০২. অশোককুমার

০২. অশোককুমার

নাজমুল হাসান যখন দেবিকারানিকে নিয়ে উধাও হল, বোম্বে টকিজে রীতিমতো একটা হইচই পড়ে গেল।(১) সবে ছবি শুরু হয়েছিল, দু-চারটে দৃশ্য গ্রহণের পরই নায়ক তার। নায়িকাকে সেলুলয়েডের জগৎ থেকে সাক্ষাৎ বাস্তব জগতে নিয়ে চলে গেল। এ সময় বোম্বে টকিজের হিমাংশুবাবুরই সবচেয়ে বেশি বিপদ। বিরাট চিন্তার পাহাড় নেমে এল তার ওপর। কারণ, তিনিই দেবিকারানির একমাত্র স্বত্বাধিকারী স্বামী এবং বিখ্যাত বোম্বে টকিজের প্রাণসর্বস্ব।

এ সময় এস মুখার্জি (অশোকের ভগ্নিপতি) বোম্বে টকিজের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার সাভাক ওয়াচার সহকারী ছিলেন। শুধু বাঙালি বলেই হিমাংশু রায়ের অনুমতি ছাড়াই তিনি তলে তলে চেষ্টা চালালেন। এবং কলকাতায় গিয়ে অনেক সাধ্যসাধনা করে অবশেষে দেবিকারানিকে ফিরিয়ে আনলেন। প্রেমাস্পদ নাজমুল হাসানের বাহুমুক্ত হয়ে একদিন সত্যি সত্যি দেবিকারানি যখন বোম্বে এসে হাজির হল, সর্বত্র একটা সাড়া পড়ে গেল। দেবিকারানিকে ফিরিয়ে এনেই এস মুখার্জির কর্তব্য শেষ হল না। এরপর হিমাংশুবাবুকে রাজি করিয়ে দেবিকারানিকে পুনরায় গ্রহণ করানোর ঝকমারিও তাকে পোহাতে হল। অবশ্য বেশি চেষ্টার দরকার হয়নি। সহজেই দেবিকা-হিমাংশু মিলে গেলেন। আর ওদিকে বেচারি নাজমুল হাসান সেসব প্রেমিকদের তালিকাভুক্ত হয়ে রইল যারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পুঁজিবাদী চক্রান্তে পড়ে প্রেমিকাদের হারিয়েছে।

ছবিটির যে কটি দৃশ্য তোলা হয়েছিল, কাঁচি চালিয়ে তার প্রায় অনেক অংশ কেটে ফেলা হল। প্রশ্ন উঠল, দেবিকারানির বিপরীতে এবারকার নায়কটি কে হবে? এবার যেন আর নিয়ে ভাগতে না পারে।

হিমাংশু রায় কঠোর পরিশ্রমী এবং নিষ্ঠাবান চিত্রনির্মাতা। সব ব্যাপারেই তিনি ছিলেন অনুসন্ধিৎসু। অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং যত্ন সহকারে তিনি তিলে তিলে বোম্বে টকিজকে গড়ে তুলেছেন। একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ বিদ্যাপীঠের মতো মনে হত বোম্বে টকিজকে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বোম্বে টকিজের পত্তন করার জন্য তিনি শহর থেকে দূরে মিলাদ গ্রামে বোম্বে টকিজের জন্য জায়গা নিলেন।

করতেন না (নাজমুল হাসানও যেহেতু বাইরের লোক ছিল)।

এবারেও এস মুখার্জি হিমাংশুবাবুর সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেন। তাঁর শ্যালক অশোক বি. এসসি. পাস করে এক বছর কলকাতাতে ওকালতি পড়ে অবশেষে বোম্বে টকিজের ল্যাবরেটরিতে বিনে পয়সায় কাজ শিখছিল। দেখতেশুনতে মন্দ ছিল না। অল্প অল্প গানবাজনাও রপ্ত ছিল। এস মুখার্জি একদিন কথায় কথায় অশোকের কথা পাড়লেন। হিমাংশুবাবু বললেন, আগে ক্যামেরার সামনে টেস্ট করে দেখতে হয়।

জার্মান ক্যামেরার সামনে টেস্ট হল। জার্মান ফিল্ম ডিরেক্টর মি. ক্লান্স অস্টন অশোক সম্পর্কে ভালো মত না দেয়া সত্ত্বেও অভিজ্ঞ হিমাংশুবাবু অশোককে পছন্দ করলেন। অতঃপর চতুর্দিকে একটা মিষ্টি খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, দেবিকারানির বিপরীতে অশোক গাঙ্গুলি নায়ক হিসাবে অবতরণ করছে। অশোকের বয়স তখন ২২ বছরের মতো হবে।

এরপর দুটো একটা করে অশোক-দেবিকার বেশ কটি ছবিই তৈরি হল। সব কটি দেখবার মতো। অশোক-দেবিকা এক রোমান্টিক জুটি হিসেবে চিত্রামোদীদের মনোরাজ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে ফেলল। লাস্যময়ী দেবীকা আর নবাগত প্রতিভাদীপ্ত নায়ক অশোক একেবারে সোনায় সোহাগা। সারা দেশের চিত্রামোদী, বিশেষ করে কলেজের ছাত্রদের মধ্যে অশোকের দেদার ভক্ত গড়ে উঠতে লাগল। সেকালে একমাত্র অশোকই ছিল আইডিয়াল হিরো। কলেজের ছাত্ররা অশোকের বেশবাস অনুকরণ করত। অনেকেই ভোলা। আস্তিনওয়ালা অশোক-মার্কা বাঙালি পাঞ্জাবি পরত। পথেঘাটে তখন অশোকের মুখের সেই গানটি প্রায়ই শোনা যেত–

তু বন কি চিড়িয়া।
মাই বনকা পনছি
বন বন বুলুরে।

আমি অশোকের মাত্র কয়েকটি ছবি দেখেছি। অভিনয়ের দিক থেকে দেবিকারানি অশোকের চেয়ে বেশ কয়েক পা আগে ছিল। নায়ক হিসেবে অশোককে প্রথমে মনে হত টাইপড। কিন্তু পরে অবশ্য তার সেসব বাঙালি আফিম-মার্কা জড়তা কেটে যায়।

প্রথম দিকে অশোক যখন ল্যাবরেটরির বহিভাগে কাজ পেল তখন তার বেতন ছিল পঁচাত্তর টাকা। তা দিয়েই অশোক দিব্যি রাজার হালে ছিল। একা একজনের জন্যে কতই বা আর লাগত সেকালে। তাছাড়া থাকত শহরতলীতে। সেখানে খাই-খরচ ছিল নেহাত কম। এরপর অশোকের বেতন যখন বেড়ে দেড়শো টাকা হল, খুব খুশি হল। কিন্তু যেবারে তার বেতন আড়াইশো টাকা হল, সে তো হতবাক। তখনকার মনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আমাকে বলল, বাই গড মান্টো, আমার অবস্থা তখন কী হয়েছিল তোমাকে আর কী বলব– আমি ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে যখন আড়াইশো টাকা হাতে নিচ্ছিলাম, তখন উত্তেজনায় রীতিমতো হাত কাঁপছিল। ভেবে পাচ্ছিলাম না যে, এত টাকা কোথায় রাখব। ছোট্ট মতো একটা বাসা আমার। একটা চারপেয়ে আর গোটা তিন চার চেয়ার, এই ছিল কুল্লে আমার আসবাবপত্র। ঘরের চারিদিকে ঘন জঙ্গল। যদি কেউ ঢের পায় যে, আমার কাছে এত টাকা আছে, রাতে এসে আমার টুটি চেপে ধরবে। ভয়ে আমার গা শিউরে উঠেছিল। অবশেষে বুদ্ধি করে আমি নোটগুলো বিছানার নীচে ছড়িয়ে রাখলাম। সারারাত অনেক আজব আজব স্বপ্ন দেখলাম। সকালে উঠে আমি সোজা পোস্টাপিসে গিয়ে টাকা জমা রেখে এলাম।

অশোক তার বাড়িতে বসে আমাকে এসব বলছিল, এমন সময় কলকাতা থেকে একজন প্রযোজক এলেন। কন্ট্রাক্ট তৈরি ছিল। কিন্তু বেশ দরকষাকষি হচ্ছিল। প্রযোজক আশি হাজার পর্যন্ত দিতে রাজি। কিন্তু অশোক পুরো এক লাখ থেকে নীচে নামছে না। কোথায় আড়াইশো টাকা আর কোথায় এক লাখ!

বোম্বে টকিজে অশোক যেমন দিন দিন উন্নতি করে যাচ্ছিল তেমনই তার ভগ্নিপতি এস মুখার্জী দ্রুতগতিতে উন্নতির সোপান অতিক্রম করছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক ছিলেন তিনি। দেখতে দেখতে জাঁদরেল প্রডিউসার হয়ে বসলেন। বোম্বে টকিজের ঝান্ডার নীচে দাঁড়িয়ে তিনি অনেক গোল্ডেন এবং সিলভার জুবিলিপ্রাপ্ত ছবি নির্মাণ করেন। দৃশ্য গ্রহণের ব্যাপারে তিনি এক নতুন টেকনিকের প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীকালের ব্যাপক ভাবে অনুসৃত হয়।

অশোকের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। সে বাইরে বড়ো একটা বের হত । লোকদের সঙ্গে মেলামেশা ছিল না। কালেভদ্রে যখনই সে বের হত, পথেঘাটে একটা দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার বেঁধে যেত। ট্রাফিক বন্ধ হয়ে যেত। তার ভক্তদেরকে নিরস্ত করতে পুলিশ বেচারিদের নাভিশ্বাস উঠে যেত।

কিন্তু কী আশ্চর্য, ভক্তদের উৎপীড়নের মুখে অশোক অত্যন্ত কঠোর মূর্তি ধারণ করত। হঠাৎই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। আমি তাকে অনেকবার বলেছি, দাদামণি, তোমার এ অভ্যাসটা বড্ড খারাপ। পৃথিবীতে ক-জনেরই বা এমন ভক্ত আছে। অথচ এতে তুমি খুশি না হয়ে বরং খেপে যাও, লোকেরা কী মনে করে? লোকেরা যে তোমায় কত ভালোবাসে তা কি তুমি জানো?

কিন্তু এসব কথা বুঝবার জন্য ওর মস্তিষ্কে কোনো আলাদা কামরা ছিল বলে আমার মনে হয় না।

প্রেমের ব্যাপারে অশোক বরাবরই গা বাঁচিয়ে চলত। মনে হত নেহাতই অবাচীন এ ব্যাপারে (বিভাগ-পূর্ব কালের কথা বলছি) অসংখ্য সুন্দরী মেয়ে তার জীবনে এসেছে। কিন্তু সবারই বুক ভেঙে দিয়েছে সে। ওর স্বভাবে অনেকটা জাঠপনা ছিল। খাওয়া-দাওয়া চলাফেরা– সব কিছুতেই ওর একটা আলাদা গোঁয়ারতুমি ছিল।

দেবিকারানি ওর সঙ্গে প্রেম করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে সে মোটেই পাত্তা দেয়নি। অন্য এক চটকদার অ্যাকট্রেস একটু দুঃসাহসিক ভাবেই একদিন তাকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল এবং বেশ চিনি মধু মিশিয়ে প্রেম নিবেদন করল। কিন্তু অশোক যখন তাকে অত্যন্ত কাঠখোট্টা ভাষায় প্রত্যাখ্যান করল, তাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল,

আসলে আমি আপনাকে পরীক্ষা করছিলাম। আপনি তো আসলে আমার ভাইয়ের মতো।

ওদিকে অশোক কিন্তু তার দেহটা পছন্দ করত। সাজগোজ করে যখন তার দেহটাকে ফুটিয়ে তুলত, অশোকের বড়ো ভালো লাগত। কিন্তু ভাই ডেকে সেসব মাটি করে দিল।

যদিও অশোক প্রেমের ব্যাপারে নিরাসক্ত ছিল, কিন্তু অন্যান্যদের মতো একটু উঁকিঝুঁকি মারার অভ্যেসটা ছিল। যে-কোনো মেয়েরই আকর্ষণীয় দিকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত এবং তা নিয়ে বন্ধু মহলে বেশ চাটনি পরিবেশন করত। কখনো-সখনো কাউকে কামনাও করত। কিন্তু সাহস পেত না। আমাকে বলত :

সত্যি মান্টো, যা-ই বলল আমার কিন্তু সাহস হয় না।

এ ব্যাপারে যদিও সে একেবারে হাঁদারাম ছিল, কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে তার দাম্পত্য জীবনের জন্য পরম আশীবাদ। এ ব্যাপারে তার স্ত্রী শোভা প্রায়শ বলতেন :

হাজার শোকর ভাই, গাঙ্গুলি এদিক দিয়ে বড়ো ভালো। ভগবান যেন তাকে সে পথে না নেয়।

রোজ তার নামে নানা ঢং-এর প্রেম নিবেদন নিয়ে হাজারো মেয়ের চিঠি আসত। কিন্তু যতটুকু আমি জানি, বড়োজোর শতখানেক চিঠি অশোক পড়ে দেখত। বাকিগুলো

তার সেক্রেটারি ডি সুজা তাকে পড়ে পড়ে শোনাত।

দেশ বিভাগের কয়েকমাস আগে অশোক ‘চন্দ্রশেখর’(২)-এর সুটিং-এর ব্যাপারে কলকাতা এল। প্রধানমন্ত্রী শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সেখান থেকে ষোলো মিলিমিটারের এক ছবি দেখে ডেরায় ফিরছিল। পথিমধ্যে দুটো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে তার গাড়ি আটকাল এবং লিফট চাইল। অশোক প্রথমটায় ভ্ৰ কুঁচকাল। কিন্তু পরে ভাবল, মন্দ কি, কিছুক্ষণ মজা তো হবে। অশোক তাদের লিফট দিল। কিন্তু খেসারত বাবদ তার দামি সিগারেট কেসটা হারাতে হল। সিগারেটের সঙ্গে সিগারেটের কেসটাও গায়েব করে দিল।

কুলাপুরে ঢাল, তলোয়ার আর যুদ্ধবিগ্রহ মাকা একটা বিরাট ছবি তৈরি হচ্ছিল। অশোকের কিছু কাজ তাতে বাকি ছিল। তারা খবরের পর খবর দিত। কিন্তু অশোক যেতে চাইত না। চরিত্রটি তার পছন্দসই ছিল না। কিন্তু, করা কী, চুক্তিবদ্ধ যে। অবশেষে একদিনের জন্যে তাকে যেতেই হল। সঙ্গে আমাকে নিয়ে নিল। আমি তখন ফিল্মিস্থানের জন্যে আটদিন’-এর কাহিনি লিখছিলাম। ছবিটি প্রযোজনা এবং পরিচালনা করছিল অশোক। তাই বলল,

‘চলো ইয়ার, সেখানেই আরামসে কাজ করা যাবে।’

কিন্তু আরাম আর কোথায়? লোকেরা হঠাৎ জেনে গেল অশোককুমার এসেছে। অশোকের হোটেল আর কুলাপুরের পথেঘাটে ভিড় সামলানো দায় হয়ে পড়ল। হোটেলের মালিক অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে লোকদেরকে নিরস্ত করল। আপনারা তো জানেন, ভক্তদের। প্রতি অশোক অত্যন্ত বদমেজাজি। এজন্যে সে তাদেরকে টিকিটি পর্যন্ত দেখতে দেয়নি।

এক বিকেলে আমরা বেড়াতে বের হলাম। চোখে কালো গগলস আর আজব ধরনের বেশবাস নিয়ে অশোক ছদ্মবেশ ধারণ করল। এক হাতে ছড়ি আর অন্য হাতে আমার কাধ। প্রয়োজন বোধে আগু-পিছু যেন করতে পারে। স্টুডিয়োর ধুলোবালি থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটা কিছু প্রতিষেধক ঔষধ তার কেনা দরকার। হাঁটতে হাঁটতে এক স্টোরে পৌঁছোল।

আপনি কে?

আমি? আমি আমিই।

আপনি কি অশোককুমার নন?

আমি অশোককুমার হতে যাব কেন? অশোক অন্য কেউ হবে হয়তো। চলো মান্টো, আর দাঁড়াবার দরকার নেই।

অতঃপর ঔষধ না কিনেই আমাদেরকে ফিরতে হল। হোটেলের মোড়ে আসতেই তিনটি মারাঠি মেয়ের আবিভাব। বেশ সুন্দরী–সাজগোজও বেশ করেছে। চুলের খোঁপায় ফুল। পায়ে হালকা চপ্পল। সবে কেনাকাটা করে ফিরছিল বোধ হয়। হাতে কী যেন ছিল। অশোককে দেখতেই তাদের একজন রীতিমতো কাঁপতে কাঁপতে বলল, ওই দেখ অশোক। এবং হাতে যা ছিল পড়ে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। এসব কাণ্ডকারখানা দেখে অশোক আমার কাধ ছেড়ে দৌড় দিল।

শেষের দিকে এস মুখার্জি তার দলবলসহ বোম্বে টকিজ ছেড়ে এসে ফিল্মিস্থান নামে এক নতুন চিত্রপুরীর পত্তন করেন। এখানে অশোকের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। এমনিতে এখানে সেখানে তাকে কবারই দেখেছি। কিন্তু সত্যিকার দেখা যাকে বলে তা ফিল্মিস্থানেই হয়েছে। আমি তখন ফিল্মিস্থানেই চাকরি করি।

এটা চিত্রজগতের বৈশিষ্ট্য, চিত্রতারকাদের পর্দাতে যেমন দেখায় পর্দার অন্তরালে তাদের অন্য রূপ। আমি যখন অশোককে ঘনিষ্ঠ আলোকে দেখলাম, পর্দার অশোকের সঙ্গে তার কোনো সাদৃশ্য পেলাম না। গাঢ় শ্যামলা রং, মোটা কর্কশ হাত, কাঠখোট্টা দেহ, চলাবলায় একটা গোঁয়ারতুমি ভাব–সর্বোপরি পদে পদে কৃত্রিম লৌকিকতা। যখন পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল আমি বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম। প্রতি উত্তরে অশোক কর্কশ ভাষায় কিছু একটা বলল। মনে হল আমার ওপর সে চটে আছে।

একবার এক মহারথী ফিল্মিস্থান পরিদর্শনে এলেন। অশোকের সঙ্গে পরিচয় হতেই বললেন- আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে মনে হয় কতকাল থেকেই যেন আপনাকে চিনি।

অশোক একটু চটে গিয়ে বলল, আপনার মুখোমুখি তো আমি কোনোদিন হইনি। মুখোমুখি শব্দটা যে অপ্রযোজ্য হঠাৎ অশোক তা আঁচ করে ফেলল। কিন্তু বড়ো পাকামো করে লজ্জাটা হজম করে নিল।

অশোক উর্দু ভালোবাসত। প্রথমদিকে সে উর্দুতে লেখা পড়া দুটোই শিখেছিল। কিন্তু পরে সব এলোমেলো হয়ে যায়। তবুও মাঝেমধ্যে একটু-আধটু উর্দু যা লিখত মন্দ হত না। দেশ বিভাগের পর আমি যখন বোম্বে টকিজ ছেড়ে চলে এসেছিলাম অশোক আমাকে ফিরে যাবার জন্য উর্দুতে চিঠি লিখেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নানা কারণে আমি সে চিঠির জবাব লেখার সময় করে উঠতে পারিনি।

অন্যান্য মেয়েদের মতো আমার সহধর্মিণীও অশোকের বড়ো ভক্ত ছিল। একদিন অশোককে আমার বাসায় নিয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকে সাফিয়াকে ডাকলাম–সাফিয়া, দেখ অশোক এসেছে।

সাফিয়া ভেতরে রুটি সেঁকছিল, কয়েকবার ডাকাডাকির পর বের হল। আমি তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম,-এ হচ্ছে আমার স্ত্রী-দাদামণি হাত মিলাও।

দুজনের মধ্যেই কেমন জড়তা লক্ষ করলাম। আমি অশোকের হাত টেনে নিয়ে বললাম– হাত মিলাও দাদামণি, তোমার এত লজ্জা কেন? বাধ্য হয়ে তাকে হাত মিলাতে হল। ঘটনাক্রমে সেদিন আমাদের কিমা-রুটি হচ্ছিল। অশোক অবশ্য খেয়ে এসেছে। তবু যখন সে খেতে বসল তিন তিনটে রুটি শেষ করল।

শুনে আশ্চর্য হবেন, আমাদের মধ্যে একটা শুভযোগ ছিল। যখনই আমার বাসায় কিমা রুটি হত কেমন করে যেন সে এসে হাজির হত।

অশোককে দাদামণি বলার একটা ইতিহাস আছে। আমাদের বন্ধুত্ব যখন বেশ জমে উঠেছে, একদিন অশোক আমাকে বাধ্য করল তাকে দাদামণি ডাকবার জন্যে। আমি অস্বীকার করে বললাম–তোমাকে দাদামণি ডাকব কোন দুঃখে? তুমি কি বয়সে আমার চেয়ে বড়ো?

এরপর সত্যি সত্যি বয়সের হিসেব করা হল। তাতে দেখা গেল, অশোক আমার চেয়ে ক-দিনের বড়ো। অথচ আমার ধারণা ছিল আমি ওর থেকে বড়ো। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে দাদামণি ডাকতে হল। দাদামণি ডাকটা আমার বেশ পছন্দ হত। বাঙালিদেরও এ ডাকটা নাকি অত্যন্ত মিষ্টি।

প্রথমদিকে ও আমাকে মিঃ মান্টো ডাকত। কিন্তু দাদামণি ডাকার পর থেকে শুধু মান্টো। অবশ্য শুধু মান্টো’ আমার ভালো লাগত না।

অশোকের বাহুতে এত জোর ছিল যে, সে অনায়াসে জানালার শিক বাঁকা করে ফেলতে পারত। রোজ ঘরে বক্সিং খেলত। শিকারের শখ ছিল। কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ করতে পারত। কিন্তু আমার বড্ড খারাপ লাগত ওর ঘরের অগোছালো ভাব। সাজগোজ বা জাঁকজমকের তেমন কোন খেয়াল ছিল না। ইচ্ছা করলে আসবাবপত্র এটা সেটা নিয়ে সে তার বাড়িকে যথেষ্ট সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে পারত। কিন্তু সেদিকে তার মোটেই খেয়াল ছিল না। যদি কালেভদ্রে কোনো সময় খেয়াল হত, এমন সব পাগলামি করত যা ভাবলে হাসি পায়। একদিন হয়তো ব্রাশ রং আনিয়ে নিজেই ঘরের আসবাবপত্র নীল করতে শুরু করে দিল। হয়তো বা কোনো সোফার পেছনের পদযুগল ভেঙে খাজাঞ্চির টেবিলের মত করে নিত।

সমুদ্রের তীরে এক নোংরা এলাকায় তার বাড়ি ছিল। জানালার গরাদে এসে লবণাক্ত পানির ঝাঁপটা লাগত। সমুদ্রের হাওয়া মন উদাস করে দিত। কিন্তু অশোক সে সম্পর্কে নিরাসক্ত ছিল। বাইরের করিডোরে থাকত তার রেফ্রিজারেটার। তার পাশে এক অ্যালসেশিয়ান কুকুর ঘুমোত। পাশের কামরায় হয়তো ছেলেরা হইচই করছে। এদিকে অশোক হয়তো গোসলখানায় বসে দেয়ালে হিসাব করে দেখছে যে, আজকের রেসে কোন ঘোড়া জিতবে। অথবা সংলাপের খাতা হাতে নিয়ে নিজের অভিনয়ের কথা চিন্তা করছে। অশোক জ্যোতিষশাস্ত্র মায় হাত গণনা জানত। এসব সে তার পিতার কাছ থেকে শিখেছিল। এ সম্পর্কে তার রীতিমতো স্টাডি ছিল। অবসর সময়ে সে তার বন্ধুদের হাত গুণে দেখত। একদিন আমার হাত দেখে বলল, তুমি বিয়ে করেছ?

–কেন, তোমার জানা নেই?

এরপর কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে বলল, হ্যাঁ, জানি, কিন্তু মান্টো একটা সত্য কথা বলবে?– এখনও তো তোমার পুত্র সন্তান হয়নি।

আমি বললাম,–আসলে ব্যাপার কী?

–না, তেমন কিছু নয়। তবে তোমার মতো যাদের হাত তাদের প্রথম সন্তান ছেলে হয়। কিন্তু সে সন্তান বাঁচে না।

আসলে অশোক জানত না যে, আমার এক বছরের এক ছেলে মারা গেছে।

অশোক আমাকে বলল, তারও প্রথম ছেলে হয়েছিল এবং ছেলেটি হয়েছিল মরা। সে আমাকে জানাল তার এবং আমার হাত প্রায় এক রকমের। যাদের হাতের রেখা এ ধরনের তার ঘরে অবশ্যই প্রথম ছেলে হবে এবং হয়ে মরে যাবে।

জ্যোতিষ শাস্ত্র এবং গণনায় অশোক পয়লা নম্বরের ওস্তাদ ছিল। অশোক বলত, যেমন টাকা পয়সার হিসাবে এক পাই-এর হেরফের হলে গোলমাল বেঁধে যায়, জ্যোতিষ শাস্ত্রের গণনার ব্যাপারটা ঠিক তাই। একটু এদিক সেদিক হলে আর হল না।

রেসের জয়-পরাজয়ের ব্যাপারেও অশোক জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস করত। আমার জানা মতে সে একশো টাকার বেশি কোনো দিনই খেলেনি। এবং বড়ো আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেক বারই সে জিতেছে। একেবারে কম পেলেও একশো টাকার ওপর দশ টাকা পেয়েছে। অবশ্য হারজিতের ব্যাপারে তার তেমন মাথাব্যথা দেখিনি। শুধু শখের বশেই রেসের টিকিট কিনত। রেসের সময় তার তিন সন্তানের মা প্রিয়তমা সুন্দরী স্ত্রী শোভাও সঙ্গে থাকতেন। মেম্বার এনক্লোজার-এ ঢুকে এক কোণে বসে পড়তেন। শোভাই টিকিট কিনতেন। তারপর রেস শেষ হলে টাকা তোলার কাজও শোভাই। করতেন।

শোভা একান্তভাবে ঘরোয়া স্বভাবের। পড়ালেখা বেশি জানতেন না। অশোক বলত, পড়ালেখা যা-ই থাকুক আমাদের জীবনটা কিন্তু বেশ।’ এত টাকাপয়সা হওয়া সত্ত্বেও শোভা ঘরের কাজকর্ম নিজ হাতে করতেন। খাঁটি বাঙালি মেয়েদের মতো বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া থেকে আরম্ভ করে ঘরকন্নার সব কাজ নিজে করতেন। সবসময় তার আঁচলের কোনায় চাবির গোছা থাকত। যখন হুইস্কি চলত, আনুষঙ্গিক নানা জিনিস শোভাই পরিবেশন করতেন।

মিসেস মান্টো এবং মিসেস গাঙ্গুলি, পরস্পর সই ছিল। তাদেরকে দিয়ে আমরা অনেক কাজ বাগিয়ে নিতাম। যুদ্ধের দরুন একবার তো সিগারেট আর পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে যা-ই আসত সব ব্ল্যাক-মার্কেটিং হয়ে যেত।

আমরা তখন এই দুই সইকে মার্কেটিং-এ পাঠিয়ে দিতাম। প্রায় দোকানিরাই অশোকের সুবাদে শোভাকে চিনত। এবং নির্বিবাদে তাদেরকে ব্ল্যাকের মাল বের করে দিত। তা ছাড়া এমনিতেও বোষের লোকেরা মেয়েদের ব্যাপারে একটু স্পর্শকাতর ছিল।

অশোক কোনো সময়ই তার খ্যাতির সাহায্যে কাজ বাগাতে চাইত না। অবশ্য অশোকদের সুবাদে অনেকেই অনেক সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকত। এ ব্যাপারে রাজা মেহেদী আলীর একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।

একদিন অশোকের সেক্রেটারি আমাকে ফোনে জানাল যে, রাজা মেহেদী আলী অসুস্থ। গিয়ে দেখলাম সত্যি অসুস্থ। নানা লক্ষণ দেখে আমি ডিপথেরিয়া বলে আশঙ্কা করলাম। তাড়াতাড়ি অশোককে ফোন করে দিলাম। অশোক আমাকে তার এক পরিচিত ডাক্তারের কথা বলে তার কাছে নিয়ে যেতে বলল, আমি তাড়াতাড়ি গাড়ি আনিয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তারও ডিপথেরিয়া বলে সাব্যস্ত করলেন। আমি তাকে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ-পথ্যের বন্দোবস্ত করলাম। পরদিন সকালে আমি আবার অশোককে রাজার অবস্থা জানালাম। কিন্তু অশোক এ ব্যাপারে তেমন ঔৎসুক্য প্রকাশ করল না। আমি রেগে গিয়ে তাকে বেশ কয়েক কথা শোনালাম। সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল “ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যায় যাওয়া যাবে।

আমার ইচ্ছা ছিল না যে, অশোককে আর এ বিষয়ে কোনো কথা বলি। কিন্তু সন্ধ্যার সময় অশোক আমাকে অলির অফিসে এসে পাকড়াও করল। অসুখের আগে রাজা মেহেদী আলী অলির জন্যে একটা কাহিনি লিখেছিল। অশোক হসপিটালে পৌঁছে রাজার কাছে নানা কাজের অজুহাত দেখিয়ে ক্ষমা চাইল।

দ্বিতীয় দিন হসপিটালে পৌঁছে দেখি এলাহি কাণ্ড। রাজার সে অবস্থা আর নেই। রাজা এখন রাজা বনে বসেছে। পরিষ্কার সুন্দর বিছানা। পান সিগারেট আর ফলমূলে টেবিল ভরা। পাশের ফ্লাওয়ার ভাসে নানা রঙের ফুল সাজানো। একান্ত নিবিষ্ট চিত্তে বসে খবরের কাগজ পড়ছে।

আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এ অবস্থা কেন রাজা?

রাজা মুচকি হেসে বলল, এ আর কী দেখছ। পাশের রুমে গিয়ে দ্যাখো কী সব কাণ্ডকারখানা। খোদা বাঁচিয়ে রাখুক আমাদের অশোককে। অশোক এল না কেন?

আসলে গতদিন অশোককে দেখেই সবার চক্ষু চড়কগাছ। অশোকের বিদায়ের পর ছোটো বড়ো সবাই রাজার কাছে এসেছে। তাকে বেশির ভাগ যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তা হল: ‘অশোক কি সত্যি আপনাকে দেখতে এসেছিলেন?

অশোক তার কে হন?

অশোক আবার আসবেন কি?

যদি আসেন কখন আসবেন?

রাজা তাদেরকে অকপটে জানাল যে, অশোক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। অশোক আজ রাতে হসপিটালেই থেকে যেত কিন্তু স্যুটিং আছে বলে থাকতে পারল না।

এসব শুনে আমি ফিরতে উদ্যত হচ্ছি, এমন সময় একদল মেডিকেল কলেজের ছাত্রী অশোকের তালাশে রাজার কামরায় প্রবেশ করল।

নিঃসন্দেহে অশোক প্রতিভাবান অভিনেতা। কিন্তু অশোকের একটা রোগ ছিল। জানাশোনা পরিচিত পরিবেশ ছাড়া সে ভালো অভিনয় করতে পারত না। অপরিচিত লোকদের সঙ্গে পার্ট পড়লে কেমন যেন তার অভিনয় খাপছাড়া হত। অশোকের নিজস্ব একটা গ্রুপ ছিল। চুক্তিপত্রের সময় সে তার গ্রুপকে প্রাধান্য দিত। নিজের গ্রুপের সঙ্গে প্রাণ খুলে অভিনয় করতে পারত। নিজের অভিনয় সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ ছিল সে। যাকে তাকে তার অভিনয়ের কথা জিজ্ঞেস করত।

শিক্ষিত, বিচক্ষণ-তদুপরি বহুকাল বোম্বে টকিজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে অশোক চিত্রশিল্পের প্রায় সব দিকেই ভালো জ্ঞান রাখত। ক্যামেরার খুঁটিনাটি মারপ্যাঁচ জানত। ল্যাবরেটরির পরিস্ফুটন মায় সব রকম টেকনিক্যাল জিনিস তার জানা ছিল। ভালো এডিটিংও করতে পারত। এত কিছু অভিজ্ঞতা ছিল বলেই ফিল্মিস্থানের রায়বাহাদুর চুনীলাল তাকে একটা ছবি পরিচালনা করতে বললেন। অশোক স্বচ্ছন্দেই রাজি হয়ে গেল।

সেকালে ফিল্মিস্থানের প্রচারমূলক ছবি ‘শিকারী’(৩) সবে শেষ হয়েছে। এই সুযোগে আমি ঘরে বসে কয়েক মাসের ছুটি উপভোগ করছিলাম। এরই মধ্যে একদিন সাভাক ওয়াচা বাড়ি এসে উপস্থিত। নানা কথার পর বলল, মান্টো, গাঙ্গুলির জন্যে একটা কাহিনি লিখে দিতে হয়।

আমি তার কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কাহিনি লেখাই তো আমার কাজ। ফিল্মিস্থানে কাহিনি লেখার কাজের জন্যেই তো আমার চাকরি। তা আবার নতুন সুপারিশ করে বলার কী দরকার?

পরে জানলাম, অশোক নিজেই একটা ছবি প্রডিউস করতে চায় এবং তার ইচ্ছা আমি তার জন্যে একটা ভালো কাহিনি লিখি। অশোক নিজে আসেনি তার কারণ হল সে আরও কয়েকজনের থেকে প্লট নিচ্ছে।

অতঃপর এ ব্যাপারে সাভাক ওয়াচার মনোরম ফ্ল্যাটে আমাদের ত্রিরত্নের সম্মেলন হল। অশোক বলল, তা মান্টো, আসলে এমন একটা কাহিনি লিখতে হবে যা খুব হিট করবে। জানো তো এটা আমার পয়লা ছবি।

ওয়াচার ফ্ল্যাটেই আমাদের আড্ডা চলল। কিন্তু কাহিনি কী যে লিখব তার কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। সেকালে আগা খানের ডায়মন্ড জুবিলি হচ্ছিল। সাভাকের ফ্ল্যাটের উলটোদিকে ব্ৰেবোর্ন স্টেডিয়ামে মস্ত বড়ো প্যান্ডেল তৈরি হয়েছে। আমি তা থেকে একটা কিছু প্রেরণা নিতে চেষ্টা করলাম। সাভাকের সিটিং রুমে একটা চমৎকার ভাস্কর্য ছিল। তা থেকেও কিছু খাড়া করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পেলাম না।

সামনে চার্চগেট স্টেশন। নীচে বাজারের চেঁচামেচি। দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। সড়কে দামি গাড়ির আনাগোনা। এর একটু পরেই একটা যন্ত্রদানব সড়ক কাঁপিয়ে কোত্থেকে যেন এসে পড়ল। আমি এ রকম একটা আশঙ্কাই করেছিলাম। জানি না আমার মাথায় কোত্থেকে এসব খেয়াল আসে। ভাবলাম, এমন যদি হয় কোনো মেয়ে একটা চিরকুটে লিখে বাতাসে ছাড়ে এই উদ্দেশ্যে যে, এটা যার কাছে গিয়ে পৌঁছোবে তাকেই সে বিয়ে করবে। আর তা উড়ে এসে যদি আমাদের মধ্যে পড়ে? অথবা সেটা উড়ে গিয়ে যদি কোনো প্যাকার্ড গাড়িতে পড়ে–এমনকি এই সড়ক বিদীর্ণ করা ট্রাক ড্রাইভারের কাছেও যদি পড়ে?

এই ‘যদি এমন হত’র খেয়ালটা আমি ওদেরকে বললাম। অশোক বলল, লেখো না, এটা নিয়েই লেখা আরম্ভ করো।

অতঃপর কাহিনি তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু তাতে সুন্দরীর চিরকুট বা বিদীর্ণ করা ইঞ্জিন–কোনো কিছুই দেওয়া গেল না। কাহিনির পরিণতিতে কিছুটা বিয়োগান্তক ভাব দেখা দিল। কিন্তু অশোক বলল, কমেডি করো। অবশেষে তাই করলাম। কাহিনি অশোকের পছন্দ হল। এরপর সে কাহিনির ছবি তৈরি হয়ে গেল।

একথা হয়তো কারোরই জানা নেই যে, আট দিন’ নামক আরও একখানি ছবি পরিচালনাও অশোকই করছিল। ডি. এন. পাই-এর তাতে এক পাইয়ের কৃতিত্বও ছিল না। সবাই শলাপরামর্শ করে ছবি তৈরি করত। ছবি রিলিজ হবার সময় সবাই মিলে এক জনের নাম দিয়ে দিত। ডি. এন. পাই আসলে একজন এডিটর ছিলেন। কিন্তু কাজকর্মে ভালো ছিলেন।

‘আট দিন’-এর স্যুটিং-এর সময়ই আমি পরিচালক অশোককে আবিষ্কার করি। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হই। প্রতিটি দৃশ্য সে অতি যত্নে গ্রহণ করত। এবং দিনের শেষে বাথরুমে যখন গোসল করতে যেত তখন নখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু পুনরায় ভাবত। এটা তার আজব অভ্যাস ছিল যে, কঠিন থেকে কঠিনতম সমস্যা সে বাথরুমে গিয়ে সমাধান করত।

এ ছবিতে চারজন নতুন মুখ নেওয়া হয়েছিল। তারা হলেন রাজা মেহেদী আলী খান, উপেন্দ্রনাথ আক, মহসীন আবদুল্লা (নায়নার প্রাক্তন স্বামী) এবং আমি হতভাগা। এরপর এস মুখার্জিকেও একটা চরিত্র দেবার কথা ছিল। কিন্তু যথাসময় তিনি সম্মত হলেন না। কারণ, চল্ চলরে নওজোয়ান’-এ ক্যামেরা লাইটের ঝলক সহ্য করতে না পেয়ে আমি কাজ বাদ দিয়েছিলাম। এবং সেটাই এস মুখার্জির বাহানা হল। আসলে সে নিজেও ক্যামেরার আলো সহ্য করতে পারত না। পোশাক-আশাক সব কিছু তৈরি ছিল। কিন্তু যথাসময়ে মুখার্জি বেঁকে বসাতে সব নস্যাৎ হয়ে গেল। কদিন সুটিং বন্ধ ছিল।

একদিন অশোক আমার বাড়ি এসে উপস্থিত। আমি তখন কটা দৃশ্য পুনরায় লিখছিলাম। অশোক আমার লেখার সরঞ্জাম একদিকে সরিয়ে দিয়ে বলল, চলো আমার সঙ্গে।

আমি ভাবছিলাম, নতুন কোনো গান বোধ হয় তৈরি হয়েছে, আমাকে তা শোনাবে। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমাকেই সেটে নিয়ে গিয়ে বলল, সেই পাগলের রোলটা তোমাকে দিয়ে হবে।

আমি আগেই জানতাম এস মুখার্জি এ চরিত্রে অভিনয় করছে না। এ চরিত্রের জন্যে অশোক লোকও পাচ্ছে না। কিন্তু এভাবে যে আমাকে পাকড়াও করবে তা আমি ভুলেও চিন্তা করিনি। আমি বললাম, তুমি পাগল হয়েছ, দাদামণি?’

অশোক বলল, যাই বলল মান্টো, তোমাকে পার্ট নিতেই হবে।’ রাজা মেহেদী আলী এবং উপন্দ্রনাথ তার কথায় সায় দিল। রাজা মেহেদী বলে, পাগলের অভিনয় করলে তোমার ক্ষতিটা কী হবে শুনি?

এরপর আমাকে নিয়ে বেশ মহড়া চলল। দেখতে দেখতে সা’দত হাসান মান্টো আমার, যে অবস্থা হয়েছে তা একমাত্র খোদাই জানেন।

ছবি তৈরির পর দেখা গেল অভিনয় মন্দ হয়নি। সমালোচকরা ভালো সমালোচনা করেছে। আমরা খুব খুশি হলাম। ঠিক করার পরে আরও এ ধরনের নতুন ছবি করব। কিন্তু কালক্রমে তা আর হয়ে ওঠেনি।

সাভাক ওয়াচা আট দিনের স্যুটিং’-এর প্রথম পর্যায়েই মায়ের অসুখের ব্যাপারে লন্ডন চলে গিয়েছিল। দীর্ঘকাল পর যখন সে ফিরে এল তখন চিত্রশিল্পের বেশ উত্থান পতন হয়ে গেছে। অনেক সংস্থাই লালবাতি জ্বালিয়েছে। বোম্বে টকিজের অবস্থাও টলমল। হিমাংশু রায়ের তিরোভাবের পর দেবিকারানি রাশিয়ার এক নিবাসিত নবাবের শিল্পীর পুত্র তোরকের সঙ্গে পরিণয়াবদ্ধ হয়ে চিত্রজগৎ ছেড়ে দিয়েছে। দেবিকারানির পর অনেক মহারথীই বোম্বে টকিজের কর্ণধার হলেন। কিন্তু কেউই বোম্বে টকিজের ভাগ্য ফেরাতে পারলেন না। অবশেষে সাভাক ওয়াচা লন্ডন থেকে ফিরে এসে অশোকের সহযোগিতায় বোম্বে টকিজ নিজের হাতে নিয়ে নিল।

তখন অশোকও ফিল্মিস্থান ছেড়ে দিয়েছে। এ সময় লাহোর থেকে মি. মোতি বি গেরওয়ানী আমাকে মাসিক এক হাজার টাকার অফার দিয়েছিল, আমি চলে যেতাম। কিন্তু সাভাকের অপেক্ষায় আর গেলাম না। তারপর সাভাক এসে বোম্বে টকিজের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলে, আমি তার সঙ্গে থাকলাম। তখন দেশ ভাগাভাগির কাজ প্রায় চূড়ান্ত হয়ে এসেছে। এ সময় চারিদিকে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। এখানে। ওখানে ক্রিকেটের মতো মানুষের মস্তক উড়তে লাগল। এবং যেখানে সেখানে অগ্নিকাণ্ড শুরু হল।

সাভাক ওয়াচা সবে বম্বে টকিজের দুরবস্থা শুধরে নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল। এ সময় তাকে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কতিপয় দুষ্ট হিন্দু স্টাফকে ছাঁটাই করে সে স্থলে যাদের নিয়োগ করল তারা সবাই ছিল মুসলমান। তারা হলেন আমি, শাহেদ লফিত, ইসমত চুঘতাই, কামাল আমরোহী, হাসরাত লাখনুভী, নজীর আজমীরি, নাজেম পানিপথি এবং সংগীত পরিচালক গোলাম হায়দর।

এ ঘটনার পর থেকে পদচ্যুত হিন্দুরা সাভাক এবং অশোকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। আমি এ ব্যাপারে অশোকের মনোযোগ আকর্ষণ করলে সে বলল, দাঁড়াও, আমি সাভাককে বলব। ও সব দমন করে ফেলবে।

কিন্তু দমন করার ফল উলটোভাবে দেখা দিতে লাগল। অনেক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির চিঠি আসতে লাগল সাভাকের নামে। প্রায় চিঠিতেই মুসলমানদেরকে স্টুডিয়ো থেকে বের করে দেবার তাগিদ।

সাভাক এসব চিঠি পড়ে উত্তেজিত হয়ে উঠত এবং বলত, শালারা বলে, আমি নাকি ভুল পথে আছি। আমি ভুল পথে থাকলে শালাদের কী? আগুন যদি লাগে সে আগুনে আমি তাদেরকেই ঠেলে দেব।

অশোক সব সময়ই জাতিগত বিদ্বেষের উর্ধ্বে ছিল। সে এসব কথা ভেবেও দেখত । সে এসব ধমক শুনলে প্রায়শ বলত, মান্টো, এসব হল পাগলামি। আস্তে আস্তে সব কিছু থেমে যাবে।

কিন্তু থেমে যাবার পরিবর্তে পাগলামি নিরন্তর বেড়েই চলল। এ ব্যাপারে আমি নিজেকেই বেশি অপরাধী মনে করলাম। কারণ অশোক এবং সাভাকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। আমি ভাবতাম, আমার কারণে যদি বোম্বে টকিজের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে অশোক এবং সাভাককে কী করে মুখ দেখাব?

চারিদিকে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। পথেঘাটে খুনখারাবি চলছে। এমন সময় আমি এবং অশোক বোম্বে টকিজ থেকে বাসায় ফিরছিলাম। অশোকের বাসায় পৌঁছে ভাবলাম, কী করে আমার বাসায় যাই। কিছুক্ষণ পর অশোক বলল, চলো মান্টো, তোমাকে রেখে আসি। যা হয় হবে।

রাস্তা শর্ট করার জন্যে সে মুসলমান বস্তির ভিতর দিয়ে চলল। সামনে থেকে একটা বিয়ের বারাত আসছিল। আমি যখন তাদের বাজনা শুনলাম অশোকের হাত ধরে কেঁদে বললাম, দাদামণি, এ তুমি কোথায় এলে?’ অশোক আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, চুপ করো কোনো চিন্তা নেই।

আমি কোনো চিন্তা না করেই বা থাকি কী করে? এই মুসলমান বস্তিতে হিন্দু বলতে কোনো লোক নেই। অশোককে কে না চেনে? সবাই জানে অশোক হিন্দু। এবং এত বড়ো হিন্দু যে, যার রক্তপাত করতে পারলে তাদের অস্ত্র সার্থক হবে। আমি আরবি ভাষায় কোনো দোয়া কালাম জানতাম না। মনে মনে আমি নিজেকে অভিসম্পাত দিতে লাগলাম। এবং মনে মনে খোদাকে বলতে লাগলাম, হে খোদা, এমন যেন না হয় যে, মুসলমানরা অশোককে মেরে ফেলবে আর আমি তার রক্ত সারা জীবনভর কাঁধে নিয়ে বহন করব।

গাড়ি যখন বারাতের সামনে এসে ঠেকল অনেকেই অশোক অশোক’ বলে চিৎকার করে উঠল। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। অশোেক নির্বিকার স্টিয়ারিং ধরে বসেছিল। আমি গলা বের করে বলতে যাচ্ছিলাম যে, সাবধান আমি মুসলমান। অশোক আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। এমন সময় দুজন যুবক এসে বলল, অশোকভাই। সামনের রাস্তা বন্ধ। বাঁ দিকের গলি দিয়ে কেটে পড়ুন।

গলি দিয়ে গাড়ি যখন নিরাপদে পার হয়ে গেল। আমার দেহে প্রাণ ফিরে এল। অশোক হেসে বলল, তুমি অযথা ঘাবড়াচ্ছ। আটিস্টদের এরা ভালোবাসে।

এর কিছুদিন পর আমি বম্বে টকিজে নজীর আজমীরির কাহিনির (পরে যা মজবুর নামে চিত্রায়িত হয়) কড়া সমালোচনা করলাম। নজীর আজমীরি অশোক এবং সাভাককে বলল, আপনারা মান্টোকে এই বিতর্কের মধ্যে টানবেন না। সে হল গল্পিকার, সবকিছু গল্পের নিরিখেই সে দেখে।

আমি অনেক চিন্তা করেও এসব কথার তাৎপর্য পেলাম না। মনে মনে বললাম, মান্টো ভাই, সামনের রাস্তা বন্ধ। বাঁ দিকের গলি দিয়ে কেটে পড়ুন।

আমি বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানে চলে এলাম। এখানে এসেও নিস্তার পেলাম না। এখানে আসতেই ঠান্ডা গোস্তের মকদ্দমায় ফেঁসে গেলাম।

১। সময়টা ১৯৩৬। বোম্বে টকিজের গুলারে তৈরি হচ্ছিল ‘জীবন-নাঈয়া’। নায়ক নাজমুল হাসান। নায়িকা দেবিকারানি। পরিচালক ছিলেন ফ্রাঞ্জ অস্টেন। শুটিং চলাকালীন নাজমুল আর দেবিকার মধ্যে বাস্তব প্রেম হয়। দুজনে পালিয়ে যায়।

২। ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিটির পরিচালক ছিলেন দেবকীকুমার বসু। অশোককুমারের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন কাননদেবী। অশোককুমার ছিলেন নামভূমিকায়। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন ছবি বিশ্বাস, ভারতীদেবী। মুমতাজ, শান্তি। ছবিটি ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায়। 

৩। ‘শিকারী’-র পরিচালক সভক বাচ্চা, অন্যান্য ভূমিকায় ভীরা, পায়রা ও কিশোরকুমার, ১৯৪৬-এ মুক্তি পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *