হৃদয় বিনিময়

হৃদয় বিনিময়

আজ পাঁচ সাত বছর হয়ে গেল বটকৃষ্ণ পুজোর মুখে দেওঘরে চলে আসছেন। জায়গাটা তাঁর খুবই পছন্দ হয়ে গিয়েছে, স্ত্রী নলিনীরও। এখানকার জল-বাতাসে নলিনীর শ্বাসের কষ্ট কম হয়, বাতের ব্যথাটাও সহ্যের মধ্যে থাকে। বটকৃষ্ণর নিজেরও খুচরো আধিব্যাধি বেশ ঢাপা পড়ে এখানে। দেওঘরে পাকাপাকিভাবে থাকার একটা ইচ্ছে বটকৃষ্ণের মনে মনে রয়েছে। ছেলেমেয়েদের জন্যে হয়ে উঠছে না, তারা দেওঘরের নাম শুনলেই নাক মুখ কোঁচকায়। প্রথম প্রথম এক-আধবার ছেলেমেয়েরা বটকৃষ্ণর সঙ্গে এসেছিল, এখন আর আসতে চায় না, বড় ছেলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে নৈনিতাল মুশৌরি রানীক্ষেত করতে যায়, ছোট পালায় পাহাড়ে-চড়া শিখতে, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে চিঠি লেখে ; ‘মা, তোমার জামাই একেবারেই ছুটি পাচ্ছে না, পুজোয় আমরা কোথাও যাচ্ছি না।’

বটকৃষ্ণ অবশ্য কারও তোয়াক্কা তেমন করেন না। বাষট্টি পেরিয়ে গিয়েছেন, তবু নুয়ে পড়েননি; শরীর স্বাস্থ্য এ-বয়সে যতটা মজবুত থাকা দরকার তার চেয়ে এক চুল কম নেই। খান-দান, বেড়ান, নলিনীর সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা করেন, শীতের মুখে ফিরে যান।

এবারে বটকৃষ্ণ ভায়রা সত্যপ্রসন্নকে আসতে লিখেছিলেন। একটা উদ্দেশ্য অবশ্য বটকৃষ্ণর ছিল। ইদানীং দু তিন বছর তিনি যে-বাড়িটায় উঠছেন—সেটা বিক্রি হয়ে যাবার কথা। বটকৃষ্ণর মনে মনে ইচ্ছে বাড়িটা কিনে ফেলেন। বাংলো ধরনের ছোট বাড়ি, কিছু গাছপালা রয়েছে ; পাশের দু চারখানা বাড়িও ভদ্রগোছের, পরিবেশটা ভাল।

সত্যপ্রসন্ন বটকৃষ্ণর নিজের ভায়রা নন, নলিনীর মাসতুতো বোন মমতার স্বামী। বয়েসে বছর ছয়েকের ছোট। পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বটকৃষ্ণর ইচ্ছে সত্যপ্রসন্নকে দিয়ে বাড়িটা দেখিয়ে তার মতামত নেন, ভবিষ্যতে সামান্য কিছু অদল-বদল করতে হবে—তারই বা কি করা যায়—সে-পরামর্শও সেরে রাখেন। সত্যপ্রসন্ন মত দিলে—বটকৃষ্ণ বায়নটাও করে রাখবেন। সত্যপ্রসন্ন স্ত্রী মমতাকে নিয়ে দেওঘর এসেছেন গতকাল। তারপর পাক্কা ছত্রিশ ঘণ্টা কেটে গেছে।

সন্ধেবেলায় বাইরের দিকের ঢাকা বারান্দায় চারজনে বসেছিলেন ; বটকৃষ্ণ, নলিনী, সত্যপ্রসন্ন আর মমতা।

ভায়রার হাতে চুরুট গুঁজে দিয়ে বটকৃষ্ণ বললেন, “সত্য, তোমার ওপিনিয়ানটা কী?”

সত্যপ্রসন্ন চুরুট জিনিসটা পছন্দ করেন না। তবু ধীরে-সুস্থে চুরুট ধরিয়ে নিয়ে বললেন, “বাড়ি খারাপ নয়, একটা একস্ট্রা বাথরুম তৈরি করা, কিচেনটাকে বাড়ানো—এসব কোনো সমস্যাই নয়। কুয়োয় পাম্প বসিয়ে ছাদের ওপর ট্যাংকে জল তোলাও যাবে—কলটল, কমোড—কোনোটাতেই আটকাবে না। কিন্তু এত পয়সা খরচ করে এ-বাড়ি নিয়ে আপনি করবেন কী?”

বটকৃষ্ণ চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “বাড়ি নিয়ে লোকে কী করে হে! আমরা থাকব।”

“পারবেন থাকতে বুড়োবুড়িতে?”

“না পারার কোনো কারণ দেখছ? ছেলেমেয়েরা এখন সাবালক; বেকার নয়, খোঁড়া অন্ধ মাথামোটা নয়, তাদের সংসার তারা করুক, আমরা বুড়োবুড়িতে এখানে থাকব।”

মমতা বললেন, “এখন মুখে বলছেন জামাইবাবু, সত্যি কি আর তাই পারবেন? নন্তুর বিয়ে দেননি এখনও। বাড়িতে বউ এলে দিদিই কি এখানে থাকতে পারবে?”

বটকৃষ্ণ বললেন, “ছেলের বউ বড়, না আমি বড়—সেটা তোমার দিদিকেই জিগ্যেস করো।”

সাদা মাথা, সাদা খোলের লাল চওড়া পেড়ে শাড়ি, গোলগাল—ফরসা, বেঁটেখাটো মানুষটি একপাশে বসেছিলেন। মাথার কাপড় ঠিক করে নলিনী বললেন, “ছেলের সঙ্গে রেষারেষি করছ নাকি?”

বটকৃষ্ণ জবাব দিলেন, “তোমার বাবার সঙ্গে করলাম—তা ছেলে।”

মমতা হেসে উঠলেন।

সত্যপ্রসন্ন একটু চুপচাপ থেকে খুঁতখুঁতে গলায় বললেন, “আপনার ওই পাশের বাড়ির ভাবগতিক আমার ভাল লাগছে না, দাদা। সারাদিন দেখছি দুটো ছোঁড়াছুঁড়িতে যা করছে—একবার দোলনায় দুলছে, একবার রবারের চাকা নিয়ে খেলছে, এ ছুটছে তো ও পেছন পেছন দৌড়চ্ছে। দুপুরবেলায় দেখলুম, ছুঁড়িটা আমতলায় জালের দোলনা বেঁধে শুয়ে শুয়ে নবেল পড়ছে—আর ছোঁড়াটা মাঝে মাঝে দোলনার নীচে বসে মেয়েটাকে ঢুঁ মারছে। নাচ, গান, হল্লা তো আছেই। এ যদি আপনার নেবার হয় জ্বলেপুড়ে মরবেন।”

বটকৃষ্ণ বললেন, “তুমি আইভির কথা বলছ। জি সেনের মেয়ে। আরে, ও তো আমার খুব পেট। ওই ছেলেটি হল, পঙ্কজ। ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে। ভেরি ব্রাইট। আইভির সঙ্গে লভে পড়েছে। দুটোই মাঝে মাঝে আমাদের কাছে আসে, নলিনীকে নাচায়।”

সত্যপ্রসন্ন কেমন থতমত খেয়ে গেলেন। ঢোক গিলে বললেন, “আপনি কি বলছেন, দাদা? একে লাভ বলে? ছাগলের মতন দুটোতে গুঁতোগুঁতি করছে?”

বটকৃষ্ণ নিবন্ত চুরুটে অভ্যেসবশ টান দিয়ে বললেন, “গুঁতোগুঁতি তো অনেক ভাল। সত্য, তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং বোঝ, কিন্তু ভগবানের এই কলকবজার কেরামতি কিছু বোঝ না। লভ হল আরথকোয়েক, বাসুকী কখন যে ফণা নাড়িয়ে দেয়, কিস্যু বোঝ যায় না।” বলে বটকৃষ্ণ চশমার ফাঁক দিয়ে নলিনীকে দেখলেন। রঙ্গরসের গলায় বলেন, “ও নলিনী, তোমার ভগিনিপোত ওই ছেলেমেয়ে দুটোর গুঁতোগুঁতি দেখছে। ওকে একেবার তোমার লভ করার গল্পটা শুনিয়ে দাও না। ব্যাপারটা বুঝুক।’

নলিনী অপ্রস্তুত। লজ্জা পেয়ে বললেন, “মুখে কিছু বাধে না। ভীমরতি। বুড়ো বয়সে আর রঙ্গ করতে হবে না।”

“বটকৃষ্ণ বললেন, “রঙ্গ করব না তো করব কি! তোমার সঙ্গে রঙ্গ করলাম বলেই না বত্রিশটা বছর সঙ্গ পেলাম।”

মমতা হেসে বললেন, “জামাইবাবুর কি বত্রিশ হয়ে গেল?’

“হ্যাঁ ভাই, বত্রিশ হয়ে গেল। ইচ্ছে ছিল গোল্ডেন জুবিলি করে যাব। অতটা দূরদর্শী হতে ভরসা পাচ্ছি না। গোল্ডেনের এখনও আঠারো বছর।”

মমতা বললেন, “ভগবান করেন আপনাদের গোল্ডেনও হোক। আমরা সবাই এসে লুচি-মণ্ডা খেয়ে যাব। কিন্তু এখন আপনার বিয়ের গল্পটা বলুন, শুনি।”

সত্যপ্রসন্নর ধাত একটু গম্ভীর। চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন।

বটকৃষ্ণ নলিনীকে বললেন, “তোমার নিতাই প্রভুকে ডাকো, একটু চা দিতে বলো।” বলে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। একটু পরে বললেন, “আহা, কী খাসাই লাগছে! সত্য, কেমন একটু শীত শীত পড়েছে দেখছ! এই হল হেমন্তকাল। দেবদারু গাছের গন্ধ পাচ্ছ তে! বাড়ির সামনে দুটো দেবদারু গাছ। তার মাথার ওপর দিয়ে তাকাও, ওই তারাটা জ্বলজ্বল করছে, সন্ধেতারা। এমন একটা বাড়ি কি ছেড়ে দেওয়া ভাল হবে, সত্য? কিনেই ফেলি—কি বলো? কিনে তোমার দিদিকে প্রেজেন্ট করে দি, বত্রিশ বছরের হৃদয়অর্ঘ্য!”

নলিনী তাঁর সোনার জল ধরানো গোল গোল চশমার ফাঁক দিয়ে স্বামীকে দেখতে দেখতে বললেন, “আমায় দিতে হবে না, তোমার জিনিস তোমারই থাক।”

বটকৃষ্ণ বললেন, “আমার তো তুমিই আছ। তুমি থাকতে আমার কিসের পরোয়া। তোমার অমন জাঁদরেল বাবা, আমার শ্বশুরমশাইকে পর্যন্ত আমি তোমার জোরে কবজা করে ফেললাম, আমার ভয়টা কিসের?”

মমতা হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন, “আমি চায়ের কথা বলে আসছি। জামাইবাবু, আপনার বিয়ের গল্পটা কিন্তু আজ শুনব। শুনেছি, আপনি নাকি বিয়ের আগে অনেক কীর্তি করেছেন!”

নলিনী বললেন, “তুই আর ধুনোর গন্ধ দিস না বাপু, এমনিতেই তো মরছি—”।

বটকৃষ্ণ বললেন, “আমায় গন্ধ দিতে হয় না। আমি গন্ধমাদন।” সত্যপ্রসন্নও হেসে ফেললেন।

চা খেতে খেতে বটকৃষ্ণ মমতাকে বললেন, “আমার বিয়ের গল্পটা হালফিলের নয়, ভাই। তোমার কত বয়েস হল, পঞ্চাশ-টঞ্চাশ বড় জোর। তুমি খানিকটা বুঝবে। আমার যখন পঁচিশ বছর বয়েস—তখন অষ্টম এডওয়ার্ড প্রেমের জন্যে রাজত্বই ছেড়ে দিলেন। ব্যাপারটা বোঝ, এত বড় ব্রিটিশ রাজত্ব—যেখানে কথায় বলে সূর্যাস্ত হয় না—সেই রাজত্ব প্রেমের জন্যে ছেড়ে দেওয়া। তখন প্রেম-ট্রেম ছিল এই রকমই পাকাপোক্ত ব্যাপার। তা আমি তখন একরকম ভ্যাগাবাণ্ডা। লেখাপড়া শিখে একবার রেল একবার ফরেস্ট অফিসে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছি, কোথাও ঠিক ঢুঁ মেরে ঢুকতে পারছি না। আমার বাবা বলছেন, ল’ পড়। আমি বলছি—কভভি নেহি। মাঝে মাঝে ছেলে পড়াই। এই করতে করতে এসে পড়লাম আসানসোলে। একটা চাকরি জুটল, মাইনে চল্লিশ। সেখানে তোমার দিদিকে দেখলাম, বছর ষোলো সতেরো বয়েস, রায়সাহেব করুণাময় গুহর বাড়ির বাগানে কুমারী নলিনী গুহ একটা সাইকেল নিয়ে হাফ প্যাডেল মারছে, পড়ছে, উঠছে আবার পড়ছে। এখন হংসডিম্বর মতন তোনার যে দিদিটিকে দেখছ—তখন তিনি এইরকম ছিলেন না—কচি শসার মতন, লিকলিকে ফিনফিনে ছিলেন…।”

নলিনী কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করে বললেন, “তবু রক্ষে শসা বলেছ, ঢেঁড়শ বলোনি।”

মমতা হেসে উঠলেন। সত্যপ্রসন্ন চুরুটে আরাম পাচ্ছিলেন না। চুরুট ফেলে দিয়ে সিগারেট ধরালেন।

বটকৃষ্ট হাসতে হাসতে বললেন, “ঢেঁড়শ লম্বার দিকে বাড়ে, তুমি ও-দিকটায় পা বাড়ওনি। তা বলে তুমি কি দেখতে খারাপ ছিল। মাথায় একটু ইয়ে হলেও লিকলিকে লাউ ডগার মতন খুব তেজি ছিলে। নয়ত আমি যেদিন ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে তোমার সাইকেল থেকে পতন দেখলাম—সেদিন শাড়ি সামলে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় জিবও ভেঙাতে না, হাত তুলে চড়ও দেখাতে না।”

মমতা হেলেদুলে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। বয়েসে গলা মোটা হয়ে গিয়েছে—খিলখিল হাসিটা মোটা মোটা শোনাল। “দিদি, তুমি চড় দেখিয়েছিলে?”

নলিনী বললেন, “দেখাব না! লোকের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করা। আবার দাঁত বের করে হাসা হচ্ছিল!”

“তা কি করব—” বটকৃষ্ণ চায়ের পেয়ালায় বড় করে চুমুক দিলেন। “তুমিই বলো মমতা, দাঁতটা যত সহজে বার করা যায়, হৃদয়টা তো তত সহজে বার করে দেখানো যায় না। যদি দেখানো যেত, আমি একেবারে সেই মুহূর্তে দেখিয়ে দিতাম—তোমার দিদি আমার হৃদয় ফাটিয়ে দিয়েছে।”

সত্যপ্রসন্নর মতন গম্ভীর মেজাজের লোকও এবারে হেসে ফেললেন। হয়ত মুখে চা থাকলে বিষম লেগে যেত। মমতাও হাসছিলেন।

বটকৃষ্ণ ধীরেসুস্থে তাঁর নিবন্ত চুরুট আবার ধরিয়ে নিলেন। বললেন, “প্রথম দর্শনে প্রেম—লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে—আমার তাই হল। পা আর নড়তে চায় না। চক্ষু আর পলক ফেলে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। এমন সময় রায়সাহেব করুণাময় গুহর বাড়ির এক নেড়ি কুত্তা ফটকের কাকলিনী যদি বুদ্ধিটা না দিতছে এসে চেল্লাতে লাগল। তার চেল্লানির চোটে বাড়ির লোক জমে যাবার অবস্থা। আমি আর দাঁড়ালাম না ভয়ে।”

নলিনী বললেন, “আমার বাবা নেড়ি কুকুর পোষার লোক নয়। ওটা খাস অ্যালসেশিয়ান। নাম ছিল কাইজার।”

বটকৃষ্ণ মিটমিটে চোখ করে বললেন, “খাস নেড়িও নয়, তাদের তেজও কম নয়। সে যাক গে, তখনকার মতন তো পালালাম। কিন্তু চোখের সামনে সেই কচি শসা দুলতে লাগল। কুকুরের মুখের ডগায় মাংস ঝুলিয়ে তাকে দৌড় কালে যেমন হয়—আমাকেও সেই রকম আড়াই মাইল দৌড় করিয়ে শসাটা বিছানায় ধপাস করে ফেলে দিল।”

সত্যপ্রসন্ন বললেন, “আড়াই মাইল কেন?”

বটকৃষ্ণ বললেন, “আড়াই মাইল দূরে একটা মেসে আমি থাকতাম। মেসে গিয়ে সেই যে শুলাম—আর উঠলাম না। বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল, সত্য। তোমার বড় শালী চোখের সামনে সাইকেল চড়তে লাগল। আর বার বার দেখতে লাগলাম সেই জিব ভেংচানো, চড় মারার ভঙ্গি। কালিদাস খুব বড় কবি, কিন্তু একবারও খেয়াল করলেন না, শকুন্তলা যদি খেলাচ্ছলে একবারও রাজা দুষ্মন্তকে চড় দেখাত কিংবা জিব ভেঙাত, কাব্যটা তবে আরও জমত।…আমার হল ভীষণ অবস্থা, সারাক্ষণ ওই একই ছবিটা দেখি। ঘুম গেল, খাওয়া গেল, অফিসের কাজকর্মও গেল। পাঁচের ঘরের নামটা ভুলে গিয়ে পাঁচ পাঁচচে পঁয়ত্রিশ লিখে ফেললুম হিসেবে। মুখুজ্যেবাবু বললেন, তোমাকে দিয়ে হবে না! …তা অত কথার দরকার কি ভাই, রোজনামচা লিখতে বসিনি। সোজা কথা, প্রেমে পড়ে গেলুম তোমার বড় শালীর। কিন্তু থাকি আড়াই মাইল দূরে, সাইকেল ঠেঙিয়ে প্রেমিকাকে দেখতে আসা বড় কথা নয়, বড় কথা হল—এলেই তো আর দেখতে পাব না। রায়সাহেব সশরীরে রয়েছেন, রয়েছে কাইজার, লোহার ফটক, বাড়ির লোকজন। তবু রোজ একটা করে গুড়ের বাতাসা মা কালীকে মানত করে রায়সাহেবের বাড়ির দিকে ছুটে আসতুম। এক আধ দিন দেখা হয়ে যেত, মানে দেখতুম—বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রেমিকা আমার ধোপার সঙ্গে কথা বলছে, কিংবা বাগানে ঘুরে ঘুরে পাড়ার কোনো মেয়ের সঙ্গে হি-হি করছে। আমায় ও নজরই করত না।…আমার নাম বটকৃষ্ণ দত্ত। বটবৃক্ষের মতন আমার ধৈর্য, আর কৃষ্ণের মতন আমি প্রেমিক। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন করে লেগে থাকলুম আমি। শেষে একদিন, ‘কণ্ঠহার’ বলে একটা বায়োস্কোপ দেখতে গিয়ে চারি চক্ষুর মিলন এবং দুপক্ষেরই হাসি-হাসি মুখ হল। হাফ টাইমে বেরিয়ে স্যাট করে দু’ ঠোঙা চিনেবাদাম কিনে ফেললুম। অন্ধকারে ফিরে আসার সময় একটা ঠোঙা কোলে ফেলে দিয়ে এলুম শ্রীমতীর। লাভের ফার্স্ট চ্যাপ্টার শুরু হল।

মমতা পায়ের তলায় চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। হেসে হেসে মরে যাচ্ছেন বটকৃষ্ণর কথা শুনতে শুনতে। নলিনী আর কি বলবেন, ডিবের পান জরদা মুখে পুরে বসে আছেন।

বটকৃষ্ণ কয়েক মুহূর্ত সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বোধ হয় ফটকের সামনে দেবদারু গাছের মাথা ডিঙিয়ে তারা লক্ষ করলেন, তারপর গলা পরিষ্কার করে স্ত্রী এবং শালীর দিকে তাকিয়ে রঙ্গের স্বরে বললেন, “থিয়েটারে দেখেছ তো ফার্স্ট অ্যাক্টের পর সেকেন্ড অ্যাক্ট তাড়াতাড়ি জমে যায়। আমাদেরও হল তাই। নলিনী বিকেল পাঁচটায় চুল বাঁধতে বাঁধতে বারান্দায় এসে দাঁড়াত, কোনোদিন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকত, ফটকের সামনে এসে কুলপি মালাই ডাকত। আমি দুদ্দাড় দৌড়ে সময়মতন হাজির থাকতাম রাস্তার উল্টো দিকে। চোখে চোখে কথা হত, হাসি ছোড়াছুড়ি করে হৃদয় বিনিময়। রায়সাহেবের বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢোকার সাহস আমার ছিল না। নলিনীরও সাধ্য ছিল না আমায় ভেতরে ডাকে। আজকাল ছেলেমেয়েরা কত সহজ—ফ্রি, লাভারের হাত ধরে বাপের কাছে নিয়ে যায়—বলে, আমার বন্ধু। বাবারাও আর রায়সাহেবের মতন হয় না। রায়সাহেব—মানে আমার ভূতপূর্ব শ্বশুরমশাই—ভূতপূর্ব বলছি এই জন্যে যে তিনি এখন বর্তমান নেই—যে কী জাঁদরেল মানুষ ছিলেন তোমরা জানো না। সেকেলে রেলের অফিসার। ফার্স্ট ওয়ারে নাকি লড়াইয়ে গিয়েছিলেন, বেঁটে চেহারা, রদ্দামারা ঘাড়, মাথার চুল কদম ছাঁট করা, তামাটে গায়ের রং, চোখ দুটো বাঘের মতন জ্বলত। গলার স্বর ছিল যেন বজ্রনিনাদ।”

নলিনী এবার ঝাপটা মেরে বললেন, “আমার বাবার নিন্দে কোরো না বলছি। যে মানুষ স্বর্গে গিয়েছেন তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা!”

হাত মাথা নেড়ে বটকৃষ্ণ বললেন, “নিন্দে কোথায় করছি, গুণগান গাইছি। আচ্ছা ভাই মমতা, তুমি ছেলেবেলায় এক-আধবার তোমার মেসোমশাইকে দেখেছ তো? আমি যা বলছি তা কি মিথ্যে! রায়সাহেব করুণাময়কে দেখলে কি মনে হত না গাদা বন্দুক তোমার দিকে তাক করে আছে। বাবারে বাবা, সে কি কড়া লোক, সাহেবি ডিসিপ্লিনে মানুষ—ফাজলামি করবে তাঁর সঙ্গে! চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরও বড় বড় রেলের অফিসাররা খানাপিনায় তাঁকে ডাকত। আমি যখনকার কথা বলছি—তখন তিনি রিটায়ার করে গিয়েছেন, করে একটা ভাড়া করা বাড়ি নিয়ে থাকেন। প্রচণ্ড খাতির, লোকে ভয় পায় বাঘের মতন ; বলত কেঁদো বাঘ। সেই বাঘের বাড়িতে কোন সাহসে আমি ঢুকব বলো! এদিকে আমার যে হৃদয় যায় যায় করছে, রোজ অম্বল, চোঁয়া ঢেকুর ; ঘুম হয় না, খাওয়ায় রুচি নেই, দুঃস্বপ্ন দেখছি রোজ। শেষে তোমাদের ওই দিদি নলিনী একদিন ইশারা করে আমায় বাড়ির পেছন দিকে যেতে বলল।”

বাধা দিয়ে নলিনী বললেন, “মিথ্যে কথা বোলো না। আমি তোমায় কিছু বলিনি ; তুমিই একদিন একটুকরো কাগজে কী লিখে ছুড়ে দিয়ে পালিয়েছিলে!”

বটকৃষ্ণ বাধ্য ছেলের মতন অভিযোটা মেনে নিয়ে বললেন, “তা হতে পারে। একে বলে স্মৃতিভ্রংশ। বুড়ো হয়ে গিয়েছি তো?”

“সুবিধে বুঝে একবার বুড়ো হচ্ছ, আবার জোয়ান হচ্ছ।” নলিনী বললেন।

মমতা বললেন, “তারপর কী হল বলুন? বাড়ির পেছনে কী ছিল?”

বটকৃষ্ণ বললেন, “রায়সাহেবের বাড়ির পিছন দিকে ছিল ভাঙা পাঁচিল, কিছু গাছপালা—বাতাবিলেবু, কুল, কলকে ফুল এই সবের। খানিকটা ঝোপঝাড় ছিল। আর বাড়িঅলা সত্য সাঁইয়ের সে আমলের একটা ভাঙা লরি। লরির চাকা-টাকা ছিল না, পাথর আর ইটের ওপর ভাঙা লরিটা বসানো ছিল। আমরা সেই ভাঙা লরির ড্রাইভারের সিটে আমাদের কুঞ্জবন বানিয়ে ফেললাম। তোমায় কি বলব মমতা, যত রাজ্যের টিকটিকি গিরগিটি পোকা-মাকড় জায়গাটায় রাজত্ব বানিয়ে ফেলেছিল। দু-চারটে সাপখোপও যে আশেপাশে ঘোরাঘুরি না করত তা নয়। কিন্তু প্রেম যখন গনগন করছে তখন কে ও সবের তোয়াক্কা রাখে। ভয় তো সব দিকেই ছিল—রায়সাহেব করুণাময় একবার যদি ধরতে পারেন হান্টার চালিয়ে পিঠের চামড়া তুলে দেবেন, বিন্দুমাত্র করুণা করবেন না। তা ছাড়া রয়েছেন নলিনীর বোন যামিনী। আর এক যন্ত্রণা। ওদিকে ছিল কালু—বাচ্চা হলে হবে কি রাম বিচ্ছু। তার ওপর সেই নেড়ি কাইজার। রোজ চার ছ’আনার ডগ বিস্কুট নিয়ে যেতাম পকেটে করে। তাতেও ভয় যেত না। বিস্কুট খেলেই কুকুর মানুষ হয় না। বিপদে পড়তে পারি ভেবে বান রুটির মধ্যে আফিঙের ডেলা মিশিয়ে পকেটে রাখতাম।”

সত্যপ্রসন্ন আবার একটা সিগারেট ধরালেন। বললেন, “কুকুরকে আফিঙের নেশা করালেন? এরকম আগে কই শুনিনি।”

“শুনবে কোথা থেকে হে” বটকৃষ্ণ বললেন, “আমার মতন গাদা বন্দুকের নলের মুখে বসে কোন বেটা প্রেম করেছে? আমি করেছি। লরির মধ্যে বসে, কাইজারকে ডগ বিস্কুট আর আফিং খাইয়ে—রাজ্যের পোকামাকড়ের কামড় খেতে খেতে পাক্কা এক বছর। গরম গেল, বর্ষা গেল, বসন্ত গেল—প্রেমের রেলগাড়ি চলতেই লাগল, যখন তখন উল্টে যাবার ভয়। তোমার নলিনীদিদির আজ এ-রকম দেখছ ; কিন্তু তখন যদি দেখতে—কী সাহস, কত বুদ্ধি। কত রকম ফন্দিফিকির করে—ছোট বোনকে হরদম কৃমি-বিনাশক জোলাপ খাইয়ে, ছোট ভাইকে দু-এক আনা পয়সা ঘুষ দিয়ে অভিসার করতে আসত। মেয়েছেলে হয়ে টিকটিকিকে ভয় পায় না এমন দেখেছ কখনো? তোমার দিদি সে-ভয়ও পেত না। আমরা দু’জনে লরির মধ্যে বসে ফিসফাস করে কথা বলতাম, হাতে হাত ধরে বসে থাকতাম, মান করতাম, মান ভাঙাতাম। বার কয়েক ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছি। একবার তো রায়সাহেব হাতে-নাতে ধরে ফেলতেন—শুধু তাঁর চশমাটা চোখে ছিল না বলে বেঁচে গিয়েছিলাম।”

নলিনী মাথার কাপড়টা ঠিক করে নিলেন আবার, টিপ্পনী কেটে বললেন, “যা সিঁধেল চোর, সারা গায়ে তেল মেখে আসতে। তোমায় কে ধরবে।”

মমতা একটু গুছিয়ে বসলেন। তাঁর শরীর বেদম ভারী নয়। তবু বেতের চেয়ারটা শব্দ করে উঠল।

বটকৃষ্ণ চুরুটটা আবার জ্বালিয়ে নিলেন। পাশের বাংলোয় আইভিরা গ্রামোফোন বাজাতে শুরু করেছে।

বটকৃষ্ণ বললেন, “নাটকের সেকেন্ড অ্যাক্ট এইভাবে শেষ হয়ে গেল ; ভাঙা লরিতে বসে—কাইজারকে ডগ বিস্কুট আর মাঝে মাঝে আফিং-রুটি খাইয়ে। এমন সময় মাথার ওপর বজ্রাঘাত হল। নলিনী বলল, রায়সাহেব কারমাটারে যে বাড়ি তৈরি করেছেন নতুন—সেখানে হাওয়া বদলাতে যাবেন। পুরো শীতটা থাকবেন। আর সেখানেই নাকি কে আসবে নলিনীকে দেখতে। ভেবে দেখো ব্যাপারটা, একে নলিনী থাকবে না, তায় আবার কে আসবে মেয়ে দেখতে। নলিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, আমি বুক চাপড়াই। আজকালকার দিন হলে অন্য কথা ছিল—ইলোপ করে নিয়ে যেতাম নলিনীকে। সেটা তো সম্ভব নয়। আর রায়সাহেব করুণাময় গুহর বাড়ি থেকে মেয়ে বার করে নিয়ে যাবার হিম্মত কার আছে। …আমরা দুটি যুবক-যুবতী তখন অকূল পাথারে ভাসছি। এক একবার মনে হত—অ্যারারুটের সঙ্গে ধুতরো ফুলের বিচি মিশিয়ে খেয়ে ফেলি। তাতে কী হত সেটা অবশ্য জানতাম না। নলিনী কেঁদে কেঁদে শুকিয়ে গেল, নলিনী মুদিল আঁখি। আর আমার তো সবদিকেই শ্মশান—খাঁ খাঁ করছে! …এমন অবস্থায় নলিনী হঠাৎ একদিন এক বুদ্ধি দিল। মেয়েরা ছাড়া কোনো বুদ্ধি কেউ দিতে পারে না। পুরাণে আছে—লক্ষ্মী বুদ্ধি দিয়েছিল বলে দৈত্যরা স্বর্গ জয় করতে পারেনি। যতরকম কুট, ফিচেল, ভীষণ ভীষণ বুদ্ধি জগৎ সংসারে মেয়েরাই দেয়।”

নলিনী আর মমতা দু’জনেই প্রবল আপত্তি তুললেন “সব দোষ মেয়েদের! তোমরা আর ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না?”

বটকৃষ্ণ হেসে বললেন, “মাছ ভাজা হলে আমরা খেতে জানি। কিন্তু মাছটা ভাজে কে? মেয়েরা। ও কথা থাক, তবে এটা তো সত্যি কথা—নলিনী যদি বুদ্ধিটা না দিত—আমার চোদ্দো পুরুষের সাধ্য ছিল না—অমন একটা মতলব মাথায় আসে।”

মমতা বললেন, “বুদ্ধিটা কী?”

“বলছি। রায়সাহেব করুণাময়ের হৃদয়ে অন্য কোনো করুণা না থাকলেও মানুষটির কয়েকটি বিগ বিগ গুণ ছিল। ভেরি অনেস্ট, কথার নড়চড় করতেন না—হ্যাঁ তো হ্যাঁ—না তো না। তোষামোদ খোসামোদ বরদাস্ত করতেন না একেবারে। আর ভদ্রলোকের সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা ছিল সাধু-সন্ন্যাসীর ওপর। গেরুয়া দেখলেই কাত, হাত তুলে দু বার হরিনাম করলেই করুণাময়ের হৃদয়ে করুণার নির্ঝর নেমে আসত। নলিনী আমার হাত ধরে বলল একদিন, সোনা—তুমি সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাও।”

মমতা হেসে বললেন, “ও, মা সেকি কথা, দিদি আপনাকে সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যেতে বলল?”

নলিনী বললেন, “তুই ওসব বানানো কথা শুনিস কেন? সবই দিদি বলছে, আর উনি গোবর গণেশ হয়ে বসে আছেন, ঘটে বুদ্ধি খেলছে না!”

বটকৃষ্ণ বনেদি ঘড়ির আওয়াজের মতন বার দুই কাশলেন, তারপর বললেন, “আমার ঘটে বুদ্ধি খেলেনি—তা তো আমি বলিনি। তুমি আমায় সোনা লক্ষ্মী দুষ্ট—এইসব করে গলিয়ে শেষে বেকায়দা বুঝে গেরুয়ার লাইনে ঠেলে দিয়ে পালাতে চেয়েছিলে। তা আর আমি বুঝিনি—”

নলিনী বোনকে বললেন, “কথার ছিরি দেখছিস?

“তোমার দিদি আমায় পথে ভাসাচ্ছে দেখে—বুঝলে ভাই মমতা, আমার বুদ্ধির ঘট নড়ে উঠল। লোকে দত্তদের কি যেন একটা গালাগাল দেয়—আমি হলাম সেই দত্ত। ভেবে দেখলাম—রায়সাহেব করুণাময়কে বাগাতে হলে গেরুয়ার লাইন ছাড়া লাইন নেই। ওই রন্ধ্রপথেই ঢুকতে হবে। নলিনীকে বললাম—ঠিক আছে, তোমরা কারমাটারে যাও—আমি আসছি। নলিনী আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি এসো লক্ষ্মীটি, আমি তোমার জন্যে হাঁ করে চেয়ে থাকব।”

সত্যপ্রসন্ন এবার বেশ জোরে হেসে উঠলেন। “দাদা কি সত্যি সত্যিই সাধু-সন্ন্যাসী হলেন?”

বটকৃষ্ণ চুরুটের ছাই ঝেড়ে আবার সেটা ধরিয়ে নিলেন। বললেন, “নাটকের সেটাই তো ভাই থার্ড অ্যাক্ট। তোমার দিদিরা কারমাটারের নতুন বাড়িতে চলে গেল। রায়সাহেবের সেই নেড়ি কুকুরটা পর্যন্ত। আমার চোখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু পুরুষমানুষ আমি—যোগী হয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন, শাস্ত্রে বলেছে—কর্ম আর উদ্যোগের দ্বারাই পৌরুষের বিচার। আমিও হাত পা ঝেড়ে উঠে বসলাম।”

মমতা বললেন, “কী করলেন?”

বটকৃষ্ণ বললেন, “লোকে মা বাপ মরলে মাথা নেড়া করে। আমি তোমার দিদিকে পাবার আশায়, আর করুণাময়ের করুণা উদ্রেকের জন্যে মাথা নেড়া করলাম, টকটকে গেরুয়া বসন পরলাম—আর একটা পকেট সংস্করণ গীতা আলখাল্লার পকেটে ঢুকিয়ে একদিন পৌষ মাসের সকালে কারমাটার স্টেশনে নামলুম। চোখে একটা চশমাও দিয়েছি, গোল গোল কাচ, চশমার ফ্রেমটা নিকেলের। চেহারাটা আমার ভগবানের কৃপায় মন্দ ছিল না, তা ছাড়া তখন কচি বয়েস, ড্রেসটা আমায় যা মানিয়েছিল—না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না। …তা কারমাটার স্টেশনে নেমে একটু খোঁজখবর করে খানিকটা এগুতেই দেখি—আমার নলিনী মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে। দেখে চক্ষু সার্থক হল। কে বলবে—এই নলিনী সেই নলিনী। পনেরো বিশ দিনেই দেখি ওঁর মুখ চোখের রং ফিরে গিয়েছে। সেকালে মেয়েরা আজকালকার মতন করে শাড়ি জামা জুতো পরত না। এই ফ্যাশনটাও ছিল না। নলিনী পার্শি ঢঙে শাড়ি পরেছে, গায়ে গরম লং কোট, মাথায় স্কার্ফ, পায়ে মোজা আর নাগরা জুতো। নলিনীর সঙ্গে বাড়ির ঝি নিত্যবালা। কাছাকাছি আসতেই নলিনী দাঁড়িয়ে পড়ল। একেবারে থ। তার চোখের পলক আর পড়তে চায় না। এদিকে পৌষ মাসের ওই ভোরবেলায় শীতে আমার অবস্থা কাহিল। একটা করকরে র‍্যাপার ছাড়া আর কোনো শীতবস্ত্র নেই। গায়ে অবশ্য তুলে ধরানো গেঞ্জি রয়েছে। কিন্তু তাতে শীত বাগ মানানো যাচ্ছে না। দিদিমণিকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নিত্যবালা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। নলিনী কথা বলতে পারছে না। আমিও চুপচাপ একটা কথা বলি—নলিনীদের বাড়ির কেউ আমাকে চিনত না। চোখে দেখে থাকবে—কিন্তু তেমন করে নজর করেনি। তার ওপর আমার নেড়া মাথা সন্ন্যাসীর বেশে চেনা মুশকিল। নলিনী চোখের ইশারায় আমায় মাঠ ভেঙে সোজা চলে যেতে বলল। বলে সে নিত্যকে নিয়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল।”

মমতা ঠাট্টা করে বললেন, “দিদি আপনাকে দেখে কেঁদে ফেলেনি তো?”

“কাঁদো কাঁদো হয়ে গিয়েছিল,” বটকৃষ্ণ বললেন, “তোমার দিদি হয়তো ভাবেইনি—সেই উৎপাত আবার এসে জুটবে।”

নলিনী বললেন, “উৎপাত ছাড়া আর কি! যে জ্বালান জ্বালিয়েছে।”

সত্যপ্রসন্ন আবার সিগারেট ধরালেন, “তারপর কী হল?”

বটকৃষ্ণ বললেন, “তারপর আমি সোজা করুণাময়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির। নতুন বাড়ি করেছেন রায়সাহেব, শৌখিন ছোট্ট বাড়ি, তখনও সব কাজ শেষ হয়নি, জানলা দরজায় সদ্য রং হয়েছে, বাড়ির বাইরে রং পড়ছে। চুনের গন্ধ, রঙের গন্ধ। তবে সত্য, জায়গাটি সত্যিই চমৎকার। রায়সাহেব বাড়ির মধ্যে কাইজারকে নিয়ে পদচারণা করছিলেন। কাঠের নতুন ফটকের সামনে আসতেই কাইজার বেটা হাউমাউ করে তেড়ে এল। কিন্তু আমার পকেটে তো তখন ডগ বিস্কুট নেই, আফিং দেওয়া বান রুটিও নেই। কাইজারের তাড়ায় গেটের সামনে থেকে পিছিয়ে এলুম। রায়সাহেবের চোখ পড়ল। তিনি একটা ঢোললা পাজামা, গায়ে জব্বর ওভারকোট পরে, গলায় মাফলার জড়িয়ে পায়চারি করছিলেন, আমায় দেখে এগিয়ে এলেন। কাইজারকে ধমক দিয়ে বললেন ; ডোন্ট শাউট। তাঁর এক ধমকেই কাইজার লেজ নাড়তে লাগল। রায়সাহেব আমায় কয়েক মুহূর্ত দেখলেন, মানে নিরীক্ষণ করলেন। আপাদমস্তক, সেই সার্চ লাইটের মতন চোখের দৃষ্টিতে আমি ভিতরে ভিতরে কাঁপতে লাগলাম। অবশ্য শীতটাও ছিল প্রচণ্ড। শেষে রায়সাহেব বললেন, কি চাই?…আমি বললুম, কিছু না। এখান দিয়ে যাচ্ছিলুম, নতুন বাড়িটা দেখে চোখ জুড়ল, তাই দেখতে এসেছিলাম। বাড়িটি বড় চমৎকার। রায়সাহেব তোষামোদে খুশি হবার লোক নন, কিন্তু বউ, বাড়ি আর গাড়ির গুণগান গাইলে পুরুষমানুষে খুশি হয়। রায়সাহেব বললেন, আচ্ছা ভেতরে আসুন। আমি হাত জোড় করে বললাম, আমায় আপনি বলবেন না, বয়স্ক প্রবীণ লোক আপনি—আমি লজ্জা পাব। ভেতরে যাবার প্রয়োজন কী! বাইরে থেকেই দেখে বড় ভাল লাগছে। রায়সাহেব আরও খুশি হলেন। বললেন, এসো, এসো ; ভেতরে এসো। তোমার তো শীত ধরে গেছে—এসো এক কাপ গরম চা খেয়ে যাও। রায়সাহেব কাঠের ফটক খুলে ধরলেন।”

মমতা হেসে গড়িয়ে পড়ে বললেন, “আপনার তো পোয়া বারো হল।”

বটকৃষ্ণ বললেন, “তা আর বলতে। রায়সাহেব তো জানেন না কোন রন্ধ্রপথে আমি ঢুকতে চাইছি। একেই বলে ভাগ্য। ভাগ্য যদি দেয় তুমি রাজা, না দিলে ফকির। অমন জাঁদরেল রায়সাহেব আমায় বাড়ির মধ্যে নিয়ে গিয়ে বসালেন। চা এল। চা খেতে খেতে বললেন : তোমার বয়েস কত হে? বললাম, ছাব্বিশ শেষ হয়েছে। উনি বললেন, তা এই বয়সে সন্ন্যাস নিয়েছ কেন?

“বললাম, বয়েস কি বৈরাগ্যকে আটকায়! গৌতম বুদ্ধ কোন বয়সে গৃহত্যাগ করেছিলেন? তীর্থংকর কখন করেছিলেন? মহাপ্রভু কোন বয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন তা তো আপনি জানেন। রায়সাহেব আমার মুখের দিকে দু দণ্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, বুঝেছি। তা এখন কদিন এখানেই থাকো। পরে আমি দেখছি।”

সত্যপ্রসন্ন বললেন, “বলেন কি দাদা, সোজাসুজি আপনাকে থাকতে বললেন।”

“বললেন”, মাথা নেড়ে নেড়ে বললেন বটকৃষ্ণ। “বলেছি না—গেরুয়াতে রায়সাহেব হৃদয় গলত। তা ছাড়া উনি সন্দেহ করেছিলেন—আমি কোনো কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে সাধু-সন্ন্যাসী সেজেছি।”

নলিনী বোনকে বললেন, “জানিস মনো, আমাদের কারমাটারে বাড়ির দশ আনা হয়েছে মাত্র—ছ’ আনা তখনও বাকি। দোতলায় মাত্র দুটো ঘর হয়েছে, একটায় থাকত বাবা ; আর অন্যটায় মা, যামিনী, কালু। নীচের তলায় একটা মাঝারি ঘরে থাকতুম আমি। নীচেই ছিল রান্না, ভাঁড়ার, বসার ঘর।—তবু কোথাও কোথাও কাজ বাকি থেকে গেছে। বাবা ওকে নীচের তলার বসার ঘরটায় থাকতে দিল।”

বটকৃষ্ণ বললেন, “তোমার বাবার মতন সদাশয় মানুষ আর হয় না। থাকতে দিলেন বটে কিন্তু চারদিক থেকে গার্ড করে দিলেন। সকালে রায়সাহেব নিজে এসে আমার ধর্মে কতটা মতি তা বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন। ভীষণ ভীষণ প্রশ্ন করতেন : রামায়ণ মহাভারত থেকে গীতা পর্যন্ত। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানার চেষ্টা করতেন আমি কে—কোথা থেকে এসেছি—কেন সংসার ত্যাগ করেছি? সকালে আমাকে ধরাশায়ী করে তিনি বেরিয়ে যেতেন। তিনি বেরিয়ে গেলে আসত ভবিষ্যৎ শ্যালিকা যামিনী আর শ্যালক কালু। ওরা এসে বলত, লুডো খেলো ; কিংবা বলত-মাথা নিচু পা উঁচু করে তপস্যা করে দেখাও, না হয় দুটো বেয়াড়া অঙ্ক এনে বলত, করে দাও। দুপুরবেলা আমার শাশুড়ি পেঁপে সেদ্ধ কাঁচকলা সেদ্ধ ডাল সেদ্ধ দিয়ে ভাত খাওয়াতেন। রায়সাহেব কারমাটারের সস্তা মুরগির ঝোল টানতেন। পঙিক্ষ চাকর, নিত্য ঝি এরাও আমাকে চোখে চোখে রাখত। সন্ধেবেলায় রায়সাহেব আবার একদফা গোয়েন্দাগিরি করতে বসতেন। রাত্রে কাইজারকে ছেড়ে রাখা হত নীচের তলায়। ভেবে দেখো, অবস্থাটা কী দাঁড়াল। একেবারে প্রিজনার হয়ে গেলাম। ভাবতাম হায়—একি হল, আমি তো নজরবন্দি হয়ে গেলাম। এরপর রায়সাহেব আমার মতলবটা জানতে পারলেই তো সোজা পুলিশের হাতে তুলে দেবেন।”

মমতা রঙ্গ করে বললেন, “দিদির সঙ্গে দেখা হত না?”

“দিদির এদিকে ঘেঁষার হুকুম ছিল না। দৈবাৎ দেখা হয়ে যেত।”

নলিনী এবার গালে হাত বললেন, “কত মিথ্যেই যে বলবে! আমি তোমায় দুবেলা চা জলখাবার দিতে আসতুম, ঘর পরিষ্কার করতে যেতাম।”

“ও তো নিমেষের ব্যাপার। আসতে আর যেতে। বড় জোর একটা চিরকুটে দু লাইন লিখে ফেলে দিয়ে যেতে। তোমার ন্যাকামি দেখলে তখন রাগে গা জ্বলে যেত। নিজেরা চারবেলা চর্বচোষ্য খাচ্ছ, ডিম উড়ছে, মুরগি উড়ছে, মাছ চলছে—রাত্রে নাক ডাকিয়ে নিদ্রা হচ্ছে—আর আমি বেটা বটকৃষ্ণ—ভেজানো ছোলা, আদার কুচি, কাঁচকলা সেদ্ধ, কপি সেদ্ধ খেয়ে বেঁচে আছি। রাত্রে মশার ঝাঁক গায়ের চামড়া ফুলিয়ে দিচ্ছে, তার ওপর ওই নেড়ি কুকুরটার সারা রাত দাপাদাপি।”

নলিনী বললেন, “দেখো দত্তবাবু, এত পাপ ভগবানে সইবেন না। তোমার জন্যে আমি লুকিয়ে ডিমের ওমলেট, মাছ ভাজা, এমন কি কাচের বাটি করে জানলা গলিয়ে মাংস পর্যন্ত রেখে গিয়েছি। মশার জন্যে রোজ ধুনো দিয়ে যেতাম তোমার ঘরে।”

বটকৃষ্ণ বললেন, “ধুনো যে কোথায় দিতে লক্ষ্মী তা তো জানি না। তবে হ্যাঁ, তোমার বাবা কাইজারকে রোজ হাড় মাংস খাইয়ে খাইয়ে একটা বাঘ করে ফেলেছিলেন। আফিং খাইয়ে খাইয়ে আমি নেড়িটার শরীর চিমসে করে দিয়েছিলাম। তোমার বাবা তাকে আবার তাজা করে ফেলেছিলেন। রাত্রে একটু বেরুব, রোমিও-জুলিয়েট করব—তার কি উপায় রেখেছিলেন রায়সাহেব! চার পাঁচ দিনেই বুঝলুম, আমার আশা নেই। বৃথাই মাথা নেড়া করে গেরুয়া পরে ছুটতে ছুটতে এসেছি। নলিনী-মিলন হবে না। মানে মানে ফিরে যেতে পারলেই বাঁচি। তবে হ্যাঁ—সংসারে আর ফিরব না। গেরুয়াই যখন ধরেছি—তখন সোজা হরিদ্বার কিংবা কনখলে চলে যাব। এটা স্থির করে নিয়ে রায়সাহেবকে বললাম, এবার আমায় যেতে দিন। উনি বললেন, সেকি আরও কটা দিন থাকো না। অসুবিধে হচ্ছে! বললাম, আজ্ঞে না, এত সুখ-আরাম আমাদের জন্যে নয়। আমরা গৃহত্যাগী। দুঃখকষ্ট সহ্য করাই আমাদের ধর্ম। রায়সাহেব ধূর্ত চোখ করে বললেন, ছেলেমানুষ তো, ফাজলামি বেশ শিখেছ। শোন হে, এই রবিবার মধুপুর থেকে আমার এক বন্ধু আসবে। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার! আমারও ঘরদোর কম। তা তুমি কালকের দিনটা থেকে পরশু—শনিবার চলে যেও।

মমতা বললেন, “ওমা! সেকি! আপনাকে চলে যেতে বললেন?”

“বললেন বই কি। সাফসুফ বললেন—” বটকৃষ্ণ মাথা নাড়লেন! “আমিও ভেবেছিলুম—চলেই যাব। জেলখানায় বসে কিছু তো করার উপায় নেই। সেদিন সন্ধেবেলায় তোমার দিদি যখন কাঠকয়লা জ্বালিয়ে ধুনো দিতে এল, বললাম—তোমার বাবা আমায় পরশুদিন চলে যেতে বলেছেন। আমি চলে যাচ্ছি। তোমাদের ঘরদোর কম ; মধুপুর থেকে তোমার বাবার কোন বন্ধু আসবেন। তোমার দিদি ধুনোয় ঘর অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেল। আমি বসে নাকের জলে চোখের জলে হলাম। রাত্রের দিকে তোমার দিদি এক চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। চিরকুট পড়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। মধুপুরের সেই ভদ্রলোক—রায়সাহেবের বন্ধু—তাঁর ভাইপোর জন্যে নলিনীকে দেখতে আসছেন। তোমার দিদি লিখেছিল : তুমি আমায় বাঁচাও। না বাঁচালে বিষ খাব। তুমি ছাড়া আমার কে আছে লক্ষ্মীটি?”

সত্যপ্রসন্ন নলিনীর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনি কি তাই লিখেছিলেন, দিদি?”

নলিনী বললেন, “বয়ে গেছে।”

বটকৃষ্ণ বললন, “বয়েই তো যাচ্ছিল। অন্য হাতে পড়লে বুঝতে। সোনার অঙ্গ কালি করে দিত।…যা বলছিলাম সত্য, তোমার দিদির চিঠি পড়ে আমার মনে হল—বিষটা আমিই আগে খেয়েনি। কিন্তু কোথায় পাব বিষ? কারমাটারে একটা সিদ্ধির দোকান পর্যন্ত নেই। ভাবলাম গলায় দড়ি দি; ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখি—একটা হুক পর্যন্ত নেই, দড়ি বাঁধব কোথায়! যেদিকে তাকাই ফাঁকা। মরার মতন কিছু হাতের কাছে পেলাম না। ভাবি আর ভাবি, কোনো উপায়ই পাই না। হঠাৎ একটা জেদ চাপল। ভাবলাম, জীবনটা তো নষ্ট হয়েই গেল, প্রেমের পূজায় এই তো লভিনু ফল। তা নষ্টই যখন হল—বেচারি নলিনীর জন্যে কিছু না করেই কি মরব? ও আমার কাছে বাঁচতে চেয়েছে। কেমন করে বাঁচাই? কেমন করে? সারা রাত ঘুম হল না। ছটফট ছটফট করে কাটল। হাজার ভেবেও কোনো বুদ্ধি এল না। পরের দিন সকাল থেকে মৌনী হয়ে থাকলাম। রায়সাহেবকেও পাত্তা দিলাম না। দুপুরবেলায় খেলাম না। বিকেলবেলায় কেমন ঘোরের মতন বাইরে পায়চারি করতে করতে খেয়ালই করিনি রায়সাহেব আমায় ডাকছেন। যখন খেয়াল হল—রায়সায়েব তখন আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। উনি বললেন, কি হে, তুমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁট নাকি? বলতে যাচ্ছিলাম—আজ্ঞে না। কিন্তু হঠাৎ আমার এক মামার কথা মনে পড়ল। মামা সোমনামবুলিজমে ভোগে, মানে স্লিপ ওয়াকার, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটে, তবলা বাজায়, ক্যালকুলাসের অঙ্ক করে। বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার ওই রোগটা আছে। বংশানুক্রমিক। রায়সাহেব আঁতকে উঠে বললেন, সেকি, আগে তো বলোনি। ও যে সর্বনেশে রোগ। আমার এক বন্ধু এই রোগে সেলুন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেল। এ তো ভাল কথা নয়। তুমি রাত্রে বাথরুম-টাথরুমে বেরিও না। কাইজার ছাড়া থাকে। তোমার গলার টুঁটি কামড়ে ধরবে। না না, খুব খারাপ, ভেরি ডেনজারাস, তোমার আগেই বাপু বলা উচিত ছিল। স্লিপ ওয়াকার্সদের আমি বড় ভয় পাই। রায়সাহেব কি যেন ভাবতে ভাবতে চলে গেলেন। আমিও হঠাৎ ব্রেন ওয়েভ পেয়ে ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে গেলাম।”

মমতা শুধোলেন, “মাথায় বুঝি কোনো বুদ্ধি এল?”

বটকৃষ্ণ চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন আবার। বললেন, “হ্যাঁ, মাথায় বুদ্ধি এল। ওই একটি মাত্র পথ ছাড়া আর কোনো পথও ছিল না। রাত্রে এক ফাঁকে তোমার দিদিকে অনেক কষ্টে ধরলাম। বললাম, সোনা আমার—তোমার শোবার ঘরের দরজাটা আজ একটু খুলে রেখো। শুনে তোমার দিদি আমায় মারতে ওঠে আর কি! অনেক করে বোঝালাম। বললাম—তোমার বাবা কত বড় বাঘা ওল আমি দেখব, আমিও সেই রকম তেঁতুল।”

অধৈর্য হয়ে মমতা বললেন, “তারপর কি করলেন বলুন।”

বটকৃষ্ণ বললেন, “সেদিন রাত্রে রায়সাহেব কাইজারকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখলেন। তোমার দিদি শুতে নীচে, তার ঘরে থাকত নিত্য ঝি। নিত্য বড় ঘুম কাতুরে। ভূতটুতের বড় ভয়। সেদিন নিত্য ঘুমিয়ে পড়ার পর নলিনী ঘরের ভেতর থেকে ছিটকিনিটা খুলে রাখল। ভোর রাতের দিকে আমি স্লিপ ওয়াকিং করতে করতে তোমার দিদির ঘরে গিয়ে হাজির। নিত্যঝি ভোরবেলায় উঠত। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল আমি সটান বিছানায় শুয়ে আছি, নলিনী জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। নিত্য হাঁউমাউ করে চেঁচাতে লাগল। তার চেঁচানির চোটে কাইজার চেন ছিঁড়ে বাঘের মতন নীচে নেমে এল। পাজামার দড়ি আঁটতে আঁটতে রায়সাহেব নীচে নেমে এলেন, আমার হবু শাশুড়ি ঠাকরুণও। পঙিক্ষ চাকরও হাজির। আমি সমস্তই বুঝতে পারছি—কিন্তু নড়ছি না—মড়ার মতন শুয়ে আছি। কানে এল, রায়সাহেব ঘরের মধ্যে বোমা ফাটানোর গলায় বললেন, ঘরের দরজা কে খুলেছিল? কে? নলিনী কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে কাঁদতে বলল, নিত্যদি। কলঘরে গিয়ে ফিরে এসে নিশ্চয় দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। নিত্য বলল, না বাবাঠাকুর আমি নই। শাশুড়ি ধমক দিয়ে বললেন, চুপ কর তুই, তোর ঘুম আমি জানি না। সব ক’টাকে বাড়ি থেকে তাড়াব। রায়সাহেব বললেন, ওই রাস্কেল, ইতর, ছুঁচোটাকে তুলে দাও, দিয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসো। হারামজাদাকে হান্টার পেটা করব।”

সত্যপ্রসন্ন প্যাকেট খুলে দেখলেন আর সিগারেট নেই। মমতা হাসির দমক তুলে দিদির হাত টিপে ধরলেন।

বটকৃষ্ণ বললেন, “খানিকটা পরে আমি রায়সাহেবের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালুম। ঘরে আমার হবু শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ ছিল না। রায়সাহেব সার্কাসের রিং মাস্টারের মতন বসে ছিলেন হান্টার হাতে, একপাশে গিন্নি, অন্য দিকে তাঁর কাইজার। রায়সাহেব আমায় দেখেই তোপ দাগলেন : বদমাশ, স্কাউড্রেল, পাজি, ইতর, কোথাকার।…তুমি কোন মতলবে বাড়ির মেয়েদের ঘরে ঢুকেছিলে? সত্যি কথা বলো? নয়ত চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব!…ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল, কিন্তু এই শেষ সময়ে ভয় করলে তো চলবে না। মা কালীকে মনে মনে ডেকে ন্যাকার মতন বললুম, আপনি কি বলছেন—আমি বুঝতে পারছি না। আমি সাত্ত্বিক সন্ন্যাসী মানুষ। আমি কেন বাড়ির মেয়েদের ঘরে ঢুকতে যাব, ছি ছি। বলে কানে আঙুল দিলাম।

রায়সাহেব হান্টারটা সোঁ করে ঘুরিয়ে মেঝের ওপর আছড়ে মারলেন। তুমি সাত্ত্বিক—তুমি সন্ন্যাসী! তুমি জোচ্চোর, ধাপ্পাবাজ, লম্পট—। আমি তোমায় পুলিসে দেব।

আমি হাত জোড় করে বললুম, আপনি বৃথা উত্তেজিত হচ্ছেন।

তোমায় আমার খুন করতে ইচ্ছা করছে।

আমি কিন্তু নির্দোষ। আমার কোনো অপরাধ নেই।

তুমি নলিনীর ঘরে কেমন করে গেলে?

আজ্ঞে আমি জানি না।

জানো না? বদমাশ?

সত্যিই জানি না। বোধ হয় ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছি। আপনি তো জানেন আমার স্লিপ ওয়াকিং রোগ আছে। ঘুমের ঘোরে কি করি জানি না।

রায়সাহেব হান্টার তুলে আছড়াতে গিয়েও থেমে গেলেন। রায়গিন্নি বললেন, ঝি-চাকর—সবাই তো দেখল জানল। তোমার কি রোগ আছে বাছা আমি জানি না। কিন্তু এ-কথা যদি বাইরে রটে তবে যে কেলেঙ্কারি হবে। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কাল মধুপুর থেকে তার বন্ধুর আসার কথা।

রায়সাহেব কী ভেবে আমায় আদেশ দিলেন, এখন নীচে যাও। পরে আমি যা করার করব।

আমি নীচে নেমে আসার সময় দেখি নলিনী পাশের ঘরে কাঁদছে।

ঘণ্টাখানেক পরে রায়সাহেবের কাছ থেকে স্লিপ এল। পঙিক্ষ নিয়ে এসে দিল আমায়। রায়সাহেব নিজে আর রাগে লজ্জায় ক্ষোভে নীচে আসেননি। স্লিপে ছিল, তুমি আমার মানমর্যাদা সম্মান ডুবিয়েছ। নলিনীকে তোমায় বিয়ে করতে হবে। সন্ন্যাসীগিরি চলবে না। বিয়ে না করলে পুলিশে দেব।”

বটকৃষ্ণ তাঁর গল্প শেষ করে হা হা করে হাসতে লাগলেন। বললেন “শ্বশুরমশাই পরে অবশ্য বুঝেছিলেন—তিনি একটি রত্ন পেয়েছেন। আমিও অবশ্য বড় রত্ন পেয়েছি, ভাই,” বলে বটকৃষ্ণ চোখের ইশারায় নলিনীকে দেখালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *