৬. লিঙ্গপুরাণ

লিঙ্গপুরাণ

লিঙ্গ (সংস্কৃতে লিঙ্গ্‌ + অ, অথবা শিশ্ন = শশ্‌ + ন) বলতে প্রথমেই যে ছবিটা মানুষের মনে ভেসে ওঠে সেটা হল পুরুষের যৌনাঙ্গ, ইংরেজিতে যেটি PENIS বোঝায়। অপরদিকে লিঙ্গ বলতে GENDER বোঝায়। মানুষ যে শব্দের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করতে চেয়েছে তার প্রমাণ ভাষায় এই ‘লিঙ্গ’-কল্পনা। পুরুষবাচক শব্দ (কিশোর, পুত্র, দেব ইত্যাদি) পুংলিঙ্গ বলে চিহ্নিত হল, আর স্ত্রীবাচক শব্দ (কিশোরী, পুত্রী, দেবী ইত্যাদি) চিহ্নিত হল স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে। ‘চিহ্নিত’ শব্দটি ব্যবহার করার কারণ ‘লিঙ্গ’ আর ‘চিহ্ন’ সমার্থক। কিন্তু যেসব জিনিস অচেতন, তারা সব যদি ক্লীবলিঙ্গ বলে চিহ্নিত হত, তাহলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু এই অচেতন জিনিসগুলোর কিছু চিহ্নিত হল পুংলিঙ্গ হিসাবে, কিছু চিহ্নিত হল স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে।

গর্ভের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ বে-আইনি হলেও জন্মের পর নবজাতকের লিঙ্গ-নির্ধারণ করতে শিশুর যৌনাঙ্গের দিকেই তাকাতে হয় সকলকে এবং যৌনাঙ্গ পর্যবেক্ষণ করেই বুঝে নিতে হবে সে নারী না, পুরুষ। শুধু নবজাতকের ক্ষেত্রেই নয়, কোনো প্রাণী পুরুষ না মহিলা সেটা বুঝতে আমরা সংশ্লিষ্ট প্রাণীটির যৌনাঙ্গটিই পর্যবেক্ষণ করতে থাকি।

লিঙ্গ: লিঙ্গ-নির্ধারণ বোঝাতে শিশ্ন (পুরুষ) অথবা যোনি (মহিলা) দুই-ই বোঝালেও লিঙ্গ আসলে পুরুষের যৌনাঙ্গকেই বোঝায়। পুরুষের যৌনতার জন্য প্রধান অঙ্গ হল তার লিঙ্গ। এটি পুরুষের প্রধান জননাঙ্গ বা যৌনাঙ্গ। এই অঙ্গটি দ্বারা পুরুষ যৌনমিলনে অংশ নেয় এবং মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি লাভ করে। লিঙ্গের দৃঢ়তার উপর নির্ভর করে পুরুষের যৌনমিলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারটি। এই লিঙ্গের একই ছিদ্র দিয়ে বীর্য এবং মূত্র নির্গত হয়। লিঙ্গ হল পুরুষের বহিঃযৌনাঙ্গের মধ্যে অন্যতম। লিঙ্গের সামনে একটি আবরণ ত্বক থাকে (মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের এই অংশটি কেটে ফেলা হয়। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত লিখব)। ইংরেজিতে এই ত্বককে বলে ফোর স্কিন। লিঙ্গে অসংখ্য কোশকলা আছে। এগুলোর প্রভাবে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পুরুষের লিঙ্গের ভিতর সবচেয়ে পুরু কৌশিক ঝিল্লির নাম হল করপরা কে ভারনোসা।

অণ্ডথলি : অণ্ডকোশ হল দুটো বলের মতো থলি, যেখানে শুক্র তৈরি হয়। এগুলোর স্বাভাবিক পরিমাপ হল দেড় ইঞ্চি। এগুলো লিঙ্গের নীচে ঝুলে থাকে। পুরুষের যৌন হরমোন এবং বীর্য উৎপাদনই হল অণ্ডকোশ দুটির কাজ।

এপিডিডাইমিস; প্রতিটি অণ্ডকোশের উপরের অংশকে এপিডিডাইমিস বলে। এপিডিডাইমিস হল বীর্যের সংরক্ষণের স্থান। টিউব এবং অন্যান্য নালি বেয়ে। বীর্য এপিডিডাইমিস থেকে অণ্ডকোশে চলে আসে।

ভাস ডিফারেন্স : প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড থেকে দুটো সেমিনাল কোশ সেমিনাল তরলের মিশ্রণ নিয়ে এপিডিডাইমিসে এসে পৌঁছোয়। এই চলাচলের নালি হল ভাস ডিফারেন্স। এটি পুরুষের অভ্যন্তরীণ যৌনাঙ্গ।

প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড : মূত্রথলির উপরে প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের অবস্থান। এই গ্ল্যান্ডের প্রোস্টেট তরল উৎপাদিত হয় শতকরা ৩৮ ভাগ এবং সেমিনাল তরল উৎপাদিত হয় ৬০ ভাগ, বাকি দুই ভাগ বীর্য উৎপাদিত হয়।

লিঙ্গের বেশ কিছু সমার্থক শব্দও আছে, যা পুরুষের যৌনাঙ্গই বোঝায়। যেমন– শিশ্ন, পুংস্তু, উপস্থ, ধোন, বাড়া, বংশদণ্ড ইত্যাদি। অপরদিকে যোনি নারীর যৌনাঙ্গকে বলে।

স্ত্রীযোনির গঠন : স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রাইমেট বর্গের প্রাণীকূলের, স্ত্রীপ্রজনন তন্ত্রের একটি অন্যতম অঙ্গ। জরায়ুর নীচের দিকে ভালভা পর্যন্ত বিস্তৃত নালি। স্বাভাবিক অবস্থায় সামনের দিকে ৬-৬.৫ সেন্টিমিটার এবং ভিতরে দিকে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮-১০ সেন্টিমিটার। তবে যৌন উত্তেজনা, সন্তান প্রসবের সময় এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রয়োজন অনুসারে বৃদ্ধি পায়। অসম্ভব একটি নমনীয় গুণের কারণে যৌনমিলনের সময় এবং সন্তান প্রসবের সময় প্রচুর পরিমাণে সম্প্রসারিত হতে পারে। দাঁড়ানো অবস্থায় যোনির শেষপ্রান্ত সামনে-পেছনে জরায়ুর সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রির বেশি কোণ উৎপন্ন করে। যোনির ব্যাপ্তির বিচারে একে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হল —

অন্তস্থিত যোনি: এই অংশ বাইরে থেকে দেখা যায় না। এমনকি সজোরে প্রসারিত করলেও বাইরে থেকে এই রন্ধ্রটি স্পষ্ট দেখা যায় না। এর নমনীয় মাংশপেশি গায়ে গায়ে লেগে থাকে বলে বাইরে থেকে অবরুদ্ধ পথ মনে হয়। এর উপরে অংশ জরায়ু-মুখের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অবস্থানের বিচারে যোনি মূত্রনালির পিছনে এবং মলদ্বারের সামনে অবস্থিত। যোনির উপরের এক-চতুর্থাংশ রেকটোউটেরিন পাউচ দ্বারা মলাধার থেকে পৃথক থাকে। যোনিদ্বারের ভিতরের অংশের রং হালকা গোলাপি। এর ভিতরের পুরোটাই মিউকাস ঝিল্লি দ্বারা গঠিত। যোনির অভ্যন্তরের তিন-চতুর্থাংশ অঞ্চল উঁচুনীচু ভাঁজে পরিপূর্ণ, এই ভাঁজকে রুগি (rugae) বলে। যোনির পিচ্ছিলতা বার্থোলিনের গ্রন্থি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই গ্রন্থি যোনির প্রবেশ মুখে এবং জরায়ু-মুখের কাছে অবস্থিত। যৌনমিলনের সময় প্রয়োজনীয় পিচ্ছিলকারক তরল ক্ষরিত করার মাধ্যমে এটি লিঙ্গের প্রবেশ জনিত ঘর্ষণ হ্রাসে ভূমিকা রাখে। এবং একই সঙ্গে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। প্রতি মাসে ডিম্বক্ষরণের সময় জরায়ু-মুখের মিউকাস গ্রন্থিগুলো বিভিন্ন রকম মিউকাস ক্ষরণ করে। এর ফলে যোনির নালিতে ক্ষারধর্মী অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় এবং এটি যৌনমিলনের মাধ্যমে প্রবিষ্ট পুরুষের শুক্রাণুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যোনিমুখ জন্মগতভাবে যোজক কলার একটি পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। এই পর্দাকে বলা হয় যোনিচ্ছদ বা সতীচ্ছদ। একসময় ধারণা ছিল পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম ছাড়া বা কোনো অপদ্রব্য প্রবেশ ছাড়া এই পর্দা ছিঁড়ে যায় না। এই পর্দা অক্ষুণ্ণ থাকাটা সতীনারীর লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা হত (আজও কোনো কোনো দেশে সতীচ্ছদ পরীক্ষা করে অক্ষত হলে অক্ষতযযানির সার্টিফিকেট দেওয়া হয়)। কিন্তু বাস্তবে নানা কারণে এই পর্দা ছিন্ন হতে পারে। ঘোড়ায় চড়া, সাইকেল চালনা, ব্যায়াম চর্চা, দৌড়ঝাঁপ ইত্যাদির কারণে এই পর্দা ছিঁড়ে যেতে পারে।

বহিঃস্থ যোনিঃ যোনিদ্বার থেকে শুরু হয়ে যোনিনালির বাইরে বিস্তৃত অংশকে বহিঃস্থ যোনির ভিতরে ধরা হয়। এই অংশটিকে বলা হয় ভালভা (Valva) বলে। ভালভা অনেকগুলো ছোটো অংশ নিয়ে তৈরি। এই অংশগুলো হল– যোনিমণ্ডপ; মন্স পিউবিস বা যোনিমণ্ডপ নারীদেহের নিম্নাঙ্গের একটি নির্দিষ্ট এলাকা মানব অঙ্গসংস্থানবিদ্যায় এবং সাধারণ স্তন্যপায়ী প্রাণীতে পিউবিক অস্থি, পিউবিক সিমফাইসিস সংযোগের উপর মেদ কলা জমে থাকা উঁচু ঢিপির (mound) মতো অংশটিকে ‘মন্স পিউবিস’ বা ‘যোনিমণ্ডপ’ বলে। এটি লাতিন শব্দ ‘pubic mound’ থেকে এসেছে, এছাড়া এটি মন্স ভেনেরিস (mound of venus) নামেও পরিচিত। মন্স পিউবিস ভালভার উপরের অংশ গঠন করে। মন্স পিউবিসে আকার সাধারণত শরীরের হরমোন ক্ষরণ ও মেদের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। বয়ঃসন্ধির পর এটি প্রসারিত হয়, এর উপরভাগে অংশ রোমে ঢেকে যায়, যা যৌনকেশ নামে পরিচিত। নারীদেহে এই উঁচু অংশটি মেদ কলা দিয়ে গঠিত এবং যথেষ্ট পরিমাণে বড়। যৌনমিলনের সময় এটি পিউবিক অস্থিকে রক্ষা করে।

মানুষের মন্স পিউবিস যে কয়েকটি অংশে বিভক্ত তার নিম্নভাগে আছে বৃহদ্দোষ্ঠ, এবং অন্য পাশে হলরেখার (লাঙ্গল ফলার দাগ) মতো অংশ, যা যোনিচিরল নামে পরিচিত। ক্লেফট অফ ভেনাস যে সকল অংশ পরিবেষ্টন করে রেখেছে সেগুলো হল– নিম্নোষ্ঠ, ভগাঙ্কুর, যোনির প্রবেশদ্বার এবং ভালভাল ভেস্টিবিউলের অন্যান্য অংশ। মন্স ভেনেরিসের মেদ কলা ইস্ট্রোজেন ক্ষরণে প্রতিক্রিয়াশীল, যা বয়ঃসন্ধি শুরুর সময় একটি স্বতন্ত্র উঁচু অংশের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে এটি লেবিয়া মেজরার সামনের অংশে, পিউবিক অস্থি থেকে সরে যায়। যোনিওষ্ঠ (Labia) দুইটি মাংসল ভাঁজ যোনিপথকে আবৃত করে রাখে। এর বড়ো ভাঁজটিকে বলা হয় বৃহদ্দোষ্ঠ (Labia majora)। বৃহদ্দোষ্ঠের ভিতরের দিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মাংসল ভাঁজকে বলা হয় ক্ষুদ্রোষ্ঠ (Labia minora)। বৃহদোষ্ঠ বহিঃস্থ অংশ, রঙিন এবং চুল বিশিষ্ট এবং অন্যটি ভেতরের অংশ, যা কোমল ও সেবাসিয়াস ফলিকল সমৃদ্ধ। এই বৃহদ্দোষ্ঠের ভিতরের দিকে থাকে। ভগাঙ্কুর (Clitoris): যোনিওষ্ঠের উপরের দিকে ছোটো বোতামের মতো একটি অংশ থাকে। একে বলা হয় ভগাঙ্কুর। এই অংশটি যোনিমুখ ও মূত্রনালির প্রবেশমুখের উপরাংশে অবস্থিত। এটি যৌন মিলনকালে তৃপ্তি প্রদান করা। যেহেতু এটি একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ তাই এর বর্ণ চামড়া মতো না-হয়ে ঝিল্লির মতো হয়। এটির উচ্চতা সিকি ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। তবে যৌন উত্তেজনা বাড়তে থাকলে এটি শক্ত ও দীর্ঘ হতে থাকে। যোনিচ্ছদ : যযানিচ্ছদ বা সতীচ্ছদ (Hymen) : এটি মিউকাস মেমব্রেন দ্বারা সৃষ্ট একটি পর্দা। এই পর্দা যা যোনির প্রবেশমুখ আংশিক বা সম্পূর্ণ আবরিত করে রাখে। ভালভাল ভেস্টিবিউল (Vulval vestibule) বা ভালভার ভেস্টিবিউল (Vulvar vestibule)। এটি লেবিয়া মাইনরার মধ্যবর্তীস্থানে অবস্থিত ভালভার একটি অংশ, যেখানে ইউরেথ্রাল ও যযানির প্রবেশমুখ উন্মুক্ত। এর প্রান্ত হার্টের লাইন দ্বারা চিহ্নিত। যোনির সম্মুখে, গ্ল্যান্স ক্লিটোরিসের ২.৫ সেন্টিমিটার ভিতরে বহিঃস্থ ইউরেথ্রাল অফিস অবস্থিত। সাধারণত এটিকে স্কিনির ডাক্টের প্রবেশমুখের নিকটে ছোটো, হালকা স্পষ্ট দাগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আর ভ্যাজাইনাল অরফিস হচ্ছে মূত্রনালির নীচে ও পিছনে অবস্থিত একপ্রকার মধ্যম। আকৃতিবিশিষ্ট চির; এর আকার সতীচ্ছদের আকৃতির সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতিক হারে পরিবর্তিত হয়। বার্থোলিনের গ্রন্থি (Bartholin’s glands)। একে অনেক সময় বৃহৎ ভেসটিবিউলার গ্রন্থি (greater vestibular glands) বলা হয়। দুটি গ্রন্থি নারীর যোনির প্রবেশদ্বারের কাছে একটু নীচে ডানে ও বামে থাকে। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকে এই গ্রন্থি দুটি সম্পর্কে প্রথম ড্যানিশ শরীরবিদ ক্যাসপার বার্থোলিন দ্য ইয়াঙ্গার (১৬৫৫-১৭৩৮) এদের বর্ণনা দেন। এই বিজ্ঞানীর নামে এই গ্রন্থদ্বয়ের নামকরণ করা হয়। গ্রাফেনবার্গ স্পট বা জি-স্পট : হচ্ছে। যোনিপথের একটি ক্ষুদ্র অংশবিশেষ। এই অংশটি মূত্রথলির নীচে অবস্থিত। এর নামকরণ করা হয়েছে জার্মান স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আর্নেস্ট গ্রাফেনবার্গের নামানুসারে। যোনিপথের শুরু হতে ১-৩ ইঞ্চির মাঝেই এর অবস্থান। সঙ্গমকালে যোনিমুখের ১-৩ ইঞ্চির ভিতরে নারী সবচেয়ে বেশি পুলক অনুভব করে। এই অধিক সংবেদনশীল অংশকেই জি-স্পট বলা হয়।

এ তো গেল নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের বিবরণ। কিন্তু যাঁরা নারী-পুরুষ কোনো লিঙ্গেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, তাঁদের যৌনাঙ্গের পরিচয় কী? হিজড়ে বা হিজড়া? যৌনাঙ্গের গঠন-বিচারে কারা হিজড়ে? হিজড়ে সাধারণত তিনরকম –(১) প্রকৃত হিজড়ে ( True Hermaphrodite), (২) অপ্রকৃত পুরুষ হিজড়ে (Male Pseudo Hermaphrodite), এবং (৩) অপ্রকৃত নারী হিজড়ে (Female Pseudo Hermaphrodite)

(১) অপ্রকৃত হিজড়ে (Pseudo Hermaphrodite) : গর্ভে থাকাকালীন সময়ে অন্যান্য শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতোই শিশুর যৌনাঙ্গ গঠিত হয়। যৌনাঙ্গ গঠনে ক্রোমোজোমের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ক্রোমোজোমের ত্রুটিবিচ্যুতির ফলেই জন্ম নেয় যৌন প্রতিবন্ধী শিশু। ক্রোমোজোমের ভিত্তিতে লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যবস্থায় এই যৌন বিকলাঙ্গরা তাই হয়ে উঠে অপ্রকৃত। সাধারণত পাঁচ ধরনের অপ্রকৃত হিজড়ে দেখা যায় —

(ক) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (Klinefelter syndrome) : ১৯৪২ সালে এইচ.এফ. ক্লাইনেফেলটার (H.F Klinefelter) নামে একজন আমেরিকান চিকিৎসক এই রোগ আবিষ্কার করেন। এই শারীরিক ত্রুটি শুধু পুরুষের ক্ষেত্রে দেখা দেয়। প্রতি ১০০০ জন পুরুষের ভিতর ১ জনের এই ত্রুটি দেখা দিতে পারে। টেস্টোস্টেরন (Testosterone) হরমোনের অভাবে এদের শারীরিক গঠনে পুরুষালি পেশির ঘাটতি দেখা দেয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ (Facial Hair), যৌনাঙ্গে চুল (Pubic Hair) কম দেখা দেয়। বক্ষ কিছুটা উন্নত হয় ও স্ফীত স্তন দেখা দেয়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে গাইনিকোমাস্টিয়া (Gynecomastia) বলে। তবে মাত্র ১০% পুরুষের গাইনিকোমাস্টিয়া লক্ষণযোগ্য হয়। বাকিদের গঠন স্বাভাবিক পুরুষের মতোই। এদের শুক্রাশয় স্বাভাবিকের তুলনায় ছোটো থাকে। সেখানে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় না। এরা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলেও স্বাভাবিক যৌন জীবন পালন করতে পারে। এরা মানসিক জড়তায় ভোগে।

(খ) XXY পুরুষ (XXY Male) : আপাত গঠন পুরুষের মতো। এদের যৌনাঙ্গের অস্বাভাবিকতা বয়ঃসন্ধিকালের ভিতর প্রকাশ পায়। শিশ্ন আছে। তবে মূত্রছিদ্রটি (Urethral Orifice) শিশ্নের স্বাভাবিক স্থানে থাকে না। ডাক্তারি ভাষায় একে হাইপোস্পেডিয়াস (Hypospadias) বলে। এদের অণ্ডকোশ শরীরের অভ্যন্তরে থাকে। একে বলে গুপ্ত শুক্রাশয় (Cryptorchidism)।

(গ) XX পুরুষ (XX): XX পুরুষের সঙ্গে ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোমের অনেক মিল আছে। প্রতি ১০,০০০০ জনের ভিতর ৪ অথবা ৫ জনের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এদের স্তন থাকে। তবে সুডৌল, স্ফীত স্তন নয়। এদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র, ২ সেন্টিমিটারেরও ছোটো শুক্রাশয় থাকে। সেখানে শুক্রাণু (Spermatozoa) উৎপন্ন হয় না। এদের হাইপোস্পেডিয়াসের সমস্যা থাকে। এরা বেঁটে হয়।

(ঘ) টার্নার সিনড্রোম (Turner Syndrome) : ১৯৩৮ সালে হেনরি টার্নার ডাক্তারি অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে এই ধরনের রোগের কারণ নির্ণয় করেন। প্রতি ২৫০০ মহিলাদের ভিতর একজনের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত একটি X ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি এই রোগের কারণ। আপাতদৃষ্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সিনড্রোম দেখা দেয়। জন্মের প্রথম তিন বছর এদের উচ্চতা স্বাভাবিক দেখা দিলেও এরপর থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির হার কমে যায়। যোনিকেশ (Pubic Hair) খুব কম দেখা দেয়। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে সেক্স-হরমোন ইস্ট্রোজেন (Estrogen) ও প্রোজেস্টেরন (Progesterone) নির্গত হওয়া শুরু করে। কিন্তু টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সেক্স-হরমোনের প্রকাশ ঘটে না। ফলে রজঃচক্র বা মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রশস্ত বুকে স্তন গ্রন্থির উদ্ভব হয়। গলার দু-দিকের পুরু মাংসল কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এদের বধির হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। এরা অস্থি সংক্রান্ত বিভিন্ন অসুবিধা ও অস্বাভাবিকতায় ভোগে। অনুন্নত ডিম্বাশয় ও গর্ভধারণে অক্ষম হলেও টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত কারও কারও স্বাভাবিক যোনিপথ ও জরায়ু থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে গণিত শিক্ষা অথবা স্মৃতি ধারণ ক্ষমতায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

(ঙ) মিশ্র যৌন গ্রন্থির বিকৃতি (Mixed Gonadal Dysgebesis-MGD) : গোনাড হল দেহের সেক্স অর্গান। পুরুষের থাকে শুক্রাশয় আর নারীর থাকে ডিম্বাশয়। MGD সিনড্রোম-ধারীদের আপাতদৃষ্টিতে পুরুষ বলে মনে হয়। শুক্রাশয় থাকে তবে একটি। এর গঠন জটিল আকারের। প্রতিটা শুক্রাশয়ে ৪০০-৬০০টির মতো শুক্রোৎপাদক নালিকা (Seminiferous Tube) থাকে। এর ৫টি স্তর- স্পার্টাগোনিয়া (Spermatogonia), প্রাথমিক স্পার্টোসাইট (Primary Spermatocyte), carica MATTICOATET (Secondary Spermatocyte), স্পার্মাটিড (Spernatid) ও স্পার্মাটোজোয়া (Sprematozoa)। এই পাঁচটি পর্যায়ের মধ্য দিয়েই শুক্রাণু তৈরি হয়। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উল্লিখিত ৫টি পর্যায়ে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে শুক্রাণু গঠন হয় না। শিশ্ন থাকা সত্ত্বেও এদের শরীরে যোনি (Vagina), জরায়ু (Uterus) ও দুটি ফেলোপিয়ান নালির (Fallopian Tube) অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বিকৃত যৌনগ্রন্থির উপস্থিতির ফলে এদের জননকোশের উৎপত্তি স্থানে গোনাডাল টিউমার (Gonadoblastoma) দেখা দিতে পারে। ২৫% MGD আক্রান্ত ব্যক্তিদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

(২) প্রকৃত হিজড়ে (True Hermaphroditism) : এদের শরীরে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় উভয়ই অবস্থান নেয়। এরা অধিকাংশই পেশিবহুল শরীরের অধিকারী থাকে। শিশ্ন থাকে। অল্প হলেও কারও কারও শিশ্নের পরিবর্তে যোনি থাকে। এবং ভগাঙ্কুর (Clitoris) স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটা বড়ো থাকে। অনেক সময় তা পুরুষ শিশ্নের মতো হয়ে থাকে। এদের মূত্রনালি ও যোনিপথ একসঙ্গে থাকে। একে বলে ইউরোজেনিটাল সাইনাস (Urogenital Sinus)। ফেলোপিয়ান নালি (Fallopian Tube) ও জরায়ু (Uterus) থাকে। জরায়ু অত্যন্ত ছোটো হয়। চিকিৎসার ভাষায় একে বলে হাইপোপ্লাস্টিক বা ইউনিকরনেট (Hypoplastic or Unicornuate)। কৈশোরে স্তন গ্রন্থির প্রকাশ ঘটে ও রজঃচক্র (Menstruation Cycle) শুরু হয়। যাদের বাহ্যিক জননাঙ্গ পুরুষের মতো অর্থাৎ শিশ্ন আছে তাদেরও রজঃচক্র হয়ে থাকে। একে বলে সাইক্লিক হেমাচুরিয়া (Cyckic Hematuria)। এ ধরনের রজঃচক্রের সময় শুক্রাশয়ে ব্যথা হয়।

কৃত্রিম হিজড়ে বা খোঁজাকরণ হিজড়ে : খোঁজাকরণ বা লিঙ্গ কর্তনের মতো ভয়ংকর আইন-বিরুদ্ধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড হিজড়ে সম্প্রদায়ের সঙ্গী। অনেকেই হিজড়ে কমিউনিটিতে যোগদানকালে নিজের শিশ্ন স্বেচ্ছায় কর্তন করে। কেউ করতে না-চাইলে তাকে জোর করা হয়। এছাড়া সুশ্রী দেখতে বালকদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে এদের শিশ্ন ও অণ্ডকোশ কেটে এদের খোঁজা করে দেওয়ার অভিযোগ আছে। এরপর হিজড়ে বানিয়ে যৌন-ব্যবসায় নামানো হয়। লিঙ্গ অপসারণ ব্যয়বহুল ও অনৈতিক হওয়ার কারণে হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে এই কর্তনকর্ম সম্পন্ন করে লিঙ্গ-কবন্ধ হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর রক্তপাতও ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায় সবার অলক্ষ্যেই।

বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন খতনা হল ইসলাম ধর্মসম্প্রদায়ের মুসলমানি একটি অনুষ্ঠান। কিন্তু এই অনুষ্ঠান শুধু মুসলিম ধর্মেই নয়, অন্য বেশকিছু প্রধান ধর্মেও করা হয়। সিমেটিক ধর্মসম্প্রদায়গুলির মধ্যে এই প্রথা বিদ্যমান। যেসব সম্প্রদায়ের মানুষরা মনে করেন শুধুমাত্র মুসলমানদেরই লিঙ্গ কাটা বা লিঙ্গের অগ্ৰত্বক কাটা, তাদের বলি শুধু মুসলমান নয়, সমগ্র খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে গুলিয়ে ফেলবেন না, এই লিঙ্গকর্তন কিন্তু খোঁজাকরণ নয় –এটা হল লিঙ্গের অগ্ৰত্বক ছেদন। লিঙ্গের অগ্ৰত্বক কর্তন করে বা সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করাকে খতনা বলা হয়। নানা কারণে ভিতর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই খতনা করা হয়ে থাকে। আর-একটু গুছিয়ে বললে যা দাঁড়ায় তা হল, পুরুষদের খতনা বলতে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের ত্বক লিঙ্গমুণ্ড পর্যন্ত কেটে ফেলাকে বোঝায়। এর ফলে লিঙ্গমুণ্ড আজীবন অনাবৃত হয়ে পড়ে। মনে করা হয়, বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আমলে খতনা প্রথার শুরু। মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাস মতে, আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.)-কে খতনা করার নির্দেশ দেন। ওই সময় তার বয়স ছিল ৯৯ বছর। এ বয়সে তিনি ঐশী নির্দেশে নিজের খতনা দেন। প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে খতনা দেওয়া হয় ১৩ বছর বয়সে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর উত্তর পুরুষ হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসারী ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যেও খতনা প্রথার প্রচলন ছিল। হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ইহুদি পরিবারে। জন্মের আট দিন পর তারও খতনা করা হয়। এটি একটি ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তা হিসাবে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে স্বীকৃত বিষয়। অনেক পুরুষের ধারণা খতনা করা হলে লিঙ্গের স্পর্শকাতরতা বেড়ে যায়। এতে করে যৌনমিলনে অধিক আনন্দ লাভ সম্ভব হতে পারে, তবে মাস্টার এবং জনসন মনে করেন খতনা পুরুষের জন্য অধিক যৌন আনন্দ নিশ্চিত করে এই ধারণাটি ভুল। খতনা করা না-হলেও যৌনমিলনে পুরুষ যথেষ্টই অংশ নিতে পারে এবং যৌন আনন্দ লাভ করে। তবে খতনার প্রধান সুবিধাটা হচ্ছে এর ফলে লিঙ্গের অগ্ৰত্বকে যে অবাঞ্ছিত দুর্গন্ধযুক্ত তরল জমে নোংরা অবস্থার সৃষ্টি করে তা থেকে লিঙ্গ রেহাই পেতে পারে। এই অবাঞ্ছিত দুর্গন্ধযুক্ত তরল জমাট বেঁধে লেগমার তৈরি করে। নানা রকম ইনফেকশন হতে পারে। যৌনজীবন বিব্রতকর হতে পারে। ডাক্তারি মতে খতনার ফলে পুরুষের লিঙ্গ পরিচ্ছন্ন থাকে বেশি। যাঁরা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই, খতনারও প্রয়োজন হয় না। তবে বর্তমান যুগে যেহেতু ওরাল সেক্স বা শকিং করার প্রবণতা বেড়েছে, সেই কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই যুবক-যুবতীদের মধ্যে যৌনাঙ্গের স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রবণতা বেড়েছে।

সেকালে খতনা করা হত হাতুড়ে দিয়ে। সময় বদলেছে। হাইজেনিকের প্রশ্নে আর কোনো আপস নয়। শিক্ষিত, অভিজ্ঞ এবং পেশাদার শল্য চিকিৎসকদের দিয়ে খতনা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রয়োজন হলেই হবে না, খরচ অনেক। ১০-১৫ হাজারের নীচে নয়। গরিবদের পক্ষে এই খরচ করে মুসলমানি অনুষ্ঠান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এই অসুবিধা দূর করার জন্য বহু জায়গায় ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেউ হাজার হাজার টাকা খরচ করে মুসলমানির অনুষ্ঠান করে, আর কেউ বয়স পেরিয়ে গেলেও টাকার জন্যে খতনা করাতে পারে না। অতএব এইসব ফাউন্ডেশনগুলি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খতনা করিয়ে থাকে। খতনার পর প্রত্যেককে ১টি করে লুঙ্গি, গামছা এবং ক্ষত শুকানোর জন্যে ফুল কোর্স অ্যান্টিবায়োটিক, পেইনকিলার ও ভিটামিন-সি ট্যাবলেট দেওয়া হয়।

মূলত খতনা প্রথার উদ্ভব হয় ইহুদি সমাজে। ইহুদিরা এটিকে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসাবেই মনে করে। খ্রিস্টীয় বিধানে বাধ্যবাধকতা তেমন না থাকলেও এ ধর্মের সূতিকাগার প্যালেস্টাইন ও আরব খ্রিস্টানদের মধ্যে খতনা প্রথার প্রচলন আছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে খতনাকে অবশ্য কর্তব্য বলে ধরা হয়। সাধারণের ভাষায় যা ‘মুসলমানি’ হিসাবে পরিচিত। অনেকেরই ধারণা খতনা না-দিলে মুসলমানিত্ব প্রাপ্ত হয় না। খতনার সঙ্গে মুসলমানিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলোকে ‘ফরজ’ বলে অভিহিত করা হয়। সে অর্থে খতনা ‘ফরজ’ নয়। অর্থাৎ এটি পালন না-করলে ধর্মচ্যুতি বা গুণাহর কোনো আশঙ্কা নেই। খতনা মুসলমানদের জন্য একটি অনুসরণীয় স্বাস্থ্যবিধি। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মহানবি হজরত মোহাম্মদ নিজে খতনা করেছেন। অন্যদেরও খতনা করতে উৎসাহিত করেছেন। যে কারণে মুসলিম সমাজে পুরুষদের ত্বকচ্ছেদকে সুন্নতে খতনা হিসাবে অভিহিত করা হয়। মহানবি যেসব অনুশাসন বা নিয়ম পালন করতেন সেগুলোকেই বলা হয়। সুন্নত। ইসলামের দৃষ্টিতে সুন্নত পালন করা উত্তম। এর মাধ্যমে মহানবির জীবনাদর্শকে অনুসরণ করা হয়। সে হিসাবে এটি একটি পুণ্যের কাজ।

শুধু পুরুষদেরই খতনা করা হয়, তা কিন্তু নয়। কোথাও কোথাও মেয়েদেরও খতনা করা হয়। মেয়েরা যেন যৌনসুখ উপভোগ করতে না পারে বা সতীত্ব রক্ষার নামে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ বা এফজিএম করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসেব অনুযায়ী, ওই দুই মহাদেশের ২৯টি দেশের প্রায় ১২০ থেকে ১৪০ মিলিয়ন নারী অমানবিক এই ঘটনার শিকার হয়েছেন। ইউনিসেফের মতে, মেয়েদের যৌনাঙ্গচ্ছেদের কারণে তাঁদের শরীরে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি নানান সমস্যা দেখা দেয়। বিশ্বে কমপক্ষে ১৫ কোটি নারী খতনা প্রথার মতো বর্বরতার শিকার। সুপার মডেল ওয়ারিস দিরির মতে, আফ্রিকায় এখনও কুমারী মেয়েদের খতনা দেওয়া হয়। নারীর জৈবিক চাহিদা কমাতে এ প্রথা চালু হয়েছিল। এ ধারাটি শুধু আফ্রিকাতে নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো সভ্য সমাজেও প্রচলিত। সুদানের বিতর্কিত লেখিকা কোলা বুফ তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘Diary of a Lost Girl’-এ খতনা প্রথার বীভৎসতার চিত্র তুলে ধরেছেন। নারীবাদী এই লেখিকার বিভিন্ন বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যে কারও দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু খতনা প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভের প্রতি মনুষ্য চেতনাসম্পন্ন যে কেউ সহানুভূতিশীল হতে বাধ্য। সুদানের এই জনপ্রিয় লেখিকাকেও তাঁর কিশোরী বয়সে খতনা প্রথার শিকার হতে হয়েছিল। আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোর নারীরাই খতনা প্রথা শিকার।

ধর্মীয় প্রথা শুধু নয়, আধুনিক বিজ্ঞানও পুরুষদের খতনার পক্ষে। কারণ কারোর মতে এটি স্বাস্থ্যসম্মত। যে কারণে ধর্মীয় দিক থেকে যাঁরা খতনা প্রথায় অভ্যস্ত নন, তারাও অনেক সময় স্বাস্থ্যগত কারণে খতনা করান। পুরুষদের খতনা চালুর পিছনে ঐশী নির্দেশের কথা বলা হলেও মেয়েদের খতনা কীভাবে চালু হল তার কোনো প্রামাণিক দলিল নেই। তওরাত, জবুর, ইঞ্জিল, কোরান অর্থাৎ সেমেটিক ধর্মাবলম্বীদের কাছে ধর্মগ্রন্থগুলোতে এ সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনা নেই। পুরুষের খতনাকে আধুনিক বিজ্ঞানও স্বাস্থ্যসম্মত মনে করে। নারীর খতনা ঠিক এর বিপরীত। ইসলামে মেয়েদের খতনার নির্দেশনা না থাকলেও ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আরব সমাজে এ কুপ্রথা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। সেন্ট জন ফিলবির লেখা ‘Empty Quarter’ বইয়ে আরব মেয়েদের খতনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বের মানুষ জানতে পারে এ কুপ্রথা সম্পর্কে। সেন্ট জন ফিলবি ১৯৩০ সালে দীর্ঘদিন অবস্থান করার ফলে তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে মেশার সুযোগ পান। সৌদি আরবে সউদ পরিবার ক্ষমতায় আসার পর মেয়েদের খতনা নিষিদ্ধ করে। তারপরও বিভিন্ন আরব গোত্রে এ প্রথা দীর্ঘদিন চালু ছিল। এমনকি বেদুইনদের কোনো কোনো গোত্রের মধ্যে এখনও মেয়েদের খতনা চালু রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। “Empty Quarter’ বইয়ে সেন্ট জন ফিলবি সৌদি আরবের মুনাসির বেদুইন গোত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এ গোত্রের মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত হলে তাদের খতনা করানো হয়। বিয়ের এক বা দুই মাস আগে আয়োজন করা হত তাদের খতনার অনুষ্ঠান। কাহতান, মুররা, বনি হাজির, আজমান ইত্যাদি গোত্রের মেয়েদের খতনা করানো হত জন্মের পরপরই। তাঁবুর মধ্যে খতনা সম্পন্ন করা হত। বিশেষজ্ঞ মহিলা হাজামরা ক্ষুর, কাঁচি এবং সুচ সুতোর সাহায্যে খতনা করত।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সহ উপমহাদেশের কোথাও মেয়েদের খতনা প্রথা চালু নেই। এসব দেশে অপরিচিত হলেও দুনিয়ার বহু দেশে বিশেষত আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোতে মেয়েদের খতনা প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এ প্রথাটি ইতোমধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও নারী অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেমন মেয়েদের সেই খতনা? জানা থাকলে ভালো, না-জানলে জেনে নিন। আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল এবং কোনো কোনো আরব দেশে মেয়েদের যে খতনা প্রথা চালু আছে তাতে ভগাঙ্কুরের বর্ধিত অংশটুকু কেটে ফেলা হয়। পুরুষ ও নারীর খতনার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের পুরুষাঙ্গের ত্বকের যে অংশটি কেটে ফেলা হয় তা তেমন স্পর্শকাতর নয়। বরং এটি অনেক সময় স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়েও দেখা দেয়। মেয়েদের ভগাঙ্কুর শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান নারী তাঁর চরম যৌনানন্দ লাভ করে এই অঙ্গের মধ্য দিয়েই। এটি কেটে ফেললে নারীর যৌনানন্দ চিরকালের মতো শেষ, শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয়ে যাবে। ভগাঙ্কুর কেটে ফেললে রক্ত বন্ধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তীব্র যন্ত্রণাদায়ক তো বটেই। বিশ্বে প্রতি বছর কোটি কোটি পুরুষের খতনা হলেও জীবনহানির ঘটনা প্রায় শূন্য। ভোগান্তির পরিমাণও একেবারে কম। পক্ষান্তরে মেয়েদের খতনার জন্য জীবনহানির ঘটনা অহরহ ঘটছে। ভগাঙ্কুরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকারও হয় হাজার হাজার নারী, নারীশিশু। স্পষ্টভাবে বলা যায়, মেয়েদের খতনা একটি বর্বর প্রথা। নারীবাদিরা কি ঘুমিয়ে আছেন? বন্ধ করুন নারীখতনা!

কুসংস্কারের বশে খতনা দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন সব পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়। তা একদিকে যেমন যন্ত্রণাদায়ক, অন্যদিকে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিও বটে। গত শতাব্দীর শেষ দিকে আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নে এমন ধরনের এক গণখতনার ঘটনা ঘটে। ঘটা করে একটা গোত্রের সব কুমারী মেয়ের ভগাঙ্কুরের অংশবিশেষ কেটে ফেলা হয়। যার সংখ্যা ছিল ৬০০। খতনায় যৌনাঙ্গে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় তাদের অন্তত ১০ জনের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এ প্রথার বিরুদ্ধে শত নিন্দা জানালেও অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। ভাবুন, সিয়েরা লিয়নে মেয়েদের খতনা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধ। আবার কৃষ্ণ আফ্রিকা অর্থাৎ এ মহাদেশের যে অংশটি মাত্র দু-এক শতাব্দী আগেও সভ্য বিশ্ব থেকে দূরে ছিল তাদের মধ্যে এ কুসংস্কার টিকে থাকার বিষয়টি হয়তো ক্ষমা করা যায়। কিন্তু যে দেশটি বিশ্ব সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত আফ্রিকার সেই মিশরেও মেয়েদের খতনা বর্বরতার যুগকে এখনও লালন করে আসছে। যদিও মিশরে আইনগতভাবে এ প্রথা নিষিদ্ধ। এটিকে নিরুৎসাহিত করতে প্রচার-প্রচারণারও অভাব নেই। তা সত্ত্বেও মিশরীয় সমাজে প্রতিবছর হাজার হাজার মেয়েকে খতনা দেওয়া হয়। মেয়েদের খতনার জন্য পুরুষশাসিত সমাজের কুৎসিত ধারণাই সম্ভবত বেশি দায়ী। মনে করা হয়, খতনা দেওয়া হলে মেয়েদের স্পর্শকাতরতা হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে পুরুষদের আধিপত্য বজায় থাকবে। অন্ততপক্ষে যৌনতার কারণে কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন ঘটাবে না। ফলে একটা যৌনবিশুদ্ধ নারী কোনো এক পুরুষের মালিকানাধীন থাকবে। এই মানসিকতার জন্যই যুগ যুগ ধরে কুপ্রথাটি টিকে আছে। যদিও ফ্রান্সে মেয়েদের খতনা মারাত্মক অপরাধ হিসাবে বিবেচিত। এ জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু তারপরও সে দেশের সরকার আফ্রিকীয় প্রবাসীদের খতনা প্রথা নিরুৎসাহিত করতে পারেনি।

হিন্দুদের ক্ষেত্রে ফাইমোসিসের কারণেও লিঙ্গের অগ্ৰত্বক ছেদন করতে হয় কখনো-কখনো। ফাইমোসিস (Phimosis) : পুরুষাঙ্গের সম্মুখে ঝুলতে থাকা বাড়তি চামড়াটুকু (Prepuceal skin) অনেক সময় লিঙ্গের শীর্ষদেশের (Glans penis) সঙ্গে আটকে গিয়ে যে সমস্যা করে তার নামই ফাইমোসিস। বিশেষ করে ছোট্ট ছেলেদের বাবা-মা অনেক সময়ই এই নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ভোগেন। প্রচলিত ভাষায় একে বলা হয় লিঙ্গ না ফোঁটা। মনে রাখতে হবে শিশুর ৬ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষাঙ্গ প্রাপ্তবয়স্কদের মতো না-ও ফুটে উঠতে পারে। তাই এ নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই, তবে প্রস্রাব করার সময় যদি ওই বাড়তি চামড়া সহ লিঙ্গের শীর্ষ ফুলে উঠে বা চামড়া ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয় কিংবা শিশুর মূত্রত্যাগে কষ্ট হয়। তবে ধরে নিতে হবে সেটা স্বাভাবিক নয়। বড়োদের ও ফাইমোসিস হয়ে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ব্যালানাইটিস (Balanitis) রোগের কারণে হয়ে থাকে। বড়োদের এমনটি হলে লিঙ্গ নিয়মিত পরিষ্কার করা সম্ভব হয়না এবং তা থেকে অনেক সময় পুরুষাঙ্গের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের যৌনজীবনও বরবাদ হয়ে যেতে পারে। ছোটো অথবা বড়ো যারই ফাইমোসিস হোক-না-কেন, এর একমাত্র চিকিৎসা হল পুরুষাঙ্গের বাড়তি চামড়াটুকু ফেলে দেওয়া। আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলনে ফরাসি গবেষক কেভিন জাঁ বলেন, “(খতনা করার ফলে এইডসের ঝুঁকি হ্রাসের মাত্রা বেশ কম মনে হলেও শুরু হিসাবে এটা কিন্তু কম নয়।” বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা (এইচআইভি)-র সংক্রমণ কমানোর লক্ষ্যে পুরুষদের খতনাকে উৎসাহিত করে আসছে। ইসলাম এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এমনিতেই খতনার চল রয়েছে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও পুরুষদের খতনার হার বাড়ছে। এইডস সম্মেলনে প্রকাশ করা নিবন্ধ অনুযায়ী খতনা করলে পুরুষের এইচআইভি সংক্রমণের আশঙ্কা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমে। অন্যদিকে নারীর কমে শতকরা ১৫ ভাগ।

কয়েক মাস আগে জার্মানে একটি চার বছরের ছেলের খতনা করানো নিয়ে এই বিতর্কের শুরু। খতনার সময় চিকিৎসকের ভুলে ওই বাচ্চার পুরুষাঙ্গ থেকে অতিরিক্ত রক্তপাত হলে, তা কোলন শহরের আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আর আদালত রায় দেয়, বাচ্চার ধর্মীয় অধিকার রয়েছে, কিন্তু সেটা তার নিজের শরীরের অধিকারের চেয়ে বেশি নয়। অর্থাৎ বাবা-মার ইচ্ছায় এখন থেকে খতনা করা বন্ধ। আর যদি করাতেই হয়, তাহলে ছেলে বড়ো হলে তার মতামত নিয়ে সেটা করতে হবে। তারপর থেকে এই নিয়ে বিতর্ক চলছে, থামছে না। কারণ কেবল মুসলমান নয়, ইহুদিদের ধর্মীয় আচারের একটি অংশ হচ্ছে এই খতনা। এই রায় নিয়ে পরবর্তীতে শুরু হয় বিতর্ক। কেন-না জার্মানে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মুসলমানের বাস। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার নিবন্ধনকৃত ইহুদি। মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদিদের মধ্যেও খতনা বিষয়টি প্রচলিত।

এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিক এমনিক গবেষকরা পর্যন্ত। কেউ আদালতের রায়কে বাচ্চার অধিকারের সংরক্ষণ হিসাবে দেখছেন, অনেকে আবার এটিকে ধর্মে আদালতের অহেতুক হস্তক্ষেপ হিসাবে মূল্যায়ন করছেন। এই যেমন ইহুদি নেতা পিনশাস গোল্ডস্মিথ। ইউরোপের রাব্বিদের এই নেতা কোলনের আদালতের রায়ের তীব্র সমালোচনা করে বললেন, “যদি এই রায়কে সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করে এবং এটিকে আইন হিসাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার অর্থ হচ্ছে জার্মান সমাজের একটি বড় অংশের কোনো ভবিষ্যত এই দেশে নেই” জার্মানির ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় প্রভাব গ্রহণ করা হয় না। অন্যদিকে ব্যক্তিগত আচার-অনুষ্ঠানেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। তাই খতনার মতো ধর্মীয় আচারকে কেবল ধর্মীয় বিষয় নয়, বাচ্চার শারীরিক অধিকার হিসাবেও অনেকে দেখতে চান। যেমন জার্মান সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগে সবুজ দলের নেত্রী রেনাটে কুনাস্ট বললেন, “আমি চাই জার্মানিতে ইহুদি ও মুসলমানরা যাতে তাদের ধর্মকানুন মেনে চলতে পারে। আবার অন্যদিকে নিজের শরীরের উপর শিশুর যে অধিকার আছে, সেটার প্রতিও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। এটা কোনো সহজ বিষয় নয়। এবং এই নিয়ে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোও যাবে না।”

তবে আর-এক রাজনীতিক ফোল্কা বেক কিন্তু ভিন্নমত জানালেন। ধর্মীয় সব বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মত জানিয়ে তাঁর বক্তব্য, “একটি উদার সমাজে রাষ্ট্র কখনো ধর্মীয় সংস্কারের দায়িত্ব তুলে নিতে পারে না, বরং ধর্মীয় সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে পারে।”

কোলনের আদালতের এই রায় নিয়ে গত জুলাই মাসে জার্মানের সংসদ সদস্যরা একটি খসড়া প্রস্তাব সংসদে তোলেন। এতে খতনার ধর্মীয় অধিকার বহাল রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তবে অনেকেই আছেন যারা আদালতের রায়কে শ্রদ্ধা করছেন এবং তা মেনে নিয়েছেন। তাদের একজন মেহমেত কিলিশ। জার্মান সংসদের এই মুসলিম সদস্য আদালতের রায় অনুসারে ছেলের খতনা করানো থেকে বিরত থাকছেন। তাঁর কথায়, “এই রায় এলে হয়তো এই গ্রীষ্মেই আমি আমার ১ এবং ৮ বছরের দুই ছেলের খতনা করিয়ে ফেলতাম। এই রায়ের পর আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। এবং এরপর আমরা খতনা না-করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা আমরা আমাদের সন্তানের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছি। আমরা মনে করি, এটা বাচ্চাদের মতামত নিয়ে করাই ভালো হবে।”

এরপরও কিন্তু বিতর্ক থামছে না। আদালতের এই রায় মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ কি না, আর সেটা হয়ে থাকলে তা কতটুকু নৈতিক, সেই বিতর্ক এখন আবার শুরু হয়েছে। সমস্যাটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন জার্মানির নৈতিকতা পরামর্শ কেন্দ্র। এখানকার একমাত্র মুসলিম সদস্য ইলহান ইলিচ এ প্রসঙ্গে বলেছেন– “নৈতিক দিক থেকে আমি মনে করি যে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সবকিছুই আইনগতভাবে পরিচালিত হওয়ার দরকার নেই। তবে এখন বিতর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে আমার সন্দেহ যে আইন–করে বিষয়টির সুরাহা করা আদৌ সম্ভব কি না।”

ভাবা যায়? শুধুমাত্র লিঙ্গকে কেন্দ্র করেই বাঙালি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। বাংলা ভাষা দুটি ভিন্ন রূপ পেল– ইসলামাশ্রয়ী মুসলমানি বাংলা আর সংস্কৃতাশ্রয়ী হিন্দু বাংলা। খিলজিরা বাঙালিদের একটি পুরুষাঙ্গের খানিকটা চামড়া কেটে দিয়ে বলল যে তোমরা মুসলমান হয়ে গিয়েছ। তাদের বিশেষ কাজে তেমন। কোনো সমস্যা না-হওয়ায় বাঙালিরা এটাকে কিছু মনে করল না। কার লিঙ্গ ‘কাটা’ আর কারটা ‘আকাটা’ তা তাদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। “সুন্নতে খতনা’ নামক এ কাজটির মাধ্যমে বাঙালিদের আর-একটি পরিচয় হল বটে, কিন্তু বাঙালি বুঝতে পারল না যে তারা দু-ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এরপর ইংরেজ শাসকরা বুঝতে পারল এই ‘কাটা’ আর ‘আকাটা’-দের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পারলেই তাদের ঔপনিবেশিক শাসন অনেক সহজ হয়। জনশ্রুতি আছে, ইংরেজরা একদিন দু-দলকে ডেকে ন্যাংটো করে সামনাসামনি দাঁড় করাল। তারপর দেখাল যে “তোমাদের দু-দলের লিঙ্গ একরকম নয়, তোমাদের একদলেরটা কাটা’ এবং অন্য দলেরটা ‘আকাটা। সুতরাং, তোমরা কখনোই এক নও”। তারপর ‘আকাটা’ দলের লিঙ্গে কিছু বিছুটি পাতার গুড়ো দেওয়া হল এবং ‘কাটা’-দের লিঙ্গে মেখে দেওয়া হল কিছু মরিচের গুড়ো। তারপর তাদের জিজ্ঞেস করা হল, “তোমাদের কেমন অনুভূত হচ্ছে?” একদল বলল চুলকানির কথা, অন্য দল বলল জ্বলুনি-পুড়নির কথা। তারপর তাদের বোঝানো হল, “দেখো, তোমাদের চুলকায় আর ওদের জ্বলে পুড়ে যায়। তার মানে এখানেও তোমরা ভিন্ন”। এবার ইংরেজরা ‘কাটা’-দেরকে বোঝাল যে তোমাদের দেশটারও ‘সুন্নতে খতনা করা দরকার। ১৯০৫ সালে ‘বাঙালিত্ব’-এর সুন্নতে খতনা করা হল। একেবারে মাঝখান থেকে কেটে। গোড়ার অংশটা পশ্চিমবঙ্গ, আগার অংশটা পূর্ববঙ্গ। তবে ১৯১১ সালেই কিছু বিশেষজ্ঞ সার্জন (কার্জন?) দ্বিখণ্ডিত বাঙালিত্বকে আবার সেলাই করে জুড়ে দিলেন। তবে বাঙালি এবার দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। ১৯৪৭ সালে এসে বাঙালিত্বকে দ্বিখণ্ডিত করে পুনরায় সুন্নতে খতনা করা হল। চেষ্টা করা হল বাঙালির সঙ্গে একেবারেই জাত-গোষ্টি-সমাজ সংস্কৃতিতে ভিন্ন আর-একজন ‘কাটা’-র সঙ্গে জুড়ে দিতে। যেহেতু ভিন্ন জাত গোষ্ঠীর অঙ্গটি বাঙালিদের মতো অর্ধেক কাটা ছিল না, তাই ওটাকে সেলাই করে সংযুক্ত করে দেয়া গেল না; কোনোরকমে সুতো দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হল। বাঙালির প্রাণের ধর্ম ‘বাঙালিত্ব’ এবার আর-একজনের কাটা অঙ্গের সঙ্গে ঝুলে রইল। পাকিস্তানিরা এবার ঝুলে থাকা অর্ধেক বাঙালিত্বর পুনরায় সুন্নতে খতনা করার প্রস্তুতি নিল। বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের খাঁটি মুসলমান বানানোর পায়তারা করল। সে তো আর-এক গল্প!

রক্তমাংসের লিঙ্গের তো অনেকটা করা গেল, কিন্তু কৃত্রিম লিঙ্গের আলোচনা না করলে এ প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কৃত্রিম লিঙ্গ বা ডিলডো পুংজননেন্দ্রিয় সদৃশ এক ধরনের যৌনখেলনা। বিশেষ করে হস্তমৈথুনের বা এধরনের বিকল্প রতিক্রীড়ার সময় অথবা সঙ্গীর সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার সময় শারীরিক অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম লিঙ্গ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কৃত্রিম লিঙ্গ আকৃতি আকার এবং সামগ্রিক চেহারার দিক দিয়ে দেখতে উলম্ব বা উত্থিত পুরুষ শিশ্নের মতো। এর প্রসারিত বর্ণনা সংযুক্ত রয়েছে ভাইব্রেটর সামগ্রীতে। এই ধরনের লিঙ্গাকৃতির সরঞ্জাম যোনিপথে অনুপ্রবেশের জন্যে ব্যবহৃত হয়, যা মানসিকভাবে পুরুষ-লিঙ্গের মতো ব্যবহার করা যায়। যে সমস্ত পুরুষ ও মহিলারা অ্যানাল সেক্স পছন্দ করেন তাঁরা অনেকে পায়ূপথে অনুপ্রবেশের জন্যেও এটা ব্যবহার করে থাকে। কৃত্রিম লিঙ্গ সব লিঙ্গের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটা মূলত হস্তমৈথুন এবং অন্যান্য যৌন কার্যকলাপের নিরাপদ বিকল্প উপায়মাত্র। কৃত্রিম লিঙ্গের বস্তুকাম মূল্য আছে। তবে কিছু ব্যবহারকারী অন্য উপায়েও এটি ব্যবহার করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ পূর্বরাগের সময় চামড়ার উপর চালনা করা। উপযুক্ত আকারের হলে, কৃত্রিম মুখমেহনের জন্য মৌখিক অনুপ্রবেশ কাজেও এর ব্যবহার হয়ে থাকে। কোনো কোনো ব্যক্তি কৃত্রিম লিঙ্গ বিশেষভাবে জি-স্পট উদ্দীপিত করার কাজে ব্যবহার করে।

কৃত্রিম লিঙ্গ বস্তুত ফাঁপা ধরনের। পুরুষ তার লিঙ্গ এই কৃত্রিম লিঙ্গের ভিতর পুরে নিয়ে নারীর সঙ্গে সঙ্গমে রত হতে পারে। যে সকল পুরুষের লিঙ্গোত্থান সমস্যা আছে তারা এই খেলনা ব্যবহার করে থাকে। এই ডিলডো নামক যন্ত্রটি কোমরে শক্ত করে বাঁধার জন্য চামড়ার স্ট্যাপ থাকে যার কারণে এর নাম স্ট্র্যাপ অন ডিলডো। অন্যদিকে নারী সমকামীরা যোনিভেদের আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে ‘স্ট্র্যাপ-অন ডিলডো’ পরে নিয়ে একজন আরেকজনকে তৃপ্ত করতে পারে। পায়ুপথে ঢোকানো এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কৃত্রিম শিশ্নের অবস্থান করাকে বাট প্লাগ বলা হয়। কৃত্রিম শিশ্নে পায়ুপথে অনুপ্রবেশের পুনরাবৃত্তি অথবা দ্রুতলয়ে খোঁচানোর জন্য ব্যবহৃত।

ভারতে কিছু বিচার ব্যবস্থায় কৃত্রিম লিঙ্গের বাজারজাতকরণ এবং বিক্রয় অবৈধ। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্থানে এবং গ্রেট প্লেইন্সের কিছু স্থানে ‘অশ্লীল সরঞ্জাম’ আইনে কৃত্রিম লিঙ্গ বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২০০৭ সালে, ফেডারেল আপিল কোর্ট যৌনখেলনা বিক্রি নিষিদ্ধে আলাবামার আইন সমর্থন করে। ১৯৩৮ সালের অশ্লীলতা-বিরোধী আইনে প্রয়োগ (Anti obscenity Enforcement Act) বহাল রাখে ২০০৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর।

কৃত্রিম লিঙ্গ গ্রিক দানি শিল্পে দেখা যেতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, এধরনের দানি শিল্পে একটি দৃশ্য রচিত আছে যেখানে মৌখিক যৌনকর্মে লিপ্ত একজন মহিলা একজন পুরুষের উপর ঝুঁকে আছে এবং অন্য একজন পুরুষ তার পায়ুপথে কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশের চেষ্টা করছে। ৪১১ খ্রিস্টপূর্বের ‘অ্যারিস্টোফেনিস’ কমেডিতে তরা বহুবার উল্লেখিত, লাইসিসট্রাটা (LYSISTRATA)। সাধারণত কৃত্রিম লিঙ্গ বিভিন্ন আকার-আকৃতির পুরুষ লিঙ্গের বা পুংজনেন্দ্রীয় আকৃতিরও হয়ে থাকে। বর্তমানে নিখুঁতভাবে পুরুষ শারীরস্থান পুনর্গঠন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঢঙের এবং আকারের কৃত্রিম শিশ্ন তৈরি হয়ে থাকে। জাপানে প্রাণী অনুরূপ এবং কার্টুন অনুরূপ কৃত্রিম শিশ্ন তৈরি হয়ে থাকে। যেমন হ্যালো কিটি। এটা মূলত খেলনা হিসাবেই বিক্রি হয়ে থাকে। ফলে অশ্লীলতা আইন থেকে বিরত থাকা যায়।

জাপানের কাওয়াসাকি অঞ্চলের শিন্ট ধর্মাবলম্বী লোকেরা প্রতি বছর এপ্রিলের প্রথম রবিবার সাড়ম্বরে পালন করে একটি ধর্মানুষ্ঠান, যার নাম কানামারা মাৎসুরি (Kanamara Matsuri)। জাপানের কাওয়াসাকির একটি মন্দিরে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবটি প্রধানত ধর্ম বিশ্বাসের অনুষ্ঠান যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পুরুষের বংশদণ্ডের মতো উত্থিত লিঙ্গ। পৃথিবী ব্যাপী এটি লিঙ্গ উৎসব (Penis Festival) নামে পরিচিত। পেনিস ফেস্টিভাল অনুষ্ঠিত হয় জাপানের কাওয়াসাকির কানাইয়ামা মন্দিরে, যা ইতিমধ্যেই পেনিস মন্দির হিসাবে পরিচিত হয়ে গেছে। এই মন্দিরের বয়স ৭০০ বছরেরও বেশি। মন্দিরে একসময় যৌনকাজ করা মেয়েরা আসতো প্রার্থনার জন্য, যাতে এসটিডি (Sexually Transmitted Diseases) থেকে মুক্ত থাকতে পারে, এরপর উৎপাদনে (বাচ্চা), এমনকি শস্য উৎপাদনের জন্য এই মন্দিরে ভক্তরা প্রার্থনার জন্য আসেন। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকে প্রথম প্রচলন হয় এই বিচিত্র উৎসবের। যখন স্থানীয় বারবনিতারা বসন্তের শেষে বিশাল অগ্ৰত্বকহীন। পুরুষাঙ্গের রেপ্লিকা নিয়ে মিছিল করে যেত কাওয়াসাকি কানামারা মঠে প্রার্থনা করতে। যেন তারা সারাবছর যে কোনো ধরনের যৌন সংক্রমণ বা রোগ থেকে বাঁচতে পারে।

মূলত এটি একটি শিন্ট ধর্মীয় উৎসব, যার মাধ্যমে প্রজনন শক্তি বৃদ্ধির জন্য বন্দনা করা হয়। জানা যায়, ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যৌনব্যাধি বিশেষ করে সিফিলিস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘটা করে এই মেলা উদযাপন করত বারবনিতারা। বর্তমানে এটি পালিত হয় নিরাপদ যৌনতা, এইডস সংক্রমণ রোধ ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার অংশ হিসাবে উৎসবে হাজার হাজার লোক জড়ো হন। সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লিঙ্গ রেলি। মন্দিরের কাঠের লিঙ্গটি নিয়ে রেলিতে বের হন ভক্তরা। সঙ্গে থাকে আরো বড়ো বড়ো লিঙ্গ এবং সবার হাতে হাতে পুরুষদের অবিকল লিঙ্গ সদৃশ খেলনা বা বস্তু। ফেস্টিভালের সময়ে প্রায় নগ্ন মেয়েরা সেখানে লিঙ্গ আকৃতির বিভিন্ন আইসক্রিম, ফাস্টফুড, খেলনা বিক্রি হয়, কেউ ইচ্ছে করে সেগুলো কিনে খেতে পারে, লিঙ্গের উপর বসতে পারে, লিঙ্গের সঙ্গে ছবি উঠতে পারে, লিঙ্গের মাথায় চুমুও খেতে পারে। সাধারণত মেয়েরা আবার এসব ব্যাপার খুবই আগ্রহী হয়ে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় ছোটো থেকে বড়ো সবাইকে দেখা যায় পুরুষাঙ্গের আদলে তৈরি চকলেট আর আইসক্রিম চুষতে। অনেককেই ছবির জন্য পোজ দিতে দেখা যায় বিশালাকৃতির পুরুষাঙ্গের পাশে। মাথায় পেনিস সদৃশ টুপি পরিধান করে নাচগান করেন অনেকেই। ৬ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে এই উৎসব চলে টানা ৭ এপ্রিল রাত পর্যন্ত। বর্তমানে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মেলাটি। শুধু জাপান নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও আলোচিত হচ্ছে কানামারা মাৎসুরি। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ৫ এপ্রিল উৎসবটি আবার পালিত হবে। এ ফেস্টিভালে আয় হওয়া টাকা এইডস গবেষণার কাজে দান করা হয়, যেহেতু এককালে এখানে যৌনকর্মীরা আসতেন, এসটিডি যাতে না হয় সেই প্রার্থনার জন্য।

জাপানের সংস্কৃতি চর্চায় রক্ষণশীলতা প্রচণ্ড। পাশাপাশি আছে অবারিত উন্মোচন। পেনিস ফেস্টিভাল বা লিঙ্গ উৎসব এই রকম অবারিত উন্মোচনেরই একটি অন্যতম উদাহরণ।

লিঙ্গ নামক বিষয়টা নিয়ে যখন এত কথা হলই, তখন বিখ্যাত লিঙ্গটি বাদ গেলে হবে কেন! হ্যাঁ, শিবলিঙ্গের কথাই বলছি। “লীনং বা গচ্ছতি, লয়ং বা গচ্ছতি ইতি লিঙ্গম্” যা লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গ। আবার কারও মতে সর্বস্তু যে আধারে লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গম। কিন্তু বৈয়াকরণিকগণের মতে “লিঙ্গতে চিহ্নতে মনেনেতি লিঙ্গম্”। লিঙ্গ শব্দের অর্থ ‘প্রতীক’ বা ‘চিহ্ন’। যার দ্বারা বস্তু চিহ্নিত হয়, সত্য পরিচয় ঘটে তাই-ই লিঙ্গ। অর্থাৎ যার দ্বারা সত্যবিজ্ঞান লাভ হয়, যার সাহায্যে বস্তুর পরিচয় পাওয়া যায় তাকেই বস্তু পরিচয়ের চিহ্ন বা লিঙ্গ বলে। আর এজন্যই দেহ প্রকৃতিতে লীনভাবে অবস্থান করে বলেই চি জ্যোতিকে বলা হয় লিঙ্গ। ভূমা ব্রহ্মের গুহ্য নাম ‘শিব’ এবং ভূমা ব্রহ্মের পরিচায়ক বলে আত্মজ্যোতির উদ্ভাসনের নাম শিবলিঙ্গ। প্রলয়ের কারণ বলে লোকে মহাদেবকে লিঙ্গ বলে। এই লিঙ্গ ব্রহ্মের পরম শরীর। আর এ জন্যই ত্রেতাযুগে রাবণ বধে যাত্রার সময় সেতুবন্ধে শ্রীরামচন্দ্র রামেশ্বরে শিবের পুজো করেন। আবার পরশুরামও পশুপতি শিবের তপস্যা করেই পশুপাত অস্ত্র লাভ করেন। দ্বাপরযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী জাম্ববতীসহ উপমন্যু মুনির আশ্রমে গমন করেন এবং তথায় দেবতা, ঋষি ও পিতৃগণের তর্পণান্তে অমিত মহাদেবের লিঙ্গমূর্তিতে পুজো করেন। আবার শ্রীকৃষ্ণ মার্কণ্ডেয় মুনির আশ্রমে গিয়ে ভুতিভূষণ শিবের পুজো করেছিলেন।

শিবলিঙ্গ হল হিন্দু দেবতা শিবের একটি প্রতীকচিহ্ন। হিন্দু মন্দিরগুলিতে সাধারণত শিবলিঙ্গে শিবের পুজো হয়। শিবলিঙ্গকে অনেক সময় যোনিচিহ্ন (এটাকে অনেকে গৌরীপট্টও বলে) সহ তৈরি করা হয়। সব মিলিয়ে একটি মৈথুনরত প্রতীকই দৃশ্যমান হয়। যোনি হল মহাশক্তির প্রতীক। শিবলিঙ্গ ও যোনির সম্মিলিত রূপটিকে নারী ও পুরুষের অবিচ্ছেদ্য ঐক্যসত্ত্বা এবং জীবনসৃষ্টির উৎস পরোক্ষ স্থান ও প্রত্যক্ষ কালের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে পাশ্চাত্য গবেষকরা লিঙ্গ ও যোনিকে নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে হিন্দুরা শিবলিঙ্গকে সৃষ্টির পিছনে নারী ও পুরুষ উভয়ের অবদানের কথা স্মরণ করে শিবলিঙ্গের পুজো করেন। একটি সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ। শিব এক অনাদি অনন্ত লিঙ্গস্তম্ভের রূপে আবির্ভূত, বিষ্ণু বরাহ বেশে স্তম্ভের নিম্নতল ও ব্রহ্মা উধ্বতল সন্ধানে রত। এই অনাদি অনন্ত স্তম্ভটি শিবের অনাদি অনন্ত সত্ত্বার প্রতীক মনে করা হয়। নৃতাত্ত্বিক ক্রিস্টোফার জন ফুলারের মতে, হিন্দু দেবতাদের মূর্তি সাধারণত মানুষ বা পশুর অনুষঙ্গে নির্মিত হয়। সেক্ষেত্রে প্রতীকরূপী শিবলিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। কেউ কেউ মনে করেন, লিঙ্গপুজো ভারতীয় আদিবাসী ধর্মগুলি থেকে হিন্দুধর্মে গৃহীত হয়েছে।

অথর্ববেদে একটি স্তম্ভের স্তব করা হয়েছে। এটিই সম্ভবত লিঙ্গপুজোর উৎস। কারোর কারোর মতে ঘূপস্তম্ভ বা হাঁড়িকাঠের সঙ্গে শিবলিঙ্গের যোগ রয়েছে। উক্ত স্তবটিকে আদি-অন্তহীন এক স্তম্ভ বা স্কম্ভ-এর কথা বলা হয়েছে; এই স্কম্ভ চিরন্তন ব্রহ্মের স্থলে স্থাপিত। যজ্ঞের আগুন, ধোঁয়া, ছাই, মাদক সোমরস ও যজ্ঞের কাঠ বহন করার ষাঁড় ইত্যাদির সঙ্গে শিবের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির যোগ লক্ষিত হয়। মনে করা হয়, কালক্রমে ঘূপস্তম্ভ শিবলিঙ্গের রূপ নিয়েছিল। লিঙ্গপুরাণে এই স্তোত্রটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি কাহিনির অবতারণা করা হয়। এই কাহিনিতে উক্ত স্তম্ভটিকে শুধু মহানই বলা হয়নি বরং মহাদেব শিবের সর্বোচ্চ সত্ত্বা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারত ও কম্বোডিয়ায় প্রচলিত প্রধান শৈব সম্প্রদায় ও অনুশাসন গ্রন্থ শৈবসিদ্ধান্ত মতে, উক্ত শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান উপাস্য দেবতা পঞ্চানন (পাঁচ মাথা-বিশিষ্ট) ও দশভূজ (দশ হাত-বিশিষ্ট) সদাশিব প্রতিষ্ঠা ও পুজোর আদর্শ উপাদান হল শিবলিঙ্গ। নেপালে দশম শতাব্দীর চার মাথা-বিশিষ্ট পাথরের শিবলিঙ্গ সবচেয়ে প্রাচীন। এখনও পূজিত হয় এমন প্রাচীনতম লিঙ্গটি রয়েছে গুডিমাল্লামে। ক্লস ক্লোস্টারমায়ারের মতে, এটি স্পষ্টতই শিশ্নের অনুষঙ্গে নির্মিত। লিঙ্গটির নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী। শিবের একটি অবয়ব লিঙ্গটির সম্মুখভাগে খোদিত রয়েছে।

১৮১৫ সালে ‘A View of the History, Literature, and Religion of the Hindoos’ গ্রন্থে লেখক ব্রিটিশ মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ড হিন্দুদের অন্যান্য ধর্মীয় প্রথার সঙ্গে লিঙ্গপুজোরও নিন্দা করেছিলেন। তাঁর মতে লিঙ্গপুজো ছিল, “মানুষের চারিত্রিক অবনতির সর্বনিম্ন পর্যায়।” শিবলিঙ্গের প্রতীকবাদটি তাঁর কাছে ছিল “অত্যন্ত অশালীন; সে সাধারণের রুচির সঙ্গে মেলানোর জন্য এর যতই পরিমার্জনা করা হোক-না-কেন।” ব্রায়ান পেনিংটনের মতে, ওয়ার্ডের বইখানা “ব্রিটিশদের হিন্দুধর্ম সম্পর্কে ধারণা ও উপমহাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের মূল ভিত্তিতে পরিণত হয়েছিল।” ব্রিটিশরা মনে করত, শিবলিঙ্গ পুরুষ যৌনাঙ্গে আদলে নির্মিত এবং শিবলিঙ্গের পুজো ভক্তদের মধ্যে কামুকতা বৃদ্ধি করে। অবশ্য ১৮২৫ সালে হোরাস হেম্যান। উইলসন দক্ষিণ ভারতের লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় সম্পর্কে একটি বই লিখে এই ধারণা খণ্ডানোর চেষ্টা করেছিলেন।

মনিয়ার উইলিয়ামস তাঁর ‘Brahmanism And Hinduism’ বইয়ে লিখেছেন, ‘লিঙ্গ প্রতীকটি “শৈবদের মনে কোনো অশালীন ধারণা বা যৌন প্রণয়াকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয় না”। জেনেন ফলারের মতে, লিঙ্গ “পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে নির্মিত এবং এটি মহাবিশ্ব-রূপী এক প্রবল শক্তির প্রতীক।” ডেভিড জেমস স্মিথ প্রমুখ গবেষকেরা মনে করেন, শিবলিঙ্গ চিরকালই পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গটি বহন করছে। অন্যদিকে এন. রামচন্দ্র ভট্ট প্রমুখ গবেষকেরা মনে করেন, পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গটি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা। এম. কে. ভি. নারায়ণ শিবলিঙ্গকে শিবের মানবসদৃশ মূর্তিগুলি থেকে পৃথক করেছেন। তিনি বৈদিক সাহিত্যে লিঙ্গপুজোর অনুপস্থিতির কথা বলেছেন এবং এর যৌনাঙ্গের অনুষঙ্গটিকে তান্ত্রিক সূত্র থেকে আগত বলে মত প্রকাশ করেছেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংস ‘জীবন্ত-লিঙ্গপুজো’ করতেন বলে কথিত আছে। ১৯০০ সালে প্যারিস ধর্মীয় ইতিহাস কংগ্রেসে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে বৈদিক যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ ধারণা থেকে। যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ হল বলিদানের হাঁড়িকাঠ। এটিকে অনন্ত ব্রহ্মের একটি প্রতীক মনে করা হত। জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে এগুলিকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে সৃষ্ট প্রতীক বলে উল্লেখ করে তা পাঠ করলে, তারই প্রতিক্রিয়ায় বিবেকানন্দ এই কথা বলেছিলেন। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, শালগ্রাম শিলাকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। তিনি আরও বলেছিলেন, শিবলিঙ্গর সঙ্গে পুরুষাঙ্গের যোগ বৌদ্ধধর্মের পতনের পর আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত গল্প। স্বামী শিবানন্দও শিবলিঙ্গকে যৌনাঙ্গের প্রতীক বলে স্বীকার করেননি। ১৮৪০ সালে এইচ. এইচ. উইলসন একই কথা বলেছিলেন। ঔপন্যাসিক ক্রিস্টোফার ইসারউড লিঙ্গকে যৌন প্রতীক মানতে চাননি। ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়ায় ‘Lingam’ ভুক্তিতেও শিবলিঙ্গকে যৌন প্রতীক বলা হয়নি।

মার্কিন ধর্মীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ওয়েনডি ডনিগারের মতে– “For Hindus, the phallus in the background, the archetype (if I may use the word in its Eliadean, indeed Bastianian, and non-Jungian sense) of which their own penises are manifestations, is the phallus (called the lingam) of the god Siva, who inherits much of the mythology of Indra (O’Flaherty, 1973). The lingam appeared, separate from the body of Siva, on several occasions… On each of these occasions, Sivas wrath was appeased when gods and humans promised to worship his lingam forever after, which, in India they still do. Hindus, for instance, will argue that the lingam has nothing whatsoever to do with the male sexual organ, an assertion blatantly contradicted by the material.” যদিও অধ্যাপক ডনিগার পরবর্তীকালে তাঁর “The Hindus : An Alternative History” বইতে তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার করে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো কোনো ধর্মশাস্ত্রে শিবলিঙ্গকে ঈশ্বরের বিমূর্ত প্রতীক বা দিব্য আলোকস্তম্ভ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এইসব বইতে লিঙ্গের কোনো যৌন অনুষঙ্গ নেই। হেলেন ব্রুনারের মতে, লিঙ্গের সামনে যে রেখাঁটি আঁকা হয়, তা পুরুষাঙ্গের গ্ল্যান্স অংশের একটি শৈল্পিক অনুকল্প। এই রেখাঁটি আঁকার পদ্ধতি মধ্যযুগে লেখা মন্দির প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত অনুশাসন এবং আধুনিক ধর্মগ্রন্থেও পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠা-পদ্ধতির কিছু কিছু প্রথার সঙ্গে যৌন মিলনের অনুষঙ্গ লক্ষ করা যায়।

আগামা ধর্মসূত্রের তৃতীয় অধ্যয়ের ১৬-১৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে Lin অর্থ বিলীন হওয়া এবং ga অর্থ উৎপন্ন হওয়া। অর্থাৎ যে মঙ্গলময় সৃষ্টিকর্তা (শিব) থেকে সবকিছু উৎপন্ন হয় এবং প্রলয়কালে সবকিছু যাতে বিলীন হয় তারই প্রতীক এই শিবলিঙ্গ। স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০০ সালে প্যরিসে হয়ে যাওয়া ধর্মসমূহের ঐতিহাসিক মূল শীর্ষক সম্মেলনে বিশ্ববাসীর সামনে অথর্ববেদের স্কন্তসুক্তের সাহায্যে তুলে ধরেন যে শিবলিঙ্গ মূলত বিশ্বব্রহ্মান্ডেরই প্রতীক। স্বামী শিবানন্দ বলেন– “এটি শুধু ভুলই নয়, বরং অন্ধ অভিযোগও বটে যে শিবলিঙ্গ পুরুষলিঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী।” তিনি লিঙ্গপুরাণের নিম্নলিখিত শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন– “প্রধানাম প্রকৃতির যদাধুর লিঙ্গমুত্তমম গান্ধবর্নরসাহৃনম শব্দ স্পর্শাদি বর্জিতম।”

শিবপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, একদা দুর্গার সঙ্গে যৌনমিলনকালে শিব এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাতে দুর্গার প্রাণনাশের উপক্রম হয়। দুর্গা মনে মনে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে থাকেন, এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়ে নিজ সুদর্শন চক্র দ্বারা আঘাত করল উভয়ের সংযুক্ত যৌনাঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়। ওই সংযুক্ত যৌনাঙ্গের মিলিত সংস্করণের নাম বাণলিঙ্গ বা শিবলিঙ্গ, যা হিন্দুসমাজের একটি প্রধান পূজ্য বস্তু এবং ওই শিবলিঙ্গের পুজোর জন্য বহু বড়ো বড়ো শিবমন্দির গড়ে উঠেছে। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে হিন্দুসমাজ মহাসমারোহে ওই শিবলিঙ্গ পুজো করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণশ্বরে শিবের সঙ্গমের অবস্থান প্রদর্শনের জন্য পরপর বারোটি মন্দির রয়েছে। ওই মন্দিরগুলিতে যৌনমিলনকালীন সময়ের বারো প্রকারের প্রমত্তাবস্থা প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার মহিলা দর্শনার্থীর সমাগম হয়।

এক শাস্ত্রীয় কাহিনিতে পাচ্ছি, দেবতারা সব একত্রে মিলিত হয়েছেন, উদ্দেশ্য রাসমেলার পরিদর্শন। কৈলাস থেকে আগত মহাদেব রাসমেলার পরিদর্শনে ইচ্ছা প্রকাশ করলে শ্রীকৃষ্ণ কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যেহেতু সর্বাধিক বুদ্ধিমান শ্রীকৃষ্ণ সকল বিষয়েই অবগত। নিরাশ না-হয়ে মহাদেব ছদ্মবেশ ধারণ করে রাসমেলার উদ্দ্যেশে রওনা দিলে নৃত্যরত স্বল্পবসনা এক সুন্দরীকে দেখতে পান। সুন্দরী দেখে মহাদেবের পুরুষদণ্ড বিকটাকার ধারণ করল। চতুঃপার্শ্বে ত্রাহি রব– হায়! এ যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হবার শঙ্কা! অবশেষে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে দেবদেবীদের সম্মিলিত প্রার্থনায় মহামায়া প্রকট হলেন। মহামায়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-জোড়া মহাযোনি সৃষ্টি করলেন। মহাদেবের নিয়ন্ত্রণহীন বিকটাকার পুরুষদণ্ডকে ধারণ করে নিবৃত্ত করলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও অহেতুক বিনাশ থেকে রক্ষা পেল। সেই থেকে প্রচলন হল যোনিতে প্রোথিত মহাদেবের লিঙ্গপুজো। উল্লেখ্য যে, শিবরাত্রির বিশেষ ক্ষণে শিবলিঙ্গকে স্নান করানো পূর্বক অবিবাহিত তনয়ারা উত্তম পুরুষাঙ্গ-ধারী বীর্যবান স্বামী প্রাপ্তির আশীর্বাদ লাভ করেন।”

‘লিঙ্গ’ শব্দটি কোল বা অস্ট্রিক ভাষার। ঋগ্বেদে ‘লিঙ্গ’-এর প্রতিশব্দ ‘শিশ্ন’। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের একুশ সুক্ত থেকে জানা যায়– এক শ্রেণির মানুষ শিশ্নোপাসনা করতেন। এরা অভিহিত শিশ্নদেবাঃ নামে। বলা হয়েছে, এই সম্প্রদায়গণ বেদ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। তাই তাদের অনার্য রাক্ষসদের সমপর্যায়ের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছেন বৈদিক ঋষিরা। অনেকের মতে, লিঙ্গপুজো প্রচলিত ছিল মহেনজোদারো এবং হরপ্পায়। শিব অনার্য দেবতা, লিঙ্গ বা শিশ্নও। তাই লিঙ্গ বা শিশ্নই যে শিবলিঙ্গটা, তা সবার কাছে গৃহীত। সেকালের ঋষিরাও শিবলিঙ্গের পুজোর নিন্দা করেছেন। কিন্তু পরে বৈদিক আর্যদের বংশধররা এ পুজোকে মেনে নিয়েছিলেন। এ হচ্ছে আর্যসমাজে অনার্যসমাজের প্রভাবের প্রতিফলন। যুগের ক্রমধারায় এই শিব তো বটেই– শিবলিঙ্গ ও প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী দেবতা হিসাবে অভিষিক্ত হন। শিবলিঙ্গ দুই ধরনের। প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম। মতান্তরে চল আর অচল। মন্দিরে স্থাপিত লিঙ্গ ‘অচল’ আর যেগুলো স্থানন্তরিত হয় সেগুলোকে বলা হয় ‘চল’।

পুরাণে জানা যাচ্ছে, বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হলে শোকার্ত শিব ক্ষোভ এবং লজ্জায় প্রস্তরময় লিঙ্গরূপ ধারণ করেন। কিন্তু তা নিছকই প্রতীক, পুরুষ চিহ্ন নয়। বামনপুরাণেই শিবলিঙ্গ নিয়ে অনেক কাহিনি আছে– এর মধ্যে একটি কাহিনি হল– সতীর দেহত্যাগের পর শিব কামদেবের বাণে কামাসক্ত হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় দারুবনে যান এবং সেখানকার মহর্ষিদের কাছে অভিলাষিত ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। এ সময় অরুন্ধতি ও অনসূয়া ছাড়া ঋষিপত্নীরা শিবকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়েন। ক্রুদ্ধ মহর্ষিদের অভিশাপে শিবের লিঙ্গ খসে পড়ে এবং তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রমুখ এসে শিবকে তার লিঙ্গ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। এ লিঙ্গের পুজো করতে হবে– এই শর্তে রাজি হলেই শিব তা আবার ধারণ করেন।

পুরাণেই উল্লেখিত ভিন্ন একটি গল্প হল– কোনো বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য শিব সুন্দর পুরুষ সেজে বনমালা পরে উলঙ্গ অবস্থায় বালখিল্য ঋষিদের পাড়ায় আসেন ভিক্ষাছলে। তাকে দেখে কামার্ত ঋষিপত্নিরাও উলঙ্গ হতে চান এবং শিবকে নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন। শিব জানান, পুরুষহীন কোনো নির্জন স্থানে গেলে তিনি এই উলঙ্গব্রতের কারণ বলবেন। এ সময় বালখিল্যরা এসে স্ত্রীদের পিটাতে থাকেন। এক পর্যায়ে এক ঋষিপত্নীর স্পর্শে খসে পরে শিবের লিঙ্গ এবং বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা এবং অন্যদের স্তবে তুষ্ট হয়ে শিব জানান, এই লিঙ্গের পুজো করলে জগতের শান্তি হবে। সেই থেকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রচালিত আছে শিবলিঙ্গের পুজো।

ঋষি মার্কণ্ডেয় সম্পর্কে প্রচলিত জনপ্রিয় উপাখ্যানটির সঙ্গে শিবলিঙ্গের অনুসঙ্গ লক্ষ করা যায় : মৃক ঋষি ও তাঁর পত্নী মরুদবতী পুত্রকামনায় শিবের আরাধনা করেন। তাঁদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা কেমন পুত্র চান –দীর্ঘজীবী মূর্খ পুত্র না ক্ষণজীবী জ্ঞানী পুত্র। মৃক ঋষি ক্ষণজীবী জ্ঞানী পুত্ৰই চান। জন্ম হয় মার্কণ্ডেয়ের। মার্কণ্ডেয়ের আয়ু ছিল মাত্র ষোলো বছরের। সে ছিল শিবের ভক্ত। ষোড়শ বছরে পদার্পণ করার পর যখন তার মৃত্যুকাল আসন্ন, তখন সে একটি শিবলিঙ্গ গড়ে পুজোয় বসে। যম তাকে নিয়ে যেতে এলে সে সেই শিবলিঙ্গ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে। যম তাঁর রজ্জু দিয়ে মার্কণ্ডেয়কে বন্ধন করলে, মার্কণ্ডেয় শিবলিঙ্গটিকে আঁকড়ে ধরে এবং শিবের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে। ভক্তবৎসল শিবভক্তের দুর্দশা দেখে শিবলিঙ্গ থেকে আবির্ভূত হন। ক্রুদ্ধ শিব আক্রমণ করেন যমকে। যম পরাভূত হন এবং মার্কণ্ডেয়ের উপর তাঁর দাবি ত্যাগ করে ফিরে যান। শিব যমকে পরাজিত করে মৃত্যুঞ্জয় নামে পরিচিত হন। শিবের বরে মার্কণ্ডেয় অমরত্ব লাভ করেন। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র মার্কণ্ডেয়ের রচনা মনে করা হয়। তামিলনাড়ুর তিরুক্কদাভুর মন্দিরে শিবের যমবিজয়ের ধাতুচিত্র রয়েছে। নৃসিংহ পুরাণ গ্রন্থেও একই প্রকার একটি কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই কাহিনি অনুযায়ী, মার্কণ্ডেয় কর্তৃক মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠের পর বিষ্ণু যমের হাত থেকে মার্কণ্ডেয়কে রক্ষা করেছিলেন।

সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য ৩৬টি পুরাণ রচিত হয়েছে। এর ১৮টি মহাপুরাণ এবং ১৮টি উপপুরাণ। মহাপুরাণগুলি হল যথাক্রমে– (১) মার্কণ্ডেয়, (২) মৎস্য, (৩) ভাগবত, (৪) ভবিষ্য, (৫) ব্রহ্মাণ্ড, (৬) ব্রহ্ম, (৭) ব্রহ্মবৈবর্ত, (৮) বায়ু, (৯) বামন, (১০) বরাহ, (১১) বিষ্ণু, (১২) অগ্নি, (১৩) নারদ, (১৪) পদ্ম, (১৫) লিঙ্গ এবং (১৬) গরুড়। অপরদিকে ১৮টি উপপুরাণ হল –(১) সনৎকুমার, (২নারসিংহ, (৩) শিব, (৪)শিবধর্ম, (৫)আশ্চর্য, (৬)নারদীয়, (৭)কাপিল, (৮) মানব, (৯) ঔশনস, (১০) আদিত্য, (১১) বারুণ, (১২) কালিকা, (১৩) মাহেশ্বর, (১৪) শাম্ব, (১৫) সেরি, (১৬) পরাশর, (১৭) ভাগবত এবং (১৮) বাশিষ্ঠ।

মহাপুরাণের পঞ্চদশ পুরাণটিই হল লিঙ্গপুরাণ। কীভাবে লিঙ্গপুরাণ শুরু হচ্ছে তা সূত ও নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণের কথোপকথনের মাধ্যমে একবার বাংলা তর্জমায় দেখে নিই– ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও আদিরূপে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কারী প্রকৃতিপুরুষের নিয়ামক পরমাত্মা শিবকে প্রণাম করি। নারায়ণ, নর, নরোত্তম, দেবী সরস্বতী এবং বেদব্যাসকে নমস্কারপূর্বক জয় অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণাদি গ্রন্থ উচ্চারণ করবে শৈলেশ, সঙ্গমেশ্বর, স্বর্গস্থিত, হিরণ্যগর্ভ, বারাণসী, মহালয়, রৌদ্র, গোপেক্ষক, শ্রেষ্ঠ পাশুপত, বিঘ্নেশ্বর, কেদার, গোমায়ূকেশ্বর, হিরণ্যগর্ভ, চন্দ্রনাথ, ঈশান্য, ত্রিবিষ্টপ ও শুক্রেশ্বর প্রভৃতি তীর্থ স্থানে যথাবিধি শিবলিঙ্গ পুজো করে মহর্ষি নারদ নৈমিষারণ্যে গমন করলেন। (১-৩) তৎকালে নৈমিষারণ্যবাসী মুনিগণ নারদকে দেখামাত্র আনন্দিত মনে পুজো করে যথাযোগ্য। আসন প্রদান করলেন। তিনিও মুনিবরকর্তৃক পূজিত হয়ে হৃষ্টমনে তাঁদের প্রদত্ত উত্তমাসনে সুখে উপবেশন করে শিবলিঙ্গ মহাত্মা বিষয়কে মনোহর ভাবশালী উপাখ্যান বলতে লাগলেন। ইত্যবসরে সেখানে সর্বপুরাণবেত্তা বুদ্ধিমান সূত স্বয়ং মুনিগণকে প্রণাম করতে উপস্থিত হলে, নৈমিষারণ্যবাসী মুনিগণ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন শিষ্যের অভ্যর্থনার জন্য যথাযযাগ্য সবিনয় সম্ভাষণ ও পুজো বিধান করলেন। (৪-৭) এরপর তাঁদের পুরাণশ্রবণে ইচ্ছা হলে তপস্বী সমস্ত অতি বিশ্বস্ত বিদ্বান রোমহর্ষণ সূতকে শিবলিঙ্গ-মহাত্ম্যপূর্ণ পবিত্র পুরাণ-শাস্ত্র জিজ্ঞাসা করলেন। (৮-৯) হে মহামতে সূত! আপনি পুরাণের জন্য মহর্ষি বেদব্যাসকে উপাসনা করে তাঁর কাছে পুরাণশাস্ত্র অবগত হয়েছেন। হে পৌরাণিকাগ্রগণ্য! সেই জন্য লিঙ্গ-মাহাত্ম্যপূর্ণ স্বর্গীয় পুরাণসংহিতা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি। ব্রহ্মার পুত্র শ্রীমান মুনিবর নারদ দেবাদিদেব পরমাত্মা মহেশ্বরের সমস্ত তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করে লিঙ্গপুজো করে এই স্থানে উপস্থিত আছেন। আপনি, আমরা ও মহর্ষি নারদ সবাই-ই শিবভক্ত; অতএব আপনি মহর্ষি নারদের কাছে (?)। এমন আপনি যা জেনেছেন, তা সবই সফল হতে পারবে। পৌরাণিকাগ্রগণ্য পূণ্যাত্মা সূতকে এমন বললে, তিনি অর্থে ব্রহ্মার পুত্র নারদকে অনম্বর, নৈমিষবাসী মুনিগণকে অভিবাদন করে পুরাণ বলতে আরম্ভ করিলেন। (১০-১৬) আমি লিঙ্গপুরাণ বলার জন্য মহাদেবকে নমস্কার করে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মুনিবর বেদব্যাসকে স্মরণ করছি। শব্দ-ব্ৰহ্ম যার শরীর, যিনি সাক্ষাৎ শব্দ-ব্রহ্মের প্রকাশক, বর্ণমালা যাহার অঙ্গ, তিনি অনেক রূপে স্থিতি করলেও অব্যক্ত স্বরূপ, যিনি অকাব, উকাব ও মকাব স্বরূপ এবং যিনি সূক্ষ্ম, স্থূল, পরাৎপর, ওঙ্কারস্বরূপ, ঋগ যার মুখ, সামগান যার জিহ্বা, যজুৰ্বেদ যার সুদীর্ঘ গ্রীবাদেশ, অথৰ্ব্ববেদ যার হৃদয়, যিনি প্রকৃতিপুরুষের অতীত, জন্ম-মৃত্যুবর্জিত হইলেও তমোগুণযোগে কাল, রুদ্র, রজোগুণযোগে ব্ৰহ্ম, সত্ত্বগুণযোগে সর্বময় বিষ্ণু নামে বিখ্যাত, যিনি নির্গুণ অবস্থায় পরম ব্রহ্ম মহেশ্বর, যিনি প্রকৃতি, পুরুষ, (?), অহংকার, মন, দর্শেন্দ্রিয়, পঞ্চতন্মাত্র ও পঞ্চভূতরূপে বিরাজমান হলেও স্বয়ং এদের অতীত ষড়বিংশ স্বরূপ, সেই মায়ার কারণ সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়-লীলার জন্য লিঙ্গরূপধারী সর্বময় মহেশ্বরকে প্রণাম করে মঙ্গলময় লিঙ্গপুরাণ বলতে আরম্ভ করছি। (১৭-২৩)।

মৎস্যপুরাণ, শিবপুরাণ, বামনপুরাণ, বায়ুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, কূর্মপুরাণ, বরাহপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, ভাগবতপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণগুলিতে কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত জানা যায়, তেমনি লিঙ্গপুরাণেও কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত উল্লেখ আছে। মহর্ষি কশ্যপ ও দিতির পুত্র দানব বজ্রাঙ্গ। বজ্রাঙ্গের স্ত্রী বরাঙ্গী। বজ্রাঙ্গ ও বরাঙ্গীর পুত্রের নাম তারক বা তারকাসুর। বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তারকাসুর দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। দেবতাদের পরাজিত করে সে স্বর্গলোক অধিকার করে এবং দেবতাদের ক্রীতদাসে পরিণত করে। তাঁর অত্যাচারে উৎপীড়িত দেবগণ পরিত্রাণের জন্য পিতামহ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা দেবতাদের অভয় দিয়ে বলেন– শিব ও পার্বতীর যে অপরাজেয় পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, তিনি সুরাসুরের অবধ্য তারকাসুরকে নিধন করবেন এবং স্বর্গরাজ্য পুনরায় দেবতাদের হবে। যথাকালে তপস্যানিরত শিবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর পঞ্চাগ্নি তপস্যানির পার্বতীর বিবাহ হয় এবং শিবতেজে পার্বতীর পুত্র কার্তিকেয়র জন্ম হয়। জন্মের পর ছয়জন কৃত্তিকা-মাতৃকা তাঁকে লালন-পালন করেন। শিব ও পার্বতীর অমিততেজা এই পুত্র ছয়মুখে ছয়। কৃত্তিকার স্তনদুগ্ধ পান করেছিলেন। ছয় মুখের জন্য তাঁর নাম ‘ষড়ানন বা ‘ষন্মুখ’। ছয়জন কৃত্তিকা-ধাত্রীজননীর স্তন্যপান করে বর্ধিত হন বলে তাঁর নাম হয় ‘কার্তিকেয়’ বা ‘কার্তিক’। জন্মের ষষ্ঠ দিন দেবসেনাপতিরূপে তাঁর অভিষেক হয় এবং ব্রহ্মার মানসকন্যা দেবসেনার সঙ্গে বিবাহ হয়। সপ্তম দিন তিনি তারকাসুরকে বধ পুরাণগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান স্কন্দপুরাণ প্রত্যক্ষত তাঁরই নাম বহন করছে।

শিবমহাপুরাণে আমরা দুই ধরনের শিবলিঙ্গ দেখতে পাই, একটা শুধু স্তম্ভ আকারে। যেমন অমরনাথ ইত্যাদির শিবলিঙ্গ। আর-একটি যোনির উপর। স্থাপিতরূপে, যেরূপে হিন্দু রমণীগণ জল-দুধ ঢেলে মনোবাঞ্ছা পূরণ করার প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা বলল —

যাবল্লিঙ্গং স্থিরং নৈব জগতাং ত্রিতয়ে শুভ।
জায়তে ন তদা কাপি সত্যমেতদ্বদাম্যহম্।। (২৫)

অর্থাৎ যে পর্যন্ত লিঙ্গ স্থিরভাব অবলম্বন না করছে, সেই পর্যন্ত ত্রিজগতের কোথায়ও শুভ হবে না, এটা সত্য বলছে।

অমরনাথের শিবলিঙ্গ : অমরনাথ গুহা একটি হিন্দু তীর্থক্ষেত্র, যা ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত। এটি একটি শৈবতীর্থ। এই গুহাটি সমতল থেকে ৩,৮৮৮ মিটার (১২,৭৫৬ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর ১৪১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই তীর্থে যেতে পহেলগাঁও শহর অতিক্রম করতে হয়। এই তীর্থক্ষেত্রটি হিন্দুদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত হয়। গুহাটি পাহাড় ঘেরা আর এই পাহাড়গুলো সাদা তুষারে আবৃত থাকে বছরের অনেক মাস ধরে। এমনকি এই গুহার প্রবেশপথও বরফে ঢাকা থাকে। গ্রীষ্মকালে খুব স্বল্প সময়ের জন্য এই দ্বার প্রবেশের উপযোগী হয়। তখন লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী অমরনাথের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। অমরনাথের গুহাতে চুঁইয়ে পড়া জল জমে শিবলিঙ্গের আকার ধারণ করে। জুন-জুলাই মাসে শ্রাবণী পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় অমরনাথ যাত্রা। শেষ হয় জুলাই-আগস্ট মাসে গুরু পূর্ণিমার সময় ছড়ি মিছিলে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অমরনাথ যাত্রায় যোগদান করেন।

গুহার ভিতরে ৪০ মিটার (১৩০ ফুট) ভিতরে গুহার ছাদ থেকে জল ফোঁটায় ফোঁটায় চুঁইয়ে পড়ে। এই চুঁইয়ে পড়া জলের ধারা খাড়াভাবে গুহার মেঝে পড়ার সময় জমে গিয়ে শিবলিঙ্গের আকার ধারণ করে। কখনো-কখনো ৮ ফুট উঁচুও হয় এই শিব লিঙ্গ। তবে গত কয়েকবছর ধরেই সময়ের আগেই বরফলিঙ্গ গলে যাচ্ছে, যা হয়তো উষ্ণায়নের ফল। জুন-জুলাই মাসে শ্রাবণী পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় অমরনাথ যাত্রা। শেষ হয় জুলাই-আগস্ট মাসে গুরু পূর্ণিমার সময় ছড়ি মিছিলে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অমরনাথ যাত্রায় যোগদান করেন। তীর্থ যাত্রার প্রধান উদ্দেশ্যই এই শিবলিঙ্গে পুজো দেওয়া। অমরনাথে কবে থেকে তীর্থযাত্রা শুরু হয় তা জানা যায় না। একটি তথ্যসুত্র থেকে জানা যায় কিংবদন্তী রাজা আরজরাজা ( খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সাল) বরফনির্মিত শিবলিঙ্গে পুজো দিতেন। ধারণা করা হয়, রানি সূর্যমতী ১১ শতকে অমরনাথের এই ত্রিশুল, বানলিঙ্গ ও অন্যান্য পবিত্র জিনিস উপহার দেন। এ ছাড়াও প্রাচীন কিছু পুথি থেকে আরও বেশ কিছু ভিন্ন এ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় মধ্যযুগে অমরনাথের কথা মানুষে ভুলে গিয়েছিল, কিন্তু পঞ্চদশ শতকে আবার নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। প্রচলিত আছে, কাশ্মীর একসময় জলে প্লাবিত হয়ে যায় এবং কাশ্যপ মুনি সে জল নদীর মাধ্যমে বের করে দেন। এরপর ভৃগুমুনি অমরনাথ বা শিবের বা শিবলিঙ্গের দেখা পান।

পরিশেষে লিঙ্গকে কেন্দ্র করে একটি ভুল ধারণা ভাঙার চেষ্টা করব। সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা শরিফের হাজরে আসওয়াদ পাথরটি কি শিবলিঙ্গ? হিন্দুদের কেউ কেউ তো এমনই বলেন শুনেছি। সত্যটা কী? মহানবি হজরত মোহম্মদ কর্তৃক মক্কা শরিফে স্থাপিত পবিত্র হাজরে আসওয়াদকে (কালোপাথর) লাখ লাখ মুসলমান পাপ থেকে মুক্তি পেতে চুম্বন করে থাকেন। অথচ এই হাজরে আসওয়াদই নাকি শিবলিঙ্গ? এই ধরনের ভিত্তিহীন যুক্তিহীন বিবৃতি থেকে সকলকেই বিরত থাকা উচিত। এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না, যা দিয়ে সেটাকে শিবলিঙ্গ বলা যায়। পাথর হলেই যেমন শিবলিঙ্গ নয়, তেমনি শালগ্রাম শিলাও নয়। পবিত্র হাজরে আসওয়াদ মোটেই শিবলিঙ্গের আদলে নয়। যে হজরত মোহাম্মদ পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসীদের যেভাবে সৌদি আরব থেকে উৎখাত করেছিলেন, সেই মোহম্মদ আহ্লাদ করে মক্কায় শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছেন, এটা মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। ইসলামের ইতিহাস এবং হজরতের জীবনী পড়লেই জানা যায় এটা কোনো মতেই শিবলিঙ্গ নয়। ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করা অপরাধ এবং অনৈতিক।

উপসংহারের বিষয় ধর্ষণ। লিঙ্গের সবচেয়ে বড়ো অপচয় এবং জঘন্যতম ব্যবহার হল ধর্ষণ। একশ্রেণির মানসিক বিকারগ্রস্ত পুরুষ নারীদের ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যেই এই অপকর্মটি করে থাকে। এইসব যৌন-প্রতিবন্ধী (Sextual Handicapd) পুরুষরা আসলে লিঙ্গ নামক অস্ত্রটিকে ব্যবহার করে নারীদের হত্যা করে। কিছু আগ্রাসী পুরুষও আছে, যাদের মধ্যে জোর করে ভোগ করার প্রবণতা কাজ করে। প্রাচীনকাল থেকে সামাজ্যবাদীরা এলাকা দখল করতে এসে তলোয়ার-বল্লমের পাশাপাশি নিজেদের লিঙ্গটাকে ব্যবহার করতে ভোলেননি। পছন্দ হলে জোর করে মেয়েদের তুলে এনে ফেলে দেওয়া হত হারেমের অন্ধকারে। নারীদের উপর চড়াও হওয়া এবং ধর্ষণ করা ছিল নিত্য আতঙ্ক। সেই আতঙ্ক কি আজও নেই? অন্যভাবে, অন্য রূপে? আজও সীমান্ত এলাকায় সৈনিকদের বন্দুকের নলের নীচে কত নারী ধর্ষিতা হচ্ছে তার হিসাব কে রাখল! শুধু সৈনিক কেন, সৈনিক নয় এমন মানুষও তো বোয়া তুলসীপাতা নয়। এইরূপ পুরুষদের উত্থিত লিঙ্গ কেউ কর্তন করে না কেন? শুধু আইন দিয়ে ধর্ষণ নির্মূল করা যাবে না। ধর্ষণ নির্মূল করতে হলে মেয়েদের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে। সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। নারীর সম্ভ্রম, নারীর আত্মরক্ষার জন্য লিঙ্গ-কৰ্তন আদালত নিশ্চয় সহানুভূতির সঙ্গে দেখবেন।

জয়তুঃ ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *