৩৭. দরজা উন্মুক্ত করা

অধ্যায় ৩৭. দরজা উন্মুক্ত করা

আপনার ধর্মীয় শব্দভাণ্ডারে যোগ করার মতো একই উপযোগী শব্দ হচ্ছে। ‘একুমেনিকাল। শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘ওইকস’ থেকে, যার অর্থ একটি বাড়ি, এটিকে ‘ওইকুমেনে’ অথবা সমগ্র মানবতার ধারণায় সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এই পরিবর্তনটি মূলত বনু দরজার পেছনে আবদ্ধ থাকা একটি একক পরিবার থেকে পৃথিবী সমগ্র মানবতার অংশে পরিণত হওয়া। একুমেনিকাল মানে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, এবং সবার সাথে আমাদের যা কিছু সাধারণ, সেগুলো উদ্যাপন করা। এর মানে বন্ধ দরজার পেছন থেকে বের হয়ে এসে আমাদের প্রতিবেশীদের হাতে হাত রাখা। এই ধরনের বেরিয়ে আসা বিংশ শতাব্দীতে ধর্মগুলোর একটি বড় কাহিনি। এটি ঘটেছিল বেশ কয়েকটি জায়গায়, কিন্তু আমরা খ্রিস্টধর্ম দিয়েই শুরু করব।

ষোড়শ শতাব্দীর রিফরমেশন আন্দোলনটি খ্রিস্টানদের পরস্পর যুদ্ধরত বহু দল আর উপদলে বিভাজিত করেছিল। এবং তারা যখন পরস্পরকে হত্যা করা বন্ধ করতে পেরেছিলেন, তার পরের কয়েক শতাব্দী তারা পরস্পরকে অবজ্ঞা আর উপেক্ষা করেই কাটিয়েছিলেন। প্রতিটি ধর্মগোষ্ঠী নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছিল, নিজেদের মতো করেই তারা তাদের জীবন কাটিয়েছে। কিন্তু তারপর সেই ভারী দরজাটি ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছিল। আর খ্রিস্টানরা বাইরে বের হয়ে এসেছিলেন এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি করা সেই উঁচু বিভেদের দেয়ালের ওপর থেকে পরস্পরের সাথে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। এই মতবিনিময়ের পর্বটি শুরু হয়েছিল ১৯১০ সালে এডিনবরায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন থেকে, যেখানে বেশকিছু প্রটেস্টান্ট মিশনারি সোসাইটির প্রতিনিধিরা তাদের সমষ্টিগত নানা সমস্যা নিয়ে একত্রে আলোচনায় বসেছিলেন। তারপর ১৯৩৮ সালে জাতিসংঘের মডেল অনুসরণ করে একশোটি চার্চের নেতাদের ভোটের মাধ্যমে একটি ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই প্রতিষ্ঠানটির উচ্চাকাঙ্ক্ষায় খানিকটা বিরতি এসেছিল। কিন্তু আবার ১৯৪৮ সালে ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চ তার প্রথম অধিবেশনটির আয়োজন করেছিল, যেখানে ১৪৭টি চার্চের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে ৩৪৫টি ভিন্ন চার্চ সম্প্রদায় এর সদস্য, আর এই সংখ্যাটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া খ্রিস্টধর্ম এখনো কত বেশি খণ্ডিত।

শুরুর বছরগুলোয় একুমেনিকাল আন্দোলন একটি পুনর্মিলনীর আশা করেছিল, বিভাজিত খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলোকে একটি একক সম্পূর্ণতায় নিয়ে আসা, একটি একক চার্চ। যদিও নিখুঁত উদাহরণ নয়, তবে এটিকে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে একটি বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অধীনে একীভূত করার মতো কিছুর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এটি মূলত প্রকৌশলের একটি মডেল। এখান থেকে কিছু নিয়ে, অন্যটার সাথে কিছু যুক্ত করে, তাদের একসাথে শক্ত করে পেরেক দিয়ে জোড়া লাগানো, ব্যস, তারপর হয়ে গেল একটি ইউনাইটেড চার্চ! অল্প কয়েকটি প্রটেস্টান্ট চার্চই এভাবে নিজেদের একীভূত করতে সফল হয়েছিলেন। যেমন, ইউনাটেড চার্চ অব ক্রাইস্ট, ১৯৫৭ সালে দুটি পৃথক খ্রিস্ট-সম্প্রদায় একত্রে যুক্ত হয়ে যা তৈরি করেছিল। এবং অষ্ট্রেলিয়ার ‘ইউনাইটিং চার্চ’ একীভূত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে, যখন তিনটি পৃথক গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছিল। এই অল্পকিছু স্থানীয় সফলতা ছাড়া, এই ধরনের একতা সৃষ্টি করার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এই প্রচেষ্টা চার্চগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।

এই একতার অনুসন্ধানকে পরে প্রতিস্থাপিত করেছিল আরো খানিকটা শিথিল দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে চার্চগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিও তারা পরস্পরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না ঠিকই, কিন্তু পরস্পরের বন্ধু হতে না-পারার কোনো কারণ তারা দেখেননি। এটি সহজতর হয় যদি তাদের মধ্যে আগে থেকেই সাধারণ কিছু থাকে এবং তারা পার্থক্যগুলোকে উপেক্ষা করতে প্রস্তুত থাকে। একুমেনিকাল আন্দোলনের নিজস্ব ভাষায়, এরপর তারা পরস্পরের সাথে কমিউনিয়নের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। সুতরাং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অ্যাঙলিকান চার্চ ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-ইউরোপের লুথারিয়ান চার্চের সাথে একটি কমিউনিয়নে যুক্ত হয়েছিল। তারা একীভূত হয়ে যায়নি এবং নতুন কোনো সম্প্রদায়ে পরিণত হয়নি। তারা নিজেদের বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরস্পরের জন্যে তারা তাদের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, এবং সম্প্রসারিত একটি পরিবারে পরিণত হয়েছিল।

এইসব একুমেনিকাল কর্মকাণ্ড খ্রিস্টধর্মকে কোথায় নিয়ে যাবে এখনো সেটি বলার মতো সময় হয়নি। তবে একটি সম্ভাব্য তথ্যপুষ্ট অনুমান হচ্ছে কোনো পরিকল্পিত পদক্ষেপ বা প্রকৌশলের মাধ্যমে একতা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টার দিন শেষ হয়ে গেছে। আরো শিথিল একটি পদ্ধতি এর জায়গা নিয়েছে এবং যেখানে মনে করা হয় বিভিন্ন চার্চগুলোর মধ্যে পার্থক্যটিকেই আমাদের উদ্‌যাপন এবং লালন করতে হবে। কারণ আর যাই হোক, প্রতিটি পরিবারের একটি নিজস্ব শৈলী আছে, কোনোকিছু করার একটি উপায় আছে, কিন্তু সবাই বিশ্বব্যাপী একটি মানবসমাজের সদস্য। যে দৃষ্টিভঙ্গিটি ভিন্নতাকে লালন করে সেটির আবির্ভাব ঘটতে শুরু করেছে। কারণ কয়েক হাজার খ্রিস্ট-সম্প্রদায়কে একসাথে জোড়া লাগিয়ে কোনো একটি বড় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার খুব সামান্যই সুযোগ আছে। কিন্তু এটি এর এই বহুত্বের মধ্যে সৌন্দর্য আর সদগুণ লক্ষ করতে শুরু করেছে। কোনো একটি বাগানের মতো যেখানে শত শত ফুল ফোটে। বহুবিধ উপায়ে ঈশ্বরকে বোঝা আর উপাসনা করা যেতে পারে।

এটি শুনলে পাশ্চাত্য নয় বরং প্রাচ্যের একটি ধারণা মনে হয়, খ্রিস্টধর্মের চেয়ে আরো বেশি হিন্দুধর্মীয়। আর এর কারণ হচ্ছে, এটি আসলেই সেটাই। একুমেনিকাল আন্দোলন হয়তো খ্রিস্টান ধর্মকে একীভূত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছিল ১৯১০ সালে, তবে এটি করার সেই তাগিদের উপস্থিতি ছিল এর আরো বহুদিন আগে থেকেই। আমরা ইতিমধ্যেই এটিকে কাজ করতে দেখেছি শিখ মতাদর্শে, যেখানে অন্য ধর্মবিশ্বাসের ঐতিহ্যের প্রতি একটি উন্মুক্ত মনোভাব আছে। এখানে এটি হিন্দুধর্মের সেই রূপকটিকে প্রতিফলিত করছে, পানির বহু স্রোতধারা একটি সাগরে মিশে যেতে প্রবাহিত হচ্ছে। আর এটি এমন কোনো। ধারণা নয়, যা হয়তো নবী মুহাম্মদের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে পারত, যিনি ইসলামকে বহু ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে একটি হিসাবে দেখেননি, বরং এদের পরিসমাপ্তি আর পরিপূর্ণ একটি রূপ হিসাবে দেখেছিলেন।

সুতরাং এটি বেশ কৌতূহল উদ্রেক করে যখন কিনা বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি একুমেনিকাল ধর্মটির উৎস কিন্তু হিন্দুবাদে না বরং ইসলামের অভ্যন্তরে। এটির নাম বাহা’ই। এটি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল পারস্যে, বর্তমানে যে-দেশটির নাম ইরান। খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামের মতো, বাহাই ধর্ম ঐতিহ্যবাহী ভবিষ্যসূচক ধর্মগুলোর মতো। তবে এই ভবিষ্যদ্বাণীর মূল বিষয়টি হচ্ছে ঈশ্বরের মন উন্মোচিত হতে পারে বিশেষভাবে নির্বাচিত কিছু পুরুষের মনে–হ্যাঁ, তারা সাধারণত পুরুষ–তারা যা কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন সেটি প্রচার করে থাকেন। এই শিক্ষাগুলো সারাবিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে সমবিশ্বাসীদের একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলাম এই ভবিষ্যসূচক বার্তাটি উদযাপন করে, যা এসেছে আব্রাহাম থেকে যিশুর মাধ্যমে মুহাম্মদের কাছে। কিন্তু এটি বিশ্বাস করে, মুহাম্মদই হচ্ছে শেষ নবী, চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি, অথবা যেখানে এসে এই ঐশী প্রত্যাদেশের প্রবাহ এর নিখুঁত পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। সব নবীদের শেষ সিলমোহর। নদী অবশেষে তার হৃদ খুঁজে পেয়েছে এবং এই ভবিষ্যদ্বাণীর সমাপ্তি হয়েছে।

কিন্তু বাহা’ইরা বিষয়টি এভাবে দেখেন না। তাদের কাছে এখানে কোনো হৃদ নেই, কোনো বাঁধ নেই, যা ঈশ্বরের ঐশী উন্মোচনের পথটিকে রুদ্ধ করে রাখতে পারে। এই নদী এখনো প্রবাহিত হচ্ছে এবং প্রফেসি বা ভবিষ্যদ্বাণী এখনো প্রবাহিত আছে। এটি চলমান থাকবে, ইতিহাস যতদিন চলবে। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনো নতুন নবীর কাছে ঐশী প্রত্যাদেশ হিসাবে এটি বুদ্বুদের মতো উপরে ভেসে উঠে আসে। বাহা’ইরা বিশ্বাস করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইরানে এভাবেই। এটি পৃষ্ঠদেশে উঠে এসেছিল, যখন ঈশ্বর তার সাম্প্রতিকতম নবীকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। আপনি মনে করতে পারবেন গসপেল আমাদের বলেছিল যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাবের আগেই তার জন্যে ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছিলেন এমন একজন অগ্রদূত ছিলেন, যার নাম ছিল জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট। মানুষ জনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনিই মেসাইয়া কিনা। তিনি বলেছিলেন, তিনি মেসাইয়া না, কিন্তু তিনি এসেছেন, যিনি পরে আসছেন, তার জন্য পথ প্রস্তুত করতে।

একই জিনিস ঘটেছিল ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইরানে। বাব’ (বা দরজা) নামের একজন তরুণ ঘোষণা করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন ঈশ্বরের একজন বার্তাবাহক, এবং পরবর্তী নবীর আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই তিনি এসেছেন। বাব নিজে নবী নন, কিন্তু নবীদের জন্য স্বাভাবিক একটি নিয়তি তাকে সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি নিজেকে শুধুমাত্র একটি দরজা হিসাবে দাবি করেছিলেন, যার মধ্যে দিয়ে। একজন নতুন নবী পৃথিবীতে প্রবেশ করবেন, তার এই দাবিটি মূলধারার মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি ধর্মদ্রোহিতা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। কারণ। তাদের জন্য মুহাম্মদই ছিলেন শেষ নবী আর তার পরে আর কেউই নবী হতে পারবেন না। সুতরাং ১৮৫৫ সালে বাবকে গ্রেফতার ও পরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।

এর কয়েক বছর পরে মির্জা হুসাইন আলি নুরি নামের একজন ব্যক্তি, বাবকে অনুসরণ এবং বাবের ভবিষ্যদ্বাণীর সেই নবীর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করার কারণে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি একটি ঐশী প্রত্যাদেশ পেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তিনি নিজেই হচ্ছেন বাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সেই নবী, এতদিন ধরে তিনি যার অনুসন্ধান করছেন। তিনি বাহাউল্লাহ নাম নিয়েছিলেন, যার মানে ঈশ্বরের মহিমা এবং এভাবেই বাহাই ধর্মবিশ্বাসটির সূচনা হয়েছিল। বাহা’উল্লাহর ভাগ্য বাবের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। ইরানি কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়নি, তবে পরবর্তী চল্লিশ বছর তাকে কারাগার আর নির্বাসনে কাটাতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্যালেস্টাইনের জেল-নগরী আক্রেতে তিনি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আরো একটি উদাহরণ, কীভাবে একটি নতুন ধর্ম শুরু করার ব্যাপারটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে গুরুতর হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

তার ছেলে আব্দুল বাহা, যিনি তার পিতার মতোই বেশি সময় কারাগারেই কাটিয়েছিলেন, তার উত্তরসূরি হিসাবে বাহা’ইদের নেতা হয়েছিলেন। আর ১৯০৮ সালে যখন তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তিনি মিশর, ইউরোপ আর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন তার নতুন বিশ্বাসের সংবাদটি প্রচার ও অনুসারী সংগ্রহ করতে। যখন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, নেতা হিসাবে তার জায়গা নিয়েছিলেন তারই নাতি, শোঘি এফেন্ডি। বাহা’ইদের বিশ্বাসটি ক্রমশ বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হতে আর পরিচিতি পেতে শুরু করেছিল। আর ১৯৫৭ সালে যখন শোঘি এফেন্ডি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব একক ব্যক্তির, যিনি কিনা কোনো নবীর উত্তরসূরি, হাত থেকে হস্তান্তরিত হয়েছিল বিশ্বাসীদের একটি গোষ্ঠীর কাছে, যারা পরিচিত ইউনিভার্সাল হাউজ অব জাস্টিস’ নামে।

বাহা’ই ধর্মের সৌন্দর্যটি হচ্ছে এই ধর্মবিশ্বাসটিতে কোনো ধরনের জটিলতা নেই। এর মূল ধারণাটি হচ্ছে অগ্রগতিশীল একটি ঐশী উন্মোচন বা প্রত্যাদেশ। ঈশ্বর নবী পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন, যাদের মধ্যে ঘটনাক্রমে বাহাউল্লাহ ছিলেন সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম একজন। তার মানে এই নয় যে, বাহাউল্লাহই হচ্ছেন সর্বশেষ ঐশী নির্দেশ পাওয়া কোনো নবী। এর মানে শুধু আপাতত এই সময়টির জন্যে মানবতার উচিত হবে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া। কারণ, তিনি হচ্ছেন ঈশ্বরের সাম্প্রতিকতম বার্তাবাহক, যার কাছ থেকে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি। এটি খুব সরল একটি শিক্ষা, যা সেই সময়ের একুমিনেকাল বা বিশ্বাসের ঐক্যসংক্রান্ত প্রাণশক্তিটিরই প্রতিধ্বনি করেছিল। ঈশ্বর একক ও অদ্বিতীয়, যার সত্তার প্রকৃতি মানুষের বোধগম্যতার সীমার বাইরে। নবীরা ঈশ্বরের মনটিকে শুধুমাত্র একঝলক দেখতে পান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যে-ধর্মগুলো গড়ে ওঠে ঈশ্বরের মনের এই ক্ষণিক দৃশ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে, সেগুলো সবসময়ই একটি বিষয়ে ভুল করে থাকে। আর তাদের এই ভ্রান্তিটি সবসময়ই একই রকম, তারা মনে করেন তাদের ধর্মটিই হচ্ছে ঈশ্বরের শেষ কথা।

বাহা’ই অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীর সব ধর্মই ঈশ্বর রহস্যটির কিছু-না-কিছু অংশ বুঝতে পেরেছে, সুতরাং সব ধর্মকেই শ্রদ্ধা করা উচিত। ঈশ্বরের মনের যে ক্ষণিক দৃশ্যগুলো তারা দেখেছেন সেগুলো সবই সত্য। কিন্তু কেউই সম্পূর্ণ চিত্রটি দেখতে পারেননি। এমনকি তাদের নবী বাহা’ইও সেটি পারেননি। বাহা’ই শুধুমাত্র এর একটি সাম্প্রতিকতম সংস্করণ। এবং এর সরলতার সৌন্দর্য আছে। এটি স্বীকার করে যে, পৃথিবীতে বহু ধর্ম আছে, কিন্তু সেগুলো সবই একই ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই অর্থে প্রতিটি ধর্মই আসলে ইতিমধ্যেই একই ধর্ম। আর তাদের পৃথক দৃষ্টিকোণ নয়, ধর্মগুলো যার’ দিকে তাকিয়ে আছে সেটিই তাদের একীভূত করেছে। ধর্মগুলো এটি ভুলে যায়।

কী দেখা হচ্ছে আর যিনি এই দেখার কাজটি করছেন, এ দুটি বিষয় নিয়ে তারা। সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়েন। অন্ধ মানুষ আর হাতির সেই নীতিগল্পটি এখানে আমরা আবার স্মরণ করতে পারি, যদি খানিকটা ভিন্নভাবে চিন্তা করা হয়। হাতি একটি, তবে প্রত্যেকেই পরস্পর থেকে পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে সেটি দেখছেন।

তাহলে বাহা’ইদের দৃষ্টিকোণ কোন্‌টি? ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় এই প্রস্তাবনার মধ্যে নতুন কিছু নেই। বাহা’ইরা যে-বিষয়টির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সেটি হচ্ছে, সমগ্র মানবতাও এক ও অভিন্ন। মানবজাতির এই সমগ্রতার শিক্ষাটি, ঈশ্বরের সমগ্রতা শিক্ষার মতো একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবং এর বেশকিছু প্রত্যক্ষ প্রায়োগিক নিহিত্যার্থ আছে। যে ধর্মগুলো মনে করে যে, তারাই ঈশ্বরের শেষ কথা, তাদের একটি ট্র্যাজেডি হচ্ছে তারা পরস্পর দ্বন্দ্বরত প্রতিপক্ষ রূপ বহু গোত্রে সমগ্র মানবতাকে বিভাজিত করে। তখন ধর্ম মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়। কিন্তু একবার যখন এটি অনুধাবন করতে পারে, যদিও সব ধর্মগুলো পরস্পর থেকে পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরকে দেখছে, কিন্তু তারা সবাই এক এবং অভিন্ন ঈশ্বরকেই দেখছে, তখন বিভাজনের নয়, ধর্ম ঐক্যবদ্ধ করার একটি শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে।

আর সে-কারণে বাহা’ইরা সেই আন্দোলনে সুপরিচিত, যা পৃথিবীর ধর্মগুলোকে একটি নতুন ধরনের বৈশ্বিক ঐক্যে একত্রিত করতে চায়, যার নাম ‘ওয়ার্ল্ডস পার্লামেন্ট অব রেলিজিয়ন। শিকাগো শহরে ১৮৯৩ সালে এটি প্রথমবারের মতো একটি সম্মেলনে একত্রিত হয়েছিল, তারপর এর একশো বছর পরে ১৯৯৩ সালে এটি আরেকটি অধিবেশন করে। এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক সভাটি হয়েছে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ইউটাহ’র সল্ট লেক সিটি শহরে। এই পার্লামেন্ট একটি ইঙ্গিত যে, আমাদের এই সময়ে, কিছু ধর্ম বন্ধুত্ব আর আলাপচারিতার একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে বহুবছরের বিভাজন আর পারস্পরিক সন্দেহ থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এছাড়াও ঈশ্বর আর মানবতার ঐক্যের প্রতি তাদের এই বৈশ্বিক সাক্ষ্য ছাড়াও, বাহা’ই অনুসারীদের নিজস্ব খুব সরল আর স্বতন্ত্র ধরনের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের আচার-অনুষ্ঠান আছে। তাদের কোনো নিবেদিত যাজক বা পুরোহিতশ্রেণি নেই, এবং একই সাথে তারা এর সদস্যদের ওপর কোনো মতবাদের অভিন্নত্ব চাপিয়ে দেয় না। তাদের বিশ্বাসটি হচ্ছে একটি গার্হস্থ্য ধর্মবিশ্বাস, এর আচার মূলত শুরু হয় তাদের নিজস্ব বৈঠকখানা থেকে। কিন্তু সেগুলো বাহা’ই মতবাদের সূচনা যে ইসলামের মধ্যে হয়েছে, সেটি প্রতিফলিত করে। আচার অনুসারে নিজেদের ধৌত করার পর, তারা একটি সুনির্দিষ্ট দিকে মুখ করে প্রার্থনা করেন। তারা মক্কা-অভিমুখে নয়, বরং তারা ইজরায়েলে অবস্থিত তাদের নবী বাহা’উল্লাহর সমাধির দিকে মুখ করে প্রার্থনা করে থাকেন। এবং তাদের প্রার্থনা খুব সরল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ও আমার ঈশ্বর, তোমাকে জানতে আর উপাসনা করতে তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ… তুমি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই, আমাদের বিপদে সহায়…’।

বাহা’ই ধর্মটি আমাদের সময়ের ধর্মগুলোর মধ্যে অতীতের বিভাজন ফেলে এসে একটি নতুন ভিন্নধরনের ঐক্যের পথে অগ্রসর হবার প্রবণতার একটি উদাহরণ। এবং এটি সেইসব পদ্ধতি থেকে আসে না, যারা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে জোরপূর্বক একটি একক প্রতিষ্ঠানের অধীনে নিয়ে আসার জন্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করেন। বরং এটি সেই কাজটি করে একটি ঐক্যতা আর সমগ্রতাকে উন্মোচন করে, যা ইতিমধ্যেই সেখানে উপস্থিত : আমাদের সমগ্র মানবতার সাধারণ ঐক্যতা। আর কথা বলার মাধ্যমে নয় বরং আরো বেশি শোনার মাধ্যমেই কেবল আমরা এটি আবিষ্কার করতে পারব। কারণ বিশৃঙ্খল হট্টগোলের মধ্যে নয়, এটি বেশি প্রকাশিত হয় নীরবতায়।

তবে এটি বিশ্বজনীন প্রবণতা হয়ে ওঠা থেকে এখনো অনেক দূরে। এর বিপরীতমুখী একটি প্রবণতা এটিকে ভারসাম্যে আটকে রেখেছে। আর এটি করছে সেই ক্ষুব্ধ মৌলবাদীরা, যারা নিজেদের ঈশ্বরের সত্যের একমাত্র মালিক ও রক্ষাকর্তা হিসাবে দেখে থাকেন। আর তারাই বর্তমান এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিততম কিছু সহিংসতার জন্যে দায়ী। আমরা পরের অধ্যায়ে তাদের কাহিনি শুনব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *