৬০. নিউইয়র্ক এডিটর জোনাস ফকম্যান

অধ্যায় ৬০

নিউইয়র্ক এডিটর জোনাস ফকম্যান তার হোম-অফিস লাইনের রিং শুনে জেগে উঠলো। বিছানায় গড়িয়ে বেডসাইড টেবিলে রাখা ঘড়ির দিকে তাকালো সে : ভোর ৪:২৮।

বই প্রকাশনার জগতে রাতারাতি সাফল্যের মতোই শেষরাতে ফোনকল পাওয়াটা বিরলতম একটি ঘটনা। ভড়কে গেলো ফকম্যান, বিছানা থেকে তড়িঘড়ি উঠে নিজের অফিসে চলে এলো।

“হ্যালো?” ওপাশের ভরাট কণ্ঠটি বেশ পরিচিত। “জোনাস, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি বাসায় আছো। আমি রবার্ট। আশা করি তোমাকে বিরক্ত করি নি।”

“অবশ্যই বিরক্ত করেছো! এখন বাজে ভোর চারটা!”

“দুঃখিত, আমি দেশের বাইরে আছি।”

হারভার্ডে কি টাইম-জোন সম্পর্কে কোনো শিক্ষা দেয়া হয় না?

“আমি একটু সমস্যায় পড়েছি, জোনাস। তোমার সাহায্য চাই।” ল্যাংডনের কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। “তোমার কর্পোরেট নেটজেটস কার্ডটা দরকার আমার।”

“নেটজেটস?” হেসে ফেললো ফকম্যান। “রবার্ট, আমরা পুস্তক প্রকাশক। প্রাইভেট জেট ব্যবহার করা লোক আমরা নই।”

“আমরা দু’জনেই জানি তুমি মিথ্যে বলছো, বন্ধু।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফকমান। “ঠিক আছে। তাহলে সত্যিটা বলি। আমরা ধর্মীয় ইতিহাসের উপর মোটা মোটা বই লেখে যেসব লেখক তাদের জন্য কোননা জেটের ব্যবস্থা করি না। তুমি যদি ফিফটি শেডস অব আইকনোগ্রাফি লিখতে চাও তাহলে অবশ্য এ নিয়ে কথা বলতে পারি।”

“জোনাস, ফ্লাইটের খরচ যাইহোক না কেন আমি দেবো। কথা দিলাম। তুমিই বলো, আমি কি কখনও কোনো কথার বরখেলাপ করেছি?”

তিন বছর ধরে লেখা জমা দেবার যে ডেডলাইন মিস করে যাচ্ছে সেটা বাদ দিয়ে বলবো? যাইহোক, ল্যাংডনের কণ্ঠের তাগাদাটা বুঝতে পারলো সে। “আমাকে বলো তো কি হয়েছে। দেখি তোমাকে সাহায্য করা যায় কিনা।”

“সব কথা খুলে বলার মতো সময় আমার হাতে নেই, তবে আমি চাই তুমি আমাকে এই সাহায্যটা করো। খুবই জরুরি, বন্ধু। জীবন-মরণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

দীর্ঘদিন ল্যাংডনের সাথে কাজ করে ফকম্যান বুঝে গেছে কখন সে ঠাট্টা করে আর কখন সিরিয়াস। এ মুহূর্তে সিম্বোলজিস্টের কণ্ঠে ঠাট্টার লেশমাত্র নেই। বরং সুস্পষ্ট উদ্বেগ টের পাচ্ছে। লোকটা একদম মরিয়া। হাফ ছাড়লো ফম্যান। যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে ফেলেছে। আমার ফিন্যান্স ম্যানেজার আমার মুণ্ডুপাত করবে। ত্রিশ সেকেন্ড পর ল্যাংডনের ফ্লাইট রিকোয়েস্টের ডিটেইল লিখে রাখলো।

“সব ঠিক আছে তো?” তার এডিটরের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ততা আঁচ করতে পেরে জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন। ফ্লাইট রিকোয়েস্টের ডিটেইল শুনে দারুণ অবাক হয়েছে সে।

“হুম। আমি মনে করেছিলাম তুমি আমেরিকাতে আছে,” বললো ফকম্যান। “তুমি যে এখন ইটালিতে আছো এটা শুনে খুব অবাক হয়েছি।”

“শুধু তুমি না, আমি নিজেও অবাক,” বললো ল্যাংডন। “আবারো ধন্যবাদ তোমাকে, জোনাস। আমি এক্ষুণি এয়ারপোর্টে রওনা দিচ্ছি।”

.

নেটজেটসের ইউএস অপারেশন সেন্টারটি ওহাইও’র কলম্বাসে অবস্থিত। সার্বক্ষণিক ফ্লাইট সাপোর্ট টিম নিয়োজিত থাকে সেখানে।

ওনার সার্ভিসেস রিপ্রেজেন্টেটিভ ডেব কিয়ার এইমাত্র নিউইয়র্কের এক কপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে কল পেলো। “এক মিনিট, স্যার, হেডসেটটা ঠিকঠাকমতো লাগিয়ে টাইপ করতে শুরু করলো ভদ্রমহিলা। “টেকনিক্যালি এটা হবে নেটজেটস ইউরোপ ফ্লাইট। তবে আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবো।” দ্রুত পর্তুগালের পাকো দি অ্যাক্রোসে অবস্থিত নেটজেটস ইউরোপ সেন্টারের সাথে কানেক্ট হয়ে জেনে নিলো ইটালিতে তাদের জেটগুলোর বর্তমান অবস্থান।

“ঠিক আছে, সার,” বললো সে, “মোনাকো’তে আমাদের একটি জেট আছে এখন। ওটা এক ঘণ্টার মধ্যে ফ্লোরেন্সে চলে যেতে পারবে। মি: ল্যাংডনের জন্য কি সেটা যথেষ্ট হবে?”

“আশা তো করি হবে,” প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বললো ওপাশ থেকে। তার কণ্ঠে ক্লান্তি আর বিরক্তি। “ওটাই পাঠিয়ে দিন তাহলে।”

“ঠিক আছে, স্যার,” ডেব বললো। “মি: ল্যাংডন জেনেভায় যেতে চাচ্ছেন, তাই না?”

“সেটাই তো বললো।”

ডেব টাইপিং করে নিলো তথ্যটি। “সব ঠিক আছে তাহলে,” অবশেষে বললো সে। “মি: ল্যাংডনকে কনফার্ম করতে হবে লুক্কায় অবস্থিত তাসিয়ানো এফবিও’তে গিয়ে। ফ্লোরেন্স থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে সেটা। ফ্লাইট ছাড়বে স্থানীয় সময় সাড়ে এগারোটায়। এফবিও’তে দশ মিনিট আগে চলে আসতে হবে মি: ল্যাংডনকে। আপনি বলেছেন কোনো গ্রাউন্ড ট্রান্সপোর্টেশন কিংবা ক্যাটারিং সার্ভিসের দরকার হবে না, আর উনার পাসপোর্ট সম্পর্কিত তথ্য আপনি আমাকে দেবেন। আপনার কি আর কিছু দরকার আছে আমার কাছে?”

নতুন একটা চাকরি?” কথাটা বলেই হেসে ফেললো সে। “না। ধন্যবাদ। আপনি অনেক করেছেন।”

“এটাই তো আমাদের কাজ, স্যার। আপনার দিনটা ভালো কাটুক। কলটা শেষ করে মনিটরের দিকে তাকালো ডেব, রিজার্ভেশনের বাকি কাজটুকু সেরে ফেলতে শুরু করলো সে। রবার্ট ল্যাংডনের পাসপোর্টের নাম্বারটি কম্পিউটারে এন্ট্রি করার পরই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। পর্দায় একটা মেসেজ আর রেড অ্যালার্ট লেখা উঠছে। মেসেজটা পড়ে ডেবের চোখ দুটো বিস্ফারিত হবার জোগার হলো যেনো।

নির্ঘাত কোনো ভুল হয়েছে।

আবারো ল্যাংডনের পাসপোর্ট নাম্বারটা এন্ট্রি করলে একই ঘটনা ঘটলো। ল্যাংডন এ পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই ফ্লাইট বুক করার চেষ্টা করুক না কেন ঠিক এই লেখাটাই ভেসে উঠবে।

বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত মনিটরের দিকে চেয়ে রইলো ডেব। সে জানে নেটজেটস তাদের কাস্টমারদের গোপনীয়তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকে। তারপরও এই অ্যালার্টটি তাদের সব ধরণের কপোরেট প্রাইভেসির নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।

ডেব কিয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্য ফোন করলো।

.

এজেন্ট ব্রুডার তার ফোনটা পকেটে রেখে নিজের লোকজনকে দ্রুত ভ্যানে উঠে পড়ার জন্য তাগাদা দিলো। “ল্যাংডন প্রাইভেট জেটে করে জেনেভায় যাচ্ছে, বললো সে। “এক ঘণ্টার মধ্যে লুক্কা’র এফবিও থেকে ফ্লাইটটা ছাড়বে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে সেটা। এক্ষুণি রওনা দিলে ফ্লাইট ছাড়ার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যেতে পারবো।”

.

ঠিক একই সময় ভাড়া করা ফিয়াটে করে ল্যাংডন, সিয়েনা আর ডা: ফেরিস যাচ্ছে ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া নভেল্লা ট্রেনস্টেশনে। ডাক্তার বসেছে ড্রাইভারের পাশে, আর পেছনের সিটে তারা দু’জন।

নেটজেটসের আইডিয়াটা ছিলো সিয়েনার। ভাগ্য ভালো থাকলে এটা বেশ ভালোই বিভ্রান্তি তৈরি করবে, আর তারা নির্বিঘ্নে পৌঁছে যেতে পারবে ট্রেনস্টেশনে। নিঃসন্দেহে এই চালাকিটা না করলে স্টেশনে পুলিশ গিজগিজ করতো। সুখের কথা, এখান থেকে ট্রেনে করে গেলে ভেনিস মাত্র দু’ঘণ্টার পথ। এই ডামেস্টিক ট্রেনে পাসপোর্টও লাগে না।

ল্যাংডন সিয়েনার দিকে তাকালো, মনে হলো সে ডা: ফেরিসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। লোকটার নিশ্চয় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসেরও সমস্যা হচ্ছে ভালোমতো। ঘোৎ ঘোৎ করে শব্দ হচ্ছে নিঃশ্বাস নেবার সময়।

আশা করি সিয়েনার ধারণাই ঠিক হবে, মনে মনে বললো ল্যাংডন। ভদ্রলোকের লালচে দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওখান থেকে জীবাণু ছড়াচ্ছে এই সঙ্কীর্ণ গাড়ির ভেতরে। তার আঙুলের ডগা পর্যন্ত কেমন লালচে হয়ে ফুলে আছে। এই চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ল্যাংডন।

ট্রেনস্টেশনের দিকে যাবার সময় গ্র্যান্ড হোটেল বাগলিওনি অতিক্রম করলো তারা। এখানে প্রায়শই শিল্পকলার উপরে কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর কম করে হলেও একবার এখানে আসে ল্যাংডন। হোটেলটা দেখামাত্র সে বুঝতে পারলো এখন যা করতে যাচ্ছে সেটা এ জীবনে এর আগে কখনও করে নি।

আমি ডেভিড’কে না দেখেই ফ্লোরেন্স ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

মাইকেলাঞ্জেলোর কাছে এজন্যে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিলো, চোখ সরিয়ে সামনের ট্রেনস্টেশনের দিকে তাকালো…সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তাভাবনায় জুড়ে বসলো ভেনিস।

.

অধ্যায় ৬১

ল্যাংডন জেনেভায় যাচ্ছে?

ডা: এলিজাবেথ সিনস্কির মনে হচ্ছে ক্রমাগতভাবেই সে আরো বেশি করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ভ্যানের পেছনের সিটে প্রচণ্ড ঝাঁকির মধ্যে ঘুমের ঘোরে আছে সে। তাদের গাড়িটা এখন ফ্লোরেন্স থেকে পশ্চিমে যাচ্ছে শহরের বাইরের একটি এয়ারফিল্ডের উদ্দেশ্যে।

জেনেভা কেন? ওখানে গিয়ে কী হবে? মনে মনে বললো সিনস্কি।

একটা কারণেই জেনেভা প্রাসঙ্গিক হতে পারে আর সেটা হলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদর দফতর ওখানে অবস্থিত। ল্যাংডন কি আমার খোঁজেই ওখানে যাচ্ছে? সিনস্কি যে ফ্লোরেন্সে আছে সেটা ল্যাংডন ভালো করেই জানে, সুতরাং ওখানে যাওয়াটা একদম অর্থহীন বলেই মনে হচ্ছে।

আরেকটি চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেলো।

হায় ঈশ্বর…জোবরিস্ট কি জেনেভাকে টার্গেট করেছে নাকি?

জোবরিস্ট এমন এক লোক যে সিম্বলিজমের ব্যাপারে অভ্যস্ত আর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদর দফতরকে ‘গ্রাউন্ড জিরো’ বানানোর ব্যাপারে তার ঝোঁক থাকতেই পারে। বিশেষ করে সিনস্কির সাথে বছরব্যাপী তার লড়াইটার কথা বিবেচনা করলে। তারপরও জোবরিস্ট যদি প্লেগের বিস্তারের জন্য জেনেভাকে বেছে নেয় তাহলে সেটা একদম ভুল নির্বাচন হবে। অন্যসব মেট্রোপলিসের তুলনায় এ শহরটি ভৌগলিকভাবে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন এবং বছরের এ সময়টাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে এখন। প্লেগের জন্য সহায়ক হলো ঘনবসতি এলাকা আর উষ্ণ পরিবেশ। জেনেভা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার ফিট উপরে অবস্থিত, মহামারি ছড়ানোর জন্য মোটেও কোনো ভালো জায়গা নয়। জোবরিস্ট আমাকে যতো ঘৃণাই করুক না কেন, এটা সে করতে চাইবে না।

তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়-ল্যাংডন ওখানে কেন যাচ্ছে? গতরাত থেকে এই আমেরিকান প্রফেসরের আচার-আচরণ যেরকম দুর্বোধ্য হতে শুরু করেছে সেই তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছে তার এই জেনেভা মিশন। কঠিন সময়ের মধ্যে নিপতিত হলেও সিনস্কি অনেক চেষ্টা করেছে ভদ্রলোকের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ বের করার জন্য কিন্তু সে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।

সে এখন কার পক্ষ হয়ে কাজ করছে?

মানতেই হবে, সিনস্কি মাত্র কয়েক দিন ধরে ল্যাংডনকে চেনে, তবে সাধারণত মানুষ চিনতে তার ভুল হয় না। তাই রবার্ট ল্যাংডনের মতো একজন মানুষ টাকার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেবে এটা ভাবা কষ্টকরই। কিন্তু সে তো গতরাত থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এখন সে অনেকটাই খলনায়কের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এ শহরে। নাকি জোবরিস্টের কাজকর্মের প্রতি সেও সমর্থন দিয়ে দিয়েছে?

এই চিন্তাটা খুব ভীতিকর ঠেকলো নিজের কাছেই।

না, নিজেকে আশ্বস্ত করলো এবার। আমি তার সুনামের ব্যাপারে বেশ ভালোমতোই অবগত আছি। সে এটা করবে না।

সি-১৩০ ট্রান্সপোর্ট বিমানের ভেতরে দেখা হবার চার রাত আগে ল্যাংডনের সাথে সিনস্কির পরিচয় হয়। এই বিমানটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মোবাইল কো

অর্ডিনেশন সেন্টার হিসেবে কাজ করে।

সাতটার পরে হ্যাঁন্সকম ফিল্ডে বিমানটি অবতরণ করে। জায়গাটা ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজ থেকে মাত্র পনেরো মাইল দূরে। সিনস্কি জানতো না এই নামকরা প্রফেসর ঠিক কেমন মানুষ হবে, যার সাথে এ আগে কেবল ফোনেই যোগাযোগ হয়েছে তার। কিন্তু প্লেনের ভেতরে আসার পর তার সাথে হাসিমুখে পরিচিত হবার পর মানুষটিকে বেশ ভালোই মনে হয়েছিলো।

“আপনি নিশ্চয় ডা: সিনস্কি?” তার সাথে করমর্দন করতে করতে বলেছিলো ল্যাংডন।

“আপনার সাথে দেখা করতে পেরে খুব সম্মানিত বোধ করছি, প্রফেরস।”

“আমিও সম্মানিত বোধ করছি। যা করেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”

ল্যাংডন বেশ লম্বা একজন মানুষ, শহুরে চেহারা, ভরাটকণ্ঠ। যে পোশাকে দেখা করতে এসেছিলো সেটা নিশ্চয় ক্লাসরুমেও পরে থাকে-হারিস টুইড জ্যাকেট, খাকি প্যান্ট আর লোফার-এ থেকে বোঝা যায় ক্যাম্পাসে সবার চোখে পড়তে চায় না ভদ্রলোক। সিনস্কি যতোটা ভেবেছিলো তার চেয়ে অনেক কম বয়স্ক লেগেছিলো তাকে। এলিজাবেথের নিজের বয়সের কথাও মনে পড়ে গেছিলো তখন। আমি প্রায় তার মায়ের বয়সি হবো।

ক্লান্ত একটি হাসি দিয়েছিলো এলিজাবেথ। “এখানে আসার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, প্রফেসর।”

ল্যাংডন কাটখোট্টা সহকারীর দিকে ইশারা করেছিলো তখন, সে-ই তাকে প্লেনে নিয়ে এসেছিলো। “আপনার বন্ধু এ ব্যাপারে আমাকে খুব একটা ভাবার সময়ও দেন নি।”

“দারুণ এজন্যেই তো তাকে আমরা বেতন দিয়ে থাকি।”

“নেকলেসটা চমৎকার, তার নেকলেসের দিকে চেয়ে বলেছিলো সিম্বোলজিস্ট। “লাপিস লাজুলি?”

একটা খাড়া দণ্ড পেচিয়ে থাকা সাপ-তার এই আইকনিক নেকলেসটির দিকে চেয়ে সায় দিয়েছিলো সিনস্কি। “চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিক সিম্বল। আমার ধারণা আপনি এটা চেনেন। এটাকে বলে কডুসিয়াস।”

কিছু একটা বলতে গিয়েও ল্যাংডন বলে নি তখন, বরং ভদ্রভাবে হেসে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেছিলো সে। “আমাকে কেন এখানে ডেকে এনেছেন?”

পাশের একটি কনফারেন্স টেবিলের দিকে ইশারা করে এলিজাবেথ। “প্লিজ, এখানে বসুন। আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো আমি।”

ল্যাংডন বেশ স্বাভাবিকভাবেই টেবিলে বসে পড়ে। এলিজাবেথ লক্ষ্য করে সিক্রেট মিটিংয়ের ব্যাপারে এই প্রফেসর বেশ অভ্যস্ত। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় নি। নিজের ক্ষেত্রে সে বেশ স্বচ্ছন্দ। তবে মনে মনে ভেবেছিলো, যখ জানতে পারবে তাকে কেন এখানে ডেকে আনা হয়েছে তখন এতোটা স্বাভাবিক আর রিলাক্স থাকতে পারবে কিনা।

একটু পরই এলিজাবেথ ল্যাংডনকে সেই জিনিসটা দেখায় যেটা মাত্র চৌদ্দ ঘন্টা আগে ফ্লোরেন্সের এক সেফ-ডিপোজিট থেকে হস্তগত করে পেয়েছিলো।

ছোট্ট নক্সা করা সিলিন্ডারটি দীর্ঘ সময় নিয়ে ল্যাংডন দেখে গেছিলো, তারপর এ ব্যাপারে সংক্ষেপে যা বলেছিলো সেটা এলিজাবেথ আগেই জানতো। এই জিনিসটা প্রাচীনকালে ছাপার কাজে ব্যবহৃত একটি সিলিন্ডার সিল। এটাতে তিনমাথার শয়তানের ভীতিকর একটি ছবি আর একটি শব্দ রয়েছে : saligia।

“saligia হলো,” ল্যাংডন বলেছিলো, “একটি লাতিন নিমোনিক, যা দিয়ে বোঝানো হয়

“সাতটি মহাপাপ, এলিজাবেথ তার কথা শেষ হবার আগেই বলেছিলো। “আরেকটু ভালোভাবে দেখেন।”

“ঠিক আছে…” একটু হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলো ল্যাংডন। “আমাকে এটা দেখানোর কি কোনো কারণ আছে?”

“সত্যি বলতে, আছে।” সিলিন্ডারটি তার হাত থেকে নিয়ে ঝাঁকাতে শুরু করে এলিজাবেথ। ভেতরে থাকা এজিটেটর বলটি ঘরঘর শব্দ করতে থাকে তখন।

এটা দেখে ল্যাংডন আরো হতবুদ্ধি হয়ে যায়। কিন্তু ডাক্তার কী করছে সে কথা জিজ্ঞেস করার আগেই সিলিন্ডারটির একপ্রান্ত দিয়ে আলো বের হতে শুরু করে। এরপর ডা: সিনস্কি সিলিন্ডারটির আলোকিত মুখ প্লেনের দেয়ালে ফেললে সেটা প্রজেক্টরের মতো একটা ছবি প্রক্ষেপ করে সেখানে।

ছবিটা দেখে ল্যাংডন শিস বাজিয়ে ওঠে।

বত্তিচেল্লির ম্যাপ অব হেল,” বলে সে। “দান্তের ইনফার্নোর অনুসরণে এটা আঁকা হয়েছিলো। যদিও আমার ধারণা আপনি ইতিমধ্যেই এটা জেনে গেছেন।”

সায় দেয় এলিজাবেথ। সে আর তার টিম ইন্টারনেট ব্যবহার করে পেইন্টিংটার পরিচয় খুঁজে বের করে। সিনস্কি যখন জানতে পারে এটা বত্তিচেল্লির আঁকা তখন কিছু অবাক হয়েছিলো। কারণ সে জানতো এই শিল্পী তার অনন্য সাধারণ মাস্টারপিস বার্থ অব ভেনাস আর স্প্রিংটাইম-এর জন্য সুপরিচিত। এই দুটি ছবিই সিনস্কির খুব প্রিয়, যদিও ছবি দুটোতে নারীর উর্বরতা আর জীবনের সৃষ্টিকে তুলে ধরা হয়েছে, যা কিনা তার জন্য সুতীব্র এক যাতনার। একজন নারী হিসেবে সন্তান ধারণের অক্ষমতা নিয়ে জীবনযাপন করে সে, যদিও এটা বাদ দিলে তার বাকি জীবন বেশ কর্মময়।

“আমি আশা করছি,” সিনস্কি বলে ওঠে, “আপনি এই ছবিতে যে লুকায়িত সিম্বোলিজম আছে সে ব্যাপারে কথা বলবেন।”

ল্যাংডনকে একটু বিরক্ত হতে দেখা গিয়েছিলো তখন। এজন্যে আপনি আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন? আমাকে বলা হয়েছে ব্যাপারটা নাকি খুবই জরুরি।”

“অবশ্যই জরুরি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাংডন। “ডা: সিনস্কি, আপনি যদি নির্দিষ্ট কোনো পেইন্টিং সম্পর্কে জানতে চান তাহলে ঐ পেইন্টিংটা যে জাদুঘরে রাখা আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। এই ছবিটার বেলায় আপনাকে অবশ্য ভ্যাটিকানের বিবলিওটেকা অ্যাপোস্টোলিকায় যোগাযোগ করতে হবে। ভ্যাটিকানে কিন্তু বেশ ভালোমানের কয়েকজন আইকনোগ্রাফার্স আছে যারা

“ভ্যাটিকান আমাকে ঘৃণা করে।”

চমকে ওঠে ল্যাংডন। “আপনাকেও? আরে, আমি তো মনে করতাম একমাত্র আমাকেই ওরা ঘৃণা করে।”

সিনস্কি হেসে ফেলে এ কথা শুনে। “বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী, বিশেষ করে কনডমের সহজলভ্যতা বিশ্বস্বাস্থ্যের পক্ষে বিরাট ভূমিকা পালন করবে-এরফলে একদিকে যেমন এইডসের মতো যৌনবাহিত রোগের বিস্তার কমে আসবে তেমনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও দারুণ কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।

“কিন্তু ভ্যাটিকান অন্যরকম ভাবে।”

“ঠিক। তারা তৃতীয়বিশ্বে প্রচুর টাকা খরচ করে কনডমসহ জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে থাকে। ধর্মভীরু লোকজনকে বুঝিয়ে থাকে এটা শয়তানি কাজ।”

“হ্যাঁ, সেটা তারা করে,” হেসে বলেছিলো ল্যাংডন। “একদল আশিঊর্ধ্ব চিরকুমার পাদ্রিদের চেয়ে আর কে ভালো বলতে পারে কিভাবে সেক্স করতে হয়?”

প্রতি মুহূর্তে প্রফেসর লোকটিকে সিনস্কির ভালো লাগতে শুরু করে।

সিলিন্ডারটি ঝাঁকিয়ে রিচার্জ করে দেয়ালে আবারো ছবিটা প্রজেক্ট করে ডাক্তার।

“প্রফেসর, একটু ভালো করে দেখুন।”

ছবিটার দিকে হেঁটে গিয়ে সামনে থেকে ভালোভাবে দেখে নেয় ল্যাংডন। আচমকা থমকে দাঁড়ায় সে। “অদ্ভুত তো। এটা একটু বদলে ফেলা হয়েছে।”

ব্যাপারটা ধরতে সে খুব বেশি দেরি করে নি। “হ্যাঁ, সেটাই। আমি চাই আপনি আমাকে বলবেন এই বদলে ফেলার মানেটা কি।”

চুপ মেরে যায় ল্যাংডন। পুরো ছবিটা আরো ভালো করে দেখে সে। catrovacer শব্দের দশটি অক্ষর…প্লেগ মুখোশ…আর বর্ডারের দিকে লেখা মৃতের চোখ’ বিষয়ক অদ্ভুত একটি উক্তির দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে নেয়।

“এটা কে করেছে?” জানতে চায় ল্যাংডন। “এটা কোত্থেকে পেয়েছেন?”

“সত্যি কথা হলো, এ সম্পর্কে যতো কম জানবেন ততোই আপনার জন্য ভালো। আমি আশা করছি আপনি এই বদলে ফেলার ব্যাপারটা কেন করা হয়েছে, এর কি মানে থাকতে পারে সেটা খুঁজে বের করবেন।” এককোণে ডেস্কের দিকে ইঙ্গিত করে সে।

“এখানে? এখনই?”

সায় দেয় ডাক্তার। “আমি জানি এভাবে চাপিয়ে দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাদের জন্য কতো জরুরি সেটা বলে বোঝাতে পারবো না আপনাকে।” একটু থামে সে। “এটা জীবন-মরণের ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে।”

চিন্তিত মুখে ল্যাংডন তার দিকে তাকায়। “এটার অর্থ বের করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। কিন্তু আমি বলবো, এই ব্যাপারটা যদি আপনাদের কাছে এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে-”

“ধন্যবাদ আপনাকে,” কথা শেষ হবার আগেই বাধা দিয়ে বলে সিনস্কি। “আপনি কি কাউকে ফোন করতে চাইছেন?”

মাথা ঝাঁকিয়ে ল্যাংডন তাকে জানায় পুরো উইকএন্ড সে একা আর নিরিবিলি, কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা করছে।

দারুণ। প্রজেক্টর, কাগজ, পেন্সিল আর ল্যাপটপ, সেইসাথে সিকিউর ইন্টারনেট লাইন দিয়ে সিনস্কি তাকে বসিয়ে দেয়। ল্যাংডন ভেবে পাচ্ছিলো না বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কেন বত্তিচেল্লির একটি মোডিফাই করা পেইন্টিং নিয়ে উঠেপড়ে লাগবে।

ডা: সিনস্কি ভেবেছিলো এসবের মর্মোদ্ধার করতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে তাই সেই ফাঁকে নিজের কিছু কাজ সেরে নিতে শুরু করে। কাজের ফাঁকে উঁকি মেরে দেখে প্রফেসর ছোট্ট প্রজেক্টরটি ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে ছবিটা প্রজেক্ট করে দেখে নিচ্ছে আর নোটপ্যাডে কিছু টুকে রাখছে। দশ মিনিট পর ল্যাংডন পেন্সিল NICO 0034 961, “Cerca trova 1”

তার দিকে চেয়ে সিনস্কি বলে, “কি?”

“Cerca trova,” আবারো বলে সে। “খোঁজো, তাহলেই তুমি পাবে। কোডটা এ কথাই বলছে।”

এরপর সিনস্কিকে বিস্তারিত বলে যায় ল্যাংডন, কিভাবে দান্তের ইনফার্নোর স্তরগুলো এলোমেলো করে দেয়া হয়েছে, আর সেগুলো ঠিক করার পর প্রতিটি স্তরে যে অক্ষরগুলো আছে সেসব মেলালে ইতালিয়ান Cerca trova পদবাচ্যটি পাওয়া যায়।

খুঁজলেই পাবে? অবাক হয়ে বলেছিলো সিনস্কি। আমাকে ঐ বদ্ধ উন্মাদ এই মেসেজ দিতে চেয়েছে? পদবাচ্যটি শুনে তো সরাসরি চ্যালেঞ্জের মতো মনে হচ্ছে। মাথানষ্ট ঐ লোকটি কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের অফিসে তাকে শেষ যে কথাটা বলেছিলো সেটা মনে পড়ে যায় তার : তাহলে ধরে নিন আমাদের নৃত্য শুরু হয়ে গেছে।

“আপনার মুখ তো দেখি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, তাকে দেখে বলেছিলো ল্যাংডন। মনে হচ্ছে আপনি এরকম কোনো মেসেজের কথা আশা করেন নি?”

সিনস্কি নিজেকে গুছিয়ে নেয় তখন। “ঠিক তা নয়। “আমাকে বলুন…আপনি কি বিশ্বাস করেন নরকের এই ম্যাপটি আমাকে কিছু খোঁজার কথা বলছে?”

“হ্যাঁ। Cerca trova।”

“এটা কি বলছে আমি কোথায় খুঁজবো?”

কথাটা শুনে গাল চুলকে নিয়েছিলো ল্যাংডন। আর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বাকি কর্মকর্তারা উদগ্রীব হয়ে জড়ো হয়েছিলো তার চারপাশে। “সরাসরিভাবে বলা নেই…তবে আমার মনে হয় আমি ধরতে পেরেছি, কোত্থেকে আপনি এটা শুরু করতে পারেন।”

“বলুন আমাকে,” বলেছিলো সিনস্কি। তার কথাটার মধ্যে বেশ তাড়া ছিলো।

“উমম…ধরুন, ইটালির ফ্লোরেন্স?”

সিনস্কির চোয়াল শক্ত হয়ে যায় কথাটা শুনে। অনেক কষ্টে নিজের প্রতিক্রিয়া লুকায় সে। তবে তার স্টাফরা নিজেদেরকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। তারা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে শুরু করে দেয়। একজন ফোন হাতে নিয়ে কল করে। আরেকজন প্লেনের সামনের দরজার দিকে ছুটে যায়।

ল্যাংডন এসব দেখে যারপরনাই বিস্মিত। “আমার কথা শুনে কি এসব হচ্ছে?”

অবশ্যই, মনে মনে বলেছিলো সিনস্কি। “কি কারণে ফ্লোরেন্সের কথা বললেন?”

“Cerca trova,” বলেছিলো সে। এরপর দ্রুত ব্যাখ্যা করতে শুরু করে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে ভাসারির ফ্রেসকো নিয়ে যে রহস্যটি আছে।

তাহলে ফ্লোরেন্সেই, যথেষ্ট শুনেছে, আর শোনার দরকার নেই সিনস্কির। তার শত্রু যে পালাজ্জো ভেচ্চিও’র কাছাকাছি একটি উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে সেটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়।

“প্রফেসর,” সে বলেছিলো, “আমি যখন আমার নেকলেসটিকে কডুসিয়াস হিসেবে উল্লেখ করলাম তখন আপনি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেছিলেন। আপনি তখন কি বলতে চাচ্ছিলেন?”

মাথা ঝাঁকালো ল্যাংডন। “তেমন কিছু না। একেবারেই সামান্য একটি ব্যাপার। কখনও কখনও আমার শিক্ষকসত্তা একটু বেশি জ্ঞান দেবার চেষ্টা করে।”

সিনস্কি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। “আমি জানতে চাচ্ছি কারণ আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই। আপনি কি বলতে চাচ্ছিলেন তখন?”

ঢোক গিলে গলা খাকারি দেয় ল্যাংডন। “এটা এমন কিছু না। আপনি বললেন আপনার নেকলেসটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রাচীন একটি সিম্বল, এটা সত্যি। কিন্তু আপনি যখন বললেন এটার নাম কডুসিয়াস তখন আসলে ঠিক বলেন নি। কডুসিয়াসে একটি দণ্ডে দুটো সাপ পেচিয়ে থাকে, আর সেই দণ্ডের উপরে থাকে একজোড়া ডানা। আপনারটায় একটামাত্র সাপ, কোনো ডানাও নেই। এটাকে বলে

“রড অব আসক্লিপিয়াস।”

ল্যাংডন একটু অবাকই হয়েছিলো। “হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন।”

“আমি জানি। আমি আসলে আপনার সত্যবাদীতা পরীক্ষা করে দেখছিলাম।”

“কী বললেন?”

“আমি চেয়েছিলাম আপনি আমাকে সত্য কথাটাই বলবেন, সেটা যতো অস্বস্তিকরই হোক না কেন।”

“মনে হচ্ছে পরীক্ষায় আমি ফেল করেছি।”

“এটা আর করবেন না। পুরোপুরি সততা ছাড়া আমি আর আপনি এই কাজটা একসাথে করতে পারবো না।”

“একসাথে কাজ করবো মানে? আমার কাজ কি এখনও শেষ হয়ে যায় নি?”

“না, প্রফেসর। আমাদের কাজ মোটেও শেষ হয় নি। আমি চাই আপনি ফ্লোরেন্সে এসে একটা জিনিস খুঁজে পেতে সাহায্য করবেন।”

অবিশ্বাসে চেয়ে থাকে ল্যাংডন। “আজরাতে?”

“বলতে বাধ্য হচ্ছি, আজরাতেই। আমি এখনও আপনাকে আসল সঙ্কটটার কথা বলি নি।”

মাথা ঝাঁকায় ল্যাংডন। “আপনি কি বললেন না বললেন তাতে কিছু যায় আসে না। এ মুহূর্তে ফ্লোরেন্সে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

“আমারও নেই,” তিক্তমুখে বলে সিনস্কি। “কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।”

.

অধ্যায় ৬২

দুপুরের প্রখর সূর্যের আলোয় ইটালির উচ্চগতিসম্পন্ন ফ্রেশ্চিয়ার্জেন্তো ট্রেনের ছাদ চক চক করছে। ওটা ছুটে চলেছে টুসকান গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে। ফ্লোরেন্স থেকে ঘণ্টায় ১৭৪ মাইল বেগে ছুটে চললেও “সিলভার অ্যারো’ ট্রেনের ভেতরে তেমন একটা নয়েজ হচ্ছে না।

রবার্ট ল্যাংডনের কাছে বিগত কয়েকটি ঘণ্টা ঘোরের মতোই কেটেছে।

এখন হাই-স্পিড ট্রেনের একটি প্রাইভেট কম্পার্টমেন্টে বসে আছে ল্যাংডন, সিয়েনা আর ডা: ফেরিস। এই কম্পার্টমেন্টে রয়েছে চারটি সিট, একটি ফোল্ডিং টেবিল। ফেরিস তার ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করে এই কম্পার্টমেন্টটি নিয়েছে, সেইসাথে কিছু স্যান্ডউইচ আর মিনারেল ওয়াটার। ল্যাংডন আর সিয়েনা পাশের ক্লিনিংরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে সেগুলো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলেছে।

তারা তিনজন ভেনিসের পথে দু’ঘণ্টার ভ্রমণের জন্য আরাম করে বসতেই ডা: ফেরিস নজর দিলো দান্তের মৃত্যু-মুখোশের দিকে। “আমাদেরকে বের করতে হবে এই মুখোশটি ভেনিসের কোথায় নিয়ে যায় আমাদেরকে।”

“আর সেটা করতে হবে দ্রুত,” যোগ করলো সিয়েনা। তার কণ্ঠে তাড়া। “জোবরিস্টের প্লেগ থেকে রক্ষা পেতে হলে এটাই সম্ভবত আমাদের একমাত্র আশা-ভরসা।”

“দাঁড়ান,” মুখোশের উপর হাত রেখে বললো ল্যাংডন। “আপনি বলেছিলেন ট্রেনে ওঠার পর বিগত কয়েকদিনে কি ঘটেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি শুধু জানি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আমাকে কেমব্রিজ থেকে রিক্রুট করেছিলো জোরিস্টের লা মাপ্পা ভার্সনটির মর্মোদ্ধার করা জন্য। এছাড়া আপনি তো আর কিছু বলেন নি।”

ডা: ফেরিস অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলো যেনো। আবারো চুলকাতে শুরু করলো ঘাড়ে আর কাঁধে। “আমি তোমার হতাশাটা বুঝতে পারছি,” বললো সে। “আমি জানি, কি ঘটেছে সেটা মনে করতে না পারাটা খুবই পীড়াদায়ক ব্যাপার। কিন্তু মেডিকেলের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে বলতে হয়…” সিয়েনার দিকে তাকালো সে, যেনো তার কাছ থেকে সম্মতি চাচ্ছে। “যেসব কথা তোমার মনে। পড়ছে না সেসব জোর করে মনে করার চেষ্টা কোরো না। অ্যামনেসিয়ার রোগিদের জন্য এটাই মঙ্গলজনক। ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো ভুলে থাকাই ভালো।”

“ভুলে থাকবো?!” ল্যাংডন টের পেলো তার মধ্যে রাগের বহিপ্রকাশ ঘটছে। “কি বলেন না বলেন! আমি কিছু প্রশ্নের জবাব চাই! আপনার সংস্থা আমাকে ইটালিতে নিয়ে এসেছে, এখানে এসে আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি, দু’তিনদিনের সব ঘটনা ভুলে বসে আছি! আর আমি জানতে চাইবো না এসব কিভাবে ঘটলো!”

“রবার্ট,” সিয়েনা আস্তে করে ঢুকে পড়লো কথার মধ্যে। চেষ্টা করলো উত্তেজিত প্রফেসরকে শান্ত করার। “ডা: ফেরিস ঠিকই বলেছেন। এভাবে বিস্মৃত ঘটনাগুলো একসঙ্গে শোনাটা তোমার জন্য ভালো নাও হতে পারে। তুমি যে বিচ্ছিন্ন কিছু দৃশ্য চোখের সামনে দেখো সেটার কথা ভাবো-সাদা-চুলের মহিলা, ‘খুঁজলেই পাবে, লা মাল্লার দোমড়ানো মোচড়ানো মানবদেহের ছবি-এগুলো এলোমেলো আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে তোমার স্মৃতিতে চলে এসেছে। এখন যদি ডা: ফেরিস বিগত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলা শুরু করেন তাহলে তোমার অন্য স্মৃতিগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে পারে, আবারো শুরু হয়ে যেতে পারে হেলুসিনেশন। রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়া খুবই সিরিয়াস একটি কন্ডিশন। ভুলে যাওয়া স্মৃতি কষ্ট করে মনে করার চেষ্টা করলে মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।”

এ চিন্তাটা ল্যাংডনের মাথায় আসে নি।

“তুমি অবশ্যই অস্বস্তির মধ্যে আছো, এক ধরণের ঘোরের মধ্যে আর কি,” ফেরিস বললো, “কিন্তু এ মুহূর্তে আমরা চাইবো তোমার মানসিক অবস্থা যেনো অটুট থাকে যাতে করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। এখন সবচেয়ে বেশি দরকার এই মুখোশটি আমাদের কি বলে সেটা খুঁজে বের করা।”

সিয়েনা সায় দিলো।

ল্যাংডন চুপচাপ বসে রইলো। অনিশ্চিত এক অনুভূতিতে আক্রান্ত সে। চেষ্টা করলো সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য। যে মানুষটিকে চিনতে পারছে না সেই মানুষটিকে আসলে বিগত কয়েক দিন ধরে চিনতো, এই অনুভূতিটা অদ্ভুতই বটে। কিন্তু কথা হলো, মনে মনে বললো ল্যাংডন। লোকটার চোখ দুটো কেমনজানি চেনা চেনা লাগছে।

“প্রফেসর, সহমর্মিতার সুরে বললো ফেলিস, “আমি বুঝতে পারছি আমাকে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে তোমার। আমিও ব্যাপারটা বুঝি। যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে তুমি গেছো সেটা বিবেচনায় নিলে এটা বুঝতে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। তাছাড়া, অ্যামনেশিয়ার একটি কমন সাইড-অ্যাফেক্ট হলো অল্পবিস্তর প্যারানইয়া আর অবিশ্বাস জন্মানো।”

এটা বোধগম্য, ভাবলো ল্যাংডন, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, আমি আমার নিজের মনকেও বিশ্বাস করতে পারছি না।

“প্যারানইয়ার কথা যখন এলোই তখন বলি,” সিয়েনা একটু ঠাট্টারছলে বললো পরিবেশ হালকা করার জন্য। রবার্ট আপনার লালচে দাগগুলো দেখে আশংকা করেছিলো আপনি প্লেগে আক্রান্ত।”

ফেরিসের ফোলা ফোলা চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেলো যেনো, অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। “এই দাগগুলো দেখে? প্রফেসর, আমি যদি সত্যি প্লেগে আক্রান্ত হতাম তাহলে সামান্য অ্যান্টিথিস্টামিন দিয়ে চিকিৎসা করতাম না।” পকেট থেকে ছোট্ট একটি টিউব বের করে আনলো সে। ল্যাংডনের দিকে ঠেলে দিলো সেটা। এরইমধ্যে অর্ধেক ব্যবহার করা হয়ে গেছে। টিউবটা দেখলো প্রফেসর। এটা চামড়ার অ্যালার্জি নিরাময়ের একটি ক্রিম।

“এই ব্যাপারটার জন্য আমি দুঃখিত,” বললো ল্যাংডন। নিজেকে বোকা বোকা লাগলো তার। “খুব ধকল গেছে আমার উপর দিয়ে।”

“এ নিয়ে এতো চিন্তার কিছু নেই,” বললো ফেরিস।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ল্যাংডন। ইটালির গ্রামীণ জনপদ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেনটি। আপেন্নাইন পর্বতের পাদদেশে ভিনিয়ার্ড চাষীরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। পাহাড়ি পথ বেয়ে তাদের ট্রেনটি এখন গতি বাড়িয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করলো। পথের পূর্বদিকে দেখা যাচ্ছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর।

আমি ভেনিসে যাচ্ছি, ভাবলো সে। একটা প্লেগ খুঁজে বের করার জন্য।

এই অদ্ভুত দিনটি ল্যাংডনের মনে এমন এক অনুভূতির জন্ম দিলো যেনো এমন এক ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যার নির্দিষ্ট কোনো আকার-আকৃতি কিংবা ডিটেইলও নেই। অনেকটা স্বপ্নের মতো। পরিহাসের ব্যাপার হলো দুঃস্বপ্ন মানুষকে জাগিয়ে তোলে…ল্যাংডনের মনে হলো সে যদি এরকম একটি দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠতো।

“কি ভাবছো?” তার পাশে বসা সিয়েনা নীচুস্বরে বললো।

মেয়েটার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো সে। “ভাবছি, ঘুম থেকে জেগে উঠে যদি দেখতাম এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলেই বোধহয় বেশি ভালো হতো।”

সিয়েনা মুখ টিপে হাসলো শুধু। “তুমি যদি ঘুম থেকে উঠে দেখতে এসব নিছক স্বপ্ন ছিলো, আর আমি মোটেও কোনো সত্যিকারের চরিত্র ছিলাম না। তাহলে তুমি নিশ্চয় আমাকে মিস করতে না?”

আবারো হাসলো ল্যাংডন। “আসলে একটু আধটু করতাম।”

তার হাটুতে আলতো করে চাপড় মারলো সে। “দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করে কাজে নেমে পড়ো, প্রফেসর।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ল্যাংডন দান্তের মুখের দিকে তাকালো। টেবিলের উপর থেকে সেটা যেনো তার দিকেই শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মুখোশটি হাতে নিয়ে পেছনের লেখাগুলো দেখলো সে :

ওহে, অসাধারণ মেধার অধিকারী…

ল্যাংডনের সন্দেহ হলো আসলেই সে এরকম কিছু কিনা।

যাইহোক, কাজে লেগে গেলো সে।

.

চলন্ত ট্রেন থেকে দুশো মাইল দূরে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপর নোঙর করে আছে মেন্দাসিয়াম। নীচের ডেস্কে বসে ফ্যাসিলিটেটর লরেন্স নোলন তার কাঁচের কিউবিকলে টোকা মারার শব্দ শুনতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে ডেস্কের নীচে বোতাম টিপে অস্বচ্ছ কাঁচটাকে স্বচ্ছ করে তুললো সে। বাইরে ছেটোটো একটি অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।

প্রভোস্ট।

তার চোখেমুখে তিক্ততা ছড়িয়ে আছে।

কোনো কথা না বলে ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সুইচ টিপে কিউবিকলের দেয়াল আবারো অস্বচ্ছ করে দিলো। তার মুখ থেকে মদের গন্ধ

আসছে।

“জোবরিস্টের ভিডিওটা,” বললো প্রভোস্ট।

“জি, স্যার?”

“আমি সেটা দেখতে চাই। এক্ষুণি।”

.

অধ্যায় ৬৩

মৃত্যু-মুখোশের পেছনে যে লেখাগুলো আছে সেগুলো একটা কাগজে লিখে ফেলেছে রবার্ট লাংডন যাতে করে আরো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। ডা: ফেরিস আর সিয়েনা তার দু’পাশে বসে কাগজটার দিকে ঝুঁকে আছে, ফেরিসের হাসফাস করে নিঃশ্বাস নেয়া আর মুখের লালচে দাগগুলো ভুলে থাকার চেষ্টা করলো লাংডন।

ভদ্রলোক ঠিকই আছে, নিজেকে বললো লাংডন। চোখের সামনে যে পংক্তিগুলো আছে জোর করে সেদিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলো।

ওহে, অসাধারণ মেধার অধিকারী…
অস্পষ্ট সব পংক্তির আড়ালে…
যা লুকিয়ে আছে তা শিখে নাও।

“আমি একটু আগেই বলেছিলাম,” বলতে শুরু করলো ল্যাংডন, “জোবরিস্টের কবিতার শুরুর পংক্তিটি নেয়া হয়েছে হুবহু দান্তের ইনফার্নো থেকে-পাঠককে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই শব্দগুলোর আরো গভীর অর্থ রয়েছে বলে।”

দান্তের অ্যালিগোরিক্যাল সৃষ্টিকর্ম ধর্ম, রাজনীতি আর দর্শনের উপর প্রহেলিকাময় বর্ণনায় এতোটাই সমৃদ্ধ যে নিজের ছাত্রদের সে প্রায় বলে থাকে তারা যেনো এই ইটালিয়ান কবির সৃষ্টিকর্মকে বাইবেলের মতোই পড়ে-প্রতিটি শব্দ আর বক্তব্যের নিহিতার্থ বুঝে।

“মধ্যযুগের অ্যালিগোরি পণ্ডিতেরা,” ল্যাংডন বলতে শুরু করলো, “সাধারণত তাদের বিশ্লেষণগুলো দুই ধরণের ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করতেন-টেক্সট’ আর ‘ইমেজ, টেক্সট মানে লেখা, আর ইমেজ হলো প্রতীকি মেসেজ।”

“ঠিক আছে,” উদগ্রীব হয়ে বললো ফেরিস। “তাহলে এই কবিতাটি এই লাইন দিয়ে শুরু হয়েছে।”

“নির্দেশ করা হয়েছে, তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো সিয়েনা, “এটা, ভালোমতো পাঠ না করলে শুধু গল্পটাই আমরা জানতে পারবো। সত্যিকারের অর্থটা জানতে পারবো না, যা লুকিয়ে আছে লেখাটার মধ্যে।”

“হ্যাঁ, সেরকমই কিছু।” লেখাটার দিকে আবার তাকালো ল্যাংডন। এবার জোরে জোরে পড়তে লাগলো।

ভেনিসের বিশ্বাসঘাতক ডওজ’কে খোঁজো…
যে কেটেছে ঘোড়ার মাথা…
আর তুলে এনেছে অন্ধের কঙ্কাল।

“তো,” ল্যাংডন বললো, “আমি মাথাবিহীন ঘোড়া আর অন্ধের কঙ্কালের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, তবে মনে হচ্ছে আমাদেরকে নির্দিষ্ট একজন উওজ’কে খুঁজে বের করতে হবে।”

“আমি ধরে নিলাম…একজন উওজ-এর কবর?” বললো সিয়েনা।

“কিংবা মূর্তি, ছবি?” ল্যাংডন তাকে বললো। “কয়েক শ’ বছর ধরে ওখানে কোনো ডওজ নেই।”

ভেনিসের উওজ হলো ইটালির অন্যান্য শহরের ডিউকের সমতুল্য পদবী, আর হাজার বছরের ইতিহাসে কম করে হলেও কয়েক শ’ ডজ শাসন করেছে ভেনিস। এর শুরু ৬৯৭ খৃস্টাব্দ থেকে। তাদের এই ধারা শেষ হয়ে যায় আঠারো শতকে নেপোলিওনের বিজয়ের পর। কিন্তু তাদের ক্ষমতা আর মহিমা এখনও ইতিহাসবিদদের আগ্রহের বিষয় হয়ে আছে।

“আপনারা হয়তো জানেন,” বললো ল্যাংডন, “ভেনিসের দুটো আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হলো উওজ-এর প্রাসাদ এবং সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকা-এ দুটো স্থাপনাই ডওজ’রা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে নির্মাণ করেছিলো। তাদের অনেককে ওখানেই সমাহিত করা হয়।”

“তুমি কি এমন কোনো উওজ’কে চেনো,” কবিতার দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলো সিয়েনা, “যাকে বিপজ্জনক মনে করা হতো?”

লাইনটার দিকে তাকালো ল্যাংডন। ভেনিসের বিশ্বাসঘাতক ডওজ’কে খোঁজো। “এরকম কাউকে চিনি না। তবে কবিতায় কিন্তু ‘বিপজ্জনক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় নি। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি। এ দুয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অন্ততপক্ষে দান্তের কাব্যিক দুনিয়ায়। মনে রেখো, বিশ্বাসঘাতকতা হলো সাতটি মহাপাপের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পাপ। এই পাপের পাপীদের শাস্তি দেয়া হয় নরকের নবম, মানে শেষ চক্রে।”

বিশ্বাসঘাতকতাকে দান্তে প্রিয়জনের সাথে বেঈমানি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ইতিহাসের সবচাইতে কুখ্যাত উদাহরণ হলো জিশুর সাথে জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতাটি। দান্তে এটাকে এতোটাই জঘন্য হিসেবে দেখেছেন যে ইনফার্নোর একটি এলাকার নাম দিয়েছেন জুডিচ্চা।

“ঠিক আছে,” বললো ফেরিস, “তাহলে আমরা এমন একজন ডজ-এর খোঁজ করবো যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো।

সায় দিলো সিয়েনা। তাহলে সম্ভাব্য তালিকাটি একটু ছোটো হয়ে আসবে। আমাদের কাজও সহজ হবে কিছুটা।” একটু থেমে লেখাটার দিকে তাকালো। “কিন্তু পরের লাইনটা…এমন একজন ডজ যে ঘোড়ার মাথা কেটেছে?” ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে। “এমন কোনো ডওজ কি আছে যে ঘোড়ার মাথা কেটেছিলো?”

সিয়েনার কথায় তার চোখে গডফাদার ছবির সেই ভয়াল দৃশ্যটি ভেসে উঠলো। “এরকম কিছুর কথা মনে পড়ছে না। কিন্তু এই যে এটা, আর তুলে এনেছে অন্ধের কঙ্কাল। “ ফেরিসের দিকে তাকালো সে। “আপনার ফোনে ইন্টারনেট আছে না?”

ফেরিস তার ফোনটা ল্যাংডনের হাতে তুলে দিলো। “আঙুলের যা অবস্থা এটার বাটন টেপাটেপি করাটা আমার জন্য কষ্টকর এখন।”

“আমাকে দিন,” ফোনটা সিয়েনা নিয়ে নিলো। “আমি ভেনিসের উওজ, মাথাবিহীন ঘোড়া আর অন্ধদের কঙ্কাল। সম্পর্কে সার্চ করে দেখি।” কথাটা বলেই সে টাইপ করতে শুরু করলো।

কবিতাটার দিকে আরো একবার তাকিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগলো ল্যাংডন।

পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মউজিওনে হাটু গেঁড়ে
মেঝেতে কান পেতে শোনো
গড়িয়ে পড়া পানির শব্দ।

“আমি কখনও মউজিওন বলে কেননা কিছুর কথা শুনি নি,” বললো ফেরিস।

“এটা খুবই প্রাচীন একটি শব্দ যার অর্থ মন্দির, মিউজরা পাহারা দেয় এমন একটি মন্দির আর কি,” জবাব দিলো ল্যাংডন। “প্রাচীন গ্রিকের শুরুর দিকে মওজিওন-এ আলোকিত সব লোকজন জমায়েত হতো নিজেদের আইডিয়া নিয়ে কথা বলতো, আলাপ আলোচনা করতো সাহিত্য, সঙ্গিত আর শিল্পকলা নিয়ে। আলেকজান্দ্রিয়ার লইব্রেরিতে প্রথম মওজিওন নির্মাণ করেছিলেন টলেমি, সেটা খৃস্টের জন্মের কয়েক শ’ বছর আগে। এরপর বিশ্বের অনেক স্থানে কয়েক শ’ মওজিওন নির্মিত হয়।”

“ডাক্তার ব্রুকস, ফেরিস আশাবাদী হয়ে তাকালো সিয়েনার দিকে। “আপনি কি একটু সার্চ করে দেখবেন ভেনিসে এরকম কোনো মওজিওন আছে কিনা?”

“ওখানে কয়েক ডজন রয়েছে,” মুচকি হাসি দিয়ে বললো ল্যাংডন। “ওগুলোকে এখন বলে মিউজিয়াম।”

“আহ…” ফেরিস বলেলো। “আমাদেরকে তাহলে আরো বড় জাল ফেলতে হবে।”

ফোনে সার্চ করার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও চালিয়ে গেলো সিয়েনা। একসাথে একাধিক কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে মেয়েটির। মাল্টিটাস্কার।

“ঠিক আছে, তাহলে আমরা এমন একটি মিউজিয়াম খুঁজবো যেখানে একজন ডজকে পাবো যে কিনা ঘোড়ার মাথা কেটেছিলো আর অন্ধের কঙ্কাল তুলে এনেছিলো। রবার্ট, এরকম কোনো মিউজিয়াম কি আছে, যেখানে আমরা আমাদের খোঁজাখুঁজি শুরু করতে পারি?”

ল্যাংডন ইতিমধ্যে ভেনিসের সুপরিচিত মিউজিয়ামগুলোর কথা বিবেচনা করা শুরু করে দিয়েছে-গ্যালারি দেল আক্কাদেমিয়া, কা রেজ্জোনিকো, পালাজ্জো গ্রাসি, পেগ্নি গুগেনহাইম কালেকশন, মিউজিও কোরার-কিন্তু কোনোটাই এই বর্ণনার সাথে খাপ খায় না।

লেখাটার দিকে আবার ফিরে তাকালো।

পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মওজিওন’র ভেতরে হাটু গেঁড়ে…

বাঁকা হাসি দেখা গেলো ল্যাংডনের ঠোঁটে। “ভেনিসে এমন একটি মিউজিয়াম আছে যেটা এই বর্ণনার সাথে ভালোমতোই মিলে যায়-পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মউজিওন।”

সিয়েনা আর ফেরিস আশাবাদী হয়ে তাকালো তার দিকে।

“সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকা,” জানালো সে। “ভেনিসের সবচাইতে বড় চার্চ।”

ফেরিস বুঝতে পারলো না। “চার্চ আবার মিউজিয়াম হয় কেমনে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। “অনেকটা ভ্যাটিকানের মিউজিয়ামের মতো। তবে সেন্ট মার্কসের ভেতরের সাজসজ্জা পুরোপুরি খাঁটি স্বর্ণের টাইলস দিয়ে করা।”

“একটি স্বর্ণালি মওজিওন,” উত্তেজিত হয়ে বললো সিয়েনা।

তার মনে কোনো সন্দেহ নেই কবিতায় বর্ণিত স্বর্ণালি মওজিওনটি সেন্ট মাকর্স মিউজিয়াম। শত শত বছর ধরে ভেনিশিয়রা সেন্ট মার্কসকে ডাকতো লা চিয়েসা দো’রো বলে-স্বর্ণের চার্চ-ল্যাংডন এটাকে এ বিশ্বের অন্য যেকোনো চার্চের চেয়ে অনন্য বলে মনে করে।

“কবিতায় বলছে ‘হাটু গেড়ে, “ ফেরিস বললো। “আর চার্চেই তো মানুষ হাটু গেড়ে বসে। সুতরাং এটা খাপ খায় পুরোপুরি।”

সিয়েনা দ্রুত কিছু টাইপ করলো আবার। “আমি সার্চের তালিকায় সেন্ট মার্কসকে রাখলাম। ওখানেই এই ডজকে খুঁজতে হবে মনে হচ্ছে।”

ল্যাংডন জানে সেন্ট মার্কসে অসংখ্য ডওজ পাওয়া যাবে-এজন্যে আক্ষরিক অর্থেই এটাকে ডওজদের ব্যাসিলিকা বলা হয়। দ্বিগুন উৎসাহে আবারো কবিতার দিকে নজর দিলো সে।

পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মউজিওনে হাটু গেঁড়ে
মেঝেতে কান পেতে শোনো
গড়িয়ে পড়া পানির শব্দ।

গড়িয়ে পড়া পানির শব্দ? ভাবলো ল্যাংডন। সেন্ট মার্কসের নীচে কি পানি রয়েছে? বুঝতে পারলো এ প্রশ্নটা একদম বোকার মতো হয়ে গেছে। ঐ শহরের নীচে সবত্রই পানি। ভেনিসের প্রায় সব ভবনই ডুবে আছে। ব্যাসিলিকার ছবিটা ভেসে উঠলো ল্যাংডনের চোখের সামনে। ওটার ভেতরে কেউ হাটু গেড়ে বসে পানির শব্দ শুনছে। আমরা সেটা শোনার পর কি করবো?

কবিতাটা আবারো জোরে জোরে পড়লো ল্যাংডন।

অনুসরণ করে চলে যাও ঐ ডুবন্ত প্রাসাদে…
ওখানে অন্ধকারে থানিক দানব প্রতীক্ষায় আছে,
ডুবে আছে সেই রক্ত-লাল জলাধারে….
যে জলাধারে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা।

“ঠিক আছে,” বললো ল্যাংডন, “মনে হচ্ছে আমাদেরকে পানি পড়ার শব্দ অনুসরণ করে…চলে যেতে হবে একটি ডুবন্ত প্রাসাদে।”

ফেরিস আবারো মুখ চুলকালো। তাকে একটু উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে এখন। “থানিক-দানব জিনিসটা আবার কি?”

‘মাটির নীচে থাকে,” সিয়েনা বললো, যদিও ফোনের বাটনে তার আঙুল ব্যস্ত। “থানিক মানে মাটির নীচে। “

“আংশিক সত্যি,” বললো ল্যাংডন। “যদিও শব্দটার সাথে আরো ঐতিহাসিক কিছু সম্পর্ক আছে-সাধারণত মিথ আর দানবের সাথে এটা সংশ্লিষ্ট। থানিক হলো পুরোপুরি এক ধরণের মিথিক্যাল দেবতা আর দানব-উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইরিনিজ, হেকাটি আর মেডুসার নাম। তাদেরকে থানিক বলা হয় কারণ তারা বাস করে মাটির নীচে নরকে।” ল্যাংডন থামলো। “ঐতিহাসিকভাবে তারা মাটির উপরে যখন উঠে আসে তখন মানুষের পৃথিবীতে বিপর্যয় আর ধ্বংস বয়ে দেয়।”

দীর্ঘ নীরবতা নেমে এলো। ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো তারা সবাই একই চিন্তা করছে। এই থানিক দানব…জোবরিস্টের প্লেগ ছাড়া আর কিছু না।

অনুসরণ করে চলে যাও ঐ ভুবন্ত প্রাসাদে…
ওখানে অন্ধকারে থানিক দানব প্রতীক্ষায় আছে,
ডুবে আছে সেই রক্ত-লাল জলাধারে…
যে জলাধারে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা

“তাহলে এটা অন্তত নিশ্চিত,” ল্যাংডন বললো, “আমরা অবশ্যই মাটির নীচে কোনো জায়গা খুঁজবো। কবিতার শেষ লাইনে এমনটাই বলা আছে : যে পুকুরের পানিতে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা।”

“ভালো পয়েন্ট,” বললো সিয়েনা। ফেরিসের ফোন থেকে চোখ তুলে তাকালো সে। “কোনো জলাধার কিংবা পুকুর যদি মাটির নীচে হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সেখানে আকাশের তারা প্রতিফলিত হবে না। কিন্তু ভেনিসে কি এমন কোনো ভূ-গর্ভস্থ জলাধার আছে?”

“থাকলেও আমি জানি না,” জবাব দিলো ল্যাংডন। “তবে যে শহর পানির উপরে নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে নিশ্চয় এরকম অসংখ্য সম্ভাবনা থাকতে পারে।”

“ইনডোর জলাধার হতে পারে না?” তাদের দুজনের দিকে চেয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো সিয়েনা। “কবিতায় বলা আছে ‘অন্ধকার’ আর ‘ডুবন্ত প্রাসাদ। তুমি একটু আগে বলেছিলে উওজ প্রাসাদটি ব্যাসিলিকার সাথে সংযুক্ত, ঠিক? তার মানে ঐ জায়গা দুটোর অনেক কিছুই কবিতার সাথে মিলে যায়-একটা পবিত্র জ্ঞানের মউজিওন, একটি প্রাসাদ, ওজ’দের সাথেও সংশ্লিষ্ট-আর এ দুটো জায়গাই ভেনিসে। যে শহরটা সমুদ্রপৃষ্ঠের সমতলে অবস্থিত।”

কথাটা বিবেচনা করলো ল্যাংডন। “তুমি মনে করছো কবিতার ‘ডুবন্ত প্রাসাদটি হলো উওজদের প্রাসাদ?”

“কেন মনে করবো না? এই কবিতাটি প্রথমে বলছে সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকায় হাটু গেড়ে বসতে, তারপর পানির শব্দ অনুসরণ করতে। হয়তো পানির শব্দ অনুসরণ করে উওজ’দের প্রাসাদে চলে যাওয়া যাবে। ওখানে পানির নীচে কোনো স্থাপনা থাকতে পারে কিংবা সেরকম কিছু।”

ডজ-এর প্রাসাদে ল্যাংডন অনেকবার গেছে, সে জানে জায়গাটা অনেক বড়। ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য ভবনের একটি কম্পেক্স। ঐ প্রাসাদে বিশাল একটি জাদুঘর, বিভিন্ন ধরণের ইন্সটিটিউশনাল কক্ষের গোলকধাঁধা, অ্যাপার্টমেন্ট, প্রাঙ্গন আর একটি বিশাল জেলখানা রয়েছে।

“তোমার কথা হয়তো সত্যি,” ল্যাংডন বললো। “কিন্তু ওই প্রাসাদে অন্ধের মতো খুঁজে বেড়ালে কয়েক দিন লেগে যাবে। আমি বরং বলবো কবিতায় আমাদেরকে যেভাবে নির্দেশ করেছে সেভাবেই কাজ করলে ভালো হবে। প্রথমে আমরা সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকায় গিয়ে বিশ্বাসঘাতক কোনো উওজ-এর সমাধি কিংবা মূর্তি খুঁজে বের করবো। তারপর হাটু গেড়ে বসে দেখবো আমরা।”

“তারপর?” সিয়েনা জানতে চাইলো।

“তারপর,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ল্যাংডন, “আমরা প্রার্থনা করবো যেনো পানির শব্দ শুনতে পাই…আর ওটা অনুসরণ করে পৌঁছে যাই কোনো জায়গায়।”

সবাই চুপ মেরে গেলে ল্যাংডনের চোখে ভেসে উঠলো এলিজাবেথ সিনস্কির উদ্বিগ্ন মুখটি। নদীর ওপার থেকে তার উদ্দেশ্যে বলছে। খুব বেশি সময় হাতে নেই। খোঁজো, তাহলেই পাবে!

সে ভাবলো সিনস্কি এখন কোথায় আছে…মহিলা ঠিক আছে তো? কালো ইউনিফর্মের সৈন্যেরা এতোক্ষণে নিশ্চয় জেনে গেছে ল্যাংডন আর সিয়েনা পালিয়েছে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। আমাদের নাগাল পেতে ওদের আর কতোক্ষণ লাগতে পারে?

কবিতাটার দিকে চোখ যেতেই ল্যাংডনের খুব ক্লান্তি বোধ হলো। শেষ। লাইনটার দিকে তাকাতেই আরেকটি চিন্তা মাথায় এলো তার। ভাবলো এটার উল্লেখ আরো বেশি নির্দিষ্ট কিনা। যে পুকুরের পানিতে প্রতিফলিত হয় না। আকাশের তারা। সম্ভবত এটা তাদের সার্চের সাথে সম্পর্কিত নয়, তারপরও কথাটা শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিলো সে। “উল্লেখ করার মতো এখানে আরেকটি ব্যাপার আছে।”

সেলফোন থেকে চোখ তুললো সিয়েনা।

“দান্তের ডিভাইন কমেডি’র তিনটি অধ্যায় আছে,” বললো সে। “ইনফার্নো, পারগেতোরিও এবং পারাদিসো। এই তিনটি অধ্যায় শেষ হয়েছে ঠিক একই শব্দ দিয়ে। “

সিয়েনাকে বিস্মিত হতে দেখা গেলো।

“শব্দটা কি?” জানতে চাইলো ফেরিস।

কাগজে টুকে নেয়া লেখাগুলোর নীচের দিকে ইশারা করলো ল্যাংডন। “এই কবিতাটারও শেষ শব্দ একই-তারা। “ দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি তুলে নিয়ে ওটার পেছনে পেচানো লেখাগুলোর মাঝখানে ইঙ্গিত করলো সে।

যে পুকুরের পানিতে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা।

“আরো আছে,” ল্যাংডন বলতে লাগলো, “ইনফার্নো’র শেষে, আমরা দেখতে পাই দান্তে ভূ-গর্ভের নীচে একটি গহ্বর থেকে পানির শব্দ অনুসরণ করে মাটির উপরে উঠে আসে…ওটাই তাকে নরক থেকে বের হবার পথ দেখায়।”

ফেরিসের মুখ আরক্তিম হয়ে উঠলো। “হায় ঈশ্বর।”

ঠিক তখনই বাতাসের কানফাটা শব্দে ভরে উঠলো ট্রেনের কম্পার্টমেন্টটি। তাদের ট্রেন ঢুকে পড়েছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া একটি টানেলে।

অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে ফেললো ল্যাংডন। চেষ্টা করলো নিজেকে রিলাক্স রাখতে। জোবরিস্ট হতে পারে একজন উন্মদা, ভাবলো সে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, সে অবশ্যই ভালোভাবে দান্তেকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলো।

.

অধ্যায় ৬৪

লরেন্স নোলটন টের পেলো স্বস্তির এক পরশ যেনো বয়ে গেলো তার উপর দিয়ে।

জোবরিস্টের ভিডিওটা দেখার ব্যাপারে প্রভোস্ট তার সিদ্ধান্ত বদলেছেন।

নোলটন প্রায় লাফিয়ে মেমোরি স্টিকটা কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দিলো যাতে জোবরিস্টের নয় মিনিটের উদ্ভট ভিডিওটা বসের সাথে বসে দেখতে পারে। এই ভিডিওটা ফ্যাসিলিটেটরকে যারপরনাই ঘাবড়ে দিয়েছিলো, সে উদগ্রীব হয়ে ছিলো যাতে অন্য আরেকজন এটা দেখুক।

এটা আর আমার উপর নির্ভর করছে না।

গভীর করে দম নিয়ে প্লে করতে শুরু করলো নোটন।

অন্ধকার পদা। পানির শব্দ। ক্যামেরা পানির নীচে লালচে আলোর গুহায় চলে গেলো। প্রভোস্ট কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। কিন্তু নোলন জানে লোকটা ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট ভড়কে আছে।

ক্যামেরা চলে গেলো পানির একেবারে নীচে। মাটিতে পুঁতে রাখা টাইটানিয়ামের ফলকটি দেখা যাচ্ছে এখন।

এই জায়গায়, এই তারিখে এ বিশ্ব চিরতরের জন্য বদলে গিয়েছিলো।

প্রভোস্ট একটু আৎকে উঠলো। “আগামীকাল, বিড়বিড় করে বললো তারিখটা দেখে। “আমরা কি জানি এ জায়গাটা কোথায় হতে পারে?”

মাথা ঝাঁকালো বোলটন।

ক্যামেরা বাম দিকে সরে গেলে প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতরে জ্বলজ্বলে হলুদ বাদামী তরল দেখা গেলো। ব্যাগটা পানিতে ভাসছে।

“এটা আবার কি জিনিস?!” প্রভোস্ট একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো থলথলে জিনিসটার দিকে। যেনো পানির নীচে কোনো বেলুন ভাসছে।

ভিডিওটা চলতে শুরু করলে ঘরে নেমে এলো অস্বস্তিকর নীরবতা। একটু পর স্ক্রিনটা আবারো অন্ধকার হয়ে গেলো, পাখির ঠোঁটের মতো নাকবিশিষ্ট অদ্ভুত এক অবয়ব গুহার দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অবয়বটি রহস্যময় ভাষায়। কথা বলতে শুরু করলো এবার।

আমি সেই ছায়া…
মাটির নীচে ঘুরে বেড়াই, গভীর নীচ থেকে কথা বলছি, এই অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায় নির্বাসিত আমি যেখানে রক্ত-লাল পানিতে আকাশের তারা প্রতিফলিত হয় না।
কিন্তু এটাই আমার স্বর্গ…আমার নাজুক সন্তানের উপযুক্ত জরায়ু।
ইনফার্নো।

প্রভোস্ট মুখ তুলে তাকালো। “ইনফার্নো?”

কাঁধ তুললো নোলটন। “আমি তো আগেই বলেছি এটা খুবই ঘাবড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার।”

প্রভোস্ট আবার স্ক্রিনের দিকে তাকালো। গভীর মনোযোগের সাথে দেখতে লাগলো ভিডিওটা।

পাখির ঠোঁটসদৃশ্য অবয়বটি কয়েক মিনিট ধরে কথা বলে গেলো, প্লেগ, জনসংখ্যা হ্রাস করা দরকার, ভবিষ্যতে নিজের মহিমান্বিত ভূমিকা, মূর্খদের বিরুদ্ধে তার লড়াই, যারা তাকে থামাতে বদ্ধপরিকর, আর বিশ্বাসীর দল, যারা বুঝতে পেরেছে এই ভয়ঙ্কর কাজটিই পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে।

এই যুদ্ধটা যা কিছু নিয়েই হোক না কেন, নোলটন আজ সারাটা সকাল ভেবে গেছে, তারা আসলে ভুলপক্ষের হয়ে লড়াই করে যাচ্ছে।

কণ্ঠটা বলে যেতে লাগলো :

মোক্ষ লাভের মাস্টারপিসটাকে আমি জালিয়াতি করেছি, তারপরও আমার এই প্রচেষ্টাকে ট্রাম্প বাজিয়ে কিংবা লরেল ফুলের মুকুট পরিয়ে পুরস্কৃত করা হয় নি…বরং মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে।
আমি মৃত্যুকে ভয় করি না…কারণ মৃত্যু স্বপ্নদ্রষ্টাদেরকে শহীদে রূপান্তরিত করে…একটি মহৎ চিন্তাকে শক্তিশালী আন্দোলনে বদলে দেয়।
জিশু। সক্রেটিস। মার্টিন লুথার কিং। খুব শীঘ্রই আমিও তাদের সাথে যোগ দেবো।
যে মাস্টারপিস আমি সৃষ্টি করেছি সেটা স্বয়ং ঈশ্বরের কাজ…যিনি আমার মধ্যে বুদ্ধি প্রোথিত করেছেন, সাহস দিয়েছেন এরকম একটি সৃষ্টিকে জালিয়াত করার জন্য, তার তরফ থেকে আমাকে দেয়া একটি উপহার এটি।
এখন সেই দিন সমাগত।
আমার অভ্যন্তরে ঘুমিয়ে আছে ইনফার্নো, পানির জরায়ু থেকে ছড়িয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে…থানিক দানব এবং তার ক্রোধের অগ্নিদৃষ্টির সতর্ক প্রহরার মধ্যে।
আমার কর্মফলের মহিমা সত্ত্বেও, তোমাদের মতো আমারও পাপের সাথে পরিচয় রয়েছে। এমনকি আমিও অন্ধকারতম সাতটি মহাপাপের অপরাধে অপরাধী-একমাত্র প্রলুব্ধ যেখান থেকে খুব কম ব্যক্তিই শান্তির আশ্রয় খুঁজে পায়।
গর্ব।
এই ভিডিওটি রেকর্ডিং করতে গিয়ে আমি গর্বের ঘূর্ণিচক্রে তলিয়ে গেছি…আমার কাজ সম্পর্কে বিশ্ববাসী জানুক সেটা নিশ্চিত করার জন্য উদগ্রীব আমি।
কেনই বা হবো না?
মানবজাতির জানা উচিত তার নিজের মোক্ষ লাভের উৎস সম্পর্কে…যে তার জন্য নরকের দরজা চিরকালের জন্য খুলে দিলো তার নামটাও জানা উচিত!
প্রতিটি অতিক্রান্ত ঘণ্টার সাথে, পরিণাম যেনো আরো বেশি করে নিশ্চিত হয়ে উঠছে। গণিত-মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই অস্থির-এটা নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। ঠিক সেরকমই জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া জীবন আমাদের মানবজাতিকে প্রায় খুন করে ফেলছে।
প্রাণীর সৌন্দর্য হলো-ভালো অথবা মন্দ-সে ঈশ্বরের নিয়ম অনুসরণ করে একটিমাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে।
উৎপাদনশীল এবং বহুগুনে বৃদ্ধি হওয়া।
তাই আমি আগুনের সাথে আগুন নিয়ে লড়াই করি।

“আর দেখার দরকার নেই,” প্রভোস্ট এতোটা আস্তে বললো যে নোলটন খুব একটা শুনতে পেলো না।

“স্যার?”

“বন্ধ করো এই ভিডিওটা।”

ভিডিওটা বন্ধ করে দিলো নোলটন। “স্যার, শেষটা কিন্তু আরো বেশি ভীতিকর।”

“যথেষ্ট দেখেছি।” প্রভোস্টকে অসুস্থ দেখালো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কিউবিকলে পায়চারি করলো সে তারপর আচমকা থেমে গেলো। “এফএস-২০৮০-এর সাথে যোগাযোগ করতে হবে আমাদেরকে।”

কথাটা বিবেচনা করে দেখলো নোলটন।

এফএস-২০৮০ হলো প্রভোস্টের বিশ্বস্ত কন্ট্যাক্টের কোডনেম-এই কন্ট্যাক্টই জোবরিস্টকে কনসোর্টিয়ামের কাছে একজন ক্লায়েন্ট হিসেবে রেফার করেছিলো। এ মুহূর্তে প্রভোস্টের কোনো সন্দেহ নেই এফএস-২০৮০-এর বিচার বুদ্ধিতে আস্থা রেখে বিরাট ভুল করেছে। বারট্রান্ড জোবরিস্টকে ক্লায়েন্ট হিসেবে রিকমেন্ড করে দীর্ঘদিন ধরে কনসোর্টিয়ামের তৈরি করা জগত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে।

এই সঙ্কটটার জন্য এফএস-২০৮০ দায়ি।

জোবরিস্টকে ঘিরে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা আর বিপর্যয় শুধুমাত্র কনসোর্টিয়ামের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে না…সম্ভবত এ বিশ্বের জন্যেও বিপর্যয় ডেকে আনছে।

“জোবরিস্টের সত্যিকারের উদ্দেশ্য কি সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে,” দৃঢ়ভাবে বললো প্রভোস্ট। “আমি জানতে চাই সে আসলে কি সৃষ্টি করেছে আর তার হুমকিটা সত্যি কিনা।”

নোলটন ভালো করেই জানে এসব প্রশ্নের উত্তর যদি কেউ জেনে থাকে তবে সেটা এফএস-২০৮০। তারচেয়ে বারট্রান্ড জোবরিস্টকে আর কেউ ভালোমতো চেনে না। কনসোর্টিয়াম তার প্রটোকল ভেঙে হিসেব করে দেখার সময় এসেছে।

জেনে যে পাগলামি আর উন্মাদনার পক্ষে কাজ করে গেছে বিগত এক বছর ধরে তা খতিয়ে দেখতে হবে এখন।

এফএস-২০৮০-এর সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার পরিণাম কি হতে পারে সেটা বিবেচনা করে দেখলো নোলটন। তার সাথে এ মুহূর্তে যোগাযোগ করাতেও কিছু ঝুঁকি আছে।

“অবশ্যই স্যার,” বললো নোলটন। “আপনি যদি এফএস-২০৮০-এর সাথে যোগাযোগ করতে চান তাহলে সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে করতে হবে।”

সেলফোনটা বের করার সময় প্রভোস্টের চোখেমুখে রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো যেনো। “আমরা এসব সূক্ষ্ম ব্যাপার-স্যাপার বহু আগেই পেরিয়ে এসেছি।”

.

দু’জন পার্টনারের সাথে ট্রেনে করে ভেনিস যাচ্ছে নেকটাই আর হালকা ফ্রেমের চশমা পরা লোকটি। চেষ্টা করে যাচ্ছে না চুলকাতে। তার লালচে গোটাগুলো আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে এখন। সেইসাথে বুকের ব্যথাটাও বাড়ছে।

টানেল থেকে ট্রেনটা বের হলে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে। প্রফেসর আস্তে করে চোখ খুললো। মনে হচ্ছে অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে গেছিলো। তার পাশে বসে আছে সিয়েনা। টানেলের ভেতরে নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে সেলফোনটা টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে, এখন সেটার দিকে চেয়ে আছে সে।

মনে হচ্ছে আবারও সেলফোনে ইন্টারনেট সার্চ করবে সিয়েনা। কিন্তু ফোনটা হাতে তুলে নেবার আগেই ভাইব্রেট করতে লাগলো, সেইসাথে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ।

এই রিংটোনটা তার ভালো করেই চেনা আছে, সেজন্যে দেরি না করে ফোনটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো ফেরিস। ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে নিজের বিস্ময় ভাবটা লুকানোর চেষ্টা করলো।

“দুঃখিত,” উঠে দাঁড়ালো সে। “অসুস্থ মা। তার সাথে একটু কথা বলতে হবে এখন।”

সিয়েনা আর ল্যাংডন তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করলে লোকটা কেবিনের বাইরে চলে গেলো। দ্রুত প্যাসাজওয়ে দিয়ে চলে এলো রেস্টরুমে।

রেস্টরুমের দরজা লক করে কলটা রিসিভ করলো সে।

“হ্যালো?” ওপাশের কণ্ঠটা বেশ গুরুগম্ভীর। “প্রভোস্ট বলছি।”

.

অধ্যায় ৬৫

ভেনিসগামী ট্রেনটির রেস্টরুম কোনো কমার্শিয়াল প্লেনের রেস্টরুমের মতো বড় নয়। ওটার ভেতরে একজন মানুষ খুব সহজে ঘুরতে পারে না। লালচে গোটার লোকটি প্রভোস্টের সাথে কথা বলা শেষ হতেই ফোনটা পকেটে রেখে দিলো।

পরিস্থিতি বদলে গেছে, বুঝতে পারলো সে। পুরো দৃশ্যপট হঠাৎ করেই উল্টে গেছে এখন। নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুটা সময় লাগলো তার।

আমার বন্ধুরা এখন আমার শক্ত হয়ে গেছে।

টাইটা আলগা করে আয়নায় নিজের মুখ দেখলো। লালচে গোটাগুলো কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। তবে এ নিয়ে তার চোখেমুখে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ। দেখা গেলো না, বুকের ব্যথাটা একটু ভোগাচ্ছে তাকে।

তড়িঘড়ি শার্টের কয়েকটা বোম খুলে আয়নার নিজের নগ্ন বুকটা দেখলো।

হায় ঈশ্বর।

কালো জায়গাটা আরো বড় হয়ে গেছে।

তার বুকের ঠিক মাঝখানে নীলচে-কালো একটি বৃত্ত আছে। গতরাতে এটার আকৃতি ছিলো একটি গলফ বলের সমান, কিন্তু এখন সেটা বেড়ে কমলার আকৃতি হয়ে গেছে। নাজুক চামড়ায় আলতো করে হাত দিতেই ভুরু কুচকে ফেললো।

দ্রুত শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিলো সে। আশা করলো সামনে যে কাজটা করতে হবে সেটা করার মতো শক্তি তার থাকবে।

পরবর্তী ঘণ্টাটা খুবই ক্রিটিক্যাল, ভাবলো সে। বেশ কিছু সূক্ষ্ম চালাকি করতে হবে।

চোখ বন্ধ করে চিন্তাভাবনাগুলো গুছিয়ে নিলো, যা যা করা দরকার তার সবই করতে হবে। আমার বন্ধুরা আমার শক্র হয়ে গেছে, আবারো কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খেলো।

বেশ কয়েকবার প্রচণ্ড কষ্ট হলেও গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো সে। আশা করলো এতে করে তার নার্ভ শান্ত হবে। ভালো করেই জানে তার উদ্দেশ্য গোপন রাখতে হলে তাকে একদম মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।

ছলনার অভিনয় করতে হলে ভেতরটা শান্ত রাখা খুব জরুরি।

ধোঁকাবাজিতে সে খুব একটা নতুন নয়, তারপরও এ মুহূর্তে তার হৃদস্পন্দন হাতুড়ি পেটা করছে। আবারো গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো। অনেক বছর ধরেই তুমি লোকজনের সাথে ধোঁকাবাজি করে আসছে, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো সে। এটাই তো তোমার কাজ।

নিজেকে ধাতস্থ করে ল্যাংডন আর সিয়েনার কাছে ফিরে যাবার প্রস্ততি নিলো এবার।

আমার শেষ পারফর্মেন্স, ভাবলো সে।

চূড়ান্ত সতর্কতার অংশ হিসেবে রেস্টরুম থেকে বের হবার আগে মমাবাইলফোনের ব্যাটারি খুলে রাখলো, যেনো এটা আর কাজ না করে।

.

তাকে খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, লালচে গোটার লোকটি কেবিনে ফিরে আসলে সিয়েনা তাকে দেখে মনে মনে বললো।

“সব ঠিক আছে তো?চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো সিয়েনা।

মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হ্যাঁ, ঠিক আছে।”

“আপনার ফোনটা দিন তো,” বললো সে। “আমি আরো কিছু উওজ-এর ব্যাপারে সার্চ করবো। সেন্ট মাক সে যাবার আগে হয়তো কিছু প্রশ্নের জবাব। পেয়ে যেতে পারি।”

“দিচ্ছি,” বলেই পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে ডিসপ্লের দিকে তাকালো। “ওহ। মার সাথে কথা বলার সময়ই আমার ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছিলো।” হাতঘড়ির দিকে তাকালো। “আমরা আর একটু পরই ভেনিসে পৌঁছে যাবো। ততোক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

.

ইটালির উপকূল থেকে পাঁচ মাইল দূরে মেন্দাসিয়াম-এ নিজের রুমে বসে নোলটন প্রভোস্টকে দেখে যাচ্ছে। যেনো খাঁচায় বন্দী প্রাণী হাসফাস করছে। ফোনকলটি করার পর প্রভোস্টের চাকা পরিস্কারভাবেই ঘুরে গেছে। প্রভোস্ট কিছু না বললেও নোলটন জানে তার বস কি ভাবছে।

অবশেষে বেশ দৃঢ়ভাবে কথা বলতে শুরু করলো প্রভোস্ট।

“আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এই ভিডিওটা ডা: এলিজাবেথ সিনস্কির সাথে শেয়ার করতেই হবে।”

নোলটন দারুণ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না, চুপচাপ বসে রইলো নিজের চেয়ারে। ঐ সাদা-চুলের ডাইনীটা? যার হাত থেকে আমরা সারা বছর ধরে জোবরিস্টকে রক্ষা করে গেছি? “ঠিক আছে, স্যার। আমি কি উনার কাছে। ভিডিওটা ই-মেইল করার ব্যবস্থা করবো?”

“আরে কী বলো! ভিডিওটা লিক হবার ঝুঁকি নিতে চাও নাকি? এটা লিক হলে কি হবে জানো না? মাস হিস্টেরিয়া শুরু হয়ে যাবে। আমি চাই ডা: সিনস্কিকে যতো দ্রুত সম্ভব এখানে নিয়ে আসা হোক।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো নোলটন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালককে এখানে এই মেন্দাসিয়াম-এ নিয়ে আসতে চাচ্ছেন? “স্যার, এটা করলে আমাদের সিকিউরিটি প্রটোকল ভঙ্গ করার ঝুঁকি নেয়া হবে।”

“যা বললাম তাই করো, নোলটন! এক্ষুণি!”

.

অধ্যায় ৬৬

ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো এফএস-২০৮০, কাঁচে রবার্ট ল্যাংডনের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো সে। বারট্রান্ড জোবরিস্ট যে ধাঁধাটি দান্তের মৃত্যু-মুখোশে কম্পোজ করেছিলো সেটার সমাধান নিয়ে ভেবে যাচ্ছে প্রফেসর।

বারট্রান্ড, ভাবলো এফএস-২০৮০। ঈশ্বর জানেন, আমি তার অভাব কতোটা বোধ করছি।

তাকে হারানোর যন্ত্রণা এখনও টাটকা। যে রাতে তাদের দুজনের দেখা হয়েছিলো সেটা তার কাছে জাদুর মতো মনে হয় এখনও।

শিকাগোতে। প্রচণ্ড তুষারপাতের সময়।

ছয় বছর আগে জানুয়ারি মাসে…কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। বরফের স্তূপ ডিঙিয়ে আমি যাচ্ছিলাম, প্রচণ্ড তুষারপাতের কারণে কলার তুলে দিতে হয়েছিলো। এরকম আবহাওয়া সত্ত্বেও আমি নিজেকে বলেছিলাম, কোনো কিছুই আমার নিয়তি থেকে আমাকে সরাতে পারবে না। আজরাতে মহান বারট্রান্ড জোবরিস্টের কথা শোনার সুযোগটি হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই…তাও আবার একান্তে।

এই লোকটি এ পর্যন্ত যা যা লিখেছে তার সবই আমি পড়েছি। আর নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে মাত্র পাঁচশত জন লোকের মধ্যে আমি আছি বলে। আজকের অনুষ্ঠানের জন্য এই পরিমাণ টিকেটই ছাড়া হয়েছে।

হলে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় অসাড় হয়ে পড়েছি প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়। ঘরটা প্রায় খালি দেখে একটু ভড়কে গেছিলাম আমি। তার বক্তৃতাটি কি বাতিল করা হয়েছে?! বাজে আবহাওয়ার কারণে শহরের সব কিছুই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে…এজন্যে কি জোবরিস্ট আজরাতে আসতে পারেন নি?!

তারপরই দেখতে পেলাম উনি সেখানে আছেন।

পর্বতের মতোই অভিজাত ভঙ্গি নিয়ে উঠেছেন মঞ্চে।

উনি অনেক লম্বা…চোখ দুটো উজ্জ্বল সবুজ, যেনো সেই চোখের গভীরতায় এ বিশ্বের সব রহস্য ধরে রেখেছেন। ফাঁকা হলের দিকে তিনি তাকালেন-হাতে গোনা এক ডজনের মতো ভক্ত জড়ো হয়েছে সেখানে-হলটা প্রায় খালি বলে আমি খুব লজ্জিত বোধ করলাম।

ইনি বাট্রান্ড জোবরিস্ট!

উনি আমাদের দিকে যখন তাকালেন তখন সুকঠিন নীরবতা নেমে এলো ঘরে। তারপর কথা নেই বার্তা নেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি। তার সবুজ চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগলো। “জাহান্নামে যাক এই ফাঁকা অডিটোরিয়াম।” ঘোষণা দিলেন যেনো। “আমার হোটেল খুব কাছেই। আসুন, সেখানকার বারে চলে যাই!”

উৎফুলু ধ্বনি শোনা গেলো, ছোটোখাটো দলটি সানন্দে হোটেলের বারে রওনা দিলো একসঙ্গে। সবার জন্য মদের অর্ডার দেয়া হলো। জোবরিস্ট আমাদেরকে তার গবেষণা, সেলিব্রেটি হিসেবে তার উত্থানের কাহিনী এবং ভবিষ্যতের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কথা বলে গেলেন। মদ পরিবেশিত হবার পর পর কথাবতার বিষয় বদলে গেলো জোবরিস্টের নতুন ঝোঁক ট্রান্সহিউম্যানিস্ট দর্শনের দিকে।

“আমি বিশ্বাস করি ট্রান্সহিউম্যানিজম মানবজাতির দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য একমাত্র আশাভরসা,” সবাইকে বোঝতে শুরু করলেন জোবরিস্ট। নিজের শার্ট সরিয়ে H+কাঁধে থাকা ট্যাটুটা দেখালেন তিনি। “আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আমি কতোটা নিবেদিতপ্রান এ বিষয়ে।”

আমার কাছে মনে হচ্ছিলো কোনো রকস্টারের সাথে একান্তে কথা বলছি। কখন কল্পনাও করি নি জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এরকম একজন জিনিয়াস এতোটা ক্যারিশমেটিক ব্যক্তি হতে পারেন। জোবরিস্ট যখনই আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে আক্রান্ত হচ্ছিলাম…মনের সুগভীরে থাকা যৌনাকাঙ্খ জেগে উঠেছিলো আমার।

রাত গম্ভীর হতে থাকলে আমাদের দলটি পাতলা হতে শুরু করে। মাঝরাতে আমি আর জোবরিস্ট সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ি।

“আজকের রাতটার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, তাকে বলি আমি। মদ্যপানের ফলে একটু ঝিমুনিও চলে এসেছিলো আমার মধ্যে। “আপনি একজন অসাধারণ শিক্ষক।”

“পাম দিচ্ছো?” আমার কাছে কুঁকে এসে বললেন জোবরিস্ট। তার হাটুর সাথে আমার হাটু স্পর্শ করলো। “এরকম পাম আমি সবখানেই পাই।”

আমার ঐ কথাটা নিশ্চয় ঠিক ছিলো না, কিন্তু রাতটা ছিলো তুষারপাতের, আমরা শিকাগোর একটি ফাঁকা হোটেলে বসে আছি। মনে হচ্ছিলো পুরো দুনিয়াটা থেমে আছে।

“তাহলে তুমি কি ভাবছো?” বলেছিলেন জোবরিস্ট। “আমার ঘরে মদ নিয়ে বসবো দু’জনে?”

আমি বরফের মতো জমে গেলাম কথাটা শুনে। যেনো বুনো হরিণের বাচ্চা গাড়ির হেডলাইটের আলোর সামনে পড়ে গেছে।

আন্তরিকতার সাথে জোবরিস্ট চোখ টিপলেন। “আচ্ছা, আমাকে অনুমান। করতে দাও। জীবনে কখনও বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে আসে নি।”

আমি আরক্তিম হয়ে উঠলাম। তীব্র আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলাম-বিব্রত, উত্তেজিত আর ভীত।

“সত্যি বলতে কি,” তাকে বলেছিলাম। “আমি আসলে কোনো পুরুষের সাথেই এভাবে একান্তে সময় কাটাই নি।”

মুচকি হেসে আরো কাছে এগিয়ে এলেন জোবরিস্ট। “আমি জানি না তুমি কিসের জন্য অপেক্ষা করে আছো এতোদিন, তবে আমি শুধু বলবো, আমাকে তোমার প্রথমজন করে নাও।”

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শৈশবের অদ্ভুত যৌনভীতি আর হতাশা নিমেষে উবে গেলো…বরফ-শীতল রাতে যেনো হাওয়া হয়ে গেলো সেসব।

জীবনে প্রথম তীব্র আকাঙ্খর কারণে লজ্জিত বোধ করলাম না।

আমি তাকে চাইলাম।

দশ মিনিট পর আমি জোবরিস্টের হোটেল রুমে। দুজনেই নগ্ন, একে অন্যের বাহুলগ্ন হয়ে। সময় নিয়ে ধৈর্যসহকারে এগোলো সে। তার আঙুলের স্পর্শ আমার অনভিজ্ঞ শরীরে অনির্বচনীয় এক শিহরণ বয়ে দিলো। এটা আমি বেছে নিয়েছি, সে আমাকে জোর করে নি।

জোবরিস্টের দু’হাতের মধ্যে নিজেকে সপে দিয়ে আমার মনে হচ্ছিলো এ বিশের সবকিছুই ঠিক আছে। তার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে থেকে জানালা দিয়ে তুষারপাতের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবলাম এই মানুষটিকে আমি সর্বত্র অনুসরণ করবো।

ট্রেনের গতি কমে এলে এফএস-২০৮০ সম্বিত ফিরে পেয়ে তার সুখের স্মৃতি থেকে হতাশাজনক বাস্তবে ফিরে এলো।

বারট্রান্ড…তুমি এখন নেই।

তাদের দু’জনের প্রথম রাতটি ছিলো একটি অবিশ্বাস্য ভ্রমণের প্রথম পদক্ষেপ।

আমি তার প্রেমিকার চেয়েও বেশি কিছু হয়ে উঠেছিলাম। আমি হয়ে উঠি তার একজন শিষ্য।

“লিবার্তা ব্রিজ,” বললো ল্যাংডন। “আমরা প্রায় এসে গেছি।”

বিষণ্ণ বদনে মাথা নেড়ে সায় দিলো এফএস-২০৮০। জানালা দিয়ে লাগুনা ভেনেতার জলের দিকে তাকালো সে। মনে পড়ে গেলো এখানে জোবরিস্টের সাথে নৌভ্রমণ করেছিলো এক সময়…সপ্তাহখানেক আগে একটি প্রশান্তিময় দৃশ্য উধাও হয়ে যায় আর সেটা এখন ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।

ও যখন বাদিয়া টাওয়ার থেকে লাফিয়ে পড়েছিলো তখন আমি সেখানে ছিলাম।

মৃত্যুর আগে আমিই ছিলাম তার দেখা শেষ ব্যক্তি।

.

অধ্যায় ৬৭

নেটজেটসের সিটেশন এক্সেল বিমানটি তাসিয়ানানো এয়ারপোর্ট থেকে প্রচন্ড গতিতে উড্ডয়ন করলো ভেনিসের উদ্দেশ্যে। ডা: এলিজাবেথ সিনস্কি উদাসভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে তার নেকলেসটি নাড়াচাড়া করছে, তাই যাত্রার সময় যে বাম্পিং হয় সেটা টেরই পেলো না।

অবশেষে তাকে ইনজেকশন দেয়া বন্ধ করেছে, সিনস্কির মাথাটাও পরিস্কার হতে শুরু করেছে এখন। তার পাশের সিটে এজেন্ট ব্রুডার চুপচাপ বসে আছে। সম্ভবত একটু আগে যে হুট করে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে সেটা নিয়ে ভেবে যাচ্ছে সে।

সব কিছু একেবারে ওলটপালট হয়ে গেছে, ভাবলো সিনস্কি। এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না কিভাবে এটা সম্ভব হলো।

ত্রিশ মিনিট আগে তারা ছোটোখাটো একটি এয়ারফিল্ডে ঝটিকা অভিযান চালায় ল্যাংডনকে ধরার জন্য। তাদের কাছে খবর ছিলো একটি কমার্শিয়াল প্রাইভেট জেটে করে ঐ প্রফেসর জেনেভায় যাচ্ছে। প্রফেসরকে ওখানে পাওয়া যায় নি, পাওয়া গেছে পার্ক করে রাখা একটি সিটেশন এক্সেল বিমান আর তার নীচে অপেক্ষারত দু’জন পাইলটকে। অধৈর্য হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছিলো তারা।

রবার্ট ল্যাংডনের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

তারপরই ফোনকলটা এলো।

কলটা আসার সময় ভ্যানের পেছনেই পড়ে ছিলো সিনস্কি। বোকা বোকা মুখে এজেন্ট ব্রুডার ভ্যানে ঢুকে তার হাতে ফোনটা তুলে দিয়েছিলো।

“আপনার জন্য জরুরি একটি কল, ম্যাডাম।”

“কে করেছে?” জানতে চেয়েছিলো সে।

“উনি কেবল আমাকে বলেছেন আপনাকে বারট্রান্ড জোবরিস্টের ব্যাপারে একটি তথ্য দেবেন।”

ফোনটা হাতে নিয়ে সে বলে, “আমি ডা: এলিজাবেথ সিনস্কি বলছি।”

“ডা: সিনস্কি, আপনার সাথে আমার কখনও পরিচয় হয় নি, দেখাও হয় নি তবে আমার সংগঠন জোবরিস্টকে আপনার হাত থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লুকিয়ে রেখেছিলো।”

কথাটা শুনে উঠে বসে সিনস্কি। “আপনি যে-ই হোন না কেন, একজন ক্রিমিনালকে আশ্রয় দিয়েছেন।

“আমরা কোনো আইনবহির্ভূত কাজ করি নি তবে সেটা-”

“করেন নি মানে!”

ফোনের অপরপ্রান্তের লোকটি গভীর করে দম নিয়ে শান্তকণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে আবার। “আমার কাজকর্মের ন্যায়-অন্যায় দিকটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার যথেষ্ট সময় আপনি পাবেন। আমি জানি আপনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তবে আমি আপনার ব্যাপারে অনেক কিছু জানি। আপনিসহ বাকিদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য মি: জোবরিস্ট আমাকে প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। আমি এখন আপনার সাথে যোগাযোগ করে নিজের প্রটোকল ভেঙে ফেলেছি। তারপও আমি বিশ্বাস করি এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিলো। না। আমার আশংকা, বারট্রান্ড জোবরিস্ট হয়তো মারাত্মক কিছু করেছে।”

সিনস্কি বুঝতে পারছিলো না এই লোকটি কে। “আপনি এসব জিনিস এতোদিন পর এসে এখন বুঝতে পেরেছেন?!”

“হ্যাঁ। কথা সত্যি। এই তো একটু আগেই।” তার কণ্ঠ আন্তরিক।

মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে সিনস্কি। “আপনি কে?”

“এমন একজন, দেরি হয়ে যাবার আগে যে আপনাকে সাহায্য করতে চাইছে। জোবরিস্টের তৈরি করা একটি ভিডিও মেসেজ আমার কাছে আছে। সে আমাকে বলে গেছে এটা যেনো আমি রিলিজ করে দেই…আগামীকাল। আমার মনে হয় আপনার এক্ষুণি এটা দেখা উচিত।”

“ওটাতে কি বলা আছে?”

“ফোনে বলতে পারছি না। আমাদের দেখা করতে হবে।”

“আমি আপনাকে কি করে বিশ্বাস করবো?”

“কারণ আমি আপনাকে বলছি এ মুহূর্তে রবার্ট ল্যাংডন কোথায় আছে…আর তার কাজকর্ম খুবই অদ্ভুত ঠেকছে আমাদের কাছে।”

ল্যাংডনের নাম শুনে সিনস্কি নড়েচড়ে ওঠে। এরপর বাকি কথাগুলো শুনে তার মনে হয় বিগত এক বছরে ধরে এই লোক তার শত্রুকে সাহায্য-সহযোগীতা করে গেলেও এ মুহূর্তে তাকে বিশ্বাস করা যেতে পারে।

এছাড়া তো আমার আর কোনো উপায়ও নেই।

তাদের দুই পক্ষের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে ল্যাংডনের বাতিল হওয়া ফ্লাইটটি দ্রুত নিজেদের জন্য ভাড়া করে নেয়। সিনস্কি এবং সৈনিকেরা এখন সেই বিমানে করে ভেনিসে যাচ্ছে। এই লোকটির তথ্যমতে ল্যাংডন আর তার দুই সঙ্গি ঠিক এ সময় ওখানে পৌঁছে গেছে। স্থানীয় পুলিশকে ব্যবহার করার মতো সময় তাদের হাতে নেই। তবে ফোনের অপরপ্রান্তের লোকটি জানে ল্যাংডন এখন কোথায় যাচ্ছে।

সেন্ট মার্কস স্কয়ারে? ভেনিসের সবচাইতে ঘনবসতি এলাকার দৃশ্যটি চোখে ভেসে উঠতেই সিনস্কি শিউরে উঠলো। “আপনি এটা কিভাবে জানলেন?”

“ফোনে বলা যাবে না,” লোকটি বললো। “তবে আপনার জানা উচিত রবার্ট ল্যাংডন খুবই বিপজ্জনক এক ব্যক্তির সাথে আছেন এ মুহূর্তে।”

“লোকটা কে?!”

“জোবরিস্টের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ আর বিশ্বস্ত একজন।” ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলো লোকটি। “যাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে। কতো বড় বোকামিটাই না করেছি। আমার বিশ্বাস সে এখন মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।”

প্রাইভেট জেটটি সিনস্কি আর ছয়জন সৈনিককে নিয়ে ভেনিসের মাকো। পোলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই সিনস্কির চিন্তাভাবনা চলে গেলো ল্যাংডনের দিকে। সে তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে? কোনো কিছুই মনে করতে পারছে না? অদ্ভুত খবর হলেও এরফলে বেশ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রফেসরকে এরকম বিপদসঙ্কুল ঘটনার মধ্যে টেনে আনাতে নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার।

আমি তার জন্য কোনো উপায়ই রাখি নি।

প্রায় দু’দিন আগে, সিনস্কি যখন ল্যাংডনকে রিক্রুট করে তখন থেকে তাকে নিজের বাসায় গিয়ে পাসপোর্ট পর্যন্ত নিতে দেয় নি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একজন স্পেশাল লিয়াজো হিসেবে বিশেষ ব্যবস্থায় কোনো রকম কাগজপত্র ছাড়াই তাকে ফ্লোরেন্সে নিয়ে আসা হয় নিজেদের বিমানে করে।

তাদের সি-১৩০ বিমানটি যখন আটলান্টিক পাড়ি দিতে থাকে তখন সিনস্কি ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে দেখেছে, ভদ্রলোককে তখন মোটেও সুস্থ মনে হচ্ছিলো না। প্লেনের দেয়ালের দিকে মুখ করে ছিলো সে। “প্রফেসর, এই প্লেনে কোনো জানালা নেই, বুঝলেন? কিছুদিন আগেও এটাকে মিলিটারি বিমান হিসেবে ব্যবহার করা হতো।”

ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়েছিলো ল্যাংডন। “এখানে ঢোকার পরই আমি খেয়াল করেছি সেটা। এরকম বদ্ধ জায়গায় আমার খুব অস্বস্তি হয়।”

“তাই আপনি একটি কাল্পনিক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার ভান করছেন?”

একটু মলিন হাসি দিয়ে বলেছিলো সে, “অনেকটা সেরকমই।”

“তাহলে একে দেখেন,” কথাটা বলেই দীর্ঘদেহী আর সবুজ চোখের শত্রুর ছবি বের করে দেখায়। “এ হলো বারট্রান্ড জোবরিস্ট।”

সিনস্কি ততোক্ষণে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সে তার সাথে জোবরিস্টের ঐ ঘটনাটির কথা বলে দিয়েছিলো। ব্ল্যাক ডেথের সাহায্যে এ পৃথিবীর জনসংখ্যা কমিয়ে আসন্ন দুর্যোগ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার যে বাতিকে ভুগছে সেটাও সবিস্তারে বলেছিলো তাকে। বিগত এক বছর ধরে তাকে যে হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে সেটাও বলতে বাদ দেয় নি।

“তার মতো এতো বিখ্যাত একজন কিভাবে দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে থাকতে পারলো?” জানতে চেয়েছিলো ল্যাংডন।

“তাকে সাহায্য করার মতো অনেকেই ছিলো। প্রফেশনালদের কথা বলছি। সম্ভবত কোনো বিদেশী সরকারও হতে পারে।”

“প্লেগ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে এমন কোন্ সরকার আছে এ পৃথিবীতে?”

“যেসব দেশের সরকার কালোবাজার থেকে পারমাণবিক ওয়ারহেড কেনার চেষ্টা করে তারা। ভুলে যাবেন না, কার্যকরী প্লেগ কিন্তু বায়োকেমিক্যাল অস্ত্র। এটার মূল্য অনেক। জোবরিস্ট খুব সহজেই ওরকম লোকজনকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে বুঝিয়ে থাকতে পারে এটার ব্যবহার হবে সীমিত পরিসরে। মানে লিমিটেড রেঞ্জে। কিন্তু তার এই প্রাণঘাতি জিনিসটা সত্যিকার অর্থে কতোটা ক্ষতি করতে পারে সে সম্পর্কে জোবরিস্ট ছাড়া আর কারোর কোনো ধারণা থাকার কথা নয়।”

চুপ মেরে যায় ল্যাংডন।

“এমনও হতে পারে, যারী জোবরিস্টকে সাহায্য করেছে তারা সেটা টাকা কিংবা ক্ষমতার জন্য করে নি, বরং তার মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই করেছে। মনে রাখবেন, জোবরিস্টের এমন অনেক শিষ্য আছে যারা তার জন্য সব করতে পারে। ভদ্রলোক একজন সেলিব্রেটি ছিলো। সত্যি বলতে, খুব বেশি দিন হয় নি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও সে বক্তৃতা করে এসেছে।”

“হারভার্ডে?” সিনস্কি কলম বের করে জোবরিস্টের ছবির বর্ডারের সাদা জায়গায় ইংরেজি H অক্ষরটির পাশে + চিহ্ন লিখলো।

H+

“এইচ পাস,” আলতো করে সায় দিয়ে বলে ওঠে ল্যাংডন। বছর কয়েক আগে সারা ক্যাম্পাসে এই লেখাটা দেখা গেছিলো। আমি মনে করেছিলাম এটা হয়তো কোনো কেমিস্ট্রি কনফারেন্স হবে।”

আক্ষেপে মাথা দোলায় সিনস্কি। “এটা ২০১০ সালের হিউম্যানিটি-প্লাস’ সামিটের সাইন-ওখানে বিপুল সংখ্যক ট্রান্সহিউম্যানিস্টরা একত্র হয়েছিলো। এইচ প্লাস ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলনের সিম্বল।

কথাটা শুনে নড়েচড়ে ওঠে ল্যাংডন।

“ট্রান্সহিউম্যানিজম,” বলেছিলো সিনস্কি, “একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, এক ধরণের দর্শন বলতে পারেন। খুব দ্রুত এটা বৈজ্ঞানিক মহলে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটার মূলপ্রতিপাদ্য হলো বংশগত কারণে যেসব শারিরীক দুর্বলতা নিয়ে মানুষ জন্মায় সেগুলো অতিক্রম করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার করা উচিত। অন্য কথায়, মানুষের বির্বতনের পরবর্তী পদক্ষেপ হওয়া উচিত নিজেদের উপর বায়োলজিক্যা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করা।”

“মনে হচ্ছে অশুভ চিন্তা,” বলেছিলো ল্যাংডন।

“আর সব পরিবর্তনের মতোই এটা মাত্রাগত ছাড়া আর কিছুই না। টেকনিক্যালি অনেক বছর ধরেই আমরা নিজেদের উপর ইঞ্জিনিয়ারিং করে আসছি-এমন সব ভ্যাকসিন আবিষ্কার করছি যেগুলো শিশুদেরকে নির্দিষ্ট রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়…পোলিও, স্মলপক্স, টাইফয়েড। পার্থক্য হলো জার্ম-লাইন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে জোবরিস্টের যুগান্তকারী আবিষ্কারটি সম্পর্কে যতোটুকু জানতে পেরেছি সেটা বংশপরম্পরা রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে, যারা নির্দিষ্ট কিছু জার্ম-লাইন লেভেল গ্রহণ করবে তারা বংশপরম্পরা ওইসব রোগ থেকে জন্মগতভাবেই সুরক্ষিত থাকবে।”

কথাটা শুনে চমকে ওঠে লাংডন। “তাহলে মানবজাতি আসলে বিবর্তিত হয়ে কিছু রোগবালাইয়ের হাত থেকে সুরক্ষিত হয়ে যাবে, যেমন টাইফয়েড?”

“এটা প্রাকৃতিক বিবর্তন নয়,” সিনস্কি শুধরে দেয়। “সাধারণত প্রাকৃতিক বিবর্তন লক্ষ-কোটি বছর সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এগোয়। এখন আমরা একটি জেনারেশনের মধ্যেই এরকম বিরাট পরিবর্তন আনতে পারবো। আসলে ঘুরেফিরে এই প্রযুক্তিটির মূল কথা হলো, ডারউইনের ‘যোগ্যতরের টিকে থাকা তত্ত্ব’-মানুষ এমন একটি প্রজাতিতে পরিণত হবে যে নিজেই নিজের বিবর্তন। প্রক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম।”

“এসব শুনে মনে হচ্ছে এটা আসলে ঈশ্বর নিয়ে খেলা,” বলে ওঠে ল্যাংডন।

“আমি মনেপ্রাণে আপনার সাথে একমত,” বলে সিনস্কি। “আর সব ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের মতো জোবরিস্টও জোর দিয়ে বলতো আমাদের অধীনে থাকা সমস্ত শক্তি মানবজাতির বিবর্তনের কাজে ব্যবহার করা উচিত-এরকম একটি শক্তি হলো জার্ম-লাইন জেনেটিক মিউটেশন-যাতে করে আমরা আমাদের প্রজাতিটিকে আরো উন্নত করতে পারি। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের জেনেটিক গঠনটি অনেকটা তাসের ঘরের মতো প্রতিটি অংশই আরো অসংখ্য অংশের উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে-বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা বুঝতেও পারি না। আমরা যদি মানুষের নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট সরিয়ে ফেলি তাহলে এর ফলাফল হিসেবে একইসাথে আরো শত শত বৈশিষ্ট বদলে যাবে। সম্ভবত সেটা মহাবিপর্যয়ের আকারেই ঘটবে।”

সায় দেয় ল্যাংডন। এ কারণেই বিবর্তনের ব্যাপারটি বিরামহীন একটি পক্রিয়া।”

“একদম ঠিক!” সিনস্কি বলে ওঠে। প্রফেসরের প্রতি তার মুগ্ধতা প্রতি মুহূর্তেই বেড়ে যেতে থাকে। “প্রকারান্তরে আমরা আসলে ইঅ্যান’দের সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিচ্ছি।”

ল্যাংডন ইঅ্যান শব্দটার মানে বোঝে-বাইবেলে এই শব্দটি অনন্তকাল বেঁচে থাকা ব্যক্তিকে বোঝায়।

“সময়টা খুবই বিপজ্জনক। আমরা এখন এমন সক্ষমতার জায়গায় পৌঁছে গেছি যে, আমাদের পরবর্তী বংশধরদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনা, স্ট্যামিনা, শক্তিমত্তা এমনকি বুদ্ধি আরো বেশি সমৃদ্ধ করে নিতে পারবো-এক ধরণের অসাধারণ প্রজাতি তৈরি করা যাকে বলে। এইসব হাইপোথেটিক্যাল সমৃদ্ধ মানুষকে ট্রান্সহিউম্যানিস্টরা পোস্টহিউম্যান হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। অনেকে বিশ্বাস করে এটাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজাতি।”

“কথাটা শুনে ইউজেনিক্সের মতোই ভীতিকর বলে মনে হচ্ছে,” বলে ল্যাংডন।

ইউজেনিক্সের কথা শুনে সিনস্কির গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।

১৯৪০-এর দশকে নাৎসি বিজ্ঞানী এমন একটি টেকনোলজি আবিষ্কার করেছিলো যার নামকরণ হয় তার নিজের নামানুসারে ইউজেনিক্স-এই টেকনোলজি ব্যবহার করে কাঙ্খিত কোনো সম্প্রদায়ের জন্মহার বাড়ানো কিংবা

অনাকাঙ্খিত’ সম্প্রদায়ের জন্মহার কমিয়ে দেয়া সম্ভব ছিলো। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে জাতিগত নিধনযজ্ঞ।

“ওটার সাথে মিল আছে,” সিনস্কি স্বীকার করে নেয়। “কিভাবে এই নতুন মানবপ্রজাতি তৈরি করা হবে সেটাই যেখানে বোধগম্য হচ্ছে না তখন অনেক স্মার্ট লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে আমাদের টিকে থাকার জন্য এই প্রক্রিয়াটি এক্ষুণি শুরু করা দরকার। ট্রান্সহিউম্যানিস্ট ম্যাগজিন H+-এর এক লেখক জার্ম-লাইন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে স্পষ্টতই পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছে, তার দাবি, এতে করে নাকি আমাদের প্রজাতির সত্যিকারের সম্ভাবনা নিশ্চিত হবে।” একটু থেমে আবার বলতে থাকে সিনস্কি। “ম্যাগাজিনটি নিজেদের সাফাই গাওয়ার জন্য ডিসকভারি টাইপের ম্যাগাজিন পরিচালনা করে থাকে, যার নাম দিয়েছে তারা এ বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক আইডিয়া। “

“আমিও কথাটার সাথে একমত,” বলে ল্যাংডন। “অন্ততপক্ষে সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে এটা বিপজ্জনক আইডিয়াই বটে।”

“কি রকম?”

“আমি ধরে নিচ্ছি জেনেটিক সমৃদ্ধকরণ অনেকটা কসমেটিক সার্জারির মতো-অনেক টাকার দরকার পড়ে এটা করতে গেলে। ঠিক?”।

“অবশ্যই। নিজেদেরকে কিংবা তাদের বংশধরদের সমৃদ্ধ করার জন্য যে টাকা লাগবে সেটা অনেকেরই সাধ্যে কুলোবে না।”

“তার মানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং খুব দ্রুত হ্যাভ আর হ্যাভ-নটদের একটি পৃথিবী তৈরি করে ফেলবে। ইতিমধ্যেই আমাদের এখানে ধনী-গরীবের বিরাট একটি পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে। আর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সেখানে সুপারহিউম্যান এবং সাধারণ মানুষ-এ দুই ধরণের প্রজাতি সৃষ্টি করে আরো বেশি বিভেদ আর ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করবে। আপনি নিশ্চয় জানেন বর্তমানে এক শতাংশ ধনীরাই এই পৃথিবী চালায় বলে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছে? এবার ভাবুন, সেই এক শতাংশ যদি আক্ষরিক অর্থে আরো উন্নত প্রজাতিতে পরিণত হয়-অন্যদের তুলনায় বেশি স্মার্ট, শক্তিশালী, স্বাস্থ্যবান-তাহলে কি হবে? এ পৃথিবীটা তখন এক ধরণের দাসযুগে ফিরে যাবে কিংবা এথনিক জাতিগত নিধন শুরু হয়ে যাবে।”

পাশে বসা হ্যান্ডসাম প্রফেসরের কথা শুনে সিনস্কি মুচকি হেসেছিলো। “আপনি আসলে খুব দ্রুত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিপজ্জনক দিকটি ধরতে পেরেছেন।”

“সেটা হয়তো ধরতে পেরেছি কিন্তু এখনও আমি জোবরিস্টের ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এইসব ট্রান্সহিউম্যানিস্টরা মানুষের সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, উন্নতি, দীর্ঘায়ু আর কল্যাণের জন্য এসব কথা বললেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার ব্যাপারে জোবরিস্টের দৃষ্টিভঙ্গি লোকজনকে হত্যার করার ব্যাপারেই সমর্থন দেয়। তার ট্রান্সহিউম্যানিজম এবং বাড়তি জনসংখ্যার ধারণার মধ্যে মারাত্মক দ্বন্দ্ব রয়েছে, তাই না?”

এ কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো সিনস্কি। ভালো একটি প্রশ্ন কি এর জবাবটি খুবই পরিস্কার এবং উদ্বেগজনক। “মনেপ্রাণে জোবরিস্ট ট্রান্সহিউম্যানিজমে বিশ্বাস করতো-টেকনোলজির মাধ্যমে মানবজাতির উন্নয়ন-কিন্তু সে আরো বিশ্বাস করতো এ কাজটা করার আগে আমাদের জনসংখ্যা ব্যাপকহারে কমিয়ে আনা জরুরি। তা-না হলে জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি সমগ্র মানবজাতিকেই বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত করে তুলবে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটা বোঝার আগেই আমরা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবো।”

ল্যাংডনের চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছিলো। “এজন্যে জোবরিস্ট মানুষের সংখ্যা কমিয়ে দিতে চেয়েছে…মানুষকে আরো বেশিদিন টিকিয়ে রাখার জন্য?”

মাথা নেড়ে সায় দেয় সিনস্কি। “একবার নিজেকে সে বর্ণনা করেছিলো এমন একটি জাহাজে মধ্যে আটকে আছে যেখানকার প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা প্রতি ঘণ্টায় দ্বিগুন হয়ে যাচ্ছে অথচ সে মরিয়া হয়ে একটি লাইফবোট তৈরি করে যাচ্ছে জাহাজটি নিজের ওজনে ডুবে যাবার আগে।” একটু থেমে আবার বলে ডাক্তার, “জাহাজের অর্ধেক মানুষ পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেবার পক্ষে মত দিয়েছিলো সে।”

ভুরু কুচকে ফেলে ল্যাংডন। “খুবই ভয়ঙ্কর চিন্তা।”

“একদম ঠিক। এ ব্যাপারে কোনো ভুলই নেই। জোবরিস্ট দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো রাতারাতি এ পৃথিবীর জনসংখ্যা কমিয়ে দেয়ার পদক্ষেপটাকে এক সময় মানবজাতি স্মরণ করবে বীরত্তোসূচক কাজ হিসেবে।”

“আমি আবারো বলবো ভয়ঙ্কর চিন্তাভাবনা।”

“তারচেয়েও বেশি কিছু কারণ এরকম চিন্তা শুধু জোবরিস্ট একাই করতো। জোবরিস্ট মারা গেলে অনেকের কাছে সে শহীদ হিসেবে সম্মান পেয়েছে। আমরা যখন ফ্লোরেন্সে পৌঁছাবো তখন কার পেছনে ছুটবো সে ব্যপারে কোনো ধারণা নেই। তবে আমাদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে এই প্লেগটা শুধু আমরা একাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি না। আর আপনার নিরাপত্তার জন্য, কেউ যেনো জানতে না পারে ওটা খুঁজে বের করার কাজে আপনি এখন ইটালিতে আছেন।”

ল্যাংডন তখন তার দান্তে বিশেষজ্ঞ বন্ধু ইগনাজিও বুসোনির কথা বলে, তার সাহায্য পেলে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে গিয়ে জোবরিস্টের ছোট্ট প্রজেক্টরে cerca trova শব্দটি যে পেইন্টিংয়ে দেখা গেছে সেটা ভালো করে দেখা সম্ভব হবে। মৃতের চোখ নিয়ে যে অদ্ভুত কোডটি রয়েছে সেটার মমোদ্ধার করতেও বুসোনি বেশ সাহায্য করতে পারবেন।

কথাটা শুনে ল্যাংডনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো সিনস্কি। “খুঁজুন তাহলেই পাবেন, প্রফেসর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।”

এরপর বিমানের ভেতরে স্টোররুম থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সিকিউড হ্যাঁজম্যাট টিউবটা নিয়ে আসে সিনস্কি-বায়োমেট্রিক সিলিং ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মডেল।

“বুড়ো আঙুলটা রাখুন,” টিউবটা ল্যাংডনের সামনে ধরে ছোট্ট একটা প্যাডের দিকে ইশারা করে সে।

হতভম্ব হলেও কথামতো কাজ করে ল্যাংডন।

সিনস্কি টিউবটাতে এমনভাবে প্রোগ্রাম করে দেয় যাতে একমাত্র তার হাতের আঙুলের ছাপ ছাড়া এটা কেউ খুলে এর ভেতরে থাকা ছোট্ট প্রজেক্টরটি বের করতে না পারে।

“এটাকে বহনযোগ্য লকবক্স মনে করুন,” হাসি দিয়ে বলেছিলো ডাক্তার।

“বায়োহ্যাজার্ড সিম্বলসহ?” অস্বস্তির সাথে তাকিয়েছিলো ল্যাংডন।

“এটাই আমাদের কাছে আছে। এর ভালো দিকটার কথা ভাবুন, কেউ এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইবে না।”

ল্যাংডন এরপর সোজা চলে যায় রেস্টরুমে। তার অনুপস্থিতিতে সিনস্কি হ্যারিস-টুইড জ্যাকেটের পকেটে ওটা ঢুকিয়ে রাখতে গেলে দেখতে পায় ওটা পকেটে ঠিকমতো রাখা যাচ্ছে না।

প্রজেক্টরটি এভাবে পকেটে নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারবে না সে। একটু ভেবে আবারো স্টোররুমে গিয়ে স্টিচবক্সটা নিয়ে ফিরে আসে। নিখুঁত দক্ষতায় জ্যাকেটের ভেতরে লাইনিং ফাঁক করে সযত্নে একটি গোপন পকেট তৈরি করে টিউবটি রেখে দেয়।

ল্যাংডন ফিরে এসে দেখতে পায় কাজ প্রায় শেষ।

প্রফেসর এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে যেনো এইমাত্র ডক্টর সিনস্কি মোনালিসাকে বিকৃত করে ফেলেছে। “আপনি আমার হ্যারিস-টুইডের লাইনিং কেটে ফেলেছেন?”

“শান্ত হোন, প্রফেসর,” বলেছিলো সে। “আমি খুব দক্ষ সার্জন। এই সেলাইগুলো একদম নিখুঁতভাবে করা হয়েছে।”

.

অধ্যায় ৬৮

ভেনিসের সান্তা লুসিয়া ট্রেন স্টেশনটি ধূসর রঙের পাথর আর কংক্রিটে তৈরি। খুবই অভিজাত আর বেশ ঢিলেঢালা কাঠামো। এটার নক্সা করা হয়েছে আধুনিক এবং শিল্পীত স্টাইলে, এর সম্মুখ ভাগটি সব ধরণের সিম্বল আর সাইন বিবর্জিত, শুধুমাত্র FS অক্ষর দুটো বাদে-ফেররোভি দেল্লো স্তাতো নামের স্টেট রেলওয়ে সিস্টেমের আইকন এটি।

শহরের একেবারে পশ্চিম দিকে গ্র্যান্ড ক্যানালের কাছ ঘেষে অবস্থিত বলে স্টেশন থেকে যাত্রিরা নেমেই দেখতে পায় চোখের সামনে অসংখ্য খাল চলে গেছে, যা কিনা ভেনিসের বৈশিষ্ট হিসেবে সারাবিশ্বে সুপরিচিত।

এখানে এলেই ল্যাংডন সবার আগে টের পায় নোনাবাতাসের ঘ্রাণ-সমুদ্র থেকে ভেসে আসা বাতাসের সাথে মিশে যায় স্টেশনের বাইরে বিক্রি হওয়া সাদা পিজ্জার সুবাস। আজ অবশ্য বাতাস বইছে পুবদিক থেকে, তাই খালে ভেসে বেড়ানো, নোঙর করে রাখা ডিজেলের স্পিডবোটের কারণে বাতাসে ডিজেলের কটু গন্ধ নাকে এসে লাগলো। বোটের লোকজন পর্যটকদের হাক দিয়ে ডাকছে। জলপথ ভ্রমণ করিয়ে আনার জন্য।

পানিতে হাউকাউ, ভাবলো ল্যাংডন। দেখতে পেলো জলপথেও ট্রাফিকজ্যাম লেগে আছে।

খালের ওপারে পাথর ছুঁড়ে মারা দূরত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সান সিমিওনি পিক্কোলোর গম্বুজটি। অসাধারণ দেখতে এই চার্চটি ইউরোপের সেরা। চ্যাপ্টা গম্বুজ আর বৃত্তাকারের স্যাঙ্কচুয়ারি পুরোপুরি বাইজান্টাইন স্টাইলের, কিন্তু এর কলামগুলো আর প্রবেশপথের নক্সা গ্রিক এবং রোমান স্থাপত্যকলার পরিচয় বহন করছে। প্রবেশপথের সামনে মার্বেলের রিলিফে স্থান পেয়েছে শহীদ হওয়া সেন্টদের ছবি।

ভেনিস একটি উন্মুক্ত জাদুঘর, ভাবলো ল্যাংডন। পানিতে ভেসে থাকা জাদুঘর। এ শহরের নীচে যে হুমকিটা রয়েছে তার তুলনায় এখানকার বন্যার সম্ভাবনা একেবারেই মামুলি।

অথচ কারোর কোনো ধারণাই নেই…।

দান্তের মৃত্যু-মুখোশের পেছনে যে কবিতাটা রয়েছে সেটা এখনও ল্যাংডনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবছে পংক্তিগুলো শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় তাদেরকে। তার পকেটে একটি কাগজে কবিতাটি লেখা আছে। কিন্তু সিয়েনার কথামতো মুখোশটি কাগজে পেচিয়ে ট্রেনস্টেশনের সেলফ-সার্ভ লকারে রেখে দিয়েছে তারা। যদিও এই অমূল্য আর্টিফেক্টটি রাখার জন্য ঐ জায়গাটা মোটেও উপযুক্ত নয় তারপরও ভেনিসের মতো খাল-বিলের শহরে প্লাস্টারের মুখোেশ নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে ওখানে থাকাটাই বেশি নিরাপদ।

“রবার্ট?” ফেরিসের সঙ্গে সামনে পার্ক করে রাখা ওয়াটার-ট্যাক্সির কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বললো সিয়েনা। “আমাদের হাতে কিন্তু একদম সময় নেই।”

চারপাশে স্থাপত্যগুলো দেখতে দেখতে ল্যাংডন একটু পিছিয়ে পড়েছিলো। দৌড়ে চলে এলো তাদের কাছে। গ্র্যান্ড ক্যানালের আশেপাশে অচিন্তনীয় ভীড়। ভাপোরেত্তো নাম্বার ওয়ান নামের ওপেন-এয়ার ওয়াটার-বাসে করে রাতের ভেনিস ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা।

আজ কোনো ভাপোরেত্তো নয়, ভাবলো ল্যাংডন। এই জিনিসটা একদম ধীরগতির, সেই তুলনায় ওয়াটার ট্যাক্সি অনেক দ্রুত চলে, কিন্তু দুঃখের বিষয় ট্রেন স্টেশনের বাইরে লম্বা লাইন দেখেছে ওয়াটার-ট্যাক্সির জন্য।

অপেক্ষা করার মেজাজে নেই ফেরিস, দ্রুত পুরো ব্যাপারটি নিজের হাতে তুলে নিলো সে। তার পকেটে প্রচুর টাকা আছে, সেটা ব্যবহার করে একটি ওয়াটার-লিমোজিন ভাড়া করে ফেললো। এটাতে করে রওনা দিলে যেমন দ্রুত যাওয়া যাবে তেমনি ভ্রমনটা বেশ প্রাইভেট হবে-গ্র্যান্ড ক্যানাল থেকে সেন্ট মার্কস স্কয়ারে যেতে মাত্র পনেরো মিনিট লাগবে তাদের।

লিমোর ড্রাইভার অসম্ভব হন্ডসাম, পরে আছে আরমানির সুট। তাকে ক্যাপ্টেন নয় বরং সিনেমার নায়ক মনে হচ্ছে। হাজার হোক, এটা ভেনিস। অভিজাত ইটালির পাদভূমি।

“মওরিজিও পিম্পোনি,” ড্রাইভার চোখ টিপে নিজের নামটা বললো সিয়েনাকে। তাদের সবাইকে অভ্যর্থনা জানালো তার লিমাতে ওঠার সময়।

“প্রসেচ্চো? লিমোচেল্লো? শ্যাম্পান?”

“নো, গাজি,” জবাবে বললো সিয়েনা। অনর্গল ইতালিতে বলে দিলো তাদেরকে যতো দ্রুত সম্ভব সেন্ট মার্কস স্কয়ারে নিয়ে যেতে হবে।

“মা সার্তো! আবারো চোখ টিপলো সে। “এই ভেনিজিয়াতে আমার বোটটাই সবচেয়ে দ্রুতগতির…”

ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়েই বোটটা দ্রুত ঘুরিয়ে রওনা দিলো মওরিজিও।

“স্কুসাতে!” ক্ষমা চেয়ে বললো মওরিজিও। আশেপাশে অন্য বোটগুলো ঢেউয়ে দুলে উঠেলো। “ভিআইপি!”

বোটটা গ্র্যান্ড ক্যানালের পুবদিক দিয়ে সেন্ট লুসিয়ার পাশ ঘেষে চলে যাবার সময় ল্যাংডন সেটা দেখলো। খালের বাঁকে বিশাল আকৃতির সান জেরেমিয়া চার্চের গম্বুজটা চোখে পড়লো এবার।

“সেন্ট লুসিয়া, ফিসফিসিয়ে বললো ল্যাংডন, চার্চের দেয়ালে খোদাই করা লেখাটা পড়লো সে। “অন্ধের কঙ্কাল।”

“কী বললে?” সিয়েনা বুঝতে না পেরে বললো। তার ধারণা ল্যাংডন বোধহয় কবিতাটির কোনো রহস্যের কূলকিনারা করতে পেরেছে।

“কিছু না,” বললো প্রফেসর। “অদ্ভুত একটি চিন্তা। হয়তো কিছু না।” চার্চটা দেখালো সে। “খোদাই করা লেখাটা দেখেছো? সেন্ট লুসিয়াকে এখানে। সমাহিত করা হয়েছে। আমি অনেক সময় খৃস্টিয় সেন্টদের উপর ভিত্তি করে যেসব আর্ট আছে, মানে হেজিওগ্রাফি আর্টের উপর লেকচার দিতে গিয়ে মনে হতো সেন্ট লুসিয়া অন্ধ সেন্টদের শুরু।”

“সি, সান্তা লুসিয়া!” মওরিজিও উৎসাহ নিয়ে বললো। “অন্ধদের সেন্ট! আপনারা গল্পটা জানেন, না? লুসিয়া অনেক সুন্দরী ছিলেন বলে সব পুরুষই তাকে কামনা করতো। তাই ঈশ্বরের কাছে বিশুদ্ধ রাখতে এবং কুমারীত্ব বজায় রাখার জন্য নিজ হাতে তার চোখ নষ্ট করে ফেলেন।”

আৎকে উঠলো সিয়েনা। “কমিটমেন্ট ভালোই ছিলো তাহলে।”

“এই আত্মত্যাগের পুরস্কার হিসেবে,” মওরিজিও আরো বলতে লাগলো, “ঈশ্বর লুসিয়াকে আরো বেশি সুন্দর একজোড়া চোখ উপহার দেন!”।

ল্যাংডনের দিকে তাকালো সিয়েনা। “এসবের কোনো মানে হয়?”

“ঈশ্বর খুবই রহস্যময় পদ্ধতিতে কাজ করেন,” ল্যাংডনের চোখে ভেসে উঠলো বিশটির মতো বিখ্যাত পুরনো মাস্টারপিস যার সবগুলোতেই চিত্রিত করা হয়েছে সেন্ট লুসিয়া প্লেটে করে নিজের চোখ জোড়া নিয়ে যাচ্ছে। যদিও সেন্ট লুসিয়ার অনেকগুলো ভার্সন আছে তারপরও একটি কমন বিষয় হলো তিনি নিজের চোখ জোড়া কেটে বিয়ে পড়ায় যে যাজক তার কাছে নিবেদন করেছিলেন। তারপর সাহসের সাথে বলেছিলেন : “এইযে আমার অর্ঘ্য তুলে নিন…যা কিনা অনেকের কামনার বস্তু…বাকি জীবন আমি এটা ছাড়াই থাকবো…আমাকে এবার শান্তিতে থাকতে দিন।”

তুলে নিন, ভাবলো ল্যাংডন। বুঝতে পারলো ঠিক একই শব্দ কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে। ভেনিসের বিশ্বাসঘাতক ডওজ’কে খোঁজো যে…অন্ধের কঙ্কাল তুলেছিলো।

কাকতালীয় মিলটা হতভম্ব করে দিলো ল্যাংডনকে। তাহলে কি সেন্ট লুসিয়াই সেই অন্ধজন যার কথা সাংকেতিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কবিতায়?

“মওরিজিও,” চিৎকার করে বললো ল্যাংডন, সান জেরেমিয়া চার্চের দিকে ইশারা করলো সে। “এই চার্চেই তো সেন্ট লুসিয়ার কঙ্কাল রাখা আছে, না?”

“হ্যাঁ, অল্প কিছু,” বললো মওরিজিও। একহাতে দক্ষভাবে বোট চালাচ্ছে। আর পেছন ফিরে যাত্রিদের সাথে কথা বলছে। সামনে কি আছে না আছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। তবে বেশিরভাগ হাঁড় কিন্তু এখানে নেই। সেন্ট লুসিয়াকে এখানকার মানুষ খুবই ভালোবাসে, তাই আমরা

“মওরিজিও!” চিৎকার করে বলে উঠলো ফেরিস। “সেন্ট লুসিয়া অন্ধ ছিলেন কিন্তু তুমি না! সামনে তাকাও!”

মওরিজিও হেসে দ্রুত তার বোটটাকে ঘুরিয়ে দিলো যাতে করে সামনের দিকে ছুটে আসা অন্য একটি বোটের সাথে সংঘর্ষ না বাধে।

ল্যাংডনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সিয়েনা। “তুমি কি মেলাতে চাচ্ছো? যে বিশ্বাসঘাতক ডজ অন্ধের কঙ্কাল তুলেছিলেন?”

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো ল্যাংডন। “বুঝতে পারছি না।”

দ্রুত সিয়েনা আর ফেরিসকে সেন্ট লুসিয়ার কঙ্কালের ইতিহাসটি বলে গেলো সে-সব ধরণের হ্যাঁজিওগ্রাফিতে এটা একেবারেই অদ্ভুত একটি ঘটনা। বলা হয়, সুন্দরী লুসিয়াকে একজন প্রভাবশালী সুইটর প্রস্তাব দিলে তিনি সেটা ফিরিয়ে দেন, তখন সেই লোক ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু কিংবদন্তী মতে লুসিয়ার দেহ নাকি আগুনে পোড়ে নি। যেহেতু তার দেহ আগুনকে প্রতিরোধ করতে পেরেছিলো তাই মনে করা হতো তার কঙ্কাল, হাঁড় এসবের বিশেষ গুন আছে। এগুলো যার কাছে থাকবে সে হবে অস্বাভাবিক দীর্ঘায়ুর অধিকারী।

“জাদুর কঙ্কাল?” বললো সিয়েনা।

“সেরকমই বিশ্বাস করা হয়। এ কারণেই তার কঙ্কালের হাঁড় সারাবিশ্বের বিভিন্ন চার্চে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দু’হাজার বছর ধরে শক্তিশালী নেতা শাসকেরা নিজেদের বয়স আর মৃত্যুকে প্রলম্বিত করার জন্য এই হাঁড়গুলো দখলের লড়াই করে গেছে। হাঁড়গুলো বার বার চুরি হয়েছে, স্থানান্তর করা হয়েছে একাধিক জায়গায়, তারপর অন্য যেকোনো সেন্টের তুলনায় তার হাঁড়গুলোই সবচেয়ে বেশি ভাগ করে ছড়িয়ে দেয়া হয় বিশ্বব্যাপী। তার হাঁড়গুলো ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী কয়েক ডজন ব্যক্তির হাত ঘুরে এসেছে।”

“তার মধ্যে,” সিয়েনা আগ বাড়িয়ে বললো, “একজন বিশ্বাসঘাতক ওজ’ও আছে?”

ভেনিসের বিশ্বাসঘাতক ডজকে খোঁজো যে ঘোড়াদের মাথা কেটেছিলো…আর তুলে এনেছিলো অন্ধের কঙ্কাল।

‘ভালো সম্ভাবনা আছে,” বললো ল্যাংডন, বুঝতে পারছে দান্তের ইনফার্নোতে সেন্ট লুসিয়ার কথাই হয়তো বলা হয়েছে। তিনজন আশীর্বাদপ্রাপ্ত নারীর মধ্যে লুসিয়া অন্যতম-লে ‘ত্রে দোন্নে বেনেদেত্তে’-যারা ভার্জিলকে ডেকে এনেছিলো দান্তেকে মাটির নীচ থেকে পালাতে সাহায্য করার জন্য। অন্য দু’জন নারী হলো কুমারি মেরি এবং দান্তের প্রিয়তমা বিয়েত্রিচ, কিন্তু দান্তে সেন্ট লুসিয়াকে স্থান দিয়েছেন বাকিদের চেয়ে একটু উচ্চে।

“তোমার কথা যদি ঠিক হয়ে থাকে,” উত্তেজিত কণ্ঠে বললো সিয়েনা, “তাহলে ঐ একই ডজ ঘোড়াদের মাথা কেটে থাকবেন…”

“…সেই সাথে সেন্ট লুসিয়ার কঙ্কাল চুরি করেছিলেন, ল্যাংডন তার সাথে তাল মেলালো।

সায় দিলো সিয়েনা। “এরফলে আমাদের তালিকা বেশ ছোটো হয়ে আসবে।” ফেরিসের দিকে তাকালো। “আপনি কি নিশ্চিত আপনার ফোনটা কাজ করছে না? একটু অনলাইনে সার্চ করলে-”।

“একদম ডেড হয়ে গেছে,” বললো ফেরিস। “আমি চেক করে দেখেছি। দুঃখিত।”

“আমরা একটু পরই পৌঁছে যাবো,” বললো ল্যাংডন। “আমার কোনো সন্দেহ নেই সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকায় কিছু একটা খুঁজে পাবোই।”

সেন্ট মার্কস হলো পাজলের একমাত্র অংশ যেটা ল্যাংডনের কাছে সবচেয়ে বেশি সলিড বলে মনে হচ্ছে। পবিত্র জ্ঞানের মওজিওন। ল্যাংডন প্রায় নিশ্চিত ঐ ব্যাসিলিকায় একজন রহস্যময় ডজ-এর সন্ধান পাওয়া যাবে…ভাগ্য ভালো থাকলে সেখান থেকে নির্দিষ্ট একটি প্রাসাদে খোঁজও তারা পাবে যে জায়গাটি জোবরিস্ট প্লেগ ছড়িয়ে দেবার জন্য বেছে নিয়েছে। ওখানে অন্ধকারে থানিক দানব প্রতীক্ষায় আছে।

জোর করে প্লেগের ভয়ঙ্কর ছবিগুলো মনের পর্দা থেকে তাড়াতে চাইলো ল্যাংডন কিন্তু পারলো না। সে প্রায়ই ভাবে এক সময় কী অসাধারণই না ছিলো এই শহরটি…তারপর প্লেগের ছোবলে দুর্বল হয়ে পড়লে প্রথমে অটোমানরা দখল করে নেয়, তারপর নেপোলিওন…তখন অবশ্য ইউরোপের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে এটি শাসিত হয়েছিলো। সবদিক থেকেই পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর, সম্পদশালী এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ একটি শহর ভেনিস। এর সমকক্ষ

আর একটিও নেই।

পরিহাসের বিষয় হলো এই শহরের অধিবাসীদের বিদেশপ্রীতিই এর সর্বনাশ ঘটিয়েছে-প্রাণঘাতি প্লেগ চীন থেকে ভেনিসে চলে আসে বাণিজ্যিক জাহাজের মালামালের সাথে জীবাণু আক্রান্ত ইঁদুরের মাধ্যমে। এই প্লেগের মরণ ছোবলেই চীনের এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা বিনাশ হয়ে গেছিলো। ইউরোপে আসামাত্র এই রোগের ছোবলে প্রতি তিনজনের একজন আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে-নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ, ধনী-গরীব কেউ বাদ যায় নি।

প্লেগের মহামারিতে যখন ভেনিস আক্রান্ত হয়েছিলো তখনকার জীবনযাত্রা কেমন ছিলো সে সম্পর্কে ল্যাংডন পড়েছে। একটা সময় এসে গেছিলো যে মৃতদের কবর দেয়ার মতো শুকনো জায়গা পাওয়া যেতো না। উপায়ন্তর না দেখে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো খালে-বিলে। কিছু কিছু খাল-বিলে এতো লাশ ভাসততা যে নৌকা চালাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হতো। লগি-বৈঠা দিয়ে লাশ সরিয়ে তাদেরকে চলাচল করতে হতো। কোনো প্রার্থনায় এই মহামারির প্রকোপ কমতো না। শহরের শাসকেরা যখন বুঝতে পারলো ইঁদুরের মাধ্যমেই এই দুর্পিবাকের শুরু ততোক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছিলো তারপরও একটা ডিক্রি জারি করে তারা, বাইরে থেকে কোনো জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারবে না, বন্দর থেকে বেশ বিছুটা দূরে চল্লিশ দিন থাকার পর জাহজাগুলোকে মালামাল নামানোর অনুমতি দেয়া হতো-আজকের দিনে ইতালিয় ভাষায় চল্লিশ সংখ্যাটি-কোয়ারান্তা-খুবই তিক্ত স্মৃতি বহন করে কোয়ারান্টাইন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

তাদের বোট আরেকটা বাঁক নিলে উৎসবমুখর একটি বাতাস যেনো। ল্যাংডনের মুখে এসে ঝাঁপটা মারলো। প্লেগের মৃত্যু আর বীভৎসতা থেকে ফিরে এলো সে, চোখের সামনে দেখতে পেলো তিন স্তরের অভিজাত একটি স্থাপনা।

কাসিনো দি ভেনিজিয়া : অ্যান ইনফিনিতি ইমোশন।

ক্যাসিনোর ব্যানারের কথাগুলো ল্যাংডন কখনই বুঝতে পারে নি। এই রেনেসাঁ আমলের প্রাসাদটি ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ভেনিসের ল্যান্ডস্কেপের একটি অংশ হয়ে আছে। এক সময়ের ব্যক্তিমালিকানায় থাকা ম্যানশনটি এখন কালো টাইয়ের গেমের হল হিসেবে বিখ্যাত। ১৮৮৩ সালে সুরকার রিচার্ড ভগনার এখানেই তার বিখ্যাত অপেরা পার্সিফল কম্পোজ করার পর পরই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

কাসিনোর পরই ডান দিকে আরেকটি পুরনো ভবনের উপর বড়সড় ব্যানার ঝুলছে, এটার রঙ গাঢ় নীল, ঘোষণা দিচ্ছে কা’প্রেসারো : গ্যালেরিয়া ইস্তারন্যাজিওনালি দা’আর্তে মদানা।

কয়েক বছর আগে এখানে এসে গুস্তাভ ক্লিতের মাস্টারপিস দ্য কিস দেখেছিলো ল্যাংডন। ছবিটা ভিয়েনা থেকে ধার করে আনা হয়েছিলো প্রদর্শনীর জন্য।

চওড়া একটি খাল দিয়ে আরো গতি বাড়িয়ে ছুটতে লাগলো মওরিজিও।

সামনেই দেখা যাচ্ছে রিয়ালতো ব্রিজ-তার মানে সেন্ট মার্কস স্কয়ারে যাবার অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছে তারা। ব্রিজের নীচ দিয়ে তাদের বোটটা যখন চলে যাবে তখন উপরের দিকে চেয়ে ল্যাংডন একজন মানুষকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তাদের দিকে চেয়ে আছে সে।

লোকটার মুখ বেশ পরিচিত…আর ভীতিকর।

সঙ্গে সঙ্গে আৎকে উঠলো সে।

ধূসর আর লম্বাটে মুখটার একদম শীতল দুটি চোখ আর পাখির ঠোঁটসদৃশ্য নাক।

তাদের বোটটা ব্রিজের নীচ দিয়ে চলে যাবার পর ল্যাংডন বুঝতে পারলো এটা আসলে একজন পর্যটক, যে কিনা এরকম জিনিস সুভেনির হিসেবে কিনে। পরে আছে-রিয়ালতো মার্কেটে প্রতিদিন এরকম শত শত মুখোশ বিক্রি হয়।

আজকে অবশ্য এটাকে খুব একটা প্রীতিকর বলে মনে হলো না।

.

অধ্যায় ৬৯

সেন্ট মার্কস স্কয়ারটি ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানালের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত, ওখানকার জলপথটি মিশে গেছে খোলা সাগরে। ওটার পরেই আছে ত্রিভূজাকৃতির দূর্গ দোগানা দা মার-মেরিটাইম কাস্টমস অফিস-সেই ভবনের ওয়াচটাওয়ারে এক সময় বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের হাত থেকে ভেনিসকে রক্ষা করার কাজে পাহারা দেয়া হতো। বর্তমানে টাওয়ারের উপরে সোনালী রঙের বিশাল একটি ভূ-গোলক আর আবহাওয়ার সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়েছে সৌভাগ্যের দেবীকে চিত্রিত করে, সাগরের নাবিকদের জানিয়ে দেয়া হয় বাতাস কোন দিকে বইছে, সাগরের মতিগতি কেমন।

মওরিজিও তার বোটটা খালের শেষমাথায় নিয়ে আসতেই তাদের সামনে খোলা সাগর উদ্ভাসিত হলো। এর আগেও রবার্ট ল্যাংডন এখানে অনেকবার ভ্রমণ করেছে অবশ্য সব সময়ই বিশাল আকারের ভাপোরেত্তা’তে করে তাই বড় বড় ঢেউয়ে তাদের লিমোটা দুলে উঠলে একটু অস্বস্তি বোধ করলো সে।

সেন্ট মার্কস স্কয়ারের ডকে ভেড়াতে হলে তাদের লিমোটাকে চওড়া একটি লেগুনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, যেখানে জড়ো হয়ে আছে অসংখ্য ইঞ্জিন বোট, ক্রুজ আর ইয়ট। যেনো তারা এখন গ্রামের পথ শেষ করে চলে এসেছে আট লেইনের মহাসড়কে।

কাছ ঘেষে দশতলার একটি বিশাল কুইজ চলে গেলে সিয়েনা চেয়ে দেখলো অবাক চোখে। জাহাজটির ডেকে গিজগিজ করছে লোকজনে। বেশিরভাগই জড়ো হয়েছে রেলিংয়ের কাছে। ছবি তুলছে সেন্ট মার্কস স্কয়ারের। ওটার ঠিক পেছনেই আছে আরো তিনটি ক্রুজার, তারা অপেক্ষা করছে রওনা দেবার জন্য। ল্যাংডন শুনেছে, ইদানীং ক্রুজারের সংখ্যা এতো বেড়ে গেছে যে, দিন-রাত। সারাক্ষণই চলাচল করতে থাকে ওগুলো।

মওরিজিও পেছনে তাকিয়ে বললো, “আমি হ্যারিস বারে পার্ক করি?” বেল্লিনি যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছিলো সেই বিখ্যাত রেস্তোরাঁটির দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “ওখান থেকে সেন্ট মার্কস স্কয়ার অল্প একটু হাটাপথের।”

“না, আমাদেরকে সেন্ট মার্কস পর্যন্ত নিয়ে যাও,” ফেরিস আদেশের সুরে বললো, সেন্ট মার্কস স্কয়ারের যে ডকটা আছে সেটা দেখিয়ে দিলো সে।

মওরিজিও কাঁধ তুললো। “আপনি যেখানে চাইবেন। একটু ধরে বসুন!”

লিমোর গতি বেড়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে, পানিতে ভেসে থাকা অসংখ্য নৌযানকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো ডকের দিকে।

ল্যাংডন অবাক হয়ে দেখতে পেলো তাদের মতোই কিছু গোন্দোলা এগিয়ে যাচ্ছে ডকের দিকে-চল্লিশ ফিট লম্বা আর প্রায় চৌদ্দ শ’ পাউন্ড ওজনের

ভেনিসিয় নৌকাগুলো উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যেও স্থির আছে।

একটা গোলোলাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে মওরিজিও বললো, “সামনের মেটাল ডিজাইনটা দেখেছন? গোন্দোলার ঐ একটা জিনিসই মেটালের-এটাকে বলে ফেরো দি পুরুয়া-মাস্তলের লোহা। এরকমটা কেবল ভেনিসেই দেখা যায়!”

মওরিজিও বলতে লাগলো ভেনিসের গোন্দোলার মাস্তলে যে ঘাসকাটার কাঁচির মতো ডিজাইনটি আছে সেটার প্রতীকি অর্থ রয়েছে। ফেরো’র বাঁকানো। অংশটি এ্যান্ড ক্যানালকে প্রতিনিধিত্ব করে। এর ছয়টি দাঁতাল ভেনিসের ছয়টি জেলাকে বোঝায়। আর লম্বা ব্লেডটি ভেনিশিয়ান ডজ-এর মাথার টুপি।

ডওজ, ভাবলো ল্যাংডন। একটু পর যে কাজটা তাকে করতে হবে তার কথা ভাবলো। ভেনিসের বিশ্বাসঘাতক ডজকে খোঁজো যে ঘোড়াদের মাথা কেটেছিলো…আর তুলেছিলো অন্ধের কঙ্কাল। সামনের দিকে তাকালো ল্যাংডন, ডকের পরে গাছপালার পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লাল টকটকে ইটের তৈরি সেন্ট মার্কসের বেলটাওয়ারটি। একেবারে শীর্ষে ফেরেস্তাদের নেতা গ্যাব্রিয়েল তিনশ’ ফুট নীচে তাকিয়ে দেখছে।

যে শহরে হাইরাইজ বিল্ডিং খুব একটা দেখা যায় না পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ের কারণে সেখানে এতো লম্বা কাম্পানিলি দি সান মাকো ভেনিসের অসংখ্য খাল-বিল দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের নেভিগেশনের কাজ করে থাকে। পথ হারিয়ে ফেলা পর্যটকেরাও এটা দেখে পথ চিনে নিতে পারে। ল্যাংডন এখনও বিশ্বাস করতে পারে না ১৯০২ সালে এই টাওয়ারটি ভেঙে পড়লে সেন্ট মার্কস। স্কয়ারে ধ্বংসস্তূপের পাহাড় জমে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই দুর্যোগের প্রাণ হারায় শুধু একটি বেড়াল।

এই শহরে অসংখ্য দেখার মতো জায়গা থাকলেও ল্যাংডনের পছন্দ রিভা দেগলি শিয়াভোনির পাথরের পথটি। জলপথের পাশ ঘেষে চলে যাওয়া এই রিভার নির্মাণ হয়েছিলো নবম শতকে। সেন্ট মার্কস স্কয়ার পর্যন্ত এটি বিস্তৃত। এই পথের এক পাশে রয়েছে অসংখ্য ক্যাফে, অভিজাত হোটেল আর আন্তোনিও ভিভালদি চার্চ। এছাড়াও এখানে ভেনিসের সর্বপ্রাচীন জাহাজ নির্মাণ ইয়ার্ড রয়েছে। বলা হয় আগের দিনে এখানকার জাহাজ নির্মাণের সময় পানিতে গরম আলকাতরা ফেলে দিলে যে বাষ্প তৈরি হতো সেটা দেখেই ইনফার্নোতে শাস্তিদানের পদ্ধতি হিসেবে আলকাতরার নদীর আইডিয়াটি অনুপ্রাণিত করেছিলো

ল্যাংডন এবার ডান দিকে তাকালো, জলপথ ধরে বহু দূরে চলে গেছে রিভা, তারপরই আচমকা যেনো থেমে গেছে, এখানেই সেন্ট মার্কস স্কয়ারের দক্ষিণ প্রান্তটি অবস্থিত, খোলা সাগরের দিকে মুখ করে থাকা বিশাল চওড়া একটি রাস্তা। ভেনিসের স্বর্ণযুগের সময় এই জায়গাটিকে বলা হতো সভ্যতার প্রান্তসীমা।

আজকের দিনে এই তিনশ’ গজ লম্বা পথের পাশে কম করে হলেও একশ’টির মতো কালো রঙের গান্দোলো নোঙর করে আছে।

এখনও ল্যাংডনের বুঝতে একটু কষ্ট হয় এই ছোটো শহরটি-আকারে নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের দ্বিগুন হবে-সমুদ্রের বুক থেকে জেগে উঠে কি করে পশ্চিমাবিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ আর বিশাল সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছিলো।

স্কয়ারের কাছাকাছি তাদের বোটটা চলে এলে ল্যাংডন দেখতে পেলো পুরো জায়গাটি লোকে লোকারণ্য। এক সময় সেন্ট মার্কস স্কয়ারকে নেপোলিওন বোনাপার্ট উল্লেখ করেছিলেন ইউরোপের ড্রইংরুম’ হিসেবে। এটাকে ‘রুম’ হিসেবে দেখলে বলতেই হয়, অসংখ্য অতিথির সংস্থান করা যাবে এখানে। পুরো পিয়াজ্জাটি দেখে মনে হয় এটা যেনো তার মুগ্ধ দর্শকদের ভারে পানিতে ডুবে যাচ্ছে।

“হায় ঈশ্বর,” লোকজনের ভীড় দেখে বিড়বিড় করে বলে উঠলো সিয়েনা।

ল্যাংডন অবশ্য বুঝতে পারলো না, জোবরিস্ট প্লেগ ছড়িয়ে দেবার জন্য এরকম জনবহুল এলাকা বেছে নেয়ার কারণে মেয়েটি অবাক হচ্ছে নাকি তার অতিরিক্ত জনসংখ্যা সমস্যাটি এইমাত্র উপলব্ধি করতে পেরেছে সে।

প্রতিবছর ভেনিসে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসে-এক হিসেবে দেখা গেছে সংখ্যাটি পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের এক শতাংশ-আনুমানিক প্রায় বিশ মিলিয়ন পর্যটক। এই হিসেবটি অবশ্য ২০০০ সালের। এরইমধ্যে আরো এক বিলিয়ন জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এখানকার পর্যটকের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন মিলিয়নে। ভেনিস যেনো এ পৃথিবীর মতোই, সীমিত স্থানে। জনসংখ্যার বিপুল চাপে দিশেহারা।

কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ফেরিস, মেইনল্যান্ডের দিকে তাকালো সে।

“আপনি ঠিক আছেন তো?” কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো সিয়েনা।

চমকে তার দিকে তাকালো ফেরিস। “হ্যাঁ, হ্যাঁ…এই তো ভাবছিলাম।” মওরিজিওর দিকে ফিরলো এবার : যতোটা সম্ভব সেন্ট মার্কসের কাছে পার্ক করো।”

“কোনো সমস্যা নেই!” হাত নেড়ে বললো ড্রাইভার। “দুই মিনিট!”

লিমোটা সেন্ট মার্কস স্কয়ারের একদম কাছে চলে এলো এবার, উওজদের প্রাসাদটি রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ডান দিকে।

ভেনিশিয় গোথিক স্থাপত্যের যথার্থ উদাহরণ এটি। ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের মতো কোনো মিনার কিংবা সুউচ্চ টাওয়ার নেই এই প্রাসাদের, একেবারেই আয়তক্ষেত্রের এই ভবনটি বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে। ফলে এর ভেতরে উওজ এবং তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অসংখ্য রুমের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয় নি।

সাদা রঙের লাইমস্টোনের এই ভবনটি রোদে চকচক করছে।

তাদের বোটটা ডকে ভেড়ার পর লোকজনের ভীড় দেখে ফেরিসকে চিন্তিত মনে হলো। ব্রিজের উপর হাজার হাজার পর্যটক দাঁড়িয়ে আছে, নীচের খালের দিকে ইঙ্গিত করছে তারা সবাই, যেটা উওজ’দের প্রাসাদকে দুটো বিরাট অংশেষ বিভক্ত করেছে।

“তারা কী দেখছে?” নার্ভাস হয়ে জানতে চাইলো ফেরিস।

“ইল পন্তে দেই সসপিরি,” জবাব দিলো সিয়েনা। “বিখ্যাত ভেনিশিয় ব্রিজ।”

সঙ্কীর্ণ জলপথের দিকে তাকালো ল্যাংডন। চমৎকার বাঁক আর টানেলটা দেখলো সে, দুটো ভবনের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। The Bridge of Sighs, ভাবলো সে। শৈশবের প্রিয় দুটো ছবিট কথা মনে পড়ে গেলো। অন্যটার নাম A Little Romance, ওটার কাহিনী গড়ে উঠেছে এক কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে : যদি কোনো প্রেমিকযুগল সূর্যাস্তের সময় এই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সেন্ট মার্কসের ঘণ্টাধ্বণি বাজার সময় একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় তাহলে তাদের ভালোবাসা চিরকাল অটুট থাকবে। সেই ছবির চৌদ্দ বছরের অভিনেত্রী ডিয়ানে লেইনকে দেখে ল্যাংডন ক্রাশ খেয়েছিলো।

অনেক বছর পর ল্যাংডন জানতে পেরেছিলো Bridge of Signs নামটি আসলে আকাঙ্খর দীর্ঘশ্বাস থেকে নয়, এসেছে দুর্দশার দীর্ঘশ্বাস থেকে। যে টানেলটি ডওজদের প্রাসাদ আর জেলখানার সাথে সংযুক্ত আছে সেখান দিয়ে হেঁটে যাবার সময় কয়েদিদের আর্তনাদ আর মৃত্যুযন্ত্রণা শোনা যেতো।

এই জেলখানাটি ল্যাংডন ঘুরে দেখার সময় অবাক হয়েছিলো। তার ধারণা। ছিলো সবচাইতে নির্মম সেলগুলো বোধহয় খালের পানির স্তরে অবস্থিত কিন্তু সে জানতে পারে ওগুলো আসলে একেবারে ছাদের উপরে-গরমের সময় নরকতুল্য গরম আর শীতকালে বরফের মতো ঠাণ্ডা ভোগ করতে হতো ওখানকার কয়েদীদের। এই সেলগুলোর নাম পিএম্বি। বিশ্বপ্রেমিক কাসানোভা যৌনাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ওখানে প্রায় পনেরো মাস বন্দী ছিলো। পরে রক্ষীকে পটিয়ে-পাটিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায় সে।

“স্তা আতেন্তো!” গোন্দোলার মাঝির উদ্দেশ্যে চিৎকার বললো মওরিজিও। ডক ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওটা। হোটেল দানিয়েলের কাছে একটি ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেলো। জায়গাটি সেন্ট মার্কস স্কয়ার আর ডওজ’দের প্রাসাদ থেকে মাত্র একশ’ গজ দূরে।

বোটটা ঠিকমতো ভেড়ানোর পর মওরিজিও সবার আগে নেমে পড়লো তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো তার যাত্রিদের উদ্দেশ্যে।

“ধন্যবাদ,” পেশীবহুল ইটালিয়ান তার হাত ধরে বোট থেকে ডকে নামতে সাহায্য করার পর বললো ল্যাংডন।

ফেরিসকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই নাভাস। বার বার সাগরের দিকে তাকাচ্ছে সে।

সবার শেষে নামলো সিয়েনা। তাকে হাত ধরে নামানোর সময় হ্যান্ডসাম ড্রাইভার এমনভাবে তার দিকে তাকালো যেনো চোখের ভাষায় বলতে চাচ্ছে, এই বুড়ো হাবড়াকে ফেলে আমার সাথে চলে আসো। ভালো সময় কাটবে! কিন্তু মনে হলো না সিয়েনা সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করেছে।

“গ্র্যাজি, মওরিজিও,” উদাস হয়ে বললো মেয়েটি। তার চোখ উওজ’দের প্রাসাদের দিকে।

তারপর সময় নষ্ট না করে ল্যাংডন আর ফেরিসের সাথে পা বাড়ালো জনারণ্যের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *