকাতা দিয়া আইসা হাজির হইলেন দিল্লি। তাগো লইয়া গেলেন বিএসএফ প্রধান রুস্তমজি। এই চারজনের দেখা হইয়া গেল।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করে :

তাজউদ্দীন আহমদ কী করে সীমান্ত অতিক্রম করলেন, সেটা আমরা মোটামুটি জানি। রেহমান সোবহান আর আনিসুর রহমানের বর্ডার পার হওয়ার গল্পটা স্মরণ করা যেতে পারে।

.

২৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় কারফিউ স্থগিত করা হলে রেহমান সোবহানের গুলশানের বাড়ি গিয়ে হাজির হন মোজাফফর ন্যাপের পক্ষ থেকে সত্তরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌকা মার্কার কাছে পরাজয় বরণ করা ৩৬ বছর বয়সী সাংবাদিক, লেখক কাম রাজনীতিবিদ মঈদুল হাসান। রেহমান সোবহানের ফোরাম পত্রিকায় তিনি ৩১ জানুয়ারি ১৯৭০ লেখেন দ্য স্ট্র্যাটেজি ফর ইকোনমি শীর্ষক প্রবন্ধ। ফোরাম পত্রিকার সম্পাদক রেহমান সোবহান বেঁচে আছেন কি না, থাকলে তাকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, এই হলো মঈদুল হাসানের আগমনের উদ্দেশ্য। রেহমান সোবহান বাইরে ছিলেন, তিনি না আসা পর্যন্ত মঈদুল অপেক্ষা করেন।

তিনি এলে মঈদুল তাকে বললেন, তোমাকে এখনই বাড়ি ছাড়তে হবে!

রেহমান সোবহান, দুই অর্থনীতি তত্ত্বের প্রবক্তা, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, স্বাধীন বাংলাদেশের তাত্ত্বিক রূপরেখা নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও পরামর্শে যিনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন, যার বাবা মুর্শিদাবাদের বাঙালি, মা লক্ষ্ণৌর। ড. রেহমান সোবহান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মায়ের সূত্রে তিনি খাজা পরিবারের আত্মীয়, খাজা নাজিমউদ্দিন তাঁর নানির ভাই। রেহমান সোবহান বললেন, আমাকে কেন বাড়ি ছাড়তে হবে?

কারণ, পাকিস্তানি আর্মি নির্বিচার মানুষ খুন করছে। আবার তালিকা ধরে খুঁজে খুঁজেও মানুষ মারছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জি সি দেব, মনিরুজ্জামানসহ অনেক অধ্যাপককে মেরেছে। শোনা যাচ্ছে, রাজ্জাক স্যারকেও মেরে ফেলেছে। তোমাকে মারবে না কেন? তুমি তো শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠজন।

আমাকে মারবে না কারণ, আমি রাজনীতি করি না।

জি সি দেব স্যারও রাজনীতি করতেন না।

আমার ধারণা তারা ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগারদের খুঁজবে। গুলশান এলাকায় আসবে না।

আমি তর্ক করব না। আমি শুধু একটা কথা বলব, তুমি যদি বাঁচতে চাও, তুমি আমার সঙ্গে এখনই গাড়িতে ওঠো। একমুহূর্তও দেরি করা চলবে না।

রেহমান সোবহান তার স্ত্রী সালমার সঙ্গে কথা বলে নিজের কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে মঈদুলের গাড়িতে উঠলেন।

মঈদুল তাকে নিয়ে গেলেন সিধু মিয়ার গুলশানের বাড়িতে।

.

এইখানে আবার ব্যাঙ্গমা কথা বলে উঠল, সিধু মিয়া হইলেন মোখলেসুর রহমান সিধু। রংপুর থাইকা আসা মানুষটা ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ভাই, তথ্যের খাতিরে এইটাও উল্লেখ করতে হয়। তিনি আছিলেন সফল ব্যবসায়ী, আর প্রগতিশীল সংস্কৃতিসংগঠক। ছায়ানটের তিনি অন্যতম। উদ্যোক্তা।

.

ব্যাঙ্গমি বলে, এইটাও কইয়া ফেলা ভালো যে ফ্যাশন-উদ্যোক্তা মডেল হিসেবে যিনি স্বাধীনতার পরে নব্বইয়ের দশকে দেশে-বিদেশে বিখ্যাত হইবেন, সেই বিবি রাসেলের তিনি বাবা।

.

সিধুর স্ত্রী রোজ। এই এক আশ্চর্য মানবী। একাত্তর সালের এই ঘোর দুঃসময়ে তাদের বাড়িতে পলায়নপর মানুষেরা আশ্রয় নিয়ে কেবল ঘর ভরে তুলেছিল তা নয়, রোজ নিজে গাড়ি চালিয়ে শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর মতো মানুষদের বর্ডার পার করিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।

সিধু মিয়া বললেন, আমাদের বাসা আপনার জন্য নিরাপদ না। আপনারা এক কাজ করুন, নদী পার হয়ে রোজের বাপের বাড়ি বেরাইদে চলে যান। আমি সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি।

রোজ ড. রেহমানকে খাইয়েদাইয়ে রওনা করিয়ে দিলেন।

পথে নেমে রেহমান সোবহান দেখতে পেলেন, পুরা পথই জনস্রোত। শত শত মানুষ হেঁটে, রিকশায় যে যেভাবে পারছে শহর ছাড়ছে। তিনি জনস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন।

মানুষের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে রেহমান পেয়ে গেলেন আরেক অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনিসুর রহমানকে।

তিনি কথা বলে উঠলেন, ড. আনিস!

সোবহান।

আপনিও ঢাকা ছাড়ছেন?

সোবহান জানেন না আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে কী হয়েছে? কোনোরকমে বেঁচে গেছি স্যার। জাস্ট একটা তালার জোরে।

মানে?

জানেনই তো আমাদের কোয়ার্টারে দুটা করে দরজা সামনের দিকে। একটা দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে আরেকটা দরজায় ছিটকিনি দিয়ে রেখেছিলাম। ২৫ তারিখ রাতে তারা বিল্ডিংয়ে আসে। নিচের তলার বাসিন্দা জি সি দেব, ওপরের তলার অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে গুলি করে মেরে ফেলে।

কোন মনিরুজ্জামান?

স্ট্যাটিস্টিকসের। সম্ভবত তারা নাম গুলিয়ে ফেলেছে। তারা বাংলার মনিরুজ্জামানকে খুঁজতে এসে স্ট্যাটিস্টিকসের নিরীহ মনিরুজ্জামানকে মেরে ফেলেছে।

রাজ্জাক সাহেব কি বেঁচে আছেন?

হ্যাঁ। তার ফ্ল্যাটে সৈনিকেরা নক করে। তিনি দরজা খুলতে দেরি করেন। অধৈর্য সৈন্যরা বাড়িতে কেউ নেই ভেবে চলে যায়।

আর আপনারা কীভাবে বাঁচলেন?

আমার বাড়িতে তালা দেখে তারা আর নক করেনি। আমরা সারা রাত মেঝেতে শুয়ে ছিলাম। ২৫ মার্চ-২৬ মার্চ এইভাবেই কেটেছে। কারণ, মিলিটারি আবার এসে লাশগুলো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে।

রোজের বাবা মতিন সাহেবের বেরাইদের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান। সেখানে ভিড়। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা মানুষেরা সিধু ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন।

এর মধ্যে পাওয়া গেল টেলিভিশনের প্রযোজক মুস্তাফা মনোয়ারকে।

এখন প্রশ্ন, তাঁরা কি ঢাকা ফিরে যাবেন নাকি অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকবেন। তখনই খবর এল, রেহমান সোবহানের বাড়ি মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। এরপর আর ঢাকা ফেরার প্রশ্নই আসে না। সাব্যস্ত হলো, তাঁরা আগরতলা যাবেন।

৩০ মার্চ তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হলেন। রেহমান সোবহানকে। বলা হলো লুঙ্গি পরতে হবে। রেহমান সোবহান জীবনে কোনো দিন লুঙ্গি পরেননি। এই সমস্যার সমাধানে রোজ তাকে একটা বেল্ট এনে দিলেন। রেহমান সোবহান ওপরে খদ্দরের একটা কুর্তা, নিচে চকচকে নতুন লুঙ্গি, কোমরে বেল্ট পরে যাত্রারম্ভ করলেন। তিনি বেরোনোর আগে আয়নায় নিজেকে দেখে আনিসুর রহমানকে বললেন, আনিস, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে।

আনিস সেই দুঃখের মধ্যেও হাসি সংবরণ করতে পারলেন না।

রেহমান বললেন, আমি আপনার হাসির কারণ জানি। আমাকে পুরান ঢাকার কসাই সরদারদের মতো দেখা যাচ্ছে।

সিধু ভাই নিজে তাঁদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন। রেহমান, আনিস, মুস্তাফা মনোয়ারের সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসেবে রইলেন দুজন, কলেজছাত্র রহমত উল্লাহ, আর স্কুলশিক্ষক আ. রশিদ।

ব্যাঙ্গমা বলবে, এই রহমত উল্লাহ ১৯৮৬ সাল থাইকা চারবারের এমপি রহমত আলী।

তাঁরা নৌকায় নদী পার হলেন, তারপর বাসে চড়ে চললেন নরসিংদী। বাসেও পলায়নপর মানুষ সব। নরসিংদী থেকে তারা উঠলেন লঞ্চে। যাবেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কিন্তু লঞ্চেই রেহমান সোবহানের অদ্ভুত পোশাক, অতি ফরসা লম্বা দেহাকৃতি যাত্রীদের সন্দেহের উদ্রেক করে। এদিকে আনিসুর রহমানের পরামর্শে তারা নাম বদলে ফেলেছেন, আনিস হয়েছেন আবদুর রশীদ, আর রেহমান সোবহানের নতুন নামকরণ করা হয়েছে দীন মোহাম্মদ। দীন মোহাম্মদ নিজের নাম মনে রাখতে পারছেন না। তার ওপর তিনি কথা বলতে পারেন ইংরেজিতে, ছোটবেলায় পড়েছেন দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে, আর তার মা উর্দুওয়ালা। তিনি কথা বলতে পারেন উর্দুতেও। মুখ খুললেই তিনি ধরা পড়ে যাবেন যে তিনি বাংলাভাষী নন। আবার নিজেদের পরিচয়ও তারা ঠিকমতো দিতে পারছেন না এই জন্য যে লঞ্চে পাকিস্তানি চর থাকতে পারে।

উত্তেজিত জনতা তাকে একটা ঘাটে নামিয়ে নিল। সঙ্গে আনিসুর রহমান এবং মুস্তাফা মনোয়ারও আছেন। কথাবার্তায় সন্দেহজনক এই লোকগুলো নিশ্চয়ই পাকিস্তানি চর, কাজেই এদের মুখ খোলাতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে মাইরের ওপরে ওষুধ নাই। আনিসুর রহমানের ওপরে পড়ল কয়েক ঘা, রেহমান সোবহানের মুখে একটাই আঘাত পড়েছিল, তা-ই তার জন্য যথেষ্ট ছিল, কারণ এরপর তিন দিন তিনি ভাত চিবুতে পারেননি। ঘা খেয়েই আনিসুর রহমান মুখ খুললেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুধু মুখ খুললেন না, তিনি গলাও খুললেন। রবীন্দ্রসংগীত জানেন ভালো, তিনি গলা ছেড়ে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন যে তিনি বাঙালি। মুস্তাফা মনোয়ার বললেন, এদের আমি ভালো করে চিনি, তোমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ছাত্রকে ডেকে আনো, তাহলে জানবে যে এঁরা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই নন, শেখ সাহেবের অতিঘনিষ্ঠ সহকর্মী। এই সময় অক্সফোর্ড প্রেসের একজন পিয়ন রেহমান সোবহান স্যারকে চিনতে পারল। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র ঘটনার বিবরণ শুনে দৌড়ে চলে এসেছে, কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, বাংলা বলতে না পারা লম্বা-ফরসা মানুষটি আর কেউ নন, তাদের প্রিয় শিক্ষক রেহমান সোবহান। তারা এসে বলল, ভাই, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ লোক, আওয়ামী লীগের নেতা এঁরা দুজন। আপনারা এঁদের কাছে মাফ চান। তখন তাদের জনতা ঘাড়ে তুলল, ফুলের মালা পরাল এবং ঘাড়ে করেই নিয়ে গেল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে। কিন্তু এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ল যে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে এসেছেন। শত শত মানুষ শেখ মুজিবের নামের মোহে বাড়িতে ছুটে এসে আরেক দৃশ্য রচনা করে ফেলল।

এরপর দুই ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনজন নৌকায় করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালেন। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো তিতাস গ্যাসের গেস্টহাউসে। সেখানে রেহমান সোবহান, আনিস, মুস্তাফা মনোয়ার দেখতে পেলেন হলিউডের এক হিরোকে। হাফহাতা চেক শার্ট, খাকি প্যান্ট, কোমরে পিস্তল, বছর ত্রিশের এক যুবক। তাঁর পরিচয় জানা গেল। মেজর খালেদ মোশাররফ।

তিনি এসে নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, ঢাকায় সেনা আক্রমণের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ান কমান্ডিং অফিসারসহ আরও দুজন অফিসারকে গ্রেপ্তার করেন। তাদের বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁদের জিপে করে নিয়ে গেলেন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের গেস্টহাউসে। গাছগাছালির নিচে এই জায়গাটাকে তিনি হেডকোয়ার্টার বানিয়েছেন, যাতে বিমান হামলা না হতে পারে।

রাতের বেলা, চা-বাগানের ঝিঁঝিডাকা বারান্দায় বসে, চা পান করতে করতে এই তিনজন শুনলেন খালেদ মোশাররফের কাহিনি।

খালেদ বললেন, কুমিল্লায় সব বাঙালি অফিসার সৈনিকদের পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।

বললেন, আমরা কিন্তু পাকিস্তানের চোখে বিদ্রোহী, অভ্যুত্থানকারী। কাজেই আমাদের ফেরার আর কোনো পথ নেই। একমাত্র উপায় হলো, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা। কিন্তু শুধু সৈনিকেরা যুদ্ধ করলে কোনো লাভ হবে না। রাজনৈতিক সরকার দরকার। আপনার কাইন্ডলি আগরতলা যান। সেখানে নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা যেন একটা বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। আরেকটা কথা। সেই সরকার যেন আমাদের মিলিটারিদের তাদের সরকারে আবার রিক্রুট করে। তাহলে আমরা একটা বৈধ সেনাবাহিনীর লোক হিসেবে গণ্য হব। আমাদের বিদ্রোহ তখন বিদ্রোহ থাকবে না, হবে যুদ্ধ। আমরা জেনেভা কনভেনশনের গ্যারান্টি পাব। তা না হলে ঢাকায় আমাদের পরিবার-পরিজন আছে, কারোরই নিরাপত্তা থাকবে না। দ্বিতীয় আমাদের যে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আছে, তা দিয়ে বেশি দিন আমরা পাকিস্তানি মিলিটারিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। আমাদের যেন আর্ম অ্যান্ড অ্যামুনিশেন ঠিকভাবে দেওয়া হয়।

রেহমান সোবহান একটা কাগজে পুরোটা নোট নিলেন।

আগরতলায় পৌঁছালেন তারা। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সভাপতি এম আর সিদ্দিকীর। তাঁকে ধরেছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লি চলুন। শরণার্থীতে আগরতলা ছেয়ে যাচ্ছে। দিল্লিকে বোঝাতে হবে পূর্ব বাংলার আসল চিত্র। এম আর সিদ্দিকী বলছেন, আমি তো এর আগে দিল্লি যাইনি। আর আমি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতিমাত্র, আমি কী করে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করব? দুই অর্থনীতিবিদকে পেয়ে তিনি পায়ের তলায় মাটি পেলেন। তিনি বললেন, আপনারা আমার সঙ্গে চলুন দিল্লি।

নিজেদের দরিদ্র বেশ ছেড়ে তারা ধার করা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে দাড়ি কামিয়ে স্নান করে বিমানে উঠে পড়লেন। ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অশোক মিত্রের মাধ্যমে তারা গেলেন ভারতের। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ডান হাত, মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের বাড়িতে। হাকসার সম্পর্কে রেহমান সোবহান আগে থেকেই ধারণা রাখেন। তাঁকে সমীহই করেন। তিনি কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ, বামপন্থী। সোভিয়েতঘেঁষা। ১৯৩০-এর দশকে লন্ডনে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর পড়াশোনা, বিদ্যা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতার কথা প্রবাদের মতো ছড়িয়ে আছে, যা রেহমান সোবহানের ভালোমতোই জানা। ড্রয়িংরুমের নরম গদিওয়ালা বিশাল সোফায় বসে আসামিজ চা খেতে খেতে হাকসার বললেন, কী হলো বলুন তো!

আনিসুর রহমান প্রথমে মুখ খুললেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি ইউনিভার্সিটিতে আমাদের কোয়ার্টারে এল। দরজায় নক করে মেরে ফেলল প্রফেসর জি সি দেবকে। মেরে ফেলল প্রফেসর মনিরুজ্জামানকে। আমরা দুই রাত মেঝেতে লুকিয়ে থাকলাম। তারা কামান দাগাল ইকবাল হলে। জগন্নাথ হল থেকে বের করে নিয়ে গেল ছাত্র-শিক্ষকদের। মাঠে নিয়ে গিয়ে লাইন করে গুলি করে মারল।

রেহমান সোবহান বলতে শুরু করলেন গোটা কাহিনির প্রেক্ষাপট, নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। আলোচনা শুরু হলো। ইয়াহিয়া খান এলেন। অ্যাসেম্বলি অধিবেশন বাতিল করা হলো। আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিজের হাতে তুলে নিল। পুরো বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ শেখ মুজিবের কথায় চলল।

তারপর রাতের অন্ধকারে প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেলেন। লোকালয়ে ঢুকে কামান, ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ চালানো হলো নিরস্ত্র মানুষের ওপর। পুলিশ, ইপিআর ঘাঁটিতে গিয়ে কামান দেগে ঘুমন্ত পুলিশ, ইপিআরদের হত্যা করা হলো। বস্তিতে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। হাকসার বলতে লাগলেন, কী বলছেন এসব?

হাকসার বলতে লাগলেন, কী বলছেন এসব?

রেহমান সোবহান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, পাশের দেশ পূর্ব বাংলায় কী হচ্ছে, এরা কত কম জানেন!

হাকসার জিজ্ঞেস করলেন, শেখ সাহেবের পরে আওয়ামী লীগের নেতা কে? হু ইজ নাম্বার টু ইন আওয়ামী লীগ?

রেহমান সোবহান বললেন, শেখ সাহেবের ডান হাত হলেন তাজউদ্দীন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

কী নাম বললেন?

তাজউদ্দীন।

হাকসার নামটা নোট করে নিলেন।

আর কে আছে?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সহসভাপতি, আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুজ্জামান। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। আর খন্দকার মোশতাক। এঁদেরকে বলা হয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তবে যদি একটা নাম চান, আমি বলব তাজউদ্দীন। আনিসুর রহমান বললেন।

রেহমান সোবহানও মাথা নাড়লেন, শেখ সাহেবের পরে সবচেয়ে যোগ্য, মেধাবী, পরিশ্রমী আর ডেডিকেটেড তাজউদ্দীন। শেখ সাহেব তার ওপরে ভরসা করতেন।

ওকে। কালকে আপনাদের সকালে এক জায়গায় যেতে হবে। রেডি থাকবেন।

পরের দিন সকালবেলা একটা গাড়ি এল, এলেন একজন ভারতীয় কর্মকর্তা। আপনাদের একটা বাড়িতে নিয়ে যাব। চলুন।

তারা চড়লেন গাড়িতে। অ্যাম্বাসেডর গাড়ি মেড ইন ইন্ডিয়া, একটু ঝরঝরে ধরনের হলেও শক্তপোক্ত, ভেতরে জায়গাও বেশ। যে বাড়িটিতে তারা গেলেন সেখানে ঢুকে রেহমান সোবহান আর আনিসুর রহমানের মুখটা প্রশান্তির হাসিতে ভরে উঠল। তাঁদের সামনে বসে আছেন তাজউদ্দীন আহমদ।

তাজউদ্দীন আহমদকে তারা জড়িয়ে ধরলেন। তাঁরা বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, আপনি এসে গেছেন। আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু আপনার সঙ্গে উনি কে?

আমি আমীর। ব্যারিস্টার আমীর!

রেহমান সোবহান বললেন, তোমার পাইরেট মার্কা দাড়ি-গোঁফ কই গেল?

পালিয়ে আসার জন্য হেঁটে ফেলতে হয়েছে। আমীর জানালেন।

.

রেহমান সোবহান আর আনিসুর রহমান জানতেন না, তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাদের এই দেখাটা ইগলের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন ভারতের কর্মকর্তারা। তাজউদ্দীনই এই লোক কি না, আর তিনি আসলেই শেখ সাহেবের ডান হাত কি না, তারা যাচাই করছেন। তাঁরা এ-ও জানেন না, আগরতলা হয়ে দিল্লি আসা আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের কাছ থেকেও তাজউদ্দীন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।

তাঁরা সবাই তাজউদ্দীন সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন আর তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।

দিনের বাকি সময়টা তাজউদ্দীন, আমীর, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান একসঙ্গে কাটালেন।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, তাজউদ্দীন আর আমীর ক্যামনে আইল দিল্লি সেইটার একটু বিবরণ দেও।

ব্যাঙ্গমি বলল, কথাটার কী মানে? তারা আইছে বিমানে।

ব্যাঙ্গমা বলল, তারপরও কোন বিমান, কেমন তার ব্যবস্থা, কয় তারিখে উড়াল দিলেন, কও না গো।

.

তাজউদ্দীন আর আমীর দিল্লি এসেছেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটা কার্গো বিমানে চড়ে। ১ এপ্রিল ১৯৭১-এ। তাদের সঙ্গে একই বিমানে এসেছেন। বিএসএফের গোলোক মজুমদার। বিমানে ওঠার আগেই দুজনকে দেওয়া হয়েছে একটা স্যুটকেস, একটা ব্যাগ। সে দুটোয় আছে কাপড়চোপড়, খাতা কলম, তোয়ালে, সাবান। রাত ১০টায় তাদের কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে আনা হয় গোপনে। মালবাহী বিমানে উঠতে হয়েছে মইয়ে করে। বসার জন্য দেওয়া হয়েছে মালবহনকারী বিশাল গহ্বরে দড়ির বানানো আসন। তাতে বসতে হবে ক্যানভাসের বেল্ট পরে। তাদের আসনের পরে বেশ কিছু মালপত্র। তারপর পেছনের পুরোটা খোলা। ভীষণ গরম। পুরোনো রুশ বিমান আকাশে উঠল পুরো পৃথিবীকে জানান দিয়ে যে আমি উঠছি। কানে তালা লাগার উপক্রম এর শব্দে। তাজউদ্দীন আর পারলেন না। বিমানের মেঝেতে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। দেখাদেখি আমীর-উল ইসলামও তাঁর পাশে শয্যা নিলেন। সারা রাত ধরে বিমান চলল। ভোরে তাঁরা পৌঁছলেন দিল্লির সামরিক বিমানঘাঁটিতে। সেখান থেকে তাদের আনা হলো বিএসএফের একটা অতিথিশালায়।

তাজউদ্দীন বললেন, মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আমাদের বৈঠক হবে। আমি সেখানে নিজেকে কী বলে পরিচয় দেব?

ব্যারিস্টার আমীর বললেন, আপনি বলবেন, শেখ সাহেব ২৫ মার্চ রাতে আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বাধীনতাসংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেখ সাহেবের অনুপস্থিতিতে আপনিই তাঁকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।

কিন্তু আমি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় নেতা নই। সৈয়দ নজরুল সাহেব আছেন। তিনি আমাদের পার্লামেন্টারি পার্টির ডেপুটি লিডার। হেনা ভাই অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আমি তো কেবল আঞ্চলিক সাধারণ সম্পাদক। সিনিয়রিটির দিক থেকে মোশতাক সাহেব, মনসুর আলী সাহেব আমার চেয়ে এগিয়ে। নজরুল সাহেব, মনসুর আলী। সাহেব, মোশতাক–তারা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁরা মুজিব ভাইয়েরও ঘনিষ্ঠ।

আমীর বললেন, আপনি অবশ্যই নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেবেন। প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যদি অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। তাহলে আর সমস্যা হবে না।

আনিসুর রহমানও একমত হলেন। তাঁরা ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান। প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গোপনে অনেক কাজ করেছেন। তারা জানেন বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের ওপরে কতটা নির্ভর করতেন। তাজউদ্দীনকে তিনি কতটা স্নেহ করতেন, কতটা বিশ্বাস করতেন।

এটাই ঠিক হলো। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেবেন। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট।

তাজউদ্দীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মুজিব ভাই যে কোথায় আছেন, কেমন আছেন! আজকে মুজিব ভাই থাকলে কি আমাকে এই কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হতো?

২৫

ইন্দিরা গান্ধীর ঘুম ভেঙেছে ভোরবেলা। তিনি তাড়াতাড়িই বিছানা ছেড়েছেন। রোজ যেমন ছাড়েন। চোখমুখ ধুয়ে তিনি এক গেলাস পানি পান করলেন। খালি পেটে পানি পান করা তাঁর শান্তিনিকেতনের দিনগুলো থেকে অভ্যাস। দিল্লির প্রধানমন্ত্রীর সাদা বাংলোর বারান্দায় তিনি এসে একটা চেয়ারে বসলেন।

একটু পরে সূর্য উঠবে। আকাশ ভরসা হতে শুরু করেছে। দিল্লির এই জায়গাটা গাছগাছালিতে ঢাকা। বিশেষ করে তার এই বাড়িটা। অনেক পাখি। আসে বাড়িটাতে। তারা ডাকতে শুরু করেছে। পাখিডাকা ভোর।

তার মাথাটা ধরা ধরা। রাতে ঘুম ভালো হয়নি। পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত।

সকালের নাশতাটা তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে করেন। রাজীব আছে, তাঁর ইতালিয়ান স্ত্রী সোনিয়া আছে, তাদের দুধের শিশু রাহুল আছে। সঞ্জয় আছে। সোনিয়া তো শাড়ি পরে রীতিমতো ভারতীয় বনে গেছে।

স্নান সেরে সুন্দর শাড়ি পরে নাশতার টেবিলে এলেন সোনিয়া। পরিচারিকা রাহুলকে নিয়ে কাছে এল। সোনিয়া আশা করছেন, ইন্দিরা মা-জি রাহুলকে এখন কিছুক্ষণ কোলে রাখবেন। কিন্তু ইন্দিরা মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। কাগজে পূর্ব পাকিস্তানের খবর বড় বড় করে ছাপা হয়েছে।

ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব বাংলা নিয়ে সত্যি চিন্তিত। কতগুলো বাস্তব সমস্যা আছে। এক হলো পশ্চিম বাংলায় নকশালরা খুবই যন্ত্রণা করছে। চীন তাদের সমর্থন দিচ্ছে। এখন পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার সংগ্রামে চলে গেলে দুই বাংলা না। চীনা বিপ্লবীদের চারণক্ষেত্র হয়ে যায়। বাংলা চিরকালই বিদ্রোহের জায়গা। বিপ্লবের সূতিকাগার। দুই হলো, পাকিস্তান জাতিসংঘের সদস্য। এখন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে ভারত কিছু করতে গেলেই সেটা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে গণ্য হবে। পাকিস্তান অবশ্য মিজো গেরিলাদের সাহায্য করে। ট্রেনিং দেয়। অস্ত্র দেয়। সেই রকমভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সীমিত আকারে ট্রেনিং অস্ত্র দেওয়া যেতে পারে। বিএসএফের মাধ্যমে করা হবে তা। আপাতত সেটাই নির্দেশ। এর। চেয়ে বেশি কিছু কি করা যেতে পারে? আরেকটা সমস্যা আছে। কাশ্মীর। আজকে তারা যদি পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে আলাদা হতে সাহায্য করেন, তাহলে কাশ্মীরকে আজাদ করতে কি পাকিস্তান চাইতে পারে না? সমস্যা হচ্ছে, দেশের ভেতরে বাংলাদেশকে সাহায্য করার প্রচণ্ড চাপ। বিরোধী দলগুলো বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত সংগঠিত করছে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ইন্দিরা একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। বিরোধীদের পায়ের নিচের মাটি নরম। তারা সেটাকে শক্ত করার জন্য বাংলাদেশ ইস্যুকে ব্যবহার করতে চাইছে। তাই ৩১ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় একটা সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হতে দিয়েছেন; তাতে বলা হয়েছে : এই আইনসভা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক উত্থান বিজয়ে রূপ নেবে। এই আইনসভা তাদের আশ্বস্ত করতে চায় যে তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি ভারতের জনগণের হৃদয় থেকে উৎসারিত সহানুভূতি ও সমর্থন রয়েছে।

রাজীব এসেছেন। সঞ্জয় এসেছেন। টেবিলে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হচ্ছে। উর্দি পরা আরদালি পরিবেশন করছে। ইংলিশ ব্রেকফাস্ট।

ইন্দিরা গান্ধীর সেদিকে মন নেই। আজকে আওয়ামী লীগের নেতা আসবেন। তাঁর নাম তাজউদ্দীন। তাঁর সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতিবেদন দিয়েছে। তিনি সেটা পড়তে আরম্ভ করলেন।

তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে গাড়ি ১ নম্বর সফদরজঙ্গ সড়কের বাড়ির

জানালেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে না এনে তাঁকে বাসভবনে আনার সিদ্ধান্তও ভেবেচিন্তে নেওয়া। বাড়ি হলো অনানুষ্ঠানিক জায়গা। অফিস হলো অফিশিয়াল। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের একজন প্রতিনিধিকে তিনি এখনই অফিশিয়ালি অভ্যর্থনা করতে পারেন না।

তাজউদ্দীন বৈঠকখানায় বসামাত্র ইন্দিরা গান্ধী জিজ্ঞেস করলেন, শেখ মুজিব কেমন আছেন?

সোফায় বসে আছেন রুস্তমজি, পি এন হাকসার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মি. জগজীবনরাম আর র-এর শংকরণ আয়ার (কর্নেল মেনন)।

তাজউদ্দীন বললেন, তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছে ২৫ মার্চ রাতে। আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বাড়ি থেকে চলে আসতে বললেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এরপর তো শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি মিলিটারির নৃশংস আক্রমণ। হাজার হাজার মানুষকে বিনা বিচারে গুলি করে মারল। পুলিশ, ইপিআর, বিশ্ববিদ্যালয়, বস্তি, বাড়িঘরে কামান দাগাল, আগুন দিল, মানুষ মেরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল। ২৭ মার্চ কারফিউ উইথড্র হলে আমি বর্ডারের দিকে রওনা হলাম। তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি।

আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।

আমরাও খুব চিন্তিত। তবে তিনি আমাদের সরকার গঠন করতে বলেছেন। আওয়ামী লীগের একটা হাইকমান্ড আছে। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবসহ মোট ৫ জন। আমাদের এই ৫ জন মিলেই আমাদের বাংলাদেশ সরকার। আমাদের বাঙালি সৈনিক, পুলিশ, আনসার, ইপিআর, ছাত্র-জনতা প্রতিরোধযুদ্ধ করছে। দেশের বহু এলাকা এখনো আমাদের দখলে। তবে আমাদের হাতে অস্ত্র আর গোলাবারুদ নেই। ভারত যদি আমাদের স্বীকৃতি দেয় এবং অস্ত্র, গোলাবারুদ দেয়, তাহলে আমরা অল্প কদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি মিলিটারিকে পরাজিত করব এবং দেশ শত্রুমুক্ত করতে পারব।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনাদের বিজয়ের জন্য আমরা সম্ভবপর সবকিছু করব। আপনারা সরকার গঠনের ব্যাপারটা ঠিক কী করবেন, ঠিক করে কালকে আবার আসুন।

.

সেদিন রাতের খাবারের সময়ও ইন্দিরা গান্ধী অন্যমনস্ক রইলেন।

সোনিয়া বললেন, মা-জি, খুব বড় কোনো সমস্যা?

ইন্দিরা হাসলেন। হাসি তার মুখে কমই দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই অসুখে ভুগেছেন। লন্ডন থেকে চিকিৎসার জন্য বারবার তাঁকে সুইজারল্যান্ড যেতে হতো। অক্সফোর্ডের পরীক্ষায় তিনি পাস করতে পারতেন না। সব সাবজেক্টে ভালো করতেন। ল্যাটিন পরীক্ষায় ফেইল। সব সাবজেক্টে পাস না করলে সে ছাত্র পাস করে না। ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে মেলামেশার দিন কটাতেই তাকে হাসিখুশি দেখা যেত। তাঁর কৈশোরেই, ১৩-১৪ বছর বয়সে ফিরোজের সঙ্গে তার দেখা হয়। ২৬ বছর বয়সে, আজ থেকে ৩০ বছর আগে ফিরোজ তাকে প্রপোজ করে। সেটা ছিল প্যারিসে মমার্তের সিঁড়িতে। ফিরোজ পারসি। ফ্যামিলির প্রবীণেরা আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, ও তোমাকে খাওয়াতে পারবে কি? আহা। ফিরোজও অল্প বয়সে চলে গেলেন। ছেলেরা তাঁকে মিস করে। ইন্দিরা ছোটবেলায় পুতুল নিয়ে খেলতেন। তবে সেই পুতুলেরা বিদ্রোহ করত। জেলে যেত। স্লোগান দিত। ইন্দিরা কিন্তু অনেক ছেলেমেয়ে চেয়েছিলেন। ১০টা-১২টা। ফিরোজই চায়নি। ইন্দিরা বলেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত হলো রাজীবের জন্মের মুহূর্তটি। ১৯৪৪ সালে রাজীব জন্ম নেয়। তখন ইন্দিরার বয়স ২৭। এখন, ১৯৭১ সালে, ইন্দিরার বয়স ৫৪।

সোনিয়ার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, সমস্যা ভাবলেই সমস্যা। যা তোমাকে মেরে ফেলছে না, তা তোমাকে স্ট্রং করবে। যেকোনো দুর্যোগই একটা সুযোগ। কোনো অসুবিধা নেই। আমাকে আমার নাতিকে দাও। ওকে কি একটু স্যুপ খাওয়াব?

বলে তিনি হাত বাড়িয়ে রাহুলকে কোলে নিলেন। রাজীব এসে গেলেন। সঞ্জয়ও এলেন। সঞ্জয় কী একটা সবার জন্য গাড়ি প্রকল্প করছে। মারুতি গাড়ি কোম্পানির সঙ্গে কী একটা প্রকল্প করে এমডি হয়েছে। না জানি কোন ঝামেলায় সে জড়িয়ে পড়ে।

তিনি ভারতীয় নারীদের মতো অতিরিক্ত গল্পগুজব পছন্দ করেন না। মিটিংয়ের শুরুতে জিজ্ঞেস করেন না কে কেমন আছে, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, কাল ক্রিকেট খেলা কেমন জমেছিল। তিনি সরাসরি কাজের কথায় আসেন।

তিনি বললেন, এসো, আমরা ডিনার সেরে নিই।

.

তাজউদ্দীন দিল্লির বিএসএফের গেস্টহাউসের নিরাপদ গৃহে ফিরে এলেন। আনিসুর রহমান, রেহমান সোবহান, আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন সরকার গঠন করতে।

প্রেসিডেন্ট : শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাইস প্রেসিডেন্ট : সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ।

মন্ত্রী : ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ।

জাতীয় পতাকা : এটা নিয়ে ভাবতে হলো না। ছাত্ররা আগেই জাতীয় পতাকা বানিয়ে ফেলেছে, মুজিব ভাই সেটা উত্তোলন করেছেন, সেই পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করতে গেছেন। সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত, বৃত্তের মধ্যে সোনালি পূর্ব বাংলার মানচিত্র। পতাকার নকশা ভারতীয়দের আশ্বস্ত করল। কারণ তাতে পশ্চিম বাংলাকে যে নেওয়া হয়নি, তা স্পষ্ট।

জাতীয় সংগীত : এটাও বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই বাছাই করে রেখেছেন। তাঁর খুবই প্রিয় গান। সব অনুষ্ঠানে এটা গাইতে বলতেন। ৭ মার্চের জনসভাতেও এটা গাওয়া হয়েছে। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…

পরের দিন তাজউদ্দীন আহমদ আবারও গেলেন সফদরজঙ্গের ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে। ইন্দিরা প্রথম যে কথাটা বললেন, শেখ সাহেবকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তিনি মিলিটারি কাস্টডিতে আছেন।

তাজউদ্দীন আহমদের চোখে পানি চলে এল। মুজিব ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে?

তাজউদ্দীন বললেন, তাঁর মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতেও আপনার সাহায্য দরকার হবে।

বেশ খানিকক্ষণ আলাপ হলো। নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ফ্যামিলিতে কে আছে।

তাজউদ্দীন বললেন, আমার স্ত্রী আছে, চারটা ছেলেমেয়ে আছে। তিনটা মেয়ে। ছোটটা ছেলে। সবাই ছোট।

ইন্দিরা বললেন, তারা কোথায়?

আমি জানি না। আমি তাদের বলে এসেছি, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে। সবার যা হবে, তোমাদেরও তা হবে।

ইন্দিরা বললেন, আপনাদের ডেডিকেশনে আমরা ইমপ্রেসড। তবে সাংগঠনিকভাবে অনেক কাজ বাকি। আমরা আপনাদের সব রকমের সাহায্য করব।

আমরা সরকার গঠন করছি। শপথ নেব বাংলার মুক্তাঞ্চলে। রেডিওতে ভাষণ দেব। এরপর ভারত আমাদের স্বীকৃতি দেবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা।

আমরা সব করব। তবে একটার পর একটা। ঠিক যখন যা করার তা-ই করা হবে। আপনারা একদম এটা নিয়ে দুর্ভাবনা করবেন না। ঐক্য ধরে রাখুন, সব দলমতকে সঙ্গে নিন। শুধু বাইরের কোনো শক্তি যেন আপনাদের সংগ্রামকে হাইজ্যাক করতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ রাখবেন।

তাজউদ্দীন আশ্বস্ত হলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মন খুলেছেন।

.

তাজউদ্দীন বিএসএফের দিল্লির বাড়িতে বসে আমীর-উল ইসলাম, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমানদের বললেন, কাইন্ডলি একটা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুসাবিদা করুন।

আর আমি একটা রেডিও ভাষণ দেব। সেই ভাষণটাও তৈরি করে ফেলতে হবে।

আমীর-উল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা সামনে নিলেন। রেহমান সোবহান প্রজাতন্ত্রের আগে একটা গণ বসাতে অনুরোধ করলেন। বাংলাদেশের নাম রাখা হলো : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

দিল্লিতেই, বিএসএফের বাড়িতে, রেডিওর রেকর্ডার এল। তাজউদ্দীনের ভাষণ রেকর্ড করা হবে।

তাজউদ্দীন দুদিন ধরে বক্তৃতাটা তৈরি করেছেন। রেহমান সোবহান, আমীর, আনিসুর রহমানকে বারবার পড়িয়েছেন। রেহমান সোবহানের মনে হলো, ফাইনালি স্পিচটা এক্সিলেন্ট হয়েছে।

তাজউদ্দীন আহমদ রেকর্ডারের সামনে বসেছেন। তার সামনে বসে আছেন আকাশবাণীর একজন নারী কর্মী। তাজউদ্দীন এক গেলাস পানি খেয়ে নিলেন।

রেহমান সোবহান, আমীর, আনিস তাঁকে চোখের ইশারায় উৎসাহিত করছেন।

তাজউদ্দীন বললেন, আমি চিরটাকাল ড্রাফট করেছি। মাইক্রোফোনের সামনে গেছেন মুজিব ভাই। মুজিব ভাই থাকলে…

রেহমান সোবহান বললেন, আমি আপনার জনসভাতেও গেছি। আপনার এলাকায় আপনার ভাষণ শুনেছি। ইউ আর আ ভেরি গুড অরাটর। দেখে লিখিত ভাষণ পড়বেন। আরম্ভ করুন।

তাজউদ্দীন আরেক গেলাস পানি খেলেন। তাঁর মনে পড়ল, সত্তরের নির্বাচনের আগে মুজিব ভাই টেলিভিশন রেডিওতে ভাষণ দিয়েছিলেন।

তিনি বললেন, স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা।

স্বাধীন। বাংলাদেশ। বীর। বলার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর রোমাঞ্চিত হলো, চিবুক শক্ত হচ্ছে। বুক ফুলে উঠছে। তিনি কোত্থেকে এই পৃথিবীর সমান সাহস আর বিশ্বাস নিজের বুকের মধ্যে যেন ধারণ করে উঠতে পারলেন–

সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি।

বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কণ্ঠস্বর বিপুল সমুদ্রের কল্লোলকে যেন ধারণ করে উঠল।

তিনি বলতে লাগলেন, ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খানের রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হলে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী অঞ্চলে মেজর জিয়াউর রহমান, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে মেজর সফিউল্লাহ যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এবং তারা স্থানীয় কিছু শত্রুশিবির নিপাত করে শিগগিরই একযোগে ঢাকা আক্রমণ করার জন্য বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। কুষ্টিয়া, যশোর জেলার যুদ্ধ পরিচালনা করছেন মেজর ওসমান। উত্তরবঙ্গ মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করছেন মেজর আহমদ, মেজর নজরুল সৈয়দপুরে, মেজর নওয়াজেশ রংপুরে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

তিনি আরও বললেন, একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর একই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেড়ে নেওয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান একটি বেতারকেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের জন্য সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় আরেকটা কার্যালয় করা হয়েছে।

তাজউদ্দীন শেষ করলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বেতার ভাষণ এই দিয়ে যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানুষের। কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা থোক জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ।

২৬

ব্যাঙ্গমা বলল, তাজউদ্দীন আহমদ যখন দিল্লিতে সরকার গঠন করা লইয়া। ব্যস্ত, তখন সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা একসঙ্গে বসলেন।

ব্যাঙ্গমি বলল, ৪ এপ্রিল এই বৈঠকে কর্নেল ওসমানী, লে. কর্নেল রব, লে. কর্নেল নুরুজ্জামান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, নাসিম, মঈনুল হোসেন চৌধুরী, নুরুল ইসলাম শিশু–এই রকম অফিসাররা জয়েন করছিলেন। এই সময় তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ওসমানী সাহেব প্রধান সেনাপতি হইবেন।

আলোচনা হইল, সামরিক বিদ্রোহ সামরিক বিদ্রোহই থাইকা যাইব। যদি সরকার গঠন করা হয় অসামরিক লোক দিয়া। রাজনৈতিক সরকার গঠিত হইলেই এই বিদ্রোহ স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃতি পাইব।

খালেদ মোশাররফের কাছ থাইকা একই বার্তা লইয়া রেহমান সোবহান সাহেবও তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে পৌঁছায়া দিছিলেন।

ব্যাঙ্গমি বলল, মেজর জিয়া আসে ৫ এপ্রিলে। মেজর সফিউল্লাহর ব্যাটালিয়ন থাইকা সৈন্য লওনের লাইগা। সফিউল্লাহ আর খালেদ এক। কোম্পানি কইরা সৈন্য দিছিলেন জিয়ার ৮ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টরে।

২৭

ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ওয়াশিংটন সরকারের অবস্থান মেনে নিতে পারছেন না।

পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে নরক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাংক, কামান নিয়ে ঢুকে ছাত্রাবাসে আক্রমণ করা হয়েছে, পুলিশ, ইপিআর, হেডকোয়ার্টার বোমা-গোলায় ধ্বস্ত, জনপদে জনপদে আগুন দিয়ে পলায়নরত মানুষদের করা হয়েছে গুলি।

রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে মানুষের লাশ।

জনপদের পর জনপদে পড়ে আছে পোড়া ছাই।

ঢাকার আমেরিকান কনস্যুলেটে কর্মরত আমেরিকান কর্তাদের বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি কর্মচারীদের পরিবার।

আর আমেরিকান সরকার পক্ষ নিচ্ছে ইয়াহিয়া খানের। আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে নিরীহ মানুষ হত্যায়। নির্বাচিত গণহত্যায়।

তার অনুলিপি যাচ্ছে ইসলামাবাদে, দিল্লিতে, কলকাতায়, আমেরিকান কূটনৈতিক মিশনগুলোতে। কিন্তু নিক্সন ও কিসিঞ্জারের এক কথা–আমরা আছি আমাদের বন্ধু ইয়াহিয়ার পাশে। তিনি খুব ভালো মানুষ।

ক্ষোভে-দুঃখে নিজের হাত কামড়াচ্ছেন ঢাকার আমেরিকানরা। এর মধ্যে ইউএসএআইডির মিশন পরিচালকও আছেন।

তারা সমবেত হলেন এবং বললেন, মানবতার ওপর এই আঘাত আমরা চুপচাপ মেনে নিতে পারি না। আমাদের কি বিবেক বলে কিছু নেই?

তারা, ২০ জন আমেরিকান, তাঁদের মধ্যে আছেন ইউএসআইএসের প্রধান, আছেন এইডের প্রধান, আর্চার কে ব্লাডের ডেপুটি, আছেন অর্থনীতি কনস্যুলার ও প্রশাসনের প্রধানেরা, একসঙ্গে বসে একটা বিবৃতি তৈরি করলেন।

নিক্সন সরকার ভিয়েতনাম বিপর্যয়ের পর একটা নতুন নিয়ম চালু করেছে। আমেরিকান সরকার যদি কোনো ভুল নীতি গ্রহণ করে, কোনো সরকারি কর্মকর্তার যদি মনে হয় এটা ভুল, তাহলে সে তার আপত্তি জানাতে পারবে। ডিসেন্ট চ্যানেল বা ভিন্নমত প্রকাশের একটা চ্যানেল খোলা হয়েছে। এই ২০ অফিসার ঠিক করলেন, তারা ভিন্নমত প্রকাশ করবেন। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে আমেরিকান সরকার বড় ভুল করছে, অন্যায় করছে, তারা তার প্রতিবাদ না করে থাকতেই পারেন না।

তারা একটা বিবৃতি মুসাবিদা করলেন।

২০ জন মার্কিন কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত ওই টেলিগ্রাম ডিসেন্ট ফ্রম ইউএস পলিসি টুওয়ার্ড ইস্ট পাকিস্তান : জয়েন্ট স্টেট/এইড/ইউএসআইএস মেসেজ।

তাঁরা বললেন, আমেরিকার সরকার গণতন্ত্রকে দলিত-মথিত করার ঘটনাকে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।

তাঁরা বললেন, তাঁদের সরকার ব্যর্থ হয়েছে নৃশংসতার নিন্দা করতে।

তাঁরা বললেন, তাঁদের সরকার গণহত্যাকে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে গণ্য করছে। এবং নিপীড়নকারীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এটা চরম দেউলেপনা। এখানকার বেসরকারি আমেরিকানরা আমেরিকান সরকারের ওপর চরম বিরক্ত। আমরা আমাদের ভিন্নমত প্রকাশ করছি।

আর্চার ব্লাড সেই বিবৃতিকে সমর্থন করে নিজের কথাও লিখলেন।

এবং এ কথাও লিখলেন যে, বাঙালিদের এই লড়াইয়ের ফল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পরাজিতদের পক্ষ নেওয়া হবে চরম বোকামি।

আর্চার ব্লাড জানেন, এটার প্রতিক্রিয়া তার চাকরিজীবনের জন্য ভালো হবে না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন মানুষকে জীবিকার চেয়ে বিবেকের দিকেই বেশি তাকাতে হয়।

তিনি টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দিলেন ওয়াশিংটনে, পাকিস্তানের আমেরিকান দূতাবাসে এবং দিল্লিতে।

সচেতনভাবে এটাকে কম গোপনীয় হিসেবে দেখানো হয়। নিক্সন আর হেনরি কিসিঞ্জার খুব খেপে গেলেন। এটা এখন সংবাদমাধ্যমে চলে যাবে, আর চলে যাবে কেনেডিদের কাছে, এই ছিল তাঁর রাগের কারণ।

তারা আর্চার ব্লাডকে পাগল বলে গালিগালাজ করতে লাগলেন।

কিন্তু এই টেলিগ্রামও নিক্সন ও কিসিঞ্জারকে তাঁদের ইয়াহিয়াপ্রীতি থেকে নড়াতে পারল না।

প্রেম কি তাতে কমে? বরং আরও বেড়েই গেল।

২৮

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ খান ডেকে পাঠিয়েছেন লে. জে. এ কে নিয়াজিকে।

তোমাকে ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্ব নিতে হবে।

স্যার।

টিক্কা খান তো পারছে না। তুমি গিয়ে দায়িত্ব নাও। টিক্কা খানকে গভর্নর করে দেব।

স্যার।

তোমার কোনো প্রশ্ন আছে?

জি না স্যার। আপনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা মান্য করাই সৈনিক হিসেবে আমার কাজ, স্যার।

নিয়াজি নিজেকে বলতেন টাইগার নিয়াজি। জেনারেল হামিদের কথায় তিনি নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলেন। অথচ এর আগে দুজন জেনারেলকে এই হুকুম দিয়েছেন হামিদ, দুজনেই নানা অজুহাত দেখিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার আদেশ অমান্য করেছেন।

নিয়াজি ঢাকা গেলেন। টিক্কা খান প্রদেশের সেনাপ্রধানের বাড়ি ছাড়তে চান না। গুল হাসানকে দিয়ে তিনি টিক্কা খানকে রাজি করালেন গভর্নর হাউসে উঠতে।

মেজর জেনারেল মিঠঠা ছিলেন টিক্কার সহযোগী। তিনি হেডকোয়ার্টার্সে চিঠি লিখেছিলেন :

এ অপারেশন এখন রূপ নিয়েছে একটি গৃহযুদ্ধে। দূরে যাওয়া যায় না, রেলগাড়িও ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কোনো ফেরি অথবা নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে চলাচলই এখন প্রধান বাধা। এ অবস্থা আরও কিছুদিন চলবে। সশস্ত্র বাহিনীকে নিজেদের বাহনেই চলতে পারতে হবে। আমি প্রস্তাব করছি : ১. চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নেভির পোর্ট অপারেটিং ব্যাটালিয়ন ২. আর্মি, নেভি বা ইঞ্জিনিয়ার রিভার ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন। তিন. নেভির কার্গো ও ট্যাংকার ফ্লোটিলা। রসদ ও সৈন্য চলাচলের জন্য আরও হেলিকপ্টার অপরিহার্য।

এর কিছুই তারা পায়নি।

নিয়াজির মনে হলো, পুরো পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য একটা মৃত্যুফাঁদ। তারা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় থাকে। অনেকে মিলে পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া বাইরে যেতে পারে না। বাইরে বেরোনো মানেই মৃত্যু। পুরোটা দেশ বেদখল হয়ে আছে, ক্যান্টনমেন্টগুলো ছাড়া। আর সীমান্ত বলতে তো কিছুই নেই।

নিয়াজি তার দায়িত্ব বুঝে নিলেন। এই ছোটখাটো কালো বাঙালিকে দমন করতে কেন বেগ পেতে হচ্ছে, এই নিয়ে তার মনে অনেক ক্ষোভ। তাঁর কোমরে একটা পিস্তল গোঁজা। অপারেশন রুমে সবাই সমবেত হয়েছে। টিক্কা খানও আছেন।

নিয়াজি ঢুকেই বললেন, মেয় এই হারামজাদি কৌম কি নাসাল বদল দুঙ্গা। ইয়ে মুঝে কিয়া সমঝতে হায়! (আমি এই বেজন্মা জাতির চেহারা বদলে দেব। ওরা আমাকে কী ভেবেছে!) আমি আমার সৈন্যদের ছেড়ে দেব এদের নারীদের ওপরে। তারা সন্তান উৎপাদন করবে। পরের প্রজন্ম নতুন চেহারার নতুন জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে।

এর পরের দিন মেজর জেনারেল খাদিম রাজার সঙ্গে নিয়াজি যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান নিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। খাদিম তাঁকে বিশদ বর্ণনা দিচ্ছেন, এই সময় নিয়াজি বলে উঠলেন, ইয়ার, লড়াই কি ফিকর নাহি করো, ওঁ তো হাম কার লেঙ্গে। আভি তো মুঝে বেঙ্গলি গার্লফ্রেন্ডস কা ফোন নম্বর দো। বন্ধু, যুদ্ধ নিয়ে চিন্তা কোরো না, সে আমি সামলাব, তুমি তোমার বাঙালি। বান্ধবীদের ফোন নম্বর দাও।

খাদিম রাজা তার পরের দিন ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন।

আকাশে উড়তে উড়তে তিনি শেষবারের মতো জলমগ্ন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে তাকালেন। পূর্ব পাকিস্তান। তোমাকে নিয়াজির হাতে রেখে এলাম। লাহোরের গুলবাগে একটা পতিতালয় আছে। নাম সিনোরিটা হোম। সেখানে যৌনকর্মীরা থাকে। সেটা চালান মিসেস সায়িদা বুখারি। জেনারেল নিয়াজির বান্ধবী তিনি। নিয়াজি লাহোরের জিওসি ও কোর কমান্ডার থাকার সময় যে টাকাপয়সা খেতেন, যে উৎকোচ গ্রহণ করতেন, সায়িদা তা গ্রহণ করতেন। নিয়াজির পক্ষ থেকে।

নিয়াজি ঢাকায় এসে পানের চোরাচালান শুরু করলেন। ঢাকা থেকে পান যেত সায়িদার কাছে।

নিয়াজি ঢাকার সেনানিবাসে তাঁর বাড়িটিতে নিয়মিত আসর বসান বাইজি নাচের। বাইজিরা আসে। জেনারেলরা আসেন। আসর জমে ওঠে মধ্যরাতে। এই যৌনকর্মীরা নিয়াজির তিন তারকাখচিত পতাকাওয়ালা গাড়িতে আসা যাওয়া করে।

যখন বলা হলো, পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে না, লঙ্গরখানায় ঠিকভাবে খাবার যাচ্ছে না, নিয়াজি বললেন, এ কী কথা, পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে কি কোনো গরু চরছে না, গোয়ালে কোনো গরু-ছাগল নেই, মানুষের গোলায় কি ধান-গম নেই?

যখন এই অভিযোগ উঠল যে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করছে। অধিকৃত বাংলায়, তখন নিয়াজি বললেন, একজন সৈন্য থাকবে পূর্ব পাকিস্তানে, লড়াই করবে, মারা যাবে এবং সেক্স করতে যাবে ঝিলম–এটা তো আপনি আশা করতে পারেন না।

পাকিস্তানে হামুদুর রহমান কমিশনে লে. কর্নেল আজিজ খান এক বছর পরেই এই সাক্ষ্য দিয়ে বলবেন, যখন কমান্ডার নিজেই একজন ধর্ষক, তখন তাঁর অধীন সৈন্যরা কী করবেন, তা বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।

২৯

মগবাজারের বাড়িতে নিচতলায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন রেহানা। বাইরে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বাঁ দিকে একটা মাধবীলতার ঝাড়। বৃষ্টির ফোঁটায় গাছের পাতাগুলো একবার ডানে একবার বাঁয়ে মাথা নাড়ছে। একটা কুকুর ওই ও বাড়ির সানশেড ঘেঁষে শুয়ে বৃষ্টির ছাট থেকে গা বাঁচানোর চেষ্টা করল। একবার চারপায়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে গা-মাথা-লেজ নেড়ে গায়ের পানি ঝাড়ল।

বদরুন্নেছা ফুফুদের বাড়ি এটা। এই বাড়িতে থাকার একট সুবিধা হলো, ভাড়া লাগবে না। ঘরে আসবাবপত্র নেই, মেঝেতে চাদর বিছিয়ে তারা ঘুমান।

বাড়ির পেছনে বদরুন ফুফুর মামা থাকেন। খুব ফরসা, খুব লম্বা একজন মানুষ। দেখলে মনে হবে জিন। তো জিন দাদা একদিন এই বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখলেন, বাড়িতে কোনো ফার্নিচার নেই। তিনি দুটো চেয়ার, একটা টেবিল, একটা খাট পাঠিয়ে দিলেন।

ভালোই বাড়িটা। বড়সড়ই আছে। তবে অসুবিধা একটাই। ১ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের এই বাড়ি একেবারেই সদর রাস্তার ওপরে। রাস্তা দিয়ে মিলিটারি গাড়ি যায়। দেখামাত্র বুকটা ধপাস করে ওঠে।

.

হাসু আপাও এখন এই বাড়িতে।

একদিন বাইরে গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ। কে এল, দেখ তো আবদুল।

রেহানাই দৌড়ে গেলেন গেটের দিকে।

চেঁচিয়ে বললেন, মা মা, আপা এসেছে। দুলাভাই এসেছে।

রেহানা গেট খুলে বাইরে গিয়ে গাড়ির দরজা খুললেন। আপা বের হলেন। আপার হাত ধরে রেহানা তাকে ঘরে নিয়ে এলেন। দুলাভাই এলেন। পেছনে পেছনে। আবদুল গিয়ে জিনিসপাতি নামাতে লাগল। জিনিসপাতিও তো বেশি কিছু নয়। ৩২ নম্বর থেকে বেরোনোর সময় বেশি কিছু তো তারা সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারেননি।

শাশুড়িকে কদমবুসি করলেন ওয়াজেদ মিয়া।

রেনু বললেন, আসো বাবা, বসো। বসতে যে দিব সোফা তো নাই। দুইটা চেয়ার আছে, দুইজন বসো।

হাসিনার দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসুর মুখটা ছোট হয়ে গেছে। এইভাবে কি আর হয়? এই সময় দরকার রেস্ট। দরকার একটু ভালো খাওয়াদাওয়া। মনটা রাখতে হয় ভালো। আর এর মধ্যে আল্লার গজব নেমে এসেছে। কোথায় ছিলি, কেমন ছিলি! আমার কী যে চিন্তা হতো!

হাসিনা বললেন, মা, আমি তোমাদের চিন্তাই করতাম। রাসেল সোনার চিন্তা করতাম। আব্বাকে নিয়ে তো চিন্তার শেষ নাই-ই। রাসেল, কাছে। আসো। শার্ট খেয়ো না। আসো। তোমার জন্য চকলেট এনেছি তো!

ওয়াজেদ মিয়া বসলেন একটা চেয়ারে। হাসিনা আরেকটা চেয়ারে।

রেনু বললেন, ওয়াজেদও তো শুকায়া গেছ। কী বলব? আমাদেরই থাকার ঠিক নাই। এই বাড়ি এক রাত, ওই ঘর এক রাত। বিছানা নাই, বালিশ নাই, চাদর বিছায়া ঘুম। জামাল আর আবদুল তো ছাদেও ঘুমাত।

হাসিনা বললেন, আমরা তো তবু আছি। আব্বা… রেনু বললেন, তোর আব্বা তো আজকেই প্রথম জেলে যাচ্ছে না।

ওয়াজেদ বললেন, এবারের পরিস্থিতি আর আগের পরিস্থিতি তো এক নয়। এবার তো যুদ্ধ।

রেনু বললেন, আগরতলা মামলার সময়ও তো ফাঁসিই হয়ে যেত। তবু জানা গেছল কোথায় আছে। এবার তো কোনো খবর নাই…আল্লাহকে শুধু ডাকি, আল্লাহকে বিচার দেই…ওয়াজেদ তুমি হাত-পা ধুয়ে নাও, আমি খাবার দিচ্ছি। এইভাবেই হাতে নিয়ে খেতে হবে…

ওয়াজেদ বাথরুমে গেলেন। হাসিনা উঠে মাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা, আমি তোমাকে মিস করেছি মা। তোমাদের ছেড়ে বিদেশে ছিলাম। কিন্তু…

রেনু বললেন, নিজে মা হওয়ার আগে মেয়েরা নিজের মাকে পাশে পেতে চায় মা। আমি জানি…, তিনি হাসিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, যাই, ওয়াজেদের প্লেটে খাবার বেড়ে দেই…

খাটটা হাসু আপাকে দেওয়া হলো। দুলাভাই মাঝেমধ্যে এই বাসায়। থাকেন, মাঝেমধ্যে আগের আশ্রয়ে যান।

জামাল ভাই বাড়ি থেকে বের হওয়া শুরু করেছেন। কারফিউ এখন। দিনের বেলা আর দেওয়া হয় না। জামাল ভাইয়ের পেছনে পেছনে তার পোষা কুকুর দুটো টমি আর টিকলি এসে হাজির হলো এই বাসায়। বাইরে কুকুরের ডাক শুনে রেহানা বেরোলেন বারান্দায়, উঁকি দিয়ে দেখলেন গেটের বাইরে টমি আর টিকলি। তিনি জামালকে ডাকতে লাগলেন, জামাল ভাই, জামাল ভাই। দেখে যাও, কারা এসেছে!

জামাল, ১৭ বছরের কিশোর, ছুটে বেরিয়ে এলেন। টমি টিকলি…কীভাবে বাসা চিনলি… জামাল বাইরে গিয়ে টমি-টিকলির মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন।

ছুটে এল সেলিম ওরফে আবদুল। জামালের সমবয়সী। টমিকে গেটের ভেতরে এনে আদর করতে লাগলেন জামাল। আবদুলকে বললেন, আবদুল, টোস্ট বিস্কিট আন। আর দ্যাখ তো, একটু গোশতটোশত পাস কি না! রোজি এলেন। বললেন, জামাল ভাই, তোমার টমি কিন্তু আমাদের কলাবাগানের বাসায় গিয়ে দুপুরে খেয়ে আসত!

জামাল বললেন, অবাক কাণ্ড। আমি তো ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে যাই নাই। টমি আমার গন্ধ পেল কীভাবে? আমি তো রিকশায় এসেছি ৩৩ নম্বর থেকে। ওখান থেকে আমার গন্ধ পেয়ে পেছনে পেছনে চলে এসেছে!

কিন্তু এই বাড়িতে কুকুর রাখার জায়গা কই! ৩২ নম্বরে তো জায়গা ছিল। এটা একেবারে রাস্তাঘেঁষা বাড়ি। ঘর থেকে বের হলেই বাউন্ডারি হাফওয়াল। গেট পেরোলে রাস্তা।

রেনু বললেন, আবদুল, যা, টমি-টিকলিকে বস্তায় ভরে আবার ৩২ নম্বরের কাছে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আয়!

রেহানা সেই কথা মনে করে এখন মন খারাপ করছেন। খুব মন খারাপ। কিন্তু কান্না চলবে না। তিনি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি হাতে নিলেন। হাতটা ভিজে উঠলে ভেজা হাত দিয়ে মুখ মুছলেন। আব্বা কোথায় তারা জানেন না। কামাল ভাই বাড়ি যাবেন বলে বেরিয়ে গেছেন, কোথায় গেছেন, কেমন আছেন, কোনো খবর নেই। ৩২ নম্বরে ২৫ মার্চের রাতে হাজি মোরশেদ চাচাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে অজ্ঞান করে তুলে নিয়ে গেল, লোকটা বেঁচে আছে কি মারা গেছে, কে বলতে পারে। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনি সব শোনা যায়। এর মধ্যে এই কুকুর দুটোকে বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হলো বলে কোনো ১৪ বছরের মেয়ে কাঁদতে পারে! না, আমার চোখের নিচে অশ্রু নয়, এ হলো বৃষ্টির পানি! রেহানা বিড়বিড় করলেন।

এর মধ্যে একদিন মিছিল বেরোল। নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর। শান্তি মিছিল। জেনারেল রাও ফরমান আলী, পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব যার ওপর, তিনি শান্তি কমিটি করে দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগের লোকেরা শান্তি কমিটির নেতা। শান্তি মিছিল হচ্ছে। অথচ রোজ মানুষ মারছে পাকিস্তানিরা। এপ্রিলের শুরুতে জিঞ্জিরায় রক্তগঙ্গা তারা বইয়ে দিয়েছে। সেসব খবর কিছু কিছু করে পাওয়া যায়।

রেহানা দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার বিপরীত দিকের জানালায়। রাস্তার দিকে যাওয়া তাঁর বারণ। কামাল ভাই বলে গেছেন, মরে যাবি, তবু পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিবি না। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অত্যাচার করছে–এই খবর। চাপা থাকছে না।

একদিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে রেহানার।

রাসেল এসে তার পাশে দাঁড়াল। দেনাপু, চলো, আব্বার বাড়ি যাই।

আব্বার বাড়ি মানে জেলখানা। আব্বাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় রেখেছে, তারা কিছুই জানেন না। শুধু আবদুর রহমান রমার কাছ থেকে এতটুকুন জানা গেছে, আব্বা বেঁচে ছিলেন। তাঁকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের ভেতরে রেখেছিল।

এসো, বাইরে কাক ডাকছে। কাক দেখি।

তাকে নিয়ে বাড়ির সামনের দিকটাতে এলেন রেহানা।

খবরের কাগজের হকার কাগজ হাতে হাঁটছে। সে হাঁকছে : শেখ মুজিবের খবর। শেখ মুজিবের খবর।

সব ভুলে ছুটে গেলেন ১৪ বছরের রেহানা। হকারের কাছ থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এসে মাকে বলতে লাগলেন, মা, মা, পয়সা দাও। আব্বার খবর।

মা পয়সা বের করে দিলেন। রেহানা হকারকে দাম দিয়ে দ্রুত গেট বন্ধ করে দিলেন।

করাচির কাগজ ডন-এ ছাপা হয়েছে একটা খবর। শেখ মুজিব রাওয়ালপিন্ডি এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে।

পাঞ্জাবি, পায়জামা, মুজিবকোট পরিহিত। চোখে চশমা। তাঁর মুখটা আগের মতো সংকল্পবদ্ধ। পেছনে দাঁড়িয়ে দুজন সৈনিক।

একটা কাগজ নিয়ে একবার রেনু দেখেন, একবার হাসিনা দেখেন, একবার জামাল দেখেন। তারপর দেখে রাসেল। রাসেল তার আব্বার ছবিতে চুমু খায়।

রেনু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। হাসিনা চোখ মুছতে লাগলেন শাড়ির আঁচল দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *