১৯. মেসাইয়া

অধ্যায় ১৯. মেসাইয়া

জিসাস (ইয়েসুস) ক্রাইস্ট বা যিশুখ্রিস্ট সম্বন্ধে প্রথম জানার বিষয়টি হচ্ছে যে খ্রিস্ট বা ক্রাইস্ট তার কোনো পদবী নয়। এটি একটি খেতাব। ‘ক্রিস্টোস’ শব্দটি হচ্ছে ‘মেসাইয়া’ শব্দটির হিব্রু প্রতিশব্দের গ্রিক অনুবাদ। তিনি ছিলেন জিসাস দ্য মেসাইয়াহ বা যিশুখ্রিস্ট। তবে সবাই যেহেতু বিষয়টি নিয়ে একমত ছিলেন না, তার নামটি বেশ বিতর্কিত ছিল, আর সেই বিতর্কটি তাকে তার মৃত্যু অবধি অনুসরণ করেছিল। যখন রোমানরা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল, তারা এই নাটকটি অব্যাহত রেখেছিলেন। তার মাথার উপর ক্রুশে একটি পরিহাস-সূচক চিহ্ন খোদাই করে দেওয়া হয়েছিল : ইহুদিদের রাজা, ইয়েসুস নাজারেনাস, রেক্স জুডাইওরাম, নাজারেথের ইয়েসুস (ইহুদিদের রাজা)। তিনি তাদের কাছে শুধুমাত্র ঠাট্টার পাত্র ছিলেন মাত্র, আরেকজন পাগল ইহুদি যে-কিনা পৃথিবী পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছেন।

একেবারে শুরু থেকে তাকে নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত ছিল : কোথা থেকে তিনি এসেছেন, তার পিতামাতা কারা ছিলেন, তিনি নিজে কী, সেটি নিয়ে কী ভাবেন, তার মৃত্যুর পর তার সাথে কী ঘটেছিল। বিতর্ক এখনো চলমান। তাকে নিয়ে বহু হাজার কোটি শব্দ রচনা করা হয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীনতমটি আছে খ্রিস্টীয় বাইবেল বা নিউ টেস্টামেন্টে (নতুন নিয়ম), নামটি এভাবে দেওয়া হয়েছিল ইহুদি বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট (পুরাতন নিয়ম) থেকে এটিকে পৃথক করতে। আর এই পার্থক্যটি ইঙ্গিত দেয় কীভাবে তার প্রথম অনুসারীরা তাকে দেখেছিলেন। তাদের কাছে তিনি কোনো নতুন ধর্ম শুরু করতে আসেননি, তিনি ইহুদিদের পুরনো ধর্মটিকে পূর্ণ করতে এসেছিলেন। ঈশ্বর আব্রাহাম আর মোজেসকে আহ্বান করেছিলেন প্রথম অঙ্গীকার বা টেস্টামেন্ট বা নিয়মটি প্রতিষ্ঠা করতে। এরপর তিনি যিশুকে একটি নতুন অঙ্গীকারপত্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেটাকেই মেসিয়ার যুগে সম্পূর্ণতার চূড়ান্ত সীমানায় নিয়ে যাবার জন্যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

তার জীবন সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের নিউ টেস্টামেন্টের আশ্রয় নিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যেভাবে এটি সংকলিত আর সংগঠিত করা হয়েছে সেটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এটি শুরু হয়েছিল চারটি বই দিয়ে, যাদের বলা হয় ‘গসপেল’, যে-শব্দটির অর্থ শুভসংবাদ বা সুসমাচার। আর এই গসপেলগুলোর ধারাবাহিক ক্রমবিন্যাস হচ্ছে এরকম : ম্যাথিউ বা মথি, মার্ক, লুক এবং তারপর জন অনুসারে সুসমাচার (মথি, মার্ক, লুক ও জনের লেখা নতুন নিয়মের চারটি শাস্ত্রীয় সুসমাচার)। তারপরে আরেকটি বই, যার নাম ‘দ্য অ্যাক্টস অব দ্য আপোস্টোলস’, এরপরে আছে বেশকিছু চিঠি, যেগুলোর অধিকাংশেরই লেখক ছিলেন পল, ধর্মান্তরিত যে-ব্যক্তির সাথে আগের অধ্যায়ে আমাদের দেখা হয়েছিল। বেশ, তাহলে কেন আমি আগের অধ্যায়টি ম্যাথিউ’র লেখা দিয়ে শুরু করিনি, খ্রিস্টীয় বাইবেলে যা হচ্ছে প্রথম লিখিত অংশ?

কারণ এটি প্রথম লেখা নয়। প্রথম বা সবচেয়ে পুরনো যে লেখার বিষয়ে আমরা নিশ্চিত, সেটি হচ্ছে একটি চিঠি, ৫৫ খ্রিস্টাব্দে, যিশুর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরে যে-চিঠিটি পল গ্রিক শহর করিন্থের নতুন খ্রিস্টান ধর্মান্তরিতদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন। এখানে যিশুর জীবনে কী ঘটেছিল সেটি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখানো হয়নি, শুধুমাত্র তার মৃত্যুর পর তার সাথে কী ঘটেছিল সেটি ছাড়া। এর বার্তাটি ছিল, মৃত্যু তাকে শেষ করে দেয়নি। এটি তাকে নিয়ে গেছে ঈশ্বররূপে তার একটি নতুন জীবনে, যেখান থেকে এই পৃথিবীতে তার ফেলে-যাওয়া সহচরদের সাথে তিনি যোগাযোগ রাখতে সক্ষম। পল বহুশত মানুষের একটি তালিকা করেছিলেন, মৃত্যুর পর যিশু যাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যার মধ্যে অবশ্যই দামাস্কাসের পথে তার নিজের অভিজ্ঞতাটিও ছিল।

সুতরাং নিউ টেস্টামেন্ট প্রথমেই যিশুখ্রিস্ট সম্বন্ধে আমাদের যা জানায়, সেটি হচ্ছে মৃত্যু তাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়নি। তার আবির্ভাবগুলোই প্রমাণ করেছে যে, মৃত্যু তার জন্যে কোনো পরিসমাপ্তি ছিল না। এটি ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত নতুন যুগের একটি সূচনা ছিল মাত্র, পৃথিবীতে নতুন একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঈশ্বরের অভিযানের প্রথম পদক্ষেপ। এবং যিশুর অনুসারীদের জন্যেও তাদের মৃত্যুই চূড়ান্ত পরিণতি হবে না। যদি তারা মারা যান, তারাও তাদের মৃত্যুর পর একটি নতুন জীবন অর্জন করবেন। তাদের এমনকি নাও মরতে হতে পারে। যিশুর পুনরুত্থান প্রমাণ করেছে যে, অবশেষে ঈশ্বর দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। ঈশ্বরের ক্রটিহীন নতুন রাজ্য, যার বর্ণনা যিশু দিয়েছেন, সেটি খুব শীঘ্রই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবং তখন সবকিছুই বদলে যাবে। এমনকি মৃত্যুও।

৫৫ খ্রিস্টাব্দে করিন্থবাসীদের উদ্দেশ্যে লেখা পলের সেই চিঠিতে আমরা প্রথম যিশুর একটি চিত্র দেখতে পাই। এটি তার মৃত্যুপরবর্তী সময়ে কী ঘটেছে, শুধু সেই সময়টাকেই বর্ণনা করেছিল। তবে তার আগের জীবন সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের গসপেলের কাহিনিতে প্রবেশ করতে হবে, যেগুলো লেখা হয়েছিল আরো পরে। প্রথম যেটি লেখা হয়েছে সেটি লিখেছিলেন মার্ক, ৬০ খ্রিস্টাব্দের শেষে অথবা ৭০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে। ম্যাথিউ আর লুকের সুসমাচার এসেছে ৮০ আর ৯০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো সময়ে। আর জনের শেষ সুসমাচার লেখা হয়েছিল ১০০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে কোনো একটি সময়ে। এই সময়গুলো লক্ষ করা দরকার। আপনি সময়ের হিসাবে যতই কোনো একজন নবীর জীবনকালের সময় থেকে বেশি দূরে চলে যাবেন, ততই তার কাহিনিতে নানা বাড়তি বিষয় যুক্ত হবে, এটি আরো বেশি বানানো আর অলংকৃত হয়ে উঠতে থাকে। যিশুর সাথেও এমনই ঘটেছিল। আমি সেই বিতর্কে প্রবেশ করতে চাই না। যে, তিনি কোথায় এবং কত সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ঠিক কীভাবে মৃত্যুর পর তার পুনরুত্থানের ঘটনাটি ঘটেছিল। অথবা ঠিক কয়জন ফেরেশতা বেথলেহেমে তার জন্মের সময় আর জেরুসালেমে তার পুনরুত্থানের সময় উপস্থিত ছিলেন। আমি তার সম্বন্ধে সাধারণভাবে গৃহীত কিছু বাস্তব তথ্যের সাথেই কেবল নিজেকে যুক্ত রাখব। আর বিশ্বাস করানোর জন্য সেগুলো যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী।

মার্ক সরাসরি মহাপ্রলয়ের কোনো নাটকের একটি দৃশ্যের সামনে আমাদের হাজির করেছিলেন। একজন বন্যমানুষ, যিনি লোকাস্ট বা পঙ্গপাল আর বন্যমধু খেয়ে বাঁচতেন আর উটের পশমে নির্মিত কাপড় পরিধান করতেন, একদিন মরুভূমি থেকে বাইরে এসে তিনি ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। তাকে তারা। নাম দিয়েছিলেন জন দ্য ব্যাপটাইজার’, কারণ তিনি মানুষকে জর্ডান নদীর পানিতে নিমজ্জিত করতেন, পাপের জন্যে যারা অনুতপ্ত ও একটি নতুন সূচনা চান। তারই একটি চিহ্ন হিসাবে। তারা তাদের ফেলে-আসা জীবনটি পানিতে নিমজ্জিত করে, নতুন জীবনে ভেসে উঠতেন। জন নিজেকে মেসাইয়া হিসাবে কখনোই দাবি করেননি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, যিনি আসল মেসাইয়া, তার প্রত্যাবর্তনের পথ প্রস্তুত করতেই তার আগমন। মার্ক তারপর আমাদের জানান, জনের হাতে ব্যাপটাইজ হতে গ্যালিলির নাজারেথ থেকে একজন ব্যক্তি জর্ডানে এসেছিলেন। ইতিহাসে এখানেই আমরা প্রথম যিশুর দেখা পাই। ততদিনে তার বয়স হয়েছিল। ত্রিশ। এরপরে যা ঘটেছিল সেটাই ছিল তার কাহিনির সত্যিকার সূচনা।

যখন জন তাকে পানির নিচে কয়েকটি দীর্ঘ সেকেন্ড নিমজ্জিত করে আবার তাকে পানির উপর টেনে তুলেছিলেন, যিশু চোখ-ধাঁধানো একটি আলো দেখতে পেয়েছিলেন এবং শুনেছিলেন ঈশ্বর তাকে তার প্রিয় ‘পুত্র’ নামে সম্বোধন করছেন। যদিও আমরা নিশ্চিত নই সেটাই সেই বিশেষ মুহূর্ত ছিল কিনা, যখন এই ইয়েসুস বা যিশু জানতে পেরেছিলেন যে, তিনি হচ্ছেন সেই প্রতিশ্রুত মেসাইয়া। তবে অবশ্যই সেই মুহূর্ত থেকে তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। আবার স্মরণ করে দেখুন, নবীরা আসলে কী করে থাকেন। তারা একটি কণ্ঠ শোনেন যখন ঈশ্বর তাদের সাথে কথা বলেন এবং তারা বাকি সবাইকে তারা যা কিছু শুনেছিলেন সেটি জানান। আর অপরপক্ষের সাথে এটাই তাদের সাংঘর্ষিক একটি অবস্থানে নিয়ে আসে, যারা দাবি করেন ঈশ্বর সম্বন্ধে ইতিমধ্যে যা কিছু জানার আছে তার সবকিছুই তারা জানেন। তারা হলেন ধর্মবিশেষজ্ঞ। গ্যালিলির গ্রামের কোনো এক ছেলের কাছ থেকে তারা এ বিষয়ে শিক্ষা নেবার কথা ভাবতেই পারেন না। যিশু আর ইহুদিবাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিদের মধ্যে সংঘর্ষের তিনটি অবস্থান আমাদের এইসব ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলো সম্বন্ধে যা কিছু জানা প্রয়োজন সবই জানাচ্ছে, যারা তাকে তার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

প্রথমটি আমরা পাই মার্কের সুসমাচারে। তিনি আমাদের বলেন তার ব্যাপটিজম শেষ হবার পর তিনি দরিদ্র আর অসহায়দের মধ্যে তার ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। পাপের দণ্ড হিসাবে দুঃখ পাবার শাস্তির ধারণাটি তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল এবং সেইসাথে এই দুঃখভোগের বাস্তব বিষয়টিও তাকে বিচলিত করেছিল। তার মতে, এই দুর্দশার কারণ ঈশ্বর যেভাবে পৃথিবী বিন্যাস করেছেন সেটি নয়, বরং এর কারণ হচ্ছে ধর্ম আর রাজনীতির ক্ষমতাবানরা যেভাবে সবকিছুকে একটি সাংগঠনিক রূপ দিয়েছেন। তারা এই পৃথিবীকে নিয়ে যা কিছু করেছেন সেটি ঈশ্বর ঘৃণা করেন, আর সে-কারণেই তিনি যিশুকে পাঠিয়েছেন, যখন এটি পৃথিবীর ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে, তার প্রতিশ্রুত রাজ্যটি কেমন দেখতে হবে, সেটি সবাইকে জানাতে। দরিদ্রদের জন্যে এটি হবে একটি সুসংবাদ। এবং ধর্মবাদী আইনপ্রণেতাদের সেই দড়ির ফাঁস থেকে এটি ঈশ্বরের সন্তানদের মুক্ত করবে, যা দিয়ে তাদের জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের সাথে তার প্রথম উন্মুক্ত সংঘর্ষ হয়েছিল সাবাথকে বিশ্রামের দিন হিসাবে চিহ্নিত করে রাখার নির্দেশটি নিয়ে। যিশু একদিন একটি গমক্ষেতের মধ্যে দিয়ে তার কিছু অনুসারীদের নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হাঁটার সময় মুখে দিয়ে চেবানোর জন্যে তারা অল্পকিছু গম তুলেছিলেন এবং সেটি দেখে ফারিসিরা তাদের উপর সাবাথের দিনে আইন অমান্য করার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ তারা শস্য তুলেছেন। এখানে যিশুর উত্তরটি ছিল বৈপ্লবিক। তিনি বলেছিলেন, সাবাথ মানবতার জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, সাবাথের জন্যে মানবতাকে সৃষ্টি করা হয়নি। সমাজের জন্যে আমাদের আইন এবং নিয়মের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেগুলো আমাদের ভৃত্য, অবশ্যই মনিব নয়। আমরা যদি সেগুলো কঠোরভাবে আরোপ করার চেষ্টা করি সেগুলো যে-মানুষগুলোকে সাহায্য করার জন্যে পরিকল্পিত, সেই মানুষগুলোর চেয়েও আইন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। আইনের বিধানের চুলচেরা অনুসরণ বা লিগালিজমকে এর ছয়শো বছর আগেই তাওবাদীরা যেভাবে শনাক্ত করেছিলেন, সেই বাস্তব সত্যটি প্রমাণ করে, এই আইনের প্রতি অন্ধত্ব কত শক্তিশালীভাবেই সমাজের অংশ হিসাবে টিকে গেছে। এখন যিশুকে এটি আমরা চ্যালেঞ্জ করতে দেখছি। মানবতার অধীনস্থ হবে আইন, মানবতা আইনের অধীনস্থ নয়। তাই অবাক হবার কোনো কারণ নেই যে, আইন-সমর্থকরা তাকে ঘৃণা করতেন। তার বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রথম গুরুতর অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে এটি জায়গা পেয়েছিল।

দ্বিতীয় সংঘর্ষ, ‘সার্মন অন দ্য মাউন্ট’, যার বিবরণ আছে ম্যাথিউর সুসমাচারে, এবং এটি আরো বিপজ্জনক। ক্ষমতাবানরা যে তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু পরিচালনা করছিলেন, যিশু এখানে সেটি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তত্ত্বটি ছিল এমন, মানুষ মূলত উচ্ছঙ্খল জনতার দল, যাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। তাদের জন্যে সামান্য একটু ছাড় দিলে, তারা আরো অনেক বেশিকিছু দাবি করে সেটি কেড়ে নেবে। সুতরাং তাদের সারাক্ষণই শক্তহাতে দমন করতে হবে। চোয়ালে মুষ্ঠি আর ঘাড়ের পেছনে বুট হচ্ছে একমাত্র ভাষা, যা তারা বুঝতে পারে। কিন্তু তারপরও ম্যাথিউ আমাদের দেখান যে, একটি পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে, যেভাবে মোজেস তার টেন কম্যান্ডমেন্ট নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যিশু যখন ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হবে তখন পরিস্থিতি কেমন হবে তার বর্ণনা দিয়েছিলেন।

যদি কেউ আপনাকে এক গালে একটি থাপ্পড় মারে, আপনি অন্য গালটি এগিয়ে দেবেন যেন সেখানেও সে থাপ্পড় মারতে পারে। কেউ যদি আপনার গায়ের উপরের আবরণটি চায়, আপনি তাকে পুরো কাপড়টাই নেবার প্রস্তাব করবেন। আপনি আপনার শত্রুদের ভালোবাসবেন, ঘৃণা করবেন না। যারা আপনার সাথে খারাপ কিছু করবে, তাদের জন্য ভালো কাজ করবেন। আপনি ক্ষমা এবং ক্ষমা এবং ক্ষমা এবং ক্ষমা করবেন… অন্তহীনভাবে। স্বর্গে এমনভাবেই সব হয়, পৃথিবীতেও তেমন হওয়া উচিত। যিশুর বর্ণিত এই পুরোপুরি উল্টো। ধরনের রাজ্যটির মূল চাবিকাঠিটি আছে সেই শব্দে, যা তার ব্যাপটিজমের সময় তাকে বলা হয়েছিল, তুমি আমার প্রিয় পুত্র। ঈশ্বর কোনো শাসক নন, মনিব নন, মানব জেলখানার ওয়ার্ডেন নয়, ক্রীতদাসের মালিক নন, বরং তিনি হচ্ছেন ‘পিতা’। এবং মানবজাতি পুরোটাই একটি পরিবার। বৈপ্লবিক কথাবার্তা! সুতরাং সেই সময়ের শাসকরা তার ওপর সতর্ক নজর রেখেছিলেন। এটি তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অপরাধের অভিযোগ ছিল। এটি তার অভিযোগপত্রে জায়গা নিয়েছিল।

তৃতীয় সংঘর্ষটি বর্ণনা করা হয়েছে লুকের সুসমাচারে। যিশু কখনোই কীভাবে চিন্তা করতে হবে এই বিষয়ে কাউকে পরামর্শ দেননি। ইজরায়েলের নবীদের মতো তিনিও গল্প বলেছিলেন, যেন মানুষরা নিজেরাই তাদের হয়ে ভাবার কাজটি করতে পারেন। এক বন্ধুসুলভ শ্রোতা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইহুদিদের ধর্মীয় আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাটি পুনরাবৃত্তি করতে। যিশু উত্তরে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরকে তাদের সমস্ত হৃদয়, আত্মা আর শক্তি দিয়ে ভালোবাসতে হবে। এটাই প্রথম নির্দেশ। দ্বিতীয় নির্দেশটি হচ্ছে নিজেদের যেভাবে তারা ভালোবাসেন, প্রতিবেশীকেও সেভাবে ভালোবাসতে হবে। ‘ঠিক’, উত্তর দিয়েছিলেন সেই শ্রোতা, ‘কিন্তু আমার প্রতিবেশী কারা? গুড সামারিটানের সেই নীতিগর্ভ গল্পটি ছিল যিশুর উত্তর।

একবার একজন ব্যক্তিকে একদল ডাকাত আক্রমণ করেছিল, যারা তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে নগ্ন আর অচেতন অবস্থায় খুব বিপজ্জনক আর নির্জন একটি রাস্তার উপর ফেলে রেখে চলে যায়। একজন যাজক তার সহকারীকে নিয়ে সে-পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা দুজনেই ভালোমানুষ ছিলেন, যারা সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের ধর্ম সেটি করতে বাধা দিয়েছিল। রাস্তার পাশে পড়ে-থাকা মানুষটি হয়তো মৃত হতে পারে। এবং সেই আহত ব্যক্তিটি, হয়তো এমন একটি জাতের ইহুদি, যাদের সাথে তার সম্পর্ক রাখার অনুমতি নেই। সুতরাং স্পর্শ করলেই তারা হয়তো অপবিত্র হয়ে যেতে পারেন। তাকে রাস্তার পাশে সেভাবে ফেলে রেখেই তারা অন্য পাশ দিয়ে সেখান থেকে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন। এরপর সেখানে এসেছিলেন একজন সামারিটান, এটি সেই বর্ণগুলোর মধ্যে একটি, যে বর্ণের সদস্যদের সাথে ইহুদিদের সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তার নিজের ধর্মেও তাদের মতো একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে, কিন্তু সেই মানুষটির কষ্টের প্রতি সহমর্মিতা তার ধর্মের নিষেধাজ্ঞাকে অতিক্রম করতে সহায়তা করেছিল। তিনি সেই মানুষটির সাহায্যে এগিয়ে যান, এবং তার জীবন। রক্ষা করেন। যিশুর মতে, এই প্রতিবেশী এমন কেউ নয়, যাকে অবশ্যই আপনার ধর্মের কেউ হতে হবে। একজন প্রতিবেশী যে-কেউই হতে পারেন, আপনার সহায়তা যার দরকার আছে। যদি ঈশ্বর আমাদের পিতা হয়ে থাকেন আর আমরা তার সন্তান হয়ে থাকি, তাহলে সবাই আমার প্রতিবেশী, আমার ভাই আর আমার বোন।

এই গল্পটির মূল নিশানাটি কী, সেটি বুঝতে ব্যর্থ হওয়া বেশ সহজ একটি ব্যাপার। আইন হচ্ছে নিশানা, মার্ক যখন সাবাথের ঘটনাটি বর্ণনা করেছিল। ক্ষমতার রাজনীতি ছিল নিশানা, যখন ম্যাথিউ সামন অন দ্য মাউন্ট বর্ণনা করেছিলেন। আর গুড সামারিটানের গল, যা লুকের সুসমাচারে আমরা পাই, সেটির নিশানা ছিল ‘ধর্ম’। যিশু বলেছিলেন, যে-প্রতিষ্ঠানগুলো ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করছে, সেগুলো খুব সহজেই ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হতে পারে। কারণ এটি ঈশ্বরের ভালোবাসার চেয়ে নিজের শাসন আর ক্ষমতাকেই বেশি মূল্য দেয়। সুতরাং, খুব বিস্ময়কর নয়, যাজক-পুরোহিতরা যিশুকে ঘৃণা করতেন এবং তার বিরুদ্ধে তারা একটি ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেছিলেন। এটি ছিল তার বিরুদ্ধে তৃতীয় অপরাধের অভিযোগ। এটিও তার অভিযোগের তালিকায় যুক্ত হয়, এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্যে প্রয়োজনীয় অভিযোগপত্র প্রস্তুত হয়েছিল। অতএব তাকে গ্রেফতার করা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।

যিশু তার শিষ্যদের একটি প্রার্থনা শিখিয়েছিলেন। এটি সংক্ষিপ্ত তবে এই অল্পকিছু বাক্যের মধ্যে ঠাসা ছিল তার সব শিক্ষা, যা তিনি এতদিন ধরে প্রচার করে আসছিলেন : ‘আমাদের পিতা, যিনি স্বর্গে বাস করেন, এটি এভাবে শুরু হয়েছিল, আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে, স্বর্গে যেমন, তেমনি পৃথিবীতেও আপনার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এই প্রার্থনাটি এতদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যে, এমনকি খ্রিস্টানদের জন্যে এটি এর মূলশক্তিটি হারিয়ে ফেলেছে, যারা এটি এখনো ব্যবহার করেন। কিন্তু এর সেই প্রভাবটির কথা কল্পনা করুন যদি আপনি একজন যাজক হতেন, যিনি ভাবেন পৃথিবীতে তিনি ইতিমধ্যে ঈশ্বরের সেবা করছেন। অথবা আপনি যদি রাজনৈতিক কোনো নেতা হয়ে থাকেন, যিনি কোনো বিদ্রোহী উপনিবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন? এটি ছিল যুদ্ধ ঘোষণার বার্তা। মানুষ হত্যা হবার জন্যে যা যথেষ্ট হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *