১৬. কাদা মন্থন

অধ্যায় ১৬. কাদা মন্থন

যখন আগের অধ্যায়ে তিব্বত নিয়ে আমি আলোচনা করছিলাম, তখন এটিকে দূরবর্তী আর দুর্গম দেশ হিসাবে বর্ণনা করেছিলাম। আমি অসতর্কভাবেই কথাটা বলেছিলাম। অন্ধ মানুষ আর হাতিদের সেই নীতিগর্ভ গল্পটি, পৃথিবীটাকে আমরা যেভাবে দেখি, সেটি তেমনই, এমন কিছু অনুমান করে নেবার ব্যাপারে আমাদের। সতর্ক করে দিয়েছিল। আমার কাছে তিব্বত বহু দূরবর্তী হতে পারে। কোনো তিব্বতীয়দের এটি তাদের মাতৃভূমি, এবং তাদের জন্যে স্কটল্যান্ড বহু দূরের একটি দেশ। জাপান নিয়ে আমি প্রায় সেই একই ভুলটি করতে যাচ্ছিলাম। এটি চীন থেকে বহুদূরে, সাগরের মধ্যে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। এমনকি চীনের অধিবাসীরা, তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী, ৬০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই। দেশে পা রাখেনি। সুতরাং জাপান বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, এমন কিছু ভাবতে আমরা প্রলুব্ধ হতে পারি। তাহলে কেন আমরা ভাবছি না, বাকি পৃথিবীটাই বরং জাপান থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল? বহু দীর্ঘ সময় ধরেই জাপানের অধিবাসীদের জানা ছিল না যে, একটি পৃথিবী আছে যেখান থেকে তাদের দেশটি বিচ্ছিন্ন। তারা ভেবেছিলেন জাপানটাই হচ্ছে সম্পূর্ণ পৃথিবী। শুধুমাত্র জাপান তাদের দেশই নয়, জাপান তাদের ধর্মও ছিল। এবং তারা তাদের দেশটিকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সুতরাং জাপানের ধর্ম বোঝার আগে, তাদের স্বদেশ সম্বন্ধে জাপানিদের অনুভূতিটি কেমন সেটি আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে।

‘জাপান’ শব্দটির মধ্যেই এই রহস্যটির সমাধানের খানিকটা ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই নামটি এসেছে দেশটিকে চীনারা যে নাম দিয়েছিল, সেই নামটি উচ্চারণ করার ইউরোপীয় প্রচেষ্টা থেকে। স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের দেশটিকে ‘নিপ্পন’নামেই ডাকেন, যার অর্থ, উদিত সূর্যের দেশ, যে বর্ণনাটি যথার্থ। পূর্বদিকে তাকালে প্রশান্ত মহাসাগরে ঝলমলে শূন্যতাই প্রথমে তাদের চোখে পড়ত, যেখান থেকে প্রতিদিন সূর্য ওঠে, এই দ্বীপপুঞ্জের ৬৮৫২টি দ্বীপে এর সোনালি আলো ঢেলে দিতে। সুতরাং আদৌ বিস্ময়কর নয়, নিপ্পনবাসীদের সৃষ্টিকাহিনিতে সূর্যের প্রধান একটি ভূমিকা ছিল। প্রতিটি ধর্মেরই একটি সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনি আছে, যেগুলো পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, কীভাবে এটি এর অস্তিত্ব পেয়েছে, সেই বিষয়ে নিজস্ব একটি সংস্করণ প্রস্তাব করেছে। জাপানের আলোচনায় আবার ফিরে আসার আগে, সেই সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনিগুলোর কয়েকটি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার এখন সময় হয়েছে।

ভারতের বহু সৃষ্টিপুরাণ আছে। এদের একটি দাবি করে যে, সময় অস্তিত্বশীল আর পৃথিবী সৃষ্টি হবার আগে একটি বিশাল সত্তা ছিল, যার নাম পুরুষ, যিনি বিস্ফোরিত হয়েছিলেন এবং চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া এর উপাদানগুলো দিয়েই সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি হিন্দু জাতপ্রথার সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও।

আব্রাহামের জন্মস্থান, মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা বলতেন, একেবারে শুরুতে দুটি বিশালাকৃতির দানব ছিল, ‘আপসু বা মিষ্টি পানি আর ‘টিয়ামাট’ বা লবণাক্ত পানি। তারা পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছিল এবং অন্য দেবতাদের আর সমুদ্র দানবদের জন্ম দিয়েছিল। এবং যেভাবে মাঝে মাঝে সাগর শুষ্ক সমতল এলাকা প্লাবিত করে, নারীসঙ্গী টিয়ামাটও সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তার নিজের পরিবারই তার বিরোধিতা করে এবং তাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। তারা তার মৃতদেহকে দ্বিখণ্ডিত করে স্বর্গ আর পৃথিবী সৃষ্টি করে। স্বর্গ নির্মিত হয়েছিল দেবতাদের বাসস্থান হিসাবে। আর তাদের সেবা করার জন্যেই মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং নিচে পৃথিবীতে দেবতারা তাদের সেই ভূত্যদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

মিশরে একই ধরনের কাহিনি আছে, যেখানে আবারও পানির গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা আছে। একেবারে শুরুতেই ছিল শুধুমাত্র সাগর। তারপর, যখন এই মহাপ্লাবনের নিমজ্জন ক্রমশ সরে যেতে শুরু করেছিল, একটি পাহাড় পানির উপরে জেগে উঠেছিল। একটি বর্ণনায় বলা হচ্ছে, তখন সূর্যদেবতা ‘রা’, সেই দৃশ্যে এসে অন্য দেবতাদের এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। আরেকটি সংস্করণে পৃথিবীর দেবতা পিটাহ, যিনি প্রথমে এসেছিলেন, এবং সবকিছুর সূচনা করেছিলেন।

আমরা যদি উত্তরে স্ক্যানডিনেভিয়ার দিকে যাই, সেই একই পানির কাহিনি পাব। একেবারে শুরুতেই ছিল শূন্যতার একটি অতল গহ্বর। এটি পানি দিয়ে পূর্ণ। হয়েছিল, তারপর পানি জমে বরফে রূপান্তরিত হয়েছিল। তারপর আবার এটি গলতে শুরু করেছিল, আর গলিত পানি থেকে একটি বিশাল দানব ইমিয়ারের আবির্ভাব হয়েছিল। তারপর তার বগল থেকে একজোড়া নারী ও পুরুষ বেরিয়ে এসেছিলেন। যখন এইসব ঘটনা ঘটছিল, একটি গরু বরফ স্তর চেটে খুব পাতলা করে দেবার কারণে আরো একটি দানব সেখান থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পেয়েছিল। এই দানব থেকেই দেবতা ওডিনের জন্ম হয়েছিল। এইসব দেবতাদের পেশাগত জীবনে সাধারণত যা হয়ে থাকে, প্রচুর যুদ্ধ আর হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। ওডিন ও তার ভাই ইমিয়ারকে হত্যা করে তার শরীর থেকে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিল। তার মাথার খুলি দিয়ে স্বর্গ এবং রক্ত থেকে সাগর সৃষ্টি করা হয়েছিল। আর তার শরীরর হাড়গুলো হয়েছিল পাহাড়, চুল থেকে সৃষ্টি হয়েছিল গাছ। ইত্যাদি আরো নানা খুঁটিনাটি বিষয় আছে, কিন্তু আপনি মোটামুটি বুঝতে পারছেন। আমি কী বলতে চাইছি।

এইসব দাঙ্গাহাঙ্গামার গল্প থেকে ইহুদি বাইবেলের সৃষ্টিকাহিনির দিকে তাকালে আমরা খানিকটা স্বস্তি অনুভব করতে পারি, এটির সূচনা কমন এরা শুরু হবার ৯০০ বছর আগের কোনো একটি সময়। জেনেসিসের দুটি সংস্করণ আছে, প্রতিটি খুব দৃঢ়ভাবে একেশ্বরবাদী, এবং দুটিতেই সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জেনেসিসে বর্ণিত সেই ‘দ্য ডিপ’, যা নিয়ে ঈশ্বর খুব উৎকণ্ঠিত চিন্তায় মগ্ন ছিলেন এবং এখান থেকেই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি এই কাজটি করেছিলেন ছয়দিনে এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সপ্তম দিনে কিছু না করাও ছিল তার জন্যে একটি সৃজনশীল কাজ, যা সবার জন্যে সাবাথকে একটি ছুটির দিন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

জাপানের এই কাহিনিটি এসেছে জেনেসিসের সমসাময়িক সময় থেকে এবং আবারো সাগর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। একেবারে শুরুতে ছিল শুধু সমুদ্র। তারপর দেবতা ইজানাগি এবং দেবী ইজানামি তাদের দীর্ঘ বর্শা দিয়ে সাগরের নিচে কাদা মন্থন করেছিলেন এবং সেই কাদা থেকেই জাপানের বহুসংখ্যক দ্বীপগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। এই স্বর্গীয় দম্পতি তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন : সূর্যের দেবী, তার দুই ভাই, চাঁদ দেবতা আর ঝড়ের দেবতা। সূর্যদেবীর নিজেরও সন্তান হয়েছিল, তার নাতি নিপ্পনের প্রথম সম্রাট হয়েছিলেন।

কিছুক্ষণের জন্য এই গল্পগুলো নিয়ে ভাবা যুক্তিযুক্ত হতে পারে, কারণ ধর্ম কীভাবে কাজ করে সেটি বুঝতে এই গল্পগুলো আমাদের সহায়তা করে। এগুলো সত্য, নাকি মিথ্যা? এটি নির্ভর করবে এই গল্পগুলোর উদ্দেশ্য কী সেটি নিয়ে আপনি কী ভাবেন তার ওপর। নবী নাথান রাজা ডেভিডকে যে-গল্পটা বলেছিলেন, সেটি কি মনে আছে? সেটি কি সত্য, নাকি মিথ্যা ছিল? বাস্তবিক তথ্যবিচারে সেটি মিথ্যা একটি গল্প ছিল। কোনো ধনী ব্যক্তি ছিলেন না, যিনি কিনা গরিব সেই অসহায় ব্যক্তির ভেড়াটি চুরি করেছিলেন। কিন্তু নৈতিকতার অর্থে এটি সত্য। গল্পটি উদ্ভাবন করা হয়েছে ডেভিডকে তার অপকর্মটি সম্বন্ধে ভাবাতে, এবং এটি কাজ করেছিল। এর শৈল্পিক সত্যতা আছে, বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই। বিজ্ঞান বাস্তব তথ্য বা ফ্যাক্ট নিয়ে আগ্রহী, যেভাবে কোনোকিছু কাজ করে। শিল্পকলার আগ্রহ হচ্ছে নিজেদের জীবনে সেই সত্যটাকে আমাদের কাছে অনাবৃত করে তোলা। আর সে কারণে কোনো কাহিনি আপনাকে কাঁদাতে পারে, যখন আপনি এটিকে নিজের অভিজ্ঞতার সমরূপ হিসাবে শনাক্ত করতে পারবেন : এটাই তো আমি! ধর্ম একটি শিল্পকলা, এটি বিজ্ঞান নয়।

সুতরাং কোনো সৃষ্টিপুরাণ সত্য বা মিথ্যা কিনা, সেই প্রশ্নটি করা উচিত নয়, বরং যে-প্রশ্নটি করতে হবে, সেটি হচ্ছে এটি আসলে কী বোঝাতে চাইছে, এটি আমাদের কী বলতে চাইছে, এই বিভাজনটি বহু ধর্মীয় মানুষই পুরোপুরি কখনোই বুঝে উঠতে পারেন না। এবং আমরা পরে দেখব, তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে নির্বোধ হিসাবে উপস্থাপন করেন, যখন তারা বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিকাহিনি শিল্পকলার কাজ নয়, বরং বিজ্ঞানের একটি কাজ হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।

যেসব সৃষ্টিকাহিনির কথা উপরে আলোচনা করেছি তার কোনোটাই বাস্তবতার অর্থে সত্য নয়, কিন্তু এগুলো প্রত্যেকটি কোনো-না-কোনো একধরনের অর্থ ধারণ করে। বাইবেলের গল্পটি বোঝা অপেক্ষাকৃত সহজ, এমনকি যদি আপনি তার সাথে একমত নাও হতে পারেন : এই মহাবিশ্ব নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি, এটি সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। এবং মেসোপটেমিয়া আর স্ক্যান্ডিনিভিয়ার কাহিনির সেই সহিংস সংঘর্ষ পৃথিবীর নিরন্তর সহিংসতা আর নিষ্ঠুরতারই প্রতিনিধিত্ব করে।

এই গল্পগুলো এসেছে মানুষের মন থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই গল্পগুলো কি ঈশ্বর নিজেই মানুষের মনে স্থাপন করেছিলেন, নাকি মানুষই এটি পুরোপুরিভাবে সৃষ্টি করেছে। যেভাবেই আপনি এই প্রশ্নটির উত্তর দেবার চেষ্টা করুন না কেন, এই কাহিনিগুলো কাহিনি হিসাবেও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এবং সেখানে কিছু অংশ থাকে যেগুলো প্রাচীন কোনো সময়ের ঘটনার স্মৃতি হিসাবে বহন করে আনা হয়েছে : একটি বিস্ফোরণ, যা সব পরিবর্তনের সূচনা করেছিল, একটি সমুদ্র যা সব প্রাণীর জন্ম দিয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের সৃষ্টিকাহিনি বলছে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে প্রায় চোদ্দ বিলিয়ন বছর আগে ঘটা একটি ‘বিগ ব্যাং’ থেকে। এবং আমাদের গ্রহে কীভাবে জীবনের সূচনা হয়েছিল সেই বিষয়ে এর সেরা অনুমানটি হচ্ছে, এটির সূচনা হয়েছিল সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে কোনো একটি সময়ে। তরুণ পৃথিবীকে আবৃত করে থাকা সমুদ্রগুলো ছিল নানা রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ, যা সৃষ্টি হয়েছিল আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতের সময়, এবং এই রাসায়নিক দ্রব্যগুলো ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় প্রথম প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল। কয়েক বিলিয়ন বছর পর আমরা ধীরে ধীরে এই দৃশ্যে প্রবেশ করেছি। পৃথিবীর নিজের ইতিহাসের স্মৃতি ঐসব শিল্পীদের মনের মধ্যে চুঁইয়ে প্রবেশ করেছিল, যারা সময়ের মধ্যে দিয়ে সেই অতীতের দিকে তাকিয়েছিলেন সবকিছুর অর্থ খুঁজতে? আমার কাছে বিষয়টি অসম্ভব মনে হয় না। এর কারণ হতে পারে পুরো মহাবিশ্বই খুব অদ্ভুত এবং প্রায় যে-কোনোকিছুই এখানে কল্পনা করা সম্ভব।

নিপ্পন দেশের মানুষদের এই সৃষ্টিপুরাণের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী বিষয়টি হচ্ছে যখন দেবতারা সাগরের নিচে তাদের বর্শার ফলা দিয়ে কাদা ঘেঁটেছিলেন, তারা একটি পৃথিবী তৈরি করেননি, তারা শুধু জাপান সৃষ্টি করেছিলেনঅথবা তারা একটি জগৎ বানিয়েছিলেন, যেখানে জাপান ছাড়া কিছু ছিল না। আর এভাবেই তাদের সুন্দর দ্বীপপুঞ্জের প্রতি যে-ভালোবাসাটি তারা অনুভব করেন সেটি ব্যাখ্যা। করেছিলেন। দ্বীপ জাতিগুলো নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকার বিষয়টি এড়াতে পারে না। তাদের এমন কোনো স্থলসীমানা ছিল না যার মধ্যদিয়ে মানুষের আনাগোনা হতে পারে, সুতরাং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দেবতাদের দ্বারা তাদের ধর্মীয় তাড়নাগুলো কদাচিৎ প্রভাবিত হবার সুযোগ পেয়েছে। আদি জাপানি ধর্ম সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জানি, সেটি এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এবং আমরা যদি স্মরণ করি, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ছাড়া আর কখনোই জাপান কারো পরাধীন হয়নি, তাহলে আমাদের বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই এমন কিছু। যদি আবিষ্কার করি : তাদের দ্বীপ জাতিকে জাপানিরা যে তীব্রভাবে ভালোবাসে শুধুমাত্র সেটাই নয়, তারা বিশ্বাস করতেন এটি অদ্বিতীয়। আর খুব দূর-অতীতে সম্ভবত তারা ভেবেছিলেন, জাপানের বাইরে আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই।

দেবতারা জাপান শুধু সৃষ্টিই করেননি, এটি তাদের নির্বাচিত বাসভূমিও ছিল। অন্য ধর্মগুলো বিশ্বাস করে, দেবতারা ইচ্ছা হলেই পৃথিবীতে আসতে পারেন, কিন্তু তাদের মূল বাসস্থান, আকাশের বহু উপরে একটি বিশেষ এলাকা, যাকে স্বর্গ বলা হয়। আর জাপানিদের কাছে তাদের সুন্দর দ্বীপপুঞ্জটি ছিল সেই বিশেষ এলাকা, তাদের কাছে স্বর্গ আর পৃথিবী ছিল একই জায়গা। স্বর্গ পৃথিবীর মধ্যে আর পৃথিবী স্বর্গের মধ্যে। কিছু ধর্ম যেভাবে মানুষের শরীরকে অমর আত্মার শারীরিক বাসস্থান। হিসাবে দেখে থাকে, ঠিক সেভাবেই জাপানিরা তাদের দেশ সম্বন্ধে ভাবতেন। জাপানের দ্বীপপুঞ্জটি ছিল কামি’ নামের পবিত্র আত্মাদের বাস্তব অভিব্যক্তি, যারা প্রকৃতিতে সর্বত্র বিরাজমান। প্রাণীদের মধ্যে তাদের বসবাস, জাপানের পর্বতমালাতেও তারা অবস্থান করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর পবিত্রটি হচ্ছে মাউন্ট ফুজি। এই কামি আত্মাদের দেখা মেলে গাছ আর নদীতেও।

আমি বলেছিলাম যে, এটাই ছিল তাদের ধর্ম, কিন্তু সেটি পুরোপুরি সঠিক নয়। এটি পৃথক একটি ধারণা প্রস্তাব করেছিল, একটি বিশ্বাস যা তারা তাদের চিন্তায় ধারণ করে। আপনি নিজস্ব সত্তা-সংক্রান্ত বোধ, আপনি কে সেটি নয় বরং নিজের সম্বন্ধে আপনি চিন্তায় যা ধারণ করেন অথবা যা বিশ্বাস করেন, সেটিকে ধর্ম হিসাবে বর্ণনা করলে ঠিক যেমন ভুল হবে। জাপানিরা অনুভব করেছিল যে, তারা একটি মহান সত্তার জালে আবৃত হয়ে আছেন, যার গঠনগত উপাদান হচ্ছে তাদের দেশটির ভূখণ্ড, তারা নিজেরা এবং সেই আত্মারা, যা সবকিছুই জীবন্ত করে তোলে। এটি এমন কিছু না যে তারা বিশ্বাস করতেন। এটি শুধুমাত্র তারা যেমন ছিলেন।

জীবনের প্রতি এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারিগরি নাম হচ্ছে ‘অ্যানিমিজম’ বা। সর্বপ্রাণবাদ। এটি ‘গাইয়া’ নামের একটি আধুনিক তত্ত্ব থেকে খুব একটা দূরে নয়, যা এই গ্রহটিকে ধ্বংস আর স্বার্থপর ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট বস্তু হিসাবে নয়, বরং একটি জীবন্ত সত্তা হিসাবে দেখে, যাকে পরিবারের সদস্য আর বন্ধুদের মতোই যত্ন। করতে হবে একই ভালোবাসা দিয়ে। এর মানে প্রকৃতি এর নিজস্ব প্রাণশক্তিতে জীবন্ত এবং মানুষের মতোই এটি গুরুত্বপূর্ণ। জাপানিরা এটি তাদের হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন। ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হিসাবে কিন্তু তাদের এই নির্দেশ দেওয়া হয়নি, প্রকৃতিকে তাদের অবশ্যই ভালোবাসতে হবে। তাদের এমন কিছু বলা হয়নি যে, পৃথিবী এরকম, সেটি তাদের বিশ্বাস করতেই হবে। পৃথিবীর এই প্রকৃতি আবিষ্কার করা উপলক্ষ্যে তারা কোনো একটি দিন বিশেষভাবে উদ্যাপনও করেন না। এই বিষয়ে তাদের কোনো বিশ্বাস নেই। শুধুমাত্র দেশটির সেই প্রবিত্র আত্মা বা কামি’র জন্য ভালোবাসা, যে-ভালোবাসাটি তারা সুন্দর জায়গাগুলোয় বিশেষ মন্দির নির্মাণ করে প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিটি মন্দিরের ছিল বৈশিষ্ট্যসূচক একটি প্রবেশপথ, যা নির্মিত হয়েছিল দুটি উল্লম্ব আর দুটি আড়াআড়িভাবে সংযোগকারী খুঁটি দিয়ে। আজও জাপানে এধরনের মন্দিরের সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি। এবং সেগুলো এখনো সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

৬০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো একটি সময় চীনের অধিবাসীরা জাপানে–আসার আগ পর্যন্ত, পৃথিবীর প্রতি তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিটির এমনকি কোনো নামই ছিল না। চীনারা দেশ-দখল বা ধর্মপ্রচার করার মতো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে জাপানে আসেননি, তবে তারা কনফুসিয়াসের মতাদর্শ, তাওবাদ এবং বৌদ্ধবাদ সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। আর এই ধর্মগুলোর প্রতিটি পরবর্তীতে জাপানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হয়তো এর কারণ ছিল যে-বিশ্বাস আর আচারগুলোর সংস্পর্শে চীনারা আসতেন, তারা সেগুলোকে শ্রেণিবিন্যস্ত করতে ভালোবাসতেন। অথবা, দেশে যে নতুন ধর্মগুলো তারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলো থেকে এটি পৃথক করতে হয়তো জাপানিরা ভেবেছিলেন এই পবিত্র আত্মপূর্ণ দেশটির প্রতি যে ভালোবাসা তারা অনুভব করেন, সেটি সম্পূর্ণভাবে ধারণ করতে পারে এমন একটি নাম তাদের প্রয়োজন। সুতরাং তারা এটির নাম দিয়েছিলেন ‘শিন্টো’, ‘শিন’ মানে দেবতারা, ঘেটা এসেছে তাওবাদের শব্দ, পথ বা উপায় থেকে। শিনের টাও। দেবতাদের পথ, শিন্টো। ভালোবাসা’ শব্দটিও এটি ভালোভাবে প্রকাশ করার জন্যে যথেষ্ট ছিল।

শিন্টো ধারণাটি দ্বারা মুগ্ধ হতে, যে দেবতারা আদিম কাদা ঘেঁটে নিপ্পনের দ্বীপগুলো সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি পৃথিবীর মধ্যদিয়েই আরো গভীরতর কিছু দেখে, কখনো খুব সূক্ষ্মভাবে সৃষ্ট মর্মস্পর্শী চিত্রকর্ম দেখলে যা অনুভব করে, এটি তা প্রকাশ করে। সাধারণত পৃথিবীর প্রতি এর ভালোবাসা উদ্যাপনের জন্যে এর যা দরকার সেটি হচ্ছে হাইকুর মাত্র তিনটি পঙক্তি।

গ্রীষ্মে একটি নদী অতিক্রম করছি
কত সুখকর,
হাতে স্যান্ডেলগুলো নিয়ে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *