চার তাস

চার তাস

নলিন ফোনে কান রেখে সাড়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল; ওপারে গলার স্বর উঠতেই নলিন বলল, “কী ব্যাপার?”

“কিসের কী ব্যাপার!”

“ন’টা পাঁচ থেকে ন’টা তেরো⋯চারবার ফোন তুলেছি⋯এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল?”

“দিদি কথা বলছিল…”

“দাদার সঙ্গে নিশ্চয়।”

“হ্যাঁ।”

নলিন দু-মুহূর্ত চুপ; তারপর বলল, “তোমার দাদাটি ভেবেছেন কী? বাড়ির ফোন কী তাঁর আর তাঁর গিন্নির মৌরসিপাট্টা?⋯আলাদা ফোন নিতে বলো। বউয়ের ঘরে থাকবে।”

ওপারে চাপা হাসি।

নলিন বলল, “হাসছ যে?”

“দাদাকে বললে দাদা কী জবাব দেবে যদি জানতে…” ওপার থেমে গিয়ে হাসতে লাগল।

“যদি জানতে…” নলিন বলার ভঙ্গি অনুকরণ করে ভেঙাল। “লহর তুলে হাসছ যে! এ্যাঁ⋯! জানার কি আছে শুনতে পাই?”

ওপারের হাসি থামল না, স্টেশনের কাছে গাড়ি পৌঁছে গেলে গতি এবং শব্দটা যেমন মন্থর ও মৃদু হয়ে আসতে থাকে, সেই রকম হাসিটাও ঈষৎ কমে আসতে লাগল। তারই ফাঁকে ফাঁকে কথা। ওপার বলল, “দাদা বলবে, তুমিই আলাদা একটা ফোন তোমার বউয়ের ঘরে রাখো। বাড়ির ফোন তোমারও মৌরসিপাট্টা নয়।”

নলিন থমকে গেল যেন। তারপরই বলল, “মানে—?”

“খুবই সহজ।”

“এ রকম কথা বলার কোনো রাইট পুলিনের নেই। আমি দিনে ক’বার বাড়িতে আমার বউয়ের সঙ্গে ফোনে গল্প করছি। সে হরদম করছে। যখনই ফোন তুলি—দেখি লাইন নেই। তারই উচিত তার বউয়ের ঘরে একটা প্রাইভেট লাইন নেওয়া।”

“তা তুমিই বা হরদম ফোন তোলো কেন?”

“তুলি না।”

“না তুললে কেমন করে জানলে দাদা দিদিতে গল্প হচ্ছে⋯”

নলিন এবার একটু যেন থতমত খেয়ে গেল, সামলে নিল অবশ্য, বলল, “বোঝাই যায়। দেখতেই তো পাচ্ছি। বেলা আটটা সোয়া আটটায় চেম্বারে এসেছে, একটাও পেশেন্ট নেই, টেবিলে পা তুলে বউয়ের সঙ্গে গল্প করছে।”

“পেশেন্ট নেই কেন?”

“থাকলে কেউ সাত সকালে পেশেন্ট ফেলে বউয়ের সঙ্গে গল্প করে?”

“ও!⋯তোমারও বুঝি পেশেন্ট নেই?”

নলিন একেবারে বোবা। মাথা ফেরাতেই চোখে পড়ল তার ডেন্টিস্টস চেয়ারটা শূন্য। জানলা দিয়ে একমাত্র যা রোদই ঘরে এ-যাবৎ এসেছে, এসে দিব্যি সেই চেয়ারে বসে আছে। নলিন হেসে ফেলল। তারপর গলার সুর পাল্টে ডাকল, “ফুলটুসি!”

“শুনেছি, বলো—”

“আমার ঘরে একজন পেশেন্ট আছে।”

ওপারে বুঝি বিস্ময় এবং সামান্য বিব্রত হবার শব্দ এল।

নলিন বলল, “পেশেন্ট বেশ শান্তশিষ্ট, কিন্তু তার দাঁত নেই।”

ওপার অস্পষ্ট করে বলল, “বুড়ো?”

“এখনও হয়নি, হতে হতে দুপুর ফুরোবে।”

“ইয়ার্কি মারা হচ্ছে, না?⋯তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারার সময় আমার এখন নেই। অনেক কাজ। কী জন্যে ডাকছিলে বলো?”

“কী করছ?”

“স্নান করতে যাব, স্নান করে মার সঙ্গে…”

“সর্বনাশ, এই শীতে এখন স্নান! তোমার না চোখ ফুলে ব্যথা হয়েছে। পুলিন সকালে কী বলল?”

“বলল, কিছু না।”

“কিছু না?”

“না।”

নলিন দু-মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, “তোমার দিদিকে বলো, আমার বউয়ের চোখ নিয়ে যদি পুলিন ছেলেখেলা করে, তবে আমি তার বউয়ের দাঁত নিয়ে অ্যায়সা হেলাফেলা করব⋯”

ওপার আবার যেন জোরে হেসে উঠল। সেই হাসির মধ্যে কি হল নলিন দেখতে পেল না। দেখতে না পেয়ে জোরে জোরে বলল, “অত হাসির কিছু নেই, আমি পুলিনের বউয়ের ভাঙা দাঁতটা সেপটিক করিয়ে দেব। টিট ফর ট্যাট…”

“তাই নাকি! দিয়েই দেখ, কত মুরোদ বুঝব?”

নলিন প্রায় চমকে গেল। এ যে অন্য গলা, ফুলটুসির নয়, তার দিদির; পাশেই ছিল নিশ্চয়। সঙ্গে সঙ্গে নলিন গলার স্বর পাল্টে নিল। “আরে তুমি! যমুনাপুলিনে⋯। তা, সারা রাত কর কী, সকালবেলাতেও গল্প থামে না। ডিসগ্রেস্⋯! রাম, রাম। চেম্বারে এসে সাত-সকালে কর্তা ফোন করছে আর গিন্নি ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে চেম্বারে পেশেন্ট বসে। ⋯মিত্তিরবংশে এরকম একটা স্ত্রৈণ আর জন্মায়নি। একেবারে ভেড়ুয়া⋯”

“কে?”

“কে আবার, তোমার হাজবেণ্ড গো, শ্রীমৎ স্বামী…!”

“তাই নাকি! লোকে তো বলে আমার দেওর—।”

“আজ্ঞে না মেমসাহেব, দেওর অন্য জিনিস।”

“জানি তাঁর আবার পুজোয় মন নেই, নৈবিদ্যিতেই চোখ…”

নলিন বুঝতে পারল না, থেমে গেল। অথচ কানে শুনছিল খুব একটা রগড়দার হাসি হচ্ছে ওপাশে, দু-বোনেই হাসছে। নলিন অপ্রস্তুত হয়ে সামান্য চুপ করে থেকে শেষে বলল, “মানেটা বুঝলাম না।”

“বুঝে নাও।”

“মেয়েলি ছড়া মানেই অসভ্য কিছু।”

“ওরে, কি আমার সভ্য পুরুষ।”

“আমি বুঝতে পারছি, তোমার পাল্লায় পড়েই পুলিনটা অসভ্য হয়ে গেছে।”

“তাও ভাল; তা ও না হয় অসভ্যই হয়েছে, আর তুমি যে এদিকে কীর্তি করে রেখেছ। কি মশাই, আমার বোনটার সভ্যসমাজে বের হবার পথ এত তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলে⋯।”

ওপাশে কেমন একটা ‘এই’ ‘যা’ ‘মাগো ‘অসভ্য’ ইত্যাদি ভাঙা, বেখাপ্পা, অনুচ্চ-স্বর কথাবার্তা, সলজ্জ হাসি শোনা গেল এবং বোঝা গেল মুখ চাপা দেবার চেষ্টা হচ্ছে। নলিন পরমুহূর্তেই সব বুঝতে পারল। ঈষৎ শিহরিত ও লজ্জিত হয়ে নিতান্ত ভাল ছেলের মতন নলিন আমতা আমতা করে বলল, “তুমি একেবারে ভল্গার। যাক গে, দয়া করে কথাটা গেজেট করে দিও না। যা পেট পাতলা মানুষ। ⋯বুঝলে⋯ ! প্লিজ। কৃতজ্ঞতার একটা পুরস্কার আছে, আমি তোমার আর পুলিনের জন্যে কম করিনি।”

“বড় ভাইকে পুলিন কি? দাদা বলো।”

“দরকারে মানুষ বাবা বলে। যাক সে পরে হবে!⋯তুমি কিন্তু এখন কোনো কিছু ফাঁস করবে না। মাইণ্ড দ্যাট। ⋯আমার হাতেও অস্ত্র আছে।” নলিন হেসে ফেলল।

দুই

এরা এই রকমই, পুলিন, নলিন এবং তাদের বউ। লোকে বলে, তাসের প্যাকেট। অর্থাৎ তারা বোঝাতে চায়, তাসের যেমন চার বাহার, দুই কালো দুই লাল, নয়ত তাসই হয় না, এরাও তেমনি, কাউকে বাদ দেবার উপায় নেই।

পুলিন এবং নলিনের একটা চলতি নাম আছে এ শহরে বাঙালিদের মধ্যে। পুলিনকে বলা হয় ‘চক্ষু’, আর নলিনকে ‘দন্ত’; পুলিন চোখের ডাক্তার বলেই তাকে ঠাট্টা করে যে ‘চক্ষু’ বলা হয় একথা পুলিনও জানে; আর নলিনও জানে সে দাঁতের ডাক্তার বলে তাকে ‘দন্ত’ বলা হয়। এ ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র রাগ নেই। রাগ করে লাভ কি, যারা বলে তারা হয় ঠাট্টা করে বলে, না হয় আদর করে তামাশা করে। ওদের মধ্যে কেউ হয়ত পুলিন নলিনের আবাল্য বন্ধু, কেউ হয়ত তাদের বাবার বন্ধু, রীতিমত গুরুজন ব্যক্তি, যাঁদের কাউকে পুলিনরা হয়ত বলে জ্যেঠামশাই, কাউকে কাকাবাবু। অবশ্য এই ঠাট্টার ডাকটুকু সর্বদার নয়, সকলের কাছেও নয়। মুখোমুখি দেখা হলে, ‘পুলিন, নলিন’ কদাচিৎ কোনো বন্ধু হয়ত বলল, ‘এই যে চক্ষু দন্ত, যাচ্ছিস কোথায়?’

পুলিনরা এ শহরে তিন-পুরুষ বসবাস করছে। ঠাকুরদা ছিলেন সিভিল সার্জন, বিহারের যত রাজ্য ঘুরে রিটায়ার করার পর জলবাতাস, গঙ্গা এবং গাছপালা পাহাড়ের জন্যে এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসলেন। বাড়িঘর তৈরি হল, ঠাকুরদাদা মারা গেলেন। বাবা অন্য কোথাও গেলেন না, এই শহরের আদালতেই ওকালতি শুরু করলেন, এবং দেখতে দেখতে প্রতিষ্ঠা পেলেন।

ক্ষিতীশ মিত্তির (পুরো নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মিত্র) এ শহরে একটা মানুষের মতন মানুষ ছিলেন। বেহারিদের ধারণা ছিল, মিত্তিরবাবুর মতন উকিল পাটনাতেও নেই, আর ‘লালচ্‌’ থাকলে উকিলবাবু পাটনায় গিয়ে লাখো টাকা কামাতেন। ‘সাচ্চা আদমি’ ছিলেন উকিলবাবু। বাঙালিরা বলত, দেবতুল্য ব্যক্তি। শ্রদ্ধাভক্তি করত, ভালবাসত, বিপদে-আপদে শরণাপন্ন হত, অভিভাবকের মতামতের মতন তাঁর মতামত মান্য করত।

মানুষটি ছিলেন নিরহঙ্কার, কর্মী, আমুদে; এমন কি থিয়েটারপাগলও। ওকালতিতে তাঁর পশার ছিল হিংসে করার মতন, তবু তিনি জীবনটা নথিপত্র আদালত করে শেষ করে দিতে চাননি। দুর্গাবাড়ির পাকা ঘর, কালীবাড়ির গায়ে লাগানো লাইব্রেরি এবং স্টেজ ইত্যাদি ক্ষিতীশ মিত্তিরই করেছিলেন। এই শহরের মধ্যে কলেজ করার পেছনেও তাঁর পরিশ্রম ছিল।

এমন একজন মানুষ মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন ভাবতেই কেমন লাগে যেন। শিবরাত্রির দিন যে মানুষ সারা রাত ‘কর্ণার্জুনে’ কর্ণের পার্ট করেছেন, সেই মানুষ পরের দিন জ্বরে পড়লেন, জ্বর হু-হু করে বাড়ল, চারদিনের দিন ডবল নিওমোনিয়ায় মারা গেলেন। বাঙালি মহল্লার লোক ক্ষিতীশ মিত্তিরের বাড়ি ঘিরে তিনদিন সমানে বসে ছিল, যেন যমকে কোন পথ দিয়েই ঢুকতে দেবে না। ছোটাছুটি, ডাক্তার ডাকাডাকি, এটা-সেটা করতে বেহারিরাও পিছপা হয়নি, মনিরামের গাড়ি গিয়েছিল পাটনার সবচেয়ে বড় ডাক্তার নিয়ে আসতে, ডাক্তার আসার আগেই ক্ষিতীশ চোখ বুজে ফেললেন চিরকালের মতন।

শোকটা সকলেরই গায়ে লেগেছিল। পুলিন তখন সবে কলেজে ঢুকেছে, নলিন স্কুলে। অভিভাবক বলতে শুধু তাদের মা। দিদি জামাইবাবু তো দূরে থাকে। অবশ্য পাড়ার লোক সবসময়ই কাছে ছিল। শোকের পর্বটা আস্তে আস্তে কাটল। প্রভাময়ী নিজেকে সামলে নিলেন।

আই-এস-সি পাশ করে পুলিন চলে গেল পাটনা মেডিকেল কলেজে পড়তে। ক্ষিতীশবাবুর সেই রকম ইচ্ছে ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন সিভিল সার্জন। ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তারি পড়ে। ক্ষিতীশের ডাক্তারিটা তেমন পছন্দ ছিল না, তবে বাবাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘তোমার নাতি পড়বে।’

পুলিন পাটনা থেকে পাশ করে গেল বিলেত, চোখের বিদ্যেতে একটা ডিপ্লোমা আনার জন্যে। সেখানে থাকতে থাকতে ছোট ভাইকে নিয়ে গেল। নলিন শিখল দন্ত চিকিৎসা। পুলিন ফিল আগে, নলিন ফিরল মাস দুই তিন পরে।

পুলিন নলিন অতঃপর এখানেই বসেছে। বাবা চাইতেন না—অর্থ এবং প্রতিষ্ঠার জন্যে ছেলেদের কেউ এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। ‘যা করার এখানে থেকেই করবে ; এদের জন্যে করবে।’ প্রভাময়ীরও সেই রকম ইচ্ছে ছিল। শ্বশুরমশাই অনেকটা জমিজায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন, বাগান করেছিলেন; স্বামীর হাতে সেই বাড়ি-বাগান জমি-জায়গা আরও তকতকে হয়েছিল, ছোটখাটো অদল-বদল হয়েছিল। দীর্ঘকাল থাকতে থাকতে এই বাড়ি আর এই জায়গার ওপর যে মায়া জন্মেছিল, সেটা পুরুষানুক্রমে মমতা এবং দুর্বলতা। শ্বশুর ও স্বামী যে ভিটেতে বসবাস করেছেন, শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তা ত্যাগ করে যাওয়ার চিন্তা প্রভাময়ী করতে পারতেন না। পুলিন-নলিনও তা চায়নি। তাদের সংসারে অস্বচ্ছলতা কোথাও ছিল না, বরং ঠাকুরদা এবং বাবা যা রেখে গেছেন তা যথেষ্ট, ভদ্রভাবে জীবন কাটাবার পক্ষে অপ্রতুল নয়। তা ছাড়া পুলিন এবং নলিন এই শহরেই বসবে এ তারা বরাবরই স্থির করে রেখেছিল। জন্মাল এখানে, মানুষ হল, লেখাপড়া শিখল, ঘরবাড়ি থাকল এখানে—আর তারা যাবে পাটনা কি ভাগলপুরে প্র্যাকটিস শুরু করতে! দূর…তা কি হয়। পুলিন ভাল করেই জানত সে একেবারে সাধারণ ছেলে, তার এমন কোনো মেধা নেই যে, বাইরে গিয়ে চেম্বার খুললেই রাতারাতি সে পশার জমিয়ে ফেলবে। বিলেত থেকে একটা ডিগ্রি ডিপ্লোমা আজকাল কে আর না আনছে! ওটা কিছুটা শখ, কিছুটা ফালতু। তার চেয়ে এই শহরে চোখের ডাক্তার নেই, চেম্বার খুললে এখানেই খুলবে। বাবা যা চাইতেন, মা যা চায়। নলিনেরও মনোভাব সেই রকম। দাঁতের ডাক্তারও তো নেই এখানে, অথচ দাঁতের গোড়া কার না ফুলছে—এইখানেই সে প্র্যাকটিস করবে, কম্পিটিটার নেই।

পুলিন বিলেত থেকে ফিরে এসে সদর বাজারের কাছাকাছি ওদেরই এক ভাড়া দেওয়া বাড়ি মেরামত করাল, বাহারি করল। ওপরতলায় খান চারেক ফালি-ফালি ঘর থাকল, সেটা হল ক্লিনিক। নীচের তলায় দুই ভাইয়ের চেম্বার, আলাদা আলাদা, একটা আই স্পেশ্যালিস্ট ডাক্তার পি সেন-এর, অন্যটা ডেন্টাল সার্জন ডাক্তার এন সেন-এর।

পুলিন আর নলিন একেবারে পিঠোপিঠি ভাই, বছর দেড়েকের ছোটবড়। মাথার ওপর ছিল দিদি, তার বিয়ে হয়েছে মুঙ্গেরে, ভগ্নিপতি কলেজে কেমিস্ট্রির প্রফেসার। আসা-যাওয়া আছে। অতি রসিক-পুরুষ। পুলিন নলিনের বিয়েতে ভদ্রলোকের কিছুটা কারসাজি ছিল।

ওদের বিয়ের গল্পটা প্রসঙ্গত কোনো সময়ে আসবে, আপাতত এইটুকু মাত্র জানা দরকার—পুলিনের স্ত্রী মানসী, এবং নলিনের স্ত্রী সরসী সহোদর বোন, পুলিন নলিনের মতনই পিঠোপিঠি। চারজনের সম্পর্কটা তাই আরও কৌতুকপ্রদ হয়ে উঠেছে। পুলিন অনেক সময় ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে শালী সম্পর্কে ঠাট্টা করে, এবং নলিনও প্রত্যুত্তরে পুলিনের বউকে বড়শালীর প্রাপ্য খোঁচাটুকু মারতে ছাড়ে না।

বিয়ে হয়েছে বছর পুরতে চলল, অথচ দুই ভাই এমন সব কীর্তি করে যাতে মনে হয় এরা সদ্য বিবাহিত। যেমন আজ সকালে ফোন নিয়ে করল। এ-রকম নিত্যই হয়। চেম্বারে এসে রুগি না থাকলেই যে যার বউকে ফোনে ডেকে গল্প করতে চাইবে। মুশকিল এই, চেম্বারে পুলিনের নিজের ফোন আছে, নলিনেরও আছে; অথচ বাড়িতে মাত্র একটা ফোন। পুলিন-মানসী বাক্যালাপ চলতে থাকলে নলিন লাইন পায় না, নলিন-সরসী বাক্যালাপ চলতে থাকলে পুলিন হাঁ করে বসে থাকে। এবং দুজনেই দুজনের আক্কেল দেখে বোধ হয় অবাক হয়ে যায়।

তিন

বারোটার পর পুলিন গায়ের কোটটা কাঁধে ঝুলিয়ে শিস দিতে দিতে নলিনের চেম্বারে এসে ঢুকল। ছিপছিপে-চেহারা পুলিনের, গায়ের রং ফরসা, মুখ লম্বা ধরনের, সোজা শক্ত নাক, চোখ দুটো চকচকে, মাথার চুল কোঁকড়ানো। বাবার মুখের আদল পেয়েছে বড় ছেলে। ঘরে ঢুকে পুলিন বলল, “কই রে, তাড়াতাড়ি নে। ⋯খিদে যা পেয়েছে!⋯তোর সিগারেটের প্যাকেটটা কই⋯?” পুলিন নলিনের টেবিল হাতড়ে সিগারেট খুঁজতে লাগল।

সামান্য আগে নলিনের এক রুগি বিদায় নিয়েছে, নলিন সাবানে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছছিল। হাত মোছা হয়ে গেলে—একপাশে রাখা স্টেরিলাইজার যন্ত্রপাতির বাক্সটা কাচের আলমারির মধ্যে সরিয়ে রাখল।

নলিন বেশ গোলগাল, গায়ের রং পুলিনের চেয়েও ফরসা। নলিনের মুখও গোল, ফোলা ফোলা গাল নাক একটু পুরু, চোখ দুটো স্বচ্ছ ও সুন্দর, মাথায় সাবেকি ধরনের টেরি, চোখে ক্যারেট গোল্ড ফ্রেমের চশমা; নলিন হাসলে তার দাঁত দু পলক তাকিয়ে দেখার মতন। দাঁতের ডাক্তার বলেই বোধ হয় নিজের দাঁত দেখিয়ে নলিন অনেক রুগিকে পরোক্ষে ঘায়েল করে। নলিনের মুখের আদলে মায়ের মুখের ছাপ আছে।

পুলিন সিগারেট খুঁজে ধরিয়ে নিয়েছিল। সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে কি ভেবে সে দাঁত-দেখানো চেয়ারে এসে বসে পড়ল। বসে বলল, “এই দেখ তো, দাঁতের ফাঁকে কোথায় একটা কাঁটা আটকে আছে, বের করে দে।”

নলিন বিন্দুমাত্র গরজ দেখাল না। জানলার কাচের পাল্লা বন্ধ করে পরদা টেনে আলো আড়াল করে দিল।

পুলিন বলল, ‘কি রে, কাঁটাটা বের করে দিলি না?’

নলিন তার টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়োতে কুড়োতে জবাব দিল, “ওবেলা দেব। এক সঙ্গে।”

“একসঙ্গে।”

“দুপুরে গিলতে গিয়ে আবার তো একটা কাঁটা ঢোকাবি।”

পুলিন ঘাড় ফিরিয়ে ভাইকে দেখছিল, এবার উঠল। পুলিন প্রায়ই খেতে গিয়ে দাঁতের ফাঁকে কাঁটা আটকে ফেলে, নাকি আটকে যায়। তার একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যেস, মাছের কাঁটা বাছাও তার সহ্য হয় না। নলিন তাকে খোঁচা দিল আর কি! দিক।

ক্লিনিকের বাইরে শীতের রোদে ওদের গাড়িটা দিব্যি রোদ পোয়াচ্ছে। ছোট্ট একটা হিলম্যান, টকটকে লাল রং। পুলিন নলিন এগিয়ে গেল, চাকর চেম্বারের দরজা জানলা বন্ধ করছে, শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

গাড়িতে উঠে পুলিন বলল, “শেতলদার মার ছানি কাটতে হবে, বুঝলি।”

নলিন অন্য পাশ দিয়ে উঠে পুলিনের পাশে বসল, “কেটে ফেল।”

নলিন এমন সাদামাটা নিরুত্তাপ গলায় বলল যে, পুলিনের মনে হল ব্যাপারটা নলিন অবহেলার চোখে দেখছে। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে পুলিন বলল, “এ তোর দাঁত তোলা নয়, সাঁড়াশি ধরে মারলাম টান, বেরিয়ে গেল জান-প্রাণ…।”

গাড়ি চলতে শুরু করল। নলিন জবাব দিল, “হাতুড়ের মতন কথা বলিস না। দাঁতের তুই কী জানিস?”

“যা যা, দাঁতের আবার জানা⋯ ! তোরা যে কত ব্লাফ দিস লোকে তো আর জানে না। জানলে কাছে ঘেঁষত না।”

“তোরাও ঘর অন্ধকার করে যে ম্যাজিক দেখাস তাই বা ক’জন জানে বল? বুদ্ধু হয়ে টাকা গুনে দিয়ে চলে যায়।”

রাস্তায় কে একজন হাত তুলে কিছু বলল, পুলিন মাথা নাড়ল, নলিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি। জয়মলরামের দোকান পেরিয়ে গেল, বাজারের একটা রাস্তা এখানে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে, পুলিন বাঁদিকে পথ নিল, ম্যাকসাহেবের বেকারি, মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে হালদারদা কার সঙ্গে যেন গল্প করছে, পুলিন নলিনকে দেখে হাসল, ওরাও প্রত্যুত্তরে হাসিমুখ করল, তারপরই গণেশ হালুইকরের মিষ্টির দোকান পড়ল ডানপাশে।

পুলিন গাড়ি দাঁড় করাল। বলল, “দই নিয়ে আসবি?”

“শীতকালে দই খেতে নেই⋯”

“দইয়ের কথা বলেছিল; কি-যেন বলল আরও একটা মনে পড়ছে না।”

“আমায় কিছু বলেনি।”

“মানসী আমায় বলেছে।”

নলিন অগত্যা হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলল। “টাকা দে।”

“তুই নিয়ে আয়⋯”

“বেশ আছিস—”

পুলিন হাসল, বলল, “গাড়ির তেল কিনতে হবে, আমার কাছে তেলের টাকাটা আছে।”

“সকালে কিছু ইনকাম হয়নি তোর?”

“দূর⋯র। প্রথমে এল সেই ফেরিঅলা বুড়োটা তারপর এল শেতলদা। টাকা দিতে চেয়েছিল, ওকি আর নেওয়া যায়!”

নলিন দু-মুহূর্ত বড় ভাইকে দেখে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে নেমে পড়ল। দু-পা এগুতেই শুনল পুলিন সিগারেট-সিগারেট করে চেঁচাচ্ছে। নলিনের হাসি পেল। তাদের দুই ভায়ের পক্ষে এখানে চেম্বার খুলে বসা বোকামি হয়েছে। অর্ধেক লোকের কাছে তারা টাকা নিতে পারে না। এত সব চেনাশোনা, কেউ দাদা, কেউ কাকা-মামা, কেউ আসে বাচ্চা ছেলেমেয়েকে দেখাতে, কেউ মা-পিসিকে নিয়ে। কেউ বা নিজের জন্যেই আসে। এদের বেশির ভাগই দু-পাঁচ টাকা দিতে চায়, স্বেচ্ছায়, পুলিন-নলিন নিতে পারে না। নিতে লজ্জা করে। এভাবে কতদিন প্র্যাকটিস চলবে? নিতান্ত বাপ-ঠাকুর্দার পয়সা ছিল তাই চলছে, নয়ত মুশকিলে পড়তে হত। অবশ্য নলিন ভাবল, তারা এখন একেবারে নতুন; পুরানো হলে ফ্রি-রুগি কমে যাবে, আশপাশ থেকে দেদার রুগি আসবে।

দই কিনে নলিন দেখল টাটকা বালুসাই তৈরি হয়েছে। ফুলটুসি বালুসাই খেতে খুব ভালবাসে। নলিন বালুসাই কিনল। হালুইকরের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গেল পানের দোকানে, সিগারেট কিনল। গাড়িতে ফিরে আসার সময় নলিন হিসেব করে দেখল, তার সকালের রোজগার শেষ হয়ে দু-টাকা গাঁট-গচ্চা গেছে। মন্দ নয়!

গাড়িতে এসে বসে দরজা বন্ধ করল নলিন।

পুলিন শুধোল, “ওটা কী আনলি?”

“বালুসাই।”

পুলিন হেসে বলল, “সরসী বলেছিল?” বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল আবার।

“না, তোর মতন আমার চেম্বারে বসে বসে বউয়ের অর্ডার নিতে হয় না।”

গাড়ি চলছে। পুলিন ভাইকে দেখল মুখ ফিরিয়ে। হাসছিল। শিস দিল একবার। তারপর মুখ গম্ভীর করে বেসুরোভাবে গাইতে লাগল, “যৌবন সরসী নীরে…।”

নলিন গম্ভীর হয়ে বলল, “বাড়িতে তোর শোবার ঘরে আরও একটা লাইন করিয়ে নে ফোনের। এ-রকম আর চলবে না। ফেড আপ হয়ে গিয়েছি।”

জবাবে পুলিন বলল, “তুই-ই বরং একটা করিয়ে নে, আমার তো লজ্জাই করে।”

নলিন পুলিনের মুখের দিকে তাকাল। “বাজে কথা বলিস না। আমি দেখেছি, যখনই ফোন করতে গেছি বাড়িতে তুই মানসীর সঙ্গে গল্প করছিস।”

“আমি তো দেখেছি, ঠিক উল্টো, তুই সরসীর সঙ্গে গল্প করছিস।”

“লায়ার।”

পুলিন হাসতে লাগল। সামান্য দূরে পেট্রল পাম্প। পেট্রল নিতে হবে গাড়িতে। পুলিন রাস্তার ধার ঘেঁষে পেট্রল পাম্পের দিকে এগুতে লাগল।

দুপুরের খাওয়াটা সাবেকি ধরনের। দুই ভাই খেতে বসে এক সঙ্গে, বউরা বসে না। কাছে থাকে। মা-ই সব দেখাশোনা করেন। বউরা ফরমাশ খাটে। রাত্রে অবশ্য মা থাকেন না, দুই ভাই এবং দুই বউ টেবিল ঘিরে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে খায়। খাওয়ার চেয়ে গল্প-গুজবই বেশি করে, হাসিঠাট্টার পাট সহজে মিটতে চায় না।

পুলিন নলিন খেতে বসেছে, মা সামনে, মানসী এবং সরসী হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রভা শুধোলেন, “কই মাছটা কেমন খাচ্ছিস? নটু কোথথেকে যোগাড় করে এনেছে।”

পুলিন বলল, “কে রেঁধেছে?”

“ছোট বউমা।”

“মন্দ না⋯” পুলিন সামান্য মুখ তুলে একবার ভাই এবং পরে সরসীকে দেখে নিল। গম্ভীর হয়ে বলল, “শীতের কই এমনিতেই খেতে ভাল লাগে। ⋯তা কই মাছ রাঁধে দিদি⋯”

“কার দিদি?” নলিন সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলল।

পুলিন সামান্য অপ্রস্তুত। “কার দিদি মানে? আমাদের দিদি।”

“ও!” নলিন ঘাড় নাড়াল বার কয়েক, বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুই সরসীর দিদির কথা বলছিস।”

সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে সরসী ও মানসী চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। হাসি চাপল।

পুলিন অল্পের জন্যে দমে গেলেও ত্বরিতে সামলে নিল। বলল, “তোর ভাবাভাবি ওই রকমই। বুদ্ধি বলে জিনিসটা তো কোনো কালে হল না। নিরেট।”

“তোর ব্রেনের ওয়েট কত?”

“যতই হোক, তোর চেয়ে বেশি।”

“তা হলে ওটা ব্রেন নয়, ব্রেনগান।”

সরসী জোরেই হেসে ফেলল। মানসী ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।

পুলিন মার দিকে তাকাল। প্রভা বুঝুন না বুঝুন, হাসছিলেন। এটা নিত্য দিনের ঘটনা। এ যদি বলে ‘তুই গাধা’, ও বলবে ‘তুই এল্ডার গাধা’।

“মা, তোমার ডেন্টাল সার্জনকে বলো দাঁতের পাটি সব সময়ে চোখের তলায় থাকে।”

পুলিন বলল, “ভগবানই মেরে রেখেছেন, আমার হাত নেই।”

“ও তোর ছোটই—” প্রভা বললেন।

“ব্যবহার দেখে তো মনে হয় না। ⋯বড় ভাইয়ের বউকে নাম ধরে মানসী বলে। আস্ত একটা ছোটলোক।”

নলিন এক মনে খেয়ে যাচ্ছে, হাসিটা চোখে জড়ানো।

মানসী বলল, “হ্যাঁ মা, এটা আমিও বলব। বাইরের লোকের সামনেও ও এইভাবে ডাকে।” বোঝাই যায় মানসী ইচ্ছাকৃতভাবে নলিনকে খোঁচাবার চেষ্টা করছে।

প্রভা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নলিন বলল, “বাইরের লোকের সামনে তোমায় কি বলে ডাকব, যদি বলো ‘মা জননী’ বলতে পারি।”

সরসী খিল খিল করে হেসে উঠল। প্রভাও হাসলেন। পুলিনও হেসে ফেলল। মানসী অপ্রস্তুত।

নলিন পুলিনকে বলল, “খাবার সময় বেশি কথা বলিস না ধীরে সুস্থে কাঁটা বেছে খা। কই মাছ খাচ্ছিস তো, সামলে⋯”

মানসী তার অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠেছিল। নলিনকে চোখের ইশারায় কি যেন বুঝিয়ে শাসাল। নলিন সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম মুখ করে চোখে চোখে বলল, খবরদার।

প্রভা বললেন, “পরশু সকালে বেয়াই-মশাই আসছেন, শুনেছিস?”

পুলিন এবং নলিন দুইজনে মার মুখের দিকে তাকাল। তারা শোনেনি। শোনার অবসর হয়নি। চেম্বার থেকে ফিরে সোজা স্নান করতে গেছে, স্নান সেরে খেতে এসেছে। ইতিমধ্যে মানসী অথবা সরসীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে বুঝি একবার, কিন্তু খবরটা তখনও পাওয়া যায়নি।

“হঠাৎ ?” পুলিন শুধলো।

“যাবেন গয়া। যাবার পথে এখান থেকে ঘুরে যাবেন।”

“গয়া কেন? কার পিণ্ডি⋯না, মানে কে থাকে গয়ায়?”

“মেসোমশাই—” মানসী বলল, “মেসোমশাই অনেক দিন ভুগছেন অসুখে, দেখতে যাবে বাবা।”

পুলিন বলল, “রাত জেগে ঠাণ্ডা লাগিয়ে আসছেন কেন? মুঙ্গের থেকে দিনের বেলায় গাড়ি পাওয়া যায়।”

জবাব দিল সরসী। “বাবা রাত্তিরের গাড়িই পছন্দ করে।”

পুলিন জল খেল, ঢেঁকুর তুলল, বলল, “একলাই আসছেন নাকি?”

“একাই”, মানসী জবাব দিল।

“ন্যাচারেলি। ⋯তোপের মুখে বসে কেই বা আসতে চাইবে।” নলিন গম্ভীর মুখে বলল।

সরসী মানসী ভ্রূকুটি করে কিছু বলবার আগেই নলিন উঠে পড়ল। পুলিনও।

বিকেলে আবার চেম্বার। শীতের বেলা, পাঁচটাতেই অন্ধকার হয়ে যায় বলে পুলিন নলিন চারটে নাগাদই চলে আসে চেম্বারে। সকালের চেয়ে বিকালের দিকটাতেই লোকজন বেশি, মানে দশ বিশজন নয়, হরেদরে চার পাঁচটা রুগি। কোনো কোনোদিন ফাঁকাও যায়।

পৌষ মাস, শীতটাও বেশ পড়েছে। সাতটা নাগাদ নলিন তার কাজকর্ম শেষ করে পুলিনের চেম্বারে ঢুকল। পুলিন টেবিলে পা তুলে দিয়ে জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছিল।

নলিন বলল, “তোর হল? আর আসবে কেউ?”

হাতের কাগজ রেখে পুলিন বলল, “না। সাতটা বাজল, চল উঠি।” বলে পুলিন তার হাতের কাছের জিনিসগুলো গুছোতে লাগল। গুছোতে গুছোতে বলল, “চন্দ্রবাবু তাঁর ভাগ্নিকে এনেছিল, বুঝলি, গ্লুকোমা বলে মনে হচ্ছে। সিরিয়াস কিছু নয়, তবু এ-বয়সে জেনারেলি গ্লুকোমা হওয়ার কথা নয়।”

“সারিয়ে ফেল।”

“সেরে যাবে। ওষুধ দিয়েছি।”

“আজ আমার একটা সাংঘাতিক এক্সপিরিয়ান্স হয়েছে।” নলিন তার সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বিভীষিকা দর্শনের ভঙ্গি করল। “একটা কাবলিঅলা এসেছিল—।”

“কাবলি⋯!” পুলিন এমনভাবে বলল, যেন কাবলিঅলাদের দাঁতে রোগ হয় এ তার জানা ছিল না।

নলিন ভাইয়ের দিকে তাকাল। “বাঃ, কাবলিদের কি দাঁত থাকে না!”

“হয়েছিল কী ওর?”

“দাঁত তুলতে হল।”

“কটা?”

“একটাই তুললাম। একটা দাঁত তুলতে ঝাড়া এক ঘণ্টা। বেটা কিছুতেই পুরো মুখ খুলবে না প্রথমে। ভুলিয়ে ভালিয়ে হাঁ করালাম তো মুখের মধ্যে কিছু ঢোকাতে দেবে না। তাতেও বাগ মানালাম তো মাড়িতে ইঞ্জেকশান করার আগেই গলগল করে ঘামতে লাগল। ওই চেহারা ভয়ে কাঠ। তারপর বেটার কী কান্না।”

“দাঁত তুললি?”

“দিলাম তুলে। বললাম, এটা তুলে দিলেই আর একটা গজাবে।” নলিন হাসতে লাগল। “অদ্ভুত, বুঝলি। নতুন দাঁত গজাবে শুনে বেটা কাবলি কাবু হয়ে গেল। ⋯ভাবল আসলটা যাক সুদ আসবে। বাপস, যা ট্রাবল দিয়েছে।”

“ক’টাকা নিলি?”

“টেন।”

“বি কেয়ারফুল। ⋯ওই কাবলি আর ক’দিন পরেই তোর চেম্বারে এসে লাঠি ঠুকবে। হামারা দাঁত কাঁহা? দাঁত দো।”

নলিন গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

বাড়ি ফিরতে দেরিই হয়ে গেল সামান্য। শীতটাও আজ গায়ে লাগছে। বিকেল থেকেই কনকনে ভাবটা বোঝা যাচ্ছিল, শুকনো অথচ বরফকুচির মতন ঠাণ্ডা আস্তে আস্তে জমছে। জমতে জমতে এই প্রথম রাত্তিরে শরীরে কাঁটা ধরিয়ে দেবার মতন শীতল হয়ে গেছে। নাক মুখ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, হিম পড়ছে খুব।

পুলিনের ইচ্ছে ছিল একটু খেলা হোক। বাড়ির সামনে বাগানে ঘাসের লনে তাদের ব্যাডমিন্টন কোর্ট, আলোর ব্যবস্থা আছে, নেট টাঙাবার খুঁটি আছে। প্রায়ই দুই ভাই দুই বউ নিয়ে র‍্যাকেট হাতে নেমে পড়ে। শরীর চর্চা তো বটেই তার সঙ্গে আনন্দ চর্চাও।

চায়ের পাট শেষ হলে (এ-সময় একবার চারজনে বসে চা খায় ওরা) মানসী বলল, “না আজ আর খেলতে পারব না, যা ঠাণ্ডা।”

পুলিন বলল, “একটু ছোটাছুটি করলেই গা গরম হয়ে যাবে।” মানসী মাথা নাড়ল। “না। সরসীর শরীরটাও ভাল নেই।”

সরসী দিদির দিকে তাকাল। মুখে আতঙ্ক ও গোপন মিনতি।

পুলিন বলল, “কী হয়েছে?”

সরসী অন্য দিকে তাকাবে ভেবেছিল, সে চাইছিল না তার মুখের ভাবটা দাদার চোখে পড়ে, কিন্তু সরসী অন্য দিকে না তাকিয়ে সোজা নলিনের দিকে তাকাল।

পুলিন কিছু বুঝতে পারল না।

জবাব দিল মানসী। বলল, “হয়েছে কিছু। শরীর খারাপ হবে না, বাঃ রে—! ও খেলতে পারবে না। আমিও বাবা এই ঠাণ্ডায় বাইরে যেতে পারব না।”

অগত্যা পুলিন তাস খেলার প্রস্তাবটা পাড়ল।

“চলে এসো—” নলিন রাজি। “ব্রিজ না ব্রে?”

“ব্ৰে না, ব্রে আমি খেলব না। ইস্‌⋯সবাই মিলে আমায় হারাও।” সরসী ব্রে খেলতে রাজি না।

“তবে ব্রিজ?” নলিন তাস আনতে উঠল।

“না, আমি তোমার পার্টনার হয়ে খেলব না, তুমি খালি রাগবে আর চেঁচাবে⋯” মানসী ব্রিজ খেলবে না।

“আমি সরসীকে নিয়ে খেলব।” নলিন বলল।

পুলিন বিপদ বুঝে বলল, “ব্রিজটা থাক, বরং ফিশ হোক। পয়সা লাগাও। নলিন আজ কাবলিঅলার দাঁত তুলে দশ টাকা পেয়েছে।”

মানসী হাঁ করে নলিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর সারা গা মুখ কুঁকড়ে কেমন একটা ভঙ্গি করল। “ই⋯মাগো! তুমি তুলতে পারলে?”

“কেন, কি হয়েছে?”

“গন্ধ⋯! বাব্বা, যা দুর্গন্ধ⋯”

“কি করে তুমি বুঝলে দুর্গন্ধ? নাক লাগিয়ে শুঁকেছ?”

“থাক, আমাকে আর শুঁকতে হবে না।” মানসী ঠোঁট উল্টে গা বিড়োনোর ভাব করল।

পুলিন বলল, “ইডিয়েট।”

তাস এনে সাফল করতে বসল নলিন। দুই ভাইয়ের শোবার ঘরের মাঝামাঝি একটা ঘরে তারা বসে আছে। এই ঘরটাই তাদের রাত্রের আড্ডাখানা। আসবাবপত্র মোটামুটি কিছু কম নেই, মেঝেতে মোটা গালচে পাতা, সোফা-সেটির সঙ্গে একপাশে ফরাসপাতা চৌকি, দরকার হলে দু-দণ্ড কেউ গড়িয়ে নেয়, এক কোণে একটা ডোয়ার্কিনের অর্গান, বাবার আমলের, অন্য কোণে দেওয়ালে একটা হরিণের সিং-অলা মাথা, তার নীচে টেলিফোন। ঘরের দরজা জানলা, কাচের শার্সি সবই বন্ধ, ফলে ঘরটা রীতিমত আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে।

নলিন তাস সাফল করছে দেখে মানসী বলল, “আমায় কেউ ক’টা টাকা ধার দাও।”

সরসী সঙ্গে সঙ্গে পুলিনের দিকে হাত বাড়াল, “আমার সেদিনের দু-টাকা শোধ করুন।”

নলিন বলল, “নো লোন বিজনেস। যে যার টাকা পয়সা নিয়ে এসো।”

“বারে, আমি দু-টাকা সেদিনের পাই—”

“সে পরে নেবে, এখন গাঁট থেকে বের করো।”

“একই হল, আমাদের কি আলাদা গাঁট, তোমাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা—” বলে মানসী বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল, তারপর পুলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “দাও, আমাকেও দুটো টাকা দাও।”

“বাক্যেন মারিতং জগৎ—” নলিন মন্তব্য করল।

পুলিন পকেট থেকে টাকা বের করে মানসী ও সরসীকে দিল, বলল, “আমার প্রথমেই চার টাকা গচ্চা। বেশ আছো!”

তাস খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিকে তেমন একটা কলরব শোনা যায় না, গল্প-গুজব এবং তাস একই সঙ্গে চলতে থাকে; তারপর ক্রমশই এদের হইচই বাড়ে। প্রভাময়ী সন্ধের পর এদিকে থাকেন না, তাঁর নিজের ঘরে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অবশ্য তাঁর কাজ বলতে জপতপ ধর্মগ্রন্থ পাঠ। কোনো কোনোদিন পাড়ার কোনো প্রবীণা আসে তাঁর সঙ্গে গল্প করতে। বউদের ডাকাডাকির প্রয়োজন তাঁর বড় একটা হয় না। তিনি এদের চারজনের আনন্দের মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটাতে চান না। বরং এই সময়টা নির্জনতা ও শান্তিই তাঁর পছন্দ। এক একদিন বউরা কিংবা ছেলেরা তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে এ সময় যেতে যেতে শুনেছে মা গুন গুন করে কীর্তন গাইছেন। প্রভার গলাটি যে এককালে অতি সুমিষ্ট ছিল তা ছেলেরা জানে, বউরাও এখন জেনে নিয়েছে।

খেলা চলছিল। মানসীর আজ কপাল ভাল। জিতেই যাচ্ছে। নলিন একবার মাত্র জিতেছে। এই দানটা কাউকে আর তাস ফেলতে সময় দিল না মানসী, হুট করে প্রায় টাকা খানেক জিতে নিল।

নলিন মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর মানসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কার মুখ দেখে উঠেছিলে আজ একটু বলবে।”

“কেন বলব…” মানসী পয়সার হিসেব করতে করতে জবাব দিল।

“বললে আমাদের দুই ভায়ের উপকার হত। ভোরে উঠেই সোজা চোখ বুজে তার কাছে চলে যেতাম।”

“সে আছে; তুকতাক করা মুখ। ⋯” মানসী চোখের পাতা টান করে রঙ্গভরে হাসল।

পুলিন গম্ভীর হয়ে বলল, “সেই মুখটা আমার। তুই আমার কাছে আসিস, আমি শুয়েই থাকব।”

মানসী হেসে উঠল। সরসী হাসতে হাসতে পুলিনকে বলল, “আর আপনি নিজে যে হারছেন⋯”

“নিজের মুখ নিজে নিজে তো আর দেখা যায় না, তাই।”

“বালিশের পাশে একটা আয়না নিয়ে শুবি—” নলিন জবাব দিল।

চারজনেই হেসে উঠল। পুলিন সিগারেট ধরাল। সরসী তাস দিতে লাগল।

মানসী এবং সরসীর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই চেহারায়। মুখের আদল প্রায় এক, দুজনের মুখের ছাঁচই বটপাতার মতন অনেকটা; কপাল পুরন্ত, চিবুক সুডৌল। মানসীর গায়ের রং সামান্য মরা, চোখ দুটিও ঈষৎ বড়। মানসীর নাক তেমন উঁচু নয়। সরসীর নাক উঁচু, চোখ দুটি টলটল করছে। দুটি মুখেই প্রসন্নতা ও তৃপ্তি দেখে মনে হয় কে যেন প্রসন্নতা ও তৃপ্তির হাসির একরকম মোম ওদের মুখে মাখিয়ে এক মসৃণতা সৃষ্টি করেছে।

পুলিন একটা তাস তুলে নিয়ে দেখল, এবং মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শিস দিল।

নলিন আপত্তি জানাল, “শিস দেওয়া চলবে না⋯”

“কেন, কেন?” পুলিন কৈফিয়ত তলব করল।

“মানসী এবার হাত ফেলে দেবে। তুমি ওকে জানিয়ে দিলে। ওটা বেআইনি।”

“তোমরাও ফেলে দাও।”

নলিন ততক্ষণে তাস টেনে নিয়ে দেখেছে, তাসটা হাতে রেখে বলল, “মামার বাড়ি আর কি! চলে এসো।”

সরসী বলল, “শিস দেওয়া কিন্তু সত্যিই চলবে না। ⋯বাবা শিস শুনলে রেগে আগুন হয়ে যায়।”

মানসীও বোনকে সমর্থন করল, বলল, “সত্যি, শিস দেওয়া যে কি বিশ্রী অভ্যেস তোমার! যতসব অসভ্যতা শিখেছ!”

পুলিন নলিনের দিকে তাকাল, তারপর মানসী ও সরসীর দিকে, “তোমার বাবা কোন ঘরে থাকবেন?”

“কেন?” দু-বোন একই সঙ্গে জানতে চাইল।

“সেই বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। উনি ওপরে থাকলে আমায় নীচে দিও; আমার নেচারের সঙ্গে কোনো সাইলেন্সার ফিট করা নেই কিনা!” পুলিন রঙ্গ করে বলল।

মানসী সরসী দু’জনেই ঘাড় সোজা করে বসল। মানসী বলল, “গুরুজন নিয়ে তামাশা—”

“মোটেই নয়,” পুলিন মাথা নাড়ল, “আমরা হইচই চেঁচামেচি করে শিসফিস দিয়েই বাড়িতে থাকি। দুম করে স্বভাব পালটাব কি করে!”

“পালটাবে—” মানসী আদেশ জারি করার মতন করে বলল, “পালটালে মরে যাচ্ছে না কেউ।”

“না—মোটেই না⋯” বলতে বলতে নলিন হাতের তাস ফেলে দিল। পুলিন ভেবেছিল দানটা জিতবে, নলিন মেরে দিল। অনেকগুলো পয়সা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল পুলিন।

পয়সা বুঝে নিয়ে নলিন তাসগুলো সরসীর দিকে এগিয়ে দিল। সিগারেট ধরাল আরাম করে। তারপর মানসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি পালটানোর কথা বলছিলে, পুলিন বলছিল পারবে না। ⋯ওকে একবার মনে করিয়ে দাও না, বিয়ের কনে পালটে যাওয়ায় ওর কোনো আফশোস হয়েছে কি না!”

পুলিন ঠিক এই ধরনের একটা জবাব আশা করেনি, কেমন হকচকিয়ে গেল, অপ্রস্তুত সামান্য, তারপর কয়েকবার ‘যাঃ যাঃ’ করল। সরসী এবং মানসী দুজনেই হাসতে লাগল।

ঘটনাটা চারজনেরই জানা, কৌতুক অনুভব করতে বাধা পেল না কেউ।

মুঙ্গেরে দিদির কাছে গিয়েছিল পুলিন-নলিন। সরসীকে নয়, সরসীর ছবি দেখেছিল মুঙ্গেরের মহিলা সমিতির ছবিতে, দিদি সেই সমিতির পাণ্ডা। ছবি দেখে পুলিনের মনটা কেমন এলোমেলো করছিল। নলিনকে বলল, এ-রকম একটা মেয়ে হলে বিয়ে করা যায়। নলিন মেয়ের খোঁজ করতে গিয়ে দেখল, সরসীরা দু-বোন, সরসী ছোট। নলিন সরসীর সঙ্গে আলাপ করে ফেলল—, জামাইবাবু সহায় হলেন। মনে ধরে গেল সরসীকে। কিন্তু পুলিন?

নলিন ভাইয়ের মনটা প্রথমে আঁচ করে নিল ভাল করে, গুরুতর কিছু কি না, দেখল সে-সব নয়। তারপর বলল, ‘দেখ, মুশকিলটা কি জানিস! ওরা দু-বোন, ওই মেয়েটা ছোট। বড়টা আরও ফাইন। ওদের বাবা আবার একই সঙ্গে দুটোর বিয়ে দিতে চায়। তা তুই যদি ছোটটাকে করিস, আমায় বড়টাকে করতে হয়। সেটা কি ভাল দেখাবে! লোকে বলবে কি, ছোট ভাই বড় বোনকে বিয়ে করল! তুই যদি বলিস, আমি তোর জন্যে সেক্রিফাইস করতে পারি, নয়ত তুই বড়টাকে কর, আমি ছোটটাকে। ভেবে দেখ…।’

পুলিন বড়র ছবি চাইল দেখতে। নলিন দেখাল। বড়র গুণগানের ব্যাখ্যা সে শুধু নিজেই করল না, জামাইবাবুকে দিয়েও করাল। পুলিনের অবশ্য অত দরকার ছিল না। মানসীকে এমনিতেই তার ভাল লেগেছিল। তা ছাড়া মেয়ে দুটি তাদের বাড়ির যে যোগ্য এ-কথা দিদি বার বার বলেছে।

পুলিন দিব্যি রাজি হয়ে গেল।

নলিন বিয়ের পরই মানসী সরসীর কাছে পুলিনের মেয়ে পছন্দের গল্পটা প্রকাশ করে দিল।

পুলিন ছোট ভাইয়ের ওপর চটে গিয়েছিল, একটা ইডিয়েট; বলেছিল ‘আমি কি মেয়ে পছন্দ করেছিলুম, এমনি ঠাট্টা করে বলেছি আর—তুই সেটা নিয়ে লেগে পড়লি। আসলে ইন্টারেস্ট তোর ছিল, আমার নয়।’

‘আমার তো সেন্ট পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট ছিল, নয়ত তোর জন্যে ওই সিক্সটি টু মডেলের জ্যান্ত কামানের সামনে কেউ দাঁড়ায়।’ সিক্সটি টু মডেল অর্থে বাষট্টি বছরের শ্বশুর।

দেখতে দেখতে রাত হয়ে এল। শীত যেন ঘরেও ঢুকেছে। তাসের পাট তুলে দিয়ে মানসী উঠল, হাই তুলল বড় করে। বলল, “বড্ড শীত, আর নয়, চলো। খেয়েদেয়ে যে যার শুয়ে পড়ি।”

সরসীও উঠে দাঁড়াল, তার বেশ ক্লান্তি লাগছে।

পুলিন আড়মোড়া ভেঙে বলল, “তোমরা বসো গে যাও, আমি একবার মার ঘর থেকে আসছি।”

চার

নির্দিষ্ট দিনে বেলা নটা নাগাদ করুণাকেতন এসে পৌঁছলেন। মেয়ে জামাইরা স্টেশনে আসতে গিয়েছিল। গাড়ির দরজা খুলে করুণাকেতন এবং তাঁর মালপত্র নামানো হল—দেখা গেল, তাঁর আকৃতির সঙ্গে তাঁর বয়ে-আনা হোন্ডঅলের আকৃতির বিশেষ কোনো তফাত নেই। লেপ, তোশক, কম্বল বালিশ যাবতীয় বিছানাপত্র ঠাসা বিপুলকায় ও খাটো মাপের হোল্ডঅলটা প্লাটফর্মে কোনো রকমে নামিয়ে কুলিরা হাঁ করে পদার্থটি অবলোকন করছিল, এবং জামাইরা দেখছিল দু-প্রস্থ জামা-জুতোর ওপর আপাদ-কণ্ঠাবৃত অলেস্টার শোভিত তাদের বেঁটে এবং গোলাকার শ্বশুরমশাইকে। গলায় মস্ত এক মাফলার তিন পাক জড়ানো, মাথায় কান-গুটানো বাঁদর-টুপি। সঙ্গে মালপত্র কিছু কম নয়, মস্ত এক সুটকেস, কপির ঝুড়ি, মিষ্টির হাঁড়ি, টিফিন কেরিয়ার, জলের কুঁজো, ছড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি।

করুণাকেতন যে বস্তুত তাঁর হোন্ডঅলের মতন নির্জীব নিরীহ নির্বাক পদার্থ নন, অবিলম্বে তা প্রকাশ পেল। মেয়ে-জামাইরা প্রণাম সারতেই তিনি দণ্ডায়মান কুলিদের দিকে তাকিয়ে তাঁর ভাঙা খসখসে গলায় চিৎকার করে ধমকে উঠলেন, “খাড়া হো কর কিয়া করতা হ্যায়, পাঁটঠা কাঁহাকার…”

তাঁর হুঙ্কার এবং মুখভঙ্গি দেখে পাঁঠারা ঘাবড়ে গিয়ে হোন্ডঅলটা টানা-হেঁচড়া করতে লাগল।

মানসী শুধল, “মা কেমন আছে?”

“যেমন থাকে,⋯” করুণাকেতন কুলিদের দেখছিলেন, “বেতো ঘোড়া।” বেতো ঘোড়া কে? মা না কুলিরা।

সরসী বলল, “বিজুর কলেজ খুলেছে?”

“দরজা খুলেছে।” মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে কুলি তাড়ানোতেই তাঁর মনোযোগ।

পুলিন বলল, “আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসছি—আপনারা এখোন।”

“আরে না না, এ তোমার বিলেত নয়; এখানকার কুলিরা লেজি, ফাঁকিবাজ, ডাকাত…। তুমি এদের সঙ্গে পারবে না।”

করুণাকেতনের বিলেত-প্রীতি না থাক, জামাইরা বিলেত-ফেরত এই অহংকার আছে। মেয়েদের বিয়েতে পাত্র অপেক্ষা পাত্রদের বিলেত-ফেরতের কথাটাই তাঁর মন টেনেছিল। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।

নলিন আড়চোখে শ্বশুরমশাইকে দেখে নিয়ে বলল, “বিলেতের কুলিরা সাহেব কুলি, এরা তো এদেশি, বেহারি-টেহারি…”

“ধড়িবাজ।” করুণাকেতন বললেন। কাকে বললেন, জামাইকে না কুলিদের বোঝা মুশকিল।

মেয়েরা তাদের বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে টেনে নিয়ে চলল, পুলিন-নলিন কুলিদের দিয়ে মালপত্র গোছাতে লাগল।

নলিন বলল, “তোকে আসবার সময় বললাম, চাকায় পাম্প দিয়ে নে; নিলি না এবার…?”

“ধরবে তো সব?”

“আমি গাড়িতে যাচ্ছি না। ⋯তোরা চলে যা, আমি হেঁটে চেম্বারে চলে যাব।”

“না না, সেটা বিশ্রী দেখাবে।”

“দেখাক গে, গাড়ির চাকা খুলে মাটিতে বসে রগড়ানোর চেয়ে সেটা ভাল।”

“চল চল—যাবার সময় চাকায় পাম্প দিয়ে নেব।”

“তোমরা যাও। আমি ওর মধ্যে থাকছি না।”

“শ্বশুর কি আমার একলার? তোমারও শ্বশুর। মাইণ্ড দ্যাট—”

নলিন যুক্তিটা অস্বীকার করতে পারল না, চুপ করে গেল। পরে প্লাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “বিয়েতে আমরা এ-রকম একটা ফাউ পাব জানলে বিয়েই করতাম না।”

করুণাকেতনের অভ্যর্থনায় কোনো ত্রুটি হল না। নীচের তলায় তাঁকে মস্ত ঘর দেওয়া হয়েছিল। খাট-বিছানার অভাব থাকার কথা নয়, ঘরের মধ্যেও সারাদিন রোদ, জানলার বাইরে বাগান, ঘরের সঙ্গে লাগানো কলঘর। করুণাকেতন প্রীত হলেন। প্রভাময়ী নিজেই বেয়াইয়ের সুখ-সুবিধা স্বাচ্ছন্দ্য দেখছিলেন, তাঁর কথা মতনই সব ব্যবস্থা হয়েছে। দোতলায় ওঠানামা করতে বুড়ো মানুষের কষ্ট হবে বিবেচনা করে নীচেই ব্যবস্থা করেছিলেন। মনে একটু শঙ্কা ও সঙ্কোচ ছিল, বেয়াইমশাই এই ব্যবস্থায় ক্ষুণ্ণ হন কি না। করুণাকেতন বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হলেন না, বললেন, তিনি একটু নিরিবিলি পছন্দ করেন।

করুণাকেতনের খাবার সময় মেয়েরা কাছে থাকলেও প্রভাময়ী নিজেই দেখাশোনা করলেন। কুটুম মানুষ, ব্যবস্থার কোনো রকম ত্রুটি, সুখ-সুবিধের স্বল্পতা প্রভাময়ী রাখেননি। দেখলেন, করুণাকেতন ভোজন বিষয়ে অসংযমী। খেতে ভালবাসেন। খাওয়ার গল্প করতে ভালবাসেন। এক সময় হাকিম ছিলেন, ঘুরেছেন নানা জায়গায়; কোথায় কোন খাদ্যটা পাওয়া যায়, তার স্বাদ কেমন, দাম কত এ-সবও নখদর্পণে।

“আমার হাই ব্লাডপ্রেশার⋯” করুণাকেতন নিজেই বললেন, “বেশ হাই। আমার ফ্রেণ্ড বলাই-ডাক্তার বলে খাওয়া কমাতে। আমি বলি ও-সব বুজরুকি, খাওয়া কমালে প্রেশার কমে না। তোমার তো বাপু এই দুটো আহার, তোমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে কেন? বলাই জবাব দিতে পারে না। বলে, বয়েস⋯। আরে, বয়েসে যা তা হবেই, মাথার চুল পাকবে, দাঁত পড়বে, ঘুম হবে না। বয়েসে যদি ব্লাডপ্রেশার বাড়ে, বাড়বে; তা বলে খাব না। ⋯মরব ভেবে খাওয়া বন্ধ রাখা আমার কুষ্ঠিতে লেখেনি।”

প্রভাময়ী প্রতিবাদ করলেন না, করা উচিত নয়, বললেন, “তা তো ঠিকই।”

দুপুরে করুণাকেতন বেশ একটা ঘুম দিলেন। ঘুম থেকে উঠেই বিপত্তিটা দেখলেন।

মুখ ধুয়ে অভ্যাস মতন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিরলকেশ মাথাটি আঁচড়াতে গিয়ে লক্ষ করলেন ডান চোখটা একটু লাল। চোখে জল দেবার সময় সামান্য জ্বালা জ্বালা করছিল, অতটা খেয়াল করেননি। ঘুমের জন্য চোখটা লাল হতে পারে। দু’চোখের জমি বিচার করে যদিও মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল, করুণাকেতন তখনকার মতন ডান চোখ লাল হওয়াটাকে ঘুমের দরুন হতে পারে ভেবে কাউকে কিছু বললেন না।

আধঘণ্টা খানেকের মধ্যে বার দশ-বারো চোখ দেখলেন। উহুঁ, লাল ভাবটা কাটছে না।

মানসী চা এনেছিল। চা খাবার সময় মেয়েকে বললেন, “আমার ডান চোখটা দেখ তো।”

মানসী চোখ দেখল, বলল, “একটু লাল হয়ে আছে।”

“কেন?”

কেনর জবাব কি দিতে পারে মানসী। বলল, “কি জানি! চোখে কিছু পড়েছিল হয়তো।”

কোথায় কি পড়েছে মানসীর জানার কথা নয়, তবু আমতা আমতা করে বলল, “ট্রেনে এসেছ, ধুলোবালি পড়েছে হয়তো। ⋯”

“জ্বালা করছে।” করুণাকেতন বললেন, এবং ডান চোখটা একটু ছোট করে তাকিয়ে থাকলেন।

সরসী এল। সরসী আসতেই করুণাকেতন ছোট মেয়েকে দিয়ে আর একবার চোখ দেখালেন। “লাল হয়েছে—” সরসী বলল।

“টকটকে লাল?”

“না—, অতটা টকটকে নয়, তবে লালই⋯”

“কেন?”

সরসী দিদির দিকে তাকাল। মানসী কোনো সঙ্গত জবাব ইশারায় বলে দিতে পারল না। অগত্যা সরসী বলল, “ঠাণ্ডা লেগেছে হয়তো, রাত্রের গাড়িতে এসেছ।”

“কেমন করে লাগল!” করুণাকেতন বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন, এবং ডান চোখ বন্ধ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। খুললেন আবার বন্ধ করলেন। এই রকম চলতে লাগল।

মানসী বলল, “তুমি ভেবো না, ওরা চেম্বারে চলে গেছে, ফিরে এসে দেখবে।”

করুণাকেতন অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “যাবার সময় এখান থেকে ঘুরে যাওয়া যেত না!” মেয়েরা মুখ নিচু করে থাকল।

সন্ধে থেকে করুণাকেতন রীতিমত অধীর হয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। ঘন ঘন আয়নায় চোখ দেখছেন, মেয়েদের দিয়ে দেখাচ্ছেন। প্রভাময়ী গোলাপজল আনিয়ে দিলেন। চোখে জল দিয়ে ঘরের সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করিয়ে সবরকম গরম জামা-কাপড় পরে করুণাকেতন বিছানায় শুয়ে থাকলেন। ঘরের বাতিটা পর্যন্ত বদলাতে হল।

মানসী স্বামীকে ফোন করল, “একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। বাবার ডান চোখটা লাল হয়েছে। বড্ড অধীর মানুষ তো, চেঁচামেচি করছেন।”

“চোখ লাল !⋯খুব⋯?”

“না, না। ডান চোখ। অল্প।”

“অত চোখ লাল করলে একটু ওই রকম হয়ই…” পুলিন ঠাট্টা করে বলল।

“তামাশা কোরো না, আমার বাবা; তোমারও শ্বশুর।”

“সে আর বলতে। ⋯ঠিক আছে, আমরা আধঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরব।”

বাড়ি ফিরে পুলিন-নলিন অবাক। করুণাকেতনের ঘরের আবহাওয়া যেন হাসপাতালের কেবিনের মতন করে ফেলা হয়েছে।

পুলিন চোখ দেখল শ্বশুরের। বলল, “ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি।”

“কী হয়েছে?” করুণাকেতন শুধোলেন।

“তেমন কিছু না⋯কাশিটাশি হয়েছে আপনার?”

“শীতকালে একটু আধটু কাশি হবে না?”

“না, না, জোর কাশি? দমক?”

“না।”

“ঠাণ্ডাফাণ্ডা লাগতে পারে। ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি।”

“জ্বালা করছে যে হে⋯, ব্যথা ব্যথা লাগছে।”

“মাইল্ড ইনফেকশান হতে পারে, ওষুধ দিচ্ছি সেরে যাবে।”

“কী ওষুধ?”

“বিলেতি।” পুলিন গম্ভীর হয়ে বলল।

পাঁচ

ব্যাপারটা অত সহজে মিটল না। পরের দিন সকালে করুণাকেতন নিজের চোখ দেখে মূর্ছা যান আর কি। ডান চোখের লালটা আরও ছড়িয়েছে। একেবারে রক্তের মতন টকটক করছে লাল। জামাই কি ওষুধ দিল? করুণাকেতন হাত-পা ছোঁড়া শুরু করলেন। ভয়ে বুক ধকধক করছে, মাথা ঘুরছে।

পুলিন আবার চোখ দেখল। বলল, “স্লাইট স্প্রেড করেছে। ওষুধটা দিন। বিকেলে দেখব আবার।”

মানসী আড়ালে স্বামীকে বলল, “বাবার খুব আতুপুতু আছে। একটু কিছু হলেই বাড়ি মাথায় তোলে। তাড়াতাড়ি সারিয়ে দাও বাপু। বদখেয়ালের মানুষ, মুখেরও কিছু ঠিক নেই, কখন কি বলে ফেলবে, আমি লজ্জায় পড়ব।”

পুলিন হেসে বলল, “সিরিয়াস কিছু না। কত কারণেই চোখ লাল হয়। তোমাদের মুখ যেমন লাল হয়।”

মানসী মুখভঙ্গি করে স্বামীকে ঠেলে দিল।

করুণাকেতন বিকেল থেকে আর আত্মসংবরণ করতে পারলেন না। থেকে থেকেই করুণকণ্ঠে নিজের দৃষ্টিহীনতার সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করতে লাগলেন, মাথা চাপড়ানোও শুরু হল, ডান চোখের ওপর একটা মস্ত রুমাল চাপা দিয়ে স্বাগত-ভাষণে জানাতে লাগলেন যে, তিনি ইহজীবনের মতন একটি চক্ষু হারালেন।

মেয়েরা এবং প্রভাময়ী যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়েও করুণাকেতনকে সংযত রাখতে পারছিল না।

পুলিনরা বাড়ি ফিরলে মানসী সরসী বলল, “বুড়ো মানুষকে এত কষ্ট দেওয়া কেন? কি রকম যে আনচান করছেন। যা হয় করো একটা কিছু।”

প্রভা বললেন, “ওঁর কষ্ট হচ্ছে। গাল মুখও ব্যথা ব্যথা বলছেন।”

পুলিন বলল, “চোখ উঠলেও দু-চার দিন কষ্ট হয়, তার কি করা যাবে! এমন কিছু হয়নি যার জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছ। ⋯আজ একটা অয়েন্টমেন্ট এনেছি, রাত্রে লাগান, কাল দেখব ভাল করে।”

পরের দিন পুলিন নানারকম যন্ত্রপাতি এনে ভাল করে দেখল শ্বশুরকে। দেখতে কি দেন করুণাকেতন, সোজা তাকাতে বললে বাঁকা তাকান, চোখের পাতা ছুঁতে গেলে ধমকে দু-পা সরিয়ে দেন। ইতিমধ্যে একটা গগলস তাঁর চোখে উঠেছে। চোখের সঙ্গে গালগলারও যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল, মাড়ি ফুলেছে দাঁতের।

পুলিন কোনো হদিশ করতে পারল না, তার যাবতীয় জ্ঞান বলছিল চোখের কোথাও কিছু হয়নি। অথচ…অথচ…।

পুলিন নলিনকে বলল, “তুই একবার দাঁতটা দেখ⋯”

নলিন দাঁত দেখল এবং গোটা কয়েক ওষুধপত্র এনে দিল। “কুলকুচো করুন, এই পেন্টটা দিনে চারবার, ট্যাবলেটটা খাবার পর দুটো করে⋯।”

কিছুতেই কিছু না। যদিবা একটু কমেও থাকে করুণাকেতনকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তাঁর মেজাজ এবার চড়ায় উঠে গেছে। কোনো কিছু পরোয়া করছেন না, মেয়ে জামাই বলে কোনো সঙ্কোচ নেই। প্রভাময়ীর ওপরই যেটুকু প্রসন্ন আছেন এখন পর্যন্ত।

মানসী মাথা ধুইয়ে দিচ্ছিল, সরসী সুজির পায়েস, ওভালটিন এনে গুছিয়ে রাখছিল বিছানার কাছে টেবিলে।

করুণাকেতন বললেন, “আমি কিছু খাব না। ⋯বিজুকে তার করে দাও, সে এসে আমায় নিয়ে যাক। আমি এখানে থাকব না।”

মেয়েদের মুখ লাল হয়ে উঠল। তারপর যেন কালসিটে ধরে গেল।

মানসী বলল, “তুমি এত অধীর হয়ে পড়ছ কেন? এরা তো দেখছে।”

“কারা?”

“তোমার জামাইরা⋯” মানসী রাগ করে বলল।

“ওরা জামাই না কসাই?”

সরসীর চোখে জল এল ; বলল, “ডাক্তার তো⋯বিলেতফেরত…”

“বাজে কথা। ওরা বিলেতে গিয়ে আড্ডা মেরেছে। জাল ডিপ্লোমা টাকা দিয়ে বাগিয়ে এনেছে। চিট…। ⋯ঘোড়ার ডাক্তার ওরা, বুঝলে⋯! বাঁদর—!”

সরসী আর কথা বলল না, ঘর ছেড়ে চলে গেল।

মানসীও চলে যেত, তবু গেল না, সে বড়। বলল, “বিজুকে তার করতে হবে না। মা কি ভাববেন! আমি দেখছি—”

“তুমি আমার কোনটা দেখবে! বিয়ে করে পর হয়ে গেছ। বাপ মরছে মরুক, তোমরা তোমাদের বরের আত্মসম্মান দেখছ।”

মানসীর গলা ক্ষোভে বন্ধ হয়ে গেল।

দুপুরে পুলিন নলিন বাড়ি ফিরতেই দুই বোন ঝাঁপিয়ে পড়ল। করছ কী তোমরা? কিছু না করে চারটে দিন বুড়ো মানুষটাকে অযথা যন্ত্রণা দিচ্ছ! মনে রেখো, আমাদের বাবা। তোমরা কেমন ওর জামাই? কী শিখে এসেছ বিলেতে? রোগ যদি সামান্যই হয়—তবে সারছে না কেন? ঘুম নেই, খাওয়া নেই, বুড়ো মানুষ চার দিনে কতটা কাহিল হয়েছে দেখতে পাচ্ছ না! ডাক্তার না হাতি!

পুলিন বলল, “ঠিক আছে, আজ বিকেলে আমাদের শঙ্করমামাকে ডাকি, একবার দেখে যান। ⋯ওঁর ওপিনিয়ান নেওয়া হোক।”

শঙ্করবাবু প্রবীণ লোক, এ শহরের সেরা ডাক্তার। এলেন, দেখলেন যত্ন করে। বললেন, তেমন কোনো গণ্ডগোল তো দেখতে পাচ্ছি না। প্রেশারটা বেশ হাই। ব্লাড টেস্ট করতে পারি, তবে দরকার কি! চোখ দাঁতের ব্যাপারে তোমরাই তো আছ, আমি আর কি করব। প্রেশারের জন্যে একটা ট্যাবলেট দাও।

রাত্রে পুলিন নলিনকে বলল “কমপ্লেনটা দাঁতের হতে পারে, চোখে সেপটিক ফোকাস পড়েছে। তুই দাঁতের ট্রিটমেন্ট কর।”

নলিন বলল, “দাঁতে যা করার আমি করছি, তুমি চোখ সামলাও, হেমারেজ চোখে হয়েছে, দাঁতে নয়।”

“আহা, কিন্তু সেটা তো দাঁতের জন্যে হতে পারে—”

“পারে তো অনেক কিছুই—”

“তুই একটা আস্ত ইডিয়েট। কিচ্ছু জানিস না, কোনো কিছু শিখিসনি, পড়িসনি।”

“তুমি আমার সাবজেক্টে কথা বলতে এসো না; আই নো বেটার দেন ইউ। তুমি চোখ সামলাও, আমি দাঁত সামলাব। দাঁতে মস্ত একটা কিচ্ছু হয়নি।”

“ননসেন্স—। রেসপনসিবিলিটি বলে কিছু নেই তোর।”

“বোগাস—। তোর এবিলিটি তো দেখতেই পাচ্ছি।”

শোবার ঘরে মানসী বলল, “করছ কি তোমরা⋯, বাবার স্বভাব তো জানো না। এখন ঘরে বসে গালাগাল দিচ্ছে, এরপর সকলের সামনে যাচ্ছেতাই করবে। মার কানে যদি যায়, কেলেংকারি।”

পুলিন চিন্তিত মুখ করে বলল, “ব্যাপার কি জানো। চোখের ব্যাপারে একটা মাইনর কিছু করতে পারি। কিন্তু ওই রকম হাই ব্লাডপ্রেশার, সাহস হয় না। বুড়ো মানুষ, তায় শ্বশুর, তার ওপর রিস্ক। যদি কিছু একটা হয়⋯আপদ বিপদ⋯।”

মানসী আঁতকে উঠল। সর্বনাশ! হিত করতে বিপরীত কিছু একটা হয়ে যাক, তারপর লোকে বলবে বড় জামাই শ্বশুরকে মারল। মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। ছিছি করবে সকলে। তা ছাড়া বরাবরের মতন একটা দাগ থেকে যাবে, বদনাম অপযশ, খুঁত। স্বামীর ডাক্তারিতেও নিন্দে রটবে। যে ডাক্তার নিজের শ্বশুর মারে তার কাছে কোন রোগী আসবে গো!”

মানসী পুলিনকে আঁকড়ে ধরল, বলল, “সর্বনাশ! না—না, ওসব তোমার করতে হবে না। খুনের দায়ে পড়বে নাকি!⋯দরকার নেই আগ বাড়িয়ে বিপদ ডেকে। ⋯যা করার অন্যে করুক।”

“নলিন দাঁতটা তুলে দিলেই আমার মনে হচ্ছে সব সেরে যাবে—”

“তবে কি! ঠাকুরপোই যা করার করুক, তোমার দালালি করতে হবে না। ওই নমো-নমো করে থাকো, লোশান-টোশান পর্যন্ত দাও তার বেশি নয়।”

সরসী নলিনের মধ্যেও কথাটা খোলাখুলি হয়ে গেল।

নলিন বলল, “একটা দাঁত তো ডেনজারাস হয়ে রয়েছে। তুলে দিতে পারি, তুলতে অসুবিধে নেই। কিন্তু যেরকম হাই ব্লাডপ্রেশার। তুলতে গিয়ে কোনো রকম বেকায়দা কিছু হয়ে যাক, ক্লট ফ্লট হয়ে যাক একটা, তারপর দম করে তোমার বাবা স্বর্গলাভ করুন। বাপস, ওই রকম রুগির চিকিৎসা!”

সরসী শিহরিত হল! বলে কি? এত কাণ্ড ভেতরে। না বাবা, দাঁত তুলে দরকার নেই। বলা কি যায় বিপদের কথা! এক করতে আরেক হবে। তখন লোকে বলবে, ছোট জামাই শ্বশুরকে মারল। বরাবরের বদনাম, মা ভাইয়ের কাছে মুখ দেখানো যাবে কোনোকালে। কেন বাবা, দরকার কিসের আমার পা বাড়িয়ে গর্তে পড়ে। এসব জিনিস থেকে সরে থাকা ভাল। সংসার বড় মুখ বাঁকা, একবার বেঁকলে সারাজীবন তার মুখ সোজা হয় না।

সরসী স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরল, বলল, “আমার মাথার দিব্যি, তুমি ওকাজ করতে যেও না। মানুষ মারার দায়ে পড়বে, তাও আবার শ্বশুর। বদনাম, নিন্দে। মাগো, ভাবতেও পারি না। রুগিও জুটবে না আর কপালে। কাজ কি তোমার ফাঁসির দড়িতে হাত দিয়ে। আপনারটা সামলে থাকো…”

নলিন বলল, “আমি কি অত বোকা! পুলিন যা করার করুক, চোখ নিয়েই তো গণ্ডগোল শুরু! দাঁতের কথা কার বা খেয়াল হবে।”

সরসী বলল, “সেই ভাল। দাদা যা পাপ করবে…। তুমি গা-আলগা দিয়ে থাকো।”

অতঃপর কয়েকটা দিন মানসী পুলিনকে ও সরসী নলিনকে আগলে আগলে রাখল। কারোরই ইচ্ছে নয়, তার স্বামী এমন একটা মারাত্মক কাজে হাত দেয়। ওদের ভয় ছিল বাবা যেরকম বেপরোয়া হয়ে হইচই, চেঁচামেচি, গালমন্দ শুরু করেছেন তাতে স্বামীরা না অসহ্য হয়ে সত্যি সত্যি একটা কিছু করতে বসে। মানসী পুলিনকে আড়ালে বার বার বলত, ‘খবরদার’; সরসী নলিনকে বলত; ‘মাথা গরম করে দাঁত তুলতে যেও না।’…

দুই বোন কেউ কাউকে বুঝতে দিত না, আড়ালে তারা স্বামীদের কেমন করে সামলাচ্ছে। বরং বিরক্তিই দেখাত সামনা-সামনি। কী যে সব ডাক্তার ছাই বুঝি না। হপ্তা কেটে গেল, কোনো কিছু করতে পারলেন না। ⋯এর চেয়ে বাবার মুঙ্গেরে ফিরে যাওয়াই ভাল ছিল। বিজুকে সত্যিই একটা টেলিগ্রাম করে দি, কি বলিস!

প্রভাময়ী ছেলেদের ওপর ভরসা রাখেননি। পাড়ার প্রবীণা যারা আসত তাদের কাছে বলতেন সব। তারা নানারকম টোটকার খবর দিত। অমুকের পাতার রস, তমুকের মাজন, অমুক ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়ানো হলুদ ভেজানো কাপড়, তমুক ফল বেটে পুড়িয়ে গরম জলে মিশিয়ে কুলকুচো⋯ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রভাময়ী সেই টোটকা যা যা সংগ্রহ করতে পারছিলেন করুণাকেতনকে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করাচ্ছিলেন। করুণাকেতনও করছিলেন।

বিজুকে টেলিগ্রাম করা হল মুঙ্গেরে। করুণাকেতনের চোখে সর্বদা গগলস। সারাটা দিন ছটফট করতে করতে আর চেঁচামেচি করে করে শরীর কাহিল হয়েছে, গলা বসে গেছে। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ থাকায় আলো বাতাস আসতে পায় না; বাতাসে বন্ধ গন্ধ ধরে গেছে।

ছয়

অবশেষে একদিন কেমন করে কী যেন হয়ে গেল। করুণাকেতন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চোখে গগলস এঁটে কলঘরে মুখ ধুতে গেলেন। মুখে জল দিতে গিয়ে দেখলেন মুখে স্বাদ লাগছে, কুলকুচো করতে কোনো কষ্ট হল না, মাড়ি বা দাঁতের গোড়ায় ব্যথাও নেই, গাল গলা টিপলেন নিজে নিজেই—ব্যথা লাগল না। এতদিন ভয়ে গগলস জোড়া খুলতেনই না, মুখে চোখে জল দিতে হলে ডান চোখটা বন্ধ করে রাখতেন। সাহস করে আজ গগলস খুলে ভয়ে ভয়ে ডান চোখের পাতা খুলে আয়নায় চোখ দেখলেন। বিশ্বাস হল না, আবার দেখলেন ভাল করে, সর্বাঙ্গে বুঝি আনন্দের তড়িৎ খেলে গেল।

ঘরে এসে মেয়েদের ডাকাডাকি শুরু হল। মানসী ছুটে এল, সরসী এল। প্রভাময়ীও এলেন সামান্য পরে। ঘরের দরজা জানলা করুণাকেতন নিজের হাতেই মহানন্দে খুলে দিচ্ছিলেন। বিকট শব্দ হচ্ছিল। এ ক’দিন ঘরে আলো বাতাস ঢোকেনি। সকালের আলো রোদ ও বাতাসে বাসি ঘর যেন ধোয়ামোছা হতে লাগল।

করুণাকেতন মানসীকে বললেন, “দেখ…চোখটা দেখ একবার…”

মানসী দেখল। চোখের কোথাও লালের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বলল, “লাল নেই কোথাও, পরিষ্কার একেবারে সাদা।”

সরসীকে দিয়েও চোখটা দেখালেন একবার। সরসী দেখল। বলল, “কিছু নেই কোথাও। সেরে গেছে।”

করুণাকেতন এবার দাঁত দেখলেন। না তাঁর সেই মাড়ির গোড়া আর ফুলে নেই, সাদাটে দাগ ধরে নেই ব্যথার জায়গাটাতে।

করুণাকেতন ঘরের মধ্যে নাচতে লাগলেন যেন। প্রভাময়ী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসলেন।

পুলিন নলিন এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে আসেনি, চেম্বারে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। তারাও এল।

করুণাকেতন পুলিনের দিকে তাকিয়ে অতিশয় গম্ভীর হয়ে গেলেন, এবং নলিনকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বারণ করলেন।

প্রভাময়ী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিয়ে করুণাকেতন কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বললেন, “ছেলেদের বলুন, ডিসপেনসারি তুলে দিয়ে আপনার কাছে টোটকা শিখুক। ⋯ওয়ার্থলেস⋯ওই দুটোই সমান। কিচ্ছু জানে না⋯। হাতুড়ে⋯।”

পুলিন নলিন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। মানসী সরসীকে দেখল একবার আড়চোখে। বউরা কেউই লজ্জিত নয়, মুখে চোখে রাগের ভাবও দেখা যাচ্ছে না।

পুলিন কোনোরকমে বলল, “আপনি টোটকা করছিলেন?”

করুণাকেতন প্রায় ভেঙিয়ে উঠে জবাব দিলেন, “না করব না, তোমাদের জন্যে, বসে থাকব, কবে আমায় অন্ধ কর,—না?”

নলিন বলল, “আমাদের বলা উচিত ছিল…”

মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে করুণাকেতন জবাবে বললেন, “কেন? আপনারা কে? আপনাদের কেরামতি কত তা আমার জানা আছে…যত সব পেন্টুল ডাক্তার।”

পুলিন নলিন মুখ লাল করে বেরিয়ে গেল।

একটা দিন অপেক্ষা করে করুণাকেতন গয়ার গাড়িতে উঠলেন। যথারীতি সাজ-পোশাক ও মালপত্র সমেত। মেয়ে জামাইরা স্টেশনে তুলে দিতে এসেছিল।

গাড়ি ছাড়ার আগে করুণাকেতন জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জামাইদের বললেন, “কিছু মনে কোরো না; বুড়ো মানুষ, দু-চারটে কটু কথা বলেছি। —দেখো হে, আমি দেখলাম তোমাদের একটু টোটকাও শিখে রাখা দরকার। দেশি জিনিসটা ফেলনা নয়। বিলেতিটা বাইরে দেখাবে, দেশিটা আণ্ডারহ্যাণ্ড।”

দুই জামাই একই সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে—”

তারপর করুণাকেতন মানসীকে বললেন, “তোদের শাশুড়িকে বলবি নাতিকে যেন কানের ডাক্তার করে। ওটাই যা বাকি।”

মানসী ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে সরসীর দিকে তাকাল।

গাড়ি ছেড়ে দিল, এবং দেখতে দেখতে করুণাকেতনের মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল।

পুলিন নলিন হাঁপ ছাড়ল। নলিন বলল, “বাপ্‌স⋯”, পুলিন বলল, “উন্মাদ একেবারে!”

মানসী হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তোমাদের ক্ষমতায় কুলোলো না, এখন তো আমাদের বাবাকে উন্মাদ বলবেই—”

সরসী বলল, “লজ্জা করা উচিত।”

পুলিন প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, “সারাবার কী ছিল, এ সিমপ্ল কেস অফ কন্‌জাংটিভাইটিস⋯। নিজের থেকেই সেরে যেত…। বরং দাঁতটা⋯”

নলিন বাধা দিল, বলল, “দাঁতে তেমন কিছু হয়নি, ইন ফ্যাক্ট গামবয়েল হয়ে কোথাও সেপটিক অ্যাবজরপ্‌শান হচ্ছিল। একটু চিরে দিলেই চলত—এমনিতেও কুলকুচো করলে পেন্ট লাগালেও অনেক সময় সেরে যায়।”

মানসী সরসী হাঁটতে লাগল। পুলিন নলিনও।

মানসী বলল, “এখন তো দুজনেই গলা বড় করে বলছ, কিছুই না, এটা সিমপ্ল সেটা সিমপ্ল, তখন এত বিদ্যে কোথায় ছিল?”

পুলিন নলিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসল। তারপর মানসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার দোষ কি, তুমিই তো বাগড়া দিচ্ছিলে। ভাবছিলে তোমার বুড়ো বাবাকে মেরে আমি কেন দোষের ভাগী হই। মরে মরুক নলিনের হাতে…”

নলিন বলল, “সরসীও যা শত্রু পরে পরের তালে ছিল—”

দুই বোন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেমন সব মানুষ দেখছ? দুম্‌ করে সব বলে দিল। লজ্জায় মরে আর কি দু-বোনে!

ছি ছি। মাথা কাটা যাচ্ছে যেন। চটে গিয়ে মানসী বলল, “বা, এখন আমরা⋯। তুমি যে তখন বললে, ভয়ের ব্যাপার আছে…”

সরসীও নলিনকে আক্রমণ করল, “তুমি না বলেছিলে, এটা আছে ওটা আছে…দাঁত তুলতে গেলে অঘটন ঘটতে পারে…”

নলিন পুলিনের দিকে তাকাল, পুলিন চোখ টিপল। দুজনে চোরা হাসি হাসল। তারপর নলিন বলল, “ও আমরা বলেই থাকি। মানে, ইচ্ছে করেই বলেছি।”

“কেন, কেন?” দুই বোন দুই স্বামীর হাত ধরে টান মারল।

পুলিন নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “না, মানে—এ রকম কিছু না বললে তোমার বাবা আর তোমাদের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যেত না। বাব্বা, যা দৌরাত্ম্য!”

মানসী পুলিনের গায়ে জোর একটা ঠেলা মারল। “অসভ্য কোথাকার।”

নলিন বলল, “তোমাদের বাবা হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে যে ওই বাবাটিই বাঘ।”

সরসী নলিনের পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল।

পুলিন ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠতে উঠতে শিস দিচ্ছিল, নলিন হাসছিল।

দুই বোনে পাশাপাশি ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠছিল। মানসী বলল, “দেখ, বাবা তো সব সময় চোখে গগলস দিয়ে থাকত, না হয় ডান চোখটা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখত। আমার মনে হয়, অনেক আগেই চোখ সেরে গিয়েছিল, দেখতে তো দেয়নি আমাদের, নিজেও দেখত না ভয়ে।”

সরসী মাথা নাড়ল; হয়তো তাই। বলল, “দাঁতের ব্যথাও ছিল না বুঝলি। আতঙ্কে ওই রকম করত। গালে ব্যথা হলে অত চেঁচামেচি কি মানুষ করতে পারে। শক্ত টোস্টই বা খেত কি করে।”

মানসী মাথা নাড়ল। ঠিক। তারপর দুবোনেই সিঁড়ি উঠতে উঠতে খিলখিল করে হেসে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *