০৯. দশ নির্দেশ

অধ্যায় ৯. দশ নির্দেশ

ইজরায়েলের সন্তানরা মিশরে তাদের দাসত্ব থেকে পালিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সমস্যাগুলো আসলেই কেবল শুরু হয়েছিল। সি অব রিডসে’ মিশরীয় সেনাবাহিনীর নিমজ্জিত হবার ঘটনাটি তাদের সাহস জুগিয়েছিল এবং মোজেস মরুভূমির দিকে তাদের জন্য প্রতিশ্রুত দেশে যাবার জন্য তাকে অনুসরণ করতে প্ররোচিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারা তখনও আসলে বুঝতে পারেনি, যখন ঈশ্বরকে নিয়ে মোজেস কথা বলছিলেন, তখন আসলে তিনি কী বলতে চাইছিলেন। সেই সময়ের গ্রহণযোগ্য সাধারণ একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, দেবতারা, বর্তমান সময়ের ফুটবল টিমগুলোর মতো, সংখ্যায় তারা অনেক এবং সহজলভ্য। অবশ্যই আপনি আপনার এলাকার দেবতাকে সমর্থন করবেন, কিন্তু তার মানে এই না যে, বাকি সব দেবতাদের ঘৃণা করবেন। কারণ, আপনি জানেন, ঈশ্বরদের এই লীগে খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক। ইজরায়েলাইটরা জানতেন, মোজেসের সাথে যে ঈশ্বর কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে বিশেষ কিছু আছে, কিন্তু তার মানে এই না যে, লীগে আর কোনো দেবতা নেই। এর মানে শুধু তাদের দেবতাই সবচেয়ে সেরা কারণ, এটি তাদের দেবতা।

আর মোজেস যে-বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে দেখছিলেন না, সেটি আবিষ্কার করতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি তাদের। তিনি বলেছিলেন, এমন একটি দেশে তিনি তাদের নিয়ে যাচ্ছেন, যে-দেশে প্রাচুর্যের কোনো অভাব নেই, কিন্তু তাদের মনে হয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুত দেশে তাদের নিয়ে যেতে মোজেসের মধ্যে তেমন বিশেষ কোনো তাড়া নেই। মিশর ত্যাগ করার বহুদিন পরে তারা একটি পর্বতের পাদদেশে এসে হাজির হয়েছিল। সেখানে তিনি তাদের বলেছিলেন, এখানে অপেক্ষা করো, আমি উপরে গিয়ে ঈশ্বরের কণ্ঠ থেকে পরবর্তী নির্দেশাবলি শুনে আসি। কিন্তু ফিরে আসতে তিনি এতই দীর্ঘ সময় নিয়েছিলেন যে, ইজরায়েলাইটরা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, এবং তাদের কিছু করারও ছিল না। সুতরাং তাদের দেখাশুনা করার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাদের মনোযোগ অন্যদিকে পরিচালিত করতে একটি ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারিগরদের দিয়ে বিশাল একটি ষাঁড়-শাবকের স্বর্ণমূর্তি তারা নির্মাণ করিয়ে ছিলেন, মিশরীয় ধর্মে দেবতাদের অসংখ্য প্রতাঁকের একটি। একটি বেদির উপর সেটি স্থাপন করে ইজরায়েলাইটদের তারা সেটি পূজা করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। হয়তো তারা ইতিমধ্যে তাদের ছেড়ে আসা মিশরের কথা ভেবে বিষণ্ণ বোধ করছিলেন, অথবা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে তাদের এই দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার পর হয়তো তাদের খানিকটা বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। সোনার বাছুরের এই পূজা উন্মত্ত একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কোনো রক-কনসার্টে উত্তেজিত ভক্তদের মতো তারাও ঢোলের আওয়াজের সাথে মূর্তির চারপাশে ঘুরে সজোরে চিৎকার করে নাচতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু হঠাৎ করেই মোজেস ফিরে এসেছিলেন তাদের মধ্যে, এবং পরিস্থিতি দেখে তিনি খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এই আনন্দ-উৎসব থামিয়ে সবাইকে তিনি নীরব হতে নির্দেশ দেন। তিনি তাদের জানান, পর্বতের উপরে যে কণ্ঠস্বর তার সাথে কথা বলেছিল, তিনি দশটি নির্দেশের একটি তালিকা দিয়ে তাকে ফেরত পাঠিয়েছেন, যে-নির্দেশগুলো ইজরায়েলাইটদের অবশ্যই এই মুহূর্ত থেকে শুরু করে মান্য করে চলতে হবে। এই দশটি নির্দেশই ‘টেন কম্যান্ডমেন্টস’ নামে পরিচিত।

বেশিরভাগ নির্দেশই যে-কোনো গোষ্ঠী বা সমাজের জন্যেই প্রযোজ্য, যে সমাজটি এর সব সদস্যদের একত্রে রাখতে চায়। কোনো হত্যা নয়, কোনো চুরি নয়, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সাথে প্রতারণা নয়, মিথ্যাকথা নয়, শ্রমিকদের জন্যে একদিন বিশ্রাম নিশ্চিত করা ইত্যাদি খুবই যুক্তিসংগত নির্দেশ। প্রথম নির্দেশনাটিও যুক্তিসংগত ছিল। যে ঈশ্বর তাদের মিশর থেকে মুক্ত করে এনেছেন, তিনিই হবেন তাদের একমাত্র ঈশ্বর এবং কখনোই তারা অন্য কোনো ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারবেন না। তারা বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন কারণ নিজেদের পক্ষকেই তারা সমর্থন করবে।

ইসরায়েলাইটদের যা বিস্মিত করেছিল সেটি হচ্ছে দ্বিতীয় নির্দেশটি, এটি তাদের কোনো ধরনের ছবি নির্মাণ করতে নিষেধ করেছিল, শুধু ঈশ্বরই নয়, যে কোনোকিছুরই ছবি তৈরি করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কোনো ছবি নয়, কোনো শিল্পকলা নয়, বিষয়টি তাদের হতবাক করেছিল। যে প্রাণীদের তারা শিকার করতেন কিংবা যে দেবতাদের তারা উপাসনা করতেন, সেগুলো আঁকা তাদের জন্য শাস নেবার মতোই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার ছিল। এক টুকরো চক হাতে যে-কোনো শিশুই এর প্রমাণ দিতে পারবে। যে-কণ্ঠস্বরটি মোজেসের সাথে কথা বলেছিল তিনি যে-কোনো ধরনের শিল্পকলাকেই গভীর সন্দেহের চোখে দেখতেন, কিন্তু এটি চূড়ান্তভাবে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উঠত, যখন তার (ঈশ্বরের) নিজস্ব সত্তার নেপথ্যের রহস্যটি ধরার চেষ্টা করতে মানুষ চিত্রের শরণাপন্ন হতো। কিন্তু, ঈশ্বরের এই ক্ষোভের মূল কারণটি কী ছিল?

এই বিষয়টি বুঝতে সহায়ক হবে যদি আমরা প্রতীক-সংক্রান্ত আমাদের সেই আলোচনায় আবার ফিরে যাই। আমরা লক্ষ করেছিলাম, কীভাবে সেই প্রতীকগুলো মানুষকে আরো বৃহত্তর একটি বাস্তবতার সাথে সংযুক্ত করে। ঠিক যেভাবে এক টুকরো রঙিন কাপড় পুরো একটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। মানবতার সবচেয়ে উপযোগী আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রতীক, সংক্ষিপ্ত একটি উপায়, যা আরো বিশাল কোনো বিমূর্ত বিষয়কে ধারণ করতে পারে, যেমন, একটি জাতির ধারণা। আর যখন লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছিল, তখন এই প্রতীক আরো বেশি উপযোগী প্রমাণিত হয়েছিল। এখন আপনি যে-কোনোকিছুই একটি বইয়ে শব্দে অনুবাদ করতে পারবেন, যে বইটি আপনি আপনার হাতে ধরতে পারবেন। কিন্তু ভুল হয় যখন সেই শব্দগুলো কিসের প্রতিনিধিত্ব করছে, সেই বিষয়ে আমরা সংশয়গ্রস্থ হয়ে পড়ি, এবং এগুলোর সাথে এমনভাবে আচরণ করি যেন এটি যা প্রতিনিধিত্ব করছে, এটি তারই সমতুল্য। কোনোকিছু সম্বন্ধে আমরা যা বলি’ সেটি কখনোই আসলে তেমন নয়। আপনি কিন্তু পানি’ শব্দটিকে পান করতে পারবেন না। এটি পানির জন্য ব্যবহৃত একটি প্রতীক, পানি নিজে’ নয়।

সমস্যা হচ্ছে যে, বিশ্বাসীরা প্রায়শই ধর্মীয় শব্দগুলো এমনভাবে ব্যবহার করে থাকেন, যেন এই নিয়মটি এই শব্দগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যেন তাদের ঈশ্বরের জন্য ব্যবহৃত শব্দটি আসলেই ঈশ্বর। তাদের বইগুলো কাগজের উপর কালির দাগ নয়, বরং দুই মলাটের মধ্যে ঈশ্বর নিজেই চেপে বসে আছেন। আর বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই, কাদের শব্দগুলো সেরা আর ঈশ্বরের জন্য সেরা প্রতীকগুলো কাদের আছে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে কেন তারা প্রায়শই পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করে। কোনোটাই আমার ধারণার ধারেকাছে আসতে পারে না, বজ্রপাতের মতো গর্জন করে দ্বিতীয় নির্দেশে ঈশ্বর তাদের বলেছিলেন। কোনো ধরনের মানব শিল্পকলা, সেটি দেয়ালে থাকা চিত্র হোক অথবা বইয়ের শব্দ, যে রূপেই প্রকাশ করা হোক না কেন, সেগুলোর কোনোটাই ঈশ্বরের অপার রহস্যময় ধারণাটি ধারণ করার নিকটে আসতে পারে না।

দ্বিতীয় নির্দেশনাটিই ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষের উদ্ভাবিত সব ধারণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টিটি ধারণ করছে। এর মূল নিশানা ছিল ধর্ম। এবং শুধু সেই প্রকারের ধর্মই নয়, সেই মানুষগুলোকে, যা একটি স্বর্ণনির্মিত বাছুরের মূর্তির চারপাশে নাচতে প্ররোচিত করেছিল। এটি আমাদের জন্যে একটি সতর্কবার্তা ছিল, কোনো ধর্মীয় পদ্ধতিই ঈশ্বরের রহস্যকে ধরতে বা ধারণ করতে পারেনি। কিন্তু তারপরও আমরা ইতিহাসে, যেমন আমরা দেখব এই বইয়ে, ঠিক সেটাই অধিকাংশ ধর্মগুলো দাবি করা অব্যাহত রেখেছে। দ্বিতীয় নির্দেশটি ছিল একটি আদি সতর্কবাণী, যে সংগঠনগুলো দাবি করে, তারা ঈশ্বরের পক্ষে কথা বলছে, তারাই ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, সব মূর্তিগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে বিপজ্জনক মূর্তি। কিন্তু এই বার্তাটি বুঝতে ইজরায়েলাইটদের বহুদিন সময় লেগেছিল।

সোনালি বাছুরের চারপাশে তাদের উন্মত্ত নৃত্যপর্বের পরে আবার পথ চলার সময় এসেছিল। কারণ তাদের প্রতিশ্রুত ভূমি জয় করতে হবে। মোজেস সেই দেশটিকে তাদের দৃষ্টিসীমানার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর একটি পর্বতের উপর উঠে দূর থেকে সেই দেশটিকে দেখতে তাকে নির্দেশ দিয়েছিল। এখানেই মোজেস মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সুতরাং তার সেনাপতি জশুয়া তাদের প্রতিশ্রুত দেশটিতে আগ্রাসনের মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এটি খুব সহজ বিজয় ছিল না। এমনকি সেই দেশে নিজেদের স্থাপিত করার পরও, সেই জায়গাটি ধরে রাখতে সারাক্ষণই তাদেরকে নিকটবর্তী গোত্রগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সুতরাং ইজরায়েলাইটরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাদের একজন রাজা দরকার, যিনি এই নিরন্তর যুদ্ধগুলোয় তাদের নেতৃত্ব দেবেন। অন্য সব গোত্রেরই তো রাজা আছে, তাহলে তাদের রাজা কেন থাকবে না? তাদের প্রথম রাজা ছিলেন সল, কানানে ইজরায়েলের অবস্থানটি সুরক্ষিত করতে তিনি তার রাজত্বকালের প্রায় পুরোটা সময় কাটিয়েছিলেন।

যাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হয়েছিল সেই গোত্রগুলির মধ্যে একটির নাম ছিল ফিলিস্টিন। এবং তাদের ভয়ংকর আর হিংস্র যোদ্ধাদের একজন ছিলেন একটি দানব, গলাইয়াথ। একদিন যখন যুদ্ধ শুরু করার আগে দুই সেনাবাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। গলাইয়াথ সামনে এগিয়ে এসে সলের সেনাবাহিনী থেকে যে-কাউকে তার সাথে একক যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। ইজরায়েলের পক্ষ থেকে কারোরই সেই সাহস হয়নি যতক্ষণ-না সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন একজন বালক মেষপালক, যে সবার সামনে এসে গলাই সেই একক যুদ্ধের আহ্বানের চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সবাই তাকে দেখে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেছিল। তারা জিজ্ঞাসা করেছিল, তার মতো একটি বালক কীভাবে প্রশিক্ষিত খুনি গলাইয়াথের সাথে লড়বে? ‘ঠিক যেভাবে নেকড়ের পাল থেকে আমি আমার বাবার মেষদের রক্ষা করে এসেছি’, উত্তর দিয়েছিল বালকটি, ‘গুলতি দিয়ে। সে সৈন্যদের সারি থেকে সামনে এগিয়ে এসে দানবটির সামনে দাঁড়ায়, যে তার দিকে তখন গর্জন করে তেড়ে এসেছিল। যখন গলাইয়াথ তার এক হাত পেছনের দিকে নিয়ে সেই বালকের উদ্দেশ্যে বর্শা ছুঁড়তে উদ্যত হয়েছিল, মেষপালক সেই বালকটি খুব শান্তভাবে, বিচলিত না হয়ে তার গুলতির মধ্যে একটি পাথর বেঁধে একবার মাথার উপর ঘুরিয়ে পাথরটি তার লক্ষ্যের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল। এটি ঠিক গলাইয়াথের কপালের মাঝখানে আঘাত করেছিল, এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ধরাশায়ী করেছিল। এরপর বালকটি গলাইয়াথের বিশাল তরবারি ব্যবহার করে তার শিরশ্চেদ করে। সেদিন সলের সেনারা যুদ্ধে জয় করেছিল এবং ইজরায়েলাইটরা একজন নতুন বীর পেয়েছিলেন। এই বালকটির নাম ছিল ডেভিড।

যখন সল যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন, ডেভিড তার জায়গায় ইজরায়েলের রাজা হয়েছিলেন। এমন একজন রাজা, ইজরায়েলাইটরা যাকে আর তার রাজত্বের সময়টিকে আদর্শ হিসাবে বিবেচনা করেন। তিনি ত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন, যার অধিকাংশ সময়ই তাকে যুদ্ধে ব্যয় করতে হয়েছে। তার ছেলে সলোমনই ইসরায়েলের প্রথম টেম্পল বা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যেখানে তারা ঈশ্বরের প্রতি তাদের সেরা পশু এবং শস্যক্ষেতের সবচেয়ে ভালো ফসলগুলো বিসর্জন দিতেন। এবং তারা ঈশ্বরকে তাদের প্রশস্তির ধূপের ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। মিশরে তাদের দাসত্বের দিন থেকে তারা বহুদূর অগ্রসর হয়ে এসেছিলেন। ইজরায়েল আর যাযাবর কতগুলো ক্ষুদ্রগোত্রের শিথিল একটি জোট ছিল না, এটি সত্যিকারের একটি জাতি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাদের নিজস্ব একজন রাজা ছিল, আকর্ষণীয় একটি মন্দিরও ছিল। অবশেষে তারা সফল হতে পেরেছিলেন ঠিকই, তবে শুধুমাত্র তাদের ‘ঈশ্বর’ সেভাবে বিষয়টি ভাবেননি।

সুতরাং যে-কণ্ঠস্বর মোজেসের সাথে কথা বলেছিল, সেটি আবারো কথা বলতে শুরু করেছিল। বহু প্রজন্ম ধরেই এটি নীরব ছিল, কিন্তু এবার এটি বজ্রপাতের মতো নতুন প্রজন্মের নবীদের মনে আঘাত হেনেছিল। এই কণ্ঠস্বর তাদের বলেছিল, ইজরায়েলাইটরা যেভাবে তাকে রূপান্তরিত করেছে, সেটি তিনি কতটা ঘৃণা করেন। তাদের ত্রাণকর্তা লোভী মূর্তিগুলোর মতোই একটি মূর্তিতে পরিণত হয়েছিল, সেই মানুষগুলোর দেবতাদের মতো, যাদের তারা সেই দেশে প্রতিস্থাপিত করেছিল। কিন্তু এমন কিছু তিনি কামনা করেননি। তিনি অসহায়দের জন্যে ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন বিধবা আর অনাথদের যেন দেখাশুনা করা হয়, সম্পত্তি থেকে যেন তাদের বঞ্চিত না করা হয়। সর্বোপরি তিনি চেয়েছিলেন, ইজরায়েলের সন্তানরা তাদের জীবনের সেই সরলতা যেন পুনরুদ্ধার করতে পারে, যে-সরলতা তাদের মধ্যে ছিল, যখন তারা মরুভূমিতে ছিলেন, যখন তারা পরস্পরের দেখাশুনা করতেন। কিন্তু আসলেই ঈশ্বর তাদের এতদিন ধরে কী বলে আসছেন, সেটি বুঝতে ভিনদেশে দাসত্বের আরো আরেকটি পর্ব তাদের পার করতে হয়েছিল।

একটি স্বাধীনরাজ্য হিসাবে ইজরায়েল কখনোই এমনিতেই বেশি সুরক্ষিত ছিলেন না। এমনকি স্থানীয় গোত্রদের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ এবং কানানকে নিজেদের দেশ বানানোর পরেও তারা সারাক্ষণই বিপদের ঝুঁকিতে ছিলেন। তাদের প্রতিশ্রুত এই দেশটির অবস্থান ছিল উত্তর আর দক্ষিণে মহাপরাক্রমশালী দুটি রাজ্যের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ ভূখণ্ডে। দক্ষিণের মিশরের কথা তারা ইতিমধ্যেই জানতেন। তাদের নিজেদের ইতিহাসের একটি অংশ কেটেছে সেই দেশে। কিন্তু উত্তরের মেসোপটেমিয়ার আসিরিয়ান সাম্রাজ্যটি তাদের স্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাবটি ফেলেছিল। আসিরীয়রা তাদের রাজ্য আক্রমণ এবং তাদের পরাধীন একটি রাজ্যে পরিণত করেছিল। মিশর থেকে যে মহাঅভিপ্রয়াণ তাদের মুক্ত করেছিল, তার বহুশত বছর পরে ইজরায়েলাইটদের আবার দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি হতে হয়েছিল। দশ হাজারেরও বেশিসংখ্যক ইজরায়েলাইটকে ব্যাবিলনে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। কানানে তাদের জয়ের পর ঠিক যেভাবে তাদের ঈশ্বর ধারণাটি বদলে গিয়েছিল, সেভাবেই ব্যাবিলনে তাদের দুর্দশার অভিজ্ঞতাটি ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণাগুলো আবার বদলে দিয়েছিল।

প্রথমে তারা ভেবেছিলেন, ঈশ্বরকে তারা চিরকালের জন্যে হারিয়ে ফেলেছেন। জেরুজালেমে তার জন্যে সলোমনের বানানো সেই টেম্পলে তিনি আছেন। তারা ব্যাবিলনে নদীর তীরে বসে অশ্রুপাত করতেন, যখন সেই কথা তারা মনে করতেন। এই অদ্ভুত প্রবাসে কেমন করে তারা তাদের প্রভুর উদ্দেশ্যে গান গাইবেন? কিন্তু এই দুঃখ ঈশ্বর সম্বন্ধে তাদের নতুন একটি উপলব্ধি দিয়েছিল : ঈশ্বর মন্দিরের মধ্যে আটকে থাকা কোনো মূর্তি নয়। এমনকি কানানেও তিনি আটকে নেই। ঈশ্বর আছেন সর্বত্র। ঈশ্বর তাদের সাথে আছেন এই ব্যাবিলনেও, যেমন তিনি জেরুজালেমে তাদের সাথে ছিলেন, এবং মিশরেও। বাস্তবিকভাবেই ঈশ্বর সবসময় এবং সর্বত্রই তাদের সাথে ছিলেন। ঠিক যেভাবে তাদের নবীরা বলেছিলেন এর আগে। তারা পুরো বিষয়টি নতুনভাবে দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধুমাত্র নবীরা তাদের আসলে কী বলতে চাইছেন তা যদি তারা আগেই বুঝতে পারতেন! কিন্তু তারা এখন এর প্রায়শ্চিত্ত করবেন।

তারা সেই গল্পগুলো সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে যে গল্পগুলো তাদের কাছে এসেছিল, তাদের জাতির অতীতে ঈশ্বরের সম্পাদিত নানা কর্মকাণ্ড। সেই কণ্ঠের গল্প, যা আব্রাহাম, আইজাক, ইয়াকব আর মোজেসের সাথে কথা বলেছিল। মিশর থেকে তাদের পালিয়ে আসা আর কানানে তাদের বসতিস্থাপনের গল্প; একজন সত্যিকারের ঈশ্বরের সাথে কীভাবে তারা অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিলেন তার গল্প : স্বাধীনতায় কিংবা দাসত্বে, পরিচিত প্রিয় পাহাড় আর নদীসহ স্বদেশে অথবা নির্বাসনে, বিদেশে, যেখানে নদী আর ভাষা তাদের অপরিচিত, ঈশ্বর সবসময়ই তাদের সাথে থাকবেন। ব্যাবিলনে নির্বাসনে থাকার সময়ে এই ভাবনাগুলোই তাদের মনে এসেছিল, যখন তারা তাদের নিজেদের ইতিহাসের অর্থ বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। ঈশ্বর আবার তাদের সাথে কথা বলতে শুরু করেছিলেন তার প্রেরিত নবীদের মুখ দিয়ে। আর এবার তারা তাদের কথা শুনেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *