১১. ইসমত চুঘতাই

১১. ইসমত চুঘতাই

প্রায় দেড় বছর পূর্বে আমি যখন বোম্বেতে ছিলাম হায়দ্রাবাদ থেকে পাঠানো এক ভদ্রলোকের চিঠি পেলাম। তাঁর চিঠির বিষয়বস্তু ছিল অনেকটা এরকম :

কী ব্যাপার, ইসমত চুঘতাই এখনও আপনাকে বিয়ে করল না। মান্টো এবং ইসমত এ দুটি হরিহর আত্মা যদি এক হয়ে যেতে পারত তাহলে কত ভালো হত। কিন্তু আফসোস, ইসমত শাহেদ লতিফকে বিয়ে করল আর মান্টো…

সেবারে হায়দ্রাবাদে প্রগতিশীল লেখকদের একটা কনফারেন্স হয়ে গেল। আমি তাতে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু হায়দ্রাবাদের একটা পত্রিকায় এই সম্মেলনের বিবরণ ছাপা হয়েছিল। এতে লেখা হয়েছিল, এখানে একপাল ধিঙ্গি মেয়ে ইসমতকে ঘিরে জিজ্ঞেস করল, আপনি মান্টোকে বিয়ে করলেন না কেন?

আমি জানি না এসব ঘটনা কতটুকু সত্যি। কিন্তু ইসমত যখন বোম্বেতে এল, আমার স্ত্রীকে বলল, হায়দ্রাবাদের এক মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মান্টো কি অবিবাহিত? তখন সে একটু রসিকতার সুরে বলল, জী না। একথা শুনে সে মেয়েটি থতমতো খেয়ে চুপসে গেল।

ঘটনা যা-ই হোক। কিন্তু এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ চমকপ্রদ ছিল যে, পুরো হিন্দুস্থানে শুধুমাত্র হায়দ্রাবাদের মেয়ে-পুরুষরাই আমার এবং ইসমতের বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাগ্রস্ত ছিল।

সে সময় তো আমি তেমন কিছু ভাবতে পারিনি, কিন্তু এখন ভাবছি, আমি এবং ইসমত সত্যি যদি স্বামী-স্ত্রী হতে পারতাম তাহলে কী হত? এই যদিটাও এমন এক ধরনের ‘যদি’ যার প্রকৃত মানে খুঁজতে হিমশিম খেতে হয়। যদি বলা হয়, ক্লিওপেট্রার নাক যদি এক ইঞ্চির আঠারো ভাগের এক ভাগ বড়ো হত তাহলে তার প্রভাবে নীল নদের ইতিহাসে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত। কিন্তু এখানে ইসমত যেমন ক্লিওপেট্রা নয় তেমনি মান্টোও এন্টনি নয়। তবে এতটুকু অবশ্য বলা চলে, যদি মান্টো এবং ইসমতের বিয়ে হয়ে যেত তাহলে সমকালীন সাহিত্যের ইতিহাসে তা একটা আণবিক বিস্ফোরণের কাজ করত বই কি। গল্প হত ঠিক গল্পের মতো। কাহিনির চরিত্রগুলো আড়মোড় ভেঙে বিদ্রোহ করে উঠত। তখন এমনও হত, লেখার রসনার বুক থেকে সকল দুধ শুষ্ক হয়ে যেত। হয়তো বা তখন একটা রূপ পরিগ্রহ করত যখন তাকে আর পরখ করা সম্ভব। হত না। অথবা এমনও হত যে, বিবাহের নিকাহনামার স্বাক্ষরই তার শেষ লেখা রূপে গণ্য হত। তবে বেশি রকম আশঙ্কা, ‘নিকাহনামা’র ওপর দুজনেই ‘গল্প’ লিখে ফেলে কাজি সাহেবের কপালে দুটো সই দিয়ে বলত, বাহ সুন্দর তো। তা ছাড়া বিয়ের মজলিশে কতকগুলো সংলাপ এমনও হতে পারত ইসমত, কাজি সাহেবের কপালটা বেশ চওড়া, ঠিক স্লেটের মতো।

কী বললে?’

কেন শুনতে পাও না, কানের মাথা খেয়েছ নাকি?

আমার কান ঠিকই রয়েছে, বরং তোমার কথাই গলার ভেতর থেকে বের হতে চায় পুরোপুরি।

তওবা, তওবা, নাও এবার ভালো করে শোনো। আমি বলছিলাম কাজি সাহেবের কপালাটা ঠিক স্লেটের মতো।

তার কপালটাও বেশ মসৃণ।

মসৃণ কাকে বলে তা তুমি জানো থোড়াই।

না, আমি জানি না, তুমি জানো বড়ো।

তুমি জানো তোমার মাথা। কাজি সাহেবের মাথা…

বড় সুন্দর।

বুঝলাম তো সুন্দর, তারপর?

তুমি বড়ো বকবক করতে পারো।

বকবক তো তুমিই করছ।

আমি বলছি, তুমি বকবক করছ।

তোমাকে মানতে হবে তুমি বকবক করছ।

বাহ্‌, তুমি দেখছি এখন থেকেই আমার সোয়ামি হয়ে গেছ দিব্যি।

কাজি সাহেব আমি এই মেয়েকে বিয়ে করব না। যদি আপনার মেয়ের মাথা ঠিক আপনার মাথার মতো হয়, তাহলে তার সাথেই আমার নিকাহ পড়িয়ে দিন দয়া করে।

কাজি সাহেব, আমিও এই লোকটাকে বিয়ে করব না। যদি আপনার চার স্ত্রী এখনো না হয়ে থাকে, তাহলে দয়া করে আমাকে আপনার ঘরে তুলে নিন। আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি।

কৃষণ চন্দর ‘চোঁটে’র ভূমিকায় লিখেছেন:

“বিষয়টি প্রচ্ছন্ন রেখে, পাঠককুলকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে, শেষে হঠাৎ নাটকীয়ভাবে আসল কথাটি বলে ফেলার মতো চমৎকারিত্বের ব্যাপারে ইসমত এবং মান্টো কারো চাইতে কেউ কম যায় না। এ ব্যাপারে উর্দু গল্প লিখিয়েদের মধ্যে কম লোকই এ ধরনের গুণের অধিকারী।

যদি আমাদের দুজনের বিয়ের খেয়াল কালেভদ্রে কখনও হয়, তখন অন্যদেরকে বিস্মিত ও বিব্রত না করিয়ে বরং আমরাই তাতে ডুব দেব তা কেমন কথা? ইসমত এবং মান্টো দুজনের বিয়ে– পুরো ব্যাপারটাই চরম হাস্যকর নয় কি?”

ইসমত একবার লিখেছিল : ‘শুধু এই সামান্য ভালোবাসার জগতে কত শওকত, কত মাহমুদ, আব্বাস, আসকারি, ইউনুস আরও কত নাম না-জানা প্রেমিক তাসের ঘরের খেলার মতো হারিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ কি বলতে পারে এর মধ্যে সত্যিকার প্রেমসুধাপ্রাপ্ত লোকটি কে? শওকতের সেই কাহিনির অতৃপ্ত আত্মার চাহনিগুলি, মাহমুদের সাপের মতো কিলবিল করা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি, আসকারির নির্দয় হস্তযুগল, ইউনুসের কালো ঠোঁটের আবেগ, আব্বাসের উদাস উদাস স্মিত হাসি আর হাজার হাজার আবেগ-বিদ্ধ চওড়া বুক, প্রশস্ত কপাল, কোকিল-কালো কেশদাম, মসৃণ সুডৌল নিতম্ব, পেশল বাহু– সবকিছু একসাথে মিলে পাকা সুতোর ডোরে বাঁধা অবস্থায় ঘুড়ির মতো ঝুলে আছে নিঃসীম শূন্যে অনন্তকাল। অস্থির চাতকের মতো তলিয়ে দেখি এদের দিকে। ভেবে পাই না কাকে রেখে কাকে ধরব। কোন ডোরটি ধরে টানতে থাকব আর টানতে টানতে আমিও ঘুড়ির মতো উড়তে থাকব নিঃসীম শূন্যে, দূরে, আরও দূরে।’ (ছোট্টি আপা)।

মান্টো লিখেছিল:

“আমি শুধু এতটুকু বুঝি, মেয়েদের সাথে প্রেম করা আর জমি খরিদ করা একই কথা। তুমি ভালোবাসার চেয়ে বরং দু-এক বিঘা জমি কিনে সারা জীবন তা দখলে রাখো। জীবনে শুধু একটি মেয়ে আর সারা দুনিয়া জুড়ে এত? কেন এতে এত তামাশা জমা হয়ে আছে? শুধু গন্ধ সৃষ্টি করেই আল্লামিয়া তার কর্মের পরিসমাপ্তি করলেন না? আমার কথা শোনো, এই যে জীবন যা তোমাকে দান করা হয়েছে, বেশ করে উপভোগ করো। তুমি এমন একজন খদ্দের, যে মেয়ে লাভ করার জন্যে সারা জীবন রসদ জুগিয়েও যা পাবে তা যৎসামান্য মনে করবে। আমি এমন একজন খদ্দের যে জীবনে অনেক মেয়েকেই লাভ করব। তুমি এমন একটা প্রেম করতে চাও, যে প্রেমের ব্যর্থ উপাখ্যান দিয়ে একজন বটতলার লেখক উপন্যাস লিখবে, নারায়ণ দত্ত-সায়গল তা ময়লা কাগজে ছাপবে আর দিব্বি বাজারে রদ্দি মাল হিসাবে সের দরে বিক্রি হবে। আমার জীবন-খাতার সকল পাতা উইপোকার মতো নিঃশেষ করে দিতে চাই, যেন আর কিছুই বাকি না থাকে। তুমি প্রেমের মাঝে জীবন লাভ করতে চাও আর আমি আকণ্ঠ প্রেমসুধা পান করতে চাই।” (তাকলিফ)

‘চোঁটে’র ভূমিকায় কৃষণচন্দর বলেন,

ইসমতের নাম উচ্চারণ করতেই পুরুষ গল্প লিখিয়েদের চক্ষু চড়কগাছ হয়। লজ্জায় অধোমুখ হয়ে পড়ে। নিজে নিজেই সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই ভূমিকাও সংকুচিত ও লজ্জা থেকে রেহাই পাবার একটি প্রয়াসমাত্র।

ইসমতের ব্যাপারে যা কিছু লিখছি তা কোনোরকম লজ্জা, সংকোচ বা নিজের দৈন্য ঢাকবার জন্যে নয়। একটা ঋণ বলা যায়, যা কিনা সামান্য সুদের সঙ্গে পরিশোধ করছি।

সর্বপ্রথম আমি ইসমতের কোন গল্পটি পড়েছি, আজ তার কোনো কিছুই মনে নেই। এই কথাগুলো লেখার সময় আমার স্মৃতিশক্তিকে খুব খোঁচা দিলাম, কিন্তু কোনো কাজ হল না। মনে হয় ইসমতের গল্প কাগজে ছাপা হওয়ার পূর্বেই আমি পড়ে ফেলেছি। এজন্যে ইসমতের ব্যাপারে আমার কোনো সংকোচ ছিল না। কিন্তু আমি যখন তাকে প্রথমবার দেখি, দারুণ হতাশ হয়েছিলাম। বোম্বের চেম্বার ক্লিয়ার রোডের ১৭নং ফ্ল্যাটে সাপ্তাহিক মোসাওয়ারের অফিস ছিল, শাহেদ লতিফ তার স্ত্রীকে (ইসমত) নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। মহাত্মা গান্ধিসহ সকল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়েছেন। শহরময় একটা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। রাজনৈতিক চিন্তাধারা সকলকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, এজন্যে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর শুরু হল সাহিত্য জগতের চুলচেরা আলোচনা।

এর একমাস পূর্বে ‘আদবে লতিফ’ পত্রিকায় ইসমতের ‘লেহাপ’ গল্প ছাপা হয়েছিল। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে কর্মরত ছিলাম। গল্পটি পড়ে আমি কৃষণচন্দরকে বলেছিলাম, বেশ খাসা গল্প তো, তবে গল্পটির শেষের লাইনটা একেবারে বেখাপ্পা, গা জ্বালা করে। আহমদ নদিমের স্থলে আমি যদি সম্পাদক হতাম তাহলে লাইনটা কেটে দিতাম। অতএব কথায় কথায় যখন গল্পের কথা উঠল, আমি ইসমতকে বললাম, আপনার ‘লেহাপ (লেপ) গল্প আমার খুব ভালো লেগেছে। গল্পের বর্ণনায় আপনার সংযম অতুলনীয় কিন্তু আমি ভেবে পাই না আপনি গল্পের শেষে এই কথাটা কেন লিখলেন যে, এক ইঞ্চি উপরের দিকে উঠানো লেপের ফাঁক দিয়ে আমি কী দেখেছি, লক্ষ টাকা দিলেও আমি কাউকে তা বলব না।

ইসমত বলল, কেন, এ লাইনটায় অসংগতি কোথায়?

জবাবে আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বলার আগেই ইসমতের চেহারার একটা অনির্বচনীয় লজ্জাবিজড়িত অভিব্যক্তি ফুটে উঠল, ঠিক যেমন অন্য দশটি লজ্জাবতী গৃহস্থ বধুদের মুখে ফুটে ওঠে। আমি খুবই হতাশ হলাম। আমি আসলে চেয়েছিলাম ‘হেলাপ’-এর চুলচেরা বৃত্তান্ত নিয়ে তার সাথে আলাপ করব, কিন্তু হা হতোস্মি। ইসমত চলে যাবার পর আমি মনে মনে বললাম, হতভাগী দেখছি নেহাত লজ্জাবতী মেয়ে।

আমার বেশ মনে আছে, এই সাক্ষাতের দ্বিতীয় দিনেই আমি দিল্লিতে আমার স্ত্রীকে চিঠি লিখলাম, শোনন, ইসমতের সাথে দেখা হয়েছিল। তুমি শুনে বিস্মিত হবে, ইসমত ঠিক তোমারই মতো, একটা নেহাতই ঘরোয়া মেয়ে। এক ইঞ্চি উপরের দিকে তোলা লেপের কথা তুলতেই সে লজ্জায় মরে গেল। আমার সব আশা মাঠে মারা গেল। তবে তুমি তাকে খুব পছন্দ করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এরপর দীর্ঘদিন আমার এই মানসিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছি এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম, মানুষকে তার শিল্পের স্থায়িত্বের জন্য নিজের সহজাত প্রবৃত্তির সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করা অপরিহার্য।

ডঃ রশিদ জাহানের শিল্পসংজ্ঞা আজ কোথায়? কিছু তার ঘনকালো কেশদামে অন্তলীন আর কিছু পাতলুনের পকেটে রয়ে গেছে। ফ্রান্সের জর্জ সান নারীত্বের সুন্দর পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করে সুকুমার শিল্পের জীবন গ্রহণ করেছেন। সংগীতকার পুলস্তানি সংগীতের রাগ-রাগিণী নিংড়াতে গিয়ে অবশ্যই হিরা-চুনি-পান্নার জন্ম দিয়েছেন কিন্তু তার নিজের রাগ-রাগিণী অঙ্কুরেই মরে গেছে।

আমি ভেবেছিলাম মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধের মাঠে লড়বে, পাহাড় কাটবে, গল্প লিখতে লিখতে ইসমত চুঘতাই হবে। কিন্তু তাদের হাতে মেহেদির রংও কখনও কখনো লাগাতে হবে, হাতের চুড়ির কঙ্কনধ্বনিও বাজতে হবে। ইসমত নেহাত ‘ঘরোয়া মেয়ে’ এই কথা বলে সত্যি আমি হোঁচট খেলাম। ইসমত যদি সত্যিকার মেয়ে না হত তাহলে তার গল্প সংকলনে রোমান্টিক প্রেমের উঁকিঝুঁকি, ‘ভুলভালাইয়া’, ‘লেহাপ’ ও ‘গিন্দা’ ধরনের মোলায়েম ও মনোমুগ্ধকর গল্প থাকত না। গল্পের মাঝে বরং মেয়েদের জন্য আরেক ধরনের অভিনয়কলা নিহিত। কোনোরকম ভাঁড়ামি ও গোঁজামিল বর্জিত অকৃত্রিম আবেগমাখা বাক্যাবলি– যা কিনা তীব্র হয়ে পুরুষদের হৃদয় বিদ্ধ করে যায়, দৈহিক বা বাহ্যিক অভিনয়ের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। হৃদয়ের গভীর অনুভূতির ইঙ্গিতের গন্তব্যে উপনীত হবার জন্যে মানুষের প্রাণাত্মার যে তাগিদ নারী সত্তারই আধো জানা, আধো অজানা প্রবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইসমতের লেখার নমুনা :

তার মুখাবয়ব পাণ্ডুর আকার ধারণ করল, আহ বেচারি অবলা শিশু- ওর বাপ বোধ হয় মারা গেছে।

তোমার মুখে ছাই পড়ক, খোদা না করুন। আমি বাছাধনকে বুকে টেনে নিলাম।

ব্যস। সুযোগ বুঝে ছেলে উঠে গিয়ে বন্দুক ছুড়ল।

হায় পাজি, আব্বাকে মারতে হয় কোনোদিন। আমি বন্দুক কেড়ে নিলাম (ভুলভালাইয়া গল্প থেকে)

সাকী’তে ইসমতের ‘দোজখী’ গল্প ছাপা হয়েছিল। আমার বোন গল্পটা পড়ে আমাকে বলেছিল : সাদত, এই ইসমতের মতো এমন কট্টর মেয়ে তো আর হয় না। হতভাগী নিজের সহোদর ভাইকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি। কীসব আজেবাজে কথা লিখেছে তার গল্পে।

আমি বললাম, ইকবাল, আমার মৃত্যুর পর তুমি যদি এ ধরনের গল্প লিখবে কথা দাও, তাহলে খোদার কসম, আজই আমি মরতে প্রস্তুত।

সম্রাট শাহজাহান প্রিয়তমার স্মরণে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। আর ইসমত তার প্রিয় ভাইয়ের স্মরণে ‘দোজখী’ গল্প লিখেছে। শাহজাহান এই মর্মরসৌধ নির্মাণের জন্য অন্যদের দ্বারা পাথর সংগ্রহ করেছেন। অন্য কারিগরদের দ্বারা পাথরে নকশা নমুনা উৎকীর্ণ করেছেন এবং অতঃপর তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন অমরসৌধ তাজমহল। আর ইসমত নিজের হাতে নিজের আবেগের কড়া মর্মরোথর একত্রিত করে একটা উঁচু বেদি তৈরি করেছে এবং নরম হাত দিয়ে আপন ভাইয়ের শবদেহ তাতে তুলে রেখেছে। তাজমহল শাহজাহানের প্রেমের একটা নগ্ন প্রতীক বিশেষ। কিন্তু ইসমতের ‘দোজখী’তে ভাতৃ-প্রেমাবেগ সম্পূর্ণ প্রচ্ছন্ন এবং শিল্পসম্মত। এই গল্পে যে স্বর্গ-সুধা রয়েছে শিরোনামে তা নেই।

আমার স্ত্রী এ গল্প পড়ে ইসমতকে বলল, এসব কি অনাসৃষ্টি তৈরি করেছ তুমি?

বকবক কোরো না, নাও সেই আইসক্রিম কোথায়?

বলাবাহুল্য, ইসমত বরফ বেশ পছন্দ করত। ঠিক ছোটো শিশুদের মতো কড়কড় করে চিবিয়ে সে আইসক্রিম খেতে থাকত। আইসক্রিম খেতে খেতে সে তার বহু গল্প লিখেছে। চারপেয়েতে কনুয়ের ওপর ভর দিয়ে কাত হয়ে আছে। সামনে বালিশের ওপর লেখার কাগজ, হাতে ফাউন্টেন পেন এবং অন্য হাতে আইসক্রিমের ডাঁটি। ঘরে রেডিয়োর ভলিয়ম জোরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রেডিও জোরে জোরে চিৎকার করছে। কিন্তু তার কলম এবং মুখের আইসক্রিম নিধনের আওয়াজ চলছে একই রকম। কড়কড়…।

ইসমতের লেখার একটা বিশেষ সময় আছে। যখন লিখবে না মাসের পর মাস গত হবে, কিন্তু যখন লেখার ঝোঁক চাপবে তখন শত শত পৃষ্ঠা তার কলমের নীচ থেকে চলে যাবে। তখন খাওয়া-দাওয়া স্নান- কিছুই তার খেয়ালে থাকবে না। সব সময় চার পেয়েতে কনুয়ের ওপর ভর দিয়ে সামনের কাগজে তার আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে মনের কথা উৎকীর্ণ হতে থাকবে অবিরাম। টেরহি লকির (আঁকাবাঁকা রেখা)-এর মতো বেশ বড়োসডো উপন্যাসটিও সে মাত্র ৭-৮ বার বসেই শেষ করেছে।

কৃষণচন্দর ইসমতের লেখার দ্রুততার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন:

গল্প সম্পর্কে (ইসমতের) আরও একটি উপমা বেশ মনে করা চলে, তা হল ‘ঘোড়দৌড়’। অর্থাৎ লেখার গতি, স্পন্দন, বিদ্যুৎসদৃশ ধাবমানতা থেকে মনে হয় পুরো গল্পটাই যেন দৌড়োচ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। তখন প্রতিটি বাক্য, ইঙ্গিত, ধ্বনি, চরিত্র, আবেগ এবং অনুভূতি যেন ধেয়ে চলে এক প্রলয় গতিসম্পন্ন বাহনের মতো।

ইসমতের কলম এবং মুখ দুটোই সমান ধারালো। লিখতে শুরু করলে কল্পনাশক্তি তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় দ্রুত গতিতে। তখন শব্দগুলো অনেক পেছনে পড়ে কাঁপতে থাকে। তখন কথা বলবে তো শব্দ একটার ঘাড়ে একটা চড়তেই থাকে। যদি খবরদারি করার জন্যে কখনও একবার বাবুর্চিখানায় ঢুকে পড়ে তাহলে আর রক্ষা নেই। হয়তো সবে আটা পিঁড়িতে পেষা হচ্ছে, কিন্তু তার মগজে রুটি তৈরি হয়ে যায়। হয়তো আলুর খোসা এখন ছাড়ানোই হয়নি কিন্তু সালুনের রং ঝোলের স্বাদ চেখে ফেলে কল্পনার চোখে। আমার মনে হয় কোনো কোনো সময় সে রান্নাঘরে ঢুকে ঘ্রাণে অর্ধভোজন সেরে ফিরে আসে। তার এই প্রচণ্ড দ্রুততার পাশাপাশি– ধীর-স্থির ও ঠান্ডা মাথার স্বভাবও আমি কখনও দেখেছি, যখন সে চুপচাপ বসে বাচ্চার জন্যে ফ্রক সেলাই করছিল। দ্রুতগতিতে লেখার সময় তার কলম অনেক সময় বানান ভুল করে বসে কিন্তু বাচ্চার। ফ্রক সেলাইয়ের সময় সঁচের একটা খোঁটও ভুল হয় না। সবদিকে মেপে পাকা দর্জির মতো সে ফ্রক সেলাই করে, কোনো দিকে একটু ঝুল হবারও অবকাশ নেই।

‘উফরে বাচ্চে’ (হায়রে ছেলেপিলে) গল্পে ইসমত লিখেছিল :

বাড়ি বাড়ি নয়, মহল্লা জুড়ে কলেরা আসুক সারা দুনিয়ার বাচ্চা পটাপট মরতে থাকুক। কিন্তু কই একটাও না। প্রতি বছর মা’শাল্লা পুরো বাড়ি হাসপাতাল হয়ে যায় (তবু মরে না)। শুনেছি দুনিয়াতে ছেলে-পিলেরাও মরে হয়তো মরে, কিন্তু কই?

কিন্তু কিছুকাল আগে বোম্বেতে যখন তার মেয়ে সীমার ক্ষয়কাশ হল রাতভর সে জাগতে লাগল। দুশ্চিন্তা আর উদাসীনতা ছেয়ে থাকত তার চোখেমুখে। মা হবার পরই মেয়েদের মমতা প্রকাশ পায়।

ইসমত দারুণ হঠকারী ছিল। তার ক্রোধটা ছিল অনেকটা শিশুসুলভ। জীবনের কোনো মতবাদ, কোনো সহজাত প্রবৃত্তির শাসনকে একেবারে প্রথমেই সে মেনে নিত না। বিয়েতে তার প্রথমে অসম্মতি ছিল। যদিও বা কোনোমতে রাজি হল, কারও ঘরনি হতে রাজি হল না। যদিও বা অনেক বলা কওয়ার পর তাতে রাজি হল, কিন্তু মা সে কোনোমতেই হবে না বলে রায় দিল। কষ্ট করতে রাজি, দুর্ভোগ পোহাতে রাজি, তবু যেটা নিয়ে জিদ ধরবে তা থেকে একচুল হটবে না। আমি মনে করি এটাও তার একটা পদ্ধতি। এভাবে ধাক্কা খেয়ে হোঁচট খেয়ে, জীবনের গভীরতর তত্ত্ব আহরণ করতে চায়, বুঝতে চায় সব কিছু আপন বৈশিষ্ট্যে। সত্যি, তার সব কিছুই আলাদা প্রকৃতির।

ইসমতের নারীসত্তা এবং পুরুষ প্রকৃতির মাঝেও আজব ধরনের জেদ এবং অসম্মতি বিদ্যমান। হয়তো প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে, কিন্তু প্রকাশ্যে অনীহা প্রকাশ করে যাচ্ছে। চুমো খাবার জন্যে হয়তো প্রাণ তার মাথা কুটে মরছে, কিন্তু চুমোর বদলে সে গালে সুই চালিয়ে দিয়ে তামাশা দেখবে। আহ্লাদে সোহাগে কোনো ছোটো শিশুকে স্পর্শ করার জন্যে হাত নিশপিশ করছে, কিন্তু কোলে নিয়ে তাকে এমন ছেলেমি করবে যে, শিশুটি চোখে সরষে ফুল দেখবে। তার এই স্ব-বিরোধী প্রেমসত্তা প্রথমত খেলাচ্ছলে শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা তার নতুন গল্পে ফল্গুধারা হয়ে পরিণতিপ্রাপ্ত হয়।

ইসমতের নিজের জীবনের পরিণতিও যদি এভাবে শুরু হয়ে শেষ হয়, আর তা দেখার জন্য আমি যদি জীবিত থাকি, তা আর তেমন বিচিত্র আমাদের কি? [কিন্তু মান্টো ইসমতের আগেই মারা গেছেন এবং ইসমত এখনও (১৯৮১) বেঁচেবর্তে আছেন।–-অনুবাদক]

ইসমতের সঙ্গে মেলামেশা শুরু হয়ে আমার পাঁচ ছ-বছর গত হয়েছে। আমাদের দুজনেরই সহনশীলতা বলতে ছিল না কিছুই, মনে হত ফুৎকারে সব উড়ে যাবে। দুজনের মাঝে এত দিনে শতশত ঝগড়া ফ্যাসাদ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনিবার্য। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে মাত্র একবার একটু সংঘর্ষ দানা বেঁধে উঠেছিল, তাও ছিল ক্ষণস্থায়ী।

শাহেদ এবং ইসমতের আমন্ত্রণক্রমে আমি এবং আমার স্ত্রী সাফিয়া মিলাদে (বোম্বাই এর উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি স্থান, শাহেদ বোম্বে টকিজে কর্মরত অবস্থায় এখানে থাকত) উপস্থিত হলাম। রাতের খাবার শেষে কথায় কথায় শাহেদ আমাকে বলল,

মান্টো, এখনও তোমার লেখায় প্রচুর ভুল থাকে।

রাত দেড়টা পর্যন্ত আমি আমার লেখার ভুল কোননাক্রমেই স্বীকার করতে রাজি হলাম না। রাত্র দুটার দিকে ইসমত তার স্বামীর পক্ষ নিল। হঠাৎ কোনো একটা কথা বলতে গিয়ে ইসমত ‘দস্ত দরাজি’ (হস্তক্ষেপ) শব্দ উচ্চারণ করল। আমি মওকা পেয়ে গেলাম, বললাম, প্রকৃত শব্দ হচ্ছে দরাজ দস্তি। রাত তিনটা বাজল, ইসমত কোনোক্রমেই নিজের ভুল স্বীকার করল না। আমার স্ত্রী ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। শাহেদ ব্যাপারটি সহজে মিটাবার জন্যে অন্য রুম থেকে অভিধান তুলে নিয়ে এল। কিন্তু ‘দস্ত দরাজি’ শব্দ অভিধানে খুঁজে পাওয়াই গেল না। তবে ‘দরাজ দস্তি’ এতে ছিল এবং তার অর্থও সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। সাহেদ বলল, ইসমত, এবার তোমাকে মানতেই হবে। এরপর স্বামী-স্ত্রীতে শুরু হল। ওদিকে ভোরের আগমনী শোনা গেল মোরগের আওয়াজে। ইসমত অভিধানটা তুলে অন্য দিকে ফিকে ফেলে বলল; যখন আমি নিজে অভিধান প্রণয়ন করব তখন সত্যিকার শুদ্ধ দস্ত-দরাজি থাকবে। দরাজ দস্তি কোনো একটা কথা হল, যত্তসব–।

ঝগড়া ফ্যাসাদ বলতে এই একটি ঘটনাই, এটাই প্রথম এবং শেষ। এরপর আমরা কোনো দিন কোনো বিতর্কে অবতীর্ণ হইনি। বরং বলা যায়, এ ধরনের বিতর্কের কোনো সুযোগ আমরা সৃষ্টি করিনি। কথা বলতে বলতে যখন এ ধরনের কোনো সংঘর্ষের মুখোমুখি হতাম, হঠাৎ ইসমত প্রসঙ্গ বদলে ফেলত অথবা আমি হঠাৎ অন্য পথে চলে যেতাম।

আমি ইসমতকে পছন্দ করি, আর ইসমতও আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় তোমরা দুজনে একত্রে কোন বস্তুটা পছন্দ করো তাহলে মনে হয় আমি এবং ইসমত কিছুক্ষণের জন্যে নির্বাক হয়ে যাব।

ইসমতের চেহারা সুরত খুব একটা আহামরি না হলেও বেশ স্নিগ্ধময়তা ছিল তার চেহারায়। তার প্রথম দর্শনের প্রতিচ্ছবি এখনও আমার মন-প্রাণকে আচ্ছন্ন করে আছে। একেবারে সাদাসিধা পোশাকে আবৃত ছিল তার দেহাবয়ব। ছোটো পাড়ের সাদা শাড়ি, সাদা জমিনের ওপর কালো ডোরাকাটা আঁটোসাঁটো ব্লাউজ, হাতে ছোটো ব্যাগ, পায়ে ক্ষুরবিহীন ব্রাউন চপ্পল, ছোটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়ার ওপর মোটা পুরো লেন্সের চশমা, ছোটো ববকাটা চুল, তির্যক চাহনি, একটু হাসলেই গালে টোল পড়ে যায়–এই ছিল আমার প্রথম দর্শনের ইসমত।

আমি ইসমতের প্রেমে পড়িনি, তবে আমার স্ত্রী তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সাফিয়া যদি ইসমতকে এ ব্যাপারে কোনো সময় বলত তাহলে অবশ্য সে বলত, প্রেমে পড়ার আদিখ্যেতা তোমার তো কম নয়। তোমার বয়েসের মেয়েদের বাপরা পর্যন্ত আমার প্রেমে হাবুডুবু খায়, আর তুমি

আমি এক সম্মানিত মসিজীবী লোককে জানি, ইসমতের প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন বহুকাল। পত্রের মাধ্যমে তিনি প্রেম নিবেদন করলেন। ইসমতও সাড়া দিয়ে যেতে লাগল নিয়মিত। কিন্তু শেষাবধি বেচারিকে এমন চিৎপটাং করে দিল যে তা আর বলাই বাহুল্য। এ সত্য ঘটনা কোনদিন এই ভদ্রলোক লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

পারস্পরিক মতদ্বৈতোর আশঙ্কায় আমার এবং ইসমতের মাঝে কথাবার্তা খুবই কম হত। কখন আমার কোনো লেখা ছাপা হলে পড়ে প্রশংসা করত। একবার নিলাম’ গল্প ছাপা হওয়ার পর ইসমত অস্বাভাবিক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল, এই বোন পাতানোটা কী? আপনি ঠিকই বলেছেন, কোনো মেয়ের সাথে বোন সম্পর্ক পাতানো তার অবমাননারই নামান্তর।

এরপরই আমি ভাবতে লেগে গেলাম, সে তো আমাকে মান্টোভাই বলে আর আমি তাকে ইসমত বোন বলে ডাকি–এবার বুঝুন ঠেলাটা।

আমাদের পাঁচ ছ-বছরের বন্ধুত্বের জীবনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যা বিশেষভাবে উল্লেখ করা চলে। অশ্লীলতার অভিযোগে একবার আমরা দুজনে একত্রে গ্রেফতার হলাম। আমার তো এ ব্যাপার পূর্বেকার দু-দুবারের অভিজ্ঞতা ছিল। এজন্যে সে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। ঘটনাক্রমে আমাদের গ্রেফতারটা শেষাবধি বেআইনি বলে প্রতিপন্ন হল। কেননা, পঞ্জাব পুলিশ আমাদের বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করেছিল। এতে ইসমত খুব খুশি হল। কিন্তু অভিযোগ যখন একবার উঠেছে তা আর কত চাপা দিয়ে রাখা যায়। অবশেষে তাকে লাহোরের আদালতে হাজির হতেই হল।

বোম্বাই থেকে লাহোর- এ বেশ দীর্ঘ পথ। কিন্তু শাহেদ এবং আমার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে ছিল। এরা দুজন এক পক্ষ হয়ে আমাদের দুজনকে উত্তেজিত করার জন্য অশ্লীলতা সম্পর্কে নানা ধরনের হামলা করতে লাগল। জেল-জীবনের নানা যন্ত্রণার একটা চিত্র তুলে ধরা হল। ইসমত শেষে উত্তেজিত হয়ে বলল, শুলে চড়ালেও এই কণ্ঠ থেকে ‘আনাহকই বের হবে জেনো।

এই মামলার ব্যাপারে আমরা বার দুয়েক লাহোরে গিয়েছিলাম। দু-বারই আমাকে এবং ইসমতকে দেখার জন্যে কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে আদালতে আসত। ইসমত আমাকে বলল, মান্টো ভাই, চৌধুরী নজিরকে বলুন সত্বর টিকিট সিস্টেম চালু করতে, আমাদের আসা-যাওয়ার খরচটা উঠে আসবে অনায়াসে।

আমরা দু-বারই লাহোরে গিয়েছিলাম এবং দুবারই কর্নেল শপে গিয়ে বিভিন্ন নমুনার দশ-বারো জোড়া স্যান্ডেল এবং জুতা কিনেছিলাম। বোম্বাইতে ইসমতকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, মামলার ব্যাপারেই লাহোর গিয়েছিলেন তাহলে? ইসমত চট করে জবাব দিল, না, জুতা কিনতে গিয়েছিলাম।

সম্ভবত সাড়ে তিন বছর আগের কথা। হোলি উৎসবের দিন এসে গিয়েছিল। মিলাদে আমি এবং শাহেদ ব্যালকনিতে বসে পান করছিলাম। ইসমত আমার স্ত্রীকে এটা ওটা বলে উত্তেজিত করছিল। সাফিয়া, এরা এত টাকা অপচয় করছে, চলো আমরাও এদের দলে শরিক হয়ে যাই।

এরা দুজন এক ঘন্টা ধরে একথা বলছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ ফিলমিস্থানের প্রডিউসর তার রাশভারী স্ত্রী এবং অন্যান্য লোকেরা এসে আমাদের হামলা করে বসল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের আর চেনার উপায় ছিল না। ইসমত। ইসমত হুইস্কি নিয়ে বসেছিল, তারও দৃষ্টি রঙের প্রতি আকৃষ্ট হল। আর যায় কোথায়? বলল, চলো সাফিয়া, আমরাও রঙের খেলায় নেমে পড়ি।

আমরা সবাই বাজারে নেমে এলাম। ঘোর বন্দর রোডে রীতিমতো হোলি খেলা জমে উঠল। নীলা, হলুদ, সবুজ, কালো– সব রকম রঙের খেলা চলছিল। ইসমতের সঙ্গে কেউ এঁটে উঠতে পারছিল না। একবার তো সে এক বাঙালি ভদ্রমহিলার পুরো চেহারাটাই লেপটে দিল রং দিয়ে। এ সময় আমার হঠাৎ ইসমতের ভাই আজিম বেগ চুঘতাইর কথা মনে পড়ে গেল। ইসমত হঠাৎ বলে উঠল, চলো পরীরানি নাসিমবানুর বাড়িতে হানা দেয়া যাক।

ইসমত ও আমি মাঝেমধ্যে আজগুবি ধরনের ভাবনাচিন্তা করতাম। একদিন ইসমত বলল, মান্টো ভাই, মোরগ-মুরগিদের রোমান্স নিয়ে একবার লিখলে কেমন হয়? অথবা বলত,

ধ্যাৎ আমার কিছুই ভালো লাগে না। আমি অচিরেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে উড়োজাহাজ চালাব।

মাত্র কয়েক মাস আগের ঘটনা। আমি এবং ইসমত বোম্বে টকিজ থেকে ট্রামে বাড়ি ফিরছিলাম। কথায় কথায় আমি বললাম, কৃষণচন্দরের লেখায় আজকাল আমি দুটো জিনিস প্রায়ই লক্ষ করি। তা হচ্ছে জিনা বিলজবর (ধর্ষণ) এবং কাওস ও কাজা (বর্ণিল স্বপ্নলোক, অতীন্দ্রিয় জগৎ বা ইন্দ্রলোক। ইসমত বলল, হাঁ ঠিকই ধরেছ।

আমি ভাবছি একটা প্রবন্ধ লিখব যার শিরোনাম থাকবে কৃষণচন্দর, জিনা বিলজবর এবং কাওস ও কাজা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবছি, জিনা, বিলজবর-এর সাথে কাওস ও কাজার মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক কী?

ইসমত কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বলল, সৌন্দর্যের প্রশ্নে কাওস ও কাজার বর্ণচ্ছটার মধ্যে রয়েছে অপরূপ আকর্ষণ। কিন্তু আপনি তো অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে কথাটি উত্থাপন করেছিলেন। প্রবন্ধটা লিখুন তাহলে তাড়াতাড়ি।

শুনেছি খ্রিস্টান চিত্রকলার লাল রং ঐশ্বরিক প্রেমের প্রতীক। না না… (হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল) ক্রুশে বিদ্ধ করার সকল আয়োজনও লাল রঙের সমবায়ে চিত্রিত করা হয়। কুমারী মেরির (মরিয়ম) আচ্ছাদনও গাঢ় লাল রঙের।

বলেই আমি সাদা পোশাক পরিহিত ইসমতের দিকে তাকালাম। ইসমত হেসে দিল। মান্টো ভাই, আপনি এ প্রবন্ধটা অবশ্যই লিখুন। তবে ‘বিল জবরটা’ (বলপ্রয়োগ) উহ্য রাখুন।

কৃষণচন্দর তাহলে রাগ করবে। বলপ্রয়োগ করে কার্যসম্পাদন করে বলেই তো মেয়েটি কান্নাকাটি করে।

বলপ্রয়োগ করে বলেই কাঁদবে কেন? অলক্ষে এই বলপ্রয়োগই হয়তো নায়িকাটির ভালো লেগেছে।

ইসমতের লেখা সম্পর্কে প্রচুর প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। পক্ষে কম, বিপক্ষেই বেশি। কিছু কিছু নিবন্ধকার তো আকাশপাতাল একত্র করেছেন তার সাহিত্যকর্ম আলোচনা করতে গিয়ে।

লাহোরের সাহিত্য জগতের ঠিকাদাররা যাকে কৌটো ভর্তি করে রেখেছিল সেই পেট্রিস সাহেব একবার কৌটোর ভেতর থেকে হাত বের করে কলম হাতে নিলেন এবং ইসমত সম্পর্কে এক নিবন্ধ লিখলেন। লোকটি মোটামুটি পণ্ডিত মনে রসিকতা রয়েছে পর্যাপ্ত, এজন্যে লেখাটা বেশ রসোত্তীর্ণ হয়েছিল। তিনি মেয়ে লেখিকাদের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, একজন শক্তিমান এবং পাকা ভূমিকা লেখকও (সালাউদ্দিন সাহেব) দেখছি মসিজীবীদের দল থেকে নরনারীদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন। ইসমত সম্পর্কে তিনি (সালাউদ্দিন বলেন, মেয়ে-লেখিকা হিসাবে উর্দু সাহিত্যে ইসমতের স্থান ইংরেজি সাহিত্যের জর্জ ইলিয়টের সমকক্ষ। মনে হয় সাহিত্যকর্মটা এক ধরনের টেনিস টুর্নামেন্ট যেখানে মেয়ে এবং ছেলেদের ম্যাচ আলাদাভাবে খেলা হয়।

এসব প্রশ্নাবলির জবাব নিশ্চয়ই এমন নয় যে, শ্রেণিভেদ হিসাবে মেয়ে এবং পুরুষ লেখকদের দু-লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু জবাব দানের সময় লোকেরা অবশ্যই সর্বাগ্রে প্রশ্ন করবে, প্রশ্নকারীটি কে? পুরুষ না মেয়ে? কেন-না, কোন লিঙ্গের মানুষ তা জানার পরেই না বোঝা যাবে প্রশ্নকর্তার আসল মনোভঙ্গি কী?

পেট্রিস সাহেব যে বলেছেন, মনে হয় সাহিত্যকর্মটা এক ধরনের টেনিস টুর্নামেন্ট যেখানে মেয়ে এবং ছেলেদের ম্যাচ আলাদা ভাবে খেলা হয়, কথাটি নেহাত পেট্রিস সুলভ বাগ্মিতা। টেনিস টুর্নামেন্ট সাহিত্যকর্ম নয়, কিন্তু মেয়ে এবং ছেলেদের ম্যাচ আলাদা অনুষ্ঠিত হলেও তেমন মহাভারত অশুদ্ধ হবার কথা নয়।

পেট্রিস সাহেব যখন ক্লাসে লেকচার দেন তখন ছাত্র এবং ছাত্রীদের তিনি আলাদা ভাবে সম্বোধন করেন না। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে যখন তিনি ছাত্রদের সংস্পর্শে আসেন। এবং লেখাপড়া সম্পর্কে আদেশ-উপদেশ দেন, তখন নিশ্চয়ই তিনি ভুলে যান না যে, তারা মেয়ে না ছেলে।

কোনো মেয়ে যদি জর্জ ইলিয়ট বা ইসমত চুঘতাই হয়ে যায়, তার মানে এই নয়, তার সাহিত্যকর্মে লিঙ্গের প্রভাব সম্পর্কে কোনো চিন্তাভাবনা করা হবে না। কেননা ক্লীবলিঙ্গের সাহিত্যকর্মী সম্পর্কেও পেট্রিস সাহেব একই মত পোষণ করবেন কি?

আমি মেয়ের ওপর মেয়ের এবং পুরুষের ওপর পুরুষের লেবেল লাগানোকে একটা পাগলামি-বই কিছু মনে করি না। মসজিদ এবং মন্দিরে যদি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বলা হয় ‘এখানে উপাসনা করা হয়’ তাহলে ব্যাপারটা কি হাস্যকর হবে না? কিন্তু যখন কোনো মসজিদ বা মন্দিরের সামনে আমরা নো বাসভবন বা প্রমোদভবন নির্মাণের চিন্তা করব, তখন নিশ্চয়ই এর পবিত্রতা সম্পর্কে আমরা একেবারে নির্লিপ্ত থাকব না।

ইসমতের মেয়ে হওয়ার স্বাক্ষর রয়েছে তার লেখার প্রতি ছত্রে ছত্রে, যা পদে পদে আমাদের দিকনির্দেশ করে। তার সাহিত্যের সৌন্দর্য এবং দৈন্য দিয়ে নিরপেক্ষভাবে পেট্রিস সাহেব যে নিবন্ধ লিখেছেন তা সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তার মতে কোনোক্রমেই লেখা থেকে তার লেখককে আলাদা করা যায় না। তা করার জন্যে না আছে কোনো বিচার-বিবেচনার পথ, না আছে রাসায়নিক প্রক্রিয়া।

আজিজ আহমেদ সাহেব ‘নয়া দৌড়’ পত্রিকার ইসমতের ‘টেরহি লকি’-এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন:

‘দেহগত পার্থক্য নিরূপণ করার জন্যে ইসমতের কাছে একই প্রক্রিয়া রয়েছে, তা হল অনুভূতির যাদুকাঠি। অতএব রশিদ থেকে শুরু করে টেলর পর্যন্ত যে গোটা বিশেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে এই উপন্যাসে, তাদের সকলকেই তিনি অনুভূতির যাদুস্পর্শে সনাক্ত করেছেন। এই যাদুস্পর্শেই ইসমত মানুষকে চিনেছেন, জীবনকে দেখেছেন– সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমা করেছেন।

আজিজ আহমদ অন্য এক নিবন্ধে বলেছেন: ইসমতের গল্পের নায়িকার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল, সত্যিকারভাবে না কোনো পুরুষ তাকে কামনা করেছে, না সে কোনো পুরুষকে প্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করেছে। প্রেম এমন এক বস্তু যার সাথে দেহের সম্পর্ক হল বিদ্যুতের সাথে তারের সম্পর্কের মতো। সুইচ অন করে দিলে মুহূর্তে এই বিদ্যুতে হাজার হাজার বাশ্বে আলো জ্বলে ওঠে। দুপুরের গরমে ‘বন বন’ পাখা ঘুরতে থাকে। জীবনযাত্রার সকল হুইল সচল হয়ে ওঠে এই বিদ্যুতের স্পর্শে। কাপড়ের ইস্ত্রি, চুলকাটার মেশিন–সবই চলতে থাকে তখন নির্বিবাদে। বিদ্যুতের মতো প্রেমের এই প্রকৃতি সম্পর্কে একজন শিল্পী হিসাবে ইসমত চুঘতাই অবগত নন।

স্বভাবতই বলা যায় আজিজ আহমদ সাহেবের এ জন্যে আক্ষেপ রয়ে গেছে। কিন্তু আজিজ আহমদ সাহেব যে ধরনের প্রেম সম্পর্কে অবহিত, মনে হয় তিনি তা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পদ্ধতিতে তৈরি করেছেন, এবং এখন তা সকল মানুষের জন্য ন্যস্ত করতে চান। আজিজ আহমদ সাহেবকে খুশি করবার জন্যে আমি বলতে চাই, ইসমতের নায়িকা এই প্রেমের এ.সি. এবং ডি.সি. উভয় কারেন্ট সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। কিন্তু তারপরও এই ট্রাজেডি কেমন করে হল যে, প্রাণ দিয়ে সে কাউকে ভালোবাসেনি এবং সেও কোন পুরুষের ভালোবাসা পায়নি।

ইসমত সত্যি আজিজ আহমদ সাহেবের লিখিত প্রেম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এবং তার এই অনভিজ্ঞতাই সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা। যদি আজ তার জীবনের তারের সঙ্গে এই প্রেমের বিদ্যুৎ সংযোগ করে দিয়ে সুইচ অন করে দেওয়া যায় তাহলে সম্ভবত অন্য এক আজিজ আহমদ জন্মলাভ করবে। কিন্তু তেল, গিন্দা, ভুলভালাইয়া এবং জালের মতো গল্পের রচয়িতা ইসমত অবশ্যই মারা যাবে।

ইসমতের নাটক দুর্বল। নানা জায়গায় অসংযম। ইসমত প্লটকে বিভিন্ন দৃশ্যে মেপে কাঁচি দিয়ে কেটে বণ্টন করেন না। এমনি দাঁত দিয়ে কেটে ছিঁড়ে জোড়াতালি দিয়ে সাজান।

দলাদলির জগতে ইসমত নেই। এই জগতে সে একেবারে নির্লিপ্ত, নির্বিকার। মেয়েসত্তা ইসমতের একটি দুরারোগ্য ব্যাধির মতো সদা সঞ্চারমান। ইসমতের শৈশব কেটেছে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। পর্দার অন্তরালের ঘটনা বিবৃত করার ব্যাপারে ইসমতের পারদর্শিতা তুলনাহীন। সমাজের প্রতি তার ক্ষোভ নেই, ক্ষোভ রয়েছে ব্যক্তিত্বের প্রতি। ইসমতের কাছে দৈহিক কামনার পরিমাপ যন্ত্র হচ্ছে অনুভূতির পরশকাঠি। ইসমতের লেখার বিশেষ কোনো ধাঁচ নেই। প্রতিটি বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পাঠককে অভিভূত করে। ইসমত অশ্লীল। সূক্ষ্ম রসিকতা ও হালকা টিপ্পনী ইসমতের লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইসমত তলোয়ারের ধারের ওপর পদচালনা করে।

ইসমত সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা হল। আরও লেখা হবে অনাগত দিনগুলোতে। কেউ তাকে পছন্দ করবে, কেউ করবে না। কিন্তু লোকদের পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে। রয়েছে ইসমতের লেখার অসীম ক্ষমতা। ভালো, মন্দ, নগ্ন, প্রচ্ছন্ন সব কিছুতেই তার অবাধ বিচরণ। সাহিত্যে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তাকে নিয়মকানুন ও ভৌগোলিক সীমারেখার আওতামুক্ত রাখাই সমীচীন।

কিছুদিন হল দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পত্রিকা ‘দেশ’ এক আজব ধরনের কারবার করে বসল। “আমার জবানিতে অপরের কাহিনি শোনো, পড়লে অনেকের উপকার হবে” এ ধরনের শিরোনামে এক স্তম্ভ প্রকাশ করল। তাতে আমার, ইসমত, মুফতি, প্রেমচাল, খাজা শফি এবং আজিম বেগ চুঘতাই-র গল্প সন্নিবেশ করা হল। অথচ ভূমিকায় প্রগতিশীল সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে দাঁত মুখ খিচে একচোট নেওয়া হল। তার এই কীর্তিকে দুটি ছোটো ছোটো শিশুর নামে উৎসর্গ করা হল। এর এক কপি আমার জন্যে এবং এক কপি ইসমতের নামে পাঠানো হল। দেশ’-এর এই অশোভন ও অপসন্দনীয় কারবারে ইসমত যারপরনাই বিরক্ত হল। অনেক অনুযোগ করে সে আমাকে লিখল :

মান্টোভাই, ‘দেশ’ নামে যে পত্রিকাটি বেরিয়েছে তা আপনি দেখেছেন কি? আদ্যোপান্ত পড়ে দেখুন এবং ওদের নামে একটা নোটিশ ইস্যু করুন। নিরপেক্ষভাবে প্রতিটি নিবন্ধের জন্যে দুশো টাকা করে জরিমানা দাও, অন্যথায় মামলা ঠুকে দেব। কিছু একটা হওয়া উচিত। আপনিই বলুন কী করা যায়। বেশ তো! যার ইচ্ছা সেই আমাদের এভাবে কাদা ছিটাবে আর আমরা এভাবে বসে থাকব? বেশ মজা হবে। লোকটিকে ধমক দিন, তুমি যদি নগ্ন বা যৌন বিষয়ক গল্পের বিরোধী হও, তাহলে তা আবার তোমার কাগজে ছাপলে কেমন করে? তোমার কাগজের কাটতির জন্যে ভালো ফন্দি এঁটেছ দেখছি। এই বুঝি আমাদের কপালে ছিল, আজেবাজে গোমূর্খদের কথা শুনতে হবে আমাদের। আমার চিঠির মর্ম অনুযায়ী আপনি চিঠি তৈরি করুন। আপনি বলবেন, আমি কেন লিখছি না। আপনি থাকতে আমি লিখব এ কেমন কথা?

যখন ইসমতের সঙ্গে দেখা হল চিঠি সম্পর্কে বললাম, সর্বাগ্রে লাহোরের চৌধুরী মোহাম্মদ হোসাইন-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। আমরা আবেদন করলে তিনি নিজেই মামলা ঠুকে দেবেন।

ইসমত বলল, প্রস্তাব তো মন্দ না। কিন্তু মুশকিল হল, তার আগে না আমাদেরকেই ধরে নিয়ে যায়।

আমি বললাম, কী বললে? আদালত কাঠখোট্টা জায়গা বটে, কর্নেল শপ তো বেশ মনোরম জায়গা। মি. দেশকে সেখানেই নিয়ে যাব।

শুনে ইসমতের কপোল আরক্ত হয়ে উঠল সহসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *